রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

আরব বিশ্বের গণতন্ত্র

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গত ১৯মে জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন তাতে আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার প্রত্যয়ের কথা ব্যক্ত করলেও, আরব বিশ্বে আদৌ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো কীনা, কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তার স্বরূপ কী হবে এ প্রশ্নটা এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আরব বিশ্বে বিশেষ করে আরবলীগভুক্ত ২২টি দেশে একটি ভিন্ন ধরনের সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। যার সাথে দক্ষিণ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কিংবা পূর্ব ইউরোপের বিকাশমান গণতন্ত্রের সাথে মেলান যাবে না। এখানে রয়েছে ভিন্ন এক জগত্। একদিকে রয়েছে সামরিক বাহিনীর প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপস্থিতি (মিসর, তিউনেসিয়া, ইয়েমেন) তেমনি রয়েছে পারিবারিক উত্তরাধিকার (সিরিয়া, লেবানন)। রাজতন্ত্র কিংবা আমির শাসিত দেশ তো রয়েছেই (জর্ডান, বাহরাইন, ওমান, সৌদি আরব)। আরব বিশ্বের তেল সম্পদ এ অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। তবে তেল সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার কিংবা জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ এ থেকে উপকৃত হয়েছে, এটা বলা যাবে না। উপকৃত হয়েছে ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পৃক্ত কিছু ব্যক্তি। এক্ষেত্রে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, তেল সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও, আরবলীগভুক্ত কোমোরোস, জিবুতি, সোমালিয়া কিংবা ফিলিস্তিনের কোন তেল সম্পদ নেই। একই বিশ্বে বাস করেও সোমালিয়ার দারিদ্র্যতা চোখে লাগার মত। আবার এ অঞ্চলে ইসলামিক জঙ্গীবাদের যে উত্থান ঘটেছে তা কিন্তু সব আরব দেশে প্রত্যক্ষ করা যায় না। যেমন আলজিরিয়া, ইয়েমেন কিংবা সোমালিয়ায় ইসলামিক জঙ্গীবাদি মনোভাব অত্যন্ত শক্তিশালী। সোমালিয়া কার্যত একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাই এ অঞ্চলের গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ফ্রিডম হাউজ এই দেশগুলোকে নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল। তাতে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা কোন আশার কথা বলে না। ওবামা প্রশাসন গণতন্ত্রে উত্তরণের কথা বললেও ফ্রিডম হাউজের এই প্রতিবেদনে তাদের আশাভঙ্গ হতে পারে। ১৬৭টি দেশের গণতন্ত্রের যে বিকাশ,তাতে ইয়েমেনের অবস্থান ১৪৬, আরব আমিরাতের ১৪৮, সিরিয়ার ১৫৩, সুদানের ১৫১, লিবিয়ার ১৫৮,জিবুতির ১৫৪, মিসরের ১৩৮, আলজেরিয়ার ১০৫। শুধুমাত্র তুলনামূলক বিচারে বাহরাইনের অবস্থা ভালো, ৪৮। অর্থাত্ এখানে নির্বাচন হয়। একটি সংসদও সেখানে রয়েছে। বিরোধীদলের অস্তিত্বও রয়েছে। রাজতন্ত্র থাকলেও এক ধরনের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এখানে গড়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের সাথে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নটি জড়িত। ফ্রিডম হাউজ এটা নিয়েও গবেষণা করেছে। তাতে দেখা যায়, (মোট ১৯৬টি দেশের মাঝে) সোমালিয়ার অবস্থান ১৮১, ইয়েমেনের ১৭৩, তিউনিসিয়ার ১৮৬, সিরিয়ার ১৭৮, লিবিয়ার ১৯৩, মিসরের ১৩০, জিবুতির ১৫৯, বাহরাইনের ১৫৩ ও আলজেরিয়ার  ১৪১। তখন ওবামা যখন গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন এসে যায় আরব বিশ্বে এই গণতন্ত্রের স্বরূপ কী। এখানে কোন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। রাজতন্ত্রের পাশাপাশি কোথাও কোথাও পারিবারিক শাসনও (সিরিয়ায়) বজায় রয়েছে। সেখানে দল ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। লিবিয়াতে গত মার্চ মাস থেকেই যুদ্ধ চলছে। সর্বশেষ ঘটনায় মিত্রপক্ষ সর্বাত্মক বিমান আক্রমণ  সেখানে শুরু করেছে । দীর্ঘ  দু’মাসেও গাদ্দাফিকে উত্খাত করা সম্ভব হয়নি। বারাক ওবামা তার ভাষণে লিবিয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গাদ্দাফি যখন অপরিহার্যভাবে সরে যাবেন, ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবেন, তখন দশকের পর দশকের দুর্দশার অবসান ঘটবে এবং লিবিয়া গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত হবে’। এই বক্তব্য স্পষ্ট করে দেয় যে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করাই হোয়াইট হাউজের উদ্দেশ্য। মাহমুদ জিবরিলের নেতৃত্বে লিবিয়ায় একটি ন্যাশনাল কাউন্সিল গঠিত হয়েছে। কিন্তু লিবিয়ার ব্যাপক জনগোষ্ঠির সমর্থন এই কাউন্সিলের ব্যাপারে রয়েছে এটা মনে করারও কোন কারণ নেই। যুক্তযাষ্ট্রের পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা মাহমুদ জিবরিল যুক্তরাষ্ট্রেই বসবাস করতেন। তাঁকে দিয়ে লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। স্পষ্টতই লিবিয়া ইরাকের মত পরিস্থিতি বরণ করতে যাচ্ছে। ২০০৩ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের কোন অনুমতি ছাড়াই বাগদাদ আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর দেশটি দখল করে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে মালিকির নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হয়েছে সত্য, কিন্তু ইরাকে জন্ম হয়েছে এক নতুন সংস্কৃতির, আত্মঘাতী বোমাবাজি। আল-কায়দার ইরাকি সংস্করণের সেখানে জন্ম হয়েছে। সেখানে এখনই ৫০ হাজার আমেরিকান সেনা রয়েছে, যদিও তারা ‘কমব্যাট’ বা যুদ্ধরত অবস্থায় নয়। সাদ্দাম পরবর্তী এই যে রাজনীতি, তাকে আমরা কী গণতন্ত্র বলবো? একটা ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ সেখানে জন্ম হয়েছে। আত্মঘাতী বোমাবাজদের কারণে কেউই আজ নিরাপদ নন। মালিকির অবস্থানও খুব শক্তিশালী নয়। সাদ্দাম হয়ত অপরাধ করেছেন। তার শাসনে স্বচ্ছতা ছিল না। কিন্তু এক স্থিতিশীল ইরাক তিনি উপহার দিয়েছিলেন। আজ সেই স্থিতিশীলতা ইরাকে নেই। লিবিয়ার পরিস্থিতিও সেদিকে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো এখন সেখানে স্থলযুদ্ধের সূচনা করতে পারে। আর তার পরিণতিতে লিবিয়া হবে আরেক ইরাক। জিবরিল মালিকির ভূমিকা পালন করতে পারেন বটে, কিন্তু প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র লিবিয়ায় প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আরব বিশ্বের তেল সম্পদের কথাও ওবামা বলেছেন। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ইরাকে তেলের নিয়ন্ত্রণ এখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক সংস্থাগুলোর হাতে। এখন লিবিয়ার তেল সম্পদ (রিজার্ভ ৪৬.৪ বিলিয়ন ব্যারেল) উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এটাই হচ্ছে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’র মূল উদ্দেশ্য। বলে রাখি বিশ্বের তেলের যে রিজার্ভ, তার ৫৬ ভাগ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। আর এই তেল সম্পদের উপর যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিম ইউরোপ পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল।
পর্যবেক্ষকরা আল-কায়দার উত্থান তথা মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের মূল কারণ হিসেবে ইসরাইলী আগ্রাসী নীতিকে দায়ী করেছেন। স্বাধীন একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় সেখানে সংকটকে আরো গভীরতর করেছে। বারাক ওবামা তার ভাষণে বলেছেন ইসরাইল ও ফিলিস্তিনে সীমান্তরেখা হবে ১৯৬৭ সালের লাইন অনুসারে। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার রয়েছে স্বাধীন একটি  ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। কিন্তু বাস্তবতা যা তা হচ্ছে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ওবামার উপস্থিতিতেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন অত্যন্ত কঠোর ভাষায়। এখানেই রয়েছে মূল সমস্যা। যতদিন ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান না হবে, ততদিন মধ্যপ্রাচ্যে সংকট থাকবে। আর এই সংকটকে পুঁজি করে আল-কায়দার মত সংগঠনের জন্ম হবে এবং তাদের ‘জিহাদী’ তত্পরতা বৃদ্ধি পাবে। মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের এটাও অন্যতম একটি সমস্যা।
আজ বারাক ওবামা আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন বটে, কিন্তু ইসরাইলের আগ্রাসী নীতি ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কখনও বন্ধ করতে পারেনি। নিরীহ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করে ইসরাইল মানবতাবিরোধী অপরাধ করলেও হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরাইলী নেতাদের বিচার করা যায়নি কখনো । আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে , কিন্তু তা হতে হবে তাদের  ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সামনে রেখে। ‘চাপিয়ে দেয়া গণতন্ত্র’ আরব বিশ্বের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিমান হামলা চালিয়ে একটি পুতুল সরকার সেখানে বসিয়ে দিয়ে তেল সম্পদকে কবজা করার নাম, আর যাই হোক গণতন্ত্র হতে পারে না।
প্রেসিডেন্ট ওবামা তার ভাষণে ইন্টারনেট বিপ্লবের কথা বলেছেন। বলেছেন ইন্টারনেট সারা পৃথিবীতে মানুষের জানালা খুলে দিয়েছে। সেলফোন ও সোশ্যাল নেটওয়ার্ক তরুণ সমাজকে যে কোন সমাজের চেয়ে অধিক কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক যে বিপ্লব ঘটাতে পারে, মিসর তার বড় প্রমাণ। আজ আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের যে ঢেউ উঠেছে, তাতে এই তরুণ সমাজ পালন করছে একটি বড় ভূমিকা। দুঃখজনক হলেও সত্য, তরুণ সমাজের একটা বড় অংশই সেখানে বেকার। তিউনিসিয়ায় গত ২৭ ডিসেম্বর ফল বিক্রেতা মোহম্মদ বউকুজিজি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। বউকুজিজি ছিলেন একজন বেকার কম্পিউটার গ্রাজুয়েট। পুরো আরব বিশ্বে এই তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা এখন অনেক। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আলজেরিয়ায় ২৫ বছরের নিচে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর ৪৭ দশমিক ৫ ভাগ। মৌরিতানিয়ায় এ সংখ্যা ৫৯ দশমিক ৩, মরক্কোয় ৪৭ দশমিক ৭, তিউনিসিয়ায় ৪২ দশমিক ১, লিবিয়ায় ৪৭ দশমিক ৪, মিসরে ৫২ দশমিক ৩, সিরিয়ায় ৫৫ দশমিক ৩, জর্ডানে ৫৪ দশমিক ৩, ইরাকে ৬০ দশমিক ৬, কিংবা সোমালিয়ায় ৬৩ দশমিক ৫। এরা একটি শক্তি। ক্ষমতাসীনদের একটি বড় ব্যর্থতা হচ্ছে এরা এসব তরুণ সমাজকে বুঝতে পারেননি। এরা একটি শক্তি। এরাই আরব বিশ্বে পরিবর্তনটা আনছে। আর প্রেসিডেন্ট ওবামা তার ভাষণে এদের কথাই উল্লেখ করেছেন।
স্পষ্টতই আরব বিশ্ব একটি পরিবর্তনের মুখোমুখি। যুক্তরাষ্ট্র এই পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮৩ সালে গঠিত হয়েছিল National Endowment for Democracy। স্ট্রেট ডিপার্টমেন্ট বছরে ১০০ মিলিয়ন সাহায্য দেয় এই প্রতিষ্ঠানকে। এই সংস্থার মাধ্যমে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মিসরের গণ-অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত দু’টি সংস্থা April 6 movement কিংবা kafya কিংবা বাহরাইনের Center for Human Right-এর নেতৃবৃন্দকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র (নিউইয়র্ক টাইমস ১৪ এপ্রিল, ২০১১)। উদ্দেশ্য একটাই— এ অঞ্চলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য তরুণ সমাজকে তৈরি করা। তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া। গণতান্ত্রিক দুনিয়ার সাথে পরিচিত করান। সমসাময়িক আরব বিশ্বের যে ইতিহাস, তাতে দেখা যায় ১৯৫২ সালে মিসরে রাজতন্ত্র উত্খাতের মধ্যে দিয়ে যে ‘বিপ্লব’-এর সূচনা হয়েছিল, সেটা ছিল পরিবর্তনের প্রথম ধাপ। ১৯৬৭ সালে ইসরাইলের সাথে কয়েকটি আরব বিশ্বের যুদ্ধ ও তাতে ব্যাপক পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় অধ্যায়ের। তৃতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছিল ১৯৭৯ সালে ইরানি ইসলামিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে। প্রতিটি বিপ্লবই আরব বিশ্বে কিছু না কিছু পরিবর্তন ডেকে এনেছে। এখন তিউনিসিয়া ও মিসরের গণ-অভ্যুত্থান এবং সেখানকার দীর্ঘদিনের সরকারের উত্খাতের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে চতুর্থ অধ্যায়। এই যে বিপ্লব, এই বিপ্লব আরব বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যায়, সেটাই দেখার বিষয় এখন।

আরব বিশ্বের গণতন্ত্র

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গত ১৯মে জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন তাতে আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার প্রত্যয়ের কথা ব্যক্ত করলেও, আরব বিশ্বে আদৌ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো কীনা, কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তার স্বরূপ কী হবে এ প্রশ্নটা এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আরব বিশ্বে বিশেষ করে আরবলীগভুক্ত ২২টি দেশে একটি ভিন্ন ধরনের সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। যার সাথে দক্ষিণ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কিংবা পূর্ব ইউরোপের বিকাশমান গণতন্ত্রের সাথে মেলান যাবে না। এখানে রয়েছে ভিন্ন এক জগত্। একদিকে রয়েছে সামরিক বাহিনীর প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপস্থিতি (মিসর, তিউনেসিয়া, ইয়েমেন) তেমনি রয়েছে পারিবারিক উত্তরাধিকার (সিরিয়া, লেবানন)। রাজতন্ত্র কিংবা আমির শাসিত দেশ তো রয়েছেই (জর্ডান, বাহরাইন, ওমান, সৌদি আরব)। আরব বিশ্বের তেল সম্পদ এ অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। তবে তেল সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার কিংবা জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ এ থেকে উপকৃত হয়েছে, এটা বলা যাবে না। উপকৃত হয়েছে ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পৃক্ত কিছু ব্যক্তি। এক্ষেত্রে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, তেল সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও, আরবলীগভুক্ত কোমোরোস, জিবুতি, সোমালিয়া কিংবা ফিলিস্তিনের কোন তেল সম্পদ নেই। একই বিশ্বে বাস করেও সোমালিয়ার দারিদ্র্যতা চোখে লাগার মত। আবার এ অঞ্চলে ইসলামিক জঙ্গীবাদের যে উত্থান ঘটেছে তা কিন্তু সব আরব দেশে প্রত্যক্ষ করা যায় না। যেমন আলজিরিয়া, ইয়েমেন কিংবা সোমালিয়ায় ইসলামিক জঙ্গীবাদি মনোভাব অত্যন্ত শক্তিশালী। সোমালিয়া কার্যত একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাই এ অঞ্চলের গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ফ্রিডম হাউজ এই দেশগুলোকে নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল। তাতে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা কোন আশার কথা বলে না। ওবামা প্রশাসন গণতন্ত্রে উত্তরণের কথা বললেও ফ্রিডম হাউজের এই প্রতিবেদনে তাদের আশাভঙ্গ হতে পারে। ১৬৭টি দেশের গণতন্ত্রের যে বিকাশ,তাতে ইয়েমেনের অবস্থান ১৪৬, আরব আমিরাতের ১৪৮, সিরিয়ার ১৫৩, সুদানের ১৫১, লিবিয়ার ১৫৮,জিবুতির ১৫৪, মিসরের ১৩৮, আলজেরিয়ার ১০৫। শুধুমাত্র তুলনামূলক বিচারে বাহরাইনের অবস্থা ভালো, ৪৮। অর্থাত্ এখানে নির্বাচন হয়। একটি সংসদও সেখানে রয়েছে। বিরোধীদলের অস্তিত্বও রয়েছে। রাজতন্ত্র থাকলেও এক ধরনের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এখানে গড়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের সাথে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নটি জড়িত। ফ্রিডম হাউজ এটা নিয়েও গবেষণা করেছে। তাতে দেখা যায়, (মোট ১৯৬টি দেশের মাঝে) সোমালিয়ার অবস্থান ১৮১, ইয়েমেনের ১৭৩, তিউনিসিয়ার ১৮৬, সিরিয়ার ১৭৮, লিবিয়ার ১৯৩, মিসরের ১৩০, জিবুতির ১৫৯, বাহরাইনের ১৫৩ ও আলজেরিয়ার ১৪১। তখন ওবামা যখন গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন এসে যায় আরব বিশ্বে এই গণতন্ত্রের স্বরূপ কী। এখানে কোন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। রাজতন্ত্রের পাশাপাশি কোথাও কোথাও পারিবারিক শাসনও (সিরিয়ায়) বজায় রয়েছে। সেখানে দল ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। লিবিয়াতে গত মার্চ মাস থেকেই যুদ্ধ চলছে। সর্বশেষ ঘটনায় মিত্রপক্ষ সর্বাত্মক বিমান আক্রমণ সেখানে শুরু করেছে । দীর্ঘ দু’মাসেও গাদ্দাফিকে উত্খাত করা সম্ভব হয়নি। বারাক ওবামা তার ভাষণে লিবিয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গাদ্দাফি যখন অপরিহার্যভাবে সরে যাবেন, ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবেন, তখন দশকের পর দশকের দুর্দশার অবসান ঘটবে এবং লিবিয়া গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত হবে’। এই বক্তব্য স্পষ্ট করে দেয় যে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করাই হোয়াইট হাউজের উদ্দেশ্য। মাহমুদ জিবরিলের নেতৃত্বে লিবিয়ায় একটি ন্যাশনাল কাউন্সিল গঠিত হয়েছে। কিন্তু লিবিয়ার ব্যাপক জনগোষ্ঠির সমর্থন এই কাউন্সিলের ব্যাপারে রয়েছে এটা মনে করারও কোন কারণ নেই। যুক্তযাষ্ট্রের পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা মাহমুদ জিবরিল যুক্তরাষ্ট্রেই বসবাস করতেন। তাঁকে দিয়ে লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। স্পষ্টতই লিবিয়া ইরাকের মত পরিস্থিতি বরণ করতে যাচ্ছে। ২০০৩ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের কোন অনুমতি ছাড়াই বাগদাদ আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর দেশটি দখল করে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে মালিকির নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হয়েছে সত্য, কিন্তু ইরাকে জন্ম হয়েছে এক নতুন সংস্কৃতির, আত্মঘাতী বোমাবাজি। আল-কায়দার ইরাকি সংস্করণের সেখানে জন্ম হয়েছে। সেখানে এখনই ৫০ হাজার আমেরিকান সেনা রয়েছে, যদিও তারা ‘কমব্যাট’ বা যুদ্ধরত অবস্থায় নয়। সাদ্দাম পরবর্তী এই যে রাজনীতি, তাকে আমরা কী গণতন্ত্র বলবো? একটা ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ সেখানে জন্ম হয়েছে। আত্মঘাতী বোমাবাজদের কারণে কেউই আজ নিরাপদ নন। মালিকির অবস্থানও খুব শক্তিশালী নয়। সাদ্দাম হয়ত অপরাধ করেছেন। তার শাসনে স্বচ্ছতা ছিল না। কিন্তু এক স্থিতিশীল ইরাক তিনি উপহার দিয়েছিলেন। আজ সেই স্থিতিশীলতা ইরাকে নেই। লিবিয়ার পরিস্থিতিও সেদিকে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো এখন সেখানে স্থলযুদ্ধের সূচনা করতে পারে। আর তার পরিণতিতে লিবিয়া হবে আরেক ইরাক। জিবরিল মালিকির ভূমিকা পালন করতে পারেন বটে, কিন্তু প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র লিবিয়ায় প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আরব বিশ্বের তেল সম্পদের কথাও ওবামা বলেছেন। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ইরাকে তেলের নিয়ন্ত্রণ এখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক সংস্থাগুলোর হাতে। এখন লিবিয়ার তেল সম্পদ (রিজার্ভ ৪৬.৪ বিলিয়ন ব্যারেল) উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এটাই হচ্ছে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’র মূল উদ্দেশ্য। বলে রাখি বিশ্বের তেলের যে রিজার্ভ, তার ৫৬ ভাগ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। আর এই তেল সম্পদের উপর যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিম ইউরোপ পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল।

