রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

বিশ্বব্যাংকের সংস্কার ও ব্রিকস ব্যাংক

অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করার মতো। প্রথমটি হচ্ছে, ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে ব্রিকস উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত। মূলত বিশ্ব অর্থনীতিতে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কর্তৃত্ব খর্ব করার উদ্দেশ্যেই গত ১৫-১৭ জুলাই ব্রাজিলের ফর্তালেজা শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ৫ জাতিভিত্তিক ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে এ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় সংবাদটি হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত ও পরিচালনায় সংস্কার আনার তাগিদ দিয়েছে ভারত। ব্রিকস সম্মেলনে যখন ‘নতুন একটি বিশ্বব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, ঠিক এর পর-পরই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়াং কিম ছুটে যান ভারতে। বৈঠক করেন ভারতের নতুন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে। অরুণ জেটলি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে জানান, ভারত মনে করে, বিশ্বব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে হবে। ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ৫০ মিলিয়ন ডলার মূলধন নিয়ে ব্রিকস ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ভারত এর প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করবে। ব্রিকস ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় হবে সাংহাইয়ে। ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠার এই সিদ্ধান্ত যে বিশ্বব্যাংককে কিছুটা হলেও একটা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের ভারত সফর এর বড় প্রমাণ। এখানে বলা ভালো, গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নেইল (ঔরস ড়’ ঘবরষষ) ২০০১ সালে নতুন অর্থনৈতিক ব্যাংক হিসেবে ইজওঈ (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন)-এর কথা বলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা এই গ্রুপে যোগ দেয় ২০১০ সালে। তবে এটাও সত্য, ব্রিকের যে ধারণা তিনি দিয়েছিলেন, ২০০৯ সালে এসে এতে তিনি কিছু পরিবর্তন আনেন এবং নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যাংকের কথা বলেন। গওকঞ নামে পরিচিত এই অর্থনৈতিক ব্লকে রয়েছে মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক। ২০১১ সালে এসে অধ্যাপক জিম ও’নেইল স্পষ্ট করেই বলেছেন, ব্রিকসকে কেন্দ্র করে যে দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির কথা বলা হয়েছিল, এতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কেননা চীন ও রাশিয়ায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পাবে এবং এই বয়স্ক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকে চাপের মুখে রাখবে। অধ্যাপক জেক গোল্ডস্টোনও একই অভিমত পোষণ করেছিলেন। তবে সত্যিকার অর্থে ব্রিকসের অর্থনীতি কতটুকু দাঁড়াতে পারবে, সেটি ভবিষ্যতের ব্যাপার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই মুহূর্তে চীন ও ভারত বিশ্বের বড় অর্থনীতি। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের পরই এর স্থান। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল কম্পারিজন প্রোগ্রামের (আইসিপি) মতে, জাপানকে হটিয়ে দিয়ে ভারত ২০১১ সালে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। আইসিপি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাজ করে। অথচ ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল।আইসিপির রিপোর্ট থেকেই জানা গেছে, ২০১১ সালে বিশ্ব ৯০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে। তবে এর মোট উৎপাদনের অর্ধেকই নিম্ন ও মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশগুলো থেকে আসে। আইসিপির প্রধান পর্যবেক্ষণ হল, বিশ্বের ১২টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের ৬টিই মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশের অন্তর্গত। ১২টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ সম্মিলিতভাবে উৎপাদন করে বিশ্ব অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশ। আর বিশ্বের ৫৯ শতাংশ মানুষ এ ১২টি দেশে বসবাস করে বলে আইসিপি তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে। ক্রয়ক্ষমতার অসমতা (পার্চেজিং পাওয়ার প্যারিটি- পিপিপি) অনুযায়ী বিশ্ব জিডিপি ৯০ হাজার ৬৪৭ মিলিয়ন ডলার। সেই তুলনায় বিনিময় হার অনুযায়ী বিশ্ব জিডিপি ৭০ হাজার ২৯৪ বিলিয়ন ডলার। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন থাকবে, মাত্র ৫টি দেশ নিয়ে গঠিত ব্রিকস কতদূর যেতে পারবে? ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা আর্জেন্টিনার মতো দেশ অদূর ভবিষ্যতে ব্রিকসে যোগ দেবে কি না, তাও একটা প্রশ্ন।বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে উন্নয়নশীল বিশ্বে। বিশ্বব্যাংক সমাজসেবা করে না। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তারা যে সাহায্য দেয়, এটি তাদের বিনিয়োগ। সুদসহ তারা আসল বুঝে নেয়। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের ঋণ পলিসি নিয়ে নানা কথা আছে। যারা পল ব্যারেন, রাউল প্রোবিস, গ্রাহাম হেনকক, পল সুইজি, এজি ফ্রাংক কিংবা সামির আমিনের লেখার সঙ্গে পরিচিত, তারা জানেন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ঋণ কেন দেয়, তাদের স্বার্থ কী এবং ঋণের বিনিময়ে তাদের ‘প্রাপ্তি’ কী? তাই শুধু ভারত নয়, বরং উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্বব্যাংকের সংস্কার দাবি করে আসছে। অনেকের স্মরণে থাকার কথা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৬৭তম অধিবেশনে (২০১৩) ভাষণ দিতে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া ৬০ বছরের পুরনো ক্ষমতার সমীকরণের প্রতিফলন। প্রধানমন্ত্রী যা বলতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে বেটন উডস (১৯৪৪) সম্মেলনের পর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ বাড়ানো উচিত। আজ প্রধানমন্ত্রীর ওই কথারই প্রতিধ্বনি করলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল বিশ্বকে আর্থিক সহায়তা দেয়- এটি সত্য। কিন্তু শর্ত থাকে। শুধু তা-ই নয়, তাদের কথা অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশেও বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা একেবারে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসবে বলা হলেও সংস্থাটি আর ফিরে আসেনি। বাংলাদেশ এখন নিজ উদ্যোগেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে।বিশ্বব্যাংকের ঋণের সঙ্গে কাঠামোগত সামঞ্জস্য বা ঝঃৎঁপঃঁৎধষ অফলঁংঃসবহঃ-এর একটি কথা শোনা যায়। বাংলাদেশে এটি ব্যাপকভাবে পরিচিত। এটা হচ্ছে একধরনের সুপারিশমালা। বিশ্বব্যাংক ঋণের শর্ত হিসেবে এই কাঠামোগত সামঞ্জস্যের কথা বলে থাকে। কাঠামোগত সামঞ্জস্যের নামে বিশ্বব্যাংক যেসব শর্ত আরোপ করে থাকে, তা হচ্ছে অনেকটা এ রকম- ১. গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন, ২. সরকারি ব্যয় হ্রাস, ৩. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষি খাতে ভর্তুকি হ্রাস, ৪. প্রকৃতি মজুরি হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, ৫. মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, ৬. জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারিকরণ, ৭. উঁচু কর ও সুদের হার বাড়ানো, ৮. আমদানি অবাধ করা, ৯. মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো এবং সমাজতন্ত্রের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এখন কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় ঋণ পেয়ে থাকে। কিন্তু এতে কি ঋণগ্রহীতা দেশের অর্থনীতিতে তেমন পরিবর্তন এসেছে? কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে এর জবাব দেওয়া যেতে পারে। ১৯৭৭-৮৫ সালে পেরুতে বিশ্বব্যাংকের ফর্মুলা অনুযায়ী কাঠামোগত সামঞ্জস্যের শর্তাবলি গ্রহণ করা হয়। ফলে মাথাপিছু আয় শতকরা ২০ ভাগ কমেছে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০ ভাগে, ওই সঙ্গে বেড়েছে বেকারত্ব। আরও একটা কথা। ঋণ দেওয়া হয় সাধারণত ধনতন্ত্র কায়েম এবং সমাজতন্ত্রের অগ্রগতিরোধ করতে। অনেক জাতীয়তাবাদী সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে শুধু তাদের কথামতো না চলার জন্য (ইরানে মোসাদ্দেক ১৯৫৩ সালে, গুয়েতেমালার আরবেনজ ১৯৫৪ সালে, ব্রাজিলে গাউলাট ১৯৬৪ সালে, ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ন ১৯৬৫ সালে, ঘানায় নক্রমা ১৯৬৬ সালে, মালিতে কাইটা ১৯৬৮ সালে, চিলিতে আলেন্দে ১৯৭৩ সালে)। ১৯৭২-৭৬ সালে আর্জেন্টিনায় পেরনিস্টরা কিংবা ব্রাজিলে গাউলাট বিশ্বব্যাংকের কোনও ঋণ পাননি। কেননা তাদের রাজনীতিতে পুঁজিবাদী বিশ্ব সন্তুষ্ট ছিল না। অথচ তারা যখন উৎখাত হন, তখন থেকেই ওই দুই দেশে বিশ্বব্যাংকের সাহায্য বেড়ে যায়। শুধু ১৯৭৬ সালে এককভাবে আর্জেন্টিনা বিশ্বব্যাংক থেকে যত ঋণ পেয়েছে, এর আগের ২০ বছরেও এত ঋণ পায়নি। বাংলাদেশের কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হয়- বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের জুলাই থেকেই সম্প্রসারিত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির আওতায় কাজ করে যাচ্ছে। এতে সরকারের ৯টি ক্ষেত্রে (কৃষি, শিক্ষা, বাণিজ্য, সরকারি সম্পদের ব্যবহার, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো, সরকারি ব্যয়নীতি, বহির্খাত, অর্থ খাত সংশোধন, মানবসম্পদ ও দারিদ্র্য দূবীকরণ এবং পরিবেশনীতি) করণীয় কাজ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। করণীয় কাজের মাধ্যে রয়েছে সেচ উপকরণ আমদানি ও বিতরণ ব্যবস্থা সহজীকরণ, আমদানির ওপর আরোপিত শর্তাবলি তুলে দেওয়া ও রপ্তানি ভর্তুকি-ব্যবস্থা বাতিল করা, ভ্যাট প্রথা প্রবর্তন, পাট, বস্ত্র, রসায়ন, ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থাকে বেসরকারিকণ, রেলওয়ে ঘাটতি দূরীকরণ, প্রশাসনিক খাতে ব্যয় হ্রাস, রপ্তানিকে বহুমুখিতা, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি। এছাড়া পরিবার পরিকল্পনা, শিল্পায়ন ইত্যাদি বিষয়েও দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ রয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ এ থেকে কতটুকু উপকৃত হয়েছে? দরিদ্রতা কিংবা চরম দারিদ্র্যসীমায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা কমেনি। বাংলাদেশে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশুর জন্ম হয়েছে কয়েক হাজার টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে। রাষ্ট্রকে এই ঋণ পরিশোধ করতে হয় আর চক্রবৃদ্ধি হারে ওই ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে, ঋণ আর শোধ হয় না। ১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে এক ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার ছিল মাত্র ৭ দশমিক ৮৮ টাকা, আজ সেখানে ৭৯ টাকা। ঋণের শর্ত হিসেবে আমরা টাকার মান নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু দরিদ্রতা কমেনি। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে বটে, কিন্তু এতে উপকৃত হয়েছে কতিপয় ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদ। তথাকথিত কনসালটেন্সির নামে কয়েক বুদ্ধিজীবী তথা শিক্ষকের পকেট ভারী হয়েছে মাত্র।মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাংক থেকে একবার ঋণ নিলে সেখান থেকে আর বের হয়ে আসা যায় না। ব্রাজিল একবার ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ‘ডিফল্টার’ হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক দেশটিকে আবারও ঋণ দিয়েছিল- যাতে ব্রাজিল ঋণের সুদ পরিশোধ করতে পারে। না হলে আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিত। এ জন্যই ঋণের পরিমাণ বাড়লেও বিশ্বব্যাংক ঋণ দেওয়া অব্যাহত রাখে।আজ তাই বিশ্বব্যাংকের যে সংস্কারের কথা উঠেছে, এতে অযৌক্তিক কিছু নেই। কিন্তু বিশ্বব্যাংক আদৌ সংস্কারের কোনও উদ্যোগ নেবে- এটা মনে হয় না। সঙ্গত কারণেই ব্রিকস ব্যাংকের দিকে তাকিয়ে থাকবে সবাই। কিন্তু কাজটি খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। এর ভবিষ্যৎ অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে। দুটি বড় অর্থনীতি চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক আগামী দিনে কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নত হয় কিংবা বড় অর্থনীতির দেখা হিসেবে চীনের ভূমিকা ব্যাংক পরিচালনায় কী হবে অথবা ঋণের ধরন কী হবে- এসবের ওপর ব্রিকস ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বলা ভালো, আপতত ১০ হাজার কোটি ডলার মূলধন নিয়ে ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করছে। এখানে চীন একাই দেবে ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার। রাশিয়া, ভারত ও ব্রাজিল দেবে ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার করে। আর দক্ষিণ আফ্রিকা দেবে ৫০০ কোটি ডলার। ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্বের ৪০ শতাংশ জনগণ ও ২৫ শতাংশ এলাকা এই দেশগুলোর দখলে এবং বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ এই দেশগুলোর। ব্রিকস দেশগুলো বর্তমানে বৈশ্বিক মুদ্রা রিজার্ভের ৪৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং ব্রিকস ব্যাংকের ব্যাপারে একটা আগ্রহ থাকবেই। তবে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে ব্রিকস ব্যাংক কতটুকু দাঁড়াতে পারবে, সে প্রশ্ন থাকলই। Daily AMADER SOMOY 28.07.14

