রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

একজন কেজরিওয়াল ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি


একজন অরবিন্দ কেজরিওয়াল এখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। সংবাদপত্রগুলো আমাদের বলছে, তিনি হচ্ছেন দিল্লির ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী। বয়স মাত্র ৪৫ বছর। যদিও বয়সটা কোনো ফ্যাক্টর নয়। এর চাইতেও কম বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন জনএফ কেনেডি কিংবা বর্তমানে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন। ওবামার কথা না হয় নাইবা বললাম। কিন্তু কে চিনত কেজরিওয়ালকে? কিংবা সদ্য গঠিত আম আদমি পার্টিকে? কিন্তু এই কেজরিওয়ালই শীলা দিক্ষিতের মতো কংগ্রেসের হেডিওয়েট নেতাদের পরাজিত করে দিল্লির মসনদে বসেছেন। একজন কেজরিওয়াল পেরেছেন। কারণ তিনি টার্গেট করেছিলেন দুর্নীতি উৎখাতের। দিল্লির মানুষ তার ওপর আস্থা রেখেছেন। এটা নয়াদিল্লির কেন্দ্রীয় প্রশাসনের জন্য কোনো ‘সিগন্যাল’ কি-না আমি জানি না। কিন্তু একটা সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো ‘কমিটমেন্ট’ যদি ঠিক থাকে, তাহলে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। আর কেজরিওয়ালের ‘দিল্লি দখল’-এর ঘটনা ঘটল, এমন এক সময় যখন বাংলাদেশেও দুর্নীতির বিষয়টি বহুল আলোচিত। বাংলাদেশে একটি নির্বাচন হতে বাকি আছে মাত্র কয়েকটি দিন। এরই মাঝে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে একটা হাস্যস্পদ ব্যাপারে পরিণত করেছে। এর চাইতেও বড় কথা, নির্বাচনের আগে সরকারি দলের এমপি প্রার্থীরা, বিশেষ করে সাবেক মন্ত্রী ও এমপিরা যে হলফনামা নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছেন, তাদের দেয়া তথ্য নয়া বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। তাদের দেখা তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় অনেকেই গেল ৫ বছরের মধ্যে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এই বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়টি যে বৈধভাবে হয়েছে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তাই নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, সেটা যেমন একটা প্রশ্ন, ঠিক তেমন একটা প্রশ্ন, কীভাবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন সরকারি দলের সাবেক মন্ত্রী ও এমপিরা। তবে এটা মানতেই হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক রকম ‘যুদ্ধ’ শুরু করে ভারতে গান্ধীবাদী নেতা আন্না হাজারে আর তার ভাবশিষ্য অরবিন্দ কেজরিওয়াল ভারতজুড়ে আলোচনার অন্যতম বিষয়ে পরিণত হলেও বাংলাদেশে দুর্নীতির বিষয়টি খুব একটা আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রধান বিরোধী দল ও জোটের (১৮ দল) কর্মসূচিতেও এই দুর্নীতির বিষয়টি স্পষ্ট নয়। সাধারণ মানুষের কাছে সহিংসতা, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিষয়টি যত বেশি আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সরকারি দলের নেতাদের ‘অবৈধ আয়’-এর বিষয়টি তেমন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। এক সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে ড. কামাল হোসেন সরব হয়েছিলেন। কিন্তু কেজরিওয়ালের মতো তিনি কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেননি।
চলতি বছর রাজনীতিতে দুটি বিষয় বেশি করে আলোচিত হয়। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিরোর্ধ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সারাটা বছর আন্দোলন করেছে। তারা সংবিধান সংশোধনেরও দাবি করে। এই দাবির পক্ষে একটা সর্বজন গ্রহণযোগ্যতাও লক্ষ্য করা যায়। বছরের শেষের দিকে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ এ সরকারকে কিছুটা নমনীয় হতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর বদলে (যিনি সংবিধান সংশোধনীর ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের দায়িত্ব পান) রাষ্ট্রপতি অথবা স্পিকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন আয়োজন করারও প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সরকার তাতে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি। ফলে সংকটের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে বছরের শেষ দিকে বিএনপি নেত্রীকে একটি চূড়ান্ত কর্মসূচি দিতে দেখা যায়। বেগম জিয়া গত ২৪ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা অভিমুখে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’-এর আহ্বান জানান। গণতন্ত্র রক্ষায় তিনি এই গণতন্ত্র অভিযাত্রার ডাক দেন। এমনকি স্থবির হয়ে যাওয়া সংলাপ শুরু করারও আহ্বান জানান তিনি। এটা বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির জন্য নতুন একটি মাত্রা এনে দেয়।
সরকার তার টার্ম শেষ করলেও সরকারের জন্য এটা ছিল একটা বড় ব্যর্থতা যে, তারা দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে আনতে পারেনি।
এমনকি ১৫৪ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির জন্য একটি কলঙ্কজনক ঘটনা। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, নির্বাচন কমিশন এই ভোটারবিহীন নির্বাচন রোধ করতে পারেনি; বরং কমিশন সরকারের একটি অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে।  একজন দলীয় প্রধান হিসেবে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী যদি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তাহলে তিনি বা তার দল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাবেন। পঞ্চম সংসদে দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী (সংসদীয় রাজনীতি) এনে আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রবর্তন করেছিলাম। কিন্তু বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড শুধু ভঙ্গই করল না; বরং গণতান্ত্রিক চর্চার পেছনে ছুরিকাঘাত করল। জাতীয় পার্টির ঘটনা (নির্বাচনে আছে, নির্বাচনে নেই। মন্ত্রিসভায় আছে, মন্ত্রিসভায় নেই, পার্টি প্রধানের অসুস্থতা ইত্যাদি) প্রমাণ করে রাজনীতিবিদদের মাঝে সুবিধাবাদিতা চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। জাতীয় পার্টি এখন অস্তিত্ব সংকটের মাঝে থাকবে।
দেশে সুশাসনের অভাব নানাভাবে অনুভূত হয়েছে চলতি বছর। দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীর কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচিত হয়েছে এবং একাধিকবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মানবাধিকার কর্মী ও একজন সিনিয়র আইনজীবী আদিলুর রহমান খানের গ্রেফতার কিংবা ড. মুহম্মদ ইউনূস ইস্যুতেও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে অরাজকতা, পোশাক কর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা, রানা প্লাজার হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি ঘটনা বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে একটি ভিন্ন মেসেজ দিয়েছে।
২০১৩ সালটি ছিল রাজনৈতিক দল ও এর নেতাদের জন্য একটি খারাপ খবর। সারাটা বছর জামায়াতে ইসলামী একটা বিতর্কের মাঝে থেকেছে। তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির সব সহিংস ঘটনার জন্য বারবার অভিযুক্ত হয়েছে। তাদের এক শীর্ষ নেতা কাদের মোল্লা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত এবং উচ্চ আদালত কর্তৃক তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করা হয়েছে। এর আগে উচ্চ আদালতের অপর একটি পর্যবেক্ষণে স্বাধীনতা আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার নিন্দা ও সমালোচনা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত যদি তার অস্তিত্ব বজায় রাখে, তাহলেও নির্বাচনে জামায়াত হিসেবে অংশ নিতে পারবে না। অন্যদিকে অপর একটি ইসলাম পছন্দ সংগঠন হেফাজতে ইসলামের উত্থান ছিল অন্যতম আলোচিত একটি বিষয়। অতীতে বাংলাদেশের মানুষের এই সংগঠনটি সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। ৫ মে শাপলা চত্বরে তাদের সমাবেশ ও ওই সমাবেশে পুলিশের হামলা এবং মৃত্যুর পর সংগঠনটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। তাদের উত্থাপিত ১৩ দফা নিয়েও সারা বছর বিতর্ক চলে এবং নারীবাদী সংগঠনগুলো এর সমালোচনা করে। মূলত বেসরকারি কওমি মাদ্রাসায় পড়–য়া শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়েই এই সংগঠন। বছরের প্রায় শেষ দিকে এরা ঢাকায় জনসভা করতে চাইলেও সরকার তাদের অনুমতি দেয়নি। গেল বছর পুরোটা সময় বিএনপি আন্দোলনে থেকেছে। শীর্ষ স্থানীয় অনেক নেতাই শেষ দিন পর্যন্ত জেলে ছিলেন। নাটকীয়ভাবে অফিসের তালা ভেঙে বিএনপির কোনো কোনো নেতাকে (রিজভী আহমেদ) গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটেছে। বিএনপির অফিসের সম্মুখে তাদের জনসভায় পুলিশেল গুলিবর্ষণ, নির্বাচিত এমপিদের পুলিশের লাঠিপেটা, পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের বিজয় সব মিলিয়ে জনমত বিএনপির পক্ষে গেলেও আন্দোলনে বিএনপি তেমন সুবিধা করতে পারেনি। এতে করে কর্মী ও শুভনবুধ্যায়ীদের মাঝে এক ধরনের হতাশা লক্ষ্য করা যায়। বছরের শেষ দিকে এসে বেগম জিয়া তার কার্যালয়ে অনেকটা ‘গৃহবন্দি’ হয়ে পড়েন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও এই নির্বাচন বিএনপিকে এক ধরনের অস্তিত্বহীনতার মাঝে ফেলে দিতে পারে। বিএনপি এখন মূলত বেগম জিয়ার ক্যারিসমেটিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। বেগম জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে চিন্তাও করা যায় না। এ ক্ষেত্রে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিঃসন্দেহে বেগম জিয়া-পরবর্তী বিএনপির হাল ধরবেন। কিন্তু তার অসুস্থতাজনিত কারণে বিদেশে অবস্থান, মানি লন্ডারিং মামলাসহ দুর্নীতির মামলার কারণে তার পক্ষে এই মুহূর্তে দেশে আসাও সম্ভব নয়। সিনিয়র নেতারা অনেকেই তৎপর নন। তরুণ প্রজন্মকে বিএনপির তরুণ নেতৃত্বে আকৃষ্ট করতে পেরেছে বলেও মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে দশম জাতীয় সংসদ যদি সংবিধান অনুযায়ী ৫ বছর থাকে, তাহলে বিএনপি তার অস্তিত্ব নিয়ে বড় সংকটে থাকবে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটা আভাস দিয়েছেন একাদশ পার্লামেন্ট নির্বাচনের। আমার ধারণা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় গঠিত দশম সংসদ দুই বছর ক্ষমতায় থাকবে। আর এরই মাঝে এই সংসদেই ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ একটা রূপরেখা উপস্থাপন করা হবে এবং তা সংসদে পাস হবে। অনেকটা ষষ্ঠ সংসদে পাস হওয়া ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মতো। এটা না হলে বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া যাবে না। এটা সত্য, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এই নির্বাচনটি সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। সরকারের এটা বড় ব্যর্থতা যে, সরকারবিরোধী দলকে আস্থায় নিতে পারেনি। আস্থায় নিতে না পারার অর্থ হচ্ছে সংকট থেকে যাওয়া। আর এই রাজনৈতিক সংকটের নতুন যে একটি মাত্রা আমরা দেখতে পেয়েছি অর্থাৎ সহিংসতা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। জোর করে ক্ষমতায় থাকা যায় বটে, কিন্তু তাতে আস্থা অর্জন করা যায় না। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে দরকার সুশাসন নিশ্চিত করা। দরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান। এটা সত্যিই একটা উল্লেখ করার বিষয় যে, নয়াদিল্লিতে শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আম আদমি পার্টি ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল ‘দিল্লির মসনদ’ দখল করতে পেরেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে ড. কামাল হোসেন কিংবা নাগরিক ঐক্য দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েও আদৌ কোনো আবেদন রাখতে পারেনি। গণফোরাম এখন শুধু ‘বেইলি রোডকেন্দ্রিক’ তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। ২০১৪ সালে এসে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা এটা চিন্তা করতে পারেন তাদের ব্যর্থতা কোথায়। ডিসেম্বরে (২০১৩) পত্র-পত্রিকায় আমাদের রাজনীতিবিদদের (ইসিতে দেয়া হলফনামা অনুযায়ী) অর্থ-সম্পদের যে বিবরণ ছাপা হয়েছে, তাতে অবাক হতে হয়। কী বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক তারা হয়েছেন! রাজনীতি কী তাহলে শুধু অর্থ-সম্পদ বানানোর একটি মাধ্যম! আবার অর্থমন্ত্রীর মতো একজন প্রবীণ ও শিক্ষিত ব্যক্তি যখন বলেন, ‘ক্ষমতায় থাকলে অর্থ-সম্পদ বাড়ে’, তখন অবাক হতে হয়! একজন শিক্ষিত ব্যক্তি কীভাবে এভাবে কথা বলতে পারেন! একজন কেজরিওয়াল দেখিয়ে দিয়েছেন রাজনীতিতে যদি সততা ও কমিটমেন্ট থাকে, তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব। আমাদের রাজনীতিবিদরা কেজরিওয়ালের কাছ থেকে শিখবেন, এটা আশা করি না। ভারতের রাজনীতির সঙ্গে আমাদের পার্থক্য এখানেই।
একজন কেজরিওয়াল আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করে যেসব বিষয়, সেই বিষয়গুলোকে যদি বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে জনসমর্থন তাতে বাড়ে। গণতন্ত্রের অপর নামই তো আস্থা। এই আস্থা অর্জন করা সম্ভব, যদি সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো নিয়ে রাজনীতিবিদরা সোচ্চার হন। নিঃসন্দেহে দুর্নীতি একটা বিষয়। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতারা যদি অবৈধভাবে অর্থ ও বিত্তের মালিক হয়ে থাকেন, তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। প্রয়োজন সুশাসন নিশ্চিত করা। বিগত জোট সরকার বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহের একটি নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে একশ্রেণীর শ্রমিক নেতার (যারা সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত) ইন্ধনে অবৈধভাবে প্রচুর গ্যাসলাইন সংযোগ দেয়া হয়েছে। অথচ এখান থেকে সরকার কোনো রেভিনিউ পাচ্ছে না। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নও করা যাচ্ছে না। এটা সুশাসনের অন্তরায়। কেজরিওয়াল নয়াদিল্লিতে বিনামূল্যে প্রতি বাড়িতে ৭০০ লিটার পানি আর সস্তায় বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ঢাকা শহরের সমস্যা হচ্ছে পানির অবৈধ ব্যবহার এবং বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ। এই অবৈধ সংযোগের কারণে বিদ্যুৎ ও পানির ‘সিস্টেম লস’ একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। বিদ্যুৎমন্ত্রী আছেন বটে, কিন্তু কেউ কখনো এই ‘সিস্টেম লস’ কমাতে পারেননি। উদ্যোগও নেননি। এ জন্য দরকার এ সেক্টরে শক্ত নেতৃত্ব। প্রযুক্তির যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটেছে। পানি ও বিদ্যুৎ লস কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রয়োজন উদ্যোগের। বাংলাদেশে মানুষ বেড়েছে। কৃষি জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। কৃষি জমিতে গড়ে উঠছে বসতি, ঘর ও শিল্প কলকারাখানা। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। গ্রামাঞ্চলেও হাইরাইজ ভবন তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে বিনাসুদে ঋণ দিতে হবে। তবে মনিটর করতে হবে, যাতে এই ঋণ শুধু ভবন নির্মাণ  কাজেই ব্যয় হয়। কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে, যাতে করে কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য হিস্যা পান। না হলে কৃষক এ পেশা ছেড়ে দেবেন। উন্নত দেশগুলোতে এটা একটা সমস্যা। বাংলাদেশে প্রচুর জনশক্তি রয়েছে। এই জনশক্তির ব্যবহার হচ্ছে না। বেশকিছু পেশার বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে (নার্সিং, আইটি) অথচ আমরা এসব সেক্টরে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারছি না। ৩৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আমরা স্থাপন করেছি। কিন্তু দক্ষ নেতৃত্বের অভাবে, দলীয়করণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক একটি অদক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গত ৭-৮ মাস ধরে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। সেখানে শিক্ষা কাঠামো এক রকম ভেঙে পড়েছে। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই।
আগামী ৫ জানুয়ারির পর শেখ হাসিনাকে আমরা ‘নয়া প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে দেখতে পাব। তার কাছে প্রত্যাশা আমাদের অনেক। শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, বাংলাদেশকে একটি ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে বিশ্বে তুলে ধরতে হলে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি।
Daily Manobkontho
31.12.13

দূর হোক অনিশ্চয়তা অস্থিরতা


দেশীয় আর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ২০১৩ সালটি ছিল একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতার বছর। বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব যখন চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, তখন ভারতে অখ্যাত এক অরবিন্দ কেজরিওয়াল দেখিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের সমস্যা আর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতিকে যদি রাজনীতিতে প্রাধান্য দেয়া যায়, তাহলে ক্ষমতায় যাওয়া কঠিন কিছু নয়। কেজরিওয়াল এখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতিতেও ছিল বড় ধরনের অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতা। ‘আরব বসন্ত’ পুরো আরব বিশ্বে যে সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল, তাতে এসেছে অনিশ্চয়তা। ইউরোপের দেশগুলো অর্থনৈতিক সঙ্কট পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। গণতন্ত্রের জন্য খারাপ খবর ছিল থাইল্যান্ডে, ইউক্রেনে কিংবা রাশিয়ায়ও। আর ভারতের নয়াদিল্লিতে আম আদমি পার্টির সরকার গঠনের খবর একদিকে যেমনি গণতেন্ত্রের জন্য একটি মাইলফলক, অন্যদিকে চার-চারটি রাজ্যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের পরাজয় এবং বিজেপির বিজয় ২০১৪ সালের মে মাসে সেখানে যে লোকভার নির্র্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তার জন্য একটি ‘সিগনাল’ হিসেবে অনেকে বিবেচনা করেছেন।

