রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ যুদ্ধ

যখন আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছে (অক্টোবর ২০১৪) ঠিক তখনই সিরিয়া-ইরাকে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের ওপর বিমান হামলার নির্দেশ দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা উপসাগরীয় অঞ্চলে ‘চতুর্থ যুদ্ধ’ শুরু করলেন। এই বিমান হামলার ফলে সিরিয়ার কুর্দি অঞ্চলের কোবানি শহর ইসলামি জঙ্গিদের হাতে পতন ঘটেনি, এটা সত্য। কিন্তু মার্কিন তথা মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা ইতোমধ্যেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ৯/১১-এর ঘটনাবলির রেশ ধরে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল। তখন অভিযোগ ছিল আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন মোল্লাহ ওমরের (আফগানিস্তানের তালেবান নেতা) আশ্রয়ে রয়েছে। তার পরের ইতিহাস সবাই জানেন। তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধে ‘পরাজিত’ হয়ে মার্কিন বাহিনী (সেই সঙ্গে সব ন্যাটোভুক্ত দেশের সেনাবাহিনী) এখন ‘ভদ্রভাবে’ আফগানিস্তান ত্যাগ করছে! কিন্তু এই দীর্ঘ ১৩ বছরে আফগানিস্তান পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। দৃশ্যপটে এখন আর বিন লাদেন নেই। এখন দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছেন ‘আরেক মোল্লাহ’ আবু বকর আল বুগদাদি। দৃশ্যপটে এখন আর আল কায়েদা নেই। তার জায়গায় এসেছে ইসলামিক স্টেট। এই ইসলামিক স্টেট বা আইএসের জঙ্গিরা তখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ইরাক আর সিরিয়াজুড়ে রয়েছে তাদের বিশাল জঙ্গি নেটওয়ার্ক। এরা এই অঞ্চলে একটি ‘জিহাদি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই জিহাদি রাষ্ট্রের স্বরূপ কী হবে, তার কিছু কিছু আলামত আমরা ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করেছি। কিন্তু যে প্রশ্নটি এখন অনেকেই করেন, তা হচ্ছে ইসলামিক জঙ্গিদের উৎখাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু সফল হবে? নাকি আরেকটি ব্যর্থতা যোগ হবে ওবামা প্রশাসনের খাতায়? ১৯৯০ সালে প্রথম ইরাক যুদ্ধ। ২০০৩ সালে দ্বিতীয় ইরাক যুদ্ধ (সাদ্দাম হত্যা) আর ২০১১ সালে লিবিয়ায় তৃতীয় যুদ্ধের পর এখন সিরিয়া-ইরাকে চতুর্থ আরেকটি যুদ্ধের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সম্পৃক্ত করল। এর শেষ কোথায় কেউ বলতে পারে না। বলা ভালো উপসাগরীয় রাজনীতিতে আইএসের নাম শোনা যায় ২০১৩ সালে। তখন এর নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট। ওই এলাকার ঐতিহাসিক নাম লেভান্ট। জঙ্গিরা তখন এই নামটি ধারণ করে। পরে তা পরিবর্তন করে। তবে ১৯৯১ সালে জামাত আল তওহিদ ওয়াল জিহাদ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে মূলত এটি সংগঠিত হয়েছিল। পরে ‘আল কায়েদা ইন ইরাক’ নাম ধারণ করে। এই সংগঠনটি মূলত সুন্নিনির্ভর ও ইরাকের সুন্নিপ্রধান এলাকায় এদের প্রভাব বেশি। ২০০৬ সালে ইরাকে সুন্নি প্রভাবাধীন মুজাহিদিন শূরা কাউন্সিলে সংগঠনটি যোগ দেয়। ২০১৩ সালে সারা বিশ্ব প্রথমবারের মতো আবু বকর বুগদাদির নাম জানতে পারে। তবে ২৯ জুন (২০১৪) বুগদাদি একটি খেলাফতের ডাক দিলে সংগঠনটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। তখন সংগঠনটি নতুন নাম ধারণ করে আইএস বা ইসলামিক স্টেট। আল কায়েদার সঙ্গে সংগঠনটির সম্পর্ক কী এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে, ২০১৪ সালের জুন মাস থেকে আল কায়েদা আইএসের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। কেন সম্পর্ক ছিন্ন করেছেÑ এটা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। কেউ বলার চেষ্টা করছেন আইএসের নৃশংসতা এর বড় কারণ। কেউ বলছেন, জিহাদি নেতৃত্ব কার হাতে থাকবেÑ এ জন্যই বিরোধের জন্ম হয়েছে। এদের রাজনীতি মূলত জিহাদি, সালাফি ও ওয়াহাবি মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়। আল কায়েদা জিহাদি ও ওয়াহাবি মতবাদ অনুসরণ করলেও খেলাফতের কথা বলেনি কখনো। আইএস খেলাফতের কথা বলেছে। আর বুগদাদি নিজেকে খলিফা বা আমিরুল মুমেনিন হিসেবে ঘোষণা করেছেন, যা আল কায়েদার নেতা লাদেন বা জাওয়াহিরি নিজেকে ঘোষণা করেননি। তবে এটা বলতেই হবে, আইএসের নৃশংসতা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। একাধিক মার্কিন সংবাদকর্মীর গলা কেটে হত্যা করে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে একটি ভয়ের আবহ তৈরি করেছে আইএস। অতি সম্প্রতি কোবানিতে যুদ্ধরত এক কুর্দি তরুণী যোদ্ধার গলা কেটে জনৈক আইএস যোদ্ধার উল্লসিত ছবিও ইন্টারনেটে প্রকাশ পেয়েছে। আল কায়েদা তার শত্রুদের হত্যা করত কিন্তু এভাবে গলা কেটে হত্যা করত না। তবে আইএসের উত্থান অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথম প্রশ্ন কোন শক্তি আইএসকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে? যতদূর জানা যায়, আইএসের যোদ্ধারা প্রতি মাসে বেতন পান। অর্থের পরিমাণটা নেহাত কম নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অর্থ কোত্থেকে এসেছে? শুধু দখলকৃত অঞ্চলের (তিকরিত, মাসুল) তেল বিক্রি করে এই অর্থ জোগান দেওয়া কি সম্ভব? অস্ত্রই বা আসছে কোত্থেকে! কারা অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন আইএসের যোদ্ধারা ইতোমধ্যে দক্ষ একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। এদের কারা প্রশিক্ষণ দিল? তৃতীয় প্রশ্ন কে এই আবু বকর বুগদাদি? কারা তাকে সামনে নিয়ে এল? বিশ্বব্যাপী আল কায়েদা স্বীকৃত। এখন বিকল্প আরেকটি ফোর্স তৈরি করে কোনো ‘শক্তি’ কী চাচ্ছে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে? যদি মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা বজায় থাকে, তাহলে তা তো মার্কিন অর্থনীতির চাঙ্গাভাব বজায় রাখতে সাহায্য করবে। কারণ মার্কিন অর্থনীতি তো ‘যুদ্ধ অর্থনীতি’। যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। অস্ত্র বিক্রি বাড়ে। ব্যবসা বৃদ্ধি পায় যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে। ইরাক এর বড় প্রমাণ। এ ধরনের হাজারটা প্রশ্ন এখন উঠেছে এবং রাজনৈতিক প-িতরা এসব প্রশ্নের সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবেন। পরিস্থিতি এখন যেদিকেই গড়াক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি আফগানিস্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছে সিরিয়ায়। এই মুহূর্তে এটা স্পষ্ট নয়Ñ যুক্তরাষ্ট্র শুধু বিমান হামলা চালিয়েই তাদের কর্মতৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখবে, নাকি একই সঙ্গে স্থলবাহিনীও পাঠাবে, যেটা তারা পাঠিয়েছিল আফগানিস্তানে। একটা মিত্রবাহিনী ইতোমধ্যে গঠন করে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত ২২টি রাষ্ট্র ওই বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। কোনো কোনো রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিমান হামলায় যোগও দিচ্ছে। এখন অবধি যুক্তরাষ্ট্র সেখানে মেরিন সেনা পাঠায়নি। স্থানীয় উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো চাচ্ছে শুধু বিমান হামলা নয়, বরং মেরিন সেনাও সেখানে পাঠানো হোক। এখানে বলা ভালো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল ইসলামিক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশও যোগ দিক। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবে তার সম্মতি জানায়নি। যদিও এ অঞ্চলে জঙ্গি রাজনীতি বিস্তারের ঝুঁকি রয়েছে। আল কায়েদা নেতা জাওয়াহিরি গত মাসে একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে আল কায়েদার শাখা প্রতিষ্ঠা করার কথা ঘোষণা করেছেন। এমনি এক পরিস্থিতিতে যেখানে এই অঞ্চলে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেখানে বাংলাদেশ আইএসের বিরুদ্ধে কোন অ্যালায়েন্সে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানাল। এখানে বাংলাদেশের এই নীতি অনেকটা ভারতীয় নীতিরই অনুসরণ মাত্র। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটন সফর করে গেছেন। ওবামা-মোদি আলোচনায় ওবামাও মোদিকে এই অ্যালায়েন্সে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মোদির সমর্থন ওবামা পাননি। এখন বাংলাদেশও আপত্তি করল। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। তাতেও বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। আইএসের জঙ্গি উত্থানকে ঠেকাতে মার্কিন অবস্থানকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। ইসলামিক জঙ্গিবাদ যে শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে বিঘিœত করছে, তা নয়। বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তাকেও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছেÑ মার্কিনি এই মূল্যায়নের সঙ্গে ওবামা প্রশাসন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকেও সম্পর্কিত করতে চায়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক মুসলিম রাষ্ট্রই ওবামার ডাকে সাড়া দেয়নি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘চতুর্থ যুদ্ধ’ কীভাবে শেষ হবে কিংবা আইএসকে পরিপূর্ণভাবে উৎখাত করা সম্ভব হবে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ইরাক কুয়েত দখল করে নিলে কুয়েত মুক্ত করার লক্ষ্যেই জাতিসংঘের উদ্যোগে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে একটি বহুজাতিক বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ নামে পরিচালিত ওই অভিযান যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছিল এবং কুয়েত শত্রুমুক্ত হয়েছিল। সেটা ছিল উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রথম যুদ্ধ’। ‘দ্বিতীয় যুদ্ধ’ শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালের ২০ মার্চ। লক্ষ ছিল একটাইÑ ইরাক আক্রমণ করে ইরাককে সাদ্দামমুক্ত করা। অভিযোগ ছিল ইরাকের কাছে অত্যাধুনিক মরণাস্ত্র রয়েছে, যা ওই অঞ্চল ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। এই অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের অনুমতি ছাড়াই ইরাক আক্রমণ করল। সাদ্দাম হোসেন উৎখাতই নয়, বরং সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করা হলো। অথচ ইরাকের কাছে কোনো অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। ‘দ্বিতীয় যুদ্ধ’ দীর্ঘস্থায়ী হয় ৮ বছর। ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইরাক থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ততদিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এই যুদ্ধ ঘোষণার কোনো অনুমতি ছিল না কংগ্রেসের। ওই যুদ্ধে শুধু কোয়ালিশন বাহিনীর সৈনিকের মৃত্যু সংখ্যা ছিল সরকারিভাবে ৪৮০৯ জন, যার মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সংখ্যা ছিল ৪৪৮১ জন। আর আহত হয়েছিল ৩২২২৬ জন। এ ক্ষেত্রে ইরাকি বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে একা যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে ৬ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। চিন্তা করা যায়? অথচ মার্কিন সমাজে বেকারত্ব রয়েছে। বৈষম্য রয়েছে। উচ্চশিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সীমিত। এই বিপুল ব্যয় এসব সামাজিক এ যুদ্ধে ন্যাটো একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। আর তাতে অংশ নিয়েছিল ১৯টি রাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ওবামা, যিনি শান্তির জন্য ২০০৮ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তিনি যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। কর্নেল গাদ্দাফির মৃত্যু ও ন্যাটোর বিমান হামলা বন্ধ কিংবা সেখানে একটি তথাকথিত সরকার গঠন করার পরও স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। লিবিয়া এখন অস্ত্রবাজদের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অস্ত্রবাজরা এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। ‘মানবতার নামে সামরিক হস্তক্ষেপ’-এর যুক্তি তুলে ধরে সেখানে সামরিক হামলা চালিয়ে দেশটি ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু শান্তি আসেনি।এখন ওবামা আরও একটি ভুল করতে যাচ্ছেন। তিনি লিবিয়ার মতোই সিরিয়ায় ইসলামিক জঙ্গিদের ওপর বোমা হামলার নির্দেশ দিয়ে উপসাগরীয় অঞ্চলে ‘চতুর্থ যুদ্ধ’ শুরু করেছেন। ইরাক যুদ্ধের সময় বুশ ছিলেন ক্ষমতায়। ওবামার মতো তিনিও সংবিধান লংঘন করেছেন। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের আর্টিকেল ১, সেকশন ৮-এ বলা আছে, যুদ্ধ ঘোষণা কিংবা শুরু করার অধিকার কংগ্রেসের, প্রেসিডেন্টের কোনো অধিকার নেই। প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ শুরু করতে পারেন না। কিন্তু ওবামা লিবিয়ার ব্যাপারেও সংবিধান লংঘন করেছিলেন। আর এখন সিরিয়ার ব্যাপারেও করলেন। তবে সিরিয়া ইরাক বা লিবিয়ার মতো নয়। ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের পরাজিত করা অত সহজ হবে না। সিআইএর হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৩০ হাজার যোদ্ধা রয়েছে ইসলামিক স্টেট বাহিনীর। মূলত ইরাকের সুন্নিদের নিয়েই এই বাহিনী গঠিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে আরও প্রায় ১৫ হাজার সেনা এই বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এরা ইতোমধ্যে একটি দক্ষ বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। সাদ্দামের সেনাবাহিনীর অনেক জেনারেল এই বাহিনীর সঙ্গে জড়িত। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে বলা যায়, আইএস যেসব এলাকা ‘স্বাধীন’ করেছে সেখানে নিজস্ব প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। একটি সরকারও আছে। আছে মন্ত্রিপরিষদ। ধর্মীয় পুলিশ বাহিনীও রয়েছে সৌদি আরবের মতো। তাদের কাজ হচ্ছে আজানের সময় সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা ও ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী জনসাধারণ পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা দেখা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। যতদূর জানা যায়, আবু বকর বুগদাদির দুজন ডেপুটি রয়েছেনÑ একজন ইরাকের জন্য, অপরজন সিরিয়ার জন্য। বেশ কিছু তেলক্ষেত্র (ইরাকের) এখন এদের দখলে। এই তেল বিক্রির অর্থ এখন তাদের আয়ের অন্যতম উৎস। প্রতিদিন তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ২৬ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলিত হয়। কালোবাজারে এর মূল্য দেড় থেকে ২ মিলিয়ন ডলার। প্রতিদিন এই অর্থ জমা হচ্ছে ইসলামিক স্টেটের ফান্ডে। আফগানিস্তানের মতোই যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘চতুর্থ যুদ্ধ’ দীর্ঘায়িত হবে। এই যুদ্ধ অনেকগুলো সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে। এক. আগামীতে ইরাক ভেঙে যাবে এবং শিয়া নিয়ন্ত্রিত একটি ক্ষুদ্র ইরাকের জন্ম হবে। দুই. সুন্নিদের নেতৃত্বাধীন একটি ‘জিহাদি রাষ্ট্র’-এর জন্ম হবে এবং এই অঞ্চলে একটি দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। এই ‘জিহাদি রাষ্ট্র’ এ অঞ্চলের অন্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি হুমকি হয়ে দেখা দেবে। তিন. সিরিয়া ভেঙে যাবে। একটা অংশ যুক্ত হবে এই ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে। চার. একটি স্বাধীন কুর্দিরাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করবে। এই সম্ভাবনাগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হবে এবং চূড়ান্ত বিচারে লাভবান হবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়নি। ইরাক যুদ্ধে লাভবান হয়েছে মার্কিন কনট্রাক্টররা, ক্ষতি হয়েছে রাষ্ট্রের। ঠিক তেমনি সিরিয়া যুদ্ধে প্রতিদিন ১০ লাখ ডলার ক্ষতির মধ্য দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু লাভবান হয়, সেটিই দেখার বিষয় এখন। Daily Amader Somoy 31.10.14

