রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

সংঘাতময় পরিস্থিতি দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে

 


অতি সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনায় সাধারণ মানুষের মাঝে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, দেশের সংঘাতময় রাজনীতি দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? সেমিনারে, টকশোতে এই মুহূর্তে আলোচনার একটি বিষয়-বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি সংঘাতময় রাজনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা তেমন কথা প্রকাশ্যেই বলছেন, ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষের মাঝেও এই প্রশ্নটি ঘুরেফিরে আবতির্ত হচ্ছে। সরকারি দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা, দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তো প্রকাশ্যেই বললেন, ‘বিএনপি-জামায়াত গৃহযুদ্ধের পরিকল্পনা করছে।’ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মন্ত্রিপরিষদের পক্ষ থেকে রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি এ অভিযোগ করেন। তার বক্তব্য পরদিন পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। নিঃসন্দেহে সৈয়দ আশরাফের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন তা গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না। সৈয়দ আশরাফ সরাসরি অভিযোগ করেছেন বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে। সৈয়দ আশরাফের ওই বক্তব্য নিয়ে যখন কানাঘুষা হচ্ছে, তখন ২৩ ডিসেম্বর ছাপা হলো আরো একটি সংবাদ। সংবাদে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ১৪ দল মাঠে থাকবে’। ১৪ দলের এক সভায়ই এ সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে। বিএনপি ২৬ ডিসেম্বর থেকে গণসংযোগ শুরু করেছে ঢাকায়। বেগম জিয়া এসব গণসংযোগে বক্তৃতা দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে ১৪ দলের কর্মীরা যদি মাঠে থাকে তাহলে সংঘাত তো অনিবার্য। এই পরস্পরবিরোধী অবস্থান কি আমাদের জন্য ভালো কোনো সংবাদ বয়ে আনবে?
আমরা বারবার বলে আসছি রাজনীতিবিদদের মধ্যে যদি শুভবুদ্ধির উদয় না হয়, তাহলে সংঘাত অনিবার্য। ছাত্রলীগের ছেলেদের হাতে বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড কিংবা ২০ ছাত্রীকে গ্রেফতারের ঘটনা, কিংবা ছাত্রশিবিরের ৪১ নেতকর্মীকে গ্রেফতারের ঘটনা সংবাদপত্রের শীর্ষ সংবাদ হয়েছে। শিবিরের সাম্প্রতিক ভূমিকা বিতর্কিত। সংবাদপত্রে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কিন্তু ছাত্রীদের যাদের মাঝে একজন আবার অন্তঃসত্ত্বা, পুলিশ তাদের গ্রেফতার করল। এরা জামায়াতের রাজনীতির সমর্থক, শিবিরের ছাত্রী সংস্থার সদস্য। তারা যদি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো অপরাধ করে থাকে, তাহলে অবশ্যই তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। ইতিমধ্যে তাদের দুদিন রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে। কিন্তু সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে তারা তাদের অফিসে ছিলেন। আলোচনা করছিলেন। এখন কোর্টই বিচার করবে তারা রাষ্ট্রদ্রোহ কোনো অপরাধ করেছিলেন কি না। অপরাধ করলে অবশ্যই তাদের বিচার দাবি করব। কিন্তু কোনো কোনো সংবাদপত্রে এ ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
আমরা আমাদের সংবিধান নিয়ে গর্ব করি। বিশেষ করে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বেশ কিছু ধারা রয়েছে; যা আমাদের অধিকারকে সংরক্ষণ করেছে। বিশেষ করে ২৭নং অনুচ্ছেদে (আইনের দৃষ্টিতে স্বচ্ছতা), অনুচ্ছেদ ৩২ (জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার), অনুচ্ছেদ ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ (চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা) ইত্যাদি উল্লেখ করা যায়। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১১ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করতে পারি যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড কিংবা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে গ্রেফতার ইত্যাদি ঘটনায় সংবিধানের এইসব ধারা লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা অধিকার আমাদের জানিয়েছে যে, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৬৪ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতিতদের মধ্যে পুলিশের হাতে ৫০ জন, র‌্যাবের হাতে ৫ জন, বিজিবির হাতে ২ জন এবং জেল কর্তৃপক্ষের হাতে ২ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন (আমার দেশ, ২৩ ডিসেম্বর ২০১২)। পুলিশের এই ভূমিকা সংগত কারণেই আমাদের উদ্বিঘœ করেছে। এমনিতেই রাজনীতি যখন উত্তপ্ত, দেশ যখন সংঘাতের মুখোমুখি তখন এই পরিসংখ্যান আমাদের নতুন উদ্বেগজনক ভাবনায় ফেলে দেয়।
সিপিবি-বাসদের হরতালের সময় পুলিশের ভূমিকার একটি ছবিও গেল সপ্তাহে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এটা ছিল বাহ্যত সরকার সমর্থিত একটি হরতাল! যেখানে অন্য সময় পুলিশ হয়ে ওঠে বেপরোয়া, কিন্তু এই হরতালে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। একটি ছবিতে দেখা গেল পিকেটাররা বাধ্য করছে এক রিকশাচালককে ফিরে যেতে। পাশে দাঁড়ান একদল পুলিশ। নির্বিকার। ভাবখানা এমনই যে রিকশাওয়ালা রিকশা বের করল কেন? আজ তো হরতাল। এই ছবি কি আমাদের বোঝার জন্য স্পষ্ট নয় যে, সরকারই ওইদিন হরতাল করেছে? আসলে ছবি কথা বলে। ছবিই বলে দেয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কী নির্দেশ ছিল পুলিশের প্রতি। বিশ্বজিতের হত্যার দৃশ্য ধারণ করে ফটো সাংবাদিকরা আমাদের দেখিয়ে দিলেন সরকার আসলে ওইদিন কী চেয়েছিল। বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডকে নানাভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। বিশ্বজিৎ একজন শিবিরকর্মী, একজন অনুপ্রবেশকারী-এ ধরনের বক্তব্য এসেছে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে। হত্যাকারীরা আদৌ ছাত্রলীগ কর্মী নন, এ ধরনের দাবি ছাত্রলীগের নেতাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হলেও ছবিই প্রমাণ করে দিয়েছে পরিকল্পিতভাবেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটান হয়েছিল। হত্যাকারীরা চেয়েছিল একটি ভয়ের আবহ তৈরি করতে।
বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড, কুপিয়ে প্রকাশ্যে একজন মানুষকে হত্যা করার ঘটনায় সরকারের কোনো উদ্বিগ্নতা প্রকাশ না পেলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি হত্যাকাণ্ডের এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তার মন্তব্য প্রমাণ করে বিদেশিদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ইতিমধ্যে নিশ্চিন্তপুরের ১১২ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো প্রকাশ্যে মানুষ মারার ঘটনা। এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এসব ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের যে বড় বাজার, সেই বাজার এখন হারাতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ১ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। স্পষ্টতই পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে বাংলাদেশ এ বাজার হারাবে। ইতিমধ্যে ওয়ালমার্ট বাংলাদেশ থেকে তার তৈরি পোশাক ক্রয় বাতিল করেছে। নিশ্চিন্তপুরের তাজরিন গার্মেন্ট ওয়ালমার্টকে বিশেষ ধরনের পোশাক সরবরাহ করত। এটা বন্ধ হয়ে গেল। এটা অন্যদের ক্ষেত্রেও একটা প্রচ্ছন্ন ‘হুমকি’। নিশ্চিন্তপুরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম কিংবা ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইটস ফোরামের মতো সংগঠন তৎপর হয়েছে। এমনকি স্টেট ডিপার্টমেন্টও একটি মন্তব্য করেছে। তারা স্পষ্ট করেই বলছে, পোশাক শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধপরিকর। এ ধরনের মন্তব্য আমাদের জন্য একটি ‘মেসেজ’। পোশাক শিল্প স্পষ্টতই একটি ঝুঁকির মুখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে যেসব মানবাধিকার সংস্থা কাজ করে, তারা ওয়াশিংটনে এক ধরনের ‘লবিস্ট’ হিসেবে কাজ করে। কংগ্রেসম্যানদের তারা বাধ্য করে আইন প্রণয়ন করতে। এমনকি বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তৈরি পোশাক শিল্পে জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা চেয়ে আসছে। বাংলাদেশ এই সেক্টরে এ সুবিধা পায় না। কিছু কিছু সেক্টর যেমন, সিরামিক, সার, ফার্নিচার ইত্যাদি শিল্পে জিএসপি সুবিধা পায়। তৈরি পোশাকে পায় না। শতকরা ১৫ ভাগ শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে প্রবেশ করছে। গুণগত মান ও সস্তা থাকায় বাংলাদেশি এই পণ্যের বড় বাজার রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এখন এই জিএসপি সুবিধার বিষয়টিও প্রশ্নের মুখে পড়ে গেলো। আমি আশঙ্কা করছি, মার্কিন শ্রমিক সংগঠন তথা শ্রমিক স্বার্থ রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘চাপে’ কংগ্রেসে একটি আইন প্রণীত হতে পারে; যেখানে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানিতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা হতে পারে। এটা হলে বাংলাদেশের জন্য তা হবে এক ধরনের আত্মহত্যার শামিল। কেননা আমাদের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্প একটা বড় অবদান রাখছে। ইউরোপের অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করায় সেখানে বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে না। এমনকি সেখান থেকে ‘অর্ডার’ও কমে আসছে। ফলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা যদি হ্রাস পায় তা আমাদের অর্থনীতির জন্য হবে হুমকি। এমনকি কম্প­ায়েন্সের যে সুযোগ-সুবিধা মার্কিন ক্রেতারা দাবি করছে, তা নিশ্চিন্তপুরের ঘটনার পর আরো শক্তিশালী হবে। ‘কম্প­ায়েন্স’ এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তার ওপর জোর দেবে। শুধু তাই নয়, একইসঙ্গে তারা চাইবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে আমি ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা করছি। বলা হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্যই বিএনপি তথা জামায়াত নানা চক্রান্ত করছে। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে বলতে পারব না। কিন্তু এটা তো সত্য, যারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে অপরাধ করেছেন তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। এ দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই এটা চান। বিএনপি এই বিচারের বিরোধী নয় বলেও জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা। তবে তাদের দাবি বিচার যেন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে আমরা সবাই সেটাই চাই। কিন্তু তাই বলে দেশে এখন ‘যুদ্ধের’ মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে-এটাও আমরা চাই না। ‘গৃহযুদ্ধের’ কথা বলে আমাদের মাঝে একটা ভয় ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা এ ‘রাজনীতি’ চাই না। দুটি বড় দলকে সংলাপে বসতে হবে। একটা সমাধানে পৌঁছতে হবে। আমরা যদি আদৌ কোনো সমাধানে পৌঁছতে না পারি, যদি প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা বন্ধ করতে না পারি, যদি মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশ বিশ্ব মিডিয়ায় একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হবে। এটা আমাদের কারো জন্যই কোনো ভালো খবর নয়। 
DailyMANOBKONTHO
30.12.12

