রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

২০১২ : বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতি

বিশ্বরাজনীতিতে ২০১২ সালে কোন বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাবে? যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে এ বছরের শেষের দিকে। ওবামার প্রার্থিতা নিশ্চিত হলেও চলতি বছরের শেষ দিন পর্যন্ত এটা নিশ্চিত হয়নি কে হবেন রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে ওবামার প্রতিদ্বন্দ্বী। রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মার্চে অনুষ্ঠিত হবে। পুতিন তার প্রার্থিতা নিশ্চিত করলেও ডিসেম্বরে (২০১১) রাশিয়ায় ডুমা নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল, তা ওই নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে রাশিয়ায় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে এখন। নিউইয়র্কে যে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ সারাবিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছিল, তার রেশ আগামী বছরও থেকে যাবে। ঠিক তেমনি ‘আরব বসন্ত’ আরববিশ্বে যে পরিবর্তনের ঢেউ সৃষ্টি করেছিল, তা নতুন বছরে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে সিরিয়া, বাহরাইনে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে। এসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি মডারেট ইসলামী শক্তির ক্ষমতাসীন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তিউনিসিয়া ও মরক্কোয় এই পরিবর্তন এরই মধ্যে সাধিত হয়েছে।অতি সাম্প্রতিককালে একটা বড় অগ্রগতি হয়েছিল ‘নিউ স্টার্ট’ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে। ২০১০ সালের এপ্রিলে বারাক ওবামা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভের সঙ্গে এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু এর বৈধতার জন্য দুই দেশের পার্লামেন্টের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। দীর্ঘদিন বারাক ওবামা এটা নিয়ে লবিং করেছেন। শেষ পর্যন্ত ২২ ডিসেম্বর সিনেটে ৭১-২৬ ভোটে তা অনুমোদিত হয়। রিপাবলিকানরা প্রথমে বিরোধিতা করলেও পরে তা অনুমোদন করেন। পরে ডুমাও তা অনুমোদন করে। এই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া তাদের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা কমাবে এবং সর্বোচ্চ এক হাজার ৫৫০টি করে পরমাণু বোমা মোতায়েন রাখতে পারবে। এর আগে ২০০২ সালে যে স্টার্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার তুলনায় এ সংখ্যা ৩০ শতাংশ কম। নিঃসন্দেহে এটা ছিল বড় অগ্রগতি। এতে করে দুই পরাশক্তির মাঝে একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। নতুন বছরে এর রেশ থেকে যাবে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র যে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে এবং কোথাও কোথাও যা রাশিয়ার স্বার্থকে আঘাত করছে, তার কী হবে? যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তাতে রাশিয়ার প্রবল আপত্তি রয়েছে। ইউক্রেন ও জর্জিয়া ন্যাটোতে যোগ দেবে, এখানেও আপত্তি রাশিয়ার। জর্জিয়া রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ। জর্জিয়া ন্যাটোতে যোগ দিলে এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলে, তা রাশিয়াকে এক ধরনের øায়ু যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেবে। কৃষ্ণ সাগর এলাকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঔড়রহঃ ঞধংশ ঋড়ৎপব-ঋধংঃ। রোমানিয়ার শহর কনসটানজার কাছাকাছি মিখাইল কোগালনাইসেনু বিমান ঘাঁটিতে রয়েছে এর সদর দফতর। কিরগিজস্তানের মানাস বিমান ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরেই ব্যবহার করে আসছে। আফগানিস্তানে এখনও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘাঁটি। যদি সূক্ষ্মভাবে খোঁজ নেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে ছয়টি মহাদেশের প্রায় প্রতিটিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। এমনকি অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশেও ৫৪টি ‘সামরিক মিশন’ রয়েছে তাদের। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান শক্তিশালী করেছে। সামরিক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৬৮০ বিলিয়ন ডলার। রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত অস্ত্র হ্রাস চুক্তি করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী সামরিক কর্তৃত্ব রাশিয়া সন্দেহের চোখেই দেখবে। নতুন বছরটি তাই এ কারণেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরও একটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীলÑ তা হচ্ছে মার্চে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডুমার নির্বাচনের পর পুতিন প্রধানমন্ত্রী পদে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। তিনি ২০১২ সালে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ২০০০ ও ২০০৪ সালে পর পর দুবার তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সাংবিধানিকভাবে তিনি তিনবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। তাই ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এখন আবার ২০১২ সালে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে পুতিন অতটা ‘উš§ুক্ত’ নন। কখনও-সখনও সমালোচনাও করেছেন। এখন দেখতে হবে পুতিনের সঙ্গে ওবামা প্রশাসন কীভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে।
গেল জানুয়ারিতে চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিন তাওয়ের ওয়াশিংটন সফরও ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। চীন বিশ্বরাজনীতিতে অন্যতম একটি শক্তি। উত্তর কোরিয়া ও ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের এই মুহূর্তে চীনের সহযোগিতা দরকার। ২০০৯ সালের নভেম্বরে বারাক ওবামা বেইজিং সফর করেছিলেন। পরে ফিরতি সফরে হু জিন তাও গিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে। যদিও বেশবিছু ইস্যুতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক ভালো নয়। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও চীনা মুদ্রানীতি নিয়ে যে বিরোধ ছিল তা রয়ে গেছে। ওয়াশিংটন মনে করে চীনা ইউয়ানের মূল্য অনেক কম, কিন্তু চীনা নেতারা এটা মানতে রাজি নন। ইরানের প্রশ্নেও দুই দেশের অবস্থান এক নয়। যুক্তরাষ্ট্র তিব্বতকে চীনের অংশ মনে করলেও দালাই লামার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পক্ষে হোয়াইট হাউস প্রশাসন। দালাই লামাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, এটা চীন সহজভাবে গ্রহণ করে নিতে পারেনি। উত্তর কোরিয়াকে ছয় জাতি আলোচনায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে চীন রাজি থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্র এখন তিন জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া) আলোচনার পাশাপাশি নয়া নেতার ভূমিকার প্রতিও লক্ষ্য রাখবে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দুই দেশের অবস্থানও ভিন্ন ভিন্ন। তবে চীনা নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ‘অংশীদারিত্ব’-এর কথা বলেছেন। এটাই মোদ্দা কথা। আধিপত্য নয়, প্রভাব বিস্তার নয়, সামরিক আগ্রাসনও নয়, দরকার সমমর্যাদাভিত্তিক অংশীদারিত্ব। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যদি সমমর্যাদাভিত্তিক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হয়, তাহলে তা বিশ্ব স্থিতিশীলতার জন্য বড় ভূমিকা রাখবে। হু জিন তাওয়ের ওয়াশিংটন সফরের মধ্য দিয়ে এ ধরনের একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ওবামা প্রশাসন চাইছে চীন নয়া বিশ্বব্যবস্থায় একটি দায়িত্বশীল আচরণ করুক। চীনকে তারা মনে করছে ‘জবংঢ়ড়হংরনষব ঝঃধশবযড়ষফবৎ’। ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট জেমস স্ট্রাইন বার্গের ভাষায় এই সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘ঝঃৎধঃবমরপ জবধংংঁৎধহপব’ হিসেবে।
তিনটি বৃহৎ শক্তিÑ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক বিশ্বরাজনীতিতে আলোচিত হলেও ভারতের একটি ভূমিকা ২০১২ সালে নানা কারণে আলোচিত হবে। ভারত বিশ্বসভার (স্থায়ী পরিষদ) সদস্য হতে চায়। ওবামার তাতে সমর্থন ভারতের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে আগামী ৩০ বছরে ভারত হবে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি। মাথাপিছু আয় ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে দাঁড়াবে। তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৭ ভাগ অবদান রাখবে ভারত (২০০৭ সালে মাত্র দুই ভাগ)। যদিও এর জন্য প্রয়োজন আট থেকে নয় ভাগ প্রবৃদ্ধি। এ ধরনের মন্তব্য প্রমাণ করে ভারত ধীরে ধীরে একটি অর্থনৈতিক শক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের নেতৃত্ব যদি পাশের দেশগুলোর সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ ও ‘আচরণ’ পরিবর্তন না করে, তাহলে বিশ্বসভায় তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। চীন-ভারত সম্পর্কের দিকে তাই দৃষ্টি থাকবে অনেকের। যদিও ২০১০ সালে চীনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়া বাওয়ের নয়াদিল্লি সফর সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আনতে পারেনি। গত ১০ বছরে এ দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে ৩০ গুণ। চুক্তি হয়েছে দুই হাজার কোটি ডলারের। চীন যা ভারতে রফতানি করে, আমদানি করে কম। ওয়েন জিয়া বাওয়ের ওই সফর ‘বাণিজ্যিক সম্পর্ক’কে বৃদ্ধি করলেও ‘রাজনৈতিক সম্পর্ক’ বৃদ্ধি করতে পারেনি। তিব্বত ও তাইওয়ানকে ভারত চীনের অংশ মনে করলেও তখন যৌথ ইশতেহারে তা উল্লেখ করা হয়নি, যেমনি উল্লেখ করা হয়নি ‘জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’Ñ এ কথাটি। ভারত মহাসাগরে চীনের নৌবাহিনীর উপস্থিতি বৃদ্ধি (‘মুক্তার মালা’ নীতি) যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতেরও চিন্তার কারণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০১২ সালে এ বিষয়টি সম্পর্ক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে গুরুত্ব পাবে বেশি। বলা ভালো, ভারত ইজওঈ-ভুক্ত চারটি নব্য বড় শিল্পোন্নত দেশের সদস্য, যেখানে চীন ও রাশিয়াও রয়েছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধে এ চারটি দেশের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন) ভূমিকাকে বিশ্বনেতারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। ডিসেম্বরে (২০১১) দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে যে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হয় (কপ-১৭), তাতে এই দেশগুলোর ভূমিকা ছিল বড়। কেননা তারা বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন করে বেশি, যা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। ডারবানে এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি হয়নি। তবে ২০১২ সালে বিশ্বের উষ্ণতা রোধসংক্রান্ত কিয়োটো চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। কানকুনে (২০১০) উন্নয়নশীল বিশ্বের অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির ব্যাপারেও কোন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইজওঈ-ভুক্ত দেশগুলোর একটি ভূমিকা হবে লক্ষ্য করার বিষয়। ২০১২ তাই সঙ্গত কারণেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ও সেইসঙ্গে ইজওঈ-ভুক্ত দেশগুলোর একটি ভূমিকা ২০১২ সালের বিশ্বরাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে।

ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

রাষ্ট্রপতির সংলাপ ও রাজনীতির চালচিত্র


তারপরও রাষ্ট্রপতির সংলাপ নিয়ে ফলপ্রসূ কোনো কিছু আশা করা ঠিক হবে না। রাষ্ট্রপতি আমাদের অভিভাবক। সংকটময় মুহূর্তে জাতি তার কাছ থেকে একটি ভূমিকা আশা করতেই পারে। সংবিধানে তার ভূমিকা সীমিত। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তিনি সরকারের পরামর্শ মতো কাজ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কতটুকু কী করতে পারবেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে সরকার ও বিরোধী দেলর মাঝে একটি সমঝোতা প্রয়োজন। জাতীয় প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হলে, গণতন্ত্র কোনো অবস্থাতেই বিকশিত হবে না। রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবেই। এই বিরোধিতা হতে হবে শান্তিপূর্ণ ও সহনীয়। এই বিরোধিতা পশ্চিমা সমাজেও আছে। আমেরিকার মতো সমাজেও 'শাটডাউন' বা বন্ধ এর মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেই 'শাটডাউন' কখনই সহিংস পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয় না। এমনকি এটাও দেখা গেছে, সংগঠিত প্রতিবাদ হয় একটা সীমিত জায়গায়_ প্রতিবাদকারীরা একটি নির্দিষ্ট স্থানে (যেমন হতে পারে কোনো কলকারখানার সামনে) জমায়েত হয়ে হাতে প্লাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে ঘুরে ঘুরে সেস্নাগান দিয়ে প্রতিবাদ করছেন। জনজীবনকে এরা বাধাগ্রস্ত করছেন না। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের খবরও আমরা দেখি। কিন্তু খুব কম পর্যায়েই তা সহিংসতায় পরিণত হয়। পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া একটি গুরুতর অপরাধ পশ্চিমা বিশ্বে। পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিবাদকারীদের ওপর সরকার সমর্থকরা আক্রমণ করেছেন_ এ ধরনের কোনো খবর আমরা কোনোদিন পড়িনি। আমি নিজে দেখিনি। আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে প্রতিবাদের ভাষা আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা শুধু বারবার আমাদের হতাশার মাঝে ফেলে দেয়। প্রতিবাদের এই সংস্কৃতিতে একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। আর উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই। আমাদের সমস্যা অনেক। এই সমস্যা একা সরকারের পক্ষে সমাধান দেয়া সম্ভব নয়। অবশ্যই বিরোধী দলের সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার তিন বছর পার করার কাছাকাছি সময়ে এসে অনেকগুলো সমস্যা মোকাবিলা করছে। এক. সরকার ইতিমধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে (সরকারি ও বেসরকারি) প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। বছর শেষে এই ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকার অংককেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এতে করে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। হ্রাস পাবে প্রবৃদ্ধির হার। এটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার একটি ত্রুটি। সরকার অবশ্যই ঋণ নেবে। কিন্তু তা যেন একটা সীমার মধ্যে থাকে। কৃচ্ছ্র সাধন জরুরি। কিন্তু কৃচ্ছ্র সাধন হচ্ছে না। এই মুহূর্তে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় পিপিপি মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। বড় প্রকল্পগুলোতে এই মুহূর্তে হাত না দেয়াই মঙ্গল। গত ১৫ ডিসেম্বর সরকার ৬১ জেলা পরিষদে দলীয় লোকদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। এতে করে বিরোধিতা আরো বাড়ল। বাড়ল খরচ। বাংলাদেশে বিশ্বমন্দার প্রভাব এই মুহূর্তে আমরা অনুভব করতে পারছি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃচ্ছ্র সাধনটা জরুরি। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী রফতানি আয় কমেছে শতকরা ৩৯ ভাগ, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। খাদ্যে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ১১ দশমিক ৭৩ ভাগ। তিন হাজার তৈরি পোশাক কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। রেমিটেন্সের প্রবাহও কম। এসব ক্ষেত্রে বিরোধী দলের বক্তব্য গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া প্রয়োজন। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। দুঃখজনক হলেও সত্য, গত চলি্লশ বছরে আমরা এই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি। আজ সময় এসেছে এই সংস্কৃতি গড়ে তোলার। বাংলাদেশে এক ধরনের অসমতা সৃষ্টি হয়েছে। এখানে ধনী ও গরিবদের মধ্যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে। বিজয়ের চলি্লশ বছরে দাঁড়িয়েও আমরা দেখি বাংলাদেশে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই অসমতা আর বৈষম্য যুক্তরাষ্ট্রে 'অকুপাই আন্দোলনের' জন্ম দিয়েছে। আরব বিশ্বে সৃষ্টি করেছে 'আরব বসন্ত'। আমরা এ থেকে যেন শিক্ষা নেই। দরিদ্রতা দূরীকরণ কিংবা অসমতা দূরীকরণে আজ প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। বিরোধী দলের সহযোগিতা ছাড়া কোনো উদ্যোগই সাফল্যের মুখ দেখবে না। 'আরব বসন্ত' সৃষ্টি করেছিল তরুণ সমাজ। আরব বিশ্বের জনগোষ্ঠীর ৪০ ভাগের ওপরে হচ্ছে এই তরুণ প্রজন্ম, যারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে 'বিপ্লব'কে সংগঠিত করেছিল। বাংলাদেশে তরুণ সমাজের অংশও একেবারে কম নয়। এদের সাঝে অনেকেই বেকার। এই তরুণ সমাজ একটি শক্তি হতে পারে, যদি এদের প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। প্রথাগত শিক্ষা বাদ দিয়ে এদের যদি কর্মমুখী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, সমাজ পরিবর্তনে পালন করতে পারে এরা একটি বড় ভূমিকা। প্রায় একশ'টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর কয়েক লাখ মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বেরুচ্ছে। অথচ এদের জন্য চাকরি নেই। পৃথিবীর কোনো দেশে এককভাবে সরকার কর্মসংস্থান করে না। বেসরকারি উদ্যোক্তারা একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে বেসরকারি সেক্টরের ভূমিকা বেড়েছে, কিন্তু সেখানে মেধার পূর্ণ বিকাশ হচ্ছে না। আগামী ২০ বছর সামনে রেখে আমাদের কোন সেক্টরে কী পরিমাণ জনশক্তি দরকার, তা আমরা জানি না। ফলে উদ্ভ্রান্তের মতো তরুণ সমাজ এমন সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, যা সমাজ বা রাষ্ট্র তাকে চাকরির নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। অথচ এই জনশক্তিকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এবং ভাষা শিক্ষা দিয়ে বিদেশের জব মার্কেটে তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা আমরা করতে পারি। এ জন্য দরকার পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গির। বিরোধী দলের ভূমিকাও এখানে থাকা উচিত। বিরোধী দল শুধু সরকার পতনে তাদের কর্মকা- সীমাবদ্ধ রাখবে, তা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে তাদেরও একটা 'ভিশন' থাকা উচিত, পরিকল্পনা থাকা উচিত। বিরোধী দল একটি 'শ্যাডো ক্যাবিনেট' বা 'ছায়া মন্ত্রিসভা' গঠন করবে, যেখানে সরকারের মন্ত্রীর বিকল্প থাকবে বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি, যিনি সরকারের নীতির সমালোচনা করে বিকল্প নীতি উপস্থাপন করবেন। প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশেই আমরা এই 'ছায়া মন্ত্রিসভা' (যেমন ব্রিটেনে) কাজ করতে দেখি। বাংলাদেশে বিরোধী দল একটি 'ছায়া মন্ত্রিসভা' গঠন করতে পারে। সরকার ও বিরোধী দলের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে জাতীয় ঐকমত্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, গত চলি্লশ বছরে জাতীয় ইস্যুতে আমরা এখনো বিভক্ত। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, একমাত্র সংসদীয় সরকারে ফিরে যাবার প্রশ্নে (পঞ্চম সংসদ, দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী) সরকার ও বিরোধী দল এক হয়েছিল। এরপর থেকে (১৯৯১) কোনো একটি ইস্যুতেও সরকার ও বিরোধী দল এক হতে পারেনি। অতি সাম্প্রতিককালে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষের শঙ্কা যখন বাড়ছে, সেখানেও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে কোনো সহাবস্থান হয়নি। অথচ টিপাইমুখের বিষয়টি একটি জাতীয় ইস্যু। এর সঙ্গে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের কয়েক কোটি জনগণের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত।
রাজনীতিতে এই যে অসহিষ্ণুতা, এই অসহষ্ণিুতা যদি আমরা পরিত্যাগ করতে না পারি, যদি জাতীয় ইস্যুতে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তাহলে প্রায় ষোল কোটির এই দেশটির জন্য আরো অনেক দুঃখ-কষ্ট অপেক্ষা করছে। দেশটি ৫০ বছরে পা দেবে ২০২১ সালে। ওই পঞ্চাশ বছরের একটি দেশের জন্য আমাদের পরিকল্পনা কী, কী পরিমাণ জনশক্তি আমাদের দরকার, আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই বা কী হওয়া উচিত, এ ব্যাপারে কোনো সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই। সরকার এককভাবে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সংসদ হয়ে পড়ছে একদলীয়। বিরোধী দল দিনের পর দিন সংসদ বয়কট করে চলছে। তাদের সংসদে নিয়ে আসার ব্যাপারে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না। সমাজের সর্বত্র বিভক্তি বাড়ছে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি সংলাপ করছেন। তবে প্রধান বিরোধী দল যদি সত্যি সত্যিই সংলাপে অংশ না নেয়, তাহলে এ সংলাপের কোনো মূল্য থাকবে না। রাষ্ট্রপতি তার অধিকার বলেই সিইসিসহ কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। ফলে ওই নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে থাকবে। এক্ষেত্রে একটা সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে যদি আভাস দেয়া হয় যে, রাষ্ট্রপতি এজেন্ডাবহির্ভূত বিষয়েও কথা শুনবেন, তাতে অন্তত বরফ গলতে পারে। নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রশ্নে যেমনি জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন, ঠিক তেমনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় আয়োজন করা যায় কি না, সে বিষয়টির ব্যাপারেও একটি ঐকমত্য প্রয়োজন। আমার ধারণা, সরকারের শরিকদের কেউ কেউ নিরপেক্ষ সরকারের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি স্বউদ্যোগে সংলাপ শুরু করতে পারেন। বর্তমান সংলাপ শুধু নির্বাচন কমিশন নিয়ে হলেও, পরবর্তী ধাপে নিরপেক্ষ সরকার নিয়েও আলোচনা হতে পারে। এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি 'সার্চ কমিটির' প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এটি ভালো। সরকার ও বিরোধী দলের সমসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে এই কমিটি গঠিত হতে পারে। স্পিকার এই কমিটির আহ্বায়ক হতে পারেন। তারা কয়েকটি নাম প্রস্তাব করতে পারেন, যাদের মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের বেছে নেবেন। মোট কথা, একটি সমাধান প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতির এই সংলাপেও এই সিদ্ধান্তটি নেয়া যায়।

দৈনিক ডেসটিনি ২৮ ডিসেম্বর।
তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
tareque.rahman(a)aol.com


