রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

রাশিয়ার সঙ্গে দুটি চুক্তি ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি রাশিয়া সফর করেছেন। বঙ্গবন্ধু দু’দুবার মস্কো সফর করেছিলেন। প্রথমবার ছিল রাষ্ট্রীয় সফর আর দ্বিতীয়বার ছিল ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্য। প্রথমবার তিনি রাষ্ট্রীয় সফরে যান ১৯৭২ সালের ২ মার্চ। এর আগে ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালের মে মাসে। তবে প্রথম সফর বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণার জš§ দিয়েছিল। এরপর দীর্ঘ সময়ে কোন সরকারপ্রধান মস্কো সফর করেননি। এমনকি ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ২১ বছর অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের কোন সরকারপ্রধান মস্কো সফরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। এটা সত্য যে, নব্বই-পরবর্তী রাশিয়ার অর্থনীতির ভঙ্গুর দশা বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহ জোগায়নি মস্কো সফরে যেতে। এমনকি ব্যবসায়ী নেতারাও রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করার ব্যাপারে উৎসাহিত হননি। বিশ্ব আসরে রাশিয়া একটি শক্তি, সন্দেহ নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্ব আসরে তার গ্রহণযোগ্যতা কম। তুলনামূলক বিচারে চীন সব দিক থেকে এগিয়ে আছে। চীন এখন বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের পরই তার অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে।
এমনই এক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা যখন মস্কো যান, তখন সঙ্গত কারণেই পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এদিকে থাকে। শেখ হাসিনার মস্কো সফরের সময় তিনটি চুক্তি ও ছয়টি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। এক, প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রাশিয়া থেকে সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র ক্রয়। দুই, পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রস্তুতিমূলক অর্থায়নে সহযোগিতা। এখানে বাংলাদেশ ৫০ কোটি ডলার ঋণ পাবে। রূপপুরে পারমাণবিক কেন্দ্রের কারিগরি গবেষণার জন্য এই অর্থ। কেন্দ্র নির্মাণে কত টাকা লাগবে, তা এখনও নির্ধারিত হয়নি। এ ব্যাপারে পরে চুক্তি হবে। আপাতত দুই বছরের মধ্যে এই ৫০ কোটি ডলার ব্যয় করা হবে কারিগরি গবেষণায়। এর বাইরে যেসব এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও আট হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ক্রয় বিতর্ক বাড়াবে। মেয়াদের শেষ সময়ে এসে সরকার যখন এত বিপুল অর্থ ব্যয় করার উদ্যোগ নেয়, তখন বিতর্ক থাকবেই।
প্রথম বিতর্ক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরিতে বিনিয়োগ অনেক বেশি। তুলনামূলক বিচারে যদি রিস্ক ফ্যাক্টরকে বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ সস্তা নয়। এখানে নিরাপত্তা ঝুঁকিটা সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞান এখনও সেই নিরাপত্তার পূর্ণ গ্যারান্টি দিতে পারেনি। ১৯৮৬ সালে আজকের ইউক্রেনের চেরনোবিলে পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর ২০১১ সালে জাপানের ফুকুসিমায় যখন পারমাণবিক চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটে তখন বুঝতে হবে, বিজ্ঞান এখনও পারমাণবিক চুল্লির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রযুক্তি খুঁজে পায়নি। বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে, যেখানে নিজস্ব জনশক্তি নেই, সেখানে একটি পারমাণবিক কেন্দ্রের নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে? জাপানের ফুকুসিমায় বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশনের মাত্রা বেড়েছিল ৫-এ। চেরনোবিলের রেডিয়েশনের মাত্রা ছিল ৭। আর যুক্তরাষ্ট্রের থ্রি মাইল আইল্যান্ডে বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশনের মাত্রা ছিল ৫। পরিসংখ্যান বলছে, চেরনোবিল বিস্ফোরণের পর ওই অঞ্চলে ক্যান্সারের প্রকোপ বেড়েছিল ৪০ ভাগ। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী বেলারুশের কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রফতানিতে মারাÍক ধস নেমেছিল। চেরনোবিলের বিস্ফোরণের পর পুরো নিউক্লিয়ার প্লান্ট তো বটেই, ওই গ্রামের একটা বড় অংশ মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু জার্মান সাংবাদিক আন্দ্রেই ক্রেমেনশক ২০১১ সালের মার্চে চেরনোবিলের আশপাশের এলাকা সফর করে তার প্রতিবেদনে লেখেন, মাটিচাপা দেয়ার পরও সেখান থেকে তেজস্ক্রিয়তা বেরুচ্ছে। ২০১১ সালের ১৭ মার্চ ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে চার্লস হোমন্স যে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন (এটমিক ডগ্স), তাতে তিনি বুলগেরিয়া, তুরস্ক, আরমেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ঝুঁকির মাত্রা ও অব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তার প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, তুরস্কের একাধিক পারমাণবিক প্লান্ট প্রতিবাদ ও দুর্ঘটনার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাশিয়ার কোম্পানি (যারা বাংলাদেশেও প্লান্ট তৈরি করার দায়িত্ব পেয়েছে) রোসাতম ওইসব প্লান্ট (তুরস্কের আক্কুজুতে) তৈরি করেছিল। বুলগেরিয়ায় কোজলোদুইয়ে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে, তা ১৯৯৫ সালেই যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। আর্মেনিয়ার মেটসামোরে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল, তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের আপত্তির মুখে ও ঝুঁকি এড়াতে ১৯৮৯ সালে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। জাপানের ‘সিক্কা’র পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও ১৯৯৯ সালে দুর্ঘটনার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তবে এটিও সত্য, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঝুঁকির মুখে থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে চীনে ২৭টি, রাশিয়ায় ১১টি ও ভারতে ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। একই সঙ্গে পরিকল্পনা আছে চীনে আরও ৩০টি, ভারতে ১৮টি, জাপানে ১২টি, রাশিয়ায় ১৪টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার। তবে জাপান সেই পরিকল্পনা ফুকুসিমার পর স্থগিত করেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কিন্তু খুব বড় অবদান রাখছে না। আন্তর্জাতিক এনার্জি এজেন্সির মতে, পারমাণবিক বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে শতকরা ৬ ভাগ হারে, ২০৩৫ সালে যা বাড়বে ৮ ভাগ হারে। ২০০৮ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল, সেখানে পারমাণবিক বিদ্যুতের অংশ ছিল মাত্র ১৩.৫ ভাগ। সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয়েছে কয়লা থেকেÑ ৪০.৯ ভাগ। তেলে ৫.৫ ও গ্যাসে ২১.৩ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল। সুতরাং শুধু পারমাণবিক বিদ্যুৎই যে সমাধান, তা বলা যাবে না। অস্ট্রেলিয়ায় কোন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই। তারা তাদের বিদ্যুতের চাহিদা মেটায় কয়লা থেকে। বাংলাদেশে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হবে। কিন্তু ফুলবাড়ির ঘটনায় আমরা রীতিমতো আতংকিত। কারণ সেখানে আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এলাকাবাসীর দাবি, ফুলবাড়ির কয়লা উত্তোলনের সময় স্থানীয় লোকজনকে তাদের ভিটাবাড়ি ছাড়তে হবে। জাতীয় পর্যায়েও কয়লা তোলা ও এশিয়া এনার্জির ভূমিকা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। জাতীয় পর্যায়েও এটা নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। সুতরাং রূপপুরে যখন পুরোপুরি কাজ শুরু হবে, তখন এই পারমাণবিক প্রকল্প নিয়েও আন্দোলন হবে। সেক্ষেত্রে একটা শংকা থেকেই গেল।
দ্বিতীয় চুক্তিটি অস্ত্র ক্রয় সংক্রান্ত। এ চুক্তিটি ইতিমধ্যেই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। রাশিয়ার ঋণের ধরন (যা দিয়ে অস্ত্র কেনা হবে) দেখে বলা যায়, এটি নন-কনসেশনাল। বাংলাদেশে কোন স্বীকৃত প্রতিরক্ষা নীতিমালা নেই, কাজেই কোন্ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এ অস্ত্র কেনা হল তা পরিষ্কার নয়। আমাদের সেনাবাহিনীর অস্ত্রের অন্যতম উৎস চীন। এখন সেই স্বাভাবিক উৎসকে বাদ দিয়ে রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির কোন পরিবর্তনের ইঙ্গিত কি-না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারে। তবে এটা যে পশ্চিমা বিশ্বে ভুল সিগনাল পৌঁছে দেবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চীন বিষয়টি ভালো চোখে দেখবে না। ফলে চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে যে আগ্রহ দেখিয়েছিল, তাতে ভাটা পড়তে পারে। ইতিমধ্যে আইএমএফের পক্ষ থেকে নেতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়েছে। আইএমএফ বাংলাদেশকে ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার সুদমুক্ত ঋণ দেবে। এর প্রথম কিস্তি ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলার আমরা পেয়ে গেছি। এখন দ্বিতীয় কিস্তি আটকে যেতে পারে। তবে আমাদের জন্য যা দুর্ভাগ্যের তা হচ্ছে, রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনার আগে বিষয়টি আমরা জানলাম না। একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল একটি দৈনিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অস্ত্র কেনা হয়েছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় (আমার দেশ, ২০ জানুয়ারি)। অভিযোগ উঠেছে, রাশিয়ার অস্ত্র ক্রয়ে একটি ‘তৃতীয় পক্ষে’র উপস্থিতি রয়েছে। এই চুক্তি নিয়ে যে অস্পষ্টতা তা হচ্ছে, এর সঙ্গে কোন শর্ত যুক্ত কিনা। যদিও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোন শর্ত যুক্ত নেই। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অস্ত্র কেনায় সুদ দিতে হবে সাড়ে ৪ শতাংশ। এই ঋণ ব্যবহার করতে হবে ২০১৩-১৭ সালের মধ্যে। আর ২০১৮ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০ কিস্তিতে ১০ বছর ধরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, অস্ত্র ক্রয়ে কোন অস্বচ্ছতা নেই। বলা হয়েছে, এই অস্ত্র সেনাবাহিনী শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে ব্যবহার করবে। এই পরিসংখ্যান নিয়েও কথা বলা যায়। বিশেষ করে সুদের হার বেশি বলেই মনে হয়। তবে আমার কাছে যা মনে হয় তা হচ্ছে, এই চুক্তি আমাদের বৈদেশিক ও সামরিক নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত বহন করে। কারণ আমাদের বৈদেশিক নীতি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা চীনের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের বিমানবাহিনী চীনা বিমান ব্যবহার করে। সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রও চীনের তৈরি। আমাদের সামরিক নেতৃত্ব চীনা যুদ্ধাস্ত্রের ওপর অনেক দিন থেকেই নির্ভরশীল। আমাদের উন্নয়নে চীন অন্যতম অংশীদার। চীন আমাদের নিকট প্রতিবেশীও। আমাদের উন্নয়নে চীনের উপস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই সরকারপ্রধান চীনে গিয়েছিলেন। এমনকি বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও সম্প্রতি চীনে গিয়েছিলেন এবং তারা দু’জনই লালগালিচা সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। চীন সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই মহাসড়ক ও গভীর সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের চেহারা আগামী দশকে বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশ হতে পারে এ অঞ্চলের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। চীন শ্রীলংকার হামবানটোটায় (প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জš§স্থান) গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে একটি বিমানবন্দরও চীন তৈরি করে দিয়েছে। সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন আগ্রহও দেখিয়েছিল। এটা নির্মিত হলে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের ‘সাত বোন’ রাজ্যগুলো যেমন এটি ব্যবহার করতে পারবে, তেমনি পারবে চীন ও মিয়ানমারও। এখন সঙ্গত কারণেই রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক চুক্তি চীন খুব সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। চীনারা এসব ক্ষেত্রে খুবই রক্ষণশীল। তারা খুব দ্রুতই প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বোধকরি এ ব্যাপারে কোন সরকারি মন্তব্যও আমরা পাব না। তবে যা হবে তা হচ্ছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনা আগ্রহের ঘাটতি আমরা দেখতে পাব। আগামী মার্চে চীনে নয়া নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করছেন। শি জিন পিং ইতিমধ্যে পার্টিপ্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং মার্চে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও নেবেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা রয়েছে। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং বেগম খালেদা জিয়া যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এখন এই অস্ত্র ক্রয় চুক্তিতে চীনে বাংলাদেশ ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে।
এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজনÑ বাংলাদেশের এই মুহূর্তে অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন হল কেন? বাংলাদেশের নিরাপত্তা এ মুহূর্তে কোন ঝুঁকির মুখেও নেই। এত বিপুল অস্ত্রের আদৌ প্রয়োজন ছিল না। অস্ত্রশস্ত্রের চেয়ে এ মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। অস্ত্র খাতে নয়, বরং অন্য খাতে আমরা ঋণ নিতে পারতাম। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর চার ভাগের এক ভাগ এখনও গরিব। ‘আইলা’ ও ‘সিডর’ আক্রান্ত এলাকায় মানুষ এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছে। সুপেয় পানির বড় অভাব সেখানে। ২০১৫ সালের মধ্যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস (এমডিজি) বাস্তবায়ন এখন ঝুঁকির মুখে। সরকার এখন রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে হাজার হাজার কোটি টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ করবে! এই আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর কোন উপকার হবে বলে মনে হয় না। সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের কারণে জাতিসংঘ থেকেই আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পায়। সেই অস্ত্রশস্ত্র তারা দেশেও নিয়ে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে এত বিপুল অংকের টাকা দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র কেনার প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশের এই মুহূর্তে কোন শত্র“ রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কম। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত রয়েছে। এই দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ আদৌ কোন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বেÑ এটি শুধু বোকারাই চিন্তা করতে পারে। দিন বদলে গেছে। মানুষ সচেতন হয়েছে। সব তথ্যই আজকাল পাওয়া যায়। সুতরাং সাধারণ মানুষের দিকে নজর না দিয়ে আট হাজার কোটি টাকার সমরাস্ত্র ক্রয় বিতর্ক বাড়াবে। এর সঙ্গে রয়েছে তৃতীয় কোন পক্ষের জড়িত থাকার বিষয়টি। আমরা এখনও নিশ্চিত নই। তবে মিগ বিমান ক্রয়ে একটি তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি আমরা দেখেছিলাম।
আমরা নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে চাই। সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। কিন্তু এভাবে নয়। যে সমরাস্ত্রের সঙ্গে আমাদের সেনাবাহিনীর পরিচয় নেই, সেই সমরাস্ত্র এনে আমাদের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা যাবে না। সমরাস্ত্র ক্রয়ের নাম করে আমাদের রাশিয়ার ওপর নির্ভর করে তোলা আমাদের প্রতিরক্ষা নীতির জন্য ভালো কোন খবর নয়। সরকার শেষ সময়ে এসে এই চুক্তিটি না করলেও পারত। আমরা চাই, সরকার সামাজিক সমস্যাগুলোর দিকে নজর দিক। দারিদ্র্য দূরীকরণের উদ্যোগ নিক। জনগণের সরকার জনগণের জন্য কাজ করবে, এটাই প্রত্যাশিত।
Daily JUGANTOR
30.01.13

