রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

দায় কার, কার দায়িত্ব


ছোট্ট মাইসার অপহরণ ও তার মায়ের কোলে ফিরে আসার কাহিনী একটি ‘বড় সংবাদ’-এ পরিণত হয়েছিল গত ২৩ এপ্রিল সংবাদপত্রগুলোতে। মাত্র আট মাসের শিশু মাইসাকে এই ঢাকা শহর থেকেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল ডাকাতরা। তারপর ওকে ডাকাতরা আটকে রেখেছিল প্রায় ১৮ ঘণ্টা। পুলিশ মাইসাকে উদ্ধার করতে পারেনি। ডাকাতরাই ওকে ফেলে রেখে গিয়েছিল। এই ১৮ ঘণ্টা মাইসার কেমন কেটেছে মাছাড়া, আমরা তা কোনো দিনই জানতে পারব না। কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে ওর ছবি যখন সকালের খবর-এ দেখলাম গত ২৩ এপ্রিল, আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। একটা অবুঝ বাচ্চা, যে কোনো পাপ করেনি, অন্যায় করেনি, তাকে কিনা টাকার লোভে এই ঢাকা শহরেই কিডন্যাপ করল ডাকাতরা! আমরা কোন শহরে বসবাস করছি এখন? ছিনতাই, রাহাজানি এসবে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। এখন কিনা বাচ্চা শিশু অপহরণ? মুক্তিপণ দাবি? ভাগ্য ভালো মাইসার বাবাকে মুক্তিপণ দিতে হয়নি। ডাকাতরা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল তারা মাইসাকে ধরে রাখতে পারবে না। তাই ফেলে রেখে গিয়েছিল। তবুও ভালো মাইসার বাবার ফোন নম্বরটি রেখে গিয়েছিল।
এই ঘটনাটি আমাকে খুব বিচলিত করেছে। আমি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে খুবই উদ্বিগ্ন। একটি ছোট্ট বাচ্চা, যে কথা বলতে পারে না, সে যদি ‘কিডন্যাপ’ হয়, তা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এটা স্বীকার করি বাড়ি বাড়ি পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের নয়। কিন্তু শহরে ডাকাতি কেন হবে? পুলিশের সোর্স কি কাজ করছে না? ওই সোর্সদের পেছনে তো লাখ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। ১৮ ঘণ্টা চলে গেল। পুলিশ মাইসাকে খুঁজে পেল না! এটা কি পুলিশ প্রশাসন তথা গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা নয়? তবুও আশা রাখছি যারা মাইসাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে ওই ডাকাতদের আমি চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। এ ক্ষেত্রে পুলিশ যেন কোনো শৈথিল্য না-দেখায়। পুলিশ এটুকু ‘প্রমাণ’ করুক-আমি তাতেই খুশি। আমি পুলিশের ওপর আস্থাটা রাখতে চাই।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের দু’মাস পেরিয়ে গেছে। খুনিরা ধরা তো পড়েইনি, এমনকি এর মোটিভও বের করতে পারেনি পুলিশ। উচ্চ আদালত যখন পুলিশের ব্যর্থতা উল্লেখ করে র্যাবকে তা তদন্তের নির্দেশ দেন, তখন পুলিশের ওপর আমাদের আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আমি বিস্মিত নই, র্যাব এই ঘটনার প্রকৃত কারণ ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে পারবে কি না। যদি না পারে, তাহলে তা র্যাবের সব অর্জনকে ধূলিসাত্ করে দেবে। র্যাবের অনেক ভালো ভালো অর্জন আছে। দুষ্কৃতকারীদের মোকাবেলার জন্য র্যাবের মতো একটি সংগঠনের প্রয়োজনও রয়েছে-এটা নিশ্চয়ই অনেকেই স্বীকার করবেন। কিন্তু বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি ঘটনায় র্যাবের সব অর্জন ধূলিসাত্ হয়ে যাবে-এটা আমি মেনে নিতে পারছি না।
ইলিয়াস আলীর ‘ঘটনা’ নিয়ে আমরাও বিভ্রান্ত। তিনি কি অপহূত? নাকি নিজে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন? যদি ‘অপহূত’ হয়ে থাকেন, তাহলে এটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। কেননা সংবিধান অনুযায়ী যেকোনো নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এ ক্ষেত্রে পুলিশ বা র্যাব তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। আর যদি তিনি ‘নিজে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন’, তাহলেও এটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব র্যাব ও পুলিশের। মনে রাখতে হবে এই একটি ঘটনায় বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিদেশি মাধ্যমগুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণায় নেমেছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রতিনিধি দল। তারা এসেছিল সৌদি কূটনীতিক খালাফ আল আলির হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে। ওই হত্যাকাণ্ডেরও কোনো কূল-কিনারা হয়নি। একটি সৌদি সংবাদপত্র এ প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছিল, তা যেকোনো বিবেচনায় উদ্বেগের কারণ। সৌদি আরবে কর্মরত প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি আগামীতে একটি হুমকির মুখে থাকবেন, এ ধরনের মন্তব্য কোনো আশার কথা বলে না। আমি বুঝতে অক্ষম কেন খালাফ আল আলির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা সম্ভব হল না। এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে-তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘একের পর এক’ যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে এবং তাতে সংবাদপত্রে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য সত্যিই দুঃখজনক। আমি নিজেও এ ঘটনায় বেশ বিব্রত। কেননা আমার অনেক ছাত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষী এখন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এরা সবাই আমার প্রিয়জন। এমনকি অনেক জেলার পুলিশ সুপার আমার লেখার নিয়মিত পাঠক। আমার একটা গর্বের জায়গা এদেরকে নিয়ে। স্বয়ং ডিএমপির পুলিশ কমিশনার আমার প্রিয় মানুষদের একজন। তিনি বিদেশে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতিসংঘের উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন। তার সঙ্গে একদিনের আলাপচারিতায় তার ওপর আস্থাটা আমার বেড়ে গিয়েছিল। তার ‘চায়ের দাওয়াত’ আমি রাখতে পারিনি বটে। কিন্তু তাকে সেদিন বলেছিলাম (একটি পত্রিকার অনুষ্ঠানে) ঢাকা শহরকে সন্ত্রাসমুক্ত রাখবেন। ঢাকা শহরে থানার সংখ্যা বেড়েছে। সম্ভবত থানার সংখ্যা এখন ৪৭টি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও অনেক। কিন্তু সবাই কি যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন? খিলগাঁও থানার ওসিকে শাস্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। আমি যে এলাকায় থাকি (আদাবর), সেই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি। সব বিষয় উচ্চ আদালতের নজরে আসে না। ডিএমপির কমিশনারের নজরেও আসে না। একজন সাধারণ নাগরিক যেতে পারেন না ডিএমপি কমিশনারের কাছে। কিন্তু একজন ওসি যখন অন্যায় করেন, তার দায়-দায়িত্ব আপনার কাঁধেও পড়ে ডিএমপি কমিশনার সাহেব। আদাবর থানার ওসি যদি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, এটা দেখার দায়িত্বটি কার? ৪৭টি থানার সবকিছু দেখভাল করার দায়িত্ব ডিএমপির কমিশনারকেই নিতে হবে সঙ্গত কারণেই। একজন খিলগাঁও থানার ওসি যদি তার যোগ্যতার পরিচয় দিতে না পারেন, তাকে সরিয়ে দেওয়াই মঙ্গল। আজ মাইসার ঘটনায় প্রমাণিত হল খিলগাঁও থানার ওসি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি। আর যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তিনি ওই পদের জন্য উপযুক্ত নন বলেই বিবেচিত হবেন। আদাবর থানার ওসির ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। ছোট্ট বাবু মাইসা তার মার কাছে ফিরে এসেছে, এটা আমাদের জন্য একটি বড় পাওয়া। ও হয়তো বড় হয়ে ওই স্মৃতি মনে রাখতে পারবে না। কিন্তু ওর বাবা-মা ঠিকই মনে রাখবে। এই দেশটিকে আমরা ‘ডাকাত’দের দেশে পরিণত করতে পারি না। ক্রাইমের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। অপহরণের ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু শিশু অপহরণের ঘটনা এই ঢাকা শহরে সম্ভবত প্রথম। প্রায় দেড় কোটি লোকের বসবাস এই ঢাকা শহরে। এখানে ক্রিমিনালদের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে ক্রাইমের ধরনও। তাই ‘কমিউনিটি পুলিশ’-এর কর্মকাণ্ডকে আরও বাড়াতে হবে। শুধু পুলিশ দিয়ে ক্রাইম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। মাইসাকে ফেরত পাওয়া যেমনি আনন্দের, ঠিক তেমনই একটি ‘সতর্ক বার্তা’ও বটে।

ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র : দৈনিক সকালের খবর 
৩০ এপ্রিল ২০১২

আতংক যেখানে নিত্যসঙ্গী

ভদ্রলোক নামটি বললেন না। ল্যান্ডফোনে জানালেন, সাবধানে থাকবেন। বেশি লেখালেখির দরকার নেই। এমন সব বিষয় নিয়ে লিখবেন, যেখানে রাজনীতির কোন গন্ধ না থাকে। আমার ল্যান্ডফোনে ‘কলার আইডি’ নেই। তাই জানার উপায় নেই কোন এক্সচেঞ্জ থেকে ফোনটি এসেছিল। গুরুত্ব দিলাম না ফোনের। ২১ জুলাই ক্যাম্পাসে গেছি। ভিসির পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকরা ভিসির অফিস ঘেরাও করে রেখেছেন। সঙ্গত কারণেই সেখানে আমার যাওয়া ও সহকর্মীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করা। সেখানেও একইরকম সমস্যা স্যার, একটু সাবধানে লিখবেন। বলা তো যায় না, আপনিও ‘গুম’ হয়ে যেতে পারেন(?)। এবারও গুরুত্ব দিলাম না। আমি শিক্ষক। আমার শত্র“ কে? আমার তো কোন শত্র“ নেই। তৃতীয় ঘটনা একটি ফোন আমার মোবাইলে আসে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের অস্ট্রিন থেকে। ভদ্রলোক আমার পরিচিত। ঢাকায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমার লেখার খুব ভালো ও বোদ্ধা পাঠক। সব ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে একমত হন না। সালোচনাও করেন। তার অনুরোধ, আমি যেন ‘গুম’ নিয়ে কিছু না লিখি। তার একটা ভয়, একজন রাজনীতিবিদ যদি ‘গুম’ হয়ে যেতে পারেন, একজন শিক্ষকও ‘গুম’-এর শিকার হতে পারেন। সুতরাং সাবধান।

আমি একটা ধন্দে পড়ে গেলাম। রাজনীতি নিয়ে লিখি। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা আমার কাজ। এটা আমার পেশা নয়। বরং বলা যেতে পারে অনেকটা ‘নেশা’। শিক্ষকরা সাধারণত সংবাদপত্রে লেখেন না। তারা গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করতেই উৎসাহী বেশি। কেউ কেউ কনসালটেন্সিও করেন, যা আমি ঘৃণা করি। কিন্তু মনে করি সাধারণ মানুষের কাছে খুব সহজ ভাষায় ‘সত্য’ প্রকাশ করার মাধ্যম হচ্ছে সংবাদপত্র। সেই আশির দশক থেকেই লিখছি। আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি অনেক অধ্যাপকের দ্বারা, যারা গবেষণা প্রবন্ধের পাশাপাশি নিয়মিত কলাম লিখে গেছেন অধ্যাপক ভবানী সেনগুপ্ত, অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি, অধ্যাপক রউবিনি, ফুকিয়ামা কত নামই তো উল্লেখ করা যায়। চেষ্টা করলাম বুঝতে অতীতে এ রকমটি কি হয়েছে কখনও? না, হয়নি। এভাবে ফোনে ঠিক হুমকি নয়, পরামর্শ। সহকর্মীদের অনুরোধ, একটু সাবধানে থাকবেন। আর শুভাকাক্সক্ষীদের ধারণা আমি রাজনীতির বিষয় নিয়ে না লিখলে ভালো করব। কোনটি করব আমি? আমি কি লিখব না?

ইলিয়াস আলী ‘হঠাৎ’ করেই ‘গুম’ হয়ে গেলেন। কে করল, কারা তাকে গুম করল? এ নিয়ে রাজনীতি এখন উত্তপ্ত। ২১ এপ্রিল রাতে ঢাকা শহরে সহিংস ঘটনা ঘটল। বাসে আগুন দেয়া হল। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেলেন একজন। হরতাল হল ২২-২৪ এপ্রিল। কিন্তু হরতাল দিয়ে কি ইলিয়াস আলীকে ‘উদ্ধার’ করা যাবে? অন্যদের কথায় নাইবা গেলাম। আবদুল জলিল সাহেবের একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এই সদস্য বললেন, ‘ইলিয়াসকে খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব’। মিথ্যা বলেননি জলিল সাহেব। ইলিয়াস আলী সাধারণ একজন নাগরিক নন। সাবেক এমপি, সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। এমন কী ঘটেছিল, যাতে করে তিনি ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাবেন এবং আমরা কেউ তা জানব না? এ ক্ষেত্রে আমরা যারা লেখালেখি করি, আমরা কি লিখব না? অনেকেই জানেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলে একটা কথা আছে। রাজনীতি বিজ্ঞানে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব¡ বহুল ব্যবহৃত। ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ রহস্যে কি আমরা এখন এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ ব্যবহার করব? সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ ও পুনরায় মন্ত্রিসভায় ফিরে আসার মধ্যে নাটকীয়তা এবং ৭০ লাখ টাকা উদ্ধারের ‘ঘটনার’ পেছনের কাহিনীর রহস্য উদঘাটনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেও এই ঘটনার সঙ্গে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার কোন যোগসূত্র আছে কিনা, ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ যারা বিশ্বাস করেন, তারা এটা নিয়ে ‘গবেষণা’ করতে পারেন। সংবিধান সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।