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

আগামী ৪ নভেম্বর (২০১৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর মার্কিন রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করছে। বিশেষ করে ২০১৬ সালে এখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনের ফলাফল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের (২০১২) দুই বছর পর কংগ্রেসের উভয় কক্ষের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে সিনেটের তিনভাগের এক ভাগ আসনের আর হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের পুরো আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সিনেট সদস্যরা ৬ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। একই সালে বেশ কয়েকটি রাজ্যের গভর্নর, কিছু রাজ্যের কংগ্রেসের কোনো কোনো শহরের মেয়রের নির্বাচনও একই সময় অনুষ্ঠিত হবে। ৪ নভেম্বর ৪৭১টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের ৪৩৫টি আসন ও সিনেটের ৩৬টি আসন। একই সালে আরো ৩৪টি গভর্নর পদেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ওবামার ডেমোক্রেটিক দলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সিনেট। ১০০ সিনেট সিটের ৫৩টি আসন রয়েছে ডেমোক্রেটদের। রিপাবলিকানদের হাতে রয়েছে ৪৫টি আসন। দুজন রয়েছেন নিরপেক্ষ। অন্যদিকে ৪৩৫ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে রিপাবলিকানদের দখলে রয়েছে ২৩৩টি আসন। আর ডেমোক্রেটদের রয়েছে ১৯৯টি আসন। এখন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে এই আসন বিন্যাসে কী ধরনের পরিবর্তন আসে, তাই দেখার বিষয়। অতীতে কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে নানা জটিলতায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। গেল বছর 'শাট ডাউন'-এর মতো ঘটনাও ঘটেছিল। বর্তমানে দুটো ইস্যুতে ওবামা বড় ধরনের সঙ্কটে আছেন। এর একটি হচ্ছে 'ইবোলা' ইস্যু ও দ্বিতীয়টি ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস বা ইসলামিক স্টেটের উত্থান। এখন কংগ্রেসের (উভয় কক্ষ) নিয়ন্ত্রণ যদি ডেমোক্রেটদের হাতে না থাকে, তাহলে সঙ্কট আরো গভীর হবে। আইএসের উত্থান নিয়ে চাপের মুখে আছেন ওবামা। স্থল যুদ্ধ তিনি সিরিয়ায় শুরু করেননি বটে, কিন্তু বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। এতে পরোক্ষ সুবিধা পাচ্ছেন আসাদ। তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হয়েছে। এর আগে মার্কিন কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আসাদবিরোধী ফোর্সকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার। কুর্দিদেরও সমর্থন করেছিল ওবামা প্রশাসন। এখন দেখা গেল আসাদবিরোধী ওই ফোর্স আর আসাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে না। বরং ওই ফোর্স ইসলামিক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এতে সুবিধা পাচ্ছেন আসাদ স্বয়ং। এটা ওবামা প্রশাসনের জন্য বড় ব্যর্থতাকে সিরিয়ায় ইসলামিক জঙ্গিদের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি ওবামা প্রশাসন। মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে ইসলামিক জঙ্গিদের যখন ওবামা প্রশাসনকে একটি বড় ধরনের বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে ঠিক তখন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস শহরে, যেখানে আমি বর্তমানে বসবাস করি, সেখানে 'ইবোলা' রোগের বিস্তার ঘটায়, ওবামা প্রশাসন আরো বিতর্কের মধ্যে পড়েছে। বলা হচ্ছে ওবামা প্রশাসন জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এই 'ইবোলা' রোগটির উৎপত্তি লাইবেরিয়ায়। একজন লাইবেরিয়ান নাগরিক ডানকান এই রোগটি শরীরে বহন করে ডালাসে আসেন। তার চিকিৎসা ঠিকমতো হয়নি। তিনি মারা গেছেন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে দুজন নার্সের শরীরে, যারা ডানকানের দেখাশোনায় নিয়োজিত ছিলেন। এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে যে প্রায় ২০০ ব্যক্তির ওপর পুরো ডালাস ও এর আশপাশ এলাকায় বসবাস করেন, তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। প্রতিদিনই মানুষ আতঙ্কে থাকে 'ইবোলা' আরো ছড়িয়ে পড়ল কিনা, তা জানার জন্য। শুধু তাই নয়_ এ ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতেও ডালাসের নার্স অ্যাসোসিয়েশন তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। তারা নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলেছে। আরো খারাপ খবর হচ্ছে স্পেন থেকেও 'ইবোলা' আক্রান্ত একজন নার্সের সংবাদ এসেছে। ওই নার্সও লাইবেরিয়া থেকে এসেছিলেন। সতর্কতা জারি করা হয়েছে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি বড় বড় শহরে। হাসপাতালগুলো বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। টিভি সংবাদে দেখা যায় কীভাবে সেবিকারা বিশেষ ধরনের পোশাক পরে হাসপাতালে কাজ করছেন। 'ইবোলা' নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃৃপক্ষ যখন হিমসিম খাচ্ছে, ঠিক তখনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে আগামী ২ মাসে ১০ হাজার 'ইবোলা' আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে পশ্চিম আফ্রিকায় বিশেষ করে লাইবেরিয়া, সিয়েরালিওন। এসব দেশে এই রোগে মারা গেছেন ৯ হাজার ব্যক্তি। এই সংখ্যা হয়তো আরো বেশি হতে পারে। পুরো তথ্য সেখান থেকে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 'ইবোলা' নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে। গত পত্রিকায় নানা সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এর মধ্যে দুটো সংবাদ বেশ স্পর্শকাতর। প্রথমটিতে নাভারো নামের একটি কলেজে, যা ডালাসে অবস্থিত, সেখানে দুজন নাইজেরিয়ার ছাত্রের ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ ওই দুই ছাত্রকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে 'ইবোলা' আক্রান্ত কোনো দেশের ছাত্রকে ভর্তি করবে না নাভারো কলেজ। দ্বিতীয় সংবাদটি আরো স্পর্শকাতর। মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে ব্যাপকভাবে 'ইবোলা' সংবাদ প্রকাশ করার উদ্দেশ্য একটিই_ আর তা হচ্ছে আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে আগমন ও বসবাসের ব্যাপারে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ওই অভিবাসীদের বিষয়টি অনেকটা সহজ এবং হাজার হাজার আফ্রিকার অভিবাসী প্রতিবছরই এখানে স্থায়ী হচ্ছেন, তাই আইন প্রণেতাদের ওপর একটা 'চাপ' ও জনমত সৃষ্টির উদ্দেশেই 'ইবোলা'র বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে জানি না। তবে কট্টরপন্থী কনজারভেটিভরা যে অভিবাসী আফ্রিকা ও এশিয়াদের বিরুদ্ধে, তার প্রমাণ আমরা একাধিকবার পেয়েছি। আফ্রো-আমেরিকান অর্থাৎ যাদের পূর্বপুরুষ আফ্রিকা থেকে এখানে দাস হিসেবে এসেছিলেন (মিসেস ওবামার পরিবারও দাস ছিল), তারা প্রায়ই শ্বেতাঙ্গদের টার্গেট হচ্ছেন। ক'দিন আগে ফার্গুসন শহরে এক কিশোর আফ্রো-আমেরিকান নাগরিককে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা বড় ধরনের আলোড়ন তুললেও, এই প্রবণতা যে থেমে গেছে তা বলা যাবে না। তাই 'ইবোলা' সংক্রমণের সঙ্গে এ ধরনের কোনো মানসিকতা কাজ করছে কিনা, তা হুট করে বলা যাবে না। ৯/১১ পরবর্তী ঘটনাবলিতে মুসলমানরা যেভাবে একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকতেন, এখন 'ইবোলা'র ঘটনা 'আবিষ্কৃত' হওয়ার পর আফ্রিকার নাগরিকরা একটা আতঙ্কে থাকবেন এটা বলাই যায়। আগামী দিনগুলোয় নাভারো কলেজের মতো অনেক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে আফ্রিকা থেকে আবেদন করা ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করতে অস্বীকার করার কথা আমরা জানতে পারব। এই ঘটনায় আবারো প্রমাণিত হলো_ অপ্রচলিত নিরাপত্তা ধারণাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এই অপ্রচলিত নিরাপত্তা ধারণাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। পানি, জলবায়ু পরিবর্তন, ব্যাপক নগরায়ণ, ইত্যাদির পাশাপাশি যোগ হয়েছে ছোঁয়াচে রোগের বিস্তার। কিছু অসাধু ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে এ ধরনের জীবাণু ল্যাবরেটরিতে তৈরি করতে পারেন এবং যার দ্বারা হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের কাছে এ ধরনের জীবাণু অস্ত্র থাকা বিচিত্র কিছু নয়। আল-কায়েদার সঙ্গে কাজ করেন এমন কিছু বিশেষজ্ঞ বা বিজ্ঞানী প্রবাসে রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। আইটিতে তারা একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন এবং সফলভাবে তা প্রয়োগও করছেন। ফলে ইসলামিক জঙ্গিরা যে জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে না, তা বলা যায় না। অনেকের স্মরণ থাকার কথা_ ৯/১১-এর ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট বুশ সম্ভাব্য একটি জীবাণু অস্ত্রের আক্রমণ ঠেকাতে একটি বিশেষ টিম গঠন করেছিলেন। যদিও পরে এ ধরনের কোনো আক্রমণ হয়নি। এখন ডালাসে 'ইবোলা' আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর পর মিডিয়ায় নানা 'স্পেসেকুলেশন' করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্কুলে কোনো বাচ্চার সামান্য জ্বর হলেই তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আফ্রিকান নাগরিকদের 'অন্য দৃষ্টিতে' দেখা হচ্ছে। এগুলো সবই সাম্প্রতিক ঘটনা। তবে এখানে গবেষণা হয়। এরা গবেষণা করে। সেই সুযোগ আছে। শীর্ষপর্যায় থেকে গুরুত্ব দেয়া হয়। ফান্ডও আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের রোগ নিয়ে গবেষণা করার সম্ভাবনা কম। আমাদের আর্থিক ভিত্তিও দুর্বল। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় এ ধরনের সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটলে সরকার হঠাৎ করেই সক্রিয় হয়, আবার কার্যক্রমে স্থবিরতা এসে যায় কিছুদিন পর। 'ইবোলা'র বিস্তারের হুমকির মুখে সরকার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্ক্যানিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয় বলেই আমার ধারণা। এখন যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানরা যদি ভালো করে, তাহলে নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে প্রশাসনে। ওবামা প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারবেন না। কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ (উভয় কক্ষ) যদি রিপাবলিকানদের হাতে চলে যায়, তাহলে রিপাবলিকানরা একের পর এক বিল পাস করবেন। যাতে ওবামা তার গৃহীত নীতি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারবেন না। আইএস জঙ্গিদের ক্ষেত্রে মার্কিনি ভূমিকায় পরিবর্তন আসতে পারে। সিরিয়া ও ইরাকে স্থল যুদ্ধের সূচনা করতে পারে কংগ্রেস। কেননা সংবিধান অনুযায়ী একমাত্র কংগ্রেসই যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। প্রেসিডেন্ট পারেন না। 'ইবোলা' রোগ নিয়ে মার্কিনিদের যে সংশয়, সে ব্যাপারেও কঠোর হতে পারে কংগ্রেস। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে অভিবাসী আগমন সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষিত হতে পারে। ইতোমধ্যে তাদের জন্য নির্দিষ্ট বিমানবন্দর ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফলে দেখতে হবে এই নির্বাচন কী ফল বয়ে আনে। এর মধ্যদিয়ে মার্কিন নীতিতে যদি পরিবর্তন আসে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। Daily Jai Jai Din 29.10.14

