রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

'ইটলস'-এ বিজয় ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

তারেক শামসুর রেহমান সমুদ্র আইনবিষয়ক আদালত (ইটলস) ১৪ মার্চ মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধে যে রায় দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের বড় 'বিজয়' অর্জিত হলেও, বাংলাদেশকে এখন মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার প্রশ্নে মিয়ানমার একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যেমনি সীমান্ত রয়েছে, ঠিক তেমনি সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গেও। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতকে আমরা যত বেশি গুরুত্ব দিয়েছি, মিয়ানমারকে সেভাবে গুরুত্ব দিইনি। শুধু তা-ই নয়, ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট-সংক্রান্ত সমঝোতায় গেলেও মিয়ানমার রয়ে গেছে উপেক্ষিত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশের উন্নয়নে মিয়ানমারের সম্ভাবনাকে কখনোই যাচাই করে দেখেননি। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক খুব ভালো, তা-ও বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টান্ত আমরা অনুসরণ করতে পারতাম; কিন্তু তা-ও আমরা করিনি। মিয়ানমারে প্রচুর গ্যাস রিজার্ভও রয়েছে। মিয়ানমার সমুদ্রের তিনটি ব্লক ছাড়া স্থলভাগে দেশটির আরো ১৯টি ব্লক রয়েছে। সমুদ্রের তিনটি ব্লকে ১৮ দশমিক ০১২ টিসিএফ এবং অপর ১৯টি ব্লকে ৮৯ দশমিক ৭২২ টিসিএফ গ্যাস মজুদ আছে। এই গ্যাসের ব্যাপারে আগ্রহ এখন অনেক দেশের। থাইল্যান্ডের সঙ্গে গ্যাস রপ্তানির ব্যাপারে ইতিমধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীনের সঙ্গেও মিয়ানমার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি অনুযায়ী পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে মিয়ানমারের গ্যাস যাবে। এর আগে ভারতও মিয়ানমারের গ্যাসের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস নিতে। এটা নিয়ে জোট সরকারের আমলে বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং একপর্যায়ে জোট সরকার ভারতের ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তী সময়ে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে গ্যাস নিতে চাইলেও, পরে ওই সিদ্ধান্ত পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু তার পরও ভারত মিয়ানমারের গ্যাসের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ অব্যাহত রেখেছে। প্রতিযোগিতায় এবং গ্যাসের মূল্য নির্ধারণে ভারত চীনের কাছে হেরে গেলেও সমুদ্রে গ্যাসপ্রাপ্তিসাপেক্ষে মিয়ানমার ভারতকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমরা এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারিনি। অথচ আমাদের জন্য সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশকেই এখন এগিয়ে আসতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্রুত মিয়ানমার সফর করে 'সম্পর্কের নতুন এক অধ্যায়ের' সূচনা করতে পারেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা অত্যন্ত জরুরি। দ্বিতীয়ত, চীনের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের ব্যাপারে (কুনমিং-মুসে-ঘুমধুম) বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় তিনি কুনমিং গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ওই সড়কটির ব্যাপারে আগ্রহ দেখান। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সম্মতি ছাড়া এই সড়কটি নির্মাণ করা যাবে না। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই তাই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরো উন্নত করা প্রয়োজন। এই সড়কটি যদি ভবিষ্যতে নির্মিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের চিত্র পুরোপুরি বদলে যাবে। তৃতীয়ত, চীন ২০০১ সালে চীনের ইউনান প্রদেশ, মিয়ানমার, ভারতের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্য ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রস্তাব করেছিল, যা 'কুনমিং উদ্যোগ' নামে পরিচিত। বাংলাদেশ যে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির সূচনা করেছিল, তার সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করে এই 'কুনমিং উদ্যোগ'-এর ওপর। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত জোট সরকারের সময় বাংলাদেশ 'কুনমিং উদ্যোগ'-এর প্রতি সমর্থন জানালেও বর্তমান মহাজোট সরকারের বৈদেশিক নীতিতে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। মহাজোট সরকার তার বৈদেশিক নীতিতে যেসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তার মধ্যে 'কুনমিং উদ্যোগ' কিংবা পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি নেই। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য ছিল একটাই_তা হচ্ছে আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করা। কিন্তু গত তিন বছরে এ ব্যাপারে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চতুর্থত, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করা, বিশেষ করে আসিয়ানের 'ডায়লগ পার্টনার'-এর মর্যাদা পেতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশ বর্তমানে ২৬ সদস্যবিশিষ্ট আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের (এআরএফ) সদস্য। এর পরের ধাপ 'ডায়লগ পার্টনার'। 'ডায়লগ পার্টনার'-এর মর্যাদা পেলে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ পেতে সহজ হয়। ভারত ইতিমধ্যে 'ডায়লগ পার্টনার'-এর মর্যাদা পেয়েছে। বর্তমানে ১০টি দেশ এর সদস্য। পঞ্চমত, মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিনির্ভর মিয়ানমারে বাংলাদেশি সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় দ্রুত বেশ কিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রপ্তানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজশিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারের মাইআউংমিয়া দ্বীপে প্রায় ৪০ মিলিয়নের বেশি টন চুনাপাথর রয়েছে। ষষ্ঠত, মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। অতীতে জমি লিজ দেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার আগ্রহ দেখিয়েছিল; কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এটা কার্যকর করা গেলে ইরাবতীর দুই কূলজুড়ে উর্বর শস্যক্ষেত্র বাংলাদেশি কৃষকরা সোনার ফসলে ভরে দিতে পারবেন। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবীখ্যাত। আমাদের বিকাশমান ফার্নিচার শিল্পের প্রয়োজনে আমরা মিয়ানমার থেকে সহজে মূল্যবান কাঠ আমদানি করতে পারি, যা কিনা আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে রপ্তানি করতে পারব। চাল, ডাল, ছোলা, আদা, পেঁয়াজ, রসুনসহ নানা জাতের মসলা মিয়ানমার থেকে আরো সহজে আমদানি করা যাবে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলে। সপ্তমত, ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর হয়ে হাজার হাজার পর্যটক মান্দালয়, কাস্পেইন ও ইয়াঙ্গুন ভ্রমণ শেষে মায়োহং আসেন। বর্তমানে এই পর্যটকরা মায়োহং থেকে পুনরায় ইয়াঙ্গুনে ফিরে যেতে বাধ্য হন। মায়োহং থেকে তাঁদের কঙ্বাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রমণের ব্যবস্থা করা যায়। কেননা অনেক পর্যটকই আর একই পথে ইয়াঙ্গুনে ফিরে যেতে চান না। অষ্টমত, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে অদূর ভবিষ্যতে ভারত-মিয়ানমার গ্যাস পাইপলাইন প্রজেক্টের সম্ভাবনা উজ্জ্বল, যা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতে গ্যাস রপ্তানির পরিকল্পনা নির্দেশ করে। এই পাইপলাইন প্রজেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশে মিয়ানমারের গ্যাস রপ্তানিও সম্ভব (মোহনা হোল্ডিংস এ ধরনের একটি প্রস্তাব করেছিল ১৯৯৬ সালে)। মিয়ানমারের কালাদান মাল্টিমুডাল রিভার প্রজেক্ট থেকেও বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে।
হামবুর্গে 'ইটলস'-এ বাংলাদেশের বিজয় বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বাংলাদেশকেই এখন উদ্যোগী হতে হবে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সড়কটি দ্রুত শেষ করাও জরুরি। 'ইটলস'-এর এই রায়ের একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়ে যাবেই। বাংলাদেশ এই রায়কে নিজেদের স্বার্থে কতটুকু এবং কিভাবে ব্যবহার করবে, সেটাই দেখার বিষয় এখন।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
KALER KANTHO, 22.03.2012

চার দশকের বৈদেশিক নীতি

ড. তারেক শামসুর রেহমান
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪১ বছরে পা দেবে চলতি মার্চ মাসে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে ২০১২ সালের ২৬ মার্চ_ এই সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে মূলত তিনটি ধারা আমরা লক্ষ করব। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত একটি ধারা। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর, যা অব্যাহত থাকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এ তিনটি ধারাতেই কিছু কিছু উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি আমরা লক্ষ করি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, তার কয়েকটি উল্লেখ্যযোগ্য দিক ছিল_ ক. সংসদীয় গণতন্ত্র, খ. সংসদীয় গণতন্ত্রের আওতায় দলীয় কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা, গ. সমাজতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো হল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি। কোনো কোনো বিশ্লেষক এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে এটা ছিল অনেকটা 'ভারতীয় মডেল'। ওই সময় বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। যেমন_ ক. সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের 'বিশেষ সম্পর্ক' স্থাপন, খ. ভারতের নির্ধারক ভূমিকা। তবে আদর্শ হিসেবে জোট নিরপেক্ষতা অনুসরণ করা, গ. অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, ঘ. চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অনীহা ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন ৪৩ মাস। ওই সময় ব্রেজনেভ (সাবেক সেভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান) প্রণীত যৌথ নিরাপত্তা চুক্তির প্রতি সমর্থন, তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারের ৭ দফা দাবির প্রতি সমর্থন, ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা শীর্ষক সম্মেলনের প্রতি সমর্থন ইত্যাদি কারণে বহির্বিশ্বে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তুলছে, যা এ অঞ্চলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থকে রক্ষা করবে। বহির্বিশ্বে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণেই বাংলাদেশ ওই সময় সোভিয়েত শিবিরে অবস্থান করেছিল এবং সোভিয়েত-ভারত সম্পর্কের কারণে এটা একধরনের বাধ্যবাধকতাও ছিল। অভ্যন্তরীণভাবে একটা 'চাপ'ও ছিল, যারা মনে করতেন সোভিয়েত সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশে 'সমাজতন্ত্র' নির্মাণ করা যাবে না। ওই সময় ১৯৭২ সালের মার্চে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা ছিল বিতর্কিত। শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিলেও ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। চীনের সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগের একটা উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। ১৯৭৫ সালের আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনা হয়। এর আগে ১৯৭৫ সালে যে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা বাতিল ঘোষিত হয়। সৌদি আরব ও চীন বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট-পরবর্তী ঘটনার মধ্য দিয়ে শহীদ জেনারেল জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জিয়া মনে করতেন বাংলাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিক্ষা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইসলামের শিক্ষা স্বরূপ। জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করে। আল কুদস কমিটি ও ১৯৮১ সালে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী কমিটিরও সদস্য ছিল বাংলাদেশ। জিয়ার আমলেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী পরিষদের সদস্যপদের একটিতে নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ সম্পর্কিত এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। জেনারেল জিয়া ভারতের ভূমিকার ব্যাপারে কঠোর হয়েছিলেন। বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে এবং একই বছরে ৪২ জাতি ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ফারাক্কা প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনের প্রশ্নে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রশ্নে তার অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি চীনের সঙ্গে শুধু সম্পর্ক বৃদ্ধিই করেননি, বরং বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে চীনের উপস্থিতিকে প্রয়োজনীয় করে তুলেছিলেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগান আগ্রাসনের (১৯৭৮) ব্যাপারেও বাংলাদেশ কঠোর হয়েছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বেগম জিয়া কিংবা শেখ হাসিনার (১৯৯৬-২০০১) বৈদেশিক নীতি ছিল জিয়া প্রণীত বৈদেশিক নীতির ধারাবাহিকতা। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ব্যাপারে এরশাদ, বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে তেমন কোনো পার্থক্য লক্ষ করা যায়নি। তবে শেখ হাসিনার সময় চীনের ওপর থেকে 'সামরিক নির্ভরতা' কিছুটা হ্রাস করে রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি উদ্যোগ লক্ষ করা যায়।
এরশাদের সময় (১৯৮২-১৯৯০) পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে ১৪ জন সোভিয়েত কূটনীতিককে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি সমাদৃত হয়েছিলেন। তার আমলেই ১৯৮৫ সালে সার্ক আত্মপ্রকাশ করে, যদিও এর উদ্যোগটা নিয়েছিলেন শহীদ জিয়া। তবে ১৯৮১ সালের ৯ মে ভারতীয় নৌবাহিনী দক্ষিণ তালপট্টি দখল করে নিলেও তিনি ভারতের ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করতে পারেননি। বেগম জিয়ার (১৯৯১-৯৬, ২০০১-২০০৬) বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, ক. চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া, খ. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো উন্নতকরণ, গ. আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ককে আরো কার্যকরী করা, ঘ. সৌদি আরব-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া, ঙ. ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করা। বেগম জিয়ার সময় বিচারক কূটনীতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেয়। তার আমলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। বেগম জিয়ার দ্বিতীয় টার্মে (২০০১-২০০৬) বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী বৈদেশিক নীতির সূচনা করে, যা ছিল আগে উপেক্ষিত। বেগম জিয়ার সময় চীন 'কুনমিং উদ্যোগ' এর কথা বলে (চীনের ইউনান প্রদেশ, মিয়ানমার, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো ও থাইল্যান্ডের সমন্বয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। কিন্তু ভারতের আগ্রহ ছিল 'গঙ্গা'-সেক্রং সহযোগিতার' ওপর, যে কারণে 'কুনমিং উদ্যোগ' এর আর জট খোলেনি। ভারত এখন আসিয়ান-এর সদস্য হতে চায়। যে কারণে 'কুনমিং উদ্যোগ' ও যেখানে চীনের জড়িত হওয়ার কথা রয়েছে, সে ব্যাপারে তার আগ্রহ কম। বেগম জিয়ার সময় মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্য সংকটে মিয়ানমার আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিতে পারে।
শেখ হাসিনা দুই টার্মের জন্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি হয়েছিল। যদিও তার আমলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি তিনি আর নবায়ন করেননি। ভারতে আশ্রিত পাহাড়ি শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তার আমলে সার্কের ভেতরে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত (ঝঅএছ) গৃহীত হয়েছিল। যদিও তা কার্যকরী হয়নি। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে ভারতীয় পশু আমদানি বাড়ে তিন গুণ। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পরপর কয়েকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তিনি শান্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ নেন, যা প্রশংসিত হয়। তার সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরকালে বাংলাদেশ সিটিসিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে 'হানা' চুক্তিও (হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসিসটেন্স নিডস অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তিনি ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নেওয়া হলেও সামরিক ক্ষেত্রে চীনের ওপর থেকে পরিষদে নির্ভরশীলতা তিনি কমানোর উদ্যাগ নিয়েছিলেন। তার আমলে ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ওই সময় চীনের বদলে রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার)। চীন মিগ-২৯ বিমান সরবরাহ করতে রাজি হলেও বাংলাদেশ ওই বিমান রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিল। শেখ হাসিনার সঙ্গে বাংলাদেশ দুটি আঞ্চলিক জোট ডি-৮ ও বিমসটেক-এ যোগ দেয়। তিনি ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে (ইসলামবাদ, মার্চ, ১৯৯৭) যোগ দিয়ে ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি একটি অভিন্ন শহর প্রতিষ্ঠারও দাবি জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি একটি মহাজোট সরকার গঠন করেছেন।
মহাজোট সরকারের সময় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরও হয়েছে, যদিও ট্রানজিট ফি এখনো নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপক্ষীয়তার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেল ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনো ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটো দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এই সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে_ এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের 'সাত বোন' রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশি পণ্য খালাশ করতেই হিমশিম খাবে। এ ক্ষেত্রে 'সাত বোন' রাজ্যের পণ্য শক্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এই ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতাসংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে 'ভাবে' ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যেভাবে পরিচালিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা সন্দেহ অবিশ্বাসে ঢাকা। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসের অপসারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে হিলারি ক্লিনটন যে খুশি হননি, তা আকারে ইঙ্গিতে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। হিলারি ক্লিনটন মিয়ানমার সফর করলেন, বাংলাদেশে আসেননি। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকা- নিয়েও ওয়াশিংটন যে খুশি, তা বলা যাবে না। এমনকি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে মার্কিন প্রশাসন। দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিত করার ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য একটি ইমেজ সংকট সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশে একটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করেছে। এই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে বাংলাদেশে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে একটি সফলতা এসেছে সমুদ্রসীমা নিয়ে। ট্রাইব্যুনালের রায় আমাদের পক্ষে আসায় মিয়ানমারের সঙ্গে ৩৮ বছরের বিরোধের সমাধান হয়েছে। সমুদ্রে আমাদের অধিকার রক্ষিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু কূটনীতিতে আমরা তেমন সফল হইনি। মোট কথা গেল তিন বছরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতার হার তুলনামূলক বিচারে অনেক কম। জাতীয় স্বার্থকে চিহ্নিত করার ব্যর্থতা বহির্বিশ্বে আমাদের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। ঘন ঘন বিদেশ সফর আর সম্মেলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আর যা-ই হোক, পররাষ্ট্রনীতিতে বড় সফলতা অর্জন করা যায়নি। যে কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতা পেতে হলে একদিকে যেমন প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি, অন্যদিকে তেমন প্রয়োজন সঠিক নীতিটি প্রণয়ন।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
DESTINY 21.3.2012

আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য মরণফাঁদ

ভারতীয় পানি আগ্রাসন যে বাংলাদেশকে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। বাংলাদেশ যদি আগামী ২০ বছর পরের পরিস্থিতি চিন্তা করে এখনই একটি সুদূরপ্রবাসী পরিকল্পনা গ্রহণ না করে তাহলে এ দেশ ২০৩০ সালের দিকে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানি সঙ্কট পারমাণবিক সঙ্কটের ভয়াবহতাকেও মস্নান করে দিতে পারে। হিমালয় অঞ্চলের পানি সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে আঞ্চলিক বহুপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে। দ্বিপক্ষীয়ভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না।ড. তারেক শামসুর রেহমান ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প সম্পর্কে ভারতের উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্তের খবর বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। প্রকল্পটি দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এটি একটি বিতর্কিত মহাপরিকল্পনা, যাতে একাধিক সংযোগ খালের মাধ্যমে গঙ্গা থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হবে গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্থান ও তামিলনাড়ুতে। এতে করে গঙ্গায় যে পানি সঙ্কট হবে, তা পূরণ করা হবে ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি প্রত্যাহার করে। অথচ ব্রহ্মপুত্র হচ্ছে বাংলাদেশের তিন প্রধান নদীর একটি। ব্রহ্মপুত্রের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পানি বাংলাদেশে আসে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এই নদীটি ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। ভারত মূলত একটি মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের সেই পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ পানিশূন্য হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের একটা অংশ মরুভূমিতে পরিণত হবে। শুধু আন্তঃনদী সংযোগের কথা বললে ভুল বলা হবে। পরিসংখ্যান মতে ভারত সরকার উত্তর-পূর্ব ভারতের ২২৬টি বড় বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করেছে, যার লক্ষ্য হবে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে প্রায় ৯৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ২০১২ সালের মধ্যে 'সবার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার' অংশ হিসেবে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ভারত উত্তর-পূর্ব ভারতের নদীগুলোর ওপর ১৬টি বৃহৎ বাঁধ চালু করেছে এবং ৮টি বৃহৎ বাঁধ নির্মাণাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। এর পাশাপাশি ভারত আরো ৬৪টি বড় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা প্রকল্প প্রণয়নের কাজ হাতে নিয়েছে। এসব বাঁধ চালু হলে উজানে ও ভাটিতে সার্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যগুলো ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। তবে নিঃসন্দেহে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প আমাদের জন্য একটি বড় শঙ্কার কারণ। এই প্রকল্প খোদ ভারতেই বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। এই বিশাল নদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে ভারতের অভ্যন্তরে ৩৭টি নদীকে ৯ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি খালের মাধ্যমে সংযোগ প্রদান করে ১৫০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করার জন্য। প্রকল্পটির মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গায়। সেখান থেকে তা নিয়ে যাওয়া হবে মহানন্দা ও গোদাগাড়ীতে। গোদাগাড়ীর পানি নিয়ে যাওয়া হলে কৃষ্ণায় এবং সেখান থেকে পেনার ও কাবেরীতে। নর্মদার পানি নিয়ে যাওয়া হবে সবরমতিতে। এই বিশাল আন্তঃঅববাহিকা পানি প্রত্যাহার প্রকল্প সম্পূর্ণ করা হবে ২০১৬ সালের মধ্যে। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকারকে এ প্রকল্প একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার পরামর্শ দিয়েছিল। আগে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৫ বছর। এখন তা কমিয়ে এনে ১০ বছর করা হয়েছে। ভারতের উচ্চ আদালত একটি রায় দিয়েছে সত্য, কিন্তু আদালত এই সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে যে গঙ্গা_ কাবেরী সংযোগ প্রকল্প কোনো নতুন ধারণা নয়। এ প্রকল্প কৌশলগতভাবে অগ্রহণযোগ্য ও অবাস্তব হওয়ার আগেই বেশ কয়েকবার পরিত্যক্ত হয়েছিল। এ কাজের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, ভারত সরকারের এই প্রকল্প তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর জন্য কি ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে, তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। একই সাথে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য আন্তর্জাতিক আইনের স্বীকৃত সব রীতিনীতির প্রতি নিদারুণ উদাসীনতা প্রদর্শন করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় যেসব নদীর সংযোগ ঘটবে, তা অনেকটা এ রকম : ১. ব্রহ্মপুত্রের উপনদী মানোশ-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ, ২. কোশী-ঘাগেরা সংযোগে, ৩. গ-ক-গঙ্গা সংযোগ, ৪. ঘাদরা-যমুনা সংযোগ, ৫. শারদা-যমুনা সংযোগ, ৬. যমুনা-রাজস্থান সংযোগ, ৭. রাজস্থান-সাবরমতী সংযোগ, ৮. চুনার-শোন ব্যারেজ, ৯. শোন ব্যারেজ ও গঙ্গার দক্ষিণে শাখাগুলোর মধ্যে সংযোগ, ১০. গঙ্গা-দামোদর-সুবর্ণ রেখা সংযোগ, ১১. সুবর্ণরেখা-মহান্দী সংযোগ, ১২. কোশিদ-কাচী সংযোগ, ১৩. ফারাক্কা-সুন্দরবন সংযোগ, ১৪. ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা সংযোগ, ১৫. মাহান্দী (মনিভদ্র)- গোদাগাড়ী (ধলেশ্বর) সংযোগ, ১৬. গোদাগাড়ী (ইকম পল্লী)-নার্গাদুন সাগর সংযোগ, ১৭. গোদাগাড়ী (পোলাভারাম)- বিজয়া-ওয়ালা সংযোগ, ১৮. কৃষ্ণা (আলামাডি) পেন্সার সংযোগ, ১৯. কৃষ্ণ (স্বীমইলাম) পেন্সার সংযোগ, ২০. কৃষ্ণ (নার্গানুন সাগর)-সোমশিলা সংযোগ, ২১. পেন্না (সোমশিলা)- কাবেরী (গ্রান্ড অ্যানিকুট) সংযোগ, ২২. কাবেরী (কন্ডরাইয়া)-ভাইগা-গু-ুর সংযোগ, ২৩. কেম-বেতওয়া সংযোগ, ২৪. পার্বতী-কালী-সিন্ধু-চম্বল সংযোগ, ২৫. পার-তাপ্তী-নর্মদা সংযোগ, ২৬. দামন গঙ্গা-পিঞ্জল সংযোগ, ২৭. বেদাতি-ভার্গা সংযোগ, ২৮. বেত্রাবতী-হেমবতী সংযোগ এবং ২৯. পদ্মা-আক্ষান শোভেলী-ভাইশ্চার সংযোগ। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থায় ভয়াবহ প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। এ প্রকল্পে বাংলাদেশের যেসব ক্ষতি হতে পারে, তা নিম্নবর্ণিতভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে : ১. ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বর্তমানে পাওয়া প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দীর্ঘদিন ধরে পাওয়া পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে। ২. বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে তার মিঠা পানির মোট ৮৫ শতাংশই ব্রহ্মপুত্র এবং গঙ্গা নদী থেকে পায়। একইভাবে ব্রহ্মপুত্র থেকেই পাওয়া যায় প্রয়োজনের ৬৫ শতাংশ পানি। সুতরাং ভারতের পরিকল্পনামতো পানি প্রত্যাহার করা হলে তা আমাদের দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। ৩. ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে ভূ-উপরিস্থ পানি কমে গেলে ভূগর্ভস্থ পানি বেশি পরিমাণে উত্তোলন করা হবে এবং এতে আর্সেনিক সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। ৪. মিঠা পানির মাছের পরিমাণ হ্রাস পাবে এবং জলপথে পরিবহন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ৫. পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কোনো কৃষি প্রকল্প হাতে নিতে পারবে না। পানির অভাবে কৃষি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ৬ দূষিত নদীগুলোর পানি অপেক্ষাকৃত দূষণমুক্ত অন্য নদীগুলোর পানিকেও দূষিত করে তুলবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গঙ্গার দূষিত পানি অন্য নদীর পানিকে দূষিত করে তুলবে। বর্তমানে পরিবেশ দূষণের শিকার নদীগুলোর পানি অন্য নদীগুলোতে মেশালে এ অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষা আরো কঠিন হয়ে পড়বে, যা এ অঞ্চলের মানুষ ও বন্যপ্রাণীর জীবন বিপন্ন করে তুলবে, ৭. এসবের চেয়েও মারাত্মক বিষয় হচ্ছে প্রকল্পে নির্মিতব্য বড় বড় বাঁধ গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। এছাড়া এ প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়ায় আমাদের পরিবেশগত ও জলপ্রবাহ বিষয়ক প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। পানি এবং মাটির অধিক লবণাক্ততা আমাদের দেশকে ধীরে ধীরে একটি মরুভূমিতে পরিণত করবে। নদী মানে শুধু পানি নয়, নদীর মধ্যে এবং একেই কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা জীবনগুলোর জন্য এখানে আছে এক অসাধারণ জীববৈচিত্র্য। অথচ এই জীববৈচিত্র্যই নয়, আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ভারত তার আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত এখন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতকে আরো শক্তিশালী করবে। ভারত অনেক আগেই এ প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এ ধরনের প্রকল্প অবৈধ। কেননা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের সবকটি নদীই আন্তর্জাতিক নদী। তাই এসব নদীর একতরফা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেআইনি ও অগ্রহণযোগ্য। আন্তর্জাতিক নদীর পানির ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতি হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। তা অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি না করেই হতে হবে। কিন্তু ভারতের এই উদ্যোগে একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে, ভারত বাংলাদেশের ওপর এ প্রকল্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে। ১৯৯২ সালের ডাকলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত একটি অস্বচ্ছ ও স্বেচ্ছাচারমূলক পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে। ভারত আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশনের বেশকিছু বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে। ১. প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহের পানি ব্যবহার করার সময় পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর যাতে কোনো বড় ধরনের ক্ষতি না হয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে [অনুচ্ছেদ ৭ (১)], ২. জলপ্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌম ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় অখ-তা, পারস্পরিক সুবিধা লাভ এবং সৎ বিশ্বাসের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহের সংরক্ষণ ও সর্বোচ্চ ব্যবহারের ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেবে (অনুচ্ছেদ ৮), ৩. রাষ্ট্রসমূহ নিয়মিতভাবে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত বিনিময় করবে [অনুচ্ছেদ ৯(১)], ৪. অপর রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন প্রকল্প গ্রহণের আগে অবশ্যই তাকে সময়মতো অবহিত করতে হবে। বলা ভালো, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের উচ্চ আদালত যাতে সমালোচিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়ার আগে ২০০২ সালে তৎকালীন ভারতের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স সরকার ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তীব্র খরা মোকাবিলায় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিল। তখন খোদ ভারতেই এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশেও প্রতিবাদ ওঠে। যৌথ নদী কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৭ থেকে ২০ মার্চ নয়াদিলি্লতে যৌথ নদী কমিশনের ৩৭তম বৈঠকে ভারত জানিয়েছিল যে, বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করে তারা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না। ভারতীয় পানি আগ্রাসন যে বাংলাদেশকে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। বাংলাদেশ যদি আগামী ২০ বছর পরের পরিস্থিতি চিন্তা করে এখনই একটি সুদূরপ্রবাসী পরিকল্পনা গ্রহণ না করে তাহলে এ দেশ ২০৩০ সালের দিকে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানি সঙ্কট পারমাণবিক সঙ্কটের ভয়াবহতাকেও মস্নান করে দিতে পারে। হিমালয় অঞ্চলের পানি সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে আঞ্চলিক বহুপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে। দ্বিপক্ষীয়ভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। ড. তারেক শামসুর রেহমান: আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক ও অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
JAI JAI DIN, 20.3.2012