লাদেন এবং সামসাম্প্রতিক ভাবনা

ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকা-ের এক সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরও তাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোচনার শেষ নেই। যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যে যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছিল, তার অবসান ঘটবে কি-না। এ নিয়ে নানা কথাবার্তা বলা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া সত্যিই কঠিন। ওসামার হত্যাকা-, হত্যাকা- নিয়ে ওবামা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য, পাকিস্তানের ভূমিকা ইত্যাদি নানা বিষয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ওসামার মৃত দেহের ছবি প্রকাশ না করা, দ্রুত ডিএনএ টেস্ট সম্পন্ন করা, মৃতদেহের প্রতি নূ্যনতম সম্মান না জানিয়ে তা আরব সাগরে দ্রুত ভাসিয়ে দেয়া ইত্যাদি নানা বিষয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে, যা কি-না বিতর্কের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে গত ৪ মে বহুল পঠিত ও নির্ভরযোগ্য একটি ম্যাগাজিন ঋড়ৎবরমহ চড়ষরপু একটি সিরিজ ছবি প্রকাশ করেছে (ঞযব করষষবৎং খধরৎ, ৪ গধু, ১১)। তাতে অ্যাবোটাবাদে যে বাড়িটিতে ওসামা বিন লাদেন থাকতেন বলে বলা হচ্ছে, ওই বাড়ির ও বাড়ির আশপাশের বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। একটি ছবি নিয়ে বিতর্ক ও নতুন জল্পনাকল্পনার জন্ম দিতে বাধ্য। ওই ছবিটি ২০০৫ সালের ১৫ জুনের তোলা। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ওই বাড়িটি, যেখানে ওসামা থাকতেন। সম্ভবত ছবিটি সিআইয়ের তোলা এবং ঋড়ৎবরমহ চড়ষরপু গধমধুরহব তা সংগ্রহ করেছে। পাঠক বোঝার চেষ্টা করুন ছবিটি ২০০৫ সালের এবং সিআইএ আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে ওসামা এখানে থাকতে পারেন। এর অর্থ কী? সিআইএ জানতো ওসামা বিন লাদেন কোথায় আছেন। ২০০৫ থেকে ২০১১ সময়টা অনেক লম্বা। ওই সময় ওসামাকে হত্যা বা গ্রেফতার করা হলো না কেন? আজ ২০১১ সালের মে মাসে তাঁকে হত্যা করা হলো এমন একটা সময় যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র এক বছর এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থার কারণে বারাক ওবামার পুনরায় বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছিল! ওসামা মারা যাওয়ার সময় তার পকেটে পাওয়া গেল মাত্র ৫৫০ ইউরো! যিনি বিলিয়ন ডলারের মালিক, তার পকেটে কি-না মাত্র ৫৫০ ইউরো! ওসামা মারা গেছেন, এটা আল-কায়েদাও স্বীকার করেছে। তাকে কী 'বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য' বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল? এসব প্রশ্ন এখন উঠেছে। আর ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক। অ্যাবোটাবাদের মতো ছোট একটি শহরে একটি বাড়িতে তিনি থাকলেন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা এটা জানবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে এখানে আরো একটি প্রশ্ন উঠেছে। খোদ আইএসআই কী শেষ পর্যন্ত লাদেনের খবর জানিয়ে দিয়েছিল মার্কিন কর্তৃপক্ষকে? পাঠক, স্মরণ করার চেষ্টা করুন গেল ১১ এপ্রিল ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন আইএসআই প্রধান জেনারেল আহমেদ সুজা পাশা। জেনারেল পাশা সিআইএ প্রধান লিওন পেন্ট্রার সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিতও হয়েছিলেন। তাদের মাঝে কী ধরনের আলোচনা হয়েছে, তার বিররণ মিডিয়ায় জানান হয়নি। হতে পারে 'কোনো বড় ধরনের প্রাপ্তির আশায় আইএসআই লাদেনের খোঁজটি জানিয়ে দিল মার্কিন কর্তৃপক্ষকে। যদিও আইএসআই অস্বীকার করেছে যে, তারা লাদেনের আস্তানার ঠিকানা জানতো; কিন্তু এই বক্তব্য কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
সত্যিকার অর্থেই পাকিস্তানের ভাবমূর্তি আজ বিশ্বে যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিল যে, পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের 'প্রমট' করছে। লাদেনের ঘটনায় এটা এখন প্রমাণিত হলো। ভারত এখন দাবি করছে যে ২০০৮ সালের মুম্বাই সন্ত্রাসী কর্মকা-ের হোতারা পাকিস্তানে লুকিয়ে আছে। ভারত তাদের গ্রেফতার ও ভারতের কাছে হস্তান্তরের দাবি করেছে। বিশ্ব আসরে ভারতের এ দাবি আরও শক্তিশালী হবে এখন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাকে এখন বিশ্বব্যাপী ভিন্ন চোখে দেখা হবে। আগামীতে গোয়েন্দ সংস্থার কর্মকর্তারা যদি ইউরোপ তথা আমেরিকায় নিষিদ্ধ হন আমি আবাক হব না। পাক প্রধানমন্ত্রী গিলানির সরকারের জন্যও এটা খারাপ সংবাদ। দুটো কারণে গিলানি সরকারকে এখন 'কঠিন পরীক্ষার' মুখোমুখি হতে হবে। প্রথমত, বিরোধী দল বিশেষ করে ইসলামিক দলগুলো এটাকে ইস্যু করবে এবং সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করবে। নওয়াজ শরিফ এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছেন। দ্বিতীয়ত, মার্কিন ৪টি হেলিকপ্টার তার টার্গেট এ (এবৎড়হরসড়- লাদেনের কোড নাম) যখন হামলা করলো, তখন পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। এটা স্পষ্টতই পাকিস্তানের সাবধানতা ও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ এই অভিযোগটি তুলেছেন। এর পেছনে যুক্তি আছে। মৌলবাদী সংগঠনগুলো এটাকেও ইস্যু করেছে ইতিমধ্যে। এমনিতেই সরকারের অবস্থান বেশ নড়বড়ে। চালকবিহীন ড্রোন বিমান হামলা সেখানে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এ যাবত প্রায় ২০০ ড্রোন হামলা পাকিস্তানের ভেতরে পরিচালিত হয়েছে। বলা হয়েছে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এই বিমান হামলা হচ্ছে। এর পেছনে সত্যতা যাই থাকুক, বাস্তবতা হচ্ছে এসব হামলায় পাকিস্তানি নাগরিকরা মারা যাচ্ছেন। এটা তো একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করার শামিল। পাক সরকার এর বিরুদ্ধে কোনো সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বলা যেতে পারে পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন চালকবিহীন ড্রোন বিমান হামলা ঠেকাতে। সরকারের জন্য এটা ভালো নয়। আরো একটি বিষয়, যা নিয়ে আমি চিন্তিত, তা হচ্ছে পাকিস্তান কী শেষ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারবে। লদেনের মৃত্যুর খবর জানাজানি হওয়ার পর লাহোরে বড় ধরনের জানাজা হয়েছে। লস্করই তালিবান নেতা হাফিজ মোহাম্মদ সাঈদ এই জানাজা পরিচালনা করেন। সেখান থেকে প্রতিশোধের কথা উচ্চারিত হয়েছে। প্রতিশোধের কথা বলেছে তেহরিকই তালিবান নামে আরেকটি সংগঠন। কোয়েটায় লাদেনের সমর্থনে মিছিল বের হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার_ পাকিস্তানে এই জঙ্গিবাদী মনোভাব আরো শক্তিশালী হলো। এরা পাকিস্তানের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। ধীরে ধীরে পাকিস্তানে সনাতন রাজনীতির 'মৃত্যু' ঘটতে পারে এবং মৌলবাদী চিন্তা চেতনা পাকিস্তানে আরো শক্তিশালী হতে পারে। ফলশ্রুতিতে ঋঅঞঅ অঞ্চল এক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, অথবা আফগানিস্তানের সঙ্গে মিশে গিয়ে বৃহত্তর একটি 'পাখতুনিস্তান' গঠন করতে পারে। শুধুমাত্র ইসলামাবাদ আর লাহোর শহরকেন্দ্রিক ছোট্ট এক পাকিস্তান তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা সামরিক নেতৃত্ব আজ কতটুকু বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন, সেটাই দেখার বিষয় এখন। সত্যিকার অর্থেই পাকিস্তান আজ বড় ধরনের এক সংকটের মুখোমুখি।
লাদেনের মৃত্যু হয়েছে। সেই সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে একটি অধ্যায়ের। ওসামা বিন লাদেন তাকে ফিরে একটি 'মিথ' তৈরি করেছিলেন। তবে অনেক প্রশ্নেরই কোনো জবাব হয়ত কোনোদিনই পাওয়া যাবে না এবং বিশ্ববাসী হয়তো কোনোদিনই জানবে না কে বা কারা লাদেনকে কেন এবং কোন কাজে 'তৈরি' করেছিল। যে ব্যক্তি সারাবিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, যার সুপরিকল্পিত পরিকল্পনায় ৯/১১-এর জন্ম হয়েছিল, তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে কোনো ইন্টারনেট বা টেলিফোন ছাড়া অ্যাবোটাবাদে একাকী থাকবেন, এটা বিশ্বসযোগ্য নয়। যিনি শত শত 'যোদ্ধা' তৈরি করেছেন, যারা তার একটি মাত্র নির্দেশে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাতে পারে, নেতা হিসেবে লাদেনের তো তাদের সঙ্গেই থাকার কথা? ইসলামের 'শত্রুদের' বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ করার কথা, যেমনি করেছিলেন তামিল টাইগার নেতা প্রভাকরণ? যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় লাদেন বাস করলেন স্ত্রী-সন্তানসহ কোনো ধরনের শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা ছাড়া? এটা কী নতুন করে কোনো প্রশ্নের জন্ম দেবে না?
লাদেনের এই মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ' এর অবসান ঘটাবে না। ইয়েমের, আলজেরিয়া, মালি, ইরাক, আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানে আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক আরো শক্তিশালী হবে। তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের সমবেদনা আরো বাড়বে। মৃত লাদেন আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন। লাদেনকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাব আরো স্পষ্প হলো। এর মধ্যে দিয়ে এটা আবারো প্রমাণিত হলো আগ্রাসন ও বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব করার যে মানসিকতা। সেই মানসিকতার প্রশ্নে বুশ আর ওবামার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বুশ যে যুক্তিতে ইরাকে আক্রমণ চালিয়েছিল, আজ ওবামা অনেকটা একই ধারাবাহিকতায় একটি স্বাধীন দেশের (পাকিস্তান) স্বাধীনতাও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করলেন। এটাই হচ্ছে স্নায়ুযুদ্ধোত্তর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য দিক। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে একক পরাশক্তি হেসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করবে। ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর কায়রো সফর করেছিলেন। সেখানে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে মনে হয়েছিল তিনি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন একটি মাত্রা দিতে চান; কিন্তু লাদেনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (হেগে) বিচারের মুখোমুখি না করে, তাকে হত্যা করা_ কোনো আন্তর্জাতিক আইন তা অনুমোদন করে না। তাই মার্কিনি ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আল-কায়েদা প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলছে। এখন আমাদের শুধু অপেক্ষার পালা- প্রতিশোধটি কেমন এবং কোন পর্যায়ে যায়, তা দেখার। একজন ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু উত্থাপিত সব প্রশ্নের কোনো সমাধান দিলো না। 
পূর্বে প্রকাশ @ দৈনিক ডেসটিনি, ১১/০৫/১১

