রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

কোন পথে পার্বত্য চট্টগ্রাম






আগামী ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ১৫ বছর পার করবে। এই পনের বছরে সেখানে অগ্রগতি হয়েছে কতটুকু? কতটুকু শান্তি সেখানে নিশ্চিত হয়েছে? এসব বিষয় আজ ভেবে দেখার পালা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর যখন শান্তি চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেটা ছিল একটা বড় ধরনের অগ্রগতি। বিদ্রোহী 'চাকমা'দের মূল ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা ও বাঙালি ও পাহাড়িরা একসাথে মিলে মিশে একটি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলা এই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু হিসাব-নিকাশ মেলান যাক। সাধারণ পাহাড়িরা বাঙালিদের সাথে মিলে মিশে থাকলেও পাহাড়ি নেতৃত্ব, বিশেষ করে চাকমা নেতৃত্বের কারণে সরকারের উদ্যোগ বারবার নষ্ট হচ্ছে। পাহাড়ি নেতারা পাহাড়ে আদৌ বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন কিনা, সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিদ্রোহী চাকমাদের পুনর্বাসন, চাকরি, চাকমা নেতাকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া স্থানীয় সরকারের আওতাধীন বেশ কিছু মন্ত্রণালয় তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের হাতে হস্তান্তর কিংবা বেশ কিছু সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়ার পরও পার্বত্য নেতারা, বিশেষ করে চাকমা নেতারা এখনও উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার, যিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তার স্ট্যাচু সেখানে প্রতিষ্ঠিত হলেও, সেখানে সেনাবাহিনীর বীর সৈনিকদের স্মরণে কোনো স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথচ সেনা সদস্যরা এ দেশটির রক্ষার জন্য নিজেদের রক্ত দিয়েছেন। আরো একটা প্রবণতা আমরা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করছি আর তা হচ্ছে বিদেশি নাগরিক, রাষ্ট্রদূতদের পার্বত্য চট্টগ্রামে গমন ও গোপনে পাহাড়ি নেতাদের সাথে বৈঠক। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ও সব ক্ষেত্রে, অর্থাৎ বৈঠকে সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হলেও, প্রায় ক্ষেত্রেই ওই সব বেঠকে সরকারি কর্মকর্তাদের থাকতে দেয়া হয় না। বিষয়টি আমাদের জন্য উদ্বেগের ও আতঙ্কের। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ্য করে আসছি যে একটি চক্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করে সেখান থেকে ফায়দা ওঠাতে চায়। আর এই চক্রের সাথে বিদেশিরা সরাসরিভাবে জড়িত। এদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে ও আর্থিক সহযোগিতায় ইতোমধ্যে পাহাড়িদের নিয়ে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। ওদেরকে উস্কানি দিচ্ছেন সাবেক গেরিলা নেতা ও জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমা। বিদেশি বিশেষ করে অস্ট্রেলীয় সরকারের ভূমিকা এখানে লক্ষ্য করার মতো। তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রচুর পাহাড়ি ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যায়। 'অস-এড'-এর কোনো বৃত্তি বাঙালি ছাত্ররা পায় না, বা তাদের দেয়া হয় না। পাহাড়ি এলাকায় বাঙালিরা মানবেতর জীবনযাপন করলেও কোনো বিদেশি সাহায্য তারা পায় না। ইউএনডিপির কোনো প্রজেক্টে বাঙালিরা চাকরি পায় না। বাঙালিরা সেখানে এক রকম দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো বসবাস করছে, যা সংবিধানের ২৭ ও ২৮নং অনুচ্ছেদের পরিপূর্ণ লঙ্ঘন। আমরা আরো গভীরভাবে লক্ষ্য করছি যে সন্তু লারমা হচ্ছেন অন্যতম উস্কানিদাতা। সরকার পাহাড়িদের অনেক সুযোগ সুবিধা দিলেও সন্তু লারমা একের পর এক সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। রামুর ঘটনায় সর্বশেষ যে বক্তব্যটি তিনি দেন, তাও ছিল উস্কানিমূলক। এমনকি তিনি বারবার আদিবাসী সমাজ বলে যে বক্তব্য দেন, তাও সংবিধান বিরোধী। সংবিধানে আদিবাসী বলে কিছু নেই। আছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। আসলে এই মুহূর্তে পার্বত্য অঞ্চলে একাধিক সমস্যা রয়েছে। মূল সমস্যা একটিই আর তা হচ্ছে এ অঞ্চলে ব্যাপক খ্রিস্টীয়করণ। অথচ পাহাড়িদের, বিশেষ করে সন্তু বাবুদের কাছ থেকে অভিযোগে পাওয়া যায় যে পাহাড়িদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। এটা একটা মিথ্যা প্রপাগা-া। পরিসংখ্যান বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকহারে খ্রিস্টীয়করণ হচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে গরিব পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। তারপর এদের অনেককে চাকরি দেয়া হচ্ছে। পাহাড়ে বেশ কিছু খ্রিস্টীয় মিশনারি স্থাপিত হয়েছে। পাহাড়িদের ধর্মান্তরিত করে ওইসব স্কুলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চার্চ, সেখানে প্রতি রোববার পাহাড়িদের যাওয়া এক রকম বাধ্যতামূলক। বিদেশি নাগরিকদের পার্বত্য চট্টগ্রামে সফরের উদ্দেশ্য একটিই খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও পাহাড়িদের খ্রিস্টধর্মের ব্যাপারে আকৃষ্ট করা। যে হারে পাহাড়ে খ্রিস্টধর্মের প্রসার বাড়ছে, তা আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ। এক সময় এই খ্রিস্টীয় জনগোষ্ঠী বিদেশিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। পাঠক পূর্ব তিমুরের কথা স্মরণ করুন। পূর্ব তিমুর ছিল ইন্দোনেশিয়ার একটি প্রদেশ। ইন্দোনেশিয়ার জনগণ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। তবে পূর্ব তিমুরের মানুষ ছিলেন খ্রিস্টীয় বিশ্বাসী। পূর্ব তিমুর ইন্দোনেশিয়ার সাথে সংযুক্তির পর সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা শক্তিশালী হয়। শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধ। পরে পশ্চিমাদের স্বার্থেই ১৯৯৯ সালে পূর্ব তিমুর স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর স্বাধীনতার পর থেকে অস্ট্রেলিয়া পূর্ব তিমুরের রাজনীতিতে অন্যতম একটি শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার প্রভাব অনেক বেশি। সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ সুদানের কথাও আমরা উল্লেখ করতে পারি। মুসলমান অধ্যুষিত সুদানকে ভেঙে খ্রিস্টীয় ধর্মে বিশ্বাসী দক্ষিণ সুদানকে একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমাদের একটা শঙ্কা থেকেই গেল। বিদেশি নাগরিকদের ঘন ঘন পার্বত্য চট্টগ্রামে যাওয়া, বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সেখানে গোপন মিটিং করা, বিদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা ইত্যাদি আমাদের শঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আরো কিছু তথ্য দিতে পারি। এক সময়, অতীতে আজকে যে 'সাতবোন রাজ্য' নামে পরিচিত সেখানকার মানুষ জঙ্গলে বাস করত ও প্রকৃতি পূজারী ছিল। তাদের কোনো ধর্ম ছিল না। প্রকৃতিকে, শক্তিকে, সূর্যকে তারা পূজা করত। ব্রিটিশদের নজর পড়ল এ অঞ্চলের দিকে। জঙ্গলে বাস করা মানুষদের শিক্ষিত করার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করল। সাথে গেল মিশনারিরা, যারা খ্রিস্টধর্ম প্রচার করত। ওই অঞ্চলে তারা চার্চ প্রতিষ্ঠা করল। ভালো ভালো কথা বলা, আর্থিক সাহায্য করা ইত্যাদিতে আকৃষ্ট হলো জঙ্গলের মানুষ। তারপর বছরের পর বছর গেল। আজ যদি পরিসংখ্যান নেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে মিজোরামের ৯৯ ভাগ মানুষ আজ খ্রিস্টান। নাগাল্যান্ডের ৯০ ভাগ, মনিপুরের ৬০ ভাগ আর মেঘালয়ের প্রায় ১০০ ভাগ মানুষ আজ খ্রিস্টান। ব্রিটিশদের পরিকল্পনা সার্থক হয়েছে। সেখানে খ্রিস্টান ধর্ম একটি শক্তি। সেখানে হিন্দু কিংবা মুসলমান ধর্মের বিকাশ ঘটেনি। ভারতের অন্যত্র ইসলাম ধর্মের বিকাশ ঘটলেও মিশনারিদের কারণে সাতবোন রাজ্যে ইসলামের বিকাশ ঘটেনি। আমাদের আতঙ্কের জায়গাটা হচ্ছে ওখানে মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশে মিজোরাম, তার উপরে ন্যাগাল্যান্ড, মনিপুর, অরুণাচল, মেঘালয়। আমাদের সিলেটের পাশেই রয়েছে আসাম ও মেঘালয়। আসামে কিছু মুসলমান থাকলেও, মেঘালয়ের প্রায় ১০০ ভাগই খ্রিস্টান। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে যেহারে খ্রিস্টান ধর্মের বিস্তার লাভ করছে, তাতে করে পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম, তথা সাতবোন রাজ্যের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা উৎফুলি্লত হতে পারেন। দুই অঞ্চলে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা আমাদের জন্য একটা বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে আগামী দিনগুলোতে। তাই অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাই কমিশনার যখন গোপনে পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেন, তার উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সন্দেহমুক্ত থাকতে পারি না। শুধুমাত্র মানবিক কারণে তিনি যদি বান্দরবান গিয়ে থাকেন, তাহলে তার বাঙালি নেতাদের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি। আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছি যে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক ব্রিগেড সৈন্য ও ৩৫টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। এর ফলে সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকা- বেড়েছে। পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পগুলোতে এখন সন্ত্রাসীরা আশ্রয় নিয়েছে। ওই অঞ্চলগুলো এখন সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমাদের সন্তু বাবু এর কোনো প্রতিবাদ করছেন না। যখন বরকলে (২১ মে ২০১১) বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছিল, তখনও প্রতিবাদ করেননি সন্তু বাবু। তথাকথিত 'ভূমি অধিকার' এর কথা বলে তিনি মূলত চাচ্ছেন' পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন'(?) এবং সেই সঙ্গে এই অঞ্চল থেকে বাঙালিদের বিতাড়ন। এর আগে তিনি একবার বাঙালিদের নোয়াখালীর চরে প্রত্যাবাসনের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। এ ধরনের সাহস তিনি কোথায় পান, ভাবতেই অবাক লাগে। দুঃখজনক হলেও সত্য, তথাকথিত বাম বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজ সন্তু লারমার ওই বক্তব্যের সমালোচনা করেননি। বাঙালিরা তাদের অধিকার নিয়ে সেখানে থাকেন। সংবিধান তাদের সেই অধিকার দিয়েছে। পাহাড়িরা ভূমিপুত্র নন। বাঙালিদের মতো চাকমারাও এ অঞ্চলে প্রায় একই সময় বসবাস করতে শুরু করেন। চাকমাদের আদি বাসস্থান ছিল উত্তর ভারতের হিমালয়ের পাদদেশে। 'চম্বকনগর' নামক স্থানে ছিল তাদের ঐশ্বর্যম-িত রাজধানী। বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী চাকমাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে তারা দেশান্তরিত হয়ে আশ্রয় নেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরান এলাকায়। এক সময় তারা বাঙালিদের মতো সমতলেই বসবাস করতেন। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর সরকার পাহাড়ি অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। কিন্তু চাকমা নেতারা সরকারকে চাপে ফেলে একের পর এক সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন। অথচ বাঙালিরা সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারা এতটুকুও সুবিধা পাচ্ছেন না। অতীতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য সরকার রাঙামাটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও চাকমা নেতৃবৃন্দের বিরোধিতার কারণে তা আজো সম্ভব হয়নি। সরকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উন্নয়নের ব্যাপারে আন্তরিক। কিন্তু দেখা গেছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করছেন চাকমা গোষ্ঠী। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসাতে চাকমাদের প্রাধান্য। ম্রো বা খিয়াং জনগোষ্ঠী এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারের উচিত হবে এসব জনগোষ্ঠীর দিকে নজর দেয়া। সংবিধান অধিকার বলে বাঙালিরা সেখানে বসবাস করে আসছেন। চাকমারা বহিরাগত। বাঙালিদের মতো তারাও 'সেটলার'। সুতরাং বাঙালিদের সেটলার বলে চিহ্নিত করার সুযোগ নেই। আমরা চাইব সন্তু লারমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং সবাই মিলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করবেন।Daily JAI JAI DIN01.12.12