দুদকের বিতর্কিত ভূমিকা ও পদ্মা সেতুর ভবিষ


দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিতে 'ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের' অভিযোগে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এই মামলায় সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনকে আসামি করা হয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের অতীত মন্ত্রিসভার একজন প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকেও আসামি করা হয়নি। সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে সরাসরি ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ছিল। আর আবুল হাসান চৌধুরী পরামর্শক নিয়োগের ব্যাপারে একটি কানাডিয়ান কোম্পানির পক্ষে তদবির করেছিলেন। বিশ্বব্যাংকের স্পষ্ট দাবি ছিল সাবেক এই দুই মন্ত্রী, বিশেষ করে আবুল হোসেন যেহেতু অভিযুক্ত, সেহেতু তাকে আসামি করতে হবে। না হলে পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ব্যাপারে বাংলাদেশের দাবি তারা বিবেচনা করবে না। এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের একটি তদন্ত টিম দু'দুবার বাংলাদেশে এলো। দুদকের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করল। এখন দেখা গেল দুদক জাতীয় স্বার্থের চাইতে 'ব্যক্তিকে' প্রাধান্য দিয়েছে বেশি। যে কারণে সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আবুল হোসেনকে আসামি না করে আসামি করলেন ৭ জনকে, যাদের মাঝে অন্যতম হচ্ছেন সচিব মোশাররফ হোসেন ভঁূইয়া। মামলা দায়ের করার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ওএসডি করা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দেশ ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধান দুই আসামীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। নেয়া হয়েছে রিমান্ডে। এ ধরনের পদক্ষেপে বিশ্বব্যাংকের মন আদৌ গলবে বলে মনে হয় না। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে গত ১৮ ডিসেম্বর জানানো হয়েছে দুদকের দায়ের করা মামলার নথি দেখে বিশ্বব্যাংকের তদন্ত টিম যে প্রতিবেদন দেবে, তার ওপরই নির্ভর করছে অর্থায়নের বিষয়টি। স্পষ্টতই পদ্মা সেতুর অর্থায়নের বিষয়টি ঝুলে গেল। দুদকের চূড়ান্ত রিপোর্ট বিশ্বব্যাংকের তদন্ত টিমকে খুশি করবে, এটা আমার মনে হয় না। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, দুদক তার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে পারল না। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের প্রভাব, বা 'নির্দেশ' দুদক এড়াতে পারল না। দুদকের নেতৃত্ব দুদককে একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করল। দুদক যে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান তা দুদকের নেতৃত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে দুদক এখন প্রচ- 'ইমেজ' সঙ্কটের মুখে পড়ল। একটি দেশ তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে। জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি মাথায় রেখেই বড় বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। পদ্মা সেতু সে রকমই একটি প্রকল্প, যার সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি জড়িত। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ হাতে নিয়েছিল। তাদের নির্বাচনী ওয়াদার অন্যতম ছিল এই পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে এখন। এডিবি ও জাইকা ঋণচুক্তির মেয়াদ আরো এক মাস বাড়িয়েছিল। এখন এডিবি ও জাইকার প্রতিশ্রুতিতেও অনিশ্চয়তা আসল। বিশ্বব্যাংক যদি ফিরে না আসে, তাহলে বাংলাদেশ হয়ত বিকল্প মালয়েশীয় প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি_ মালয়েশিয়ার প্রস্তাবটি আদৌ জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত কি না। আর চুলচেরা বিশ্লেষণে মালয়েশিয়ার প্রস্তাবটি যদি জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে না পারে, তাহলে প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয়াই মঙ্গল। পদ্মা সেতু আমাদের প্রয়োজন, সন্দেহ নেই তাতে। এই সেতুটি দেশের অর্থনৈতিক চিত্রকে পুরোপুরিভাবে বদলে দিতে পারে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা এই সেতুটি নির্মাণের পর সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে, এটা যেমন সত্য। তেমনি এটাও সত্য, এই সেতুটি জিডিপিতেও অবদান রাখবে। এখন তুলনামূলক বিচারে যে প্রস্তাবটি আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে বেশি, আমরা সে প্রস্তাবটিই গ্রহণ করব। তুলনামূলক বিচারে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবটি ছিল ভালো। কিন্তু পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এবং এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের ব্যাপারে কোনো 'পজিটিভ' সাড়া দেবে না। অনেকেই জানেন কানাডার ওন্টারিও প্রদেশে এ সংক্রান্ত একটি মামলা বিচারাধীন। দুই ব্যক্তি যার একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, তারা সেখানে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের বিচার চলছে। ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেছেন আদালত। অভিযোগ উঠেছে গ্রেপ্তারকৃত ওই দুই ব্যক্তি কানাডার কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের পক্ষে 'ঘুষের বিনিময়ে' কাজ পাইয়ে দেয়ার অপতৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন। সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ব্যাংকের অভিযোগে ছিল তার বিরুদ্ধে। এমনিতে ওন্টারিওর আদালতে বিষয়টি ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিত না। এডিবি ও জাইকা ঋণের মেয়াদ বাড়ালেও, তা বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে না। বলা ভালো, প্রায় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ২৩৭৮০ কোটি টাকার ওপরে)। এখানে বিশ্বব্যাংকের দেয়ার কথা ১২০ কোটি ডলার। সেই সঙ্গে এডিবি ৬১ কোটি ৫০ লাখ ও জাইকা ৪০ কোটি ডলার দেয়ার কথা। ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক বা আইডিবির দেয়ার কথা ১৪ কোটি ডলার। এখন বিশ্বব্যাংক যদি সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে এডিবি, জাইকা কিংবা আইডিবি কোনো সিদ্ধান্ত নিলেও তাতে কোনো কাজ হবে না। যে বিষয়টি আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত আমরা কতদিন অপেক্ষা করবো? নাকি বিকল্প সিদ্ধান্ত আমরা নেবো। বিকল্প সিদ্ধান্তের ব্যাপারে দু'টো প্রস্তাব আছে এক. মালয়েশিয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করা, দুই. নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করা। তৃতীয় আরেকটি প্রস্তাবও আমরা চিন্তা করতে পারি আর তা হচ্ছে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে পদ্মা সেতুর নির্মাণ পরিকল্পনা আপাতত পিছিয়ে দেয়া। এই তিনটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। মালয়েশিয়ার প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের 'ফাঁদ'। এই 'ফাঁদ' এ বাংলাদেশ যদি একবার পা দেয়, তা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ডেকে আনবে। যেখানে একনেকে সর্বোচ্চ ২.৯ বিলিয়ন ও বিশ্বব্যাংক ২.৯ বিলিয়ন ডলার অর্থ প্রাক্কলন করেছিল, সেখানে মালয়েশিয়ার প্রস্তাব ছিল ৫.৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবের চাইতে দ্বিগুণ ব্যয় প্রাক্কলন করেছিল মালয়েশিয়া। শুধু তাই নয়, যেখানে বিশ্বব্যাংকের সুদ দশমিক ৭৫ ভাগ, সেখানে মালয়েশিয়াকে সুদ দিতে হবে ৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংককে সরল সুদে টাকা পরিশোধ করতে হবে, আর মালয়েশিয়াকে চক্রবৃদ্ধি হারে এই সুদ পরিশোধ করতে হবে। এখানে আরো যে প্রশ্নটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সেতু নির্মাণের মান ও স্থায়িত্ব নিয়ে বিশ্বব্যাংক তার প্রতিটি প্রকল্পে (পদ্মা সেতুসহ) মান রক্ষা করে ও বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এই মান রক্ষা করা হয়। ফলে সেতুর দীর্ঘস্থায়ীত্বের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে সেতুর মানের ক্ষেত্রে কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে না। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করলেও সেতুটির মালিকানা থাকবে বাংলাদেশের কাছে। কিন্তু মালয়েশিয়ার প্রস্তাবে মালিকানা থাকবে মালয়েশিয়ার হাতে। যেখানে তুলনামূলক বিচারে বিশ্বব্যাংক ২০ হাজার কোটি টাকা ফেরত নেবে, সেখানে মালয়েশিয়া ফেরত নেবে ৭০ হাজার কোটি টাকা। কোনো বিবেচনাতেই মালয়েশিয়ার প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য লাভজনক নয়। এমনকি এ থেকে দক্ষিণ বাংলার মানুষ যে আদৌ উপকৃত হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে। কেননা সেতু ব্যবহারকারীরা, অর্থাৎ যারা গাড়ি ব্যবহার করে সেতু পারাপার হবেন (যাত্রী ও ব্যবসায়ী), তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে টোল দেবেন। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবে যে টোল আদায় হবে, তা জমা হবে সরকারের কোষাগারে। অন্যদিকে মালয়েশিয়া টোল আদায় করে নিজ দেশে নিয়ে যাবে। বিনিয়োগকৃত অর্থ দ্রুত তুলে নেয়ার জন্য তারা অতিরিক্ত টোলও আদায় করবে। এতে করে যাত্রীরা ও ব্যবসায়ীরা টোল ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবেন। দক্ষিণ বাংলা থেকে যে সব পণ্য ঢাকায় আসবে, তার দামও বেড়ে যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সেতু ও হাইওয়ে নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট, বিশেষ করে কারিগরি সেবা, পরামর্শক সেবা ও মনিটরিং সেবা বিশ্বমানের। এসব প্রকল্পে কোনো অনিয়মের সম্ভাবনা কম। থাকেই না। নিয়মিত তারা মনিটর করে ও সদর দপ্তরে তা মূল্যায়ন করে। কিন্তু বিশ্বের কোথাও মালয়েশিয়া এ ধরনের বড় সেতু করেছে, তার নজির নেই। সুতরাং মালয়েশিয়ার প্রস্তাব কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার জেদের বশবর্তী হয়ে যদি শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করে, তাহলে তাতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে না। জনসাধারণের ওপর এই ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হবে মাত্র। এতে করে দক্ষিণ বাংলার জনগণের উপকারের চাইতে অপকার হবে বেশি। বাংলাদেশ নিজেও করবে- এমন একটি হাস্যস্পদ সংবাদের জন্ম দিয়েছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর কথার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীরাও জোরেশোরে বলতে শুরু করলেন, স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে। এমনকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে চাঁদাবাজি শুরু হয়ে গেল। একজন ছাত্র মারাও গেল চাঁদার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে। চাঁদার বাক্স নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ছাত্রলীগের ছেলেদের চাঁদাবাজির ছবিও ছাপা হয়েছিল পত্র-পত্রিকায়। আমাদের রাজনীতিবিদরা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য অনেক কথা বলেন। পদ্মা সেতু নিয়ে এখনো অর্থমন্ত্রী কথা বলে যাচ্ছেন। সর্বশেষ যে কথাটি অর্থমন্ত্রী বললেন, তা হচ্ছে খুব শিগগিরই পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হবে। আমাদের কত বোকা ভাবেন অর্থমন্ত্রী! তবে বলতেই হবে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করা, পুনরায় বাংলাদেশের অনুরোধে ফিরে আসা ইত্যাদি বিশ্বব্যাংকের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। কিন্তু দুদক সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনকে বাদ দিয়ে যখন মামলা করল, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেল বিশ্বব্যাংকের 'দাবি' আমরা পূরণ করতে পারিনি। একজন আবুল হোসেনের কাছে পদ্মা সেতু 'হেরে' গেল। আবুল হোসেন ক্ষমতাসীনদের কাছে 'বড়' হলেন, 'বড়' হলো না পদ্মা সেতুর বিষয়টি। দুঃখ লাগে সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার জন্য। তিনি পরিস্থিতির শিকার হলেন। অথচ একজন আমলা কাজ করেন মন্ত্রীর নির্দেশে। সেই নির্দেশে তিনি কাজও করেছিলেন। এখন তিনি ফেঁসে গেলেন। কিন্তু বেঁচে গেলেন সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেন। এই ঘটনা বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি আরো নষ্ট করবে। আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আবারো প্রমাণিত হলাম।Daily JAI JAI DIN29.12.12

মিসর কি ‘ইসলামী রাষ্ট্রে’ পরিণত হচ্ছে


দু’দফা গণভোটে নয়া সংবিধানের পক্ষে ব্যাপক ভোট পড়ায় একদিকে প্রেসিডেন্ট মুরসির হাত যেমন শক্তিশালী হল, অন্যদিকে আগামী দিনের মিসর সম্পর্কে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তাও সৃষ্টি হল। কোন পথে এখন মিসর? খসড়া সংবিধান অনুমোদিত হওয়ায় নানা প্রশ্ন মিসরকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। মিসর কি একটি কট্টরপন্থী ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে? নাকি দেশটি তুরস্কের মডেল অনুসরণ করবে? সামরিক কাউন্সিল বা স্ক্যাফের ভূমিকাই বা কী হবে শেষ পর্যন্ত? খসড়া সংবিধান গণভোটে অনুমোদিত হওয়ায় পশ্চিমা বিশ্বে মিসর সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জš§ হতে পারে। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে এর সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও এ ‘সম্পর্ক’ এখন কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটাও দেখার বিষয়।
একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন। ২০১১ সালে ‘আরব বসন্ত’ মিসরে বড় ধরনের পরিবর্তন ডেকে আনলেও মিসরকে নিয়ে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা এখন ধীরে ধীরে মিইয়ে যাচ্ছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ, বহুদলীয়, উদারমনা মিসরের স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত স্বপ্নই থেকে যেতে পারে। কারণ এ খসড়া সংবিধানের ব্যাপারে আপত্তি ছিল গণতন্ত্রকামী তথা নারীবাদীদের। আপত্তি ছিল বিচারপতিদেরও, যারা নির্বাচন আয়োজন করতে তাদের আপত্তি জানিয়েছিলেন। উপরন্তু সেনাবাহিনীর কমান্ডও যে রাজি ছিল তাও নয়। একটা পর্যায়ে কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে আবার মানুষ সমবেত হতে শুরু করেছিল। তাদের সঙ্গে মুরসির সমর্থকদের বাকবিতণ্ডা ও সংঘর্ষের খবরও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখন গণভোটে খসড়া সংবিধানের পক্ষে ব্যাপক ভোট পড়ায় এ প্রতিবাদের কোন মূল্য থাকল না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, যে সংবিধানটি শেষ পর্যন্ত গণভোটে অনুমোদিত হল, তা মিসরীয় সমাজকে বিভক্তিই করবে। খসড়া সংবিধানে বলা আছে, আইনের প্রধান উৎস হবে শরিয়াহ। শরিয়াহ আইন প্রবর্তিত হলে অমুসলিম, বিশেষ করে কপটিক খ্রিস্টানরা বৈষম্যের শিকার হবেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে নারীদের অধিকার ক্ষুণœ হবে বলেও নারী সমাজের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে। সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল, যা এখন অনুমোদিত হল। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ফেব্র“য়ারিতে মিসরে গণঅভ্যুত্থান হোসনি মোবারককে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এরপর থেকেই মিসর সম্পর্কে আগ্রহ বাড়তে থাকে পশ্চিমা সমাজে। গত জুলাইয়ে (২০১২) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুরসির বিজয় পশ্চিমা বিশ্বে নতুন একটি মাত্রা দেয়। এখন ইসলামিক ভাবাপন্ন একটি সংবিধান গণভোটে অনুমোদিত হওয়ায় আগ্রহের মাত্রায় নতুন একটি পালক যোগ হল মাত্র। বলা ভালো, মিসরে সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি সংবিধান পরিষদ গঠন করার জন্য যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে বিজয়ী হয়েছিল কট্টরপন্থীরা। তারা যে সংসদ গঠন করেছিল তাতে বেশ কিছুদিন ধরে সংবিধানের ২৩৪টি ধারা নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক চলে। এক পর্যায়ে ইসলামপন্থীরা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে উদারপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্যরা সংসদ বয়কট করেছিল। এরপর কোন রকম সংশোধনী ছাড়াই খসড়া সংবিধানটি সংসদে অনুমোদিত হয়। পরে খসড়া সংবিধানের উপর গণভোট অনুষ্ঠিত হল। কিন্তু বিরোধীদলীয় মোর্চা ন্যাশনাল সালভেশন ফ্রন্ট এই গণভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মোহাম্মদ মুরসি কি মিসরে ইসলামের শরিয়াহভিত্তিক একটি সমাজ বিনির্মাণের উদ্যোগ নেবেন? তার দল ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস’ পার্টি। ইসলামিক ব্রাদারহুড একটি ‘ধর্মভিত্তিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে। মুরসি কি এখন এ দিকেই মিসরকে চালিত করবেন? এই মুহূর্তে এটি স্পষ্ট নয়। তবে মুরসি অতটা কট্টরপন্থী নন। তিনি ইসলামপন্থী। তিনি ইসলাম আর গণতন্ত্রকে এক কাতারে দেখতে চান। আর এ কারণে তিনি ‘ইসলামিক গণতন্ত্রে’র কথা বলছেন। সম্ভবত মিসর ‘তুরস্ক মডেল’ অনুসরণ করবে। তুরস্কে ইসলামপন্থীরা জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। তুরস্কের সেনাবাহিনী ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের অনুসারী। মিসরের সেনাবাহিনীও অনেকটা তাই।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে তুরস্কের ক্ষমতাসীন এরদোগান সরকারের দ্বন্দ্বের কথা সবাই জানেন। সেনাবাহিনী এখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। যে কারণে সেখানে সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা কম। মুরসিও এমনটি চাইবেন মিসরের জন্য। এক্ষেত্রে তিনি কতটুকু সফল হবেন, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। উপরন্তু ইসরাইলের ব্যাপারে নয়া প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, ইসরাইলের আগ্রাসী নীতির কারণে সমগ্র আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক কখনও ভালো হয়নি। ১৯৭৮ সালে মিসরের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও এ সম্পর্ক কখনোই উন্নত হয়নি। এমনকি কট্টরপন্থীদের হাতে মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। যদিও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মুরসিকে শুভেচ্ছা জানাবেন।
কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। কেননা ব্রাদারহুডের নেতৃত্ব এখনও পরিপূর্ণভাবে ‘ইসরাইল বিরোধিতা’ থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। তারা যে প্রেসিডেন্টকে প্রভাব খাটাবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানেই এসে যায় ‘রিয়েল পলিটিক্সে’র বিষয়টি। মুরসি এই রিয়েল পলিটিক্স কতটুকু অনুসরণ করেন সেটাই দেখার বিষয়। তবে আমি মোহাম্মদ মুরসির সাম্প্রতিক দেয়া বক্তব্যে কিছুটা আশাবাদী। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি একটি জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটি এ মুহূর্তে খুবই জরুরি। কারণ মিসর এখন একটি বিভক্ত সমাজ। একদিকে রয়েছে ইসলামিক কট্টরপন্থীরা, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মোবারক সমর্থকরা। ২০১১ সালে তাহরির স্কোয়ারে ১৭ দিনের ‘বিপ্লব’ নতুন এক ইতিহাসের জš§ দিয়েছিল মিসরে। দীর্ঘ ১৭ দিন দখলে রেখেছিল ‘বিপ্লবীরা’। মূলত তরুণরাই এ বিপ্লবের নায়ক। এরা সবাই যে ইসলামিক আদর্শকে পছন্দ করেন, তা নয়। তারা মোবারকের অপশাসন (১৯৮১ সাল থেকে ক্ষমতায় ছিলেন) থেকে মিসরকে ‘মুক্ত’ করতে চেয়েছিলেন। ওই তরুণরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে বিপ্লবকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই তরুণ প্রজšে§র কেউ কেউ মুরসিকে সমর্থন করেছেন, এটা সত্য। কিন্তু মিসর ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্র হোক, এটি তারা চাইবেন না। মিসর ‘বিপ্লবে’ নারীরা একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। সেনাবাহিনীর হাতে অনেক তরুণী নিগৃহীতও হয়েছিলেন। এরা নিশ্চয়ই চাইবেন না মিসরে নারীদের অধিকার সংকুচিত হোক, বাধ্যতামূলক পর্দা প্রথা আরোপ করা হোক। মিসরের নারীরা যথেষ্ট স্বাধীন। তারা আধুনিকমনস্ক। পূর্ণ পর্দা প্রথা তারা অনুসরণ না করলেও শালীনতা বজায় রেখে চলেন। নয়া নেতৃত্ব নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি করবেন। মিসরের সংখ্যালঘু কপটিক খ্রিস্টানরা কিছুটা আতংকগ্রস্ত। তারা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন। সম্ভবত এটা উপলব্ধি করেই প্রেসিডেন্ট অঙ্গীকার করেছিলেন নতুন সরকারে ‘কপটিক খ্রিস্টানদের’ প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং নয়া প্রধানমন্ত্রী হবেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। মুরসি বাস্তববাদী। তিনি সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছেন। তিনি আধুনিকমনস্ক একজন মানুষ। প্রকৌশল বিদ্যায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডক্টরেট ডিগ্রিও নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। তার রাজনৈতিক জীবন মাত্র ১২ বছরের। দীর্ঘ ৮৪ বছরের একটি সংগঠনের (ইসলামিক ব্রাদারহুড) প্রতিনিধি তিনি। দলে কট্টরপন্থী, ধর্মীয় উগ্র আদর্শে বিশ্বাসী এবং শরিয়াহ আইনভিত্তিক একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লোক অনেক রয়েছে। এদের ‘চাপও’ থাকবে তার ওপর। এই ‘চাপ’ উপেক্ষা করে ইসলামিক আদর্শ ও গণতন্ত্রকে একত্রিত করে ‘নতুন এক মিসর’ কীভাবে তিনি জš§ দেন, সেটাই দেখার বিষয়। গণভোটের ফলাফলকে বিরোধী দলের প্রত্যাখ্যান প্রেসিডেন্ট মুরসিকে এখন বড় বিপদে ফেলে দিল।
আরব বিশ্বে যে বসন্তের ঢেউ বইছিল, তা এখন দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রম করল। তিউনিশিয়ার পর মিসরে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের উচ্ছেদ হয়। এরপর জনগণের ভোটে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাসীন হয়। এটা ছিল বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তর। তৃতীয় স্তরে কট্টরপন্থীদের অবস্থান শক্তিশালী হল। গণভোটের পর ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করবে। এ মুহূর্তে তাদের পাল্লা ভারি। নয়া সংবিধানের আলোকে দু’মাস পর সেখানে নয়া পার্লামেন্টের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে গণভোটের ফলাফলের প্রতিফলন ঘটলে আমি অবাক হব না। আগামী নির্বাচনেও ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হবে। এক্ষেত্রে ন্যাশনাল সালভেশন ফ্রন্ট বড় কিছু আশা করতে পারে না। একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী করবেন, এ প্রতিশ্র“তি মুরসি রাখতে পারবেন বলেও মনে হয় না। তবে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। সেনাবাহিনী এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল। তবে ভুলে গেলে চলবে না, সেনাবাহিনী একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী। ১৯৫২ সালে রাজতন্ত্র উৎখাতের মধ্য দিয়ে মিসরের সেনাবাহিনী সেখানে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। কর্নেল জামাল আবদুন নাসের ওই ‘বিপ্লবের’ মধ্য দিয়ে শুধু মিসরই নয়, সমগ্র আরব বিশ্বে আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জš§ দিয়েছিলেন। সমগ্র আরব বিশ্বে এবং সেই সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বে এক অবিসংবাদিত নেতায় তিনি পরিণত হয়েছিলেন। আজ ঠিক ৬০ বছর পর ‘নতুন এক জাতীয়তাবাদী রাজনীতি’ নিয়ে আবিষ্কৃত হলেন মুরসি। খসড়া সংবিধান তাকেও যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে, যে কারণে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন ‘মিসরের নয়া ফারাও’ হিসেবে। মিসরের সভ্যতা দীর্ঘদিনের। ফারাওদের কাহিনীও মানুষ জানে।
আধুনিক ইতিহাসে মুরসিকে কীভাবে চিহ্নিত করা হবে জানি না। কিন্তু এটা সত্য, মিসর নতুন এক রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসছে, আর তা হচ্ছে ইসলামী গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রে পশ্চিমা সমাজের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোন উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইসলাম, শরিয়াহ আর কোরআনভিত্তিক একটি সমাজ বিনির্মাণে ব্রতী হবেন মুরসি ও তার দল। স্পষ্টতই তা আধুনিকমনস্ক ও পশ্চিমা সমাজের পুুঁজিবাদের উপকরণকে অস্বীকার করবে না। তবে তালেবান স্টাইলে মধ্যযুগীয় ইসলাম তারা বিনির্মাণ করবেন না। জনগণের সমর্থন নিয়েই তারা একটি ইসলামী সমাজ মিসরে নির্মাণ করতে চান। মিসরে মোবারককে উৎখাতের প্রাক্কালে মুসলিম ব্রাদারহুডের গাইডিং কাউন্সিলের সদস্য এচ্ছাম এল এরসিয়ানের একটি প্রবন্ধ নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়েছিল (৯ ফেব্র“য়ারি ২০১১)। ওই প্রবন্ধে এরসিয়ান স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, যে গণতন্ত্র ইসলামী মূল্যবোধকে স্বীকার করে না, সেই গণতন্ত্র মিসরবাসী গ্রহণ করে নেবে না। যে গণতন্ত্রে ধর্মের ভূমিকা স্বীকৃত এবং জনগণের অধিকার ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা থাকবে, সেই গণতন্ত্রই মিসরে বিকশিত হবে। গণভোটের পর এখন সত্যি সত্যিই মনে হচ্ছে মিসর সেদিকেই যাচ্ছে।
Daily JUGANTOR
27.12.12