অস্ত্র ক্রয় ও দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা


প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরে যে আট হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা নিয়ে নানা মহলে নানা কথাবার্তা হচ্ছে। বিএনপি অস্ত্র ক্রয়ের সমালোচনা করলেও, একই সঙ্গে ক্রয় প্রক্রিয়ায় 'কমিশন'-এর অভিযোগ তুলেছে। সেনাবাহিনীর স্বার্থেই অস্ত্র ক্রয় করা হয়েছে। তবে যে প্রশ্নটি সহজেই করা যায়, তা হচ্ছে বিশ্ব মন্দার এই যুগে রাশিয়ার সঙ্গে এই মুহূর্তে অস্ত্র কেনার প্রয়োজন ছিল না। সামাজিক খাতকে অগ্রাধিকার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে সরকার যখন বিদেশি ঋণে অস্ত্র ক্রয় করে, তখন বিতর্কের মাত্রাটা বাড়ে বৈকি! আরো একটা কথা। অতীতেও প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য অস্ত্র ক্রয় করা হয়েছে। কিন্তু তখন প্রশ্ন ওঠেনি এবং সেনাবাহিনীকে সংবাদ সম্মেলন করে এর ব্যাখ্যাও দিতে হয়নি। আজ কেন দিতে হলো, এটাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। অঙ্কের হিসাবে এটা অনেক টাকা। সুদ দিতে হবে ৪ শতাংশ, যার পরিমাণ একটু বেশিই। এই ঋণ ব্যবহার করা হবে ২০১৩-১৭ সালের মধ্যে। আর ২০১৮ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০ কিস্তিতে ১০ বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রায় এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। যে পরিমাণ টাকা আমাদের সুদসহ পরিশোধ করতে হবে, তা একেবারে কম নয়। এই মুহূর্তে আমাদের প্রায়োরিটি অবশ্যই অস্ত্রশস্ত্র নয়, বরং দারিদ্র্য দূরীকরণ তথা সামাজিক খাতের উন্নয়ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন বাংলাদেশের একচতুর্থাংশ মানুষ গরিব। তাদের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। শত শত মানুষ জলবায়ু শরণার্থী হিসেবে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের পেশার পরিবর্তন হয়েছে। তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। আইলা ও সিডরের কারণে দক্ষিণাঞ্চলে যে ক্ষতি হয়েছিল, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। জোয়ারে পানি ঠেকাতে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা যায়নি। সুপেয় পানির অভাব ওই সব অঞ্চলে। নূ্যনতম এই নাগরিক অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা বৈদেশিক সহায়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। কিন্তু এই সহায়তাও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে আমরা গরষষবহরঁস উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং (গউএ)- এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব না। জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত বেশ কিছু ক্ষেত্রে ২০১৫ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। যেমন, প্রাথমিক শিক্ষায় লৈঙ্গিক সমতা, সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, শিশু মৃত্যু হার কমানো, মাতৃ স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া, অন্যান্য সংক্রামক রোগের বিস্তার কমানো, পরিবেশগত স্থিতিশীলতা ইত্যাদি। যেখানে আইলা ও সিডর আক্রান্ত এলাকায় শত শত পরিবার নিজেদের গৃহে ফিরে যেতে পারেনি এবং এখনো বেড়িবাঁধের ওপর তাদের বসবাস, সেখানে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ কোথায়? ওই এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা চরমে উঠেছে। মাতৃস্বাস্থ্যেরও যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। তাই বাংলাদেশ যে ২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না, তা একরকম নিশ্চিত। 'সিডর' ও 'আইলা' আক্রান্ত এলাকায় সরকারের নীরবতা ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সরকার নিজ উদ্যোগে কোনো বড় কর্মসূচি নেয়নি। সরকার গুরুত্ব দিয়েছে বৈদেশিক অর্থ প্রাপ্তির। যে কারণে সেখানকার মানুষ এক মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে সরকার রাশিয়া থেকে অস্ত্র কিনছে। এই অস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হবে না। এমনিতেই জনজীবন নানা সমস্যায় আক্রান্ত। এই শীতেও লোডশেডিং হচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার কোনো উদ্যোগ নেই। বরং দলীয় লোকদের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়ে আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা 'লুটপাটের' সুযোগ করে দিয়েছি। কোনোরকম নিয়ম নীতি ছাড়াই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। কেননা পরিবহন খরচ অনেকগুণ বেড়ে যাবে। বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ৭.৪১ ভাগ, সেখানে ২০১২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১৩ ভাগে। আর চলতি ২০১৩ সালে তা যদি ১৫ ভাগকে অতিক্রম করে আমি অবাক হবো না। একই সময় ২০০৯ সালে জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ১৯ ভাগ। আর ২০১২ সালে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৪২। আর ২০১৩ সালে এই হার যে বাড়বে, তা তো কাউকে বলে দিতে হবে না। সরকারের এই সিদ্ধান্তে, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষকদের। লিটার প্রতি ৭ টাকা দাম বাড়ায়, প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে গত বছরের চেয়ে প্রায় ১ টাকা বেশি হবে। বোরো উৎপাদনে প্রায় ৪১ শতাংশ খরচ হয় সেচকাজে। ডিজেলের দাম বাড়ায় এ ব্যয় বেড়ে ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। ফলে কৃষকের পকেট কাঁটা যাবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জনগণকে বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে অন্তত ৯০০ কোটি টাকা। এই তথ্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মতে। কপোরেশনের মতে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বাড়তি ৩৫০ কোটি টাকা, আর কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধিতে বিদ্যুৎবিহীন অঞ্চলে জনগণকে বাড়তি গুনতে হবে অন্তত ৩১৬ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন অর্থের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। এই বাড়তি অর্থ যে মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেবে, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। তাহলে সরকারের দায়িত্বটি কী? শুধু ক্ষমতায় থাকা সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিরোধী এসব কর্মসচি গ্রহণ করা? সরকার তো জনস্বার্থে কর্মসূচি গ্রহণ করে ও তা বাস্তবায়ন করে। কিন্তু যেসব কর্মসূচি জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তা তো কোনো অবস্থাতেই নেয়া উচিত নয়। সরকারের শেষ সময়ে এসে এমন সব কর্মসূচি নিচ্ছে, যা কোনো অবস্থাতেই সরকারের পক্ষে যাবে না। জনস্বার্থের সঙ্গে যেসব বিষয় জিড়ত, সেই সব বিষয়ে সরকারের ভর্তুকি দেয়া উচিত। সরকার কোন কোন খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে, এটা সত্য। কিন্তু তা জনগণের উপকারে আসছে না। যেমন বলা যেতে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা। দেশে বিদ্যুৎ চাহিদা অনেক বেড়েছে। নিঃসন্দেহে এটা সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার বিদ্যুতের বিপুল চাহিদা মেটাতে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করেছে। উদ্দেশ্য সেখান থেকে বিদ্যুৎ কিনে চাহিদা পূরণ করা। এটি ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। সরকারকে এখানে ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি সরবরাহ করতে হচ্ছে। কিন্তু তাতে করে কী সরকারের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে? না, সফল হয়নি। কেননা এই শীতেও লোডশেডিং হচ্ছে। এটা অতীতে কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না। এই শীতেও যখন লোডশেডিং হচ্ছে, এখন গ্রীষ্ম আমাদের কীভাবে কাটবে, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। স্পষ্টতই এবারের গ্রীষ্মটা আমাদের ভালো যাবে না। অথচ শত শত কোটি টাকা আমরা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভর্তুকি দিচ্ছি। এখন এলো অস্ত্র কেনার বিষয়টি। অতীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসেছিল, তখন রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ বিমান কেনা হয়েছিল। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ওই মিগ বিমানগুলো গ্রাউনডেড হয়েছে। উড়তে পারছে না সবকটি। দু'একটিকে সচল রাখা হয় বটে, কিন্তু বাকিগুলো উড়বার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এখন আবার অস্ত্র কিনলাম। বলা হচ্ছে এ অস্ত্র জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু জাতিসংঘের কাজে ব্যবহারের জন্য (?) জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেন ৮ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনা হবে? আমরা শক্তিশালী সেনাবাহিনী চাই। সেনাবাহিনী আমাদের গৌরবের। আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। কিন্তু রাশিয়ার অস্ত্র দিয়ে আমাদের সেনাবাহিনী কতটুকু শক্তিশালী হবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। আমি চাই 'সিডর' ও 'আইলা' আক্রান্ত মানুষের পুনর্বাসন। আমার কাছে এটা প্রথম প্রায়োরিটি। সেই সঙ্গে দারিদ্র্য দূরীকরণ, হাজার হাজার তরুণের জন্য চাকরির সংস্থান করা, সরকারের দায়িত্ব । নির্বাচনের আগে সরকার এদিকে দৃষ্টি দিলে ভালো করবে।Daily JAI JAI DIN29.01.13

যে সংবাদ আমাদের আশাবাদী করে না

সরকার যখন তার চার বছরের বর্ষপূর্তি পালন করছে, তখন সংবাদপত্রে এমন কতগুলো সংবাদ ছাপা হয়েছে, যা আমাদের আশাবাদী করে না। শুধু তা-ই নয়, সরকারের ভূমিকা নিয়েও উদ্বেগের সৃষ্টি করে। আমাদের সংবিধান নিয়ে আমরা গর্ব করি। আমাদের সংবিধানে বেশ কিছু সুন্দর অনুচ্ছেদ রয়েছে, যা আমাদের অধিকারকেই শুধু সুরক্ষা করেনি; বরং একই সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনসাধারণের অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে এবং দৈনন্দিন জীবনে এর যে প্রভাব পড়বে, তাতে করে এ প্রশ্নটা এসেই যায় যে রাষ্ট্রের ভূমিকাটা তাহলে কী? যেখানে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে, তখন সরকার দাম বাড়াল। কেন? সরকারের যুক্তি- ভর্তুকির ওপর থেকে 'চাপ' কমাতেই এই মূল্যবৃদ্ধি! মন্ত্রীরা গর্ব করে বলেন, পাশের দেশের চেয়ে আমাদের দাম কম। মিথ্যা বলেননি আমাদের মন্ত্রীরা। কিন্তু মন্ত্রী বাহাদুররা কী জানেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে একটা কথা ব্যবহার করা হয়- PPP, অর্থাৎ Purchasing Power Parity। মূল কথা হচ্ছে, ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী মাথাপিছু আয় নির্ধারণ করার এক ধরনের হিসাব। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ক্ষমতা নির্ধারণের জন্য একদিকে যেমন PPP ব্যবহার করা হয়, অন্যদিকে তেমন ব্যবহার করা হয় PQLI, অর্থাৎ Physical Quality of Life Index। একটু ব্যাখ্যা করলে যা বলা যায় তা হচ্ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী মাথাপিছু আয় নির্ধারণ করা। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আর ভারতের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এক নয়। তাদের মাসিক আয়, আমাদের টাকার মানের হিসাবে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি- প্রায় দ্বিগুণ। এ ক্ষেত্রে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি। জ্বালানি তেলের যে দাম সেখানে, তা জনজীবনে যে প্রভাব ফেলে, তা অনেকটা সহনীয়। কিন্তু আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়বে জনজীবনে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর প্রভাবে গ্যাসের দাম বাড়বে, বাড়বে বিদ্যুতের দাম। তাহলে সরকার কী জনস্বার্থে এ কাজটি করল? সংবিধানে যেখানে জনসাধারণের নূ্যনতম মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, সেখানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে, এতে করে সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার খর্বের শামিল। আমরা পরিসংখ্যান দিয়েও আমাদের যুক্তির পক্ষে কথা বলতে পারি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। কেননা পরিবহন খরচ অনেকগুণ বেড়ে যাবে। বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ৭.৪১ শতাংশ, সেখানে ২০১২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে। আর চলতি ২০১৩ সালে তা যদি ১৫ শতাংশকে অতিক্রম করে আমি অবাক হব না। একই সময় ২০০৯ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হার ছিল ৬.১৯ শতাংশ। আর ২০১২ সালে এ হার ছিল ৬.৪২ শতাংশ। ২০১৩ সালে এই হার যে বাড়বে, তা তো কাউকে বলে দিতে হবে না। সরকারের এই সিদ্ধান্তে ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকরা। লিটারপ্রতি সাত টাকা দাম বাড়ায় প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে গত বছরের চেয়ে প্রায় এক টাকা বেশি খরচ হবে। বোরো উৎপাদনে প্রায় ৪১ শতাংশ খরচ হয় সেচকাজে। ডিজেলের দাম বাড়ায় এ ব্যয় বেড়ে ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। অঙ্কের হিসাবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা কৃষকের পকেট কাটা যাবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জনগণকে বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে অন্তত ৯০০ কোটি টাকা। এই তথ্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের। করপোরেশনের মতে, কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বাড়তি ৩৫০ কোটি টাকা, আর কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধিতে বিদ্যুৎবিহীন অঞ্চলে জনগণকে বাড়তি গুনতে হবে অন্তত ৩১৬ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, অর্থের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। এই বাড়তি অর্থ যে মূল্যস্ফীতিকে আরো উস্কে দেবে, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। তাহলে সরকারের দায়িত্বটি কী? শুধু ক্ষমতায় থাকা আর গণবিরোধী এসব কর্মসূচি গ্রহণ করা? সরকার তো জনস্বার্থে কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়ন করে। কিন্তু যেসব কর্মসূচি জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তা তো কোনো অবস্থাতেই নেওয়া উচিত নয়। সরকার শেষ সময়ে এসে এমন সব কর্মসূচি নিচ্ছে, যা কোনো অবস্থাতেই সরকারের পক্ষে যাবে না। জনস্বার্থের সঙ্গে যেসব বিষয় জড়িত, সেসব বিষয়ে সরকারের ভর্তুকি দেওয়া উচিত। সরকার কোনো কোনো খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে, এটা সত্য। কিন্তু তা জনগণের উপকারে আসছে না। যেমন বলা যেতে পারে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা। দেশে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়েছে। নিঃসন্দেহে এটা সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার বিদ্যুতের বিপুল চাহিদা মেটাতে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করেছে। উদ্দেশ্য, সেখান থেকে বিদ্যুৎ কিনে চাহিদা পূরণ করা। এটি ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। সরকারকে এখানে ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি সরবরাহ করতে হচ্ছে। কিন্তু এতে করে কি সরকারের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে? না, সফল হয়নি। কেননা এই শীতেও লোডশেডিং হচ্ছে। এটা অতীতে কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না। এই শীতেও যখন লোডশেডিং হচ্ছে, তখন গ্রীষ্ম আমাদের কিভাবে কাটবে, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। স্পষ্টতই এবারের গ্রীষ্মটা আমাদের ভালো যাবে না। অথচ শত শত কোটি টাকা আমরা কুইক রেন্টালের নামে ভর্তুকি দিয়েছি। অভিযোগ আছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের সঙ্গে জড়িত। দেশে বর্তমানে মোট রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৩২টি। বেশির ভাগই ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল দিয়ে চালাতে হয়। সরকার এ খাতে ভর্তুকি দেয়। কোনো কোনো কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ওইসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। যেখানে ২০০৬ সালে বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে কোনো ভর্তুকি দিতে হয়নি, সে ক্ষেত্রে ২০১১ সালে ভর্তুকি দিয়েছিল ছয় হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। আর ২০১২ সালের পরিসংখ্যান আমাদের হাতে এলে দেখা যাবে ভর্তুকির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার অঙ্ককেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপক। এটা সরকারের প্রথম 'প্রায়োরিটি' হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু তা হয়নি। সরকারের একজন জ্বালানি উপদেষ্টা থাকলেও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে তাঁর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। আমাদের প্রচুর কয়লাসম্পদ রয়েছে, যা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। মোট পাঁচটি খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ পরিমাণ কয়লাসম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে সবটা তোলা যাবে না। যা তোলা যাবে, তা আমাদের ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে। কয়লা উত্তোলন নিয়ে কিছুটা জটিলতা রয়েছে সত্য, একটি 'রাজনীতি'ও আছে। তবে সরকার যদি আন্তরিক হতো, আমার বিশ্বাস আমরা 'জাতির স্বার্থে' কয়লা উত্তোলন করে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারতাম। অভিযোগ আছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে 'সহায়তা' করার উদ্দেশ্যেই সরকার কয়লা উৎপাদনে যাচ্ছে না। গত এক বছরে এ ব্যাপারে কোনো বড় অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। তাহলে সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, সরকার কার স্বার্থ রক্ষা করছে? জনগণের না 'বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের'?
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সরকারের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। এই শীতের মৌসুমে শীতের সবজির দাম আকাশছোঁয়া। কৃষক উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। মাঝখানে কিছু ফড়িয়া ব্যবসায়ী কৃষিপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এই ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনকে তাঁদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমান সরকারের আমলে গৃহীত নীতির কারণে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। আগে মানুষ যে পরিমাণ অর্থ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়ে ব্যয় করত, এখন আর তা করতে পারে না। বেতন বৃদ্ধি না পাওয়ায় তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে। অথচ এই সাধারণ মানুষের ভোটেই মহাজোট সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। নির্বাচনী ইশতেহারও তারা পূরণ করতে পারেনি। মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু অদক্ষ ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত মন্ত্রীরা রয়ে গেছেন। ২০১২ সালের অর্থনীতির বেহাল দৃশ্য চলতি ২০১৩ সালেও প্রভাব ফেলতে পারে। বাড়তে পারে জনদুর্ভোগ।
আমাদের আতঙ্কের একটা বড় জায়গা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। মন্ত্রী বদল করেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা আজও সরকার করতে পারেনি। ইলিয়াস আলী 'হারিয়ে' গেলেন। সরকার তাঁকে উদ্ধার করতে পারল না। ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলামের হাতকড়া পরা অবস্থায় মৃতদেহ পাওয়া গেল কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার আদাবাড়ি-মনোহরপুর মাঠের খালের পাশে। কে খুন করল তাঁকে? অভিযুক্ত র‌্যাব। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব তো সরকারের। গত এক বছরে জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রশ্নে সরকারের ব্যর্থতা ছিল চরম। অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র- কোনো একটি ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য খুব উজ্জ্বল নয়। রিজার্ভ বেড়েছে। তাতে অবদান রেখেছেন সাধারণ মানুষ, যাঁরা বিদেশে কঠিন পরিশ্রম করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়েছেন।
সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। পদ্মা সেতু আটকে গেল। ডেসটিনি, হলমার্ক লুট করল শত শত কোটি টাকা। পর্দার অন্তরালে কলকাঠি নাড়ালেন সরকারের ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা। মূল ব্যক্তিরা কেউই গ্রেপ্তার হলেন না। শেয়ারবাজার থেকে চলে গেল ১০ হাজার কোটি টাকা। আর অর্থমন্ত্রী অভিযোগ আনলেন 'ফাটকাবাজির'। বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলের দুর্নীতি তাড়াতে নিজেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেলেন। তাই ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ যে বিপুল আস্থা রেখেছিল আওয়ামী লীগের ওপর, তা এখন ফিকে হয়ে আসছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতা, ব্যর্থতা তাই আমাদের আশাবাদী করে না।Daily KALERKONTHO27.01.13