বাংলাদেশের জন্য যে দুঃখজনক সংবাদ তা হচ্ছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ একটি বড় ধরনের হুমকির সম্মুখীন হলো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে। এরই মধ্যে আমরা জেনে গেছি, ১৫৪ জন প্রার্থী এই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা ১৮ দলের অনুপস্থিতিতে এই নির্বাচন একটি হাস্যকর নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। বিএনপি ও ১৮ দল বেশ কিছুদিন ধরে তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্দলীয় সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবি করে এলেও, তাতে সরকার কোনো ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি। দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে ২৯ ডিসেম্বর। ওইদিন খালেদা জিয়া ঢাকায় সমবেত হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি এর নামকরণ করেছিলেন ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ হিসেবে। কিন্তু দেখা গেল, সরকার গণতন্ত্রের এই অভিযাত্রাকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে ঢাকা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সরকারি দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনের কর্মীরা ওই দিন রাজপথে যে আচরণ করেছে, তা শুধু দুঃখজনকই নয়, বরং গণতন্ত্রের পিঠে ছুরিকাঘাতের শামিল। প্রেসক্লাবে হামলা, সুপ্রিমকোর্টে হামলা চালিয়ে আইনজীবীদের আহত করা গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য কোনো ভালো খবর নয়। খালেদা জিয়াকে পল্টনের সমাবেশে যোগ দিতে দেয়া হয়নি। উপরন্তু তার বাসায় তাকে অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ উঠেছে। ফলশ্রুতিতে খালেদা জিয়া ৩০ ডিসেম্বরও কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। রাজনীতিতে এখন টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। খালেদা জিয়া গণতন্ত্র রক্ষার যে আহ্বান জানিয়েছেন, তার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে এটা তিনি আহ্বান করেছেন এমন একটা সময় যখন নির্বাচনের বাকি আছে আর মাত্র ৫ দিন। ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যদিও এরই মধ্যে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন এবং বাকি ১৪৬ আসনে সেই অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কেননা নির্বাচনের অর্থই হচ্ছে জয়-পরাজয়। কিন্তু ওই আসনগুলোতে আদৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, কিংবা সেখানে নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করছেÑ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। খোদ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে এ রকম একটি আভাস পাওয়া যায়। এখন যে অভিযোগটি সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছে তা হচ্ছে, সরকার বিরোধী দলের সঙ্গে আরও আলোচনার সুবিধার্থে নির্বাচনের তারিখ আরও ৯০ দিন পিছিয়ে দিতে পারত। সংবিধানের ১২৩(৪) ধারা অনুসরণ করে এবং উচ্চ আদালতের একটি রেফারেন্স নিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু সরকার তা করেনি। সরকার ‘ভোটারবিহীন’ একটি নির্বাচন করতে চায়। সরকারের দরকার একটি সংসদ। সেই সংসদের গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও, সরকারের কাছে ওই সংসদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে নানা কারণে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে এটা বোঝা যায়। এমনকি প্রধানমন্ত্রী ২৮ ডিসেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছেন, তাতে সরকারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়েছে।
হরতাল ও অবরোধের কারণে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকা। বিজিএমইএ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির একটি হিসাব দিয়েছিল। এটা আরও বাড়বে। এর ফলে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। গেল বছর যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ২ ভাগ, এখন তা ৫ দশমিক ২ ভাগে নেমে আসবে। রাজনৈতিক এই অস্থিরতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে অর্থনীতি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এর বাইরে প্রতিটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসেনি। চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রথমবর্ষ স্নাতক সমমান শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এর ফলে তাদের জীবন থেকে ১ বছর হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে একটি সমঝোতা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ যখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পারস্পরিক বিশ্বাস আর আস্থার অভাবে, ঠিক তখন বিশ্বের অন্যত্রও গণতন্ত্র ছিল ঝুঁকির মুখে। মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসি সেনাবাহিনী কর্তৃক এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। সেখানে ইসলামিক ব্রাদারহুড নিষিদ্ধঘোষিত হয়েছে। আর তিউনেসিয়ার প্রধান দলগুলো মেহদি জোমাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নিতে রাজি হয়েছে। জোমা এখন নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। ইয়েমেনে ড্রোন বিমান হামলা অব্যাহত এবং সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধও অব্যাহত রয়েছে বছরের শেষ দিন পর্যন্ত।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে দ্বিতীয় দফা ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং আবদুল্লাহ ইয়ামিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট নাশিদ তা মেনে নিয়েছেন। পাকিস্তানে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং নওয়াজ শরিফ আরও একবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনও সাধিত হয়েছে পাকিস্তানে। প্রধান বিচারপতি ও সেনাপ্রধান অবসরে গেছেন। প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরী নিয়মমাফিক অবসরে যাওয়ার পর তাসাদ্দুক হোসেন জিলানী প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। আর জেনারেল কায়ানির টার্ম শেষ হয়ে যাওয়ার পর জেনারেল রাহিল শরিফ নয়া সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে শরিফের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, তেহরিক-ই-তালেবানকে নিষ্ক্রিয় করা ও তাদের জঙ্গিবাদী তৎপরতা বন্ধ করা। মূলত তেহরিক-ই-তালেবান সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
এ অঞ্চলে এখন ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ সরকার গঠন করেছে। ধারণা করা হয়, ইমরান খানের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি দল হিসেবে পরিচিত তেহরিক-ই-তালেবানের একটা সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে সীমান্ত অঞ্চলে মার্কিন ড্রোন বিমান হামলা বন্ধ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শরিফ এই হামলা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানালেও তা রক্ষিত হয়নি। এটা খোদ নওয়াজ শরিফের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের জন্য এটা বড় খবর হলো, একটা নির্বাচিত সরকার তার ৫ বছরের টার্ম পূরণ করল। আর ভারতের নয়াদিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকার গঠন অন্যতম আলোচিত বিষয়। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। ওবামা এই প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি এই প্রতিশ্রুতি কতটুকু রাখতে পারবেন, সেটা একটা প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে আফগানিস্তানের কারজাই সরকারের সঙ্গে একটা নিরাপত্তা চুক্তি করতে চাইলেও, তা হয়নি। এক্ষেত্রে চলতি বছর আফগানিস্তানের দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। অনেকেরই ধারণা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটা উপস্থিতি সেখানে থাকবেই। এক্ষেত্রে পাকিস্তানেও জঙ্গি তৎপরতা বাড়বে। পাকিস্তানের কথা শুধু নয়, খোদ নেপালও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন করল। এই দুটো দেশ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। নেপালে মাওবাদীরা সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচনে ভালো ফল করেনি। ভালো খবর হলো, তারা শেষ অব্দি অধিবেশনে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে যেসব দেশ গণতন্ত্র চর্চা করে, তাদের জন্য ‘খারাপ’ খবর আছে। বিশেষ করে থাইল্যান্ড আর ইউক্রেনে সরকারবিরোধী আন্দোলন নতুন একটি মাত্রা পায়। থাইল্যান্ডে সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতি মূলত দু’পক্ষের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। একদিকে ‘রেড শার্ট’ আন্দোলন, যারা সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে ‘হলুদ শার্ট’ আন্দোলন, যারা সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত। আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে প্রধানমন্ত্রী ইংলাক ফেব্রুয়ারিতে নয়া নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও ‘হলুদ শার্ট’ আন্দোলনকারীদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। এক পর্যায়ে সেনাপ্রধান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন এবং সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ‘রেড শার্ট’ আর ‘হলুদ শার্ট’ আন্দোলনের কারণে থাইল্যান্ডের গণতন্ত্র একটি বড় প্রশ্নের মাঝে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইংলাক এভাবে ‘রেড শার্ট’ আন্দোলনকারীদের উসকে দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, তিনি তার ভাই থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে (সাবেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী) দায়মুক্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে সংসদে একটি বিল এনেছেন। ইউক্রেনের অবস্থাও ঠিক তেমনি। ২০০৪ সালের ‘কমলা বিপ্লব’ এখন ব্যর্থ হতে চলেছে। ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তি বাতিল ও রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
২০১৩ সালে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের মৃত্যু ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে হাসান রুহানির অভিষেক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ করে এক সময় হেরে গিয়েছিলেন হুগো শ্যাভেজ। তার মৃত্যুর পর তিনি যে ‘সমাজতন্ত্রের নতুন এক ধারা’ প্রবর্তন করেছিলেন, তার স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যু ছিল সবচেয়ে শোকাবহ ও বেদনার অভিজ্ঞতা, মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিংয়ের যোগ্য উত্তরসূরি ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, তিনি এখন আর আমাদের নন, তিনি এখন মহাকালের। তার মৃত্যু ছিল গৌরব ও অহঙ্কারের। কেননা, জীবনভর তিনি সাম্য, শান্তি আর মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূরীকরণে ছিলেন বিশ্বের অনন্য এক নায়ক।
তাই নানা কারণে ২০১৪ সাল আলোচিত হতে থাকবে। বিশেষ করে সিরিয়ায় একটি সমঝোতা, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প কর্মসূচি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কংগ্রেসের বিবাদ ইত্যাদি বিশ্ব সংবাদে আলোচতি বিষয় হয়ে থাকবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে দশম সংসদ তাদের অস্তিত্ব নিয়ে কতদিন টিকতে পারবে, সে ব্যাপারেও আগ্রহ থাকবে অনেকের। আগামী বছর বিএনপিকে সংসদীয় ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হলে নির্বাচনকালীন একটা সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। আর এজন্যই সরকারকে ভেঙে যাওয়া সংলাপ অব্যাহত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটা সমঝোতা না হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আসরে তার ভাবমূর্তি শুধু নষ্টই করবে না, বরং বাংলাদেশ বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। সুতরাং একটা আস্থা ও পারস্পরিক বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরি। ২০১৪ সালের রাজনীতিতে এটাই হবে মুখ্য বিষয়।
Daily Alokito Bangladesh
31.12.13

বিদায়ী বছরের ব্যর্থতাগুলো কাটিয়ে সামনে এগোতে হবে


২০১৩ সালের বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে আস্থাহীনতা। বছরের পুরোটা সময় এ আস্থাহীনতা বজায় থাকে এবং এ আস্থাহীনতার অভাবেই একদলীয় একটি নির্বাচনের আয়োজন করতে হচ্ছে সরকারকে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটকে সারাটা বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে আন্দোলন করতে দেখা গেছে। অন্যদিকে সরকারকে দেখা গেছে সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে এককভাবে নির্বাচনের পথে এগিয়ে যেতে। আস্থাহীনতার অভাবে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করলেও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হয়নি। একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু দেখা গেছে, যে দলগুলোকে নিয়ে মহাজোট গঠিত হয়েছিল, তারাই মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মন্ত্রিসভায় স্থান পায়নি। এক্ষেত্রেও আস্থাহীনতা ছিল প্রধান কারণ। যদিও প্রধানমন্ত্রীকে একাধিকবার বিএনপিকে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাতে দেখা গেছে। এক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান ছিল মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়া নয়, বরং নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর একটি সিদ্ধান্তের পক্ষে। বিএনপি বছরের শুরু থেকেই বলে আসছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তিকে ‘নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান’ করা হলে তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে কোনো আপত্তি নেই। এ নিয়ে বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট একের পর এক হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি দিলেও সরকারের মনোভাবের এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর এককভাবে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করলেও সরকার তার সিদ্ধান্তে ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে এ আস্থাহীনতা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা আন্তর্জাতিক আসরে প্রশংসিত হলেও আস্থাহীনতা যে একটি দেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে কত বড় বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিতে পারে এবং বিশ্ব আসরে দেশটির ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে, ২০১৩ সালের বাংলাদেশের রাজনীতি তার বড় প্রমাণ। দুটি বড় শক্তির (বিএনপি আর আওয়ামী লীগ) মাঝে আস্থার সম্পর্ক ছিল বিধায় ১৯৯১ সালে আমরা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম। এমনকি ৭ম, ৮ম, ৯ম সংসদ নির্বাচনেও একটি আস্থার সম্পর্ক ছিল। এ সম্পর্কের অবনতি ঘটে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করার পর।
চলতি বছর সারাটা সময়জুড়ে ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সহিংসতা। বিরোধী দল একের পর এক হরতাল, পরে লাগাতার অবরোধ দিয়ে রাজনীতিতে নতুন একটি মাত্রা এনে দেয়। চলতি বছরের একটা বড় সময় আমরা দেখেছি একের পর এক বিদেশী দূতদের বাংলাদেশে আসা ও সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেয়া। তারানকো, ওয়ারসি কিংবা নিশার মতো বিদেশীরা চেষ্টা করেছেন সরকার ও বিরোধী দলকে একটা সমঝোতায় উপনীত করতে। দাতাগোষ্ঠী পুরোটা সময়েই একাধিকবার এটা স্পষ্ট করেছে যে, তারা চায় সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হোক। কিন্তু তা হয়নি। বিদেশীদের মাঝে তারানকো আর সুজাতা সিংয়ের সফর নানা কারণে গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। তারানকো জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত ও জাতিসংঘের কর্মকর্তা। আর সুজাতা সিং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। তারানকোর উপস্থিতিতে সরকার ও বিরোধী দল সংলাপে বসলেও তা কোনো ফল বয়ে আনতে পারেনি। এমনকি তারানকো বাংলাদেশ ত্যাগ করার পর সংলাপের ব্যাপারে সরকারি পক্ষের কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি। তারানকো বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে উভয় পক্ষকে ‘ছাড়’ দেয়ার যে মানসিকতার কথা বলে গিয়েছিলেন, তার প্রতি কোনো পক্ষই সম্মান দেখায়নি। তবে সুজাতা সিংয়ের বক্তব্য (যা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে) বাংলাদেশে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। জাতীয় পার্টি প্রধান এইচএম এরশাদের সঙ্গে দেখা করার পর তার যে অভিমত পাওয়া যায় (নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ, আর বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় গেলে এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটবে), তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘হস্তক্ষেপে’র শামিল বলে অনেকে অভিমত পোষণ করেছেন। অনেকেরই অভিমত, বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে কিংবা একটি রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে মন্তব্য করতে পারে না এবং কোনো ‘উপদেশ’ও দিতে পারে না। সেই একই ধরনের অভিযোগ ওঠে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যখন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে কাদের মোল্লার ফাঁসির ঘটনায় একটি নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের বলার কিছু নেই।
চলতি বছর রাজনীতিতে দুটো বিষয় বেশি করে আলোচিত হয়। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি, দ্বিতীয়টি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বিএনপি তথা ১৮ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সারাটা বছর আন্দোলন করেছে। তারা সংবিধান সংশোধনেরও দাবি করে। এ দাবির পক্ষে একটা সর্বজনগ্রহণযোগ্যতাও লক্ষ্য করা যায়। বছরের শেষের দিকে, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে সরকারকে কিছুটা নমনীয় হতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর বদলে (যিনি সংবিধান সংশোধনীর ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পান) রাষ্ট্রপতি অথবা স্পিকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন আয়োজন করারও প্রস্তাব দেয় বলে শোনা গেছে। কিন্তু সরকার তাতে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি। ফলে সংকটের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে বিএনপি নেত্রীকে একটি চূড়ান্ত কর্মসূচি দিতে দেখা যায়। খালেদা জিয়া গত ২৪ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা অভিমুখে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র আহ্বান করেন। গণতন্ত্র রক্ষায় তিনি এ ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’র ডাক দেন। এমনকি স্থবির হয়ে যাওয়া সংলাপ শুরু করারও আহ্বান জানান তিনি। এটা বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে নতুন একটি মাত্রা এনে দেয়।
সরকার তার টার্ম শেষ করলেও সরকারের জন্য একটা বড় ব্যর্থতা ছিল, তারা দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে আনতে পারেনি। এমনকি ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির জন্য একটি কলংকজনক ঘটনা। এ ঘটনা প্রমাণ করে, নির্বাচন কমিশন এই ভোটারবিহীন নির্বাচন রোধ করতে পারেনি। বরং কমিশন কার্যত সরকারের একটি অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ছাড়া যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হল। একজন দলীয় প্রধান হিসেবে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী যদি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তাহলে তিনি বা তার দল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাবেন। পঞ্চম সংসদে দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী (সংসদীয় রাজনীতি) এনে আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রবর্তন করেছিলাম। কিন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড শুধু ভঙ্গই করেনি, বরং গণতান্ত্রিক চর্চার পেছনে ছুরিকাঘাত করেছে। জাতীয় পার্টির ঘটনা (নির্বাচনে আছে, নির্বাচনে নেই; মন্ত্রিসভায় আছে, মন্ত্রিসভায় নেই; পার্টি প্রধানের অসুস্থতা ইত্যাদি) জনমনে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
এটা আবারও প্রমাণিত হয়েছে, এদেশের রাজনীতিতে দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে একটি ‘শান্তিপূর্ণ’ সহাবস্থান ছাড়া কোনো সমঝোতা সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্য এখানেই যে আমাদের রাজনীতিকরা এ সত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের রাজনীতি এ দুটি প্রধান দলকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এর বাইরে তৃতীয় কোনো জোট বা পক্ষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। তবে রাজনীতিতে নতুন একটি মাত্রা যোগ হয়েছে, আর তা হচ্ছে ‘জোট রাজনীতি’। অর্থাৎ দুটি প্রধান দলকে ঘিরে ছোট ছোট অনেক দল জোটবদ্ধ হয়েছে। ধারাটি স্পষ্ট- একদিকে রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি, একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের অনুসারীরা, যারা এক ব্যানারে একত্রিত হয়েছেন। অন্যদিকে রয়েছে ইসলাম পছন্দ অনুসারীরা, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও মুক্তবাজারের প্রবক্তারা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দুই ধারার রাজনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। গেল এক বছরের রাজনীতিতে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ছোট ছোট রাজনৈতিক সংগঠন, যারা এ পরস্পরবিরোধী দুই ধারার রাজনীতি সমর্থন করে, তারা বড় দল দুটোর পেছনে একত্রিত হয়েছে। এবং বাংলাদেশে একটি জোট রাজনীতি শুরু করেছেন। এর বাইরে তৃতীয় একটি ‘জোটজন্মপ্রকাশ করলেও জনসাধারণের মাঝে তাদের আবেদন খুবই সীমিত। কাদের সিদ্দিকী, আসম রব, বি চৌধুরীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা থাকলেও দলীয়ভাবে তারা বড় দুর্বল। গেল এক বছর তারা ব্যক্তি পর্যায়ে থেকে সোচ্চার হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে কোনো ‘আবেদন’ রাখতে পারেননি। এটা সত্যিই একটা উল্লেখ করার বিষয় যে, নয়াদিল্লিতে শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আম আদমি পার্টি ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল ‘দিল্লির মসনদ’ দখল করতে পেরেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে ড. কামাল হোসেনের মতো ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েও আদৌ কোনো আবেদন রাখতে পারেননি। গণফোরাম এখন শুধু ‘বেইলি রোডকেন্দ্রিক’ তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। ২০১৪ সালে এসে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা ভেবে দেখতে পারেন তাদের ব্যর্থতা কোথায়।
ডিসেম্বরে (২০১৩) পত্র-পত্রিকায় আমাদের রাজনীতিকদের (ইসিতে দেয়া হলফনামা অনুযায়ী) অর্থ সম্পদের যে বিবরণ ছাপা হয়েছে, তা দেখে অবাক হতে হয়। কী বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক তারা হয়েছেন! রাজনীতি কি তাহলে শুধু অর্থ সম্পদ বানানোর একটি মাধ্যম। আবার অর্থমন্ত্রীর মতো একজন প্রবীণ ও শিক্ষিত ব্যক্তি যখন বলেন, ‘ক্ষমতায় থাকলে অর্থ সম্পদ বাড়ে’ তখনও অবাক হতে হয়! একজন শিক্ষিত ব্যক্তি কিভাবে এমন কথা বলতে পারেন! একজন কেজরিওয়াল দেখিয়ে দিয়েছেন রাজনীতিতে যদি সততা ও কমিটমেন্ট থাকে, তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব। আমাদের রাজনীতিকরা কেজরিওয়ালের কাছ থেকে শিখবেন বলে মনে হয় না। ভারতের রাজনীতির সঙ্গে আমাদের পার্থক্য এখানেই।
চলতি বছর বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির একটি বিষয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আর তা হচ্ছে, দেশে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো বিকল্প নেই। ২০১৪ সালে এটা হচ্ছে রাজনীতির মূল বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘তৃতীয়বারের মতো’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন বটে। কিন্তু রাজনীতিতে স্থায়ী আবেদন রাখতে হলে তত্ত্বাবধায়কের বিকল্প একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা’ প্রবর্তন করতে হবে। বিগত দিনের ঘটনাবলী প্রমাণ করে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজের মতো বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিনির্মাণ অত সহজ নয়। পশ্চিমা সমাজের গণতন্ত্রের ‘স্পিরিট’ আমরা গ্রহণ করেছি, কিন্তু গণতন্ত্র চর্চায় পশ্চিমা সমাজকে আমরা অনুসরণ করিনি। পাশের দেশ ভারতের দিল্লির ‘হেভিওয়েট’ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিত যখন অখ্যাত এক কেজরিওয়ালের কাছে হেরে যান, তখন সেখানে নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি ওঠে না। ভারতের গণতন্ত্রের এটাই সৌন্দর্য। আমরা এ থেকেও কিছু শিখিনি। ইতিহাসে শেখ হাসিনা কিভাবে চিহ্নিত হবেন জানি না। কিন্তু তিনি তার ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে পারবেন যদি তিনি নির্বাচনকালীন একটি সরকারের রূপরেখা দশম সংসদে পাস করে ২০১৪ সালেই আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এক্ষেত্রে সবার মতামত তিনি নিতে পারেন। একটি কমিশনও গঠন করতে পারেন। যদি তিনি দলীয় লোকদের নিয়ে ‘কমিশন’ করেন, তাহলে তাদের লক্ষ্য হবে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় রাখা। জাতি এ থেকে কিছুই পাবে না। তাই তিনি যদি নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিশন করেন, আমার বিশ্বাস এতে তার সম্মান পুনরুদ্ধার হবে। তার উপদেষ্টারা তাকে সঠিক উপদেশ দিয়েছেন, এটা আমি বিশ্বাস করি না। একটা ভুল সিদ্ধান্ত আরেকটি ভুল সিদ্ধান্তকে ‘টেনে’ আনে। জোর করে ক্ষমতায় থাকার মাঝে কোনো সার্থকতা নেই। বরং সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া, তাদের মতামত নেয়া, তাদের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখাই হওয়া উচিত রাজনীতির মূল লক্ষ্য। মানুষ চেয়েছে একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার। চেয়েছে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, তা হয়নি। এ থেকে যদি আমরা শিক্ষা নেই, তার মাঝেই আমাদের মঙ্গল নিহিত।
 ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৩
Dainik JUGANTOR