কোরীয় উপদ্বীপের ভবিষ্যত্ কোন পথে


উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান কিম জং ইল মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর তার ছোট সন্তান কিম জং উন তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। চীন এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে শান্তির পথে আসার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের প্রশ্নটি কোন পথে! বিষয়টি এখন আলোচিত। যদিও চীন সরাসরি দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে এটা সত্য, চীন যদি তার অবস্থান পরিবর্তন করে, তাহলে আগামীতে আমরা দুই কোরিয়াকে এক দেখতে পাব। এ ক্ষেত্রে একত্রীকরণের পথে নানা সমস্যা রয়েছে। দুই জার্মানি একত্রিত হয়েছিল আজ থেকে ২০ বছর আগে। ১৯৯০ সালের পর থেকেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ছিল দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের দিকে। এখানে সমস্যা হচ্ছে একত্রীকরণের পর কোরিয়ার সমাজব্যবস্থা কী হবে? পুঁজিবাদী সমাজ, নাকি সমাজতান্ত্রিক সমাজ? জার্মানিতে এখন আর সমাজতান্ত্রিক সমাজ নেই। পূর্ব জার্মানি পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে মিশে গিয়ে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। চীনেও আজ ধ্রুপদী মার্কসবাদ নেই। চীনের সঙ্গে হংকং একীভূত হয়েছে হংকংয়ের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা বজায় রেখেই। যে ব্যবস্থাকে চীন বলছে ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’। তেং জিয়াও পিং ছিলেন এই ধারণার প্রবক্তা। চীন তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও একই নীতি আবলম্বন করছে। তাইওয়ান হংকং মডেল অনুসরণ করে চীনের সঙ্গে একীভূত হতে পারে। কোরিয়ার ক্ষেত্রে এই হংকং মডেল একটি সমাধান হতে পারে। ভবিষ্যত্ই বলে দেবে দুই কোরিয়া এক হবে কি না।
এই মুহূর্তে কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা নেই বটে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ইয়ংপিং দ্বীপে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ (২০১০-এর ২৩ নভেম্বর) ও তাতে দুই সৈনিকের মৃত্যু, দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীপ্রধানের পদত্যাগের পর দীর্ঘদিন উত্তেজনা সেখানে বজায় ছিল। ওই সময় একটি যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সেখানে বিরাজ করছিল। উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে ছয় জাতি আলোচনাও কার্যত ব্যর্থ। উত্তর কোরিয়াকে কোনোভাবেই আলোচনার টেবিলে আনা যাচ্ছে না। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন তিন জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া) আলোচনায় উত্সাহী। কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক প্রধান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন ছুটে গিয়েছিলেন জাপানে। তিনি সেখানে তিন জাতিভিত্তিক একটি ‘প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার কথাও বলেছিলেন। চীনের একজন সিনিয়র কূটনীতিকও পিয়ং ইয়ং সফর করেছিলেন। এতে উত্তেজনা সাময়িকভাবে হ্রাস পেয়েছিল সত্য। কিন্তু স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে যে এ ধরনের উত্তেজনা বড় বাধা, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই উত্তর কোরিয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া বিশ্বে ৮ম পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর পর থেকেই উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে এ অঞ্চলের বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। এরপর থেকেই আলোচনা শুরু হয় কীভাবে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণুমুক্ত করা যায়। একপর্যায়ে চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া অবিলম্বে তার ইয়ংবাইঅনস্থ (ণড়হমনুড়হ) পারমাণবিক চুল্লিটি বন্ধ করে দেয়, যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা উত্তর কোরিয়া ছয় থেকে ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া ৬০ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুল্লিগুলো পরিদর্শনেরও সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এরপর ২০০৭ সালের অক্টোবরে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বোহ মু হিউম ২ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া যান ও সেখানে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন। এটা ছিল দুই কোরিয়ান রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক। এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কোরিয়া বিভক্তকারী অসামরিক পানমুনজমে সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে। এ অঞ্চলের গত ৫৩ বছরের রাজনীতিতে ওই ঘটনা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে আর দুই কোরিয়ান নেতারা কোনো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হননি। স্নায়ুযুদ্ধপরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের (১৯৯০) পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন কোরীয় উপদ্বীপের দিকে। সেই থেকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জংকে ‘দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টার’ জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
কোরিয়া একটি বিভক্ত সমাজ। দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট উত্তর কোরিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ। আর ৯৯ হাজার ২২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট দক্ষিণ কোরিয়ার লোকসংখ্যা ৪ কোটি ২৮ লাখ। একসময় যুক্ত কোরিয়া চীন ও জাপানের উপনিবেশ ছিল। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধের পর কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে ও জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কৌশলগত কারণে কোরিয়াকে দু’ভাগ করে। এক অংশে মার্কিন বাহিনী ও অপর অংশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাহিনী অবস্থান নেয়। সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতেই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে (আজকের যা উত্তর কোরিয়া) একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে নিউ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে নবগঠিত কোরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে। জাতিসংঘের আহ্বানে সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও, দেখা গেল নির্বাচন শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী ৩৮তম সীমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে যুদ্ধ বেধে যায়। জাতিসংঘ এই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ বাহিনী মাঞ্চুরিয়া সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং চীনা সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সেটি কার্যকর হয় দু’বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই। এরপর থেকে কার্যত উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া দুটি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে আসছে। ১৯৫৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তিবলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও, উত্তর কোরিয়ায় কোনো চীনা সৈন্য নেই। উত্তর কোরিয়া চীনের সঙ্গে ১৯৬১ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। গত ৬৪ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় একাধিক সরকার গঠিত হলেও, উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে একবার, ১৯৯৪ সালে কিম ইল সুং-এর মৃত্যুর পর তার পুত্র কিম জং ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন কিম জং ইল অসুস্থ ছিলেন। এখন তার ছোট সন্তানকে সেখানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেওয়া হল। তিনি যদি দায়িত্ব পালনকালে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের উদ্যোগ নেন, সেটা হবে একুশ শতকের শুরুতে একটি বড় ধরনের ঘটনা। তবে যে কোনো মুহূর্তে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। উত্তর কোরিয়া তাদের প্রধান পরমাণু স্থাপনা ছাড়াও গোপনে আরও কয়েকটি স্থাপনায় ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধ করছে বলে দক্ষিণ কোরিয়া অভিযোগ করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে উত্তর কোরিয়া আরও পরমাণু পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনাও করছে। এজন্য তারা সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে। এ হারে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হলে আগামী মার্চ বা মে মাস নাগাদ প্রয়োজনীয় এক হাজার মিটার সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শেষ হবে। এর অর্থ হচ্ছে উত্তর কোরিয়া আরেকটি পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে পারে। এতে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। যুদ্ধ হবে কি না বলা মুশকিল। কেননা উত্তর কোরিয়া যেখানে বড় ধরনের খাদ্য সঙ্কটের মুখে সেখানে তারা এত বড় ঝুঁকি নেবে না। উত্তেজনা জিইয়ে রেখে তারা সুবিধা আদায় করে নিতে চায়।
এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়ার বড় বন্ধু চীন। চীন যদি তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে উত্তর কোরিয়া ‘একা’ হয়ে পড়বে। তখন আলোচনায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না। উত্তর কোরিয়া বারবার বলে আসছে তার পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যুত্ উত্পাদন। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এবং দক্ষিণ কোরিয়া এই কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার জ্বালানি সঙ্কটের সমাধানের সাময়িক উদ্যোগ নিলেও এই সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হয়নি। উত্তর কোরিয়া তার জ্বালানি সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের আশ্বাস পেলে, দেশটি তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করতে পারে। তবে একটা মূল প্রশ্নের সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর তা হচ্ছে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণ। আগামীতে সব আলোচনাই কেন্দ্রীভূত হবে একত্রীকরণের লক্ষ্যে। ওবামা প্রশাসনকে এ লক্ষ্যেই কাজ করে যেতে হবে। কোরীয় উপদ্বীপে এই মুহূর্তে উত্তেজনা নেই সত্য, তবে লক্ষ রাখতে হবে নয়া নেতা কিম জং উন কী সিদ্ধান্ত নেন তার ওপর। তিনি যদি উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে চান, তাহলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়বে মাত্র। ইরানের মতো উত্তর কোরিয়ায়ও ২০১২ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন একটি ইস্যু হতে পারে। তাই উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতার পালাবদল যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোচিত হতে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দৈনিক সকালের খবর, ২৮ ডিসেম্বর ২০১১।
তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
tareque.rahman(a)aol.com

