রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

এখনও অনিশ্চয়তায় পদ্মা সেতু



পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, এমনকি সরকার ঘেঁষা অর্থনীতিবিদরা প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক উপদেশ দেননি। বরং প্রকাশ্যে বারবার বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করে এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটা ‘বৈরিতা’ তৈরি করেছিলেন। এক্ষেত্রে সাবেক ‘মস্কোপন্থী’ বলে পরিচিত মন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদরা ছিলেন সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে ‘সুদখোর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এটিও উচিত হয়নি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাÍক চেষ্টা চলছে এ মুহূর্তে। এদিকে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে এ প্রকল্পের অপর অংশীদার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক হুয়ান মিরান্ডা পদ্মা সেতু নির্মাণে জটিলতা নিরসনের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের কোন ভাষ্য পাওয়া যায়নি। যারা বিশ্বব্যাংকের নীতিমালা সম্পর্কে কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন এ প্রতিষ্ঠান একবার কোন প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে দ্বিতীয়বার আর ওই প্রকল্পে অর্থায়নে এগিয়ে আসে না। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে আমাদের মধ্যে একটা ধারণার জš§ হয়েছিল, বিশ্বব্যাংক হয়তো আর এ প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না। আমাদের সেই ধারণাই সত্য প্রমাণিত হল। তবে অর্থমন্ত্রী অনেকদিন ধরেই বিশ্বব্যাংকের ‘মান ভাঙানোর’ চেষ্টা করে আসছেন। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রথমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেয়া এবং পরে পদত্যাগে বাধ্য করা হলেও বিশ্বব্যাংক আর ফিরে আসেনি। এমনকি অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানও পদত্যাগে রাজি ছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। আসলে এটা বিশ্বব্যাংকের নীতির প্রশ্ন। এখন দুটো প্রশ্ন আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার কি অতিরিক্ত সুদের ঝুঁকি নিয়ে অন্য দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে এগিয়ে যাবে? নাকি পদ্মা সেতু প্রকল্পটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করবে? দুই. বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অন্য যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, তার কী হবে?
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক বেশ কিছু প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। মোট ৩৪টি প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্র“ত সাহায্যের পরিমাণ ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মাঝে পদ্মা সেতুতে অর্থ সহায়তার পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি ডলার। এখন এ প্রকল্প পরিত্যক্ত। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় অন্যান্য প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থ ছাড়করণে কিছুটা শ্লথগতি আসে। বিদায়ী অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ৫০ কোটি ডলার। অথচ বিশ্বব্যাংক প্রতি বছর ১০০ কোটি ডলার করে সহায়তা বাড়ানোর কথা বলেছিল। পদ্মা সেতু ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্থাটি হতাশা প্রকাশ করেছে, সেগুলো হচ্ছে ঢাকা পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প (১৪৯ মিলিয়ন ডলার, শুরু ২০০৯ সালে), সামাজিক বিনিয়োগ প্রকল্প-২ (১১৫ মিলিয়ন ডলার), উচ্চশিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি প্রকল্প (৮১ মিলিয়ন ডলার), চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প, সিদ্ধিরগঞ্জ পিকিং পাওয়ার প্লান্ট, বিশুদ্ধ বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্প, ঘূর্ণিঝড় পুনর্বাসন প্রকল্প, ডিএসবিলিটি অ্যান্ড চিলড্রেন অ্যাট রিক্স প্রকল্প, পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প, সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম ইত্যাদি। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অর্থ ছাড়করণের পরিমাণ খুবই কম। দুর্নীতি ছাড়াও অদক্ষতা, কাজের শ্লথগতির কারণেও বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ উত্থাপন করেছে। হাইটেক পার্কে চলাচলের সুবিধার জন্য ঢাকা-কালিয়াকৈর শাটল ট্রেনপথ নির্মাণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংক ৫৫০ কোটি টাকা দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল। একটি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুর ঘটনার পর বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পেও অর্থায়ন স্থগিত করেছে। এখন কোন প্রকল্পেই বিশ্বব্যাংক অর্থছাড় দিচ্ছে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার ‘লিভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স’ প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়ার এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। এতে করে ৩০ হাজার মানুষকে প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন করে গড়ে তোলা হবে। এ পরিকল্পনায় সরকারের সঙ্গে ৫০৯ কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য দেয়ার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বিশ্বব্যাংক। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে এ প্রকল্পের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং ফেব্র“য়ারি মাসে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। এখন জটিলতা তৈরি হওয়ায় প্রকল্পটি ঝুলে গেল। অথচ ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এ প্রকল্পের খুবই প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই আইসিটি ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান বিশ্বে খুব ভালো নয়। ইউএনডিপি বিশ্বব্যাপী আইসিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের র‌্যাংকিং বা তালিকা করে। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩ নম্বরে। অবস্থান আরও উন্নত করতে হলে ইন্টারনেট কানেকটিভি খুবই দরকার। কিন্তু এই কানেকটিভি কাজে লাগাতে দরকার প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, যা আমরা ওই প্রকল্পের আওতায় তৈরি করতে পারতাম। এখন আমরা ওই প্রকল্প নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে গেলাম।
বিশ্বব্যাংকের সাহায্য নিয়ে অনেক কথা আছে। গরিব দেশ বলে বিশ্বব্যাংক বিনা সুদে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রায় সাহায্য দেয় না। সুদে-আসলে তা তুলে নেয়। বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য দিয়েই নিজেরা টিকে আছে। তবে তুলনামূলক বিচারে তাদের সুদের পরিমাণ কম এবং পরিশোধের সময়সীমাও দীর্ঘ। যেমন পদ্মা সেতুতে তাদের সুদের পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ৭৫ ভাগ। অন্যদিকে মালয়েশিয়া কিংবা অন্য কোন বাণিজ্যিক ঋণের মাধ্যমে সেতু নির্মিত হলে সুদের হার হবে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। উপরন্তু দীর্ঘসময় তাদের টোল আদায়ের সুযোগ দিতে হবে। আর ঋণের টাকা তুলতে তারা অতিরিক্ত টোল আদায় করবে, যাতে করে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে কথা থাকলেও সহজলভ্যতা ও সুদের হার কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২৫১টি প্রকল্পের বিপরীতে ১ হাজার ৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার তারা অর্থায়ন করেছে। এখন পর্যন্ত এ সংস্থার ১ হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অপরিশোধিত রয়েছে। বর্তমানে মোট ৩৪টি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের মোট ৪৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। যদিও খুব কম ক্ষেত্রে এবং বিশেষ কোন কারণ না থাকলে বিশ্বব্যাংক সাধারণত অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় না। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। এতে করে বাকি প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে একটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেও সরকারের আচরণের ওপরই এখন সবকিছু নির্ভর করছে। আমরা যত বেশি বিশ্বব্যাংককে সমালোচনা করব, তত তিক্ততা সৃষ্টি হবে, যা কোন ভালো ফল বয়ে আনবে না।
পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল হওয়া আমাদের জন্য একটি ‘শিক্ষা’। দুর্নীতির এই অভিযোগ সরকার কিভাবে কাটিয়ে উঠবে, তা ভবিষ্যতের ব্যাপার। তবে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, এমনকি সরকার ঘেঁষা অর্থনীতিবিদরা প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক উপদেশ দেননি। বরং প্রকাশ্যে বারবার বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করে এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটা ‘বৈরিতা’ তৈরি করেছিলেন। এক্ষেত্রে সাবেক ‘মস্কোপন্থী’ বলে পরিচিত মন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদরা ছিলেন সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে ‘সুদখোর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এটিও উচিত হয়নি। সরকারের মেয়াদ আছে মাত্র তের থেকে চৌদ্দ মাস। পদ্মা সেতুর বিষয়টিকে আগামী নির্বাচনে বিরোধী দলের কাছে একটি ইস্যু করে তুলে দেয়া হল। পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা। সরকার সেই ওয়াদা পূরণে ব্যর্থ হল। অতিরিক্ত সুদ নিয়ে এখন পদ্মা সেতু নির্মাণ হবে ঝুঁকিপূর্ণ। শেষ সময়ে এসে সরকার যদি আদৌ কিছু ‘শেখে’ সেটা হবে আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।
Daily JUGANTOR
31.08.12

দিল্লির পরামর্শেই এরশাদের রাজনীতি


সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভারতে গিয়েছিলেন। ঈদের আগেই ফিরে এসেছেন। এর আগেও তিনি একাধিকবার ভারত সফর করেছেন। কিন্তু এবারের তার ভারত সফর নানা কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। তার এই সফরটি ছিল একটি ‘হাই প্রোফাইল ভিজিট’। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, নিরাপত্তা উপদেষ্টা, বিদেশ সচিব সবাই তাকে সাক্ষাৎ দিয়েছেন। এটা কোনো রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। এমনকি এরশাদ কোনো রাষ্ট্রীয় পদেও নেই। এটা নিয়ে তার অভিমানের শেষ ছিল না। ভারতের পত্র-পত্রিকাগুলো আমাদের জানাচ্ছে তিনি ভারতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হিসেবে। যদিও এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। যে বিষয়টি অনেকের কাছেই  একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে সাবেক রাষ্ট্রপতি কী নয়াদিল্লি থেকে কোনো ‘ম্যাসেজ’ বহন করেছেন? যদি তাই হয়, তাহলে সেই ম্যাসেজটি কী? ঢাকায় ফিরেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন তিনি একটি তৃতীয় শক্তির নেতৃত্ব দিতে চান। নব্বই ছুঁই ছুঁই বয়সে এসে তিনি আবারো রাষ্ট্র ক্ষমতা ভোগ (?) করতে চান! এরশাদের বক্তব্য নিয়ে আমরা কখনো উৎকণ্ঠিত নই। তিনি কখন কি বলেন, তা তিনি নিজেও জানেন না। এমনকি একদিন এক কথা বলেন তো পরের দিন বলেন অন্য কথা। কিন্তু এরশাদের সাথে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সাক্ষাতের পর ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আকবর উদ্দিন যখন বলেন, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং বহুদলীয় ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের চলতি কূটনৈতিক বিনিময়েরই অংশ এরশাদের এই সফর, তখন আমি কিছুটা হতাশার মধ্যে পড়ে যাই। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিনির্মাণ নিয়ে যে সমস্যা, তার সমাধান বাংলাদেশেই হবে। এই সঙ্কট নিয়ে আমরা, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দিল্লি যাবেন কেন? দিল্লি আমাদের প্রতিবেশী ‘বড়’ রাষ্ট্র। তাদের নিজস্ব একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি আছে। আমরা সেখান থেকে কিছু ধার নেবো কেন? বাংলাদেশের জনগণ, রাজনৈতিক দল, জাতীয় সংসদই এ সমস্যার সমাধান করবেন। কিন্তু দিল্লি যদি এ ব্যাপারে কোনো ‘দিকনির্দেশনা’ দিয়ে দেয়, তা আমাদের জন্য আদৌ কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। এমনকি ভারতের এই ভূমিকা আমাদের  অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছুটা হলেও হস্তক্ষেপের সামিল। জাতিসংঘ সনদের ২.৪ ও ২.৭ নম্বর ধারা আনুযায়ী একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ভারত এটা করছে। ভারত সরকারের মুখপাত্র আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, তারা কী চান। সাবেক সেনাশাসক, যিনি দুর্নীতির অভিযোগে জেলও খেটেছেন কয়েক বছর, তাকে  জানিয়ে দেয়া হয়েছে নয়াদিল্লি কী চায়! প্রশ্ন আমাদের সেখানেই। নয়াদিল্লি কি আমাদের কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে? শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দিনকাল যে ভালো না, সেই রিপোর্ট নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতির টেবিলে আছে। তার প্রেক্ষিতেই কি এরশাদকে কিছু নির্দেশনা (?) দিলেন নয়াদিল্লির নীতি নির্ধারকরা!
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে ন’টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় (১৯৮৬), চতুর্থ (১৯৮৮) ও ষষ্ঠ (১৯৯৬) সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি শুধুমাত্র একটি কারণেÑ আর তা হচ্ছে বিএনপি (তৃতীয় ও চতুর্থ) ও আওয়ামী লীগ (ষষ্ঠ) ওইসব নির্বাচনে অংশ নেয়নি। পরিসংখ্যান বলে আওয়ামী লীগ ৭৩.২০ ভাগ (১৯৭৩), ২৭.৩৪ (মালেক-মিজান গ্রুপ ১৯৭৯), ৩০.০৮ ভাগ (১৯৯১), ৩৭.৪৪ (১৯৯৬), ৪০.১৩ ভাগ ও ৪৮.০৬ ভাগ ভোট পেয়েছিল। অন্য দিকে বিএনপি পেয়েছে ৪১.১৭ ভাগ (১৯৭৯), ৩০.৮১ ভাগ (১৯৯১), ৩৩.৬১ ভাগ (১৯৯৬), ৪০.৯৭ ভাগ (২০০১) ও ৩২.৩৫ ভাগ ভোট (২০০৮)। প্রাপ্ত ভোটের পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয় এই দুটো দলের বাইরে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অন্য কোনো দলের কোনো সুযোগই নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ একটি ধারা থাকবে, তারা কখনই মূল ধারায় আসতে পারবে না। তবে মূল ধারার সহযোগী মিত্র হিসেবে কাজ করবে। আজ তাই নয়াদিল্লি থেকে ফিরে এসে এরশাদ যখন বলেন, তিনি একটি তৃতীয় ধারার নেতৃত্ব দিতে চান, তখন বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে থাকেন তিনি। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে বটে, কিন্তু দলটি  জাতীয় পর্যায়ের একটি দলে এখনও পরিণত হতে পারেনি। দলটি মূলত একটি আঞ্চলিক দল। দলটির ক্ষমতা ওই উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুরেই সীমাবদ্ধ। তার আর্থিক ভিত্তির কারণেই, এরশাদ এখনও দলটিকে ধরে রাখতে পেরেছেন।  সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছে, নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিনি হেলিকপ্টার ক্রয় করবেন। গত ২৫ আগস্ট (সকালের খবর) প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটির পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, আমি জানি না। কিন্তু দল হিসেবে জাতীয় পার্টি তেমন বড় একটি দল নয়। দলটির আর্থিক ভিত্তিও তেমন নেই। তাহলে হেলিকপ্টার কেনার পয়সা যোগাবে কে?
ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। ভারতের সাথে আমাদের বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে, যা অমীমাংসিত। তিস্তার পানি বণ্টন, ছিটমহল বিনিময় ও বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ব্যাপারে ভারত আন্তরিক না হলেও ভারত বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের কাছ থেকে ট্রানজিট সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। এখন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের বিষয়টিও সময়ের ব্যাপারমাত্র। এখন আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে নয়াদিল্লি যদি জাতীয় পার্টিকে চিন্তা করে থাকে, তাহলে নয়াদিল্লি ভুল করবে। এরশাদ সাহেব নয়াদিল্লিতে যাদের সাথে কথা বলেছেন, তাদের মাঝে একজন হচ্ছে শিবশঙ্কর মেনন, যিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। শিবশঙ্কর মেননের সাথে এরশাদের আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত নই। তবে ওই বৈঠকটি যে তাৎপর্যপূর্ণ, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
নয়াদিল্লির নীতি নির্ধারকদের বুঝতে হবে বাংলাদেশের সমস্যা বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বই সমাধান করবেন। এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এর সমাধান বাইরে থেকে আসবে না এবং তারা কোনো সমাধানও দিতে পারবেন না। আমরা আমাদের রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থাশীল। তারা নিশ্চয়ই একটা সমাধান বের করতে পারবেন এবং সকলের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়েই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হবে। বিএনপি তথা ১৮ দল মূলত একটি দাবিকেই সুস্পষ্ট করেছেÑ আর তা হচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা নিরপেক্ষ সরকারের মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করা। বিদেশী দাতাগোষ্ঠীও প্রত্যাশা করছেন আগামী নির্বাচন সম্পন্ন হবে সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি  আসে, তা হচ্ছে বিএনপিকে বাদ দিয়ে যদি নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনের আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে  কি না? আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখবো এরশাদের শাসনামলেই ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ তৃতীয়, চতুর্থ  এবং ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সব নির্বাচনের একটিও  গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টি উপলব্ধি করেন, তাহলেই আমাদের জন্য তা মঙ্গল। এরশাদ ফিরে এসে অনেক কথাই বলছেন বটে (‘একক নির্বাচনে ভারতের সমর্থন রয়েছে’) কিন্তু এর কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। তার এই বক্তব্য তার দলের দৈন্য প্রকাশ করে মাত্র। নির্বাচন করবেন তিনি বাংলাদেশে। আর প্রত্যাশা করবেন জনগণের সমর্থন। এটা নিশ্চিত করতে তিনি দিল্লি যাবেন কেন? তার এই দিল্লি সফর তাঁকে বিতর্কিত করেছে মাত্র। তিনি যদি মনে করে থাকেন, দিল্লির পরামর্শ নিয়ে তিনি নির্বাচন করবেন, তাহলে তিনি ভুল করেছেন। উত্তরবঙ্গের মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে এবার।
এরশাদের হাইপ্রোফাইল দিল্লি সফর ভারতীয় সংবাদপত্র মাধ্যমে গুরুত্বসহকারে দেখা গেলেও বাংলাদেশের জনগণের কাছে এর কোনো আবেদন নেই। শুধু এরশাদ একাই নয়, সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচনই প্রত্যাশিত। ভারতের নীতিনির্ধারকরা যদি এই মতটি অনুসরণ করেন, তাহলে তারা ভালো করবেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারই কাম্য

 লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যে কোনো জট খুলছে না। লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেয়ার জন্য বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অনেকটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে তিনি বলেছিলেন বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দিতে পারে। যদিও এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি দেননি। কিন্তু বিএনপি নেত্রী ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। বেগম জিয়া জানিয়ে দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয়, বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের বাকি আছে ১৩ থেকে ১৪ মাস। নির্বাচন কমিশন একটি সম্ভাব্য সময়সীমাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অথচ মূল প্রশ্নের এখনও কোনো সমাধান হয়নি। দেশের নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশই চাচ্ছেন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন, এই নির্বাচনে সরকারের শরিকরাও রাজি নয়। প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। বিএনপি কিভাবে যোগ দেবে, কতজন সদস্য থাকবে ওই সরকারে কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব কে দেবেন, তার বিশদ ব্যাখ্যা নেই। প্রধানমন্ত্রী যদি এটা স্পষ্ট করতেন, তাহলে ওই সরকার নিয়ে বিশদ আলোচনা করা যেতো। কিন্তু তার কোনো সুযোগ নেই। মনে হচ্ছে এটা প্রধানমন্ত্রীর ‘বলার কথা’। তবে প্রধানমন্ত্রী এক জায়গায় ঠিক আছেন আর তা হচ্ছে সংবিধান। সংবিধান সংশোধনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। আছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর ব্যাখ্যাও আছে সংবিধানেÑ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস আগে যে সরকার থাকবে, সেটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থাৎ ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই সরকারের বয়স। ২০১৩ সালের অক্টোবরের পর মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত মহাজোট সরকারই ক্ষমতায় থাকবে এবং তারাই সংবিধান অনুযায়ী চিহ্নিত হবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে। শেখ হাসিনাই এই সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। এমপিরা থাকবেন। মন্ত্রীরা থাকবেন বহাল তবিয়তে। বিএনপি তাতে যোগ দেবে, এটা মনে করার আদৌ কোনো কারণ নেই। অন্য দিকে বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে, তা সংবিধানে না থাকায়, বিএনপি সংবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সরকার এটা মানবে। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আর জটটা লেগেছে এ জায়গাতেই। কেউ আধা ইঞ্চি ছাড় দিতেও রাজি নন। দাতারা বারবার বলছেন একটি সংলাপের কথা। বলছেন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা। কিন্তু সরকার এ দিকটাতে যে খুব আন্তরিক, তা মনে হয় না। এতে করে তো সমাধান হবে না। যেখানে মহাজোট সরকারের শরিকরা পর্যন্ত বলছেন, একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার নির্বাচন পরিচালনার জন্য, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর একগুঁয়েমি  মনোভাব অনেক জটিলতা তৈরি করছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার সাথে সাথে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন বটে, কিন্তু সংবিধানে কোনো ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধাযক সরকার গঠন করা সম্ভব। এ জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে সরকারের আন্তরিকতা। দুটোভাবে সরকার এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে পারে। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের রায় প্রকাশ করে সেই রায় অনুসরণ করে সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা। দুই. সরকার তার আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণের স্বার্থে সংবিধানে ষোলতম সংশোধনী আনতে পারে। সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। ইতোমধ্যে জানা গেছে যে, আপিল বিভাগের যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষিত হয়েছে, সেই রায়টি দীর্ঘ প্রায় এক বছর পর আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। পত্রপত্রিকা থেকে যতটুকু জানা গেছে, তা হচ্ছে সর্বসম্মতিক্রমে ওই রায়টি হয়নি। রায়টি হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের মতামতের ভিত্তিতে। এই রায়টি একটি ঐতিহাসিক রায়।  এর একাডেমিক ভেল্যুও আছে। সর্বোপরি যারা রাজনীতি বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করেন, তাদের কাছে এই রায়টির গুরুত্ব অনেক বেশি। এর যেমনি একাডেমিক ভেল্যু রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের একটি দিকনির্দেশনা। কথা ছিল রায়টি ‘ওয়েব সাইট’-এ দেয়া হবে অথবা প্রকাশ করা হবে, যাতে করে ঐতিহাসিক এই রায়টি সম্পর্কে  সবাই জানতে পারেন। কিন্তু গেল মার্চেই রায়টি জমা পড়লেও, তা অদ্যাবধি প্রকাশ করা হয়নি। ফলে সরকারের সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছেই। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে আগামী দুটো সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে জাতীয় সংসদ। এখানেই সমাধানের বীজ রোপিত। সংসদে যে কেউ, সরকারের কোনো মন্ত্রী মহাজোটের কোনো সংসদ সদস্য, কিংবা একমাত্র নির্দলীয় সংসদ সদস্যও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা সংসদে উপস্থাপন করতে পারেন, যেখানে সরকারি দলীয় সংসদ সদস্যরা তা সমর্থন করবেন। সেখানে সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। মূল কথা আন্তরিকতা ও বিশ্বাস। এটি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই, যা দুঃখজনক এবং একটি সংলাপের সম্ভাবনাও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে।
সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সংবিধানই চূড়ান্ত নয়। মানুষের জন্যই সংবিধান। মানুষের কল্যাণে সংবিধান পরিবর্তন আনা যায়। অতীতেও আনা হয়েছে। সমঝোতা ছাড়া কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এককভাবে করা নির্বাচনও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নেবে না। এর ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে একটি বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে বহিঃবিশ্বে। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৮৬ সালে তৃতীয়, ১৯৮৮ সালে চতুর্থ, ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তার আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (এরশাদের জমানায়) আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে সদ্য গঠিত জাতীয় পার্টি ১৫৩টি ্আসন পেয়েছিল (শতকরা হার ৪২ দশমিক ৩৪ ভাগ), আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৬টি আসন (২৬ দশমিক ১৫ ভাগ) বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু ৭ মের (১৯৮৬) ওই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গঠিত সংসদ তার মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। মজার ব্যাপার ওই নির্বাচনে জামায়াত ১০টি, সিপিবি ৫টি, ন্যাপ (মো.) ২টি, ন্যাপ (ভাসানী) ৫টি, বাকশাল ৩টি, জাসদ (রব) ৪টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, মুসলিম লীগ ৪টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি ও স্বতন্ত্ররা ৩২টি আসন পেয়েছিল। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল এবং সংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ৩ মাসের মধ্যে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিও দেশে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের বয়কটের কারণে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তবে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়েছিল। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টারা যদি মনে করে থাকেন, তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচলনা করবেন, তাহলে সম্ভবত তারা ভুল করবেন। নির্বাচন হয়তো হবে। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বরং সঙ্কটকে আরো গভীরতর  করবে। একটা সমঝোতায় পৌঁছতেই হবে, যা জাতির জন্য মঙ্গল। আওয়ামী লীগ যদি ১৯৮৬ সালের মডেল অনুসরণ করে (আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে এনে বিরোধী দলে বসান), তা তারা ভুল করবে। জাতীয় পার্টি এই ট্রাপে পা দেবে না বলেই আমার বিশ্বাস। বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন, কিংবা সদ্য গঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে বিএনপির ‘বিকল্প’ হিসেবে তৈরি করা, জাতিকে এক চরম সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেবে। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সংলাপ হোক। একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত হোক। এখনও সময় আছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনীতিতে গোয়ার্তুমির কোনো জায়গা নেই। রাজনীতি হচ্ছে ‘এ্যান আর্ট কমপ্রোমাইজ’। সেই ‘কমপ্রোমাইজের’ দিকে প্রধানমন্ত্রী যাবেন, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করে।

হুদার নয়া দল গঠন প্রসঙ্গে


ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা একটি নতুন দল গঠন করেছেন ১০ আগস্ট। দলটির নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট (বিএনএফ)। তিনি জানিয়েছেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার আদর্শ অনুসরণ করবেন এবং এ কথাটা তিনি জানাতেও ভোলেননি যে তাঁর দল আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। প্রশ্ন হচ্ছে- বিএনএফ আদৌ কী বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো অবদান রাখতে পারবে? নাকি বিএনপিতে তাঁর ফিরে আসার এটা একটা কৌশলমাত্র! বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন তিনি স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন বটে, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিএনপির রাজনীতিতে তিনি কোনো অবদান রাখতে পারেননি। তাঁর দুঃখ ছিল যেহেতু তিনি শহীদ জিয়ার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, সেহেতু বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিও তাঁকে স্থায়ী পরিষদের সদস্য করবে। বেগম জিয়া তা করেননি। এর পেছনে সংগত কারণও ছিল। দলের ভেতরে থেকে তিনি একাধিকবার বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছেন। দল থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছেন। আবার ফিরেও এসেছেন। কিন্তু নিজেকে 'বিতর্কিত' রাখতে বোধ করি তিনি পছন্দ করেন বেশি, সে কারণে সব শেষে একটি 'বক্তব্য' দিয়ে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০১-২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার কারণে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি তখন জানতেন দলের নীতি কী? জানতেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বিএনপি কী মনে করে। মন্ত্রিসভায় থেকেও তিনি ওই সময় দলের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন। ২০১০ সালের ২১ নভেম্বর দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কথা বলার জন্য তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে অবশ্য তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেও নেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে হাস্যস্পদ মন্তব্যটি তিনি করেন গত ২৩ মে। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেছিলেন, ৫ জুনের মধ্যে বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যদি চিঠি না লেখেন, তাহলে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করবেন। তিনি কথা রেখেছিলেন এবং পদত্যাগ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অনেকের মতো একটি দলও গঠন করলেন। অনেক প্রশ্ন এখন তাঁকে ঘিরে। দল গঠন করার উদ্দেশ্য কী? প্রথমত, তিনি যদি মনে করে থাকেন, তিনি বিকল্প একটি 'বিএনপি' গঠন করবেন, তাহলে তিনি ভুল করেছেন। ইতিহাস বলে বিএনপি থেকে যারাই বেড়িয়ে গেছেন, তারা কেউই সুবিধা করতে পারেননি। অধ্যাপক বি. চৌধুরী বিএনপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিকল্প ধারা গঠন করেছিলেন। কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারেননি। কর্নেল অলি এলডিপি গঠন করেছেন। সাধারণ মানুষ তাঁকে গ্রহণ করে নিয়েছে, এটা বলা যাবে না। কর্নেল অলি এখন ১৮ দলীয় জোটে। অধ্যাপক চৌধুরী এখনো ফিরে আসেননি বটে। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগটা বেশি। অধ্যাপক চৌধুরী ও কর্নেল অলি দুজনই শহীদ জিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার পরও তাঁর গড়া দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা দল গঠন করেছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা গ্রহণ করেনি। গত কয়েক বছরের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে বিকল্প ধারা কিংবা এলডিপি বিএনপির বিকল্প নয়। ১৮ দলে যোগ দিয়ে কর্নেল অলি যেমনই তাঁর বৃহত্তর চট্টগ্রামের নির্বাচনী আসনটি নিশ্চিত করেছেন, ঠিক তেমনি মাহি চৌধুরী তাঁর মুন্সীগঞ্জের আসনটিও নিশ্চিত করতে পারবেন যদি তাঁর দল ১৮ দলে যোগ দেয় অথবা বিএনপি ওই আসনে কোনো প্রার্থী না দেয়। প্রয়াত মান্নান ভূঁইয়াও বিকল্প একটি জাতীয়তাবাদী ধারা তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। এখন নাজমুল হুদাও যে পারবেন না, তা দিব্যি দিয়েই বলা যায়। হুদা সাহেব তাঁর দলের নাম রেখেছেন 'ফ্রন্ট'। কিন্তু মানুষ নাজমুল হুদা। কোনো দলের নাম কী 'ফ্রন্ট' হতে পারে? রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এটি আমার মাথায় ঢোকে না। তিনি জাতীয়তাবাদী নাম ধারণ করেছেন। বুঝতে কষ্ট হয় না, তাঁর উদ্দেশ্য কী? যদি বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে তিনি বিএনপির সুবিধাভোগীদের নিয়ে 'বিকল্প একটি বিএনপির নামে নির্বাচনে অংশ নেবেন। অনেকটা ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার শামিল। দ্বিতীয়ত, আকার-ইঙ্গিতে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যেকোনো একটি 'বিশেষ মহলের' ইঙ্গিতে হুদা সাহেব এই কাজটি করলেন। তাঁর দলের নামে 'জাতীয়তাবাদী' নাম ধারণ করা ও শহীদ জিয়ার নাম ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে কারো কষ্ট হয় না- জাতীয়তাবাদী ধারার সমর্থকদের আকৃষ্ট করা। জাতি যখন তত্ত্বাবধায়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত এবং প্রধানমন্ত্রী যখন প্রকাশ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারে বিএনপিকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান, তখন নাজমুল হুদার জাতীয়তাবাদী ধারার একটি দল গঠনের ঘোষণা, এই 'বিতর্কে' 'ঘি' ঢেলে দেবে মাত্র। তৃতীয়ত, একটি দলের গঠনতন্ত্র থাকে, কর্মসূচি থাকে। বিএনএফের তা কী আছে? লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করলেন হুদা সাহেব। তিনি বললেন বটে, জিয়ার ১৯ দফা তিনি বাস্তবায়ন করবেন, তাহলে তো বিএনপি আর বিএনএফের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। একই আদর্শ নিয়ে দুটি দল থাকে নাকি? হুদা সাহেব কী আমজনতাকে বোকা বানাতে চাচ্ছেন? ২১ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি থাকবে বলে ঘোষণা করলেও ইফতার মাহফিলে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিসর্বস্ব একটি দল নিয়েই যাত্রা শুরু করলেন হুদা সাহেব। চতুর্থত, হুদা সাহেবের ঘোষণা 'বিএনপি, আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে ও দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে।' তিনি মন্ত্রী হিসেবে সফল ছিলেন, এটা জানাতেও ভোলেননি। তাঁর কথায় বিএনপি যদি দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে থাকে, তাহলে সেই 'ব্যর্থ সরকারে' তিনি 'সফল মন্ত্রী' হন কিভাবে! যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। রেলের জমি তিনি তাঁর নিয়ন্ত্রিত মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থাকে 'লিজ' হিসেবে দিয়েছিলেন- এটা নিয়ে তো কম বিতর্ক হয়নি। অভিযোগের লিস্টি আরো বড় করা যায়, সেটা এখানে উল্লেখ না-ইবা করলাম। 'সবাই খারাপ', 'নিজে সফল' এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি নিজেকে হাস্যস্পদ করে তুললেন মাত্র। তিনি দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে যা যা বললেন, তা মূলত একধরনের 'স্টেটমেন্ট', এটা কোনো কর্মসূচি নয়। কর্মসূচি থাকে ভিন্ন। গঠনতন্ত্রও ভিন্ন হয়। একজন ব্যারিস্টার (আইনজীবী হিসেবে খুব একটা মামলা কী তিনি কখনো পরিচালনা করেছেন!) হিসেবে দলের গঠনতন্ত্র ও দলের কর্মসূচির মধ্যে পার্থক্য কী, তা তাঁর জানার কথা। এখন 'হুট' করেই একটি দল গঠনের ঘোষণা, তাঁকে শুধু বিতর্কিতই করবে না, বরং তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে হাজারটা প্রশ্নের জন্ম দেবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দলগত ব্যবস্থা, সেখানে দলীয় গণতন্ত্র চর্চার অভাব, স্বচ্ছ ও সৎ নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে সন্দেহ নেই তাতে। দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা দল গঠন করার নাম গণতন্ত্র নয়। দলের ভেতরে থেকেই দলকে আরো গণমুখী, আরো বেশি গণতন্ত্রীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজে এমনটাই আমরা দেখি। ব্রিটেনে, জার্মানিতে কিংবা নরডিকভুক্ত দেশগুলোতে একটি সুস্পষ্ট নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি নিয়ে দলের নেতৃত্ব এগিয়ে যায়। দলের কাউন্সিলে কিংবা নির্বাচনে সেই নীতি যদি পরিত্যক্ত হয় কিংবা সমর্থন না পায়, নেতা নেতৃত্বের আসন থেকে সরে দাঁড়ান; এটাই নিয়ম। এটাই গণতন্ত্র। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের প্রায় সবাই তাঁদের নীতি ও আদর্শ যখন জনসমর্থন পায়নি, দলের কাউন্সিলে যখন তা অনুমোদিত হয়নি, তখন তাঁরা 'ব্যাক বেঞ্চার এমপি' হয়ে যান, নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। ম্যাগী থ্যাচারের দৃষ্টান্ত অনেকেরই মনে থাকার কথা। আজ হুদা সাহেব তেমনটি করতে পারতেন। তিনি স্পষ্ট করে বিএনপির নীতি ও আদর্শকে আরো জনমুখী করার জন্য কর্মসূচি দিতে পারতেন। তিনি যদি মনে করে থাকেন, বিএনপির রাজনীতিতে 'ভুল' আছে, তখন তিনি দলের ভেতরে থেকে এর প্রতিবাদ করতে পারতেন, বিকল্প কর্মসূচি দিতে পারতেন। তা তিনি করেননি। দলে থেকে তিনি প্রকাশ্যে দাবি করলেন, দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখবেন। এটা তিনি দলীয় ফোরামে আলোচনা করতে পারতেন। একজন আইনের মানুষ হিসেবে তিনি ভালো করে জানেন, এভাবে প্রকাশ্যে দাবি করা যায় না। এটা দলের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থী।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে ৯টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় (১৯৮৬), চতুর্থ (১৯৮৮) ও ষষ্ঠ (১৯৯৬) সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি শুধু একটি কারণে- আর তা হচ্ছে বিএনপি (তৃতীয় ও চতুর্থ) ও আওয়ামী লীগ (ষষ্ঠ) ওই সব নির্বাচনে অংশ নেয়নি। পরিসংখ্যান বলে, আওয়ামী লীগ ৭৩.২০ শতাংশ (১৯৭৩), ২৭.৩৪ (মালেক ও মিজান গ্রুপ ১৯৭৯), ৩০.০৮ শতাংশ (১৯৯১), ৩৭.৪৪ (১৯৯৬), ৪০.১৩ শতাংশ (২০০১) ও ৪৮.০৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অন্যদিকে বিএনপি পেয়েছে ৪১.১৭ শতাংশ (১৯৭৯), ৩০.৮১ (১৯৯১), ৩৩.৬১ (১৯৯৬), ৪০.৯৭ (২০০১) ও ৩২.৪৫ শতাংশ ভোট (২০০৮)। প্রাপ্ত ভোটের পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয় এই দুটি দলের বাইরে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অন্য কোনো দলের কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ একটি ধারা থাকবে, তারা কখনোই মূলধারায় আসতে পারবে না। তবে মূলধারার সহযোগী মিত্র হিসেবে কাজ করবে। আজ তাই নাজমুল হুদার একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট কোনো বড় আবেদন রাখতে পারবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।Daily SAKALER KHOBOR28.08.12