আমি লজ্জিত দুঃখিত ও অপমানিত

আমি লজ্জিত, দুঃখিত ও অপমানিত বোধ করছি। এই প্রবাসে থেকে যখন খবর দেখি একটি সংগঠন ৯ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীকে ‘বুদ্ধি বেশ্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে, তখন লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়। কারণ তাদের ‘অপরাধ’ ছিল, তারা প্রয়াত বুদ্ধিজীবী পিয়াস করিমের মরদেহ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আনার দাবি জানিয়েছিলেন। সেটা হয়নি। এটা নিয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কম ‘নাটক’ করেনি। তারা অনুমতি দেয়নি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের নামে (সেইসঙ্গে সিপি গং) একটি সংগঠনের ব্যানারে এদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা এবং এদের ছবিতে কালি লেপন করে তা টানিয়ে দেয়া। এ ঘটনায় আমি দুঃখিতও বটে।কেননা সরকারি বুদ্ধিজীবী হিসেবে যারা পরিচিত, তাদের একজনও এর প্রতিবাদ করলেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও মুখ খুললেন না। পিয়াস করিমের ‘অধ্যায়’ শেষ হয়ে গেছে। তিনি কবরে শায়িত হয়েছেন। কিন্তু তাকে নিয়ে যা ঘটল, তার রেশ রয়ে যাবে আরও অনেক দিন।যে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং যে শব্দ ব্যবহার করে তাদের অপমান করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। একজন ছাড়া বাকি আটজন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন এবং বিএনপির কোনো ফোরামে উপস্থিত থেকে বক্তব্যও রাখেন না। বরং বিএনপি এবং জামায়াতবিরোধী একটি পরিচিতি সবার আছে। এদের মাঝে পিয়াস করিমের স্ত্রী অধ্যাপক আমেনা মহসিনের নামও আছে। অথচ অধ্যাপক আমেনা দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি ইস্যুতে কিংবা নৃ-গোষ্ঠীর দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে তার অবস্থান ছিল বিএনপিবিরোধী শিবিরে। সাম্প্রতিক টকশোতে আমার সঙ্গে একাধিকবার তিনি ছিলেন। কিন্তু সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে বিএনপির সমালোচনা করতেও তিনি ভোলেননি।অপরদিকে মতিউর রহমান চৌধুরী কিংবা নূরুল কবিরের মতো সম্পাদকরা বিএনপিকে সমর্থন করেন। এটা বোধকরি কেউই বিশ্বাস করেন না। একাধিকবার মতি ভাইয়ের সঙ্গে এ নিয়ে আমার ‘বিতর্ক’ হয়েছে। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমার ‘অবস্থান’কে তিনি সমালোচনা করতেও দ্বিধা করেননি। অধ্যাপক আসিফ নজরুলের ‘অবস্থান’ মানুষ জানে। বারবার তিনি বিএনপির সমালোচনা করেছেন। বাকিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এরা কেউই বিএনপি-জামায়াত রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও, এটা সত্য ওরা সরকারের সমালোচনা করতেন।তাহলে কী সরকারের সমালোচনার জন্যই তাদের অপমানিত হতে হলো। সরকারের নীতির সমালোচনা করা কি অপরাধ? একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সরকার সব কাজ ভালো করে, এটা বলা যায় না। সরকারের সমালোচনা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। সরকারের যদি সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা না থাকে, যদি সরকার অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, তাহলে তো সেই সরকারকে গণতান্ত্রিক সরকার বলা যাবে না। সরকারের ‘সহ্য’ ক্ষমতা থাকতে হয়। টকশোতে আমরা সরকারের ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিই। এটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি অংশ। অধ্যাপক পিয়াস করিমকে নিয়ে যা হয়ে গেল, তা শুধু দুঃখজনকই নয়, অনাকাক্সিক্ষতও বটে। অধ্যাপক করিম সব সময় তার বক্তব্যে কিংবা তার মূল্যায়নে সৎ ছিলেন। এটা আমি বলব না। তিনি বিএনপির রাজনীতিকে সমর্থন করতেন। তাতেও আমি কোনো অন্যায় দেখি না। কিন্তু অন্যায় দেখি যখন তাকে নিয়ে ‘বিতর্ক’ হয়। তাকে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। রাজাকার বলা হয়। স্বাধীনতাবিরোধী বলা হয়। এটাই অন্যায়।ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির সমালোচনা করতে নেই। জীবনাবসানের মধ্যে দিয়ে তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে যান। তাই কোনো মৃত ব্যক্তির অতীত ইতিহাস নিয়ে আমরা ঘাঁটাঘাঁটি করি না। কেননা তিনি তখন সমালোচনার ঊর্ধ্বে চলে যান। কিন্তু যখন পিয়াস করিমের বাবার স্বাধীনতা যুদ্ধের ভূমিকা টেনে আনা হলো, তখন আমাকে তা কষ্ট দিয়েছে। পিয়াস করিম নিশ্চয়ই তার বাবার পরিচয়ে পরিচিত হননি। কিংবা বাবার ভূমিকার জন্য আমরা তাকে দায়ীও করব না। এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে, টকশোর মাধ্যমেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সাত-আট বছর আগে মানুষ তাকে চিনত না। এখন চেনে এবং তা মিডিয়ার কল্যাণেই। তিনি বিএনপির পক্ষে কথা বলতেন। বিএনপি সমর্থকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি যেতেন। তবে একসময় মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক কমিটির সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। এমনও শোনা গেছে, ছাত্রাবস্থায় তিনি সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির সমর্থক ছিলেন। এসব নিয়ে আলোচনা এখন মূল্যহীন।একজন মানুষের অতীত পরিচয় থাকতেই পারে। সেই অতীত ভূমিকা বিতর্কিত ছিল কিনা- এটা বর্তমানকে দিয়ে বিচার করা যাবে না। তার বর্তমান পরিচয়ই আসল। বর্তমানে তিনি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ধারণ করেছিলেন। এতেও দোষের কিছু ছিল না। এ দেশের লাখ লাখ মানুষ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ধারণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনেক শিক্ষকও এ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পেশাজীবীদের একটি অংশও এ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সুতরাং পিয়াস করিম এ রাজনীতি ধারণ করে কোনো অন্যায় করেননি। কিন্তু তার মৃত্যু ও মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে যা ঘটেছে, তা এখন অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এলো। এ জাতি যে কত ‘বিভক্ত’, তা আবারও প্রমাণিত হলো। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার কোনো কোনো বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে আহত করেছিল। ফলে ওই পক্ষের কাছে তিনি ‘বিতর্কিত’ ছিলেন।সুতরাং তার মরদেহ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর সিদ্ধান্ত, একটি পক্ষের মনঃপূত হয়নি। এটাই স্বাভাবিক। এর মাঝে ‘রাজনীতি’ যে কাজ করেনি, তা বলা যাবে না। একটি প্রশ্ন উঠেছে, শহীদ মিনার তাহলে কার? শহীদ মিনারের দেখভাল, নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কি এ দায়িত্বটি সুষ্ঠুভাবে পালন করে? খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে, শুধু ভাষা আন্দোলনের মাসটিতে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৎপর হয়। এরপর সারা বছর এদের তৎপরতা দেখা যায় না। বছরজুড়ে এখানে ভবঘুরে, দেহপসারিনী, আর ভিক্ষুকদের ‘আশ্রয়স্থল’-এ পরিণত হয়। তখন দেখার কেউ থাকে না।এখন একজন পিয়াস করিমের মৃতদেহকে শ্রদ্ধা জানানোর প্রশ্নটি যখন এলো, তখন আপত্তি তুলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তথাকথিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল। এর পেছনে যে ‘যুক্তি’ই থাকুক না কেন, এটা একটি বাজে সিদ্ধান্ত হয়ে রইল। আগামীতে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যারা বরেণ্য ব্যক্তি, তবে সরকারবিরোধী, তাদের মৃত্যুর পর তাদের মরদেহ সম্মান জানানোর জন্য শহীদ মিনারে আনার কি অনুমতি দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ? কারা শহীদ মিনার ব্যবহার করতে পারবে, কাদের মৃতদেহ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা যাবে, সে ব্যাপারে একটি নীতিমালা থাকা উচিত। না হলে বারবার আমরা এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো এবং যারা সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত, তাদের মৃত্যুর পর শ্রদ্ধা জানানোর কোনো সুযোগ থাকবে না শহীদ মিনারে। মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর স্থান শহীদ মিনার হতে পারে না। অন্য একটি উন্মুক্ত স্থান আমরা চিন্তা করতে পারি। শাহবাগ চত্বর একটি বিকল্প স্থান হতে পারে। শহীদ মিনার এলাকাটির ব্যবস্থাপনা তদারকির জন্য একটি বিকল্প কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, এ এলাকাটিকে ঘিরে একটি ‘বলয়’ প্রতিষ্ঠা করা যায়। যেখানে ভাষা আন্দোলন শুধু নয়, ১৯৪৭-পরবর্তী প্রতিটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার ‘ইতিহাস’ সংরক্ষিত থাকবে।অধ্যাপক পিয়াস করিমের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহের প্রতি সম্মান জানানো নিয়ে যা ঘটল, তাতে আমি নিজেই এখন থেকে আতঙ্কিত। আমি নিজেও চাই না আমার মৃত্যুর পর আমার মরদেহ শহীদ মিনার কিংবা আমার কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগরে নিয়ে যাওয়া হবে। এর কোনো প্রয়োজন নেই। পিয়াস করিমের মৃত্যুর পর এখনও লেখালেখি চলছে। বিবৃতি চলছে। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। জীবদ্দশায় যিনি সম্মান পান না, মৃত্যুর পর তাকে সম্মান দেখানো অর্থহীন। আমরা অনেক বিষয় নিয়ে এখনও বিতর্ক করছি। এ ধরনের বিতর্ক জাতি হিসেবে আমাদের সম্মানকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। চিরস্থায়ীভাবে এ ধরনের বিতর্কের অবসান হওয়া প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। ৪৩ বছর পার করলাম- এখনও যদি আমাদের শুনতে হয় কে মুক্তিযোদ্ধা, কে মুক্তিযোদ্ধা নন, এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। এ প্রশ্ন নিয়ে এত বছর পর জাতিকে বিভক্ত করাও ঠিক নয়।আমরা জানি, কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। ইতিহাস তাদের ‘শাস্তি’ দিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম এ অপশক্তিকে ঘৃণা করে। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের উল্লাস এর বড় প্রমাণ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাতিকে বিভক্ত নয় বরং বিরোধিতাকারীদের ঘৃণা করাই মঙ্গল। এ কাজটি সম্মিলিতভাবে করাই উচিত। আমাদের ব্যর্থতা আমরা এটা পারিনি। কিন্তু তাই বলে জাতিকে বিভক্ত কেন? বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়াটা জরুরি। এটাও আমরা পারিনি। রাজনীতির নতুন এক সংস্কৃতির আমরা জন্ম দিয়েছি। নির্বাচনে একটা বড় জনগোষ্ঠীর অংশ না থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন হয়েছে এবং সরকার সাংবিধানিকভাবে সরকার পরিচালনা করছে এখানে ‘সব দলের অংশগ্রহণের যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি’, তা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছি। এখানে কার ভুল বেশি, এটা নিয়ে আমরা এখনও বিতর্ক করছি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, একটা ভুল সিদ্ধান্ত হাজারটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্ম দিতে পারে। জাতির জন্য তা কখনও কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। আমরা টকশোতে এ ভুলগুলো শোধরানোর কথা বলি। দেয়ালের লেখা থেকে শিখতে বলি। কিন্তু ইতিহাস থেকে, দেয়ালের লিখন থেকে কেউ কিছু শেখে না, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। আর এ বাস্তবতার কারণেই জাতি হিসেবে আমরা আজ বিভক্ত। এ বিভক্তিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে পিয়াস করিমের মরদেহের প্রতি সম্মান জানানোর বিষয়ে। আরও দুঃখজনক ঘটনা ঘটল ৯ জন বরেণ্য ব্যক্তিকে অপমানিত করে। জাতি হিসেবে আমরা কত অকৃতজ্ঞ।ওইসব ব্যক্তির বক্তব্য, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আমরা প্রশ্ন করতে পারি। সমালোচনা করতে পারি। প্রবন্ধ লিখতে পারি। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী বলা কি ঠিক? এ রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের বদলাতে হবে। না হলে জাতি হিসেবে আমরা দাঁড়াতে পারব না। এতে করে বিস্মৃত হবে জাতি গঠন। যারা সরকারের কর্মকা-ের সমালোচনা করেন, তাদের সবাইকে যুদ্ধাপরাধী বলা একটি ‘ফ্যাশন’ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। কেউ কেউ এটা করেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, কোনো এক সময় অন্য পক্ষ যদি ক্ষমতায় আসে, তারাও ঠিক একই কাজ করবে। এরই মধ্যে আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি। একদলীয় নির্বাচন হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মেলে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে আমরা জাতিকে বিভক্ত করে ফেলেছি। ৪৩ বছর পর আবারও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটা কোনো ভালো খবর নয়।আমি তাই ৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করে তাদের সমালোচনা করা, ইত্যাদি ঘটনার নিন্দা জানাই। আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরাও এর সমালোচনা করবেন। না করলে তারাও সমালোচিত হবেন। এ ঘটনায় আমি নিজেও বিব্রতবোধ করছি। কেননা সরকারের অনেক কর্মকা- আমি সমালোচনা করেছি। এ ঘটনার পর আমার বারবার মনে হয়েছে, ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’দের তালিকায় আমার নামও সংযোজিত হতে পারে আগামীতে! নিঃসন্দেহে এটা দুঃখজনক ঘটনা। যাকে নিয়ে এত ঘটনা, তিনি চলে গেছেন না ফেরার জগতে। এর মধ্যে দিয়ে সব বিতর্কের অবসান হবে, এটাই প্রত্যাশা করি। Daily ALOKITO BANGLADESH 19.10.14

মার্কিনি প্রশাসন: বহুবিধ সংকটে নিমজ্জিত

আইএস বা ইসলামিক স্টেট আর ‘এবোলা’ নিয়ে বড় ধরনের সংকটে রয়েছে মার্কিনি প্রশাসন। ওবামা প্রশাসন এর আগে এত বড় সংকটে অতীতে কখনো পড়েনি। সিরিয়া ও ইরাকে ইসলামি স্টেটের ব্যানারে ইসলামি জঙ্গিদের উত্থান ঠেকাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ওবামা প্রশাসন। ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের ঠেকাতে ২০টি দেশের অংশগ্রহণে একটি কোয়ালিশন গঠন করলেও এখন অবধি সেখানে কোনো স্থল সেনাবাহিনী পাঠায়নি যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এটা বারবার বলা হচ্ছে এবং ইরাক থেকে দাবি জানানো হচ্ছে যে সেখানে স্থল সেনাবাহিনী অথবা মেরিন সেনা পাঠানো হোক। গত ৮ আগস্ট থেকে মার্কিন যুদ্ধ বিমান ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করলেও ইসলামিক জঙ্গিদের তৎপরতা বন্ধ করা যায়নি। বরং জঙ্গিরা ইরাকের প্রায় কাছাকাছি এলাকায় চলে এসেছে। ইরাকের আবু খরবাইক শহরের নিয়ন্ত্রণভার চলে গেছে জঙ্গিদের হাতে। ইরাকের অনেক তেল উৎপাদন ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণভার এখন জঙ্গিদের হাতে। ওই তেল বিক্রি করে জঙ্গিরা এখন শক্তিশালী হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করছে। জঙ্গিদের এইউত্থান ওবামা প্রশাসনের জন্য চিন্তার একটা বড় কারণ। তাদের ভয় ইরাককে নিয়ে। এমনিতেই ইরাকে একটি নড়বড়ে সরকার গঠিত হয়েছে। মালিকির পতন ও হায়দার আবাদির নেতৃত্বে সেখানে একটি সরকার গঠিত হলেও ওই সরকার ইরাকের প্রতিটি অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে, এটি বলা যাবে না। সিয়া, সুন্নি ও কুর্দিদের মধ্যে একটা সমঝোতা হয়েছে বটে, কিন্তু এই সমঝোতা ভেঙে পড়তে পারে। সরকারের পতন ঘটতে পারে। এখন ভয়টা হচ্ছে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের হাতে যদি ইরাক সরকারের পতন ঘটে। তাহলে তা পুরো মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপটকে বদলে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সেটা হবে একটা বড় পরাজয়। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ইরাকি সেনাবাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য ২৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ফেলেছে। মার্কিন কংগ্রেসের চাপের মুখে এখন আছেন ওবামা। অন্যদিকে জঙ্গিদের এই উত্থান পরোক্ষাভাবে আমাদের ক্ষমতাকে আরো দীর্ঘায়িত করেছে। এর আগে মার্কিন কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আসাদবিরোধী ফোর্সকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার। কুর্দিদেরও সমর্থন করেছিল ওবামা প্রশাসন। এখন দেখা গেল আসাদবিরোধী এই ফোর্স আর আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে না। বরং ওই ফোর্স ইসলামিক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এতে করে সুবিধা পাচ্ছেন আসাদ স্বয়ং। এটা ওবামা প্রশাসনের জন্য বড় ব্যর্থতা যে সিরিয়ায় ইসলামিক জঙ্গিদের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি ওবামা প্রশাসন।
মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে ইসলামিক জঙ্গিদের উত্থান যখন ওবামা প্রশাসনকে একটি বড় ধরনের বিতর্কের মাঝে ফেলে দিয়েছে, ঠিক তখন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস শহরে, যেখানে আমি বর্তমানে বসবাস করি, সেখানে ‘এবোলা’ রোগের বিস্তার ঘটায়, ওবামা প্রশাসন আরো বিতর্কের মাঝে পড়েছে। বলা হচ্ছে, ওবামা প্রশাসন জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এই ‘এবোলো’ রোগটির উৎপত্তি লাইবেরিয়ায়। একজন লাইবেরিয়ান নাগরিক ডানকান এই রোগটি শরীরে বহন করে ডালাসে আসেন। তার চিকিৎসা ঠিকমতো হয়নি। তিনি মারা গেছেন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে দুজন নার্সের শরীরে, যারা ডানকানের দেখাশোনায় নিয়োজিত ছিলেন। এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে যে, প্রায় দুশ’ ব্যক্তির ওপর, যারা ডালাস ও এর আশপাশ এলাকায় বসবাস করেন, তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। প্রতিদিনই মানুষ আতঙ্কে থাকে ‘এবোলো’ আরো ছড়িয়ে পড়ল কিনা, তা জানার জন্য। শুধু তাই নয়, এ ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতেও ডালাসের নার্স অ্যাসোসিয়েশন তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। তারা নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলেছে। আরো খারাপ খবর হচ্ছে সেখান থেকেও ‘এবোলো’ আক্রান্ত একজন নার্সের সংবাদ এসেছে। ওই নার্সও লাইবেরিয়া থেকে এসেছিলেন। সতর্কতা জারি করা হয়েছে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি বড় বড় শহরে। হাসপাতালগুলো বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। টিভি সংবাদে দেখা যায় কি ভাবে সেবিকারা বিশেষ ধরনের পোশাক পরে হাসপাতালে কাজ করছেন। ‘এবোলো’ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ যখন হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক তখনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, আগামী ২ মাসে ১০ হাজার ‘এবোলো’ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে পশ্চিম আফ্রিকায়, বিশেষ করে লাইবেরিয়া, সিয়েরা, লিওন এসব দেশে এই রোগে মারা গেছেন ৯ হাজার ব্যক্তি। এর সংখ্যা হয়তো আরো বেশি হতে পারে। পুরো তথ্য সেখান থেকে আসছে না।
এখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রে ‘এবোলো’ বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ায় অনেক প্রশ্ন এখন উঠেছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য দফতর বিষয়টি নিয়ে কি ভাবছেন, আমরা জানি না। তবে বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশ একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এখন। সাধারণত ধনী দেশগুলোতে এ ধরনের ছোঁয়াচে রোগের জন্ম ও বিস্তার ঘটে কম। এ ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পশ্চিম আফ্রিকায় প্রথমে আক্রান্ত হন এবং আক্রান্ত হয়ে ইউরোপে বা আমেরিকাতে আসেন। প্রথমে ডাক্তাররা তা বুঝতে পারেন না বা রোগীরা তাদের ভ্রমণসংক্রান্ত বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষপকে তা অবহিতও করেন না। থমাস ডানকান ও মিস রামোসের (স্পেন)-এর ক্ষেত্রে এ রকমটি হয়েছিল। কম উন্নত দেশে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা পর্যাপ্ত নয় কিংবা এ ধরনের রোগ নিয়ে গবেষণা কম হয়, প্রতিরোধের কোনো ওষুধও  প্রস্তুতিও তেমন থাকে না, সেসব দেশে এসব রোগের বিস্তার ঘটে দ্রুত। বাংলাদেশকে নিয়ে তাই চিন্তার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। সাধারণত পশ্চিম আফ্রিকা থেকে যারা আসেন, তারাই এই রোগের জীবাণু বহন করেন। বাংলাদেশের সেনা সদস্যরা পশ্চিম আফ্রিকাতে ছিলেন বা এখনো আছেন। তারা ফিরে আসছেন। ফলে তারা যে জীবাণুটি বহন করছেন না, তা পরীক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। করাও হয় না। উপরন্তু বাংলাদেশে এখন অনেক বিদেশি কাজ করেন, বসবাস করেন, যারা পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক অথবা ওইসব দেশ থেকে সরাসরি এসেছেন। ঢাকায় তাদের পরীক্ষা করা হয় না। অনতিবিলম্বে শাহজালাল বিমানবন্দরে একটি মনিটরিং সেন্টার স্থাপন করা উচিত। প্রাথমিকভাবে কোনো জ্বর নিয়ে কেউ আসছেন কিনা, তা পরীক্ষা করা জরুরি। লাখ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক এখন বিদেশে কাজ করেন। সেখানে পশ্চিম আফ্রিকার নাগরিকদের সঙ্গে তাদের এক সঙ্গে কাজ করতে হয়। এর ফলে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন এবং ওই রোগের জীবাণুটি বহন করে দেশে আসতে পারেন। সুতরাং প্রাথমিক পরীক্ষাটা জরুরি। সাধারণত ‘এবোলো’ আক্রান্তরা খুব জ্বর নিয়ে (প্রায় ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) আসেন। তাদের বমি ও সর্দিজ্বর থাকে। ডাক্তাররা এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকস ওষুধ দেন। ডানকানের ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছিল। তিনি লাইবেরিয়ার নাগরিক। ডালাসে তার বান্ধবী স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। তিনি বান্ধবীকে বিয়ে করার জন্যই এসেছিলেন। হাসপাতালে তিনি তথ্য গোপন করেছিলেন যে তিনি তিন দিন আগে লাইবেরিয়া থেকে এসেছিলেন। তথ্য গোপন না করলে তিনি বেঁচে যেতে পারতেন। অ্যান্টিবায়োটিকস ওষুধ তাকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আরো ৩ দিন পর তাকে অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। ৮ অক্টোবর তিনি মারা যান। বাংলাদেশে সর্দিকাশি অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। কোনো প্রবাসীর ক্ষেত্রে এ রকমটি হলে দ্রুত তার উন্নতি স্বাস্থ্যসেবা নেয়া প্রয়োজন।
মার্কিন প্রশাসন যে ‘এবোলো’ আর আইএসের উত্থান নিয়ে বড় ধরনের বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে আছে, তা পত্রপত্রিকা দেখলেই বোঝা যায়। ডানকানের মৃত্যুর দু’সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। কিন্তু ‘এবোলো’ নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। ইতোমধ্যে আক্রান্ত নার্স নীনা ফমকে একটি বিশেষ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিএনএন তা ‘লাইভ’ সম্প্রচার করেছে। এ থেকেই ‘এবোলার’ গুরুত্বটি বোঝা যায়। প্রেসিডেন্ট ওবামা ইতোমধ্যে একজন ‘এবোলা জার’-এর নাম ঘোষণা করেছেন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে ‘এবোলা’সংক্রান্ত সব বিষয় দেখাশোনা করবেন। তার নিযুক্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কেননা তার কোনো মেডিকেল ডিগ্রি নেই। একই সঙ্গে তিনি লাইবেরিয়াতে ৩০০ মার্কিন সেনা পাঠানোর কথাও বলেছেন, যারা সেখানে ‘এবোলো’ নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। ‘এবোলো’ কত বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে, তা মার্কিন প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে। কেননা জঙ্গিরা এ ধরনের জীবাণু জনবসতি এলাকায় ছড়িয়ে দিয়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ ঘটাতে পারে। ডানকানের ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুতি তেমন ছিল না। এদিকে ইরাক-সিরিয়ায় আইএসের উত্থান ও মার্কিন জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এই ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা করা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক-আফগান যুদ্ধে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করলেও মার্কিন নাগরিকদের সবার নূ০্যনতম চাকরি নিশ্চিত করতে পারেনি। তরুণ প্রজšে§র একটা বড় অংশ এখন বেকার। তারা গ্রাজুয়েশন শেষ করে অপেক্ষা করছেন চাকরির জন্য। কিন্তু চাকরি পাচ্ছেন না। ওবামার স্বাস্থ্যসেবা তাকে আরো বিতর্কিত করেছে। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাই হয়েছে। বেতন দিতে না পারায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সরকারি সেবা। এমনি এক পরিস্থিতিতে আবার নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যে ‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে যাওয়ার অর্থ, সরকারি ব্যয় এর ওপর চাপ বাড়ানো। যুদ্ধের পেছনে খরচ বেড়ে গেলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিশুদের জন্য অনেক সেবা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক পর্যবেক্ষকই বলছেন ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যে ‘যুদ্ধ’ তার শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। প্রতিদিনের ‘যুদ্ধে’ সেখানে খরচ হচ্ছে কয়েক লাখ ডলার। ওবামা নতুন করে এই ‘যুদ্ধ’ শুরু করায় বিতর্কে জড়িয়েছেন। ২০১৬ সালে এখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। হিলারি ক্লিনটন প্রতিযোগিতায় আছেন। তবে ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান ভালো, তা বলা যাবে না। ওবামার ব্যর্থতা রিপাবলিকানদের যদি ক্ষমতায় নিয়ে আসে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র Daiy Manobkontho 27 October 2014

