রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

এই মৃত্যু কি আমাদের কিছু শেখায়

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীরের মৃত্যু কি আমাদের কিছু শেখায়? গত ১৩ আগস্টের ওই দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ পর যখন এই নিবন্ধটি লিখছি, তখন এ প্রশ্নটাই আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে_ওই মৃত্যু আমাদের কিছু শিখিয়েছে কি না? না, কিছুই শেখায়নি। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর দুজনই ভিআইপি, সমাজে তাঁদের একটা অবস্থান ছিল। যে কারণে ওই দুর্ঘটনার খবর পরদিন সব পত্রিকায় শুধু প্রধান সংবাদ শিরোনামই হয়নি, বরং রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী_সবাই শোক প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। ভিআইপি বলেই আলোচিত হয়েছে বেশি করে। সাধারণ একজন মানুষ যদি এভাবে দুর্ঘটনায় মারা যেত, তাকে নিয়ে আদৌ কোনো দিন আলোচনা হতো না। এভাবে তো কত দুর্ঘটনাই ঘটে। তার কয়টি সংবাদপত্রে ছাপা হয়? কয়টি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা আলোচনা করেন? সংবাদপত্রগুলো আমাদের পরিসংখ্যান দিচ্ছে কোন বছর কত লোক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। টিভি টকশোতে বিজ্ঞ ব্যক্তিরা আলোচনা করছেন। নিবন্ধ লিখছেন কেউ কেউ। তারপর? নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রীকে হারিয়ে একটি আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু খুব কি সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছেন তিনি? মনে হয় না তিনি পেরেছেন। আসলে যে কাজটি করার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা সেই কাজটি করছেন না। গত ১৭ আগস্ট মানিকগঞ্জের ওই সড়ক দুর্ঘটনার ঠিক চার দিন পর আমি যখন আরিচা সড়ক ধরে নিত্যদিনের মতো আমার কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগরে যাচ্ছি, দেখলাম ঠিক একই চিত্র। চালকরা ওভারটেক করছে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। অবলীলায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিচ্ছে রং সাইডে, যে পথে যাওয়ার তার আদৌ কথা নয়। হেমায়েতপুর, সাভার বাজার, সেই একই চিত্র। ট্রাফিক পুলিশের কাজটি হচ্ছে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা। তারা তা করছেন না। হেমায়েতপুর বাজারে দেখলাম দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন (তিনি কি ঈদ বখশিশ আদায় করছিলেন!)। সাভার বাজারে সেই পুরনো দৃশ্য_রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠাচ্ছে, আর পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ নির্বিকার। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছেন না। একটু সামনে গেলেই একটা পাক। দেখলাম সেখানে সেই প্রতিযোগিতা_কে কার আগে যাবে! কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ দৃশ্য আমাকে সপ্তাহে একাধিক দিন দেখতে হয়। কেননা এ রুট ধরেই আমি আমার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করি। উপযাচক হয়ে অতীতে একাধিক দিন সাভার এলাকায় দায়িত্ব পালনরত সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি। না, কিছুই হয়নি। কোনো পরিবর্তন হয়নি। যেমনটা ছিল দুদিন আগেও, তেমনটিই রয়ে গেছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই ওভারটেকিং, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানো, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন না করা, ভুল পথে চালকদের গাড়ি চালানো_সব কিছুই আগের মতো। গত ১৭ আগস্ট ঢাকা-আরিচা রোডের এই ছিল দৃশ্য। এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল, যেখানে প্রধানমন্ত্রী, এমনকি রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো, সেখানে এতটুকুও সচেতন হলেন না যাঁদের দায়িত্ব পালন করার কথা, তাঁরা। ওই মৃত্যু তাঁদের এতটুকুও স্পর্শ করেনি। আমরা এ কোন দেশে বসবাস করছি? আর কত নিবন্ধ লিখলে আমরা সচেতন হব? মানিকগঞ্জ ট্র্যাজেডির ঘাতক বাসচালক জামির হোসেন যখন ডিবি অফিসে গণমাধ্যম কর্মীদের জানান তিনি নির্দোষ, তখন সত্যি সত্যিই আমার ভাবতে কষ্ট লাগে, আমরা এ কোন দেশে বসবাস করছি! ঘাতক চালক জামির হোসেনের কথার সঙ্গে আমি মিল খুঁজে পাই মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রীর। আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী তো 'আবিষ্কার' করেছিলেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালকও দায়ী! কী অদ্ভুত এক দেশ! যে ঘাতক পাঁচজনকে হত্যা করল, হত্যা সংঘটিত করে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ না করে পালিয়ে গেল, সে কি না বলছে আমি নির্দোষ! আর বলছে কোথায়? ডিবি অফিসে, পুলিশের সম্মুখে। কী জানি, পুলিশ কি এ কথা বলতে তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল! না হলে জামির এত সাহস পেল কোথায়? আমি জানি না, পুলিশ কোন ধারায় মামলা করবে? কিংবা তদন্ত রিপোর্টে কী দেবে? তবে আমি বুঝি এটা একটা হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হওয়া উচিত। না হলে ঘাতক বাসচালকরা এতটুকু সচেতন হবে না। ১৭ আগস্টও যখন আমি আরিচা রোডে বাসচালকদের বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে দেখি, তখন আমার কাছে এ প্রশ্নটাই মুখ্য। হত্যাকাণ্ডের আইনেই এর বিচার হতে হবে। আমাদের 'বিবেক' আইনজীবীরা দয়া করে জামির হোসেনের পাশে দাঁড়াবেন না। আপনারা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন, যাতে আমরা আপনাদের ওপর আস্থা রাখতে পারি।
আর সাংবাদিক মুন্নী সাহা, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনার আমন্ত্রণে আপনার টকশোতে আমি আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। কালের কণ্ঠে লিবিয়ার ওপর আমার লেখা পড়ে আপনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মিশুক মুনীরের সঙ্গে। আমরা চা পান করতে করতে সেদিন অনেক আলাপ করেছিলাম। পররাষ্ট্রসচিবও ছিলেন আমাদের আলোচনায়। মিশুক মুনীর আমাকে আবারও এটিএনে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার আর মিশুকের সঙ্গে আমার চা পান করা হয়নি। মুন্নী, আমাকে ক্ষমা করবেন_আমরা যারা ছাত্র পড়াই, রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের কোনো ভূমিকা নেই, ঘাতক জামিরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। টিভি পর্দায় আপনার সহকর্মীসহ মুন্নী আপনার কান্নার দৃশ্যও আমি দেখেছি, আমি নিজেও আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আমি শুধু ভেবেছি মিশুক, আপনার জীবনটা এত ছোট কেন হলো? আপনার বাবাও ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তার বিচার হয়নি। আপনিও প্রাণ হারালেন এক ঘাতকের হাতে। হয়তো এই ঘাতকেরও বিচার হবে না! যে ঘাতক অনেকটা হাসিমুখে ডিবি অফিসে 'ফটোসেশন' করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে_এটা আশা করতে পারি না। আমাকে ক্ষমা করবেন মুন্নী। মুন্নী, আপনি অনুসন্ধান করে দেখুন, অর্থমন্ত্রী একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ড্রাইভারদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করে একটি আইন হচ্ছে। এটা ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। আমি তখন একট নিবন্ধও লিখেছিলাম (হাইওয়ে : জীবনের নিরাপত্তা যেখানে অনুপস্থিত, যায়যায়দিন, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)।
তারপর ১৮ মাস পার হয়েছে। ওই আইনটি হয়নি। কেন হয়নি, মুন্নী সাহা, আপনি অনুসন্ধান করুন। আজ মিশুক মুনীরের স্ত্রী যখন রাজনীতিবিদদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন যেন তিনি আমাদের সবার কথাই বলেন। আজ যখন সংবাদপত্রে ছাপা হয় মন্ত্রীর নির্দেশে কয়েক হাজার অদক্ষ চালককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তখন আমাকে এক বড় ধরনের হতাশার মাঝে ফেলে দেয়। আমি আর কারো ওপর আস্থা রাখতে পারি না।

হাইওয়েগুলো একেকটি মৃত্যুকূপ। এই হাইওয়েতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন থাই কূটনীতিক পানি্ন লিবানাজুলসহ বাংলাদেশ সরকারের দুজন সচিব। আহত হয়েছিলেন সংসদ সদস্য আবদুল মান্নানসহ হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু ঘাতকদের কারোরই সুষুম বিচার হয়নি। আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যে ঘাতক পানি্ন লিবানাজুল কিংবা দুজন সাবেক সচিবকে যারা হত্যা করেছিল, তারা এখনো হাইওয়েতে গাড়ি চালায়। হত্যাকাণ্ডের বিচার মাত্র তিন বছরের জেল! এ কোন দেশে আমরা বসবাস করছি। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তারেক ও মিশুকের মৃত্যুতে শোকবাণী পাঠিয়েছেন। কিন্তু এ পর্যন্তই। আমরা আদৌ সচেতন হইনি। আর যাঁদের দায়িত্ব পালন করার কথা, তাঁরা গা-ছাড়াভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ধরনের মৃত্যু আমাদের কিছুই শেখায় না। আমরা কিছুই শিখি না।
ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ আগষ্ট ২০১১, ৮ ভাদ্র ১৪১৮, ২২ রমজান ১৪৩২
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

উচ্চশিক্ষা নিয়ে কিছু কথা ।

ঈদের পর পরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। এটা আরেকটা ‘যুদ্ধ’। এ ‘যুদ্ধে’ কেউ জেতে, কেউবা আবার হেরে যায়। দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও। কিন্তু একটা নীতিমালা থাকা দরকার, আমাদের দেশে কত এবং কোন কোন শাখায় গ্রাজুয়েট দরকার। সেই নীতিমালাটি নেই। যারা উচ্চশিক্ষার সাথে জড়িত, তারা এটা বোঝেন বলেও মনে হয় না। ইউজিসির নাম পরিবর্তন করে উচ্চতর শিক্ষা কমিশন হচ্ছে। কিন্তু তাদেরও কোন ‘ভিশন’ নেই। লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী পাস করছে। তাদের অনেকেরই লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, তা যদি  উর্দু ভাষাতে হয়, তাহলে তাও। উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া। তারপর এক সময় ‘একখানা সার্টিফিকেট’ নিয়ে চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান। এবং প্রায় ক্ষেত্রেই চাকরি না পেয়ে বেকার থাকা! এই সমাজ উর্দু বা সংস্কৃতি পাস ক’জন ছাত্রকে চাকরি দেবে? যারা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছেন, তারাও বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন বলে মনে হয় না।
এবার দশটি বোর্ডের মোট পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। পাসের হার এবার ৭৫ দশমিক শূন্য আট। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৯ হাজার ৭৬৯ জন ছাত্র-ছাত্রী, যা গত বছরের চেয়ে ১০ হাজার ৭৬৫ জন বেশি। আর সব মিলিয়ে বিভিন্ন গ্রেডে পাস করেছে ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৬১ জন। এরা কোথায় যাবে? কোথায় পড়বে? এদের একটা বড় অংশের ঠাঁই হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটা আস্থার জায়গা এখনও আমাদের জন্য তৈরী করতে পারেনি। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো শুধুমাত্র সার্টিফিকেট বাণিজ্য করে। মাননীয় রাষ্ট্রপতি, এমনকি শিক্ষামন্ত্রীও শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে কথা বলছেন। মাননীয় রাষ্ট্রপতি শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে যখন বলেন, তখন আমরা আমজনতা তার বক্তব্য শুনে উত্ফুল্লিত হচ্ছি। কিন্তু তিনি কী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বাণিজ্য বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন? কেন এখনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ গঠন করা হল না, যারা শিক্ষার মান নির্ধারণ করবে? নামসর্বস্ব একটি সার্টিফিকেট, শিক্ষার মানোন্নয়নের কোন পরিচয় হতে পারে না। আমরা আশংকা করছি এইচএসসি পাস করা অনেক তরুণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আদৌ কোন সুযোগ না পেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। এবং একসময় নামসর্বস্ব একখানা সার্টিফিকেটের অধিকারী সে হবে! ওই সার্টিফিকেট দেখিয়ে সে চাকরি পাবে, এই নিশ্চয়তা সমাজ তাকে দেবে না।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও ভালো ভালো শিক্ষক রয়েছেন। অনেকেই শুধুমাত্র ‘টাকার জন্য’ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করেন। তরুণ শিক্ষার্থীরা যাতে করে নামসর্বস্ব সার্টিফিকেটের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে ঝুঁকে না পড়ে, সে জন্য নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলো নেয়া যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘দ্বিতীয় শিফট’ চালু করা যায়। এ ক্ষেত্রে ‘দ্বিতীয় শিফট’-এ যারা পড়বে, তারা অতিরিক্ত ভর্তি ফি দিয়ে পড়বে। বিভাগের শিক্ষকদের এ জন্য অতিরিক্ত সম্মানীর ব্যবস্থা করতে হবে। ফলে একদিকে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে নিরুত্সাহিত হবেন, অন্যদিকে ব্যাপক সংখক ছাত্র-ছাত্রীকে আমরা ‘দ্বিতীয়  শিফট’-এর ব্যাপারে আকৃষ্ট করতে পারবো। ‘দ্বিতীয়  শিফট’-এর জন্য ইউজিসি একটি নীতিমালা তৈরী করবে এবং প্রতিটি পাবলিক  বিশ্ববিদ্যালয় তা অনুসরণ করবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘দ্বিতীয় ক্যাম্পাস’ চালু করা সম্ভব। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কিংবা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্বিতীয় ক্যাম্পাস’ বিভাগের অন্যত্র চালু করা সম্ভব। একজন প্রো-ভিসির পরিচালনায় তা চালু হতে পারে। মূল ক্যাম্পাসের শিক্ষকরাই সেখানে নিয়মিতভাবে ক্লাস নিতে পারেন। প্রয়োজনে কিছু তরুণ শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ভেঙ্গে ৭টি বিভাগীয় শহরে ৭টি পুরনো কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চালু করা যেতে পারে। কোন কোন কলেজে ভালো শিক্ষক আছেন। এদের নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো সম্ভব। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে রয়েছে, তা শুধু সার্টিফিকেট সর্বস্ব একটি তরুণ প্রজন্মের জন্ম দিচ্ছে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপে নতুন ক্যাম্পাস, ‘দ্বিতীয় শিফট’ চালুর বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের মেধা আছে। এরা প্রতিভাবান। উচ্চশিক্ষা এদের অধিকার। এদের মেধাকে ব্যবহার করার স্বার্থেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ  নিতে হবে। আমরা চাই না যে জিপিএ-৫ পেয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছিল, তার ওই স্বপ্ন ভেঙ্গে যাক। উচ্চশিক্ষা তাদের অধিকার। আমাদের সংবিধান এই অধিকার তাদেরকে দিয়েছে। এই অধিকার থেকে আমরা তাদেরকে বঞ্চিত করতে পারি না। তাদের সবার আগ্রহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তথা মেডিকেল কলেজগুলোর দিকে। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে এর সংখ্যা প্রায় ৩৫টি। মেডিকেল কলেজের সংখ্যাও বেড়েছে। শোনা যাচ্ছে সরকার আরো ৩টি মেডিকেল কলেজ চালু করবে। এখন যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এতে করে শিক্ষার মানোন্নয়ন হয়েছে কতটুকু? নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। কিন্তু পড়াচ্ছেন কারা? আমি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছি, যেখানে কোন ‘অধ্যাপক’ নেই। এমনকি সহযোগী অধ্যাপকও ছিল না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোন কোন বিভাগে যদি আদৌ অধ্যাপক না থাকেন, যদি সহযোগী অধ্যাপকও না থাকেন, তাহলে ওই বিভাগের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তো থাকবেই। অভিযোগ আছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক-এর পদ বিজ্ঞাপিত হলেও, যোগ্য আবেদনকারী খুঁজে পাওয়া যায় না। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটি হয়েছে। সেখানকার রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে কোন অধ্যাপক নেই। দু’দিন আগে পর্যন্ত সেখানে সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত ছিল না (এখন অবিশ্যি পদোন্নতির মাধ্যমে দু’জন সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন)। নতুন লোক প্রশাসন বিভাগ চালু করা হয়েছে। সেখানে অতিসম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে একজন সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন। অধ্যাপক নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি আমার বিভাগের কথা বলতে পারি। আমার বিভাগে ৯ জন প্রভাষক কর্মরত। ৯ জন প্রভাষককে দিয়ে বিভাগের শিক্ষার মান কীভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব, আমি জানি না। উপাচার্য মহোদয় কী বিষয়টি বোঝেন? আমার দুঃখবোধটা এখানেই। এ জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে মঞ্জুরী কমিশনকে তখন নতুন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে-যেখানে সিনিয়র শিক্ষকরা কোন এক্সচেঞ্জ প্রোগ ামের আওতায় নির্দিষ্ট কিছু সময় নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পাঠদান করবেন। এতে করে তাদের সিনিয়রিটি ক্ষুণ্ন হবে না, বরং তারা বাড়তি কিছু সুযোগ-সুবিধা পাবেন। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে (ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর) কোন কোন বিভাগে প্রচুর ‘অধ্যাপক’ রয়েছেন। তাদের কাউকে কাউকে ‘ট্রান্সফার’ করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে সাধারণত কোন শিক্ষককে ‘ট্রান্সফার’ করা যায় না। কিন্তু আইন যদি করা যায় এবং যদি কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা যায়, আমার বিশ্বাস অনেকে উত্সাহিত হবেন (আমি নিজে রাজী আছি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করাতে)। এই আইনটি করা জরুরি। নচেত্ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হবে। ইতোমধ্যে বৈষম্য যে তৈরি হয়নি, তা বলা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট আর পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট-বৈষম্য তো রয়েছেই। এই বৈষম্য রোধ করার উদ্যোগ নিতে হবে মঞ্জুরী কমিশনকেই। একই সাথে শিক্ষক প্রশিক্ষণটাও জরুরি। তরুণ শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণটা খুবই জরুরি। একটি কাঠামোর আওতায় এই কাজটি করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। সেই সাথে তরুণ শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানোটাও দরকার। বিশ্ব ব্যাংকের সাথে বিষয়টি নিয়ে মঞ্জুরী কমিশন কথাবার্তা বলতে পারে। মেডিকেল শিক্ষা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করাটাও জরুরি। শুধুমাত্র মেডিকেল কলেজ চালু করলেই শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাবে না। মেডিকেল শিক্ষায় অধ্যাপকরা ঢাকার বাইরে যেতে চান না। রাজনৈতিক বিবেচনায় আবার কারো কারো মেধা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। এখানেও আইনের প্রয়োগটা শক্তিশালী হওয়া উচিত।
দিনে দিনে এইচএসসি পাস করা মেধাবি ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। ওদের অনেক স্বপ্ন। অনেক আকাঙ্ক্ষা। এই স্বপ্নগুলোর যেন মৃত্যু না হয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক সদস্য।
tsrahmanbd@yahoo.com

