রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করুক

তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে 'ব্যাপক অনিয়ম' বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। নির্বাচনের মাঝখানে নির্বাচন থেকে 'বয়কট'-এর ঘোষণা দিয়ে বিএনপি আবারও পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলল। গত বেশ কদিন, নির্বাচনের আগে ও পরে আমরা টিভি টক শোগুলোতে এটা বলার চেষ্টা করেছিলাম যে জাতির প্রয়োজনে, আর স্থিতিশীলতার স্বার্থেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন। আমার মতো অনেকেই সেদিন জাতিকে আশ্বস্ত করেছিলেন, সিটিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচনের দিন যা দেখলাম এবং পরদিন সংবাদপত্রে যেভাবে সংবাদগুলো পরিবেশিত হয়েছে, তাতে করে একটা প্রশ্নই আমাদের মনে উঁকি দিচ্ছে, আর তা হচ্ছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কি 'মৃত্যু' ঘটল এ দেশে! ১৯৯২ সালে সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করে আমরা আবার গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। এখন ২৩ বছর পর কি আমরা আবারও পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি। জাতীয় রাজনীতির আলোকে এই তিনটি সিটি করপোরেশনের গুরুত্ব 'তেমন একটা' ছিল না। 'ছিল না' এই যুক্তিতে যে এতে করে সরকার পরিবর্তন হবে না এবং সরকার পরিবর্তনের আদৌ কোনো সম্ভাবনাও নেই। যুক্তি হিসেবে এটা বলা যায়, যদি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের 'বিজয়' হতো, তাহলে বিএনপির 'নয়া নির্বাচনের' দাবি আরো শক্তিশালী হতো। এই দাবি তো বিএনপির এখনো আছে। ভবিষ্যতে এ দাবি অব্যাহত থাকলেও তাতে কী হতো সরকারের? নীতগতভাবে সরকারের তো একটা সিদ্ধান্তও রয়েছে যে ২০১৯ সালেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তাহলে? বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করুক এই নির্বাচনে বিরোধীপক্ষের 'বিজয়' সরকারকে তার অবস্থান থেকে সরাতে পারত না। বরং সরকারের লাভ ছিল অনেক। সরকার দেখাতে পারত তার আমলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব এবং সরকার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো হস্তক্ষেপ করে না। দ্বিতীয়ত, বহির্বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বহির্বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তির কিছুটা ক্ষতি হলেও এই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার তা কাটিয়ে উঠতে পারত। কিন্তু এই সুযোগ আর থাকল না। তৃতীয়ত, বিএনপিকে 'মূলধারার' রাজনীতিতে নিয়ে আসার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল। বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছিল। এখন আবার সরকার ও বিএনপির মধ্যে 'ব্যবধান' বাড়ল। এতে করে 'গণতন্ত্র' শক্তিশালী হবে না। চতুর্থত, দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থেই প্রয়োজন ছিল বিরোধী দলকে 'মূলধারায়' রাখার অর্থাৎ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রাখার। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় ইউনিয়ন পরিষদ এবং মার্চ-জুলাই মাসে (২০১৬) অনুষ্ঠেয় পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করত। এতে করে ধীরে ধীরে বিএনপি 'মূলধারার' রাজনীতিতে ফিরে আসত এবং আগামী ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিত। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে 'অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়' সরকারের বড় ধরনের সাফল্য রয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো যেখানে এখনো অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না, সেখানে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬ ভাগে ধরে রাখা, রিজার্ভের পরিমাণ দুই হাজার ২৪০ কোটি ডলারে উন্নীত করা, রপ্তানি ২৭ বিলিয়নে উন্নীত করা, রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১১.৭৯ বিলিয়ন ডলার, বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা (৭ মিলিয়ন), দারিদ্র্যের পরিমাণ কমিয়ে আনা (২৪ ভাগ), মাথাপিছু আয় এক হাজার ১৯০ ডলারে উন্নীত করা ইত্যাদি পরিসংখ্যান সরকারের বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য। শুধু তা-ই নয়, এমডিজিতেও আমাদের সাফল্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে (জন্মহার ১.৪ ভাগে নামিয়ে আনা, স্যানিটেশন ৫৬ ভাগে উন্নীত করা, ৬০ শতাংশ শিক্ষিত)। এখন যদি দেশে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে ঝুঁকির মুখে থাকবে আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া। খোদ বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করেছে বিগত ৯২ দিনের 'হরতাল-অবরোধের রাজনীতির' কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবারও যদি আমরা একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করি, তাহলে তা অর্থনীতিকেও আঘাত করবে। পঞ্চমত, সত্যিকার অর্থেই আমাদের জানার প্রয়োজন ছিল বিএনপির জনপ্রিয়তা কেমন? এখন ভোটের একটা 'ফলাফল' পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু ব্যাপক অনিয়মের মধ্য দিয়ে পাওয়া এই 'ফলাফল' সঠিক জনপ্রিয়তার কোনো মাপকাঠি হতে পারে না! আমাদের জন্য একটা বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। 'বেপরোয়া জালিয়াতি' (সমকাল), 'হিসাব কষছে বিএনপি' (কালের কণ্ঠ), 'ডিজিটাল জমানায় অ্যানালগ কারচুপি' (মানবকণ্ঠ), 'জিতল আওয়ামী লীগ, হারল গণতন্ত্র' (প্রথম আলো), 'ভোট জালিয়াতির মহোৎসব' (যুগান্তর)- সংবাদপত্রের এই যে শিরোনাম, তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। এ জন্য মূলত দায়ী নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অতীতেও নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। বিবিসি বাংলার সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেছিলেন- নির্বাচন কমিশনের দায়দায়িত্ব সরকার নেবে না। এমনকি বেগম জিয়ার গাড়িবহরের ওপর যখন হামলা হয় তখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, 'খালেদা জিয়ার ওপর হামলার দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের' (ঢাকা টাইমস)। একটি 'ভালো নির্বাচন' উপহার দেওয়ার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আইন ও সংবিধান কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। তখন কমিশন যদি নির্বাচনের সময় সংঘটিত 'অনিয়ম'-এর ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে থাকে, তাহলে সরকারকে দোষ দেওয়া যাবে কি? কমিশনের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। যখন সংবাদপত্রে বলা হলো ঢাকায় ৮০, চট্টগ্রামে ৮৩ ভাগ কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ (যুগান্তর, ২৫ এপ্রিল), 'উৎসবের সঙ্গে শঙ্কা', 'ভোট কেনার অভিযোগে ১৪ জন গ্রেপ্তার ঢাকায়' (কালের কণ্ঠ, ২৮ এপ্রিল), তখন আমরা ইসিকে কোনো ভূমিকা নিতে দেখিনি। ইসির এই ভূমিকা বরং সরকারকেই একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছিল। সুতরাং উপদেষ্টা গওহর রিজভী কিংবা মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যখন স্পষ্ট করেন 'সরকার কোনো দায়দায়িত্ব নেবে না'- আমি এটাকে গুরুত্ব দিতে চাই। ইসি একটি দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালন করেছে। নির্বাচনে যত অনিয়ম হয়েছে, তার দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকেই বহন করতে হবে। ইসি তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়েও ইসির বক্তব্য ছিল বিভ্রান্তিকর। সিটি করপোরেশন নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপির রাজনীতি কী হবে, আমরা জানি না। তবে আমরা চাইব বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করুক। অবরোধ-হরতালের রাজনীতি কোনো সমাধান নয়। গত ৯২ দিনের রাজনীতি নিয়ে বিএনপি কতটুকু 'লাভবান' হয়েছে, এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করা উচিত। বেগম জিয়া বিগত আন্দোলনে তাঁর স্থায়ী কমিটির সবার সমর্থন পেয়েছিলেন কি না, তা ভেবে দেখতে পারেন। দীর্ঘদিন 'নীরব' থাকার পর মওদুদ আহমদ আবার সক্রিয় হয়েছেন। এটা বেগম জিয়াকে খুশি করার জন্য কি না জানি না, কিন্তু এটা তো সত্য, অন্য স্থায়ী কমিটির সদস্যদের আমরা মাঠে দেখছি না। স্থায়ী কমিটির পুনর্গঠনের প্রশ্নটি তাই খুবই প্রাসঙ্গিক। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি সঠিক কাজটি করেছিল। এখন দলের নেতৃত্বকে ভবিষ্যতে এই 'সঠিক কাজটিই' করতে হবে। বিগত প্রায় এক মাস এক ধরনের স্বস্তির বাতাস বইছিল। রাজনীতিতে 'বিশ্বাস' ও আস্থার সম্পর্ক' তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল, তা এই 'বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক'কে একটা অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিল। দুটি বড় দলের মধ্যে ব্যবধান আরো বাড়ল। নতুন করে 'সংকট' তৈরি হলো। ঈশান কোণে আমরা আবারও 'মেঘ' দেখতে পাচ্ছি। তিনটি সিটি করপোরেশন তিনজন 'নগরপিতা' পেল বটে, কিন্তু একটি বড় দলের অসহযোগিতার মধ্য দিয়ে নগরপিতারা তাঁদের 'কমিটমেন্ট' কতটুকু রক্ষা করতে পারবেন, এটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রশাসনে জনসম্পৃক্ততা বাড়ল। জনগণের প্রতিনিধিরা প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন বটে, কিন্তু 'অনেক প্রশ্ন'ই অমীমাংসিত থেকে গেল। - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2015/04/30/216419#sthash.ObM2QdhB.dpuf

আমরা পেছনের দিকে হাঁটছি আবার!

তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন আমাদের কী দিল? যেখানে সাধারণ মানুষের এবং সেই সঙ্গে বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের একটা প্রত্যাশা ছিল নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে এবং বিএনপি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ফিরে আসবে, সেখানে ২৯ এপ্রিলের সংবাদপত্রগুলোর শীর্ষ সংবাদ আর ছবি আমাদের এ সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য করছে যে, আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ‘ভোট জালিয়াতির মহোৎসব’, ‘সকালেই অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র দখল’ (যুগান্তর), ‘অনিয়ম দখল সিল আর বর্জনে শেষ হল ভোট’ (মানবকণ্ঠ), ‘প্রশ্নবিদ্ধ ভোট, বিএনপির বর্জন’ (সমকাল), ‘নির্বিঘ্নে ভোট ছিনতাই!’ (সকালের খবর), ‘অবাধ দখল ও বর্জনে সিটি নির্বাচন’ (যায়যায়দিন)- সংবাদপত্রগুলোর এই যে শিরোনাম, এগুলো আমাদের শুধু হতাশই করল না, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বুকে একটি ‘কালো কালি’ মেখে দিয়ে গেল! জানুয়ারি পরবর্তী রাজনৈতিক সংকট থেকে আমরা বের হয়ে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলাম না। যেখানে প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্র, অনলাইন সংবাদপত্র নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, সেখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। অথচ ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলেছে, ভোট কেন্দ্রগুলো পরিদর্শনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্টের মাধ্যমে আমরা আজ ভোট কারচুপি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার কথা জেনে অসন্তুষ্ট হয়েছি এবং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জনে বিএনপির সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছি (যুগান্তর, ২৯ এপ্রিল)। আমরা এখন কার কথাকে সত্য বলে ধরে নেব? সিইসি নাকি মার্কিন দূতাবাস? এটাও দুঃখজনক যে, আমরা চাই আর না চাই বিদেশী দূতাবাসগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে এবং মন্তব্য করছে। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বই বিদেশীদের মন্তব্য করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার ব্যর্থতার দায়ভার এখন নির্বাচন কমিশনকেই বইতে হবে। আমার স্মরণ আছে, বিবিসি বাংলার এক সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী মন্তব্য করেছিলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়-দায়িত্ব সরকার নেবে না।’ এমনকি বেগম জিয়ার গাড়িবহরের ওপর যখন হামলা হয়, তখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়ার ওপর হামলার দায়-দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।’ এখন নির্বাচন সম্পন্ন হল। সংবাদ সম্মেলনে সিইসি হাসলেন। আর ঢাকা উত্তরের ‘বিজয়ী’ নয়া নগরপিতা আনিসুল হক বললেন, ‘খেলতে গেলে ফাউল হয়।’ এই ‘ফাউল’ তার ব্যক্তিগত ইমেজকে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত করল, তা হয়তো ভবিষ্যতে বলা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা যা তা হচ্ছে, আমরা নির্বাচন সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিলাম। যেভাবে প্রকাশ্যে যুবলীগের দুই নেতা সিল মারলেন (যুগান্তর), যেভাবে জাল ভোট দিলেন একজন কর্মকর্তা (যায়যায়দিন), কিংবা যত্রতত্র পড়ে থাকল সিল মারা ব্যালট পেপার (সকালের খবর) তাতে করে আর যাই হোক, এটাকে কোনো অবস্থাতেই সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যাবে না।আমাদের একটা ধারণা ছিল, বিএপির জন্য যে ‘এক্সিট রুট’ তৈরি হয়েছিল তা কাজে লাগিয়ে বিএনপিকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনা হবে। বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল সঠিক এবং তা প্রশংসিতও হয়েছিল। কিন্তু এখন আবার উল্টো স্রোত বইল। নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে সরকারি দলের সুবিধাভোগীরা ‘সিল মারার সংস্কৃতি’ আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। এর মধ্য দিয়েই বিএনপির অভিযোগ আবারও সত্যে পরিণত হল। বিএনপি বারবার বলে আসছিল, এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সেটাই এখন প্রমাণিত হল। নির্বাচন কমিশন পরোক্ষভাবে বিএনপির অভিযোগই ‘সত্য’ প্রমাণ করল। নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। আইন ও সংবিধান বলে নির্বাচন কমিশনকে যতটুকু ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, ওই ক্ষমতা প্রয়োগ করার ব্যর্থতা (নাকি অনীহা!) আবারও প্রমাণ করল, সিইসি ও কমিশনের সদস্যরা নিজেদের এক একজন ‘সরকারি কর্মচারী’ হিসেবেই ভাবতে ভালোবাসেন। সংবিধান তাদের যে ‘দায়িত্ব’ নির্ধারণ করেছে [১১৮(৪)] তা পালনে ও ক্ষমতা প্রয়োগে তারা ব্যর্থ হলেন। তাদের এ ব্যর্থতার কারণে ‘গণতন্ত্রের পরাজয়’ হল, শংকা সত্যি হল; কিন্তু রকিবউদ্দীন কমিশন একটি বড় ক্ষত সৃষ্টি করে গেল আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে। এ ক্ষত সহজে সারার নয়।মাঝপথে বিএনপির নির্বাচন বয়কটের পেছনে যুক্তি যাই থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত বিএনপির মাঠে থাকা উচিত ছিল। কারণ মাঠে শেষ পর্যন্ত থাকলে রেজাল্ট যাই হোক, তাদের বলার সুযোগ আরও বেশি হতো। মাঝপথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে বয়কটের সিদ্ধান্ত সুযোগ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিরূপ মন্তব্য করার। যেমনটি বলেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি বলেছেন, পরাজয়নিশ্চিত জেনেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করেছেন। রাজনীতিকরা এ ধরনের কথা বলেন। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু আমরা কেন এ ধরনের মন্তব্য করতে সুযোগ তৈরি করে দেব?একটা হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সিটি নির্বাচন সম্পন্ন হল। এখন সরকারি দল বিজয় উৎসব করতেই পারে। কিন্তু আগামীর রাজনীতির জন্য তা আদৌ কোনো সুবাতাস বয়ে নিয়ে আসবে কি? সম্ভবত এর জবাব হচ্ছে- না। একটা আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হোক- এটাই আমরা চেয়েছিলাম। একটা ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এ নির্বাচন সব সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিল। দ্বিতীয়ত, এ সিটি নির্বাচন প্রমাণ করল সরকার একতরফাভাবে নির্বাচনে বিশ্বাসী। সিটি নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের মধ্য দিয়ে এ সত্যটাই প্রমাণিত হল, সরকার চায় তার একক কর্তৃত্ব বজায় থাকুক! তৃতীয়ত, মধ্যবর্তী একটি নির্বাচনের কথা বিএনপি তথা অন্য দলগুলো বলে এলেও এটা এখন দিব্যি দিয়ে বলা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারির তিন মাস আগেই নির্বাচন হবে। এর আগে নয়। বিএনপিকে ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। চতুর্থত, বিএনপির আগামী কর্মসূচি কী হবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা অনেক। বিএনপি কি এখন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করবে, নাকি আবারও হরতাল-অবরোধের ডাক দেবে- সেটা একটা প্রশ্ন বটে। কেননা এটা সত্য যে, বিগত ৯২ দিনের হরতাল-অবরোধের রাজনীতি ব্যাপক জনসমর্থন তৈরি করতে পারেনি। সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতি অনেক দলের বিরোধিতা থাকলেও বিএনপি এদের সবার সঙ্গে ‘ঐক্য’ করতে পারেনি। ফলে সুবিধা নিয়েছে সরকার। তাদের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। সুশীলসমাজের মাঝে সরকার তার সমর্থকের সংখ্যা বাড়াতে পেরেছে- এটাও সরকারের একটা প্লাস পয়েন্ট। পঞ্চমত, ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর বিদেশী দাতাগোষ্ঠী বারবার বলে আসছে, ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটা নির্বাচন হোক। এখন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকলেও দেখা গেল নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। জাল ভোট ও নির্বাচনে কারচুপি ঠেকাতে ইসির ব্যর্থতা এ শংকা তৈরি করল যে, আগামীতে যে কোনো নির্বাচনে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যতই বলুক, ‘ভোট কারচুপির বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট রয়েছে’, কিংবা যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার গিবসন যতই ‘ভোট অনিয়মের নিরপেক্ষ তদন্ত’ চান, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিয়ে এখন নতুন করে ভাবতে হবে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে সরকারের ওপর বিদেশী চাপ আরও বাড়বে, এটা দিব্যি দিয়ে বলা যায়।নিঃসন্দেহে বলা যায়, সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল, তা বাংলাদেশের রাজনীতিকে আবারও এক মহা অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিল। সুস্থ রাজনীতি বিকশিত হওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা আর থাকল না। ১৯৯২ সালে জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাস করে আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ফিরে এসেছিলাম, সংসদীয় রাজনীতি দেশে প্রবর্তিত হয়েছিল, ‘নিজের ভোট নিজে দেব’- এই সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। আজ ২৩ বছর পর মনে হল আমরা পেছনের দিকে হাঁটছি আবার! তরুণ প্রজন্মের জন্য আমরা কী রেখে যাচ্ছি- এ প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে দেখা দেবে। একটা নির্বাচন হল বটে। কিন্তু তাতে সব প্রশ্নের জবাব মিলল না। Daily Jugantor 30.04.15