ঘুরেফিরে ‘তৃতীয় শক্তি’

ঘুরেফিরে আবারও ‘তৃতীয় শক্তির’ কথা আলোচিত হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। আসম আবদুর রব বলেছেন, তিনি রাজনীতিতে তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করতে চান। নাজমুল হুদা বললেন, তিনি তৃতীয় ধারার নেতৃত্ব দেবেন। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট নামে একটি দল ইতোমধ্যে তিনি গঠন করে ফেলেছেন। কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যের এক সভায় বলা হয়েছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তৃতীয় শক্তির উত্থান জরুরি। আর সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তো প্রকাশ্যেই বললেন তিনিই তৃতীয় শক্তি। মূল বিষয় একটাই, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে আলাদা একটি রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি করা। বাংলাদেশে গত বেশ কিছুদিন ধরেই একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির কথা বিভিন্ন মহল থেকে শোনা যাচ্ছে। এই বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উদ্যোগ যে নেওয়া হয়নি, তেমনটি নয়। উদ্যোগ নেওয়া হলেও এই উদ্যোগ কাজে লাগেনি। অতীতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কিংবা সরকারের উচ্চ মহল থেকে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ার যে উদ্যোগ, তা কাগজ-কলমেই থেকে গেছে পরবর্তীতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্পষ্টতই দ্বিদলীয় একটি রাজনীতির ধারা সূচিত হয়েছে। এর বাইরে তৃতীয় ধারার জন্ম হচ্ছে না। উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বটে। কিন্তু তা কোনো অবদান রাখতে পারছে না। কেন তৃতীয় ধারা বিকশিত হচ্ছে না, এটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দেশ যখনই একটি সঙ্কটের মুখে পড়ে, তখনই এই তৃতীয় ধারা বা বিকল্প ধারার কথা উচ্চারিত হয়। অতীতেও হয়েছে। এখনও হচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এর মূল কারণ উদ্যোক্তাদের সঠিক রাজনীতি বাতলে দেওয়ার ব্যর্থতা। বিকল্প রাজনীতির কথা যারা বলছেন তারা মূলত ব্যক্তিনির্ভর। এই ব্যক্তিনির্ভরতা কোনো বিকল্প রাজনীতির পথ আমাদের দেখিয়ে দেয়নি। আবার ব্যক্তিনির্ভর রাজনীতিবিদদের মাঝে ব্যক্তিদ্বন্দ্ব এত বেশি যে, সবাই মিলে এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ফলে দুটি বড় দল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ওপরই নির্ভর করছে এ দেশের ভাগ্য। একদল ‘ভুল’ করলে, সাধারণ মানুষ অন্য দলের দিকে তাকায়। সেই দলকে ভোট দেয়। কিন্তু কোনো বিকল্প শক্তির দিকে তাকায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১/১১-এর (১১ জানুয়ারি ২০০৭) ঘটনার পর আমরা একটি তৃতীয় শক্তির কথা শুনেছিলাম। সেই তৃতীয় শক্তি বিকশিত হয়নি। আজ ঠিক পাঁচ বছর পর পুনরায় আবার তৃতীয় শক্তির কথা উঠেছে। গত ৭ জুন নাগরিক ঐক্যের উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে এই তৃতীয় শক্তি গড়ার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি বড় দল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তৃতীয় ধারা সৃষ্টির প্রয়াস অনেক দিন ধরেই নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সমাজে আদৌ তা কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। একসময় জাতীয় পার্টি বা বাম ধারার দলগুলোকে তৃতীয় ধারার অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হতো। কিন্তু জাতীয় পার্টি সেই অর্থে গ্রহণযোগ্য একটি তৃতীয় শক্তি না হয়ে উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক একটি আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আর বাম দলগুলোর আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। এখন মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য একটি তৃতীয় ধারার সূচনা করবে, এ বিশ্বাস রাখতে পারছি না। কিংবা হুদা একটি তৃতীয় ধারার জন্ম দেবেন এটাও মনে হয় না।
এটা স্বীকার করতেই হবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি অবিসংবাদিত শক্তি। আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত দল। এদের রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। যে কারণে ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্তক ঘটনার পরও দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে দু’দুবার সরকারও গঠন করেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপি একটি ধারা তৈরি করেছে। বিএনপি আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি। এই বিকল্প শক্তি বাংলাদেশে একটি দ্বি-দলীয় রাজনীতির সূচনা করেছে। পরিসংখ্যান বলে সংসদীয় রাজনীতিতে এই দল দুটির অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। প্রথম সংসদ থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবম সংসদ পর্যন্ত সংসদীয় রাজনীতির যে ধারা, তাতে দেখা যায় যেখানে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, সেখানে বিএনপির অবস্থান বিরোধী শিবিরে। শক্তিশালী তৃতীয় কোনো পক্ষ বিকশিত হয়নি। স্বতন্ত্ররা প্রথম সংসদে (৪টি আসন), মুসলিম লীগ-আইডিএল দ্বিতীয় সংসদে (২০ আসন), জাতীয় পার্টি (৫ম, ৭ম, ৮ম, ৯ম) তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও, জাতীয় পার্টি বরাবরই সরকারের অংশীদার। ফলে তৃতীয় শক্তি বিকশিত হতে পারেনি। এখন বাংলাদেশে একটি তৃতীয় শক্তির প্রয়োজনীয়তার কথাও আকার-ইঙ্গিতে বলছেন দাতারা। দুর্নীতির প্রশ্নটি এখন সামনে চলে এসেছে। বলা হচ্ছে এই তথাকথিত তৃতীয় শক্তি দুর্নীতিমুক্ত থাকবে। এই দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতির কথা বলছে নাগরিক ঐক্য। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক তথা দাতাগোষ্ঠীর একটা ‘বিরোধ’ তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক সরাসরি দুর্নীতির প্রশ্ন তুলেছে। এই ‘দুর্নীতি’র ইস্যুটি বিশ্বব্যাংক তথা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খুব জনপ্রিয় একটি ‘শব্দ’। এটা ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বে সরকার পরিবর্তন করায়। পাকিস্তানে তারা ইমরান খানকে সামনে নিয়ে এসেছে। মিসরে ‘আরব বসন্ত’-এ দুর্নীতির বিষয়টি ছিল মুখ্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা মিসরে আরব বসন্তকে সংঘটিত করেছিল তাদের নেতৃত্ব সারির অনেকেই ওয়াশিংটনে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। এখন মিসরে পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতন্ত্র বিনির্মাণে তরুণ সমাজ, সুশীল সমাজকে ‘প্র্রমোট’ করে। পাঠক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের কথা স্মরণ করুন। হিলারি ক্লিনটন তৃতীয় বা চতুর্থ রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে দেখা না করলেও, তরুণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন এবং রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় তরুণদের ভূমিকার প্রশংসা করেছিলেন। এখন যারা নাগরিক ঐক্যের ব্যাপারে সংগঠিত হয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় তেমন একটা নেই। তারা মূলত সুশীল সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। সঙ্গত কারণেই যে আশঙ্কাটা থেকে যায়, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যে সুশীল সমাজকে ‘প্রমোট’ করছে, তারাই কি নাগরিক ঐক্যের ব্যানারে সংগঠিত হচ্ছে?
এই তথাকথিত তৃতীয় শক্তি নিয়ে দুটি বড় দল আবার পরস্পরকে অভিযুক্ত করেছে। গত ২২ জুন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, বিএনপি তৃতীয় শক্তির উত্থান চাইছে। আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর একদিন আগে বলেছেন, বিএনপি কোনো তৃতীয় শক্তিকে সমর্থন করে না। তবে নাগরিক ঐক্য যদি একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে তারা দল হিসেবে এটাকে সমর্থন করবে। যাকে কেন্দ্র করে এই নাগরিক ঐক্য, বা তৃতীয় শক্তি, সেই মাহমুদুর রহমান মান্না একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় লিখেছেন, জনগণ দুটো বড় দলের কাছে জিম্মি। জনগণের কথা শুনছে না এই দল দুটি। কিন্তু জনগণকে ওই দল দুটি তাদের কথা শুনতে বাধ্য করেছে। তিনি বলেছেন, এই দল দুটি জনগণের কথা না শুনলে, তৃতীয় শক্তির অভ্যুদয় ঘটবেই। তিনি বড় দল দুটোর নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন প্রত্যাশা করেছেন। একজন মান্না কি এই তৃতীয় শক্তির প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন? মান্নার রাজনীতি কতটা স্বচ্ছ? মান্না আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও, তিনি মূল ধারার আওয়ামী লীগার নন। এক সময় জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। কিন্তু নেত্রীর কাছাকাছি যেতে পারেননি। সংস্কারবাদী হিসেবে তার একটা পরিচিতি আছে। এই পরিচয়ের কারণে এবং বিভিন্ন টক শোতে স্পষ্ট বক্তব্য রাখার কারণে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাবেন না বলে অনেকের ধারণা। এ কারণেই তিনি নাগরিক ঐক্যের জন্ম দিলেন। এর কিছুদিন পর হুদা দিলেন আরেকটি দলের জন্ম।
ফ্রন্ট বা নাগরিক ঐক্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো তৃতীয় ধারার সূচনা করতে পারবে না। তাদের কোনো সুস্পষ্ট দিকদর্শনও নেই। এরা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন। সুশীল সমাজকে দিয়ে রাজনীতি হয় না, অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি সম্ভব নয়। সুশীল সমাজের সঙ্গে যারা আছেন, তারা যদি রাজনীতিতে অবদান রাখতে চান, সেটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো দিক। রাজনীতি করতে হলে তাদেরকে মূল ধারার রাজনীতিতে আসতে হবে। মূল ধারার বাইরে গিয়ে কেউ অতীতে কোনো সুবিধা করতে পারেননি। ড. ইউনূস কিংবা ড. কামাল হোসেনের মতো ব্যক্তিত্ব এখন শুধু সংবাদপত্রের পাতাতেই আছেন। অধ্যাপক ইউনূস চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। রাজনীতি একটা ভিন্ন জিনিস। রাজনীতিবিদরা ভুল করতে পারেন। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারেন, এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে জনগণের সঙ্গে এরাই থাকেন। সাধারণ একজন মানুষ যখন কোনো সমস্যায় পড়েন, তখন তিনি ছুটে যান স্থানীয় নেতৃত্বের কাছে। তারাই তাদের আশ্রয়স্থল। ড. ইউনূস সাধারণ মানুষকে নিয়ে এখন সামাজিক ব্যবসার কথা বলেন। কিন্তু তিনি কি আদৌ সাধারণ মানুষের পাশে গিয়ে কোনোদিন দাঁড়িয়েছেন? একজন কামাল হোসেনের কাছে কি সাধারণ মানুষ যেতে পারে? ড. কামাল হোসেনের যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তার সীমাবদ্ধতা তাকে জাতীয় নেতায় পরিণত করতে পারেনি। আজ একজন মান্নার মাঝে হতাশা কাজ করে। তার নিজের নির্বাচনী এলাকা কোনটি, এটা নিয়েও সমস্যা আছে। বগুড়াতে তিনি নির্বাচন করেছিলেন বটে। কিন্তু নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি আর তার নির্বাচনী এলাকায় যাননি। ফলে ঢাকাকেন্দ্রিক একজন ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধিজীবী এক কথা নয়। মান্না আজ যে কথাগুলো বলছেন, সেই কথাগুলো তিনি দলীয় ফোরামে বললে ভালো করতেন। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। এটা না বলে আরেকটি ‘দল’ গঠন করা, তৃতীয় শক্তির কথা বলা জনগণকে বিভ্রান্ত করার শামিল। এই তথাকথিত ‘তৃতীয় শক্তি’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদৌ কোনো অবদান রাখতে পারবে না। তবে এটা ঠিক বর্তমানে রাজনীতি যেভাবে চলছে, সে ধারায় রাজনীতি চললে একুশ শতকে আমরা বাংলাদেশকে যোগ্য স্থানে নিয়ে যেতে পারব না। দুটি বড় দলের মাঝে সুস্পষ্ট দিকদর্শন নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা আমরা বলছি বটে। কিন্তু সেই অর্থে কোনো উদ্যোগ আমরা নিচ্ছি না। নতুন নেতৃত্বও তৈরি হচ্ছে না। দুটি বড় দলের নেতৃত্বের সারিতে যারা আছেন, তারা আগামী ৫-৬ বছর পর অবসরে যাবেন। তখন দলটি থাকবে বটে। কিন্তু নয়া নেতৃত্ব তো তৈরি হচ্ছে না। নয়া নেতৃত্ব তৈরি করার কোনো উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে না। আগামী ২০৫০ সালকে সামনে রেখে একটি রূপকল্প প্রণয়ন করা উচিত। আমাদের জনসংখ্যা, খাদ্য, অর্থনীতি, নিরাপত্তা, জলবায়ু, সুপেয় পানি, জ্বালানি, যোগাযোগ, প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দুটো বড় দলেরই বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। এদের এসব বিষয়ে বেশ কয়েকটি ‘সেল’ থাকা উচিত। গবেষণা ‘সেল’ থাকা প্রয়োজন। ওই গবেষণা ‘সেল’ দলের নীতি নির্ধারণ  করবে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে। দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় এটাই নিয়ম। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া আর জনসমর্থন হারিয়ে অন্য দলের জন্য পথ করে দেওয়া। এর কোনো বিকল্প নেই। আজ যারা তৃতীয় ধারার কথা বলছেন, এরা ভালো করতেন, যদি স্ব স্ব দলে থেকে দলকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে পারতেন। তারা তা করেননি। একজন আমলা, একজন শিক্ষাবিদ কিংবা একজন আইনজীবী বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারবেন না। তৃতীয় শক্তি বা নাগরিক ঐক্য তাই কোনো সমাধান নয়।
Daily SAKALER KHOBOR
27.08.12