ইরাক নিয়ে বড় প্রশ্ন থেকেই গেল

যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আগ্রাসনের ৯ বছর পর ১৭ ডিসেম্বর ইরাক থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ইতিহাসে এই ইরাকি আগ্রাসন এখন কিভাবে চিহ্নিত হবে? ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকের কাছে তথাকথিত WMD (Weapons of Mass Destruction) আছে, এই অভিযোগ তুলে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী ইরাক আক্রমণ করেছিল। ৯ এপ্রিল তারা দখল করে নিয়েছিল বাগদাদ। তখনো জীবিত ছিলেন সাদ্দাম হোসেন। তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেননি। ডিসেম্বরে নিজ শহর তিকরিতের পার্শ্ববর্তী একটি ছোট্ট শহর আদদাওরে মাটির নিচে একটি গর্তে লুকানো অবস্থায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারে তার ফাঁসি হয়েছিল। ২০০৩ থেকে ২০১১_সময়টা দীর্ঘ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অর্জনটা কী? কিংবা ইরাকিরাই বা এই আগ্রাসন থেকে কী পেল?
ইরাক আগ্রাসনের ঠিক তিন দিন আগে ১৭ মার্চ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক টিভি ভাষণে সম্ভাব্য ইরাক আক্রমণের একটা যুক্তি দিয়েছিলেন এভাবে, 'We will deliver the food and medicine you need. We will tear down the apparatus of terror and we will help you to build a new Iraq that is prosperous and free'। ইরাকি জনগণকে বুশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি তাদের খাদ্য ও ওষুধপত্র দেবেন। একটি সমৃদ্ধিশালী ইরাক তিনি উপহার দেবেন। আজ ৯ বছর পর যদি হিসাবের খাতা মেলানো যায়, তাহলে এ প্রশ্নটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে? একটি সমৃদ্ধিশালী ইরাকের কি জন্ম হয়েছে। সাদ্দাম হোসেনের জমানায় যে ইরাক একটি ধনী রাষ্ট্ররূপে পরিচিত ছিল, আজ সেই ইরাকের রাজধানী বাগদাদে বিদ্যুৎ নেই, সুপেয় পানি পাওয়া যায় না, দরিদ্রতা অনেক বেশি। বুশ বলেছিলেন, তিনি সন্ত্রাসীদের মূল কাঠামো ভেঙে দেবেন। তিনি সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিতে চড়িয়েছেন সত্য, কিন্তু ইরাক আজ পরিণত হয়েছে আত্মঘাতী বোমাবাজদের স্বর্গরাজ্যে। ইরাক যুদ্ধ ইরাকের কী ক্ষতি করেছে, তা নিচের একটি পরিসংখ্যান দিয়েই বোঝা যাবে। যুদ্ধে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১১০৬৬৩ থেকে ১১৯৩৮০ জন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা মৃত্যুর সংখ্যা ৪৪৮৪ জন, বহুজাতিক বাহিনীর ৪৮০৩ জন। যুক্তরাষ্ট্রের আহতের সংখ্যা ৩২২০০ জন। ইরাকি সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ১০৩৬৭৪ থেকে ১১৩২৬৫ জন। যুদ্ধে স্থানচ্যুত হয়েছে ১ দশমিক ২৪ মিলিয়ন মানুষ, আর শরণার্থী হয়েছে ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী। ইরাকি যুদ্ধের মোট খরচ ৮০৬ মিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে ইরাক যুদ্ধে আহত যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সদস্যদের চিকিৎসাভাতা যদি যোগ করা হয়, যার পরিমাণ ৪২২ মিলিয়ন থেকে ৭১৭ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে_তাহলে ইরাক যুদ্ধের খরচ ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অঙ্ককেও ছাড়িয়ে যাবে। ইরাক পুনর্গঠনে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮২ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ইরাক সরকার জোগান দেবে ১০৭ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র জোগান দেবে ৬১ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়া গেছে ১৩ দশমিক ০৩ মিলিয়ন ডলার। যুদ্ধ মানেই তো ব্যবসা। ইরাকের পুনর্গঠনের কাজ করছে মার্কিন কম্পানিগুলো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মার্কিন প্রশাসন ছয়টি মার্কিন বৃহৎ করপোরেশনের সঙ্গে ইরাক পুনর্গঠনের কাজের জন্য গোপনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। এই কম্পানিগুলো আগে যুদ্ধের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। যুদ্ধের কারণে তারা লাভবান হয়েছিল। ওই কম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেকটেল গ্রুপ (Bectel Group), যারা ইরাকের যোগাযোগব্যবস্থা, বিদ্যুৎ বিতরণ, পানি এবং পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থা পুনর্গঠনের কাজে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। ইরাক যুদ্ধ মার্কিন সেনাদের জন্য কোনো সুখ বয়ে আনেনি। ইরাক ফেরত মার্কিন সৈনিকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। যেখানে প্রতি এক লাখ সাধারণ মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা ১১ দশমিক ২৬ জন, সেখানে যুদ্ধ ফেরত মার্কিন সেনাদের এই সংখ্যা ৩৮ জন। আফগান যুদ্ধের এ পরিসংখ্যান (খরচ, মৃত্যু ইত্যাদি) আমাদের দিয়েছে একটি আমেরিকান গবেষণা সংস্থা The Center for American Progress। এ সংস্থার দুই গবেষকের (Matt Duss and Peter Juul) গবেষণায় (The Progress Report, 16 December, 2011) এ তথ্যগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এ সংস্থার পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের অন্য একটি গবেষণা সংস্থা Maplecraft-এর গবেষণায় ইরাককে পৃথিবীর তিনটি সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে একটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত Rand Corporation তাদের একটি গবেষণায় (২০১০) উল্লেখ করেছিল, ইরাক যুদ্ধ ইরাকে একটি বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছে। এ অঞ্চল ঘিরে ভবিষ্যতে একটি বৃহৎ শিয়া রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে এবং শিয়া ও সুনি্নদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের সূচনা হতে পারে। এ গৃহযুদ্ধের ফলে সৌদি আরব, ইয়েমেন, লেবানন ও বাহরাইনের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে।
ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের এক দিনের মাথায় ইরাক থেকে যেসব খবরাখবর আসছে, তা এ ইঙ্গিতই দিচ্ছে যে ইরাক একটি বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে শিয়া ও সুনি্ন সম্প্রদায় পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এমন সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে যে শিয়া প্রভাবাধীন মালিকি সরকার সুনি্ন ভাইস প্রেসিডেন্টকে ও তাঁর দেহরক্ষীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিল। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়, বাগদাদে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ইরাকের উপ-প্রধানমন্ত্রী সালেহ আল মুতলাব সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মালিকির সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, মালিকি সাদ্দাম হোসেনের চেয়েও খারাপ। তিনি প্রধানমন্ত্রী মালিকিকে যিনি একজন শিয়া নেতা, তাঁকে স্বৈরশাসক হিসেবে অভিহিত করেছেন। এদিকে ইরাকের ভাইস প্রেসিডেন্ট (যিনি একজন সুনি্ন সম্প্রদায়ের লোক) তারেক আল হাশমি তাঁর বিরুদ্ধে মালিকি সরকার যে সন্ত্রাসের অভিযোগ এনেছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ইরাক একটি বড় দেশ (৪৩৮৩১৭ বর্গকিলোমিটার), বাংলাদেশের চেয়ে তিনগুণ বড়। সাদ্দাম হোসেন অত্যন্ত শক্ত হাতে দেশটি শাসন করেছিলেন। তাঁর সময়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা বিকশিত হয়নি। উত্তরে কুর্দি অধ্যুষিত এলাকা, দক্ষিণাঞ্চলে ইরান সমর্থিত শিয়া অঞ্চল আর বাগদাদকেন্দ্রিক মধ্যাঞ্চল এখন আলাদা হয়ে যেতে পারে। কুর্দিরা (তিনটি অঞ্চল) এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে আসছে। তাদের নিজস্ব পার্লামেন্টও আছে। তারা স্বাধীনতার দাবি করে বসতে পারে। জনগোষ্ঠীর তিন ভাগের একভাগ মাত্র সুনি্ন সম্প্রদায়ভুক্ত। অথচ এরাই দেশটি শাসন করে আসছিল। অন্যদিকে তিন ভাগের দুই ভাগ জনগোষ্ঠী শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। ইরানের শিয়া নেতৃত্বের সঙ্গে ইরাকি শিয়াদের একটি সম্পর্ক রয়েছে। ইরাকি শিয়ারা ইরাকি মডেলে ইরাকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ার উদ্যোগ নিতে পারে। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে ইরান-ইরাক মিলে একটি কনফেডারেশন গঠনের সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইরাকি শিয়া সম্প্রদায়ও বেশি মাত্রায় ধর্মীয় রাজনীতি দ্বারা প্রভাবানি্নত। অন্যদিকে সুনি্ন নেতাদের মধ্যেও গ্রহণযোগ্য এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যিনি ইরাককে একুশ শতকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। সুতরাং আগামী দিনের ইরাক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
২০১০ সালের মার্চে ইরাকে নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ মাস লেগেছিল সেখানে একটি সরকার গঠন করতে। ইরাক এখন ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে ঘুরপাক খাচ্ছে। একদিকে শিয়া-সুনি্ন, অন্যদিকে শিয়া নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এর বাইরে রয়ে গেছে কুর্দিরা। ২০০৫ সালের নির্বাচনে সুনি্নরা অংশ নেয়নি। ওই নির্বাচনের পর ইরান সমর্থিত একটি শিয়া ব্লক সরকার গঠন করে। কুর্দিরা তখন শিয়াদের সঙ্গে একটি সহাবস্থানে গিয়েছিল। বিনিময়ে প্রেসিডেন্ট পদটি কুর্দিদের দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন আইয়াদ আলাভি। কিন্তু শিয়াদের ভেতরকার দ্বন্দ্বে আলাভি ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মালিকি। শিয়া নেতৃত্বের মধ্যে এই যে বিভেদ, তা একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। গেল বছরের মার্চ মাসে যে নির্বাচন হয়, তাতে আলাভির দল শতকরা ২৪ দশমিক ৭ ভাগ ভোট পেয়েছিল। আর মালিকির সমর্থকরা পেয়েছিল ১৮ দশমিক ২ ভাগ ভোট। ফলে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা রয়ে গিয়েছিল। কে সরকার গঠন করবে, এর ফয়সালা দীর্ঘদিন হয়নি। যদিও ধারণা করা হয়েছিল, কম ভোট পেয়েও মালিকি মুকতাদা আল সদরের সমর্থন পেয়েছিলেন। এর আগে মুকতাদা মালিকির ওপর থেকে তাঁর সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ইরাকি পার্লামেন্টে মুকতাদার সমর্থকদের পাল্লাও একেবারে খারাপ নয়। সরকার গঠনে তাঁর সমর্থন খুব জরুরি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নির্বাচন হতে পারে। ইরাকে নিযুক্ত সাবেক শীর্ষ মার্কিন কমান্ডার জেনারেল রে অডিয়েরনো একবার বলেছিলেন, নতুন নির্বাচনই একমাত্র সমাধানের পথ। কিন্তু যে সমস্যা আজ সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে, তা হচ্ছে আত্মঘাতী বোমাবাজির যে সংস্কৃতি ইরাকে জন্ম হয়েছে, তা থেকে ইরাক বেরিয়ে আসতে পারবে কি না? এটি একটি বড় চিন্তার কারণ। আল কায়েদার প্রভাব ইরাকে বাড়ছে। এরা এখন যথেষ্ট শক্তিশালী। ইরাকে যেকোনো সরকারের জন্য এটি একটি হুমকি। সাদ্দাম-পরবর্তী ইরাকে যে সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছে, তা শিয়া প্রভাবাধীন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, যেকোনো সংকটে এরা নিরপেক্ষ থাকবে। কিন্তু আল-কায়েদা সমর্থকদের বিরুদ্ধে 'যুদ্ধে' এরা কেমন করবে, সেটা একটা ঝড় প্রশ্ন এখন। ইরাকের আনবার প্রদেশে এরা ঘরে ঘরে আল-কায়েদার পতাকা পর্যন্ত তুলতে বাধ্য করেছিল। এখন মার্কিন সেনাদের অনুপস্থিতিতে ইরাকি সেনাবাহিনী আল-কায়েদার বিরুদ্ধে কিভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করে, সেটাই দেখার বিষয়।
ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার সেখানে একটা 'শূন্যতার' সৃষ্টি করবে। এর সুযোগ নেবে চরমপন্থীরা। আর যেহেতু ইরাক এখন জাতিগত দ্বন্দ্বে বিভক্ত, ফলে তা ইসলামী চরমপন্থীদের বড় ধরনের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ পরিস্থিতিকে কিভাবে দেখবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। এমনিতেই ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। ইরাক-ইরানের প্রভাব বাড়ুক, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ইরাকি নেতাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছে। মালিকি সরকার এ আহ্বানে কতটুকু সাড়া দেয়, সেটাই দেখার বিষয়। তাই ইরাক নিয়ে একটি বড় প্রশ্ন থেকেই গেল।
 
দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৭ ডিসেম্বর ২০১১

ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman@aol.com

মহাজোট সরকারের পররাষ্ট্রনীতি : একটি মূল্যায়ন

আগামী বছরের জানুয়ারিতে মহাজোট সরকার তার তিন বছর পার করবে। এই তিন বছরে একাধিকবার সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা উঠেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আলোচিত হয়েছে বেশি করে। এক্ষেত্রে আমাদের স্বার্থ সব সময় রক্ষিত হয়নি। এসব অভিযোগও উঠেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সর্বশেষ ঘটনায় ভারতের সাথে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর দু’জন উপদেষ্টাকে যখন নয়াদিল্লি যেতে হয়, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের কাজটি ঠিকমতো করতে পারছে না। জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা ও এর জন্য কাজ করা হলো একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য। কিন্তু গত তিন বছরে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়, এমন খুব কম ক্ষেত্রেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সফলতা দেখাতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যিনি গত তিন বছরে সবচেয়ে বেশিদিন বিদেশে কাটিয়েছেন। সংখ্যার দিক থেকে যা ইতিমধ্যে একশ’ দিবস অতিক্রম করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার শিশুসুলভ বালখিল্যতায় অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে ছবি তুলে ও অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা সমৃদ্ধি করতে পারলেও (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪ নভেম্বর ’১১) গত তিন বছরে বাংলাদেশের অর্জন খুব বেশি নয়।
মহাজোট সরকারের সময় অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় ভারতের সাথে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরীও হয়েছে, যদিও ট্রানজিট ফি এখনও নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপাক্ষিকতার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেল ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এই দুটো দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এই সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে- এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের ‘সাত বোন’ রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে তাতে করে আগামী দিনগুলো বাংলাদেশী পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খাবে। এক্ষেত্রে ‘সাত বোন’ রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে, তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এই ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে ‘ভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত দু’বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাল্লাটা ভারতের দিকে ঝুঁকে গেছে, বাংলাদেশের প্রাপ্তিটা তুলণামূলকভাবে কম। বাংলাদেশ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা হলেও (৪৮:৫২ ভাগ), চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হবে না এবং সেখানে কোন অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশকে তা জানানো হবে- এ ধরনের প্রতিশ্র“তি ভারত দিলেও, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি গত ২২ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ এ ব্যাপারে তার কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজ কার্যকর হলে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পানিশূন্য হয়ে পড়বে ও এ অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। ঘাটতি বাড়ছে। ভারত অতি সম্প্রতি ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা বললেও তা দিয়ে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যাবে না। স্পর্শকাতর তালিকা বাদ কিংবা সাফটা চুক্তি অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমাদের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তাও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। ছিটমহল বিনিময় নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে, তাতেও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর পরই বেড়ুবাড়ি আমরা দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনবিঘা আমরা পাইনি। সমুদ্র সীমানা নিয়ে ভারতের সাথে বিবাদ (ভারত বাংলাদেশের সীমানার ৮নং ব্লকে ৩১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা দাবি করেছে। ৪নং ব্লকেরও দাবি ভারতের) দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সমাধান হয়নি। এখন আমরা গেছি আরবিট্রেশনে। ফলশ্র“তি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হলেও, দেখা গেছে বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের অর্জন কম, কিন্তু ভারতের প্রাপ্তি অনেক বেশি। পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতি এক ধরনের ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাও আমরা লক্ষ্য করি।
তবে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরের আগে চীন সফর করে এই দুই নিকট প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে পররাষ্ট্রনীতিতে এক ধরনের ব্যালেন্স বা ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। চীন সফরের সময় তিনি কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক ও বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। চীন এ ব্যাপারে আগ্রহও দেখিয়েছে। কুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়ক নির্মিত হলে, তা এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। এর ফলে আগামীতে আমরা সড়ক পথেই যে শুধু চীন যেতে পারবো তা নয়, বরং চীন তার ইউনান প্রদেশের পণ্য রফতানিতে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরও ব্যবহার করতে পারবে। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। আমাদের জন্য চীনের সাথে সম্পর্ক রাখাটা জরুরি। এখন দেখতে হবে ভারত-বাংলাদেশ পরিবর্তিত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়। ইতিমধ্যে চীনকে সার্কের সদস্যপদ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবটি সমর্থন করতে পারে। সেক্ষেত্রে সার্কের নাম পরিবর্তন করতে হবে। চীন বর্তমানে সার্কের পর্যবেক্ষক। সম্প্রতি মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ভুটান, ভারত, নেপাল ও চীনকে নিয়ে ‘গঙ্গা নদী অববাহিকা সংস্থা’ ও ‘ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকা সংস্থা’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনার জন্য এ ধরনের সংস্থার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এখানেও মূল সমস্যা ভারতের আচরণ নিয়ে। কেননা এ অঞ্চলে বিপুল জ্বালানি সম্পদের (জলবিদ্যুৎ) সম্ভাবনা থাকলেও, ভারত দ্বিপাক্ষিক আলোকে এর সমাধান করছে। আর বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস করে। ফলে বাংলাদেশ যে বহুপাক্ষিকতার প্রস্তাব করেছে, তা কাগজে-কলমে থেকে যেতে পারে। ২৬ বছরে পা দিয়েও সার্কের কর্মকাণ্ড তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। এক সময় চীন এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমন্বয়ে ২০০১ সালে ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এর কথা বলেছিল। কিন্তু ভারত তাতে সায় দেয়নি। ভারত চাচ্ছে ‘মেকং-গঙ্গা সহযোগিতা’, যা ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এর বিকল্প।
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে বড় ধরনের উত্থান-পতন হচ্ছে। এর ঢেউ এসে বাংলাদেশেও লাগবে। ইউরোপ আমাদের তৈরি পোশাকের একটি বড় বাজার। কিন্তু ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা আমাদের পোশাক শিল্পে আঘাত হেনেছে। রফতানিতে ধস নেমেছে। এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের নতুন নতুন বাজার সন্ধান করতে হবে এবং সেই আলোকে পররাষ্ট্রনীতি নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। আসিয়ান একটি বড় বাজার। ভারত চেষ্টা করছে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ পেতে। বাংলাদেশের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে তারা এখন আসিয়ানের ‘ডায়ালগ পার্টনার’ (বাংলাদেশ আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের সদস্য)। বাংলাদেশকে এখন আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে উদ্যোগী হতে হবে। সেই সাথে সার্ক ও আসিয়ানের মাঝে সম্পর্ক কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সে প্রচেষ্টাও চালাতে হবে। জনশক্তি রফতানির বাজার আমরা খুঁজছি। গত তিন বছরে উল্লেখযোগ্য কোন নতুন বাজার আমরা খুঁজে পাইনি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই বিষয়টির ওপর এখন গুরুত্ব দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঝুঁকির মুখে যে ক’টি দেশ রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম’ (সিডিএফ)-এর তৃতীয় সম্মেলন। সম্মেলন শেষে ১৪ নভেম্বর ১৪ দফা ঢাকা ঘোষণা গৃহীত হয়। ওই ১৪ দফায় বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্তির পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা, বিশেষ করে ‘আইলা’ ও ‘সিডর’ পরবর্তী মানুষগুলোর দুরবস্থা বিশদ আকারে তুলে ধরা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কতটুকু সফল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। পররাষ্ট্রনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থটাই হলো প্রধান। এই জাতীয় স্বার্থ সব সময় রক্ষিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। মহাজোট সরকারের সময় গত তিন বছরে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, তা নিয়ে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ, জ্বালানি, বিদেশে কর্মসংস্থান ইত্যাদি ‘অপ্রচলিত ধারণা’ এখন বৈদেশিক নীতিতে প্রভাব ফেলছে। এর সাথে যোগ হয়েছে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা। তাই ২০২১ সালকে সামনে রেখে (যখন বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর) বাংলাদেশকে তার সনাতন পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। আর শুরুটা করতে হবে এখন থেকেই। কিন্তু গত তিন বছর পররাষ্ট্রনীতি যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, তাতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, তা এক বড় প্রশ্ন এখন। জাতীয় স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী নীতি গ্রহণ করা জরুরি। পৃথিবী খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা, ইউরোপে ‘ইউরোর’ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমরা বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। এ কারণে ‘বিশেষজ্ঞদের’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পর্কিত করা যায়। এবং তাদের দ্বারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালনা সম্ভব। মোটকথা পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতা পেতে হলে, একদিকে যেমনি প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি, অন্যদিকে প্রয়োজন সঠিক নীতিটি প্রণয়ন। ভারতের ওপর অতি নির্ভরতা কমাতে হবে। সেই সাথে নিকট প্রতিবেশী চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিও জরুরি। এ দিকটির দিকে লক্ষ্য রেখে আগামী দু’বছর সরকার যদি পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে, তাহলে দেশটির জন্য তা মঙ্গলই বয়ে আনবে।

দৈনিক ইনকিলাব। ২২ ডিসেম্বর ২০

ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল

গত ১৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে দুটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। একটিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তার নয় বছরের ইরাক আগ্রাসনের অবসান ঘটিয়েছে। আর দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে, চাকচিক্যের দেশ আমেরিকায় প্রতি দুজনে একজন চরম গরিব। এই দুটো সংবাদের একটির সঙ্গে অপরটির আদৌ কোনো মিল নেই। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী যে একটা 'মিল' তৈরি হয়েছিল, তা অবসান হতে বাধ্য। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে দেশটি দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু এই দখলি স্বত্ব তাদের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি। একসময়ের ঐতিহ্যম-িত ইরাক এখন ধ্বংসের নগরী। মৃত্যুর সংখ্যা ১১০৬৫৩ থেকে ১১৯৩৮০ জন। এর মাঝে আমেরিকান সেনা হতের সংখ্যা ৪৪৮৪ জন। আর যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মোট খরচ হয়েছে ৮০৬ বিলিয়ন ডলার, যে অর্থ জুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের করদাতারা। ইরাক যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের কোনো মঙ্গল বয়ে আনেনি। কেননা সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দুরবস্থার যেসব খবর পত্রপত্রিকায় ও গবেষণাপত্রে ছাপা হচ্ছে, তা দেশটির ভবিষ্যৎকে একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক শেলডন ড্যানিজার সম্প্রতি ২৯টি শহরে একটি জরিপ চালান। তাতে দেখা যায়, আমেরিকায় প্রতি দুজনের মাঝে একজন চরম গরিব। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র কোটি কোটি ডলার খরচ করছে যুদ্ধের পেছনে, সেখানে নিজ দেশে দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে পারেনি। ড্যানিজার তার গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ফুড স্টাম্প এবং ট্যাক্স ক্রেডিটের মতো সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিগুলো দারিদ্র্যের হার কমিয়ে রেখেছিল। কিন্তু দারিদ্র্য এখন আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। এমনকি তা ২০১০ সালের চেয়েও বেড়ে গেছে। ভাবতে অবাক লাগে, যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে দারিদ্র্য বাড়ছে, সেখানে দেশটি যুদ্ধের পেছনে (আফগানিস্তান ও ইরাক) ব্যয় করেছে ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। বেকারত্বের হার সেখানে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির অবস্থাও উদ্বেগজনক। গড় প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশেরও কম। একদিকে যুদ্ধের খরচ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব এবং করপোরেট হাউসগুলোর অতিরিক্ত মুনাফা জন্ম দিয়েছে 'অকুপাই মুভমেন্ট'-এর। ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজায় যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে (ঙপঃড়নবৎ ২০১১ গড়াবসবহঃ), তার মূল টার্গেট যুদ্ধের খরচ কমানো ও সামাজিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো। এ আন্দোলন গতকাল ৭৫ দিন অতিক্রম করেছে। অন্যদিকে নিউইয়র্কের 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলন গতকাল পার করেছে ৯২ দিন। এই 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলন, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের বৈষম্য ও অসমতার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিবাদ। নোয়াম চমস্কি এ ধরনের আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। চমস্কি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চিহ্নিত করেছেন চষঁঃড়হড়সু হিসেবে। অর্থাৎ সম্পদের কারণে একটি ধনিক শ্রেণীর জন্ম হয়েছে, যারা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। এরা সমাজের মাত্র ১ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন, বাকি ৯৯ ভাগ চৎবপধৎরধঃ, অর্থাৎ অনিশ্চিতভাবে জীবন যাপনকারী একটি শ্রেণী। এই দুই শ্রেণীর মাঝে দ্বন্দ্ব এখন অনিবার্য।
পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় অর্থনীতির দেশে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের পেছনে (ইরাক ও আফগানিস্তান) ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করছে (প্রতি মাসে ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার), সেখানে জনগোষ্ঠীর ৯ দশমিক ১ ভাগের কোনো চাকরি নেই। শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগ মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ মানুষ। ক্ষোভটা তাই ওয়াল স্ট্রিটকে ঘিরেই। ওয়াল স্ট্রিটকে ধরা হয় পুঁজিবাদের একটা সিম্বল হিসেবে। প্রধান প্রধান করপোরেট হাউসগুলোর অফিস সেখানে। স্টক একচেঞ্জ ভবনও এখানে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদী সমাজে ১৯৭০ সালে ধনী গুণী হিসেবে পরিচিতদের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১১ সালে তারা ভোগ করে মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ব্রাকলে) অধ্যাপক এমানুয়েল সাজ (ঊসধহঁবষ ঝধবু) তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন কীভাবে আমেরিকান সমাজে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। তার মতে, ১০ ভাগ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ গ্রহণ করে। ডেভিড গ্র (উধারফ এৎধ)ি তার এক প্রবন্ধে (ঞযব জরপযবংঃ ষ%. ঐধাব পধঢ়ঃঁৎবফ অসবৎরপধহ্থং ডবধষঃয, অষঃবৎহবঃ) উল্লেখ করেছেন আমেরিকান ধনীদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের গরিব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের মোট সম্পদের চাইতেও বেশি। অর্থাৎ ১৫৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর সম্পদের চাইতেও বেশি। তার মতে, শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। যদিও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিটস (ঔড়ংবঢ়য ঝঃরমষরঃু) মনে করেন শীর্ষে থাকা ওই এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। অথচ ২৫ বছর আগে ধনীরা নিয়ন্ত্রণ করতো মাত্র, ১২ ভাগ সম্পদ (ইু ঃযব ১%, ভড়ৎ ঃযব ১%, ঠধহরঃু ভধৎব)। অপর এক গবেষক রবার্ট রাইচ (জড়নবৎঃ জবরপয)-এর মতে, যুক্তরাষ্ট্রেও সর্বোচ্চ বেতনভোগী মানুষদের মাঝে ৫.৩৭ শতাংশ ভোগ্যপণ্যের ক্রেতা। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় যুক্তরাষ্ট্রে একটি শ্রেণী ধনী থেকে আরো ধনী হচ্ছে, আর অপর শ্রেণী গরিব থেকে আরো গরিব হচ্ছে, যাদের ক্রয়ক্ষমতা কম, সম্পদের পরিমাণও কম। যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটি সমাজব্যবস্থার জন্ম হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে ঈধংরহড় ঈধঢ়রঃধষরংস। অর্থাৎ ক্যাসিনোনির্ভর একটি অর্থনীতি, যেখানে এক রাতে লাখ লাখ ডলার জুয়া খেলায় হেরে যান অনেক আমেরিকান। ব্যক্তিগত প্লেন নিয়ে আটলান্টায় যান। ক্যাসিনোগুলোর নিজস্ব ফাইভ স্টার হোটেল আছে, সেখানে থাকেন, সারারাত জুয়া খেলে রোববার যার যার শহরে চলে যান। ওখানে একদিকে ক্যাসিনোগুলোর জৌলুস, অন্যদিকে ক্যাসিনোগুলোর কিছুটা দূরে জরাজীর্ণ পুরনো বাড়ি, সেখানে বাস করে বস্নাক আমেরিকানরা, যাদের অনেকেরই চাকরি নেই। স্বাস্থ্যসেবাও তারা পান না। কী বৈসাদৃশ্য! একই দেশের নাগরিক। একজন যেখানে এক রাতে জুয়া খেলে হেরে যান কয়েক হাজার ডলার, অন্যজন সারা মাসেও যার রোজগার নেই মাত্র এক হাজার ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের এই সমাজব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের সমাজব্যবস্থায় 'সোশ্যাল ডেমোক্রেসি'র ধারণা সেখানে গরিবদের, বেকারদের নূ্যনতম অধিকার (স্বাস্থ্য, শিক্ষা) নিশ্চিত করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এই অধিকার নিশ্চিত হয়নি। রাষ্ট্র সব নাগরিকের নূ্যনতম অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। আমি যুক্তরাষ্ট্রে গৃহহীন মানুষ দেখেছি। ভিক্ষা করে এমন লোকও আমি সাবওয়েতে দেখেছি। গায়িকা ম্যাডোনার ভাইও গৃহহীনদের একজন_এ খবরও ছাপা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকায়।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেখানে ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন, অর্থাৎ ১ কোটি ৬৪ লাখ শিশু রয়েছে অত্যন্ত গরিব। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার দরিদ্র পরিবারের যে সীমা নির্ধারণ করেছে (অর্থাৎ ২২ হাজার ৫০ ডলার বছরে), সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ২১ ভাগ শিশুসন্তান (প্রতি ৫ জনে ১ জন) ওই সব পরিবারে বসবাস করে। জীবনের কোনো একসময় ৯০ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ শিশু 'ফুড স্টাম্প' (বিনে পয়সায় খাদ্য)-এর ওপর নির্ভরশীল ছিল। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য পাস করা একজন গ্র্যাজুয়েট কোনো চাকরির সংস্থান করতে পারছে না, সেখানে ২০১০ সালে করপোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। জুকোট্টি পার্কে যারা অবস্থান নিয়ে দিনের পর দিন প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন, তাদের অনেকেরই চাকরি নেই। অথচ সরকারি হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বছরে ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্য। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে আফগানিস্তানে যুদ্ধের জন্য ব্যয় করেছে ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে অনেকের চাকরির সংস্থান করা যেত। শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়ানো যেত। বাড়ানো যেত 'সামাজিক নেট'-এর পরিধি (ফুড স্টাম্প, হাউজিং ইত্যাদি)। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা করেনি। ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ সেখানে যখন কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারেনি, তখন লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র 'তৃতীয় যুদ্ধ' এর সূচনা করেছিল। গাদ্দাফির হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে বটে, কিন্তু লিবিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী একটি অস্থিতিশীলতার জন্ম হয়েছে। লিবিয়ায় 'আরেকটি আফগানিস্তান' কিংবা 'আরেকটি সোমালিয়া' জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে জড়িয়ে গেছে। এখন জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় সেখানে যুদ্ধের খরচ মেটাতে হচ্ছে।
এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এই যে বৈষম্য, এই বৈষম্যের কারণেই সেখানে 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট'-এর মতো আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। যদিও পুঁজিবাদী সমাজে এ বৈষম্য নতুন কিছু নয়। পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিই হল আসল কথা। এই পুঁজি একটি নতুন অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে। এই সম্পদশালী ধনিক শ্রেণী এখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, যেখানে সাধারণ মানুষের কথা বলার কেউ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে যারা নির্বাচিত হন, তারা এই চষঁঃড়হড়সু-রই প্রতিনিধি। এদের আর্থিক সহায়তায় এরা নির্বাচিত হন। তাই নির্বাচিত হওয়ার পর তারা এই সম্পদশালী ধনিক শ্রেণীরই স্বার্থরক্ষা করেন। নোয়াম চমস্কি লিখেছেন, The world is divided into two blocks-the Plutonomy and the rest। যুক্তরাষ্ট্র এই  Plutonomy অর্থনীতিরই প্রতিনিধিত্ব করে। কার্ল মার্কস শ্রেণী দ্বন্দ্বের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন শ্রেণী দ্বন্দ্বের কারণে বিপ্লব অনিবার্য। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন করে শ্রেণী দ্বন্দ্বের একটি রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। একটি সামাজিক বিপ্লব সেখানে আসন্ন। যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে তাই একটা শঙ্কা থেকেই গেল।
দৈনিক ডেসটিনি, ২১ ডিসেম্বর ২০১১।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ব রাজনীতির চালচিত্র