রূপপুরে কি আরেকটি ফুলবাড়ীর জন্ম হবে

 
প্রধানমন্ত্রী আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, চলতি সেপ্টেম্বর মাসে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু হবে। তখন যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে রূপপুর কি \\'আরেকটি ফুলবাড়ী\\'র জন্ম হতে যাচ্ছে? ফুলবাড়ীর ঘটনা আমরা অনেকেই স্মরণ করতে পারি। ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করেছিল স্থানীয় জনগণ। তারা বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছিল। তাদের সেই আশঙ্কার পেছনে সত্যতাও ছিল। ফুলবাড়ীর জনগণ সেদিন কয়লা তুলতে দেয়নি। আন্দোলনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গুলি চালিয়েছিল ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট। গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন ৬ ব্যক্তি। সেদিনের সেই আন্দোলন বাংলাদেশে একটি ইতিহাস রচনা করেছিল। আজ যখন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হতে যাচ্ছে তাতে আশঙ্কা একটা থেকেই গেল_ আর তা হচ্ছে ফুলবাড়ীর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে রূপপুরে। যদিও রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়া ও সেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমাদের নূ্যনতম আরও ৬ থেকে ৮ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এখানে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা ফুলবাড়ীর চেয়ে অনেকগুণ বেশি। এখানে নিরাপত্তা ঝুঁকিটা অনেক বেশি। রূপপুরে যেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হয়েছে, তার পাশ দিয়ে একটি নদী বয়ে গেছে। ঝুঁকিটা এ কারণেই। ফুকুসিমার পারমাণবিক বিপর্যয়ের পর রূপপুরের ব্যাপারে আমাদের একটা শঙ্কা থাকবেই। বাংলাদেশের পরিবেশবাদীরা বিষয়টি যে হালকাভাবে নেবেন তা মনে করারও কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ অনেক ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। ফুকুসিমা কিংবা চেরনোবিলের চেয়ে অনেক বেশি ঘনবসতি রূপপুরে। রাশিয়ার সঙ্গে যে ৫০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, তা দিয়ে গবেষণা করা হবে। ধারণা করছি, এই গবেষণার নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে বেশি। বলা হচ্ছে, ৫ স্তরবিশিষ্ট একটি নিরাপত্তা বলয় থাকবে এবং তৃতীয় জেনারেশনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানো হবে। কিন্তু নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটুকু নিশ্চিত হওয়া যাবে, সে প্রশ্ন থেকেই গেল।
জাপানের ফুকুসিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ বিস্ফোরণের (২০১১) রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশ যখন রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুরে পারমাণবিক চুলি্ল তৈরির একটি সমঝোতায় যায়, তখন সঙ্গত কারণেই এ নিয়ে বিতর্ক বাড়বেই। জাপান প্রযুক্তিবিদ্যায় শীর্ষে অবস্থান করলেও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি দেশটি। বলা হচ্ছে, মধ্য আশির দশকে (১৯৮৬) রাশিয়ার চেরনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তার চেয়েও ভয়াবহ ছিল ফুকুসিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিস্ফোরণ। চেরনোবিলের বিস্ফোরণের পর তেজস্ক্রিয়তা ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। গরুর দুধ, গুঁড়া দুধ, শাকসবজি, ফলমূল সবকিছুতেই তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ প্রায় ২৬ বছর পরও চেরনোবিল ও তার আশপাশের এলাকা বিপদমুক্ত নয়। ইউরোপের বেশ কিছু দেশ থেকে কৃষিপণ্য রফতানি বেশ কয়েক বছর বন্ধ ছিল। এখন বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গেল। কিন্তু এর নিরাপত্তা আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব, সে প্রশ্ন থেকেই গেল।
পরমাণু প্রকল্প খুব ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণও। দক্ষিণ এশিয়ায় পরমাণু শক্তির ব্যবহার খুবই কম। ভারতে মোট জ্বালানির মাত্র ২ ভাগ ও পাকিস্তানের এক ভাগ আসে পরমাণু জ্বালানি থেকে। যদিও এ দুটি দেশ পরমাণু শক্তি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা খোদ ভারতেও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। গত বছর পাকিস্তান চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যেখানে চীন পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে দেবে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয় দেশ, যারা পরমাণু শক্তির উৎপাদনে যাবে। সাধারণত ৬০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ৫০০ মেগাওয়াটের ওপরে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থান করা হয়। ৫০০ মেগাওয়াটের ওপর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে উৎপাদন খরচ কম হয়। কিন্তু এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপনে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ খরচ হয়। প্রচলিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে প্রতি মেগাওয়াটের জন্য গড়ে খরচ হয় এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে পরমাণু কেন্দ্রে এই খরচ হয়েছে দেড় থেকে দুই মিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে খরচ হবে দেড় মিলিয়ন বা ১৫০ কোটি টাকা। জাপানে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় প্রতি ইউনিটে ৪ ডলার ৮০ সেন্ট। জাপানে কয়লায় খরচ হয় ৪ ডলার ৯৫ সেন্ট ও গ্যাসে ৫ ডলার ২১ সেন্ট। দক্ষিণ কোরিয়ায় পরমাণুতে দুই ডলার ৩৪ সেন্ট, কয়লায় দুই ডলার ১৬ সেন্ট, আর গ্যাসে ৪ ডলার ৬৫ সেন্ট। ফ্রান্সে পরমাণুতে দুই ডলার ৫৪ সেন্ট, কয়লায় তিন ডলার ৩৩ সেন্ট ও গ্যাসে তিন ডলার ৯২ সেন্ট। বর্তমানে বিশ্বে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার ১৩.৫ ভাগই পরমাণু শক্তি থেকে। এগুলো সবই উন্নত দেশে অবস্থিত। বিশ্বে ২৮টি পরমাণুভিত্তিক ৪২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মাঝে ফ্রান্সে ৫৯টি। ফ্রান্সে মোট বিদ্যুতের ৭৯ শতাংশ উৎপাদিত হয় পরমাণু শক্তি থেকে। বেলজিয়ামে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫৮টি। দেশটির মোট বিদ্যুতের ৫৮ ভাগই পারমাণবিক। সুইডেনের ৪৪ ভাগ, কোরিয়ায় ৪০ ভাগ, জাপানে ৫৫ ভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২০ ভাগ বিদ্যুৎ পরমাণু শক্তিনির্ভর। তবে ফুকুসিমার পর জাপান নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে এবং বিকল্প শক্তির কথা চিন্তা করছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে চীনে ৯ হাজার, ভারতে ৪ হাজার ১২০ ও পাকিস্তানে ৪২৫ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ২০২০ সালের মধ্যে চীন ৪০ হাজার, ভারত ২০ হাজার ও পাকিস্তান ৭ হাজার মেগাওয়াটের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। অনেকেই জানেন, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমতি নিতে হয়। বাংলাদেশ এই অনুমতি পেয়েছিল ২০০৭ সালের জুন মাসে। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়টা হচ্ছে এর রক্ষণাবেক্ষণ। দক্ষ জনশক্তি আমাদের নেই। এর অর্থ দীর্ঘদিন রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের থেকে যাবে। দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা হচ্ছে জনবসতির ঘনত্ব। রূপপুরে যেখানে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সেখানে আশপাশে জনবসতি রয়েছে। এই জনবসতি অপসারণ করা হবে একটি বড় সমস্যা। এ ছাড়া বাংলাদেশে এমন কোনো বিরান এলাকা নেই, যেখানে কেন্দ্রটি স্থাপন করা যায়। আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। আগামী ২০২০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াটে। তখন এ চাহিদা আমরা মেটাব কীভাবে? সম্ভবত পারমাণবিক বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের কয়লার একটা সম্ভাবনা থাকলেও সেখানে একটা \\'রাজনীতি\\' ঢুকে গেছে। কয়লা উত্তোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে স্থানীয় জনগণের স্বার্থ। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুললে কয়লা খনির সর্বোচ্চ ব্যবহার আমরা নিশ্চিত করতে পারব বটে, কিন্তু বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তর করতে হবে। উপরন্তু ভূগর্ভস্থ বিপুল পানি অপসারণ করতে হবে। তাতে করে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। কোনো জনপ্রিয় সরকারই এই অপ্রিয় কাজটি করতে চাইবে না। দলটি স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে।
বাংলাদেশের মতো অধিক ঘনবসতিপূর্ণ ও কৃষিনির্ভর দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের একটা ঝুঁকি থাকবেই। ঝুঁকির বিষয়টি থাকা সত্ত্বেও সরকার এই সিদ্ধান্তটি নিল। কেননা আমাদের কাছে এই মুহূর্তে বিকল্প জ্বালানির কোনো উৎস নেই। গ্যাস সম্পদ সীমিত হয়ে আসার কারণে পারমাণবিক বিদ্যুৎই আমাদের ভরসা। তবে সরকারের যে কাজটি করা উচিত তা হচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তার কথাটা স্থানীয় জনগণকে বোঝানো, যাতে করে এখানে কোনো ধরনের আন্দোলনের জন্ম না হয়। উপরন্তু যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা এবং অন্যত্র জমি বরাদ্দের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। বাংলাদেশে জ্বালানি সম্পদের উৎস সীমিত হয়ে আসায় বাংলাদেশ আগামী দশকে বড় ধরনের একটি \\'জ্বালানি ফাঁদে\\' পড়তে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎ একটি \\'সমাধান\\' হলেও সমস্যা রয়ে গেছে অনেক।
Daily SAMAKAL
27.01.13

