রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

যুদ্ধ-অর্থনীতি ও সিরিয়ার অভিজ্ঞতা

শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সিরিয়া আক্রমণের নির্দেশ দেননি। আক্রমণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিলেও নানা কারণে তিনি কিছুটা সময় নিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে 'যুদ্ধ' শুরু করার একমাত্র অধিকার দেওয়া হয়েছে কংগ্রেসকে। প্রেসিডেন্ট এককভাবে যুদ্ধ শুরু করতে পারেন না। তবে এটাও সত্য, ২০১১ সালে লিবিয়া আক্রমণের সময় ওবামা একাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কংগ্রেসের সমর্থন তিনি তখন নেননি। এবার প্রস্তুতিটা চূড়ান্তই ছিল। সবাই যখন অপেক্ষা করছিল প্রেসিডেন্টের নির্দেশের, তখন প্রেসিডেন্ট কিছুটা সময় নিলেন। এর কারণ একাধিক। প্রথমত, কংগ্রেসের সদস্যদের একটি চিঠি। ১১৬ জন কংগ্রেস সদস্য প্রেসিডেন্টকে একটি চিঠি লিখে কংগ্রেসের সমর্থন ছাড়া যুদ্ধ শুরু না করার অনুরোধ করেছেন। একই সঙ্গে সিনেটের সভাপতিও একটি চিঠি দিয়েছেন যুদ্ধ শুরু না করার। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাজ্যের সমর্থন তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন। শেষ মুহূর্তে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হাউস অব কমন্সে সিরিয়া প্রশ্নে ভোটাভুটিতে হেরে গেছেন। ব্রিটেনের সমর্থন ওবামা পাবেন না। ব্রিটেনের বিরোধী দল সিরিয়া আক্রমণের বিপক্ষে। তৃতীয়ত, ওবামা চাচ্ছেন, সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের ব্যাপারে জাতিসংঘের তদন্ত কর্মকর্তারা কী সিদ্ধান্ত দেন, তা দেখার। একই সঙ্গে ওবামা চাচ্ছেন, নিরাপত্তা পরিষদ সিরিয়া আক্রমণের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি সিরিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। চতুর্থত, বিশ্ব আসরে দুটি বড় শক্তি রাশিয়া ও চীন সিরিয়া আক্রমণের বিরুদ্ধে। এমনিতেই বেশ কয়েকটি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। সিরিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত দিয়ে ওবামা চাচ্ছেন না রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের আরো অবনতি হোক। পঞ্চমত, মার্কিন জনমত ও মার্কিন অর্থনীতিও যুদ্ধের পক্ষে নয়। এমনিতেই আফগানিস্তানে ও ইরাক-লিবিয়া যুদ্ধে মার্কিন অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে সত্য, কিন্তু সিরিয়া-যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয় মার্কিন অর্থনীতি। মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ডেমপসে স্বীকার করেছেন, প্রতি মাসে এক বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে সিরিয়া-যুদ্ধ শুরু হলে। তাই ওবামা প্রশাসন কিছুটা পিছিয়ে এসেছে। কিন্তু যুদ্ধে তাঁকে যেতেই হবে। যুদ্ধ শুরু করা ও দীর্ঘস্থায়ী করার মধ্য দিয়েই মার্কিন অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব ফিরে আসে। যুদ্ধের সঙ্গে মার্কিন অর্থনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যুদ্ধ যদি শুরু না হয়, তাহলে মার্কিন অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব আসবে না। কেননা, মার্কিনি তৈরি কোনো পণ্য এখন আর বিশ্ববাজারে দাঁড়াতে পারে না। সহজলভ্য চীনা পণ্যে খোদ মার্কিন বাজার এখন সয়লাব। একসময় যুক্তরাষ্ট্রের টেঙ্টাইল সারা বিশ্ব কর্তৃত্ব করত। এখন চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ আর লাতিন আমেরিকার তৈরি পোশাকের সহজলভ্যতার কারণে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই নিজেদের তৈরি পোশাক পাওয়া যায় না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সচল রাখতে হলে চাই যুদ্ধ। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। যেমনটি আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ইরাকে। ইরাক যুদ্ধের পর ইরাক পুনর্গঠনের নামে আমেরিকান কম্পানিগুলো সেখানে এককভাবে কাজ পেয়েছে। আর ইরাকের মালিকি সরকার তেল বিক্রি করে মার্কিনি কম্পানিগুলোর দেনা পরিশোধ করেছে। এতে করে একদিকে মার্কিনি কম্পানিগুলোর অর্জিত অর্থ মার্কিন বাজারে প্রবেশ করেছে, যা অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখেছিল। এখন ইরাকের পুনর্গঠন এক রকম শেষ। সেনাবাহিনী সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে অনেক আগেই। এমনকি ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকেও সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সচল হবে কিভাবে? তাই চাই একটি যুদ্ধ।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলে আসছে প্রায় ২৯ মাস ধরে। সিরিয়ায় বাসারবিরোধী একটি রাজনৈতিক মোর্চা তথা প্রবাসী সরকার গঠন করা, বিদ্রোহী সেনাবাহিনী গঠন ও তাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র স্বয়ং। এটা কোনো রাখঢাকের বিষয় ছিল না। কিন্তু এই যুদ্ধ সিরিয়ার অর্থনীতিকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। যে সিরিয়া ছিল খাদ্যে ও উৎপাদিত পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ, সেই দেশটি এখন খাদ্য ও পণ্য আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বেকার সমস্যা যেখানে যুদ্ধের আগে তেমন একটা ছিল না, এখন তা শতকরা ৬০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। যেখানে যুদ্ধের আগে তেল উৎপাদিত হতো দৈনিক তিন লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল, এখন উৎপাদিত হয় সেখানে মাত্র ২০ হাজার ব্যারেল। শুধু তেল উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন ডলার। সিরিয়ার মুদ্রার (পাউন্ড) ব্যাপক দরপতন হয়েছে। আগে ডলারে পাওয়া যেত ৪৭ পাউন্ড, এখন ২৫০ পাউন্ডে পাওয়া যায় এক ডলার। জনসংখ্যার ৭৯ শতাংশ গরিব হয়ে গেছে যুদ্ধের কারণে। অথচ যুদ্ধের আগে গরিব জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এক শতাংশেরও কম ছিল। স্বাস্থ্যসেবা পরিপূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। দেশের ৭৫টি হাসপাতালের মধ্যে এখন চলছে মাত্র ৩০টি। একসময় সরকার জ্বালানি তেল ও খাদ্যে সাবসিডি দিত, যার পরিমাণ ছিল বছরে ছয় মিলিয়ন ইউরো, এখন তা শূন্যের কোটায়। যুদ্ধের আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার, এখন তা এক রকম শূন্য (ইকোনমিস্ট, ১০ এপ্রিল, ২০১৩)। তাই যুদ্ধ না হলে এখানে মার্কিন কন্ট্রাক্টররা আসবেন না, তেল উৎপাদন বাড়ানো যাবে না, 'আরেকটি ইরাক'ও তৈরি হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক বাহিনী ইরাকি বাহিনীর কুয়েত দখল থেকে মুক্ত করেছিল। ২০০৩ সালে ইরাকের কাছে মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে- এই অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বাগদাদে মিসাইল হামলা চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করেছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০১১ সালে লিবিয়ায়। এবার যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা 'মানবতা রক্ষায়' হস্তক্ষেপ করেছিল এবং গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এ ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে কুয়েতকে ইরাকি দখলমুক্ত করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের সাহায্য নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০০৩ ও ২০১১ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরাক ও লিবিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালাতে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। এবারের ক্ষেত্রেও তেমনটি হতে যাচ্ছে। লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে উৎখাতের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়েছিল Humanitariam Intervention-এর তত্ত্বটি। আর এবার ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে Responsibility to Protect তত্ত্বটি। এর মূলকথা হচ্ছে, মানবতা রক্ষায় বিশ্বশক্তির দায়িত্ব। যেহেতু সিরিয়ায় সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে (?), সেহেতু সাধারণ মানুষকে রক্ষায় পশ্চিমা শক্তি দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই এই সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে! এখানে বলা ভালো, সিরিয়ার ঘটনাবলি সে দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। জাতিসংঘের চার্টারে উল্লেখ করা আছে, একটি দেশ অপর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি এমন কোনো ঘটনার জন্ম হয় যে সেখানে স্থিতিশীলতা ও গণহত্যা রোধে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে, তাহলে কাজটি করতে হবে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। ইরাকের (২০০৩) ক্ষেত্রে কিংবা লিবিয়ার ক্ষেত্রেও (২০১১) এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়নি নিরাপত্তা পরিষদ। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা পরিষদ এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে এটাও সত্য, আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে Responsibility to Protect'-এর একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি এবং এটা কোনো আন্তর্জাতিক আইনও নয়। এর অর্থ হচ্ছে, সিরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইন অনুমোদন করে না। তবে ওবামাকে শেষ পর্যন্ত সিরিয়ায় আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দিতে হবে! মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ী, ইসরায়েলি লবির চাপ রয়েছে। তবে পরিস্থিতি এবার ভিন্ন। এ যুদ্ধ শুধু আর সিরিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। আঞ্চলিক শক্তিগুলো, এমনকি বৃহৎ শক্তিগুলোর জড়িয়ে পড়াও বিচিত্র কিছু নয়। তেলের জন্য ইরাকে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বুশ। তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ওয়াদা করেছিলেন, প্রত্যেক ইরাকিকে তিনি খাদ্য, বাসস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবেন। দীর্ঘ ১০ বছর পার হওয়ার পরও ইরাকিরা সেই নিরাপত্তা পায়নি। সেই তেলের কারণেই লিবিয়ায় বিমান আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন ওবামা। কিন্তু লিবিয়ায় মানবাধিকার নিশ্চিত করা যায়নি। বরং সেখানে মৃত্যুর হার বাড়ছে। Eric Chenoweth-এর একটি গবেষণায় (Do Military Intervention Reduce Killings of Civilians in Civil War-2012) দেখানো হয়েছে বিদ্রোহীদের সমর্থনে যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপে মৃত্যুর হার বেড়ে যায় ৪০ শতাংশ। ইরাক ও লিবিয়ার ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। এখন একই ঘটনার প্রতিফলন ঘটবে সিরিয়ায়। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে প্রচুর মানুষ মারা গেছে এটা সত্য। কিন্তু এর চেয়েও বেশি মানুষ মারা যাবে, যদি যুক্তরাষ্ট্র দেশটিতে সামরিক আগ্রাসন চালায়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে এমন প্রশ্ন থাকবেই।
দৈনিক কালের কন্ঠ, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৩।
অস্টিন, টেক্সাস, ২৯ আগস্ট, ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রচর্চা

আজ যদি সরকারি ও বিরোধী দলের মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন না আসে, তাহলে কোনো জট খুলবে না। বান কি মুনের টেলিফোনেও কোনো ফল আসবে না। এতে বিদেশের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি আরো নষ্ট হবে। আজ সরকারেরও বুঝতে হবে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতা ধরে রাখার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। সংকট নিরসনে আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি ব্যর্থ হন, তা জাতিকে অনেক পিছিয়ে দেবে। আমরা শুধু প্রত্যাশা করতে পারি, আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের দুই নেত্রীর সঙ্গে ফোনালাপ এ মুহূর্তে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান আলোচিত বিষয় হলেও এর মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি প্রমাণিত হলো তা হচ্ছে, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাদের এই ব্যর্থতার ফলে জাতিসংঘের মহাসচিবকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে! জাতিসংঘের মতো একটি বিশ্ব সংস্থা আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করবে কিংবা তাদের নির্দেশমতো আমাদের রাজনীতিবিদরা কাজ করবেন— এটা সুস্থ গণতন্ত্রচর্চার পথে একটি অন্তরায়। এটি কখনো কাম্য হতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, একটি ন্যূনতম ইস্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা এক হতে পারছেন না। যদিও তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করার কথা বলেন, তৃতীয় শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের বিরুদ্ধে কথা বলেন; কিন্তু গণতন্ত্রের মূল যে কথা— পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখা, এটি তারা নিশ্চিত করতে পারছেন না। স্বাধীনতার ৪২ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজ আমরা আজো বিনির্মাণ করতে পারিনি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমাদের রাজনৈতিক নেতারা। তারপর অনেক সময় পার হয়েছে। কিন্তু সেই সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং গণতন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার, সংসদীয় সরকার কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি। আমরা একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেও ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো উদ্যোগই সফলতা পায়নি। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে দেশে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হলেও মাত্র ১৭ বছরের মধ্যে সংবিধানে সংশোধনী এনে তা বাতিল করা হয়। এক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একটা বড় অংশ এর পক্ষে থাকলেও আওয়ামী লীগ এককভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে সংবিধানে সংশোধনী আনে। যদিও এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত ছিল। ২০১২ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনকালীন একটি দলনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে আসছে। এক্ষেত্রে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো সমঝোতা হচ্ছে না। ফলে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর এ সংকটকে কেন্দ্র করেই বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু এতে একটা সমাধান বের হবে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি সংবিধান থেকে এক চুলও নড়বেন না। তিনি এমন কথাও বলছেন যে, নির্বাচন পর্যন্ত সরকার কার্যকর থাকবে। তার এ বক্তব্য বির্তকের মাত্রা বাড়িয়েছে। কেননা এর আগে ২৫ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা ছিল যৌক্তিক। নির্বাচন পর্যন্ত সংসদ কার্যকর থাকলে নানা জটিলতা সৃষ্টি হবে। ওই সময় পর্যন্ত যারা সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল থাকবেন, তারা নির্বাচনে প্রভাব খাটাবেন। বিশেষ করে যারা সরকারি দলের সংসদ সদস্য হিসেবে থাকবেন, তারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর প্রভাব খাটাবেন। তাতে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষে নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে অস্বীকার করা কোনোমতেই সম্ভব হয়ে উঠবে না। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে তখন স্থানীয় সংসদ সদস্যের ‘চাপ’ অস্বীকার করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আমরা এর আগে একাধিকবার উল্লেখ করেছিলাম, বর্তমান রাজনৈতিক কাঠামোয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন নানা কারণে সরকারের ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়োগ দেয় সরকার। তাদের ওপর নির্বাচন কমিশনের কোনো কর্তৃত্ব বা প্রভাব নেই। তারা স্থানীয় প্রশাসনকে কোনো নির্দেশও দিতে পারেন না। আর স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রের জনপ্রশাসন। এরই মধ্যে এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যাবেন। ফলে ওই সময় তার নেতৃত্বাধীন যে সরকার থাকবে, সে সরকারের অধীনে যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থাকবে, তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে জেলা-উপজেলা পরিষদের প্রশাসন। এক্ষেত্রে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে না। এরই মধ্যে প্রশাসনে ব্যাপকভাবে রাজনীতি ঢুকে গেছে। সরকার সমর্থক জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রমোশন দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে যারা সরকারের ঠিক ‘বন্ধু নন’— এমন কর্মকর্তাদের ওএসডি অথবা ছাঁটাই করা হয়েছে। তাই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কাঠামোকে এভাবে রেখে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা আশা করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী নিজে ও একাধিক মন্ত্রী প্রায়ই একটি কথা বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, এভাবেই বাংলাদেশে নির্বাচন হবে। তারা প্রায়ই ভারতের দৃষ্টান্ত দেন। এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী তিন মাসের জন্য থাকেন বটে, কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা থাকে না। এই তিন মাস মূল ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। আর ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিংবা কমিশনাররা নিরপেক্ষতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা আমাদের কমিশনাররা পারেননি অতীতে। বরং দেখা গেছে, তারা অনেকটা সরকারি কর্মচারীদের মতো আচরণ করে গেছেন। অতীতে এমনো দেখা গেছে, ভারতের নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন কোনো কোনো মন্ত্রীকে নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন কি অতীতে কখনো এমন ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পেরেছে? বরং দেখা গেছে, তারা সরকারের সিদ্ধান্তের এক চুল বাইরেও যেতে পারেননি। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন আরপিওতে কিছু কিছু পরিবর্তন আনার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে রাজনৈতিক মহলে তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে যদি ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তুলনা করতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। সংসদে বিল আনতে হবে। কমিশনের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে হবে। নিজস্ব ক্যাডার তৈরি করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা যদি সাংবিধানিকভাবে শক্তিশালী করা হয়, যদি জেলা পর্যায়ের জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা জেলা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব খাটাতে না পারেন, তাহলেই সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু বর্তমান কাঠামোয় তা সম্ভব নয়। তাই ভারত তথা অন্যান্য দেশের দৃষ্টান্ত দেয়া অর্থহীন। বর্তমান সরকারের হাতে সুযোগ ছিল। যখন সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হলো এবং সংসদে পাস করা হলো, তখন সরকার নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে পারত। সরকার তা করেনি। এটা সত্য, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা যদি পুরোপুরি অনুসরণ করা হতো, তাহলে কোনো বির্তক উঠত না। কিন্তু সরকার তা করেনি। আগামী দুটো সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় আয়োজন করারও সুপারিশ ছিল উচ্চ আদালতের। সরকার সেদিকেও যায়নি। সরকার সংবিধান সংশোধনী আনার জন্য যে কমিশন গঠন করেছিল, তারা নীতিগতভাবে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন— এমন একটি সংবাদ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সরকারপ্রধানের ইচ্ছার কারণে তা বাদ দিতে হয়েছিল। এমনকি সংবিধানে সংশোধনী আনার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। প্রধান বিরোধী দলের কোনো মতামত আমলে নেয়া হয়নি। ফলে সংবিধানে যে পরিবর্তন-পরিবর্ধন, তা একতরফাভাবে হয়েছে। ঐকমত্যভাবে সংবিধানে সংশোধনী আনা হলে আজকের পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। এখন ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান রেখে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। নির্বাচনের মতো একটি বিষয়ে যদি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই এবং তাতে সংকট বাড়বেই।