পর্যবেক্ষকরা আল-কায়দার উত্থান তথা মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের মূল কারণ হিসেবে ইসরাইলী আগ্রাসী নীতিকে দায়ী করেছেন। স্বাধীন একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় সেখানে সংকটকে আরো গভীরতর করেছে। বারাক ওবামা তার ভাষণে বলেছেন ইসরাইল ও ফিলিস্তিনে সীমান্তরেখা হবে ১৯৬৭ সালের লাইন অনুসারে। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার রয়েছে স্বাধীন একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। কিন্তু বাস্তবতা যা তা হচ্ছে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ওবামার উপস্থিতিতেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন অত্যন্ত কঠোর ভাষায়। এখানেই রয়েছে মূল সমস্যা। যতদিন ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান না হবে, ততদিন মধ্যপ্রাচ্যে সংকট থাকবে। আর এই সংকটকে পুঁজি করে আল-কায়দার মত সংগঠনের জন্ম হবে এবং তাদের ‘জিহাদী’ তত্পরতা বৃদ্ধি পাবে। মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের এটাও অন্যতম একটি সমস্যা।

আজ বারাক ওবামা আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন বটে, কিন্তু ইসরাইলের আগ্রাসী নীতি ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কখনও বন্ধ করতে পারেনি। নিরীহ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করে ইসরাইল মানবতাবিরোধী অপরাধ করলেও হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরাইলী নেতাদের বিচার করা যায়নি কখনো । আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে , কিন্তু তা হতে হবে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সামনে রেখে। ‘চাপিয়ে দেয়া গণতন্ত্র’ আরব বিশ্বের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিমান হামলা চালিয়ে একটি পুতুল সরকার সেখানে বসিয়ে দিয়ে তেল সম্পদকে কবজা করার নাম, আর যাই হোক গণতন্ত্র হতে পারে না।

প্রেসিডেন্ট ওবামা তার ভাষণে ইন্টারনেট বিপ্লবের কথা বলেছেন। বলেছেন ইন্টারনেট সারা পৃথিবীতে মানুষের জানালা খুলে দিয়েছে। সেলফোন ও সোশ্যাল নেটওয়ার্ক তরুণ সমাজকে যে কোন সমাজের চেয়ে অধিক কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক যে বিপ্লব ঘটাতে পারে, মিসর তার বড় প্রমাণ। আজ আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের যে ঢেউ উঠেছে, তাতে এই তরুণ সমাজ পালন করছে একটি বড় ভূমিকা। দুঃখজনক হলেও সত্য, তরুণ সমাজের একটা বড় অংশই সেখানে বেকার। তিউনিসিয়ায় গত ২৭ ডিসেম্বর ফল বিক্রেতা মোহম্মদ বউকুজিজি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। বউকুজিজি ছিলেন একজন বেকার কম্পিউটার গ্রাজুয়েট। পুরো আরব বিশ্বে এই তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা এখন অনেক। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আলজেরিয়ায় ২৫ বছরের নিচে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর ৪৭ দশমিক ৫ ভাগ। মৌরিতানিয়ায় এ সংখ্যা ৫৯ দশমিক ৩, মরক্কোয় ৪৭ দশমিক ৭, তিউনিসিয়ায় ৪২ দশমিক ১, লিবিয়ায় ৪৭ দশমিক ৪, মিসরে ৫২ দশমিক ৩, সিরিয়ায় ৫৫ দশমিক ৩, জর্ডানে ৫৪ দশমিক ৩, ইরাকে ৬০ দশমিক ৬, কিংবা সোমালিয়ায় ৬৩ দশমিক ৫। এরা একটি শক্তি। ক্ষমতাসীনদের একটি বড় ব্যর্থতা হচ্ছে এরা এসব তরুণ সমাজকে বুঝতে পারেননি। এরা একটি শক্তি। এরাই আরব বিশ্বে পরিবর্তনটা আনছে। আর প্রেসিডেন্ট ওবামা তার ভাষণে এদের কথাই উল্লেখ করেছেন।

স্পষ্টতই আরব বিশ্ব একটি পরিবর্তনের মুখোমুখি। যুক্তরাষ্ট্র এই পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮৩ সালে গঠিত হয়েছিল National Endowment for Democracy। স্ট্রেট ডিপার্টমেন্ট বছরে ১০০ মিলিয়ন সাহায্য দেয় এই প্রতিষ্ঠানকে। এই সংস্থার মাধ্যমে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মিসরের গণ-অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত দু’টি সংস্থা April 6 movement কিংবা kafya কিংবা বাহরাইনের Center for Human Right-এর নেতৃবৃন্দকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র (নিউইয়র্ক টাইমস ১৪ এপ্রিল, ২০১১)। উদ্দেশ্য একটাই— এ অঞ্চলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য তরুণ সমাজকে তৈরি করা। তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া। গণতান্ত্রিক দুনিয়ার সাথে পরিচিত করান। সমসাময়িক আরব বিশ্বের যে ইতিহাস, তাতে দেখা যায় ১৯৫২ সালে মিসরে রাজতন্ত্র উত্খাতের মধ্যে দিয়ে যে ‘বিপ্লব’-এর সূচনা হয়েছিল, সেটা ছিল পরিবর্তনের প্রথম ধাপ। ১৯৬৭ সালে ইসরাইলের সাথে কয়েকটি আরব বিশ্বের যুদ্ধ ও তাতে ব্যাপক পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় অধ্যায়ের। তৃতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছিল ১৯৭৯ সালে ইরানি ইসলামিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে। প্রতিটি বিপ্লবই আরব বিশ্বে কিছু না কিছু পরিবর্তন ডেকে এনেছে। এখন তিউনিসিয়া ও মিসরের গণ-অভ্যুত্থান এবং সেখানকার দীর্ঘদিনের সরকারের উত্খাতের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে চতুর্থ অধ্যায়। এই যে বিপ্লব, এই বিপ্লব আরব বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যায়, সেটাই দেখার বিষয় এখন।
[ পূর্বপ্রকাশ @ দৈনিক ইত্তেফাক ৩০-০৫-২০১১ ]

পাহাড়ে অসন্তোষ কার স্বার্থে

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে। গত ২১ মে রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার দুর্গম মিতিঙ্গাছড়ি এলাকায় পার্বত্য জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলায় ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের চারজন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। নিহতদের মাঝে একজন হচ্ছেন অনিমেষ চাকমা, যিনি ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় নেতা। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইউপিডিএফের ডাকে গত ২৩ মে রাঙ্গামাটিতে পূর্ণদিবস সড়ক ও নৌ অবরোধ পালিত হয়েছে। এদিকে স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুস সোবহান বিবিসি’র বাংলা বিভাগকে জানিয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হচ্ছে। যদিও এটা নিশ্চিত নয় যে সরকার এ ব্যাপারে নীতিগতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা। আমি ধরে নিচ্ছি, প্রশাসনের একজন গুরুত্বপূর্ণ আমলা স্বরাষ্ট্র সচিব যখন এ ধরনের একটি বক্তব্য দেন, তখন এর পেছনে সত্যতা আছে। সরকার জনস্বার্থে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেই অধিকার সরকারের আছে। কিন্তু পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য শুধুই কি ইউপিডিএফ দায়ী? জনসংহতি সমিতি কি দায়ী নয়? জনসংহতি সমিতির ক্যাডাররা তো হত্যা করেছে ইউপিডিএফের নেতা ও কর্মীদের। একই অপরাধে তো দুটো সংগঠনই সমানভাবে দায়ী। নিষিদ্ধ করলে তো দুটো সংগঠনকেই নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। আসলে পাহাড়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই এই হত্যাকাণ্ড। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড এই প্রথম নয়। অতীতেও বাঙালি মুসলমানদের হত্যা করেছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা, যাদের বেশিরভাগই জনসংহতি সমিতির সঙ্গে জড়িত।

পাহাড়ে সন্ত্রাস এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল পাহাড়ে শান্তি আসবে বলে। কিন্তু সেই শান্তি এখনও আসেনি। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকবে। অর্থাত্ যে যেখানে আছে, সে সেখানে থাকবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমরা লক্ষ্য করলাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করার পর পাহাড়িদের নেতা হিসেবে দাবিদার সন্তু লারমা একের পর এক যে বিবৃতি দিয়ে আসছিলেন, তাতে তার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি বারবার ফুটে উঠেছিল। তিনি একাধিকবার বাঙালিদের ওখান থেকে প্রত্যাহার করার দাবি করে আসছিলেন। এমনকি এক পর্যায়ে দাতা সংস্থা বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সন্তু বাবুর এই বক্তব্যকে পরোক্ষভাবে সমর্থনও করে। সন্তু বাবুর এ ধরনের বক্তব্য তাকে শুধু বিতর্কিতই করেনি, বরং তার উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত, সন্তু লারমা এ ধরনের বক্তব্য রাখার কোনো অধিকার রাখেন না। কেননা তিনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেনি। তিনি চাকমাদেরও এককভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন না। ইউপিডিএফও পাহাড়ি তথা চাকমাদের প্রতিনিধিত্ব করে। দ্বিতীয়ত, চাকমাদের মতো বাঙালিরাও সেখানকার ‘সেটলার’। বিরান পাহাড়ি ভূমিতে প্রথমে চাকমা তথা অন্য পাহাড়িরা বসবাস করতে শুরু করে। প্রায় একই সময় বাঙালিরাও সেখানে বসবাস করতে শুরু করে। তবে নিঃসন্দেহে তারা সংখ্যায় কম ছিল। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা কিংবা লুসাই জনগোষ্ঠী ‘আদিবাসী’ নয়। বাংলাদেশের আদি জনগোষ্ঠী হচ্ছে সাঁওতাল ও খাসিয়ারা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্তিক বিভাগের এক গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি উপজাতির মাত্র ৬ লাখ মানুষ ‘আদিবাসী’ দাবি করে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিতে পারে না।

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশক’টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। তাতেও মন গলেনি সন্তু বাবুর। এরপরও তিনি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। তাদের কর্মযোগ্যতা, শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। অথচ সেই সেনাবাহিনীকে বারবার বিতর্কিত করছেন সন্তু বাবু। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তারা নিজেদের উত্সর্গ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে। কিছু কিছু এলাকা থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করার ফলে ওইসব অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বরকলের ঘটনা এর বড় প্রমাণ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বরকলের হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র আছে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে তারা অস্ত্র সংগ্রহ করছে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সময় অভিযোগ করা হয়েছিল, জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র ক্যাডাররা সব অস্ত্র জমা দেয়নি। এখন মনে হচ্ছে ওই অভিযোগের পেছনে সত্যতা ছিল। শান্তিচুক্তি নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এর একটা ভালো দিক হচ্ছে, ভারতে আশ্রিত চাকমারা তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে এসেছেন। সরকার তাদের এককালীন টাকা দিয়ে পুনর্বাসিত করেছে। কিন্তু আমরা কখনও চাইব না পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ব তিমুর কিংবা দক্ষিণ সুদানের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক। পূর্ব তিমুর ছিল এক সময় ইন্দোনেশিয়ার একটি অংশ, একটি প্রদেশ। কিন্তু খ্রিস্টান অধ্যুষিত পূর্ব তিমরুকে পশ্চিমা বিশ্ব স্বাধীন করেছিল তাদের স্বার্থে। পূর্ব তিমুর স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯৯ সালে। আর দক্ষিণ সুদান, যেখানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেশি, সেখানে অতি সম্প্রতি গণভোটের মাধ্যমে দেশটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আগে দক্ষিণ সুদান ছিল সুদানের একটি অংশ। পূর্ব তিমুরের মতো দক্ষিণ সুদানে তেল পাওয়া গেছে। পশ্চিমাদের স্বার্থ এখানে অনেক। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমাদের শঙ্কাটা তাই অনেক বেশি। আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সপ্তম সভায়ও এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে (আমার দেশ, ১০ এপ্রিল, ২০১১)। সেখানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ঘন ঘন সফর, ইউএনডিপির কর্মকাণ্ড ইত্যাদি এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

যারা দেশ, জাতি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে ভাবেন, তাদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এক ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। পার্বত্য সাধারণ উপজাতীয়রা গভীর জঙ্গলে বসবাস করে। তারা ছোটখাটো দোকান কিংবা জুম চাষ করে, কৃষিপণ্য বিক্রি করে অতি কষ্টে দিন যাপন করে। মিশনারিরা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে এদের ধর্মান্তরিত করছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কী হারে উপজাতীয়রা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে, তা একটা পরিসংখ্যান নিলেই জানা যাবে। উপজাতীয়দের দারিদ্র্যকে পুঁজি করে খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে। শুধু তাই নয়, ইউএনডিপির বিভিন্ন প্রজেক্টে পাহাড়ি ধর্মান্তরিত লোকদের চাকরি দেয়া হচ্ছে। অথচ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাঙালিরা সেখানে চাকরি পাচ্ছে না। বাঙালিদের সঙ্গে সেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। পাহাড়ি অঞ্চলে একজন উপজাতীয় ড্রাইভার যে বেতন পান, অনেক বাঙালি কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও সেই বেতন পান না। পাহাড়ে স্পষ্টতই একটি বিভাজন তৈরি করা হয়েছে, যা সংবিধানের ১৯ নং (সুযোগের সমতা), ২৭ নং (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), ২৮ নং (ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। কিন্তু দুঃখ লাগে, তথাকথিত সুশীল সমাজ কোনোদিনও এ প্রশ্নে মুখ খোলেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতীয়দের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে তারা মানববন্ধন করলেও, ওখানে বসবাসকারী বাঙালিরা যে ষড়যন্ত্র ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, সে ব্যাপারে একবারও তারা কথা বলেননি। বিদেশিরা পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানকে মূল রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন করেছিল। স্থানীয় লোকদের ব্যাপক ধর্মান্তরিত করে তারা তাদের উদ্দেশ্য সাধন করেছিল। আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়েও ওই একই ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এ ব্যাপারে সোচ্চার ও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

