রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্

গত শনিবার ঢাকায় এসেছেন মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অতুল কেশাপ। এর আগে গেল নভেম্বরে ঢাকায় এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই। নিশা দেশাইয়ের ঢাকা সফরের পর বাংলাদেশের একটি উচ্চপর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধি দল ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন। আগামী ৭ এপ্রিল টিকফা বা 'ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্কের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আর ১৬ এপ্রিল ঢাকায় বসবে দুই দেশের মধ্যকার 'নিরাপত্তা সংলাপ'। এসব সফর ও বৈঠক প্রমাণ করে দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। তবে বিভিন্ন ইস্যুতে এখন দুই দেশের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এর একটি হচ্ছে জিএসপি সুবিধা। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা সম্পর্কিত জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে। জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সব শর্তই পূরণ করেছে। কিন্তু তাতে যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা দেবে এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কিংবা ড. ইউনূস ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট। সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক দিনের। কিন্তু তা হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা গুরুত্ব দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকেন্দ্রিক যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি বাড়াতে চায়। যেহেতু এ অঞ্চলে ভারত একটি শক্তি, সেহেতু ভারতকে সঙ্গে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে মার্কিন নীতি-নির্ধারক বিশেষ করে সাময়িক নীতি-নির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে ভারত-বাংলাদেশ কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের আগ্রহটা আরো বেড়েছে। যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র একটি অক্ষ গড়ে উঠেছে। একদিকে চলতি ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে সেখানে যে 'শূন্যতার' স্মৃতি হবে, মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা মনে করেন সেই 'শূন্যতা' পূরণ হতে পারে ভারতকে দিয়ে, যা চূড়ান্ত বিচারে তার স্বার্থকে রক্ষা করবে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত, যার পরিমাণ কয়েক মিলিয়ন ডলার। ভারত যেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করছে। প্রচুর হাইওয়ে তৈরি করছে ভারত। এখানে সীমান্তবর্তী পাকিস্তান বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। আর ভারতের এ বিনিয়োগ সম্ভব হয়েছে মার্কিন নীতি-নির্ধারকের সম্মতি দেয়ার পরই। ধারণা করছি ২০১৪ সালে মার্কিন বাহিনী সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হলে, ভারতের তথাকথিত একটি 'শান্তিরক্ষী' বাহিনী সেখানে অবস্থান নেবে। অথবা ন্যাটোর একটি এশীয় সংস্করণ দেখতে পাব আমরা ওই সময়, সেখানে ভারতের একটি অংশগ্রহণ থাকবে। ১৯৪৯ সালে ন্যাটো যখন গঠিত হয়েছিল, তার প্রথম এবং একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এই বাহিনী শুধু ইউরোপেই নিয়োজিত থাকবে। ন্যাটোর উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে 'ইউরোপের গণতন্ত্রকে' রক্ষা করা। ন্যাটোর সেই ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। প্রথমবারের মতো আফগান যুদ্ধে ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। যেহেতু ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্ররা আর আফগানিস্তানে 'ঝুঁকি' নিতে চাচ্ছে না, সেহেতু এ অঞ্চলকে ঘিরে ন্যাটোর এশীয় সংস্করণ (সেটা ভিন্ন নামেও হতে পারে) হবে এবং ভারত তাতে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। এ 'প্রক্রিয়ায়' বাংলাদেশও জড়িত হবে। মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের সুবিদা এখানেই যে বাংলাদেশ সরকার 'ভারতের এই ভূমিকাকে', যা যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, সমর্থন করছে। সূক্ষ্নভাবে লক্ষ্য করলে আরো দেখা যাবে সম্প্রতি ভারত পারমাণবিক অস্ত্র বহনযোগ্য যে মিসাইল, ক্ষেপণাস্ত্র (অগি্ন-৫) সাফল্যের সঙ্গে উৎক্ষেপণ করেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে তার নীতি গ্রহণ করেছে। ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে তার সেই নীতি পরস্পরবিরোধী। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার মিত্র দেশগুলোকে ব্যবহার করছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে এ কাজটি করছে না। বরং ভারতকে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে এ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে পারমাণবিক চুক্তি রয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অত্যাধুনিক পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই_ চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে একটি শক্তি হিসেবে দাঁড় করানো। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। একজন ডেমোক্রেট বারাক ওবামা হোয়াইট হাউসে ক্ষমতাসীন হয়েও, দুই দেশের মধ্যকার সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। এমনকি নয়া চীনা নেতা শি জিন পিংয়ের যুক্তরাষ্ট্র সফরের পরও কোনো কোনো ইস্যুতে দুই দেশের মতপার্থক্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, অতি সাম্প্রতিককালে ভারত মহাসাগরে তার নৌ-বাহিনীর উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে ছয়টি জাহাজ মোতায়েন করবে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। চীনের ওপর পরোক্ষ চাপ প্রয়োগ করা। চীন যাতে নৌশক্তিতে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, যুক্তরাষ্ট্র তা-ই চায়। আর এটাকে সামনে রেখেই যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সাময়িক সখ্য গড়ে তুলছে। চীন ইতোমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। এটাকে বিবেচনায় নিয়েই গড়ে উঠছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, যে অক্ষে বাংলাদেশও একটি অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের এ স্ট্র্যাটেজি বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে গড়ে ওঠা ্তুঈড়হঃধরহসবহঃ ঃযবড়ৎু্থ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এ নীতি অবলম্বন করেছিল। এ কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। বাংলাদেশের সীমান্তে রয়েছে মিয়ানমার, যে দেশটির সঙ্গে চীনের কৌশলগত সামরিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। চীনের সীমান্তবর্তী দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে। সু চি এখন সংসদ সদস্য। অনেক পশ্চিমা দেশ এখন মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জেনারেল সেইন এখন তার সরকারকে একটি 'বেসামরিক অবয়ব' দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র চাইবে বাংলাদেশ ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে। এমনকি ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনী মোতায়েনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৩ সালের পুরোটা সময় বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে এসেছিলেন মারিয়া ওটেরো (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয় সম্পর্কিত ডেস্ক) রবার্ট ও'বেস্নক (সহকারী পররাষ্ট্র সচিব, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ডেস্ক), ডেভিড শেরম্যান (আন্ডার সেক্রেটারি রাজনৈতিক বিষয়াদি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)। ১৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তা শীর্ষক একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব (রাজনৈতিক বিষয়াদি) আন্দ্রে শাপিরো। অত্যন্ত গোপনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা, কিংবা কী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা সংবাদপত্রে জানানো হয়নি। নিরাপত্তা বিষয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুই দেশ আলোচনা করল; কিন্তু জাতি তা জানল না। গোপনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত গোপনেই রাখা হলো। এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের কোনো মন্তব্যও আমার চোখে পড়েনি। তবে বাংলাদেশে মার্কিন সেনা মোতায়েনের একটি সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে! অনেকেরই মনে থাকার কথা ২ মার্চ (২০১৩) সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রে প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত) কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের 'বিশেষ বাহিনী' মোতায়েন রয়েছে। এটা নিয়ে বাংলাদেশে গুঞ্জনের সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মজিনার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন কিছু সেনা রয়েছে, যারা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে প্রশিক্ষণের জন্য আসে, আবার চলেও যায়। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা 'তথাকথিত সন্ত্রাসীদের মোকাবেলার' জন্য(?) ভিন্ন নামে ও ভিন্ন পরিচয়ে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর লোকজন বাংলাদেশে রয়েছে। এর একটা আইনি কাঠামো দেয়ার জন্যই ওই নিরাপত্তা শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্বীকার করে না যে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উৎকণ্ঠা কম। যুক্তরাষ্ট্র যা চায়, তা হচ্ছে গণতন্ত্র এখানে শক্তিশালী হোক। একটি মুসলমান অধ্যুষিত দেশেও যে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে, বাংলাদেশ তার প্রমাণ রেখেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের যে মূল কথা, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ, তা হয়নি। দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে। কিন্তু ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। তাই তোফায়েল আহমেদ যখন জিএসপি সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশা করেন, তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আবারো বলেন গণতান্ত্রিক সমঝোতার জন্য সংলাপের কথা। এটা অনেকটা এখন স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে দ্রুত একাদশ সংসদের নির্বাচন করা। যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। কিন্তু একাদশ সংসদ নিয়ে সরকারি মহলে কোনো আলোচনা নেই। উপরন্তু একজন নয়ামন্ত্রী ও ডেপুটি স্পিকার ১০ ফেব্রুয়ারি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে ৫ বছরের আগে কোনো নির্বাচন নয়। এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী কিংবা স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বলেছেন যে নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে ৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে। বিএনপি আপাতত নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে। মে-জুনের দিকে, যখন যুক্তরাষ্ট্র জিএসপির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে, তখন নতুন করে আন্দোলনের কর্মসূচি দেবে। এতে বিএনপি কতটুকু সফল হবে বলা মুশকিল। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না থাকলে তা মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের প্রভাবিত করতে পারে। বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধাটি প্রয়োজন। আর মার্কিন আস্থা ফিরে পেতে হলে বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সংলাপের ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ওয়াশিংটন গিয়েছিলেন বটে। কিন্তু তারা মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের কতটুকু আশ্বস্ত করতে পেরেছিলেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। এমনি এক পরিস্থিতিতে অতুল কেশাপ বাংলাদেশে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গেও তার বৈঠক হবে। এতে বরফ কতটুকু গলবে বলা মুশকিল। এটা স্পষ্ট যুক্তরাষ্ট্র চায় দ্রুত একটি সংলাপ। সুতরাং বিএনপির সঙ্গে যদি সংলাপ হয়, তাহলে বহির্বিশ্বে সরকার একটি ম্যাসেজ পেঁৗছে দেবে, যা সরকারের গ্রহণযোগ্যতাই বাড়াবে মাত্র। - Daily Jai Jai Din 25.02.14

ব্লেইম গেমে জঙ্গিরাই উৎসাহিত হবে

তার নাম রাসেল। টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটে চতুর্থ বর্ষে পড়ে। বাড়ি টাঙ্গাইল। র‌্যাব তাকে গ্রেফতার করেছে। রাসেল জানিয়েছে, সে নিজে বহুল আলোচিত আল কায়দার অডিওবার্তাটি ইন্টারনেটে আপলোড করেছে। সে গত ৩০ নভেম্বর ‘দাওয়া ইল্লাহ’ নামে একটি সাইটে এটা আপলোড করে এবং পরে তা সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। রাসেল শিবিরকর্মী এবং শিবিরের বিভিন্ন সাইটের এডমিন। র‌্যাব এই অডিওবার্তার আপলোডকারীকে গ্রেফতার করায় আমরা অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে গত ক’দিনে এই কথিত আল কায়দার অডিও টেপ নিয়ে যে লংকাকাণ্ড ঘটে গেল, তার ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে দেব? আমি একাধিক টিভি চ্যানেলে কথা বলেছি। কিন্তু দু-একজন বিশেষজ্ঞ যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে আমি অবাক হয়েছি তাদের জ্ঞানের গভীরতা দেখে। একজন অধ্যাপক বললেন, এই টেপের সঙ্গে একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত! যদিও তিনি এটাও বলেছেন, এটা সাজানো নাটক। একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তো বলেই ফেললেন, ওই অডিও টেপের বক্তব্যের সঙ্গে জামায়াত ও বিএনপির অতীত বক্তব্যের মিল আছে। ১৬ ফেব্র“য়ারি (যেদিন এটি প্রকাশ পায়) থেকে ১৮ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত তিনি অন্তত গোটা সাতেক চ্যানেলে একই কথা বলে গেছেন। এ ধরনের বিশেষজ্ঞরা যখন প্রকাশ্যে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেন, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বক্তব্য দেয়ার আগে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের ধরন, আল কায়দার সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের স্ট্র্যাটেজি, বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির সংস্কৃতির ধরন ইত্যাদি সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা থাকা প্রয়োজন। তবে বলতেই হবে, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার হাফিজ কিংবা সাখাওয়াত হোসেন এ ব্যাপারে যথেষ্ট অগ্রগণ্য। সাখাওয়াত সাহেব আল কায়দা নিয়ে লিখেছেন। তার প্রকাশিত একটি গ্রন্থে একটি অধ্যায়ও রয়েছে আল কায়দা নিয়ে। টিভি চ্যানেলে তিনিও কথা বলেছেন। তবে তিনি এ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন।প্রসঙ্গক্রমে আল কায়দা নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বিন লাদেনের মৃত্যুর (অথবা হত্যা) পর আমি যুগান্তরে একাধিক নিবন্ধ লিখেছি আল কায়দার ভবিষ্যৎ স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। আমি বলার চেষ্টা করেছি, আল কায়দা তার স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন এনেছে। যারা এ সম্পর্কে ধারণা রাখেন না, তাদের আল কায়দা সম্পর্কে বলা ঠিক নয়। বাংলাদেশে আল কায়দার নেটওয়ার্ক কাজ করছে, এমন একটা কথা আমরা বিভিন্ন মহল থেকে শুনে আসছি। কিন্তু আমি গবেষণা করে দেখেছি, আল কায়দার যে স্ট্র্যাটেজি, যেভাবে তারা অপারেশন পরিচালনা করে, বাংলাদেশে এমনটি দেখা যায় না। আল কায়দার তাত্ত্বিক হচ্ছেন আবু মুসাব আল সুরি। তার একটি গ্রন্থ রয়েছে- ‘গ্লোবাল রেজিস্ট্যান্স ম্যুভমেন্ট’। তার ‘স্পাইডার ওয়েব’ তত্ত্বটি এখন ইসলামী জঙ্গিদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। মাকড়সারা যেভাবে জাল বিস্তার করে এবং জাল নষ্ট হয়ে গেলে অন্য জায়গায় গিয়ে জাল বোনে, আল কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত জঙ্গিরা এভাবেই তাদের অপারেশন পরিচালনা করে। তবে ইয়েমেন থেকে শুরু করে সিরিয়া পর্যন্ত তারা বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠনকে তাদের সহযোগী সংগঠন বলে মনে করে এবং তাদের সাহায্য করে। ২০০০ সালের পর থেকেই এ অঞ্চলে গঠিত হয়েছে আল কায়দা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা, আল কায়দা ইন ইসলামিক মাগরেব, আল কায়দা ইন ইরাক। এগুলো হচ্ছে আল কায়দার স্থানীয় সংগঠন। এর বাইরে বেশ কিছু সংগঠন আছে, যাদের সঙ্গে আল কায়দার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যেমন আল গামা আল ইসলামিয়া (মিসর), আল নুসরা ফ্রন্ট (সিরিয়া) ইত্যাদি। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় এবং তিউনিসিয়ায় এদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। সোমালিয়ার আল সাহাব কিংবা কেনিয়ার বোকো হারাম গ্র“পের সঙ্গেও রয়েছে এদের যোগাযোগ। লিবিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ মালিতে ইতিমধ্যে এরা শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে। ইয়েমেনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল আল কায়দার নিয়ন্ত্রণে, যে কারণে আলী আবদুল্লাহ সালেহ-পরবর্তী ইয়েমেনে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি এবং সেখানে এখনও ড্রোন বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে।সুতরাং আল কায়দার বাংলাদেশে কোনো ‘সম্পর্ক’ আছে কি-না এটা বুঝতে হলে আমাদের আল কায়দার ইতিহাস ও স্ট্র্যাটেজি বুঝতে হবে। আল কায়দা শরীয়াহর ভিত্তিতে দেশ চালানোর পক্ষে। নুসরা ফ্রন্ট সিরিয়ায় একটি ইসলামী আমিরাত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এমনকি আফগানিস্তানের তালেবানের একটি গ্র“পও আফগানিস্তানকে ইসলামী আমিরাতে পরিণত করতে চায়। ইয়েমেনেও আল কায়দা তেমনটি চায়। এখন বাংলাদেশে যাদের আল কায়দার সহযোগী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তারা কি আদৌ এই ‘রাজনীতিতে’ বিশ্বাস করে? তারা কি চায় দেশে শরীয়াহ আইন প্রবর্তিত হোক? জাতিসংঘ বাংলাদেশে সক্রিয় দুটি সংগঠনকে চিহ্নিত করেছে, যারা আল কায়দার সঙ্গে সম্পর্কিত। এ দুটি সংগঠন হল ‘গ্লোবাল রিলিফ ফাউন্ডেশন’ ও ‘আল হারমাইন’। এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশে পাঁচটি জঙ্গি সংগঠনকে ইতিমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরা সবাই যে আল কায়দার রাজনীতিকে সমর্থন করে, তা নয়। অনেকের সঙ্গেই আল কায়দার তাত্ত্বিক মতপার্থক্য রয়েছে। শায়েখ আবদুর রহমান কিংবা বাংলাভাইয়ের উত্থান নিঃসন্দেহে জঙ্গি তৎপরতাকে উৎসাহিত করেছিল। রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে তাতে জঙ্গিবাদের অবসান ঘটেছে বলা যায় না। দেশে জঙ্গি তৎপরতা যে এখনও নিয়ন্ত্রিত নয়, সর্বশেষ প্রিজন ভ্যান থেকে তিন জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাই তার প্রমাণ। তবে তারা আল কায়দার সঙ্গে জড়িত কি-না সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।যারা বা যে গোষ্ঠীই আল কায়দার বার্তাটি ইন্টারনেটে ছাড়–ক না কেন, তাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল না। আর রাসেল একা এ কাজটি করেছে, এটাও আমার মনে হয় না। বলা হচ্ছে, রাসেল বাঁশের কেল্লা সাইটটির এডমিন। অথচ বাঁশের কেল্লা থেকে জানানো হয়েছে, রাসেল তাদের এডমিন নন। সবাই জানে ছাত্রশিবির ‘বাঁশের কেল্লা’ সাইটটি পরিচালনা করে। এখন সরকারের দায়িত্ব খুঁজে বের করা- রাসেল কাদের হয়ে কাজ করেছে কিংবা তার উদ্দেশ্য কী ছিল।আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া। যদি সত্যিই এটা প্রমাণিত হয় যে জাওয়াহিরির নাম ব্যবহার করে হেফাজতে ইসলাম (কিংবা জামায়াত) এ কাজটি করেছে, তাহলে তাদের আইনের আওতায় নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হওয়া উচিত। অডিও বার্তায় যে বক্তব্য ছিল, তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী। যারা স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তারা দেশের শত্র“। মুসলিম উম্মাহ নিয়ে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এর পর শহীদ জিয়াউর রহমানের সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সম্পর্ক জোরদার হয়। সেই ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ এমন কিছু করেনি, যাতে মুসলিম উম্মাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুতরাং এটা স্পষ্ট, কোনো একটি পক্ষ একটি ভুল মেসেজ দিতে চেয়েছিল। আর আমার সন্দেহটা তাই এ কারণেই যে, টেক্সটাইল নিয়ে পড়া একটি ছেলের পক্ষে এভাবে এ বক্তব্য উপস্থাপন করা সম্ভব কি-না?বাংলাদেশকে আমরা জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই না। এটা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। জঙ্গিবাদের প্রশ্নে আজ সবাইকে এক হতে হবে। আমরা যেন পাকিস্তানের কথা ভুলে না যাই। অডিও টেপের বার্তার সঙ্গে জামায়াত ও বিএনপির অতীত বক্তব্যের কিছু মিল রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রীরা প্রকাশ্যেই তা বলছেন। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে তা দুঃখজনক। বিএনপির মতো একটি মূলধারার গণতান্ত্রিক দলকে আল কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা কতটুকু যৌক্তিক, সে প্রশ্ন উঠবেই। এই অডিওবার্তায় বিএনপির নাম নেই। কিন্তু কোনো কোনো মন্ত্রী, সাবেক মন্ত্রী, দলের শীর্ষ নীতিনির্ধারক যখন বিএনপিকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেন, তখন ব্লেইম গেমের কথাই মনে আসে। অর্থাৎ দোষারোপের রাজনীতি! এক পক্ষ অপর পক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করছে। যেখানে ১৮ ফেব্র“য়ারি কানাডার হাইকমিশনার বললেন, কানাডা দ্রুত সংলাপ ও সমঝোতা চায়, সেখানে একই দিন সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বললেন, বিএনপি ও জামায়াত জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে আসছে। এটা তো সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ করে দেবে! আমরা অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করেছি, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশে দ্রুত একটি নির্বাচন ও সমঝোতা নিয়ে কথা হয়েছে। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সরকার এটাকে উপেক্ষা করে কীভাবে? আর যদি সত্যি সত্যিই উপেক্ষা করে, তা কি এদেশের স্থিতিশীলতার জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে? উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে। এটা সরকারের জন্য একটি মেসেজ অথাৎ নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি সিরিয়াস। সুতরাং যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হয়, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।আল কায়দার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখা হয়। যেখানেই আল কায়দা ঢুকেছে, সেখানেই সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। সোমালিয়া আজ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। পাকিস্তানও সে পথেই যাচ্ছে। বাংলাদেশে আল কায়দার একটা বার্তা প্রচারিত হল। যেদিন রাসেলের গ্রেফতারের খবর ছাপা হয়েছে (১৮ ফেব্র“য়ারি), সেদিন একই পত্রিকায় অনলাইনে হাছান মাহমুদের একটি বক্তব্যও ছাপা হয়েছে (‘এই বার্তাটি আল কায়দার’)। এর অর্থ কী? এ বক্তব্য দিয়ে তিনি কি অন্য কিছু বোঝাতে চাচ্ছেন? মির্জা ফখরুল বলছেন, আল কায়দার হুমকির কথা বলে সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। উদ্দেশ্য যাই হোক, এতে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বৈকি। বাংলাদেশ জঙ্গিবাদকে প্রমোট করে না। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। তারা জঙ্গিদের বারবার ঘৃণা করেই আসছে। বাংলাদেশে আল কায়দার কোনো স্থান নেই।র‌্যাবের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত র‌্যাবই রাসেলকে গ্রেফতার করেছে। এখন যা দেখার বিষয়, তা হচ্ছে রাসেল স্বউদ্যোগে ‘অতি উৎসাহী’ হয়ে এ কাজটি করেছে, নাকি তার পেছনে কোনো শক্তি আছে, কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের ইন্ধন আছে। এ কাজটি র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা করতে পারবে- এ বিশ্বাসও আমার আছে। র‌্যাবকে তার কাজ করতে দেয়া উচিত। আর একটা কথা। জঙ্গিবাদ একটা অভিশাপ। আমরা এ থেকে যেন শিক্ষা নেই। পরস্পরকে অভিযুক্ত করলে জঙ্গিরাই উৎসাহিত হবে বেশি। কোনো প্রমাণ না থাকলে কোনো সংগঠনকে, কোনো শক্তিকে জঙ্গিবাদের অপবাদে অভিযুক্ত করা ঠিক নয়। এখন সত্যিকার অর্থেই দেখার বিষয়, এটা আসলেই একটা ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা কি-না Daily Jugantor 25.02.14

