রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

জনপ্রশাসনে অসন্তোষ ও একজন মনোয়ার হোসেনের আত্মহত্যা

একজন মনোয়ার হোসেন আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর আত্মহত্যার খবর ছাপা হয়েছে ১৩ জুলাইয়ের সংবাদপত্রে। এ ধরনের আত্মহত্যার খবর তো সংবাদপত্রে ছাপা হয়ই। মনোয়ার হোসেনের আত্মহত্যা আমার বিবেককে নাড়া দিয়েছে। কেননা তিনি জনপ্রশাসনে কর্মরত ছিলেন। দুই বছর ধরে তিনি ওএসডি অবস্থায় ছিলেন। অর্থাৎ জনপ্রশাসনে তাঁর নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। দু-দুবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মহত্যার পথই বেছে নিলেন। '৮৩ ব্যাচের জনপ্রশাসনের এই কর্মকর্তার বন্ধুরা অনেকেই সচিব হয়েছেন। আর তিনি যুগ্ম সচিব হিসেবে 'বসে' ছিলেন দীর্ঘ দুই বছর। চাকরিতে তাঁর বয়স সবার মতো দুই বছর বাড়লেও, পদোন্নতি তিনি পাননি। আত্মহত্যা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়; অভিযোগ উঠেছে যে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকে পদোন্নতি পেয়েছেন। ঢালাওভাবে জনপ্রশাসনে এই পদোন্নতিতে অনেক অযোগ্য ব্যক্তি পদোন্নতি পাচ্ছেন এবং যোগ্যদের বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। সরকারের উচ্চপর্যায়ের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের অভাবের ফলে (যুগান্তর, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১) জনপ্রশাসনে কাজের গতি আসছে না এবং 'চেইন অব কমান্ড' ভেঙে পড়ছে। ঢালাও পদোন্নতির ফলে জনপ্রশাসনে সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা (আমার দেশ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন কেন্দ্রীয় স্তরে বর্তমান সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদে ১২৭, যুগ্ম সচিব পদে ২৬৪ এবং উপসচিব পদে ২৫৮ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। মোট পদোন্নতি পেয়েছেন ৬৮১ জন। এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে বিদ্যমান বিধিবিধানের অপব্যবহার করে এক অশুভ নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে (নয়া দিগন্ত, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। দুঃখজনক হচ্ছে, এটা করতে গিয়ে ৭০০-এর অধিক জ্যেষ্ঠ ও পদোন্নতির সব শর্ত পূরণকারী কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাই ৮ ফেব্রুয়ারিকে অনেকে 'কালো দিবস' হিসেবে অভিহিত করেছেন (ঐ)। যে অভিযোগটি গুরুতর তা হচ্ছে, পিএসসি কর্তৃক নির্ধারিত জাতীয় মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, যারা পদোন্নতি পেয়েছেন, তাঁরা একটি বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী (ঐ)। পদোন্নতির জন্য আবশ্যক সিনিয়র স্টাফ কোর্স এবং উচ্চতর প্রশাসনিক ও উন্নয়নবিষয়ক কোর্স সম্পন্ন না করেই পদোন্নতি পেয়েছেন কয়েকজন। মজার ব্যাপার- শীর্ষ পর্যায়ে পদোন্নতির জন্য ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন এমন অনেকে এই দক্ষতা দেখাতে পারেননি। কেউ কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি ডিগ্রি 'ক্রয়' করে তাঁদের পদোন্নতি নিশ্চিত করেছেন। কেউ কেউ অনলাইনে একখানা পিএইচডি ডিগ্রি জোগাড় করে তা ব্যবহারও করছেন। উচ্চতর ডিগ্রি পদোন্নতির জন্য প্রয়োজন রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি ভুয়া ডিগ্রি যখন জনপ্রশাসনের কেউ ব্যবহার করেন, তখন আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। যাঁরা জনপ্রশাসনের শীর্ষে রয়েছেন, তাঁরা আশা করছি বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন।
জনপ্রশাসনে এভাবে ঢালাও পদোন্নতি, যাকে কি না 'সুনামি' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তা আমাদের দেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তাদের কোনো কারণ ছাড়াই বাদ দেওয়া, পদের চেয়ে দ্বিগুণ কর্মকর্তা (আমার দেশ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২) কিংবা যোগ্য কর্মকর্তাদের ওএসডি করা জনপ্রশাসনের জন্য কোনো সুস্থ লক্ষণ নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারি ('১২) পর্যন্ত ওএসডি হিসেবে কর্মরত ছিলেন ৮৩৫ জন, আর তিন বছর ধরে আছেন ১২৩ জন (আমার দেশ, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। দুঃখজনক হলেও সত্য, গেল আড়াই বছরে ওএসডি অবস্থায় পিআরএল-এ গেছেন ২২৭ জন কর্মকর্তা। কর্মহীন অবস্থায় পিআরএল-এ যাওয়ায় সহকর্মীদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেওয়ারও সুযোগ তাঁরা পাননি। সারা জীবন যিনি জাতির জন্য, রাষ্ট্রের জন্য শ্রম দিলেন, মেধা দিলেন, তাঁকে বাধ্য করা হলো পিআরএল-এ যেতে- ওএসডি থাকা অবস্থায়ই। সুষ্ঠু জনপ্রশাসনের জন্য এ ধরনের প্রবণতা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। ইতিমধ্যে সচিবদের মধ্যে আটটি সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করে এক তুঘলকি কাণ্ড ঘটানো হয়েছে জনপ্রশাসনে। এমনকি পুলিশের মহাপরিদর্শককে সিনিয়র সচিব পদ দিয়ে পুলিশ বিভাগে একাধিক সচিব পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই 'সিনিয়র সচিব' পদ সৃষ্টি কিংবা পুলিশ বিভাগের জন্য একাধিক সচিব পদ সৃষ্টি জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ও কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য আদৌ করা হয়নি। বরং বিশেষ ব্যক্তিকে খুশি করা, একই সঙ্গে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে দিয়ে সুবিধা আদায় করার নিমিত্তেই করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে জনপ্রশাসনে ওই যে পদোন্নতি, তার কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। শুধু বিধিমালা দিয়েই চলছে গত ৪১ বছর (ডেসটিনি, ১৭ এপ্রিল ২০১২)। শুধু দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতির স্বার্থেই কোনো আইন করা হয়নি। এখানে অভিযোগ উঠেছে যে আইন প্রণয়ন না হওয়ায় শুধু ১৩৩ অনুচ্ছেদ নয়, সংবিধানের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদের নির্দেশনাও যথাযথভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। ইতিমধ্যে একটি সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টের কথা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে এবং এর একটি খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। এই আইনটি বাস্তবায়ন হলে কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যেত। এতে করে প্রশাসনের ওপর দলীয়করণের খৰ অনেকাংশে কমত। বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার কালাকানুন থাকত না। মেধাবী কর্মকর্তারা নির্ভয়ে কাজ করতে পারতেন। প্রস্তাবিত এই অ্যাক্টে ২৮টি আলাদা ক্যাডার সার্ভিস প্রথা তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, প্রতিটি পদে পদোন্নতি পেতে হলে লিখিত পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণরাই কেবল পদোন্নতির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। কিন্তু এটি করা হচ্ছে না শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায়। প্রশাসনে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই প্রস্তাবিত আইনটি পাস হচ্ছে না।
একটি দেশ ও সরকারের মস্তিষ্ক হলো জনপ্রশাসন। এ জন্যই জনপ্রশাসনে যোগ্য লোকের দরকার। অযোগ্য, অদক্ষ ও মেধাহীন কর্মকর্তারা যদি দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি পান, তাঁরা দরকষাকষিতে কোনো যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারবেন না। ফলে বিদেশে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে তাঁরা ব্যর্থ হবেন। এ জন্য দরকার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ। আন্ত-ক্যাডার কলহ, বদলি আতঙ্ক, পদায়নবৈষম্য ইত্যাদি উপসর্গ দূর করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যদি দূর করা না যায়, তাহলে সেই প্রশাসন দিয়ে জাতির কোনো মঙ্গল প্রত্যাশা করা যায় না। একজন মনোয়ার হোসেন আত্মহত্যা করলেন। তিনি কি কোনো প্রতিবাদ করে গেলেন? যাঁরা আজ জনপ্রশাসনের শীর্ষে রয়েছেন, তাঁরা কি বিষয়টি নিয়ে ভাববেন? হতাশা মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, মনোয়ার হোসেনের আত্মহত্যা তার বড় প্রমাণ। আত্মহত্যা পাপ। এটি কাম্য নয়, সমর্থনযোগ্যও নয়। তবুও এই আত্মহত্যা একটি 'মেসেজ' দিয়ে গেল- কোনো কর্মকর্তা তাঁর অধিকার থেকে যেন বঞ্চিত না হন। যোগ্য ও মেধাবীরাই যেন পদোন্নতি পান। আর কোনো রাজনৈতিক বিবেচনাই যেন জনপ্রশাসন পরিচালনায় মুখ্য হয়ে দেখা না দেয়। এ দেশে রাজনীতি থাকবে। রাজনীতিবিদরাই দেশ পরিচালনা করবেন। একটি রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা অন্য একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসাবে। এ ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনকে রাজনীতির ঊধর্ে্ব রাখা উচিত। এখানে মনোয়ার হোসেনের মতো কর্মকর্তারা যেন পদবঞ্চিত না হন। পদোন্নতি তাঁদের অধিকার। এই অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা ঠিক নয়।Daily KALER KONTHO01.08.12

এ কিসের ইঙ্গিত দিলেন ড্যান মজিনা

ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে মজিনা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পেতে হলে বাংলাদেশকে ‘টিকফা’ বা ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম অ্যাগ্রিমেন্ট’ চুক্তি করতে হবে। এর আগে তিনি প্রেসক্লাবের ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন, যার একটি নেতিবাচক দিক আছে। তিনি ওই অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, এ দেশের পণ্য কিনতে মার্কিন ক্রেতারা ঝুঁকি না-ও নিতে পারেন। এই বক্তব্যটি এল এমন একটি সময়ে যখন পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। সরকার এখন চেষ্টা করছে এডিবি, আইডিবি কিংবা জাইকা থেকে এই ফান্ড জোগাড় করতে। কিন্তু কাজটি খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের কারণে অন্য দাতা সংস্থাগুলো আগ্রহী হবে বলেও মনে হয় না। সরকার এরই মধ্যে আবার সিদ্ধান্তও নিয়েছে যে, বিশ্বব্যাংকের কাছে আর ধরনা তারা দেবে না। গত ৯ জুলাই মন্ত্রিসভায় একটি সিদ্ধান্তও হয়েছে যে পদ্মা সেতু সরকার নিজেই করবে। সরকার যদি নিজেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করে, এর প্রতিক্রিয়া, ৩০ প্রজেক্টে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ভবিষ্যত্ ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু আমি গুরুত্ব দিতে চাই ড্যান মজিনার বক্তব্যটিতে, যেখানে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশি পণ্য বিক্রি বন্ধ হয়ে যেতে পারে (?)। এই বক্তব্যটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বক্তব্য নয়। এটি রাষ্ট্রদূত মজিনার উপলব্ধি। তিনি দু’সপ্তাহ যুক্তরাষ্ট্রে থেকে সম্প্রতি ঢাকায় ফিরে এসেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এই দু’সপ্তাহে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর, পেন্টাগন, মার্কিন কংগ্রেস ছাড়াও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এসব কথাবার্তা থেকে তার মনে হয়েছে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপারে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা তথা ব্যবসায়ীরা একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আর বাংলাদেশি পণ্য মানেই তো তৈরি পোশাক। সেই তৈরি পোশাক রফতানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তার কী প্রতিক্রিয়া হবে আমরা কি তা আদৌ ভেবে দেখেছি? শুধু বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের কারণেই যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতায় কিছুটা দাগ লেগেছে, তা নয়। বরং শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার ঘটনা, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ-ইত্যাদি নানা কারণে মাঝে মধ্যেই দু’দেশের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর ওপরে রয়েছে ড. ইউনূস ইস্যুটি। যদিও মজিনা বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুর ঘটনায় ইউনূসের হাত নেই।’ এটাই সত্য এবং বাস্তব। কিন্তু ড. ইউনূসের অনেক ‘বন্ধু’ রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তার পরিচয় রয়েছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। এদের অনেকেই গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসের অপসারণে খুশি হননি। খোদ হিলারি ক্লিনটনও অখুশি। অতি সম্প্রতি ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তার উদ্বেগ আবার প্রকাশ করেছেন। এই সংবাদটি যে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছে গেছে এটা স্বাভাবিক। হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের সময় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তিনি সময় বের করতে পারেননি। কিন্তু ঠিকই ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি একটি মেসেজ দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকরা ওই  মেসেজটি বুঝতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। ঢাকা সফরে মিসেস ক্লিনটন ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান ও গার্মেন্ট শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড নিয়েও মন্তব্য করেছিলেন। এরপর অনেক সময় পার হয়ে গেছে। আজও ইলিয়াস আলী ফিরে আসেননি। তিনি মৃত, কি বেঁচে আছেন, আমরা কেউ তা জানি না। রাষ্ট্রের এতগুলো এজেন্সি তার অন্তর্ধান সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারবে না, এটা আশা করা যায় না। ঠিক তেমনি শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামকে কারা হত্যা করল, তা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানবে না, তা তো হতে পারে না। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই ভূমিকা তাদেরকে আরও বিতর্কিত করেছে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হলেও তাতে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন চিন্তা-চেতনার জন্ম হয়েছিল মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে। ক্লিনটনের সফরের সময় একটি ‘অংশীদারি সংলাপ’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যার বিস্তারিত আমরা কিছুই জানি না। অভিযোগ আছে, যুক্তরাষ্ট্র ‘চীনকে ঘিরে ফেলার’ যে স্ট্র্যাটেজি রচনা করছে, তাতে এই চুক্তি একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ‘আকসা’ চুক্তি নিয়েও কথা আছে। ‘আকসা’ চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র তাদের সশস্ত্র বাহিনীর জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রাবিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ বিভিন্ন সুবিধার জন্য ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। এই চুক্তি নিয়েও কথা আছে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি বাংলাদেশে মার্কিন ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, যদিও বাংলাদেশ এখনও চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়নি।
আর এখন মজিনা বললেন ‘টিকফা’ চুক্তির কথা। এই চুক্তিটি আসলে কী, কিংবা এতে করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আমরা অনেকেই জানি না। সংবাদপত্রেও এটা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। তবে মজিনা বলেছেন, এই চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষিত হবে। কীভাবে হবে, তা অবশ্য তিনি বিস্তারিত বলেননি। এমনকি এই চুক্তির সঙ্গে ‘টিফা’ বা টিআইসিএফ চুক্তির কোনো যোগ আছে কি না, তা-ও আমরা নিশ্চিত নই। যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই ‘টিফা’ চুক্তি করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়নি। এখন বাংলাদেশের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র টিআইসিএফ চুক্তি করার প্রস্তাব করে। চুক্তিটির পূর্ণ নাম হচ্ছে ‘ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম’। বাংলাদেশ যদি এই চুক্তি স্বাক্ষর করে তাহলে বাংলাদেশ পাইরেটেড কোনো পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। শ্রমিকের মানও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। তা ছাড়া ওষুধ প্রস্তুত ও রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত ডব্লিউটিও’র কাছ থেকে ট্রিপসের আওতায় যে সুবিধা ভোগ করছে, তা-ও বাতিল হতে পারে। আসলে টিআইসিএফের বিকল্প নাম হচ্ছে ‘টিফা’। এর বিস্তারিত কোনো পক্ষ থেকেই উপস্থাপন না করায় তাতে নানা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো একটি চুক্তির প্রস্তাব করে। তখন এর নাম ছিল ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা ‘টিফা’। ২০০২ সালে প্রণীত টিফার প্রথম খসড়াটিতে ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আপত্তি থাকায় ২০০৫ সালে সংশোধিত টিফায় ৭টি ধারা ও ১৯টি প্রস্তাবনা বহাল থাকে। ওই সময় সংশোধিত টিফায় ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে বিনিয়োগ বাতিল করাসহ মামলার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টিও শর্ত হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র টিফা চুক্তির খসড়ায় ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর প্রস্তাবনায় মেধাস্বত্ব অধিকার, আন্তর্জাতিক শ্রম মান ও পরিবেশগত সুরক্ষা এই তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। শুধু এই তিনটি ধারাই নয়, বরং টিফা চুক্তির একাধিক ধারা ছিল বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। যেমন বলা যেতে পারে মেধাস্বত্ব আইন। এটা মানলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে ধস নামবে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর প্রায় ৫৫টি দেশে ওষুধ রফতানি করে। বাংলাদেশের ওষুধের মান আন্তর্জাতিক মানের। এখন মেধাস্বত্বের শর্তের কারণে বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশের ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্য সংশ্লিষ্ট দেশ বা কোম্পানির অনুমতি ছাড়া তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের একটি বিশেষ অধিকার রয়েছে। ওষুধের প্যাটেন্ট ব্যবহার করেই বাংলাদেশ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ তৈরি করছে, যা দিয়ে দেশের লাখো মানুষ উপকৃত হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সুযোগ ভোগ করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শর্তের কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে শ্রমমানের কথা বলছে, সেটা নিয়েও কথা আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইএলও’র মান বজায় রাখা কঠিন। ইউরোপের একজন শ্রমিক যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন এবং শ্রমিকদের যে মান, তার সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মানের বিচার করা যাবে না। ইউরোপে একজন শ্রমিকের যে অধিকার, সেই অধিকার বাংলাদেশের শ্রমিকদের নেই। এটাই বাস্তব। এই বাস্তবতা মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব শ্রমিক মানকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের শ্রমমানকে বিচার করা যাবে না। সুতরাং আজ ‘টিকফা’ বলি, আর ‘টিআইসিএফ’ চুক্তি বলি কোনো চুক্তিই বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করবে না। বরং এ ধরনের চুক্তি মার্কিনিদের স্বার্থই রক্ষা করবে মাত্র। এ ধরনের কোনো চুক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারকে কোনোমতেই মেলানো যাবে না। শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার আমাদের অধিকার। আমরা তো একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রকে সুযোগ দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু বিনিময়ে আমাদের প্রাপ্তি শূন্য। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন’ (এমসিসি) থেকেও কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিভিন্ন দেশকে বড় অঙ্কের মজুরি সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এমসিসি গঠন করেছিল মার্কিন কংগ্রেস। এর যুক্তি হিসেবে সুস্পষ্টভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া না হলেও ধারণা করা হচ্ছে গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, বিনিয়োগের পরিবেশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এমসিসি থেকে বাংলাদেশকে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ড. ইউনূসের বিষয়টিও যে অন্যতম একটি কারণ, তা জোসেফ ক্রাউলির একটি মন্তব্য থেকে জানা যায়। জোসেফ ক্রাউলি মার্কিন কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। দুর্নীতির বিষয়টি এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে। আর এখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললেন ‘টিকফা’ চুক্তি না হলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি। নিঃসন্দেহে এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র এখানে নাক গলাতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো আমরা যেমন শ্রমমান নির্ধারণ করতে পারি না, ঠিক তেমনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা
আমাদের যে সুযোগ দিয়েছে, সেই
সুযোগ আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। মজিনার ‘হুমকি’তে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করবে, এটা জাতি প্রত্যাশা করে না।
Daily SAKALER KHOBOR
31.7.12

