রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

আইওআর শীর্ষ সম্মেলন কিছু মৌলিক প্রশ্ন

ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত 'ইন্ডিয়ান ওসেন রিম' বা আইওআরের একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ভারতের ওড়িষা রাজ্যের রাজধানী ভুবনেশ্বরে ২০-২২ মার্চ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। ভারত মহাসাগরভুক্ত বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া আইওআরের সদস্য। এই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এমন একটি সময়ে যখন ভারতের নয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন করে সাজাচ্ছেন। তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই সঙ্গে এশিয়ায় ভারতকে অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বাদে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশ সফর করেছেন। তার পররাষ্ট্র সচিবও 'সার্ক যাত্রার' অংশ হিসেবে সার্কভুক্ত প্রতিটি দেশ সফর করেছেন। ভুবনেশ্বর শীর্ষ সম্মেলনের আগে নরেন্দ্র মোদি মরিশাস, সিসিলি ও শ্রীলংকা সফর করেছেন। মরিশাস সফরের সময় মরিশাসের সঙ্গে সেখানে একটি ভারতীয় ঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার ভারত ভারতীয় মহাসাগরে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ ব্যাপারে মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার সঙ্গে একটি মৈত্রী জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। এবং ওই জোট মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকার আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূল থেকে শ্রীলংকা, দক্ষিণ মধ্যাঞ্চলের সিসিলি, মরিশাস, এমনকি ওমান-মোজাম্মিকও এই প্রক্রিয়ায় একীভূত হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিকভাবে এ অঞ্চলের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। ভারত তাই এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে অন্যতম শক্তি হিসেবে বিশ্বরাজনীতিতে আবির্ভূত হতে চায়। এ ক্ষেত্রে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে চীন। চীন যে তার 'মেরিটাইম সিল্করুট'-এর কথা বলছে, সেই 'সিল্ক রুট'-এর সঙ্গে ভারতের এই অর্থনৈতিক স্বার্থ সাংঘর্ষিক। চীন ও ভারতের স্বার্থ এক ও অভিন্ন_ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ফলে চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখন রীতিমতো ওসেনের রুখে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গেল সেপ্টেম্বরে চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফর এবং আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কর্তৃক তাকে অভ্যর্থনা জানানো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের সেই পঞ্চাশের দশকের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দিলেও, অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে অতি সম্প্রতি দুই দেশের সঙ্গে আস্থার সম্পর্কে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ২০ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী মোদি অরুণাচল সফর করেন। সেখানে তিনি রেলপথ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করেন। এর প্রতিবাদ জানিয়েছে চীন। টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মোদির অরুণাচল সফরের সমালোচনা করে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া ওই বিবৃতিতে বলা হয় চীনা সরকার কখনো 'অরুণাচল প্রদেশ'কে স্বীকৃতি দেয়নি। বেইজিংয়ের মতে চীনের অন্তর্গত তিব্বতের মনিযুল, লোয়ুল ও নিম্নসায়ুল এলাকা নিয়ে 'তথাকথিত অরুণাচল' প্রদেশ গড়েছে নয়াদিলি্ল। ওই এলাকাগুলো এখনো ভারতের বেআইন দখলদারির কবলে রয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই অভিমত সঙ্গত কারণেই দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন কিছুদিন আগে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুজিও কিসিদা ভারতে এসেছিলেন। সেখানে তিনি অরুণাচল প্রদেশ যে ভারতের, সে ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিরিনদার ওই বক্তব্যে চীন ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। চীন মনে করে ভারত জাপানকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। আগামী মে মাসে প্রধানমন্ত্রী মোদি চীন সফরে যাবেন। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়ছে। মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি প্রথম সফরে ভুটান গিয়েছিলেন। ওই সময় সেখানে চীনবিরোধী বক্তব্যও তিনি দিয়েছিলেন। চীন এখন পর্যন্ত ভুটানে তার দূতাবাস খোলার অনুমতি পায়নি শুধু ভারতের আপত্তির কারণে। নয়া পররাষ্ট্রসচিব জয়শংকর তার দক্ষিণ এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে ভুটান হয়ে ২ মার্চ ঢাকা সফর করেন। এরপর যান পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। ইতোমধ্য ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এ অঞ্চলে নতুন এক মেরুকরণের জন্ম দিয়েছে। ওবামার ভারত (২৫ জানুয়ারি ২০১৫) সফর এই নয়া মেরুকরণের জন্ম দিয়েছে। ভারতের 'নয়া পররাষ্ট্রনীতিতে' এই মেরুকরণ কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল তথা ভারত মহাসাগর আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা। এই দুটো অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু সামরিক তৎপরতা লক্ষণীয়। দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে একটি সামরিক ঐক্য গঠিত হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে চীনের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করা। অন্যদিকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন তার নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়িয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে অ্যারাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্র পক্ষ তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। কারণ এ পথ তার জ্বালানি সরবরাহের পথ। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। এদিকে ভারতও ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতের নৌবাহিনীর 'নিউ ইস্টার্ন ফ্লাইট'-এ যুক্ত হয়েছে বিমানবাহী জাহাজ। রয়েছে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন। আন্দামান ও নিকোমরে রয়েছে তাদের ঘাঁটি। ফলে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চীন ও ভারতের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। এশিয়া-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্ব নিয়ে চীন ও ভারতের অবস্থান এখন অনেকটা পরস্পর বিরোধী। যেখানে চীনা নেতৃত্ব একটি নয়া 'মেরিটাইম সিল্ক রুট'-এর কথা বলছে, সেখানে মোদি সরকার বলছে 'ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোর'। স্বার্থ মূল এক ও অভিন্ন এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই এশিয়ার এই দুটো বড় দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। এটাকেই কাজে লাগাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এক সময় মার্কিনী গবেষকরা একটি সম্ভাব্য চীন-ভারত অ্যালায়েন্সের কথা বলেছিলেন। জনালন হোলসলাগ ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে লিখিত একটি প্রবন্ধে ঈযরহফরধ (অর্থাৎ চীন-ভারত)-এর ধারণা দিয়েছিলেন। নয়া চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের (২০১৪) পর ধারণা করা হচ্ছিল যে দেশ দুটো আরো কাছাকাছি আসবে। কিন্তু শ্রীলংকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা, ওবামার ভারত সফর এবং চীনা প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে এই সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। নতুন আঙ্গিকে 'ইন্ডিয়া ডকট্রিন'-এর ধারণা আবার ফিরে এসেছে। এই 'ইন্ডিয়া ডকট্রিন' মানরো ডকট্রিনের দক্ষিণ এশীয় সংস্কার। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কারো কর্তৃত্ব ভারত স্বীকার করে নেবে না। এক সময় এই এলাকা অর্থাৎ ভারত মহাসাগরীয় এলাকা ঘিরে 'প্রিমাকভ ডকট্রিন' (২০০৭ সালে রচিত। শ্রীলংকা, চীন, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার ঐক্য)-এর যে ধারণা ছিল শ্রীলংকায় সিরিসেনা বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণা এখন আর কাজ করবে না। ফলে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী ধারণাকে আরো শক্তিশালী করতে বিসিআইএস (বাংলাদেশ চীনের ইউনান রাজ্য, ভারতের সাতবোন, মিয়ানমার) যে আগ্রহ দেখিয়েছিল, তাতে তখন শ্লথগতি আসতে পারে। সাময়িক এ অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত এখন আর বিসিআইএম ধারণাকে 'প্রমোট' করবে না। আর বাংলাদেশের একার পক্ষে চীন ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে 'বিসিএম' ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হবে না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে ওবামার ভারত সফরের মধ্যদিয়ে ভারত নানাভাবে লাভবান হয়েছে। 'পাক্কা গুজরাতি' নরেন্দ্র মোদি জাতিগতভাবেই ব্যবসা বোঝেন। ভারতের জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ ভাগ মানুষ অতি দরিদ্র, অর্ধেক জনগোষ্ঠীর যেখানে স্বাস্থ্যসম্মত কোনো পায়খানা নেই আর সেখানকার ৩১ ভাগ জনগোষ্ঠীর দৈনিক আয় ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে (যা চীনা জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত প্রতি দরিদ্রের মানদ-) ভাবতে প্রতি ৩ জনের মধ্যে একজন দরিদ্র। ১২১ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত। প্রতিদিন ভারতে মারা যায় ৫ হাজার শিশু। আর কন্যা শিশুর ভ্রূণ হত্যা করার কাহিনী তো অনেক পুরনো। এক সংবাদে বলা হয়েছিল ভারতে ১ লাখ ৮৩ হাজার কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে গত ১০ বছরে আত্মহত্যা করেছেন। মোদি এখানে পরিবর্তনটি আনতে চাচ্ছেন। তার পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হচ্ছে বিনিয়োগ বাড়ানো। আর বিনিয়োগ বাড়াতেই তিনি জাপান ও মার্কিন বিনিয়োগকারীদের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। স্বভাবতই ভারতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে, দরিদ্র্য কমবে। মানুষের মধ্যে যে বৈষম্য তা যদি কমিয়ে আনা যায় ভারত আরো সামনে এগিয়ে যাবে। মোদির স্বার্থ এখানেই। তবে একটা ভয়ের কারণ আছে। আর তা হচ্ছে চিরবৈরী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা। ওবামার ভারত সফরের পর পরই ভারত পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য মিসাইল অগি্ন-৫ উৎক্ষেপণ করেছিল। এই অগি্ন-৫-এর ব্যপ্তিসুদূর চীন পর্যন্ত। ভারত এখন আর পাকিস্তানকে বিবেচনায় নিচ্ছে না। ভারতের টার্গেট হচ্ছে চীন। অর্থাৎ চীনের কর্তৃত্ব কমানো। অগি্ন-৫ নিক্ষেপের পরদিনই পাকিস্তান তার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র 'রাদ' না 'ব্রজ'-এর পরীক্ষা চালিয়েছিল। এর আগে পাকিস্তান হাতল নামে পারমাণবিক বোমা বোহনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। ফলে দেশ দুটি আবারো এক ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষায় নিয়োজিত হলো। মোদির পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানের গুরুত্ব কম। যদিও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাক-প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছিল দুই দেশের সম্পর্ক বাড়বে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মোদির পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। ইতোমধ্যে তিনি ভুটান, নেপাল সফর করছেন। এই মার্চেই তিনি গেছেন শ্রীলংকায়। তিনি জাফনাতেও গেছেন। আগামীতে বাংলাদেশেও আসতে পারেন। চীনকে গুরুত্ব দেয়ার পেছনে কাজ করছে তার ব্যবসায়িক নীতি। তিনি চান বিনিয়োগ। তবে চূড়ান্ত বিচারে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। তবে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোই হবে মোদি সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার। ভুবনেশ্বর সম্মেলনটি তাই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ভারত মহাসাগরের বিশাল অর্থনৈতিক সম্পদ, সম্পদ আহরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এটাকে বলা হচ্ছে 'নীল অর্থনীতি'। অর্থাৎ সাগরের নীল জলরাশির সঙ্গে মিল রেখে এই উদ্যোগকে বলা হচ্ছে নীল উদ্যোগ।' নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ এই উদ্যোগ থেকে উপকৃত হতে পারে। কেননা আমাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ ছিল (ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে), তার একটা সমাধান হয়েছে। এখন প্রয়োজন সমুদ্র সম্পদ আহরণের উদ্যোগ, বড় বিনিয়োগ। এ ক্ষেত্রে আইওআর জোট আমাদের সাহায্য করতে পারে কিংবা জোট থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি। কিন্তু জোটটি যদি চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, তাহলে আমরা উপকৃত হবো না। বরং চীনের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক, তাতে প্রভাব ফেলবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা উচিত। চীনের বিরুদ্ধে কোনো জোটে শরিক হওয়া আমাদের উচিত নয়। Daily Jai Jai Din 31.03.15

একটি ভালো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রত্যাশা


তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে চলমান রাজনীতিকে সক্রিয় করার একটি উদ্যোগ নিয়েছে বটে; কিন্তু তাদের সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও ‘বিতর্ক’ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে অনেকেই মনে করেন, খুব দ্রুত তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা চাচ্ছিলেন ঢাকা সিটির (উত্তর ও দক্ষিণ) নির্বাচন হোক। কেননা আট বছর ধরে এই নির্বাচন হচ্ছে না। তবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়রের সময়সীমা খুব শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে এবং আগামী জুলাই মাসের মধ্যে সেখানে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হতো। দেশের চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি(?) অব্যাহত থাকার মাঝে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে বৈকি। তবে প্রশ্ন যতই থাকুক, একটা নির্বাচনের প্রয়োজন ছিল। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমেই জনসেবা নিশ্চিত করা যায়। আমলা দিয়ে জনসেবা নিশ্চিত করা যায় না। ঢাকা মহানগরের মানুষ এ জনসেবা পাচ্ছে না বেশকিছু দিন ধরে। মশক নিধন কর্মসূচিসহ অনেক জনসেবামূলক কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কোটি

কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এই মশক নিধন কর্মসূচিতে। তাহলে এ টাকা কোথায় যাচ্ছে? কে এ থেকে সুবিধা নিচ্ছে? জনপ্রতিনিধিরা থাকলে তাদের দায়বদ্ধতা থাকে; কিন্তু আমলারা থাকলে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। সেজন্যই আসন্ন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের সিদ্ধান্তটি প্রশংসাযোগ্য।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারের নীতিনির্ধারকরা চাচ্ছেন নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়ে ‘সব রাজনৈতিক দলকে’ স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করার একটি সুযোগ দিতে। কিন্তু যে মিলিয়ন ডলার প্রশ্নের সমাধান এখন পর্যন্ত হয়নি তা হচ্ছে, বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা? পত্রপত্রিকায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে বলা হলেও এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমান বিষয়টি খোলাসা করেননি। ২৯ মার্চের মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে। সুতরাং সময় খুব বেশি নেই। এরই মধ্যে বিএনপির দু-একজন নেতা মনোনয়নপত্র ক্রয়ও করেছেন। তবে যেহেতু সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হয়, সেহেতু বিএনপি একটি কৌশল অবলম্বন করতে পারে। কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা না করে বিএনপি পরোক্ষভাবে কোনো কোনো প্রার্থীকে মেয়র পদে সমর্থন করতে পারে। সেই সঙ্গে কাউন্সিলর পদে বিএনপি সমর্থকরাও প্রার্থী হবেন বলে আমার ধারণা। এক্ষেত্রে
বিএনপি দুটি কৌশল গ্রহণ করতে পারে- এক. আন্দোলন যেভাবে চলছে, সেভাবে আন্দোলন
অব্যাহত রাখা। দুই. নির্বাচনে প্রার্থী হতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি তার জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটারও পরীক্ষা করে দেখতে পারে।
তবে নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর একটি সুযোগ এসেছে। নির্বাচনটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও সন্ত্রাসমুক্ত হবে- এটা ইসিকে নিশ্চিত করতে হবে। এমনিতেই ইসি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক হারিয়েছে। এখন সুযোগ এসেছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। এটা তো সত্য, সরকার যদি ইসিকে সহযোগিতা না করে, তাহলে ইসির পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া সম্ভব নয়। সরকার সমর্থকরা প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। ইসি এক্ষেত্রে কতটুকু শক্তিশালী হতে পারবে, এ প্রশ্ন থাকলই। নির্বাচনী এলাকায় কর্মকর্তাদের বদলি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসি এ ব্যাপারে সরকারকে চিঠি দিয়েছে। এখন সরকার ইসির পরামর্শ কতটুকু গ্রহণ করে সেটি দেখার বিষয়। একটি জটিলতা আছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) ওয়ার্ড সংখ্যা নিয়ে। উত্তরের লোকসংখ্যা ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩১৩, আর ওয়ার্ডের সংখ্যা ৩৬। অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের লোকসংখ্যা কম, কিন্তু ওয়ার্ড সংখ্যা বেশি। লোকসংখ্যা ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৬৩, আর ওয়ার্ড ৫৭টি। ফলে এক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য রয়েছে। নির্বাচনের আগে এ বৈষম্য দূর করা সম্ভবও হবে না। ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল।
নির্বাচনের জন্য যে বিষয়টি বেশ জরুরি তা হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা। ইসি কি এটা পারবে? বিএনপির অনেক স্থানীয় নেতা, সাবেক কাউন্সিলর হয় পলাতক, নতুবা মামলার আসামি। কেউ বা আবার গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন। তাদের কেউ যদি প্রার্থী হনও তারা তো ভয়ে প্রচারণা চালাতে পারবেন না। তাহলে কি নির্বাচনটা একপক্ষীয় হয়ে যাবে না? তাদের ন্যূনতম যে সুযোগ থাকার কথা তা নিশ্চিত হবে কীভাবে? সরকারি দলের ঘোষিত প্রার্থীরা এরই মধ্যে নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘন করেছেন। একজন ব্যবসায়ী, একজন সংসদ সদস্য এবং একজন সাবেক মেয়রপুত্রের বিলবোর্ডে ঢাকা শহর ছেয়ে গিয়েছিল নির্বাচনের আগেই। কেউ নির্বাচনে ‘জয়ী’ হওয়ার আগেই যদি আচরণবিধি লংঘন করে, তা ইসির ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বৈকি! শুধু তাই নয়, প্রার্থীরা আদৌ ঋণখেলাপি কিনা, এটাও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। একজন প্রার্থীর কাছে একটি বেসরকারি ব্যাংকের পাওনা ছিল ১১৮ কোটি টাকা। তিনি বাড়ি বিক্রি করে টাকার কিছুটা পরিশোধ করেছেন, এমন তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী প্রার্থীর খবর কী? তিনি আদৌ ঋণখেলাপি কিনা, ঋণ রিসিডিউল করেছেন কিনা, আমরা জানি না। এসব ধনী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী যখন প্রার্থী হন এবং যাদের কাছে ব্যাংকের পাওনা থাকে ১০০ কোটি টাকার ওপরে, তারা যখন ‘নগরপিতা’ হতে চান, তখন আমাদের দুঃখ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা
থাকে না। সিটি কর্পোরেশনের মতো জায়গায় ব্যবসায়ীদের প্রার্থী না করাই মঙ্গল। কারণ এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের ব্যবসায়িক ‘স্বার্থ’
থাকে। হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের কাজ
হয় সিটি কর্পোরেশনগুলোয়। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ থাকাটাই স্বাভাবিক।
এ তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন কতটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, আমরা জানি না। বিএনপির প্রার্থীরা অংশ নিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। আর না নিলে সরকারি দলের প্রার্থীরা ‘খালি মাঠে’ গোল দেবে! প্রশ্ন এখানেই। বিএনপি এ সুযোগটি দেবে কিনা? বিএনপির ব্যাপক সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। আন্দোলনের পরিণতি
যাই হোক না কেন, একটা নৈতিক সমর্থন তো বিএনপির প্রতি আছেই। বিএনপি কি এ সুযোগটি কাজে লাগাবে না? বিএনপি আন্দোলনের বিকল্প হিসেবেও এ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, সেটা প্রত্যক্ষ হোক কিংবা পরোক্ষভাবে হোক।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে এক ধরনের অস্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছে। সরকার ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের মধ্যে কোনো আস্থার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না। খালেদা জিয়া সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে ৩ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করলেও কোনো একটি দাবিও সরকার মানেনি। ফলে নির্বাচন সামনে রেখে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা একরকম ‘ভেস্তে’ গেছে। তাই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির সরাসরি অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন থাকলই। যদিও জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের মতো সিনিয়র নেতারা বলেছেন, বিএনপি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবে। ২০ দলীয় জোটে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এমন কথাও আমাদের জানিয়েছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান।
বিএনপি তার কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। অতীতে টানা হরতাল থাকলেও গেল ২৫ মার্চ বিএনপি কোনো হরতালের কর্মসূচি দেয়নি। ২৬ মার্চ ছিল স্বাধীনতা দিবস। বোধকরি এটা বিবেচনায় নিয়েই বিএনপি হরতাল কর্মসূচি স্থগিত করেছে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ হচ্ছে ২৯ মার্চ। ওইদিন মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষদিন। ১ ও ২ এপ্রিল মনোনয়নপত্র বাছাই আর ৯ এপ্রিল প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। এখন ২৯ তারিখ একদিন মাত্র কর্মদিবস। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার তারিখ বাড়িয়ে ইসি একটি সুযোগ নিতে পারে বিএনপিকে কাছে টানার। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনোভাব এ ব্যাপারে কী তা স্পষ্ট নয়।
একটি ভালো নির্বাচন আমরা চাই, দলমত নির্বিশেষে সবাই তাতে অংশ নিক। একটা প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি হোক। আর নির্বাচন মানেই তো প্রতিযোগিতা। প্রধান রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি এ প্রতিযোগিতাকে ম্লান করে দেবে। প্রতিযোগিতাবিহীন একটি নির্বাচন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য মোটেই কোনো ভালো খবর নয়।
Daily Jugantor
28.03.15

কোরীয় উপদ্বীপে নতুন করে উত্তেজনা

কোরীয় উপদ্বীপে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম হয়েছে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত হাইয়ুন হাকবংয়ের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। ২০ মার্চ স্কাই নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত বলেছেন, পরমাণু অস্ত্র ছোড়ার সক্ষমতা উত্তর কোরিয়ার আছে এবং আক্রান্ত হলে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারে দেশটি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য এবং বিবিসি ও আল জাজিরার মতো সংবাদমাধ্যমগুলো গুরুত্ব সহকারে সংবাদটি প্রকাশ করেছে। এর প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা উদ্বিগ্ন এবং উত্তর কোরিয়া যে আন্তর্জাতিক চুক্তির বরখেলাপ করেছে- এটা জানাতেও তারা ভোলেনি। একদিকে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ ও দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের প্রশ্নটি বেশ কিছুদিন ধরে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোচিত হয়ে আসছে। ১৯৯০ সালের পর থেকেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ছিল দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের দিকে। এখানে সমস্যা হচ্ছে, একত্রীকরণের পর কোরিয়ার সমাজ ব্যবস্থা কী হবে? পুঁজিবাদী সমাজ, নাকি সমাজতান্ত্রিক সমাজ? জার্মানিতে এখন আর সমাজতান্ত্রিক সমাজ নেই। পূর্ব জার্মানি পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে মিশে গিয়ে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। চীনেও আজ ধ্রুপদী মার্কসবাদ নেই। চীনের সঙ্গে হংকং অনেক আগেই একীভূত হয়েছে হংকংয়ের পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা বজায় রেখেই, যে ব্যবস্থাকে চীন বলছে 'এক দেশ দুই অর্থনীতি'। তেং জিয়াও পিং ছিলেন এই ধারণার প্রবক্তা। চীন তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও একই নীতি অবলম্বন করছে। তাইওয়ান হংকং মডেল অনুসরণ করে চীনের সঙ্গে একীভূত হতে পারে। কোরিয়ার ক্ষেত্রে এই হংকং মডেল একটি সমাধান হতে পারে। ভবিষ্যৎই বলে দেবে দুই কোরিয়া এক হবে কিনা।

বেশ কিছুদিন কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা নেই। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ইয়ংপিয়ং দ্বীপে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ (২০১০-এর ২৩ নভেম্বর) ও তাতে দুই সৈনিকের মৃত্যু, দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীপ্রধানের পদত্যাগের পর কিছুদিন উত্তেজনা সেখানে বজায় ছিল। ওই সময় একটি যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সেখানে বিরাজ করছিল। উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে ছয় জাতি আলোচনাও কার্যত ব্যর্থ। উত্তর কোরিয়াকে কোনোভাবেই আলোচনার টেবিলে আনা যাচ্ছে না। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন তিন জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া) আলোচনায় উৎসাহী। কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক প্রধান এডমিরাল মাইক মুলেন ছুটে গিয়েছিলেন জাপানে। তিনি সেখানে তিন জাতিভিত্তিক একটি 'প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা' গড়ে তোলার কথাও বলেছিলেন। চীনের একজন সিনিয়র কূটনীতিকও ওই সময় পিয়ং ইয়ং সফর করেছিলেন। এতে করে উত্তেজনা সাময়িকভাবে হ্রাস পেয়েছিল সত্য; কিন্তু তা স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে যে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই উত্তর কোরিয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া বিশ্বে অষ্টম পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপর থেকেই উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে এ অঞ্চলের বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। এরপর থেকেই আলোচনা শুরু হয় কীভাবে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণুমুক্ত করা সম্ভব। একপর্যায়ে চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কারিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া অবিলম্বে তার ইয়ংবাইঅনস্থ (ণড়হমনুড়হ) পারমাণবিক চুলি্লটি বন্ধ করে দেয়, যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা, উত্তর কোরিয়া ৬ থেকে ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া ৬০ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুলি্লগুলো পরিদর্শনেরও সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এরপর ২০০৭ সালের অক্টোবরে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোহ মু হিউম ২ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া যান এবং সেখানে উত্তর কোরিয়ার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন। এটা ছিল দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক। এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কোরিয়া বিভক্তকারী অসামরিক গ্রাম পানমুনজমে সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে। এ অঞ্চলের গত ৫৩ বছরের রাজনীতিতে ওই ঘটনা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে আর দুই কোরিয়ার নেতারা কোনো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হননি। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের (১৯৯০) পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন কোরীয় উপদ্বীপের দিকে। সেই থেকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জংকে 'দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টার' জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।

কোরিয়া একটি বিভক্ত সমাজ। দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের সমাজ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট উত্তর কোরিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ। আর ৯৯ হাজার ২২২ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট দক্ষিণ কোরিয়ার লোকসংখ্যা ৪ কোটি ২৮ লাখ। একসময় যুক্ত কোরিয়া চীন ও জাপানের উপনিবেশ ছিল। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধের পর কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে ও জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কৌশলগত কারণে কোরিয়াকে দুই ভাগ করে। এক অংশে মার্কিন বাহিনী ও অপর অংশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাহিনী অবস্থান নেয়। সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতেই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে (আজকের যা উত্তর কোরিয়া) একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে নিউ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে নবগঠিত কোরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে। জাতিসংঘের আহ্বানে সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও, দেখা গেল নির্বাচন শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে যুদ্ধ বেধে যায়। জাতিসংঘ এ যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ বাহিনী মাঞ্চুরিয়ার সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং চীনা সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যকর হয় দুই বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই। এরপর থেকে কার্যত উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া দুইটি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে আসছে। ১৯৫৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তিবলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও, উত্তর কোরিয়ায় কোনো চীনা সৈন্য নেই। উত্তর কোরিয়া চীনের সঙ্গে ১৯৬১ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। গত ৬৪ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় একাধিক সরকার গঠিত হলেও, উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে একবার, ১৯৯৪ সালে কিম উল সুংয়ের মৃত্যুর পর তার পুত্র কিম জং ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন কিম জং ইল অসুস্থ ছিলেন। এখন তার ছোট সন্তানকে সেখানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি যদি দায়িত্ব পালনকালে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের উদ্যোগ নেন, সেটা হবে একুশ শতকের শুরুতে একটি বড় ধরনের ঘটনা। তবে যে কোনো মুহূর্তে উত্তেজনা সেখানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। উত্তর কোরিয়া তাদের প্রধান পরমাণু স্থাপনা ছাড়াও গোপনে আরও কয়েকটি স্থাপনায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে বলে দক্ষিণ কোরিয়া অভিযোগ করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে উত্তর কোরিয়া আরও পরমাণু পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করছে। এজন্য তারা সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে। এ হারে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হলে আগামী (২০১৫) মে মাস নাগাদ প্রয়োজনীয় এক হাজার মিটার সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শেষ হবে। এর অর্থ হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া আরেকটি পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে পারে। এতে করে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। যুদ্ধ হবে কিনা বলা মুশকিল। কেননা উত্তর কোরিয়া যেখানে বড় ধরনের খাদ্য সঙ্কটের মুখে, সেখানে তারা এত বড় ঝুঁকি নেবে না। উত্তেজনা জিইয়ে রেখে তারা সুবিধা আদায় করে নিতে চায়।

এ মুহূর্তে উত্তর কেরিয়ার বড় শত্রু চীন। চীন যদি তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে উত্তর কোরিয়া 'একা' হয়ে পড়বে। তখন আলোচনায় যাওয়া ছাড়া তার কোনো বিকল্প থাকবে না। উত্তর কোরিয়া বারবার বলে আসছে তার পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এবং দক্ষিণ কোরিয়া এ কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার জ্বালানি সঙ্কটের সমাধানের সাময়িক উদ্যোগ নিলেও এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হয়নি। উত্তর কোরিয়া তার জ্বালানি সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের আশ্বাস পেলে দেশটি তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করতে পারে। তবে একটা মূল প্রশ্নে সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর তা হচ্ছে, দুই কোরিয়ার একত্রীকরণ। আগামীতে সব আলোচনাই কেন্দ্রীভূত হবে একত্রীকরণের লক্ষ্যে। তবে এটাও সত্য, একত্রীকরণের প্রশ্নটি যত সহজ ভাবা হচ্ছে, অত সহজ নয়। উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি এখনও সমাজ ও সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং সেখানে অভ্যুত্থান কিংবা ক্ষমতাসীন পার্টিকে উৎখাত করার সম্ভাবনা কম।

তবে এ মুহূর্তে বড় সমস্যা হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি ও পারমাণবিক পরীক্ষার সম্ভাবনা। যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটা আবারও প্রমাণিত হলো যে, উত্তর কোরিয়া বড় ধরনের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা থাকবেই। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের প্রায় একই সময় জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। সেখানে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়টি প্রকাশ্যে আলোচিত না হলেও, এ অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। এ অঞ্চলের উত্তেজনা কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। এমনিতেই বিশ্বে নতুন করে এক ধরনের 'স্নায়ু যুদ্ধের' জন্ম হয়েছে। ইউক্রেনকে নিয়ে এক ধরনের 'প্রঙ্ িওয়ার' এর জন্ম দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এমনি এক পরিস্থিতিতে কোরীয় উপদ্বীপে যে কোনো উত্তেজনা এ 'স্নায়ু যুদ্ধের' সম্ভাবনাকে আরও উসকে দেবে। - See more at: http://www.alokitobangladesh.com/editorial/2015/03/29/130167#sthash.KPvpasuV.dpuf