যেখানে সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে ‘মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা’ দেয়া হয়েছে, তৃতীয় ভাগের একাধিক অনুচ্ছেদে, বিশেষ করে ২৭, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৬, ৩৯ নং অনুচ্ছেদে সাধারণ একজন নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সেখানে ‘একজন সাধারণ নাগরিক’ ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা সরকার উদঘাটন করতে পারবে, এ বিশ্বাস করতেই পারি। ইতিমধ্যে র‌্যাবের এক অভিযানে অংশ নিয়েছেন মিসেস ইলিয়াস গত ২১ এপ্রিল। আমার ধারণা, ইলিয়াসের উদ্ধার এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমরা আশাবাদী। আশা আমরা করতেই পারি।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ আমি যাব না। আমরা অনেকেই বলি, বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনার দেশ। গত ফেব্র“য়ারির শেষের দিকে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলাম তুরস্কে। ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ২৬টি দেশের প্রতিনিধিরা, যারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একাধিক শিক্ষক আমাকে বলেছেন, বাংলাদেশের সম্ভাবনা আছে। প্রয়োজন সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্বের। এখানেই এসে যায় প্রশ্নটিÑ আমরা কি সঠিক নীতিটি গ্রহণ করতে পেরেছি? ২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর। ৪১ বছরে পা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? যৌথভাবেই পরিকল্পনা নেয়া দরকার। এরই নাম গণতন্ত্র। অর্থনীতি একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে একটি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিশ্বমন্দায় আমরা আক্রান্ত নই, এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তৈরি পোশাকের রফতানি কমেছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহও কম। যেখানে ইউরোপজুড়ে কৃচ্ছ সাধন চলছে (গ্রিস এর বড় উদাহরণ), সেখানে আমাদের রাজস্ব ব্যয় বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, যারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিনির্মাণে পালন করছেন গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা। এরাই ভোট দিয়ে ‘প্রিয় দলকে’ ক্ষমতায় পাঠায়। বিদ্যুৎ সংকট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। এই যখন দেশের পরিস্থিতি, তখন সরকার ও বিরোধী দল পরস্পর বিরোধী একটি অবস্থান গ্রহণ করেছে। প্রায় প্রতিটি ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান পরস্পর বিরোধী।

ইলিয়াস আলীর ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ব্যাপারেও এই পরস্পর বিরোধী অবস্থান আমরা লক্ষ্য করি। যেখানে সরকার বলছে ‘এটা সাজানো নাটক’, সেখানে বিরোধী দল বিএনপি বলছে ‘এটা সরকারের কাজ’। আর মাঝখানে আমরা আমজনতা থাকি এক অনিশ্চয়তায়। যে কোন বিবেচনায় এটা কোন ভালো খবর নয়। বিএনপির হাইকমাণ্ড যখন তাদের নেতাদের সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরার নির্দেশ দেন, তখন আতংকের বিষয়টিকে আরও উস্কে দেয়া হয়। সংবাদপত্র থেকে জানলাম, ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের এমপি রিচার্ড ফুলার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইলিয়াস আলীর ‘গুম’ হওয়ার ঘটনাটি উত্থাপন করেছেন। এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য কোন ভালো খবর নয়। এতে করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? রাষ্ট্র যদি একজন সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, আন্তর্জাতিক আসরে সেই রাষ্ট্রের মর্যাদা নষ্ট হয় বৈকি। এমনিতেই দুর্নীতিতে আমাদের সব অর্জন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। গত ৪০ বছরে আমাদের অর্জন একেবারে কম নয়। কিন্তু সেই অর্জনগুলো একে একে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি আমরা নির্মূল করতে পারছি না। আর এখন যদি এই ‘গুম’-এর প্রবণতা আমরা রোধ করতে না পারি, তাহলে আগামী দিনগুলোতে আমাদের জন্য কোন ভালো খবর অপেক্ষা করছে না। প্রায় ১৬ কোটি লোকের দেশ এই বাংলাদেশ।

এ দেশে রয়েছে একটি শক্তিশালী তরুণ প্রজš§। এরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। এরাই বাংলাদেশকে বদলে দিতে পারে। এদের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই তরুণ প্রজš§কে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। রাজনীতির ‘নোংরা গলিতে’ আমাদের রাজনীতিবিদরা হাতড়ে ফিরছেন। কোন পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। এ যেন এক ‘কৃষ্ণ গহ্বর’, যার কোন শেষ নেই।

আমি তো সাধারণ মানুষেরই একজন। আতংক যে আমার মনে বাসা বাঁধেনি, তা দিব্যি বলতে পারব না। একজন রাজনীতিবিদ ইলিয়াস আলী যদি নিখোঁজ হয়ে যান, তখন আমার মতো একজন শিক্ষক যে নিখোঁজ হয়ে যাবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? ‘গুমকারীদের’ হাত কি এতটা লম্বা যে তা ছুঁতে পারে না আমাদের প্রশাসনের যন্ত্র! আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা দেয়ালের লিখন থেকে কেউ কিছু শিখিনি, এখনও শিখছি না। ‘গুম’ নিয়ে যে আতংক, সেই আতংকের অবসান হওয়াই মঙ্গল।

ড. তারেক শামসুর রেহমান 
প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(সূত্র: যুগান্তর,২৬/০৪/১২)

বিদ্যুৎ সংকট কয়লা উত্তোলনের প্রয়োজনীয়তা

গত ২৯ মার্চ সারা দিনে যখন একাধিকবার লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত, ঠিক তখনই বিদ্যুতের মূল্য আরেক দফা বাড়ানো হলো। বিদ্যুতের এই বেহাল অবস্থায় মূল্য বাড়িয়ে বিদ্যুৎ খাতের আর্থিক শৃঙ্খলা কতটুকু কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, তা এক ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু যে বিষয়টিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল, তা হচ্ছে এই মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ জনগণের ওপর এক বাড়তি বোঝা। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। সরকার ও বিরোধী দল ক্রমেই একটি বড় ধরনের সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের হতাশা তাদের সরকারবিরোধী অবস্থানে ঠেলে দেবে। ইতিমধ্যে সংসদে সরকারি দলের নেতারাই বিদ্যুৎ পরিস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিদ্যুৎ উপদেষ্টা অযোগ্য- এমন অভিযোগও করেছেন সরকারি দলের সিনিয়র নেতারা। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর অপসারণও দাবি করেছেন কেউ কেউ।
যেখানে সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, রাষ্ট্র জনগণের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করবে, সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা নিশ্চিত না করে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। মূলত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার কারণেই বিদ্যুতের এই দাম বাড়ানো হলো। কুইক রেন্টালের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল একটি আত্মঘাতী। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে কম, কিন্তু ব্যয় হয়েছে বেশি।
এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে এর প্রভাব সরাসরি জনগণের ওপর পড়বে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বাড়বে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যমূল্য ধরে রাখা সম্ভব হবে না, যা কি না নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য হবে আরেক যন্ত্রণার কারণ। এতে করে জীবনযাত্রার খরচও অনেক বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যুৎ নিয়ে এমনিতেই সংকট আছে। এখন এই সংকট আরো বাড়ল। এমনিতেই এই ঢাকা শহরে হাজার হাজার ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে। এসব ফ্ল্যাটে আদৌ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যদি না হয়, তাহলে যাঁরা লাখ লাখ টাকা খরচ করে নির্মিতব্য এই ফ্ল্যাটগুলো ক্রয় করেছেন, তাঁরা এখন কী করবেন? আবাসন শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। তাদের আয়-রোজগারের কী হবে? ডেভেলপাররা যদি ক্রেতাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে না পারে, তাহলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে যাবে। সরকারের জন্য আদৌ তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।
বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে। এই গ্যাস এখন ফুরিয়ে আসছে। চলমান গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সরকার ২০০৯ সালে 'ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রাম' নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর অধীনে অতি দ্রুত নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের হাতে থাকা ৩, ৬, ৮ ও ১১ নম্বর ব্লকের মোট ৩১০০ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক (টু-ডি) সিসমিক জরিপের কাজ তিন বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে যে স্থলভাগের ২৩টি ও অগভীর সমুদ্রের আটটি ব্লককে পিএসসির আওতায় বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে কনোকো-ফিলিপস একটির দায়িত্ব পেয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম এবং অস্ট্রেলিয়ার কম্পানি স্যান্ডোজও শিগগিরই কাজ পাচ্ছে। এমন অভিযোগও উঠেছে যে স্থলভাগে সুনেত্রার মতো বিশাল মজুদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে। কনোকো-ফিলিপস যে দায়িত্বটি পেয়েছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্ক হচ্ছে। তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা এই চুক্তির বিরোধিতা করে দেশব্যাপী প্রচুর গণসংযোগ করেছেন। তাঁদের যুক্তি একটাই, কোনো অবস্থায়ই বাংলাদেশের গ্যাস রপ্তানি করা যাবে না। গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। কেননা মিয়ানমার এবং ভারত গভীর সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে। মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস আগামী বছর যাবে থাইল্যান্ডে। চীনও এই গ্যাস কিনছে। এ ক্ষেত্রে যদি গ্যাস পাওয়াও যায়, তা উত্তোলন ও জাতীয় গ্রিডে তা দিতে নূ্যনতম আরো পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে বিকল্প কী, এটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। যদিও একটা কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে যে সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বাপেঙ্ যে ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (সম্ভাব্য মজুদ) গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তা যদি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বিদ্যুৎ সংকটের একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে- এই মজুদও বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত সরকার বিষয়টি খোলাসা করেনি।
যেহেতু গ্যাসের একটি সংকট আছে, তাহলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আমরা কিভাবে করব? গ্যাসের বিকল্প হতে পারে কয়লা। এ পর্যন্ত দেশে পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লা সম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি-নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কয়লা উত্তোলন নিয়েও বাংলাদেশে একটি বড় বিতর্ক রয়েছে। কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা হবে, নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তোলা হবে- এটা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করলে ছয় হাজার হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হবে এবং তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিপক্ষে। অথচ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, এই পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা। বড়পুকুরিয়া কয়লাক্ষেত্রের বেলায় দেখা যাচ্ছে, ১০ শতাংশ কয়লাও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অভিমত দিয়েছেন যে বড়পুকুরিয়া থেকে ১০০ মিলিয়ন টনের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হবে না। পক্ষান্তরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন টন কয়লা তোলা সম্ভব, যা বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে।
জ্বালানি খাতে কয়লা একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও তাতে এখন সমস্যা দেখা দেবে। যেখানে বিশ্বের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে, সেখানে এই সেক্টরের উন্নয়নের ব্যাপারে আমরা তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছি না। আমাদের প্রচুর কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও আমরা খুলনা ও চট্টগ্রামে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছি ভারত থেকে আমদানীকৃত কয়লার ওপর নির্ভর করে। এই সেক্টরটিও আমরা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছি। বিদ্যুৎ নিয়ে অতীতে এবং এখনো বিগত চারদলীয় জোট সরকারকে দোষারোপ করলেও বর্তমান সরকার যদি বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে না পারে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের ওপর থেকে জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলবে। এ সত্যটি সরকার যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবে, ততই মঙ্গল।
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman@aol.com

ইউরোপীয় ইউনিয়ন কী ভেঙে যাবে

একজন পেনশনভোগীর আত্মহত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে গ্রিস যে এখনো অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে কথাটাই প্রমাণিত হল। এতে করে একক মুদ্রা ইউরো নিয়ে যেমনি প্রশ্ন উঠেছে, ঠিক তেমনি প্রশ্ন উঠেছে ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এখন অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কল্পনাতেই থেকে যেতে পারে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কোনো অমূলক ধারণা ছিল না। বরং ১৯৫৭ সালে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত ম্যাসট্রিচট চুক্তি ছিল অভিন্ন ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ। ম্যাসট্রিচট চুক্তিতে একটি একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে সেভেন চুক্তি ও ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অভিন্ন এক ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপ। বলা ভালো, ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাম ধারণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বেশ কটি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইইউতে যোগ দিয়েছে। ইইউর সদস্য সংখ্যা এখন ২৭। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ইইউর ১৫টি দেশের মাঝে ১১টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু রয়েছে ১৭টি দেশে। ইউরো চালু হওয়ার সময়ই ইউরো নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল ইউরোপের উত্তরের ধনী দেশগুলো ইউরো চালু হলে এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এত বছর পর এই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হল। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও, তিন বছর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাই মাসে ইউরোর কাগজি ও ধাতব মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়। গত নয় বছর ইউরো নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা না দিলেও, গেল বছরের প্রথম দিকে ইইউর কয়েকটি দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে পাপেন্দ্রুর নেতৃত্বাধীন গ্রিস সরকারের পতন হয়েছে এবং পাপাদেসস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। একইসঙ্গে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বারলুসকোনিও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
পাপেন্দ্রু ও বারলুসকোনির পরিণতি প্রমাণ করে ইউরোপ এখনো বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকারগুলো প্রচুর ঋণ গ্রহণ করেও সেই ঋণ শোধ করতে পারছে না। ধীরে ধীরে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করলেও, সেই দেউলিয়াত্ব রোধ করতে পারছে না। গ্রিস কিংবা ইতালি কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের কথা ঘোষণা করলেও, সাধারণ জনগণ তার বিরোধিতা করছে। তারা দিনের পর দিন বিক্ষোভ মিছিল করছে। গ্রিসের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিখ্যাত দৈনিক গার্ডিয়ানের অনলাইন ভার্সনে যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, তা দেখে দেশটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গ্রিসের একটি শহর থেসসালোনিকির গির্জার পাশে বসে এক মধ্যবয়সী রমণী ভিক্ষা করছেন। রাষ্ট্র এই রমণীর দায়িত্ব নিতে পারছে না। ফলে তাকে ভিক্ষা করে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের গপপষধঃপযু হবংি-এর অনলাইন ভার্সন যারা দেখেছেন সেখানেও রয়েছে গ্রিসের ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে পেরামা জাহাজ নির্মাণ বন্দরের একটি বিবরণ দিয়ে। পেরামা বন্দর এখন জনমানবশূন্য, কোনো কর্মচাঞ্চল্য নেই, একরকম পরিত্যক্ত। গ্রিসে বেকারত্বের হার এখন শতকরা ৬০ ভাগ। সেখানে এখন কৃচ্ছ্রসাধন চলছে। আইএমএফের ঋণের শর্ত হিসেবে সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমানো হয়েছে। পেনশন হ্রাস করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা এখন বন্ধ। সরকারি গড় বেতন কমিয়ে আনা হয়েছে মাসিক ৮৬০ ডলারে, আর বেসরকারি সেক্টরে গড় বেতন মাসে ৭৫০ থেকে ১০০০ ডলার। আর বিশ্বব্যাংক বলছে বেতন কমাতে হবে ৬০০ ডলারে। এক সময় হাসপাতালগুলোতে বিনে পয়সায় ওষুধ পাওয়া যেত। এখন তা পুরোপুরি বন্ধ। প্রবাসী গ্রিকদের আর্থিক সহযোগিতায় উড়পঃড়ৎং ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ নামে একটি এনজিও এখন বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করছে। আগে এরা মাত্র ৩ দিন (সপ্তাহে) ওষুধ সরবরাহ করত। এখন তাদের ৭ দিনই ওষুধ দিতে হয়। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে যারা ওষুধ নেন, তাদের অনেকেই কিছুদিন আগে পর্যন্ত সচ্ছলভাবে দিন যাপন করতেন। এখন আয় কমে যাওয়ায় তারা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। গপপষধঃপযু্থর প্রতিবেদনে একজন প্রত্নতাত্তি্বক মিসেস ডেলপিনা কউটিসউম্বার ছবি ও বক্তব্য ছাপা হয়েছে। ডেলপিনা আগে মাসে বেতন পেতেন ১১৯০ ডলারের সমতুল্য। এখন তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৬০ ডলারে। অথচ তাকে বাসা ভাড়া দিতে হয় ৭৩০ ডলার। অধ্যাপক স্বামী ও এক সন্তান নিয়ে তার দিন আর চলছে না। ঋণের শর্ত হিসেবে দেশটির সরকারি লোকবল ১ লাখ ৫০ হাজার কমিয়ে মোট ৪ লাখ ৫০ হাজার নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। অর্থনীতি ঠিকমতো চলছে না। এখন দেশটিকে ঋণ নিয়েই ঋণের সুদের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। গ্রিসকে তার বাজেটের শতকরা ২০ ভাগ ব্যয় করতে হয় ঋণ পরিশোধে। গ্রিসের এই অর্থনৈতিক সংকট খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্বকে একটি ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাঠামো ভেঙে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি শক্তি। অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সংকট ইইউর ভূমিকাকে সংকুচিত করে দিয়েছে। এখানে বলা ভালো, ১৯৫৭ সালে মাত্র ৬টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্যের যে যাত্রা শুরু হরেছিল, তা আজ পরিণত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ)। ২৭টি দেশ এখন ইইউর সদস্য। এর মাঝে আবার ২৪টি দেশ ন্যাটোর সদস্য।
ইউরোপে এরই মাঝে বেশ কয়েকটি সংস্থার জন্ম হয়েছে, যে সংস্থাগুলো ইউরোপীয় ঐক্যকে ধরে রেখেছে। যেমন বলা যেতে পারে_ ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দফতর, অর্থনেতিক ও সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় মুদ্রা ইনস্টিটিউট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা। এই সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু ইউরোপই নয়, বরং সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। যে যুক্তি তুলে এক সময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোন (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি, সেই যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হল। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। এখানে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কিনা?
২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন তার পশ্চাশতম পূর্তি উৎসব পালন করে তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ইইউর মাঝে বিভক্তি আছে। লুক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান অর্জন হিসেবে ইউরোর মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হল ইউরো সব দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স এর বিরোধিতা করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও, ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিন্তিত ছিল এ কারণে যে, নিরাপত্তার বিষয়টিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে খেপিয়ে তুলতে পারে। জার্মানি ও স্পেন ইইউর জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও, ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালের 'ভেলভেট রেভ্যুলেশন' এই দেশগুলোকে সোভিয়েত নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় এবং দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। এই দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেওয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউর সদস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল_ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া-হারজেগোভিনা কিংবা ক্রয়েশিয়া এখনো ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সংকট সব সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সংকটে জর্জরিত ইউরোপে আবারো মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে। এখন ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ, তা আরো বাড়বে। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুই স্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এ বিভক্তির কথা বলছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর মরকেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা। যদিও এই বিভক্তির বিরোধিতা করছেন ইউরোপীয় কমিশনের চেয়ারম্যান জোসে ম্যানুয়েল হারোসো। এখন সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কি না কিংবা 'নতুন ইউরোপ'-এর স্বরূপ কী হবে, তা এ মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসন্ন, তা গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় ব্যর্থতা।