নির্বাচন কি উৎসবমুখর হবে

তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কি আদৌ উৎসবমুখরভাবে অনুষ্ঠিত হবে? বেগম জিয়ার নির্বাচনী প্রচারণায় চিঠি দিয়ে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছিল নির্বাচন কমিশন। তাতেও ক্ষান্ত হয়নি কমিশন। নির্বাচন কমিশনের সচিব মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম অনেকটা ‘হুমকি‘র সুরে বলেছিলেন, ইসির নির্দেশ না মেনে বেগম জিয়া যদি আবারও নির্বাচনী প্রচারণা চালান, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কী সাংঘাতিক কথা! একজন মন্ত্রী নন, নীতিনির্ধারক নন, স্রেফ একজন আমলা, তাও আবার সচিব পর্যায়ের আমলা ননÑ তিনি কি না বললেন, ‘আইনগত ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা! তিনি কি এভাবে কথা বলতে পারেন? তিনি হয়তো আচরণবিধিভঙ্গের কথা বলতে পারেন, আইন ইসিকে কী ক্ষমতা দিয়েছেÑ এ প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু বেগম জিয়ার গাড়িতে যখন হামলা চালানো হলো এবং এক-একবার নয়, পর পর তিন দিন, গুলিও করা হলোÑ তখন কি সেই পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়েছিল? এতে কি নির্বাচন কমিশনের কখনো মনে হয়েছে, এ ‘ঘটনা’ যারাই ঘটিয়ে থাকুকÑ তাতে নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে? আমি অনন্ত খুশি একটি কারণেÑ আনিসুল হক বলেছেন, যারাই বেগম জিয়ার গাড়িবহরের ওপর হামলা চালিয়ে থাকুক না কেন, তিনি তাদের বিচার চান। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কোনো বক্তব্য আমি এ ব্যাপারে পাইনি। ইসির একটি ‘ডিগবাজি’র খবর অবশ্য আছে। ইসি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচনের আগে ও পরে (২৬-২৯ এপ্রিল) সেনা মোতায়েনের। কিন্তু ‘সাহসী’ সিইসি পরদিনই বললেন, সেনাবাহিনী সেনানিবাসেই থাকবে। অর্থাৎ তারা টহল দেবে না। যদি তারা টহল না-ই দেয়, তাহলে ‘বিজ্ঞ’ সিরাজ সাহেবদেরÑ যিনি ‘সচিব’ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, দৈনিক পত্রিকার একটি শীর্ষ খবর, ‘ঢাকায় ৮০ ও চট্টগ্রামে ৮৩ শতাংশ কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ’। একই দৈনিকের আরেকটি খবরÑ ‘পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে নেমেছেন এমপিরা।’ এতে কি নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে? নির্বাচন আচরণবিধিতে মসজিদ-মন্দিরসহ ধর্মীয় উপাসনালয়ে নির্বাচনী প্রচার নিষিদ্ধ। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী সাঈদ খোকন মসজিদে গিয়ে ভোট চেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে এসব সাধারণ ঘটনা। বেগম জিয়া কেন, প্রায় সবাই আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘনে হিড়িক পড়েছে সর্বত্র । শুধু আচরণবিধি কেন বলি, নির্বাচনটি আদৌ সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। যেখানে মাঠে নেই বিএনপির প্রার্থীরা Ñ সেখানে ইসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বৈকি! উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনটি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সেটি কি হবে? বেগম জিয়ার ওপর হামলার ঘটনাকে আমি স্বাভাবিকভাবে নিতে চাই না। তিনি যদি তার প্রচারণায় মানুষের ‘সমস্যা’ করে থাকেন, তাহলে ‘অন্যভাবে’ তাকে বোঝানো যেত। নিশ্চয়ই তিনি অবিবেচক নন। তিনি বুঝতেন। তিন-তিন দিন হামলা হলো। এই হামলার সঙ্গে সরকার সমর্থকরা জড়িত নয় বলে সরকারের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি মন্তব্য করলেও একাধিক মিডিয়ার প্রতিবেদন ও ছাত্রলীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এই হামলার সঙ্গে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এটা কোনো অবস্থাতেই ভালো খবর নয় এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে না। ইতোমধ্যে বেগম জিয়ার ওপর এই হামলাকে বিএনপির সিনিয়র নেতারা ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ‘বেগম জিয়াকে হত্যার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন। এ ধরনের একটি মন্তব্য আমাদের উদ্বেগের জন্য যথেষ্ট। এই মন্তব্য যে ‘সত্য নয়’, তা প্রমাণ করার জন্যই সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারত। একই সঙ্গে নির্বাচন প্রচারণায় হামলার বিষয়টি নির্বাচন কমিশন খতিয়ে দেখতে পারত। কেননা এই ঘটনা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ইসি যদি শক্ত অবস্থান গ্রহণ না করে, তাহলে নির্বাচনের দিনেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে! নির্বাচনী প্রচারণায় বাধাদানে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন নিন্দা জানিয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। এতে আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বিদেশিদের ‘হস্তক্ষেপ’-এর প্রবণতা আরও বাড়বে। অতীতে শেখ হাসিনার (তিনি যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন) ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। আমাদের জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেদিন সরকার ব্যর্থ হয়েছিল। আজও হামলা হলো। সরকারের দায়িত্ব দোষীদের আইনের আশ্রয়ে আনা। সরকারের সমর্থক হলেই তিনি আইনের ঊর্ধ্বে থাকবেনÑ এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। গত ৯২ দিনের আন্দোলনে ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে খুদে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেনÑ এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তাদের লোভের বহিঃপ্রকাশ কি এভাবে হওয়া উচিত ছিল? হামলাকারীদের ছবি ও পরিচিতি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। তারা কেউই খুদে ব্যবসায়ী নন। সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপি ‘মূল ধারা’র রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। একটি আস্থা বা ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স’-এর আবহ তৈরি হয়েছিল। এখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এই আস্থার সম্পর্কটা ধরে রাখা। কিন্তু যদি নির্বাচনী প্রচারণায় বাধাদান অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামীতে যে কোনো নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সরকারের ভাবমূর্তির জন্য তা ভালো কোনো সংবাদ নয়। সুষ্ঠু একটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনÑ আগামীতে সুষ্ঠু ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌর নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করবে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। আর পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলে। এক্ষেত্রে এই তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের গুরুত্ব বেশি। এটা অস্বীকার করা যাবে না, নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে বেগম জিয়া একটি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। আরচণবিধির অনেকটাই তার জন্য প্রযোজ্য নয়। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সমর্থক মেয়র প্রার্থী কিংবা কাউন্সিলর প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার ‘অংশগ্রহণ-এর সুবিধা পাননি। শেখ হাসিনার উপস্থিতি কিংবা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ খুব স্বাভাবিকভাবেই কর্মীদের উজ্জীবিত করত। একই সঙ্গে ভোটারদেরও উজ্জীবিত করত। বেগম জিয়া আইনগতভাবেই নির্বাচনী প্রচারণায় ছিলেন। কিন্তু যেতে পারেননি শেখ হাসিনা। তবে এটাও একটা ভালো খবর, প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরা নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটা সহাবস্থান থাকতে হবে। এই সহাবস্থান নিশ্চিত না হলে গণতন্ত্রটি আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। এ দেশের হাজারো মানুষ যেমনি মনে করে, আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই তাদের মুক্তি ও জীবন-মানের উন্নয়ন সম্ভব, ঠিক একই সঙ্গে এটাও সত্যÑ হাজারো মানুষ এখনো বিএনপির পতাকাতলে আছে এবং বিএনপির রাজনীতিটি ধারণ করে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি দ্বিদলীয় রাজনীতির জন্ম হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এই দ্বিদলীয় রাজনীতি আমরা লক্ষ করি। ইউরোপের অনেক দেশের রাজনীতি প্রধানত দুটি প্রধান দলের ওপর নির্ভরশীল। তৃতীয় বা চতুর্থ দল থাকে বটে, সেগুলো প্রধানত প্রধান দুটি দলের সহযোগী মিত্র হিসেবে রাজনীতিতে অবদান রাখে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গত ৪৪ বছরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। স্বাধীনতার পর পরই জাসদ প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। হাজারো তরুণ জাসদে আস্থা রেখেছিল। কিন্তু জাসদের হটকারী রাজনীতির কারণে দলটি মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে। আর জাসদের পরিবর্তে রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হয় বিএনপিÑ যাদের রাজনীতি বিকশিত হয় আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই (১৯৯১) বিএনপি জাতীয় রাজনীতিতে তার অবস্থান শক্তিশালী করেছে। বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) অংশ না নিলেও এর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এবং নির্বাচনে ভালো করেছিল। এর অর্থ হচ্ছে, উপজেলা পর্যায়ে বিএনপির অবস্থান বেশ শক্তিশালী। ফলে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি শক্তিশালী করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাবের পরিবর্তন। এই বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সহায়ক নয়। সত্যিকার অর্থেই আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি। দীর্ঘ ৯২ দিনের হরতাল আর অবরোধ আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। অনেকে মারা গেছেন, অনেকে পঙ্গু হয়েছেন। অথচ এ জন্য তারা কেউই দায়ী ছিলেন না। তাই দায়ী আমাদের অসহিষ্ণু রাজনীতি। বিদ্বেষপ্রসূত এই হটকারী রাজনীতি। ইতিহাসই একদিন বিচার করবে কে বা কারা এ জন্য দায়ী ছিল। সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে একটি ছোট খবর। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ডামাডোলে অনেকেই সংবাদটি হয়তো পাঠ করেননি। জাতিসংঘ পরিচালিত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেস্কে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের আগে। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯ আর ভারতের ১১৭। তবে সুখী দেশের তালিকায় এবার উভয় দেশেরই অবনতি হয়েছে। কারণ আগের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৮ আর ভারতের ১১১। এ বছর ভারত সাত ধাপ পিছিয়েছে। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এ তালিকায় আমাদের পার্শ্ববর্তী ভুটানের অবস্থান ৭৯তম। এত সংকটের পরও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ সুখীÑ এটা আমাদের জন্য কম পাওয়া নয়। আমরা আরও সুখী হতে চাই। আর রাজনৈতিক বৈরিতা, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব যদি কমিয়ে আনা যায়, আমরা যে আরও সুখী হবÑ তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। বিএনপি মূলধারায় ফিরে আসায় আমরা আস্থাশীল। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি করবেন। নিশ্চয়ই তারা একটি ভালো নির্বাচন আমাদের উপহার দেবেন। এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। Daily Amader SOMOY 28.04.15

নির্বাচন পারস্পরিক আস্থা ফেরাতে পারবে কি

তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন প্রচারের শেষ পর্যায়ে এসে দুই বড় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব পরস্পরকে দোষারোপ করে বক্তব্য রাখলেও এ নির্বাচনের ফলাফল আগামী দিনের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। প্রধানমন্ত্রী রোববার তার ইন্দোনেশিয়া সফর নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলেও কার্যত তা অনেকটাই সিটি কর্পোরেশনকেন্দ্রিক হয়ে যায় এবং তিনি বেগম জিয়ার ভূমিকা নিয়েও মন্তব্য করেন। অন্যদিকে বেগম জিয়ার সংবাদ সম্মেলনটি ছিল সিটি কর্পোরেশন নিয়েই। এবং সেখানে তিনি ‘নীরব প্রতিশোধ’ নেয়ার আহ্বানও জানান। বেশকিছু কারণে এ নির্বাচন সাধারণ মানুষের মনে দাগ কেটেছে। প্রথমত, নির্বাচন কমিশন তার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি- এমন অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে সিইসির এ ঘোষণার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই ইসি এর একটি ব্যাখ্যা দেয়। ব্যাখ্যায় বলা হয়, সেনাবাহিনী সেনা ছাউনিতেই থাকবে এবং শুধু ‘গণ্ডগোল’ হলেই সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে যাবে (নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ)। এদিকে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অভিযোগ করেছেন, ‘মওসুস’ নামে একটি নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থাকে প্রায় এক হাজার পর্যবেক্ষক নিয়োগের অনুমতি দিয়ে কমিশন নিজেই নিজেকে বিতর্কিত করেছে। অন্যদিকে ‘সুজন’ ও ‘অধিকারে’র মতো সংস্থাকে কোনো পর্যবেক্ষক নিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়নি (শীর্ষ নিউজ)। অবশ্য এর ব্যাখ্যায় ‘সুজন’ জানিয়েছে, তারা অতীতে কখনও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেনি এবং এটা তাদের কাজের পরিধির মধ্যেও পড়ে না। আবার ‘ফেমা’ (১০ জন), ‘ডেমোক্রেসিওয়াচে’র (৫৭ জন) মতো সংস্থাকে সীমিত পর্যবেক্ষক নিয়োগের সুযোগ দেয়ায় ইসির ভূমিকা আবারও বিতর্কিত হল। দ্বিতীয়ত, ঢাকায় ৮০ ও চট্টগ্রামে ৮৩ ভাগ ভোট কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় (যুগান্তর, ২৫ এপ্রিল) একটা ‘ভয়’ থেকেই গেল। তৃতীয়ত, যেখানে বলা হচ্ছে ‘আত্মগোপনে’ বিএনপির ৫৬ কাউন্সিলর প্রার্থী (সমকাল, ২৪ এপ্রিল), সেখানে নির্বাচন কমিশন কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবে, এ প্রশ্ন থাকলই। চতুর্থত, ঢাকা দক্ষিণে বিএনপিরপ্রার্থী মির্জা আব্বাস শেষদিন পর্যন্ত উচ্চ আদালত থেকে নির্বাচনী প্রচারণারঅনুমতি পাননি। এখন দেখতে হবে তিনি ‘সিমপ্যাথি’ ভোট পান কি-না? পঞ্চমত, প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে ‘ওয়ার্ডপ্রতি আওয়ামী লীগের একজন এমপি’ (আমাদের সময়, ২৬ এপ্রিল)। এটা কোনো ‘সিগন্যাল’ কি-না, তা নির্বাচনের পরপরই বোঝা যাবে।নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সবার জন্যই এ নির্বাচনের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। নির্বাচনে ছোটখাটো বিশৃংখলা হয়। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। অতীতে ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনের (যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল) সময়ও এ ধরনের বিশৃংখলা আমরা দেখেছি। তবে দেখতে হবে এবার এর মাত্রা কতটুকু। যদি বড় ধরনের বিশৃংখলা হয় (?), তা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে। যেখানে জাতিসংঘ আবারও ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার’ আহ্বান জানিয়েছে এবং বলেছে, এ ক্ষেত্রে যে কোনো ‘অনিয়ম’ আমাদের গণতন্ত্র চর্চার জন্য হবে বড় আঘাত। দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য হবে এ নির্বাচন একটি ‘লিটমাস টেস্ট’। যদি বিএনপির প্রার্থীরা মেয়র নির্বাচন তথা কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হন, বিএনপি যুক্তি দেখাবে বিগত ৯২ দিনের ‘অবরোধ-হরতাল’ রাজনীতির পেছনে মানুষের সমর্থন ছিল। অন্যদিকে যদি বিএনপি নির্বাচনে হেরে যায়, তাহলে সরকার বলার চেষ্টা করবে জনগণ ‘বিএনপির হটকারী রাজনীতি’ পরিত্যাগ করেছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ২০১৯-এর আগেই সাধারণ নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে রাজি হবে। সরকার প্রধান খুব সঙ্গত কারণেই যুক্তি দেখাতে পারবে যে, ‘জনগণ বেগম জিয়ার ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে।’সবার জন্যই তাই নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়া খুবই প্রয়োজন। আমরা সাধারণ মানুষ যেমন অবরোধ, হরতাল আর পেট্রলবোমার রাজনীতি চাই না, ঠিক তেমনি এটাও চাই- সবার অংশগ্রহণে এ নির্বাচন সুষ্ঠু হোক। কোনো পক্ষ এ নির্বাচন নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াক, আমরা তা চাই না। ফলকে ‘স্পোর্টিংলি’ নেয়াই মঙ্গলজনক। জনগণ এটাই চায়। আর গণতন্ত্র এ কথাটাই শেখায়। অতীতে যা-ই হয়েছে, তা কষ্টদায়ক হলেও আমরা তা ভুলে যেতে চাই। তাকাতে চাই সামনের দিকে। পরস্পর বিদ্বেষপূর্ণ এই যে রাজনীতি, এ রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। একটি সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস না থাকলে আমরা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে পারব না।এই নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে সরকারের পরিবর্তন হবে না। কিন্তু একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি করবে, যার ওপর ভিত্তি করে আগামীতে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে। Daily Jugantor 28.04.15