উপজেলা নির্বাচন কী মেসেজ দিয়ে গেল

>
প্রথম পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচন হয়ে গেল ১৯ ফেব্রুয়ারি। আরও চার পর্যায়ে এ নির্বাচন সম্পন্ন হবে। শেষ হবে মার্চের শেষ সপ্তাহে। প্রথম দফায় অনুষ্ঠিত হলো ৯৭টি উপজেলার নির্বাচন। মোট ৪৮৭টি উপজেলার নির্বাচন সম্পন্ন হবে মার্চের শেষ সপ্তাহের মধ্যে। যদিও উপজেলা নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনকে মেলান যাবে না; কিন্তু উপজেলা নির্বাচনের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে উপজেলা নির্বাচন এমন একটি স্তর, যেখান থেকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি হয়। বাংলাদেশেও জাতীয় পর্যায়ে এমন অনেক নেতা আছেন, যারা উপজেলা থেকে উঠে এসেছেন।স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়ে ধীরে ধীরে জাতীয় পর্যায়ে চলে এসেছেন। মন্ত্রীও হয়েছেন কেউ কেউ। যদিও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অতীতে এ নির্বাচনকে কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়নি। ১৯৮২ সালে এরশাদীয় জমানায় দেশে উপজেলা অধ্যাদেশ বলে এ উপজেলা পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এরশাদের আমলে দু'বার উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। একবার ১৯৮৫ সালে, আর দ্বিতীয়বার ১৯৯০ সালে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার দীর্ঘদিন পর, এমনকি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের সময়ও (১৯৯৬-২০০১) উপজেলা নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (ডিসেম্বর) এক মাসের মাথায় শেষবারের মতো উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, যে প্রত্যাশা নিয়ে উপজেলা আইন সৃষ্টি করা হয়েছিল, সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। নানা কারণে ওই উপজেলা পরিষদ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। একটা প্রধান সমস্যা ছিল, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যের দ্বন্দ্ব। দু'জনই জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ায়, কার ক্ষমতা কতটুকু, এই দ্বন্দ্ব রয়ে গিয়েছিল। ফলে সত্যিকার অর্থে উপজেলা পরিষদ কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। আইনে নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান থাকলেও, বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তার ক্ষমতা নির্ধারিত নেই এবং তিনি নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছেন না। ফলে কাগজে-কলমে উপজেলা পরিষদ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটা ভিত্তি হলেও, এই সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। উপজেলা থেকে নেতৃত্ব তৈরি হয়নি এবং আগামীতেও হবে কিনা সে প্রশ্ন রয়ে গেছে। কেননা উপজেলা চেয়ারম্যানদের সরকারি অর্থে পাজেরো গাড়ি কিনে দেয়া ও মাসে মাসে জ্বালানি এবং বেতন-ভাতা দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির যে ভিত্তি, তা গড়ে তোলা যায়নি।


এখন উপজেলা পরিষদের যে নির্বাচন হয়ে গেল, তার ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব? প্রথমত, এটাও অনেকটা আইনগত বাধ্যবাধকতা ছিল। অনেক উপজেলা চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং নতুন উপজেলা চেয়ারম্যানের নির্বাচন প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে একটি ফলাফল বেসরকারিভাবে পাওয়া গেছে। প্রাথমিক পর্যায়ের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে। এতে করে এটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে, স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির ভিত্তি অনেক শক্তিশালী। সুতরাং এটা বিবেচনায় নিতে হবে। তৃতীয়ত, এই নির্বাচন আবারও প্রমাণ করল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থা জন্ম হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে তো বটেই, স্থানীয় পর্যায়ে এ দুই দলের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। যদিও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনকে মেলান যাবে না। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে এই দল দুটির গণভিত্তি অনেক শক্তিশালী। আর এ গণভিত্তিই জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়। চতুর্থত, যেহেতু এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচনপ্রক্রিয়া চিন্তা করা যাবে না, সেহেতু এ উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলকে ধারণ করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। পঞ্চমত, উপজেলা নির্বাচন বিএনপি বয়কট করেনি। এর অর্থ পরিষ্কার। বিএনপি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় থাকতে চায়। অর্থাৎ জাতীয় পর্যায়ের যে সংসদ নির্বাচন, সে ব্যাপারে বিএনপি একটি মেসেজ দিল যে, তারা এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারেও সিরিয়াস। ষষ্ঠত, এই নির্বাচন প্রমাণ করল স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীরও একটা অবস্থান রয়েছে। জামায়াতের প্রার্থীরা একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছে। সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়কে হাল্কাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সপ্তমত, উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের ভরাডুবি প্রমাণ করল জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক ভূমিকায় স্থানীয় পর্যায়ের প্রার্থীরা অসন্তুষ্ট। এটা জাতীয় পার্টির জন্য একটি মেসেজও বটে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় একটি শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টি বিকশিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের পর থেকে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে এ সত্যটাই প্রমাণ করবে যে, জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে তৃতীয় পার্টি। যদিও এর প্রায় পুরোটারই কৃতিত্ব ব্যক্তি এরশাদের। বাহ্যত বৃহত্তর উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক এই দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্যক্তি এরশাদের কারণে। এর বাইরে অন্যত্র জাতীয় পার্টি কিছুটা হলেও তার প্রভাব বাড়িয়েছিল, এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল, তা পার্টির জন্য কোনো 'শুভ' সংবাদ বয়ে আনেনি। একদিকে সরকারে থাকা, আবার বিরোধী দলেও থাকা- এই যে 'রাজনীতি', এই রাজনীতি মানুষ গ্রহণ করে নেয়নি। উপজেলা নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। অষ্টমত, উপজেলা নির্বাচনেও সহিংস ঘটনা ঘটেছে। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এত ব্যাপকতা ছিল না। এখানে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা ছিল চোখে লাগার মতো। নির্বাচন কমিশন সহিংসতা রোধের ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যেসব জায়গায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সহিংসতা হয়েছে, সেসব জায়গাতেই উপজেলা নির্বাচনের সময় সহিংসতা বেশি হয়েছে। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল নির্বাচনের আগে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা, তা তারা করেনি। নবমত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'বেস্নম গেম', অর্থাৎ পরস্পরকে দোষারোপ করার যে 'রাজনীতি', তা উপজেলা নির্বাচনেও প্রতিফলিত হয়েছেনির্বাচনের পরপরই বিএনপির মুখপাত্র বিভিন্ন কেন্দ্রে জাল ভোট দেয়া, কেন্দ্র দখল ইত্যাদি ঘটনার জন্য সরকারি দল তথা প্রশাসনযন্ত্রকে দায়ী করেছিলেন। ঠিক তেমনি প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা অভিযোগ করলেন, 'বিএনপি মিথ্যা কথার জাল বুনছে'। বিএনপির অভিযোগের পেছনে সত্যতা যে নেই, তা কিন্তু বলা যাবে না। একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে প্রথম পাতায় একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, নির্বাচনের দায়িত্বে নিযুক্ত এক কর্মকর্তা ব্যালট পেপারে সিল মারছেন। এর কোনো ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশন থেকে দেয়া হয়নি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, এই দোষারোপের রাজনীতি যদি পরিত্যাগ করতে না পারি, তাহলে আমরা গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না।প্রথম পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর মার্চে হবে আরও দু'দফা নির্বাচন। আমার ধারণা, পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ায়ই দুটো বড় দলের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকবে। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের নীতি-নির্ধারকদের কাছে একটা মেসেজ পেঁৗছে দেবে। তবে এই ফলাফল থেকে তারা কতটুকু ধারণ করবেন, সেটা ভিন্ন একটা প্রশ্ন।যে প্রশ্নটি অনেকেই এখন করার চেষ্টা করবেন, তা হচ্ছে এই নির্বাচনের ফলাফল কী সরকারের নীতি-নির্ধারকদের একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাব বিস্তার করবে? আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র পর্যায়ের নেতা আকারে-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেছেন, দশম সংসদ পাঁচ বছর টিকে থাকবে এবং ২০১৯ সালে 'সমঝোতা'র ব্যাপারে কথা হবে। আওয়ামী লীগের অনেক নীতি-নির্ধারককে বলতে শুনেছি, সংসদ যদি দীর্ঘদিন চলে, তাহলে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা আসতে বাধ্য। তাতে করে বিএনপি ভেঙে যাবে! এ ধরনের কথাবার্তা কোনো বাস্তববাদী কথাবার্তা নয়।এখন নির্বাচন আয়োজন করে প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্দেহে 'বিজয়ী' হয়েছেন! কিন্তু তার 'পরাজয়' ঘটবে যদি তিনি বাস্তববাদী নীতি অনুসরণ না করেন। আর বাস্তববাদী নীতি অনুসরণ করতে হলে তাকে বিএনপির সঙ্গে একটা সমঝোতায় যেতে হবে। এই সমঝোতার ধরন কী হবে, কিংবা সরকার কতটুকু ছাড় দেবে, তা এই মুহূর্তে হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন এবং জনপ্রিয়তা আরও বাড়াতে পারবেন, যদি থেমে যাওয়া সংলাপ প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ তিনি দেন। মনে রাখতে হবে, দশম সংসদ নির্বাচন কিংবা উপজেলা নির্বাচন আয়োজন করে 'পূর্ণ বিজয়' নিশ্চিত করা যাবে না। দ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে। কেননা এর সঙ্গে অনেক প্রশ্ন জড়িত।প্রথমত, দশম সংসদ নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা না আসায় বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। 'সব দলের অংশগ্রহণের নির্বাচনের' যে দাবি দাতারা করেছিল, তা নিশ্চিত করা যায়নি। এর জন্য কে দায়ী, সে হিসাব নিশ্চয়ই করা যায়। কিন্তু এর চেয়েও যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে নির্বাচনের প্রশ্নে একটি ঐকমত্যে পেঁৗছা এবং সহিংসতা বন্ধে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া। বিগত দশম সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার যে চিত্র আমরা দেখেছি, তা যে কোনো বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য। এই সহিংসতা গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায়, সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা এখন ঝুঁকির মুখে থাকল। আগামীতে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিতে আসার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তারা তখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। আজকে নিউইয়র্কের ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায়, যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু যে দেশটি এখন বিশ্বে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি মডেল (শান্তিরক্ষায় অংশগ্রহণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, দারিদ্র্যসীমা কমিয়ে আনা, এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ইত্যাদি), সেই দেশটির সব উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা এখন প্রশ্নের মুখে থাকল। আমাদের নেতারা ব্যর্থ হলেন একটা সমঝোতায় যেতে।সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে একদলীয় নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের বক্তব্যকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাদের বাংলাদেশের ব্যাপারে 'গৃহযুদ্ধের' মূল্যায়ন আমাদের সব অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে! বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম দিতে পারে। এই প্রতিবেদনটি, যা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ২ জানুয়ারি। ঠিক তার একদিন পর বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) বার্ষিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। বিএমবিএস বলেছে, ২০১৩ সালে দেশজুড়ে যে সহিংসতা হয়েছে, তাতে মারা গেছেন ৫৭৩ জন, যার মধ্যে পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। আর আহতদের সংখ্যা ১০ হাজার ৪০৩ জন।একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে মানুষ মারা যাবে, এটা অকল্পনীয়। 'গৃহযুদ্ধের' ধারণা যারা দেন, তারা এই পরিসংখ্যানকে এখন ইস্যু করতে পারে। অনেকেই এখন জানেন, ওই নির্বাচনে ১৫৩ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। শতকরা ৫২ ভাগ জনগোষ্ঠী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদের এটা ছিল পরিপন্থী, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে 'প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।' সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর (১৯৯১) মাধ্যমে এই শব্দগুলো সংবিধানে সনি্নবেশিত হয়। আমাদের সবার মাঝে একটা ধারণা রয়েছে যে, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব। কিন্তু সহিংসতা রোধে ব্যর্থতা এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এত বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর বিজয়(?) প্রমাণ করল নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ। তাদের এই ব্যর্থতার প্রশ্নটিই তুলেছেন সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার।বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে সরকারের প্রভাবের বাইরে কাজ করতে পারে না, তা আরও একবার প্রমাণিত হলো। একাধিক ক্ষেত্রে ইসির ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। সরকারের চাপ উপেক্ষা করে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা কমিশনের সফলতা হিসেবেই বিবেচিত। কিন্তু 'সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি না জানিয়ে' ইসি বিতর্কিত হয়েছিল। কমিশন ২৮ জুলাই (২০১৩) নিজের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে প্রার্থিতা বাতিল সম্পর্কিত আরপিওর ৯১(ই) ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও পরে প্রতিবাদের মুখে ইসি সরে আসে। মিথ্যা হলফনামা দিয়ে কেউ নির্বাচিত হলে তার নির্বাচন বাতিল, নির্বাচনে কারচুপি হলে ফলাফল স্থগিত ও বাতিল করার ক্ষমতা ইসির নেই।নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না, এটা যদি ইসির কাছে প্রতীয়মান হয়, তাহলে ওই নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতাও ইসির নেই। আর্থিক ব্যাপারগুলোতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্পূর্ণ অবমুক্তি করার দাবিরও কোনো সমাধান হয়নি। এর মধ্য দিয়ে সরকারের প্রভাব বিস্তার করার একটা সুযোগ থেকে যায়। সুতরাং ইসির বর্তমান কাঠামোয় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা যে সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হলো। আমরা ভারতের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা থেকেও কিছু শিখিনি।জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন করে সরকার আবারও সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করল। এটা সরকারের এক ধরনের 'বিজয়' সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। মানুষ নির্বাচন চায়। কিন্তু সব দলের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত হয়, তাহলেই এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। উপজেলা নির্বাচন এ কথাটাই আবার প্রমাণ করল। উপজেলা নির্বাচনের এই 'গ্রহণযোগ্যতা'কে ধারণ করে সরকার যদি একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে একটা উদ্যোগ নেয়, তাহলে ভালো করবে। Daily ALOKITO BANGLADESH 24.02.14