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে ২০১১ সালে কোন বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল? ‘ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ড?’ ‘আরব বসন্ত?’ যুক্তরাষ্ট্রের ‘তৃতীয় যুদ্ধ’, নাকি ‘অকুপাই মুভমেন্ট?’ টাইম সাময়িকী ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ বা বিশ্ব জুড়ে চলা প্রতিবাদ বিক্ষোভকে ‘বর্ষ সেরা ঘটনা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই কাজটি টাইম সাময়িকী বরাবরই করে থাকে। এবারও করেছে। তবে কোনো ব্যক্তিকে এরা বর্ষসেরা করেনি, করেছে একটি আন্দোলনকে। এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়ার একটি ছোট্ট শহর সিদি বওজিদে তরুণ কম্পিউটার গ্রাজুয়েট ও জীবন ধারণের জন্য ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বওকুজিজির আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে। তার আত্মহত্যা ‘আরব বসন্ত’-এর জন্ম দিয়েছিল। সাধারণ মানুষের এই বিক্ষোভ ভিন্ন আঙ্গিকে শুরু হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে পুঁজিবাদের আখড়া হিসেবে খ্যাত নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে। ‘আরব বসন্ত’ ও ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে সত্য, কিন্তু মিল আছে এক জায়গায়-আর তা হচ্ছে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজের সম্পৃক্ততা। টাইম সাময়িকী সামগ্রিকভাবে বিক্ষোভকারীদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়েছে। টাইম মন্তব্য করেছে এভাবে, ‘বিক্ষোভকারীরা নিজেদের দুর্দশা ও দুর্ভোগের অভিযোগ তুলেই ক্ষান্ত হয়নি। বদলে দিয়েছে বিশ্বকে। তরুণ সমাজের এই বিক্ষোভ সারা বিশ্বকে একটি বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের জন্য তা নিঃসন্দেহে একটি শিক্ষা।’ একুশ শতকে ইন্টারনেট যে একটি সমাজকে কীভাবে বদলে দিতে পারে, তার বড় প্রমাণ ‘আরব বসন্ত’, আর যুক্তরাষ্ট্রের ‘অকুপাই মুভমেন্ট’। দেশ, কাল, পাত্রের মাঝে পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু সামাজিক নেটওয়ার্ক (ফেইসবুক, টুইটার) যেভাবে কায়রোর তেহরির স্কোয়ারে হাজার হাজার মানুষকে সমবেত হতে সাহায্য করেছিল, একইভাবে সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে জুকোটি পার্কে সমবেত হয়েছিল হাজার হাজার মার্কিন যুবা। যদিও নিউইয়র্কের বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তেহরির স্কোয়ারের বিক্ষোভকারীদের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। নিউইয়র্কে বিক্ষোভকারীদের মূল দাবি মার্কিন সমাজে অসমতা, বেকারত্ব দূর করা। একই সঙ্গে করপোরেট হাউসগুলোর একচ্ছত্র মুনাফা হ্রাস করা। যদিও ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজায় যে আন্দোলন হচ্ছে তার ধরনটা একটু ভিন্ন। তারা চাচ্ছে যুদ্ধের ব্যয় হ্রাস করে সামাজিক খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য) ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো। আর তেহরির স্কোয়ার থেকে শুরু করে সারা আরব বিশ্বে যে আন্দোলন চলছে, এই আন্দোলনের মূল টার্গেট হচ্ছে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা শাসকবর্গ, যাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই, তাদের উত্খাত করা। ইতোমধ্যে এই আন্দোলনের ফলে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েছেন তিউনিসিয়ার জইনাল আবেদিন বেন আলী, মিসরের হোসনি মুবারক, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, আর ইয়েমেনের আলী আবদুল্লাহ সালেহ। সঙ্গত কারণেই টাইম সাময়িকী যখন এই সব অভ্যুত্থানকে বছরের সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে, এর পেছনে যুক্তি রয়েছে বৈকি! কিন্তু শুধু ওই গণঅভ্যুত্থানকে সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। আমার বিবেচনায় মে মাসে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে আল কায়দার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও বিশ্ব রাজনীতিতে ২০১১ সালের অন্যতম সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। পেছনে যুক্তিও রয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে আল কায়দার উস্কানি ও ইসলামী সন্ত্রাসবাদের জন্ম বিশ্ব রাজনীতিকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছিল। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে জন্ম হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একমাত্র চ্যালেঞ্জকারী শক্তি। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাবে চ্যালেঞ্জ করার কেউ থাকল না। কিন্তু ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে টুইন টাওয়ারে হামলা ও তা ধ্বংস করা, পেন্টাগনের ব্যর্থ বিমান হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে সারা বিশ্ব জানল আল কায়দা নামের একটি সংগঠনের নাম, যারা ইসলাম ধর্মকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। যদিও এটা আজও অস্পষ্ট রয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একসঙ্গে একই সময়ে চারটি বিমান হাইজ্যাক করে আত্মঘাতী হামলা চালানোর সঙ্গে ইসলামী জঙ্গিরা কতটুকু জড়িত ছিল। যদিও আল কায়দা ওই হামলার সঙ্গে তার দায় স্বীকার করে নিয়েছিল।
কিন্তু অনেক প্রশ্নের জবাব আজও মেলেনি। টুইন টাওয়ার হামলাকে  কেন্দ্র করে আফগানিস্তান আক্রমণ করা ও দেশটি দখল করে নেওয়া, পাকিস্তানে লাদেনের আশ্রয় ও পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার তা না জানার কথা ইত্যাদি গত দশ বছরে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এসব প্রশ্নের জবাব এই মুহূর্তে হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু ইতিহাস হয়তো একদিন বলবে কী ঘটেছিল লাদেনকে ঘিরে। লাদেন অ্যাবোটাবাদে বসবাস করতেন পাঁচ বছর ধরে এবং দুই স্ত্রীসহ, কোনো রকম নিরাপত্তা ব্যূহ ছাড়াই। যাকে সারা বিশ্বের গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে খুঁজছিল, তিনি কিনা একাকী বসবাস করবেন একটি বাড়িতে! পাকিস্তানের কোনো গোয়েন্দা সংস্থাই তা জানবে না-এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? লাদেনকে হত্যার পর ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে অনেক ছবি ছাপা হয়েছিল অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়িকে নিয়ে। একটি ছবি ছিল পাঁচ বছর আগের তোলা। সূত্র সিআইএ। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ওই বাড়িটি দেখানো হয়েছিল। প্রশ্ন এসে যায় পাঁচ বছর আগে যদি সিআইএ ওই বাড়িটি চিহ্নিত করে থাকে, (যেখানে লাদেন লুকিয়ে থাকতে পারেন এমন আশঙ্কা করা হয়েছিল) তাহলে সিআইএ এত সময় নিল কেন, লাদেনকে হত্যা করার? আরও একটা প্রশ্ন, মৃত লাদেনের ছবি সিআইএ ‘রিলিজ’ করল না কেন? নাকি লাদেনের নামে যাকে হত্যা করা হয়েছিল, সে অন্য কেউ! এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। তবে লাদেনকে নিয়ে একটা ‘মিথ’ তৈরি হয়েছিল। এই ‘মিথ’কে উস্কে দিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে একটা প্রচারণা চালানো হয়েছিল। আর এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইরাক দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ ঘটনায় গাদ্দাফিও উত্খাত হলেন। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। যুদ্ধের নামে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করেছে মার্কিন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলো। ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রতিমাসে এই দুটো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। চিন্তা করা যায় কী বিপুল পরিমাণ অর্থ যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে এই যুদ্ধের পেছনে? সুতরাং অবশ্যই লাদেনের মৃত্যু আমার কাছে ২০১১ সালের অন্যতম একটি ঘটনা। এর গুরুত্ব এ কারণে বেশি যে, লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে কিনা? যদিও লাদেনের মৃত্যুর ৬ মাস পার হয়ে গেছে এবং আল কায়দার কোনো বড় ধরনের আক্রমণ আমরা বিশ্বের কোথাও লক্ষ করছি না। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর যে ধারণা উস্কে দিয়েছিল, তাতে কোটি কোটি ডলার খরচ করেও ওই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যায়নি। ইরাক ও আফগানিস্তানে আত্মঘাতী বোমা সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। পাকিস্তান আজ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। আগামী ২০ বছরে এ অঞ্চলের মানচিত্র যদি বদলে যায়, আমি অবাক হব না। ২০১১ সালের আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা গুরুত্বের দাবি রাখে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপের অর্থনৈতিক সঙ্কট। ইউরোপের এই অর্থনৈতিক সঙ্কটে পর্তুগাল, গ্রিস ও ইতালি সরকারের পতন ঘটেছে। গ্রিসের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। কৃচ্ছ্র সাধন করেও অর্থনীতিকে বাগে আনা যাচ্ছে না। ইউরোপের এই অর্থনৈতিক সঙ্কট দুটো বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। এক. একক মুদ্রা হিসেবে ইউরো টিকে থাকবে কি না? দুই. ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার ঐক্যকে ধরে রাখতে পারবে কি না? ২৭টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর মধ্যে ১৭টি দেশে ইউরো চালু রয়েছে। একটা প্রশ্ন ইতোমধ্যে উঠেছে যে, ইউরোপের ধনী দেশগুলো ইউরোপের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেই ধনী ও গরিব রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। ইউরোপের এই সঙ্কট ২০১২ সালেও অব্যাহত থাকবে, যা নতুন নতুন সঙ্কটের জন্ম দেবে।
ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণ, ডারবানে ব্যর্থ জলবায়ু সম্মেলন, ইরানের পারমাণবিক সঙ্কট ইত্যাদি বিষয়কেও হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর এখন পারমাণবিক বিদ্যুতের ভবিষ্যত্ একটা প্রশ্নের মুখে থাকল। খোদ জাপানের মতো দেশে পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদন যেখানে ঝুঁকির মুখে, সেখানে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবেই। বাংলাদেশ এরই মাঝে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে একটি চুক্তি করেছে। ডারবানে কপ-১৭ সম্মেলনে বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাসকল্পে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে ব্যর্থ হওয়ায় ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে একধরনের ‘ঈষরসধঃব অঢ়ধত্ঃযবরফ’ অর্থাত্ জলবায়ু বর্ণবৈষম্যের জন্ম হয়েছে। চলতি বছরও এর প্রভাব থাকবে। একই সঙ্গে সিরিয়া ও ইরানের পারমাণবিক পরিস্থিতি বিশ্ব রাজনীতিতে ২০১২ সালে বার বার আলোচিত হতে থাকবে। ইরাক থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চল থেকে তার হাত গুটিয়ে নিল, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। ২০১১ সাল শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেক নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে। ২০১২ সালও আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরও অনেক নাটকীয় ঘটনা প্রত্যক্ষ করার।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