সংঘাতময় পরিস্থিতি দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে

তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
স্বাধীনতার এই মাসে দুটি বড় দল পরস্পর পরস্পরের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ১২ মার্চ চারদলীয় জোট ঢাকায় মহাসমাবেশ করে ১০ জুন সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাদের দাবি একটাই- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্বহাল। অন্যদিকে ১৪ মার্চ সরকার সমর্থিত ১৪ দল পাল্টা একটি জনসভা করে জানিয়ে দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের আওতায়। দুই জোটের পরস্পরবিরোধী এই অবস্থান রাজনীতিতে একটি সঙ্কট তৈরি করেছে। সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়ছে। রাজনৈতিক সঙ্কট অর্থনীতিকে একটি ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন দাতাগোষ্ঠীও। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা তারা বললেও বরফ গলছে না। বরং একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে একেকটি দিন। একটি সমঝোতার কথা বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হলেও সেই সম্ভাবনা দিনে দিনে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। বিএনপির আপত্তি সেখানেই। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত ঘোষিত হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে দলীয় সরকারের সময় যে নির্বাচন হয় সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না। অতীতে মাগুরা উপনির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান মহাজোট সরকারের সময় ভোলায় যে উপনির্বাচন হয়েছে, তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা গণতন্ত্র চাই বটে, কিন্তু নিজ দলীয় কর্তৃত্বের আওতায় সেই গণতন্ত্রকে দেখতে চাই। সুতরাং দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে নেই বটে, কিন্তু তারপরও একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা এ দেশে গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি একটি বড় দল। এ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দলটির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে এবং এই ভূমিকা আগামীতেও থাকবে। দলটিকে অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। তাদের নীতি ও আদর্শ নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু দলটিকে কোনো অবস্থাতেই অবজ্ঞা করা যায় না। এটা শোভন নয়। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে আগামী জুনের পর বেগম জিয়া লাগাতার হরতালের কর্মসূচি দিলে আমি অবাক হব না। এটা বিএনপি তথা চার দলের কৌশল-সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করা। বিএনপি দীর্ঘদিন হরতালের ডাক দেয়নি। এর মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হল যে বিএনপি অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতায় যেতে চায় না। আমি অবাকই হয়েছিলাম যখন বিএনপির গণমিছিলে পুলিশের গুলিতে পাঁচ জন বিএনপি কর্মী হত্যার পরও বিএনপি হরতালের মতো বড় কর্মসূচি দেয়নি। এটা একটা ভালো লক্ষণ। আওয়ামী লীগ এটা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বিএনপির কর্মসূচি দেখে মনে হচ্ছে বিএনপি ধীরে ধীরে তাদের কর্মসূচি নিয়ে এগুতে চায়, যাতে সাধারণ মানুষের কষ্ট না হয়। বিএনপি তথা চার দল বিগত নির্বাচনে কম আসন পেয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু মাত্র ক’টি আসন দিয়ে বিএনপি তথা চার দলকে বিবেচনা করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, চার দল ৩৭ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। এই ৩৭ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারীদের বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গেই নিতে হবে। এ কথাগুলোই বলছেন আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রদূতরা। ইতোমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাতে করে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, একটি অর্থবহ নির্বাচনের জন্য সকল দলের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। দায়িত্বটি সরকারের। কীভাবে করবে, কোনভাবে করবে এটা সরকারকেই করতে হবে। প্রয়োজনে সরকার এ ব্যাপারে একটি সংলাপও করতে পারে। কিন্তু সরকারপ্রধান ও মন্ত্রীরা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে করে তারা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছেন।
এটা সত্য, এই মুহূর্তে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কোনো বিধান নেই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ২০১৩ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যাবে না। দু’ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যায়। এক. সরকার সংসদে ষোলতম সংশোধনী আনতে পারে, যেখানে নতুন আঙ্গিকে, নতুন কাঠামোয় তত্ত্বাবধায়ক অথবা নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে, যাদের কাজ হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। দুই. সরকার উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করতে পারে, যেখানে বলা হয়েছিল আরও দুটো সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় পরিচালনা করা। এ ক্ষেত্রে এটা সংবিধানের কোনো অংশ হবে না। সরকারি দল বা মহাজোটের শরিক যে কেউ এ ধরনের প্রস্তাব সংসদ তুলতে পারে এবং সরকার ওই প্রস্তাবে সায় দিতে পারে। মোট কথা, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। বিএনপি তথা চারদলীয় জোট একটি শক্তিশালী জোট। এখানে এখন আরও বেশ ক’টি দল একত্রিত হয়েছে। তাদের অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। লাখ লাখ মানুষ এদের আদর্শ ও নীতিতে বিশ্বাসী। সংসদেও এদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ইতোমধ্যে বেগম জিয়া অনেক ম্যাচিউরড বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি হটকারি বক্তব্য দেননি। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একটি সংঘর্ষের রাজনীতির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বিএনপি তথা চার দলের প্রতিটি কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে। ১৪ মার্চ আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দল সমাবেশ করেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজে দলীয় কর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি সহনশীল রাজনীতির কথা বলে না। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যে সহনশীলতার কথা বলা হয়, বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে তা নেই। বরং পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে দলীয় কর্মীদের একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে দুটো বড় দল। সুতরাং আগামী নির্বাচনের আগে যদি নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে কোনো ঐকমত্য না হয়, পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হবে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় দশম সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা যায়। এটা করা জাতির জন্যই মঙ্গল। না হলে বিএনপি তথা চারদলীয় জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না দেশে ও বিদেশে। বিশেষ করে বিএনপির নির্বাচন বয়কট দেশকে পুনরায় ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিস্থিতির দিকে পুনরায় ঠেলে দিতে পারে। আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব নাও হতে পারে। এতে করে রাজনীতিতে সংঘাত বৃদ্ধি পাবে এবং অসাংবিধানিক শক্তিগুলো এ থেকে ফায়দা নিতে পারে। দেশের চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা এক চরম ঝুঁকির মুখে থাকবে। আমাদের অর্থনীতিতে এর যে প্রভাব পড়বে, সরকারের পক্ষে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, দাতাগোষ্ঠী বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর। তারা সব সময়ই একটি সমঝোতার কথা বলে। এ ক্ষেত্রে সরকারের একগুঁয়েমি মনোভাবের কারণে দাতারা সরকারের ওপর থেকে আস্থা তুলে নিতে পারে। আগামীতে সরকার জাতীয় পার্টিকে নিয়ে একটা ‘স্বপ্ন’ দেখলেও জাতীয় পার্টি যে পক্ষ ত্যাগ করবে না, তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। অতীতে এরশাদ আওয়ামী লীগকে নিয়ে নির্বাচন করলেও (১৯৮৬) ক্ষমতা নিয়মসিদ্ধ করতে পারেনি। আবার আসম আবদুর রবকে (১৯৮৮) বিরোধী দল নেতা বানিয়েও ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পারেনি। বাস্তবতা হচ্ছে এ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় জাতীয়তাবাদী জোট তথা বিএনপির ভূমিকা অনেক ব্যাপক। তাই এই জোটের একটিকেও বাদ দিলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। এখন তাই তত্ত্বাবধায়ক না হোক একটি ‘নিরপেক্ষ সরকারের’ আওতায় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে উচ্চ আদালতের রায়, যার একটি অংশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়েছে, কিন্তু অপর অংশে পরবর্তী দুটো নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় করার কথা বলা হয়েছে। আরও একটি কথা, রাজনৈতিক বিষয়গুলো সংসদেই আলোচিত হওয়া উচিত। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, সংসদ এখন অকার্যকর। সংসদ চলছে বটে, কিন্তু সংসদের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে মারাত্মকভাবে। সরকার বিরোধী দলকে সংসদে এসে প্রস্তাব দেওয়ার কথা বললেও সেখানে যেভাবে ব্যক্তি আক্রমণ চালানো হয় তাতে করে বিএনপি সংসদে যাবে না-এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা একটু সহনশীল হলে সমঝোতার একটি পথ উন্মুক্ত হতে পারে। রাজনীতিতে কিছু ‘কোড অব কনডাক্ট’ও থাকা উচিত। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নেতাদের ব্যক্তিপর্যায়ে আক্রমণ না করে তাদের রাজনীতির সমালোচান করাই মঙ্গল। এরই নাম গণতন্ত্র। এরই নাম গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। ব্যক্তি আক্রমণ, বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাব, অসংলগ্ন কথাবার্তা বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশে আদৌ কোনো অবদান রাখবে না। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাকে আমরা গণতন্ত্র না বলে জনতাতন্ত্রই বলব। জনতাতন্ত্রে দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, যাতে সাধারণ জনগণের মঙ্গল নিহিত থাকে না। বাংলাদেশ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে করে হতাশ হওয়ার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। যে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে দেশ ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় একটাই-আর তা হচ্ছে একটি সংলাপ। অতীতে সংলাপের অভিজ্ঞতা ভালো না থাকলেও সংলাপেই যেতে হবে বড় দল দুটোকে। আর সংলাপের মধ্য দিয়ে আগামীতে সমাধানের একটা পথ যে আমরা খুঁজে পাব না, তা বলা যাবে না। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক : প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
http://www.shokalerkhabor.com/online/details_news.php?id=69042&&+page_id=+67

বাংলাদেশ কি ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে


সৌদি দূতাবাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা খালাফ আল আলীর হত্যাকাণ্ডের পর মুসলিম বিশ্বের সংবাদপত্র তথা মিডিয়ায় যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের ইমেজ সংকটের জন্য যথেষ্ট। যদিও আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি কিংবা সৌদি উপরাষ্ট্রদূত জামির আল হিন্দ বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। এটা মূলত 'কূটনৈতিক ভাষা'। কূটনীতিকরা এভাবেই কথা বলেন। সৌদি আরব আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক চমৎকার। এই একটি হত্যাকাণ্ড দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ককে যাচাই করা যাবে না- এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। যদি ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য, সৌদি সরকারের বক্তব্য, সেই সঙ্গে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করি, এটি আমাদের জন্য কোনো ভালো সংবাদ নয়। সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটল এমন একসময়, যখন ঢাকায় মার্কিন উপসহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস শিয়ার বললেন, অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয় বাংলাদেশ। (আমার দেশ ৭ মার্চ)। এটি একটি স্পষ্ট বক্তব্য। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশকে কিভাবে দেখছে, এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়েছে।
'বাংলাদেশ সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়'- এ ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে মিল রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলের প্রধান অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ডের একটি বক্তব্যের। ১ মার্চ উইলার্ড কংগ্রেস কমিটিকে জানিয়েছিলেন, 'সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের সহযোগিতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী অবস্থান করছে। এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশে মার্কিন ঘাঁটি নেই, সহযোগিতা আছে। এখন সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা যখন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন, তখন এই মার্কিন কর্মকর্তাদের 'বাংলাদেশ সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়' বক্তব্যটি সামনে চলে আসে।
আমার কাছে এই মুহূর্তে যা বিবেচ্য তা হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া। সৌদি সরকারের প্রতিক্রিয়া কূটনৈতিক শিষ্টাচার অনুসরণ করলেও একটি মেসেজ তাতে আছে। খুনিদের গ্রেপ্তার ও সঠিক তদন্ত চায় সৌদি আরব। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেছেন।
এই 'দাবি' একটি মেসেজ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি যে কিভাবে নেবে, আমি জানি না।
কিন্তু সত্যি সত্যিই যদি প্রকৃত দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হয় কিংবা প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করা সম্ভব না হয়, তাহলে তা মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবেচনায় নিলে ভালো করবে। এমনিতেই পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আমি রীতিমতো হতাশ। রুনি-সাগরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আজও কূলকিনারা হলো না। আমরা ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছি এই হত্যাকাণ্ডের খবর। মিডিয়ায় লেখালেখির কারণে সম্ভবত এখানে একটি 'জজমিয়া নাটক' মঞ্চস্থ হয়নি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং রুনি-সাগরের হত্যাকাণ্ড মনিটর করছেন। আর আমি একটা ধন্দে পড়ে যাই। যদি সত্যি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী মনিটর করে থাকনে, তাহলে এত দিন কেন লাগবে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের যোগ্যতা ও দক্ষতা তাই সংগতকারণেই উঠবে। পুলিশ যদি মূল কাজ ফেলে 'অন্য কাজে' বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে হত্যাকারীরা তো এ সুযোগ নেবেই। পুলিশের উচিত, মূল কাজে মনোনিবেশ করা ও তাদের দক্ষতা বাড়ানো। একজন 'থ্রি স্টার জেনারেল'-এর পদ সৃষ্টি করে কিংবা পুলিশ বাহিনীর জন্য পাঁচজন সিনিয়র সচিব সৃষ্টি করে যে পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানো যায় না, তা আবারও প্রমাণিত হলো খালাফ আল আলী হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী এই মন্ত্রণালয়ের দিকে দৃষ্টি দিলে ভালো করবেন।
মার্কিন কর্মকর্তা জেমস শিয়ার যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যখন বলেন, 'বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়', তখন সরকারের পক্ষ থেকে এর একটা ব্যাখ্যা দাবি করা উচিত ছিল। কেননা প্রধানমন্ত্রী তো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। এটা হচ্ছে বাস্তব কথা। বর্তমান সরকারের শাসনামলে গেল তিন বছরে আমরা কোনো বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড লক্ষ করিনি। সন্ত্রাসীরা তেমনভাবে সংগঠিত হতে পারছে না। বিচ্ছিন্ন দু-একটি সংবাদ ছাপ হলেও তাদের তৎপরতা, সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ কিংবা জমায়েতের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থেকেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ অতিরিক্ত তৎপর হয়েছে। কিন্তু ওই সব নিষিদ্ধ ঘোষিত গ্রুপ কর্তৃক কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে আমরা দেখিনি। তাই অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিমুক্ত দেশ, তা নিঃসন্দেহে বলা যাবে না। বাইরের সন্ত্রাসী হামলা? এটাও তো আমাদের চোখে ধরা পড়েনি। কিছু 'ভারতীয় সন্ত্রাসী' বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাদের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল না এ দেশে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের হস্তান্তরের ফলে ওই অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটেছে। এর বাইরে 'আল-কায়েদা' কিংবা 'লস্কর-ই-তৈয়বা'র মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনো নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে কাজ করছে বলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের কখনো অবহিত করেনি। ফলে মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তার ওই বক্তব্যের উদ্দেশ্য কী- এ প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর করতে ভালোবাসেন। তিনি জানিয়েছেন, খালাফ আল আলীর মৃত্যুর ঘটনায় তিনি সৌদি আরবেও যাবেন। তিনি যেতেই পারেন। তাতে করে কি ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল হবে? বাংলাদেশি প্রায় ২৫ লাখ (প্রকারান্তরে ৩০ লাখ) নাগরিক এখন সৌদিতে কর্মরত। তাঁদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। ৭ মার্চ রাতে একটি চ্যানেলে অংশ নিতে গিয়ে সৌদি আরব থেকে প্রবাসীরা ফোন করে আমাদের তাঁদের আতঙ্কের কথা জানিয়েছেন। এই আতঙ্কের খবরটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। এমনিতেই বাংলাদেশ-সৌদি আরব সম্পর্ক খুব উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে- এটা বলা যাবে না। গত ২০০৮ সাল থেকেই সৌদিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়োগ পরিপূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। এটা আমাদের একটা কূটনৈতিক ব্যর্থতা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়নি কখনো। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের জনশক্তি বাজার যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, আমাদের নীতিনির্ধারকরা তা আদৌ বিবেচনায় নেননি। আমাদের অদক্ষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিদেশ সচিব পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটি বারবার এড়িয়ে গেছেন।
অথচ সৌদি আরব বাংলাদেশকে বাইরে রেখে নেপালের মতো দেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করে আসছিল। শুধু তা-ই নয়, সংবিধানে ২৫(২) ধারাটি সংযোজন করে আমরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এটি ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল নির্দেশনা। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের ফলে সংবিধানের ওই ধারাটি এখন আর নেই। এতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে 'বিশেষ সম্পর্ক'-এর ওপর যে প্রভাব ফেলছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে এ প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যেতে পারে। মোটা দাগে যেটা বলা যায়, তা হচ্ছে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থেই উচিত এই হত্যাকাণ্ডের 'মোটিভ' খুঁজে বের করে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা। প্রায়াজনে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে। দেশে এ মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। বিরোধী দল ১২ মার্চের কর্মসূচি পালন করে সরকারবিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে, অতিদ্রুত হত্যাকাণ্ডের মোটিভটি সুস্পষ্ট করা। এটি একটি স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ড। এর কিনারার সঙ্গে আমাদের অনেক স্বার্থ জড়িত। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে একটি সংবাদও কোনো কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এরই প্রতিধ্বনি আমরা দেখতে পাই Global threat নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে গত ৯ মার্চ। সেখানেও মধ্যপ্রাচ্যের ওই রাষ্ট্রটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা চিন্তার কারণ। খুব দ্রুত আমরা যদি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে না পারি, তাহলে তা শুধু সৌদি আরবের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে না, বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতেও এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাতে করে জনশক্তি রপ্তানিতে আরো ধস নামবে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমবে। আর মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লাখ লাখ বাংলাদেশি কর্মী থাকবেন এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায়। আমাদের জন্য সত্যিকারার্থেই তা কোনো ভালো সংবাদ নয়।
দৈনিক কালের কন্ঠ, ১৩ মার্চ ২০১২ 
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