আজ বরকলের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পাহাড়ে স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করছে। পাহাড়ে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড সেখানে বাড়ানো উচিত। প্রয়োজনে প্রত্যাহারকৃত ক্যাম্পগুলোতে ফের সেনাক্যাম্প স্থাপন করা দরকার। ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ করাও ঠিক হবে না। কেননা সংবিধানের ৩৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংগঠনটি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের পরিচালনা করার অধিকার রাখে। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হওয়াও জরুরি। নির্বাচন না হওয়ায় সন্ত্রাসীরা সুযোগ পাচ্ছে। আরও একটা কথা। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। কোনো ধরনের নির্বাচন কিংবা দায়বদ্ধতা ছাড়াই সন্তু লারমা ১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এটা অবৈধ ও অশোভন। একটানা দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর এ দেশের রাষ্ট্রপতিও ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। সন্তু বাবু থাকছেন কোন আইন বলে? আমরা বরকলের ঘটনায় উদ্বিগ্ন। সরকার দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে—এটাই প্রত্যাশা করি।

একটি ছবি, অনেক প্রশ্ন

একটি ছবি ছাপা হয়েছে দৈনিক যুগান্তরের ১৯ মে’র সংখ্যায় প্রথম পাতায়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কুশপুত্তলিকা দাহ করছেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির কুশপুত্তলিকা দাহ! এটা কী কোন ‘সভ্য’ দেশে চিন্তা করা যায়? কেন একজন প্রধান বিচারপতি বিতর্কিত হবেন? সবাই প্রধান বিচারপতি হতে পারেন না। সবার সেই মেধা ও যোগ্যতা থাকে না। একজন বিচারপতি তো সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষটি। জাতি, সমাজ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সংকটের সময় তিনি হচ্ছেন ভরসারস্থল। আজ তিনিই কিনা বিতর্কিত হলেন! আমরা আমজনতা, আমরা দেখলাম তার কুশপুত্তলিকা দাহ করছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সমিতির নেতারা। এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না।
ছবিটি দেখে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, আমি জানি না। কিন্তু আমি কষ্ট পেয়েছি। বিচারপতি হক যদি নিরপেক্ষ থেকে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন, তাহলে বোধকরি আমাদের এই কুশপুত্তলিকা দাহ করার ছবি দেখতে হতো না। বাংলাদেশের ৪০ বছরের জীবনে এভাবে অতীতে কোন প্রধান বিচারপতির কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। আমি সাবেক প্রধান বিচারপতিদের সঙ্গে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে মেলাতে পারলাম না, দুঃখিত আমি। আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতিদের অনেকেই জীবিত আছেন এবং তারা সবার শ্রদ্ধাভাজন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান কিংবা বিচারপতি মোস্তফা কামাল আমাদের কাছে এক একজন আদর্শ। তারা যখন সমাজ, দেশ, জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেন, লেখেন, আমি আগ্রহসহকারে তা পড়ি। বোঝার চেষ্টা করি তাদের মূল্যায়ন। তাদের মূল্যায়ন আমাকে সাহায্য করে সমাজকে বিশ্লেষণ করতে, রাজনীতির গতিপথ কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে, তা অনুধাবন করতে। কিন্তু আমি বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কাছ থেকে কী গ্রহণ করব? তিনি তো আমার আদর্শ হতে পারেন না। যার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়, তিনি হাজার হাজার মানুষের হƒদয় ভেঙে দেন। তিনি এ দেশের অতি সাধারণ মানুষের আদর্শ হতে পারেন না। কিন্তু বিচারপতি হাবিবুর রহমান, কিংবা বিচারপতি মোস্তফা কামালÑ এরা আদর্শ। আমি আমার অনেক প্রবন্ধে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বক্তব্য উল্লেখ করেছি। এমনকি বিচারপতি মোস্তফা কামালের উদ্ধৃতিও আমি দিয়েছি। কিন্তু বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের উদ্ধৃতি আমি কী দেব! যেখানে তিনি নিজে আইনজীবীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেন না, সেখানে আমজনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন কিভাবে?
অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় তিনি দিয়েছেন। পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী কিংবা ত্রয়োদশ সংশোধনীÑ সংবিধানের এসব সংশোধনী বাতিল হয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। তার নেতৃত্বে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন। রায় নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। তাতে করে আদালত অবমাননা হয়ে যেতে পারে। আমি সাধারণ শিক্ষক একজন। আমি ঝুঁকি নিতে পারি না। ওই তিনটি রায় নিয়ে নানা মন্তব্য, নানা কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মুন সিনেমা হল নিয়ে মামলা হয়েছিল। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক রায় দিলেন পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের। বিচারপতি মুন সিনেমা হলের মালিকানার সঙ্গে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর কী সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছিলেন, আমি বলতে পারব না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মুন সিনেমা হলের আদি মালিক তার সিনেমা হল আর ফেরত পাননি। কিন্তু ইতিমধ্যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে গেছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হল। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হল। আবার একই রায়ে বলা হল আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এটা কি পরস্পরবিরোধী নয়। যদি বাতিল হয়, সব সময়ের জন্যই বাতিল। পরের দুটো কেন তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে? এটা কি এ জন্য যে, বিচারপতি খায়রুল হক নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন? সংবিধান তো তাই বলে। সংবিধানের ৫৮(খ) এবং বিশেষ করে ৫৮(গ)(৩) ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান।
যিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরে গেছেন, তার তো চাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা তাকে তো অনেক দিয়েছেন। সাধারণ নিয়মে তার প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ছিল না। দু’দুবার অন্যকে ‘সুপারসিড’ করে তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল। সর্বশেষ ঘটনা, বিচারপতি শাহ মোহাম্মদ আবু নাইম মোমিনুর রহমান পদত্যাগ পর্যন্ত করেছিলেন। বিচারপতি শাহ আবু নাইমের পদত্যাগের ঘটনাও বিচার বিভাগের জন্য কলংক। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে পারত। এক্ষেত্রে শাহ মোহাম্মদ আবু নাইম মোমিনুর রহমানকে প্রধান বিচারপতি করা হলে তাতে ক্ষতির কিছু ছিল না। তিনিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারতেন না। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বিশ্বাস করেন, তারা তো ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজবেনই। আমি আরও খুশি হতাম বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার আগের দিন যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন, তখন যদি তিনি ঘোষণা করতেন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন না, তাহলে তিনি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা বলেননি। বলেছেন, ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে সবকিছু। এটা ‘ডিপ্লোমেটিক অ্যানসার’। জবাব এড়িয়ে যাওয়া। তার এ জবাবই বলে দেয় তার কিছুটা হলেও ওই পদটির ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে। এটা আমাকে অবাক করেছে। একজন বিচারপতি তো সব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকেন। এই রাষ্ট্র তো বিচারপতি ও বিজ্ঞ খায়রুল হককে অনেক কিছু দিয়েছে। তিনি কোন দিনই প্রধান বিচারপতি হতে পারতেন না। কিন্তু হয়েছেন। তাকে নিয়ে এত যখন বিতর্ক, তখন তার বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেয়া উচিত তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন না। যেমনটি করেছিলেন বিচারপতি কেএম হাসান।
আরও একটি বিষয়ে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি কষ্ট পেয়েছি। তা হচ্ছে, তার স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। বিচারপতি খায়রুল হক আপিল বিভাগে আইনজীবীদের এনরোলমেন্ট নিয়ে লাগামহীন অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতি করেছেন। কতিপয় মুখচেনা আর রাজনৈতিক আদর্শগতভাবে একই ঘরানার লোকদের এনরোলমেন্ট করে গেছেন তিনি। এর ফলে হাইকোর্ট বিভাগের অনেক যোগ্য আইনজীবীও আপিল বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বাদ পড়েছেন। এটা করা কি তার ঠিক হয়েছে? তিনি কেন রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেন না? এখন কেউ যদি তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়, তাহলে কি তিনি ভুল করবেন? বিচারপতিরা আমাদের নমস্য। তারা যদি কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে অনুপ্রাণিত কিংবা প্রভাবিত হন, তাহলে তা জাতির জন্য খারাপ। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সুন্দরবনে ‘প্রমোদ ভ্রমণে’ গিয়েছিলেন। তিনি সুন্দরবনে যেতেই পারেন। একজন নাগরিক হিসেবে এই অধিকার তার আছে। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি কিভাবে সুন্দরবন ভ্রমণে গেছেন, তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছে যুগান্তরের অপর একটি প্রতিবেদন। তিনি তো অতীতে অনেককে ‘শাস্তি’ দিয়েছেন। বিচারপতিদের হাত অনেক লম্বা। তারা যখন এজলাসে থাকেন, তখন কথা বলা যায় না, প্রশ্ন তোলা যায় না, তাতে আদালত অবমাননা হয়। এখন তিনি অবসরে। এখন সাহস করে বলা যায়। সত্য উদ্ঘাটিত হোক। তিনি যদি অন্যায় করে থাকেন, তারও ‘বিচার’ হওয়া উচিত। তিনি যদি সত্যি সত্যিই ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন, প্রমোদ ভ্রমণের নামে সরকারি অর্থের অপচয় করে থাকেন, তাহলে দুদকের উচিত তাকে নোটিশ দেয়া। ব্যাখ্যা চাওয়া। অতীতে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিকে তো দুদক নোটিশ দিয়েছিল। কিংবা বিচারপতি খায়রুল হক নিজেও পারেন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলোর একটা ব্যাখ্যা দিতে। না হলে প্রশ্ন থাকবেই। তারপরও আমি তাকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে চাই। কেননা তিনি আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতি। সংবাদপত্রে যখন লিড স্টোরি ছাপা হয়Ñ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে গেছেন খায়রুল হক (যুগান্তর, ১৮ মে), তখন তার প্রতি আস্থাটা কেন যেন আর থাকে না। আমার ধারণা অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন, বিচারপতি হক নিজেকে বিশেষ কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি যদি নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ থেকে প্রত্যাহার করে না নেন, তাহলে বিতর্ক বাড়বে। তিনি নিজে আরও বেশি বিতর্কিত হবেন। একসময় এমন সব ‘তথ্য’ বেরিয়ে আসবে, তাতে করে তিনি নিজে এবং সমগ্র জাতি আরও লজ্জিত হবে। তাকে উপদেশ দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তার সঙ্গে আমার আগামীতে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তাকে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে অনুরোধ করব, এ দেশের সাধারণ মানুষ অনেক কষ্টে থাকে, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত তারা। সুবিধাভোগীরা টাকার জোরে সব অন্যায়কে ‘জায়েজ’ করে নেয়। আপনি এই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে আপনাকে মানুষ মনে রাখবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে যদি আপনি দাঁড়ান, দুঃখী মানুষরা আপনাকে মনে রাখবে। মাওলানা ভাসানী কোনদিন ক্ষমতায় যাননি। ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতিও তিনি করেননি। কিন্তু সাধারণ মানুষ, কৃষকদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন। দ্বিতীয় আরেকজন মাওলানা ভাসানীর জš§ হয়নি আজও। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, আপনি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকুন, এটাই আমরা চাই। কেননা আপনি বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর নিয়েছেন। আর আমাদের ভরসার স্থান এখনও উচ্চ আদালত। ওই আদালত এবং আদালতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের আমরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেখতে চাই। ইয়াজউদ্দিন, ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দিনের কী পরিণতি, আমরা সবাই তা জানি। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, আমরা আপনাকে ওই কাতারে দেখতে চাই না।
আরও একটা কথা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার আমি পক্ষে। ভোলার উপনির্বাচন প্রমাণ করেছে আমরা এখনও দলীয় সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের নিরপেক্ষতার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। আমাদের মানসিকতায় এখনও আমরা পরিবর্তন আনতে পারিনি। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সংবিধানের ৫৮(খ) ও ৫৮(গ)-তে কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে। সংবিধান সংশোধনের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়েছে, সেই কমিটি এই কাজটি করতে পারে। বিশেষ করে ৫৮গ(৩), ৫৮গ(৪), ৫৮গ(৬) ধারায় পরিবর্তন এনে এখানে বিচারপতিদের পরিপূর্ণভাবে বাদ দেয়া যেতে পারে। একটি ‘এলডার্স কাউন্সিল’ গঠন করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে বাধ্যবাধকতা ও নীতি নির্ধারণী কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার বাধ্যবাধকতা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। একজন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অনেক বিতর্কের জš§ দিয়ে গেছেন। আগামীতে আরও বিতর্ক হোকÑ এটা কারোই কাম্য নয়।
[ পূর্ব প্রকাশ @ দৈনিক যুগান্তর ২৮ মে ২০১১]

আল-কায়েদার নতুন নেতৃত্ব এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকা-ের পর আল-কায়েদা নতুন একজন নেতা পেয়েছে। তার নাম সাইফ আল আদেল। তিনি এক সময় মিসরের সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। অনেকটা অপরিচিত সাইফ আল আদেলের নির্বাচন অনেকেরই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কেননা তিনি এর আগে কখনো আলোচনায় আসেননি। অনেকেই ধারণা করেছিলেন আল-কায়েদার দ্বিতীয় নেতা আইমান আল জাওয়াহিরী আল-কায়েদার নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু সেটা হলো না। তবে যতটুকু জানা গেছে, তাতে দেখা যায় সাইফ আল আদেল দীর্ঘদিন ধরেই আল-কায়েদার নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত। মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাত হত্যাকা-ের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করেছেন। তিনি একজন সামরিক কৌশলবিদ। সম্ভবত এ কারণেই তিনি ওসামা বিন লাদেনের খুব কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন। ওসামা তার মৃত্যুর আগে এ ব্যাপারে কোনো উইল করে গিয়েছিলেন কি না তা জানা না গেলেও সাইফ আল আনোয়ার নির্বাচন প্রমাণ করে তার ব্যাপারে দলীয় কমান্ডের কোনো আপত্তি নেই। এমনকি আল-কায়েদা যে সক্রিয় এটা আরো একটা বড় প্রমাণ। না হলে অতি দ্রুত তারা নেতা নির্বাচন করতো না। তবে তার এই নির্বাচন নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে এখন। আল-কায়েদার মাঝে কোনো বিভক্তি আছে কি না, সেটা লক্ষ্য রাখার বিষয়। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এর যে সূচনা করেছিল, তার অবসান হবে না।
সর্বশেষ ওবামা যে ভাষণ দিয়েছেন, তাতে তিনি আরব বিশ্বের গণতন্ত্রের জন্য এক ধরনের মায়াকান্ন দেখালেও, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এ অবসানের কথা তিনি বলেননি। এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিতৃষ্ণা মনোভাব অব্যাহত রয়েছে। ওবামার ২০০৮ সালে দেয়া কায়রো ভাষণ (যেখানে তিনি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলেছিলেন) ও সর্বশেষ ভাষণেও এমন কোনো বক্তব্য দেননি, যা মুসলমানদের আস্থা অর্জন করতে পারে। তাই আল-কায়েদার তৎপরতা কমাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আল-কায়েদা ইরাকি সংস্করণ। একই সঙ্গে অষ-য়ধবফধ রহ ওংষধসরপ সধমযৎধন আমেরিকার ঝধষধভরংঃ মৎড়ঁঢ় ভড়ৎ ঢ়ৎবধপযরহু পড়সনধঃ এবং অষ-য়ধবফধ রহ ঃযব অৎধনরধহ ভৎহরহংঁষধ-এর মতো সংগঠনগুলোর তৎপরতা বাড়বে। মৃত ওসামা তাদের জন্য তখন একই আদর্শ। জিহাদি তৎপরতা উত্তর আফ্রিকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে তখন। ঙঢ়বৎঃরড়হ এবৎড়হরসড় নিঃসন্দেহে একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করেছে। আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। এটা যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করল। তখন যে কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যুক্তরাষ্ট্র (অথবা অন্য কোনো রাষ্ট্র) হামলা চালাতে পারে। এ ধরনের প্রবণতা কিংবা শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোনো অবদান রাখবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ওসামার মৃত্যুর পর এখন আফগানিস্তান থেকে খুব দ্রুত সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। কিন্তু এটি হবে না। কারণ আফগানিস্তানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। এ অঞ্চল থেকে মধ্য এশিয়ার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে গ্যাস ও তেলের বড় রিজার্ভ। এ তেল ও গ্যাসের ব্যাপারে আরো রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ওয়েল কোম্পানিগুলো (আইওসি)। ইতোমধ্যে বেশ কটি আইওসি (বিলি, মবেল, ইউনিকল, সেল, টোটাল) এ অঞ্চলে গ্যাস ও তেল উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। মধ্য এশিয়ার এই জ্বালানি সম্পদের কারণে আগামী দিনে এ অঞ্চলে আঞ্চলিক যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সখ্য, তা ভেঙে যেতে পারে মধ্য এশিয়ার এই জ্বালানি সম্পদের কারণে। ভারত ও চীনেরও আগ্রহ রয়েছে এই জ্বালানি সম্পদের ব্যাপারে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে চীন ইতোমধ্যে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন গড়ে তুলেছে। যেখানে রাশিয়াও এর সদস্য। মধ্য এশিয়ার এই তেল ও গ্যাস চীন বা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে যাবে এটা যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না। তাই আফগানিস্তানে তার উপস্থিতি দীর্ঘায়িত হবে। প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় যাবে।
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন প্রশ্নের মুখে। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ৩ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় শুধু সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকা- রোধ করতে। তখন মার্কিন কংগ্রেস এই অর্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন লাদেনের ঘটনায় দুই রাষ্ট্রের মাঝে আস্থার ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য সামনের দিনগুলো খারাপ। পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যদি নিজেদের মাঝে আস্থার সম্পর্ক বাড়াতে না পারেন, তাহলে তা পাকিস্তানের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণভার চলে যেতে পারে, এই যুক্তি তুলে ওঅঊঅ পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণভার নিজেদের হাতে রাখার একটি উদ্যোগ নিতে পারে। স্পষ্টতই লাদেনের ঘটনায় প্রমাণিত হলো পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের লালন করে ও প্রশ্রয় দেয়। এই ঘটনায় পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়ল। ভারত এখন পাকিস্তানকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নিতে পারে। ভারত যদি এটা করে, তাহলে তা উপমহাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরো বাড়াবে মাত্র। প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০০৯ সালের জুন মাসে কায়রোতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে করে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন সূচনার কথা তিনি বলেছিলেন। এখন, লাদেনকে হত্যার পরে এই আস্থায় চিড় ধরতে বাধ্য। কোনো মুসলিম দেশই এখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কথা বিবেচনা করে প্রকাশ্যে মার্কিন প্রশাসনের বিরোধিতা অথবা সমর্থন করেন না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ডড়ড়ফৎড় িডরষংড়হ ঈবহঃবৎ-এর গবেষকরাও বলেছেন লাদেনের হত্যাকা-ের ঘটনার পর আরব বিশ্বে ইসলামপন্থীদের উত্থান রোধ করা সম্ভব হবে না। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনির মধ্যে একটা সমঝোতা হবে, এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখন ইসরাইলের আগ্রাসী তৎপরতা আরো বাড়তে পারে। মিসরে ইসলামপন্থী হিসেবে খ্যাত 'ইসলামিক ব্রাদারহুড' পার্টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলেছে। বোঝাই যায় লাদেনের হত্যাকা- যে 'সহানুভূতির ঢেউ' সৃষ্টি করেছে, তা থেকে ফায়দা ওঠাতে চাচ্ছে আরব বিশ্বের ইসলামিক দলগুলো। ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা একটি নতুন মাত্রা পাবে। এ অঞ্চলে ন্যাটোর এশীয়করণ হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের তথা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের কয়েকটি দেশ এবং ভারতের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে ন্যাটোর এশীয় সংস্কার, যা কিনা তথাকথিত 'নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হতে পারে ন্যাটো বাহিনী। মনে রাখতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ ১৯৪৮ সালে এভাবেই ন্যাটো গঠিত হয়েছিল। এ ধরনের যে কোনো সিদ্ধান্ত এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে। চীনও বিষয়টি সহজভাবে দেখছে না। ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকা-ের পর খুব দ্রুত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাবুল সফর প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র চায় পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত একটা বড় ভূমিকা পালন করুক। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্স এ অঞ্চলে নতুন করে এক ধরনের যুদ্ধের নাম দিতে পারে।
ইতোমধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করেছেন। চীন পাকিস্তানকে শুধু ৫০টি আধুনিক যুদ্ধ বিমান দিয়েই সাহায্য করছে না; বরং বিশ্ববাসীকে চীন জানিয়ে দিয়েছে সঙ্কটের এই মুখে চীন পাকিস্তানের পাশে থাকবে। এর অর্থ চীন-পাকিস্তান এবং রাশিয়াকে নিয়ে একটি পক্ষ গড়ে উঠতে পারে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে।
এরই মাঝে আল-কায়েদার নবনির্বাচিত নেতা সাইফ আল আদেল হুশিয়ারি দিয়েছে ব্রিটেনে হামলার। পাকিস্তানে তালেবান অনুসারি লাদেনের মৃত্যুর বদলা নিতে ন্যাটোর মালবাহী ট্যাংকারে হামলা চালিয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, তা হচ্ছে লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদ কমলো না, বরং বাড়ল এবং জঙ্গিরা এখন লাদেন হত্যার প্রতিশোধ নিতে আরো সংঘবদ্ধ।