একটি সাক্ষাৎকার ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন

আমাদের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন একটি জাতীয় দৈনিকে গত ২২ জুলাই ২০১৪ তারিখে। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘তালপট্টি থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হতো বাংলাদেশ’ (সকালের খবর)। দীপু মনি আদালতে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান এজেন্ট ছিলেন। তার ডেপুটি ছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব পর্যায়ে কর্মরত রিয়ার এডমিরাল (অব.) খুরশীদ আলম। খুরশীদ আলম নেভিতে থাকার কারণে সমুদ্রসীমা, সমুদ্র আইন ইত্যাদি নিয়ে যথেষ্ট কাজ করেছেন। মূলত তার এই অভিজ্ঞতার কারণেই তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তার এই অভিজ্ঞতার পাশাপাশি দীপু মনির তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। এ বিষয়ে তিনি পড়ালেখা করেছেন, এমন তথ্যও আমার জানা নেই। কিন্তু তারপরও একজন পূর্ণমন্ত্রী হয়ে তিনি আদালতে ছিলেন প্রধান এজেন্ট, যেখানে ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব। উক্ত সাক্ষাৎকারে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তার সারসংক্ষেপ অনেকটা এ রকম : ১. তালপট্টি কোনো দ্বীপ ছিল না, ২. তালপট্টি থাকলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতাম, ৩. ১৯৮০ সালের পর ম্যাপে তালপট্টিকে ভারতের দিকে দেখানো হয়েছে, ৪. বাংলাদেশ সালিশি আদালতে ন্যায্য দাবি নিয়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব পালন করেনি, ৫. মামলা করে আমরা ৮০ শতাংশ পেয়েছি, আর ভারত পেয়েছে ২০ শতাংশ। সুতরাং ভারত এটাকে বিজয় বলতেই পারে, ৬. ভারতের দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবই আমরা পেয়েছি। তিনটি ব্লকের সামান্য একটু অংশ ভারত পেয়েছে। এখন ইজারাদাররা আসবে। দীপু মনির এই বক্তব্য নিয়ে বলার কিছু নেই। ইতোমধ্যে এ নিয়ে বেশ লেখালেখি হয়েছে। তার বক্তব্য অনেকটাই ‘রাজনৈতিক’ ও নিজের অবস্থানকে বড় করে দেখানো। তালপট্টি দ্বীপ ছিল কি-না, তা খুরশীদ আলমের নিজের লেখাতেই প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ‘নতুন গোল পোস্ট’ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেয়ার আগে তিনি সমুদ্র আইন ও সমুদ্রসীমা নিয়ে লেখালেখি করেছেন। সেমিনারে বক্তব্যও রেখেছেন। একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে এই সময় তার বক্তব্য বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। তালপট্টি দ্বীপের যে অস্তিত্ব ছিল, তা খুরশীদ আলমের লেখনীতেও আমরা পেয়েছি। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকের লেখনীতেও এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে, তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্ব ছিল। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটা ডুবে যেতে পারে, কিন্তু তার অস্তিত্ব নেই, এটা বলা যাবে না। গুগল আর্থে এখনো তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্ব দেখানো আছে। ওখানে তেল ও গ্যাসের রিজার্ভের বেশ সম্ভাবনাও রয়েছে। ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের ডিফেন্স ফোরাম ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ভারত ২০০৬ সালে হাড়িয়াভাঙ্গার মুখের ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে ১০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেয়েছে। এখানে গ্যাসের সর্বোচ্চ মজুদ রয়েছে। কৃষ্ণ-গোদাবরি অঞ্চলে যে গ্যাস পাওয়া গিয়েছিল, তার পরিমাণ ছিল ৫০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ভারতের দৈনিক টেলিগ্রাফের ২৭ নভেম্বরের সংখ্যায়ও এই পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছিল। অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ একটি জাতীয় দৈনিকে গত ১৮ জুলাই (২০১৪) যে প্রবন্ধ লেখেন, তাতে তিনি এসব তথ্য উল্লেখ করেছেন। সুতরাং তালপট্টি দ্বীপ যে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে গভীর ও অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য যে ২৮ ব্লকে এলাকাটিকে ভাগ করেছিল তার মাঝে ২১নং ব্লকে অন্তর্ভুক্ত ছিল দক্ষিণ তালপট্টি। হেগের সালিশি আদালতের রায় অনুযায়ী হাড়িয়াভাঙ্গা নদী বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, বাংলাদেশ এর আশপাশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে উদ্যোগ নেবে কি-না, সেটাই একটা প্রশ্ন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ও টিভি টকশোতে (আরটিভি) অধ্যাপক হোসেন মনসুর (চেয়ারম্যান পেট্রোবাংলা) আমাকে জানিয়েছেন, দক্ষিণ তালপট্টি এলাকায় জ্বালানি সম্পদ আছে (তেল ও গ্যাস), এ তথ্য তার জানা নেই। আমি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নই। ফলে কার বক্তব্য সত্য, এটা নিয় প্রশ্ন থাকবেই। ভারত বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র ১০০ টিসিএফ গ্যাস ও বিলিয়ন ব্যারেল তেল আবিষ্কার করেছে। মিয়ানমার করেছে ৭.৭ টিসিএফ গ্যাস। ২০০৬ সালে ভারত সরকার তাদের ২৪টি গভীর সমুদ্র ব্লক টেন্ডার প্রদানের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। এর মধ্যে ব্লক ডি ২৩ (৮৭০৬ বর্গকিলোমিটার) ও ব্লক ডি ২২ (৭৭৯০ বর্গকিলোমিটার) বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ১৯৯১ সালের ২১টি ব্লকের অনেক অংশ জুড়ে রয়েছে। এখন নয়া রায়ের ফলে দেখতে হবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্লকগুলোর কটি এখন পুনর্বিন্যাস করতে হবে। মহীসোপান নিয়েও একটা বিভ্রান্তি আছে। এমনকি ‘ধূসর এলাকা’ নিয়েও আছে প্রশ্ন।
তবে এটা বলতেই হবে এই রায়ে বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করল। বাংলাদেশের সালিশি আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটিও ছিল সঠিক ও যুক্তি সঙ্গত। চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারত আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই ১৯৭৪ সাল থেকেই আলোচনা চলে আসছিল। ফলাফল ছিল শূন্য। উল্লেখ্য, সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বলবৎ রয়েছে 3rd united Nations convention on the Law of Sea (UNCLOS 111)। এটি ১৯৮২ সালে গৃহিত এবং ১৯৯৪ সালের নভেম্বর থেকে কার্যকর। ভারত ১৯৮৫ সালের ২৭ জুন ও মিয়ানমার ১৯৯৬ সালের ২১ মে UNCLOS 111 অনুমোদন করে। বাংলাদেশ অনুমোদন করে অনেক পরে ২০০১ সালের ২৭ জুলাই (অনুস্বাক্ষর ১৯৮২) নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে সমুদ্রসীমার দাবির স্বপক্ষে তথ্য, উপাত্ত উপস্থাপন করতে হতো। বাংলাদেশ ২০১১ সালের জুলাইয়ের পর তথ্য-উপাত্ত জমা দেয়ার পরই আদালত এই সিদ্ধান্ত নিল। তখন আদালতের এই রায় আমাদের জন্য যেমনি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করল, ঠিক তেমনি দায়িত্বও বেড়ে গেল। সমুদ্রে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। প্রচুর তেল-গ্যাস সম্পদের পাশাপাশি খনিজ ও মৎস্য সম্পদের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে সমুদ্রে। যেহেতু মিঠা পানির মাছের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমাদের আমিষের একটা সম্ভাবনা হলো সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ। এই সম্পদ আহরণে আমাদের পর্যাপ্ত আধুনিক ট্রলার নেই। ছোট ছোট নৌকা বা ছোট ট্রলারে করে মৎস্য আহরণ করা হয়। কিন্তু এগুলো গভীর সমুদ্রে যেতে পারে না। ফলে আমাদের এলাকা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে থাইল্যান্ড ও ভারতীয় জেলেরা। বাংলাদেশ সরকারকে এখন উদ্যোগী হয়ে বড় বড় ট্রলার তৈরি ও মৎস্যজীবীদের মাঝে সমবায়ের ভিত্তিতে বিতরণ করতে হবে, যাতে এরা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে পারেন। দক্ষ ও জনশক্তি আমাদের নেই। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা হয় কম। বাংলাদেশ নেভি তাদের স্বার্থে কিছু গবেষণা করে। কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধতা আছে। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে দুটি সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ আছে। চট্টগ্রামে একটি মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এসব সিদ্ধান্ত ভালো। বরিশাল ও পটুয়াখালী (যা সমুদ্রে এলাকায় অবস্থিত) বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে নেভির তথা সমুদ্র অধিদফতর থেকে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের এসব বিভাগে নিয়োগ দিতে হবে। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে আইন অনুষদ আছে, সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে সমুদ্র আইন সংক্রান্ত একটি বিষয় চালু করতে হবে। দীর্ঘদিন পর মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলো। কিন্তু কাজ অনেক বাকি। সরকারের একটি বড় উদ্যোগের প্রতি তাকিয়ে থাকবে এখন সবাই। এখন বিজয় উৎসবের সময় নয়। এ নিয়ে কৃতিত্ব নেয়ারও কিছু নেই। আমরা ভারতের দৃষ্টান্ত দেখে শিখতে পারি। ভারতে এটা নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। লেখালেখিও তেমন চোখে পড়েনি। একটা রায় হয়েছে এবং আমাদের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তখন দেখতে হবে এই ‘অধিকারকে’ আমরা কীভাবে ব্যবহার করি। আমরা দুটি রায়ই পেলাম। রায়ের আলোকে অতি দ্রুত সীমানা নির্ধারণ করে সেখানে আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এ জন্য সমুদ্র অধিদফতরকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের UNCLOS ডেস্ককে আরো শক্তিশালী করাও জরুরি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরুণ কর্মকর্তাদের নির্দেশে পাঠিয়ে এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে বঙ্গোপসাগর হচ্ছে ২.২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের এক বিশাল এলাকা। এর মাঝে একটা সীমিত এলাকা আমাদের। তবে এখানে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। শুধু মৎস্য সম্পদ আহরণ করে আমরা আমাদের আমিষের ঘাটতি মেটাতে পারি। আগামী দিনে বঙ্গোপসাগরের স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব পড়বে। একদিকে চীন, অন্যদিকে ভারত এ অঞ্চলে তাদের নৌ তৎপরতা বাড়াচ্ছে। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ৫০ শতাংশ পরিচালিত হয় এই রুট দিয়ে। আর চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ৬০ শতাংশ বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং আগামী দিনে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বাড়বে। এ জন্য আমাদের নৌ বাহিনী ও কোস্টাল গার্ডকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। বহিঃসমুদ্রে টহল বাড়াতে হবে। বঙ্গোপসাগর নিয়ে গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকায় ‘বিস’ এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘বিস’ একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তবে এখানে বঙ্গোপসাগর নিয়ে কোনো কাজ হয় না। এখন হতে পারে। সিঙ্গাপুরের জমিন পূর্ব এশিয়ান ইনস্টিটিউটের সঙ্গেও যৌথভাবে গবেষণা কর্ম পরিচালনা করা সম্ভব। আমরা একটা ‘রায়’ পেয়েছি বলে যদি আত্মতুষ্টিতে ভুগি, তাহলে আমরা ভুল করব। আমাদের কাজ আরো বাড়ল। আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। মহীসোপানের বিষয়টিরও সমাধান হয়নি। এটা সমাধান করবে জাতিসংঘের অপর একটি সংস্থা। ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক অঞ্চল শেষ হওয়ার পরই শুরু হয় মহীসোপান। উপরের অংশ, অর্থাৎ জলরাশি দিয়ে মহীসোপানের বিচার করা হয় না। মহীসোপানের বিচার করা হয় পানির নিচের অংশ দিয়ে, যেখানে তেল, গ্যাসসহ প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। মহীসোপানে আমাদের সীমানা নির্ধারিত হলেই আমরা মহীসোপানে অর্থাৎ সাগরের নিচে আমাদের কর্মকাণ্ড চালাতে পারব। এই মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণের জন্য আমাদের ন্যূনতম চার থেকে ছয় বছর অপেক্ষা করতে হবে। সাধারণত ৩৫০ থেকে ৪০০ নটিক্যাল মাইলকে মহীসোপানের সীমানা ধরা হয়। বাংলাদেশ ২০১১ সালে তার মহীসোপানের দাবি জাতিসংঘে জমা দেয়। মোট ৫২টি দেশের আবেদনপত্র জাতিসংঘ বিবেচনা করছে। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন সরকারকে এখন খুব দ্রুত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। রায়ের পর সরকার সময় পাবে ৫ বছর। নিয়মানুযায়ী কোনো দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর প্রথম ৫ বছর সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথোরিটিকে কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হয় না। কিন্তু ৫ বছরের পর থেকে আহহৃত মোট সামুদ্রিক সম্পদের একটা অংশ এই কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। সমুদ্র সম্পদ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সমুদ্র অধিদফতরকে রেখেও একটি বৃহৎ পরিসরে পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নৌ বাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া সিনিয়র কর্মকর্তাদের এই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জড়িত করা প্রয়োজন। এর ফলে তাদের মেধা ও যোগ্যতাকে আমরা কাজে লাগতে পারব। একজন অদক্ষ আমলাকে দিয়ে এই কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। একটা রায় পেয়েছি। এটা নিয়ে যদি আমরা বসে থাকি, আমরা অনেক বড় ভুল করব। আমাদের যেতে হবে অনেক দূরে। আমরা কি পেয়েছি, কি হারিয়েছি, এটা নিয়ে যত কম বিতর্ক করব, ততই আমাদের মঙ্গল। দীপু মনি তার সাক্ষাৎকারে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ‘ভূমিকা’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এটা অনভিপ্রেত। আমাদের এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। কোনোকিছুতেই আমরা অতীতকে টেনে আনি, বিরোধী পক্ষের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করি, এটা ঠিক নয়। সবাইকে নিয়েই দেশ। এখন সীমানা নির্ধারিত হলো এটাই বড় কথা। কাউকে ছোট করে নিজেকে বড় করা যায় না। বড় হতে হয় কর্মে ও অভিজ্ঞতায়। মামলা করে আমরা ৮০ শতাংশ পেয়েছি এটার পুরোপুরিভাবে সঠিক নয়। সালিশি আদালতে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প ছিল না। কেননা তিন ভাগে সমুদ্র সীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল, আন্তর্জাতিক আদালত ও আরব্রিটাল ট্রাইব্যুনাল বা সালিশি আদালত। ভারত প্রথম দুটি কোর্টের ব্যাপারে তার আপত্তি আগেই দেয়ায় তৃতীয় বিকল্প অর্থাৎ সালিশি আদালতে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প ছিল না। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমা নির্ধারণে কিন্তু সালিশি আদালতে যায়নি। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে এই বিবাদ মীমাংসিত হয়েছিল। তবে এটা সত্য, সালিশি আদালতে যাওয়ার পরও ভারত আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল, যা বাংলাদেশ গ্রহণ করেনি। সুতরাং সমুদ্র সীমা নিয়ে আমরা আর কোনো বিতর্ক চাই না। এটা এখন মীমাংসিত বিষয়। Daily Manob Kontho 27.07.14

গাজা-ইউক্রেন ও বৃহৎ শক্তির ভূমিকা

চলতি সপ্তাহে গাজায় ইসরাইলি সামরিক আগ্রাসন ও ইউক্রেনে একটি মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমানকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ভূপাতিত করার ঘটনা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বড় ধরনের ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এ দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর ভূমিকা আবারো উন্মোচিত হলো। নিঃসন্দেহে ইউক্রেনে বিমান ধ্বংস ও ২৯৬ জন যাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা একটি বড় ধরনের অপরাধের শামিল। তবে গাজায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী যে হত্যাকা- চালিয়েছে, তার অপরাধ কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, ইউক্রেনের ঘটনায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং একটি আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু গাজায় ছোট ছোট শিশুদের যখন হত্যা করা হয় এবং শিশু ও নারীদের হত্যাকা-ের খবর যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তোলে, তখন জাতিসংঘ থাকে নির্বিকার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ফোন করে ইউক্রেনের ঘটনার প্রতিবাদ করেছন। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরো শক্ত অবস্থান নিতে তিনি তার ইউরোপীয় মিত্রদের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু শিশুদের হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে কোনো নির্দেশ দেননি গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ করতে। এখানেই এসে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের দ্বৈত নীতি। গণতন্ত্র তথা মানবাধিকার সংরক্ষণের তথাকথিত উদ্যোক্তা পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থ যেখানে বেশি, সেখানেই তারা সোচ্চার। যেখানে স্বার্থ নেই, সেখানে তারা সোচ্চার নয়। গাজায় যখন মানুষ মরছে এবং গাজা একটি বিধ্বস্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে, সেখানে তাদের বিবেক এতটুকু জাগেনি। বরং রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্যই ইউক্রেন ইস্যুটিকে তারা মুখ্য করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে, যাতে উত্তেজনা বাড়ছে। প্রথমে ক্রিমিয়ার গণভোট ও রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির সিদ্ধান্ত, পরে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরদার ও ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্তের পর ঘটল মালয়েশিয়ান বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা। এ ঘটনায় কোন পক্ষ জড়িত, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটা প্রচারণা চলছে এবং রাশিয়াকে ইতোমধ্যে জি-৮ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ইউক্রেন সঙ্কটকে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর। বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপকভাবে আলোচিত। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ইউরোপে দুই পরাশক্তির মাঝে প্রভাববলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের। দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউপোপে নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল, একসময় তা ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা বিশ্বে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ও দেশটি ভেঙে যাওয়ার পরই আবসান ঘটে এ স্নায়ুযুদ্ধের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলোয় রাশিয়ার উত্থান ও বিশ্বরাজনীতিকে প্রভাবিত করার প্রবণতা এবং সর্বশেষ রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ ইউক্রেনের সীমান্তে সেনাবাহিনী পাঠানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাশিয়ার যে বৈরিতার জন্ম হয়েছে, তাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা আখ্যায়িত করেছেন স্নায়ুযুদ্ধ-২ হিসেবে। এর আগে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান সেনা পাঠানোর ঘটনা এ অঞ্চলে বড় ধরনের উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। শুধু ইউক্রেনই নয়, বরং পাশের পোল্যান্ডের নিরাপত্তাও এখন হুমকির সম্মুখীন। এ নিরাপত্তাহীনতা এখন এ দেশগুলোকে এবং সেই সঙ্গে জর্জিয়াকে আরো বেশি মাত্রায় ন্যাটোর ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে। এ দেশগুলো, সেই সঙ্গে তার পাশে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, অন্যপাশে জর্জিয়া, কৃষ্ণ সাগরভুক্ত অঞ্চল। তুরস্ক রয়েছে অন্য পাশে। ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে এ অঞ্চলে ন্যাটোর যে সম্প্রসারণ ঘটেছে, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই ক্রিমিয়ায় সৈন্য পাঠিয়েছিল রাশিয়া। এ অঞ্চলজুড়ে ন্যাটোর যে সম্প্রসারণ ঘটেছে, তা রাশিয়ার নেতারা শুধু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণই করছেন না, বরং এ সম্প্রসারণ যে তাদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ তা তারা একাধিকবার বলেছেন। একসময় পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ সামরিক জোটের (বিলুপ্ত ১৯৮৮) সদস্য ছিল। এখন এ দেশগুলো (রোমানিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বাল্টিক দেশগুলো, চেক, বুলগেরিয়া) ন্যাটোর সদস্য। ঐতিহাসিকভাবেই ক্রিমিয়ার বন্দর সেভাস্টোপোলে রয়েছে রাশিয়ার নৌবাহিনীর বিশাল উপস্থিতি। কৃষ্ণ সাগর বা বস্নাক সির পশ্চিম পাশে রোমানিয়ার মিহাইল কোগালনাইসেআনুতে রয়েছে ন্যাটোর বিমানঘাঁটি। এ ঘাঁটির গুরুত্ব অনেক। আফগানিস্তানে সেনা ও রসদ সরবরাহের জন্য ট্রানজিট রুট হিসেবে এ বিমানঘাঁটিটি ব্যবহৃত হয়। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণ সাগরের গুরুত্ব আরো একটি কারণে। এখানে অবস্থান রয়েছে ন্যাটোর জয়েন্ট টাস্কফোর্স ইস্টের। কৃষ্ণ সাগরভুক্ত তিনটি দেশ রোমানিয়া, বুলগেরিয়া আর তুরস্ক নিয়ে ন্যাটো গেল বছর তাদের তিন মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছিল। এটা রাশিয়ার ওপর এক ধরনের স্নায়বিক চাপ। ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা অনেক দিক থেকেই কৃষ্ণ সাগরভুক্ত এলাকা, সেই সঙ্গে কাস্পিয়ান সাগরভুক্ত অঞ্চলকে 'হট এরিয়া', অর্থাৎ উত্তেজনাপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে আসছেন। সুতরাং ক্রিমিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ রাশিয়ানদের (জনসংখ্যার ৫৯ ভাগ, প্রায় ২০ লাখ) নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই যে শুধু রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছিল, তা বিবেচনায় নিলে ঠিক হবে না। রাশিয়ায় 'নয়া জার' নেতৃত্ব রাশিয়ার নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ক্রিমিয়ায় বসবাসকারী রাশিয়ানদের নিরাপত্তার পাশাপাশি তাদের নিজেদের ভূখ-গত নিরাপত্তার বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পুরো কৃষ্ণ সাগরভুক্ত অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব করার জন্যই ন্যাটোর দরকার জর্জিয়া ও ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেয়া। তাহলে রাশিয়ার সীমান্তে উপস্থিত থাকবে ন্যাটোর সেনাবাহিনী। এটা রাশিয়ার ওপর এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক চাপ। রাশিয়ার সমরনায়করা এটা যে মেনে নেবেন না, তা-ই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, গেল বছর কৃষ্ণ সাগরে ন্যাটো ও জর্জিয়ার নৌবাহিনী যৌথভাবে একটি সামরিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল, যা রাশিয়া খুব সহজভাবে নেয়নি। ক্রিমিয়ার ঘটনার রেশ ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে। কার্যত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে তখন আর ইউক্রেন সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই। এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব করে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা, যারা ক্রিমিয়ার মতোই রাশিয়ার অংশ হতে চায়। আর এ অঞ্চলেই মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের বিমানটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হলো। তবে এ হামলা কারা চালিয়েছে তা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। অভিযুক্তদের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। তারা অবশ্য হামলা চালানোর কথা অস্বীকার করেছে। ইউক্রেন সরকারকেও অভিযুক্ত করা হচ্ছে। মার্কিনি ভূমিকাও সন্দেহের বাইরে নয়। কেননা ন্যাটোর পূর্বমুখী যে সম্প্রসারণ, তার প্রধান উদ্যোক্তা যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই চাচ্ছে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দুটো দেশ_ জর্জিয়া ও ইউক্রেন ন্যাটোর পূর্ণ সদস্য হোক। তাহলে ন্যাটোর তথা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী এ দুই দেশে মোতায়েন করা যাবে। ফলে চাপের মুখে রাখা যাবে রাশিয়াকে। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার জ্বালানিসম্পদ, বিশেষ করে গ্যাসের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হবে। তাই পুতিন যে এই মার্কিনি স্ট্রাটেজি বোঝেন না তা ভাবা ছিল ভুল। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়ার সঙ্গে সীমিত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটোর উপস্থিতি রাশিয়া মেনে নেবে না। এর পরই ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ইউক্রেন সঙ্কটকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া পরস্পর 'বাগ্যুদ্ধে' অবতীর্ণ হয়। ইউক্রেনকে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ইউক্রেনকে রাশিয়া তার ইউক্রেন পাইপলাইন বন্ধ করে দিয়েছে। আর এতে করে বুলগেরিয়া, রোমানিয়া আর সার্বিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এ তিন দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। পরিসংখ্যান বলছে, রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ সংস্থা গ্যাসপ্রোমের ইউক্রেনের কাছে পাওনা রয়েছে ২ বিলিয়ন ডলার। এ টাকা এখন ইউক্রেন কীভাবে শোধ করবে? এ সঙ্কট এখনো যুদ্ধের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে। রাশিয়া ইতোমধ্যে ইউক্রেনকে বাইপাস করে কৃষ্ণ সাগরের নিচ দিয়ে একটি পাইপলাইন তৈরি করছে। সমগ্র ইইউর গ্যাস চাহিদার ৩০ ভাগ একা জোগান দেয় রাশিয়া। আর জার্মানির ৪০ ভাগ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ওই গ্যাস আগামী দিনে অন্যতম একটি ফ্যাক্টর হবে ইউরোপের রাজনীতিতে। ইউক্রেনের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রহ এ কারণেই তৈরি হয়েছে। সেখানে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে রাশিয়া সমর্থিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইয়াকোনোভিচকে উৎখাত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং একজন পশ্চিমা রাজনীতি সমর্থক ধনকুবের সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এ অঞ্চলে মূলত এক ধরনের 'প্রস্ক্রি ওয়ার' চলছে। এ প্রস্ক্রি ওয়ারটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার। অন্যদিকে গাজায় পশ্চিমা স্বার্থ তুলনামূলকভাবে কম। গাজায় তেমন সম্পদ নেই। এখানে যে গণহত্যা চলছে, তাতে পশ্চিমা বিশ্ব নিশ্চুপ। যা প্রতিবাদ হয়েছে, তা শুধু উন্নয়নশীল বিশ্বে। এমনকি আরব বিশ্বেও তেমন বিক্ষোভ হয়নি। বাংলাদেশ সরকার গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলার নিন্দা জানালেও, ভারতে মোদি সরকার ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করেনি। নিন্দা প্রস্তাবও নেয়নি মোদি সরকার। তুরস্ক সোচ্চার হয়েছে বটে, কিন্তু ইসলামিক ঐক্য সংস্থা কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি। অনেকেই মনে করেন অনেক আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে গোপনে ইসরাইল সম্পর্ক রক্ষা করে। তুরস্কসহ কিছু কিছু আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে (মিসরসহ) ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি পাকিস্তানও গোপনে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে, যা প্রকাশ্যে স্বীকার করা হয় না। শিশু ও নারীদের হত্যা করে ইসরাইল আরো একবার তাদের আগ্রাসী চেহারা উন্মোচন করল। এখন ইসরাইলের নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার জন্য মামলা দায়ের করা যেতে পারে। বসনিয়ার মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যদি দ্য হেগের আদালতে বিচার হতে পারে, যদি বুরুন্ডি ও লাইবেরিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হতে পারে, তাহলে আজ গাজায় গণহত্যার জন্য নেতানিয়াহু ও তার সহকর্মীদের বিচার হওয়া উচিত। উদ্যোগ নিতে হবে তথাকথিত গণতন্ত্রী পশ্চিমা বিশ্বকেই। গাজার হত্যাকা- আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সব ধরনের অন্যায় আর অবিচারের প্রতিবাদ করার। বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা আজ জরুরি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ন্যায়সঙ্গত। আর এ প্রতিবাদটিই করতে হবে উন্নয়নশীল বিশ্বকে। - See more at: http://www.jjdin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=24-07-2014&type=single&pub_no=904&cat_id=1&menu_id=19&news_type_id=1&index=0#sthash.whVzlPbI.dpuf