চীন-ভারত দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে একটি প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, আর তা হচ্ছেÑ এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তি চীন ও ভারতের মধ্যকার দ্বন্দ্বে কি বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে? অর্থাৎ বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় চীনের অর্থায়নে কি শ্লথগতি আসবে? ভারত ও চীনের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে যে দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্ব মূলত ভারত মহাসাগরে প্রভাব বলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে। চীন যখন তার মেরিটাইম সিল্ক রোডের নামে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে, ঠিক তখনই মোদি সরকার প্রাচীন ‘কটন রুট’কে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন গত মাসে মোদি মরিশাস, সিসিলি ও শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। তার মালদ্বীপ সফরেও যাওয়ার কথা ছিল। এর অর্থ পরিষ্কার ভারত মহাসাগরে ভারত তার প্রভাব ও সামরিক কর্তৃত্ব বাড়াচ্ছে। কেননা ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি ও টহল বৃদ্ধি ভারতের নিরাপত্তাকে এক ধরনের হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কায় বিগত রাজাপাকসে সরকারের সময় হামবানতোতা গভীর সামুদ্রিক বন্দরে চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি এবং মালদ্বীপের সীমানায় চীনা সাবমেরিনের অবাধ চলাচল ভারতের সামরিক গোয়েন্দাদের একটা চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। চীন ও ভারত সাম্প্রতিক সময়ে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করলেও ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে উভয় শক্তিই এক ধরনের ‘প্রভাব বিস্তার করার’ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। প্রভাব বিস্তার করার এই যে প্রতিযোগিতা, এই প্রতিযোগিতায় এ অঞ্চলের দেশগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যাবে। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আর ভারত ইতোমধ্যে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে ভারত তার ‘ক্ষমতা প্রয়োগ’ করতে শুরু করেছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা আগামীতে চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে। ভারতের নীতি নির্ধারকরা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন তারা এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি ‘সহ্য’ করবেন না। ভুবনেশ্বর আইএআর সম্মেলনে (মার্চ ২০১৫) এই মেসেজটিই তারা দিয়েছেন। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নয়া দিক। সিসিলি ও মরিশাসের সঙ্গে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ও এ দুটি দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় প্রভাব বাড়ানো এবং ভবিষ্যৎ এ ‘জাফনা কার্ড’ ব্যবহার করা প্রমাণ করে ভারত ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে তার প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন ভারত প্রাচীনকালে তার ‘কটন রুট’ ব্যবহার করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা বিকাশে ভারতীয় পণ্ডিতরা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌ-বাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। ওই সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারতীয় নৌ-বাণিজ্যের যে প্রাচীন রুট, তাতে দেখা যায় ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, মিসর, আফ্রিকার মাদাগাস্কার, আবার অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা হয়ে সুমাত্রা, জাভা (মালাক্কা প্রণালি), হংকং, জাপান পর্যন্ত ভারতীয় বাণিজ্য রুট সম্প্রসারিত ছিল। মোদি সরকার এই ‘কটন রুট’কেই নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চায়। প্রাচীনকালে ভারতীয় তুলা তথা সুতা এই সমুদ্র পথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। একদিকে চীনা নেতা শি জিন পিং তার ‘সিল্ক রুট’-এর ধারণা নিয়ে ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্ব যেমন প্রতিষ্ঠা করতে চান, এর প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত তার পুরনো ‘কটন রুট’-এর ধারণা প্রমোট করছে। দ্বন্দ্বটা তৈরি হবে সেখানেই। বাণিজ্যনির্ভর এই দ্বন্দ্ব, শেষ অবধি পরিণত হবে সামরিক দ্বন্দ্বে। চীন তার নৌবহরে বিমানবাহী জাহাজ আরো বাড়াচ্ছে। ভারতও ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনী শক্তিশালী করছে। আন্দামানে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। বলা হয় একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তি চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এ ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি। জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপানেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিপদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে। সম্প্রতি চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলেছেন তা ‘অন্য চোখে’ দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের ধারণা, এতে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃক, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এই ‘সিল্ক রুট’টি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই ‘সিল্ক রুট’-এর মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের নয়া প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রুট ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’-এর কথাও আমরা জানি। যা কিনা চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই মেরিটাইম সিল্ক রুটের ধারণাও কয়েকশ’ বছরের। এই মেরিটাইম সিল্ক রুট ধরে চীনা এডমিরাল ঝেং হে (মা হে) ১৪০৫ সাল থেকে ১৪৩৩ সাল এই ২৮ বছর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে চীনা পণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৪২১-১৪৩১ সালে তিনি দুবার তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে এসেছিলেন। চীন এই নৌরুটটি নতুন করে আবার ব্যবহার করতে চায়। তবে কয়েকশ’ বছরের ব্যবধানে এই অঞ্চল অনেক বদলে গেছে। চীন আর একক শক্তি নয়। ভারত তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়েই তার নিজের স্বার্থ আদায় করতে চায়। ফলে এটা স্পষ্ট নয় ভারত-চীন সম্পর্ক আগামীতে কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নতি হবে। কেননা ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। মৎস্য সম্পদ থেকে শুরু করে জ্বালানি সম্পদ ও জ্বালানি সম্পদ সরবরাহের অন্যতম রুট হচ্ছে এই ভারত মহাসাগর। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির কারণে এই সামুদ্রিক রুটের গুরুত্ব বাড়ছে। এই সামদ্রিক রুটের গুরুত্ব অনুধাবন করতেই চীন এ অঞ্চলে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়েছে। এর ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থও বিঘিœত হচ্ছে। ভারত তাই এ অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোতে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি ও কর্তৃত্ব বাড়াচ্ছে। ফলে এক ধরনের ‘স্নায়ুবিক যুদ্ধ’ শুরু হয়েছে এশিয়ায় প্রভাবশালী এই দেশ দুটির মধ্যে। আগামী মে মাসে নরেন্দ্র মোদি বেইজিং যাবেন। ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে ভারতীয় তৎপরতা দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় হয়তো স্থান পাবে না। কিন্তু চীনা নেতারা বিষয়টি জানেন ও বোঝেনও। মোদি নিজে চীনের ব্যাপারে যতই আগ্রহী থাকুন না কেন, ভারতে একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্রও আছে এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা পৃথিবীর শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি। এরা ভারতের স্বার্থকে সব সময় ‘বড়’ করে দেখতে চায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ইতোমধ্যে ভারতের এক ধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টদের চোখ এখন ভারত মহাসাগরের দিকে। ভারত মহাসাগরে শুধু যে বিশাল সম্পদই রয়েছে, তা নয়। বরং বিশ্বের ‘কার্গো শিপমেন্ট’-এর অর্ধেক পরিবাহিত হয় এই ভারত মহাসাগর দিয়ে। সেই সঙ্গে ৩ ভাগের ১ ভাগ কার্গো ব্যবহƒত জ্বালানি তেলের ৩ ভাগের ২ ভাগ এবং ৪ ভাগের ৩ ভাগ ট্রাফিক পৃথিবীর অন্যত্র যেতে ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ। পৃথিবীর আমদানিকৃত পণ্যের (তেলসহ) শতকরা ৯০ ভাগের পরিচালিত হয় এই সামুদ্রিক রুট ব্যবহার করে। সুতরাং এই সমুদ্র পথের নিরাপত্তার প্রশ্নটি তাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি করে। ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য ভারত-চীন দ্বন্দ্বে আক্রান্ত হবে এ অঞ্চলের দেশগুলো। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য এই চীন-ভারত দ্বন্দ্ব নতুন একটি ‘জটিলতার’ জš§ দিয়েছে। কেননা বাংলাদেশের বর্তমান সরকার চীন ও ভারতের সঙ্গে ‘ভারসাম্যমূলক’ কূটনীতি অবলম্বন করেছে। যদিও অনেকই বিশ্বাস করেন বাংলাদেশের কূটনীতি বেশি মাত্রায় ভারতনির্ভর। প্রধানমন্ত্রী ২০১০ সালের মার্চে চীনে গিয়েছিলেন। ওই সফরে তিনি কুনমিংও গিয়েছিলেন এবং কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এখন এই সড়ক নির্মাণের প্রশ্নটি এবং বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার) জোটের জš§ ও বিকাশ প্রশ্নের মুখে থাকল। কেননা চীন-ভারত দ্বন্দ্বে এই আঞ্চলিক জোটের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চীনের ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এর পরিবর্তিত নাম হচ্ছে বিসিআইএম জোট। এখানে চীনের স্বার্থ বেশি। এই জোট গঠিত হলে চীনা পণ্য সড়কপথে বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে বিদেশে রফতানি সম্ভব হবে। অনেকে স্মরণ করতে পারবেন সোনাদিয়ার অদূরে যে গভীর সমুদ্র বন্দরটি নির্মাণ করার কথা ছিল তাতে চীন যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চীনের এটি নির্মাণ করে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই পরিকল্পনা এখন পরিত্যক্ত। গভীর সমুদ্রবন্দরটি এখন নির্মিত হবে পায়রা বন্দরে। একনেকে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে ভারতের আপত্তি। ভারতের সঙ্গে তার নিরাপত্তার প্রশ্নটি তুলেছে। এমনকি ভারতের নীতি নির্ধারকরা এটাও মনে করেন এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হলে চীনা পণ্যে এ অঞ্চল ছেয়ে যাবে। এতে ভারতীয় পণ্য মার খাবে। ফলে বিসিআইএম আঞ্চলিক জোট নিয়ে প্রশ্ন থাকলই। উল্লেখ্য যে, ভুটানে চীনা দূতাবাস খোলার ব্যাপারেও ভারতের আপত্তি রয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের নিরাপত্তা, পণের অবাধ চলাচল, সম্পদের আহরণ ইত্যাদির ব্যাপারে আগামী দিনগুলোতে চীন ও ভারতের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আরো স্পষ্ট হবে। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলো এই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যেতে পারে। আঞ্চলিক সহযোগিতাকে কেন্দ্র করেই বর্তমান বিশ্ব বিকশিত হচ্ছে। এখানে সামরিক দ্বন্দ্বের চেয়ে বাণিজ্যিকনির্ভরতার বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। ভারতে দরিদ্রতা থাকলেও ভারত আঞ্চলিক শক্তি তো বটেই, বড় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত। আর চীন দূর প্রতিবেশী। চীনের সঙ্গে আমাদের সীমান্তের দূরত্ব খুব বেশি নয়। দুটি দেশের উন্নয়ন থেকেই আমরা উপকৃত হতে পারি। অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য কাটিয়ে উঠে চীন ও ভারত যদি নিজেদের মধ্যে ‘সহযোগিতার সম্পর্ক’ গড়ে তোলে তাহলে এ অঞ্চলের দেশগুলো উপকৃত হবে। সেই পঞ্চাশের দশকে হিন্দি-চীন ভাই ভাই সম্পর্ক, পঞ্চকীলার ধারণা (যা ন্যামের জš§ দিয়েছিল) এই দুটি দেশের মাঝে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। একুশ শতকে এসে বৈরিতা নয়, বরং আস্থার সম্পর্ক এ অঞ্চলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। এখন দেখার পালা আগামী দিনগুলোতে এই দেশ দুটি বৈরিতা কতটুকু কমিয়ে আনতে পারে। Daily Manobkontho 27.04.15

