রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

প্রণব মুখার্জির কাছে আমাদের প্রত্যাশা



ভারতে এই প্রথমবারের মতো একজন বাঙালি রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই ইউপিএ সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে প্রণব মুখার্জি এবং বিজেপি সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে পিএ সাংমা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে প্রণব বাবুই যে রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন তা প্রায় নিশ্চিত। একজন বাঙালি হিসেবে এতে আমার গর্ব হওয়ার কথা। কিন্তু একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমার গর্বের জায়গাটা খুবই সীমিত। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সমস্যা একাধিক। বাঙালি রাষ্ট্রপতির আমলে এসব সমস্যার সমাধান হবে- এটা আমরা আশা করতেই পারি। সমস্যাগুলোর ব্যাপারে প্রণব বাবু জানেন ও বোঝেনও।
তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারটি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। চুক্তি হচ্ছে না। এ-সংক্রান্ত কোনো দিকনির্দেশনা না থাকলেও, বিবিসির বাংলা বিভাগ (৯ মে) আমাদের জানাচ্ছে যে তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে আদৌ কোনো চুক্তি হচ্ছে না। এ কথাটা নাকি দীপু মনিকে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। যদিও দীপু মনি তা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন অবধি কোনো চুক্তি হয়নি। এখানে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই। কিন্তু ভারত আমাদের সেই অধিকার নিশ্চিত করছে না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও ভারত আমাদের বারবার মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একাধিকবার বলেছেন, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? নয়াদিল্লিতে ইতিমধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সেখানে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার। প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপিও ব্যয় করা হয়ে গেছে। বাঁধটি যদি নির্মিত হয়, তাতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হবে, তা একাধিক সেমিনারে আলোচিত হয়েছে। এখানে আমাদের ব্যর্থতা, আমরা শক্ত অবস্থানে যেতে পারছি না। জেসিসির যৌথ ইশতেহারে এ-সংক্রান্ত কোনো কথা বলা হয়নি। গঙ্গা চুক্তি আমরা করেছিলাম ১৯৯৬ সালে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। এর আগেই পদ্মায় পানি নেই। চুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি না। ২০২৭ সালে লোকসংখ্যা বাড়বে তিন গুণ। যে বিপুল পানির চাহিদা থাকবে, তার কী হবে? চুক্তি অনুযায়ী পর্যালোচনার সুযোগ আছে। কিন্তু সেই সুযোগটি আমরা নিচ্ছি কই? অতীতে কখনো আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি। সীমান্ত হত্যা আজো বন্ধ হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও একের পর এক সীমান্ত হত্যা হচ্ছে। এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই, যেখানে বিজিবির গুলিতে কোনো ভারতীয় নাগরিক মারা গেছেন। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন নিরপরাধ বাংলাদেশি নাগরিকরা। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৪০ মাসে কতজন বাংলাদেশি মারা গেছেন, তার পরিসংখ্যান 'অধিকার'-এর কাছে আছে। এ নিয়ে কত শীর্ষ বৈঠক হলো। কিন্তু হত্যা বন্ধ হয়নি। প্রণব বাবু যখন ঢাকায়, তখনো এটা নিয়ে কিছু বলা হলো না। সীমান্ত চিহ্নিত ও অপদখলীয় ভূমির ব্যাপারেও প্রণব বাবু মুখ খোলেননি ঢাকায়। গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ব্যাপারে আমরা কিছুই শুনলাম না। ভারতের ভেতরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা ভারতেই থাকতে চান। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ভেতরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবেই থাকতে চান। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই ১৯৭৪ সালে। তারপর কখনোই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগ নেয়নি সংবিধান সংশোধন করার। সমস্যাটা তো আমাদের নয়। সমস্যাটা ভারতের। আজ প্রায় ৩৮ বছর পরও এ কথাগুলো আমাদের বলতে হয়। এতে করে কি ভারতের সদিচ্ছা প্রমাণ করে? ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। প্রণব বাবু ঢাকায় এসে ২০ কোটি ডলার অনুদানের কথা বলে গেলেন। কিন্তু ঋণের টাকা দিয়ে তো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না? ১৩ প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার অভাবে প্রকল্পগুলো আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে। আর ২০১১-১২ সালের পরিসংখ্যান যখন আমাদের হাতে আসবে, ধারণা করছি তা চার মিলিয়ন ডলারের অঙ্ককে ছাড়িয়ে যাবে। ভারত মাঝেমধ্যে কিছু পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা বলে বটে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ এসব পণ্যের অনেকগুলোই রপ্তানি করে না। ভারতের অশুল্ক বাধা দূর করা নিয়েও 'নানা কাহিনী' আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নানা ধরনের শুল্ক দূর করা যাচ্ছে না। ফলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি সেই তুলনায় বাড়ছে না। শুধু ঘাটতিই বাড়ছে। এটা আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি নিয়ে আদৌ কোনো অগ্রগতি নেই। কিন্তু ২০১৩ সালে আমরা আদৌ বিদ্যুৎ পাব- এ ব্যাপারটিতে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। বাংলাদেশ বড় ধরনের বিদ্যুৎ সংকটের মুখে। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন বন্ধ অনেক কারখানায়। অথচ ভারত যদি আন্তরিক হয়, তাহলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব। ভুটানে সারপ্লাস বিদ্যুৎ রয়েছে। এই বিদ্যুৎ ভুটান বাংলাদেশে রপ্তানি করতে পারে। এ জন্য সম্মতি প্রয়োজন ভারতের। কিন্তু ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়নি। আশুগঞ্জে যে কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে, তাতে লাভবান হবে ভারত। আমরা লাভবান হব না। ভারত তার পণ্যের পরিবহন সুবিধার জন্যই এই টার্মিনাল ব্যবহার করছে। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে আমরা ভারতীয় কনটেইনারগুলো পরিবহনের সুযোগ করে দিয়েছি। ভারত প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আমাদের স্বার্থ হয়ে পড়েছে গৌণ। আজ জেসিসির বৈঠকের পর যৌথ ইশতেহারে যেসব বক্তব্য স্থান পেয়েছিল, তাতে ওই ভারতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রণব বাবু ঢাকায় এসে আমাদের স্বার্থে কোনো কথা বলে গেলেন না।
বাংলাদেশিরা খুবই অতিথিপরায়ণ। সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছিল, প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে পায়েস রান্না করে তাঁকে খাইয়েছিলেন। কত আন্তরিক হলে আমাদের সরকারপ্রধান এই কাজটি করতে পারেন! আর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো নয়াদিল্লিতে পদ্মার ইলিশ, মিষ্টি আর সিরামিকের উপহারসামগ্রী নিয়ে গিয়েছিলেন। এটা তো মিথ্যা নয়। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর 'ইলিশ কূটনীতি' কি আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছে? আমরা কি আমাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে পেরেছি? আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে দেয়, আমাদের প্রাপ্তি খুব বেশি নয়। আমরা বারবার আশ্বাস পাচ্ছি। ভারতের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। ভারতীয় নেতাদের সেই আশ্বাস আর পূরণ হয় না। কিন্তু ভারত ইতিমধ্যে তার ষোলআনাটা বুঝে নিয়েছে। আজ একটি সুযোগ এসেছে আমাদের জন্য। যদিও ভারতীয় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খুবই সীমিত। নীতিনির্ধারণীতে রাষ্ট্রপতির কোনো ভূমিকা নেই। তিনি হবেন আলংকারিক প্রধান। তবু প্রণব মুখার্জি বলে কথা। যিনি ভারতীয় রাজনীতিতে 'চাণক্য' হিসেবে পরিচিত, তাঁর একটি 'উপদেশ' বা 'পরামর্শ' মন্ত্রীরা গ্রহণ করবেন- এটা আমরা আশা করতেই পারি। আজ যা উপলব্ধি করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক যদি আরো উন্নত হয়, তাহলে তা ভারতের জন্যই মঙ্গল। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ব্যাপারে ভারতের যে নীতি, তাতে পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশকে 'বন্ধু' ভাবতে হবে। প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের জনগণের 'বন্ধু'। আমরা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।Daily KALERKONTHO01.7.12

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক

অতি সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ব্যাপক হারে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এই রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কের অবনতি হবে কী-না? এমনিতেই দুদেশের মাঝে সম্পর্ক যে উষ্ণ রয়েছে, তা বলা যাবে না। গত মে মাসে তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাদে ওআইসির উদ্যোগে শরণার্থীবিষয়ক একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা সমস্যাটি তুলে ধরেছিলেন। তিনি সম্মেলনে অভিযোগ করেছিলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এর প্রতিক্রিয়ায় কী-না তা বলতে পারব না। কিন্তু বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা সমস্যাটা আন্তর্জাতিক আসরে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়, ঠিক তার দুই সপ্তাহ পরেই গত ৩ জুন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুনরায় জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। এই জাতিগত সহিংসতায় ইতিমধ্যে সেখানে প্রায় ৫২ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। যদিও সেখানে এই জাতিগত সহিংসতার ইতিহাস আজকের নয়। বরং বেশ পুরনো। মূলত সেখানে বসবাসকারী কয়েক লাখ মুসলমান, যারা রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয় না। ১৯৭৮ ও ১৯৯১ সালে এ ধরনের জাতিগত সহিংসতায় ব্যাপক হারে রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। কক্সবাজার এলাকায় এসব রোহিঙ্গা নানা রকম অবৈধ কর্মকা-ে লিপ্ত। দু-দুটো ক্যাম্পে এরা বসবাস করে। জাতিসংঘের উদ্যোগে পরিচালিত এই দুটো ক্যাম্পে রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গার সংখ্যা ২৮ হাজার। কিন্তু এর বাইরে আরো প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করছে। স্পষ্টতই বাংলাদেশ আর অতিরিক্ত রোহিঙ্গা গ্রহণ করতে পারে না। অবৈধ রোহিঙ্গারা আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বিনীতভাবে পশ্চিমা বিশ্বের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেন বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয় রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করা, তখন তিনি সঠিক কাজটিই করেছেন। বাংলাদেশ আর রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে পারে না। এতে করে দুদেশের সম্পর্কে একটা ভুল বোঝাবুঝির যেন সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। আগামী জুলাই মাসে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বাংলাদেশ সফরে আসছেন। সেটাও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাসী। কিন্তু ভারতের দ্বিপাক্ষিকতার কারণে আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির বহুপাক্ষিকতার চরিত্র হারিয়ে ফেলেছি। ফলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি না নেয়ার কারণে। অথচ চীন, থাইল্যান্ড এবং ভারতও এই জ্বালানি সম্পদকে ব্যবহার করছে। প্রতিবেশী দেশ হওয়ার কারণে আমাদের সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা থাকলেও, আমরা এ ব্যাপারে গত তিন বছরে কোনো উদ্যোগ নেইনি। মিয়ানমার চট্টগ্রাম সীমান্তে সারকারখানা স্থাপন করে মিয়ানমারের বিপুল সারের চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারতাম। কিন্তু তা হয়নি। মংডুর আশপাশে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এর ভিত্তিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিলেট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারত, সঠিক দিকনির্দশনার অভাবে তা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও আমরা উৎসাহিত করিনি। আমরা বেসরকারি উদ্যোগ আফ্রিকায়ও জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদের উদ্যোগ নিয়েছি। অথচ পাশের দেশে রয়েছে প্রচুর অনাবাদি জমি। মিয়ানমার জমি 'লিজ' দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও, আমাদের নীতি প্রণেতারা বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি। এমনকি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও উৎসাহিত করেননি। অতি সম্প্রতি ভারত থেকে তুলা আমদানি নিয়ে একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ মিয়ানমারের কয়েকটি অঞ্চলে প্রচুর তুলা উৎপন্ন হয়। আমরা কখনো ওই তুলার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাইনি। এমনকি ওই অঞ্চলে প্রচুর ভুট্টা চাষ হয়। মিয়ানমারে প্রচুর গবাদিপশু উৎপাদন হয়, যা কী-না আমাদের চাহিদা মেটাতে পারে। যৌথভাবে গবাদিপশুর ফার্ম তৈরি করাও সম্ভব। মিয়ানমারে প্রচুর বিদেশি পর্যটক আসেন। এরা যাতে বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আসেন কিংবা সদূর সুন্দরবনে এদের নিয়ে যাওয়া যায় কী না, আমাদের ট্যুর অপারেটররা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। কুনমিং মুসে-ঘুমধুম সড়ক আমাদের জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে বটে, কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সড়ক যোগাযোগের জন্য 'মৈত্রী সড়ক' এর কাজ শুরু হয়েছিল বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়। এই সড়কে বেশকটি সেতু নির্মাণ করার কথা, যা কী না বাংলাদেশ তার নিজের অর্থায়নে করবে। কিন্তু ওই 'মৈত্রী সড়ক' এর কোনো খবর আমরা জানি না। অথচ ভারতকে ট্রানজিট দিতে আমরা অনেক রাস্তা সংস্কার করেছি। এমনকি তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতীয় ২৮ চাকার যান চলাচলের সুযোগ আমরা করে দিয়েছি। অথচ 'মৈত্রী সড়ক' দ্রুত সম্পন্ন করার তেমন কোনো উদ্যোগ আমাদের নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রয়োজনে আমরা মিয়ানমারকে গুরুত্ব দেইনি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার 'বিমসটেক' এর সদস্য। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশি পণ্যের বাজারই আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর জন্য উন্মুক্ত করবে না, বরং আসিয়ানের সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আসিয়ানের 'ডায়লগ পার্টনার' এর মর্যাদা পেতে সাহায্য করবে। বলা ভালো, ভারত ইতিমধ্যে 'ডায়লগ পার্টনার' এর মর্যাদা পেয়েছে। মিয়ানমার আসিয়ানের সভাপতির দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে আগামী বছর। এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। বহির্বিশ্বে মিয়ানমারের যে 'বদনাম' ছিল, তা ইতিমধ্যে কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। গণতন্ত্রী নেত্রী সুচির সঙ্গে সেইন সেইন প্রশাসনের সম্পর্ক এখন ভালো। সুচি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। জেনারেল সেইনস নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্ক আগের মতো নেই। মিয়ানমারের বিপুল জ্বালানি সম্পদের সম্ভাবনা মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে মিয়ানমারের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে। বলতে বাধা নেই, মিয়ানমার আর আগের অবস্থানে নেই। ওখানে ভারতের ভূমিকা লক্ষ্য করার মতো। ভারত তার জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনেই মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এ ক্ষেত্রে সুচির গণতান্ত্রিক আন্দোলন কখনই প্রধান্য পায়নি। ভারত বহির্বিশ্বে সুচির মুক্তির ব্যাপারেও তেমন কোনো আন্দোলন গড়ে তোলেনি। মিয়ানমার সরকারের ওপর কোনো 'প্রেসার'ও সৃষ্টি করেনি। কেননা মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে সুচির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশ ভারতের এই 'এপ্রোচ' থেকে শিখতে পারে অনেক কিছু।
ঢাকায় নিযুক্ত নয়া চীনা রাষ্ট্রদূত লি জুন একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন গত ১৯ মার্চ। তিনি বলেছেন, চীন এ অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটি মেনে নেবে না। ক্রমবর্ধমান ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্তব্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এ অঞ্চলে মার্কিন কর্তৃত্ব ও প্রভাব বাড়ছে। মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের আওতাধীন এই অঞ্চল। তথাকথিত 'সন্ত্রাসী কর্মকা-' দমনে এ অঞ্চলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মার্কিন সেনার উপস্থিতি রয়েছে, যা দৃশ্যমান নয়। তবে যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন, এ অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতির উদ্দেশ্য একটাই_ আর তা হচ্ছে, ধীরে ধীরে 'চীনকে ঘিরে ফেলা'। যুক্তরাষ্ট্রের এই স্ট্রাটেজি স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়কার 'কনটেইনমেন্ট পলিসি'র কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই চীন এ ধরনের কোনো 'চাপ' এর কাছে নতি স্বীকার করবে না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কারণে স্বাভাবিকভাবে দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বলয়ে বাংলাদেশ যদি প্রবেশ করে, তাহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চীন তথা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি 'ফ্রন্ট' গড়ে তোলাই হচ্ছে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মূল উদ্দেশ্য। বিদেশের সংবাদপত্র তথা বস্নগে বাংলাদেশের সম্ভাব্য এই ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ও ওআইসির সম্মেলনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়া, একই সূত্রে গাঁথা। এতে করে বাংলাদেশ লাভবান হবে না। বাংলাদেশের এই ভূমিকা মিয়ানমার খুব ভালো চোখে দেখবে বলে মনে হয় না। রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য অবশ্যই একটি সমস্যা। নানা সামাজিক সমস্যা তারা সৃষ্টি করছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) আশাবাদে যৌথভাবে এই সম্মেলন আয়োজন করলেও, অতীতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে ইউএনএইচসিআরের ভূমিকা ইতিবাচক ছিল না। তারা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আজো তারা রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বলছে। বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার জন্য। আমরা তা পারি না। এরা আমাদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের উসকে দিচ্ছে। এদের মাঝে ইসলামিক জঙ্গিরাও রয়েছে। আমরা চাই না বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত রোহিঙ্গাদের কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠুক। এতে করে দুদেশের মাঝে সম্পর্কের অবনতি হতে বাধ্য। আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে দিতে পারি না। তাই রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করতে না দিয়ে বাংলাদেশ সঠিক কাজটিই করেছে। তবে রোহিঙ্গারা যেহেতু এখনো প্রবেশের চেষ্টা করছে সে কারণে বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের যাতে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেয়া হয়, এ ব্যাপারেও বাংলাদেশের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
Daily DESTINY
27.6.12