আমাদের দুর্ভাগ্য একটাই— নির্বাচন এলেই দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা তত্পর হয়ে ওঠেন। অতীতেও হয়েছেন। বিএনপির জমানায় তথাকথিত ‘টুয়েস ডে ক্লাবের’ তত্পরতার খবর আমাদের অনেকেরই জানা আছে। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করত।

এখন দশম সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এদের তত্পরতা আবার শুরু হয়েছে। নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এ দেশের জনগণ। এক্ষেত্রে বাইরের হস্তক্ষেপ বা পরামর্শ কাম্য হতে পারে না। কিন্তু হচ্ছে। আর আমাদের রাজনীতিবিদরাই তার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন। আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে যদি ঐকমত্য হতে পারতাম, তাহলে দাতারা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারতেন না। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে যে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, সরকার সেই আশঙ্কা দূর করতে পারেনি। এক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা এখানেই— বিরোধী দলগুলোকে তারা আশ্বস্ত করতে পারেনি দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন, তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। অনেক কারণে দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সরকারের দমননীতি কিংবা বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের আচরণ, সরকারের আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকার আগ্রহ, সরকারপ্রধানের বারবার তৃতীয় শক্তির ব্যাপারে প্রশ্ন রাখা ইত্যাদি কারণে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিয়ে একটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এটা সরকারের ব্যর্থতা। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকার বিরোধী দলকে আশ্বস্ত কিংবা নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানেই। আস্থার বড় অভাব। এই আস্থার অভাব যে আজই তৈরি হয়েছে, তা নয়। ইতিহাস বলে, বিরোধী দলের টানা হরতালের মুখে স্যার বিবিয়ানও বাংলাদেশে এসেছিলেন মধ্যস্থতা করার জন্য। সেটা ১৯৯৬ সালের কথা। তিনিও সফল হননি। যদিও এরপর অনেক নির্বাচন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আর প্রতিটি নির্বাচনই বহির্বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ওইসব নির্বাচনে বিরোধী দল ক্ষমতা পেয়েছে, আবার অন্য নির্বাচনে ক্ষমতা ছেড়েও দিয়েছে। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। আজ এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচনে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বর্তমান সরকার বিজয়ী হয়েছিল।

সুতরাং আজ যদি সরকারি ও বিরোধী দলের মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন না আসে, তাহলে কোনো জট খুলবে না। বান কি মুনের টেলিফোনেও কোনো ফল আসবে না। এতে বিদেশের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি আরো নষ্ট হবে। আজ সরকারেরও বুঝতে হবে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতা ধরে রাখার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। সংকট নিরসনে আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি ব্যর্থ হন, তা জাতিকে অনেক পিছিয়ে দেবে। আমরা শুধু প্রত্যাশা করতে পারি আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে।
হাইল্যান্ড ভিলেজ, ডালাস, ২৬ আগস্ট, ২০১৩
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক বণিক বার্তা, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৩।

সিরিয়ায় সীমিত আক্রমণ ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

সিরিয়ায় ‘সীমিত’ আক্রমণের বিষয়টি এখন বোধকরি একরকম নিশ্চিত। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এক বক্তব্যের পর মার্কিন মিডিয়ায় এখন দিনক্ষণ গোনা শুরু হয়ে গেছে কখন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে ক্রুস মিসাইল নিক্ষেপ করে এ আক্রমণ চালানো হবে। এরই মধ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে চারটি মার্কিন ডেসট্রয়ার এবং সাইপ্রাসের এক্রোটিরি ব্রিটিশ বিমানঘাঁটিতে বেশ কিছু ব্রিটিশ বিমান প্রস্তুত রাখা হয়েছে বিমান আক্রমণ পরিচালনার জন্য। বলা ভালো, সাইপ্রাসের এ বিমানঘাঁটি থেকে সিরিয়ার দূরত্ব মাত্র ১৫০ মাইল। সিরিয়ার বিরুদ্ধে সর্বশেষ যে অভিযোগটি উঠেছে তা হচ্ছে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার। অভিযোগ উঠেছে, সিরিয়ার সৈন্যরা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে প্রায় এক হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। এ অভিযোগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মৃত্যুর ঘটনাটি সত্য এবং জাতিসংঘের তদন্তকারী দল এর সত্যতা খুঁজে পেলেও তদন্তকারী দল বলেনি এ ঘটনাটি সিরিয়ার সৈন্যরাই করেছে। যদিও সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ঘটনায় সিরিয়ার সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে স্পষ্টতই এ হত্যাকাণ্ড বহির্বিশ্বে সিরিয়ার ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট করেছে। শুধু পশ্চিমা বিশ্বই নয়, বরং সৌদি আরব, উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো এবং তুরস্কও আজ সিরিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া এখন অনেকটা একা।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ২৯ মাস ধরে চলা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এখন এক নতুন দিকে টার্ন নিয়েছে। সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির অবনতি হল এমন একটা সময়, যখন মিসরে সেনাবাহিনী নির্বাচিত ইসলামপন্থী একটি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। এমনকি তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও ইরাকের পরিস্থিতিও টলটলায়মান। ‘আরব বসন্ত’ যে ব্যাপক প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছিল, সেই প্রত্যাশা এখন ফিকে হয়ে আসছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এ অঞ্চলে বৃহৎ শক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এর আগে তিন-তিনবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এ অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক বাহিনী কুয়েতকে ইরাকি বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করেছিল। ২০০৩ সালে ইরাকের কাছে মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে এ অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বাগদাদে মিসাইল হামলা চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করেছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০১১ সালে লিবিয়ায়। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ‘মানবতা রক্ষায়’ হস্তক্ষেপ করেছিল এবং গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এ ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে কুয়েতকে ইরাকি দখলমুক্ত করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের সাহায্য নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০০৩ ও ২০১১ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরাক ও লিবিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালাতে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। এবারও তেমনটি হতে যাচ্ছে।
লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে উৎখাতের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়েছিল ‘হিউম্যানিটারিয়ান ইন্টারভেনশনে’র তত্ত্বটি। আর এবার ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রোটেক্ট’ তত্ত্ব। এর মূল কথা হচ্ছে, মানবতা রক্ষায় বিশ্বশক্তির দায়িত্ব। যেহেতু সিরিয়ায় সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে(?), সেহেতু সাধারণ মানুষকে রক্ষায় পশ্চিমা শক্তি দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই এ সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে! এখানে বলা ভালো, সিরিয়ার ঘটনাবলী সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। জাতিসংঘ সনদে উল্লেখ আছে, একটি দেশ অপর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি এমন কোনো ঘটনার জন্ম হয় যে, সেখানে স্থিতিশীলতা ও গণহত্যা রোধে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে, তাহলে কাজটি করতে হবে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। ইরাকের (২০০৩) ক্ষেত্রে কিংবা লিবিয়ার ক্ষেত্রে (২০১১) এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়নি নিরাপত্তা পরিষদ। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা পরিষদ এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে এটা সত্য, আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রোটেক্টে’র একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি এবং এটা কোনো আন্তর্জাতিক আইনও নয়। এর অর্থ হচ্ছে, সিরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইন অনুমোদন করে না। যুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে অধ্যাপক গ্লেননের একটি বই রয়েছে- ‘লিমিটস অব ল’, প্রিরোগেটিভ্স অব পাওয়ার’। এ গ্রন্থে গ্লেনন উল্লেখ করেছেন, এ ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ।
বিশ্বশক্তি বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার স্বার্থ রয়েছে, সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। ‘মানবিক কারণে হস্তক্ষেপ’ কিংবা ‘মানবতা রক্ষায় দায়িত্বশীলতা’র যে যুক্তি সামরিক হস্তক্ষেপের প্রেক্ষাপট তৈরি করে, আফ্রিকার বরুন্ডি-রুয়ান্ডায় গণহত্যা বন্ধে কিংবা কসোভোতে গণহত্যা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা-বরুন্ডিতে হুতু-তুতসি দ্বন্দ্ব ও গণহত্যায় কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। কসোভোতে ১৯৯৯ সালে সার্বিয়ার জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের একপর্যায়ে, শেষের দিকে, ন্যাটোর বিমানবহর সার্বিয়ার সেনা ঘাঁটির ওপর বিমান হামলা চালালেও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এ সংকটে হস্তক্ষেপ করেনি। আজ সিরিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তা করতে যাচ্ছে। কারণ এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা ওয়াশিংটনে অবস্থিত একটি গবেষণা সংস্থা দ্য প্রোজেক্ট ফর দ্য নিউ অ্যামেরিকান সেঞ্চুরি কর্তৃক (১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত) প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ ‘গ্লোবাল ইউএস এম্পায়ার : রিবিল্ডিং অ্যামেরিকা’স ডিফেন্সেস- স্ট্রাটেজি, ফোর্সেস অ্যান্ড রিসোর্সেস ফর এ নিউ সেঞ্চুরি’ পড়ে দেখতে পারেন।
সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য বিমান হামলা ‘সীমিত’ সময়ের জন্য পরিচালিত হবে বলে বলা হচ্ছে। এ বিমান হামলা পরিচালিত হবে সিরিয়ার সেনাঘাঁটিকে কেন্দ্র করে এবং তা সীমাবদ্ধ থাকবে কয়েক দিন মাত্র। এ হামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে সিরিয়ার সরকারকে বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ‘শাস্তি’ দেয়া। এতে করে বাশার কতটুকু ‘শাস্তি’ পাবেন, তা এক ভিন্ন প্রশ্ন। এ হামলা নিঃসন্দেহে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীকে উৎসাহ জোগাবে। এমনকি এ বিমান হামলা যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট বাশারের ক্ষমতাচ্যুতিও বিচিত্র কিছু নয়। তবে এ হামলা সিরিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে নানা জটিলতা ও সংকট তৈরি করতে পারে। প্রথমত, এ যুদ্ধ শুধু যে সিরিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নয়। বরং এ যুদ্ধে লেবানন ও তুরস্ক জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে করে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার শরণার্থীদের মাঝে। বর্তমানে শরণার্থীর যে সংখ্যা পাওয়া গেছে, তা অনেকটা এ রকম : তুরস্কে ৪ লাখ, লেবাননে ৭ লাখ, বেক্কা উপত্যকায় ২ লাখ ৪০ হাজার, বৈরুতে ১ লাখ ৬০ হাজার, ইরাকে ১ লাখ ৫০ হাজার, জর্দানে ৫ লাখ, মিসরে ১ লাখ ১০ হাজার। এ শরণার্থীরা একটা বড় সমস্যা তৈরি করবে আগামীতে। দ্বিতীয়ত, সিরিয়া জাতিগতভাবে ভাগ হয়ে যেতে পারে। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার মতো পরিস্থিতি বরণ করতে পারে সিরিয়া। তৃতীয়ত, সিরিয়ায় আক্রমণ আগামীতে ইরানে সম্ভাব্য হামলায় মার্কিন নীতিনির্ধারকদের উৎসাহ জোগাতে পারে। চতুর্থত, এ ধরনের একটি হামলায় ইসরাইল খুশি হবে সবচেয়ে বেশি। ইসরাইলের স্বার্থ এতে করে রক্ষিত হবে। বলা ভালো, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে ইসরাইল আতংকিত। একই সঙ্গে সিরিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো নয় ইসরাইলের। পঞ্চমত, এ হামলার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল দেশগুলো। ষষ্ঠত, বাশারের অবর্তমানে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়বে বিদ্রোহীরা। আর তাতে করে সুবিধা নেবে আল-কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল নুসরা ফ্রন্ট ও ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সংগঠন দুটি। এরা এরই মধ্যে সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এই হামলা এ দুটি সংগঠনের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়া ও সাদ্দাম-পরবর্তী ইরাকে এ রকমটি আমরা লক্ষ্য করেছি।
সিরিয়ায় সম্ভাব্য মার্কিন আগ্রাসন সিরিয়া সমস্যার আদৌ কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। প্রেসিডেন্ট ওবামা শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের একটি সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবেন। এ সিদ্ধান্তটি তিনি হয়তো পাবেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি ‘যুদ্ধ’ বিশ্বে বিশেষ করে আরব বিশ্বে তার অবস্থানকে দুর্বল করবে। এক ধরনের ‘আমেরিকা বিদ্বেষে’র জš§ হবে এ অঞ্চলে। এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে। ‘আরব বসন্ত’ যে সম্ভাবনার জš§ দিয়েছিল, তার মৃত্যু ঘটবে। ‘যুদ্ধ’ সিরিয়া সমস্যার কোনো সমাধান নয়।
অস্টিন, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd-yahoo.com - See more at: http://jugantor.com/window/2013/08/31/24745#sthash.k7C4rLkN.dpuf

