রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

জিএসপি সুবিধা স্থগিত ও আমাদের পররাষ্ট্রনীতি

শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা, যা জিএসপি নামে পরিচিত, তা স্থগিত করেছে। মার্কিনি বার্তা সংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে এ কথা জানা গেছে। এর আগে ৯ জন সিনেটর ওবামাকে লিখিত এক চিঠিতে বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত রাখার আবেদন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ৭ জুন পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটিতেও এ ধরনের একটি সুপারিশ করা হয়েছিল। মূলত শ্রমিক স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থতা ও কারখানার পরিবেশ ভালো না থাকার যুক্তি তুলে মার্কিন আইন-প্রণেতারা প্রেসিডেন্ট ওবামাকে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করলেন। আপাতদৃষ্টিতে এতে করে বাংলাদেশের রফতানি খাত খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও, এটা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য একটা খারাপ ‘ইমেজ’ সৃষ্টি করল। বলা ভালো, প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশী পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও তৈরি পোশাক কোনো শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়নি। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে এ শুল্কমুক্ত সুবিধা দাবি করে আসছিল। বাংলাদেশী রফতানিকারকরা শতকরা ১৫ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করে তৈরি পোশাকের একটি বড় বাজার সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশী যেসব পণ্যের জন্য জিএসপি সুবিধা দেয়া হয়েছে, তার অনেক আইটেম বাংলাদেশ আদৌ রফতানি করে না। প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের যে বাণিজ্য, তাতে মাত্র ১ ভাগ এ শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। তার পরও জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার বা স্থগিতের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য বহির্বিশ্বে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেবে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটা ব্যর্থতা এখানেই যে, আমরা মার্কিনি আইন-প্রণেতাদের আশ্বস্ত করতে পারিনি। রানা প্লাজার ঘটনার পর সরকার যেসব কর্মসূচি নিয়েছে, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন-প্রণেতাদের কাছে পৌঁছানো হয়নি। অথচ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সারা বিশ্ব চষে বেড়ান। দু’সপ্তাহ আগেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল, জাতিসংঘের সংস্কৃতিবিষয়ক এক সম্মেলনে যোগ দিতে। এর আগে একই সফরে তিনি গিয়েছিলেন আজারবাইজানে। তারপর নিউইয়র্ক থেকে গিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডে। ঢাকায় মাত্র এক সপ্তাহ থেকে আবার গেলেন প্যারিসে। অথচ যেখানে বাংলাদেশের স্বার্থ জড়িত, সেখানে তিনি যাননি। এমনকি জাতীয় স্বার্থ উদ্ধারে তার ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে উষ্ণতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বেশ কিছু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। দুর্নীতির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন থেকে কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করেনি। জন কেরির বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। কিন্তু ভারত সফর করে দেশে ফিরে গেছেন তিনি। এখন এলো জিএসপি সুবিধা স্থগিতের সিদ্ধান্ত।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক্ষেত্রে প্রায় নিষ্ক্রিয়। তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ গার্মেন্টের সব আইটেমে জিএসপি সুবিধা পায় না। কিছু কিছু পণ্যে জিএসপি সুবিধা পায়। এসব পণ্যের সব আবার বাংলাদেশ রফতানিও করে না। বাংলাদেশ অনেক দিন থেকেই গার্মেন্ট সেক্টরে এ জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছে। চলতি জুন মাসেই এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ছিল। এখন পুরো জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে গেল। দ্বিতীয় আরও একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে, ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সম্ভাবনার বিষয়টি। এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে ৩১ মে। ন্যাটোর ওয়েবসাইটেও বিষয়টি আছে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কূটনীতিকরা ১৫ মে ব্রাসেলসে ন্যাটোর সদর দফতর পরিদর্শন করেছেন এবং ন্যাটোর এ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন বাংলাদেশের কোনো পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়নি এবং বাংলাদেশ এ থেকে কতটুকু উপকৃত হতে পারে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও উপস্থাপন করা হয়নি। তবে ন্যাটোর ঝঃৎধঃবমরপ পড়হপবঢ়ঃ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষকরা মোটামুটি ধারণা রাখেন। ন্যাটোর লিসবন শীর্ষ সম্মেলনে ২০১০ সালে এ ধারণাপত্র গ্রহণ করা হয়েছিল। এ ধারণাপত্রের মূল বিষয়টি হচ্ছে, ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। ন্যাটোর কর্মকা- এখন আর শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং তা দক্ষিণ এশিয়াতেও সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন বাংলাদেশ যদি সম্প্রসারিত এ কর্মসূচিতে নিজেকে জড়িত করে, তা যে অভ্যন্তরীণভাবে বিতর্কের মাত্রা বাড়াবে, এ কথা বলা যায়।

অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীর এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মকা- ভারত মহাসাগর এলাকায় সম্প্রসারিত করেছে। আগামীতে মার্কিন ষষ্ঠ নৌবহরের বেশ ক’টি জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রসীমায় মোতায়েন করা হবে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়বে। সঙ্গত কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একটি প্রশ্নের মধ্যে থেকে যাবে। তবে এখানে একটা কথা বলা বাঞ্ছনীয়। শেখ হাসিনার প্রথম টার্মের (১৯৯৬-২০০১) পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে বর্তমান টার্মের পররাষ্ট্রনীতির সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে প্রথম টার্মে তিনি যতটা না ‘স্পষ্ট’ ছিলেন, এবার তিনি অনেক বেশি ‘স্পষ্ট’। তবে তার প্রথম টার্মেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নত হয়েছিল। তার প্রথম টার্মে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিবিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে ‘হানা’ চুক্তিও (হিউম্যানিটোরিয়ান অ্যাসিসটেন্স নিডস অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তার প্রথম টার্মে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (১২৪ মিলিয়ন ডলার), যা পরে নানা বিতর্কের জন্ম দেয়। তার দ্বিতীয় টার্মেও সেই ধারাবাহিকতা তিনি রক্ষা করলেন। আসলে জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা উচিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া উচিত বেশি। মহাজোট সরকারের আমলে এ স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। শুধু শুধু বিদেশ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে এ স্বার্থ অর্জিত হবে না। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেক্টরগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে হবে। মাত্র ৫ ঘণ্টার নিউইয়র্ক সফর করে মন্ত্রী তার নামের ওপর সুবিচার করতে পারেননি। একুশ শতকে বাংলাদেশের লক্ষ্য কী, অর্জন কী, ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে বাংলাদেশ কীভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করবে, এর কোনো দিকনির্দেশনা নেই আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে। বিদেশ সফর করে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি।

ভারতের সঙ্গে আমাদের বেশ কিছু বিষয় ঝুলে আছে। এ ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা স্পষ্ট নয়। তিস্তা চুক্তি নিয়ে যে ধূম্রজাল, তার অবসান হয়নি। আমাদের স্বার্থে তিস্তা চুক্তি অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে এ চুক্তিটি এখন পর্যন্ত হচ্ছে না। এ চুক্তিটি না হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরও ঝুলে গেল। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি যাওয়ার কথা। বাস্তবতা হচ্ছে, তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। আগামীতে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন। এরপর ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচন। মমতা ব্যানার্জি তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টিকে তার স্বার্থে ব্যবহার করবেন। তাকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র কোনো চুক্তি করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, মমতা এখন আর কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটে নেই। ফলে কেন্দ্র তার ওপর কোনো প্রভাব খাটাতে পারবে না। তৃতীয়ত, তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আরও একটি পক্ষ আছে। আর তা হচ্ছে সিকিম। সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুঁড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্সের সমভূমি দিয়ে চিলহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ীর কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। সিকিম মূল প্রবাহে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সিকিম তিস্তার উজানে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। দীর্ঘ দুই যুগেও তিস্তা নদীর পানির হিস্যা না পাওয়ায় প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পটি এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিস্তা চুক্তিটির গুরুত্ব অনেক বেশি। এটা এখন ঝুলে গেল।

টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও অস্পষ্টতা আছে। ভারত বারবার বলছে, তারা টিপাইমুখে এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু সংবাদপত্রে (ভারতীয়) প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ভারত এ প্রকল্প নিয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। খোদ মণিপুরেই প্রস্তাবিত এ বাঁধের ব্যাপারে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। টিপাইমুখ হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্টে যে হাইড্যাম নির্মিত হবে, তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা হবে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এটি নির্মিত হওয়ার কথা বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে আসামের করিমগঞ্জে বরাক নদীর ওপর। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ হাইড্যামের অবস্থান বাংলাদেশের সীমানার খুবই কাছে। ফলে এর থেকে সৃষ্ট সব ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব, যেমন নদীগর্ভে অতিরিক্ত বালুর সঞ্চালন ও সঞ্চয়ন, হঠাৎ বন্যা, অতিবন্যা ইত্যাদির প্রভাব সম্পূর্ণটাই পড়বে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সম্পূর্ণ হাওর জনপদের ওপর। আনুমানিক ১০-১৫ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলের হাওর, বিলঝিল, বাঁওড়, নদীনালা বালুতে প্রায় ভরে যাবে। জেআরসির সভা না হওয়ায় বাংলাদেশ টিপাইমুখ নিয়ে আলোচনার সুযোগ হারাল।

বাংলাদেশ তার বন্ধুকে সম্মান জানাতে জানে। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় সম্মানে সম্মানিত করেছে। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে আরও একটু উদার হতে পারত। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ব্যাপারে যেমন জটিলতা রয়েছে, সেইসব জটিলতা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে ভারতের কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না। ভারতের রাষ্ট্রপতির ঢাকা সফরের সময় সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।

কিন্তু সেই আশ্বাস রক্ষিত হয়নি। ছিটমহল নিয়ে যে সমস্যা, সে সমস্যা আজও রয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ভূখ-ে আছে ১৭ হাজার ১৪৯ একর ভারতীয় ভূমি। আর ভারতের ভূখ-ে আছে ৭ হাজার ১১১ একর বাংলাদেশী ভূমি। এসব অঞ্চলের মানুষ এক মানবেতর জীবনযাপন করছে। ভারত বড় দেশ। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি হবে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি। সঙ্গত কারণেই ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে আমরাও উপকৃত হতে পারি। এজন্য যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে ভারতের উদার মনোভাব। ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দিনে দিনে বাড়ছেই। অশুল্ক বাধা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয়নি। ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ভারি যন্ত্রপাতি সরবরাহের পর খাদ্যদ্রব্য সরবরাহেরও সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো ট্রানজিট সুবিধা পায়নি। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির একটা কথা বলা হয়েছিল। সেখানেও সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

সব মিলিয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে অর্জনটা খুব বড় নয়। তার চেয়েও দুঃখজনক হচ্ছে, যতটুকু অর্জন, তা ম্লান হয়ে গেছে বেশ ক’টি ঘটনায়। র‌্যাব তথা মানবাধিকারের ঘটনা বারবার আলোচিত হচ্ছে। সমালোচনা করা হচ্ছে সরকারের। মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের প্রতিবেদনে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে। ড. ইউনূস ইস্যু নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশবিরোধী একটি জনমত তৈরি হয়েছে। মার্কিন সিনেটর তথা কংগ্রেস সদস্যদের অনেকেই অধ্যাপক ইউনূসের বন্ধু। গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারিকরণ তথা ভেঙে ফেলার উদ্যোগকে মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা খুব ভালো চোখে দেখেনি। সব মিলিয়ে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে এসে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে একটা ভাবমূর্তি সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। আগামীতে নির্বাচন হবে। সরকারপ্রধান এরই মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। নির্বাচনের আগে সরকার যদি তার ভাবমূর্তি উদ্ধারে সচেষ্ট না হয়, তাহলে তা সরকারের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এটা সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে একটা ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত হতে বাধ্য।


Daily ALOKITO BANGLADESH


30.6.13





নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া গত্যন্তর নেই

চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর পরই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দলীয় সরকারের আওতায় যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এটা তার প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রীর দেখাদেখি দলের অন্য নেতারাও একই সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন। আমি এটাই প্রত্যাশা করেছিলাম, এ ধরনের কথাই আওয়ামী লীগের নেতারা বলবেন। বলতে দ্বিধা নেই, চারটি সিটি কর্পোরেশনের ভোটাররা আওয়ামী লীগকে পরিত্যাগ করেছে। এই যে চিত্র, তা শুধু চারটি সিটি কর্পোরেশনেই সীমাবদ্ধ নেই, এটা সারা বাংলাদেশের চিত্র। স্থানীয় নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। অনেকগুলো কারণ রয়েছে, যা আমাদের বোঝার জন্য যথেষ্ট যে, বর্তমান সরকারপ্রধানকে ক্ষমতায় রেখে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রথমত, তিনি একটি দলের প্রধান। দলীয় প্রধান যদি অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন, সেখানে তিনি চাইবেন যেনতেনভাবে দলকে বিজয়ী করতে। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী থাকার ফলে প্রশাসন থাকবে তার নিয়ন্ত্রণে। ইতোমধ্যে সরকার প্রশাসন সাজাতে শুরু করে দিয়েছেন। প্রতিটি জেলা, উপজেলা প্রশাসনে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের সময় এরা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন। দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করলে, নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তৃতীয়ত, নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। ফলে পোলিং বুথগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কীভাবে? যে পুলিশ দলীয়ভাবে পরিচালিত হয়, তাদের কাছে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায় কী? চতুর্থত, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়। নানা কারণে তারা সরকারের ওপর নির্ভরশীল। তারা নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্ভর করবেন হাজার হাজার সরকারি কর্মচারী এবং স্কুল শিক্ষকদের ওপর। যে প্রশাসনে ইতোমধ্যে বেশি মাত্রায় রাজনীতিকরণ হয়েছে, সেই প্রশাসনে নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ থাকবে, এটা বিশ্বাস করা যায় না।