ইবোলা ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইবোলা আতংক এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমি যে রাজ্যে এখন অবস্থান করছি সেই টেক্সাসের ডালাসের একটি হাসপাতালে প্রথম ধরা পড়ে এ রোগটি। মূলত পশ্চিম আফ্রিকায় এ রোগটির উৎপত্তি। বলা হয় পশু-পাখি, বিশেষ করে বানর থেকে এ রোগটি ছড়ায় এবং রোগটি ছোঁয়াচে। এ ধরনের একটি রোগ যে পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য কত ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, ডালাসের ঘটনা তার বড় প্রমাণ। প্রতিদিনই টিভিতে এ নিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে। টকশোগুলো ইবোলো রোগ নিয়ে এখন সরব। খোদ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে মন্ত্রী তথা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মিটিং করছেন। করণীয় নির্ধারণ করছেন। কিন্তু ইবোলাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আক্রান্ত রোগী টমাস ডানকান মারা গেছেন প্রায় এক সপ্তাহ আগে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে দুজন নার্সের শরীরে, যারা ডানকানের দেখাশোনায় নিয়োজিত ছিলেন। এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে, ডালাস ও এর আশপাশ এলাকায় বসবাস করেন এমন প্রায় ২০০ ব্যক্তির ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। প্রতিদিনই মানুষ আতংকে থাকে ইবোলা আরও ছড়িয়ে পড়ল কিনা তা জানার জন্য। শুধু তাই নয়, এ ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতেও ডালাসের নার্স অ্যাসোসিয়েশন তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। তারা নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলেছে। আরও খারাপ খবর হচ্ছে, স্পেন থেকেও ইবোলা আক্রান্ত একজন নার্সের মৃত্যু সংবাদ এসেছে। ওই নার্সও লাইবেরিয়া থেকে এসেছিলেন। সতর্কতা জারি করা হয়েছে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি বড় শহরে। হাসপাতালগুলো বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। টিভি সংবাদে দেখা যায় কীভাবে সেবিকারা বিশেষ ধরনের পোশাক পরে হাসপাতালে কাজ করছেন। ইবোলা নিয়ন্ত্রণে মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ যখন হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক তখনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, আগামী দুমাসে ইবোলা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১০ হাজারে। ইতিমধ্যে পশ্চিম আফ্রিকায়, বিশেষ করে লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন, গিনি- এসব দেশে এ রোগে মারা গেছে চার হাজার ব্যক্তি। এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। পুরো তথ্য সেখান থেকে আসছে না। ইবোলা নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র লাইবেরিয়ায় সেনা পাঠাচ্ছে বলে জানা গেছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে ইবোলা বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ায় অনেক প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদফতর এ বিষয়ে কতটা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে জানি না। তবে বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশ বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এখন। প্রথমত, সাধারণত ধনী দেশগুলোতে এ ধরনের ছোঁয়াচে রোগের জন্ম ও বিস্তার ঘটে কম। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পশ্চিম আফ্রিকায় প্রথমে আক্রান্ত হন এবং আক্রান্ত হয়ে ইউরোপ বা আমেরিকায় আসেন। প্রথমে ডাক্তাররা তা বুঝতে পারেন না। অথবা রোগীরা তাদের ভ্রমণসংক্রান্ত বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তা অবহিতও করেন না। টমাস ডানকান ও মিস রামোসের (স্পেন) ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে। কম উন্নত দেশে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা পর্যাপ্ত নয় কিংবা এ ধরনের রোগ নিয়ে গবেষণা কম হয়, প্রতিরোধের কোনো উপায় ও প্রস্তুতিও তেমন থাকে না। সেসব দেশে এসব রোগের বিস্তার ঘটে দ্রুত। বাংলাদেশকে নিয়ে তাই চিন্তার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। দ্বিতীয়ত, সাধারণত পশ্চিম আফ্রিকা থেকে যারা আসেন, তারাই এ রোগের জীবাণু বহন করেন। বাংলাদেশের সেনাসদস্যরা পশ্চিম আফ্রিকায় ছিলেন বা এখনও আছেন। তারা ফিরে আসছেন। ফলে তারা যে ইবোলার জীবাণু বহন করছেন না, তা নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। উপরন্তু বাংলাদেশে এখন অনেক বিদেশী কাজ করেন, বসবাস করেন, যারা পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক, অথবা ওই সব দেশ থেকে সরাসরি এসেছেন। ঢাকায় তাদের পরীক্ষা করা হয় না। অবিলম্বে হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরে একটি মনিটরিং সেন্টার স্থাপন করা উচিত। প্রাথমিকভাবে কোনো জ্বর নিয়ে কেউ আসছেন কিনা, তা পরীক্ষা করা জরুরি। লাখ লাখ বাংলাদেশী নাগরিক এখন বিদেশে কাজ করেন। বিদেশে পশ্চিম আফ্রিকার নাগরিকদের সঙ্গেও তাদের কাজ করতে হয়। এর ফলে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন এবং জীবাণুটি বহন করে দেশে আসতে পারেন। সুতরাং প্রাথমিক পরীক্ষাটা জরুরি। সাধারণত ইবোলা আক্রান্তদের খুব জ্বর হয় (প্রায় ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। তাদের বমি ও সর্দিজ্বর থাকে। ডাক্তাররা এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেন। টমাস ডানকানের ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছিল। তিনি লাইবেরিয়ার নাগরিক। ডালাসে তার বান্ধবী স্থায়ীভাবে বসবাস করত। তিনি বান্ধবীকে বিয়ে করার জন্যই এসেছিলেন। হাসপাতালে তিনি তথ্য গোপন করেছিলেন যে, তিনি তিন দিন আগে লাইবেরিয়া থেকে এসেছিলেন। তথ্য গোপন না করলে হয়তো তিনি বেঁচে যেতে পারতেন। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ তাকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আরও তিন দিন পর তাকে অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। ৮ অক্টোবর তিনি মারা যান। বাংলাদেশে সর্দি-কাশি অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। কোনো প্রবাসীর ক্ষেত্রে এ রকমটি হলে দ্রুত তার উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নেয়া প্রয়োজন। তৃতীয়ত, এ ধরনের ছোঁয়াচে রোগ আমাদের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিতে পারে। যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে, সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ধরনের ছোঁয়াচে রোগও দেশের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করতে পারে। হাজার হাজার নাগরিকের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এর আগে আমরা সার্স, এভিয়াস ইনফ্লুয়েঞ্জা, মার্স নামক ছোঁয়াচে রোগের কথা শুনেছি। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত রোগী বাংলাদেশে পাওয়া গেছে এমন খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। কাজেই আমরা একটা ঝুঁকির মাঝে রয়েছি। চতুর্থত, সন্ত্রাসীরা এ ধরনের রোগের জীবাণু সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে এবং হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে কোনো ধরনের যুদ্ধ ছাড়াই। ইসলামী জঙ্গিদের কাছে এ ধরনের জীবাণু অস্ত্র থাকতে পারে এবং তারা প্রয়োগ করে তা ব্যবহারও করতে পারে। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে আল কায়দা নতুন করে সংগঠিত হয়েছে। ফলে তারা ভবিষ্যতে এ জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে- এ ধরনের একটি আশংকাকে সামনে রেখে নীতিনির্ধারকদের প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত। পঞ্চমত, এ ধরনের রোগের কী চিকিৎসা দেয়া উচিত, কী প্রস্তুতি নেয়া উচিত ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের চিকিৎসকদের ধারণা কম। প্রয়োজনে আমরা বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে অথবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করতে পারি। অর্থাৎ ইবোলা সংক্রমিত হওয়ার ব্যাপারে আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি। ষষ্ঠত, শুধু বিমানবন্দর নয়, বরং সব সীমান্তে রেড অ্যালার্ট জারি করাটাও জরুরি। কারণ ভারতে ইবোলা আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে বলে সেখানকার সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশীরা সেখানে আছেন বিভিন্ন সূত্র ধরে। যে কোনো বাঙালি তাতে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করা সব ব্যক্তির স্ক্যানিং জরুরি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইবোলা নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে। একটি অভিবাসনবিরোধী তৎপরতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পত্রপত্রিকায় নানা সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এর মাঝে দুটি সংবাদ বেশ স্পর্শকাতর। প্রথমটিতে নাভারো নামের একটি কলেজে, যা ডালাসে অবস্থিত, দুজন নাইজেরীয় ছাত্রের ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ ওই দুই ছাত্রকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, ইবোলা আক্রান্ত কোনো দেশ থেকে কোনো ছাত্রকে ভর্তি করবে না তারা। দ্বিতীয় সংবাদটি আরও স্পর্শকাতর। মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে ব্যাপকভাবে ইবোলার সংবাদ প্রকাশ করার উদ্দেশ্য একটিই- আফ্রিকা থেকে অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে আগমন ও বসবাসের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে এ অভিবাসনের বিষয়টি অনেকটা সহজ এবং হাজার হাজার আফ্রিকার অভিবাসী প্রতিবছরই এখানে স্থায়ী হচ্ছেন, তাই আইন প্রণেতাদের ওপর একটা চাপ ও জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই হয়তো ইবোলার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। কট্টরপন্থী কনজারভেটিভরা যে আফ্রিকা ও এশিয়ার অভিবাসীদের বিরুদ্ধে, এর প্রমাণ আমরা একাধিকবার পেয়েছি। আফ্রো-আমেরিকানরা অর্থাৎ যাদের পূর্বপুরুষ আফ্রিকা থেকে এখানে দাস হিসেবে এসেছিলেন (মিসেস ওবামার পরিবারও দাস ছিলেন), তারা প্রায়ই শ্বেতাঙ্গদের টার্গেট হচ্ছেন। কদিন আগে ফার্গুসন শহরে এক কিশোর আফ্রো-আমেরিকান নাগরিককে গুলি করে হত্যার ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এ প্রবণতা যে থেমে গেছে, তা বলা যাবে না। তাই ইবোলা সংক্রমণের সঙ্গে এ ধরনের কোনো মানসিকতা কাজ করেছে কিনা, তা হুট করে বলা যাবে বা। ৯/১১-এর ঘটনার পর মুসলমানরা যেমন একটা আতংকের মাঝে থাকতেন, এখন ইবোলার ঘটনা আবিষ্কৃত হওয়ার পর আফ্রিকার নাগরিকরা সেরকম আতংকে থাকবেন, এটা বলাই যায়। আগামী দিনগুলোতে নাভারো কলেজের মতো আরও অনেক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় আফ্রিকা থেকে আবেদন করা ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করতে অপারগতা জানাবে, এটা নিশ্চিত। এ ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হল, অপ্রচলিত নিরাপত্তা ধারণাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের মতো স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এ অপ্রচলিত নিরাপত্তা ধারণাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। পানি, জলবায়ু পরিবর্তন, ব্যাপক নগরায়ণ ইত্যাদির পাশাপাশি যোগ হয়েছে ছোঁয়াচে রোগের বিস্তার। কিছু অসাধু ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে এ ধরনের জীবাণু ল্যাবরেটরিতে তৈরি করতে পারে এবং এর দ্বারা হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া সম্ভব। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ৯/১১-এর ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট বুশ জীবাণু অস্ত্রের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করেছিলেন। যদিও পরে এ ধরনের কোনো আক্রমণ হয়নি। এখন ডালাসে ইবোলা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর পর মিডিয়ায় নানা স্পেসেকুলেশন করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মাঝে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্কুলে কোনো শিশুর সামান্য জ্বর হলেই তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আফ্রিকান নাগরিকদের অন্য দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। এগুলো সবই সাম্প্রতিক ঘটনা। তবে এখানে গবেষণা হয়। এরা গবেষণা করে। সে সুযোগ আছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে গুরুত্ব দেয়া হয়। ফান্ডও আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের রোগ নিয়ে গবেষণা করার সম্ভাবনা কম। আমাদের আর্থিক ভিত্তিও দুর্বল। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এ ধরনের সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটলে সরকার হঠাৎ করেই সক্রিয় হয়, আবার কার্যক্রমে স্থবিরতা চলে আসে কিছুদিন পর। ইবোলা বিস্তারের হুমকির মুখে সরকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্ক্যানিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এতে খুব দ্রুতই স্থবিরতা এসে যাবে বলে আশংকা। অভিজ্ঞতা তাই বলে। এ ছোঁয়াচে রোগটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত এবং আইসিডিডিআরবিতে এ রোগ নিয়ে গবেষণার পরিধি আরও বাড়ানো উচিত। কানাডা বলেছে, তারা ইবোলা চিকিৎসার ওষুধ উদ্ভাবন করেছে। তবে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। ইবোলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে, আমরা তা পারব না বটে, তবে বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়াও ঠিক হবে না। ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র ২৫ অক্টোবর, ২০১৪ Daily Jugantor