সরকার জনস্বার্থে কি সব কাজ করে

সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ। অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে হোঁচট খেয়েছে সরকার। সরকারের আয় ব্যাপক হারে বাড়ানোর লক্ষ্যে নির্ধারণ করে বাজেট ঘোষণা করা হলেও তখন উন্নয়ন বাজেটে চার হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করা হচ্ছে। কিন্তু এটা কি জনস্বার্থে করা হচ্ছে? ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ নিচ্ছে। এতে সংগত কারণেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। আর এ কারণে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও জাতীয় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাছাড়া সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবের দামও বেড়ে যাবে। গত ৩ জানুয়ারি ২০১৩, সরকার পঞ্চম দফায় জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। এর যে একটি নেতিবাচক দিক আছে, আমরা তা ভেবেও দেখি না। বলা হয়, পার্শ্ববর্তী দেশে জ্বালানি তেলের দাম আমাদের চেয়ে বেশি। এটা সত্য। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে এ যুক্তি তো বিবেচনায় নেয়া যাবে না। অর্থাৎ ভারতে মধ্যবিত্তের বেতন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক আমাদের চেয়ে তিনগুণ বেশি বেতন পান। উপরন্তু তুলনামূলক বিচারে ওদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসিপত্রের দাম আমাদের চাইতে কম। বেতন বেশি হওয়ায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা আমাদের চাইতে অনেক বেশি। সে কারণে ওখানে জ্বালানি তেলের দাম বেশি হলেও তা মধ্যবিত্তকে তেমন স্পর্শ করে না। সব কিছুর দামই ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে, যা আমাদের দেশে নেই। আমাদের দেশে সরকার যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, সে সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। তাই যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়, তা হচ্ছে সরকার কি জনস্বার্থে এসব কাজ করে?
আমাদের সংবিধানে যেখানে জনসাধারণের ন্যূনতম মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, সেখানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে, তাতে তা সংবিধানবর্ণিত মৌলিক অধিকার খর্বের শামিল। আমরা পরিসংখ্যান দিয়েও আমাদের যুক্তির পক্ষে কথা বলতে পারি। কোনো পরিসংখ্যানই সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করবে না। এটা নির্বাচনের বছর। সরকারের এমন কোনো কিছু করা ঠিক নয়, যা জনজীবনকে আক্রান্ত করতে পারে। সরকার তো জনগণের অভিভাবক। সরকারের উচিত জনস্বার্থে কাজ করা। কিন্তু সরকার যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তাতে জনস্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না।
সরকার চার বছর পার করল গত ৬ জানুয়ারি ২০১৩। গত বছর অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের সাফল্য নেই, বরং দুর্নীতিতে বাংলাদেশ একরকম ‘রেকর্ড’ করেছে। দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। হলমার্ক, ডেসটিনি আর পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির রেকর্ড, দুর্নীতির সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা জড়িত। অথচ লোকদেখানো তদন্ত রিপোর্টে অত্যন্ত সুকৌশলে সরকারের কর্মকর্তাদের বাঁচিয়ে দেয়া হয়েছে। মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে উঠলেও অভিযুক্ত সেই মন্ত্রীকে বাঁচিয়ে দিয়েছে দুদক। দুজন কর্মকর্তা গ্রেফতার হলেও বাকিরা থেকে গেছেন পর্দার অন্তরালে। ডেসটিনি, শেয়ারবাজার ও হলমার্ক অর্থ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়নি। সেসব ঘটনা থেকেই প্রমাণ হয়, সরকার দুর্নীতিকে ‘সহ্য’ করছে। সরকার ও দুদকের কর্মকাণ্ড টিআই’র রিপোর্টকেই সমর্থন করে, যেখানে বলা হয়েছিল বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। দুর্নীতি দমনে সরকারের ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। সেই সঙ্গে মানবাধিকার হরণ ও মিডিয়া দলন ছিল সর্বকালের শীর্ষে। দুজন শীর্ষ সাংবাদিক সাগর ও রুনিকে রাতের আঁধারে খুন করা হলো। সাংবাদিকরা সারাবছর আন্দোলন করলেন, কিন্তু প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার করা হলো না। বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকাণ্ড ছিল গত বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তন এনেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধানের ঘটনা বছরজুড়ে আলোচিত হলেও সরকার ছিল নির্বিকার। একজন জনপ্রিয় নেতা এভাবে ‘অদৃশ্য’ হয়ে আছেন, আর রাষ্ট্র তাকে খুুঁজে পাবে না-এটা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় ব্যর্থতা। অতীতে কখনো এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।
ইলিয়াস আলীর পাশাপাশি ঢাকার ৫৬নং ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলামের হাতকড়া পড়া অবস্থায় পেঁয়াজ ক্ষেত থেকে লাশ পাওয়া গেল কুষ্টিয়ায়। অভিযোগ ছিল র‌্যাবের বিরুদ্ধে। কিন্তু র‌্যাব বলেছে, তারা তাকে অপহরণ করেনি। তাহলে কে করল? এটা বের করার দায়িত্বও তো র‌্যাবের। র‌্যাব যদি এটা বের করতে না পারে, তাহলে র‌্যাবের কর্মকাণ্ড প্রশ্নের মুখে থাকবে। বিদেশে র‌্যাবের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে-এটা যেন আমরা বিবেচনায় নেই। সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তন এনেছেন। উদ্দেশ্য একটাই, আস্থা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সেই আস্থা তো ফিরে আসেইনি; বরং আস্থায় ঘাটতি বেড়েছে। ১৭ জন সাংবাদিক হত্যা, ৩ সম্পাদককে গ্রেফতার, পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে বর্তমানে সরকার গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর অত্যাচারের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এদিকে জ্বালানি তেলে ভর্তুকির নামে মূল্যবৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ালেও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি। এ শীতেও প্রতিদিন একাধিকবার লোডশেডিং হচ্ছে। অতীতে কখনো শীতের সময় লোডেশেডিং হয়নি। তাহলে ভর্তুকির টাকা যাচ্ছে কোন পকেটে? প্রকৃত অর্থে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর টাকা চলে যাচ্ছে কিছু ব্যক্তির হাতে-যারা তথাকথিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনা করছেন। বর্তমানে দেশে মোট রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৩২। বেশিরভাগই ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল দিয়ে চালাতে হয়। সরকার এ খাতে ভর্তুকি দেয়। কোনো কোনো কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হলেও রাজনৈতিক বিশ্বে কোনো ভর্তুকি দিতে হয়নি। সেক্ষেত্রে ২০১১ সালে ভর্তুকি দিয়েছে ৬ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। আর ২০১২ সালে এ ভর্তুকির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার অঙ্ককেও ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। শুধু লুটপাটের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের কোনো উদ্যোগ গত এক বছরে পরিলক্ষিত হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ ছিল অসহায়। তাদের জিম্মি করে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি সুবিধা নিয়েছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষ ছিল অসহায়। শীতের দিনেও শীতের সবজির দাম ছিল আকাশছোঁয়া। মধ্যস্বত্বভোগীরা কাঁচাবাজার থেকে প্রতিদিন ‘লুট’ করেছেন কোটি কোটি টাকা। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার আদৌ কোনো উদ্যোগ নেয়নি; বরং সুবিধাভোগীদের উৎসাহ জুগিয়েছে। ওইসব সুবিধাভোগী প্রত্যক্ষভাবে সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে জড়িত।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ৭.৪১ ভাগ, সেখানে ২০১২ সালে তা দাঁড়ায় ১৩ ভাগে। একই সময় ২০০৯ সালে জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৬ দশমিক ১৯ ভাগ। আর ২০১২ সালে এ হার ছিল শতকরা ৬ দশমিক ৪২ ভাগ। জানুয়ারিতে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির হার যেমন বৃদ্ধি পায়, ঠিক তেমনি বৃদ্ধি পাবে জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির হারও। সরকারের এ সিদ্ধান্তে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কৃষকের। লিটারপ্রতি ৭ টাকা দাম বাড়ায় প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে গত বছরের চেয়ে প্রায় ১ টাকা বেশি হবে। বোরো উৎপাদনে প্রায় ৪১ শতাংশ খরচ হয় সেচ কোজে। ডিজেলের দাম বাড়ায় এ ব্যয় বেড়ে ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। অঙ্কের হিসাবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা কৃষকের পকেট কাটা যাবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জনগণকে বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে অন্তত ৯০০ কোটি টাকা। এই তথ্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মতে। কর্পোরেশনের মতে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে ৩৫০ কোটি, আর কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধিতে বিদ্যুৎবিহীন অঞ্চলে জনগণকে বাড়তি গুনতে হবে অন্তত ৩১৬ কোটি টাকা (সকালের খবর, ৫ জানুয়ারি)। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন এ অঙ্ক আরো বেশি। আর তা যে জনজীবনের মূল্যস্ফীতিতে উসকে দেবে, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। সুতরাং যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে সরকারের দায়িত্বটি আসলে কী? শুধুই কি জনস্বার্থবিরোধী কর্মসূচি নেয়া? সংবিধান তো রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের এ দায়িত্বটি দেয়নি যে, তারা বারবার মূল্যবৃদ্ধি করে জনস্বার্থবিরোধী কর্মসূচি নেবে। জনস্বার্থে সরকারের কাজ করার কথা। কিন্তু সরকার সেই কাজটি করেনি। হলমার্ক, ডেসটিনি, পদ্মা সেতুর কেলেঙ্কারিতে যারা জড়িত, তাদের শাস্তি দেয়নি সরকার। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। দেশজুড়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হলেও তা বন্ধ করতে পারেনি সরকার। সারাদেশে একের পর এক ‘গুমে’র ঘটনা ঘটেছে, তা রোধ কিংবা এর পেছনের কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি সরকার। সাংবাদিক হত্যার রহস্যও উদ্ঘাটিত হয়নি। সব মিলিয়ে সরকার ব্যর্থ। তাই বিভিন্ন পত্রিকার জরিপে যখন প্রকাশ পায়, বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে (৫ জানুয়ারি), তখন সরকার এটা যদি উপলব্ধি করেন, তাহলে ভালো করবেন। তা না হলে দেশ একটি বড় ধরনের সঙ্কটে পড়বে। সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের (আইসিবি) ত্রৈমাসিক নিউজ বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, দেশে সাম্প্রতিক সময়ের অবনতিশীল ও সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে। লাগাতার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাষ্ট্রের ব্যাপক আর্থিক অপচয়ও হচ্ছে। তাই রাষ্ট্রের যখন আর্থিক ক্ষতি হয়, তখন তা জনস্বার্থে প্রভাব পড়বেই। সবাইকে নিয়েই রাষ্ট্র। সরকার ও বিরোধী দল মিলেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি-যেখানে গণতন্ত্র চর্চাকে আমরা প্রাধান্য দিয়েছি। তাই সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। একটি সমঝোতায় যেতে হবে। আর এ সমঝোতা আমাদের স্বার্থেই হতে হবে।
Daily MANOBKONTH
27.01.13

ভারতের উপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বাড়ছে


প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরের সময় বাংলাদেশ রাশিয়ার সাথে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ক্রয় সংক্রান্ত দু’টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। যে কোনো বিবেচনায় এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি এবং এই চুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা কথা উঠেছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী তথা সামরিক বাহিনীর জন্য ব্যবহৃত সমরাস্ত্র রাশিয়া নির্ভর নয়। উপরন্তু রাশিয়ার সমরাস্ত্র নিয়ে নানা কথা আছে। আওয়ামী লীগ যখন ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করেছিল, তখন রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ বিমান ক্রয় করা হয়েছিল। ওই মিগ বিমানগুলো নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। অনেকগুলোই এখন আর উড়ছে না। কারণ মিগের খুচরা যন্ত্রাংশের অভাব। বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর অফিসারদের কাছে মিগ জনপ্রিয় নয়। খুচরা যন্ত্রাংশ পাওয়াও যায় না। পেলে দাম অত্যাধিক। ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে মিগ বহরের অনেকগুলো বিমান এখন গ্রাউনডেড। উড়তে পারছে না। এখন আবার সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্রশস্ত্র কেনা হলো। এই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনী কোনো ‘ঝামেলায়’ জড়িয়ে পড়বে কীনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এই অস্ত্র ক্রয় আমাদেরকে ও আমাদের সেনাবাহিনীকে পরোক্ষভাবে আরো বেশি মাত্রায় ভারত নির্ভর করে তুলবে। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুটা খোজ-খবর রাখেন, তারা জানেন গেল বছর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভারত সফরের সময় ভারত-রাশিয়ার সাথে একটি বড় ধরনের অস্ত্র চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। প্রায় ৭৫০ কোটি ডলারের ওই চুক্তিতে ভারত ৪২টি সুখোই এস ইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধ বিমানসহ দীর্ঘমেয়াদে ৯৭০টি বিমান ইঞ্জিন পাবে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারতের সামরিক সম্পর্ক একসময় পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। সোভিয়েত লাইসেন্স নিয়ে ভারত মিগ বিমান তৈরি করতো। মিগের খুচরা যন্ত্রাংশ ভারত সরবরাহ করতো। এখন ভারত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রযুক্তি নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রও তৈরি করে। এখন দেখতে হবে রাশিয়ান অস্ত্রশস্ত্র ও খুচরা যন্ত্রাংশ সরাসরি রাশিয়া থেকে আসে নাকি ভারত থেকে আসে। চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ, সুদের হিসাব, পরিশোধের সময়সীমা ইত্যাদি বিস্তারিত আমরা জানি না। কোনো সংবাদপত্রেও তা প্রকাশিত হয়নি। আমরা আশা করবো চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ সংসদে উপস্থাপিত হবে। তখন বিস্তারিত মন্তব্য করা সহজ হবে। এই মুহূর্তে যা বলা যায়, তা হচ্ছে এই অস্ত্র চুক্তি আমাদের বৈদেশিক ও সামরিক নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত। কেননা আমাদের বৈদেশিক নীতি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা চীনের উপর নির্ভরশীল। আমাদের বিমান বাহিনী চীনা বিমান ব্যবহার করে। সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রও চীনের তৈরি। আমাদের সামরিক নেতৃত্ব চীনা যুদ্ধাস্ত্রের উপর অনেক দিন থেকেই নির্ভরশীল। আমাদের উন্নয়নে চীন অন্যতম অংশীদার। চীন আমাদের নিকট প্রতিবেশীও। আমাদের উন্নয়নে চীনের উপস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই সরকার প্রধান চীনে গিয়েছিলেন। এমনকি বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও অতি সম্প্রতি চীনে গিয়েছিলেন এবং তারা দু’জন লালগালিচা সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। চীন সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক ও গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চীনের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রেক্ষিতে এই মহাসড়ক ও গভীর সমুদ্র বন্দর বাংলাদেশের চেহারা আগামী দশকে বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশ হতে পারে এ অঞ্চলের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চীনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। চীন শ্রীলংকার হাম্মানটোটায় (প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জন্মস্থান) গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে একটি বিমানবন্দরও চীন তৈরি করে দিয়েছে। সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন আগ্রহও দেখিয়েছিল। এটা নির্মিত হলে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের সাতবোন রাজ্যগুলো যেমনি এটি ব্যবহার করতে পারবে, তেমনি পারবে চীন তথা মিয়ানমারও। এখন সঙ্গত কারণেই রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের এই সামরিক চুক্তি চীন খুব সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। চীনারা এসব ক্ষেত্রে খুবই রক্ষণশীল। তারা খুব দ্রুতই প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বোধকরি এ ব্যাপারে কোনো সরকারি মন্তব্যও আমরা পাবো না। তবে যা হবে, তা হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনা আগ্রহের ঘাটতি আমরা দেখতে পাবো। আগামী মার্চে চীনে নয়া নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করছেন। শিজিন পিং ইতোমধ্যে পার্টি প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং মার্চে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও নেবেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা রয়েছে। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং বেগম জিয়া যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন তার সাথে দেখা করেছিলেন। এখন এই অস্ত্র ক্রয় চুক্তিতে চীনে বাংলাদেশ ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে।
এখানে আরো একটা কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের এই মুহূর্তে অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন হলো কেন? বাংলাদেশের নিরাপত্তা এই মুহূর্তে কোনো ঝুঁকির মুখেও নেই। এত বিপুল অস্ত্রের আদৌ প্রয়োজন ছিল না। অস্ত্রশস্ত্রের চাইতে এই মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের এক চতুর্থাংশ মানুষ গরিব। এদের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। শত শত মানুষ জলবায়ু শরণার্থী হিসেবে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে আশ্রয় নিয়েছে। এদের পেশার পরিবর্তন হয়েছে। এদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। ‘আইলা’ ও ‘সিডর’ এর কারণে দক্ষিণাঞ্চলে যে ক্ষতি হয়েছিল, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। জোয়ারের পানি ঠেকাতে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা যায়নি। সুপেয় পানির অভাব ওই সব অঞ্চলে। ন্যুনতম এই নাগরিক অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা বৈদেশিক সহায়তার উপর গুরুত্ব দিয়েছি। কিন্তু এই সহায়তাও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে আমরা Millenium Development Goals (MDG) এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবো না। জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত বেশ কিছু ক্ষেত্রে ২০১৫ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। যেমন, প্রাথমিক শিক্ষায় লৈঙ্গিক সমতা, সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, শিশু মৃত্যু হার কমানো, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া, অন্যান্য সংক্রামক রোগের বিস্তার কমানো, পরিবেশগত স্থিতিশীলতা ইত্যাদি। যেখানে ‘আইলা’ ও ‘সিডর’ আক্রান্ত এলাকায় শত শত পরিবার নিজেদের গৃহে ফিরে যেতে পারেনি এবং এখনো বেড়িবাঁধের উপর তাদের বসবাস, সেখানে বাচ্চাদের স্কুলে যাবার সুযোগ কোথায়? ওই এলাকায় স্বাস্থ্য সেবা চরমে উঠেছে। মাতৃস্বাস্থ্যেরও যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। তাই বাংলাদেশ যে ২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না, তা একরকম নিশ্চিত। ‘সিডর’ ও ‘আইলা’ আক্রান্ত এলাকায় সরকারের নীরবতা ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সরকার স্ব-উদ্যোগে কোনো বড় কর্মসূচি নেয়নি। সরকার গুরুত্ব দিয়েছে বৈদেশিক অর্থ প্রাপ্তির। যে কারণে সেখানকর মানুষ এক মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
এই যখন পরিস্থিতি তখন হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে রাশিয়া থেকে অস্ত্র কিনছে। এই অস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হবে না। এমনিতেই জনজীবন নানা সমস্যায় আক্রান্ত। এই শীতেও লোড শেডিং হচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার কোনো উদ্যোগে নেই। বরং দলীয় লোকদের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়ে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের সুযোগ করে দিয়েছে। কোনো রকম নিয়ম-নীতি ছাড়াই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। কেননা পরিবহন খরচ অনেকগুণ বেড়ে যাবে। বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ৭.৪১ ভাগ, সেখানে ২০১২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১৩ ভাগে। আর চলতি ২০১৩ সালে তা যদি ১৫ ভাগকে অতিক্রম করলে আমি অবাক হবো না। একই সময় ২০০৯ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ১৯ ভাগ। আর ২০১২ সালে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৪২। আর ২০১৩ সালে এই হার যে বাড়বে, তা তো কাউকে বলে দিতে হবে না। সরকারের এই সিদ্ধান্তে, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কৃষকদের। লিটার প্রতি ৭ টাকা দাম বাড়ায়, প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে গতবছরের চেয়ে প্রায় ১ টাকা খরচ বেশি হবে। বোরো উৎপাদনে প্রায় ৪১ শতাংশ খরচ হয় সেচকাজে। ডিজেলের দাম বাড়ায় এ ব্যয় বেড়ে ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। অঙ্কের হিসাবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা কৃষকের পকেট কাঁটা যাবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জনগণকে বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে অন্তত ৯০০ কোটি টাকা। এই তথ্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মতে। কর্পোরেশনের মতে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বাড়তি ৩৫০ কোটি টাকা, আর কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধিতে বিদ্যুৎবিহীন অঞ্চলে জনগণকে বাড়তি গুণতে হবে অন্তত ৩১৬ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন অর্থের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। এই বাড়তি অর্থ যে মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেবে, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। তাহলে সরকারের দায়িত্বটি কী? শুধু ক্ষমতায় থাকা আর হাজার হাজার কোটি টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে খচর করা? এই ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর কোনো উপকার হবে বলে মনে হয় না। সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের কারণে জাতিসংঘ থেকেই আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পায়। সেই অস্ত্রশস্ত্র তারা দেশেও নিয়ে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে এই ৮ হাজার কোটি টাকা দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র কেনার প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশের এই মুহূর্তে কোনো শত্রু রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও কম। ভারত ও মিয়ানমারের সাথে আমাদের সীমান্ত রয়েছে। এই দুটো দেশের সাথে বাংলাদেশ আদৌ কোনো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বেÑ তা শুধু বোকারাই চিন্তা করতে পারে। দিন বদলে গেছে। মানুষ সচেতন হয়েছে। সব তথ্যই আজকাল পাওয়া যায়। সুতরাং সাধারণ মানুষের দিকে নজর না দিয়ে ৮ হাজার কোটি টাকার সমরাস্ত্র ক্রয় বিতর্ক বাড়াবে। এর সাথে জড়িত রয়েছে তৃতীয় কোনো পক্ষের জড়িত থাকার বিষয়টি। আমরা এখনও নিশ্চিত নই। তবে মিগ বিমান ক্রয়ে একটি তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি আমরা দেখেছিলাম। আমরা নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে চাই। সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। কিন্তু এভাবে নয়। যে সমরাস্ত্রের সাথে আমাদের সেনাবাহিনীর পরিচয় নেই, সেই সমরাস্ত্র এনে আমাদের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা যাবে না। সমরাস্ত্র ক্রয়ের নাম করে আমাদেরকে ভারত নির্ভর করে তোলা, আমাদের প্রতিরক্ষা নীতির জন্য ভালো কোনো খবর নয়
25.01.13

প্রতিহিংসার রাজনীতির চালচিত্র







মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আরো দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিন করে ২০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। এটা ছিল ১৭ জানুয়ারির সংবাদপত্রের খবর। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ- পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা, মারধর, হত্যাচেষ্টা ও চুরি। মামলা দুটি করা হয়েছে কলাবাগান ও পল্টন থানায়। এর আগে পল্টন থানায় দায়ের করা আরেক মামলায় গাড়ি ভাঙচুর ও বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগ তুলে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। সেই থেকে তিনি কারাগারে। এই একটি ছোট্ট ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশের প্রতিহিংসার রাজনীতি আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। মির্জা ফখরুল একটি বড় রাজনৈতিক দলের মহাসচিব। অতীতে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কয়জন সজ্জন ব্যক্তি এখনো আছেন এবং যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই, মির্জা ফখরুল তেমন একজন ব্যক্তি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে যখন গাড়ি ভাঙচুর, মারামারি, হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়, তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি খারাপ দিকই উন্মোচিত হয়। মন্ত্রী থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে যদি দুর্নীতির অভিযোগ থাকে, সেই অভিযোগে তাঁর বিচার হতেই পারে। কিন্তু তিনি গাড়ি ভাঙচুর করবেন! দলের একজন সিনিয়র নেতা, তিনি গাড়ি ভাঙচুর করবেন! এটাও আমাদের শুনতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ আজ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। যে রাজনীতি হওয়া উচিত জনকল্যাণমূলক, সে রাজনীতি এখন স্থান করে নিয়েছে প্রতিহিংসার। রাজনীতিতে বৈরিতা, বিরোধ থাকবেই। কিন্তু সেই বৈরিতা আজ চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
আমরা আমাদের সংবিধান নিয়ে গর্ব করি। বিশেষ করে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বেশ কিছু ধারা রয়েছে, যা আমাদের অধিকারকে সংরক্ষণ করেছে। এ ক্ষেত্রে ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), অনুচ্ছেদ ৩২ (জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অঙ্গীকার), অনুচ্ছেদ ৩৬, ৩৭, ৩৮ (চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা) ইত্যাদি উল্লেখ করা যায়। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১১ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করতে পারি, যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড কিংবা বিএনপির মহাসচিবকে গ্রেপ্তার ইত্যাদি ঘটনায় সংবিধানের এসব ধারা লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে 'অধিকার' আমাদের জানিয়েছে, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৬৪ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নির্যাতিতদের মধ্যে পুলিশের হাতে ৫০ জন, র‌্যাবের হাতে পাঁচজন, বিজিবির হাতে দুজন এবং জেল কর্তৃপক্ষের হাতে দুজন নির্যাতনের শিকার হয়েছে (আমার দেশ, ২৩ ডিসেম্বর ২০১২)। পুলিশের এই ভূমিকা সংগত কারণেই আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। এমনিতেই রাজনীতি যখন উত্তপ্ত, দেশ যখন সংঘাতের মুখোমুখি, তখন এই পরিসংখ্যান আমাদের বড় ধরনের হতাশার মধ্যে ফেলে দেয়।
স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি প্রসঙ্গে একটি প্রবন্ধ লিখে প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেন। সেটা ১৯৭৪ সালের কথা। তারপর কেটে গেছে ৩৮টি বছর। কিন্তু এই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কি নিশ্চিত হয়েছে? র‌্যাব এখন অনেকের কাছেই একটি আতঙ্কের নাম। র‌্যাবের অনেক ভালো অর্জন নষ্ট হয়ে গেছে দু-একটি ঘটনায়। সর্বশেষ ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলামের হাতকড়া পরা অবস্থায় মৃতদেহ পাওয়া গেল কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার আদাবাড়ী মনোহরপুর গ্রামের পেঁয়াজক্ষেতের পাশে। অভিযোগ র‌্যাবের বিরুদ্ধে। র‌্যাব তা অস্বীকার করলেও পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে র‌্যাবের পরিচয়ে কয়েক ব্যক্তি তাঁকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর মৃতদেহ পুলিশের হাতকড়া লাগানো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ বলছে, এ ধরনের হাতকড়া বাইরে কিনতে পাওয়া যায়। কী ভয়াবহ কথা! প্রকাশ্যে বা গোপনে যদি এ ধরনের হাতকড়া পাওয়া যায়, তাতে তো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সতর্ক হওয়ার কথা। তারা এটা বন্ধ করছে না কেন? রফিকুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। তাঁর ব্যবসায়িক বিরোধ, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি, সম্পত্তি ইত্যাদি প্রশ্ন তাঁর হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এখন পুলিশ কিংবা র‌্যাবেরই দায়িত্ব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত মোটিভ খুঁজে বের করা। আমরা চাই না র‌্যাবের সব অর্জন দু-একটি ঘটনায় ম্লান হয়ে যাক। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা আজও আমরা করতে পারলাম না। আমাদের এতগুলো সংস্থা, রাষ্ট্র জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে র‌্যাব, পুলিশসহ বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার পেছনে; কিন্তু ফলাফল কী? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বারবার র‌্যাবের নাম এসেছে। অতীতে যাঁদের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, তাঁরা সমাজের উঁচুস্তরের কেউ নন। বরং প্রায় সবার বিরুদ্ধেই খুন, হত্যা, চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল। তাঁরা কেউই সমাজের ভালো মানুষ ছিলেন না। তার পরও তাঁদের এই মৃত্যু প্রত্যাশিত নয়। এই অস্বাভাবিক মৃত্যু আমরা কামনা করতে পারি না। কিন্তু ইলিয়াস আলীর ঘটনাকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব? ইলিয়াস আলী সাধারণ কেউ নন। সাবেক ছাত্রনেতা ও বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতাদের একজন। তিনি 'হারিয়ে' গেলেন। আমরা কেউ তার খোঁজ পেলাম না। র‌্যাব তো কত কিছুই করল। তাঁর বাসায় সিসি ক্যামেরা বসানো হলো। জানা গেল না কারা তাঁকে ধরে নিয়ে গেল। কেনই বা নিল। কী তাঁর অপরাধ। তাঁকে 'গুম' করার অভিযোগে হরতাল হলো। কিন্তু ইলিয়াস আলী আর ফিরে এলেন না।
রাজনীতিতে বৈরিতা থাকবেই; কিন্তু তা যেন হিংসাত্মক রূপ না নেয়। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা কত মারাত্মক হতে পারে, তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ১৯৯৪ সালে আফ্রিকার একটি দেশ রুয়ান্ডায়। হুতু-তুতসির দ্বন্দ্বে লাখ লাখ মানুষকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছিল। আইন, মানবতা, সংবিধান সেখানে কাজ করেনি। এই প্রতিহিংসাপরায়ণতা ওই দেশটিকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। আমরা হুতু-তুতসিদের দেশে পরিণত হতে চাই না। রাজনীতি হোক জনকল্যাণমূলক, মানুষকে সেবা করার যে মহান ব্রত- সেটাই হোক রাজনীতি। এই রাজনীতি করে গেছেন মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অগাধ সম্পত্তির মালিক তাঁরা কেউ হননি। ভাসানী কুঁড়েঘরে থেকেই রাজনীতি করেছেন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ব্যাংকে অগাধ টাকা, ঢাকা শহরে প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক ভাসানী ছিলেন না। তাঁর পরিবারের সদস্যদের অনেককেই দুঃখকষ্টের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। ভাসানী যে রাজনীতি করে গেছেন, সেই রাজনীতিতে প্রতিহিংসাপরায়ণতার কোনো স্থান ছিল না। বঙ্গবন্ধুর এক ডাকে, তাঁর অঙ্গুলিহেলনে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে যেত। তিনি মানুষকে ভালোবেসে রাজনীতি করে গেছেন। অথচ আজ রাজনীতিকে ঘিরে প্রতিহিংসার প্রবণতা খুব বেশি। মির্জা ফখরুলের দৃষ্টান্ত দিয়ে আমরা বোঝাতে চেয়েছি, বাংলাদেশে প্রতিহিংসার রাজনীতির ব্যাপ্তি ঘটেছে। মির্জা ফখরুলের পাশাপাশি রুহুল কবীর রিজভীর নামও উল্লেখ করা যায়, যিনি নিজ অফিসেই অবরুদ্ধ জীবন যাপন করছেন। এই প্রবণতা বর্তমান সময়ে বাড়লেও অতীতে চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও ওই প্রতিহিংসার রাজনীতিকে আমরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখেছি।
পরস্পরকে অবিশ্বাস আমাদের দেশে যে সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, এই সংস্কৃতি ধারণ করে আমরা গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। বরং গণতন্ত্রচর্চা এ দেশে মুখ থুবড়ে পড়বে। হেনরি ডেভিড থরোর একটি উক্তি মনে পড়ে গেল। তিনি লিখেছিলেন, There will never be a really free and enlightened state until the state comes to recognize the individual as a higher and independent power, from which all its own power and authority are derived and treats him accordingly। বাংলা করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, রাষ্ট্র যে পর্যন্ত ব্যক্তিকে উচ্চতর ও স্বাধীন ক্ষমতা হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়, যা তার নিজের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উৎস এবং যে পর্যন্ত ব্যক্তির সঙ্গে সে অনুসারে আচরণ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত সত্যিকারের কোনো মুক্ত ও জ্ঞানালোকিত রাষ্ট্র হবে না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের একজন কবি ও দার্শনিক ছিলেন থরো। বাংলাদেশে যে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, তাতে আমরা জ্ঞানালোকিত রাষ্ট্র গঠন করতে পারব না। মুখে যত কথাই বলি না কেন, আমরা গণতন্ত্রকেও বিনির্মাণ করতে পারব না; যদি না প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে পারি।
Kalerkontho ( Rajniti )22.01.13

ওবামার জন্য আদৌ কোন সুসংবাদ অপেক্ষা করছে কি?


যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব নেয়ার আগে একটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন বারাক ওবামা। আজ ২১ জানুয়ারি তিনি শপথ নেবেন। থাকবেন ২০১৬ সাল পর্যন্ত। কিন্তু এই চার বছর তার জন্য কতটুকু সুখের হবে কিংবা মার্কিন অর্থনীতিতে আদৌ কোন সুবাতাস বইবে কিনা, সে প্রশ্ন করাই যায়। অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, বিশাল বেকারত্ব, রেকর্ড অতিক্রম করা ১৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ আর অচলপ্রায় ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতকে সামনে রেখেই তিনি গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। বড় ব্যবধানেই তিনি মিট রমনিকে হারাতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু বছরের শুরুতেই তাকে ‘ফিসকাল ক্লিফে’র মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এটা হচ্ছে খাদে পড়ার হাত থেকে মার্কিন অর্থনীতিকে রক্ষা করা। বিলটি উভয় কক্ষে পাস হওয়ায় তা এখন আইনে পরিণত হল। এর ফলে বছরে ৪ লাখ ডলারের কম আয়ের মানুষ প্রত্যক্ষ করের আওতায় থাকবে না। যদিও ডেমোক্র্যাটরা চেয়েছিলেন আড়াই লাখ ডলারের মধ্যেই সীমাটা বেঁধে রাখতে। অর্থনীতিকে খাদে পড়া থেকে বাঁচাতে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে এস্টেটগুলোর কর ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা, ক্যাপিটাল ট্যাক্স বাড়ানো, প্রায় ২০ লাখ লোকের জন্য বেকার ভাতার মেয়াদ এক বছর বাড়ানো, প্রায় ৫০ লাখ লোকের জন্য ট্যাক্স ক্রেডিটের মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানো ইত্যাদি। কিন্তু এতে করে অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে কতটুকু?
মার্কিন অর্থনীতি ঠিকমতো চলছে না। ধনী-গরিবদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে সীমিত কিছু ব্যক্তির হাতে। শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ সেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ। ১৯৭০ সালে ধনিক শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ গচ্ছিত হতো। আর ২০১২ সালে এসে তারা ভোগ করে মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯.৭ ভাগ গ্রহণ করে। এক ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক।
দ্বিতীয় টার্মে বারাক ওবামার দায়িত্ব গ্রহণ তাই সঙ্গতকারণেই একটি প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে তরুণ প্রজšে§র মধ্যে। তারা চাকরি চায়। সবার জন্য চায় স্বাস্থ্যসেবা। মার্কিন জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের কোন হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেই। ওবামা স্বাস্থ্য সেবায় কিছু কাটছাঁট করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। এখন দেখার বিষয় তিনি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কতদূর যান। ১৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের আর্থিক ঘাটতি নিয়ে ওবামা তার দ্বিতীয় টার্ম শুরু করবেন। তিনি নির্বাচনের আগে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন, এই ঘাটতি তিনি ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে কমিয়ে আনবেন। ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার কর্মসূচি তার রয়েছে। মোটরগাড়ি শিল্পকে বাঁচাতে প্রণোদনা দেয়া সরকারের সফলতা বলে মনে করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। ২০১৪ সালে তিনি আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন। ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির শান্তিপূর্ণ সমাধান চান তিনি। এতে করে ইসরাইলি নেতৃত্ব যে খুশি হবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওবামা জাতীয় নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন। ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সামরিক ব্যয় বাড়ানোর বিপক্ষে ওবামা। বরং আগামী এক দশকে এ খাতে ব্যয় সাড়ে ৪৮ কোটি ডলার কমাতে চান তিনি।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতিতে আদৌ কোন পরিবর্তন আসবে কিনা, তা এই মুহূর্তে বলা না গেলেও দু-একটি ঘটনায় ইঙ্গিত মিলেছে যে এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সম্প্রতি যে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের জন্য কোন ভালো খবর নয়। খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দিতে পারে। যদিও অনেক দিন থেকেই বলা হচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কিন্তু সরকারি পর্যায়ে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুত টিকফা চুক্তি করতে চাচ্ছিল। বাংলাদেশ সরকার এ ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ করেছে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের অধিকার লংঘন, শ্রমিক নেতা আমিনুলের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে না পারা, সর্বোপরি ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সরকার বিষয়গুলো কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। ফলে ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ সম্প্রতি যে চিঠি ইস্যু করেছে, তাতে জিএসপি সুবিধা বাতিলের কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ ৪৮০ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে, তার মাঝে মাত্র ৫ শতাংশ জিএসপি সুবিধা পায়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে আসছি তৈরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার। কোন কোন মহল থেকে আমাদের আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল যে, তৈরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা দেয়া হবে। এখন সব ভেস্তে যেতে বসেছে। যুক্তরাষ্ট্র একজন নয়া বাণিজ্যমন্ত্রী ও একজন নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাচ্ছে। তাতে করে বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রচলিত নীতিতে বড় কোন পরিবর্তন আসবে না।
ওবামার দ্বিতীয় দফা দায়িত্ব গ্রহণ নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের জন্য একটি আনন্দের সংবাদ। এতে অভিবাসী ও অবৈধ অভিবাসীদের জন্য সুযোগ আরও বাড়ল। ওবামার জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনীতিকে ‘বিপদে’র হাত থেকে রক্ষা করা। ফিসকাল ক্লিফের ব্যাপারে সিনেট ও কংগ্রেস নীতিগতভাবে এক হলেও এখানে বলা হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের ১৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণের কী হবে। এই ঋণ যে অর্থনীতিতে একটি অস্থিরতা তৈরি করবে, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। অর্থনীতির ‘পাগলা ঘোড়া’কে তিনি যদি বাগে আনতে না পারেন, তাহলে অতি দ্রুত তিনি জনপ্রিয়তা হারাবেন। যে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি হোয়াইট হাউসে থেকে গেলেন, অতি দ্রুত সেই জনপ্রিয়তা তিনি হারাতে পারেন।
আগামী ৪ বছর ওবামার খুব ভালো সময় যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি ইতিমধ্যে কংগ্রেসের কাছে ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর অনুরোধ করেছেন। কারণ আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে ফেডারেল সরকারকে ট্যাক্স রিটার্ন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, সোশ্যাল সিকিউরিটি খাতে বিপুল অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এ জন্য তাকে ঋণ করতে হবে। এ ঋণের পরিমাণ এখন ১৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। রিপাবলিকানরা ঋণ ‘ফ্রিজ’ করে দিতে চাচ্ছে। অর্থাৎ ঋণের পরিধি বাড়ানো যাবে না। আর সত্যি সত্যিই যদি ওবামা প্রশাসন ঋণের পরিধি না বাড়ায়, তাহলে ট্যাক্স রিটার্নের ৮৬ বিলিয়ন ডলার, সোশ্যাল সিকিউরিটির ৬১ বিলিয়ন ডলার কিংবা মেডিকেয়ারের ৭৩ বিলিয়ন ডলারের ‘বিল’ পরিশোধে ব্যর্থ হবে। তাতে করে সাধারণ মানুষ, বিশেষত প্রবীণরা একটা বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়বেন। তাদের স্বাস্থ্যসেবা সংকুচিত হবে। সোশ্যাল সিকিউরিটির ‘চেক’ যারা পান, তারাও পড়বেন বিপদে। যে মধ্যবিত্ত ওবামাকে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছে, তারা পড়বে বিপদে। তাই ওবামাকে ঋণ করতেই হবে। কংগ্রেস যদি ঋণ গ্রহণের অনুমতি না দেয়, তাহলে বছরের শুরুতেই এক ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে তিনি যাত্রা করবেন।
সমস্যা তার জন্য আরও আছে। আফগানিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন তার জন্য বড় সমস্যা। আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের (২০১৪) সিদ্ধান্তে তিনি অটল। কিন্তু তারপর? তালেবানদের সঙ্গে কোন ‘সমঝোতা’ হয়নি। ২০১৪ সালে কারজাইয়ের শেষ বছর হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। চলতি বছর আফগানিস্তানের জন্য একটি ‘বিকল্প সমাধান’ তিনি বের করতে পারবেন বলেও মনে হয় না। আর কারজাইয়ের পতন যদি সেখানে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের পথকে প্রশস্ত করে, সেটা হবে ওবামার বৈদেশিক নীতির জন্য দুঃসংবাদ। পাকিস্তানে অব্যাহত ড্রোন বিমান হামলা চালিয়েও ‘পাকিস্তানি তালেবান’দের নির্মূল করা যায়নি। বরং পাকিস্তান আজ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ব্যাপ্তি সিরিয়াকে এক ‘নয়া লেবাননে’ পরিণত করতে পারে। আর মিসরে ইসলামপন্থীদের উত্থান ওবামা প্রশাসনের জন্য আদৌ কোন ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না আগামী দিনে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ সেখানে এক ধরনের উৎসবের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ১০ লাখ মানুষ এ উৎসবে অংশ নেবে। এটা ৫৭তম শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। এটিও চাঁদানির্ভর। ২০০৯ সালে প্রথমবার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ওবামা ব্যয় করেছিলেন ৫৩ মিলিয়ন ডলার। সিনিয়র বুশ ও ক্লিনটন ব্যয় করেছিলেন যথাক্রমে ৩০ ও ৪২ মিলিয়ন ডলার। চাঁদার পরিমাণও নির্ধারিত থাকে। ১ লাখ ডলার থেকে ১০ লাখ ডলার। আর কেউ যদি ১০ লাখ ডলার চাঁদা দেয়, তিনি সামনের সারিতে বসে প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। আড়াই লাখ ডলার দিলে আপনি সব ধরনের কনসার্টে অংশ নিতে পারবেন। ১৫০ ডলার দিয়ে শার্টের কাফলিং কিনতে পারেন, আর ৭ হাজার ৫০০ ডলার খরচ করে আপনি কিনতে পারেন ‘প্রেসিডেন্টস মেডেল’। এটা একটা উৎসব। কিন্তু যেখানে জনগোষ্ঠীর ১৫ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তাদের জন্য এ উৎসব আদৌ কোন সুসংবাদ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক হোসাইন ওবামা আজ থেকে তার দ্বিতীয় টার্ম শুরু করলেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কোন ক্ষেত্রেই তার জন্য কোন সুসংবাদ অপেক্ষা করছে না।
Daily JUGANTOR
21.01.13

পারমাণবিক বিদ্যুৎ ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গ






প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মস্কো সফরের সময় বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রস্তুতিমূলক অর্থায়নে সহযোগিতা শীর্ষক এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ পাবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারিগরি গবেষণার জন্য এ অর্থ ব্যয় হবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এটা প্রাথমিক স্টেজ। গেল বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটম নিউক্লিয়ার এনার্জির সঙ্গে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এর রেশ ধরেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফরের সময় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো। এখানে বলা প্রয়োজন, তত্কালীন পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। এখন সেখানেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে। প্রস্তাবিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার, যা প্রায় ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমান। তবে এ খরচ এখন আরো বাড়বে। বাংলাদেশ যে চুক্তিটি করল এবং চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়ার কাছ থেকে যে আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া যাবে, ওই অর্থ ব্যয় হবে কারিগরি গবেষণার জন্য। গবেষণায় নির্ধারিত হবে— কত খরচ হবে। দুই বছরের মধ্যে ওই গবেষণার কাজ শেষ হবে। রূপপুরে দুটি ইউনিট হবে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, পাঁচ স্তরবিশিষ্ট একটি নিরাপত্তা বলয় থাকবে এবং তৃতীয় জেনারেশনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখানে বসানো হবে।
জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ বিপর্যয়ের (২০১১) রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশ যখন রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুরে পারমাণবিক চুল্লি তৈরির সমঝোতায় যায়, তখন সঙ্গত কারণেই এ নিয়ে বিতর্ক বাড়বে। জাপান প্রযুক্তিবিদ্যায় শীর্ষে অবস্থান করলেও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। বলা হচ্ছে, আশির দশকের (১৯৮৬) মাঝামাঝিতে রাশিয়ার চেরনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে ঘটনা ঘটেছিল, তার চেয়েও ভয়াবহ ছিল ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপর্যয়। চেরনোবিল বিপর্যয়ের পর তেজস্ক্রিয়তা ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। গরুর দুধ, গুঁড়ো দুধ, শাকসবজি, ফলমূল সব কিছুতেই তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ প্রায় ২৬ বছর পরও চেরনোবিল ও তার আশপাশের এলাকা বিপদমুক্ত নয়। ইউরোপের বেশকিছু দেশ থেকে কৃষিপণ্য রফতানি বেশ কয়েক বছর বন্ধ ছিল। এখন বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাবে। কিন্তু এর নিরাপত্তা আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব, সে প্রশ্ন থেকেই গেল।
পরমাণু প্রকল্প খুব ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণও। দক্ষিণ এশিয়ায় পরমাণু শক্তির ব্যবহার খুবই কম। ভারতে মোট জ্বালানির মাত্র ২ শতাংশ ও পাকিস্তানের ১ শতাংশ আসে পরমাণু থেকে। যদিও এ দুটি দেশ পরমাণু শক্তি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা খোদ ভারতেও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। গেল বছর পাকিস্তান চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যেখানে চীন পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে দেবে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয় দেশ, যেটি পরমাণু শক্তির উৎপাদনে যাচ্ছে। সাধারণত ৬০০ থেকে ১ হাজার মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ৫০০ মেগাওয়াটের ওপরে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে উৎপাদন খরচ কম হয়। কিন্তু এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপনে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ খরচ হয়। প্রচলিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে প্রতি মেগাওয়াটের জন্য গড়ে খরচ হয় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্মাণে খরচ হয়েছে দেড় থেকে ২ মিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে খরচ হবে দেড় মিলিয়ন বা ১৫০ কোটি টাকা। জাপানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় প্রতি ইউনিটে ৪ ডলার ৮০ সেন্ট, কয়লায় ৪ ডলার ৯৫ সেন্ট ও গ্যাসে ৫ ডলার ২১ সেন্ট। দক্ষিণ কোরিয়ায় খরচ হয় পারবমানবিকে ২ ডলার ৩৪ সেন্ট, কয়লায় ২ ডলার ১৬ সেন্ট আর গ্যাসে ৪ ডলার ৬৫ সেন্ট। ফ্রান্সে পারমাণবিকে ২ ডলার ৫৪ সেন্ট, কয়লায় ৩ ডলার ৩৩ সেন্ট ও গ্যাসে ৩ ডলার ৯২ সেন্ট খরচ হয়।
বর্তমান বিশ্বে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তার ২৪ শতাংশই আসে পরমাণু শক্তি থেকে। এগুলো সবই উন্নত দেশে অবস্থিত। বিশ্বে ২৮টি পরমাণুভিত্তিক ৪২০ বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মাঝে ফ্রান্সে ৫৯টি। ফ্রান্সে মোট বিদ্যুতের ৭৯ শতাংশ উৎপাদিত হয় পরমাণু শক্তি থেকে। বেলজিয়ামে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫৮টি। দেশটির মোট বিদ্যুতের ৫৮ শতাংশই আসে পরমাণু শক্তি থেকে। সুইডেনে ৪৪ শতাংশ, কোরিয়ায় ৪০, জাপানে ৫৫ ও যুক্তরাষ্ট্রে ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ পরমাণু শক্তিনির্ভর। তবে ফুকুশিমার পর জাপান নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে এবং বিকল্প শক্তির কথা চিন্তা করছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে চীনে ৯ হাজার, ভারতে ৪ হাজার ১২০ ও পাকিস্তানে ৪২৫ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। ২০২০ সালের মধ্যে চীন ৪০ হাজার, ভারত ২০ হাজার ও পাকিস্তান ৭ হাজার মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। অনেকেই জানেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমতি নিতে হয়। বাংলাদেশ এই অনুমতি পেয়েছিল ২০০৭ সালের জুনে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়টা হচ্ছে এর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে। দক্ষ জনশক্তি আমাদের নেই। এর অর্থ, দীর্ঘদিন রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা থেকে যাবে আমাদের। দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা হচ্ছে জনবসতির ঘনত্ব। রূপপুরে যেখানে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, সেখানে আশপাশে জনবসতি রয়েছে। এই জনবসতি সরিয়ে নেয়াটা হবে এক বড় সমস্যা। এছাড়া বাংলাদেশে এমন কোনো বিরান এলাকা নেই, যেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করা যায়। আমাদের বিদ্যুতের চহিদা বাড়ছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের দুর্নীতি এখন মুখে মুখে। এ শীতেও লোডশেডিং হচ্ছে। আগামী গ্রীষ্মে লোডশেডিং কোন পর্যায়ে যাবে, ভাবতেই আঁতকে উঠতে হয়। আমাদের কয়লার একটা বড় সম্ভাবনা থাকলেও এটি উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক আছে। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এটিকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কার হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লা সম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। কিন্তু উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য; যা আমাদের ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখতে পারে।
সরকার পরমাণু শক্তিতে কেন গেল, তার একটা যুক্তি আছে। বর্তমানে বিদ্যুতের যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সর্বত্র তা সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াটে। তখন এ চাহিদা আমরা পূরণ
করব কীভাবে?
জ্বালানি আজ বিশ্বের অন্যতম একটি সমস্যা। সস্তায় জ্বলানী তেল পাওয়ার দিন ফুরিয়ে আসছে। আমরা বর্তমানে এক ধরনের ‘অয়েল শক’-এ আক্রান্ত। তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের সর্বোচ্চ পয়েন্টটিতে আমরা পৌঁছে গেছি। এখন সাপ্লাই কমে যাচ্ছে বিশ্ববাজারে, যাতে করে দাম বেড়ে যাচ্ছে। ৪০ বছর ধরে নতুন তেল খনি অবিষ্কারের হার পড়তির দিকে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য জ্বালানি গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত জনসংখ্যা, উন্নয়নের চাপ, কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। তেলের দুষ্প্রাপ্যতা ও দামের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাসকূপগুলো নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এবং বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবনে ব্যর্থতা বাংলাদেশের জ্বালানী নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে একটি বড় ধরনের
সংকটে ফেলবে। বাংলাদেশ এ ‘অয়েল শক’ সহজে কাটিয়ে উঠতে পারবে না। তাই এখন থেকেই বিকল্প জ্বালানির কথা ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে পরমাণু জ্বালানিকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্তটি ভালো। তবে এর নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। শুধু কেন্দ্র নির্মাণ করলেই চলবে না, রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করা, ওই দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের মনোভাবও বিবেচনায় নিতে হবে। রূপপুরে একাধিক ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ রয়ে গেছে। নদীর একেবারে পার্শ্ববর্তী এই রূপপুর। চেরনোবিল ও ফুকুশিমা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। চেরনোবিলের দুর্ঘটনাকবলিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই এলাকা আজো নিরাপদ নয়। আর ফুকুশিমার দুর্ঘটনার পর এর আশপাশ ‘সিল’ করে দেয়া হয়েছে। জার্মানি এরই মধ্যে কয়েকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। বিষয়গুলো আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিবেচনায় নিলে ভালো করবেন।
Daily BONIK BARTA
19.01.13