স্বর্ণের নৌকা যখন উপহার

জনপ্রতিনিধিদের স্বর্ণের তৈরি নৌকা ‘উপহার’ হিসেবে নেয়া এখন যেন ট্রেডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে! প্রথমে খবর এলো একজন নয়া প্রতিমন্ত্রীর। তারপর এলো চিফ হুইপের। তিনি নৌকা চাইলেন না। তিনি চাইলেন টাকা, তাও প্রকাশ্যে জনসভায়। আর এবার তিনি সোনার নৌকা (ফোন পিন) নিলেন বাগেরহাট-৪-এর এমপি। এবারো জনসভায় (সকালের খবর, ১৬ ফেব্র“য়ারি)। একজন নয়া প্রতিমন্ত্রীর সোনার নৌকা উপহার নেয়া সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি যখন পত্রিকায় ছাপা হলো, তখন তিনি এটা বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ দান করলেন একটি প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনে। কাজটি ভালো, সন্দেহ নেই। কিন্তু যিনি প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন একটি সুযোগ পেয়েছেন নিজেকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার। তিনি কি সচেতন মনে এই ‘স্বর্ণ নৌকা’টি গ্রহণ করেছিলেন? তার কি একবারো মনে হয়নি যে এটা নেয়া তার উচিত নয়? পত্র-পত্রিকায় সংবাদটি ছাপা না হলে কি ‘স্বর্ণ নৌকা’টি তিনি তার ড্রইং রুমে সাজিয়ে রাখতেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কম বিতর্কিত এবং তরুণ নেতৃত্বকে এবার মন্ত্রিসভায় নিয়ে এসেছেন। এটা একটা ভালো দিক। এটা বোঝাই যায় তিনি আগামী দশকের জন্য আওয়ামী লীগে নয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। মন্ত্রিসভায় অনেক নতুন মুখ এসেছে, কিন্তু পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এ কাজটি কি করলেন? দেশজুড়ে যখন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী ও এমপিদের সহায়সম্পত্তি নিয়ে তোলপাড়, সেখানে ‘স্বর্ণ নৌকা’ নেয়া কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছিল, সেটা তিনি এখন নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে পারেন। আর মন্ত্রীর মর্যাদায় আসীন চিফ হুইপ চাইলেন টাকা! টাকার কথা তিনি স্বীকার করেছেন বটে, তবে বিতর্কের মুখে একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন-টাকাটা দরকার তার দলের জন্য! সত্যিই কি তাই? দল কি তাকে এই অনুমতি দিয়েছিল? নয়া নেতৃত্ব চাই, কিন্তু কেমন হচ্ছে এই নয়া নেতৃত্ব? চিফ হুইপ কিংবা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যদি গাছের চারা চাইতেন, আমরা খুশি হতাম সবচেয়ে বেশি। হরতাল আর অবরোধের কারণে অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এতে আমাদের যে কত ক্ষতি হয়ে গেল কেউই তা উপলব্ধি করতে পারিনি। এখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মন্ত্রীরা উপঢৌকন হিসেবে গাছের চারা নিন। রাস্তার পাশে নতুন করে গাছের চারা রোপণ করা হোক। মন্ত্রীদের অভ্যর্থনা বাবদ যে অর্থ ব্যয় হয় তা দিয়ে গাছের চারা কেনা হোক। লাগানো হোক হাজার হাজার গাছের চারা। একজন কর্মী যদি একটি করে গাছের চারাও লাগান, হাজার হাজার চারা লাগানো হবে। এতে কিছুটা ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব।চিফ হুইপের টাকা চাওয়ার ঘটনা যখন পত্র-পত্রিকায় চাপা হয়েছে, ঠিক তখনই ছাপা হয়েছে আরো একটি সংবাদ নারী আসনে নতুনরা প্রাধান্য পাবেন আওয়ামী লীগে। সংবাদটিতে আমি খুব উৎসাহিত বোধ করছি না। কেননা সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম দেখলাম, তাতে হতাশা আরো বাড়ল। অভিনেত্রী, নায়িকা, ভাস্কর্য শিল্পী সবাই মহিলা এমপি হতে চান! একজন মঞ্চ অভিনেত্রী বা একজন চলচ্চিত্র নায়িকার এমন কী অভিজ্ঞতা রয়েছে যে, তিনি একজন আইন প্রবণতা হতে চান? তাদের জন্য কি মঞ্চ বা সিনেমাই ভালো জায়গা নয়, যেখানে তারা তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারবেন। সংসদ কেন? পুরনো সংসদে (নবম জাতীয় সংসদ) আওয়ামী লীগের অনেক এমপি বারবার বিতর্কিত হয়েছেন। অশ্লীল বাক্য ব্যবহার, উত্তেজিত হয়ে কথা বলা, গালিগালাজ করে তারা সংসদের সৌন্দর্যও নষ্ট করেছেন অনেক। তাদের পুনরায় মনোনয়ন দেয়া ঠিক হবে না। অনেক মহিলা এমপি আছেন বিগত পাঁচ বছরে তারা সংসদে একটি কথা বলেছেন কি-না সন্দেহ। তাদেরও মনোনয়ন দেয়া ঠিক হবে না। সমাজে নামি-দামি অনেক সমাজকর্মী রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক রয়েছেন। আওয়ামী লীগ তাদের দলের টানতে পারে। তাদের সুযোগ করে দিতে পারে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার। একজন ড. শিরীন শারমিন শুধু একজন নারী হিসেবেই নন, একজন যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই তিনি আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। তাই বিতর্কিত মহিলা এমপিদের বাদ দিয়ে যোগ্য নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুক আওয়ামী লীগ। নয়া নেতৃত্ব দরকার। জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদরা আর কত দিন রাজনীতির মাঠে বিচরণ করবেন? দশম সংসদে তাদের দু’একজনকে দেখেছি বটে, কিন্তু একাদশ সংসদে তারা থাকবেন কি-না নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। ভারতে কিন্তু একটা নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে এসেছে। তারা আধুনিকমনস্ক। উচ্চ শিক্ষিত এবং প্রযুক্তিবান্ধব। যদিও অনেকেই এসেছেন পারিবারিক রাজনীতির ধারা অনুসরণ করে। আমি তাতে দোষ দেখি না। চলতি বছরের মাঝামাঝি সেখানে যে সাধারণ নির্বাচন হবে, তাতে কংগ্রেস জোট যদি বিজয়ী হয়, তাহলে রাহুল গান্ধী হতে যাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। রাহুল গান্ধী ইতোমধ্যে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি কংগ্রেসের ঊর্ধ্বতন নেতাও বটে। তবে তার চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে তিনি একটি তরুণ প্রজন্মকে তার সঙ্গে পেয়েছেন। বিজেপি তার বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের যত অভিযোগই আনুক না কেন, তিনি ভারতব্যাপী একটি ‘ইমেজ’ তৈরি করে ফেলেছেন। তরুণ প্রজšে§র প্রতিনিধি তিনি। প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবারতন্ত্র ভালো, না খারাপ। সিঙ্গাপুরে লি কুয়ান ইউ’র ছেলে যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন সেখানে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ তিনি যোগ্য। সিঙ্গাপুরকে বিশ্বসভায় নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা তিনি অতীতে রেখেছেন। এ প্রশ্ন ওঠেনি ফিলিপাইনে কোরাজন একিনোর ছেলের বেলায়। একজন সিনেটর হিসেবে তিনি অবদান রেখেছিলেন। প্রাচীন ভারতে একটি শ্লোক আছে Vasudua Kutumbikam। সংস্কৃতি থেকে ইংরেজি করলে দাঁড়ায় ‘All the Univers is a Family।’ অর্থাৎ বিশ্বকে একটি পরিবার হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমান যুগের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সেই বিবেচনায় নিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে তারা শাসন করে। ভারতের রাজনীতিতে এই পারিবারিক ধারা অত্যন্ত শক্তিশালী। নেহরু পরিবারের বাইরে বেশকিছু পরিবারের জন্ম হয়েছে, যারা রাজনীতিতে প্রভাব খাটাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় চরণ সিং, দেবগৌড়া, শারদ পাওয়ার, আব্দুল্লাহ, মুলায়ম সিং যাদব, করুণানিধি, রেড্ডি ও সিন্ধিয়া পরিবার। এসব পরিবারের পেশা হচ্ছে রাজনীতি। পারিবারিক ও রাজনীতির ধারা বাংলাদেশেও আছে এবং থাকবে। বাংলাদেশে আলোচিত হচ্ছেন তারেক ও জয়। জয় সক্রিয় রাজনীতিতে আসেননি। আমার ধারণা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি আগামীতে সক্রিয় হবেন এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়াবেন। তিনি যদি পূর্ণকালীন রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করেন আমি তাতে অবাক হব না। বিদেশে দীর্ঘদিন থাকা একজন ব্যক্তি, তিনি তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তিনি আধুনিকমনস্ক ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। আমি তো মনে করি তিনি রাজনীতির সনাতন ধারাকে বদলে দিতে পারেন। তার বিদেশি স্ত্রী তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতির কোনো কারণ হতে পারেন না। একুশ শতকে এক তরুণ নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগকে সজীব ওয়াজেদ জয় একুশ শতক উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারেন। একই কথা প্রযোজ্য তারেক রহমানের ক্ষেত্রেও। গেল বছর জুলাই মাসে লন্ডনে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে আমি নেতৃত্বের একটি ‘গন্ধ’ পাচ্ছি। তিনিই বিএনপির নেতা। বেগম জিয়া-পরবর্তী দলকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তৈরি হয়েছেন তারেক রহমান। তিনি যে ‘ভুল’ করেননি তা নয়। অতীত থেকে তিনি শিখেছেন। তিনি এখন যথেষ্ট ‘ম্যাচিউরড’। তার বক্তব্যের মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছে তিনি বাংলাদেশকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চান। বিএনপিকে এখন এই তরুণ নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করতে হবে, গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তাদের নিয়ে আসতে হবে স্থায়ী কমিটিতে। স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে যারা আছেন, তাদের দু’একজন বাদে অনেকেই কর্মহীন। প্রত্যাশা অনুযায়ী দলকে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন দরকার। বিরোধী পক্ষকে আস্থায় না নেয়া এবং রাজনীতি থেকে তাদের উৎখাত করা, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির পরিবেশ উত্তেজিত করে তোলা, সহিংস পথে রাজনীতিকে পরিচালনা করা, ব্যক্তিগত প্রাপ্তিকে রাজনীতির চেয়ে বড় করে দেখা, হত্যা, চাঁদাবাজির মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা এই যে রাজনীতির চিত্র তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। আওয়ামী লীগের সিনিয়র পর্যায়ে যারা রয়েছেন দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, তারা জাতির জন্য কোনো ‘রোল মডেল’ নন। অনেকেই আছেন বহিরাগত। যে দলটিকে এক সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাজউদ্দীন আহমদ, আজ এত বছর পর দল কি ‘আরেকজন শেখ মুজিব’ কিংবা ‘আরেকজন তাজউদ্দীন’ তৈরি করতে পেরেছে? প্রধানমন্ত্রী সুযোগ দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মকে। কিন্তু ‘স্বর্ণ নৌকা’ উপহার নেয়া, সাধারণ মানুষের কাছে নগদ টাকা চাওয়া, বাস-ট্রাক বন্ধ করে, সড়ক দখল করে হুইপের সংবর্ধনা নেয়া আর যাই হোক এতে আস্থার জায়গাটা তৈরি হয় না এবং এমনটি রাজনীতিকে কালিমালিপ্ত করে। চিফ হুইপ দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রতিমন্ত্রী স্বর্ণ বিক্রি করে সে টাকা দান করেছেন, কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমরা এ ধরনের তরুণ নেতৃত্ব আদৌ চাই না। এ থেকে আমাদের দেশের তরুণ নেতৃত্ব যদি কিছু শেখেন, সেটা হবে আমাদের জন্য বড় পাওয়া। বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ তরুণ নেতৃত্বের জন্য তৈরি। তবে সেই তরুণ নেতৃত্বকে হতে হবে দুর্নীতিমুক্ত ও আধুনিকমনস্ক। দেশপ্রেম বোধে উজ্জীবিত হয়ে উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির রাজনীতি বর্জন করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে হবে। নীতি-নৈতিকতাকে রাজনৈতিক জীবনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষের পাশে থাকার মানসিকতা তাদের থাকতে হবে। শত শত তোরণ তৈরি করে জোর করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাত্রদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে সংবর্ধনা পায় বটে; কিন্তু তাতে যে ‘ইমেজ’ তৈরি হয়, তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনে না। তরুণ নেতৃত্ব আসুক, কিন্তু সেই নেতৃত্ব যেন ‘স্বর্ণের নৌকা’ আর নগদ টাকা নেয়ার জন্য উদগ্রীব না থাকেন। Daily Manobkontho 20.02.14

এ লজ্জা আমরা রাখব কোথায়!

তাঁর সোজাসাপ্টা কথা। ক্রেস্ট নয়। চাই নগদ টাকা। প্রকাশ্যে জনসভায় তিনি জানিয়ে দিলেন কোথায় কখন টাকা দিতে হবে। তিনি আমাদের সংসদের চিফ হুইপ, মন্ত্রীর পদমর্যাদা তাঁর। এর আগে একজন নবনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী 'স্বর্ণের নৌকা' নিয়েছিলেন। উপহার পাওয়া এই নৌকা সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি যখন পত্রিকায় ছাপা হলো, তখন তিনি এটা বেচে দিয়ে প্রাপ্ত অর্থ দান করলেন একটি প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনে। কাজটি ভালো, সন্দেহ নেই। কিন্তু যিনি প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন, একটি সুযোগ পেয়েছেন নিজেকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার, তিনি কি সচেতন মনে এই 'স্বর্ণ নৌকা'টি গ্রহণ করেছিলেন? তাঁর কি একবারও মনে হয়নি যে এটা নেওয়া তাঁর উচিত নয়! পত্রপত্রিকায় সংবাদটি ছাপা না হলে কি 'স্বর্ণ নৌকা'টি তিনি তার ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখতেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কম বিতর্কিত এবং তরুণ নেতৃত্বকে এবার মন্ত্রিসভায় নিয়ে এসেছেন। এটা একটা ভালো দিক। এটা বোঝাই যায়, তিনি আগামী দশকের জন্য আওয়ামী লীগে নয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। মন্ত্রিসভায় অনেক নতুন মুখ এসেছে। কিন্তু পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এ কাজটি কী করলেন? দেশজুড়ে যখন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী ও এমপিদের সহায়-সম্পত্তি নিয়ে তোলপাড়, সেখানে 'স্বর্ণ নৌকা' নেওয়া কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছিল, সেটা তিনি এখন নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে পারেন। আর মন্ত্রীর মর্যাদায় আসীন চিফ হুইপ কিনা চাইলেন টাকা? টাকার কথা তিনি স্বীকার করেছেন বটে। তবে বিতর্কের মুখে একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন- টাকাটা দরকার তাঁর দলের জন্য! সত্যিই কী তাই? দল কি তাঁকে এই অনুমতি দিয়েছিল? নয়া নেতৃত্ব চাই। কিন্তু কেমন হচ্ছে এই নয়া নেতৃত্ব? চিফ হুইপ কিংবা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যদি গাছের চারা চাইতেন, আমি খুশি হতাম সবচেয়ে বেশি। হরতাল আর অবরোধের কারণে অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এতে আমাদের যে কত ক্ষতি হয়ে গেল, আমরা কেউই তা উপলব্ধি করতে পারিনি। এখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মন্ত্রীরা উপঢৌকন হিসেবে গাছের চারা নিন। রাস্তার পাশে নতুন করে গাছের চারা রোপণ করা হোক। মন্ত্রীদের অভ্যর্থনা বাবদ যে অর্থ ব্যয় হয়, তা দিয়ে গাছের চারা কেনা হোক। লাগানো হোক হাজার হাজার গাছের চারা। একেকজন কর্মী যদি একটি করে গাছের চারাও লাগান, হাজার হাজার চারা লাগানো হবে। এতে কিছুটা ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব।
চিফ হুইপের টাকা চাওয়ার ঘটনা যখন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, ঠিক তখনই ছাপা হয়েছে আরো একটি সংবাদ- নারী আসনে নতুনরা প্রাধান্য পাবেন আওয়ামী লীগে। সংবাদটিতে আমি খুব উৎসাহ বোধ করছি না। কেননা সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যাঁদের নাম দেখলাম, তাতে হতাশা আরো বাড়ল। একজন অভিনেত্রী, একজন চিত্রনায়িকা, একজন ভাস্কর্য শিল্পী সবাই মহিলা এমপি হতে চান! একজন মঞ্চ অভিনেত্রী বা একজন নায়িকার এমন কী অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান রয়েছে যে তিনি একজন আইনপ্রণেতা হতে চান? তাঁদের জন্য কি মঞ্চ বা সিনেমাই ভালো জায়গা নয়, যেখানে তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারবেন। সংসদ কেন? পুরনো সংসদে (নবম জাতীয় সংসদ) আওয়ামী লীগের অনেক এমপি বারবার বিতর্কিত হয়েছেন। অশ্লীল বাক্য ব্যবহার, উত্তেজিত হয়ে কথা বলা, গালিগালাজ করে তাঁরা সংসদের সৌন্দর্যও নষ্ট করেছেন অনেক। তাঁদের আবারও মনোনয়ন দেওয়া ঠিক হবে না। অনেক মহিলা এমপি আছেন। বিগত পাঁচ বছরে তাঁরা সংসদে আদৌ একটি কথা বলেছেন কি না সন্দেহ। তাঁদেরও মনোনয়ন দেওয়া ঠিক হবে না। সমাজের নামিদামি অনেক সমাজকর্মী রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক রয়েছেন। আওয়ামী লীগ তাঁদের দলে টানতে পারে। তাঁদের সুযোগ করে দিতে পারে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার। একজন ড. শিরীন শারমিন শুধু একজন নারী হিসেবেই নন, একজন যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই তিনি আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। তাই বিতর্কিত মহিলা এমপিদের বাদ দিয়ে যোগ্য নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুক আওয়ামী লীগ। নতুন নেতৃত্ব দরকার। সিনিয়র রাজনীতিবিদরা আর কত দিন রাজনীতির মাঠে বিচরণ করবেন? দশম সংসদে তাঁদের দু-একজনকে দেখেছি বটে, কিন্তু একাদশ সংসদে তাঁরা থাকবেন কি না, নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। ভারতে কিন্তু একটা নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে এসেছে। তারা আধুনিক মনস্ক, উচ্চ শিক্ষিত এবং প্রযুক্তিবান্ধব। যদিও অনেকেই এসেছেন পারিবারিক রাজনীতির ধারা অনুসরণ করে। আমি তাতে দোষ দেখি না। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে সেখানে যে সাধারণ নির্বাচন হবে, তাতে কংগ্রেস জোট যদি বিজয়ী হয়, তাহলে রাহুল গান্ধী হতে যাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। রাহুল গান্ধী ইতিমধ্যে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি কংগ্রেসের ঊর্ধ্বতন নেতাও বটে। তবে তাঁর চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে তিনি একটি তরুণ প্রজন্মকে তাঁর সঙ্গে পেয়েছেন। বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের যত অভিযোগই আনুক না কেন, তিনি ভারতব্যাপী একটি 'ইমেজ' তৈরি করে ফেলেছেন। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি তিনি।
প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবারতন্ত্র ভালো, না খারাপ! সিঙ্গাপুরে লি ফুয়ান ইউর ছেলে যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন সেখানে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ তিনি যোগ্য। সিঙ্গাপুরকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা তিনি প্রমাণ করেছেন। এ প্রশ্ন ওঠেনি ফিলিপাইনে কোরাজন আকিনোর ছেলের বেলায়ও একজন সিনেটর হিসেবে তিনি অবদান রেখেছিলেন। প্রশ্নটা সেখানেই। প্রাচীন ভারতে একটি শ্লোক আছে-Vasudua kutumbikam। সংস্কৃতি থেকে ইংরেজি করলে দাঁড়ায়। 'all the universe is a family'। অর্থাৎ বিশ্বকে একটি পরিবার হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমান যুগের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সেই বিবেচনায় নিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে তাঁরা শাসন করেন। ভারতে রাজনীতিতে এই পারিবারিক ধারা অত্যন্ত শক্তিশালী। নেহেরু পরিবারের বাইরে বেশ কিছু পরিবারের জন্ম হয়েছে, যাঁরা রাজনীতিতে প্রভাব খাটাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, চরণ সিং, দেবগৌড়া, সারদ পাওয়ার, আবদুল্লাহ, মুলায়ম সিং যাদব, করুণানিধি, রেড্ডি, সিঙ্গিয়া পরিবার। এসব পরিবারের পেশা হচ্ছে রাজনীতি। বাংলাদেশ এ থেকে পৃথক নয়। পারিবারিক এ রাজনীতির ধারা বাংলাদেশে আছে ও থাকবে। বাংলাদেশে আলোচিত হচ্ছেন তারেক ও জয়। জয় সক্রিয় রাজনীতিতে আসেননি। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি ভবিষ্যতে সক্রিয় হবেন এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়াবেন। তিনি যদি পূর্ণকালীন রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করেন, আমি তাতে অবাক হব না। বিদেশে দীর্ঘদিন থাকা একজন ব্যক্তি, যিনি তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি আধুনিকমনস্ক ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। আমি তো মনে করি, তিনি রাজনীতির সনাতন ধারাকে বদলে দিতে পারেন। তাঁর বিদেশি স্ত্রী, তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতির কোনো কারণ হতে পারে না। একুশ শতকে এক তরুণ নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগকে সজীব ওয়াজেদ জয় একুশ শতক উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারেন। একই কথা প্রযোজ্য তারেক রহমানের ক্ষেত্রে। গেল বছর জুলাই মাসে লন্ডনে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে আমি নেতৃত্বের একটি 'গন্ধ' পাচ্ছি। তিনিই বিএনপির নেতা। বেগম জিয়া-পরবর্তী দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছেন তারেক রহমান। তিনি যে 'ভুল' করেননি, তা নয়। অতীত থেকে তিনি শিখেছেন। তিনি যথেষ্ট 'ম্যাচিওরড'। তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছে তিনি বাংলাদেশকে ২১ শতকে নিয়ে যেতে চান। বিএনপিকে এখন এই তরুণ নেতৃত্বের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাদের নিয়ে আসতে হবে স্থায়ী কমিটিতে। স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে যাঁরা আছেন, তাঁদের দু-একজন বাদে অনেকেই কর্মহীন। প্রত্যাশা অনুযায়ী দলকে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না।
বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন দরকার। বিরোধী পক্ষকে আস্থায় না নেওয়া এবং রাজনীতি থেকে তাঁদের উৎখাত করা, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে রাজনীতিকে উত্তেজিত করে তোলা, সহিংস পথে রাজনীতিকে পরিচালনা করা, ব্যক্তিগত প্রাপ্তিকে রাজনীতির চেয়ে বড় করে দেখা, হত্যা, চাঁদাবাজির মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা- এই যে রাজনীতির চিত্র, তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। আওয়ামী লীগের সিনিয়র পর্যায়ে যাঁরা রয়েছেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, তাঁরা জাতির জন্য কোনো 'রোল মডেল' নন। অনেকেই আছেন বহিরাগত। যে দলটিকে একসময় নেতৃত্ব দিয়েছেন মাওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাজউদ্দীন আহমেদ, আজ এত বছর পর দল কি 'আরেকজন শেখ মুজিব' কিংবা 'আরেকজন তাজউদ্দীন' তৈরি করতে পেরেছে? প্রধানমন্ত্রী সুযোগ দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মকে। কিন্তু 'স্বর্ণ নৌকা' উপহার নেওয়া, সাধারণ মানুষের কাছে নগদ টাকা চাওয়া, বাস-ট্রাক বন্ধ করে সড়ক দখল করে হুইপের সংবর্ধনা নেওয়া (কালের কণ্ঠ, ৯ ফেব্রুয়ারি) আর যা-ই হোক, এতে আস্থার জাগয়াটা তৈরি হয় না। চিফ হুইপ দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রতিমন্ত্রী স্বর্ণ বিক্রি করে সে টাকা দান করেছেন। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমরা এ ধরনের তরুণ নেতৃত্ব আদৌ চাই না। এ থেকে আমাদের দেশের তরুণ নেতৃত্ব যদি কিছু শেখেন, সেটা হবে আমাদের জন্য বড় পাওয়া। বাস্তবতাই হচ্ছে বাংলাদেশ তরুণ নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছে। তবে সেই তরুণ নেতৃত্বকে হতে হবে দুর্নীতিমুক্ত ও আধুনিকমনস্ক। মানুষের পাশে থাকার মানসিকতা তাঁদের থাকতে হবে। শত শত তোরণ তৈরি করে (শেরপুর) জোর করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাত্রদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে সংবর্ধনা নেওয়া যায় বটে, কিন্তু তাতে যে 'ইমেজ' তৈরি হয়, তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনে না। তরুণ নেতৃত্ব আসুক। কিন্তু সেই নেতৃত্ব যেন 'স্বর্ণের নৌকা' আর নগদ টাকা নেওয়ার জন্য উদগ্রীব না থাকেন।
Daily Kalerkontho
19.02.14