রাজনীতিতে চুলতত্ত্ব এবং বান কি মুনের টেলিফোন

হঠাৎ করেই রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘চুল’ নিয়ে আলোচনার পরিধি বেড়েছে। আর এর সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। প্রধানমন্ত্রী ১৮ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে জানালেন, ‘সরকার আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে এক চুলও নড়বে না।’ এর প্রতিক্রিয়ায় বেগম জিয়া বললেন ‘আন্দোলনের বাতাসে চুল তো থাকবেই না, অস্তিত্বও যাবে।’ মন্ত্রীরা চুল নিয়ে কথা বলবেন না, তা কি হয়! হঠাৎ মন্ত্রী হওয়া হাসান মাহমুদও চুল নিয়ে মন্তব্য করে বসলেন। আসলে প্রধানমন্ত্রী যা বলতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে আগামীতে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংবিধান অনুযায়ী। সংবিধানে যেভাবে নির্বাচনের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সরকার সেভাবেই নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আরো অনেক কথা বলেছেন, যা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচন পর্যন্ত সংসদ কার্যকর থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য ইতোমধ্যে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ফেসবুকে দেখলাম অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রে নির্বাচনের ব্যাপারে যে সমঝোতার সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল, তাতে এখন বড় ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলো। এরপর জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন দু’নেত্রীকে টেলিফোন করেন এবং চলমান রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে সবার অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের তাগিদ দেন। বান কি মুনের টেলিফোন নতুন আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন নির্বাচন পর্যন্ত সংসদ কার্যকর থাকবে, তখন বিতর্ক যে বাড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সংসদে দেয়া তার আগের বক্তব্য থেকে সরে এলেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছিলেন ২৫ অক্টোবরের পর সংসদ ভেঙে যাবে। প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো তারিখ নির্ধারণ করে দেন, তখন এই তারিখটি গুরুত্ব দিতে হয়। মানুষ দিয়েছেও। আমরাও দিয়েছি। তার এই বক্তব্যের পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে চলে এলো নির্বাচনের প্রশ্নটি। বিভিন্ন মহল থেকে বলাবলি হতে লাগল যে, ডিসেম্বরে অথবা জানুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। কেননা সংবিধানে বলা আছে সংসদ ভেঙে দিলে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। তাই ধারণাটা স্বাভাবিকই ছিল যে, নির্বাচন হবে ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে। এখন প্রধানমন্ত্রী বললেন নির্বাচন পর্যন্ত সংসদ কার্যকর থাকবে। এর ব্যাখ্যা কি? যদি জানুয়ারিতে নির্বাচন হয়, তাহলে কি সংসদ জানুয়ারি পর্যন্তই চালু থাকবে? ২৫ জানুয়ারি (২০১৪) পর্যন্ত বর্তমান সংসদের সময়কাল। জানুয়ারি পর্যন্ত সরকার থাকতেই পারে। এক্ষেত্রে জানুয়ারি পর্যন্ত যদি সংসদ চলে, তাহলে নির্বাচন হতে হবে এপ্রিলের ২৫ তারিখের মধ্যে। কিন্তু তা কি রাজনৈতিক দলগুলো চাইবে? প্রধানমন্ত্রী ২৫ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা ছিল যৌক্তিক। নির্বাচন পর্যন্ত সংসদ কার্যকর থাকলে নানা জটিলতা তৈরি হবে। ওই সময় পর্যন্ত যারা সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল থাকবেন, তারা নির্বাচনে প্রভাব খাটাবেন। বিশেষ করে যারা সরকারি দলের সংসদ সদস্য হিসেবে থাকবেন, তারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর প্রভাব খাটাবেন। তাতে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষে নির্বাচিত এমপিকে অস্বীকার করা কোনো মতেই সম্ভব হয়ে উঠবে না। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে তখন স্থানীয় এমপির চাপ অস্বীকার করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আমি এর আগের একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম বর্তমান রাজনৈতিক কাঠামোয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন নানা কারণে সরকারের ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয় প্রশাসনে নিয়োগ দেয় সরকার। তাদের ওপর নির্বাচন কমিশনের কোনো কর্তৃত্ব বা প্রভাব নেই। তারা স্থানীয় প্রশাসনকে কোনো নির্দেশও দিতে পারে না। স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রের জনপ্রশাসন। ইতোমধ্যে এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যাবেন। ফলে ওই সময় তার নেতৃত্বাধীন যে সরকার থাকবে, সেই সরকারের অধীনে যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থাকবে, তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসন। এক্ষেত্রে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে না। ইতোমধ্যে প্রশাসনে ব্যাপকভাবে রাজনীতি ঢুকে গেছে। সরকারের সামরিক জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রমোশন দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে যারা সরকারের ঠিক ‘বন্ধু নন’, এমন কর্মকর্তাদের ওএসডি অথবা ছাঁটাই করা হয়েছে। তাই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কাঠামোকে এভাবে রেখে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা আশা করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী নিজে এবং একাধিক মন্ত্রী প্রায়ই একটা কথা বলেন-পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, এভাবেই বাংলাদেশে নির্বাচন হবে। তারা প্রায়ই ভারতের দৃষ্টান্ত দেন। এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী তিন মাসের জন্য থাকেন বটে, কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ওই তিন মাস মূল ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। আর ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিংবা কমিশনাররা নিরপেক্ষতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা আমাদের কমিশনাররা পারেননি অতীতে; বরং দেখা গেছে তারা অনেকটা সরকারি কর্মচারীদের মতো আচরণ করে গেছেন। অতীতে এমনও দেখা গেছে ভারতের নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন কোনো কোনো মন্ত্রীকে নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন কি অতীতে কখনো এমন ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পেরেছে? বরং দেখা গেছে তারা সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরেও এক চুল যেতে পারেনি। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন আরপিওতে কিছু কিছু পরিবর্তন আনার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে রাজনৈতিক মহলে তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে যদি ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তুলনা করতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। ভারতের নির্বাচন কমিশন যেসব দৃষ্টান্তযোগ্য কাজ ইতোমধ্যে করেছে আমাদের নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কি এমন কোনো কাজ করা সম্ভব হয়েছে? সংসদে বিল আনতে হবে। কমিশনের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে হবে। নিজস্ব ক্যাডার তৈরি করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা যদি সাংবিধানিকভাবে শক্তিশালী করা হয়, যদি জেলা পর্যায়ের জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা জেলা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব খাটাতে না পারেন, তাহলেই সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু বর্তমান কাঠামোয়, তা সম্ভব নয়। তাই ভারতীয় তথা অন্যান্য দেশের দৃষ্টান্ত দেয়া অর্থহীন। বর্তমান সরকারের হাতে সুযোগ ছিল। যখন সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হলো এবং সংসদে পাস করা হলো, তখন সরকার নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে পারত। সরকার তা করেনি। এটা সত্য, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা যদি পুরোপুরি অনুসরণ করা হতো, তাহলে কোনো বিতর্ক উঠত না। কিন্তু সরকার তো তা করেনি। আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় আয়োজন করারও সুপারিশ ছিল উচ্চ আদালতের। সরকার সেদিকে যায়নি। সরকার সংবিধানে সংশোধনী আনার জন্য যে কমিশন গঠন করেছিল, তারা নীতিগতভাবে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন-এমন একটি সংবাদ পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সরকারপ্রধানের ইচ্ছার কারণে তা নাকি বাদ দিতে হয়েছিল। এমনকি সংবিধানে সংশোধনী আনার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। প্রধান বিরোধী দলের কোনো মতামত গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া হয়নি। ফলে সংবিধানে যে পরিবর্তন, পরিবর্ধন তা একতরফাভাবে হয়েছে। ঐকমত্যভাবে সংবিধানে সংশোধনী আনা হলে আজকের পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। এখন ক্ষমতাসীন সরকারকে এবং প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান রেখে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। নির্বাচনের মতো একটি বিষয়ে যদি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই এবং তাতে সংকট বাড়বেই।
আমাদের দুর্ভাগ্য একটাই-নির্বাচন এলেই দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা তৎপর হয়ে ওঠেন। অতীতেও এমনটি পরিলক্ষিত হয়েছে। বিএনপির জমানায় তথাকথিত ‘টুয়েস ডে ক্লাবের’ তৎপরতার খবর আমাদের অনেকেরই জানা আছে। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করত। এখন দশম সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের তৎপরতা আবার শুরু হয়েছে। নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এদেশের জনগণ। এক্ষেত্রে বাইরের হস্তক্ষেপ বা পরামর্শ কাম্য হতে পারে না। কিন্তু হচ্ছে। আর আমরা, আমাদের রাজনীতিবিদরাই তার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন। আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে যদি ঐকমত্য হতে পারতাম, তাহলে দাতারা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারতেন না। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সরকার সেই আশঙ্কা দূর করতে পারেনি। এক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা এখানেই যে, বিরোধী দলগুলোকে তারা আশ্বস্ত করতে পারেনি, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। তবে এখন অনেক কারণের জন্য দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রথমত, সরকারের দমননীতি। সরকার যেভাবে বিরোধী দলের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে, তাতে বিরোধী দলের পক্ষে এটা ভাবা স্বাভাবিক যে, সরকার বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। তাদের কর্মকাণ্ডে সীমিত করতে চায়। উপরন্তু বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা এটাই প্রমাণ করে গণতন্ত্রে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার যে সম্পর্ক থাকা দরকার, তা নেই। সরকারের ব্যর্থতা এখানেই যে, তারা সেই আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে পারেনি। বিরোধী দলকে আস্থায় না নিয়ে যে দমননীতি গ্রহণ করেছে তা দশম সংসদ নির্বাচনে সরকারের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন একটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। বাংলাদেশ যখন এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, তার প্রায় ১৭ বছর পর বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পাকিস্তান ও নেপাল এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। এমনকি গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত গ্রিসেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইউরোপের অপর একটি দেশ বুলগেরিয়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো সংশোধন করে এই ব্যবস্থাকে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারত, কিন্তু সরকার তা করেনি। ফলে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। সংবিধান এমন কোনো দলিল নয় যে, এটা পরিবর্তন করা যাবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে ঐকমত্য থাকা দরকার। উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই। তৃতীয়ত, একটি তত্ত্বাবধায়ক তথা ‘তৃতীয় শক্তির’ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন। তিনি আকার-ইঙ্গিতে সেনাবাহিনীর কথা বলতে চেয়েছেন। তার এই ধারণা ভুল। সেনাবাহিনী এখন যথেষ্ট ‘প্রফেশনাল।’ তারা সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ। তাদের দ্বারা কোনো অসাংবিধানিক কাজ হবে বলে মনে হয় না। চতুর্থত, সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। নষ্ট হওয়া ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সরকারের। পঞ্চমত, পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে সরকার প্রমাণ করতে চাইছে যে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, কিন্তু এটাও ভুল ধারণা। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। সিটি কর্পোরেশনে মিডিয়ার উপস্থিতি ছিল সরব। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে তিনশ’ আসনে মিডিয়ার উপস্থিতি সম্ভব নয়। ষষ্ঠ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যানারে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় থেকে যাওয়া জনমনে এমন একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়। এই প্রবণতা একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে! ভবিষ্যতে বিরোধী দল যদি ক্ষমতায় আসে, তারাও সংবিধানের কাটছাঁট করে নিজেরা ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করবে। এটা গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের দোহাই দিয়ে এক চুলও সরে না যাওয়ার যে বক্তব্য দিলেন তা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো ভালো খবর নয়। এতে দুটি বড় দলের মাঝে অবিশ্বাস আরো বাড়বে। সংকটের গভীরতা আরো বাড়বে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একদলীয় শাসন কায়েম করার যে অভিযোগ, সেই অভিযোগ আরো শক্তিশালী হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার প্রতিবাদে ১৮ দলীয় জোট যদি বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলে কিংবা যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বয়কট করে তা বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য হবে ছুরিকাঘাতের শামিল। যারা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বাস করেন, তারা এটা মনে করতেই পারেন যে, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা। তাতে সরকারের লাভ একাধিক। এককভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যাওয়া। সেই সঙ্গে বিএনপির বিভক্তিকে ত্বরান্বিত করা। বিএনপি নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিলে একটা অংশ বিএনপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট (বিএনএফ) নামে একটি নয়া দলের অনুমোদন প্রক্রিয়া এখন চূড়ান্ত। বিএনপির বিকল্প হিসেবে বিএনএফ যদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মপ্রকাশ করে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা চলমান সংকটে কোনো সমাধান বয়ে আনবে না; বরং দেশে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে, যা আমাদের জন্য আদৌ কোনো ভালো খবর নয়। জাতিসংঘের মহাসচিব আমাদের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে যে ভূমিকা ইতোমধ্যে রাখলেন তা শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবে তা এখনই বলা মুশকিল। কিন্তু আমাদের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য আমাদেরই ভাবতে হবে, অন্যদের ভাবনা মুখ্য নয়। আমাদের সমস্যা-সংকটের নিরসন করতে
হবে আমাদেরই।
দৈনিক মানবকন্ঠ, ২৭ আগস্ট ২০১৩।
ডালাস, ২০ আগস্ট ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনৈতিক বিশ্লেষক





কোন পথে মিসর?