নাম পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নামের পরিবর্তন করে রাখা হচ্ছে বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন বা হেক। ইউজিসি থেকে হেক, পরিবর্তনটা কি শুধু নামের? নাকি কাজেরও? ১৯৭৩ সালে মঞ্জুরি কমিশন গঠিত হয়েছিল। যে আইনবলে ইউজিসি গঠিত হয়েছিল, ২০১১ সালে এসে ওই আইন অচল। সুতরাং পরিবর্তনটা প্রয়োজন ছিল। এটা যুগের চাহিদা। সুতরাং নাম পরিবর্তন ও আইন পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল, এটা সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু যেভাবে প্রস্তাবিত 'বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন-২০১১' আইনটি সংসদে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে আমার আপত্তি রয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পূর্ণকালীন সদস্য ৫ জনই রেখে দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে আরও ১১ জন খণ্ডকালীন সদস্য নেওয়া হচ্ছে, যাদের মধ্যে থাকবেন ২ জন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি। বর্তমান কাঠামোয়ও খণ্ডকালীন সদস্যরা রয়েছেন। আমার অভিজ্ঞতা বলে ইউজিসি পরিচালনায় তারা কোনো ভূমিকা রাখেন না। ফলে উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও খণ্ডকালীন সদস্যরা আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না।
সংবাদপত্রে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার মানোন্নয়ন। তার এই বক্তব্যে আমি উৎফুল্ল হয়েছি। কিন্তু আমি কি বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করতে পারি গত ৪৩ মাসে আপনার মন্ত্রণালয় উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে? ঢালাওভাবে ও দলীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ যদি শিক্ষার মানোন্নয়নের মাপকাঠি হয়, আমার বলার কিছু নেই।
বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন-২০১১-র খসড়ায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি বলে আমি মনে করছি। প্রথমত, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিশ্চিত করার স্বার্থে একটি আলাদা কমিশন গঠন করা উচিত বলে আমি মনে করি। এ ক্ষেত্রে একটি কমিশনের আওতায় যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাখা হয়, তাহলে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি আলাদা ডিভিশন হিসেবে এটাকে রাখতে হবে। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা কমিশনে দুটো ডিভিশন থাকবে_ একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, অপরটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। মনে রাখতে হবে, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ধরন এক নয়। ব্যবস্থাপনাও এক নয়। সংগত কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যত না নজরজারিতে থাকবে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নজরজারিতে থাকবে বেশি। দ্বিতীয়ত, মাত্র ৫ জন পূর্ণকালীন সদস্য দিয়ে প্রায় একশ'টি (পাবলিক ও প্রাইভেট) বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এ জন্য সদস্য সংখ্যা নূ্যনতম দশজন করা উচিত। নূ্যনতম ৫ জন সদস্যকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া উচিত। একজনের পক্ষে ৫৬টি (আরও নূ্যনতম ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের অপেক্ষায়) বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করা সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দেশভালের জন্য একটি 'সহযোগী পরামর্শক' সংস্থা থাকতে পারে, যারা কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তারা পরামর্শ দেবে। এ সংস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে। এমনকি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। উচ্চশিক্ষা কমিশনের নীতিনির্ধারণী কাঠামোয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো প্রতিনিধি থাকতে পারবে না। চতুর্থত, বাংলাদেশে পরিচালিত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এটি ভালো ও প্রশংসাযোগ্য। পঞ্চমত, প্রস্তাবিত আইনে শিক্ষার মান ও রেটিং নিশ্চিত করার স্বার্থে একটি 'এক্রিডিটেশন কাউন্সিল' গঠন করার বিধান রাখা হয়েছে কি-না আমি নিশ্চিত নই। এটা অবশ্যই থাকা উচিত। শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও 'এক্রিডিটেশন কাউন্সিল' থাকা উচিত। কেননা ইতিমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেই এক ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। বৈষম্য কমিয়ে আনার স্বার্থেই 'এক্রিডিটেশন কাউন্সিল' থাকা উচিত।
মূল কাঠামোতে এসব বিষয় থাকা উচিত। এর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য রেগুলেশন ও স্ট্যাটিউট থাকা উচিত। বিশেষ করে স্ট্যাডিউটে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালগুলোর শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত বিধিবিধানে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। এখন এই ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে। উপাচার্যের মর্জির কাছে অনেক ভালো ছাত্রও শিক্ষক হতে পারে না। এ কারণেই পিএসসির মতো একটি কাঠামো দাঁড় করানো যায় কি-না তা ভেবে দেখা যেতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করবে উচ্চশিক্ষা কমিশন। একই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের কোনো নীতিমালা নেই। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, 'অধ্যাপক' তথা 'ডক্টরেট' ডিগ্রি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। যিনি কোনোদিন শিক্ষকতা করেননি, তিনি দিব্যি ক্ষমতার বলে অধ্যাপক পদবি ব্যবহার করছেন। শিক্ষকতা না করেও কেউ কেউ উপাচার্য হচ্ছেন। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এসব দেখেও না দেখার ভান করছে। সরকারি চাকুরে, কলেজ থেকে অবসর নিয়ে অনেক 'শিক্ষক' এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি হলেও তারা আদৌ শিক্ষকতা করার ক্ষমতা রাখেন কি-না, তা দেখার কেউ নেই। আরও একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে_ পিতার বা স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজ সন্তান অথবা স্ত্রীকে উপাচার্য বানানোর পাঁয়তারা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিবারের সন্তানদের চাকরির ক্ষেত্র হতে পারে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখভাল করা জরুরি। তদারকিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাবিত কাঠামোয় এর বিধান থাকা উচিত। মঞ্জুরি কমিশনের সচিবালয়কে শক্তিশালী করাও প্রয়োজন। একজন সচিবের নেতৃত্বে বিশাল এই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করাও অসম্ভব। প্রস্তাবিত আইনে এ ব্যাপারে বিশেষ দিকনির্দেশনা থাকা উচিত।
শুধু নাম পরিবর্তন করেই শিক্ষার মানোন্নয়ন করা যাবে না। চাই আন্তরিকতা। চাই বলিষ্ঠ উদ্যোগ। শুধু লোক দেখানো একটি উদ্যোগ যদি নেওয়া হয়, তাতে চেয়ারম্যানের মর্যাদা হয়তো বাড়বে (প্রতিমন্ত্রী বা পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা), কিন্তু শিক্ষার মানের তাতে উন্নতি হবে না।

প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান 
সাবেক সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন
tsrahman09@gmail.com