তবে আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি সরকারের নীতি নির্ধারকরা এখন হাজারটা যুক্তি দেখাবেন যে, দলীয় সরকারের আওতায়ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এখানে যে বিষয়টি মুখ্য, তা হচ্ছে এটা স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন। এই নির্বাচনের সাথে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের তুলনা করা যাবে না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাজ করে স্থানীয় ইস্যু। যেমন সিলেটের সাধারণ মানুষ মেয়র কামরানের ‘পারফরমেন্স’ এ খুশি ছিলেন না। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে তার ব্যর্থতা ছিল চরমে। উপরন্তু নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে তার দ্বিতীয় স্ত্রী’র আবিষ্কারের ঘটনা (?) নারী ভোটারদের প্রভাবিত করে থাকতে পারে। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে খুলনাতে। দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তালুকদার আব্দুল খালেক ছিলেন ব্যর্থ। উপরন্তু তার শুভাকাক্সিদের কেউ কেউ এমন সব কাণ্ড করেছেন, যা তাকে বিতর্কিত করেছে। তিনি মানুষের আস্থা হারিয়েছেন। খুলনার পাইওনিয়ার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর পরীক্ষায় (ইসলাম ধর্মশিক্ষা) তালুকদার আবদুল খালেককে হজরত উমর (রা.) এর সাথে তুলনা করা হয়েছে। এটা অনভিপ্রেত এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এটা ভালো চোখে নেয়নি। তার ব্যক্তিগত আচরণে (রিকশাওয়ালাকে থাপ্পর মারার ঘটনা) অনেকে অখুশি ছিলেন। এটা সত্য সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দলীয়ভাবে হয়নি। কিন্তু দেখা গেল চূড়ান্ত বিচারে দু’টি বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাদের প্রার্থীর পক্ষে ব্যাপক গণসংযোগ করেছেন। মন্ত্রীরা নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছেন। অর্থমন্ত্রী জাইকার সাথে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বাদ দিয়ে সিলেটে চলে গিয়েছিলেন। তিনি রিকশায় চড়ে এবং সরকারি গাড়ি ব্যবহার না করেও তার ‘নিরপেক্ষতা’ নিশ্চিত করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে ইসির যতটুকু কঠোর হওয়া উচিত ছিল, তারা ততটুকু কঠোর হতে পারেননি। ইসির ভূমিকা তাই প্রশ্নের মধ্যে থেকেই গেল। সিলেটে রিটার্নিং অফিসারের ভূমিকা কিছুটা হলেও নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকাকে প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। যখন সিলেটের ১২৮টি কেন্দ্রের ফলাফল রাতের মধ্যেই এসে গিয়েছিল, তখন তিনি বিরোধী ১৮ দলের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করতে ইতঃস্তত করছিলেন। এ নিয়ে বিএনপির নেতাদের সাথে তার তর্কও হয়। রিটার্নিং অফিসার পরদিন, অর্থাৎ রোববার দুপুরে এটা ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। পরে অবিশ্যি শনিবার রাতেই আরিফুল হক চৌধুরীকে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই একটি ‘ছোট্ট’ ঘটনা প্রমাণ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ ধরনের আচরণ করতে পারেন। ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যে,আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার তার প্রশাসন সাজাচ্ছেন। এই জুন মাসেই বেশ ক’জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। বেশ কিছু কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তাহলে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বাইরে কাজ করতে পারবেÑ এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। প্রশাসনের কাছে নির্বাচন কমিশন যে কত দুর্বল, তা একাধিক ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচনবিধি অনুযায়ী নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রীদের যাবার কথা নয়। কিন্তু মন্ত্রীরা গেছেন। নির্বাচনী এলাকায় সরকার কোনো উন্নয়ন কাজ করতে পারবেন না, যাতে করে ভোটাররা প্রভাবান্বিত হতে পারেন। কিন্তু রাজশাহীতে গ্যাস সরবরাহ চালু হয়েছে নির্বাচনের মাত্র দু’দিন আগে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তা উদ্বোধন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তো নির্বাচনের পরেও এ কাজটি করতে পারতেন। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য ইসির যে কর্তৃত্ব তা কাগজ কলমে থাকবে, ইসি তা প্রয়োগ করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি দলের সভানেত্রী। তিনি যখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকবেন, তখন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা ও কর্মীরা আরো বেশি মাত্রায় উৎসাহিত হবেন। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে পদত্যাগ করেন, কিংবা রাজনীতি থেকে অবসরে যাবার ঘোষণা দেন, তখন আর এ প্রশ্নগুলো উঠবে না। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। সেনাবাহিনী ছাড়া আমাদের দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা অকল্পনীয় একটি বিষয়। অবশ্যই সেনা মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।


যোগাযোগমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী সঠিক কথাই বলেছেন। যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ওয়েক আপ কল ফর দি রুলিং পার্টি’। আর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, একটি ‘অশনি সঙ্কেত’ এর কথা। তারা মিথ্যা বলেননি। দু’জনই যথেষ্ট অভিজ্ঞ। তারা বোঝেন ও জানেন কেন মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এর মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক চাইলে নির্বাচনই হবে না।’ (যায়যায়দিন, ১৭ জুন) তখন আমি এক ধরনের হতাশার মাঝে পড়ে যাই। আমি জানি না কোন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘নির্বাচন হবে না’। নিশ্চয়ই নির্বাচন হবে। আর সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব সরকারের। বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার আর ‘এক-এগারো’র জন্ম হবে না। শুধুমাত্র ‘এক-এগারো’র ঘটনা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে যাচাই করা ঠিক নয়। আমরা ১৯৯৬ সালে, ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পেয়েছিলাম, যারা সাফল্যের সাথে নির্বাচন পরিচালনা করেছে। এর আগে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেখানেও বিতর্ক ছিল কম। শুধুমাত্র ‘এক-এগারো’র ঘটনা দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করা ঠিক নয়।


অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দেশের কিছু চিহ্নিত বুদ্ধিজীবী ‘এক-এগারো’র ঘটনাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটা বড় ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত করেন। অথচ তারা কখনোই বলেন না, ১৯৯৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবার পর এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে অনুষ্টিত ৭ম জাতীয় সংসদে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। এমনকি যারা ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করেছিল, সেই সরকারও ছিল সেনানিয়ন্ত্রিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা খারাপই হয়ে থাকে, তাহলে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের মেয়াদ শেষ হবার পর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তার জন্য কী আওয়ামী লীগ দায়ী নয়?


লগি-বৈঠার রাজনীতি তো আওয়ামী লীগ ওই সময় শুরু করেছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজুদ্দিন আহমেদ নিজে নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সেটা সঠিক ছিল না। একজনের ভুলের জন্য পুরো ব্যবস্থাকে দায়ী করা যাবে না। আজ সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই বটে, কিন্তু একটি দল নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়, যাদের কাজ হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধায়ক সরকারে কেন ভয় এটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। গত ১৯ জুন তিনি সংসদে বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে আর সরানো যাবে না। গত এক সপ্তাহে তিনি একাধিকবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কথা বলেছেন। অথচ ইতিহাস বলে অতীতে জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের পর তিনিই দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় নির্বাচনের দাবি করেছিলেন। এখন তিনি ভোল পাল্টাচ্ছেন কেন?


একমাত্র আওয়ামী লীগ বাদে প্রতিটি দলই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। এমনকি মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টিও চায় একটি নিরপেক্ষ সরকার। এ ক্ষেত্রে সরকার এ দাবি মেনে না নেয়ায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আর প্রধানমন্ত্রী যখন সুস্পষ্ট করেই বলেন, ‘ওরা ক্ষমতায় এলে আর নির্বাচন দেবে না’, তখন নানা প্রশ্ন এসে ভিড় করে। কেন প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলছেন বারবার? প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কেননা কোনো অসংবিধানিক সরকারের পক্ষে এখন আর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা সম্ভব নয়। তারা চাইলেও পারবেন না। একদিকে রয়েছে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর চাপ। মাঝখানে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। কারো পক্ষেই আর নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত থাকা সম্ভব নয়। ২০০৭ সালের পরিস্থিতির সাথে আজকের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। তবে ‘একজন নির্বাচিত ব্যক্তিও’ এই নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেন। রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব।


সুতরাং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হলেও তাদের সামনের দিনগুলো বেশ কঠিন। যেকোনো ভুল সিদ্ধান্ত তাদেরকে আবারো পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতার বাইরে রাখতে পারে। কোনো হটকারী সিদ্ধান্ত নয়, বরং বুঝে শুনে বিএনপি তথা ১৮ দলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবারো ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এ দেশের সবচেয়ে বড় দল ও জোটকে বাইরে রাখার। একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবি অব্যাহত রাখতে হবে। বেগম জিয়া এখন বিরোধী দলের আন্দোলনের প্রাণ। তাকে যেতে হবে জেলাগুলোতে, ন্যূনতম বিভাগীয় শহরগুলোতে। স্থায়ী কমিটির নেতৃবৃন্দকে যেতে হবে প্রতিটি জেলায়। চারজন নির্বাচিত মেয়র তাদের প্লাস পয়েন্ট। তাদেরকে সাথে নিয়ে গণসংযোগ বাড়াতে হবে। শুধু ঢাকায় বসে থাকলে চলবে না। বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সাথে গণযোগাযোগ বাড়াতে হবে। বিদেশী বন্ধুদের কাছে দল ও জোটের অবস্থান তুলে ধরতে হবে। দলীয় নেতৃবৃন্দকে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। একটি ভুল সিদ্ধান্ত দলকে অনেক পেছনে ফেলে দিতে পারে। নানা ধরনের ফাঁদ তৈরি হয়েছে। দেশী ও বিদেশী শক্তি দশম নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। দেশপ্রেমিক প্রতিটি নাগরিককে আজ এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।


নির্বাচন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে জনসাধারণ তাদের অধিকার প্রয়োগ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। আজ সাধারণ মানুষকে সেই সুযোগটি দেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যদি সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার পরও থেকে যান, তাহলে প্রশাসনের সাজানো মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করলে, তাতে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় ভয় কেন?