কোন পথে সিরিয়া




সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ কি আসন্ন? ওআইসি থেকে সিরিয়ার বহিষ্কার এবং ওবামার হুমকির পর ঘুরেফিরে এখন এ প্রশ্নটিই পশ্চিমা বিশ্বে আলোচিত হচ্ছে বেশি করে। লিবিয়ায় যেভাবে জাতিসংঘের কোনো অনুমতি ছাড়াই পশ্চিমা বিশ্ব সামরিক হস্তক্ষেপ করে গাদ্দাফিকে হত্যা ও তার সরকারকে উৎখাত করেছিল, সিরিয়ায় এখন সে রকমই হতে যাচ্ছে। লিবিয়ার ক্ষেত্রে তথাকথিত মানবিক নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে লিবিয়ার জনগণের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন সিরিয়ার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, R2P or Responsibility to protect, অর্থাৎ \'নিরাপত্তার প্রশ্নে দায়িত্বশীলতার\' মডেল। যুক্তিটা হচ্ছে এই_ সিরিয়ার জনগণ আজ সরকারি বাহিনী কর্তৃক অত্যাচারিত (?)। তাদের রক্ষায় এ হস্তক্ষেপ অনিবার্য। লিবিয়ার ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছিল, ভাড়াটে সৈন্য ও প্রশিক্ষকদের দিয়ে একটি বিদ্রোহী সেনাবাহিনী গঠন করা এবং তাদের সাহায্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সামরিক হস্তক্ষেপ_ সিরিয়ায়ও ঠিক তেমনটি ঘটেছে। একটি বিদ্রোহী \'সিরিয়ান ফ্রি আর্মি\' গঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে লিবিয়ার ইসলামী বিদ্রোহীরা, উত্তর আফ্রিকার ভাড়াটে সৈন্যরা। এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে যে, মার্কিন বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা ব্ল্যাক ওয়াটার বিদ্রোহী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তাদের হাতে বিমান বিধ্বংসী MANPAD রকেটও ((Man Portable air defense system) পেঁৗছে দেওয়া হয়েছে। এই MANPAD রকেট দিয়ে অতিসম্প্রতি বিদ্রোহীরা একটি বিমান ধ্বংসও করেছে।
স্পষ্টতই সিরিয়ার সংকট দেশটির অভ্যন্তরীণ ঘটনা। দেশটিতে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। গণতন্ত্র সূচকে দেশটির অবস্থান ১৫৩ (১৬৭টি দেশের মধ্যে)। আর দুর্নীতিতে দেশটির অবস্থান ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১২৭। পিতার মৃত্যুর পর বাশার আল আসাদ ক্ষমতা নেন, আছেন ২০০০ সাল থেকেই। ধর্মনিরপেক্ষ বাথ পার্টি সিরিয়ার ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। আর সেনাবাহিনী মূলত বাথ পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাশার আল আসাদের পিতা জেনারেল হাফিজ আল আসাদ ১৯৭১ সাল থেকে দেশটি শাসন করে আসছিলেন। সিরিয়ায় সুনি্ন মুসলমানরা (জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ) সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শাসন ক্ষমতায় এদের যেমন নেই কোনো প্রতিনিধিত্ব, ঠিক তেমনি নেই অংশগ্রহণও। আলওবি, যারা জনসংখ্যার মাত্র ৭ ভাগ, তারাই মূলত দেশটি শাসন করে আসছে কয়েক দশক ধরে। প্রেসিডেন্ট হাফিজ এই আলওবি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন। এরা সুনি্ন মুসলমান নয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুনি্নদের একটা ক্ষোভ বরাবরই ছিল। কিন্তু অত্যধিক ক্ষমতাসম্পন্ন সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে এই আলওবি গোষ্ঠী। সিরিয়ায় এ গৃহযুদ্ধের পেছনে কাজ করছে সুনি্নদের অসন্তোষ। এ অসন্তোষকেই কাজে লাগিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে স্পষ্টতই এর পেছনে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা। মধ্যপ্রাচ্যে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে উত্তর আফ্রিকায় তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে উৎখাতের মধ্য দিয়ে এ লক্ষ্য কিছুটা অর্জিত হয়েছে। অন্যদিকে বৃহত্তর \'ইউরো এশিয়া\' অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখতে চায়। এ অঞ্চলের বিপুল জ্বালানি সম্পদের রিজার্ভই যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় আশঙ্কা_ চীন ও রাশিয়ার সমন্বয়ে ওই অঞ্চলজুড়ে গড়ে ওঠা \'সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)\' তার স্বার্থে আঘাত হানতে পারে। কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান এসসিওর সদস্য। অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান ও মঙ্গোলিয়াকে এসসিওর অবজারভার স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে। বেলারুশ আর শ্রীলংকা হচ্ছে ডায়ালগ পার্টনার। ন্যাটোর অব্যাহত সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে এসসিও আগামী দিনে একটি বড় ভূমিকা নিতে পারে, অনেকটা অধুনালুপ্ত ওয়ারশ সামরিক জোটের মতো। স্ট্র্যাটেজিক্যালি সিরিয়ার অবস্থান তাই মার্কিন সমরনায়কদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মিখাইল চসসুডোভস্কির (Michel chossudovsky) একটি মন্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি লিখেছেন, The war on Syria is part of an integrated worldwide military agenda. The road to Tehran goes through Damascuss, Iran, Russia, China & North Korea also being threatened. এটাই হচ্ছে আসল কথা। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন ইরানে ইসলামপন্থিদেরও পতন ডেকে আনতে পারে। ইরানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি স্ট্র্যাটেজি তো অনেক দিনের। বলা হচ্ছে, এই গ্রীষ্মে ইরান আক্রমণ করতে পারে মার্কিন ও ইসরায়েলি বিমান। ধ্বংস করে দিতে পারে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো। আর তাই ইরান সিরিয়া সংকটে আসাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ যদি সিরিয়া ও ইরানে ইসলামপন্থিদের পতন ঘটে (?) তাহলে বৈরী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত উত্তর কোরিয়া ও চীনের ওপর যে \'চাপ\' আসবে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে একটি অক্ষ গড়ে তুলেছে। ভারত মহাসাগরে চীনা কর্তৃত্ব খর্ব করতে যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে নানা উদ্যোগ।
সিরিয়া সংকটের সমাধান যদি পাওয়া না যায়, তাহলে R2P মডেলে সিরিয়ায় সামরিক অভিযান অনিবার্য। সম্ভাব্য এ অভিযানকে অনেক বিশ্লেষক Soft invasion’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ধরনের একটি সামরিক অভিযানে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে যাবে। ইতিমধ্যে সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে দুটি পক্ষের জন্ম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি সৌদি আরব, কাতার ও তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে সমর্থন করছে। তুরস্কে একটি ইসলামপন্থি সরকার থাকলেও দেশটি ন্যাটোর সদস্য। অভিযোগ আছে, MANPAD মিসাইল তুরস্ক বিদ্রোহীদের সরবরাহ করেছিল। শুধু তা-ই নয়, সিরিয়া সীমান্ত থেকে ৬০ মাইল দূরে তুরস্কের আদানা শহর। সেখানে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করছে তুরস্ক। এমনকি আল কায়দার ঘাঁটি রয়েছে বলেও পশ্চিমা সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে। আল কায়দার যোদ্ধারা সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিশেষ করে আলেপ্পো শহর দখলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক সিরিয়ার সংকটকে Cold war style confrontation হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ ইউরোপে প্রভাববলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দীর্ঘদিন যে \'যুদ্ধাবস্থা\' বিরাজ করছিল, সে রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে। ভুলে গেলে চলবে না, সিরিয়া ও ইরানে রাশিয়া এবং চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। এ অঞ্চলের গ্যাস ও তেল উত্তোলনের সঙ্গে দেশ দুটি জড়িত। সিরিয়ার আস সুকনাহ (As-Suknah) দায়ার আজ জাওয়ার ((gazprom)) তেল ও গ্যাস উত্তোলন প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার সংস্থা গ্যাজপ্রম (মধুঢ়ৎড়স) জড়িত। হিম্স ও বানিয়াস শহরে রয়েছে রিফাইনারি। রাশিয়ার বড় বিনিয়োগ রয়েছে এ খাতে। সিরিয়ায় যে গ্যাস ও তেল উৎপাদিত হয় তার তিন ভাগের এক ভাগ উত্তোলিত হয় রাশিয়ার সাহায্যে। এমনকি বিদ্যুৎ উৎপাদনের তিন ভাগের এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে রাশিয়া। অন্যদিকে ইরানের বুশহের পারমাণবিক চুলি্ল রাশিয়ার সাহায্যে নির্মিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে আরও তিনটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে রাশিয়া। চীনের বিনিয়োগও প্রচুর। চীন ১২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে ইরানের গ্যাস ও তেল উত্তোলন প্রক্রিয়ায়। বিশ্বের গ্যাসের মোট রিজার্ভের ১৫ ভাগ ও তেলের ১০ ভাগ রিজার্ভ রয়েছে ইরানে। সিরিয়ায় \'সরকার পরিবর্তন\'-এর স্ট্র্যাটেজিতে এই জ্বালানি স্বার্থর্ও কিছুটা ভূমিকা রাখছে। যারা Primakov Doctrine সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন এ অঞ্চলে সম্ভাব্য এক \'স্নায়ুযুদ্ধের\' ধারণা দেওয়া হয়েছিল অনেক আগেই। সুতরাং সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। কী হতে যাচ্ছে সিরিয়ায়, তা বলাটা অত সহজ নয়। অনেক কিছু ঘটতে পারে সিরিয়ায়। এক. আসাদের পতনের পর সৌদি আরব কিংবা কাতারের মডেলে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রটি ইসরায়েলের জন্য অত হুমকির হবে না এবং ইসরায়েলের সমর্থন থাকবে তাতে। দুই. লেবাননের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে সিরিয়ায়, যেখানে হিজবুল্লাহর মতো যোদ্ধারা বিশেষ বিশেষ এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। তিন. সিরিয়া কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারে। চার. ১৯২১ সালের চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক সিরিয়ায় সৈন্য পাঠাতে পারে। সুলাইমান শাহ জাদুঘর (অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান-১-এর দাদার মাজারে নির্মিত) রক্ষায় তুরস্ক এটা করতে পারে। Treaty of Ankara (তুরস্ক ও ফ্রান্সের মধ্যে) অনুযায়ী তুরস্কের এই অধিকার রয়েছে। সিরিয়া সংকটে তুরস্কের ভূমিকাকে কেউ কেউ New Ottoman সাম্রাজ্যের একটি প্রয়াস হিসেবে দেখছেন। কারও কারও মতে, ১৯১৬ সালের Sykes-Picot (অ্যাংলো-ফ্রান্স) চুক্তি আবার নতুন আঙ্গিকে ফিরে আসছে। ইরান, ইরাক আর সিরিয়া দখলের বা নিয়ন্ত্রণের একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই সিরিয়া সংকট শুধু আসাদের পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যাবে_ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
Daily SAMAKAL
26.08.12