'মার্চ ফর ডেমোক্রেসি' এবং প্রসঙ্গ কথা




বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ২৯ ডিসেম্বর রবিবার 'মার্চ ফর ডেমোক্রেসি'তে অংশ নেওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এটা অনেকটা লং মার্চের মতো। সব শ্রেণীর মানুষকে তিনি ওই দিন ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি তথা ১৮ দল সরকারবিরোধী যে আন্দোলন করছে, তার অংশ হিসেবেই তিনি এই আহ্বান জানালেন। তিনি গণতন্ত্র রক্ষায় যে ডেমোক্রেসি মার্চের আহ্বান জানিয়েছেন, তার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে এটা তিনি আহ্বান করলেন এমন একটা সময়, যখন নির্বাচনের বাকি আছে আর মাত্র ১১ দিন। আগামী ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন। যদিও এরই মধ্যে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় 'নির্বাচিত' হয়েছেন এবং বাকি ১৪৬ আসনে সেই অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কেননা নির্বাচনের অর্থই হচ্ছে জয়-পরাজয়। কিন্তু ওই আসনগুলোয় আদৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে কিংবা সেখানে নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করছে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এখন যে অভিযোগটি সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছে, তা হচ্ছে সরকার বিরোধী দলের সঙ্গে আরো আলোচনার সুবিধার্থে নির্বাচনের তারিখ আরো ৯০ দিন পিছিয়ে দিতে পারত। সংবিধানের ১২৩(৪) ধারা অনুসরণ করে এবং উচ্চ আদালতের একটি রেফারেন্স নিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু সরকার তা করেনি। সরকার 'ভোটারবিহীন' একটি নির্বাচন করতে চায়। সরকারের দরকার একটি সংসদ। সেই সংসদের গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও সরকারের কাছে ওই সংসদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে নানা কারণে। এমনি এক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া মার্চ ফর ডেমোক্রেসির আহ্বান জানালেন। অতীতে বারবার দেখা গেছে বিএনপি কোনো কর্মসূচি দিলে নেতাদের কাউকে মাঠে পাওয়া যায় না। যদিও এটা ঠিক, বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা এখন জেলে অন্তরীণ। কিন্তু তার পরও যাঁরা বাইরে আছেন কিংবা ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাদের কাউকে দেখা যায় না। ফলে একটা বাজে ইমেজ তৈরি হয়েছে। কর্মসূচি দিয়ে মাঠে না থাকলে দল সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম হয়। খালেদা জিয়া যে চার দফা দাবি করেছেন, তার মধ্যে গণভোটের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, 'বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে।' তাঁর এই প্রস্তাবটি একটি ভালো প্রস্তাব। সংবিধানে যেভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং যা এখন সংবিধানের অংশ, সে ব্যাপারে জনগণের সমর্থন চাওয়া যেতে পারে। গণভোটে এটা যদি সমর্থন পায়, তাহলে বিরোধী পক্ষের আর বলার কিছু থাকবে না। খালেদা জিয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জান-মাল রক্ষা করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা লক্ষ করেছি যে প্রায়ই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন আক্রান্ত হচ্ছে। অতীতেও এটা হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ও দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। অতীতে আওয়ামী লীগ এই সংখ্যালঘুর বিষয়টিকে ইস্যু করেছিল। আজ তাদের সরকারের সময় এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটবে? এ ব্যাপারে একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত। খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, তাঁর দল আলোচনায় রাজি। এটা সত্য যে তারানকোর উপস্থিতিতে যে সংলাপ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, যাকে তারানকো তাঁর রিপোর্টে 'সফল' বলে দাবি করেছেন, সেই সংলাপ এখন 'ডিপফ্রিজে'। বর্তমান সংকটের জন্য খালেদা জিয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে দায়ী করেছেন এবং বলেছেন, সব পরিস্থিতির দায়দায়িত্ব সরকারের। এটা অবশ্য মিথ্যা বলেননি তিনি। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল না করলে আজ আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় নির্বাচনটি দেখতাম (দশম সংসদ নির্বাচন)। উচ্চ আদালতের যে রায়ের ওপর নির্ভর করে এটা বাতিল করা হলো, তাতে আরো দুই টার্মের জন্য এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রেখে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটা ছিল উত্তম। এটি বাদ দেওয়ার পর থেকেই সব ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির একটি উদ্যোগের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। সংলাপ ও বিএনপির প্রস্তাবে এ রকমটি ছিল। এটা সত্য, সংবিধানে রাষ্ট্রপতির এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু নৈতিক অধিকার তাঁর রয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীকে এই নির্বাচনে জড়িত না করানোর আহ্বান জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। যেখানে আদৌ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না, সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন না করাই মঙ্গল ছিল।
খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যে সমঝোতার একটি জট খোলার আহ্বান থাকলেও সরকার ইতিবাচক দৃষ্টিতে তা দেখবে বলে মনে হয় না। সরকার ৫ তারিখের নির্বাচনের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে গেছে। জাতীয় পার্টিকে নিয়ে যে 'নাটক' করা হলো, তা সাধারণ একজন মানুষও বোঝে। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি আরো কয়েক দফা ভাঙনের মুখোমুখি হলো। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমনকি জাতিসংঘের আহ্বান (সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন) উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে কোনো ইতিবাচক সংবাদ বয়ে আনবে না। অর্থনীতি এখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। একটি দৈনিক আমাদের জানাচ্ছে, শুধু তৈরি পোশাক খাতে গত ২১ দিনে আমাদের ক্ষতি হয়েছে কয়েক মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে এই ক্ষতি স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়।
আমি জানি না আমাদের রাজনীতিবিদরা এসব সংবাদ পড়েন কি না। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন কংগ্রেস বাংলাদেশের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যাতে করে বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হতে পারে। সংঘাত যদি চলতেই থাকে, তাহলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টি তাতে এড়াবে না। যেকোনো সদস্য দেশ 'প্রশ্ন' তুলতে পারে সেখানে। তাই সমঝোতাটা প্রয়োজন। খালেদা জিয়া কোনো হার্ড লাইনে যাননি। 'গণতন্ত্র অভিযাত্রা' মূলত সরকারকে চাপে রাখার একটি কৌশল। সরকার এই অভিযাত্রায় হস্তক্ষেপ না করে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিতে পারে এবং ভেঙে যাওয়া সংলাপ শুরু করে তার সদিচ্ছার পরিচয় দিতে পারে। আর বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে পারে সরকার। বল এখন সরকারের কোর্টে।
Daily Kalerkontho
26.12.13