দৈনিক ডেসটিনি ২৫ এপ্রিল ২০১২। 

রেলগেট' কেলেঙ্কারির তদন্তের এখন কী হবে

পদত্যাগের মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পুনরায় মন্ত্রিসভায় ফিরে আসা যে প্রশ্নটির জন্ম দিয়েছে, তা হচ্ছে ৭০ লাখ টাকা দুর্নীতি উদ্ঘাটনের জন্য যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল, তার ভবিষ্যৎ কী? তদন্ত কমিটি কি 'মন্ত্রী' সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে 'জেরা' করতে সাহস পাবে? 'মন্ত্রী' সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কি দুর্নীতি তদন্তে 'নিরপেক্ষ' থাকতে পারবেন? আর যে ৭০ লাখ টাকা ওমর ফারুক নিজ অ্যাকাউন্টে জমা দিয়েছেন, তার কী হবে? ওই টাকার মালিক কি আসলেই ওমর ফারুক? নাকি অন্য কেউ? যুক্তরাষ্ট্রের 'ওয়াটারগেট' কেলেঙ্কারির আদলে (যেখানে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল) সাংবাদিকরা ৭০ লাখ টাকার কেলেঙ্কারিকে 'রেলগেট' কেলেঙ্কারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পুনরায় মন্ত্রিসভায় ফিরে আসার নাটকীয়তায় ভরা থাকলেও, অনেক প্রশ্ন এখন এই 'রেলগেট' কেলেঙ্কারিকে নিয়ে আবর্তিত হতে থাকবে। বিজিবির ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হলো। এত গভীর রাতে কোনো ব্যক্তি ৭০ লাখ টাকা নিয়ে গাড়িতে ঘোরেন না। গভীর রাতে অনেক রাস্তাতেই 'চেকপোস্ট' বসানো থাকে। এটা এপিএস, মৃধা আর এনামুল হকের অজানা নয়। তারপরও এপিএস ফারুক যখন দাবি করেন, এ টাকা তার, তখন সঙ্গত কারণেই ওই টাকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ওই টাকার উৎস, বিদেশ থেকে আনা পাউ-ের ডকুমেন্ট ও ব্যাংকে ভাঙানোর রশিদ নিশ্চই তার কাছে থাকার কথা। আমরা জানি না 'মন্ত্রী' হিসেবে সুরঞ্জিত বাবুর ফিরে আসার পর, তদন্ত কমিটি আদৌ ফারুকের কাছে এসব বিষয় জানতে চাইবে কি না? প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পুনরায় মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে। এই কাজটি তিনি পরে করলেও পারতেন। তার এই সিদ্ধান্ত বরং বিরোধী দলকে উসকে দিল। বিরোধী দল নতুন আরেকটি অস্ত্র পেল। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে সুরঞ্জিত সেন তদন্তের স্বার্থে নিজ পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। এটা যেমন একটি ভলো দিক। ঠিক এর একটি মন্দ দিকও আছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রত্যাবর্তন অনেক প্রশ্নের জবাব আমাদের দেবে না। সংবাদ সম্মেলনে ওই ৭০ লাখ টাকার ব্যাপারে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই জানালেও, সাসপেন্ড হওয়া রেলওয়ের জিএম আবু ইউসুফ মৃধা জানিয়েছিলেন তারা গাড়িতে করে মন্ত্রী সাহেবের বাসাতেই যাচ্ছিলেন। এত টাকা নিয়ে কোনো ব্যক্তি এত গভীর রাতে সাধারণত চলাচল করেন না। সুতরাং ওই টাকার সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সম্পৃক্ততা কতটুকু ছিল, তা আর জানা যাবে না কোনোদিন। ঘুষ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ এ দেশের সব রাজনীতিবিদের, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় আছেন এবং আগামিতে ক্ষমতায় যেতে চান, তাদের ভূমিকাকে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছিললা রাজনীতিবিদরা জনগণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছিলেন। অথচ বারবার এ দেশের জনগণ রাজনীতিবিদদের কাছেই ফিরে গেছে। ব্যক্তি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে খুব সৎ ছিলেন না, তা সংবাদপত্রগুলো থেকে আমরা জানতে পারি তার ছেলে সৌমেন গুপ্তের ৫ কোটি টাকা দিয়ে ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স প্রাপ্তি, দিরাইয়ে আলিশান সেন মার্কেট, নামে বেনামে শত কোটি টাকার 'শত্রু সম্পত্তি' দখল ইত্যাদি প্রমাণ করে সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা ছিল না। কেননা তার আয়ের যে হিসাব তিনি নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছিলেন, তাতে তার স্বীকারোক্তি ছিল তার বার্ষিক আয় মাত্র ৭ লাখ টাকা। ৭ লাখ টাকার আয় দিয়ে কোটি টাকার মার্কেট করেন কীভাবে? আর তার সন্তান নিশ্চয়ই কোনো 'আলাদীনের চেরাগ' পাননি যে ৫ কোটি টাকা দিয়ে 'ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স তিনি পেতে পারেন। এটা তো শুধু ৫ কোটি টাকার ব্যবসা নয়। এটা প্রায় ৩০ কোটি টাকার একটা বিনিয়োগ। 'সেনগুপ্ত কমিউনিকেশন' এই টাকা পেল কোত্থেকে? দুর্মুখরা বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কলকাতাতেও নাকি বাড়ি আছে! সুরঞ্জিত বাবুর কী টিআইএন নাম্বার আছে? সেখানে তিনি কত টাকা ট্যাক্স দিয়েছিলেন? অভিযোগ আছে জিগাতলার বাড়ি নিয়েও। বেশ কিছুদিন আগে এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। দুদক এখন এসব বিষয় নিয়ে তদন্ত করবে বলে আমার মনে হয় না। যে ৭০ লাখ টাকার কথা বলা হয়েছে এবং যা ওমর ফারুক পরদিন নিজ অ্যাকাউন্টে জমা দেন, এর মূল মালিক যে ওমর ফারুক নন, এটা জানা যাবে না কোনোদিন। এপিএস হিসেবে, তিনি বেতন পান, ওই বেতন দিয়ে কি এত বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা সম্ভব? তার এবং তার স্ত্রীর অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে করে কি 'অবৈধ লেনদেনের' বিষয়টির সমাধান হবে? অবৈধ লেনদেনের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হওয়াই শ্রেয়। শুধু অ্যাকাউন্ট জব্দই নয়, প্রকৃত 'সত্য' জানতে অবিলম্বে তিন অভিযুক্ত ব্যক্তি ওমর ফারুক, এনামুল হক ও ইউসুফ আলী মৃধাকে গ্রেপ্তার করা উচিত। না হলে 'সত্য' চাপা পড়ে যাবে চিরদিনের জন্য। দুদকের জন্য একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে 'ইমেজ' বৃদ্ধির। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুদক কার্যত একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখতে পারছে না। সর্বশেষ ঘটনায় দুদক যখন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের দুর্নীতির ব্যাপারে একটি 'সার্টিফিকেট' দেয়, তখন দুদক সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। তখন দুদকের জন্য একটি সুযোগ সষ্টি হলো মন্ত্রীসহ অভিযুক্ত ওই তিন ব্যক্তির আর্থিক লেনদেন, ব্যাংক ব্যালেন্সের তদন্ত করা। এটি যদি দুদক করতে না পারে, তাহলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে থাকবেই। দুদক যদি নিরপেক্ষভাবে এবং প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের স্বার্থেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি তদন্ত করে, আমার বিশ্বাস দুদক তার গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাবে। সরকারেরও উচিত দুদককে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেয়া। কিন্তু এই সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ বড় ধরনের ইমেজ সঙ্কটের মুখে পড়েছে। মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে টাকা পাওয়ার ঘটনায় খোদ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন কংগ্রেসম্যান যোসেফ ক্রাউলি। এর আগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা সরকারের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে সরকার প্রধান ভালো কাজটিই করেছিল। কিন্তু তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তটি ভালো হলো না। রাজনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজের প্রায় সবাই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগের সিদ্ধান্তটি সমর্থন করেছিলেন। এটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য ছিল একটি দৃষ্টান্ত। তবে এটা সবাই জানেন যে সুরঞ্জিত বাবু প্রথমে পদত্যাগ করতে চাননি। প্রধানমন্ত্রী চেয়ে ছিলেন বিধায়, তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু কেন এত দ্রুত তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হলো? বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলা করার জন্য তার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য প্রধানমন্ত্রী যদি এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি ভুল করেছেন। এতে করে বিরোধী দলের এজেন্ডায় যুক্ত হলো নতুন একটি বিষয়। সরকারের ভাবমূর্তি এতে করে উজ্জ্বল হবে না। 'রেলগেট' কেলেঙ্কারি এখন কঠিন বরফের নিচে চাপা পড়ে যেতে পারে। হাজারটা 'সমস্যার' ভিড়ে মানুষের মন থেকে হারিয়ে যেতে পারে মন্ত্রীর এপিসের গাড়িতে পাওয়া ৭০ লাখ টাকার ঘটনাটি। কিন্তু রাজনীতিতে এই ঘটনাটি হারিয়ে যাবে না। ব্যক্তি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জন্যও এই ঘটনা 'কাল' হয়ে থাকবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে এই ৭০ লাখ টাকার ঘটনা 'তাকে তাড়া' করে ফিরবে। এর জবাব তার কাছে একটা আছে। কবিতার ভাষায় আর গানের কলি দিয়ে এর জবাব তিনি দেন সুধী সমাজে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি তার জন্য খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ, আবার প্রত্যাবর্তন অনেক নাটকীয়তার জন্ম দিলেও অনেক প্রশ্নের জবাব আমরা পাব না কোনোদিন। 
 দৈনিক যায় যায় দিন ২৪ এপ্রিল ২০২