অবনতিশীল শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক

লেখাটা শুরু করি আমার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক রওনাক জাহানকে নিয়ে। স্বাধীনতার পর আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়তে এলাম, তখন রওনাক জাহান ছিলেন বিভাগের চেয়ারম্যান। ভীষণ গুরুগম্ভির, তার রুমে যেতে ভয় করত। ছাত্রজীবনে তার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম, তাও নয়। তাও অনেক ছাত্র, সবাইকে মনে রাখাও কঠিন। তবে আমার কথাটা তাও মনে ছিল, কারণ আমি জার্মানি থেকে পিএইচডি করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই যোগ দিয়েছিলাম। সম্ভবত সে কারণেই মনে রাখা। কিন্তু দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না, এমনকি এখনও নেই। আশির দশকের মাঝামাঝি আমার পিএইচডি প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে আমি যখন জেনেভায় গিয়েছিলাম, অধ্যাপক রওনাক জাহান তখন আইএলওতে। আমি যোগাযোগ করলাম। তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। আইএলও’র ক্যান্টিনে নিজে লাইনে দাঁড়িয়ে আমার জন্য খাবার কিনলেন। আমরা খেলাম।
দ্বিতীয় ঘটনার কথা বলি। রওনাক ম্যাডাম তখন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি তখন নিউইয়র্কে। ফোন করলাম। সেই একই কণ্ঠ, আসতে বললেন। কলাম্বিয়ার স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল ও পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিল্ডিংয়ের খুব সম্ভবত এগার তলায় তার সঙ্গে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম, তখন নিজ হাতে কফি বানিয়ে তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। একজন শিক্ষকের তার একজন ছাত্রের প্রতি কতটুকু ভালোবাসা থাকে, কতটুকু আন্তরিক তিনি, অধ্যাপক রওনাক জাহান তার বড় উদাহরণ।
আরেকটি দৃষ্টান্ত দিই। তিনি আমার শিক্ষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, এখন ইসলামাবাদ ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন। আমি ইসলামাবাদ গেছি। স্যারের ফোন জোগাড় করে একটি ক্যাব নিয়ে রাতে তার বাসায় গেলাম। মনে আছে রাত প্রায় এগারটার দিকে তিনি অনেক দূর হেঁটে এসে মেইন রাস্তায় আমাকে একটা ট্যাক্সি ক্যাবে তুলে দিয়েছিলেন। একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে কতটুকু ভালোবাসতে পারেন, নজরুল ইসলাম স্যার ছিলেন তার একটি প্রমাণ।
অন্য আরেকটি দৃষ্টান্ত দিই। অধ্যাপক আসাদুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে প্রয়াত। ২০০৬ সালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্যপদে নিয়োগ পেলাম, যেদিন আগারওগাঁও অফিসে যোগ দিতে গেলাম, সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তার চোখে সেদিন আমি অশ্র“ দেখেছিলাম। ধানমণ্ডির ৩ নম্বর রোডে তার সরকারি কোয়ার্টারের পাশেই ছিল আমার সরকারি এপার্টমেন্ট। কতদিন যে ফোন করে তার বাসায় ডেকে নরসিংদীর মিষ্টি খাইয়েছেন, আমি বলতে পারব না। আমাকে অনেক øেহ করতেন। আমার অবর্তমানে অন্যদের কাছে প্রশংসাও করতেন। একজন শিক্ষক কত আন্তরিক হলে ছাত্রের প্রশংসা করেন, অধ্যাপক আসাদুজ্জামান এর বড় প্রমাণ।
বাংলাদেশ বলি কেন? জার্মানিতে আমার পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক ডিটমার রথারমুন্ড। বিখ্যাত হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের অধ্যাপক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশে আমরা অনেকে অধ্যাপক রথারমুন্ডের ছাত্র ছিলাম। আমাদের এক সহকর্মী যখন তার ছোট্ট বাচ্চাকে রেখে সমস্যায় পড়েছিলেন, তখন পিতার মতো তার ছাত্রের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার গবেষণার কাজটি দ্রুত দেখে দিয়েছিলেন। আমি নিজে কীভাবে তার কাছে উপকৃত হয়েছি, তা আজ নাইবা বললাম। আমার প্রথম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন এগবার্ট ইয়ান (জার্মানিতে দু’জন তত্ত্বাবধায়কের প্রয়োজন হয়)। আমরা প্রায় প্রতি রোববার তার বাসায় ঘরোয়া আলোচনায় মিলিত হতাম। তার উদ্যোগেই তিনি আমাকে রাশিয়ার মস্কো ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে পাঠিয়েছিলেন। সেটা প্রয়োজন ছিল আমার গবেষণার জন্যই। মিসেস ইয়ান, যিনি ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা, আমাদের জন্য রান্না করতেন। প্রতি রোববার। দৃষ্টান্তগুলো দিলাম এটা বোঝানোর জন্য যে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন হয়, কেমন হওয়া উচিত। কিন্তু আজ যারা শিক্ষকতায় আসছেন, তাদের মধ্যে এ উপলব্ধিটুকু কি আছে? আজ আমার ছাত্র, যারা শিক্ষক হয়েছেন, তাদের মধ্যে সেই সৌজন্যবোধটুকু নেই। এতটা বছর শিক্ষকতা করলাম, দুই যুগেরও বেশি, আমার প্রাপ্য হচ্ছে আমার ছাত্রদের কাছ থেকে অসম্মান পাওয়া? আমার একাডেমিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া? এটা আমার বড় ব্যর্থতা। একজন ব্যর্থ শিক্ষক আমি। আমি একজন রওনাক জাহান হতে পারলাম না! একজন আসাদুজ্জামান আমি হতে চাইনি। অনেক বড় মাপের মানুষ তিনি। আমি তার ছাত্র। আমার সৌভাগ্য আমার শিক্ষকের সঙ্গেই আমি মঞ্জুরি কমিশনে কাজ করেছি। তার মতো শিক্ষক আমি নই। কিন্তু আমি আমার ছাত্রদের নিয়েও এরকমটি আশা করেছিলাম। কী জানি, হয়তো ওদের সৌজন্যবোধটুকু যে কী, তা বোঝাতে পারিনি। শেখাতে পারিনি। আমি ক্লাসে বলি, আমার ছাত্ররাই আমার সন্তান, আমার প্রাণ। ওরা আমার চেয়েও আরও বড় পণ্ডিত হোক। কিন্তু এ কোন জগতে বাস করছি? যেখানে পিতৃতুল্য শিক্ষককে নিয়ে কটাক্ষ করা, অসম্মান করা তাদের রুচিতে বাধে না! কারা আগামী দিনের শিক্ষাঙ্গন নিয়ন্ত্রণ করবে? শিক্ষাঙ্গনে যিনি বা যারা ক্যাডার হিসেবে পরিচিত, কিংবা যারা রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান, আমরা তাদের কাছ থেকে কীইবা আশা করতে পারি!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫-এ নির্ধারণ করেছেন। এই ৬৫ হতে আমার এখনও অনেক সময় বাকি। কিন্তু তার আগেই আমি অবসরে যাব। শিক্ষকতার প্রতি আমার আর মোহ নেই। ভালোবাসাও নেই। যে ২৬টি বই লিখেছি, আমার মনে হয় ওখানে আমার ভুল হয়েছে। আমার এই লেখার কোন প্রয়োজন ছিল না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্যাবাটিকাল ছুটি নিয়ে যে গবেষণা করেছি, তা বই আকারে প্রকাশও করেছি (অন্যরা করেছে কিনা তা আমার জানা নেই)। আমার অনেক সিনিয়র সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছিÑ তাদের সবার মাঝেই দেখেছি এক ধরনের হতাশা। কেন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে? কেন? এই ‘কেন’র জবাব কে দেবে? শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আহমদ আমাদের ভিসি ছিলেন খুব সীমিত সময়ের জন্য। তার কাছেই আমি প্রশ্নটি রাখলাম। জাহাঙ্গীরনগরের ভিসি, যিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি, তার কাছেও প্রশ্নটা থাকল। এই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক জড়িত। নৃ-বিজ্ঞান বিভাগে একজন সিনিয়র শিক্ষক কর্তৃক একজন জুনিয়র শিক্ষক (যে তার ছাত্র) প্রহƒত হয়েছিলেন। একজন সিনিয়র শিক্ষক কোন পর্যায়ে গেলে তার অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়, তা ভেবে দেখা দরকার। তবুও তিনি যে ‘কাণ্ডটি’ ঘটিয়েছেন তা সমর্থনযোগ্য নয়। তারপরও বলি, নতুন প্রজšে§র অনেক কিছু শেখার আছে সিনিয়রদের কাছ থেকে। তারা পিতৃতুল্য। পিতাকে অসম্মান করলে নিজেও অসম্মানিত হতে হয়। দ্বিতীয় ঘটনায় একজন তরুণ শিক্ষক অভিযুক্ত হয়েছেন একজন ছাত্রীর আÍহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে। অত্যন্ত মেধাবীসম্পন্ন ওই ছাত্রীর সঙ্গে সেই তরুণ শিক্ষকের ‘সম্পর্ক’ ছিল। ‘সম্পর্ক’ ভেঙে গেলেই ছাত্রীটি আÍহত্যা করে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ‘দোষী’ করা যাবে না, কিন্তু ওই ঘটনায় শিক্ষক-ছাত্রী সম্পর্ক কী হওয়া উচিত, সেই বিষয়টি সামনে চলে এলো। এটি খুব স্পর্শকাতর একটি বিষয়। ছাত্রী সুমির বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগের দাবি করেছে। এটা যুক্তিযুক্ত। সুমির মৃত্যু আমাকে কষ্ট দিয়েছে। যে কিনা আমার মতো একজন শিক্ষক হতে পারত, কেন আÍহননে গেল? একজন মেধাবী এভাবে চলে যাবে, এটা তো কষ্টেরই। একজনের ‘অতীত’ থাকতেই পারে। সেই ‘অতীত’ দিয়ে কারও ‘বর্তমানকে’ বিচার করা ঠিক নয়। এরকম ‘ঘটনা’ কর্তৃপক্ষের জন্যও একটি সতর্কবাণী। বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখা ঠিক হবে না।
ক’দিন আগে ৮ আগস্ট বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মৌন মিছিলকে উদ্দেশ্য করে কটূক্তি করে ছাত্রলীগের চার কর্মী। তাদের পুলিশে দেয়া হলে ছাত্রলীগের কর্মীরা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। শিক্ষক সমিতির ডাকে শিক্ষকরা ক্লাস বর্জন করেন। এই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তদন্ত কমিটি কোন রিপোর্ট দেয়নি। ছাত্ররা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালাবে, এটা চিন্তাও করা যায় না। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা তাহলে কাদের পড়াচ্ছেন? ছাত্র মানেই তো সন্তান। এই ‘সন্তান’ এখন ‘পিতার’ গায়ে হাত তুলল?
সবকিছু মিলিয়েই শিক্ষাঙ্গনে এখন অস্থিরতা বিরাজ করছে। জুনিয়র শিক্ষকরা সম্মান করছে না সিনিয়রদের। সিনিয়ররা এক ধরনের হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এর কারণ একটাই রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, যাদের কাছে ‘রাজনৈতিক আনুগত্যটাই’ বেশি, শিক্ষকসুলভ আচরণ তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। যে কারণে সিনিয়রদের ‘সম্মান’ করার যে সংস্কৃতি, এই সংস্কৃতি তারা ধারণ করছেন না। একজন জুনিয়র শিক্ষক সরাসরি ভিসির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। ভিসি তাদের ‘নানা কাজে’ ব্যবহার করেন। তাদের কাছে একাডেমির বিষয়গুলো মুখ্য নয়। মুখ্য ‘রাজনৈতিক আনুগত্য’। আমি জানি না একুশ শতকে কোন ধরনের শিক্ষাঙ্গন আমরা পাব। তবে উচ্চশিক্ষা এক ধরনের ঝুঁকির মাঝেই আছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় যতদিন শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ হবে না, ততদিন জুনিয়র শিক্ষকরা ‘রাজনৈতিক কর্মীর’ মতোই আচরণ করবেন, তারা অসম্মানিত করবেন সিনিয়র শিক্ষকদের। আজকে যারা বিশ্ববিদ্যালয় চালান, তারা যদি বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেন, তাহলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
দৈনিক যুগান্তর, ২৩ শে আগস্ট ২০১১ ইং
ড. তারেক শামসুর রেহমান
 অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

পাহাড়ে অসন্তোষ কার স্বার্থে

গত ২৯ জুলাই জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে (ইকোসক) বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করায় বাংলাদেশে নতুন করে আবার বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে 'আদিবাসী' বলে কিছু নেই। তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতীয়কে নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ৪ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে বলে অভিমত পোষণ করেছেন। তিনি এ কথা জানাতেও ভোলেননি যে, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। ইতিমধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ক্ষুদ্র নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস নিয়ে বই প্রকাশ করবে। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে তথাকথিত আদিবাসী স্বীকৃতির নামে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থির করে তুলছে একটি আন্তর্জাতিক চক্র। মানবসেবার নামে দেশও জাতির বিরুদ্ধে গভীর এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তারা। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে ৭ আগস্ট (সকালের খবর)। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে পশ্চিমা কূটনৈতিকদের আনাগোনা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। এনজিওগুলোর প্রলোভনে পড়ে ধর্মান্তরিত লোকের সংখ্যাও বাড়ছে অধিক হারে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে হিন্দু মুসলমান ও বৌদ্ধদের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়ে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারির সংখ্যা বেশি। প্রতিবেদনে গোয়েন্দা সংস্থা তথা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে এসব তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। যে কোনো বিবেচনায় অভিযোগটি গুরুতর।
আমরা বারবার বলে আসছি পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একটি চক্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। পাহাড়িদের একটা অংশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের বিভ্রান্তির ও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করছে। এমনকি পাহাড়িরা কোথাও কোথাও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত রয়েছে। চাঁদাবাজি এখন সেখানে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পাহাড়িদের নেতা হিসেবে দাবিদার সন্তু লারমা তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। সরকারের আন্তরিকতাকে তিনি সমালোচনা করেছেন একাধিকবার। বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি তার অনেক পুরনো। এমনকি এক পর্যায়ে দাতা সংস্থা বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সন্তু বাবুর এই বক্তব্যকে পরোক্ষভাবে সমর্থনও করে। সন্তু বাবুর এ ধরনের বক্তব্য তাকে শুধু বিতর্কিতই করেনি, বরং তার উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত, সন্তু লারমা এ ধরনের বক্তব্য রাখার কোনো অধিকার রাখেন কি-না? কেননা তিনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাকে ভোট দিয় নির্বাচিত করেনি। তিনি চাকমাদেরও এককভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন না। ইউপিডিএফও পাহাড়ি তথা চাকমাদের প্রতিনিধিত্ব করে। দ্বিতীয়ত, চাকমাদের মতো বাঙালিরাও সেখানকার 'সেটলার'। বিরান পাহাড়ি ভূমিতে প্রথমে চাকমা তথা অন্য পাহাড়িরা বসবাস করতে শুরু করে। প্রায় একই সময় বাঙালিরাও সেখানে বসবাস করতে শুরু করে। তবে নিঃসন্দেহে তারা সংখ্যায় কম ছিল। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা কিংবা লুসাই জনগোষ্ঠী 'আদিবাসী' নয়। বাংলাদেশের আদি জনগোষ্ঠী হচ্ছে সাঁওতাল ও খাসিয়ারা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্তি্বক বিভাগের এক গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি উপজাতির মাত্র ৬ লাখ মানুষ 'আদিবাসী' দাবি করে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিতে পারে না।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। তাতেও মন গলেনি সন্তু বাবুর। এরপরও তিনি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করেছে। তাদের কর্মযোগ্যতা, শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। অথচ সেই সেনাবাহিনীকে বারবার বিতর্কিত করছেন সন্তু বাবু। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জন্ম হয়েছে। স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব রক্ষায় তারা নিজেদের উৎসর্গ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি প্রতিকূল পরিবেশে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে। কিছু কিছু এলাকা থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করার ফলে। ওইসব অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। গত ২১ মের বরকলের ঘটনা এর বড় প্রমাণ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বরকলের হত্যাকা- প্রমাণ করে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র আছে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে তারা অস্ত্র সংগ্রহ করছে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সময় অভিযোগ করা হয়েছিল জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র ক্যাডাররা সব অস্ত্র জমা দেয়নি। এখন মনে হচ্ছে ওই অভিযোগের পেছনে সত্যতা ছিল। শান্তিচুক্তি নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এর একটা ভালো দিক হচ্ছে ভারতে আশ্রিত চাকমারা তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে এসেছেন। সরকার তাদের এককালীন টাকা দিয়ে পুনর্বাসনও করেছে; কিন্তু আমরা কখনো চাইবো না পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ব তিমুর কিংবা দক্ষিণ সুদানের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক। পূর্ব তিমুর ছিল একসময় ইন্দোনেশিয়ার একটি অংশ, একটি প্রদেশ; কিন্তু খ্রিস্টান অধ্যুষিত পূর্ব তিমুরকে পশ্চিমা বিশ্ব স্বাধীন করেছিল তাদের স্বার্থে। পূর্ব তিমুর স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯৯ সালে। আর দক্ষিণ সুদান, যেখানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেশি, সেখানে অতিসম্প্রতি গণভোটের মাধ্যমে দেশটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আগে দক্ষিণ সুদান ছিল সুদানের একটি অংশ। পূর্ব তিমুরের মতো দক্ষিণ সুদানে তেল পাওয়া গেছে। পশ্চিমাদের স্বার্থ এখানে অনেক। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমাদের শঙ্কাটা তাই অনেক বেশি। আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সপ্তম সভায়ও এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে (আমার দেশ, ১০ এপ্রিল, ২০১১)। সেখানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ঘন ঘন সফর, ইউএনডিপির কর্মকা-, ইত্যাদি এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যারা দেশ, জাতি, স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব নিয়ে ভাবেন তাদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এক ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। পার্বত্য সাধারণ উপজাতীয়রা গভীর জঙ্গলে বসবাস করে। তারা ছোটখাটো দোকান, কিংবা জুম চাষ করে, কৃষি পণ্য বিক্রি করে অতি কষ্টে দিনযাপন করে। মিশনারিরা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে এদের ধর্মান্তরিত করছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কী হারে উপজাতীয়রা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে, তা একটা পরিসংখ্যান নিয়েই জানা যাবে। উপজাতীয়দের দরিদ্রতা পুঁজি করে খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে। শুধু তাই নয়। ইউএনডিপির বিভিন্ন প্রজেক্টে পাহাড়ি ধর্মান্তরিত লোকদের চাকরি দেয়া হচ্ছে। অথচ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাঙালিরা সেখানে চাকরি পাচ্ছে না। বাঙালিদের সঙ্গে সেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে। পাহাড়ি অঞ্চলে একজন উপজাতীয় ড্রাইভার যে বেতন পান, অনেক বাঙালি কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও সেই বেতন পান না। পাহাড়ে স্পষ্টতই একটি বিভাজন তৈরি করা হয়েছে, যা সংবিধানের ১৯নং (সুযোগের সমতা), ২৭ নং (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), ২৮ নং (ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য) অনুচ্ছেদের পরিপন্থি; কিন্তু দুঃখ লাগে তথাকথিত সুশীল সমাজ কোনোদিনও এ প্রশ্নে মুখ খোলেননি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতীয়দের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে তারা মানববন্ধন করলেও, ওখানে বসবাসকারী বাঙালিরা যে ষড়যন্ত্র ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, সে ব্যাপারে একবারও তারা কথা বলেননি। বিদেশিরা পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানকে মূল রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন করেছিল। স্থানীয় লোকদের ব্যাপক ধর্মান্তরিত করে তারা তাদের উদ্দেশ্য সাধন করেছিল। আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়েও ওই একই ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এ ব্যাপারে সোচ্চার ও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
গত ২১ মের বরকলের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল সন্ত্রাসী কর্মকা- পাহাড়ে স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করছে। পাহাড়ে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনীর কর্মকা- সেখানে বাড়ানো উচিত। প্রয়োজনে প্রত্যাহারকৃত ক্যাম্পগুলোতে পুনরায় সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা দরকার। ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ করাও ঠিক হবে না। কেননা সংবিধানের ৩৮নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংগঠনটি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের পরিচালনা করার অধিকার রাখে। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হওয়াও জরুরি। নির্বাচন না হওয়ায় সন্ত্রাসীরা সুযোগ পাচ্ছে। আরো একটা কথা। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। কোনো ধরনের নির্বাচন কিংবা দায়বদ্ধতা ছাড়াই সন্তু লারমা ১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এটা অবৈধ ও অশোভন। একটানা দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর এ দেশের রাষ্ট্রপতিও ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। সন্তু বাবু থাকছেন কোন আইন বলে? আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঘটনায় উদ্বিগ্ন। সরকার দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে, এটাই প্রত্যাশা করি।
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
tsrahmanbd@yahoo.com