টিআইবির প্রতিবেদন ও বাংলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থা


সংবাদ শিরোনা
  গেল সপ্তাহে টিআইবির একটি প্রতিবেদন নিয়ে সারা দেশ জুড়ে বড় ধরনের ঝড় বয়ে গেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল নবম পার্লামেন্টের সংসদ সদস্যদের শতকরা ৯৭ ভাগ নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। নেতিবাচক কর্মকাণ্ড হিসেবে টিআইবি বোঝাতে চেয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাব বিস্তার, ক্রয় সংক্রান্ত কাজে হস্তক্ষেপ, নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন ইত্যাদি। মোট ১৪৯ জন এমপির উপর গবেষণা চালানো হয়, যাদের মাঝে ২৭ জন মন্ত্রীও আছেন। বাংলাদেশ তো বটেই, বাংলাদেশের বাইরেও টিআইবির একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সেই টিআইবির রিপোর্টে যখন মন্ত্রী তথা সরকারি দলের এমপিদের নেতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরে, তখন বুঝতে হবে দেশে সুশাসনের বড় অভাব। দেশটি ঠিকমত চলছে না। টিআইবির রিপোর্টে অতিরঞ্জিত করে কিছু বলা হয়নি। যা সত্য, গবেষণায় সেই সত্যটিই বেড়িয়ে এসেছে। সংবাদপত্রগুলোই এর সাক্ষী। প্রতিদিন সংবাদপত্রে সরকারি দলের যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর ছাপা হচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে সরকারি দলের এমপিরা। টিআইবি তাদের রিপোর্টে ১৩৬ জন এমপির কর্মকাণ্ড উল্লেখ করেছে। আমার ধারণা আওয়ামী লীগের মোট ২৩১ জন এমপির ব্যাপারে যদি গবেষণা চালানো হত, একই ধরনের ফলাফল পাওয়া যেত। সরকারি দলের ভাগ্য ভালো, টিআইবি তাদের নির্বাচিত সব সংসদ সদস্যদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালায়নি।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি কিংবা ডেসটিনির ঘটনা, যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা ‘লুটপাট’ হয়েছে, সেখানে টিআইবির প্রতিবেদনে তার যে প্রতিফলন ঘটবে, সেটাই স্বাভাবিক। শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে ডেসটিনি প্রতিটির সাথে ক্ষমতাসীন দলের ঊর্ধ্বতন নেতা তথা ঊর্ধ্বতন সমর্থকরা জড়িত। হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে অভিযোগ উঠেছে একজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে। দুদক তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। ডেসটিনির অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত ছিলেন একজন ঊর্ধ্বতন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, যিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। সোনালী ব্যাংকের পাশাপাশি আরো কয়েকটি ব্যাংকও অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িত। এটা তো স্পষ্ট উপর মহলের সাথে যোগসাজশ না থাকলে এটা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বিষয়টি আগেই ধরা পড়ে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেশ কেন ‘উপেক্ষিত’ হলো, তা জানা প্রয়োজন। দুদক বিষয়টি তদন্ত করছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকের কর্মকর্তা ও পরিচালনা পর্ষদের সাবেক কর্মকর্তাদেরও তারা তলব করেছিল। কিন্তু আদৌ কী কোনো ‘ফল’ তাতে পাওয়া গেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি এখনও দিব্যি ‘ঘুরে’ বেড়াচ্ছেন। তারা কেন গ্রেফতার হননি, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাংক চিঠি লিখে জানিয়েছিল পনের দিনের মধ্যে ঋণের অর্ধেক এক হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা ফেরত দেয়ার। ওই টাকা হলমার্ক দেয়নি। নানা ছলাকলার আশ্রয় নিচ্ছে। রাষ্ট্র কী এত দুর্বল যে, হলমার্ক থেকে টাকা উদ্ধার করতে পারবে না? অভিযুক্ত ব্যক্তি ও ব্যক্তিদের বাইরে রেখে ‘তদন্ত’ কাজ করলে, তাতে কী ‘তদন্ত’ কাজে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকবে না? কোনো সভ্য দেশে এটা সম্ভব নয়। হাজার হাজার কোটি টাকা, এ টাকা জনগণের। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এ টাকা তারা আত্মসাৎ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যদিও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন, কিন্তু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কমছে। একটি চক্র বাংলাদেশ ব্যাংক তথা গভর্নরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। একটি অসাধু চক্র সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে ‘ম্যানেজ’ করে হাতিয়ে নিয়েছিল কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর আগে শেয়ারবাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ‘লুট’ হয়েছে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ রিপোর্টে এ ব্যাপারে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করলেও ‘অদৃশ্য শক্তি’র বলে পার পেয়ে যাচ্ছেন অর্থনৈতিক ক্রিমিনালরা। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের নির্লিপ্ততা জনমনে সরকার সম্পর্কে মিশ্র ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। হলমার্কের ঘটনার যদি ‘বিচার’ না হয়, যদি আত্মসাৎ করা টাকা উদ্ধার না হয়, তাহলে মানুষ পুরো ব্যাংক ব্যবস্থার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। সংবাদপত্রে এমন খবরও ছাপা হয়েছে যে, হলমার্ক কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা সদ্য ওএসডিতে যাওয়া ডিএমডি মো. মইনুল হক ছিলেন ট্রুথ কমিশনে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ (আমার দেশ, ১৩ সেপ্টেম্বর)। আত্মস্বীকৃত এই দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীনদের ব্যবহার করে হলমার্কের সাথে অবৈধ সম্পর্ক রেখে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সভাপতি তাই দাবি জানিয়েছিলেন অভিযুক্তদের গ্রেফতারের। সেটা করা হয়নি। এতেই প্রমাণ হয়, হলমার্ক কেলেঙ্কারির সাথে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট রয়েছে। এ ধারণা আরো বদ্ধমূল হয় যখন জানা যায়, গেল বছর বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি লিখিতভাবে অর্থমন্ত্রীকে জানালেও অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি। হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায়দায়িত্ব মুহিত সাহেব এড়াতে পারেন না। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। এখন এর সাথে যোগ হলো হলমার্কের ঘটনা।
আরো একটি সমস্যা সরকারের ভাবমূর্তি ুণœ করেছেÑ আর তা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিশেষ করে সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কূল-কিনারা না হওয়া। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড বিভক্ত সাংবাদিক সমাজকে একত্রিত করেছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যের জন্য সমালোচিত হয়েছেন বারবার। সাংবাদিক সমাজে যারা সরকারের ‘বন্ধু’ বলে পরিচিত ছিলেন এই হত্যাকাণ্ডে তারাও আজ সরকারের পাশে নেই। সাংবাদিক সমাজ একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছেন এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত খুনীদের খুঁজে বের করার। কিন্তু নয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ব্যর্থ। সর্বশেষ পরাগ অপহরণ ঘটনায় জড়িয়ে গেছে যুবলীগের এক কর্মকর্তা। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বটে। কিন্তু উদ্ধার হয়নি ৫০ লাখ টাকা। আজ পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে পুলিশ তথা র‌্যাবের কার্যক্রম থাকা সত্ত্বেও ‘মুক্তিপণ’ এর মতো ঘটনা ঘটেছে। যা আমাদের জন্য চিন্তার কারণ। অভিভাবকদের মধ্যে তাদের সন্তানদের জন্য একটা দুশ্চিন্তা থাকবেই। পুলিশ বিরোধী দলকে হেনস্তা আর লাঠিপেটা করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু ছিনতাইকারী, অপহরণকারীকে গ্রেফতার করতে পারছে না এবং এই প্রবণতা রোধ করতেও পারছে না। শিশু পরাগ অপহরণের ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমরা কত অসহায়। আরো দুঃখজনক খবর হচ্ছে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, তা বন্ধেরও কোনো উদ্যোগ নেই।
আগামী কয়েকটি মাস সরকারের জন্য অত্যন্ত কঠিন সময়। একদিকে বিরোধী দলের সাথে রাজনৈতিক ‘দ্বন্দ্ব’ আরো তীব্র হচ্ছে, অন্যদিকে একাধিক ঘটনায় সরকারের সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হচ্ছে। প্রথম ঘটনায় সরকার রেলের ভাড়া অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করেছে। এর আদৌ প্রয়োজন ছিল না। সাধারণ মানুষ রেলে চলাফেরা করে। ভাড়া কম থাকায় রেল যাত্রা তারা পছন্দ করে। ভাড়া বৃদ্ধি মানেই হচ্ছে সাধারণ মানুষের উপর আঘাত আসা। আমরা ভারতের উদাহরণ দেখাতে পারি। সাধারণত খুব কম ক্ষেত্রেই রেলের ভাড়া সেখানে বাড়ানো হয়। ভাড়া বাড়িয়ে কোনো দলই জনপ্রিয়তা হারাতে চায় না। তৃণমূলের রেলমন্ত্রী ভাড়া বৃদ্ধি করেছিলেন দলের সিদ্ধান্ত না নিয়ে। ফলে মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। নয়া রেলমন্ত্রী বিষয়টি বোঝেন কী না জানি না। কিন্তু রেলের ভাড়া বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য বোঝা। মানুষ খুশি হবে না এই সিদ্ধান্তে। আমলাদের দ্বারা প্রণীত সিদ্ধান্ত যদি জনপ্রতিনিধিরা কোনো কিছু না বুঝেই গ্রহণ করেন, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। দ্বিতীয় ঘটনা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে। যেখানে বিদ্যুতের চুরি রোধ করার কোনো উদ্যোগ নেই, সেখানে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে সরকার কী লাভবান হবে? এতে তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। বিদ্যুৎ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা থাকলেও, তিনি মূলত আমলা, জনগণের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সরকার প্রধানকে তিনি সঠিক উপদেশটি দিয়েছিলেন বলে মনে হয় না।
পদ্মা সেতু, হলমার্ক, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, রেলের ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি একটি ঘটনাও সরকারের পক্ষে যায়নি। এমনিতেই কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, এটা নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষ পরস্পর বিরোধী এক অবস্থান গ্রহণ করেছে। সংবিধান, নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন। যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিষয়টি মুখ্য, সেখানে সরকারের এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। এমনি এক পরিস্থিতিতে আসলো টিআইবির রিপোর্টটি। সরকারের প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করে এর পেছনে সত্যতা আছে। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, তারা টিআইবির সদর দফতরে নালিশ জানাবেন। এতে করে কী ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ সংসদ সদস্যদের তাদের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা যাবে? আমার তা মনে হয় না। বরং তারা উৎসাহিত হতে পারেন। বরং সরকার যদি বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করে এবং টিআইবি যেসব সুপারাশি করেছে তা যদি অনুসরণ করে,আমার ধারণা এতে করে রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতি ঘটবে। মনে রাখতে হবে টিআইবি’র এই রিপোর্ট এখন আন্তর্জাতিকভাবে ‘রেফার’ করা হবে। এটা সরকার নয়, রাষ্ট্রের জন্যও অমঙ্গল। আমরা এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে চাই। আর তার পথ একটাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে আসা। এটা সবার জন্যই মঙ্গল।

খালেদা জিয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে দুটি কথা


খালেদা জিয়া সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে সম্পৃক্ত করতে সরকার জামায়াতে ইসলামীকে পক্ষে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। ওই সভায় জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগর আমির শামসুল ইসলাম এমপিও বক্তৃতা করেন। খালেদা জিয়া প্রশ্ন রাখেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তলে তলে সরকারের কোনো সম্পর্ক আছে কি না সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। আমরা যাঁরা রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে লেখালেখি করি, তাঁদের কাছে খালেদা জিয়ার এই মন্তব্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। খালেদা জিয়ার এই মন্তব্যের পাশাপাশি ইদানীং ছাত্রশিবিরের কর্মকাণ্ডের সচিত্র প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে। সরকারের দাবি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতেই শিবির এই কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী বর্তমানে ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল। জোটের পক্ষ থেকে সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্বও আছে। খালেদা জিয়া যে 'অভিযোগ'টি করেছেন, এ ধরনের অভিযোগ ইদানীং আমি শুনতে পাচ্ছি। বিশেষ করে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রকাশ্যেই যখন বলেন, বর্তমান সরকারের আমলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শেষ হবে, তখন থেকেই বাজারে নানা 'গুজব' ভাসছে। এর কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা বলতে পারব না। তবে রাজনীতির ছাত্র হিসেবেই জানি, রাজনীতিতে স্থায়ী 'বন্ধু' বলে কিছু নেই। আজ যে 'শত্রু', কাল সে 'মিত্র'ও হতে পারে। ভারতে তৃণমূল কংগ্রেস ইউপিএ সরকারের মিত্র ছিল। 'ছিল' বললাম এ কারণে যে সম্প্রতি তারা ইউপিএর মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে থাকবে, নাকি বিজেপির সঙ্গে থাকবে- তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। অতীতে তো তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গেও গিয়েছিল। তাদের স্বার্থ যারা নিশ্চিত করবে, তাদের সঙ্গেই যাবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক অতীতে ভালো ছিল না। অথচ পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে ভারতীয় নেতারা খালেদা জিয়াকে 'হাইপ্রোফাইল' ভিজিটে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিএনপিকে আস্থায় নিতে তাদের দেরি হয়নি। এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির স্থায়ী মিত্র, তা বলা যাবে না। বিএনপি ইসলামী আদর্শ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলে। জামায়াতে ইসলামীও এই মতাদর্শের প্রবক্তা। সে জন্যই এই দল দুটির মধ্যে ঐক্য হয়েছিল; কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর একটা 'অতীত' আছে। ১৯৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক ধরনের 'ঐক্য' করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে। এ ধরনের 'ঐক্য' হতেই পারে! তবে খালেদা জিয়াকে আমি সব সময় জামায়াতে ইসলামীর প্রতি 'দুর্বল' থাকতেই দেখেছি।
রাজনীতিতে 'ষড়যন্ত্র'তত্ত্ব বলে একটি কথা আছে। যাঁরা এই 'ষড়যন্ত্র'তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এই বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন যে খালেদা জিয়া অতিসম্প্রতি ভারত সফর করে এসেছেন। সেখানে তিনি লাল গালিচা সংবর্ধনা পেয়েছেন। খালেদা জিয়া তাঁর এই সফর 'সফল' হয়েছে বলে দাবি করেছেন। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় কোনো কোনো মহল থেকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরামর্শও নাকি দেওয়া হয়েছে! যদিও এ ব্যাপারে কোনো পক্ষ থেকেই স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। খালেদা জিয়া নিজে বলেননি। এমনকি তরিকুল ইসলামের সংবাদ সম্মেলনেও এ ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি। তাই সংগত কারণেই ধরে নিচ্ছি, এর কোনো সত্যতা নেই। জামায়াতে ইসলামীর কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার হচ্ছে। বিচার নিয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। রামুতে খালেদা জিয়া আবারও বলেছেন, তিনিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান। তবে সেই বিচার হতে হবে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে। সুতরাং বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না, এটা বলা যায় না। জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি নিশ্চয়ই আছে। তাদের দলীয় স্বার্থ যেখানে বেশি নিশ্চিত হবে, সেখানেই তারা যাবে, এটাই স্বাভাবিক। ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী শক্তিশালী- এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। তারা আগামীতে ১৮ দলীয় জোটে থাকবে, এটা যেমন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, তেমনি এ সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে জামায়াতে ইসলামী ১৮ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে 'তৃতীয় ধারা'র সূচনা করবে না। ইসলামপন্থী দলগুলোর সমন্বয়ে একটি জোট গঠন করার কথাও বলছেন কেউ কেউ। তবে আমার বিবেচনায় জামায়াত ১৮ দলীয় জোট ছাড়বে না। জামায়াত সমর্থক কিছু কিছু বুদ্ধিজীবীর (ডাক্তার, সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার) সঙ্গে মাঝেমধ্যে আলাপে আমার মনে হয়েছে, তরুণ প্রজন্ম জামায়াতকে তুরস্কের 'জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট' পার্টির মডেলে একটি পার্টি হিসেবে দেখতে চায়। খালেদা জিয়ার 'অভিযোগের' পেছনে সত্যতা যা-ই থাকুক না কেন, বাংলাদেশে একটি তথাকথিত 'তৃতীয় ধারার' বিকাশের সম্ভাবনা ক্ষীণ। অনেক দিন ধরেই এই তৃতীয় ধারার কথা বলা হচ্ছে। এখন কার নেতৃত্বে এই তৃতীয় ধারা বিকশিত হবে? এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বে? এরশাদ সাহেব তো একটি ইঙ্গিত ইতিমধ্যে দিয়েছেন যে জানুয়ারিতে তিনি ঢাকায় মহাসমাবেশ করে মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দেবেন; কিন্তু যাঁরা এরশাদকে চেনেন, তাঁরা জানেন এ ধরনের বক্তব্য এরশাদ সাহেব বহুবার দিয়েছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের উদ্যোগেও একটি তৃতীয় ধারার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর কোনো আবেদন নেই। তাঁরা খুব একটা জনমত সৃষ্টি করতে পেরেছেন বলেও মনে হয় না। বাস্তবতা হচ্ছে- বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি পক্ষ, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি পক্ষ, অন্যটি ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বে একটি পক্ষ, যারা ইসলামী মূল্যবোধ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির মূলত তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অতীতে এরশাদ ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে একটি জোট গঠন করে নির্বাচনও করেছিলেন। কিন্তু ফলাফল খুব সুবিধার ছিল না। সুতরাং ইসলাম-পছন্দ দলগুলো আলাদাভাবে জোট করলেও তাতে জনসমর্থন থাকবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। নানা কারণে খালেদা জিয়াও চাইবেন না জামায়াতে ইসলামী ১৮ দলীয় জোট ত্যাগ করুক। তিনি মূলত একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে 'বাজার' যাচাই করে দেখাচ্ছেন- বিতর্কিত হলেও ১৮ দলীয় জোটে জামায়াতই বড় দল। তাদের যেমন কর্মী রয়েছে, তেমনি রয়েছে আর্থিক ভিত্তি। তবে সরকার যদি জামায়াতকে 'যেকোনো প্রলোভন' দেখিয়ে ১৮ দলীয় জোট থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারে, তাতে তাদের 'সাফল্য' অনেক বেশি। এতে করে নিঃসন্দেহে বিএনপি দুর্বল হবে। তবে যেকোনো বিবেচনায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে এই প্রক্রিয়া 'মেলানো' যাবে না। তরুণ প্রজন্ম চায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। তরুণ প্রজন্ম একটি 'শক্তি'। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সর্বশেষ নির্বাচনে তরুণ প্রজন্মের ভোটেই আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল।
খালেদা জিয়ার 'অভিযোগ'টিকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই না। বরং তাঁর মন্তব্য জামায়াতের গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি সাধারণ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। এতে করে বহির্বিশ্বে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব করেছিলেন বটে; কিন্তু তার কোনো জট খোলেনি। মোদ্দাকথা- বর্তমান সরকারকে অথবা প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে কোনো সরকার বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক আসরে খালেদা জিয়ার গুরুত্ব বেড়েছে। তাঁর চীন ও ভারত সফর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে। চীনের আগামী রাষ্ট্রপ্রধান জি চিন পিং তাঁকে সাক্ষাৎ দিয়েছেন। এটা নিছক সাধারণ ঘটনা নয়। চীনা নেতারা খালেদা জিয়াকে যে গুরুত্ব দেন, এটা তার বড় প্রমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলকে বিচারে যে মার্কিন নীতি, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান 'ছোট' করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একদিকে পূর্ব চীন সাগরভুক্ত দেশগুলো, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে 'চীনকে ঘিরে ফেলার' নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। ওবামার দ্বিতীয় প্রশাসনেও এই নীতিতে কোনো পরিবর্তন হবে না। ওবামার ১৯ নভেম্বর মিয়ানমার সফরকেও এই দৃষ্টিতে দেখতে হবে। ওবামা প্রশাসন তাদের স্ট্র্যাটেজিতে মিয়ানমারকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইবে। তবে ওবামা প্রশাসন কতটুকু সফল হবে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলবে। এসব কারণে চীনা নেতাদের কাছে খালেদা জিয়ার গুরুত্ব অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি 'অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি' স্বাক্ষর করেছে। 'আকসা' চুক্তি নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে। আকসা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে মার্কিন মেরিন সেনা বাংলাদেশে অবস্থান ও বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে পারবে। খালেদা জিয়ার গুরুত্ব তাই বাড়ছে। খালেদা জিয়া রামুতে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে কিছুটা কৌতূহল সৃষ্টি হলেও বাস্তবতাই বলে, জামায়াতে ইসলামীর কাছে বিএনপি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। খালেদা জিয়ার মন্তব্যের পর সরকার আরো সতর্ক হয়ে যাবে। জামায়াতে ইসলামী কোন জোটে যোগ দিল বা কোন জোটে থাকল, ওটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে বিএনপিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা। সরকারের সাফল্য সেখানেই নিহিত।Daily KALERKONTHO27.11.12

সম্পর্কে কী আদৌ পরিবর্তন আসবে?