গত ২০ জুন যায়যায়দিনের প্রথম পৃষ্ঠায় শীর্ষ শিরোনাম ছিল 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে আর সরানো যাবে না'। এটা প্রধানমন্ত্রীর উক্তি। জাতীয় সংসদে তিনি কথাগুলো বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে তারা নির্বাচন দেবে না। মাইনাস টু ফর্মুলা যারা করেছিলেন, তারা এখনো আছেন। তারা তৎপর। তারা সুযোগের অপেক্ষায় বসে আছেন। তারা কেয়ামত পর্যন্ত থাকবেন, এমন কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী যখন এ ধরনের কথা বলেন, তাকে গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করে যে সরকার গঠিত হবে, সে সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে। কিন্তু বিপরীত মতটি স্পষ্ট, বর্তমান সরকারপ্রধানকে ক্ষমতায় রেখে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রথম তিনি একটি দলের প্রধান। দলীয় প্রধান যদি অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন, সেখানে তিনি চাইবেন যেনতেনভাবে দলকে বিজয়ী করতে। দ্বিতীয়ত প্রধানমন্ত্রী থাকার ফলে প্রশাসন থাকবে তার নিয়ন্ত্রণে। এরই মধ্যে সরকার প্রশাসন সাজাতে শুরু করে দিয়েছে। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় প্রশাসনে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগে দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের সময় এরা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন। দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তৃতীয়ত নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। ফলে পোলিং বুথগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কীভাবে? একটি অভিযোগ আছে যে পুলিশ দলীয়ভাবে পরিচালিত হয়। তাদের কাছে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায় না এ অভিযোগ বিরোধী পক্ষের। চতুর্থত নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়। নানা কারণে তারা সরকারের ওপর নির্ভরশীল। তারা নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্ভর করবে হাজার হাজার সরকারি কর্মচারী এবং স্কুল শিক্ষকদের ওপর। যে প্রশাসনে এরই মধ্যে বেশি মাত্রায় রাজনৈতিকীকরণ হয়েছে, সেই প্রশাসন নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ থাকবে, তা বিশ্বাস করা যায় না।
তবে আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, সরকারের নীতিনির্ধারকরা এখন হাজারটা যুক্তি দেখাবেন যে দলীয় সরকারের আওতায়ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব! এখানে যে বিষয়টি মুখ্য তা হলো এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এ নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের তুলনা করা যাবে না। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাজ করে স্থানীয় ইস্যু। যেমন সিলেটের সাধারণ মানুষ মেয়র কামরানের 'পারফরম্যান্স'-এ খুশি ছিল না। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে তার ব্যর্থতা ছিল চরমে। উপরন্তু নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে তার 'দ্বিতীয় স্ত্রী' আবিষ্কারের ঘটনা (?) নারী ভোটারদের প্রভাবিত করে থাকতে পারে। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে খুলনায়। দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তালুকদার আবদুল খালেক ছিলেন ব্যর্থ। উপরন্তু তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের কেউ কেউ এমনসব কা- করেছেন, যা তাকে বিতর্কিত করেছে। তিনি মানুষের আস্থা হারিয়েছেন। খুলনার পাইওনিয়ার বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির পরীক্ষায় (ইসলাম শিক্ষা) তালুকদার আবদুল খালেককে হজরত ওমর (রা.)-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এটা অনভিপ্রেত এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ভালো চোখে নেয়নি। তার ব্যক্তিগত আচরণে (রিকশাওয়ালাকে থাপ্পড় মারার ঘটনা) অনেকে অখুশি ছিলেন। এটা সত্য, সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয়ভাবে হয়নি। কিন্তু দেখা গেল চূড়ান্ত বিচারে দুটি বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাদের প্রার্থীর পক্ষে ব্যাপক গণসংযোগ করেছেন। মন্ত্রীরা নির্বাচনবিধি লঙ্ঘন করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছেন। অর্থমন্ত্রী জাইকার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বাদ দিয়ে সিলেটে চলে গিয়েছিলেন। তিনি রিকশায় চড়ে এবং সরকারি গাড়ি ব্যবহার না করেও তার 'নিরপেক্ষতা' নিশ্চিত করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে ইসির যতটুকু কঠোর হওয়া উচিত ছিল ততটুকু কঠোর হতে পারেনি। ইসির ভূমিকা তাই প্রশ্নের মধ্যে থেকেই গেল। সিলেটে রিটার্নিং অফিসারের ভূমিকা কিছুটা হলেও নির্বাচনকালীন সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকাকে প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। যখন সিলেটের ১২৮টি কেন্দ্রের ফল রাতের মধ্যেই এসে গিয়েছিল, তখন তিনি বিরোধী ১৮ দলের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করতে ইতস্তত করছিলেন। এ নিয়ে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তার তর্কও হয়। রিটার্নিং অফিসার পর দিন অর্থাৎ রোববার দুপুরে এটা ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। পরে অবশ্য শনিবার রাতেই আরিফুল হক চৌধুরীকে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই একটি 'ছোট্ট' ঘটনা প্রমাণ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ ধরনের আচরণ করতে পারেন। এরই মধ্যে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার তার প্রশাসন সাজাচ্ছে। এই জুন মাসেই বেশ কজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। বেশ কিছু কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তাহলে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বাইরে কাজ করতে পারবে_ এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। প্রশাসনের কাছে নির্বাচন কমিশন যে কত দুর্বল, তা একাধিক ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচনবিধি অনুযায়ী নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রীদের যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু মন্ত্রীরা গেছেন। নির্বাচনী এলাকায় সরকার কোনো উন্নয়ন কাজ করতে পারবে না, যাতে করে ভোটাররা প্রভাবান্বিত হতে পারে। কিন্তু রাজশাহীতে গ্যাস সরবরাহ চালু হয়েছে নির্বাচনের মাত্র দুই দিন আগে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তা উদ্বোধন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তো নির্বাচনের পরেও এ কাজটি করতে পারতেন। এখন অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য ইসির যে কর্তৃত্ব তা কাগজ-কলমে থাকবে, ইসি তা প্রয়োগ করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি দলের সভানেত্রী। তিনি যখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকবেন, তখন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা ও কর্মীরা আরো বেশি মাত্রায় উৎসাহিত হবেন। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে পদত্যাগ করেন (?) কিংবা রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দেন (?) তখন আর এ প্রশ্নগুলো উঠবে না। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। সেনাবাহিনী ছাড়া আমাদের দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা অপকল্পনীয় একটি বিষয়। অবশ্যই সেনা মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। অতীতে তা-ই হয়েছে। এবার বাধা কেন?
যোগাযোগমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী সঠিক কথাই বলেছেন। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'ওয়েব আপ কল ফর দ্য রুলিং পার্টি' আর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন একটি 'অশনি সংকেত'-এর কথা। তারা মিথ্যা বলেননি। দুজনই যথেষ্ট অভিজ্ঞ। তারা শোনেন ও জানেন কেন মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ নেতারা এর মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন_ 'তত্ত্বাবধায়ক চাইলে নির্বাচনই হবে না' (যায়যায়দিন, ১৭ জুন) তখন আমি একধরনের হতাশার মাঝে পড়ে যাই। আমি জানি না কোন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন 'নির্বাচন হবে না'। নিশ্চয়ই নির্বাচন হবে। আর সে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব সরকারের। বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার আর 'এক-এগারো'র জন্ম হবে না। শুধু 'এক-এগারো'র ঘটনা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে যাচাই করা ঠিক নয়। আমরা ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পেয়েছিলাম, যারা সাফল্যের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করেছে। এর আগে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেখানেও বিতর্ক ছিল কম। শুধু 'এক-এগারো'র ঘটনা দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করা ঠিক নয়।
অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, কয়েকজন মন্ত্রী ও বুদ্ধিজীবী 'এক-এগারো'র ঘটনাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটা বড় ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত করেন। অথচ তারা কখনই বলেন না ১৯৯৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর এ সরকারের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। এমনকি যারা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করেছিল, সেই সরকারও ছিল সেনানিয়ন্ত্রিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা খারাপই হয়ে থাকে, তাহলে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তার জন্য কি আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি দায়ী ছিল না?
দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউ শিখি না। কোন পরিস্থিতিতে সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ওই সময়ে নূ্যনতম ইস্যুতে এক হতে পারত, তাহলে সে পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। এ জন্য আমাদের রাজনীতিবিদরা কম দায়ী নন। আজকে রাজনৈতিক দলগুলোকে এ কথাটা উপলব্ধি করতে হবে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্যও এই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ধারণা ভালো। তাতে করে তারা একটা সুযোগ পাবে তাদের আমলের যে অবদান তা ভবিষ্যতে তুলে ধরতে। উপরন্তু আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ তাদের বক্তব্য নিয়ে জনসাধারণের কাছে যাক। জনগণ যদি তা সমর্থন করে তাহলে তারা আবার পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসবে। এতে তো ক্ষতির কিছু নেই।
একমাত্র আওয়ামী লীগ বাদে প্রতিটি দলই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। এমনকি মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টিও চায় একটি নিরপেক্ষ সরকার। এ ক্ষেত্রে সরকার এ দাবি মেনে না নেয়ায়, সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আর প্রধানমন্ত্রী যখন সুস্পষ্ট করেই বলেন, 'ওরা ক্ষমতায় এলে আর নির্বাচন দেবে না', তখন নানা প্রশ্ন এসে ভিড় করে। কেন প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলছেন বার বার? প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কেননা কোনো অসাংবিধানিক সরকারের পক্ষে এখন আর ক্ষমতা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তারা চাইলেও পারবে না। কেননা একদিকে রয়েছে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর চাপ। মাঝখানে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। কারো পক্ষেই আর নির্ধারিত সময়ের বাইরে থাকা সম্ভব নয়। ২০০৭ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের পরিস্থিতি মেলানো যাবে না। তবে 'একজন নির্বাচিত ব্যক্তিও' এ নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেন। রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব। আর সে জন্য সংলাপটা জরুরি।
জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরেই সরকারপ্রধান একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি ইতিহাসে তার নাম রেখে যেতে পারবেন, যদি তিনি নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দেন। এ নির্দলীয় সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে না। এর কাঠামোও হবে ভিন্ন। শুধু প্রয়োজন আন্তরিকতার। না হলে দেশ এক চরম সংকটের মুখে পড়বে। এ জন্য একটা সমঝোতা প্রয়োজন। বিএনপি নেত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন দলীয় সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টিও অংশ নেবে না বলে মনে হচ্ছে। এর ফলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে চলতি বছরের শেষের দিকে সরকার যদি নির্বাচনের আয়োজন করে, তার পরিণতি তৃতীয় (১৯৮৬), চতুর্থ (১৯৮৮) কিংবা ষষ্ঠ (১৯৯৬) সংসদ নির্বাচনের মতো হবে। এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আমাদের মতো একটি গরিব দেশে নির্বাচনের নামে শত শত কোটি টাকা খরচ করা বিলাসিতা মাত্র। তাই আওয়ামী লীগ নেতাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। একটি ভুল সিদ্ধান্ত দলকে অনেক পেছনে ফেলে দিতে পারে। নানা ধরনের ফাঁদ তৈরি হয়েছে। দেশি ও বিদেশি শক্তি দশম নির্বাচন সামনে রেখে নানা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। দেশপ্রেমিক প্রতিটি নাগরিককে আজ এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
নির্বাচন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে জনসাধারণ তাদের অধিকার প্রয়োগ করে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। আজ সাধারণ মানুষকে সে সুযোগটি দেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যদি সংসদ ভেঙে দেয়ার পরও থেকে যান, তাহলে সরকারের সাজানো মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করলে, তাতে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
প্রধানমন্ত্রী যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তার কোনো ভিত্তি নেই। অসাংবিধানিক শক্তির পক্ষে আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশীদার হওয়া সম্ভব নয়। সেনা নেতৃত্ব বার বার বলছেন তারা সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ। আমাদের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট বিতর্কিত করেছে। সুতরাং তারা আর কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে, এটা আমার মনে হয় না। তাই উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারপ্রধানকেই। তিনিই পারেন একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে।
Daily JAI JAI DIN29.06.13

পুনরায় ক্ষমতায় বসার জন্য প্রশাসন সাজাচ্ছে সরকার

সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনার মধ্যে দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সরকার দশম জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রশাসন সাজাচ্ছে। গত ৪ জুন সমকালে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় সরকার জনপ্রশাসনের অর্ধশত কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলেও শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় এদের অবসরে পাঠানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার নির্বাচনকে প্রভাবিত করা। কিছু কিছু কর্মকর্তা আবার নিজেদের সুবিধা ও প্রমোশন বাগিয়ে নেয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছেন। এর ফলে যারা সৎ ও কিন ইমেজের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত, তারা বঞ্চিত হচ্ছেন পদে পদে। কোথাও কোথাও তাদের প্রমোশন বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর। এ রকম এক কর্মকর্তা, যিনি প্রমোশন বঞ্চিত হয়েছিলেন, তিনি আত্মহত্যা করে প্রতিবাদ জানিয়ে গিয়েছিলেন গেল বছরের জুলাই মাসে। এর ফলে জনপ্রশাসনে এক ধরনের হতাশা রয়েছে। অযোগ্য ব্যক্তি পদোন্নতি পাচ্ছেন এবং যোগ্যদেরকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের অভাবের ফলে জনপ্রশাসনে কাজের গতি আসছে না এবং ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়ছে। ঢালাও পদোন্নতির ফলে জনপ্রশাসনে সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। গত ৮ ফেব্রুয়ারি (২০১২) জনপ্রশাসন কেন্দ্রীয় স্তরে বর্তমান সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদে ১২৭, যুগ্ম-সচিব পদে ২৬৪ এবং উপ-সচিব পদে ২৫৮ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। মোট পদোন্নতি পেয়েছেন ৬৮১ জন। এত বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে বিদ্যমান বিধিবিধানের অপব্যবহার করে এক অশুভ নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দুঃখজনক হচ্ছে এটা করতে গিয়ে ৭০০-এর অধিক জ্যেষ্ঠ ও পদোন্নতির সব শর্ত পূরণকারী কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাই ৮ ফেব্রুয়ারিকে অনেকে ‘কালো দিবস’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। যে অভিযোগটি গুরুতর, তা হচ্ছে পিএসসি কর্তৃক নির্ধারিত জাতীয় মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া বেশ ক’জন কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যারা পদোন্নতি পেয়েছেন, তারা একটি বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী। পদোন্নতির জন্য আবশ্যক সিনিয়র স্টাফ কোর্স এবং উচ্চতর প্রশাসনিক ও উন্নয়ন বিষয়ক কোর্স সম্পন্ন না করেই পদোন্নতি পেয়েছেন কয়েকজন। মজার ব্যাপার শীর্ষ পর্যায়ে পদোন্নতির জন্য ইংরেজি ভাষার উপর দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন এমন অনেকে এই দক্ষতা দেখাতে পারেননি। কেউ কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি ডিগ্রি ‘ক্রয়’ করে তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করেছেন। অথচ ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে একখানা সার্টিফিকেট তারা সংগ্রহ করেছেন। নিয়মিত কাস বা কোর্স ওয়ার্ক তারা করেননি। কেউ কেউ অনলাইনে একখানা পিএইচডি যোগাড় করে, তা ব্যবহারও করছেন। উচ্চতর ডিগ্রি পদোন্নতির জন্য প্রয়োজন রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি ভুয়া ডিগ্রি যখন জনপ্রশাসনের কেউ ব্যবহার করেন, তখন আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। যারা জনপ্রশাসনের শীর্ষে রয়েছেন, তারা আশা করছি, বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন।