টিপাইমুখ নিয়ে আলোচনা হওয়াটা জরুরি

আগামী ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ফিরতি সফর। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়েছিলেন ২০১০ সালের জানুয়ারিতে। তখন বেশ কয়েকটি চুক্তি তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন। এখন ফিরতি সফরে আসছেন মনমোহন সিং। এর আগে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন বেশ কয়েকজন ভারতীয় মন্ত্রী। বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃষ্ণা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরমের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। এমনকি কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বাংলাদেশ সফরও দুদেশের সম্পর্ককে একটি নতুন উচ্চতায় পেঁৗছে দিয়েছিল। যদিও সোনিয়া গান্ধীর সফর কোনো রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। কেননা তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত নেই। তারপরও তিনিই পর্দার অন্তরালে ভারত সরকারের মূল ব্যক্তি। মনমোহন সিং সরকার পরিচালনা করলেও, সোনিয়া গান্ধীর পরামর্শ তিনি নেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনমোহন সিংয়ের এই সফর বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। কেননা বেশ কিছু দ্বিপক্ষীয় সমস্যা রয়েছে, যার সমাধান বাঞ্ছনীয়। শোনা যাচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিস্তার পানি বণ্টন যেমনি গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা। যদিও ভারতীয় পক্ষ বারবার বলে আসছে ভারত টিপাইমুখে এমনকিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ লঙ্ঘিত হয়। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের আশ্বাসের বাণী সত্ত্বেও পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত এই প্রকল্প নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। গত ১২ জুলাই বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় ভারতে নর্থ ইস্টার্ন ইলকট্রিক পাওয়ার করপোরেশনের চেয়ারম্যান প্রেমচান্দ পংকজের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে, সেখানে তিনি বলেছেন টিপাইমুখে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবেই (আমার দেশ)। বলা ভালো, ভারতের মনিপুর রাজ্যের চোরা চাঁদপুর জেলার তুইভাই ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ নামক স্থানে বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। এমনকি আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈও বলেছেন এই বাঁধটি নির্মিত হবেই। এ কারণেই মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হোক।
বাঁধটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে বাংলাদেশ যে বড় ধরনের একটি পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ইতোমধ্যে বলা হচ্ছে ৯৩০ মিটার দীর্ঘ ও ৯৬৯ মিটার উঁচু এই বাঁধটি চালু হলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এলাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রীষ্মকালে ৯৪৬ কি. মি. এলাকা মারুভূমির ন্যায় শুকনো থাকবে এবং বর্ষাকালে হঠাৎ পানি ছাড়লে ব্যাপক বন্যা হবে। প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রভাবিত হবে এর কারণে। ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়বে। খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে এবং বেশকিছু শাখা নদী মরে যাবে। বলাবাহুল্য, এই বাঁধটিতে প্রায় ১৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি আটকে রাখা হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। পানি সম্পদমন্ত্রী এই বাঁধটির ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত না হলেও গেল বছর টিপাইমুখ সফররত সংসদের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন এই ক্ষয়ক্ষতির কথা।
২০১০ সালের ২৮ জুলাই বিবিসির বাংলা বিভাগ টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে একটি প্রতিবেদন পরিবেশন করে। বাংলাবিভাগের প্রতিনিধি নিজে টিপাইমুখ এলাকায় গিয়েছিলেন এবং সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সাধারণ মানুষ, যারা বংশপরম্পরায় ওই এলাকায় বসবাস করে আসছে, তারা অকপটে স্বীকার করেছেন তাদের জমি হারানোর কথা। বাঁধটি নির্মাণ করা হলে যে এলাকাগুলো সম্পূর্ণ পানির নিচে ডুবে যাবে, তার ৯৪ শতাংশ মনিপুরে আর বাকি ৬ শতাংশ মিজোরামে পড়েছে। মনিপুর হারাবে ৪৭৬০ হেক্টর বাগান, ২০৫৩ হেক্টর ধানি জমি, ১৭৮.২১ বর্গ কিমি বনভূমি। আর আসাম, মনিপুর ও মিজোরাম একত্রে হারাবে মোট ৩১১ হাজার হেক্টর ভূমি। উভয় রাজ্যের ৬৭টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং মনিপুরের ১৬ গ্রাম সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে পানির নিচে। এই পরিসংখ্যান মনিপুরের পরিবেশবাদীদের। আমরা বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা না হয় নাইবা বললাম। মনিপুরের পরিবেশবাদীরা গত বছর বাংলাদেশে এসেছিলেন। তারা বাংলাদেশে এসে তাদের সমস্যার কথা বলে গেছেন। বলে গেছেন বাংলাদেশকে টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে প্রতিবাদ জানাতে। এরপর সংসদের সরকারি প্রতিনিধি দল ভারত গেলেন। তারা কিন্তু সেখানে গিয়ে মনিপুরের পরিবেশবাদীদের সঙ্গে কথা বলেননি। তাদের কি কথা বলা উচিত ছিল না? আমি নিশ্চিত যে, খোদ মনিপুরই যখন বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি, তখন বাংলাদেশ যে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে, এ কথাটা রাজ্জাক সাহেব সাহস করে ভারতীয় পক্ষকে বলেননি। বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী যখন নিজে ভারতীয় হাই কমিশনারের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেন, তখন আমি সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রীর ওপরও আস্থা রাখতে পারি না। প্রতিনিধি দলে সংসদ সদস্য ছিলেন ৬ জন। এরা জনপ্রতিনিধি। জনগণ তাদের ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। কিন্তু তাদের তো সেই বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নেই। তারা কি বুঝবেন বাঁধ নির্মাণের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? বাঁধের এরিয়াল সার্ভে ম্যাপ, হাইড্রোলজিক্যাল ম্যাপ, জিয়োটেকটোনিক ডাটা বিশ্লেষণ করার ও বোঝার জ্ঞান দরকার, তাদের তা নেই। এজন্য একাধিক কারিগরি বিশেষজ্ঞ থাকা প্রয়োজন ছিল। পানি সম্পদ সচিব প্রায় একবছর হলো এ মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়েছেন। তারও এ ব্যাপারে জ্ঞান সীমিত। সেই অর্থে বিশেষজ্ঞ ছিলেন দুজন_ যৌথ নদী কমিশনের একজন সদস্য ও বুয়েটের পানিসম্পদ বিভাগের একজন অধ্যাপক। যেখানে যৌথ নদী কমিশনে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনা হয়নি, সেখানে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য প্রতিনিধি দলটিকে সহযোগিতা করতে পারেননি। বুয়েটের যিনি অধ্যাপক তার কাছেও প্রচুর তথ্য ও উপাত্ত নেই।
বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী স্বয়ং নিজে স্বীকার করেছেন ভারত বাঁধটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্তের হিসাব ছাড়া আর কোনো তথ্য দেয়নি। তাহলে এই তথ্য নিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক সাহেব প্রতিনিধিদলকে আদৌ সহযোগিতা করতে পারেননি। এ বিষয়ে তিনি কোনো গবেষণা করেছেন বলে আমার জানা নেই। এ ক্ষেত্রে যারা এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন এবং বিভিন্ন সেমিনারে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন, তাদের কয়েকজন ভারতে গেলে ভালো হতো। কিন্তু তা হয়নি। টিপাইমুখ বিতর্ক এড়ানোর জন্য সরকার এটি করলে ভালো করত। আরো একটি কথা। টিপাইমুখ ব্যর্থ সফর শেষে প্রতিনিধি দল ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন। গত এক বছরে আমরা আর টিপাইমুখ নিয়ে কিছু শুনিনি। ভারত আমাদের তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করলেও, সংসদীয় প্রতিনিধি দলের পক্ষে তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করাও সম্ভব ছিল না। তবে আমার বিশ্বাস ভারত ওই প্রতিনিধি দলকে আদৌ কারিগরি তথ্য ও উপাত্ত দেয়নি। এদিকে গত ৩০ জুলাই (২০১০) সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছিলেন যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতিকারক কোনো পদক্ষেপ ভারত নেবে না। টিপাইমুখে কোনো সেচ প্রকল্প হবে না, এমন কথাও আমাদের জানিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আমরা কতটুকু আশ্বস্ত হতে পারি? গঙ্গার পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে অতীতে ভারত আমাদের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলে ভিন্ন কথা।
গত ৫ জুলাই (২০১১), ছাপা হওয়া একটি সংবাদই এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট। ওই সংবাদে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া গঙ্গা পানি চুক্তির পর এ বছর পদ্মা নদীতে পানির প্রবাহ সবচেয়ে কম। ভারত ফারাক্কা পয়েন্টে আগেভাগেই পানি প্রত্যাহার ও ১ জানুয়ারি থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়ার ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন ভারতীয় মন্ত্রীর কথায় আমরা আস্থা রাখি কিভাবে? আমরা কখনো বলিনি টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে তা সেচকাজে ব্যবহার করবে। ভারতের কাছারে বরাকের উজানে ফুলেরতাল এলাকায় ভারত নির্মাণ করছে একটি ব্যারাজ, যার মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে অথবা সংরক্ষণ করে এ অঞ্চলের সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করবে। ভারতীয় মন্ত্রী কিন্তু ফুলেরতাল প্রকল্পের ব্যাপারে কিছু বলেনি। আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই বাংলাদেশ সরকার ফুলেরতাল ব্যারাজ নির্মাণের ব্যাপারটি নিয়ে ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন কিনা কখনো? না হলে, আলোচনাটা এখন জরুরি।
সংসদের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের টিপাইমুখ পরিদর্শনের পর এক বছর পার হয়েছে। এরই মধ্যে এলো প্রেমচান্দের বক্তব্যটি। এখন রাজ্জাক সাহেব বিষয়টি কিভাবে নেবেন, আমি জানি না। তবে তিনি বাংলাদেশি হাইকমিশনের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। তিনি সংসদে একটি বক্তব্য রেখেছিলেন বটে। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা জানতে চাই স্থায়ী কমিটির মূল্যায়ন কি? আমরা দেখতে চাই টিপাইমুখ তথা ফুলেরতাল ব্যারেজ 'ডিটেইলড প্ল্যান'_ যা ভারতীয় পক্ষ আমাদের সরবরাহ করবে এবং আমাদের বিশেষজ্ঞরা এই 'ডিটেইলড প্ল্যান' নিয়ে পর্যালোচনা করবেন। ফারাক্কা চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে দিলি্ল আমাদের নদীগুলোর উজানে কোনোরকম স্থাপনা তৈরি করবে না। তখন আমাদের প্রশ্ন ভারত এই চুক্তির লঙ্ঘন করছে কি না? টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমাদের শঙ্কা আমরা ভারতীয় পক্ষকে অবহিত করেছি কি না, তাও আমরা জনাব রাজ্জাকের মুখ থেকে জানতে চাই। আসলে ভারত 'কূট' কৌশলের কাছে আমরা শক্ত হাতে দাঁড়াতে পারি না। ভারত মুখে বলে এক কথা। কাজ করে উল্টোটি।
সারা বিশ্বেই বড় বড় বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে। বিশ্বব্যাংক এ ধরনের প্রকল্পে সাধারণত অর্থায়ন করে না। বিশ্বজনমতকে আমরা আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। ভারতে অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যারা বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে। তাদের সঙ্গেও বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ করা যায়। মনিপুরের পরিবেশবাদীদের সঙ্গেও আমরা সম্পর্ক বাড়াতে পারি। এ কাজগুলো সরকার যদি না করে, তাহলে তা করতে হবে বিরোধী দলকে। সেই সঙ্গে স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের।
দৈনিক যায় যায় দিন, মঙ্গলবার ১৬ আগস্ট ২০১১ ১ ভাদ্র ১৪১৮ ১৫ রমজান ১৪৩২
ড. তারেক শামসুর রেহমান অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,  রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