বিদ্যুতের জন্য কি কোনো ভালো খবর অপেক্ষা করছে

গ্রীষ্ম পুরোপুরি শুরু না হলেও তাপমাত্রা বাড়ছে। কিন্তু এরই মধ্যে কোথাও কোথাও লোডশেডিং শুরু হয়েছে। এবার গ্রীষ্ম কেমন কাটবে তা নিয়ে একটা শঙ্কা এখন থেকেই তৈরি হয়েছে। যে হারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে, সে হারে বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে না। গেল ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল গড়ে ৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, যা আগামি এপ্রিলে গিয়ে দাঁড়াবে ৭ হাজার ১৫৭ মেগাওয়াটে। মার্চে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ৬ হাজার ৯৫৮ মেগাওয়াট। ধীরে ধীরে এই চাহিদা বাড়বে। মে-জুন মাসে বিদ্যুতের চাহিদা আরও বাড়বে। কিন্তু সেই চাহিদার কতটুকু পূরণ হবে, সেটা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। এর ওপরে রয়েছে বোরো মৌসুমে চাষিদের বিদ্যুত্ চাহিদা। গত ৮ ফেব্রুয়ারি শীর্ষ পর্যায়ের এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বোরো মৌসুমে প্রয়োজনে সার কারখানা বন্ধ রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হবে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এবার সেচের জন্য ৭ হাজার ৮৭৬টি নতুন বিদ্যুত্ সংযোগ দেওয়া হবে। সংযোগ দেওয়ার বাকি রয়েছে ২৩ হাজার ২০৬টি। গত বছর বিদ্যুত্ সংযোগ দেওয়া হয়েছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৪৪১টি। বলা প্রয়োজন, দেশে বর্তমানে সাতটি সার কারখানায় দৈনিক প্রায় ২৯ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে কর্ণফুলী সার কারখানা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দৈনিক প্রায় ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয় মাত্র ৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। পিডিবির হিসাব অনুযায়ী এবার সেচে পিক আওয়ারে লোডশেডিং হবে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। তবে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ধারণা বিদ্যুত্ ঘাটতির পরিমাণ দু’হাজার মেগাওয়াট ছড়িয়ে যেতে পারে। এই যে বিদ্যুত্ পরিস্থিতি, তা কোনো আশার কথা বলে না। রাজনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি চাহিদামতো বিদ্যুত্ সরবরাহ করা যদি না যায়, তা হলে স্বাভাবিক কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।

বিদ্যুত্ নিয়ে সঙ্কট আছে। চাহিদা বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। কিন্তু সেভাবে উত্পাদন হচ্ছে না। হাজার হাজার ফ্ল্যাট এই ঢাকা শহরেই তৈরি হচ্ছে। এসব ফ্ল্যাটে কি আদৌ পূর্ণ বিদ্যুত্ সরবরাহ করা সম্ভব হবে? যদি না হয়, তা হলে যারা বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে নির্মীয়মান এই ফ্ল্যাটগুলো ক্রয় করেছেন, তারা এখন কী করবেন? আবাসন শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। তাদের আয় রোজগারের কী হবে? ডেভেলপাররা যদি ক্রেতাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে না পারেন, তা হলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে যাবেন। সরকারের জন্য আদৌ তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।

বিদ্যুৎ উত্পাদিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে। এই গ্যাস এখন ফুরিয়ে আসছে। চলমান গ্যাস সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার ২০০৯ সালে ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রাম’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর অধীনে অতি দ্রুত নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের হাতে থাকা ৩, ৬, ৮ ও ১১ নম্বর ব্লকের মোট ৩ হাজার ১০০ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক (টু-ডি) সিসমিক জরিপের কাজ তিন বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে যে, স্থলভাগের ২৩টি ও অগভীর সমুদ্রের ৮টি ব্লককে পিএসসির আওতায় বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে কনোকো ফিলিপস একটির দায়িত্ব পেয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার তেল গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাসপ্রম এবং অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোসও শিগগিরই কাজ পাচ্ছে। এমন অভিযোগও উঠেছে যে স্থলভাবে সুনেত্রার মতো বিশাল মজুদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে। কনোকো ফিলিপস যে দায়িত্বটি পেয়েছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্ক হচ্ছে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা এই চুক্তির বিরোধিতা করে দেশেব্যাপী প্রচুর গণসংযোগ করেছেন। তাদের যুক্তি একটাই-কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশের গ্যাস রফতানি করা যাবে না। গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। কেননা মিয়ানমার এবং ভারত গভীর সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে। মািয়ানমারের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস আগামী বছর যাবে থাইল্যান্ডে। চীনও এই গ্যাস কিনছে। এ ক্ষেত্রে যদি গ্যাস পাওয়া যায়, তা উত্তোলন ও জাতীয় গ্রিডে দিতে ন্যূনতম আরও পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে বিকল্প কী, এটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। যদিও একটা কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে যে, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বাপেক্স যে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (সম্ভাব্য মজুদ) গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তা যদি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায় তা হলে বিদ্যুত্ সঙ্কটের একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে এই মজুদও বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে, যদিও এখন পর্যন্ত সরকার বিষয়টি খোলাসা করেনি।

যেহেতু গ্যাসের একটি সঙ্কট আছে, তা হলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আমরা কীভাবে করব? গ্যাসের বিকল্প হতে পারে কয়লা। এ পর্যন্ত দেশে পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লাসম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কয়লা উত্তোলন নিয়েও বাংলাদেশে একটি বড় বিতর্ক রয়েছে। কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা হবে, নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তোলা হবে-এটা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করলে ছয় হাজার হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হবে এবং অনেককে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিপক্ষে। অথচ উন্মুক্ত পদ্ধতির একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এই পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা। বড়পুকুরিয়া কয়লাক্ষেত্রের বেলায় দেখা যাচ্ছে শতকরা ১০ ভাগ কয়লাও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অভিমত দিয়েছেন যে বড়পুকুরিয়া থেকে ১০০ মিলিয়ন টনের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হবে না। পক্ষান্তরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন টন কয়লা তোলা সম্ভব, যা বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে।

জ্বালানি খাতে কয়লা একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও তাতে এখন রাজনীতি ঢুকে গেছে। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীর কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ছয় জন। এরা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। সেই থেকে ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি ঝুলে আছে। এ ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো কয়লানীতিও গ্রহণ করতে পারেনি, যদিও ২০০৭ সালের ১১ জুন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। তাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন, রফতানির সুযোগ না রাখা, দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, খনির মুখে একটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু ওই রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকার কোনো কয়লানীতিও গ্রহণ করেনি। ফলে একটি সম্ভাবনাময় সেক্টর আমাদের কোনো কাজে আসছে না। এখানে বলা ভালো, বিশ্বের ৪০ শতাংশ বিদ্যুত্ উত্পন্ন হয় কয়লা থেকে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিমাণ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ৭৯, চীন ৭৮, জার্মানি ৪৯, ভারত ৬৯, দক্ষিণ আফ্রিকা ৯২ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতংশ। এখানে আরও একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও সরকার খুলনা ও চট্টগ্রামে দুটি বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করছে আমদানিকৃত (ভারত) কয়লার ওপর নির্ভর করে। এই সেক্টরটিও আমরা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছি।

অতীতে বিদ্যুত্ ঘাটতিতে সরকারি দলের সদস্যরাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। গত ৩ আগস্ট (২০১১) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায় বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছিল। কমিটির সভায় সরকারের দেওয়া বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিসংখ্যানও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। সরকারি দলের এমপিরা যখন খোদ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন, তখন বুঝতে কারও বাকি থাকে না পরিস্থিতি আদৌ ভালো নয়। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী গত ১ জানুয়ারি বিদ্যুত্ ভবনে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে এর আওতাধীন কোম্পানি ও সংস্থাগুলোর চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেছিলেন আগামী তিন বছর বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকবে। যেখানে বিদ্যুত্ সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, সেখানে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যুক্তিহীন। সাধারণ মানুষের এতে খুশি না হওয়ারই কথা। বিদ্যুত্ আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। সরকার যদি বিদ্যুতের এই চাহিদা পূরণ করতে না পারে, সেই সরকার অজনপ্রিয় হতে বাধ্য। বিদ্যুতের অভাব জনসাধারণের মাঝে ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই সঙ্গে আরও যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে বিদ্যুতের অপচয় রোধ করার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

লেখক : প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman(a)yahoo.com
[সূত্রঃ সকালের খবর, ০৬/০৩/১২]

গ্রিসের পরিস্থিতি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যত্

গ্রিসের পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। গ্রিসের অর্থনৈতিক সঙ্কটের যে চিত্র ইউরোপীয় সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে, তাতে করে দেশটির জন্য শুধু দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিই সৃষ্টি করছে না, বরং একক মুদ্রা ইউরোর ভবিষ্যেক একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। এখন অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কল্পনাতেই থেকে যেতে পারে।

২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কোনো অমূলক ধারণা ছিল না, বরং ১৯৫৭ সালে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত ম্যাসট্রিচট চুক্তি ছিল অভিন্ন ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ। ম্যাসট্রিচট চুক্তিতে একটি একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

এরপর ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে সেভেন চুক্তি ও ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অভিন্ন এক ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপ। বলা ভালো, ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাম ধারণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতোমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বেশ কটি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইইউতে যোগ দিয়েছে। ইইউর সদস্যসংখ্যা এখন ২৭।

১৯৯৯ সালে তত্কালীন ইইউর ১৫টি দেশের মাঝে ১১টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু রয়েছে ১৭টি দেশে। ইউরো চালু হওয়ার সময়ই এটি নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল ইউরোপের উত্তরের ধনী দেশগুলো ইউরো চালু হলে এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এত বছর পর এই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হল। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও তিন বছর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাই মাসে ইউরোর কাগজি ও ধাতব মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়।

গত ৯ বছর ইউরো নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা না দিলেও গেল বছরের প্রথমদিকে ইইউর কয়েকটি দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে পাপেনদ্রুর নেতৃত্বাধীন গ্রিস সরকারের পতন হয়েছে ও পাপাদেমস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। একই সঙ্গে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বারলুসকোনিও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।

পাপেনদ্রু ও বারলুসকোনির পরিণতি প্রমাণ করে ইউরোপ কী বড় ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকারগুলো প্রচুর ঋণ গ্রহণ করেও সেই ঋণ শোধ করতে পারছে না। ধীরে ধীরে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করলেও সেই দেউলিয়াত্ব রোধ করতে পারছে না। গ্রিস কিংবা ইতালি কঠোর কৃচ্ছ্র সাধনের কথা ঘোষণা করলেও সাধারণ জনগণ তার বিরোধিতা করছে। তারা দিনের পর দিন বিক্ষোভ মিছিল করছে। গ্রিসের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিখ্যাত দৈনিক গার্ডিয়ানের অনলাইন ভার্সনে যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, তা দেখে দেশটির ভবিষ্যত্ সম্পর্কে হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে গ্রিসের একটি শহর থেসসালোনিকির গির্জার পাশে বসে এক মধ্যবয়সী রমণী ভিক্ষা করছেন। রাষ্ট্র এই রমণীর দায়িত্ব নিতে পারছে না। ফলে তাকে ভিক্ষা করে জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের Meclatchy news-এর অনলাইন ভার্সন যারা দেখেছেন, সেখানেও রয়েছে গ্রিসের ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে পেরামা জাহাজ নির্মাণ বন্দরের একটি বিবরণ দিয়ে।

পেরামা বন্দর এখন জনমানবশূন্য, কোনো কর্মচাঞ্চল্য নেই, এক রকম পরিত্যক্ত। গ্রিসে বেকারত্বের হার এখন শতকরা ৬০ ভাগ। সেখানে এখন কৃচ্ছ্র সাধন চলছে। আইএমএফের ঋণের শর্ত হিসেবে সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমানো হয়েছে। পেনশন হ্রাস করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা এখন বন্ধ। সরকারি গড় বেতন কমিয়ে আনা হয়েছে মাসিক ৮৬০ ডলারে, আর বেসরকারি সেক্টরে গড় বেতন মাসে ৭৫০ থেকে ১০০০ ডলার। এখন বিশ্বব্যাংক বলছে বেতন কমিয়ে আনতে হবে ৬০০ ডলারে। এক সময়ে হাসপাতালগুলোতে বিনাপয়সায় ওষুধ পাওয়া যেত। এখন তা পুরোপুরি বন্ধ। প্রবাসী গ্রিকদের আর্থিক সহযোগিতায় উড়পঃড়ত্ং ড়ভ ঃযব ড়িত্ষফ নামে একটি এনজিও এখন বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করছে।

আগে এরা মাত্র তিন দিন (সপ্তাহে) ওষুধ সরবরাহ করত। এখন তাদের সাত দিনই ওষুধ দিতে হয়। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে যারা ওষুধ নেন, তাদের অনেকেই কিছুদিন আগে পর্যন্ত সচ্ছলভাবে দিনযাপন করতেন। এখন আয় কমে যাওয়ায় তারা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। Meclatchy-এর প্রতিবেদনে একজন প্রত্নতাত্ত্বিক মিসেস ডেলপিনা কউটিসউম্বার ছবি ও বক্তব্য ছাপা হয়েছে। ডেলপিনা আগে মাসে বেতন পেতেন ১১৯০ ডলারের সমতুল্য। এখন তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৬০ ডলারে। অথচ তাকে বাসাভাড়া দিতে হয় ৭৩০ ডলার। অধ্যাপক স্বামী ও এক সন্তান নিয়ে তার দিন আর চলছে না। ঋণের শর্ত হিসেবে দেশটির সরকারি লোকবল ১ লাখ ৫০ হাজার কমিয়ে মোট ৪ লাখ ৫০ হাজারে নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। অর্থনীতি ঠিকমতো চলছে না।

এখন দেশটিকে ঋণ নিয়েই ঋণের সুদের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। গ্রিসকে তার বাজেটের শতকরা ২০ ভাগ ব্যয় করতে হয় ঋণ পরিশোধে। গ্রিসের এই অর্থনৈতিক সঙ্কট আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। বাংলাদেশে কৃচ্ছ্র সাধনের কথা উচ্চ মহল থেকে বলা হলেও কৃচ্ছ্র সাধন হচ্ছে না। সরকারকে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ গ্রহণ করে সরকার চালাতে হচ্ছে। সরকার ইতোমধ্যে ৮ জন সচিবকে সিনিয়র সচিবের মর্যাদা দিয়েছে। আইজিকে সিনিয়র সচিবের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সাড়ে ছয়শ’ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এতে করে সঙ্গতকারণেই সরকারের খরচ বাড়বে।

গ্রিসের অর্থনৈতিক সঙ্কট খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্বকে ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। এটাও আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। কেননা সার্কভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে অদূর ভবিষ্যতে একটি ‘এশীয় ইউনিয়ন’ গঠিত হতে পারে, এমন ধারণাও করেছিলেন কেউ কেউ। এখন ‘ইউরো জোন’-এর সঙ্কটের ফলে নতুন করে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। এখানে বলা ভালো, ১৯৫৭ সালে মাত্র ৬টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পরিণত হয়েছে। ইউরোপের ২৭টি দেশ এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। বেশ কটি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইতোমধ্যে শুধু ইইউতেই যোগ দেয়নি, বরং ন্যাটোতেও যোগ দিয়েছে। ন্যাটোর এই সম্প্রসারণ নিয়েও নানা কথা রয়েছে। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মাঝে ২৪টি দেশ এখন ন্যাটোর সদস্য।

ইউরোপে এরই মাঝে বেশ কয়েকটি সংস্থার জন্ম হয়েছে, যে সংস্থাগুলো ইউরোপীয় ঐক্যকে ধরে রেখেছে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দফতর, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় মুদ্রা ইনস্টিটিউট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা। এই সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু ইউরোই নয়, বরং খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে।