কোন পথে মিসর

শেষ পর্যন্ত সকল অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে মিসরে মোহাম্মদ মুরসিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হলেও অনেক প্রশ্নের জবাব এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে পাওয়া যায়নি। একটা অনিশ্চয়তা ছিল কাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হবে, তা নিয়ে। কেননা দু’জন প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি এবং মোহাম্মদ শফিক দু’জনই বিজয়ী হয়েছেন বলে দাবি করেছিলেন। কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রের কিছু অনিয়ম নিয়ে অভিযোগও ছিল। এরপর নির্ধারিত তারিখে যখন ফলাফল ঘোষণা করা হল না, তখন সৃষ্টি হয়েছিল অনিশ্চয়তার। আবারও তেহরির স্কয়ারে (কায়রো) সমবেত হতে শুরু করল বিপ্লবীরা। এমনি এক পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ সেনা পরিষদ মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর পরপরই মুরসিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই ঘোষণা সব প্রশ্নের জবাব দেয় না। মিসরে বিকাশমান গণতন্ত্র নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে এবং আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে সত্যিকার অর্থেই মিসর কোন দিকে যাচ্ছে। যে প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সর্বোচ্চ সেনা পরিষদের সঙ্গে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে। সর্বোচ্চ সেনা পরিষদ কার্যত একটি ‘সুপার কেবিনেট’ হিসেবে কাজ করছে। এই সেনা পরিষদে ৩০ জন সদস্য রয়েছেন, যারা শীর্ষ সেনা কমান্ডার। তারা অলিখিতভাবে অগাধ ক্ষমতা ভোগ করছেন। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তারা যা বলবেন, সেটাই আইন। অনেকেই জানে সর্বোচ্চ সেনা পরিষদ মিসরের নয়া সংবিধানে সেনাবাহিনীর জন্য একটি ভূমিকা দাবি করে আসছে। এই সেনা জান্তা কিছুদিন আগে কতগুলো ডিক্রি জারি করে। ওইসব ডিক্রিতে প্রেসিডেন্টের ভূমিকা কমানো হয়। ডিক্রিতে বলা হয়েছে-সেনা বাজেট, সেনা নেতৃত্ব কিংবা যুদ্ধ শুরু করার ব্যাপারে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এমনকি খসড়া সংবিধান চূড়ান্ত করার আগে সর্বোচ্চ সেনা পরিষদের অনুমোদন নিতে হবে এবং তা তিন মাসের মধ্যে গণভোটে পাস করাতে হবে। সেনা পরিষদ নির্বাচিত পার্লামেন্টকেও বাতিল ঘোষণা করেছিল। সর্বোচ্চ সেনা পরিষদের এই ভূমিকা স্পষ্টতই তাদেরকে বিতর্কিত করেছে। তারা একটি সাংবিধানিক অধিকার চাচ্ছেন এবং এটা যদি স্বীকৃত হয়, তাহলে প্রশাসনে ‘দ্বৈত প্রশাসনিক ক্ষমতা’র জন্ম হবে। একদিকে প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে একটি প্রশাসন, যেখানে একজন প্রধানমন্ত্রী ও কেবিনেট প্রেসিডেন্টকে সহযোগিতা করবেন। অন্যদিকে সর্বোচ্চ সেনা পরিষদের নেতৃত্বে একটি অদৃশ্যমান ‘সুপার কেবিনেট’, যারা কোনো কোনো বিষয়ে তাদের ভেটো প্রয়োগ করবে। এই সেনা পরিষদ একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নামও ঘোষণা করেছে। এর আগে নির্বাচিত সংসদ যে কমিটি গঠন করেছিল, তা সেনা পরিষদ বাতিল ঘোষণা করেছিল। এখন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কী করবেন? একদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা। মোহাম্মদ মুরসির জন্য বিষয়টি যে খুব সহজ হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। দ্বিতীয়ত, মোহাম্মদ মুরসি কি ইসলামের শরিয়াভিত্তিক একটি সমাজ বিনির্মাণের উদ্যোগ নেবেন মিসরে? তার দল ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস’ পার্টি। ইসলামিক ব্রাদারহুড একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে। মুরসি কি এদিকে মিসরকে চালিত করবেন? এই মুহূর্তে এটি স্পষ্ট নয়। তবে মুরসি অতটা কট্টরপন্থী নন। তিনি ইসলামপন্থী। তিনি ইসলাম আর গণতন্ত্রকে এক কাতারে দেখতে চান। আর এ কারণে তিনি ‘ইসলামিক গণতন্ত্র’র কথা বলছেন। সম্ভবত মিসর ‘তুরস্ক মডেল’ অনুসরণ করবে। তুরস্কে ইসলামপন্থীরা জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছেন। তুরস্কের সেনাবাহিনী ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের অনুসারী। মিসরের সেনাবাহিনীও অনেকটা তাই। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তুরস্কের ক্ষমতাসীন এরদোগান সরকারের দ্বন্দ্বের কথা সবাই জানেন। সেনাবাহিনী এখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। যে কারণে সেখানে সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা কম। মুরসি এমনটি চাইবেন মিসরের জন্য। এ ক্ষেত্রে তিনি কতটুকু সফল হবেন তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। তৃতীয়ত, ইসরায়েলের ব্যাপারে নয়া প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। কেননা ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতির কারণে সমগ্র আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক কখনও ভালো হয়নি। ১৯৭৮ সালে মিসরের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও এ সম্পর্ক কখনই উন্নত হয়নি। এমনকি কট্টরপন্থীদের হাতে মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছিল, যদিও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মুরসিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং নয়া প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন তিনি সকল চুক্তির প্রতি সম্মান জানাবেন। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। কেননা ব্রাদারহুডের নেতৃত্ব এখনও পরিপূর্ণভাবে ‘ইসরায়েল বিরোধিতা’ থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। তারা যে প্রেসিডেন্টকে প্রভাব খাটাবেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
এখানেই এসে যায় ‘রিয়েল পলিটিক্স’-এর বিষয়টি। মুরসি এই রিয়েল পলিট্রিক্স’ কতটুকু অনুসরণ করেন, সেটাই দেখার বিষয়। তবে আমি মোহাম্মদ মুরসির সাম্প্রতিক দেওয়া বক্তব্যে আশাবাদী। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি একটি জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি এই মুহূর্তে খুবই জরুরি। কেননা মিসর এখন একটি ‘বিভক্ত’ সমাজ। একদিকে রয়েছে ইসলামিক কট্টরপন্থীরা, অন্যদিকে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মোবারক সমর্থকরা। ২০১১ সালে তেহরির স্কয়ারের ১৭ দিনের ‘বিপ্লব’ নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল মিসরে। দীর্ঘ ১৭ দিন দখলে রেখেছিল ‘বিপ্লবীরা’। মূলত তরুণরাই এই বিপ্লবের নায়ক। এরা সবাই যে ইসলামিক আদর্শকে পছন্দ করেন, তা নয়। তারা   মোবারকের অপশাসন (১৯৮১ সাল থেকে ক্ষমতায় ছিলেন) থেকে মিসরকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ওই তরুণরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে বিপ্লবকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ মুরসিকে সমর্থন করেছেন, এটা সত্যি। কিন্তু মিসর ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্র হোক, এটি তারা চাইবে না। মিসর বিপ্লবে নারীরা একটা বড় ভূমিকা রেখেছেন। সেনাবাহিনীর হাতে অনেক তরুণী নিগৃহীতও হয়েছিলেন। এরা নিশ্চয়ই চাইবেন না মিসরে নারীদের অধিকার সঙ্কুুচিত হোক, বাধ্যতামূলক পর্দাপ্রথা আরোপ করা হোক। মিসরের নারীরা যথেষ্ট স্বাধীন। তারা আধুনিকমনস্ক। পূর্ণ পর্দাপ্রথা তারা অনুসরণ না করলেও শালীনতা তারা বজায় রেখে চলেন। নয়া নেতৃত্ব নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি করেন। মিসরের সংখ্যালঘু ‘কপটিক খ্রিস্টান’রা কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত। আশঙ্কা করছেন তারা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। সম্ভবত এটা উপলব্ধি করেই নয়া প্রেসিডেন্ট অঙ্গীকার করেছেন নতুন সরকারে ‘কপটিক খ্রিস্টান’দের প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং নয়া প্রধানমন্ত্রী হবেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। মুরসি বাস্তববাদী। তিনি সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছেন। তিনি আধুনিকমনস্ক একজন মানুষ। প্রকৌশল বিদ্যায় আমেরিকা থেকে ডক্টরেট ডিগ্রিও নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। তার রাজনৈতিক জীবন মাত্র ১২ বছরের। দীর্ঘ ৮৪ বছরের একটি সংগঠনের (ইসলামিক ব্রাদারহুড) প্রতিনিধি তিনি। দলে কট্টরপন্থী, উগ্র ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাসী এবং শরিয়া আইনভিত্তিক একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লোক অনেক রয়েছে। এদের ‘চাপ’ও থাকবে তার ওপর। এই ‘চাপ’ উপেক্ষা করে ইসলামিক আদর্শ ও গণতন্ত্রকে একত্রিত করে ‘নতুন এক মিসর’ কীভাবে তিনি জন্ম দেন, সেটাই দেখার বিষয়।
আরব বিশ্বে যে বসন্তের ঢেউ বইছিল, তা এখন দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রম করছে। তিউনিসিয়ার পর মিসরে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের উচ্ছেদের পর জনগণের ভোটে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাসীন হয়েছেন। এটা বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তর। তৃতীয় স্তরে হয় কট্টরপন্থীরা ক্ষমতা নেবেন, নতুবা আধুনিকমনস্ক ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করবেন। এই মুহূর্তে মিসরে মুরসির জন্য সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ পাঁচটি। এক. সেনাবাহিনীর পূর্ণ আস্থা অর্জন করা। সর্ব্বোচ্চ সেনা পরিষদের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে যাওয়া। দুই. সেনাবাহিনীকে একধরনের সাংবিধানিক অধিকার দেওয়া। সংবিধানে এই অধিকার না দেওয়া হলেও পরোক্ষভাবে এই অধিকার তিনি দিতে পারেন। তিন. একটি সাংবিধানিক পরিষদ গঠন ও একটি নয়া সংবিধান প্রণয়ন করা। চার. সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। পাঁচ. ইসরায়েলসহ দাতা দেশগুলোর আস্থা অর্জন করা। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি ঘোষণা করেছেন ‘ঞযব ত্বাড়ষঁঃরড়হ পড়হঃরহঁবং ঁহঃরষ বি ধপযরবাব ধষষ ড়ঁত্ ধরসং’. অর্থাত্ বিপ্লব চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করি। যদিও মুরসি ‘লক্ষ্য’গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়। নিঃসন্দেহে মুরসির বিজয়ের মধ্য দিয়ে নতুন এক ইতিহাস রচিত হয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়।
Daily SAKALER KHOBOR
26.6.12