গাজা হত্যাকাণ্ডে বৃহৎ শক্তির নীরব সমর্থন!

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের ১৫ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সেখানে ইসরাইলিদের হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে। সেখানে ইসরাইলি সেনা প্রবেশ করেছে এবং শহরটি বাহ্যত একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গাজা এখন কার্যত একটি মৃত্যুনগরী। মৃত্যুর সংখ্যা প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৬০০ ছাড়িয়ে গেছে। এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ বলতে পারে না। তবে দুঃখজনক হচ্ছে, ইসরাইলি বোমায় প্রতিদিনই শিশু ও নারী মারা গেলেও পশ্চিমা বিশ্ব পালন করছে অদ্ভুত এক নীরবতা! ইউক্রেনে একটি মালয়েশিয়ান বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় জাতিসংঘ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, গাজায় শত শত শিশু ও নারী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাদের সেভাবে কঠোর অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া বারাক ওবামার প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই সাধারণ। গত সোমবার জাতিসংঘ ও ওবামা লোক দেখানো যুদ্ধবিরতি পালন করার আহ্বান জানিয়েছেন সত্য, কিন্তু গাজা থেকে ইসরাইলি সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়নি। জর্ডান নিরাপত্তা পরিষদে এ প্রস্তাবটি এনেছিল। প্রেসিডেন্ট ওবামা গাজায় বেসামরিক লোকজন নিহত হওয়ার ঘটনায় এক ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বটে, কিন্তু এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। তিনি টেলিফোনে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিয়েছেন এভাবে যে, গাজায় ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে এমনভাবে অভিযান পরিচালনা করতে হবে যাতে বেসামরিক নিহতদের সংখ্যা কম হয়!ওবামার এ ধরনের বক্তব্য মূলত গাজা হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষ সমর্থনেরই শামিল। শুধু ওবামা বলি কেন, ফ্রান্সে ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতে মোদি সরকারও গাজার গণহত্যার সমালোচনা করেনি। আরও দুঃখজনক হচ্ছে আরব বিশ্বের দৃষ্টিকটু নীরবতা। মুসলমান প্রধান দেশ হিসেবে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগানই একমাত্র সরকারপ্রধান, যিনি প্রকাশ্যে ইসরাইলি ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, ইসরাইলের বর্বরতা হিটলারকেও ছাড়িয়ে গেছে। তার মতে, ইসরাইল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। তুরস্কের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও এবং তুরস্ক মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর অন্যতম সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ইসরাইলের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সনাতন মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো, বিশেষ করে সৌদি আরবের ভূমিকাও ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের অভিভাবকের দাবিদার সৌদি আরবের পরোক্ষ সমর্থন নিয়ে (?) ইসরাইল গাজায় স্থল অভিযান চালাচ্ছে, এমন অভিযোগও উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, হামাসের কর্মকাণ্ডে সৌদি রাজবংশ পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। হামাসের রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি সৌদি রাজবংশের জন্য এক ধরনের হুমকিও বটে।>ইসরাইল গাজায় যে অভিযান চালাচ্ছে, তার নাম দিয়েছে অপারেশন প্রটেকটিভ এজ। এ অভিযানের শেষ কোথায়, তা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না। ১১ জুন তিনজন ইসরাইলি কিশোরকে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে এ অভিযান শুরু হলেও এর পেছনে ইসরাইলি নেতাদের সুদূরপ্রসারী দুরভিসন্ধি কাজ করছে। বলা ভালো, হামাস এই কিশোরদের হত্যাকাণ্ডে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে। তবে এটা সত্য, অতীতে হামাস এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল।গাজায় ইসরাইলি স্থল অভিযান ও হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে এমন একটি সময়ে, যখন ফাতাহ ও হামাস নেতারা নীতিগতভাবে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে রাজি হয়েছিলেন। ইসরাইলি স্থল অভিযানের মুখে এই কোয়ালিশন সরকার গঠন প্রক্রিয়া এখন অনিশ্চিত হয়ে উঠল। বলা ভালো, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এখন কার্যত দ্বিধাবিভক্ত। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন আল ফাতাহ গ্র“প নিয়ন্ত্রণ করে পশ্চিমতীর, আর হামাস নিয়ন্ত্রণ করে গাজা। হামাস উগ্রবাদী একটি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত। তবে ২০০৬ সালে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের পার্লামেন্টের যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে হামাস বিজয়ী হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ইসমাইল হানিয়া। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। এমনকি খোদ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের কাছেও তার এই নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ছিল।ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধীন একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে ওয়াশিংটন চুক্তি (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩) ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ওই শান্তিচুক্তির ফলে ইসরাইল অধিকৃত গাজা ও পশ্চিততীরের জেরিকো শহরে সীমিত স্বায়ত্তশাসন স্বীকৃত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি অপর একটি চুক্তির মাধ্যমে হেবরন শহরে ফিলিস্তিনি শাসন সম্প্রসারিত হয়। ওয়াশিংটন চুক্তির পরপরই যে ফিলিস্তিনি স্বশাসিত এলাকার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়নি। তবে ১৯৯৬ সালে ফিলিস্তিনি স্বশাসিত এলাকার প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং ইয়াসির আরাফাত প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু ২০০৪ সালে আরাফাতের মৃত্যু ফিলিস্তিনি আন্দোলনের জন্য ছিল এক ছুরিকাঘাতের শামিল। জীবদ্দশায় আরাফাত একজন প্রেসিডেন্টের সম্মান পেয়ে গেছেন, কিন্তু স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তিনি রেখে যেতে পারেননি। অভিযোগ আছে, ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করেছে। এরপর ২০০৫ সালে মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু অচিরেই ফিলিস্তিনের জনগণ প্রত্যক্ষ করে হামাস-আল ফাতাহ দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বের জের ধরে ২০০৭ সালে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়া পদত্যাগ করেন। অথচ এর ঠিক এক বছর আগে হামাস নেতা হানিয়াকে ফিলিস্তিনি জনগণ বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল।>ফিলিস্তিন নিয়ে সমস্যা মূলত একটিই- আর তা হচ্ছে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। পশ্চিমা বিশ্ব বারবার এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি দিলেও আজও তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক শান্তি আলোচনা সেই ১৯৭৩ সালে শুরু হয়েছে। আজও এ আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯৩ সালে ওয়াশিংটনে ইসরাইল-ফিলিস্তিন শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৮ সালে ওয়াশিংটনের অদূরে উই রিভার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইসরাইলের ব্যাপারে পিএলও ও আরব রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন সময়ে কিছু নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করলেও ইসরাইল কখনও তার একগুঁয়ে ও আগ্রাসী মনোভাব পরিত্যাগ করেনি। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ ও ৩০৮নং প্রস্তাব অনুযায়ী ইসরাইলের অধিকৃত আরব এলাকা ফিরিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু ইসরাইল নিরাপত্তা পরিষদের সেই সিদ্ধান্ত কখনোই কার্যকর করেনি। বরং একের পর এক বসতি স্থাপন করে উত্তেজনা জিইয়ে রেখেছে। নিরাপত্তা পরিষদও সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে কখনও উদ্যোগী হয়নি। অথচ ১৯৯১ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে বহুজাতিক বাহিনী গঠন করে সেখানে সেনা পাঠানো হয়েছিল এবং ইরাককে বাধ্য করা হয়েছিল সেই সিদ্ধান্ত মানতে। কিন্তু আজ ফিলিস্তিনের নিরীহ শিশুদের ইসরাইল হত্যা করলেও এ কর্মকাণ্ড বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়নি জাতিসংঘ। এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি- জাতিসংঘ মূলত পশ্চিমাদের স্বার্থেই পরিচালিত হয়। যুদ্ধ, মানবতা তাদের কাছে বড় নয়। গাজা একটি বিধ্বস্ত নগরীতে পরিণত হলেও, শত শত শিশুকে হত্যা করা হলেও তা প্রাধান্য পায়নি জাতিসংঘের কাছে। বরং নিরাপত্তা পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউক্রেনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায়! কী বৈপরীত্য!যারা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন, জিওনবাদের বা ইহুদিবাদের স্বপ্নদ্রষ্টা থিওডর হারজেল ১৯০৪ সালে একটি বৃহত্তর ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই রাষ্ট্রটির সীমানা হবে একদিকে নীল নদ, অন্যদিকে ফোরাত নদী। এ লক্ষ্যেই ১৯৮২ সালে ইনন পরিকল্পনা (ণরহড়হ) প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে ধর্মীয় ও এথনিকভাবে ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হবে। ফলে আরব রাষ্ট্রগুলো দুর্বল হবে এবং তা ইসরাইলি রাষ্ট্রের জন্য কোনো নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করবে না। আজ ইরাকের দিকে তাকালে কিন্তু সেই ইনন ফর্মুলার বাস্তব প্রতিফলনই আমরা দেখতে পাই। ইরাক আজ বাহ্যত তিন ভাগে বিভক্তির পথে- কুর্দি অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কুর্দিস্তান, শিয়া ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে একটি শিয়া রাষ্ট্র এবং সুন্নিরা আলাদা হয়ে একটি আলাদা রাষ্ট্র। এই পরিকল্পনা এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কুর্দিরা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য একটি ভোটের কথা বলছে। অনেকে স্মরণ করতে পারেন, জো বাইডেন (বর্তমানে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট) ২০০৬ সালের ১ মে পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটিতে (তখন তিনি একজন সিনেটর) এক ভাষণে ইরাককে ভেঙে তিনটি রাষ্ট্র করার প্রস্তাব করেছিলেন। ২০০৭ সালে সিনেটে গৃহীত এক প্রস্তাবে (৭৫-২৩ ভোটে) সেই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল। কুর্দিরা সেই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। আজ যখন জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যান, তখন সঙ্গত কারণেই তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। উল্লেখ্য, জো বাইডেন নিজে একজন ইহুদি। ওবামার ইহুদিপ্রীতির খবরও ইতিহাসে আছে। তরুণ সিনেটর হিসেবে প্রয়াত ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামায়ারের সঙ্গে দেখা ও তার প্রশংসা করা এবং চলতি জানুয়ারিতে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্যারনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান এবং নেতানিয়াহুর সঙ্গে দুঘণ্টা বৈঠক- এসবই ছিল ইসরাইলের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ। এখানে আরও একটা কথা বলা দরকার। ১৯৬০ সাল থেকেই কুর্দি নেতারা ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে এবং সেখান থেকে সামরিক সাহায্য পেয়ে আসছে। চলতি জুনে নেতানিয়াহু তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভাষণে স্বাধীন কুর্দিস্তানের পক্ষে কথা বলেছেন।ইতিহাসের কী অনিবার্য পরিণতি! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হিটলারের দক্ষিণ হস্ত বলে পরিচিত আইকম্যানের ফর্মুলা অনুযায়ী হিটলার ইহুদিদের বন্দি শিবিরে একত্রিত রাখা ও তাদের উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছিলেন। গ্যাস চেম্বারে ইহুদিদের হত্যা করা হয়েছিল। আজ এত বছর পর সেই ইহুদি নেতৃত্ব একই পন্থা অবলম্বন করে ফিলিস্তিনিদের বস্তি-জীবনযাপনে বাধ্য করছে! ইতিহাস থেকে ইহুদি নেতৃত্ব কোনো শিক্ষাই নেননি। আজ গাজায় ইসরাইলের স্থল অভিযান মূলত এ লক্ষ্যেই রচিত। ফিলিস্তিন থেকে হামাস নেতাদের উৎখাত করে গাজায় তাদের পদলেহীদের দিয়ে একটি দুর্বল প্রশাসন পরিচালনা করা এবং সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের ছোট ছোট গ্র“পে বিভক্ত করে তাদের এক রকম বস্তি-জীবনযাপনে বাধ্য করছে। এটাই হচ্ছে ইসরাইলের স্ট্র্যাটেজি। এর সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ শাসনের, যখন শ্বেতাঙ্গ নেতৃত্ব ১০টি হোমল্যান্ড গঠন করে কৃষ্ণাঙ্গদের সেখানে পাঠিয়ে এক ধরনের বস্তির জীবনযাপনে বাধ্য করেছিল।হামাসের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ফিলিস্তিনের জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে এবং ইসরাইলের আগ্রাসী নীতি আজ তাদের বাধ্য করেছে এ পর্যায়ে আসতে। আজ যদি ইসরাইলি নেতৃত্ব তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন না আনে, তাহলে এ এলাকায় কোনোদিন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। হামাস যে ১০ দফা প্রস্তাব করেছে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হতে পারে। ১০ বছর মেয়াদি একটি যুদ্ধবিরতি, গাজার অবরোধ প্রত্যাহার, কারাগারে আটক ফিলিস্তিনিদের মুক্তি, গাজার সমুদ্র ও বিমানবন্দর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে খুলে দেয়া ইত্যাদি প্রস্তাব খুব সহজেই মেনে নেয়া যায়। কিন্তু ইসরাইল এ কাজটি করবে না। তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। স্থল অভিযানে গাজা দখল করে নিয়ে গাজা থেকে হামাস নেতাদের উৎখাত করেই তারা তাদের অভিযান শেষ করবে। এর মধ্য দিয়ে মার্কিনি একটি সন্তুষ্টি হয়তো আমরা দেখতে পাব। কিন্তু ফিলিস্তিন-ইসরাইল এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। এতে করে হামাসের যোদ্ধারা আরও বেপরোয়া হবে এবং ইহুদি এলাকায় আÍঘাতী হামলা আরও বাড়বে। ইসরাইল যতদিন না ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব মেনে নেবে, ততদিন এ এলাকায় অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবেই। পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘ একটি টু-নেশন ফর্মুলায় যতদিন না ইসরাইলকে রাজি করাতে পারবে, ততদিন বান কি মুন, ওবামা কিংবা জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফর কোনো ফল বয়ে আনবে না। Daily JUGANTOR 24.07.14