ভুবনেশ্বর সম্মেলন আমাদের কী মেসেজ দিয়ে গেল

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরে একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ২০-২২ মার্চ। ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোর (মোট ২০টি দেশ) একটি সংস্থা হচ্ছে ‘ইন্ডিয়ান ওসেন রিম’ বা সংক্ষেপে আইওআর। আর আইওআরের শীর্ষ সম্মেলন ছিল এটি। শীর্ষ সম্মেলন শেষে ‘ভুবনেশ্বর ঘোষণাপত্র’ও স্বাক্ষরিত হয়। এখন আমাদের মতো ছোট দেশগুলোর জন্য এই ভুবনেশ্বর ঘোষণার গুরুত্ব অনেক বেশি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই ভুবনেশ্বর সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। শীর্ষ সম্মেলনের নামকরণ করা হয়েছে ‘ভারত ও ভারত মহাসাগর সম্মেলন।’ এ থেকেই বোঝা যায়, সম্মেলন আয়োজন করার পেছনে ভারতের উদ্দেশ্য কী। সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান আর এন রবি যে বক্তব্য রেখেছেন, তা যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে ভারতের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হবে আমাদের কাছে। সম্মেলনে সুষমা স্বরাজ সুস্পষ্ট করেই বলেছেন, ভারত মহাসাগরে চিনের প্রবেশ ভারতের কাছে কাক্সিক্ষত নয়। আর শীর্ষ গোয়েন্দা কর্তা আর এন রবি বলেছেন, ভারত মহাসাগরকে কোনোভাবেই শক্তিশালী দেশগুলোর দাবার বোর্ড বানাতে দেওয়া যাবে না। তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতের কর্তৃত্ব থাকলে এই অঞ্চলে শান্তি বজায় থাকবে (আনন্দবাজার, ২১ মার্চ)। বার্তাটি স্পষ্টÑ এ অঞ্চলে ভারত কাউকে প্রভাব বিস্তার করতে দেবে না। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ভুবনেশ্বর শীর্ষ সম্মেলনের আগে নরেন্দ্র মোদি মরিশাস, সিসিলি ও শ্রীলঙ্কা সফর করেছিলেন। মরিশাস সফরের সময় মরিশাসের সঙ্গে সেখানে একটি ভারতীয় ঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার ভারত ভারতীয় মহাসাগরে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ ব্যাপারে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটি মৈত্রী জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত এবং এ জোটে মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। ফলে ভারত মহাসাগরে আগামী দিনে ভারতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল তথা ভারত মহাসাগর আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা। এই দুটি অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ‘সামরিক তৎপরতা’ লক্ষণীয়। দক্ষিণ চিন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে একটি সামরিক ঐক্য গঠিত হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে চিনের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। অন্যদিকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিন তার নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়িয়েছে। দক্ষিণ চিন সাগর থেকে মাল্লাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে অ্যারাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চিন। কারণ এ পথ তার জ্বালানি সরবরাহের পথ। চিনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। এদিকে ভারতও ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতের নৌবাহিনীর ‘নিউ স্টান ফিট’-এ যুক্ত হয়েছে বিমানবাহী জাহাজ। রয়েছে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন আন্দামান ও নিকোবরে রয়েছে তাদের ঘাঁটি। ফলে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চিন ও ভারতের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। এশিয়া-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্ব নিয় চিন ও ভারতের অবস্থান এখন অনেকটা পরস্পরবিরোধী। যেখানে চিনা নেতৃত্ব একটি নয়া ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’-এর কথা বলছে, সেখানে মোদি সরকার বলছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোর।’ স্বার্থ মূলত এক ও অভিন্নÑ এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই এশিয়ার এই দুটো বড় দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। এটাকেই কাজে লাগাতে চয় যুক্তরাষ্ট্র।এক সময় মার্কিনি গবেষকরা একটি সম্ভাব্য চিন-ভারত অ্যালায়েন্সের কথা বলেছিলেন। জনাথন হোলসলাগ ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে লিখিত একটি প্রবন্ধে ঈযরহফরধ (অর্থাৎ চিন-ভারত) এর ধারণা দিয়েছিলেন। নয়া চিনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের (২০১৪) পর ধারণা করা হচ্ছিল যে, দেশ দুটি আরও কাছাকাছি আসবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা, ওবামার ভারত সফর এবং চিনা প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে এই সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। নতুন আঙ্গিকে ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ ধারণা আবার ফিরে এসেছে। এই ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ মনরো ডকট্রিনের দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কারও কর্তৃত্ব ভারত স্বীকার করে নেবে না। এক সময় এই এলাকা অর্থাৎ ভারত মহাসাগরীয় এলাকা ঘিরে ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ (২০০৭ সালে রচিত। শ্রীলংকা, চিন, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার ঐক্য) এর যে ধারণা ছিল, শ্রীলঙ্কায় সিরসেনার বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণা এখন আর কাজ করবে না। ফলে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী ধারণাকে আরও শক্তিশালী করতে বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চিনের ইউনান রাজ্য, ভারতের সাতবোন, মিয়ানমার) যে আগ্রহ দেখিয়েছিল, তাতে এখন শ্লথগতি আসতে পারে। সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত এখন আর বিসিআইএম ধারণাকে ‘প্রমোট’ করবে না। আর বাংলাদেশের একার পক্ষে চিন ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে ‘বিসিএম’ ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হবে না। ভারতের ওই কর্তৃত্ব করার প্রবণতা এ অঞ্চলের দৃশ্যপটকে আগামী দিনে বদলে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও লক্ষণীয়। ভারত বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। এখানে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ছে। ফলে এখানে মার্কিনি স্বার্থ থাকবেই। এ অঞ্চলে মার্কিনি স্বার্থের অপর একটি কারণ হচ্ছে চিন। চিনকে ‘ঘিরে ফেলা’র একটি অপকৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি কৌশলগত সম্পর্কে নিজেদের জড়িত করেছে। এই দুই দেশের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। তবে ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুদেশের মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। বিভিন্ন গবেষকের লেখনীতে এটা মন্তব্য করা হচ্ছে যে, একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বড় অর্থনৈতিক শক্তিÑ চিন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করবে। সঙ্গত কারণেই বিশ্বের বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ থাকবে এই অঞ্চলের ব্যাপারে। যদিও জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টারও যুক্তরাষ্ট্র। জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চিনের সঙ্গে যে বিপদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে। এদিকে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলছেন, তা ‘অন্য চোখে’ দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা এতে করে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চিনা কর্তৃক, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগ চিনের হ্যান রাজবংশ এই ‘সিল্ক রোড’টি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ সিল্ক রোডের মাধ্যমে চিনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য সেখানেও চিনের প্রভাব বেড়েছিল। চিনের নয়া প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চিনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’-এর কথাও আমরা জানি, যা কি না চিনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই মেরিটাইম সিল্ক রুটের ধারণাও কয়েকশ বছর আগের। এ মেরিটাইম সিল্ক রুট ধরে চিনা এডমিরাল ঝেং হে (মা হে) ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সাল- এই ২৮ বছর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে চিনা পণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৪২১-১৪৩১ সালে তিনি দুবার তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে এসেছিলেন। চিন এই নৌরুটটি নতুন করে আবার ব্যবহার করতে চায়। তবে কয়েকশ বছরের ব্যবধানে এই অঞ্চল অনেক বদলে গেছে। চিন আর একক শক্তি নয়। ভারত তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়েই তার নিজের স্বার্থ আদায় করতে চায়। ফলে এটা স্পষ্ট নয়, ভারত-চিন সম্পর্ক আগামীতে কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হবে। কেননা ভারত মহাসাগরে চিন ও ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। এই স্বার্থ যদি পরস্পরবিরোধী হয়, তাহলে সংঘর্ষ অনিবার্য। মোদির মে মাসে চিন সফরের আগে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান কৈলাসের যাত্রা সহজ করতে চায় ভারত। চিন এ ব্যাপারে নমনীয় হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এখন কৈলাসে যেতে হয় উত্তরাখ-ের কাঠগোদাম থেকে হেঁটে। এটা কষ্টদায়ক ও পথটি দুর্গম। পথটিও দীর্ঘ। অথচ কৈলাসে গাড়িতে করে যাওয়া সম্ভব। গ্যাংটকের পাশেই নাথুলা। রাস্তাও ভালো চিনের দিকে। চিন অনুমতি দিলে গাড়িতে করেই তীর্থযাত্রীরা কৈলাসে যেতে পারবেন। মোদি নিজেও এ পথে কৈলাস যেতে চান। তাই দক্ষিণ এশিয়ায় চিনা প্রভাব কমাতে মোদির উদ্যোগ আদৌ কোনো ফল দেবে কি না, এটা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। ব্যক্তিগতভাবে মোদি চিনের ব্যাপারে যতই আগ্রহী থাকুন না কেন, ভারতে একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্র আছে। এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা পৃথিবীর শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি। এরা ভারতের স্বার্থকে সব সময় ‘বড়’ করে দেখতে চায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ইতোমধ্যে ভারতের এক ধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টদের চোখ এখন ভারত মহাসাগরের দিকে। ভারত মহাসাগরে শুধু যে বিশাল সম্পদই রয়েছে, তা নয়। বরং বিশ্বের ‘কার্গো শিপমেন্ট’-এর অর্ধেক পরিবাহিত হয় এই ভারত মহাসাগর দিয়ে। একই সঙ্গে ৩ ভাগের ১ ভাগ কার্গো, ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৩ ভাগের ২ ভাগ এবং ৪ ভাগের ৩ ভাগ ট্রাফিক পৃথিবীর অন্যত্র যেতে ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ। পৃথিবীর আমদানিকৃত পণ্যের (তেলসহ) শতকরা ৯০ ভাগ পরিচালিত হয় এই সামুদ্রিক রুট ব্যবহার করে। তাই এই সমুদ্র পথের নিরাপত্তার প্রশ্নটি গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি করে। ভুবনেশ্বর সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ভারত তার অবস্থান স্পষ্ট করল। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে, ভারত এ অঞ্চলের অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে চায়। চিনা নেতারা ভারতীয় এই ভূমিকাকে যে খুব সহজভাবে নেবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। Daily Amader Somoy 29.03.15

ভারত-চীন দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের অবস্থান স্পর্শকাতর

| ২২ মার্চ ২০১৫, রবিবার
<a href="http://platinum.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/ck.php?n=a52828b8&cb=INSERT_RANDOM_NUMBER_HERE" target="_blank"><img src="http://platinum.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/avw.php?zoneid=785&cb=INSERT_RANDOM_NUMBER_HERE&n=a52828b8" border="0" alt="" /></a>
সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া যে নমনীয়তা দেখিয়েছেন তাতে সরকারের সাড়া দেয়া উচিত। তিনি সেখানে তিন দফা দিয়েছেন। দুটি অনায়াসে মেনে নিতে পারে সরকার। যেমন গ্রেপ্তারকৃত সকল নেতাকর্মীকে মুক্তি ও সভা-সমাবেশ করতে দেয়া। এক্ষেত্রে বিএনপি চলমান কর্মসূচি স্থগিত করতে পারে। আসতে পারে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। সরকার দুই দফা মেনে নিয়ে আলোচনার একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে।
মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার নুর মোহাম্মদ।
অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বলেন, বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের পথ একটাই। সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারই দেশের অভিভাবক। তাদেরকেই উদ্যোগ নিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সকল দলের অংশগ্রহণের একটি নির্বাচন। কিন্তু সরকার এই মুহূর্তে সেটি চাচ্ছে না। তিনি বলেন, বিদেশীদের হস্তক্ষেপ বা উপদেশ বর্তমান সংকট সমাধানে কোন ভূমিকা পালন করবে না। এই সংকটের সমাধান দুটি বড় দলকে মিলে করতে হবে। এক্ষেত্রে সংলাপের কোন বিকল্প নেই। যেকোন পর্যায়ে হউক এটা করতে হবে। সহিংসতার প্রতি মানুষের কোন সমর্থন নেই। এই সহিংস ঘটনাবলী আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় একটি কথা আছে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্ড’ অর্থাৎ ‘আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা’। একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে এই আস্থার সম্পর্কটি থাকে। আস্থার সম্পর্ক না থাকলে গণতন্ত্র বির্নিমাণ করা যায় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই আস্থার পরিবেশটি জরুরি।
সমাধান কূটনীতিকরা করতে পারবে না তারাও জানে। কারণ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে কূটনীতিকরা সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এক্ষেত্রে বিদেশীরা বলতে পারে এটা কর, ওটা কর। জাতিসংঘ বলতে পারে সংকট আছে। কিন্তু কোন এখতিয়ার নেই সরাসরি হস্তক্ষেপ করার। এরপরও তারা যদি কোন ফয়সালা করে তাতে আমাদের এখানে বাজে সংস্কৃতি জন্ম দেবে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারত চাচ্ছে ভারত মহাসাগর সংশ্লিষ্ট দেশগুলো নিয়ে একটি লিডারশিপ তৈরি করা। সে লিডারশিপ তাদের হাতে রাখা। এটি মোদি সরকারের নতুন নীতি। ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন পরস্পর শক্তি ও প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ভারত চাচ্ছে ভারত মহাসাগরকে সামনে রেখে এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। যাতে চীন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারে। এতে সঙ্গত কারণে ভারত-চীন এক ধরনের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাবে। সেখানে বাংলাদেশ খুব স্পর্শকাতর অবস্থানে থাকবে। তাই অনেকটা সাবধানে এগুতে হবে আমাদের। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে যাতে কোন পক্ষকে সমর্থন না করা হয়। কৌশলগত কারণে যদি চীনকে সমর্থন না করি তবে ভারতকে যেন সমর্থন না করা হয়। আর পশ্চিমারা বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে এখানে ভারতকেন্দ্রিক একটি বলয় গড়ে তুলতে। এ জন্য ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করছে। আগামী দিনে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক আরও গাঢ় হবে। এরফলে মার্কিন কর্তৃত্বটা প্রতিষ্ঠা হতে পারে এ অঞ্চলে। উদ্দেশ্য চীনকে এ অঞ্চলে কোণঠাসা করে রাখা।

এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

যৌক্তিক পরিণতিটা আসলে কী

বেগম জিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন গত ১৩ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে। দীর্ঘ ৫৩ দিন পর গণমাধ্যমের সম্মুখে তিনি হাজির হলেন। ওই দিন টানা অবরোধ-হরতাল যখন ৬৬ দিন পার করেছে, তখন বেগম জিয়া হাজির হয়েছিলেন গণমাধ্যমকর্মীদের সম্মুখে। সব মিডিয়ার দৃষ্টি ছিল বেগম জিয়ার দিকে- কী কথা বলেন তিনি? তিনি বললেন, 'যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।' অর্থাৎ চলমান আন্দোলনকে একটি 'যৌক্তিক পরিণতির' দিকে তিনি নিয়ে যেতে চান! নিঃসন্দেহে এই বক্তব্যটি আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সংবাদ সম্মেলনে কিছু 'প্রশ্ন' ও 'প্রস্তাব' রেখেছেন, যার সঙ্গে এই 'যৌক্তিক পরিণতির' একটা মিল আমরা খুঁজে নিতে পারি। তিনি বলেছেন, ১. চলমান সংকটের চরিত্র রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক, ২. ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি (৪৫তম) আমরা পালন করতে পারি, ৩. আন্দোলন ছাড়া কোনো পথ খোলা রাখা হয়নি, ৪. বর্তমান সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন, ৫. পেট্রলবোমা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপি জড়িত নয়, ৬. নেতা-কর্মীদের মুক্তি, গুপ্তহত্যা বন্ধ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, ৭. সভা-সমিতি আয়োজন করার ওপর যে বিধিনিষেধ, তা প্রত্যাহার, ৮. সবার অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচনের জন্য একটি সংলাপ। মোটা দাগে এগুলোই হচ্ছে মোদ্দাকথা। তিনি বললেন না যে হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। তবে একটি আভাস আছে, সংলাপ হলে এই কর্মসূচি তিনি আর দেবেন না। আভাস আছে আরো একটি- বর্তমান সংসদকে তিনি পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছেন! এবং দাবি করেছেন সংসদ সংবিধান সংশোধন করতে পারে। যেহেতু বর্তমান সংকটকে তিনি মনে করছেন, 'রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক', সেহেতু ওই সংকটের সমাধানের পথ একটাই আর তা হচ্ছে সংবিধান সংশোধন! স্পষ্টতই 'রাজনীতির বল'টি তিনি ঠেলে দিয়েছেন সরকারের পায়ে। সরকার এখন 'বল'টি কিভাবে খেলে, সেটাই আমাদের দেখার পালা। কিন্তু আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ সরকার ইতিমধ্যেই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন, ২০১৯ সালের আগে আর সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই। যুক্তি হিসেবে এটা ঠিক আছে। কেননা আমরা সংবিধানের বাইরে যেতে পারব না। আর সংবিধানই আমাদের বলছে পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের কথা। এখন সংলাপ হচ্ছে না। তাহলে কোন দিকে যাচ্ছে দেশ? আল-জাজিরাতে যে প্রতিবেদনটি দেখলাম, তা বাংলাদেশের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। গত অর্থবছরের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। আর গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে দুই হাজার ১৭০ কোটি ডলার। সেই সঙ্গে এটাও সত্য, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে- এটা প্রায় সবাই বলছেন। যেখানে ইউরোপের অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট পুরো ইউরোপের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে এত হরতাল-অবরোধের পরও প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের মতো ধরে রাখা সহজ কাজ নয়। এর অর্থ কল-কারখানায় প্রায় 'স্বাভাবিক অবস্থা' বিরাজ করছে। রপ্তানি খাতে কিছুটা শ্লথগতি এলেও এই খাত খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সরকারের সার্থকতা এখানেই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই 'অস্থিরতার' একটা সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই 'সমাধান'টা করতে হবে দুটো বড় দলকেই। বুদ্ধিজীবীরা কিংবা বিদেশি দূতরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। সেই সঙ্গে এই 'পেট্রলবোমা'র সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে যে বিভেদ ও বিদ্বেষ তা কাটিয়ে ওঠা খুবই প্রয়োজন ও জরুরি। এই অসহিষ্ণুতা দেশ ও জাতির কোনো মঙ্গল ডেকে আনতে পারবে না। বর্তমান যে সংকট, সেই সংকট রাজনীতিবিদদেরই কাটিয়ে উঠতে হবে। কোনো 'তৃতীয় শক্তি' এর সমাধান করত পারবে না। যাঁরা বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের দিকে হাত বাড়ান, তাঁরাও ভুল করছেন। এটা সমাধানের পথ নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি একটি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অবরোধ আর হরতালের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন আমরা পার করছি। আর প্রতিদিনই পেট্রলবোমা আক্রমণের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বার্ন ইউনিটগুলোতে অগ্নিদগ্ধ মানুষের করুণ কাহিনী প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে সংবাদপত্রে। ছোট্ট শিশুরা অগ্নিদগ্ধ বাবাকে চিনতে পারছে না। প্রশ্ন রাখছে সে তো কোনো অন্যায় করেনি। তাহলে তাকে মানুষ পোড়াল কেন? এ প্রশ্নের জবাব কারো কাছেই নেই। সাধারণ মানুষ জানেও না এ পরিস্থিতির অবসান হবে কিভাবে? বা কখন আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে দেশ? এমনিতেই অবরোধের মধ্যে ঢাকার বাইরে থেকে রাজধানীতে খুব বেশি যানবাহন না এলেও খোদ রাজধানীতে কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিতভাবে ক্লাস হচ্ছে। ভয়ের মধ্যেও মানুষ তার নিত্যদিনের কাজ করে নিচ্ছে। কিন্তু তাদের মধ্যে আছে অসন্তোষ আর রাজনীতিবিদদের প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ। আর হতাশা। এ পরিস্থিতিতেও দোষারোপের রাজনীতি আমরা লক্ষ করছি। সরকার দায়ী করছে বিএনপিকে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরকে অভিযুক্ত করছে। অন্যদিকে বিএনপির অভিযোগ, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী। তাদের দাবি ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন না হলে এ পরিস্থিতির জন্ম হতো না। পরস্পর দোষারোপের মধ্য দিয়ে এক অসহিষ্ণু রাজনীতির জন্ম হয়েছে এ দেশে। এ বড় দল দুটোর বাইরে শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের কেউই কোনো সমাধান বের করতে পারছেন না। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সরকারের 'বিশেষ দূত' এইচ এম এরশাদ পাঁচ ঘণ্টা অনশন পর্যন্ত করেছেন গত ৩০ জানুয়ারি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এখনো অবস্থান ধর্মঘট করছেন। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এরই মধ্যে আরো দুটো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। একটি নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না গ্রেপ্তার হয়েছেন। দ্বিতীয়টি একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান অভিজিৎ রায় জঙ্গিদের হাতে খুন হয়েছেন। দুটো ঘটনাই চলমান রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে অভিযোগে মান্না গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ সংগঠিত করা (?) একটি বড় ধরনের অপরাধ। এ জন্য রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হলে সরকারকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না। সাধারণ মানুষ একটা সমাধান চায়। নিরাপদে কর্মক্ষেত্রে ও বাড়িতে যেতে চায়। অভিভাবকরা চান তাঁর সন্তান পরীক্ষা দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসুক। কোনোমতে এসএসসি পরীক্ষা হলেও এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষা। এ পরীক্ষা নিয়েও রয়ে গেছে প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেল বছর এইচএসসি পাস করে যারা ভর্তি হয়েছে, তারা এখনো ক্লাস শুরু করতে পারেনি। আবার নতুন আরেক গ্রুপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দরজার সামনে দাঁড়ানো। আমরা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কেউ ভাবছি না। এর শেষ কোথায় আমরা জানি না। খেটে খাওয়া মানুষ এটা বোঝে না। বোঝে এটা কাম্য নয়। এখন সংকট কাটিয়ে উঠব কিভাবে? নয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, গণতন্ত্র বিকাশে ভিন্নমত ও সংলাপ প্রয়োজন। মার্কিন কংগ্রেসের ১১ জন সদস্য মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব জন কেরিকে লিখিত এক চিঠিতে 'বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে ভূমিকা রাখার' জন্য অনুরোধ করেছেন। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল। জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাহলে কেরি 'ভূমিকা রাখবেন' কিভাবে? এদিকে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও, তা নিয়ে একটা ধোঁয়াশা রয়েছে। বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হলে সরকারের শেষ 'অস্ত্র'টিও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে! সরকার বোধ করি এটি চাচ্ছে না এবং তারা আইনি পথেই এগোতে চায়। ৫ এপ্রিল আদালত নতুন তারিখ নির্ধারণ করেছেন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায়। বোঝাই যায়, সরকার মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে বেগম জিয়াকে 'চাপে' রাখতে চায়। তাতে কতটুকু ফল হবে- এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। রাজনীতিবিদরাই দেশ চালাবেন। এটাই কাম্য। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজনীতিবিদদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা এটাই। তাই আমার বিবেচনায় উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই। এখন বেগম জিয়া 'যৌক্তিক পরিণতির' কথা বলে কী বোঝাতে চাচ্ছেন, আমার কাছে তা স্পষ্ট নয়। এখন বেগম জিয়াকে 'আন্দোলনের' নতুন 'কৌশল' নির্ধারণ করতে হবে। সহিংসতা পরিহার করতে হবে। একটি 'আস্থার সম্পর্ক' গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে সরকারের ভূমিকাও হতে হবে নমনীয়। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক যদি গড়ে ওঠে, তাহলে সংকট উত্তরণ সম্ভব। Daily KALERKONTHO 22.03.15

বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবে?

শেষ পর্যন্ত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। ২৮ এপ্রিল এ নির্বাচন। এ নির্বাচন দলীয়ভাবে হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দলই প্রার্থী ঠিক করে। তবে এটা সত্য, দলীয় মার্কা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যবহার করা যায় না। দলীয় প্রার্থীরাই নির্বাচন করেন। দল তাদের ঠিক করে। দলীয় পতাকাতলেই দলীয় প্রার্থীরাই নির্বাচন করেন। আমরা বিগত উপজেলা নির্বাচনের সময় দেখেছি, সেখানে দলীয় প্রার্থীরাই অংশ নিয়েছিলেন এবং অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ওই নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। গেল বছরের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে শেষ হওয়া উপজেলা নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু হয়েছে, এটা বলা না গেলেও, পরিসংখ্যান বলে ৪৮৭টি উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ব্যাপক সংখ্যায় বিজয়ী হয়েছিলেন। বিশেষ করে, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা তুলনামূলক বিচারে বেশি সংখ্যায় বিজয়ী হয়েছিলেন। তবে উপজেলা নির্বাচনের সঙ্গে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণের এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছেন এবং আমরা যারা ঢাকা শহরে বাস করি, এ দুই প্রার্থীর, একদিকে আনিসুল হক ও অন্যদিকে সাঈদ খোকনের ব্যানার, বিলবোর্ডে তাদের দুজনের উপস্থিতি লক্ষ্য করি। এর বাইরে হাজী সেলিমের বিলবোর্ডেও ছেয়ে গেছে ঢাকা শহর। হাজী সেলিম কিংবা কামাল মজুমদার দুজনই প্রার্থী হতে আগ্রহী এবং প্রকাশ্যে তারা প্রার্থী হওয়ার খায়েশও প্রকাশ করেছেন। চূড়ান্ত বিচারে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে তারা প্রার্থী হবেন, এটা আমার মনে হয় না। তবে এটা তো সত্য, হাজী সেলিম ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন। যদিও তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা। মজার ব্যাপার, আওয়ামী লীগের কোনো ফোরামে তিনি বক্তব্য না রাখলেও নৌকা সমর্থক গোষ্ঠীর ব্যানারে তিনি প্রায়ই সেমিনার করেন এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সেই সভায় বক্তব্যও রাখেন। সংসদে তার অবস্থান একজন স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে এবং দলীয় সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে সংসদ নির্বাচন করায় তাকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়নি। এখন যে প্রশ্নটি অনেকেই করেন তা হচ্ছে, বিএনপি কি এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে? খালেদা জিয়া কি মেয়র পদে তিনজন প্রার্থী বাছাই করবেন? নাকি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ছাড়াই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সম্পন্ন হবে? আমি এটা বিশ্বাস করতেই পারি যে, খালেদা জিয়া ১৩ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেই প্রস্তাবের ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা তিনি বিবেচনায় নিতে পারেন। যদিও তিনি কোনো শর্ত যোগ করেননি, তবে একটা 'বরফ গলা' পরিস্থিতি প্রত্যাশা করছেন এদেশের মানুষ। যদিও সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য থেকে এটা বোঝা যায়, সরকার খালেদা জিয়ার কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই আদৌ আগ্রহী নয়। ফলে প্রার্থী নির্বাচনের ব্যাপারে খালেদা জিয়া বা বিএনপির হাইকমান্ড কোনো মন্তব্য করবেন না। একইসঙ্গে খালেদা জিয়া একটু কৌশলী হতে পারেন। কেউ যদি নির্বাচন করতে চায়, যারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাতে খালেদা জিয়ার আপত্তি থাকবে না। খালেদা জিয়া একটি 'রাজনীতির বল' প্রতিপক্ষ, অর্থাৎ সরকারের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। সরকার এখন 'বল'টি কীভাবে খেলে, সেটাই আমাদের দেখার পালা। কিন্তু আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ সরকার এরই মধ্যে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন, ২০১৯ সালের আগে আর সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই। যুক্তি হিসেবে এটা ঠিক আছে। কেননা আমরা সংবিধানের বাইরে যেতে পারব না। আর সংবিধানই আমাদের বলছে ৫ বছর পর পর নির্বাচনের কথা। এখন সংলাপ হচ্ছে না। তাহলে কোন দিকে যাচ্ছে দেশ? আল জাজিরাতে যে প্রতিবেদনটি দেখলাম, তা বাংলাদেশের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। গত অর্থবছরের চেয়ে রফতানি আয় কমেছে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ। আর গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ১৭০ কোটি ডলার। সেইসঙ্গে এটাও সত্য, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে-এটা প্রায় সবাই বলছেন। যেখানে ইউরোপের অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, গ্রিসের অর্থনৈতিক সঙ্কট পুরো ইউরোপের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে, এত হরতাল-অবরোধের পরও প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের মতো ধরে রাখা সহজ কাজ নয়। এর অর্থ কলকারখানায় প্রায় 'স্বাভাবিক অবস্থা' বিরাজ করছে। রফতানি খাতে কিছুটা শ্লথ গতি এলেও খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সরকারের সার্থকতা এখানেই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এ 'অস্থিরতার' একটা সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ 'সমাধান'টা করতে হবে দুটো বড় দলকেই। বুদ্ধিজীবীরা কিংবা বিদেশি দূতরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। সে সঙ্গে এ 'পেট্রলবোমা'র সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে যে বিভেদ ও বিদ্বেষ, তা কাটিয়ে ওঠা খুবই প্রয়োজন ও জরুরি। না হলে অসাংবিধানিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বিভিন্ন ধরনের 'ষড়যন্ত্র'র কথা আমরা শুনেছি, দেশে ও দেশের বাইরে। সেনাবাহিনীকে জড়িত করানোর একটা 'নগ্ন ষড়যন্ত্র' সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ফাঁস করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। একটা ভয় আছে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে। রাজনীতিবিদরা যখন ব্যর্থ হন, তখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জঙ্গিবাদ। এটা ইতিহাসের কথা। তত্ত্বের কথা। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলি, আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানের ঘটনাবলি এর বড় প্রমাণ। আমরা বাংলাদেশকে এ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই না। আল কায়দা না আইএসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা বাংলাদেশে যে নেই, তা বলা যাবে না। এরা সুযোগ পেলেই ফণা তুলবে। সব শেষ তথ্যেও জানা গেছে বাংলাদেশের দুজন জঙ্গি সিরিয়ায় গেছে আল নূসরা ফ্রন্টের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য। খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে অন্তত একটি ক্ষেত্রে আমি স্বাগত জানাই। তিনি কঠোর কোনো কর্মসূচি দেননি। তিনি ভালো করে বোঝেন ও জানেন নেতা এবং কর্মীবিহীন রাজপথে হরতাল ডেকে সেই হরতাল সফল করা যায় না। হরতাল হোক আর না হোক হরতাল ডাকা হচ্ছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তারিখ যখন ঘোষিত হলো, তখন সঙ্গত কারণেই সাধারণ মানুষের দৃষ্টি খালেদা জিয়ার দিকে থাকবে- তিনি কি ঘোষণা দেবেন এখন? পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে। ঢাকা শহরের নেতারা জেলে অথবা ফেরারি। মহানগরী কমিটি গঠিত হলেও তাদের কোনো কর্মকা- চোখে পড়ে না। কর্মীরা রাস্তায় নামতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়ে। সরকারি দলের সমর্থক এবং প্রার্থীরা যেখানে সরব, সেখানে বিএনপি নীরব। বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে রয়েছে একটা বড় হতাশা। এক্ষেত্রে বিএনপি সমর্থকদের কেউ যে প্রার্থী হবেন না, এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। প্রার্থী হতে পারেন কেউ কেউ। আর খালেদা জিয়ার 'নীরব' সমর্থন তাতে থাকতেও পারে। স্পষ্টতই বিএনপি নেতারা একটি বড় ধরনের ডায়ালেমা 'ফেস' করছেন। একদিকে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জনসমর্থন আদায় করা, অন্যদিকে নির্বাচনকে 'প্রতিহত' করা- দুই 'সম্ভাবনাই' 'উজ্জ্বল'। কোনটি করবে এখন বিএনপি? জনপ্রিয়তা যাচাই করার জন্য বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবে? নাকি বয়কটের ডাক দেবে? বয়কটের ডাক দিলেও কি মানুষ তাতে কর্ণপাত করবে? খোদ ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার কর্মী রয়েছেন। তাদের তো 'আটকানো' যাবে না। তারা তো ভোট কেন্দ্রে যাবেই। এক্ষেত্রে 'খালি মাঠ' পেয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা একাই 'গোল' দিতে পারেন! সরকার যদি বড় বড় দলের প্রার্থীদের নির্বাচনে নিয়ে আসতে না পারে, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এমনিতেই ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকার বেকায়দায় আছে। আর এখন আবার ২৮ এপ্রিলের সিটি করপোরেশনের নির্বাচন? এদিকে এ নির্বাচনে সিপিবি তাদের প্রার্থী দিলেও সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ১৮ মার্চ বলেছেন, '৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের পথ অনুসরণ করে আবারও ছলচাতুরী ও তামাশার নির্বাচনের আয়োজন করেছে সরকার।' (বাংলা নিউজ২৪, ১৯ মার্চ)। ফলে নির্বাচন নিয়ে একটা শঙ্কা থাকলই। খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যেও মেয়র প্রার্থী কিংবা কাউন্সিলর প্রার্থী নিয়ে বিবাদ আছে। ফলে সিটি করপোরেশন নিয়ে প্রত্যাশিত যে নির্বাচন সেটি হচ্ছে, এটা আশা করতে পারছি না। তারপরও এ নির্বাচন হওয়া উচিত ছিল। সেটি এখন হতে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যদি বিএনপি এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না-ই করে, সেটা সরকারের ভাবমূর্তির জন্যও কোনো সুখের কিছু হবে না। Daily ALOKITO BANGLADESH 22.03.15