সবাইকে আস্থায় আনতে পারাও গণতন্ত্র

 গত ২০ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল নির্বাচনের পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে কি স্থিতিশীলতা আদৌ ফিরে আসছে? একদিকে শিক্ষকদের এক অংশের অনশন, অন্যদিকে সিনেটের অধিবেশন_ এটা ছিল ২০ জুলাইয়ের চিত্র। জাবির ভিসি ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমুন্নত রাখতে চেয়েছিলেন। সে কারণে ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ভিসি প্যানেল নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন; কিন্তু তা অত সহজ ছিল না। শিক্ষকদের একটি শক্তিশালী গ্রুপ (আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামমনা শিক্ষকদের সমন্বয়ে) প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত কোর্টের আদেশ নিয়ে তাকে এ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়। এ নির্বাচন অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এলো, সেসব প্রশ্নের জবাবের ওপর নির্ভর করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী দিনের রাজনীতি। প্রশ্ন এক. এই নির্বাচন প্রমাণ করল সাবেক ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর এখনও জনপ্রিয় এবং সমান শক্তিশালী। জাবির শিক্ষক রাজনীতিতে তিনি যে একটি ফ্যাক্টর, এটা তিনি আবারও প্রমাণ করলেন। তিনি সর্বোচ্চ ৫০ ভোট পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের অবস্থান দ্বিতীয়, তাও টস করে। যদি গণতান্ত্রিক চেতনার কথা বলা হয় তাহলে রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীরকে আবার নিয়োগ দেবেন। যদিও আইনে এটি স্পষ্ট করে বলা নেই যে, সিনেটে সর্বোচ্চ ভোট যিনি পাবেন রাষ্ট্রপতি তাকেই উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন। রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে আবার নিয়োগ দিয়েছেন। তবে এটাও সত্য, রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের ওপর তা নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রপতি অনেক কিছু বিবেচনায় নেবেন। তবে এটাও সত্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে পুরস্কৃত হওয়া অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর একজন \'সুপার ভিসি\' হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন বলেই অনেকের ধারণা।
এখন প্রশ্ন_ আন্দোলনকারীদের ভূমিকা কী হবে? তারা অনশন করেছেন। অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন। সেটা ছিল তাদের \'প্রতিবাদ\'। কিন্তু এখন? সিনেটে একটি প্যানেল নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। একটি বৈধ প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাবিতে। তাদের পক্ষে আন্দোলন করা এখন কঠিন হবে। নতুন করে আন্দোলন সংগঠিত করার কাজটি অত সহজ হবে না। নয়া প্রশাসনের উচিত হবে, আন্দোলনকারী সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের সঙ্গে একটা \'ডায়ালগ\' ওপেন করা। তাদের আস্থায় নিতে হবে। আস্থায় নিতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতা থেকেই যাবে। অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর সমর্থিত শিক্ষকদের একটি অংশ তাকে ছেড়ে সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদে যোগ দিয়েছিল। তাদের অন্যতম ছিলেন যৌন অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালায়র একমাত্র শিক্ষক। গত ১৮ জুলাই প্রশাসনিকভাবে সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে তিনি তাদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজও সারেন। এখন এসব শিক্ষককে কি শরীফ সমর্থিত বঙ্গবন্ধু পরিষদ ফিরিয়ে নেবে? নাকি চিহ্নিত করে তাদের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেবে? অভিযোগ উঠেছিল, মেয়াদোত্তীর্ণ সিনেট, সিন্ডিকেট ও ডিন নির্বাচনের। ডিন নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। বাকি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে কর্তৃপক্ষ ভালো করবে। তবে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের ফলাফল ডিন নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। ৪টি ডিন নির্বাচনে অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীরের সমর্থকরা এখন ভালো করবেন। এর অর্থ জাবির সিন্ডিকেটও এখন থাকবে শরীফ সমর্থিতদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। গত কয়েক মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। ভিসি উৎখাত আন্দোলনের সময় একটি ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ইমেজ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু অনেক কাজ এখনও বাকি। অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর ভিসি থাকার সময় কিছু ভুল-ভ্রান্তি করেছেন।
তিনি তা স্বীকারও করেছেন। সে ভুলগুলো থেকে যদি \'কিছু\' শিখে থাকেন তাহলে তিনি ভালো করবেন। জাবির ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন গত ২৯ জুন ৩১তম সিনেট অধিবেশনে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছিলেন, তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে চান। এখন এ স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপটি কী হবে?
একটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে জাবিতে। এতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩-এর চর্চা হয়েছে বটে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু শুধু এর নামই গণতন্ত্র নয়। বরং গণতন্ত্রে বলে সবাইকে নিয়ে কাজ করার কথা। আস্থা অর্জন করাটা জরুরি। সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের ব্যানারে যারা এতদিন আন্দোলন করে আসছিলেন তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় একটি সুবিবেচকের পরিচয় দিয়েছেন। তারা অনশনও দীর্ঘস্থায়ী করেননি। এটা ভালো লক্ষণ। নয়া প্রশাসনকে এখন এদিকগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। প্রশাসনকে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের আস্থায় নিতে হবে। এভাবেই গণতন্ত্র চর্চাকে আরও শক্তিশালী করা যায়। নির্বাচনে বিজয়ের নামই গণতন্ত্র নয়। আস্থায় নেওয়ার আরেক নামও গণতন্ত্র। একটি \'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস\', অর্থাৎ পরস্পরের প্রতি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। দ্বিতীয় যে কাজটি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, শিক্ষার একটা পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। বেশ ক\'টি বিভাগে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘি্নত হচ্ছে নানা কারণে। তরুণ শিক্ষকদের একটা অংশের উদ্যত আচরণ, সহকর্মীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রদর্শন, ক্লাস না নেওয়া, দলবাজিতে ব্যস্ত সময় পার করা, সিনিয়র শিক্ষকের অভাব প্রভৃতি কারণে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশাসনকে এখন এদিকটার দিকে নজর দিতে হবে। অনেক বিভাগে অধ্যাপক নেই। অথচ ওইসব বিভাগে পিএইচডি-এমফিল প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। বিভাগে সিনিয়র শিক্ষক ছাড়া পিএইচডি প্রোগ্রাম কীভাবে চালু হয়? বিজনেস স্টাডিজ ও আইন অনুষদ চালু হয়েছে। কিন্তু অধ্যাপক নেই। ফলে উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। সামনে প্রথম বর্ষ অনার্সের ভর্তি পরীক্ষা। ৬১ হাজার ছাত্রছাত্রী এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাদের অনেকের আশার জায়গা এই জাহাঙ্গীরনগর। আন্দোলনকারী শিক্ষকদের আস্থায় নিয়েই এ ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে। অতীত আঁকড়ে থাকলে চলবে না। সামনের দিকে তাকাতে হবে। জাবিতে উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচন নতুন একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করল। সবকিছু ভুলে, সবাইকে নিয়েই এ \'স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর\' গড়তে হবে। এ কাজটি করতে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের দায়িত্ব যত না বেশি তার চেয়ে বেশি প্রশাসনের। প্রশাসনকেই এখন উদ্যোগ নিতে হবে। সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ একটি শক্তিশালী পক্ষ। সাবেক দুই উপাচার্যের আশীর্বাদ রয়েছে তাদের পেছনে। সুতরাং তাদের আস্থায় নিতে না পারলে স্থিতিশীলতা বিপন্ন হবে। বারবার আন্দোলন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি যেমন নষ্ট করে, ঠিক তেমনি এটাও সত্য যে, আন্দোলনের কারণগুলো যদি আমরা অনুসন্ধান করি এবং সে মতে ব্যবস্থা নিই তাহলে তা বন্ধ করা সম্ভব। আসুন, সবাই মিলে আমরা জাহাঙ্গীরনগরকে গড়ে তুলি, যেখানে কোনো প্রতিপক্ষ থাকবে না। কাউকে আমরা প্রতিপক্ষ ভাববও না। যারা সমালোচনা করে তাদের আস্থায় নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াব। এরই নাম গণতন্ত্র। শুধু নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে নিশ্চিত করে না।
Daily SAMAKAL,
29.7.12

বাঙালি প্রণব বাংলাদেশের কী উপকারে আসবেন?


ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন প্রণব মুখার্জি, প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ‘চানৈক্য’ হিসেবে পরিচিত প্রণব মুখার্জির জন্য আমাদের সবার গর্ব হওয়ারই কথা। আমাদের নড়াইলের তিনি ‘জামাই বাবু’। আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সেই সম্পর্ক আজও বজায় আছে। সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছিল, অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার ঢাকা সফরের সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে তাকে পায়েস রান্না করে খাইয়েছিলেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকেও তিনি ভোলেননি এতগুলো বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও। এ ধরনের একজন ব্যক্তিত্ব যখন ভারতের নয়াদিল্লির রাইসিনা হিলের রাষ্ট্রপতি ভবনে উঠলেন, তখন তো আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জানেন। ভারতীয় মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশের বিষয়টি তিনিই দেখভাল করতেন। অতীতে সমস্যাগুলোর ব্যাপারে তিনি যে একটা সমাধান বের করতে পেরেছিলেন, সে কথা আমি বলব না। তবে তার আন্তরিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না। অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক’মাস আগেও তিনি ঢাকা ঘুরে গেছেন। তখনও তিনি আমাদের আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। বলেছেন, সমস্যার সমাধান হবে। ধৈর্য রাখতে হবে।
ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। ভারতের বৈদেশিক নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দ্বিপাক্ষিকতা, অথচ আমরা বিশ্বাস করি বহুপাক্ষিকতায়। আর ওই দ্বিপাক্ষিকতার কারণেই অনেক সমস্যার জট খুলছে না। একজন নীতিনির্ধারক হিসেবে প্রণব মুখার্জি এসব জানতেন। আগে কেবিনেটের একজন সদস্য হিসেবে তিনি যতটুকু প্রভাব রাখতে পারতেন, এখন তার সুযোগটি সীমিত। এখন তিনি রাষ্ট্রপতি, এখন আর কেবিনেট সদস্য তিনি নন। কোন নীতিনির্ধারণী সভায়ও তিনি থাকবেন না। তিনি এখন সবার অভিভাবক, রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তি। রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তি এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তার সেই সুযোগও নেই। সংবিধান তার ক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছে। তিনি চাইলেও অনেক কিছু করতে পারবেন না। তবে আমরা তো প্রত্যাশা করবই। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে দু’দেশের মাঝে বিরোধ আছে। সমস্যার সমাধান হয়নি। এখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি নীতিনির্ধারণ করতে পারবেন না বটে, তবে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণের কাছে তার অভিমত তো রাখতে পারবেন।
তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারটি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। চুক্তি হচ্ছে না। এ সংক্রান্ত কোন দিকনির্দেশনা না থাকলেও, বিবিসির বাংলা বিভাগ (৯ মে) আমাদের জানাচ্ছে যে, তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে আদৌ কোন চুক্তি হচ্ছে না। এ কথাটা নাকি দীপু মনিকে জানিয়েও দেয়া হয়েছে। যদিও দীপু মনি তা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত প্রতিশ্র“তি দিলেও এখন অবধি কোন চুক্তি হয়নি। এখানে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই। কিন্তু ভারত আমাদের সেই অধিকার নিশ্চিত করছে না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও ভারত আমাদের বারবার মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একাধিকবার বলেছেন, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? নয়াদিল্লিতে ইতিমধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সেখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার। প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপিও ব্যয় হয়ে গেছে। বাঁধটি যদি নির্মিত হয়, তাতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হবে, তা একাধিক সেমিনারে আলোচিত হয়েছে। এখানে আমাদের ব্যর্থতা আমরা শক্ত অবস্থানে যেতে পারছি না। জেসিসির যৌথ ইশতেহারে এ সংক্রান্ত কোন কথা বলা হয়নি। গঙ্গা চুক্তি আমরা করেছিলাম ১৯৯৬ সালে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। এর আগেই পদ্মায় পানি নেই। চুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি না। ২০২৭ সালে লোকসংখ্যা বাড়বে ৩ গুণ। যে বিপুল পানির চাহিদা থাকবে, তার কী হবে? চুক্তি অনুযায়ী পর্যালোচনার সুযোগ আছে। কিন্তু সেই সুযোগটি আমরা নিচ্ছি কই? অতীতে কখনও আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি। সীমান্ত হত্যা আজও বন্ধ হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও একের পর এক সীমান্ত হত্যা হচ্ছে। এমন কোন দৃষ্টান্ত নেই যেখানে বিজিবির গুলিতে কোন ভারতীয় নাগরিক মারা গেছেন। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন নিরপরাধ বাংলাদেশী নাগরিক। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৪২ মাসে কতজন বাংলাদেশী মারা গেছেন, তার পরিসংখ্যান ‘অধিকার’-এর কাছে আছে। এ নিয়ে কত শীর্ষ বৈঠক হল। কিন্তু হত্যা বন্ধ হয়নি। প্রণব মুখার্জি যখন ঢাকায়, তখনও এটা নিয়ে কিছু বলা হল না। সীমান্ত চিহ্নিত ও অপদখলীয় ভূমির ব্যাপারেও প্রণব মুখার্জি মুখ খোলেননি ঢাকায়। গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি।
বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ব্যাপারে আমরা কিছুই শুনলাম না। ভারতের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা ভারতেই থাকতে চান। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবেই থাকতে চান। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই ১৯৭৪ সালে। তারপর কখনোই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগ নেয়নি সংবিধান সংশোধন করার। সমস্যাটা তো আমাদের নয়। সমস্যাটা ভারতের। আজ প্রায় ৩৮ বছর পরও এ কথাগুলো আমাদের বলতে হয়। এতে কি ভারতের সদিচ্ছা প্রকাশ পায়? ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। প্রণব মুখার্জি ঢাকায় এসে ২০ কোটি ডলার অনুদানের কথা বলে গেলেন। কিন্তু ঋণের টাকা দিয়ে তো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না? ১৩টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার অভাবে প্রকল্পগুলো আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে। আর ২০১১-১২ সালের পরিসংখ্যান যখন আমাদের হাতে আসবে, ধারণা করছি তা ৪ বিলিয়ন ডলারের অংককে ছাড়িয়ে যাবে। ভারত মাঝে মধ্যে কিছু পণ্যের শুল্কমূল্য প্রবেশাধিকারের কথা বলে বটে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ এসব পণ্যের অনেকগুলোই রফতানি করে না। ভারতের অশুল্ক বাধা দূর করা নিয়েও নানা কাহিনী আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নানা ধরনের শুল্ক দূর করা যাচ্ছে না। ফলে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি সেই তুলনায় বাড়ছে না। শুধু ঘাটতি বাড়ছেই। এটা আমাদের জন্য শংকার কারণ।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি নিয়ে আদৌ কোন অগ্রগতি নেই। ২০১৩ সালে আমরা বিদ্যুৎ পাবÑ এ ব্যাপারটি আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। বাংলাদেশ বড় ধরনের বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে রয়েছে। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন বন্ধ অনেক কারখানায়। অথচ ভারত যদি আন্তরিক হয়, তাহলে আমাদের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
মহাজোট সরকারের গত ৪২ মাসে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব ভারতের পাল্লা ভারি, আমাদের প্রাপ্তি কম। আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর), কিন্তু ট্রানজিট ফি এখনও নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপাক্ষিকতার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেল ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটো দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এই সুবিধা এই দুটো দেশকে নিশ্চিত করা হয়েছেÑ এ তথ্য আমাদের জানা নেই। আগামীতে ভারতের ‘সাত বোন’ রাজ্যগুলোও আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করবেÑ এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতাও স্বাক্ষরিত হয়েছে। অথচ আমাদের যে ন্যূনতম প্রাপ্তি, সে ব্যাপারে এতটুকু ভারতীয় উদ্যোগও আমরা লক্ষ্য করিনি। আজ তাই প্রণব মুখার্জি যখন ভারতের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছেন, আমরা চাইব তার প্রতি সম্মান দেখিয়েই ভারত সমস্যাগুলোর সমাধানে উদ্যোগ নেবে। প্রণব মুখার্জি বরাবরই আমাদের সম্যাগুলোর ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশ বরাবরই একটি ফ্যাক্টর। আগামীতে ২০১৪ সালে ভারতে সাধারণ নির্বাচন। ইউপিএ জোটে ভাঙনের আলামত শোনা যাচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেস পুনরায় ডিগবাজি খেয়ে যে বিজেপি শিবিরে যাবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই। সুতরাং ভারতীয় নেতৃবৃন্দেরই উচিত হবে সমস্যাগুলোর সমাধান করা। সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে তা এক নির্বাচনী ইস্যু হতে পারে ভারতে। এমনকি বাংলাদেশে মহাজোট সরকারের জন্যও তা কোন ভালো সংবাদ হবে না।
ভারতের কংগ্রেসের রাজনীতিতে অত্যন্ত মেধাবী এই বাঙালি এখন রাইসিনা হিলের রাষ্ট্রপতি ভবনে। তিনি নিশ্চয়ই সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারককে এই পরামর্শটিই দেবেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান করা হোক। আমরা বাংলাদেশীরা, প্রণব মুখার্জির রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণকে স্বাগত জানাই।
Daily JUGANTOR
28.7.12

পদ্মা সেতু ও আমাদের পররাষ্ট্র নীতি


প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু নিয়ে বহিঃবিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়ার পর এডিবিও বলেছে, তারা পদ্মা সেতু নির্মাণে কোনো অর্থ দেবে না। পদ্মা সেতুর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশমাফিক ব্যবস্থা না নেয়ায় এডিবি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। সরকার স্পষ্টতই বিশ্বব্যাংককে উপেক্ষা করে পদ্মা সেতু নির্মাণে একটি তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। অনেকটা ঘরে ঘরে চাঁদা আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত ১৭ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকে ছবিও ছাপা হয়েছেÑ তাতে দেখা যায় চাঁদার বাক্স নিয়ে ছাত্রলীগের সোনার টুকরার ছেলেরা চাঁদাবাজি করছে। একই দিন ছাপা হয়েছে আরেকটি সংবাদÑ পদ্মা সেতু নির্মাণে চাঁদার টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে খুন হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা আব্দুল্লাহ আল হাসান। এই পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে সরকার একটি চাঁদাবাজি  সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। অথচ মূল বিষয়ের দিকে সরকার যায়নি। দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদেরকে স্বচ্ছতার স্বার্থে তাদের পদ থেকে অব্যাহতি না দিয়ে বরং প্রকারান্তরে দুর্নীতিকে সমর্থন করেছে। অথচ এতে করে বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের যে কতবড় ক্ষতি হয়ে গেল সরকার তা একবারও চিন্তা করেনি। এখন পদ্মা সেতুতে আদৌ কোনো বিদেশী সাহায্য পাওয়া যাবে না। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়েও কথা আছে। কিন্তু যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হলো, তা উদ্ধার করবো কিভাবে? ইতোমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা ঢাকায় যে বক্তব্য রেখেছেন, তা আমাদের জন্য উদ্বেগের আরেক কারণ। গত ১০ জুলাই প্রেস কাবের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের পণ্য কিনতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ঝুঁকি নাও নিতে পারে। দু’দেশের মাঝে বিভিন্ন ইস্যুতে সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছে, মজিনার বক্তব্যে সেটাই ফুঁটে উঠেছে। মজিনা ইঙ্গিত করেছেন বাংলাদেশী গার্মেন্টস পণ্যের দিকে। বাংলাদেশী পণ্য বয়কট করতে পারে মার্কিন ব্যবসায়ীরা! এর বেশকটি কারণও রয়েছে। শুধু যে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, সেটাই মুখ্য বিষয় নয়। বরং শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর ‘গুম’ হয়ে যাবার ঘটনা, যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশÑ ইত্যাদি নানা কারণে মাঝেমধ্যেই দু’দেশের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর ওপরে রয়েছে ড. ইউনুস ইস্যুটি। যদিও মজিনা বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুর ঘটনায় ইউনুসের হাত নেই’। এটাই সত্য এবং বাস্তব। কিন্তু ড. ইউনুসের আরেক ‘বন্ধু’ রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে নীতি নির্ধারকদের সাথে তার পরিচয় রয়েছে ব্যক্তিগতপর্যায়ে। এদের অনেকেই গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনুসের অপসারণে খুশি হননি। খোদ হিলারি কিনটনও অখুশি। অতি সম্প্রতি ড. ইউনুস গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তার উদ্বেগ আবার প্রকাশ করেছেন। এই সংবাদটি যে মার্কিন নীতি নির্ধারকদের কাছে পৌঁছে গেছে এটা স্বাভাবিক। হিলারি কিনটনের ঢাকা সফরের সময় রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাতের জন্য তিনি সময় বের করতে পারেননি। কিন্তু ঠিকই ড. ইউনুসের সাথে দেখা করেছিলেন। এর মধ্যে দিয়ে তিনি একটি ম্যাসেসজ দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের নীতি নির্ধারকরা ওই ম্যাসেজটি বুঝতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। ঢাকা সফরে মিসেস কিনটন ইলিয়াস আলীর অর্ন্তধান ও গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড নিয়েও মন্তব্য করেছিলেন। এরপর অনেক সময় পার হয়ে গেছে। আজো ইলিয়াস আলী ফিরে আসেননি। তিনি মৃত, কি বেঁচে আছেন, আমরা কেউ তা জানি না। রাষ্ট্রের এতোগুলো এজেন্সি তার অর্ন্তধান সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারবে না, এটা আশা করা যায় না। ঠিক তেমনি শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামকে কারা হত্যা করলো, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানবে না, তা তো হতে পারে না। বিষয়টি খুবই স্পর্শকতার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই ভূমিকা তাদেরকে আরো বিতর্কিত করেছে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হলেও, তাতে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। হিলারি কিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন চিন্তা-চেতনার জন্ম হয়েছিল মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে। কিনটনের সফরের সময় একটি ‘অংশীদারী সংলাপ’ চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল, যার বিস্তারিত আমরা কিছুই জানি না। অভিযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্র ‘চীনকে ঘিরে ফেলার’ যে স্ট্রাটেজি রচনা করছে, তাতে এই চুক্তি একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ‘আকসা’ চুক্তি নিয়েও কথা আছে। ‘আকসা’ চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রা বিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ বিভিন্ন সুবিধার জন্য ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। এই চুক্তি নিয়েও কথা আছে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি বাংলাদেশে মার্কিন ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যদিও বাংলাদেশ এখনও চুক্তি সাক্ষরে রাজি হয়নি।
এমনি এক সময় আসলো দুর্নীতির প্রশ্নটি। বিশ্বব্যাংক মূলত ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর ও ২০১২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেশ করে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অভিযোগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক আলোচিত দুটি অভিযোগের ব্যাপারে সরকার ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। একটি বাইরের প্যানেলের কাছে তথ্য দেয়ার এবং প্যানেলকে তদন্ত প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ততা মূল্যায়নের সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হলেও তা দুর্নীতি দমন কমিশন মেনে নেয়নি। এছাড়া তদন্ত চলকালে সরকারি দায়িত্ব পালন থেকে সরকারি ব্যক্তিবর্গকে (আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব) ছুটি দিতেও সরকার রাজি হয়নি। মূলত এ দুটো বিষয়ে ঐক্যমত না হওয়ায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। এখন সরকার সামনের নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতুটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে। কেননা সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণের। কিন্তু সেতুর দীর্ঘস্থায়িত্বতা, টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি, বৈদেশিক মুদ্রার যোগান নিয়ে যে বড় প্রশ্ন ইতোমধ্যেই উঠেছে, তা সরকার একবারও ভেবে দেখেনি। এটা নিয়ে সরকার প্রধানের খামখেয়ালি, বারেবারে ড. ইউনূসকে জড়িত করার প্রক্রিয়া (একাধিকবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও বিশ্বব্যাংক থেকে অস্বীকার করা হয়েছে) বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এই ভাবমূর্তি উদ্ধারে এতোটুকু উদ্যোগও লক্ষ করা যাচ্ছে না। সরকারের ভাবমূর্তি আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তা কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলেই বোঝা যাবে। গত ২০ জুলাই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একটি খবর ছাপা হয়েছে, মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেককে উদ্ধৃতি করে। লেখক বলেছেন, বাংলাদেশে হত্যা ও গুমের সাথে র্যাব জড়িত। এই বক্তব্য তিনি দিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসে। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মার্কিন সরকারের নীতি প্রতিফলিত হলো। এই বক্তব্য কোনো আশার কথা বলে না। এখন কংগ্রেসের কোনো সদস্য যদি বাংলাদেশ বিরোধী কোনো আইন কংগ্রেসে উপস্থাপন করে, আমি অবাক হবো না। সম্ভবত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা এ দিকটার দিকেই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন বলিÑ সম্প্রতি বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় জার্মানিও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে এসেছিলেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওইডো ভেস্টারভেল। তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির উপস্থিতিতেই যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে এই কথাগুলো বলেছিলেন, যা সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছিল। একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও। সবচেয়ে যা দুঃখজনক তা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাপারে দাতা দেশগুলোর নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহেও এক ধরনের মন্থরতা সৃষ্টি হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায় গেল জুন পর্যন্ত (২০১২)। আমাদের বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ছিল ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু মে পর্যন্ত গেল ১১ মাসে প্রতিশ্রুতি আদায় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ৪২৮ কোটি ৪২ লাখ ৪ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের মতো কম প্রতিশ্রুতি। এখন পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির প্রশ্ন ওঠায় বিশ্বব্যাংকসহ অন্য দাতারাও যে অর্থ ছাড়করণের ব্যাপারে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করবে, এটা স্বাভাবিক। বিশ্বব্যাংক ছাড়াও, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান বাংলাদেশকে বড় অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। এখন এই অর্থ প্রবাহে মন্থরতা আসবে। বিশ্বব্যাঙ্ক প্রায় ৩০টি প্রকল্পে অর্থ যুগিয়ে থাকে। ঐসব প্রকল্পগুলো নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠতে পারে। দাতাদের সাথে সম্পর্ক আরো নষ্ট হবে যদি সত্যি সত্যিই ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ সরকার শুরু করে দেয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুতি দেয়া ১২০ কোটি ডলারের পাশাপাশি এডিবি ৬১ কোটি ডলার ও জাপান ১৪ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছিল। এখন আর এদের থেকে ঋণ পাওয়া যাবে না। পদ্মা সেতুতে মোট খরচ ধরা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার, বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ২৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা।
সরকার এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা দেশকে আগামী দিনে একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে ফেলে দেবে। বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে যেতে পারে। শুধুমাত্র একজন মন্ত্রীকে বাঁচাতে (যায়যায়দিন) সরকারের এই সিদ্ধান্ত জাতিকে কড়া মূল্য দিতে হবে। এতে করে নির্মাণ খরচ বাড়বে। দক্ষতার প্রশ্ন উঠবে। সেতুর দীর্ঘস্থায়িত্ব একটি প্রশ্নের মুখে থাকবে। মালয়েশিয়ার প্রস্তাবও টেকসই নয়। বিশ্বব্যাংকের ঋণের সুদের চাইতে মালয়েশিয়াকে সূদ দিতে হবে অনেক বেশি। এটা কোন গোয়ার্তুমির বিষয় নয়। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তে শুধুমাত্র এক ধরনের গোয়ার্তুমিই প্রতিফলিত হয়নি, বরং বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিল। কোন খাত থেকেই এই ২৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। চাঁদা তুলে, একদিনের বেতন দিয়ে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা কী সম্ভব? সরকার মূলত একটি ভাওতাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এটা মূলত আওয়ামী লীগের একটি নির্বাচনী স্ট্রাটেজিÑ জনগণকে আশ্বাস দেয়া যে, পদ্মা সেতু হবে। আসলে এ সরকারের পক্ষে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব নয়

ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি

স্বাধীন ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন প্রণব মুখার্জি। এটা অনেকটা প্রত্যাশিতই ছিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ (২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে ১৩ মে ১৯৬২) আর তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৩তম প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন ৭৬ বছর বয়সী প্রণব মুখার্জি। ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো কংগ্রেস দলের সদস্য হয়ে রাজ্যসভায় তিনি প্রবেশ করেছিলেন। সেই থেকে শুরু। দীর্ঘ ৩৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটিয়েছিলেন তিনি শুধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রার্থী হওয়ার জন্য। রাষ্ট্রপতির কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে না। তিনি নিরপেক্ষ। জাতির প্রতীক। একসময়ে কাজপাগল এ মানুষটির রাইসিনা প্যালেসে এখন দিন কাটবে বই পড়ে আর বাগান করে। ভারতের রাজনীতিতে রাষ্ট্রপতির সেই অর্থে কোনো ভূমিকা নেই। সংবিধান তার ক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছে। তিনি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণব মুখার্জির এ বিজয় আমাদের জন্য একাধিক কারণে গর্বের। প্রথমত, তিনি বাঙালি হওয়ায় আমরা গর্বিত। দ্বিতীয়ত, তিনি আমাদের নড়াইলের জামাই। সে কারণে তিনি আমাদেরও আত্মীয়। স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির পৈতৃক বাড়ি নড়াইলে। তৃতীয়ত, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রয়েছে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক। তাই আমরা আশা করতেই পারি যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে তিনি কিছুটা হলেও অবদান রাখবেন। এ সম্পর্ক তো এখন নানা জটিলতায় আটকে আছে। বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে যার সমাধান হচ্ছে না। অতি সম্প্রতি নয়াদিলি্লতে জেসিসির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও, বন্দি বিনিময়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যাতে ভারতের প্রাপ্তি বেশি।
এটা অনেকেই জানেন, এ চুক্তিটি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ভারত মূলত একটি জিনিসই চায়_ আর তা হচ্ছে উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত। অনুপ চেটিয়া এখন বাংলাদেশের জেলে আটক। বন্দি বিনিময়ের যে চুক্তিটি চূড়ান্ত করা হয়েছে তাতে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি নিজ দেশে সাজা খাটার সুযোগ পাবেন। এ ক্ষেত্রে অনুপ চেটিয়া ভারতে সাজা খাটতে পারেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এ মুহূর্তে অনুপ চেটিয়াকে খুবই দরকার। উলফার নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার একটা আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। উলফার চেয়ারম্যান এখন তাদের কব্জায়। এ জন্যই তাদের অনুপ চেটিয়াকে দরকার। কিন্তু বিষয়টি কী অত সহজ হবে? অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে একটি আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। কেননা সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। তার সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী কোনো ব্যক্তিকে ফেরত পাঠানো যায় কি না, তা এক প্রশ্ন বটে। যে কোনো আন্তর্জাতিক আইনের এটা পরিপন্থী। এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। এই চুক্তিতে আমাদের কোনো লাভ হয়নি।
তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারটি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। চুক্তি হচ্ছে না। এ সংক্রান্ত কোনো দিকনির্দেশনা না থাকলেও, বিবিসির বাংলা বিভাগ (৯ মে) আমাদের জানাচ্ছে, তিস্তার পানি বণ্টনের বাপারে আদৌ কোনো চুক্তি হচ্ছে না। এ কথাটা নাকি দীপু মনিকে জানিয়েও দেয়া হয়েছে। যদিও দীপু মনি তা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন অব্দি কোনো চুক্তি হয়নি। এখানে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই। কিন্তু ভারত আমাদের সেই অধিকার নিশ্চিত করছে না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও ভারত আমাদের বারবার মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একাধিকবার বলেছেন ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? নয়াদিলি্লতে ইতিমধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সেখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার। প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপিও ব্যয় করা হয়ে গেছে। বাঁধটি যদি নির্মিত হয়, তাতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হবে, তা একাধিক সেমিনারে আলোচিত হয়েছে। এখানে আমাদের ব্যর্থতা, আমরা শক্ত অবস্থানে যেতে পারছি না। জেসিসির যৌথ ইশতেহারে এ সংক্রান্ত কোনো কথা বলা হয়নি। গঙ্গা চুক্তি আমরা করেছিলাম ১৯৯৬ সালে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। এর আগেই পদ্মায় পানি নেই। চুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি না। ২০২৭ সালে লোকসংখ্যা বাড়বে ৩ গুণ। যে বিপুল পানির চাহিদা থাকবে, তার কী হবে? চুক্তি অনুযায়ী পর্যালোচনার সুযোগ আছে। কিন্তু সেই সুযোগটি আমরা নিচ্ছি কৈ? অতীতে কখনো আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি। সীমান্ত হত্যা আজো বন্ধ হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও একের পর এক সীমান্ত হত্যা হচ্ছে। এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই যেখানে বিজেবির গুলিতে কোনো ভারতীয় নাগরিক মারা গেছে। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে নিরাপরাধ বাংলাদেশি নাগরিকরা। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৪০ মাসে কতজন বাংলাদেশি মারা গেছে, তার পরিসংখ্যান 'অধিকার' এর কাছে আছে। এ নিয়ে কত শীর্ষ বৈঠক হল। কিন্তু হত্যা বন্ধ হয়নি। প্রণব বাবু যখন ঢাকায়, তখনো এটা নিয়ে কিছু বলা হল না। সীমান্ত চিহ্নিত ও অপদখলীয় ভূমির ব্যাপারেও প্রণব বাবু মুখ খোলেননি ঢাকায়। গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১টি সিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি সিটমহলের ব্যাপারে আমরা কিছুই শুনলাম না। ভারতের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা ভারতেই থাকতে চান। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবেই থাকতে চান। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই ১৯৭৪ সালে। তারপর কখনই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগ নেয়নি সংবিধান সংশোধন করার। সমস্যাটা তো আমাদের নয়। সমস্যাটা ভারতের। আজ প্রায় ৩৮ বছর পরও এ কথাগুলো আমাদের বলতে হয়। এতে করে কী ভারতের সদিচ্ছা প্রমাণ করে? ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। প্রণব বাবু ঢাকায় এসে ২০ কোটি ডলার অনুদানের কথা বলে গেলেন। কিন্তু ঋণের টাকা দিয়ে তো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না? ১৩ প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার অভাবে প্রকল্পগুলো আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে। ২০১১-১২ সালের পরিসংখ্যান যখন আমাদের হাতে আসবে, ধারণা করছি তা ৪ বিলিয়ন ডলারের অংককে ছাড়িয়ে যাবে। ভারত মাঝেমধ্যে কিছু পণ্যের শুল্কমূল্য প্রবেশাধিকারের কথা বলে বটে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ এসব পণ্যের অনেকগুলোই রফতানি করে না। ভারতের অশুল্ক বাধা দূর করা নিয়েও 'নানা কাহিনী' আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নানা ধরনের শুল্ক দূর করা যাচ্ছে না। ফলে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি সেই তুলনায় বাড়ছে না। শুধু ঘাটতি বাড়ছেই। এটা আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি নিয়ে আদৌ কোনো অগ্রগতি নেই। কিন্তু আদৌ ২০১৩ সালে আমরা বিদ্যুৎ পাব_ এ ব্যাপারটি আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। বাংলাদেশ বড় ধরনের বিদ্যুৎ সংকটের মুখে। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন বন্ধ অনেক কারখানায়। অথচ ভারত যদি আন্তরিক হয়, তাহলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব। ভুটানে সারপ্লাস বিদ্যুৎ রয়েছে। এই বিদ্যুৎ ভুটান বাংলাদেশে রফতানি করতে পারে। সম্মতি প্রয়োজন ভারতের। কিন্তু ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়নি। আশুগঞ্জে যে কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের ব্যাপারে দুই দেশের মাঝে চুক্তি হয়েছে, তাতে লাভবান হবে ভারত। আমরা লাভবান হব না। ভারত তার পণ্যের পরিবহন সুবিধার জন্যই এই টার্মিনাল ব্যবহার করছে। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে আমরা ভারতীয় কনটেইনারগুলো পরিবহনের সুযোগ করে দিয়েছি। ভারত প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আমাদের স্বার্থ হয়ে পড়েছে গৌণ। আজ জেসিসির বৈঠকের পর যৌথ ইশতেহারে যেসব বক্তব্য স্থান পেয়েছিল, তাতে ওই ভারতীয় স্বার্থকেই বেশি করে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। প্রণব বাবু ঢাকায় এসে আমাদের স্বার্থে কোনো কথা বলে যাননি। তিনি ভারতীয় স্বার্থ দেখবেন, এটই স্বাভাবিক। তবুও বাঙালি হিসেবে তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবেই। তিনি কতটুকু কী করতে পারবেন, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। সংবিধান অনুযায়ী তার ক্ষমতাও সীমিত। তিনি কিছু করতে চাইলেও, করতে পারবেন না। তিস্তার পানি বণ্টনে মমতার আপত্তি আমাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করছে। প্রণব মুখার্জি একটা সমাধান চাইলেও, তাতে তিনি সফল হবেন না। তবুও লাখ লাখ বাংলাদেশির একটা প্রত্যাশা থেকে যাবেই। আমরা প্রণব মুখার্জিকে স্বাগত জানাই এবং প্রত্যাশা করি আগামীতে কোনো একসময় ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশেও আসবেন তিনি।
Daily DESTINY
25.7.12