বিতর্ক না হলেই ভালো হতো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক পিয়াস করিমের মৃতদেহ শহীদ মিনারে আনার অনুমতি দিল না। এটা ভালো হয়েছে, কী মন্দ হয়েছে আমি এই বিতর্কে যাব না। কিন্তু বাস্তবতা যা তা হচ্ছে পিয়াস করিমের মরদেহ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নিয়ে আসার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যা ঘটল, এই মার্কিন মুলুকে অবস্থান করে আমার তাতে কষ্টই বেড়েছে বেশি। এর কী আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? পিয়াস করিম বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো বুদ্ধিজীবী নন। এমনকি তিনি কোনো দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেননি। তার কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বা প্রকাশনা নেই, যাতে করে ৩ প্রজন্ম তা পড়ে বা তা ধারণ করে উপকৃত হতে পারে। তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, তাও মাত্র ৭-৮ বছর। ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মান জানাতে পারত। এমনকি ব্র্যাক সেন্টারেও তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া যেত। সেটাই বরং শোভন ছিল। এখন তার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে লেখালেখি, তার পিতার পরিচয় টেনে আনা কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে তিনি কী বলেছেন, তা উল্লেখ করাÑ এসবই আমাদের অসুস্থ মানসিকতার পরিচয়। তিনি যা মিডিয়ায় বলেছেন, তাও গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির সমালোচনা করতে নেই। জীবনাবসানের মধ্যে দিয়ে তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে যান। তাই কোনো মৃত ব্যক্তির অতীত ইতিহাস নিয়ে আমরা ঘাঁটাঘাঁটি করি না। কেননা তিনি তখন সমালোচনার ঊর্ধ্বে চলে যান। কিন্তু যখন পিয়াস করিমের বাবার স্বাধীনতা যুদ্ধের ভূমিকা টেনে আনা হলো, তখন আমাকে তা কষ্ট দিয়েছে। পিয়াস করিম নিশ্চয়ই তার বাবার পরিচয়ে পরিচিত হননি। কিংবা বাবার ভূমিকার জন্য আমরা তাকে দায়ীও করব না। এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, টক-শোর মাধ্যমেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ৭-৮ বছর আগে মানুষ তাকে চিনত না। এখন চেনে এবং তা মিডিয়ার কল্যাণেই। তিনি বিএনপির পক্ষে কথা বলতেন। বিএনপি সমর্থকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি যেতেন। তবে এক সময় মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক কমিটির সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। এমনও শোনা গেছে, ছাত্রাবস্থায় তিনি সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির সমর্থক ছিলেন। এসব নিয়ে আলোচনা এখন মূল্যহীন। একজন মানুষের অতীত পরিচয় থাকতেই পারে। সেই অতীত ভূমিকা বিতর্কিত ছিল কি না, এটা বর্তমানকে দিয়ে বিচার করা যাবে না। তার বর্তমান পরিচয়ই আসল। বর্তমানে তিনি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ধারণ করেছিলেন। এতেও দোষের কিছু ছিল না। এ দেশের লাখ লাখ মানুষ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ধারণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনেক শিক্ষকও এই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পেশাজীবীদের একটা অংশও এই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাই পিয়াস করিম এই রাজনীতি ধারণ করে কোনো অন্যায় করেননি। কিন্তু তার মৃত্যু ও মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে যা ঘটেছে, তা এখন অনেকগুলো প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এল। এক. এই জাতি যে কত ‘বিভক্ত’, তা আবারও প্রমাণিত হলো। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার কোনো কোনো বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে আহত করেছিল। ফলে ওই পক্ষের কাছে তিনি ‘বিতর্কিত’ ছিলেন। তাই তার মরদেহ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর সিদ্ধান্ত, একটি পক্ষের মনঃপূত হয়নি। এটাই স্বাভাবিক। এর মাঝে ‘রাজনীতি’ যে কাজ করেনি, তা বলা যাবে না। দুই. একটি প্রশ্ন উঠেছেÑ শহীদ মিনার তাহলে কার? শহীদ মিনারের দেখভাল, নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কী এই দায়িত্বটি সুষ্ঠুভাবে পালন করে? খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে শুধু ভাষা আন্দোলনের মাসটিতে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৎপর হয়। এরপর সারা বছর এদের তৎপরতা দেখা যায় না। বছরজুড়ে এখানে ভবঘুরে, দেহপসারিণী আর ভিক্ষুকদের ‘আশ্রয়স্থল’-এ পরিণত হয়। তখন দেখার কেউ থাকে না। এখন একজন পিয়াস করিমের মৃতদেহকে শ্রদ্ধা জানানোর প্রশ্নটি যখন এল, তখন আপত্তি তুলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তথাকথিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। এর পেছনে যে ‘যুক্তিই থাকুক না কেন, এটা একটা বাজে সিদ্ধান্ত হয়ে রইল। আগামীতে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যারা বরেণ্য ব্যক্তি, তবে সরকারবিরোধী, তাদের মৃত্যুর পর তাদের মরদেহ সম্মান জানানোর জন্য শহীদ মিনারে আনার কী অনুমতি দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ? তিন. কারা শহীদ মিনার ব্যবহার করতে পারবে, কাদের মৃতদেহ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা যাবে, সে ব্যাপারেই একটি নীতিমালা থাকা উচিত। না হলে বারবার আমরা এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হব এবং যারা সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত, তাদের মৃত্যুর পর শ্রদ্ধা জানানোর কোনো সুযোগ থাকবে না শহীদ মিনারে। চার. মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর স্থান শহীদ মিনার হতে পারে না। অন্য একটি উন্মুক্ত স্থান আমরা চিন্তা করতে পারি। শাহবাগ চত্বর একটি বিকল্প স্থান হতে পারে। চার. শহীদ মিনার এলাকাটির ব্যবস্থাপনা তদারকির জন্য একটি বিকল্প কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, এই এলাকাটিকে ঘিরে একটি ‘বলয়’ প্রতিষ্ঠা করা যায়, যেখানে ভাষা আন্দোলন শুধু নয়, ১৯৪৭-পরবর্তী প্রতিটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার ‘ইতিহাস’ সংরক্ষিত থাকবে। পাঁচ. অধ্যাপক পিয়াস করিমের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহের প্রতি সম্মান জানানো নিয়ে যা ঘটল, তাতে আমি নিজেই এখন থেকে আতঙ্কিত। আমি নিজেও চাই না আমার মৃত্যুর পর আমার মরদেহ শহীদ মিনার কিংবা আমার কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগরে নিয়ে যাওয়া হবে। এর কোনো প্রয়োজন নেই। ছয়. পিয়াস করিমের মৃত্যুর পর এখনো লেখালেখি চলছে। বিবৃতি চলছে। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। জীবদ্দশায় যিনি সম্মান পান না। মৃত্যুর পর তাকে সম্মান দেখানো অর্থহীন।
আমরা অনেক বিষয় নিয়ে এখনো বিতর্ক করছি। এ ধরনের বিতর্ক জাতি হিসেবে আমাদের সম্মানকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। চিরস্থায়ীভাবে এ ধরনের বিতর্কের অবসান হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। ৪৩ বছর পার করলাম এখনো যদি আমাদের শুনতে হয় কে মুক্তিযোদ্ধা, কে মুক্তিযোদ্ধা নন, এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। এই প্রশ্ন নিয়ে এত বছর পর জাতিকে বিভক্ত করাও ঠিক নয়। আমরা জানি কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। ইতিহাস তাদের ‘শাস্তি’ দিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম এই অপশক্তিকে ঘৃণা করে। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের উল্লাস এর বড় প্রমাণ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাতিকে বিভক্ত নয়, বরং বিরোধিতাকারীদের ঘৃণা করাই মঙ্গল। এই কাজটি সম্মিলিতভাবে করাই উচিত। আমাদের ব্যর্থতা আমরা এটা পারিনি। কিন্তু তাই বলে জাতিকে বিভক্ত কেন? দ্বিতীয়ত, বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়াটা জরুরি। এটাও আমরা পারিনি। তৃতীয়ত, রাজনীতির নতুন এক সংস্কৃতির আমরা জন্ম দিয়েছি। নির্বাচনে একটা বড় জনগোষ্ঠীর অংশ না থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন হয়েছে এবং সরকার সাংবিধানিকভাবে সরকার পরিচালনা করছে। এখানে ‘সকল দলের অংশগ্রহণের যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি’ তা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছি। এখানে কার ভুল বেশি, এটা নিয়ে আমরা এখনো বিতর্ক করছি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই একটা ভুল সিদ্ধান্ত হাজারটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্ম দিতে পারে। জাতির জন্য তা কখনো কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। আমরা টক-শোতে এই ভুলগুলো শোধরানোর কথা বলি। দেয়ালের লিখন থেকে শিখতে বলি। কিন্তু ইতিহাস থেকে, দেয়ালের লিখন থেকে কেউ কিছু শেখে না, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতার কারণেই জাতি হিসেবে আমরা আজ বিভক্ত। এই বিভক্তিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে পিয়াস করিমের মরদেহের প্রতি সম্মান জানানোর বিষয়ে। আজ যখন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে সময় কাঁটাতে এসেছি, তখন এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি আমাকে হতে হয়েছে। প্রতিবারই হয়। গেল বারও হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতির আদৌ পরিবর্তন হবে, এটা কেন জানি বিশ্বাস করতে পারছি না। তাহলে কি দেশ এভাবেই চলবে? একটা সম্ভাবনার দেশ ছিল আমাদের এই দেশটি। কিন্তু সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে পারছি না। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নতুন করে আবার তৈরি করা হচ্ছে। দিব্যি দিয়েই বলতে পারি যদি এই সরকারের পতন ঘটে কোনো একদিন, নয়া সরকার আবার নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের তালিকা তৈরি করবে! শিক্ষামন্ত্রী যতই ‘বড় কথা’ বলেন না কেন, জিপিএ ৫ এবং সংখ্যা বাড়িয়ে যে শিক্ষার মানের উন্নতি করা যায় না, এটা নিশ্চয়ই তিনি উপলব্ধি করেন। হয়তো রাজনৈতিক কারণেই বলতে পারেন না প্রকাশ্যে। যখন তিনি বলেন, ‘অতীতে শিক্ষার কোনো মান ছিল না’, তখন তার জন্য আমার কষ্ট হয়। একজন শিক্ষামন্ত্রী এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। এভাবে বাহবা নেওয়া যায় না। ইদানীং তার নানা বক্তব্য তাকে বিতর্কিত করেছে। উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমি হতাশাগ্রস্ত। এখানে এসে দেখলাম সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কলেজগুলোকে আবার বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করার। এটিও একটি ভুল সিদ্ধান্ত। ইডেন বা ঢাকা কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে? কারা সেখানে পড়াবে? যেখানে নিয়মিত কাস হয় না, সেখানে শিক্ষার মানের উন্নতি হবে কীভাবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একখানা সার্টিফিকেট দিয়ে আমরা এতে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে কী এক ধরনের প্রতারণা (২) করব না? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ ভালো। এ জন্য সাতটি বিভাগীয় শহরে নতুন করে সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায়। জগন্নাথ কলেজকে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা যায়, তাহলে ঢাকা বা ইডেন কলেজকে সামনে রেখে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব। তবে আলাদা একটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় (ইডেন কলেজ থেকে অনেক সময় এ দাবি উঠেছে) প্রতিষ্ঠা করার দাবি অযৌক্তিক। একুশ শতকে এসে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে বিভক্তিকে সমর্থন করা যায় না। যদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হয়, তাহলে বিভাগীয় শহরে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেখানকার কলেজগুলোকে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর এ দিকে দৃষ্টি নেই। তার দৃষ্টি জিপিএ ৫ সংখ্যা বাড়ানো। এখানেও রাজনৈতিক মানসিকতা কাজ করছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও আমাদের মধ্যে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখানেও বিভক্তি লক্ষ করা যায়। আজ যখন দেখি শহীদ মিনারে পুলিশ, যখন শ্রদ্ধা জানানোকে কেন্দ্র করে দুটি পক্ষ তৈরি হয়ে গেছে, তখন এসব প্রশ্ন এসে ভিড় করে আমাদের মনে। ছোট্ট একটি ঘটনাকে এখন সরকার সমর্থকরা ‘বড়’ করল। সৃষ্টি হল বিতর্কের। আর এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ল বড় দল দুটি। কী দুর্ভাগ্য এ জাতির! বিএনপির নেতারাও হুমকি দিলেন পিয়াস করিমের মরদেহটি শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার। এ ধরনের বক্তব্য কী যুক্তিসঙ্গত? যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন, কোনো রাষ্ট্রীয় পদকে যিনি ভূষিত হননি, মুক্তিযুদ্ধেও যার অবদান নেই, তার মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের এই আপত্তির ব্যাপারে সমর্থন রয়েছে প্রশাসনের। এই বিষয়টি অন্যভাবেও ‘সমাধান’ করা যেত। কিংবা বিএনপি তার প্রতি সম্মান জানানোর জন্য পল্টনে বিএনপির অফিসের সম্মুখের স্থানটি বেছে নিতে পারত। তাতে বিতর্ক কম হতো। এখন এটা অনেকটা জেদাজেদির পর্যায়ে চলে গেছে। রাজনীতিতে যে অস্থিরতা রয়েছে, এই ঘটনায় এটা একটা বড় প্রমাণ। বিএনপি সুযোগ খুঁজছে আন্দোলনে যাওয়ার। সরকারের উচিত হবে না ‘রাজনীতির বলটি’ বিএনপির হাতে তুলে দেওয়ার। আরও অনেক ইস্যু রয়েছে। সরকার সেদিকে নজর দিক। মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথাও সরকার ভাবতে পারে। পিয়াস করিমের মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ঘটনা নিয়ে যা ঘটল, তা দুঃখজনক ও অনাকাক্সিক্ষত। এ ঘটনা এখানেই শেষ হোকÑ বিদেশ থেকে এটাই প্রত্যাশা করি। ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র Daily Amader Somoy 20.10.14