টকশোতে ঝগড়া নয়, বিশেষজ্ঞ মতই কাম্য

সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টকশোতে এ কী আচরণ দেখলাম আমরা? একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যিনি আবার অ্যাক্টিভিস্টও, তার সঙ্গে রীতিমতো ‘ঝগড়া’ লেগে গেল বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত একজন সাবেক সংসদ সদস্যের। শুধু ঝগড়া বললে ভুল বলা হবে- হুমকি-ধামকি, এমনকি দু’জন অতিথি একপর্যায়ে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। টিভি টকশোগুলোর দর্শক বেশি। লাখ লাখ দর্শক দেখল কীভাবে একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (এ পরিচয় সচরাচর তিনি দেন না), যার জন্ম খুব সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের পরে, কীভাবে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার(?) করেন দলীয় স্বার্থে। বিএনপির ওই সাবেক সংসদ সদস্য, যিনি একসময় সেনাবাহিনীতে ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাও বটে, তার আপত্তি লাগারই কথা। যেভাবে লাইভ সম্প্রচারে এ দুই ব্যক্তি ঝগড়া করলেন, হুমকি দিলেন, পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিলেন, তা শুধু ওই উপস্থাপককেই নয়, বরং ওই টিভি চ্যানেলকেও বিতর্কিত করল। অনলাইনের পাঠকরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা দেখেছেন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এসব বিতর্কিত ব্যক্তিকে কেন টকশোতে ডাকে? যিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান এবং কোনো সিনিয়র শিক্ষকও নন, তার রাজনৈতিক ‘কানেকশন’ শক্ত হতে পারে কিন্তু রাজনীতির গতিধারা, অতীত ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে কি তিনি যথেষ্ট ধারণা রাখেন? রাজনীতি তো তার বিষয় নয়। তিনি অন্য বিষয়ের ছাত্র। মেধা থাকলে তো তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক হতেন। তাই সীমিত জ্ঞান নিয়ে টিভি টকশোতে যান এবং বিতর্কিত মন্তব্য করে তিনি নিজেও বিতর্কিত হন। তার সামনে অনেক দিন পড়ে আছে। কথা বলার অনেক সুযোগ পাবেন তিনি। এখন কি তার সময় হয়েছে ‘বুদ্ধিজীবী’ হওয়ার? টিভি চ্যানেলের উপস্থাপকরা তাকে কেন ডাকেন, এটা আমরা বুঝি। লক্ষ্য করেছি, অনেক সময় কোনো কোনো উপস্থাপক অতিথিদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে নিজে চুপচাপ গালে হাত দিয়ে তা দেখেন। এটা কি উপস্থাপকের কাজ? তিনি ঝগড়া লাগানোর সুযোগটা কেন তৈরি করবেন? কেন তিনি বিতর্কিত মন্তব্য করতে দেবেন? টকশো মানুষ শোনে ও দেখে শুধু দেশের চলমান রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বোঝার জন্য। কিন্তু তারা যদি ঝগড়া দেখে, বিতর্কিত ব্যক্তিদের বারবার পর্দায় দেখে, তাহলে অচিরেই টকশোগুলো জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলবে। ‘জয় বাংলা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘গণজাগরণ মঞ্চ’, ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি’- এসব শব্দ খুব স্পর্শকাতর। প্রকাশ্যে এসব বিষয়ে কথা বলতে হলে একটু ভেবেচিন্তে বলা প্রয়োজন। এমন কোনো মন্তব্য করা শোভন নয়, যা অন্য অতিথিকে বিব্রত করতে পারে। আমি নিজে নিয়মিত টকশোতে যাই। ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সঙ্গেও আমি থেকেছি একাধিক শোতে। আমার অভিজ্ঞতাও খুব ভালো নয়। আমি লক্ষ্য করেছি, তিনি জোর করে অনেক কিছু চাপিয়ে দিতে চান। তার মাঝে এক ধরনের উন্নাসিকতা কাজ করে। অনেক দিন থেকেই একটা কথা শুনছি- টকশো থাকবে কী, থাকবে না। শুনছি একটি নীতিমালা নাকি করা হচ্ছে। আরও একটি কথা শুনলাম, সরকার নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যারা সরকারবিরোধী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত, তাদের আমন্ত্রণ না জানানোর। কোনো একটি চ্যানেলে নাকি একটি লিস্টও পড়ে শোনানো হয়েছে, কাকে কাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। প্রথম কথা হচ্ছে, সরকার যদি এটা পাঠিয়ে থাকে, তাহলে সরকার ভুল করেছে। চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক হবে না। দ্বিতীয় কথা, যদি সরকার সমর্থকদের দিয়ে টকশো পরিচালনা করা হয়, তাহলে টকশোগুলোর জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যাবে না। চ্যানেলগুলোর কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই এটা চাইবে না। টিভি টকশোর মধ্য দিয়ে এক ধরনের গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে। এটা একটা ভালো দিক। যেখানে সংসদ হয়ে পড়েছে একদলীয়, যেখানে সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে, সেখানে কথা বলার মাধ্যম তো এই চ্যানেলগুলোই। সেখানে সরকারের সমালোচনা হয়। তবে এ সমালোচনা তো সরকারের জন্যই মঙ্গলজনক। সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীরা কখনোই সরকারের সমালোচনা করবেন না। এ ক্ষেত্রে কেউ যদি সরকারকে সঠিক পথটি ধরিয়ে দেয়, সেটা সরকারের জন্যই ভালো। এটাকে ‘সরকারের সমালোচনা’ ধরলে ভুল করা হবে। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা তো আরও জরুরি। যেখানে দশম সংসদে ‘বিরোধী দল’ সরকারেরই অংশ। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতির সমালোচনা হবে কম। ফলে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যেতে পারে এবং নিশ্চিত করেই বলতে পারি, সংসদের যে জনপ্রিয়তা, তাতে ধস নামবে। টকশোগুলো বিকল্প মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিকল্প মাধ্যম বলেই মানুষ গভীর রাতে এসব শোনে এবং দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে একটা ধারণা পায়। নীতিমালা থাকতে পারে। জঙ্গিবাদবিরোধী, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী কিংবা জাতীয় নেতাদের ব্যাপারে কটূক্তি নিষিদ্ধ করা সম্পর্কিত একটি ‘উপদেশ’ থাকতেই পারে। তাই বলে টকশো নিয়ন্ত্রণ নয়। টকশো সম্পর্কে একটা কথা প্রায় শুনি। বলা হয় টকশো উপস্থাপকরা একটি বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী এবং তারা তাদের রাজনৈতিক দর্শন অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। অন্তত একটা চ্যানেল সম্পর্কে আমি এ সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। আমি অনেক চ্যানেলেই যাই। অনেকের উপস্থাপনায় আমি অংশ নিতে আগ্রহবোধ করি। বিশেষ করে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। এক সময়ের সাংবাদিক এখন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। বিষয়ের গভীরে গিয়ে তিনি মূল সত্যটি বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো কোনো উপস্থাপক যখন তাদের রাজনৈতিক দর্শন চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন, উদ্ধত আচরণ করেন, তখন সংশ্লিষ্ট চ্যানেলের ওপর আস্থাটা আর রাখতে পারি না। রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে দল চালানো যায়। কিন্তু চ্যানেল চালানো যায় না। চ্যানেলের উদ্যোক্তারা এটি যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল। পড়াশোনা ও গবেষণার সুবাদে আমি অনেক দেশে গেছি। আমাদের এ উপমহাদেশের সন্তান ফরিদ জাকারিয়া এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় একজন টিভি উপস্থাপক। সিএনএন কিংবা আল জাজিরার নিউজ চ্যানেলের উপস্থাপকরা এক একজন ‘স্টার’। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ওবামা তাদের সমীহ করেন। নিউজ চ্যানেলগুলো টকশো করবেই। এই টকশোগুলোর কারণেই চ্যানেলগুলো টিকে আছে এবং তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাংলাদেশে শুধু নিউজ বা সংবাদ বিশ্লেষণের জন্য চ্যানেল রয়েছে মাত্র ক’টি, খুব বেশি নয়। নিউজ ও সংবাদ বিশ্লেষণও যে বিনোদন দিতে পারে, তা দু’-একটি চ্যানেল প্রমাণ করেছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। একটি চ্যানেল তরুণ প্রজন্মনির্ভর। যারা চ্যানেলটি চালান, উপস্থাপনা করেন, তাদের অনেকেরই বয়স ত্রিশের ঘরে, সংবাদকর্মীদের আরও কম, ত্রিশের নিচে। এ প্রবণতাকে আমি ভালো মনে করি। আমার মনে হয়, চ্যানেলের টকশোর উপস্থাপকরা অতিথিদের আমন্ত্রণের ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অলিখিত ‘উপদেশ’ অনুসরণ করেন। একই সঙ্গে তাদের নিজস্ব পছন্দও প্রাধান্য পায়। আর এক্ষেত্রেই তারা বিপত্তি বাধিয়ে ফেলেন। যিনি যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নন, তাকে সেই বিষয়ের জন্য আমন্ত্রণ না জানানোই মঙ্গল। ১০ ফেব্র“য়ারির রাতে একটি চ্যানেলের টকশো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম। বিষয় ছিল আঞ্চলিক নিরাপত্তা। আমার সঙ্গে আরও দু’জন আলোচক ছিলেন- মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম ও মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ। দু’জনই নিরাপত্তা নিয়ে ধারণা রাখেন এবং লেখালেখি করেন। জেনারেল ইবরাহিম নিজে দীর্ঘদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করেছেন। এ অঞ্চলের নিরাপত্তা সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা রাখেন। এক্ষেত্রে অতিথি নির্বাচন সঠিক হয়েছে। আমার নিজেরও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ধারণা রয়েছে। ফলে আলোচনাটা গুরুত্ব পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে যিনি বিষয় সম্পর্কে আদৌ ধারণা রাখেন না, তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলে দর্শকদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হতো না। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক চ্যানেলই এ কর্মটি করে থাকে- যিনি যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নন, তাকে সেই বিষয়ে বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাই আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, কিছু ব্যক্তি অর্থনীতি থেকে নারীমুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি- সব বিষয়েই অবলীলায় বলে যাচ্ছেন। তারা ‘সর্ব বিশেষজ্ঞ’। আলোচিত-বিতর্কিত ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পাশাপাশি আরও একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে দেখেছি, যিনি খুব বেশি কথা বলেন এবং তিনি সব বিষয়েরই বিশেষজ্ঞ! অনেক চ্যানেলের উপস্থাপক জানেন, যে বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে কোনো আলোচনা অনুষ্ঠানে আমি যাই না। এটাই হওয়া উচিত। চ্যানেল কর্তৃপক্ষেরও উচিত এ দিকটা দেখা। চ্যানেলগুলোর কর্তৃপক্ষকে কোনো কিছু ‘উপদেশ’ দেয়া আমার জন্য শোভন নয়। তবে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নিুোক্ত কাজগুলো করতে পারে : ১. আলোচক দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা ভালো। এতে করে আলোচকরা বিষয়ের গভীরে যেতে পারবেন; ২. যিনি যে বিষয়ের ‘বিশেষজ্ঞ’, সেটা বিবেচনায় নিয়ে বিষয়ভিত্তিকভাবেই তাদের আমন্ত্রণ জানানো উচিত। যেমন যিনি ফিল্ম মেকিং পড়ান, তাকে রাজনীতি সংক্রান্ত আলোচনায় না ডাকাই ভালো। কিংবা যিনি দীর্ঘদিন সচিবালয়ে ছিলেন, তিনি বা তাকে বৈদেশিক নীতি নিয়ে আলোচনার জন্য না ডাকাই ভালো; ৩. বিতর্কিত ‘বিশেষজ্ঞ’ কিংবা অতিকথন প্রিয় লোকদের থেকে দূরে থাকা ভালো; ৪. সরাসরি যিনি রাজনীতি করেন, তারা কোনো অনুষ্ঠানে এলে তারা দল সম্পর্কে বলবেন বেশি। মূল আলোচনায় তার মতামত পাওয়া যাবে না। একই কথা প্রযোজ্য উপস্থাপকদের ক্ষেত্রেও। অনেকেই ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু উপস্থাপনায় কিংবা প্রশ্নের মাঝে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রাধান্য পেতে পারে; ৫. দর্শকদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে পারে কর্তৃপক্ষ। ফেসবুক, অনলাইন, সরাসরি টেলিফোন, প্রশ্ন পাঠানো ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণ দর্শকদের অংশগ্রহণ বাড়লে টকশোগুলো আরও জনপ্রিয় হবে। টকশোগুলোতে কাউকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখার জায়গা হতে পারে না। অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে, উত্তেজনা ছড়িয়ে জনপ্রিয় হওয়া যায় না। এতে করে সাধারণ দর্শকদের মাঝে ওই চ্যানেল, কিংবা বিতর্কিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম হয়। Daily JUGANTOR ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪

টক শো: গণতন্ত্র চর্চার বিকল্প মাধ্যম

কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে লেখাটা শুরু করতে চাই। দৃশ্যপট এক। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত একটি চ্যানেল। আমন্ত্রিত ‘টকার’দের (যারা কথা বলেন) মাঝে আমিও একজন। বাড়িতে বসে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন একজন মন্ত্রী, যিনি ক’দিন আগে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি আর রাজনীতি করবেন না। রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন! কিন্তু তিনি রাজনীতি করছেন এবং মন্ত্রীও হয়েছেন। প্রসঙ্গ ছিল চলমান রাজনীতি। কিন্তু আলোচনা এগোলো না। তিনি হঠাৎ করেই আক্রমণ করে বসলেন আমরা যারা আলোচনা করি ‘টক শো’গুলোতে তাদের ওপর। বললেন ‘জ্ঞানপাপী।’ বললেন গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় আমরা প্রধান অন্তরায় ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে কয়েকজন মন্ত্রীর মতো তিনি উত্তেজিত হয়ে কথা বলেননি। অত্যন্ত মার্জিত ভাষাতেই তিনি টিভির ‘টকার’দের সমালোচনা করলেন। আমরা অর্থাৎ দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তা শুনলাম। মন্ত্রীর সঙ্গে তো আর ‘বেয়াদবি’ করা যায় না। দৃশ্যপট দুই। বারিধারায় অবস্থিত একটি চ্যানেলের স্টুডিও। আলোচকদের মাঝে আমিও একজন। অন্যজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক যিনি পড়ান টেলিভিশন এবং ফ্লিম মেকিংয়ের ওপর। আলোচনাটা ছিল জাতীয় পার্টির একই সঙ্গে বিরোধী দলে ও মন্ত্রিসভায় থাকা নিয়ে। আমি বলছিলাম এটা ঐকমত্যের সরকার নয়। ঐকমত্যের সরকার বললে দৃষ্টান্ত দিতে হবে জার্মানির, যেখানে অতি সম্প্রতি ক্ষমতাসীন সিডিইউ প্রধান বিরোধী দল এসপিডিকে সঙ্গে নিয়ে একটি সরকার গঠন করেছে। ওই অধ্যাপক দৃষ্টান্ত দিলেন ওবামা প্রশাসনের। বললেন তার দেশরক্ষা মন্ত্রী চাক হেগেল রিপাবলিকান পার্টি করেন এখনো। কথাটা কি সত্যি? চাক হেগেল সিনেটর ছিলেন ১৯৯৬-২০০৮ সময়সীমায়। এরপর তিনি আর রিপাবলিকান দলের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তিনি বুশের ইরাক নীতির সমালোচনা করেছিলেন। এই দৃষ্টান্ত কি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? একজন অধ্যাপক যদি বিভ্রান্তকর বক্তব্য দেন তাতে মন্ত্রীরা তো ‘জ্ঞানপাপী’ বলবেনই। দৃশ্যপট তিন। একই চ্যানেলের ৫ ফেব্র“য়ারির রাতের শো। উপস্থাপক একজন জনপ্রিয় উপস্থাপক। তিনি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং মিডিয়া বিষয়ে পড়ান কোনো একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আলোচনার শুরুতে আমি জানলাম তিনি আমার লেখার সঙ্গে আদৌ পরিচিত নন। পড়েননি কখনো! যিনি রাজনীতি নিয়ে ‘শো’ করেন, আমার লেখা তার চোখে পড়েনি! কী অবাক কাণ্ড! রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে কলাম লিখছি আজ কত বছর? সেই মধ্য আশির দশক থেকে। রাজনীতি নিয়ে আমার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যাও ৩২টিরও মতো। তিনি সাংবাদিকতা পড়ান। তিনি কি আদৌ পড়েননি আমার রাজনৈতিক কলামগুলো! নাকি শুধু এটা তার অহংকার! সত্যকে অস্বীকার করা? দৃশ্যপট চার। মগবাজার এলাকায় অবস্থিত একটি চ্যানেল। ওখানে আমার যাতায়াত নিয়মিত। চলতি ফেব্র“য়ারি মাসের প্রথম দিকে আমন্ত্রণ পেলাম। বিষয় ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের (ডিআই) সাম্প্রতিক জরিপ যেখানে বলা হয়েছে, ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ যদি নির্বাচন হতো তাহলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী ৪২.৭ ভাগ আর বিএনপি ৩৫.১ ভাগ ভোট পেত। আমার সঙ্গে আলোচক ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, যিনি ব্যবসা প্রশাসনের শিক্ষক। রাজনীতির গতিধারা, রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে কোনোদিন একটা প্রবন্ধ লেখেননি। অতি সম্প্রতি ‘নানা কারণে’ তিনি আলোচিত এবং প্রায় প্রতিটি চ্যানেলে তাকে নিত্য দেখা যায়। তিনি আবার ‘অতি কৌশলে’ ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি ব্যবহার করেন না। ডিআইয়ের ওই ‘গবেষণা’ নানা কারণে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং কিছুদিন আগে দেশের দুটি জনপ্রিয় সংবাদপত্র (প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার) যে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল (যা একটি বিদেশি জরিপ সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত), তার সঙ্গে ডিআইয়ের জরিপের কোনো মিল দেখা যায় না। আমাদের সহকর্মীদের অনেকেই যারা এ ধরনের সার্ভে করেন তাদের ভেতরে একটি প্রশ্ন সব সময়ই কাজ করে যে, এ ধরনের দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে মতামত নিয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যায় কিনা? যেখানে বাংলাদেশে ভোটার সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৩১ লাখ ২৯ হাজার ৮৫২ জন, সেখানে মতামত নেয়া হয়েছে ১ হাজার ৫০০ ব্যক্তির। সেই সঙ্গে মোবাইলে মতামত নেয়া হয়েছে ১ হাজার ৪৪ জনের। এতে কি কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়? উপরন্তু ৫ জেলায় আদৌ কোনো ভোট হয়নি, ১৫ জেলায় মাত্র ১টি আসনে ভোট হয়েছে, ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন (আওয়ামী লীগের ১২৮, ওয়ার্কার্স পার্টির ২, জামায়াতের ৩, জাতীয় পার্টির ২০, জেপির ১) সেখানে কোন কোন এলাকায় সার্ভে করা হলো? আমি ডিআইয়ের ওয়েবসাইটে গেলাম, সেখানে এই সার্ভের কোনো ফলাফল নেই। ওই ভদ্রলোক (নামটা উল্লেখ করলাম না। খুব নামিদামি ব্যক্তি) অবলীলায় ‘ভুল তথ্য’ দিয়ে বলে গেলেন প্রথম আলো ও স্টারের জরিপ ভুল! সার্ভে সঠিক হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। চ্যানেলে এ ধরনের আলোচনায় ‘ঝগড়া’ করা যায় না। সেটা শোভনও নয়। কিন্তু লক্ষ্য করলাম ‘জোর করে’ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করার একটা প্রবণতা। সেই একই কাজটি তিনি করলেন জিটিভির অনুষ্ঠানে। এবার সরাসরি আক্রমণ করে বললেন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানকে। মেজর (অব.) আখতারের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করলেন! আর যায় কোথায়? লাখ লাখ দর্শক লাইভ সম্প্রচারে দেখল দু’জনের মধ্যকার ঝগড়া, এমনকি প্রায় মারামারি পর্যন্ত। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের রুচি কোথায়, কীভাবে টক-শো’তে কথা বলতে হয় তা তিনি জানেন না। অথচ ওইসব ব্যক্তিকেই চ্যানেলে আমন্ত্রণ জানানো হয়! দৃশ্যপট পাঁচ। একটি নিবন্ধ ‘টক শো আর টকারদের কথা।’ লেখক সৈয়দ ইমতিয়াজ রেজা, ব্যক্তি জীবনে যিনি ৭১ চ্যানেলের বার্তা বিভাগের পরিচালক। এটি প্রকাশিত হয় অনলাইন সংবাদপত্র নতুন বার্তায় গত ৩১ জানুয়ারি। ওই নিবন্ধে তিনি অনেক সাহসী কথা উচ্চারণ করেছেন। যেমন বলেছেন, ১. ‘টক শো’তে অসৎ একজন সম্পাদকের কদর সবচেয়ে বেশি, ২. যারা পত্রিকা চালাতে পারেন না, তারা ‘টক শো’তে এসে জ্ঞান দেন, ৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সব বিষয়ে জ্ঞানী। পড়ান সাংবাদিকতা, বলেন অর্থনীতি নিয়ে ৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বউ পেটানো’ অধ্যাপক ‘টক শো’তে নীতিমালার কথা বলেন। ক্লাস ফাঁকি দেন ইত্যাদি। ব্যক্তিগতভাবে রেজা সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। কিন্তু তিনি যেসব কথা বলেছেন বা অন্যের উদ্ধৃতি দিয়ে (শওকত হোসেন মাসুম, প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক) উল্লেখ করেছেন তা সব মিথ্যা বলি কী করে? মজার ব্যাপার হলো তার নিজের চ্যানেলেই ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়, যারা আলোচিত বিষয় নিয়ে কোনো ধারণা রাখেন না। এটা কেন হয়? তাহলে কি তিনি নীতি-নির্ধারকদের কেউ নন? তার সঙ্গে আমি একমত। অর্থনীতির বিষয় হলে অর্থনীতির অধ্যাপককে ডাকা ভালো। আর রাজনীতির বিষয় হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক এ বিষয়ে ভালো বলতে পারতেন। কিন্তু টিভি সাংবাদিকতা কিংবা ফিল্ম পড়ানো ‘অধ্যাপক’ যদি রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান দেন, তখন প্রশ্ন উঠবেই। ‘অসৎ সম্পাদক’দের কথা বলেছেন তিনি। চারজন সম্পাদক এখন ঘুরে ফিরে সব চ্যানেলেই আসেন। এর মাঝে দু’জন উপস্থাপকের অনুষ্ঠানে একাধিকবার আমি আমন্ত্রিত হয়েছি। দুজন ‘টকার।’ তাদের একটা চাহিদা আছে। বাকি দুজনকে আমি চিনি ২০ বছরের ওপরে। কিন্তু এই দুজন সম্পর্কে আমার কখনো মনে হয়নি, তারা ‘জ্ঞান’ দেন। ‘বউ পেটানো’ অধ্যাপক হিসেবে তিনি কাকে খোঁচা দিলেন বলতে পারব না। তবে খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই ‘টক শো’তে আসেন। যারা আসেন, তারা কেউ ‘বউ পিটিয়েছেন’ বলে আমার জানা নেই। আমার নিজের ‘বউ’ও থাকেন আমেরিকাতে। মূল কথা হচ্ছে একটিই ‘টক শো’ থাকবে কি থাকবে না। শুনছি একটি নীতিমালা নাকি করা হচ্ছে। আরো একটি কথা শুনলাম সরকার নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যারা সরকারবিরোধী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত, তাদের যাতে আমন্ত্রণ না জানানো হয়। কোন একটি চ্যানেলে নাকি একটি লিস্টও পড়ে শোনানো হয়েছে যে কাকে কাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। প্রথম কথা হচ্ছে সরকার যদি এটা পাঠিয়ে থাকে তাহলে সরকার ভুল করেছে। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক হবে না। তাছাড়া, যদি সরকার সমর্থকদের দিয়ে ‘টক শো’ পরিচালনা করা হয়, তাহলে ‘টক শো’ জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যাবে না। চ্যানেলগুলোর কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই এটা চাইবেন না। চ্যানেলগুলোর ‘টক শো’র মধ্য দিয়ে এক ধরনের গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে। এটা একটা ভালো দিক। যেখানে সংসদ হয়ে পড়েছে এক দলীয়, যেখানে সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নেই সেখানে কথা বলার মাধ্যম তো এই চ্যানেলই। এখানে সরকারের সমালোচনা হয়। কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা তো সরকারের জন্যই মঙ্গল। সরকারপন্থি বুদ্ধিজীবীরা কখনোই সরকারের সমালোচনা করবেন না। এ ক্ষেত্রে কেউ যদি সরকারকে সঠিক পথটি ধরিয়ে দেয়, সেটা সরকারের জন্যই মঙ্গল। এটাকে ‘সরকারের সমালোচনা’ ধরলে ভুল করা হবে। টক শোগুলোতে সরকারের ভুল-ত্র“টিগুলো ধরিয়ে দেয়া হয়। এটা যে কোনো সরকারের জন্যই মঙ্গল। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা তো আরো জরুরি। যেখানে দশম সংসদে ‘বিরোধী দল’ হচ্ছে সরকারেরই অংশ, এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতির সমালোচনা হবে কম। ফলে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যেতে পারে এবং নিশ্চিত করেই বলতে পারি সংসদের যে জনপ্রিয়তা, তাতে ধস নামবে। ‘টক শো’গুলো বিকল্প মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিকল্প মাধ্যম বলেই মানুষ গভীর রাতে এসব শোনেন এবং দেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে একটা ধারণা পান। নীতিমালা থাকতে পারে। জঙ্গিবাদবিরোধী, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী কিংবা জাতীয় নেতাদের ব্যাপারে কটূক্তি নিষিদ্ধ করা সম্পর্কিত একটি ‘নির্দেশ’ থাকতেই পারে। তবে তাই বলে ‘টক শো’ নিয়ন্ত্রণ নয়। টক শো সম্পর্কে একটা কথা প্রায়ই শুনি। বলা হয় ‘টক শো’ উপস্থাপকরা একটি বিশেষ মর্তাদশের অনুসারী এবং তারা তাদের রাজনৈতিক দর্শন অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। অন্তত একটা চ্যানেল সম্পর্কে আমি এই সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। আমি অনেক চ্যানেলেই যাই। অনেকের উপস্থাপনায় আমি অংশ নিতে আগ্রহ বোধ করি। বিশেষ করে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। এক সময়ের সাংবাদিক এখন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। বিষয়ের গভীরে গিয়ে তিনি মূল সত্যটি বের করার চেষ্টা করেন। আমাকে লেখার জগতে এনেছিলেন জাহাঙ্গীর ভাই। সেই দৈনিক বাংলার যুগ থেকে আজ অবধি। সুকান্ত গুপ্ত অলোক, প্রণব সাহা, পান্না এদের মাঝে পেশাদারিত্ব আমার চোখে ধরা পড়েছে বেশি। অলোক যখন বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে অতিথির কাছ থেকে মূল জবাবটি বের করে আনেন, তখন তার মাঝে এই পেশাদারিত্বে ফুটে ওঠে বেশি। আর প্রণব? তার মাঝে দেখেছি জানার প্রচণ্ড একটা আগ্রহ। প্রণব প্রায়ই একটা কথা বলেন, ‘স্যার প্রতিদিনই আপনাকে রাখতে চাই। আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ আমরা আর কোথাও পাব না।’ প্রণবের কথায় আমি হাসি। বলি, আপনার পক্ষেও এটা সম্ভব নয়, আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। এটা ঠিক অনেক সময় তার আহ্বানে আমি সাড়া দিতে পারি না। মতি ভাই আমার প্রিয় মানুষ। আর শ্যামল দা একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক। এটা আমার ভালো লাগা যে এরা আমাকে আমন্ত্রণ জানান। আরো একটা কথা। বারিধারার ওই চ্যানেলের একজন প্রযোজক যখন আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, তিনি আশির দশক থেকেই আমার লেখার সঙ্গে পরিচিত, সেখানে তারই উপস্থাপক অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এমনকি শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একটি ‘টক শো’তে যখন বলেন যে, তিনি আমার লেখা পড়েন, তখন ভাবি এখনো শুভবুদ্ধির কিছু মানুষ আছেন। কিন্তু দুঃখটা এখানেই রাজনৈতিক প্রোগ্রামের একজন উপস্থাপক যখন তার ঔদ্ধত্য ও অহংকার প্রকাশ করেন, তখন ওই চ্যানেলের ওপর আস্থাটা আর রাখতে পারি না। রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে দল চালানো যায়, কিন্তু চ্যানেল চালানো যায় না। চ্যানেলের উদ্যোক্তারা এটি যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন ততই মঙ্গল। পড়াশোনা ও গবেষণার সুবাদে আমি পৃথিবীর অনেক দেশে গেছি। আমাদের এই উপমহাদেশের সন্তান ফরিদ জাকারিয়া এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় একজন টিভি উপস্থাপক। সিএনএন কিংবা আল জাজিরার নিউজ চ্যানেলের উপস্থাপকরা এক একজন স্টার। প্রেসিডেন্ট ওবামাও তাদের সমীহ করেন। নিউজ চ্যানেলগুলো টক শো করবেই। এই ‘টক শো’গুলোর কারণেই চ্যানেলগুলো টিকে আছে এবং তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাংলাদেশেও শুধু নিউজ বা সংবাদ বিশ্লেষণের জন্য চ্যানেল রয়েছে কয়েকটি তবে সংখ্যা খুব বেশি নয়। সংবাদ ও সংবাদ বিশ্লেষণও যে বিনোদন দিতে পারে তা দু’একটি চ্যানেল প্রমাণ করেছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। সময় চ্যানেল তরুণ প্রজন্মনির্ভর। যারা চ্যানেলটি চালান, উপস্থাপন করেন, তাদের অনেকেরই বয়স ত্রিশের ঘরে, সংবাদকর্মীদের আরো কম, ত্রিশের নিচে। এই প্রচেষ্টাকে আমি ভালো মনে করি। তুষার আবদুল্লা নিজেও ত্রিশের ঘরে। তাকে আমার কখনো দলবাজ মনে হয়নি। কিংবা আহমেদ জোবায়ের এরা নতুন প্রজšে§র টিভি ব্যক্তিত্ব। মানুষকে এরা সম্মান দেন। কোনো অহংকার নেই। কোনো বাহাদুরিও নেই। একটা টিভি চ্যানেল এভাবেই দাঁড়ায়। যখন টিভি রেটিংয়ে সময়কে শীর্ষে দেখি তখন ভালো লাগে। তবে তুলনামূলক বিচারে দেশ টিভির টক শো আমার মনে হয়েছে বেশ গোছানো ও সুপরিকল্পিত। পুরনো চ্যানেলগুলো নতুনদের কাছে দাঁড়াতে পারেনি শুধু ভুল পরিকল্পনার কারণে। পাঁচটা দৃষ্টান্ত দিয়ে টিভির ‘টক শো’গুলোর বর্তমান অবস্থা বোঝাতে চেয়েছি। ‘টক শো’গুলোর জনপ্রিয়তা আছে। মানুষ গভীর রাতে এসব টক শো দেখে। বলাই যায় এক ধরনের বিকল্প গণতন্ত্র চর্চার জন্ম হয়েছে টিভি চ্যানেলগুলোতে। কিন্তু অর্থনীতির অধ্যাপক যদি রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন, যদি ফিল্ম বানানোর অধ্যাপক ‘রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ’ হয়ে যান তখন কোনো কোনো ব্যক্তি ‘বউ পেটানো অধ্যাপকের’ মতো অবান্তর প্রশ্ন তুলে ‘টক শো’র গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দেবেন বৈকি! মন্ত্রী মহোদয়রা নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন যে ‘সংসদে ঘুমিয়ে থেকে’ যেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না, সেখানে ‘টক শো’গুলোতেই সরকারি নীতির সমালোচনা করা হয় যা সংসদে হওয়া উচিত ছিল। আমরা সংসদ আলোচনা বা ডিবেটকে প্রাণবন্ত করতে পারিনি শুধু একটি কারণে আর তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, কেউ কাউকে সহ্য করতে না পারা, কিংবা জাতীয় নেতাদের সম্পর্কে কটূক্তি করা। ‘টক শো’তে এটা কম হয়। এ জন্যই ‘টক শো’গুলো জনপ্রিয়। ‘টক শো’ থাকুক। মন্ত্রীরাও এতে অংশ নিন। কিন্তু এটা বোধহয় ঠিক হবে না ‘রাজনৈতিক কর্মীদের’ উপস্থাপনার দায়িত্বটি দেয়া। সেই সঙ্গে যিনি আদৌ বিশ্লেষণধর্মী রাজনৈতিক প্রবন্ধ পড়তে আগ্রহবোধ করেন না, কিংবা বিশেষ বিশেষ প্রবন্ধকারের প্রবন্ধ পড়ে একটি বিভ্রান্তিকর ধারণা নিয়ে পর্দায় আসেন, তার উচিত হবে পর্দার আড়ালে থেকেই ‘চাকরি’ করে যাওয়া! কোনো ব্যক্তি বিশেষের কারণে আমার এতদিনের অর্জনকে আমি ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারি না। আমি রাজনীতি করি না। ‘টক শো’গুলো আমার রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মও নয়। সত্যকে ধারণ করি আর সত্যটাই বলে যেতে চাই। যিনি এই মানসিকতা ধারণ করে আমন্ত্রণ জানাবেন, আমার অন্তত তাতে সায় থাকবেই Daily MANOB KONTHO 13.02.14