কেন বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে পারে না


মিয়ানমারে প্রেসিডেন্ট থেইন মেইন'র নেতৃত্বাধীন একটি সরকার যখন পশ্চিমা বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং সেখানকার বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সুচিকে দীর্ঘ ২১ বছর পর যখন প্রথমবারের মতো ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হলো, তখন রোহিঙ্গা ইস্যুটি পুনরায় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে। রোহিঙ্গারা মূলত ধর্মীয়ভাবে মুসলমান এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের অধিবাসী। মিয়ানমারের ৭টি রাজ্য ও ৭টি ডিভিশনের একটি হচ্ছে এই আরাকান। ইতিহাস বলে আরাকান অঞ্চলটি কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য ছিল। অষ্টাদশ শতকে প্রথমবারের মতো এই অঞ্চলটি তার স্বাধীনতা হারায় এবং বর্মী বাজার অধীনস্থ হয়। তাও মাত্র অর্ধশতাব্দীর জন্য। তার পরই এ এলাকা ব্রিটিশ শাসনে চলে যায়। ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবেই এটি আজ মিয়ানমারের অংশ। মোগল আমলের আগে আরাকান রাজ্যের রাজ্য এক পর্যায় চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার (তখনকার নাম বার্মা) স্বাধীন হলে, একটি বহুজাতি ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রটি গড়ে ওঠে। দেশটির জনসংখ্যার ৪৮ ভাগ বার্মিজ হলেও, জনসংখ্যার ৯ ভাগ শনি, ৭ ভাগ কারেন, ৪ ভাগ রাখাইন। রাখাইনদেরই বাস এই আরাকান রাজ্যে। আমাদের দেশে একসময় এই রাখাইনরা মগ নামে পরিচিত ছিল। ধর্মীয়ভাবেও এদের মাঝে বিভিক্ত আছে। শতকরা ৮৯ ভাগ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ৪ ভাগ মানুষ খ্রিস্টিয় ধর্মাবলম্বী। মুসলমানরা জনসংখ্যার মাত্র ৪ ভাগ। এই মুসলমানরা আরাকান রাজ্যে বসবাস করলেও, চীনা বংশোভূত কিছু মুসলমান চীন-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের এলাকায় বসবাস করে। তবে এদের নিয়ে তেমন সমস্যার কথা শোনা যায় না। শোনা যায় আরাকান রাজ্যে বসবাসকারী মুসলমান তথা রোহিঙ্গাদের নিয়ে। এখানে মূলত মুসলমানদের উচ্ছেদ করে সেখানে বসবাসকারী রাখাইনদের (যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী) একক কর্তৃত্ব ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আজকে মিয়ানমারের জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান নব্বইয়ের দশকে বসনিয়া-হারজেগোভিনার জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৯২ সালের মার্চে বসনিয়ার জগগোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষে গণভোটে রায় দিলে, সেখানে সার্বিয়ার উস্কানিতে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান চলে। শতকরা ৪৩ ভাগ মুসলমান জগগোষ্ঠী হত্যা, ধর্ষণ ও উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হন। সার্বিয়া এই দেশটিকে সার্বিয়ার একটি আশ্রিত রাজ্য বানাতে চেয়েছিল। জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধে ১৯৯৪ সালের মার্চে ন্যাটোর বিমান বহরকে সার্বীয় অবস্থানের ওপর বিমান হামলা পর্যন্ত চালাতে হয়েছিল। আজ এত বছর পর সেই সার্বিয়া গণহত্যাকারীদের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হচ্ছে। বৃহৎ পরিসরে দেখালে বসনিয়ার সেই পরিস্থিতির সাথে আজকের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির অবশ্য কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মুসলমানরা উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হচ্ছেন এবং রাখাইন রাজ্যটি ধীরে ধীরে একটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে পরিণত হতে যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কোনো নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। এমনকি সকল ধরনের সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। এখানে আরো একটি বৈসাদৃশ্য আমাদের চোখে পড়ার কথা। যেখানে বসনিয়ায় ন্যাটোরে এক পর্যায়ে বিমান হামলা চালাতে হয়েছিল, সেখানে আজকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানের ব্যাপারে পশ্চিম বিশ্ব নিরব। বরং উল্টো বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দেয়ার 'চাকা' পর্যন্ত দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছে। বাংলাদেশ এমনিতেই জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত। বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। সুতরাং বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করতে বাধ্য নয়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশন প্রয়োজনে রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যত্র, এমনকি ইউরোপে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইতোমধ্যে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গারা নানা রকম অনৈতিক ও অসামাজিক কর্মকা-ে লিপ্ত। তারা ইতোমধ্যে কক্সবাজার এলাকার ব্যাপক বনাঞ্চল ধ্বংস করেছে। উপরন্তু মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় তাদের ব্যাপক উপস্থিতি একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। বিদেশিদের 'দুরভিসন্ধি' আমাদের নজরে এসেছে। এমনিতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদেশি তৎপরতা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। আমরা নতুন করে আরেকটি 'সমস্যা' দেখতে চাই না, যেখানে বিদেশি দাতাসংস্থা, এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলানোর সুযোগ পাক। এখানেই এসে যায় রিয়েল পলিটিক্সের প্রশ্নটি। বাংলাদেশ রাহিঙ্গাদের প্রত্যাখ্যান করেছে বটে। কিন্তু কেন প্রত্যাখ্যান করল, তা বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে তুলে ধরতে হবে। জাতিসংঘে বিষয়টি প্রয়োজনে তুলতে হবে জোরালোভাবে। কিছু মুসলমান দেশ রয়েছে, যারা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। তাদের বোঝাতে হবে এখানে 'মানবতা' কোনো বিষয় নয়, বিষয় 'রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা'। সেই সঙ্গে দ্রুত মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে 'সংলাপ' শুরু করা উচিত। আমাদের স্বার্থেই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা প্রয়োজন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে নয়। একাধিক কারণ এই নিরাপত্তা আজ ঝুঁকির মুখে প্রথমত, রোহিঙ্গা ইস্যুটি অবশ্যই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধের ব্যাপারে জাতিসংঘকেই উদ্যোগ নিতে হবে। জাতিসংঘ তথা পশ্চিমা বিশ্বকে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে করে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হয়। প্রয়োজনে সেখানে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিকে পাঠাতে হবে এবং তাকে পরিস্থিতি মনিটর করার সুযোগ দিতে হবে। দ্বিতীয়, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বয়কট তথা অর্থনৈতিক অবরোধের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। তৃতীয়ত, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শিবিরে সরকারি তালিকাভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা (রোহিঙ্গা) ১০ হাজার ৪০০ জন। অন্যদিকে টেকনাফের নয়াপাড়া শিবিরে তালিকাভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা ১৪ হাজার। এর বাইরে আরো প্রায় দুই লাখ আন-রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। রেজিস্টার্ড শরণার্থীরা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন থেকে সাহায্য সহযোগিতা পায়। আন-রেজিস্টার্ডরা কোনো সাহায্য পায় না। ফলে তারা আসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে এ অঞ্চলের নিরাপত্তাকে একটি হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন আর নতুন করে কোনো ঝুঁকি গ্রহণ করতে পারে না। চতুর্থ, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশি এলাকায় এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতি একসময় রোহিঙ্গাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। মিয়ানমারে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের লড়াই অনেক পুরনো। কোচিন, মান জাতিগোষ্ঠী স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে। একসময় রোহিঙ্গারাও বাধ্য হবে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে। বাংলাদেশ এর দায় দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশের নিজের স্বার্থেই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা প্রয়োজন। মিয়ানমার আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। আমাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টারও। আমাদের জ্বালানি ও খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারে মিয়ানমার। সুতরাং আমাদের স্বার্থেই আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি ঘটাতে পারি না। পঞ্চমত, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কোনো কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের অতি উৎসাহ আমাদের চিন্তিত করে। হঠাৎ করেই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার প্রবণতা বাড়েনি। বরং বাইরের কোনো কোনো মহল থেকে এদেরকে বাংলাদেশে আসতে উৎসাহ জোগানো হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রাখাইন (বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী) কর্তৃক সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত উৎপীড়ন চলছে, এটা সত্য। তবে দীর্ঘদিন সেখানে এ ব্যাপারে 'স্ট্যাটাস কো' বজায় ছিল। হঠাৎ করেই আবার জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়। এ ব্যাপারে পশ্চিমা শক্তির ইন্ধন রয়েছে। তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করতে চায়। বিশেষ করে এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে মার্কিনি নয়া স্ট্র্যাটেজি স্মরণ করা যেতে পারে। 'চীনকে ঘিরে ফেলার' একটি চক্রান্ত চলছে। মার্কিন নীতি নির্ধারকরা এ লক্ষ্যে এখন কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের দিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিতে চায়। সুতরাং বাংলাদেশ এই মার্কিন স্ট্র্যাটেজির অংশ হতে পারে না। বাংলাদেশ স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ কোনো রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করতে পারে না। শরণার্থী বিষয়ক কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেনি। সুতরাং রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে বাংলাদেশ বাধ্য নয়। বাংলাদেশের এই ভূমিকা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশ মার্কিনি চাপের কাছে মাথা নত করেনি। তবে রোহিঙ্গা সমস্যাটি বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় তুলতে পারে। আগামী ১৭ জুলাই মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসছেন। ওই সময় বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি তুলতে পারে। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি হোক, আমরা তা চাই না। আমাদের জাতীয় স্বার্থে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা আমাদের প্রয়োজন রয়েছে।Daily JAI JAI DIN25.6.12

ভারত মহাসাগরকে ঘিরে কি নয়া স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে



 
সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে যে বিতর্কের জন্ম হয়েছে, তা হচ্ছে ভারত মহাসাগরকে ঘিরে কি নতুন করে একটি স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে? বিশেষ করে গত ৩১ মে ভারতের প্রভাবশালী টিভি চ্যানেল ‘টাইম নাউ’ এর প্রতিবেদন, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্যানেট্টার সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত সাংগ্রি-লা সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ শতাংশ নৌ শক্তির এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিয়োজিত করার ঘোষণার পর এ ধারণাটি এখন বদ্ধমূল হয়েছে যে, চলতি একুশ শতকেই স্নায়ুযুদ্ধের ‘নতুন এক রূপ’ আমরা দেখতে পাব। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে প্রভাববলয়কে কেন্দ্র করে প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। ইউরোপের কর্তৃত্ব কার হাতে থাকবে, এটা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইউরোপ মূলত দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিলÑ একদিকে পশ্চিম ইউরোপ, যে দেশগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও পুঁজিবাদনির্ভর গণতন্ত্রকে তাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। অন্য দিকে পূর্ব ইউরোপ, যে দেশগুলো সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণ করেছিল এবং সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার আগ পর্যন্ত পরস্পর বিরোধী এই দুই আদর্শের মধ্যে লড়াই আমরা প্রত্যক্ষ করি। স্নায়ুযুদ্ধকে বলা হয় এমন একটি ‘যুদ্ধ’ যে ‘যুদ্ধ’ হয়নি বটে, কিন্তু তা ছিল যুদ্ধের চাইতেও ভয়ঙ্কর। প্রভাববলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপার থেকে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে নিয়ে গঠন করেছিল সামরিক জোট ‘ন্যাটো’। অন্য দিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই গঠন করেছিল সামরিক জোট ‘ওয়ারশ’। ‘ন্যাটো’ আর ‘ওয়ারশ’ এর মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ‘উন্নীত’ হয়েছিল যে, ইউরোপে একাধিকবার ‘পারমাণবিক যুদ্ধে’র সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ‘যুদ্ধ’ হয়নি বটে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পুরোটা সময় এই দুই শক্তির মাঝে প্রতিযোগিতা বজায় ছিল। দুই পরাশক্তিই ইউরোপে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পরই এই স্নায়ুযুদ্ধের  অবসান ঘটে। এর প্রধান কারণ ছিল একটি- রাশিয়া এখন আর ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। দু’টি আদর্শের (সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ) মাঝে যে দ্বন্দ্ব ছিল, সেই দ্বন্দ্বেরও অবসান ঘটে, যখন রাশিয়া আদর্শ হিসেবে মুক্তবাজার ও পুঁজিবাদকে গ্রহণ করে। উপরন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার অনেক আগেই ১৯৮৮ সালে গরবাচেভ ‘ওয়ারশ’ সামরিক জোট ভেঙে দিয়েছিলেন। যে কারণে ইউরোপে রাশিয়ার উত্থান যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। আর তাই নতুন করে এই অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধের জন্মের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কিন্তু ভারত মহাসাগর হচ্ছে সম্ভাব্য ক্ষেত্র, যেখানে নতুন করে স্নায়ুুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে চীন। চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভয় ও শঙ্কা’ এখন অনেক বেশি। প্রথমত, তত্ত্বগতভাবে চীন এখনও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তবে তারা এখন আর ধ্রুপদী মার্কসবাদ মাওবাদ অনুসরণ করে না। চীনে যে নতুন প্রজন্মের জন্ম হয়েছে এরা সমাজতন্ত্র বোঝে না। এরা বোঝে ভোগবাদ। চীনে একদলীয় কমিউনিস্ট পার্টির শাসন রয়েছে বটে। কিন্তু ঐ একদলীয় শাসনে চীনা নেতৃত্ব তিনটি বিষয়কে একত্র করেছে : ১. পূর্ব এশিয়ার (Now Authoritariamism,) ২. ল্যাতিন আমেরিকার করপরেটইজম (Corporatism) ৩. পশ্চিম ইউরোপের ‘স্যোসাল ডেমোক্র্যাসি (Social Democracy)। ফলে চীনকে এই মুহূর্তে একটি পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যাবে না। বিশ্বে এখন যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে একমাত্র শক্তি হচ্ছে এই চীন। সুতরাং চীনকে ‘ছেঁটে ফেলার’ একটি স্ট্রাটেজি গ্রহণ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয়ত আগামী দুই দশকের মধ্যে চীন অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। চীনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২ ট্রিলিয়ন (১ হাজার বিলিয়ন এক ট্রিলিয়ন) ডলার। ফরচুন ম্যাগাজিন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ  ৫০০টি বহুজাতিক সংস্থার নাম করেছে। তার মাঝে চীনের রয়েছে ৩৭টি। বিশ্বে যে জ্বালানি ব্যবহৃত হয়, চীন একাই শতকরা ১৬ ভাগ তা ব্যবহার করে। আর তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বে চীনের অবস্থান তৃতীয়। চীন বিশ্বের রূপান্তরযোগ্য জ্বালানির বিনিয়োগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। গত বছর সাড়ে ৫ হাজার কোটি ডলার চীন এ খাতে খরচ করেছে। চীন বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পর তার স্থান। কিন্তু ২০২০ সালে জাতীয় উৎপাদনের দিক দিয়ে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বের যত ফটোকপি, মাইক্রোওয়েভ ও জুতা উৎপাদন হয়, তার তিন ভাগের দু’ভাগ উৎপাদন হয় চীনে। বিশ্বের মোবাইল ফোনের শতকরা ৬০ ভাগ চীন একা উৎপাদন করে। একই সাথে বিশ্বের ডিভিডি উৎপাদনের শতকরা ৫৫ ভাগ, ক্যামেরার ৫০ ভাগ, ৩০ ভাগ পারসোনাল কম্পিউটার, শিশুদের খেলনার ৭৫ ভাগ চীন একাই উৎপাদন করে। চীনের এই অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে বড় ধরনের আঘাত হানছে। প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করছে। তৃতীয়ত পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে চীনের যে বিনিয়োগ, তাতে উৎকণ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৩ সাল থেকে  ২০০৮ সাল পর্যন্ত আফ্রিকাতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ল্যাটিন আমেরিকাতে এর পরিমাণ বেড়েছে ১ বিলিয়ন থেকে ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। আর এশিয়াতে বেড়েছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন থেকে ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। সুদান ও কম্বোডিয়ায় বিনিয়োগের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে চীন। অন্য দিকে সুদানের পাশাপাশি ইরানের তেল সেক্টরে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। ২০০৯ সালে চীন ইরানের তেল ও গ্যাস সেক্টরে ব্যাপক বিনিয়োগ করে। আগামী ৫ বছরে এই সেক্টরে তারা বিনিয়োগ করবে ১২০ বিলিয়ন ডলার। ইরানের তেলের অন্যতম ক্রেতা আজ চীন। আন্তর্জাতিক অবরোধ উপেক্ষা করে চীন ইরান থেকে তেল আমদানি করছে। এসব বিষয় মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। অনেকেরই জানার কথা যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়। এই ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার। এই ঋণ যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। চতুর্থত দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান চীনের উপস্থিতি মার্কিন নীতি নির্ধারকদের চিন্তার অন্যতম কারণ। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাসহ সকল বিদেশী সেনা প্রত্যাহারের পর সেখানে যে এক ধরনের ‘শূন্যতার’ সৃষ্টি হবে সেই শূন্যতা চীন পূরণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। চীন ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের লোগার প্রদেশের আইনাক (Aynak) নামক স্থানে  কপার ফ্লিড উন্নয়নে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। নেপালের মহাসড়ক নির্মাণ, সীমান্ত পোর্ট নির্মাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীন জড়িত রয়েছে। মিয়ানমারে মহাসড়ক নির্মাণ, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে চীন। মিয়ানমারের সমুদ্র উপকূলে যে বিশাল গ্যাস রিজার্ভ আবিষ্কৃত হয়েছে, তা এখন পাইপ লাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে যাবে। আর ঐতিহাসিকভাবেই চীনের সাথে সামরিক চুক্তি রয়েছে মিয়ানমারের। মিয়ানমারের গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে চীন। পাকিস্তানেও (গাওদার) গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে চীন। কারাকোরাম পর্বতমালায় সড়ক পথও নির্মাণ করছে চীন। শ্রীলংকায় হামবানটোটায় (প্রেসিডেন্ট রাজা পাকসের এলাকা) গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে চীন। এই পোর্ট পুরোপুরিভাবে চালু হবে ২০২০ সালে। একই সাথে প্রায় ১৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির দক্ষিণাঞ্চলে একটি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও তৈরি করছে চীন। হামবানটোটায় ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি তাদেরই তৈরি করে দেয়া। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের এই যে বিশাল বিনিয়োগ, তা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের অজানা নয়। এমনকি বাংলাদেশেও বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। বাংলাদেশেও সোনাদিয়া দ্বীপের গভীরে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করতে চায় চীন। ভারত মহাসাগরভুক্ত বিভিন্ন সমুদ্র বন্দরকে যুক্ত করে চীন যে String of pearls বা মুক্তার মালার নীতি গ্রহণ করেছে, তা যুক্তরাষ্ট্র শুধু নয়, ভারতের স্বার্থকেও আঘাত হানছে।
ভারত মহাসাগর আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের ‘স্নায়ুযুদ্ধ’। এখানে কার নিয়ন্ত্রণ থাকবে এই বিপুল জলসীমা, তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। এ অঞ্চলজুড়ে গাওদার (বেলুচিস্তান, পাকিস্তান), হামবানটোটা (শ্রীলংকা), সিটওয়ে, কিয়াউকপাইউই বন্দরে (মিয়ানমার) রয়েছে চীনের নৌবাহিনীর রিফুয়েলিং সুবিধা ও সাবমেরিন ঘাঁটি। কোকো দ্বীপপুঞ্জও চীনা নৌবাহিনী ব্যবহার করে। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। চীনের জ্বালানি চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগ এ অঞ্চলে অবস্থিত মালাক্কা প্রণালী দিয়ে পরিবহন করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য হয়ে শ্রীলংকা পর্যন্ত ভারত মহাসাগর। তারপর এই মহাসাগর হয়ে মালাক্কা প্রণালী (মালয়েশিয়া) অতিক্রম করে ইন্দোনেশিয়ার পাশ দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর যাবার যে সমুদ্র পথ এই পথের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। যুক্তরাষ্ট্রও প্রশান্ত  মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম নৌ শক্তি। এ অঞ্চলে চীনা নৌ শক্তির উপস্থিতি তার কাম্য নয়। অথচ জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তার জন্যও এই রুটটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠুক, চীন তা কখনোই চাইবে না। এমনকি মধ্য এশিয়ার গ্যাস গাওদার বন্দরের মধ্যে দিয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে চীনের পূর্বাঞ্চলে নিয়ে যাবার এক বিশাল ও ব্যয়বহুল প্রকল্পও হাতে নিয়েছে চীন। এজন্য ভারত মহাসাগরে তার নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন রয়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রও চায় এই অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব থাকুক। কেননা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে দিনে দিনে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরান আক্রমণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগর তথা গাওদার পোর্টের গুরুত্ব রয়েছে। গাওদার থেকে ‘স্ট্রেইট তার হরমুজ’ এর দূরত্ব মাত্র ১৮০ নটিক্যাল মাইল (এ পথ দিয়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে), আর ৭২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ইরান সীমান্ত। বেলুচিস্তানের মরুভূমিতে কিছুদিন আগ পর্যন্ত একটি বিশাল ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করতো। সুতরাং আগামী দিনে ভারত মহাসাগর অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে মার্কিন সমর নায়কদের কাছে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র Containment theory প্রয়োগ করেছিল। পশ্চিম ইউরোপ এ ক্ষেত্রে পালন করেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আজ সেই Containment theory আবার নতুনভাবে প্রয়োগ হতে যাচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে ভারত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে চারদিক থেকে ঘিরে চাপ প্রয়োগ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতাকে সঙ্কুচিত করতে চেয়েছিল, আজ চীনকে সামনে রেখেই সেই একই স্ট্রাটেজি রচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে লাভ কতটুকু হবে বলা মুস্কিল। তবে নতুন করে আবার উত্তেজনার জন্ম হবে। নতুন করে আবার জন্ম হবে স্নায়ুযুদ্ধের। ফলে ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলো এই প্রতিযোগিতায় কোনো একটি পক্ষ অবলম্বন করতে বাধ্য হবে। অতীতে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্ব দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বেড়েছিল। আজও সে রকম একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বিশ্ব। নিশ্চিত করেই বলা যায় এতে কোনো পক্ষের লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ বরং এতে করে এ অঞ্চলের দারিদ্র্য আরো বাড়বে।

মিয়ানমারে দাঙ্গা ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি



মিয়ানমারে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা পুনরায় জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হয়েছেন। দলে দলে ইসলাম ধর্মাবলম্বী, যারা রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত, তাদের পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ সঙ্গত কারণেই এসব রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করতে পারে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে এ ব্যাপারে একটি বিবৃতিও দিয়েছেন। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের ভূমিকা একটা প্রশ্নের মাঝে থেকে যাবেই। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন যখন মিয়ানমারের দরজা পশ্চিমাদের জন্য খুলে দিয়েছেন, যখন বিরোধী নেতা অং সান সু চি বিদেশ ভ্রমণে রয়েছেন, তখন নতুন করে এই জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলো কেন? পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়টি কীভাবে দেখছে, সেটাই আমাদের বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
বলা প্রয়োজন, নতুন করে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপক স্থান পেয়েছে। যারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করে, সে রকম একটি প্রতিষ্ঠান, নিউইয়র্কের ঙঢ়বহ ঝড়পরবঃু ঋড়ঁহফধঃরড়হ-এর গত ১৪ জুনের এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়টি স্থান পেয়েছে। এমনকি অং সান সু চি যখন জেনেভায় (১৪ জুন), তখন তাকেও সাংবাদিকরা এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। বাংলাদেশের মিডিয়ায় সু চির ওই বক্তব্য ছাপা না হলেও বিদেশি মিডিয়ায় তা ছাপা হয়েছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে সু চি অনেকটা সরকারের পক্ষেই অবস্থান নিলেন। যেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের, যাদের মধ্যে ৩ মাসের শিশু পর্যন্ত রয়েছে, তাদের যখন নিজস্ব বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়, তখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি একটিবারের জন্যও এর নিন্দা করলেন না। আমাদের শোনালেন সেই পুরনো \'কাহিনী\', বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন। বিদেশি মিডিয়ায় তার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে_ \'ডব যধাব ঃড় নব াবৎু পষবধৎ ধনড়ঁঃ যিধঃ ঃযব ষধংি ড়ভ পরঃরুবহংযরঢ় ধৎব ধহফ যিড় ধৎব বহঃরঃষবফ ঃড় ঃযবস.\' অর্থাৎ পরোক্ষভাবে বলার চেষ্টা করলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন! সরাসরি তিনি এ কথাটা বলেননি বটে, কিন্তু তার বক্তব্যে পরোক্ষভাবে এ কথাটিই ফুটে উঠেছে। তিনি সহিংস ঘটনাবলির নিন্দাও করেননি।
এখানেই এসে যায় মূল বক্তব্যটি_ মিয়ানমারের নেতৃত্ব সেখানে এক ধরনের \'বৌদ্ধরাজ\' প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। এ প্রক্রিয়া তারা যে আজকেই শুরু করেছে, তা নয়। এই মানসিকতা তাদের দীর্ঘদিনের; মিয়ানমার শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাষ্ট্রই হবে, সেখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কোনো স্থান হবে না। মিয়ানমারে শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাই বসবাস করে না। সেখানে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি কারেন, কাচিন কিংবা শান জাতিও যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে, যাদের মধ্যে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীও রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের নেতৃত্ব এই দেশটিকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে চায়। অথচ পরিসংখ্যান বলে, ৬৪ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর এই দেশটিতে প্রায় ১৩৫টি ছোট-বড় নৃগোষ্ঠী রয়েছে। বড় এবং প্রভাবশালী নৃগোষ্ঠীগুলো তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও জাতিরাষ্ট্রের দাবিতে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে একটি সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। কারেন কিংবা শান জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগ্রামের খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হলেও রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা কোনো সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করছে তেমনটি শোনা যায় না।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ২০১০ সালের এক প্রতিবেদনে \'হারকাত উল জিহাদ-ই-ইসলামী\' নামক একটি বাংলাদেশি মৌলবাদী সংগঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, যারা রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বাংলাদেশ ওই সংগঠনটিকে ২০০৫ সালে নিষিদ্ধ করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য সংসদে জামায়াতে ইসলামীর কথা উল্লেখ করেছেন, যারা রোহিঙ্গাদের উস্কানি দিচ্ছে বলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। এ ব্যাপারে আরও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। একটি বন্ধু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক সংগঠন সশস্ত্র উস্কানি দেবে, তা কাম্য হতে পারে না।
ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা মূলত আরব বংশোদ্ভূত। এক সময় আরব বণিকরা এ অঞ্চলে এসে বসবাস করতে শুরু করে। তাদের কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করা যাবে না। প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে। ১৯৭৮ সালে ব্যাপক হারে উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে আসতে ও বসবাস করতে বাধ্য হয়। পরে ১৯৯১ সালেও দ্বিতীয় দফায় আরও বেশ কিছু রোহিঙ্গা কক্সবাজার এলাকায় এসে আশ্রয় নেয়। সরকারিভাবে ২৮ হাজার রোহিঙ্গা রেজিস্ট্রিভুক্ত করা হলেও ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় দু\'লাখ অবৈধ রোহিঙ্গা বর্তমানে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করছে। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন সরকারের মতো অং সান সু চি ও তার দল এনএলডিও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। এনএলডি রোহিঙ্গাদের অভিহিত করেছে \'বাঙালি টেররিস্ট\' হিসেবে।
আজকে মিয়ানমারের জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান নব্বইয়ের দশকে বসনিয়া-হারজেগোভিনার জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৯২ সালের মার্চে বসনিয়ার জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষে গণভোটে রায় দিলে সেখানে সার্বিয়ার উস্কানিতে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান চলে। শতকরা ৪৩ ভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠী হত্যা, ধর্ষণ ও উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হয়। এই দেশটিকে সার্বিয়া একটি আশ্রিত রাজ্য বানাতে চেয়েছিল। জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধে ১৯৯৪ সালের মার্চে ন্যাটোর বিমানবহরকে সার্বীয় অবস্থানের ওপর বিমান হামলা পর্যন্ত চালাতে হয়েছিল। আজ এত বছর পর সেই সার্বীয় গণহত্যাকারীদের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হচ্ছে। বৃহৎ পরিসরে দেখলে বসনিয়ার সেই পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মুসলমানরা উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হচ্ছে এবং রাখাইন রাজ্যটি ধীরে ধীরে একটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে পরিণত হতে যাচ্ছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কোনো নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি। এমনকি সব ধরনের সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। এখানে আরও একটি বৈসাদৃশ্য আমাদের চোখে পড়ার কথা। যেখানে বসনিয়ায় ন্যাটোকে এক পর্যায়ে বিমান হামলা চালাতে হয়েছিল, সেখানে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানের ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্ব নীরব। বরং উল্টো বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দেওয়ার \'চাপ\' পর্যন্ত দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছে। বাংলাদেশ এমনিতেই জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত। বাংলাদেশ আর অতিরিক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। সুতরাং বাংলাদেশ রোহিঙ্গা গ্রহণ করতে বাধ্য নয়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশন প্রয়োজনে রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যত্র, এমনকি ইউরোপে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইতিমধ্যে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গারা নানা রকম অনৈতিক ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। তারা ইতিমধ্যে কক্সবাজার এলাকার ব্যাপক বনাঞ্চল ধ্বংস করেছে।
আমরা নতুন করে আরেকটি \'সমস্যা\' দেখতে চাই না, যেখানে বিদেশি দাতা সংস্থা, এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলানোর সুযোগ পাক। এখানেই এসে যায় রিয়েল পলিটিক্সের প্রশ্নটি। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাখ্যান করেছে বটে। কিন্তু কেন প্রত্যাখ্যান করল, তা বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে তুলে ধরতে হবে। জাতিসংঘে বিষয়টি প্রয়োজনে তুলতে হবে জোরালোভাবে। কিছু মুসলিম দেশ রয়েছে, যারা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। তাদের বোঝাতে হবে, এখানে \'মানবতা\' কোনো বিষয় নয়, বিষয় \'রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা\'। সেই সঙ্গে দ্রুত মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে \'সংলাপ\' শুরু করা উচিত। আমাদের স্বার্থেই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা প্রয়োজন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে নয়।
Daily SAMAKAL
24.6.12