ড্যান মজিনার বক্তব্যে আমরা শংকিত




ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এখন মিডিয়ায় অন্যতম আলোচিত ব্যক্তি। তার একাধিক মন্তব্যের কেউ কেউ ভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। সর্বশেষ মন্তব্যটি তিনি করেছেন ১৩ আগস্ট। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তিনি সাংবাদিকদের বললেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চায় ঋণগ্রহীতারাই গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ করবেন।’ সংবাদটা এভাবেই ছাপা হয়েছে যুগান্তরে। মজিনা অর্থমন্ত্রীকে এ কথাটা জানাতেও ভোলেননি যে, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত যখন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনোভাবের কথা জানান, তখন সঙ্গত কারণেই দু’দেশের বর্তমান সম্পর্ক নিয়ে একটা প্রশ্ন ওঠে। এর আগে, জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে ড্যান মজিনা জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘এ দেশের পণ্য কিনতে মার্কিন ক্রেতারা ঝুঁকি না-ও নিতে পারে।’ এটা ছিল স্পষ্টতই একটি সিগনাল, বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করে দেয়া। জুলাইয়ের শেষে আরেকটি অনুষ্ঠানে তিনি একটু খোলাসা করেই বললেন, ‘টিকফা’ চুক্তি না করলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত ও কোটা সুবিধা পাবে না। ‘টিকফা’ হচ্ছে ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম অ্যাগ্রিমেন্ট’। যদিও আমাদের পররাষ্ট্র সচিব ২৯ জুলাই এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের কারণে ‘টিকফা’ চুক্তি হচ্ছে নাÑ এ কথা সত্য নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে কোন রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে কি-না? না, পারে না। জাতিসংঘের ২.৪ এবং ২.৭ নং ধারা অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কিন্তু ড্যান মজিনার বক্তব্য জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী। এটা দৃষ্টিকটুও। এ দেশের মানুষ জানে না ‘টিকফা’ চুক্তি কী। এই চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, সে ব্যাপারেও আমরা স্পষ্ট নই। দুঃখজনক হচ্ছে, বিদেশে এ ধরনের চুক্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মহাজোট সরকারের আমলে এ ধরনের কোন চুক্তি নিয়ে সংসদে আমরা আলোচনা হতে দেখিনি। মজিনার কথাবার্তা থেকে মনে হয়েছে, বাংলাদেশী পণ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর বাংলাদেশী পণ্য মানেই তো তৈরি পোশাক। সেই তৈরি পোশাক রফতানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তার একটা মারাÍক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্র মূলত প্রেসার খাটিয়ে সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় একটি ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ। এ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কিছুই নেই। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ নামে এটি চুক্তির প্রস্তাব করেছিল। ‘আকসা’ চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে আগামীতে।
‘আকসা’ চুক্তি প্রস্তাবের রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই এখন মজিনা বললেন ‘টিকফা’ চুক্তির কথা। এই চুক্তিটি আসলে কী, কিংবা এতে করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আমরা অনেকেই জানি না। সংবাদপত্রেও এটা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। তবে মজিনা বলেছেন, এই চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষিত হবে। কীভাবে হবে, তা অবশ্য তিনি বিস্তারিত বলেননি। এমনকি এই চুক্তির সঙ্গে ‘টিফা’ বা টিআইসিএফ চুক্তির কোন যোগ আছে কি-না, তাও আমরা নিশ্চিত নই। যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই ‘টিফা’ চুক্তি করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়নি। তখন বাংলাদেশের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র টিআইসিএফ চুক্তি করার প্রস্তাব দেয়। চুক্তিটির পূর্ণনাম হচ্ছে ‘ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম’। বাংলাদেশ যদি এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করে তাহলে পাইরেটেড কোন পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। শ্রমিকের মানও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। তাছাড়া ওষুধ প্রস্তুত ও রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত ডব্লিউটিও’র কাছ থেকে ট্রিপসের আওতায় যে সুবিধা ভোগ করছে, তাও বাতিল হতে পারে। আসলে টিআইসিএফেরই বিকল্প নাম হচ্ছে ‘টিফা’। এর বিস্তারিত কোন পক্ষ থেকেই উপস্থাপন না করায় নানা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো একটি চুক্তির প্রস্তাব করে। তখন এর নাম ছিল ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা ‘টিফা’। ২০০২ সালে প্রণীত টিফার প্রথম খসড়াটিতে ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আপত্তি থাকায় ২০০৫ সালে সংশোধিত টিফায় ৭টি ধারা ও ১৯টি প্রস্তাবনা বহাল থাকে। ওই সময় সংশোধিত টিফায় ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে বিনিয়োগ বাতিল করাসহ মামলার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টিও শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়। টিফা চুক্তির খসড়ার ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর প্রস্তাবনায় মেধাস্বত্ব অধিকার, আন্তর্জাতিক শ্রমমান ও পরিবেশগত সুরক্ষাÑ এই তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। শুধু এই তিনটি ধারাই নয়, বরং টিফা চুক্তির একাধিক ধারা ছিল বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। যেমন বলা যেতে পারে মেধাস্বত্ব আইন প্রসঙ্গে। এটা মানলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে ধস নামবে। বাংলাদেশ এখন প্রায় ৫৫টি দেশে ওষুধ রফতানি করে। বাংলাদেশের ওষুধের মান আন্তর্জাতিক মানের। মেধাস্বত্বের শর্তের কারণে বাংলাদেশ অন্য কোন দেশের ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্য সংশ্লিষ্ট দেশ বা কোম্পানির অনুমতি ছাড়া তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের একটি বিশেষ অধিকার রয়েছে। ওষুধের পেটেন্ট ব্যবহার করেই বাংলাদেশ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ তৈরি করছে, যা দিয়ে দেশের লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সুযোগ ভোগ করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শর্তের কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে কি-না, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র যে শ্রমমানের কথা বলছে, সেটা নিয়েও কথা আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইএলও’র মান বজায় রাখা কঠিন। ইউরোপের একজন শ্রমিক যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এবং শ্রমিকদের যে মান, তার সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মানের বিচার করা যাবে না। ইউরোপে একজন শ্রমিকের যে অধিকার, সেই অধিকার বাংলাদেশের শ্রমিকদের নেই। এটাই বাস্তব। এই বাস্তবতা মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব শ্রমিক মানকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের শ্রমমানকে বিচার করা যাবে না। সুতরাং আজ ‘টিকফা’ বলি আর ‘টিআইসিএফ’ বলি, কোন চুক্তিই বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করবে না। বরং এ ধরনের চুক্তি মার্কিনিদের স্বার্থই রক্ষা করবে মাত্র। এ ধরনের কোন চুক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারকে কোনমতেই মেলানো যাবে না। শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার আমাদের অধিকার। আমরা তো একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রকে সুযোগ দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু বিনিময়ে আমাদের প্রাপ্তি শূন্য। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি) থেকেও কোন সাহায্য পাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিভিন্ন দেশকে বড় অংকের মঞ্জুরি সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এমসিসি গঠন করেছিল মার্কিন কংগ্রেস। এর যুক্তি হিসেবে সুস্পষ্টভাবে কোন ব্যাখ্যা দেয়া না হলেও ধারণা করা হচ্ছে গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, বিনিয়োগের পরিবেশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এমসিসি থেকে বাংলাদেশকে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ড. ইউনূসের বিষয়টিও যে অন্যতম একটি কারণ, তা জোসেফ ক্রাউলির একটি মন্তব্য থেকে জানা যায়। জোসেফ ক্রাউলি মার্কিন কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। দুর্নীতির বিষয়টি এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। আর এখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘টিকফা’ চুক্তি না হলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি। নিঃসন্দেহে এগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র এখানে নাক গলাতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো আমরা যেমন শ্রমমান নির্ধারণ করতে পারি না, ঠিক তেমনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আমাদের যে সুযোগ দিয়েছে, সেই সুযোগ আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। মজিনার বক্তব্যের পর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আÍসমর্পণ করবে, এটা জাতি প্রত্যাশা করে না। এরপর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললেন গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে।
এখন যে বিষয়টি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে মার্কিনি এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করা। আমাদের পররাষ্ট্র সচিব মজিনার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, কিন্তু তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়নি। এটা আমাদের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কথাই স্মরণ করিয়ে দিল। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের প্রতিবাদ শুধু নয়, তাকে আস্থায় নিতে হবে। এভাবে যদি মজিনা একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যেতে থাকেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক অবনতি হতে বাধ্য। যা আমাদের জন্য কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলামের একটি বিরূপ মন্তব্যও ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। একই সঙ্গে ২১ আগস্ট ওয়াশিংটনে সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের হস্তক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। আমাদের দুর্বল ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা এ ধরনের সুযোগ পাচ্ছেন। আমরা তাদের এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছি। ভারত, পাকিস্তান, এমনকি শ্রীলংকার মতো দেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের বক্তব্য দিতে সাহস পায় না। কারণ তাদের দেশপ্রেম অনেক বেশি। জাতীয় স্বার্থে সেখানে সরকার ও বিরোধী দল সবাই এক। পার্থক্য শুধু আমাদের ক্ষেত্রে। আমরা মজিনার বক্তব্যে শংকিত। বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য হয় ৬ কোটি ডলারের। বাংলাদেশী পণ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শতকরা ১৫ দশমিক ৩ ভাগ শুল্ক দিয়ে প্রতিযোগিতা করে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পোশাকের রয়েছে বড় বাজার। বাংলাদেশে এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে ১৫ লাখ মানুষ, যাদের অধিকাংশই নারী। এদের অনেকের টাকায় সংসার চলে। যুক্তরাষ্ট্র যদি বিধিনিষেধ আরোপ করে, তাহলে এই সেক্টরে হাজার হাজার লোক বেকার হয়ে যাবে। এটা সৃষ্টি করবে একটি সামাজিক সমস্যা।
কূটনীতিতে আমাদের দক্ষতা দেখাতে হবে। মার্কিন প্রশাসনকে আস্থায় আনাটা খুবই জরুরি। শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড, ড. ইউনূস ইস্যু কিংবা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিÑ সবকিছুই এই দুটি দেশের মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। এই তিনটি ইস্যুতেই বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা খুশি নন। ড্যান মজিনার বক্তব্যের মধ্য দিয়েই তা এখন প্রতিফলিত হল।
Daily JUGANTOR
23.08.12

যেসব প্রশ্নের জবাব জানা খুবই প্রয়োজন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে, যা দৈনিক সকালের খবর-এ ছাপা হয়েছে। অধ্যাপক হোসেন একাধিক কারণে আলোচিত ছিলেন বা এখনও আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিযুক্তি জাবির শিক্ষকরা মেনে নেননি। গত ২০ মে তিনি জাবির ভিসি হিসেবে দায়িত্ব নিলেও সরকার সমর্থিত শিক্ষকরা তাকে সমর্থনের পেছনে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এমনি এক পরিস্থিতিতে জাবির সিনেট নির্বাচন (২০ জুলাই) সম্পন্ন হয় এবং যা প্রত্যাশা করা হয়েছিল তা-ই ঘটেছিল নির্বাচনের ফলাফলে। পদত্যাগকারী উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীরের ‘সাজানো সিনেটে’ ভোটাভুটিতে সর্বোচ্চ ভোট পান অধ্যাপক কবীর। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পান অধ্যাপক হোসেন। রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক হোসেনকেই নিয়োগ দেন, যা অনেকটা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে গত ২ আগস্ট রাতে। পুলিশ বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। প্রতিবাদে ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ভাঙচুর করে এবং ঢাকা-আরিচা রাস্তা অবরোধ করে রাখে কয়েক ঘণ্টা। গুলিবর্ষণের ঘটনা অতীতের সব ঘটনাকে ম্লান করে দিয়েছে। ছাত্রদের অসন্তোষ থাকতেই পারে। জাবির ছাত্রদের অসন্তোষের ঘটনা উপাচার্য মহোদয় যেমন জানেন, ঠিক তেমনি জানেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। কিন্তু তাই বলে গুলি করতে হবে? যদিও আশ্বস্থ হওয়ার কথা’ গুলিতে কোনো ছাত্র মারা যায়নি, আহত হয়েছে মাত্র। এ ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৬৯ সালের ঘটনা, যখন পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ড. জোহা। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে ক্যাম্পাসে আবার গুলি হল। কোনো ছাত্রের মৃত্যু হল না বটে, কিন্তু ঘটনাটি একটি ‘কালো দাগ’ রেখে গেল। প্রতিবাদ করা তরুণদের ধর্ম। ওরা বিশ্বব্যাপীই এ কাজটি করে। প্রতিবাদী হয়। কিন্তু আমি কখনও প্রত্যাশা করিনি পুলিশ গুলি ছুড়বে। হোক না তা রাবার বুলেট। পুরো ঘটনাটি ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্যই ভিসি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। ভিসি বললেন ক্যাম্পাসের সহিংসতার পেছনে একটি ‘কালো শক্তি’ রয়েছে। এই ‘কালো শক্তি’ স্বাধীনতাবিরোধী। তিনি একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনেরও আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিংস ঘটনাবলির পেছনে নানা ‘থিওরি’ ক্যাম্পাসে চালু রয়েছে। পদত্যাগকারী অধ্যাপক কবীরের সমর্থকদের প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন কেউ কেউ।
অধ্যাপক হোসেন দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা ক্যাম্পাসে স্থিতিশীলতার জন্য কোনো ভালো খবর নয়। অনেকেরই মনে থাকার কথা অধ্যাপক কবীরের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তরা ‘মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করিয়েছিলেন, যারা শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসেনের বিচার দাবি করে মিটিং মিছিল পর্যন্ত করেছিলেন। তারা একপর্যায়ে জাবি প্রশাসনকে একটি বিব্রতকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। কর্মসূচি দেওয়ার তো আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। তারা স্মারকলিপি দিয়েছেন, এটা কী যথেষ্ট ছিল না? এভাবে একজন সিনিয়র শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনাটা অশোভন, দৃষ্টিকটু। আমরা কি এতে করে প্রকারান্তরে সিনিয়র জুনিয়র ব্যবধান তৈরি করছি না? অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের একজন। আজ যারা ‘মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা’ ব্যানারে সমবেত হয়েছিলেন, তাদের প্রায় সবাই তার ছাত্রতুল্য, ছাত্রও বটে। এতে করে কি সিনিয়র শিক্ষকদের অসম্মানিত করা হল না? যে দু’জন শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন গত সাড়ে তিন বছরে, এটা অস্বাভাবিক। আমাদের অনেক ছাত্র শিক্ষক হয়েছেন। আবার অনেক ‘ভালো’ ছাত্রও শিক্ষক হতে পারেননি। তাদেরও ক্ষোভ থাকতে পারে। বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদনও দেখেছি। কিন্তু তাতে কোনো নিয়োগই বাতিল হয়ে যায়নি। অতীতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের কোনো ঘটনায় নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল হয়েছে, এটা আমার জানা নেই। সুতরাং এ বিষয়টি নিয়ে ‘জল ঘোলা করার’ কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমরা সবাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও কিছুদিন থাকব (আমি ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ষাট বছরেই আমি অবসরে যাব)। যারা আজ নিয়োগ পেলেন, তারা থাকবেন প্রায় ৪০ বছর, অর্থাত্ ধরে নিচ্ছি ২০৫২ সাল পর্যন্ত। তাদের অনেক পথ যেতে হবে। একুশ শতকের একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে হবে। ‘স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর গড়ার’ যে প্রত্যয় উপাচার্য ব্যক্ত করেছেন, তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব তরুণ প্রভাষকদের। বিশ্ব জুড়েই তরুণরা পরিবর্তন আনছেন। নিউইয়র্কের ‘অকুপাই ম্যুভমেন্ট’ ৩২১ দিন অতিক্রম করল গত ৪ আগস্ট। আর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আধুনিকতামনস্ক তরুণরা। শক্তিশালী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে তারা দাঁড়িয়ে গেছেন। আরব বিশ্বে পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন এই তরুণরাই। ‘আরব বসন্ত’-এ তরুণ সমাজের অবদান নিয়ে সারা বিশ্ব আজ সোচ্চার। ‘মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা’ ব্যানার তৈরি না করে বরং তরুণ প্রভাষকরা যদি ‘পরিবর্তনের পক্ষে আমরা’ ব্যানার তৈরি করে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত রাখতেন, আমি খুশি হতাম। কেননা তরুণদের পক্ষেই পরিবর্তন সম্ভব। তারা যে যোগ্য, এটা তাদেরকেই প্রমাণ করতে হবে। বিদেশে গিয়ে ডিগ্রি নিয়ে প্রমাণ করতে হবে আমরাও পারি। শুধু শুধু আন্দোলনের নাম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতা কেন? আমরা নিশ্চয় এটা স্বীকার করব, ইতোমধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের কাছে এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। ‘শিক্ষক সমাজ’ আন্দোলন করেছিল একটা যৌক্তিক দাবি তুলে। কিছুটা হলেও সেই দাবি বাস্তবায়িত হয়েছে। ভিসি পদত্যাগ করেছেন। আমরা নয়া ভিসি পেয়েছি। আবার সহিংস ঘটনা কেন? এতে কি নতুন করে সেশনজট তৈরি হবে না? মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা কর্মসূচি দিলে সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ নতুন করে কর্মসূচি দেবে। এতে করে লাভ কার? ভিসি মহোদয় কি শিক্ষকদের এই দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যস্ত থাকবেন, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উন্নয়নের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন! আমাদের তো সবার উচিত নয়া ভিসিকে সহযোগিতা করা, যাতে তিনি অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করতে পারেন। তার সামনে তো এখন অনেক কাজ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি সকল শিক্ষকের প্রতিনিধিত্ব করে। তরুণ শিক্ষকরা যদি মনে করে থাকেন, তাদের অপমান করা হয়েছে, তারা শিক্ষক সমিতির কাছে অভিযোগটি তুলতে পারতেন। সমিতি বিষয়টি দেখতে পারে। আমরা তো এভাবেই সমস্যার সমাধান করি। সবচেয়ে বড় কথা, একটি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এর পেছনে সত্যতা আছে কি নেই, আমরা জানি না। তবে অভিযোগটি বেশ পুরনো।
এক্ষেত্রে তরুণ শিক্ষকরা দাবি করুন একটি নিরপেক্ষ তদন্তের, যাতে করে প্রকৃত ‘সত্য’ বেরিয়ে আসবে। আমরা তো তেমনটিই চাই। এটা তাদের জন্য ভালো। কেননা আগামী দিনে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে সিনিয়র অনেক শিক্ষক অবসরে যাবেন। নাসিম আখতাররাও থাকবেন না তখন। তরুণরাই তো তখন এই বিশ্ববিদ্যালয় চালাবেন। এজন্যই তাদের দাবি হওয়া উচিত ছিল তদন্ত করা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও এ কাজটি করতে পারে। নয়া উপাচার্য বলেছেন ১৯৭৩ সালের জাবি আইন অনুযায়ী একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এখানে তিনি গড়ে তুলবেন। এটা শুভ লক্ষণ। এজন্য অনেক কাজ তাকে করতে হবে। সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের পর শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বের নির্বাচন করতে হবে, যা এখন মূল্যহীন। ডিন নির্বাচনও বাকি। ধারণা করছি সিন্ডিকেটের কয়েকটি পদেরও নির্বাচন হবে। এ সিদ্ধান্তগুলো তিনি একে একে নেবেন। একাডেমিক শৃঙ্খলাও ফিরিয়ে আনবেন তিনি। সামনে প্রথম পর্বের ভর্তি পরীক্ষা। এখানেও প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। কিন্তু ব্যাপক সহিংস ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। ঈদের পর বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে বটে, কিন্তু মূল ঘটনার যদি ‘বিচার’ না হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় আবার অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। উপাচার্য মহোদয় সহিংস ঘটনাবলির সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধীদের একটা যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তা চিন্তার কারণ। কারণ অতীতে আমরা কখনও কোনো উপাচার্যের মুখ থেকে এধরনের কথা শুনিনি। স্বাধীনতাবিরোধীরা স্বাধীনতার এত বছর পরও জাবিতে সক্রিয় (?)-একজন উপাচার্য যখন এধরনের কথা বলেন, তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা জরুরি। কারা এই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি? এদের চিহ্নিত করা দরকার। জাবি উপাচার্য অনেক অভিজ্ঞ মানুষ। নিজে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছেন অনেকদিন ধরে। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আওয়ামী লীগবিরোধী শিক্ষকদের গ্রুপের (সম্ভবত সাদা) সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। আশির দশকে একবার তিনি ওই গ্রুপ থেকে সিন্ডিকেট (নাকি শিক্ষক সমিতি!) নির্বাচনে বিজয়ীও হয়েছিলেন। জাসদ রাজনীতির সমর্থক হিসেবে তার পরিচিতিও ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ ক’জন সিনিয়র শিক্ষক আমাকে জানিয়েছেন সাদা (নাকি গোলাপি) গ্রুপের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার খবর। গোলাপি শিক্ষকদের অনেকেই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক। এ কারণেই অধ্যাপক হোসেন এখন এই রাজনীতির সমর্থক। তার এই ‘কালো শক্তি’র তত্ত্ব আমাদের যথেষ্ট উত্কণ্ঠায় ফেলে দিয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে আমরা জানতে পারি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই এই সহিংস ঘটনা ঘটেছে। পাঠক, এতদিনে জেনে গেছেন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ-এক গ্রুপ, যারা বহিষ্কৃত, কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত। এদের দুয়েকজন কর্মীকে হলে ওঠার অনুমতি দিয়েছেন নয়া উপাচার্য। অন্য গ্রুপ, যারা ‘ভিসি লীগ’ হিসেবে পরিচিত, তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ক্যাম্পাস! অভিযোগ আছে, এরা সাবেক উপাচার্যের আশীর্বাদপুষ্ট। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, কাদেরকে (কোন অংশকে) উপাচার্য মহোদয় ‘কালো শক্তি’ বা স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করলেন? আমরা তার বক্তব্যকে সমর্থন করি। চাই একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। যে কমিটি সকল ঘটনার অনুসন্ধান করবে। এতে ক ‘জাবির কালো বিড়াল’-এর পেছনের ঘটনাও আমরা জানতে পারব।
Daily SAKALER KHOBOR
17.08.12