জোট রাজনীতির অতীত ও ভবিষ্যৎ


¦



দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে, ততই 'জোটের রাজনীতি'র ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশের ৪১ বছরের রাজনীতিতে জোটের রাজনীতি প্রথমদিকে গুরুত্ব না পেলেও ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই এই 'জোট রাজনীতি'র গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে কোনো একটি একক দলের পক্ষে সরকার পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো যখন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তখন প্রথমবারের মতো মুসলিম লীগ ও সদ্য গঠিত ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ একটি সংসদীয় ঐক্য গঠন করলেও পরবর্তী সময়ে সেই ঐক্য টিকে থাকেনি। বলা ভালো স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী প্রথমবারের মতো ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছিল এবং সংসদীয় রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোটের রাজনীতি শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে।
জোটের রাজনীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশের রাজনীতি স্পষ্টতই দুটি ধারায় বিভক্ত। যারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তথা ইসলামিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী, তাদের একটি জোট। এই জোটের মূল শক্তি বিএনপি। এই জোট চারদলীয় জোট হিসেবে পরিচিতি পেলেও অতিসম্প্রতি তা ১৮ দলীয় জোটে সম্প্রসারিত হয়েছে। যদিও এই ১৮ দলীয় জোটে অনেক দল রয়েছে, যা ব্যক্তিনির্ভর, প্যাডসর্বস্ব এবং যাদের কোনো সংসদীয় ভিত্তি নেই। অন্যদিকে যারা বাঙালি সংস্কৃতি, ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী এবং সমাজতন্ত্রী, তারা মহাজোটের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ এই মহাজোটের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি। তবে এখানে একটা মজার ব্যাপার লক্ষণীয়। রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী জাতীয় পার্টি মহাজোটের অন্যতম শরিক। জাতীয় পার্টি বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তাদের রাজনীতির সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির কোনো বড় পার্থক্য নেই। এ ক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে তাদের ঐক্য করা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তা হয়নি। উল্টো যারা বিএনপির মতাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে, তাদের সঙ্গেই ঐক্য করেছে জাতীয় পার্টি। এর ব্যাখ্যা কী? সাধারণ অর্থে দেখা যায়, এক ধরনের সুবিধাবাদিতা কাজ করেছে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের মধ্যে। এরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে সব ধরনের সুবিধা নিতে চায়। বিগত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় রাজনীতি করার প্রবণতা আমরা লক্ষ করি। ওই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে (২০০৬) আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে জাতীয় পার্টি মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল। পরে জাতীয় পার্টির নেতা এইচ এম এরশাদ দলীয় মন্ত্রীকে (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) পদত্যাগ করার আহ্বান জানালেও জাতীয় পার্টির মন্ত্রী পদত্যাগ করেননি। এ নিয়ে ওই সময় জাতীয় পার্টি ভেঙেও যায়। এ মুহূর্তে জাতীয় পার্টি তিন ধারায় বিভক্ত হয়ে আছে। একটি ধারা (প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জু) বর্তমানে বিএনপির সঙ্গে আছে এবং সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্বও রয়েছে (বিজেপি)।
জোট রাজনীতিতে আলোচনা করলে সংগত কারণেই বাংলাদেশে সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস আলোচনা করা প্রয়োজন। ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার আওতায়। এরপর ১৯৭৯ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতির অধীনে। তবে ১৯৯৬ থেকে সর্বশেষ ২০০৮ সালের পর পর তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। ওই সময় কোনো জোটের রাজনীতি ছিল না এবং ইসলামপন্থী কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ও অংশগ্রহণও ছিল না। মোট ৩০০ আসনে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল ২৯২ আসনে, ভোট পেয়েছিল ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ। মজার ব্যাপার ওই সময় বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল জাসদ, ন্যাপ (মো:), যারা এখন সরকারি জোটের অন্যতম শরিক। ন্যাপ (মো:) ২২৪ আসনে প্রার্থী দিয়ে পেয়েছিল মাত্র একটি আসন (শতকরা ভোট ৮.৩৩)। আর জাসদ ২৩৭ আসনে প্রার্থী দিয়েও পেয়েছিল একটি আসন (৬.৫২ শতাংশ)। ভাসানী ন্যাপও ১৬৯ আসনে প্রার্থী দিয়ে একটি আসন (৫.৩২ শতাংশ ভোট) পেয়েছিল। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছিল চারটি আসন। স্বাধীনতা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ভূমিকা, শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ইত্যাদি নানা কারণে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী হতে সাহায্য করলেও ওই সময় কোনো কোনো আসনে কারচুপির অভিযোগও উঠেছিল। ওই সময় কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জোট গঠনের কথা না বললেও, নির্বাচনের পরপরই (ন্যাপ-মো:) ও কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতারা, যাঁরা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনীতির সমর্থক ছিলেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার আহ্বান জানান। ১৯৭৩ সালের মে মাসে তিনটি সংগঠনের (আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপ-মো:) ছাত্র সংগঠনগুলো একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন করে। ধীরে ধীরে তা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর দিকে গড়ায়। ৫ আগস্ট কুমিল্লায় (১৯৭৩) ও ২৬ আগস্ট বগুড়ায় (১৯৭৩) ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকার ঘোষণা করে যে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিকে সামনে রেখে প্রগতিশীল সংগঠনগুলোকে নিয়ে একটি ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হবে। অক্টোবর মাসে বহুল আলোচিত 'গণ ঐক্যজোট' গঠিত হয়। ১৯ সদস্যবিশিষ্ট যে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাতে ১১ জন ছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে, পাঁচজন ন্যাপ (মো.) থেকে ও তিনজন সিপিবি থেকে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। এই 'গণ ঐক্যজোট'-এর সম্প্রসারিত রূপ ছিল বাকশাল। যদিও বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই জোট সংসদীয় নির্বাচনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কেননা নির্বাচন হয়েছিল এর আগে মার্চে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি 'নয়া রাজনীতির' আলোকে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৭৯) আমরা এই গণ ঐক্যজোটের কোনো প্রতিফলন লক্ষ্য করিনি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে পৃথকভাবে আবদুল মালেক উকিল ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে অংশ নেয়। এমনকি ন্যাপ (মো:), একতা পার্টি, জাসদ, যারা একসময় মিত্র ছিল আওয়ামী লীগের, তারাও আলাদাভাবে নির্বাচন করে। আওয়ামী লীগের মালেক গ্রুপ ২৯৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয় ৩৯টিতে (ভোটের হার ২৪.৫৬ শতাংশ); আর মিজান গ্রুপ ১৮৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয় মাত্র দুটিতে (০.৬৬ শতাংশ)। ন্যাপ (মো:) এক আসন (২.২৪ শতাংশ ভোট), জাসদ ৮ (৪.৮৩ শতাংশ ভোট) আসন পায়। এখানে লক্ষণীয়, মুসলিম লীগ ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামী) ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ২৬৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২০টিতে বিজয়ী হয় (১০.০৭ শতাংশ ভোট)। তারা ওই সময় নবগঠিত বিএনপির সঙ্গে কোনো ঐক্য করেনি। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। কোনো ফ্রন্টও গঠিত হয়নি। মজার ব্যাপার, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (৭৬ আসন, ২৬.১৬ শতাংশ ভোট), জামায়াতে ইসলামী (১০ আসন, ৪.৬১ শতাংশ ভোট), যুক্ত ন্যাপ (৫, ১.২৯ শতাংশ ভোট), সিপিবি (৫, ০.৯১ শতাংশ ভোট) ও ন্যাপ (মো:) (২, ০.৭১ শতাংশ ভোট) অংশ নিয়েছিল। কিন্তু কোনো জোট করেনি।
পরিবর্তিত রাজনীতির আলোকে পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯১ সালে, যা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এই নির্বাচনের আগে ও পরে জোটের রাজনীতি নয়া রূপ পায়। বিএনপি ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়, বিজয়ী হয় ১৪১টিতে (ভোট ৩০.৮১ শতাংশ)। আর আওযামী লীগ প্রার্থী দেয় মাত্র ২৬৪ আসনে (৮৮ সিট, ৩০.০৮ শতাংশ ভোট), বাকি আসন সিপিবি, ন্যাপ ও বাকশাল প্রার্থীদের ছেড়ে দেয়। জামায়াতে ইসলামী ২২২ আসনে প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী হয় ১৮টিতে (১২.১৩ শতাংশ)। জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ২৭২ আসনে প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী হয় ৩৫টিতে (১১.৯২ শতাংশ ভোট)। আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়ে বাকশাল পাঁচ আসনে (১.৮১ শতাংশ ভোট), সিপিবি পাঁচ আসন (০.১৯ শতাংশ ভোট) বিজয়ী হয়েছিল। নির্বাচনের পর সরকার গঠন প্রশ্নে বিএনপি জামায়াতের সমর্থন নিয়েছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যাদের সমর্থন দিয়েছিল, তাদের নিয়েও কোনো ঐক্যজোট করেনি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচন নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই প্রথমবারের মতো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবার আর আওয়ামী লীগ কোনো আসন ছাড়েনি। আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৪৬ আসনে বিজয়ী হয় (৩৭.৪৪ শতাংশ ভোট)। অন্যদিকে তাদের মিত্র বলে পরিচিত জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ২৯৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পায় ৩২ আসন (১৬.৩৯ শতাংশ ভোট)। অন্য 'মিত্ররা' কোনো আসন পায়নি। বিএনপি ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পায় ১১৬ আসন (৩৩.৬১ শতাংশ ভোট)। তাদের 'মিত্র' জামায়াতে ইসলামীও ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পায় মাত্র ৩ আসন (৮.৬১ শতাংশ ভোট)। দৃশ্যপট আবারও পাল্টে যায় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০০১ সালে। এবারে বিএনপি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে (শরিক জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি (নাজিউর)। বিএনপি প্রার্থী দেয় ২৫২ (বিজয়ী ১৯৩, ৪০.৯৭ শতাংশ ভোট), জামায়াত প্রার্থী দেয় ৩১ (বিজয়ী ১৭, ৪.১৮ শতাংশ), ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী ছিল ৭ (বিজয়ী ২, ০.৬৮), আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিল ১১ (বিজয়ী ৪, ১.১৮ শতাংশ ভোট)। চারদলীয় জোট মোট ৪৭ শতাংশ ভোট পায়। আওয়ামী লীগ সব আসনে প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী হয় ৬২টিতে (৪০.১৩ শতাংশ প্রাপ্ত ভোট)। জাতীয় পার্টির (এরশাদ) নেতৃত্বাধীন ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ২৮১ আসনে প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী হয় ১৪টিতে (৭.২৫ শতাংশ)। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দৃশ্যপট আবার ভিন্ন (২০০৮)। চারদলীয় জোট জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে ৩৩ আসনে বিজয়ী হয় (জামায়াত ২ ও বিজেপি ১ আসনসহ)। বিএনপির একক আসন ছিল ৩০, প্রাপ্ত ভোট ৩২.৪৫ শতাংশ । জামায়াতের ৪.৬০ ও বিজেপির ০.২৬। এই জোটে এখন এলডিপি (১ আসন), শরিক (০.২৭ শতাংশ)। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আসন ২৩১ (৪৮.০৬ শতাংশ ভোট)। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির (এরশাদ) আসন ২৬ (৭.০৫ শতাংশ), জাসদের ৩ (০.৭৪ শতাংশ), আর ওয়ার্কার্স পার্টির ২ (০.৩৮)।
জোট রাজনীতির এই যে চিত্র তাতে দেখা যায় : (১) এ দেশের রাজনীতিতে দুটি ধারা স্পষ্ট। একটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, অন্যটি বিএনপির নেতৃত্বে; (২) মূলত চারটি দল বার বার সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। এককভাবে এদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। দুটি বড় দলের বাইরে রয়েছে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ও জামায়াতে ইসলামী। তবে এদের একার পক্ষে কোনো জোটের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়; (৩) এদের বাইরে সংসদে জাসদ, ওয়ার্কার্স, এলডিপির অস্তিত্ব রয়েছে সত্য। কিন্তু জোটের প্রার্থী না হলে নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করলে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সংসদের বাইরে যে রাজনীতি, সেখানেও এই রাজনীতি প্রতিফলিত হয়। জাতীয় পার্টি (এরশাদ) এখনো একটি আঞ্চলিক দল, আর জামায়াতের ভোট ব্যাংক মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ। আগামী রাজনীতি তথা সংসদ নির্বাচনে এই জোটের রাজনীতি প্রতিফলিত হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির নেতা এইচ এম এরশাদ এককভাবে নির্বাচনের কথা বললেও চূড়ান্ত বিচারে তিনি মহাজোটেই থাকবেন। আর বেগম জিয়া জামায়াতের প্রশ্নে বড় ধরনের 'ডায়লামা' 'ফেস' করছেন। বিজয় দিবসে জামায়াতকে দাওয়াত না করা এক ধরনের স্ট্রাটেজি। শেষ অব্দি তিনি সংসদকেন্দ্রিক চারদলীয় ঐক্য ধরে রাখবেন। নির্বাচন প্রশ্নে কাদের সিদ্দিকী ও আ স ম আবদুর রবের সঙ্গে তাদের একটি ঐক্য হতে পারে। তৃতীয় একটি জোটের কথা বলা হলেও এ জোট গঠিত হবে বলে মনে হয় না। এককভাবে কোনো একটি দলের পক্ষে সংসদ কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব হবে না। দুটি বড় দলকেই এখন ও আগামীতে জোট রাজনীতির ওপর নির্ভর করতে হবে।
Daily Kalerkontho( Rajniti)25.12.12

বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ কী


পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য বিশ্বব্যাংক যে তদন্ত প্যানেল গঠন করেছিল, তারা অনেকটা নিরাশ হয়েই ফিরে গেছে। দুদকের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পরও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে দুর্নীতির মামলায় আসামি না করায় একরকম হতাশা নিয়েই তারা ফিরে গেল। পদ্মা সেতুতে \'দুর্নীতির ষড়যন্ত্র\' হয়েছে বলে দুদক স্বীকার করে নিয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে এখন আইনি ব্যবস্থা নেবে দুদক। অভিযুক্তদের সংখ্যা ৮ থেকে ১০ জনের মধ্যে থাকলেও সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের নাম তাতে না থাকায় বিশ্বব্যাংকের টিম তা সহজভাবে নিতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক দলের অভিমত ছিল, যেহেতু এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা ঢাকায় সাবেক মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন, সেহেতু তাকে অভিযুক্ত করা যায়। এ বক্তব্য দুদকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক টিমের \'ফিরে যাওয়া\' এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক. পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের বিষয়টি এখন ঝুলে গেল। বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত নিতে আরও সময় নেবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক এ প্রকল্প বাতিল ঘোষিত হলে আমি অবাক হব না। দুই. বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় এডিবি ও জাইকার প্রতিশ্রুত অর্থও পাওয়া যাবে না। উল্লেখ্য, ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুতি দেওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি ডলার। সেই সঙ্গে এডিবি ও জাইকার প্রতিশ্রুতি ছিল যথাক্রমে ৬১ কোটি ও ৪০ কোটি ডলার। তিন. কানাডার এসএনসি-লাভালিন কোম্পানির বিরুদ্ধে \'ঘুষের বিনিময়ে\' কাজ নেওয়ার অভিযোগে ওন্টারিও প্রদেশে একটি মামলা হয়েছে। মামলার আগামী তারিখ ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল। এ তারিখটির দিকেও দৃষ্টি থাকবে এখন অনেকের। চার. অর্থমন্ত্রী পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়ে যায়নি বলে মন্তব্য করলেও বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক ফিরে আসুক বা না আসুক সেটা ভিন্ন প্রশ্ন; কিন্তু বিশ্বব্যাংক যেসব প্রকল্পে সাহায্য দিচ্ছে, তার কী হবে?
মোট ৩৪টি প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে পদ্মা সেতুতে অর্থ সহায়তার পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি ডলার। এখন পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় অন্যান্য প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থ ছাড়করণে কিছুটা শ্লথগতি আসে। বিদায়ী অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ৫০ কোটি ডলার। অথচ বিশ্বব্যাংক প্রতি বছর ১০০ কোটি ডলার সহায়তা বাড়ানোর কথা বলেছিল। পদ্মা সেতু ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্থাটি হতাশা প্রকাশ করেছে, সেগুলো হচ্ছে ঢাকা পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প (১৪৯ মিলিয়ন ডলার, শুরু ২০০৯ সালে), সামাজিক বিনিয়োগ প্রকল্প-২ (১১৫ মিলিয়ন ডলার), উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি প্রকল্প (৮১ মিলিয়ন ডলার), চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প, সিদ্ধিরগঞ্জ পিকিং পাওয়ার প্লান্ট, বিশুদ্ধ বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ প্রকল্প, ঘূর্ণিঝড় পুনর্বাসন প্রকল্প, ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড চিলড্রেন অ্যাট রিস্ক প্রকল্প, পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প, সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম ইত্যাদি। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অর্থ ছাড়করণের পরিমাণ খুবই কম। দুর্নীতি ছাড়াও অদক্ষতা, কাজে শ্লথগতির কারণেও বিভিন্ন সময় বিশ্বব্যাংক অভিযোগ উত্থাপন করেছে। হাইটেক পার্কে চলাচলের সুবিধার জন্য ঢাকা-কালিয়াকৈর শাটল রেলপথ নির্মাণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক ৫৫০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। একটি এমওইউ স্বাক্ষরিতও হয়েছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুর ঘটনার পর বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পের অর্থায়নও স্থগিত করেছে। এখন কোনো প্রকল্পেই বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় দিচ্ছে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার \'লেভারাইজিং আইসিটি ফর গ্রোথ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স\' প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। এতে ৩০ হাজার মানুষকে প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন করে গড়ে তোলা হবে। এ পরিকল্পনায় সরকারের সঙ্গে ৫০৯ কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য দেওয়ার একটি চুক্তি সই করেছিল বিশ্বব্যাংক। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে এ প্রকল্পের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং গত ফেব্রুয়ারি মাসে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা। এখন জটিলতা তৈরি হওয়ায় এ প্রকল্পটিও ঝুলে গেল। অথচ ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এ প্রকল্পের খুবই প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই আইসিটি ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান বিশ্বে খুব ভালো নয়। ইউএনডিপি বিশ্বব্যাপী আইসিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের র‌্যাংকিং বা তালিকা করে। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩ নম্বরে। এ তালিকা আরও উন্নত করতে হলে ইন্টারনেট কানেকটিভিটি খুবই দরকার। কিন্তু এ কানেকটিভিটি কাজে লাগাতে দরকার প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, যা আমরা ওই প্রকল্পের আওতায় তৈরি করতে পারতাম। এখন আমরা ওই প্রকল্প নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলাম।
বিশ্বব্যাংকের সাহায্য নিয়ে অনেক কথা আছে। গরিব দেশ বলে বিশ্বব্যাংক বিনা সুদে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রায় সাহায্য দেয় না। সুদে-আসলে তা তুলে নেয়। বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য দিয়েই নিজেরা টিকে আছে। তবে তুলনামূলক বিচারে তাদের সুদের পরিমাণ কম এবং পরিশোধের সময়সীমাও দীর্ঘ। যেমন পদ্মা সেতুতে তাদের সুদের পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ৭৫ ভাগ। অন্যদিকে মালয়েশিয়া কিংবা অন্য কোনো বাণিজ্যিক ঋণের মাধ্যমে সেতু নির্মিত হলে সুদের হার হবে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। উপরন্তু দীর্ঘ সময় তাদের টোল আদায়ের সুযোগ দিতে হবে। আর ঋণের টাকা তুলতে তারা অতিরিক্ত টোল আদায় করবে, যাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে কথা থাকলেও সহজলভ্যতা ও সুদের হার কম হওয়ায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক ২৫১টি প্রকল্পের বিপরীতে ১ হাজার ৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থায়ন করেছে। এখন পর্যন্ত এ সংস্থার ১ হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অপরিশোধিত রয়েছে। বর্তমানে ৩৪টি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের মোট ৪৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। যদিও খুব কম ক্ষেত্রে এবং বিশেষ কোনো কারণ না থাকলে বিশ্বব্যাংক সাধারণত অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় না। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে_ সন্দেহ নেই। এতে বাকি প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে একটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেও সরকারের আচরণের ওপরই এখন সবকিছু নির্ভর করছে। আমরা বিশ্বব্যাংককে যত বেশি সমালোচনা করব, তত তিক্ততা সৃষ্টি হবে। তা ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না।
বাংলাদেশের দুর্নীতির বিষয়টি এখন বিশ্ব আসরে আলোচনার অন্যতম বিষয়। গত ৬ ডিসেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতি বিষয়ক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। ওই রিপোর্টে দুর্নীতিতে ২৪ ধাপ অবনতির কথা বলা হয়েছে। টিআইর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৩। টিআইর রিপোর্টটি এলো এমন এক সময়ে, যখন পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দুদকের আলোচনা ভেস্তে গেল। দুদকের কাছে ব্যক্তি আবুল হোসেন প্রাধান্য পেল; প্রাধান্য পেল না দেশের স্বার্থ। বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক দলের নাখোশ হয়ে ফিরে যাওয়া বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উদ্ধারে কোনো সাহায্য করবে না। বৈদেশিক সাহায্য, বিনিয়োগ, জিএসপি সুবিধা_ অনেক কিছুই এখন নির্ভর করে দেশটি কতটুকু দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারছে তার ওপর। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। দেশটির সম্ভাবনা আছে; কিন্তু দুর্নীতির কারণে আমাদের সব অর্জন ও সম্ভাবনার মৃত্যু হতে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক টিমের হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়া আমাদের জন্য আগামীতে কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না।
Daily Manobkontho
23.12.12

সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই


অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। যাদের এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি নেই, তারাই এখন এমফিল ডিগ্রি দিচ্ছে, পিএইচডি ডিগ্রি দিচ্ছে। এটি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাহিনী। উচ্চশিক্ষা আজ কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে, তা বোঝার জন্য এই একটি সংবাদই যথেষ্ট। আমরা এতদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে হাজারো প্রশ্ন রেখেছি। আমি নিজে একাধিকবার একাধিক প্রবন্ধে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সবক’টি নয়) সার্টিফিকেট বাণিজ্য নিয়ে লিখেছি। এখানে যে যুক্তি নেই, তা বলা যাবে না, যুক্তি আছে। সংবাদপত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে যেসব সংবাদ নিত্য প্রকাশিত হয়, তাতে করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। আমি মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য থাকার সুবাদে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আউটার ক্যাম্পাস’ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। মিডিয়ার সমর্থন আমি পেয়েছিলাম। কীভাবে সার্টিফিকেট ব্যবসা হয়, তার হাজারটা নজির আমার কাছে ছিল। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে আমার কখনো আগ্রহ তৈরি হয়নি। কিন্তু এখন কী দেখছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন তরুণ শিক্ষক তার পিএইচডি গবেষণায় ১৩ লাখ লোকের ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন! যিনি এই থিসিস তত্ত্বাবধান করলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক। যিনি এই থিসিস পরীক্ষা করলেন, তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যার নিজেরই পিএচডি ডিগ্রি নেই। সিন্ডিকেটে কেউ প্রশ্ন করল না এভাবে ১৩ লাখ লোকের ইন্টারভিউ নিয়ে কোনো গবেষণাকর্ম সম্পাদন করা যায় না? সংবাদপত্রে এই সংবাদটি প্রকাশিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন-এ রকমটি আমাদের জানা নেই। এখন এলো এই সংবাদটি-জাবিতে যাদের পিএইচডি ডিগ্রি নেই, তারাই এখন পিএইচডি ডিগ্রি দেবে। প্রাসঙ্গিকভাবে একটা কথা বলা প্রয়োজন আর তা হচ্ছে যে বিভাগে এই তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে, সেখানে এর আগের বছর এমফিল/পিএইচডি কোর্সে ছাত্র ভর্তি করানো হয়েছে। যখন ওই বিভাগে ওইসব কোর্সের জন্য কোনো সিলেবাসই ছিল না। বিষয়টি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে আলোচিত হলেও শেষ পর্যন্ত ভিসি মহোদয় অবৈধভাবে তার অনুমোদন দিয়েছিলেন। এটাও কী সম্ভব? সিলেবাস নেই অথচ ছাত্র ভর্তি করানো হয়েছে! রাজনৈতিক বিবেচনায় এতদিন আমরা শিক্ষক নিয়োগের কথা শুনেছি। এখন শুনলাম এবং দেখলাম রাজনৈতিক বিবেচনায় পিএইচডি ও এমফিল কোর্সেও ছাত্র ভর্তি করানো হচ্ছে। যিনি কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি, তাকেও রাজনৈতিক বিবেচনায় উচ্চতর কোর্সে ভর্তি করানো হয়েছে। এটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাহিনী। ধারণা করছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের হাজারটা ‘কাহিনী’ আছে, যার অনেকই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমফিল ও পিএচডি ডিগ্রি নিয়েও আরো কাহিনী আছে। প্রতিবছরই আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরে প্রচুর ছাত্র এমফিল ও পিএইচডিতে ভর্তি হচ্ছে। এসব ছাত্রের একটা অংশ আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো রকমে একটা ‘ডিগ্রি’ নিয়ে তারা ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগরে এবং তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বেছে নেন এমন কিছু শিক্ষককে, যারা নিয়মিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন। পুলিশের শীর্ষস্থানীয় অফিসার, সেনাবাহিনীর জেনারেল, হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, সচিব বা অতিরিক্ত সচিব মর্যদার কর্মকর্তা তারাও পিএইচডি করছেন এবং ডিগ্রিও পেয়ে যাচ্ছেন। এটা কীভাবে সম্ভব আমি বুঝে উঠতে পারি না। কেননা পিএইচডি হচ্ছে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকর্ম। ছাত্রকে নিয়মিত লাইব্রেরিতে কাজ করতে হয়। ফিল্ডওয়ার্ক করতে হয়। কাজটি খুব সহজ নয়। একজন পুলিশের এডিশনাল আইজি পদমর্যাদার লোক কিংবা একজন সচিবের কি সেই সময় থাকে লাইব্রেরিতে যাওয়ার? লাইব্রেরিতে না গেলে, ফিল্ডওয়ার্ক না করলে তিনি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবেন কীভাবে? এখানেই এসে যায় শুভঙ্করের ফাঁকি। কোনো মতে তত্ত্বাবধায়কের উদ্যোগে একটা গবেষণাকর্ম উপস্থাপন করা হয়। বহিস্থ পরীক্ষক ‘নির্ধারণ’ করাই থাকে। ডিগ্রিটা হয়ে যায়। বিভাগগুলোর নাম উল্লেখ করলাম না। এতে করে আমার সহকর্মীরা বিব্রত হতে পারেন। কিন্তু আমি চাই পিএইচডি কোর্সের ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হোক নতুবা আগামী দিনগুলোতে জাহাঙ্গীরনগরের পিএইচডির মান নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দেবে।
প্রসঙ্গক্রমে একটা থিসিসের কথা বলি। অনেকটা ‘রাজনৈতিক চাপ’-এ তত্ত্বাবধায়ক চূড়ান্ত রিপোর্টটি দিতে বাধ্য হন। যেখানে নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি অধ্যায়ের বিশ্লেষণ করে সব শেষে পিএইচডির জন্য সুপারিশ করার কথা, সেখানে তত্ত্বাবধায়ক দুই লাইনে শুধু লিখলেন জবপড়সসবহফবফ, অর্থাৎ সুপারিশ করা হলো। কলা ও মানবিকী অনুষদের ওই থিসিস নিয়েও নানা কথা আছে। অত্যন্ত সতর্কভাবেই তত্ত্বাবধায়ক এই কাজটি করলেন। কেননা তিনি জানতেন তিনি নিজে ‘বিতর্কিত’ হবেন। তাই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তিনি কাজটি করলেন। এটা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বরখেলাপ। এটা নিয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ক্ষমতাবান ওই শিক্ষকের থিসিসের তদন্ত করবে কে? আরো মজার কাহিনী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো থিসিস বিদেশে কোনো পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হয় না। অথচ ঢাকা কেন কুষ্টিয়ার খোদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিস বিদেশে পাঠানো হয় পরীক্ষার জন্য। পিএইচডি ডিগ্রি হচ্ছে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা। এই থিসিস একাধিক পরীক্ষককে দিয়ে পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ‘স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর’ করতে চান। কথাটা শুনতে ভালোই শোনায়। কিন্তু তার বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে অনিয়ম হচ্ছে, তা যদি তিনি রোধ করতে না পারেন, যদি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন, তাহলে তিনি নিজেই বিতর্কিত হয়ে যাবেন, যা আমরা চাই না। তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় নানা কাহিনীর জন্ম দিচ্ছে। একজন বিতর্কিত ও যৌন অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত শিক্ষককে তিনি পদোন্নতি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষকদের বাধার মুখে তিনি পারেননি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীরা (ভিসি নিজেও এই মতবাদের সমর্থক) এর প্রতিবাদ করেছেন। আর বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা সমর্থন করলেন যৌন অপরাধী ওই শিক্ষককে, ভিসি নিজে আবার আওয়ামী ঘরনার শিক্ষক। কী বৈসাদৃশ্য! বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা সমর্থন করছেন আওয়ামীপন্থি বিতর্কিত এক শিক্ষককে! এটা কোন রাজনীতি? এই রাজনীতি যে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার মানের অবনতি ঘটাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে বিতর্কিত করার একটি কৌশল। জাতির সামনে তাকে হেয় করার একটি অপচেষ্টা।
২০১০ সালের ১৫ এপ্রিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক শিক্ষিকা ভিসি বরাবর অভিযোগ করেন তাকে এক বিভাগের শিক্ষক যৌন নিপীড়ন করেছেন (যুগান্তর-১৭ নভেম্বর-২০১২)। এটা নিয়ে সারা ক্যাম্পাসে আন্দোলনের ঝড় বয়ে যায়। পরবর্তীকালে উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয় এবং অধ্যাপক খুরশিদা বেগমের নেতৃত্বাধীন কমিটি এর সত্যতা খুঁজে পায়। ওই বিতর্কিত ব্যক্তির শাস্তি হয়। কিন্তু মাত্র দু’বছরের মধ্যে বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা তার পদোন্নতির দাবি করে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে বিতর্কিত করতে চাচ্ছেন। এটা সুদূরপ্রসারি ষড়যন্ত্রের একটা অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়কে আবার অস্থিতিশীল করতে চায় একটি ‘শক্তি’। অনেকদিন থেকেই লক্ষ্য করছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে। প্রভাষকদের দিয়ে মাস্টার্স পর্যায়ে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। যেখানে প্রয়োজন অধ্যাপক পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ, সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রভাষক নিয়োগ করে নতুন নতুন বিভাগ চালানো হচ্ছে। এতে করে শিক্ষার মান কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে, এটা নিশ্চয় অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন উপলব্ধি করতে পারবেন। যেখানে অধ্যাপক নেই অথবা মাত্র একজন অধ্যাপক আছেন এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক নেই, সেইসব বিভাগে এমফিল ও পিএইচডি কোর্স চালু না করাই মঙ্গল। উপাচার্য মহোদয় বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারেন। ‘স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর’ বাস্তবায়ন করতে হবে একাডেমিক মান বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন বিভাগে একাডেমিক অনিয়ম যদি তিনি বন্ধ না করেন, তাহলে অচিরেই জাবির উচ্চশিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়বে। আমরা চাই না অধ্যাকে হোসেন বিতর্কিত হন।
উচ্চশিক্ষা নিয়ে যখন লিখছি, তখন এলো আরো দুটি সংবাদ। প্রথম সংবাদটি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে। সেখানে ‘পলিটিক্যাল সায়েন্স স্টাডিজ’ বিভাগে প্রভাষক নিয়োগের নির্বাচনী বোর্ড ছিল। ওই নির্বাচনী বোর্ডে বিশেষজ্ঞ ছিলেন দু’জন বিতর্কিত অধ্যাপক। তারা বিতর্কিত এক প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে চাইলে উপাচার্য মহোদয় তাতে সম্মতি দেননি। নিঃসন্দেহে এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে শিক্ষার মানের যথেষ্ট অবনতি হয় এবং উচ্চশিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়ে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন। এর আগের নির্বাচনী বোর্ডে তিনি যদি যোগ্য শিক্ষকদের নিয়োগ দিতেন, তাহলে তার সম্মান বাড়তো বৈ কমত না। শিক্ষার মানোন্নয়নের সঙ্গে নতুন অনুমোদনপ্রাপ্ত ৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গটিও এসে গেল। এই নিয়ে মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ালো ৭১টিতে। এই সরকারের আমলে অনুমোদন পেয়েছে ১৬টি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক বিবেচনা’ প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। দেশে ইতিমধ্যে ৩৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এখন কারা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন? খোদ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেখানে অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব রয়েছে, সেখানে নতুন ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষক পাবে কোথায়? কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো এক একটা কলেজ! রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পাস করে এখন পড়াচ্ছেন ইংরেজি। আইন অনুষদের শিক্ষক না হয়েও পড়াচ্ছেন আইন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা আইন পড়াচ্ছেন, তাদের আইনের ডিগ্রি বেসরকারি আইন কলেজ থেকে, তাও আবার নাইটে পড়ে। অনলাইনে তথাকথিত পিএইচডি ডিগ্রি করে হুট করে ঢুকে যাচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অথচ অনলাইনের ডিগ্রির যে কোনো মূল্য নেই, তা তারা হয় জানেন না অথবা বোঝেন না। পুণ্ড্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা টিএমএসএস নামের একটি এনজিও। টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক নিজেকে পরিচয় দেন অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম। এই ভুয়া পিএচইডিধারী ও অধ্যাপক পদের অপব্যবহারকারীকে আমি সতর্ক করেছিলাম পুণ্ড্র বিশ্ববিদ্যালয়ে (বগুড়া প্রস্তাবিত) পরিদর্শনে গিয়ে। তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। তিনি দিব্যি পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করছেন। তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজটি কী? আমাদের শিক্ষা সচিব পিএইচডি ডিগ্রির অব্যাবহার সম্পর্কে কী জ্ঞাত নন? এমন অসংখ্য ভুয়া পিএচইডিতে ভরে গেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এসব কে দেখবে? বলা হয়েছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নির্ণয়ের জন্য একটি ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ গঠিত হবে। আজ অবধি তা হলো না। আদৌ হবে কি-না কিংবা কাদেরকে নিয়ে এই কাউন্সিল গঠিত হবে, সে ব্যাপারেও প্রশ্ন থেকে যায়। এখানেও যদি রাজনীতি ঢুকে যায়, উচ্চশিক্ষার ধস আমরা ঠেকাতে পারব না। আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘ডাটাবেজ’ তৈরি করার। সে পরিকল্পনাও এখন ‘ডিপফ্রিজে’। তাহলে উচ্চশিক্ষার ধস ঠেকাবে কে? শিক্ষামন্ত্রী বারবার শিক্ষার মান উন্নয়নের কথা বলেন। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ আছে। আপনি ‘ভূত’ তাড়বেন কীভাবে? ইউজিসির চেয়ারম্যান নিজেকে ‘প্রতিমন্ত্রী’ হিসেবে পরিচয় দিতে ‘গর্ববোধ’ করেন অথচ তার অনেক কিছু করার কথা। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য যে নেতৃত্বের দরকার, তা তার নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, ইউজিসিতে যারাই আসেন, তারা সবাই  মধ্য ষাটের ঘরে। এদের দিয়ে পরিবর্তন সম্ভব নয়। জাবির একটি ছোট ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমরা উচ্চশিক্ষাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? সতর্ক হওয়ার ও সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। সব কিছুতেই যদি ‘রাজনীতি’ খুঁজি, তাহলে আমরা আগামী দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ব। আজ দেশের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে এক হওয়া প্রয়োজন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ন্যায়সঙ্গত। অন্তত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে আমি এটাই প্রত্যাশা করি।
Daily Manobkontho
23.12.12

কোন পথে বাংলাদেশ?


গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকা অবরোধ, ১১ ও ১৩ ডিসেম্বর সকাল সন্ধ্যা ও অর্ধবেলা হরতালের পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে কোন পথে এখন বাংলাদেশ? হরতালের সময় ছাত্রলীগের ক্যাডারদের সহিংস তৎপরতার ছবি, বিশেষ করে ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকাণ্ডের পর স্পষ্টতই আমি বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতি নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। অবরোধ আর হরতালের সময় যে চিত্র আমি দেখেছি, তা আমাকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের সেই ‘লগি-বৈঠার’ ভয়াবহ দৃশ্যের কথা। ঢাকায় বিশ্বজিৎ আর সিরাজগঞ্জে ওয়ারেস আলীর হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে গাঁথা। বিশ্বজিৎ নিজেকে একজন ‘হিন্দু’ ও অরাজনৈতিক কর্মী হিসেবে পরিচয় দিলেও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা তাঁকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। পত্রিকায় সেই হত্যাকাণ্ডের ছবি ছাপা হয়েছে। বলা হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা মাহফুজুর রহমান নাহিদ ও নূরে আলম লিমনের নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়। দৈনিক যায় যায় দিন-এর ১০ ডিসেম্বরের প্রথম পাতার পাঁচ কলামের ছবি আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে অতীত দিনের কথা। ছাত্রলীগ নামধারী কত বড় সন্ত্রাসী হলে কুপিয়ে একজন সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে পারে। বিশ্বজিৎ রাজনীতি করতেন না। কোনো দলের সমর্থক তেমনটিও নয়। একজন দর্জি, সাধারণ মানুষ, তাঁকে প্রাণ দিতে হলো সন্ত্রাসীদের হাতে। আর সিরাজগঞ্জের জামায়াত কর্মী ওয়ারেস আলীকে প্রাণ দিতে হলো ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে।
১০ ডিসেম্বর প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের যে ছবি ছাপা হয়েছে, তা আমাদের এক ভয়ঙ্কর বাংলাদেশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় একজন মহিলা আইনজীবী লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। আর একই দিন (৯ ডিসেম্বর)  প্রধানমন্ত্রী ‘রোকেয়া দিবস’-এ নারীর অধিকার সংরক্ষণের কথা বললেন। কী বৈসাদৃশ্য। ওসমানী মিলনায়তন থেকে জজকোর্ট খুব বেশি দূরে নয়। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেগম রোকেয়ার স্মরণ সভায় প্রধানমন্ত্রী যখন নারী জাতির অধিকারের কথা বলছেন, ঠিক একই সময় তার ‘সোনার ছেলেরা’ একজন মহিলা আইনজীবীকে মাটিতে ফেলে পেটাচ্ছে! দৈনিক আমার দেশে ছাপা হওয়া সেই ছবি কী প্রধানমন্ত্রী দেখেছেন! এ কেমন নারী অধিকার! ওই একই দিন প্রতিটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সাবেক এমপি নাজিউদ্দিন আলমের রক্তাক্ত ছবি। কপাল ভালো গুলিতে তিনি আহত হয়েছেন। মারা যাননি। সিরাজগঞ্জের ওয়ারেস আলীর মতো তিনি মারা যেতে পারতেন! জনাব আলম শীর্ষনেতা বিএনপির। তাকে পুলিশ চিনবে না, কিংবা ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা তাকে চিনবে নাÑ এটা আমি বিশ্বাস করি না। তাঁকে চিনেই তার ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য একটাইÑ নৈরাজ্য সৃষ্টি করা, একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে করে মানুষ প্রতিবাদী না হয়, রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ না করে।
যারা বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে, তাদের নাম-ধাম ও ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। যারা গুলিতে নাজিম উদ্দিন আলমকে আহত করেছে কিংবা ওয়ারেস আলীকে হত্যা করেছে, তারাও পরিচিত। কিন্তু পুলিশ তাদের মাঝে দুইজনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতার করেছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। সিটি কর্পোরেশনের আবর্জনা পরিবহনের গাড়ি নাকি তিনি ভাঙচুর করেছেন। মির্জা ফখরুলের মতো সিনিয়র নেতা গাড়ি ভাঙবেন! এই ‘সংস্কৃতি’ আমরা আগেও দেখেছি। গাড়ি পোড়ানো, গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে আগেও মামলা হয়েছিল। তিনি তখন জেলও খেটেছিলেন। আবারো জেলে গেলেন। এর মধ্যে দিয়ে সরকার একটি ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ তৈরি করেছে। কিন্তু এসব করে কী সরকার পার পাবে! সরকার ইতোমধ্যে তার সমর্থকদের মাঠে নামিয়েছে। বিরোধী দলের প্রতি একটা পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এই  প্রবণতা ভালো নয়। এই প্রবণতা সহিংসতা বাড়াবে মাত্র। ঢাকা সফররত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লেকও এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির জন্য ভালো কোনো সংবাদ নয়। পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক পানি গড়াল। শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু ঝুলে গেল। বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ টিম অনেকটা হতাশ হয়েই ফিরে গেলেন। গেল সপ্তাহে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছিল। এটা বার্লিন ভিত্তিক একটা সংস্থা। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায় বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩ নম্বর। এ ধরনের একটি রিপোর্ট বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বহিঃর্বিশ্বে নষ্ট করে। কিন্তু সরকার এই রিপোর্টটিকে সিরিয়াসলি নেয়নি। উচিত ছিল এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য একটি কমিটি গঠন করা। কিন্তু সরকার তা করেনি। তা না করে বিরোধী দল, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সকল যন্ত্র ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির বিষয়টি একরকম ‘ওপেন সিক্রেট’। বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতির সকল রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। পদ্মা সেতু, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি গ্রুপের দুর্নীতি নিয়ে বলতে গেলে প্রতিদিনই আলোচনা হচ্ছে। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিসরে স্থান পেয়েছে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দুদকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, যেদিন টিআইবি প্রতিবেদনটি ঢাকায় প্রকাশিত হয়, সেদিনও সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে বিশ্বব্যাংকের ওই টিমটি লুই গাব্রিয়েল মোরেনোর নেতৃত্বে বাংলাদেশে এসেছিল, তারা অসন্তোষ নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেছে। দুদক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে (তাদের ভাষায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্র) যাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে, সেখানে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম নেই। অসন্তোষের এটাই মূল কারণ। বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ টিমের মতে কানাডার এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা একাধিকবার সাবেক মন্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন এবং ১০ পার্সেন্ট ঘুষ দাবির সাথে তার নামটি আছে, সেহেতু তাকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দেয়া যায় না। শুধুমাত্র পদ্মা সেতুতে ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে’র কথা কেন বলি, হলমার্ক কেলেঙ্কারির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন সরকারের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিরা। হলমার্কের  এমডিকে গ্রেফতার করা হলেও, অনেক ‘রাঘব বোয়াল’ই রয়ে গেছেন পর্দার অন্তরালে। হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারিতে সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা জড়িত থাকলেও সরকারি ব্যাংকগুলোতে এ ধরনের বড় দুর্নীতির ‘আরো খবর’ রয়েছে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। ডেসটিনির অর্থ কেলেঙ্কারির দায়ভারও সরকার এড়াতে পারে না। যদিও ওই কোম্পানির এমডি ও চেয়ারম্যান এখন জেলে। আর পর্দার অন্তরালে চলে গেছেন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা। অনেক দিন থেকেই রেন্টাল (ভাড়াভিত্তিক) ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্নীতি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হচ্ছে। দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। আর এ চাহিদা মেটাতে সরকার আশ্রয় নিয়েছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। মোট ৩২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে এ খাতে। অধিকাংশই ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল দিয়ে চালানো হয়। এ খাতে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয় সরকারকে। এখানেই রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ খাতে রাষ্ট্রের প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ থেকে মুনাফা লুটেছেন এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী, যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের সাথে জড়িত।
সুতরাং আজকে যখন টিআই’র প্রতিবেদনে বাংলাশেকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, তখন আমি অবাক হই না। কেননা বড় বড় দুর্নীতির জন্য ‘রাঘব-বোয়াল’রা জড়িত। এরা এতই ক্ষমতাবান যে আইনেরফাঁক ফোঁকড় দিয়ে এরা পার পেয়ে যান। এদেরকে কেউ ছুঁতে পারে না। শেয়ারবাজার থেকে অবৈধভাবে দশ হাজার কোটি টাকা ‘লুট’ হয়েছিল। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগে সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল, এই কমিটি দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু এর একজনের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। পাচার করা টাকাও ফেরত আসেনি।
পৃথিবীর সব দেশেই দুর্নীতি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও হয়, এমনকি চীনেও শীর্ষ পর্যায়ে দুর্নীতির খবর আমরা পত্র-পত্রিকা থেকে জেনেছি। আমাদের সাথে ওই দেশগুলোর পার্থক্য এখানেই যে, ওইসব দেশে দুর্নীতি যদি প্রমাণিত হয়, তার শাস্তি ভয়াবহ। চীনের একটি শহরের মেয়র দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের একজন আইন প্রণেতা দুর্নীতির অভিযোগে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে জেলে কাটিয়েছেন সারা জীবন। জার্মানির একজন সাবেক চ্যান্সেলর কোল দুর্নীতির অভিযোগে প্রমাণিত হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এমনকি ভারতের মতো দেশেও প্রচুর দুর্নীতি হয়। কিন্তু সেখানকার তদন্ত সংস্থা ও বিচার বিভাগ অত্যন্ত শক্তিশালী। প্রভাব খাটানোর কোনো সুযোগ নেই। মন্ত্রী হয়েও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে জেলে গেছেন, এ ধরনের সাবেক ও ক্ষমতাসীন মন্ত্রীর সংখ্যা অনেক। অস্বীকার করা যাবে না যে ভারত কিছুটা হলেও দুর্নীতিকে দমন করতে পেরেছে, যা  আমরা পারিনি। আমাদের আইনে দুর্নীতি সংক্রান্ত একাধিক ধারা রয়েছে। যেমন দুর্নীতির ষড়যন্ত্রমূলক অপরাধের জন্য রয়েছে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২০(খ), দুর্নীতির উদ্যোগ গ্রহণের জন্য দণ্ডবিধির ৫১১ ধারা, ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও পরস্পর যোগসাজশে অপরাধটি সংগঠনের জন্য দণ্ডবিধির ১০৯ নম্বর ধারা। এসব ধারায় দর্ুীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে বড় বড় দুর্নীতির ক্ষেত্রে সরকার তদন্ত কাজে প্রভাব খাটায়। তদন্ত কর্মকর্তারা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায়, তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেন না। তাদের চাকরির ভয় থাকে। ট্রান্সফারের ভয় থাকে। অনেক সময় ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের উদ্দেশ্যে’ তদন্তকাজ প্রভাবিত হয়। যে কারণে দেখা যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শাস্তি পান না। অথবা এমনভাবে তদন্ত রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয়, যা দিয়ে উচ্চ আদালতে দুর্নীতির প্রমাণ করান যায় না। বাংলাদেশ বোধকরি পৃথিবীর কয়েকটি  দেশের মাঝে একটি, যেখানে বড় দুর্নীতি করেও অভিযুক্তরা পার পেয়ে যায়।
টিআই’র রিপোর্টে আমরা আবারো দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে প্রমাণিত হলাম। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের প্যানেল টিম হতাশ হয়েই বাংলাদেশ ছাড়লেন। এর অর্থ পরিষ্কার- বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে সম্ভবত অর্থায়ন করছে না। একজন ব্যক্তি এখানে প্রধান্য পেলেন। প্রাধান্য পেলো না অর্থায়নের বিষয়টি। সরকারের নীতি নির্ধারকরা এখন কী করবেন আমি জানি না। কিন্তু টিআই’র রিপোর্ট আর বিশ্বব্যাংকের প্যানেলের হতাশ হয়ে ফিরে যাবার ঘটনা আমাদের জন্য অনেক ‘খারাপ’ খবর অপেক্ষা করছে। দাতাগোষ্ঠী এখন আর বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবে না। বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। বাংলাদেশে সুশাসনের বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রাধান্য পাবে। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে যে জিএসপি সুবিধা চেয়েছিল তা আর পাবে না। ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ একাউন্ট’ থেকে সাহায্য পাবার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
এই যখন পরিস্থিতি তখন সরকারের উচিত ছিল বিরোধী দলের সাথে একটি সমঝোতায় যাওয়া। কিন্তু বিরোধী দলকে দমনের নামে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সরকার উৎসাহিত করছে, তা আমাদের জন্য ভালো কোনো সংবাদ বয়ে আনবে না। সরকার যদি কোনো ‘সংলাপ’ এ না যায়, তাহলে বিরোধী দলকে বাধ্য করবে আরো কঠিন কর্মসূচি দিতে। এখনও সময় আছে। একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যাপারে সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আমাদেরকে বড় ধরনের সঙ্কট থেকে উদ্ধার করতে পারে।
21.12.12

