রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

শুধুমাত্র তিস্তা চুক্তিই নয়

বহুল আলোচিত মমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফর শেষ হয়েছে গেল সপ্তাহে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ সফরের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। কেননা ভারত আমাদের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করবে- এর পুরোটাই নির্ভর করছে মমতা ব্যানার্জির ওপর। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একটি চুক্তি করতে চাইলেও মমতার আপত্তির কারণে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিটি হতে পারেনি। যদিও যতদূর জানা যায়, একটা খসড়া চুক্তিতে উভয় দেশ রাজি হয়েছিল। কিন্তু মমতার আপত্তির কারণে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। এখন চুক্তিটি আদৌ স্বাক্ষরিত হবে কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। সে কারণেই মমতার ঢাকা সফরের সময় আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। আমরা ধারণা করেছিলাম, মমতা আমাদের একটা 'কমিটমেন্ট' করে যাবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শুধু বলে গেছেন, আস্থা রাখতে। এ আস্থা রাখার কথা বলা একটি কূটনৈতিক ভাষা। এতে করে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। আমরা এটাও লক্ষ্য করেছি মমতার ঢাকা সফর কলকাতায় একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তার ঢাকা সফরের পর কলকাতার জনপ্রিয় দৈনিক আনন্দবাজারে মন্তব্য করা হয়েছিল এভাবে- 'পশ্চিমবঙ্গের পাওনা শূন্য'। এর অর্থ পরিষ্কার, তিস্তায় পানিবণ্টন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের একটা আপত্তি রয়েছে। সুতরাং অদূর ভবিষ্যতে তিস্তা চুক্তি হবে- এটা আশা করতে পারছি না। তবে শুধু তিস্তার পানি বণ্টনই নয়, আরও বেশ কিছু ইস্যু রয়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রে ভারতের সাবেক মনমোহন সিং সরকারের সঙ্গে বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পার্থক্য নেই। কেননা মোদি সরকার ক্ষমতায় এসে অবধি একটি সমস্যাও সমাধানের উদ্যোগ নেয়নি। বরং সমস্যাগুলো যেভাবে ছিল, সেভাবেই রয়ে গেছে। এটা ঠিক, মোদি দায়িত্ব নেয়ার এক মাসের মাথায় জুলাই মাসে (২০১৪) তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুবার সাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় কোনো আলোচনা হয়নি। তবে বাংলাদেশের মনোভাব বুঝতে সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার সফরের সময় কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল বটে; কিন্তু তাতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, সে প্রশ্ন থাকবেই। বাংলাদেশ ছোট দেশ হতে পারে। কিন্তু সম্ভাবনার দেশ। বাংলাদেশে ভারতের প্রচুর স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের বিশাল বাজার। ১৬ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশে ভারতের বিক্রি করার অনেক কিছু আছে এবং ভারত সেটা করছেও। উপরন্তু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তাদের একটা পথ দরকার। সেটাও তারা পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রাপ্তির খাতা শূন্য। আমাদের পণ্যের যে বাজার সৃষ্টি হয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে, তা এখন ভারতীয় পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। ফলে বাংলাদেশ তার বাজার হারাবে। এমনিতেই বাংলাদেশ তার পণ্য নিয়ে ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। আমরা বারবার এ কথাগুলো বলছি। যখন মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখনও বলেছি। এরপর যখন সুষমা এলেন, তখনও আমরা বললাম। কিন্তু তাতে এতটুকু দৃষ্টি দেয়নি ভারত। অথচ আমরা সুষমা স্বরাজকে ও পরে মমতাকে যেভাবে সম্মান দিলাম, তা সমসাময়িককালে বিরল একটি ঘটনা। এখন ভয় হচ্ছে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর নিয়ে, ওই সফরটা না-জানি কেমন হয়! ভারত বড় দেশ। আমাদের উন্নয়নে ভারত একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সব সময় তাদের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখেন। ছোট্ট একটি ঘটনা- প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপে মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের চাহিদার কথা বলেছিলেন। অথচ তিনি তিস্তার পানির অভাবে বৃহত্তর রংপুরের মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের কথা একবারও বললেন না। পানির চেয়ে মমতার কাছে ইলিশই বড় হয়ে দেখা দিল। ঘটনাটি ছোট; কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ২ মার্চ ভারতের নয়া পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামনিয়াম জয়শংকর ঢাকা আসছেন। এ সফর একটি রুটিন ওয়ার্ক হলেও এই সফরে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদির মনোভাব জানাবেন ঢাকাকে। তার ওই সফরে মোদির ঢাকা সফরও চূড়ান্ত হতে পারে। জয়শংকরের সফরের এই সুযোটাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। আমাদের সমস্যাগুলো আবারও আমরা তুলে ধরতে পারি জয়শংকরের কাছে। বিশেষ করে, তিস্তা পানিশূন্য হওয়ায় আমরা যে পরিবেশগত মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, এ বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারি। যাতে করে মোদির ঢাকা সফরের সময় তার কাছ থেকে একটি আশ্বাসের বাণী আমরা শুনতে পারি। মমতা ব্যানার্জি যাতে রুদ্র কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করেন, সে ব্যাপারে আমরা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করতে পারি। কেন্দ্রীয় সরকার মমতা ব্যানার্জির ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে। সেইসঙ্গে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে যখন প্রচুর বৃষ্টি হয় উজানে, অর্থাৎ সিকিমে, সেখানে জলাধার নির্মাণ করে পানি ধরে রাখা যায় কিনা সে ব্যাপারে একটি যৌথ কমিশন গঠন করার প্রস্তাব রাখতে পারি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ ঘাটতি ও পানি ঘাটতি মেটাতে যৌথ ব্যবস্থাপনার কথা বলেছেন। জয়শংকরের ঢাকা সফরের সময়ও আমরা এ ব্যাপারটি পুনর্ব্যক্ত করতে পারি। দক্ষিণ এশিয়ার মোট আয়তনের ৭২ ভাগ ভারতের। সুতরাং ভারতকে বাদ দিয়ে কোনো সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। একটি স্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়া তিনি চান। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। প্রধানমন্ত্রী মোদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ফোন করে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ক্রিকেট দলের সাফল্য কামনা করলেও এই দুটো দেশ এরই মধ্যে এক ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। ওবামার জানুয়ারিতে ভারত সফরের পরপরই ভারত পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অগ্নি-৫ মিসাইল উৎক্ষেপণ করেছে। এটি তাদের আধুনিক সংস্করণ। এ অগ্নি-৫ এর ব্যাপ্তি সুদূর চীন পর্যন্ত। ভারত এখন আর পাকিস্তানকে বিবেচনায় নিচ্ছে না। ভারতের টার্গেট এখন চীন। অর্থাৎ চীনের কর্তৃত্ব কমানো। অগ্নি-৫ নিক্ষেপের পরদিনই পাকিস্তান তার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র 'রাদ' বা 'ব্রজ' এর পরীক্ষা চালিয়েছে। এর আগে পাকিস্তান 'হাতাফ' নামে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। ফলে দেশ দুইটি আবারও এক ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষায় নিয়োজিত হলো। মোদির পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানের কোনো জায়গা নেই। যদিও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছিল, দুই দেশের সম্পর্ক বাড়বে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মোদির পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। এরই মধ্যে তিনি ভুটান, নেপাল সফর করছেন। এ মার্চেই তিনি যাবেন শ্রীলঙ্কায়। তিনি জাফনায়ও যাবেন। মার্চে বাংলাদেশেও আসতে পারেন। চীনকে গুরুত্ব দেয়ার পেছনে কাজ করছে তার ব্যবসায়িক নীতি। তিনি চান বিনিয়োগ। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা এ মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। তবে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোই হবে মোদি সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার। মোদির পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করলে এটা বলা যায়, মোদি একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছেন। একদিকে চীন, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি রাশিয়ার সঙ্গেও সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক রক্ষা করে মোদি তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছেন। রাশিয়া থেকে তিনি অস্ত্র কিনছেন। ইউক্রেন ইস্যুতে তিনি রাশিয়ার অবস্থানকে সমর্থন করেছেন। (এ প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থানও অনেকটা ভারতের মতো)। রাশিয়া ও চীনকে সঙ্গে নিয়ে ভারত ব্রিকস ব্যাংক গড়ে তুলছে, যা কিনা হবে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প 'আরেকটি বিশ্বব্যাংক'। বাংলাদেশও এ ব্যাংকের ব্যাপারে আগ্রহী। সুষমা স্বরাজের বেইজিং সফরের সময় সেখানে ত্রিদেশীয় একটি 'মিনি সামিট' হয়েছে। চীন, রাশিয়া ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সেখানে মিলিত হয়েছেন। ফলে বোঝাই যায়, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় ধরনের ব্যবসায়িক ও পারমাণবিক সম্পর্ক গড়ে তুললেও চীন ও রাশিয়াকে কাছে রাখতে চায়। এখন আগামী দিনগুলোই প্রমাণ করবে এ সম্পর্ক কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বড় অর্থনৈতিক শক্তি চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে। সঙ্গত কারণেই বিশ্বের বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ থাকবে এ অঞ্চলের ব্যাপারে। যদিও জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টারও যুক্তরাষ্ট্র। জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে। এদিকে চীনের নয়া প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলছেন, তা 'অন্য চোখে' দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, এতে করে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনের প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ঠিক এমনি এক পরিস্থিতিতে মোদি চাচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ায় তার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে। একইসঙ্গে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোও হবে তার অন্যতম স্ট্র্যাটেজি। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে এ কারণেই গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে পারে না। শুধু তিস্তার পানিবণ্টনই নয়, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, টিপাইমুখ বাঁধ, শুল্ক, অশুল্ক বাধা, ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। ২ মার্চ ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ পক্ষের উচিত হবে এই অবস্থান স্পষ্ট করা। Daily ALOKITO BANGLADESH 01.03.15