মিসরে গণহত্যার পর যে কথাটা এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে, তা হচ্ছে কোন পথে যাচ্ছে এখন মিসর। কিংবা সেখানে আদৌ কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে? যে দেশটিতে দীর্ঘ ৬১ বছর সেনাবাহিনী পরোক্ষভাবে শাসন করেছে, সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম হলেও ৩ জুলাইয়ের সামরিক অভ্যুত্থান গণতন্ত্র বিকাশের সব সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়েছে। এখানে সেনাবাহিনী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, তা আদৌ মনে হয় না। প্রায় সাড়ে ৮০০ মানুষ হত্যা করে সেনাবাহিনী বিশ্ববাসীকে একটা মেসেজই দিল- আর তা হচ্ছে ইসলামপন্থী ইসলামিক ব্রাদারহুডের কাছে তারা আর ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে না। প্রেসিডেন্ট ওবামা গণহত্যার নিন্দা করলেও মিসরে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য বন্ধ করেননি। সম্ভবত মার্কিন প্রশাসনের কাছে ড. মুরসির চেয়ে সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের গুরুত্ব অনেক বেশি। ওই সেনা অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলি লবিরও একটা যোগসাজশ আছে। মুরসির অতিমাত্রায় ইসলামপ্রিয়তা তেলআবিব ও ওয়াশিংটনে ভুল সংবাদ পৌঁছে দিয়েছিল। ভয়টা ছিল সেখানেই, শরিয়াভিত্তিক সংবিধান প্রণীত হওয়ায় মিসর একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যা তেলআবিব একটি বড় হুমকি বলে মনে করে। অন্যদিকে ওয়াশিংটনের ভয়টা ছিল, সেখানে ইসলামপন্থীদের উত্থান এই অঞ্চলজুড়ে ইসলামিক শক্তিকে আরো শক্তিশালী করবে এবং ভবিষ্যতে ইরানের ইসলামিক শক্তির সঙ্গে তাদের সহাবস্থান এ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। তাই মুরসিকে উৎখাতের মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটন ও তেলআবিবে এক ধরনের 'স্বস্তি' ফিরে এসেছে। তবে ভয়টা হচ্ছে এখানেই, একটি ইসলামিক সংস্কৃতিনির্ভর দেশে যে পশ্চিমা গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না, এটাই প্রমাণিত হলো। ইসলামপন্থীরা বারবার বলে আসছিলেন, ইসলাম আর গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না। এখন ইসলামপন্থীরা এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন নেতা এসাম এল হাদ্দাদ তো স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন The message will resonate throughout the Muslim world loud and clear : democracy is not for Muslim. শঙ্কাটা তাই রয়েই গেল। মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্র যদি ব্যর্থ হয়, তার অর্থ কী? ১৯৯১ সালে আলজিরিয়ায় ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৯৫ সালে তুরস্কে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের কাছে ক্ষমতা দেয়নি। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনে হামাস নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল, কিন্তু ক্ষমতা পায়নি। কোনদিকে তাহলে যাবে এখন মিসর?
মিসর কি আরেকটি আফগানিস্তানে পরিণত হতে যাচ্ছে? এই সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে মিসরে ইসলামী জঙ্গিবাদী সংগঠন 'আল গামা আল ইসলামিয়া' কর্তৃক প্রচারিত একটি বিবৃতির পর। সংগঠনটি অভিযোগ করেছে যে মিসরকে আরেকটি আফগানিস্তান বানানোর লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র করে একটি ইসলামপন্থী সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। জঙ্গিবাদী আল গামা আল ইসলামিয়ার বিবৃতিটি যখন প্রচারিত হয়, ঠিক তখনই আল-কায়েদার নেতা জওয়াহিরির একটি বিবৃতিও ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়েছে। জওয়াহিরি মুরসির উৎখাতের পেছনে সেনাবাহিনী, ইহুদিবাদ, খ্রিস্টান তথা যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। স্পষ্টতই মিসর নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের শঙ্কা অনেক। কী হতে যাচ্ছে মিসরে- এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। বাস্তবতা হচ্ছে ৩ জুলাই সেনাবাহিনী মুরসিকে উৎখাত করার পর এখন পর্যন্ত সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। এরই মধ্যে কায়রো সফর করেছেন মার্কিন দূত উইলিয়াম বার্নস ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিশনার এসটন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, লেডি এসটন ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে বাস্তবতা ও নয়া প্রেসিডেন্টকে মেনে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু মুরসি তাতে রাজি হননি। মুরসির সমর্থকরা কায়রোর একটি মসজিদ দখল করে সেখানে অবস্থান করছিলেন। প্রতি শুক্রবার তারা বড় বিক্ষোভের আয়োজন করে। এদিকে নয়া সরকারের পক্ষে জনসমর্থনও বাড়ছে। তারাও সেনাবাহিনীর সমর্থনে বিক্ষোভ করছে। সুতরাং মিসর নিয়ে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। নয়া সরকার আগামী ২০১৪ সালে একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, তার আগে সংবিধান সংশোধন করাসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। একটি সাংবিধানিক পরিষদও গঠন করা হয়েছে, যারা সংবিধান সংশোধন করবে। একটি সমঝোতার উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এই সমঝোতার উদ্যোক্তা। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থান ও গণহত্যা মিসরের সমাজে যে বিভক্তি ডেকে এনেছে, তা অপসারিত হবে কিভাবে? একদিকে ইসলামপন্থী, অন্যদিকে সেক্যুলারপন্থী, যাদের সঙ্গে মিলেছে লিবারেলরা ও ডেমোক্রেটরা- এই পরস্পরবিরোধী দুই শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান আদৌ হবে কি?
মিসরের সেনা অভ্যুত্থান ও গণহত্যার পর বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। যে প্রশ্নটা এখন উঠেছে, তা হচ্ছে মিসর কি আদৌ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত? সামরিক শাসকরা যে মিসরের সমাজে একটি বড় 'রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি', তার ইতিহাস তো শুধু মুরসিকে উৎখাত করার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হলো না। বলা যেতে পারে, মিসরের সেনাবাহিনী গত ৬১ বছরে যেভাবে বিকশিত হয়েছে, তাতে এই সমাজ সামরিক বাহিনীনির্ভর একটি সমাজে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তা প্রতিটি ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্তৃত্ব রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান সে দেশে অলিখিতভাবে 'ছায়া রাষ্ট্রপতি', আর লিখিতভাবে দেশরক্ষামন্ত্রী। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন একটি পরিষদ 'কিচেন ক্যাবিনেট' হিসেবে কাজ করে। এটা আগেও ছিল। এখনো আছে। এমনকি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ও জনগণের ভোটে মুরসি সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও, তিনি সেনাবাহিনীর এই প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। 'প্রেসিডেন্ট' মুরসি নিজে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসিকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। সেনাপ্রধান হিসেবে দেশরক্ষামন্ত্রীও ছিলেন জেনারেল সিসি মুরসির শাসনামলে। যে নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল, সেখানে মুরসির কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছিলেন জেনারেল সিসি। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের জুলাই- মাত্র দুই বছর সময় নিয়েছিল সেনাবাহিনী। এই দুই বছরে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুতির ব্যাপারে তারা যে যুক্তি দেখিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস, যাদের ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করে, তাদের সমর্থন দিয়েছিলেন মুরসি। এই যুক্তিতে তার 'বিচার' হয়েছে এবং ১৫ দিনের 'জেল' হয়েছিল। স্পষ্টতই বলা যায়, জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসি হতে যাচ্ছেন মিসরের পরবর্তী 'নেতা'। ইতিহাস বলে মিসরের ফারাওরা (অর্থাৎ শাসক, বাদশাহ, রাজা) যেভাবে সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে করায়াত্ত করে রেখেছিলেন, আজকের যুগে মিসরে সেনাবাহিনী সেই ক্ষমতাই পালন করতে যাচ্ছে। মাঝখানে পাঁচ হাজার বছর চলে গেলেও, মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
মিসরে গণহত্যার পর এটা এখন স্পষ্ট যে জেনারেল সিসি ক্ষমতা ছাড়ছেন না। ওবামা 'মৃদু' সমালোচনা করলেও, সামরিক সাহায্য মিসরে বন্ধ করেননি। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ জাতিসংঘও মিসরের ব্যাপারে কোনো কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। ফলে পরোক্ষভাবে তা জেনারেল সিসির হাতকেই শক্তিশালী করছে। জেনারেল সিসির পূর্বসূরিরা দল গঠন করে ক্ষমতা করায়ত্ত করেছিলেন। ১৯৫৩-৫৬ সালে নাসের গঠন করেছিলেন 'লিবারেশন র‌্যালি'। ১৯৫৭-৭০ সময়সীমায় গঠিত হয়েছিল 'ন্যাশনাল ইউনিয়ন'। উভয় ক্ষেত্রেই 'লিবারেশন র‌্যালি' ও 'ন্যাশনাল ইউনিয়ন' একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। ১৯৭১ সালে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদাত গঠন করেছিলেন 'আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন'। আর হোসনি মোবারকও একই পথ অনুসরণ করে গেছেন। আর এখন জেনারেল সিসি যে একই পথ অনুসরণ করবেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এতে মিসরে ক্ষমতাসীন জেনারেলরা হয়তো ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন। কিন্তু মিসরে একটি বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার জন্ম দেবে। মিসরের অর্থনীতি এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম এই ক্ষমতার পালাবদলে কোনো আশার আলো দেখছে না। মিসরে ২০০৮ সালে যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে তা ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলার। মিসর নিয়ে তাই ভয় রয়েই গেল। আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর তৎপরতা বাড়ছে। আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির হুমকি স্মরণ করিয়ে দিল আল-কায়েদা ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছে। কলম্বিয়া (নিউ ইয়র্ক) বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ডিন অধ্যাপক স্টিভ কোলও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা করায়ত্ত করা মিসরে সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিতে পারে এবং তা আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ধরনের একটি মন্তব্যকে হালকাভাবে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। জঙ্গীবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে আরব বিশ্বে। লন্ডনের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট প্রশ্ন রেখেছে, 'আরব বসন্ত' কী শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে চলেছে? ১৩-১৯ জুলাইয়ের (২০১৩) সংখ্যায় বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে 'আরব বসন্ত'-এর ব্যর্থতার! মিসরের সামরিক অভ্যুত্থান ও পরবর্তী সময়ে ব্যর্থতা মিসরের ভবিষ্যৎকে একটা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিল। আগামীতে মিসর একটি গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করবে কি না, সেটিই দেখার বিষয় এখন।
দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৭ আগস্ট ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

মার্টিন লুথার কিংয়ের স্বপ্ন ও আজকের যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে যারা অতীতে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন মার্টিন লুথার কিং। আজ ২৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র তাকে আবার স্মরণ করবে। ১৯৬৩ সালের ২৬ আগস্ট ওয়াশিংটনের লিংকন মেমোরিয়াল প্রাঙ্গণে মার্টিন লুথার কিং তার সেই বিখ্যাত ভাষণটি দিয়েছিলেনÑ ‘ও যধাব ধ ফৎবধস’, আমার একটি স্বপ্ন। তার সেই ভাষণের ৫০ বছর পালন করবে যুক্তরাষ্ট্র। ইতিমধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে। প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে দেয়া মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই ভাষণের কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? মার্টিন লুথার কিং যেন একজন কবি! কবিতার ভাষায় বলছেন তার স্বপ্নের কথা। বলছেন, একদিন কৃষ্ণাঙ্গরা, যারা দাস হিসেবে এ দেশে এসেছিলেন, তাদের সন্তানরা এবং শ্বেতাঙ্গরা সবাই মিলে এ দেশকে গড়ে তুলবে। হাতে হাত রেখে একসঙ্গে বেড়ে উঠবে। এই একটি ভাষণের জন্য মার্টিন লুথার কিং ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন। তার নাম আজ একই সঙ্গে উচ্চারিত হয় জর্জ ওয়াশিংটন, জেফারসন কিংবা লিংকনের সঙ্গে। সেই বিখ্যাত ভাষণের ৫০ বছর পর টাইম ম্যাগাজিন তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছে (আগস্ট ২৬, ২০১৩)। তাকে বলা হচ্ছে ‘একুশ শতকের রূপকার’। তাকে নিয়ে লিখেছেন অনেকেইÑ জেসি জ্যাকসন, কলিন পাওয়েল থেকে শুরু করে মালালা ইউসুফজাই পর্যন্ত। মালালা লিখেছে, কীভাবে মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই বিখ্যাত উক্তি তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
অহিংস পথে লুথার কিং কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায় করতে চেয়েছিলেন। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা মার্টিন লুথার কিং ১৯৫৯ সালে ভারতেও এসেছিলেন গান্ধীর অহিংস নীতি সম্পর্কে ধারণা নিতে। অহিংস পন্থায় অধিকার আদায়ে তার এই সংগ্রামের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাকে শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। শুধু তাই নয়, ১৯৭৭ সালে তাকে মরণোত্তর ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল ফর ফ্রিডম’ এবং ২০০৪ সালে ‘কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য মার্কিন জাতিরÑ যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না, সবাই একসঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্রকে গড়ে তুলবে, তাকেই কিনা শ্বেতাঙ্গ জেমস আর্ল রয়ের গুলিতে প্রাণ দিতে হয় ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল।
মার্টিন লুথর কিং জীবদ্দশায় বৈষম্য কমিয়ে আনার সংগ্রাম করলেও এবং জীবন দিলেও মার্কিন সমাজে বৈষম্য কি কমেছে? ১৯৬৩ সালের বিখ্যাত ‘মার্চ অন ওয়াশিংটনে’র পর ৫০ বছর পার হতে চলেছে। কিন্তু বৈষম্য পুরোপুরি দূর হয়েছে, এটা বলা যাবে না। তবে নিঃসন্দেহে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। ১৯৬০ সালে মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ যেখানে ছিল শতকরা ১১ ভাগ, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৪ ভাগ। ১৯৬০ সালে প্রায় ১৫৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ছিল ১৭.০৫ মিলিয়ন। এখন ২৫১ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ৪৫ মিলিয়ন। তারা সবচেয়ে বড় এথনিক গ্র“প নয়। বর্তমানে মার্কিন জনগোষ্ঠীর বড় অংশ হচ্ছে লাতিনো অথবা হিসপানিক, ৫৪ মিলিয়ন। শিক্ষাক্ষেত্রে দেখা গেছে ১৯৬৭ সালে স্কুল ত্যাগকারী কৃষ্ণাঙ্গদের হার যেখানে ছিল শতকরা ২৯ ভাগ, ২০১১ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ৭ ভাগে। অথচ একই সময় শ্বেতাঙ্গদের স্কুল ত্যাগের হার ছিল ১৫ ভাগ (১৯৬৭), আর এখন ৫ ভাগ। ১৯৬০ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ব্যাচেলর ডিগ্রি গ্রহণকারীদের হার ছিল ৪ ভাগ (শ্বেতাঙ্গ ৮ ভাগ), ২০১২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২১ ভাগ, আর শ্বেতাঙ্গদের এ হার ৩৫ ভাগ। তবে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার হার বেশি। পরিসংখ্যান বলে, কারাগারে অবস্থানকারী কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর হার ৩৭ ভাগ, এর মধ্যে ৪২ ভাগ আবার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। কিশোর অপরাধীর হার (কৃষ্ণাঙ্গ) শতকরা ৩২ ভাগ। পরিসংখ্যান বলে, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার কমেছে। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল শতকরা ৪১ ভাগ, সেখানে বর্তমানে এই হার ২১ ভাগ। অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে মেইন-এ কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বেকারত্বের হার বেশি, শতকরা ২১ ভাগ, আর দারিদ্র্যের হারও বেশি ৪৬ ভাগ। মিসিসিপি যুক্তরাষ্ট্রের দরিদ্রতম রাজ্য। অথচ সেখানে শতকরা ৫৭ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। নিউইয়র্কে সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণাঙ্গ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এ সংখ্যা ২,০৪০৩২। আয়ের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের গড় আয় যেখানে বছরে ২১ হাজার ডলার, সেখানে শ্বেতাঙ্গদের আয় ২৭ হাজার ডলার। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও পিছিয়ে আছে। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যেখানে শতকরা ৭ জন শ্বেতাঙ্গ বেকার, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে এ হার শতকরা ১৫ জন। এই পরিসংখ্যান শুধু পুরুষদের জন্য। কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের মধ্যে বেকারত্বের হার শতকরা ১৩ ভাগ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৩ ভাগ। আর ৬০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে বেকারত্বের হার মাত্র ৯ ভাগ। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা গেছে শতকরা মাত্র ৭ ভাগ ব্যবসা রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে (২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী)। যদিও ১৯৬১ সালের হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা তিনগুণ বেশি। তবে নিজস্ব বাড়ি নেই অনেক কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের। পরিসংখ্যান বলছে, শতকরা ৭০ ভাগ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান যেখানে নিজস্ব বাড়ির মালিক, সেখানে শতকরা মাত্র ৪৫ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। ১৯৬০ সালে একজন কৃষ্ণাঙ্গ বেঁচে থাকতেন গড়ে ৫০ বছর। এখন বাঁচেন ৭২ বছর। তুলনামূলকভাবে শ্বেতাঙ্গদের বেঁচে থাকার গড় ৭৭ বছর (১৯৬০ সালে ৬৮)। তবে শ্বেতাঙ্গ মহিলারা বাঁচেন বেশি দিন, ৮১ বছর (কৃষ্ণাঙ্গ মহিলারা ৭৮ বছর)। স্বাস্থ্য সচেতনতার দিক থেকে কৃষ্ণাঙ্গরা যে কতটা পিছিয়ে আছে, তা জানা যায় আরেকটি পরিসংখ্যান থেকে। প্রতি এক লাখ আমেরিকানের মধ্যে ২৩৩ জন কৃষ্ণাঙ্গ যেখানে মারা যায় হƒদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে, সেখানে শ্বেতাঙ্গ মারা যায় ১৮২ জন। ডায়াবেটিস, ব্রেস্ট ক্যান্সার, আÍহত্যার ক্ষেত্রে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৪০, ১৮ ও ৫ জন (কৃষ্ণাঙ্গ) এবং ১৯, ১২ ও ১৩ জন (শ্বেতাঙ্গ)। এখানে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে আÍহত্যার প্রবণতা বেশি। প্রশাসনে ও রাজনীতিতেও বড় ধরনের বৈষম্য রয়েছে। ১৯৬৩ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কংগ্রেসের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে (মোট সদস্য ৪৩৫ জন) মাত্র ৫ জন সদস্য ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। একজনও সিনেটর ছিলেন না (মোট সদস্য ১০০ জন)। ৫০ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্য থেকে ৪৩ জন হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের সদস্য পেয়েছে, একজন সিনেটর পেয়েছে, একজন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে। যদিও বারাক ওবামাকে পুরোপুরি কৃষ্ণাঙ্গ বলা যাবে না। ওবামার মা ছিলেন শ্বেতাঙ্গ, আর বাবা আফ্রো-আমেরিকান (কেনিয়ান)।
এই পরিসংখ্যান কতটুকু আশার কথা বলে? মাটির্ন লুথার কিংয়ের স্বপ্ন কতটুকু পূরণ হয়েছে? মার্কিন সমাজে এখন কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে যে বৈষম্য নেই, তা বলা যাবে না। দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবেও পার্থক্য রয়েছে। আগস্টের প্রথম দিকে সিমারম্যান নামে এক কিশোরের মৃত্যুর ঘটনায় (নিউইয়র্ক) অভিযুক্ত একজন শ্বেতাঙ্গ নাগরিককে অভিযুক্ত করেনি জুরি বোর্ড। অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রকাশ্যে গুলি করে মেরেছিল কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরকে। তারপরও তাকে অভিযুক্ত করা হয়নি। এ ঘটনায় মার্কিন সমাজে বৈষম্যের বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। টাইম ম্যাগাজিন একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। তাতেও কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৫ জন কৃষ্ণাঙ্গ উত্তরদাতা সিমারম্যানের বিচারের ঘটনায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। অথচ শতকরা ৪৯ জন শ্বেতাঙ্গ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তারা সন্তুষ্ট। প্রশ্ন করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। শতকরা ৬৮ জন কৃষ্ণাঙ্গ উত্তরদাতা মনে করেন, বিচার বিভাগ কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যাপারে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’। শতকরা ২৫ জন শ্বেতাঙ্গ তা মনে করেন না। ৫৩ জন কৃষ্ণাঙ্গ মনে করেন, জনসাধারণের অধিকার সংক্রান্ত আইনে আরও পরিবর্তন দরকার, যাতে বৈষম্য কমানো যায়। ১৭ ভাগ শ্বেতাঙ্গ অবশ্য তা মনে করেন না।
সুতরাং যে ‘স্বপ্নের’ কথা মার্টিন লুথার কিং শুনিয়েছিলেন, তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে, তা বলা যাবে না। অগ্রগতি কিছুটা হয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এখনও যেতে হবে অনেক দূর। একদিন যে ‘কালো মানুষ’রা এ দেশে দাস হিসেবে এসেছিল, তারা, তাদের পরবর্তী প্রজš§ এখনও মূলধারায় পুরোপুরিভাবে মিশে যেতে পারেনি। ইতিহাস বলে ১৬২০ থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে ২১ হাজার কৃষ্ণাঙ্গকে ক্রীতদাস হিসেবে আফ্রিকা থেকে মার্কিন মুল্লুকে আনা হয়েছিল। ভার্জিনিয়ার জেমসটাউনে হল্যান্ডের দাস ব্যবসায়ীরা প্রথম ১৯ জন দাসকে এনেছিল তামাক ক্ষেতে কাজ করানোর জন্য। সময়টা ১৬১৯। সেই থেকে শুরু। তারপর অনেক সময় পার হয়ে গেছে। ১৮৬০ সালে আব্রাহাম লিংকন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দাস ব্যবস্থা বন্ধের উদ্যোগ নেন। আর ১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে দাস ব্যবস্থা নিষিদ্ধ হয়। তবে এটা তো ঠিক, ১৭৭৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে দাস ব্যবস্থা স্বীকৃত ছিল। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, প্রায় ৪০ লাখ মানুষ আফ্রিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল, যাদের দাস হিসেবে ‘বিক্রি’ করা হয়েছিল। ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা এই দাস পরিবারেরই সন্তান।
মার্কিন লুথার কিং ‘আধুনিক কালের দাসদের’ মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন কালো মানুষদের স্বীকৃতি। চেয়েছিলেন কালো মানুষদের সামাজিক নিরাপত্তা। চেয়েছিলেন সাদা আর কালো মানুষদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। সবাই সমান, সবাই এক- যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে এই সমতা আর ভ্রাতৃত্ববোধের কথাই বলা হয়েছে। তবে ‘একতা আর অধিকারে’র যে আহ্বান মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৩ সালে জানিয়েছিলেন, তার পূর্ণ বাস্তবায়ন আজও হয়নি। তাই অধিকার আন্দোলনের অপর নেতা জেসি জ্যাকসনের ভাষায় বলতেই হয়, ‘ডব’াব মড়ঃ ঃড় শববঢ় সধৎপযরহম’। আন্দোলন চলবেই।
হাইল্যান্ড ভিলেজ, ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd-yahoo.com