যে যুক্তি তুলে এক সময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোনে (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি, সেই যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হল। অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যত্ নিয়ে। এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড়, তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না।

২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন তার পঞ্চাশতম পূর্তি উত্সব পালন করে তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ইইউর মাঝে বিভক্তি আছে। লুক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান অর্জন হিসেবে ইউরোর মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র চার বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হল ইউরো সব দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স এর বিরোধিতা করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিন্তিত ছিল এ কারণে যে নিরাপত্তার বিষয়টিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে খেপিয়ে তুলতে পারে।

জার্মানি স্পেন ইইউর জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও তাদের ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালের ‘ভেলভেট রেভল্যুশন’ এই দেশগুলোকে সোভিয়েত নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় ও দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। এই দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেওয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউর সদস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।

এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া-হারজেগোভিনা কিংবা ক্রোয়েশিয়া এখনও ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সঙ্কট সব সঙ্কটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সঙ্কটে জর্জরিত ইউরোপে আবারও মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে। গেল বছর ইউরো ব্যবহারকারীরা ইউরো জোনের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করেছিলেন। এখন ইইউর ঐক্য নিয়ে সন্দেহ আরও বাড়বে। ইতোমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দু’স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দু’স্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এই বিভক্তির কথা বলছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন।

তিনি বলছেন, এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা। যদিও এই বিভক্তির বিরোধিতা করছেন ইউরোপীয় কমিশনের চেয়ারম্যান জোসে ম্যানুয়েল বারোসো। এখন সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কী না, কিংবা ‘নতুন ইউরোপ’-এর স্বরূপ কী হবে, তা এই মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। গ্রিসের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাওয়ায় এই ধারণা এখন আরও বদ্ধমূল হল যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউরোপের ছোট অর্থনীতির জন্য কোনো সুসংবাদ বয়ে আনতে পারেনি।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়
tsrahmanbd(a)yahoo.com
[সূত্র : সকালের খবর-২৩/০২/২০১২]

সিল্ক রোড' ধরে যেতে যেতে

যারা সিল্ক রোড সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন, সিল্ক রোডে দুটি রুট ছিল। একটি সড়কপথ, যা অনেক দেশের ওপর দিয়ে গেছে। অপরটি সাগররুট। তবে সড়কপথের সঙ্গে সাগররুটের একটা সংযোগ ছিল। প্রায় ৪ হাজার মাইল বিস্তৃত সিল্ক রোডটি এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের যোগসূত্র ঘটিয়েছে। ইতিহাসে আছে, চীনের হান রাজবংশের আমলে (খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ থেকে ২২০), চীনের ব্যবসায়ীরা এই সড়ক ও সাগরপথ ধরে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তেন। তারা চীন থেকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন চীনের বিখ্যাত সিল্ক কাপড়, শার্টিন, চা ও পোরসেলিনের দ্রব্যাদি। সাগররুটে তারা ভারতে আসতেন। এখান থেকে নিয়ে যেতেন মসলা, হাতির দাঁত এবং অলঙ্কারাদি। যেহেতু চীনারা সিল্ক কাপড়ের ব্যবসা করতেন, সে কারণেই তাদের ব্যবহৃত পথটি 'সিল্ক রোড' হিসেবে পরিচিত।

ইতিহাসের ছাত্র মাত্রেই 'সিল্ক রোড' সম্পর্কে একটা ধারণা রাখেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের এরজুরুম শহর থেকে চলে যাওয়া 'সিল্ক রোড' ধরে যখন একটি গ্রামে যাচ্ছি, তখন ইতিহাস ধরা দিল আমার কাছে। এরজুরুম শহরে এসেছি আতাতুর্ক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। ঊঝজটঈ সম্মেলন। এর অর্থ ঊঁৎড়অংরধহ ঝরষশ জড়ড়ফ টহরাবৎংরঃু পড়হাবহঃরড়হ. বলা যেতে পারে, সিল্ক রোডভুক্ত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা শিক্ষার্থীদের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। আমাদের 'সিল্ক রোড' দিয়ে যাওয়ার কোনো প্রোগ্রাম ছিল না। কিন্তু এটা সম্ভব হয়েছিল প্রফেসর জেকারিয়া আতাতুর্কের সৌজন্যে। মাইলের পর মাইল আমরা মাইনাস ২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ভ্রমণ করেছি। তুরস্ক এই 'সিল্ক রোড' নতুন করে তৈরি করেছে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, মধ্য এশিয়ার মুসলমান প্রধান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো। ঐতিহাসিকভাবেই তুরস্কের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর একটা সম্পর্ক রয়েছে। ইতিহাস বলে, আজকের তুরস্কের জনগোষ্ঠী একসময় মধ্যযুগে মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিল। তাদের বলা হতো ঙমযুঁ ঞঁৎশং, অর্থাৎ টার্কিস ট্রাইজ। এগারো শতকে তারা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং এক সময় উরাল হ্রদ থেকে অঞ্চল ছেড়ে আজকের পারস্যে বসবাস করেন। তারাই জন্ম দিয়েছিলেন এৎবধঃ ঝবষরলঁশ সাম্রাজ্যের। ওই শতকের শেষ দিকে ওই সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে পূর্ব আনাতোলিয়ায়, আজকে যা তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত। ইতিহাসে আরও আছে, মোঙ্গলরা ১২৪৩ সালে ঝবষরলঁশ সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে। এর মধ্য দিয়ে জন্ম হয় অটোমান সাম্রাজ্যের। আর এর ঠিক ২১০ বছর পর ১৪৫৩ সালে বাইজেনটাইনদের পরাজিত করে এ অঞ্চলজুড়ে গড়ে ওঠে বিশাল অটোমান সাম্রাজ্য, যে সাম্রাজ্য টিকেছিল ৬২৩ বছর। এসব ইতিহাসের কথা। আজ এত বছর পর সিল্ক রোড ধরে যেতে যেতে আমার বারবার মনে হয়েছিল, তুরস্ক কি সত্যিকার অর্থে একুশ শতকে নিজেকে নতুন এক অটোমান সাম্রাজ্য দেখতে চায়? তুরস্কে, বিশেষ করে ইস্তাম্বুলের ফাতেহ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা এরজুরুমের আতাতুর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আলাপচারিতায় কেউই তুরস্ককে একটি আগ্রাসী শক্তি হিসেবে দেখতে চাননি। তবে তুরস্ক এ অঞ্চলের উন্নয়নে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে, এটা তাদের অভিমত।

যারা সিল্ক রোড সম্পর্কে ধারণা রাখেন,তারা জানেন, সিল্ক রোডে দুটি রুট ছিল। একটি সড়কপথ, যা অনেক দেশের ওপর দিয়ে গেছে। অপরটি সাগররুট। তবে সড়কপথের সঙ্গে সাগররুটের একটা সংযোগ ছিল। প্রায় ৪ হাজার মাইল বিস্তৃত সিল্ক রোডটি এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের যোগসূত্র ঘটিয়েছে। ইতিহাসে আছে, চীনের হান রাজবংশের আমলে (খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ থেকে ২২০), চীনের ব্যবসায়ীরা এই সড়ক ও সাগরপথ ধরে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তেন। তারা চীন থেকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন চীনের বিখ্যাত সিল্ক কাপড়, শার্টিন, চা ও পোরসেলিনের দ্রব্যাদি। সাগররুটে তারা ভারতে আসতেন। এখান থেকে নিয়ে যেতেন মসলা, হাতির দাঁত এবং অলঙ্কারাদি। যেহেতু চীনারা সিল্ক কাপড়ের ব্যবসা করতেন, সে কারণেই তাদের ব্যবহৃত পথটি 'সিল্ক রোড' হিসেবে পরিচিত। সড়কপথটি চীনের বিভিন্ন অঞ্চল হয়ে মঙ্গোলিয়া, মধ্য এশিয়া, পারস্য ও আজকের তুরস্কে এসে শেষ হয়েছিল। এরপর ভূমধ্যসাগর হয়ে সাগররুটে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল ইউরোপের সঙ্গে। অন্যদিকে 'সি রুট' বা সাগররুট ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও ভারত মহাসাগর হয়ে একদিকে সৌদি আরব ও মিসর, অন্যদিকে সোমালিয়ায় গিয়ে শেষ হয়েছিল। এই সিল্ক রোড নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে চীনের, আগ্রহ রয়েছে তুরস্কেরও। চীন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে গড়ে তুলেছে 'সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন', যার সদস্য রাশিয়াও বটে। তুরস্কও গড়ে তুলেছে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। ঊঝজটঈ সম্মেলনে যোগ দিতে এসে আমার মনে হয়েছে, চলতি শতাব্দীতেই তুরস্ক সিল্ক রোডভুক্ত দেশগুলোকে একটি প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে চায়। তবে একটা বড় প্রশ্ন থেকেই গেল, চীনের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে? এর জবাব শুধু ভবিষ্যৎই দিতে পারে। অস্বীকার করা যাবে না এ অঞ্চলে তুরস্ক অন্যতম একটি শক্তি। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য এবং মুসলিম দেশ হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে এর কূটনৈতিক সম্পর্কও রয়েছে। যদিও এই সম্পর্কে এখন ভাটা পড়ছে। তুরস্কের অর্থনীতি, জনসাধারণের জীবনধারণের মান ইউরোপের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তুরস্ক আমাদের জন্য একটি মডেলও। তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুধু মধ্য এশিয়ার দেশগুলো কেন, আমাদের জন্যও একটা আশার সঞ্চার করেছে। মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের বিনিয়োগও বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১২ সালে মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের বিনিয়োগের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ২২২ বিলিয়ন ডলারে।

মিসর (১৭৬ মিলিয়ন) ও ইরানের (১৭৬ মিলিয়ন) মতো দেশেও গত বছর বড় বিনিয়োগ ছিল তুরস্কের। ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী (পিপিপি) তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় (পিপিপি) বছরে ১৫ হাজার ৩৪০ ডলার। বিশ্ব অর্থনীতিতে তুরস্কের অবস্থান ১৫তম। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান ম্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও নেইল ২০১১ সালে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেন। তাতে তিনি তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করেছেন গওকঞ গ্রুপে, অর্থাৎ মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ককে নিয়ে এসেছেন এক কাতারে। এই ৪টি দেশকে শুধু দ্রুত বর্ধনশীল, উন্নয়নশীল বিশ্ব বলতে তিনি নারাজ। এর চেয়ে আরও কিছু বেশি। তাই সঙ্গত কারণেই তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি মডেল। সারা আরব বিশ্ব যখন একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের মুখোমুখি, তখন তুরস্কের স্থিতিশীলতা সারাবিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। এ জন্যই টাইম ম্যাগাজিন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগানকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল গত বছর ২৮ নভেম্বরের সংখ্যায় (ঊৎফড়মধহরং ধিু)। তুরস্কে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন একটি সরকার (২০০২ সাল থেকে ক্ষমতায়) সেখানে যে রাজনীতির জন্ম দিয়েছে, তার মূল কথা হচ্ছে 'ইসলাম ও গণতন্ত্র', যা কি-না এখন 'আরব বসন্ত'-পরবর্তী আরব বিশ্বের রাজনীতির মূল কথা। তিউনিসিয়া, মরক্কো কিংবা মিসরের রাজনীতি এখন 'ইসলাম এবং গণতন্ত্র'কে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা মডেল। অভিযোগ উঠেছে, জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি কিছুটা ইসলামিক এবং মেয়েদের অধিকার রক্ষায় সচেতন নয়। অথচ আমরা পরিসংখ্যান পেয়েছি, তুরস্কের পার্লামেন্টে মহিলা এমপির সংখ্যা ৯ ভাগ থেকে ১৪ দশমিক ১ ভাগ বেড়েছে। কর্মজীবী মহিলাদের সংখ্যাও সেখানে কম নয়, ২৪ ভাগ (পুরুষ ৬৯.৬ ভাগ)।

সেনাবাহিনী অতীতে বরাবরই তুরস্কে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। মোস্তফা কামাল পাশা নিজে ছিলেন সেনাবাহিনীর লোক। তুরস্কের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা স্বীকৃত। এটা নিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিরোধ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। ৩৬৫ জন জেনারেল ও ৭ লাখ ২০ হাজার সেনাসদস্যকে নিয়ে গঠিত সেনাবাহিনীকে (ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম) গণতন্ত্রের মূলধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের উদ্যোগ গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রশংসিতও হয়েছে। ২০১০ সালে তুরস্কের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৯ ভাগ, আর ২০১১ সালে তা উন্নীত হয়েছে ১১ ভাগে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশের তুলনায় তুরস্কের বেকার সংখ্যা কম, ৯.২ ভাগ (স্পেনে ২২.৬, গ্রিসে ১৭.৬, লিথুনিয়ায় ১৫.৫, যুক্তরাষ্ট্রে ৯.১ ফ্রান্সে ৯.৯১)। ইসলামমনস্ক একটি দল তুরস্কে ক্ষমতায় থাকলেও আল কায়দার কোনো তৎপরতা সেখানে নেই। দুর্নীতির তেমন কোনো অভিযোগও আমরা শুনিনি। তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি তুরস্ককে একটি অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে মুসলিম বিশ্বে। দারিদ্র্যপীড়িত সোমালিয়া থেকে শত শত শিশুকে তুরস্ক বৃত্তি দিয়ে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছে। দেশটির সাহায্যের পরিমাণও বাড়ছে মুসলিম বিশ্বে। সিল্ক রোড ধরে চলতে চলতে আমার মনে পড়ে গেল সেমিনারের মূল সম্মেলন কক্ষে অভ্যর্থনায় নিয়োজিত তরুণীদের একটি কথা। আলাপচারিতায় গুল আমাকে বলছিল,'ঞূৎশরুব নরৎ ফূহুধ মূপূ ড়ষধপধশ'_ আমি ওর কথা নোট করে নিয়েছিলাম। এর অর্থ তুরস্ক আগামী দিনে বিশ্বশক্তিতে পরিণত হবে। জানি না এ কথার পেছনে কোনো
সত্যতা আছে কি-না। কিন্তু তুরস্ককে নিয়ে ভাবনার সুযোগ আছে যথেষ্ট।

প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : শিক্ষক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ সমকাল, ১১/০৩/১২]