নির্বাচন এবং ভবিষ্যৎ মেয়রদের দায়বদ্ধতা

তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ব্যাপারে সারাদেশে এখন ব্যাপক প্রত্যাশা ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তখনই বেগম জিয়ার গাড়িবহরের ওপর হামলা এবং সেনাবাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে একটি ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হবে সে প্রশ্ন তখনই উঠেছে। তবে এই নির্বাচন একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বিএনপি মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। বেগম জিয়ার গাড়ির ওপর হামলার পরও বিএনপি কোনো 'শক্ত অবস্থানে' যায়নি। সরকারের দায়িত্ব এখন বিএনপিকে নির্বাচনী প্রচারণায় রাখা। যারা বিএনপির চেয়ারপারসনের গাড়ির ওপর হামলা চালিয়েছে, একটি ইংরেজি দৈনিক তাদের নাম-ধাম প্রকাশ করেছে। সরকার এখন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে একটি 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড'-এর দাবি বাস্তবায়ন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আগামী ডিসেম্বরে ইউনিয়ন পরিষদের এবং মার্চ-এপ্রিলে পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই বিএনপি ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌর নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বিএনপি প্রশ্ন তুলবে এবং চলমান রাজনীতি আবার অস্থির হবে! তৃতীয়ত, এই নির্বাচন একটি 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস'-এর আবহ সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ একটি আস্থার সম্পর্ক। যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে। তাই এ নির্বাচনটি সরকারের জন্য যেমনি গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বিএনপির জন্যও। তবে নির্বাচিত মেয়রদের জন্য আগামী দিনগুলো খুব সুখের হবে বলে মনে হয় না। যদি বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচিত হন, তাদের জন্য অপেক্ষা করেছে সরকারের অসহযোগিতা! কোনো একটি সিদ্ধান্তও তারা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। অন্যদিকে সরকারি দলের প্রার্থীরা তাদের স্ব স্ব নির্বাচনী ইশতেহারে যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবেন, তা নিয়েও আছে নানা শঙ্কা ও উদ্বেগ। কেননা অনেক 'ক্ষমতাই' তাদের হাতে নেই। নির্বাচনী ইশতেহার একটি নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে বলতে দ্বিধা নেই ভোটাররা নির্বাচনী ইশতেহার দেখে ভোট দেন না। ভোট দেন ব্যক্তি দেখে, মার্কা দেখে, বিশেষ করে কে কোন দলের প্রার্থী এটা বিবেচনায় নিয়েই ভোট দেন। তবুও ইশতেহারে যেমন কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আনিসুল হক অনেক আগেই তার 'কর্মসূচি' উপস্থাপনা করেছেন। আনিসুল হক 'আলোচিত' ও 'পরিবেশবান্ধব' নগরী উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার দেয়া প্রতিশ্রুতির মধ্যে যা উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে_ স্মার্ট ও অংশগ্রহণমূলক সুশাসিত ঢাকা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, গণপরিবহন, ধনী-গরিব সবার জন্য মানবিক এক ঢাকা, দুর্নীতিমুক্ত সিটি করপোরেশন, বিনিয়োগ বাড়ানো, ৩৬টি ওয়ার্ডে আধুনিক হেলথ কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা, 'সিটি কার্ড', পৃথক সাইকেল লেন, ৩৬ ওয়ার্ডের ৭২ সুনাগরিককে প্রতিবছর পুরস্কৃত করা, মশক নিধন কর্মসূচি, হকারমুক্ত ফুটপাত ইত্যাদি। অন্যদিকে সাঈদ খোকন তার নির্বাচনী ইশতেহারে ৫ অগ্রাধিকার নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তার এই পাঁচ অগ্রাধিকার হলো_ যানজট নিরসন, দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর মহানগরী, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, নাগরিকদের নিরাপদ জীবন। তিনি ঢাকাকে ডিজিটাল মহানগরী, বস্তি উন্নয়ন, হরিজন সম্প্রদায়ের নাগরিক মর্যাদা। মহানগর নিজস্ব পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। যদি সরকারের সমর্থনপুষ্ট দুজন প্রার্থীর ইশতেহার বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে উভয় ইশতেহারই প্রতিশ্রুতিতে ভরা। অর্থাৎ তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কিভাবে তারা এ কাজগুলো করবেন তা সুস্পষ্ট করে বলেননি। ঢাকা মহানগরীর সমস্যা অনেক। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, যানজট, সুশাসন, জলাবদ্ধতা, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ দূষণ, আবাসন ইত্যাদি। সিটি করপোরেশনের ২৮ ধরনের কাজ করে সরকারের ৫৬টি সংস্থা। এদের কখনো মধ্যে সমন্বয় করার কাজটি কঠিন। প্রশাসনের সর্বত্র আমলাতন্ত্রের শক্ত অবস্থান রয়েছে। কোনো নির্বাচিত মেয়রের পক্ষে এই আমলাতন্ত্রের প্রভাব উপেক্ষা করা কঠিন। মেয়ররা চাইলেও আমলাতন্ত্রের 'লাল ফিতা' সবকিছু আটকে দেবে। এজন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল। যেমন জলাবদ্ধতা। ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও এটা বড় সমস্যা। একটু সৃষ্টি হলেই ঢাকার বিশাল এলাকা ডুবে যায়। সাঈদ খোকনের নির্বাচনী এলাকার একটা বিশাল অংশ চলে যায় পানির নিচে। কোনো ইশতেহারেই এ ব্যাপারে কিছু বলা নেই। কেন? এখানে একটা মাস্টার প্ল্যান করা দরকার। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীদের সহযোগিতা নিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। সেনাবাহিনী শুধু শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে 'অর্থ উপার্জন' করবে, এটা তো হতে পারে না? তাদের দক্ষতা, কমিটমেন্ট, সততা এবং নেতৃত্বকে আমরা নগরবাসীর এ সমস্যার সমাধানে কাজে লাগাতে পারি। এ ধরনের একটি প্রকল্পে শত শত কোটি টাকার প্রশ্ন জড়িত। সেনাবাহিনী ছাড়া দুর্নীতিমুক্তভাবে এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাও আমরা কাজে লাগাতে পারি। কিন্তু খোকনের এ ধরনের কোনো চিন্তাধারার খবর আমার জানা নেই। উপরন্তু বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত ও এর নাব্য বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। কিন্তু কিভাবে? কিভাবে তিনি করবেন? তিনি কি আদৌ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন? বুড়িগঙ্গার পানি এখন কুচকুচে কালো, আছে গন্ধ এবং কোনো মাছ এই পানিতে বাস করতে পারে না। একজন মেয়র চাইলেও তা পারবেন না। এর সঙ্গে পরিবেশ মন্ত্রণালয় জড়িত। তবে রাইন নদীর ইতিহাস আমি জানি। এ প্রসঙ্গটি নিয়ে আমি ২০১২ সালে তুরস্কে এক জার্মান বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন ইইউ এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও আর্থিক সহায়তা দিতে পারে। আমি ঢাকায় এসে একটি দৈনিকেও কথাটা লিখেছিলাম। দুঃখজনক হচ্ছে ওই সময় পরিবেশমন্ত্রী যিনি ছিলেন, তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়নি। আমাদের পরিবেশমন্ত্রীও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আমলারা বিদেশে যেতে 'পছন্দ' করেন। তারা কী 'জ্ঞান' অর্জন করেন, তারাই জানেন। কিন্তু বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর কোনো উদ্যোগ আমরা দেখি না! উভয় প্রার্থীই যানজট নিরসনের কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি_ এ কাজটি করার দায়িত্ব তাদের নয়। এ ক্ষেত্রে ডিএসসির ভূমিকা সবচেয়ে বড়। অসাধু কর্মচারীদের দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যে দেশে মন্ত্রী স্বয়ং বাসশ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করেন মন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই, সে ক্ষেত্রে মানুষ 'খুন' করেও ড্রাইভাররা পার পেয়ে যান, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করে প্রতিনিয়ত যানজট সৃষ্টি করা হয়_ এর সমাধান মেয়ররা পারবেন না। একটা দৃষ্টান্ত দিই_ যারা জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যান, তারা দেখেছেন সেখানে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে যানবাহন চলাফেরা করছে। রাতের বেলায় রিকশায় আলোও দেখতে পাবেন। কই সেখানে তো যানজট হয় না? তাহলে ঢাকার অন্যত্র হচ্ছে কেন? ওই এলাকায় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর কোনো সুযোগ নেই। শৃঙ্খলা সেখানে মানতে হয়। আমাদের 'নির্বাচিত' মেয়ররা এটা থেকে শিখতে পারেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি দলের প্রার্থীরা অনেক এগিয়ে আছেন। অনেক আগে থেকেই আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন তাদের স্ব স্ব প্রচারণা শুরু করেছেন। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের একজন তাবিথ আউয়াল মাঠে থাকলেও, মাঠে নেই মির্জা আব্বাস ও তার স্ত্রী তার হয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। বাংলা নববর্ষের দিন বেগম জিয়া পল্টনে জাসাসের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এক ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলেন। একই দিন আদর্শ ঢাকা আন্দোলন সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি ১৭ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেছিল। এটাকেও নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে ধরা যেতে পারে। যদিও পরে বিএনপি প্রার্থী আলাদাভাবে দুটি সিটি করপোরেশনের জন্য দুটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছেন। এত দেরি করে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে তা ভোটারদের মধ্যে পেঁৗছে দেয়ার সময় তারা কম পাবেন। তবে বেগম জিয়া ইতোমধ্যে ঢাকায় পথসভা করেছেন এবং তা ভোটাদের কিছুটা হলেও উদ্দীপ্ত করেছে। আদর্শ ঢাকা আন্দোলন যে ১৭ দফা উপস্থাপন করেছে, সেখানেও সুস্পষ্ট কোনো কর্মসূচি নেই। এই ১৭ দফার মধ্যে রয়েছে মহানগর ব্যবস্থাপনা, নগর পরিকল্পনা, মহানগরীর সড়কে যানবাহন ও পরিবহন ব্যবস্থা, শিক্ষা বিস্তার ও রোগ প্রতিরোধ, পরিবেশ সুরক্ষা, মাদক নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ইত্যাদি। কিন্তু তারা কিভাবে এসব করবেন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেননি। সমস্যাটা এখানেই। যারা এটা প্রণয়ন করেছেন, তাদের কোনো সুস্পষ্ট 'পরিকল্পনা' নেই। একটি নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকে। বলা থাকে তাদের প্রার্থীরা বিজয়ী হলে তারা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন। তাদের ১৭ দফা মূলত এক ধরনের দাবি। কোনো পরিকল্পনা নেই। মজার ব্যাপার ঢাকা মহানগরীর (দুটি সিটি করপোরেশন) মূল সমস্যা সমাধানের জন্য একটি নগর সরকার গঠন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সরকার এই 'নগর সরকার' গঠনের ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক মনোভাব দেখা যায়নি। ফলে সরকারি দলের প্রার্থীরা এ ব্যাপারে কোনো কমিটমেন্ট করেননি। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ওটাকে ইস্যু করতে পারত। পৃথিবীর অনেক দেশে বড় বড় শহরে 'নগর সরকার' রয়েছে। আগামী ২৮ এপ্রিল নির্বাচন। নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি কর্মকর্তারা যথেষ্ট এগিয়ে আছেন। পিছিয়ে পড়েছেন বিএনপি প্রার্থীরা। মির্জা আব্বাস মাঠে নামতে পারেননি। একাধিক প্রার্থী (কাউন্সিলর) গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিএনপি যথেষ্ট পোলিং এজেন্ট পাবে, এটাও আমার মনে হচ্ছে না। ফলে 'সব দলের সমান সুবিধা' নিশ্চিত হয়নি। বেগম জিয়ার গাড়িবহরের ওপর হামলার ব্যাখ্যা যাই দেয়া হোক না কেন, এর মাধ্যমে এক ধরনের 'সিমপ্যাথি ভোট' বিএনপি সমর্থকরা পাবেন। বেগম জিয়া একটা পথ খুঁজছিলেন দুঃসহ হরতাল আর অবরোধের রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসার। তা তিনি পেয়েছেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিজে শরিক হয়ে তিনি ফিরে এসেছেন মূল ধারায়। আমরা এই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিটাই দেখতে চাই। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকুক। কিন্তু তা যেন কখনো সহিংসতামূলক না হয়। মেয়র নির্বাচন একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করল। এখন দেখার পালা নির্বাচিত মেয়ররা তাদের স্বল্প প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে কী ধরনের কর্মসূচি নেন ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসীর জন্য। Daili JAI JAI DIN 27.04.15