সঙ্কটের গভীরতা ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

কথাটা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, সংবিধানের বাইরে তিনি যাবেন না। আর সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। আর এর প্রতিক্রিয়ায় বেগম জিয়াও অনেকটা হুমকির সুরে বলেছেন, আন্দোলনের মুখে সরকারি দল তার অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলবে...। এ ধরনের বক্তব্য ও পাল্টা বক্তব্যের সঙ্গে আমরা মোটামুটি পরিচিত। গত বেশ কিছুদিন ধরেই দল দুটোর নেতারা এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করে রাখছেন। এতে করে বাড়ছে উত্তেজনা।

গত ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী যখন সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, তখন তিনি ছিলেন স্পষ্ট। তার ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ দেখে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, তিনি বিরোধী দলের ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ ব্যাপারে এতটুকুও ছাড় দিতে নারাজ। অর্থাৎ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবেই তিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু রাজনৈতিক ময়দানে এখন নানা প্রশ্ন। সরকারের একের পর এক সিদ্ধান্ত দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খান শুভর গ্রেফতারের রেশ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি সরকার। ওই ঘটনা সরকারের সুনাম বয়ে আনেনি। দীর্ঘদিন পর হেফাজতের জমায়েতে সত্যিকার অর্থে কতজন মানুষ মারা গিয়েছিল, সে প্রশ্নটা উঠে এসেছে আবার। জামায়াতের ইসিতে নিবন্ধন বাতিল ঘোষিত হয়েছে উচ্চ আদালতে। আপিল করেছে জামায়াত। দল হিসেবে জামায়াত থাকবে কি থাকবে না, এটা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। আদালতের এই রায় সরকার তার স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, এমন অভিযোগও উঠেছে। নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ থাকলেও, নির্বাচন কমিশন তথাকথিত সংস্কারের নামে নিজেরাই অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। যেখানে নির্বাচন কমিশন তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য একটা উদ্যোগ নিতে পারত, সেখানে তা না করে একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কেউই সমর্থন করেনি। সুতরাং নির্বাচন নিয়ে মানুষের মাঝে শঙ্কা বাড়ছে। ২৫ অক্টোবর সংসদ আদৌ ভেঙে যাবেÑ এমন সম্ভাবনাও কেউ আর দেখছেন না।

নির্বাচন কমিশন যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করেছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতটুকু? তারা মোট ৪১টি সংশোধনী প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ইসি যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নির্বাচনী ব্যয় ১৫ লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকায় বাড়ানো, নির্বাচনবিধি ভঙ্গ করলে শাস্তি কমানো, স্বতন্ত্র সদস্যদের জন্য শতকরা এক ভাগ ভোটারের পূর্ব স্বাক্ষর গ্রহণ প্রযোজ্য না করা, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থীপদ বাতিলের ব্যাপারে দলীয় প্রধানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, নির্বাচন কমিশনের প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রহিত করা ইত্যাদি। ইসি আরপিওর ৯১ ধারা বাতিলের যে প্রস্তাব করেছে, তা শুধু বিতর্ককে উস্কেই দেবে না, কমিশন যে সরকারের মুখাপেক্ষিÑ এই অভিযোগকে আরও শক্ত করবে।

আরপিও’র ৯১ই(২) ধারায় আছে, আচরণবিধি ভঙ্গের অপরাধে কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলে এবং সেখানে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে ওই আসনে নির্বাচন বন্ধ থাকবে। পরবর্তীকালে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই ধারায়। বর্তমান কমিশন এই ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে। তারা প্রস্তাব করেছে, কোনো প্রার্থীর প্রার্থীপদ বাতিল হলে, ওই আসনে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে তাকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হবে। এর অর্থ কী? যে কোনো প্রক্রিয়ায় যদি বিএনপি তথা ১৮ দলীয় প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়, তাহলে সরকারি দলীয় সদস্যকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা সহজ হবে। এখন ইসির সংশোধনী প্রস্তাবটি বিতর্কিত হওয়ায় ইসি পুরো ৯১ ধারাই বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে তো প্রশ্ন থেকেই যায়, ইসি কার স্বার্থে এ ধরনের একটি প্রস্তাব এনেছিল? দল নিবন্ধন কিংবা স্বতন্ত্র সদস্যদের ব্যাপারে আরপিওতে যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তাও বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সুতরাং ইসির কর্মকা- যে বিতর্কের সৃষ্টি করবে, এটা বলাই বাহুল্য। নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক মাস। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধীপক্ষ পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান নিয়েছে। ঠিক এমন একটি সময় নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংস্কারের উদ্যোগ ‘রাজনীতির আগুনে’ ঘি ঢেলে দেয়ার শামিল। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এই মুহূর্তে এর আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর চেয়েও নির্বাচন কমিশনের আরও অনেক কাজ বাকি। কমিশন সেসব ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো করত।

সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই একটা কথা বলা হয়, তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা! আমাদের মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলতে ভালোবাসেন। আমাদের সংবিধানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কি আদৌ স্বাধীন? বর্তমান প্রেক্ষাপটে ওই নির্বাচন কমিশন দিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা কি সম্ভব? এর জবাব হচ্ছে, এক কথায় ‘না’। যে কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই বিতর্কিত হয়ে যায়, সেই কমিশন দিয়ে কোনো মতেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করা যায় না। তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন কমিশন যদি সরকারের প্রভাবের বাইরে থেকে নিজের ক্ষমতাবলে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কী?

নির্বাচন কমিশন কাগজে-কলমে স্বাধীন। নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব এখনও বহাল। বলা হয়, ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করে। কথাটার পেছনে সত্যতা আছে। কিন্তু এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন সব ক্ষমতা ভোগ করে। নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কোনো ক্ষমতা থাকে না। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকেন বটে; কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ওই তিন মাস মূল ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। তারা কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়নসহ বিধিভঙ্গের অভিযোগে মন্ত্রীদের, সাবেক মন্ত্রীদের গ্রেফতারের নির্দেশ পর্যন্ত দিতে পারেন। এখন ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের নির্বাচন কমিশনের পার্থক্য একটাইÑ আমাদের কমিশন, কমিশনের সদস্যরা অনেকটা ‘সরকারি চাকরি’ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর দলীয় আনুগত্যের কারণে তারা কমিশনে আসেন পাঁচ বছরের জন্য এবং যাদের দ্বারা তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাদের স্বার্থরক্ষা করেন।

ইদানীং একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি তা হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবসরের পর কমিশনে নিয়োগ পান। এসব সামরিক কর্তার রাজনীতি, রাজনীতির গতিধারা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও নির্বাচন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান। এরা সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন ‘কমান্ড’ মানতেন। মানতে বাধ্য থাকতেন। এখন কমিশনে এসেও তারা সেই ‘কমান্ড’ই মেনে চলছেন। তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয়া অসম্ভব। তাদের ‘মাইন্ড সেটআপ’-এর কারণে তারা কমান্ডের বাইরে যেতে পারেন না। অতিরিক্ত সচিব (অবসর) পদমর্যাদায় কিংবা জেলা জজ পদমর্যাদায় যারা থাকেন, তারাও সরকারি প্রভাবের বাইরে যেতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কমিশনকে দিয়ে তাই নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

আমরা মনে করি, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব। তবে সেখানে ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’ আছে। প্রতিটি জেলায় যে নির্বাচন কমিশনের অফিস ও কর্মকর্তারা আছেন, তারা সরকারি কর্মকর্তা। সরকারের আদেশ মানতে তারা বাধ্য। এখানে পিএসসির মাধ্যমে এবং সরকারি ইসির তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তাদের নিয়োগকর্তা হবে কমিশন। তাদের বদলি, বেতন-ভাতা, নিয়োগে ইত্যাদি সব কিছু করবে কমিশন। সরকারের কর্তৃপক্ষের কোনো প্রভাব তাদের ওপর থাকবে না। তারা কোনো সরকারি কর্মকর্তার (যেমন জেলা প্রশাসক) নির্দেশ মানতে বাধ্য হন। তারা শুধু নির্বাচন কমিশনের আদেশ গ্রহণ করবেন ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন। এখন যদিও পিএসসি তাদের রিক্রুট করেছে; কিন্তু নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব তাদের ওপর রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিকভাবে নির্বাচন কমিশন সরকারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারবে না। বাজেটে প্রথম থেকেই তাদের জন্য বরাদ্দ থাকবে। বাজেট বরাদ্দ থাকলে তারা টাকার জন্য সরকারের মুখাপেক্ষি হবে না। না হলে এই আর্থিক নির্ভরতাকে সরকার নিজের কাজে ব্যবহার করে। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক পদ হলেও কারা কারা এর প্রধান হবেন বা সদস্য হবেন, তার কোনো নীতিমালা নেই। এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার। এ ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। না হলে বারে বারে একই ঘটনা ঘটতে থাকবে। সরকার তার সমর্থকদের এ কমিশনে নিয়োগ দেবে এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা সরকারের স্বার্থরক্ষা করবে।

আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, সমাজের প্রতিটি সেক্টরে ‘রাজনীতিকরণ’ হয়েছে। শিক্ষকতা, পেশাজীবী, প্রশাসনÑ সব জায়গাতেই রাজনীতি। নিয়োগগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শকে মাথায় রেখে। ফলে নিয়োগপ্রাপ্তরা ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ‘আদেশ’ অনুসরণ করবেন, তাদের ‘খুশি’ করার জন্য ‘পদক্ষেপ’ নেবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। মহাজোট সরকারের আমলে প্রশাসনে রাজনীতিকরণের বিষয়টি এত বেশি হয়েছে যে, প্রশাসনের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা আশা করা যায় না। এরই মধ্যে জামায়াতের নিবন্ধন নিষিদ্ধ করে উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা যদি সরকার অনুসরণ করে, তা আদৌ কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারবে না। কেননা, ইতিহাস বলে, দল নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। অন্য নামে দলগুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটে। তিউনেসিয়া, তুরস্ক কিংবা থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, কোনো কোনো দল সেখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও, পরে তা নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। জামায়াতের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে।

সরকারের সামনে তাই একের পর এক ‘ফ্রন্ট’ উন্মুক্ত হচ্ছে। সরকার কোনো একটিরও সুষ্ঠু সমাধান বের করতে পারছে না। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ‘নির্বাচন পর্যন্ত সরকার ক্ষমতায় থাকবে’ বলে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এই আস্থাহীনতা বাংলাদেশে বিকাশমান গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু দুটি বড় দল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা যেভাবে পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখছেন, তাতে করে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে। তাই প্রয়োজন সংযম প্রদর্শন ও সেই সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ ২৬ আগস্ট, ২০১৩।
ডালাস, ২২ আগস্ট, ২০১৩
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক
tsrahmanbd@yahoo.com