অনিশ্চয়তার আবর্তে পদ্মা সেতু




পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন বন্ধ ঘোষণা করলে, সরকার নিজ উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এত বড় একটি সেতু আদৌ স্ব উদ্যোগে নির্মাণ করা যায় কিনা, আমাদের সেই টেকনিক্যাল জ্ঞান আছে কিনা, এসব বিষয়গুলো কতটুকু বিবেচনায় নেয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। খোদ অর্থমন্ত্রী যখন নিজেই সন্দিহান, সেখানে সরকার সমর্থক কিছু অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন 'নিজস্ব টাকায় চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব' (আমার দেশ, ২০ জুলাই)। ড. আবুল বারকাতের বক্তব্য এভাবেই ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। তিনি তত্ত্ব দিয়েছেন ১২টি উৎস থেকে চার বছরে ৯৮ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব। একটি সেমিনারে যে ১২টি উৎসের কথা তিনি বলেছেন, এগুলো সবই তত্ত্বের কথা। প্রবাসীদের পাঠানো টাকা, পেনশন ফান্ড, দেশজ ব্যাংক ব্যবস্থা, দেশীয় বীমা কোম্পানির যে উৎসের কথা তিনি বলেছেন, তা অঙ্কের হিসেবে হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তব নিরিখে ঠিক নেই। এগুলো সবই প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করা। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু নিয়ে চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। একজন ছাত্র চাঁদার টাকা ভাগাভাগিতে খুনও হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য মহোদয়রা এখন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন কে কত বেশি টাকা প্রধানমন্ত্রীর ফান্ডে জমা দেবেন। উদ্দেশ্য কিন্তু পদ্মা সেতু নয়, উদ্দেশ্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এভাবে চাঁদা আদায় করে বিশাল বাজেটের পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যায়, এটা বোধকরি বাংলাদেশেই সম্ভব। এমনিতেই নানা কারণে বহির্বিশ্বের বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে র‌্যাবকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এখন পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির প্রসঙ্গটি যোগ হলো। এর ফলে আমাদের ভাবমূর্তি যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াল, তা আমাদের নীতিনির্ধারকরা আদৌ চিন্তা করছেন না। অভিযুক্ত মন্ত্রী অবশ্য পদত্যাগ করেছেন। দুদক থেকে তিনি ইতোমধ্যে একখানা সার্টিফিকেটও জোগাড় করে ফেলেছেন। পত্রিকায় বিশাল একখানা বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর ও ২০১২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেশ করে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অভিযোগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক আলোচিত দুটি অভিযোগের ব্যাপারে সরকার ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। একটি বাইরের প্যানেলের কাছে তথ্য দেয়ার এবং প্যানেলকে তদন্ত প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ততা মূল্যায়নের সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হলেও তা দুর্নীতি দমন কমিশন মেনে নেয়নি। এছাড়া তদন্ত চলাকালে সরকারি দায়িত্ব পালন থেকে সরকারি ব্যক্তিবর্গকে (আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব) ছুটি দিতেও সরকার রাজি হয়নি। এ দুটো বিষয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। এখন সরকার সামনের নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতুটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে। কেননা সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণের। কিন্তু সেতুর দীর্ঘস্থায়িত্বতা, টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি, বৈদেশিক মুদ্রার জোগান নিয়ে যে বড় প্রশ্ন ইতোমধ্যেই উঠেছে, তা সরকার একবারো ভেবে দেখেনি। এটা নিয়ে সরকার প্রধানের খামখেয়ালি, বারেবারে ড. ইউনুসকে জড়িত করার প্রক্রিয়া (একাধিকবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও বিশ্বব্যাংক থেকে অস্বীকার করা সত্ত্বেও), বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এ ভাবমূর্তি উদ্ধারে এতটুকু উদ্যোগও নষ্ট করা যাচ্ছে না। সরকারের ভাবমূর্তি আজ কোন পর্যায়ে উত্থিত হয়েছে, তা কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলেই বোঝা যাবে। ২০ জুলাই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একটি খবর ছাপা হয়েছে, মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট বেস্নককে উদ্ধৃতি করে। বেস্নক বলেছেন বাংলাদেশে হত্যা ও গুমের সঙ্গে র‌্যাব জড়িত। এ বক্তব্য তিনি দিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসে। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মার্কিন সরকারের নীতি প্রতিফলিত হন। এ বক্তব্য কোনো আশার কথা বলে না। এখন কংগ্রেসের কোনো সদস্য যদি বাংলাদেশ বিরোধী কোনো আইন কংগ্রেসে উপস্থাপন করে, আমি অবাক হবো না, সম্ভবত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনো এ দিকটার দিকেই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন জানি- সম্প্রতি বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি বিশেষ করে বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনায় জার্মানিও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে এসেছিলেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওইডো ভেস্টারভেল। তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির উপস্থিতিতেই যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথাগুলো বলেছিলেন, যা সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছিল। একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও। সবচেয়ে যা দুঃখজনক তা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাপারে দাতা দেশগুলোর নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহেও এক ধরনের মন্থরতা সৃষ্টি হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা গেল জুন পর্যন্ত (২০১২) আমাদের বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ছিল ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু মে পর্যন্ত গেল ১১ মাসে প্রতিশ্রুতি আদায় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ৪২৮ কোটি ৪২ লাখ ৪ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের মতো কম প্রতিশ্রুতি। এখন পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির প্রশ্ন ওঠায় বিশ্ব ব্যাংকসহ অন্য দাতারাও যে অর্থ ছাড় করণের ব্যাপারে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে, এটা স্বাভাবিক। বিশ্বব্যাংক ছাড়াও, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান বাংলাদেশকে বড় অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। এখন এই অর্থ প্রবাহে মন্থরতা আসবে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে প্রায় ৩০টি প্রকল্পে অর্থ জুগিয়ে থাকে। ওইসব প্রকল্পগুলো নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠতে পারে। দাতাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরো নষ্ট হবে যদি সত্যি সত্যিই ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ সরকার শুরু করে দেয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুতি দেয়া ১২০ কোটি ডলারের পাশাপাশি এডিবি ৬১ কোটি ডলার ও জাপান ১৪ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছিল। এখন আর এদের থেকে ঋণ পাওয়া যাবে না। পদ্মা সেতুতে মোট খরচ ধরা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ২৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। সরকার এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা দেশকে আগামীদিনে একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে ফেলে দেবে। বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে যেতে পারে। শুধু একজন মন্ত্রীকে বাঁচাতে (যায়যায়দিন) সরকারের এ সিদ্ধান্ত জাতিকে কড়া মূল্য দিতে হবে। এতে করে নির্মাণ খরচ বাড়বে। দক্ষতার প্রশ্ন উঠবে। সেতুর দীর্ঘস্থায়িত্ব একটি প্রশ্নের মুখে থাকছে। মালয়েশিয়ার প্রস্তাবও টেকসই নয়। বিশ্বব্যাংকের ঋণের সুদের চেয়ে মালয়েশিয়াকে সুদ দিতে হবে অনেক বেশি। এটা কোনো গোঁয়ার্তুমির বিষয় নয়। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তে শুধু এক ধরনের গোঁয়ার্তুমিই প্রতিফলিত হয়নি বরং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিল। কোনো খাত থেকেই ২৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। চাঁদা তুলে, একদিনের বেতন দিয়ে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা কী সম্ভব? সরকার একটি ভাঁওতাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এটা আওয়ামী লীগের একটি নির্বাচনী স্ট্রাটেজি জনগণকে আশ্বাস দেয়া যে পদ্মা সেতু হবে। আসলে এ সরকারের পক্ষে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব নয় বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুটো বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করছে। বিএনপি বলছে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে দুর্নীতিবাজদের বিচার করতে হবে। আর সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন বিএনপি পদ্মা সেতু চায় না। অথচ মূল বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলছে না। পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ যদি বেড়ে যায়, তাহলে চূড়ান্ত বিচারে তা ব্যবহারকারীদের উপর গিয়ে বর্তাবে। গাড়ি পারাপারের টোল বৃদ্ধি পাবে, ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। সাধারণ মানুষের সুবিধা এই সেতু থেকে পাওয়া যাবে না। ২৪ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে একটা সেতু যদি নির্মিত হয়, আর সাধারণ মানুষ যদি তা ব্যবহার না করে, তাহলে এই সেতু নির্মাণ করে লাভ কী? আমার ধারণা নীতিনির্ধারকরা এটাকে একটা 'প্রেসটিজ ইস্যু' হিসেবে নিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়ায় নিজেরা উদ্যোগী হয়েছেন। কিন্তু তাতে খরচ কতটুকু বাড়ল তা তারা চিন্তা করেননি। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ পদ্মা সেতু চায়, এতে দ্বিধাও নেই। কিন্তু আর্থিক বোঝা যদি তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তাতে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হবে না। অভিযুক্ত মন্ত্রীর পদত্যাগের ফলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে। এতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং অর্থায়নের একটা সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। দেখা যাক অবশেষে কী হয়।Daily JAI JAI DIN25.7.12

বিটিভি কি হুমায়ূন আহমেদকে বয়কট করেছে?

গত ২০ জুলাই বাংলাদেশের সংবাদপত্রের পাঠক যখন জেনে গেছেন জননন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ আর নেই, তখন থেকে আমার মাঝে একটা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল যে, বিটিভি কীভাবে হুমায়ূন আহমেদকে সম্মান জানায়। খুব আগ্রহ নিয়ে আমি প্রতিদিন বিটিভি খুলি, যদি হুমায়ূনকে নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান হয়! যদি হুমায়ূন ভাইয়ের কোনো ছবির অংশবিশেষ দেখানো হয়! শুক্রবার, শনিবার বিটিভিতে ছায়াছবি দেখানো হয়। এটা নিয়ে আবার নানা কাহিনী আছে। একটি ‘বিশেষ গোষ্ঠী’ এই ছবি প্রদর্শনের সঙ্গে জড়িত। তাদের স্বার্থেই বস্তাপচা ছবি দেখানো হয়, যা কোনো দর্শক দেখে বলে আমার মনে হয় না। আমি ধারণা করেছিলাম, সারা জাতি যখন হুমায়ূনের শোকে মোহ্যমান, তখন নিদেনপক্ষে বিটিভি হুমায়ূন আহমেদের একটি পুরনো ছবি দেখাবে। না, বিটিভি দেখায়নি। এটা কি হুমায়ূন আহমেদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন নয়? অতীতে হুমায়ূন আহমেদের অনেক নাটক বিটিভি দেখিয়েছে। নিজেরা তৈরি করেছে, কখনও অন্যের বা হুমায়ূনের নিজের করা ছবি প্রদর্শন করেছে। বিটিভি কি পারত না এ ধরনের একটি নাটক পুনঃপ্রচার করতে? বিটিভির কি এটি করা উচিত ছিল না? কী জবাব দেবেন বিটিভির মহাপরিচালক? অনেককে নিয়েই তো বিটিভি অনুষ্ঠান করে। অনেকে বিটিভিতে এসে ওইসব ব্যক্তির গুণকীর্তন করেন। এরা সবাই যে জাতীয় পর্যায়ের নেতা, তা নন। কিন্তু বিটিভি করে। কেন করে তা আমরা জানি। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ কি সে ধরনের একজন ব্যক্তি ছিলেন না, থাকে নিয়ে বিটিভি একটা অনুষ্ঠান করতে পারত। প্রাইম টাইমে না হোক, গভীর রাতে হলেও তো তাতে কোনো ক্ষতি ছিল না।
ম. হামিদ এখন বিটিভির মহাপরিচালক। তিনি সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকা অবস্থা থেকে আজ অবধি নিরলসভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রেখেছেন। তিনি কীভাবে পারলেন হুমায়ূনকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান না করে? এই প্রথমবারের মতো বিটিভিতে ধারাবাহিক নাটকের একটি ‘প্রিমিয়ার শো’ অনুষ্ঠিত হয়েছে (যেখানে অবধারিতভাবে তার কন্যাও অভিনয় করেছেন)। তথ্য সচিব উপস্থিত থেকেছেন, তা-ও আবার ঘটা করে সংবাদে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু একজন হুমায়ূন আহমেদ কি বিটিভিতে উপেক্ষিত থেকে গেলেন না? বিটিভি কি তাকে অবজ্ঞা করল না? হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর সংবাদপত্রগুলো তার প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছে, তাতে করে সংবাদপত্রকর্মী তথা সম্পাদকদের ওপর আমার শ্রদ্ধাবোধ আরও বেড়ে গেল। এমনকি কোনো কোনো সংবাদপত্র প্রথম পাতার পুরোটা উত্সর্গ করেছে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি। সম্পাদকরা তাকে নিয়ে লিখেছেন প্রথম পাতাতেই। এটাই সঠিক। যে জাতি গুণীজনকে সম্মান না জানায়, সে জাতি বড় হতে পারে না। বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। হুমায়ূন আহমেদ তো সেই ব্যক্তিদেরই একজন, থাকে নিয়ে জাতি গর্ব করতে পারে। তিনি প্রকাশনা জগেক কোন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। হুমায়ূন না থাকলে এ দেশের প্রকাশনা শিল্প পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশকরা দখল করে নিত। ভারতীয় হাজারটা পণ্যের সঙ্গে যোগ হতো আরও একটা ‘পণ্য’-ভারতীয় উপন্যাস। হুমায়ূন আহমেদ এটা হতে দেননি। তিনি নিজস্ব একটি পাঠক শ্রেণী তৈরি করেছেন, যারা পয়সা দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস কিনত। এই ক্রেডিট তো হুমায়ূনকে দিতেই হবে। আমি সাহিত্য সমালোচক নই। তার সাহিত্যকর্ম কতটুকু উচ্চমার্গের তা সাহিত্য সমালোচকরাই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু যিনি ‘হিমু’ কিংবা ‘মিসির আলি’র মতো চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, তার এই সৃষ্টি নিয়ে একদিন গবেষণা হবে, এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা হয়নি। প্রথমত বয়সের একটা পার্থক্য ছিল। দ্বিতীয়ত, আমরা দু’জন ছিলাম দুই জগতের বাসিন্দা। তিনি সাহিত্য নিয়ে চর্চা করে গেছেন, আর আমি রাজনীতির উত্থান-পতন বোঝার চেষ্টা করছি। ধানমণ্ডির ‘দখিন হাওয়া’র পাশে ছিল আমার ফ্ল্যাট, লেকের পাশে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য। একবারই কথা হয়েছিল ওই বাসাতে। আরও দুয়েকবার কথা হয়েছে, সেটা মনে রাখার মতো নয়। একটা স্মৃতির কথা আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন তারা পিরোজপুরে থাকতেন। বাবা ফয়জুর রহমান ওই পিরোজপুরেই শহীদ হন। ১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে আমরা বাগেরহাট লঞ্চ স্টেশন থেকে হেঁটে শহরে এসেছিলাম। আমি, জাফর ইকবাল এবং হুমায়ূন ভাই। আমরা যখন মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছিলাম, আমার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের যে খবরাখবর প্রচারিত হয়, তা মনিটর করা। সেই সুবাদে একাধিকবার পিরোজপুর শহরের পুরনো থানার ঠিক উল্টো দিকে এসডিপিওর বাংলোতে গেছি। ফয়জুর রহমান সাহেব আমাকে প্রচুর তথ্য দিতেন। আমার প্রয়াত বাবার সঙ্গেও তার ছিল সখ্য। সীমিত আলাপচারিতায় ওই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হলেও তা বেশিদূর কখনও গড়ায়নি। আমি সবসময়ই চেয়েছি হুমায়ূন ভাই চাণক্য সেনের মতো (ভবানী সেনগুপ্ত) রাজনৈতিক উপন্যাস লিখবেন। সত্তর দশকে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন আমাদের কাছে চাণক্য সেনের রাজনৈতিক উপন্যাস ছিল প্রবল এক আকর্ষণ। আজমল ভাই (সাবেক ব্যাংকার, এখন অবসরে) আমাকে সেসব বই পড়তে দিতেন। আজও সেই সব বইয়ের চরিত্রগুলো মনের আনাচে-কানাচে উঁকি দেয়। কর্নেল উনতুং (ইন্দোনেশিয়া) কিংবা কিউবার বিপ্লবের কাহিনী এত বছর পর আজও ভুলে যাইনি। এ ধরনের রাজনৈতিক উপন্যাস আমার আর পড়া হয়নি। শেষ বেলায় হুমায়ূন ভাই একটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন বটে, কিন্তু তা শেষ করতে পারেননি। ‘দেয়াল’ আদৌ সম্পাদিত আকারে প্রকাশিত হবে কি না, বলতে পারব না। কিন্তু ‘দেয়াল’ নিয়ে তো কম ‘কাহিনী’ হল না। উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনাও আছে এতে। এখন তার অবর্তমানে ‘দেয়াল’ প্রকাশ না করাই হবে মঙ্গলজনক।
হুমায়ূন আহমেদ জাতিকে অনেক দিয়েছেন। তরুণ সমাজের মাঝে একটি  ক্রেজ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। ‘বাকের ভাই’-এর কাহিনী নিয়ে যে ‘লঙ্কাকাণ্ড’ বাংলাদেশে ঘটে গিয়েছিল, তা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধু লেখালেখি করবেন, এই আশায়। তাতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তা পারবও না। এমনকি তার ভাই জাফর ইকবাল জনপ্রিয় লেখক হয়েও শিক্ষকতা ছেড়ে দেননি। দিতে পারবেনও না। হুমায়ূন চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। আমাদের এখন উচিত স্মৃতিকে ধরে রাখা। বাংলা একাডেমীর সম্মুখের রাস্তাটি আমরা ‘হুমায়ূন স্কয়ার’ বা ‘হুমায়ূন চত্বর’ হিসেবে ঘোষণা করতে পারি। বইমেলায় একটি কর্নার স্থায়ীভাবে হুমায়ূনের নামে নামকরণ হতে পারে। বাংলাবাজারের প্রকাশকরা বাংলাবাজারের একটি সড়কের নাম হুমায়ূন আহমেদের নামে নামকরণের উদ্যোগ নিতে পারেন। বিটিভির অডিটরিয়ামের নাম হুমায়ূন আহমেদের নামে নামকরণ করলে ক্ষতি কী? বিটিভি হুমায়ূন আহমেদের প্রতি অসম্মান দেখিয়ে নিজেদের যে ‘ক্ষতি’ করেছে, সেই ক্ষতিপূরণ করতে পারে এই নামকরণের উদ্যোগ নিয়ে। আমার ধারণা, তথ্য মন্ত্রণালয়ের এতে আপত্তি থাকার কথা নয়। এখন ম. হামিদ কি এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেবেন? যেখানে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদকে সম্মান দিয়েছেন, নিজে হুমায়ূনের বাসায় (নিউইয়র্ক) তাকে দেখতে গেছেন, সেখানে বিটিভির এ ধরনের একটি উদ্যোগের ব্যাপারে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। মূল কথা হল উদ্যোগটাই আসল।
Daily SAKALER KHOBOR
23.7.12

ভারত মহাসাগর এলাকায় নতুন স্নায়ুযুদ্ধ?