দেশে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের নামে কী হচ্ছে

খবরটি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে গত ১৭ জুন। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যারা জড়িত, যারা গবেষণা করেন তারা এ সংবাদটি পাঠ করে উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারবেন না। সংবাদটিতে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন প্রভাষক তার পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রায় ১২ লাখ ৭৫ হাজার ৪৭ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। ২০০৮ সালে পিএইচডির কাজ শুরু করে ২০১১ সালের মে মাসে তিনি থিসিস জমা দেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ওই গবেষক ২২ জন অধ্যাপকের নাম উল্লেখ করেছেনÑ যারা তার সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। তার এ গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. শওকত আরা হোসেন। বহিঃস্থ দু’জন পরীক্ষক হলেন অধ্যাপক আবদুল মান্নান (জাহাঙ্গীরনগর) ও অধ্যাপক মকসুদুর রহমান (রাজশাহী)। অধ্যাপক মান্নানের নিজের কোন পিএইচডি ডিগ্রি নেই।
সংবাদটি পাঠ করে আমার মনে নানা প্রশ্নের জš§ হয়েছে। আমার ধারণা, আরও অনেক শিক্ষকের মনে দেখা দিয়েছে একই প্রশ্ন। প্রথমত, প্রায় ১৩ লাখ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়া সম্ভব কি-না? আর যদি সম্ভব হয়েও থাকে, তবে তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তিনি কিভাবে ‘এনালাইসিস’ করলেন? এটা সম্ভব কি-না? যারা রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন তারা জানেন এটি আদৌ সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, কেউ এভাবে কাজ করেন না। আমি জানি না তত্ত্বাবধায়ক অথবা বহিঃস্থ পরীক্ষকরা এটি আদৌ যাচাই করে দেখেছেন কি-না। আমার ধারণা, এটি করা হয়নি। তারা তা না করে একটা ‘ইনটেলেকচুয়াল’ অপরাধ করেছেন। এ অপরাধে ওই তত্ত্বাবধায়ক তথা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়। দ্বিতীয়ত, গবেষণার বিষয়টি ছিল মার্কসবাদ এবং বর্তমান বিশ্বে এর প্রভাব নিয়ে। স্পষ্টতই এটা একটা বিশাল ক্ষেত্র। গবেষণার ক্ষেত্রে ‘কেস স্টাডি’ হিসেবে একটা দেশকে বেছে নেয়া হয়। গবেষক তা করেননি। বিশাল একটা ক্ষেত্র তিনি বেছে নিয়েছিলেন। এটি নিয়ে প্রবন্ধ লেখা যায়, কোন পিএইচডি গবেষণা হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের উচ্চতর শিক্ষা কমিটি কীভাবে এ প্রস্তাব অনুমোদন করল আমি তা ভেবে পাই না। উপরন্তু আমার কাছে আরও অবাক লেগেছে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অধ্যাপক শওকত আরা হোসেনের নাম দেখে। অধ্যাপক শওকত আরা আদৌ মার্কসবাদ নিয়ে কোন প্রবন্ধ লেখেননি, গ্রন্থ তো দূরের কথা। তিনি কী করে তত্ত্বাবধায়ক হলেন? সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। চীনে মার্কসবাদ নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছেÑ সেখানে পূর্ব এশিয়ার ঘবড় অঁঃযড়ৎরঃধৎরধহরংস, লাতিন আমেরিকার ঈড়ৎঢ়ড়ৎধঃরংস এবং পশ্চিম ইউরোপের ঝড়পরধষ উবসড়পৎধপু’র এক সংমিশ্রণ ঘটেছে। এসব বিষয় সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক আদৌ ধারণা রাখেন কি-না, আমার সন্দেহ রয়েছে। উপরন্তু দু’জন বহিঃস্থ পরীক্ষক অধ্যাপক মান্নান ও মকসুদুর রহমান কেউই এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। স্পষ্টতই পরীক্ষা কমিটি গঠনের ব্যাপারে অসততার আশ্রয় নেয়া হয়েছিল। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন। কেননা পিএইচডি গবেষণা কোন ‘ছেলেখেলার’ বিষয় নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠান থেকে যদি এ ধরনের থিসিস ‘তৈরি’ হয় (কোন রকম তত্ত্বাবধান ছাড়াই!), তাহলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান আমরা কোথায় নিয়ে গেলাম। আমি জানি, বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশ ক’জন প্রবীণ ও সিনিয়র অধ্যাপক রয়েছেন, যারা এ গবেষণাটি তত্ত্বাবধান তথা পরীক্ষা করতে পারতেন। এ গবেষণায় তাদের কেন অন্তর্ভুক্ত করা হল না, এ প্রশ্ন থেকেই গেল। তৃতীয়ত, আমি থিসিসটি দেখিনি, কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে ধারণা করছি প্রচণ্ড রকম ‘মেথোডোলজিক্যাল’ সমস্যা রয়েছে এতে। কিভাবে এটি উচ্চতর কমিটি তথা ডিন কমিটি পার হল, বুঝতে কষ্ট হয়। চতুর্থত, আকার-ইঙ্গিতে অভিযোগ করা হয়েছে, থিসিসটির সঙ্গে একটি ‘রাজনীতি’ আছে। এতদিন শুনে এসেছি, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এখন শুনলাম পিএইচডি ডিগ্রিও দেয়া হচ্ছে! অধ্যাপক শওকত আরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক। তিনি খুব উঁচুমানের পণ্ডিত, তা বলা যাবে না। তবে ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কমিটিতে রয়েছেন। আর ওই গবেষক নিজেও একই রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার অনুসারী। এ ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘পেট্রোনাইজেশন’ হয়েছে বলে আমার ধারণা। বহিঃস্থ দু’জন পরীক্ষকের সঙ্গে অধ্যাপক শওকত আরার ব্যাপক যোগসাজশ রয়েছে। অধ্যাপক মান্নানের স্ত্রীর পিএইচডি থিসিসেরও তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক শওকত আরা। মিসেস মান্নান এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পঞ্চমত, অধ্যাপক শওকত আরা প্রতিবেদকের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, ওই গবেষক প্রায় ১৩ লাখ লোকের (৮০টি দেশের) সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন তার কাছে এ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট চাইতে পারে। তিনি যদি দেখাতে ব্যর্থ হন, তাহলে ভবিষ্যতে তাকে সব ধরনের গবেষণা থেকে নিবৃত রাখা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উত্তম কাজ। ষষ্ঠত, ওই গবেষক ২২ জন অধ্যাপককে তার সহকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কী ঔদ্ধত্য! প্রভাষক হয়ে একজন অধ্যাপককে দেখান ‘গবেষণা সহকারী’! বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই ২২ জন অধ্যাপকের কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাইতে পারে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আমাদের জন্য অনেক চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। এভাবে আমরা তথাকথিত পিএইচডি ডিগ্রি দেব কি-না? এ ধরনের প্রবণতা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে সারাদেশ লাখ লাখ পিএইচডিতে ভরে যাবে। এমনিতেই পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে আমরা বিপদে আছি। শত শত ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিতে দেশ ভরে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অনেক শিক্ষকের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে কথা উঠেছে। কুষ্টিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে (তাদের চাকরি থাকে কীভাবে?)। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’একজন শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনলাইনে করা পিএইচডি ডিগ্রির এখন রমরমা বাজার বাংলাদেশ। একজন সাবেক সচিব (তিনি আবার কলাম লেখকও বটে) অনলাইনে ডিগ্রি নিয়ে নির্দ্বিধায় তা ব্যবহার করছেন। অথচ একজন সাবেক সচিবের জানার কথা, অনলাইনে নেয়া পিএইচডি ডিগ্রি নামের আগে ব্যবহার করা যায় না। আরও একজন এনজিও ব্যক্তিত্ব ‘অধ্যাপক’ ও ‘পিএইচডি’ ডিগ্রি দুটোই ব্যবহার করে চলেছেন কোনরকম লজ্জা-শরম ছাড়াই। একটি টিভি চ্যানেলের মালিক, তিনিও পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করছেন। অথচ তারা জানেন না পিএইচডি একটি গবেষণা। বছরের পর বছর লাইব্রেরি ঘেঁটে, ফিল্ড ওয়ার্ক করে গবেষণা কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। তা না করে কোন একটি সংস্থা কাউকে ‘সম্মানজনক’ পিএইচডি ডিগ্রি দিল, আর তিনি তা ব্যবহার করতে শুরু করলেন! জানা যায়, ঢাকার বনশ্রীতে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈঁষঃঁৎব টহরাবৎংরঃু নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছেÑ তারাও টাকার বিনিময়ে পিএইচডি দিচ্ছে!
উচ্চশিক্ষা আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, এসব ঘটনা তার বড় প্রমাণ। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এভাবে ডিগ্রি কেনা যায় কি-না, ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করা যায় কি-না, আমার জানা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা বড় ব্যর্থতাÑ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারী থাকলেও তারা এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ থাকলে, ওই ‘ভূত’ আমরা তাড়াব কীভাবে? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এতদিন শুধু সার্টিফিকেট বিক্রি করত। এখন সেখানে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির ছড়াছড়ি। সেদিন পত্রিকায় এক অধ্যাপিকার ছবি দেখলাম, যিনি এখন স্বামীর মালিনাকাধীন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ভিসি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন! বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাচ্ছেন, তিনি পিএইচডি করে ফেলেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কবে করলেন তিনি গবেষণা? কবে গেলেন ওখানে? দিনের পর দিন ঢাকায় থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে কি গবেষণা করা যায়! হায়রে পিএইচডি! এ দেশে বুঝি সবই সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই তরুণ প্রভাষক ও তার তত্ত্বাবধায়কের কর্মকাণ্ড দেখে আমি উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। জানি না আর কতদিন শিক্ষকতায় থাকতে পারব! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক পণ্ডিত শিক্ষক আছেন, যারা আমার নমস্য। তারা কি বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন? তারা যদি সোচ্চার না হন, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ধরে রাখা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও একটি ভূমিকা আছে বলে আমি মনে করি। ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের হাত থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচানোর দায়িত্ব তাদের। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় বিষয়টি এড়িয়ে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ’ শিক্ষকের মান-সম্মানের প্রশ্নও জড়িত। আমি এক সময় এ বিভাগের ছাত্র ছিলাম। আজ আমি নিজেও বিব্রতবোধ করছি। যে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তিনি আবার ইতিমধ্যে বিভাগের অপর পাঁচজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তাদের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অথচ এ পাঁচ শিক্ষকের সবাই ৫ থেকে ৭ বছর আগে বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং তাদের ডিগ্রি নিয়ে কখনও প্রশ্ন তোলা হয়নি। ভিসি ইতিমধ্যে অভিযুক্ত শিক্ষকের পিএইচডি থিসিস পরীক্ষার জন্য প্রো-ভিসিকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। আমরা চাই, তদন্ত রিপোর্টটি দ্রুত প্রকাশিত হোক। আর ইউজিসির চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া পিএইচডি শনাক্ত করতে সব শিক্ষকের ‘ডাটাবেজ’ তৈরি করার জন্য। আমরা উচ্চশিক্ষার অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি। আর ক্ষতি করতে চাই না।
Daily JUGANTOR
23.6.12

পাকিস্তান কি সত্যিই একটি ‘ব্ল্যাক হোল’