সংকট নিরসনের পথ রুদ্ধ হচ্ছে

সংকট নিরসনের সম্ভাবনা কি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে? এই মন্তব্যটি করেছে ব্রিটেনের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট গত ১০ আগস্ট তাদের এক প্রতিবেদনে। ইকোনমিস্ট এর আগেও বাংলাদেশকে নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনগুলোতে বাংলাদেশের রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সর্বশেষ প্রতিবেদনটিতেও আগের মতো যেমন মন্তব্য করা হয়েছে, তাতে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের খুশি না হওয়ারই কথা। সরকার তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে এবং আগামী নির্বাচনে সরকারি দল ও জোট হেরে যেতে পারে, এমন মন্তব্যও আছে প্রতিবেদনটিতে। চলতি বছরের ২৫ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দেয়া হবে-এমন আভাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে যে জটিলতা ছিল তা দূর হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকবেন-এটাই এখন অবধি সরকারের অবস্থান। অন্যদিকে বিএনপি তথা ১৮ দলের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অথবা নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার। এরই মাঝে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। উচ্চ আদালতে জামায়াতকে দেয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। আপিল বিভাগে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে জামায়াত দল হিসেবে তার অস্তিত্ব হারাল। তবে জামায়াত নতুন করে ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারবে, নির্বাচন না করলেও দলীয় কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে এমন কথাই বলেছেন ইসির কমিশনাররা। নির্বাচন কমিশন আরপিও সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা বিতর্কের মাত্রা বাড়িয়েছে। এরই মধ্যে গ্রেফতার হলেন অধিকারের সম্পাদক ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আদিলুর রহমান। নি¤œ আদালত তাকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলেও উচ্চ আদালত তা স্থগিত করেন। জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। সরকারের অভিযোগে তিনি তথ্য অধিকার আইন লঙ্ঘন করেছেন। রাজনীতিতে উত্তেজনার মাত্রা বাড়ানোর জন্য এসব ঘটনা যথেষ্ট। তবে দশম জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসি যেমন সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে, তা আমার বিবেচনায় আলোচনার অন্যতম বিষয়। কেননা দিন যতই যাচ্ছে ততই নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। আর কমিশনের সংস্কারের প্রস্তাব আলোচনার মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।


প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশন যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করেছে তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতটুকু? তারা মোট ৪১টি সংশোধনী প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটির রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ইসি যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নির্বাচনী ব্যয় ১৫ লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকায় বাড়ানো, নির্বাচন বিধি ভঙ্গ করলে শাস্তি কমানো, স্বতন্ত্র সদস্যদের জন্য শতকরা ১ ভাগ ভোটারের পূর্ব স্বাক্ষর গ্রহণ প্রযোজ্য না করা, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থীপদ বাতিলের ব্যাপারে দলীয়প্রধানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, নির্বাচন কমিশনের প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রহিত করা ইত্যাদি। ইসি আরপিওর ৯১ ধারা বাতিলের যে প্রস্তাব করেছে, তা শুধু বিতর্ককে উস্কেই দেবে না, কমিশন যে সরকারের মুখোমুখি-এই অভিযোগকে আরো শক্ত করবে। আরপিওর ৯১ই (২) ধারায় আছে আচরণবিধি ভঙ্গের অপরাধে কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলে এবং সেখানে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে ওই আসনের নির্বাচন বন্ধ থাকবে। পরবর্তীতে পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই ধারায়। বর্তমান কমিশন এই ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে। তারা প্রস্তাব করেছে যে কোনো প্রার্থীর প্রার্থীপদ বাতিল হলে, ওই আসনে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে তাকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হবে। এর অর্থ কী? যে কোনো প্রক্রিয়ায় যদি বিএনপি তথা ১৮ দলীয় প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয় তাহলে সরাসরি দলীয় সদস্যকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা সহজ হবে। এখন ইসির সংশোধনী প্রস্তাবটি বিতর্কিত হওয়ায় ইসি পুরো ৯১ ধারাই বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে তো প্রশ্ন থেকেই যায় ইসি কার স্বার্থে এ ধরনের একটি প্রস্তাব এনেছিল। দল নিবন্ধন কিংবা স্বতন্ত্র সদস্যদের ব্যাপারে আরপিওতে যে বাধ্যবাধকতা ছিল তাও বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সুতরাং ইসির কর্মকাণ্ড যে বিতর্কের সৃষ্টি করবে এটা বলাই বাহুল্য। নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক মাস। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধীপক্ষ পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান নিয়েছে। ঠিক এমন একটি সময় নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংস্কারের উদ্যোগ ‘রাজনীতির ময়দানে’ আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার শামিল। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এই মুহূর্তে এর আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর চাইতেও নির্বাচন কমিশনের অনেক কাজ বাকি। কমিশন সেসব ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো করত।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই একটা কথা বলা হয় এবং তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। আমাদের মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলতে ভালোবাসেন। আমাদের সংবিধানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কি আদৌ স্বাধীন? বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা কি সম্ভব? এর জবাব হচ্ছে এক কথায় ‘না’। যে কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই বিতর্কিত হয়ে যায়, সেই কমিশন দিয়ে কোনোমতেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করা যায় না। তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন কমিশন যদি সরকারের প্রভাবের বাইরে থেকে নিজের ক্ষমতাবলে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। নির্বাচন কমিশন কাগজ-কলমে স্বাধীন। নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব এখনো বহাল। বলা হয় ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করে। কথাটার পেছনে সত্যতা আছে। কিন্তু এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালে কমিশন সব ক্ষমতা ভোগ করে। নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কোনো ক্ষমতা থাকে না। অন্তবর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকেন বটে, কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ওই তিন মাস মূল ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। তারা কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়নসহ বিধি ভঙ্গের অভিযোগে মন্ত্রীদের, সাবেক মন্ত্রীদের গ্রেফতারের নির্দেশ পর্যন্ত দিতে পারেন। এখন ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের নির্বাচন কমিশনের পার্থক্য একটাই-আমাদের কমিশন, কমিশনের সদস্যরা অনেকটা ‘সরকারি চাকরি’ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর দলীয় আনুগত্যের কারণে তারা কমিশনে আসেন পাঁচ বছরের জন্য এবং যাদের দ্বারা তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাদের স্বার্থ রক্ষা করেন। ইদানীং একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করছি, তা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবসরের পর কমিশনে নিয়োগ পান। এসব সামরিক কর্তাদের রাজনীতি, রাজনীতির গতিধারা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও নির্বাচন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান। এরা সামরিক বাহিনীতে থাকাকালে সব সময়ই ‘কমান্ড’ মানতেন। মানতে বাধ্য থাকতেন। এখন কমিশনে এসেও তারা সেই ‘কমান্ড’ই মেনে চলছেন। তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয়া অসম্ভব। তাদের ‘সাউন্ড সেটআপ’ এর কারণে তারা কমান্ডের বাইরে যেতে পারেন না। অতিরিক্ত সচিব (অব.) পদমর্যাদায় কিংবা জেলা জজ পদ মর্যাদায় যারা থাকেন, তারাও সরকারি প্রভাবের বাইরে যেতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কমিশনকে দিয়ে তাই নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আমরা বারবার বলেছি নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব। তবে সেখানে ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’ আছে। প্রথমত, প্রতিটি জেলায় যে নির্বাচন কমিশনের অফিস ও কর্মকর্তারা আছেন, তারা সরকারি কর্মকর্তা। সরকারের আদেশ মানতে তারা বাধ্য। এখানে পিএসপির মাধ্যমে এবং সরকারি ইসির তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তাদের নিয়োগকর্তা হবে কমিশন। তাদের বদলি, বেতন-ভাতা, নিয়োগ ইত্যাদি সব কিছু করবে কমিশন। সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো প্রভাব তাদের ওপর থাকবে না। তারা কোনো সরকারি কর্মকর্তার (যেমন জেলা প্রশাসক) নির্দেশ মানতে বাধ্য নন। তারা শুধু নির্বাচন কমিশনের আদেশ গ্রহণ করবেন ও সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন। এখন যদিও পিএসসি তাদের রিক্রুট করেছে। কিন্তু নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব তাদের ওপর রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিকভাবে নির্বাচন কমিশন সরকারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারবে না। বাজেটে প্রথম থেকেই তাদের বরাদ্দ থাকবে। বাজেট বরাদ্দ থাকলে তারা টাকার জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হবে না। না হলে এই আর্থিক নির্ভরতাকে সরকার নিজের কাজে ব্যবহার করে। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক পদ হলেও কারা কারা এর প্রধান হবেন বা সদস্য হবেন, তার কোনো নীতিমালা নেই। এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার। এক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে একটা নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। না হলে বারে বারে একই ঘটনা ঘটতে থাকবে। সরকার তার সমর্থকদের এই কমিশনে নিয়োগ দেবে এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা সরকারের স্বার্থ রক্ষা করবে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, সমাজের প্রতিটি সেক্টরে ‘রাজনীতিকরণ’ হয়েছে। শিক্ষকতা, পেশাজীবী, প্রশাসন সব জায়গাতেই রাজনীতি। নিয়োগগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শকে মাথায় রেখে। ফলে নিয়োগপ্রাপ্তরা ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ‘আদেশ’ অনুসরণ করবেন, তাদের ‘খুশি’ করার জন্য ‘পদক্ষেপ’ নেবেন-এটাই স্বাভাবিক। মহাজোট সরকারের আমলে প্রশাসনে রাজনীতিকরণের বিষয়টি এত বেশি ঘটেছে যে অতীতের সব রেকর্ড তারা ভঙ্গ করেছেন। প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতি, পুলিশ বিভাগে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি, শিক্ষক-বিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের ঘটনা এত বেশি ঘটেছে যে প্রশাসনের ওপর আস্থা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। মূল ধারায় আমরা কীভাবে ফিরিয়ে নিয়ে আসব সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। একটা দেশের প্রশাসন যদি ঠিক না থাকে, তাহলে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের ব্যাপারে এই মুহূর্তে ইসির করণীয় কিছুই নেই। আদালতের নির্দেশনার বাইরে ইসি যেতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে জামায়াত যদি নিষিদ্ধ হয় তাতে কি সমাধান হবে? এই নিউইয়র্ক শহরে থেকে ভয়েস অব আমেরিকার এক অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে বেশ কয়েক স্রোতা তাতে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের সবার প্রশ্ন ছিল একটাই-জামায়াত নিষিদ্ধ হলে তারা কী করবে? কিংবা জামায়াত কি এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে? ইতিহাস বলে পৃথিবীর অনেক দেশে অনেক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তারা ভিন্ন নামে ফিরে এসেছে। কেননা তাদের সমর্থকদের তো নিষিদ্ধ করা যায়নি। থাইল্যান্ডে সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার দল থাই রাক থাই পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। কিন্তু তার সমর্থকরা লাল শার্ট আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ও নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে তারা আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। থাকসিনের বোন এখন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিউনেসিয়ায় এন্মাহদা পার্টি নিষিদ্ধ ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু ‘আরব বসন্ত’ দলটিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তারা ক্ষমতা পরিচালনা করছে জনসমর্থন নিয়ে। মিসরে ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ ছিল। ড. মুরসি সে দলের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তুরস্কে জাস্টিস এড ডেভেলমেন্ট পার্টি (একেপি) পরপর তিনবার সেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতায়। ২০০১ সালে তারা প্রথম ক্ষমতা পেয়েছিল। অথচ তাদের মূল দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। একেপির ব্যানারে সংগঠিত হয়ে তারা ক্ষমতা পেয়েছে। এরদোগান সে দেশের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। আলজেরিয়াতে ইসলামপন্থি সালভোসন ফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও ক্ষমতা পায়নি। দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তারা এখন ‘ফ্রি এওয়াকেনিং পার্টি’ নামে নিবন্ধন নেয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি আফগানিস্তানে সলিডারিটি পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু দলটি বর্তমানে যথেষ্ট জনপ্রিয়। ইতিহাসই বলে দেয় দল নিষিদ্ধ করে কোনো সমাধান বয়ে আনা যায় না। সম্ভবত এটা বিবেচনা করেই সৈয়দ আশরাফ বলেছেন তাদের কোনো ইচ্ছা নেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার।
তবে অধিকারের সম্পাদককে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। অধিকারের রিপোর্টে হেফাজতে ইসলামের জামায়াতে মৃত্যুর খবর নিয়ে যদি অতিরঞ্জিত কোনো খবর থেকে থাকে সরকার আইনি প্রক্রিয়ায় তার সমাধান করতে পারত। কিন্তু গ্রেফতার ও রিমান্ড চাওয়া কেন? সরকারকে সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা থাকতে হবে। অনেকেই পত্র-পত্রিকায় সরকারের সমালোচনা করেন। টক শোতে মন্তব্য করেন যা সরকারের কঠোর সমালোচনার শামিল। কিন্তু তাই বলে কি সবাইকে গ্রেফতার করতে হবে? অধিকারের রিপোর্টে ৬১ জনের মৃত্যুর খবর বলা হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে ধরে নিচ্ছি এ তথ্য ভুল। কিন্তু আল-জাজিরা কিংবা সর্বশেষ ইকোনমিস্টের রিপোর্টেও অনেক মৃত্যুর খবর বলা হয়েছে। সরকার এর প্রতিবাদও করেছে। গ্রেফতার কোনো সমাধান নয়। এখন সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে আদৌ কোনো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি। গ্রেফতার করার সিদ্ধান্তটি সঠিক নয়। সরকার এতে সমর্থন পাবে না। সুশীল সমাজের সমর্থন এখন গেল সরকারের বিরুদ্ধে। রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হচ্ছে। ১৩ ও ১৪ আগস্ট জামায়াতের আহ্বানে হরতাল হয়েছে। এতে ঈদ-পরবর্তী ঢাকায় ফেরা মানুষগুলো পড়েছিলেন নানা বিড়ম্বনায়। আগামীতে আরো হরতাল আসছে। তাই ইকোনমিস্ট যে মন্তব্যটি করেছে, তা হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংকট নিরসনের একটি সম্ভাবনার দ্রুত ‘মৃত্যু’ ঘটছে। আমরা চাই সংকটের একটা সমাধান হোক। নির্বাচনকালীন একটি সরকারের ব্যাপারে আলোচনা শুরু হোক। আর নির্বাচন আচরণবিধি কিংবা গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ যদি পরিবর্তন করতে হয় তাহলে তা করা হোক সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে।
দৈনিক মানবকন্ঠ, ১৭ আগস্ট ২০১৩।
ওয়াশিংটন ডিসি ১৪ আগস্ট ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 
ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
 