সবচেয়ে দুঃখজনক যা, তা হচ্ছে প্রশাসনে রাজনীতিকরণ। বিশেষ বিশেষ কর্মকর্তা যারা ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, তাদের দ্রুত প্রমোশন দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে পুলিশ বিভাগে সাবেক ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্রুত প্রমোশন দেয়া হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকলেও শাস্তির বদলে তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। এভাবে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে প্রশাসনে বিভক্তি আনা হয়েছে। এখানে যোগ্যতা, মেধা বিবেচনায় আনা হয়নি। বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক দলের সাথে তাদের অতীত সম্পর্ক। গেল বছর আমার দেশ পিআরএলএ যাওয়া কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিস্তারিত বিবরণ ছেপেছিল। যারা জাতির জন্য রাষ্ট্রের জন্য শ্রম দিয়েছিলেন, তাদের বাধ্য করা হয়েছিল পিআরএ যেতে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওএসডি থাকা অবস্থাতেই। সুষ্ঠু প্রশাসনের জন্য এ ধরনের প্রবণতা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। ইতোমধ্যে সচিবদের মধ্যে ৮টি সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করে এক তোঘলকি কাণ্ড ঘটানো হয়েছে জনপ্রশাসনে। এমনকি পুলিশের মহা-পরিদর্শককে সিনিয়র সচিব পদ দিয়ে পুলিশ বিভাগে একাধিক সচিব পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ‘সিনিয়র সচিব’ পদ সৃষ্টি কিংবা পুলিশ বিভাগের জন্য একাধিক সচিব পদ সৃষ্টি জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ও কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য আদৌ করা হয়নি। বরং বিশেষ ব্যক্তিকে খুশি করা, একই সাথে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে দিয়ে সুবিধা আদায় করার নিমিত্তেই করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জনপ্রশাসনে এই যে পদোন্নতি, তার কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। শুধুমাত্র বিধিমালা দিয়েই চলছে গত ৪২ বছর। শুধুমাত্র দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতির স্বার্থেই কোনো আইন করা হয়নি। এখানে অভিযোগ উঠেছে যে, আইন প্রণয়ন না হওয়ায়, শুধু ১৩৩ অনুচ্ছেদ নয়, সংবিধানের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদের নির্দেশনাও যথাযথভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে ২০১০ সালে সিভিল সার্ভিস এ্যাক্ট ২০১০ নামে একটি আইন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। পরে সরকারের উদ্যোগে গভর্নমেন্ট এমপ্লয়ইস এ্যাক্ট ২০১২ প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে আদৌ কোনো অগ্রগতির খবর আমরা জানি না। অর্থমন্ত্রী এক চিঠিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন যে, এখন তিনি ‘আউট সোর্সিং’-এর মাধ্যমে নিয়োগের প্রস্তাব করেছেন। এটা যদি কার্যকরী করা হয়, তাহলে সচিবালয়ের শীর্ষ পর্যায় থেকে নি¤œ পর্যায় পর্যন্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হবে। এটা সুস্থ প্রশাসনের জন্য আদৌ কোনো ভালো লক্ষণ নয়। পাক-ভারত উপমহাদেশের তো বটেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশে সচিবালয়ে ‘আউট সোর্সিং’-এর মাধ্যমে কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয় না।


সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রশাসনে ও সুশীল সমাজের মাঝে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও সরকার তাতে আদৌ নজর দেয়নি। আকবর আলী খান, কিংবা ড. শাহাদাৎ হোসেনের মতো সিনিয়র অবসরে যাওয়া আমলারা সরকারের এই কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন। কিংবা সাবেক আমলা মোফাজ্জল করীম প্রশাসনের রাজনীতিকরণের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও সরকারের টনক তাতে নড়েনি। সাময়িক স্বার্থের কারণে তারা দক্ষ কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাচ্ছেন। তাদের কাছে রাজনৈতিক স্বার্থটাই বড়। যেসব সরকারি কর্মকর্তা দলবাজ নন, কিন্তু দক্ষ ও নিরপেক্ষ, তারাই স্বীকার হচ্ছেন বাধ্যতামূলক অবসরের। গেল সপ্তাহে তিনজন দক্ষ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে। অথচ এরা তিনজনই দক্ষ। দলবাজ ছিলেন না।


সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে স্বয়ং সরকার প্রধান নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তিনি গণভবনে বিভিন্ন জেলার নেতা-কর্মীদের নিয়ে সভা করছেন এবং সেখানে প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। ২৫ অক্টোবর হচ্ছে বর্তমান সরকারের শেষ দিন। এরপর নভেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে যে কোনো একদিন নির্বাচন হবে। যেখানে মূল বিষয়ে এখনও কোনো সমাধান হয়নি, সেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠনে আপত্তি রয়েছে। মহাজোট সরকার শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান রেখেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নিরপেক্ষ সরকারের পক্ষে তাদের মতামত দিলেও সরকার তাতে রাজি নয়। এমনকি দাতাগোষ্ঠীও চাচ্ছেন নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় ও সকল দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন। কিন্তু শেখ হাসিনার তাতে সায় নেই। তিনি ভালো করে জানেন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তার বিজয়ী হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই যেনতেন ভাবে তারা একটি নির্বাচন করতে চাচ্ছেন। তাই অত্যন্ত সুকৌশলে প্রশাসন সাজাচ্ছেন তিনি। চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগে দেখা গেল প্রশাসন কোথাও কোথাও তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছিল। নির্বাচনবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ছিল ব্যাপক। ইসি এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বিরোধী দলের সাথে সম্পৃক্ত প্রার্থীর নিরাপত্তা ছিল ঝুঁকির মুখে। গুলি হয়েছে। কিন্তু তারপরও সেনাবাহিনী নামানো হয়নি। সবচেয়ে অবাক হওয়ার ঘটনাটি ঘটেছিল সিলেটে। সেখানে রাতের মধ্যেই ১২৭টি নির্বাচনী কেন্দ্রের ফলাফল পেলেও প্রধান রিটার্নিং অফিসার আরিফুল হক চৌধুরীকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করতে ইতঃস্তত করছিলেন। তিনি পরদিন (রোববার) ফলাফল ঘোষণা করবেন বলে জানিয়েছিলেন। তিনি ‘চাপ’ এর কারণে অবিশ্যি ফলাফল ঘোষণা করতে বাধ্য হন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ ধরনের রিটার্নিং অফিসার পাওয়া যাবে, যারা ফলাফল ঘোষণা করতে ইতঃস্তত করবেন। কিংবা রাতের আঁধারে ফলাফল পাল্টে দেবেন। আর তাই সরকার প্রশাসন সাজালেও নির্বাচনের আগে ব্যাপক প্রশাসনিক পরিবর্তন আনতে হবে। আর এ জন্যই প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ সরকার, যারা সুবিধাভোগী ও দলবাজ কর্মকর্তাদের পরিবর্তন করে স্থানীয় পর্যায়ে ত্যাগী ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেবেন।


আমরা সত্যিকার অর্থেই দক্ষ জনপ্রশাসন চাই। বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে আইন, নিয়ম ও নেগোসিয়েশনসের টেকনিক। এ ক্ষেত্রে আমাদের জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের যোগ্যতা দেখাতে হবে। তারা যদি দক্ষ না হন, উচ্চ শিক্ষিত না হন, তাহলে তারা নেগোসিয়েশনস এ তাদের যোগ্যতা দেখাতে পারবেন না। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ কিংবা পদোন্নতি বহিঃর্বিশ্বে আমাদের অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে। পদোন্নতির জন্য প্রতিটি পদে লিখিত পরীক্ষা থাকতে হবে, যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন, তারাই কেবল পদোন্নতির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। রাজনৈতিক বিবেচনা বা বয়স কোনো অবস্থাতেই পদোন্নতির মাপকাঠি হতে পারে না। একটি দেশ যদি দক্ষ জনপ্রশাসন কর্মী গড়ে তুলতে না পারে, সে দেশ কখনই উন্নতির শিখরে উঠতে পারবে না। আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত রয়েছে সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ার। এমনকি ভারতের দৃষ্টান্তও আমরা দিতে পারি। যাদের কেউ কেউ আজ আন্তর্জাতিক আসরেও তাদের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। আমরা ব্যর্থ হতে চাই না। আমাদের মাঝে অনেক তরুণ জনপ্রশাসন কর্মকর্তা রয়েছেন। সরকার তাদেরকে বিদেশে ট্রেনিং ও উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এদের অনেকেরই কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু এরা যদি পাদোন্নতির ক্ষেত্রে কিংবা পদায়নের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হন, তাহলে এদের মাঝে হতাশা কাজ করবে। এরা তখন তাদের দক্ষতা দেখাতে পারবেন না। খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রশাসনে এখন রাজনীতি ভর করছে। সরকার প্রলোভন আর সুযোগ সুবিধা দিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হাত করেছে। ফলে আগামী নির্বাচন নিয়ে একটা শঙ্কা থেকেই গেল। সরকার যেভাবে প্রশাসনকে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন, তাতে করে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নেই। সরকার এখন এই রায়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে পদত্যাগ করে দ্রুত সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে। আর নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার স্বার্থেই প্রয়োজন একটি দলনিরপেক্ষ সরকার, যারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন এখন সরকারকে বিদায় ঘণ্টা জানিয়ে দিল।


‘জঙ্গি’ দমনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র নয়া চুক্তি

অতি সাম্প্রতিককালে ন্যাটোর কর্মসূচিতে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই কর্মসূচিতে বাংলাদেশ কি অংশ নেবে? গত ৩১ মে ন্যাটো ও বাংলাদেশকে নিয়ে এমন একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে, তাতে করে এ ধরনের একটি সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে। এমন একটি ধারণার জন্ম হয়েছে যে, বাংলাদেশ ন্যাটোর স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে অংশ নেবে! গত ১৫ মে বাংলাদেশের কূটনীতিকরা ন্যাটোর সদরদফতর ব্রাসেলসে ন্যাটোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে মিলিত হন। তারা আলোচনায় ন্যাটোর কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের আগ্রহের কথা জানান। ন্যাটোর ওয়েবসাইটে এ সংবাদটি আছে। যদিও এ সংক্রান্ত কোনো খবর বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়নি। এমনকি দীপু মনি সাংবাদিকদের সাথে কথাবার্তা বললেও এ সম্পর্কে কিছু বলেননি। বিষয়টি আমাদের কাছে এখনও অস্পষ্ট যে ন্যাটোর এ ধরনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আমরা কতটুকু উপকৃত হব। ন্যাটোর strategic concept সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন, তারা জানেন ন্যাটোর লিসবন সম্মেলনে ২০১০ সালে এই ধারণাপত্র গ্রহণ করা হয়েছিল। এই ধারণাপত্রের মূল বিষয়টি হচ্ছে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। ন্যাটোর কর্মকাণ্ড এখন আর শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং তা দক্ষিণ এশিয়াতে সম্প্রসারিত হয়েছে। স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মকাণ্ড ভারত মহাসাগর এলাকায় সম্প্রসারিত করেছে। আগামীতে মার্কিন ষষ্ঠ ফিটের বেশ কটি জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রসীমায় মোতায়েন করা হবে। যে কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য মার্কিনী ভূমিকা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেল। জানার কথা, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইতোমধ্যে একটি অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই তথাকথিত ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ’ চুক্তির আওতায় দৃশত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ দমন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ, শ্রমমান, পণ্যের শুল্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করলেও, মূল বিষয় একটিইÑ যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ’ এর আড়ালে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। বলা ভালো প্রতি বছর একবার ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তির’ আওতায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র মিলিত হবে। প্রথম সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল গেল বছরের ১৯-২০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে। আর এবার দ্বিতীয় সংলাপ হলো ঢাকায়, গত ২৬ মে। সংলাপ শেষে একটি ব্রিফিং করা হয় বটে, কিন্তু ‘ভেতরের অনেক কথাই’ জানান হয় না। তাই বাংলাদেশ যখন ন্যাটোর স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে, তখন গুজবের ডালপালা বেড়েছে এবং আগামীতে তা আরও ছড়াবে। গেল বছরের ১৮ জুন ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়ায় একটি ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ন্যাটোর ২৫টি সদস্য দেশের বাইরেও মোট ৫৫টি দেশ অংশ নিয়েছিল। ওই সম্মেলনকে তারা বলছে Strategic Military Partnership Conference। যারা সরাসরি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র নয়, তারাও এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। ন্যাটোর সাথে কাজ করতে পারে এমন দেশগুলোকে ন্যাটোর নীতি নির্ধারকরা মোট ৪ ভাগে ভাগ করেছে। যারা ন্যাটোর সদস্য নয়, তবে ন্যাটোর সহযোগী। যেমন ইউরোপের ১২টি দেশকে নিয়ে গঠিত হয়েছে The Partnership for Peace। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত আলজেরিয়া, তিউনেসিয়ার মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে Mediterrian Dialogue Members। সৌদি আরব কিংবা ওমানের মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে Istanbul Cooperation Initiative। অস্ট্রেলিয়া কিংবা জাপানের মতো দেশগুলোকেও ন্যাটো Partners Accross the Globe এর ব্যানারে একত্রিত করেছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানও এই ব্যানারে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ন্যাটোর কোনো কর্মকাণ্ড নেই। এখন এল সালভাদর ও কলম্বিয়ার মতো দেশও ন্যাটোর সাথে জড়িত হতে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার ইউরোপে ন্যাটোর কমান্ডার এডমিরাল স্টাভরিডিস সম্প্রতি বলেছেন, তারা ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশকে নিয়ে ভাবছেন এবং আশা করছেন এই দেশ দুটো Partners Accross the Globe এর ব্যানারে আগামীতে ন্যাটোর কর্মকাণ্ডে শরিক হবে। ২০১০ সালে ন্যাটো লিসবন সম্মেলনে ন্যাটোর Strategic Concept গ্রহণ করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রোয়েশিয়ায় সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল একুশ শতকে ন্যাটো নতুন এক কৌশলগত ধারণা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। ন্যাটোর এই ভূমিকা, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিশ্বকে কর্তৃত্ব করার প্রবণতা নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে প্রভাব বলয়কে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের। আর ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে সেই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান, ঘটেছিল। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙ্গে দেয়া হলেও, ন্যাটো জোট ভেঙ্গে দেয়া হয়নি। বরং এর সম্প্রসারণ ঘটেছিল। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ন্যাটো ও ওয়ারশ’ জোটের মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা এসব একটা পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছিল। যে ইউরোপে একাধিকবার ‘পারমাণবিক যুদ্ধ’ এর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ‘যুদ্ধ’ হয়নি বটে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পুরোটা সময় ওই দুই শক্তির মাঝে প্রতিযোগিতা বজায় ছিল। দুই পরাশক্তিই ইউরোপে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই এই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। এর প্রধান কারণ ছিল একটিÑ রাশিয়া এখন আর ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। দুটি আদর্শের (সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ) মাঝে যে দ্বন্দ্ব ছিল, সেই দ্বন্দ্বেরও অবসান ঘটে, যখন রাশিয়া আদর্শ হিসেবে মুক্তবাজার ও পুঁজিবাদকে গ্রহণ করে। উপরন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার অনেক আগেই ১৯৮৮ সালে গরবাচেভ ‘ওয়ারশ’ সামরিক জোট ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। যে কারণে ইউরোপে রাশিয়ার উত্থান যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। আর তাই নতুন করে এই অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধের জন্মের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এখন ভারত মহাসাগর হচ্ছে সম্ভাব্য ক্ষেত্র, যেখানে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে চীন। চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভয় ও শঙ্কা এখন অনেক বেশি। প্রথমত, তত্ত্বগতভাবে চীন এখন আর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীন এখন বিশ্বকে কর্তৃত্ব করছে। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ায় তা এখন মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করছে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে নিজের অভ্যন্তরীণ বাজারকে সচল রাখছে। এটা মার্কিন নীতি নির্ধারকদের অনেকেরই অপছন্দের। গত ৮ জুন নয়া চীনা প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এই সফরে ওবামার সাথে শীর্ষ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু বেশ কিছু ইস্যুতে বিরোধ রয়েছে। তৃতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে। এটা মার্কিনীদের চিন্তার কারণ। বিশেষ করে ভারত মহাসাগর ও আফগানিস্তানের ব্যাপারে তাদের আশঙ্কার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সকল মার্কিন সৈন্য ও সেইসাথে সকল বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে না। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। এ কারণেই তথাকথিত ‘অংশীদারিত্ব চুক্তি’ করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে ব্যবহার করে এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। ন্যাটোর স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম এক ধরনের কর্মসূচি, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার উপস্থিতিকে নিশ্চিত করতে চায়।


সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে একটা পরিবর্তন এসেছে। পাকিস্তানে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে নওয়াজ শরিফ তৃতীয়বারের মতো সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যে পাকিস্তানে মার্কিন ড্রোন বিমান হামলা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। ভারতে আগামী বছর নির্বাচন হবার কথা। সেই নির্বাচন এ বছর এগিয়ে নিয়ে আসা হতে পারে। নেপালে জুন মাসেই নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায়। আর বাংলাদেশে ২৫ অক্টোবর হচ্ছে সংসদের শেষ দিন। এরপর তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন। সুতরাং এ অঞ্চলে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে মার্কিন নীতির ব্যাপারটিও লক্ষণীয়। এ অঞ্চলে বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে মার্কিনী স্বার্থ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনও চাইবে না তার স্বার্থ বিঘিœত হোক।
ভারত মহাসাগর আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের ‘স্নায়ুযুদ্ধ’। এখানে কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে এই বিপুল জলসীমা, তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। এ অঞ্চল জুড়ে গাওদার (বেলুচিস্তান, পাকিস্তান), হামবানটোটা (শ্রীলংকা), সিটওয়ে, কিয়াউক-পাইউই বন্দরে (মিয়ানমার) রয়েছে চীনের নৌবাহিনীর রিফুয়েলিং সুবিধা ও সাবমেরিন ঘাঁটি। কোকো দ্বীপপুঞ্জও চীনা নৌবাহিনী ব্যবহার করে। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। চীনের জ্বালানির চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগ এ অঞ্চলে অবস্থিত মালাক্কা প্রণালী দিয়ে পরিবহন করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য হয়ে শ্রীলংকা পর্যন্ত ভারত মহাসাগর। তারপর এই মহাসাগর হয়ে মালাক্কা প্রণালী (মালয়েশিয়া) অতিক্রম করে ইন্দোনেশিয়ার পাশ দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর যাবার যে সমুদ্র পথÑ এই পথের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। যুক্তরাষ্ট্রও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম নৌশক্তি। এ অঞ্চলে চীনা নৌ শক্তির উপস্থিতি তার কাম্য নয়। অথচ জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তার জন্যও এই রুটটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠুক, চীন তা কখনওই চাইবে না। এমনকি মধ্য এশিয়ার গ্যাস গাওদার বন্দরের মধ্যে দিয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে চীনের পূর্বাঞ্চলে নিয়ে যাবার এক বিশালও ব্যয়বহুল প্রকল্পও হাতে নিয়েছে চীন। এজন্য ভারত মহাসাগর তার নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন রয়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রও চায় এই অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব থাকুক। কেননা ইরানের পারমাণকি কর্মসূচি নিয়ে দিনে দিনে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরান আক্রমণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগর তথা গাওদার পোর্টের গুরুত্ব রয়েছে। গাওদার থেকে ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ এর দূরত্ব মাত্র ১৮০ নটিক্যাল মাইল (এ পথ দিয়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে), আর ৭২ কি. মি. দূরে রয়েছে ইরান সীমান্ত। বেলুচিস্তানের মরুভূমিতে কিছুদিন আগ পর্যন্ত একটি বিশাল ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করতো। সুতরাং আগামী দিনে ভারত মহাসাগর অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে মার্কিন সমর নায়কদের কাছে।


সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ‘Containment theory’ প্রয়োগ করেছিল। পশ্চিম ইউরোপ এ ক্ষেত্রে পালন করেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আজ সেই ‘Containment theory’ আবার নতুনভাবে প্রয়োগ হতে যাচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে ভারত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়কে চারদিক থেকে ঘিরে চাপ প্রয়োগ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতাকে সঙ্কুচিত করতে চেয়েছিল, আজ চীনকে সামনে রেখেই সেই একই স্ট্রাটেজি রচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে লাভ কতটুকু হবে বলা মুশকিল। তবে নতুন করে আবার উত্তেজনার জন্ম হবে। নতুন করে আবার জন্ম হবে স্নায়ুযুদ্ধের। ফলে ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলো এই প্রতিযোগিতায় কোনো একটি পক্ষ অবলম্বন করতে বাধ্য হবে। অতীতে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিশ্ব দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বেড়েছিল। আজও সে রকম একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বিশ্ব। নিশ্চিত করেই বলা যায়, আগামী দিনে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়বে। এ অঞ্চলে ন্যাটো বা যে কোনো মার্কিন সেনার উপস্থিতি উত্তেজনাকে আরও উসকে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরীয় দেশ মালদ্বীপের সাথেও এ ধরনের একটি চুক্তি করতে চাচ্ছে। ওই চুক্তিটির নাম হচ্ছে Status Forces Agreement (SOFA)। কিন্তু তা ইতোমধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি গাইয়ুম এই চুক্তির বিরোধিতা করেছেন (সিনহুয়া বার্তা সংস্থা, ৭ জুন ২০১৩) বাংলাদেশ কোনোভাবেই মার্কিন স্ট্রাটেজির অংশ হতে পারে না। যে কোনো চুক্তি, যা মার্কিনী বা ন্যাটোর স্বার্থে করা হবে, তা বাংলাদেশে বিতর্ক বাড়বে মাত্র। বাংলাদেশে কোনো জঙ্গিবাদ নেই। এখানে কোনো জঙ্গি নেই। সুতরাং জঙ্গিবাদ (?) দমনের নামে বাংলাদেশ যদি কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, তা বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করবে।
14.6.13

জন কেরির বাংলাদেশ সফর বাতিল প্রসঙ্গে

২৪ জুন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব জন কেরি ভারত সফরে আসছেন। এ সফরে তার বাংলাদেশে আসা নির্ধারিত থাকলেও, শেষ মুহূর্তে তা বাতিল ঘোষিত হয়। তার বাংলাদেশ সফরকাল প্রত্যাশিত হলেও শেষ মুহূর্তে বাতিল ঘোষিত হওয়ায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দু’দেশের মধ্যে সম্প্রতি নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্য যতটুকুই জেএসপি সুবিধা পায়, সেই জেএসপি সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১০০ এর ওপর পোশাক কর্মীর মৃত্যু, পোশাক শিল্পে প্রশাসন, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকা-ের ঘটনার বিচার না হওয়া ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশী তৈরি পোশাক নিয়ে মার্কিন সমাজে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। উপরন্তু ড. ইউনূস ইস্যুতেও বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকায় নাখোশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ‘টিকফা’ চুক্তিটি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ৮ জুন ঢাকায় দু’দেশের মধ্যে এ ‘সংলাপ’-এর দ্বিতীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এ যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তিতে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই’-এ সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ‘আকসা’ বা ‘অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট’ চুক্তি করতে চায়। এ চুক্তিটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি চুক্তি। প্রস্তাবিত এ চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ‘গাইডেড মিসাইল’সহ বেশ কয়েক ধরনের আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করবে। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রা বিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ এ ধরনের বিভিন্ন সুবিধার জন্য বাংলাদেশে ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতিরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। এদিকে বাংলাদেশ ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ ব্যাখ্যা করেছে। ১৫ মে বাংলাদেশের কূটনীতিকরা ব্রাসেলসে ন্যাটোর সদর দফতরে মার্কিন কমান্ডারদের সঙ্গে আলোচনায় এ আগ্রহের কথা জানান। তবে এ আগ্রহের ধরন কী হবে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। ন্যাটো ২০১০ সালে তার লিসবন সম্মেলনে ঝঃৎধঃবমরপ ঈড়হপবঢ়ঃ-টি গ্রহণ করেছিল। এ ধারণাপত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। অর্থাৎ ইউরোপের বাইরেও ন্যাটো একটি ভূমিকা রাখতে চায়। অনেকেরই মনে থাকার কথা, গেল বছরের ৩১ মে টাইমস অব ইন্ডিয়ার অনলাইনে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি গাড়তে চাইছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব লিওন প্যানেট্টা ‘সংগ্রিলা ডায়লগ’-এ (সিঙ্গাপুর, জুন ২০১২) স্পষ্ট করছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রণতরীর সংখ্যা বাড়াবে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে এই রণতরীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬-এ। খুব স্বাভাবিক কারণেই এতে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন রণতরীর যাতায়াত বাড়বে। তারা চট্টগ্রাম বন্দরের ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা নেবে। এ জন্যই তারা চাচ্ছে ‘আকসা’ চুক্তিটি। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গোপসাগরভুক্ত এ অঞ্চল ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

অনেকেরই মনে থাকার কথা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরপরই প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মিয়ানমারকে (নভেম্বর ১৯, ২০১২)। মিয়ানমারে প্রথমবারের মতো একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়েছে। এ অঞ্চলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের ধারাবাহিকতায়ই জন কেরির বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল। তিনি না এলেও বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।

বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে নানা কারণে। প্রথমত, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের নৌবাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে, সেখানে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে, সেই ‘শূন্যতা’ পূরণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘শান্তিরক্ষী’ বাহিনী গঠন করা, যারা ২০১৪ সালে মার্কিন সৈন্যদের পরিবর্তে আফগানিস্তানের শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত হবে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ইসলামিক কট্টরপন্থিরা দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে নতুন করে একটি ঘাঁটি গড়তে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মোর্চা গঠন করা প্রয়োজন। চতুর্থত, এ অঞ্চলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে বিপুল জ্বালানি সম্পদ রয়েছে গভীর সমুদ্রে। মার্কিনি আইওসির এ ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে যথেষ্ট। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জন্য এ কারণেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অবস্থান করে খুব সহজেই মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায় এবং বাংলাদেশের নিকট-প্রতিবেশী চীনের রাজনৈতিক উত্থানপতনে প্রভাব খাটানো সম্ভব। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পরপরই বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি রচিত হয়েছে। এ লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আকসা চুক্তি করতে চাচ্ছে। যদিও এখন অবধি বাংলাদেশ তার সমর্থন জানায়নি।