 প্রেসিডেন্ট ওবামার দ্বিতীয় টার্মে বিজয় ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারি কিনটনের সম্ভাব্য বিদায়ের মধ্যদিয়ে যে প্রশ্নটি এখন উঠেছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিনি নীতিতে আদৌ পরিবর্তন আসবে কী না? যারা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের কিছুটা খোঁজ খবর রাখেন, তারা জানেন বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দু’দেশের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। অধ্যাপক ইউনূসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের অসন্তোষের খবর আমরা সবাই জানি। ওবামার নির্বাচনের পরদিনও অর্থমন্ত্রী পুনরায় অধ্যাপক ইউনূস সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এর ফলে ওবামার নয়া প্রশাসন বিষয়টি খুব ভালো চোখে দেখবে বলেও মনে হয় না। ড. ইউনূস ইস্যুর বাইরেও ‘টিকফা’ ও ‘আকসা’ চুক্তি নিয়ে দু’ দেশের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। দু’টো চুক্তিই স্বাক্ষরিত হয়নি। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘চাপ’ আছে। এমনকি ‘টিকফা’ চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে কোনো সুবিধা পাবে না, এমন কথাও বলেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা।  তার বক্তব্য পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। এখন বাংলাদেশ ওবামা প্রশাসনের সমর্থন পেতে ‘টিকফা’ এবং ‘আকসা’ চুক্তি স্বাক্ষর করে কী না সেটাই দেখার বিষয়। তবে এ দেশের মানুষ জানে না ‘টিকফা’ চুক্তি কী? এই চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, সে ব্যাপারেও আমরা স্পষ্ট নই। দুঃখজনক হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে বিদেশে, এ ধরনের চুক্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মহাজোট সরকারের আমলে এ ধরনের কোনো চুক্তি নিয়ে সংসদে আমরা আলোচনা হতে দেখিনি। মজিনার কথাবার্তা থেকে মনে হয়েছে বাংলাদেশী পণ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর বাংলাদেশী পণ্য মানেই তো তৈরি পোশাক। সেই তৈরি পোশাক রফতানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তার একটা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্র মূলত প্রেসার খাটিয়ে সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। হিলারি কিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় একটি ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ। এ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কিছুই নেই। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ নামে একটি চুক্তির প্রস্তাব করেছিল। ‘আকসা’ চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতির সুযোগ সুষ্টি হবে। এই উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে আগামীতে। ‘আকসা’ চুক্তি প্রস্তাবের রেশ ফুরিয়ে যাবার আগেই মজিনা বললেন, ‘টিকফা’ চুক্তির কথা। এই চুক্তিটি আসলে কী, কিংবা এতে করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আমরা অনেকেই জানি না। সংবাদপত্রেও এটা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। তবে মজিনা বলেছেন, এই চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষিত হবে। কীভাবে হবে, তা অবিশ্যি তিনি বিস্তারিত বলেননি। এমনকি এই চুক্তির সাথে ‘টিফা’ বা টিআইইএফএ চুক্তির কোনো যোগ আছে কীনা, তাও আমরা নিশ্চিত নই। যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই ‘টিফা’ চুক্তি করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তাতে রাজী হয়নি। তখন বাংলাদেশের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র টিাইসিএফ চুক্তি করার প্রস্তাব করেছিল। চুক্তিটির পূর্ণ নাম হচ্ছে ‘ট্রেড অ্যান্ড ইকনোমিক কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট’। বাংলাদেশ যদি এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করে তাহলে বাংলাদেশ পাইরেটেড কোনো পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। শ্রমিকের মানও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। তাছাড়া ওষুধ প্রস্তুত ও রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেধশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত ডব্লিউটিওর কাছ থেকে ট্রিপসের আওতায় যে সুবিধা ভোগ করছে, তাও বাতিল হতে পারে। আসলে টিআইইএফএ’র এরই বিকল্প নাম হচ্ছে ‘টিফা’। এর বিস্তারিত কোনো পক্ষ থেকেই উপস্থাপন না করায় তাতে নানা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো একটি চুক্তির প্রস্তাব করে। তখন এর নাম ছিল ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ বা ‘টিফা’। ২০০২ সালে প্রণীত টিফার প্রথম খসড়াটিতে ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু কোনো  কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আপত্তি থাকায় ২০০৫ সালে সংশোধিত টিফায় ৭টি ধারা ও ১৯টি প্রস্তাবনা বহাল থাকে। ওই সময় সংশোধিত টিফায় ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে বিনিয়োগ বাতিল করাসহ মামলার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টিও শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র টিফা চুক্তির খসড়ায় ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর প্রস্তাবনায় মেধাস্বত্ব অধিকার, আন্তর্জাতিক শ্রমমান ও পরিবেশগত সুরক্ষাÑ এই তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। শুধু এই তিনটি ধারাই নয়, বরং টিফা চুক্তির একাধিক ধারা ছিল বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। যেমন বলা যেতে পারে মেধাস্বত্ব আইন। এটা মানলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে ধস নামবে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর প্রায় ৫৫টি দেশে ওষুধ রফতানি করে। বাংলাদেশের ওষুধের মান আন্তর্জাতিক মানের। এখন মেধাস্বত্বের শর্তের কারণে বাংলাদেশ অন্য দেশের ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্য সংশ্লিষ্ট দেশ বা কোম্পানির অনুমতি ছাড়া তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের একটি বিশেষ অধিকার রয়েছে। ওষুধের পেটেন্ট ব্যবহার করেই বাংলাদেশ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ তৈরি করছে, যা দিয়ে দেশের লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সুযোগ ভোগ করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শর্তের কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে কী না, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে শ্রমমানের কথা বলছে, সেটা নিয়েও কথা আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশের  শ্রমিকদের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইএলও’র মান বজায় রাখা কঠিন। ইউরোপের একজন শ্রমিক যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন এবং শ্রমিকদের যে মান, তার সাথে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মানের বিচার করা যাবে না। ইউরোপে একজন শ্রমিকের যে অধিকার, সেই অধিকার বাংলাদেশের শ্রমিকদের নেই। এটাই বাস্তব। এই বাস্তবতা মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব শ্রমিক মানকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের শ্রমমানকে বিচার করা যাবে না। সুতরাং আজ ‘টিকফা’ বলি আর টিফা চুক্তি বলি, কোনো চুক্তিই বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করবে না। বরং এ ধরনের চুক্তি মার্কিনীদের স্বার্থই রক্ষা করবে মাত্র। এ ধরনের কোনো চুক্তির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারকে কোনো মতেই মেলানো যাবে না। শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার আমাদের অধিকার। আমরা তো একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রকে সুযোগ দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু বিনিময়ে আমাদের প্রাপ্তি শূন্য। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি). থেকেও কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিভিন্ন দেশকে বড় অঙ্কের মঞ্জুরি সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এমসিসি গঠন করেছিল মার্কিন কংগ্রেস। এর যুক্তি হিসেবে সুস্পষ্টভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া না হলেও ধারণা করা হচ্ছে গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, বিনিয়োগের পরিবেশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এমসিসি থেকে বাংলাদেশকে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ড. ইউনূসের বিষয়টিও যে অন্যতম একটি কারণ, তা জোসেফ ক্রাউলির একটি মন্তব্য থেকে জানা যায়। জোসেফ ক্রাউলি মার্কিন কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। দুর্নীতির বিষয়টি এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। আর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘টিকফা’ চুক্তি না হলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি। নিঃসন্দেহে এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র এখানে নাক গলাতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের কথা মতো আমরা যেমনি শ্রমমান নির্ধারণ করতে পারি না, ঠিক তেমনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আমাদের যে সুযোগ দিয়েছে, সেই সুযোগ আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। আমরা সমমর্যাদা ভিত্তিক সম্পর্ক চাই। হিলারি কিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি বাংলাদেশকে একটি ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়েও কথা আছে। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে ভারত মহাসাগরে ৭ম নৌবহর ঘাঁটি তৈরি করতে পারেÑ এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘চীনকে ঘিরে ফেলার নীতি গ্রহণ করা। ওবামার প্রথম শাসনের সাথে চীনের সম্পর্ক ভালো ছিল না। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যের (৫৩৯ বিলিয়ন ডলার) নিয়েও কথা আছে। পূর্ব এশিয়ায়ও যুক্তরাষ্ট্র চীন বিরোধী একটি এলায়েন্স গড়ে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকার সাথে বাংলাদেশ নিজেকে সম্পর্কিত করতে পারে না। তাই ওবামার দ্বিতীয় টার্মে দু’ দেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নত হবেÑ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং আমি আশঙ্কা করছি বাংলাদেশের উপর মার্কিনি চাপ আরো বাড়বে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ওবামা প্রশাসনকে কতটুকু ছাড় দেয় সেটাই দেখার বিষয়। আমাদের প্রত্যাশ্যা বাংলাদেশ সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তুলুক। যেখানে আমাদের কোনো ‘স্বার্থ’ নেই, সেখানে বা সেইসব চুক্তিতে আমরা স্বাক্ষর করতে পারি না। আমরা ভারত-মার্কিনি স্বার্থে আমাদের জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিতে পারি না।