পাকিস্তান সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা। মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান, উভয়দলীয় নেতারা মন্তব্য করেছিলেন যে, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘ব্ল্যাক হোলে’র মতো। অর্থাত্ তারা যা বলতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে পাকিস্তান যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কেউ-ই স্পষ্ট করে বলতে পারছে না। এটা সেই ‘ব্ল্যাক হোল’ এর মতো, যার কোনো শেষ নেই।
মার্কিন কংগ্রেসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটদলীয় গ্রে অ্যাকারম্যান কিংবা রিপাবলিকানদলীয় ড্যানা রোহরাব্যাচারের মতো ব্যক্তিত্ব যখন পাকিস্তান সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ নিয়ে উত্কণ্ঠিত না হয়ে পারা যায় না। মার্কিন আইন প্রণেতারা এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন গত মে মাসে কংগ্রেসের মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক একটি প্যানেলে আমন্ত্রিত হয়ে। মার্কিন আইনপ্রণেতাদের এই মন্তব্য যখন ওয়াশিংটনে নীতিনির্ধারকদের চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে, ঠিক তখনই আরও একটি ‘বোমা ফাটালেন’ পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন পূর্ণ বেঞ্চ। গত ১৯ জুন এক রায়ে তারা প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এমনকি সংসদ সদস্যপদেও তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। আদালত অবমাননার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় আদালত এই রায় দেন। পাকিস্তানের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন অবৈধ। প্রধান বিচারপতি চৌধুরী তার রায়ে উল্লেখ করেন, বিচারকদের সাত সদস্যের বেঞ্চ ২৬ এপ্রিল গিলানিকে সংবিধানের ২০৪(২) ধারা অনুযায়ী আদালত অবমাননার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। প্রতীকী সাজা দিয়েছিলেন বিচারকরা। ৩০ সেকেন্ড কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন গিলানি। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো আপিল নথিভুক্ত না হওয়ায় তিনি সংসদ সদস্যপদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।
একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, অন্যদিকে খোদ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ‘তালেবানি’ তত্পরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাকিস্তানের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। আগের চেয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা পাকিস্তানের ব্যাপারে সোচ্চার। প্রকাশ্যেই তারা বলছেন গত দশক ধরে দেশটিকে দেওয়া ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অর্থ সহায়তা কোনো কাজেই লাগেনি। মার্কিন কংগ্রেসে এমন কথাও উঠেছে যে, পাকিস্তানে সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেয়া উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান সম্পর্কে যখন এ ধরনের একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে, ঠিক তখনই গিলানিকে অযোগ্য ঘোষণা করলেন উচ্চ আদালত। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান স্পষ্টতই একটি গভীর সঙ্কটে পতিত হল।
কী হতে যাচ্ছে এখন পাকিস্তানে? সেখানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পিপলস পার্টির নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সিনিয়র নেতা মখদুম শাহাবুদ্দিনকে নয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছে। তিনি মজলিসে শূরার (সংসদ) সমর্থন পাওয়ার আগেই তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ফলে তার দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেল। যদিও কোয়ালিশন সরকারের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তবে শেষ রক্ষা হবে কি না বলা মুশকিল। শাহাবুদ্দিন  কিংবা অন্য যে কারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি সব প্রশ্নের জবাব দেয় না। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, যে কারণে গিলানি অভিযুক্ত হয়েছিলেন, সে ব্যাপারে নয়া প্রধানমন্ত্রী আদৌ কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না? পাকিস্তানের বর্তমান যে সঙ্কট, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি। পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন জারদারি অবৈধভাবে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার ঘুষ নিয়েছিলেন এবং ওই টাকা সুইজারল্যান্ডে পাচার করেছিলেন। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে সুইজারল্যান্ডে তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু স্ত্রী বেনজির ভুট্টোর বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু (২০০৭) জারদারিকে ক্ষমতার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে। তিনি ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুইজারল্যান্ডের ওই মামলার তদন্ত  কাজ স্থগিত করতে প্রভাব খাটান। কিন্তু পাকিস্তানের উচ্চ আদালত আবার মামলা শুরু করার ব্যাপারে সুইজারল্যান্ডকে অনুরোধ করতে গিলানির প্রতি নির্দেশ দেন। গিলানি উচ্চ আদালতের এই নির্দেশ অমান্য করেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট দায়মুক্তি পেয়েছেন। তাই তার পক্ষে সুইজারল্যান্ড কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখা সম্ভব নয়। এই যুক্তি উচ্চ আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এখন নয়া প্রধানমন্ত্রী মখদুম শাহাবুদ্দিন কী করবেন? তিনি কি চিঠি লিখবেন সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে, নাকি গিলানির পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন? নয়া প্রধানমন্ত্রী যদি গিলানিকে অনুসরণ করেন তা হলে তিনিও যে আদালত অবমাননার শিকার হবেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন, জারদারির ভূমিকা এখন কী হবে? তিনি কি রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন? গিলানি অযোগ্য হলেন বটে, কিন্তু এর জন্য তিনি এতটুকুও দায়ী নন। ইফতেখার-জারদারির দ্বন্দ্বে বলি হলেন গিলানি। জারদারির একটা বড় ব্যর্থতা তিনি এই সঙ্কেটে পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতা নওয়াজ শরিফের সমর্থন পাননি। মূলত আদালত অবমাননার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন নওয়াজ শরিফ স্বয়ং। তৃতীয় প্রশ্ন, বিচার বিভাগের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে লাভবান হবে কোন শক্তি? অত্যধিক ক্ষমতাবান সেনাবাহিনী তথা সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানির ভূমিকাও বা কী এই সঙ্কটে? কিংবা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এই সঙ্কট থেকে কোনো সুবিধা নেবে কি না? চতুর্থ প্রশ্ন, সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসতে পাকিস্তান কি সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? আগামি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেখানে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। পাকিস্তানের ইতিহাস বলে, অতীতে কখনই কোনো সরকার তার টার্ম (পাঁচ বছর) শেষ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে পিপিপির নেতৃত্বাধীন সরকার যদি এই টার্ম শেষ করে, তা হলে এটা হবে একটা রেকর্ড। পঞ্চম প্রশ্ন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের উত্থানের মধ্য দিয়ে যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে উচ্চ আদালতের এই রায়ের মধ্য দিয়ে আগামীতে ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির পথ কি উন্মুক্ত হল? ইমরান খান রাজনীতিতে এসেছেন কিছুদিন হল। তিনি একটি দলও করেছেন-‘তেহরিক-ই ইনসাফ’। তার মূল স্লোগান হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান। উচ্চ আদালত গিলানির বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছেন, তার পেছনেও কাজ করছে এই দুর্নীতির প্রশ্নটি। একসময় জারদারি পরিচিত ছিল ‘মি. টেন পারসেন্ট’ হিসেবে। স্ত্রী বেনজির ভুট্টো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বড় বড় কনট্যাক্ট তিনি পাইয়ে দিতেন অর্থের বিনিময়ে। ওই টাকায় তিনি দুবাইয়ে  বিশাল বাড়ি কিনেছেন। সুইজারল্যান্ড তথা লন্ডনেও রয়েছে তার সম্পদ। তবে তার প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফও ‘ধোয়া তুলসী পাতা’ নন। তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আগামীতে উচ্চ আদালত যদি নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধেও কোনো রুল ইস্যু করে আমি অবাক হব না। এর মধ্য দিয়ে তৃতীয় শক্তি হিসেবে ইমরান খান সামনে চলে আসছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইমরান খানের মাঝে বিকল্প শক্তি দেখতে চাইবে। পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের সঙ্গেও ইমরান খানের যোগাযোগ রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ইসরায়েল অনেকদিন ধরেই চাইছে পাকিস্তান তাদের স্বীকৃতি দিক। এখন ইমরান খানকে যদি ক্ষমতায় আনা যায়, তা হলে ইসরায়েলের স্ট্র্যাটেজি তাতে সার্থক হবে। উচ্চ আদালতের রায় ইমরান খানের ইসলামাবাদে যাওয়ার যাত্রাপথকে আরও প্রশস্ত করছে কি না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। ষষ্ঠ প্রশ্ন, এই রায় ইসলামী কট্টরপন্থীদের স্ট্র্যাটেজিতে আদৌ কি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনবে? আমার তা মনে হয় না। পাকিস্তান বাহ্যত ধীরে ধীরে আরেকটি ‘তালেবানি রাষ্ট্র’-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী পাখতুন খোয়া প্রদেশে সনাতন রাজনীতির কোনো প্রভাব নেই। এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তানপন্থী তালেবানরা। উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানসহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ এখন ইসলামিক কট্টরপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে। এদের সঙ্গে আফগানিস্তানের তালেবানদের রয়েছে যোগাযোগ। পাকিস্তান অধ্যুষিত এই অঞ্চলে একটি ইসলামপন্থী দল স্থানীয় ক্ষমতা পরিচালনা করে বটে, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে কট্টরপন্থীরা। তাই এখানে দীর্ঘদিন যাবত্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানববিহীন ড্রোন বিমান হামলা পরিচালনা করে আসছে। কট্টরপন্থীদের প্রভাব দিন দিন বাড়ছেই। পাঁচ-ছয় বছর আগে পাকিস্তান সফরে গিয়ে কট্টরপন্থীদের যে ‘শক্তি’ আমি দেখেছিলাম, আজ সেই ‘শক্তি’ কমেনি, বরং বেড়েছে। ইসলামাবাদে গিলানি সরকারের পতন ঘটলেও পাকিস্তানি তালেবানদের তাতে কিছু যায় আসে না। তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছেই।
পাকিস্তানে একটি পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান একজন নয়া প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। মনে রাখতে হবে, আগামী ২০১৩-১৪ সাল পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগানিস্তান থেকে সকল সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। এর ফলে কারজাই সরকার আদৌ কাবুলে থাকতে পারবে কি না সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মডারেট তালেবানদের সঙ্গে (যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে) কারজাই সরকারের যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল, তা খুব বেশি দূর যেতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরিভাবে এ অঞ্চলে তার স্বার্থ পরিত্যাগ করবে, আমার তা মনে হয় না। ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে নতুন করে এক স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’র এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে যাচ্ছে। ভারত হচ্ছে তার সঙ্গী। এ ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক্যালি পাকিস্তানের গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রথমত, আফগানিস্তানে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর জন্য রসদ সরবরাহের পথ পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে। পাকিস্তান এই পথ (খাইবার উপতক্যা) বন্ধ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার অন্যতম কারণ। ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য বেলুচিস্তানের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অতি জরুরি। পাকিস্তানের প্রদেশ বেলুচিস্তান থেকে ইরান সীমান্ত মাত্র ৭২ কিমি দূরে। তৃতীয়ত, গাওদারের গভীর সমুদ্রে রয়েছে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি। ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হলে বেলুচিস্তানের গাওদার ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন রয়েছে। সব মিলিয়ে তাই দরকার ইসলামাবাদে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার। গিলানি সরকার মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে পারছিল না। তাই তাকে চলে যেতে হল। আগামীতে যিনিই আসবেন তাকে মার্কিনি স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। তবে মার্কিন আইনপ্রণেতারা পাকিস্তান সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। পাকিস্তানের পরিস্থিতি ‘ব্লাক হোল’-এর মতো-কোন দিকে যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। আর এর শেষ কোথায়, তাও কেউ বলতে পারছে না।
Daily SAKALER KHOBOR
22.6.12

চীনকে টুকরো করতে মার্কিন সঙ্গী ভারত

অং সান সূ চি যেদিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন, সেদিন পুরো বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মিয়ানমারের দিকে। যাক বাবা, দীর্ঘ দিনের সামরিক শাসনের লৌহ কপাট ভেঙ্গে তাহলে দেশটি সংস্কার আর বিনিয়োগের পথ ধরেই আগাবে। ২৪ বছর পর পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে সূ চি দেশের বাইরে সফরে গিয়ে সেই আমন্ত্রণ জানালেন। আর সে নিমন্ত্রণ রক্ষায় যখন অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখনি ফের অঘটন।

আরাকানে মুসলিম নিধন। মিয়ানমারের এ প্রদেশটির নামও পাল্টে ফেলা হয়েছে রাখাইন নামে। দেশটিতে মুসলিম নিধন অনেক পুরোনো কাহিনী। রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী দাবি করে নাগরিকের মর্যাদা দিতে নারাজ মিয়ানমার।

এমনি এক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হামলার শিকার রোহিঙ্গা মুলমানদের সীমান্তে ফিরিয়ে না দিয়ে আশ্রয় দেবার আবেদন জানিয়েছে।

সরকারি হিসেবে ২৫ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয়ের হিসেব থাকলেও এ সংখ্যা বেসরকারি হিসেবে ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এ নিয়ে অনেক সামাজিক সংকট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ তাই আরো শরণার্থী নিতে রাজি নয়।

তাহলে যতই সংস্কারের কথা বলা হোক মিয়ানমারের শাসকদের মনোভাব এখনো পরিবর্তন হয়নি। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এ সহিংস হামলার আড়ালে বিশ্ব রাজনীতির পট পরিবর্তনের অন্য কোনো আলামত টের পাওয়া যাচ্ছে কি? যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার আগে মধ্য এশিয়ার অনেক দেশেই মুসলমানদের ওপর হামলা কিংবা স্বায়ত্তশাসনের দাবি তীব্র হয়ে উঠেছিল।

অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান আভাস দিয়েছেন চীনকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গী পেয়েছে ভারতকে। রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন উপলক্ষ মাত্র। সংস্কার, বিনিয়োগের পথ ধরে পুঁজিবাদের প্রবক্তারা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চীনকে একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে আগাচ্ছে।

রিয়েল-টাইম নিউজ ডটকম- এর সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক মনে করছেন আপাতত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হাতে মুসলিম নিধনের মত ঘটনা ঘটলেও এর একটা বিহিত মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সন্ধান করতেই হবে।

প্রশ্ন: কিছু দিন আগেই সমুদ্র সীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের ফয়সালা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার মেনে নিয়েছে। সংস্কার ও বিনিয়োগের জন্যে অনেক দেশ এখন মিয়ানমারের দিকে তাকাচ্ছে। আবার ভূকৌশলগত অবস্থান বিবেচনায় মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়ন প্যানেট্টা এ অঞ্চলে দেশটির নৌবাহিনীর তদারকি বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এমনি এক সময়ে মিয়ানমারে নতুন করে সহিংস ঘটনাকে আপনি কিভাবে দেখছেন।

অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: এ ঘটনার অনেকগুলো প্রেক্ষাপট আছে। অনেকগুলো দিক আছে। প্রথম দিকটি হল আমি ২১ শতকে একটা নতুন করে স্নায়ু যুদ্ধের আশঙ্কা করছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে স্নায়ু যুদ্ধের বিষয়টা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। এখন চীন অন্যতম সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি রুপে আবির্ভূত হয়েছে। এখন চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে স্নায়ু যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগর অন্যতম ক্ষেত্র। যাকে কেন্দ্র করে এই স্নায়ু যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে যে তাদের সামরিক প্রভাব বলয় বিস্তার করতে চাচ্ছে তার উদ্দেশ্য মূলত একটাই তা হচ্ছে চীনকে ধরে রাখা অর্থাৎ সেই মার্কিন কূটনীতিক জর্জ এফ কেনানের ‘কনটেইনমেন্ট’ থিউরি বাস্তবায়নে অগ্রসর হচ্ছে ফের যুক্তরাষ্ট্র। ওই কনটেইনমেন্ট থিউরির একটা এশীয় সংস্করণ আমরা দেখতে পাব। চীনকে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক নীতি থেকে বের করে আনতে তাকে ঘিরে ফেলা এবং খুব সম্ভবত চীনকে একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে যুক্তরাষ্ট্র একটা সুদূরপ্রসারী একটা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।

এক্ষেত্রে খুব আশ্চর্যজনকভাবে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। অতীতে ভারত কখনই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বা সামরিক বন্ধু ছিল না। কিন্তু একুশ শতকে এসে আমরা দেখলাম, সেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে সমর্থন জানাচ্ছে এবং এ অঞ্চল ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একটা বলয় তৈরি করছে যে বলয়টা চীনের বিরুদ্ধে কাজ করবে।

এখানে খুব সঙ্গত কারণেই মিয়ানমার একটা ফ্যাক্টর। দেশটির এক পাশে চীন ও অন্য পাশে বাংলাদেশ। এই মিয়ানমারকে যদি এখন নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তাহলে খুব সঙ্গত কারণেই চীনের ওপর চাপটা বাড়বে। এজন্যেই নতুন নতুন পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে, মিয়ানমারে সংস্কার বা উদার নীতি, অং সান সূ চির সাথে মার্কিন সখ্যতার মত বিষয়গুলো যদি আমরা এক নজরে আনতে চাই তাহলে দেখতে পাব মিয়ানমারে একটি তথাকথিত সংস্কারবাদী সরকার চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যে সরকার তার স্বার্থ রক্ষা করবে এবং বাহ্যত সে সরকার চীনের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান গ্রহণ করবে। এখন রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন একই সূত্রে গাঁথা।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে তারা মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে, এটাই কি যথেষ্ট নাকি কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে? বিশেষ করে ভূ-কৌশলগত অবস্থান দিক থেকে?

অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এককেন্দ্রীকমুখী পররাষ্ট্রনীতি। এটা করা হয়েছে ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার জন্যে। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। সেই বৃটিশ যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষ মিয়ানমারে যেয়ে কাজ করতে। আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের কদর সবার জানা। ভারতের শেষ স্বাধীন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের মাজার এখনো রেঙ্গুনে। বার্মার কালাপানিতে নির্বাসনের কাহিনী আজো গ্রামে গ্রামে মায়েরা শিশুদের গল্প বলে শোনায়। কিন্তু পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির কথা বলছি বটে, কিন্তু এজন্যে মিয়ানমার যে একটা ফ্যাক্টর, সেই দেশটির সাথে সুসম্পর্ক ধরে রাখা যায়নি। অস্বীকার করেছি। অবজ্ঞা করেছি। আর বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্কে একটা বড় বাধা রোহিঙ্গা সমস্যাতো আছেই।

প্রশ্ন: কিন্তু মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে ধরে নিয়ে তাদেরকে নাগরিকের মর্যাদা দিতে নারাজ। উল্টো দাবি করে আসছে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে রাখাইন রাজ্যে ঢুকে আবাস গড়ে তুলেছে।

অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে এসে অবৈধভাবে বসবাস করছে। দ্রুত আমাদের জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যাচ্ছে। সামাজিক সংকট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে পাসপোর্ট করে অন্য দেশে গিয়ে অপরাধ করলে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তারপরও বাংলাদেশের উচিত স্টাটাসকু বজায় রেখে  মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নত করা। কারণ আমাদের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে মিয়ানমার অন্যতম একটা ফ্যাক্টর হতে পারে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে একটা ফ্যাক্টর হতে পারে। গার্মেন্টস খাতের জন্যে মিয়ানমার থেকে তুল আমদানি করতে পারি। বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারি মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে। সীমান্তে বাঁধ নির্মাণ করে সেখানে বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব। মিয়ামারের আমাদের কৃষক যেয়ে কনট্রাক্ট ফার্ম করে বাড়তি ফসল বাংলাদেশে আনতে পারে। এধরনের অনেক বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যদি মিয়ানমারের সাথে সাংঘর্ষিক সম্পর্কের দিকে আগাই তা কখনো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্যে মঙ্গল ডেকে আনবে না।

প্রশ্ন: তাহলে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ত্রুটি কোথায়?

অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: আমি মনে করি পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজানো উচিত। মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেই পূর্বমূখী কূটনীতিতে এগিয়ে যেতে হবে। এটা আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, বহির্বিশ্বে আমাদের সম্মান উজ্জ্বল করা ছাড়াও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পূর্বমুখী কূটনীতি অনেক অবদান রাখবে।

প্রশ্ন: তো জাতিসংঘ বলছে মিয়ানমার থেকে শরণার্থী বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ঢুকতে দিক। এমনিতে সরকারি হিসেব ২৮ হাজার রোহিঙ্গা মুসলামান যা বেসরকারি হিসেবে প্রায় ৫ লাখ  শরণার্থী বাংলাদেশে বাস করছে। এরপরও কি বাংলাদেশের পক্ষে আরো শরণার্থীর চাপ সহ্য করা সম্ভব।

অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: বাংলাদেশ কোনো অবস্থাতেই রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ এমনিতেই একটা জনসংখ্যা বহুল দেশ। উপরন্তু রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের বাস করতে যেয়ে বনাঞ্চলের বড় ক্ষতি করেছে। এখন জাতিসংঘ কোন প্রেক্ষাপটে আরো শরণার্থী নিতে বলছে এটা বিবেচনায় আনতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টি এখন মিয়ানমারের দিকে। দেশটিতে তেল গ্যাসসহ প্রচুর খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। তারা পেয়েছেও। এখন মিয়ানমারকে যদি একটু হাতে রাখা যায়, তাহলে অনেক স্বার্থ আদায় করা সম্ভব। এখানে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ একটা বড় ঝুঁকির মুখে থাকলেও  কূটনৈতিক উদ্যোগটা কিভাবে গ্রহণ করবে, কিভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করবে এটাই হচ্ছে বড় কথা। জাতিসংঘ একটা কথা বললেই যে বাংলাদেশ মানবে তা নয়, এ ক্ষেত্রেও মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক রেখে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের সব সরকারই পূর্বমুখী কূটনীতির কথা বলে। তা যদি সম্ভব হত, রেল ও সড়ক পথে যোগাযোগ হলে দুদেশের মানুষের চলাচল ও পণ্যের আদান প্রদান হত। চীন, ভিয়েতনাম, লাওস বা আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মানুষের সাথে আরো যোগাযোগ বৃদ্ধি পেত, ওসব দেশ থেকে প্রযুক্তি আনা যেত যা বাংলাদেশের উৎপাদনশীল খাতে কাজে লাগানো যেত, কিন্তু তা হচ্ছে না কেনো?

অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: মূল কারণ একটাই। কূটনৈতিক ব্যর্থতা। আমরা আমাদের বন্ধু চিনতে ভুল করেছি। একমুখী পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে ভারতকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। সেখানে মিয়ানমারকে আমরা অবজ্ঞা করেছি। মিয়ানমার বাংলাদেশের স্বার্থে অনেক বড় অবদান রাখতে পারে। শুধু স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে নয়, খাদ্য ও জ্বালানির মত বিভিন্ন সংকটগুলো নিরসনে মিয়ানমারের কাছ থেকে একটা বড় সহায়তা পেতে পারি। এজন্যে সফল কূটনীতি প্রয়োগ করতে পারিনি। মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বাড়লে চীনের সাথে সম্পর্ক আরো বাড়বে।

আর যেটা বলা হচ্ছে যে, চীনের কুম্বিং থেকে কক্সবাজার রাস্তাটা চলে আসার কথা,  সেজন্যে সম্পর্ক উন্নয়ন হলেই তা সম্ভব হবে। চীনের সাথে সড়ক যোগাযোগ হলে বাংলাদেশের জন্যে একটা বিশাল ক্ষেত্র তৈরি হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আসিয়ানের বড় একটা বাজার রয়েছে। সেখানে ভারত তার পণ্য নিয়ে যেতে শুরু করেছে, আমরা পারছি না। কারণ চীন ও মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি না করে তা সম্ভব নয়। আর এগুলো আটকে আছে একমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্যে, একই কারণে আমরা মিয়ানমারকে উপেক্ষা করছি।

প্রশ্ন: কিন্তু মহাজোট সরকারতো সবসময় কানেকটিভিটির কথা বলে, এখন ভারত মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করছে, আমরা বসে আছি কেন? নাকি বসিয়ে রাখা হয়েছে? আমরাতো জানি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর প্রযুক্তি ও পণ্য উন্নত ও অপেক্ষাকৃত সস্তা তাইনা?

অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: খেয়াল করবেন, বাংলাদেশ ভারতের একটা বিশাল বাজার। আমাদের প্রয়োজন এমন প্রতিটি পণ্য ভারত উৎপাদন করে। যে পণ্যগুলো অনেক সহজ শর্তে আমরা চীন থেকে পেতে পারি। ভারত তা কখনই করতে দেবে না। কারণ বাংলাদেশে ভারত একটা বিশাল বাজার তৈরি করেছে। আর আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে পূর্বমুখী কূটনীতির পথ ধরে এগিয়ে যাই, বা ওসব দেশে পণ্য রফতানি করি তা ভারতের বণিকরা কখনই চাইবে না। এজন্যেই পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের প্রভাব ব্যাপকভাবে রয়েছে।

মুখে পূর্বমুখী কূটনীতির কথা বলছি বটে কিন্তু বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছি না। সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন চীনে গিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু কুম্বিং গিয়েছিলেন, সেখান থেকে কক্সবাজারের সাথে সংযোগ সড়কের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ঐ বক্তব্য কিন্তু ওখানেই থেকে গেছে। উনি এ প্রকল্প নিয়ে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে পারেননি।

প্রশ্ন: তাহলে প্রযুক্তির অভাব থেকেই যাচ্ছে, উৎপাদনশীল খাত বা উদ্যোক্তার বিকাশ অবহেলিত থাকবে কেবল? আমরা বিদেশি পণ্যের ভোক্তা হয়েই থাকব?

অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: দেখুন সারা বিশ্বে কানেকটিভিটির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তা যদি একমাত্র ভারতের সাথেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে তা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে না। শুধু ভারতের স্বার্থে কানেকটিভিটি নয়, সবার সাথেই তা উম্মুক্ত করতে হবে। চীন কিন্তু শ্রীলংকা ও পাকিস্তানে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে। বাংলাদেশেও গভীর সমুদ্র বন্দ্রর তৈরিতে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। কিন্তু সেই উদ্যোগ না নিয়ে শুধু আমরা মুখে মুখে বলছি।

প্রশ্ন: তাহলে নতুন করে মিয়ানমারে মুসলিম নিধন বা এধরনের আরো অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটবে বলে আপনি আশঙ্কা করছেন?

অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: না বিষয়টিকে আমি এভাবে দেখি যে, রোহিঙ্গা সমস্যা  একেবারেই মিয়ানমারের বিষয়। এ সমস্যা আজকের নয়, অনেক আগে থেকে। তবে মিয়ানমারে খুব সূক্ষ্মভাবে বুড্ডিষ্ট ডমিনেট তৈরি করা হচ্ছে। অর্থাৎ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটা কর্তৃত্ব মিয়ানমারের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। যে কারণে বৌদ্ধ ধর্মের বাইরে অন্য ধর্ম বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উচ্ছেদ করার একটা প্রক্রিয়া কিন্তু আজকে থেকে নয় অনেক আগে থেকেই  শুরু হয়েছে।

যার ফলশ্রুতিতেই বেশ কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে এসেছে। আমাদের পরিবেশ নষ্ট করছে। তাই সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়া এ সংকট মোকাবেলা করা যাবে না। ভারত এখন এগিয়ে আসছে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে। ভারত গণতন্ত্রের প্রবক্তা কিন্তু ভারত কখনো অং সান সূ চির মুক্তির ব্যাপারে বড় ধরনের কোনো ভুমিকা পালন করেনি। ভারতের প্রয়োজন ছিল জাতীয় স্বার্থ, সে কারণে মিয়ানমার সরকারের সাথে ভারত সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। অং সান সূ চির মুক্তি দাবি নয়, ভারত মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাস উত্তোলনে বিনিয়োগ করেছে, আরো অনেক প্রকল্প নিয়ে এগিয়েছে। বাংলাদেশের উচিত মিয়ানমার সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করে এগিয়ে যাওয়া।