অথঃ গোলতত্ত্ব


বজিয় দিবস উপলক্ষে শনিবার আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘খালি মাঠ/খেলোয়াড় নেই। গোল তো হবেই।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বক্তব্য এভাবেই ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা বলেননি। সহজ-সরল অর্থে দেখলে, এমনটাই দেখায়। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের দুটো দিক আছে। এক. বাস্তবতা। দুই. নৈতিক। বাস্তবতা বলে একটি নির্বাচন অত্যাসন্ন। তারিখ ঘোষিত হয়েছে, নির্বাচন কমিশন শিডিউল ঘোষণা করেছে। ‘প্রার্থীরাও’ মাঠে আছেন। এখন প্রার্থীরা কাদের, কোন দলের, সেটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিবেচ্য নয়। তিনি ‘রাজনীতির খেলোয়াড়’। রাজনীতির মাঠে তিনি ‘বিজয়ী’ হতে চান। এক্ষেত্রে অপর পক্ষকে যদি তিনি ‘রাজনীতির খেলায়’ মাঠের বাইরে রাখতে চান, সেটা তার ‘কূটকৌশল’। নিঃসন্দেহে, এ ‘কূটকৌশলে’ তিনি বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু তার ‘নৈতিক পরাজয়ও’ হয়েছে। এককভাবে মাঠে খেলে ‘বিজয়ী’ হওয়া যায়; কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করে না। খেলার মাঠে যদি অপর পক্ষ না থাকে, তাহলে ওই খেলা দেখতে ‘দর্শক’ও মাঠে আসে না!
সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন খেলায় ‘বিজয়ী’ হয়ে আনন্দ কোথায়! এটা অবশ্যই সরকারের এক ‘ব্যর্থতা’ যে, ‘রাজনীতির খেলায়’ তিনি অপর পক্ষকে ‘মাঠে’ আনতে পারেননি। এ ‘বিজয়’ সরকারের অবস্থানকে আরও ‘শক্তিশালী’ করবে না বরং সরকারের ‘ভিত’ আরও দুর্বল হবে। আমরা বারবার বলি, রাজনীতিতে আস্থা ও বিশ্বাস যদি স্থাপন করা না যায়, তাহলে সেই ‘রাজনীতি’ শক্তিশালী হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা ৪২ বছর পার করেছি। কিন্তু এখনও আমরা সেই ‘ভিতকে’ শক্তিশালী করতে পারিনি। পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস এত বেশি যে, যেখানে রাজনীতি ‘মুখ্য’ হওয়া উচিত ছিল, সেখানে রাজনীতি ‘গৌণ’ হয়ে গেছে। ‘মুখ্য’ হয়ে উঠছে ব্যক্তিগত কুৎসা আর হিংসা। আমরা একটা কথা ভুলে যাই, এ দেশের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আমরা আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধর্ম নিয়ে হাজার বছর টিকে থাকব। এখানে ‘রাজনীতির ভিতটা যদি শক্তিশালী না হয়, তাহলে সমাজের বিনির্মাণটা শক্তিশালী হবে না। এক সময় শক্ত ‘ভিত’ এর অভাবে তাসের ঘরের মতো তা ভেঙে যেতে পারে!
‘রাজনীতির খেলোয়াড়’ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্দেহে এ ‘খেলায়’ বিজয়ী হয়েছেন। তিনি ‘গোলকিপারবিহীন’ গোলপোস্টে একের পর এক ‘গোল’ করেছেন। কিন্তু তিনি যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট, তা কিন্তু নয়। আর সন্তুষ্ট নন বলেই তিনি আভাস দিয়েছেন, প্রয়োজনে তিনি দশম সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। এবং একাদশ সংসদেও সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে চান। একটি ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’ও আছে তার বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, বিরোধী দল বিএনপিকে জামায়াত ও সহিংসতা ছাড়তে হবে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, একটা দলের এটা ‘রাজনৈতিক কৌশল’, তারা কার সঙ্গে ঐক্য করবে।
জামায়াত সম্পর্কে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, জামায়াতের যে একটা ‘ভোট ব্যাংক’ আছে, তা কি আমরা অস্বীকার করতে পারব? এখানে প্রধানমন্ত্রী আরও ‘কৌশলী’ হলে পারতেন! জামায়াতের কোনো নিবন্ধন নেই। নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করেছে। জামায়াত নামে এ দলটি আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এমনকি সরকার ইচ্ছে করলে জামায়াতকে নিষিদ্ধও করতে পারে। কেননা আদালতের নির্দেশনাতেও জামায়াত সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য রয়েছে। সরকার এটাকে ব্যবহার করেই তো জামায়াতকে প্রয়োজনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। সুতরাং জামায়াতকে ‘বাদ’ দেয়া-সম্পর্কিত প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও ‘কৌশলী’ হতে পারতেন। যুক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক ‘ঘটনার’ পর বিএনপিও বলতে পারে, সরকারকে জাতীয় পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। এটা কথার পিঠে কথা। কোনো যুক্তির কথা নয়। এটা ঠিকও নয়। জাতীয় পার্টি একটি নিবন্ধিত দল। তাদের একটা জনসমর্থন আছে। রাজনীতি করার এবং যে কোনো ফ্রন্টে থাকার অধিকার তাদের রয়েছে। আমরা সেই ‘অধিকার’ খর্ব করতে পারি না। আমরা বারবার ভুলে যাই, রাজনীতি হচ্ছে একটা ‘খেলা’। এ খেলায় এক পক্ষ জিতবে, এক পক্ষ হারবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ‘খেলায়’ প্রতিযোগিতা থাকতে হয়। প্রতিযোগিতা ছাড়া এ ‘খেলা’ মূল্যহীন। ১৫৪ জন প্রার্থী এরই মধ্যে দশম জাতীয় সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন! এখন তাদের নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হতে হবে। এটা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু এটা সংসদীয় রাজনীতি নয়। সংসদীয় রাজনীতির যে স্পিরিট, তা এখানে নেই। নেই কোনো শক্ত বিরোধী দলের অবস্থান, যা কিনা সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণ। আস্থা ও বিশ্বাসের যে কথা গণতন্ত্র বলে, তাও এখানে অনুপস্থিত। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা প্রায় সবাই জেলে। কেউ বা আবার রয়েছেন আত্মগোপনে। মামলা আছে এখনও সবার বিরুদ্ধে। কেউ কেউ আদালত থেকে জামিনও পেয়েছেন। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের জন্য দরকার সব দলের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ জরুরি। দরকার স্থিতিশীলতা। দরকার পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন। কিন্তু সংবাদপত্রে যখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের অবরোধের ছবিগুলো দেখি, তখন দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই! যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণটা জরুরি, সেখানে তাদের সবার নামেই মামলা! হয়তো আজ বা আগামীকাল আমরা দেখব আরেকটি ‘কমান্ডো স্টাইলে’ গ্রেফতারের কাহিনী! এতে করে কী আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে?
এটা সত্য, বিরোধী দল এ অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাকে কী বিশ্বাস করতে হবে, এসব নেতা বাসে পেট্রলবোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন! পত্রিকায় দু’একজন দুষ্কৃতকারীর ছবিও ছাপা হয়েছে, যারা বাসে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পুলিশ এদের গ্রেফতার করতে পারেনি কেন? এসব দুষ্কৃতকারীর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এরা রাজনীতি করে না। এরা সন্ত্রাসী। যারা পেট্রলবোমা মেরে মানুষ মারে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে দেয়, অসহায় করে দেয় একটা পরিবারকে, তারা তো জনগণের ‘বন্ধু’ হতে পারে না। এরা জনগণের শত্রু। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তবে এটাও সত্য, ‘হুকুমের আসামি’ হিসেবে যদি বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হয়, তাহলে তো আস্থার জায়গাটা আর থাকে না।
অবরোধের কারণে আমরা এখন ‘জিম্মি’। স্থবির হয়ে গেছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ আজ আর ঘর থেকে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতি কোনো ভালো কথা বলে না। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সেক্টর থেকে পাচ্ছি একের পর এক নেতিবাচক সংবাদ। বৈদেশিক আয়ের একটা বড় উৎস হচ্ছে তৈরি পোশাক। এ তৈরি পোশাক রফতানিতে এখন স্থবিরতা এসেছে। কমে গেছে অর্ডার। এর প্রভাব কারখানাগুলোতে পড়তে পারে। বাদ হয়ে যেতে পারে অনেক কারখানা। এমনকি বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যায় পড়তে পারেন গার্মেন্ট মালিকরা। তাদের সাদা পতাকা মিছিল প্রমাণ করে, তারা আজ কত অসহায়। কিন্তু অর্থনীতিতে সুবাতাস যে বইবে, তার কোনো লক্ষণ দেখছি না।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক সঙ্কট দেশকে পিছিয়ে দেবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা এসব নিয়ে ভাবেন না। খবর বের হয়েছে, প্রতিটি ট্যানারিতে চার কোটি টাকার চামড়াজাত পণ্য আটকে আছে। রফতানি করা যাচ্ছে না। শিল্প খাতে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে চরম আতঙ্কে আছেন উদ্যোক্তারা। সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে আছেন তৈরি পোশাকের মালিকরা। হরতাল আর অবরোধজনিত কারণে তাদের মাথায় হাত। তাদের সংস্থা বিজেএমইএ’র হিসাব মতে, হরতাল ও অবরোধজনিত কারণে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে গত দেড় মাসে ক্ষতি হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। একটা দেশের জন্য এ বিপুল ‘ক্ষতি’ কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর রেশ আগামীতে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, ভাবতেই আঁতকে উঠতে হয়! আর একটা জিনিস আমরা অনেকেই চিন্তা করছি না, অবরোধ যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে দেশের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির সৃষ্টি হবে। অর্থনীতি সচল না হলে ভ্যাট আদায় হবে না। আর ভ্যাট আদায় না হলে রাষ্ট্রের আয় কমে যাবে। এক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-পাওনা পরিশোধ করায় একটা সমস্যা সৃষ্টি হবে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে নোট ছাপিয়ে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে বলতে পারে, তাতে করে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে যেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি গেল বছর ছিল ৬ দশমিক ২ ভাগ, তা কমে এসে ৫ দশমিক ২ ভাগে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এনবিআর আমাদের জানাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। দৈনিক পত্রিকাগুলো আমাদের জানাচ্ছে, (১৭ ডিসেম্বর) বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট কয়েকটি দেশের সঙ্গে এখন আমদানি-রফতানি বাণিজ্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। দেশগুলো এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে শুরু করেছে। একটি উদ্বেগজনক সংবাদও দিয়েছেন এক প্রতিবেদক। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত বিশ্বের আমদানিকারক দেশগুলো। তাদের এ শঙ্কার কথা জানিয়ে এরই মধ্যে ৩৫ দেশের বায়ার্স প্রতিষ্ঠান প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানে তারা ব্যবসার পরিবেশ না পেলে ভিন্ন দেশে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছেন।
বেশ ক’টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন আমি জানি না; কিন্তু পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এ পরিস্থিতি চলতে থাকবে বলে আমার ধারণা। কেননা নির্বাচন বাতিল করার আর কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। ৫ জানুয়ারির আগে আর দু’পক্ষের মধ্যে কোনো সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সংলাপ কার্যত এখন ব্যর্থ। আমরা বারবার বলছি, আমাদের রাজনীতিবিদদেরই উদ্যোগটি নিতে হবে। আমাদের রাজনীতিবিদরা সমস্যার সমাধানে যদি ব্যর্থ হন, তাহলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। সাধারণ মানুষকে ‘জিম্মি’ করে যে রাজনীতি, তা দেশ ও জাতির কোনো মঙ্গল ডেকে আনতে পারে না। বরং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখার যে সংস্কৃতি, এ সংস্কৃতি জাতির মঙ্গল ডেকে আনতে পারে।
Daily Alokito Bangladesh
25.12.13

প্রশ্নবিদ্ধ সংসদীয় গণতন্ত্র


বাংলাদেশের সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তিত হওয়ার ২২ বছরের মধ্যে এ সংসদীয় রাজনীতি এখন বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ল। যদিও এর প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল দুই বছর আগে, যখন সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাসংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষিত হয়েছিল। সংবিধানে সর্বশেষ মহাজোট সরকারের আমলে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থায় সর্বশেষ ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী (নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য) হিসেবে রেখে দেয়া হয়েছে। সে হিসেবে শেখ হাসিনা আজ প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু একজন দলীয় প্রধানকে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয়, তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আবার প্রমাণিত হলো। এরই মধ্যে আমরা জেনে গেছি ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এমনকি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিলেও, তা আমলে নেয়া হয়নি। তিনিও এখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি। কাউকে লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ না করার কথা বললেও এরই মধ্যে তা বরাদ্দ করা হয়েছে। ফলে দশম সংসদ নির্বাচন একদিকে যেমনি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তেমনি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সংসদীয় পদ্ধতিও।
আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচন। ২৪ জানুয়ারির আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে_ এটা সাংবিধানিক মাধ্যবাধকতা। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা ১৮ দল আন্দোলন করে আসছে একটি তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য। তারা অনেকটা এক জায়গায় এসে তাদের আন্দোলনকে কেন্দ্রীভূত করেছিল_ শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি ছেড়ে দেন, তাহলে যে কোনো ফর্মুলায় তারা সমঝোতায় যেতে রাজি। কিন্তু তা হয়নি। তাই আমরা প্রত্যক্ষ করছি একের পর এক হরতাল, অবরোধ। বাড়ছে সহিংসতা। দীর্ঘমেয়াদি অবরোধ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা এখন অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সংবাদপত্রে প্রতিদিন যেসব ছবি আমরা দেখছি, তা কোনো আশার কথা বলে না। রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। শত শত গাছ কেটে অবরোধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে। অথচ পরিবেশ রক্ষার জন্য এ গাছগুলো আমাদের খুব প্রয়োজন ছিল। এরই মধ্যে ঘটে গেল কাদের মোল্লার ফাঁসির ঘটনা। এতে সহিংসতা আরো বেড়েছে। সহিংসতায় জানমালের ক্ষতি হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় কি? সমস্যাটা রাজনৈতিক। এর সমাধান করতে হবে রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের। অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তারা কোনো সমাধানে আসতে পারছেন না। এমনকি তারানকোর মতো জাতিসংঘের একজন দূত বাংলাদেশে ৬ দিন অবস্থান করেও কোনো সমাধান দিয়ে যেতে পারলেন না। 'সংলাপ' হচ্ছে। তৃতীয় দফা শেষ হয়েছে গত শুক্রবার। এটা তো সময় ক্ষেপণ করার শামিল! নির্বাচনের তফসিল পরিবর্তনেরও আর কোনো সুযোগ নেই। এখন তত্ত্বগতভাবে একটা 'সমঝোতা' হলেও, ৫ তারিখের নির্বাচন পেছানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তারানকো 'ছাড়' দেয়ার যে মানসিকতার কথা বলেছিলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য, তা বড্ড প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোনো পক্ষ, বিশেষ করে সরকার পক্ষ এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। এ ক্ষেত্রে বিএনপি প্রথম দিকে কিছুটা নমনীয় হয়েছিল বলেও মনে হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতা অর্পণ করে তার নেতৃত্বে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারত। যদিও এ ক্ষেত্রে সংবিধান একটি বাধা। এর পরও রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে যদি কোনো 'সমঝোতায়' আমরা পেঁৗছাতে পারতাম, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সংবিধানের আওতায় কীভাবে এটা সম্ভব, সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতে রেফারেন্সের জন্য তা পাঠাতে পারতাম। ঐকমত্যটা যেখানে জরুরি ছিল, সেখানে 'ডকট্রিন অব নেসেসিটি'র ধারণাকে মাথায় রেখে উচ্চ আদালত থেকে রেফারেন্স নিতে সব দলের অংশগ্রহণে আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারতাম। তারানকোর সেই 'ছাড়' দেয়ার আহ্বানে সরকারি দলকে আমরা এতটুকুও নমনীয় হতে দেখলাম না। শেষ পর্যন্ত 'বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন' যদি না আসে, তাহলে প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই নির্বাচন হতে যাচ্ছে। যে প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের 'পদত্যাগপত্র' এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি, একই প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সুযোগও রাখা হলো না। এ ক্ষেত্রে এরশাদের 'প্রত্যাহারের সেই নির্দেশ' কাগজ-কলমেই থেকে গেল। নির্বাচনে একটি 'বড় পক্ষ' দরকার। সম্ভবত জাতীয় পার্টি হতে যাচ্ছে সেই 'বড় পক্ষ', যারা দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে। নিঃসন্দেহে সংবিধান সরকার এ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে। দেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দরকার সব দলের অংশগ্রহণ বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ। দরকার স্থিতিশীলতা। দরকার পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন। কিন্তু সংবাদপত্রে যখন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের অবরোধের ছবিগুলো দেখি, তখন দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই! যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণটা জরুরি সেখানে এদের সবার নামেই মামলা। হয়তো আজ বা আগামীকাল আমরা দেখব আরেবটি 'কমান্ডো স্টাইলে' গ্রেফতারের কাহিনী! এতে কি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে? এটা সত্য, বিরোধী দল এ অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাকে কি বিশ্বাস করতে হবে এসব নেতা বাসে পেট্রলবোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন! পত্রিকায় দু-এক জন দুষ্কৃতকারীর ছবিও ছাপা হয়েছে, যারা বাসে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পুলিশ এদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি কেন? এসব দুষ্কৃতকারীর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এরা রাজনীতি করে না। এরা সন্ত্রাসী। যারা পেট্রলবোমা মেরে মানুষ মারে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে দেয়, অসহায় করে দেয় একটা পরিবারকে, তারা তো জনগণের 'বন্ধু' হতে পারে না। এরা জনগণের শত্রু। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তবে এটাও সত্য, 'হুকুমের আসামি' হিসেবে যদি বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হয়, তাহলে তো আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। অবরোধের কারণে আমরা এখন 'জিম্মি'। স্থবির হয়ে গেছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ আজ আর ঘর থেকে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতি কোনো ভালো কথা বলে না। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সেক্টর থেকে পাচ্ছি একের পর এক নেতিবাচক সংবাদ। বৈদেশিক আয়ের বড় উৎস হলো তৈরি পোশাক। এ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এখন স্থবিরতা এসেছে। কমে গেছে অর্ডার। এর প্রভাব কারখানাগুলোয় পড়তে পারে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে অনেক কারখানা। এমনকি বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যায় পড়তে পারেন গার্মেন্ট মালিকরা। তাদের সাদা পতাকা মিছিল প্রমাণ করে তারা আজ কত অসহায়। কিন্তু অর্থনীতিতে সুবাতাস যে বইবে তার কোনো লক্ষণ দেখছি না। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক সঙ্কট দেশকে পিছিয়ে দেবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা এসব নিয়ে ভাবেন না। খবর বের হয়েছে, প্রতিটি ট্যানারিতে ৪ কোটি টাকার চামড়াজাত পণ্য আটকে আছে। রপ্তানি করা যাচ্ছে না। শিল্প খাতে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে চরম আতঙ্কে আছেন উদ্যোক্তারা। সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে আছেন তৈরি পোশাকের মালিকরা। হরতাল আর অবরোধের কারণে তাদের মাথায় হাত। তাদের সংস্থা বিজিএমইএ-এর হিসাব মতে হরতাল ও অবরোধের কারণে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে গত দেড় মাসে ক্ষতি হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। একটা দেশের জন্য এই বিপুল ক্ষতি কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর রেশ আগামীতে কোথায় গিয়ে পেঁৗছাবে, ভাবতেই অাঁতকে উঠতে হয়। আর একটা বিষয় আমরা অনেকেই চিন্তা করছি না যে অবরোধ যদি এভাবে চলতেই থাকে, তাহলে দেশের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির সৃষ্টি হবে। অর্থনীতি সচল না হলে ভ্যাট আদায় হবে না। আর ভ্যাট আদায় না হলে রাষ্ট্রের আয় কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-পাওনা পরিশোধ করায় একটা সমস্যা সৃষ্টি হবে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে নোট ছাপিয়ে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে বলতে পারে। তাতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে যেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি গেল বছর ছিল ৬ দশমিক ২ ভাগ, তা কমে এসে ৫ দশমিক ২ ভাগে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এনবিআর আমাদের জানাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। দৈনিক পত্রিকাগুলো আমাদের জানাচ্ছে (১৭ ডিসেম্বর), বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট কয়েকটি দেশের সঙ্গে এখন দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে পেঁৗছেছে। দেশগুলো এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে শুরু করেছে। একটি উদ্বেগজনক সংবাদও দিয়েছেন এক প্রতিবেদক। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত বিশ্বের আমদানিকারক দেশগুলো। তাদের এ শঙ্কার কথা জানিয়ে এরই মধ্যে ৩৫টি দেশের বায়ার্স প্রতিষ্ঠান প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তারা ব্যবসার পরিবেশ না পেলে দেশে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছেন। বেশ কটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন আমি জানি না, কিন্তু পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার একটা আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এ পরিস্থিতি চলতে থাকবে বলে আমার ধারণা। কেননা নির্বাচন বাতিল করার আর কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধ্যকতা। ৫ জানুয়ারির আগে আর দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সংলাপ কার্যত এখন ব্যর্থ। আমরা বারবার বলেছি, আমাদের রাজনীতিবিদদের 'মাইন্ড সেটআপ'-এ যদি পরিবর্তন আনা না যায়, তাহলে এ ধরনের 'সংলাপ' হবে লোক দেখানো। ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর স্যার নিনিয়ানের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর আরেক ডিসেম্বরে তারানকোর উদ্যোগ ব্যর্থ হলো! এ পরিস্থিতিতে আগামীতে আর কেউ আসবেন না আমাদের নিজস্ব সমস্যার সমাধানকল্পে। এখন বিএনপিকে বাদ রেখেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ সংসদ কত দিন টিকবে, তা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু বাংলাদেশ যে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের জন্য আদৌ উপযুক্ত নয়, সে প্রশ্ন উঠবে বিভিন্ন মহলে। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই_ প্রথম সংসদ (১৯৭৩) ৩০ মাস, দ্বিতীয় সংসদ (১৯৭৯) ৩৫ মাস, তৃতীয় সংসদ (১৯৮৬) ১৭ মাস, চতুর্থ সংসদ (১৯৮৮) ৩১ মাস, পঞ্চম সংসদ (১৯৯১) ৫৬ মাস, ষষ্ঠ সংসদ (১৯৯৬) ১৩ দিন, সপ্তম সংসদ (১৯৯৬) ৬০ মাস, অষ্টম সংসদ (২০০১) ৬০ মাস, নবম সংসদ (২০০৮, ধারণা করছি ৬০ মাস) টিকে ছিল। রাজনীতির স্ট্র্যাটেজিস্টরা 'রাজনীতির অঙ্ক' কষতেই পারেন। লাভ-ক্ষতির হিসাবও কষতে পারেন কেউ কেউ। তাতে পরিস্থিতি বদলে যাবে না।
নির্বাচন হবেই। এ ক্ষেত্রে আমরা কেউ স্বীকৃতি দিই আর না দিই। দশম জাতীয় সংসদে আমরা একটা 'বিরোধী দল'ও পাব! কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হবে না। মূল সমস্যা রয়ে যাবেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক স্থাপিত না হলে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দলের মতামত নিয়ে যত দ্রুত একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা যায়, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।
Daily Jai Jai Din23.12.2013