নির্বাচন কমিশনের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত

নির্বাচন কমিশন একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২-এর ব্যাপক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে ৪১টি সংশোধনী প্রস্তাব এনে আইন মন্ত্রণালয়ে একটি নোট পাঠিয়েছে। যদিও আইন মন্ত্রণালয় এখন অবধি সেসব প্রস্তাব গ্রহণ করেনি, কিন্তু ইসির এ প্রস্তাব ইতিমধ্যেই রাজনীতির ময়দানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ছাড়াও মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ইসির এ উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন। যে অভিযোগটি উঠেছে তা হচ্ছে, ইসি সরকারের পক্ষে কাজ করছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এসব অভিযোগের কোনো জবাব দেননি। তবে বলছেন, কমিশন ইতিমধ্যে এসবের জবাব দিয়েছে। প্রয়োজনে কমিশন আরও ব্যাখ্যা দেবে। দেশ যখন একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি, জাতি যখন এখনও স্পষ্ট নয় কোন পদ্ধতির সরকারের আওতায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তখন নির্বাচন কমিশন এ ধরনের কোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত না নিলেই পারত। নির্বাচন কমিশন কি আদৌ চিন্তা করেনি যে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি করবে? ইসির দায়িত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সব দলের অংশগ্রহণের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা। কিন্তু এ ধরনের একটি অযৌক্তিক সংশোধনী শুধু নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণকেই অনিশ্চিত করবে না, বরং নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বস্তুত কমিশন ইতিমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এতে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জটিলতা আরও বাড়বে।
নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে থাকে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২-এ সংশোধনী আনা প্রয়োজন, তারা সেটা করতে পারে। এতে আপত্তি থাকার কথা নয়। সময়ের পরিক্রমায় কিছু কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। কিন্তু মূল প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, যারা মূল ‘অ্যাক্টর’, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে তাদের যদি সম্মতি না থাকে, তাহলে ওই সব সংশোধনী আনার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। বর্তমান ইসি যেসব সংশোধনী আনল, তাতে মূল ‘অ্যাক্টর’দের সম্মতি না থাকায় সেসব সংশোধনী অর্থহীন হয়ে পড়ল। কমিশন দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারল না। বরং রাজনৈতিক সংকটে নতুন একটি মাত্রা যোগ করল। কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হল।
প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করেছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতটুকু? তারা মোট ৪১টি সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে, যার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ইসি যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নির্বাচনী ব্যয় ১৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকায় বাড়ানো, নির্বাচনবিধি ভঙ্গ করলে শাস্তি কমানো, স্বতন্ত্র সদস্যদের জন্য শতকরা ১ ভাগ ভোটারের পূর্ব-স্বাক্ষর গ্রহণ প্রযোজ্য না করা, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থী পদ বাতিলের ব্যাপারে দলীয় প্রধানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, নির্বাচন কমিশনারের প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রহিত করা ইত্যাদি। ইসি আরপিও’র ৯১ ধারা বাতিলের যে প্রস্তাব করেছে, তা শুধু বিতর্ককে উসকেই দেবে না, কমিশন যে সরকারের মুখাপেক্ষী- এ অভিযোগকে আরও জোরালো করবে।
আরপিওর ৯১ই(২) ধারায় আছে, আচরণবিধি ভঙ্গের অপরাধে কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলে এবং সেখানে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে ওই আসনের নির্বাচন বন্ধ থাকবে। পরবর্তী সময়ে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই ধারায়। বর্তমান কমিশন ওই ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে। তারা প্রস্তাব করেছে, কোনো প্রার্থীর প্রার্থী পদ বাতিল হলে, ওই আসনে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে, তাকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হবে। এর অর্থ কী? যে কোনো প্রক্রিয়ায় যদি বিএনপি তথা ১৮ দলীয় প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়, তাহলে সরকারদলীয় সদস্যকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা সহজ হবে। এখন ইসির সংশোধনী প্রস্তাবটি বিতর্কিত হওয়ায় ইসি পুরো ৯১ ধারাই বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে তো প্রশ্ন থেকেই যায়, ইসি কার স্বার্থে এ ধরনের একটি প্রস্তাব এনেছিল? দল নিবন্ধন কিংবা স্বতন্ত্র সদস্যদের ব্যাপারে আরপিওতে যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তাও বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সুতরাং ইসির কর্মকাণ্ড যে বিতর্কের সৃষ্টি করবে, এটা বলাই বাহুল্য।
নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক মাস। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষ পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান নিয়েছে। ঠিক এমন একটি সময় নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংস্কারের উদ্যোগ ‘রাজনীতির আগুনে’ ঘি ঢেলে দেয়ার শামিল। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এ মুহূর্তে এর আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর চেয়ে নির্বাচন কমিশনের আরও অনেক কাজ বাকি। কমিশন সেসব ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো করত। সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই একটা কথা বলা হয়- তা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। আমাদের মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলতে ভালোবাসেন। আমাদের সংবিধানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কি আদৌ স্বাধীন? বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা কি সম্ভব? এক কথায় এর জবাব হচ্ছে, ‘না’। যে কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই বিতর্কিত হয়ে যায়, সেই কমিশন দিয়ে কোনোমতেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করা যায় না। তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন কমিশন যদি সরকারের প্রভাবের বাইরে থেকে নিজের ক্ষমতাবলে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কী? নির্বাচন কমিশন কাগজে-কলমে স্বাধীন। নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব এখনও বহাল। বলা হয়, ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করে। কথাটার পেছনে সত্যতা আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন সব ক্ষমতা ভোগ করে। নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কোনো ক্ষমতা থাকে না। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকেন বটে, কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ওই তিন মাস মূল ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। তারা কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়নসহ বিধিভঙ্গের অভিযোগে মন্ত্র্রীদের, সাবেক মন্ত্রীদের গ্রেফতারের নির্দেশ পর্যন্ত দিতে পারেন। ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের নির্বাচন কমিশনের পার্থক্য একটাই- আমাদের কমিশন, কমিশনের সদস্যরা অনেকটা ‘সরকারি চাকরি’ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর দলীয় আনুগত্যের কারণে তারা কমিশনে আসেন পাঁচ বছরের জন্য এবং যাদের দ্বারা তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাদের স্বার্থ রক্ষা করেন। ইদানীং একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি, তা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবসরের পর কমিশনে নিয়োগ পান। এসব সামরিক কর্মকর্তার রাজনীতি, রাজনীতির গতিধারা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও নির্বাচন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান। তারা সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন সব সময়ই ‘কমান্ড’ মানতেন। মানতে বাধ্য থাকতেন। এখন কমিশনে এসেও তারা সেই ‘কমান্ড’ই মেনে চলছেন। তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয়া অসম্ভব। তাদের ‘মাইন্ড সেটআপে’র কারণে তারা কমান্ডের বাইরে যেতে পারেন না। অতিরিক্ত সচিব (অবসর) পদমর্যাদায় কিংবা জেলা জজ পদমর্যাদায় যারা থাকেন, তারাও সরকারি প্রভাবের বাইরে যেতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কমিশনকে দিয়ে তাই নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
আমরা বারবার বলেছি, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব। তবে সেখানে ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’ আছে। প্রথমত, প্রতিটি জেলায় যে নির্বাচন কমিশনের অফিস ও কর্মকর্তারা আছেন, তারা সরকারি কর্মকর্তা। সরকারের আদেশ মানতে তারা বাধ্য। এখানে পিএসসির মাধ্যমে এবং সরাসরি ইসির তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তাদের নিয়োগকর্তা হবে কমিশন। তাদের বদলি, বেতন-ভাতা, নিয়োগ ইত্যাদি সবকিছু করবে কমিশন। সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো প্রভাব তাদের ওপর থাকবে না। তারা কোনো সরকারি কর্মকর্তার (যেমন জেলা প্রশাসক) নির্দেশ মানতে বাধ্য নন। তারা শুধু নির্বাচন কমিশনের আদেশ গ্রহণ করবেন এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন। এখন যদিও পিএসসি তাদের রিক্রুট করেছে, কিন্তু নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব তাদের ওপর রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশন আর্থিকভাবে সরকারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারবে না। বাজেটে প্রথম থেকেই তাদের বরাদ্দ থাকবে। বাজেট বরাদ্দ থাকলে তারা টাকার জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হবে না। না হলে এই আর্থিক নির্ভরতাকে সরকার নিজের কাজে ব্যবহার করে। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক পদ হলেও কারা কারা এর প্রধান হবেন বা সদস্য হবেন, তার কোনো নীতিমালা নেই। এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার। এক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে একটা নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। না হলে বারবার একই ঘটনা ঘটতে থাকবে- সরকার তার সমর্থকদের এই কমিশনে নিয়োগ দেবে এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা সরকারের স্বার্থ রক্ষা করবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, সমাজের প্রতিটি সেক্টরে ‘রাজনীতিকরণ’ হয়েছে। শিক্ষকতা, পেশাজীবী, প্রশাসন সব জায়গায়ই রাজনীতি। নিয়োগগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শকে মাথায় রেখে। ফলে নিয়োগপ্রাপ্তরা ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ‘আদেশ’ অনুসরণ করবেন, তাদের ‘খুশি’ করার জন্য ‘পদক্ষেপ’ নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। মহাজোট সরকারের আমলে প্রশাসনে রাজনীতিকরণের বিষয়টি এত বেশি ঘটেছে যে, অতীতের সব রেকর্ড তারা ভঙ্গ করেছেন। প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতি, পুলিশ বিভাগে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের ঘটনা এত বেশি ঘটেছে যে, প্রশাসনের ওপর আস্থা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। মূলধারায় আমরা কিভাবে ফিরে আসব, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। একটা দেশের প্রশাসন যদি ঠিক না থাকে, তাহলে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আজ নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করল, কমিশন সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ একটি কমিশন হিসেবে কাজ করতে পারছে না। কমিশন একটি ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে’র মতোই আচরণ করছে। তাদের এই ‘আচরণ’ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু কমিশনের বড় কাজ হচ্ছে বড় দলগুলোর আস্থা অর্জন করা। শুধু সরকারি দলের আস্থা অর্জন করলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, বড় দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে কমিশন যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তুতি মূল্যহীন। আরপিওতে সংশোধনী যদি আনতে হয়, তাহলে তা বড় দলগুলোর সম্মতি নিয়েই আনতে হবে। এককভাবে সংশোধনীর উদ্যোগ বিতর্কের মাত্রা বাড়াবেই মাত্র। সিইসি বলেছেন, তিনি একটি ব্যাখ্যা দেবেন। কিন্তু ব্যাখ্যার চেয়েও বড় প্রয়োজন বড় দলগুলোর মতামতকে গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া। আরপিওর ব্যাপারে বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি যে মতামত দিয়েছে, নির্বাচন কমিশন তা গ্রহণযোগ্যতায় নিতে পারে এবং সেই মতো কাজ করতে পারে। তাহলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রতিফলন ঘটবে। না হলে যে কোনো উদ্যোগ হয়তো সরকারি দলকে খুশি করবে, কিন্তু বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করতে পারবে না।
এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাচন কমিশন। তাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক বেশি। সেই প্রত্যাশা নির্বাচন কমিশন কতটুকু পূরণ করে, সেটাই দেখার বিষয়।
দৈনিক যুগান্তর, ১৭ আগস্ট ২০১৩।
ওয়াশিংটন ডিসি, আগস্ট ২০১৩
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
 

তিউনেশিয়া কি মিসরের পরিস্থিতি বরণ করতে যাচ্ছে

মিসরে সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী আবদেল ফাত্তাহ এল সিসি যখন ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সঙ্গে একটি সমঝোতায় যেতে ব্যর্থ হয়েছেন, ঠিক তখনই পার্শ্ববর্তী তিউনেশিয়ার রাজধানী তিউনিশে সেøাগান উঠেছে ‘ফবমধমবষ’। অর্থাৎ ‘বের হয়ে যাও’। ফরাসি ভাষার ইংরেজি অনুবাদ করলে এমনটিই দাঁড়ায়। দু’বছর আগে তিউনিশের রাজপথ এভাবেই প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল বেন আলির বিরুদ্ধে। সাধারণ একজন ফল বিক্রেতা পওয়াফুজিজি আত্মহত্যা করে ‘বিপ্লব’-এর সূচনা করেছিলেন। এই বিপ্লব শুধু বেন আলি পতনকেই ত্বরান্বিত করেনি, বরং তিউনেশিয়ায় একটি ঐকমত্যের রাজনীতির সূচনা করেছিল। কিন্তু দু’বছরের মাথায় সেই ঐকমত্য এখন ফিকে হয়ে আসছে। গত পাঁচ মাসে দু’জন বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ খুন হয়েছেন। সর্বশেষ খুন হলেন মোহাম্মদ ব্রাহিমি। একই সঙ্গে জঙ্গিদের হাতে খুন হয়েছেন ৯ সৈন্য। ব্রাহিমির মৃত্যু মানুষকে আবারও রাস্তায় নিয়ে এসেছে। তারা এখন সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাদের দাবি, সরকার এক বছরের মাথায় একটি সংবিধান প্রণয়ন করবে বলে ঘোষণা করলেও, তা তারা করেনি বা পারেনি। নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও, তারিখ নির্ধারিত হয়নি। শুধু একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন ও সংবিধান প্রণয়ন পরিষদ দিয়ে চলছে দেশ। সরকারের এই ব্যর্থতাই সাধারণ মানুষকে আবারও রাস্তায় নামিয়ে এসেছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী আলি লারায়েধ শেষ পর্যন্ত সংবিধান চূড়ান্তকরণ ও নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। আগামী ১৭ ডিসেম্বর সেখানে নির্বাচন। আর ২৩ আগস্টের মধ্যে সংবিধান চূড়ান্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতিতে সেখানকার উত্তপ্ত রাজনীতি কতটুকু শান্ত হবে বলা মুশকিল। তাই নিউনেশিয়া নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল, শেষ পর্যন্ত তিউনেশিয়ার সেনাবাহিনী কি মিসরের সেনাবাহিনীর পদাঙ্ক অনুসরণ করবে? স্পষ্টতই মিসরের ঘটনাবলি পুরো আরব বিশ্বের দৃশ্যপটকে বদলে দিয়েছে। ‘আরব বসন্ত’ সেখানে গণতন্ত্র বিকাশের যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, সেই সম্ভাবনা এখন ফিকে হয়ে আসছে। মিসরে গণতন্ত্র বিকাশের সম্ভাবনা এখন রহিত হয়ে গেল। তিউনেশিয়াও সেদিকেই যাচ্ছে। ইয়েমেনের অবস্থাও তেমনি। তাহলে ‘আরব বসন্ত’ কি ব্যর্থ হলো? গোটা আরব বিশ্বে গণতন্ত্র বিকাশে মিসর ও তিউনেশিয়ার রাজনীতির উত্থান-পতন অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিশেষ করে মিসর হচ্ছে কেন্দ্রবিন্দু। মিসরে গণতন্ত্র বিকশিত না হলে, গোটা আরব বিশ্বেই গণতন্ত্র হুমকির মুখে থাকবে।

মিসরের সেনা অভ্যুত্থানের পর প্রায় পাঁচ সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন উঠেছে তা হচ্ছে, মিসর কি আদৌ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত? সামরিক শাসকরা যে মিসরের সমাজে একটি বড় ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি’, তার ইতিহাস তো শুধু মুরসিকে উৎখাত করার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হলো না। বলা যেতে পারে, মিসরের সেনাবাহিনী ৬১ বছরে যেভাবে বিকশিত হয়েছে, তাতে করে এ সমাজ সামরিক বাহিনীনির্ভর একটি সমাজে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তাÑ প্রতিটি ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্তৃত্ব রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান সে দেশের অলিখিতভাবে ‘ছায়া রাষ্ট্রপতি’, আর লিখিতভাবে দেশরক্ষামন্ত্রী। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন একটি পরিষদ ‘কিচেন ক্যাবিনেট’ হিসেবে কাজ করে। এটা আগেও ছিল, এখনও আছে। এমনকি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এবং জনগণের ভোটে মুরসি সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও তিনি সেনাবাহিনীর এই প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। ‘প্রেসিডেন্ট’ মুরসি নিজে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসিকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। সেনাপ্রধান হিসেবে দেশরক্ষামন্ত্রীও ছিলেন জেনারেল সিসি মুরসির শাসনকালে। যে নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল, সেখানে মুরসির কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছিলেন জেনারেল সিসি। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ইলাহিÑ মাত্র দু’বছর সময় নিয়েছিল সেনাবাহিনী। এই দু’বছর তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুতির ব্যাপারে তারা যে যুক্তি দেখিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস, যাদের ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করে, তাদের সমর্থন দিয়েছিলেন মুরসি। এই যুক্তিতে তার ‘বিচার’ হয়েছে এবং ১৫ দিনের ‘জেল’ হয়েছে। স্পষ্টতই বলা যায়, জেনারেল আবদেল ফাত্তাই এল সিসি হতে যাচ্ছেন মিসরের পরবর্তী ‘নেতা’। ইতিহাস বলে, মিসরের ফারাওরা (অর্থাৎ শাসক, বাদশাহ, রাজা) যেভাবে সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে করায়ত্ত করে রেখেছিলেন, আজকের যুগে মিসরে সেনাবাহিনী সেই ক্ষমতাই পালন করতে যাচ্ছে। মাঝখানে পাঁচ হাজার বছর চলে গেলেও মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।

জেনারেল সিসির পূর্বসূরিরা দল গঠন করে ক্ষমতা করায়ত্ত করেছিলেন। ১৯৫৩-৫৬ সালে নাসের গঠন করেছিলেন ‘লিবারেশন র‌্যালি’। ১৯৫৭-৭০ সময়সীমায় গঠিত হয়েছিল ‘ন্যাশনাল ইউনিয়ন’। উভয় ক্ষেত্রেই লিবারেশন, র‌্যালি ও ন্যাশনাল ইউনিয়ন একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। ১৯৭১ সালে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদাত গঠন করেছিলেন আরব সোস্যালিস্ট ইউনিয়ন। ১৯৭৯ সালে এটাকে ভেঙে গঠন করেছেন ‘নিউ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন’। আর হোসনি মোবারকও একই পথ অনুসরণ করে গেছেন। সুতরাং জেনারেল সিসি যে ক্ষমতা একজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাবেন, এটা আমার মনে হয় না।

তাহলে কোন পথে যাচ্ছে মিসর? মিসর থেকে যেসব খবরাখবর আসছে, তা কোনো আশার কথা বলছে না। মুরসির পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি জনমত রয়েছে। মুরসির সমর্থক মুসলিম ব্রাদারহুড লাখ লাখ লোকের জমায়েত করলে সেনাবাহিনী তাতে গুলি চালায়। এতে মারা যায় প্রায় ১৫২ জন। সর্বশেষ ১৪ আগস্ট আবারও রক্তাক্ত হয়েছে কায়রোর রাজপথ। সেনাবাহিনীর চতুর্মুখী অভিযানে মুরসিপন্থীদের উৎখাত হতে হয়েছে দুটো ক্যাম্প থেকে। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে মুসলিম ব্রাদারহুডের দাবি অনুযায়ী নিহত হয়েছে কমপক্ষে দু’হাজার এবং আহত অগণিত। তবে সরকারি ভাষ্য বলছে, নিহতের সংখ্যা দু’শতাধিক। এতে করে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়েছেÑ ‘সেনাবাহিনী’ কোনো মতেই আর মুরসিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনছে না। যদিও মুরসির সমর্থকদের দাবি এটাই। এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা এখনও স্পষ্ট নয়। সেনাবাহিনী কী এককভাবে কোনো একটি দল গঠন কিংবা পুনর্গঠিত করে নিজেরা ক্ষমতা পরিচালনা করবে! যেমনটি করেছিলেন আনোয়ার সাদাত কিংবা হোসনি মোবারক?