শিক্ষামন্ত্রীর কাছে একটি খোলা চিঠি

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে আমি একটু বিশেষ দৃষ্টিতে দেখি। একজন ‘বাই বর্ন আওয়ামী লীগার’-এর মতো তাকে আমি কখনও ঔদ্ধত্য, প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখতে দেখিনি। আপাদমস্তক একজন ভদ্রমানুষ। সম্ভবত তার অতীত কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত থাকায় তিনি রাজনীতিতে ভদ্রতা, নম্রতা ও ভালমানুষি ভাবটা এখনও রক্ষা করে চলেছেন। কিন্তু এক সময়ের সিপিবির সাধারণ সম্পাদক আর আজকের আওয়ামী লীগনেতা নুরুল ইসলাম নাহিদ ইদানীং যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে আমার আস্থার জায়গাটা ধীরে ধীরে ধূসর হয়ে যাচ্ছে! পাবলিক পরীক্ষায় নকল হয়নি বলে তার ঘোষণার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই এখন তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব অনিয়মের পক্ষে নামলেন। টিআইবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্নীতি নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনা করেছিল। নাহিদ সাহেবের আপত্তিটা সেখানেই। সংবাদ সম্মেলন ডেকে বললেন, টিআইবির প্রতিবেদনের তথ্য অসত্য! আমাদের দুঃখের জায়গাটা এক জায়গায়- আমরা স্পষ্টবাদী কোনও মন্ত্রী পেলাম না! কেন জানি সবাই সুবিধাবাদিতার জায়গায়ই আশ্রয় নেয়। নাহিদ সাহেবও নিলেন। টিআইবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে যে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেছে, তাতে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, কিন্তু ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকা- কী শুধু টিআইবি একাই বলল? আমার ধারণা শিক্ষামন্ত্রী পত্রিকা পড়েন এবং সংবাদপত্রে তো বহুবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকা- নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় কী এর একটিও পড়েননি? গত ১৫ জুলাই শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, ‘শিক্ষার মান ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যই এই ভুল তথ্যের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।’ শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য এভাবেই ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। এ কী কথা বললেন শিক্ষামন্ত্রী? শিক্ষার মান? শিক্ষাব্যবস্থাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে? সার্টিফিকেট বিক্রি যদি শিক্ষার মান হিসেবে গণ্য করা হয়, আমি দুঃখিত মাননীয় মন্ত্রী, আপনার মতের সঙ্গে এক হতে পারলাম না। পত্রিকায় দেখলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয় টিআইবির প্রতিবেদনটি ‘পরীক্ষা’র জন্য দুজন বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠিয়েছে। আমরা জানি না এই দুই বিশেষজ্ঞ কারা? কিন্তু কিছু মুখচেনা ও দলবাজ ‘বিশেষজ্ঞ’ আপনার আছে- তাদের কাছে পাঠালে তো ‘সত্য’ কোনও দিনই আবিষ্কৃত হবে না। তারাও আপনার সুরে কথা বলবেন। আমি নিশ্চিত তারাও বলবেন শিক্ষার মান নষ্ট করার জন্যই এই প্রতিবেদন! এ জাতির দুর্ভাগ্য। একজন মুহম্মদ জাফর ইকবাল পাবলিক পরীক্ষায় নকলের প্রতিবাদ করলেন। অন্যরা কেউ এগিয়ে এলেন না! আবার এই জাফর ইকবালই মন্ত্রীর পাশে বসে পদক নিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদে এগিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা কম। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদের মতো শুভবুদ্ধির মানুষ যখন সমস্যার গভীরে যান না, তখন কষ্ট লাগে বৈকি! তিনি তো দুর্নীতির প্রতিবাদ করতেই ছাত্র রাজনীতি করেছিলেন। আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আর আজ? টিআইবি তার প্রতিবেদনে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছিল, তার মধ্যে রয়েছে উচ্চশিক্ষা লাভজনক পণ্যে পরিণত করেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল ৪ বছরেও গঠন না করা। শিক্ষার নামে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি। মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক আইন ভঙ্গকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ না করা ও সনদ বাতিল না করা। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনে রাজনৈতিক প্রভাব, অনুমোদনে স্বজনপ্রীতি ও অর্থ লেনদেন, মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগসাজশে ইউজিসি কর্তৃক উত্থাপিত অভিযোগ অদৃশ্য উপায়ে মীমাংসা হওয়া, শাস্তি প্রদান না করে বারবার আলটিমেটাম দিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করা। ইউজিসিকে না জানিয়ে সাধারণ তহবিলের টাকা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, শিক্ষকদের পারফরম্যান্স মূল্যায়নে প্রভাব বিস্তার, কম যোগ্য এবং বিষয় সম্পর্কে উচ্চতর কোনও ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও কোনও কোনও শিক্ষককে বিভাগীয় প্রধান করা, ট্রাস্টি বোর্ডের কোনও কোনও সদস্যের ব্যক্তিগত ও আর্থিক সুবিধা লাভ। ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি দেখিয়ে উপাচার্য পদ গ্রহণ এবং অবৈধভাবে অধ্যাপক পদবি ব্যবহার (দূতাবাসে চাকরি করা লোক এখন উপাচার্য এবং কোনও দিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেননি তারাও এখন উপাচার্য!), ১২ বছরে স্থায়ী সনদ গ্রহণ না করা। ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া কোর্স কারিকুলাম পড়ানো, শিক্ষার্থীদের কাছে বাধ্যতামূলক ‘নোট’ বিক্রি করে অবৈধ অর্থসম্পদ অর্জন, অযোগ্য ও অদক্ষ লোকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের নাম ব্যবহার করে ছাত্রদের আকর্ষণ করা, কাস না করিয়ে, পরীক্ষা না নিয়ে, ব্যবহারিক পরীক্ষা ছাড়াই ‘টাকার বিনিময়ে’ সনদ বিক্রি। গবেষণায় কোনও অর্থ ব্যয় করা হয় না, প্রশ্ন বলে দেওয়া, অতিরিক্ত নম্বর দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের বাধ্য করা, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উপঢৌকন নেওয়া, যৌনহয়রানি, ভিসি, প্রো-ভিসি নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব, আর্থিক লেনদেন ইত্যাদি। মোটা দাগে এ সবই অভিযোগ। এসব অভিযোগের পেছনে সত্যতা যে নেই, তা বলা যাবে না। >এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা। এই প্রয়োজনীয়তা আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘রাজনৈতিক আখড়ায়’ পরিণত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে ঝুঁকছে। মানহীন এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী নিত্য জব মার্কেটে প্রবেশ করছে। এবং এরা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে ব্যবহার করে সরকারি পদগুলো পেয়ে যাচ্ছে। এরা সমাজকে কী দেবে, সঙ্গত কারণেই সে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা ধীরে ধীরে একটি সার্টিফিকেটসর্বস্ব জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ‘খুলে’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেও ‘সনদ বিতরণ’ কেন্দ্রে পরিণত করেছি। অথচ দেখার কেউ নেই। টিআইবির এই রিপোর্ট তাই যুগোপযোগী। মাত্র ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে করা এই গবেষণা হয়তো পূর্ণাঙ্গ নয়। আমি অনুরোধ করব টিআইবি বাকি ৫৭ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও দ্বিতীয় আরেকটি গবেষণা পরিচালনা করবে। আমি মনে করি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে এই রিপোর্টটিকে বিবেচনায় নিয়ে কীভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন করা যায় সে ব্যাপারে অতি শিগগিরই একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া। ইউজিসি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে তিনজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে। এই কমিটি কী রিপোর্ট দেবে জানি না। কিন্তু তাদের কেউ কেউ নিজেরাই তো অভিযুক্ত। রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগও আছে। ফলে এই কমিটি লোক দেখানো কমিটি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে ইউজিসি যে কাজগুলো এখন করতে পারে, তা হচ্ছে বিতর্কিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে একটি শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে পরিবর্তনের সুপারিশ করা ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে শক্ত অবস্থানে যাওয়া। সমস্যাটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিয়েই। শর্ষের ভূত সেখানেই। আমার বিশ্বাস ছাত্রতুল্য শিক্ষাসচিব (যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় পিএইচডি করেছেন) মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের অবস্থানের বাইরে যেতে পারবেন না। শিক্ষকের দাবি নিয়ে তিনি এই কাজটি আদায় করে নিতে পারেন। জনমত সৃষ্টি করাও জরুরি। জাতিকে বারবার জানানো প্রয়োজন শিক্ষা নিয়ে কারা অনিয়ম করছে। তাদের বয়কট করাও প্রয়োজন। টিআইবি তাদের গবেষণায় যেসব তথ্য উপস্থাপন করেছে, সে ব্যাপারে তারাই ব্যাখ্যা দেবেন। তাদের সমর্থন করাও আমার কাজ নয়। মন্ত্রী মহোদয় সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন রেখেছেন পত্রিকার তথ্য গবেষণার ক্ষেত্রে কতটা গ্রহণযোগ্য? মন্ত্রী মহোদয় গবেষক নন। তার জানার কথাও নয়। কিন্তু গবেষকরা সূত্র হিসেবে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, প্রবন্ধ ইত্যাদি ব্যবহার করেন। এই রেওয়াজ অনেক পুরনো এবং এটি গবেষণার অন্যতম একটি সূত্র। আরেকটি তুঘলকি কা- করেছে মন্ত্রণালয়। টিআইবিকে একটি চিঠি দিয়েছে কারা কারা ঘুষ খেয়েছে, কে কত ঘুষ দিয়েছে, তার একটি তালিকা দিতে! মন্ত্রী মহোদয়ের অনুমোদন নিয়েই এটি পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয়ের দূরদর্শিতা দেখে আমার কষ্ট হয়। যে ঘুষ নেয়, আর যে ঘুষ দেয়, তারা কী বলে-কয়ে এই কর্মটি করে? ঘুষখোর কী কখনও স্বীকার করে তিনি ঘুষ খেয়েছেন! এটা তো তদন্ত করে খুঁজে বের করতে হয়। এই কাজটি মন্ত্রণালয় কিংবা দলবাজ তিন ভিসিকে দিয়ে করানো যাবে না। বিষয়টি দুদকের কাছে পাঠানো যেতে পারে, যদিও দুদকের কর্মতালিকায় এ ধরনের কাজের সঙ্গে তারা পরিচিত নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা না থাকলে এ ধরনের তদন্তে কোনও ফল পাওয়া যাবে না। আমি আগেও বলেছি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আমি। এ জন্য যা দরকার তা হচ্ছে সেখানে যোগ্য ও সৎ নেতৃত্ব, যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। ১৭ জুলাই এক সাবেক ভিসির (?) রিমান্ডে নেওয়ার খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তিনি একটি গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত। এই ভদ্রলোক মানবসম্পদ রপ্তানি করে প্রচুর টাকা-পয়সা কামিয়েছেন। তিনি ‘অধ্যাপক’ বা ‘ভিসি’ হলেন কীভাবে? তার ডিগ্রি নিয়েও প্রশ্ন আছে। কে বা কারা তাকে উপাচার্য হিসেবে মনোনীত করে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠিয়েছে? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের ‘অনুগ্রহ’ না পেলে মানবসম্পদ রপ্তানিকারকরা কিংবা মার্কিন দূতাবাসে কেরানির চাকরি করা ব্যক্তিরা হঠাৎ করে ‘অধ্যাপক’ ও ভিসি হতে পারেন না। মাননীয় মন্ত্রী আপনার আমলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভিসি হয়েছেন, তাদের কজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন? এসব কী আপনার জানার কথা নয়! এগুলো এক একটি পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এগুলো কি আপনার অজানা? বছরের পর বছর তিনি ভিসি। তারপর ছেলে, মেয়ে, বউ তারাও ভিসি! আপনার মন্ত্রণালয় থেকেই কিন্তু এসব ফাইল ‘প্রসেস’ হয়। দায়িত্ব আপনিও এড়াতে পারেন না। তাই টিআইবির রিপোর্ট নিয়ে কোনও বিষোদগার নয়, বরং আসুন সবাই মিলে কীভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাঁচানো যায়, সে চেষ্টা করি। শুধু দয়া করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সার্টিফিকেট বিক্রির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন না। আমার আশংকা হচ্ছে, মন্ত্রীর এই বক্তব্যে অসৎ ‘শিক্ষা ব্যবসায়ীরা’ তাদের অসৎ কর্মকা- আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন। দয়া করে এই কর্মটি করবেন না। টিআইবির রিপোর্টে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। এই রিপোর্টের পুনর্মূল্যায়নের আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি যাদের ডেকেছেন, তারা তোষামোদকারী, সুবিধাভোগী ও দলবাজ। তাদের ‘মূল্যায়ন’ আপনাকে এতটুকুও সাহায্য করবে না। অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আপনাকে বিভ্রান্তই করবে। সুতরাং টিআইবির রিপোর্টটি আমলে নিন। উদ্যোগ নিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে। উদ্যোগ নিন কঠোর হস্তে সব অনিয়ম বন্ধের। আমাদের সমর্থন আপনার প্রতি থাকবেই। Daily Amader Somoy 3.07.14

পরাশক্তির 'প্রক্সিওয়ার'

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহীকবলিত এলাকায় একটি যাত্রীবাহী মালয়েশিয়ান বিমান ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর দুই পরাশক্তির মাঝে এক ধরনের 'প্রস্ক্রিওয়ার' এর সম্ভাবনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ১৬ মার্চ ক্রিমিয়ায় গণভোট ও রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তি, রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, ইউক্রেন সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য ইত্যাদি ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। আর সর্বশেষ ঘটনায় যোগ হলো মালয়েশিয়ার যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা 'ভুল করে' এ যাত্রীবাহী বিমানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। প্রেসিডেন্ট ওবামা ওই ঘটনার জন্য পরোক্ষভাবে রাশিয়াকে দায়ী করেছেন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবরোধের নির্দেশ দিয়েছেন। এ হামলায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ শনিবার একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নেদারল্যান্ডস জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেছে। সুষ্ঠু তদন্তের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। ইউক্রেনের পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিল হচ্ছে। নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছে, যাকে অভিহিত করা হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ-২ হিসেবে। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী কর্মকান্ডের কারণে এ অঞ্চলে এক ধরনের উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ কিংবা রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে ন্যাটোর সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত এবং রাশিয়াকে 'ঘিরে ফেলার' সদূরপ্রসারী মার্কিন চক্রান্তের কারণে এ অঞ্চলে উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই চাচ্ছে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ জর্জিয়া ও ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। ২০০৮ সালে রাশিয়ার সঙ্গে জর্জিয়ার সীমিত যুদ্ধের (ওসেটিয়া প্রশ্নে) কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। 'ব্লাক সি'র অপর পাশের দেশগুলো (বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, রুমানিয়া) এরই মধ্যে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। তুরস্ক ও গ্রিস আগে থেকেই ন্যাটোর সদস্য। জর্জিয়া ও ইউক্রেন এখনও ন্যাটোর সদস্য নয়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, ইউক্রেন সঙ্কটের জন্ম হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচের উৎখাতের মধ্য দিয়ে। গণঅভ্যুত্থানে তিনি উৎখাত হলেও অভিযোগ আছে, তার উৎখাতের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল। রুশপন্থী ওই নেতা ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। তারপর ঘটল ক্রিমিয়ার ঘটনা। ক্রিমিয়ার ঘটনায় রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বহিষ্কার ও দেশটির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নের সমাধান এখনও হয়নি তা হচ্ছে, রাশিয়াকে 'বয়কট' করে পশ্চিম ইউরোপ রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কাটাবে কীভাবে? সেনাবাহিনী পাঠিয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে বটে; কিন্তু পুরো ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করবে কীভাবে? কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি গ্যাস আমদানি করার। কিন্তু বাস্তবতা কী তা বলে? পাঠকমাত্রই জানেন, পশ্চিম ইউরোপ থেকে শুরু করে সমগ্র পূর্ব ইউরোপ, যে দেশগুলো এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক প্রভাবে ছিল, তারা এখন স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরিপূর্ণভাবে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্যাসের রিজার্ভ হচ্ছে রাশিয়ায়। মূলত তিনটি পথে এ গ্যাস যায় ইউরোপে। সাবেক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো, যারা এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বস্নকে ছিল, তারাও এখন জ্বালানি খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। তিনটি পাইপলাইন, নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয় বছরে ৫৫ মিলিয়ন কিউসিক মিটার (বিসিএম), বেলারুশ লাইনে সরবরাহ করা হয় ৩৬ বিসিএম আর ইউক্রেন লাইনে সরবরাহ করা হয় ১০৭ বিসিএম। এখন ইইউর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে রাশিয়া যদি এ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে এক বড় ধরনের জ্বালানি সঙ্কটে পড়বে ইউরোপ। যদিও রাশিয়ার বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এ গ্যাস বিক্রি। এটা সত্য, রাশিয়া অত্যন্ত সস্তায় বেলারুশ ও ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহ করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ দেশ দুটি আবার রাশিয়ার গ্যাসের রিজার্ভ গড়ে তুলে সরাসরি পশ্চিম ইউরোপে তা বিক্রি করে কিছু 'আলাদা অর্থ' আয় করে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ২০০৯ সালে ইউক্রেন ও বেলারুশের সঙ্গে রাশিয়ার এক ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, যাকে বলা হয়েছিল 'গ্যাসওয়ার' অর্থাৎ গ্যাসযুদ্ধ। ইউক্রেনে অত্যন্ত সহজ মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করত রাশিয়া। কিন্তু ইউক্রেন অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল, যা ইউরোপে একটি সঙ্কট তৈরি করে। শুধু গ্যাস নয়, রাশিয়া বেলারুশকে সস্তা দামে তেলও দেয়। ওই তেল আবার বেলারুশ অধিক মূল্যে ইউরোপে বিক্রি করে। Druzhba  অথবা Friendship পাইপলাইনের মাধ্যমে এ গ্যাস ও তেল সরবরাহ করা হতো। বেলারুশের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হয়েছিল। তারা অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। রাশিয়া পাইপলাইনে গ্যাস ও তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন আবার নতুন আঙ্গিকে এ 'গ্যাসওয়ার' শুরু হওয়ার একটা সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ সংস্থা 'গ্রাসপ্রোম' ইউক্রেনের কাছে পাবে ২ বিলিয়ন ডলার। এ টাকা ইউক্রেন পরিশাধ করতে পারছে না। অন্যদিকে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের নামে আইএমএফের কাছ থেকে ইউক্রেনের যে বিলিয়ন ডলার অর্থ পাওয়ার কথা ছিল, তাতে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে রাশিয়া যদি ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে এক মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে সমগ্র ইউরোপে (সমগ্র ইইউর গ্যাসের চাহিদার ৩০ ভাগ জোগান দেয় রাশিয়া আর জার্মানি দেয় ৪০ ভাগ)। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের ২২ বছর পর নতুন করে আবার দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রাশিয়া চায় এ অঞ্চলের ওপর তার যে পরোক্ষ 'প্রভাব', তা বজায় রাখতে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে রাশিয়ার এ 'প্রভাব' কমাতে। ফলে নতুন করে সঙ্কট তৈরি হয়েছে। নতুন করে একটি প্রশ্ন উঠেছে- রাশিয়াকে বাদ দিয়ে ইউরোপের নিরাপত্তা অর্থহীন। রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা বিবেচনায় নিয়েই রাশিয়ার সঙ্গে ১৯৯৭ সালে ন্যাটোর একটি চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তিতে ন্যাটোকে রাশিয়ার পরামর্শকের ভূমিকা দেয়া হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ২৭ মে প্যারিসে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন (রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট) ও সার্বেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। সেইসঙ্গে ন্যাটো সদস্যভুক্ত অন্য দেশের সরকারপ্রধানরাও। কিন্তু তা সত্ত্বেও ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রাশিয়াকে একটি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অনেকটা সেই 'কনটেইনমেন্ট থিউরির' মতো রাশিয়াকে ঘিরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে ন্যাটো। ক্রিমিয়ার পার্শ্ববর্তী কৃষ্ণসাগর বা বস্নাক সির পশ্চিমে রুমানিয়ার মিখাইল কোগলেনাইসেআনুতে রয়েছে ন্যাটোর বিমান ঘাঁটি। আফগানিস্তানে সেনা ও রসদ সরবরাহের জন্য এ বিমান ঘাঁটিটি ব্যবহৃত হয়। গেল বছর কৃষ্ণসাগরে ন্যাটো ও জর্জিয়ার নৌবাহিনী যৌথভাবে একটি সামরিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল, যা রাশিয়া খুব সহজভাবে নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই চাইছে জর্জিয়া ন্যাটোতে যোগ দিক। এটা যদি হয়, তাহলে রাশিয়ার সীমান্তে উপস্থিত থাকবে মার্কিন সেনাবাহিনী। রাশিয়ার সমরনায়করা এটা মানবেন না। আজকে ইউক্রেনের পরিস্থিতি, যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ, এ অঞ্চলে সেনা মোতায়েন-সবকিছুতে ক্রমেই মার্কিনি স্বার্থ স্পষ্ট হচ্ছে। এদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলকৃত পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেন সামরিক অভিযান আপাতত স্থগিত রেখেছে। রাশিয়ার প্রবল আপত্তির মুখে এ অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে পুরো পূর্বাঞ্চলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। ৭ এপ্রিল সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুধু পূর্বাঞ্চলীয় শহর ওডেসায় কমপক্ষে ৩৬ জন নিহত হয়েছেন। পূর্বাঞ্চলের আরেকটি শহর ক্রামাটোরস্কে ঘরে ঘরে লড়াই চলছিল। ওই 'গৃহযুদ্ধ' শুধু যে ইউক্রেনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা বলা যাবে না। ওই পরিস্থিতি সীমান্ত অতিক্রম করে রাশিয়ার ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে ইউক্রেনের পরিস্থিতি দীর্ঘদিন পর রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে একটা 'প্রস্ক্রিওয়ার' এর জন্ম দিয়েছে। এ 'যুদ্ধে' কোন পক্ষ জয়ী হবে, এটা আশা করাও ঠিক হবে না। বরং এ উত্তেজনায় বিশ্বের অন্যত্র অন্য দেশগুলোও আক্রান্ত হতে পারে। এমনিতেই বিশ্ব পরিস্থিতিতে উত্তেজনা বাড়ছে। গাজায় ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসনের কারণে সেখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি চরমে উঠেছে। বিশ্ব সম্প্রদায় সেখানে একরকম নিশ্চুপ। এমনকি ইসরাইলি সেনাবাহিনীর এ গণহত্যা বন্ধের ব্যাপারে জাতিসংঘের কোনো উদ্যোগও পরিলক্ষিত হয়নি। সেখানে শিশু ও নারী হত্যার ঘটনা প্রতিদিনের সংবাদে পরিণত হয়েছে, সেখানে পশ্চিমা বিবেক নিশ্চুপ! গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের কথাও চিন্তা করছে না। গাজায় এ গণহত্যার জন্য ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সরাসরিভাবে দায়ী। আজকে বসনিয়ার গণহত্যাকারীদের কিংবা রুয়ান্ডার মানবতাবিরোধী অপরাধীদের যদি দি হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হতে পারে, তাহলে আজকে গাজায় নিরপরাধ শিশু ও নারী হত্যাকারী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও ইসরাইলি সেনা নেতৃত্বেরও বিচার হওয়া উচিত। আজকে মার্কিন নেতারা বলছেন, যারা মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এমএইচ ১৭-এর বিমানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ধ্বংস করেছে, তাদের বিচার হতে হবে। কিন্তু তাদের মুখ থেকে একবারও বের হলো না, গাজার হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে। আসলে সেই ক্ষমতা মার্কিন নেতাদের নেই। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি লবি দ্বারা চালিত। তাদের রাজনৈতিক ও আর্থিক উৎস হচ্ছে ইহুদি লবি। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ফিলিস্তিনি এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি! তিনি তার পররাষ্ট্র সচিবকে ওই এলাকায় পাঠিয়েছিলেন, এটা সত্য। কিন্তু ওই পর্যন্তই। 'লোক দেখানো' একটি দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তাকে দেখি মালয়েশিয়ান বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় অতি দ্রুত রাশিয়ার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে। অথচ এ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় কারা সত্যিকার অর্থে জড়িত, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ ঘটনায় ২৯৫ জন যাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন, এটা নিঃসন্দেহে একটা দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু কারা দোষী? ওবামা নিজে ইউক্রেনের বিদ্রোহীদের দিকে আঙুল নির্দেশ করেছেন। কিন্তু সাধারণত যাত্রীবাহী বোয়িং বিমানগুলো ৩৩ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে যায়। ওই বিমানকে আঘাত করার সক্ষমতা বিদ্রোহীদের না থাকারই কথা। তবে মালয়েশিয়ান এক মন্ত্রী বলেছেন, তাদের কাছে বিদ্রোহীদের সঙ্গে জাপানি এক মেজরের কথোপকথনের অডিও টেপ রয়েছে। তার দাবি, এ ঘটনায় ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দায়ী। আসলে প্রকৃত তদন্ত ছাড়া এটা প্রমাণ করা যাবে না যে, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় কারা জড়িত। রাজনীতিতে 'ষড়যন্ত্রতত্ত্ব' নামে একটি তত্ত্ব আছে। সাধারণত বৃহৎ শক্তিগুলো একটা 'ঘটনা' থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে নেয়ার জন্য আরেকটি 'ঘটনার' জন্ম দেয়। এটা এমনও হতে পারে, গাজার হত্যাকান্ড থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেয়ার জন্য এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। অথবা সিরিয়া-ইরাকের পরিস্থিতিকে ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যেও এ ঘটনা ঘটানো হতে পারে। এসবই ধারণা মাত্র। তবে এটা সত্য, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী মার্কিনি আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে একটা জনমত তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করছে। রাশিয়ার ভূমিকা অতীতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কোনো কোনো বিশ্লেষকের লেখনীতে স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর কথাও বলা হচ্ছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া এক ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এ প্রতিযোগিতা হচ্ছে প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা। প্রতিটি ক্ষেত্রে এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমরা লক্ষ্য করি। এরই মধ্যে 'ব্রিকস' সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কতৃত্ব খর্ব করার লক্ষ্যে বিকল্প একটি ব্যাংক গঠন করার। প্রস্তাবিত ব্যাংকটির নাম দেয়া হয়েছে 'নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক'। বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত চীন, ভারত, রাশিয়া, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা বিক্রসের সদস্য। ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় সদ্য শেষ হওয়া ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ফলে এটা স্পষ্ট যে, বিশ্বে নতুন করে মেরুকরণ ঘটছে এবং উদীয়মান শক্তিগুলো একত্রিত হচ্ছে। এরা যে বিশ্বব্যাপী মার্কিনি খবরদারির বিরুদ্ধে একত্রিত হবে, এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ইউক্রেনের ঘটনাবলি দিয়েই শুরু হলো এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা দুই বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে কোথায় নিয়ে যায়, সেটাই দেখার বিষয়। Daily Alokito Bangladesh 23,07.14