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন কতটা জমবে

আগামী ২৬ মার্চ জাতি যখন তার ৪৪তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই বেশকিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে ভিড় করেছে। এক. বেগম জিয়া গত ১০ মার্চের সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতা দিবস পালনের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, আগামীতে এর আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা? দুই. বহুল প্রত্যাশিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) নির্বাচনের কথা ঘোষণা করে সরকার কি বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে পারবে? তিন. একদিকে হরতাল-অবরোধ, অন্যদিকে নির্বাচনী আমেজ- কোন পথে যাবে বাংলাদেশ? চার. বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ অবস্থায় রয়েছেন ১১ দিন ধরে (২১ মার্চ পর্যন্ত)। তাকে খুঁজে বের করতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব? বেগম জিয়ার ১০ মার্চের সংবাদ সম্মেলনে নতুন কথা বলা হয়নি এটা যেমনি সত্য, তেমনি এটাও সত্য, বেগম জিয়া একটি নরম কর্মসূচি দিয়ে চাচ্ছেন- সরকার নমনীয় হোক, সংলাপে রাজি হোক। তিনি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন ওই দিন। চলমান সংকটকে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক হিসেবে আখ্যায়িত করা, সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা, নেতাকর্মীদের মুক্তিসহ সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য সংলাপের আহ্বান জানিয়ে তিনি একটা মেসেজ অন্তত দিলেন- সরকার আলোচনার উদ্যোগ নিক। আর আলোচনার উদ্যোগ নিলে বিএনপি তার কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেবে, এমন একটা ধারণা তার ওই বক্তব্য থেকে পাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সরকারের কৌশল সুস্পষ্ট- তারা বিএনপির সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী নয়। উল্টো তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে (২৮ এপ্রিল) সরকার এখন চাচ্ছে বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠে নামাতে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, বিএনপির একটা অংশ নির্বাচনে অংশ নেবে এবং এতে করে বিএনপির আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়বে। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দিয়ে সরকার বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে চায়। এতে করে সরকার বিশ্বকে দেখাতে পারবে বিএনপি নির্বাচনে এসেছে। সুতরাং আগামীতে একাদশতম সংসদ নির্বাচন যখনই হোক, ওই নির্বাচনেও বিএনপি অংশ নেবে। এটা সরকারের একটা কৌশল- বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসা। কিন্তু বেগম জিয়া কি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন? কিংবা তিনি যদি এ ব্যাপারে নীরব থাকেন, তাহলে কি বিএনপি সমর্থিত কাউকে কাউকে প্রার্থী হতে পরোক্ষভাবে সমর্থন করবেন? স্থানীয়ভাবে নির্বাচন দলীয়ভাবে হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিগত উপজেলা নির্বাচনও অনেকটা দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) বিএনপি অংশ না নিলেও এর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে অনেক বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল। এটা বিএনপির নীতিনির্ধারকরা ভালো করে জানেন। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ ঢাকা সিটির প্রচুর নেতাকর্মী এখন জেলে অথবা ফেরারি। অনেকের নামেই মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে। গ্রেফতারের ভয় রয়েছে। বেগম জিয়া নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবি করেছিলেন। সরকার মুক্তি দেয়নি। এ অবস্থায় তিনি প্রার্থী দেবেন, এটা মনে হয় না। তবে বিএনপি স্বতন্ত্র কোনো প্রার্থীকে (যেমন মাহমুদুর রহমান মান্না) সমর্থন করতে পারে। অথবা স্ট্যাটাস কো ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারে। অর্থাৎ বিএনপির কোনো শীর্ষ নেতা বা স্থানীয় নেতা যদি প্রার্থী হন, বিএনপি সেক্ষেত্রে নীরবতা অবলম্বন করবে। তবে আমি নিশ্চিত ঢাকা সিটির মোট ওয়ার্ডের সংখ্যা ৯২, এ ক্ষেত্রে বিএনপি সমর্থক অনেকেই ওয়ার্ড কমিশনের নির্বাচনে অংশ নেবেন। এটা তাদের এক ধরনের নিরাপত্তাও দিতে পারে। ক্ষমতা প্রয়োগ করার একটা সম্ভাবনাও তাদের জন্য তৈরি হতে পারে। বিএনপির এসব স্থানীয় নেতাদের অনেকেরই ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। প্রশাসনে না থাকলে এসব ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়। তারা এ ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। এজন্যই আমার ধারণা, স্থানীয় পর্যায়ের এসব নেতার কেউ কেউ ওয়ার্ড কমিশনের নির্বাচনে অংশ নেবেন। তারা যদি ভবিষ্যতে নতুন এক রাজনৈতিক মেরুকরণে অংশ নেন, আমি তাতে অবাক হব না। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনপ্রিয় মেয়র এম মনজুর আলম অংশ নেবেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়। তিনি বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছেন বেগম জিয়ার হাতে। বেগম জিয়া চাইলে তিনি নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বিএনপির হাতে থাকা জরুরি। মনজুর আলম ছাড়া কোনো বিকল্প নেই সেখানে। মনজুর আলম প্রার্থী না হলে আওয়ামী লীগের আজম নাসির হতে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থী। অপর সম্ভাব্য প্রার্থী আখতারুজ্জামান হয়তো আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। ধনাঢ্য ব্যক্তি মনজুর আলম। তিনি যতটুকু না রাজনীতিক, তার চেয়ে বেশি একজন সজ্জন ব্যক্তি। তার এই ইমেজ তাকে অতীতে নির্বাচনে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছিল। চূড়ান্ত বিচারে বিএনপি এ সুযোগটি নিলেও নিতে পারে। তবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে কথা অনেক। ব্যবসায়ী আনিসুল হক মেয়র প্রার্থী হয়েছেন উত্তরের। ব্যক্তি আনিসুল হকের সাফল্য অনেক। ধনী ব্যক্তি। সজ্জন ব্যক্তি। সফল উপস্থাপক। ব্যবসায়ীদের নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু মানুষ কি তাকে একজন রাজনীতিক হিসেবে দেখতে চাইবে? আমার মনে হয় না। একজন মেয়রের চেয়েও অনেক বেশি সম্মান তিনি পান এবং পেয়ে আসছেন। মেয়র পদ তাকে বাড়তি সম্মান দেবে না। ঢাকার বিলবোর্ডগুলো তার ছবিতে ভরে গেছে। তিনি কি এগুলো ভাড়া নিয়েছেন? বিল পরিশোধ করেছেন? যদি না করে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন উঠবে। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি ঋণখেলাপি কিনা, ঋণ সিডিউল করেছেন কিনা, তা ব্যাংকগুলোই বলতে পারবে এবং নির্বাচন কমিশন নিশ্চই বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। একজন ভোটার হিসেবে আমি আনিসুল হককে ব্যবসায়ী কাম সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চেয়েছি, একজন মেয়র হিসেবে নয়। এ ক্ষেত্রে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কামাল মজুমদারের বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। মজুমদার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মেয়র পদে ব্যবসায়ী নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন (মানবকণ্ঠ, ১৯ মার্চ)। রাজনীতিকদের জনগণের কাছে যেতে হয়। তাদের সঙ্গে ভোটারদের সম্পর্ক থাকে সরাসরি। তারা সমস্যাগুলো বোঝেন ও জানেন। আর ব্যবসায়ীরা সুযোগ সন্ধানী। তারা জানেন শুধু লাভের বিষয়টি। একজন ধনী ব্যক্তি হিসেবে আনিস সাহেবরা জনস্বার্থে কতটুকু কাজ করেছেন, আদৌ করেন কি-না তা তিনি নিজে বলতে পারবেন। বিলবোর্ডে স্বপ্নের কথা তিনি আমাদের শোনাচ্ছেন। ইতিমধ্যে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তিনি মতবিনিময় শুরু করেছেন। এ কাজটি তিনি ভালো পারেন। এখন বিএনপি প্রার্থীর অবর্তমানে তিনি যে জিতে যাবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। তবে আবদুল আউয়াল মিন্টু যদি শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হন, তার জন্য সমস্যা হবে। উপরন্তু দলীয় সমর্থন পুরোপুরিভাবে তিনি পাবেন না। কামাল মজুমদারের মতো ব্যক্তি যদি শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হন, তিনি অনেক ভোট কাটবেন। সাঈদ খোকনের জন্যও সমস্যা অনেক। তিনি ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে তার মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম্ভাবনা কম। তিনি ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী হলেও থাকেন উত্তরে। এক-এগারোর সময় তিনি পিডিপিতে যোগ দিয়ে সুবিধাবাদী রাজনীতির পরিচয় দিয়েছিলেন। তারপরও আওয়ামী লীগ তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন তো আছেই। তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হাজী সেলিম। হাজী সেলিম আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি এখন সংসদে স্বতন্ত্র সদস্য। নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী নামে তার একটি সংগঠন রয়েছে। ওই সংগঠনের ব্যানারেই তিনি প্রেস ক্লাবভিত্তিক আলোচনা সভার আয়োজন করে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন। ধনাঢ্য ব্যক্তি তিনি। থাকেন পুরনো ঢাকাতে। কথাবার্তা বলেন ঢাকাইয়া ভাষায়। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও তার জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও আছে। তবে ঢাকা শহরের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা সংগঠিত হচ্ছে। তারা একটা সমস্যা তৈরি করতে পারে। বেগম জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পর পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়েছে, এটা বলা যাবে না। ১৯ মার্চের খবর : দিনাজপুরে বাসে পেট্রলবোমা হামলা, দগ্ধ ও আহত ৮ জন। চাঁদপুরে ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হয়েছেন ৩ জন। এর অর্থ পরিষ্কার- সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। এসব সন্ত্রাসী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় ঢাকা ও চট্টগ্রামে সমবেত হতে পারে এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে। ভয়টা এখানেই। ঢাকা শহরে নির্বাচন হচ্ছে। অনেক আগেই এ নির্বাচন প্রত্যাশিত ছিল। হয়নি নানা কারণে। প্রশাসক দিয়ে চলছে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকাণ্ড। এটা সমর্থনযোগ্য নয়। সে জন্যই নির্বাচনটা প্রয়োজন ছিল, যাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কর্পোরেশনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে পারে। কিন্তু বিএনপি অংশ না নিলে নির্বাচন হবে বটে, তবে জমজামট হবে না। ভোটারদের উপস্থিতিও হবে কম। দলীয়ভাবে নির্বাচন হয় না বটে। কিন্তু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন প্রার্থী ঠিক করেন, তখন এটা দলীয় হয়ে যায় বৈকি। তাই সঙ্গতকারণেই মানুষ তাকিয়ে থাকবে বেগম জিয়ার দিকে। এক কঠিন সময় পার করছেন বেগম জিয়া। তাকে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। স্থায়ী পরিষদের সদস্যরা কেউই ভয়ে তার কার্যালয়ে যেতে পারছেন না। ২০-দলীয় নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ একরকম বিচ্ছিন্ন। সালাউদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ রয়েছেন আজও। কেউ তার খোঁজ জানে না। সরকারের ভাষ্য- তিনি নিজে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। বিএনপির বক্তব্য- সালাউদ্দিনের ভাগ্য ইলিয়াস আলীর মতোই হতে যাচ্ছে। এটা দুঃখজনক যে, একজন বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তি হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যাবেন, সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এর কোনো খোঁজ পাবে না। এটা মেনে নেয়া যায় না। বেগম জিয়া এখন অনেকটা কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কী সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি? মাথার ওপরে গ্রেফতারি পরোয়ানা। যে কোনো মুহূর্তে তিনি গ্রেফতার হতে পারেন। অবরোধ-হরতালের ডাক দিচ্ছেন বটে, কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না। হরতালেও ঢাকা এখন যানজটের নগরী। নির্বাচনের কোনো আমেজ তাই আমি দেখি না। নির্বাচন মানেই তো এক ধনের উৎসব। কোথায় সেই উৎসব? ভয় হচ্ছে, এ নির্বাচন না আবার নিয়ম রক্ষার নির্বাচন হয়ে যায়! একটা নির্বাচন আমরা চাই। চাই প্রতিযোগিতা হোক। ভোটারদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়াগ করার সুযোগ দেয়া হোক। ভোটারদের এ প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে, জানি না। ২১ মার্চ, ২০১৫ Daily Jugantor.