জাবি উপাচার্যের এক মাস

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন তার দায়িত্ব গ্রহণের একমাস পার করলেন আজ। শিক্ষক ও ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং গত ২০ মে অধ্যাপক হোসেন জাবির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন। গত এক মাসে অধ্যাপক হোসেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেননি বটে; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এতদিন আন্দোলনে ছিলেন শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। এবারে আন্দোলনে নেমেছে কর্মচারীরা। পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে সদ্য নিয়োগ পাওয়া একজন শিক্ষক ও কয়েকজন শিক্ষার্থী জনৈক ঊর্ধ্বতন সহকারীকে লাঞ্ছিত করায় তারা আন্দোলনে নেমেছেন। তারা এই শিক্ষকের বিচারও দাবি করেছেন। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এখন উত্তপ্ত। এ ঘটনায় উপাচার্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। এদিকে সাবেক উপাচার্যের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তরা 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা' নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসেনের বিচার দাবি করে আসছেন। আর 'শিক্ষক সমাজ' নতুন করে আন্দোলনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছে। তাই সঙ্গত কারণেই নয়া উপাচার্যের জন্য দিনগুলো মোটেই ভালো নয়। একটি দাবি উঠেছিল, নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ব্যাপারে একটি 'রিভিউ কমিটি' গঠন করার। 'শিক্ষক সমাজ' এর দাবি ছিল এটি। জাবির নয়া প্রশাসন এখন একটি 'রিভিউ কমিট' গঠন করতে পারেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষককে দিয়ে এই কমিটি গঠন করলে, তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয় মুঞ্জরি কমিশনের একজন সদস্যকে দিয়ে এই 'রিভিট কমিটি' গঠন করা উত্তম। না হলে আন্দোলনকারীদের আস্থায় নেয়া যাবে না এবং নয়া প্রশাসন তার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার স্বার্থেই এই কাজটি করা জরুরি। একই সঙ্গে দুর্নীতির বড় অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে যে, শিক্ষক নিয়োগসহ কর্মচারী নিয়োগে লাখ লাখ টাকা হাতবদল হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, কর্মচারী নিয়োগে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। তাদের অনেকেই সাবেক ভিসির ঘনিষ্ঠ ছিলেন। গত ৪ মে দৈনিক যুগান্তরের শেষের পাতায় প্রকাশিত হয়েছে, জাবিতে চাকরি দেয়ার নাম করে ৪০ লাখ টাকাসহ জনৈক জসিমুদ্দিনকে আশুলিয়া পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওই ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার স্বার্থেই দুদককে দিয়ে দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত করা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, 'শিক্ষক সমাজ' ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের একটা দাবি ছিল, যেসব ছাত্র সাংস্কৃতিক কর্মী বিগত প্রশাসন দায়িত্ব নেয়ার পর ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল, তাদেরকে ক্যাম্পাসে, তাদের নিজস্ব হলগুলোতে তুলে দিয়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ছাত্রলীগের মূল ধারাটি ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত। এদেরকে ক্যাম্পাসে ফিরে আসার স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে ক্যাম্পাসে অবস্থান করা ও তাদের মাঝে সহাবস্থান নিশ্চিত করা এই মুর্হূতে জরুরি। নয়া প্রশাসন এই কাজটি করলে, তিনি তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারবেন। জাহাঙ্গীরনগরের লেকগুলো ছিল অতিথি পাখীদের একটি বড় আশ্রয়স্থল। লেক সংস্কারের নামে এই আশ্রয়স্থল ধ্বংস করা হয়েছে। গেলবার এখানে এই লেকে পাখি আসেনি। পাখিরা যাতে শীতে আসতে পারে, সে জন্য লেকগুলোতে পাখিদের আশ্রয়স্থল তৈরি করতে হবে। প্রশাসন অনেক গাছ কেটে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। জাবি প্রশাসনের উচিত হবে ক্যাম্পাসে ব্যাপক বনায়নের উদ্যোগ নেয়া। প্রশাসন প্রয়োজনে এ ব্যাপারে বন অধিদফতরের সহযোগিতা নিতে পারে। অভিযোগ আছে, একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী জন্ম হয়েছে জাহাঙ্গীরনগরে, যারা স্থানীয় অধিবাসীর নাম করে, ক্ষমতাসীন দলের নাম করে, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে শিক্ষক তথা কর্মচারী নিয়োগে প্রভাব খাটাচ্ছে। অনেকে অভিযোগ করেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকের ছেলে বা মেয়ে বা মেয়ের স্বামী এখানে ভর্তি হচ্ছেন, পরে শিক্ষক হচ্ছেন। এখানে মেধার চেয়ে ব্যক্তি সম্পর্ক কাজ করছে বেশি। এই প্রবণতা যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে আগামী দিনে মেধাবীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কোনো সুযোগই পাবে না। শিক্ষকের সন্তান শিক্ষক হতেই পারে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সন্তানের সেই 'মেধা' তারা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করাতে পারেন। বিগত প্রশাসনের আমলে যত বেশি শিক্ষকের সন্তান বা তাদের আত্মীয়-স্বজন শিক্ষক হয়েছেন, অতীতে কখনো এমনটি হয়নি। এটা এলার্মিং চিন্তা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যতের জন্য এটা মঙ্গল। জাবির সাবেক উপাচার্য দাবি করেছেন তার আমলে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এটা সত্য, অবকাঠামো খাতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বেশ কিছু ভবন তৈরি হয়েছে। কিন্তু একাডেমিক ভবন কী তৈরি হয়েছে? নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে। কিন্তু ক্লাসরুম নেই। পর্যাপ্ত ল্যাব নেই। শুধু প্রভাষকদের দিয়ে নতুন নতুন বিভাগে শিক্ষাদান করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের বয়স ১২ বছরের ওপরে হলেও, ৯ জন প্রভাষককে দিয়ে বিভাগ চলছে। প্রফেসর মাত্র একজন। শতকোটি টাকার 'উন্নয়ন' এর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু একাডেমিক উন্নতি কতটুকু হয়েছে? অনেক বিভাগেই (পুরনো বিভাগগুলো ছাড়া) সিনিয়ির শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সিনিয়র শিক্ষকদের ছাড়া যে একাডেমিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, নয়া প্রশাসন এটা উপলব্ধি করলে ভালো করবেন। প্রভাষক নয়, বরং সিনিয়র শিক্ষক নিয়োগ করা উচিত। অনেক বিভাগেই সিনিয়র-জুনিয়র শিক্ষক সম্পর্কে অবনতি ঘটেছে। এটা উচ্চশিক্ষার পথে বড় বাধা। এ ক্ষেত্রে সাবেক উপাচার্যের নেতৃত্বের ব্যর্থতা অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। নৃ-বিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিদ্যা কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ঘটনাবলির ব্যাপারে উপাচার্য মহোদয় তথা প্রশাসন যদি 'শক্ত' অবস্থান নিতেন, তাহলে পুলিশ দিয়ে শিক্ষক গ্রেফতারের ঘটনা ঘটত না। উপাচার্য মহোদয় এসব ঘটনা ঘটতে দিয়ে নিজে 'সুবিধা' নিয়েছেন_ এই অভিযোগ তিনি কাটাতে পারবেন না। জাবির পরিবহন প্রশাসনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সাবেক উপাচার্য একাধিক গাড়ি ব্যবহার করতেন (একটি অ্যাম্বুলেন্সসহ)। সরকারি খরচে তার ব্যক্তিগত কাজে এসব গাড়ি ব্যবহার করা হতো। সাবেক একজন উপ-উপাচার্য তার দীর্ঘ ৪ বছরের আমলে প্রতিদিন তিনি ঢাকা থেকে যাওয়া-আসা করে বিপুল জ্বালানি খরচ করেছেন। উপ-উপাচার্যের পদটি সার্বক্ষণিক, তার ক্যাম্পাসেই থাকার কথা। তিনি তা করেননি। বর্তমান উপ-উপাচার্যের জ্বালানি বিলের ব্যাপারেও কথা উঠেছে। এ ব্যাপারে বস্নগে ও সংবাদপত্রে বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, পরিবহন প্রশাসক নিজে সার্বক্ষণিক একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। এটি তিনি কোনো আইন বলেই পারেন না। পরিবহনের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা উচিত। নয়া প্রশাসনকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। জাবির প্রক্টরের কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সংকটের সময় তিনি বিদেশে ছিলেন। তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন, এটা জেনে-শুনেই তাকে প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এখন প্রক্টরিয়াল বডিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। বিগত তিন বছরে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী চাকরিচ্যুত হয়েছেন। এদের ব্যাপারটি নয়া প্রশাসন বিবেচনায় নিতে পারেন। দলীয় প্রশাসন নয়, বরং সবার মতামতের ও সহযোগিতার ভিত্তিতেই একটি প্রশাসন গড়ে তোলা উচিত। সিন্ডিকেট বা সিনেটের বাইরে নয়া প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থে একটি উপদেষ্টা পরিবষদ গঠন করতে পারেন, যাদের উপদেশ নিয়ে তিনি প্রশাসন পরিচালনা করবেন। যদিও এর কোনো আইনগত বৈধতা তিনি দিতে পারবেন না। কিন্তু 'শিক্ষক সমাজ' এর আন্দোলন প্রমাণ করেছে, নয়া প্রশাসনের জন্য এ ধরনের একটি উপদেষ্টাম-লী তার প্রয়োজন। ভিসি প্যানেল নির্বাচনের দাবি অনেক আগেই উঠেছে। এ ব্যাপারে তিনি উদ্যোগ নিতে পারেন। আগামী ২৯ জুন তিনি সিনিটের বিশেষ অধিবেশন ডেকেছেন। এখান থেকে ৩ জন সিন্ডিকেট প্রতিনিধি তিনি নির্বাচন করবেন। এখানেও অনেকের আপত্তি রয়েছে। নতুন সিনেট নির্বাচন করে এ কাজটি করলে তিনি ভালো করতেন। সামনে তার অনেক কাজ বাকি। ডিন নির্বাচনসহ সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন তাকে সম্পন্ন করতে হবে। তিনি ধীরে আগাচ্ছেন। এমনি সময় এলো কর্মচারীদের আন্দোলনের খবর। এ খবরগুলো ভালো নয়। নয়া ভিসিকে একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেবে। তাঁকে কাজ করতে দেয়া উচিত। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হোক। নিয়মিত ক্লাস হোক। পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন হোক। কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।
Daily DESTINY
20.6.12

কী হতে যাচ্ছে ঈদের পর





ঢাকার নয়া পল্টনে ১৮ দলের গণসমাবেশে গত ১১ জন বেগম জিয়া ঘোষণা করেছেন দাবি না মানলে ঈদের পর হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচি দেয়া হবে। ১৮ দলের মূল দাবি এখন একটাই আর তা হচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু সরকারের সম্মতি এতে নেই। সৈয়দ আশরাফ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলছেন বটে, কিন্তু এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি দেননি। এদিকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন আগামী ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা করা হবে, আর ২০১৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে (সমকাল, ১২ জুন)। নির্বাচনের সিডিউল ও তারিখ ঘোষণা করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী আগাম ঘোষণা কিভাবে দেন, তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। তবে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, তা হচ্ছে সংবিধানের কথা। বর্তমান সরকার ক্ষমতা ছাড়ার তিন মাস আগেই নির্বাচন দেবে এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন একটি 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই সেই নির্বাচনের আয়োজন করবে। বিএনপির আপত্তি সেখানেই। তাদের ভাষায় এতে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। এতে করে জট খুলবে না। কোনো সংলাপও হবে না। বলতে গেলে এ দেশের সুশীল সমাজের প্রায় সবাই বলছেন একটি সংলাপ হোক, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো দাঁড়া করানো হোক, যারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালিত করবে। হিলারি ক্লিনটন বলে গেলেন যে কথা। তার কথার প্রতিধ্বনি করলেন ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত। আর সর্বশেষ গত ৩০ মে তাদের সুরে সুর মেলালেন অ্যালিস্টার বাট, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মন্ত্রী। বললেন, 'বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করে যুক্তরাজ্য'। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কথা বললেন না বটে, কিন্তু সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বললেন। একটি সংলাপ হবে, এমনটাও আশা করলেন তিনি। কিন্তু ঘুরে-ফিরে সেই প্রশ্নই তো ফিরে আসছে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমরা নিশ্চিত করবো কিভাবে। সরকার হার্ডলাইনে গেছে। এ কথাটা সরাসরিই বলেন মন্ত্রীরা। এর প্রমাণ তো আমরা পাচ্ছিই। ৫ জন এমপিসহ বিরোধী দলের ৩৩ জন নেতাকর্মীকে জেলে পাঠানো হয়েছিল যে 'অভিযোগের' পরিপ্রেক্ষিতে, সেই 'অভিযোগটি' নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। অভিযোগটি গুরুতর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মুখে বাসে অগি্নসংযোগ। ৫ জন এমপি ছাড়া পেয়েছেন। বাকিরা ছাড়া পেয়েছেন পরে_ তাদের মধ্যে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবও। তার বিরুদ্ধে সচিবালয়ে বোমা নিক্ষেপের ঘটনায় অভিযোগ এনে চার্জশিটও দাখিল করা হয়েছে। ফলে ঝুলে গেছে সংলাপ প্রক্রিয়া। এখন সংলাপ হবে, এই বিশ্বাসটা রাখতে পারছি না। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছে। পুলিশ এখন নিয়ন্ত্রণবিহীন। কেউ তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সাংবাদিক পেটানো থেকে শুরু করে আদালতপাড়ায় তরুণীর শ্লীলতাহানি, বিচারক পেটানোর মতো ঘটনা ঘটিয়েছে পুলিশ। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে এ ঘটনায় ৩ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশও দিয়েছেন। অতীতেও একাধিকবার আদালত পুলিশ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতির নির্দেশও দিয়েছেন। ভর্ৎসনা করেছেন। তাতে কিছু একটা হয়েছে বলে মনে হয় না। যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে 'সার্টিফিকেট' দেন, যেখানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী 'সাংবাদিকদের পুলিশের কাছ থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেন', যেখানে অত্যন্ত ক্ষমতাবান আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব 'ষড়যন্ত্র' আবিষ্কার করেন, সেখানে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আমরা কী ভুলে গেছি বহির্বিশ্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকলাপ মনিটর করা হচ্ছে। অ্যালিস্টার বার্ট বলে গেলেন তারা র‌্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠায় র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দেয়া বন্ধ করেছেন। লন্ডনের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও পুশিল হেফাজতে নির্যাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। আর সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের যে রিপোর্ট তা তো আমাদের জন্য কোনো আশার কথা বলে না। রাজনীতির বাইরেও অর্থনীতির যে সূচক তাতেও তো কোনো ভালো খবর নেই। গড়ভিত্তিক মূল্যস্ফীতি তখন ১০.৮৬ শতাংশ। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি আগের অর্থবছরের ৪১.৪৭ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে মাত্র ৮.৪১ শতাংশ। অথচ আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১.২২ শতাংশ। টাকার মান কমেছে। কুইক রেন্টাল নিয়ে 'নানা' কাহিনী। এ 'কাহিনী' সাধারণ মানুষ জানে না। বোঝে না। কিন্তু বোঝে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ মাঝেমধ্যে আসে মাত্র। এখন শোনা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম আবার বাড়বে। 'কুইক রেন্টাল' নিয়ে সংসদে বিদ্যুৎ উপদেষ্টার সমালোচনা করলেন রাশেদ খান মেনন। আগামী দেড় বছর সরকারের জন্য অনেক কঠিন সময়। একটা সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে পরিস্থিতি যে অসহনীয় হয়ে উঠবে, তা বলার আর আপেক্ষা রাখে না। একটি সমঝোতা এখন কীভাবে সম্ভব? প্রধানমন্ত্রী তথা বর্তমান মন্ত্রিপরিষদকে ক্ষমতায় রেখে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেই সরকার বিরোধী দল কেন, কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে যদি ষষ্ঠ সংসদের মতো একটি ঝুঁকি নেয়, তাহলে সরকার ভুল করবে। আমরা আর ইয়াজউদ্দীন মার্কা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাবো না_ এটা ঠিক আছে। কিন্তু সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক না হোক, অন্য কোনো নামে একটি নির্দলীয় সরকার গঠন করতে হবে। বিএনপি যদি নিজেরাই একটা 'ফর্মুলা' দেয়, তাতেও আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। আর সেটা যে সংসদেই হতে হবে, তার কোনো মানে নেই। বিএনপি চলতি জুনের সংসদে যোগ দিয়ে এই 'ফর্মুলা' উপস্থাপন করতে পারে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দেশের দুটি অবিসংবাদিত শক্তি। দুটো শক্তিই প্রায় সমান সংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল এ কথাই প্রমাণ করে। এ ক্ষেত্রে কখনো আওয়ামী লীগ জনসমর্থনে এগিয়ে থাকে। কখনো থাকে বিএনপি। সুতরাং এটা উপলব্ধি করেই একটা সমঝোতা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ যদি ভালো কাজ করে থাকে, তাহলে জনগণ আবার দলটিকে ক্ষমতায় পাঠাবে। আর জনসমর্থন নিশ্চিত করা না গেলে, 'ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। গণতন্ত্রে এ কথাটাই শেখায়। সংবিধানের যুক্তি তুলে ধরা হয় বটে, কিন্তু বিশ্ব ইতিহাস বলে সংবিধানের বাইরে গিয়েও সমঝোতা হয়েছে। যেমন কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে ২০০৮ সালে সরকার ও বিরোধী দল মিলেই সেখানে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করে আসছে। আসলে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে আন্তরিকতা। বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ যদি আন্তরিক হয়, তাহলে সমাধান সম্ভব। হার্ডলাইন কখনো মঙ্গল ডেকে আনে না। দেয়ালের লিখনই তাই বলে। সরকার যেহেতু ক্ষমতায়, তাই উদ্যোগটি তাকেই নিতে হবে। সৈয়দ আশরাফ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি এখন এর কাঠামো তুলে ধরতে পারেন, যা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিছুটা ছাড় দেয়ার মানসিকতা তাদের থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি 'এলডার্স কাউন্সিল', সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন বিশিষ্ট নাগরিকের নেতৃত্বে একটি সরকার, সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের নিয়ে সরকার কিংবা সরকার ও বিরোধী দলের সমসংখ্যক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সরকার ইত্যাদি নানা ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আর আলোচনার মধ্য দিয়েই একটি পথ বের হয়ে আসবে। কিন্তু সরকারের হার্ডলাইনে যাওয়ার কারণে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না একটি সমঝোতা আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা? আর যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে দেশ যে এক গভীর সঙ্কটে পড়বে, তা আর কাউকে বলে দিতে হবে না। বেগম জিয়া ঈদের পরে কর্মসূচি দেবেন। হরতাল, অবরোধ দিয়ে সরকারের পতন হয় না। অতীতেও হয়নি। ১৮ দলের ১১ জুনের গণসমাবেশে সরকার তো নিজেরাই এক রকম 'হরতাল' ডেকে বসেছিল। ঢাকা অভিমুখে কোনো গাড়ি, লঞ্চ আসতে দেয়া হয়নি। কিন্তু তাতে গণসমাবেশ 'বাতিল' হয়নি। লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে গণসমাবেশ সমাপ্ত হয়েছে। এখন সরকার গণসমাবেশের ভাষা যদি বিবেচনায় নেয়, তাহলে একটা সমাধান সম্ভব। দেশ গভীর সঙ্কটে পড়ুক আমরা তা চাই না। জাতির বৃহত্তম স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে একটা সমাধান কাম্য। এ প্রশ্নে 'বিভক্তি' যদি থেকেই যায়, তাহলে তা আমাদের কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে নাDaily JAI JAI DIN18.6.12