হেগের আদালতের সিদ্ধান্ত ও আমাদের করণীয়

হেগের আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ ছিল, এর একটি সমাধান করে দিয়েছেন। এই রায় নিয়েও দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও দুটি বড় দল যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে, তা তাদের প্রতিক্রিয়া থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। সরকারি দল বলছে, ‘এটা তাদের বিজয়।’ এমনকী এটাও বলা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারি সংসদের নির্বাচন হয়েছিল বলেই এই রায় পাওয়া গেছে। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই রায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। মজার ব্যাপার, বাংলাদেশের সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এই ইস্যু নিয়ে ‘অতি আগ্রহ’ দেখালেও ভারতের কোনও আগ্রহ দেখিনি। ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির কোনও নেতৃবৃন্দের কোনও মন্তব্য আমি পাঠ করিনি- যাতে তারা দাবি করেছেন, এই রায়ে তারা ‘বিজয়ী’ হয়েছেন। এমনকী বাংলাদেশের সংবাপদত্রে যেভাবে লেখালেখি হচ্ছে, ভারতে সেভাবে দেখিনি। অনেক সংবাদপত্রে রায়ের খবরটিও প্রকাশিত হয়নি। এখন একটি রায় বের হয়েছে। কিন্তু আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। দক্ষিণ তালপট্টি আমরা হারিয়েছি- এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, একসময় আমরা এই জেগে ওঠা দ্বীপটি দাবি করেছিলাম এবং আওয়ামী লীগও অতীতে যখন ক্ষমতায় ছিল (১৯৯৬, ২০০৮-বর্তমান) কিংবা বিরোধী দলে ছিল (১৯৯১-২০০১), তখনও তারা এ দ্বীপটি বাংলাদেশের নয়- এমন দাবি করেনি। এখন ২০১৪ সালে এসে সালিশি আদালতের বিচারপতিরা স্বচক্ষে ওই দ্বীপটির অস্তিত্ব দেখতে পাননি। এটিই বাস্তবতা। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের দুর্বল উপস্থাপনায়ও বেশ ত্রুটি ছিল। তারা সঠিক ম্যাপ উপস্থাপন করতে পারেননি। যে ম্যাপটি তারা ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করেছিলেন, এতে ভুল তথ্য সংযোজিত ছিল। আদালত এটি গ্রহণ করেননি। তবে মজার ব্যাপার, ১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশ এ দ্বীপটি জেগে ওঠার পর থেকে দ্বীপটির ওপর বাংলাদেশের দাবি অব্যাহত রাখলেও কখনও ম্যাপে দক্ষিণ তালপট্টিকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। তাই প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই ওঠে, বাংলাদেশের কোনও সরকারই কেন এটি করেনি? ভারতের আপত্তির কারণে যদি দ্বীপটি ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত না হয়ে থাকে, তাহলে সরকারগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তো থাকবেই। এখানে বলা ভালো, ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব মিয়ানমার ও ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার বিষয়টি অবহিত করেছিলেন। দীর্ঘ শুনানির পর ২০১২ সালের ১৪ মার্চ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আমরা একটা রায় পেয়েছি। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে। এখন ভারতের সঙ্গেও এই সীমা নির্ধারিত হল। সমুদ্রের সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি বেশ জটিল। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বলবৎ রয়েছে ৩ৎফ টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঃযব খধি ড়ভ ঝবধ (টঘঈখঙঝওওও)। এই আইন ১৯৮২ সালে গৃহীত এবং ১৯৯৪ সালের নভেম্বর থেকে কার্যকর। ভারত ১৯৯৫ সালের ২৭ জুন আর মিয়ানমার ১৯৯৬ সালের ২১ মে টঘঈখঙঝওওও অনুমোদন করে। আর বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষরের পর তা অনুমোদন করে ২০০১ সালের ২৭ জুলাই। আইন অনুযায়ী অনুমোদনের ১০ বছরের মধ্যে সমুদ্রসীমায় দাবির পক্ষে তথ্য ও উপাত্ত উপস্থাপন করতে হয়। টঘঈখঙঝ১১১-এর ধারা ২৮৭, এনেক্স ঠওও, আর্টিকেল-১ অনুযায়ী বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই তার দাবি উপস্থাপন করেছিল। এখানে বলা ভালো, বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে ঞবৎৎরঃড়ৎরধষ ধিঃবৎ ধহফ গধৎরঃরসব ২০ হড়ং অপঃ ১৯৭৪ গেজেট আকারে প্রকাশ করে। এই অ্যাক্টের বেজলাইন ৬০ ফুট সমুদ্র গভীরতার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। ভারত ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের এই দাবির বিরোধিতা করে এই যুক্তিতে, সর্বপশ্চিমের পয়েন্ট তার (ভারতের) ২১ মাইল ভেতরে চলে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও ভারত ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরেই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনায় বসে। এখানে বলা ভালো, কোন নীতি অনুসরণ করে ওই বিবাদ নিষ্পত্তি করা হবে- এটি নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে পরস্পরবিরোধী অবস্থান ছিল। মিয়ানমার ও ভারত চেয়েছে ‘সমদূরত্ব’নীতি অনুসারণ করে এই বিবাদের নিষ্পত্তি। অন্যদিকে বাংলাদেশ চেয়ে এসেছে, ‘সমতা’নীতি। ‘সমদূরত্ব’-পদ্ধতি বা নীতি অনুসরণ করলে বঙ্গোপসাগরের ওপর যথাক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দুটি সীমারেখা টানা হতো। ফলে বাংলাদেশ সমুদ্র অঞ্চলের ওপর তার অধিকার হারাত। অন্যদিকে ‘সমতা’-পদ্ধতি অনুসরণ করলে সোজা দক্ষিণ দিকে এই সীমারেখা টানা হবে। তবে এটিও সত্য, আন্তর্জাতিক আইনে সমদূরত্ব এবং সমতানীতি- দুটোই স্বীকৃত এবং দুটোই অনুসরণ করা হয়। এক্ষেত্রে দুপক্ষ যদি আলাপ-আলোচনায় কোনও সমঝোতায় উপনীত হতে না পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে দেশ দুটোকে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে আদালতের রায় দেশ দুটো মানতে বাধ্য। তখন বাংলাদেশ ও ভারত কোনও আপত্তি উপস্থাপন করতে পারবে না। রায় মানতে হবে। আপিলেরও কোনও সুযোগ নেই। জাতিসংঘের সমুদ্র আইন অনুযায়ী কোনও দেশ বেজলাইন থেকে সমুদ্রের দিকে ২০০ মাইল পর্যন্ত একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে দাবি করতে পারে। সব দেশের ক্ষেত্রে সমান দূরত্বের এই বিধানকে সমদূরত্বনীতি বলা হয়। তবে যদি দুটি বা ততোধিক দেশের উপকূলরেখা পরস্পর-বিপরীতভাবে বা বক্রভাবে বিরাজ করে, তাহলে সমদূরত্বের নীতি কার্যকর হবে না। কারণ এতে কোনও একটি দেশ তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তাই সেক্ষেত্রে টঘঈখঙঝ- এর ৭৪ ধারা অনুযায়ী দেশগুলোর পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে ন্যায়পরায়ণতার নীতির ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতে হবে। এ জন্য একাধিক বিষয় বিবেচনায় আনতে বলা হয়েছে। দেশের উপকূলের রেখা বিন্যাস, এর বক্রতা, দৈর্ঘ্য ইত্যাদি। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সমুদ্র উপকূল পরস্পর বক্র আকারে বিরাজ করলেও তারা দীর্ঘদিন তা গণ্য করেনি, বরং সমদূরত্বের নীতির আলোকে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দাবি করে আসছিল। এখন আদালত এই সমুদূরত্বের নীতি গ্রহণ না করে কিছুটা সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে এ রায়টি দিল। এখন এ রায়টি নিয়ে আমরা যত কম বির্তক করব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমাদের এখন সামনে তাকাতে হবে। দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে শুধু-শুধু বিতর্ক করলে আমরা আর কোনও দিনই দক্ষিণ তালপট্টি ফিরে পাব না। এটি সত্য, দক্ষিণ তালপট্টির অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। এখানে প্রচুর গ্যাস, তেল ও মিনারেল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর আশপাশে আমাদের যে অঞ্চল রয়েছে, সেখানে আমরা তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে পারি। শুধু দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে ‘বিবাদ’ করলে আমরা বঙ্গোপসাগরে যে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, তা কাজে লাগাতে পারব না। এই রায়ের ফলে বঙ্গোপসাগরে আমাদের সীমানা নির্ধারিত হল। বঙ্গোপসাগর হচ্ছে বিশাল এক সম্ভাবনার জায়গা। প্রায় ২ দশমিক ২ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে বিশাল এই বঙ্গোপসাগর। এই বঙ্গোপসাগর পৃথিবীর বৃহৎ উপসাগর, আগামী প্রজন্মের জন্য আশীর্বাদ। বঙ্গোপসাগর থেকে পানি, লবণ, শক্তি, মৎস্যসহ বিভিন্ন মিনারেলস পাওয়া যাবে। যতটুকু এলাকাই আমরা পেয়েছি, সেখানে যদি অনুসন্ধান চালানো যায়- তাহলে বিশাল এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মিয়ানমার গভীর সমুদ্রে যে গ্যাস ও তেল পেয়েছে, তা এখন চীন ও থাইল্যান্ডে রপ্তানি করছে। ভারত এখানে বিনিয়োগ করেছে। এই গ্যাস ভারতেও যাবে। অথচ পাশের দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের বৈদেশিক নীতির ব্যর্থতার কারণে মিয়ানমারের এই গ্যাস আমরা আমদানি করতে পারলাম না। ভারতের রিলায়েন্স কোম্পানি ভিসাখাপট্টমের কাছে বঙ্গোপসাগরে ২০০৩ সালে ৭ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস পেয়েছিল। সেই গ্যাস এখন উত্তোলিত হচ্ছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ চাহিদার এক শতাংশ গ্যাস আসে গভীর সমুদ্র থেকে। ভারত এখন প্রাপ্ত গ্যাসকে এলএনজিতেও রূপান্তর করছে। ভারতের ৭০ শতাংশ তেল আমদানি হয় (প্রধানত প্যারসীয় অঞ্চল থেকে) বঙ্গোপসাগর রুট ব্যবহার করে। এর পরিমাণ ২০১৫ সালে বাড়বে ৮৫ শতাংশে। আর চীনের বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরতার হার শতকরা ৬০ ভাগ। এশিয়ার বড় অর্থনীতি ভারত ও চীন। তাদের জ্বালানি চাহিদা বাড়ছে। ভারতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হলেও চাহিদার মাত্র ৩ শতাংশ সরবরাহ করা হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে। ভারত এখন বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতি। ভারতের জ্বালানি চাহিদা বাড়বেই। ফলে বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ভারত বাড়াবেই। আমাদের উচিত হবে এখন দ্রুত গভীর ও অগভীর সমুদ্রে যে ২৮টি ব্লক (তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান), এর কোনও কোনওটির- যেগুলো নিয়ে আদালতের রায়ে সুস্পষ্ট হয়েছে, সীমানা নতুন করে নির্ধারণ করা। এক্ষেত্রে অনুসন্ধানে বাপেক্সের দক্ষতা আছে কি না, তা আমি নিশ্চিত নই। আমরা ইতোমধ্যে কিছু ব্লক বিদেশি কোম্পানিকে দিয়েছি। বাকিগুলো নিয়ে দ্রুত আলোচনা হতে পারে। সমুদ্রবিজ্ঞান দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে অবহেলিত। একমাত্র দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়টি একাডেমিক কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু গবেষণার পরিধি সীমিত। এক্ষেত্রে সরকার ‘বিস’কে শক্তিশালী করতে পারে। সেখানে গবেষণার সুযোগ অনেক বেশি। এখানে বঙ্গোপসাগর নিয়ে পৃথক একটি উইং থাকতে পারে। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও সিঙ্গাপুরের সাউথ ইস্ট এশিয়ান ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বিস যৌথভাবে বঙ্গোপসাগর নিয়ে গবেষণা চালাতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনক্লোজ ডেস্কটি শক্তিশালী করাও জরুরি। সমুদ্র আইন নিয়ে দেশে কাজ করা মানুষের সংখ্যা কম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন অনুষদগুলো যথেষ্ট জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না। হেগের রায় দেখিয়ে দিল, আমাদের কাজ এখনও অনেক বাকি। এখন রায়ের ফলে আমরা যদি আত্মতুষ্টিতে ভুগি, তাহলে খুব বেশিদূর যেতে পারব না। সমুদ্রের সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্যও প্রয়োজন। সুতরাং দায়িত্ব এখন আরও বাড়ল। গভীর সমুদ্রে মহীসোপানের ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হতে আরও ৪ থেকে ৫ বছর লেগে যাবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা এখন নির্ধারিত হয়েছে। এ সীমানা নিয়েই এখন আমাদের দ্রুত এগোতে হবে। Daily AMADER SOMOY 17.07.14

দক্ষিণ তালপট্টি হারিয়ে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম?