সময় টেলিভিশন টক শো


গণতন্ত্রের নয়ামাত্রা : শ্রীলংকা ও দিল্লির অভিজ্ঞতা

সম্প্রতি শ্রীলংকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের হেরে যাওয়া এবং এর পর পরই ভারতের দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনে আম আদমি পার্টির বিজয় গণতন্ত্রের নতুন একটি মাত্রা দিয়েছে। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও যে হেরে যেতে পারেন, শ্রীলংকায় রাজপক্ষের পরাজয় সেটিই প্রমাণ করল আবার। শুধু তা-ই নয়, বিরোধী দলের সমন্বয়েও যে একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন করা যায়, এটাও সেখানে প্রমাণ করেছেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মূল কথাটাই হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত দলগুলোর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা। তা গণতান্ত্রিক তত্ত্বে বলা হয়, কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস বা সিবিএম। এই সিবিএমেরই আমরা প্রকাশ দেখলাম দিল্লির বিধানসভার নির্বাচনে আম আদমি পার্টির অভাবনীয় বিজয়ের পর রামলীলা ময়দানে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ভাষণের মধ্য দিয়ে। একতরফাভাবে তার এই বিজয় নিয়ে তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি। এমনকি বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীর প্রার্থী কিরণ বেদি সম্পর্কেও তিনি কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেননি। বরং বলেছেন, কিরণ বেদিকে আমি সম্মান করি। নির্বাচনী লড়াইয়ে হারজিত থাকবেই। তিনি আমার বড় দিদির মতো। তাকে সঙ্গে নিয়ে তার পরামর্শ মতো চলব। এটা তিনি না বললেও পারতেন। কেননা আগামী পাঁচ বছর দিল্লির রাজ্য শাসনে তাকে বিজেপির মতামত বা পরামর্শ না নিলেও চলবে। কেননা বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে বিজেপির আসন মাত্র ৩টি। আবার ওই তিনটি আসনের মধ্যে আবার কিরণ বেদির আসনটিও নেই। অর্থাৎ দিল্লির বিধানসভায় বিজেপি আছে বটে কিন্তু সাংবিধানিকভাবে দিল্লি বিধানসভায় কোনো বিরোধী দল থাকবে না। অরবিন্দ কেজরিওয়াল শুধু কিরণ বেদির কথাই বলেননি, বলেছেন অজয় মাকেনের কথাও। মাকেন ছিলেন কংগ্রেসের নেতা। আর কংগ্রেস একটি আসনও পায়নি দিল্লি বিধানসভায়।
গণতন্ত্র নিয়ে যারা ভাবেন, বলেনÑ তাদের কাছে এ দুটি দেশের ঘটনার গুরুত্ব অনেক। গণতান্ত্রিক সমাজে পরস্পরের মাঝে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকতে হয়। না হলে সমাজ অহিংস হয়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক ভাবধারা ভেঙে পড়ে। সমাজ একদলীয় হয়ে পড়ে। সিরিসেনার অভিজ্ঞতা অনেক দিনের। কিন্তু অরবিন্দ কেজরিওয়ালের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তো মাত্র দুই বছরের। দুবছরের একটি দল নিয়ে সবাইকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। আসলে শ্রীলংকা বলি ও নয়াদিল্লির বিধানসভার নির্বাচন বলি, বিজয় হয়েছে গণতন্ত্রের। ব্যক্তি এখানে মুখ্য নয়। উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা বড় শিক্ষাÑ যেখানে ক্ষমতায় থেকেও ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জনরায়ে হেরে যান। হেরে যাওয়ার আগেই রাজাপক্ষে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং কোনো আপত্তির কথা তার সমর্থকদের মুখ থেকে শোনা যায়নি। কোনো সূক্ষ্ম কারচুপির কথাও আমরা শুনিনি। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় যাওয়া যায়। আবার জনসমর্থন না থাকলে জোর করে সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করেও ক্ষমতায় থাকা যায়। রাজাপক্ষের বিদায় এটাই প্রমাণ করেছিল আবার। অথচ রাজপক্ষে এক সময় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। শ্রীলংকাকে ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে তিনি রক্ষা করেছিলেন। ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে শ্রীলংকা সেনাবাহিনীর বিজয় নানা বিতর্কের জন্ম দিলেও এটা প্রমাণিত হয়েছিল, রাজাপক্ষে যদি ওই সময় টাইগারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা না করতেনÑ তাহলে সম্ভবত শ্রীলংকা এর রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব নিয়ে আজ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারত না। এখানে বলা ভালো, রাজাপক্ষে ২০০৫ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে সেখানে গণতন্ত্রের পরিপন্থী এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার একটি প্লাস পয়েন্ট ছিল, তিনি দীর্ঘদিন ধরে চলা তামিল বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। ২৬ বছর ধরে চলা তামিল বিদ্রোহ দমন করে তিনি শ্রীংহলি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল পারিবারিককরণের। তার দুভাই, ছেলেÑ তারা সবাই সরকারের ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে প্রভাব খাটাতেন। এই পারিবারিককরণ শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ খুব ভালোভাবে নেয়নি। তামিল টাইগারদের পরাজিত করে তার জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে ২০১০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। তার দ্বিতীয় টার্ম শেষ হওয়ার কথা আরও দুবছর পর। তৃতীয় টার্মে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন না। এক্ষেত্রে সংবিধান অন্যতম বাধা ছিল। কিন্তু অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী রাজাপক্ষে সংবিধানে পরিবর্তন এনে নিজের জন্য তৃতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ প্রশস্ত করেছিলেন। ধারণা ছিল, তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিবতা করার মতো কোনো উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে পাবে না বিরোধী দল। কিন্তু তার সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিথ্রিপাল সিরিসেনা যে স্বয়ং তাকেই চ্যালেঞ্জ করবেন, এটা তিনি বুঝতে পারেননি। এক সময় সিরিসেনা তার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এমনকি ক্ষমতাসীন শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টির তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু সিরিসেনা গত অক্টোবর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর রাজাপক্ষেকে তিনি চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেন। আস্থার প্রতীক হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি কোনো প্রার্থী দেয়নি। বরং তারা একত্র হয়ে সিরিসেনাকে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং নির্বাচনে তাকে সর্বাত্মক সমর্থন করেন। নির্বাচনের আগে সিরিসেনার সঙ্গে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির যে সমঝোতা হয়েছিল, এর আলোকেই বিরোধী দল নেতা রবিল বিক্রমাসিংহেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। বিক্রমাসিংহে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথও নিয়েছেন।
শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরিসেনার বিজয় ছিল গণতন্ত্রের বিজয়। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়ে এত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও কেন রাজাপক্ষে হেরে গেলেনÑ এ প্রশ্ন এখন অনেকেই করছেন। আসলে রাজাপক্ষে জনগণের পালস বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ক্ষমতা মানুষকে যে অন্ধ করে দেয়, রাজাপক্ষে ছিলেন এর বড় প্রমাণ। তিনি শ্রীলংকার মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে এক ধরনের একনায়কতন্ত্র চালু করেছিলেন। তার কথাই ছিল আইন। শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ শিক্ষিতের দেশ শ্রীলংকার মানুষ এটা গ্রহণ করে নেয়নি। ওই একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে মানুষ তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। তিনি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। তা শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ সমর্থন করেনি। এমনকি তিনি পরিবারতন্ত্র চালু করেছিলেন। এটাও মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। যদিও শ্রীলংকায় এক ধরনের পরিবারতন্ত্র আছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা কিংবা তার মা প্রয়াত শ্রীমাভো বন্দেরনায়েকে পরিবারতন্ত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। বন্দেরনায়েকে ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী (১৯৪৮ সালে দেশটি স্বাধীন হয়) শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী শ্রীমাভো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পরে মেয়ে চন্দ্রিকাও প্রেসিডেন্ট হন। মেয়ে চন্দ্রিকা যখন প্রেসিডেন্ট, তখন মা শ্রীমাভোও দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সে দেশে।
নিঃসন্দেহে সিরিসেনার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি সবাইকে অবাক করেছে। তাকে ঘিরে একটি বড় ধরনের ‘ঐক্য’ গড়ে উঠেছে। আমাদের মতো দেশ হলে নির্বাচনে বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) নিজেদের প্রার্থী দিত। কিন্তু দলটি তা করেনি। বরং সিরিসেনাকে সমর্থন করে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করেছে শ্রীলংকায়। নয়াদিল্লির বিধানসভার নির্বাচন কিংবা নির্বাচন-পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের বক্তব্য ওই স্পিরিটই প্রতিনিধিত্ব করে। কেজরিওয়াল বলেছেন, সবাইকে নিয়েই তিনি প্রশাসন পরিচালনা করবেন। তিনি একাই সব সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু চাচ্ছেন সবাইকে নিয়ে প্রশাসন চালাতে। গণতন্ত্রে এ কথাটাই বলে। মানুষটা ছোট। কিন্তু অরবিন্দ কেজরিওয়াল এখন অনেক ‘বড় মানুষ’। বলেছেন নয়াদিল্লিতে কোনো ‘ভিআইপি কালচার’ থাকবে না। মন্ত্রীরা গাড়ির ওপর লালবাতি জ্বালিয়ে চলাচলে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নেবেন না।
ভারতে এক ধরনের ‘পপুলিজম’-এর মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বলা হচ্ছে, এটা একটা ‘মোদিওয়েভ’ বা ‘মোদি ঢেউ’। তা সারা ভারত ছুঁয়ে গেছে। দিল্লিতেও ওই একই ধরনের ‘পপুলিজম’ কেজরিওয়ালকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। কিন্তু পার্থক্যটা হচ্ছে, ওবামার সঙ্গে বৈঠকে মোদি ১০ লাখ টাকা দামের স্যুট পরে প্রমাণ করলেনÑ তিনি মূলত ধনী, ব্যবসায়ী গোষ্ঠীরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। অন্যদিকে রামলীলা ময়দানে সাধারণ একটা প্যান্ট ও নীল সোয়েটার পরে কেজরিওয়াল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে প্রমাণ করলেন, তিনি আসলে সাধারণ মানুষেরই মুখ্যমন্ত্রী। সংবাদপত্র থেকে নিশ্চয়ই অনেকে জেনেছেন, শপথগ্রহণের দিন দিল্লির ট্যাক্সিচালকরা রামলীলা ময়দানে যেসব যাত্রী কেজরিওয়ালের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গেছেন, তাদের কারও কাছ থেকেই ভাড়া নেননি। কেননা ট্যাক্সিচালকদের ভাষায়Ñ কেজরিওয়াল তো তাদেরই লোক! কেজরিওয়াল কোনো জেড গ্রেডের (ভিআইপিদের জন্য) নিরাপত্তাও নিচ্ছেন না। তিনি কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করেছেনÑ যা তার শাসনামলে বাস্তবায়ন করবেন। যেমনÑ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, বিদ্যুতের বিল অর্ধেক করা, বিনামূল্যে গরিবদের জন্য ৭০০ লিটার পানি প্রতি মাসে (আগে ছিল ২০ হাজার লিটার), স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, হাসপাতালে ফ্রি বেড ইত্যাদি। তার ওই প্রতিশ্রুতি সুশাসনের কথাই বলে। আর সুশাসনই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল কথা।
গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে কিংবা গণতন্ত্রের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হলে শ্রীলংকা ও দিল্লিতে আম আদমি পার্টির উত্থান থেকে আমরা শিখতে পারি। তাদের অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারি। সাম্প্রতিক কালে সিরিসেনা কিংবা অরবিন্দ কেজরিওয়াল আমাদের কাছে দুটি দৃষ্টান্ত। সিরিসেনা সংবিধান সংশোধন করে পুনরায় সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন। অন্যদিকে এক সময়ের আয়কর বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা ও এখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা। দু’জনই বলেছেন সবাইকে নিয়ে কাজ করার কথা। এখন আগামী দিনগুলোই বলবে তারা কতটুকু সফল হবেন। 