আলোচনায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা

খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারণায় সরকার সমর্থকদের একাধিকবার হামলার পর মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি ২৩ এপ্রিল বলেছেন, খালেদা জিয়ার ওপর হামলার দায় নির্বাচন কমিশনের (ঢাকা টাইমস)। এর আগে বিবিসি বাংলার একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়দায়িত্ব সরকার নেবে না। তবে নির্বাচন কমিশন একটি দায়িত্ব পালন করেছে। খালেদা জিয়াকে অতিরিক্ত গাড়িবহর নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় না যাওয়ার জন্য সতর্ক করে দিয়েছে। যেখানে খালেদা জিয়ার ওপর হামলার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তাকে অনেকে দায়ী করেছেন, সেখানে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাটি সামনে চলে এলো। বিএনপি এবং আরও কয়েকটি দল নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী নামানোর অনুরোধ জানালেও ইসি এক্ষেত্রেও একটি ‘দ্বৈত ভূমিকা’ পালন করে। তখন তাদের সিদ্ধান্তে জানা যায়, সেনাবাহিনী ২৬-২৯ এপ্রিল মাঠে থাকবে। ঠিক ১২ ঘণ্টা পর ইসি মত পরিবর্তন করে জানায়, সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্টে থাকবে। শুধু সেনাবাহিনীকে ডাকা হলেই তারা মাঠে যাবে! ইসির ওই ভূমিকাকে বিবেচনায় নিয়ে সাবেক সিইসি বিচারপতি রউফ মন্তব্য করেছিলেন কিনা জানি না, তিনি বলেছিলেন, যদি সরকারের কাছ থেকে নির্বাচন কমিশনকে ‘মুক্ত’ করা না যায়, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়! ১৯, ২০ ও ২১ এপ্রিল খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দেয়া হয়। তাকে কালো পতাকা ও তার গাড়িতে লাঠি নিক্ষেপ করা হয়েছে। তিনি নির্বাচনী প্রচারণা (উত্তর ঢাকাতে) অনেকটা অসম্পূর্ণ রেখেই ফিরে গেছেন। বিএনপির ও সুজনের পক্ষ থেকে নির্বাচনের অনেক আগেই সেনা মোতায়েনের দাবি করা হলেও প্রথমে মিশনের পক্ষ থেকে চার দিনের (২৬-২৯) জন্য সেনা মোতায়েনের কথা বলা হলেও, ইসি পরে তাদের মত বদলায়। সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীরা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন নেই। এমনকি র‌্যাবের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও বলেছিলেন, সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন নেই। বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা গ্রেফতার হয়েছেন। আর তাদের প্রচারণায় বাধা দেয়া হচ্ছে- এ অভিযোগ আমরা প্রতিদিন শুনছি। একাধিক প্রার্থীর প্রার্থিতা নিশ্চিত করা, বুথে পোলিং এজেন্টদের থাকা নিশ্চিত করা এবং একইসঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশনের। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ইসি এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। বিএনপি প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় রাখা (অভিযুক্ত হলে কীভাবে আইনি সহযোগিতায় জটিলতা দূর করা সম্ভব, তা দেখা) এবং তাদের নিরাপত্তা দেয়া, একটি ‘লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড’ এর পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশনের। আইন তাদের যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। নির্বাচনের এক মাস আগে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন পুলিশ প্রশাসনের ‘নিয়ন্ত্রণ’ এর দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তিয়েছে। অর্থাৎ ইসির আন্ডারে এখন কাজ করছে পুলিশ প্রশাসন। ফলে একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। আইন বলে, ওই সময় নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া কোনো প্রার্থীকে, কোনো পোলিং এজেন্টকে গ্রেফতার করা যাবে না। কিন্তু প্রার্থীদের গ্রেফতারের খবর ছাপা হয়েছে। সুতরাং ‘ইসির’ মুখের কথায় চিড়ে ভিজছে না। কমিশনকে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে তার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। কমিশন এটি পারবে কিনা, সেটিই এখন দেখার বিষয়। মাত্র কয়েকটি দিন। এ নির্বাচন দুইটি বড় দলের জন্যই ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’। কোনো ধরনের ‘প্রভাব’ বিস্তার না করে নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে দেয়া সরকারের জন্য মঙ্গল। এর মাধ্যমে সরকার প্রমাণ করতে পারবে যে, সরকার এ ধরনের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে না! অতীতে বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে (সিলেট, গাজীপুর, খুলনা ইত্যাদি) সরকারের কোনো ‘হস্তক্ষেপের’ রেকর্ড নেই। কোনো ধরনের কারচুপিও হয়নি। আরেকবার সুযোগ এসেছে সরকারের কাছে, এটা বিশ্ববাসীকে দেখানো যে, সরকার নির্বাচনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করছে না। আমরা যেন ভুলে না যাই, পৃথিবীর অনেক দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তাকিয়ে আছে এই নির্বাচনের দিকে। শেষ মুহূর্তে কে কোন যুক্তি তুলে ধরে। বিএনপি যদি নির্বাচন বয়কট(?) করে, তা সরকারের ভাবমূর্তির জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। বিএনপির জন্যও এটা ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি মূল ধারায় যাওয়ার একটি সুযোগ পাচ্ছে এবং দীর্ঘ ৯২ দিনের আন্দোলনের একটা ফল আমরা দেখতে পাব ভোটারদের প্রতিক্রিয়ায়। একইসঙ্গে তাদের আন্দোলনের পেছনে কতটুকু জনসমর্থন ছিল, তাও বোঝা যাবে। যদিও সারা দেশের মানুষের পাল্স এতে বোঝা যাবে না। কিন্তু তারপরও দুইটি বড় শহরের মানুষের মনোভাব এতে বোঝা যাবে। দেশের মানুষের পলিসি বুঝতে এই নির্বাচনের ফলকে আমরা একটি মাপকাঠি হিসেবে ধরতে পারি। সেজন্যই বিএনপিকে নির্বাচনী মাঠে রাখা জরুরি। আমরা একটা ভালো নির্বাচন চাই। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের অনেক প্রশ্নের জবাব দেবে। দেশে গত প্রায় ৯২ দিন ধরে যে অসহনীয় পরিবেশ বিরাজ করছিল, এ থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন ছিল। আমাদের সবার জন্যই তা মঙ্গল ছিল। ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ এর যে কথা আমরা বারবার বলে আসছি, খালেদা জিয়ার জামিনপ্রাপ্তি, তাতে একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তবে আস্থার সম্পর্কটি স্থাপিত হবে কিনা, সে ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছি না। নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অনেক আগেই প্রচারণা শুরু করেছিলেন সরকারি দল সমর্থক প্রার্থীর পক্ষে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। উপরন্তু ঢাকায় একজন ব্যবসায়ী প্রার্থী অনেক আগে থেকেই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ‘মতবিনিময়’ শুরু করে নির্বাচন বিধি ভঙ্গ করলেও ইসির কোনো ভূমিকা আমরা দেখিনি। এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত বিএনপির প্রার্থীরা প্রচারণা শুরু করলেও তাদের অভিযোগ অনেক। এ নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না, এটা সত্য কথা। তবে আগেই উল্লেখ করেছি জাতীয় রাজনীতিতে এর একটা প্রভাব থাকবে। ইসি এবং পরোক্ষভাবে সরকারের দায়িত্ব যেমনি বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠে রাখা, ঠিক একইসঙ্গে বিএনপির উচিত হবে ‘সব প্রতিকূলতা’ উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ‘জনমত’ যাচাই করা। এটা ঠিক, ডজন ডজন মিডিয়াকর্মীর উপস্থিতিতে ‘কারচুপি’ করাটা অত সহজ হবে না। কোনো না কোনো মিডিয়ায় এটা আসবেই। এ যুগে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। শুধু তাই নয়, বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধিরাও এ নির্বাচন ‘পর্যবেক্ষণ’ করবেন। ফলে ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচনের একটা সম্ভাবনা কিন্তু আছেই! এক্ষেত্রে ‘লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড’ এর প্রশ্নটি এসেই যায়- বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা, তাদের সমর্থকরা কতটুকু প্রচারণা চালাতে পারবেন? খালেদা জিয়া জামিন পেয়েছেন। কিন্তু মির্জা আব্বাস জামিন পাননি। মিসেস আব্বাস নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলেছেন। আর সর্বশেষ ঘটনায় খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারণায় হামলা হলো। একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন, খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সরকার যে ‘নীতি’ অনুসরণ করেছে (আদালত কর্তৃক জামিন দিয়ে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ), তা যদি বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা না হয়, তাহলে ‘জটিলতা’ বাড়বে। এক্ষেত্রে বিএনপিকে একটি শক্তিশালী বিরোধী অবস্থানের দিকে ঠেলে দিতে পারে! সেটি হবে না, আমরা এটাই প্রত্যাশা করি। মোট কথা, উভয় দলের জন্যই একটি সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সামনের দিকে তাকানোর। বিএনপি নিশ্চয়ই গত তিন মাসের ‘আন্দোলন’ থেকে অনেক কিছুই শিখেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন যে, তাদের ব্যর্থতা কোথায়! এককভাবে খালেদা জিয়া এখনও একটি ‘শক্তি’। বিএনপির হাজার হাজার কর্মী ও সমর্থকের মাঝে তার কোনো বিকল্প নেই। প্রায় ৩৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’তে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি থেকে নিশ্চয়ই তিনি কিছু ‘শিখেছেন’। দলের সিনিয়র নেতারা যারা স্থায়ী পরিষদে রয়েছেন, তাদের সবার সমর্থন তিনি পেয়েছেন, তা বলা যাবে না। তাই দল গোছানোর কাজটি তাকে এখন করতে হবে। আরও একটি কথা, যা সবার জন্যই ভালো এবং বড় দলগুলোকে তা বিবেচনায় নিতে হবে। এক. স্থানীয় সরকার পর্যায়ে দলীয়ভাবে নির্বাচন হওয়াই মঙ্গল। আর এজন্য আইন পরিবর্তন করাটা জরুরি। দুই. নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকারভাবে ‘নিরপেক্ষভাবে’ কাজ করতে দেয়া। নির্বাচনের তারিখ যখন ঘোষণা করা হয়, তার ঠিক এক সপ্তাহ আগেই পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন করার কথা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন। কাকতলীয়ভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ২৮ এপ্রিলই তারিখ ঘোষণা করলেন। এতে করে মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে। সিইসি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনটি করলে, তাতে ক্ষতি তেমন ছিল না। এখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা নির্বাচন কমিশনের কর্মকা-ে হস্তক্ষেপ করছে না। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারছে না। আইজিপি প্রশ্ন রেখেছেন, খালেদা জিয়া আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন কিনা? (কালের কণ্ঠ, ২০ এপ্রিল)। একজন সরকারি বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে তিনি কি এ ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন? যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নিই খালেদা জিয়া আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন, তাহলে এটির দেখার দায়িত্ব তো নির্বাচন কমিশনের! কোনো সরকারি কর্মকর্তা কি বলতে পারেন? একজন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় সরকারের ক্ষমতা অঘোষিতভাবেই থেকে যায়। ...তাই আমরা ‘লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড’ চাই বলি না কেন, বাস্তবে এটা করাটা খুব সহজ নয়। তিনি আরও বলেছেন, ‘দুর্নীতি দূর করতে না পারলে সিটি করপোরেশনের কোনো সমস্যারই সমাধান হবে না। (কালের কণ্ঠ, ২০ এপ্রিল)। তিনি দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষেও অভিমত দিয়েছেন। একজন সাবেক সিইসি। তিনি জানেন সমস্যাটা কোথায়? তাই একটি কার্যকর সিটি করপোরেশনের স্বার্থে তার পরামর্শ বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। একটি নির্বাচন হচ্ছে বটে, কিন্তু এই নির্বাচন অনেক প্রশ্নের জন্মও দেবে। মেয়র প্রার্থীরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এসব প্রতিশ্রুতি তারা আদৌ পূরণ করতে পারবেন না। কেননা তাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ কারণে ‘নগর সরকারে’ ধারণাটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত। তবুও নির্বাচনটি অনেক দিক দিয়ে ভালো। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি মূল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার একটি ‘পথ’ পেল। কিন্তু নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, তাহলে আমাদের জন্য আরও খারাপ দিন অপেক্ষা করছে! তাই দায়িত্বটি সবার- সরকার, বিরোধী দল এবং সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনেরও। Daily Alokito Bangladesh 26.04.15

যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক

গত ১২ এপ্রিল মধ্য আমেরিকার দেশ পানামায় আমেরিকান দেশগুলোর তিন দিনব্যাপী শীর্ষ সম্মেলনে বারাক ওবামা ও রাউল কাস্ত্রোর মধ্যকার বৈঠককে একটি ঐতিহাসিক বৈঠক হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও খুব দ্রুত দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হবে, এমনটি আশা করা যাচ্ছে না। দীর্ঘ ৫৪ বছরের বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে গত ২১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্য আলোচনা শুরু হয়েছিল। এর আগে ১৭ ডিসেম্বর (২০১৪) প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলেছিলেন। তবে বেশ কিছু ‘সমস্যা’ রয়ে গেছে, যার সমাধান হয়নি। যেমন বলা যেতে পারে, প্রেসিডেন্ট ওবামা বিশ্ব সন্ত্রাসী তালিকা থেকে কিউবাকে বাদ দিয়েছেন। কিন্তু কংগ্রেস তা এখনো অনুমোদন করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘কালো তালিকায়’ অন্তর্ভুক্ত দেশ হচ্ছে কিউবা। আর কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকায় কিউবার সঙ্গে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য নিষিদ্ধ। তবে ওবামা-কাস্ত্রো বৈঠক বরফ গলাতে সাহায্য করবে। রাউল কাস্ত্রো নিজে ওবামাকে ‘সৎ মানুষ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর ওবামা কাস্ত্রোর নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। তবে কিউবা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক অনেকদিন ধরেই আলোচনার একটি বিষয়। কিউবা কী আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতি পরিত্যাগ করবে, নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘আবারও’ হাভানায় সরকারের উৎখাতের উদ্যোগ নেবেÑ এসব প্রশ্ন বারবার মিডিয়া ও বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের লেখনীতে উঠে আসছিল। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব ইউরোপে ‘সোভিয়েত ধাঁচের’ সমাজতন্ত্রের পতনের রেশ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল, তখন বলতে গেলে সারা বিশ্বের দৃষ্টি এক রকম নিবদ্ধ ছিল কিউবার দিকে। কেননা কিউবা ছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অন্যতম সমর্থক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল কিউবার অর্থনীতির অন্যতম উৎস সেই সঙ্গে নিরাপত্তার অন্যতম গ্যারান্টার ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে কিউবা টিকে থাকতে পারবে কি না? এ প্রশ্নটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘আগ্রাসনের’ মুখ থেকে কিউবা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না, এটা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। আরও একটি প্রশ্ন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে আলোচিত হচ্ছিলÑ তা হচ্ছে কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে? কেননা চিন ও ভিয়েতনামের মতো দেশেও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর পরিবর্তন এসেছে। ওই দুটি দেশ এখন আর ধ্রুপদী মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। তাই খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ছিল কিউবা চিন বা ভিয়েতনামের পথ অনুসরণ করবে কি না? কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ছিল কিউবার নিরাপত্তাহীনতা। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই কিউবায় একটি সমাজতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকার করে নেয়নি। বরং কিউবায় বিপ্লবের পর (১৯৫৯), কিউবা সরকার যখন লাতিন আমেরিকাজুড়ে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে চাইল, চে গুয়েভারা যখন ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করার জন্য কিউবা সরকারের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে বলিভিয়ায় গেলেন (সেখনেই তাকে পরে হত্যা করা হয়), তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কাছে ভিন্ন একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চায়নি, তার প্রভাবাধীন এলাকায় অন্য কোনো শক্তি প্রভাব খাটাক। ‘মনরো ডকট্রিন’-এর আদলে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে এ এলাকায় তথা লাতিন আমেরিকায় তার পূর্ণ কর্তৃত্ব। কিন্তু কিউবার বিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘হিসাব-নিকাশ’-এ বড় বাধা হয় দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র কিউবা বিপ্লবের মাত্র দুবছরের মধ্যে ১৯৬১ সালে ভাড়াটে কিউবানদের দিয়ে কিউবা সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। সিআইএর অর্থে পরিচালিত এ অভিযান ‘বে অব পিগস’-এর অভিযান হিসেবে খ্যাত। বলাই বাহুল্য ওই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেমে থাকেনি। ঠিক এর পরের বছর ১৯৬২ সালের অক্টোবরে ‘কিউবা সংকট’ একটি পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছিল কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে, যা তার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছে, এটা বিবেচনায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র একটি নৌ-অবরোধ আরোপ করে, যাতে করে কিউবায় কোনো ধরনের সামরিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করা না যায়। এই নৌ-অবরোধ অনেকটা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে একটি যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্ক থেকে তাদের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নিতে হবে। দীর্ঘ ১৩ দিন ওই নৌ-অবরোধ বহাল ছিল। অবশেষে যুক্তরাষ্ট তুরস্ক থেকে মিসাইল প্রত্যাহার করে নিলে সোভিয়েত ইউনিয়নও কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরিয়ে নেয়। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে গেলেও সংকট থেকে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে এই অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে কিউবা ‘যুদ্ধ’ করে আসছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরও মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্পর্কোন্নয়নের ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বললেও এটি খুব সহজ হবে না। কেননা ওবামাকে এ সংক্রান্ত একটি আইন পাস করতে হবে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে কংগ্রেসে তীব্র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। কংগ্রেসের উভয় কক্ষ এখন নিয়ন্ত্রণ করে রিপাবলিকানরা। রিপাবলিকানরা ওবামার ঘোষণায় খুশি নন। আমি একাধিক কংগ্রেস সদস্য তথা সিনেটরের বক্তব্য দেখেছি, যেখানে তারা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ওবামার ওই বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। সিনেটর জন মেককেইন ও সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার ওই সিদ্ধান্ত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সংকুচিত করবে। অন্যদিকে সিনেটর রয় প্লান্ট মনে করেন, এই ঘোষণা রাহুল কাস্ত্রোকে ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য করবে। ডেমোক্রেট দলীয় সিনেটর রবার্ট মেনডেজ মনে করেন প্রেসিডেন্ট ওবামার এই সিদ্ধান্ত হচ্ছে কিউবার মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ও স্বৈরশাসনকে স্বীকার করে নেওয়া। সিনেটর মেনডেজ নিজে কিউবান-আমেরিকান। এতে করে ধারণা করা স্বাভাবিক যে, কিউবার ওপর থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত কোনো আইনকে কংগ্রেস অনুমোদন দেবে না। ফলে ওবামার ঘোষণা ও উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ‘একটি ঘোষণা’ হিসেবেই থেকে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের দাবি, কিউবায় আরও বেশি গণতন্ত্রায়ন, আরও বেশি অর্থনৈতিক উদারীকরণ, মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও উন্নতিÑ একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কার। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের শর্তে কিউবা সবকিছু ‘উন্মুক্ত’ করে দেবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নে গর্ভাচেভের সংস্কার কর্মসূচির ফলাফল তাদের অজানা নয়। সংস্কার, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আনতে গিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছিল। চিন ও ভিয়েতনামে অর্থনৈতিক সংস্কার এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কার কর্মসূচির ‘পেরেস্ত্রৈকা’ বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু ‘গ্লাসনস্ত’ কার্যকর হয়নি। রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। কিউবাতে কোনোটাই আসেনি। চিন তার সংস্কার কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চিন থেকে এখন ঋণ গ্রহণ করছে। ভিয়েতনামও কম যায়নি। যে ভিয়েতনাম প্রায় ৪০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তারাই আজ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকের যে বিশাল চাহিদা তার একটা বড় অংশ ভিয়েতনাম সরবরাহ করছে। এখানে রাজনীতি অগ্রাধিকার পায়নি। পেয়েছে বাণিজ্য। এখন কিউবা কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাও দেখার বিষয়। তবে হুট করে দুদেশের সম্পর্কে কোনো বড় পরিবর্তন আসবে না। প্রেসিডেন্ট রাহুল কাস্ত্রো ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ওবামার এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে কিউবার রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিউবার জনগণ এখনো কিউবা সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। তবে এটাও ঠিক বিশ্বায়নের এই যুগে কিউবা ‘একা একা’ চলতে পারবে না। দেশটিকে ‘দুয়ার’ উন্মুক্ত করে দিতে হবেই। দেশের অর্থনীতির শতকরা ৮০ ভাগ এখনো সরকার নিয়ন্ত্রিত। কিছু কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে এ সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার। বেসরকারি খাত সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ট্যুরিজম খাত। এ খাত কিছুটা উন্মুক্ত করা হয়েছে। আরও উন্মুক্ত করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের হোটেল চেন ব্যবসায়ীরা এই খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। কিউবাতে সীমিত আকারে ‘ডলার বাণিজ্য’ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিউবান-আমেরিকান পাঠানো অর্থ এখন নিয়মিত কিউবাতে আসছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে একটা সমস্যা রয়েছে। কিউবা প্রতিদিন এক লাখ ব্যারেল তেল ‘অত্যন্ত কম মূল্যে’ ভেনিজুয়েলা থেকে পেয়ে আসছে। এর বিনিময়ে কিউবা ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক দিচ্ছে। এসব ডাক্তার, নার্স আর শিক্ষক এখন ভেনিজুয়েলার হয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে কাজ করছে। পুরো ব্যয়ভার বহন করছে ভেনিজুয়েলা। প্রয়াত হুগো শাভেজ এই পরিকল্পনা শুরু করলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাদুরো এই পরিকল্পনা কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন সেই প্রশ্ন ইতোমধ্যেই উঠেছে। কেননা ভেনিজুয়েলার রমরমা তেল ব্যবসার দিন শেষ। অর্থনীতি আগের মতো আর শক্তিশালী নয়। রাজধানী কারাকাসে বিশাল বিশাল ভবন খালি পড়ে আছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছেন না। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনিজুয়েলার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ভেনিজুয়েলার ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যখন ওবামা কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেন, তার ঠিক একদিন পর ১০ ডিসেম্বর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর মেনডেজ ‘ভেনিজুয়েলার জনগণের বিজয়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। গত এপ্রিল থেকেই সেখানে অসন্তোষ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বেশ কয়েকজন ভেনিজুয়েলার ভিআইপির ব্যাপারে। সম্পদ আটক থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগে ভেনিজুয়েলার মারাত্মক মানবাধিকার পরিস্থিতি অবনতির। এটা সত্য হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর ভেনিজুয়েলায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। কিন্তু এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে কলম্বিয়ায় কিংবা মেক্সিকোতে, যেখানে গেল বছর ৪৩ জন স্কুলশিক্ষার্থীকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। ভেনিজুয়েলার বিষয়টি যে পরিপূর্ণ রাজনৈতিক, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। এখন খুব সঙ্গত কারণেই ভেনিজুয়েলার ওপর মার্কিনি ‘চাপ’ যদি বাড়ে, তাহলে কিউবাকে দেওয়া তাদের আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তা কিউবার অর্থনীতিকে আঘাত করবে। কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে খোদ যুক্তরাষ্ট্রও উপকৃত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাত মারাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করতে পারছে না। স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশ আসছে বাইরে থেকে। এ ক্ষেত্রে কিউবার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা জগদ্বিখ্যাত। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এই চাহিদা পূরণ করতে পারে। ২০০২ সালে ফিদেল কাস্ত্রো এ ধরনের একটি প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা গ্রহণ করেনি। গেল বছর পশ্চিম আফ্রিকায় মারাত্মক ইবোলো রোগ ছড়িয়ে পড়ায় কিউবার স্বাস্থ্যকর্মীরা সেখানে গেছেন। এখন কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হলে যুক্তরাষ্ট্র স্বাস্থ্য খাতে উপকৃত হতে পারে। ওবামা-কাস্ত্রো বৈঠক এই সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে উদ্যোগটি নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস কালো তালিকা থেকে কিউবাকে বাদ দেবে এবং বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে তা এক বড় অবদান রাখবে। Daily Amader Somoy 17.04.15