প্রথমে মিয়ানমার ও পরে ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নির্ধারিত হওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, সমুদ্রভিত্তিক বিশাল যে অর্থনীতি, তার কতটুকু আমরা কাজে লাগাতে পারব? কিংবা সমুদ্র অর্থনীতিকে বোঝা ও ব্যবহারের জন্য যে জনশক্তি আমাদের দরকার, তা কি আমাদের আদৌ আছে? দ্য হেগের সর্বশেষ রায়ের পর সবার দৃষ্টি এখন এদিকেই থাকবে। এই রায়ের পর ‘সমুদ্র জয় হয়েছে’ বলে একটি অতি উৎসাহী ভাব আমি কারও কারও মাঝে লক্ষ্য করেছি। আসলে সমুদ্র জয় করা যায় না। সমুদ্র হচ্ছে বিশাল। বিশাল এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। এই অর্থনৈতিক সম্ভাবনার খুব কম অংশই আমরা আহরণ করতে পারি। সমুদ্রের বিশাল সম্ভাবনা এখনও অনাবিষ্কৃত। আমরা সাধারণত জানি, গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস পাওয়া যায়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমার গভীর সমুদ্র থেকে তেল ও গ্যাস আহরণ করছে। কিন্তু এখানে কোবালরিচ ক্রাস্ট, পলিমেটালিক সালফাইড, পলিমেটালিক নডিউলস ও গ্যাস হাইড্রেটের মতো মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ সাগরের তলদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তা আহরণের প্রযুক্তি ও জনশক্তি আমাদের নেই। তাছাড়া উপকূলজুড়েই রয়েছে জিরকন, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, মোনজাইট ও গারনেটসহ অনেক ধরনের খনিজ পদার্থ। ক্রুক্ড স্যান্ড ও হেভি মিনারেলস তো আছেই। ‘ব্লাক ডায়মন্ড’ নামে পরিচিত খনিজ হচ্ছে ইলমেনাইট। বাংলাদেশে এর প্রচুর মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বলা ভালো, হেভি মিনারেলস ব্যবহার হয় ধাতব শিল্প, বিমান ও রকেট শিল্প এবং রেডিও-ইলেকট্রনিকের মতো শিল্পে। আর গ্যাস হাইড্রেট হচ্ছে এক ধরনের বলের মতো, যা থেকে মিলবে গ্যাস। নডিউলস সালফাইড থেকে মিলবে কপার, ম্যাগনেসিয়াম, নিকেল ও কোবাল্টের মতো দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান খনিজ পদার্থ (যায়যায়দিন, ১৩ জুলাই ২০১৪)।সমুদ্রে প্রচুর মৎস্য সম্পদ রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সাগর-মহাসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে। তবে বঙ্গোপসাগরে কত প্রজাতির মাছ রয়েছে এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বিচ্ছিন্নভাবে দু’একটি গবেষণা চালানো হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে পূর্ণাঙ্গ চিত্র উঠে এসেছে বলে মনে হয় না। এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। আমরা অতীতে কখনও সমুদ্রকে গুরুত্ব দিইনি। সমুদ্রের সম্পদ যে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে শুধু বাঁচিয়ে রাখতে পারবে, তা নয়। বরং এই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারব। সমুদ্রের ঢেউ নিয়েও কথা থেকে যায়। পশ্চিমা বিশ্বে এটা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, এই ঢেউ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এই প্রযুক্তি বা জনশক্তি আমাদের নেই- এটা আমরা স্বীকার করতেই পারি। তবে ভবিষ্যতে যে এই প্রযুক্তি এ দেশে আসবে না, তা আমরা বলতে পারি না। পৃথিবী দ্রুত বদলে যাচ্ছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে। পশ্চিমা বিশ্বেও সমুদ্র নিয়ে গবেষণা বাড়ছে। সুতরাং আমরাও পিছিয়ে থাকতে পারি না। আমাদের সমুদ্র সীমানা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এটা নিয়ে বিতর্ক কিংবা প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে কে জয়ী হয়েছে, কে হেরে গেছে এ বিতর্ক না তোলাই মঙ্গল। এটা সত্য, সমুদ্রসীমায় একটি বড় অংশই আমরা পেয়েছি। কিন্তু পুরোটা আমরা পাইনি। যে ৬ হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় আমরা হারিয়েছি, সেখানেই রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল রিজার্ভ। তালপট্টি দ্বীপ ওই ৬ হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটারের অন্তর্ভুক্ত। তবে এর আশপাশে যে অঞ্চল, বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত, সেখানেও প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের অনেকে এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক হাবিবুর রহমানের নাম জানেন। অধ্যাপক রহমান একবার বলেছিলেন, ১৯৬৫ সালে জাতিসংঘের একটি সংস্থা দক্ষিণ তালপট্টি এলাকায় বিপুল রিসোর্সের কথা উল্লেখ করেছিল। সাংবাদিক সিদ্দিকুর রহমান এ তথ্যটি সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন। এদিকে ফার্স্ট পোস্ট নামে ভারতের একটি সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, জাতিসংঘ সমুদ্রসীমা রায়ের মাধ্যমে হাড়িয়াভাঙ্গা নদী ও দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা লাভ করায় ভারত বিপুলভাবে লাভবান হয়েছে। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, হাড়িয়াভাঙ্গা নদী যেখানে সাগরে মিশেছে, সেখান থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণের একটি খাঁড়িতে ভারত ২০০৬ সালে ১০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পেয়েছিল। হাড়িয়াভাঙ্গার মজুদ গ্যাসের পরিমাণ ভারতের কৃষ্ণ-গোদাবারি অববাহিকার পুরো মজুদের প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য যে ২৮ ব্লকে এলাকাটিকে ভাগ করেছিল, তার মধ্যে ২১ নং ব্লকে অন্তর্ভুক্ত ছিল দক্ষিণ তালপট্টি। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ও টিভি টকশোতে অধ্যাপক হোসেন মনসুর (চেয়ারম্যান, পেট্রোবাংলা) জানিয়েছেন, দক্ষিণ তালপট্টি এলাকায় জ্বালানি সম্পদ আছে (তেল ও গ্যাস) এ তথ্য তার জানা নেই। আমি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নই। ফলে কার বক্তব্য সত্য, এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ভারত বঙ্গোপসাগরে ১০০ টিসিএফ গ্যাস ও ২ বিলিয়ন ব্যারেল তেল আবিষ্কার করেছে। মিয়ানমার করেছে ৭.৭ টিসিএফ গ্যাস। ২০০৬ সালে ভারত সরকার তাদের ২৪টি গভীর সমুদ্র ব্লক টেন্ডার প্রদানের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। এর মধ্যে ব্লক ডি ২৩ (৮৭০৬ বর্গকিলোমিটার) ও ব্লক ডি ২২ (৭৭৯০ বর্গকিলোমিটার) বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ১৯৯১ সালের ২১টি ব্লকের অনেক অংশজুড়ে রয়েছে। এখন নতুন রায়ের ফলে দেখতে হবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্লকগুলোর ক’টি এবার পুনর্বিন্যাস করতে হবে। মহিসোপান নিয়েও একটা বিভ্রান্তি আছে। এমনকি ‘ধূসর এলাকা’ নিয়েও আছে প্রশ্ন।তবে এটা বলতেই হবে, এ রায় বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করল। বাংলাদেশের সালিশি আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটিও ছিল সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত। চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারত আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই ১৯৭৪ সাল থেকেই আলোচনা চলে আসছিল। ফলাফল ছিল শূন্য। উল্লেখ্য, সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বলবৎ রয়েছে 3rd United Nations Convention on the Law of Sea (UNCLOS III)। এটি ১৯৮২ সালে গৃহীত এবং ১৯৯৪ সালের নভেম্বর থেকে কার্যকর। ভারত ১৯৯৫ সালের ২৭ জুন ও মিয়ানমার ১৯৯৬ সালের ২১ মে UNCLOS III অনুমোদন করে। বাংলাদেশ অনুমোদন করে অনেক পরে, ২০০১ সালের ২৭ জুলাই (অনুস্বাক্ষর ১৯৮২)। নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে সমুদ্রসীমার দাবির পক্ষে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে হতো। বাংলাদেশ ২০১১ সালের জুলাইয়ের পর তথ্য-উপাত্ত জমা দেয়ার পরই আদালত এ সিদ্ধান্ত নিল। এখন আদালতের এ রায় আমাদের জন্য যেমন সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করল, ঠিক তেমনি দায়িত্বও বেড়ে গেল।সমুদ্রে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। প্রচুর তেল/গ্যাস সম্পদের পাশাপাশি খনিজ ও মৎস্য সম্পদের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু মিঠা পানির মাছের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমাদের আমিষের একটা সম্ভাবনা হল সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ। এ সম্পদ আহরণে আমাদের পর্যাপ্ত আধুনিক ট্রলার নেই। ছোট ছোট নৌকা বা ছোট ট্রলারে করে মৎস্য আহরণ করা হয়। কিন্তু এগুলো গভীর সমুদ্রে যেতে পারে না। ফলে আমাদের এলাকা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে থাইল্যান্ড ও ভারতীয় জেলেরা। বাংলাদেশ সরকারকে এখন উদ্যোগী হয়ে বড় বড় ট্রলার তৈরি ও মৎস্যজীবীদের মাঝে সমবায়ের ভিত্তিতে বিতরণ করতে হবে, যাতে তারা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে পারে। দক্ষ জনশক্তি আমাদের নেই। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা হয় কম। বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাদের স্বার্থে কিছু গবেষণা করে। কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধতা আছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ আছে। চট্টগ্রামে একটি মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এসব সিদ্ধান্ত ভালো। বরিশাল ও পটুয়াখালী (যা সমুদ্র এলাকায় অবস্থিত) বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে নৌবাহিনী ও সমুদ্র অধিদফতর থেকে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের এসব বিভাগে নিয়োগ দিতে হবে। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে আইন অনুষদ আছে, সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে সমুদ্র আইন সংক্রান্ত একটি বিষয় চালু করতে হবে।দীর্ঘদিন পর মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হল। কিন্তু কাজ অনেক বাকি। সরকারের একটি বড় উদ্যোগের প্রতি তাকিয়ে থাকবে এখন সবাই। এখন বিজয় উৎসবের সময় নয়। এ নিয়ে কৃতিত্ব নেয়ারও কিছু নেই। আমরা ভারতের দৃষ্টান্ত দেখে শিখতে পারি। ভারতে এটা নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। লেখালেখি তেমন চোখে পড়েনি। একটা রায় হয়েছে এবং আমাদের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। এখন দেখতে হবে এই ‘অধিকারকে’ আমরা কীভাবে ব্যবহার করি। আমরা দুটি রায়ই পেলাম। রায়ের আলোকে অতি দ্রুত সীমানা নির্ধারণ করে সেখানে আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এজন্য সমুদ্র অধিদফতরকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের UNCLOS ডেস্ককে আরও শক্তিশালী করাও জরুরি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরুণ কর্মকর্তাদের বিদেশে পাঠিয়ে এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গোপসাগর হচ্ছে ২ দশমিক ২ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এক বিশাল এলাকা। এর মাঝে একটা সীমিত এলাকা আমাদের। তবে এখানে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। শুধু মৎস্য সম্পদ আহরণ করে আমরা আমাদের আমিষের ঘাটতি মেটাতে পারি। আগামী দিনে বঙ্গোপসাগরের স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব বাড়বে। একদিকে চীন, অন্যদিকে ভারত এ অঞ্চলে তাদের নৌ তৎপরতা বাড়াচ্ছে। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ৫০ ভাগ পরিচালিত হয় এই রুট দিয়ে। আর চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ৬০ ভাগ বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং আগামী দিনে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বাড়বে। এজন্য আমাদের নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। বহিঃসমুদ্রে টহল বাড়াতে হবে। বঙ্গোপসাগর নিয়ে গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকায় ‘বিস’ এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘বিস’ একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তবে সেখানে বঙ্গোপসাগর নিয়ে কোনো কাজ হয় না। এখন হতে পারে। সিঙ্গাপুরের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান ইনস্টিটিউটের সঙ্গেও যৌথভাবে গবেষণাকর্ম পরিচালনা করা সম্ভব। আমরা একটা ‘রায়’ পেয়েছি বলে যদি আত্মতুষ্টিতে ভুগি, তাহলে আমরা ভুল করব। আমাদের কাজ আরও বাড়ল। আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। মহিসোপানের বিষয়টিরও সমাধান হয়নি। এটা সমাধান করবে জাতিসংঘের অপর একটি সংস্থা। ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক অঞ্চল শেষ হওয়ার পরই শুরু হয় মহিসোপান। উপরের অংশ, অর্থাৎ জলরাশি দিয়ে মহিসোপানের বিচার করা হয় না। মহিসোপানের বিচার করা হয় পানির নিচের অংশ দিয়ে, যেখানে তেল, গ্যাসসহ প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। মহিসোপানে আমাদের সীমানা নির্ধারিত হলেই আমরা মহিসোপানে অর্থাৎ সাগরের নিচে আমাদের কর্মকাণ্ড চালাতে পারব। এই মহিসোপানের সীমানা নির্ধারণের জন্য আমাদের ন্যূনতম চার থেকে ছয় বছর অপেক্ষা করতে হবে। সাধারণত ৩৫০ থেকে ৪০০ নটিক্যাল মাইলকে মহিসোপানের সীমানা ধরা হয়। বাংলাদেশ ২০১১ সালে তার মহিসোপানের দাবি জাতিসংঘে জমা দেয়। মোট ৫২টি দেশের আবেদনপত্র জাতিসংঘ বিবেচনা করছে।এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। সরকারকে এখন খুব দ্রুত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। রায়ের পর সরকার সময় পাবে ৫ বছর। নিয়মানুযায়ী কোনো দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর প্রথম ৫ বছর সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য ইন্টারন্যাশনাল সি-বেড অথরিটিকে কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হয় না। কিন্তু ৫ বছরের পর থেকে আহরিত মোট সামুদ্রিক সম্পদের একটা অংশ এই কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। সমুদ্র সম্পদ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সমুদ্র অধিদফতরকে রেখেও একটি বৃহৎ পরিসরে পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নৌবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া সিনিয়র কর্মকর্তাদের এই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জড়িত করা প্রয়োজন। এর ফলে তাদের মেধা ও যোগ্যতাকে আমরা কাজে লাগাতে পারব। একজন অদক্ষ আমলাকে দিয়ে এই কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। একটা রায় পেয়েছি। এটা নিয়ে যদি আমরা বসে থাকি, আমরা অনেক বড় ভুল করব Daily JUGANTOR 16.07.14

'নতুন গোলপোস্ট' তত্ত্ব!