ড. তারেক শামসুর রেহমান: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের বাঙলাদেশ
প্রথম প্রকাশঃ দৈনিক যায় যায় দিন
শুক্রবার ২৭ মে ২০১১ ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮ ২২ জমাদিউস সানি ১৪৩২ বছর ০৫ সংখ্যা ৩৪৪  

বিন লাদেন-পরবর্তী বিশ্বরাজনীতির চালচিত্র

ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডের পর অনেক প্রশ্ন এখন বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। খোদ মার্কিন মুল্লুকেই এখন বলা হচ্ছে, লাদেন 'অপরাধী' হতে পারেন; কিন্তু কমান্ডো পাঠিয়ে তাঁকে হত্যা করা কোনো ধরনের আইনের মধ্যে পড়ে না। দোষীকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে_এটাই আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা। যাঁরাই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন (নাজি যুদ্ধাপরাধী, বসনিয়া, রুয়ান্ডা কিংবা লাইবেরিয়ার যুদ্ধাপরাধী) তাঁদের বিচার হয়েছে। লাদেনের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। উপরন্তু অ্যাবোটাবাদের বাড়িতে যে মার্কিনি অপারেশন পরিচালিত হবে, তা পাকিস্তানি প্রশাসন জানত। Global Post-এর ১২ মের সংখ্যায় বলা হয়েছে, ওসামা বিন লাদেন যে বাড়িতে থাকতেন, অপারেশনের দুই ঘণ্টা আগে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন এসে আশপাশের সব বাড়ির লোকজনকে বলে গিয়েছিল বাড়ির সব আলো নিভিয়ে রাখতে। পার্শ্ববর্তী এলাকা 'বিশাল টাউন'-এ বসবাসকারীরাও জানিয়েছেন, তাঁরা গভীর রাতের অপারেশনের আগে ওই এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা লক্ষ করেছেন। অর্থাৎ পরিকল্পনা করেই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে (হতে পারে সেটা সেনাবাহিনীর একটা অংশ) জানিয়েই অপারেশন Geronimo (বিন লাদেনকে হত্যা) পরিচালিত হয়েছিল। পাঁচ বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন জানত ওসামা কোথায় আছেন (Foreign Policy Magayine ও গত ৪ মে প্রকাশিত একটি ছবি তার বড় প্রমাণ)। তাই সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন মার্কিন প্রশাসন এত দিন তাঁকে বাঁচিয়ে রাখল এবং বিচারের জন্য হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মুখোমুখি করল না। তবে তাঁর হত্যাকাণ্ডের পর এখন নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত, বিন লাদেনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর যে সূচনা যুক্তরাষ্ট্র করেছিল, তার অবসান হবে কি না। এর জবাব হচ্ছে-না। যুক্তরাষ্ট্র এ ধারণা পরিত্যাগ করবে না। বরং বেশ কিছু মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রকে 'অকার্যকর বা সন্ত্রাসীদের মদদদাতা' আখ্যায়িত করে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা রাষ্ট্র ওইসব রাষ্ট্রকে এক ধরনের চাপের মুখে রাখতে পারে। একই সঙ্গে আল-কায়েদার তৎপরতা বন্ধ হবে বলেও মনে হয় না। AQI (ইরাক), AQIM (Al-Qaeda in Islamic Maghreb) কিংবা GSPC (Salafist Group for Preaching & Combat, Algeria), AQAP (AL-Qaeda in the Arabian Peninsula)-এর মতো সংগঠনের তৎপরতা বাড়বে। মৃত ওসামা তাদের জন্য এখন একটি আদর্শ। 'জিহাদি' তৎপরতা উত্তর আফ্রিকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, 'Operation Geronimo' নিঃসন্দেহে একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। এটা যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করল। এখন যেকোনো রাষ্ট্রের ভেতরে যুক্তরাষ্ট্র (অথবা অন্য কোনো রাষ্ট্র) হামলা চালাতে পারে। এ ধরনের প্রবণতা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোনো অবদান রাখবে না। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, ওসামার মৃত্যুর পর এখন আফগানিস্তান থেকে খুব দ্রুত সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে; কিন্তু এটি হবে না। কারণ আফগানিস্তানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। এ অঞ্চল থেকে মধ্য এশিয়ার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে গ্যাস ও তেলের বড় রিজার্ভ। এ তেল ও গ্যাসের ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কম্পানিগুলোর (আইওসি)। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি আইওসি (বিলি, মবিল, ইউনিকল, শেল, টোটাল) এ অঞ্চলে গ্যাস ও তেল উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। মধ্য এশিয়ার এই জ্বালানি সম্পদের কারণে আগামী দিনে এ অঞ্চলে 'আঞ্চলিক যুদ্ধের' সূচনা হতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সখ্য তা ভেঙে যেতে পারে মধ্য এশিয়ার এই জ্বালানি সম্পদের কারণে। ভারত ও চীনেরও আগ্রহ রয়েছে এই জ্বালানি সম্পদের ব্যাপারে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে চীন ইতিমধ্যে 'সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন' গড়ে তুলেছে, যেখানে রাশিয়াও সদস্য। মধ্য এশিয়ার এই তেল ও গ্যাস চীন বা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে যাক, এটা যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না। তাই আফগানিস্তানে তার উপস্থিতি দীর্ঘায়িত হবে। প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় যাবে। চতুর্থত, ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন প্রশ্নের মুখে। প্রতিবছর পাকিস্তানকে তিন মিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় যুক্তরাষ্ট্র শুধু সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ড রোধ করতে। এখন মার্কিনি কংগ্রেস এই অর্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিন লাদেনের ঘটনায় দুই রাষ্ট্রের মধ্যে আস্থার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য সামনের দিনগুলো খারাপ। পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতারা যদি নিজেদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক বাড়াতে না পারেন, তাহলে তা পাকিস্তানের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণভার চলে যেতে পারে, এই যুক্তি তুলে IAEA পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণভার নিজেদের হাতে রাখার একটি উদ্যোগ নিতে পারে। স্পষ্টতই বিন লাদেনের ঘটনায় প্রমাণিত হলো, পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের লালন করে ও প্রশ্রয় দেয়। এ ঘটনায় পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়ল। ভারত এখন পাকিস্তানকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নিতে পারে। ভারত যদি এটা করে, তাহলে তা উপমহাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা আরো বাড়াবে মাত্র। পঞ্চমত, বারাক ওবামা ২০০৯ সালের জুন মাসে কায়রোতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন সূচনার কথা তিনি বলেছিলেন। এখন বিন লাদেনকে হত্যার পর এ আস্থায় চিড় ধরতে বাধ্য। কোনো মুসলিম দেশই এখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কথা বিবেচনা করে প্রকাশ্যে মার্কিন প্রশাসনের কর্মকাণ্ড সমর্থন করবে না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের Woodrow Wilson Center-এর গবেষকরাও বলেছেন, বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর আরব বিশ্বে ইসলামপন্থীদের উত্থান রোধ করা সম্ভব হবে না। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটা সমঝোতা হবে, এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখন ইসরায়েলের আগ্রাসী তৎপরতা আরো বাড়তে পারে। মিসরে ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত 'ইসলামিক ব্রাদারহুড' পার্টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলেছে। বোঝাই যায়, বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ড যে 'সহানুভূতির ঢেউ' সৃষ্টি করেছে, তা থেকে ফায়দা ওঠাতে চাচ্ছে আরব বিশ্বের ইসলামিক দলগুলো। ষষ্ঠত, লাদেনের মৃত্যুর পর এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা একটি নতুন মাত্রা পাবে। এ অঞ্চল ন্যাটোর এশীয়করণ হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের তথা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের কয়েকটি দেশ এবং ভারতের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে ন্যাটোর এশীয় সংস্করণ, যা কি না তথাকথিত 'নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা'র স্বার্থে এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হতে পারে। মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে ১৯৪৮ সালে এভাবেই ন্যাটো গঠিত হয়েছিল। এ ধরনের যেকোনো সিদ্ধান্ত এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে। চীনও বিষয়টি সহজভাবে দেখবে না। সপ্তমত, বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডের পর খুব দ্রুত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাবুল সফর প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্র চায় পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত একটা বড় ভূমিকা পালন করুক। ভারতের বড় বিনিয়োগ রয়েছে আফগানিস্তানে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারত চাইবে সুবিধা আদায় করে নিতে। অষ্টমত, যুক্তরাষ্ট্রের 'মোস্ট ওয়ানটেড পারসন' বিন লাদেনকে হত্যা করে ওবামা যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছেন। ওই ঘটনার পর এক জরিপে দেখা গেছে, ওবামার জনপ্রিয়তা এখন ৬০ শতাংশের ঊর্ধ্বে। আগামী বছর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ওবামা দ্বিতীয় টার্মের জন্য তাঁর জয় নিশ্চিত করলেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ যখন তাঁর 'স্বাস্থ্য পরিকল্পনা' নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত, তখন ওসামা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে ওবামা দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন। মানুষ এখন আর স্বাস্থ্য খাত নয়, বরং ওসামা নিয়েই বেশি উৎসাহী এবং তাঁর হত্যাকাণ্ডে তারা খুশিও। যুক্তরাষ্ট্র এটাই চেয়েছে এবং তাতে সফল হয়েছে। নবমত, বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব করার এ প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে বারবার বিতর্কিত করছে। Humanitarian Intervention-এর নামে লিবিয়ায় বোমাবর্ষণের নির্দেশ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে জানিয়ে দিল, লিবিয়ায় গাদ্দাফিপরবর্তী নেতৃত্বকে তারা দেখতে চায়। লিবিয়ার তেলসম্পদ একদিকে যেমন তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করেছে, ঠিক তেমনি রয়েছে উত্তর আফ্রিকার (শাদ, নাইজার) বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের (তেল, গ্যাস, ইউরেনিয়াম, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, প্লাটিনাম) ওপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। লিবিয়া হচ্ছে 'গেটওয়ে'-এখান থেকে উত্তর আফ্রিকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো তার সামরিক কমান্ড AFRICOM প্রতিষ্ঠা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র একুশ শতকে নতুন এক আফ্রিকাকে দেখতে চায়। একসময় যে অঞ্চলগুলো ছিল ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের উপনিবেশ (১৮৮৪ সালের বার্লিন সম্মেলন অনুযায়ী), সেই অঞ্চলগুলো এখন পরিণত হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০১ সালে প্রণয়ন করেছিলেন Great Middle East Project। আজকে সমগ্র আরব বিশ্বে যে পরিবর্তনের ঢেউ, তার পেছনে রয়েছে এই মহাপরিকল্পনা। লিবিয়ায় Humanitarian Intervention ও বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ড মূলত একই সূত্রে গাথা, একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক রয়েছে।
বিন লাদেনকে হত্যা করার পর তাঁর বিচার করার আর কোনো সুযোগ থাকল না। ঠিক তেমনি তাঁর মুখ থেকে নাইন-ইলেভেনের ঘটনার প্রেক্ষাপটও জানা গেল না। কিন্তু পেন্টাগন যখন বেশ কিছু ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ করে, তখন তাদের 'আসল উদ্দেশ্য'টি ফাঁস হয়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে, যে ব্যক্তিকে সারা বিশ্বের মানুষ বাড়িতে বসে ভিডিওতে দেখছে, এটা কি সম্ভব? তিন স্ত্রী এবং ১৭ সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন_এটা কি কল্পনা করা যায়? কোনো ইন্টারনেট বা ফোন ছিল না। তাহলে আল-কায়েদাকে পরিচালনা করতেন কিভাবে? এর জবাব এখন নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে সত্য বেরিয়ে আসবেই। এক দিন (১৯৭৯) ওসামাকে পেন্টাগনই সৃষ্টি করেছিল। তারাই তাঁকে এত দিন বাঁচিয়ে রেখেছিল। এখন তাঁর প্রয়োজনীয়তা আর নেই। তাই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হলো। যুক্তরাষ্ট্র যে শুধু ওসামা বিন লাদেনের ক্ষেত্রে এমনটি করল, তা নয়। বরং ইতিহাসে এর প্রমাণ আরো আছে। একজন মৃত বিন লাদেন বরং জিহাদি আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী ও উৎসাহী করবে মাত্র।