প্রধানমন্ত্রীর একটি উক্তি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা


প্রধানমন্ত্রীর একটি উক্তি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে গত শুক্রবার। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে আভাস দিয়েছেন যদি বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয় তাহলে তিনি দশম জাতীয় সংসদ ভেঙে দেবেন! যেখানে এখন অবধি দশম জাতীয় সংসদ গঠিতই হয়নি, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের মন্তব্য নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী সরকারের মূল শক্তি। এখন তিনি যখন আভাস দেন দশম জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া হতে পারে, তখন একটা জিনিস অন্তত আমার কাছে স্পষ্ট আর তা হচ্ছে দশম সংসদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নিজেও সন্দিহান! তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ। তিনি অতীত ইতিহাস জানেন। সবার অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে সেই সংসদ স্থায়িত্ব পায় না। এখন বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হয়নি। এখন হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তারিখ অনেক আগেই ঘোষিত হয়েছে। কিছু আসনে নির্বাচন হবে বটে; কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের মতো শক্তি ইতোমধ্যে ‘সঞ্চয়’ করে ফেলেছে। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। কিন্তু এরপর কী?
বাংলাদেশের সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় রাজনীতি পুনপ্রবর্তিত হওয়ার বাইশ বছরের মধ্যে এই সংসদীয় রাজনীতি এখন বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ল। যদিও এর প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল দু’বছর আগে, যখন সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাসংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষিত হয়েছিল। সংবিধানে সর্বশেষ মহাজোট সরকারের আমলে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থায় সর্বশেষ ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী (নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য) হিসেবে রেখে দেয়া হয়েছে। সেই হিসেবে শেখ হাসিনা আজ প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু একজন দলীয় প্রধানকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয়, তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আবার প্রমাণিত হলো।’ ইতোমধ্যে আমরা জেনে গেছি, ১৫৬ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন! এমনকি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ তার প্রার্থী বাদ প্রত্যাহার করে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। তিনিও এখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি। কাউকে লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ না করার কথা বললেও ইতোমধ্যে তা বরাদ্দ করা হয়েছে। ফলে দশম সংসদ নির্বাচন একদিকে যেমনি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সংসদীয় পদ্ধতিও।
এটা সংসদীয় রাজনীতি নয়। সংসদীয় রাজনীতির যে স্পিরিট তা এখানে নেই। নেই কোনো শক্ত বিরোধী দলের অবস্থান। যা কিনা সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণ। আস্থা ও বিশ্বাসের যে কথা গণতন্ত্রে বলে তাও এখানে অনুপস্থিত। বিরোধী দলের শীর্ষ প্রায় নেতাই জেলে। কেউ বা আবার রয়েছেন আত্মগোপনে। মামলা আছে এখনো সবার বিরুদ্ধে। কেউ কেউ সম্প্রতি আদালত থেকে জামিনও পেয়েছেন। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের জন্য দরকার সব দলের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ জরুরি। দরকার স্থিতিশীলতা। দরকার পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন। কিন্তু সংবাদপত্রে যখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের অবরোধের ছবিগুলো দেখি তখন দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণটা জরুরি সেখানে এদের সবার নামেই মামলা! হয়তো আজ বা আগামীকাল আমরা দেখব আরেকটি ‘কমান্ডো স্টাইলে’ গ্রেফতারের কাহিনী। এতে কি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে? এটা সত্য, বিরোধী দল এই অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাদের কি বিশ্বাস করতে হবে এসব নেতা বাসে পেট্রোল বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন! পত্রিকায় দু’একজন দুষ্কৃতকারীর ছবিও ছাপা হয়েছে, যারা বাসে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পুলিশ এদের গ্রেফতার করতে পারেনি কেন? এসব দুষ্কৃতকারীর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এরা রাজনীতি করে না। এরা সন্ত্রাসী। যারা পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ মারে, সাধারণ মানুষদের পুড়িয়ে দেয়, অসহায় করে দেয় একটা পরিবারকে তারা তো জনগণের ‘বন্ধু’ হতে পারে না। এরা জনগণের শত্র“। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তবে এটাও সত্য, ‘হুকুমের আসামি’ হিসেবে যদি বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হয়, তাহলে তো আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। অবরোধের কারণে আমরা এখন ‘জিম্মি।’ স্থবির হয়ে গেছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ আজ আর ঘর থেকে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি কোনো ভালো কথা বলে না। এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সেক্টর থেকে পাচ্ছি একের পর এক নেতিবাচক সংবাদ। বৈদেশিক আয়ের একটা বড় উৎস হচ্ছে তৈরি পোশাক। এই তৈরি পোশাক রফতানিতে এখন স্থবিরতা এসেছে। কমে গেছে অর্ডার। এর প্রভাব কারখানাগুলোতে পড়তে পারে। বাদ হয়ে যেতে পারে অনেক কারখানা। এমনকি বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যায় পড়তে পারেন গার্মেন্টস মালিকরা। তাদের সাদা পতাকা মিছিল প্রমাণ করে তারা আজ কত অসহায়। কিন্তু অর্থনীতিতে সুবাতাস যে বইবে তার কোনো লক্ষণ দেখছি না।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক সংকট দেশকে পিছিয়ে দেবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা এসব নিয়ে ভাবেন না। খবর বের হয়েছে প্রতিটি ট্যানারিতে চার কোটি টাকার চামড়াজাত পণ্য আটকে আছে। রফতানি করা যাচ্ছে না। শিল্প খাতে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে চরম আতঙ্কে আছেন উদ্যোক্তারা। সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে আছেন তৈরি পোশাকের মালিকরা। হরতাল আর অবরোধের কারণে তাদের মাথায় হাত। তাদের সংস্থা বিজিএমইএ’র হিসেব মতে, হরতাল ও অবরোধের কারণে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকা। সেই হিসেবে গত দেড় মাসে ক্ষতি হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। একটা দেশের জন্য এই বিপুল ‘ক্ষতি’ কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর রেশ আগামীতে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে ভাবতেই আতকে উঠতে হয়! আর একটা জিনিস আমরা অনেকেই চিন্তা করছি না যে, অবরোধ যদি এভাবে চলতেই থাকে তাহলে দেশের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি সৃষ্টি হবে। অর্থনীতি সচল না হলে ভ্যাট আদায় হবে না। আর ভ্যাট আদায় না হলে রাষ্ট্রের আয় কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-পাওনা পরিশোধ করায় একটা সমস্যা সৃষ্টি হবে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে নোট ছাপিয়ে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে বলতে পারে, তাতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে যেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি গেল বছর ছিল ৬ দশমিক ২ ভাগ, তা কমে এসে ৫ দশমিক ২ ভাগে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এনবিআর আমাদের জানাচ্ছে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। দৈনিক পত্রিকাগুলো আমাদের জানাচ্ছে (১৭ ডিসেম্বর) বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট কয়েকটি দেশের সঙ্গে এখন দেশের আমদানি-রফতানিবাণিজ্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। দেশগুলো এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে শুরু করেছে। একটি উদ্বেগজনক সংবাদও দিয়েছেন এক প্রতিবেদক। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত বিশ্বের আমদানিকারক দেশগুলো। তাদের এ শঙ্কার কথা জানিয়ে এরই মধ্যে ৩৫ দেশের বায়াস প্রতিষ্ঠান প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তারা ব্যবসার পরিবেশ না পেলে ভিন্ন দেশে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছেন। বেশ ক’টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সরকারের নীতি-নির্ধারকরা বিষয়টি কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন আমি জানি না। কিন্তু পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে আগামী ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এ পরিস্থিতি চলতে থাকবে বলে আমার ধারণা। কেননা নির্বাচন বাতিল করার আর কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। ৫ জানুয়ারির আগে আর দু’পক্ষের মধ্যে কোনো সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সংলাপ কার্যত এখন ব্যর্থ। আমরা বারবার বলছি, আমাদের রাজনীতিবিদদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের রাজনীতিবিদরা সমস্যার সমাধানে যদি ব্যর্থ হন, তাহলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। সাধারণ মানুষকে ‘জিম্মি’ করে যে রাজনীতি, তা দেশ ও জাতির কোনো মঙ্গল ডেকে আনতে পারে না। বরং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখার যে সংস্কৃতি এই সংস্কৃতি জাতির মঙ্গল ডেকে আনতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী একাদশ সংসদ নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা অনভিপ্রেত। এই মুহূর্তে এটা নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। সব দলের অংশগ্রহণের যে সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতি যদি গড়ে তুলতে হয়, তাহলে নির্বাচনের তারিখ আদৌ পিছিয়ে দেয়া যায় কিনা, তা বিবেচনা করা যেতে পারে। সংবিধানে ১১নং ধারায় বলা আছে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ সেই সঙ্গে সংবিধানের ১২৩(৪) ধারাটিও আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। এই ধারায় ‘সংসদের শূন্য আসন’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনের মতে কোনো দৈব-দুর্বিপাকের কারণে এই দফার নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হয় তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ এই ধারাটি এখন বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। যদিও এখানে ‘দৈব-দুর্বিপাকের’ কথা বলা হয়েছে। এখন রাজনৈতিক সংকটকে ‘দৈব-দুর্বিপাক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না, এটা সত্য। কিন্তু এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে একটি রেফারেশন সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে। এককভাবে নির্বাচন করলে বিরাজমান সমস্যার কোনো সমাধান দেবে না। বরং প্রশ্ন উঠবে সংবিধান লঙ্ঘনের। প্রশ্ন উঠবে সংবিধানের ১১, ১২১, ১২২(২) ধারাগুলো কি লঙ্ঘিত হচ্ছে না। এই নির্বাচন আমাদের কী দেবে? যেখানে প্রধান প্রধান দলগুলোর আদৌ কোনো অংশগ্রহণ নেই, সেখানে ক্ষমতাসীন দল ও জোটকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে বটে। কিন্তু জনমানসে এটা একটা বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
অনেকেই যুক্তি দেখান সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার। এটা ঠিক ২৪ তারিখের (২০১৪) মধ্যে নির্বাচনটা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারানকো যে সংলাপের সূচনা করেছিলেন এবং যার ধারাবাহিকতায় তিনটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এটা অব্যাহত রাখা যেত। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের কাছে একটা রেফারেন্স চাওয়া যেত। আমরা ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র খবর জানি। ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটির’ আলোকে উচ্চ আদালত এই নির্বাচন ন্যূনতম দুই থেকে চার মাস পিছিয়ে দিতে পারেন। উচ্চ আদালত জাতির ক্রান্তিলগ্নে এ ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়ে মহাসংকট থেকে দেশকে উদ্ধার করেন। এখন সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। সরকার চাইলে সংলাপ অব্যাহত রাখতে পারে। এমনকি সংলাপ ও বিএনপি যে নির্বাচনকালীন একটি কাঠামোর কথা বলছে, সেটাকে ভিত্তি ধরে আলোচনা অব্যাহত রাখা যায়। তাই প্রয়োজন দূরদর্শিতার। বল এখন সরকারের কোর্টে। অর্থনীতির মন্দাভাব আর মার্কিন কংগ্রেস উইম্যান গ্রেস কিংয়ের বক্তব্যের পর আমরা অবশ্যই প্রত্যাশা করব সরকার ইতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত নেবে এবং আমরা সংকটমুক্ত হ’ব। এই সংকটের গভীরতা আরো বাড়বে যদি সত্যি সত্যিই শেষ পর্যন্ত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়ে দিয়েছে, তারা নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। এটা সরকারের জন্য একটা ‘সেট ব্যাক।’ সম্ভবত ইউরোপীয় ইউনিয়ন এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে যে এই নির্বাচনে ‘কারচুপি’(?) কোনো সম্ভাবনা নেই। যেখানে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নেই, সেখানে ‘কারচুপির’ সম্ভাবনাও নেই। তবে পর্যবেক্ষকদের অনুপস্থিতি একটা বাজে ‘মেসেজ’ বিশ্বে পৌঁছে দেবে। সরকারের জন্য তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।
এখন ৫ তারিখের নির্বাচনের শিডিউল যদি পরিবর্তন করা না হয় তাহলে অনেক ঘটনা ঘটতে পারে। ১. বিরোধী দল তাদের আন্দোলন আরো প্রলম্বিত করবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের দিন থেকে শুরু করে পরের দিনগুলোতে আমরা লাগাতার অবরোধ প্রত্যক্ষ করতে পারি; ২. অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। উত্তর বঙ্গে জাতীয় পার্টির ভোটব্যাংকে ধস নামতে পারে; ৩. দাতা রাষ্ট্রগুলোর ‘পর্যবেক্ষণের’ মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ সরকার; ৪. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রোধে সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারে; ৫. অর্থনীতির মন্দাভাব জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে রাস টেনে ধরবে। এটা ৫-এর নিচে নেমে যেতে পারে।
তাই এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। ঢাকা অনেকটা ‘স্বাভাবিক’ হলেও দেশের সর্বত্র স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়েছে বলা যাবে না। যৌথবাহিনী তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। আমরা আশা করব তাদের কার্যক্রম শুধু বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দমনের কাজে যেন ব্যবহৃত না হয়। দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করা হোক। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। তবে বিরোধী দলের সঙ্গে ‘সংলাপ’ অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের স্থায়ী রূপরেখা তৈরি করতে হবে। সরকার একটি কমিশন গঠন করুক। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিক। বিরোধী দলের মতামতও নিক। প্রয়োজনে একটি স্থায়ী কাঠামো সংবিধানে সংযোজন করা হোক। বাস্তবতা হচ্ছে ৫ তারিখের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হবে বটে। কিন্তু এই সংসদের গ্রহণযোগ্যতা নেই, এটা বিবেচনায় নিয়েই ‘সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের স্বার্থে সরকার উদ্যোগী হয়ে ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ কাঠামো তৈরি করবে যা একাদশ সংসদের নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করবে অথবা বিকল্প হিসেবে ‘উচ্চ আদালতের কাছে’ একটা ‘রেফারেন্স’ চাইতে পারে, যাতে নির্বাচন তিন মাস পিছিয়ে দেয়া যায়।
Daily Manobkontho
23.12.2013

প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনটি খারাপ দৃষ্টান্তই তৈরি করবে