বেগম জিয়া একটি মেসেজ দিয়েছেন

বে গম জিয়া একটি মেসেজ দিয়েছেন। গত ১৩ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে তিনি কোনো কঠোর কর্মসূচি না দেওয়ায় এটা বলাই যায়, বেগম জিয়া চাচ্ছেন সরকারের পক্ষ থেকে একটি ‘ইতিবাচক’ পদক্ষেপ! আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতির কথা তিনি বলেছেন বটে, কিন্তু কোনো কঠোর কর্মসূচি দেননি! বিএনপি তথা ২০ দলের দীর্ঘ দুই মাসের ওপর চলা এই আন্দোলন তার ‘যৌক্তিক লক্ষ্যে’ পৌঁছতে পারেনি এটা সত্য, কিন্তু এই আন্দোলনের একটা বড় ‘সাফল্য’ বহির্বিশ্বে ব্যাপক প্রচার পাওয়া। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে, সমাজের সর্বক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এটা যে কোনো সরকারের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব যদি প্রতিষ্ঠিত না থাকে, সেই সরকার টিকে থাকতে পারে না। দীর্ঘ দিন ধরে চলা এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে, এভাবে সরকার পতন ঘটানো যায় না। এটা যেমন সত্য, তেমনি আবার এটাও সত্যÑ ব্যাপকসংখ্যক মানুষের একটা ‘অসন্তোষ’ এখনো রয়ে গেছে। সরকারের উচিত হবে এই অসন্তোষের দিকে নজর দেওয়া। এই ‘আন্দোলন’ প্রমাণ করেছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যে ‘আস্থার সম্পর্ক’ থাকে, বাংলাদেশে এই আস্থার সম্পর্ক ভেঙে গেছে। অতীতে এই আস্থার সম্পর্ক ছিল। আস্থার সম্পর্ক ছিল বিধায় আমরা দেশে পুনরায় সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পেরেছিলাম পঞ্চম সংসদে। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও ছিল এই আস্থার সম্পর্কের ফলশ্রুতি।বিএনপি ১৩ দিনের ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস না করালে হয়তো আমরা ভিন্ন এক পরিস্থিতি দেখতে পেতাম ১৯৯৬-৯৭ সালে। আজ সেই আস্থার সম্পর্কটা একেবারেই নেই। বেগম জিয়া আন্দোলনে আছেন। অনেকটা কর্মীবিচ্ছিন্ন, নেতাবিচ্ছিন্ন গুলশান কার্যালয়ে ‘গৃহবন্দিত্ব’ জীবন তার। এক ছেলেকে হারিয়েছেন। বড় ছেলে তাও বিদেশে। এই আন্দোলনে একাকী ‘সৈনিক’ তিনি। ‘যৌক্তিক লক্ষ্যে’ তিনি আদৌ পৌঁছতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন থাকবেই। একরকম ‘বিছিন্ন’ এক জীবন, মাথার ওপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশি চালানোর আদালতের হুকুমনামা, দুর্নীতির অভিযোগ একের পর এক উত্থাপন, সব মিলিয়ে এক ভিন্নরূপে আমরা দেখছি বেগম জিয়াকে। এ ‘পরিস্থিতি’ থেকে তিনি কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন, সেটা একটা ‘মিলিয়ন ডলার’ প্রশ্ন। এমনকি দলটি ভেঙে যাওয়ার মুখেও দাঁড়িয়ে আছে। জীবনের শেষ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে এক কঠিন ‘সত্য’-এর মুখোমুখি তিনি। শত শত কর্মীর আশার একমাত্র ‘স্থান’ বেগম জিয়া স্বয়ং দলের অন্য কেউ নন। দলের ভেতরে অবিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়ছে। তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়েও আছে নানা শঙ্কা। দলের একটা অংশ এই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে দলের ঐক্যকে টিকিয়ে রাখা হবে কঠিন এক কাজ। সব মিলিয়ে তার সংবাদ সম্মেলনের উত্থাপিত বক্তব্যগুলো ছিল আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সংবাদ সম্মেলনে কিছু ‘প্রশ্ন’ ও ‘প্রস্তাব’ রেখেছেন, যার সঙ্গে এই ‘যৌক্তিক পরিণতি’র একটা মিল আমরা খুঁজে নিতে পারি। তিনি অনেকগুলো কথা বলেছেন চলমান সংকটের চরিত্র রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি (৪৫) আমরা পালন করতে পারি। আন্দোলন ছাড়া কোনো পথ খোলা রাখা হয়নি। বর্তমান সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন। পেট্রলবোমা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে বিএনপি জড়িত নয়। নেতাকর্মীদের মুক্তি, গুপ্তহত্যা বন্ধ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত বক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সভা-সমিতি আয়োজন করার ওপর যে বিধিনিষেধ, তা প্রত্যাহার করা, সবার অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচনের জন্য একটি সংলাপ ইত্যাদি। মোটা দাগে এগুলোই হচ্ছে মোদ্দা কথা। তিনি বললেন না হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। তবে একটি আভাস আছেÑ সংলাপ হলে এই কর্মসূচি তিনি আর দেবেন না। আভাস আছে আরও একটিÑ বর্তমান সংসদকে তিনি পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছেন! এবং দাবি করেছেন সংসদ সংবিধান সংশোধন করতে পারে। যেহেতু বর্তমান সংকটকে তিনি মনে করছেন ‘রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক’, সেহেতু এই সংকটের সমাধানের পথ একটাইÑ আর তা হচ্ছে সংবিধান সংশোধন! স্পষ্টতই ‘রাজনীতির বল’টি তিনি ঠেলে দিয়েছেন সরকারের দিকে। সরকার এখন ‘বল’টি কীভাবে খেলে, সেটাই আমাদের দেখার পালা। কিন্তু আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ সরকার ইতোমধ্যেই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন, ২০১৯ সালের আগে আর সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই। যুক্তি হিসেবে এটা ঠিক আছে। কেননা আমরা সংবিধানের বাইরে যেতে পারব না। আর সংবিধানই আমাদের বলছে ৫ বছর পরপর নির্বাচনের কথা। এখন সংলাপ হচ্ছে না। তাহলে কোন দিকে যাচ্ছে দেশ? আল জাজিরাতে যে প্রতিবেদনটি দেখলাম, তা বাংলাদেশের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। গত অর্থবছরের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। আর গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ১৭০ কোটি ডলার। সেই সঙ্গে এটাও সত্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবেÑ এটা প্রায় সবাই বলছেন। যেখানে ইউরোপের অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট পুরো ইউরোপের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে, এত হরতাল-অবরোধের পরও প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের মতো ধরে রাখা সহজ কাজ নয়। এর অর্থ কলকারখানায় প্রায় ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ বিরাজ করছে। রপ্তানি খাতে কিছুটা শ্লথগতি এলেও, এই খাত খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সরকারের সার্থকতা এখানেই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এই ‘অস্থিরতার’ একটা সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই ‘সমাধান’টা করতে হবে দুটি বড় দলকেই। বুদ্ধিজীবীরা কিংবা বিদেশি দূতরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। সেই সঙ্গে এই ‘পেট্রলবোমা’র সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে যে বিভেদ ও বিদ্বেষ তা কাটিয়ে ওঠা খুবই প্রয়োজন ও জরুরি। না হলে অসাংবিধানিক শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। বিভিন্ন ধরনের ‘ষড়যন্ত্র’-এর কথা আমরা শুনেছি, দেশে ও দেশের বাইরে। সেনাবাহিনীকে জড়িত করানোর একটা ‘নগ্ন ষড়যন্ত্র’ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ফাঁস করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। একটা ভয় আছে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে। রাজনীতিবিদরা যখন ব্যর্থ হন, তখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে জঙ্গিবাদ। এটা ইতিহাসের কথা। তত্ত্বের কথা। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলি, আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানের ঘটনাবলি এর বড় প্রমাণ। আমরা বাংলাদেশকে এই পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই না। আল কায়েদা বা আইএসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা বাংলাদেশে যে নেই, তা বলা যাবে না। এরা সুযোগ পেলেই কথা তুলবে! সব শেষ তথ্যেও জানা গেছে, বাংলাদেশের দুজন জঙ্গি সিরিয়ায় গেছে আল নুসরা ফ্রন্টের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য। বেগম জিয়ার বক্তব্যকে অন্তত একটি ক্ষেত্রে আমি স্বাগত জানাই। তিনি কঠোর কোনো কর্মসূচি দেননি। তিনি ভালো করে বোঝেন ও জানেন নেতা ও কর্মীবিহীন রাজপথে হরতাল ডেকে সেই হরতাল সফল করা যায় না। একজন রিজভী আহমেদ পারেননি। জেলে এখন নিঃসঙ্গ জীবন তার। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী এখনো ফুটপাতে শুয়ে আছেনÑ মানুষ রাস্তায় নেমে আসেনি। কামাল হোসেনের আহ্বান ওই বেইলি রোডেই সীমাবদ্ধ। ২০ দলের ‘একদল এক নেতা’দের কাউকে আমি দেখি না রাজপথে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে। হরতাল-অবরোধে তাদের কাউকে কাউকে দেখি টক শোতে রাতের বেলায় ‘বয়ান’ দিতে। হরতালের সময় যখন ঢাকায় যানজট সৃষ্টি হয়, তখন তারা ড্রইংরুমে বসে ‘বিশ্বকাপ ক্রিকেট’ দেখেন। ‘নিঃসঙ্গ’ বেগম জিয়া যে ৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, তাতে স্পষ্টতই একটি মেসেজ আছে। প্রথম দুটি শর্ত খুব সহজেই মেনে নেওয়া যায়। তাতে ক্ষতির কোনো কারণ নেই। বিএনপিকে সমাবেশ করতে দিলে আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি হতে বাধ্য। আমরা বারবার বলছি, সংবিধানকে সামনে রেখেই আরেকটি নির্বাচন হতে পারে এবং তাতে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারে। সরকার হচ্ছে অভিভাবক। তাই উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই। Daily Amader SOMOY 21.03.15

NTV Photo


মোদি-মমতা বৈঠকে বাংলাদেশের জন্য কোনো মেসেজ আছে কি

বহুল প্রত্যাশিত মোদি-মমতা বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৯ মার্চ নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বৈঠকের যথেষ্ট তাৎপর্য ছিল। কেননা এই বৈঠবের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টনচুক্তি ও স্থলসীমান্ত চিহ্নিতকরণের প্রশ্নটি সরাসরিভাবে জড়িত। মমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফরের সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন তিস্তাচুক্তির ব্যাপারে তার ওপর আস্তা রাখতে। বাংলাদেশ ওই আস্থাটা রেখেছিল। এ জন্যই একটা প্রত্যাশা ছিল, মমতা ব্যানার্জি যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেনÑ তখন হয়তো তিস্তাচুক্তির জট খুলবে। শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মমতার সাক্ষাৎ হলো। কিন্তু এতে তিস্তাচুক্তির জট খুলল কি? ১০ মার্চ ঢাকার পত্রপত্রিকায় মোদি-মমতার সাক্ষাৎকারের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়েছে। ভারতীয় পত্রপত্রিকায়. বিশেষ করে কলকাতার পত্রিকাগুলো ঘেঁটে দেখছি। সেখানে সাক্ষাৎকারের বিষয়টি আছে। কিন্তু তিস্তা নিয়ে জট খুলছে কি না, এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। মোদি নিজে অথবা মমতা ব্যানার্জি নিজেও কোনো কথা বলেননি। ফলে তিস্তাচুক্তির ভবিষ্যৎ একটি প্রশ্নের মুখে থাকল। মোদি তিস্তাচুক্তির ব্যাপারে এবং চুক্তি করতে মমতার পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেনÑ এটা বলা যাবে না। বাংলাদেশের ব্যাপারে মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী? এর কিছুটা আভাস আমরা পেয়েছিলাম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের সময়। তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রালয়ে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়ে তার সফরের গুরুত্ব আমরা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। জাপান সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশ হলেও জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীও এই সংবর্ধনা পাননি। এরপরও সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের সময় দু’দেশের মাঝে বিরাজমান সমস্যাগুলোর ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক মনোভাব আমরা দেখিনি। তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে যে সমস্যা ছিল, তা মমতার ব্যানার্জি ঢাকা সফরের পরও রয়ে গেছে। কৌশলী মমতা আস্থা রাখার কথা বলে গেলেও এটা বলতে ভোলেননি, দু’দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান হবে। এক্ষেত্রে মেসেজটা স্পষ্টÑ পশ্চিম বাংলার স্বার্থ উপেক্ষা করে কেন্দ্র এককভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারবে না। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন। সুতরাং কৌশলী মমতা ‘তিস্তা কার্ড’টি কখনোই বিজেপির হাতে তুলে দেবেন না। তবে স্থলসীমানা চুক্তিটি ভারতীয় লোকসভায় চলতি বাজেট অধিবেসনই পাস হবে। কেননা মমতা ব্যানার্জি তার আপত্তি তুলে নিয়েছেন। আসাম বিজেপির আপত্তিও নেই। ফলে এই একটি ক্ষেত্রে আমরা সমাধানটা পেতে যাচ্ছি। নরেন্দ্র মোদি আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের জন্য এটা নিঃসন্দেহে একটা চিন্তার কারণ। তিস্তায় যেমন পানি নেই, তেমন চুক্তি করার পরও পদ্মায় পানি হ্রাস পেয়েছে। এখন ভারত যদি শেষ পর্যন্ত ভারতীয় পরিবেশবাদীদের বিরোধিতা করে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে যাবে। ভারত গত ছয় বছর বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশকিছু সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ওই অর্থে তেমন সুবিধা পায়নি। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করিডর পেতে যাচ্ছে ভারত। অরুণাচল থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ যাবে বিহারে। চলতি বছরই বহুল বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে ভারত। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের যে আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, তা থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ঢাকায় এসে ২০ কোটি ডলারের অনুদান দিয়েছিলেন। প্রায় ১৪টি প্রকল্পে এই অর্থ ব্যয় করার কথা। কিন্তু প্রকল্পের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলারে। সর্বোচ্চ তথ্য নিলে দেখা যাবে, ঘাটতির পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলারও (অর্থাৎ ৪ হাজার মিলিয়ন) ছাড়িয়ে গেছে। এই বাণিজ্য ঘাটতি এখন ভারত ব্যবহার করছে তার স্বার্থে। অথচ ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের বিশাল চাহিদা রয়েছে। কিন্তু শুল্ক ও অশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে বাজার পাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে ভারতের পক্ষ থেকে কিছু পণ্যের শুল্ক ছাড়ের কথা বলা হয় বটে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বাংলাদেশ ওইসব পণ্য উৎপাদন করে না। ভারত আমাদের জমি ব্যবহার করছে তথাকথিত কানেকটিভির নামে। কিন্তু কোনো ফি প্রদান করছে না। উপরন্তু নেপাল ও ভুটান এ সুবিধা পাচ্ছে না। ভারত এখন পর্যন্ত এ দুটি দেশে ট্রানজিট সুবিধা দেয়নি। নরেন্দ্র মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে দুটি দেশেÑ ভুটান ও শ্রীলংকায় ভারতের ভূমিকাটি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উভয় দেশই ভারতের ভূমিকা চিনের স্বার্থে আঘাত করেছে। শ্রীলংকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরি সেনার বিজয়ের পেছনে ভারত একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল বলে সংবাদপত্রে খবর এসেছে। সিরি সেনা চিনের প্রভাব থেকে শ্রীলংকাকে বের করে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজপক্ষে ছিলেন অতিমাত্রায় চিননির্ভর। প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে সিরি সেনার নয়াদিল্লি সফর দু’দেশের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করেছে। নরেন্দ্র মোদি তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ভুটানে গিয়েছিলেন। অতীতে ভারতের কোনো সরকারপ্রধানই ভুটানকে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। ভুটান-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্কও তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। তবে ভুটানের একটা স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে। আর এটি বিবেচনায় নিয়েই মোদি ভুটানে গিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ভুটান সফরের পর যেসব সিদ্ধান্তের কথা জানা গিয়েছিল, এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। যেমনÑ ভুটানে মোদি সফরের পর পরই ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোগবে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ভুটান দূতাবাস খুলতে চিনকে অনুমতি দেওয়া হবে না। ভুটানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সম্প্রতি খুব তোড়জোড় শুরু করেছে চিন। চিনের ওই উদ্যোগে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন ভারত। শুধু তা-ই নয়, সফর শেষে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, জাতীয় স্বার্থে দু’দেশÑ ভারত ও ভুটান একে অপরকে সাহায্য করবে। মোদির ভুটান সফর ও যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ভুটান ও ভারতের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ একই। ভারতের সীমান্তে চিনের ‘আগ্রাসন’ ও ভুটানের উত্তরেও চিনের আগ্রাসন একই রকমের উদ্যোগের কারণ। চিনের সম্ভাব্য আগ্রাসন রোধে ভারত ও ভুটান একে অপরকে সাহায্য করবে বলেও যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ভারতের জি নিউজ আমাদের জানাচ্ছে যে, চিন সীমান্তে দ্বিগুণ সেনা মোতায়েন করছে ভারত। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণওরখা বরাবর চিন শক্তি বৃদ্ধি করছে এবং চিনা হামলা বাড়ছে। বলা ভালো, ভারত-চিন সীমান্তে ইন্দো-তিব্বত বর্ডারে পুলিশের ৪০টি ঘাঁটি রয়েছে। মোতায়েন রয়েছে ১৫ হাজার সেনা। এখন দ্বিগুণ সেনা মোতায়েনের বিষয়টি এবং ভুটানে চিনা দূতাবাস না খোলার সিদ্ধান্ত ভারত-চিন সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে। অথচ বলা হয়েছিল, মোদির জমানায় চিন-ভারত সম্পর্কে উন্নতি হবে। এমনকি মোদির শপথ নেওয়ার পর পরই চিনা পররাষ্ট্রুমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফর ওই আভাসই দিয়েছিল, এই দু’দেশের মাঝে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে। এখন মনে হচ্ছে, চিনের ব্যাপারেই মোদির মনোভাবে পরিবতর্তন এসেছে। চিনকে ভারত এখন এ অঞ্চলে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করছে। এ অঞ্চলের উন্নয়নে চিন নাক গলাক তা ভারত কোনোভাবেই চাইবে না। আমরা মোদির শাসনামলে ইন্ডিয়া ডকট্রিনের নতুন এক রূপ দেখতে পাব। মোদির ভুটান সফরের সময় চিন প্রসঙ্গ প্রকাশ্যে আলোচিত হলেও বাংলাদেশে সুষমা স্বরাজের সফরের সময় এ প্রসঙ্গটি প্রকাশ্যে আসেনি। তবে একটা খবর এসেছে, চিনা অর্থায়নে গোনাদিয়ায় যে গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল, তা ভারত তার নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছে। ভারত মনে করে, এটা নির্মিত হলে এ অঞ্চলে চিনের প্রভাব বাড়বে। একই সঙ্গে চিনা পণ্যে এ অঞ্চল সয়লাব হয়ে যাবে এবং প্রতিযোগিতায় ভারতীয় পণ্য মার খাবে। এখন গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হচ্ছে পায়রাবন্দে। ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএমের (বাংলাদেশ, চিন, ভারত ও মিয়ানমার) ভবিষ্যৎ একটা প্রশ্নের মুখে থাকল। এখন প্রত্যাশিত নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর সম্পর্কেও নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। কেননা বাংলাদেশে তার যে জনপ্রিয়তা, ওই জনপ্রিয়তা তিনি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবেন না। তিনি ভালো করেই জানেন তার ঢাকা সফরের সময় তাকে তিস্তাচুক্তির মুখোমুখি হতে হবে। তিনি একটি নিশ্চয়তা ছাড়া ঢাকা আসবেন না। উপরন্তু বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজীতিবিদ তাকে এই মুহূর্তে ঢাকা সফরে না আসতে অনুরোধ করেছেন। সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লিখে তাকে ঢাকা সফরে না আসতে বলা হয়েছে। ফলে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরও একটি অনিশ্চিয়তার মধ্যে থাকল। অথচ আমাদের জন্য এ সফরটি ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিষয় রয়েছেÑ যা দু’দেশের স্বার্থেই সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। একদিকে আমাদের পানিসম্পদমন্ত্রীর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে কোনো কোনো সংবাদপত্রে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, টিপাইমুখ ড্যামে কোনো যৌথ সমীক্ষা হচ্ছে না। গত মনমোহন সিং সরকারের সময় এটা বলা হয়েছিল, ভারত টিপাইমুখে এমন কিছু করবে নাÑ যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। তখন দু’দেশ টিপাইমুখে একটি যৗথ সমীক্ষা চালাবেÑ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এখন যৌথ সমীক্ষা না হওয়ায় এটা ধরে নেওয়া যায়, মোদি সরকার টিপাইমুখে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সিরিয়াস। দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা নতুন করে এখন প্রশ্নের জন্ম দিল। প্রত্যাশিত মোদি-মমতা বৈঠকটি আমাদের জন্য কোনো সুসংবাদ বয়ে এনেছেÑ এটা বলা যাবে না। আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু নয়াদিল্লি থেকে আদৌ কোনো সুসংবাদ আমরা পেলাম না। এক্ষেত্রে আমাদের দাবি অব্যাহত রাখতে হবে। প্রতিটি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের ওই দাবিটি আরও স্পষ্ট করতে হবে। তিস্তায় পানিপ্রাপ্তির দাবিটি আমাদের ন্যায্য এবং আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। মনে রাখতে হবে, তিস্তায় পানিপ্রাপ্তির বিষয়টি আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই বিষয়ে আমরা কোনো ছাড় দিতে পারি না। Daily AMADER SOMOY 16.03.15