তিন নির্বাচন, প্রশ্ন অনেক

খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের ওপর একাধিকবার হামলা, পাল্টাপাল্টি মামলা আর কূটনীতিকদের ‘সমবেদনা’র মধ্য দিয়ে তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২৮ এপ্রিল। এর মাঝে আবার বিএনপি হামলার প্রতিবাদে ২২ এপ্রিল হরতালও ডেকেছিল (ঢাকা ও চট্টগ্রাম বাদে)। এ হামলা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং চলমান রাজনীতিতে এর রেশ যে থেকে যাবে, এটি আর কাউকে মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। এক. খালেদা জিয়ার জামিনপ্রাপ্তি ও নিজ বাসগৃহে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে ‘সমঝোতার’ যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল, তা এখন ভেস্তে যেতে বসেছে! স্পষ্টতই অসহিষ্ণু রাজনীতির যে চিত্র এদেশে রয়েছে, তাই রয়ে গেল। দুই. এই হামলার সঙ্গে সরকার সমর্থকরা জড়িত নয় বলে সরকারের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি মন্তব্য করলেও একাধিক মিডিয়ার প্রতিবেদনে সবাই ধরা পড়েছে। ছাত্রলীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও এ হামলার সঙ্গে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এটি কোনো অবস্থাতেই ভালো খবর নয় এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য তা কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে না। তিন. খালেদা জিয়ার ওপর এ হামলাকে বিএনপির সিনিয়র নেতারা ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ‘খালেদা জিয়াকে হত্যার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন। এ ধরনের একটি মন্তব্য আমাদের উদ্বেগের জন্য যথেষ্ট। এই মন্তব্য যে ‘সত্য নয়’, তা প্রমাণ করার জন্যই সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে। চার. নির্বাচনী প্রচারণার সময় হামলার বিষয়টি নির্বাচন কমিশন খতিয়ে দেখতে পারে। কেননা এ ঘটনা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ইসি যদি শক্ত অবস্থান গ্রহণ না করে, তাহলে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকবে। পাঁচ. নির্বাচনী প্রচারে বাধাদানে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন নিন্দা জানিয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য এটি কোনো ভালো খবর নয়। এতে করে আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বিদেশীদের ‘হস্তক্ষেপের’ প্রবণতা আরও বাড়বে। ছয়. অতীতে শেখ হাসিনার (তিনি যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন) ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। আমাদের জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেদিন সরকার ব্যর্থ হয়েছিল। আজও হামলা হল। সরকারের দায়িত্ব দোষীদের আইনের আওতায় আনা। ‘সরকারের সমর্থক হলেই তিনি আইনের ঊর্ধ্বে থাকবেন’- এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। সাত. বিগত ৯২ দিনের আন্দোলনে ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন- এটি অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কি এমন হতে পারে? হামলাকারীদের ছবি ও পরিচিতি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এরা কেউই ক্ষুদে ব্যবসায়ী নন। আট. সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ‘মূল ধারার’ রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। একটি আস্থা বা ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স’-এর আবহ তৈরি হয়েছিল। এখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এই আস্থার সম্পর্কটা ধরে রাখা। নয়. যদি নির্বাচনী প্রচারণায় বাধাদান অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামীতে যে কোনো নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সরকারের ভাবমূর্তির জন্য তা ভালো কোনো সংবাদ নয়। দশ. সুষ্ঠু একটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আগামীতে সুষ্ঠু ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌর নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করবে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আর পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলে। তাই এ তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনেরগুরুত্ব অনেক বেশি।এটা অস্বীকার করা যাবে না, নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। আচরণবিধির অনেকটাই তার জন্য প্রযোজ্য নয়। ওদিকে আওয়ামী লীগের সমর্থক মেয়র কিংবা কাউন্সিলর প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার ‘অংশগ্রহণের’ সুবিধা পাচ্ছেন না। শেখ হাসিনার উপস্থিতি কিংবা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ খুব স্বাভাবিকভাবেই কর্মীদের উজ্জীবিত করত। একইসঙ্গে ভোটারদেরও উজ্জীবিত করত। খালেদা জিয়া আইনগতভাবেই নির্বাচনী প্রচারণায় যাচ্ছেন। কিন্তু যেতে পারছেন না শেখ হাসিনা। তবে এটিও একটা ভালো খবর, প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরা নির্বাচন আচরণবিধি লংঘন করছেন না।বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক. দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটা সহাবস্থান থাকতে হবে। এই সহাবস্থান নিশ্চিত না হলে গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। এদেশের হাজার হাজার মানুষ যেমন মনে করে আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই তাদের মুক্তি ও জীবনমানের উন্নয়ন সম্ভব, ঠিক একইসঙ্গে এটিও সত্য, হাজার হাজার মানুষ এখনও বিএনপির পতাকাতলে আছে ও বিএনপির রাজনীতিকে ধারণ করছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি দ্বিদলীয় রাজনীতির জন্ম হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এই দ্বিদলীয় রাজনীতি আমরা লক্ষ্য করি। ইউরোপের অনেক দেশের রাজনীতি প্রধানত দুটো প্রধান দলের ওপর নির্ভরশীল। তৃতীয় বা চতুর্থ দল থাকে বটে, তারা প্রধানত প্রধান দুটো দলের সহযোগী মিত্র হিসেবে রাজনীতিতে অবদান রাখে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রধান দুটি দল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গত ৪৪ বছরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। স্বাধীনতার পরপরই জাসদ প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। হাজার হাজার তরুণ জাসদে আস্থা রেখেছিল। কিন্তু জাসদের হটকারী রাজনীতির কারণে জাসদ মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে, আর জাসদের পরিবর্তে রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হয় বিএনপি, যাদের রাজনীতি বিকশিত হয় আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই (১৯৯১) বিএনপি জাতীয় রাজনীতিতে তার অবস্থান শক্তিশালী করেছে। বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) অংশ না নিলেও এর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এবং নির্বাচনে ভালো করেছিল। এর অর্থ হচ্ছে উপজেলা পর্যায়ে বিএনপির অবস্থান বেশ শক্তিশালী। ফলে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে হবে।দ্বিতীয় যে বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে সনাতন ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থাৎ ব্রিটিশ মডেলের গণতন্ত্রের পরিবর্তে উন্নয়নমুখী একটি গণতান্ত্রিক মডেল আমাদের দেশে দরকার। উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে অনেক কথা আছে। অধ্যাপক হানটিংটন উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রের বিকাশে উন্নয়ন প্রক্রিয়া তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তিনি পূর্ব এশিয়ার তথা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার (বিশেষ করে সিঙ্গাপুর মডেল) গণতন্ত্রের মডেলকে দক্ষিণের গরিব দেশগুলোর জন্যও একটি মডেল হিসেবে বিবেচনায় নিতে বলেছেন। প্রায় ২০ বছর আগে আমার সুযোগ হয়েছিল নিউইয়র্কের জনপ্রিয় মেয়র এড কচের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে মতবিনিময় করার। কচ আমাকে বলেছিলেন, আমেরিকার মডেলের গণতন্ত্র উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য উপযুক্ত নয়। তিনি কিছু চাপিয়ে দেয়ার পক্ষপাতী নন। বলেছিলেন, সিঙ্গাপুর মডেলের গণতন্ত্র উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। ব্যাখ্যা চাইলে ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এটি আগে দরকার। আজ এত বছর পর এড কচের কথা মনে পড়ে গেল। আমি আমার একটি গ্রন্থে এড কচের কথা উল্লেখও করেছিলাম। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। অনেকের স্মরণ থাকার কথা- হিলারি ক্লিনটন তার বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশকে soft power-এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বেশকিছু পরিসংখ্যান আমাদের এই সম্ভাবনার কথা বলে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.২ শতাংশ (যা এখন ৫.৭ শতাংশে নেমে যাওয়ার আশংকা)। রিজার্ভ ২২৪০ কোটি ডলার, রফতানি ২৭ বিলিয়ন ডলার, রেমিট্যান্স ১১.৭৯ বিলিয়ন ডলার, আয়ু ৭০ বছর, শিক্ষিতের হার ৬০ ভাগ, শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের স্যানিটেশন সুবিধা, দারিদ্র্য মাত্র ২৪ ভাগ, মাথাপিছু আয় ১১৯০ ডলার, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ইত্যাদি। এ পরিসংখ্যান বলে বাংলাদেশ দ্রুতবর্ধনশীল উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি। আর সরকারেরও ইচ্ছা দেশকে ২০৫০-এর আগেই একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। আর এটা করতে গেলে বড় প্রয়োজন আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধের সম্পর্ক গড়ে তোলা, জাতীয় নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সহিংস রাজনীতি পরিত্যাগ করা, হরতালের মতো আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করে এর ‘বিকল্প রাজনীতি’ খুঁজে বের করা, সংসদকে সত্যিকার অর্থে প্রতিনিধিত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবেই। আর এই বিরোধিতা হতে হবে এজেন্ডাভিত্তিক। অর্থাৎ ভোটারদের সুযোগ দিতে হবে বেছে নেয়ার। এখন যদি নির্বাচনে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়, তাহলে ভোট কেন্দ্রে উপস্থিতির হার কম হবে। আর যদি কারচুপি হয়, তাতে করে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রশ্নের মুখে পড়বে। ইসি বিতর্কিত হবে। আমার প্রত্যাশা ছিল প্রার্থীরা সুস্পষ্টভাবে কর্মসূচি উপস্থাপন করবেন। কিন্তু তা তারা করেননি। ভাসা ভাসা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আর নির্বাচনী প্রচারণাতেও সেই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ দেখা যাচ্ছে না। মির্জা আব্বাস সুযোগ পাননি প্রচার চালানোর। উপরন্তু বিএনপি সমর্থক একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী গ্রেফতার হয়েছেন। এরপর ঘটল খালেদা জিয়ার ওপর হামলা। এক দিন নয়, পরপর তিন দিন। এর অর্থ পরিষ্কার, সরকার সমর্থকরা চান না তিনি মাঠে থাকুন। এ হামলার ফলে কি এখন বিএনপির দিকে সমর্থন আরও বাড়ল না? ২৮ তারিখের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি-না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। ইসি নির্বাচনের ৪ দিন আগে সেনাবাহিনী নামানো হবে, এই ঘোষণা দিলেও ঠিক তার পরদিন তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসে। এখন ইসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সেনাবাহিনী মাঠে নয়, ক্যান্টনমেন্টেই থাকবে। তবে নির্বাচনী মাঠে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তাদের প্রয়োজনে ডাকতে পারবেন। সেনাবাহিনী তো ক্যান্টনমেন্টেই থাকে। সরকার চাইলেই সেনাবাহিনী মাঠে নামে। এখন কি ইসির এই বক্তব্য কোনো বিভ্রান্তি তৈরি করবে না? এটা তো সবাই জানে, সরকার কখনও চায়নি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীকে নামানো হোক কিংবা আইনশৃংখলা রক্ষায় তাদের ব্যবহার করা হোক। বাহ্যত ইসির পরবর্তী ব্যাখ্যায় সরকারের ইচ্ছারই প্রতিধ্বনি হল। আমাদের জন্য মঙ্গল ছিল যদি আমরা সেনাবাহিনী ছাড়াই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারতাম। কিন্তু আমরা কি তা পেরেছি কখনও? অতীতে উপজেলা নির্বাচনে যে সহিংস ঘটনাবলি আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, তা বিবেচনায় নিয়েই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রশ্নটি উঠেছিল। এখন সেনাবাহিনী আদৌ মাঠে নামবে কিনা, সে প্রশ্ন থেকেই গেল।আমরা চাই নির্বাচনটি সুষ্ঠু হোক। একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হোক। ভোটারদের সুযোগ দেয়া হোক তাদের প্রার্থী নির্বাচনের। আর খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করুক। বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক বৃদ্ধি পাক। আর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনটি হোক একটি প্লাটফর্ম, যেটাকে ভিত্তি করে আস্থার সম্পর্কটি আরও সম্প্রসারিত হতে পারে। Daily JUGANTOR 25.04.15