বদলে যাচ্ছে রাজনীতির দৃশ্যপট


বদলে যাচ্ছে রাজনীতির দৃশ্যপট। প্রথমে অবরোধ, তারপর দুদিন হরতাল। ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে মারা গেলেন সাধারণ একজন মানুষ, বিশ্বজিৎ দাস। বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যা করার ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ করেছে সংবাদপত্রগুলো। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফটোসাংবাদিকরা যেসব ছবি তুলেছেন, তা দেখে অাঁতকে উঠতে হয়। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে এভাবে মানুষকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় কি না, আমি জানি না। এই ঘটনা আমাকে ১৯৯৪ সালের আফ্রিকার একটি দেশ বরুন্ডির হুতু-তুতসির হত্যাকা-ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকা- নিয়েও প্রশ্ন আছে। ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তাদের কাউকে কাউকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, এ কথাটাই আমাকে শোনালো ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ। যেদিন বিশ্বজিতের হত্যাকা-ের ভয়াবহ ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল, সেদিনই রাতে একটি টিভি চ্যানেলে সোহাগের সঙ্গে আমি 'টকশো'তে অংশ নিয়েছিলাম। সোহাগ আমাকে দেখিয়েছিল কবে অভিযুক্তদের ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ওরা ছিল অনুপ্রবেশকারী। তবে বাস্তবতা হচ্ছে ছাত্রলীগের মিছিলে ওই অভিযুক্তরা অংশ নিয়েছিল। তখন তাদের কেন বাধা দেয়া হলো না? হরতালের আগে বা পরে এ ধরনের বিশ্বজিৎদের 'হত্যার' মতো ঘটনা ঘটে। অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। কখনই এ ধরনের হত্যাকা- বন্ধ হয়নি। অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে, সেটাওবা বলি কী করে? এবারেও হবে, সেই বিশ্বাসটাও রাখতে পারছি না। আশার কথা বিশ্বজিৎ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। বিশ্বজিতের হত্যার পাশাপাশি 'স্কাইপি স্ক্যান্ডাল' এখন রাজনীতিতে ঢেউ তুলেছে। যখন ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচার হচ্ছে এবং এই ডিসেম্বরেই একটি রায় যখন প্রত্যাশিত, ঠিক তখনই ঘটল এই 'স্কাইপি স্ক্যান্ডালে'র মতো ঘটনা। বিচারপতি নিজামুল হক ওই ঘটনায় পদত্যাগ করেছেন। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হয়েছে। বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন। নতুন একজন বিচারপতিও দায়িত্ব পেয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-২-এ। এর মধ্য দিয়ে বিচারকাজ অব্যাহত থাকবে। আইন অনুযায়ী বিচারকাজ থেমে থাকার বা নতুন করে শুরু করার কোনো সুযোগ নেই। এই বিচারকাজ নিয়ে প্রত্যাশা অনেক বেশি। বিচারপতি কবীর এখন ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান। এই ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর বিচারের যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। বিচারপতি কবীর এখন কী করবেন, এটা তার বিচারিক অধিকার। তবে তার জন্য নিঃসন্দেহে কাজটি সহজ নয়। ইতোমধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে সংবাদপত্রের ভূমিকা নিয়ে। একটি সংবাদপত্র বিচারপতি হকের স্কাইপি সংলাপ ফাঁস করে দিয়েছে। এটা সংবাদপত্র পারে কি না? এতে করে তো বিচারপতিদের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হলো। যতদূর মনে পড়ে ব্রিটেনের একটি সংবাদপত্র নিউজ অব দি ওয়ার্ল্ড একটি গোপন সরকারি তথ্য ফাঁস করে দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল। পরে কর্তৃপক্ষ পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলি। এই স্বাধীনতা যদি 'কোনো একজনের' বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সেই স্বাধীনতাকে আমরা কতটুকু সম্মান করব! অবশ্যই গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হচ্ছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। কিন্তু আমরা সেই স্বাধীনতা কতটুকু প্রয়োগ করব, এটা ভেবে দেখার বিষয়। নিশ্চই যারা বিষয়টি নিয়ে ভাবেন, তারা বিষয়টি পুনরায় বিবেচনায় নেবেন। বিচারপতি কবীর ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন। এই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম, মামলার ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। এখন বিচারপতির পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে থাকবে অনেকে। আরো একটা কথা। এটা বিজয়ের মাস। অনেকেরই প্রত্যাশা এই বিজয়ের মাসে অন্তত একজন অপরাধীর বিচার সম্পন্ন হোক। যারা অপরাধ করেছে, ইতিহাস যেমনি তাদের ক্ষমা করেনি ঠিক তেমনি বিচারেরও তারা ক্ষমা পাননি। রুয়ান্ডায় কিংবা সাবেক যুগোসস্নাভিয়ায় যারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিচার হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। একসময় লাইবেরিয়ার অত্যন্ত ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ও যুদ্ধবাজ চার্লস টেইলারের বিচার সম্পন্ন হয়ে আদেশও হয়েছে। আমরা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করেছি দীর্ঘ ৪০ বছর পর। নতুন আইনে আদালত হয়েছে। বিচারকাজ পরিচালিত হচ্ছে। এ জন্য সময়ের প্রয়োজন আছে। আমরা চাই একটা দৃষ্টান্তমূলক রায় হোক, যা যুগ যুগ ধরে জাতি স্মরণ করবে। এই বিজয়ের মাসে যেখানে আমরা উৎসব করব, সেখানে আমরা দেখছি এক হতাশার চিত্র। রাজনীতিতে যে পরস্পর বিশ্বাসের কথা বলে তা বাংলাদেশে নেই। হরতালের পর হরতাল হচ্ছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। গাড়ি ভাংচুর হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ মানুষের। এজন্য যত দ্রুত সম্ভব একটা 'সংলাপ' প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে রেখে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না বিরোধী দলের কাছে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এই 'আলোচনা' আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিতে পারে। বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের স্বার্থে এই স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। এখন যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে আদৌ কি 'সংলাপ' অনুষ্ঠিত হবে? সরকারি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বিএনপিকে সংসদে ফিরে গিয়ে একটা প্রস্তাব দেয়ার কথা বলেছেন। এর পেছনে আন্তরিকতা কতটুকু আছে বলতে পারব না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি এই 'প্রস্তাবকে বিবেচনায় নিয়ে সংসদে যেতে পারে এবং একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারে। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে প্রস্তাব দিয়েছে তা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে করা যায় তা তারা বলতে পারে। এটা এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে সংসদে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। বিএনপির সাংসদরা যাতে সংসদে থাকেন এ বিষয়টি দেখার দায়িত্ব সরকারি দলের সাংসদদের। সংসদে তাদের আচরণ, বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয় তা কাম্য নয়। সংসদে সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেশি। তারা সবাই মিলে যদি 'আক্রমণ' করেন সঙ্গতকারণেই বিএনপির সাংসদদের তা পেরে ওঠার কথা নয়। তবে এ মুহূর্তে সরকারি দলের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিএনপির সাংসদদের সংসদে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। প্রয়োজনে স্পিকার সাংসদদের জন্য একটি 'কোড অব কন্ডাক্ট' করতে পারেন। ২০১৩ সাল আমাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে নিয়ে আসতে পারে সরকার। কিন্তু কোনো ফর্মুলাই কাজ করবে না, যদি না বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করা যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে পদ ছাড়তে হবে। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেই নির্বাচনে অংশ নেবেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ১. প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে দুদলের ৫ জন করে সদস্য নিয়ে একটি সরকার, যারা আদৌ নির্বাচনে অংশ নেবেন না। ২. স্পিকারের নেতৃত্বে ৫ জন করে সদস্য নিয়ে একটি সরকার। স্পিকারসহ কেউই নির্বাচনে অংশ নেবেন না। ৩. সাংবিধানিক পদের অধিকারী এরকম তিনজনকে নিয়ে একটি সরকার, যারা নির্বাচনের পরপরই আর দায়িত্বে থাকবেন না নিরপেক্ষতার স্বার্থে। ৪. সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন বুদ্ধিজীবী নিয়ে একটি সরকার। এর বাইরেও আরো বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে মোটকথা হচ্ছে এই সরকারের বয়স হবে মাত্র ৩ মাস এবং তারা কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এখানে যে বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় নেয়া উচিত তা হচ্ছে মূলধারার দল বিএনপি বাদ দিয়ে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে এ দেশে নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু ওই নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিতে পারেনি। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক, আমরা এটাই প্রত্যাশা করব।Daily JAI JAI DIN20.12.12