কোন পথে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন দৈনিক যায়যায়দিন-এ প্রকাশিত হয়েছে গত ১১ নভেম্বর। চার পর্বের ওই প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব ছিল শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে। এর রেশ শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই গত ১৭ নভেম্বর আরো একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে। ওই সংবাদে বলা হয়েছে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে শাস্তিপ্রাপ্ত একজন শিক্ষককে পদোন্নতির উদ্যোগ নিয়েছেন জাবির উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। অধ্যাপক হোসেন জাবির উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে 'স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে' পরিণত করতে চান। আমরা সেদিন তাকে সমর্থন করেছিলাম। এখন অবধি তিনি সুষ্ঠুভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনা করছেন। এখন এ কী করলেন অধ্যাপক হোসেন? একজন বিতর্কিত এবং নিজের বিভাগের একজন নারী শিক্ষককে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে শাস্তিপ্রাপ্ত ওই শিক্ষককে পদোন্নতির উদ্যোগ নিলেন? আইন অনুযায়ী একজন সহকারী অধ্যাপককে ৪ বছরের অভিজ্ঞতা ও কমপক্ষে তিনটি প্রকাশনা থাকতে হবে। এটা থাকলেই তিনি পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩৮তম সিন্ডিকেটে (২১-০১-৮৯) এ রকম একটি নীতিমালা তৈরি হয়েছিল। এই নীতিমালা লঙ্ঘন করে ৫ নভেম্বর তিনি কীভাবে নির্বাচনী বোর্ডে ওই বিতর্কিত শিক্ষককে পদোন্নতির সুপারিশ করলেন? এটা কি তার 'স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর' বিশ্ববিদ্যালয়ের নমুনা? বিতর্কিত ও যৌন অপরাধী ওই শিক্ষকের ব্যাপারে দায়-দায়িত্ব তিনি কেন গ্রহণ করবেন? বিতর্কিত ওই শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল বায়েসপন্থী আওয়ামী লীগের সমর্থক। আওয়ামী লীগের মূল ধারার শিক্ষকরা সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরিফ এনামুল কবীরের পক্ষে রয়েছেন। শিক্ষক রাজনীতি আজ কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে, তা ভাবতেই অবাক লাগে। উপাচার্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র আমাকে জানিয়েছে খোন্দকার মুস্তাহিদুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের একটি অংশ 'শিক্ষক রাজনীতির' কারণে বিতর্কিত ওই শিক্ষককে পদোন্নতি দেয়ার জন্য 'চাপ' দিয়ে আসছিলেন। শোনা যায় কিছুদিন আগে কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা বিতর্কিত ওই শিক্ষককে পদোন্নতির জন্য ভিসিকে 'চাপ' দেন। এই 'চাপের' মুখেই ভিসি নতি স্বীকার করেন। দেশজুড়ে যেখানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি একটা আলাদা অবস্থান নিয়েছে সেখানে বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা জাবিতে তাদের নিজেদের নিজ নিজ স্বার্থে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সঙ্গে ঐক্য করেছে। বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের এই ভূমিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। যায়যায়দিন-এর ওই প্রতিবেদনটিতে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করা হয়েছে জাতীয় রাজনীতির চাইতে জাবিতে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত স্বার্থই বেশি। তাই পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকলেও, নিজেদের স্বার্থের ক্ষেত্রে তারা এক। সে ক্ষেত্রে জামায়াতও কোনো ফ্যাক্টর নয়। যায়াযায়দিন-এর ওই প্রতিবেদন পাঠ করলে জানা যায় কীভাবে দীর্ঘদিন শিক্ষকদের দুটি গ্রুপ তথাকথিত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নাম ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। অধ্যাপক বায়েস সাবেক ভিসি। আগামীতে তিনি আবারো ভিসি হতে চান। ভিসি থেকে অব্যাহতি নেয়ার পর তিন দু'দুটো বিভাগের সভাপতি হয়েছিলেন। ডিনও হয়েছিলেন। একজন ভিসি পরে ডিন হতে পারেন কিনা, এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে কিছু লেখা নেই। তিনি ওই 'শিক্ষক রাজনীতির' কারণে ভিসি হওয়ার পরও বিভাগীয় সভাপতি ও ডিনও হয়েছিলেন। সাধারণ শিক্ষকরা এটাকে ভালো চোখে দেখেননি। তিনি আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপের নেতা। অন্যদিকে খোন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান চার বছর ভিসি থাকার পর এখনও সক্রিয়। তিনি সরাসরি এখনও শিক্ষক রাজনীতি করেন। বিএনপি সরকারে আগামীতে তিনি 'শিক্ষা উপদেষ্টা' (?) হবেন- এমন একটা ধারণা বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের দেয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে নানা কথা রয়েছে। ক্ষমতাবান ওইসব শিক্ষকের জন্য কেউ কিছু বলতে পারেন না। কোনো শিক্ষক আইন বহির্ভূতভাবে কাজ করলেও, ক্ষমতাবান শিক্ষকদের জন্য তারা পার পেয়ে যান। বিভাগে সিলেবাস না থাকা সত্ত্বেও এমফিল ও পিএইচডি কোর্সে ছাত্র ভর্তি করানোর বিষয়টিও চাপা পড়ে যায় শিক্ষক রাজনীতির কারণে। যার এমফিল নেই, পিএইচডি নেই, তিনি কী করে পিএইচডি কমিটিতে থাকেন? সিনিয়র শিক্ষকরা রাজনীতির কারণে এসব অনিয়মকে প্রশ্রয় দেন। 'ভোটরাজনীতি' তাদের কাছে মুখ্য। তাই বিতর্কিত ওই আওয়ামীপন্থী শিক্ষককে পদোন্নতি দিতে তদবির করেন বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা। অধ্যাপক হোসেন এখন অবধি শিক্ষকদের কোনো গ্রুপেই যোগ দেননি। এটা একটা ভালো লক্ষণ। সাবেক ভিসি অধ্যাপক শরীফ এই কাজটি করলে ভালো করতেন। তিনি রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রায় ৩০০ শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই এখন শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয়। অধ্যাপক হোসেন বিগত প্রশাসনের খুব একটা পরিবর্তন করেননি। কিন্তু বিতর্কিত শিক্ষককে পদোন্নতি দিয়ে কী তিনি 'স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর' তৈরি করতে পারবেন? এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাডেমিক মান বাড়াতে হবে। তরুণ শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠাতে হবে। এটা সম্ভব। একজন উপাচার্য যদি উদ্যোগ নেন তরুণ শিক্ষকদের জন্য বিদেশি বৃত্তি জোগাড় করা কঠিন নয়। তরুণ শিক্ষকরা যদি বিদেশে যেতে পারেন, তাহলে তারা আর নিজেদের শিক্ষক রাজনীতির সাথে জড়িত করবেন না। তখন তথাকথিত সিনিয়র শিক্ষকরা তাদের 'ব্যবহার'ও করতে পারবে না। জাবিতে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে তুঘলকি কর্মকা- হচ্ছে। জাবিতে পিএইচডি থিসিস পরীক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হয় না। অথচ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও এই কাজটি করে থাকে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পিএইচডি থিসিসের পরীক্ষক ছিলাম, সেখানে তৃতীয় পরীক্ষক ছিলেন ব্রিটেনের একজন অধ্যাপক। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন। একই সাথে যে বিভাগে নূ্যনতম তিনজন থেকে চারজন 'অধ্যাপক' নেই, সেইসব বিভাগে আপাতত এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থী ভর্তি করানো ঠিক হবে না। একজন সহকারী অধ্যাপক পিএইচডি কমিটির সদস্য হবেন। অথচ তার নিজের পিএইচডি ডিগ্রিই নেই। পিএইচডি ও এমফিলের জন্য কোর্স করা বাধ্যতামূলক। নিয়মিত ক্লাস করার কথা। কাগজ কলমে এটি লেখা আছে। দু'একটি বিভাগ বাদে বাকি বিভাগগুলোতে আদৌ ক্লাস হয় না। তবে ল্যাবের সাথে সম্পর্কিত বিভাগগুলোতে গবেষণা হয়। অধ্যাপক হোসেন কী এসব বিষয় খোঁজ-খবর নেন? আমাদের শিক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। নির্লোভ এই মানুষটি এক সময় বামরাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন বিধায় এই বুর্জোয়া রাজনীতিতে তিনি অনেকটাই অচল। তিনি শিক্ষা দিবসে (১৭ সেপ্টেম্বর) শিক্ষার মান বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার ওই আহ্বান কাগজ কলমেই থেকে গেছে। কোনো উপাচার্যই শিক্ষার মান বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেননি। তারা কিভাবে ক্ষমতায় থাকা যায়, সেই চেষ্টাই করে গেছেন বা যাচ্ছেন। সিনিয়র শিক্ষকরা আগামী কয়েক বছরে যখন অবসরে যাবেন, তখন কারা শিক্ষার হাল ধরবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু ভালো শিক্ষক থাকলেও বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা করুণ। এখানে এক ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। এক বিভাগের শিক্ষক অন্য বিভাগে ক্লাস নেন- সে খবরও শুনেছি। শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম হচ্ছে। দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, আর আঞ্চলিকতা উচ্চ শিক্ষাকে আজ প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা তখন একুশ শতকে কেমন বিশ্ববিদ্যালয় পাচ্ছি_ এটা চিন্তা করতেও আমার এখন ভয় হচ্ছে। আমাদের দেশে এই মুহূর্তে 'রাজনীতিক ভিসি'র চাইতে দরকার 'একাডেমিক ভিসি'। সরকার ভিসিদের নিয়োগ দেয়। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় যোগ্য শিক্ষক উপাচার্য হতে পারেন না। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কিংবা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অথবা অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান কোনোদিনই ভিসি হতে পারেননি। এরা অবসরে গেছেন এবং এখনও তাদের অবস্থান থেকে সমাজ বিনির্মাণ করে যাচ্ছেন। একজন শিক্ষকের প্রাপ্তি ভিসি হওয়া নয়, তার প্রাপ্তি একজন ভালো শিক্ষক হওয়া। সেই ভালো শিক্ষকই আমি হতে চেয়েছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে যে 'অন্ধকার' আমি দেখছি, তাতে আমি শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। হয়ত আট বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই আমি অবসরে যাব (আমাদের অবসরের বয়স ৬৫)। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষকতার পরিবেশ, সেই পরিবেশের সঙ্গে আমি খাপ খাওয়াতে পারছি না। আমার বড় ধরনের আশা ভঙ্গ হয়েছে। যখন আমি দেখলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয়ই 'যৌন অপরাধে' শাস্তিপ্রাপ্ত শিক্ষক পদোন্নতি দেয়ার উদ্যোগ নিলেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। আমার আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেল! এর তো আদৌ প্রয়োজন ছিল না? অধ্যাপক হোসেন কি ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের 'চাপ'-এর মুখে এই কাজটি করলেন? তার তো চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। তিনি ভিসি হয়েছেন। একসময় তিনি ঢাকায় চলে যাবেন। কিন্তু তাকে মানুষ কীভাবে স্মরণ করবে? এর আগে তাকে আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম। সেই পরামর্শ তিনি শোনেননি। এমনকি তিনি সময়ও বের করতে পারেননি আমার বা আমাদের মতো শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলার। আমি আওয়ামী ঘরানার শিক্ষক নই। বোধকরি এটাই তিনি বিবেচনায় নিয়েছেন। তিনি যাই করুন না কেন, আমি চাইবো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস হোক। আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একটি অংশ 'সিন্ডিকেট ঘেরাও'-এর হুমকি দিয়েছেন। তিনি যদি আইনের বরখেলাপ করেন, তাহলে তিনি বিতর্কিত হবেনই, যা আমি চাই না। সিন্ডিকেটে বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা আছেন। তারা এখন যৌন অপরাধে অপরাধী শিক্ষকের 'মিত্র'। তারা পদোন্নতি চাইবেন। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি তিনি উচ্চ আদালতে 'রেফার' করতে পারেন। যৌন অপরাধে অপরাধী এই শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মান-সম্মানকেই 'ধূলিসাত করেছিলেন। উচ্চ আদালত শুধু তাকেই নয়, বরং উপাচার্যকেও আদালতে ডেকে নিয়ে ভর্ৎসনা করেছিলেন। আজ সবকিছু আমরা ভুলে গেলাম। শিক্ষক রাজনীতি আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? যারা দু'বছর আগেও বিতর্কিত ওই শিক্ষকের শাস্তি দাবি করেছেন, আজ সেই বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা শুধু ভোটের রাজনীতির কারণে ওই বিতর্কিত শিক্ষকের 'মিত্র' হয়ে গেলেন। ওই বিতর্কিত শিক্ষকের ভোটেই আজ কলা অনুষদের ডিন নির্বাচিত হয়েছেন অধ্যাপক সৈয়দ কামরুল ইসলাম। হায়রে শিক্ষক রাজনীতি! শিক্ষক রাজনীতি থাকুক। কিন্তু তা যেন হয় শিক্ষকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। জাবির শিক্ষকরা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত। নূ্যনতম সুবিধা তারা পান না। কিন্তু শিক্ষকরা 'অন্যায়' সমর্থন করেন, এটা কাম্য হতে পারে না। এই 'ভোটের রাজনীতি' তরুণ শিক্ষকদের জন্য কোনো 'আদর্শ' হতে পারে না। আসুন, আমরা সবাই মিলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ন্যায়সঙ্গত। যায়যায়দিন-এর প্রতিবেদন তরুণ শিক্ষকদের 'দুয়ার খুলে দিক'_ আমার প্রত্যাশা এটাই।Jai Jai Din 24.11.2012

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ নীতি বদলাবে না


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামার বিজয়ের মধ্য দিয়ে যে প্রশ্নটি এখন সামনে চলে এলো, তা হচ্ছে এই 'বিজয়' কি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আদৌ কোনো পরিবর্তন ডেকে আনবে? যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ কোনো বড় ভূমিকা পালন করে না। এর পরও হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ও বাংলাদেশের সঙ্গে ওয়াশিংটনের যৌথ অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এটা বলা সঙ্গত যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কিছুটা গুরুত্ব দেয়। বিশেষ করে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এবং চীন বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী হওয়ায় মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে কিছুটা হলেও বাংলাদেশের গুরুত্ব রয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা গুরুত্ব দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকেন্দ্রিক যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি বাড়াতে চায়। যেহেতু এ অঞ্চলে ভারত একটি শক্তি, সেহেতু ভারতকে সঙ্গে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশের ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণে মার্কিন নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে ভারত-বাংলাদেশ কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্কিন নীতিনির্ধারকদের আগ্রহটা আরও বেড়েছে। যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র একটি অক্ষ গড়ে উঠেছে। একদিকে ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে সেখানে 'যে শূন্যতার' সৃষ্টি হবে, মার্কিন নীতিনির্ধারকরা মনে করেন সেই 'শূন্যতা' পূরণ হতে পারে ভারতকে দিয়ে, যা চূড়ান্ত বিচারে তার স্বার্থকে রক্ষা করবে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত, যার পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার। ভারত সেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করছে। প্রচুর হাইওয়ে তৈরি করছে ভারত। এখানে সীমান্তবর্তী পাকিস্তান সরকারই উপেক্ষিত থেকেছে। আর ভারতের এই বিনিয়োগ সম্ভব হয়েছে মার্কিন নীতিনির্ধারকের সম্মতি দেওয়ার পরই। ধারণা করছি, ২০১৪ সালে মার্কিন বাহিনী সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হলে ভারতের তথাকথিত একটি 'শান্তিরক্ষী' বাহিনী সেখানে অবস্থান নেবে। অথবা ন্যাটোর একটি এশীয় সংস্করণ দেখতে পাব আমরা ওই সময়, যেখানে ভারতের একটি অংশগ্রহণ থাকবে। ১৯৪৯ সালে ন্যাটো যখন গঠিত হয়েছিল, তার প্রথম এবং একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, এই বাহিনী শুধু ইউরোপেই নিয়োজিত থাকবে। ন্যাটোর উদ্দেশ্য ছিল, সম্ভাব্য সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে 'ইউরোপের গণতন্ত্রকে' রক্ষা করা। ন্যাটোর সেই ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। প্রথমবারের মতো আফগান যুদ্ধে ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। যেহেতু ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্ররা আর আফগানিস্তানে 'ঝুঁকি' নিতে চাইছে না, সেহেতু এ অঞ্চলকে ঘিরে ন্যাটোর এশীয় সংস্করণ (সেটা ভিন্ন নামেও হতে পারে) হবে এবং ভারত তাতে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। এই 'প্রক্রিয়ায়' বাংলাদেশেও জড়িত হবে। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সুবিধা এখানেই যে, বাংলাদেশ সরকার 'ভারতের এই ভূমিকাকে', যা যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, সমর্থন করছে। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে আরও দেখা যাবে, সম্প্রতি ভারত পারমাণবিক অস্ত্র বহনযোগ্য যে মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র (অগি্ন-৫) সাফল্যের সঙ্গে উৎক্ষেপণ করেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে যে নীতি গ্রহণ করেছে, ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে তার সেই নীতি পরস্পরবিরোধী। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার মিত্র দেশগুলোকে ব্যবহার করছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে এই কাজটি করছে না। বরং ভারতকে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে এই কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে পারমাণবিক চুক্তি রয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অত্যাধুনিক পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই আর তা হচ্ছে, চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে একটি শক্তি হিসেবে দাঁড় করানো। নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বেশ ক'টি ইস্যুতে দেশ দুটির মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। বাংলাদেশ সফর করার আগে হিলারি ক্লিনটন বেইজিংও সফর করেছিলেন। সেখানে চীনা নেতাদের সঙ্গে তার আলোচনা সফল হয়নি। চীনের সমরসজ্জা বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার একটি কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য চীন যাতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। চীন ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌ-শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত করছে। এটি বিবেচনায় নিয়েই গড়ে উঠছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, যে অক্ষে বাংলাদেশও একটি অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের এই স্ট্র্যাটেজি কিংবা শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে গড়ে ওঠা ÔContaintment theoryÕ-এর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি অবলম্বন করেছিল। এ কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। বাংলাদেশের সীমান্তে রয়েছে মিয়ানমার, যে দেশটির সঙ্গে চীনের কৌশলগত সামরিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। চীনের সীমান্তবর্তী দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে। সু চি এখন সংসদ সদস্য। অনেক পশ্চিমা দেশ এখন মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জেনারেল সেইন এখন তার সরকারকে একটি 'বেসামরিক অবয়ব' দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র চাইবে বাংলাদেশ ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে। এমনকি ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনী মোতায়েনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিককালে, বিশেষ করে গেল ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে এসেছিলেন মারিয়া ওটেরো (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয় সম্পর্কিত ডেস্ক), রবার্ট ও'ব্লেক (সহকারী পররাষ্ট্র সচিব, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ডেস্ক) এবং ওয়েন্ডি শেরম্যান (আন্ডার সেক্রেটারি রাজনৈতিক বিষয়াদি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)। গত ১৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তা শীর্ষক একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব (রাজনৈতিক বিষয়াদি) আন্দ্রে শাপিরো। অত্যন্ত গোপনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিংবা কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা সংবাদপত্রে জানানো হয়নি। নিরাপত্তা বিষয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দু'দেশ আলোচনা করল, কিন্তু জাতি তা জানল না। গোপনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত গোপনেই রাখা হলো। এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের কোনো মন্তব্যও আমার চোখে পড়েনি। তবে বাংলাদেশে মার্কিন সেনা মোতায়েনের একটি সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, গত ২ মার্চ সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের 'বিশেষ বাহিনী' মোতায়েন রয়েছে। এটি নিয়ে বাংলাদেশে গুঞ্জনের সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, কিছু সেনা রয়েছে, যারা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে প্রশিক্ষণের জন্য আসে আবার চলেও যায়। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, 'তথাকথিত সন্ত্রাসীদের মোকাবেলার' জন্য(?) ভিন্ন নামে ও ভিন্ন পরিচয়ে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর লোকজন বাংলাদেশে রয়েছে। এর একটি আইনি কাঠামো দেওয়ার জন্যই ওই নিরাপত্তা শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও স্বীকার করে না যে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এক সময় আশ্রয় দিয়েছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। খালেদা জিয়ার নয়াদিলি্ল সফর ও ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়ার প্রত্যয় নিঃসন্দেহে মার্কিন নীতিনির্ধারণদেরও খুশি করবে। বাংলাদেশ-ভারত ভালো সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য। বাংলাদেশ এখন 'টিফা' চুক্তির বদলে 'টিকফা' (ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম) চুক্তি করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। একই সঙ্গে 'আকসা' (অ্যাকুইজিশন ও ক্রস সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তির ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী। বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এখন বারাক ওবামা আবার নির্বাচিত হওয়ার পর এসব নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না। 'মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট' থেকে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাও এখন সৃষ্টি হলো। সব মিলিয়ে যা বলা যায় তা হচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
Daily SAMAKAL
20.11.12