ক্লাসিক্যাল সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী যা করে, তাই করেছে মিসরের সেনাবাহিনী। হাজেম এল বেবলাওইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার এই নিযুক্তি কিংবা মন্ত্রিসভায় যোগদানে মুসলিম ব্রাদারহুডের আপত্তি মিসরের এই সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করবে। মিসরের সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। এমনকি তারা এই অভ্যুত্থানকে একটি সামরিক অভ্যুত্থান বলতেও রাজি ছিল না। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন কোনো সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন করে না। তাই তারা ওটাকে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত না করে পরোক্ষভাবে সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছে। এটা তাদের রাজনীতির একটা বৈপরীত্য। আসলে বিশ্বব্যাপী মার্কিন রীতিনীতি সমালোচিত হচ্ছে। মিসরের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে কেউ সমর্থন করেনি। আসলে এখানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে মিসরে এমন একটি সরকার দরকার, যে সরকার ইসরাইলের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করবে। মুরসি তাদের জন্য একটা সমস্যা ছিল। তাই তাকে চলে যেতে হলো। আপতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র মিসরের জন্য ৪টি এফ-১৬ বিমান সরবরাহ স্থগিত করেছে। এটা লোক দেখানো। এতে করে মিসরের ব্যাপারে তাদের স্ট্রাটেজির কোনো পরিবর্তন আসবে না। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র মিসরকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য দেয়। এর কোনো হেরফের হবে না।

মুরসির ব্যর্থতা আছে। কিন্তু যা সত্য তা হচ্ছে, আরবের সমাজ, সংস্কৃতি গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। মিসরের জনগণ সামরিকতন্ত্রেই অভ্যস্ত। ইসলামী শক্তিগুলো, বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুড ও আল নূর পার্টির জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু জনপ্রিয়তা ও দেশ শাসন এক নয়। যেখানে প্রয়োজন ছিল ব্যাপকভিত্তিক ঐকমত্যের, তাতে মুরসি ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার ব্যর্থতাই সামরিক বাহিনীকে এখানে নিয়ে এলো। ভুলে গেলে চলবে না, মিসরের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনী জড়িত। খাদ্য উৎপাদন, বণ্টন, বিশুদ্ধ পানি, উৎপাদন ও সরবরাহ, রিয়েল স্টেটÑ এ ধরনের অনেক ব্যবসার সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই জড়িত। সুতরাং এই ‘শক্তি’কে অস্বীকার করা যাবে না। এটা ঠিক, মুসলিম ব্রাদারহুডের সমাজে একটা ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাবই মুরসিকে নির্বাচনে বিজয়ী করেছিল। তবে তিনি ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর স্পিরিট অনুসরণ করেননি। এটা সত্য, ইসলামিক শক্তিগুলো এখনও সেনা সমর্থনকারী শক্তিকে সমর্থন করেনি। এখনও তারা তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তাতে করে সরকারের পতন ঘটবে না।

তিউনেশিয়া নিয়ে এই ভয়টা রয়েই গেল। সেখানে ইসলামী জঙ্গিরা শক্তিশালী হচ্ছে। মিসরেও তাদের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। এই ইসলামী জঙ্গিরা এখন গোটা আরব বিশ্বের স্থিতিশীলতার জন্য রীতিমতো হুমকি। আজ তাই তিউনেশিয়ায় যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে, তা যদি স্তিমিত না হয়, তাহলে তিউনেশিয়া অবধারিতভাবে বহন করবে মিসরের পরিণতি। আর এতে করে অনিবার্যভাবে স্তিমিত হবে গণতন্ত্রের বিকাশ।
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


রাজনীতিতে জয় ও রাজনীতির উত্তরাধিকার

শেষ পর্যন্ত কি বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় সক্রিয় রাজনীতিতে এলেন? এ মুহূর্তে তিনি সস্ত্রীক দেশে। দাদাবাড়ি পীরগঞ্জে গিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন মা ও বিদেশিনী স্ত্রী। তাঁর একটি বক্তব্য- 'মুই ফিরি আসিম', অনেক প্রশ্নের জবাব হয়তো আমাদের দেবে আগামী দিনে। এর আগে ঢাকায় যুবলীগের এক ইফতার পার্টিতে তিনি বলেছিলেন, তাঁর কাছে খবর আছে, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে। তাঁর ওই বক্তব্যে রাজনীতি মহলে তোলপাড় কম হয়নি। খোদ এই নিউ ইয়র্ক শহরেও একদিকে বাঙালিরা যেমনি তাঁর রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে স্বাগত জানিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ যে তিনি কী করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসবে। এটা রাজনৈতিক বক্তব্য। আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের মতো তিনিও বক্তব্য রেখেছেন। রংপুরে একটি জনসভায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বক্তব্যও দিয়েছেন। এর অর্থ কি দাঁড়াল এই যে প্রধানমন্ত্রীই তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী ঠিক করে দিলেন! জয়কে তিনি তৈরি করছেন!
সজীব ওয়াজেদ জয়ের রক্তে রয়েছে রাজনীতি। তিনি রাজনীতিতে আসবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ দেশের আরেক পরিবার, জিয়া পরিবারের সন্তান তারেক রহমানের রাজনীতিতে অভিষেক হয়েছে অনেক আগেই। তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। 'এক-এগারো'র ঘটনায় তিনি নির্যাতিত হয়েছেন। এখন লন্ডনে 'চিকিৎসাধীন'। তিনি যে বিএনপির হাল ধরবেন, তা নির্ধারিত। গেল জুলাই মাসে লন্ডনে তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি এই দুই পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই দুই পরিবার প্রভাব বিস্তার করে বটে; কিন্তু আরো বেশ কয়টি পরিবার রয়েছে, রাজনীতির উত্তরাধিকারের ধারা তারা বহন করে চলছে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সন্তান ও বর্তমান রাষ্ট্রপতির সন্তানের রাজনৈতিক অভিষেক হয়েছে। যদিও সন্তানদের দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নেই। বাবাদের মতো দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা সমাজে স্ব স্ব অবস্থান গড়ে তুলতে পারেননি এখনো। একজন জিল্লুর রহমান কিংবা আবদুল হামিদ একদিনে তৈরি হয়নি। তাঁদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। 'সোনার চামচ' মুখে দিয়ে তাঁরা মন্ত্রী হননি। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাঁদের ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে সাহায্য করেছিল।
শুধু বাংলাদেশ বলি কেন, দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল বিশ্বে এই পারিবারিক রাজনীতির ধারা সর্বত্র প্রত্যক্ষ করা যায়। আমরা প্রায়ই ভারতে নেহরু পরিবারের দৃষ্টান্ত দিই; কিন্তু ভারতে প্রতিটি রাজ্যে এই পারিবারিক রাজনীতির শক্ত ভিত্তি রয়েছে। কোথাও কোথাও (উড়িষ্যা, তামিলনাড়ু) ব্যক্তির নামেই দলের পরিচয়। পারিবারিক রাজনীতির এই ধারা যে শুধু কংগ্রেসের মধ্যেই আছে, তা নয়। বরং বিজেপি থেকে শুরু করে প্রতিটি আঞ্চলিক দলের মধ্যেই আছে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে এ প্রবণতা ব্যাপকভাবে না থাকলেও আছে। আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি, আফ্রিকার অনেক দেশে এ প্রবণতা ব্যাপক। কোথাও কোথাও স্বামী, সন্তান, ভাই- সবাই মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছেন। আফ্রিকার অনেক দেশে আমি দেখেছি যে রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত। তাঁদের সন্তানদের অনেকেই ব্রিটেন অথবা ফ্রান্স থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
আমাদের উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের বীজ যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্য। নেহরু পরিবার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী পরিবার। নেহরুর বাবা মতিলাল নেহরু একসময় (১৯২১) কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শ্রীলঙ্কায় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে বন্দরনায়েকে পরিবার। প্রথমে বাবা, পরে মা, তারপর চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা নিজে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি পরিচালনা করে গেছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে ও তাঁর পরিবার এখন শ্রীলঙ্কার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র একটি ঐতিহ্য। এটা নিয়ে কেউ সেখানে হৈচৈ করে না। নেপালে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে, সেখানেও রয়েছে পরিবারতন্ত্র। কৈরালা পরিবার শুধু নেপালের সরকার পরিচালনায়ই সম্পৃক্ত ছিল না, বরং নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বও রয়েছে কৈরালা পরিবারের হাতে, এমনকি মাওবাদী নেতা প্রচণ্ড এ ধারা থেকে নিজেকে বাইরে রাখতে পারেননি। তাঁর মেয়ে এখন দলের তথা রাষ্ট্রের নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছেন। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপেও গাইয়ুমের (সাবেক রাষ্ট্রপতি) মেয়ে পরবর্তী নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছেন। সিঙ্গাপুরেও পরিবারতন্ত্র আছে। পাকিস্তানের কথা না হয় নাই বললাম। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছেলেরা রাজনীতিতে আসছেন না। আসছেন তাঁর মেয়ে কুলসুম। ফিলিপাইনের দিকে তাকান। কোরাজন অ্যাকুইনোর (সাবেক প্রেসিডেন্ট) ছেলে এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবারতন্ত্র ভালো, না খারাপ? সিঙ্গাপুরে লি কোয়াক কুয়ান ইউর ছেলে যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন সেখানে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ, তিনি যোগ্য। সিঙ্গাপুরকে বিশ্বসভায় নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা তিনি অতীতে রেখেছেন। এ প্রশ্ন ওঠেনি কোরাজন অ্যাকুইনোর ছেলের বেলায়- একজন সিনেটর হিসেবে তিনি অবদান রেখেছিলেন। প্রশ্নটা সেখানেই। প্রাচীন ভারতে একটি শ্লোক আছে- Vasudua Kutumbikam। সংস্কৃতি থেকে ইংরেজি করলে দাঁড়ায় all the Universe is a family। অর্থাৎ বিশ্বকে একটি পরিবার হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমান যুগের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সেই বিবেচনায় নিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে তাঁরা শাসন করেন। ভারতে রাজনীতিতে এই পারিবারিক ধারা অত্যন্ত শক্তিশালী। নেহরু পরিবারের বাইরে বেশ কিছু পরিবারের জন্ম হয়েছে, যাঁরা রাজনীতিতে প্রভাব খাটাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, চরণ সিং, দেবগৌড়া, শারদ পাওয়ার, আবদুল্লাহ, মুলায়ম সিং যাদব, করুণানিধি, রেড্ডি, সিন্দিয়া পরিবার। এসব পরিবারের পেশা হচ্ছে রাজনীতি। বাংলাদেশ এ থেকে পৃথক নয়। পারিবারিক এ রাজনীতির ধারা বাংলাদেশে আছে ও থাকবে। এ মুহূর্তে আলোচিত হচ্ছেন তারেক ও জয়। জয় সক্রিয় রাজনীতিতে আসেননি। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি এখন সক্রিয় হবেন এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়াবেন। তিনি যদি পূর্ণকালীন রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করেন, আমি তাতে অবাক হব না। বিদেশে দীর্ঘদিন থাকা একজন ব্যক্তি, যিনি তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি আধুনিকমনস্ক ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। আমি তো মনে করি, তিনি রাজনীতির সনাতন ধারাকে বদলে দিতে পারেন। তাঁর বিদেশি স্ত্রী, তাঁর জন্য আদৌ কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারবে কি না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। তবে ভারতে রাজীব গান্ধীর দৃষ্টান্ত আমাদের জানা আছে। প্রয়াত রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধীকে একজন 'পুরোপুরি ভারতীয়' হিসেবে বিজেপি গ্রহণ করে নেয়নি, যে কারণে সোনিয়া গান্ধী কোনো দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি এবং ভবিষ্যতেও পারবেন না। তবে নির্বাচনের সময় যদি রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণবিধিতে পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে জয় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন।
জয়ের রাজনীতিতে আসাকে আমি স্বাগত জানাই। এর মধ্য দিয়ে দুটো ধারার সূচনা হতে পারে। এক. সিনিয়র নেতারা বিদায় নিতে পারেন; দুই. দলে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হবে। বর্তমানে দেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে তরুণ সমাজের জন্য কোনো আদর্শ আমরা রেখে যেতে পারছি না। বিরোধী পক্ষকে আস্থায় না নেওয়া এবং রাজনীতি থেকে তাদের উৎখাত করা, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে রাজনীতিকে উত্তেজিত করে তোলা, সহিংস পথে রাজনীতিকে পরিচালনা করা, ব্যক্তিগত প্রাপ্তিকে রাজনীতির চেয়ে বড় করে দেখা, হত্যা, চাঁদাবাজির মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা- এই যে রাজনীতির চিত্র, তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। আওয়ামী লীগের সিনিয়র পর্যায়ে যাঁরা রয়েছেন, দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, তাঁরা জাতির জন্য কোনো 'রোল মডেল' নন। অনেকেই আছেন বহিরাগত। যে দলটিকে একসময় নেতৃত্ব দিয়েছেন মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাজউদ্দীন আহমেদ- আজ এত বছর পর দল কি 'আরেকজন শেখ মুজিব' কিংবা 'আরেকজন তাজউদ্দীন' তৈরি করতে পেরেছে? না, পারেনি। আজ তাই সজীব ওয়াজেদ জয়ের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতি এক নয়া নেতৃত্ব পাক, যারা একুশ শতকে বাংলাদেশকে একটি 'সফট পাওয়ার' হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করবে।
(নিউইয়র্ক থেকে)
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়