আবারও লাগাতার ৮৩ ঘণ্টার অবরোধ আর ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্যের খবর যখন সংবাদপত্রগুলো আমাদের দিচ্ছে, ঠিক তখন মনে পড়ে গেল ২০০৮ সালের একটা লেখার কথা। লেখক ছিলেন ই জে সি দুরু এবং ও ও জর্জ। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘দ্য প্যারাডক্স অব ডেমোক্রেটাইজেশন ডার্জ’। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘মৃত গণতন্ত্রের স্মরণগীত’। অন্ত্যেষ্টিকালে যে শোকস্তবক উচ্চারণ করা হয়, তাকে ইংরেজিতে বলে ‘উরৎমব’। এটা পশ্চিমা সমাজের ঐতিহ্য হলেও আমরাও কিন্তু তা অনুসরণ করি। একজন মানুষ মারা গেলে জানাজায় তার সম্পর্কে কিছু ভালো ভালো কথা বলা হয় এবং তার বিগত জীবনের ভুল-ত্র“টির জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়। এটা আমাদের মুসলমান সমাজেরও ঐতিহ্য। আফ্রিকার ওই দুই লেখক উল্লিখিত প্রবন্ধে আফ্রিকার গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে ওই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। যারা আফ্রিকার রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন, বিশেষ করে ২০০৮ সালের দিকে জিম্বাবুয়ে কিংবা কেনিয়ার ঘটনাবলী সম্পর্কে যাদের কিছুটা ধারণা আছে, তারা জানেন আফ্রিকায় গণতন্ত্র চর্চা কীভাবে তখন বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। তাই ওই দুই লেখক অনেকটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে গণতন্ত্রের ‘মৃত্যু’ হয়েছে মনে করে তার জন্য শোকবাণী উচ্চারণ করেছিলেন!
বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ে কিংবা কেনিয়া নয়। আমাদের গণতন্ত্র চর্চার আলাদা একটা ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু লাগাতার অবরোধ আর একতরফা নির্বাচন এই গণতন্ত্রকে এখন একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিল। একটা বাজে দৃষ্টান্ত আরেকটা বাজে দৃষ্টান্তকে টেনে আনবে ভবিষ্যতে। ইতিমধ্যে একটা বাজে দৃষ্টান্ত আমরা তৈরি করেছি তারানকোকে মধ্যস্থতা করার সুযোগ দিয়ে। বিষয়টি একান্তভাবেই আমাদের। এখানে নির্বাচন ব্যবস্থা কীভাবে হবে, সংসদ কীভাবে চলবে- এ বিষয়গুলো একান্তভাবেই আমাদের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়েছে ‘তৃতীয় পক্ষ’ অর্থাৎ বিদেশীরা। জাতিসংঘের দূত যখন বাংলাদেশে আসেন তখন আমরা বলেছি, এটা অশনি সংকেত! এভাবে আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জাতিসংঘের মতো সংস্থা আসতে পারে না। এটা জাতিসংঘের কাজও নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনীতিকরা এ সুযোগটি করে দিয়েছেন। দাতাগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল ‘সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু সেটা হল না। এখন একটা নির্বাচন হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন! নির্বাচন হচ্ছে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নেই, সেটা কেমন নির্বাচন? এটা তো সংবিধানে বর্ণিত ১১নং অনুচ্ছেদের বরখেলাপের শামিল। ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ এখন জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হল কোথায়? আরও একটা কথা। কোথাও কোথাও এখন দু’জন সংসদ সদস্যের (যেমন পিরোজপুর-২) অবস্থান হয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ ভেঙে না দেয়ায় সেখানে এখনও একজন এমপি ‘আইনগতভাবে’ বহাল রয়েছেন। কিন্তু ওই আসনে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ আরেকজন এমপি এসে গেছেন, যিনি নবম জাতীয় সংসদে বিজয়ী হয়ে এমপি হননি। বাংলাদেশে আমরা এখন এ কোন গণতন্ত্র দেখছি! জাতীয় পার্টি একটি বড় দল। সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দল। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান তার দলের প্রার্থীদের নাম প্রত্যাহার করে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিলেও কোথাও কোথাও জাতীয় পার্টির প্রার্থী রয়ে গেছেন। অর্থাৎ সেসব আসনে নির্বাচন হচ্ছে! খোদ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানও ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হয়ে আছেন! তার প্রত্যাহারের চিঠি গ্রহণ করা হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তার দলের ৬ জন সদস্য থাকলেও (একজন উপদেষ্টাসহ) তিনি তাদের পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। মন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র পাঠালেও তা এখন অবধি গ্রহণ করা হয়নি! আমরা এ কোন গণতন্ত্র প্রত্যক্ষ করছি এ দেশে!
যখন এ নিবন্ধ তৈরি করেছি, তখন একের পর এক খারাপ খবর আসছে। সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে মার্কিন কংগ্রেসউইম্যান গ্রেস মেংয়ের একটি বক্তব্য। তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি না বদলালে মার্কিন কংগ্রেসে ফের বাংলাদেশ নিয়ে শুনানি হবে। গেল নভেম্বরে একবার শুনানিতে কংগ্রেস সদস্যরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর কংগ্রেসের ফরেন রিলেশন কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডওয়ার্ড রয়েস ও কংগ্রেসনাল বাংলাদেশ ককাসের চেয়ারম্যান জোসেফ ক্রাউলি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে চিঠি দিয়ে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতিনিধি তারানকোর বাংলাদেশে পাঁচ দিনের সফরও কার্যত ‘ব্যর্থ’ হয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার খবর অনুযায়ী কেরি প্রধানমন্ত্রীকে সরে গিয়ে নির্বাচন আয়োজন করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। যদিও সংবাদটির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিজয় দিবসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা সাভারে স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেননি। প্রতিটি ঘটনা কতগুলো মেসেজ আমাদের পৌঁছে দিচ্ছে : ক. বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দাতারা অসন্তুষ্ট; খ. তারা নিশ্চিত নির্বাচনটা প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখেই একতরফাভাবে হচ্ছে; গ. ‘একটি সিদ্ধান্তে’ আসতে পারে(?) মার্কিন কংগ্রেস। প্রতিটি ঘটনা আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। স্পষ্টতই বিদেশীদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
শুধু বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হচ্ছে তা নয়। বরং অর্থনীতির ‘বারোটা’ বেজে গেছে। তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংস্থা বিজিএমইএ’র হিসাব মতে, হরতাল ও অবরোধজনিত কারণে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে গত দেড় মাসে ক্ষতি হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। একটা দেশের জন্য এই বিপুল ‘ক্ষতি’ কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর রেশ আগামীতে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, ভাবতেই আঁতকে উঠতে হয়! আর একটা জিনিস আমরা অনেকেই চিন্তা করছি না যে, অবরোধ যদি এভাবে চলতেই থাকে, তাহলে দেশের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির সৃষ্টি হবে। অর্থনীতি সচল না হলে ভ্যাট আদায় হবে না। আর ভ্যাট আদায় না হলে রাষ্ট্রের আয় কমে যাবে। সেক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে একটা সমস্যা সৃষ্টি হবে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে নোট ছাপিয়ে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে বলতে পারে, তাতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। যেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি গেল বছর ছিল ৬ দশমিক ২ ভাগ, সেখানে তা কমে ৫ দশমিক ২ ভাগে নেমে আসবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এনবিআর আমাদের জানাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। যুগান্তর আমাদের জানাচ্ছে (১৭ ডিসেম্বর), বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দেশের সঙ্গে এখন দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশগুলো এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে শুরু করেছে। একটি উদ্বেগজনক সংবাদও দিয়েছেন প্রতিবেদক। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে শংকিত আমদানিকারক দেশগুলো। তাদের এ শংকার কথা জানিয়ে এরই মধ্যে ৩৫টি দেশের বায়ার্স প্রতিষ্ঠান প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তারা ব্যবসার পরিবেশ না পেলে ভিন্ন দেশে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছেন। বেশ ক’টি বিদেশী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন আমি জানি না, কিন্তু পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার একটা আশংকা রয়েছে। বিশেষ করে আগামী ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এ পরিস্থিতি চলতে থাকবে বলে আমার ধারণা। কেননা নির্বাচন বাতিল করার আর কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।
৫ জানুয়ারির আগে আর দুপক্ষের মধ্যে কোনো সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সংলাপ কার্যত এখন ব্যর্থ। আমরা বারবার বলছি, আমাদের রাজনীতিকদের ‘মাইন্ড সেটআপে’ যদি পরিবর্তন আনা না যায়, তাহলে এ ধরনের ‘সংলাপ’ হবে লোক দেখানো। ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর স্যার নিনিয়ানের ব্যর্থ চেষ্টার পর আরেক ডিসেম্বরে তারানকোর উদ্যোগও কার্যত ব্যর্থ হল! এতে আগামীতে আর কেউ আসবেন না আমাদের নিজস্ব সমস্যার সমাধানকল্পে। এখন বিএনপিকে বাদ রেখেই দশম জাতীয় সংসদ ‘নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই সংসদ কতদিন টিকবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু বাংলাদেশ যে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের জন্য আদৌ উপযুক্ত নয়, সে প্রশ্ন উঠবে বিভিন্ন মহলে। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- প্রথম সংসদ (১৯৭৩) ৩০ মাস, দ্বিতীয় সংসদ (১৯৭৯) ৩৫ মাস, তৃতীয় সংসদ (১৯৮৬) ১৭ মাস, চতুর্থ সংসদ (১৯৮৮) ৩১ মাস, পঞ্চম সংসদ (১৯৯১) ৫৬ মাস, ষষ্ঠ সংসদ (১৯৯৬) ১৩ দিন, সপ্তম সংসদ (১৯৯৬) ৬০ মাস, অষ্টম সংসদ (২০০১) ৬০ মাস, নবম সংসদ (২০০৮) ধারণা করছি ৬০ মাস টিকে ছিল। রাজনীতির স্ট্র্যাটেজিস্টরা ‘রাজনীতির অংক’ কষতেই পারেন। লাভ-ক্ষতির হিসাবও কষতে পারেন কেউ কেউ। তাতে পরিস্থিতি বদলে যাবে না। নির্বাচন হবেই। এ ক্ষেত্রে আমরা কেউ স্বীকৃতি দিই আর না দিই, দশম জাতীয় সংসদে আমরা একটা ‘বিরোধী দল’ও পাব!
পঞ্চম দফা অবরোধ আন্দোলন অনেক ‘বিষয়’ সামনে নিয়ে এলো। এক. নির্বাচন কমিশনকে ‘স্বাধীন’ করেও ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ কমিশন নিশ্চিত করতে পারে না। প্রশাসনের প্রভাবের বাইরে গিয়ে ইসি কাজ করতে পারে না। সুতরাং ‘স্বাধীন’ ও ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার জন্য যথেষ্ট নয়। সিইসি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচিত হলেও তিনি শেষ পর্যন্ত তার নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলেন। অতীতের অনেক ব্যর্থ কমিশনের মতো ‘রকিব কমিশন’ও ব্যর্থতার খাতায় নাম লেখাল! দুই. এবার আমাদের একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো’ গড়ে তুলতে হবে। এটা এখন সময়ের দাবি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে সরকার একটি কমিশন গঠন করে বুদ্ধিজীবীদের মতামতও নিতে পারে। তিন. সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত সব মামলা প্রত্যাহার করে নিতে পারে। এতে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পথ প্রশস্ত হতে পার। চার. পাড়ায় পাড়ায় প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলার যে আহ্বান সরকারি নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, তা প্রত্যাহার করতে হবে। এতে উত্তেজনা, সংঘাত বাড়বে বৈ কমবে না।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাই সব কথা নয়। গণতন্ত্র সহনশীলতা ও আস্থার কথা বলে। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, সহনশীলতা ও আস্থার সম্পর্ক এ মুহূর্তে নেই। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগটা তাই বাঞ্ছনীয়।
Daily Jugantor
২১ ডিসেম্বর, ২০১৩