মমতার বিজয় আমাদের আশাবাদী করে না

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এখন মমতা ব্যানার্জি। দীর্ঘ বছর ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টকে পরাজিত করে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রীর আসনটি ‘দখল’ করতে সমর্থ হলেও এ থেকে আমাদের উত্ফুল্ল হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। কেননা মমতা কেন্দ্রের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। এখন জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে আছেন। এক সময় বিজেপির সঙ্গেও ছিলেন। কেন্দ্রে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ’র (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স) মিত্র ছিলেন মমতা। অনেকদিন থেকেই ক্ষমতার আশপাশে আছেন। আমাদের নেতা-নেত্রীরা যখনই নয়াদিল্লি যান, তখন দু’ব্যক্তির সঙ্গে অবশ্যই তারা দেখা করেন। তাদের একজন প্রণব মুখার্জি, অপরজন মমতা ব্যানার্জি। আমাদের নেতা-নেত্রীদের ধারণা তাদের দু’জনের সঙ্গে দেখা করলে, পদ্মার ইলিশ, মিষ্টি আর সিরামিকের উপহার সামগ্রী নিয়ে গেলে তারা বাংলাদেশের সমস্যার ‘সমাধান’ করে দেবেন। 
অতীতে জ্যোতি বসু যত দিন জীবিত ছিলেন, তিনি ছিলেন আমাদের আরেকটা ‘ভরসার স্থান’। কিন্তু বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান কী হয়েছে, আমরা তা সবাই জানি—আমাদের সমস্যা এখানেই। যেখানে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদ অনুসরণ করে আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারছি না, সেখানে আমরা ভরসা করছি কখনও জ্যোতি বসুর ওপর, কখনও প্রণব, কখনও মমতার ওপর। কিন্তু আমরা ভুলে যাই তারা রাজনীতি করেন সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। মমতা বা প্রণব বাবু বাংলায় কথা বললেও মূলত এরা ভারতীয়। ভারতের স্বার্থটা আগে। জ্যোতি বসু তো কমিউনিস্ট ছিলেন। আদি বাড়ি বাংলাদেশে। কমিউনিস্টরা সাধারণত নিপীড়িত ও শোষিত মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ায় বলে বলা হয়। কেননা তত্ত্বগতভাবে তারা আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু বাংলাদেশের কোন সমস্যাটা সমাধান করে দিয়েছেন জ্যোতি বসু? একটিও নয়। অথচ জ্যোতি বসুর নাম শুনলেই আমরা গদগদ হয়ে গেছি। কিশোরী ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ অমানবিকভাব তার লাশ ঝুলিয়ে রাখল কয়েক ঘণ্টা, সেদিন কি মমতা এর প্রতিবাদ করেছিলেন? তিনি তো তখন কেন্দ্রের মন্ত্রী, ইউপিএ জোটের শরিক। মমতা প্রতিবাদ করেননি। বাংলাদেশের মানুষদের মূল্যবোধের প্রতি সহমর্মিতাও দেখাননি। কারণ তিনি সর্বভারতীয় রাজনীতি করেন, যেখানে বাংলাদেশকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। বাংলাদেশের স্বার্থ তাই ভারতীয় নেতাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়নি। যশোরের মেয়ে মমতা। তার জন্ম যশোরে হয়নি বটে, কিন্তু বাবার বাড়ি ছিল যশোরে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির সময় তার পূর্বপুরুষ চলে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। তিনি যে ধরনের নেত্রী, তাতে কেন্দ্র সরকার তার কথা শুনতে বাধ্য। কিন্তু বাংলাদেশ যে ধীরে ধীরে মরুময়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শুধু ভারতের পানি প্রত্যাহারের কারণে, মমতা কি এ ব্যাপারে কোনো দিন কোনো কথা বলেছেন? কেউ কি সে কথা বলে?
নির্বাচনে বিজয়ের পর আমাদের প্রধানমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে ফোন করেছিলেন। এ কথাটা প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের কাছ থেকে আমরা শুনিনি। তিনি ব্রিফিংও করেননি। আমরা জানলাম মমতা ব্যানার্জির মুখ থেকে (‘বাংলাদেশ থেকে হাসিনাদির ফোন পেয়েছি’)। প্রধানমন্ত্রী কি এটা করতে পারেন! প্রটোকল কি তাকে অনুমতি দেয়? একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী কী পারেন অন্য কোনো দেশের প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে? ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কি জার্মানির রাইনল্যান্ড ফালসের অতি সম্প্রতি নির্বাচনে বিজয়ী মুখ্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন? না, জানাননি। কেননা প্রটোকল অনুযায়ী তিনি তা পারেন না। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী তা করলেন। তারপর শুনুন মমতা কী বলেছেন। মমতার ভাষায় ‘মনে হচ্ছে যেন দুই বাংলা এক হয়ে গেল’ (কালের কন্ঠ, ১৪ মে, পৃ.-১০)। কী ভয়ঙ্কর কথা! ‘দুই বাংলা এক হয়ে গেল’! কী বোঝাতে চাচ্ছেন মমতা? আমাদের প্রধানমন্ত্রী ফোনে শুভেচ্ছা জানাবেন আর ভারতের নেতারা বলবেন ‘দুই বাংলা এক হয়ে গেল’—এটা তো আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি! আমরা তো এ জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম করিনি। এ জন্য তো লাখ লাখ লোক মারা যায়নি।
স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে আমরা পা দিয়েছি। এই চল্লিশ বছরে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতের সঙ্গে আমাদের যত সমস্যা বেড়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের এ সমস্যা নেই। গত ১৬ মে ছিল ফারাক্কা দিবস। পানির ন্যায্য হিস্যা ও ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ফারাক্কা মিছিল করেছিলেন মওলানা ভাসানী। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসেই নয়াদিল্লি ছুটে গিয়ে একটি চুক্তি করেছিলেন (১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে)। কিন্তু যতটুকু পানি আমাদের পাওয়ার কথা সে পানি চুক্তি স্বাক্ষরের পর কোনো দিনই আমরা পাইনি। অথচ ওই চুক্তি নিয়ে কত ‘অর্জনের’ কথা বলা হয়। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও কোনো খবর নেই। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যখন আমরা সোচ্চার, তখন আমাদের সংসদ সদস্যরা ‘প্রমোদ বিহারে’ গেলেন, হেলিকপ্টারে ঘুরলেন, জানালেন তারা কিছুই দেখতে পাননি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার কথা যখন পত্রিকাগুলো প্রকাশ করছে, তখন মিজোরামের মানুষ ওই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করছে। ভারতীয় নেতারা আমাদের ‘ঘুম পাড়ানির গান শুনিয়ে’ আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিলাম। কিন্তু আমরা, বা নেপাল ও ভুটান এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারত থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আমরা ভারতীয় হেভি ট্রাক চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করছি। ওই রাস্তা দিয়ে ভারতীয় হেভি ট্রাক যাবে কোনো ধরনের শুল্ক না দিয়েই। আর আমরা বছরের পর বছর গুনতে থাকব সুদ। বলা হয়েছিল বিদ্যুত্ আসবে ভারত থেকে। কৈ সেই বিদ্যুত্? ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা ভারতে থাকলেও তা নানা ট্যারিফ ও প্যারা-ট্যারিফের কারণে ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। জানা গেছে, আগামী ৩ বছরের জন্য ভারত শুল্কমুক্ত আরও ১০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২২৪টি পণ্য বাংলাদেশে রফতানি করার অনুমতি চেয়েছে। অথচ ভারতে বাংলাদেশী ৬১টি পণ্য শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশের অনুমতির কথা রয়েছে, যা দীর্ঘসূত্রতার জন্য আটকে আছে। সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত সিমেন্টের ওপর অতিরিক্ত ১৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। জানা গেছে, দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী ভারতে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নানা ধরনের সুবিধা পাওয়ার কথা (দিনকাল, ১৭ মে)। বাংলাদেশ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বল্পোন্নত। এ জন্য বাংলাদেশের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু ভারত সেই সুবিধা বাংলাদেশকে কখনই দেয়নি। এক্ষেত্রে মমতা বা প্রণব মুখার্জির মতো নেতারা কোনো দিন বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়াননি। কেননা তারা বাঙালি হয়েও স্বার্থ দেখেছে ভারতের। অথচ আমাদের নেতারা বারবার ভারতীয় ‘বাঙালি বাবুদের’ দিকে তাকিয়ে থেকেছেন। বলতে দ্বিধা নেই, শুধু ভারতের কারণেই সার্ক ঠিকমত বিকশিত হতে পারছে না। এর মূল কারণ, মূলত ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীতি। নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রচন্দ প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছেন যে, তার অপসারণের পেছনে ভারতের হাত ছিল। যারা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন ভারত নেপালের রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব খাটায়। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা নেপালে অত্যন্ত সক্রিয়। শ্রীলঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতা প্রভাকরণকে তারাই তৈরি করেছিল। আসলে ভারত তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই পার্শ্ববর্তী দেশগুলো তথা দক্ষিণ এশিয়াকে দেখতে চায়। অর্থনীতিতে অনেক বড় শক্তি ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্রতা দূরীকরণে তথা উন্নয়নে ভারত বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু এই আধিপত্যবাদী নীতির কারণেই ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় ‘বন্ধুশূন্য’ হতে যাচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি, প্রণব মুখার্জি—এরা সবাই মূলত এই আধিপত্যবাদী নীতিরই সমর্থন করছেন। সুতরাং আমাদের প্রধানমন্ত্রী মমতাকে ফোন করে যত আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলেন না কেন, এই আঞ্চলিক সহযোগিতা কোনো দিনই প্রতিষ্ঠিত হবে না—যতদিন না ভারত তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সাহায্য করেছিল। কিন্তু সেই সাহায্য ও সহযোগিতা অর্থহীন হয়ে গেছে ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে। ফেলানী যেন এক টুকরা বাংলাদেশ। যখন লাশ হয়ে ঝুলে থাকে ফেলানীরা তখন ভারতের ‘বন্ধুত্ব’ কোথায় প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে এ দেশের জনগণের। বাংলাদেশকে তারা কীভাবে দেখে, ফেলানীর ঝুলে থাকা লাশ এর বড় প্রমাণ। তাই মমতা ব্যানার্জি যখন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজয়ী হন, তখন আমাদের উত্সাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। মানুষ সেখানে পরিবর্তন চেয়েছে। আর সেই পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আদৌ কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হবে না। যারা সম্পর্ক উন্নত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন তত্কালীন ভারতীয় সরকারের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, তখন মমতা এর প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিলেন। মমতা হচ্ছেন ভারতীয় রানজীতিতে ‘মোস্ট আনপ্রেডেকটিবল পার্সন’, যার ওপর আস্থা রাখা যায় না। যে কোনো সময় তিনি ভোল পাল্টাতে পারেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তার আঁতাত কতদিন স্থায়ী হয়, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন এখন। মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা করার কিছু নেই।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com
তথ্যসুত্রঃ আমার দেশ। রোববার, ২২ মে ২০১১

যে বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন

বাপ্পির সাথে আমার পরিচয় খুব অল্প দিনের। চমত্কার একটি ছেলে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অন্য হাজারটা তরুণের মতো চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিচ্ছে না। উচ্চপর্যায়ের আত্মীয়-স্বজনও নেই বাপ্পির, যাকে ‘ধরে’ একটি চাকরি জোগানো সম্ভব। বাপ্পি তা করেনি। করার ইচ্ছেও নেই। বাপ্পি তথ্যপ্রযুক্তিতে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে ফ্রিল্যান্স আউটসোসিং করে সে প্রতিমাসে যা আয় করছে, তা অনেকের ঈর্ষার কারণ হতে পারে। মাত্র ২৩ বছরের যুবক বাপ্পি তাই ‘চাকরি’ নিয়ে ভাবে না। ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংই তার ধ্যান-ধারণা। এটা নিয়েই সে আরো এগিয়ে যেতে চায়। বাংলদেশের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) একটি বিশাল সম্ভাবনার খাত। খোঁজ-খবর নিয়ে দেখলাম তথ্যপ্রযুক্তি আউটসোসিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে প্রথম ৩০টি দেশের মধ্যে। বাংলাদেশে মোট ১৫০টি আউটসোর্সিং ফার্মে প্রায় ২৫ হাজার কর্মী কাজ করছে। এ খাতে এ যাবত্ বাংলাদেশের উপার্জিত আয় খুব আশাব্যঞ্জক না হলেও ভারত আউটসোর্সিং করে আয় করেছে প্রায় ৬ হাজার কোটি রুপি। অথচ এই সম্ভাবনাময় খাতটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেরক প্রতি বছর লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বেরুচ্ছে, যাদের অনেকেই বেকার থাকছে। ৩২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৫২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা বেরুচ্ছে, তাদের একটা বড় অংশই ‘জব মার্কেটে’ ঢুকতে পরছে না। এর মাঝে আবার সরকার নতুন করে বেশ ক’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ৫৮টি আবেদনের মধ্যে ৪২টির যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। এর অর্থ ন্যূনতম আরো অন্তত ৫০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এখানে কোন কোন বিষয় পড়ানো হবে? ইউজিসির চেয়ারম্যান সাহেব বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করতে উত্সাহী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাজারে এর কী চাহিদা রয়েছে? একজন ছাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা সাহিত্যে অর্নাস করে কোথায় চাকরি পাবে? এ ব্যাপারে শিক্ষানীতিতে কোন দিকনিদের্শনা নেই। যারা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেন, তাদেরও সুস্পষ্ট কোন চিন্তুা-ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। যে মুহূর্তে একটিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন নেই, সেখানে আরো ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। এখানে শুধু সার্টিফিকেট-বাণিজ্য হবে। আর এই সার্টিফিকেট-বাণিজ্য কেউ বন্ধ করতে পারবে না। অতীতেও আমরা পারিনি। এখন একজন বাপ্পি আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তথ্যপ্রযুক্তির আরো সম্প্রসারণ দরকার। সাধারণ বিষয়ে ছাত্র সংখ্যা না বাড়িয়ে, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে নতুন নতুন বিভাগ সৃষ্টি করে, সেখানে ছাত্র সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। তাহলে তথ্যপ্রযুক্তিতে আমরা একটা দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারবো, যারা হাজার হাজার ‘বাপ্পির মতো’ তরুণ তৈরি করবে, যারা আর বেকার থাকবে না, সরকারকেও এদের কর্মসংস্থানের জন্য চিন্তা করতে হবে না। পৃথিবীর কোন দেশেই সরকার সবাইকে চাকরি দিতে পারে না বা দেয় না। বেসরকারি খাত যেমনি রয়েছে, তেমনি এখন সৃষ্টি হয়েছে আউটসোর্সিং। বাপ্পির মতো তরুণরা নিজের বাসায় থেকেই এই কাজগুলো করতে পারে। তার অফিসে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। নির্ধারিত সময়ে অফিস করারও কোন প্রয়োজন নেই। শুধু প্রয়োজন যোগাযোগ ও নিজের যোগ্যতা বাড়ানো। এ খাতে বৈদেশিক আয়ের সম্ভাবনা প্রচুর। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। এমনিতেই বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো নয়। বর্তমানে দেশে যে বিনিয়োগ হচ্ছে, তার ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে হচ্ছে। আর মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ হচ্ছে বৈদেশিক উত্স থেকে, যা কোনভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই বক্তব্যটি আমাদের অর্থমন্ত্রীর। অর্থমন্ত্রী যখন এ ধরনের কথাবার্তা বলেন, তখন আমাদের চিন্তায় ফেলে দেয়। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি, রেমিটেন্স ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং। লিবিয়া তথা আরব বিশ্ব থেকে সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিরা দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সহজ কাজ নয়। সরকারের জন্য এটা একটা বাড়তি বোঝা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বড় ধরনের জনশক্তি স্থানান্তরের সম্ভাবনা রয়েছে। এরা রাজধানীতে এসে বস্তি তৈরি করছে। সৃষ্টি করছে নানা সমস্যা। পরিবেশ দুষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। খাদ্য নিরাপত্তা এখন ঝুঁকির মুখে। খাদ্য আমদানিতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে। এমনিতেই বিশ্ব নতুন করে এক ধরনের খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। এ কথা স্বীকার করেছেন সয়ং বিশ্ব ব্যাংকর প্রধান। তাই সংগত কারণেই বাংলাদেশের জন্য চিন্তাটা অনেক বেশি। দেশে খাদ্য উত্পাদন বেড়েছে, এটা সত্য, কিন্তু সেই সাথে এটাও সত্য, জনসংখ্যাও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমও খুব আশার কথা বলে না। পত্র-পত্রিকায় দেশের অর্থনীতি নিয়ে যেসব খবরা খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তা কোন আশার কথা বলে না। মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি (যুগান্তর, ৬ এপ্রিল)। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

আর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এ অস্থিরতার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থনীতির এ নাজুক পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। তাদের আশঙ্কা সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি, তারল্য সংকট, বিনিয়োগে বেহাল অবস্থা, প্রকট অবকাঠামো সমস্যা, নাজুক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দুর্নীতির উচ্চমাত্রা আর চাঁদাবাজির কারণে অধোগতিতে চলবে অর্থনীতির ধারা (ঐ)। অর্থনীতির এই অবস্থা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করতে পারে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে সরকার একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মাঝে আছে। সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। একই সাথে তারা অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ দাবি করেছে। এই রিপোর্টটি আদৌ কোনদিন প্রকাশিত হবে কিনা, তা নিয়েও শঙ্কা আছে। ইতোমধ্যে উচ্চ আদালত থেকে এ ব্যাপারে একটি রুলও ইস্যু হয়েছে। এই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে সরকারের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে শেয়ারের সূচক যখন ৬০০ পয়েন্ট নিচে নেমে গিয়েছিল, তখন বুঝতে কারো বাকি থাকে না যে একটি শক্তিশালী অসাধু চক্র এর সাথে জড়িত। সরকার কি তার দায় এড়াতে পারে? ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছে শেয়ার মার্কেটে। এদের অসন্তোষ সরকারের জন্য কোন শুভ সংবাদ নয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়, তখনও শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি হয়েছিল। তখন তদন্ত কমিটি ৩৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। কিন্তু তাদের একজনেরও বিচার হয়নি। ২০১১ সালে এসে তদন্ত কমিটিও কিছু দোষী ব্যক্তিকে কারসাজির সাথে জড়িত বলে অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু আদৌ বিচার হবে কী? না হলে অসন্তোষ বাড়বেই। উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সংবিধান পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটিতে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকলেও বিএনপি তাতে অংশ নেয়নি। জাতীয় কমিটি বিএনপির সাথে কথা বলতে চাইলেও বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এখানেও সেই ‘বিরোধ’ রয়ে গেল। সংবিধান একটি জাতির, এটা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নয়। এখানে বিশেষ করে এ ধরনের জাতীয় প্রশ্নে সরকারের সাথে বিরোধী দলের ন্যূনতম ঐকমত্য প্রয়োজন। চল্লিশ বছরে পা দিয়েও আমাদের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করলো, জাতি হিসাবে আমরা আজো বিভক্ত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার যদি একক উদ্যোগে সংবিধান সংশোধন করে, তাহলে তা বিতর্কের মাত্রা আরো বাড়াবে মাত্র। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সরকারের জন্য একটি ‘গলার কাঁটা’। সারা বিশ্বব্যাপীই খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে। এর প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এখানে রয়েছে একটি অসাধু চক্র, যারা উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যের (চাল, তেল, চিনি, আটা) মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। বাণিজ্যমন্ত্রীর ‘হুমকিও’ এখানে ব্যর্থ। নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চমূল্য সরকারের জন্য বড় হুমকি। অর্থনীতির মন্দার কারণে কৃচ্ছ সাধন যেখানে জরুরি, সেখানে সরকারি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে। চাকরির ক্ষেত্রে (এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও) ‘প্রায়োরিটি’ পাচ্ছে সরকারি দলের লোকেরা। পদ্মা সেতু নির্মাণ এখন ঝুঁকির মুখে। বিদ্যুত্ যেখানে ‘প্রায়োরিটি’, সেখানে অনুত্পাদনশীল খাতে অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সর্বশেষ একটি প্রকল্পে দেশ নিরক্ষরমুক্ত করার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে ছাত্রলীগকে (কালের কণ্ঠ, ২১ এপ্রিল), যেখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার আলোকে দেশে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই।

বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক সুবিধাভোগিতা, রাজনৈতিকভাবে একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা আরব বিশ্বে ‘বিপ্লবের’ জন্ম দিয়েছে। ‘আরব বসন্ত’-এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। ‘আরব বসন্ত’ থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছু। আমরা এ থেকে আদৌ কোন শিক্ষা নেবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। তবে এটা সত্য, আরব বিশ্বের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার সাথে আমাদের যথেষ্ঠ পার্থক্য রয়েছে। আমাদের এখানে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি রয়েছে। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে, যা আরব বিশ্বের কোথাও নেই। এদেশে একদলীয় শাসন কিংবা রাজতন্ত্রও নেই। তবে এদেশে অদক্ষ একটি তরুণ সমাজ আছে, যাদের মেধা আছে। এখন প্রয়োজন সেই মেধাকে ব্যবহার করা। এটা যে করা যাবে না, তা নয়। এটা করা যাবে। এর জন্য প্রয়োজন সুষুম পরিকল্পনা। প্রয়োজন দক্ষ লোকদের যোগ্য স্থানে বসানো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাজার হাজার গ্র্যজুয়েট তৈরি করে, একটা ‘সংকট’ সৃষ্টি করছে। ‘জব মার্কেটে’ চাপ বাড়াচ্ছে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষাখাতকে আমরা যদি সম্প্রসারণ করতে পারতাম, তাহলে হাজারটা ‘বাপ্পির, জন্ম হতো, যারা সরকারের প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে শুধুমাত্র ‘আউটসোসিং’ করে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারত। বিষয়গুলো তাই বিবেচনায় নেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। 
[পূর্বে প্রকাশা @ দৈনিক ইত্তেফাক ১৯ মে ২০১১] 

বিরোধ থেকেই গেল

সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিরোধিতা রয়েই গেল। সংবিধান সংশোধন নিয়ে যে জাতীয় কমিটি গঠিত হয়েছে, তারা প্রধান বিরোধী দলকে সংলাপে ডাকলেও বিএনপি ওই সংলাপে যায়নি। কেন তারা যায়নি, তা তারা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েও দিয়েছে। এমনকি সংসদে এলডিপিকে প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সদস্য ড. কর্নেল অলি আহমদও সংলাপে যোগ দেননি। আমাকে তিনি জানিয়েছেন, যে প্রক্রিয়ায় তাকে সংলাপে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তা শোভন ছিল না। অনেকটা দায়সারাগোছের কাজটি করেছে বিশেষ কমিটি। বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ব্যক্তিগতভাবে সংসদ ভবনের আটতলায় অবস্থিত কর্নেল অলির অফিসে যদি 'চা-পান' করতে যেতেন, তাহলে ভালো করতেন। এমনকি তিনি যদি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন, সেটা তার অবস্থানকে জাতির কাছে আরও শক্তিশালী করত। এখন কিছুই হলো না। এমনকি খোদ মহাজোটের শরিকদের মধ্যেও সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে দ্বিমত আছে। যেখানে জাতীয় পার্টি রাষ্ট্রধর্ম চায়, সেখানে শরিক বাম ঘরানার ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদেরও অবস্থান ভিন্ন। তারা রাষ্ট্রধর্ম চান না। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, সংবিধানে যেমনি ধর্মনিরপেক্ষতা থাকছে, ঠিক তেমনি থাকছে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম'ও। এটা তো পরস্পরবিরোধী ও সাংঘর্ষিক। ভবিষ্যতে এটা নিয়েও একটি সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকছে কিনা তা অনিশ্চিত। তবে এতে কিছু কিছু পরিবর্তন আনা দরকার। বিশেষ করে ৫৮গ(৩) ধারা নিয়ে এখন নানা কথা উঠেছে। এখানে 'ব্যক্তি' অর্থাৎ সাবেক প্রধান বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) মুখ্য হয়ে উঠেছেন, পদ্ধতিটি মুখ্য হয়ে ওঠেনি।

অতীতেও দেখা গেছে, ২০০৬ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতা ছাড়ার আগে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মুখ্য হয়ে উঠলেন। তখন আপত্তি উঠেছিল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। শুধু আপত্তি বললে ভুল বলা হবে। তারা এ প্রশ্নে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত ওই সময়ে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও তাতে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। এখন পরিস্থিতি অনেকটা সেদিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি অবসরে গেলেন ১৭ মে। এর পর কী হবে? কেন্দ্রবিন্দু এখন আবারও 'ব্যক্তিকে' নিয়ে। বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের পদত্যাগের পর ১৭ মে অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক হবেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। তিনি দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন আয়োজন করবেন। বিএনপি ইতিমধ্যে তার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, আমরা বারবার আমাদের প্রধান বিচারপতিদের বিতর্কিত করছি। এরা আমাদের শ্রদ্ধাভাজন। জাতীয় গার্ডিয়ান। জাতিকে অনেক পথনির্দেশনাও দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে যা করা যায় তা হচ্ছে, ৫৮গ(৩) ধারায় পরিবর্তন এনে এখানে একটি 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠন করা যেতে পারে, যারা প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে একজনের নাম প্রস্তাব করবে, যার ব্যাপারে কোনো আপত্তি উত্থাপন করা যাবে না। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, একজন শিক্ষাবিদ ও একজন বুদ্ধিজীবীর সমন্বয়ে এই 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে ৫৮গ(৪), ৫৮গ(৫) ও ৫৮গ(৬) ধারাগুলোর বিলুপ্তিও প্রয়োজন। এসব ধারায় একজন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ও রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণ করার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন বাধ্যতামূলক করা ও নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কথাও সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। কেউ কেউ সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের কথা বলছেন। এটা পরিবর্তন করা ঠিক হবে না (দলের বিপক্ষে ভোটদান প্রসঙ্গে)। এটা করা হলে 'হর্স ট্রেডিং' হবে, সাংসদরা বিকিকিনির শিকার হবেন। সংবিধানের ষষ্ঠভাগে ৯৫, ৯৬ ও ৯৮নং অনুচ্ছেদেও পরিবর্তন প্রয়োজন। ষষ্ঠভাগে বিচারপতি নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন [৯৬(৩)] ও শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। সপ্তম ভাগে (১১৮নং অনুচ্ছেদ) নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা ও আর্থিকভাবে সরকারের ওপর নিরপেক্ষ না থাকার বিধান সংযোজন করা যেতে পারে।

সংবিধানের ৮(১) অনুচ্ছেদে যেখানে 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস'-এর কথা বলা হয়েছে, তার কী হবে, সে ব্যাপারে অস্পষ্টতা রয়েই গেল। সংবিধানের ২(ক) ধারায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কথা বলা হয়েছে। দুটি ক্ষেত্রেই কোনো পরিবর্তন আনা ঠিক হবে না। তাতে করে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ভিন্ন ধারণার জন্ম দিতে পারে। ইসলামপন্থি দলগুলো এটা থেকে ফায়দা লুটতে পারে। ইউরোপের অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। আমেরিকার মতো রাষ্ট্রেও প্রেসিডেন্ট বাইবেলে হাত রেখে শপথ নেন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম যদি থাকে, তা হলে তাতে ক্ষতির কিছু নেই। রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা পরস্পরবিরোধী হলেও রাষ্ট্রধর্ম রাখলে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্রে তেমন কোনো বাধা আসবে না। এখন রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিলে সংবিধানের ২৫(২) ধারা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, যেখানে বলা হয়েছে_ 'রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।' এটা তো আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি মৌলিক চরিত্র। এটা যদি বাতিল হয়ে যায় তা হলে মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে।

বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, তাতে করে গণতন্ত্রের নামে প্রধানমন্ত্রীর এক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংবিধানের ৫৫(১), ৫৫(২), ৫৬(১), ৫৮(২) ইত্যাদি ধারা এমনভাবে সংযোজিত হয়েছে যে, তাতে করে প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে, যাকে 'প্রধানমন্ত্রীর একনায়কতন্ত্র' হিসেবে অভিহিত করা যায়। এখানে মন্ত্রিসভার যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে গণতন্ত্রে এই যৌথ নেতৃত্বই আসল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতিকে কিছুটা ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষপাতী আমি। বর্তমান সংবিধানে ৪৮(৩) ধারায় রাষ্ট্রপতির দুটি ক্ষমতা আছে। এক. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ও দুই. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। এর বাইরে প্রতিটি সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সম্পন্ন করবেন। এই ধারায় পরিবর্তন প্রয়োজন। শ্রীলংকা ও ফ্রান্স রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হলেও সংসদ ও প্রধানমন্ত্রী কিছু ক্ষমতা ভোগ করেন। আমরা বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির হাতে কিছু ক্ষমতা তুলে দিতে পারি। অতীতে সংবিধানে যে ১৪টি সংশোধনী আনা হয়েছে, তা কখনও গণভোটে প্রেরণ করা হয়নি। কিন্তু ১৪২(১) ধারায় গণভোটে প্রেরণের বিধান রয়েছে। এখন উচ্চ আদালতের রায়ে 'সংবিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে গেছে'। যদি তাই হয়, তা হলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত ১৪১(ক)(১) ধারার কী হবে? ১৯৭২ সালের সংবিধানে তো জরুরি অবস্থা ঘোষণার কোনো বিধান ছিল না। ঠিক তেমনি চতুর্থ সংশোধনীসহ আরও অনেক সংশোধনী নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে।

সংবিধান সংশোধন খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। এখন যে দল বিগত নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের ৩২.৪৫ ভাগ ভোট পেয়েছিল (জোটগতভাবে প্রায় ৩৮ ভাগ), সংবিধান সংশোধনীতে তাদের যদি কোনো বক্তব্য না থাকে অথবা তাদের বক্তব্য যদি অন্তর্ভুক্ত করা না যায়, তা হলে তো প্রশ্ন থেকেই যাবে। প্রায় ৩৮ ভাগ জনগোষ্ঠীকে অবজ্ঞা করা হবে এতে করে। প্রধান বিরোধী দলকে সংলাপে না আনার ব্যর্থতা বিশেষ কমিটিকে বহন করতে হবে। সংসদে সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সংবিধানের ১৪২(১)(আ) ধারামতে, সরকার সংবিধান সংশোধন করতে পারে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। রাজনীতি হচ্ছে 'An art of the compromise. সরকারে যারা থাকেন, তাদের আরও সহনীয় হতে হয়। হতে হয় আরও উদার ও উন্মুক্ত। এখন সরকার যেভাবে চাচ্ছে, সেভাবেই সংবিধান সংশোধিত হচ্ছে। ফলে বিরোধ থেকেই গেল। যে রাজনীতি পরস্পর পরস্পরকে শত্রু মনে করে, যে রাজনীতি বিদ্বেষের জন্ম দেয়, সেই রাজনীতি থেকে ৪০ বছরেও আমরা বের হয়ে আসতে পারলাম না। দুঃখটা এখানেই।
[সূত্রঃ সমকাল, ১৮/০৫/১১]