টিপাইমুখ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল

টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। সেখানে একটি যৌথ সমীক্ষা চালানোর যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তা আর হচ্ছে না। এ কথাটা আমাদের জানিয়েছেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এ সংক্রান্ত একটি খবর কোনো কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ৯ মার্চ। অথচ ভারতে বিগত সরকারের সময় এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বাংলাদেশের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল যখন টিপাইমুখ বাঁধ দেখতে গিয়েছিল ২০১১ সালে, তখন তারা নয়াদিল্লিতে ঊর্ধ্বতন ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। তখন তাদের বলা হয়েছিল, ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। সংসদীয় প্রতিনিধি দলটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ২৯ জুলাই (২০১০) টিপাইমুখ বাঁধের নির্মাণাধীন এলাকায় যেতে পারেনি। তারা বাংলাদেশে ফিরে এসে বলেছিলেন, ভারত টিপাইমুখে কোনো বাঁধ নির্মাণ করছে না। আমরা তখন আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু এরপর হাটে হাঁড়িটি ভেঙে দিয়েছিলেন ভারতের নর্থ-ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেডের (নিপকো) চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রেমাচান্দ পংকজ। তিনি ১১ জুলাই (২০১১) আসামে স্থানীয় একটি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, টিপাইমুখে বরাক নদীতে প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবেই। তিনি জানিয়েছিলেন, প্রস্তাবিত ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম টিপাইমুখ প্রকল্পের কাজ যথারীতি এগিয়ে নেয়া হবে। (আমার দেশ, ১২ জুলাই ২০১১)। প্রেমাচান্দের ওই বক্তব্য বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ভারতের মণিপুর রাজ্যের চোরাচাঁদপুর জেলার তুই ভাই ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। ভারত প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপি ব্যয় করে এ বাঁধট নির্মাণ করছে। কয়েক বছরের মধ্যে বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। শুধু বাংলাদেশেই নয়। খোদ আসাম ও মণিপুরের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এ বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করছে। তারা মনে করছেন, ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ফলস্বরূপ অর্থনৈতিকভাবে বিপক্ষ হয়ে পড়বে এলাকার বাসিন্দারা। ভারতের পরিবেশবাদীরা এ প্রকল্পের বিরোধিতা করলেও আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেছিলেন, বৃহৎ নদীবাঁধ যে কোনো মূল্যে হচ্ছেই। কেউ বাঁধের কাজ আটকাতে পারবে না। এখন মুখ্যমন্ত্রী গগৈ কিংবা প্রেমাচান্দের মন্তব্যের পর এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, টিপাইমুখ বাঁধ হচ্ছেই। ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। কিন্তু ভারত এমন কিছু করতে পারবে না, যা পার্শ্ববর্তী দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক আইনে এ ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আছে। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ আমাদের সীমান্তের খুব কাছে। ফলে এর থেকে সৃষ্ট সব ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব, যেমন নদীগর্ভে অতিরিক্ত বালুর সঞ্চালন ও সঞ্চয়ন, হঠাৎ বন্যা, অতি বন্যা ইত্যাদির প্রভাব সম্পূর্ণটুকুই পড়বে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সম্পূর্ণ হাওর জনপদের ওপর। আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলের হাওর, বিল, ঝিল, বাঁওড়, নদীনালা বালুতে ভরে যাবে। হাওর অঞ্চলের অত্যন্ত উর্বরা ধানের জমি পুরো বালির স্তরের নিচে চাপা পড়বে। ধ্বংস হয়ে যাবে কৃষি। হারিয়ে যাবে শস্য, তথা বোরো, শাইল ও আমন ধানের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। হারিয়ে যাবে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মাছ, গাছপালা, জলজ উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম। সুরমা ও কুশিয়ারা ধ্বংস হলে মেঘনার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। সুতরাং শুধু সিলেটের হাওর অঞ্চলই নয়, মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে মেঘনা নদী অধ্যুষিত জনপদে বসবাসরত এদেশের প্রায় অর্ধেক জনগণ। ধস নামবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়। দেশের অর্থনীতিতে। এক্ষেত্রে ওই বাঁধটি নির্মিত হলে আমাদের পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। এজন্যই প্রয়োজন ছিল যৌথ সমীক্ষার। এখন ভারত রাজি না হওয়ায় বাংলাদেশকে দায়িত্বটি নিতে হবে। সরকার স্বউদ্যোগে একটি সমীক্ষা চালাতে পারে। ওই সমীক্ষায় বেরিয়ে আসবে পরিবেশগত কী কী সমস্যা হতে পারে বাঁধ নির্মাণ করার ফলে। বাংলাদেশ দাতাগোষ্ঠীর সহযোগিতাও নিতে পারে সমীক্ষা পরিচালনার জন্য। সমীক্ষার ওই ফল নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। যৌথ নদী কমিশন বা জেআরসির বৈঠকের কথাও বলা হচ্ছে। এজন্য অতীতের কোনো বাংলাদেশ সরকারকেই দায়ী করা যাবে না। ভারত জেআরসির বৈঠকগুলো ব্যবহার করেছে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য। জেআরসির বৈঠকের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ থাকলেও ভারতের আগ্রহ ছিল কম। আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে অবশ্যই ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। সে সঙ্গে বিশ্ব আসরে এ সমস্যাটা তুলে ধরাও প্রয়োজন। কেননা পরিবেশগত সমস্যার ব্যাপারে সারা বিশ্ব আজ অত্যন্ত সচেতন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে একটি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সেটা বলা কোনো অপরাধ নয়। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত হেলসিংকি নীতিমালা, ১৯৯২ সালে প্রণীত ডাবলিন নীতিমালা, আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশন, রামসার কনভেনশন (জলাভূমিবিষয়ক), জীববৈচিত্র্য কনভেনশন, প্রতিটি আন্তর্জাতিক আইনে ভাটির দেশের অধিকার রক্ষিত। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ওই আইনে বর্ণিত অধিকার বলেই দেশটির সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারে। অতীতে ভারত যখন একতরফাভাবে গঙ্গায় পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, তখন বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালে আন্তর্জাতিক আসরে তার সমস্যার কথা তুলে ধরেছিল। ফলে ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো গঙ্গার পানিবণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত COP-20 সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বেশ ক'টি এনজিও বেসরকারি প্রতিনিধি দল হিসেবে ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। তারাও টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়টি বিশ্ববাসীকে জানাতে পারেনি। সারা বিশ্বই আজ বড় বড় বাঁধের ব্যাপারে সোচ্চার। বাঁধ নির্মাণের ফলে হাজার হাজার লোক গৃহহীন হয়, স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের শত বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে অনত্র আশ্রয় নেয়- এটা আজ আন্তর্জাতিকভাবেই ঘৃণিত একটি কাজ হিসেবে গণ্য হয়। মণিপুরে টিপাইমুখে বাঁধটি নির্মিত হলে ওই এলাকার বেশ কিছু গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যাবে। শত শত স্থানীয় আদিবাসী নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হবে। আন্তর্জাতিক আইন এটা অনুমোদন করে না। ভারত আরও একটি বিষয়ে লুকোচুরির আশ্রয় নিচ্ছে। টিপাইমুখের আরও উজানে আসামের কাছার জেলার ফুলেরতাল নামক স্থানে (সেচের জন্য) ভারত একটি ব্যারাজ তৈরি করছে। ফলে বরাক নদী থেকে ভারত কিছু পানি প্রত্যাহার করে নেবে। এ বিষয়টি ভারত খোলাসা করছে না। টিপাইমুখ নিয়ে চুক্তির কথা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও ফুলেরতাল ব্যারাজ নিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। টিপাইমুখ নিয়ে মানুষের যে উৎকণ্ঠা তা শুধু বাংলাদেশেই নয়। বরং ভারতের 'সাতবোন' রাজ্যের মধ্যে তিনটি রাজ্য মণিপুর, আসাম ও মিজোরামেও ওই উৎকণ্ঠা আমরা লক্ষ্য করেছি। এরই মধ্যেই ভারতের ওই রাজ্যগুলোর ৩০টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিয়ে গঠিত হয়েছে 'কমিটি অন পিপলস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট' (কোপে)। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ফলে ওই অঞ্চলে যে ক্ষতি হবে, তার প্রতিবাদ করতেই তারা ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশবাদীরা এখন 'কোপের' সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে পারেন। কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যৌথভাবেও বিষয়টি উত্থাপন করা যায়। মনে রাখতে হবে, ভারতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। যতদূর জানা যায়, তাতে দেখা গেছে ভারত সরকার উত্তর-পূর্ব ভারতে ২২৬টি বড় বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করছে, আর লক্ষ্য হবে ৫০ বছরের মধ্যে ৯৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। মুখে মুখে ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা যতো আশ্বাসই দেন না কেন, ভারত অত্যন্ত কৌশলে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন আমরা জেনেছি, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রেও ভারত কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করতে পারে। ভারত অতীতের মতো কূটনৈতিক ভাষা প্রয়োগ করে আবারও বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করতে পারে 'তারা এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়।' টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে এ ধরনের আশ্বাসও আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী (মহাজোট সরকার) বেশ ক'বছর আগে একটি সেমিনারে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া ভারত টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যাব।' সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রীর এ বক্তব্যের মাঝে 'রাজনীতি' কতটুকু কিংবা 'বাস্তবতা' কতটুকু তা ভিন্ন প্রশ্ন। এ মুহূর্তে যা দরকার তা হচ্ছে, ভারতকে ওসব প্রকল্প বাতিল করতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া ও সে সঙ্গে এ অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে হিমালয় অঞ্চলভুক্ত দেশ ও চীনের সমন্বয়ে একটি ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা। আর অভ্যন্তরীণভাবে যে বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি, তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পরিত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। কেননা টিপাইমুখ বিষয়টি একটি জাতীয় ইস্যু। এখানে সব দলের ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন। এখন পানিসম্পদমন্ত্রী বললেন, যৌথ সমীক্ষা হচ্ছে না, এখন মন্ত্রী এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞ আইনবিদ তথা পরিবেশবাদীদের সঙ্গে বৈঠক করে একটি করণীয় নির্ধারণ করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, আগামীতে এটা একটা নির্বাচনী ইস্যুও হয়ে যেতে পারে। সুতরাং বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষের সমর্থন পেতে হলে সরকারকে টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপারে বাস্তবমুখী কর্মসূচি নিতে হবে। না হলে মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাবে। পানিসম্পদমন্ত্রী শুধু 'সমীক্ষা হবে না' বলেই দায়িত্ব শেষ করেছেন। আমরা আশা করব, তিনি এখন করণীয় নির্ধারণ করবেন। Daily ALOKITO BANGLADESH 15.03.15

বরফ যদি না গলে!