তুরস্কের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে

ঢাকা থেকে তুরস্কের এরজুরুমের দূরত্ব কতটুকু বলতে পারব না। কিন্তু টার্কিস এয়ারলাইন্সের সহযোগী বিমান সংস্থা ওডুগোলোগোর বিমানে করে যখন সন্ধ্যাবেলায় এরজুরুমের বিমানবন্দরের টারমাকে পা রাখলাম, তখন সেখানকার তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি। অথচ আমি ঢাকা ছেড়েছিলাম প্লাস ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নিয়ে। এরজুরুমের আতাতুর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে সেখানে গেছি। উদ্দেশ্য প্রথম আনাতোলিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়া। সেখানে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় ২৬টি দেশের বিশেষজ্ঞরা। মূল বিষয় ছিল জীববৈচিত্র্য, ভ্রমণ ও পরিবর্তিত বিশ্ব নিয়ে আলোচনা করা। আমি নিজেও একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছি, যা প্রশংসিত হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে তুরস্কের সঙ্গে যাদের সাংস্কৃতিক বন্ধন ছিল, সেসব দেশকে নিয়েই এ সম্মেলন। সম্মেলনে তাজিকিস্তান, কিরঘিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখিস্তান, আজারবাইজানের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি মালয়েশিয়া, ভারত কিংবা পাকিস্তানের প্রতিনিধিরাও অংশ নিয়েছেন। আফগানিস্তান ও মঙ্গোলিয়ার প্রতিনিধিরাও ছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র হিসেবে আমার কাছে বারবার মনে হয়েছে, একুশ শতকে এসে তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে চায়। তাদের সেই যোগ্যতা রয়েছে এবং তাদের পক্ষে সেটা সম্ভবও। সম্মেলনে যোগ দেয়া কিংবা তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে আমার বারবার মনে হয়েছে আমরা তুরস্ক থেকে কত পিছিয়ে আছি। আজ তুরস্কের নেতৃত্ব দেশটিকে যেখানে নিয়ে গেছে, আমরাও তো পারতাম বাংলাদেশকে সেখানে নিয়ে যেতে। কেন পারলাম না? বরং মেধার দিক থেকে আমাদের প্রজন্ম তুরস্ক থেকে অনেক এগিয়ে থাকলেও নেতৃত্বের প্রশ্নে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। প্রায় দু’সপ্তাহ তুরস্ক সফর করে তুরস্ক সম্পর্ক সবকিছু জানা সম্ভব নয়। কিন্তু ইস্তামবুল, আনকারায় যাদের সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে, আমি জানতে চেয়েছি মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের অবস্থান কোথায়। তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা ‘জামান’ (প্রচার সংখ্যা ১০ লাখ)-এর অঙ্গসংগঠন’র বিদেশ ডেস্কের প্রধান ইয়াকুপ সালভারসি, ফাতেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (ওরা ভাইস রেক্টর বলে) প্রফেসর বজকুর্ট কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ড. জেনসের সঙ্গে আলাপ ও মতবিনিময় করে আমার মনে হয়েছে, ‘নতুন এক তুরস্ককে’ আমরা দেখতে পাব এই শতাব্দীতে। সেই মেধা, অর্থনৈতিক ভিত্তি তাদের রয়েছে। ইস্তামবুলে * মতো মিউজিয়াম তৈরি করে তারা তাদের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে রেখেছে। ঞঙচকঅচও-তে হজরত আলীর (রা.) ব্যবহৃত তলোয়ারও সংরক্ষণ করা হয়েছে। রয়েছে মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর দাড়ি মোবারক ও তার সাহাবিদের ব্যবহৃত পোশাক। হজরত আলী (রা.) যে তলোয়ারটি যুদ্ধে ব্যবহার করতেন, তা এত বড় ও চওড়া যে ভাবতে অবাক লাগে এই তলোয়ার দিয়ে তিনি কীভাবে যুদ্ধ করতেন।

তুরস্ক তাদের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করেছে। প্রায় পাঁচশ’ বছরের পুরনো মসজিদও রয়েছে ইস্তামবুলে একাধিক। একটি জাতি তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করে দেশটিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তুরস্ক তার বড় প্রমাণ। *’র মিউজিয়ামটি দেখে আমার শাহবাগের মিউজিয়ামের কথাটি মনে হয়েছিল। আমরা কী সেখানে পুরোপুরিভাবে আমাদের অতীতকে সংরক্ষণ করতে পেরেছি? পারলে কতটুকু পেরেছি? বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জনমত ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের দাবি উপেক্ষা করে ফ্রান্সের একটি জাদুঘরের জন্য পাঠানো হয়েছিল আমাদের কিছু প্রত্ননিদর্শন। সাবেক আমলা (পাক আমলের সিএসপি) আইয়ুব কাদরী সব প্রতিবাদ উপেক্ষা করে নিজ ক্ষমতাবলে (শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা) আমাদের কিছু প্রত্ননিদর্শন গিমের মিউজিয়ামে পাঠিয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, সব প্রত্ননিদর্শন ফেরত আসেনি। ভাবতে অবাক লাগে, বিষয়টি নিয়ে তেমন আর আলোচনা হল না এবং কাদরী সাহেবের ভূমিকা পর্দার অন্তরালেই থেকে গেল। পৃথিবীর কোন দেশেই এটা সম্ভব নয়। কেউ এটা চিন্তাও করতে পারে না। লাখ লাখ ডলারে এসব প্রত্ননিদর্শন বিক্রি হয়। ওই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একটি আন্তর্জাতিক চোরাকারবারির দল অত্যন্ত সক্রিয়। তারা এগুলো কিনে নেয় অল্প দাম দিয়ে। পরে অত্যন্ত চড়া দামে তা ইউরোপ তথা আমেরিকার বাজারে বিক্রি করে। তুরস্কেও এমনটি ঘটেছিল। কিন্তু ওরা পেরেছে। আমেরিকার মতো দেশ থেকে ওরা ওদের চুরি হয়ে যাওয়া প্রত্ননিদর্শন ফেরত নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমরা পারিনি। অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে গিমের মিউজিয়ামে পাঠানো প্রত্ননিদর্শনগুলো নিয়ে (যার একটা অংশ হারিয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে) আর আলোচনা হয় না। একটা জাতি যদি তার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে না পারে, সে জাতি নিজেকে কখনও উন্নত করতে পারে না। ঞঙচকঅচও-তে আমি অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকদের ব্যবহৃত পোশাক, অলংকারাদিও দেখেছি। আমাদের এই অঞ্চলের শাসকদের পাঠানো উপহার সামগ্রীও সেখানে প্রদর্শন করা হয়। লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কের মিউজিয়ামের চেয়ে কোন অংশে কম নয় ইস্তামবুলের *’র মিউজিয়ামটি।

ইস্তামবুলের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বসফরাস চ্যানেল। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই এ চ্যানেলের কথা জানেন। এটাকে ওরা ওদের ভাষায় বলে ইড়মধুরপর। ইউরোপ আর এশিয়ার সংস্কৃতির এক যোগসূত্র হচ্ছে বসফরাস চ্যানেলের ওপর নির্মিত সেতুটি। এ চ্যানেল কৃষ্ণ সাগরের সঙ্গে মার্মার সাগরকে সংযুক্ত করেছে। পরে মার্মার সাগর আজিয়ান সাগরের সঙ্গে মিশে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে মিশেছে। যারাই ইস্তামবুলে যান, তারা ছোট্ট জাহাজে করে বসফরাস চ্যানেল দিয়ে দেড় ঘণ্টার এক সাগর ভ্রমণ করেন। বসফরাস চ্যানেলের একদিকে ইউরোপ, অন্যদিকে এশিয়া। দুই ঐতিহ্যই ধারণ করেছে ইস্তামবুল। বসফরাস চ্যানেল দিয়ে যখন সাগরে যাচ্ছি, তখন আমার মনে পড়ে গেল বুড়িগঙ্গার কথা। বসফরাস চ্যানেলের পানি এত স্বচ্ছ, এত পরিষ্কার। আর আমরা বুড়িগঙ্গাকে ইতিমধ্যে হত্যা করেছি। বুড়িগঙ্গার পানি এত দুর্গন্ধময় ও কালো যে শরীরে লাগলে তাতে চর্মরোগ হতে বাধ্য। বুড়িগঙ্গা পর্যটকদের জন্য আমরা আকর্ষণীয় করে তুলতে পারতাম। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবেশমন্ত্রীরা আসেন আর যান, কেউ বুড়িগঙ্গা নিয়ে ভাবেন না। আমাদের মন্ত্রীরা তো ইস্তামবুলে রাষ্ট্রীয় সফরে যান। তাদের কারোর কি বসফরাস চ্যানেল দেখার সময় বুড়িগঙ্গার কথা মনে হয়েছে? আমাদের বর্তমান পরিবেশমন্ত্রী অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। ‘পরিবেশ রক্ষায়’ বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি সুদূর এন্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রী বাহাদুরের সময় কি কখনও হয়েছে বুড়িগঙ্গার কালো পানি দেখার? সচিবালয় থেকে বুড়িগঙ্গার দূরত্ব কত? পাঁচ কিলোমিটার। মন্ত্রী সাহেব সুদূর এন্টার্কটিকায় যান। কিন্তু যান না বুড়িগঙ্গায়। আমরা পরিবেশ নিয়ে কথা বলি। পরিবেশ তথা জীববৈচিত্র্য নিয়ে কথা বলতে আমরা গিয়েছিলাম তুরস্কে। বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে সম্মেলনে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন ফ্রান্সের সাভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. কারমেন ডি জং। তিনি উদ্বিগ্ন জলবায়ু উদ্বাস্তু নিয়ে। পানি সমস্যা নিয়েও উদ্বিগ্ন তিনি। সারা বিশ্ব তিনি চষে বেড়ান। পরিবেশ নিয়ে কথা বলেন। তাকে বুড়িগঙ্গার কথা বললাম। তিতাসে বাঁধ দেয়ার প্রশ্ন উঠল। পরিবেশবিদ প্রফেসর কারমেন জানতে চাইলেন পরিবেশমন্ত্রীর ভূমিকার কথা। আমার কোন জবাব ছিল না। আমরা সেই মন্ত্রী কবে পাব, যিনি বিদেশ সফর না করে নিজ দেশের পরিবেশ রক্ষায় নিরলস কাজ করে যাবেন। ড. কারমেন জানালেন, নদী রক্ষায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাহায্য দেয়। বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে আমাদের পরিবেশমন্ত্রী কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলবেন?

সম্মেলনে অংশ নিয়ে আমার মনে হয়েছে, তুরস্কের কাছ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। তুরস্কের ইতিহাস ও সভ্যতা কয়েক হাজার বছরের পুরনো হলেও আধুনিক তুরস্কের যাত্রা ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর, যখন তুরস্ক মুস্তাফা কামাল পাশার নেতৃত্বে একটি রিপাবলিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর আগে দেশটি ৬২৩ বছর অটোমান শাসকদের দ্বারা পরিচালিত হতো। অটোমান শাসকরা সুলতান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশের চেয়ে সাড়ে পাঁচগুণ বড় তুরস্ক। কিন্তু লোকসংখ্যা মাত্র সাড়ে ৭ কোটি, বাংলাদেশের অর্ধেক। বাংলাদেশ যদি জনসংখ্যার হার আরও কমিয়ে আনতে না পারে, তাহলে তা উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে আটকে দেবে। তুরস্ক এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য একটি মডেল। তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আমাদের জন্য একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে যৌথ উদ্যোগে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার। তুরস্ক এখন একটি মধ্য আয়ের দেশ। ক্রয় ক্ষমতা অনুযায়ী (পিপিপি) তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় (পিপিপি) বছরে ১৫ হাজার ৩৪০ ডলার। বিশ্ব অর্থনীতিতে তুরস্কের অবস্থান ১৫তম। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নেইল ২০১১ সালে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেন। তাতে তিনি তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করেছেন * গ্রুপে, অর্থাৎ মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক বিশ্বে নতুন একটি অর্থনৈতিক ব্লক সৃষ্টি করেছে। জিম ও’নেইল এ চারটি দেশকে শুধু দ্রুতবর্ধনশীল উন্নয়নশীল বিশ্ব বলতে নারাজ। ২০০১ সালে তিনিই **-এর ধারণা দিয়েছিলেন (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন)। বাংলাদেশ গওকঞ মডেল অনুসরণ করতে পারে এবং এ ব্লকের দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে পারে।

২০০২ সাল থেকেই জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতৃত্বে একটি সরকার সেখানে স্থিতিশীলতা উপহার দিয়ে আসছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল (২০০৭ সাল থেকে) ও প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইপ এরদোগান অত্যন্ত জনপ্রিয়। এদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন অভিযোগ নেই। পর পর তিনবার এরদোগান প্রধানমন্ত্রী ও তার দল বিজয়ী হয়েছে (২০০২ সালে ৩৪ ভাগ, ২০০৭ সালে ৪৭ ভাগ আর ২০১১ সালে ৪৯ ভাগ ভোট)। প্রেসিডেন্ট গুল ও প্রধানমন্ত্রী এরদোগান ব্যক্তিজীবনে ইসলামিক জীবনধারা (তাদের স্ত্রীরা মাথায় হেজাব ব্যবহার করেন) অনুসরণ করলেও তারা কট্টর নন। তারা বাধ্য করছেন না সবাইকে ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলতে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রীদের জন্য ‘হেজাব না পরার’ যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা তুলে নেয়া হয়েছে। আমি বেশ ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, মেয়েরা আদৌ হেজাব পরে না। জিন্স প্যান্ট পরা আধুনিক মেয়েদের ক্যাম্পাসে চলাফেরা আমাকে ইউরোপের দেশগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বে অভিযোগ রয়েছে যে, দলটি ইসলামপন্থী ও কট্টর। কিন্তু তুরস্কে আমি এ অভিযোগ শুনিনি। সেখানে আদৌ কোন জঙ্গিবাদী তৎপরতা নেই। একাধিক ফোরামে আমি আল-কায়েদার তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন করেছি। জবাব পেয়েছি একটাই, সেখানে আল-কায়েদার কোন তৎপরতা নেই। একটি মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ যে ব্যক্তিজীবনে ইসলামকে ধারণ করেও আধুনিকমনস্ক হতে পারে, তুরস্ক তার বড় প্রমাণ। কামাল পাশা (যিনি জাতির পিতাও বটে) তুরস্কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। তা আজও আছে। কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে বটে, তবে তাতে মূলনীতিতে তেমন পরিবর্তন আসেনি। আমি তুরস্কে কোথাও শুনিনি যে, বিরোধী পক্ষ সরকারের ইসলামপন্থী কিছু কর্মকাণ্ডকে ‘জঙ্গিবাদী’ তৎপরতা বলে দাবি করছে (অথচ আমরা জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গটি বারবার টেনে আনছি)। অত্যন্ত ‘ক্লিন’ চরিত্রের অধিকারী এরদোগান ছিলেন ইস্তামবুলের মেয়র। বাংলাদেশ তুরস্কের এই ‘রাজনীতি’ থেকে কিছুটা শিখতে পারে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তার পুরনো সম্পর্ক নতুন করে স্থাপন করার উদ্যোগ নিচ্ছে। পুরনো ‘সিল্করোড’কে নতুন করে আবার ‘আবিষ্কার’ করছে তুরস্ক। চেষ্টা করছে ওই দেশগুলোকে একটি প্লাটফর্মে দাঁড় করাতে। তুরস্ক হতে যাচ্ছে ‘সিল্করোড’ভুক্ত দেশগুলোর নেতা। বাকু-তিবিলিসি-সাইহান পাইপ লাইন (গ্যাস ও তেল) এ লক্ষ্যেই রচিত। চার বছর পর পর সেখানে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর সংসদ নির্বাচনে যারা ন্যূনতম ১০ ভাগ ভোট পেয়েছে, সংসদে তারাই দলীয়ভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। যদিও ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের’ আলোকে সেখানে নির্বাচন হয়।

তুরস্ক আধুনিক মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি আদর্শ। একটি ইসলামপন্থী দলও যে জনসমর্থন পেতে পারে এবং আধুনিকমনস্ক একটি নীতি গ্রহণ করে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একটি মডেল হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারে, তুরস্ক হচ্ছে তার বড় প্রমাণ। তুরস্ক থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

ড. তারেক শামসুর রেহমান 
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
 জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[সূত্রঃ যুগান্তর, ১২/০৩/১২]