ওবামার এশিয়া সফর ও আমাদের পররাষ্ট্রনীতি


ওবামা মিয়ানমারে যাচ্ছেন আজ ১৯ নভেম্বর। তার এশিয়া সফরে তিনি তিনটি দেশে যাবেনÑ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। দ্বিতীয় টার্মে বিজয়ী হওয়ার পর প্রথম সফর হিসেবে তিনি যখন মিয়ানমারকে বেছে নেন, তখন বুঝতে হবে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, সেই স্ট্র্যাটেজিতে দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। আমেরিকান নীতিতে যে পরিবর্তন আসছে, তাতে বাংলাদেশও একটি অংশ। বাংলাদেশের ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় একটি ‘যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ’ চুক্তি স্বাক্ষর, প্রস্তাবিত ‘আকসা’ (অ্যাকুইজেশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসেস এগ্রিমেন্ট) চুক্তি বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহেরই বহিঃপ্রকাশ। এ অঞ্চল ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, তাতে আগামীতে বাংলাদেশ একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। এখন এই স্ট্র্যাটেজিতে যোগ হল মিয়ানমারের নাম। ওবামার মিয়ানমার সফরের সুযোগটি আমরা গ্রহণ করতে পারতাম। যদিও একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি সামনে রেখেই ওবামা এ অঞ্চলে আসছেন। কম্বোডিয়ায় পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে তিনি যোগ দেবেন। আর থাইল্যান্ডে একটি সামরিক মহড়ায়ও উপস্থিত থাকবেন। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা এখানেই যে, আমরা এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারলাম না এবং ওবামাকেও বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানাতে পারলাম না। আমাদের স্বার্থেই এ সফর আমাদের প্রয়োজন ছিল।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি ‘কাজে’ অত্যন্ত দক্ষ। তিনি ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। নিজে সব প্রটোকল ভেঙে শীর্ষ সম্মেলন চলাকালীনই ছবি তোলেন এবং নিজের ‘অবস্থান’-এর কথা ভুলে গিয়ে ভিভিআইপিদের ‘অটোগ্রাফ’ নেন। পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন কিংবা সফলতার জন্য তার এই ‘ফটোগ্রাফি’ কিংবা ‘অটোগ্রাফ’ নেয়া আদৌ কোন ভূমিকা পালন করতে পেরেছে কিনা, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। তবে আমি নিশ্চিত কোন কোন ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’ কোম্পানি তার তোলা ছবি ও ‘অটোগ্রাফ’ নিয়ে একটি প্রদর্শনী করতে পারে আগামীতে (প্রদর্শনীর নাম হতে পারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চোখে বিশ্ব)। কিছুদিন আগে একটি দৈনিক পত্রিকা তাদের প্রথম পাতার সংবাদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ সফর নিয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেছিল। তাতে দেখা যায়, গত ৪৬ মাসে তিনি ১৪৯ বার বিদেশ সফর করেছেন। ৪৫২ দিন সফরে বিদেশে কাটিয়েছেন। এর পরে যোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কম্বোডিয়া ও লাওস সফর। তিনি জিবুতিতেও গিয়েছিলেন। এখন যাবেন রাশিয়া সফরে। তার পেছনে ২০০৯ সালে খরচ হয়েছিল ৬৬ লাখ ৭৮ হাজার ৮৫ টাকা (হাত খরচ, দৈনিক ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা, আনুষঙ্গিক ভাতা, ট্রানজিট ভাতা ইত্যাদি)। মাত্র ১৩টি দেশের খরচ ছিল ওটি। এরপর কোন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালের খরচ বের করতে পারেন। তার সফরের একটা বড় অংশজুড়ে থাকে সেমিনারে অংশগ্রহণ। এসব সফরে দেশের স্বার্থ সুরক্ষা ও কূটনৈতিক দরকষাকষির কোন সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশে, যেখানে কৃচ্ছ্রসাধন জরুরি, সেখানে সেমিনারকেন্দ্রিক সফরে না যাওয়াই উত্তম। যেখানে বাংলাদেশের স্বার্থ জড়িত রয়েছে, কিংবা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ আছে, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্যই যাবেন। পত্রিকায় দেখলাম, আমাদের ‘রবীন্দ্রপ্রেমিক’ ও ‘চিত্রকলা বিশেষজ্ঞ’ পররাষ্ট্র সচিব জাতিসংঘের সিভিল সার্ভিস সমিতির সদস্য মনোনীত হয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে তার জন্য একটি বড় পাওয়া। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনি কতটুকু সাফল্য বয়ে আনতে পেরেছেন, সে প্রশ্ন থেকেই গেল।
প্রসঙ্গে আসছি। ওবামার এশিয়া সফর আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারতÑ যদি ওবামাকে বাংলাদেশে আসার ব্যবস্থা আমরা করতে পারতাম। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো। ড. ইউনূসের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের নাম-যশ আরও বেড়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ বারবার প্রশংসিত হয়েছে। একাধিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। এটা আমাদের বড় পাওয়া। আমাদের সেনাবাহিনী প্রকারান্তরে আমাদের বৈদেশিক নীতির সাফল্যের পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দু-একটি বিষয় এখনও ঝুলে আছে। এর একটি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের কোটামুক্ত সুবিধা। অনেক দিন থেকেই আমাদের ব্যবসায়িক নেতারা শুল্কমুক্ত কোটা সুবিধা চেয়ে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকার অনেক দেশকেই এ সুবিধা দেয়। আমাদের ব্যবসায়ীরা প্রায় ১৫ ভাগ শুল্ক দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তাদের পণ্য (তৈরি পোশাক) নিয়ে মার্কিন বাজারে টিকে আছেন। আজ ওবামার সফরের মধ্য দিয়ে আমরা এ ধরনের একটি প্রতিশ্র“তি আদায় করতে পারতাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন’ (এমসিসি) থেকে বাংলাদেশ কোন সাহায্য পাচ্ছে না। ২০০৪ সালে এমসিসি গঠিত হয়েছিল। ওবামার সফরের মধ্যে দিয়ে আমরা এ ব্যাপারে সুবিধা নিতে পারতাম। বিশ্বব্যাপী জঙ্গি উচ্ছেদে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের পার্টনার। এ লক্ষ্যে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় আমরা একটা ‘যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। ‘আকসা’ বা ‘অ্যাকুইজেশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসেস এগ্রিমেন্ট’ নিয়েও আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রস্তাবিত ওই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র তার সশস্ত্র বাহিনীর জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রাবিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ বিভিন্ন সুবিধার জন্য ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। এই চুক্তির কিছু ধারা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সরকার ‘আকসা’ চুক্তি স্বাক্ষর করবে। যুক্তরাষ্ট্র ‘টিকফা’ বা ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট’ চুক্তিতে আগ্রহী। ‘টিফা’র পরিবর্তিত নামই হচ্ছে ‘টিকফা’। এখানে মার্কিন স্বার্থ অনেক বেশি। ‘আকফা’ ও ‘টিকফা’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ অনেক। ওবামার সফর অনুষ্ঠিত হলে এ ব্যাপারে একটি চুক্তি হতে পারত। ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস এ ব্যাপারে আদৌ কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূত তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। এটা সত্য, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মার্কিন রাষ্ট্রপতির ব্যস্ততা অনেক বেশি। তিনি এর আগে যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এসেছিলেন, তখনও একাধিক দেশ সফর করেছিলেন। এ ধরনের সফর অনেক আগেই নির্ধারিত থাকে। ‘হুট’ করে তা পরিবর্তন করা যায় না। তুলনামূলক বিচারে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের চেয়ে মিয়ানমার মার্কিন প্রশাসনের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন নিজে বেসামরিক প্রেসিডেন্টের তকমা লাগিয়েছেন। বিরোধী নেত্রী অং সান সু চিকে উপনির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন। সু চি এখন সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ভারতেও গেলেন। প্রেসিডেন্ট সেইনের এই ‘দুয়ার খোলা’ নীতির সুযোগ নিচ্ছেন মার্কিন বিনিয়োগকারীরা। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অফিস আবার খোলা হয়েছে। কোকাকোলাও এসেছে। মিয়ানমারে রয়েছে বিপুল জ্বালানিসম্পদের (গ্যাস ও তেল) রিজার্ভ। মার্কিন বিনিয়োগকারীরা আসবে এটাই স্বাভাবিক। ওবামার সঙ্গে যে বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী আসবেন, তা বলে দিতে হয় না। এখানেই আমাদের ব্যর্থতা। ওবামা ভারতেও এসেছিলেন। তখনও আমরা সুযোগটি নিতে পারিনি। এখন মিয়ানমারে আসছেন। আমরা এই ‘সুযোগ’টিও কাজে লাগাতে পারলাম না। মার্কিন বিনিয়োগকারীদের আমরা আকৃষ্ট করতে পারলাম না। আমাদের অর্থমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, দেশে বিনিয়োগ নেই। এর জন্য তিনি দায়ী করেন অধ্যাপক ইউনূসকে (?)। অথচ বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস কোনভাবেই জড়িত নন। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার ব্যাপারে দূতাবাসগুলোর কোন ভূমিকা নেই।
প্রসঙ্গক্রমে এসে গেল একটা কথাÑ বাংলাদেশ পর্তুগালে নতুন দূতাবাস খুলেছে। এটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা নিশ্চয়ই জানেন, সারা ইউরোপেই অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। মন্দার কারণে সেখানে একাধিক রাষ্ট্রে কৃচ্ছ্রসাধন চলছে। সরকারেরও পতন হয়েছে (গ্রিস, ইতালি)। পর্তুগালের অবস্থা আরও খারাপ। একক মুদ্রা হিসেবে ইউরো ব্যবহারকারী ১৭ দেশের এ অঞ্চলের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি আরও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। শুধু ইউরো অঞ্চল নয়, ২৭ দেশের ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তাই পর্তুগালে নয়া দূতাবাস খুলে আমাদের প্রাপ্তি কী? কিছুই না। বরং গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নেইল সম্ভাব্য অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গওকঞ দেশগুলোর (মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক) কথা বলছেন, সেসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বাড়ানো উচিত। গওকঞ দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়ে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ আদায় করতে পারব বেশি।
বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। প্রতিটি দেশের পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আসছে। সনাতন পররাষ্ট্রনীতি আর থাকছে না। এক্ষেত্রে আমাদের দূতাবাসগুলো পরিচালনায়ও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। অনেক দেশে দূতাবাস খোলা হয়েছে, যার আদৌ প্রয়োজন ছিল না। খুব কম ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রদূতরা ‘সফলতা’ দেখাতে পারছেন। রাষ্ট্রদূত নিয়োগের ক্ষেত্রে সনাতন নিয়োগের প্রক্রিয়া বাতিল করাও প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি ‘সফ্ট স্টেট’ (ঝড়ভঃ ঝঃধঃব)। আমাদের অনেক কিছু দেয়ার আছে বিশ্বে। আমাদের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারছেন না। বারাক ওবামাকে আমরা যদি বাংলাদেশে আনতে পারতাম, তাতে করে বিনিয়োগ বাড়ত। বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও বিশ্বে উজ্জ্বল হতো। আমরা অধ্যাপক ইউনূসকে ব্যবহার করেও বারাক ওবামার বাংলাদেশ সফর নিশ্চিত করতে পারতাম। কিন্তু সেখানেও আমাদের ব্যর্থতা। অধ্যাপক ইউনূস আমাদের ‘সম্পদ’। এই সম্পদকেও আমরা আমাদের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারলাম না। একটি বড় দেশের প্রেসিডেন্ট যখন তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশে যান, তখন ওই দেশের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যায়। এখন মিয়ানমারের গ্রহণযোগ্যতা বিশ্ব আসরে বাড়বে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ল না।
Daily JUGANTOR
19.11.12