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে নানা কথা

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে এখনো তের থেকে চৌদ্দ মাস। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে এই নির্বাচন হতে হবে। আর বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। এই হিসাবে ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে নির্বাচন নিয়ে একটি বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে_ নির্বাচন হবে দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে? সংবিধানে বলা আছে সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের যে তিন মাস সেই তিন মাসই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এখানে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। সংবিধানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়নি কারা ওই সরকারে থাকবে। ধারণা করা স্বাভাবিক ওই সময় যারা ক্ষমতায় থাকবে তাদেরকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। অর্থাৎ দলীয় সরকার আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে সংবিধান কোনো পার্থক্য করেনি। সমস্যাটা শুরু হয়েছে সেখান থেকেই। বিরোধী দলের আপত্তি তারা দলীয় সরকার (অর্থাৎ ওই সময়ের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনে অংশ নেবেন না। তাদের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের, সংবিধান অনুযায়ী যা এই মুহূর্তে নেই। তাদের যুক্তি ফেলে দেয়া যায় না। দলীয় সরকারের আওতায় যে নির্বাচন সেই নির্বাচন কখনো নিরপেক্ষ হয় না। ক্ষমতাসীন দল সব সময় প্রভাব খাটায়। সুতরাং বিরোধী দলের যুক্তি দলীয় সরকারের আওতায় নির্বাচন হলে ওই নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না। এক্ষেত্রে মহাজোটেরও কেউ কেউ চাচ্ছেন নির্বাচনের নিরপেক্ষতার স্বার্থে একটি 'বিকল্প' সরকারের অধীনে নির্বাচন। সম্ভবত জনমতকে বিবেচনায় নিয়েই প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলেছেন, যেখানে বিএনপি যোগ দিতে পারে। তবে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি দেননি। ইতোমধ্যে বিএনপি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানও করেছে। প্রধানমন্ত্রী একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এটা নিয়ে আলোচনায় হতে পারত। কিন্তু জট খুললো না। এর আগেই প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের মৃত্যু ঘটল। এরই মাঝে বিএনপির সিনিয়র নেতা মওদুদ আহমদ গত ১১ আগস্ট জানিয়েছেন বিএনপি নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা তৈরি করছে। কিন্তু দলের মহাসচিব পরদিন এর প্রতিবাদ করেছেন। সঙ্গত কারণেই তাই সবার আগ্রহ থাকবে বিএনপির পরিকল্পনা আসলে কী? কিন্তু এ ধরনের একটি পরিকল্পনা যে সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। ফলে বিভক্তি থেকেই গেল। একদিকে দলীয় সরকারের আওতায় নির্বাচন, অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার_ এতে সমাধান হবে না। যেখানে মহাজোট সরকারের শরিকরা পর্যন্ত বলছেন একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার নির্বাচন পরিচালনার জন্য, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর মনোভাব অনেক জটিলতা তৈরি করছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন বটে, কিন্তু সংবিধানে কোনো ধরনের পরিবর্তন ছাড়াও একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা সম্ভব। এ জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে সরকারের আন্তরিকতা। দুভাবে সরকার এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে পারে। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের রায় প্রকাশ করে সেই রায় অনুসরণ করে সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা। দুই. সরকার তার আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণের স্বার্থে সংবিধানে ষোলতম সংশোধনী আনতে পারে। সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। ইতোমধ্যে জানা গেছে যে, আপিল বিভাগের যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষিত হয়েছে, সেই রায়টি দীর্ঘ প্রায় এক বছর পর আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। পত্র-পত্রিকা থেকে যতটুকু জানা গেছে, তা হচ্ছে সর্বসম্মতিক্রমে ওই রায়টি হয়নি। রায়টি হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের মতামতের ভিত্তিতে। এই রায়টি একটি ঐতিহাসিক রায়। এর একাডেমিক ভেল্যুও আছে। সর্বোপরি যারা রাজনীতি বিজ্ঞান নিয়ে চর্চার করেন, তাদের কাছে এই রায়টির গুরুত্ব অনেক বেশি। এর যেমনি একাডেমিক ভেল্যু রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের একটি দিকনির্দেশনা। কথা ছিল রায়টি 'ওয়েব সাইটে' দেয়া হবে, অথবা প্রকাশ করা হবে। যাতে করে ঐতিহাসিক ওই রায়টি সম্পর্কে সবাই জানতে পারেন। কিন্তু গেল মার্চে ওই রায়টি জমা পড়লেও তা অদ্যাবধি প্রকাশ করা হয়নি। ফলে সরকারের সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে আগামী দুটো সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে জাতীয় সংসদ। এখানেই সমাধানের বীজ রোপিত। সংসদে যে কেউ সরকারের কোনো মন্ত্রী, মহাজোটের কোনো সংসদ সদস্য, কিংবা একমাত্র নির্দলীয় সংসদ সদস্যও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা সংসদে উপস্থাপন করতে পারেন, যেখানে সরকারি দলীয় সংসদ সদস্যরা তা সমর্থন করবেন। সেখানে সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। মূল কথা আন্তরিকতা ও বিশ্বাস। এটি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই, যা দুঃখজনক এবং একটি সংলাপের সম্ভাবনাও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে। সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সংবিধানই চূড়ান্ত নয়। মানুষের জন্যই সংবিধান। মানুষের কল্যাণে সংবিধানে পরিবর্তন আনা যায়। অতীতেও আনা হয়েছে। সমঝোতা ছাড়া কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এককভাবে করা নির্বাচনও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নেবে না। এর ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে একটি বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে বহির্বিশ্বে। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (এরশাদের জমানায়) আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে সদ্য গঠিত জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসন পেয়েছিল (শতকরা হার ৪২ দশমিক ৩৪ ভাগ), আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৬টি আসন (২৬ দশমিক ১৫ ভাগ)। বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু ৭ মের (১৯৮৬) ওই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গঠিত সংসদ তার মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। মজার ব্যাপার ওই নির্বাচনে জামায়াত ১০টি, সিপিবি ৫টি, ন্যাপ (মো.) ২টি, ন্যাপ (ভাসানী) ৫টি, বাকশাল ৩টি, জাসদ (রব) ৪টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, মুসলিম লীগ ৪টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি ও স্বতন্ত্ররা ৩২টি আসন পেয়েছিল। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছিল এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ৩ মাসের মধ্যে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিও দেশে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের বয়কটের কারণে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তবে ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়েছিল। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টারা যদি মনে করে থাকেন তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবেন তাহলে সম্ভবত তারা ভুল করবেন। নির্বাচন হয়তো হবে। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বরং সঙ্কটকে আরো গভীরতর করবে। একটা সমঝোতায় পেঁৗছতেই হবে, যা জাতির জন্য মঙ্গল। আওয়ামী লীগ যদি ১৯৮৬ সালের মডেল অনুসরণ করে (আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে এনে বিরোধী দলে বসান), তা তারা ভুল করবে। জাতীয় পার্টি এই ট্র্যাপে পা দেবে না বলেই আমার বিশ্বাস। বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন কিংবা সদ্যগঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে বিএনপির 'বিকল্প' হিসেবে তৈরি করা, জাতিকে এক চরম সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেবে। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সংলাপ হোক। একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত হোক। এখনো সময় আছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনীতিতে গোয়ার্তুমির কোনো জায়গা নেই। রাজনীতি হচ্ছে 'এ্যান আর্ট অব কম্প্রোমাইজ'। সেই কমপ্রোমাইজের দিকে প্রধানমন্ত্রী যাবেন সেটাই সবাই প্রত্যাশা করে।Daily JAI JAI DIN
17.08.12