প্রশ্নটা হাইপ্যোথেটিকাল। বিদেশী কূটনীতিকদের উদ্যোগ যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে কী হবে দেশে? এ ধরনের হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি প্রতিদিন। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে। ই-মেইলে প্রশ্ন আসে। টকশোতে সঞ্চালক জানতে চান, কী হতে পারে ভবিষ্যৎ রাজনীতি? বিদেশে বন্ধুরা, নিজের আত্মীয়স্বজন জিজ্ঞেস করেন, তারা দেশে আসতে চান- আসবেন কিনা এখন? পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে? এর জবাব কী দেব? টকশোতে প্রায়ই যাই। কিছু পরিচিত মুখকে প্রায়ই দেখি। কখনও-সখনও মনে হয়, সরকারের বক্তব্যই যেন শুনছি তাদের মুখ থেকে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, জামায়াত- ঘুরেফিরে আসছে এসব কথাই। সাহস করে আগ বাড়িয়ে কিছু বলা যায় না। বলিও না। মধ্যবিত্তের মানসিকতায় বেড়ে ওঠা আমি। যেখানে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের সমালোচনা করা হচ্ছে, সেখানে আমার মতো সাধারণ একজনের কী-ই বা বলার আছে?রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে পড়াশোনা করতে আর লিখতে ভালো লাগে। তুলনামূলক রাজনীতি আমার প্রিয় বিষয়। বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গে অন্য দেশের রাজনীতিকে মেলাতে চাই। কোথায় মিল আছে, কোথায় অমিল আছে- খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু মিলটা আর খুঁজে পাই না। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যা ঘটছে, কিংবা যা ঘটে চলেছে গত প্রায় দুমাস ধরে, তার ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে দেব? বার্ন ইউনিটের আহাজারি আমার হৃদয়কে বারবার ছুঁয়ে গেছে। একাধিকবার লিখেছি। নিজে গিয়েছিও দেখতে। চোখ ভিজে যায় ওইসব দৃশ্য দেখে। বাংলাদেশের ৪৪ বছরে কেউ কখনও দেখেনি এ দৃশ্য। হরতালে ঢাকা শহরে যানজটের চেনা দৃশ্য! রাস্তায় গাড়িগুলো পার্ক করা থাকে যত্রতত্র। এ কারণে রাস্তা সংকুচিত হয়ে আসে, সৃষ্টি হয় যানজটের। দিনের বেলায় শ্যামলী-কল্যাণপুর-রিংরোড এলাকায় গেলে দেখতে পাবেন এ দৃশ্য। আমি ঠিক জানি না, ট্রাফিক বিভাগের জ্ঞাতসারেই গাড়িগুলো পার্ক করা থাকে কি-না। তবে এটা তো ঠিক, হরতাল-অবরোধের ধার অনেক কমে গেছে। মানুষের সমর্থন আছে কী নেই, এ প্রশ্ন অর্থহীন। বাস্তবতা হচ্ছে, অবরোধ আর হরতাল ডেকে যে সরকারের পতন ঘটানো যায় না, সেটা প্রমাণিত হয়েছে। সরকার আরও শক্তিশালী হয়েছে। এ পরিস্থিতি এমন একটা মেসেজ দিল, যা ভবিষ্যতে রাজনীতিকদের জন্য শিক্ষণীয় হবে। যারা বিশ্বের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তাদের কাছে কালার রেভ্যুলেশনের ইতিহাস অজানা নয়। থাইল্যান্ডের রেড শার্ট মুভমেন্ট, জর্জিয়ার গোলাপ বিপ্লব, ইউক্রেনের অরেঞ্জ রেভ্যুলেশন, কিরঘিজস্তানের টিউলিপ রেভ্যুলেশন কিংবাকায়রোর তেহরির স্কয়ারের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না। নিশ্চয়ই বিএনপি এ আন্দোলন থেকে শিখছে অনেক কিছুই।গত দুমাসের পরিস্থিতি দেখে আমার কাছে চারটি বিষয় স্পষ্ট। এক. দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটছে; দুই. দেশে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বাড়ছে; তিন. জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি শক্তিশালী হচ্ছে; চার. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ বাড়ছে। বর্তমানে যে আন্দোলন চলছে, তাকে জঙ্গিবাদের উত্থানের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। মধ্যপ্রাচ্যে যে জঙ্গিবাদের উত্থান, তার সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের উত্থানকে মেলানো যাবে না। আবার এটাও সত্য, দেশে জঙ্গিরা আছে। অভিজ্ঞতা বলে, জঙ্গিরা দেশের একটি জেলা বাদে প্রতিটি জেলায় একসঙ্গে একই সময় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, কিংবা আদালত পাড়ায় আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে একটা মেসেজ দিয়েছিল। জঙ্গি নেতাদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, এটা সত্য। কিন্তু জঙ্গিবাদকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। মাঝে মধ্যেই এদের তৎপরতা আমাদের চোখে পড়ে। ত্রিশালে জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা তাদের উপস্থিতির জানান দিয়েছিল। তবে এটাও সত্য, মধ্যপ্রাচ্যে আইএস বা আল কায়দার জঙ্গিদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের মেলানো যাবে না। বাংলাদেশে জঙ্গিরা বিভ্রান্ত। ইসলামের নামে এদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলো যখন ব্যর্থ হয়, তখন জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এটা তত্ত্বের কথা। মধ্যপ্রাচ্যে এভাবেই জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের পার্থক্য এখানেই যে, এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক শক্তিশালী। সমাজেও তাদের অবস্থান শক্তিশালী। ফলে নিশ্চিত করেই বলা যায়, আইএসের মতো কোনো জঙ্গি সংগঠনকে আমরা বাংলাদেশে দেখব না। তবে এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে, বর্তমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসবাদের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। পেট্রলবোমা সংস্কৃতির যে জন্ম হয়েছে, তা কোনো ভালো কথা বলে না। সাইকেল বোমা কিংবা সীতাকুণ্ড পাহাড় থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গুলি ও পেট্রলবোমা উদ্ধার প্রমাণ করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেমে নেই। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে খোদ বিদেশীরা যখন প্রশ্ন রাখেন, তখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। তবে বিদেশীরা যেভাবে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছেন, তা কোনো আশার কথা বলে না। সর্বশেষ ১৬ জন রাষ্ট্রদূত খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার অবরুদ্ধ কার্যালয়ে দেখা করে একদিকে যেমন বোঝাতে চেয়েছেন, খালেদা জিয়া চলমান সংকট সমাধানে একটি ফ্যাক্টর; অন্যদিকে প্রকাশ পাচ্ছে, তারা একটা দূতিয়ালি করতে চান। এটা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়।একটা প্রশ্ন এখন বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে- সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী? এটা সত্য, সরকার সাংবিধানিকভাবেই ক্ষমতায় আছে। সংবিধান অনুযায়ীই একটা নির্বাচন হয়েছে গেল বছরের ৫ জানুয়ারি। ওই নির্বাচনে সব দল অংশ না নিলেও নির্বাচনটি ছিল সাংবিধানিকভাবে বৈধ। কিন্তু এ নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে পারেনি। কেননা গণতন্ত্রে কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারসের যে কথা বলা হয়, তা রক্ষিত হয়নি। অর্থাৎ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপিত হয়নি। বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তখন অবশ্য বলা হয়েছিল, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। আমরা সেটাই ধরে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সরকার এক বছরের মধ্যে আরেকটি নির্বাচনের কথা বলবে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রায় সবাই বলছেন, পরবর্তী নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে। সংবিধান এ কথাই বলে, ৫ বছর পরপর নির্বাচন। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের আন্দোলন এখনই একটি নয়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আর সংকটটা তৈরি হয়েছে সেখানেই। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ তথা সরকার, আর বিএনপি তথা ২০ দল আজ নো রিটার্নের পর্যায়ে চলে গেছে। কেউ কাউকে এতটুকু স্পেস দিতে চাচ্ছে না। সরকার তার অবস্থানে অনড়। আর বিএনপিও এতটুকু পিছপা হচ্ছে না। যদিও এটা সত্য, মাঠে বিএনপির নেতাকর্মীদের আদৌ দেখা যাচ্ছে না; কিন্তু হরতাল-অবরোধের আহ্বান আসছে। আর সংবাদপত্রের মাধ্যমেই মানুষ জানছে পরবর্তী সপ্তাহের হরতালের খবর। ফলে বিদেশী দাতাগোষ্ঠী যে উদ্বিগ্ন থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সর্বশেষ খবরে দেখলাম, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার হাইকমিশনার জেইড রাড হুসেইন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করার পরামর্শ দিয়েছেন।খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিদেশী দূতদের দেখা করা, আর জেইড রাড হুসেইনের পরামর্শ মূলত একই সূত্রে গাঁথা। বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো চাচ্ছে একটা সমঝোতা। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, আমরা আমাদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে পারছি না। এভাবে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে কতটুকু উন্নত করবে, তা আমাদের রাজনীতিকরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন।নয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, গণতন্ত্র বিকাশে ভিন্নমত ও সংলাপ প্রয়োজন। মার্কিন কংগ্রেসের ১১ জন সদস্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে লেখা এক চিঠিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে ভূমিকা রাখার অনুরোধ করেছেন। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাহলে কেরি ভূমিকা রাখবেন কীভাবে? এদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও তা নিয়েও একটা ধোঁয়াশা রয়েছে। খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলে সরকারের শেষ অস্ত্রটিও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। সরকার বোধকরি এটি চাচ্ছে না এবং তারা আইনি পথেই এগোতে চায়। ৫ এপ্রিল আদালত নতুন তারিখ নির্ধারণ করেছেন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায়। অন্যদিকে বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলার নতুন তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ১৫ মার্চ। বোঝাই যায়, সরকার মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে খালেদা জিয়াকে চাপে রাখতে চায়। তাতে কতটুকু ফল মিলবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।রাজনীতিকরা দেশ চালাবেন, এটাই কাম্য। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। কিন্তু যে রাজনীতি জনগণ ও অর্থনীতির ক্ষতি করে, সেই রাজনীতি দেশের কোনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। তাই সংকটের গভীরতা অনুধাবন করে এবং অর্থমন্ত্রীর ভাষায় বর্তমান সংকট জাতীয় সংকট এটা বিবেচনায় নিয়ে উভয়পক্ষ যদি একটি সমঝোতায় উপনীত হয়, তা হবে সবার জন্যই সুখবর। সেই সমঝোতাটা কী, তার ধরন কী, কোন পক্ষ কতটুকু ছাড় দেবে কিংবা কীভাবে বিএনপি তার বর্তমান অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে, তা নির্ধারিত হতে পারে একটা সংলাপের মাধ্যমে। Daily Jugantor 14 march 2015

গ্রিসের ঋণ সঙ্কট ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ

গ্রিসের ঋণ সঙ্কট একটি প্রশ্নকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে আর তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে তো? গ্রিসের সাম্প্রতিক নির্বাচনে একটি বামপন্থী সরকার সেখানে গঠিত হয়েছে। কিন্তু গ্রিস ঋণ সঙ্কটজনিত অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। গেল সপ্তাহে গ্রিসকে দেয়া আন্তর্জাতিক ঋণ সহায়তা তহবিলের মেয়াদ আগে ৪ মাস বাড়াতে সম্মত হয়েছে ইউরোজোন। তবে এর মধ্যে কিছু শর্তও বেঁধে দেয়া হয়েছে। নতুন করে অর্থ সহায়তা না পেলে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গ্রিস দেউলিয়া হয়ে যাবে। দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরকার দেশগুলোর আর্থিক সঙ্কট বার বার সংবাদের শিরোনাম হয়ে আসছে। ইইউতে অধিভুক্ত একাধিক দেশে এই ঋণ সঙ্কটের কারণে সরকারের পতন ঘটেছে। নতুন নির্বাচন ও নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ায় ঋণের আর্থিক সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না। গ্রিস সর্বশেষ উদাহরণ। ফলে অভিন্ন ইউরোপের ধারণা সন্দেহের মধ্যে থেকে যেতে পারে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কোনো অমূলক ধারণা ছিল না। বরং ১৯৫৭ সালে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত ম্যাসাট্রিট চুক্তিতে একটি একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৯৭ সালের মার্চের চুক্তি ও ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্যদিয়ে অভিন্ন এক ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপ। বলা ভালো ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাম ধারণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতোমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বেশ কটি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইইউতে যোগ দিয়েছে। ইইউর সদস্য সংখ্যা এখন ২৭। ১৯৯৯ সালের তৎকালিন ইইউর ১৫টি দেশের মধ্যে ১১টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু হয়েছে ১৭টি দেশে। ইউরো চালু হওয়ার সময়ই ইউরো নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল ইউরোপের উত্তরের ধনী দেশগুলো ইউরো চালু হলে এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এত বছর পর এই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হলো। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়া সিদ্ধান্ত হলেও তিন বছর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাই মাসে ইউরোর কাগজী ও ধাতব মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়। গত নয় বছর ইউরো নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা না দিলেও, গেল বছরের প্রথম দিকে ইইউর কয়েকটি দেশে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে গ্রিস ও ইতালির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চরমে ওঠে। কিন্তু গ্রিসের পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে খারাপ। সেখানে পরোক্ষ সরকারের পতন, বিচারপতি পাপাদেমাসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিংবা সর্বশেষ নির্বাচনে বামপন্থী এলেক্সিস গ্রিসের নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হলেও গ্রিস অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। তখন গ্রিস পুনর্গঠনে একটি তালিকা চেয়েছে ইউরো গ্রুপ। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি শক্তি। অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সঙ্কট ইইউর ভূমিকাকে সংকুচিত করে দিয়েছে। এখানে বলা ভালো ১৯৫৭ সালে মাত্র ৬টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্যের যে যাত্রা শুরু করেছিল তা আজ পরিণত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ)। ২৭টি দেশ এখন ইইউর সদস্য। এর মধ্যে আবার ২৪টি দেশ ন্যাটোর সদস্য। তবে জর্জিয়া ও ইউক্রেন এখনো ন্যাটোর সদস্য হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এই দুটো দেশকে ন্যাটোর সদস্যপদ দিতে চাচ্ছে যাতে রাশিয়ার রয়েছে আপত্তি। ইউরোপে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্থার জন্ম হয়েছে, যে সংস্থাগুলো ইউরোপীয় ঐক্যকে ধরে রেখেছে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দপ্তর, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় মুদ্রা ইন্সটিটিউট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা। এই সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু ইউরোই নয়, বরং খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। যে যুক্তি তুলে এক সময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোনে (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি। সেই যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হলো। অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজেকে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড়, তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না? ২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন উৎসব পালন করে তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্যে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ইইউর সঙ্গে বিভক্তি আছে। লুক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান হয়ে ইউরো মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল ইউরো সব দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স এর বিরোধিতা করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিন্তিত ছিল এ কারণে যে, নিরাপত্তার বিষয়টিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে খেপিয়ে তুলতে পারে। জার্মানি ও স্পেন ইইউর জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও ব্রিটেন ও নেদারল্যালন্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোর সাবেক সমাজতন্ত্র দেশগুলো তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালের 'ভেলভেট রেভ্যুলেশন' এই দেশগুলোকে সোভিয়েত নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্তের পতন হয় ও দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। এ দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগের ফর্মুলা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেয়া হয়েছিল যা পূরণ করলেই ইইউর সদস্য পদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তক, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। ওইসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া হারজেগোভিনা কিংবা ক্রয়েশিয়া এখনো ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সঙ্কট সব সঙ্কটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সঙ্কটে জর্জরিত ইউরোপে আবারো মন্দার অপেক্ষা বাড়ছে। গেল বছর ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের শূন্য প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ইইউর প্রবৃদ্ধিও ছিল শূন্যের কোঠায়। তাই ইউরো মুদ্রা নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। এখন ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ তা আরো বাড়বে। ইতোমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুই স্তর বিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এ বিভক্তির কথা বলেছিলেন। জার্মানির চ্যাঞ্চেলর মার্কেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপের কথা। যদিও এই বিভক্তির বিরোধিতা করছেন ইউরোপীয় কমিশনের চেয়ারম্যান। এখন সত্যি সত্যিই কি ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে? 'নতুন ইউরোপ' এর স্বরূপ কী হবে, তা এই মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসছে, তা গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটাই ইউরোপীয় ইউনিয়ের বড় ব্যর্থতা। তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন যখন ইইউতে থাকা না থাকা নিয়ে গণভোট করতে চান, তখন ইউরোপের ঐক্যে যে ফাটলের জন্ম হয়েছে তারই ইঙ্গিত দিলেন তিনি। ক্যামেরন স্পষ্ট করেই বলেছেন, 'আমরা যদি এখনই এসব সমস্যা নিয়ে উদ্যোগ নিতে না পারি, তাহলে ইউরোপের পতন হবে এবং ব্রিটিশরাও পতনের দিকে যেতে থাকবে।' অতীতে ইইউ সম্পর্কে এত ভয়ঙ্কর কথা কেউ বলেনি। এখন ক্যামেরন সাহস করেই বললেন। সামনের দিনগুলো অত্যন্ত কঠিন সময় ইইউর জন্য। মন্দাভাব যদি ইইউ কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় আগামী দুই দশকের মধ্যে আমরা এক ভিন্ন ইউরোপকে দেখতে পাব। Daily Jai Jai Din 12.03.15