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি-কৌশল

দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রথম বিদেশ সফরে মিয়ানমার আসছেন ১৯ নভেম্বর। ওই সময় তিনি কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিত আশিয়ান শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দেবেন। ওবামার মিয়ানমার সফরের গুরুত্ব অনেক। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ‘সিভিলিয়ান’ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তার দেশের ‘দুয়াল খুলে দিয়েছেন।’ মিয়ানমারে প্রথমবারের মতো একজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ, কোকাকোলার অফিস খোলা এবং সর্বশেষ ওবামার মিয়ানমার সফর প্রমাণ করে মার্কিন প্রশাসন পরিবর্তিত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারকে কত গুরুত্ব দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ওবামার উপস্থিতিতে থাইল্যান্ডে যে যুক্তরাষ্ট্র-থাইল্যান্ড সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হবে, তাতে অংশ নিতে মিয়ানমারকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, দক্ষিণ এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র যে স্ট্র্যাটেজি রচনা করছে তাতে মিয়ানমারকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যেই মূলত ওবামা মিয়ানমারে আসছেন। ওই স্ট্র্যাটেজিতে বাংলাদেশও রয়েছে। পাঠক স্মরণ করার চেষ্টা করুন, টাইমস অব ইন্ডিয়ার অন লাইন সংস্করণে একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল গত ৩১ মে। তাতে বলা হয়েছিল চট্টগ্রামে ঘাঁটি গড়ছে মার্কিন সপ্তম নৌবহর! যদিও বাংলাদেশ সরকার তা অস্বীকার করেছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল বলেও সংবাদটিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। দক্ষিণ  চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এ রকমটি চাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে ‘আকসা’ নামে একটি চুক্তিও করতে চাচ্ছে।
বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে নানা কারণে। প্রথমত, ভারত মহাসগরীয় অঞ্চলে চীনের নৌবাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে সেখানে যে ‘শূন্যতার’ সৃষ্টি হবে, সেই শূন্যতা পূরণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘শান্তিরক্ষী’ বাহিনী গঠন করা, যারা ২০১৪ সালে মার্কিন সৈন্যদের পরিবর্তে আফগানিস্তানে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত হবে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইসলামিক কট্টরপন্থিরা দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে নতুন করে একটি ঘাঁটি গড়তে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মোর্চা গঠন করা প্রয়োজন। চতুর্থত, এ অঞ্চলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিপুল জ্বালানি সম্পদ রয়েছে গভীর সমুদ্রে। মার্কিন আইওসির এ ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে যথেষ্ট। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের জন্য এ কারণেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অবস্থান করে খুব সহজেই মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায় এবং বাংলাদেশের নিকট-প্রতিবেশী চীনের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে প্রভাব খাটানো সম্ভব। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর পরই বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি রচিত হয়েছে। ‘আকসা’ চুক্তি এ লক্ষ্যেই স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হিলারির সফরের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল একটি যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর। এই সংলাপের আওতায় বছরে একবার বাংলাদেশ ও মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা মিলিত হবেন। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধবোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের ব্যাখ্যা নানাভাবে বিশ্লেষণ হতে পারে। সন্ত্রাসবাদ রোধে সহযোগিতার আলোকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটাই দেখার বিষয় এখন। আরো একটা কথা। তরুণদের এক সমাবেশে হিলারি ক্লিনটন যখন বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের কথা বলেন, তখন আমাদের প্রখ্যাত মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্ট রবার্ট কাপলানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কাপলান লিখেছেন দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির উদ্দেশ্য একটাই-আর তা হচ্ছে চীনের প্রভাবকে সংকুচিত করা। বাংলাদেশের অবস্থান তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের আকৃষ্ট করবে। মার্কিন স্ট্র্যাটেজিতে ভারতের গুরুত্ব বেড়েছে। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। চীন যাতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। চীন ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌ-শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। চীন এ অঞ্চলে ‘মুক্তারমালার’ মতো বিভিন্ন সামুদ্রিক বন্দরে তার অবস্থান শক্তিশালী করে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। চীনের ‘মুক্তমালার’যে নেটওয়ার্ক, তাতে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত গাওদার সমুদ্রবন্দর একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী হয়ে ভারত মহাসাগর পার হয়ে এরাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, এ পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। চীন যে তেল আমদানি করে তার ৮০ ভাগ এই মালাক্কা প্রণালী হয়ে চীনে যায়। তাই সঙ্গত কারণেই চীনের জন্য তার ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাওদারে চীনা নৌবাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিটও থাকবে, যা কি-না ভারত মহাসাগরের সব নৌম্যুভমেন্ট মনিটর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে গাওদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব আরো বেড়েছে। স্ট্রেইট অব হরমুজ থেকে গাওদারের দূরত্ব মাত্র ১৮০ নটিক্যাল মাইল। আর ইরান সীমান্ত রয়েছে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে। চীন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে গাওদার সমুদ্র ন্দর উন্নয়নে। চীন তার দক্ষিণাঞ্চলের ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস এই গাওদার বন্দর দিয়েই পাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে চায়। চীন শ্রীলঙ্কার হামবানটোটায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে চীন শ্রীলঙ্কার সরকারকে সমর্থন করেছিল। মিয়ানমারে রয়েছে চীনের নৌবাহিনীর একটি রাডার স্টেশন। সিটওয়েসহ আরো বেশক’টি বন্দরে রয়েছে চীনা উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন যে বিশাল প্রতিরক্ষা গড়ে তুলছে তা মূলত তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। চীনের এই জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করা ও চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এই অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে, যাতে বাংলাদেশকে অন্যতম একটি পার্টনার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি সেই স্ট্র্যাটেজিকে সামনে রেখেই এখন যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ চুক্তি করতে আগ্রহী হয়েছে। আকসা চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। যতদূর জানা গেছে, এ ধরনের চুক্তি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। প্রস্তাবিত আকসা চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ‘গাইডেড মিসাইল’সহ বেশ কয়েক ধরনের আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করবে। এসব অস্ত্র ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সহযোগিতা দেয়ার কথাও রয়েছে। এছাড়া থাকবে যৌথ মহড়া ও সংলাপের ব্যবস্থা। প্রস্তাবিত ‘আকসা’ চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রাবিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ এ ধরনের বিভিন্ন সুবিধার জন্য বাংলাদেশে ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতিরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রস্তাবিত এই চুক্তিটির এক সময় নাম ছিল ‘ন্যাটো মিউচ্যুয়াল সার্পোট অ্যাক্ট’। যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা ও সরবরাহ বিনিময় সহজ করার জন্য এটি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ওই অ্যাক্টে পরিবর্তন আনা হয়, যাতে করে ন্যাটোর সদস্য নয়, এমন দেশগুলোর সঙ্গে এ ধরনের একটি চুক্তি করা যায়। চুক্তিটির নামেও পরিবর্তন আনা হয়। চুক্তিটি এখন ‘আকসা’ চুক্তি নামে পরিচিত।
‘আকসা’ চুক্তি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে না; বরং বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, বাংলাদেশ সেই পরিকল্পনার যদি অংশ হয়, তাহলে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে। একইভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতেও বাধ্য। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজির অংশ হতে পারি না। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রাপ্তিও খুব কম। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর ও তথাকথিত প্রশিক্ষণগ্রহণ করে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারব না। তাই প্রস্তাবিত চুক্তিটি স্বাক্ষরের আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ, বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া জরুরি। চুক্তিটি নিয়ে সংসদে আলোচনা করারও প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের একটি চুক্তি বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের উসকে দিতে পারে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও বেড়ে যেতে পারে, যা কোনোমতেই কাম্য নয়। সংসদকে অবহিত না করে এ ধরনের একটি চুক্তি যদি করা হয়, তাহলে সেই চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
সুতরাং বাংলাদেশ যখন ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির একটা অংশ হতে যাচ্ছে, ঠিক তখন মিয়ানমার সফরে আসছেন ওবামা। দীর্ঘদিন মিয়ানমার মার্কিন প্রশাসনের কাছে ছিল একটি ‘নিষিদ্ধ রাষ্ট্র’। সব ধরনের সাহায্য, বাণিজ্য বন্ধ ছিল। এখন পরিবর্তন আসছে মিয়ানমারে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি, তাতে মিয়ানমারকে যুক্ত করতে চায় মার্কিন প্রশাসন। চলতি বছরের জুন মাসে সিঙ্গাপুরে বিখ্যাত সাংগ্রিলা ‘ডায়লগ’-এর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।  প্রতিবছরই এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এটা মূলত নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটা শীর্ষ সম্মেলন। ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেট্টা বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রণতরীর সংখ্যা বাড়াবে। ২০১৩ সালে এই রণতরীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬-এ। সুতরাং মার্কিন রণতরী চট্টগ্রাম বন্দরের ‘পোর্ট অব কল’-এর সুবিধা নেবে, তা বলাই বাহুল্য। এ জন্যই তাদের প্রয়োজন ‘আকসা’ চুক্তি। সম্ভবত এটা বিবেচনায় নিয়েই ভারতীয় পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছিল যে, চট্টগ্রাম বন্দরে ঘাঁটি গাড়ছে মার্কিন নৌবাহিনী। ওবামার মিয়ানমার সফর তাই নিছক সাধারণ একটি রাষ্ট্রীয় সফর নয়। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি ও এ অঞ্চলের দেশগুলোর (ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান) সমন্বয়ে চীনবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে (ভারত, বাংলাদেশ এবং সম্ভাব্য মিয়ানমার) চীনের বিরুদ্ধে আরেকটি অ্যালয়েন্স গড়ে তোলা। উদ্দেশ্য একটাই-‘চীনকে ঘিরে ফেলার’ একটি নীতি। এই স্ট্র্যাটেজিতে মিয়ানমার নিজেকে জড়িত করবে বলে মনে হয় না। খুব দ্রুত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে। এ থেকে বাংলাদেশ কতটুকু সুবিধা নিতে পারে, সেটাই এখন লক্ষ্য করার বিষয়।
Daily MANOBKONTHO
18.11.12

ওবামার দ্বিতীয় টার্ম ও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক


ওয়াশিংটনে বারাক ওবামার দ্বিতীয় টার্মের বিজয় উৎসব যখন শেষ হয়ে যায়নি, ঠিক তখনই ঢাকায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আবারো একটি বেফাঁস মন্তব্য করে বসলেন। বললেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে ড. ইউনূস। সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ বহির্ভূতভাবে তিনি এই মন্তব্যটি করেন। ড. ইউনূস এই মুহূর্তে দেশে নেই। তিনি বিদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করছেন। ওবামার বিজয়ের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্যের একটি যোগসূত্র আছে। আর তা হচ্ছে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক। ড. ইউনূসকে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের নেতিবাচক মনোভাব মার্কিন প্রশাসন কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। এ নিয়ে একাধিকবার তাদের মন্তব্য পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতও এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। ড. ইউনূসকে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের নেতিবাচক মনোভাব দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। কেননা ডেমোক্রেটরা বরাবরই ড. ইউনূসকে একটি ভিন্ন চোখে দেখে আসছেন। ক্লিনটন পরিবারের বন্ধু তিনি। হিলারি ক্লিনটন ওবামার দ্বিতীয় টার্মে প্রশাসন না থাকলেও, তার একটি প্রভাব থেকে যাবে। তাঁকে ২০১৬ সালের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ড. ইউনূস তার ব্যক্তিগত বন্ধুও। সুতরাং ড. ইউনূসকে নিয়ে সরকারের কর্মকর্তাদের বারবার মন্তব্য, মার্কিন প্রশাসন আদৌ ভালো চোখে নেবে না। সম্পর্কের প্রশ্নে প্রস্তাবিত 'টিকফা' চুক্তি নিয়েও কথা আছে। একবার তো মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন 'টিকফা' না হলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকে কোনো সুবিধা পাবে না। এমনকি রপ্তানি ক্ষেত্রে সমস্যাও তৈরি হতে পারে। 'আকসা' চুক্তির প্রস্তাব করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওই চুক্তি নিয়েও কথা আছে। হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের সময় একটি 'অংশিদারিত্ব সংলাপ' চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। এই চুক্তি নিয়েও কথা আছে। তবে এই মুহূর্তে আলোচিত বিষয় হচ্ছে 'টিকফা' চুক্তির ভবিষ্যৎ। এই চুক্তিটি আসলে কী, কিংবা এতে করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আমরা অনেকেই জানি না। সংবাদপত্রেও এটা নিয়ে খুব একটা আলোচনাও হয়নি। তবে মজিনা বলেছেন, এই চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষিত হবে। কীভাবে হবে, তা অবশ্য তিনি বিস্তারিত বলেননি। এমনকি এই চুক্তির সঙ্গে 'টিফা' বা টিআইইএফএ চুক্তির কোনো যোগ আছে কি না, তাও আমরা নিশ্চিত নই। যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই 'টিফা' চুক্তি করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়নি। তখন বাংলাদেশের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র টিআইসিএফ চুক্তি করার প্রস্তাব করেছিল। চুক্তিটির পূর্ণ নাম হচ্ছে 'ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট'। বাংলাদেশ যদি এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করে তাহলে বাংলাদেশ পাইরেটেড কোনো পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। শ্রমিকের মানও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। তাছাড়া ওষুধ প্রস্তুত ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত ডবিস্নউটিও'র কাছ থেকে ট্রিপসের আওতায় যে সুবিধা ভোগ করছে, তাও বাতিল হতে পারে। আসলে টিআইইএফের এরই বিকল্প নাম হচ্ছে 'টিফা'। এর বিস্তারিত কোন পক্ষ থেকেই উপস্থাপন না করায়, তাতে নানা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো একটি চুক্তির প্রস্তাব করে। তখন এর নাম ছিল 'ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট' বা 'টিফা'। ২০০২ সালে প্রণীত টিফার প্রথম খসড়াটিতে ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আপত্তি থাকায় ২০০৫ সালে সংশোধিত টিফায় ৭টি ধারা ও ১৯টি প্রস্তাবনা বহাল থাকে। ওই সময় সংশোধিত টিফায় ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে বিনিয়োগ বাতিল করাসহ মামলার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টিও শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র টিফা চুক্তির খসড়ায় ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর প্রস্তাবনায় মেধাস্বত্ব অধিকার, আন্তর্জাতিক শ্রম মান ও পরিবেশগত সুরক্ষা-এই তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। শুধু এই তিনটি ধারাই নয়, বরং টিফা চুক্তির একাধিক ধারা ছিল বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। যেমন বলা যেতে পারে মেধাস্বত্ব আইন। এটা মানলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে ধস নামবে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর প্রায় ৫৫টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। বাংলাদেশের ওষুধের মান আন্তর্জাতিক মানের। এখন মেধাস্বত্বের শর্তের কারণে বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশের ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্য সংশ্লিষ্ট দেয়া বা কোম্পানির অনুমতি ছাড়া তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের একটি বিশেষ অধিকার রয়েছে। ওষুধের পেটেন্ট ব্যবহার করেই বাংলাদেশ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ তৈরি করছে, যা দিয়ে দেশের লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সুযোগ ভোগ করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শর্তের কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে কি-না, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে শ্রমমানের কথা বলছে, সেটা নিয়েও কথা আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট আইএলওর মান বজায় রাখা কঠিন। ইউরোপের একজন শ্রমিক যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন এবং শ্রমিকদের যে মান, তার সাথে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মানের বিচার করা যাবে না। ইউরোপে একজন শ্রমিকের যে অধিকার, সেই অধিকার বাংলাদেশের শ্রমিকদের নেই। এটাই বাস্তব। এই বাস্তবতা মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব শ্রমিক মানকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের শ্রমমানকে বিচার করা যাবে না। সুতরাং আজ 'টিকফা' বলি, আর টিফা চুক্তি বলি, কোন চুক্তিই বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করবে না। বরং এ ধরনের চুক্তি মার্কিনীদের স্বার্থই রক্ষা করবে মাত্র। এ ধরনের কোন চুক্তির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটাযুক্ত প্রবেশাধিকারকে কোনোমতেই মেলানো যাবে না। শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার আমাদেও অধিকার। আমরা তো একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রকে সুযোগ দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু বিনিময়ে আমাদের প্রাপ্তি শূন্য। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি) থেকেও কোন সাহায্য পাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিভিন্ন দেশকে বড় অঙ্কের মজুরি সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এমসিসি গঠন করেছিল মার্কিন কংগ্রেস। এর যুক্তি হিসেবে সুস্পষ্টভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া না হলেও ধারণা করা হচ্ছে গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, বিনিয়োগের পরিবেশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এমসিসি থেকে বাংলাদেশকে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ড. ইউনূসের বিষয়টিও যে অন্যতম একটি কারণ, তা জোসেফ ক্রাউলির একটি মন্তব্য থেকে জানা যায়। জোসেফ ক্রাউলি মার্কিন কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান। পদ্মা সেতু নিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। দুর্নীতির বিষয়টি এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। আর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললেন 'টিকফা' চুক্তি না হলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি। নিঃসন্দেহে এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র এখানে নাক গলাতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো আমরা যেমনি শ্রমমান নির্ধারণ করতে পারি না। ঠিক তেমনি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা আমাদের যে সুযোগ দিয়েছে, সেই সুযোগ আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। ওবামার নীতিতে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না। তবে ১৯ নভেম্বর মিয়ানমার আসছেন ওবামা। এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিনি নীতিতে বড় পরিবর্তন আসছে। মিয়ানমার একটি 'দুয়ার খোলা নীতি' গ্রহণ করায় মিয়ানমার-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নতুন দিকে টার্ন নিতে পারে। এ থেকে আমরা সুবিধা নিতে পারতাম। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে এই বিষয়টি উষ্ণ। মিয়ানমারের পাশাপাশি ওবামাকে যদি বাংলাদেশে সফর করার ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে তা বহির্বিশ্বে আমাদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করতে পারত। এই সুযোগটি আমরা কাজে লাগাতে পারলাম না। ওবামার দ্বিতীয় টার্মে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। এই সম্পর্ককে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটি আজ পালন করতে হবে বাংলাদেশকেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর ভালোবাসেন। কিন্তু শুধু বিদেশ সফর দিয়ে একটা দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনা যায় না।Daily JAI JAI DIN17.11.12