লাদেনের মৃত্যু ও একটি কালো অধ্যায়

ওসামা বিন লাদেন এখন মৃত। তার মৃত্যু নিয়ে যত ‘কাহিনী’ই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি ‘অধ্যায়ের’ অবসান হল। ওসামার এ মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমে যাবে কিনা, সেটা ভিন্ন এক প্রশ্ন। কিন্তু  বিন লাদেনের মৃত্যু একটি ‘কালো অধ্যায়ের’ সূচনা করল, যেখানে কোন পরাশক্তি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সীমানা লঙ্ঘন করতে পারে অনায়াসে। কোন আইন তাকে বাধা দিতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র আজ যে কাজটি করল, তাতে করে এখন উৎসাহিত হতে পারে আরও অনেক আগ্রাসী রাষ্ট্র। সন্দেহের দৃষ্টি এখন থাকবে ইসরাইলের দিকে।
নিঃসন্দেহে ওসামা বিন লাদেন একজন বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন। ইসলামের নামে তার কর্মকাণ্ড অনেকেই সমর্থন করবেন না। আÍঘাতী বোমারু তৈরি করা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার নাম আর যাই হোক, ইসলাম নয়। আমাদের দেশে যারা ইসলাম প্রচার করার জন্য একসময় আরব দেশ থেকে এসেছিলেন, তারা এভাবে ইসলাম প্রচার করেননি। একে-৪৭ রাইফেল হাতে নিয়ে আর পুঁজিবাদের প্রতীক ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করে দিলেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয় না। এ কারণেই ওসামা বিন লাদেনের কর্মকাণ্ড বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। যেহেতু তিনি অন্যায় করেছেন এবং অভিযুক্ত, সেহেতু তার বিচার হওয়া উচিত ছিল। এ ধরনের বিচার তো হচ্ছে। যারা বসনিয়া, রুয়ান্ডা কিংবা কসোভোতে গণহত্যা চালিয়েছিল, দি হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার হচ্ছে। লাইবেরিয়া কিংবা রুয়ান্ডায় যারা হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল, তাদেরও বিচার হচ্ছে। চার্লস টেলর, মিলোসেভিচের মতো একসময়ের মতাসীন ব্যক্তিরা আজ বিচারের মুখোমুখি। পানামার সাবেক সামরিক শাসক নরিয়েগাকে যুক্তরাষ্ট্র ধরে নিয়ে এসেছিল। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের জেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি বাহিনী ইউরোপে ‘অপরাধ’ করেছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের, যুদ্ধ সংঘটিত ও শান্তি বিঘিœত করার। ১৯৪৫ সালে গঠিত ওহঃবৎহধঃরড়হধষ গরষরঃধৎু ঞৎরনঁহধষ (ঘঁৎবসনবৎম) এ তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়েছিল। বিচার তাদেরও হয়েছিল যারা দূরপ্রাচ্যে (ঋধৎ ঊধংঃ) অপরাধ সংঘটিত করেছিল। ১৯৪৬ সালে গঠিত হয়েছিল ওহঃবৎহধঃরড়হধষ গরষরঃধৎু ঞৎরনঁহধষ ভড়ৎ ঋধৎ ঊধংঃ (ঔধঢ়ধহ)। জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছিল। ওসামা বিন লাদেনও তো একই ধরনের অপরাধ করেছেনÑ যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ড তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এর জন্য উপযুক্ত জায়গা ছিল দি হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেখানে তাকে তার অপরাধের জন্য ‘বিচার’ করা যেত। তা না করে যুক্তরাষ্ট্র কমান্ডো পাঠিয়ে তাকে হত্যা করল। আন্তর্জাতিক আইনে এ ধরনের হত্যা অনুমোদন করে না। এমনকি কোন দেশের সীমান্ত লঙ্ঘন করাও আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ। ওহঃবৎহধঃরড়হধষ খধি অংংড়পরধঃরড়হ ২০১০ সালের আগস্টে দি হেগে একটি আইন অনুমোদন করেছিল। তাতে বলা হয়েছেÑ ‘ঈধষষং ড়হ ধষষ ংঃধঃবং ঃড় ড়নংবৎাব পধৎবভঁষষু ঃযব ফরংঃরহপঃরড়হ নবঃবিবহ ংরঃঁধঃরড়হং ড়ভ ধৎসবফ পড়হভষরপঃ ধং ফবভরহবফ রহ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ খধি ধহফ ংরঃঁধঃরড়হং ড়ভ ঢ়বধপব রহ ফবাবষড়ঢ়রহম ধহফ পধৎৎুরহম ড়ঁঃ ঢ়ড়ষরপরবং রহাড়ষারহম ঃযব ঁংব ড়ভ ষবঃযধষ ভড়ৎপব, ফবঃবহঃরড়হ ধহফ ঃৎরধষং, ধংুষঁস ড়নষরমধঃরড়হং, ধহফ ড়ঃযবৎ ৎবষবাধহঃ ংঃধঃব ধপঃরড়হ.’ ঊঁৎড়ঢ়বধহ ঈড়ঁৎঃ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং (ঊঈঐজ) ১৯৯৫ সালে সংঘটিত একটি ঘটনার রায় দিয়েছিল, যে ঘটনার সঙ্গে বিন লাদেনের ঘটনার অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। মামলাটি ছিল ‘ম্যাককেন (গপঈধহহ) বনাম যুক্তরাজ্য’। এ মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন ওজঅ সদস্যরা, যাদের জিব্রালটারে হত্যা করেছিল ব্রিটিশ ঝঅঝ বাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ওজঅ সদস্যরা বোমা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঊঈঐজ তখন রায় দিয়েছিল, ঝঅঝ’র উচিত ছিল তাদের গ্রেফতার করা। যদি সন্দেহভাজনরা গ্রেফতার এড়ানোর চেষ্টা করতেন, তাহলে তারা অস্ত্র ব্যবহার করতে পারতেন। এখন বিন লাদেনের েেত্র ব্যাপারটি কি সেরকমই দাঁড়ালো না? বিন লাদেন নিরস্ত্র ছিলেন। জিব্রালটার ছিল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত এলাকা। কিন্তু পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত এলাকা নয়। পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ। সেই স্বাধীন দেশের সীমানায় অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ করে একজন ‘সন্ত্রাসী’কে হত্যা করা একটা অপরাধ এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল। ওহঃবৎ অসবৎরপধহ ঈড়ঁৎঃও বলছে, সন্ত্রাস দমনের নামে অস্ত্রের অতিরিক্ত ব্যবহারের বৈধতা দেয়া যায় না [আইনের অধ্যাপক গধৎু ঙ’ ঈড়হহবষষ (ঘড়ঃৎব উধসব) এর প্রবন্ধ ঞযব ইরহ খধফবহ ধভঃবৎসধঃয : অননড়ঃঃধনধফ ধহফ রহঃবৎহধঃরড়হধষ ষধ,ি অঋচঅক ঈযধহহবষ, ৪ সধু)]। যুক্তরাজ্যের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিশেষজ্ঞ নিক গ্রিফ লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় ঠিক এ প্রশ্নটিই তুলেছেন যে, লাদেনের হত্যাকাণ্ড আইনসম্মত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার কর্মী জিওফ্রে রবার্টসনের মতে, লাদেনকে ধরে নিয়ে আসা উচিত ছিল। নিরস্ত্র লাদেনকে মাথায় গুলি করে হত্যা করার ঘটনার ব্যাখ্যাও দাবি করেছেন তিনি। ওয়ারেন রিচি ঞযব ঈযৎরংঃরধহ ঝপরবহপব গড়হরঃড়ৎ এ সরাসরিই প্রশ্ন তুলেছেন, ডধং রঃ খবমধষ ঃড় করষষ ইরহ খধফবহ? যুক্তরাষ্ট্রের অপর এক মানবাধিকার কর্মী কার্টিস ডোয়েবলার অযৎধস ঙহষরহব এ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে।
বিন লাদেন অপরাধ করেছেন। বিচারে তার ফাঁসি হতে পারতÑ সেটাই বরং স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র অনেক প্রশ্নের জš§ দিল এখন। মৃত ওসামা বিন লাদেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠল। বিন লাদেনের জনপ্রিয়তা বাড়বে বৈ কমবে না এতে করে। কিন্তু যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর জন্য কোন ধরনের হুমকি কিনা? মুসলমান বিশ্বে অসন্তোষ আছে। বিশ্বায়নের নামে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের আধিপত্যবাদ। এেেত্র ইসলামিক পণ্ডিতদের কারও কারও মতে, (যেমন মিসরের ঝধুুরফ ছঁঃন) ‘ওংষধস রং ঃযব ংড়ষঁঃরড়হ’ অর্থাৎ ইসলামই সমাধানের পথ। বছরের পর বছর যখন ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয় না, যখন ইসরাইলি কমান্ডোরা ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে এবং তার বিচার হয় না, তখন লাদেনের মতো নেতারা জিহাদের ডাক দেন। এই তথাকথিত ‘জিহাদ’ মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমর্থিত হয়নি এটা সত্য, কিন্তু ইরাক ও আফগানিস্তানে যখন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়, তখন এক ধরনের ােভ ও ঘৃণা মুসলিম বিশ্বে জš§ হওয়া স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছিল এ যুক্তিতে যে, বিন লাদেনকে তালেবানরা আশ্রয় দিয়েছিল। সেই ২০০১ থেকে ২০১১Ñ আফগানিস্তানে আজও মার্কিন সৈন্য আছে। ওবামা শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু তার হাতেও ‘রক্ত’ এখন। তিনি প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন, ২০১১ সালে সব মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করা হবে। এখন বলছেন, সেই সময়সীমা ২০১৪। কিন্তু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞকরা জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের ‘বড় স্বার্থ’ রয়েছে আফগানিস্তানে, তাই সেখানে তাদের থাকতে হবে। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে বিপুল জ্বালানি সম্পদÑ গ্যাস ও তেল। সেখানে মার্কিন কোম্পানিগুলোর বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। অন্য কোন শক্তি এই জ্বালানি সম্পদে ভাগ বসাবে (বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া), তা চাইবে না যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানে বসেই মধ্য এশিয়ার ‘জ্বালানি সম্পদ’ নিয়ন্ত্রিত হবে। তাই তাজিকিস্তান কিংবা উজবেকিস্তানে ‘ইসলামী জঙ্গিবাদে’র ‘জš§’ হয়েছে! এই জঙ্গিবাদও মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি! ‘ন্যাটোর এশীয়করণ’ হবে এ অঞ্চলকে ঘিরে। তাই আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সম্ভাবনা ীণ। ইরাকে বলা হয়েছিল ডগউ বা গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে। বলা হয়েছিল, এ মারণাস্ত্র এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই যুক্তি তুলে ২০০৩ সালে দেশটি দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তার পরের কাহিনী আমরা সবাই জানি। সেখানে কোন ডগউ পাওয়া যায়নি। কিন্তু সাদ্দামের ফাঁসি হয়েছে। ইরাক ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরাকের তেল বিক্রি করে সেদেশের পুনর্গঠনের কাজ করছে কিছু মার্কিন কোম্পানি। আজ ঐঁসধহরঃধৎরধহ ওহঃবৎাবহঃরড়হ-এর নামে লিবিয়ায় সামরিক হস্তেেপর পথ খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের টার্গেট লিবিয়ার তেল। লিবিয়া হচ্ছে উত্তর আফ্রিকায় যাওয়ার ‘গেটওয়ে’। লিবিয়াকে যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তাহলে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী আফ্রিকার দেশগুলোও নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে।  অঋজওঈঙগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এ ল্য সামনে রেখেই।
ইসলামের নামে যে সন্ত্রাসবাদ, তা সমর্থনযোগ্য নয়। এটা ইসলাম নয়। কিন্তু এই সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে অন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আক্রমণ করা কিংবা তার সার্বভৌমত্ব লংঘন করাও গ্রহণযোগ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা জাতিসংঘ সনদ ৪.১ ও ৪.৪ এর পরিপন্থী, যেখানে ‘সার্বভৌমত্ব’ ও ‘আঞ্চলিক অখণ্ডতার’ কথা বলা হয়েছে। সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ‘সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ‘চৎববসঢ়ঃরাব ঝঃৎরশব’ বা আগাম আক্রমণের যে ধারণা প্রেসিডেন্ট বুশ ব্যবহার করেছিলেন, কিংবা এখন ওবামা ব্যবহার করলেন, তা বাহ্যত যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে আদৌ কোন সাহায্য করবে না। ইতিহাসে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটাচ্ছে। ১৯৮৬ সালে দি হেগের ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়ঁৎঃ ড়ভ ঔঁংঃরপব নিকারাগুয়ায় ‘অবৈধভাবে শক্তি প্রয়োগ’ করা ও কন্ট্রা বিদ্রোহীদের (যারা ওই সময় নিকারাগুয়ার বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিল) সাহায্যের অপরাধে অভিমত দেয়, যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আদালতের এ রায় স্বীকার করে নেয়নি। অথচ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৯৪-২ ভোটে আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায় মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল তাদের। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ওই প্রস্তাবের বিপে ভোট দিয়েছিল সেদিন।
লাদেন হত্যাকাণ্ড অনেক প্রশ্নেরই জবাব দেবে না। আমরা কোনদিনই জানতে পারব না কেন সেদিন ৯/১১ সংঘটিত হয়েছিল, কারা কারা ছিল এর পেছনে। ঋড়ৎবরমহ চড়ষরপু গধমধুরহব এ (৪ মে) একটি সিরিজ ছবি ছাপা হয়েছে। একটি স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিও আছে, যাতে দেখানো হয়েছে অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়িটি, যেখানে বিন লাদেন থাকতেন। ছবিটি তোলা হয়েছে ২০০৫ সালের ১৫ জুন। বিন লাদেনের স্ত্রীও স্বীকার করেছেন, তারা ২০০৫ সাল থেকেই ওখানে আছেন। তাহলে প্রশ্নটি এসেই যায়, আগেই কেন সেখানে কমান্ডো পাঠানো হল না? এই ‘কেন’র কোন জবাব নেই। কারণ যিনি জবাব দিতেন, তিনি আজ মৃত। বিন লাদেনকে হত্যা করার ঘটনা একটি ‘কালো অধ্যায়’। যুক্তরাষ্ট্র আজ যে কাউকে ‘বড় সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে যে কোন দেশে কমান্ডো হামলা চালাতে পারে। আন্তর্জাতিক আইনকে থোড়াই কেয়ার করে যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রবণতা ভালো নয়। এটা বিশ্বে উত্তেজনা বাড়াবে মাত্র। মুসলিম বিশ্ব একসময় বারাক ওবামার ওপর আস্থা রেখেছিল। এখন ওসামার হত্যাকাণ্ডে সেই আস্থা যদি ফিঁকে হয়ে আসে, আমি তাতে অবাক হব না।
[পূর্বে প্রকাশ @দৈনিক যুগান্তর ১৪-০৫-২০১১]

লাদেনের মৃত্যু যেসব প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না

আরব সাগরের নোনা পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল বিশ্বের ‘এক নম্বর ওয়ান্টেড পারসন’ ওসামা বিন লাদেনের মৃতদেহ। আরব সাগরে টহল দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ‘কার্ল ভিনসন’ থেকে ওসামার মৃতদেহ যখন ভাসিয়ে দেয়া হলো তখন তার জানাজা না হওয়ারই কথা। যে লোকটি ইসলামের জন্য বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাক দিয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পর ইসলামের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ন্যূনতম যে শ্রদ্ধাটুকু তার পাওয়ার কথা, তাও তিনি পাননি। যদিও বলা হচ্ছে, একজন মার্কিন মুসলমান সৈনিক লাদেনের মৃতদেহ সাগরে ভাসিয়ে দেয়ার আগে কোরআন শরীফ থেকে পাঠ করেছিলেন। কিন্তু জাহাজে জানাজা তো হওয়ার কথা নয়! এক টুকরো মাটিও পেলেন না এক সময়ের বিশ্বব্যাপী ঝড় তোলা ওসামা বিন লাদেন। এই মৃত্যু কি তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন? তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্রশ্নেরও আমরা কোনো জবাব খুঁজে পাব না কোনো দিন। প্রথমত, যার মাথার মূল্য যুক্তরাষ্ট্র নির্ধারণ করেছিল আড়াই কোটি ডলার, সেই তিনি, ওসামা বিন লাদেন বউ-বাচ্চা নিয়ে বাস করতেন পাক সেনাবাহিনীর নাকের ডগায় অ্যাবোটাবাদ শহরে! এটা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য? যার একটি মাত্র নির্দেশে শত শত যোদ্ধা তাদের নিজেদের জীবন উত্সর্গ করতে প্রস্তুত, তিনি কীনা থাকলেন একাকী, কোনো ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই! তার তো থাকার কথা গহীন পাহাড়ে শত শত জঙ্গি পরিবেষ্টিত অবস্থায়! নাকি, যারা এক সময় লাদেনকে তৈরি করেছিল, তাদের কাছে আর লাদেনের প্রয়োজন নেই। তাই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয়া, লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে এবং তার লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। অতীতে যুক্তরাষ্ট্রে চরমপন্থীদের গ্রেফতার করে সাংবাদিকদের ডেকে তাদের উপস্থাপন করা হয়েছে। লাদেনের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটলো কেন? কেনইবা তাকে কবর দেয়া হলো না? বলা হচ্ছে, কোনো দেশ তাঁকে গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। এ কথাটা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য? কেননা, মৃত লাদেনকে পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানের জনগণ গ্রহণ করে নিতেন খুব সহজেই। তার আদর্শের অনুসারীদের সংখ্যাও এ অঞ্চলে কম নয়।
লাদেনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো এমন এক সময় যখন সারা আরব বিশ্বে এক ধরনের টলটলায়মান অবস্থা বিরাজমান। একের পর এক সরকারের পতন ঘটছে এবং সেখানে পরিবর্তন আসছে। দ্বিতীয় আরও একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হচ্ছে গত ১১ এপ্রিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার (আইএসআই) প্রধান জেনারেল সুজা পাশার ওয়াশিংটন সফর, যেখানে তিনি কথা বলেছেন সিআইএ প্রধান লেওন পেনেট্রার সঙ্গে। কী আলোচনা হয়েছিল, তার বিবরণ কোনো দিনই প্রকাশ করা হয়নি। এই দুটো ঘটনার সঙ্গে লাদেনের হত্যাকাণ্ডের কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, তা প্রমাণ করবে আগামী দিনের ইতিহাস। তবে লাদেনকে হত্যার ঘটনায় মার্কিন জনগণ উত্ফুল্ল হলেও এর কতগুলো নেতিবাচক দিক আছে। এক. লাদেনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ হত্যার জন্য। ৯/১১-এর ঘটনায় নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তাতে মারা গিয়েছিলেন তিন হাজার মানুষ। এ ক্ষেত্রে লাদেনের প্রতি অনুকম্পা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। ভিন্ন একটি দেশে গিয়ে কমান্ডো বাহিনী পাঠিয়ে হত্যাকাণ্ড চালানো আন্তর্জাতিক কোনো আইনেই অনুমোদন করে না। কিন্তু যিনি অভিযুক্ত তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি যুদ্ধাপরাধীদের নুরেমবার্গে বিচার হয়েছিল। উপরন্তু সম্প্রতি দি হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিভিন্ন দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। তাহলে ওসামা বিন লাদেনকে কেন হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মুখোমুখি করা হলো না? পানামার এক সময়ের শক্তমানব নরিয়েগাকে সেখান থেকে ধরে এনে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজ দেশে বিচার করেছিল। লাদেনের ক্ষেত্রে এমনটা হলো না কেন? যুক্তরাজ্যের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিশেষজ্ঞ নিক গ্রিফ লন্ডনের গার্ডিয়ানে ঠিক এ প্রশ্নটিই তুলেছেন যে, লাদেনের হত্যাকাণ্ড আইনসম্মত ছিল না। অনেকটা একই সুরে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন মানবাধিকার কর্মী জিওফ্রে রবার্টসন। তার মতে, লাদেনকে ধরে নিয়ে আসা উচিত ছিল। নিরস্ত্র লাদেনকে মাথায় গুলি করে হত্যা করার ঘটনার ব্যাখ্যাও দাবি করেছেন তিনি। ওয়ারেন রিচি The Christian Science Monitor-এ সরাসরিই প্রশ্ন তুলেছেন, Was it legal to kill Bin Laden? তিনি জবাবও দিয়েছেন ওই হত্যাকাণ্ড আইনসম্মত ছিল না। দুই. যে কমান্ডো বাহিনী (Navy SEAL Team 6) ৪টি হেলিকপ্টার নিয়ে পাকিস্তানে আফগানিস্তান থেকে প্রবেশ করল, তারা পাকিস্তান সরকারের কোনো অনুমতি নেয়নি। এতে করে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন মানবাধিকার কর্মী কার্টিস ডোয়েবলার Ahram Online-এ ঠিক এ প্রশ্নটিই তুলেছেন। একই ধরনের অভিযোগ সাবেক পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফেরও। এর খারাপ দিকটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যাকে ‘শত্রু’ মনে করবে, তাকে হত্যা করতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করতে এতটুকুও দ্বিধাবোধ করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা জাতিসংঘ সনদ ৪.১ ও ৪.৪-এর পরিপন্থী, যেখানে ‘সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার’ কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এই ভূমিকা বিশ্বে পুনরায় স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিতে বাধ্য।
লাদেন নিঃসন্দেহে অন্যায় করেছেন। তিনি ইসলাম ধর্মকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন অনেকেই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু ইসলাম ধর্মকে তিনি নতুন এক ‘ব্রান্ড’-এ উপস্থাপন করেছেন, যা সন্ত্রাসী ভাবধারায় প্রভাবান্বিত। এটা ইসলাম নয়। কোটি কোটি মানুষ, যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী তারা এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে বরং ঘৃণাই করবেন। তবে ভেবে দেখতে হবে ওসামার উত্থান কেন হলো। অনেক গবেষক মনে করেন, ওসামার উত্থানের পেছনে যে বিষয়টি কাজ করে তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের বিকল্প। ওসামা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ‘বিকল্প’ উপস্থাপন করেছিলেন (Niall Ferguson-এর প্রবন্ধ Foreign Affairs, April 2005)। ‘বিশ্বায়নের বিকল্প হচ্ছে ইসলাম’ কিংবা মিসরের প্রখ্যাত পণ্ডিত সাঈদ কুতুবের ব্যাখ্যা 'Islam is the solution' (ইসলামই একমাত্র সমাধানের পথ) মতবাদে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কিছুটা আস্থা খুঁজে পেলেও ওসামা যেভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইসলামকে উপস্থাপন করেছেন, সে ব্যাপারে আপত্তি উঠেছিল খোদ মুসলিম বিশ্ব থেকেই। ওসামা মূলত ছিলেন ‘ওয়াহিবিজম’-এর প্রবক্তা। এরা সালাফি বা আদিপন্থী হিসেবেও পরিচিত। সৌদি রাজপরিবার এই ‘ওয়াহিবিজম’ মতবাদে বিশ্বাসী (১৭০৩ সালে জন্ম নেয়া মুহম্মদ ইবন আবদ আল ওয়াহাব ইসলামের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন)। ‘ওয়াহিবি’ মতবাদে জিহাদের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। ওসামা বিন লাদেন মূলত ওয়াহিবি মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাক দিয়েছিলেন। এর সঙ্গে যে ইসলামের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই এবং ইসলাম সন্ত্রাসবাদকে যে সমর্থন করে না মুসলিম বিশ্ব এটা উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আর পরিণামে ৯/১১-এর ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ’ শুরু করেছিল, তা লাদেনের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর নতুন এক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন (Preemptive attack—শত্রু আঘাত করার আগেই শত্রুকে আঘাত করে শেষ করে দেয়া। দৃষ্টান্ত ইরাক)। আর ওবামা এটাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করলেন (Humanitarian Intervention, লিবিয়া)। মনে রাখতে হবে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এ টার্গেট করা হয়েছে মুসলমানদের। শুধু মুসলমানদেরই সন্ত্রাসী বানানো হয়েছে। ইহুদি সন্ত্রাসীদের টার্গেট করা হয়নি। কিংবা ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করলেও ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রেসিডেন্ট ওবামার কায়রো ভাষণ মুসলিম বিশ্বে একটি ইমেজ সৃষ্টি করেছিল। ধারণা করা হয়েছিল, ওবামা মুসলিম বিদ্বেষী ভাবধারা থেকে বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু ওসামার হত্যাকাণ্ড, বিশেষ করে অসম্মানিতভাবে তার মৃতদেহ সাগরে ফেলে দিয়ে মাছের খাবারে পরিণত করা তথা ইসলামকে অবমাননা করা, তার মৃতদেহের ছবি প্রকাশ না করা, কিংবা তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেয়া, ইত্যাদি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে বাধ্য। এতে করে ২০১২ সালে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওবামার অবস্থান শক্তিশালী হবে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু মুসলমান বিশ্বে তার ইমেজ বৃদ্ধি ঘটবে না।
কিন্তু এরপর কী? অনেকগুলো প্রশ্ন এখন। আল কায়দা কি ধ্বংস হয়ে যাবে? আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা কি ফিরে আসবে? পাকিস্তানের কী হবে? এর জবাব পাওয়া সত্যিই কঠিন। আল কায়দা ধ্বংস হবে না। তবে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যাবে। ওসামা বিন লাদেনের বিকল্প জাওয়াহিরি নন। জাওয়াহিরির একক নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আল কায়দা তাদের অপারেশন পরিচালনা করলেও তা কোনো বড় ইমেজ সৃষ্টি করতে পারবে না এবং বিশ্বের কোথাও বড় ধরনের হামলা করতে পারবে বলেও মনে হয় না। আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। কেননা, শুধু তালেবানদের দমনই যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র স্ট্র্যাটেজি নয়। আফগানিস্তানের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেক। একদিকে বিপুল জ্বালানি সমৃদ্ধ মধ্য এশিয়া, অন্যদিকে চীন। জ্বালানি সম্পদ (তেল ও গ্যাস) নিয়ে আগামিতে আঞ্চলিক যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং ‘প্রচণ্ড জ্বালানি ক্ষুধা’র কারণে চীনও এই আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে। আর যুক্তরাষ্ট্রের এই জ্বালানি সম্পদের ব্যাপারে আগ্রহ তো অনেক দিনের। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে যাবে না। সেনা প্রত্যাহার করা হলেও (২০১৪) ভিন্ন আঙ্গিকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব থেকে যাবে। ন্যাটোর ‘এশীয়করণ’ হবে। এখানে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে (যেমনটি হয়েছিল ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর) ন্যাটোর সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। আর মূলধারার তালেবানদের সঙ্গে সংলাপ শরু না করলে আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আসবে না। কারজাই তালেবানদের নামে যাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। আলোচনার জন্য মোল্লা ওমরকেই এখন বেছে নিতে হবে, যদি তা সম্ভব হয়। পাকিস্তান সরকার এখন বড় ধরনের অস্বস্তির মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব এখন পাকিস্তানে আরও শক্তিশালী হবে। পাকিস্তানি তালেবানদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব এখন আরও বাড়বে। বহির্বিশ্বে পাকিস্তানের ভূমিকা (লাদেনকে আশ্রয়, আইএসআই’র ভূমিকা) এখন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। পাকিস্তানকে একটি ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কেরও অবনতি ঘটবে। পাকিস্তানের অস্তিত্বও আজ হুমকির মুখে।
লাদেনের মৃত্যু একটা অধ্যায়ের অবসান হলো মাত্র। জীবিত লাদেনের চেয়ে মৃত লাদেন একটি ‘অবিসংবাদিত শক্তি’তে পরিণত হতে পারেন। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন একজন লাদেনকে সৃষ্টি করেছিল। জন্ম হয়েছিল শত শত জিহাদির। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল লাদেনের। আজ সেই প্রয়োজনটি নেই। তাই চলে যেতে হলো লাদেনকে। ইতিহাস এখন ওসামা বিন লাদেনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে? একজন সন্ত্রাসী হিসেবে? নাকি একজন রিফর্মার হিসেবে? 

আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও লাদেন অধ্যায়

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে লাদেন অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে। লাদেন এখন মৃত, ইতিহাসের অংশ। এই লাদেন অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অনেক করুণ ইতিহাস, অনেক মৃত্যু। তিনি ইসলাম ধর্মের নতুন এক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তার এই ব্যাখ্যা বিতর্কিত ছিল এবং সব মুসলিম বিশ্বের মানুষ তা গ্রহণ করে নিয়েছিল, তাও বলা যাবে না। কিন্তু এটা সত্য, তিনি মুসলিম বিশ্বের শত শত 'জিহাদি' তৈরি করেছিলেন, যারা ইসলামের নামে 'শহীদ' হতে প্রস্তুত ছিলেন। লাদেন ইসলামের আদি ধারায় ফিরে যেতে চেয়েছেন। ওয়াহাবি মতবাদে এই আদি ধারার কথা বলা হয়েছে। কেউ কেউ একে 'সালাফি' মতবাদ হিসেবেও চিহ্নিত করেন। সৌদি রাজপরিবার এই ওয়াহাবি মতবাদে বিশ্বাসী। ওয়াহাবি মতবাদের প্রবক্তা হচ্ছেন একজন সৌদি ইসলামিক প-িত মুহম্মদ বিন আবদ আল ওয়াহাব। তার জন্ম ১৭০৩ সালে। সৌদি রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সৌউদ একসময় ওই মতবাদে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, যা তারা আজো ধরে রেখেছেন। বলা হয় সৌদি আরব এই ওয়াহাবি মতবাদকে প্রমোট করছে। ওয়াহাবি মতবাদে জিহাদকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। ওয়াহাবি মতবাদিরা পীর ভক্তি, মাজার পূজা, মিলাদ, কবর জিয়ারত, শিরক ও বিদআতের ব্যাপারে বিশ্বাসী নন। লাদেন বিশ্বাস করতেন জিহাদের মাধ্যমে বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে ইসলাম ধর্মের বিস্তৃতি ঘটেছে, সেখানে কোথাও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইসলামের বিস্তার ঘটেনি। আমাদের এ অঞ্চলে হাজার বছর আগে ইসলাম প্রচারের জন্য যারা এসেছিলেন, তারা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের আশ্রয় নেননি। তারা শান্তির বাণী প্রচার করে গেছেন এবং এ দেশকে ভালোবেসে, এ দেশে থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু লাদেন এ কোন ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য নেমেছিলেন? শত শত তরুণ যুবককে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন 'জিহাদি' কর্মকা-ে অংশ নিতে। শত শত কোটি ডলারের মালিক ছিলেন ওসামা। এ অর্থ তিনি ব্যয় করেছেন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে। বিশাল এক নেটওয়ার্ক তিনি গড়ে তুলেছেন আরব বিশ্বে, ইরাক থেকে শুরু করে আলজিরিয়া। ইয়েমেনে রয়েছে-আল-কায়েদার শক্ত ঘাঁটি। এই আল-কায়েদা নামক সংগঠনটির জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করে দেয়ার ঘটনার সঙ্গে আল-কায়েদা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এরপর থেকেই বিন লাদেনের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তিনি পরিণত হন 'বিশ্বের একনাম্বার সন্ত্রাসী হিসেবে। ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পর তাঁকে পাওয়া গেল পাকিস্তানের এবোটাবাদ শহরে।
নিঃসন্দেহে লাদেন অপরাধ করেছেন। বিচারে তার ফাঁসি হতে পারতো_ সেটাই বরং স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তাকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র অনেক প্রশ্নের জন্ম দিল এখন। মৃত ওসামা বিন লাদেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠল। লাদেনের জনপ্রিয়তা বাড়বে বৈ কমবে না এতে করে। কিন্তু যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর জন্য কোনো ধরনের হুমকি কি না? মুসলমান বিশ্বে অসন্তোষ আছে। বিশ্বায়নের নামে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের আধিপত্যবাদ! এ ক্ষেত্রে ইসলামিক প-িতদের কারো কারো মতে (যেমন মিসরের ঝধুুরফ ছঁঃন) ওংষধস রং ঃযব ংড়ষঁঃরড়হ; ইসলামই সমাধানের পথ। বছরের পর বছর এখন ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয় না, যখন ইসরাইলী কমান্ডোরা ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে এবং তার বিচার হয় না, তখন লাদেনের মতো নেতারা জিহাদের ডাক দেয়। এই তথাকথিত 'জিহাদ' মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমর্থিত হয়নি এটা সত্য, কিন্তু ইরাক ও আফগানিস্তানে যখন নিরীহ মানুষদের হত্যা করা হয়, তখন এক ধরনের ক্ষোভ ও ঘৃণা মুসলিম বিশ্বে জন্ম হওয়া স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আগ্রসন চালিয়েছিল এই যুক্তিতে যে লাদেনকে তালেবানরা আশ্রয় দিয়েছিল। সেই ২০০১ থেকে ২০১১ আফগানিস্তানে এখনো মার্কিন সৈন্য আছে। ওবামা শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু তার হাতেও 'রক্ত' এখন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২০১১ সালে সব মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করা হবে। এখন বলছেন সেই সময়সীমা ২০১৪। কিন্তু নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের 'বড় স্বার্থ' রয়েছে আফগানিস্তানে। এখানে থাকতে হবে। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে বিপুল জ্বালানি সম্পদ, গ্যাস ও তেল। এখানে মার্কিন কোম্পানিগুলোর বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। অন্য কোনো শক্তি এই জ্বালানি সম্পদে ভাগ বসাবে (বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া), তা চাইবে না যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানে বসেই মধ্য এশিয়ার 'জ্বালানি সম্পদ' নিয়ন্ত্রিত হবে। তাই তাজিকিস্তান কিংবা উজবেকিস্তান এ 'ইসলামি জঙ্গিবাদ'-এর জন্ম হয়েছে। এই জঙ্গিবাদও মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি! 'ন্যাটোর এশীয়করণ' হবে এ অঞ্চলে ঘিরে। তাই আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ইরাকে বলা হয়েছিল ডগউ বা মরণাস্ত্র রয়েছে। বলা হয়েছিল এই মরণাস্ত্র এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই যুক্তি তুলে ২০০৩ সালে দেশটি দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তার পরের কাহিনী আমরা সবাই জানি। ডগউ পাওয়া যায়নি। কিন্তু সাদ্দামের ফাঁসি হয়েছে। ইরাক ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরাকের তেল বিক্রি করে ইরাক পুনর্গঠনের কাজ করছে কিছু মার্কিন কোম্পানি। আজ ঐঁসধহরঃধৎরধহ ওহঃবৎাবহঃরড়হ-এর নামে লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের পথ খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের টার্গেট লিবিয়ার তেল। লিবিয়া হচ্ছে উত্তর আফ্রিকায় যাওয়ার 'গেটওয়ে'। লিবিয়াকে যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তাহলে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী আফ্রিকার দেশগুলো নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে। অঋজওঈঙগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই।
ইসলামের নামে যে সন্ত্রাসবাদ, তা সমর্থনযোগ্য নয়। এটা ইসলাম নয়। কিন্তু এই সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে অন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আক্রমণ করা কিংবা তার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করাও গ্রহণযোগ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা জাতিসংঘ সনদ ৪.১ ও ৪.৪-এর পরিপন্থী, যেখানে 'সার্বভৌমত্ব' ও 'আঞ্চলিক অখ-তার' কথা বলা হয়েছে, সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই 'সন্ত্রাসী' কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। 'চৎববসঢ়ঃরাব ঝঃৎরশব' আগাম আক্রমণের যে ধারণা বুশ ব্যবহার করেছিলেন কিংবা এখন ওবামা ব্যবহার করলেন, তা বাহ্যত যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। ইতিহাসে আছে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটাচ্ছে। ১৯৮৬ সালে হেগের ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়ঁৎঃ ড়ভ ঔঁংঃরপব নিকারাগুয়ায় 'অবৈধভাবে শক্তি প্রয়োগ' করাও কন্ট্রা বিদ্রোহীদের (যারা ওই সময় নিকারাগুয়ার বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিল) সাহায্যের অপরাধে অভিমত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায়কে স্বীকার করে নেয়নি। অথচ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৯৪-২ ভোটে আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায় মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল সেদিন।
লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নতুন একটি 'অধ্যায়ের' সূচনা হলো। এই 'মৃত্যু' মুসলিম বিশ্বে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সেটাও লক্ষ্য রাখার বিষয়। তবে ওবামা প্রশাসনের দায়িত্ব আজ অনেক বেশি মুসলিম বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের 'ইমেজ' বৃদ্ধি করা। প্রেসিডেন্ট ওবামার 'কায়রো ভাষণ' একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু অগ্রগতি হয়েছে কম। বেশ কিছু মুসলিম দেশে আল-কায়েদার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়েছে। বিশেষ করে আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, সুদান, ও সোমালিয়ায় এদের প্রভাব ও কর্তৃর্ত্ব অনেক বেশি। সোমালিয়ায় ইসলামিক জঙ্গিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে।' আল সাদার্ব নামের সংগঠনটি তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ইসলামিক শরিয়া আইন চালু করেছে। আলজেরিয়াতে জন্ম হয়েছিল অষ-ছঁধবফধ রহ ঃযব ওংষধসরপ গধমযৎবন (অছওগ), ও ঝধষধভরংঃ এৎড়ঁঢ় ভড়ৎ চৎবধপযরহম ধহফ পড়সনধঃ-এরা আত্মঘাতী বোমাবাজি ও বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাক দিয়েছিল। অছওগ পুরো মাগরের অঞ্চলে তৎপর। এখন ওবামা প্রশাসনের দায়িত্ব হচ্ছে এসব জঙ্গিকে মূল ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে উদ্যোগ গ্রহণ করা। দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানের ব্যাপারে জঙ্গিদের সঙ্গে 'সংলাপ' শুরু করাও জরুরি। ওসামা বিন লাদেনের পর এখন মার্কিনিদের টার্গেট মোল্লাহ ওমর। দীর্ঘ ১০ বছরেও মোল্লাহ ওমরের অস্তিত্ব আফগানিস্তানে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মূল ধারার তালেবানদের সঙ্গে যদি 'সংলাপ শুরু করা না যায়, তাহলে আফগান সমস্যার সমধান হবে না। যদিও আল-কায়েদা ও তালেবান আন্দোলন এক নয়। এদের মাঝে মতপার্থক্যও আছে।
আল-কায়েদা যেখানে বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাক দিয়েছিল, সেখানে তালেবানরা শুধু আফগানিস্তানেও ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। ওবামার জন্য আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার জরুরি। প্রেসিডেন্ট ওবামার দায়িত্ব আরো বাড়ল। আরব সাগরে টহলরত যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ কার্ল ভিনসন থেকে লাদেনের মৃতদেহ আরব সাগরে সমাহিত করে সমস্যার সমধান করা যাবে না। মুসলিম বিশ্বে আস্থা অর্জন করতে হলে উদ্যোগী হতে হবে ওবামাকেই। ওসামার মৃত্যুর মধ্যে এ সম্ভাবনার জন্ম দিয়ে গেল মাত্র। লাদেনকে হত্যা করে ওবামা ২০১২ সালে অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার 'বিজয়'কে নিশ্চিত করেছেন_ এটা নিয়ে সন্দেহের কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব, পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্ক, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কেও এখন নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এই জটিলতা আঞ্চলিক উত্তেজনা যেমনি বাড়বে, তেমনি বিশ্ব রাজনীতিতেও উত্তেজনা সৃষ্টি করবে। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায়, তা হবে প্রধান অন্তরায়।
[পূর্বে প্রকাশ @ যায়যায়দিন ১৪.০৫.২০১১]