বাংলাদেশ কি জিএসপি সুবিধা পাবে

বাংলাদেশ কি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাচ্ছে? বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এ ব্যাপারে আশাবাদী। ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র যে ১৬টি শর্ত আরোপ করেছিল, তার মাঝে ১৩টি শর্ত আগেই পূরণ করা হয়েছে। বাকি তিনটি শর্ত পূরণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই তিনটি শর্ত হচ্ছে- ১. গার্মেন্ট শিল্প পরিদর্শনে ২ জন কারখানা পরিদর্শক নিয়োগ, ২. ১৯টি কারখানায় শ্রমিক নির্যাতনের তদন্ত এবং ৩. ইপিজেডে শ্রমিক ইউনিয়ন করার অধিকার। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা-সম্পর্কিত জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে। তবে বাংলাদেশ শেষ তিনটি শর্ত পূরণ করলেও আদৌ এ সুবিধা পাবে, তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। কেননা ১১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে তৃতীয়বারের মতো 'বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সমঝোতা ও শ্রমিক অধিকার পরিস্থিতি' নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে দ্রুত একটি সংলাপ ও সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ সংসদের নির্বাচন। কিন্তু এর কোনো লক্ষণ নেই। ফলে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। গত বেশ কিছুদিন ধরে নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক বারবার আলোচিত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা গুরুত্ব দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকেন্দ্রিক যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি বাড়াতে চায়। যেহেতু এ অঞ্চলে ভারত একটি শক্তি, সেহেতু ভারতকে সঙ্গে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে মার্কিন নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্কিন নীতিনির্ধারকদের আগ্রহটা আরও বেড়েছে। যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র একটি অক্ষ গড়ে উঠেছে। একদিকে চলতি ২০১৪ সালে আফগানিসান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে সেখানে যে 'শূন্যতার' সৃষ্টি হবে, মার্কিন নীতিনির্ধারকরা মনে করেন সেই 'শূন্যতা' পূরণ হতে পারে ভারতকে দিয়ে, যা চূড়ান্ত বিচারে তার স্বার্থকে রক্ষা করবে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আফগানিসান সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত, যার পরিমাণ কয়েক মিলিয়ন ডলার। ভারত সেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করছে। প্রচুর হাইওয়ে তৈরি করছে ভারত। এখানে সীমান্তবর্তী পাকিসান বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। আর ভারতের এই বিনিয়োগ সম্ভব হয়েছে মার্কিন নীতিনির্ধারকের সম্মতি দেয়ার পরই। ধারণা করছি, ২০১৪ সালে মার্কিন বাহিনী সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হলে, ভারতের তথাকথিত একটি 'শান্তিরক্ষী' বাহিনী সেখানে অবস্থান নেবে। অথবা ন্যাটোর একটি এশীয় সংস্করণ দেখতে পাব আমরা ওই সময়, যেখানে ভারতের একটি অংশগ্রহণ থাকবে। সালে ন্যাটো যখন গঠিত হয়েছিল, তার প্রথম এবং একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এ বাহিনী শুধু ইউরোপেই নিয়োজিত থাকবে। ন্যাটোর উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে 'ইউরোপের গণতন্ত্রকে' রক্ষা করা। ন্যাটোর সেই ধ্যানধারণায় পরিবর্তন এসেছে। প্রথমবারের মতো আফগান যুদ্ধে ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। যেহেতু ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্ররা আর আফগানিসানে 'ঝুঁকি' নিতে চাচ্ছে না, সেহেতু এ অঞ্চলকে ঘিরে ন্যাটোর এশীয় সংস্করণ (সেটা ভিন্ন নামেও হতে পারে) হবে এবং ভারত তাতে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। এই 'প্রক্রিয়ায়' বাংলাদেশও জড়িত হবে। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সুবিধা এখানেই যে, বাংলাদেশ সরকার 'ভারতের এই ভূমিকাকে', যা যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, সমর্থন করছে। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে আরও দেখা যাবে, সম্প্রতি ভারত পারমাণবিক অস্ত্র বহনযোগ্য যে মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র (অগি্ন-৫) সাফল্যের সঙ্গে উৎক্ষেপণ করেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে যে নীতি গ্রহণ করেছে, ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে তার সেই নীতি পরস্পরবিরোধী। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার মিত্র দেশগুলোকে ব্যবহার করছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে এ কাজটি করছে না। বরং ভারতকে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে এই কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে পারমাণবিক চুক্তি রয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অত্যাধুনিক পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই- আর তা হচ্ছে, চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে একটি শক্তি হিসেবে দাঁড় করান। এ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের একজন ভূ-কৌশলবিদ রবার্ট কাপলান গেল বছর প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে (STRATFOR, 25 April)  মন্তব্য করেছেন এভাবে,‘The growth of Indian military and economic power, benefits the USA since its acts as a Counter balance to a rising Chinese Power, the USA never wants to see a power as dominant in the Eastern Hemisphere as it itself is in the western Hemisphere. That is the silver lining of the India-China rivalry. India, balancing against China and thus relieving, USA of some of the burden of being the worlds dominant power ওটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। চীন যাতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা।চীন এরই মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। এটাকে বিবেচনায় নিয়েই গড়ে উঠছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, যে অক্ষে বাংলাদেশও একটি অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের এই স্ট্রাটেজি বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে গড়ে ওঠা Containment theory কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি অবলম্বন করেছিল। এ কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। বাংলাদেশের সীমান্তে রয়েছে মিয়ানমার, যে দেশটির সঙ্গে চীনের কৌশলগত সামরিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। চীনের সীমান্তবর্তী দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে। সুচি এখন সংসদ সদস্য। অনেক পশ্চিমা দেশ এখন মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জেনারেল সেইন এখন তার সরকারকে একটি 'বেসামরিক অবয়ব' দিczযুক্তরাষ্ট্র চাইবে বাংলাদেশ ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে। এমনকি ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনী মোতায়েনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৩ সালের পুরোটা সময় বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে এসেছিলেন মারিয়া ওটেরো (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়-সম্পর্কিত ডেস্ক), রবার্ট ও'ফ্লেক (সহকারী পররাষ্ট্র সচিব, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ডেস্ক), ভেন্ডি শেরম্যান (আন্ডার সেক্রেটারি রাজনৈতিক বিষয়াদি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)।১৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তা শীর্ষক একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব (রাজনৈতিক বিষয়াদি) আন্দ্রে শাপিরো। অত্যন্ত গোপনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিংবা কী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা সংবাদপত্রে জানানো হয়নি। নিরাপত্তা বিষয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দু'দেশ আলোচনা করল; কিন্তু জাতি তা জানল না। গোপনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত গোপনেই রাখা হলো। এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের কোনো মন্তব্য আমার চোখে পড়েনি। তবে বাংলাদেশে মার্কিন সেনা মোতায়েনের একটি সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে! অনেকেরই মনে থাকার কথা, গত ২ মার্চ (২০১৩) সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত) কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের 'বিশেষ বাহিনী' মোতায়েন রয়েছে। এটা নিয়ে বাংলাদেশে গুঞ্জনের সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মজিনা এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কিছু সেনা রয়েছে, যারা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য আসে, আবার চলেও যায়। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, 'তথাকথিত সন্ত্রাসীদের মোকাবিলার' জন্য(?) ভিন্ন নামে ও ভিন্ন পরিচয়ে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর লোকজন বাংলাদেশে রয়েছে। এর একটা আইনি কাঠামো দেয়ার জন্যই ওই নিরাপত্তা শীর্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও স্বীকার করে না যে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উৎকণ্ঠা কম। যুক্তরাষ্ট্র যা চায় তা হচ্ছে, গণতন্ত্র এখানে শক্তিশালী হোক। একটি মুসলমান অধ্যুষিত দেশেও যে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে, বাংলাদেশ তার প্রমাণ রেখেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের যে মূল কথা, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ, তা হয়নি। দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে; কিন্তু ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। তাই তোফায়েল আহমেদ যখন জিএসপি সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশা করেন, তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আবারও বলেন, গণতান্ত্রিক সমঝোতার জন্য সংলাপের কথা। এটা অনেকটা এখন স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে দ্রুত একাদশ সংসদের নির্বাচন করা, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। কিন্তু একাদশ সংসদ নিয়ে সরকারি মহলে কোনো আলোচনা নেই। উপরন্তু একজন নয়া মন্ত্রী ও ডেপুটি স্পিকার ১০ ফেব্রুয়ারি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, পাঁচ বছরের আগে কোনো নির্বাচন নয়। এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী কিংবা স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বলেছেন, নয়া নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। বিএনপি আপাতত নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে। মে-জুনের দিকে, যখন যুক্তরাষ্ট্র জিএসপির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে, তখন নতুন করে আন্দোলনের কর্মসূচি দেবে। এতে বিএনপি কতটুকু সফল হবে বলা মুশকিল। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না থাকলে তা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে পারে। বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধাটি প্রয়োজন। আর মার্কিন আস্থা ফিরে পেতে হলে বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। Alokito Bangladesh 13.02.14

আরব বসন্ত কি জঙ্গিবাদ উসকে দিয়েছে?

‘আরব বসন্ত’ চতুর্থ বর্ষে পা দিয়েছে। তিউনেসিয়ার ছোট্ট ও অখ্যাত সিদি বওজিদ শহরের বেকার কম্পিউটার গ্রাজুয়েট বোউয়াজিজির আত্মহননের মধ্য দিয়ে অন্যায়-অত্যাচারের যে প্রতিবাদ তিনি করেছিলেন, তা রূপ নিয়েছিল ‘আরব বসন্তে’। সেই প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে গিয়েছিল তিউনেসিয়া থেকে মিসর, ইয়েমেনে ও লিবিয়ায়। একের পর এক পতন ঘটেছিল স্বৈরাচারী সরকারের। রচিত হয়েছিল ইতিহাস। সেটা ২০১১ সালের কথা। তারপর কেটে গেছে তিন বছর। এরই মাঝে এ অঞ্চলে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। বোউয়াজিজির নিজের দেশ তিউনেসিয়ায় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হলেও সেখানে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু সংবিধান রচনা করার ব্যর্থতা আর বিরোধী দলের নেতাদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার রেশ ধরে সেখানে মেহদি জোমাকে প্রধান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকার ২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করবে। বলা ভালো, দীর্ঘদিন অচলাবস্থা চলার পর দেশটির সংসদ একটি নয়া সংসদ অনুমোদন করেছে। দেশে ইসলামী শাসন বাতিলের বিষয়ে সম্মত হয় সংসদ। তবে সংবিধানে দেশটির রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ইসলামকেই রাখা হয়েছে।মিসরে গণঅভ্যুত্থানে হোসনি মোবারকের পতন সুখের হয়নি মিসরবাসীর জন্য। মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচনে ইসলামপন্থী মুরসির বিজয় একটি সম্ভাবনার জন্ম দিলেও সেনাবাহিনী পুনরায় সেখানে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এর মধ্য দিয়ে মিসর আবার ফিরে গেল পুরনো বৃত্তে। ইয়েমেনে দীর্ঘদিনের শাসক আলী আবদুল্লাহ সালেহর অপশাসনের অবসান ঘটলেও সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। ঐকমত্যের প্রার্থী হিসেবে আবদ রাব্বু মনসুর হাদী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেও সেখানে সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো কী হবে তা নিশ্চিত করতে পারেনি ‘ন্যাশনাল ডায়লগ কনফারেন্স’, যাদের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করার।লিবিয়ার পরিস্থিতি আরও খারাপ। গাদ্দাফি হত্যাকাণ্ডের পর সেখানে সংসদ বা জেনারেল পিপলস কংগ্রেসের নির্বাচন হয়েছে বটে, কিন্তু নয়া সংবিধান এখনও রচিত হয়নি। ইতিমধ্যে সেখানে খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করার জন্য একটি গণপরিষদের নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছে। ৬০ সদস্যবিশিষ্ট এই গণপরিষদের নির্বাচন হবে ২০ ফেব্র“য়ারি। এই গণপরিষদ আগামী ১২০ দিনের মধ্যে নতুন একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করবে এবং ২০১৪ সালের শেষদিকে সেখানে পূর্ণাঙ্গ সংসদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে পুরনো কাঠামো এখনও বজায় রয়েছে। শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।
সিরিয়ায় পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক। প্রেসিডেন্ট আসাদ এখনও রয়ে গেছেন ক্ষমতায়। তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ দেশান্তরিত হয়েছে। সেখানে শেষ মুহূর্তে মার্কিন হামলা এড়ানো গেছে বটে, কিন্তু জেনেভা সম্মেলনে যদি কোনো ‘সমাধান’ না হয়, তাহলে সেই হামলার সম্ভাবনা আরও বাড়বে।আরব বসন্ত একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল যে, সেখানে একনায়কতন্ত্রের পরিবর্তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। মানবাধিকার রক্ষিত হবে। সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন হবে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। যে সম্ভাবনা নিয়ে আরব বসন্তের জন্ম হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই অতীত। আরব বসন্ত যখন চতুর্থ বর্ষে পড়েছে, তখন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে এ অঞ্চলে। মিসরে বহুল আলোচিত সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি এখন ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদাংকই অনুসরণ করতে যাচ্ছেন। এপ্রিলে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর জেনারেল সিসি তাতে প্রার্থী হচ্ছেন। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে তিনি সেনাঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। সেনাবাহিনীর শীর্ষ সামরিক পরিষদ ইতিমধ্যে তার এই মনোনয়নকে সমর্থন করেছে। এর মধ্য দিয়ে মিসরে সিসির যুগ শুরু হচ্ছে এই এপ্রিল থেকেই। অন্যদিকে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির বিচার হচ্ছে একটি বেসামরিক আদালতে। যদিও তিনি নিজেকে এখনও প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনে করেন, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তার পূর্ব পদে ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিনি মিসরের জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও বেশি মাত্রায় ইসলামের দিকে ঝুঁকেছিলেন। মিসরকে তিনি খুব দ্রুত একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। কোনো কোনো আইনে নারীদের অধিকারও খর্ব করা হয়েছিল। তাহরির স্কোয়ারের ‘বিপ্লবীরা’, যাদের মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, তারা এটা চাননি। আর এ সুযোগটাই নিয়েছিল সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকার গত ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি সেখানে সংবিধানের পক্ষে একটি গণভোটের আয়োজন করে। প্রস্তাবিত সংবিধানের পক্ষে শতকরা ৯৮.১ ভাগ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছে। ব্রাদারহুড এই গণভোট বর্জন করেছিল। প্রস্তাবিত সংবিধানে এ ধারাগুলো সংযোজন করা হয়েছে- ১. প্রেসিডেন্ট ৪ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। তবে তিনি দু’টার্মের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না; ২. ইসলাম হবে রাষ্ট্রধর্ম; ৩. ধর্ম, গোত্র, লিঙ্গ বা ভৌগোলিকতাকে কেন্দ্র করে দেশে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না; ৪. আগামী ৮ বছর প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগ দেবে সেনাবাহিনী।এদিকে জেনেভা থেকে এসেছে হতাশাজনক খবর। জেনেভায় সিরিয়ার সরকার পক্ষ ও বিরোধীদের মধ্যে আলোচনা (যা জেনেভা-২ নামে পরিচিত) ব্যর্থ হয়েছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ থাকবেন কী থাকবেন না- এটা একটা প্রধান ইস্যু। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে শুরু হওয়া আলোচনা আদৌ কোনো ফল দেবে কি-না, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। আলোচনায় সরকারি পক্ষ ‘নীতিগত ঘোষণা’ সংবলিত যে অবস্থানপত্র উত্থাপন করে, তাতে ক্ষমতা পরিবর্তনের কোনো কথা উল্লেখ নেই। ফলে একটি জটিলতা রয়েই গেল। একই সঙ্গে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের আরও ব্যাপ্তি হয়েছে। সরকারি বাহিনীর হাতে প্রায় একশ’ বিদ্রোহী সেনা মারা গেছেন জেনেভা আলোচনা চলাকালীন। আরও একটি উদ্বেগজনক খবর হচ্ছে, আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠন নুসরা ফ্রন্ট কর্তৃক সিরিয়ার তেল কূপগুলোর (ফালুজা শহরে) দখল। এটা পশ্চিমা বিশ্বে একটি ভুল সিগনাল পৌঁছে দিতে পারে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সমঝোতা যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে আনলেও সিরিয়ায় আল কায়দার উত্থান একটি বড় ধরনের সংবাদের জš§ দিয়েছে। এটি এখন আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়। কোনো কোনো অনলাইন সংবাদপত্রে [ফ্রন্টপেইজ ম্যাগ (২০ সেপ্টেম্বর)] এমন কথাও বলা হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট ওবামা বাহ্যত আল কায়দাকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছেন। গেল বছর লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় আল কায়দার উত্থান নিয়ে একটি উদ্বেগজনক সংবাদ ছাপা হয়েছিল। পত্রিকাটি ‘আইএইচএস জেন’ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল, সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে (সংখ্যায় প্রায় এক লাখ), সেই বিদ্রোহী বাহিনীর প্রায় অর্ধেক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে লন্ডনের জেন গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি কোনো অপরিচিত নাম নয়। জেনের পক্ষ থেকে গবেষণাটি পরিচালনা করেন চার্লস লিস্টার। লিস্টার তার গবেষণায় এটাও উল্লেখ করেছেন, বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার যোদ্ধা রয়েছেন, যারা আদৌ সিরিয়ার নাগরিক নন। তারা জঙ্গিবাদী সংগঠন আল নুসরা ফ্রন্ট, ইসলামিক টেস্ট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ার ব্যানারে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে যেসব অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে, তার একটা বড় অংশ চলে গেছে জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর কাছে। এখন এমন ধারণাও পোষণ করা হচ্ছে যে, আগামীতে যদি আসাদ সরকারের পতন ঘটে, তাহলে আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিপুল অস্ত্র ভাণ্ডার চলে যাবে এসব জঙ্গিবাদী সংগঠনের কাছে, যাদের প্রায় সবাই আল কায়দার সঙ্গে জড়িত।সিরিয়ায় আল কায়দার উত্থান নিয়ে খোদ ওবামা প্রশাসনও উৎকণ্ঠিত। গেল বছর ওয়াশিংটনে সিনেটের এক শুনানিতে (হোমল্যান্ড সিকিউরিটি) টম জোসেলিনও এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। যারা নিয়মিত সিরিয়ার ঘটনাবলী মনিটর করেন তাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, কিছুদিন আগে ইসলামী জঙ্গিরা আলেপ্পো শহরের কাছাকাছি আস সাদ্দাদি শহরটি (লোকসংখ্যা ৭০ হাজার) দখল করে নিয়েছিল।
জেনের গবেষণা প্রতিবেদনে যে উদ্বেগজনক দিকটি রয়েছে তা হচ্ছে, সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছে তাদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ যোদ্ধা ধর্মনিরপেক্ষ, লিবারেলপন্থী। বাকিরা সবাই বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। যদিও এ ধরনের সংবাদের সত্যতা যাচাই করা সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না, তবে বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, গবেষণা নিবন্ধ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোর অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যে, আগামীতে যদি আসাদ সরকারের পতন ঘটে, তাহলে কোন শক্তি সিরিয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে?সিরিয়ায় বিদ্রোহী গ্র“পগুলো কোনো একক নেতৃত্বে পরিচালিত হয় না। তারা বিভিন্ন গ্র“প, উপ-গ্র“পে বিভক্ত। এককভাবে কোনো বিরোধী দল বা গ্র“প নেই, যারা আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় সরকার গঠন করতে পারে। এ সময় সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এই কাউন্সিল এখন বিলুপ্ত। এর পরিবর্তে গঠিত হয়েছে ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সিরিয়ান রেভ্যুলেশনারি অ্যান্ড অপজিশন ফোর্সেস’ (এনসিএসআরও)। এটি গঠিত হয় ২০১২ সালের নভেম্বরে দোহায়। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে আহমেদ জারবা এ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ সিরিয়া এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, যেখানে সংসদের কর্তৃত্ব নিশ্চিত হবে। এরা আসাদ সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনার পক্ষপাতী ছিলেন না। এদের একটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল তাদের সমর্থন করে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে মরক্কোর মারাকাশে আসাদ বিরোধীদের যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং প্রায় ১০০ দেশ সেখানে প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল, তাতে তাদের সমর্থন নিশ্চিত করা হয়। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এদের সমর্থন করে। সিরিয়ার বামপন্থীরা ‘ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি’র ব্যানারে কাজ করে। মোট ১৩টি দল এ ব্যানারে রয়েছে। কুর্দিরাও এ ব্যানারের আওতায় কাজ করে। এর বাইরে রয়েছে ইসলামিক শক্তিগুলো, যাদের সঙ্গে আল কায়দার সম্পর্ক রয়েছে। ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে জাবহাল উল নুসরা। মোট ১২টি ইসলামী জঙ্গি সংগঠন সিরিয়ান ইসলামিক ফ্রন্টের ব্যানারে একত্রিত হয়েছে। নুসরা ফ্রন্টের বাইরে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া, আহরার আল সামের মতো সংগঠনের নাম পাওয়া যায়, যারা আলাদাভাবে পাঁচ থেকে ছয় হাজার জঙ্গি সেনার নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ধারণা করা হয়, কোনো কোনো গ্র“পের হাতে ২৫ হাজার সেনা পর্যন্ত রয়েছে। যদিও এরা কেউই প্রশিক্ষিত যোদ্ধা নন। এদের মূল দর্শন হচ্ছে সিরিয়াকে একটি ইসলামিক এমিরাতে পরিণত করা। ফ্রি সিরিয়ান আর্মি মূলত সিরিয়ান সেনাবাহিনী ত্যাগ করে বিদ্রোহী দলে যোগ দেয়া সেনাসদস্য ও ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের নিয়ে গঠিত। এই সেনাবাহিনী রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি দায়বদ্ধ থাকলেও আগামী দিনের রাজনীতিতে এদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছে প্রচুর অস্ত্র চলে গেছে। এই অস্ত্র আগামী দিনের সিরিয়ার রাজনীতিতে একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমরা লক্ষ্য করেছি, এর আগে যে দুটি দেশে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন হয়েছে (ইরাক ও লিবিয়া), সেখানে ইসলামী জঙ্গিরা শক্তিশালী হয়েছে। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে (২০০৩) সাদ্দাম হোসেন উৎখাত হওয়ার পর একটি সরকার সেখানে গঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু ইসলামী জঙ্গিরা সেখানে শক্তিশালী হয়েছে, যা সাদ্দামের জমানায় ছিল না। ইরাকে এখন আÍঘাতী বোমা সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। লিবিয়ায়ও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সেখানকার ইসলামী জঙ্গিরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তাদের হাতেই বেনগাজিস্থ মার্কিন দূতাবাস আক্রান্ত হয়েছিল এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তারা হত্যা করেছিল। এখন সিরিয়ার পরিস্থিতিও অনেকটা সেরকম।সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে গত ৩৪ মাস ধরে। ২০১১ সালের এপ্রিলে সিরিয়ায় যে আন্দোলনের সূত্রপাত, তা মিসরের আন্দোলন দ্বারা বেশি মাত্রায় প্রভাবান্বিত ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেখানে ইসলামী জঙ্গিরা শক্তিশালী হয়েছে। জঙ্গিদের এ উত্থান নিঃসন্দেহে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বড় ধরনের ‘ডিলেমা’র মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আসাদ বিরোধিতাকে সমর্থন করার অর্থ ইসলামী জঙ্গিদের উত্থানকে সমর্থন করা। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি খুব সুখের হয়নি। একসময় তালেবানদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল মার্কিনিরা। পরবর্তীকালে তালেবানদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরতে হয় মার্কিনিদের। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক। উপরন্তু এ অঞ্চলের সন্নিহিত দেশগুলোতে রয়েছে পশ্চিমা শক্তিগুলোর সামরিক ঘাঁটি। বাহরাইন ও কাতারে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে আরব আমিরাত ও সাইপ্রাসে। সুতরাং একটি জঙ্গিগোষ্ঠী যদি সিরিয়ায় ক্ষমতা দখল করে, তা হুমকি হয়ে দেখা দেবে পশ্চিমা শক্তিগুলোর জন্য। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র তা চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সেখানে বিকশিত হবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সুন্নিদের নেতৃত্বাধীন একটি জোট সেখানে আসাদের বিকল্প হতে পারে। কিন্তু ইরাকের অভিজ্ঞতা সে দেশটির জন্য আদৌ সুখের হয়নি। আপাতত বাশার আল আসাদ রয়ে যাচ্ছেন ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ২০১৪ সালেই সেখানে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আসাদের অংশগ্রহণ না করা (বিনিময়ে আসাদকে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি না করা), সিরিয়ার সব রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করে দেয়া (যাতে আসাদ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছেন)- এ দুটো বিষয় সামনে রেখেই রাজনীতি এখন আবর্তিত হতে পারে। কিন্তু জেনেভা-২ আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, সিরিয়ার বিদ্রোহীরা আসাদকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাইছে না। আরব লীগ ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আয়োজিত জেনেভা-২ আলোচনা আদৌ কোনো ফল দেয় কি-না, তার প্রতিই লক্ষ্য থাকবে অনেকের। তবে ইসলামী জঙ্গিরা যে এখন সিরিয়ায় একটি শক্তি, তা বিবেচনায় নিতে হবে। তাদের ভূমিকা হবে অনেকের জন্যই উদ্বেগের একটি কারণ।‘আরব বসন্ত’ আরব বিশ্বে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সম্ভাবনার জন্ম দিলেও সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়নি। ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থান সেখানে সব সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটিয়েছে। আরব বসন্ত পূর্ব পর্যন্ত আরব বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে মিসর, তিউনেসিয়া, ইয়েমেন কিংবা লিবিয়ায় নারী সমাজ এক বিশেষ অধিকার ভোগ করত। বহু বিবাহ প্রায় প্রতিটি দেশেই নিষিদ্ধ ছিল। পর্দা প্রথায় বাধ্যবাধকতা ছিল না। এখন আরব বসন্ত একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর পতন ঘটিয়েছে সত্য; কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, নারী সমাজকে কি আবার ঠেলে দেয়া হচ্ছে পর্দা প্রথায়, কঠোর ইসলামী বিধিবিধানে? প্রায় প্রতিটি দেশে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর উত্থান ও তাদের ‘ক্ষমতা প্রয়োগ’ এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। আরব বসন্ত যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, তা এখন সুদূরপরাহত। সেখানে দীর্ঘদিনের ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা শাসকদের পতন হয়েছে সত্য, কিন্তু জন্ম দিয়েছে ইসলামী জঙ্গিবাদের, যারা আগামী দিনে এ অঞ্চলের অস্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। Daily JUGANTOR 08.02.14