বিশ্বব্যাপী ন্যাটোর তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের আশংকা করছেন অনেকে। সম্প্রতি ন্যাটোর একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ক্রোয়েশিয়ায়। ইউরোপের ৩১টি দেশের মধ্যে এ মুহূর্তে ন্যাটোর সদস্য ২৫টি। মজার কথা, ক্রোয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল ৫৫টি দেশ। এ সম্মেলনটিকে তারা নামকরণ করেছে Strategic Military Partnership Conference। যারা সরাসরি ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র নয়, তারাও এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। ন্যাটোর সঙ্গে কাজ করতে পারে এমন দেশগুলোকে ন্যাটোর নীতিনির্ধারকেরা চার ভাগে ভাগ করেছেনÑ যারা ন্যাটোর সদস্য নয়, তবে ন্যাটোর সহযোগী। যেমন, ইউরোপের ১২টি দেশকে নিয়ে গঠিত হয়েছে The Partnership for Peace। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত আলজেরিয়া, তিউনিসিয়ার মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে Mediterranean Dialogue Members। সৌদি আরব কিংবা ওমানের মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে Istanbul Cooperation Initiative। অস্ট্রেলিয়া কিংবা জাপানের মতো দেশগুলোকেও ন্যাটো partners Across the Globe-এর ব্যানারে একত্রিত করেছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানও এ ব্যানারে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ন্যাটোর কোন কর্মকাণ্ড নেই। এখন এল সালভাদর ও কলম্বিয়ার মতো দেশও ন্যাটোর সঙ্গে জড়িত হতে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার, ইউরোপে ন্যাটোর কমান্ডার অ্যাডমিরাল স্টাভরিডিস সম্প্রতি বলেছেন, তারা ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশকে নিয়ে ভাবছেন এবং আশা করছেন এ দেশ দুটো Partners Across the Globe-এর ব্যানারে আগামীতে ন্যাটোর কর্মকাণ্ডে শরিক হবে।
২০১০ সালে ন্যাটো লিসবন সম্মেলনে তার Strategic concept গ্রহণ করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রোয়েশিয়ায় সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল, একুশ শতকে ন্যাটো নতুন এক কৌশলগত ধারণা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। ন্যাটোর এ ভূমিকা অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিশ্বকে কর্তৃত্ব করার প্রবণতা নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে দুই পরাশক্তির প্রভাব বলয়কে কেন্দ্র করে জš§ হয়েছিল øায়ুযুদ্ধের। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে সেই øায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দেয়া হলেও ন্যাটো জোট ভেঙে দেয়া হয়নি; বরং এর সম্প্রসারণ ঘটেছিল। øায়ুযুদ্ধ চলাকালীন ন্যাটো ও ওয়ারশ জোটের মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল যে, ইউরোপে একাধিকবার ‘পারমাণবিক যুদ্ধে’র আশংকা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ‘যুদ্ধ’ হয়নি বটে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পুরোটা সময় এ দুই শক্তির মাঝে প্রতিযোগিতা বজায় ছিল। দুই পরাশক্তিই ইউরোপে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই এ øায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। এর প্রধান কারণ ছিল একটিÑ রাশিয়া এখন আর ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। দুটি আদর্শের (সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ) মাঝে যে দ্বন্দ্ব ছিল, সেই দ্বন্দ্বেরও অবসান ঘটে। এখন রাশিয়া আদর্শ হিসেবে মুক্তবাজার ও পুঁজিবাদকে গ্রহণ করেছে। উপরন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার অনেক আগেই ১৯৮৮ সালে গর্বাচেভ ‘ওয়ারশ’ সামরিক জোট ভেঙে দিয়েছিলেন। যে কারণে ইউরোপে রাশিয়ার উত্থান যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি আর হুমকি নয়। তাই নতুন করে এ অঞ্চলে øায়ুযুদ্ধের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখন ভারত মহাসাগর হচ্ছে সম্ভাব্য ক্ষেত্র, যেখানে নতুন করে øায়ুযুদ্ধের জš§ হতে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে চীন। চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভয় ও শংকা এখন অনেক বেশি। প্রথমত, তত্ত্বগতভাবে চীন এখনও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তবে তারা এখন আর ধ্র“পদী মার্কসবাদ-মাওবাদ অনুসরণ করে না। চীনে যে নতুন প্রজšে§র জš§ হয়েছে, তারা সমাজতন্ত্র বোঝে না। এরা বোঝে ভোগবাদ। চীনে একদলীয় কমিউনিস্ট পার্টির শাসন রয়েছে বটে, কিন্তু এ একদলীয় শাসনে চীনা নেতৃত্ব তিনটি বিষয়কে একত্রিত করেছে : ১. পূর্ব এশিয়ার নয়া কর্তৃত্ববাদ ২. ল্যাটিন আমেরিকার করপোরেটইজম ৩. পশ্চিম ইউরোপের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি। ফলে চীনকে এ মুহূর্তে একটি পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যাবে না। বিশ্বে এখন যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে একমাত্র শক্তি হচ্ছে এই চীন। সুতরাং চীনকে ‘ছেঁটে ফেলার’ একটি স্ট্রাটেজি গ্রহণ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয়ত, আগামী দুই দশকের মধ্যে চীন অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। চীনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দুই ট্রিলিয়ন (এক হাজার বিলিয়নে এক ট্রিলিয়ন) ডলার। ‘ফরচুন’ ম্যাগাজিন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ যে ৫০০ বহুজাতিক সংস্থার নাম করেছে, তাতে চীনের রয়েছে ৩৭টি। বিশ্বে যে জ্বালানি ব্যবহƒত হয়, চীন একাই শতকরা ১৬ ভাগ তা ব্যবহার করে। আর তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বে চীনের অবস্থান তৃতীয়। চীন বিশ্বের রূপান্তরযোগ্য জ্বালানি বিনিয়োগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। গত বছর সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি ডলার এ খাতে খরচ করেছে। চীন বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পর তার স্থান। কিন্তু ২০২০ সালে জাতীয় উৎপাদনের দিক দিয়ে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে যাবে। চীনের এ অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে বড় ধরনের আঘাত হানছে। প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করছে। তৃতীয়ত, পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে চীনের যে বিনিয়োগ, তাতে উৎকণ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৩ থেক ২০০৮ সাল পর্যন্ত আফ্রিকাতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার। ল্যাটিন আমেরিকাতে এর পরিমাণ বেড়েছে এক বিলিয়ন থেকে তিন দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার। আর এশিয়াতে বেড়েছে এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন থেকে ৪৩ দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার। সুদান ও কম্বোডিয়ায় বিনিয়োগের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে চীন। অন্যদিকে সুদানের পাশাপাশি ইরানের তেল সেক্টরে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। ২০০৯ সালে চীন ইরানের তেল ও গ্যাস সেক্টরে ব্যাপক বিনিয়োগ করে। আগামী পাঁচ বছরে এ সেক্টরে তারা বিনিয়োগ করবে ১২০ বিলিয়ন ডলার। ইরানের তেলের অন্যতম ক্রেতা আজ চীন। আন্তর্জাতিক অবরোধ উপেক্ষা করে চীন ইরান থেকে তেল আমদানি করছে। এসব বিষয় মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। অনেকেরই জানার কথা, যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়। এ ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণ যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। চতুর্থত, দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান চীনের উপস্থিতি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের চিন্তার অন্যতম একটি কারণ। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিনসহ সব বিদেশী সেনা প্রত্যাহারের পর সেখানে যে এক ধরনের ‘শূন্যতা’র সৃষ্টি হবে, সে শূন্যতা চীন পূরণ করতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। চীন এরই মধ্যে আফগানিস্তানের লোগার প্রদেশের আইনাক নামক স্থানে কপার ফিল্ড উন্নয়নে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। নেপালের মহাসড়ক নির্মাণ, সীমান্ত পোর্ট নির্মাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীন জড়িত রয়েছে। মিয়ানমারে মহাসড়ক নির্মাণ, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে চীন। মিয়ানমারের সমুদ্র উপকূলে যে বিশাল গ্যাস রিজার্ভ আবিষ্কৃত হয়েছে, তা এখন পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে যাবে। আর ঐতিহাসিকভাবেই চীনের সঙ্গে সামরিক চুক্তি রয়েছে মিয়ানমারের। মিয়ানমার ও পাকিস্তানে (গাওদার) গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। কারাকোরাম পর্বতমালায় সড়কপথও নির্মাণ করছে চীন। শ্রীলংকায় হামবানতোতায় (প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের এলাকা) গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। এ পোর্ট পুরোপুরিভাবে চালু হবে ২০২০ সালে। একই সঙ্গে প্রায় ১৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এ দ্বীপরাষ্ট্রটির দক্ষিণাঞ্চলে একটি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও তৈরি করছে চীন। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের এই যে বিশাল বিনিয়োগ, তা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের অজানা নয়। এমনকি বাংলাদেশে বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। বাংলাদেশে সোনাদিয়া দ্বীপের গভীরে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চায় চীন। ভারত মহাসাগরভুক্ত বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরকে যুক্ত করে চীন যে ‘ঝঃৎরহম ড়ভ চবধৎষং’ বা মুক্তার মালার নীতি গ্রহণ করেছে তা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ভারতের স্বার্থকেও আঘাত হানছে।
ভারত মহাসাগর আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের ‘øায়ুযুদ্ধ’। এখানে কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে এ বিপুল জলসীমা, তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। এ অঞ্চলজুড়ে গাওদার (বেলুচিস্তান, পাকিস্তান), হামবানতোতা (শ্রীলংকা), সিটওয়ে, কিয়াউক পাইউই বন্দরে (মিয়ানমার) রয়েছে চীনের নৌবাহিনীর রিফুয়েলিং-সুবিধা ও সাবমেরিন ঘাঁটি। কোকো দ্বীপপুঞ্জও চীনা নৌবাহিনী ব্যবহার করে। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। এ চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগ মালাক্কা প্রণালী দিয়ে পরিবহন করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য হয়ে শ্রীলংকা পর্যন্ত ভারত মহাসাগর। তারপর এ মহাসাগর হয়ে মালাক্কা প্রণালী (মালয়েশিয়া) অতিক্রম করে ইন্দোনেশিয়ার পাশ দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে যাওয়ার যে সমুদ্রপথÑ এ পথের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। যুক্তরাষ্ট্রও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম নৌশক্তি। এ অঞ্চলে চীনা নৌশক্তির উপস্থিতি তার কাম্য নয়। অথচ জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তার জন্য এ রুটটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠুক, চীন তা কখনোই চাইবে না। এমনকি মধ্য এশিয়ার গ্যাস গাওদার বন্দরের মধ্য দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের পূর্বাঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার এক বিশাল ও ব্যয়বহুল প্রকল্পও হাতে নিয়েছে চীন। এজন্য ভারত মহাসাগর তার নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন রয়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রও চায় এ অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব থাকুক। কেননা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরান আক্রমণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে ভারত মহাসাগর তথা গাওদার পোর্টের গুরুত্ব রয়েছে। গাওদার থেকে ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’-এর দূরত্ব মাত্র ১৮০ নটিক্যাল মাইল (এ পথ দিয়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে), আর ৭২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ইরান সীমান্ত। বেলুচিস্তানের মরুভূমিতে কিছুদিন আগ পর্যন্ত একটি বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করত। সুতরাং আগামী দিনে ভারত মহাসাগর অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে মার্কিন সমরনায়কদের কাছে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ‘কনটেইনমেন্ট থিওরি’ প্রয়োগ করেছিল। পশ্চিম ইউরোপ এ ক্ষেত্রে পালন করেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আজ সেই ‘কনটেইনমেন্ট থিওরি’ আবার নতুনভাবে প্রয়োগ হতে যাচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে ভারত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চারদিক থেকে ঘিরে চাপ প্রয়োগ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতা সংকুচিত করতে চেয়েছিল, আজ চীনকে সামনে রেখে সেই একই স্ট্র্যাটেজি রচনা করছে তারা। এতে লাভ কতটুকু হবে বলা মুশকিল। তবে নতুন করে আবার উত্তেজনার জš§ হবে। নতুন করে আবার জš§ হবে øায়ুযুদ্ধের। ফলে ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলো এ প্রতিযোগিতায় কোন একটি পক্ষ অবলম্বন করতে বাধ্য হবে। অতীতে øায়ুযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্ব দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বেড়েছিল। আজও সে রকম একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বিশ্ব। নিশ্চিত করেই বলা যায়, এতে কোন পক্ষের লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরং এতে এ অঞ্চলের দারিদ্র্য আরও বাড়বে। ন্যাটোর ভূমিকার ব্যাপারে তাই পর্যবেক্ষকদের আগ্রহ থাকবে। সরাসরিভাবে ন্যাটোর সদস্য না হলেও যৌথ অংশীদারিত্ব চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্যাসিফিকভুক্ত অনেক দেশকে ন্যাটোর স্ট্রাটেজিক কনসেপ্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত করছে। বাংলাদেশও এ প্রক্রিয়ার অংশীদার। এতে ধীরে ধীরে আমরা আবারও নতুন এক ধরনের øায়ুযুদ্ধের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। নতুন করে জš§ হওয়া øায়ুযুদ্ধ বিশ্ববাসীর জন্য আদৌ কোন মঙ্গল ডেকে আনবে না।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা কেন


পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্থিরতা দেশের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপাচার্যদের পরিবর্তন করা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি এতটুকুও। আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তারপর যাঁকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো, তিনিও পড়েছেন আন্দোলনের মুখে। আগামী ২০ জুলাই ভিসি প্যানেল নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলেও এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন শিক্ষকদের একটি বড় অংশ। বুয়েটের পরিস্থিতি এখন চরম পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে। শিক্ষকরা পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি প্যানেল নির্বাচন নিয়ে খোদ সরকারি দলের সমর্থক শিক্ষকরা দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ভিসির সঙ্গে দ্বন্দ্বে সাবেক প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার ক্ষমতা হারিয়েছেন। হাইকোর্টে একটি রিটও হয়েছে। অসন্তোষ আছে পাবনা, রাজশাহী, ডুয়েট, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক কথায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অশান্ত। মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে এসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই অশান্তি, অস্থিরতা আমাদের উচ্চ শিক্ষার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা যদি মোটা দাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্থিরতা নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে বেশ কিছু চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে। এক. এই অস্থিরতার সঙ্গে দেশের চলমান রাজনীতির সম্পৃক্ততা কম। দেশীয় রাজনীতি আদৌ প্রভাব ফেলেনি। বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণেই এই অস্থিরতা বেড়েছে। দুই. প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে সরকারসমর্থক শিক্ষকদের একটি অংশ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই আন্দোলনে বিরোধী দল সমর্থক শিক্ষকরা শরিক হলেও তাঁরা বড় কোনো ভূমিকা পালন করছেন না। জাবিতে যাঁরা ভিসিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন, তাঁরাই এখন নয়া ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বুয়েটে আন্দোলনে আছেন আওয়ামী লীগ তথা বাম আদর্শের শিক্ষকরা। বিএনপি তথা ইসলামপন্থী শিক্ষকদের অংশগ্রহণ সীমিত। তিন. এই আন্দোলনে শিক্ষকদের সঙ্গে কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীরাও সংহতি প্রকাশ করেছেন। এ রকমটি অতীতে কখনো হয়নি। চার. আন্দোলন দমানোর ক্ষেত্রে ভিসিরা নিজ উদ্যোগে তাঁর সমর্থিত শিক্ষকদের নিয়ে একটা পাল্টা 'শো-ডাউনে'র চেষ্টা করছেন। জাবিতে চেষ্টা করেছিলেন ভিসি। কিন্তু তাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। বর্তমান ভিসিও নিজস্ব একটি বলয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন। রাজশাহীতেও এমনটি আমরা লক্ষ করি। বুয়েটেও শেষপর্যায়ে এসে ভিসি তাঁর সমর্থিত শিক্ষকদের মাঠে নামিয়েছেন। এখানে ছাত্রলীগের ভূমিকাও লক্ষ করার বিষয়। জাবিতে সাবেক ভিসি নিজস্ব একটি ছাত্রলীগ তৈরি করেছিলেন। মূলধারা ছাত্রলীগের সমর্থন তিনি পাননি। আর বুয়েটে ছাত্রলীগ ভিসির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। রাজশাহী বা ডুয়েটের ছাত্রলীগের ভূমিকা অনেকটা একই। পাঁচ. প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সরকারপ্রধানকে একসময় হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। জাবিতে তিনি করেছেন এবং একটি সমাধানও দিয়েছেন। বুয়েটের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে ১৬ জুলাই শিক্ষামন্ত্রীর একটি উদ্যোগ কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে এবং শেষপর্যন্ত সরকারপ্রধানকেই হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। এই প্রবণতা ভালো নয়। কাম্যও নয়। যিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকেন বা তাঁকে থাকতে হয়, তিনি কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করবেন? তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা মঞ্জুরি কমিশন কেন আছে? প্রয়োজনে ইউজিসির 'অথরিটি' বাড়াতে হবে। সরকারপ্রধান নিঃসন্দেহে আমাদের সবার মুরবি্ব। কিন্তু প্রতিটি কাজে তাঁর সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকা কোনো ভালো কথা নয়। ছয়. প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অঞ্চলপ্রীতি, আত্মীয়প্রীতির অভিযোগ উঠেছে। জাবিতে শিক্ষক নিয়োগে টাকার লেনদেন হয়েছে, এ অভিযোগ সংবাদকর্মীদের তথা আন্দোলনকারী শিক্ষকদের। এটা অস্বীকার করা যাবে না, জাবিতে কম মেধাসম্পন্নরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। টাকার বিষয়টি প্রমাণ করা যায়নি, কেউ উদ্যোগও নেয়নি। কিন্তু ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দেওয়ার একটি ঘটনায় আশুলিয়া থানায় জিডি হয়েছে। যিনি ঘুষ দিয়েছেন তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষকপ্রার্থী ছিলেন। এই ঘটনা কি প্রমাণ করে না অতীতেও এ রকমটি হয়েছিল? ১০ লাখ টাকা নিয়ে ধরা পড়েছিলেন এক ভদ্রলোক। তিনিও জাবির লোক। কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার জন্য তিনি অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন। বুয়েটেও অতিরিক্ত শিক্ষক, দলবাজ শিক্ষক নিয়োগে অভিযুক্ত হয়েছেন ভিসি। খুলনায় ভিসি থাকার সময়ও তিনি একই ধরনের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। অঞ্চলপ্রীতিতে তিনি সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছেন (বাড়ি তাঁর গোপালগঞ্জে)। তবে আত্মীয়প্রীতিতে সবার শীর্ষে আছেন পাবনা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। তাঁর আত্মীয়-স্বজনসহ নিজ গ্রামের অর্ধশত লোককে তিনি কর্মচারী তথা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও বাদ যাননি। সাত. আরেকটি নতুন প্রবণতা আমরা লক্ষ করছি, আর তা হচ্ছে, নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি নিয়োগের দাবি। জাবির ভিসিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল জাবির শিক্ষক সমিতি। এখন ডুয়েট বা ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও একই দাবি উঠেছে। এটা ভালো নয় এবং সমর্থনযোগ্যও নয়। ডুয়েটকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে অতিসম্প্রতি। সেখানে উপাচার্য হওয়ার মতো সিনিয়র ও মেধাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও। আট. জাবিতে যে আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলনকে 'স্বেচ্ছাচারী' হিসেবে অভিহিত করেছেন নয়া ভিসি। তাঁর এই মূল্যায়ন ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনকে (সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য নয়) একটি প্রশ্নের মুখে ফেলল। এই আইন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এক ধরনের অধিকার দিয়েছে। তাঁদের 'স্বেচ্ছাচারী' বলা ঠিক নয়। জাবি ভিসি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন বাস্তবায়নে সব সময় অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। 'ওয়ান-ইলেভেন'-এর ঘটনায় তিনি যখন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তখন যুক্তি তুলে ধরেছিলেন ১৯৭৩ সালের এই আইনটির, যে আইন বলে শিক্ষকরা কিছুটা হলেও স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। এখন জাবিতে শিক্ষকরা যে 'আন্দোলন' করছেন, তার সঙ্গে তিনি দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন। এটাও তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু 'স্বেচ্ছাচারী' বলাটা শোভন হয়নি। শিক্ষকরা সিনেটে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের আগে পর্যায়ক্রমে সিন্ডিকেট, শিক্ষক প্রতিনিধি (সিনেট) নির্বাচনের যে দাবি করেছেন, তা মেনে নিলে তো ক্ষতির কিছু ছিল না? সবাইকে নিয়েই তো বিশ্ববিদ্যালয়। সবাইকে নিয়েই তাঁকে চলতে হবে। আন্দোলনরত শিক্ষকরাও তো চান ভিসি প্যানেল নির্বাচন। এ ক্ষেত্রে বিরোধ থাকার তো কথা নয়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান অবস্থা আমাদের জন্য একটা আশঙ্কার কারণ। বুয়েট তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। বুয়েটে এ রকমটি কখনো হয়নি। এখানে শীর্ষে থাকা সিনিয়র শিক্ষকই অতীতে সব সময় ভিসি হয়েছেন। প্রো-ভিসির আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবু সিনিয়রিটির দিক থেকে ৫৯ নম্বরে থাকা একজন অধ্যাপককে প্রো-ভিসি করা হয়েছে শুধু দলীয় স্বার্থে। এর ফলে যে ট্র্যাডিশন ভাঙল, তা কি আর বুয়েটে ফিরে আসবে? বুয়েটের ভিসি ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছেন। কিন্তু তাতে তাঁর সম্মান বাড়েনি। মুক্তিযোদ্ধা ও জাবির ভিসি জাবির শিক্ষক ও ছাত্রদের স্বার্থের কথা শুনিয়েছিলেন। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে তিনি শিক্ষকদের গ্রহণযোগ্যতা হারালেন। তিনি সবার ভিসি হতে পারলেন না। অন্তর্দ্বন্দ্বে ঢাবির ভিসি 'বিজয়ী' হয়েছেন। কিন্তু টিকতে পারবেন কি? আসলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনেরও ত্রুটি রয়েছে। একুশ শতকে এই আইনটি অচল। অতিরিক্ত স্বায়ত্তশাসন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অচলাবস্থার একটা কারণ। ১৯৭৩ সালের আইন (যা আবার মাত্র চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য) ভিসিকে আপাত ক্ষমতা দিয়েছে। শিক্ষক হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ, দলীয় আনুগত্য, আত্মীয়তা প্রাধান্য পাচ্ছে। মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে বাদ পড়ছেন। তাই শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি রাখতে হবে ইউজিসির হাতে, অথবা পিএসসির মতো একটি সংস্থা গঠন করতে হবে, যার মাধ্যমে শিক্ষকরা নিয়োগ পাবেন। এ ক্ষেত্রে চারটি স্টেজ বিবেচনায় নিতে হবে (লিখিত পরীক্ষা, ডেমো, মৌলিক পরীক্ষা ও অতীত শিক্ষা রেকর্ড)। শিক্ষকদের অবসরের বয়স আমরা বাড়িয়েছি। কিন্তু তরুণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও তাঁদেরকে যোগ্য শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ আমরা নিইনি। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা যদি জাবি ও বুয়েটের ঘটনাবলি থেকে কিছুটা শেখেন এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের হারানো গৌরব কিছুটা হলেও উদ্ধার করতে পারবে। জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখার পেছনে কোনো সার্থকতা নেই।Daily KALERKONTHO19.7.12