একজন কারসেন ও বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের কিছু কথা

ডারবান সম্মেলনের পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, প্রতি বছর এ ধরনের সম্মেলন করে শেষ পর্যন্ত কী বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করা সম্ভব হবে? বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তাই 'কপ' সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। ইতিমধ্যে জাপান, কানাডা ও রাশিয়া কিয়োটো-পরবর্তী আলোচনা থেকে বেরিয়ে গেছে। সুতরাং বোঝাই যায়, এক ধরনের হতাশা এসে গেছে। আসলে বিশ্বের দেশগুলো এখন বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একেক গ্রুপের একেক এজেন্ডা। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি, তার মাঝে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেক্স-১-এ অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগ এই দেশুগলোর। অথচ লোকসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ১৯ ভাগ। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশি, শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ ৭৭-এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ, জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ। কিন্তু কার্বন উদগিরণ করে ৪২ ভাগ। আবার সাগর পাড়ের দেশগুলো, যারা বিশ্বের জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ১ ভাগ, তাদের দাবি ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো, আবার 'রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন' হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ্ব জনগোষ্ঠীর ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ ভাগ তাদের। আর মাত্র ৪ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ ভাগ, জিডিপির ৩০ ভাগ তাদের। অথচ জনসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ৫ ভাগ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ ভাগ ও জনসংখ্যার ৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ ভাগ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ ভাগ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ ভাগ তাদের। প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটাকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। অর্থাৎ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাই অক্সাইড উদগিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিন হাউস গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে এই হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিত_ এটা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে, সে প্রশ্নের কোন সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সঙ্গে ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়, সে কারণে এই দুটো দেশের কাছ থেকে 'কমিটমেন্ট' আশা করেছিল বিশ্ব। কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিল ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চেয়ে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল তারা ১৭ ভাগ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২.৮৫ টন, আর ভারতের ১০৮ টন। চীন ও ভারত দুটো দেশই বড় অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে এই শতাব্দীতে। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় তখন ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ, ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। তবে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ ভাগ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়_ তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কেননা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। আর তাতে করে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৯০ সালের কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ৭ শতাংশ, জাপান ৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা। তাছাড়া সার্বিকভাবে ৫.২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল সবগুলো দেশকে ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজে-কলমে থেকে গিয়েছিল।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে কটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মাঝে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে গেলে উপকূলের মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশে প্রতি ৭ জনে ১ জন উদ্বাস্তু হবে। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্ধাস্তুদের টহরাবৎংধষ ঘধঃঁৎধষ চধৎংড়হ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল।
ডারবান সম্মেলনে বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে মাত্র পাওয়া গেছে আড়াই বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সেখান থেকে পেয়েছে ১৩০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু আইলার কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর হয়নি। সার্ক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঐক্যবদ্ধভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সম্যাগুলো আমরা তুলে ধরবো। কিন্তু ডারবানে তা হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারত একই ফেরামে ছিল না। একটি আইনি বাধ্যবাধকতার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু তা নিয়েও প্রশ্ন আছেই। প্রযুক্তি হস্তান্তর সম্পর্কেও কোনো সমঝোতা হয়নি। কপ সম্মেলন এলেই বড় বড় কথা বলা হয়। কয়েক টন কার্বন নিঃসরণ করে সম্মেলন 'অনেক আশার কথা শুনিয়ে' শেষ হয় বটে; কিন্তু সে ক্ষেত্রে আগ্রগতি হয় খুব কমই। আগে সমস্যা ছিল উন্নত বিশ্বকে নিয়ে। এখন চীন ও ভারতও একটি সমস্যা। তাদের যুক্তি, নিঃসরণের পরিমাণ হ্রাস করলে, তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। তাতে করে বাড়বে দরিদ্রতা। এই যুক্তি ফেলে দেওয়ার নয়। ফলে কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেলই। চলতি বছর কাতারে এ সম্মেলন হবে। কিন্তু চুক্তির ব্যাপারে অগ্রগতি কতটুকু হবে, বলা মুশকিল।
কিছুদিন আগে আমাদের পরিবেশমন্ত্রী আল গোরের সঙ্গে এন্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ যে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে, এটা বিশ্ববাসীকে জানাতেই আল গোর আমাদের পরিবেশমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এন্টার্কটিকায়। আল গোর নিজে তার প্রবন্ধে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ ২ থেকে আড়াই কোটি বাংলাদেশিকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে হবে। এর ফলে প্রচুর মানুষ হারাবে তাদের বসতি, তাদের পেশা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া মানে কেবল বন্যা নয়, এর মানে লোনা পানির আগ্রাসন। ধানের আবাদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। ২ কোটি কৃষক পেশা হারিয়ে শহরে আশ্রয় নেবে_ এমন আশঙ্কাও করেছেন আল গোর। মিথ্যা বলেননি তিনি।
আজ যখন প্রফেসর কারসেন বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে কথা বলেন, তখন আমি তার বক্তব্যের মাঝে আল গোরের বক্তব্য খুঁজে পাই। এটা সত্য, বিশ্ব আজ বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা জানে। কিন্তু এই বিপর্যয় রোধে উন্নত বিশ্বের ভূমিকা খুবই সীমিত। এক্ষেত্রে নিজস্ব উদ্যোগেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। উন্নত দেশের সাহায্যের আশায় বসে থাকলে চলবে না। অধ্যাপক কারসেন সে কথাই বলছিলেন আমাকে।
দৈনিক ডেসটিনি, ১৩ মার্চ ২০১২।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এ রায় বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বিজয়


হামবুর্গের এই ট্রাইব্যুনালের রায় আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের এলাকায় ১৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশ যে বড় ধরনের জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এই রিজার্ভ আমাদের জন্য একটা সমাধান বয়ে আনতে পারে।

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধে বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইবুনাল ফর ল’ অব দ্য সি। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের বিজয়। এ রায়ের ফলে সমুদ্রে ২০০ নটিক্যাল মাইল (১ লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার) পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এলাকা ও সার্বভৌম অধিকারের অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত হল। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোন সুযোগ নেই এবং মিয়ানমার রায়টি মানতে বাধ্য। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতের সঙ্গেও সমুদ্রসীমা নিয়ে আমাদের বিরোধ রয়েছে। মিয়ানমার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এর সমাধান চাইলেও ভারত দ্য হেগের পারমানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান চাইছে। দু’ভাবেই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা যায়। মূলত মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে সমস্যা ছিল একটাই। আর তা হচ্ছে, কিভাবে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হবে। মিয়ানমারের দাবি ছিল, ‘সমদূরত্ব’ ভিত্তিতে এ সীমা নির্ধারণ করতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের যুক্তি ছিল, সীমানা নির্ধারণ করতে হবে ‘ন্যায়পরায়ণতা’র ভিত্তিতে। কারণ বাংলাদেশ মনে করে, যদি ‘সমদূরত্ব’কে ভিত্তি করে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা ১৩০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। এর ফলে সমুদ্রের অগাধ সম্পদ আহরণ থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে।

দীর্ঘদিন সমুদ্রসীমা নিয়ে দু’দেশের মাঝে বিরোধ চলে এলেও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এর কোন সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সমস্যা ছিল ভারতের সঙ্গেও। এমন এক পরিস্থিতিতে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মিয়ানমার ও ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে হার্মবুগের ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার কথা জানান। বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালে তার অভিযোগ দায়েরের পর ২০১০ সালের ১ জুলাই তার দাবির সমর্থনে নথিপত্র উপস্থাপন করে। মিয়ানমার তাদের দাবির সমর্থনে নথি উপস্থাপন করে ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর। এখন মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের অবসান হলেও ভারতের সঙ্গে বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসায় আমরা ট্রাইব্যুনালে যাইনি। আমরা গেছি আরবিট্রেশনে। চলতি বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ভারত তার জবাব দেবে। আমরা সময় পাব ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। আর আরবিট্রেশনের চূড়ান্ত রায় পাওয়া যাবে ২০১৪ সালে।

সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি বেশ জটিল। অতীতে বাংলাদেশে বিষয়টির ওপর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বাংলাদেশে সমুদ্র আইন নিয়ে গবেষণাও ছিল সীমিত। যে কারণে তেমন কোন বিশেষজ্ঞ এ দেশে তৈরি হয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘এটাচড’ করা হয় এবং তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে। মূলত তিনভাবে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে থাকে- ১. সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল, ২. আন্তর্জাতিক আদালত ও ৩. আরবিট্রয়াল ট্রাইব্যুনাল। ভারত প্রথম দুটিতে আগেই আপত্তি দেয়ায় ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আমাদের তৃতীয় ‘অপশনে’ যেতে হয়েছে। এখন মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তিতে ‘ন্যায়পরায়ণতা’র (বা ইকুইটি) দাবি স্বীকৃত হওয়ায় ধারণা করছি, ভারতের সঙ্গেও বিরোধ নিষ্পত্তিতে এই দাবি টিকে যাবে। ভারত ও মিয়ানমার প্রথম থেকেই ‘ইকোডিসটেন্স’ বা সমদূরত্বের কথা বলে আসছিল। এ দাবি মেনে নেয়া হলে বঙ্গোপসাগরের ওপর যথাক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দুটি সীমারেখা টানা হতো। এর ফলে বাংলাদেশ সমুদ্র অঞ্চলের ওপর তার অধিকার হারাত। বাংলাদেশ চেয়েছে ‘সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার’ ভিত্তিতে একটি সমাধান। এ পদ্ধতিতে সোজা দক্ষিণ দিকে এই সীমারেখা টানতে হবে। ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের এই দাবিকে স্বীকৃতি দিল। বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ী ‘সমদূরত্বে’র দাবি মেনে নিত, তাহলে বাংলাদেশের ৪৮ হাজার ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা মিয়ানমারের হাতে চলে যেত। একই সঙ্গে ৩১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা চলে যেত ভারতের হাতে। ফলে সমুদ্রের যে বিশাল সম্পদ, সেই সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো বাংলাদেশ। তাই ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি এখন সঠিক বলেই বিবেচিত হবে।

যারা সমুদ্র আইন নিয়ে কাজ করেন তারা জানেন, হামবুর্গে বাংলাদেশের অনুকূলে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে, তার সঙ্গে ১৯৬৯ সালের আন্তর্জাতিক আদালতের দেয়া একটি রায়ের অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। আজ বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতকে নিয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, ঠিক একই ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছিল জার্মানি, ডেনমার্ক ও হল্যান্ডের মধ্যে। এই তিনটি দেশই তেলসমৃদ্ধ নর্থ সিতে তাদের বিশাল এলাকা দাবি করেছিল। ওই সময় একদিকে ছিল জার্মানি, অন্যদিকে ডেনমার্ক ও হল্যান্ড। জার্মানির অবস্থান ছিল অনেকটা আজকের বাংলাদেশের মতো। জার্মানির দাবি ছিল, ডেনমার্ক ও হল্যান্ড ‘সমদূরত্বে’র নীতি অনুসরণ করায় সমুদ্রে তার অধিকার খর্ব হয়েছে এবং দেশটি ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিরোধ নিষ্পত্তিতে দেশ তিনটি ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে যায়। আদালত ১৯৬৯ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি এক রায়ে ঘোষণা করে যে, দেশ তিনটির সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতে হবে ‘সমদূরত্বে’র নীতিতে নয়, বরং ‘ন্যায়পরায়ণতা’র ভিত্তিতে। আজ ৪৩ বছর পর নতুন করে আবার ‘ন্যায়পরায়ণতা’র ভিত্তিটি স্বীকৃতি পেল।

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের উপকূল বিচিত্র ধরনের। এখানে প্রতিনিয়ত পলি জমার কারণে তীরের গভীরতাও এতই কম যে জাহাজ সরাসরি বন্দরে ভিড়তে পারে না। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমারের উপকূল উত্তল (কনভেক্স), অর্থাৎ তাদের উপকূল সমুদ্রের ভেতর ঢুকে গেছে। আমাদের উপকূল অবতল (কনকেইভ), অর্থাৎ সমুদ্র এখানে উপকূলের ভেতর ঢুকে গেছে। এর ফলে উপকূল আঁকাবাঁকা হয়। এখানে পলি বেশি জমা হয়। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনে একে বিশেষ পরিস্থিতি বলা হয়েছে। ভূসন্নিহিত এ ধরনের সমুদ্র সম্পদে পরিপূর্ণ হলে আন্তর্জাতিক আইনে সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার বেশি থাকে। তবে এক্ষেত্রে একটা সমস্যা ছিল ভারতকে নিয়ে। সমুদ্রসীমাটা কোত্থেকে শুরু হয়েছে, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যাখ্যা ভিন্ন ভিন্ন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক নদী হাড়িয়াভাঙ্গার মধ্য স্রোত হবে বাংলাদেশের সীমানা। অন্যদিকে ভারত চাইছে, রায়মঙ্গল, যমুনা ও হাড়িয়াভাঙ্গা নদী বঙ্গোপসাগরে গিয়ে যেখানে মিশেছে, সেখানে গভীর চ্যানেলের কোন এক জায়গায় সীমানা নির্ধারিত হোক। তবে বাংলাদেশের যুক্তি- রায়মঙ্গল ও যমুনা অভ্যন্তরীণ নদী। সমুদ্রসীমা শুরুর পয়েন্ট নিয়ে বিরোধ থাকায় ভারত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপকে নিজের বলে দাবি করে আসছে।

এখানে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৫৮ সালের আগ পর্যন্ত সমুদ্রসংক্রান্ত কোন আইন ছিল না। ১৯৫৮ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রথমবারের মতো চারটি কনভেনশন বা সনদ গ্রহণ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় সমুদ্র ও নিকটস্থ অঞ্চলবিষয়ক কনভেনশন, উন্মুক্ত সমুদ্রবিষয়ক কনভেনশন, মহীসোপান বিষয়ক কনভেনশন ও মৎস্য শিকার ও প্রাণিজসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণবিষয়ক কনভেনশন। এসব কনভেনশন পরে অনেক রাষ্ট্রের অনুমোদন পেয়ে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বলবৎ আছে। এটি ১৯৮২ সালে গৃহীত এবং ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে তা কার্যকর হয়। ভারত ১৯৯৫ সালের ২৭ জুন ও মিয়ানমার ১৯৯৬ সালের ২১ মে * অনুমোদন করে। বাংলাদেশ তা অনুমোদন করে ২০০১ সালের ২৭ জুলাই। তবে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ** ১৯৭৪ পাস করেছিল। ওই আইনের বেইজলাইন ৬০ ফুট সমুদ্র গভীরতার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়েছিল। জাতিসংঘের সমুদ্র আইনের ৭৬ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সমুদ্র তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিকেল মাইল বা ৬৪৮ দশমিক ২ কিলোমিটার পর্যন্ত নিজেদের অধিকার দাবি করতে পারে। ২০০ নটিক্যাল মাইল এমনিতেই বাংলাদেশের পাওনা। বাকি ১৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে জাতিসংঘে দাবি করতে হয়। আইন অনুযায়ী মহীসোপানের মহিঢাল থেকে যেখানে সেডিমেন্ট (পলি) ১ শতাংশ পর্যন্ত আছে অথবা ২ হাজার ৫০০ মিটার পানির গভীরতা রেখা থেকে আরও ১০০ নটিকেল মাইল পর্যন্ত পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রথম ২০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই ভারত ও মিয়ানমার তাদের ভূখণ্ড দাবি করে আসছিল। ২০০৯ সালের ২৯ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংসদকে জানিয়েছিলেন, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে ২৮ হাজার ৪৭৬ বর্গনটিক্যাল মাইল অমীমাংসিত সীমান্ত রয়েছে। এখানে ভারতের দাবি ৮ হাজার ৭১৪ বর্গ নটিক্যাল মাইল ও মিয়ানমারের দাবি ১৯ হাজার ৭০২ বর্গনটিক্যাল মাইল। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সমুদ্রে গ্যাস ব্লক (৫, ১০ ও ১১) ইজারা দিতে গেলে ভারত (৫ ও ১০) এবং মিয়ানমার (১১) একযোগে আপত্তি তোলে। শুধু তাই নয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের ২৮টি ব্লকের মাঝে ভারতের দাবি রয়েছে ১০টিতে, আর মিয়ানমারের দাবি ১৭টিতে। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র ব্লক ১৩, ১৭, ১৮, ২২, ২৩, ২৭ ও ২৮-এর ভেতর মিয়ানমারের গভীর সমুদ্র ব্লক এডি-৭, এডি-৮, এডি-৯ ও এডি-১০ ঢুকে পড়েছে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে মিয়ানমার এডি-৭ (বাংলাদেশের ব্লক ১৩) ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে গেলে (কোরিয়ার দেওউ কোম্পানি) দু’দেশের নৌবাহিনী পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল।