সরকার কি মেয়াদ পূর্ণ করার কথা ভাবছে

গেল ২০ জানুয়ারি বিএনপির উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভা এবং জামায়াতকে 'মাইনাস' করার পর একটা প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে উঠেছে যে একটি সংলাপের ক্ষেত্র বোধ হয় তৈরি হলো। এমনকি ২১ তারিখ যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করে ব্রিটিশ হাইকমিশনারও বললেন দ্রুত সংলাপের কথা। গত ১০ দিনের সংবাদগুলো যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে কিংবা ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তাতে একটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর তা হচ্ছে সংলাপ। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ওই সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের আপাতত কোনো সম্ভাবনাও নেই! শুনতে হয়তো খারাপ শোনাবে এবং বিএনপির নেতা-কর্মীরা হয়তো আশাহত হতে পারেন একথা শুনে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সরকার এই মুহূর্তে মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে না। এর অনেক কারণও আছে। প্রথমত, নির্বাচন নিয়ে প্রথম দিকে দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে থেকে যত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াই আসুক না কেন, সরকার মনে করছে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে তার 'অবস্থান' এখন অনেক শক্তিশালী। বিদেশ থেকে একের পর এক অভিনন্দন আসছে। এর মধ্য দিয়ে তার 'লেজিটেমেসি' বেড়েছে। সরকার মনে করছে তারা খুব সহজেই পাঁচ বছর পার করে দিতে পারবে। দ্বিতীয়ত, যারা দশম জাতীয় সংসদে এসেছেন, তাঁরা চাইবেন না এখনই সংসদ ভেঙে দেওয়া হোক। তাঁরা চাইবেন পুরো টার্ম পূরণ করতে। বিদেশে এই সংসদ নিয়ে যত নেতিবাচক ধারণারই জন্ম হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে একটা সংসদ গঠিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ষষ্ঠ সংসদের বয়স ছিল মাত্র ১৩ দিন। আমরা ওই সংসদের সঙ্গে দশম সংসদকে মেলালে ভুল করব। কেননা, ওই সংসদ গঠিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এ কারণে সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়েছিল। কিন্তু দশম সংসদের কাছে এ রকম কোনো এজেন্ডা নেই। ফলে সংসদ ভেঙে দেওয়ার চাপ থাকলেও তা খুব শক্তিশালী হবে বলে মনে হয় না। তৃতীয়ত, সরকারের শক্ত অবস্থানের কারণে বিএনপি তথা ১৮ দল আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। অভিযোগ উঠেছে, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকেই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। ফলে 'নির্বাচন প্রতিহত' করার ডাক দিয়েও তা 'প্রতিহত' করা যায়নি। এখন সংসদ গঠিত হওয়ায় সরকারের অবস্থান ভালো। বিএনপি শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে সরকার 'চাপে' থাকবে না এবং সে ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে বাধ্য করানো যাবে না। চতুর্থত, সরকার বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের একটা 'ব্যবধান' তৈরি করে দিতে সমর্থ হয়েছে। এই কৌশলে সরকার লাভবান হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে বিএনপির। সরকার কখনো জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবে না! অথচ সরকার ইচ্ছা করলে তা পারে। সংবিধানের ৩৮ (গ) ও (ঘ) রিপ্রেজেনটেশন অব পিপলস অর্ডিন্যান্স ১৯৭২, দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮-এর ধারা-উপধারা বলে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যায়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ কিংবা উচ্চ আদালতে দায়ের করা একটা আপিল মামলার নিষ্পত্তি করে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। সরকার সেদিকে যাবে বলে আমার মনে হয় না। সরকারের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে জামায়াতের সঙ্গে যদি বিএনপির 'দূরত্ব' সৃষ্টি করা যায়, তাতে দুর্বল হবে ১৮ দল। আর তাতে লাভ সরকারের। সরকার, সুধীসমাজ এবং মিডিয়ার কারণে জামায়াত একটি জঙ্গিবাদী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সরকারের বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে বিদেশে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জামায়াতের কর্মকাণ্ডকে জঙ্গি কর্মকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেছে। এতে করে পরোক্ষভাবে সরকারের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। পঞ্চমত, দুজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী (ত্রাণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও খাদ্যমন্ত্রী) সরাসরি বলেছেন, নির্বাচন চাইতে হলে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অর্থমন্ত্রীর অভিমতও অনেকটা তেমনি। অন্যদিকে আরো কয়েকজন মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া বেগম জিয়ার বক্তব্যের (সাতক্ষীরায় যৌথ বাহিনীর অপারেশন প্রসঙ্গে) যেভাবে সমালোচনা করেছেন, তাতে করে সংলাপের সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ হয়ে এলো। বেগম জিয়াকে 'ক্ষমা চাইতে হবে', 'জঙ্গিদের সেনাপতি' (সৈয়দ আশরাফ), 'খালেদা সঙ' (আমির হোসেন আমু), 'তিনি অশান্তি চান' (হাসানুল হক ইনু), 'তাঁর বক্তব্য বিপজ্জনক' (ওবায়দুল কাদের)- এ ধরনের বক্তব্য সংলাপের পরিবেশের জন্য যথেষ্ট অনুকূল নয়। এমনকি বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। আমরা এখানে সাতক্ষীরায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও (খালেদা জিয়ার শয়নে স্বপনে পেয়ারে পাকিস্তান) উল্লেখ করতে পারি। এতে করে এমন একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে আগামীতে সংলাপের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ষষ্ঠত, নির্বাচনের পর এখন সংলাপের এজেন্ডা কী? বিএনপি যদি এখনো তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কথা বলতে চায়, তাহলে সরকারের সমর্থন তাতে থাকবে না। বিএনপি সরকারকে বাধ্য করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের (প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে) আওতায় নির্বাচন দিতে। সরকার যেভাবে সংবিধানে পরিবর্তন এনেছিল (পঞ্চদশ সংশোধনী), সেভাবেই নির্বাচন হয়েছে এবং আগামীতেও হবে। এখন বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে রেখেই নির্বাচনে যেতে হবে। কিন্তু বিএনপি কি তা করবে? এটা যদি বিএনপি করে, তাহলে প্রশ্ন আসবে বিএনপি তাহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিল না কেন? সপ্তমত, সরকার আন্দোলনের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে জনগণ যাতে আন্দোলনে সম্পৃক্ত না হয় সে জন্য উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। দলীয়ভাবে উপজেলা নির্বাচন হয় না। তবে দলীয় নেতা ও কর্মীরা অন্য মার্কা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। এ ক্ষেত্রে তাই ঘটবে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা এই নির্বাচনে অংশ নেবে। এখানে বিএনপির সমর্থকরা যদি বিজয়ীও হয়, তাতে করে তা সরকারের ওপর আদৌ কোনো 'প্রভাব' ফেলবে না। এতে করে আন্দোলনও আপাতত স্থগিত থাকবে। অষ্টমত, সরকারের এখন স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে মামলা-মোকদ্দমা ও আইন-আদালত করে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের ব্যতিব্যস্ত রাখা। নেতাদের কেউ কেউ উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও অন্য মামলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দুদকের মামলায় নিম্ন আদালত থেকে খালাস পেলেও দুদক আপিল করেছে। নব নিযুক্ত আইনমন্ত্রী বলেছেন, তারেক রহমান নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে জামিন পাবেন। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে একটি- তারেক রহমানের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করে পরোক্ষভাবে বেগম জিয়ার ওপর 'মনস্তাত্তি্বক চাপ' প্রয়োগ করা। নবমত, নতুন করে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যে সরকার গঠন করেছেন, তাঁকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন 'ঐকমত্যের সরকার' হিসেবে। এ মুহূর্তে এই সরকারে চারটি দল রয়েছে- আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টি। আমার ধারণা, ভবিষ্যতে এই সরকারে আরো দু-চারটি দল (সিপিবি, তরিকত ইত্যাদি) যোগ দিতে পারে। বিএনপির একটি অংশ যদি যোগ দেয়(?) আমি তাতে অবাক হব না। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে একটি 'মালয়েশিয়ান মডেল' উপহার দিতে পারেন, যেখানে উমনো বা ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন প্রধান রাজনৈতিক দল হলেও ১৩টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা বারিসোআ নেসিওনাল, যারা ১৯৬৪ সাল থেকেই জোটগতভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। সেখানে বিরোধী দলের অস্তিত্ব তেমন শক্তিশালী নয়, যদিও সর্বশেষ নির্বাচনে (২০১৩) বিরোধী দল কিছুটা ভালো করেছে (বিরোধী পিপলস অ্যালায়েন্স পেয়েছে ৮৯ আসন, আর ক্ষমতাসীন ফ্রন্ট পেয়েছে ১৩৩। মোট আসন ২২২)। বারিসোআ নেসিওনাল সেখানে 'নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র' চালু করেছে। মাহাথির মোহাম্মদ দীর্ঘ ২২ (১৯৮১-২০০৩) বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৩ সালে অবসর নেন। মালয়েশিয়ায় নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে নাগরিক অধিকার কিছুটা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু নিয়মমাফিক পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন হয়। সেখানে নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না কিংবা 'ভোটকেন্দ্র দখল' কিংবা 'সিল মারার' ঘটনা কখনো ঘটেনি। তারা রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে মালয়েশিয়া আজ বিশ্বে নতুন এক অর্থনৈতিক শক্তির জন্ম দিয়েছে। শেখ হাসিনা যদি মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক মডেলকে অনুসরণ করেন, তিনি ভালো করবে আপাতত মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারেও সরকারের কোনো 'কমিটমেন্ট' নেই। সরকারের অবস্থান এখন শক্তিশালী। কিন্তু তার পরও 'রিয়েল পলিটিকস' বলছে স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসা উচিত সরকারের। আগামী দুই থেকে তিন মাস বিএনপি কোনো কঠোর কর্মসূচি দেবে না। বেগম জিয়া আবারও বিভাগীয় শহরগুলোতে জনসভা করবেন। ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতকে মাইনাস করে বিএনপির জনসভা সফল হয়েছে। এতে প্রমাণ হয়েছে বিএনপি জামায়াতনির্ভর একটি দল নয়। এখন সরকার যদি বিএনপির এই উদ্যোগে সাড়া না দেয়, তাহলে বিএনপি আবারও ফিরে যাবে জামায়াতের মিত্রতায়। একমাত্র সংলাপ আর বিএনপিকে আস্থায় নেওয়ার মাধ্যমেই জামায়াতকে চূড়ান্তভাবে মাইনাস করা সম্ভব। একই সঙ্গে মন্ত্রীরা যত কম আক্রমণাত্মক কথা বলবেন, ততই সরকারের জন্য মঙ্গল। জাতীয় পার্টিকে একই সঙ্গে সরকারে, আবার বিরোধী দলে রেখে একটি নয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেওয়া যাবে বটে, কিন্তু স্থিতিশীল রাজনীতি নিশ্চিত করা যাবে না। তাই 'অঙ্কের হিসাবে' আপাতত কোনো সংলাপ ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা না থাকলেও সরকারপ্রধান দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে সংলাপের সূচনা করবেন- এটাই প্রত্যাশিত। Daily KALERKONTHO 04.02.14