মন্ত্রীদের কথাবার্তা ও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি



সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দু’-একজন মন্ত্রীর কথাবার্তায় রাজনৈতিক দৈন্য আবার নতুন করে ফুটে উঠেছে। নৌপরিবহন মন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা শাজাহান খানের লাইভ টকশোতে দেয়া হুমকির রেশ কাটতে না কাটতেই আবার বলে বসলেন ‘তিনি রাজাকার’। আর বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ একটি বেফাঁস মন্তব্য করে বসলেন গত ৩০ অক্টোবর। শাজাহান খান সাবেক এক মন্ত্রীর ‘চোখ তুলে ফেলা’র হুমকি দিয়েছিলেন প্রকাশ্যেই একটি টিভি টকশোতে, যেখানে সংসদ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ র‌্যাবের এক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার ভারত সফরের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বনমন্ত্রী বললেন, তিনি সে দেশের শিবসেনার সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন। জঙ্গিবাদের তিনি উদ্যোক্তা। মুসলমানবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতে তাদের উৎসাহিত করেছেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী ও বনমন্ত্রীর বক্তব্য পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রীরা এভাবে কথা বলতে পারেন কি-না? খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তার সম্পর্কে এ ধরনের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেয়া ঠিক নয়। আমি অবাক হয়েছি শাজাহান খানের বক্তব্যে। তিনি কীভাবে রাজাকার বলেন, প্রকাশ্যে সাবেক একজন মন্ত্রীকে হুমকি দেন। আমাদের রাজনীতি থেকে ভদ্রতা, শালীনতা কি উঠে গেল? অবশ্যই মন্ত্রীরা বিরোধী দলের রাজনীতির সমালোচনা করবেন। কিন্তু প্রকাশ্যে হুমকি দেয়া, এ কেমন রাজনীতি?
শাজাহান খান কি নিজেকে প্রশ্ন করে দেখেছেন, লাইভ অনুষ্ঠানে এ ধরনের একটি ‘কাণ্ড’ ঘটিয়ে তিনি তার মান-সম্মান বাড়াতে পেরেছেন কি-না? ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তিনি যে দল করেন সেই দল সংসদে এবং জাতীয় পর্যায়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। তিনি সংসদ সদস্য নন বটে, কিন্তু অতীতে সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। তিনি একটি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থার সদস্য। তার সঙ্গে ‘রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব’ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। মন্ত্রী শাজাহান খান তার সরকারের গুণগান গাইবেন, ব্যারিস্টার মিয়া সরকারের সমালোচনা করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা হতে হবে ভদ্রজনিত, শোভন ও মার্জিত। ভাষা প্রয়োগে আমাদের হতে হবে আরও সচেতন। একজন মন্ত্রী তুই তোকারি করবেন, চোখ তুলে ফেলার হুমকি দেবেনÑ এ কোন সমাজে আমরা বসবাস করছি! আমি চিন্তাও করতে পারি না, মন্ত্রী হয়ে শাজাহান খান এ ধরনের কথা বললেন কীভাবে!
তার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে অনেকেই জানেন। তিনি শ্রমিক নেতা। শ্রমিকদের নিয়ে তিনি রাজনীতি করেন। পরিবহন শ্রমিকরাই হচ্ছে তার ‘রাজনৈতিক অস্ত্র’। এই ‘অস্ত্র’ তিনি অতীতে সরকারের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন। পরিবহন শ্রমিকদের নেতা আর মন্ত্রী এক কথা নয়। পরিবহন শ্রমিক নেতা হিসেবে তার ‘ব্যবহার’ আমরা গ্রাহ্য করতে পারি। কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে তার এ ব্যবহার আমরা মানতে পারি না। সম্ভবত শাজাহান খান তার পুরনো ‘পরিচয়’ থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারেননি। সম্ভবত তিনি নিজেও ভুলে গেছেন তিনি এখন মন্ত্রী, এখন আর পরিবহন শ্রমিকদের নেতা নন। আমাদের দুর্ভাগ্য, মন্ত্রী শাজাহান খান এমন একটি দলের নেতা ও মন্ত্রী, যে দল থেকে এ দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকদের জš§ হয়েছিল। মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদÑ এরা তো আওয়ামী লীগেরই নেতা ছিলেন। কিন্তু তারা কি কখনও অভদ্রজনিত আচরণ করেছেন? শাজাহান খান খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে রাজনীতি করেন। ভাসানীও তো খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। তার নাম ভাঙিয়ে পরবর্তী সময়ে অনেকে মন্ত্রী হয়েছেন। মন্ত্রী হয়ে ভাসানীর সমালোচনাও করেছেন, কিন্তু ভাসানী কি তাদের সঙ্গে কখনও অভদ্রজনিত আচরণ করেছেন? কখনও করেননি। ভাসানী জীবদ্দশায় শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক সমালোচনা করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুু একদিনের জন্যও ভাসানী সম্পর্কে কোন খারাপ কথা বলেছেন, এ ধরনের কোন রেকর্ড নেই। বরং ‘হুজুরের’ জন্য লুঙ্গি, গামছা বঙ্গবন্ধুই দিতেন। এজন্যই তিনি বঙ্গবন্ধু। আর তার দলের হয়ে শাজাহান খান আজ একি আচরণ করলেন!
শাজাহান খান অতীতেও বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের বিরুদ্ধে পরিবহন শ্রমিকদের উসকে দিয়েছিলেন। কারণ মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য তিনি অদক্ষ ড্রাইভারদের দায়ী করেছিলেন। এবং ড্রাইভারদের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় অধ্যাপক মামুন শাজাহান খানেরও সমালোচনা করেছিলেন। আর তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পরিবহন শ্রমিকদের এক সমাবেশ থেকে অধ্যাপক মামুনকে হুমকি দেয়া হয়েছিল। ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতা মারার ছবিও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। সারাদেশ যখন অদক্ষ ড্রাইভারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল, তখন তিনি অদক্ষ ড্রাইভারদের পক্ষ অবলম্বন করে বলেছিলেন ‘ড্রাইভারদের গরু-ছাগল চিনলেই যথেষ্ট’! কী ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য! অদক্ষ ড্রাইভাররা যেখানে মহাসড়কে এক ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ কায়েম করেছে, সেখানে অদক্ষ বাসচালকদের সমর্থন করেছিলেন তিনি।
অনেকেরই মনে থাকার কথা, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় বিরোধী দলের এক এমপি বিএনপির এক মহিলা এমপি (তিনি মাদারীপুরের একটি আসনের প্রতিনিধিত্ব করতেন) সম্পর্কে খোদ সংসদেই একটি অশোভন মন্তব্য করেছিলেন। একজন মহিলা এমপির সঙ্গে যখন ‘রাতের নারীদের’ তুলনা করা হয়, তখন ওই লোকটি সম্পর্কে মন্তব্য করতেও আমার রুচিতে বাধে। একজন নির্বাচিত এমপির রুচি কোন পর্যায়ে গেলে তিনি তার মহিলা সহকর্মী সম্পর্কে একটি অশোভন মন্তব্য করতে পারেন!
যিনি প্রকাশ্যে সাবেক একজন মন্ত্রীর চোখ তুলে নেয়ার হুমকি দেন, তিনি তো আমাদের সবার জন্যই হুমকি। তার সঙ্গে কোন গোলটেবিলে অংশ নেয়া কিংবা টকশোতে অংশ নেয়া আমার জন্যও এক ধরনের ঝুঁকি। যিনি অধ্যাপক মামুনকে হুমকি দিতে দ্বিধা করেননি, তিনি যে ব্যারিস্টার মিয়ার মতো একজন সিনিয়র সিটিজেনকে হুমকি দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। আমি তার ব্যবহারে লজ্জিত ও দুঃখিত।
মহাজোট সরকারে দু’-একজন মন্ত্রী আছেন, যারা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক মন্ত্রীই নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রী বেশি কথা বলেন। এটা তার স্বভাব। ‘খামোশ’ খ্যাত অর্থমন্ত্রী সরকারের জন্য বোঝা। ‘কালো বিড়াল’ খ্যাত সুরঞ্জিত বাবু নিজেকে যতই নির্দোষ বলে দাবি করেন না কেন, সাধারণ মানুষের কাছে তার কোন ‘ইমেজ’ নেই। তিনিও সরকারের বোঝা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের জন্য কোন সম্মান বয়ে আনতে পারেননি। মন্ত্রী রাজিউদ্দীন রাজু তার নিজ এলাকায় যেতে পারেন না। ‘ফটোগ্রাফার’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের স্বার্থে কোন বড় অবদান রাখতে না পারলেও ‘বিশ্ব ভ্রমণে’ বোধ করি ইতিমধ্যে একটা ‘বিশ্বরেকর্ড’ করে ফেলেছেন! আরও দু’-চারজন মন্ত্রীর কথা নাইবা বললাম। বিশেষ করে সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সরকারের ভাবমূর্তি আজ কোথায় নিয়ে গেছেন, সরকারপ্রধান এটা স্বীকার না করলেও সাধারণ মানুষ বোধ করি এটা বোঝে। তার কারণেই পদ্মা সেতু ঝুলে গেল! বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে, এটি নিশ্চিত হতে পারছি না। এখন এই কাতারে যোগ দিলেন শাজাহান খান। তাকে কিছু বলার বা শেখানোর ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুধু তাকে বলতে পারিÑ মাননীয় মন্ত্রী এভাবে নয়। সরকারপ্রধান আপনাকে একটি বড় দায়িত্ব দিয়েছেন। মন্ত্রী হয়েছেন। মন্ত্রী পদের প্রতি সম্মান জানিয়ে আপনার এমন কিছু করা ঠিক নয়, যাতে আপনার নিজের, দলের, সেই সঙ্গে সরকারের অসম্মান হয়। মন্ত্রী হলে অনেক সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে। বিরোধী দল সমালোচনা করবে। এটাই রাজনীতির নিয়ম। তাই বলে অশোভন আচরণ করবেন কেন?
একজন শাজাহান খানকে নিয়ে পুরো সরকারকে বিচার করা যাবে না, এটা সত্য। কিন্তু এটাও তো সত্য, ‘দুধে এক ফোঁটা চানা পড়লে পুরো দুধই নষ্ট হয়ে যায়’। যে সরকারে শাজাহান খানরা থাকেন, সেই সরকার সম্পর্কে মানুষ যদি কটূক্তি করে, আমি তাতে অবাক হব না। কোন ‘গুণে’ তিনি মন্ত্রী হয়েছেন, আমি বলতে পারব না। এটা সরকারপ্রধানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। সরকারপ্রধানের এটা সাংবিধানিক অধিকারÑ তিনি যে কাউকে মন্ত্রী বানাতে পারেন। তবে মন্ত্রীদের অতীত রেকর্ড বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। এমনিতেই সরকারের সামনে নানা সমস্যা। হলমার্ক কেলেংকারি, ডেসটিনি, শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, কোন একটি ক্ষেত্রেও সরকারের জন্য কোন প্লাস পয়েন্ট নেই। আওয়ামী ঘরানার লোক হিসেবে পরিচিত প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার একটি উক্তিও (তুই চোর!) বলে দেয় বুদ্ধিজীবীদের মাঝে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে যেখানে সহনশীলতা খুবই প্রয়োজন, সেখানে কি-না কোন কোন মন্ত্রী ‘মাস্তানসুলভ’ আচরণ করেন! আমাদের দুর্ভাগ্য, মন্ত্রিসভায় খুব কম সদস্যই আছেন, যাদের আমরা স্মরণে রাখতে পারি। যাদের কথা আমরা ‘রেফার’ করতে পারি। একজন শাজাহান খান আমাদের জন্য কোন গৌরব বয়ে আনবেন না। আর বন ও পরিবেশমন্ত্রী সম্পর্কে বেশি কিছু বলতে চাই না। রাজনীতিতে নতুন। শুধু সরকারপ্রধানের কাছের মানুষ হওয়ার সুবাদে কোনরকম রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই হঠাৎ করে মন্ত্রী হয়ে গেলেন। খালেদা জিয়া সম্পর্কে জনগণকে ভুল তথ্য দেয়া ঠিক নয়। তার বক্তব্যে একটি সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ রয়েছে। তাকে আরও অনেক দূর যেতে হবে। খালেদা জিয়ার দিল্লি সফরের সমালোচনা হতেই পারে। সেটা হওয়া উচিত বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যভিত্তিক।
মন্ত্রীরা যদি এভাবে আচরণ করেন, তাহলে আমরা যাই কোথায়! পরবর্তী প্রজš§ কি শিখবে সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রীদের কাছ থেকে? তারা তো জুনিয়রদের তৈরি করবেন ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য। তারা তো শেখাবেন। কিন্তু একজন শাজাহান খান কিংবা একজন হাছান মাহমুদ আমাদের ভালো কিছু শেখাতে পারছেন না। পরবর্তী প্রজšে§র কাছে তারা কোন ‘আদর্শ’ নেতা নন।
Daily JUGANTOR
10.11.12