হিলারি ক্লিনটন ও যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট

শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে হিলারি ক্লিনটন ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর প্রার্থীপদ ঘোষণা করেছেন। তিনি হতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট। জর্জ ওয়াশিংটনের (প্রথম প্রেসিডেন্ট, ১৭৮৯-১৭৯৭) পর বারাক ওবামা পর্যন্ত ৪৪ জন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে এসেছেন। কেউ এক টার্ম বা কেউ দুই টার্মের জন্য আট বছর থেকেছেন (ব্যতিক্রম ছিলেন ৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট। তিনি ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন)। বারাক ওবামার দুই টার্মের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৬ সালের নভেম্বরে। ৮ নভেম্বর (২০১৬) সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর ওই নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন যদি 'বিজয়ী' হন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি শপথ নেবেন ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি। গেল সপ্তাহে দুই মিনিটের এক ভিডিওবার্তায় তিনি জানান, প্রেসিডেন্ট দৌড়ে তিনি নামছেন। ভিডিওবার্তায় তিনি বলেছেন, 'এ দেশের প্রত্যেকটি মানুষের জন্য একজন চ্যাম্পিয়ন দরকার। আমি সেই চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। আশা করি এই চলার পথে আপনাদের সবাইকে পাশে পাব।' ১৯৪৭ সালে জন্ম নেওয়া ও ৬৭ বছর বয়সী হিলারি ক্লিনটনের হোয়াইট হাউস, প্রশাসন ও আইন প্রণেতা হিসেবে অভিজ্ঞতা অনেক দিনের। হোয়াইট হাউসে তিনি ছিলেন আট বছর, ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত একজন ফার্স্ট লেডি হিসেবে। এরপর নিউ ইয়র্ক থেকে একজন সিনেটর হিসেবে তিনি কংগ্রেসে আইন প্রণয়নে সহায়তা করেন ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর আগে ২০০৮ সালে তিনি বারাক ওবামার সঙ্গে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী হতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে তিনি ওবামার কাছে হেরে যান। এরপর বারাক ওবামা মন্ত্রিপরিষদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দিলেও হিলারি ক্লিনটন বারেবারেই আলোচনায় ছিলেন। মিডিয়া তাঁকে বারবার ফোকাস করেছে। শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটালেন তিনি। কিন্তু হোয়াইট হাউসে আসার পথটি কি মসৃণ? তিনি কি পারবেন ইতিহাস গড়তে? যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ২০০৮ সালে ওবামাকে নির্বাচিত করে ট্র্যাডিশনাল প্রথা ভেঙেছিল- একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট হন। এই ধারাবাহিকতায় এখন যুক্তরাষ্ট্র একজন নারী প্রেসিডেন্টকে পায় কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তবে অনেক প্রশ্ন তো আছেই। এক, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ এখনো কনজারভেটিভ। তারা একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে না-ও চাইতে পারে। যদিও বিভিন্ন দেশে নারীরা সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় বেশ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। জার্মানি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলসহ চার ডজন দেশে নারীরা এখনো রাষ্ট্র তথা সরকার পরিচালনা করে আসছেন। ইউরোপের অনেক দেশে রাষ্ট্রপ্রধান এখন নারী। ফলে একদিকে হিলারি ক্লিনটনের সম্ভাবনা যেমনি আছে, তেমনি এটাও সত্য তিনি কনজারভেটিভদের বাধার সম্মুখীন হতে পারেন। দ্বিতীয়ত, জনগণের ভোটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। নির্বাচিত হন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে। যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা ৫০টি, আর নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা ৫৩৮। সাধারণত সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের (প্রতিনিধি পরিষদ) সদস্যসংখ্যার ভিত্তিতে এই নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়। হিলারি ক্লিনটনের জন্য সমস্যা হচ্ছে, কনজারভেটিভ রিপাবলিকানরা এখন কংগ্রেসের উভয় কক্ষ (সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ) নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে রিপাবলিকানরা ভারী। ২০১৬ সালে এক-তৃতীয়াংশ সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে। তাতে করে যদি পরিবর্তন আসে, তাহলে তা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। নতুবা কনজারভেটিভদের বলয় ভাঙা তাঁর জন্য কঠিন হবে। তৃতীয়ত, হিলারিকে বলা হয় দুর্বলচিত্তের একজন মানুষ। তাঁর স্বামী বিল ক্লিনটন যখন প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে অবৈধ যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে যান, তখন স্ত্রী হিসেবে তিনি যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেননি। যদিও ওই ঘটনার পরও তিনি স্বামীকে 'ক্ষমা' করে দিয়েছিলেন ও বৈবাহিক জীবন টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, নির্বাচনী প্রচারণায় হিলারি ক্লিনটনকে এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। এ জন্য হিলারি ক্লিনটন কতটুকু মানসিক শক্তির অধিকারী হন, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। চতুর্থত, ক্লিনটন দম্পতির বিরুদ্ধে বেশ কিছু আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যখন এই দম্পতি হোয়াইট হাউস ছাড়ে, তখন তাদের আর্থিক ভিত্তি অতি শক্তিশালী ছিল না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নিউ ইয়র্কে ২৭ লাখ ডলারের একটি বাড়ি ও ওয়াশিংটনে ২৮ লাখ ৫০ হাজার ডলারের তাদের অন্য একটি বাড়ি ক্রয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। ক্লিনটন ফাউন্ডেশন নিয়েও প্রশ্ন আছে। অভিযোগ আছে, অনেক বিদেশি রাষ্ট্র এই ফাউন্ডেশনকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে তাদের 'সুবিধা' আদায় করে নিয়েছে। যদিও দুজনই বক্তৃতা, আর সেমিনার করে বেশ অর্থ আয় করেন। পঞ্চমত, হিলারির বিরুদ্ধে বড় একটি অভিযোগ হচ্ছে, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় লিবিয়ার বেনগাজিতে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেটে জঙ্গিবাদীদের হামলা ও ওই হামলায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নিহত হওয়ার ঘটনা ঠেকাতে পারেননি। এবং রাষ্ট্রদূতসহ অন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেননি। ষষ্ঠত, ওয়াশিংটনের পিউ রিচার্স ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বৈদেশিক নীতি ইস্যুতে মানুষ রিপাবলিকানদের বেশি বিশ্বাস করে। এটা হিলারি ক্লিনটনের জন্য একটা মাইনাস পয়েন্ট। সপ্তমত, অতীতে হিলারি ইরাক, বসনিয়া ও কসোভোয় 'যুদ্ধ' সমর্থন করেছিলেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরোধী একটা জনমত তাঁকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তবে হিলারি ক্লিনটনের বেশ কিছু প্লাস পয়েন্টও রয়েছে। এক. তিনি পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। এ ক্ষেত্রে রিপাবলিকান প্রার্থী জেব বুশের (সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ভাই ও সিনিয়র বুশের ছোট ছেলে) চেয়ে তিনি অনেক এগিয়ে আছেন। দুই. গেল বছরের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের যে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে রিপাবলিকানরা বিজয়ী হলেও ইতিমধ্যে রিপাবলিকান স্রোতে উল্টো বাতাস বইছে। বিশেষ করে তরুণ ও গরিব আমেরিকান ভোটারদের মধ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তিন. যুক্তরাষ্ট্রে একটি শক্তিশালী তরুণ প্রজন্ম রয়েছে, যাদের নেতৃত্বে নিউ ইয়র্কসহ অন্যান্য শহরে 'অকুপাই মুভমেন্ট' পরিচালিত হয়েছিল। এই 'শক্তি' ডেমোক্র্যাটদের আবার ২০১৬ সালে কংগ্রেসে ফিরিয়ে আনতে পারে, যা হিলারিকে বিজয়ী হতে সাহায্য করবে। চার. ওবামা তাঁর শেষ টার্মে এসে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন (স্বাস্থ্যসেবা, অভিবাসন, তরুণদের উচ্চশিক্ষায় সাহায্য ইত্যাদি), যা কি না তিনি কংগ্রেসের বিরোধিতার কারণে বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। এই তরুণ প্রজন্মের সমর্থন পেতে পারেন হিলারি। পাঁচ. যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবিরোধী একটি জনমত রয়েছে, যা বেশ শক্তিশালী। প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলেই যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আইএসবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিয়ে নতুন একটি 'ফ্রন্ট' ওপেন করেছে। কোটি কোটি ডলার খরচ হয় যুদ্ধে। হিলারি যদি এই 'যুদ্ধবিরোধী' জনমতের সঙ্গে অবস্থান করেন, তাহলে তাঁর সমর্থন ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। ছয়. রিপাবলিকান শিবিরে তেমন কোনো শক্ত প্রার্থী নেই। এটা হিলারির জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। ডেমোক্র্যাট শিবিরে হিলারি ক্লিনটনের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁকে একজন সম্ভাব্য 'ভালো প্রেসিডেন্ট' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তুলনামূলক বিচারে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন অনেক পিছিয়ে আছেন। কৌশলী হিলারি অনেক আগে তাঁর প্রার্থীপদ ঘোষণা করে প্রতিযোগিতায় নিজেকে এগিয়ে রাখলেন। তবে যেতে হবে অনেক দূর। পার্টি ফোরামে ও কনভেনশনে তাঁকে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে নিজ দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে। সেই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে তাঁকে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। বড় ব্যবসায়ী হাউসগুলো অর্থ জোগায়। হিলারিকে তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এটা সত্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর প্রেসিডেন্ট পদে দলের পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ একটি দল (যেমন- ডেমোক্রেটিক পার্টি) ক্ষমতায় দুই টার্ম থাকলেও পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকানদের মধ্য থেকে। হ্যারি ট্রুম্যান (১৯৪৫-১৯৫৩) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে। কিন্তু পরবর্তী অর্থাৎ ৩৪তম প্রেসিডেন্ট হলেন রিপাবলিকান দল থেকে (আইসেনহাওয়ার, ১৯৫৩-১৯৬১)। ৩৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবার পরিবর্তন। কেনেডির মৃত্যুর পর জনসন (১৯৬১-১৯৬৯) ডেমোক্র্যাটদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন। ১৯৬৯ সালে আবার পরিবর্তন। প্রেসিডেন্ট হলেন রিপাবলিকানরা (নিক্সন ও ফোর্ড, ১৯৬৯-১৯৭৭)। এই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার (ডেমোক্র্যাট, ১৯৭৭-১৯৮১), রিগান (রিপাবলিকান, ১৯৮১-১৯৮৯), ও জর্জ বুশ (রিপাবলিকান, ১৯৮৯-১৯৯৩), বিল ক্লিনটন (ডেমোক্র্যাট, ১৯৯৩-২০০১), বুশ-২ (রিপাবলিকান, ২০০১-২০০৮), ওবামা (২০০৮-২০১৬)। এই ধারা হিলারি ক্লিনটন ভাঙতে পারবেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। হিলারি ক্লিনটনের ব্যাপারে যে কথাটা বলা যায় তা হচ্ছে, তিনি মার্কিন বৈদেশিক নীতিতে একটি নতুন দিকদর্শন আনেন। বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এখন এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল। ২০১০ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত Forward Deployed Diplomacy-র মাধ্যমে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন। তিনি বিখ্যাত Foreign Policy ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন, The Asia Pacific has became a key driver of global politics and US Commit there is essential. তাঁর এই নীতির উদ্দেশ্য ছিল তিনটি। ১. এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকা, ২. যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং ৩. এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানে, একুশ শতক হবে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ককে (চীন, জাপান, ভারত) কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতি বিকশিত হবে। জন কেরি হিলারির স্থলাভিষিক্ত (পররাষ্ট্রসচিব) হয়েও হিলারির এই নীতি অব্যাহত রেখেছেন। এটা একটা বাস্তববাদী নীতি। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে হিলারি ক্লিনটনের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী হতেই পারি। অনেকের স্মরণ থাকতে পারে, বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি বাংলাদেশকে একটি Soft Power হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য এটা বড় পাওয়া। তিনি যোগ্য ব্যক্তি। একটি সম্মোহনী শক্তি তাঁর রয়েছে। একজন 'চ্যাম্পিয়নে'র কথা তিনি বলেছেন। দেখতে হবে ২০১৬ সালে কোন চ্যাম্পিয়ন হোয়াইট হাউসে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। Daily KALERKONTHO 21.04.15

কেমন হবে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন

কেমন হবে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন? তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৮ এপ্রিল। হাতে সময় কম। ইতোমধ্যে প্রার্থীরা 'মার্কা'ও পেয়েছেন এবং প্রচারণাও শুরু করেছেন। কিন্তু প্রচারণায় সরকারি দলের প্রার্থীরা বিশেষ করে ঢাকা সিটিতে (উত্তর ও দক্ষিণ) এগিয়ে আছেন প্রধান বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীদের চাইতে। সরকারি দলের প্রার্থীরা যেখানে মাঠে আছেন, সেখানে মাঠে নেই বিরোধী দল বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন তাদের স্ত্রী ও সমর্থকরা। সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যে, একাধিক বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীকে পুলিশ খুঁজছে (যুগান্তর, ১২ এপ্রিল) এবং তাদের প্রচারণায় বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা সমান সুযোগ চাইলেও গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার জানিয়েছেন, বিভিন্ন মামলার আসামি এসব প্রার্থীকে গ্রেপ্তারে অভিযোগ চলছে (মানবকণ্ঠ, ১২ এপ্রিল)। যদিও মামলা-মোকদ্দমার কথা বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯৩ ওয়ার্ডে ৭২ নতুন মুখ দিয়েছে (আমাদের সময়, ১২ এপ্রিল)। কিন্তু তার পরও পুলিশ ঝামেলা করছে_ এ দাবি বিএনপি সমর্থকদের। ফলে এ নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হবে, কতটুকু নিরপেক্ষ হবে এ প্রশ্ন উঠছে। নির্বাচন মানেই হচ্ছে প্রতিযোগিতা। দুজন সরকার সমর্থিত হেভিওয়েট প্রার্থী (মেয়র পদে) রয়েছেন মাঠে। অথচ ঢাকা দক্ষিণে যিনি বিএনপির প্রার্থী তিনি গ্রেপ্তারের ভয়ে মাঠে নামতে পারছেন না। তার স্ত্রী তার হয়ে গণসংযোগ করছেন। কিন্তু তাতে করে কি আদৌ কোনো প্রতিযোগিতা হবে? ঢাকা উত্তরের বিএনপির প্রার্থী নিয়েও আছে 'নানা কাহিনী'। নিঃসন্দেহে আবদুল আউয়াল মিন্টু 'শক্ত' প্রার্থী ছিলেন। উচ্চ আদালত তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে। এখানে জনাব মিন্টুর 'ভূমিকাকে' হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। পর্দার অন্তরালে নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে তিনি নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে সরে গেলেন কি না, এ প্রশ্ন এখন অনেকের মুখে মুখে। সরকার সমর্থিত দুজন মেয়র প্রার্থীই ব্যবসায়ী। আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসায়ীদের প্রার্থী হওয়ার বিপক্ষে। তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকায় তাদের মেয়র পদে না প্রতিযোগিতা করাই মঙ্গল। দুজন প্রার্থীর মধ্যে একজন (দক্ষিণ) ঋণ কিছুটা পরিশোধ করেছেন। কিন্তু ঢাকা উত্তরের প্রার্থীর খবর কী? তিনি আদৌ ঋণখেলাপি কি না কিংবা ঋণ রিশিডিউল করেছেন কি না, আমরা জানি না। এসব ধনী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী যখন প্রার্থী হন এবং যাদের কাছে ব্যাংকের পাওনা থাকে ১০০ কোটি টাকার ওপরে, তারা যখন 'নগর পিতা' হতে চান তখন আমাদের দুঃখ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। সিটি করপোরেশনের মতো জায়গায় ব্যবসায়ীদের প্রার্থী না করাই মঙ্গল। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকে। হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের কাজ হয় সিটি করপোরেশনগুলোয়। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ থাকাটাই স্বাভাবিক। তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কতটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, আমরা জানি না। বিএনপির প্রার্থীরা প্রচারণায় অংশ নিতে পারলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। আর না পারলে সরকারি দলের প্রার্থীরা 'খালি মাঠে' গোল দেবেন। প্রশ্ন এখানেই_ বিএনপি এ সুযোগটি কেন দিল? বিএনপির ব্যাপক সমর্থক রয়েছে। বিগত আন্দোলনের পরিণতি যাই হোক না কেন, একটা নৈতিক সমর্থন তো বিএনপির জন্য আছে। ফলে বিএনপি কি এ সুযোগটি কাজে লাগাতে পারবে? বিএনপি আন্দোলনের বিকল্প হিসেবে এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, আর তা প্রত্যক্ষ হোক কিংবা পরোক্ষ। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে বিএনপির 'অবস্থান' শক্তিশালী হবে মাত্র। দীর্ঘদিন ধরে দেশে এক ধরনের অস্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছিল। সরকার ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের সঙ্গে কোনো আস্থার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল না। বেগম জিয়া সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে তিন দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করলেও কোনো একটি দাবিও সরকার মানেনি। ফলে নির্বাচন সামনে রেখে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কতটুকু সফল হয়েছে বলা মুশকিল। তাই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির সরাসরি অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন থাকলই। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নির্বাচনে যারা কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন ২০ দলের পক্ষ থেকে তাদের মধ্যে ১৮৩ জন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি (যুগান্তর, ১ এপ্রিল)। আর বিএনপির ৪৪ জেলা অফিসে তালা (যুগান্তর ২ এপ্রিল)। এ পরিস্থিতি সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুকূলে নয়। সোমবার (১৩ এপ্রিল) এ নিবন্ধটি যখন তৈরি করছি, তখনো তথাকথিত 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড' তৈরি হয়নি। নির্বাচনের যখন দুই সপ্তাহও বাকি নেই, তখনো ঢাকায় বিএনপির সিনিয়র নেতারা কেউ মাঠে নেই! চট্টগ্রামে নোমান-খসরুকে বেশ তৎপর দেখালেও ঢাকায় কাউকেই আমরা মাঠে দেখছি না। তাহলে কি বিএনপি এ নির্বাচনকে সিরিয়াসলি নেয়নি? লন্ডন থেকে তারেক রহমানের কোনো বক্তব্যও আমরা দেখছি না। যারা 'ষড়যন্ত্রতত্ত্ব'-এ বিশ্বাস করেন তারা নানা 'তত্ত্ব' উপস্থাপন করতে পারেন এখন। বিএনপির প্রার্থীরা এবং নেতারা যদি মাঠে না থাকেন, যদি প্রচারণায় অংশ না নেন, তাহলে কি নির্বাচনটা একদলীয় হয়ে যাবে না? বিএনপি কি তা-ই চাচ্ছে? বিএনপি কি বিশ্বকে আরো একবার দেখাতে চাইছে এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়! এতে বিএনপির লাভ কতটুকু হবে বলা মুশকিল। তবে এটা তো সত্য, বিএনপির ওই 'ধারণা' আরো শক্তিশালী হবে। আরো একটা বিষয় বেশ দৃষ্টিকটু আর তা হচ্ছে, বিএনপিকে কি না 'এমাজউদ্দীন ফর্মুলা'য় নির্বাচনে যেতে হলো। এমাজউদ্দীন আহমদ বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবী। তার এ 'ফর্মুলা' নিয়ে নানা কথা হতে পারে। তবে সিনিয়র নেতাদের 'অন্ধকার'-এ রাখা কোনো ভালো কথা নয়। আরো একটা কথা, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন সরকারি দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন তখন অনেক প্রশ্ন ওঠে। এটা বুঝতে কারো বাকি থাকে না, সরকারপ্রধান কত সিরিয়াস। নিঃসন্দেহে এটা দল তথা সরকারের জন্য একটা প্রেস্টিজ ইস্যু। নির্বাচনে 'বিজয়ী' হয়ে সরকার দেখাতে চাইবে বিএনপির কোনো জনপ্রিয়তা নেই। এজন্যই বিএনপির নির্বাচনে মাঠে থাকা উচিত। ডজন ডজন মিডিয়া কর্মী ও ক্যামেরার উপস্থিতিতে নির্বাচনে জালিয়াতি ও কারচুপির সুযোগ থাকবে কম। এ নির্বাচনে কোন ইস্যুটি প্রাধান্য পাবে, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা যে একটা ইস্যু হবে তা দিব্যি দিয়ে বলা যায়। এ জলাবদ্ধতা দূরকরণে নির্বাচিত মেয়র মনজুর আলম তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেননি। ২০১০ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পেছনে এটা ছিল বড় কারণ। আজ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে আমি অবাক হব না। বিগত আন্দোলন চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে কোনো বড় ভূমিকা পালন করবে বলে আমার মনে হয় না। এমনকি ঢাকা সিটি নির্বাচনেও এ আন্দোলন তেমন গুরুত্ব পাবে না। সরকারি দলের প্রার্থীদ্বয়ের বক্তব্যে তা বেশি গুরুত্ব পায়নি। মূলত স্থানীয় সমস্যাগুলোই প্রাধান্য পাবে। সে ক্ষেত্রে দুজন সরকারি দলের মেয়র প্রার্থী বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এসবই আশ্বাস। কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট কর্মসূচি নেই। পুরান ঢাকার যানজট একটা বড় সমস্যা। জনাব খোকন আশ্বাস দিয়েছেন যানজট কমাবেন। কিন্তু কিভাবে? যেখানে সরকার বাড়ি বাড়ি গ্যাস সংযোগ না দেয়ার কথা বলেছে, সেখানে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন গ্যাস সংযোগ দেয়ার! তার ইশতেহারে নতুনত্ব কিছু নেই। আমি যদি আনিসুল হকের ইশতেহারের কথা বলি, সেখানেও সেই প্রতিশ্রুতি। কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। 'আলোকিত নগরী', 'সবুজ ঢাকা', স্মার্ট ও অংশগ্রহণমূলক 'সুশাসিত ঢাকা', 'বিশেষ সিটি কার্ড', পৃথক 'সাইকেল লেন'_ এ ধরনের বক্তব্য শুনতে ভালো শোনায়। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। সন্ত্রাস নির্মূলের কথা নেই। টেন্ডারবাজি বন্ধের কথা নেই। জলাবদ্ধতা দূরীকরণের কথা নেই। ভেজালমুক্ত খাদ্য নিরাপত্তার কথা নেই। ফলে ইশতেহারের বক্তব্য শুধু প্রতিশ্রুতিতেই ভরা। কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। মানুষ চায় নাগরিক সেবা। কিন্তু এ সেবা কিভাবে তারা নিশ্চিত করবেন, তা আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। তবুও এ নির্বাচনটি ভালো। আমরা চাই নির্বাচন সুষ্ঠু হোক। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১২ এপ্রিল পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রার্থীদের হয়রানি না করতে। পুলিশ প্রশাসন একে গুরুত্বের সঙ্গে নেবে বলেই আমি মনে করি। আমরা একটা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন চাই, যাতে বিশ্ববাসীকে দেখাতে পারি নির্বাচনের মাধ্যমেই আমরা আমাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করতে পারি। যদি ভোট কারচুপি হয়, যদি বিরোধী প্রার্থীরা সমান সুযোগ না পান তাহলে এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সরকারের জন্যও তা ভালো কোনো সংবাদ বয়ে আনবে না। দেশে একটি নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়েছে। এ আবহ দুটি বড় দলের মধ্যে 'শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান'-এর একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য এটা একটা ভালো খবর Daily JAI JAI DIN 20.04.15