মোদির ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি

ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অতিসম্প্রতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করার মতো। এক. চীনের প্রেসিডেন্ট শিজেন পিং-এর ভারত সফর এবং দুই. প্রধানমন্ত্রী মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য দুটি ঘটনাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বটি আরো বেড়েছে যখন যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে এক নম্বরে অবস্থান নিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা অনেক দিন থেকেই বলে আসছেন একুশ শতকে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হবে এশিয়া। এশিয়ার তিনটি দেশ চীন, ভারত ও জাপানের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ভর করবে। এমনি এক পরিস্থিতিতে খোদ চীনা প্রেসিডেন্ট ভারতে আসেন, তখন বুুঝতে হবে চীন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। এখন ভারত চীনের সঙ্গে এই সম্পর্ককে কিভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে? কিংবা ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার কৌশলগত সামরিক সম্পর্ককে পাশ কাটিয়ে কি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেবে? এখানে মোদির ‘এপ্রোচ’ দেখে বোঝা যায় ভারত দুটি বড় শক্তির ব্যাপারে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থান গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ ভারত চীনকে বাদ দিয়ে যেমনি যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, ঠিক তেমনি যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘সাইড লাইন’ এ ঠেলে দিচ্ছে না। উভয় দেশের সঙ্গেই সম্পর্কের প্রশ্নে ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। মোদি নিজে একটি বিনিয়োগবান্ধব অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। তিনি চীনের যেমনি বিনিয়োগ চান, তেমনি চান মার্কিনি বিনিয়োগও। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পারমাণবিক প্রযুক্তি হস্তান্তর ও ‘গ্রিন এনার্জি’র সম্প্রসারণের ব্যাপারে মোদির স্বার্থ অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে মোদির মতো ওবামাও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেন। এই প্রেক্ষাপটে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দুটি দেশের সম্পর্কের বিষয়ে নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছে। হংকংয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ে চীনা নেতারা এক ধরনের অস্বস্তিতে আছেন। এটা এখন প্রমাণিত যে, যুক্তরাষ্ট্র এই আন্দোলনের পেছনে মদত দিচ্ছে। ফলে আগামীতে চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সে ব্যাপারে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। চীনে সরকারের পতন ঘটানো কিংবা চীনে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মার্কিনি উদ্যোগের ব্যাপারে মোদি সরকার কতটুকু সায় দেবেন, এদিকেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। ফলে এই তিন সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ কিছুদিন ধরেই পর্যবেক্ষণ তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের মাঝে আলোচিত হতে থাকবে। উভয় শক্তির মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে ভারতের স্বার্থ মোদি কতটুকু রক্ষা করতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়। ভুলে গেলে চলবে না, ভারত ও চীন উভয়ই ‘ব্রিকস’র সদস্য। ‘ব্রিকস’ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে একটি ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার, যা ২০১৬ সাল থেকে কাজ শুরু করার কথা। উপরন্তু চীন নতুন করে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের সময় একই সময় তিনি মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাও সফর করেছেন। এই দুটি দেশে বিপুল চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের পাকিস্তানেও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি পাকিস্তানে যাননি বটে, কিন্তু চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও চীন সফর করে এসেছেন। এমতাবস্থায় এটা বোঝা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা স্বার্থ বাড়ছে। ওয়াশিংটন এটা যে বোঝে না তা নয়। এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে হলে ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটনের ‘দূরত্ব’ কমাতে হবে। ওবামা প্রশাসনের কাছে মোদির গুরুত্ব তাই অনেক বেশি। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে একজন নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিয়েছেন। ২০১৪ সালের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা থাকলেও নয়া আফগান প্রেসিডেন্ট নতুন একটি নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় আরো বেশ কিছুদিনের জন্য মার্কিন সৈন্য রাখতে চান। এ ধরনের একটি চুক্তি করতে বিগত আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এখন একটি নয়া নিরাপত্তা চুক্তি ও সম্ভাব্য একটি ভারতীয় ভূমিকা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হবে। এটা অনেকেই জানেন যে, ওবামা প্রশাসন চাচ্ছে ভারত আফগানিস্তানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। আফগানিস্তানের আবকাঠামো উন্নয়নে কিংবা শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে ভারতের বড় ভূমিকা রয়েছে। যত দূর জানা যায়, আফগানিস্তানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটিও রয়েছে। এখন মোদি মার্কিনি স্বার্থ রক্ষা করে আফগানিস্তানের ব্যাপারে আরো বড় কোনো কর্মসূচি নেন কি-না, সেটাই দেখার বিষয়।
ফলে ওয়াশিংটনে মোদি-ওবামা শীর্ষ বৈঠক যে অনেকের কাছেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এই বৈঠক কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে, এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রতিরক্ষা খাতে ১০ বছর মেয়াদি যে সহযোগিতা চুক্তি তার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। দু’দেশের স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত। সমুদ্র নিরাপত্তার ব্যাপারে দু’দেশের মনোভাব এক ও অভিন্ন। এ ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে, সে ব্যাপারেও চুক্তি হয়েছে। আজমির, আহমেদাবাদ শহর আর ভিজাগাপট্রস সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করবে। সে সঙ্গে ভারতের ছোট ৫০০ শহরে ‘সোলার এনার্জি’ চালু করবে যুক্তরাষ্ট্র। বেসরকারি খাতে এখানে বিনিয়োগ বাড়বে। সন্ত্রাস দমনেরও দু’দেশের মনোভাব এক। লস্কার-ই তৈয়্যেবা, জইস-ই মোহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়নের ব্যাপারটি গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। এসব জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়ন বন্ধে দু’দেশ কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে। বেসরকারি খাতে পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ব্যাপারেও দু’দেশ নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে কোনো কোনো ইস্যুতে ভারতের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেনি ওবামা প্রশাসন। বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’র আগ্রাসন রোধে ১৫ দেশীয় যে আন্তর্জাতিক একটি এলায়েন্স গঠিত হয়েছে, ওবামা প্রশাসন চেয়েছিল ভারত সেই এলায়েন্সে যোগ দিক। কিন্তু ভারত তাতে রাজি হয়নি। যদিও খোদ ভারতের নিরাপত্তাও আজ ঝুঁকির মুখে। আল কায়দার উপমহাদেশীয় শাখা গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে এই শাখার আওতায় আনা হয়েছে। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে যে আরো ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’র উত্থান ও আরব দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন গঠিত হলেও ভারত তাতে যোগ না দেয়ায় নিশ্চয়ই নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। ভারত আরব রাষ্ট্র নয়। তবে ভারতে মুসলমান ধর্মাবলম্বীর এক বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। মুসলমানদের সঙ্গে মোদি সরকারের সম্পর্ক ভালো, তা বলা যাবে না। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় মোদি নিজে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ওই দাঙ্গায় প্রায় এক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন, যার অধিকাংশই মুসলমান। মার্কিনি চাপ উপেক্ষা করে যে কোনো আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দিয়ে মোদি সম্ভবত একটি মেসেজ দিতে চেয়েছেন আর তা হচ্ছে আইএসের (ইসলামিক স্টেট) বিষয়টি আরব বিশ্বের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত কোনো অংশ হতে পারে না। উপরন্তু এতে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে একটি ভিন্ন বার্তা পৌঁছে যেতে পারে। ভারত এ ক্ষেত্রে একটি ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানই গ্রহণ করেছে। ভারতের এই ভূমিকাকে অনেকেই সমর্থন করবেন। ভারত যে মার্কিনি স্বার্থে সবসময় কাজ করে না, এটা আবারো প্রমাণিত হলো। ভারতের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়। শুধু জঙ্গি দমনে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দেয়ার পাশাপাশি, একটি যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ও টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তির ব্যাপারেও মোদি কোনো ‘কমিটমেন্ট’ করেননি। মুক্তবাণিজ্য আলোচনা নিয়ে আরো আলোচনা প্রয়োজন-এমন অভিমত ভারতের নীতি-নির্ধারকদের। অন্যদিকে টিপিপি চুক্তি নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের সঙ্গেই এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। তবে কোনো চূড়ান্ত চুক্তিতে এখনো উপনীত হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। টিপিটিতে ভারতের অংশগ্রহণ না থাকা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। কেননা এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে, এতে ভারতের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এটা নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। মোদি নিজে এই সময়কে একটি ‘নতুন ডাইমেনশন’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এটা সত্য ২০০৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ওয়াশিংটন সফরের সময় তার ওই সফর যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছিল মোদির এই সফর তুলনামূলক বিচারে কম গুরুত্ব পেয়েছে। তবে মোদিকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ওবামা এই মেসেজটি দিতে চেয়েছেন যে, তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে চান। অন্যদিকে হংকংয়ে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন চীনের জন্য একটি বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনা ঘটল এমন এক সময়, যখন বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন এখন এক নম্বর শক্তি। চীনের অর্থনীতি এখন ১৭ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের। এই অর্থনীতি যে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে, এটা সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু এতে চীনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবি কি কমে আসবে? আজ যখন হংকংয়ে আরো বেশি গণতন্ত্রের দাবি উঠেছে, তখন চীনেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিও জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। বিল ক্লিনটন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তিনি ১৯৯৭ সালে হংকংয়ে এসে একটি মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন জীবদ্দশায় চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এটা তিনি দেখে যেতে চান। চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এ ধরনের স্বপ্ন কেউ কেউ দেখেন বটে, কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। চীনের সমাজ ব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যর সঙ্গে পশ্চিমা সমাজের কোনো মিল নেই। ফলে চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, পশ্চিমা সমাজের কারো কারো এই চিন্তাধারা নিয়ে প্রশ্নই থেকে যাবে শুধু। অতিসম্প্রতি হংকংয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন যখন গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে, তখন নতুন করে চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি আবারো উঠল। কিন্তু যে প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা অনেকেই করেন না, তা হচ্ছে হংকং আর চীন এক নয়। হংকং তার পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামো নিয়েই চীনের সঙ্গে একত্রিত হয়েছিল। আর চীন বিশ্ব রাজনীতিতে ১৯৪৯ সালে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ২০১৪ সালে এসে চীনকে আর পুরোপুরি একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যাবে না। সেখানে সমাজতন্ত্র আর বাজার অর্থনীতির সমন্বয়ে নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। আর পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র বোধকরি হংকংয়ের সমস্যার কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারবে না। সুতরাং হংকংয়ের এই আন্দোলন কি আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে চীনের ওপর? গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে আমরা যা বুঝি, সেই সংস্কৃতি হংকংয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। চীনা নেতৃত্ব এটা মানবে না। কেননা এতে চীনের অন্যান্য অঞ্চলে এই আন্দোলনের প্রভাব পড়তে পারে। তবে ২০১৭ সালে হংকংয়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যাপারে আরো কিছুটা ছাড় দিতে পারে চীন।  প্রার্থীদের যে তালিকা চীন অনুমোদন করবে, সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। হংকংয়ের বিকল্প হিসেবে সাংহাই, শেনঝেন কিংবা গুয়াংঝো এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। হংকংয়ের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন আর সাধারণ চীনাদের আকৃষ্ট করে না; বরং শেনঝেন কিংবা গুয়াংঝোর মতো এলাকায় ‘নতুন অর্থনৈতিক জোন’ গঠিত হয়েছে, যেখানে জীবনযাত্রায় একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। মানুষের আয় বেড়েছে। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, চীনা নেতৃত্ব চীনের অর্থনীতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে চীনের অর্থনীতিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। ২০৫০ সালের মধ্যেই চীন হবে বিশ্বের একমাত্র বড় অর্থনীতি। ফলে সব ধরনের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে চীনা নেতৃত্ব সজাগ রয়েছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং অত্যন্ত প্রাগমেটিক। তিনি চীনা অর্থনীতিকে আরো উন্মুক্ত করে দেবেন। জাতীয় স্বার্থকে তিনি গুরুত্ব দেবেন। একটি ‘মার্কিনি ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে তিনি ও তার পলিট ব্যুরোর সদস্যরা সচেতন। চীনা অর্থনৈতিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তি করতে চাচ্ছে, তাতে চীনকে রাখা হয়নি। এটা চীনবিরোধী একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে। চীনা নেতৃত্ব এটা বোঝেন। তাই চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে জন্ম হতে যাচ্ছে একটি ‘নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’, যা পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আঘাত করবে। জন্ম দেবে বিকল্প একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার।এ লক্ষ্যেই ২০১৬ সালে ব্রিকস ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। তাই হংকংয়ের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে পরোক্ষভাবে চীনা নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল, এটা চীনা নেতারা উপলব্ধি করেছেন। চীনে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র বিনির্মাণ সম্ভব নয়। চীন গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্তও নয়। চীনে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চীনা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সেখানেই লুক্কায়িত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন চাচ্ছে চীনও একাধিক চীনা রাষ্ট্রে বিভক্ত হোক। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনা সেনাবাহিনী এখনো পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। চীনা সেনাবাহিনী এখনো পার্টির নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল। ফলে চীনে হংকংয়ের মতো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে অদূর ভবিষ্যতে চীনে একটি ‘সিঙ্গাপুর মডেল’র জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। চীন এখন আর ধ্রুপদি মার্কসবাদ দ্বারা পরিচালিত হয় না। তারা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত খাতের বিকাশ ঘটিয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ নামে নতুন এক অর্থনীতি চালু করেছে। এর ফলও তারা পেয়েছে। চীন এখন বিশ্বের বড় অর্থনীতি। সুতরাং হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন হংকংয়ের ব্যাপারে চীনা নীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।মোদি সরকার এ বিষয়টি বোঝে। তাই এই সরকার চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ভারত উভয় শক্তির সঙ্গেই একটি ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বাজায় রাখছে। এখানেই ভারতের স্বার্থ নিহিত। অদূর ভবিষ্যতে ‘চীনকে ঘিরে ফেলার’ কোনো মার্কিনি পরিকল্পনায় ভারত কোনো অংশ হবে না এটাই কাম্য। মোদির মূল টার্গেট হচ্ছে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আর এ জন্য তার যেমনি প্রয়োজন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার, ঠিক তেমনি তার প্রয়োজন রয়েছে চীনা বিনিয়োগ। তাই মোদি এক ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছেন। ১২ অক্টোবর, ২০১৪; ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে Daily Manonkontho 16 October 2014