মোদি-কেজরিওয়াল দ্বন্দ্ব কি শুরু হয়ে গেল

দিলি্লর বিধানসভার নির্বাচনে আপ আদমি পার্টির অভাবনীয় বিজয় নিয়ে যখন সারা ভারতে মাতামাতি চলছে, তখন নরেন্দ্র মোদির একটি মন্তব্য কেজরিওয়ালের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। দিলি্ল একটি পূর্ণ রাজ্য নয়_ এটা কেজরিওয়াল বোঝেন। তাই নির্বাচনে বিজয়ের পরপরই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে। কারণ দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানেন তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করতে হলে নরেন্দ্র মোদির সমর্থন তার প্রয়োজন। সে কারণেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অফিস করার আগেই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রধানমন্ত্রী সেদিন আশ্বাসও দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, কেজরিওয়াল লীলাবতী ময়দানে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পরাজিত বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী কিরণ বেদিকে 'বড় দিদি' হিসেবে সম্বোধন করে প্রশাসন পরিচালনায় তার সহযোগিতাও চেয়েছিলেন। বলেছিলেন কিরণ বেদির সঙ্গে পরামর্শ করেই তিনি সরকার পরিচালনা করবেন। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে এ 'পরিস্থিতি' কী বদলে গেল? কেজরিওয়াল নির্বাচনের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন (বিনামূল্যে পানি, বিদ্যুৎবিল ছাড়), প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসব প্রস্তাবকে অবাস্তব বলেছেন। গেল সোমবার দিলি্লতে বিদ্যুৎসংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, 'বিদ্যুতের জন্য অন্য রাজ্যের ওপর যাদের নির্ভর করতে হয়, সেসব দল কিভাবে দাম ছাড়ের প্রতিশ্রুতি দেয় বুঝতে পারি না।' তিনি আরো বলেছেন, 'যখনই ভোট হয়, রাজনৈতিক দলগুলো তখনই বিনে পয়সায় বিদ্যুৎ দেয়ার কথা বলতে থাকে। এসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ভর্তুকির রাজনীতিতে লাগাতার ছাড়ের বন্যা ভারতের অর্থনীতিকে যে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারবে না তা আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন নরেন্দ্র মোদি। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে অর্থনীতিতে সংস্কারের প্রস্তাব করেছেন। ভর্তুকি কমানো এই সংস্কারেরই অংশ। ফলে নরেন্দ্র মোদির এ বক্তব্য একটা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যে, কেজরিওয়াল কেন্দ্র থেকে কোনো বড় ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা নাও পেতে পারেন। নরেন্দ্র মোদি যা বলেছেন, তাকে একেবারে অস্বীকারও করা যাবে না। দিলি্লর বিদ্যুৎ আসে অন্য রাজ্য থেকে। সেই বিদ্যুৎ বিল মেটাবে কে? কেন্দ্র বা দিলি্লর রাজ্য সরকার? খুব সঙ্গত কারণেই দিলি্ল সরকার যখন বিদ্যুৎবিলে ভর্তুকি দেবে, তাতে আপত্তি জানাবে কেন্দ্রের সরকার। দিলি্লর পানির সঙ্কট অনেক পুরনো। ভূগর্ভের পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এই পানির চাহিদা মেটায় হরিয়ানা রাজ্য। তাদের পানির বিল মেটাবে কে? কেন্দ্র কেন এখানে ভর্তুকি দেবে? তাহলে কী দিলি্লর বিধানসভার নির্বাচনে আম আদমি পার্টির (আপ) অসাধারণ বিজয় ও আপ 'সুপ্রিমো' অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সব প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত কাগজকলমেই থেকে যাবে? ইতোমধ্যেই হিসাব-নিকেশ শুরু হয়ে গেছে_ কিভাবে অরবিন্দ কেজরিওয়াল তার প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করবেন। কেননা দিলি্লর নিজস্ব আয়ের ক্ষেত্রটা খুব বড় নয়। তার ওপর কেন্দ্রে যে সরকার রয়েছে, তার সঙ্গে 'আপে'র সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন আছে। নির্বাচনের আগে কেজরিওয়াল যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎবিল অর্ধেক করে দেয়া, পরিবারপ্রতি প্রতিমাসে ২০ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা বিনামূল্যে, ১৫ লাখ সিসি টিভি স্থাপন, ফ্রি ওয়াইফাই, ৫০০ ফ্রি স্কুল, ২০ ফ্রি কলেজ, হাসপাতালে ৩০ হাজার 'বেড' বাড়ানো, ৫৫ হাজার নতুন স্থায়ী চাকরি, ভিআইপি সংস্কৃতি বন্ধ ইত্যাদি। এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি 'ধাক্কা' খাবেন। দিলি্লর বর্তমান বিদ্যুৎ চাহিদা ৬২০০ মেগাওয়াট। 'আপ' নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা বলছে। এক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের কারণে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা অতিরিক্ত গ্যাসের কারণে গ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা দিলি্লতে বেসরকারি খাতে। এরা শতকরা ৫২ ভাগ বেশি আয় করে। এদের আয়-ব্যয় হিসাব করার হুমকি দিয়েছে 'আপ'। এখন যদি মুখ্যমন্ত্রী বিদ্যুৎবিল অর্ধেক করার নির্দেশ দেন তাতে রাজস্ব আয় অনেক কমে যাবে। আয় কমে গেলে কোন খাত থেকে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল রাজ্যের উন্নয়নের অর্থ যোগাবেন? প্রতিমাসে ২০ হাজার লিটার পানি বিনামূল্যে দেয়ার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। অথচ দিলি্লর ভূগর্ভে পানির স্তর এই সরবরাহের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে তাকে পার্শ্ববর্তী হরিয়ানা রাজ্যের দিকে তাকাতে হবে। কিন্তু সেখানে রয়েছে একটি বিজেপি সরকার। বিজেপির সঙ্গে তার সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোন পর্যায় উন্নীত হয়, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। পুরো দিলি্ল শহরে ১৫ লাখ সিসি টিভি বসানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে 'আপ'। এতে খরচ হবে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা, যা কিনা দিলি্লর বার্ষিক আয়ের চারগুণ বেশি। সিসি টিভির নজরদারির জন্য দরকার হবে আরো ৪ লাখ পুলিশ। এতে তো খরচ বাড়বে। এত বিপুল খরচ 'আপ' মেটাবে কিভাবে? পত্রিকাগুলো লিখছে, যেখানে বেইজিং ও লন্ডনের মতো শহরে সিসি টিভির সংখ্যা ৪ লাখ ৭০ হাজার ও ৪ লাখ ২০ হাজার, সেখানে দিলি্লতে ১৫ লাখ সিসি টিভি বসানোর প্রতিশ্রুতি কাগজকলমেই থেকে যাবে। বর্তমানে দিলি্লতে ১ লাখ পুলিশ রয়েছে। নজরদারির জন্য অতিরিক্ত পুলিশ নিয়োগে খরচ বাড়বে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। হাসপাতালগুলোয় অতিরিক্ত 'বেড' বসাতে খরচ হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ৫৫ হাজার অতিরিক্ত কর্মচারী নিয়োগে আরো খরচ হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। দিলি্লর বার্ষিক বাজেট ৩৭ হাজার কোটি টাকা। নয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে এই বাজেট বাড়বে। অথচ রাজস্ব আসে মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে ভ্যাট কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কেজরিওয়াল। তাহলে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন কিভাবে নয়া মুখ্যমন্ত্রী? দিলি্লর বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করল গেলবারের ত্রিশঙ্কু অবস্থা থেকে রাজ্যটি মুক্তি পেয়েছে। এবার তারা একটি স্থায়ী রাজ্য সরকার পাবে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেজরিওয়াল কতটুকু সফল হবেন, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। তবে সর্বভারতব্যাপী এটা কোনো মডেল হবে না। অনেক রাজ্য আছে, যেখানে স্থানীয় দলগুলো রাজ্য সরকার পরিচালনা করে। মাত্র দু'বছর আগে এএপির আবির্ভাব সর্বভারতব্যাপী তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। অরবিন্দ কেজরিওয়াল একজন জাতীয় নেতা হিসেবেও স্বীকৃতি পাননি। গেলবারের লোকসভায় তার দল কোনো আসন পায়নি। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন তাকে পরিচিত করেছিল। সামান্য একজন সরকারি কর্মচারী থেকে আজ তিনি দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন দ্বিতীয়বারের মতো। তার এই অর্জন একেবারে কম নয়। তবে দিলি্লর রাজ্য সরকার পরিচালনা করা তার জন্য একটা সমস্যা হতে পারে। কেন্দ্র থেকে তিনি যদি আদৌ আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতা না পান, তাহলে কোনো কর্মসূচি তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। প্রতিশ্রুতি দেয়া যায় কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন। যদিও মোদি এক সময় তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই 'প্রতিশ্রুতি'র পেছনে কতটুকু আন্তরিকতা আছে, তা শুধু আগামী দিনগুলোর জন্য একটা প্রশ্ন হয়ে থাকল। তবে এটা সত্য, কেজরিওয়াল একটা 'ইমেজ' ইতোমধ্যে গড়ে তুলেছেন। একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ তিনি চান। কাজটি যে খুব সহজ, তা নয়। ভারতে দুর্নীতি প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই রয়েছে। অতিসম্প্রতি একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে_ তাতে দেখা যায়, জেনেভায় বিভিন্ন ব্যাংকে ভারতীয়দের হাজার হাজার কোটি টাকা রয়েছে। কর ফাঁকি আর দুর্নীতির মাধ্যমে এই টাকা পাচার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ৬০ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে বলেও সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং যে রাজ্যের দায়িত্ব নিয়েছেন কেজরিওয়াল, সেখানে কর ফাঁকি আর দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা বেশি। এক্ষেত্রে তিনি কতটুকু সফল হবেন, তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। কেজরিওয়ালের মূল স্পিরিট হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা ও শাসনব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া। এজন্যই তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, বিদ্যুতের বিল অর্ধেক করা এবং বিনামূল্যে দিলি্লবাসীকে পানি সরবরাহ করা ইত্যাদি। ভয় হচ্ছে যে, তার এসব প্রতিশ্রুতি না আবার সস্তা সস্নোগান হয়ে যায়। এখন বিদ্যুৎ কিংবা পানির বিলে রাজ্য সরকার ভর্তুকি দিলে কেন্দ্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হতে বাধ্য। দিলি্লর আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী নয়। এসব ক্ষেত্রে এই ভর্তুকি তিনি কিভাবে মেটাবেন, সে ব্যাপারে তাকে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। পাঞ্জাবে বিনে পয়সায় কৃষকদের বিদ্যুৎ দেয়া হয়। সেখানে আকালি দল ক্ষমতায়। আর আকালি দল হচ্ছে কেন্দ্রের এনডিএ জোটের মিত্র। দিলি্লতেও আকালি দলের সঙ্গে জোট বেধেছিল বিজেপি। সুতরাং একটা প্রশ্ন থাকবেই_ যদি পাঞ্জাবে এই ভর্তুকির ব্যাপারটি বিজেপি সরকার সমর্থন দিয়ে থাকে, তাহলে দিলি্লতে তারা দেবে না কেন? তবু মোদির মন্তব্যের পর কেজরিওয়ালকে এখন নতুন করে ভাবতে হবে। কেজরিওয়ালের ফেরত আসার আর পথ নেই। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাকে এখন তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে। কেন্দ্রের সাহায্য ছাড়া কিভাবে তিনি এসব বাস্তবায়ন করবেন_ সেটাই বড় প্রশ্ন এখন Daily Jai Jai Din 23.02.15