আঞ্চলিক সহযোগিতা, নাকি প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা

এপ্রিলের মাঝামাঝিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রিদেশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতার ব্যাপারে তিন দিনব্যাপী একটি সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ‘ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা’ শীর্ষক এ সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ। এ সিম্পোজিয়ামে ভারতের হাইকমিশনার ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতও বক্তৃতা করেন। সিম্পোজিয়ামে খোলামেলাভাবেই বলা হয়, এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য সবাইকে আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে সবার আগে প্রয়োজন খোলা মন নিয়ে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করা। সম্মেলনে এটিও বলা হয় বাংলাদেশ খোলা মন নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে অন্য দেশগুলোর কাছ থেকেও একইভাবে বিনিময় আশা করে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রশ্নে এ ধরনের একটি সম্মেলন বা সিম্পোজিয়ামের গুরুত্ব অনেক বেশি, তবে এখানে প্রশ্ন আছে ভারতের ভূমিকা নিয়ে। একই সঙ্গে এ অঞ্চলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকেও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ভারত ত্রিদেশীয় (বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার) একটি আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলছে বটে, কিন্তু একইসঙ্গে ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে একটি সামরিক অ্যালায়েন্স গড়ে তুলছে, যা কিনা আগামীতে এ অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করবে। সিরিয়াস পাঠকমাত্রই জানেন, ঢাকায় শেষ হওয়া এ সিম্পোজিয়ামের আগে ২০ থেকে ২২ মার্চ ভারতের ভুবনেশ্বরে ‘ইন্ডিয়ান ওসেন রিম’ বা আইওআর একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা ভারতের জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান যেসব বক্তব্য রেখেছেন, তাতে এটি স্পষ্ট যে, ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় চীনকে এককভাবে কর্তৃত্ব করতে দেবে না। ফলে একদিকে ভারত যখন আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলছে, অন্যদিকে আবার এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এখানে দুইটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এক. মিয়ানমার ধীরে ধীরে ‘উন্মুক্ত’ হয়ে যাচ্ছে। দুই. যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে এবং ভারতের সঙ্গে একটি কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা হবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে চীনবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে চায়। তাই ত্রিদেশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা যখন বলা হচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে বিবেচনায় নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এ ভূমিকা ত্রিদেশীয় এ আঞ্চলিক সহযোগিতাকে কতটুকু প্রভাবিত করে, তা দেখতে হবে। গবেষকরা এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারেন। বলা ভালো, ওবামা তার শাসনামলে দুইবার ভারত সফর করেন। ২৫ জানুয়ারি তিনি ভারত সফর করে গেছেন। ওবামার এ সফরের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার জট খুলেছিল। সমস্যা ছিল ভারতের পক্ষ থেকে। কেননা ২০১০ সালে ভারতে পরমাণু দায়বদ্ধতা আইন পাস হওয়ার পর গোটা প্রক্রিয়াটি থমকে গিয়েছিল। কেননা ওই আইনে বলা হয়েছিল কোনোরকম দুর্ঘটনা ঘটলে, তার দায় নিতে হবে ইউরেনিয়াম সরবরাহকারী মার্কিন সংস্থাগুলোকে। এখন একটি বীমা কোম্পানি গঠন করা হয়েছে, তারা এ দুর্ঘটনার দায়ভার বহন করবে। ফলে পরমাণু সেক্টরে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগে আর কোনো বাধা থাকল না। ওবামা ভারতে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টির জন্য ৪০০ কোটি ডলার তহবিলের ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি ব্যাংক এ অর্থ জোগাবে। এ অর্থের প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ২০০ কোটি ডলার দেয়া হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য। একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ১০ বছরের জন্য এ চুক্তি নবায়ন করা হযেছে, যেখানে একসঙ্গে গবেষণা ও অস্ত্র তৈরির কথা রয়েছে। এ চুক্তির আওতায় রাসায়নিক বা জৈব প্রতিরক্ষা কর্ম তৈরি, রোল অন রোল অব ইনটেলিজেন্স এবং নজরদারি বিমান তৈরিতে ভারতকে সহায়তা করবে যুক্তরাষ্ট্র। সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর কথাও বলছিল দুই পক্ষ। যৌথ বিবৃতিতে পাকিস্তানভিত্তিক ভারতবিরোধী সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর নামও উল্লেখ করা হয়েছিল। একইসঙ্গে দুই পক্ষ সাইবার হুমকি মোকাবিলায় তথ্য আদান-প্রদানে সম্মত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ‘ভূমিকা’ এবং সেই ভূমিকার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীরব সমর্থন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অ্যালায়েন্সকে নতুন করে সামনে নিয়ে এলো। পার্শ্ববর্তী দুইটি দেশ চীন ও পাকিস্তানের যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তাতে প্রমাণ হয়, দেশ দুইটি খুব খুশি নয়। চীনের প্রেসিডেন্ট ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে যে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন, তাতে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, ‘ওয়াশিংটন চাইছে ভারত ও চীনের মধ্যে যেন একটি সহজাত শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব তৈরি হয়।’ আর পাকিস্তান বলেছে, ‘নিরাপত্তা পরিষদে যোগ্য নয় ভারত।’ ওবামা ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদে সমর্থন করেছিলেন। এখানে বলা প্রয়োজন যে, অতি সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তন হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে অতিমাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন এবং শ্রীলঙ্কাকে অতিমাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছিলেন। এ নির্ভরশীলতা একটি নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি করেছিল, যা ভারত খুব ভালো চোখে নেয়নি। এখন শ্রীলঙ্কার নয়া সরকার বলছে, তারা শ্রীলঙ্কা-চীন সম্পর্ক নতুন করে পুনঃবিবেচনা করবে। এমনকি শ্রীলঙ্কায় চীনের বিনিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নয়া প্রধানমন্ত্রী। ফলে শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তনে ‘ভারতের একটি ভূমিকা’ নিয়ে কথা উঠেছে। চীনবিরোধী কথাবার্তা বলার মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কা-চীন সম্পর্ক এখন প্রশ্নের মুখে থাকল। অপরদিকে শ্রীলঙ্কা-ভারত সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠল। এটি স্পষ্ট যে, এ অঞ্চলে বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান কিংবা বাংলাদেশে চীনের একটি ‘ভূমিকা’র ব্যাপারে ভারতের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দারা খুব খুশি ছিল না। ভারত চীনের এ ভূমিকাকে আরও সঙ্কুচিত করতে চায়। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, গেল বছরের মাঝামাঝি মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে প্রথম বিদেশ সফরে ভুটানে গিয়েছিলেন। তখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গিয়েছিল যে, চীন ভুটানে দূতাবাস খুলতে চায়, এ ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা এটিকে নিরাপত্তা দৃষ্টিকোণের আলোকে দেখেনি।অরুণাচল নিয়ে ভারত ও চীনের মাঝে দ্বন্দ্ব বেশ পুরনো। চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফর ও গুজরাটে সরাসরি চীনা প্রেসিডেন্টকে সংবর্ধনা জানানোর পরও চীন অরুণাচল রাজ্যের ওপর থেকে তার ‘দাবি’ প্রত্যাহার করে নিয়েছে, এটি বলা যাবে না। এর অর্থ হচ্ছে নতুন আঙ্গিকে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। এমনকি কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করার কথা ছিল চীনের তাও এখন বাতিল করা হয়েছে। এখন এটি নির্মাণ করা হবে পায়রা বন্দরে। এখানেও নিরাপত্তাটার প্রশ্নটি উঠেছে। ভারত চায় না এ অঞ্চলে চীনের রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পাক। এখানেই তাই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রও চায় না এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাক। ওবামার ভারত সফরের পেছনে এ উদ্দেশ্যটিও কাজ করেছিল মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে। তাই প্রশ্ন থাকলই, ওবামার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে কে লাভবান হয়েছিল? ভারত না যুক্তরাষ্ট্র? ওবামাকে ভারতে নিয়ে আসার ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদি কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন। এতে করে তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির কিছুটা হলেও অগ্রগতি হবে। এর আগে পররাষ্ট্র সচিব জন কেরি ‘ভাইব্রান্ট গুজরাট’ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এর মধ্য দিয়ে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা ভারতে আসবেন। এখন বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় এবং তাতে মার্কিনি বিনিয়োগকারীদের জন্য রক্ষাকবচ থাকায়, বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ল। ওবামা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ীপদে ভারতের প্রার্থিতা সমর্থন করে ভারতকে কাছে টানার একটি উদ্যোগ নিলেন বটে। কিন্তু তিনি যদি ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ‘ব্যবহার’ করেন, তাহলে ভুল করবেন এবং ভারতও যদি এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে চীনবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলে তাও এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না! এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে উত্তেজনা দিন দিন বাড়ছে। এখানে ‘সীমিত যুদ্ধ’ এর সম্ভাবনা উজ্জ্বল হচ্ছে! চীনের সঙ্গে প্যাসিফিক অঞ্চল ফিলিপাইন, জাপানের দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে এ অঞ্চলে। পূর্ব চীন সমুদ্রে জাপান এবং দক্ষিণ চীন সমুদ্রে ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব ও বিবাদ একাধিকবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ফায়দা উঠাতে চায়। অনেকের স্মরণ থাকার কথা কিছুদিন আগে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে এসেছিলেন। সেখানে তিনি অরুণাচল রাজ্য যে ভারতের, সে ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছিলেন। ফুমিও কিসিদার এ বক্তব্যে চীনের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়। চীন অরুণাচল রজ্যের ওপর তার দাবি পরিত্যাগ করেনি। চীন মনে করে, ভারত জাপানকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে এবং সেই সঙ্গে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্ক একটি ভিন্ন মেসেজ পৌঁছে দিতে পারে বেইজিংয়ে। স্পষ্টতই প্রভাব বিস্তারের এক অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে ভারত ও চীন। বাংলাদেশের মতো ছোট একটি দেশ এ প্রতিযোগিতায় নিজেকে জড়িত করতে পারে না। তবে এটি সত্য, আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতায় বিশ্বাসী। এ কারণে বাংলাদেশ বিসিআইএম জোটের ব্যাপারে তার আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (উত্তর পূর্বাঞ্চল রাজ্যগুলো) এবং মিয়ানমারকে নিয়ে প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোটটি গঠিত। কিন্তু ভারত মহাসাগর নিয়ে উত্তেজনা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এ জোটটি বিকশিত হবে না। ফলে বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি একটি বড় ধাক্কা খাবে। ঢাকায় তিন দিনব্যাপী ত্রিদেশীয় সিম্পোজিয়ামটি শেষ হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য সিম্পোজিয়ামে এ অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা, কিংবা চীনের ভূমিকা এবং প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে কম। নিঃসন্দেহে আঞ্চলিক সহযোগিতা থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি। বিশেষ করে ভারত ও মিয়ানমার আমাদের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই চীনের সঙ্গে বৈরিতা সৃষ্টি করে এ আঞ্চলিক সহযোগিতা কোনো বড় অবদান রাখতে পারবে না। Daily Alokito Bangladesh 19.04.15