ওবামা-মোদি বৈঠকের বার্তাটি কী

সম্প্রতি ওয়াশিংটনে মোদি-ওবামা বৈঠকের পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এই আলোচনা ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবে? ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এটা ছিল প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর। একসময় যে মোদি যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ছিলেন, ওবামা প্রশাসন তাকে ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। মোদি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে একটা মেসেজ অন্তত দিতে চেয়েছেন যে, তিনি অতীতকে ভুলে সামনে তাকাতে চান। মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই সঙ্গত কারণেই তিনি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে আগামী দিনে এ সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। কারণ এই সম্পর্কোন্নয়নের সঙ্গে অনেক প্রশ্ন জড়িত। এক. ভারত-চীন সম্পর্ক নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। বিশেষ করে চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফর এবং আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে মোদি নিজে উপস্থিত থেকে চীনা প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে এটা নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি দেশজুড়েই ব্যাপক চীনা বিনিয়োগ চান। চীনা প্রেসিডেন্ট তাকে সেই আশ্বাসই দিয়ে গেছেন। এখন ভারতে চীনা স্বার্থের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব দেখা দেয় কি-না, সেটা দেখার বিষয়।দুই. রাজনৈতিকভাবে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন কর্তৃত্ব বাড়ছে। ২০১৯ সালের মধ্যে এ অঞ্চলে ছয়টি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এক সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য, চীনকে ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলা। চীনে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটানো মূল লক্ষ্য। চীনকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতেই হবে। মোদিকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানানোর পেছনে কাজ করছে এই মানসিকতা। ফলে মোদি ওয়াশিংটনের এই পরিকল্পনায় কতটুকু সায় দেবেন, তা ভবিষ্যতের ব্যাপার। একদিকে চীন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, উভয় শক্তির মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে ভারতের স্বার্থ মোদি কতটুকু রক্ষা করতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়। ভুলে গেলে চলবে না, ভারত ও চীন উভয়ই ব্রিকস সদস্য। ব্রিকস সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে একটি ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার, যা ২০১৬ সাল থেকে কাজ শুরু করার কথা। উপরন্তু চীন নতুন করে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্ট ভারত সফরের সময় মালদ্বীপ ও শ্রীলংকাও সফর করেছেন। এই দুটি দেশে বিপুল চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের পাকিস্তানেও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি সেদেশে যাননি বটে, কিন্তু চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও চীন সফর করে এসেছেন। এ অবস্থায় এটা বোঝা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা স্বার্থ বাড়ছে। ওয়াশিংটন এটা যে বোঝে না, তা নয়। এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে হলে ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটনের দূরত্ব কমাতে হবে। ওবামা প্রশাসনের কাছে মোদির গুরুত্ব তাই অনেক বেশি।তিন. আফগানিস্তানে একজন নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিয়েছেন। ২০১৪ সালের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা থাকলেও নয়া আফগান প্রেসিডেন্ট নতুন একটি নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় আরও বেশকিছু দিনের জন্য মার্কিন সৈন্য রাখতে চান। এ ধরনের একটি চুক্তি করতে বিগত আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এখন একটি নয়া নিরাপত্তা চুক্তি ও সম্ভাব্য ভারতীয় ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা হবে। অনেকেই জানেন, ওবামা প্রশাসন চাচ্ছেন ভারত আফগানিস্তানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। আফগানিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়নে কিংবা শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে ভারতের বড় ভূমিকা রয়েছে। যতদূর জানা যায়, আফগানিস্তানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটিও রয়েছে। এখন মোদি মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করে আফগানিস্তানের ব্যাপারে আরও বড় কোনো কর্মসূচি নেন কি-না, সেটাই দেখার বিষয়। কাজেই ওয়াশিংটনে মোদি-ওবামা বৈঠক যে নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এ বৈঠক কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। দুদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে ১০ বছর মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। উভয়ের স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত। সমুদ্র নিরাপত্তার ব্যাপারে দুই দেশের মনোভাব অভিন্ন। এ ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে, সে ব্যাপারেও চুক্তি হয়েছে। আজমির, আহমেদাবাদ শহর আর বিশাখাপত্তম সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করবে। সেই সঙ্গে ভারতের ৫০০ ছোট শহরে সোলার এনার্জি চালু করবে যুক্তরাষ্ট্র। সন্ত্রাস দমনেও দুই দেশের মনোভাব এক। লস্কর ই তৈয়্যেবা, জইশ-ই-মোহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়নের ব্যাপারটি গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। এসব জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়ন বন্ধে দুই দেশ কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। বেসরকারি খাতে পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ব্যাপারেও দুই দেশ নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে কোনো কোনো ইস্যুতে ভারতের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেনি ওবামা প্রশাসন। বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট-এর আগ্রাসন রোধে ১৫ দেশীয় যে আন্তর্জাতিক অ্যালায়েন্স গঠিত হয়েছে, ওবামা প্রশাসন চেয়েছিল ভারত তাতে যোগ দিক। কিন্তু ভারত রাজি হয়নি। যদিও খোদ ভারতের নিরাপত্তাও আজ ঝুঁকির মুখে। আল কায়দার উপমহাদেশীয় শাখা গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে এ শাখার আওতায় আনা হয়েছে। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে যে আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর উত্থান ও আরব দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন গঠিত হলেও ভারত এতে যোগ না দেয়ায় নিশ্চয়ই তা নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। ভারত আরব রাষ্ট্র নয়। তবে ভারতে মুসলমান ধর্মাবলম্বী এক বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। মুসলমানদের সঙ্গে মোদি সরকারের সম্পর্ক ভালো, তা বলা যাবে না। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় মোদি নিজে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ওই দাঙ্গায় প্রায় ১ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন, যার অধিকাংশই ছিল মুসলমান। মার্কিন চাপ উপেক্ষা করে কোনো আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দিয়ে মোদি সম্ভবত একটি মেসেজ দিতে চেয়েছেন- আর তা হচ্ছে, আইএসের বিষয়টি আরব বিশ্বের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত কোনো অংশ হতে পারে না। উপরন্তু এতে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে একটি ভিন্ন বার্তা পৌঁছতে পারে। ভারত এ ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ অবস্থানই গ্রহণ করেছে। ভারতের এ ভূমিকাকে অনেকেই সমর্থন করবেন। ভারত যে মার্কিন স্বার্থে সবসময় কাজ করে না, এটা আবারও প্রমাণিত হল। ভারতের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়। জঙ্গি দমনে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দেয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মুক্ত বাণিজ্য তথা টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তির ব্যাপারে মোদি কোনো কমিটমেন্ট করেননি। মুক্ত বাণিজ্য আলোচনা নিয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন- এমন অভিমত ভারতের নীতিনির্ধারকদের। অন্যদিকে টিপিপি চুক্তি নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের সঙ্গেই এ চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। তবে কোনো চূড়ান্ত চুক্তিতে এখনও উপনীত হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। টিপিপিতে ভাতের অংশগ্রহণ না থাকা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। কারণ এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তাতে ভারতের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এ নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। মোদি নিজে এই সফরকে একটি নতুন ডাইমেনশন হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এটা সত্য, ২০০৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ওয়াশিংটন সফরের সময় তার ওই সফর যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছিল, মোদির এই সফর তুলনামূলক বিচারে তেমন গুরুত্ব পায়নি। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, মনমোহন সিংয়ের জন্য ওবামা যে ডিনারের আয়োজন করেছিলেন, তাতে আমন্ত্রিত অতিথির সংখ্যা ছিল ৩০০ আর তাতে খরচ হয়েছিল ৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার। অথচ মোদির সম্মানে যে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন মাত্র ২০ জন। মোদি নিজে উপস্থিত থেকে ডিনারে অংশ নেননি। তিনি তখন উপবাসে ছিলেন। হিন্দু শাস্ত্রে এই উপবাসকে বলা নয় নবরাত্রি। আরও একটি কারণে মোদির সফর কিছুটা কলংকিত হয়েছে। মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রাক্কালে নিউইয়র্কের একটি কোর্ট ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে একটি সমন জারি করে। তাকে ২১ দিনের একটি সময়সীমা দেয়া হয় জবাব দেয়ার জন্য। কোর্টের এই সমন তার যুক্তরাষ্ট্র সফরকে স্থগিত করতে পারেনি সত্য, তবে তা মার্কিন সমাজে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেনি। মার্কিন মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে সোচ্চার। ভবিষ্যতে কোনো মার্কিন আইনপ্রণেতা এই গণহত্যা নিয়ে যে প্রশ্ন তুলবেন না, এটা বলা যাবে না। মার্কিন বিচার বিভাগ স্বাধীন। তারা যে কোনো দেশের সরকারপ্রধানের বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। এতে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব পড়ে না এটা সত্য, তবে দেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম দেয় বৈকি! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারত একটি বিশাল বাজার। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ২০১০ সালে ওবামা যখন ভারত সফরে এসেছিলেন, তখন এক বিশাল বাণিজ্য প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে ছিল। ভারত এখন বিশ্বের তৃতীয় অথবা চতুর্থ বড় অর্থনীতির দেশ। সেখানে রয়েছে বিশাল এক মধ্যবিত্ত শ্রেণী। মার্কিন ব্যবসায়ীদের জন্য তাই রয়েছে বিশাল এক সম্ভাবনা। তেল ও গ্যাস সেক্টরে সম্ভাবনা বাড়ছে। ভারতে এনার্জি চাহিদা বাড়ছে শিল্পায়নের কারণে। মোদি নিজে শিল্পায়নের পক্ষে। তিনি গুজরাট মডেলকে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে চান। ফলে তার বিনিয়োগ দরকার। সুতরাং ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যে আগামীতে নতুন একটি মাত্রা পাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারতের বাজারে প্রবেশ করা যে খুব সহজ হবে, তা বলা যাবে না। এরই মধ্যে ভারতের দিকে চোখ পড়েছে চীনাদের। চীনারাও বিপুল বিনিয়োগ নিয়ে আসছেন। তাই একদিকে ভারত-চীন সম্পর্ক যেমন আলোচিত হতে থাকবে, তেমনি আলোচিত হতে থাকবে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কও। এতে করে ভারত নিজে কতটুকু উপকৃত হয়, সেটাই দেখার বিষয়। ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে Daily Jugantor 15.10.14

এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ঐতিহাসিক ভারত সফরের পর একটি 'ম্যারিটাইম সিল্ক রুট'-এর যে কথা তিনি বলেছেন, তাতে আগামী দিনে চীনের স্বার্থের সঙ্গে ভারতীয় স্বার্থ একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। কেননা মোদি সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে যে 'ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোর'-এর কথা বলেছেন, তার সঙ্গে চীনের প্রস্তাবিত 'ম্যারিটাইম সিল্ক রুট'-এর কোনো অমিল নেই। চীনের প্রেসিডেন্ট ভারত সফরের পাশাপাশি মালদ্বীপ ও শ্রীলংকাও সফর করেন। এসব সফরের মধ্যদিয়ে একটা মেসেজ চীনা নেতারা দিলেন যে চীন দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিচ্ছে। চীন এই সম্পর্ককে ভারতীয় মহাসাগরের ব্যাপারে তার স্বার্থকে এক করে দেখতে চায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন একটি 'মুক্তার মালা' নীতি গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সামুদ্রিক বন্দরগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় একত্রিত করেছে। আর এটাকেই তারা বলছে মুক্তার মালা নীতি। চীনা নেতারা এটা বোঝেন যে ভারতীয় মহাসাগর তথা প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি হবে এই অঞ্চল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশাল এক মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। চীন এই অঞ্চলে কর্তৃত্ব করতে চায়। এটাই হচ্ছে চীনের নয়া সিল্ক রুট, ম্যারিটাইম বা বাণিজ্যিক সিল্ক রুট। অন্যদিকে এ অঞ্চলের ব্যাপারে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থ রয়েছে। মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ওবামার সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে তিনি একটি 'ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনিক করিডোর'-এর কথা বলেছেন। এর সঙ্গে বাহ্যত চীন প্রস্তাবিত 'ম্যারিটাইম সিল্ক রুট'-এর কোনো পার্থক্য নেই। চীন ও ভারত উভয়েই এশিয়ার উঠতি শক্তি। মোদি নিজে একদিকে চীন, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে তার পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনা করছেন। ফলে তার যুক্তরাষ্ট্র সফর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই তিন সরকারের (চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র) মধ্যকার সম্পর্ক দেখা কিছুদিন ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের মধ্যে আলোচিত হতে থাকবে। একদিকে চীন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র উভয় শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে ভারতের স্বার্থ মোদি কতটুকু রক্ষা করতে পারবেন সেটাই দেখার বিষয়। ভুলে গেলে চলবে না, ভারত ও চীন উভয়ই 'ব্রিকস'-এর সদস্য। 'ব্রিকস' সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে একটি ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার, যা ২০১৬ সাল থেকে কাজ শুরু করার কথা। উপরন্তু চীন নতুন করে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের সময় একই সময় তিনি মালদ্বীপ ও শ্রীলংকাও সফর করেছেন। এই দুটো দেশে বিপুল চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের পাকিস্তানেও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি পাকিস্তানে যাননি বটে। কিন্তু চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও চীন সফর করে এসেছেন। এমতাবস্থায় এটা বোঝা যায় যে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা স্বার্থ বাড়ছে। ওয়াশিংটন এটা যে বোঝে না, তা নয়। এ অঞ্চল তার প্রভাব বাড়াতে হলে ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটনের 'দূরত্ব' কমাতে হবে। ওবামা প্রশাসনের কাছে মোদির গুরুত্ব তাই অনেক বেশি। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে একজন নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিয়েছেন। ২০১৪ সালের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা থাকলেও, নয়া আফগান প্রেসিডেন্ট নতুন একটি নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় আরো বেশ কিছুদিনের জন্য মার্কিনী সৈন্য রাখতে চান। এ ধরনের একটি চুক্তি করতে বিগত আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এখন একটি নয়া নিরাপত্তা চুক্তি ও সম্ভাব্য একটি ভারতীয় ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা হবে এটা অনেকেই জানেন যে ওবামা প্রশাসন চাচ্ছেন ভারত আফগানিস্তানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। আফগানিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়নে কিংবা শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে ভারতের বড় ভূমিকা রয়েছে। যতদূর জানা যায়, আফগানিস্তানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটিও রয়েছে। এখন মোদি মার্কিনী স্বার্থ রক্ষা করে আফগানিস্তানের ব্যাপারে আরো বড় কোনো কর্মসূচি নেন কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। ফলে ওয়াশিংটনে মোদি-ওবামা শীর্ষ বৈঠক যে তাদের কাছেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এই বৈঠক কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে, এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রতিরক্ষা খাতে ১০ বছরমেয়াদি যে সহযোগিতা চুক্তি তার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। দু'দেশের স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত। সমুদ্র নিরাপত্তার ব্যাপারে দু'দেশের মনোভাব এক ও অভিন্ন। এ ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে। সে ব্যাপারেও চুক্তি হয়েছে। আজমির, আহমেদাবাদ শহর আর ভিজাগাপট্টম সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করবে, সেই সঙ্গে ভারতের ছোট ছোট ৫০০ শহরে 'সোলার অ্যানার্জি' চালু করবে যুক্তরাষ্ট্র। বেসরকারি খাতে এখানে বিনিয়োগ বাড়বে। সন্ত্রাস দমনেও দু'দেশের মনোভাব এক। লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশই মোহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়নের ব্যাপারটি গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। এসব জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়ন বন্ধে দু'দেশ কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। বেসরকারি খাতে পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ব্যাপারেও দু'দেশে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে কোনো কোনো ইস্যুতে ভারতের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেনি ওবামা প্রশাসন। বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী 'ইসলামিক স্টেট'-এর অগ্রসর রোধে ১৫ দেশীয় যে আন্তর্জাতিক একটি এলায়েন্স গঠিত হয়েছে। ওবামা প্রশাসন চেয়েছিল ভারত সেই এলায়েন্সে যোগ দিক। কিন্তু ভারত তাতে রাজি হয়নি। যদিও খোদ ভারতের নিরাপত্তাও আজ ঝুঁকির মুখে। আল-কায়েদার উপমহাদেশীয় শাখা গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে এই শাখার আওতায় আনা হয়েছে। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে যে আরো ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে সুন্নী জঙ্গিগোষ্ঠী 'ইসলামিক স্টেট'-এর উত্থান ও আরব দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন গঠিত হলেও ভারত এতে যোগ না দেয়ায় নিশ্চয়ই নানার প্রশ্নের জন্ম দেবে। ভারত আরব রাষ্ট্র নয়। তবে ভারতে মুসলমান ধর্মাবলম্বী এক বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। মুসলমানদের সঙ্গে মোদি সরকারের সম্পর্ক ভালো তা বলা যাবে না। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় মোদি নিজে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ওই দাঙ্গায় প্রায় এক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন, যার অধিকাংশই ছিল মুসলমান। সম্ভবত মার্কিনী চাপ উপেক্ষা করে যে কোনো আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দিয়ে মোদি সম্ভবত একটি মেসেজ দিতে চেয়েছেন_ আর তা হচ্ছে আইএসের (ইসলামিক স্টেট) বিষয়টি আরব বিশ্বের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত কোনো অংশ হতে পারে না। উপরন্তু এতে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে একটি ভিন্ন বার্তা পেঁৗছে যেতে পারে। ভারত এ ক্ষেত্রে একটি 'নিরপেক্ষ' অবস্থানই গ্রহণ করেছে। ভারতের এই ভূমিকাকে অনেকেই সমর্থন করবেন। ভারত যে মার্কিনী স্বার্থে সব সময় কাজ করে না, এটা আবারো প্রমাণিত হলো। ভারতের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাই ভারতের পররাষ্ট্র নীতি পরিচালিত হয়। শুধু জঙ্গি দমনে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দেয়ার পাশাপাশি, একটি যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তির ব্যাপারেও মোদি কোনো 'কমিটমেন্ট' করেননি। মুক্ত বাণিজ্য আলোচনা নিয়ে আরো আলোচনা প্রয়োজন_ এমন অভিমত ভারতের নীতিনির্ধারকদের। অন্যদিকে টিপিপি চুক্তি নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের সঙ্গেই এ চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। তবে কোনো চূড়ান্ত চুক্তিতে এখনো উপনীত হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। টিপিপিতে ভারতের অংশগ্রহণ না থাকা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। কেননা এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এতে ভারতের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এটা নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। মোদি নিজে এই সফরকে একটি 'নতুন ডাইমেনশন' হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, এটা সত্য ২০০৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ওয়াশিংটন সফরের সময় তার ওই সফর যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছিল, মোদির এই সফর তুলনামূলক বিচার কম গুরুত্ব পেয়েছে। তবে মোদিকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ওবামা এই মেসেজেটি দিতে চেয়েছেন যে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে চান। অন্যদিকে হংকংয়ে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন চীনের জন্য একটি বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনা ঘটল এমন এক সময় যখন বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন এখন এক নাম্বার শক্তি। চীনের অর্থনীতি এখন ১৭ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। এই অর্থনীতি যে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। এটা সবাই স্বীকার করেন। ভারতের অর্থনীতিও কম শক্তিশালী নয়। বিশ্বের চারটি বড় অর্থনীতির একটি হচ্ছে ভারত। ভারত বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব রাখছে। ওবামা নিজে ২০১০ সালে তার ভারত সফরের সময় ভারতকে জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সদস্য হিসেবে দেখার প্রস্তাব করেছিলেন। ফলে ভারতের গুরুত্ব বাড়ছে। আগামী দিনের যে বিশ্বব্যবস্থা, তাতে অর্থনীতি একটা বড় ফ্যাক্টর। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-চীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়লেও বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকবেই। আপাতত এই দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে না বটে। কিন্তু আগামীতে এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ পাবে। তাই শি জিন পিং যখন 'সিল্ক রুট'-এর কথা বলেন, কিংবা মোদি যখন 'ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোর'-এর প্রস্তাব করেন, তখন আমাদের বুঝতে হবে উভয়ের স্বার্থ অভিন্ন। বাজার দখল নিয়ে অচিরেই এই দুই শক্তি একটি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো 'যুদ্ধ' হয়তো হবে না। কিন্তু এক ধরনের 'স্নায়ুগত প্রতিযোগিতা' থেকে যাবে। আর এই 'প্রতিযোগিতা'কে যুক্তরাষ্ট্র নিজের কাজে কতটুকু লাগাবে সেটাই এখন দেখার বিষয় । Daily Jai Jai Din 15.10.14

হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে চ্যালেঞ্জে চীনের সমাজতন্ত্র

হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন যখন সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে, তখন একটি প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে যে, চীনে কি আদৌ পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? কিংবা চীন কি তার সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে আরও এগিয়ে যেতে পারবে? সংস্কারের নামে চীন কি তার রাষ্ট্র কাঠামো টিকিয়ে রাখতে পারবে? সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ায় এ বিষয়গুলো বহুল আলোচিত। দুই সপ্তাহ হলো যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন যা কিনা 'অকুপাই সেন্ট্রাল' হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে, দ্বিতীয় সপ্তাহ এরই মধ্যে পার করেছে। এ আন্দোলন যে খোদ চীনের রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলছে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। সঙ্গত কারণেই মার্কিনি মিডিয়ায় তাই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে- কোন পথে এখন চীন? চীনের ব্যাপারে পশ্চিমা সমাজ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের আগ্রহ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর পৃথিবীর বড় 'সমাজতান্ত্রিক' দেশ চীনের দিকে দৃষ্টি এখন অনেকের। যারা সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের কিছুটা খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সংস্কার প্রক্রিয়া (গ্লাসনোস্ত ও পেরেস্ত্রাইকা) চালু হওয়ার অনেক আগেই চীন তার সংস্কার প্রক্রিয়া চালু করেছিল। চীনে অর্থনৈতিক সংস্কার এসেছে। রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। কিন্তু গরবাচেভ খুব দ্রুত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন; কিন্তু সফল হননি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছিল। চীন তার অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে শুধু এগিয়েই যায়নি, বরং চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। প্রয়াত চীনা নেতা দেং জিয়াও পিং ছিলেন চীনা অর্থনৈতিক সংস্কারের জনক। তার প্রণীত এক দেশ দুই অর্থনীতি নীতির আলোকে হংকং চীনের সঙ্গে ১৯৯৭ সালে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। অর্থাৎ হংকং তার পুঁজিবাদী অর্থনীতি বজায় রেখেও চীনের অংশ হতে পেরেছে। আজ এত বছর পর হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রমাণ করল হংকংবাসী আরও গণতন্ত্র চায়। যদিও তথাকথিত এ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে, তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, অন্যান্য দেশের মতো (মিসর) হংকং এ 'অকুপাই মুভমেন্ট' করছে। যদিও 'অকুপাই সেন্ট্রাল'-এর সঙ্গে অন্যান্য 'অকুপাই মুভমেন্টের' কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেননা 'অকুপাই সেন্ট্রাল' হংকংয়ে সরকার পরিবর্তনের কোনো আন্দোলন নয়। বরং বলা যেতে পারে, এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে এক ধরনের রাজনৈতিক সংস্কার। আরও বেশি গণতন্ত্র। ২০১৭ সালে হংকংয়ে প্রধান প্রশাসনিক পদের জন্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৯৭ সালে হংকং চীনের অন্তর্ভুক্ত হলেও হংকং তার অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য এখনও বজায় রেখেছে। অর্থাৎ এখানে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। তবে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব এখনও চীনের হাতে। অর্থাৎ চীন এখানে একজন প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে থাকে। এ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ চীনের প্রতি দায়বদ্ধ। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানেই। হংকংয়ের গণতন্ত্রকামীরা চাচ্ছে এখানে পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন সম্পন্ন হোক। অর্থাৎ 'এক মাথা এক ভোট' ভিত্তিতে দলগতভাবে এখানে নির্বাচন হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হংকংয়ের প্রশাসন পরিচালনা করবেন। এক্ষেত্রে চীন যে সংস্কারের কথা বলেছে (প্রধান প্রশাসনিক ব্যক্তির নির্বাচন), সেখানে দলগতভাবে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। চীনা কর্তৃপক্ষ একটি তালিকা তৈরি করে দেবে এবং জনগণ ওই তালিকা থেকে একজনকে বেছে নেবে। চীনা কর্তৃপক্ষের এ প্রস্তাব গণতন্ত্রকামীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা মধ্য হংকংয়ের কিছু সংখ্যক এলাকা দখল করে নিয়ে অকুপাই মুভমেন্টের জন্ম দিয়েছে।হংকংয়ের অকুপাই মুভমেন্টের ইতিহাস খুঁজে দেখা গেছে, এ আন্দোলন তরুণদের দ্বারা পরিচালিত হলেও এর তাত্তি্বক হচ্ছেন অধ্যাপক বেনই তাই নামে এক ব্যক্তি। তিনি হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কম্পারেটিভ অ্যান্ড পাবলিক ল'-এর আইনের অধ্যাপক। তিনি দুই বছর আগে তত্ত্বগতভাবে এ ধরনের একটি আন্দোলনের কথা বলেন। অহিংস পদ্ধতিতে, অনেকটা গান্ধীবাদী নীতির আলোকে তিনি হংকংয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। তার এই গান্ধীবাদী নীতি অনুসরণ করেই তরুণরা, যাদের অধিকাংশই ছাত্র- এ অকুপাই মুভমেন্টের জন্ম দিয়েছে। হংকংয়ের ফেডারেশন অব স্টুডেন্টস এ আন্দোলনে নিজেদের জড়িত করেছে। আর মজার ব্যাপার, এর নেতৃত্বে রয়েছে ১৭ বছরের এক যুবক, তার নাম জসুয়া ওং। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন।তবে এ আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্রাটেজি, তারই অংশ হিসেবে জন্ম হয়েছে হংকং 'অকুপাই সেন্ট্রাল' আন্দোলনের। চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। হংকংয়ের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন এ পরিকল্পনার একটি অংশ মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র এনডিআই বা 'ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি' নামক সংস্থার মাধ্যমে হংকংয়ের গণতন্ত্রকামীদের প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন করেছে। অধ্যাপক বেনই তাইকে তারাই তৈরি করেছে এবং অধ্যাপক তাইকে সামনে রেখেই গঠন করা হয়েছে সেন্টার ফর কম্পারেটিভ অ্যান্ড পাবলিক ল' নামের একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, একটি গবেষণা সংস্থা। এনডিআইয়ের অর্থায়নে হংকংয়ের মার্টিন লির নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ডেমোক্রেটিক পার্টি। মার্টিন লি নিজে ২০১৫ সালে ও অধ্যাপক তাই ওয়াশিংটন সফর করেছেন একাধিকবার। শুধু তাই নয়, হংকংয়ে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানে যে রেফারেন্ডাম বা গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল, তারও অর্থায়ন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। হংকংয়ের ৭ লাখ ৮০ হাজার মানুষ (পাঁচ ভাগের একভাগ) ওই গণভোটে অংশ নিয়েছিল।মিসরেও যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের গণভোটের আয়োজন করেছিল। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ইউএসএইডের হংকংয়ে সাহায্যের পরিমাণও বেড়েছিল। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৫৪ হাজার ডলার। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, হংকংয়ে একটি তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সেখানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। উদ্দেশ্য, মূল চীনে এ আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে দেয়া ও চীনে চূড়ান্ত বিচারে চীনা সরকারের পতন ঘটানো। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যুক্তরাষ্ট্র হংকংয়ে গণতন্ত্র চায় বটে(?); কিন্তু সেখানকার জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কখনও কোনো উদ্যোগ নেয়নি। হংকংয়ে ঘণ্টাপ্রতি যে বেতন দেয়া হয় (৩ দশমিক ৬০ ডলার), তা যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের গড় বেতনের অর্ধেক।শুধু তাই নয়, হংকংয়ে জীবনযাত্রার খরচ এত বেশি যে, অনেকের খরচ মেটানোর জন্য দুটো চাকরি পর্যন্ত করতে হয়। গণতন্ত্র সেখানে সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে পারবে না। গণতন্ত্র বোধকরি হংকংয়ের সমস্যার কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারবে না। সুতরাং হংকংয়ের এ আন্দোলন কী আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে চীনের ওপর? গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে আমরা যা বুঝি, সেই সংস্কৃতি হংকংয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। চীনা নেতৃত্ব এটা মানবে না। কেননা, এতে করে চীনের অন্যান্য অঞ্চলে এ আন্দোলনের প্রভাব পড়তে পারে।তবে ২০১৭ সালে হংকংয়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যাপারে আরও কিছুটা ছাড় দিতে পারে চীন। প্রার্থীদের যে তালিকা চীন অনুমোদন করবে, সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। হংকংয়ের বিকল্প হিসেবে সাংহাই, শেন ঝেন কিংবা গুয়াংঝো এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। হংকংয়ের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন আর সাধারণ চীনাদের আকৃষ্ট করে না। বরং শেন ঝেন কিংবা গুয়াং ঝোর মতো এলাকায় 'নতুন অর্থনৈতিক জোন' গঠিত হয়েছে, যেখানে জীবনযাত্রায় একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। মানুষের আয় বেড়েছে। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। শুধু তাই নয়, চীনা নেতৃত্ব চীনের অর্থনীতি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে চীনের অর্থনীতিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। ২০৫০ সালের মধ্যেই চীন হবে বিশ্বের প্রথম অর্থনীতি।ফলে সব ধরনের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে চীনা নেতৃত্ব সজাগ রয়েছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং অত্যন্ত প্রাগমেটিক। তিনি চীনা অর্থনীতিকে আরও উন্মুক্ত করে দেবেন। জাতীয় স্বার্থকে তিনি গুরুত্ব দেবেন। একটি 'মার্কিনি ষড়যন্ত্র' সম্পর্কে তিনি ও তার পলিট ব্যুরোর সদস্যরা সচেতন। চীনা অর্থনৈতিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তি করতে চাচ্ছে, তাতে চীনকে রাখা হয়নি। এটা চীনবিরোধী একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে, চীনা নেতৃত্ব এটা বোঝে। তাই চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে জন্ম হতে যাচ্ছে একটি 'নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা', যা পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আঘাত করবে। জন্ম দেবে বিকল্প একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার। এ লক্ষ্যেই ২০১৬ সালে ব্রিকস ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে।তাই হংকংয়ের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে পরোক্ষভাবে চীনা নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করার শামিল, এটা চীনা নেতারা উপলব্ধি করেছেন। চীনে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র বিনির্মাণ সম্ভব নয়। চীন গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। চীনে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চীনা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সেখানেই লুক্কায়িত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এখন চাচ্ছে চীনও একাধিক চীনা রাষ্ট্রে বিভক্ত হোক। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনা সেনাবাহিনী এখনও পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। চীনা সেনাবাহিনী এখনও পার্টির নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল। ফলে চীনে হংকংয়ের মতো গণতান্ত্রিক আন্দোলন জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।তবে অদূর ভবিষ্যতে চীনে একটি 'সিঙ্গাপুর মডেল' এর জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। চীন এখন আর ধ্রুপদী মার্কস দ্বারা পরিচালিত হয় না। তারা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত খাতের বিকাশ ঘটিয়ে 'সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি' নামে নতুন এক অর্থনীতি চালু করেছে। এর ফলও তারা পেয়েছে। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতি। সুতরাং হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন হংকংয়ের ব্যাপারে চীনা নীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। চীন একটি বড় দেশ। প্রায় ৫৫ জাতি-উপজাতি নিয়ে গড়ে উঠেছে এ চীনা রাষ্ট্রটি। ২২টি প্রদেশ, ৫টি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, ৪টি বিশেষ অঞ্চল ও ১৪৭টি বিশেষ এলাকা নিয়ে যে চীনা রাষ্ট্র, রাজনৈতিক সংস্কার তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে এ রাষ্ট্রটি ভেঙে যেতে পারে।এটা বলা যায় একুশ শতক হচ্ছে চীনের। এ শতকে চীন অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, ২০৩৫ সালে চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। এর পরিমাণ হবে শতকরা ৩০ শতাংশ। ভারতের অবস্থান দাঁড়াবে তৃতীয়, শতকরা ১৪.৩ ভাগ। জাপান তার অর্থনৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না। সুতরাং পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীন যে একটি 'হুমকি' তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং 'চীনের ডানা' কেটে ফেলতে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা যে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। কেননা বিশ্বে চীনা কর্তৃত্ব যদি বেড়ে যায়, তাহলে তা মার্কিনি স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। আফ্রিকায় চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যেখানে জ্বালানি সম্পদ রয়েছে, সেখানে চীন বড় বিনিয়োগ করেছে (যেমন সুদান)। মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলোর সমন্বয়ে চীন গড়ে তুলেছে 'সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন' (এসসিও)। রাশিয়াও এসসিওর সদস্য। এ এসসিওকে অনেকে সাবেক ওয়ারশ সামরিক জোট (১৯৮৫ সালে অবলুপ্ত) এর বিকল্প ভাবছে। এখন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বিকল্প একটি 'বিশ্বব্যাংক' এর কথাও বলছে চীন। ফলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব যতটুকু 'সফল' হয়েছিল, চীনের ক্ষেত্রে অতটুকু সফল হবে বলে মনে হয় না। চীনকে ভাঙাও সহজ হবে না। চীনে দরিদ্রতা আছে, এটা সত্য। এ দরিদ্রতা এরই মধ্যে অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানও বৃদ্ধি পেয়েছে। তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থাই করছেন চীনা নেতারা।আইএমএফ সর্বশেষ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০১৪ সালে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির পরিমাণ যেখানে ১৭ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার (এক হাজার মিলিয়নে এক ট্রিলিয়ন) সেখানে চীনের অর্থনীতির পরিমাণ ১৭ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ ২০০৫ সালে চীনের অর্থনীতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির অর্ধেক। আইএমএফ বলছে, ২০১৯ সালে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির চেয়ে শতকরা ২০ ভাগ হারে বাড়বে। এখন চীনা নেতারা যদি এ অর্থনৈতিক শক্তিকে চীনা জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের স্বার্থে ব্যয় করেন, তাহলে সেখানে অসন্তোষ জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।গণতন্ত্র চীনের জন্য কোনো 'মডেল' নয়। চীন তার নিজস্ব স্বকীয়তায় সমাজ বিনির্মাণ করছে। অর্থনীতিই হচ্ছে নয়া চীনা সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রাজনীতি এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে না। তাই পশ্চিমা সমাজের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকলেও ১৯৮৯ সালের মতো আরেকটি 'তিয়েন আন মেন স্কয়ার' এর জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সুতরাং আজ হংকংয়ে যা হয়েছে, তার প্রভাব চীনা সমাজে ফেলবে না। যতদিন পর্যন্ত চীন অর্থনীতিতে তার সফলতা অব্যাহত রাখবে, ততদিন পর্যন্ত চীনারা বড় ধরনের রাজনৈতিক সংস্কার চাইবে না। তাই চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও ক্ষীণ। চীন ও হংকং এক নয়। হংকংয়ে চীনা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে আলোচনায় কিছুটা ছাড় দিলেও চীনের মূল রাজনীতিতে এর আদৌ কোনো প্রভাব থাকবে না। Daily Alokito Bangladesh 15.10.2014

হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন কী বার্তা দিয়ে গেল

হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন কী বার্তা দিয়ে গেল? দুই সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ায় এই আন্দোলন নিয়ে মাতামাতি কম দেখছি না। শত শত চ্যানেলের ভিড়ে কোথাও না কোথাও হংকংয়ের এই আন্দোলন ও চীনের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। অনেকেই হংকংয়ের এই আন্দোলন, যা কিনা পরিচিতি পেয়েছে 'অক্যুপাই সেন্ট্রাল' হিসেবে, তার সঙ্গে আরব বসন্তকালে কায়রোয় যে আন্দোলন হয়েছিল, তার একটা মিল খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশে যে 'অক্যুপাই মুভমেন্ট' হয়েছে তার সঙ্গে হংকং অক্যুপাই আন্দোলনের যেমন মিল আছে, তেমনি আছে অমিলও। খোদ নিউ ইয়র্ক শহরে অক্যুপাই ওয়ালস্ট্রিট বড় ধরনের আবেদন সৃষ্টি করতে পারলেও তাতে পরিবর্তন এসেছে অতি সামান্যই।