মমতার সফরে কী পেল বাংলাদেশ

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তিন দিনের সফর শেষ হয়েছে শনিবার। কিন্তু কী পেল বাংলাদেশ? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের তিনি শ্রদ্ধাও জানিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ‘হাসিনা দিদি’ হিসেবে সম্বোধন করে তিনি প্রমাণ করলেন, তিনি কত আন্তরিক! প্রটোকল তার কাছে মুখ্য নয়, গৌণ। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে যে এভাবে প্রকাশ্যে ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করা যায় না, মমতা ব্যানার্জির কাছে এটা বিবেচনায় আসেনি। তার জন্য গণভবনে দুপুরের খাবারেরও আয়োজন করা হয়েছিল। ১২ পদের খাবারের তালিকায় ইলিশ ছিল ৪ পদের। সবাই জানেন, বাংলাদেশের ইলিশের প্রতি মমতার বিশেষ টান আছে। আগে মমতা যখন দিল্লিতে রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে যারাই নয়াদিল্লি গেছেন (বিশেষ করে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী), তারা অবধারিতভাবেই সঙ্গে নিয়ে গেছেন ‘পদ্মার ইলিশ’। এবারও ইলিশ প্রসঙ্গ এসেছে (আপাতত রফতানি বন্ধ)। যাকগে। তিস্তার পানি বাণ্টনের সমস্যা একটাই- আর তা হচ্ছে মমতা। মমতার আপত্তির মুখে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এমনকি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখন মমতার আসার কথা ছিল। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যের কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী এলেও শেষ মুহূর্তে মমতা তার আপত্তির কথা জানান। ফলে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি আর করা হয়নি। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে মমতার দৃষ্টিভঙ্গীর কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর তিনি ‘দুদেশের স্বার্থ বিবেচনা করে তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানের আশ্বাস’ দিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা জানিয়েছেন এ কথা। তার আগে ভারতীয় হাইকমিশনার কর্তৃক আয়োজিত ‘বৈঠকি বাংলা’য় মমতা নিজেই বলেছেন তার ওপর ‘আস্থা’ রাখতে। স্থল সীমানা চুক্তি নিয়ে তার আপত্তি নেই- এটা আগেও আমরা জেনেছি। ঢাকাতেও এ কথাটা পুনর্ব্যক্ত করলেন মমতা। কিন্তু তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তার ‘কমিটমেন্ট’ কোথায়? সোজাসাপটা হিসাব হচ্ছে, তিনি ঢাকায় এসে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে কোনো ‘কমিটমেন্ট’ করে গেলেন না। এটাই মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক চরিত্র। যেখানে স্বার্থ রয়েছে, সেখানে মমতা আছেন। তিস্তার পানির ব্যাপারে তার স্বার্থ অনেক বেশি। ২০১৬ সালে সেখানে বিধান সভার নির্বাচন। এটাকে তিনি বিজেপির হাতে তুলে দিতে চান না। উত্তরবঙ্গে পানির চাহিদা বেশি। মমতা এটা জানেন ও বোঝেন। বলা ভালো, ১৯ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ঢাকা সফরের প্রাক্কালে তিস্তায় পানির সর্বনিু প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে। এটা কাকতালীয় কিনা জানি না। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ক’টি বিষয় অন্তরায় সৃষ্টি করেছে, তার মাঝে তিস্তার পানি বণ্টন অন্যতম। এক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একটা আগ্রহ থাকলেও মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। সেই মমতা ব্যানার্জিই এখন ঢাকা ঘুরে গেলেন। তিস্তায় পানি বণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেক বেশি। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, চলতি মাসের প্রথম ৫ দিনে তিস্তার পানি প্রবাহ ৫০০ কিউসিকের নিচে নেমে গেছে। সেচ প্রকল্পে পানি দেয়া দূরের কথা, শুধু নদী বাঁচানোর জন্যই দরকার এক হাজার কিউসেক। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা আজ মৃত্যু মুখে। গত নভেম্বর থেকেই তিস্তার পানি প্রবাহ কমতে থাকে। বাংলাদেশের লালমনিরহাটের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীতে ইতিহাসের সবচেয়ে কম পানি প্রবাহ আসছে। ফেব্রুয়ারি (২০১৫) মাসের প্রথম চার দিনের হিসাবে দেখা গেছে, প্রথম দিন পাওয়া গেছে ৪২৬ কিউসেক, দ্বিতীয় দিন ৪৭৫ কিউসেক, তৃতীয় দিন ৪৪৫ কিউসেক, আর চতুর্থ দিন ৪১৬ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয় (সকালের খবর, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। যৌথ নদী কমিশন সূত্র জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ শুরুর আগে ১৯৭৩-৮৫ সময়কালে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি প্রবাহ ভালো ছিল বলে তুলনার জন্য ওই সময়কালের হিসাবকে ঐতিহাসিক গড় প্রবাহ ধরা হয়। ওই ১২ বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম ১০ দিনে পানি প্রবাহ ছিল ৫৯৮৬ কিউসেক। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে আসে ৯৬৩ কিউসেকে। এ বছর নামল ৫০০ কিউসেকের নিচে। অথচ নদী রক্ষার জন্যই দরকার ১ হাজার কিউসেক পানি। আর বিদ্যমান সেচ প্রকল্পের জন্য আরও সাড়ে ৩ হাজার কিউসেক পানি দরকার। এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি ‘নোট ভারবাল’ পাঠানো হয়েছে।মমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফরের আগে আমরা অনেক প্রত্যাশার কথা শুনেছি। তবে এটা সত্য, তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে এটা সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতি নির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে করে বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তায় পানিপ্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব, আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি বা সমর্থন এটা কোনো বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারী গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দু’দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তীকাল ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু’দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয়েছিল মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই অতীতে মমতার সম্মত্তি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানি বণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানি প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু’।তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যকটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানি সম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই ‘যুক্তি’ ও ন্যায়ের ভিত্তিটি উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জল প্রবাহ কনভেনশন নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এমনভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ, জলভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ- প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমনকিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ এই নিরাপত্তার বিষয়টিকে উপেক্ষা করতে পারে না। এখন ঢাকায় দেয়া মমতার বক্তব্যকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? তার ওপর আমাদের আস্থা রাখতে বলেছেন। কিন্তু আমরা আস্থাটা রাখি কীভাবে? ভারতীয় রাজনীতিতে ‘মোস্ট আনপ্রেডিকটেবল ক্যারেক্টার’ হচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। তার কথার কোনো মূল্য নেই। তার অতীত বলে, তিনি এক সময় কংগ্রেসের মিত্র ছিলেন। আবার বেরিয়ে গেছেন। বিজেপির মিত্র ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। আবার বেরিয়ে গেছেন। সুতরাং তার ওপর আস্থা রাখাটা কঠিন। তিনি যদি সত্যিই আন্তরিক হন, তাহলে তিনি কল্যাণ রুদ্র কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি নিজে এই কমিশন গঠন করেছিলেন। কলকাতার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রুদ্র কমিশন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দেয়া রিপোর্টে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গকে ক্ষতি না করেও বাংলাদেশকে শতকরা ৫০ ভাগ পানি দেয়া সম্ভব। তার এই মন্তব্যকে সমর্থন করেছেন আরেকজন পানি বিশেষজ্ঞ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক প্রণবকুমার রায়। অধ্যাপক রায়ের অভিমত হচ্ছে, তিস্তায় পানি নেই কথাটা ঠিক নয়। পানি মজুদ রাখা (বর্ষা মৌসুমে) ও ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ বাস্তবতার সমাধান করা যায়।এখন মমতা কলকাতা ফিরে গেলেন। তিনি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষের ‘সেন্টিমেন্ট’কে উপলব্ধি করেছেন। তার ঢাকায় থাকা অবস্থাতেই তিস্তার করুণ কাহিনী বাংলাদেশী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিশ্চয়ই এটা দেখেছেন। বাংলাদেশ তাকে ‘বন্ধু’ মনে করে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। তিনি এখন সেই সম্মানটুকু রাখবেন, এটাই বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে। স্থল সীমানা চুক্তির প্রতি তার সমর্থনকে আমরা স্বাগত জানাই। এমনকি বাংলাদেশ-পশ্চিমবাংলা বাণিজ্য বৃদ্ধির উদ্যোগ, যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণ ইত্যাদি সবই ভালো। কিন্তু তিস্তা চুক্তিতে মমতা সমর্থন না দিলে তার সব আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। Daily Jugantor ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫

ভারতীয় রাজনীতি : 'বহেনজি' থেকে 'মাফলারম্যান'

ভারতীয় সাংবাদিকদের অনেকের কাছেই তিনি পরিচিত 'মাফলারম্যান' হিসেবে। তিনি হচ্ছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এখন দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী। মাত্র দুই বছর বয়সের একটি রাজনৈতিক দল আম আদমি পার্টির তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আম আদমি পার্টি বা 'আপ'-এর এ বিজয় একটি প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে- আর তা হচ্ছে, ভারতীয় রাজনীতিতে বড় দলগুলোর কর্তৃত্ব ও প্রভাব কমছে এবং সেইসঙ্গে বাড়ছে আঞ্চলিক দলগুলোর প্রভাব। আপ একটি আঞ্চলিক দল। সর্বভারতব্যাপী একটি চরিত্র এ দলটি এখনও পায়নি। তবে চেষ্টা করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে কিংবা বিহারে দলটির শাখা গঠিত হয়েছে। তবে দিলি্লতে এ দলটি সফলতা পেলেও পশ্চিমবঙ্গে কতটুকু সফল হবে, তার জন্য আমাদের ২০১৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কেননা ২০১৬ সালে সেখানে বিধানসভার নির্বাচন। ভারতীয় রাজনীতি মূলত এখন নিয়ন্ত্রণ করে আঞ্চলিক দলগুলো। তবে কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে হলে বড় দলগুলো (মূলত কংগ্রেস ও বিজেপি) আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে জোট বাঁধে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে পিডিপি, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজবাদী পার্টি, জনতা দল, তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে, বিজু জনতা দল, তেলেগু দেশম, রাষ্ট্রীয় লোকদল ও আকালি দল কোথাও কোথাও বেশ শক্তিশালী। অথচ ৫ বছর আগেও ২০১০ সালে ১৫তম সংসদে এদের আসনসংখ্যা ছিল ৪ থেকে ২২-এর মধ্যে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলোর মধ্যে শিবসেনা, ডিএমডিকে, এসডিএমকে, লোকজনশক্তি, আকালি দল আবার বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটভুক্ত। এদের সবার সমন্বয়ে যদি লোকসভায় (১৬তম লোকসভা) ২৭২ আসনের সমর্থন নিশ্চিত করা না যেত, তাহলে অন্য ছোট ছাট দলগুলোর দিকে তাকাত বিজেপি। আর কংগ্রেসের চেষ্টা ছিল তাদের বিরত রাখতে। দুইটি বড় জোট, একদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ, অন্যদিকে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ- এ দুই জোটের বাইরে বামমনারা তৃতীয় জোটের সৃষ্টি করলেও তা আদৌ কোনো আবেদন রাখতে পারেনি। তৃতীয় জোটের পক্ষে ক্ষমতার আশপাশে থাকারও কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে ভারতীয় রাজনীতিতে তিন মহিলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। এদের একটি অলিখিত জোটও রয়েছে। যদিও ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এ জোট কোনো কাজ করেনি। এমনকি বিজেপির বিশাল জয় নরেন্দ্র মোদিকে কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে তার এনডিএ জোটভুক্ত আঞ্চলিক দলগুলোর দিকেও তাকাতে হয়নি। যারা ভারতীয় রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন ওই তিন মহিলা, বিশেষ করে মায়াবতী দলিতদের পুঁজি করে উত্তর প্রদেশে বিশাল এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। নিজে দলিত, অর্থাৎ নিম্নবর্ণের মানুষ হলেও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী এবং কোনোদিন সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করেননি। রাজনীতি করে বিশাল এক আঞ্চলিক সাম্রাজ্য তিনি গড়ে তুলেছেন। মমতা আর সাবেক অভিনেত্রী জয়ললিতাও এ থেকে পার্থক্য নন। এদের মধ্যে আবার অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। এরা কুমারী, অর্থাৎ বিয়ে করেননি। তবে এদের সবারই বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। এ তিন মহিলা তিনটি রাজ্যের বর্তমান ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং সেখানকার সাধারণ মানুষকে পুঁজি করে রাজনীতি করলেও, তারা নিজ নিজ রাজ্যের বৈষম্য, নারী সহিংসতা দূর করতে পারেননি। মায়াবতীর উত্তর প্রদেশের কথাই বলা যেতে পারে। এ রাজ্যের বুন্দেলখ- গ্রামের গুলাব গ্যাংয়ের কথা বাংলাদেশের মানুষ পত্রপত্রিকা পড়ে জেনেছেন এত দিনে। অন্যায়ের প্রতিবাদে, নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে সাধারণ এক নারী সম্পাত পাল দেবী সংগঠিত করেছিলেন গ্রামের নারীদের। গোলাপি শাড়ি সবাই পরতেন বিধায় এ বাহিনীর নামকরণ হলো গুলাব গ্যাং। লাঠি হাতে তাদের মিছিলের ছবি ও তাদের ওপর এক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল লন্ডনের গার্ডিয়ানে। সম্প্রতি গুলাব গ্যাংয়ের কাহিনী নিয়ে মুম্বাইয়ে একটি ছবিও হয়েছে। মাধুরী দীক্ষিত অভিনয় করেছেন সম্পাত পাল দেবীর ভূমিকায়। এটা একটা বাস্তব কাহিনী। মায়াবতীরা সাধারণ নারীদের বিরুদ্ধে অন্যায়কে পুঁজি করেই বহুজন সমাজবাদী পার্টিকে সংগঠিত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এখন অবশ্য তিনি আর মুখ্যমন্ত্রী নন। কিন্তু তিনি নিজে দলিত হয়েও দলিতদের নূ্যনতম অধিকার নিশ্চিত করতে পারেননি। ভারতের গণতন্ত্রের এটাই বড় সমস্যা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে বৈষম্য অনেক বেশি। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেনের ধারণা এখানে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তার নিজ দেশেই তার তত্ত্ব খাটেনি (যে দেশে গণতন্ত্র রয়েছে, সে দেশে দরিদ্রতা নেই!)। একটা পরিসংখ্যান দিই, ২০০৪ সালে ভারতে ৪১ কোটি লোক দরিদ্র ছিল, জনসংখ্যার যেটা ২৭ দশমিক ৫ ভাগ। আর ২০১০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ০২ ভাগ। যারা জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিদিন ১ দশমিক ২৫ ডলার আয় করেন। সেই হিসাবে দারিদ্র্যের এ সংখ্যা ঠিক করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক তার ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ গরিব মানুষের বাস ভারতে। এ গরিব মানুষগুলোর একটা বড় অংশ বাস করে উত্তর প্রদেশে। এরাই হচ্ছেন মায়াবতীর ক্ষমতার উৎস। তিনি সবার কাছেই 'বহেনজি' হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, তার পরিচয় 'দিদি' হিসেবে। তিনি সবার দিদি। অতি সাধারণ এক জীবনযাপন তার। সাধারণ এক সুতি শাড়ি আর পায়ে সাধারণ সেন্ডেল পরে তিনি এখন মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে বসেন। সাধারণ মানুষের জন্য তিনি কাজ করেন। যে কারণে সাধারণ মানুষ বামপন্থী সিপিএমের পরিবর্তে তার দলকে বেছে নিয়েছিল। সেটা ছিল একটা যুগান্তকারী ঘটনা, যেখানে তিনি বামদের দুর্গে ধস নামিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, একরকম অস্তিত্ববিহীন করেছেন বামদের। তৃণমূল কংগ্রেসের কারণে মূল কংগ্রেসের কোনো অস্তিত্বই নেই পশ্চিমবঙ্গে। সোনিয়া গান্ধী পর্যন্ত এখন সমীহ করে চলেন মমতা ব্যানার্জিকে। মমতা ব্যানার্জি যে এখনও জনপ্রিয়, তার সর্বশেষ প্রমাণ ১৬ ফেব্রুয়ারির দুইটি উপনির্বাচনের ফল। দুইটি উপনির্বাচনেই বিজয়ী হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী। এখানে কংগ্রেস তৃতীয় অবস্থানেও থাকেনি। এর অর্থ হচ্ছে, মমতার প্রতিদ্বন্দ্বী এখন মমতা নিজেই। দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে সিপিএম।