অথ কালো বিড়াল সমাচার

দুর্নীতির 'কালো বিড়াল' খুঁজতে গিয়ে নিজেই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। যদিও সুরঞ্জিত সেন দুর্নীতির সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরও কথা থেকে যায়। ইতিহাস এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে? একজন দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ? গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ সাচ্চা একনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ? নাকি একজন সুবিধাভোগী ব্যক্তি, যিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করেছেন তাঁর স্বার্থে? আমরা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারছি না দুদক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিষয়ে তদন্ত করবে কি না? একটি কাগজ লিখেছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তা এক চিন্তার কারণ। তিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রতি সুবিচার করেননি। যেখানে তিনি বরাবর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, সেখানে দিরাইয়ে 'সেন মার্কেট' তৈরি করা কিংবা 'সেন কমিউনিকেশন' (ছেলে সৌমেন সেনগুপ্ত স্বত্বাধিকারী)-এর নামে পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ লাইসেন্স প্রাপ্তি তাঁর ভূমিকাকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাঁর নিজ এলাকায় 'শত্রু সম্পত্তি' দখল করার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। দুদক বলছে, তারা সৌমেন সেনগুপ্তের ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট তদন্ত করে দেখবে। তবে দুদক এ ক্ষেত্রে কতটুকু সফল হবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কিন্তু যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে রেলের 'কালো বিড়াল'দের এখন কী হবে? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলের দায়িত্ব নিয়ে দুর্নীতিবাজ 'কালো বিড়াল' খুঁজে বের করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে সেটা ছিল তাঁর লোকদেখানো এবং সংবাদপত্রে কভারেজ পাওয়ার একটা কৌশল মাত্র। তিনি নিজেই 'কালো বিড়াল' বনে গেলেন। রেলের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে দুর্নীতি। একজন ইউসুফ আলী মৃধা, কিংবা একজন এনামুল হক ঘটনাক্রমে 'ধরা খেয়েছেন'। মৃধারা সদ্য গজিয়ে ওঠা দুর্নীতিবাজ নন। তিনি একদিনে সৃষ্টি হননি। প্রশাসনের অনেক ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির এখন মৃধাদের 'সৃষ্টি' করেছেন শুধু তাঁদের স্বার্থে। তাঁদের স্বার্থেই তাঁরা মৃধাদের বাঁচিয়ে রাখবেন। না হলে কোন সাহসে মৃধা সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর নামে অবৈধ কোনো সম্পদ নেই। অথচ সংবাদপত্রেই ছাপা হয়েছে ঢাকা শহরে তাঁর একাধিক ফ্ল্যাটের খবর। কিছুদিন আগেও তাঁর চট্টগ্রামের ফ্ল্যাট থেকে ২৪ লাখ টাকা ডাকাতি হয়েছিল। ধৃত ডাকাতরা ২৪ লাখ টাকা ডাকাতির কথা বললেও, মৃধা তখন স্বীকার করেছিলেন মাত্র দুই লাখ টাকার কথা। সেদিন রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হলেও, মৃধার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। আজও যখন রেলের কর্মচারীরা মিছিল করে সংবাদ সম্মেলন করে মৃধার বিচার দাবি করেন, আমি তখন আস্থাটা রাখতে পারি না। মৃধারা এভাবেই পার পেয়ে যান। এবারও পার পেয়ে যাবেন কি না আমরা জানি না। এত বড় একটা অপরাধ, যেখানে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো একজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ 'ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে' পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, সেখানে আমলাদের নিয়ে গঠিত কমিটি দিয়ে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করা যাবে না। এ জন্য দরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। স্বচ্ছতার স্বার্থেই সরকারের উচিত একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা। 'কালো বিড়াল'দের কোনো ষড়যন্ত্র ছিল কি না, এটাও উদ্ঘাটন করা জরুরি। কেননা 'কালো বিড়াল'রা দীর্ঘদিন ধরেই রেলে সক্রিয়। এরা যে কোনো 'ষড়যন্ত্র' করবে না, এটা দিব্যি দিয়ে বলা যায় না। যিনি আগে রেল মন্ত্রণালয়ে ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল বিশ্বব্যাংক। তাই প্রধানমন্ত্রীকে এখন সতর্ক হতে হবে। একজন মন্ত্রীকে এখানে নিয়োগ দিতে হবে সত্য, কিন্তু তাঁকে হতে হবে যোগ্য ও সৎ। তবে এই মুহূর্তে মন্ত্রিসভার কলেবর বাড়ানোর আমি পক্ষপাতী নই। অর্থনীতির অবস্থা খুব ভালো নয়। বিশ্ব অর্থনীতিতেও মন্দাভাব চলছে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়িয়ে রাষ্ট্রীয় খরচ না বাড়িয়ে মন্ত্রিসভার একজন সদস্যকে রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়াটাই উত্তম। প্রধানমন্ত্রী সেই সঙ্গে মন্ত্রিসভার রদবদলের কাজটিও সেরে ফেলতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর হাতে মন্ত্রীদের 'পারফরম্যান্স' রিপোর্ট নিশ্চই আছে। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের দক্ষতা নিয়ে বাজারে নানা কথা চালু রয়েছে। দু-একজন 'ছোট' মন্ত্রীর অতিকথন সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে না। অদক্ষ মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে যোগ্য লোকদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেন সরকারপ্রধান।
আমার কাছে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ আর তা হচ্ছে ড্রাইভার আলী আজমের নিরাপত্তা। আলী আজম কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন, তাঁর খবর গণমাধ্যমগুলো আমাদের দিতে পারেনি। এত বড় একটা 'ঘটনার' যিনি জন্ম দিলেন, তাঁর সম্পর্কে গণমাধ্যমেরই যে আগ্রহ থাকবে, তা নয়। বরং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও আগ্রহ থাকবে। কিন্তু তাঁর কোনো হদিস নেই। বিজিবি বলেছে, তাদের হাতে নেই আলী আজম। তাহলে কি তিনি 'গুম' এর শিকার হলেন? মানবাধিকার কমিশন কি বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে? যিনি আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু, তিনি হঠাৎ করে 'উধাও' হয়ে যাবেন, বিষয়টি সহজভাবে মেনে নেওয়া যায় না। পুলিশের ভূমিকাও রহস্যজনক। পুলিশও বলছে, তাদের কাছে আলী আজম নেই। তাহলে? এত বড় একটা ঘটনা। তাঁকে বাদ দিয়ে তো তদন্তকাজ সম্পন্ন হবে না? তথাকথিত ৭০ লাখ টাকার রহস্য উদ্ঘাটনের স্বার্থেই প্রয়োজন আলী আজমকে জেরা করা। র‌্যাব কি আবারও তাদের কর্মদক্ষতার প্রমাণ রাখবে?
বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দেশের বদনাম এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মার্কিন কংগ্রেসম্যান জোসেফ ক্রাউলির একটি বক্তব্যও এক কাগজে ছাপা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক তাঁদের অর্থায়ন বন্ধ রেখেছে। এখন রেলওয়ের এই অর্থ কেলেঙ্কারি ও তাতে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ বহির্বিশ্বে আমাদের সম্মানকে উজ্জ্বল করবে না। আরো একটি কথা মনে রাখতে হবে। এসব কালো বিড়ালরা যে শুধু রেল মন্ত্রণালয়েই আছে, তা নয়। সেই বিখ্যাত 'বনখেকোর' কথা আমাদের নিশ্চই মনে আছে, যিনি ভয়ে ব্যাংকে টাকা রাখতেন না। রাখতেন বালিশের ভেতরে, তোষকের ভেতরে। আমরা কী সেই 'বনখেকো'র নাম মনে রাখতে পেরেছি। কী শাস্তি হয়েছিল ওই 'বনখেকো'র? এই সমাজ ওই 'বনখেকো'কে হয়তো ইতিমধ্যে পুনর্বাসন করেছে! সেদিন আগারগাঁওয়ের বন বিভাগের অফিসে গিয়েছিলাম। অভিযুক্ত একজন 'বনখেকো'র নেমপ্লেট তামার প্লেটে খোদাই করে বসানো হয়েছে। তিনি 'পুরস্কৃত' হয়েছেন। এই সমাজ ওই সব 'বনখেকো'দের সামাজিকভাবে উৎখাত করতে পারেনি। এদের হাত অনেক লম্বা। রেল, বন, গণপূর্তসহ প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে 'কালো বিড়াল' রয়েছে। একজন স্পষ্টবাদী ওবায়দুল কাদের সরকারের মাঝামাঝি সময়ে এসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। মন্ত্রণালয়টি খুব ভালো নয়। পদ্মা সেতু নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে একটি এমওইউ হয়েছে। বাজারে নানা কথা। আমি শুধু ভাবছি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের 'কালো বিড়াল'রা না আবার ওবায়দুল কাদেরকে আঁচড় দেয়। গভীর সমুদ্রে আমাদের অধিকার স্বীকৃত হওয়ায় বিদেশি তেল কম্পানিগুলো বিনা টেন্ডারেই সেখানে জরিপ চালাতে চায়। এই মন্ত্রণালয়ে 'কালো বিড়াল'রা তৎপর। আবার 'একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত' যেন সৃষ্টি না হয় এই মন্ত্রণালয়ে। প্রধানমন্ত্রী একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্তটি বলা অত সহজ ছিল না। 'রাজনীতির অনেক অঙ্ক' এর সঙ্গে জড়িত। এখন আইন তার নিজ নিয়মেই চলুক। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ যদি 'অভিযুক্ত' হন, তাঁর শাস্তি হওয়া উচিত। '৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবন' তাঁকে সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে না। সব রাজনীতিবিদের জন্যই এটা একটা দৃষ্টান্ত। রাজনীতিবিদরা নিজেরা 'কালো বিড়াল' হবেন না, আমাদের প্রত্যাশা এতটুকুই। 
দৈনিক কালের কন্ঠ ২২ এপ্রিল ২০১২

এগোতে পেরেছি কত দূর?

ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা চাইছি বটে, কিন্তু এককভাবে তো এই বাংলাদেশ গড়া যাবে না? ২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর। ৪২ বছরে পা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? যৌথভাবেই তো পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। এরই নাম গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র অনুপস্থিত বাংলাদেশে। অর্থনীতি একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে
আমরা স্বাধীনতার এই একচলি্লশ বছরে এগোতে পেরেছি কত দূর? ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা। কিন্তু আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। কত ধরনের সরকারই তো এসে গেল গত ৪১ বছরে_ গণতান্ত্রিক, একদলীয়, সামরিক একনায়কতান্ত্রিক, রাষ্ট্রপতিশাসিত, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কিংবা দলীয় কর্তৃত্ববাহী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কিন্তু সঠিক অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রতিষ্ঠিত হয়নি ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। বরং ধনী ও গরিবের মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে। হাজার হাজার কোটিপতির সৃষ্টি হয়েছে এই বাংলাদেশে। অন্যদিকে দারিদ্র্য বেড়েছে। ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিগত ২৮ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নে ২৪ হাজার ১০১ কোটি টাকা সাহায্য এসেছিল আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে। কিন্তু তাতে উপকৃত হয়েছে কারা? বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শে আমরা তৈরি করেছিলাম দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র। প্রথম কৌশলপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় আরেকটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছিল ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করে। কিন্তু দারিদ্র্য কমেনি। দারিদ্র্যকে ব্যবহার করে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীর জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে। ১৯৭২ সালে মাথাপিছু ঋণের বোঝা যেখানে ছিল মাত্র ৬৭ টাকা, ২০০৪ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৭ হাজার ২০০ টাকায়। ২০০৮ সালে সরকারি হিসাবে এর পরিমাণ ১৭ হাজার টাকা। ২০১১ সালে এই অর্থের পরিমাণ ২৪ হাজার টাকাকে অতিক্রম করেছে। আমরা এগোতে পেরেছি! নিশ্চয়ই পেরেছি। হাজার হাজার গাড়ি প্রতিদিন ঢাকা শহরে নামছে। শত শত ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে, বিক্রিও হচ্ছে। সাধারণ একটি ফ্ল্যাটের দাম যেখানে এক কোটি টাকা, তা তো বিক্রি হচ্ছে এই ঢাকা শহরেই। আমরা এগোতে তো পেরেছিই!
গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করার জন্য আমরা দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম। গত একচলি্লশ বছরে ১৫ বার সংবিধান সংশোধন করেছি। সংবিধান সংশোধন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়। আমরাও করেছি। কিন্তু তাতে করে জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে কি? যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আমরা হরতাল পর্যন্ত করেছিলাম এবং যা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন তিনটি জাতীয় নির্বাচনের পরও আবার তা সংসদে বাতিল হলো। কিন্তু কার স্বার্থে? গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কোনো বিধান থাকতে পারে না_ এটি সত্য। সে সঙ্গে এটিও সত্য, পৃথিবীর সব দেশে একই নিয়মে গণতন্ত্র বিকশিত হয় না। মিল খোঁজাটা অর্থহীন। আজকে রাশিয়ার বিকাশমান গণতন্ত্রের সঙ্গে ইউরোপের জার্মানি বা ফ্রান্সের গণতন্ত্রকে মেলানো যাবে না। অথচ রাশিয়া ইউরোপীয় সংস্কৃতিরই ধারক। আজকে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যখন অখিলেশ যাদব শপথ নেন, তিনি পরিবারতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন বটে, কিন্তু এটিই ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। উচ্চশিক্ষিত অখিলেশ ভারতীয় রাজনীতির তরুণ প্রজন্ম। এই তরুণ প্রজন্ম উচ্চশিক্ষিত, আধুনিকমনস্ক, এরাই ভারতকে নতুন এক যুগে টেনে নিয়ে যাবেন। বাংলাদেশে যদি এই পরিবারতন্ত্রের ছায়া পড়ে, তাতে ক্ষতি কী? আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। উচ্চশিক্ষিত একটি মধ্যবিত্তশ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা আধুনিকমনস্ক। তারা রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারেন।
গত একচলি্লশ বছরে আমরা অনেক এগিয়েছি। এ পর্যন্ত নয়টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যদিও তার তিনটির (১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬) কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আমরা সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী (১৯৯১) এনে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে গিয়েছিলাম। সেই সংশোধনীর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ছিল, আজও আছে। কিন্তু যা হয়নি, তা হচ্ছে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। আমরা সংসদীয় রাজনীতি চেয়েছি বটে, কিন্তু চেয়েছি নিজের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ও দলীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থে। বিরোধী দলও যে সরকারের একটি অংশ_ এ কথাটি আমরা ভুলে গেছি। সংসদীয় রাজনীতিতে 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস' বা পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখার যে কথা বলা হয়, তা আমরা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেইনি।
আমরা গণতন্ত্র চেয়েছি। কিন্তু শুধু একটি নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এ জন্য দরকার মানসিকতা পরিবর্তনের, যা আমাদের রাজনীতিতে দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের মূল জায়গাটা হচ্ছে সংসদ, যেখানে আলোচনা হবে, সমালোচনা হবে এবং জাতীয় স্বার্থে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। কিন্তু সেই সংসদকে আমরা অকার্যকর করছি। সংসদ বয়কট একটা \'কালচারে\' পরিণত হয়েছে। এই ধারা শুরু হয়েছিল পঞ্চম সংসদ থেকে, যেখান থেকে আমরা গণতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করেছিলাম। জনগণের কথা বলার জন্যই সংসদ। হাজার হাজার টাকা প্রতি মিনিটে খরচ হয় সংসদ পরিচালনা করতে। এখন সংসদ চলছে একদলীয়ভাবে, সিদ্ধান্ত হচ্ছে একদলীয়ভাবে, জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্তই সংসদে আলোচিত হচ্ছে না। কোনো কোনো ইস্যুতে জাতি থাকছে এক মহাঅন্ধকারে। সংসদে একটা ডিবেট চাই, কিন্তু যেভাবে সংসদে অসংলগ্ন কথা বলা হয়, জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করা হয়, কিংবা কালো পতাকা প্রদর্শন করা হয়, তার নাম আর যা-ই হোক সংসদীয় রাজনীতি হতে পারে না।
'ডিজিটাল বাংলাদেশ' আমরা চাইছি বটে, কিন্তু এককভাবে তো এই বাংলাদেশ গড়া যাবে না? ২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর। ৪২ বছরে পা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? যৌথভাবেই তো পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। এরই নাম গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র অনুপস্থিত বাংলাদেশে। অর্থনীতি একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। বিশ্বমন্দায় আমরা আক্রান্ত। প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ ভাগ হবে কি-না তার নিশ্চয়তা নেই। যেখানে ইউরোপে কৃচ্ছ্রসাধন চলছে (গ্রিস আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত), সেখানে আমাদের রাজস্ব ব্যয় বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণী। অথচ তারাই গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক। তারাই ভোট দিয়ে 'প্রিয় দল'কে ক্ষমতায় বসায়। বিদ্যুৎ সংকট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে এরই মধ্যে জটিল করেছে। শিল্প ও কৃষি খাতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল তা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এ থেকে উত্তরণের যে পথ (সবাই মিলে সমাধানের পথ খোঁজা), সে পথে আমরা হাঁটছি না। আমরা তো এগোতে চাই। কিন্তু এগোব কীভাবে? জাতীয় ইস্যুতে আমরা এখনও বিভক্ত। এই বিভক্তি জাতি গঠনে প্রধান অন্তরায়। সংসদীয় রাজনীতি প্রাধান্য পেয়েছে, কিন্তু দলীয় কর্তৃত্ব এখানে সর্বগ্রাসী। পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা আমাদের 'বড় অর্জন'কে ম্লান করে দিয়েছে। বাস্তবতাই হচ্ছে বিরোধী দল জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৭ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে (নবম সংসদ)। বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র বিনির্মাণ অর্থহীন। বাংলাদেশের গত ৪১ বছরের রাজনীতিতে রাজনীতিবিদরা পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আমাদের উপহার দিতে পারেননি। এটি আমাদের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার সুযোগ নিতে পারে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো। 
ড. তারেক শামসুর রেহমান 