বাংলাদেশে খুব নগণ্য ব্যক্তিই সমুদ্র নিয়ে কাজ ও গবেষণা করেন। এঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলম অন্যতম। দীর্ঘদিন নেভিতে কাজ করার সুবাদে সমুদ্র সম্পর্কে জানা ও এর আইন সম্পর্কে জানার এবং বোঝার সুযোগ হয়েছে তাঁর। তিনি এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিব পদমর্যাদার অধিকারী। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার ও ভারতের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ, তার অবসানে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা স্বাধীনতার এত বছর পার করার পরও সমুদ্র সম্পর্কে তথা সমুদ্র আইন সম্পর্কে তেমন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য নয়। ফলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, রিয়াল অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ এ বিষয়ে একমাত্র ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ান। অতিসম্প্রতি হেগের আন্তর্জাতিক সালিসি আদালত বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্র সীমানা বিরোধের নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। আদালতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের ডেপুটি এজেন্ট ছিলেন খুরশেদ আলম। আর প্রধান এজেন্ট ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। যেখানে ভারতের প্রতিনিধিদলের প্রধান এজেন্ট ছিলেন তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব, সেখানে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব (এবং নিঃসন্দেহে সমুদ্র আইনে অনভিজ্ঞ!) কেন প্রতিনিধিত্ব করলেন কিংবা আদৌ তাঁর মতো অনভিজ্ঞ লোকের আদালতে উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল কি না সে প্রশ্ন রয়েই গেল। যদিও এর বাইরে বাংলাদেশ আরো অনেক বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ করেছিল। খুরশেদ আলম আবারও আলোচনায় এসেছেন। একটি জাতীয় দৈনিকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়ে আদালতের রায় বর্তমান সরকারের বিজয় হিসেবে অভিহিত করে মন্তব্য করেছেন যে 'বাংলাদেশ নতুন গোলপোস্ট' পেয়েছে! শুধু তার 'গোলপোস্ট' তত্ত্বই নয়, বরং সাক্ষাৎকারে দেওয়া তাঁর বক্তব্য নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন আর তা হচ্ছে বাংলাদেশ স্বেচ্ছায় এই বিরোধ মীমাংসায় আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের কাছে যায়নি। সাধারণত তিন ভাগে সমুদ্রসীমার বিরোধী নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল, আন্তর্জাতিক আদালত ও আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনাল বা সালিসি আদালত। ভারত প্রথম দুটি কোর্টের ব্যাপারে তার আপত্তি আগেই দেওয়ায় তৃতীয় বিকল্প অর্থাৎ আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনালে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনালে যায়নি। হামবুর্গে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে এই বিবাদ মীমাংসিত হয়েছিল। সালিসি আদালতের একটি সমস্যা ছিল, এই আদালতের সব খরচ, আইনজীবীদের খরচ, সবই দুই পক্ষকে বহন করতে হয় (অনুসন্ধানী যেকোনো সাংবাদিক খোঁজ নিয়ে দেখাতে পারেন বাংলাদেশের কত খরচ হলো!) এখন খুরশেদ আলমের 'নতুন গোলপোস্ট' তত্ত্বের মূল বিষয় একটিই- নতুন একটি 'সম্ভাবনার' ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হলো। আমাদের আগামী প্রজন্মের স্বার্থে এই 'সম্ভাবনাকে' ব্যবহার করা অর্থাৎ 'গোলপোস্টে' 'গোল' করা! মিথ্যা বলেননি তিনি। কিন্তু কতগুলো প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গেল। ১. বাংলাদেশের কোনো সরকারি ম্যাপে তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্ব দেখানো হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে এর আগে কেন এটি দেখানো হলো না? এটা কী গাফিলতি নাকি আমাদের অদক্ষতা? ২. বাংলাদেশ আদালতে যে ম্যাপটি উপস্থাপন করে, তা ১৮৮০-১৯০৪ সালের জরিপের ভিত্তিতে তৈরি ব্রিটিশ অ্যাডমিরালিটি ম্যাপ। অথচ আদালত মন্তব্য করেছে এটি ১৯৩৩ সালের তৈরি। বাংলাদেশ তড়িঘড়ি করে এ কাজটি কেন করতে গেল? বাংলাদেশ ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি টপোমানচিত্রটি ব্যবহার করতে পারত। ৩. দক্ষিণ তালপট্টির কোনো 'চিহ্ন' নেই এখন। এটা সত্য। কিন্তু অস্তিত্ব আছে। গুগল আর্থে সার্চ দিলে এর অস্তিত্ব ধরা পড়ে। আগামীতে কোনো একদিন আরো পলি পড়ে পড়ে দ্বীপটি দৃশ্যমান হবে কি না সে প্রশ্ন রইল। তবে এখন আর বাংলাদেশ তা দাবি করতে পারবে না। ৪. খুরশেদ সাহেব নিজে গানবোট নিয়ে নেভির একজন অফিসার হিসেবে ১৯৮১ সালে ভারতীয় নেভিকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ভারত সেখানে পতাকা উড়িয়েছিল। ঘর তৈরি করেছিল এবং গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল (সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য)। এর অর্থ দ্বীপটির অস্তিত্ব ছিল। খুরশেদ সাহেব নিজে লিখেছেন, 'এটি একটি ভাটার দ্বীপ। হাইড্রোলজিক্যাল কারণে এর পরিমাণ কমতে বা বাড়তে পারে। তবে এর সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে গেলে বাংলাদেশ বিরাট সমুদ্র এলাকা এবং সেই সঙ্গে মৎস্য সম্পদ হারাবে। মেরি টাইম বাউন্ডারি নির্ধারণে এর সার্বভৌমত্ব একটি বিরাট ভূমিকা পালন করবে। দক্ষিণ তালপট্টির দক্ষিণ-পশ্চিমে পূর্বাশা বলে আরেকটি ভাটার দ্বীপ আছে, যা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে (আমার সম্পাদিত গ্রন্থ বাংলাদেশ রাজনীতির চার দশক, পৃ. ২৬৭, ২০০৮)। প্রশ্ন হচ্ছে খুরশেদ সাহেব কী তাঁর এই 'মূল্যায়ন' হেগের আদালতে উপস্থাপন করেছিলেন? ৫. ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা নির্ধারণে নবম বৈঠকেও বাংলাদেশ দক্ষিণ তালপট্টির ওপর থেকে তার মালিকানার দাবি থেকে সরে আসেনি (আমাদের সময়, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৮) গত ২০১২ কিংবা ২০১৩ সালের কোনো একসময় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে বলতে শুনেছি, দক্ষিণ তালপট্টি ডুবে গেছে। এর কোনো অস্তিত্বই নেই! এর পর থেকেই কী বাংলাদেশ তার 'অবস্থান' পরিবর্তন করে? ৬. প্রিয়ভাজন সিদ্দিকুর রহমান তাঁর এক প্রবন্ধে ১৯৯৭ সালের ৩ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে সার্ভে অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, 'তালপট্টি বাংলাদেশের অংশ' (দ্য রিপোর্টার, ১০ জুলাই, ২০১৪)। ৭. একটি জাতীয় দৈনিকের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০০৮ সালের দাবীকৃত ১১টি গভীর ও অগভীর পানির গ্যাস ব্লক ২০১২ সালের দাবি থেকে বাদ দেয় (এসএস-০১, এসএস-০৫, ডিএস-০৯, ডিএস-১০, ডিএস-১১, ডিএস-১৪, ডিএস-১৫, ডিএস-১৯, ডিএস-২০, ডিএস-২৪, ডিএস-২৫)। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? ৮. সমুদ্রে বাংলাদেশের দাবি ছিল ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার। এখন আমরা পুরোটা পাইনি। পেয়েছি ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার। আমাদের দাবির প্রায় পুরোটা স্বীকৃত হলেও, কিছু তো আমাদের ছাড় দিতেই হলো! ৯. সমুদ্র আইনে অভিজ্ঞ প্রবীণ অধ্যাপক হাবিবুর রহমান একবার উল্লেখ করেছিলেন, ১৯৬৫ সালে জাতিসংঘের একটি সংস্থা দক্ষিণ তালপট্টি এলাকায় বিপুল রিসোর্সের কথা উল্লেখ করেছিলেন (সিদ্দিকুর রহমান, ওই)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য যে ২৮ ব্লকে এলাকাটিকে ভাগ করেছিল, তার মধ্যে ২১ নম্বর ব্লকে অন্তর্ভুক্ত ছিল দক্ষিণ তালপট্টি। হেগের সালিসি আদালতের রায় অনুযায়ী হাড়িয়াভাঙ্গা নদী বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ এর আশপাশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে উদ্যোগ নেবে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ও টিভি টক শোতে (আরটিভি) অধ্যাপক হোসেন মনসুর (চেয়ারম্যান পেট্রোবাংলা) আমাকে জানিয়েছেন, দক্ষিণ তালপট্টি এলাকায় জ্বালানি সম্পদ আছে (তেল ও গ্যাস), এ তথ্য তাঁর জানা নেই। আমি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নই। ফলে কার বক্তব্য সত্য, এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ভারত বঙ্গোপসাগরে ১০০ টিসিএফ গ্যাস ও দুই বিলিয়ন ব্যারেল তেল আবিষ্কার করেছে। মিয়ানমার করেছে ৭.৭ টিসিএফ গ্যাস। ২০০৬ সালে ভারত সরকার তাদের ২৪টি গভীর সমুদ্র ব্লক টেন্ডার প্রদানের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। এর মধ্যে ব্লক ডি ২৩ (৮৭০৬ বর্গকিলোমিটার) ও ব্লক ডি ২২ (৭৭৯০ বর্গকিলোমিটার) বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ১৯৯১ সালের ২১টি ব্লকের অনেক অংশজুড়ে রয়েছে। এখন নয়া রায়ের ফলে দেখতে হবে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দাবি কোর্ট কতটুকু গ্রহণ করলেন। ১০. মহীসোপান নিয়েও একটা বিভ্রান্তি আছে। এমনকি 'ধূসর এলাকা' নিয়েও আছে প্রশ্ন। তবে এটা বলতেই হবে এই রায় বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করল। বাংলাদেশের সালিসি আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটিও ছিল সঠিক ও যুক্তিসংগত। চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারত আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই ১৯৭৪ সাল থেকেই আলোচনা চলে আসছিল। ফলাফল ছিল শূন্য। উল্লেখ্য, সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বলবৎ রয়েছে 3rd United Nations Convention on the Law বা Sea (UNCLOS III)। এটি ১৯৮২ সালে গৃহীত এবং ১৯৯৪ সালের নভেম্বর থেকে কার্যকর। ভারত ১৯৯৫ সালের ২৭ জুন ও মিয়ানমার ১৯৯৬ সালের ২১ মে UNCLOS III অনুমোদন করে। বাংলাদেশ অনুমোদন করে অনেক পরে ২০০১ সালের ২৭ জুলাই। নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে সমুদ্রসীমার দাবির পক্ষে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশ ২০১১ সালের জুলাইয়ের পর তথ্য-উপাত্ত জমা দেওয়ার পরই আদালত এই সিদ্ধান্ত নিলেন। এখন আদালতের এই রায় আমাদের জন্য যেমনি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করল, ঠিক তেমনি দায়িত্বও বেড়ে গেল। ১. সমুদ্রে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। প্রচুর তেল-গ্যাস সম্পদের পাশাপাশি খনিজ ও মৎস্য সম্পদের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে সমুদ্রে। যেহেতু মিঠাপানির মাছের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমাদের আমিষের একটা সম্ভাবনা হলো সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ। এই সম্পদ আহরণে আমাদের পর্যাপ্ত আধুনিক ট্রলার নেই। ছোট ছোট নৌকা বা ছোট ট্রলারে করে মৎস্য আহরণ করা হয়। কিন্তু এগুলো গভীর সমুদ্রে যেতে পারে না। ফলে আমাদের এলাকা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে থাইল্যান্ড ও ভারতীয় জেলেরা। বাংলাদেশ সরকারকে এখন উদ্যোগী হয়ে বড় বড় ট্রলার তৈরি ও মৎস্যজীবীদের মধ্যে সমবায়ের ভিত্তিতে বিতরণ করতে হবে, যাতে এরা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে পারেন। ২. দক্ষ জনশক্তি আমাদের নেই। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা হয় কম। বাংলাদেশ নেভি তাদের স্বার্থে কিছু গবেষণা করে। কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধতা আছে। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে দুটি সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ আছে। চট্টগ্রামে একটি মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এসব সিদ্ধান্ত ভালো। বরিশাল ও পটুয়াখালী (যা সমুদ্র এলাকায় অবস্থিত) বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে নেভির তথা সমুদ্র অধিদপ্তর থেকে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের এসব বিভাগে নিয়োগ দিতে হবে। ৩. প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে আইন অনুষদ আছে, সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে সমুদ্র আইনসংক্রান্ত একটি বিষয় চালু করতে হবে। দীর্ঘদিন পর মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলো। কিন্তু কাজ অনেক বাকি। সরকারের একটি বড় উদ্যোগের প্রতি তাকিয়ে থাকবে এখন সবাই। Daily KALER KONTHO 16.07.14

অবসরের বয়স যখন সাতষট্টি!

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের অবসরের বয়স ৬৭-তে উন্নীত করার দাবি জানিয়েছেন। গেল সপ্তাহে প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকরা মানববন্ধন করেছেন। শিক্ষকদের এ দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি আছে। এরই মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করেছে। ধারণা করছি, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় একই পথ অনুসরণ করবে। বিশেষ করে সবাই তাকিয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ সিদ্ধান্ত নিলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় খুব দ্রুত এ সিদ্ধান্ত নেবে। তবে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয় অবসরের বয়সসীমা ৬৭ নির্ধারণ করে সামগ্রিকভাবে এটা আইনে পরিণত করতে পারবে না। এজন্য সংসদে আইন প্রণয়ন করতে হবে। বলা ভালো, বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫-তে উন্নীত করেছিল। এখন আবার এটা যদি ৬৭-তে উন্নীত করা হয়, তাহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। অতিরিক্ত এ দুই বছরের বেতন কোত্থেকে আসবে, সে প্রশ্ন থাকবেই। অর্থ মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সমর্থন এতে নেই। ফলে একটা বড় জটিলতা নিয়েই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এখন অবসরের বয়স ৬৭ বছরের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। বলাই বাহুল্য, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকার এ চাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না। দ্বিতীয়ত, প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় ৬০ বছরের পর একজন সিনিয়র শিক্ষকের দেয়ার কিছুই থাকে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, খুব কম শিক্ষকই ৬০ বছরের পর তেমন একটা গবেষণার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন না। অথবা রাখতে পারেন না। অসুস্থতা তাকে পেয়ে বসে। এ বয়সে এসে অনেকেই দেখেছি, প্রবাসে অবস্থানরত ছেলে বা মেয়ে এবং সেইসঙ্গে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পড়াশোনা, গবেষণা, ক্লাস নেয়া ইত্যাদির পেছনে 'সময় দেয়ার' প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন কম। এর একটি বাস্তব ভিত্তিও রয়েছে। আমাদের যে সংস্কৃতি, তাতে পরিণত বয়সে এসে মানুষ সন্তানদের কাছে আবার ফিরে যায়। এটাই বাস্তব। গবেষণা তাকে টানে না। তবে ব্যতিক্রম যে নেই, তা আমি বলছি না। ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু আমরা অনেক জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিকে ৬৫ বছরের সুযোগও দেইনি। অনেক পন্ডিত ব্যক্তি এ সমাজে এখনও আছেন, যারা ৬০ বছরেরও আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন; কিন্তু এখনও সক্রিয়। বই লিখছেন। সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন। নিঃসন্দেহে এ প্রজন্মের তরুণরা তাদের ক্যাম্পাসে পেলে আরও বেশি অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হতো। কিন্তু তা হয়নি। আরও একটি কারণে অবসরের বয়স ৬৭-তে উন্নীত করার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করা যেতে পারে। তা হচ্ছে ৬৭ বছর নির্ধারণ করে দেয়ায় অনেকেই (যারা সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত) সরাসরি ৪০ বছর শিক্ষকতা করবেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? গবেষণা, পাঠ্যদানের চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য যেখানে বেশি, সেখানে তারা গবেষণায় মনোনিবেশ করবেন, পাঠ্যবই রচনা করবেন- এটা আশা করা যায় না। অনেক তরুণ প্রভাষকের বিরুদ্ধে এমনসব অভিযোগ শুনি, তাতে করে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি রীতিমতো আতঙ্কিত। আমার আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৭-তে উন্নীত করায় সমাজ, রাষ্ট্র উপকৃত হবে- এ বিশ্বাস রাখতে পারছি না। এরই মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শত শত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পক্ষ থেকেও দাবি উঠেছে, তাদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর। রাজনৈতিক সরকারের ওপর সঙ্গত কারণেই 'চাপ' আসবে এবং কোনো সরকারই চাইবে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থিতিশীল হোক। এক সময় সরকারও বাধ্য হবে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীমা বাড়াতে। ফলে যা হবে, তা হচ্ছে 'উপরের স্তরে' জট সৃষ্টি হবে এবং নতুনদের চাকরি পেতে অসুবিধা হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসরদের দুটো গ্রেড- প্রফেসর ও সিলেকশন গ্রেড প্রফেসর। অনেক শিক্ষক দীর্ঘদিন প্রফেসর হিসেবে নিজ পদে থাকলেও, ১০ ভাগ কোঠার কারণে কোনোদিনই 'সিলেকশন গ্রেড প্রফেসর' হতে পারেন না। ফলে যা হবে তা হচ্ছে, সিনিয়র সচিবদের মতো 'সিনিয়র প্রফেসর' পদ সৃষ্টি করতে বাধ্য হবে সরকার। কেননা রাজনৈতিক সরকার সব সময়ই চায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমর্থন। শিক্ষকদের খুশি করার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি 'সিনিয়র প্রফেসরের' পদ আগামীতে সৃষ্টি করা হয়, আমি তাতে অবাক হব না। তবে এক্ষেত্রে যেন একটি নীতিমালা থাকে। সরকার সিনিয়র সচিবের আটটি পদ সৃষ্টি করেছে। এতে করে সচিবদের পাশে সিনিয়র-জুনিয়র পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু আদৌ কী কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে? বয়সে সিনিয়র- এটাই কি নীতিমালা? আসলে নীতিমালাটি হওয়া উচিত যোগ্যতার ফলে। একজন সচিব বয়সের কারণে সিনিয়র সচিবের পদমর্যাদা পাবেন, সেটি ঠিক নয়। তিনি যোগ্যতা দেখাতে পেরেছেন কিনা, সেটাই হলো আসল কথা। সচিব সাহেবদের কাজ যদি হয় 'বিদেশ ভ্রমণ' আর 'দাতাদের নির্দেশনা' অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করা, সেই সচিব 'যোগ্য' বলে বিবেচিত হবেন না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী মেধাশূন্য সচিবের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক আগে ২৮ সেপ্টেম্বর (২০১১) এ ধরনের একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল একটি জাতীয় দৈনিকে। সচিবদের 'পারফরম্যান্সে' প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট এমন খবরও ছিল ওই প্রতিবেদনে। তবুও প্রধানমন্ত্রীকে সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করতে হয়েছিল। আইজিকে 'থ্রিস্টার জেনারেলের' পদমর্যাদা দেয়া হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর জন্য পাঁচজন সিনিয়র সচিবের পদও সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে করে রাষ্ট্র, সমাজ কতটুকু উপকৃত হলো? এখন সঙ্গত কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দাবি করবেন 'সিনিয়র প্রফেসর'-এর পদ সৃষ্টি করার। তাদের কী ফেলে দিতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী! এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৭ হতে পারে তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু এখানে যেন কিছু চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকে। ঢালাওভাবে একজন অসুস্থ, কর্মে অক্ষম, মেধাহীন, অযোগ্য শিক্ষক ৬৭ বছর পর্যন্ত শিক্ষকতা করবেন- এটি কাম্য নয়। সমাজ তার কাছ থেকে কিছু পাবে না। শিক্ষকতায় দয়া-দাক্ষিণ্যের কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় 'দলীয় ক্যাডার' নিয়োগ দিয়ে আমরা এরই মাঝে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস করে ফেলেছি। আর নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করেই আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। শিক্ষকদের অবসরসংক্রান্ত আইনটি সংশোধন হতে পারে। সবাই যখন সবকিছু পাচ্ছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পাবেন না কেন, তাদের দায়িত্ব এখন আরও বেশি। এখানে সংসদীয় কমিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শিক্ষাসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি অতীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে, যা প্রশংসিত হয়েছে। নবম সংসদে রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ওই কমিটি ছিল আমাদের জন্য একটা আস্থার জায়গা। তারা তা প্রমাণও করেছেন। শিক্ষকদের স্বার্থে আঘাত করে এমন কোনো সিদ্ধান্ত এ কমিটি অতীতেও নেয়নি, আগামীতেও নয়া কমিটি নেবে না। তবে সংসদীয় কমিটি শিক্ষকদের অবসরের ব্যাপারে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে পারে- ১. অবসরের বয়সসীমা ৬৭ করা হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু তাকে প্রমাণ করতে হবে তিনি শারীরিকভাবে 'ফিট'। অর্থাৎ সুস্থ আছেন এবং নিয়মিত ক্লাস নেয়ার ক্ষমতা তার আছে (এক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা এড়িয়ে চলতে হবে), ২. ২+২+১ এর যে ফর্মুলা, তা নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজাতে হবে। নয়া ফর্মুলা আসতে পারে অর্থাৎ সরাসরি ৬৭ পর্যন্ত আইন না করে ধাপে ধাপে তা কার্যকর করলে ভালো হয়, ৩. এ সুযোগ তিনি পাবেন, যিনি নিয়মিত এমফিল এবং পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা তত্ত্বাবধান করেন, ৪. শর্ত হিসেবে তাকে ৬০ বছরের পর প্রতি বছর একটি পাঠ্যবই রচনা করতে হবে। যদি তিনি তা না পারেন, তাহলে তিনি ৬৭ বছরে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন না, ৫. ৬৭-তে যাওয়ার যোগ্যতা তিনি অর্জন করতে পারবেন, অথবা যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন, যিনি অধ্যাপক পদে থাকাকালীন নূ্যনতম একবার 'সেবাটিক্যাল লিভ' নিয়ে (এক বছর) একটি গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার কোনো গবেষণাগ্রন্থ নেই, তিনি ৬৭-তে যাওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। অধ্যাপক থাকাকালীন তিনি যদি আদৌ কোনো এমফিল বা পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধান না করে থাকেন, তিনিও যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। মোট কথা একটা নীতিমালা থাকুক। কিছু শর্ত থাকুক। যদি ঢালাওভাবে ৬৭ করা হয়, তাহলে তাতে 'রাজনীতি' ঢুকে যাবে। জাতি, সমাজ, রাষ্ট্র শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়েও তেমন উপকৃত হবে না। আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নূ্যনতম পাওনা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করছি না। আমি প্রশ্ন রাখছি নৈতিকতার। আমি যদি আমার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হই, তাহলে কী অধিকার আছে আমার শিক্ষকতার পথকে দীর্ঘায়িত করার? আমি বাস্তবতাকে মেনে নিতে চাই। শুধু অবসরের বয়স আরও দুই বছর বাড়িয়ে রাষ্ট্রের কী ক্ষতিসাধন আমরা করছি না। আজ যারা নতুন প্রজন্ম শিক্ষকতায় আসছেন, তারা জাতিকে কী দেবেন? এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক তরুণ প্রভাষকের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে স্বয়ং তার শিক্ষকরাই প্রশ্ন তুলেছেন। যিনি তার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন, তিনি তখন ৬৭ বছরের অবসরের সুবিধা ভোগ করবেন। একটি 'বিতর্কিত' থিসিস তত্ত্বাবধায়ন করে তিনি আদৌ বিভাগের কোনো সুনাম আনতে পারেননি। তিনি যদি ৬৭ বছর পর্যন্ত থাকেন, তিনি কী সুনাম আনবেন আর? আর এক ভদ্রলোক 'ঘুষ' দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন। পারেননি। সাবেক ভিসির নির্দেশে মামলা হয়েছিল। এখন যে ভদ্রলোক টাকা দিয়ে 'শিক্ষক' হতে চান, তিনি যদি ঘটনাক্রমে শিক্ষক হয়ে যান অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিনি জাতিকে কী দেবেন? তাদের কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ঘটনায় হতাশাগ্রস্ত। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কার আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকার শিক্ষকদের অবসরের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারে। একইসঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। দেশে ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করা হয়েছে। কেউই খেয়াল করছেন না, এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে ভালো শিক্ষকের অভাবে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করে ফেলেছি। সব বিশ্ববিদ্যালয় একটি আইনে এখনও চলছে না। মাত্র চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তথাকথিত সিনেট আছে, যেখানে গণতান্ত্রিকভাবে ভিসিরা 'নির্বাচিত' হচ্ছেন। ওই নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন আছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট নির্বাচন হয় না বছরের পর বছর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার এটা একটা বড় ব্যর্থতা। সরকারের দৃষ্টি এদিকে নেই। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালা একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক রকম। এতে করে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নীতিমালা অনুসরণ করা উচিত। তৃতীয়ত, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচ- অনিয়ম হচ্ছে। কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই পিএইচডি ও এমফিল কোর্সে ছাত্র ভর্তি করানো হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তারা, পুলিশের সিনিয়র অফিসাররা, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা পিএইচডি নিচ্ছেন। ভর্তি হচ্ছেন। একজন পূর্ণ চাকুরে কোনো ধরনের ফিল্ডওয়ার্ক কিংবা লাইব্রেরি ওয়ার্ক ছাড়া পিএইচডি করেন কীভাবে? এখানে দেখভাল করার কেউ নেই। চতুর্থত, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভাগ খোলা হচ্ছে। আর সেইসব বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে অন্য ডিসিপ্লিনের। অনেকটা যেন প্রাইমারি স্কুলের মতো। যে কেউ যে কোনো বিষয় পড়াতে পারে। কোথাও কোথাও সহকারী অধ্যাপকরাও বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এতে করে উচ্চশিক্ষার মান রক্ষিত হচ্ছে না। শিক্ষকরা তাদের অবসরের বয়সসীমা বাড়াতে চাচ্ছেন। কোনো কোনো পেশায় বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের বাড়ানো হবে না কেন? এটা হতেই পারে। কিন্তু শিক্ষক রাজনীতির জন্য যদি এ বয়সসীমা বাড়ানো হয়, তাহলে তা সমর্থনযোগ্য হবে না। সিনিয়র শিক্ষকরা 'রাজনীতি' করেন। অভিযোগ আছে, শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার জন্যই এ বয়সসীমা বাড়ানো। বয়সসীমা বাড়ানোর আগে উচ্চশিক্ষার মানের দিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার। সিনিয়র শিক্ষকরা, ভিসিরা এটি করছেন না, দুঃখটা এখানেই। তাই অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দেয়া হোক। একুশ শতকে এসে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। মেধার চেয়ে এখানে 'রাজনীতি' প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। সংস্কারটা তাই জরুরি। Daily ALOKITO BANGLADESH 11.07.14