আর আম্মার গল্পটা শুরু জয়ললিতাকে দিয়ে। একসময়ের তামিল, তেলেগু আর কান্নাড়া ছবির নায়িকা জয়ললিতার রাজনীতিতে উত্থান তামিলনাড়ুর জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী রামচন্দ্রনের হাত ধরে। রামচন্দ্রনও একসময় তামিল ফিল্মের নায়ক ছিলেন। রামচন্দ্রনই তার 'নায়িকা' জয়ললিতাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। অভিযোগ আছে, জয়ললিতা রামচন্দ্রনের সঙ্গে একটা অবৈধ সম্পর্ক রক্ষা করতেন। কিন্তু রামচন্দ্রন কোনো দিনই জয়ললিতাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেননি। রামচন্দ্রন ছিলেন 'অলইন্ডিয়া আন্না ডেবিদ্রা সুনেত্রা কাজাখাম (আইএডিএমকে)-এর প্রতিষ্ঠা সভাপতি। তার মৃত্যুর পর এআইএডিএমকে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগের নেতৃত্ব দেন রামচন্দ্রনের স্ত্রী, যিনি পরবর্তী সময়ে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। অন্যভাগের নেতৃত্ব দেন জয়ললিতা। জয়ললিতা তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন চার চারবার- ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০২-২০০৬, ২০১১-১৪ সাল পর্যন্ত। তিনি এখনও আইএডিএমকের নেত্রী। সবাই তাকে 'আম্মা' বা মা হিসেবেই সম্বোধন করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জয়ললিতা তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হলেও তিনি কিন্তু এ রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি জন্মেছিলেন মহিসুরে, যা আজ কর্নাটক রাজ্য হিসেবে পরিচিত। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই তিনি উচ্চআদালত কর্তৃক অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। আয়কর আইনে সম্পত্তির তথ্য গোপন করার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তারপরও তিনি তামিলনাডুর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অন্যতম একটি ফ্যাক্টর।এ তিন মহিলার সঙ্গে এখন যুক্ত হলেন 'মাফলারম্যান' অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এটা একটা ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে, কেজরিওয়ালের ছবি মানেই হচ্ছে গলায় সব সময় মাফলার পেঁচানো একজন মানুষ। এরা তিনজনই এখন তিনটি রাজ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন। এর বাইরেও বিহার, উড়িষ্যা কিংবা জম্মু ও কাশ্মীরে এক ধরনের ব্যক্তি বা পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি আমরা লক্ষ্য করি। তবে বিহারে লালু প্রসাদ যাদব, উড়িষ্যায় বিজু পট্টনায়েকের সঙ্গে তাদের পার্থক্য হচ্ছে মমতা-ব্যার্নাজি কিংবা কেজরিওয়াল কোনো পারিবারিক রাজনীতি থেকে উঠে আসেননি। নিজেদের কর্মদক্ষতা আর সুশাসনের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার তাদের আজ এ অবস্থায় নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। মমতা ও অরবিন্দের ক্ষেত্রে পারিবারিক রাজনীতি প্রচলন করারও সুযোগ কম। মমতা কুমারী, বিয়ে করেননি। আর অরবিন্দ কেজরিওয়ালের স্ত্রী সরকারি চাকুরে, ছেলে ও মেয়ে দুজনই এখনও কৈশোর অতিক্রম করেনি। ফলে মমতা আর কেজরিয়ালের উত্থানের পেছনে কাজ করছে তাদের রাজনীতি এবং কমিটমেন্ট। পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতির পতন ঘটানো এত সহজ ছিল না। কিন্তু মমতা এটা করেছিলেন। এমনকি মূল কংগ্রেসের কোনো চিহ্নও নেই পশ্চিমবঙ্গে। আর কেজরিওয়ালের উত্থান অতি সাম্প্রতিক। ঝানু ঝানু রাজনীতিবিদকে পেছনে ফেলে তিনি নিজেকে স্থানীয় রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলেন।কেজরিওয়ালের মূল স্পিরিট হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা ও শাসন ব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া। এজন্যই তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- বিদ্যুৎতের বিল অর্ধেক করা, বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করা ইত্যাদি। ভয় হচ্ছে, এটা না আবার 'সস্তা সেস্নাগান' হয়ে যায়! তবে কেজরিওয়ালের একটা ভালো জিনিস লক্ষণীয়। তিনি নির্বাচনের আগে ও পরে তার বিরোধী পক্ষ, বিশেষ করে কিরণ বেদি সম্পর্কে কোনো খারাপ মন্তব্য করেননি। ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমনটি দেখা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে তার পার্থক্য এখানেই। দিলি্লর বিধানসভায় কোনো বিরোধী দল থাকবে না। এটাও একটা খারাপ দিক। 'আপ' এর নীতির কোনো সমালোচনা আমরা শুনতে পাব না। এতে করে দায়বদ্ধতার একটা অভাব অনুভূত হবে। সেইসঙ্গে কেজরিওয়ালকে একনায়কতন্ত্রী করে তুলতে পারে! তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, ভারতীয় রাজনীতিতে একটি ভিন্ন চরিত্র নিয়ে আবির্ভূত হলেন মাত্র ৪৭ বছরের অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ৫ বছর তার জন্য কম সময় নয়। তিনি কতটুকু সফল হবেন, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে।তবে এখন যে প্রশ্নটি অনেকেই করার চেষ্টা করবেন তা হচ্ছে, ভারতীয় রাজনীতিতে 'মাফলারম্যান', 'দিদি' কিংবা 'আম্মা'দের উত্থান রাজনীতিটাকে তারা কতটুকু বদলে দিতে পারবেন? স্থানীয়ভাবে এরা শক্তিশালী, জনপ্রিয়, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা সীমিত। তবে এদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। কখনও কখনও এদের সমর্থন ছাড়া কেন্দ্রে সরকার গঠন করাও যাচ্ছে না। ১৬তম লোকসভা নির্বাচন হয়ে গেল। ১৭তম লোকসভার নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে। সময়টা অনেক লম্বা। তখন দেখতে হবে সর্বভারতব্যাপী বিজেপির একক কর্তৃত্বের ধারায়, এরা কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারেন। কেজরিওয়াল, মমতা আর জয়ললিতার আগামী ৫ বছরের রাজনীতির দিকে তাই লক্ষ্য থাকবে অনেকের। Daily ALOKITO BANGLADESH 22.02.15