আমাদের সমুদ্র অঞ্চল নানা ধরনের খনিজ পদার্থ ও গ্যাসসম্পদে ভরপুর। বাংলাদেশের নিজ উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নৌসীমা রয়েছে। এই অভ্যন্তরীণ নৌসীমায় বাংলাদেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব বজায় রয়েছে। এর পরের ১২ নটিক্যাল মাইল সন্নিকটবর্তী অঞ্চল এবং এ অঞ্চলের সীমানা শেষ হলে শুরু হয় ‘একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল’, যা ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন টাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী এই ২০০ নটিক্যাল মাইলের ওপর আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরেই সাগরের যে মহীসোপান, সেখানেও আমাদের অধিকার রক্ষিত হল। হামবুর্গের এই ট্রাইব্যুনালের রায় আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের এলাকায় ১৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশ যে বড় ধরনের জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এই রিজার্ভ আমাদের জন্য একটা সমাধান বয়ে আনতে পারে।

মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা এখন চিহ্নিত হল। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে না, এটাই আশা করি। কারণ বাংলাদেশের উন্নয়নে মিয়ানমারের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের ‘পূর্বমুখী’ পররাষ্ট্রনীতির আলোকে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা অত্যন্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের **-কে আরও শক্তিশালী করা দরকার। বিশেষজ্ঞ টিম তৈরি করাও জরুরি। কারণ একুশ শতকে সমুদ্র হবে সম্পদের আধার। এ সম্পদের সুষ্ঠু আহরণ ও ব্যবহারের জন্য চাই দক্ষ জনশক্তি।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[সূত্রঃ যুগান্তর, ১৬/০৩/১হামবুর্গের এই ট্রাইব্যুনালের রায় আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের এলাকায় ১৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশ যে বড় ধরনের জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এই রিজার্ভ আমাদের জন্য একটা সমাধান বয়ে আনতে পারে।

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধে বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইবুনাল ফর ল’ অব দ্য সি। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের বিজয়। এ রায়ের ফলে সমুদ্রে ২০০ নটিক্যাল মাইল (১ লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার) পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এলাকা ও সার্বভৌম অধিকারের অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত হল। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোন সুযোগ নেই এবং মিয়ানমার রায়টি মানতে বাধ্য। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতের সঙ্গেও সমুদ্রসীমা নিয়ে আমাদের বিরোধ রয়েছে। মিয়ানমার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এর সমাধান চাইলেও ভারত দ্য হেগের পারমানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান চাইছে। দু’ভাবেই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা যায়। মূলত মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে সমস্যা ছিল একটাই। আর তা হচ্ছে, কিভাবে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হবে। মিয়ানমারের দাবি ছিল, ‘সমদূরত্ব’ ভিত্তিতে এ সীমা নির্ধারণ করতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের যুক্তি ছিল, সীমানা নির্ধারণ করতে হবে ‘ন্যায়পরায়ণতা’র ভিত্তিতে। কারণ বাংলাদেশ মনে করে, যদি ‘সমদূরত্ব’কে ভিত্তি করে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা ১৩০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। এর ফলে সমুদ্রের অগাধ সম্পদ আহরণ থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে।

দীর্ঘদিন সমুদ্রসীমা নিয়ে দু’দেশের মাঝে বিরোধ চলে এলেও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এর কোন সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সমস্যা ছিল ভারতের সঙ্গেও। এমন এক পরিস্থিতিতে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মিয়ানমার ও ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে হার্মবুগের ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার কথা জানান। বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালে তার অভিযোগ দায়েরের পর ২০১০ সালের ১ জুলাই তার দাবির সমর্থনে নথিপত্র উপস্থাপন করে। মিয়ানমার তাদের দাবির সমর্থনে নথি উপস্থাপন করে ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর। এখন মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের অবসান হলেও ভারতের সঙ্গে বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসায় আমরা ট্রাইব্যুনালে যাইনি। আমরা গেছি আরবিট্রেশনে। চলতি বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ভারত তার জবাব দেবে। আমরা সময় পাব ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। আর আরবিট্রেশনের চূড়ান্ত রায় পাওয়া যাবে ২০১৪ সালে।

সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি বেশ জটিল। অতীতে বাংলাদেশে বিষয়টির ওপর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বাংলাদেশে সমুদ্র আইন নিয়ে গবেষণাও ছিল সীমিত। যে কারণে তেমন কোন বিশেষজ্ঞ এ দেশে তৈরি হয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘এটাচড’ করা হয় এবং তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে। মূলত তিনভাবে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে থাকে- ১. সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল, ২. আন্তর্জাতিক আদালত ও ৩. আরবিট্রয়াল ট্রাইব্যুনাল। ভারত প্রথম দুটিতে আগেই আপত্তি দেয়ায় ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আমাদের তৃতীয় ‘অপশনে’ যেতে হয়েছে। এখন মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তিতে ‘ন্যায়পরায়ণতা’র (বা ইকুইটি) দাবি স্বীকৃত হওয়ায় ধারণা করছি, ভারতের সঙ্গেও বিরোধ নিষ্পত্তিতে এই দাবি টিকে যাবে। ভারত ও মিয়ানমার প্রথম থেকেই ‘ইকোডিসটেন্স’ বা সমদূরত্বের কথা বলে আসছিল। এ দাবি মেনে নেয়া হলে বঙ্গোপসাগরের ওপর যথাক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দুটি সীমারেখা টানা হতো। এর ফলে বাংলাদেশ সমুদ্র অঞ্চলের ওপর তার অধিকার হারাত। বাংলাদেশ চেয়েছে ‘সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার’ ভিত্তিতে একটি সমাধান। এ পদ্ধতিতে সোজা দক্ষিণ দিকে এই সীমারেখা টানতে হবে। ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের এই দাবিকে স্বীকৃতি দিল। বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ী ‘সমদূরত্বে’র দাবি মেনে নিত, তাহলে বাংলাদেশের ৪৮ হাজার ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা মিয়ানমারের হাতে চলে যেত। একই সঙ্গে ৩১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা চলে যেত ভারতের হাতে। ফলে সমুদ্রের যে বিশাল সম্পদ, সেই সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো বাংলাদেশ। তাই ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি এখন সঠিক বলেই বিবেচিত হবে।

যারা সমুদ্র আইন নিয়ে কাজ করেন তারা জানেন, হামবুর্গে বাংলাদেশের অনুকূলে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে, তার সঙ্গে ১৯৬৯ সালের আন্তর্জাতিক আদালতের দেয়া একটি রায়ের অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। আজ বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতকে নিয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, ঠিক একই ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছিল জার্মানি, ডেনমার্ক ও হল্যান্ডের মধ্যে। এই তিনটি দেশই তেলসমৃদ্ধ নর্থ সিতে তাদের বিশাল এলাকা দাবি করেছিল। ওই সময় একদিকে ছিল জার্মানি, অন্যদিকে ডেনমার্ক ও হল্যান্ড। জার্মানির অবস্থান ছিল অনেকটা আজকের বাংলাদেশের মতো। জার্মানির দাবি ছিল, ডেনমার্ক ও হল্যান্ড ‘সমদূরত্বে’র নীতি অনুসরণ করায় সমুদ্রে তার অধিকার খর্ব হয়েছে এবং দেশটি ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিরোধ নিষ্পত্তিতে দেশ তিনটি ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে যায়। আদালত ১৯৬৯ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি এক রায়ে ঘোষণা করে যে, দেশ তিনটির সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতে হবে ‘সমদূরত্বে’র নীতিতে নয়, বরং ‘ন্যায়পরায়ণতা’র ভিত্তিতে। আজ ৪৩ বছর পর নতুন করে আবার ‘ন্যায়পরায়ণতা’র ভিত্তিটি স্বীকৃতি পেল।

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের উপকূল বিচিত্র ধরনের। এখানে প্রতিনিয়ত পলি জমার কারণে তীরের গভীরতাও এতই কম যে জাহাজ সরাসরি বন্দরে ভিড়তে পারে না। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমারের উপকূল উত্তল (কনভেক্স), অর্থাৎ তাদের উপকূল সমুদ্রের ভেতর ঢুকে গেছে। আমাদের উপকূল অবতল (কনকেইভ), অর্থাৎ সমুদ্র এখানে উপকূলের ভেতর ঢুকে গেছে। এর ফলে উপকূল আঁকাবাঁকা হয়। এখানে পলি বেশি জমা হয়। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনে একে বিশেষ পরিস্থিতি বলা হয়েছে। ভূসন্নিহিত এ ধরনের সমুদ্র সম্পদে পরিপূর্ণ হলে আন্তর্জাতিক আইনে সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার বেশি থাকে। তবে এক্ষেত্রে একটা সমস্যা ছিল ভারতকে নিয়ে। সমুদ্রসীমাটা কোত্থেকে শুরু হয়েছে, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যাখ্যা ভিন্ন ভিন্ন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক নদী হাড়িয়াভাঙ্গার মধ্য স্রোত হবে বাংলাদেশের সীমানা। অন্যদিকে ভারত চাইছে, রায়মঙ্গল, যমুনা ও হাড়িয়াভাঙ্গা নদী বঙ্গোপসাগরে গিয়ে যেখানে মিশেছে, সেখানে গভীর চ্যানেলের কোন এক জায়গায় সীমানা নির্ধারিত হোক। তবে বাংলাদেশের যুক্তি- রায়মঙ্গল ও যমুনা অভ্যন্তরীণ নদী। সমুদ্রসীমা শুরুর পয়েন্ট নিয়ে বিরোধ থাকায় ভারত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপকে নিজের বলে দাবি করে আসছে।

এখানে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৫৮ সালের আগ পর্যন্ত সমুদ্রসংক্রান্ত কোন আইন ছিল না। ১৯৫৮ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রথমবারের মতো চারটি কনভেনশন বা সনদ গ্রহণ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় সমুদ্র ও নিকটস্থ অঞ্চলবিষয়ক কনভেনশন, উন্মুক্ত সমুদ্রবিষয়ক কনভেনশন, মহীসোপান বিষয়ক কনভেনশন ও মৎস্য শিকার ও প্রাণিজসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণবিষয়ক কনভেনশন। এসব কনভেনশন পরে অনেক রাষ্ট্রের অনুমোদন পেয়ে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বলবৎ আছে। এটি ১৯৮২ সালে গৃহীত এবং ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে তা কার্যকর হয়। ভারত ১৯৯৫ সালের ২৭ জুন ও মিয়ানমার ১৯৯৬ সালের ২১ মে * অনুমোদন করে। বাংলাদেশ তা অনুমোদন করে ২০০১ সালের ২৭ জুলাই। তবে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ** ১৯৭৪ পাস করেছিল। ওই আইনের বেইজলাইন ৬০ ফুট সমুদ্র গভীরতার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়েছিল। জাতিসংঘের সমুদ্র আইনের ৭৬ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সমুদ্র তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিকেল মাইল বা ৬৪৮ দশমিক ২ কিলোমিটার পর্যন্ত নিজেদের অধিকার দাবি করতে পারে। ২০০ নটিক্যাল মাইল এমনিতেই বাংলাদেশের পাওনা। বাকি ১৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে জাতিসংঘে দাবি করতে হয়। আইন অনুযায়ী মহীসোপানের মহিঢাল থেকে যেখানে সেডিমেন্ট (পলি) ১ শতাংশ পর্যন্ত আছে অথবা ২ হাজার ৫০০ মিটার পানির গভীরতা রেখা থেকে আরও ১০০ নটিকেল মাইল পর্যন্ত পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রথম ২০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই ভারত ও মিয়ানমার তাদের ভূখণ্ড দাবি করে আসছিল। ২০০৯ সালের ২৯ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংসদকে জানিয়েছিলেন, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে ২৮ হাজার ৪৭৬ বর্গনটিক্যাল মাইল অমীমাংসিত সীমান্ত রয়েছে। এখানে ভারতের দাবি ৮ হাজার ৭১৪ বর্গ নটিক্যাল মাইল ও মিয়ানমারের দাবি ১৯ হাজার ৭০২ বর্গনটিক্যাল মাইল। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সমুদ্রে গ্যাস ব্লক (৫, ১০ ও ১১) ইজারা দিতে গেলে ভারত (৫ ও ১০) এবং মিয়ানমার (১১) একযোগে আপত্তি তোলে। শুধু তাই নয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের ২৮টি ব্লকের মাঝে ভারতের দাবি রয়েছে ১০টিতে, আর মিয়ানমারের দাবি ১৭টিতে। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র ব্লক ১৩, ১৭, ১৮, ২২, ২৩, ২৭ ও ২৮-এর ভেতর মিয়ানমারের গভীর সমুদ্র ব্লক এডি-৭, এডি-৮, এডি-৯ ও এডি-১০ ঢুকে পড়েছে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে মিয়ানমার এডি-৭ (বাংলাদেশের ব্লক ১৩) ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে গেলে (কোরিয়ার দেওউ কোম্পানি) দু’দেশের নৌবাহিনী পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল।

আমাদের সমুদ্র অঞ্চল নানা ধরনের খনিজ পদার্থ ও গ্যাসসম্পদে ভরপুর। বাংলাদেশের নিজ উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নৌসীমা রয়েছে। এই অভ্যন্তরীণ নৌসীমায় বাংলাদেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব বজায় রয়েছে। এর পরের ১২ নটিক্যাল মাইল সন্নিকটবর্তী অঞ্চল এবং এ অঞ্চলের সীমানা শেষ হলে শুরু হয় ‘একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল’, যা ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন টাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী এই ২০০ নটিক্যাল মাইলের ওপর আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরেই সাগরের যে মহীসোপান, সেখানেও আমাদের অধিকার রক্ষিত হল। হামবুর্গের এই ট্রাইব্যুনালের রায় আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের এলাকায় ১৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশ যে বড় ধরনের জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এই রিজার্ভ আমাদের জন্য একটা সমাধান বয়ে আনতে পারে।

মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা এখন চিহ্নিত হল। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে না, এটাই আশা করি। কারণ বাংলাদেশের উন্নয়নে মিয়ানমারের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের ‘পূর্বমুখী’ পররাষ্ট্রনীতির আলোকে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা অত্যন্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের **-কে আরও শক্তিশালী করা দরকার। বিশেষজ্ঞ টিম তৈরি করাও জরুরি। কারণ একুশ শতকে সমুদ্র হবে সম্পদের আধার। এ সম্পদের সুষ্ঠু আহরণ ও ব্যবহারের জন্য চাই দক্ষ জনশক্তি।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[সূত্রঃ যুগান্তর, ১৬/০৩/১২