আস্থাহীনতার রাজনীতি


আমাদের জাতীয় নেতাদের মাঝে আস্থাহীনতা কত প্রকট, বিজয়ের একচল্লিশ বছর পার করার পর সেটা আবারও প্রমাণিত হল। হরতালের সময় মারা গেলেন বিশ্বজিৎ দাস। যারা তাকে কুপিয়ে হত্যা করল, তারা ছাত্রলীগের কর্মী, হোক না বহিষ্কৃত। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে জল ঘোলা হল অনেক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা বললেন, হত্যাকারীরা অনুপ্রবেশকারী, কেউ কেউ শিবিরের সমর্থক! নিজেদের দোষ আমরা কেউ স্বীকার করতে চাই না। ছাত্রলীগের সবাই যে সৎ ছেলে, তা তো নয়। কিন্তু কী অবলীলায় আমাদের নেতারা বলে ফেললেন, বিশ্বজিতের হত্যাকারীরা শিবির কর্মী! দোষ স্বীকার করলে তো ক্ষতি ছিল না। কিন্তু আমরা দোষ চাপালাম বিরোধী পক্ষের ওপর। বিজয়ের একচল্লিশ বছর পার করার পরও দেখতে হল আমাদের রাজনীতিকরা সত্য কথা বলেন না। মতিয়া চৌধুরীকে আমি শ্রদ্ধা করি। সৎ ও ত্যাগী। রাজনীতির জন্য তিনি সবকিছুই ত্যাগ করেছেন। তিনি কিনা বললেন, ‘বেগম জিয়া জামায়াতের মহিলা আমীর’! এ কথাটা সাধারণ একজন কর্মীর মুখ থেকে শুনলে আমি অবাক হতাম না। কিন্তু সেই ব্যক্তিটি যদি হন মতিয়া চৌধুরী, আমি অবাক হই। তিনি মন্ত্রী। এক সময়ের জঙ্গি নেত্রী, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। আমরা যখন মধ্য সত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি, ততদিনে ছাত্র ইউনিয়ন ভাগ হয়ে গেছে। যারা মতিয়াপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, তারা ছিলেন ভদ্র, নম্র। ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থকদের আমরা কখনও উগ্র আচরণ করতে দেখিনি। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। তার সেই বিখ্যাত ‘ডুগডুগি তত্ত্ব’ আজও স্মরণ করেন কেউ কেউ। সেই মতিয়া চৌধুরী কালের পরিক্রমায় ‘সমাজতান্ত্রিক নীতি’ পরিত্যাগ করে মার্কিন রাজনীতি ঘেঁষা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে মিশে গেলেন। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম তার উত্থান। বেগম জিয়ার রাজনীতি তার পছন্দ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে কি তাকে ‘জামায়াতের মহিলা আমীর’ বলা ঠিক হবে? এ সংস্কৃতি কবে আমরা বদলে ফেলতে পারব? নতুন যে জেনারেশন নেতৃত্বে আসছেন, তারা কী শিখছেন সিনিয়র নেতাদের কাছ থেকে? একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘ হচ্ছে! একচল্লিশ পার করলাম। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উন্নতি করতে পারলাম না এতটুকুও!
হরতাল হতেই পারে। আগেও হয়েছে। ধারণা করছি আগামীতেও হবে। কিন্তু তাই বলে সহিংসতা কেন? কেন এ হত্যা? একজন বিশ্বজিতের খবর সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু এর আগেও হরতালে সহিংসতায় মানুষ মারা গেছে। মানুষ হত্যা বন্ধ হয়নি। উš§ত্ততা বন্ধ হয়নি। ওইদিন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সাবেক এমপি নাজিমউদ্দিন আলমের রক্তাক্ত ছবিও। কপাল ভালো, গুলিতে তিনি আহত হয়েছেন। মারা যাননি। জজকোর্ট এলাকায় বিশ্বজিৎ দাসের মতো তিনি মারা যেতে পারতেন! জনাব আলম শীর্ষ নেতা বিএনপির। তাকে পুলিশ চিনবে না, কিংবা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাকে চিনবে নাÑ এটা আমি বিশ্বাস করি না। তাকে চিনেই তার ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য একটাইÑ নৈরাজ্য সৃষ্টি করা, একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে করে মানুষ প্রতিবাদী না হয়, রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ না করে।
যারা বিশ্বজিতকে হত্যা করেছে, তাদের নাম-ধাম ও ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। যারা গুলিতে নাজিমউদ্দিন আলমকে আহত করেছে, তারাও সবাই পরিচিত। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে পুলিশ অভিযুক্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতার করেছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও। সিটি কর্পোরেশনের আবর্জনা পরিবহনের গাড়ি নাকি তিনি ভাংচুর করেছেন! মির্জা ফখরুলের মতো সিনিয়র নেতা গাড়ি ভাঙবেন! এ ‘সংস্কৃতি’ আমরা আগেও দেখেছি। গাড়ি পোড়ানো, গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে আগেও মামলা হয়েছিল। তিনি তখন জেলও খেটেছিলেন। আবারও জেলে গেলেন। এর মধ্য দিয়ে সরকার একটি ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ তৈরি করেছে। কিন্তু এসব করে কি সরকার পার পাবে? সরকার এরই মধ্যে তার সমর্থকদের মাঠে নামিয়েছে। বিরোধী দলের প্রতি একটা পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এ প্রবণতা ভালো নয়। এ প্রবণতা সহিংসতা বাড়াবে মাত্র। ঢাকা সফররত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেকও এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
এই যে আস্থাহীনতার রাজনীতি, এই রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমরা দেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চাই। কিন্তু কেউ আমরা বলছি না, যে রাজনীতির মধ্য দিয়ে আমরা বিজয়ের একচল্লিশ বছর পার করলাম, সেই রাজনীতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আমরা সে লক্ষ্যে কোনদিনই পৌঁছতে পারব না। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। ক্ষমতার বাইরে থাকলেও বিএনপি একটি শক্তি। ৯ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশ, ১১ ও ১৩ ডিসেম্বরের হরতাল তারাই ডেকেছিল। তথাকথিত ১৮ দলীয় জোটের শরিকরা তাদের সঙ্গে আছে। একমাত্র জামায়াত বাদে কারোরই কোন শক্তি নেই। দুটি বড় দলই এ জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুটি জোটের বাইরে তৃতীয় একটি জোট গঠনের কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে। ১৭ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকের খবর ছিল এটি। ওই খবরে বলা হয়েছে, ৪টি দল খুব শিগগিরই একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছে। এ চারটি দল হচ্ছে অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্প ধারা, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং আসম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি। খবরটি শীর্ষ সংবাদ হিসেবে ছাপা হলেও বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। এ চারটি দলই ব্যক্তিসর্বস্ব দল। অধ্যাপক চৌধুরী সৎ ও গুণী ব্যক্তি, সন্দেহ নেই তাতে। ১৮ দলীয় জোটে যোগ না দিলেও যুগপৎ আন্দোলনে তাদের সঙ্গে আছেন। ব্যক্তি বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছাড়া বিকল্প ধারার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন বড় জোট ছাড়া তিনি নিজে কিংবা তার ছেলে মাহি চৌধুরী আদৌ বিজয়ী হতে পারবেন কিনা সন্দেহ। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর এখন রাজনীতি থেকে অবসর নেয়া উচিত। তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার তো আর কিছু পাওয়ার নেই। তিনি নিশ্চয় ‘মোহাম্মদ উল্লাহ’ স্টাইলে আবার ভবিষ্যতে কোন মন্ত্রী হবেন না। তিনি জাতির অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেই ভালো করবেন। ড. কামাল হোসেন নিঃসন্দেহে ভালো লোক, সৎ এবং আন্তর্জাতিক সম্মান তার রয়েছে। তার নিজের সংসদীয় কোন আসন নেই। একবারই (১৯৭৩) বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেয়া আসনে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। তারপর আর তাকে সংসদে দেখা যায়নি। তার দল ছোট, তাও ভেঙে গেছে। এই দল নিয়ে কারও সঙ্গে যাওয়া কী না যাওয়ায় কিছু যায় আসে না। ব্যক্তি কামাল হোসেন তৃতীয় ধারার প্রবক্তা। কিন্তু দুঃখ এটাই তাতে জনগণের তেমন সাড়া নেই। তার মতো একজন গুণী লোক কেন একটি ‘গণজোয়ার’ সৃষ্টি করতে পারলেন না, এটা আমি ভেবে পাই না। তার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে তিনি নিজেই নষ্ট করেছেন। ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে তিনি কখনও গেছেন, এটা কেউ বলতে পারবে না। এমনকি এই খোদ ঢাকা শহরে তিনি কখনও গণসংযোগে বেরিয়েছেন, তাও কেউ বলতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি সোচ্চার হন। তার কর্মকাণ্ড অনেকটা সেমিনার অর্থাৎ প্রেস ক্লাবভিত্তিক। বেইলী রোড থেকে তিনি গণফোরামকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারেননি। এক সময়ের তুখোড় বক্তা ও জাসদ নেতা আসম আবদুর রব এখন ক্ষুদ্র জেএসডি নিয়ে আছেন। মূলধারা চলে গেছে ইনুর হাতে। জাসদ নিয়ে তার মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। একবার বলেন, জাসদকেন্দ্রিক রাজনীতি তিনি করেন না, কিন্তু সেই জাসদকে (জেএসডি) তিনি ছাড়তেও পারেন না। তার একটা সম্ভাবনা ছিল। সেই সম্ভাবনাকেও তিনি কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যক্তি হিসেবে মানুষ তাকে চেনে। কিন্তু দলকে কেউ চেনে না। সংসদীয় আসনে তার একটা অবস্থান আছে। কিন্তু প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে। কোন বড় দলের সমর্থন না পেলে তার পক্ষে সংসদে ফিরে আসা কষ্টকর। পারবেন না। আওয়ামী লীগবিরোধী ভূমিকার কারণে তিনি সুপরিচিত। নির্বাচনে জিততে হলে তাকে তাকাতে হবে বিএনপির দিকে। তৃতীয় ধারা তার বিজয়কে নিশ্চিত করবে না। কাদের সিদ্দিকীও ব্যক্তিনির্ভর দলের প্রধান। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নাম মানুষ যতটুকু না জানে, তার চেয়েও বেশি জানে ও চেনে কাদের সিদ্দিকীকে। দলেও তিনি পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছেন, যদিও তিনি রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের বিরোধিতা করেন।
এদের এ চারজনের সমন্বয়ে কী হবে? সংসদীয় রাজনীতিতে এসব দলের আদৌ কি কোন ভূমিকা আছে? সংসদীয় আসনে জিততে হলে এদের হয় আওয়ামী লীগ, নতুবা বিএনপির ওপর নির্ভর করতে হবে। কাদের সিদ্দিকী সংসদে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তা একবার সম্ভব হয়েছিল বিএনপির সমর্থন তথা আসন ছেড়ে দেয়ার কারণে। আগামীতে তিনি কি জিততে পারবেন? মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে তাকে আবারও বিএনপির সমর্থন নিতে হবে। তৃতীয় ধারার কথা বলে তিনি এ সমর্থন নিশ্চিত করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির একটি ভূমিকা লক্ষ্য করার বিষয়। উত্তরবঙ্গনির্ভর এ দলটির এলাকাভিত্তিক সমর্থন রয়েছে। এরশাদ নয়াদিল্লি ঘুরে এসে বলেছেন, তিনি এককভাবে নির্বাচন করবেন। তিনি যদি আলাদাভাবে নির্বাচন করেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তার দল একটি ফ্যাক্টর। তবে বড় দল দুটিÑ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মূল দুটি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিকল্প তৃতীয় ধারা নয়, বরং আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপিই। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস তাই বলে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দুটি বড় দলের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে আস্থাহীনতা। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা শুনি ‘অমুক’ দল পাকিস্তানের দালাল, আর ‘তমুক’ দল ভারতের দালাল। ১৫ ডিসেম্বর বিটিভিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকেও বের হল ‘পাকিস্তানি দালালের’ কথা।
পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থা স্থাপনটা জরুরি। এটা না হলে বিজয় দিবস পালন কিংবা স্বাধীনতা দিবস পালন মূল্যহীন হয়ে যাবে। বিজয়ের বিয়াল্লিশ বছরে পা দিলাম। আর কত আমরা লিখব? শুভবুদ্ধির উদয় হোক। তবে হ্যাঁ, নতুন প্রজšে§র ওপর আমার আস্থা আছে। এরাই পারবে এ দুই শক্তির মাঝে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে। ইতিহাস তো তাই বলে।
Daily JUGANTOR
19.12.12

হরতালের রাজনীতিতে বাংলাদেশ


এক সপ্তাহের মধ্যে দু-দুটো হরতাল প্রত্যক্ষ করল বাংলাদেশ। ১১ ডিসেম্বর ছিল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আর ১৩ ডিসেম্বর আধা বেলা। এর আগে ৯ ডিসেম্বর ছিল অবরোধ। ওই অবরোধ অনেকটা হরতালের মতোই পালিত হয়েছিল। ধারণা করছি, বিএনপি তথা ১৮ দল সরকারের ওপর 'চাপ' সৃষ্টি করার লক্ষ্যে হরতালের মতো কর্মসূচি আরো দিতে পারে। খালেদা জিয়া সে রকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এতে করে কি সরকার বিরোধী দলের দাবি মেনে নেবে? কোন পরিস্থিতির দিকে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি? অবরোধের সময় বিশ্বজিৎ মারা গেলেন। বলা যেতে পারে, তাঁকে 'হত্যা' করা হলো। সাহসী ফটোসাংবাদিকরা সেই ছবি তুলেছেন। যারা বিশ্বজিৎকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করল, তাদের ছবি, নাম-ধাম_সবই পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তারা ছাত্রলীগ করে। ছাত্রলীগের নেতা। পুলিশ তখন তাদের গ্রেপ্তার করল না কেন? মামলা একটা হয়েছে। করিৎকর্মা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সিটি করপোরেশনের আবর্জনা পরিবহনের গাড়ি ভাঙচুর করেছেন। আমরা এতটাই বোধশক্তিহীন মানুষ যে আমাদের শুনতে হয়, মির্জা সাহেবের মতো মানুষ, যিনি একটি বড় দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব_তিনি ময়লা টানার গাড়ি ভাঙচুর করেছেন। পুলিশ এ কাজটিই পারে। পারে না শুধু বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে। একটি রিট হয়েছে। রুলও হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্রলীগ কর্মীর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে দুজন।
১১ ডিসেম্বরের হরতালের সময় যখন রিকশায় একাকী ঢাকার রাস্তায় ঘুরেছি, তখন অনেক কথা 'কানে' এসেছে। মানুষ অনেক কথা বলে। সব কথা শুনতে নেই। হিসাবটা মেলাতে চাই। একটা সমঝোতা কি আসলেই সম্ভব নয়? দেয়ালের লিখন থেকে কি কিছু শিখব না আমরা? আফ্রিকার সেই হুতু-তুতসিদের কাহিনীর কথা মনে আছে? দেশটির নাম রুয়ান্ডা। উত্তরে উগান্ডা, পূর্বে তানজানিয়া, দক্ষিণে বুরুন্ডি। লোকসংখ্যা মাত্র ৬১ লাখ। ১৯৯৪ সালে দেশটি সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। গৃহযুদ্ধ আর লাখ লাখ মানুষের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্ববাসী আঁতকে উঠেছিল। টিভি পর্দায় দেখেছিলাম সেই হত্যাকাণ্ডের ছবি। হুতু ও তুতসি উপজাতি নিয়েই রুয়ান্ডা। জনগোষ্ঠীর ৮৫ শতাংশই হুতু উপজাতির। আর ১৪ শতাংশ হচ্ছে তুতসি। ঘটনা ৭ এপ্রিল, ১৯৯৪ সালের। একই বিমানে ফিরছিলেন রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা, আর বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট নাটারিয়ামিরা। কিগালিতে (রুয়ান্ডার রাজধানী) বিমান অবতরণের ঠিক আগ মুহূর্তে রকেট হামলায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। মারা যান দুই প্রেসিডেন্ট। সৃষ্টি হয় জাতিগত সহিংসতার। হুতুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আর তুতসিরা মেধাসম্পন্ন। অর্থনীতি ও সেনাবাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৯৪ সালের গণহত্যাকারীদের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হয়েছিল। কিন্তু হুতু-তুতসি দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে, তা বলা যাবে না। বাংলাদেশের পরিস্থিতি আজ কোনো অবস্থায়ই সেই হুতু-তুতসির পরিস্থিতির সঙ্গে মেলানো যাবে না। জাতিগত বিভেদ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব প্রকট, যা শুধু আমাদের কারো কারো মনে হুতু-তুতসি দ্বন্দ্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইতিহাস বলে, এ ধরনের ঘটনায় কাউকে না কাউকে ছাড় দিতে হয়। পাঠক স্মরণ করুন ২০০৮ সালের কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের পরিস্থিতির কথা। ওই দুটি দেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা ও সমঝোতার জন্য প্রেসিডেন্ট মুগাবে (জিম্বাবুয়ে) সাভাঙ্গিরাইকে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। আর কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট কি বাকি বিরোধী নেতা অডিংগাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ইউরোপের দেশ গ্রিসের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু ছিল না। কিন্তু এ বছরের মাঝামাঝি সাবেক বিচারপতি পানাগিওটিস কিপরামানোসের নেতৃত্বে সেখানে সরকার ও পরে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এর অর্থ কী? সংকট মোকাবিলায় জাতিকে এমন সব সিদ্ধান্ত দিতে হয়, যা সংবিধান অনুমোদন করে না। এর পরও বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে করতে হয়। গ্রিসের মতো দেশও তো একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল? কেনিয়া বা জিম্বাবুয়ের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমরা বাংলাদেশে তা পারব না কেন? অবশ্যই আমাদের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। কিন্তু সেটাই চূড়ান্ত নয়। সংবিধান সংশোধন না করি, সংসদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমরা নিরপেক্ষ একটি সরকারের মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে পারি। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন 'মডেল' নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আসলে মূল বিষয়টি হচ্ছে আন্তরিকতা। সরকার ও বিরোধী দলের এই আন্তরিকতা থাকতে হবে।
একটা বিষয় আমাদের স্মরণ থাকা ভালো_আর তা হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তি। বিদেশে এ ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতিতে একজন ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই ঝুলে গেল পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে_এ আশা যাঁরা করেন, তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করেন। দুর্নীতিতে বিশ্বে আমাদের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ দেশগুলোর মধ্যে ১৩তম। দুর্নীতিতে প্রথম হইনি, এটাই রক্ষা! টিআইবির রিপোর্টে বলা হলো, সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করে হলমার্কের এমডি এখন জেলে। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের যাঁরা জড়িত, তাঁরা রয়ে গেছেন বাইরে। সোনালী ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কি আদায় হবে? ডেসটিনি নিয়েও অনেক 'কাহিনী'। সে টাকাও তো উদ্ধার হলো না। যেখানে তাকাই, সেখানেই দুর্নীতি। আমাদের আশ্বাস আর বিশ্বাসের জায়গাটা থাকল না। আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টে আগুন লেগে মারা গেলেন ১১১ জন মানুষ। এটা ভয়ংকর একটা ঘটনা। একসঙ্গে শ্রমজীবী মানুষ এতজনের মৃত্যু একসঙ্গে হয়েছে, এ ইতিহাস আমার জানা নেই। শ্রম দিতে এসে, বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে এসে এতগুলো মানুষ প্রাণ দিল। ওইসব মৃত্যুর মূল্য কী মাত্র কয়েক লাখ টাকা? দেড় বছরের ছোট্ট শিশু সিয়াম এসেছিল মৃত মায়ের বকেয়া বেতন তুলতে। আমাদের মুনাফালোভী গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের ওই অবুঝ শিশুর নিষ্পাপ ছবি দেখেও মন গলেনি। কেউ কি নিতে পারতেন না ওই শিশুর লেখা-পড়ার দায়িত্ব! আমরা এতই নির্বোধ জাতি_ওই কারখানার মালিক, যিনি এতগুলো মৃত্যুর জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী, তাঁকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো গেল না। অথচ তথাকথিত 'গাড়ি ভাঙচুর' মামলায় গ্রেপ্তার হলেন মির্জা ফখরুল। কিন্তু তাজরীন গার্মেন্টের মালিককে গ্রেপ্তার করা গেল না। আমাদের অনেক কিছু দেওয়ার আছে বিশ্বকে। ১৬ কোটি মানুষের দেশের নাগরিক আমরা। আমরা বিশ্বকে নেতৃত্বও দিতে পারব আগামীতে। কিন্তু ভয় হচ্ছে, আমাদের সব অর্জন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতির কারণে বিনিয়োগ তথা সাহায্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অবরোধের সময় আহত হয়েছেন একজন জার্মান স্থপতি। তাঁর আহত হওয়ার ঘটনা একটা ভুল 'সিগন্যাল' পেঁৗছে দিতে পারে ইউরোপে। পদ্মা সেতুর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের অন্য প্রকল্পগুলোতেও অর্থ ছাড়ে শ্লথগতি আসতে পারে। তাই একটা সমঝোতা অত্যন্ত জরুরি। হরতালের পর হরতাল দিয়ে যেমন সরকারের পতন হবে না, ঠিক তেমনি সরকার যদি জোর করে থাকতে চায়, তার পরিণতিও ভালো নয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে একটা সমঝোতা হতেই হবে। আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে না উঠলে, আমাদের জন্য আরো খারাপ সংবাদ অপেক্ষা করছে। আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সরকার যদি একটি সংলাপে যায়, আমার বিবেচনায় সেটা সরকারের জন্যও মঙ্গল। সরকার সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে_এটা সত্য এবং তা অস্বীকারও করা যাবে না। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। কিন্তু তাই বলে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করার স্বার্থে নতুন একটি ব্যবস্থা যে প্রবর্তন করা যাবে না, তা তো নয়। আমরা তো সর্বশেষ গ্রিসের সিদ্ধান্তটিও অনুসরণ করতে পারি। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারেরও হুমকি দিয়েছেন। আমরা ভুলে যাই, অতীত বড় নির্মম। বিগত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারও করেছিল। কিন্তু পরিণতি কি ভালো হয়েছে? নিশ্চয়ই সরকার যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। সেটা তাদের অধিকার। কিন্তু সংঘাত যখন তীব্র হচ্ছে, তখন এ ধরনের কথাবার্তা না বলাই শ্রেয়। হরতাল কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। বরং হরতাল আমাদের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে নষ্ট করছে। আমরা এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে চাই। আর পথ খোলা একটাই_সংলাপ।Daily KALERKONTHO19.12.12