চার দশকের বৈদেশিক নীতি : একটি মূল্যায়ন

গত চল্লিশ বছরের বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে
মূলত তিনটি ধারা আমরা লক্ষ্য করবো। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট
পর্যন্ত একটি ধারা। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর, যা
অব্যাহত থাকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায়
আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এই তিনটি ধারাতেই কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য
অগ্রগতি আমরা লক্ষ্য করি। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে
তোলা হয়েছিল, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, ক. সংসদীয় গণতন্ত্র, খ.
সংসদীয় গণতন্ত্রের আওতায় দলীয় কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা, গ. সমাজতান্ত্রিক সমাজ
কাঠামো, ঘ. নিরপেক্ষ রাজনীতি। কোন কোন বিশ্লেষক এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে,
এটা ছিল অনেকটা ‘ভারতীয় মডেল।' ওই সময় বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি
বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। যেমন- ক. সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের
সাথে বাংলাদেশের ‘বিশেষ সম্পর্ক' স্থাপন, খ. ভারতের নির্ধারক ভূমিকা। তবে
আদর্শ হিসেবে জোটনিরপেক্ষতা অনুসরণ করা, গ. অর্থনৈতিক সাহায্যের
প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, ঘ. চীনের সঙ্গে
সম্পর্ক স্থাপনে অনীহা ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন ৪৩ মাস।
ওই সময় ব্রেজনেভ (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান) প্রণীত যৌথ নিরাপত্তা
চুক্তির প্রতি সমর্থন, তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিরোধী সরকারের ৭ দফা দাবির
প্রতি সমর্থন, ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা শীর্ষক সম্মেলনের প্রতি সমর্থন
ইত্যাদি কারণে বহি:বিশ্বে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে বাংলাদেশ সোভিয়েত
ইউনিয়নের সাথে একটা এ্যালায়েন্স গড়ে তুলছে, যা এ অঞ্চলে সাবেক সোভিয়েত
ইউনিয়নের স্বার্থকে রক্ষা করবে। বহিঃবিশ্বে  চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার
কারণেই বাংলাদেশ ওই সময় সোভিয়েত শিবিরে অবস্থান করছিল এবং সোভিয়েত-ভারত
সম্পর্কের কারণে এটা এক ধরনের বাধ্যবাধকতাও ছিল। অভ্যন্তরীণভাবে একটা ‘চাপ'ও
ছিল, যারা মনে করতেন সোভিয়েত সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশে
‘সমাজতন্ত্র' নির্মাণ করা যাবে না। ওই সময় ১৯৭২ সালের মার্চে বাংলাদেশ-ভারত
মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা ছিল বিতর্কিত। শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালে
আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিলেও, ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিলেন।
১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন।
চীনের সাথে প্রাথমিক যোগাযোগের একটা উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু সফল
হননি। ১৯৭৫ সালের আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে
পরিবর্তন আনা হয়। এর আগে ১৯৭৫ সালে যে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা
হয়েছিল, তা বাতিল ঘোষিত হয়। সৌদি আরব ও চীন বাংলাদেশকে প্রথমবারের মত
স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট পরবর্তী ঘটনার মধ্যে দিয়ে শহীদ জেনারেল জিয়া
রাষ্ট্র ক্ষমতায় অপ্রতিদ্বন্দ¡ী শক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে
বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সাথে
সম্পর্ক বৃদ্ধির উপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জিয়া মনে করতেন বাংলাদেশ হচ্ছে
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে ইসলামের ব্রিজ স্বরূপ। জিয়ার
শাসনামলেই বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ
করে। আল কুদ্স কমিটি ও ১৯৮১ সালে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ইরান-ইরাক যুদ্ধের
মধ্যস্থতাকারী কমিটিরও সদস্য ছিল বাংলাদেশ। জিয়ার আমলেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের
নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী পরিষদের সদস্যপদের একটিতে নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৭৯
সালে বাংলাদেশ পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ সম্পর্কিত ঘচঞ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।
জেনারেল জিয়া ভারতের ভূমিকার ব্যাপারে কঠোর হয়েছিলেন। বাংলাদেশ ১৯৭৬
সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে ও একই বছরে ৪২ জাতি ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের
সম্মেলনে ফারাক্কা প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৭  সালে বাংলাদেশ
ভারতের সাথে গঙ্গার পানি বণ্টনের প্রশ্নে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। চীনের সাথে
সম্পর্ক উন্নয়নের প্রশ্নে তার অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি চীনের সাথে শুধু
সম্পর্ক বৃদ্ধিই করেননি বরং বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে চীনের উপস্থিতিকে
প্রয়োজনীয় করে তুলেছিলেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগান আগ্রাসনের
(১৯৭৮) ব্যাপারেও বাংলাদেশ কঠোর হয়েছিল। হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ, বেগম
জিয়া কিংবা শেখ হাসিনার (১৯৯৬-২০০১) বৈদেশিক নীতি ছিল জিয়া প্রণীত বৈদেশিক
নীতির ধারাবাহিকতা। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের
সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির ব্যাপারে এরশাদ, বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার সরকারের মাঝে
তেমন কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়নি। তবে শেখ হাসিনার সময় চীনের উপর থেকে
‘সামরিক নির্ভরতা' কিছুটা হ্রাস করে রাশিয়ার সাথে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি
উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়।

এরশাদের সময় (১৯৮২-১৯৯০) পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে ১৪ জন
সোভিয়েত কূটনীতিককে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি
সমাদৃত হয়েছিলেন। তার আমলেই ১৯৮৫ সালে সার্ক আÍপ্রকাশ করে, যদিও এর
উদ্যোগটা নিয়েছিলেন শহীদ জিয়া। তবে ১৯৮১ সালের ৯ মে ভারতীয় নৌ-বাহিনী
দক্ষিণ তালপট্টি দখল করে নিলেও  তিনি ভারতের ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ
করতে পারেননি। বেগম জিয়ার (১৯৯১-৯৬, ২০০১-২০০৬) বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য
দিক ছিল, ক. চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া, খ. যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের
আরো উন্নতকরণ, গ. আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ককে আরো কার্যকরী করা, ঘ.
সৌদি আরব-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া, ঙ. ভারতের সাথে দ্বি-পাক্ষিক
সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি সমঝোতায় উপনীত হবার চেষ্টা করা। বেগম জিয়ার সময় বিচারক
কূটনীতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশ মায়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ
নেয়। তার আমলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ
করে। বেগম জিয়ার দ্বিতীয় টার্মে (২০০১-২০০৬) বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী বৈদেশিক
নীতির সূচনা করে, যা ছিল আগে উপেক্ষিত। বেগম জিয়ার সময় চীন ‘কুনমিং
উদ্যোগ'-এর কথা বলে (চীনের ইউনান প্রদেশ, মায়ানমার, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের
রাজ্যগুলোও থাইল্যান্ডের সমন¦য়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা)। কিন্তু ভারতের
আগ্রহ ছিল ‘গঙ্গা মেকং সহযোগিতার' উপর, যে কারণে ‘কুনমিং উদ্যোগ' এর আর
জট খোলেনি। ভারত এখন আসিয়ান এর সদস্য হতে চায়। যে কারণে ‘কুনমিং উদ্যোগ'
 এ যেখানে চীনের জড়িত হওয়ার কথা রয়েছে, সে ব্যাপারে তার আগ্রহ কম। বেগম
জিয়ার সময় মায়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মায়ানমার
আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্য সংকটে মিয়ানমার
আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিতে পারে।