সমঝোতা ছাড়া নির্বাচন অর্থহীন


আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব এখন আলোচনার অন্যতম বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব এবং খালেদা জিয়ার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর এখন নানা মহল থেকে নয়া প্রস্তাব ও পাল্টা প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জট খুলছে না। ধারণা করছি ঈদের পরের যে রাজনীতি, সেই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দুটি প্রস্তাব এখন রাজনীতির মাঠে আছে। একটি প্রধানমন্ত্রীর, যেখানে তিনি বলেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যোগ দিতে পারে। আর দ্বিতীয়টি খালেদা জিয়ার, যেখানে তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। কোনো পক্ষই এ প্রস্তাব দুটির পক্ষে নমনীয় হচ্ছে না। ফলে একটি বড় ধরনের আশঙ্কা দানা বাঁধছে।
প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। বিএনপি কীভাবে যোগ দেবে, কতজন সদস্য থাকবে ওই সরকারে কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব কে দেবেন, তার বিষয়ে ব্যাখ্যা নেই। প্রধানমন্ত্রী যদি এটা স্পষ্ট করতেন, তাহলে ওই সরকার নিয়ে বিশদ আলোচনা করা যেত। কিন্তু তার কোনো সুযোগ নেই। মনে হচ্ছে এটা প্রধানমন্ত্রীর \'কথার কথা\'। তবে প্রধানমন্ত্রী এক জায়গায় ঠিক আছেন, আর তা হচ্ছে সংবিধান। সংবিধান সংশোধনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। আছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর ব্যাখ্যাও আছে সংবিধানে_ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস আগে যে সরকার থাকবে, সেটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থাৎ ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই সরকারের বয়স। ২০১৩ সালের অক্টোবরের পর মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত মহাজোট সরকারই ক্ষমতায় থাকবে এবং তারাই সংবিধান অনুযায়ী চিহ্নিত হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে। শেখ হাসিনাই এ সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। এমপিরা থাকবেন। মন্ত্রীরা থাকবেন বহাল তবিয়তে। বিএনপি তাতে যোগ দেবে, এটা মনে করার আদৌ কোনো কারণ নেই। অন্যদিকে বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে, তা তো সংবিধানে নেই। বিএনপি সংবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সরকার এটা মানবে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আর জটটা লেগেছে এই জায়গাতেই। কেউ আধা ইঞ্চি ছাড় দিতেও রাজি নয়। দাতারা বারবার বলছে একটি সংলাপের কথা। বলছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা। কিন্তু সরকার এদিকটায় যে খুব আন্তরিক তা মনে হয় না। এতে করে তো সমাধান হবে না। এখানে সম্ভাব্য কয়েকটি \'বিকল্প\' নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এক. শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সমন্বয়েই গঠিত হবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যেখানে মোট সদস্য থাকবেন দশজন। খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপি তথা তার নেতৃত্বাধীন জোটের ৫ জন, অন্যদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোটের ৫ জন। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো সমানভাবে দুই জোটের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে এক জোট স্বরাষ্ট্র পেলে অন্য জোট পাবে পররাষ্ট্র। নির্বাচন কমিশন তাদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে এবং রাষ্ট্রপতির কোনো ভূমিকা থাকবে না। এখানে বলা ভালো, সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের সমন্বয়ে যে সরকার গঠন সম্ভব, তার ইতিহাস আমাদের সম্মুখে আছে। বিগত আশির দশকে ইসরায়েলে এমনটি হয়েছিল। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা যদি রাখা যায়, তাহলে এই ফর্মুলা কাজ করবে। দুই. রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যেখানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমানসংখ্যক প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এই সরকার কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তাদের দায়িত্ব হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। তিন. স্পিকারের নেতৃত্বে একটি সরকার, যে সরকারে দুই জোটের সমসংখ্যক প্রতিনিধি থাকবেন এবং স্পিকারসহ কেউই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। স্পিকার দীর্ঘদিন ধরে সংসদে আছেন। এখন অবসরে যেতে পারেন। তিনি হতে পারেন জাতির অভিভাবক। সংকটকালীন সময়ে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেতে পারেন। কিন্তু তিনি যদি আবার নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। চার. প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে শুধু সাংবিধানিক পদে যারা অধিষ্ঠিত, তাদের নিয়েও একটি সরকার হতে পারে। তবে বিগত প্রধান বিচারপতির কর্মকাণ্ড এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ে বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে নিরুৎসাহিত করার কারণে সঙ্গত কারণেই বর্তমান প্রধান বিচারপতি এ দায়িত্ব নেবেন না। পাঁচ. তিন বা পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি \'এলডার্স কাউন্সিল\'-এর বিষয়েও আলোচনা হতে পারে। মূল কথা আন্তরিকতা ও বিশ্বাস। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যা নেই এবং একটি সংলাপের সম্ভাবনাও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে।
সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সংবিধানই চূড়ান্ত নয়। মানুষের জন্যই সংবিধান। মানুষের কল্যাণে সংবিধানে পরিবর্তন আনা যায়। অতীতেও আনা হয়েছে। সমঝোতা ছাড়া কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এককভাবে করা নির্বাচনও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নেবে না। ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে একটি বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে বহির্বিশ্বে। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৮৬ সালে তৃতীয়, ১৯৮৮ সালে চতুর্থ, ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তার আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (এরশাদের জমানায়) আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে সদ্য গঠিত জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসন পেয়েছিল (শতকরা হার ৪২ দশমিক ৩৪ ভাগ), আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৬টি আসন (২৬ দশমিক ১৫ ভাগ)। বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু ৭ মের (১৯৮৬) ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদ তার মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। মজার ব্যাপার, ওই নির্বাচনে জামায়াত ১০টি, সিপিবি ৫টি, ন্যাপ (মোজাফফর) ২টি, ন্যাপ (ভাসানী) ৫টি, বাকশাল ৩টি, জাসদ (রব) ৪টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, মুসলিম লীগ ৪টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি ও স্বতন্ত্ররা ৩২টি আসন পেয়েছিলেন। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ৩ মাসের মধ্যে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিও দেশে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের বয়কটের কারণে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তবে এই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়েছিল। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টারা যদি মনে করে থাকেন, তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবেন, তাহলে সম্ভবত তারা ভুল করবেন। নির্বাচন হয়তো হবে। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বরং সংকটকে আরও গভীরতর করবে। একটা সমঝোতায় পেঁৗছতেই হবে। যে সম্ভাবনা বা বিকল্প নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম, তার একটি নিয়ে সংলাপ হতে পারে। আরও ভালো হয় যদি বিএনপি নিজে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। সমঝোতা ছাড়া যে কোনো নির্বাচন হবে অর্থহীন।
Daily SAMAKAL
14.08.12

খাদের কিনারে প্রশাসন




‘খাদের কিনারে প্রশাসন’Ñ এভাবেই যুগান্তরের শিরোনাম ছিল ২৯ জুলাই। যারা প্রশাসন নিয়ে কাজ করেন এবং প্রশাসনের অন্দরমহলের কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তাদের কাছে প্রশাসনে অস্থিরতার খবর নতুন কোন বিষয় নয়। সরকারি পদে পদায়নের যেমনই কোন পরিকল্পনা নেই, ঠিক তেমনি নেই পদের হিসাবও। যেখানে মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি হওয়ার কথা, সেখানে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে বিশেষ দল ও মতের প্রতি আনুগত্য। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রশাসনের শীর্ষপর্যায়ে বিরোধ এখন চরমে (যুগান্তর, ৫ আগস্ট)। সবচেয়ে যা বেশি ভয়ের তা হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তারা নিজেদের জন্য সুবিধা ও প্রমোশন বাগিয়ে নেয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছেন। এর ফলে যারা সৎ ও ক্লিন ইমেজের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত, তারা বঞ্চিত হচ্ছেন পদে পদে। কোথাও কোথাও তাদের প্রমোশন বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর। এমনই এক প্রমোশনবঞ্চিত যুগ্ম সচিব মনোয়ার হোসেনের আÍহত্যার খবরও ছেপেছিল যুগান্তর ১৩ জুলাই। ’৮৩ ব্যাচের ওই কর্মকর্তা ওএসডি অবস্থায় ছিলেন দু’বছর, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। অথচ তার ব্যাচমেটরা অনেকেই সচিব পর্যন্ত হয়েছিলেন। প্রশাসনে এই যে অনিয়ম, এই অনিয়ম জনপ্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের এক ধরনের হতাশার মাঝে ফেলে দেয়। এ নিয়ে বেশকিছু লেখালেখি হলেও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডকে একটি নিয়মনীতির ভেতরে নিয়ে আসার কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এটা দুঃখজনক, অযোগ্য ব্যক্তি পদোন্নতি পাচ্ছেন এবং যোগ্যদের বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। সরকারের উচ্চপর্যায়ের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের অভাবের ফলে জনপ্রশাসনে কাজের গতি আসছে না এবং ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়ছে (যুগান্তর, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১)। ঢালাও পদোন্নতির ফলে জনপ্রশাসনে সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা (আমার দেশ, ২৭ ফেব্র“য়ারি ২০১২)। ৮ ফেব্র“য়ারি জনপ্রশাসনে কেন্দ্রীয়র স্তরে বর্তমান সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদে ১২৭, যুগ্ম সচিব পদে ২৬৪ এবং উপসচিব পদে ২৫৮ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। মোট পদোন্নতি পেয়েছেন ৬৮১ জন। এ বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে বিদ্যমান বিধি-বিধানের অপব্যবহার করে এক অশুভ নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে (নয়া দিগন্ত, ১৫ ফেব্র“য়ারি ২০১২)। দুঃখজনক হচ্ছে, এটা করতে গিয়ে ৭০০-এর অধিক জ্যেষ্ঠ ও পদোন্নতির সব শর্ত পূরণকারী কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাই ৮ ফেব্র“য়ারিকে অনেকে ‘কালো দিবস’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। যে অভিযোগটি গুরুতর তা হচ্ছে, পিএসসি কর্তৃক নির্ধারিত জাতীয় মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া বেশ ক’জন কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, যারা পদোন্নতি পেয়েছেন, তারা একটি বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী। পদোন্নতির জন্য আবশ্যক সিনিয়র স্টাফ কোর্স এবং উচ্চতর প্রশাসনিক ও উন্নয়নবিষয়ক কোর্স সম্পন্ন না করেই পদোন্নতি পেয়েছেন কয়েকজন। মজার ব্যাপার, শীর্ষপর্যায়ে পদোন্নতির জন্য ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন এমন অনেকে এই দক্ষতা দেখাতে পারেননি। কেউ কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি ডিগ্রি ‘ক্রয়’ করে তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করেছেন। অথচ ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। শুধু টাকার বিনিময়ে একখানা সার্টিফিকেট তারা সংগ্রহ করেছেন। নিয়মিত ক্লাস বা কোর্স ওয়ার্ক তারা করেননি। কেউ কেউ অনলাইনে একখানা পিএইচডি ডিগ্রি জোগাড় করে, তা ব্যবহারও করছেন। উচ্চতর ডিগ্রি পদোন্নতির জন্য প্রয়োজন রয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি ভুয়া ডিগ্রি যখন জনপ্রশাসনের কেউ ব্যবহার করেন, তখন আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। যারা জনপ্রশাসনের শীর্ষে রয়েছেন, তারা আশা করছি, বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন।
জনপ্রশাসনে এভাবে ঢালাও পদোন্নতি, যা কিনা ‘সুনামি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তা আমাদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তাদের কোন কারণ ছাড়াই বাদ দেয়া, পদের চেয়ে দ্বিগুণ কর্মকর্তা কিংবা যোগ্য কর্মকর্তাদের ওএসডি করা জনপ্রশাসনের জন্য কোন সুস্থ লক্ষণ নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ফেব্র“য়ারি (২০১২) পর্যন্ত ওএসডি হিসেবে কর্মরত ছিলেন ৮৩৫ জন, আর তিন বছর ধরে আছেন ১২৩ জন। দুঃখজনক হলেও সত্য, গেল আড়াই বছরে ওএসডি অবস্থায় পিআরএলএ গেছেন ২২৭ জন কর্মকর্তা। কর্মহীন অবস্থায় পিআরএলে যাওয়ায় সহকর্মীদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেয়ারও সুযোগ তারা পাননি। সারাজীবন যিনি জাতির জন্য, রাষ্ট্রের জন্য শ্রম দিলেন, মেধা দিলেন, তাকে বাধ্য করা হল পিআরএলে যেতে ওএসডি থাকা অবস্থায়ই। সুষ্ঠু জনপ্রশাসনের জন্য এ ধরনের প্রবণতা কোন মঙ্গল ডেকে আনবে না। ইতিমধ্যে সচিবদের মধ্যে ৮টি সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করে এক তুঘলকি কাণ্ড ঘটানো হয়েছে জনপ্রশাসনে।
এমনকি পুলিশের মহাপরিদর্শককে সিনিয়র সচিব পদ দিয়ে পুলিশ বিভাগে একাধিক সচিব পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ‘সিনিয়র সচিব’ পদ সৃষ্টি কিংবা পুলিশ বিভাগের জন্য একাধিক সচিব পদ সৃষ্টি জনপ্রশাসনে শৃংখলা ও কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য আদৌ করা হয়নি। বরং বিশেষ ব্যক্তিকে খুশি করা, একই সঙ্গে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে দিয়ে সুবিধা আদায় করার নিমিত্তেই করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনে এই যে পদোন্নতি, তার কোন সুনির্দিষ্ট আইন নেই। শুধু বিধিমালা দিয়েই চলছে গত ৪১ বছর। শুধু দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতির স্বার্থেই কোন আইন করা হয়নি। এখানে অভিযোগ উঠেছে, আইন প্রণয়ন না হওয়ায় শুধু ১৩৩ অনুচ্ছেদ নয়, সংবিধানের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদের নির্দেশনাও যথাযথভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে ২০১০ সালে সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট ২০১০ নামে একটি আইন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। পরে সরকারের উদ্যোগে গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িস অ্যাক্ট ২০১২ প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে আদৌ কোন অগ্রগতির খবর আমরা জানি না। অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি এক চিঠিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন এখন থেকে সচিবালয়ের সব নিয়োগ হবে রাজনৈতিক বিবেচনায়। তিনি ‘আউট সোর্সিং’-এর মাধ্যমে নিয়োগের প্রস্তাব করেছেন। এটা যদি কার্যকর করা হয়, তাহলে সচিবালয়ের শীর্ষপর্যায় থেকে নিুপর্যায় পর্যন্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হবে। এটা সুস্থ প্রশাসনের জন্য আদৌ কোন ভালো লক্ষণ নয়। পাক-ভারত উপমহাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন দেশে সচিবালয়ে ‘আউট সোর্সিং’-এর মাধ্যমে কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয় না।
একটি দেশ ও সরকারের মস্তিষ্ক হল জনপ্রশাসন। এ জন্যই জনপ্রশাসনে যোগ্য লোকের দরকার। অযোগ্য, অদক্ষ ও মেধাহীন কর্মকর্তারা যদি দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি পান, তারা দরকষাকষিতে কোন যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারবেন না। ফলে বিদেশে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করতে তারা ব্যর্থ হবেন। এজন্য দরকার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ। এর ফলে প্রশাসনে এহেন বিড়ম্বনা অনেকটাই প্রশমিত হবে এবং প্রশাসনে অধিকতর গতিশীলতা আনা সম্ভব হবে। এছাড়া আন্তঃক্যাডার কলহ, বদলি আতংক, পদায়নবৈষম্য ইত্যাদি উপসর্গ দূর করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যদি দূর করা না যায়, তাহলে সেই প্রশাসন দিয়ে জাতির কোন মঙ্গল প্রত্যাশা করা যায় না।
আমরা সত্যিকার অর্থেই দক্ষ জনপ্রশাসন চাই। বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে আইন, নিয়ম ও নেগোসিয়েশনের টেকনিক। এক্ষেত্রে আমাদের জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের যোগ্যতা দেখাতে হবে। তারা যদি দক্ষ না হন, উচ্চশিক্ষিত না হন, তাহলে তারা নেগোসিয়েশনে তাদের যোগ্যতা দেখাতে পারবেন না। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ কিংবা পদোন্নতি বহিঃবিশ্বে আমাদের অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে। পদোন্নতির জন্য প্রতিটি পদে লিখিত পরীক্ষা থাকতে হবে। যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন, তারাই কেবল পদোন্নতির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। রাজনৈতিক বিবেচনা বা বয়স কোন অবস্থায়ই পদোন্নতির মাপকাঠি হতে পারে না। একটি দেশ যদি দক্ষ জনপ্রশাসন কর্মী গড়ে তুলতে না পারে, সে দেশ কখনই উন্নতির শিখরে উঠতে পারবে না। আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত রয়েছে সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ার।
এমনকি ভারতের দৃষ্টান্তও আমরা দিতে পারি, যাদের কেউ কেউ আজ আন্তর্জাতিক আসরেও তাদের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। আমরা ব্যর্থ হতে চাই না। আমাদের মাঝে অনেক তরুণ জনপ্রশাসন কর্মকর্তা রয়েছেন। সরকার তাদের বিদেশে ট্রেনিং ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এদের অনেকেরই কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু এরা যদি পদোন্নতি কিংবা পদায়নের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হন, তাহলে এদের মাঝে হতাশা কাজ করবে।
এরা তখন তাদের দক্ষতা দেখাতে পারবেন না। ‘খাদের কিনারে প্রশাসন’ প্রতিবেদনটি আমাদের চোখ খুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আমাদের নীতিনির্ধারকরা এ থেকে যদি কিছুটা ‘শেখেন’, জনপ্রশাসনের জন্য তা হবে মঙ্গল।
Daily JUGANTOR
13.08.12