এ রায়কে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের রায় দিয়েছে দ্য হেগে অবস্থিত পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশন। এ রায় প্রকাশ করা হয়েছে গত মঙ্গলবার। রায় প্রকাশকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এ রায়ে বাংলাদেশই জয়ী হয়েছে। কিন্তু পুরো রায় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সালিশি কোর্ট বাংলাদেশের পুরো দাবি মেনে নেননি। বাংলাদেশের দাবি ছিল ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু বাংলাদেশ পেয়েছে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ ৬ হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ কম পেয়েছে। বাংলাদেশের দাবি ছিল ভূমির মূল বিন্দু থেকে সমুদ্রের দিকে ১৮০ ডিগ্রি সোজা রেখা টেনে সীমানা চিহ্নিত করার। আর ভারত দাবি করেছিল সমুদ্রের তট বিবেচনায় রেখে এ রেখা ১৬২ ডিগ্রি করার। আদালত এ ক্ষেত্রে কোনো পক্ষেরই যুক্তি গ্রহণ করেননি। আদালতের রায়ে মূল বিন্দু থেকে ১৭৭.৩ ডিগ্রি রেখা টানা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে যে সীমানা রেখা নির্ধারণের দাবি করেছিল, তা বাহ্যত এ রায়ের ফলে স্বীকৃতি পেল। আদালত নিজস্ব মতামত, তারা সমতার ভিত্তিতেই এ রায় দিয়েছেন। ভারতের দাবি ছিল সমদূরত্বের নীতিতে সীমানা নির্ধারণ করার। আন্তর্জাতিক আইনে দুটিই স্বীকৃত। তবে সীমানা নির্ধারণের এ রায়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ তালপট্টির ওপর তার অধিকার হারিয়েছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর বাংলাদেশ সীমান্তে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি জেগে ওঠে। দ্বীপটি ছিল খুলনা-বাগেরহাটের দক্ষিণে। আমাদের রায়মঙ্গল নদী এবং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনার অদূরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় এ দ্বীপটি জেগে উঠেছিল। নদীর মোহনা থেকে ২ কিলোমিটার দূরে এর অস্তিত্ব ছিল। ১৯৭৪ সালে মার্কিন স্যাটেলাইটে আড়াই হাজার বর্গমিটারের এ দ্বীপটির অস্তিত্ব ধরা পড়ে। পরে দ্বীপটির আয়তন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার বর্গমিটার। তবে দ্বীপটির মালিকানা দাবি করেছিল ভারত। বাংলাদেশী এলাকায় এর নাম দক্ষিণ তালপট্টি হলেও ভারতীয় এলাকায় এর নাম হল পূর্বাশা। ১৯৭৮ সালের মার্চে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার সেখানে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে। বাংলাদেশ দ্বীপটির ব্যাপারে যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব করলেও ভারতের কাছে তখন তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। ১৯৮১ সালের ৯ মে ভারতীয় নৌবাহিনী দক্ষিণ তালপট্টিতে অবতরণ করে। বাংলাদেশ তখন দক্ষিণ তালপট্টি থেকে ভারতীয় নৌবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানালেও ভারত তাতে রাজি হয়নি। তবে সাম্প্রতিককালে দ্বীপটির অস্তিত্ব আর ধরা পড়েনি। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার একবার প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, এ দ্বীপটির কোনো অস্তিত্ব নেই। সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরাও এটা স্বীকার করেছেন যে, দ্বীপটির এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। এটা তো বাস্তবতা, ভূপৃষ্ঠে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় মরু অঞ্চলের বরফ গলছে। ফলে সাগর-মহাসাগরে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে দক্ষিণ তালপট্টি তার অস্তিত্ব হারিয়েছে কি-না, তা একমাত্র গবেষণার মাধ্যমেই নির্ধারণ করা সম্ভব। এখানে আরও একটা প্রশ্ন- বাংলাদেশ সালিশি আদালতে দক্ষিণ তালপট্টির দাবি করে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছিল কি-না? সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা স্বীকার করেছেন, ২০১০ সালে সরকার বাংলাদেশের যে মানচিত্র তৈরি করেছিল, তাতে ওই দ্বীপটির অর্থাৎ দক্ষিণ তালপট্টির কোনো অস্তিত্ব নেই। কোর্টও তার রায়ে বলেছেন, দক্ষিণ তালপট্টির কোনো অস্তিত্ব নেই। তারা নাকি নিজেরা দেখে গেছেন। এখন এ রায়ের ফলে এই এলাকা আমরা পুরোপুরিভাবে হারালাম। এ এলাকা এখন ভারতের। এক সময় আমরা গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ব্লক ২১-এর অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম এ এলাকাটিকে। এ এলাকায় বিশাল জ্বালানি সম্পদের রিজার্ভ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এ সম্পদ এখন স্থায়ীভাবে ভারতের হয়ে গেল। তবে কোর্টের রায়ে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই খুশি। এ রায়ে উভয় রাষ্ট্রের বিজয় নিশ্চিত হয়েছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করেন। তিনি বলেছেন, এ বিজয় বন্ধুত্বের বিজয়। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সাধারণ মানুষের বিজয়। বঙ্গোপসাগরের আয়তন প্রায় ৩ লাখ বর্গকিলোমিটার। রায়ের ফলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের মধ্যে অবস্থিত সব ধরনের খনিজ ও অখনিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। এতদিন দক্ষিণ তালপট্টিতে কোনো দেশ তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চালায়নি। এখন ভারত চালাবে। আমাদের করার কিছু নেই। এখানে বলা ভালো, ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মিয়ানমার ও ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার বিষয়টি অবহিত করেছিলেন। দীর্ঘ শুনানির পর ২০১২ সালের ১৪ মার্চ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আমরা একটা রায় পেয়েছি। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হয়েছে। এখন ভারতের সঙ্গেও এ সীমা নির্ধারিত হল। সমুদ্রের সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি বেশ জটিল। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বলবৎ রয়েছে 3rd United Nations Convention on the Law of Sea (UNCLOS III)। এই আইন ১৯৮২ সালে গৃহীত এবং ১৯৯৪ সালের নভেম্বর থেকে কার্যকর। ভারত ১৯৯৫ সালের ২৭ জুন, আর মিয়ানমার ১৯৯৬ সালের ২১ মে UNCLOS III অনুমোদন করে। আর বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষরের পর তা অনুমোদন করে ২০০১ সালের ২৭ জুলাই। আইন অনুযায়ী অনুমোদনের ১০ বছরের মধ্যে সমুদ্রসীমার দাবির স্বপক্ষে তথ্য ও উপাত্ত উপস্থাপন করতে হয়। UNCLOSS III-এর ধারা ২৮৭, এনেক্স VII, আর্টিকেল ১ অনুযায়ী বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তার দাবি উপস্থাপন করেছিল। এখানে বলা ভালো, বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে Territorial Waters and Maritime Zones Act 1974 গেজেট আকারে প্রকাশ করে। এ অ্যাক্টের বেইজ লাইন ৬০ ফুট সমুদ্র গভীরতার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত বংলাদেশের এ দাবির বিরোধিতা করে এই যুক্তিতে যে, সর্ব পশ্চিমের পয়েন্ট তার (ভারতের) ২১ মাইল ভেতরে চলে গেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও ভারত ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরেই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনায় বসে। আরও বলা ভালো, কোন নীতি অনুসরণ করে এ বিবাদ নিষ্পত্তি করা হবে, তা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে পরস্পরবিরোধী অবস্থান ছিল। মিয়ানমার ও ভারত চেয়েছে সমদূরত্ব নীতি অনুসরণ করে এ বিবাদের নিষ্পত্তি। অন্যদিকে বাংলাদেশ চেয়ে এসেছে সমতা নীতি। সমদূরত্ব পদ্ধতি বা নীতি অনুসরণ করলে বঙ্গোপসাগরের ওপর যথাক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দুটি সীমারেখা টানা হতো। ফলে বাংলাদেশ সমুদ্র অঞ্চলের ওপর তার অধিকার হারাত। অন্যদিকে সমতা পদ্ধতি অনুসরণ করলে সোজা দক্ষিণ দিকে এ সীমারেখা টানা হবে। তবে এটাও সত্য, আন্তর্জাতিক আইনে সমদূরত্ব ও সমতা নীতি দুটিই স্বীকৃত এবং দুটিই অনুসরণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষ যদি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনো সমঝোতায় উপনীত হতে না পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতে দেশ দুটিকে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে আদালতের রায় দেশ দুটি মানতে বাধ্য। এখন বাংলাদেশ ও ভারত কোনো আপত্তি উত্থাপন করতে পারবে না। রায় মানতে হবে। আপিলেরও কোনো সুযোগ নেই। জাতিসংঘের সমুদ্র আইন অনুযায়ী কোনো দেশ বেইজলাইন থেকে সমুদ্রের দিকে ২০০ মাইল পর্যন্ত একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে দাবি করতে পারে। সব দেশের ক্ষেত্রে সমান দূরত্বের এ বিধানকে সমদূরত্ব নীতি বলা হয়। তবে যদি দুটি বা ততোধিক দেশের উপকূল রেখা পরস্পর বিপরীতভাবে বা বক্রভাবে বিরাজ করে, তাহলে সমদূরত্বের নীতি কার্যকর হবে না। কারণ তাতে কোনো একটি দেশ তার ব্যাখ্যা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে UNCLOS-এর ৭৪ ধারা অনুযায়ী দেশগুলোকে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে ন্যায়পরায়ণতার নীতির ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতে হবে, আর এজন্য একাধিক বিষয় বিবেচনায় আনতে বলা হয়েছে। যেমন দেশের উপকূলের রেখা বিন্যাস, তার বক্রতা, তার দৈর্ঘ্য ইত্যাদি। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সমুদ্র উপকূল পরস্পর বক্র আকারে বিরাজ করলেও তারা দীর্ঘদিন তা গণ্য করেনি, বরং সমদূরত্বের নীতির আলোকে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দাবি করে আসছিল। এখন আদালত এ সমদূরত্বের নীতি গ্রহণ না করে কিছুটা সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে এ রায়টি দিল। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের উপকূল নাজুক এবং নিরন্তর পলি জমার কারণে তীরের গভীরতাও খুব কম। অপরদিকে ভারত ও মিয়ানমারের উপকূল উত্তল বা কনভেক্স, অর্থাৎ তাদের উপকূল সমুদ্রের ভেতরে ঢুকে গেছে। আর আমাদের উপকূল হল অবতল বা কনকেভ। সমুদ্র এখানে উপকূলের ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে উপকূল আঁকাবাঁকা হয়, পলি বেশি জমা পড়ে। বাংলাদেশের এ অবস্থান এখন আদালত মেনে নিল। আমার ধারণা, আদালত অতীতের কয়েকটি রায়ের আলোকেই এ রায়টি দিলেন। সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের যে অবস্থান তার সঙ্গে ইউরোপের তিনটি দেশ জার্মানি, ডেনমার্ক আর নেদারল্যান্ডসের অবস্থানের একটি অদ্ভুত মিল রয়েছে। বাংলাদেশের মতো মাঝখানে অবস্থান জার্মানির। একদিকে ডেনমার্ক অন্যদিকে নেদারল্যান্ডস। সবাই তেল সমৃদ্ধ সাগর নর্থ সিতে তেল অনুসন্ধানে আগ্রহী ছিল। সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হলে তিনটি দেশই ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে যায়। ওই মামলায় একদিকে ছিল জার্মানি (আজকে যেমন বাংলাদেশ), অপর পক্ষে ছিল ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস (এ ক্ষেত্রে ভারত ও মিয়ানমার)। ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসের দাবি ছিল সমদূরত্বের নীতি অনুসরণ করার। ১৯৬৯ সালে আদালত রায় দিয়েছিলেন সমদূরত্বের নীতিতে নয়, বরং ন্যায়পরায়ণতার নীতির ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতে হবে। ২০১২ সালে হামবুর্গে ইটলসের রায়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছিল। এখন দ্য হেগে সালিশি আদালতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হল। এতে করে কোনো একটি পক্ষ বিজয়ী হয়েছে এটা বলা যাবে না। একটা ভালো জিনিস হয়েছে- তা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে একটা বিবাদ জিইয়ে ছিল। দীর্ঘ আলোচনায় কোনো ফল মেলেনি। বাংলাদেশ আলোচনায় সময়ক্ষেপণ না করে সালিশি আদালতে গিয়ে এবং নিজেদের খরচায় (ট্রাইব্যুনাল ও সদস্যদের খরচ দুপক্ষ সমানভাবে ভাগ করবে। আইনজীবীর খরচ তো আছেই) একটি রায় পেল, এটি একটি ভালো দিক। এখন এ রায়কে অনুসরণ করে সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের ওপরই নির্ভর করছে এর সফলতা। এটা নিয়ে যদি রাজনীতি হয়, তাহলে তা হবে একটি দুঃখজনক ঘটনা। সাধারণ মানুষের কল্যাণেই এ রায়কে এখন ব্যবহার করতে হবে। Daily JUGANTOR ১০ জুলাই, ২০১৪