বিদ্যুৎ সংকট ও সরকারের দায়দায়িত্ব

বিদ্যুৎ বিভাগ বেশ কিছুদিন ধরে ‘বিদ্যুৎবার্তা’ প্রচার করে আসছে। এই ‘বিদ্যুৎবার্তা’য় আমজনতাকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে সর্বশেষ বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কথা। মোটামুটি সব পত্রিকায়ই এই বিজ্ঞাপনটি (?) প্রচার হচ্ছে। যেমন ৩১ জুলাইয়ের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ছিল : উৎপাদন ৪৫০৫ দশমিক ৫ মেগাওয়াট (এর আগের দিন ছিল ৪৬৩২ মেগাওয়াট)। লোডশেডিং ৯৮৫ মেগাওয়াট (গত বছর ছিল ৮৯০ মেগাওয়াট)। গত বছর অর্থাৎ ২০১০ সালের এই দিনে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৯০১ দশমিক ৫ মেগাওয়াট। এটা সরকারি ভাষ্য, সরকারি প্রপাগান্ডা। ওই ‘বিদ্যুৎবার্তা’য় আমাদের জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, ৬ জানুয়ারি, ২০০৯ যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৩২৬৭ দশমিক ৫ মেগাওয়াট, সেখানে ৩১ জুলাই, ২০১১ এ উৎপাদন হয়েছে ৪৫০৫ দশমিক ৫ মেগাওয়াট। অর্থাৎ উৎপাদন বেড়েছে। সরকারি তথ্যে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের জুলাইয়ে উৎপাদন যোগ হয়েছে ২০৫ মেগাওয়াট। আর চলতি আগস্টে নতুন উৎপাদন যোগ হবে ৭৯৮ মেগাওয়াট।
সংবাদটি পড়ে যে-কেউ পুলকিত হতে পারেন। হাতে তালিও দিতে পারেন। কিন্তু কোথায় যেন একটা ‘কিন্তু’ আছে। উৎপাদন যদি বাড়েই, তাহলে বিদ্যুতের এই পরিস্থিতি কেন? ১ আগস্টের রাতের কথাই বলিÑ আমি যে এলাকায় থাকি (আদাবর) সেখানে রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত কোন বিদ্যুৎ ছিল না। আর দিনের বেলার কথা নাইবা বললাম। দিনের মধ্যে কতবার যে বিদ্যুৎ যায়, তার হিসাব করিনি। ক্লাস নিতে গিয়ে পারিনি বিদ্যুতের অভাবে। এখন শুধু রাতেই যদি কয়েক ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে (অথচ রাতে বিদ্যুতের চাহিদা কম। অফিস, কল-কারখানা বন্ধ), তাহলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি যে কোথায়, তা সহজেই আঁচ করা যায়। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সরকারি বক্তব্যকে সমর্থন করছে না। সরকার যে তথ্য দিচ্ছে, তার সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই।
বিদ্যুৎ নিয়ে সংকট আছে। চাহিদা বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। কিন্তু সেভাবে উৎপাদন হচ্ছে না। হাজার হাজার ফ্ল্যাট এই ঢাকা শহরেই তৈরি হচ্ছে। এসব ফ্ল্যাটে কি আদৌ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে? যদি না হয়, তাহলে যারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে ফ্ল্যাটগুলো কিনছেন, তারা কী করবেন? আবাসনশিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। তাদের আয়-রোজগারের কী হবে? ডেভেলপাররা যদি ক্রেতাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে না পারেন, তাহলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে যাবেন। সরকারের জন্য আদৌ তা কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না।
বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে। এই গ্যাস এখন ফুরিয়ে আসছে। চলমান গ্যাস সংকট মোকাবেলায় সরকার ২০০৯ সালে ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রাম’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর অধীনে অতিদ্রুত নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের হাতে থাকা ৩, ৬, ৮ ও ১১ নম্বর ব্লকের মোট তিন হাজার ১০০ কিলোমিটার লাইন দ্বিমাত্রিক (টু-ডি) সিসমিক জরিপের কাজ তিন বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, স্থলভাগের ২৩টি ও অগভীর সমুদ্রের আটটি ব্লককে পিএসসির আওতায় বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে কনোকো-ফিলিপস একটির দায়িত্ব পেয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাসপ্রম এবং অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোসও শিগগিরই কাজ পাচ্ছে। এমন অভিযোগও উঠেছে যে, স্থলভাগে সুনেত্রার মতো বিশাল মজুদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া হতে পারে। কনোকো-ফিলিপস যে দায়িত্বটি পেয়েছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্ক হচ্ছে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা এই চুক্তির বিরোধিতা করে দেশব্যাপী এখন গণসংযোগ করছেন। তাদের যুক্তি একটাই, কোন অবস্থাতেই বাংলাদেশের গ্যাস রফতানি করা যাবে না। গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। মিয়ানমার ও ভারত গভীর সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে। মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস আগামী বছর যাবে থাইল্যান্ডে। চীনও এই গ্যাস কিনছে। এক্ষেত্রে যদি গ্যাস পাওয়াও যায়, তা উত্তোলন ও জাতীয় গ্রিডে দিতে ন্যূনতম আরও পাঁচ-ছয় বছর প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারের কাছে বিকল্প কী, এটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। যদিও একটা কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বাপেক্স যে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (সম্ভাব্য মজুদ) গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তা যদি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বিদ্যুৎ সংকটের একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এই মজুদও বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত সরকার বিষয়টি খোলাসা করেনি।
যেহেতু গ্যাসের একটি সংকট আছে, তাহলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আমরা কীভাবে করব? গ্যাসের বিকল্প হতে পারে কয়লা। এ পর্যন্ত দেশে পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লাসম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি-নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কয়লা উত্তোলন নিয়েও বাংলাদেশে একটি বড় বিতর্ক রয়েছে। কয়লা উš§ুক্ত পদ্ধতিতে তোলা হবে, নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তোলা হবেÑ এটা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। উš§ুক্ত পদ্ধতিতে খনন করলে ছয় হাজার হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হবে এবং অনেককে ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি উš§ুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিপক্ষে। অথচ উš§ুক্ত পদ্ধতির একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, এই পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা। বড়পুকুরিয়া কয়লাক্ষেত্রের বেলায় দেখা যাচ্ছে, শতকরা ১০ ভাগ কয়লাও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কোন কোন বিশেষজ্ঞ অভিমত দিয়েছেন যে বড়পুকুরিয়া থেকে ১০০ মিলিয়ন টনের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হবে না। পক্ষান্তরে উš§ুক্ত পদ্ধতিতে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন টন কয়লা তোলা সম্ভব, যা বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৫০ বছরের জ্বালানি-নিরাপত্তা দেবে।
জ্বালানি খাতে কয়লা একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও তাতে এখন রাজনীতি ঢুকে গেছে। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীর কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইন-শৃংখলা রক্ষাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ছয়জন। এরা উš§ুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। সেই থেকে ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি শুনে আসছি। এ ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোন কয়লানীতিও গ্রহণ করতে পারেনি। যদিও ২০০৭ সালের ১১ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দেয়। তাতে উš§ুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন, রফতানির সুযোগ না রাখা, দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি-নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, খনির মুখে একটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকার কোন কয়লানীতিও গ্রহণ করেনি। ফলে একটি সম্ভাবনাময় সেক্টর আমাদের কোন কাজে আসছে না। এখানে বলা ভালো, বিশ্বের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে। কয়েকটি দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ হচ্ছেÑ অস্ট্রেলিয়া ৭৯, চীন ৭৮, জার্মানি ৪৯, ভারত ৬৯, দক্ষিণ আফ্রিকা ৯২ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতাংশ। এখানে আরও একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন আর তা হচ্ছে, বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও আমরা খুলনা ও চট্টগ্রামে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছি আমদানিকৃত (ভারত) কয়লার ওপর নির্ভর করে।
বিদ্যুৎ ঘাটতিতে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ৩ আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। কমিটির সভায় সরকারের দেয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিসংখ্যানও প্রত্যাখ্যান করা হয়। সরকারি দলের এমপিরা যখন খোদ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন, তখন বুঝতে কারও বাকি থাকে না পরিস্থিতি আদৌ ভালো নয়। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি সমস্যার কোন সমাধান নয়। বিদ্যুৎ সংকট আগামীতে আরও ঘনীভূত হবে। এটা অন্যতম একটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে যেতে পারে এখন। সরকার এখন বিভিন্ন ‘চাপ’-এর মুখে আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের ব্যর্থতা প্রকট। এখন এর সঙ্গে যোগ হল বিদ্যুৎ ঘাটতির বিষয়টি। বিদ্যুৎ ঘাটতি রোধে সরকারের কাছে এ মুহূর্তে কোন ‘ফর্মুলা’ আছে বলেও মনে হয় না। একমাত্র কয়লা উত্তোলনকে অগ্রাধিকার দিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের একটা পথ হতে পারে। এ জন্য দ্রুত কয়লানীতি মন্ত্রিসভায় পাস করা জরুরি।
দৈনিক যুগান্তর, ১০ ই আগস্ট, বুধবার,
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেয়া কেন জরুরি

বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান একটা বেফাঁস মন্তব্য করে বিপদেই আছেন মনে হচ্ছে। গত ৪ আগস্ট ঢাকায় এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেছিলেন, 'আপনারা কম খান, কম খেলে সমস্যা কমবে। ব্যবসায়ীরা ভেজাল মেশাতে নিরুৎসাহিত হবে। খাদ্যের মাধ্যমে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মানুষের শরীরে সহজে প্রবেশ করে। আগেকার মানুষ কম খেত বলে বেশি দিন বাঁচত।' ফারুক খানের এই বক্তব্য প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় এভাবেই ছাপা হয়েছে। তিনি এর প্রতিবাদও করেননি। ফলে ধরে নিতে হবে তিনি যা বলেছেন, সংবাদপত্রে তার বক্তব্য সেভাবেই ছাপা হয়েছে। ফারুক খানের এই বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন সরকারি দায়িত্বশীল পদে বসে কারো দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দেয়া উচিত নয়। কারো নাম উল্লেখ না করেই তিনি বলেছেন 'দায়িত্ব পালন করতে না পারলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান'। অত্যন্ত স্পষ্টভাষী ওবায়দুল কাদেরকে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে মনে করেন আওয়ামী লীগের 'বিবেক'। তিনি দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেও, মাঝে মধ্যে স্পষ্ট কথা বলেন। অতীতেও তিনি মন্ত্রীদের সমালোচনা করেছেন। ছাত্রলীগের এই সাবেক নেতা বর্তমানে ছাত্রলীগের কর্মকা-েও অসন্তুষ্ট। তাই স্পষ্টভাষী এই নেতা যখন ফারুক খানের ওই বক্তব্যের একদিন পর এ ধরনের কথা বলেন, তখন বুঝতে কারো বাকি থাকে না ফারুক খানের ওই বক্তব্যে খোদ দলের মধ্যেই একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের মন্ত্রিপরিষদে যে ক'জন ব্যক্তি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না, তার মাঝে বাণিজ্যমন্ত্রী অন্যতম। অতীতেও তিনি একাধিকবার বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। তিনি বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ব্যবসায়ীদের হুমকি-ধামকি দিয়েও বাগে আনতে পারেননি। ব্যবসায়ীরা তার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে অতি উচ্চমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করলেও, বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। তার ব্যর্থতা এখানেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ আজ হতাশাগ্রস্ত। ইতিমধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষদের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। ২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজির বাস্তবায়ন এখন প্রশ্নের মুখে। যে রেমিটেন্স নিয়ে আমাদের এত গর্ব, সেখানে আশার কোনো খবর নেই। রেমিটেন্স আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। গত অর্থবছরের অর্থ এসেছে (১ হাজার ১৬৪ কোটি ৯৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার), তার প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ এর আগের বছরে (২০০৯-১০) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি। এর অর্থ পরিষ্কার শ্রমবাজার খোঁজার ব্যর্থতা। বাংলাদেশের মূল জনবল রফতানির বাজার মধ্যপ্রাচ্য। সেখানে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসছে (কিন্তু নেপালের মতো দেশের সম্ভাবনা সেখানে বাড়ছে কোনো কোনো দেশে)। দেশে বেকার সমস্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। কিন্তু সরকারের কোনো বড় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। এমনিতেই জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগও দেয়া সম্ভব হয়নি। ২০১১ সালে জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ যুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে জুন পর্যন্ত মাত্র ৬৩০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ছয় বছর আগে ২০০৪ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো, এখনো সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে (কালের কণ্ঠ ৫ জুলাই)। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে ভালো তা বলা যাবে না। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন পুলিশের জন্য আরো ১০টি আইজি পদ চাচ্ছেন, তখন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। শুধু এক মাসে ২৬ শিশু ও ১২ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সকালের খবর গত ৭ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে। আর জুন মাসে ঢাকা শহরের একাধিক সোনার দোকানে ও বাসায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের ভূমিকা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হলো যখন বিএনপির সংসদীয় দলের চিফ হুইপ পুলিশের পিটুনিতে আহত হয়েছিলেন। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন পুলিশের পিটুনির শিকার হন, তখন এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। পুলিশের পিটুনির পরও তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য তিনি এখন বিদেশে। মামলা হয়েছে আরেকজন এমপির বিরুদ্ধেও।
সরকারের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ একাধিক। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আসছেন সেপ্টেম্বরে। এসে গেলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সোনিয়া গান্ধী স্বয়ং। স্পষ্টতই বোঝা যায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি নতুন দিকে টার্ন নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমস্যা রয়েছে একাধিক। গত ৪০ বছরেও সেসব সমস্যার সমাধান হয়নি। আমরা ট্রানজিট দিলাম। কিন্তু বিদ্যুৎ কবে আসবে, আমরা জানি না। 'হাই প্রোফাইল' ভিজিট ভালো। কিন্তু আমরা পদ্মায় পানি চাই। চাই তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকার। চাই বিএসএফের হত্যা বন্ধ। চাই ছিটমহলগুলো ফেরত। ভারতকে 'বন্ধু' ভাবতে চাই। কিন্তু এই বন্ধুত্ব হতে হবে একপক্ষীয় নয়, দ্বিপাক্ষিক, প্রয়োজনে বহুপাক্ষিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য এটা আরেকটা চ্যালেঞ্জ_ অতি মাত্রায় ভারত নির্ভরতা বাংলাদেশের জন্য 'ইমেজ সংকট' সৃষ্টি করতে পারে।
রাজনীতি এক অনিশ্চয়তার দিকে যাত্রা শুরু করেছে। সরকারের কঠোর মনোভাব সংকটকে আরো জটিল করেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। বিরোধী দলের উত্থাপিত দাবি-দাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। বিশেষ করে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে পরিবর্তন আনাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। কীভবে পরিবর্তন আনা যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা যায়, এ বিষয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে 'সংলাপ' ওপেন করা জরুরি। বেগম জিয়া ইতিমধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন কোন কোন জায়গায় পরিবর্তনটা প্রয়োজন। তার ওই বক্তব্যকে বিবেচনায় নিলে একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু তা না করে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে, মামলা দিয়ে যদি বিরোধী দলকে দমিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়, তা সরকারের জন্য খুব ভালো হবে বলে মনে হয় না। কেননা সংবিধান একটি দেশের, কোনো দলের নয়। দলীয় বিবেচনায় সংবিধান সংশোধন করা ঠিক নয়। সরকার ও বিরোধী দল নিয়েই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়। বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে যে 'গণতন্ত্র', তাকে কোনোমতেই 'গণতন্ত্র' বলা যাবে না।
বেগম জিয়া ঈদের পর বড় ধরনের গণআন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এটাকে বিবেচনায় নিতে হবে। হরতাল, লাগাতার হরতাল, লংমার্চ ইত্যাদি কর্মসূচি আসছে। এসব কর্মসূচি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় পেঁৗছে দেবে না। সরকারের কঠোর মনোভাব দেশকে চরম অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে। আর এর দায়ভার নিতে হবে সরকারকেই। লাগাতার হরতাল ও গণঅনশনের পর বিএনপি একটা ম্যাসেজ পেঁৗছে দিয়েছে আর তা হচ্ছে, অতি দ্রুত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের উদ্যোগ নেয়া। যে দ্রুততার সঙ্গে সংবিধানে পঞ্চশ সংশোধনী আনা হয়েছিল, একই ধরনের দ্রুততার সঙ্গে সংবিধানে ১৬তম সংশোধনী আনা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা ও 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' সংবিধানে ফিরিয়ে আনা। একটি আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা জরুরি। সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে যদি আস্থার পরিবেশ না থাকে, তাহলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেবেই। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজে ব্যবসায়ী। তার পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আজ সংসদ যদি ঠিক মতো চলতো, তাহলে অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। বাজার মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে_ এটা সংসদে আলোচনা হওয়া উচিত ছিল। দুঃখ লাগে একজন মাননীয় সংসদ সদস্যও সংসদে দাঁড়িয়ে এ প্রশ্নটা করলেন না। অথচ সাধারণ মানুষের ভোটেই এরা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং আগামীতে নির্বাচিত হবারও স্বপ্ন দেখছেন।
সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আস্থার পরিবেশ নেই বলেই আদালতপাড়ায় একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলো। আদালতে আইনজীবীদের মধ্যে হাতাহাতির খবর কোনো ভালো খবর নয়। কোনো বিচারপতিকে নিয়ে কটূক্তি করাও শোভন নয়, কাম্য নয়। একজন বিচারপতিকে সম্মান করেই সম্বোধন করতে হয়। আদালতপাড়ায় রাজনীতি টেনে আনাও কোনো শুভ লক্ষণ নয়। বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সনদ বাতিল করে রুল ইস্যু করা হয়েছে। এর একটা সমাধান প্রয়োজন। ধারণা করছি সিনিয়র আইনজীবীদের মধ্যস্থতায় একটা সমাধান পাওয়া যাবে। আদালতপাড়ায় এসব ঘটনা আমাদের আহত করে। আমাদের আস্থার জায়গাটা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়।
বর্তমান সরকার আরো দু'বছরের উপরে ক্ষমতায় থাকবে। সরকার সাধারণ মানুষের যে সমস্যা, সেসব সমস্যার দিকে নজর দেবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সেই সঙ্গে সরকার যদি পুনরায় সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়, আমার বিশ্বাস এতে করে সরকারের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে। 
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

বেলুচিস্তান কি যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী টার্গেট?

পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যখন 'অস্বাভাবিক', তখন ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্যামেরন মুন্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ। আগস্টের প্রথম দিকে তিনি বেলুচিস্তান সফর করেন এবং সেখানে অবস্থানকালে বেলুচিস্তানের আঞ্চলিক পরিষদের স্পিকার মোহাম্মদ আসলাম ভুটানির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় তিনি এ মন্তব্যটি করেন। যদিও মুন্টার তাঁর মন্তব্যের কোনো ব্যাখ্যা দেননি, কিন্তু যাঁরা এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা জানেন বেলুচিস্তানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ দীর্ঘদিনের। এ অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এর গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবেই বেলুচিস্তান বিভক্ত। এর এক অংশ পাকিস্তানে, অন্য অংশ ইরানে, যা ইরানের একটি প্রদেশ। এটি সিস্তান বেলুচিস্তান নামে ইরানে পরিচিত। বেলুচিস্তানের দক্ষিণে রয়েছে আরব সাগর, আর উত্তরে আফগানিস্তান। বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন রয়েছে এবং আফগানিস্তানের তালেবানের আশ্রয়স্থলও রয়েছে এখানে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে বেলুচিস্তানের গুরুত্ব আরো বেড়েছে। চীনেরও উপস্থিতি রয়েছে বেলুচিস্তানে। চীন বেলুচিস্তানের গাওদারে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। ভারতেরও আগ্রহ রয়েছে বেলুচিস্তানের ব্যাপারে। একদিকে আফগানিস্তান থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যখন তার পরিকল্পনার ছক কাটছে, তখন বেলুচিস্তানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ নতুন করে এ অঞ্চল সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে সামনে নিয়ে এল। বেলুচিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, বেলুচিস্তানের দুই নেতা গেল বছর ভারত সফর করেছিলেন। দুই নেতা_ওয়াহিদ বালুচ ও মুনির মেহুল নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দিল্লি সফর করেছিলেন। এ দুই নেতা ফ্রান্স থেকে ভারতে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য 'স্বাধীন বেলুচিস্তানের' ব্যাপারে ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা। তাঁরা দিল্লিতে এসে এ কথাও বলেছিলেন যে ৬২ বছর ধরে পাকিস্তান বেআইনিভাবে বেলুচিস্তান জবরদখল করে রেখেছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বেলুচিস্তানকে একটি বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে_এ অভিযোগও এ দুই নেতার। এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ঢাকার সংবাদপত্রেও ছাপা হয়েছিল তখন। দৈনিক যায়যায়দিনের নিজস্ব প্রতিবেদক কলকাতা থেকে প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছিলেন গত ৯ নভেম্বর। ওয়াহিদ বালুচ ও মুনির মেহুলকে নয়াদিল্লিতে আসতে দেওয়া এবং ভারতীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেওয়ায় নতুন করে পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। কেননা পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পেছনে ভারতের হাত রয়েছে। ওয়াহিদ ও মুনিরের দিল্লি সফরের পর পাকিস্তানের অভিযোগ আরো শক্ত হয়েছিল। এখানে বলা প্রয়োজন যে বেলুচিস্তানের ব্যাপারে বৃহৎ শক্তি তথা আঞ্চলিক শক্তিগুলোর আগ্রহের অন্যতম কারণ এ অঞ্চলের গ্যাসসম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বেলুচিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলিত। বেলুচিস্তানের 'সুই' গ্যাস দিয়ে পাকিস্তানের জ্বালানি চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু এ অঞ্চল বরাবরই অবহেলিত। উন্নয়নের ছোঁয়া এখানে লাগেনি। বেলুচিস্তানে ২০০১ সালে গঠিত হয় বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি। এর নেতৃত্বে আছেন বেলুচ মারি, যিনি একসময় মস্কোতে পড়াশোনা করেছেন। ২০০৫ সালে তাঁরা সুই গ্যাসকেন্দ্রে হামলা চালালে তাঁদের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে তাঁরা আলোচনায় আছেন। ইরানের সিস্তান বেলুচিস্তানেও 'জুনদুল্লাহ'র নেতৃত্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে।
বেলুচিস্তানের অবস্থান আরব সাগর ঘেঁষে। এ কারণে একদিকে যেমন আগ্রহ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের, তেমনি আগ্রহ রয়েছে চীনের। অন্যদিকে ভারতের আগ্রহেরও কমতি নেই। এখানে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন। এ অঞ্চলকে যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় অথবা যদি বিচ্ছিন্নতা উসকে দেওয়া যায়, তাহলে তা থেকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই ফায়দা লুটতে পারবে বেশি। আফগানিস্তানের একটি সীমান্ত রয়েছে বেলুচিস্তানের সঙ্গে। আফগান তালেবান এ সীমান্ত অতিক্রম করে বেলুচিস্তানে আশ্রয় নিচ্ছে_এ অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের। যে কারণে বেলুচিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কার্যক্রম রয়েছে। পাকিস্তানের পরিস্থিতি ভালো নয়। পাকিস্তানি তালেবান এখন পাকিস্তানের ভেতরেই আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের সেনা অভিযানের ফলে তালেবান যদি সেখান থেকে উৎখাত হয়, তাহলে বেলুচিস্তান হবে তালেবানের পরবর্তী অভয়ারণ্য। সে ক্ষেত্রে ২০০১ সালের অক্টোবরে যেমন বোমা হামলা চালিয়ে আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, তেমনটিও ঘটতে পারে বেলুচিস্তানের ক্ষেত্রে। এ অঞ্চলে আরব সাগরঘেঁষা গাওদার একটি সমুদ্রবন্দর। বন্দরটির স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেক বেশি। বন্দরটি তৈরি করে দিচ্ছে চীন, যেখানে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলার। চীন 'মুক্তার মালা' বা String of Pearls-এর যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে গাওদার একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে অ্যারাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, এই পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। কেননা এ পথ তার জ্বালানি সরবরাহের পথ। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। গাওদারে চীনা নৌবাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিট থাকবে, যেখান থেকে ভারত মহাসাগরের সব ধরনের নৌ কার্যক্রম লক্ষ করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রেরও আগ্রহ রয়েছে গাওদারের ব্যাপারে। ইরানের সীমান্ত থেকে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে গাওদার। আর হরমুজ প্রণালি থেকে দূরত্ব মাত্র ৪০০ কিলোমিটার। এই হরমুজ প্রণালি দিয়েই মধ্যপ্রাচ্যের তেল পশ্চিম ইউরোপসহ জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ করা হয়। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের সদস্যরা যেকোনো সময় এই হরমুজ প্রণালিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভবিষ্যতে ইরানের বিরুদ্ধে যদি কোনো নৌ অবরোধ সৃষ্টি করতে হয় (?) তাহলে গাওদার বন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। চীন তার পূর্বাঞ্চলে ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস গাওদার বন্দর দিয়েই পাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে চায়। এ ব্যাপারে একটি মহাপরিকল্পনাও তারা প্রণয়ন করছে। সুতরাং সংগত কারণেই বেলুচিস্তান আগামী দিনগুলোতে উত্তপ্ত থাকবে এবং বৃহৎ তথা কোনো কোনো আঞ্চলিক শক্তির কাছে স্বাধীন একটি বেলুচিস্তান রাষ্ট্র (?) আকর্ষণীয়। ২০০১ সালের জুলাই মাসে জেনস ইনফরমেশন গ্রুপ তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, বেলুচিস্তানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ যথেষ্ট তৎপর।
ইরানি প্রদেশ সিস্তান বেলুচিস্তান ছিল বরাবরই শান্ত ও স্থিতিশীল। ইতিহাসের কিংবদন্তির বীর রুস্তমের জন্ম এখানে। এমনকি ইরানের শীর্ষস্থানীয় শিয়া নেতা আয়াতুল্লাহ আলী সিস্তানির জন্মও এখানে। সিস্তান ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের ভাষা ও ধর্ম এক, তবে স্থানীয় ভাষায় তারা কথা বলে। বেলুচিস্তানের যে অংশ ইরানের সঙ্গে ছিল, তা একসময় যুক্ত ছিল ইরানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশের সঙ্গে। কিন্তু রেজা শাহ ১৯৫৯ সালে সিস্তানকে আলাদা প্রদেশ করেন। জুনদুল্লাহরা তাদের আন্দোলন বেলুচিস্তানে সম্প্রসারিত করছে। তাদের যুক্তি বেলুচ ও পারসীয়রা এক নয়। তারা মনে করে, পারসীয়রা ইরানি হলেও সব ইরানি পারসীয় নন। ইরানিদের মধ্যে আজারি, বেলুচরা রয়েছে। সিস্তানের ব্যাপারে দ্বন্দ্ব মূলত পারসীয়দের সঙ্গে বেলুচদের। এই দ্বন্দ্বটাকে জুনদুল্লাহই কাজে লাগাতে চায়। সিস্তানকে ইরান থেকে তারা আলাদা করতে চায়। তবে একটি 'গ্রেটার বেলুচিস্তান' গড়ার ডাক তারা দেয়নি। ইরানের অভিযোগ, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র জুনদুল্লাহকে 'প্রমোট' করছে। জুনদুল্লাহর নেতা আবদুল মালেক রিগি একসময় তালেবানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি হিসেবেও তিনি পরিচিত। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানিতে তাঁর ক্রিমিনাল রেকর্ড রয়েছে। জুনদুল্লাহরা সমর্থন পাচ্ছে পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন আনজুমান ই সিপাহ ই সাহাব ও লস্কর ই জাগজাবি নামক দুটি সংগঠনের, যারা পাকিস্তানে শিয়া স্থাপনার ওপর একাধিকবার আক্রমণ চালিয়েছে।
পাকিস্তান অধ্যুষিত বেলুচিস্তান ও ইরানের প্রদেশ সিস্তানের সমস্যা এক নয়। উভয় অঞ্চলের মানুষের মিল এক জায়গায়_তারা বেলুচ। এবং উভয় অঞ্চলেই উন্নয়ন হয়নি। এ কারণে তাদের ক্ষোভ রয়েছে। পাকিস্তান অধ্যুষিত বেলুচিস্তানে স্থায়ী বাসিন্দা অর্থাৎ বেলুচরা ক্রমেই সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। অন্য প্রদেশ থেকে মানুষ এসে এখানে বসবাস করছে। অন্যদিকে সিস্তানের সমস্যাটা মূলত অনুন্নয়ন। বেলুচিস্তান নিয়ে সমস্যা মূলত দুটি। এক. আফগানিস্তানের পসতুনরা আর বেলুচিস্তানের পাঠানরা এক হয়ে ভবিষ্যতে একটি পসতু রাষ্ট্র (চধংযঃড় ঝঃধঃব) গঠন করতে পারে। আফগানিস্তানে তালেবানকে যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে একদিন এ অঞ্চলে জন্ম হবে তালেবানমুক্ত পসতু রাষ্ট্র। পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন থাকবে এই পসতু রাষ্ট্রের ব্যাপারে। দুই. ইরান ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তান মিলে একটি গ্রেটার বেলুচিস্তান রাষ্ট্র গঠন করতে পারে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যদি কোনো ধরনের সহাবস্থান না হয়, তাহলে এই গ্রেটার বেলুচিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা আরো শক্তিশালী হবে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানে গঠিত হয়েছে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি, যার নেতৃত্বে রয়েছে বেলুচ মারি। রয়েছে বেলুচিস্তান পিপলস ফ্রন্ট, যাদের নেতৃত্বে গ্রেটার বেলুচিস্তান আন্দোলন শুরু হতে পারে। পাঠক, নব্বইয়ের দশকের সাবেক যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্রের কথা স্মরণ করতে পারেন। সার্বদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে একে একে স্বাধীন হয়েছিল ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া (১৯৯১), বসনিয়া-হারজেগোভিনা (১৯৯২)। এরপর স্বাধীন হয়েছে মন্টিনেগ্রো, ম্যাসিডোনিয়া ও স্বাধীনতার পথে রয়েছে কসোভো। 'বলকানাইজেশন'-এর প্রক্রিয়া ইরানেও আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি ভবিষ্যতে। ইরান ইতিমধ্যেই অভিযোগ করেছে যে যুক্তরাষ্ট্র যে ঝড়ভঃ ডধৎ শুরু করেছে, তার উদ্দেশ্য একটাই, ইরানকে খণ্ড-বিখণ্ড করা। বেলুচিস্তান দিয়েই (?) এ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এখানে এক ও অভিন্ন। ভারতের যে বিপুল জ্বালানি চাহিদা, তা দেশটি মেটাবে দুটি পাইপলাইনের মাধ্যমে। এক. ইরান থেকে বেলুচিস্তান হয়ে নয়াদিল্লি (আসালুইয়ে-বন্দর আব্বাস-ইরানশহর-গুজদার-সুই-মুলতান-নয়াদিল্লি)। দুই. তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে নয়াদিল্লি (দুজুলেবাদ-হেরাত-কান্দাহার-কোয়েটা-মুলতান-ফাজিলকা-নয়াদিল্লি, TAPI প্রজেক্ট)। বেলুচিস্তান ভারতের জন্য যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা এই দুটি প্রজেক্টের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। তাই বেলুচিস্তানের ঘটনাবলি যে আগামী দিনগুলোতে বারবার আলোচিত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বুধবার, ১০ আগষ্ট ২০১১, ২৬ শ্রাবণ ১৪১৮, ৯ রমজান ১৪৩২, দৈনিক কালের কন্ঠ.ড. তারেক শামসুর রেহমান নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক। অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল : tsrahmanbd@yahoo.com