কোন পথে বিএনপি







বিএনপি তথা ১৮ দল কর্তৃক আহূত ৯ ডিসেম্বর রাজপথ অবরোধের পর যে প্রশ্নটি আমাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এরপর কী? ১৮ দলীয় জোট ঢাকার রাজপথ অবরোধের ডাক দিয়েছিল কয়েকটি সুনির্দিষ্ট দাবিকে সামনে রেখে— অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল। সে সঙ্গে রয়েছে দুর্নীতি, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধে সরকারের ব্যর্থতা। এসব দাবি-দাওয়ার পেছনে সাধারণ মানুষের সমর্থন কতটুকু আছে কিংবা দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সরকারের ব্যর্থতা কতটুকু, এটা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা এখন অনেকের কাছেই আলোচনার অন্যতম বিষয়। আমরা বারবার বলে আসছি, বিএনপির অতীত যা-ই থাকুক না কেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিতে হলে সরকারকে বিএনপির সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসতেই হবে। এ সমঝোতার ধরন যা-ই হোক না কেন, বিএনপিকে আস্থায় নিতে না পারলে দেশের রাজনৈতিক সংকট আরও গভীরতর হবে। বিএনপি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। বেগম খালেদা জিয়া সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদীয় ভাষায় যিনি ‘ছায়া প্রধানমন্ত্রী’। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (ডিসেম্বর, ২০০৮) বিএনপির ভরাডুবি দলকে ক্ষমতার বাইরে ঠেলে দেয়। কিন্তু মাত্র ৩০টি আসন পাওয়া বিএনপিকে যদি সেই বিবেচনায় বিচার করা হয়, তাহলে সেটা হবে আমাদের জন্য বড় ভুল। কেননা এ নির্বাচনেও বিএনপি ৩২ দশমিক ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আর চারদলীয় জোটকে যদি বিবেচনায় নিই, তাহলে ৩৭ শতাংশ জনগোষ্ঠীর সমর্থন রয়েছে এ জোটের পেছনে। এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা— এ ৩৭ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না।
গত প্রায় এক বছর বিএনপির রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে, তা হচ্ছে বিএনপির রাজনীতিতে কোনো ‘হঠকারিতা’ লক্ষ করা যায়নি। অর্থাৎ পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলেও বিএনপি বারবার হরতাল দেয়নি। হরতাল দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতি করে। বিদেশীদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। দাতারা বেশকিছু দিন ধরেই হরতালের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই কথা বলে আসছে। ধারণা করছি, বিএনপি দাতাগোষ্ঠীর কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর স্বার্থেই হরতালের মতো কোনো কর্মসূচি দেয়নি। তবে বেগম খালেদা জিয়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, তিনি প্রয়োজনে লাগাতার হরতালও দিতে পারেন। স্পষ্টতই এটা একটা হুঁশিয়ারি। এ জন্যই আমরা বারবার একটা সমঝোতার কথা বলছি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এ সমঝোতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেগম খালেদা জিয়া এরই মধ্যে তার ও দলের ভাবমূর্তি উদ্ধারে যথেষ্ট সচেষ্ট হয়েছেন। তিনি চীন ও ভারত সফর করেছেন। সেখানে তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে একটি ‘বিকল্প নেতৃত্ব’ তিনি এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। ভারত সফরের মাধ্যমে তিনি তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের পানি সমস্যা তুলে ধরেছেন। সমমর্যাদার কথা বলেছেন। ভারতের আচরণে সেই সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা হয়নি। দ্বিতীয়ত. বাংলাদেশ ভারতীয় ‘বাণিজ্যনীতি’র ফাঁদে আটকা পড়ে আছে অনেক দিন ধরে। অর্থাৎ ভারতীয় বাণিজ্যনীতি এমন যে, একটি বড় ধরনের বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, যা ভারত ব্যবহার করছে নিজের স্বার্থে। ভারত তথাকথিত বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধার কথা ঘোষণা করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের রফতানি আয় কমে গেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশ রফতানি করেছে মাত্র ৪৯ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের পণ্য (আগের বছরের আয় ৫১ কোটি ২৫ লাখ ডলার)। এতে দেখা যায়, রফতানি আয় কমেছে (কালের কণ্ঠ, ১৮ জুলাই, ২০১২)। গেল বছর ৬-৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরের সময় ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, ভারত অশুল্ক বাধা দূর করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বেগম খালেদা জিয়া ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে স্পষ্ট করলেন অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে। এতে বাংলাদেশ তার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারবে। তৃতীয়ত. বারবার প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। একতরফাভাবে ভারতীয় বিএসএফ প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। এ হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। পৃথিবীর কোনো সীমান্তে এভাবে মানুষ মারা হয় না। এ সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে ভারতকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে— বেগম খালেদা জিয়া এ ‘মেসেজ’ পৌঁছে দিলেন ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে। চতুর্থত. খালেদা জিয়া ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর, সাড়ে ৬ কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিতকরণের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী অনেক আগেই ছিটমহল সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ভারত তা করেনি। খালেদা জিয়া দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের জনগণের কথা তুলে ধরেছেন। পঞ্চমত. বাংলাদেশের দুর্বল ও ভারতঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির সুযোগে দেশটি বাংলাদেশের কাছ থেকে সুকৌশলে ট্রানজিটের নামে করিডোর সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। তখন বলা হয়েছিল, বহুপক্ষীয়ভাবে ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান অনুরূপ সুবিধা পাবে। বাংলাদেশের জন্য চীন-নেপাল-ভুটানের যে সংযোগ ভারতের ওপর দিয়ে যাবে, তা ১০০ কিলোমিটারের চেয়ে কম। সুযোগটি বাংলাদেশ পায়নি, এমনকি ভারত ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের মাত্র ২৫ কিলোমিটার স্থল সংযোগে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ভারত আমাদের সে সুযোগ দেয়নি। অথচ আমরা এককভাবে ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতের ২৮ চাকার ভারী গাড়ি পারাপারের সুযোগ করে দিয়েছি। এ জন্য ভারত আমাদের কোনো ট্রানজিট ফিও দেয়নি। সাধারণ মানুষের মনোভাব আজ খালেদা জিয়াকে তুলে ধরতে হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ভারত নিজ স্বার্থে এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের পথরেখাটি নিজের সুবিধামতো আদায় করে নিয়েছে। ভারতের এ এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের পথরেখাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢুকে ঢাকা ও সিলেট হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় প্রবেশ করবে। পথটি ভারতের জন্য অনুকূল হলেও বাংলাদেশের জন্য দুর্গম, বেশি দূরত্বের এবং অনিরাপদ হওয়ায় এটি বাংলাদেশের জন্য মোটেই লাভজনক নয়। অথচ পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-টেকনাফ-সিত্তোই-আকিয়াব-ইয়াঙ্গুনগামী পথটি বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দূরপ্রাচ্যের গন্তব্যগুলোয় স্থল যোগাযোগের জন্য (সড়ক ও রেলপথ) কম দূরত্ব ও কম দুর্গম এবং নিরাপদ হওয়ায় এশিয়ান হাইওয়ের যে পথ আমরা বেছে নিয়েছি, তাতে আমাদের প্রাপ্তি কম। এমনকি ভারতকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের ব্যাপারে আমরা চুক্তিবদ্ধ। এসব চুক্তি আমরা এখন বাতিল করতে পারব না। তবে বেগম জিয়া ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের এটা বোঝাতে পেরেছেন যে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারত যদি এককভাবে সুবিধা নেয়, তাতে করে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্ব পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ছে। আমদানি-রফতানিতে চট্টগ্রাম বন্দর এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে। নতুন করে ভারতীয় কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সুযোগ কম। বিষয়টি নিয়ে বেগম জিয়া ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপও করেছেন।
বাংলাদেশের জনগণ ভারতের বন্ধুত্ব চায়। বাংলাদেশের উন্নয়নে ও সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে ভারত বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে ভারত যদি সমর্থন করে, তাতে বাংলাদেশে ভারতের ইমেজ নষ্ট হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানুষ চায় না ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করুক। তবে বেগম জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এবং সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বেগম জিয়া একটি বাস্তবমুখী সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। এটা তার ভাবমূর্তির জন্য যথেষ্ট হলেও সংসদীয় রাজনীতিতে সংসদ বয়কটের রাজনীতি মানুষ পছন্দ করে না। মানুষের প্রত্যাশা, তিনি ও তার দল সংসদে ফিরে আসবে এবং সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ নেবেন। এটা সত্য, তারা সংসদে বাধা পাবেন। কিন্তু তার পরও সংসদে যেতে হবে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তরুণ সমাজে প্রশ্ন আছে। তরুণ সমাজ যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারেও বেশ সোচ্চার। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি যেমন জামায়াতকে ছাড়তে পারবে না, ঠিক তেমন জামায়াতও ছাড়তে পারবে না বিএনপিকে। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে তার অবস্থান শক্তিশালী করছে। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বলে কিছু নেই। কিন্তু তার পরও এ প্রশ্নে সংলাপ হতে পারে। কেননা ক্ষমতাসীন শরিক দলের অনেকেই চাচ্ছে, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে একটি সরকার হোক, যাদের কাজ হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। এমনকি দাতাগোষ্ঠীর প্রায় সবাই একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। কিন্তু সরকারের তাতে রয়েছে আপত্তি। প্রধানমন্ত্রী একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং ওই সরকারে বিএনপিও যোগ দিতে পারে— এমন প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে রেখে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেবে না বিএনপি, এটাও জানাতে ভোলেননি বেগম জিয়া। এই যখন পরিস্থিতি, তখন বিএনপিকে নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হয়তো হবে। কিন্তু ওই নির্বাচনে বিএনপি হয়তো অংশ নেবে না। ৯ ডিসেম্বর রাজপথ অবরোধ এবং ১১ তারিখের হরতালের পর এটা প্রমাণিত হলো, সামনের দিনগুলো আমাদের জন্য ভালো নয়। হরতাল ও লাগাতার হরতালের দিন আসছে। ২০১৩ সালটি আমাদের জন্য হবে চরম সংকটের বছর। হরতাল দিয়ে মহাসমাবেশ ডেকে অথবা ঢাকা অবরোধ করে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বাধ্য করানো হবে বলে মনে হয় না। তাই আমরা চাই শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। রাজনৈতিক সংকট দেশটির ভাবমূর্তির জন্য ভালো খবর নয়। এমনিতেই দুর্নীতি ও গার্মেন্টশিল্পে অব্যবস্থাপনার কারণে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এখন যদি রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়, তা আগামীতে কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। সরকারও বিএনপিকে এমন অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে, যেখান থেকে বিএনপির আর ফিরে আসার সুযোগ নেই। তাই একটি ‘সংলাপ’ হোক। আমার বিশ্বাস, সংলাপের মধ্য দিয়ে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। অবরোধ ও হরতালের পর আবার সেই প্রশ্নটাই বড় হয়ে দেখা দিল। ‘সংলাপ’ ভিন্ন বিকল্প নেই।
Daily BONIK BARTA
15.12.12