অভিনন্দন ও কিছু প্রশ্ন

শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামাই বিজয়ী হলেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে না। তবে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের দিকে অনেকের দৃষ্টি থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ইস্যুতে দু’দেশের মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। অধ্যাপক ইউনূস ইস্যু, গ্রামীণ ব্যাংক, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড, ‘আকসা’ কিংবা ‘টিকফা’ চুক্তি নিয়ে মতপার্থক্য স্পষ্ট। এসব মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা প্রকাশ্যেই সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। এখন ওবামার বিজয়ের পর মার্কিন নীতিতে কী আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে? মনে হয় না। মার্কিন রাষ্ট্রদূত গত জুলাই মাসে প্রকাশ্যেই ‘টিকফা’ চুক্তি স্বাক্ষরের কথা বলেছিলেন। তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘টিকফা’ না হলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত ও কোটা সুবিধা পাবে না। টিকফা হচ্ছে ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট’। যদিও আমাদের পররাষ্ট্র সচিব ২৯ জুলাই এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের কারণে যে টিকফা চুক্তি হচ্ছে না, কথাটা সত্য নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে কোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে কি না? না পারে না। জাতিসংঘের ২.৪ এবং ২.৭নং ধারা অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কিন্তু ড্যান মজিনার বক্তব্য ছিল জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী। এটা দৃষ্টিকটুও। এদেশের মানুষ জানে না টিকফা চুক্তি কী? এ চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, সে ব্যাপারেও আমরা স্পষ্ট নই। দুঃখজনক হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে বিদেশে এ ধরনের চুক্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মহাজোট সরকারের আমলে এ ধরনের কোনো চুক্তি নিয়ে সংসদে আমরা আলোচনা হতে দেখিনি। মজিনার কথাবার্তা থেকে মনে হয়েছে, বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর বাংলাদেশি পণ্য মানেই তো তৈরি পোশাক। সেই তৈরি পোশাক রফতানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তার একটা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্র মূলত প্রেসার খাটিয়ে সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় একটি ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ। এ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কিছুই নেই।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ নামে একটি চুক্তির প্রস্তাব করেছিল। আকসা চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে আগামীতে। আকসা চুক্তি প্রস্তাবের রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই মজিনা বললেন টিকফা চুক্তির কথা। এ চুক্তিটি আসলে কী কিংবা এতে আমরা কতটুকু উপকৃত হব, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আমরা অনেকেই জানি না। সংবাদপত্রেও এটা নিয়ে খুব একা আলোচনাও হয়নি। তবে মজিনা বলেছেন, এ চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষিত হবে। কীভাবে হবে, তা অবশ্য তিনি বিস্তারিত বলেননি। এমনকি এ চুক্তির সঙ্গে ‘টিফা’ বা ‘টিআইএফএ’ চুক্তির কোনো যোগ আছে কি না, তা-ও আমরা নিশ্চিত নই। যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই টিফা চুক্তি করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়নি। তখন বাংলাদেশের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র টিআইসিএফ চুক্তি করার প্রস্তাব করেছিল। চুক্তিটির পূর্ণ নাম হচ্ছে ‘ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেট’। বাংলাদেশ যদি এ চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করে, তাহলে বাংলাদেশ পাইরেটেড কোনো পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। শ্রমিকের মানও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। তাছাড়া ওষুধ প্রস্তুত ও রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ডব্লিউটিও’র কাছ থেকে ট্রিপসের আওতায় যে সুবিধা ভোগ করছে, তা-ও বাতিল হতে পারে। আসলে টিআইএফএ’র এরই বিকল্প নাম হচ্ছে টিফা। কোনো পক্ষ থেকেই এর বিস্তারিত উপস্থাপন না করায় নানা সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো একটি চুক্তির প্রস্তাব করে। তখন এর নাম ছিল ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ বা টিফা। ২০০২ সালে প্রণীত টিফার প্রথম খসড়াটিতে ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আপত্তি থাকায় ২০০৫ সালে সংশোধিত টিফায় ৭টি ধারা ও ১৯টি প্রস্তাবনা বহাল থাকে। ওই সময় সংশোধিত টিফায় ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে বিনিয়োগ বাতিলসহ মামলার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টিও শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্র টিফা চুক্তির খসড়ায় ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর প্রস্তাবনায় মেধাস্বত্ব অধিকার, আন্তর্জাতিক শ্রমমান ও পরিবেশগত সুরক্ষা-এ তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। শুধু এ তিনটি ধারাই নয়, টিফা চুক্তির একাধিক ধারা ছিল বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। যেমন বলা যেতে পারে মেধাস্বত্ব আইন। এটা মানলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে ধস নামবে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর প্রায় ৫৫টি দেশে ওষুধ রফতানি করে। বাংলাদেশের ওষুধ আন্তর্জাতিক মানের। এখন মেধাস্বত্ত্বের শর্তের কারণে বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশের ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্য সংশ্লিষ্ট দেশ বা কোম্পানির অনুমতি ছাড়া তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের একটি বিশেষ অধিকার রয়েছে। ওষুধের পেটেন্ট ব্যবহার করেই বাংলাদেশ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ তৈরি করছে, যা দিয়ে দেশের লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ সুযোগ ভোগ করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শর্তের কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা ভোগ করতে পারবে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে শ্রমমানের কথা বলছে, সেটা নিয়েও কথা আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইএলও’র মান বজায় রাখা কঠিন। ইউরোপের একজন শ্রমিক যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন এবং শ্রমিকদের যে মান, তার সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মানের বিচার করা যাবে না। ইউরোপে একজন শ্রমিকের যে অধিকার, সে অধিকার বাংলাদেশের শ্রমিকদের নেই। এটাই বাস্তবতা। এ বাস্তবতা মানতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ব শ্রমিকমানকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের শ্রমমানকে বিচার করা যাবে না। সুতরাং আজ টিকফা বলি আর টিফা চুক্তি বলি, কোনো চুক্তিই বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করবে না; বরং এ ধরনের চুক্তি মার্কিনিদের স্বার্থই রক্ষা করবে মাত্র। এ ধরনের কোনো চুক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারকে কোনোমতেই মেলানো যাবে না। শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার আমাদের অধিকার। আমরা তো যুক্তরাষ্ট্রকে একের পর এক সুযোগ দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু বিনিময়ে আমাদের প্রাপ্তি শূন্য। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি) থেকেও কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিভিন্ন দেশকে বড় অঙ্কের মজুরি সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এমসিসি গঠন করেছিল মার্কিন কংগ্রেস। এর চুক্তি হিসেবে সুস্পষ্টভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া না হলেও ধারণা করা হচ্ছে গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, বিনিয়োগের পরিবেশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এমসিসি থেকে বাংলাদেশকে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ড. ইউনূসের বিয়টিও যে অন্যতম একটি কারণ, তা জোসেফ ক্রাউলির একটি মন্তব্য থেকে জানা যায়। জোসেফ ক্রাউলি মার্কিন কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের কো চেয়ারম্যান। পদ্মা সেতু নিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। দুর্নীতির বিষয়টি এখানে প্রধান্য পাচ্ছে বেশি। আর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘টিকফা চুক্তি না হলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি’। নিঃসন্দেহে এসব বিষয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র এখানে নাক গলাতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো আমরা যেমন শ্রমমান নির্ধারণ করতে পারি না, ঠিক তেমনই বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা আমাদের যে সুযোগ দিয়েছে, সে সুযোগ আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। আমরা সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক চাই। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি বাংলাদেশকে একটি ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশও বিশ্বকে কিছু দিতে পারে। এখন ওবামা পুনর্নির্বাচিত হলেন। আমরা তাতে উৎফুল্ল। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত ও কোটা সুবিধা তিনি নিশ্চিত করবেন। এমসিসি থেকে যাতে সাহায্য পেতে পারি, সে ব্যাটারটিও তিনি নিশ্চিত করবেন। ওবামা যেমন হাজার হাজার মার্কিন নাগরিককে তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন; ঠিক তেমনি আমরাও প্রত্যাশা করি, আমাদের ন্যায্য অধিকারের প্রতি তিনি সম্মান জানাবেন। আকসা বা টিকফা চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে বাংলাদেশিদের বন্ধুত্ব পাওয়া যাবে না; বরং পারস্পরিক স্বার্থ যাতে নিশ্চিত হয়, সে ব্যাপারটি দেখা জরুরি।
Daily MANOBKONTHO
09.11.12

ওবামার বিজয় এবং অমীমাংসিত কিছু প্রশ্ন


শেষ পর্যন্ত বারাক ওবামাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হলেন। এটা নিয়ে কম আশঙ্কা ছিল না। জনমত জরিপগুলোতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস ছিল। তবে ৫ নভেম্বর অর্থাৎ নির্বাচনের এক দিন আগে অত্যন্ত প্রভাবশালী ওয়াশিংটন পোস্ট যে জনমত সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল (ওবামার পক্ষে ৫০ ভাগ ভোট, আর রমনির পক্ষে ৪৭ ভাগ ভোট) সেটাই সত্য বলে প্রমাণিত হলো। তথাকথিত 'সুইং স্টেট'গুলোর ফলাফলও বারাক ওবামার পক্ষে গেল। আগামী ২০ জানুয়ারি (২০১৩) তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। প্রশ্ন হচ্ছে ওবামার এই বিজয় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আদৌ কী কোনো নতুন 'বার্তা' বয়ে আনবে? অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, বিশাল বেকারত্ব, রেকর্ড অতিক্রম করা ঋণ (১৬ ট্রিলিয়ন ডলার), সরকারের অনধিকার চর্চায় অচলপ্রায় ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাত, সেই সঙ্গে বৈদেশিক নীতিতে ওবামা কী আদৌ কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারবেন? সামনের দিনগুলো ওবামার জন্য যে সুখের হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এটা সত্য, গেল মাসে এক লাখ ৭০ হাজার মানুষ চাকরি পেয়েছেন। যেখানে জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতি চারজন একটি চাকরির পেছনে দৌড়াচ্ছেন, সেখানে নতুন করে প্রায় দুই লাখ লোকের চাকরি পাওয়া কম কথা নয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণী এ থেকে উপকৃত হয়েছে। বারাক ওবামার টার্গেটই ছিল এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। আর্থিক খাতকে এখন একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। ২০০৯ সালে বারাক ওবামা বিখ্যাত কায়রো ভাষণে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে 'নতুন এক সম্পর্ক' গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ উৎখাত করতে গিয়ে জঙ্গিবাদেরই জন্ম হয়েছে সেখানে। লিবিয়া থেকে সিরিয়া- সব জায়গায়ই আত্মঘাতী বোমাবাজির জন্ম হয়েছে। ওবামার 'আরব বসন্ত' নীতির এটা একটা বড় ব্যর্থতা। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের কিংবা লিবিয়ায় গাদ্দাফির উৎখাতের পর সেখানে ইসলামী কট্টরপন্থীরা শক্তিশালী হয়েছে। সিরিয়ায় আসাদকে উৎখাত করতে গিয়ে দেখা গেল অস্ত্র চলে গেছে জঙ্গিদের হাতে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। 'আরব বসন্ত' তিউনেশিয়া, ইয়েমেন, মিসরে পরিবর্তন ডেকে আনলেও সেখানে কী ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সমস্যার কোনো সমাধান তিনি বের করতে পারেননি। তবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ওবামার পাশাপাশি রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনির বক্তব্য এসব ইস্যুতে স্পষ্ট ছিল না। তাঁর অর্থনৈতিক তথা বৈদেশিক নীতি মানুষকে টানতে পারেনি। বরং গর্ভপাতের বিরোধিতা করা, অভিবাসীদের ব্যাপারে কঠোর হওয়া এবং সমকামীদের বিয়ের বিরোধিতা করায় তিনি হিসপানিক ও অভিবাসী আমেরিকানদের ভোট পাননি। তবে রমনি তাঁর চরম দক্ষিণপন্থী অবস্থান থেকে অনেক সরে এসেছিলেন। ওবামার বৈদেশিক নীতির সমালোচনা করলেও তিনি নিজে কোনো সুস্পষ্ট নীতি উপস্থাপন করতে পারেননি। বরং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে তাঁর অতি ঘনিষ্ঠতা আরব বিশ্বে তাঁর অবস্থানকে অনেক দুর্বল করেছিল। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে ১৫টি পয়েন্ট চিহ্নিত করেছে, যেখানে ওবামা ও রমনির মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। নীরব ছিলেন। এ সবের মধ্যে রয়েছে মৃত্যুদণ্ড রদ প্রসঙ্গ, ৫১১৩টি পারমাণবিক ওয়্যারহেডের ভবিষ্যৎ, গুয়ানতানামো বের বন্দি শিবিরের ভবিষ্যৎ ও এই বন্দি শিবিরে নির্যাতনকারীদের বিচার, বাড়ি ব্যবসায় ধসের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার, পাকিস্তান, ইয়েমেন, সোমালিয়ায় ড্রোন বিমান আক্রমণের ভবিষ্যৎ, নূ্যনতম বেতন ১০ ডলারে উন্নীত করা (প্রতি ঘণ্টায় বর্তমানে ৭.২৫ ডলার), ইরানে সম্ভাব্য বিমান আক্রমণের ব্যাপারে অসম্মতি, নির্বাচনী প্রচারণায় যে বিপুল অর্থ দাতাদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয় (চাঁদা) তা প্রত্যাখ্যান করা, জলবায়ু পরিবর্তন তথা উষ্ণতা হ্রাসে একটি কমিটমেন্ট, সবার জন্য চাকরির নিশ্চয়তা, পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুলি্লর ভবিষ্যৎ, লাদেনকে কেন ধরে এনে কোর্টে বিচার করা হলো না ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো সাধারণের মধ্যে আলোচিত হলেও কোনো একটি ইস্যুতেও ওবামা ও রমনির কোনো 'কমিটমেন্ট' নেই। উভয়ই বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন। অথচ একজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে মানুষ এসব বিষয়ে শুনতে চেয়েছিল। তিনটি বিতর্কের একটিতেও তাঁরা এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি।
ওবামা ২০০৮ সালের নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গ, হিসপানিক তথা অভিবাসী আমেরিকানদের ভোট পেয়েছিলেন। এবারও পেলেন। মহিলাদের ভোটও এবার পেলেন। অন্যদিকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে রমনি ধনিক শ্রেণীর ভোট পেয়েছেন বটে, কিন্তু মধ্যবিত্তদের টানতে পারেননি। তাঁর অর্থনৈতিক নীতিতে মানুষ আস্থা রাখতে পারেনি। রমনি একজন সফল ব্যবসায়ী। ধনী। ধনিক শ্রেণীকেই তিনি আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। নির্বাচন শেষ হয়েছে। কিন্তু অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। ওবামার জন্য অর্থনীতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি বারবার বলেছেন, চার বছর আগে যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন তিনি, তা শেষ করতে আরো চার বছর সময় তাঁর প্রয়োজন। মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেছে বটে। কিন্তু অর্থনীতিকে বাগে আনার কাজটি সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ধনী ও গরিব শ্রেণীর মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে অসমতা, দারিদ্র্য আর বৈষম্যই সেখানে 'আকুপাই মুভমেন্ট'-এর জন্ম দিয়েছে- যা ইতিমধ্যে প্রায় ৪২০ দিন অতিক্রম করেছে। এই বৈষম্য কমিয়ে আনার এক কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে ওবামাকে। কাজটি সহজ নয়। পরিসংখ্যান বলে, শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ সেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছেন জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ মানুষ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১২ সালে এসে তারা ভোগ করেন মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯.৭ ভাগ গ্রহণ করে। শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। জোসেফ স্ট্রিগলিৎজের মতে শীর্ষে থাকা ওই ১ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। এই ধনীরা এক রাতে জুয়া খেলায় হেরে যান লাখ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে Cosino Capitalism। অর্থাৎ জুয়ানির্ভর এক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের অপর পিঠে রয়েছে অন্ধকার এক চিত্র। ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন অর্থাৎ এক কোটি ৬৪ লাখ শিশু অত্যন্ত গরিব। ২০১০ সালে করপোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। এ ধরনের পরিসংখ্যান আরো দেখা যায়। এসব পরিসংখ্যান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ঠিকমতো চলছে না। বৈষম্য দিনে দিনে বাড়ছে। গরিব আরো গরিব হচ্ছে। যে সমাজে শতকরা ৪৭ দশমিক ৮ ভাগ মানুষ 'ফুড স্ট্যাম্প' (খাদ্য সাহায্য)-এর ওপর নির্ভরশীল, সেই সমাজেই একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে গেল, যেখানে মূল দুজন প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয় করেছেন ৬০০ কোটি (কারো কারো মতে ১০০০ কোটি) ডলার। ওবামা বা রমনি আবার নিজের অর্জিত আয় থেকে এই অর্থ ব্যয় করেননি। তাঁরা প্রকাশ্যেই চাঁদা তোলেন। বড় বড় ব্যবসায়ী তথা করপোরেট হাউসগুলো তাঁদের চাঁদা দেয়। এটা বৈধ। ওই চাঁদার টাকায় তাঁরা নির্বাচন করেন। নির্বাচনে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে পারেন না বিধায় তৃতীয় কোনো শক্তিশালী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতে পারেন না। এবারও প্রায় ২৫ জন তথাকথিত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউই থাকতে পারেননি। তাঁদের নামও কেউ জানে না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে একটা সমতা ফিরিয়ে আনা, সবার জন্য চাকরি ও স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না বারাক ওবামার জন্য। মানুষ ওবামার ওপর আস্থা রেখেছে এটা সত্য, কিন্তু সেই আস্থার প্রতি কতটুকু সম্মান তিনি দেখাতে পারবেন, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। ওবামার বিজয় অবশ্য একটি বিষয়কে নিশ্চিত করেছে আর সেটি হচ্ছে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে বিমান হামলার সম্ভাবনা সীমিত হওয়া। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যে সংকট, ওবামা তার সমাধানের জন্য আলাপ-আলোচনার ওপরই গুরুত্ব দেবেন। রমনি বিজয়ী হলে হামলার সম্ভাবনা বাড়ত। তবে ওবামার জন্য মধ্যপ্রাচ্য হবে একটি 'টেস্ট কেস'। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন কোনো দেশ থেকেই সুবাতাস আসছে না। 'আরব বসন্ত' সেখানে সরকারের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু জন্ম দিয়েছে নতুন এক সংকটের- জঙ্গিবাদের উত্থান। আত্মঘাতী বোমাবাজি সংস্কৃতির সেখানে জন্ম হয়েছে। ওবামার বৈদেশিক নীতির এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সব মিলিয়ে পুরনো প্রেসিডেন্টকে নতুনভাবে পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি শপথ নেবেন। কিন্তু অর্থনীতির মন্দাভাব তিনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি না, বৈদেশিক নীতিতে 'সফলতা' পাবেন কি না, বিশ্বে একটি স্থিতিশীলতা তিনি উপহার দিতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন থেকেই গেল।Daily KALERKONTHO09.11.12