কয়লানীতি কেন জরুরি


বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিদ্যুত্ সংকটের কারণে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এ ধরনের একটি দাবি যখন ওঠে, তখন আমি অবাক হই না। বাংলাদেশ বর্তমানে এক চরম বিদ্যুত্ সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রোজা-রমজানের দিনে-রাতেও একাধিকবার বিদ্যুত্ যাচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে গ্যাস সংকট। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যাচ্ছে না। অথচ চাহিদা বাড়ছে। এ কারণেই কয়লাকে এখন গ্যাসের বিকল্প ভাবতে হবে। কয়লার এক বিশাল ভাণ্ডার বাংলাদেশে রয়েছে। কয়লার সুষ্ঠু ব্যবহার, উত্তোলন ও কয়লানির্ভর বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য তাই চাই কয়লানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
বিদ্যুত্ আমাদের প্রয়োজন। সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এখন বিদ্যুত্ শীর্ষে থাকা উচিত। গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে এবং নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্রও আবিষ্কৃত হচ্ছে না। সুতরাং গ্যাসনির্ভর যে বিদ্যুত্ কেন্দ্র, তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই ভরসা এখন কয়লা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৫টি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন, যা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য (উত্তোলনযোগ্য ২০ টিসিএফ)। এতে ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি চাহিদা পূরণ সক্ষম। উত্তরাঞ্চলের বড় পুকুরিয়ায় ৬টি কয়লা স্তর (১১৯ থেকে ৫৬০ মিটার গভীরে) পাওয়া গেছে, যার মজুদের পরিমাণ ৬০৩ মিলিয়ন টন। বর্তমানে এ কয়লা খনিটি ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতির মাধ্যমে উত্তোলনের পর্যায়ে রয়েছে। বড় পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে কয়লা পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই কয়লা উত্তোলনের ব্যাবস্থা না করে সরকার ভারত থেকে কয়লা আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের সাথে পিডিবির একটি চুক্তি সম্প্রতি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারতীয় কয়লায় চট্টগ্রাম ও খুলনায় দু’টি বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এতে ব্যায় ধরা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশের কয়লা দিয়েই আমরা বিদ্যুত্ কেন্দ্র ২টি চালাতে পারতাম। আমাদের নিম্নমানের ভারতীয় কয়লার প্রয়োজন হত না।
জামালগঞ্জে ৭টি কয়লাস্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়লা এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার এবং মোট আনুমানিক মজুদের পরিমাণ ১০৫৩ মিলিয়ন টন। এখানে কয়লা স্তরের গভীরতা বেশি হওয়ায় তা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক হবে কি না, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। ফলে এ মজুদের উন্নয়নের কাজ আরাম্ভ হয়নি। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কয়লা খনি বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়াছে। এখানে কয়লা মজুদের পরিমাণ ৫৭২ মিলিয়ন টন। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তা এশিয়া এনার্জি কর্পোরেশন (বাংলাদেশ)। খনির মেয়াদকালে মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। ফুলবাড়ি কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলার কথা, যা ইতিমধ্যে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ খনিতে বার্ষিক উত্পাদন ক্ষমতা হবে ১৫ মিলিয়ন টন। এই কয়লা খনির দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার (উত্তর-দক্ষিণে) এবং প্রস্থ ৩ কিলোমিটার (পূর্ব-পশ্চিমে)। এই খনিটি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৬৫ থেকে ২৭০ মিটার গভীরে অবস্থিত।
এসব কয়লা খনি নিয়ে আমাদের দেশে একটি বড় বিতর্ক চলছে-আর তা হচ্ছে কয়লা আমরা তুলবো কিভাবে ? ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে, নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে? উন্মুক্ত পদ্ধতির গ্যাস পরেই হচ্ছে এই পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড বা ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ। এতে ঝুঁকিও বেশি। বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা। অল্প জমিতে প্রচুর মানুষ বাস করে। সমস্যা হচ্ছে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তুলতে হলে অনেকে জমি হারাবেন। ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫ হাজার ৯৩৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে, এর প্রায় ৮০ শতাংশই কৃষি জমি। প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে প্রকল্পকালে প্রায় ২ হাজার ৩০০ আদিবাসীসহ প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে স্থানাস্তর ও পুনর্বাসিত করতে হবে। এই কাজটি ১০ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এখানে ১০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত্ উত্পাদন করার কথা। এটা বলা হয়ে থাকে যে, ফুলবাড়ি কয়লা প্রকল্প চালু হলে প্রতি বছর জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ সংযোজন হতে পারে। প্রকল্প মেয়াদকালে জিডিপিতে অবদান রাখবে প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ফুলবাড়ির জনগণ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিরোধিতা করে আসছে সেই প্রথম থেকেই। ২০০৬ সালের ২৬ আগষ্ট ফুলবাড়ি কয়লা খনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সাথে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ৬ জন মানুষ। এশিয়া এনার্জির সাথে যে চুক্তি হয়েছিল, তারও বিরোধিতা করছে একটি জাতীয় কমিটি। ফুলবাড়ি কয়লা উত্তোলন নিয়ে যে জটিলতা, সেই জটিলতা এখনও দূর হয়নি। তবে একটি আশার কথা শুনিয়েছেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির বৈঠকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে মত দেয়া হয়েছে। তারা কয়লা নীতি দ্রুত চূড়ান্ত করারও সুপারিশ করেছে। এই যখন পরিস্থিতি এবং যেখানে দেশে প্রচুর কয়লা সম্পদ রয়েছে, সেখানে বিদেশ থেকে (ভারত) কয়লা আমদানি করে বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত-এ প্রশ্ন করাই যায়। এতে করে ভারতের উপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে। আগামীতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যদি অবনতি ঘটে, তাহলে এই কয়লা আমদানির উপর তা কোন প্রভাব ফেলবে কী না আমরা জানি না। বলা হচ্ছে বিদ্যুত্ কেন্দ্র দু’টি নির্মাণে যে ব্যয় হবে, তা দেশ দু’টি সমানভাবে ভাগ করে নেবে। এক্ষেত্রে ভারত যা ব্যয় করবে তা তুলে নেবে কীভাবে? এই চুক্তিটি বহাল থাকবে কত বছরের জন্য? এসব বিষয় বিস্তারিত জানা দরকার। এটা ভালো হয় যদি তা সংসদে উপস্থাপন করা হয়। এতে করে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের একটি সুযোগ তৈরি হল। এর মধ্যদিয়ে আমাদের বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা এটা জানার সুযোগ পাবেন যে বিদ্যুত্ কেন্দ্র দু’টির জন্য যে কয়লা প্রয়োজন, তা আমরা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে পারতাম কী না? দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে যেসব শর্ত রাখা হয়েছে তা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূলে কী না? তৃতীয়ত, ভারতীয় ঋণ শোধ করার প্রক্রিয়াটি কী? চতুর্থত, যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে কোন ‘তৃতীয় পক্ষ’-এর উপস্থিতি রয়েছে কী না?
ক্রমাবর্ধমান বিদ্যুত্ সংকটে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ আমাদের জন্য একটি ‘আশার আলো’। কিন্তু যেহেতু দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে, সেহেতু এই চুক্তি যেন আমাদের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে না দাঁড়ায়! একই সাথে সংসদীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার যে সুপারিশ করেছে, আমি তাকে স্বাগত জানাই। তবে ফুলবাড়ীর মানুষের কথা মনে রাখতে হবে। কয়লা সম্পদের ভাগিদার তারাও। তাদের পুনর্বাসনই শুধু নয়, চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রেও তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফুলবাড়ীর কয়লা সম্পদের ‘হক’ তাদেরও আছে। এই ‘হক’ থেকে তাদের আমরা বঞ্চিত করতে পারি না। রাষ্ট্র এ অঞ্চলের সম্পদ জাতীয় উন্নয়নে ব্যয় করবে এটা যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা। দেশে ইতিমধ্যে একটি ‘জাতীয় কমিটি’ গঠিত হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই
দেশের জ্বালানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে তাদের বক্তব্য দিয়ে আসছে। তাদের সাথে কথাবার্তা বলাটাও জরুরী। তবে এটা ঠিক বাংলাদেশের কয়লা ব্যাবহার না  করে কেন ভারতীয় কয়লা আমাদানি করবো-এর একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। কেননা আমরা জানি, ভারতীয় কয়লায় পরিবেশ দূষণ হয় সবচেয়ে বেশি। সেই তুলনায় আমাদের কয়লার মান অনেক ভাল। মনে রাখতে হবে যেখানে সারাবিশ্বে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিমাণ ৭৯ শতাংশ, চীনে ৭৮ শতাংশ, জার্মানিতে ৪৯ শতাংশ, কিংবা ভারতে ৬৯ শতাংশ, সেখানে আমাদের কয়লা সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা তা ব্যবহার করতে পারছি না। বাংলাদেশে ২০১২ সালে বিদ্যুত্-এর চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১০ হাজার মেগাওয়াট, আর ২০২০ সালে ১৬৮০৮ মেগাওয়াট, তখন কয়লা ছাড়া আমাদের কোন বিকল্প নেই। গ্যাস সম্পদ ফুরিয়ে আসছে। গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। সে ক্ষেত্রে আমাদের কয়লা সম্পদ আমাদের জন্য একটি ভরসা। কিন্তু এই কয়লা সম্পদকে ব্যাবহার না করে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কয়লা আমদানি করলে বিতর্ক তো বাড়বেই। আমরা চাই এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হোক। আমরা বিদ্যুত্ উত্পাদন বাড়াতে চাই। কিন্তু পরনির্ভরশীল হতে চাই না।
বিদ্যুত্-এর ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে সামনে রেখে তাই কয়লা নীতি দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরী হয়ে পড়েছে। মনে রাখতে হবে বিদ্যুত্ নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। বিরোধী দল এটাকেও ইস্যু করতে পারে। তাই একটি সুষ্ঠু নীতিমালার আওতায় কয়লা উত্তোলনের প্রক্রিয়া যদি আমরা শুরু করি, আমার বিশ্বাস বিদ্যুত্-এর অনেক চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারবো। ইতোমধ্যে কয়ল নীতি প্রণয়ন হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মতামতও দিয়েছেন। ২০০৭ সালের ১১ জুন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহবায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। তাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন, রফতানির সুযোগ না রাখা, দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিধান রাখা হয়েছিল। ওই রিপোর্টটিকে বিবেচনায় নিয়েই প্রয়োজনে কিছু সংযোজন ও বিয়োজন করে নতুন একটি কয়লানীতি আমাদের দরকার। মনে রাখতে হবে জ্বালানি নিরাপত্তা শুধুমাত্র আমাদের ব্যক্তিগত জীবনই নয়, বরং আমাদের উন্নয়নের সাথেও সম্পর্কিত।
মঙ্গল, ৯ অগাষ্টu-এ ২০১১, ২৫ শ্রাবণ ১৪১৮   দৈনিক ইত্তেফাক
লেখক: ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
tsrahman09@g-mail.com

সোনিয়া গান্ধীর সফর ও আমাদের প্রত্যাশা

সোনিয়া গান্ধী ঢাকায় আসলেন। দেখলেন। চলেও গেলেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এসপিজির (স্পেশাল প্রটেকশন গ্রুপ) একটি গ্রুপ। সেটা খুব অস্বাভাবিক ছিল না। তার শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধী নিজ দেহরক্ষীদের দ্বারা মারা গিয়েছিলেন। স্বামী রাজীব গান্ধীকে হত্যা করেছিল তামিল টাইগাররা। সুতরাং তার সঙ্গে এসপিজি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন অটিজমের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। তিনি ভারতের অটিজম সম্পর্কিত একটি ন্যাশনাল কমিটির উপদেষ্টা। বাংলাদেশে এ ধরনের একটি সম্মেলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কানাডা প্রবাসী মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। নিঃসন্দেহে উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু সোনিয়া গান্ধীর ঢাকা সফর নিয়ে সংবাদপত্রগুলো যেভাবে ‘উচ্ছ্বাসের ফুলকি’ ছড়িয়েছিল, তাতে আমি অবাকই হয়েছি। এমনকি আমাদের তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত যেভাবে বলার চেষ্টা করেছেন যে ‘সোনিয়া গান্ধী সমস্যার সমাধান দিয়ে যাবেন’, তাতে আমি বিস্মিত না হয়ে পারিনি। প্রধানত সোনিয়া গান্ধী সরকারে নেই। হতে পারে তিনি কংগ্রেসের সভাপতি ও ক্ষমতাসীন জোটের (ইউপিএ) প্রধান; কিন্তু আমরা বোধকরি ভুলে গিয়েছিলাম সরকার চালান মনমোহন সিং। ব্যক্তির ইচ্ছা এখানে মুখ্য নয়, মুখ্য রাষ্ট্রীয় নীতি। বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের একটা স্পষ্ট নীতি আছে। ওই নীতির বাইরে সোনিয়া কেন, মনমোহন সিং যেতে পারেন না বা যান না। দ্বিতীয়ত, ভারত বহুপাক্ষিকতার আলোকে সম্পর্ক তৈরি করে না। সম্পর্ক তৈরি করে দ্বিপাক্ষিকতার ভিত্তিতে। এখানে বহুপাক্ষিকতার কোনো সুযোগ নেই। তাই এ সফর থেকে যে বেশি কিছু পাওয়া যাবে না, এটা ছিল খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। আমি এতে অবাক হইনি। অবাক হয়েছিলাম যখন আমাদের পত্রিকাগুলো মন্তব্য করেছিল, অনেকটা এভাবে যে, বাংলাদেশ-ভারত মধ্যকার সমস্যার সমাধান সোনিয়া গান্ধীর হাতে রয়েছে। ভারতের বাইরে গিয়েও সোনিয়া গান্ধী খুব একটা মন্তব্য কখনও করেননি। বাংলাদেশে এসেও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে খুব একটা মন্তব্য করলেন না। অটিজম সম্মেলনে কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তার তথ্যসচিব সংবাদমাধ্যমকে যা জানালেন, তাতে আমরা কয়েকটি বিষয় খুঁজে পাই। এক. জঙ্গি এবং সন্ত্রাস দমনে সমন্বিত পদক্ষেপ নেবে বাংলাদেশ ও ভারত, দুই. সোনিয়া-হাসিনা আলোচনায় আঞ্চলিক সহযোগিতা, উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয় অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে স্থান পায়, তিন. ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় আলোচনা হয়, চার. স্বাস্থ্য ও সামাজিক ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন সোনিয়া গান্ধী। সোনিয়া সাংবাদিকদের সঙ্গে মুখোমুখি হননি। দুই নেত্রীর আলোচনার বিবরণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য সচিব। যদিও একান্তে কোনো সহকারী ছাড়াই সোনিয়া-হাসিনা যে আলোচনা হয়, তার বিবরণ তথ্যসচিব দেননি। তাহলে প্রশ্ন এসে যায়, সোনিয়ার এই সফর থেকে আমরা কী পেলাম? ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ও সোনিয়া গান্ধীর শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা দিয়েছে। বাংলাদেশ যে ‘বন্ধুকে’ সম্মান জানাতে জানে, এটা বাংলাদেশ আবারও প্রমাণ করল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্তি ইন্দিরা গান্ধীর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। ইন্দিরা গান্ধী নিজে সেই ১৯৭১ সালে বিভিন্ন দেশ সফর করেছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগ্রহ করতে। ওই সময়ে ভারত যদি আমাদের পাশে না থাকত, তাহলে হয়তো মুক্তিযুদ্ধ আরও প্রলম্বিত হতো। তাই ইন্দিরা গান্ধীকে যখন বাংলাদেশ মরণোত্তর স্বাধীনতা সম্মাননা দেয়, এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু সোনিয়া গান্ধীর ঢাকায় উপস্থিতির সময় যখন লালমনিরহাটের পাটগ্রামের রফিকুল ইসলামকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে সনিয়াজান নদীতে ভাসিয়ে দেয় (যার ছবিও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে), তখন ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকে বৈকি! আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিএসএফের হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সোনিয়া-হাসিনা আলোচনায় এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। সন্ত্রাস দমনে যৌথ উদ্যোগ কেন? সন্ত্রাসবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। যদি সার্কভুক্ত দেশগুলো সন্ত্রাস দমনে একটি চুক্তির আওতায় আসত, তাহলে ভালো হতো। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সমস্যা প্রচুর (ছিটমহল, বাণিজ্য, বাংলাদেশী পণ্যের প্রবেশাধিকার, সীমান্ত ইত্যাদি)। এর একটি ক্ষেত্রেও যদি সোনিয়া গান্ধী আমাদের আশ্বাসের বাণী শোনাতেন, আমরা খুশি হতাম। কিন্তু সেই আশ্বাসের বাণী নেই।
 