তারুণ্যের প্রতিবাদ ও ক্যাম্পাসে অস্থিরতা প্রসঙ্গে

বুয়েট ক্যাম্পাস ‘দখল’ করে নেওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের একটি ছবি দেখে আমার নিউইয়র্কের ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর কথাই স্মরণ হল। সেখানে মার্কিন সমাজের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেই আন্দোলন এখনও চলছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ন্যায়সঙ্গত। যুগে যুগে তরুণ সমাজ এভাবেই প্রতিবাদ করে আসছে। এক সময় এ সমাজের ধারণা ছিল বুয়েটের ছাত্ররা যেহেতু তুলনামূলকভাবে মেধাবী, সে কারণে তারা রাজনীতির ব্যাপারে ততটা সচেতন নয়। কিন্তু ওরা সেই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ওরাও শরিক হয়েছে, যেমনটি হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগরে কিছুদিন আগে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে জাবির ভিসি পদত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু তাতে সব সমস্যার সমাধান হয়েছে বলা যাবে না। নয়া ভিসি ছাত্র ও শিক্ষকদের আস্থায় নিতে পেরেছেন- তা-ও মনে হয় না। শিক্ষকরা সেখানে নতুন করে আন্দোলন শুরু করেছেন। আর মজার ব্যাপার হল আন্দোলনরত শিক্ষকদের একটা বড় অংশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক। ২০ জুলাই ভিসি প্যানেল নির্বাচনের তারিখ দিয়েছেন নয়া উপাচার্য। আর শিক্ষকদের দাবি, মেয়াদ-উত্তীর্ণ সিনেট দিয়ে ভিসি প্যানেল নির্বাচন করা যাবে না। এর আগে মেয়াদ-উত্তীর্ণ ডিন ও সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের বড় অংশের দাবি উপেক্ষা করে তিনি যদি ভিসি প্যানেলে নির্বাচন করেন তাহলে জটিলতা বাড়বে। সঙ্কটকে আরও গভীরতর করবে। আজ শিক্ষকরা অনশন ধর্মঘট পালন করবেন। গত এক সপ্তাহে সেখানে কোনো ক্লাস হয়নি। একই সঙ্গে বুয়েটে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীরা সবাই একাট্টা হয়েছেন ভিসি ও প্রো-ভিসির পদত্যাগের দাবিতে। বুয়েটে তারা সৃষ্টি করেছেন একটি ইতিহাস। একটা সমাজে যখন পরিবর্তন আনতে হয়, তখন সবাইকে এক হতে হয়। বুয়েটে তা-ই হয়েছে। জাবিতেও তা-ই হয়েছিল। সেখানে পরিবর্তন এসেছে। এখন বুয়েটে যে পরিবর্তন আসবে, তা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা নিশ্চয় নিউইয়র্কের ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ সম্পর্কে ধারণা রাখেন। গত ১৪ জুলাই এই আন্দোলন তার ৩০০ দিন পার করেছে। আগের মতো এই ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর খবর শীর্ষস্থানীয় মার্কিন সংবাদপত্রগুলোতে ছাপা হয় না সত্য, কিন্তু যারা অনলাইনে বিভিন্ন ব্লগে তথ্য অনুসন্ধান করেন, তারা ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর খবর পাবেন। এই আন্দোলন এখনও চলছে এবং বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদও অব্যাহত রয়েছে। মূলত মার্কিন সমাজে বৈষম্য, অসমতা, দারিদ্র্য আর ধনিক শ্রেণীভিত্তিক যে সমাজ ব্যবস্থা (প্লুটোনমি), তার প্রতিবাদেই নিউইয়র্কে ওই ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর জন্ম হয়েছিল। এক সময় এই আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে ইউরোপ ও প্যাসিফিকভুক্ত দেশগুলোতেও ছড়িয়ে গিয়েছিল। নিউইয়র্কের ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর সঙ্গে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের আন্দোলনের কোনো মিল নেই সত্য, কিন্তু এক জায়গায় আমি অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই। আর তা হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এ নিজেদেরকে শরিক করে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। আর বুয়েটে শিক্ষক সমিতির ব্যানারে শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হওয়া ‘সকল অন্যায়ের’ বিরুদ্ধে গত বেশ কিছুদিন ধরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। মিলটা এখানেই। শিক্ষকরা হচ্ছেন সমাজের সচেতন শ্রেণী। তারাই তো প্রতিবাদ করবেন। প্রতিবাদের এই ধরন ন্যায়সঙ্গত। সমাজে অসমতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই যে প্রতিবাদ, যুগে যুগে বিভিন্ন আঙ্গিকে এর প্রকাশ ঘটেছে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে সারা ইউরোপে তরুণ প্রজন্ম প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ করেছিল। তারা সমাজ ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি সত্য, কিন্তু সমাজ ব্যবস্থাকে একটা ধাক্কা দিয়েছিল। আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি পুঁজিবাদী সমাজে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ আমাদের দেখিয়ে দিল এই ‘বিদ্রোহের’ সঙ্গে সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ, তার সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই। ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ একটি নতুন ধরনের ‘বিপ্লব’। ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল তার পেছনেও কাজ করেছিল সমাজের ভেতরকার অসমতা আর বৈষম্য। আজ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এবং যাদের সঙ্গে অতি সম্প্রতি যোগ দিয়েছে ছাত্র ও কর্মচারীরা-তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরকার অসমতা আর বৈষম্যেরই প্রতিবাদ করেছেন। নোয়াম চমস্কি তার সর্বশেষ গ্রন্থ ড়পপঁঢ়ু-তে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘রঃ রং ঔঁংঃ ধ ধুি ড়ভ ষরারহম’-জীবনধারণের একটা অংশ। আজ বুয়েটের ক্যাম্পাসে তরুণ প্রজন্ম যখন সবাই একত্রিত হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে, আমার কাছে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। এমনটিই আমরা লক্ষ করেছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যে ন্যায়সঙ্গত, সেটা বুয়েটের তরুণরা আবারও প্রমাণ করল। যেমনটি করেছিল জাহাঙ্গীরনগরের তরুণরা।
শিক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। আমার ধারণা, এ দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে পছন্দ করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিস্থিতি যে বোঝেন না তা নয়। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই অস্থিরতা বিরাজ করছে। জাহাঙ্গীরনগর, পাবনা, রাজশাহী, ডুয়েট-সব জায়গাতেই এই অস্থিরতা। এই অস্থিরতা সমাধানে সরকারপ্রধানকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগরে তিনি হস্তক্ষেপ করেছিলেন। একটা সমাধান দিয়েছিলেন। নয়া ভিসি সেখানে দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা যা ছিল তা রয়ে গেছে। ঢাকার উপকণ্ঠে ডুয়েটে উপাচার্য নেই বেশ কয়েক দিন হল। নতুন উপাচার্যও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সেখানকার শিক্ষকরা দাবি করেছেন উপাচার্য তাদের শিক্ষকদের মধ্যে থেকেই নিয়োগ দিতে হবে। ঢাকার শেরেবাংলা নগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবিও তেমনি। সেখানকার উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী ও পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। দলীয় বিবেচনায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ। আর এই শিক্ষক নিয়োগে আত্মীয় কোটা ও জেলা কোটা প্রাধান্য পেয়েছে। মজার ব্যাপার, রাজশাহীর বর্তমান ভিসি সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের সময় সেখানে আন্দোলন করেছিলেন একটি ইস্যুকে সামনে রেখে। তা হচ্ছে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ। আজ তিনি নিজে ভিসি হয়ে একই অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন।
আজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তার পেছনে যে কারণগুলো কাজ করছে, তা অনেকটা এ রকম : ১. দলীয় কোটায় অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, ২. কর্মচারী নিয়োগে জেলা কোটা, ৩. উপাচার্যদের দলবাজি, ৪. শিক্ষকদের অগাধ স্বাধীনতা, ৫. উপাচার্য কর্তৃক সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের ব্যবহার, ৬. ছাত্র নেতাদের টেন্ডারবাজি, ৭. সরকার সমর্থক শিক্ষকদের গ্রুপিং, ৮. ভিসি নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষকদের নিয়োগের দাবি, ৯. বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩-এর অপব্যবহার ইত্যাদি। আরও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, প্রায় ক্ষেত্রেই দলীয়ভাবে মনোনীত উপাচার্যরা সমস্যা সমাধান করতে পারছেন না। প্রায় ক্ষেত্রে সরকার সমর্থক অনেক শিক্ষকই ভিসি হতে চান এবং তারাই সমস্যাগুলো সৃষ্টি করছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো সমাধান বের করা সম্ভব হচ্ছে না। অসহায় শিক্ষামন্ত্রীকে তাকিয়ে থাকতে হয় সরকারপ্রধানের দিকে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য যদি প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাজটি কী? ওই সংস্থার চেয়ারম্যান বা সদস্যদের দায়িত্বটি তাহলে কী? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা থাকতেই পারে। আর এর দেখ-ভালের দায়িত্ব তো মঞ্জুরি কমিশনের।
বুয়েটের সর্বশেষ ঘটনা প্রমাণ করল দলীয়ভাবে নির্বাচিত ও অদক্ষ উপাচার্যের জন্য একটি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যেখানে আদৌ প্রয়োজন নেই, সেখানে একজন প্রো-ভিসি দিয়ে বুয়েটকে দলীয়করণের চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলাম আমরা। ভিসি ও প্রো-ভিসির পদত্যাগ ছাড়া কোনো কিনারা নেই। কিন্তু তারা বুয়েটে যে ক্ষত সৃষ্টি করে গেলেন, সেই ক্ষত আমরা সারাব কীভাবে? অতিদ্রুত বুয়েটের শিক্ষক সমিতির সঙ্গে আলাপ করে আমরা যদি সমস্যার সমাধান করতে না পারি তাহলে অনেক ক্ষতি করে ফেলব। বুয়েটের ঘটনাবলি সরকারের জন্য একটা শিক্ষাও বটে।
Daily SAKALER KHOBOR
19.7.12

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কি অবনতি হচ্ছে


গত ১০ জুলাই প্রেস ক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে স্পষ্টতই এটা প্রতীয়মান হয় যে দু'দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা চিড় ধরেছে। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন বেশকিছু ইস্যুতে মার্কিন আইন প্রণেতারা প্রশ্ন তুলেছেন। এর মধ্যে রয়েছে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকা-ের প্রকৃত কারণ উদঘাটনের সরকারের ব্যর্থতা, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান, র‌্যাবের বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- ইত্যাদি। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশের পণ্য বিক্রিতে (যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে) বিধি নিষেধ আরোপিত হতে পারে। হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছিলেন। তখনো তিনি সংবাদ সম্মেলনে আমিনুল ইসলামের হত্যাকা- নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমিনুল ছিলেন আশুলিয়া এলাকায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের নেতা। তাকে কারা হত্যা করেছিল, তার রহস্য আজো উদঘাটিত হয়নি। এটা নিয়ে আমেরিকার লেবার অর্গানাইজেশনগুলো প্রশ্ন তুলেছে। সংবাদপত্রে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো পদ্মা সেতুর বিষয়টি। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে দুর্নীতির কারণে। বিষয়টি যে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। অথচ হিলারির সফরের মধ্যে দিয়ে সম্পর্কের নতুন একটি ইতিহাস রচিত হয়েছিল। বাংলাদেশে তার উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওই সফর নিয়ে প্রচুর লেখাও হয়েছিল। যদিও এর যে একটি নেতিবাচক দিকও ছিল, তাও ওই সময় বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখায় প্রতিফলিত হয়েছিল। এখন মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে দু'দেশের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এক ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন হিলারি ক্লিনটন। বাংলাদেশটা তার একেবারে অপরিচিত নয়। এর আগেও তিনি বাংলাদেশে এসেছেন, তবে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে নয়। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণের বিকাশ ড. ইউনূসের সঙ্গে তার সখ্যতা, বাংলাদেশে নারীদের ক্ষমতায়ন ইত্যাদি নানা কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনকে আগ্রাহান্বিত করে তুলেছিল। এর প্রমাণও তিনি দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ না হলেও ড. ইউনূসের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। দীর্ঘ কথাও হয়েছে। তবে এবারে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিভিন্ন কারণে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব এ মুহূর্তে অনেক বেশি। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি বেড়ে যাওয়া, মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়া, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হওয়া ইত্যাদি নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। নিছক প্রটোকল রক্ষার্থে হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে এসেছিলেন, এটা আমি মনে করি না। বরং দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতিতে যে পরিবর্তন আসছে, সেই পরিবর্তনের আলোকেই দু'দেশের সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করতে হবে। প্রশ্ন উঠেছিল ওই সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি নিয়ে। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের আলোকে এই সফর থেকে আমরা সুবিধা আদায় করে নিতে পারিনি। যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে হিলারি ক্লিনটনের দেয়া বক্তব্য থেকে যে বিষয়গুলো বেরিয়ে এসেছিল, তাতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি যে খুব বেশি ছিল তা আমার কাছে মনে হয়নি। তখন একটি যৌথ অংশীদারিত্বের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে দু'দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ে বছরে একবার সংলাপ হবে। এ ধরনের সংলাপ অতীতে হলেও এবার এর একটি আইনি কাঠামো দেয়া হলো। প্রশ্ন হচ্ছে এই সংলাপ এর মধ্য দিয়ে কী আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ আদায় করে নিতে পারব? নাকি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থটা এখানে বেশি? চুক্তিতে সন্তানের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধবোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের ব্যাখ্যা নানাভাবে বিশ্লেষণ হতে পারে। যা আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা হচ্ছে ভবিষ্যতে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ রোধে সহযোগিতার আলোকে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হোক মার্কিন সেনা মোতায়েন হবে কিনা? যে অংশীদারী সংলাপের কথা বলা হচ্ছে, তাতে এই দিকটা নির্দেশ করে কিনা? অনেকের মনে থাকার কথা গত ২ মার্চ সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ প্যাসিফিক ফ্লিটের অন্তর্ভুক্ত) কমান্ডার রবার্ট উইলাড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। যদিও ঢাকার মার্কিন দূতাবাস পরে এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছিল। আসলে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে নানা কারণে ভারতীয় মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর শক্তিশালী উপস্থিতি, যা মার্কিন তথা ভারতীয় স্বার্থকে আঘাত করছে, এটা পেন্টাগনের উদ্বেগের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে মিয়ানমার এখন অনেকটা 'উন্মুক্ত' হয়ে যাচ্ছে। সু চি সংসদে গেছেন। সু চির ভবিষ্যতে ক্ষমতায় বসান এবং মিয়ানমারে তাদের উপস্থিতি বাড়িয়ে 'চীনকে ঘিরে ফেলার' মার্কিনী নীতিতে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। যদিও এটা ঠিক যুক্তরাষ্ট্র চায় না বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক। বাংলাদেশকে তারা একটি মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবেই মনে করে। জঙ্গিবাদকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভয়। প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের ব্যর্থতা স্বীকার করে ২০১৪ সালে সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে যাচ্ছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়া, হর্ন অফ আফ্রিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ বিকশিত হোক, আল-কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি দলগুলো শক্তিশালী হোক, এটা যুক্তরাষ্ট্র কখনো চাইবে না। আমেরিকা-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব চুক্তি এ লক্ষ্যেই স্বাক্ষরিত হয়েছে কিনা, এটাই বড় প্রশ্ন এখন। ভুলে গেলে চলবে না দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব মার্কিনীদের কাছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। অতি সম্প্রতি এডমিরাল জেমস স্টাভরিডিস মার্কিন বাহিনীর ভড়ৎধিৎফ ঢ়ৎবংবহপব এর কথা বলেছেন। এডমিরাল স্টাভরিডিস যুক্তরাষ্ট্রের ঊটঈঙগ (টহরঃবফ ঝঃধঃবং ঊঁৎড়ঢ়বধহ ঈড়সসধহফ) এর প্রধান। স্টাভরিডিস দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য তথা আফ্রিকাতে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তার কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। এখন দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিটিকে কীভাবে ব্যবহার করে। এখান থেকে আমাদের পাওয়ার কিছু নেই। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে সুযোগ চেয়েছিল, তা পায়নি। বাংলাদেশকে তার তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে যে শুল্ক দিতে হয়, তাতে করে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারছি না। অথচ এলএসডির দেশ হিসেবে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগে আমাদের পাওয়ার কথা। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিপি) থেকে বাংলাদেশ কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের সফরের সময় কোনো বক্তব্য বা সহযোগিতার আশ্বাসও আমরা পাইনি। ঢাকায় মিসেস ক্লিনটন গণতন্ত্রের জন্য সংলাপ ও পার্লামেন্টারি ডিবেটের কথা বলেছিলেন। এগুলো হচ্ছে_ তত্ত্বের কথা। আমরা সবাই জানি গণতন্ত্রে সরকারি ও বিরোধী দলের মাঝে সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখাটা যে জরুরি এ কথাটা আমরা বারবার বলে আসছি। কিন্তু এই সংলাপ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়নি। এমনকি সংসদীয় ডিবেট ও তেমন কার্যকর নয় বাংলাদেশে। হিলারি ক্লিনটনের মুখ থেকে এ কথাটা বেরিয়ে এসেছিল সত্য, কিন্তু আদৌ সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে, এ আস্থাটা রাখতে পারছি না। হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল-বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের 'নাক গলানো'। ভারত কিংবা অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এমনটা করে না। আমরা তেমন একটা 'ক্ষেত্র' তৈরি করেছি, সেখানে বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় মন্তব্য করছে। আজ ড্যান মজিনাও করলেন। আমরা একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করেছি। যাতে বিদেশিরা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাচ্ছে। সরকার যদি আরো সতর্ক হতো, আমার বিশ্বাস তারা এ ধরনের মন্তব্য করতে সাহস পেত না। পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে অনেকের আবেগ জড়িত। সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। সুতরাং যেভাবেই হোক সরকারকে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে হবে। নিজস্ব অর্থায়নে কাজটি করা সম্ভব। কিন্তু তাতে করে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে। সেতুটির স্থায়ীত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। সর্বোপরি দুর্নীতির প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেবে তখন। যারা বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল বিশ্বে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এ সংক্রান্ত অনেক গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একটি প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুললে, ছলে-বলে কৌশলে বাকি প্রকল্পগুলোও আটকে দেয় বিশ্বব্যাংক। আজ সে রকম একটি পরিস্থিতিরই মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। তাদের এ সিদ্ধান্তে অন্যরাও প্রভাবিত হবে। ড্যান মজিনার মন্তব্যে আমি একটি খারাপ গন্ধ পাচ্ছি। যদি সত্যি সত্যিই পোশাক রপ্তানিতে বাধা আসে, তাহলে শত শত পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। লাখ লাখ নারী চাকরি হারানোর ঝুঁকির মুখে থাকবে। কেননা মার্কিন লেবার অর্গানাইজেশন অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা আমিনুল হত্যার বিচার চাইবে এটাই স্বাভাবিক। আর বিচার না পেলে তারা বাংলাদেশি পোশাক বয়কটের ডাক দিতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে আমিনুলের হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচন করে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অবহিত করা। র‌্যাবের কর্মকা- সংস্থাটিকে বিতর্কিত করেছে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধের ব্যাপারেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। শুধু তাই নয়। পদ্মা সেতু নিয়ে অভিযুক্ত মন্ত্রীকে অপসারণ করে সরকার প্রধান একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আমরা আরো উন্নত পর্যায়ে দেখতে চাই। বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক বেশি, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু আমাদের বৈদেশিক নীতির প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। এই সম্পর্কের মাঝে চিড় ধরুক, কিংবা সম্পর্কে অবনতি হোক আমরা তা চাই না। মজিনার আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হবে না, এটাই আমরা আশা করি।Daily JAI JAI DIN18.7.12