অনিশ্চয়তার আবর্তে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের ওপর আবারও চড়াও হয়েছেন। এবার বললেন, বিশ্বব্যাংক ‘কমিশন খায়’। লন্ডনে দেয়া তার এই বক্তব্য যখন বাংলাদেশের মিডিয়ায় ছাপা হয়েছে, তখন ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বিশ্বব্যাংকের সদর দফতরেও তা পৌঁছে যাবার কথা। এখন যে প্রশ্ন অনেকের মতো আমাকেও ভাবিয়ে তুলেছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের যে ৩৩টি প্রকল্প রয়েছে,তার এখন কী হবে? বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ওই প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়, তখন, সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে বাকি প্রকল্পগুলোতে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির প্রশ্ন তুলবে কী না? কিংবা ওইসব প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দেবে কী না? স্পষ্টতই যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। সদ্য পদত্যাগকারী মন্ত্রী আবুল হোসেনকে যখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ‘বদলি’ করা হয়, তখন ওই সেক্টরে যে দু’টি প্রকল্পে অর্থায়নের কথা ছিল, বিশ্বব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে তারা আর অর্থায়ন করবে না। এতে করে  এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যেখানে আবুল হোসেন থাকবেন, সেখানে বিশ্বব্যাংক কোনো অর্থায়ন করবে না। শুধু তাই নয়, পুরো সরকারের উপরই অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। ফলে ভবিষ্যতে অর্থ ছাড়ের সম্ভাবনা কম। এখন খোদ সরকার প্রধান যখন প্রকাশ্যেই বিদেশে বসে বিশ্বব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তখন বিশ্বব্যাংক বিষয়টি সহজভাবে নেবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই।
বিশ্বব্যাংক অনেকগুলো প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। মোট ৩৪টি প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মাঝে পদ্মা সেতুতে অর্থ সহায়তার পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি ডলার। এখন এ প্রকল্প পরিত্যক্ত হলো। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংকের অর্থ ছাড়করণে কিছুটা স্লথ গতি আসে। বিদায়ী অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ৫০ কোটি ডলার। অথচ বিশ্বব্যাংক প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলার করে সহায়তা বাড়ানোর কথা বলেছিল। পদ্মা সেতু ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্থাটি হতাশা প্রকাশ করেছে, সেগুলো হচ্ছে ঢাকা পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প (১৪৯ মিলিয়ন ডলার, শুরু ২০০৯ সালে), সামাজিক বিনিয়োগে প্রকল্প-২ (১১৫ মিলিযন ডলার), উচ্চ শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি প্রকল্প (৮১ মিলিয়ন ডলার), চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প, সিদ্ধিরগঞ্জ পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট, বিশুদ্ধ বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ প্রকল্প, ঘূর্ণিঝড় পুনর্বাসন প্রকল্প, ডিসএবিলিটি অ্যান্ড চিলড্রেন অ্যাক্ট রিক্স প্রকল্প, পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প, সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম ইত্যাদি। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থ ছাড়করণের পরিমাণ খুবই কম। দুর্নীতি ছাড়াও অদক্ষতা, কাজের স্লথ গতির কারণেও বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ উত্থাপন করেছে। হাইটেক পার্কে চলাচলের সুবিধার জন্য ঢাকা-কালিয়াকৈর শাটল ট্রেনপথ নির্মাণ ও অবকাঠামোগত  উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকে ৫৫০ কোটি টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। একটি এমওইউও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুর ঘটনার পর বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পের অর্থায়ন স্থগিত করেছে। এখন কোনো প্রকল্পেই বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় দিচ্ছে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার ‘লেভারাইজিং আইসিটি ফর গ্রোথ অ্যামপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গর্ভনেন্স’ প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়ার এক মহাপরিকল্পনা  হাতে নিয়েছিল। এতে করে ৩০ হাজার মানুষকে প্রযুক্তিগত জ্ঞান সম্পন্ন করে গড়ে তোলা হবে। এই পরিকল্পনায় সরকারের সঙ্গে ৫০৯ কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য দেয়ার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বিশ্বব্যাংক। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে এই প্রকল্পের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবার কথা। এখন জটিলতা তৈরি হওয়ায় এই প্রকল্পটি ঝুলে গেল। অথচ ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে জনগণের দোড়গোড়ায় নিয়ে যাবার জন্য এই প্রকল্পের খুবই প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই আইসিটি ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান বিশ্বে খুব ভালো নয়। ইউএনডিপি বিশ্বব্যাপী আইসিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের র‌্যাংকিং বা তালিকা করে। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩ নম্বরে। এই তালিকা আরো উন্নত করতে হলে ইন্টারভিউ কানেকটিভিটি খুবই দরকার। কিন্তু এই কানেকটিভিটি কাজে লাগাতে দরকার প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ, যা আমরা ওই প্রকল্পের আওতায় তৈরি করতে পারতাম। এখন আমরা ওই প্রকল্প নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে গেলাম।
বিশ্বব্যাংকের সাহায্য নিয়ে অনেক কথা আছে। গরিব দেশ বলে বিশ্বব্যাংক বিনে সুদে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রায় সাহায্য দেয় না। সুদে-আসলে তা তুলে নেয়। বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য দিয়েই নিজেরা টিকে আছে। তবে তুলনামূলক বিচারে তাদের সুদের পরিমাণ কম এবং পরিশোধের সময়সীমাও দীর্ঘ। যেমন পদ্মা সেতুতে তাদের সুদের পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ৭৫ ভাগ। অন্যদিকে মালয়েশিয়া কিংবা অন্য কোনো বাণিজ্যিক ঋণের মাধ্যমে সেতু নির্মিত হলে সুদের হার হবে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। উপরন্তু দীর্ঘ সময় তাদেরকে টোল আদায়ের সুযোগ দিতে হবে। আর ঋণের টাকা তুলতে তারা অতিরিক্ত টোল আদায় করবে, যাতে করে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে কথা থাকলেও সহজলভ্যতা ও সুদের হার কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখনঅব্দি ২৫১টি প্রকল্পের বিপরীতে ১ হাজার ৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার তারা অর্থায়ন করেছে। এখন পর্যন্ত এ সংস্থার ১ হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অপরিশোধিত রয়েছে। বর্তমানে মোট ৩৪টি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের মোট ৪৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। যদিও খুব কম ক্ষেত্রে এবং বিশেষ কোনো কারণ না থাকলে বিশ্বব্যাংক সাধারণত অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় না। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। এতে করে বাকি প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে একটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেও সরকারের আচরণের ওপরই এখন সব কিছু নির্ভর করছে। আমরা যতবেশি বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করবো, তত তিক্ততা সৃষ্টি হবে, যা কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না।

বাংলাদেশ কোন পথে

প্রধানমন্ত্রী অতি সম্প্রতি লন্ডন সফরকালে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেওয়ার জন্য বিরোধী দল বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিরোধী দল নেত্রী বেগম জিয়া আবারো বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয়, বরং একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটা সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে পরিস্থিতি যে অসহনীয় হয়ে উঠবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। একটি সমঝোতা এখন কীভাবে সম্ভব? প্রধানমন্ত্রী তথা বর্তমান মন্ত্রিপরিষদকে ক্ষমতায় রেখে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেই সরকার বিরোধী দল কেন, কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে যদি ষষ্ঠ সংসদের মতো একটি ঝুঁকি নেয়, তাহলে সরকার ভুল করবে। আমরা আর ইয়াজউদ্দিন মার্কা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাব না_ এটা ঠিক আছে। কিন্তু সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক না হোক, অন্য কোনো নামে একটি নির্দলীয় সরকার গঠন করতে হবে। বিএনপি যদি নিজেরাই একটা 'ফর্মুলা' দেয়, তাতেও আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। আর সেটা যে সংসদেই হতে হবে, তার কোনো মানে নেই। বিএনপি আগামী সংসদে যোগ দিয়ে এই 'ফর্মুলা' উপস্থাপন করতে পারে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এ দেশের দুটি অবিসংবাদিত শক্তি। দুটো শক্তিই প্রায় সমানসংখক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল এ কথাই প্রমাণ করে। এ ক্ষেত্রে কখনো আওয়ামী লীগ জনসমর্থনে এগিয়ে থাকে। কখনো থাকে বিএনপি। সুতরাং এটা উপলব্ধি করেই একটা সমঝোতা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ যদি ভালো কাজ করে থাকে, তাহলে জনগণ আবার দলটিকে ক্ষমতায় পাঠাবে। আর জনসমর্থন নিশ্চিত করা না গেলে, ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। গণতন্ত্রে এ কথাটাই শেখায়। সংবিধানের যুক্তি তুলে ধরা হয় বটে, কিন্তু বিশ্ব ইতিহাস বলে সংবিধানের বাইরে গিয়েও সমঝোতা হয়েছে। যেমন কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে ২০০৮ সালে। সরকার ও বিরোধী দল মিলেই সেখানে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করে আসছে। আসলে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে আন্তরিকতা। বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ যদি আন্তরিক হয়, তাহলে সমাধান সম্ভব। হার্ডলাইন কখনো মঙ্গল ডেকে আনে না। দেয়ালের লিখন তাই বলে। সরকার যেহেতু ক্ষমতায়, তাই উদ্যোগটি তাকেই নিতে হবে। সৈয়দ আশরাফ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে কথা বলেছিলেন। তিনি এখন এর কাঠামো তুলে ধরতে পারেন, যা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিছুটা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তাদের থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি 'এলডার্স কাউন্সিল', সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন বিশিষ্ট নাগরিকের নেতৃত্বে একটি সরকার, সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের নিয়ে সরকার, কিংবা সরকার ও বিরোধী দলের সমসংখক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সরকার, ইত্যাদি নানা ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আর আলোচনার মধ্যে দিয়েই একটি পথ বের হয়ে আসবে। কিন্তু সরকারের হার্ডলাইনে যাওয়ার কারণে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না একটি সমঝোতা আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে কি না? আর যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে দেশ যে এক গভীর সংকটে পড়বে, তা আর কাউকে বলে দিতে হবে না। বেগম জিয়া ঈদের পরে কর্মসূচি দেবেন। হরতাল, অবরোধ দিয়ে সরকারের পতন হয় না। অতীতেও হয়নি। ১৮ দলের ১১ জুনের গণসমাবেশে সরকার তো নিজেরাই এক রকম 'হরতাল' ডেকে বসেছিল। ঢাকা অভিমুখে কোনো গাড়ি, লঞ্চ আসতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু তাতে গণসমাবেশ 'বাতিল' হয়নি। লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে গণসমাবেশ সমাপ্ত হয়েছে। এখন সরকার গণসমাবেশের 'ভাষা' যদি বিবেচনায় নেয়, তাহলে একটা সমাধান সম্ভব। দেশ গভীর সংকটে পড়ুক, আমরা তা চাই না। জাতির বৃহত্তম স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে একটা সমাধান কাম্য। এ প্রশ্নে 'বিভক্তি' যদি থেকেই যায়, তাহলে তা আমাদের কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। ইতিমধ্যে সুশীল সমাজের বক্তব্যও পাওয়া গেছে। সুশীল সমাজের প্রায় সবাই বলছেন_ একটি সংলাপ হোক, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো দাঁড় করানো হোক, যারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে। হিলারি ক্লিনটন বলে গিয়েছিলেন সে কথা। তার কথার প্রতিধ্বনি করেছিলেন ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত। আর সর্বশেষ গত ৩০ মে তাদের সুরে সুর মেলালেন অ্যালিষ্টার বার্ট, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মন্ত্রী। বললেন, 'বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করে যুক্তরাজ্য। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কথা বললেন না বটে, কিন্তু সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বললেন। একটি সংলাপ হবে, এমনটাও আশা করলেন তিনি। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই প্রশ্নই তো ফিরে আসছে_ সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে?
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে যখন আমন্ত্রণ জানান, ঠিক তখনই গত ৩১ জুলাই মির্জা ফখরুলসহ ৪৬ জন বিএনপির নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে ঢাকার দ্রুত বিচার আদালতে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সম্মুখে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় চার্জ গঠন করা হয়েছে। ৭ আগস্ট মামলার বিচার শুরু হবে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা ৫ জন এমপিসহ বিরোধী দলের ৩৩ জন নেতাকর্মীকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। তারা পরে অবশ্য উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছিলেন। এখন চার্জ গঠন করার ফলে মামলা চলবে। তাতে করে কী বিএনপিকে আস্থায় নেওয়া যাবে? এতে করে দূরত্ব আরো বাড়বে। ঝুলে যাবে সংলাপ প্রক্রিয়া। এখন সংলাপ হবে, এ বিশ্বাসটা রাখতে পারছি না। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছে। পুলিশ এখন নিয়ন্ত্রণবিহীন। কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিক পেটানো থেকে শুরু করে আদালতপাড়ায় তরুণীর শ্লীলতাহানি, বিচারক পেটানোর মতো ঘটনা ঘটিয়েছে পুলিশ। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ ঘটনায় তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশও দিয়েছিলেন। অতীতেও একাধিকবার আদালত পুলিশ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতের নির্দেশও দিয়েছেন। ভর্ৎসনা করেছেন। তাতে কিছু একটা হয়েছে বলে মনে হয় না। যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে 'সার্টিফিকেট' দেন, যেখানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী 'সাংবাদিকদের পুলিশের কাছ থেকে দূরে থাকার' উপদেশ দেন, যেখানে অত্যন্ত ক্ষমতাবান আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব 'ষড়যন্ত্র' আবিষ্কার করেন, সেখানে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আমরা কী ভুলে গেছি বহির্বিশ্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকলাপ মনিটর করা হচ্ছে? অ্যালিস্টার বার্ট বলে গিয়েছিলেন তারা র‌্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠায় র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দেওয়া বন্ধ করেছেন। লন্ডনের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে নির্যাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকারবিষয়ক রিপোর্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। আর সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের যে রিপোর্ট তা তো আমাদের জন্য কোন আশার কথা বলে না। রাজনীতির বাইরেও অর্থনীতির যে সূচক, তাতেও তো কোনো ভালো খবর নেই। গড়ভিত্তিক মূল্যস্ফীতি এখন ১০.৮৬ শতাংশ। রফতানি আয় বৃদ্ধি আগের অর্থবছরের ৪১.৪৭ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে মাত্র ৮.৪১ শতাংশ। অথচ আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১.২২ শতাংশ। টাকার মান কমেছে। বাজেট পাস ও রমজানের সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো কোনো জিনিসের দাম আবার বেড়ে গেছে। কুইক রেন্টাল নিয়ে 'নানা' কাহিনী। এ 'কাহিনী' সাধারণ মানুষ জানে না। বোঝে না। কিন্তু মানুষ ইতিমধ্যে জেনে গেছে এখানে দুর্নীতি হয়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে বিশ্বব্যাংক। মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সচিব দীর্ঘ ছুটিতে গেছেন। কিন্তু তাতে করে কী কুল রক্ষা হবে? আদৌ কী বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে পুনরায় এগিয়ে আসবে? মনে হয় না। বিশ্বব্যাংকের নীতিতে এমনটি নেই। আর পদ্মা সেতু যদি নির্মাণ করা সম্ভব হয়ে না ওঠে, তাহলে দক্ষিণাঞ্চলে মহাজোটের জন্য খারাপ খবর অপেক্ষা করছে। এখানে সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান এক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এখন লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্য ও বেগম জিয়ার ড্যাবের অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। অর্থাৎ 'টানেলের শেষে কোনো আলোর রেখা' দেখা যাচ্ছে না। দুটি বড় দল তথা জোট পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। সমঝোতার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। রাজনীতিতে এই যে একগুঁয়েমি, এই একগুঁয়েমি দেশটির জন্য কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। আমরা একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। আর এই নির্বাচন আয়োজন ও সম্পন্ন করার ব্যাপারে সরকারের যেমনি দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি দায়িত্ব রয়েছে। বিরোধী দলেরও।
Daily DESTINY
08.08.12