আরো ব্যাংক আরো প্রশ্ন

আরও নয়টি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাঝে তিনটি এনআরবি অর্থাৎ বিদেশী উদ্যোক্তাদের, বাকিগুলো দেশীয় উদ্যোক্তাদের। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ব্যাংকের মোট সংখ্যা দাঁড়াল ৫৬তে, যার মাঝে ৪টি হচ্ছে সরকারি ব্যাংক। তবে নতুন ব্যাংকগুলো নিয়ে নানা প্রশ্ন এখন বাজারে। নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা অর্থনীতির সফলতা নির্দেশ করে কিনা, আমি বলতে পারব না। যারা অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন তারা ভালো বলতে পারবেন। আমার ভাবনাটা অন্য জায়গায়। একজন শিক্ষাবিদ কিংবা একজন সাবেক আমলা যদি সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ব্যবহার করে এভাবে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, তাহলে আগামীতেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এভাবে শিক্ষকরা যদি শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে টাকা উপার্জনের জন্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন, তাহলে তা জাতির জন্য আদৌ কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না। যে শিক্ষাবিদের নামটি একজন উদ্যোক্তা হিসেবে ছাপা হয়েছে, তিনি ইতিমধ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রতিষ্ঠা’ করে তার ‘ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড’ শুরু করেছেন। এখন ব্যাংকিং সেক্টরে তার ‘ব্যবসা’ সম্প্রসারণ করলেন। ভালোই।

আসলে প্রশ্ন সেটি নয়। যদি সত্যি সত্যিই ‘প্রয়োজন’ থাকে, তাহলে নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যেতেই পারে। কিন্তু সেই প্রয়োজনটি আছে কি? আদৌ কি বাংলাদেশ ব্যাংক কোন ‘স্টাডি’ করেছে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা? যদি আদৌ কোন ‘স্টাডি’ না হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংককে সব ধরনের দায়ভার বহন করতেই হবে। অতীতে এমনটি কখনও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তেল, পেঁয়াজ আর রসুনের মতো ব্যাংকিং সেক্টর ব্যবসার জায়গা নয়। নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ফলে এখানে আমানত সংগ্রহের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতে পারে, যা কিনা ব্যাংকিং সেক্টরে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকরা কতটুকু ভেবে দেখেছেন, আমি বলতে পারব না।

নতুন ব্যাংকগুলোকে নিয়ে এখন অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসা। এক. বলা হয়েছে নতুন ব্যাংকের জন্য পরিশোধিত মূলধন ৪০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, উদ্যোক্তারা যে ৪০০ কোটি টাকা একেকটি ব্যাংকের জন্য জমা দেবেন বা দিয়েছেন, তাদের অর্জিত ওই ‘সম্পদ’ কি বৈধ? ট্যাক্স রিটার্নে কি তা দেখানো হয়েছে? যদি সম্পদের হিসাব ট্যাক্স রিটার্নে থাকে, তাহলে কোন সমস্যা নেই। বিনিয়োগের উৎস কী, এটা জানা জরুরি। যে শিক্ষাবিদ, আমলা কিংবা ব্যাংকারের নাম উদ্যোক্তা হিসেবে ছাপা হয়েছে, তারা কি সারা জীবনে বৈধ পথে (কোন ব্যবসা না করে, কোন পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না থেকে) এত টাকা উপার্জন করতে পারেন? একজন শিক্ষক হিসেবে আমি তো জানি আমার সারা জীবনের সঞ্চয় কত। একজন আমলা অবসর নিয়ে রাজনীতি করে কত টাকাই বা বৈধ পথে আয় করতে পারেন? দুই. অনেকদিন ধরেই ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সংকট চলছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা কি এটা ভেবে দেখেছেন যে, নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ফলে এই তারল্য সংকট আদৌ বাড়বে কিনা? তিন. ব্যাংকিং সেক্টরে যারা কাজ করেন, তারা জানেন ব্যাসেল-২ বলে একটা কথা আছে। এখানে কিছু শর্ত থাকে, যা ব্যাংকগুলোকে পালন করতে হয়। এমনিতেই ব্যাংকগুলো ব্যাসেল-২ এর শর্ত পূরণ করতে পারছে না। এখন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ায় পরিস্থিতি কি আরও জটিল হল না?

চার. কিছুদিন আগে পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকগুলো বাজার থেকে আমানত সংগ্রহের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। কোন কোন ব্যাংক আমানতকারীদের সাড়ে ১৪ ভাগ সুদ পর্যন্ত দিতে শুরু করেছিল। এর ফলে যারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতেন, তাদের অতিরিক্ত সুদ দিতে হতো, কোন কোন ক্ষেত্রে যা ২০ ভাগের ওপরে। একপর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে হস্তক্ষেপ করে আমানতের সুদের হার নির্দিষ্ট করে দিতে হয়েছিল। এখন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ফলে এই ‘অসুস্থ প্রতিযোগিতা’ আবার শুরু হবে। নতুন ব্যাংকগুলো ‘আগ্রাসী ব্যাংকিং’ করবে এবং আমানতকারীদের অতিরিক্ত সুদের প্রলোভন দেখাবে। এতে করে একদিকে অন্য ব্যাংকগুলোও এই প্রতিযোগিতায় নামবে এবং এর ফলে সরকারের যে সঞ্চয় প্রকল্পগুলো চালু রয়েছে (পারিবারিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি), তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকার এসব প্রকল্প থেকে যে টাকা সংগ্রহ করে, তা ব্যাহত হবে। পাঁচ. বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা নতুন ব্যাংকগুলোকে ঢাকার বাইরে ব্যাংক স্থাপনের জন্য উৎসাহিত করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন ব্যাংকগুলো তা কি করবে? যেখানে ব্যাংক স্থাপনের পেছনে শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি কাজ করছে, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘উপদেশ’ তারা গ্রহণ করবেন, এই বিশ্বাসটা রাখতে পারছি না। ‘ব্যবসা’ করার জন্যই তারা এখানে পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন, কোন সমাজসেবা করার জন্য নয়। সুতরাং ঢাকা আর চট্টগ্রামে যে প্রথমেই শাখা খোলা হবে, তা দিব্যি ধরে নিতে পারি। ছয়. বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, তা কি নতুন ব্যাংকগুলো অনুসরণ করবে? যেমন বলা হয়েছে, উদ্যোক্তার সংখ্যা ১৩ সদস্যের বেশি হতে পারবে না এবং উদ্যোক্তারা ১০ শতাংশ শেয়ারের অধিকারী হবেন। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? কোন কোন ব্যাংকের উদ্যোক্তার সংখ্যা ৪০-এর কাছাকাছি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় কী?


এসব প্রশ্নের একটা জবাব বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আছে, আমরা তা জানি। সদ্য পদোন্নতি পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর সুর চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় কোন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়নি। তিনি এও জানিয়েছেন যে, আবেদনগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করেই ব্যাংকগুলোকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু অতি উৎসাহী সুর বাবু ভুলে গেছেন যে, স্বয়ং অর্থমন্ত্রী একবার স্বীকার করেছিলেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনাতেই ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেয়া হবে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের করার কিছুই নেই।’ অথচ সুর বাবু আরেকটু এগিয়ে গিয়েই বললেন, রাজনৈতিক বিবেচনা বিবেচ্য বিষয় ছিল না। সুর সাহেব কি গত ৯ এপ্রিলের পত্রিকাগুলো দেখেছেন? ব্যাংক উদ্যোক্তা হিসেবে যেসব নাম ও ছবি ছাপা হয়েছে, আপনার কি মনে হয় ওই ব্যক্তিদের সঙ্গে রাজনৈতিক কোন সংশ্লিষ্টতা নেই? এতদিন জানতাম বাংলাদেশ ব্যাংকে যারা ক্যারিয়ার গঠন করেন, তারা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ। আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদে আছেন (ডেপুটি গভর্নর) বা ছিলেন। তারা কেউই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। কিন্তু সুর বাবুর বক্তব্যে ‘রাজনীতির’ গন্ধ পাচ্ছি। যা হোক, সুর বাবুদের কথায় কিছু যায় আসে না। সংবাদগুলোই আমাদের বলে দিচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনাতেই ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

তারপরও কথা থেকে যায়। ব্যাংকগুলো যদি সনাতন ব্যাংকিং খাতে পরিবর্তন আনতে পারে, নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে গ্রাহকদের কাছে যেতে পারে, আমার বিশ্বাস, তারা সাধারণ মানুষের মাঝে একটা আস্থা অর্জন করতে পারবে। ফারমার্স ব্যাংক কিংবা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক নামে দুটো ব্যাংক অনুমোদন পেয়েছে। এখন ফারমার্স ব্যাংক যদি ঢাকায় অফিস খুলে বসে, তা যেমন দেখতে বেমানান হবে, ঠিক তেমনি তার কর্মপরিধির সঙ্গে তা খাপ খাবে না। ফারমার্স ব্যাংক গ্রামে যাক। দশ টাকায় কৃষকদের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলুক। অথবা প্রয়োজনে বিনে পয়সায় অ্যাকাউন্ট খুলতে কৃষকদের সাহায্য করুক। কৃষকদের বিনা জামানতে ঋণ দিক। ক্ষুদ্রঋণ চালু করুক। একই কথা প্রযোজ্য এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ক্ষেত্রেও। এত গ্রাম। এত কৃষক। ব্যাংকগুলো কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিয়েও একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারে। সেখান থেকেও ব্যবসা করা সম্ভব। বেসরকারি ব্যাংক মানেই ঢাকায় অফিস, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস কক্ষ, এমডির মাসিক বেতন দশ লাখ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এই যে মানসিকতা, এই মানসিকতা বদলাতে হবে।

কৃষকরা এসি রুমে যেতে পারেন না। ‘স্যুটেড বুটেড’ বিবিএ পাস তরুণ ব্যাংককর্মীর কাছে সে অপরিচিত। অথচ কৃষকরাই এই দেশটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সরকারি ব্যাংকগুলো তাদের কাছে যায়নি। যায়নি কৃষি ব্যাংকও। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো তো শুধু শহরকেন্দ্রিক। এখন নয়া ব্যাংকগুলো যদি এই বৃত্ত ভাঙতে পারে, তাহলে তারা ব্যাংকিং খাতে শুধু একটি বড় পরিবর্তনই আনবে না, বরং ব্যাংকিং ব্যবস্থার পুরো চেহারাটাই বদলে দিতে পারে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদেরও নাম এসেছে একটি ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে। এখানে ব্যক্তি এরশাদ যদি অনুমোদন নিয়ে থাকেন, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে যদি অনুমোদন নিয়ে থাকেন, তাহলে এর একটি পজিটিভ দিক রয়েছে। পশ্চিম ইউরোপে অনেক রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ব্যাংক রয়েছে (যেমন জার্মানি)। ব্যাংক পরিচালনা থেকে যে আয় হয়, সেই অর্থ দিয়ে দলটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো শুধু ব্যাংকিং সেক্টরেই নয়, বরং সংবাদপত্র ও রিয়েল এস্টেটেও অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশে এরকমটি নেই। কোন রাজনৈতিক দলেরই আর্থিক কোন ভিত্তি নেই। বলা হয় দল চলে চাঁদায়। এটি সত্য নয়। দল চলে বড় বড় ব্যবসায়ীর অর্থে। যারা দল ক্ষমতায় গেলে সুবিধা উঠিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি যদি একটি ব্যাংকের অনুমোদন নেয়, সেটা হবে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য নতুন একটি দিগন্ত। জাতীয় পার্টি সে ক্ষেত্রে নতুন একটি রাজনীতির ধারা সূচনা করতে পারে।

নতুন ৯টি ব্যাংক অর্থনীতিতে আদৌ কোন অবদান রাখতে পারবে কিনা, তা শুধু ভবিষ্যৎই বলতে পারে। তবে ব্যাংকগুলোর শুরুটা ভালো হল না। ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া’র অভিযোগটি ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎকে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিতে পারে। তবে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপকরা এই অভিযোগটি কাটিয়ে উঠতে পারবেন যদি তারা নতুন এপ্রোচে ব্যাংকগুলো পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে সুযোগ রয়েছে। সম্ভাবনাও রয়েছে। এখন দেখার বিষয় উদ্যোক্তারা কিভাবে ব্যাংকগুলো পরিচালনা করেন।

ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[সূত্র: যুগান্তর, ১৯/০৪/১২]

ব্যর্থতার সুযোগ নিতে পারে অসাংবিধানিক শক্তি

গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ৪১ বছর আমরা পার করেছি। কিন্তু এই ৪১ বছরে আমাদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়েছে? সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিরোধীদলের নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে বাধা দান, কিংবা শহীদ জিয়াউর রহমানের ওপর পাঁচটি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনে বাধাদান ইত্যাদি প্রমাণ করে যে আদর্শ নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলাম, সেই আদর্শ থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গেছি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে ন্যায়বিচারভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল, ক্ষমতাসীন সরকারের আচরণ প্রমাণ করে তারা এই আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। তারা ধীরে ধীরে একদলীয় শাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। যে কারণে অধ্যাপক রওনক জাহানের মতো পণ্ডিত ব্যক্তিও বলতে বাধ্য হয়েছেন ‘এ দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ খুব একটা সুপ্রসন্ন নয়’। (একটি সেমিনারে দেয়া বক্তব্যে ২৭ মার্চ)। অধ্যাপক রওনক জাহানকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। 
গণতন্ত্র, সুশীল সমাজ নিয়ে এ দেশে যে ক’জন পণ্ডিত কাজ করেছেন, তিনি তার অন্যতম। তিনি বলেছেন, সরকারি প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের রাজনীতিকরণ ও বিভক্তিকরণ এখনও বিদ্যমান। বিচার বিভাগ দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। সরকারের কিছু কিছু বক্তব্য থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকে বৈধ করার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। উপরন্তু ছাত্রলীগের সহিংস কার্যকলাপের ধারাবাহিকতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যক্ষ নয়। স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও একজন শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিতের মুখ থেকে যখন এ ধরনের কথা বের হয়, তখন আমাদের বুঝতে কারো বাকি থাকে না যে, দেশটি সঠিক পথে চলছে না। যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে বারে বারে সেই গণতন্ত্র থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে।

গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করার জন্য আমরা দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম। গত একচল্লিশ বছরে ১৫ বার সংবিধান আমরা সংশোধন করেছি। সংবিধান সংশোধন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়। আমরাও করেছি। কিন্তু তাতে করে জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে কী? যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আমরা হরতাল পর্যন্ত করেছিলাম এবং যা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন তিনটি জাতীয় নির্বাচনের পরও আবার তা সংসদে বাতিল হলো। কিন্তু কার স্বার্থে? গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কোনো বিধান থাকতে পারে না এটা সত্য। সেইসাথে এটাও সত্য পৃথিবীর সব দেশে একই নিয়মে গণতন্ত্র বিকশিত হয় না। 
মিল খোঁজাটা অর্থহীন। আজকে রাশিয়ার বিকাশমান গণতন্ত্রের সাথে ইউরোপের, জার্মানির বা ফ্রান্সের গণতন্ত্রকে মেলানো যাবে না। অথচ রাশিয়া, ইউরোপীয় সংস্কৃতিরই ধারক। আজকে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যখন অখিলেস যাদব শপথ নেন, তিনি পরিবারতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন বটে, কিন্তু এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। উচ্চ শিক্ষিত অখিলেস ভারতীয় রাজনীতির তরুণ প্রজন্ম। এই তরুণ প্রজন্ম উচ্চ শিক্ষিত, আধুনিক মনস্ক, এরাই ভারতকে নতুন এক যুগে টেনে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশে যদি এই পরিবারতন্ত্রের ছায়া পড়ে, তাতে ক্ষতি কী? আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। উচ্চ শিক্ষিত একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা আধুনিক মনস্ক। এরা রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারেন।

গত চল্লিশ বছরে আমরা অনেক এগিয়েছি। এ যাবতকাল নয়টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যদিও তার তিনটির (১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬) কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আমরা সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী (১৯৯১) এনে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে গিয়েছিলাম। সেই সংশোধনীর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ছিল, আজো আছে। কিন্তু যা হয়নি, তা হচ্ছে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। আমরা সংসদীয় রাজনীতি চেয়েছি বটে, কিন্তু চেয়েছি নিজের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে ও দলীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থে। বিরোধী দলও যে সরকারের একটি অংশ, এ কথাটা আমরা ভুলে গেছি। সংসদীয় রাজনীতিতে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ বা পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখার যে কথা বলা হয়, তা আমরা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নিইনি। সর্বশেষ ঘটনায় ২৬ মার্চের বেগম জিয়ার সাভারে যাওয়াকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছিল, তা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। এর আগে ঢাকা শহরকে অবরুদ্ধ করে, সাধারণ মানুষের জন্য জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে, বিরোধীদলের সমাবেশে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে যে ‘গণতন্ত্র’ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি, তাতে আর যাইহোক প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। গত ১২ মার্চকে ঘিরে যে অস্থিরতা ও অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল তা ছিল দ্বাদশ সংশোধনীর স্পিরিটের পরিপন্থি, গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পথে তা অন্তরায়। এখানে প্রয়োজন ছিল সমঝোতার। প্রয়োজন ছিল আন্তরিকতা। সেটি দেখা যায়নি। বরং পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে এক চরম অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল। আগামী ১০ জুনের ডেডলাইন আদৌ কোনো সমাধান বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। পরস্পর বিরোধী এই অবস্থান আমাদের আবারো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ এর কথা।

আমরা গণতন্ত্র চেয়েছি। কিন্তু শুধু একটি নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এ জন্য দরকার মানসিকতা পরিবর্তনের, যা আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের মূল জায়গাটা হচ্ছে সংসদ, যেখানে আলোচনা হবে, সমালোচনা হবে এবং জাতীয় স্বার্থে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। কিন্তু সেই সংসদকে আমরা অকার্যকর করছি। সংসদ বয়কট একটা ‘কালচারে’ পরিণত হয়েছে। এই ধারা শুরু হয়েছিল পঞ্চম সংসদ থেকে, যেখান থেকে আমরা গণতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করেছিলাম। জনগণের কথা বলার জন্যই সংসদ। হাজার হাজার টাকা প্রতি মিনিটে খরচ হয় সংসদ পরিচালনা করতে। এখন সংসদ চলছে একদলীয়ভাবে, সিদ্ধান্ত হচ্ছে একদলীয়ভাবে, জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্তই সংসদে আলোচিত হচ্ছে না। কোনো কোনো ইস্যুতে জাতি থাকছে এক মহাঅন্ধকারে। সংসদে একটা ডিবেট চাই, কিন্তু যেভাবে সংসদে অসংলগ্ন কথা বলা হয়, জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করা হয়, কিংবা কালো পতাকা প্রদর্শন করা হয়, তার নাম আর যাই হোক সংসদীয় রাজনীতি হতে পারে না।

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আমরা চাচ্ছি বটে, কিন্তু এককভাবে তো এই বাংলাদেশ গড়া যাবে না? ২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর। ৪১ বছরে পা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? যৌথভাবেই তো পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। এরই নাম গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র অনুপস্থিত বাংলাদেশে। অর্থনীতি একটি সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। বিশ্ব মন্দায় আমরা আক্রান্ত। প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ ভাগ হবে কী না, তার নিশ্চয়তা নেই। যেখানে ইউরোপে কৃচ্ছ্রসাধন চলছে (গ্রিস আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত), সেখানে আমাদের রাজস্ব ব্যয় বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণী। অথচ এরাই গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক। এরাই ভোট দিয়ে ‘প্রিয় দলকে’ ক্ষমতায় বসায়। বিদ্যুৎ সংকট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে এরই মাঝে জটিল করেছে। শিল্প ও কৃষিখাতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, তা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এ থেকে উত্তরণের যে পথ (সকলে মিলে সমাধানের পথ খোঁজা), সে পথে আমরা হাঁটছি না। আমরা তো এগুতে চাই। কিন্তু এগুবো কীভাবে? জাতীয় ইস্যুতে আমরা এখনও বিভক্ত। এই বিভক্তি জাতি গঠনে প্রধান অন্তরায়। সংসদীয় রাজনীতি প্রধান্য পেয়েছে, কিন্তু দলীয় কর্তৃত্ব এখানে সর্বগ্রাসী। পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা আমাদের ‘বড় অর্জনকে’ ম্লান করে দিয়েছে। বাস্তবতাই হচ্ছে বিরোধীদল জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৭ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে (৯ম সংসদ)। বিরোধীদলকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র বিনির্মাণ অর্থহীন। বাংলাদেশের গত ৪১ বছরের রাজনীতিতে রাজনীতিবিদরা পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আমাদের উপহার দিতে পারেননি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার সুযোগ নিতে পারে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো।

প্রধানমন্ত্রীর তুরস্ক সফর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিনদিনের তুরস্ক সফর শেষ হয়েছে গত ১৪ এপ্রিল। প্রধানমন্ত্রীর তুরস্ক সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সমসাময়িককালে মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের গুরুত্ব বেড়েছে। তুরস্ক ও বাংলাদেশ_ দুটো দেশেই মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। দুটো দেশই ডি-৮-এর সদস্য। কিছুদিন আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট গুল বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এখন ফিরতি সফরে প্রধানমন্ত্রী তুরস্ক গেলেন। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের মধ্য দিয়ে দুদেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হল। বস্তুতপক্ষে তুরস্কের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন আজ মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি মডেল। 'আরব বসন্ত'-এর পর অনেক দেশ এখন 'তুরস্ক মডেল'কে গ্রহণ করেছে। গেল ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আমার সুযোগ হয়েছিল তুরস্কে যাওয়ার। সেখানে আমি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। ওই সম্মেলনে যোগ দেওয়া তুরস্কের বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশের সঙ্গে আমার মতবিনিময়কালে আমার মনে হয়েছে তুরস্ক একুশ শতকে মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমাদের জন্য তুরস্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা অনেক কিছুই শিখতে পারি তুরস্কের কাছ থেকে। শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত দেশও যে বিশ্বে একটি মডেল হতে পারে, আজকের তুরস্ক তার বড় প্রমাণ। মুসলিম বিশ্ব মানেই মনে করা হতো একনায়কতান্ত্রিক সামরিক শাসন (মিসর, তিউনেসিয়া, ইয়েমেন), কিংবা ক্ষমতালোভী রাজতন্ত্র (গালফভুক্ত দেশগুলো) অথবা ইসলামিক চরমপন্থীদের উর্বরভূমি (আফগানিস্তান, সোমালিয়া)। কিন্তু এর বাইরেও একটি ইসলামিক সমাজ ব্যবস্থা যে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র উপহার দিতে পারে, গত প্রায় ১৬ বছরের তুরস্কের রাজনীতি এটাই প্রমাণ করেছে। সারা আরব বিশ্বে গণতন্ত্র বিনির্মাণের যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে (আরব বসন্ত), তার মধ্যে ব্যতিক্রম তুরস্ক। এমনকি ইসলামী জঙ্গিদের কোনো তৎপরতাও নেই তুরস্কে। কুর্দিদের নিয়ে একটা সমস্যা রয়েছে সত্য; কিন্তু তা এখন নিয়ন্ত্রিত। একসময় তুরস্কের সেনাবাহিনী ছিল গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। এখন সেনাবাহিনীকে হুমকি হিসেবে গণ্য করা হয় না।
তুরস্ক এখন একটি মধ্য আয়ের দেশ। ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী (পিপিপি) তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় (পিপিপি) বছরে ১৫ হাজার ৩৪০ ডলার। বিশ্ব অর্থনীতিতে তুরস্কের অবস্থান ১৫তম। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও'নেইল (ঔরস ড় ঘবরষষ) ২০১১ সালে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে ভাগ করেছেন। তাতে তিনি তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করেছেন গওকঞ গ্রুপে, অর্থাৎ মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক বিশ্বে নতুন একটি অর্থনৈতিক বস্নক সৃষ্টি করেছে। জিম ও'নেইল এ চারটি দেশকে শুধু দ্রুত বর্ধনশীল উন্নয়নশীল বিশ্ব বলতে নারাজ। ২০০১ সালে তিনিই ইজওঈ এর ধারণা দিয়েছিলেন (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন)। বাংলাদেশ গওকঞ মডেল অনুসরণ করতে পারে এবং গওকঞ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে পারে। ২০০২ সাল থেকেই জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতৃত্বে একটি সরকার সেখানে স্থিতিশীলতা উপহার দিয়ে আসছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল (২০০৭ সাল থেকে) ও প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইপ এরদোগান অত্যন্ত জনপ্রিয়। এদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। পরপর তিনবার এরদোগান প্রধানমন্ত্রী ও তার দল বিজয়ী হয়েছে (২০০২ সালে ৩৪ ভাগ ভোট, ২০০৭ সালে ৪৭ ভাগ ভোট, আর ২০১১ সালে ৪৯ ভাগ ভোট)। প্রেসিডেন্ট গুল ও প্রধানমন্ত্রী এরদোগান ব্যক্তিজীবনে ইসলামিক জীবনধারা (তাদের স্ত্রীরা মাথায় হেজাব ব্যবহার করেন) অনুসরণ করলেও, তারা কট্টর নন। তারা বাধ্য করছেন না সবাইকে ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলতে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রীদের জন্য 'হেজাব না পরার' যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা তুলে নেওয়া হয়েছে। তুরস্ক ভ্রমণে আমি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি মেয়েরা আদৌ হেজাব পরে না। জিন্স প্যান্ট পরা আধুনিক মেয়েদের ক্যাম্পাসে চলাফেরা আমাকে ইউরোপের দেশগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বে অভিযোগ রয়েছে, দলটি ইসলামপন্থী এবং কট্টর; কিন্তু তুরস্কে আমি এ অভিযোগ শুনিনি। সেখানে আদৌ কোনো জঙ্গিবাদী তৎপরতা নেই। একাধিক ফোরামে আমি আল-কায়েদার তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন করেছি। জবাব পেয়েছি একটাই_ সেখানে আল-কায়েদার কোনো তৎপরতা নেই। একটি মুসলিম জনসংখ্যা অধিষ্ঠিত দেশ যে ইসলামকে ধারণ করেও আধুনিকমনস্ক হতে পারে, তুরস্ক তার বড় প্রমাণ। কামাল পাশা (যিনি জাতির পিতাও বটে) তুরস্কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। তা আজো আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে বটে, তবে তাতে মূল নীতিতে তেমন পরিবর্তন আসেনি। আমি তুরস্কে কোথাও শুনিনি যে, বিরোধী পক্ষ সরকারের ইসলামপন্থী কিছু কর্মকা-কে 'জঙ্গিবাদী' তৎপরতা বলে দাবি করছে (অথচ আমরা জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গটি বারবার টেনে আনছি)। অত্যন্ত 'ক্লিন' চরিত্রের অধিকারী এরদোগান ছিলেন ইস্তাম্বুলের মেয়র। দুর্নীতির কোনো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে নেই। বাংলাদেশ তুরস্কের এ 'রাজনীতি' থেকে কিছুটা শিখতে পারে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তার পুরনো সম্পর্ক নতুন করে স্থাপন করার উদ্যোগ নিচ্ছে। পুরনো 'সিল্করোড'কে নতুন করে আবার 'আবিষ্কার' করছে তুরস্ক। চেষ্টা করছে ওই দেশগুলোকে একটি প্লাটফার্মে দাঁড় করাতে। তুরস্ক হতে যাচ্ছে 'সিল্করোড'ভুক্ত দেশগুলোর নেতা। বাকু-তিবিলিসি-সাইহান পাইপলাইন (গ্যাস ও তেল) এ লক্ষ্যেই রচিত। ৪ বছর পরপর সেখানে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর সংসদ নির্বাচনে যারা নূ্যনতম ১০ ভাগ ভোট পেয়েছে, সংসদে তারাই দলীয়ভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। যদিও 'আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের' আলোকে সেখানে নির্বাচন হয়।
তুরস্কের সাম্প্রতিক রাজনীতি, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের ভূমিকা এখন বহির্বিশ্বে বেশ আলোচিত। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তুরস্ক যে গণতন্ত্রের একটি 'মডেল' হতে পারে, তা তিনি প্রমাণ করেছেন। তিনি কট্টর নন, আধুনিকমনস্ক এক মানুষ। তুরস্কে ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে যে বিরোধ রয়েছে, তা থেকে তিনি ও তার দল (জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) বেরিয়ে আসতে পেরেছেন বলে মনে হয়। মুসলিম বিশ্বে, সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ক্ষমতা পরিচালনা করেছে এবং সেসব দেশে (মিসর, তিউনেসিয়া, ইয়েমেন) সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। তুরস্কও এ থেকে পার্থক্য ছিল না। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনী তিনবার ক্ষমতা দখল করেছিল। সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল কেনান এভরেন ১৯৮০ সালে। ১৯৮২ সালে তিনি ৭ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। জেনারেল এভরেন 'রাজনীতি' থেকে অবসর নিলে সেনাবাহিনী রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। পরে প্রেসিডেন্ট হন তুরগুত ওজাল ও সোলেমান ডেমিরেল। মূলত নব্বইয়ের দশকের পর থেকেই গণতন্ত্রমনা ইসলামিক শক্তিগুলো নতুন শক্তিরূপে আবির্ভূত হয় এবং সমাজে তাদের অবস্থান এখন যথেষ্ট শক্তিশালী। এই ইসলামিক শক্তির নেতৃত্ব (১৯৯৬) দিয়েছিল ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টি ও তার নেতা নেকমাতিন এরবাকান। তারা একসময় ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের সঙ্গে একটি কোয়ালিশন সরকারও গঠন করেছিল। সেনাবাহিনীর চাপে এরবাকান পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ১৯৯৭ সালের ১৮ জুন। একসময় ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধও ঘোষণা করা হয়েছিল। এরবাকানের মৃত্যু ইস্তাম্বুলের সাবেক মেয়র এরদোগানকে ক্ষমতার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে। ২০০২ সাল থেকেই নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করা ইসলামিক জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ক্ষমতা এককভাবে পরিচালনা করে আসছে। বর্তমান সরকারের একটা বড় উদ্যোগ হচ্ছে প্রাচীন 'সিল্করোড'কে পুনরুজ্জীবিত করা। এই 'সিল্করোড' এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের যোগসূত্র ঘটিয়েছে। প্রায় চার হাজার মাইল বিস্তৃত এই 'সিল্করোড' চীন থেকে শুরু। চীনা ব্যবসায়ীরা চীন থেকে সঙ্গে করে আনতেন সিল্ক কাপড়, সার্টিন, চা ও পোরসেলানের দ্রব্যাদি। সাগর রুটে তারা ভারতে আসতেন। এখান থেকে নিয়ে যেতেন মসলা, হাতির দাঁত এবং অলঙ্কারাদি। যেহেতু চীনারা সিল্ক কাপড়ের ব্যবসা করতেন, সে কারণেই তাদের ব্যবহৃত পথটি 'সিল্করোড' হিসেবে পরিচিত।
তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুধু মধ্য এশিয়ার দেশগুলো কেন, আমাদের জন্যও একটা আশার সঞ্চার করেছে। মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের বিনিয়োগও বাড়ছে। চলতি ২০১২ সালে মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের বিনিয়োগের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ২২২ বিলিয়ন ডলার। তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ইউরোপের কোনো দেশের চেয়ে কম নয়। সুতরাং তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করে আমরা উপকৃত হতে পারি। বাংলাদেশে তুরস্কের বিনিয়োগ বাড়তে পারে। দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থানের একটি সুযোগ রয়েছে তুরস্কে। আমরা এই উদ্যোগটি নিতে পারি। এখন প্রধানমন্ত্রীর তুরস্ক সফরের মধ্য দিয়ে এই সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হল।
তথ্যসূত্র:  দৈনিক ডেসটিনি
১৮ এপ্রিল ২০১২.
অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান

একটি সংবাদ অনেক প্রশ্ন

সৌদি আরবের আরব নিউজ-এ একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে অতি সম্প্রতি। উক্ত সংবাদে সৌদি উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলাউদ্দিন আল আসকারির একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি কূটনীতিক খালাফ আল আলির হত্যাকাণ্ডের মোটিভ ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ওই পত্রিকাটিতে অন্য যে মন্তব্যটি করা হয়েছে, তা আমাদের জন্য উত্কণ্ঠার ও উদ্বেগের। পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছে, খালাফ আল আলির হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হলে সৌদি আরবে বসবাস ও কর্মরত ২০ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক নিয়ে সঙ্কট তৈরি হতে পারে। ‘আরব নিউজ’-এ প্রকাশিত সংবাদটি অনলাইন বার্তা সংস্থা বার্তা২৪.নেট-এ গত ১৩ এপ্রিল প্রকাশ পেয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সৌদি কূটনীতিক খালাফ আততায়ীর হাতে মারা যান গত ৬ মার্চ। এর প্রতিক্রিয়ায় আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি সৌদি আরব সফর করেন ২১ মার্চ। এরপর সৌদি গোয়েন্দাদের একটি প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশ সফর করে যায়। কিন্তু তারপরও খালাফ হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা হয়নি। এমনি এক পরিস্থিতিতে আরব নিউজ যখন এ ধরনের একটি মন্তব্য করে, তখন তা গুরুত্ব পায় বৈকি! সৌদি কূটনীতিকের হত্যাকাণ্ডের খবরটি মধ্যপ্রাচ্যসহ বহির্বিশ্বে ব্যাপক প্রচার পায়। এতে করে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশে সন্ত্রাসীরা তত্পর এবং বাংলাদেশ সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, এমন মন্তব্যও করেছিলেন মার্কিন উপসহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস শিয়ার। সুতরাং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলির দিকে যে আমাদের বহু রাষ্ট্র নজর রাখছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা এ ধরনের ‘হাই প্রোফাইল’ হত্যাকাণ্ডকে কতটুকু বিবেচনায় নিয়েছেন, বলতে পারব না। কিন্তু আরব নিউজ যখন সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় কিংবা যখন উল্লেখ করা হয় ঢাকা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া থেকে ইউরোপে যে মাদক পাচার করা হয়, তার অন্যতম কেন্দ্র, তখন পরোক্ষভাবে আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এ ধরনের প্রতিবেদন সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে উন্নত করতে আদৌ সাহায্য করবে না। বরং সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে। প্রতিবেদনটিতে সৌদি উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্ধৃতি থাকায় প্রতিবেদনটির গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। খালাফ হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে বিবৃতি প্রচার করা হয়েছিল, তাতে স্পষ্টতই একটি মেসেজ ছিল। এটা স্পষ্ট খুনিদের গ্রেফতার ও সুষ্ঠু তদন্ত চায় সৌদি আরব। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছিলেন। এই ‘দাবি’ একটি মেসেজ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি যে কীভাবে নেবে, আমি জানি না। কিন্তু সত্যি সত্যিই যদি প্রকৃত দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতার করা সম্ভব না হয় কিংবা প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা সম্ভব না হয়, তাহলে তা মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবেচনায় নিলে ভালো করবে। এমনিতেই পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আমি রীতিমতো হতাশ। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড নিয়ে আজও কূল-কিনারা হল না। আমরা ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছি এই হত্যাকাণ্ডের খবর। মিডিয়ায় লেখালেখির কারণে সম্ভবত এখানে একটি ‘জজমিয়া নাটক’ মঞ্চস্থ হয়নি। কিন্তু মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন ‘প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড মনিটর করছেন, তখন আমি একটা ধন্দে পড়ে যাই। যদি সত্যি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী মনিটর করে থাকেন (?), তাহলে এতদিন কেন লাগবে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের ভূমিকা ও দক্ষতা তাই সঙ্গত কারণেই উঠবে। পুলিশ যদি মূল কাজ ফেলে ‘অন্য কাজে’ বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে হত্যাকারীরা তো এ সুযোগ নেবেই! পুলিশের উচিত মূল কাজে মনোনিবেশ করা ও তাদের দক্ষতা বাড়ানো। একজন ‘থ্রি স্টার জেনারেলের’ পদ সৃষ্টি করে কিংবা পুলিশ বাহিনীর জন্য পাঁচজন সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করে যে পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানো যায় না, সেটা আবারও প্রমাণিত হল খালাফ আল আলির হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই মন্ত্রণালয়ের দিকে দৃষ্টি দিলে ভালো করবেন।


মার্কিন কর্মকর্তা জেমস শিয়ার যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যখন বলেন, ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়’, তখন সরকারের পক্ষ থেকে এর একটা ব্যাখ্যা দাবি করা উচিত ছিল। কেননা প্রধানমন্ত্রী তো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। এটাই হচ্ছে বাস্তব কথা। বর্তমান সরকারের শাসনামলে গেল তিন বছরে আমরা কোনো বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড লক্ষ করিনি। সন্ত্রাসীরা তেমনভাবে সংগঠিত হতে পারছে না। বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি সংবাদ ছাপা হলেও তাদের তত্পরতা, সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ কিংবা জমায়েতের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থেকেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ অবিশ্যি তত্পর হয়েছে। কিন্তু ওইসব নিষিদ্ধ ঘোষিত গ্রুপ কর্তৃক কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে আমরা দেখিনি। তাই ‘অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিমুক্ত দেশ’, তা নিঃসন্দেহে বলা যাবে না। বাইরের সন্ত্রাসী হামলা? এটাও তো আমাদের চোখে ধরা পড়েনি। কিছু ‘ভারতীয় সন্ত্রাসী’ বাংলাদেশে পালিয়ে ছিল। কিন্তু তাদের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল না এ দেশে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের হস্তান্তরের ফলে ওই অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটেছে। এর বাইরে আল কায়দা কিংবা লস্কর-ই তৈয়বার মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনো নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে কাজ করছে বলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের কখনও অবহিত করেনি। ফলে মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তার ওই বক্তব্যের উদ্দেশ্য কী-এ প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে।


আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর করতে ভালোবাসেন। তিনি জানিয়েছিলেন, খালাফ আল আলির মৃত্যুর ঘটনার প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু এত দিন পার হওয়ার পরও সত্য বেরিয়ে আসেনি। তাতে কি আমাদের ভাবমূর্তি আদৌ উজ্জ্বল হয়েছে? বাংলাদেশি প্রায় ২০ লাখ (প্রকারান্তরে ৩০ লাখ) নাগরিক এখন সৌদিতে কর্মরত। তাদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। গত ৭ মার্চ রাতে একটি চ্যানেলে অংশ নিতে গিয়ে সৌদি আরব থেকে প্রবাসীরা ফোন করে তাদের আতঙ্কের কথা আমাদের জানিয়েছেন। এই আতঙ্কের খবরটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। এমনিতেই বাংলাদেশ-সৌদি আরব সম্পর্ক খুব ভালো পর্যায়ে রয়েছে, এটা বলা সাজে না। গত ২০০৮ সাল থেকেই সৌদিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়োগ পরিপূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। এটা আমাদের একটা কূটনৈতিক ব্যর্থতা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়নি কখনও। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের জনশক্তি বাজার যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, আমাদের নীতিনির্ধারকরা তা আদৌ বিবেচনায় নেননি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিদেশ সচিব পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটি বারবার এড়িয়ে গেছেন। অথচ সৌদি আরব বাংলাদেশকে বাইরে রেখে নেপালের মতো হিন্দুপ্রধান দেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করে আসছিল। শুধু তাই নয়, সংবিধানে ২৫ (২) ধারাটি সংযোজন করে আমরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এটি ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল নির্দেশনা। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের ফলে সংবিধানের ওই ধারাটি এখন আর নেই। এতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’তে যে প্রভাব পড়ছে তা অস্বীকার করা যাবে না। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে এ প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যেতে পারে। মোটা দাগে যেটা বলা যায়, তা হচ্ছে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থেই উচিত ওই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ খুঁজে বের করা এবং হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা। প্রয়োজনে স্কটল্যান্ডইয়ার্ডের মতো বিশ্বসেরা আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে। দেশে এই মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। বিরোধী দল ১২ মার্চের কর্মসূচি পালন করে সরকার পতনের আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে অতিদ্রুত হত্যাকাণ্ডের মোটিভটি সুস্পষ্ট করা। এটি একটি স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ড। এর সঙ্গে আমাদের অনেক স্বার্থ জড়িত। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে একটি সংবাদও কোনো কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। এরই প্রতিধ্বনি আমরা দেখতে পাই ষেড়নধষ ঞযত্বধঃ নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে গত ৯ মার্চ। সেখানেও মধ্যপ্রাচ্যের ওই রাষ্ট্রটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা চিন্তার কারণ। খুব দ্রুত আমরা যদি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে না পারি, তাহলে তা শুধু সৌদি আরবের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে না, বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতেও এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাতে করে জনশক্তি রফতানিতে আরও ধস নামবে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমবে। আর মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লাখ লাখ বাংলাদেশি কর্মী থাকবেন একধরনের নিরাপত্তাহীনতায়। আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থেই তা কোনো ভালো সংবাদ নয়। এখন আরব নিউজ-এ প্রকাশিত সংবাদটির পর সরকার যদি দ্রুত খালাফ হত্যাকাণ্ডের মোটিভ উদঘাটন করতে পারে, তা আমাদের জন্য মঙ্গল।
দৈনিক সকালের খবর, ১৭ এপ্রিল ২০১২,
ড. তারেক শামসুর রেহমান।