বঙ্গোপসাগরে মার্কিন রণতরীর দীর্ঘ উপস্থিতি বাংলাদেশকে তার স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্টের আওতায় নিয়ে আসা। এমনকি মালদ্বীপের সঙ্গে প্রস্তাবিত চুক্তির অর্থ একটাই, চীন যে এ অঞ্চল ঘিরে ‘ঝঃৎরহম ড়ভ চবধৎষং’ বা ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করছে, তার বিরুদ্ধে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর পার হয়ে অ্যারাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্র পথ, এ পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। চীন যে তেল আমদানি করে, তার ৮০ ভাগ এই মালাক্কা প্রণালি হয়ে চীনে যায়। তাই সঙ্গত কারণেই চীনের জন্য ভারত মহাসাগরে তার উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাওদারে চীনা নৌবাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিট থাকবে, যা কিনা ভারত মহাসাগরের সব নৌ ম্যুভমেন্ট মনিটর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে গাওদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব আরও বেড়েছে। স্ট্রেইট অব হরমুজ থেকে গাওদারের দূরত্ব মাত্র ১৮০ নটিক্যাল মাইল। আর ইরান সীমান্ত রয়েছে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে। চীন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে গাওদার সমুদ্র বন্দর উন্নয়নে। চীন তার দক্ষিণাঞ্চলের ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস এই গাওদার বন্দর দিয়েই পাইপ লাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে চায়। চীন শ্রীলংকার হামবানটোটায় একটি গভীর সামদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে। তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে চীন শ্রীলংকা সরকারকে সমর্থন করেছিল। মিয়ানমারের রয়েছে চীনের নৌবাহিনীর একটি রাডার স্টেশন। সিটওয়েসহ আরও বেশ ক’টি বন্দরে রয়েছে চীনা উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন যে বিশাল প্রতিরক্ষা গড়ে তুলছে, তা মূলত তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। চীনের এই জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করা ও চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এই অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে, যাতে বাংলাদেশকে অন্যতম একটি পার্টনার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যে স্ট্র্যাটেজি, তাতে আদৌ পরিবর্তন আসবে না। জন কেরি না এলেও ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা নিয়মিত বাংলাদেশ সফর করছেন এবং আগামীতেও করবেন। এখানে দেখতে হবে, আমরা আমাদের স্বার্থকে কীভাবে নিশ্চিত করতে পারি। সেই জাতীয় স্বার্থ খুব একটা নিশ্চিত হচ্ছে না। মহাজোট সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হলেও, নানা ইস্যুতে এখনও জটিলতা রয়ে গেছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে এখনও রয়ে গেছে ধূম্রজাল। বলা হচ্ছে, সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য ভারত সফরের সময় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে যে সমীকরণ, তাতে পশ্চিম বাংলার আপত্তির মুখে কেন্দ্রীয় সরকার আদৌ চুক্তি করতে পারবে বলে মনে হয় না। উপরন্তু ভারতে ২০১৪ সালে নির্বাচন। এই নির্বাচনে তিস্তা চুক্তি একটি ইস্যু হয়ে যেতে পারে। তবে জন কেরির ভারত সফরের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের চেয়ে ভারতকে গুরুত্ব দেয় বেশি। সেটাই স্বাভাবিক। ভারত উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি। সেখানে মার্কিনি স্বার্থ অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনোই ভারতকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করবে না। এ অঞ্চলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যে অক্ষ গড়ে উঠছে, বাংলাদেশকে সেই অক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এর বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ লাভবান হবে না। তবে মনে রাখতে হবে, ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্ষকে ব্যবহারে করেই বাংলাদেশকে তার জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে। আর সেভাবেই পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন করতে হবে। জন কেরি বাংলাদেশ সফরে এলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়ত। এখন সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে, কী করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়ানো যায়। পররাষ্ট্র নীতির সাফল্য নিহিত সেখানেই।
Daily ALOKITO BANGLADESH

24.06.13

জোট রাজনীতির অতীত ও ভবিষ্যৎ


দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে, ততই 'জোটের রাজনীতি'র ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশের গত ৪২ বছরের রাজনীতিতে 'জোটের রাজনীতি' প্রথম দিকে গুরুত্ব না পেলেও, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান ও '৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই এ 'জোট রাজনীতি'র গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে কোনো একটি একক দলের পক্ষে সরকার পরিচালনা করা সম্ভ নয়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো যখন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তখন প্রথমবারের মতো মুসলিম লীগ ও সদ্যগঠিত ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ একটি সংসদীয় ঐক্য গঠন করলেও, পরে সে ঐক্য টিকে থাকেনি। বলা ভালো, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী প্রথমবারের মতো ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছিল এবং সংসদীয় রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোটের রাজনীতি শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে।
জোটের রাজনীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশের রাজনীতি স্পষ্টই দুটি ধারায় বিভক্ত। যারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তথা ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী তাদের একটি জোট। এ জোটের মূল্য শক্তি বিএনপি। এ জোট চারদলীয় জোট হিসেবে পরিচিতি পেলেও অতি সম্প্রতি তা ১৮ দলীয় জোটে সম্প্রসারিত হয়েছে। যদিও এ ১৮ দলীয় জোটে অনেক দল রয়েছে, যা ব্যক্তিনির্ভর, প্যাডসর্বস্ব এবং যাদের কোনো সংসদীয় ভিত্তি নেই। অন্যদিকে যারা বাঙালি সংস্কৃতি, ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী এবং সমাজতন্ত্রী, তারা মহাজোটের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ এ মহাজোটের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি। তবে এখানে একটা মজার ব্যাপার লক্ষণীয়। রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী জাতীয় মার্টি মহাজোটের অন্যতম শরিক। জাতীয় পার্টি বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তাদের রাজনীতির সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির কোনো বড় পার্থক্য নেই। এ ক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে তাদের ঐক্য করা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তা হয়নি। উল্টো যারা বিএনপির মতাদর্শের সম্পর্কে বিপরীত মেরুতে, তাদের সঙ্গেই ঐক্য করেছে জাতীয় পার্টি। এর ব্যাখ্যা কী? সাধারণ অর্থে দেখা যায় একধরনের সুবিধাবাদিতা কাজ করেছে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের মাঝে। এরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে সব ধরনের সুবিধা নিতে চান। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক রাজনীতি করার প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি। ওই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে (১৯৯৬) আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে, জাতীয় পার্টি মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল। পরে জাতীয় পার্টির নেতা এইচ এম এরশাদ দলীয় মন্ত্রীকে (আনোয়ারা হোসেন মঞ্জু) পদত্যাগ করার আহ্বান জানালেও, তিনি পদত্যাগ করেননি। এ নিয়ে ওই সময় জাতীয় পার্টি ভেঙেও যায়। এ মুহূর্তে জাতীয় পার্টি তিন ধারায় বিভক্ত হয়ে আছে। একটি ধারা (প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জু) বর্তমানে বিএনপির সঙ্গে আছে এবং সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্বও রয়েছে (বিজেপি)।
জোট রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করলে সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশে সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস আলোচনা করা প্রয়োজন। ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার আওতায়। এরপর ১৯৭৯ থেকে '৯১ সাল পর্যন্ত চারটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার পদ্ধতির অধীনে। তবে '৯৬ থেকে সর্বশেষ ২০০৮ সালের পর তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। ওই সময় কোনো জোটের রাজনীতি ছিল না এবং ইসলামপন্থী কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ও অংশগ্রহণ ছিল না। মোট ৩০০ আসনে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল ২৯২টিতে। শতকরা ভোট পেয়েছিল ৭৩ দশমিক ২০ ভাগ। মজার ব্যাপার হলো, ওই সময় বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল জাসদ, ন্যাপ (মো.), যারা এখন সরকারি জোটের অন্যতম শরিক। ন্যাপ (মো.) ২২৪ আসনে প্রার্থী দিয়ে পেয়েছে মাত্র ১টি (শতকতরা ভোট ৮.৩৩)। আর জাসদ ২৩৭ আসনে প্রার্থী দিয়েও পেয়েছিল ১টি (শতকরা ৬.৫২)। ভাসানী ন্যাপও ১৬৯ আসনে প্রার্থী দিয়ে ১টি আসন (শতকরা ৫.৩২ ভাগ ভোট) পেয়েছিল। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছিল ৪টি আসন। স্বাধীনতা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ভূমিকা, শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ইত্যাদি নানা কারণে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী হতে সাহায্য করলেও, ওই সময় কোনো কোনো আসনে কারচুপির অভিযোগও উঠেছিল। ওই সময় কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জোট গঠনের কথা না বললেও, নির্বাচনের পর পরই (ন্যাপ-মো.) ও কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতারা, যারা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনীতির সমর্থক ছিলেন, তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার আহ্বান জানান। '৭৩ সালের মে মাসে ৩টি সংগঠনের (আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপ-মো.) ছাত্র সংগঠনগুলো একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন করে। ধীরে ধীরে তা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর দিক গড়ায়। ৫ আগস্ট, ১৯৭৩ কুমিল্লায় ও ২৬ আগস্ট বগুড়ায় ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। সেপ্টেম্বরে সরকার ঘোষণা করে যে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিকে সামনে রেখে প্রগতিশীল সংগঠনগুলোকে নিয়ে একটি ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হবে। অক্টোবরে বহুল আলোচিত 'গণঐক্যজোট' গঠিত হয়। ১৯ সদস্যবিশিষ্ট যে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাতে ১১ জন ছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে, ৫ জন ন্যাপ (মো.) আর ৩ জন সিপিবি থেকে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এ সিদ্ধান্তকে অভিবাদন জানিয়েছিল। এ গণঐক্যজোটের সম্প্রসারিত রূপ ছিল 'বাকশাল'। যদিও বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ জোট সংসদীয় নির্বাচনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কেননা নির্বাচন হয়েছিল এর আগে, মার্চে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি 'নয়া রাজনীতির' আলোকে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৭৯) আমরা এই গণঐক্যজোটের কোনো প্রতিফলন লক্ষ্য করিনি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে পৃথকভাবে আবদুল মালেক উকিল ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে অংশ নেয়। এমনকি ন্যাপ (মো.) একতা পার্টি, জাসদ, যারা একসময় মিত্র ছিল আওয়ামী লীগের, তারাও আলাদাভাবে নির্বাচন করে। আওয়ামী লীগের মালেক গ্রুপ ২৯৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয় ৩৯টিতে (ভোটের হার ২৪.৫৬ ভাগ) আর মিজান গ্রুপ ১৮৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয় মাত্র ২টিতে (০.৬৬ ভাগ)। ন্যাপ (মো.) ১ আসন (২.২৪ ভাগ), জাসদ ৮ (৪.৮৩ ভাগ) আসন পায়। এখানে লক্ষণীয়, মুসলিম লীগ ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামী) ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ২৬৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২০টিতে বিজয় হয় (১০.০৭ ভাগ ভোট)। তারা ওই সময় নবগঠিত বিএনপির সঙ্গে কোনো ঐক্য করেনি। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৮৬ ও '৮৮ সালে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। কোনো ফ্রন্টও গঠিত হয়নি। মজার ব্যাপার হলো, '৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (৭৬ আসন, ২৬.১৬ ভাগ ভোট), জামায়াতে ইসলামী (১০ আসন, ৪.৬১ ভাগ ভোট), যুক্ত ন্যাপ (৫ আসন, ১.৩৯ ভাগ ভোট), সিপিবি (৫ আসন, ০.৯১ ভাগ ভোট), ন্যাপ (মো.) (২ আসন, ০.৭১ ভাট ভোট) অংশ নিয়েছিল। কিন্তু কোনো জোট করেনি।
পরিবর্তিত রাজনীতির আলোকে পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯১ সালে, যা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এ নির্বাচনের আগে ও পরে জোটের রাজনীতি নতুন রূপ পায়। বিএনপি ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়, বিজয়ী হয় ১৪১টিতে (ভোট ৩০.৮১ ভাগ) আর আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয় ২৬৪ আসনে (৮৮ আসন, ৩০.০৮ ভাগ ভোট), বাকি আসন সিপিবি, ন্যাপ, বাকশাল প্রার্থীদের ছেড়ে দেয়। জামায়াতে ইসলামী ২২২ আসনে প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী হয় ১৮টিতে (১২.১৩ ভাগ) আর জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ২৭২ আসনে প্রার্থী দিয়ে তারা বিজয়ী হয় ৩৫টিতে (১১.৯২ ভাগ ভোট)। আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়ে বাকশাল ৫ আসনে (১.৮১ ভাগ), সিপিবি ৫ আসনে (০.১৯ ভাগ ভোট) বিজয়ী হয়েছিল। নির্বাচনের পর সরকার গঠন প্রশ্নে বিএনপি জামায়াতের সমর্থন নিয়েছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যাদের সমর্থন দিয়েছিল, তাদের নিয়েও কোনো ঐক্যজোট করেনি। '৯৬ সালের নির্বাচন নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই প্রথমবারের মতো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবার আর আওয়ামী লীগ কোনো আসন ছাড়েনি। আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৪৬টিতে বিজয়ী হয় (৩৭.৪৪ ভাগ ভোট)। অন্যদিকে তাদের মিত্র বলে পরিচিত জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ২৯৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পায় ৩২টি (১৬.৩৯ ভাগ ভোট) অন্য 'মিত্ররা' কোনো আসন পায়নি। বিএনপি ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পায় ১১৬টি (৩৩.৬১ ভাগ ভোট)। তাদের 'মিত্র' জামায়াতে ইসলামীও ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পায় মাত্র ৩টি (৮.৬১ ভাগ ভোট)। দৃশ্যপট আবারো পাল্টে যায় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, ২০০১ সালে। এবারে বিএনপি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে (শরিক জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি_ নাজিউর)। বিএনপি প্রার্থী দেয় ২৫২ (বিজয়ী ১৯৩, ৪০.৯৭ ভাগ ভোট), জামায়াত প্রার্থী দেয় ৩১ (বিজয়ী ১৭, ৪.১৮ ভাগ ভোট), ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী ছিল ৭ (বিজয়ী ২, ০.৬৮ ভাগ ভোট) আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিল ১১ (বিজয়ী ৪, ১.১৮ ভাগ ভোট)। চারদলীয় জোট মোট ৪৭ ভাগ ভোট পায়। আওয়ামী লীগ সব আসনে প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী হয় ৬২টিতে (৪০.১৩ ভাগ প্রাপ্ত ভোট)। জাতীয় পর্টির (এরশাদ) নেতৃত্বাধীন ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ২৮১ আসনে প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী হয় ১৪টিতে (৭.২৫ ভাগ ভাগ)। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দৃশ্যপট আবার ভিন্ন, ২০০৮ সালে। চারদলীয় জোট জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে ৩৩ আসনে বিজয়ী হয় (জামায়াত ২ ও বিজেপি ১ আর বিএনপির একক আসন ৩০)। প্রাপ্ত ভোট বিএনপির ৩২.৪৫, জামায়াতের ৪.৬০ ও বিজেপির ০.২৬ ভাগ। এ জোটে এখন এলডিপি (১ আসন) শরিক (০.২৭ ভাগ) আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আসন ২৩১ (৪৮.০৬ ভাগ ভোট)। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির (এরশাদ) আসন ২৬ (৭.০৫ ভাগ), জাসদের ৩ (০.৭৪ ভাগ) আর ওয়ার্কার্স পার্টির ২ (০.৩৮ ভাগ)।
জোট রাজনীতির এই যে চিত্র তাতে দেখা যায় : ১. এ দেশের রাজনীতির দুটি ধারা স্পষ্ট। একটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, অপরটি বিএনপির নেতৃত্বে। ২. মূলত চারটি দল বার বার সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। এককভাবে এদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবানাও রয়েছে। দুটি বড় দলের বাইরে রয়েছে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ও জামায়াতে ইসলামী। তবে এদের একার পক্ষে কোনো জোটের নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়। ৩. এদের বাইরে সংসদে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, এলডিপির অস্তিত্ব রয়েছে সত্য। কিন্তু জোটের প্রার্থী না হলে নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করলে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সংসদের বাইরে যে রাজনীতি সেখানেও এই রাজনীতি প্রতিফলিত হয়। জাতীয় পার্টি (এরশাদ) এখনো একটি আঞ্চলিক দল, আর জামায়াতের ভোটব্যাংক মাত্র ৪-৫ ভাগ। আগামী রাজনীতি তথা সংসদ নির্বাচনে এ জোটের রাজনীতি প্রতিফলিত হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি নেতা এইচ এম এরশাদ এককভাবে নির্বাচনের কথা বললেও, চূড়ান্ত বিচারে তিনি মহাজোটেই থাকবেন। আর বেগম জিয়া জামায়াতের প্রশ্নে বড় ধরনের 'ডায়নামা' 'ফেস' করছেন। গত বিজয় দিবসে (২০১২) জামায়াতকে দাওয়াত না করা একধরনের স্ট্র্যাটেজি। শেষ পর্যন্ত তিনি সংসদকেন্দ্রিক চারদলীয় ঐক্য ধরে রাখবেন। নির্বাচন প্রশ্নে কাদের সিদ্দিকী ও আ স ম আবদুর রবের সঙ্গে তাদের একটি ঐক্য হতে পারে। তৃতীয় একটি জোটের কথা বলা হলেও এ জোট গঠিত হবে বলে মনে হয় না। একককভাবে কোনো একটি দলের পক্ষে সংসদ কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব হবে না। দুটো বড় দলকেই এখনো আগামীতে জোট রাজনীতির ওপর নির্ভর করতে হবে।
Daily JAI JAI DIN06.06.13