বস্তুত ভারত তার স্বার্থ একের পর এক আদায় করে নিচ্ছে। আমরা আমাদের সুবিধা পাচ্ছি না। ট্রানজিট আমরা দিলাম। এখন আসবে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবহারের দাবি। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে আমাদের নিজেদেরই সমস্যা। আমাদের আমদানি-রফতানি বাড়ছে। ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে ১ কোটি ৮৯ লাখ ৮৪ হাজার ৩৩৫ মেট্রিক টন কার্গো (২০০৪ সালে এর পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৯৪ লাখ ১৩ হাজার ৪৬০ মেট্রিক টন)। ২০০৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ৪২ লাখ ৩৬ হাজার ২৬১ মেট্রিক টনে। একই সময় রফতানির পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ ৫৭ হাজার ৫৫৪ মেট্রিক টন (২০০৩) থেকে ৩৩ লাখ ৯২ হাজার ৯৭৪ মেট্রিক টন (২০০৭)। ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর মোট হ্যান্ডলিং করেছে ২ কোটি ১৪ লাখ ৪১ হাজার ৮৮৯ মেট্রিক টন পণ্য। ২০০৭ সালে তা হয়েছে ২ কোটি ৭৬ লাখ ২৯ হাজার ২৩৫ মেট্রিক টন। জাহাজ ভিড়েছে ১৭২০টি থেকে (২০০৩) ১৯৪৫টি (২০০৭)। প্রতিবছর শতকরা ১৪ ভাগ হারে কনটেইনার পরিবহন বাড়ছে। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান আমাদের কী বলে? পরিসংখ্যানই বলে দেয় আগামী ৫ বছরে এই বন্দরের কনটেইনার পরিবহন আরও বাড়বে। তাই বর্তমান অবকাঠামো বজায় রেখে অন্যকোনো দেশকে ওই বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া যায় না। গভীর সমুদ্রে বন্দর নির্মিত হলে তা বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, আমাদের নিরাপত্তার জন্য এই বন্দরের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের সামুদ্রিক পরিবহনের ৯২ ভাগ পরিচালিত হয় এই বন্দর দিয়ে। এখন ভারতের ‘সাত বোন’ রাজ্যগুলোর কনটেইনার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিবহনের সুযোগ দিলে চট্টগ্রাম বন্দরে জট সৃষ্টি হবে। বিঘ্নিত হবে আমাদের পণ্য রফতানি। মনে রাখতে হবে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমরা ১৪ লাখ ৪২ হাজার ৭৫৭ মেট্রিক টন গার্মেন্ট পণ্য (তৈরি পোশাক) রফতানি করেছি, যা ছিল রফতানির তালিকায় শীর্ষে। এখন এ খাতে রফতানি বিঘ্নিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। একই সঙ্গে খাদ্যদ্রব্য ও বিভিন্ন কাঁচামাল মূলত আমদানি হয় এই বন্দর দিয়েই। খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। ভারত থেকে খাদ্য আমদানি করার সম্ভাবনা (ট্রেনে) দিনে দিনে কমে আসছে। কেননা সেখানে উত্পাদন হ্রাস পাচ্ছে খরার কারণে। চলতি বছর ভারতকে খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে। সুতরাং সমুদ্র পথেই আমাদের খাদ্য আমদানি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভরসা ওই চট্টগ্রাম বন্দর। কিন্তু ভারতকে এই বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ায় এখন চীনও এই বন্দর ব্যবহার করতে চাইবে। কেননা চীনের উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোর (ইউনানসহ) সঙ্গে কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। এ অঞ্চলে রয়েছে চীনের বেশ কয়েকটি প্রদেশ-ইউনান, গুইজু, গুয়ানজি ইত্যাদি। শুধু গুয়ানজি প্রদেশ দক্ষিণ চীন সাগর ঘেঁষে থাকায় এখানে পোর্ট রয়েছে। তবে তা আন্তর্জাতিক মানের নয়। এবং কুনমিং (ইউনানের রাজধানী) থেকে বেশ দূরে। পণ্য পরিবহনে তাই খরচ বেড়ে যায়। কুনমিংয়ের সঙ্গে চট্টগ্রামের বিমান দূরত্ব মাত্র এক ঘণ্টার। চীনের তাই আগ্রহ রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যাপারে। আগামীতে চীনের সঙ্গে সড়ক পথে চট্টগ্রামের (মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে) একটা যোগসূত্র স্থাপিত হতে পারে। এখন ভারতকে আমরা চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দিলাম। আগামীতে চীনকেও দিতে হবে। একই সঙ্গে চীনকে এই বন্দর ব্যবহার করে আমদানি করারও সুযোগ দিতে হবে। আমরা কি বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছি কী পরিমাণ কনটেইনার তখন চট্টগ্রাম বন্দরে আসবে? ‘কানেকটিভি’র আওতায় ভুটান ও নেপালকে মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মংলা বন্দর তো এক কথায় অচল। পলি পড়ে সমুদ্রের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। বড় জাহাজ সেখানে খুব একটা প্রবেশ করতে পারে না। অতীতে কোনো সরকারই মংলাকে সচল করার উদ্যোগ নেয়নি। কেননা ড্রেজিংয়ে অনেক খরচ। উপরন্তু ড্রেজিং করেও দেখা গেছে অতিদ্রুত পলি এসে তা আবার ভরাট করে দেয়। এ অঞ্চলের রাস্তাঘাটও প্রশস্ত নয়। হেভি ট্রাক চলাচলের জন্য অনুপযুক্ত। যুক্তির খাতিরে ভুটান ও নেপালের কথা বলা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রেই তারা এটা ব্যবহার করবে না। ভারতের আগ্রহ নেই মংলা বন্দরের ব্যাপারে। মূলত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘সাত বোন’ রাজ্যগুলোর জন্যই চট্টগ্রাম বন্দরের এই গুরুত্ব। ভারতের সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের ঋণসহায়তার কথা স্মরণ করতে চাই। ওই ঋণ ব্যবহার হবে আবার সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নে। এতে করে তো লাভবান হবে ভারত। বাংলাদেশের ভেতরকার রাস্তা প্রশস্ত হবে, বেশকিছু কৃষিজমি তাতে নষ্ট হবে। কিন্তু উন্নয়ন হবে ভারতের ‘সাত বোন’ রাজ্যের। চট্টগ্রাম থেকে আগরতলার দূরত্ব ২৪৮ কিমি, আইজলের দূরত্ব ৬৫৫ কিমি, শিলংয়ের দূরত্ব ৬৭৫ কিমি আর কোহিমা রয়েছে ৮৮০ কিমি দূরত্বে। এখন এই অঞ্চলগুলো ব্যবহার করে কলকাতা বন্দর। দূরত্বটা লক্ষ্য করুন : কলকাতা থেকে আগরতলা (ত্রিপুরা) ১৬৮০ কিমি, কলকাতা-আইজল (মিজোরাম) ১৫৫০ কিমি, কলকাতা-শিলং (মেঘালয়) ১১৮০ কিমি ও কলকাতা-কোহিমা (নাগাল্যান্ড) ১৪২০ কিমি। অংকের হিসেবেই বলে দেয় চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ কেন? প্রশ্ন আসতেই পারে—বিনিময়ে আমরা কী পেলাম? কিছু অশুল্ক বাধা দূর করার প্রতিশ্রুতি (কোন কোন পণ্য? যা সম্ভবত বাংলাদেশ উত্পাদন করে না!)! ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ (কবে থেকে তাও আমরা জানি না)। আমাদের এজেন্ডা তো অনেক। টিপাইমুখ, তিস্তা, সীমান্ত চিহ্নিতকরণ, সমুদ্রসীমা, বাণিজ্য ভারসাম্য কমানো, বিএসএফ হত্যা বন্ধ, ছিটমহল, দক্ষিণ তালপট্টি ইত্যাদি। প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থ জড়িত। এই জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। সোনিয়া-হাসিনা আলোচনায়ও উপেক্ষিত থাকল জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো। আমি খুশি হতাম যদি সরকারপ্রধান সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার আগে বিরোধী দলের মতামত বা তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। আমরা তো এই সংস্কৃতি বাংলাদেশে তৈরি করতে পারিনি। ভারত কিন্তু তা করে। জাতীয় ইস্যুতে বিরোধী দলের মতামত নেয়। ইউরোপের কথা না হয় নাই বা বললাম। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা তা করছি না। জনগণের ভোটে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার দলটির বা প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে। জনগণের ম্যান্ডেট তার রয়েছে। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত, সেখানে বিরোধী দলের পরামর্শ নেয়া ক্ষতির কিছু ছিল না। বরং তাতে করে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান আরও শক্তিশালী হতো। তারপরও ডিবেট হোক। বিএনপি সংসদে গিয়ে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করুক। তাদের সমালোচনা সংসদেই হোক। তারা তাদের প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করুক। শুধু একটা অনুরোধ রাখব সরকারি দলের সংসদ সদস্যের প্রতি, তারা সংসদে অসংলগ্ন আচরণ করবেন না, অতীত ইতিহাস টেনে সংসদে অযথা উত্তাপ ছড়াবেন না। তারা বিরোধী দলের বক্তব্যের জবাব দেবেন। কিন্তু তা যেন হয় মার্জিত এবং তথ্যনির্ভর। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম সেই বিতর্কের জন্য। বিএনপিকে সংসদে আসতে সুযোগ দেয়া হোক। জাতীয় ইস্যুগুলো আলোচিত হোক। ডিবেট হোক। প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসুক। শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় (জানুয়ারি ২০১০) যেসব চুক্তি হয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ জানাটা জরুরি। এখন সোনিয়া গান্ধী বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসা নিয়ে দিল্লি ফিরে গেলেন। কিন্তু আমরা কী পেলাম? 
ড. তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com

আস্থার জায়গাটা কি তৈরি হচ্ছে ????

ড. তারেক শামসুর রেহমান
গত ২৯ জুলাইর একটি খবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরের পুলিশি নির্যাতনের খবর যখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় ও তা হাইকোর্টের নজরে আসে, তখন হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে সকালে (২৮ জুলাই) একটি রুল জারি করেছিল। আর বিকালে শুনানি শেষে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত। আট সপ্তাহের মধ্যে বিভাগীয় তদন্তেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের একটি আদেশে আমরা আশার আলো দেখতে পাই। আদালত যে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে পারে, এটা একটা বড় প্রমাণ। নিরীহ ছাত্র কাদেরকে পুলিশ ডাকাত বানিয়েছিল। যে ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন বিভাগে পড়ে পাস করে বেরুনোর পরপরই যার ভালো চাকরি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে পুলিশ তাকে ডাকাত বানিয়ে ফেললো। আজ মাননীয় বিচারপতিরা যদি হস্তক্ষেপ না করতেন, তাহলে কাদেরকে হয়তো জেলের ঘানি টানতে হতো। একজন মেধাবী ছাত্র কাদের হয়তো শেষ পর্যন্ত ডাকাত (?) হিসেবেই পরিচিত হতো। এর চেয়ে আর দুঃখজনক তো কিছু হতে পারে না।
সাম্প্রতিককালে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। আমিনবাজারে ৬ ছাত্রের হত্যাকা- ও সেখানে মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে পুলিশের ব্যর্থতা কিংবা আরো আগে বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুককে পিটিয়ে আহত করার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে নানা কথা। এর একটি ঘটনায়ও পুলিশের ভূমিকাকে সমর্থন করেননি কেউ। আজ যখন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে হাইকোর্ট প্রশ্ন তোলে, তখন একটা আস্থার জায়গা আমরা দেখতে পাই। এর আগে হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ ১২ জুলাই সরকার ও বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিল, 'দয়া করে জাতিকে উদ্ধার করুন। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে জাতি উদ্বিগ্ন। এই সংকটপূর্ণ অবস্থা থেকে জাতি মুক্তি চায়।' বিচারপতিদের ওই মন্তব্যই বলে দেয় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন। অর্থনীতির অবস্থাও ভালো নয়। ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আটার দাম বেড়েছে প্রায় ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে শতকরা ১১৮ দশমিক ৩৬ ভাগ ও ১৪৬ দশমিক ১৫ ভাগ। ২০১০-২০১১ অর্থবছরের শুরু থেকেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘর অতিক্রম করে। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সার ও ডিজেলের দামও বাড়ান হয়েছে। ইতিমধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষদের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ায় এমডিজি'র বাস্তবায়ন (২০১৫ সালের মধ্যে) এখন প্রশ্নের মুখে। রেমিটেন্স আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। গত অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ এর আগের বছরে (২০০৯-২০১০) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি। বিদেশে বাংলাদেশিদের শ্রমবাজার দিনে দিনই সংকুচিত হয়ে আসছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়েও সমস্যা রয়ে গেছে। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগও দেয়া সম্ভব হয়নি। ২০১১ সালে জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ যুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে জুন পর্যন্ত মাত্র ৬৩০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী (৫ জুলাই) ২০০৪ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো, এখনো সেই পরিমাণ বিদ্যুৎই উৎপাদন হচ্ছে। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি কোনো আশার কথা বলে না। এর মাঝে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। পুলিশের পিটুনিতে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য এখন নিউইয়র্কে। জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে পুলিশের কী লাভ হয়েছে, আমি জানি না। কিন্তু এতে সরকারের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। পুলিশি অত্যাচারের ওই ছবি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে সমগ্র বিশ্বে, যা পুলিশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পুলিশের এই 'অতি বাড়াবাড়ি'র সমালোচনা না করে সমর্থন করেছিলেন। অতীতেও পুলিশ প্রায় একই ধরনের 'কা-' করেছে। পুলিশের জন্য একটি 'কোড অফ কনডাকট' প্রণয়ন করা বোধ হয় জরুরি হয়ে পড়েছে। মিডিয়ায় দুই পুলিশ অফিসার 'অভিযুক্ত' হলেও, তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়া সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে না কোনো অবস্থাতেই। এই যখন পরিস্থিতি তখন যে প্রশ্নটি জরুরি তা হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। দেশের সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তনের ফলে একটা আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকগুলো ইস্যুতে (রাষ্ট্রধর্ম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, মৌলিক কাঠামো) খোদ মহাজোটের শরিকদের মাঝেও বিভক্তি রয়েছে। মহাজোটের শরিকরা (ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাপ) পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিশেষ কমিটির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেও, প্রকারন্তরে তারা তাদের দ্বিমতের কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন সেমিনারে। এদিকে ড. কামাল হোসেন বলেছেন সংবিধানে ১৬তম সংশোধনী আনার। সব মিলিয়ে সমঝোতা কীভাবে সম্ভব, তা এক বড় প্রশ্ন এখন। সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হবার পরও সরকার বিরোধী দলকে সংসদে এসে কথা বলার আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাবে_ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বিরোধী দলের উচিত সরকারের এই বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে তাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করা। এতে করে অন্তত সংসদে একটি রেকর্ড থাকলো। সরাকর যদি তাদের প্রস্তাব নাও মানে, বিরোধী দলের প্রস্তাবাবলি বিবেচনায় নিয়ে একটি আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। যেহেতু সংসদ কার্যকর, সেহেতু সংসদে এসে প্রস্তাব দেয়ার মধ্য দিয়ে সংসদীয় রাজনীতির ধারাকে আমরা আরো শক্তিশালী করতে পারি।
যে জনপ্রিয়তা নিয়ে সরাকর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল, সেই জনপ্রিয়তা অনেকটাই মস্নান হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর তাৎপর্য যতটা না বেশি, তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা। বিশ্ব অর্থনীতির উত্থান-পতন তারা বোঝেন না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়লো কী কমলো, এতে তাদের কিছু যায় আসে না। টাকার মান কমে গেলে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়ে, এটাও তারা বোঝেন না। তারা চান জিনিসের দাম কম থাকুক। চালের দাম কমে যাক। কমুক তেলের দাম। সরকার যদি এদিকে দৃষ্টি দিত, বোধকরি এটা সরকারের জন্য ভাল হতো। মানুষের তো সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা অনেক। ওএমএসের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সরকারের নীতি নির্ধারকরা এ দিকে দৃষ্টি দেন কি না জানি না। দেশে কত সংখ্যক লোক দরিদ্রতার নিচে বসবাস করে, এর একটা পরিসংখ্যান আছে। এর জন্য কিছু লোকও রয়েছেন, যারা এসব পরিসংখ্যান তৈরি করে দেন। কিন্তু কেউ কী জানেন 'ছদ্মবেশী দরিদ্রের' সংখ্যা বাংলাদেশে কত? মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা অংশ দরিদ্রতার নিচে চলে গেছে। সীমিত আয়ে তাদের আর সংসার চলে না, চালানো যায় না। এদের নিয়ে কেউ ভাবে না।
শুধু নির্বাচনের নামই গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রে শেখায় সহনশীলতা। গণতন্ত্রে শেখায় পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখার কথা। একদলীয় সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের স্পিরিটের পরিপন্থী। বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে আমরা গণতন্ত্রের সুফলকে সাধারণ মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে পারিনি। উচ্চ আদালত যে মন্তব্যটি করেছে, তা যদি আমরা বিবেচনায় নেই, তাহলে তা আমাদের সবার জন্যই মঙ্গল।
উচ্চ আদালতের দুটো সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ। একটি সিদ্ধান্তে যেমনি সরকার ও বিরোধী পক্ষকে বলা হয়েছে একটি সমঝোতায় যেতে, তেমনি অপর একটি বেঞ্চের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে পুলিশ যাই করুক, তা উচ্চ আদালতের দৃষ্টি এড়ায় না। এতে করে সরকার বা পুলিশের কতটুকু টনক নড়বে বলতে পারবো না, তবে একটা আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষ একটা আস্থা খুঁজে পেয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। কাদেরের ঘটনায় ইতিমধ্যে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। আদালতের রায় অনুযায়ী একটি তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। আমরা দেখতে চাই তদন্ত কমিটি দোষীদের দৃষ্টন্তমূলক শাস্তি দিক। উচ্চ আদালতের এই রায়টি একটি 'ম্যাসেজ' পেঁৗছে দিল সবার কাছে_ আর তা হচ্ছে যিনি যত শক্তিশালীই হোন না কেন, অন্যায় করলে তার শাস্তি পেতে হয়ই।
দৈনিক ডেসটিনি. বুধবার৩ আগস্ট ২০১১, ১৯ শ্রাবণ ১৪১৮
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়