অবশেষে রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করলেন


তারেক শামসুর রেহমান
অবশেষে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগ করলেন দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে। এর একটি ভালো দিক অবশ্য আছে। দুদকসহ বিভিন্ন সরকারি এজেন্সি যখন রেলমন্ত্রীর এপিএসের কাছে পাওয়া ৭০ লাখ টাকার বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে, ঠিক তখনই তদন্তের স্বচ্ছতার স্বার্থে নিজ পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন। এটা যেমনি একটি ভালো দিক, ঠিক এর একটি মন্দ দিকও আছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ অনেক প্রশ্নের জবাব আমাদের দেবে না। প্রথমত, সংবাদ সম্মেলনে ওই ৭০ লাখ টাকার ব্যাপারে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই জানালেও, সাসপেন্ড হওয়া রেলওয়ের জিএম আবু ইউসুফ মৃধা জানিয়েছিলেন, তারা গাড়িতে করে মন্ত্রী সাহেবের বাসাতেই যাচ্ছিলেন। এত টাকা নিয়ে কোন ব্যক্তি এত গভীর রাতে সাধারণত চলাচল করেন না। সুতরাং ওই টাকার সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সম্পৃক্ততা কতটুকু ছিল, তা জানা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ঘুষ কেলেংকারিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ এ দেশের রাজনীতিবিদদের, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় আছেন এবং আগামীতে ক্ষমতায় যেতে চান, তাদের ভূমিকাকে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিল। রাজনীতিবিদরা জনগণের কাছে হেয়প্রতিপন্ন হলেন। অথচ বারবার এ দেশের জনগণ রাজনীতিবিদদের কাছেই ফিরে গেছে। তৃতীয়ত, ব্যক্তি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে খুব সৎ ছিলেন না, তা প্রমাণিত হল। তার ছেলে সৌমেন গুপ্তের ৫ কোটি টাকা দিয়ে ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জ লাইসেন্স প্রাপ্তি, দিরাইয়ে আলিশান সেন মার্কেট, নামে-বেনামে শত কোটি টাকার 'শত্রু সম্পত্তি' দখল ইত্যাদি প্রমাণ করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা ছিল না। কেননা তার আয়ের যে হিসাব তিনি নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছিলেন, তাতে তার স্বীকারোক্তি ছিল, তার বার্ষিক আয় মাত্র ৭ লাখ টাকা। ৭ লাখ টাকার আয় দিয়ে কোটি টাকার মার্কেট করেন কিভাবে? আর তার সন্তান নিশ্চয়ই কোন আলাদিনের চেরাগ পাননি যে, ৫ কোটি টাকা দিয়ে ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স তিনি পেতে পারেন? এটা তো শুধু ৫ কোটি টাকার 'মামলা' না। এটা প্রায় ৩০ কোটি টাকার একটা বিনিয়োগ। 'সেনগুপ্ত কমিউনিকেশন' এই টাকা পেল কোত্থেকে? দুর্মুখরা বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কলকাতাতেও বাড়ি আছে। সুরঞ্জিত বাবুর কী টিআইএন নাম্বার আছে? সেখানে তিনি কত টাকা ট্যাক্স দিয়েছিলেন? অভিযোগ আছে, জিগাতলায় যে বাড়িতে তিনি থাকেন, ওই বাড়িটির মূল মালিক তিনি নন। বেশ কিছুদিন আগে এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। দুদক কী এখন এসব বিষয় নিয়ে তদন্ত করবে? চতুর্থ, যে ৭০ লাখ টাকার কথা বলা হয়েছে এবং যা ওমর ফারুক পরদিন নিজ অ্যাকাউন্টে জমা দেন, এর মূল মালিক কে? ওমর ফারুক কী এই অবৈধ টাকার মালিক? এপিএস হিসেবে তিনি যে বেতন পান, ওই বেতন দিয়ে কী এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ উপার্জন করা সম্ভব? তার এবং তার স্ত্রীর অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে করে কী 'অবৈধ লেনদেনের' বিষয়টির সমাধান হবে? 'অবৈধ লেনদেন' এর টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হওয়াই শ্রেয়। শুধু অ্যাকউন্ট জব্দই নয়, প্রকৃত 'সত্য' জানতে অবিলম্বে তিন অভিযুক্ত ব্যক্তি ওমর ফারুক, এনামুল হক ও ইউসুফ আলী মৃধাকে গ্রেফতার করা উচিত। না হলে 'সত্য' চাপা পড়ে যাবে। পঞ্চমত, দুদকের জন্য একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে 'ইমেজ' বৃদ্ধির। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুদক কার্যত একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখতে পারছে না। সর্বশেষ ঘটনায় দুদক যখন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের দুর্নীতির ব্যাপারে একটি 'সার্টিফিকেট' দেয়, তখন দুদক সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। এখন দুদকের জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি হল, মন্ত্রীসহ অভিযুক্ত ওই তিন ব্যক্তির আর্থিক লেনদেন, ব্যাংক ব্যালেন্সের তদন্ত করা। এটি যদি দুদক করতে না পারে, তাহলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে থাকবেই। দুদক যদি নিরপেক্ষভাবে এবং প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের স্বার্থেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি তদন্ত করে, আমার বিশ্বাস দুদক তার গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাবে। সরকারেরও উচিত দুদককে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেয়া। ষষ্ঠ. দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ বড় ধরনের ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে। মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে টাকা পাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ মার্কিন কংগ্রেসম্যান জোসেফ ক্রাউলি। এর আগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা সরকারের জন্য কোন ভালো খবর নয়। এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে সরকারপ্রধান ভালো কাজটিই করলেন। সরকারপ্রধান যদি এখন সব সেক্টরে দুর্নীতি নির্মূলের নির্দেশ দেন, তাহলে তাতে তার নিজের ও সরকারের জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে। সপ্তম. তথাকথিত 'ঘুষ কেলেংকারির' দায় নিয়ে একজন মন্ত্রী পদত্যাগ করলেন। তখন সরকারপ্রধানের উচিত সব মন্ত্রীর ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া। মন্ত্রীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব জমা দেয়ার ওয়াদা তিনি করেছিলেন। এই সুযোগে তিনি তা সংগ্রহ করতে পারেন। প্রয়োজনে তা জাতীয় সংসদেও উপস্থাপন করা যায়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার একটা দৃষ্টান্ত প্রধানমন্ত্রী সৃষ্টি করতে পারেন। অষ্টম. রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে অন্য মন্ত্রীরাও সতর্ক হতে পারেন। এ ধরনের 'একজন ওমর ফারুক' কিংবা 'একজন ইউসুফ আলী মৃধা' প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়েই আছে। অনেক সময়ই তারা মন্ত্রীদের 'ব্ল্যাকমেইলিং' করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়। প্রায় ক্ষেত্রেই ওইসব ওমর ফারুকরা ধরা পড়েন না। মন্ত্রী বাহাদুররা যত বেশি সতর্ক হবেন, ততই মঙ্গল। নয়. মন্ত্রীদের এপিএস থাকাটা জরুরি। এসব এপিএস সাধারণত মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হন (ওমর ফারুকের সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সম্পর্ক প্রায় ২০ বছরের)। তারা ছাত্র তথা দলের যুব সংগঠনের সদস্য। তারা সরকারি কর্মচারী নন। এক্ষেত্রে সরকারি ক্যাডারদের এ পদে আনা যায় কিনা, তা বিবেচনা করা যেতে পারে। নতুবা এপিএসদের জন্য নতুন একটি ক্যাডার পদও সৃষ্টি করা যেতে পারে। দশ. ঘুষ কেলেংকারির ঘটনায় বিজিবি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। বিজিবি প্রধানের বক্তব্যও প্রশ্নবিদ্ধ। অবৈধ টাকা পাওয়ায় অভিযুক্তদের পুলিশের কাছে টাকাসহ হস্তান্তর করাই ছিল আইনি কাজ। এ কাজটি বিজিবি করেনি।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনকে কলংকিত করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। এটা বাংলাদেশে নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জন্য তা কোন ভালো খবর নয়। তিনি যদি রাজনীতিতে থাকেন, আজীবন তাকে এই ঘুষ কেলেংকারির ঘটনা তাড়া করবে। প্রতিপক্ষরা এটাই ইস্যু করবে। আর তিনি যদি 'অবসর' নেন এবং আগামীতে একজন 'জাতীয় অভিভাবক' হিসেবে জাতিকে দিকনির্দেশনা দেন, তিনি ভালো করবেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল অহেতুক কোন বিতর্কে জড়িয়ে পড়-ক, আমরা তা চাই না। এটা নিয়ে রাজনীতি উত্তপ্ত হোক, এটাও কাম্য নয়।
Daily JUGANTOR, 17.4.12

একটি সিদ্ধান্ত ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন


বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে সামনে রেখে তাই কয়লানীতি দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। মনে রাখতে হবে বিদ্যুৎ নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। বিরোধী দল এটাকেও ইস্যু করতে পারে। তাই একটি সুষ্ঠু নীতিমালার আওতায় কয়লা উত্তোলনের প্রক্রিয়া যদি আমরা শুরু করি, আমার বিশ্বাস বিদ্যুতের অনেক চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারব। ইতোমধ্যে কয়লানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মতামতও দিয়েছেন। ২০০৭ সালের ১১ জুন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। তাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন রপ্তানির সুযোগ না রাখা দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিধান রাখা হয়েছিল।ড. তারেক শামসুর রেহমান বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তাদের মতে দেশে প্রচুর কয়লা মজুদ আছে। এ কয়লা উত্তোলন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগাতে হবে। গ্যাসের ওপর চাপ কমাতে হবে। স্থায়ী কমিটির এই সিদ্ধান্তটি ছাপা হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে গত ২২ মার্চ। বিদ্যুতের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে করে স্থায়ী কমিটির ওই সিদ্ধান্তটি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে না। বর্তমানে সারাদেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন আড়াইশ কোটি ঘনফুট। অথচ সরবরাহ করা হচ্ছে ২০৬ কোটি ঘনফুট। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই কয়লা নিয়ে ভাবনাটা জরুরি। বিদ্যুৎ আমাদের প্রয়োজন। সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এখন বিদ্যুৎ শীর্ষে থাকা উচিত। গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে এবং নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্রও আবিষ্কৃত হচ্ছে না। সুতরাং গ্যাসনির্ভর যে বিদ্যুৎকেন্দ্র, তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই ভরসা এখন কয়লা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৫টি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্বিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন, যা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য (উত্তোলনযোগ্য ২০ টিসিএফ ১)। এতে ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি চাহিদা পূরণ সক্ষম। উত্তরাঞ্চলের বড়পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে কয়লা পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই কয়লা উত্তোলনের ব্যবস্থা না করে সরকার ভারত থেকে কয়লা আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের সাথে পিডিপির একটি চুক্তি সাম্প্রতি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারতীয় কয়লায় চট্টগ্রাম ও খুলনায় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশের কয়লা দিয়েই আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি চালাতে পারতাম। আমাদের নিম্নমানের ভারতীয় কয়লার প্রয়োজন হতো না। বাংলাদেশ থেকে ৫টি কয়লাখনি আবিষ্কৃৃত হয়েছে। (মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়নটন), যা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য (উত্তোলনযোগ্য ২০ টিসিএফ) বড় পুকুরিয়া ছাড়াও জামালগঞ্জে ৭টি কয়লাস্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়লা এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার এবং মোট আনুমানিক মজুদের পরিমাণ ১০৫৩ মিলিয়ন টন এখানে কয়লা স্তরের গভীরতা বেশি হওয়ায় তা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক হবে কিনা, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। ফলে এ মজুদের উন্নয়নের কাজ আরম্ভ হয়নি। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কয়লাখনি বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখানে কয়লা মজুদের পরিমাণ ৫৭২ মিলিয়ন টন। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তা এশিয়া এনার্জি করপোরেশন বাংলাদেশ। খনির মেয়াদকালে মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। ফুলবাড়ী কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলার কথা, যা ইতোমধ্যে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ খনিতে বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১৫ মিলিয়ন টন। এই কয়লা খনির দৈর্ঘ ৮ কিলোমিটার (উত্তর-দক্ষিণে) এবং প্রস্থ ৩ কিলোমিটার (পূর্ব-পশ্চিমে)। এই খনিটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬৫ থেকে ২৭০ মিটার গভীরে অবস্থিত। এইসব কয়লা খনি নিয়ে আমাদের দেশে একটি বড় বিতর্ক চলছে আর তা হচ্ছে কয়লা আমরা তুলব কীভাবে? ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে, নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে? উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড বা ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ। এতে ঝুঁকিও বেশি। বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা। অল্প জমিতে প্রচুর মানুষ বাস করে। সমস্যা হচ্ছে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তুলতে হলে অনেক জমি হারাবেন। ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫ হাজার ৯৩৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহরের প্রয়োজন হবে, এর প্রায় ৮০ শতাংশই কৃষি জমি। প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে প্রকল্পকালে প্রায় ২ হাজার ৩০০ আদিবাসীসহ প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে স্থানান্তর ও পুনর্বাসিত করতে হবে। এই কাজটি ১০ বছরের মধ্যে সম্পাদন হবে। এখানে ১০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ চালু হলে প্রতিবছর জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ সংযোজন হতে পারে। প্রকল্প মেয়াদকালে জিডিপিতে অবদান রাখবে প্রায় ২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ফুলবাড়ীর জনগণ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিরোধিতা করে আসছে সেই প্রথম থেকেই। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সাথে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ৬ জন মানুষ। এশিয়া এনার্জির সাথে যে চুক্তি হয়েছিল, তারও বিরোধিতা করছে একটি জাতীয় কমিটি। ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলন নিয়ে যে জটিলতা, সেই জটিলতা এখনো দূর হয়নি। এমনি এক সময় স্থায়ী কমিটি দ্রুত কয়লা উত্তোলন করে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পক্ষে মতামত দিলেন। কিন্তু তা না করে ভারত থেকে কয়লা আমদানি করে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা ভবিষ্যতে একটি সঙ্কট তৈরি করতে পারে। আগামীতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যদি অবনতি ঘটে, তাহলে এই কয়লা আমদানির ওপর এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা নিয়েও কথা রয়েছে। প্রথমত, ভারত ওই দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন হতো তা আমরা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে পারতাম কিনা? তৃতীয়ত, চুক্তিতে যেসব শর্ত রাখা হয়েছে, তা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূলে কিনা? চতুর্থত, ভারতীয় ঋণ করার প্রক্রিয়াটি কী? পঞ্চমত, যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে কোনো তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি রয়েছে কিনা? আমি জানি না সংসদের স্থায়ী কমিটি এসব বিষয় আদৌ বিবেচনায় নিয়েছিলেন কিনা? তবে স্বচ্ছতার স্বার্থেই সরকারের উচিত ছিল চুক্তিটি সংসদে উপস্থাপন করা। তাতে করে আমরাও বিস্তারিত জানতে পারতাম এবং সরকারও তার কাজের জন্য স্বচ্ছ থাকতে পারত। সংসদে চুক্তিটি উপস্থাপিত না হওয়ায়, বিতর্ক থেকেই গেল। আমরা অবশ্যই কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই। সারা বিশ্বে যেখানে ৪০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে (অস্ট্রেলিয়ায় ৭৯ শতাংশ, চীনে ৭৮ শতাংশ, ভারতে ৬৯ শতাংশ) সেখানে আমাদের অবশ্যই কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়া উচিত। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে সামনে রেখে তাই কয়লানীতি দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। মনে রাখতে হবে বিদ্যুৎ নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। বিরোধী দল এটাকেও ইস্যু করতে পারে। তাই একটি সুষ্ঠু নীতিমালার আওতায় কয়লা উত্তোলনের প্রক্রিয়া যদি আমরা শুরু করি, আমার বিশ্বাস বিদ্যুতের অনেক চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারব। ইতোমধ্যে কয়লানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মতামতও দিয়েছেন। ২০০৭ সালের ১১ জুন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। তাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন রপ্তানির সুযোগ না রাখা দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিধান রাখা হয়েছিল। ওই রিপোর্টটিকে বিবেচনায় নিয়েই প্রয়োজনে কিছু সংযোজন ও বিয়োজন করে নতুন একটি কয়লানীতি আমাদের দরকার। মনে রাখতে হবে বিদ্যুতের প্রাপ্তি শুধু আমাদের ব্যক্তিগত জীবনই নয়, বরং আমাদের উন্নয়নের সাথেও সম্পর্কিত। Daily Jai Jai Din, 16.4.12