শেখ হাসিনা দুই টার্মের জন্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো
ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্ব
দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদী
একটি চুক্তি হয়েছিল। যদিও তার আমলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি তিনি আর
নবায়ন করেননি। ভারতে আশ্রিত পাহাড়ী শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে
এসেছিলেন। তার আমলে সার্ক এর ভেতরে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত
(ঝঅএছ) গৃহিত হয়েছিল। যদিও তা কার্যকরী হয়নি। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে
ভারতীয় পণ্য আমদানি সাড়ে ৩ গুণ। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পর পর কয়েকটি
পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তিনি শান্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ নেন, যা
প্রশংসিত হয়। তার সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে
আসেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিপিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সাথে ‘হানা'
চুক্তিও (হিউম্যানিটোরিয়ান অ্যাসিস্টটেন্ট নিডস অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করে
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। তিনি ১৯৯৭ সালের ফেব্র“য়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব
ক্ষুদ্র ঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে
বেছে নিলেও সামরিক ক্ষেত্রে চীনের উপর থেকে পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা তিনি কমানোর
উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার আমলে ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা
হয়েছিল। বাংলাদেশ ঐ সময় চীনের বদলে রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয়
করেছিল (মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার)। চীন মিগ-২৯ বিমান সরবরাহ করতে রাজি হলেও
বাংলাদেশ ঐ বিমান রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিল। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ
দু'টি আঞ্চলিক জোট ডি-৮ ও বিমস্টেক এ যোগ দেয়। তিনি ওআইসির শীর্ষ
সম্মেলনে (ইসলামাবাদ, মার্চ ১৯৯৭) যোগ দিয়ে ইসলামি বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের
সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠারও
দাবি জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী
হয়ে তিনি একটি মহাজোট সরকার গঠন করেছেন।

মহাজোট সরকারের সময় অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সাথে সম্পর্ক
সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর) নিয়ে
বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি
স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরীও হয়েছে, যদিও
ট্রানজিট ফি এখনও নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে ট্রানজিটের বিষয়টি বহু পাক্ষিকতার
আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেল ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান
বা নেপাল এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটো দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার
কথা। কিন্তু ইতোমধ্যে এই সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে- এ তথ্য আমাদের জানা নেই।
এমনকি ভারতের 'সাতবোন' রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহারের যে
সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি
রফতানি যেভাবে বাড়ছে তাতে করে আগামী দিনগুলো বাংলাদেশী পণ্য খালাস করতেই
হিমশিম খাবে। এক্ষেত্রে ‘সাতবোন' রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি
করেছে। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এই ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে
আমরা বাধ্য। মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংক্রান্ত
চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব অনেক বেশি। উক্ত চুক্তিতে যে ‘ভাষা' ব্যবহার
করা হয়েছে তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের
স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত ৩ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাল্লাটা ভারতের
দিকে ঝুঁকে গেছে, বাংলাদেশের প্রাপ্তিটা তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশ তিস্তার
পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা হলেও
(৪৮:৫২ ভাগ), চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হবে না এবং
সেখানে কোন অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশকে তা জানানো হবে, এ
ধরনের প্রতিশ্র“তি ভারত দিলেও, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ
নির্মাণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি গত ২২ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ এ
ব্যাপারে তার কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজ
কার্যকর হলে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পানিশূন্য হয়ে পড়বে ও এ অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া
শুরু হবে। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। ঘাটতি বাড়ছে। ভারত অতি
সম্প্রতি ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা বললেও তা দিয়ে বিশাল বাণিজ্য
ঘাটতি কমানো যাবে না। স্পর্শকাতর তালিকা বাদ কিংবা সাফটা চুক্তি অনুযায়ী
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমাদের যে সুবিধা পাবার কথা, তাও আমরা নিশ্চিত করতে
পারিনি। ছিটমহল বিনিময় নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে, তাতেও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পর পরই বেরুবাড়ি আমরা দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনবিঘা আমরা পাইনি।
সমুদ্রসীমানা নিয়ে ভারতের সাথে বিবাদ (ভারত বাংলাদেশের সীমানার ৮ নং ব্লকে
৩১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা দাবি করেছে। ৪ নং ব্লকেরও দাবি ভারতের)
দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সমাধান হয়নি। এখন আমরা গেছি আরবিট্রেশনে। ফলশ্র“তি
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হলেও, দেখা গেছে
বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের অর্জন করা, কিন্তু ভারতের প্রাপ্তি অনেক বেশি।
পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতি এক ধরনের ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাও
আমরা লক্ষ্য করি। তবে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে চীন সফর করে এই দুই নিকট
প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে পররাষ্ট্রনীতিতে এক ধরনের ব্যালেন্স বা ভারসাম্য
রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। চীন সফরের সময় তিনি কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক ও
বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্র বদর নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
চীন এ ব্যাপারে আগ্রহও দেখিয়েছে। কুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়ক নির্মিত হলে, তা এক
নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। এর ফলে আগামীতে আমরা সড়ক পথেই যে শুধু চীনে
যেতে পারবো তা নয়, বরং চীন তার ইডনান প্রদেশে পণ্য রফতানিতে চট্টগ্রাম সমুদ্র
বন্দরও ব্যবহার করতে পারবে। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। আমাদের জন্য চীনের সাথে
সম্পর্ক রাখাটা জরুরি। এখন দেখতে হবে ভারত-বাংলাদেশ পরিবর্তিত সম্পর্কের
পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়। ইতোমধ্যে চীনকে
সার্কের সদস্যপদ দেয়ার আহ্বান জানান হয়েছে। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবটি সমর্থন
করতে পারে। সেক্ষেত্রে সার্কের নাম পরিবর্তন করতে হবে। চীন বর্তমানে সার্কের
পর্যবেক্ষক। সম্প্রতি মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে।
উক্ত সম্মলনে প্রধানমন্ত্রী ভুটান, ভারত, নেপাল ও চীনকে নিয়ে ‘গঙ্গা নদী অববাহিকা
সংস্থা' ও ‘ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকা সংস্থা' গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। অভিন্ন
নদীর পানি ব্যবস্থাপনার জন্য এ ধরনের সংস্থার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এখানেও
মূল সমস্যা ভারতের আচরণ নিয়ে। কেননা এ অঞ্চল বিপুল জ্বালানি সম্পদের
(জলবিদুৎ) সম্ভাবনা থাকলেও ভারত দ্বিপাক্ষিক আলোকে এর সমাধান করছে। আর
বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস করে। ফলে বাংলাদেশ যে বহুপাক্ষিকতার প্রস্তাব
করেছে, তা কাগজ-কলমে থেকে যেতে পারে। ২৬ বছরে পা দিয়েও সার্কের কর্মকাণ্ড
তেমন আশাব্যাঞ্জক নয়। এক সময় চীন এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমন¦য়ে ২০০১ সালে
‘কুনমিং উদ্যোগ' এর কথা বলেছিলো। কিন্তু ভারত তাতে সায় দেয়নি। ভারত চাচ্ছে
“মেকং-গাঁদা সহযোগিতা”, যা ‘কুনমিং উদ্যোগ এর বিকল্প।

বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে বড় ধরনের উত্থান-পতন হচ্ছে। এর ঢেউ এসে বাংলাদেশেও
লাগবে। ইউরোপ আমাদের তৈরি পোশাকের একটি বড় বাজার। কিন্তু ইউরোপে
অর্থনৈতিক মন্দা আমাদের পোশাক শিল্পে আঘাত হেনেছে। রফতানিতে ধস নেমেছে। এই
বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের নতুন নতুন বাজার সন্ধান করতে হবে এবং সেই
আলোকে পররাষ্ট্রনীতি নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। আসিয়ান একটি বড় বাজার।
ভারত চেষ্টা করছে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ ‘ডায়লগ পার্টনার' (বাংলাদেশ আসিয়ান
আঞ্চলিক ফোরামের সদস্য)। বাংলাদেশকে তখন আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে উদ্যোগী
হতে হবে। সেই সাথে সার্ক ও আসিয়ানের মাঝে সম্পর্ক কিভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সে
প্রচেষ্টাও চালাতে হবে। জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই।
সনাতন দেশগুলোতেই রফতানির বাজার আমরা খুঁজছি। গত তিন বছরে উল্লেখযোগ্য
কোনো নতুন বাজার আমরা খুঁজে পাইনি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই বিষয়টির উপর
এখন গুরুত্ব দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। ঝুঁকির মুখে যে ক'টি দেশ রয়েছে, তার মাঝে বাংলাদেশ অন্যতম।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ক্লাইমেট ভলনারেবেল ফোরাম' (সিভিএফ)-এর
তৃতীয় সম্মেলন। সম্মেলন শেষে ১৪ নবেম্বর ১৪ দফা ঢাকা ঘোষণা গৃহীত হয়। উক্ত ১৪
দফায় বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে
অর্থপ্রাপ্তির পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা, বিশেষ করে ‘আইলা' ও ‘সিডর'
পরবর্তী মানুষগুলোর দুরবস্থা বিষয়ক আসরে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমাদের
পররাষ্ট্রমন্ত্রী কতটুকু সফল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। পররাষ্ট্রনীতিতে জলবায়ু
পরিবর্তনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থটাই হলো প্রধান। এই জাতীয় স্বার্থ সব সময় রক্ষিত
হয়েছে, তা বলা যাবে না। মহাজোট সরকারের সময় গত তিন বছরে জাতীয় রক্ষা
কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, তা নিয়ে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন,
সন্ত্রাসবাদ, জ্বালানি, বিদেশে কর্মসংস্থান ইত্যাদি। ‘অপ্রচলিত ধারণা' তখন
বৈদেশিক নীতিতে প্রভাব ফেলছে। এর সাথে যোগ হয়েছে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক
মন্দা। তাই ২০২১ সালকে সামনে রেখে যেমন বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০
বছর) বাংলাদেশকে তার সনাতন পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। আর
শুরুটা করতে হবে এখন থেকেই। কিন্তু গত তিন বছর পররাষ্ট্রনীতি যেভাবে পরিচালিত
হয়েছে, তাতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, তা এক বড়ো প্রশ্ন
এখন। জাতীয় স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী নীতি
বহন করা জরুরী। পৃথিবী খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা,
ইউরোপ ‘ইউরোর' অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে
সাজানো প্রয়োজন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক
আলোচনায় আমরা বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। এ কারণে ‘বিশেষজ্ঞদের'
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পর্কিত করা যায় এবং তাদের দ্বারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
পরিচালনা সম্ভব। মোটকথা পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতা পেতে হলে একদিকে যেমনি
প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি, অন্যদিকে প্রয়োজন সঠিক নীতিটি প্রণয়ন। ভারতের উপর অতি
নির্ভরতা কমাতে হবে। সেই সাথে নিকট প্রতিবেশী চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিও
জরুরী। এ দিকটির দিকে লক্ষ্য রেখে আগামী দু' বছর সরকার যদি পররাষ্ট্রনীতি
প্রণয়ন করে, তাহলে দেশটির জন্য তা মঙ্গলই বয়ে আনবে।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।