রাজনীতি কোন পথে


আগামী দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫৪ জন প্রার্থী এরই মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। এর মধ্যে সরকারি দল আওয়ামী লীগের আবার ১৩০ জন। বৃহস্পতিবার ছিল মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর ভিত্তিতেই সংবাদপত্রগুলো এ পরিসংখ্যান আমাদের দিয়েছে। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত রয়েছে ৫ জানুয়ারি। কিন্তু তারপরও দেখি বিএনপি-আওয়ামী লীগ সংলাপ হচ্ছে। তারানকোর ঢাকা সফরের পর তিন দফা সংলাপ হয়ে গেছে। তাহলে কী নির্বাচন ওই তারিখে হচ্ছেই! এরই মধ্যে এরশাদ গ্রেফতারের ‘নাটক’ হয়েছে। এরশাদ এখন সিএমএইচে। তিনি একটা মেসেজ পাঠিয়েছেন ওখান থেকে যে, তিনি অসুস্থ নন। ‘তাকে আটকে রাখা হয়েছে’। এর আগে আমরা সংবাদপত্র থেকে জানলাম, র‌্যাব তাকে বারিধারার বাসা থেকে তুলে নিয়ে ‘চিকিৎসার’ জন্য সিএমএইচে নিয়ে গেছে! র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তিনি চিকিৎসা নিতে সিএমএইচে ভর্তি হয়েছেন। র‌্যাব তাকে শুধু নিরাপত্তাই দিয়েছে। তিনি ‘চিকিৎসা নিচ্ছেন’ (?) তিনি বলছেন, তিনি অসুস্থ নন আর র‌্যাব বলছে তিনি অসুস্থ! ‘এরশাদ নাটক’-এর শেষ এখনও হয়নি। তিনি নিজে নির্বাচনে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আবেদন করলেও, তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা হয়নি। তিনি রংপুরে প্রার্থী রয়ে গেছেন। তার দল থেকে ৬ জন মন্ত্রী ও উপদেষ্টা অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন, তারা এখনও ‘মন্ত্রী’ বা ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে আছেন কিনা, তাও স্পষ্ট নয়। কেননা এ সংক্রান্ত কোনো গেজেট প্রকাশিত হয়নি। মন্ত্রীদের পদত্যাগ নিয়েও কম ‘নাটক’ হয়নি।
৫ জানুয়ারি নির্বাচন। ২৪ জানুয়ারির আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবেÑ এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা ১৮ দল আন্দোলন করে আসছে একটি তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য। তারা অনেকটা এক জায়গায় এসে তাদের আন্দোলনকে কেন্দ্রীভূত করেছিলÑ শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি ছেড়ে দেন, তাহলে যে কোনো ‘ফর্মুলায়’ তারা সমঝোতায় যেতে রাজি। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। তাই আমরা প্রত্যক্ষ করছি, একের পর এক হরতাল আর অবরোধ। বাড়ছে সহিংসতা। দীর্ঘমেয়াদি অবরোধ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা এখন অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সংবাদপত্রে প্রতিদিন যেসব ছবি আমরা দেখছি, তা কোনো আশার কথা বলে না। রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। শত শত গাছ কেটে অবরোধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে।
অথচ পরিবেশ রক্ষার জন্য এ গাছগুলো আমাদের খুব প্রয়োজন ছিল। এরই মধ্যে ঘটে গেল কাদের মোল্লার ফাঁসির ঘটনা। এতে করে সহিংসতা আরও বেড়েছে। সহিংসতায় জানমালের ক্ষতি হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় কী? সমস্যাটা রাজনৈতিক। এর সমাধান করতে হবে রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের। অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তারা কোনো সামাধানে আসতে পারছেন না। এমনকি তারানকোর মতো একজন জাতিসংঘের দূত বাংলাদেশে ৫ দিন অবস্থান করেও সে সমাধান দিয়ে যেতে পারলেন না। ‘সংলাপ’ হচ্ছে। তৃতীয় দফা শেষ হয়েছে শুক্রবার। এটা তো সময়ক্ষেপণ করার শামিল। নির্বাচনের তফসিল পরিবর্তনের আর কোনো সুযোগ নেই। এখন তত্ত্বগতভাবে একটা ‘সমঝোতা’ হলেও, ৫ তারিখ নির্বাচন পেছানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তারানকো ‘ছাড়’ দেয়ার যে মানসিকতার কথা বলেছিলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এটা বড্ড প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোনো পক্ষ, বিশেষ করে সরকারি পক্ষ এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কিছুটা নমনীয় হয়েছিল বলেও মনে হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতা অর্পণ করে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারত। যদিও এ ক্ষেত্রে সংবিধান একটি বাধা। তারপরও রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে যদি কোনো ‘সমঝোতায়’ আমরা পৌঁছতে পারতাম, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সংবিধানের আওতায় কীভাবে এটা সম্ভব, সে ব্যাপারে আমরা উচ্চ আদালতের রেফারেন্সের জন্য তা পাঠাতে পারতাম। ঐকমত্যটা যেখানে জরুরি ছিল, সেখানে ‘স্টেট অব নেসেসিটির’ ধারণাকে মাথায় রেখে উচ্চ আদালত থেকে রেফারেন্স নিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারতাম। তারানকোর সেই ‘ছাড়’ দেয়ার আহ্বানে সরকারি দলকে আমরা এতটুকুও নমনীয় হতে দেখলাম না। শেষ অব্দি ‘বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন’ যদি না আসে, তাহলে প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই নির্বাচন হতে যাচ্ছে! যে প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের ‘পদত্যাগপত্র’ এখন অব্দি গ্রহণ করা হয়নি, একই প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের সুযোগও আর থাকল না। এ ক্ষেত্রে এরশাদের ‘প্রত্যাহারের সেই নির্দেশ’ কাগজ-কলমেই থেকে গেল! নির্বাচনে একটি ‘বড় পক্ষ’ দরকার। জাতীয় পার্টি হতে যাচ্ছে সেই ‘বড় পক্ষ’, যারা দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে! নিঃসন্দেহে সংবিধান সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে।
প্রধানমন্ত্রী জানতেন, বিএনপি না যাওয়ায় এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে নির্বাচনের আগে। এখন আগামীর ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কীভাবে চিহ্নিত হবেন, জানি না। কিন্তু জাতির বৃহত্তম স্বার্থের খাতিরে তিনি যদি নিজেকে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে নিতেন, ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকত। এ সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে গেল এখন। সংলাপ হয়তো আরও হবে। কিন্তু আমাদের ‘মাইন্ড সেটআপ’-এ পরিবর্তন না আসায়, এ থেকে ফল আসা করা যায় না। কেননা এখানে সব পক্ষের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। তারানকো দু’দলকে সংলাপে বসাতে পেরে নিজেকে ‘সফল’ মনে করেছেন বটে; কিন্তু এই ‘সফলতার’ মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। সেটি হচ্ছেও না।
আজ তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন কিংবা আমির হোসেন আমুর মতো ঝানু রাজনীতিবিদ ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হয়েছেন। তারা তাদের নামের প্রতি কতটুকু ‘সৎ’ থাকলেন, আমি নিশ্চিত নই। তারা অনেক সিনিয়র রাজনীতিবিদ। জাতি তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। কিন্তু ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে’ যে সংসদে তারা যাবেন, সেই সংসদ থেকে তাদের পাওয়ার কিছু আছে কি? নির্বাচন মানেই তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। জনগণের আস্থা নেয়া। তিনি বা তার দল যে কর্মসূচি নিয়েছে, তার প্রতি জনগণের আস্থা আছে কিনা, তা পরীক্ষা করা। কিন্তু এখন কী হলো?
সরকারি দলের নেতারা বারবার ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলেন। ওই সংসদ টিকে ছিল মাত্র ১৩ দিন। কিন্তু ওই সংসদেও তো এ রকম পরিস্থিতি ছিল না? ওই সংসদে ৪৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন; কিন্তু এবার এই সংখ্যা ১৫৪। যে নির্বাচনে আদৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না, সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার যুক্তি কী? শুধু সংবিধানের দোহাই গ্রহণযোগ্য নয়, পৃথিবীর বহু দেশে ‘জাতির বৃহত্তম স্বার্থের’ খাতিরে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। যেখানে ‘জাতির স্বার্থ’ জড়িত, সেখানে সংবিধান বড় ‘বিষয়’ হতে পারে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের রাজনীতিবিদরা এটা উপলব্ধি করতে পারলেন না। দেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দরকার সব দলের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ জরুরি। দরকার স্থিতিশীলতা। দরকার পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন। কিন্তু সংবাদপত্রে যখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের অবরোধের ছবিগুলো দেখি, তখন দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই! যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণটা জরুরি, সেখানে তাদের সবার নামেই মামলা! হয়তো আজ বা আগামীকাল আমরা দেখব আরেকটি ‘কমান্ডো স্টাইলে’ গ্রেফতারের কাহিনী! এতে করে কি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে?
এটা সত্য, বিরোধী দল এই অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাকে কি বিশ্বাস করতে হবে, এ নেতারা বাসে পেট্রল বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন! পত্রিকায় দু’একজন দুষ্কৃতকারীর ছবিও ছাপা হয়েছে, যারা বাসে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি কেন? এ দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এরা রাজনীতি করে না। এরা সন্ত্রাসী। যারা পেট্রল বোমা মেরে মানুষ মারে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে দেয়, অসহায় করে দেয় একটা পরিবারকে, তারা তো জনগণের ‘বন্ধু’ হতে পারে না। এরা জনগণের শত্রু। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তবে এটাও সত্য, ‘হুকুমের আসামি’ হিসেবে যদি বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হয়, তাহলে তো আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। অবরোধের কারণে আমরা এখন ‘জিম্মি’। স্থবির হয়ে গেছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ আজ আর ঘর থেকে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি কোনো ভালো কথা বলে না। এই পরিস্থিতিতে গুজব যে কত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, তার বড় প্রমাণ আমরা দেখলাম গাজীপুরে ২৯ নভেম্বর। পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নিহতের গুজব ছড়িয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে আগুন দেয়া হয়েছিল গাজীপুরের কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় অবস্থিত স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের পোশাক কারখানাগুলোতে। আগুন লাগার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে ১ হাজার ২০২ কোটি টাকার সম্পদ।
রোববার আলোকিত বাংলাদেশের পাতায় ছাপা হয়েছিল স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের মালিক প্রকৌশলী মোশারফ হোসেনের কান্নার ছবি। এ ঘটনায় আমাদের কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল, আমাদের রাজনীতিবিদরা কতটুকু বুঝতে পেরেছেন জানি না। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় যখন বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে একটা প্রশ্নের মাঝে ফেলে দেয় বৈকি! এই অসুস্থ রাজনীতি আমাদের একটি অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের নয়া পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। ৬ ডিসেম্বর এসেছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত তারানকো। এরপর এসেছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ওয়ারসি। বোঝা যায়, বাংলাদেশের সহিংস ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন বিশ্ব কমিউনিটি। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দল যখন ‘সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ নিশ্চিত করতে পারছে না, তখন জাতিসংঘ নিজ উদ্যোগে এখন কোনো উদ্যোগ নেবে কিনা? কিংবা তা উভয় পক্ষের মাঝে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা? অনেকে এ ধরনের ধারণা পোষণ করেন; কিন্তু এ ধরনের কোনো উদ্যোগ আমাদের সংবিধান অনুমোদন করে না।
সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচন কমিশন গঠন ও এর দায়িত্ব সম্পর্কে (১১৮-১২৬নং ধারা) বলা হয়েছে। সংবিধানের আওতায় জাতিসংঘকে এ ধরনের সুযোগ দেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দু’পক্ষ যদি রাজিও হয়, তাহলেও ‘সংবিধানের আওতায়’ কীভাবে জাতিসংঘকে অনুমতি দেয়া যায়, সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতের মতামত নিতে হবে। তবে এটা সত্যÑ সংঘাত, গৃহযুদ্ধকবলিত দেশে জাতিসংঘ এ ধরনের ‘দায়িত্ব’ পালন করে থাকে। যেমন বলা যেতে পারে নেপাল, হাইতি, তিমুর, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, লাইবেরিয়া, কম্পুচিয়ার কথা। কম্পুচিয়ায় ১৯৯৩ সালে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের আওতায় সে নির্বাচন বাংলাদেশের সেনারা পরিচালনা করেছিল। নেপালের কথা বলা হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রেজ্যুলেশন ১৭৪০ অনুযায়ী সেখানে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি ‘সহায়তা গ্রুপ’ গঠন করেছিল। এটা সত্য, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এসব দেশে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ওইসব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো মিল নেই।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট রয়েছে, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা একটা রাজনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাতে পেরেছি। একটা সংবিধান আছে। সংবিধানের ধারা-উপধারা নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার পরপরই দেশ একটি সংবিধান পেয়েছিল। কঙ্গো বা লাইবেরিয়ায় কোনো স্বীকৃত সংবিধান ছিল না। গৃহযুদ্ধ সেখানকার রাজনীতি নির্ধারণ করত। বাংলাদেশে এমনটি নেই। তবুও এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক যে, জাতিসংঘের বিশেষ দূত ‘সমঝোতার’ জন্য এ দেশে আসবেন! আমরা বারবার বলে আসছি, সমঝোতা হতে হবে প্রধান দুই শক্তির মাঝে একদিকে সরকার, অন্যদিকে বিরোধী দল। এখানে উভয় পক্ষকে কিছুটা ‘ছাড়’ দিতে হবে। ‘ছাড়’ না দিলে সমঝোতা হবে না। সুস্থ রাজনীতির স্বার্থেই একটা সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। আর যত ‘বিদেশিদের’ আমরা এড়াতে পারব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। এজন্যই দরকার ছিল রাজনৈতিক দূরদর্শিতার। সেইসঙ্গে প্রয়োজন ছিল পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা পারলেন না। বিশেষ করে সরকারি দলের নেতাদের ওপর দায়িত্বটি ছিল আরও বেশি। কিন্তু তারা তা পারলেন না।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়ে গেছে। নতুন তফসিল ঘোষণার আর সুযোগও নেই। ২০০৭ সালে নবম জাতীয় সংসদের জন্য প্রস্তাবিত তফসিল করা হয়েছিল বটে; কিন্তু তা করা হয়েছিল ‘জেনারেল ক্লজ অ্যাক্ট’ বলে। এখন এই মুহূর্তে এটা করা সম্ভব কিনা, সে প্রশ্ন এখন উঠতেই স্পষ্টতই একটা সমঝোতা দরকার। এ ক্ষেত্রে সংবিধান কোনো বাধা হবে না বলে আমি মনে করি। আমাদের সামনে অতীত অভিজ্ঞতা আছে। সমঝোতার ক্ষেত্রে, ঐকমত্যের ক্ষেত্রে সংবিধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। সংবিধানের ১১তম সংশোধনী (বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের স্বপদে ফিরে যাওয়া) এর বড় প্রমাণ। আজ সহিংসতা বন্ধে একটি সমঝোতা বড় প্রয়োজন। সরকার একটি নির্বাচন করে ফেলতে পারবে, এটা সত্য। কিন্তু ওই নির্বাচনই সব কথা নয়। দেশের স্থিতিশীলতা, দেশের অর্থনীতি, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাÑ এসব আজ সরকারকে ভাবতে হবে। সরকার এ জাতির অভিভাবক। আমরা চাই না, বারে বারে বিদেশিরা এসে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করুক। অনেক সম্ভাবনা আছে এই দেশটির। প্রয়োজন শুধু স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
একটি ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপির একটি প্রস্তাবের খবর আমরা জানতে পেরেছি। তত্ত্বাবধায়ক নয় বরং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব করেছে বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদলে তারা প্রস্তাব দিয়েছে রাষ্ট্রপতি, স্পিকার অথবা পরিকল্পনামন্ত্রীকে প্রধান করে একটি সরকার, যে সরকার নির্বাচন পরিচালনা করবে। দশম সংসদ নির্বাচনে এই ‘ফর্মুলা’ আদৌ কার্যকরী করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ রাজি হলে, দশম সংসদে এটা সংবিধানের অংশ হতে পারে। তারপর একাদশ সংসদ নির্বাচন এই ফর্মুলার আলোকে হতে পারে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ ফর্মুলার আলোকে আয়োজন করা সম্ভব নয়। তবুও আমরা চাই, একটা সমঝোতা হোক। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই সমঝোতাটি প্রয়োজন।
Daily Alokito Bangladesh
18.12.13

তারানকো কতটুকু সফল হলেন

তারানকোর বাংলাদেশ সফরের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এই সফরে বাংলাদেশ কী পেল? বহুল প্রত্যাশিত এই সফর শেষ হয়েছে। তারানকো গত বুধবারই নিউ ইয়র্ক চলে গেছেন। সারা বাংলাদেশ যখন একের পর এক লাগাতার অবরোধ প্রত্যক্ষ করছে, সহিংস ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা যখন বাড়ছে, তখন তারানকোর এই সফর 'সমস্যার' সমাধানে একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না। দেশ যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমরা কী সেই সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি? আমি তিন ভাগে তারানকোর এই সফরকে দেখছি। এক, তারানকো এক ধরনের 'দূতিয়ালির' জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। এটা জাতিসংঘ মহাসচিবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্ভব হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘ যেসব নির্বাচন সম্পন্ন করেছে (বিশেষ করে সর্বশেষ নেপালের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি), তার সঙ্গে তারানকোর দূতিয়ালিকে মেলানো যাবে না। নামিবিয়া, কম্বোডিয়া, লাইবেরিয়াসহ যেখানেই জাতিসংঘ নির্বাচন আয়োজন করেছে, সেখানেই নিরাপত্তা পরিষদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ছিল। নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকেই জাতিসংঘ সেসব দেশে নির্বাচন সম্পন্ন করে ক্ষমতা জনপ্রতিনিধিদের হাতে তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ রকমটি হয়নি। এখানে নিরাপত্তা পরিষদ তারানকোকে কোনো দায়িত্ব দেয়নি। সুতরাং তাঁর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। দ্বিতীয়ত, সংবাদ সম্মেলনে তিনি 'কিছু' কথা বলেছেন। কিছু মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এ ধরনের 'মন্তব্য' সমস্যার সমাধানে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে না। তৃতীয়ত, তারানকোর এই সফরে একটা বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। যে বিষয়টি (নির্বাচন) আমাদের দেশের নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট 'স্টেকহোল্ডার'দের দেখার কথা, তাদের ব্যর্থতাই তারানকোর মতো একজন আন্তর্জাতিক ব্যুরোক্রেটকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। এর একটা খারাপ দিক হচ্ছে- আমাদের রাজনীতিবিদরা নিজেদের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ। আমরা তাকিয়ে থাকি বিশ্বের দিকে- তারা এসে আমাদের সমস্যার 'সমাধান' করে দিয়ে যাবে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তারানকো এলেন। তাহলে কী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালেও 'আরেকজন তারানকোকে' আমাদের প্রয়োজন হবে! আমাদের রাজনীতিবিদদের বিষয়টি বুঝতে হবে। তাঁদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। ৪২ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য 'অন্যের দিকে' তাকানো, 'সমাধান করে দিয়ে যাওয়ার' আহ্বান কোনো সুস্থ চিন্তার লক্ষণ নয়।
এক কথায় তারানকোর এবারের ঢাকা সফরের ফলাফল 'শূন্য'। আমরা স্পষ্ট করে বলছি না বটে, কিন্তু বাস্তবতা এটাই। তাঁর উপস্থিতিতে দুই দফা সংলাপ হয়েছে দুই দলের মধ্যে, এর পরেও আরেক দফা সংলাপ হয়েছে। তারানকো বলেছেন, 'আলোচনায় এনেছি, তা চালিয়ে যেতে হবে।' সেটা হয়তো হবে। তৃতীয় দফা কিংবা চতুর্থ দফা 'সংলাপ' হলেও ফলাফল কী? দুটি বড় দল, বিশেষ করে সরকারি দল কি তাদের অবস্থান (প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন) থেকে কিছুটা সরে এসেছে! না, আমার কাছে তা দৃশ্যমান নয়। তাহলে এই 'সংলাপ' সংবাদপত্রগুলোর জন্য সংবাদ হলেও আমজনতার জন্য তা কোনো আশার বাণী বয়ে আনছে না। লোক দেখানো সংলাপ কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। কেননা ১২ ডিসেম্বরের খবর- আওয়ামী লীগ আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করেছে। নিজেরা ২২৭টি আসন রেখেছে। ৭৩টি আসন তারা দিয়েছে শরিকদের। এর মধ্যে ৬১টি আসন জাতীয় পার্টির। যদিও পার্টিপ্রধান এরশাদ বারবার বলে আসছেন তাঁর দল নির্বাচন করবে না, কিন্তু সাধারণ একজন মানুষও এখন জানে তাঁর কথায় বিশ্বাস রাখা যায় না।
তারানকো গত পাঁচ দিনে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছেন। কিন্তু এ দেশের মানুষ একটা ফলাফল দেখতে চায়। ফলাফলের খাতায় এখন একটা বড় 'শূন্য'। তিনি বলেছেন 'সংলাপ' চালিয়ে যেতে হবে। এটা ভালো কথা। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা নেই। যদি কোনো 'সমঝোতা' আদৌ হয়, তা হতে হবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য। তারানকো বলেছেন, 'সমাধান এখনো সম্ভব, তবে তা আসতে হবে নিজেদের মধ্য থেকে।' সমস্যাটা এখানেই। সমাধান তাঁরা বের করতে পারবেন না। তারানকো আরো বলেছিলেন, 'সংঘাত বন্ধ, আটক রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির কথা।' কিন্তু নেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়নি। সুতরাং দুই দলের সংলাপের নামে এক ধরনের নাটক হলো! আমি সমঝোতার এতটুকু চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না। প্রকারান্তরে চতুর্থ দফা সংলাপের পরও যদি 'ট্যানেলের শেষ প্রান্তে' কোনো 'আলো' দেখতে না পাই, এটা বিদেশিদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি আরো নষ্ট করবে। তারানকো আর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আসবেন- এই বিশ্বাস রাখতে পারছি না।
তারানকো 'ছাড়' দেওয়ার যে মানসিকতার কথা বলেছিলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এটা খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোনো পক্ষ, বিশেষ করে সরকারি পক্ষ এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কিছুটা নমনীয় হয়েছিল বলেও মনে হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করে তাঁর নেতৃত্বে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারত। যদিও এ ক্ষেত্রে সংবিধান একটি বাধা। তর পরও রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে যদি কোনো 'সমঝোতায়' আমরা পৌঁছতে পারতাম, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সংবিধানের আওতায় কিভাবে এটা সম্ভব, সে ব্যাপারে আমরা উচ্চ আদালতের রেফারেন্সের জন্য তা পাঠাতে পারতাম। ঐকমত্যটা যেখানে জরুরি ছিল, সেখানে 'স্টেট অব নেসেসিটির' ধারণাকে মাথায় রেখে উচ্চ আদালত থেকে রেফারেন্স নিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারতাম। তারানকোর সেই 'ছাড়' দেওয়ার আহ্বানে সরকারি দলকে আমরা এতটুকুও নমনীয় হতে দেখলাম না। শেষ পর্যন্ত 'বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন যদি না আসে, তাহলে প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সে প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। একই প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের অনেকেরই মনোনয়ন প্রত্যাহারের সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে এরশাদের 'প্রত্যাহারের সেই নির্দেশ' কাগজে-কলমেই থেকে গেছে! নির্বাচনে একটি বড় পক্ষ দরকার। জাতীয় পার্টি হতে যাচ্ছে সেই বড় পক্ষ, যারা দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে। নিঃসন্দেহে সংবিধান সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে।
প্রধানমন্ত্রী জানতেন এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে নির্বাচনের আগে। এখন ভবিষ্যতের ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে চিহ্নিত হবেন, জানি না। কিন্তু জাতির বৃহত্তম স্বার্থের খাতিরে তিনি যদি নিজেকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে নিতেন, ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকত। এই সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে গেল এখন। সংলাপ হয়তো আরো হবে। কিন্তু আমাদের 'মাইন্ড সেট-আপে' পরিবর্তন না আসায় এ থেকে ফলাফল আশা করা যায় না। আর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কোনো নির্বাচনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কেননা, এখানে সব পক্ষের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। তারানকো দুই দলকে সংলাপে বসাতে পেরে নিজেকে সফল মনে করেছেন। কিন্তু এই সফলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পাবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
Daily Kalerkontho
17.12.13