তত্ত্বাবধায়ক নাকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার


বছরের শুর্কটা আবার জমে উঠেছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। বিএনপি তথা আঠারো দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। বেগম জিয়া জানিয়ে দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া অন্য কোনো কিছু তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আর প্রধানমন্ত্রীর খুব আস্থাভাজন বেগম মতিয়া চৌধুরী বললেন ভিন্ন কথা। মতিয়া চৌধুরী বললেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্বটি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর। গেল বছর লন্ডনে একটি অনুষ্ঠানে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধারণা দিয়েছিলেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি নিজে থাকবেন। তার এই ধারণা কোনো একটি পক্ষ থেকেই সমর্থিত হয়নি। এমনকি মহাজোটের শরিকরাও এমনটি চান না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে, এই ধারণাটি সংবিধান সম্মত নয়।  সম্প্রতি তিনটি পত্রিকার জনমত জরিপে দেখা গেছে শতকরা  প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ তত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত দিয়েছে। প্রথম আলোর জনমত জরীপে ৭৬ ভাগ, ডেইলি স্টারের জরিপে ৬৭ ভাগ আর সমকালের জরিপে ৬২ ভাগ মানুষ তত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে তাদের মতামত দিয়েছে। সরকার বলছে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কথা । কিন্তু সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও কোনো উল্লেখ নেই। তাহলে মতিয়া চৌধুরী যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলেন, এই সরকার তিনি প্রতিষ্ঠা করবেন কোত্থেকে? সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাখ্যা তো নেইই, নির্বাচনের আগে যে সরকার থাকবে, তাকেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলা হয়নি। তাহলে মতিয়া চৌধুরী এই সরকারের ধারণাটাই পেলেন কোথায়? আসলে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে যাবার জন্যই বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলছে সরকার। কিছুদিন আগে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য সৈয়দ আশরাফ বললেন, গোপনে গোপনে বিরোধী দলের সাথে আলাপ আলোচনা হচ্ছে! এটা যে একটি মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য, তা পরিষ্কার করলেন বেগম জিয়া। ১ জানুয়ারি ছাত্রদলের ৩৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে বেগম জিয়া বললেন, তলে তলে আলোচনা হয় না, ষড়যন্ত্র হয়। মিথ্যা বলেননি বেগম জিয়া। আলোচনা হবে প্রকাশ্যে। এজেন্ডা থাকবে স্পষ্টÑ একটি নির্দলীয় সরকার। সেই সরকারকে তত্ত্বাবধায়কের পরিবর্তে অন্য যেকোনো নামেও ডাকা যেতে পারে। সুতরাং আলোচনা গোপনে কেন? আসলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার এটা একটা সরকারি কৌশল মাত্র। তাহলে কী সরকার বিএনপির নামধারী কারো সাথে গোপনে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে? ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ যারা বিশ্বাস করেন, তারা এ কথাটা বলতেই পারেন। এটা তো সত্য বিএনপি থেকে বেড়িয়ে গিয়ে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা নিজে একটি দল করেছেন। নির্বাচনের তারিখ যতই এগিয়ে আসবে, সুবিধাভোগীরা ততই হুদার পাশাপাশি থাকবেন। একটি ‘সরকারি বিএনপি’ গঠিত হলেও আমি অবাক হবো না। বাংলাদেশের রাজনীতির যে ইতিহাস, তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বিএনপিকে বাদ দিয়ে যে সংসদ নির্বাচন, তা কখনোই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আমরা তো জানি এ দেশে ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে তিনটি নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু ওই নির্বাচনগুলো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এমনকি ১৯৮৬ সালে এরশাদীয় জমানায় আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও, সেই সংসদ স্থায়ী হয়নি। আজ সরকারের পক্ষ থেকে যে সংবিধানের কথা বলা হয়েছে, তার মাঝে কোনো অসত্য নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের প্রশ্ন যেখানে বড়, সেখানে সংবিধান বড় হতে পারে না। সংবিধানে কোনো ধরনের সংশোধনী ছাড়াই নির্বাচন আয়োজন করার পেছনে একটি ঐকমত্যে পৌঁছান সম্ভব। যেমন ৫টি বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এক. প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে দু’দলের ৫ জন করে সদস্য নিয়ে একটি সরকার, যাদের দায়িত্ব শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা। নিরপেক্ষতার স্বার্থে ওই দশজন সদস্যের কেউই নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অথবা দুই. স্পিকারের নেতৃত্বে দু’দলের পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে একটি সরকার। উভয় ক্ষেত্রে তারা তিনমাসের মধ্যে নির্বাচন করতে বাধ্য থাকবেন এবং নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রেও স্পিকারসহ কেউই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। অথবা তিন. সাংবিধানিক অধিকারী (অর্থাৎ যারা শপথ নিয়েছেন) ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সরকার, যারা নিরপেক্ষতার স্বার্থে নির্বাচনের পর পরই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেবেন। অথবা চার. সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি সরকার, যেখানে সচিবরা সাময়িকভাবে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করবেন। অথবা পাঁচ. তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অথবা আপিল বিভাগের তিজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ‘এলডার্স কাউন্সিল’ যারা নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এই পাঁচটি বিকল্পের যে কোনো একটি বিকল্প নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে এর কোনো কিছুরই প্রয়োজন হতো না, যদি আমরা নির্বাচন প্রশ্নে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে পারতাম। আমরা সেই ঐকমত্যে পৌঁছতে পারিনি।
গণতন্ত্র আমাদের একটা কথা শিখিয়েছে। আর তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন। সেই সাথে জনগণের প্রতি আস্থা রাখাটাও জরুরি। সরকার যদি জনগণের পক্ষে কাজ করে থাকে, তাহলে তাদের জনগণের আস্থা হারানোর কোনো ভয় নেই। সরকার এই জানুয়ারিতে চার বছর পার করছে। সরকার একটা তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়ার সময়ের পরিস্থিতি, বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল, আর আজকেইবা কেমন। সুশাসনের ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। সরকারের অর্জনগুলো ম্লান হয়ে গেছে অনেকগুলো ব্যর্থতার কারণে। এটা সত্য, বৈশ্বিক অর্থনীতির ঢেউ বাংলাদেশে তেমন একটা লাগেনি। নিঃসন্দেহে বলতে পারি গ্রীস বা স্পেনের মতো পরিস্থিতি এ দেশে এখনও সৃষ্টি হয়নি। রেমিট্যান্স এর প্রবাহ ভালো। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ভালো। প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি সরকারের ভাবমূর্তি দেশে ও বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ছাত্রলীগের ভূমিকা, ক্যাম্পাসগুলোতে ভিসিদের ‘নিয়োগ বাণিজ্য’ একজন শিক্ষামন্ত্রীর ভূমিকাকে উজ্জ্বল করেনি। ইউজিসির ভূমিকাও এখানে চোখে লাগার মতো নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল শক্ত অবস্থানে যাবার। কিন্তু সরকার যায়নি। কেন যায়নি, সে প্রশ্ন ভিন্ন। সাত দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। অথচ বিদ্যুতের মূল্য বাড়ালে যে সাধারণ মানুষ তিগ্রস্ত হয়, সে ব্যাপারে সরকার উদাসীন। এটা সরকারের সুশাসনে ব্যর্থতা হিসেবে  চিহ্নিত হতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে জনসাধারণকেই সুযোগ দেয়া উচিত তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের। গণতন্ত্রের এই মূল স্পিরিটটি আমাদের দেশে অনুপস্থিত।
চলতি ২০১৩ সালে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে ওই একটি ইস্যুতেÑ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে একটি সরকার, যাদের কাজ হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। এ ক্ষেত্রে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকারও হতে পারে। নামে কিছু যায় আসে না। মূল বিষয়টি হচ্ছে ওই সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। প্রধানমন্ত্রী একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার জট খোলেনি। কেননা সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই একটি সরকারের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেই প্রস্তাবের গ্রহণযোগ্যতাও পায়নি। আমরা সব সময়ই একটা ভুল করি। আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কথা বলি। কিন্তু সব সময়ই পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির আদলে আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বিনির্মাণ করতে চাই। আমাদের ভুলটা সেখানেই। পশ্চিমা সমাজ যেভাবে বিকশিত হয়েছে, সেখানকার সংস্কৃতি, শিক্ষা, সুশাসন, বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব, সর্বোপরি ইতিহাস ও ঐতিহ্য তাদেরকে আজ এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। সেখানে ভোট ডাকাতি, ভোট জালিয়াতি হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অতীতে ‘ফোরিডার কেলেঙ্কারি’ সেখানকার নির্বাচন প্রক্রিয়াকে কালিমালিপ্ত করেছিল। কিন্তু তাই বলে একটি ‘ফোরিডা’র ঘটনা নিয়ে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়নি। এমনকি আমরা ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্তরেও যেতে পারিনি। আমরা ইতোমধ্যে ৪১ বছর পার করে ফেলেছি। ভারতের নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত শক্তিশালী। আইন সেখানকার কমিশনকে অনেক শক্তিশালী করেছে। কিন্তু আমরা তা পারিনি। আমাদের স্বদিচ্ছার অভাব ছিল। অনেকেই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলেন। কিন্তু এখানে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি হয়েছে। বর্তমান সরকার, অতীতে ও বর্তমানে, সত্যিকার অর্থে নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন ও স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ‘অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের’ জন্য বিগত নির্বাচন কমিশন সদস্যরা বারবার বিদেশে গেছেন। কিন্তু সেই ‘অভিজ্ঞতা’ তারা কোথায়, কীভাবে ব্যবহার করেছেন, আমরা জানি না। কিন্তু রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা তাতে খরচ হয়েছে। সংবিধানে নির্বাচন কমিশনে সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যায় না। আর্থিক ভিত্তি, জনবল, ইত্যাদি প্রতিটির জন্য নির্বাচন কমিশন সরকারের ওপর নির্ভরশীল। সরকারের প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর পরে। এমনি এক পরিস্থিতিতে একটি ফর্মূলার কথা বলেছেন ড. আকবর আলি খান। তার সাথে আমরা দ্বিমত করতেই পারি। কিন্তু আলোচনা হতে ক্ষতি কী? কিন্তু সরকার প্রধান অত্যন্ত অসৌজন্যমূলকভাবে ড. আকবর আলির সমালোচনা করেছেন। ড. আকবর আলি খান সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। তিনি বিএনপি করেন না। বরং বিএনপির সমালোচকদের একজন তিনি। এর আগে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক স্বপ্রণোদিত হয়ে বলেছিলেন, প্রয়োজনে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতেও রাজি। কিন্তু অত্যন্ত অশালীন ভাষায় প্রধানমন্ত্রী ব্যারিস্টার হকেরও সমালোচনা করেছিলেন। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন যে, এক-এগারোর ঘটনায় তার আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার হক। তিনি ভুললেও, জাতি ভোলেনি। বিভিন্ন আলোচনা ও টক-শোতে বলা হচ্ছে সরকার যদি জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চায়, তার পরিণতিও ভালো নয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র সাথে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে একটা সমঝোতা হতেই হবে। আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে না উঠলে, আমাদের জন্য আরো খারাপ সংবাদ অপেক্ষা করছে। আজ তত্ত্বাবধায়ক  সরকার প্রশ্নে সরকার যদি একটি সংলাপে যায়, আমার বিবেচনায় সেটা সরকারের জন্যও মঙ্গল। সরকার সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে। এটা সত্য।  সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। কিন্তু তাই বলে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করার স্বার্থে নতুন একটি ব্যবস্থা যে প্রবর্তন করা যাবে না, তা তো নয়। আমরা তো সর্বশেষ গ্রীসের সিদ্ধান্তটিও অনুসরণ করতে পারি। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা বেগম জিয়াকে গ্রেফতারেরও হুমকি দিয়েছেন। আমরা ভুলে যাই অতীত বড় নির্মম। বিগত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারও করেছিল। কিন্তু পরিণতি কী ভালো হয়েছে? নিশ্চয়ই সরকার যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে। সেটা তাদের অধিকার। কিন্তু সংঘাত যখন তীব্র হচ্ছে, তখন এ ধরনের কথাবার্তা না বলাই শ্রেয়। এ ধরনের বক্তব্য কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। বরং তা আমাদের ভাবমূর্তি বহিঃবিশ্বে নষ্ট করবে। আমরা এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে চাই। আর পথ খোলা একটাই- সংলাপ। সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত না করে যদি সত্যিকার অর্থেই সংলাপের একটি উদ্যোগ নেয় এবং নির্দলীয় সরকারের কাঠামো নিয়ে বিরোধী দলের সাথে আলোচনা করে, তা শুধু সঙ্কট নিরসনই করবে না, বরং জাতিকে একটা বড় স্বস্তি এনে দেবে।
18.01.13