বিএনপির রাজনীতি ও দশম সংসদের ভবিষ্যৎ

দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছে ২৯ জানুয়ারি। ওই একই দিন বিএনপি সারা দেশে কালো পতাকা দিবস পালন করেছে। বিষয়টি এখন অনেকের কাছেই আলোচনার একটি বিষয়Ñ বিএনপি এখন কী করবে? আর দশম সংসদের ভবিষ্যৎ কতদিনের? বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি একটি শক্তি। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ থেকে শুরু করে নবম সংসদ পর্যন্ত, দীর্ঘ ৩৪ বছর ছয়টি সংসদে (ষষ্ঠ সংসদসহ) বিএনপির প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। যদিও এরশাদ জামানায় অনুষ্ঠিত এ দুটো সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিলেও, ওই সংসদ টিকেছিল ১৭ মাস। আর ১৯৮৮ সালের সংসদ, যেখানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কোনো দলই অংশগ্রহণ করেনি, সেই সংসদও টিকেছিল ৩১ মাস। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবর্তমানে ওই সংসদে একটি ‘বিরোধী দল’ও পাওয়া গিয়েছিল। ‘কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিস’ বা ‘কপ’ এর ব্যানারে ওই সংসদে বিরোধী দলের নেতা হয়েছিলেন আসম আবদুর রব। সবাই জানেন, এইচএম এরশাদের সঙ্গে আসম আবদুর রবের সখ্য ছিল এবং কৌশলী এরশাদ সে সখ্যকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। অনেকটা একই দৃশ্যের অবতারণা হতে যাচ্ছে এবার। জাতীয় পার্টি এবার বিরোধী দলে। তবে পার্থক্য এখানেইÑ জাতীয় পার্টি সরকারেও আছে। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ইতিহাসে বোধকরি এবার বাংলাদেশ ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, যেখানে ‘প্রধান বিরোধী দল’ সরকারেও আছে আবার বিরোধী দলেও আছে। এতে করে সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের যে সনাতন ভূমিকা, সেই ‘ভূমিকা’ জাতীয় পার্টি পালন করতে পারবে বলে মনে হয় না। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সরকারের জন্যও ভালো। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে এ বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি। দেশের রাজনীতিতে বিএনপি একটি বড় দল। অতীতেও বিএনপি বিরোধী দলে ছিল। এখন বিএনপিকে বাদ দিয়ে সংসদ গণমানুষের কাছে কতটুকু যেতে পারবে, সে প্রশ্ন থাকবেই। অনেকের কাছে তাই প্রশ্ন উঠেছে, সংসদের বাইরে থেকে বিএনপির ভূমিকা এখন কী হবে? বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করেছে। সেখানে খালেদা জিয়া কোনো কঠোর কর্মসূচি দেননি। নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো দিক সরকারের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় যাওয়ার। তিনি উপলব্ধি করেছেন, হরতাল আর অবরোধে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। আর এই সহিংসতায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। সহিংসতায় সাধারণ মানুষের খুব একটা সমর্থন থাকে না। রাজনীতিতে সহিংসতার বিষয়টি এখন বহুল আলোচিত একটি বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট আর হাউস অব কমন্সের সিদ্ধান্তগুলো দেখলে বোঝা যাবে, এরা রাজনীতিতে সহিংসতার বিষয়টিকে সমর্থন করেনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই সহিংসতার বিষয়টি বেশ কিছুদিন ধরেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা যে মহাজোট সরকারের সময়েই লক্ষ্য করা গেছে, তা নয়। বরং বিগত জোট সরকারের সময়ও আমরা এটা লক্ষ্য করেছি। তবে ওই মাত্রা বেড়েছে। বাসে পেট্রল বোমা মারা, নিরীহ মানুষকে দগ্ধ করা, এটা কোনো মতেই রাজনীতির কৌশল হতে পারে না। এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটা অংশও হতে পারে না। আমরা মিডিয়ার কল্যাণে সংবাদপত্রে দগ্ধ মানুষদের কাহিনী শুনেছি। একজন গীতা সরকারের সাহসী বক্তব্য ছাপা হয়েছিল সংবাদপত্রে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আপনাদের তৈরি করেছি। আপনারা আমাদের তৈরি করেননি। আমরা আমাদের স্বামীরটা খাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না...।’ প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে তার এই হৃদয়ছোঁয়া বক্তব্য সেদিন ঝড় তুলেছিল সারা দেশে। গীতা সরকার যেন সেদিন এ দেশের লাখো লাখো মানুষের কথাই বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা বাসে পেট্রল বোমা ছোড়ে, খুব কম ক্ষেত্রেই তাদের গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ। গীতা সরকারের ওই ক্ষোভের কথা সংবাদপত্রের পাতাতেই থেকে গেছে। আজ এতদিন পর আমরা জানি না, গীতা সরকাররা কেমন আছেন। আমরা জানি না হরতাল আর অবরোধে যারা মারা গিয়েছিলেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা কেমন আছেন। সংবাদপত্রগুলোও তেমন একটা খোঁজ নেয় না। আমরা কেউই চাই না, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক। একটা স্বস্তির জায়গা এখানেই যে, ১৯ দল আর হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দেয়নি। কিন্তু কতদিনের বিরতি দিল ১৯ দলÑ এ প্রশ্ন তো থাকবেই। তাই সংলাপটা জরুরি। সংসদ বসেছে। সংসদ নেত্রীও পারেন সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে দিতে, যারা ১৯ দলের সঙ্গে সংলাপে বসবেন। মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে কথা বলবেন। সরকার যদি আন্তরিক না হয়, যদি সংলাপ না করে, তাহলে জটিলতা বাড়তে পারে। তবে সংলাপের ব্যাপারে বেশ কিছু জটিলতা রয়ে গেছে। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, কোন বিষয় নিয়ে সংলাপ হবে? একাদশ সংসদ নির্বাচন? কিন্তু কোন পদ্ধতিতে এই নির্বাচন হবে? বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আন্দোলন তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। সাধারণ মানুষ তথা সুশীল সমাজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে থাকলেও, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে সরকার কোনো ছাড় দেয়নি। প্রশ্ন থাকবে, বিএনপি তাহলে সংলাপে কী নিয়ে আলোচনা করবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াতকে নিয়ে। বিএনপি কী জামায়াতকে বাদ দেবে? জামায়াত এখনও একটি বৈধ দল। কোনো পর্যায়ে দলকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। অনেকেরই মনে থাকার কথা, অতীতে এই জামায়াতকে নিয়েই আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। এর ব্যাখ্যায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, তখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের পরিস্থিতিকে মেলান যাবে না। এই যুক্তির পেছনে সত্যতা যাই থাকুক, আওয়ামী লীগ-জামায়াত সখ্য তো ইতিহাসের অংশ। আজ পরিস্থিতি বদলে গেছে, সন্দেহ নেই তাতে। জনমত এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে। তাই জামায়াত সম্পর্কে এখন একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারাই হত্যাকা- আর লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ছিল, বিএনপি তাদের বিচারও চেয়েছে। তবে বিএনপি চেয়েছে, হত্যাকারী বা লুণ্ঠনকারী যেই হোক, বিচার হোক সবার। একটা জিনিস হয়তো আমরা অনেকেই খেয়াল করিনিÑ জামায়াত সম্পর্কে বারে বারে বলতে গিয়ে আমরা কী পরোক্ষভাবে জামায়াতের নামটা সর্বত্র ছড়িয়ে দিলাম না? যদিও এটা সত্য, জামায়াতের নেতিবাচক ধারণাটাই মানুষ জেনেছে। এ নিয়ে ডকুমেন্টেশনও তৈরি হয়েছে। তবে বাস্তবতা এটাইÑ জামায়াতকে বিদেশি রাষ্ট্র এখনও একটি ইসলামিক দল হিসেবে বিবেচনা করে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিংবা নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ ঢাকায় জামায়াত নেতাদের সঙ্গে দেখাও করেছেন। এখন জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সখ্য সংলাপের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। সরকার বলতে পারে, জামায়াতকে না ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপ হবে না। কেননা সরকার জামায়াতকে একটি জঙ্গিবাদী সংগঠন হিসেবে মনে করে। সরকারের প্লাস পয়েন্ট এখন একাধিক। তথাকথিত ভোটারবিহীন নির্বাচনের আয়োজন করে সরকার যে দুর্নামের ভাগীদার হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। বিদেশ থেকে একের পর এক অভিনন্দন তথা সমর্থন আসছে। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নির্বাচনের ব্যাপারে দাতা দেশগুলোর রিজার্ভেশন থাকলেও, চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা তাদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে পারবে না। তাই তাদের বাংলাদেশকে প্রয়োজন আছে। সুতরাং জি-২ পর্যায়ে (সরকার-টু-সরকার) সম্পর্ক যে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে সরকারের দায়িত্বটা এখন অনেক বেশি। দাতাদের সমর্থন আর নয়া একটি সরকার গঠন করার মধ্য দিয়ে সরকার যদি আত্মতুষ্টিতে ভোগে, তাহলে সরকার ভুল করবে। সরকারের উচিত হবে এখন বিএনপিকে আস্থায় নেয়া। এটা সরকারের জন্যই মঙ্গল। একই সঙ্গে বিএনপিও এর মধ্য দিয়ে ‘নতুন এক রাজনীতি’ খোঁজার সুযোগ পাবে। স্থিতিশীলতার স্বার্থে এটা বড় প্রয়োজন। অন্যদিকে বিএনপিকে এখন বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে যে গণঅভ্যুত্থান (মিসর, থাইল্যান্ড, ইউক্রেন), তার ঢেউ লাগেনি বাংলাদেশে। বিএনপিকে এখন বিগত দিনের আন্দোলনের হিসাব মেলাতে হবে। আন্দোলনে বিএনপি কর্মীদের মাঠে না থাকা, জেলের ভয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পালিয়ে বেড়ানো সরকারবিরোধী আন্দোলনকে বিএনপি চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারেনি। তাই নতুন করে ‘হিসাবের খাতা’ খুলতে হবে। জামায়াত কৌশলী। তারা আপাতত ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাবে। তবে তারা চূড়ান্তভাবে হারিয়ে যাবে, এটা আমার মনে হয় না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও(?) তারা নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করবে। তুরস্কের ইতিহাস আমাদের কাছে আছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা। নব্বইয়ের শেষের দিকে নেকমাতিন এরবাকানের নেতৃত্বে ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল তুরস্কে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী ট্রু পাথ পার্টির একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল তুরস্কে ১৯৯৬ সালে। এরবাকান ছিলেন ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। যদিও সেই সরকার স্থায়ী হয়নি। এক পর্যায়ে ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হলে, তারা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির ব্যানারে সংগঠিত হন এবং পর পর তিনবার সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন। সুতরাং জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও, তারা হারিয়ে যাবেন, এটা আমার মনে হয় না। খালেদা জিয়া নতুন করে কোনো কঠোর কর্মসূচি না দেয়ায় স্পষ্টতই সঙ্কটের জট খোলার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই। এমনকি ২১ জানুয়ারি রেলমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ হাইকমিশনারও বলেছেন দ্রুত সংলাপে যাওয়ার। কিন্তু সিনিয়র মন্ত্রীদের কথাবার্তা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে খালেদা জিয়াকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান, আমাদের মনে একটা ভয় ধরিয়ে দিয়েছে যে, প্রত্যাশিত এই সংলাপটি নাও হতে পারে! তাই একটি সংলাপ হবে কিংবা একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন ২০১৪ সালেই অনুষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে আস্থাটা রাখতে পারছি না। এখন অনেক সম্ভাবনার জন্ম হবে রাজনীতি নিয়ে। যারা নতুন করে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন(?), তারা চাইবেন ৫ বছরের টার্ম পূরণ করতে। জাতীয় পার্টির সুবিধাভোগী শ্রেণী জানেন, ক্ষমতা হারালে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই তারা সংসদ ভেঙে দিতে চাইবেন না। এটা খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে সরকারি দলের অনেক নেতাকর্মী আছেন, তারা মনে করেন আগামী ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারলে, বিএনপি ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ক্ষমতা আরও দীর্ঘায়িত করা, বিশেষ করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হবে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করেন, আগামীতে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হবে (রাজনৈতিকভাবে) জামায়াতকে, জামায়াত যে নামেই আত্মপ্রকাশ করুক না কেন। জামায়াতের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বেই একটি আধুনিক ইসলামিক ফোর্স (অনেকটা তুরস্কের মডেলে) আত্মপ্রকাশ ঘটবে এবং তারাই হবে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বিএনপি অনেকটা ‘রণে ভঙ্গ দিয়েছে’। সুতরাং আওয়ামী লীগ খুব অনায়াসে ৫ বছর ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারবে! একটা ভালো দিক হচ্ছে, বিএনপি নয়া সংসদ ও নয়া সরকারের ব্যাপারে একটা ‘সফট এটিচিউড’ গ্রহণ করেছে। অনেকের ধারণা ছিল, ২৯ জানুয়ারি (যেদিন দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছে) বিএনপি হরতাল দেবে; কিন্তু বিএনপি তা দেয়নি। এর মধ্য দিয়ে মেসেজটি পরিষ্কারÑ বিএনপি এক ধরনের সমঝোতা চায়। আগামী মাসে উপজেলা নির্বাচন। এ নির্বাচন দলীয়ভাবে হয় না। তবে সমর্থকরা অংশ নেয়। বিএনপির সমর্থকরা এ নির্বাচনে অংশ নেবে বলে তাদের নেতারা আমাদের জানিয়েছেন। এ নির্বাচনে অংশ না নিলে স্থানীয়ভাবে বিএনপির যে ভিত্তি, তাও হারাতে পারে দলটি। তাই খালেদা জিয়াকে এখন পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণ করে সামনে এগোতে হবে। তার উচিত হবে, এখন জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা। খালেদা জিয়া এখন প্রতিটি বিভাগীয় শহরে যাবেনÑ এই সিদ্ধান্তটি ভালো। তবে এবারের আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন থাকবে। নিশ্চয়ই বিগত আন্দোলন থেকে তিনি শিখেছেন। জনসমর্থন থাকলেও, সরকারের যে পতন ঘটানো যায় না, তা এবার প্রমাণিত হলো। তবে সরকার ও বিরোধী দলÑ উভয়ই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ চায়। আর এটা নিশ্চিত করতে হলে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে ন্যূনতম সহাবস্থান ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এই মুহূর্তে এ সহাবস্থানটি নেই। ফলে খুব দ্রুত একটি সংলাপ হবে, মধ্যবর্তী নির্বাচন হবেÑ এটা দৃঢ়ভাবে বলতে পারছি না। অন্তত আগামী দু’বছরের মধ্যে আদৌ কোনো সংলাপ হবে, কিংবা সরকার কিছুটা নমনীয় হবে, এ বিশ্বাসটা রাখতে পারছি না। এ দেশে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। এটা ‘বিবেচনায় নিয়েই’ বিএনপিকে এগোতে হবে। তবে বিএনপি ‘হারিয়ে’ যাবে, আমার তা মনে হয় না। সাধারণ মানুষের মাঝে বিএনপির সমর্থন রয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। পত্র-পত্রিকায় বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়া এখন বিএনপিতে নতুন ‘নেতৃত্ব’ সৃষ্টি করবেন। এর আগে এক ‘নতুন রাজনীতি’র কথা তিনি বলেছিলেন। সেটা কী আমরা তা জানি না। তবে বিগত মাসগুলোতে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা এবং আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে ‘ব্যর্থতা’, বিএনপিকে এখন নতুন করে ‘ঘর সাজাতে হবে’। প্রথমত, বিএনপিতে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ছাত্রদল কিংবা যুবদল থেকে যে নেতৃত্ব আসার কথা ছিল, তা আসেনি। স্থায়ী কমিটিতে পরিবর্তন আনাও জরুরি হয়ে পড়েছে। মওদুদ আহমদ নিজে কোর্টে দাঁড়িয়ে বয়সের কথা বলেছেন। তাই বিএনপিতে তরুণ ও ডায়নামিক নেতৃত্ব দরকার, যারা বিএনপিকে একুশ শতকে নিয়ে যাবে এবং একুশ শতক উপযোগী একটি রাজনীতি জাতিকে উপহার দেবে। দ্বিতীয়ত, বিএনপিকে এখন ‘নয়া রাজনীতি’ উপহার দিতে হবে। হরতাল, অবরোধ দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো যায় না। তাই হরতালের বিকল্প ভাবতে হবে। বিএনপি এখন সরকারে নেই। কিন্তু সরকারের বাইরে থেকেও জনমত গড়ে তোলা যায়। তৃতীয়ত, বিএনপিকে এখন সুস্পষ্ট নীতি নিয়ে এগোতে হবে। দলটিকে এখন নতুন কর্মসূচি দিতে হবে। এ কাজটি করার জন্য প্রয়োজন একটি ‘থিংক ট্যাঙ্ক’ গঠন করা। চতুর্থত, বিএনপির নেতৃত্বকে এখন যেতে হবে প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি উপজেলায়। শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক যে রাজনীতি, সে রাজনীতি দিয়ে পুরো জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করা যায় না। আশার কথা, বিএনপি কাউন্সিল করতে যাচ্ছে। ধারণা করছি, ওই কাউন্সিলে ‘আয়নায় নতুন করে নিজেদের দেখতে চাইবে বিএনপি।’ আত্মসমালোচনাটা জরুরি। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে যে দল শতকরা ৪১.১৭ ভাগ (১৯৭৯), ৩০.৮১ ভাগ (১৯৯১), ৩৩.৬১ ভাগ (১৯৯৬), ৪০.৯৭ ভাগ (২০০১) ও ৩২.৪৫ ভাগ ভোট (২০০৮) পায়, সে দলটিকে বাদ রেখে যে সংসদীয় রাজনীতি, সেই সংসদ জনমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। আবার বাস্তবতা হচ্ছে, একটি সংসদ হয়ে গেছে। বিদেশ থেকে সমর্থনও আসছেÑ এই সংসদকে ‘উপেক্ষা’ করাও যাবে না। এখানে তাই ‘রিয়েল পলিটিকস’ এর প্রয়োগটাই আসল। স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বিএনপিকে আস্থায় নিতে হবে। সংলাপ শুরু করতে হবে এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট একটা নীতি ঘোষণা করতে হবে। এটা না হলে ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে মাত্র। দুটো দলের কাছ থেকে প্রত্যাশা তাই অনেক বেশি। Daily ALOKITO BANGLADESH 04.02.14