রাজনীতিতে নাটকীয় পটপরিবর্তন


বৃহস্পতিবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মানবতাবিরোধী অপরাধে কাদের মোল্লার ফাঁসি যখন কার্যকর হয়েছে, ঠিক তার পরই বারিধারায় ‘গ্রেফতার’ করা হয়েছে জাতীয় পার্টির প্রধান এইচএম এরশাদকে। তাকে ‘অসুস্থ’ অবস্থায় সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছে সরকারি ভাষ্যে এমন কথাই বলা হয়েছে। আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে একের পর এক ‘ঘটনা’ ঘটছে। ধারণা করছি নির্বাচনের আগে আরো এ ধরনের ‘ঘটনা’ আমরা প্রত্যক্ষ করব। এর আগে বহুল আলোচিত জাতিসংঘের বিশেষ দূত তারানকো বাংলাদেশে এসেছিলেন। অনেকটা ‘ব্যর্থ’ হয়ে তিনি চলে গেছেন। তার চলে যাওয়ার পর পরই ঘটল কাদের মোল্লার ফাঁসির ঘটনা, যা সব আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কার্যকর করা হয়েছে। এরশাদের ‘গ্রেফতার’ ছিল নাটকীয়তায় ভরা। এরশাদকে ‘নির্বাচনে’ আনার সব চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়, তখনই তাকে রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে আপাতত সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিল সরকার! বাজারে গুজব, রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে এবং ‘অসুস্থ’ এরশাদ চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন! নাটকের ‘পরের দৃশ্য’ দেখার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এর আগে তারানকোর বাংলাদেশ সফর একটি সম্ভাবনার জন্ম দিলেও সেই সম্ভাবনা এখন ‘মৃত’।
তারানকো চলে গেছেন। যে প্রত্যাশা নিয়ে তিনি এসেছিলেন, সেই প্রত্যাশা অপূর্ণ রেখেই তিনি চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেছেন একটা ‘কালো চিহ্ন’। তার পাঁচ দিনের ঢাকা সফরে সারাদেশের মানুষ তাকিয়েছিলেন তার দিকে। সংবাদপত্রে তার ঢাকা সফর নিয়ে বেশকিছু প্রত্যাশার ‘গল্প’ ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আমরা জানতাম তার এই ঢাকা সফর নিয়ে পাওয়ার তেমন কিছু নেই। প্রথমত, তিনি দূতিয়ালি করেছেন সত্য, কিন্তু জাতিসংঘ তাকে কোনো ম্যান্ডেট দেয়নি। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্তও ছিলেন না। তিনি কথা বলেছেন। সমাধান চেয়েছেন। কিন্তু সমাধান তার হাতে ছিল না। মূল যে দুই ‘স্টেক হোল্ডার’, সমাধান তাদের হাতেই নিহিত এবং যাওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে এটাই তিনি নিশ্চিত করে গেলেন। দ্বিতীয়ত, সংবাদ সম্মেলনে তিনি বেশকিছু ভালো কথা বলেছেন। ‘সংলাপ চালিয়ে যাওয়া’, ‘সমাধানে আসতে হবে নিজেদের মধ্য থেকে’, দু’দলের নেতাদের ‘দায়িত্বশীল আচরণ’ ও ‘ছাড় দেয়ার মানসিকতা’, ‘সহিংসতা বন্ধ ও বিরোধী দলের নেতাদের মুক্তি’ ইত্যাদি যেসব মন্তব্য করেছেন, এসব বিষয়ে আমরা মোটামুটিভাবে অবহিত। আমরা জানি ও বুঝি। এ জন্য তারানকোর মতো একজন আন্তর্জাতিক ব্যুরোক্রেটের প্রয়োজন হয় না। তার সর্বশেষ ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হলো যে, আমরা একদিকে যেমনি আমাদের নিজেদের সমস্যা আমরা সমাধান করতে পারছি না, অন্যদিকে তেমনি বিদেশি কারো মধ্যস্থতাও মানছি না। তৃতীয়ত, তারানকোর এই সফরের মধ্য দিয়ে একটা বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। যে বিষয়টি (নির্বাচন সংক্রান্ত) সমাধান করবেন আমাদের রাজনীতিবিদরা, সেখানে জাতিসংঘকে আসতে হলো। এই ধরনের ঘটনা আগামীতেও ঘটতে পারে। তাহলে কী প্রতিবারই আমাদের তাকাতে হবে বিদেশিদের দিকে? এটা কোনো সুস্থ রাজনীতি চর্চার জন্য ভালো খবর নয়।
দু’দু’বার সংলাপ হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা কোনো ফলাফল পাইনি। সরকার যে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের ব্যাপারে নিশ্চিত, তা তাদের কর্মকাণ্ড দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে আসন ভাগাভাগি করে ফেলেছে। ২২৭টি আসন তারা নিজেরা রেখেছে। অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টিকে দিয়েছে ৬১টি আসন। অথচ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ নির্দেশ দিয়েছেন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার। তাই জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল।
স্পষ্টতই দেশ আজ বড় ধরনের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের মুখে পড়েছে। ‘সংলাপ’ অব্যাহত রাখতে হলে তাতে করে ২৪ তারিখের আগে একটা সমাধানে পৌঁছতে হবে। ২৪ তারিখের পর নির্বাচন করার কোনো সুযোগ সংবিধান আমাদের দেয়নি। ফলে একটি সাংবিধানিক সংকটের মুখে পড়তে পারে দেশটি। আবার এটাও সত্য, একটা ‘সমাধান’ যে হবে, সে ব্যাপারেও কেউ নিশ্চিত নয়। এটা অনেকটা সময়ক্ষেপণ করার শামিল। কেননা ১১৬ জন তো এরই মাঝে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন! এখন শুধু গেজেটে নাম প্রকাশ বাকি। এখন এদের বাদ দেব আমরা কীভাবে? এটা তো সত্য, অসাংবিধানিক শক্তির উত্থান ও ক্ষমতা দখল রোধ করতে হলে নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সংবিধান নির্বাচনের কথাই বলছে। আর এই নির্বাচনটি হতে হবে ২৪ জানুয়ারির আগে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনের তফসিলও ঘোষিত হয়েছে এবং সরকার ও সরকারের সমর্থক কিছু দলের পক্ষ থেকে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে এখন অবধি যেটা স্পষ্ট, তা হচ্ছে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও পার্টির চেয়ারম্যানের নির্দেশের পর প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সংখ্যা কম। অন্যদিকে বাস্তবতা হচ্ছে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা ১৮ দল শুধু নির্বাচন বয়কটই নয়; বরং নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। এখন পরস্পরবিরোধী এই দুই ধারার মাঝে সমন্বয় কীভাবে হবে তার কোনো হিসাব মিলছে না। দিন যতই যাচ্ছে, ততই সংকটের গভীরতা বাড়ছে। বিশ্ব সম্প্রদায় একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের কথা বললেও এর সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। আমাদের রাজনীতিবিদদের যে দূরদর্শিতার পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন ছিল, তা তারা দিতে পারছেন না। যেখানে সমঝোতা মুখ্য ছিল, সেখানে দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রধান বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হচ্ছে। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় বেশ ক’জন নেতা এখন জেলে। এর মধ্যে সাদেক হোসেন খোকা একটি ‘রাজনৈতিক বোমা’ ফাটিয়েছেন। তিনি বলেছেন তাকে মন্ত্রী হওয়ার ‘অফার’ দেয়া হয়েছিল। কথাটির পেছনে ‘সত্যতা’ কতটুকু আছে, আমরা বলতে পারব না, কিন্তু বাজারে বড় গুজব যে, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতাকে ‘মন্ত্রী’ হওয়ার টোপ দেয়া হয়েছিল! সরকার যে ‘সর্বদলীয় ঐকমত্যের’ সরকার গঠন করেছে, তাতে বিএনপির অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বিএনপি তাতে যোগ দেয়নি। ফলে সর্বদলীয় সরকারের চরিত্র পায়নি এ সরকার। এরই মাঝে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। চলমান সংকটে এটা একটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। সহিংসতার খবর প্রতিদিনই আসছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে সব বড় বড় দেশের উৎকণ্ঠা প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা জানি না এ থেকে পরিত্রাণ কীভাবে সম্ভব?
এখনো সময় আছে একটা সমঝোতার। সুজাতা সিং কিংবা তারানকো আমাদের কোনো সমাধান দিয়ে যাবেন না। আমাদের সমস্যার সমাধান আমাদেরই করতে হবে। তাই প্রয়োজন দূরদর্শিতার। প্রয়োজন আন্তরিকতার। প্রয়োজন ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর বাস্তব প্রয়োগ। রাজনীতিবিদরা সেই কাজটিই করবেন, আমাদের এটাই প্রত্যাশা। সংবাদপত্রের পাতা কিংবা টক শোতে আমরা বারবার এ কথাটিই বলে আসছি। রাজনীতিবিদরা যদি দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে না পারেন, তাহলে তা দেশকে আরো বড় ধরনের সংকটের মাঝে ফেলে দেবে। দুঃখ লাগে, যারা সরকারে আছেন, তারা এই ‘সরল অঙ্কটি’ বুঝতে পারছেন না। গত তিন সপ্তাহে দেশজুড়ে যে তাণ্ডব চলেছে, তা কারো কাছেই ‘কাম্য’ নয়, প্রত্যাশিত নয়। একটা ‘মেসেজ’ কিন্তু এর মাঝে পৌছে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা! আমি যখন সংবাদপত্রে কানসার্টে গোলাম রব্বানীর বাড়ি পুড়তে দেখি, তখন আমাকে মনে করিয়ে দেয় তার সেই অবিসাংবাদিত ভূমিকার কথা। তিনি স্থানীয় একটি ইস্যু নিয়ে (কয়লা উত্তোলন) আন্তর্জাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা তাকে অবিসাংবাদিত নেতায় পরিণত করেছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘নেতা’। যে জনগণ তাকে ‘হিরোতে’ পরিণত করেছিল, তারাই আবার তাকে ‘পরিত্যাগ’ করল। তার বাড়িতে আগুন দিল। এর অর্থ পরিষ্কার, স্থানীয় জনগণের সায় নেই এই নির্বাচনের। যেভাবে তথাকথিত প্রার্থীদের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে তা সুস্থতার কোনো কথা বলে না। এটা সুস্থ রাজনীতির লক্ষণও নয়। এটা ‘অসুস্থ’ রাজনীতির লক্ষণ। এই ‘অসুস্থ রাজনীতি’ থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। আর উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই। যারা সাধারণ নির্বাচনে জামানত হারায়, যাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই, চাঁদাবাজির ওপর যাদের সংগঠন চলে, তাদের মন্ত্রী বানিয়ে, উপদেষ্টা করে প্রধানমন্ত্রী তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে জনসমর্থন পেয়েছেন বলে মনে হয় না; বরং তার উপদেষ্টারা তাকে সঠিক ‘উপদেশটি’ দিতে পারেননি। সুবিধাভোগীরা সবসময় ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট পেতে উৎসাহী হয়। চাঁদা নিয়ে যার সারা জীবন চলেছে, প্রধানমন্ত্রীর বদন্যতায়, তিনি মন্ত্রী-উপদেষ্টা হয়েছেন বটে, কিন্তু এতে করে মূল সমস্যার সমাধান হয়নি। মূল সংগঠনকে বাদ দিয়ে যে নির্বাচন, সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাই এখনো সময় আছে। জরুরি অবস্থাও কোনো সমাধান নয়। রাষ্ট্রপতি একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। এটা নৈতিক, সাংবিধানিক নয়। সংবিধান তাকে কোনো ক্ষমতায় দেয়নি। কিন্তু যিনি ৫০ বছর শুধু রাজনীতিই করেছেন, তিনি তো সাধারণ মানুষের ‘পালস’ বুঝতে পারবেন। গতকাল শুক্রবার লাগাতার অবরোধ শেষ হলো। শুধু রাজনীতিই নয়, অর্থনীতিও আজ হুমকির মুখে। এক ধরনের আতঙ্কের মাঝে বাস করছে মানুষ। মানুষের জন্যই সংবিধান। সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। তাই প্রয়োজনে আবারো সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি সমঝোতা। নির্বাচনের তফসিল বাতিল করাও সম্ভব। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সংবিধান মুখ্য হয়ে দেখা দেয়নি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করা হয়েছিল, তখন সংবিধানকে অনুসরণ করা হয়নি। স্থিতিশীলতার স্বার্থে এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে বিএনপিকে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়ার স্বার্থে নির্বাচনের শিডিউলে পরিবর্তন আনা। নির্বাচন আরো দুই থেকে তিন মাস পিছিয়ে দেয়া যায় কি-না এবং সংবিধানের আলোকে তা সম্ভব কি-না, সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতে একটি রেফারেন্স চাওয়া। উচ্চ আদালত ‘স্টেট অব নেসেসিটি’র আলোকে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। অতীতে উচ্চ আদালত সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধারের জন্য এভাবে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। বর্তমান সংকটকালীনও আদালত একটা দিক-নির্দেশনা দিতে পারেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সহিংস ঘটনাবলির যে ‘চিত্র’ আমরা সংবাপদত্রে দেখছি, তা যে কোনো বিবেকবান মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কোনো রাজনীতিবিদ এ ঘটনায় মারা যাননি কিংবা আহত হয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হননি। মারা গেছে সাধারণ মানুষ। গত ১২ ডিসেম্বরের সংবাদপত্র যারা পাঠ করেছেন, তারা জেনেছেন একজন মাসুমার মৃত্যুর খবর। শাহবাগের বাসে বোমা হামলায় তিনি আহত হয়েছিলেন গত ২৮ নভেম্বর। তারপর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে তিনি হেরে গেলেন। কী অপরাধ ছিল তার? এ প্রশ্নই করেছিলেন তার স্বামী মাহবুবুর রহমান। মাত্র ২৯ বছরের জীবন ছিল মাসুমার। এ জীবন আরো অনেক দীর্ঘায়িত হতে পারত, কিন্তু দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে এই ‘নষ্ট রাজনীতির’ প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েই তিনি চলে গেলেন ‘ফিরে না আসার জগতে।’ কিন্তু কপাল ভালো গীতা সরকারের। তিনি আহত হয়েছিলেন। বার্ন ইউনিটে তাকে যখন প্রধানমন্ত্রী দেখতে যান, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘আমরা আপনাদের তৈরি করেছি। আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না...আমরা ভালো সরকার চাই। আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।’
একজন গীতা সরকার যেন বলতে চেয়েছেন সবার কথা। এ কেমন রাজনীতি! অসুস্থ রাজনীতির কারণে এখন বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বার্ন ইউনিটের এক একজনের কাহিনী যখন পত্রিকায় পড়ি, তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাও রেহাই পাননি দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায়। ঢাকা কলেজের এক ছাত্র, যে আমার সন্তান হতে পারত, সেও রেহাই পায়নি বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হেরে গেল বাবু। এই অসুস্থ রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? রাজনীতি তো সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্যই, কিন্তু এ কোন রাজনীতি? যে রাজনীতি গীতা সরকারকে দগ্ধ করে, যে রাজনীতি ‘আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’ অহিদুর রহমান বাবুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়; এই রাজনীতি আমাদের কী মঙ্গল আনবে? আমার মনে আছে বছর দুয়েক আগে তুরস্কের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তুরস্কের একজন অধ্যাপকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন মওলানা ভাসানী সম্পর্কে, আজীবন যিনি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। ক্ষমতার ‘দৌড়ে’ তিনি কোনো দিন হরতাল ডাকেননি! অবরোধ ডাকেননি এভাবে! মানুষ মারার রাজনীতি তিনি করেননি। ‘নষ্ট রাজনীতি’র কারণে জিম্মি হয়ে গেছে সাধারণ মানুষ।
আবারো হরতাল শুরু হচ্ছে! আজ জামায়াত কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে। এর আগেই অনলাইনে যেসব খবরাখবর পাচ্ছি, তা আমাদের দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা কোথায় যাচ্ছি? নির্বাচন মানেই একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। কিন্তু ৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে তৈরি হয়েছে একটা ভয়ের আবহ। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের। তাদের দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হব
Daily Manobkontho
15.12.13