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফটোসেশন ও আমাদের অর্জন

বিএনপি এখন কী করবে?

চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে বিএনপি তথা ১৮ দল এখন কী করবে? চলতি বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠেয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তথা ১৮ দল কি শেষ পর্যন্ত অংশ নিতে যাচ্ছে? সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হলেও তাদের একটা বড় ডায়লামার মাঝে ফেলে দিয়েছে। প্রথমত, এই বিজয় স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের উৎসাহিত করবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে। তাদের এই ‘চাপ’ উপেক্ষা করা কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়ে ১৮ দল যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে জাতির কাছে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে থাকবে। কেননা বিএনপি তথা ১৮ দল বারবার বলে আসছে তত্ত্বাবধায়ক তথা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। তৃতীয়ত, বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে বিএনপি ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকির মুখে থাকবে। একটি মহল এটা চাইতে পারে। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এ বিশ্বাস করেন, তারা হয়তো এই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলের পেছনে একটি ‘গভীর ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করতে পারেন! নির্বাচনে বিরোধী দলের শক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে মহাজোট সরকারের নিজেদের নির্বাচনী কাজে ব্যবহার না করে, কিংবা অন্যতম ‘মিত্র’ জাতীয় পার্টিকে আলাদাভাবে নির্বাচন করার সুযোগ করে দিয়ে সরকারদলীয় প্রার্থীদের হেরে যাওয়ার একটা ‘ক্ষেত্র’ তৈরি হয়েছিল ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এর প্রবক্তারা এই যুক্তি তখন দেখাতে পারেন। অনেকে বলতে চাইবেন নির্বাচনের পর পরই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এর প্রবক্তাদের উৎসাহিত করতে পারে। মনে রাখতে হবে সিটি নির্বাচনটা হলো এমন একটা সময় যখন জাতীয় নির্বাচনের আর বাকি আছে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় মাস। কিন্তু নির্বাচনের প্রশ্নে একটি বড় বাধা এখনো দূর হয়নি অর্থাৎ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নাকি একটি নিরপেক্ষ সরকার এ প্রশ্নের ফয়সালা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি মনে করে, নির্বাচনের ‘রায়ে’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে সমর্থন মিলেছে। নির্বাচিত মেয়ররাও সে কথা বলেছেন। ফলে এ প্রশ্নে একটা জটিলতা থেকেই গেল।


এমতাবস্থায় নিশ্চিত করেই বলতে পারি সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এখন হাজারটা যুক্তি দেখাবেন যে, দলীয় সরকারের আওতায়ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এখানে যে বিষয়টি মুখ্য, তা হচ্ছে এটা স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন। এই নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের তুলনা করা যাবে না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাজ করে স্থানীয় ইস্যু। যেমন সিলেটের সাধারণ মানুষ মেয়র কামরানের ‘পারফরমেন্স’-এ খুশি ছিলেন না। জলাবদ্ধতা দূরকরণে তার ব্যর্থতা ছিল চরমে। উপরন্তু নির্বাচনের ঠিক আগমূহূর্তে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর আবিষ্কারের ঘটনা নারী ভোটারদের প্রভাবিত করে থাকতে পারে। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে খুলনাতে। দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তালুকদার আবদুল খালেক ছিলেন ব্যর্থ। উপরন্তু তার শুভাকাক্সক্ষীদের কেউ কেউ এমন সব কাণ্ড করেছেন, যা তাকে বির্তকিত করেছে। তিনি মানুষের আস্থা হারিয়েছেন। খুলনার পাইওনিয়ার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর পরীক্ষায় (ইসলাম ধর্ম শিক্ষা) তালুকদার আবদুল খালেককে হজরত উমর (রা.)-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এটা অনভিপ্রেত এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এটা ভালো চোখে নেননি। তার ব্যক্তিগত আচরণে (রিকশাওয়ালাকে থাপ্পড় মারার ঘটনা) অনেকে অখুশি ছিলেন। এটা সত্য সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দলীয়ভাবে হয়নি। কিন্তু দেখা গেল, চূড়ান্ত বিচারে দুটি বড় দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা তাদের প্রার্থীর পক্ষে ব্যাপক গণসংযোগে করেছেন। মন্ত্রীরা নির্বাচন বিধি লঙ্ঘন করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছেন।
অর্থমন্ত্রী জাইকার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বাদ দিয়ে সিলেটে চলে গিয়েছিলেন। তিনি রিকশায় চড়ে এবং সরকারি গাড়ি ব্যবহার না করেও তার ‘নিরপেক্ষতা’ নিশ্চিত করতে পারেননি। এক্ষেত্রে ইসির যতটুকু কঠোর হওয়া উচিত ছিল, তারা ততটুকু কঠোর হতে পারেনি। ইসির ভূমিকা তাই প্রশ্নের মধ্যে থেকেই গেল। সিলেটে রিটার্নিং অফিসারের ভূমিকা কিছুটা হলেও নির্বাচনকালে সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকাকে প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। যখন সিলেটের ১২৮টি কেন্দ্রের ফলাফল রাতের মধ্যেই এসে গিয়েছিল, তখন তিনি বিরোধী ১৮ দলের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করতে ইতস্তত করছিলেন। এ নিয়ে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে তার তর্কও হয়। রিটার্নিং অফিসার পরদিন অর্থাৎ রোববার দুপুরে এটা ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। পরে অবিশ্যি শনিবার রাতেই আরিফুল হক চৌধুরীকে বেসকারিভাবে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই একটি ‘ছোট্ট’ ঘটনা শংকা তৈরী করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ ধরনের আচরণ করতে পারেন। ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচকে সামনে রেখে সরকার তার প্রশাসন সাজাচ্ছে। এই জুন মাসেই বেশ ক’জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এসবের একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তাহলে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বাইরে কাজ করতে পারবে এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। প্রশাসনের কাছে নির্বাচন কমিশন যে কত দুর্বল তা একাধিক ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচন বিধি অনুযায়ী নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রীদের যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু মন্ত্রীরা গেছেন। নির্বাচনী এলাকায় সরকার কোনো উন্নয়ন কাজ করতে পারবে না, যাতে ভোটাররা প্রভাবান্বিত হতে পারেন। কিন্তু রাজশাহীতে গ্যাস সরবরাহ চালু হয়েছে নির্বাচনের মাত্র দু’দিন আগে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তা উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী তো নির্বাচনের পরেও এ কাজটি করতে পারতেন। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য ইসির যে কর্তৃত্ব তা কাগজ-কলমে থাকবে, ইসি তা প্রয়োগ করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি দলের সভানেত্রী। তিনি যখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকবেন, তখন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা ও কর্মীরা আরো বেশি মাত্রায় উৎসাহিত হবেন। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে পদত্যাগ করেন, কিংবা রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দেন, তখন আর এ প্রশ্নগুলো উঠবে না। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। সেনাবাহিনী ছাড়া আমাদের দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা এখন পর্যন্ত অকল্পনীয় একটি বিষয়। অবশ্যই সেনা মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। যোগাযোগমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী সঠিক কথাই বলেছেন। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুুল কাদের বলেছেন, ‘ওয়েফ আপ কল ফর দি রুলিং পার্টি’ আর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, একটি ‘অশনি সংকেত’-এর কথা। তারা মিথ্যা বলেননি। দু’জনই যথেষ্ট অভিজ্ঞ। তারা শোনেন ও জানেন কেন মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের নেতারা এর মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক চাইলে নির্বাচনই হবে না’ (যায়যায়দিন ১৭ জুন) তখন আমরা এক ধরনের হতাশার মাঝে পরে যাই। আমি জানি না কোন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘নির্বাচন হবে না’। নিশ্চয়ই নির্বাচন হবে। আর সেই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব সরকারের। বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার আর ‘এক-এগারো’র জন্ম হবে না। শুধু ‘এক-এগারো’র ঘটনা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে যাচাই করা ঠিক নয়। আমরা ১৯৯৬ সালে, ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পেয়েছিলাম, যারা সাফল্যের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। এর আগে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেখানেও বিতর্ক ছিল কম। শুধু ‘এক-এগারো’র ঘটনা দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করা ঠিক নয়। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্বচ্ছ হয়েছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। সরকার নিরপেক্ষ থেকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং এর কৃতিত্ব নিতেই পারে। কিন্তু সরকারের কৃতিত্ব আরো বাড়বে, যদি সরকার একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। এক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের নির্বাচিত কোনো সদস্যকে দিয়ে, যিনি নিরপেক্ষ থাকবেন এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন না, তাকে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায়। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন, ২৫ অক্টোবর হচ্ছে সংসদের শেষ দিন। এর অর্থ কী? তিনি কি সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানাবেন? ২৫ অক্টোবরের পরেও কি সংসদ সদস্যরা দায়িত্বে থাকবেন? এর সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। ফলে নানারকম গুজব ও ডালপালা গজাচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি উজ্জীবিত, এতে সন্দেহ করার কিছু নেই। কিন্তু ওই নির্বাচন বিএনপিকে এক জটিল সমীকরণের দিকেও ঠেলে দিয়েছে।
সরকারের সঙ্গে ‘সংলাপ’-এর মৃত্যু ঘটেছে। যত দিন যাবে ততই সংকটের মাত্রা আরো বাড়বে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে বলেও মনে হয় না। সম্ভবত বিএনপি এখন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের বিজয়কে সামনে রেখে ‘নিরপেক্ষ সরকারের’ ইস্যুকে প্রাধান্য দেবে। বেগম জিয়া অচিরেই বিভাগীয় শহরগুলোতে গণসংযোগ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিজয়ের পক্ষে তিনি চারটি বিভাগীয় শহরে যাবেন। নিঃসন্দেহে সরকার এখন ‘ব্যাকফুটে’। সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে গিয়ে সরকার তার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করেছে, এজন্য সরকারকে অবশ্যই ধন্যবাদ। সেই সঙ্গে এই স্পিরিটকে সামনে রেখে সরকার যদি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করে, আমার বিশ্বাস সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তাতে আরো বাড়বে। অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিবেচনায় রাখা হোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবেই আবার জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াবেন। প্রয়োজন নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। কিন্তু প্রয়োজন আছে একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের। চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল আমাদের এ শিক্ষাই দেয়।
তথসূত্র: দৈনিক মানবকন্ঠ ২০/৬/২০১৩
http://manobkantha.com/2013/06/20/126384.html


দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে কিছু কথা

প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, ২৫ অক্টোবর হচ্ছে বর্তমান সংসদের শেষ দিন। এরপর ২৫ জানুয়ারির মধ্যে যে কোনো একদিন নির্বাচন হবে। কিন্তু একটা বিষয়ে এখনও কোনো সমঝোতা হয়নি- আর তা হচ্ছে, নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারে কারা কারা থাকবেন? বর্তমান সংবিধানে যেভাবে রয়েছে এবং ক্ষমতাসীন সরকার যেভাবে এর ব্যাখ্যা করেছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যাচ্ছেন। বিএনপির আপত্তিটা সেখানেই। ১০ জুন বেগম জিয়া আবারও স্পষ্ট করে বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। নির্বাচন প্রশ্নে তাই একটা জটিলতা রয়েই গেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের স্ট্রাটেজি অনেক।
এক. বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখা, যাতে করে তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে না পারেন। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা ও ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। প্রয়োজনে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে, তা সচল করা ও তার বিচার নিশ্চিত করা।
দুই. প্রধানমন্ত্রী প্রতি সপ্তাহেই গণভবনে বিভিন্ন জেলার নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে তিনি প্রার্থী চূড়ান্ত করছেন এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন।
তিন. তথাকথিত সংলাপের প্রক্রিয়াকে ‘লো প্রোফাইল’-এ রাখা। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। দাতাগোষ্ঠীকে একটা মেসেজ পৌঁছে দেয়া যে, সরকার সংলাপের ব্যাপারে সিরিয়াস। সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এটা ভালো করেই জানেন, সংলাপের এজেন্ডা নির্ধারিত না থাকায় বিএনপি সংলাপে অংশ নেবে না। বিএনপির মূল দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা নির্বাচনকালীন একটি সরকার। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এটা স্পষ্ট করেছেন, শেখ হাসিনাই হবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান। এর বাইরে অন্য কোনো প্রস্তাব তারা গ্রহণ করবেন না। আর বিএনপির এ ক্ষেত্রে আপত্তি রয়েছে। ফলে সংলাপের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
চার. সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এটা মনে করেন, নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা করলে শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবে। অথবা বিএনপির একটা অংশ বেরিয়ে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের একটা সমর্থনও তাতে থাকতে পারে। এইচএম এরশাদের নেতৃত্বে একটি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করাও বিচিত্র নয়। এরশাদ এরই মধ্যে সরকারবিরোধী একটা অবস্থান গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের আগামী রাজনীতিতে তার একটি ভূমিকা থাকবে বলেই অনেকে মনে করছেন।
তবে সব ‘অঙ্কের’ হিসাব বদলেও যেতে পারে। চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা অংশ নিয়েছেন। ১৫ জুন এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য এই নির্বাচন ছিল একটি ‘লিটমাস টেস্ট’। এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয় এবং বিএনপি প্রার্থীরা যদি বিজয়ী হন, তাহলে হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে। রাজশাহীতে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, খুলনায় মনিরুজ্জামান মনি, বরিশালে আহসান হাবিব কামাল ও সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপি প্রার্থী। ১৮ দল তাদের সমর্থন দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও জামায়াতের প্রার্থী ছিলেন (রাজশাহী, সিলেট)। তারা কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। এর মধ্যে জনগণ ব্যালট পেপারের মাধ্যমে তাদের চূড়ান্ত রায় প্রদান করেছেন এবং চার সিটিতেই বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচন হয়েছে মোটামুটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। জনগণ সরকারের ব্যর্থতা ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সুচিন্তিত রায় প্রদান করেছেন। এটি সরকারের জন্য একটি বার্তাও বটে। সে ক্ষেত্রে ভোটের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাওয়ায়, তা বিএনপিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেতে প্ররোচিতও করতে পারে।
তবে নির্বাচন প্রশ্নে শুধু কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হবেন, এ প্রশ্নেই যে জটিলতা রয়েছে, তা নয়। আরও বেশকিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এ ব্যাপারেও একটা ঐকমত্য প্রয়োজন। ধরে নিচ্ছি সংসদ যদি ভেঙে যায়, তা যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে নবম জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভূমিকা কী হবে? তারা কী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাবেন না? শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রী থেকে যান, তাহলে দলীয় এমপিরা একটা প্রভাব খাটানোর সুযোগ পাবেন। সম্প্রতি একটি কাগজে বলা হয়েছে, সরকার এরই মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসন সাজানো শুরু করে দিয়েছে। সরকারের (অন্তর্বর্তী) এই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এমনকি অন্তর্বর্তী প্রশাসনে কারা থাকবেন, সে ব্যাপারটিরও ফয়সালা হয়নি। যারা অন্তর্বর্তী প্রশাসনে থাকবেন, তারা কী নির্বাচন করতে পারবেন? এখানে যে প্রশ্নটি উঠেছে, সংসদ সদস্যের পদটি কি ‘লাভজনক’ পদ? এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে ‘লাভজনক’ পদের যারা অধিকারী, সে ব্যাপারে সংবিধানের ৬৬(৪) ২(ক) ধারায় একটি ব্যাখ্যা আছে। ওই ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে (অর্থাৎ সংসদ সদস্য হবার যোগ্যতা) কোনো ব্যক্তি (রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী) প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না।’ অর্থাৎ উপরে উল্লেখিত পদগুলো সংবিধান অনুযায়ী ‘লাভজনক পদ’ নয়। যদিও এখানে ‘সংসদ সদস্যপদ’ কথাটি লেখা হয়নি। তবে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে মেয়র পদকে লাভজনক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মেয়র যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত, সংসদ সদস্যরাও জনগণের ভোটে নির্বাচিত। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যপদ লাভজনক পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ অবস্থায় সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হয়ে তিনি যদি মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হন, তিনি মন্ত্রী থেকে নির্বাচন করতে পারবেন কি-না, সেটা একটা প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলের আচরণবিধিতে [২০০৮(১৪)-ধারা (১)] বলা হয়েছে, মন্ত্রী বা সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি নির্বাচন চলাকালীন সময়ে নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারবেন না এবং প্রচারও চালাতে পারবেন না। এর অর্থ কী? একজন মন্ত্রী বা এমপি, তিনি তো সুবিধাভোগী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। সরকারের কাছ থেকে ভাতা নেন, সুযোগ-সুবিধা নেন। তিনি তো সরকারের সুবিধাভোগী। তিনি যদি নির্বাচনী প্রচার চালাতে না পারেন, তাহলে প্রশ্ন তো থাকবেই। আর তিনি কী তা মানবেন? তিনি কী প্রভাব খাটাবেন না? অতীতে আমরা দেখেছি, নির্বাচনের সময় নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে যে নির্বাচন, তার নিরপেক্ষতা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে?
গত ২৬ ও ২৯ মে বিএনপি হরতাল পালন করলেও, এরপর বিএনপি আর কোনো বড় কর্মসূচি দেয়নি। জামায়াত হরতাল দিয়েছিল ১০ জুন। জামায়াতের এই হরতালে আবার বিএনপির সমর্থন ছিল না। গত ১২ জুন বিএনপি বড় জমায়েত করেছে। এর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, বিএনপি আপাতত হরতালের মতো কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে না। এটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো দিক এবং বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর অনেকেই এই ‘হরতাল না দেয়ার’ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দাতাগোষ্ঠীর, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে একাধিক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা দলটি ছিল অতি ক্ষমতাসম্পন্ন। তারা একদিকে রাজনৈতিক সহিংসতায় যেমনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে মার্কিন জনগণের উৎকণ্ঠার খবরও জানিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে বিকল্প জনমত কোনো আশার কথা বলে না। রাজনীতির এই সংকটকালীন সময়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতার ও দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তাতে করে পুরো সংলাপ প্রক্রিয়া এখন ঝুলে গেল। সংলাপ হওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেল, সরকার ও বিরোধী দল আদতেই ‘সংলাপ’ চায় না। সংলাপের জন্য যে পরিবেশ দরকার, এই মুহূর্তে সেই পরিবেশ নেই। সরকারের কর্মকা- দেখে ওই সিদ্ধান্তে আসা যায়, সরকার এককভাবে নির্বাচনের দিকেই এগুচ্ছে। কিন্তু এই পক্ষ ভালো নয়। এই পক্ষ দেশের কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। পরিকল্পনামাফিক সরকার ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, সরকারপ্রধান এরই মধ্যে ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়া’ শুরু করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গণভবনে বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলছেন। কারা কারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তাও ঠিক করে ফেলেছেন। ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, যিনি সরকারপ্রধানের খুব ঘনিষ্ঠ। একদিকে সংলাপের কথা বলে বিএনপিকে তথাকথিত ‘আমন্ত্রণ’, অন্যদিকে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে শীর্ষ নেতাদের ব্যতিব্যস্ত রাখাÑ আর এক সময় হঠাৎ করেই নির্বাচনের ‘সিডিউল’ ঘোষণা করা হবে! উদ্দেশ্য একটাই, বিএনপি তথা ১৮ দলকে নির্বাচনী প্রচার তথা প্রস্তুতির সুযোগ না দেয়া এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় নির্বাচন সম্পন্ন করা।
কিন্তু এ ধরনের নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না এবং এতে করে সংকট আরও বাড়বে। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন আর ২০১১ সালে সেই সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হওয়ার পর পাকিস্তান ও নেপাল নির্বাচনকালীন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। গত ১১ মে পাকিস্তানে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে দেশে নির্বাচন সম্পন্ন করেছে এবং একটি নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। ২ জুন নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তৃতীয়বারের মতো শপথ নিয়েছেন। জুন মাসেই নেপালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেখানে একটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে যাচ্ছে। সাবেক বিচারপতি মির হাজার খান খোসোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানে গেল মার্চে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, তা ছিল পাকিস্তানের রাজনীতির জন্য একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। একদিকে উগ্র তালেবানি রাজনীতি পাকিস্তানের অস্তিত্বকে যখন হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল, তখন সেখানে সম্ভাব্য একটি সামরিক অভ্যুত্থানের কথা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছিল। এমনি এক পরিস্থিতিতে বিচারপতি খোসোর নেতৃত্বাধীন সরকার একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে প্রমাণ করল, পাকিস্তানের মানুষ এ নতুন ব্যবস্থায় আস্থাশীল।
পাকিস্তান ও নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পাকিস্তানের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল পিপল্স পার্টি ও মুসলিম লীগের (নওয়াজ শরিফ) মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে একাধিকবার সেখানে সরকারের পতন ঘটেছে। পিপিপি নেত্রী প্রয়াত বেনজির ভুট্টো দু’দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু টার্ম পূরণ করতে পারেননি। ঠিক তেমনি মুসলিম লীগ নেতা নওয়াজ শরিফও দু’দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও কোনোবারই তার টার্ম শেষ করতে পারেননি। এমনি এক পরিস্থিতিতে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু ২০০৮ সালে আত্মঘাতী বোমা হামলায় বেনজির ভুট্টো নিহত হলে দৃশ্যপট বদলে যায়। নির্বাচনে পিপিপি বিজয়ী হয় ও গত ১৭ মার্চ পিপিপি তাদের ৫ বছরের টার্ম শেষ করে। একই কথা প্রযোজ্য নেপালের ক্ষেত্রে। নেপালে রাজতন্ত্র অবসানের পর সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে যে সাংবিধানিক পরিষদ গঠিত হয়েছিল, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো ঐক্য ছিল না। সাংবিধানিক পরিষদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরই নয়া সংসদ নির্বাচনের জন্য তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। পাকিস্তানে এবং নেপালে নির্বাচনকালীন সময়ে এ ধরনের একটি সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হলো, এই দেশ দু’টোর রাজনীতিবিদরা চেয়েছেন নির্বাচনকে অর্থবহ এবং গ্রহণযোগ্য করতে এ ধরনের একটি সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কেননা পাকিস্তান ও নেপালের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সেখানকার পরিস্থিতিকে উত্যপ্ত করেছিল। এখন পাকিস্তান নতুন এক সরকার পেয়েছে। ধারণা করছি, নেপালে যে সরকার গঠিত হবে, তারাও স্থিতিশীলতা উপহার দিতে পারবে। বাংলাদেশ পাকিস্তান ও নেপালের দৃষ্টান্ত থেকে ‘শিখতে’ পারে। আগামীতে নির্বাচন হতে হবে। এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি। সব দলের অংশগ্রহণ না হলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তার গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। তাই সংলাপটা জরুরি, সেটা সংসদের ভেতরেও হতে পারে, সংসদের বাইরেও হতে পারে। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। রাজনীতিবিদরাই বাংলাদেশকে একুশ শতকে নেতৃত্ব দেবেন। তাই ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর যে ধারণা, সেটাই প্রমাণ করবেন আমাদের রাজনীতিবিদরা। বিএনপি এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় না। সুতরাং বিএনপির এই স্পিরিটকে ধারণ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে একটি দলনিরপেক্ষ সরকার গঠনকল্পে আলাপ-আলোচনা শুরু করার সময় এখনই।
Alokito Bangladesh
17.06.2013