আপ ম্যাজিক কি কাগজে-কলমেই থেকে যাবে

বিধানসভার নির্বাচনে আম আদমি পার্টির (আপ) অসাধারণ বিজয় ও আপ ‘সুপ্রিমো’ অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সব প্রতিশ্র“তি কি শেষ পর্যন্ত কাগজে-কলমেই থেকে যাবে? ইতিমধ্যেই হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গেছে। কীভাবে অরবিন্দ কেজরিওয়াল তার প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করবেন? কেননা দিল্লির নিজস্ব আয়ের ক্ষেত্রটা খুব বড় নয়। তার ওপর কেন্দ্রে যে সরকার রয়েছে, তার সঙ্গে ‘আপ’-এর সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন আছে। নির্বাচনের আগে কেজরিওয়াল যেসব প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ বিল অর্ধেক করে দেয়া, প্রতি মাসে পরিবারপ্রতি বিনামূল্যে ২০ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা, ১৫ লাখ সিসিটিভি স্থাপন, ফ্রি ওয়াইফাই, ৫০০ ফ্রি স্কুল, ২০ ফ্রি কলেজ, হাসপাতালে ৩০ হাজার বেড বাড়ানো, ৫৫ হাজার নতুন স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা, ভিআইপি সংস্কৃতি বন্ধ করা ইত্যাদি। এসব প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ‘ধাক্কা’ খাবেন দিল্লির বর্তমান বিদ্যুৎ চাহিদা ৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ‘আপ’ নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা বলছে। এক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের কারণে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা অতিরিক্ত গ্যাসের কারণে গ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা দিল্লিতে বেসরকারি খাতে। এরা শতকরা ৫২ ভাগ বেশি আয় করে। এদের আয়-ব্যয় হিসাব করার হুমকি দিয়েছে ‘আপ’। এখন যদি মুখ্যমন্ত্রী বিদ্যুৎ বিল অর্ধেক করার নির্দেশ দেন, তাতে রাজস্ব আয় অনেক কমে যাবে। আয় কমে গেলে কোন খাত থেকে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের উন্নয়নের অর্থ জোগাবেন? প্রতি মাসে ২০ হাজার লিটার পানি বিনামূল্যে দেয়ার প্রতিশ্র“তি তিনি দিয়েছেন। অথচ দিল্লির ভূগর্ভে পানির স্তর এ সরবরাহের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে তাকে পার্শ্ববর্তী হরিয়ানা রাজ্যের দিকে তাকাতে হবে। কিন্তু সেখানে রয়েছে বিজেপি সরকার। বিজেপির সঙ্গে তার সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। পুরো দিল্লি শহরে ১৫ লাখ সিসিটিভি বসানোর প্রতিশ্রুতি পূরণে খরচ হবে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা, যা কিনা দিল্লির বার্ষিক আয়ের ৪ গুণ। সিসিটিভির নজরদারির জন্য দরকার হবে আরও ৪ লাখ পুলিশ। এতেও খরচ বাড়বে। এত বিপুল খরচ ‘আপ’ মেটাবে কীভাবে? পত্রিকাগুলো লিখছে, যেখানে বেইজিং ও লন্ডনের মতো শহরে সিসিটিভির সংখ্যা ৪ লাখ ৭০ হাজার ও ৪ লাখ ২০ হাজার, সেখানে দিল্লিতে ১৫ লাখ সিসিটিভি বসানোর প্রতিশ্রুতি কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। বর্তমানে দিল্লিতে ১ লাখ পুলিশ রয়েছে। নজরদারির জন্য অতিরিক্ত পুলিশ নিয়োগে খরচ বাড়বে ৫ হাজার কোটি টাকা। হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত বেড বসাতে খরচ হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ৫৫ হাজার অতিরিক্ত কর্মচারী নিয়োগে আরও খরচ হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। দিল্লির বার্ষিক বাজেট ৩৭ হাজার কোটি টাকা। নয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে এ বাজেট বাড়বে। অথচ রাজস্ব আসে মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে ভ্যাট কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কেজরিওয়াল। তাহলে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন কীভাবে নয়া মুখ্যমন্ত্রী?সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে বিজেপির ভোটপ্রাপ্তি এবার কমেছে। অর্থাৎ বিজেপির যে নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক ছিল তাতে ধস নেমেছে। যদিও তাদের নির্দিষ্ট ভোটার আছে। একই সঙ্গে ধস নেমেছে কংগ্রেস ভোটেও। যারা এতদিন কংগ্রেসকে ভোট দিত, তারা এখন কংগ্রেসের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। গরিব, মধ্যবিত্ত, দলিত মুসলমানরা এতদিন কংগ্রেসকেই ভোট দিয়েছে। এরাই কংগ্রেসের ভোটব্যাংক। এরা এবার আর কংগ্রেসকে ভোট দেয়নি। এরা এখন ‘আপ’ বা এএপিতে তাদের আস্থা খুঁজে পেয়েছে। ফলে এএপির ভোটপ্রাপ্তি বেড়েছে, যা কেজরিওয়ালের সরকার গঠনে সহায়ক হচ্ছে।একটা প্রশ্ন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই করবেন- যেখানে লোকসভায় সবক’টি আসন পেয়েছিল বিজেপি, সেখানে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বিজেপি সমর্থন হারাল কেন? এর অনেক কারণ আছে। লোকসভা আর বিধানসভার নির্বাচন এক নয়। দুই নির্বাচনের মেজাজ ভিন্ন ধরনের। লোকসভায় জাতীয় ইস্যু প্রাধান্য পায় আর বিধানসভায় প্রাধান্য পায় স্থানীয় ইস্যু। ২০১৪ সালে ভারতব্যাপী একটি পরিবর্তনের ঢেউ ছিল। সেই পরিবর্তনে ক্ষমতাচ্যুত হয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। মোদি নতুন একটা ইমেজ নিয়ে এসেছিলেন। সাধারণ মানুষ তাতে আস্থা রেখেছিল আর কংগ্রেসের ব্যর্থতা ছিল কংগ্রেস ২০১৪ সালে কোনো নতুন রাজনীতি উপহার দিতে পারেনি। কিন্তু দিল্লির বিধানসভার নির্বাচন একটি ভিন্ন বিষয়। এখানে দুর্নীতি, ধর্ষণ ইত্যাদি ইস্যু প্রাধান্য পেয়েছে। কিরণ মোদিকে বিজেপি সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরেছিল। এতে সমস্যা হয়েছে একাধিক। দলের ভেতরে, যারা স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তারা খুশি হননি। তাদের নীরবতা এএপির অনুকূলে গেছে। উপরন্তু কিরণ বেদী দিল্লির বাসিন্দা নন। তিনি বহিরাগত। রাজনীতিতেও যথেষ্ট অভিজ্ঞ নন। দক্ষ পুলিশ অফিসার হিসেবে তার নামডাক আছে। মানুষ তাকে চেনে দক্ষ ও যোগ্য অফিসার হিসেবে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়ে নিজেকে সুবিধাবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়ান। তুলনামূলক বিচারে অরবিন্দ কেজরিওয়াল আরও বেশি যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য ছিলেন। দিল্লির ১ কোটি ৩০ লাখ ভোটারের একটা বড় অংশ নিু-মধ্যবিত্ত, দলিত ও মুসলমান। বিজেপি এদের কাছে যেতে পারেনি। কিরণ বেদীর ব্যর্থতা ছিল এখানেই যে, তিনি এ শ্রেণীর সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেননি। তারা কংগ্রেসের পরিবর্তে এএপিকেই ভোট দিয়েছে।বিজেপির নীতি এবং নরেন্দ্র মোদির নীতি উচ্চবিত্ত তথা ব্যবসায়ী শ্রেণীকে টার্গেট করে পরিচালিত হচ্ছে। বড় বড় ব্যবসার কথা বলেন মোদি। তার আশপাশে নব্য ব্যবসায়ী শ্রেণীর ভিড় বেড়েছে। এতে করে উপেক্ষিত থাকছে মধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণী। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, ওবামার অনুষ্ঠানে মোদি যে স্যুটটি পরেছিলেন তার দাম প্রায় ১০ লাখ টাকা। লন্ডনের এক ফ্যাশন হাউস থেকে এটি তৈরি করা হয়। মোদি ‘গরিবের বন্ধু’ নন, এমন একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যে। ফলে মধ্যবিত্ত ও দলিত শ্রেণী যে তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিরণ বেদী নিজেও কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। খুব স্বাভাবিকভাবেই দলিত শ্রেণী ধরে নিয়েছে তিনিও মোদির মতো ‘ধনীদের বন্ধু’। শুধু তাই নয়, বিজেপির সমর্থন নিয়ে সংঘ পরিবারের নেতৃত্বে ভারতজুড়ে ‘ঘর ওয়াপসি’ বা ধর্মান্তকরণ কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। ধর্মান্তকরণের (অথবা মূল ধর্মে প্রত্যাবর্তন) নামে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের হিন্দু বা সনাতন ধর্মে দীক্ষিত করার কর্মসূচি ভারতজুড়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। খোদ ওবামা ভারত সফরের সময় পরোক্ষভাবে এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। দিল্লির ভোটারদের একটা অংশ শিক্ষিত। তারা বিজেপির এ পরোক্ষ সমর্থনকে সহজভাবে নিতে পারেনি। ভোটের হিসাব-নিকাশে এর প্রভাব পড়েছে।অতীতে কেজরিওয়ালের অনেক কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছিল। যেমন আগেরবার ক্ষমতায় গিয়ে তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি ও বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করে দিয়েছিলেন। এতে বস্তিবাসী গরিব মানুষ উপকৃত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ এখনও মনে করেন, তিনি এ ধরনের কর্মসূচি আরও দেবেন। তাতে উপকৃত হবে মধ্যবিত্ত। ধনীরা তার কাছ থেকে সুবিধা পাবে না। ফলে ভোট পড়েছে বেশি। তার দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচিতেও মানুষের আস্থা রয়েছে। ভোটারদের একটা বড় অংশই মনে করে, ভারতে দুর্নীতি একটা বড় সমস্যা। এ সমস্যার কারণেই উন্নয়ন ঠিকমতো হচ্ছে না। আর রাজনীতিকদের একটা বড় অংশই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এক্ষেত্রে এএপি ব্যতিক্রম।দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করল, গেলবারের ত্রিশঙ্কু অবস্থা থেকে রাজ্যটি মুক্তি পেয়েছে। এবার তারা একটি স্থায়ী রাজ্য সরকার পাবে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেজরিওয়াল কতটুকু সফল হবেন, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। তবে এটা ভারতব্যাপী কোনো মডেল হবে না। অনেক রাজ্য আছে, যেখানে স্থানীয় দলগুলো রাজ্য সরকার পরিচালনা করে। মাত্র দু’বছর আগে এএপির আবির্ভাব ভারতব্যাপী তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। অরবিন্দ কেজরিওয়াল একজন জাতীয় নেতা হিসেবেও স্বীকৃতি পাননি। গত লোকসভায় তার দল কোনো আসন পায়নি। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন তাকে পরিচিত করেছিল। সামান্য একজন সরকারি কর্মচারী থেকে তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন দ্বিতীয়বারের মতো। তার এ অর্জন একেবারে কম নয়। তবে দিল্লির রাজ্য সরকার পরিচালনা করা তার জন্য একটা সমস্যা হতে পারে। কেন্দ্র থেকে তিনি যদি আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতা না পান, তাহলে কোনো কর্মসূচিই তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। প্রতিশ্রুতি দেয়া যায়; কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন। যদিও মোদি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবে সে প্রতিশ্রুতির পেছনে কতটুকু আন্তরিকতা আছে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। তবে এটা সত্য, কেজরিওয়াল একটা ‘ইমেজ’ ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছেন। একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ তিনি চান। কাজটি যে খুব সহজ, তা নয়। ভারতে দুর্নীতি প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই রয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, জেনেভায় বিভিন্ন ব্যাংকে ভারতীয়দের হাজার হাজার কোটি টাকা রয়েছে। কর ফাঁকি আর দুর্নীতির মাধ্যমে এ টাকা পাচার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ৬০ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে বলেও সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং যে রাজ্যের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন কেজরিওয়াল, সেখানে কর ফাঁকিবাজ আর দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা বেশি। এক্ষেত্রে তিনি কতটুকু সফল হবেন, তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।কেজরিওয়ালের মূল স্পিরিট হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং শাসন ব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া। এজন্যই তিনি প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন বিদ্যুতের বিল অর্ধেক করা, বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করা ইত্যাদির। ভয় হয়, এটা না আবার ‘সস্তা স্লোগান’ হয়ে যায়। তবে কেজরিওয়ালের একটা ভালো জিনিস লক্ষণীয়। তিনি নির্বাচনের আগে ও পরে তার বিরোধী পক্ষ, বিশেষ করে কিরণ বেদী সম্পর্কে কোনো খারাপ মন্তব্য করেননি। ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমনটি দেখা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে তার পার্থক্য এখানেই।দিল্লির বিধানসভায় কোনো বিরোধী দল থাকবে না, এটাও একটা খারাপ দিক। ‘আপ’-এর নীতির কোনো সমালোচনা আমরা শুনতে পাব না। এতে করে দায়বদ্ধতার একটা অভাব অনুভূত হবে। এটা কেজরিওয়ালকে একনায়কতন্ত্রী করে তুলতে পারে। তবে স্বীকার করতেই হবে, ভারতীয় রাজনীতিতে একটি ভিন্ন চরিত্র নিয়ে আবির্ভূত হলেন মাত্র ৪৭ বছরের অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ৫ বছর তার জন্য কম সময় নয়। তিনি কতটুকু সফল হবেন, সেটাই দেখার বিষয়। Daily Jugantor ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫

মমতা আসছেন : তিস্তাচুক্তির কী হবে

সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ঢাকা আসছেন। বিষয়টি ইতোমধ্যেই নিশ্চিত হয়েছে। কয়েকজন ফিল্ম স্টার ও ব্যবসায়ী তার সঙ্গে আসছেন। তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তিনি দেখা করবেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি বাংলাদেশের অনেকেই করতে চাইবেন তা হচ্ছে, মমতার এই সফরের মধ্য দিয়ে কি একটি তিস্তা চুক্তির পথ প্রশস্ত হবে? আদৌ কি একটি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে? এখানে বলা ভালো, ২০১১ সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমাহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় মমতা ব্যানার্জির সফরসঙ্গী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি ঘুরে দাঁড়ান। জানিয়ে দেন তিনি ঢাকা যাবেন না। সেই থেকে তিস্তা পানিবণ্টন নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণেই একটা প্রশ্ন থাকবে যে, মমতার এই সফরের মধ্য দিয়ে বরফ আদৌ গলবে কিনা? মমতা কি শেষ পর্যন্ত পানিবণ্টনে রাজি হবেন? তার এই সফর কি নরেন্দ্র মোদির মার্চে বাংলাদেশ সফরের পথ প্রশস্ত করবে?


এই নদীর পানিবণ্টন আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে হতে হবে। মমতার
পাগলামোর জন্য পানি-নাটক বন্ধ থাকতে পারে না। পানি দেওয়া, না দেওয়ার সঙ্গে তার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। বাংলাদেশ পানি পাবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। আর পশ্চিমবঙ্গ যদি বাধা দেয়, তার দায়ভার গিয়ে বর্তাবে ভারত সরকারের ওপর। এতে করে আন্তর্জাতিক আসরে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকবে। ভারত বিশ্বসভায়, বিশেষ করে জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদে স্থায়ী সদস্য হতে চায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর প্রতি তার আচরণ যদি ন্যায়সঙ্গত না হয়, যা জাতিসংঘের আইনে বলা আছে, তাহলে তার নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে থাকবে। এমনিতেই ভারতের আচরণ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো এ ধরনের অস্বস্তিতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তিস্তায় পানি না দিয়ে উজানে পানি প্রত্যাহার করা হলে, তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে ঠেলে দেবে মরুময়তার দিকে। পানির এভাবে যে সংকটের সৃষ্টি হবে, তা বাংলাদেশকে ঠেলে দেবে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন তাহলে এ দেশ, বিশেষ কর উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে করে বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তায় পানিপ্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তিÑ এটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুদেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তীকালে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দুদেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখন যুক্ত হয়েছে মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচকাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি রাজনৈতিক ইস্যু

তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিটি উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জলপ্রবাহ কনভেনশন নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমি বিষয়ক রামসাগর কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহের সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।

তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভারত কখনই বাংলাদেশের এই নিরাপত্তা ঝুঁকিটি বিবেচনায় নেয়নি। আমরা বারবার লক্ষ করেছি, ভারত তার স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে বেশি। ত্রিপুরায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করা হয়েছে। এরপর ত্রিপুরায় খাদ্য সরবরাহেরও আমরা অনুমতি দিয়েছি। ভারত ‘বিদ্যুৎ কানেকভিটি’র নামে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে। অথচ কোনো একটি ক্ষেত্রেও আমাদের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে ভারত নজর দেয়নি। শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর হয়নি। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি ভারত। ফারাক্কায় পানির প্রবাহ কমে গেছে। এ ব্যাপারেও আলোচনার কোনো উদ্যোগ নেই। টিপাইমুখ ও ফুলেরতল ব্যারাজ নিয়ে একটা ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে, মোদি সরকার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পও বাস্তবায়ন করবে। তাই ভারতের নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বাংলাদেশে এসে বলেন, তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান হবে, কিন্তু তাতে আস্থা রাখি কীভাবে? কেননা পশ্চিমবঙ্গে ২০১৫ সালেই পৌরসভা নির্বাচন ও ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচন। তিস্তার পানি মমতারও দাবি। ভারতের সংবিধানে রাজ্য সরকারকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাই সুষমা স্বরাজ যখন তিস্তার পানিবণ্টনের কথা বলেন, তাতে হাজারটা প্রশ্ন এসে যায় বৈকি! এটা কথার কথা। মমতা ঢাকায় আসছেন। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি তিনি প্রথম দেখবেন পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ। এক সময় তার পূর্বপুরুষ যশোরের অধিবাসী ছিলেন। এতে করে একটা প্রত্যাশা থাকতেই পারে তিনি বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই তিনি বাঙালি হতে পারেন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে তার কাছে প্রথম অগ্রাধিকার। তবে একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছেÑ আগের চেয়ে তিনি বেশ নমনীয়। সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে তিনি তার সম্মতি দিয়েছেন। এখন দেখতে হবে তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে তিনি কতটুকু ‘কমিনমেন্ট’ করেন। ভুলে গেলে চলবে না ভারতের রাজনীতিতে ‘মোস্ট আনপ্রডেকটিভ ক্যারেক্টার’ হচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। যেখানে তার স্বার্থ নেই, সেখানে তিনি নেই। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো, এটা বলা যাবে না। গত ৮ ফেব্রুয়ারি নরেন্দ্র মোদি সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে যে মিটিং করেন, সেখানে মমতা অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি এমন কিছু করেন না যাতে মোদি সুবিধা পাবেন। তাই তিস্তাচুক্তি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তারপরও মমতা ঢাকা আসছেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই।