রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে শঙ্কা আবারও বাড়লো

ভারত আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে এমন একটি সংবাদ বাংলাদেশের মিডিয়ায় প্রকাশিত হবার পরপরই যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে ভারত কি তাহলে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পও কার্যকরী করবে? যদিও গেল জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় ৬৫ দফা সম্বলিত যে যৌথ ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল ভারত আন্ত:নদী সংযোগ ও টিপাইমুখে এমন কোন কার্যক্রম গ্রহণ করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। এখন সেই পরিস্থিতি থেকে ভারত সরে আসছে।
অনেকেই জানেন টিপাইমুখে ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা অনেক পুরনো। পাঁচবছর আগে দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারনে (২৯ জুলাই, ২০১০) একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল টিপাইমুখ নির্মানাধীন এলাকায় যেতে পারেননি। তারা বাংলাদেশে ফিরে এসে বলেছিলেন ভারত টিপাইমুখে কোন বাঁধ নির্মাণ করছে না। আমরা তখন আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু এরপর হাটে হাড়িটি ভেঙে দিয়েছিলেন ভারতের নর্থ ইস্টার্ণ ইলেকট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেডের (নিপকো) চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রেমচান্দ পঙ্কজ। তিনি জুলাই ২০১১ তে আসামে স্থানীয় একটি সংবাদ সংস্থার সাথে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, টিপাইমুখে বরাক নদীতে প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবেই। তিনি জানিয়েছিলেন প্রস্তাবিত ১৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম টিপাইমুখ প্রকল্পের কাজ যথারীতি এগিয়ে নেয়া হবে (আমার দেশ, ১২ জুলাই ২০১১)। প্রেমচান্দের ওই বক্তব্য বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে তখন ছাপা হয়েছিল।
উল্লেখ্য যে, ভারতের মনিপুর রাজ্যের চোরা-চাঁদপুর জেলার তুইভাই ও বরাক নদীর সংযোগস্থলে টিপাইমুখ বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। ভারত প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপি ব্যয় করে এই বাঁধটি নির্মাণ করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হবার কথা। শুধু বা্ংলাদেশেই নয়, আসাম ও মনিপুরের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এই বাঁধ নির্মানের বিরোধীতা করছে। তারা মনে করছেন এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ফলস্বরুপ অর্থনৈতিকভাবেও বিপন্ন হয়ে পড়বে এলাকার বাসিন্দারা। ভারতের পরিবেশবাদীরা এই প্রকল্পের বিরোধীতা করলেও, আসামের মূখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ তখন বলেছিলেন, বৃহৎ নদী বাঁধ যে কোন মূল্যে হচ্ছেই, কেউ বাঁধের কাজ আটকাতে পারবে না। মূখ্যমন্ত্রী গগৈ কিংবা প্রেমচান্দের বক্তব্যের পর এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে টিপাইমুখ বাঁধ হচ্ছেই। কিন্তু মোদি ঢাকায় এসে আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়।
ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায় কিন্তু ভারত এমন কিছু করতে পারবে না যা পার্শ্ববর্তী দেশের অর্থাৎ বাংলাদেশের ক্ষতির কারন হয়ে দাড়ায়। আন্তর্জাতিক আইনে এ ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আছে। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ আমাদের সীমান্তের খুব কাছে। ফলে এর থেকে সৃষ্ট সব ধরনের বিরুপ প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব, যেমন নদীগর্ভে অতিরিক্ত বালুর সঞ্চালন ও সঞ্চয়ের, হঠাৎ বন্যা, অতি বন্যা ইত্যাদির প্রভাব সম্পূর্ণটুকুই পড়বে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সম্পূর্ণ হাওড় জনপদের ওপর। আনুমানিক ১০-১৫ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলের হাওড়, বিল, ঝিল, নদী-নালা বালুতে ভরে যাবে। হাওড় অঞ্চলের অত্যন্ত উর্বরা ধানের জমি পুরু বালির নীচের স্তরে চাপা পড়বে। ধ্বংস হয়ে যাবে কৃষি। হfরিয়ে যাবে শস্য তথা বোরো, শাইল ও আমন ধানের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। হারিয়ে যাবে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যের মাছ, গাছপালা, জলজ উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম। সুরমা ও কুশিয়ারা ধ্বংস হলে মেঘনার কোন অস্তিত্বই থাকবে না। সুতরাং শুধু সিলেটের হাওড় অঞ্চলই নয় মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে মেঘনা নদী অধ্যুষিত জনপদে বসবাসরত এ দেশের প্রায় অর্ধেক জনগণ। ধস নামবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়, দেশের অর্থনীতিতে। এক্ষেত্রে ওই বাঁধটি নির্মিত হলে আমাদের পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। এজন্যই প্রয়োজন ছিল যৌথ সমীক্ষার। তবে ভারত রাজী না হওয়ায় বাংলাদেশও দায়িত্বটি নিতে পারে। সরকার স্ব-উদ্যোগে একটি সমীক্ষা চালাতে পারে। এই সমীক্ষায় বেরিয়ে আসবে পরিবেশগত কী কী সমস্যা হতে পারে বাঁধ নির্মাণ করার ফলে। বাংলাদেশ দাতাগোষ্ঠীর সহযোগিতাও নিতে পারে সমীক্ষা পরিচালনার জন্য। সমীক্ষার ওই ফলাফল নিয়ে ভারতের সাথে আলাপ আলোচনাও করা যেতে পারে। যৌথ নদী কমিশন বা জেআরসির বৈঠকের কথাও বলা হচ্ছে।
এজন্য অতীতের কোন বাংলাদেশ সরকারকেই দায়ী করা যাবে না। ভারত জেআরসির বৈঠকগুলো ব্যবহার করেছে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য। জেআরসির বৈঠকের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ থাকলেও ভারতের আগ্রক ছিল কম। আলোচনার কোন বিকল্প নেই। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে অবশ্যই ভারতের সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। সেইসাথে বিশ্ব আসরে এই সমস্যাটাকে তুলে ধরাও প্রয়োজন। কেননা পরিবেশগত সমস্যার ব্যাপারে সারাবিশ্ব আজ অত্যন্ত সচেতন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে একটি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে সেটা বলা কোন অপরাধ নয়। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত হেলসিংকি নীতিমালা, ১৯৯২ সালে প্রণীত ডাবলিন নীতিমালা, আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশন, রামসার কনভেনশন (জলাভূমি বিষয়ক), জীববৈচিত্র্য কনভেনশন, প্রতিটি আন্তর্জাতিক আইনে ভাটির দেশের অধিকার রক্ষিত। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ওই আইনে বর্ণিত অধিকার বলেই দেশটির সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারে। অতীতে ভারত যখন একতরফাভাবে গঙ্গাঁর পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল তখন বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালে আন্তর্জাতিক আসরে তার সমস্যার কথা তুলে ধরেছিল। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো গঙ্গাঁর পানি বন্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বরে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত cop 20 সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বেশ ক’টি এনজিও বেসরকারী প্রতিনিধিদল হিসেবে ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। তারাও টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়টি বিশ্ববাসীকে জানাতে পারেনি। সারা বিশ্বই আজ বড় বড় বাঁধের ব্যাপারে সোচ্চার। বাঁধ নির্মানের ফলে হাজার হাজার লোক গৃহহীন হয়, স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের শত বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়- এটা আজ আন্তর্জাতিকভাবেই ঘৃণিত একটি কাজ হিসেবে গণ্য হয়। মনিপুরে টিপাইমুখে এই বাঁধটি নির্মিত হলে ওই এলাকার বেশ কিছু গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যাবে। শত শত স্থানীয় আদিবাসী নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হবেন। আন্তর্জাতিক আইন এটা অনুমোদন করে না। ভারত আরো একটি বিষয়ে লুকোচুরির আশ্রয় নিচ্ছে। টিপাইমুখের আরো উজানে আসামের কাছার জেলার ফুলেরতাল নামক স্থানে (সেচের জন্য) ভারত একটি ব্যারেজ তৈরী করছে। এর ফরে বরাক নদী থেকে ভারত কিছু পানি প্রত্যাহার করে নেবে। এই বিষয়টি ভারত খোলাসা করছে না। টিপাইমুখ ‍নিয়ে চুক্তির কথা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও ফুলেরতাল ব্যারেজ নিয়ে কোন সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। টিপাইমুখ ‍নিয়ে মানুষের যে উৎকন্ঠা তা যে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই তা নয়। বরং ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যের মধ্যে তিনটি রাজ্যে মনিপুর, আসাম ও মিজোরামেও এই উৎকন্ঠা আমরা লক্ষ্য করেছি। ইতোমধ্যেই ভারতের এই রাজ্যগুলোর ৩০টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিয়ে গঠিত হয়েছে কমিটি অব পিপলস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (কোপ)। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের ফলে ওই অঞ্চলে যে ক্ষতি হবে, তার প্রতিবাদ করতেই তারা ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশবাদীরা এখন ‘কোপ’ এর সাথে যৌথভাবে কাজ করতে পারেন। কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যৌথভাবেও বিষয়টি উত্থাপন করা যায়। মনে রাখতে হবে ভারতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। যতদূর জানা যায়, তাতে দেখা গেছে ভারত সরকার উত্তর পূর্ব ভারতে ২২৬টি বড় বাঁধ নির্মানের সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করছে যার লক্ষ্য হবে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে ৯৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। মুখে মুখে ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা যত আশ্বাসেই দিন না কেন, ভারত অত্যন্ত কৌশলে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন আমরা জেনেছি আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে আদালতের একটি সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে ভারত কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করছে। ভারত অতীতের মতো কূটনৈতিক ভাষা প্রয়োগ করে আবারো বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করছে। ‘তারা এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়’। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে এ ধরনের আশ্বাসও আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী (মহাজোট সরকার) বেশ ক’বছর আগে একটি সেমিনারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া ভারত টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যাবো’। সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মাঝে ‘রাজনীতি’ কিংবা ‘বাস্তবতা’ কতটুকু তা ভিন্ন প্রশ্ন। এই মূহুর্তে যা দরকার তা হলো ভারতকে এইসব প্রকল্প বাতিল করতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া এবং সেইসাথে এই অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে হিমালয় অঞ্চলভূক্ত দেশ ও চীনের সমন্বয়ে একটি ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা। আর অভ্যন্তরীনভাবে যে বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পরিত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থে একটি ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করা। কেননা টিপাইমুখ বিষয়টি একটি জাতীয় ইস্যু। এর সাথে কোন দলের স্বার্থ জড়িত নয়। এখন এ প্রশ্নটি সামনে আসলো এ কারনে যে, অতিসম্প্রতি ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের বিশেষ কমিটির পঞ্চম বৈঠকে মানস-সংকোস-তিস্তা-গঙ্গাঁ সংযোগের মাধ্যমে দক্ষিণে পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে (সকালের খবর, ২৩ জুলাই)। ভারতের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আনোয়ার লাল জাতের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়া আমাদের জানিয়েছে যে ভারত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট তিনটি রাজ্য আসাম, পশ্চিতবঙ্গ ও বিহারের সাথে শীঘ্রই আলোচনায় বসবে (যুগান্তর, ১৬ জুলাই)। এর অর্থ কি? এর অর্থ পরিস্কার- ভারত মুখে এক কথা বললেও তারা তাদের ‘কমিটমেন্ট’ থেকে এখন সরে আসছে। বাংলাদেশ সরকারকে এ ব্যাপারে অতি দ্রুত ভারতের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। ইতোমধ্যে আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার একটা ‘নোট ভারবাল’ পাঠিয়েছে। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের স্বার্থেই আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প ও টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে ভারতের কাছ থেকে একটা স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। Prio.com 30.07.15

রাজনীতিতে সহাবস্থান প্রয়োজন

প্রধানমন্ত্রী, অনেক মন্ত্রী এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক কোনো কোনো মন্তব্য আগামী দিনের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। কয়েকটি প্রশ্ন ঘিরে এখন রাজনীতি আবর্তিত হবে। এক. বিশেষ ট্রাইব্যুনালে খালেদা জিয়ার বিচারের সম্ভাবনা, দুই. বিএনপির ভেঙে যাওয়া এবং বিকল্প বিএনপির আবির্ভাবের সম্ভাবনা, তিন. কিছু স্ট্র্যাটেজি সামনে রেখে সরকারের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঘোষণা, চার. চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে জিয়ার এবং সংসদ এলাকা থেকে একাধিক রাজনৈতিক নেতার কবর সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ, পাঁচ. দাতাগোষ্ঠী মধ্যবর্তী নির্বাচনের পক্ষে। উল্লিখিত প্রতিটি ইস্যুতে আগামীতে রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়বে এবং এতে করে আবারও দেশের স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে এটা একটা বড় প্রশ্ন- এখন সরকার কি সত্যি সত্যিই বিশেষ ট্র্যাইব্যুনাল গঠন করে খালেদা জিয়ার বিচারের উদ্যোগ নেবে? প্রধানমন্ত্রী যখন সংসদে এ ধরনের একটি মন্তব্য করেন, তখন বিষয়টাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এমনকি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু যখন বলেন, খালেদা জিয়ার বিচারে ঈদের পরই ট্র্যাইব্যুনাল (যুগান্তর, ১২ জুলাই), তখন বিষয়টাকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই। যদিও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এ বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। জনাব ইনুর বক্তব্যের দুটি দিক আছে। একটি রাজনৈতিক, অপরটি বাস্তবতা। রাজনীতিকরা অনেক কথাই বলেন। জনাব ইনু যে সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই রাজনৈতিক দলের অতীত ভূমিকা, বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন(?), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের ঘটনা জাসদকে বিতর্কিত করলেও দলটি তার অতীত ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে এমন তথ্য আমার জানা নেই। তবে হঠকারি কোনো সিদ্ধান্ত যে দলের ও জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না, বাংলাদেশের রাজনীতি সে কথাই প্রমাণ করে। সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠন করতেই পারে। সেই সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সরকারের আছে। বিগত তিন মাসের আন্দোলন, বাসে বোমা মেরে ১৫৮ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু- এসব ঘটনার দায়ভার বিএনপি এড়াতে পারে না। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে এসব বোমাবাজি ও হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করা হয়েছে এবং তাদের পক্ষ থেকে একটি আন্তর্জাতিক তদন্তেরও আহ্বান করা হয়েছে। সরকার অবশ্য তাতে সায় দেয়নি। দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার জন্য আইনানুযায়ী সরকার ট্র্যাইব্যুনাল গঠন করতে পারে। কিন্তু এতে করে কি রাজনৈতিক সহাবস্থান বিঘ্নিত হবে না?বিগত ৩ মাসের অরাজক পরিস্থিতির পর মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। মানুষ এখন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারছে। অর্থনীতিতেও আবার চাঞ্চল্য এসেছে। বিএনপির ভেতরেও একটা উপলব্ধি এসেছে যে, এভাবে আন্দোলন করা যায় না। বিগত তিন মাসের আন্দোলন থেকে নিশ্চয়ই বিএনপি কিছু শিখেছে। এই উপলব্ধি ভবিষ্যৎ আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে নিশ্চয়ই বিএনপিকে কর্মপন্থা গ্রহণে উৎসাহ জোগাবে। ট্রাইব্যুনালের ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্কে ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে। এটি দুদলকে আবারও পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে ঠেলে দিতে পারে। বিচার শুরু হওয়ার আগেই মন্ত্রীরা যদি খালেদা জিয়াকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানোর কথা বলেন, তাহলে সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ বাড়বেই। গাড়ি পোড়ানো আর মানুষ হত্যার বিচার হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত করলে ভালো হয়। কারণ অভিযোগ আছে, এসব ঘটনার সঙ্গে অন্য কোনো শক্তি জড়িত!জিয়ার মাজার সরিয়ে নেয়ার কথাও উঠেছে। এত বছর পর মাজার সরিয়ে নেয়ার প্রশ্ন তোলা নিঃসন্দেহে বিতর্কের মাত্রা বাড়াবে। আমরা বারবার বলে আসছি, জাতীয় নেতাদের সম্পর্কে কটূক্তি না করা এবং তাদের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার মধ্য দিয়েই জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করা সম্ভব। এ মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যটা আরও জরুরি এ কারণে যে, আমরা নিু-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা এবং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে জাতীয় ঐকমত্য জরুরি। আমরা বিগত তিন মাসের কালো অধ্যায়কে ভুলে যেতে চাই। এগোতে চাই সামনের দিকে। তাই জিয়ার মাজারের ব্যাপারে স্ট্যাটাস কো বজায় রাখাটা জরুরি। তবে সংসদ এলাকায় সাতজন রাজনীতিকের কবর নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সংসদীয় এলাকায় এ ধরনের কবর থাকা যৌক্তিক নয়। প্রকাশ্য স্থানে তথাকথিত একটা কবরস্থান প্রতিষ্ঠা করে সংসদ এলাকার সৌন্দর্যই শুধু নষ্ট করা হয়নি, বরং একটা বাজে দৃষ্টান্তও স্থাপন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কোনো কোনো জাতীয় নেতাকে এই তথাকথিত জাতীয় কবরস্থানে সমাহিত করার দাবি উঠতে পারে। ফলে এখনই এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। তবে অবশ্যই শহীদ জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমি এদের মেলাতে চাই না। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানের কারণেই তাকে যথাযথ সম্মান দেয়া প্রয়োজন। এর মাঝে কোনো রাজনীতি থাকা উচিত নয়।বিএনপি ভেঙে যেতে পারে কিংবা কোনো কোনো মহলের উদ্যোগে বিকল্প একটি বিএনপি গঠিত হতে পারে, এমন কথা এখন প্রায়ই উচ্চারিত হচ্ছে। এমনকি বিএনপির স্থায়ী পরিষদের দু-একজন সদস্যের টেলিফোন কথোপকথন ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনায় এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়েছে যে, বিএনপির ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে অমূলক নয়। পর্দার অন্তরালে এ ব্যাপারে সরকারের যে কোনো ভূমিকা নেই তাও শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যাবে না। সম্প্রতি তিনজন সিনিয়র মন্ত্রীর বক্তব্যও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি ভাঙার ব্যাপারে সরকারের কোনো গরজ নেই। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রশ্ন রেখেছেন, সরকার কেন বিএনপিকে ভাঙতে যাবে? অন্যদিকে সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, এ ব্যাপারে তিনি জ্ঞাত নন। এ ধরনের মন্তব্য আমাকে ওই কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয়- ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না।বিএনপি ভেঙে যাবে কি-না, কিংবা বিএনপি আগামীতে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি-না, এটা বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু সরকারি দলের সিনিয়র নেতারা যখন এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন সন্দেহের সৃষ্টি হয় বৈকি! তবে এখানে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বিএনপি ভাঙা কোনো সমাধান নয়। একটি শক্তিশালী বিএনপি সরকার তথা গণতন্ত্রের জন্যও মঙ্গলজনক। বাংলাদেশে একদলীয় গণতন্ত্র নয়, বরং দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিই জনগণের মঙ্গল বয়ে আনতে পারে। অতীতে যারা বিএনপি ভেঙে আলাদা অবস্থান নিয়েছেন, তারা কেউই সফল হননি। ওবায়দুর রহমানের মতো সংগঠকও শেষ বেলায় আবার বিএনপিতে ফিরে এসেছিলেন। খালেদা জিয়া বাদে কেউই বিএনপির জন্য অপরিহার্য নন। জিয়া আর খালেদা জিয়াকে ঘিরেই বিএনপির রাজনীতি। ফলে বিএনপির স্থায়ী পরিষদের কোনো সদস্যকে ঘিরে বিএনপি ভাঙার প্রক্রিয়া যদি শুরু হয়, তা আদৌ কোনো ফল দেবে না। বরং তারা ইতিহাসে এক একজন মান্নান ভূঁইয়া হিসেবে পরিচিতি পাবেন। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে খালেদা জিয়াকে এখন দল গোছাতে হবে। স্থায়ী পরিষদে পরিবর্তন আনাও জরুরি। বিগত আন্দোলনে যারা পরীক্ষিত, তাদের স্থায়ী পরিষদে অন্তর্ভুক্তি করা প্রয়োজন। আমি অনেক স্থায়ী পরিষদের সদস্যকে চিনি, যাদের একদিনের জন্যও মাঠে দেখিনি। বয়সের ভারে তাদের অনেকেই ক্লান্ত। সংকটের সময় তারা খালেদা জিয়াকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এদের স্থায়ী পরিষদে রাখার কোনো যুক্তি নেই। বিগত আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছি, বেশ কজন বুদ্ধিজীবী বিএনপির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের কাউকে কাউকে স্থায়ী পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা অথবা তাদের দিয়ে একটি থিংক ট্যাঙ্ক গঠনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বয়োজ্যেষ্ঠ স্থায়ী পরিষদের সদস্যদের উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো যেতে পারে।বিএনপির একটি কাউন্সিল আয়োজন করাও জরুরি। কাউন্সিলে দল পুনর্গঠন এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই চলমান রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যারা কাজ করেন, যারা গবেষণা করেন, তারা জানেন বিএনপি এ দেশের জনগণের একটা বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। সংসদীয় রাজনীতিতে বিএনপি একটি ফ্যাক্টর। সংসদে বিএনপি না থাকলে যে সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়ে, বর্তমান সংসদ এর বড় প্রমাণ। সংসদে বিরোধী দলের জায়গায় জাতীয় পার্টিকে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে নেয়নি। জাতীয় ইস্যুতে সংসদে জাতীয় পার্টিরও কোনো ভূমিকা নেই। ভারতের সঙ্গে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো নিয়ে সংসদে আলোচনা হওয়া উচিত ছিল (সংবিধানের ১৪৫(ক) ধারামতে, বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন)। কিন্তু তা হয়নি। ফলে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করছি। যদিও এটা সত্য, সংসদ বয়কটের রাজনীতি সংসদীয় রাজনীতিকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেনি। এর দায়ভার বিএনপির ওপর যেমন, তেমনি আওয়ামী লীগের ওপরও বর্তায়।একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের খবর এখন অনেক মহল থেকেই আলোচিত হচ্ছে। সংবাদপত্রেও এমন আভাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার বিবেচনায় বেশকিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে এই মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা। এক. বিএনপি আদৌ ওই নির্বাচনে অংশ নেবে কি-না? সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না নিশ্চিত হবে যে, বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সরকার এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। কারণ বিএনপির অবস্থান এখনও একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। বিএনপি মনে করে, নিরপেক্ষ সরকার না হলে নয়া নির্বাচনে (একাদশ সংসদ) ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেরই প্রতিফলন ঘটবে। সুতরাং সরকার অপেক্ষা করবে বিএনপির সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য। দুই. সরকার তখনই নির্বাচন দেবে, যখন বিএনপির একটা অংশ (বিকল্প বিএনপি, তৃণমূল বিএনপি) মূলধারা থেকে বেরিয়ে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগ্রহ দেখাবে। তবে এ প্রক্রিয়ায় বিএনপির সিনিয়র নেতারা না থাকলে তা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তিন. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চেয়ে ভারতের ভূমিকা এখানে মুখ্য। ভারত এ মুহূর্তে একটি নয়া নির্বাচন নাও চাইতে পারে। বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারতের নীতিনির্ধারকদের সম্পর্ক ভালো। ভারতের নীতিনির্ধারকরা চাইবে না এই সম্পর্ক নষ্ট হোক। তবে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ভারতের নীতিনির্ধারকরা সম্পর্ক রাখছেন। এ ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে যত কথাই বলা হোক, বাস্তবতা বলে ২০১৮ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমরা সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন চাই বটে; কিন্তু তা নির্ভর করছে একদিকে যেমন বিএনপির ওপর, অন্যদিকে তেমনি সরকারের আচরণের ওপরও। তবে আমি নিশ্চিত নই সরকার আদৌ বিএনপির মূলধারাকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে যেতে চায় কি-না।বিএনপির পক্ষ থেকে একটি পজিটিভ অ্যাটিটিউড লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সৈয়দ আশরাফের একটি বক্তব্যকে, যেখানে তিনি প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখার কথা বলেছেন, স্বাগত ও সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি। ভারত অতিসম্প্রতি আন্তঃনদী সংযোগ বাস্তবায়ন করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সে ব্যাপারে সরকার তার দৃঢ় অবস্থানের কথা জানিয়েছে। বিএনপি এই ইস্যুতে সরকারকে সমর্থন করেছে। এটা জাতীয় ইস্যু। জাতীয় ইস্যুতে সরকারকে সমর্থন করছে বিএনপি। গত ২৫ জুলাই বিএনপির মুখপাত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। ড. আসাদুজ্জামান রিপন এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাভাবিক রাজনীতি করার গ্যারান্টি চেয়েছেন। এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। এমনকি খালেদা জিয়া গত ২৫ জুলাই যে মন্তব্যটি করেছেন, তাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতে হবে এমন কোনো মানে নেই, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে। বিএনপির থিংক-ট্যাঙ্ক প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, চার শর্ত পূরণ হলে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে। শর্তগুলো হল- নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে জড়িত আইনশৃংখলা বাহিনীসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হতে হবে নিরপেক্ষ। মেয়াদ শেষে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকারে বর্তমান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে স্বপদে রেখেই একটি সরকার গঠিত হবে। এগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সরকার ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারে।রাজনীতিতে সহাবস্থান প্রয়োজন। সহাবস্থানের স্বার্থে বিএনপিকে স্বাভাবিক রাজনীতি করার অধিকার দিতে হবে। বিএনপি যদি স্বাভাবিক রাজনীতি করার সুযোগ না পায়, তাহলে রাজনীতিতে অস্থিরতা থাকবেই। এ অস্থিরতা আমাদের অর্থনীতির জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। দেশে অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশকে নিু-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে এলডিসির খেতাব মুছে ফেলতে হবে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি এ ব্যাপারে ২০১৮ সালেই সিদ্ধান্ত নেবে। আর ২০২৪ সালে জাতিসংঘের কাছ থেকে স্বীকৃতি মিলবে উন্নয়নশীল দেশের। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে বাংলাদেশ তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। তাই বিএনপির সঙ্গে যে কোনো পর্যায়ে একটি সংলাপ প্রয়োজন। খালেদা জিয়ার সর্বশেষ বক্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে এ সংলাপ শুরু করা যেতে পারে। Daily Jugantor ৩০ জুলাই, ২০১৫

সিপ্রাস কি টিকে গেলেন?

শেষ পর্যন্ত গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী আলেকসিস সিপ্রাস কি টিকে গেলেন? প্রথমে আইএমএফের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা ও দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, পরে গণভোটে দাতাগোষ্ঠীর ‘প্রস্তাব’ প্রত্যাখ্যান এবং শেষ পর্যন্ত ইউরো জোনকে বাঁচাতে দাতাগোষ্ঠীর পুনরায় ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্তে আপাতত মনে হয়েছে সিপ্রাসের হাত শক্তিশালী হয়েছে এবং সরকার টিকে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই বলে? গত এক সপ্তাহে আমরা দুটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছি। এক. গ্রিসের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে (বেইল আউট) তৃতীয় কিস্তির ঋণ ছাড় দেয়ার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতাদের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে আইএমএফ। আইএমএফ বলেছে ‘গ্রিসের সাধারণ ঋণ দেশটিকে খুবই অস্থিতিশীল করে তুলেছে।’ আইএমএফের মতে, দেশটির ঋণের দায় থেকে মুক্তি প্রয়োজন। গ্রিসকে দেয়া ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনারও পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। আইএমএফ জানিয়ে দিয়েছে জার্মানি ও এর মিত্ররা যদি গ্রিসের ঋণের পরিমাণ না কমায়, তাহলে দেশটিকে পরবর্তী কোনো ধরনের ঋণ ছাড়ের ব্যাপারে অংশ নেবে না তারা। গ্রিসের মোট ঋণের ১০ শতাংশ আইএমএফ সরবরাহ করেছে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন গত ৩০ জুন গ্রিসকে দেয়া আইএমএফের ঋণ পরিশোধের দ্বিতীয় ডেড লাইনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু গ্রিস ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। ১৬০ কোটি ইউরো পরিশোধ করতে না পারায় গ্রিস দেউলিয়া হয়ে যায়। আমি এর আগে এনটিভি অনলাইনে লেখা এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম দাতাগোষ্ঠী তাদের স্বার্থেই গ্রিসকে আবারো ঋণ দেবে। শেষ পর্যন্ত আমার কথাই সত্য প্রমাণিত হলো। ইউরো জোনের নেতারা গ্রিসকে ইউরো জোনে রাখার স্বার্থে আবারো ৮৬০০ কোটি ইউরো ঋণ দিয়েছে। তবে এখানেও শর্ত আছে। শেষ অবধি গ্রিসের পার্লামেন্ট ওই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। দুই. ইউরো জোনের এই নয়া ঋণ প্রস্তাব নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাসের সিরিজা পার্টির মাঝে বড় ধরনের বিতর্কের জš§ হয়েছে। বেশ কয়েক মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সিরিজা পার্টির মধ্যে বড় ধরনের ‘বিদ্রোহ’ সংঘটিত হয়েছে। দলের কট্টরপন্থিরা সিপ্রাসের এই সমঝোতার সমালোচনা করে পার্লামেন্টের ভোটাভুটিতে সিপ্রাসবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। দল এখন ভেঙে যাওয়ার মুখে। এমনকি সরকারের কোয়ালিশন পার্টনার ইন্ডিপেন্ডেট গ্রিক পার্টিও এই সমঝোতার বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। ফলে সিপ্রাস এক বড় ধরনের সংকটের মাঝে আছেন। তিনি আগামী সপ্তাহেই মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করবেন এবং আভাস দিয়েছেন আগামী সেপ্টেম্বর তিনি নয়া নির্বাচন দিয়ে পুনরায় জনগণের ম্যান্ডেট নেবেন। এখানে বলা ভালো গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে গেল জানুয়ারি মাসে (২০১৫) সেখানে যে নির্বাচন হয় এই নির্বাচনে বামপন্থি সিরিজা পার্টি বিজয়ী হয়ে সিপ্রাসের নেতৃত্বে সেখানে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে গ্রিক কি তার অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে আদৌ বের হয়ে আসতে পারবে? কতগুলো পরিসংখ্যান দিলেই বোঝা যাবে সংস্কার আনতে গিয়ে গ্রিসের অর্থনীতিতে কি পরিমাণ ধস নেমেছে। ২০১০ সালের পর ২৯ লাখ লোকের পেনশনের পরিমাণ শতকরা ৪৫ ভাগ কমানো হয়েছে। এটা করা হয়েছে আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী। গ্রিসের মোট ঋণের পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে ৩২০ বিলিয়ন ডলারে, যা কিনা জিডিপির শতকরা ১৮০ ভাগ। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির মাত্র ৬০ ভাগ। অর্থাৎ কৃচ্ছ তা অবলম্বন করেও গ্রিস ঋণের পরিমাণ কমাতে পারেনি। আইএমএফের পরামর্শ অনুসরণ করে দেশটির জিডিপির পরিমাণ কমেছে, বাড়েনি। পরিসংখ্যান বলছে ২০০৮ সালে গ্রিসের জিডিপির পরিমাণ যেখানে ছিল ৩৫৪ মিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ২৪২ বিলিয়ন ডলারে। এই পরিসংখ্যান বিশ্বব্যাংকের। গত ৫ বছরে, অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংকট ও আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী চলার প্রায় কাছাকাছি সময় থেকে গ্রিসে ১০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছে। এই মুহূর্তে কর্মক্ষম গ্রিকবাসীর প্রতি ৪ জনের মাঝে একজন বেকার। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে প্রায় ২ লাখ গ্রিক নাগরিক দেশ ত্যাগ করেছেন, যাদের অনেকেই দেশে ইঞ্জিনিয়ার অথবা ডাক্তার এবং আইটি সেক্টরে কাজ করতেন। সেদিন বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখলাম মেলবোর্নে প্রায় ৪ লাখ গ্রিক নাগরিক বসবাস করেন। একজন গ্রিক ব্যাংকারের সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়েছিল, যিনি মেলবোর্নে (অস্ট্রেলিয়া) এখন একটি গ্রিক ক্যাফেতে সাধারণ কাজ করেন। মাত্র ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটিতে ১০ লাখ মানুষের কোনো স্বাস্থ্য ইন্স্যুরেন্স নেই। যেখানে ইউরো জোনে বেকারের গড় হিসাব হচ্ছে জনসংখ্যার ১১ দশমিক ১ ভাগ, সেখানে গ্রিসে এই সংখ্যা ২৫ দশমিক ৬ ভাগ। অথচ ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ৭ দশমিক ৮ ভাগ। গত ৫ বছর থেকেই গ্রিক আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী অর্থনীতিতে কৃচ্ছ তা সাধন করে আসছে। বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, অথবা সেখানে কাটছাঁট করা হয়েছে। বর্তমানে বেতন কমানো হয়েছে শতকরা ২০ ভাগ হারে। সরকারি সেক্টরে বেতন বৃদ্ধি ‘ফ্রিজ’ করে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস চেয়েছিলেন ন্যূনতম বেতন ৭৫০ ইউরোতে (৮৩৫ ডলার) উন্নীত করতে। কিন্তু আইএমএফের চাপে তিনি পারেননি। গ্রিকবাসীর মাঝে শতকরা ২০ ভাগ মানুষের বয়স ৬৫ বছর বয়সের ওপরে। ওই বুড়ো মানুষগুলোর পেনশন কমানো হয়েছে প্রায় ৪৮ ভাগ হারে। কিন্তু তাতে করে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি করা যায়নি। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার কল্যাণে বাংলাদেশে মানুষ দেখেছে গ্রিসে ‘হোমলেস’ অথবা গৃহহীন মানুষের সংখ্যা কিভাবে বাড়ছে। এই সংখ্যা এখন মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ২৫ ভাগ। চিন্তা করা যায় গ্রিসের মতো একটি উন্নত দেশে শতকরা ২৫ ভাগ মানুষের থাকার কোনো জায়গা নেই।
গ্রিসের পরিস্থিতিকে অনেকে ২০০১ সালের আর্জেন্টিনার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেন। আর্জেন্টিনা ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে ঋণ দাতারা তাদের স্বার্থেই আবার আর্জেন্টিনাকে ঋণ দিয়েছিল। আজকে গ্রিসের পরিস্থিতিকে জিম্বাবুয়ে ও সোমালিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এই দেশ দুটি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। মূলত বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ কাঠামোগত সামঞ্জস্য বা ঝঃৎঁপঃঁৎধষ অফলঁংঃসবহঃ-এর আওতায় এই ঋণ দিয়ে থাকে। এই ধরনের ঋণের সঙ্গে কড়া শর্ত জড়িত থাকে এবং এটা এক ধরনের সুপরিকল্পনা, যা ঋণ গ্রহীতা দেশকে অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই সুপারিশমালা অনুসরণ করে ঋণ গ্রহীতা দেশ তাদের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পেরেছে। কাঠামোগত সামঞ্জস্যে যেসব সুপারিশ থাকে তার মাঝে রয়েছে, গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা, সরকারি ব্যয় হ্রাস করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষি খাতে ভর্তুকি হ্রাস করা, প্রকৃত মজুরি হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, দাম নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারিকরণ, উঁচু কর ও সুদের হার বাড়ানো, আমদানি অবাধ করা, মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এসব সুপারিশমালা গ্রিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গ্রিসের বামপন্থি সরকার আইএমএফ কর্তৃক দেয়া এসব সুপারিশমালার অনেকগুলো গ্রহণ করেও সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তেমন উন্নতি করতে পারেনি। বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো এবং সমাজতন্ত্র পরবর্তী পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো (১৯৯১ পরবর্তী) এই কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় আমলেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আর আগের জায়গায় ফিরে যায়নি। পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ, যারা এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র ছিল, তারা পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিলেও এখন পর্যন্ত তারা ইউরো জোনে যোগ দিতে পারেনি। ফলে স্পষ্টতই ইউরোপ এখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। জার্মান ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে ধনী ইউরোপ, অন্যদিকে গ্রিস, পর্তুগাল কিংবা স্পেনের মতো গরিব ইউরোপ। পূর্ব ইউরোপের কথা না হয় নাই বা বললাম। সমস্যাটা এখানেই।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট যখন শুরু হয়, তখন থেকেই মোট তিন দফায় বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেও গ্রিস তার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারছে না। আইএমএফ তথা ‘ট্রয়কা’র ‘প্রেসক্রিপশন’ অনুযায়ী বারেবারে বাজেট কাট, পেনশন কাট, সামাজিক খাতে ব্যয় হ্রাস করেও কোনো পজিটিভ ফল পাচ্ছে না গ্রিসের জনগণ। ফলে সেখানে ‘ট্রয়কা’ (আইএমএফ, ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) বিরোধী একটি শক্তিশালী জনমত রয়েছে। সর্বশেষ যে ঋণ সিপ্রাস সরকার গ্রহণ করেছে, সেখানে যেমন শর্ত রয়েছে, তার মাঝে রয়েছে পেনশনের পরিমাণ আরো হ্রাস, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেসরকারিকরণ। কিন্তু এতে করে পরিস্থিতির উন্নতি হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তাই ইউরো জোনের মাঝে (১৯ সদস্য দেশ) গ্রিসকে ইউরো জোন থেকে বের করে দেয়ার দাবি শক্তিশালী হচ্ছে। জার্মানি ইউরো জোনের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। জার্মানির অর্থমন্ত্রী শোয়েবলে এবং বিরোধী ‘দি লিংকে’ দলের সভাপতি অস্কার ল্যাফোনটেন প্রকাশ্যেই বলেছেন ইউরো জোন থেকে গ্রিসের বিদায়ই একমাত্র সমাধান। কিন্তু চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল আবার গ্রিসকে ইউরো জোনে রাখার পক্ষে। আর তাকে সমর্থন করছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলান্দ। তাদের যুক্তি গ্রিস ইউরো জোনে থাকলেই ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ টিকে থাকবে। গ্রিস যদি ইউরো জোন থেকে বের হয়ে যায়, তাতে লাভবান হবে রাশিয়া। এমনকি ন্যাটোর ঐক্যও ঝুঁকির মুখে থাকবে। তাই গ্রিস নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। আপাতত গ্রিস ব্যাংকগুলো খুলেছে, অর্থনীতির কর্মকাণ্ড বাড়ছে। কিন্তু গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধান হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। Daily Manobkontho 29.07.15

আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ও ভারতের প্রতিশ্রুতি

একটি উদ্বেগের খবর গত ১৬ জুলাই বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে ওই সংবাদে বলা হয়েছে, ভারতে নদী সংযোগের বিতর্কিত পরিকল্পনার আওতায় এবারে মানস-সংকোস-তিস্তা-গঙ্গাকে যুক্ত করার প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাবে বলে ঘোষণা করেছে সে দেশের সরকার। বিবিসির বাংলার ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ প্রকল্পের জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্য আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের সঙ্গে তারা শিগগিরই আলোচনায় বসবে (যুগান্তর, ১৬ জুলাই)। এ ধরনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের অন্যতম একটি কারণ। বাংলাদেশ সেই উদ্বেগটিই প্রকাশ করেছে ভারতকে একটি ‘নোট ভারবাল’ পাঠিয়ে। ওই নোট ভারবালে বাংলাদেশের ভয়াবহ ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিশেষ কমিটির পঞ্চম বৈঠকে মানস-সংকোস-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগের মাধ্যমে দক্ষিণে পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে (জাতীয় দৈনিক, ২৩ জুলাই)। শুধু সরকারের পক্ষ থেকে নয়, বরং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ইস্যুতে (ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প) সরকারকে বিএনপি সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত। আন্তঃনদী সংযোগ ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে দেনদরবারে বিএনপি সরকারকে ‘সøাইড সাপোর্ট’ দেবে বলেও বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ধারণা করছি, বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনও এই ইস্যুতে সরকারের পাশে থাকবে। তবে বিষয়টি ভারত সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত কি না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। যদিও ভারতের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আনোয়ার লাল জাতের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে সংবাদটি প্রচারিত হয়েছে, তারপরও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাখ্যা এতে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ সরকারের উচিত অতিদ্রুত বিষয়টির ব্যাপারে ভারত সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া। সাধারণত নোট ভারবাল একটি রুটিন ওয়ার্ক। এটা কোনো প্রতিবাদ নয়। ভারত যদি সত্যি সত্যিই এই প্রকল্পটি কার্যকর করে, তাহলে তা হবে মোদির ঢাকা সফরের সময় যে ৬৫ দফা যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার বরখেলাপ। কেননা ৬৫ দফাসংবলিত যৌথ ঘোষণাপত্রের ২১নং দফায় বলা হয়েছে, ‘হিমালয় অঞ্চলের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে না নেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।’ এখন ভারতের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আনোয়ার লাল জাতের বক্তব্য কিংবা ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিশেষ কমিটির পঞ্চম বৈঠকের সিদ্ধান্তটি কি যৌথ ঘোষণার ২১নং দফার পরিপন্থী নয়? তাই বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এখানে বলা ভালো, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি মূলত আজকের নয়। এই প্রকল্প নিয়ে খোদ ভারতেই বিতর্ক রয়েছে। এই বিশাল নদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে ভারতের অভ্যন্তরে ৩৭টি নদীকে ৯ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি খালের মাধ্যমে সংযোগ প্রদান করে ১৫০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করার জন্য। প্রকল্পটির মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গায়। সেখান থেকে তা নিয়ে যাওয়া হবে মহানন্দা ও কাবেরীতে। গোদাবরির পানি নিয়ে যাওয়া হবে কৃষ্ণায় এবং সেখান থেকে পেনার ও কাবেরীতে। নর্মদার পানি নিয়ে যাওয়া হবে সবরমতিতে। এই বিশাল আন্তঃঅববাহিকা পানি প্রত্যাহার প্রকল্প সম্পন্ন করা হবে ২০১৬ সালের মধ্যে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকারকে এ প্রকল্প একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার পরামর্শ প্রদান করেছেন (আগে নির্ধারিত ৪৫ বছরের পরিবর্তে ১০ বছরের মধ্যে)। কিন্তু ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এই সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন যে, গঙ্গা-কাবেরী সংযোগ প্রকল্প কোনো নতুন ধারণা নয়। এ প্রকল্প কৌশলগতভাবে অগ্রহণযোগ্য ও অবাস্তব হওয়ার আগেই বেশ কয়েকবার পরিত্যক্ত হয়েছিল। এ কাজের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, ভারত সরকারের এই প্রকল্প তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর জন্য কী ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। একই সঙ্গে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য আন্তর্জাতিক আইনের স্বীকৃত সব রীতিনীতির প্রতি নিদারুণ উদাসীনতা প্রদর্শন করা হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থার ভয়াবহ প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। এ প্রকল্পে বাংলাদেশের যেসব ক্ষতি হতে পারে তা নিম্নবর্ণিতভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ১. বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বর্তমানে পাওয়া প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের যে পানি পাওয়ার কথা, তা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে। ২. বাংলাদেশের মিঠা পানির শতকরা ৮৫ ভাগের উৎস হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা। ব্রহ্মপুত্র থেকেই শতকরা ৬৫ ভাগ পানি পায় বাংলাদেশ। এখন এই পানি প্রাপ্তি বিঘিœত হতে পারে। ৩. ভারতের পানি প্রত্যাহারের ফলে ভূ-উপরিস্থ পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে আর্সেনিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। ৪. মিঠা পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় মৎস্য উৎপাদন কমে যাবে এবং জল পরিবহন ব্যাহত হবে। ৫. পানির অভাবে কৃষি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ৬. দূষিত নদীগুলোর পানি অন্যান্য নদীকেও ধূষিত করবে। ৭. গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। ৮. লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশের এই যে পরিবেশগত সমস্যা, সে ব্যাপারে অবগত নন, তা নয়। এটা জেনেও ভারতের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি ধারণাগত পর্যায়ে রয়েছে। ভারত এই প্রকল্পের ব্যাপারে সিরিয়াস। তারা ধীরে ধীরে এই প্রকল্পটি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যই তা প্রমাণ করে। তবে এখানে একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, ভারতের বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ এবং পরিবেশবাদীরা এই প্রকল্পের বিরোধী। প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার ২০০৫ সালে নর্মদা বাঁধের বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, নর্মদা বাঁধের চেয়েও আরও বেশি বিপর্যয় অপেক্ষা করছে নদী সংযোগ প্রকল্পে (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় লিখিত প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ নয়া দিগন্ত ৩ মে, ২০০৫)। কুলদীপ নায়ার ওই প্রবন্ধে সুপ্রিম কোর্টের অপর একটি রায়ের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, ‘ছিন্নমূল জনগণকে সম্পূর্ণভাবে পুনর্বাসিত করার আগ পর্যন্ত কোনো অঞ্চলকে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে প্লাবিত করা যাবে না। সুতরাং সংগত কারণেই প্রশ্ন এসে যায়, নদী সংযোগ প্রকল্পের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাদের কী হবে? ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের অন্য একটি রায় অনুযায়ী এ ধরনের প্রকল্প তো অবৈধ।’ কুলদীপ নায়ারের এই মন্তব্যকে তো হালকাভাবে নেওয়া যায় না। ভারতের খরা এলাকার জন্য পানি দরকার। কিন্তু এক নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে খালের মাধ্যমে অন্য এলাকায় (দক্ষিণে) নিয়ে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। ভারতের ভাকরা বাঁধ নিয়ে একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছিল, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা প্রদেশের জন্য ভাকরা থেকে পাওয়া পানি নয়, বরং ভূগর্ভস্থ পানি ও উন্নত কৃষিব্যবস্থা বেশি জরুরি। পাঞ্জাবের মোট ২০ শতাংশ এবং হরিয়ানার ৩১ শতাংশ চাষযোগ্য জমি বাঁধনিয়ন্ত্রিত। এমনকি ৫০ বছর পর আজও সেখানকার বাস্তুহারা মানুষ কঠোর সংগ্রাম করে যাচ্ছে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য। ওই গবেষণার ফলাফলই বলে দিচ্ছে, নর্মদা বাঁধের উচ্চতা না বাড়িয়ে কীভাবে আরও বেশি পানি ও বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে মাথা ঘামানো দরকার। নর্মদা বাঁধসংলগ্ন অঞ্চলের বাস্তুহারা ৫০ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র, যখন কি না ওইসব রাজ্যে বাড়তি কোনো জমি নেই তাদের পুনর্বাসনের জন্য? তিহরি বাঁধের শিকার হয়েছে যারা, তারাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার। কেননা না ইউপি, না কেন্দ্র সরকার কোনোরূপ সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল তাদের সাহায্যার্থে। এখন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প যে শুধু বাংলাদেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা নয়। বরং খোদ ভারতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ভারতের নীতিনির্ধারকরা এটা বিবেচনায় নিচ্ছেন না। এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি অবৈধ। আন্তর্জাতিক আইন বিশারদ অধ্যাপক ওপেনহেইম বলেছেন, কোনো রাষ্ট্রকে নিজ ভূখ-ের প্রাকৃতিক অবস্থা এমনভাবে পরিবর্তন করতে দেওয়া যাবে না, যার ফলে তা প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের ভূখ-ের প্রাকৃতিক অবস্থার কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে। এ আলোকেই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি অবৈধ। যখন কোনো রাষ্ট্র একটি অভিন্ন সম্পত্তির উন্নতি, পরিবর্তন বা ধ্বংস সাধনের জন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে, তখন ওই রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কিছু নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়। আন্তর্জাতিক আইন আরও বেশি সুনির্দিষ্ট যখন তা আন্তর্জাতিক নদী সম্পর্কিত হয়। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের সব ক’টি নদীই আন্তর্জাতিক নদী। তাই এসব নদীর একতরফা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেআইনি এবং অগ্রহণযোগ্য। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। তা অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি না করেই হতে হবে। কিন্তু ভারতের এ উদ্যোগে একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে, ভারত বাংলাদেশের ওপর এ প্রকল্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষা করছে। হেলসিংকি নীতিমালার অনুচ্ছেদ ২৯-এ বলা হয়েছে, এক অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অপর অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্রকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক নিষ্কাশন অববাহিকার পানি ব্যবহারের ব্যাপারে কৃত পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করবে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার (আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত) ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত একটি অস্বচ্ছ ও স্বেচ্ছাচারমূলক পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জলপ্রবাহ কনভেশনটি গ্রহণ করা হয়। এই কনভেনশনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কনভেনশনের ৬ অনুচ্ছেদে যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহার নির্দিষ্টকরণে কতগুলো শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহার নির্ধারণে এ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সব ক’টি শর্তকে একই সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বিবদমান দেশগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। জলপ্রবাহ কনভেনশনে উল্লিখিত নীতিমালাগুলোর আলোকে ভারতে প্রস্তাবিত নদী সংযোগ প্রকল্পকে বিচার করলে দেখা যাবে, ভারত সুস্পষ্টভাবে কনভেনশনে বিধিবদ্ধ প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন করছে। এমনকি জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ অনুসারে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো পরস্পর পরামর্শ করবে। একই সঙ্গে জলাভূমির এবং সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর সংরক্ষণের স্বার্থে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়ন করবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোকে ধ্বংস করার নামান্তর, যা কি না রামসার কনভেনশনের সুস্পষ্ট লংঘন। আমরা ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করতে পারি। যেখানে ওই অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘উভয় পক্ষ সমতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং পারস্পরিক ক্ষতি না করার নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে’, সেখানে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করা হলে তা হবে ওই চুক্তির বাধ্যবাধকতা ও অঙ্গীকারের চরম লংঘন। তাই ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প কার্যকর করার সিদ্ধান্তে আমরা উদাসীন থাকতে পারি না। অতিদ্রুত দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এই বিষয়টির সমাধান হওয়া প্রয়োজন। ভারত যেখানে অঙ্গীকার করেছে তারা ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়’ সেখানে ভারতের বর্তমান ভূমিকার ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। Daily Amader Somoy 26.07.15

গ্রিসের পরিস্থিতি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ

গ্রিসের পরিস্থিতি এখন কোন দিকে? গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় শেষ পর্যন্ত কিছু শর্তসাপেক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা পুনরায় গ্রিসকে ঋণ দিয়েছেন। কিন্তু গ্রিসের সিপ্রাস সরকারের এ ঋণ গ্রহণের মধ্য দিয়ে গ্রিসে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। দলের অভ্যন্তরে বড় ধরনের এক বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছেন সিপ্রাস। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। তার কোয়ালিশন সরকার ভেঙে গেছে। তিনি নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। এবং জনগণের ম্যান্ডেট নেয়ার জন্য আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে নয়া নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেছেন। সব মিলিয়ে এক বড় ধরনের অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গ্রিস। এখানে বলা ভালো, দাতাগোষ্ঠীর শর্ত না মানায় গেল ৩০ জুনের মধ্যে গ্রিস আইএমএফের কাছ থেকে নেয়া ঋণের ১৬০ কোটি ইউরো পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে দেশটি দেউলিয়া হয়ে যায়। দাতাদের শর্ত গ্রহণ করা হবে কি না, এ প্রশ্নে গ্রিস সরকার একটি গণভোটের আয়োজন করলে ভোটারদের একটি বড় অংশ এ শর্ত প্রত্যাখ্যান করে। এতে করে প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাসের অবস্থান শক্তিশালী হলেও, শেষাবধি তিনি দাতাগোষ্ঠীর কিছু শর্ত মেনেই পুনরায় ঋণ গ্রহণ করেন। আর্জেন্টিনা, কিংবা স্পেনের ক্ষেত্রেও আইএমএফ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবারো ঋণ দিয়েছিল। এখন তারাই গ্রিসকে ৮ হাজার ৬০০ কোটি ইউরো ঋণ দিয়েছে। কিন্তু এতে করে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।
এক. এ ঋণ কি গ্রিসের অর্থনীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে? গত প্রায় পাঁচ বছর গ্রিস এভাবেই ঋণ গ্রহণ করে আসছে। কিন্তু তাতে অর্থনীতিতে পরিবর্তন এসেছে খুব সামান্যই। বরং পরিস্থিতির দিনে দিনে সেখানে অবনতি হয়েছে। দুই. গ্রিসের পরিস্থিতির সঙ্গে ইউরোপের তিনটি দেশ_ স্পেন, পর্তুগাল আর আয়ারল্যান্ডের পরিস্থিতির অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্পষ্টতই ইউরো জোনের অর্থনীতিতে দুটো ঋণের জন্ম হয়েছে। একটি ধনী ইউরোপ, যার নেতৃত্বে রয়েছে জার্মানি ও ফ্রান্স। অন্যদিকে গরিব ইউরোপ, গ্রিসের মতো দেশ যার অংশ।
তিন. জার্মানির অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেছেন গ্রিসের ইউরো জোন (১৯টি দেশ নিয়ে গঠিত) ত্যাগ করা উচিত। আগামীতে এ বক্তব্যটি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
চার. গ্রিস যদি পুনরায় ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গ্রিস কি নবগঠিত এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের দিকে হাত বাড়াবে? চীন ও রাশিয়া কি এ সুযোগটি গ্রহণ করবে?
পাঁচ. গ্রিস ন্যাটোর অন্যতম সদস্য। দেশটির স্ট্রাটেজিক অবস্থানও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিস্থিতিতে গ্রিস কি ন্যাটো থেকেও বের হয়ে যাবে?
ছয়. ইউরো জোনের ব্যর্থতা কি ইউরোপের অখ-তাকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে?
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি শক্তি।
অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কিন্তু ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সংকট ইইউর ভূমিকাকে সংকুচিত করে দিয়েছে।
এখানে বলা ভালো, ১৯৫৭ সালে মাত্র ছয়টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ পরিণত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ)। ২৮টি দেশ এখন ইইউর সদস্য। এর মাঝে আবার ২৪টি দেশ ন্যাটোর সদস্য। তবে জর্জিয়া ও ইউক্রেন এখনো ন্যাটোর সদস্য হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এ দুটি দেশকে ন্যাটোর সদস্যপদ দিতে চাচ্ছে, যাতে রাশিয়ার রয়েছে আপত্তি।
ইউরোপে এরই মাঝে বেশ কয়েকটি সংস্থার জন্ম হয়েছে, যে সংস্থাগুলো হলো ইউরোপীয় কাউন্সিল, কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দপ্তর, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় মুদ্রা ইন্সটিটিউট, কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু ইউরোপই নয়, বরং খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। যে যুক্তি তুলে একসময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোনে (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি, সে যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হলো। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড়, তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না?
২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন তার পঞ্চাশতম পূর্তি উৎসব পালন করে তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইইউর মাঝে বিভক্তি আছে। লক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান অর্জন হিসেবে ইউরো মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল ইউরোর সব দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স এর বিরোধিতা করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিহ্নিত ছিল এ কারণে যে নিরাপত্তার বিষয়টিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে খেপিয়ে তুলতে পারে।
জার্মানি ও স্পেন ইইউর জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালের 'ভেলভেট রেভ্যুলুশন' দেশগুলোকে সোভিয়েতনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় এবং দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। এ দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউর সদস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া হারজেগোভিনা, কিংবা ক্রোয়েশিয়া এখনো ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সংকট সব সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সংকট জর্জরিত ইউরোপে আবারো মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে। ২০১৩-২০১৪ সময়সীমায় ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের শূন্য প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ইইউর প্রবৃদ্ধিও ছিল শূন্যের কোঠায়। তাই ইউরোপ নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। এখন ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ তা আরো বাড়বে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুই স্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এ বিভক্তির কথা বলেছিলেন। জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা, যদিও এ বিভক্তির বিরোধিতা করেছিলেন ইউরোপীয় কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান জোসে ম্যানুয়েল বারোসো। এখন সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কি না, কিংবা 'নতুন ইউরো'র স্বরূপ কী হবে, তা এ মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসন্ন, তা গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় ব্যর্থতা। তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন যখন ইইউতে থাকা-না থাকা নিয়ে গণভোট করতে চান, তখন ইউরোপের ঐক্যে যে ফাটলের জন্ম হয়েছে, তারই ইঙ্গিত দিলেন তিনি। ক্যামেরন স্পষ্ট করেই বলেছেন, আমরা যদি এখনই এসব সমস্যা নিয়ে উদ্যোগ নিতে না পারি, তাহলে ইউরোপের পতন হবে এবং ব্রিটিশরাও পতনের দিকে যেতে থাকবে।
অতীতে ইইউ সম্পর্কে এত ভয়ংকর কথা কেউ বলেননি। এখন ক্যামেরন সাহস করেই বললেন। সামনের দিনগুলো অত্যন্ত কঠিন সময় ইইউর জন্য। অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংকট যদি ইইউ কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায় আগামী এক দশকের মধ্যে আমরা এক ভিন্ন ইউরোপের চেহারা দেখতে পাব। ইইউতে থাকা-না থাকা নিয়ে ব্রিটেনের গণভোটের আয়োজন ও ক্যামেরনের সর্বশেষ বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্প্রতিক কর্মকা-ে বেশ অসন্তুষ্ট। ব্রিটেনের পর এখন দৃষ্টি গ্রিসে আবদ্ধ।
তবে সব ছাপিয়ে গেছে গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় গ্রিসের সংসদের অধিকাংশ সদস্য ৫ জুলাইয়ের গণভোটে 'না' ভোটের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, ঋণদাতা দেশগুলো যে সংস্কারের কথা বলেছে, অর্থাৎ বাজেট কাট এর কথা বলছিল, তাতে সংসদের আপত্তি রয়েছে, যদিও সিপ্রাস সে শর্তই মেনে নিলেন। গণভোটে 'না' ভোট জয়যুক্ত হয়েছিল। এর অর্থ হচ্ছে গ্রিসের জনমত ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে। শেষাবধি গ্রিস ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কি না, তাও একটা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কিংবা এমনও হতে পারে, গ্রিস ব্রিটেন ও ডেনমার্কের মতো অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকেও নিজস্ব মুদ্রা তারা ব্যবহার করবে। যেমন ব্রিটেনে ইউরো চালু না হওয়ায় এখনো পাউন্ড সেখানে চালু রয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে গ্রিস তার পুরনো মুদ্রা ড্রাকমা পুনরায় চালু করবে, এটাই বাস্তবতা। তবে সব কিছু নির্ভর করছে আগামী তিন বছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। এখানে এ কথা বলা প্রয়োজন, গ্রিস যদি ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে যায়, এর একটা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বের অর্থনীতিতেই পড়বে। ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি স্টক এক্সচেঞ্জ মার্কেটের পতন ঘটেছে। শুধু অস্ট্রেলিয়ার স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার 'হাওয়া' হয়ে গেছে। মুদ্রা হিসেবে ডলারের মানও কমে গেছে। বলা হচ্ছে, এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ২০১৬ সালে এশিয়ার প্রবৃদ্ধি ০.৩ ভাগ কমে যাবে। সুতরাং সারা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। গ্রিস ব্যর্থ হলে এর প্রতিক্রিয়া পড়বে পর্তুগাল, স্পেন ও আয়ারল্যান্ডেও। Daily Jai jai Din 23.07.15

দক্ষ ও প্রতিনিধিত্বশীল মন্ত্রিসভাই কাম্য

মন্ত্রিসভা নিয়ে আবারও আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। বিশেষ করে ৯ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে তার পূর্ববর্তী মন্ত্রণালয় (এলজিআরডি) থেকে সরিয়ে দেয়া এবং এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা, ১৪ জুলাই নতুন একজন পূর্ণ মন্ত্রীসহ দুজন প্রতিমন্ত্রীকে পদোন্নতি এবং দুজন নয়া প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের মধ্য দিয়ে মন্ত্রিসভার যে সম্প্রসারণ করা হয়েছে, তাতে সৃষ্টি হয়েছে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারণ বিতর্কিত, অদক্ষ মন্ত্রীদের বাদ পড়া নিয়ে মিডিয়ায় একটি গুঞ্জন থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত কাগজ-কলমেই থেকে গেছে, বাস্তবে রূপ পায়নি। তবে ঈদের আগে সবচেয়ে বড় আলোচনাটি ছিল সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে একনেকের গুরুত্বপূর্ণ একটি সভায় সৈয়দ আশরাফ অনুপস্থিত থাকায় মন্ত্রিসভায় তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করার ঘটনাটিকে স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। একজন মন্ত্রী, তিনি যত ক্ষমতাবানই হোন না কেন, তিনি একনেকের মতো সভায় অনুপস্থিত থাকতে পারেন না। থাকা উচিত নয়। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ অনুপস্থিত ছিলেন। এর আগেও তিনি একনেকের সভায় অনুপস্থিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, গত দেড় বছরে মাত্র ৩ দিন এবং এর আগের টার্মে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছরে অফিস করেছিলেন মাত্র ২৪ দিন। এভাবে কোনো মন্ত্রী অফিস না করে মন্ত্রণালয় চালাতে পারেন কি-না, আমি জানি না। তবে কাজ আটকে থাকেনি। মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা মন্ত্রণালয়ের কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অফিস না করা এক ধরনের দায়িত্বহীনতা, নেতৃত্বে অনীহা ও অদক্ষতাই প্রমাণ করে। যেহেতু তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক এবং তার ক্ষমতার বলয় অত্যন্ত শক্তিশালী, সেজন্য কেউ কথা বলতে সাহস পেত না। কিন্তু দফতরবিহীন মন্ত্রী করার সাত দিনের মাথায় তিনি যখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন, তখন আমি অবাকই হয়েছি! এতে প্রমাণ হল তিনি সত্যি সত্যিই মন্ত্রিসভার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এলজিআরডির মতো জনপ্রশাসনও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। এখন তিনি এখানে কতদিন অফিস করবেন, এ প্রশ্ন আমাকে ভাবিত করে। তিনি লন্ডনে যেতে চেয়েছিলেন বলে খবর বেরিয়েছিল। যাননি বটে; কিন্তু লন্ডনে বাংলাদেশী কমিউনিটি জানে সেখানে তার স্ত্রী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শায়লা ঠাকুর স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট এলাকায় তার নিজস্ব বাড়িও রয়েছে।শোনা যাচ্ছে, ঈদের পর মন্ত্রিসভায় আবার রদবদল হবে। তখন আরও কিছু পূর্ণ মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত হবেন। যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন মন্ত্রিসভায় আর কোনো রদবদল হবে না, তবে এটা প্রধানমন্ত্রীর মর্জির ওপর নির্ভরশীল। প্রধানমন্ত্রী ভালো মনে করলে মন্ত্রিসভায় আবার রদবদল করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রীদের সংখ্যা বাড়িয়েই কি কেবিনেটে গতিশীলতা আনা যায়? কিংবা কেবিনেটের দক্ষতা বাড়ানো যায়? এর জবাব হচ্ছে, না। আমি তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে দেখাতে পারব পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ছোট মন্ত্রিসভা নিয়ে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে। যুক্তরাজ্যে কেবিনেট পদমর্যাদায় মন্ত্রী রয়েছেন মাত্র ২১ জন। জার্মানিতে তিনটি বড় দলের সমন্বয়ে রয়েছে একটি কেবিনেট। সদস্য সংখ্যা মাত্র ১৬। এর মধ্যে চ্যান্সেলর (বা প্রধানমন্ত্রী) অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের সিডিইউ থেকে ৭ জন, একসময়ের বিরোধী দল ও এখন কোয়ালিশনের অংশীদার এসপিডি থেকে ৬ জন, আর সিডিইউ-এর ট্রেডিশনাল পার্টনার সিএসইউ থেকে ৩ জন। জার্মানির মতো বড় অর্থনীতির দেশে কেবিনেটের সদস্য সংখ্যা মাত্র ১৬, এটা চিন্তা করা যায়? যুক্তরাষ্ট্রের কথা চিন্তা করুন। সেখানে কেবিনেট পদমর্যাদার মন্ত্রীর সংখ্যা ১৫। তবে ভাইস প্রেসিডেন্টও সেখানে কেবিনেটের অংশ। ভারতের মতো বিশাল দেশে নরেন্দ্র মোদি মাত্র ৩৪ জন মন্ত্রী নিয়ে একটি কেবিনেট পরিচালনা করে আসছেন। অথচ বাংলাদেশে পূর্ণ মন্ত্রী আছেন ৩২ জন, ১৮ জন রয়েছেন প্রতিমন্ত্রী ও ২ জন উপমন্ত্রী। গত ১৪ জুলাই ৩ জন পূর্ণ মন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রী আমরা পেয়েছি। পূর্ণ মন্ত্রীর ২ জন পদোন্নতি পেয়েছেন। আর একজন পূর্ণ মন্ত্রী আমরা পেয়েছি নতুন।মূলত মন্ত্রিসভায় কোনো রদবদল হয়নি। শুধু সংখ্যা বেড়েছে। গুণগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। এটা ছোটখাটো একটা কসমিক চেঞ্জ। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, আরও একবার মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ ঘটবে। তখন হয়তো আমরা আরও বেশ কয়েকজন পূর্ণ মন্ত্রী পাব। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার তা হচ্ছে, বিতর্কিত নন এবং যোগ্য এমন ব্যক্তিদেরই যেন মন্ত্রিসভায় নেয়া হয়। একসময় যিনি পাখির মতো সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন, বিদেশী মন্ত্রীদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেছেন এবং জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে যিনি ছিলেন উদাসীন, তিনি দলের যত বড় নেতাই হোন না কেন, মন্ত্রিসভার ভাবমূর্তির জন্য তিনি যোগ্য ব্যক্তি নন। আরেকজনের কথা বলি। সিলেটের শিশু রাজন হত্যার জন্য তিনি দায়ী করেন বেগম জিয়াকে! মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের উত্থানের জন্যও তিনি দায়ী করেন বেগম জিয়াকে! তার দুর্নীতি নিয়ে যখন টিভি প্রতিবেদন দেখি তখন খটকা লাগে। এভাবে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে কি তিনি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন? আমার অবজার্ভেশনটা হচ্ছে এখানেই। বড় মন্ত্রিসভার প্রয়োজন নেই। দরকার ছোট মন্ত্রিসভা। কিন্তু তারা হবেন দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন। যতদূর জানি, অতীতে কোনো একটি কমিটির সুপারিশ ছিল এমনটাই- ২০ থেকে ২৫ জনের মধ্যে মন্ত্রিসভার সদস্য সীমাবদ্ধ রাখা। এটাই সঠিক। সাধারণত জেলা কোটা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইত্যাদি কারণে কেবিনেট সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। প্রায় ক্ষেত্রেই যোগ্যতার বিষয়টি খুব একটা বিবেচনায় নেয়া হয় না। তবে বলতেই হবে, বর্তমান কেবিনেটে বেশ কজন সদস্য রয়েছেন, যারা স্ব স্ব মন্ত্রণালয় পরিচালনায় যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।সাধারণত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী নেয়া হয়। তবে সংবিধানের ৫৬(২) ধারা মতে টেকনোক্রেট কোটায়ও মন্ত্রী নেয়া হয় (মোট সদস্যদের দশ ভাগের এক ভাগ)। এ ধারাটিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা যোগ্য এবং আন্তর্জাতিক আসরে খ্যাতি অর্জন করেছেন, এমন কাউকে কাউকে মন্ত্রিসভায় নেয়া যায়। বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্যনির্ভর বিশ্বব্যবস্থায় যেখানে নেগোসিয়েশনসের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে কোনো কোনো মন্ত্রণালয় (বাণিজ্য, শিল্প, পররাষ্ট্র, মানবসম্পদ) পরিচালনায় দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মন্ত্রী প্রয়োজন। সংসদ সদস্যরা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়, দলকে তারা সংগঠিত করেন। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির অনেক জটিল প্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে তাদের ধারণা নাও থাকতে পারে। প্রয়োজনটা এ কারণেই।মন্ত্রিসভার সম্ভাব্য সম্প্রসারণ নিয়ে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি! কোনো কোনো মিডিয়ায় এমন আভাস দেয়া হচ্ছে যে, আবার কেবিনেটে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে আরও বড় দায়িত্ব দেয়ার উদ্দেশ্য সামনে রেখেই নাকি উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে! যদিও এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দলের অভ্যন্তরে আরও বিতর্ক বাড়াবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা যাবে, একসঙ্গে একাধিক উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে কাউকে কাউকে একোমোডেট করার জন্য! এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। জার্মানিতে একজন উপ-প্রধানমন্ত্রী বা ভাইস চ্যান্সেলর আছেন বটে। কিন্তু যেহেতু তিনি কোয়ালিশনের অন্যতম অংশীদার, সেটা বিবেচনায় নিয়েই এসপিডির সভাপতিকে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ দেয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যেও একজন উপ-প্রধানমন্ত্রী আছেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় কোনো উপ-প্রধানমন্ত্রী নেই। ভারতেও নেই। আমাদের সংবিধানে কোনো উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ নেই। যদি উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাউকে নিয়োগ দিতে হয়, তাহলে সংবিধানে সংশোধন আনতে হবে। সংসদে বিল আকারে তা উপস্থাপন করে সংসদে তা পাস করাতে হবে। বলা ভালো, অতীতে বাংলাদেশে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল, যা পরে বিলুপ্ত করা হয়।বাংলাদেশ এখন নিু-মধ্যম আয়ের দেশ। আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা ও ভূমিকা বেড়েছে। ফলে বিশ্ব আসরে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে প্রয়োজন দক্ষ, শিক্ষিত ও প্রতিনিধিত্বশীল একটি কেবিনেট। অযোগ্য ও বিতর্কিতদের বাদ দেয়া হোক। আধুনিকমনস্ক একটি কেবিনেটই বাংলাদেশকে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণের চেয়ে এ মুহূর্তে বড় প্রয়োজন মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করে ছোট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা। Daily Jugantor 23.07.15

ইরান সমঝোতা ও উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতি

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে ভিয়েনায় ইরানের সঙ্গে ৬ জাতির সমঝোতা এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অন্যতম একটি আলোচিত বিষয়। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে উপসাগরীয় অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধ এড়ানো গেছে বটে কিন্তু রেখে গেছে বিভিন্ন প্রশ্ন। এ চুক্তি যে উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। শুধু তা-ই নয়, এ অঞ্চলের রাজনীতিতে তা গুণগত এক পরিবর্তনও ডেকে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও এ ধরনের একটি চুক্তির প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে এক ধরনের ‘যুদ্ধ’ শুরু করে ওবামা প্রশাসন। সেখানে কোনো ‘বিজয়’ নিশ্চিত করতে পারেনি। এমন এক পরিস্থিতিতে ইরানের পরমাণু প্রকল্পে বিমান হামলা চালিয়ে এবং তা ধ্বংস করে দিয়ে ওবামা প্রশাসন উপসাগরীয় অঞ্চলে আরেকটি ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করতে চায়নি। ফলে ইরানের সঙ্গে একটি সমঝোতা প্রয়োজন ছিল। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে যে সমঝোতা হয়েছে, এতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে দেখা যায়Ñ ১. আগামী ১০ বছরের মধ্যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে পারবে না। তাদের পরমাণুকেন্দ্রে চলবে নজরদারি। ২. অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকছে। ৩. তেহরান শর্ত ভাঙলে ৬৫ দিনের মধ্যে ফের কিছু নিষেধাজ্ঞা বহাল হবে। ৪. ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে কতটা এগিয়েছে, তা তদন্ত করবে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ। ৫. ফের আইএইএ ইরান বিরোধ হলে তা মেটাবে সালিশি বোর্ড। এ চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইরানের যে সম্পদ জব্দ করা হয়েছিল, তা ইরানকে ফেরত দেওয়া হবে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ফলে ইরান তার যাত্রীবাহী বিমান সংস্থার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১০ বছর পর ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আরও গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ করতে পারবে। নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের রাজনীতির জন্য এ চুক্তি আপাতত উত্তেজনা হ্রাস করতে সাহায্য করবে। ওবামা প্রশাসনের ওপর ইসরায়েলি প্রশাসনের প্রচ- একটা ‘চাপ’ থাকা সত্ত্বেও ওবামা প্রশাসন ওই ধরনের শর্তে রাজি হয়েছিলেন। ফলে আলোচনায় বাকি বৃহৎ শক্তিগুলোও রাজি হয়ে যায়। ওবামার জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টার এবং প্রায় ১০০ সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওবামাকে সমর্থন করেছেন। কংগ্রেস সদস্যদের বিরোধিতার মুখে ওবামা এটিও জানিয়ে দিয়েছেন, কংগ্রেস যদি এই সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করেÑ তাহলে তিনি ‘ভেটো’ দেবেন। অর্থাৎ তিনি চান কংগ্রেস এ চুক্তি অনুমোদন করুক। চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলেও এখনই কার্যকর হচ্ছে না। বেশ কয়েকটি দেশের সংসদে এ চুক্তিটি অনুমোদিত হতে হবে। মার্কিন কংগ্রেস, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের পাশাপাশি ইরানের পার্লামেন্টে এটি অনুমোদিত হতে হবে। না হলে এটি অকার্যকর হয়ে যাবে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ৬ জাতির যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেটিকে ‘ঐতিহাসিক’ভাবে আখ্যায়িত করা হলেও চুক্তিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অবশ্যই মার্কিন কংগ্রেসে এ চুক্তিটি অনুমোদিত হতে হবে। না হলে চুক্তিটির কার্যকারিতা থাকবে না। কংগ্রেসের উভয়কক্ষ, সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ এখন ওবামাবিরোধী রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে এ চুক্তির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন। ওবামার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থকরা সবাই যে খুশি, তাও তাদের কারও কারও মন্তব্যে মনে হয়নি। বলা ভালো, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অন্যতম একটি ফ্যাক্টর হচ্ছে ইসরায়েল। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মন্তব্য করেছেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক ভুল’। ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ চুক্তির কোনো কোনো ধারা নিয়ে সমালোচনা করেছেন। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ওই চুক্তির প্রশংসা এবং ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এই চুক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করলেও ঈশান কোণে একটি ‘কালো মেঘ’ থাকলই। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছেÑ এই অভিযোগ তুলে ২০০৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের ইউরোপিয়ান সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বাতিল করার দাবি সংবলিত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এরপর অন্তত এ সংক্রান্ত আরও ছয়টি প্রস্তাব পরে গ্রহণ করা হয়েছে এবং ইরান ওই কর্মসূচি বাতিল না করায় ২০১০ সালে ইরানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার সম্পদ জব্দসহ দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবরোধ এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাতিসংঘ। তবে ২০০৬ সাল থেকেই ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চিন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানি) আলোচনা চলে আসছিল। এতে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু ২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত হাসান রুহানি বিজয়ী হলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। ফলে এই ৬ জাতি আলোচনা আরও গতি পায়। গত বছরের নভেম্বরে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং এপ্রিলে (২০১৫) সুইজারল্যান্ডের লুজানে একটি খসড়া চুক্তিতে ইরান ও ৬ জাতি উপনীত হয়। গত ৩০ জুনের মধ্যে ওই খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। তা হয়নি। এখন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো। এ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অন্তত একটি জিনিস স্পষ্ট হলো। তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ সম্পর্ক আরও উন্নত করার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ, প্রশাসন, সেনাবাহিনীতে এখনো ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর দীর্ঘ ৪৪৪ দিন রেভলিউশনারি স্টুডেন্টস কর্তৃক তেহরানের মার্কিন দূতাবাস দখল করে নেওয়ার ঘটনার স্মৃতি একটি ‘ক্ষতচিহ্ন’ হিসেবে রয়ে গেছে। ফলে সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনাটা অত সহজ ছিল না। এরপর যোগ হয় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। ওই ঘটনার দীর্ঘ ৩৬ বছর পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এই দেশ দুটিকে আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। তাই এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্ধ’ ইসরায়েলের আপত্তি সত্ত্বেও। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিস্টরা মনে করেনÑ মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় জঙ্গিবাদী ইসলামিক স্টেটের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে হলে তাদের ইরানের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, গত নভেম্বরে (২০১৪) বারাক ওবামা স্বীকার করেছিলেন, তিনি গোপনে ইরানি সমর্থন চেয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। প্রতিউত্তরে খামেনিও তাকে একটি গোপন চিঠি পাঠিয়েছিলেন। আইএস জঙ্গিদের ঠেকাতে খামেনির সমর্থন চেয়েছিলেন ওবামা। পরে ইয়েমেনে ‘কুলি বিদ্রোহ’ প্রমাণ করল, এখানেও একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনে ইরানের সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে। কেননা হুতিরা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং অভিযোগ আছে, হুতি বিদ্রোহীরা ইরান থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পেয়ে থাকে। অবশ্য ইরান বারবার তা অস্বীকার করে আসছে। এখন ‘ইরান চুক্তি’ সাক্ষরিত হওয়ায় সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আরও স্বাভাবিক হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র এটিই চাইছে। পারস্যীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি সৌদি-ইরান জোট একটি বড় ভূমিকা পালন করুকÑ এটি চাইবেন মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টরা। কেননা ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহে সেখানে সরকারের পতন ঘটে এবং প্রেসিডেন্ট দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর মার্চে সৌদি বিমান হুতি বিদ্রোহী ঘাঁটিতে বোমা হামলা চালালেও সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। এখন সৌদি-ইরান একটি ‘সমঝোতা’ সেখানে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে সাহায্য করবে। একই কথা প্রযোজ্য সিরিয়ার ক্ষেত্রেও। সেখানে একদিকে যেমনই আসাদবিরোধীরা (যাদের যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক ও সামরিকভাবে সাহায্য করছে) প্রেসিডেন্ট আসাদকে উৎখাতের জন্য ‘যুদ্ধ’ করছে, অন্যদিকে তেমনি আইএসএর জঙ্গিরা সিরিয়ার ভেতরে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা আরও সম্প্রসারিত করছে। এক্ষেত্রে মার্কিন সমরনায়করা মনে করেন, সৌদি-ইরান ‘সমঝোতা’ সিরিয়ায়ও একটি ‘ঐকমত্যের সরকার’-এর জন্ম দিতে পারে। উপরন্তু লেবাননে ইরানি প্রভাব এখন কমে যেতে পারে। তা সৌদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য কোনো হুমকি সৃষ্টি করবে না। তবে নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে উল্লেখ করার মতো। যুক্তরাষ্ট্র যদি ‘ইরান চুক্তি’র পরও সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের বিরোধ জিইয়ে রাখে, তাহলে এ অঞ্চলে আইএসএর প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়বে। ১০৭ পৃষ্ঠাব্যাপী ‘ইরান চুক্তি’তে ইরানের করণীয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে চুক্তির দুটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, চুক্তিতে ইরানের পরমাণু তৎপরতা কমিয়ে আনা হবে এবং পূর্ণ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে থাকবে ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। ইরান কোনো কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্য দেশে স্থানান্তরিত করবে এবং আগামীতে নতুন কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে না। দ্বিতীয়ত, ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে শিথিল করা হবে। তবে ইরানের ওপর থেকে অস্ত্র রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আপাতত তুলে নেওয়া হচ্ছে না। এখন ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে ইরান এ অঞ্চলে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। ইরানে বিনিয়োগ বাড়বে, বিশেষ করে ইরানের গ্যাস ও তেল সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়বে। তবে অনেক বিষয়ের ওপর এ চুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। ইসরায়েলের বিরোধিতা ও মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের আপত্তির মুখে এ চুক্তিটি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। অবশ্য ইরানে ব্যাপকভাবে এ চুক্তিটি প্রশংসিত হয়েছে এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এ চুক্তিটি সমর্থন করেছেন। এ থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে গেল, চুক্তির ব্যাপারে ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানির স্পষ্ট নির্দেশ থাকলেও তিনি খামেনির পরামর্শ ছাড়া এদিকে অগ্রসর হননি। এটিই হচ্ছে বাস্তববাদী নীতি। দীর্ঘ ৩৬ বছর ইরান আন্তর্জাতিক আসরে একা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কারণে ইরান বিশ্বে একা হয়ে গিয়েছিল। ইরানের বৈদেশিক আয়ের বড় উৎস পেট্রলিয়াম সেক্টরে কোনো বিনিয়োগ আসছিল না, এমনকি ইরান তেল রপ্তানি করতেও পারছিল না। এ জন্যই ইরানিদের প্রয়োজন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন। কট্টর শিয়া ধর্মীয় ভাবধারায় বিশ্বাসী ইরানি ধর্মীয় নেতারা এটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এটিই হচ্ছে বাস্তববাদী নীতির মূল কথা। ২০১৬ সালে ইরানের পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমার বিশ্বাস, ওই নির্বাচনে রুহানি সমর্থকরা বিজয়ী হবেন। একই সঙ্গে ২০১৭ সালে ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ওই নির্বাচনে রুহানির দ্বিতীয়বারের মতো বিজয়ী হওয়ার পথও প্রশস্ত হবে। ইসরায়েলের বিরোধিতার কারণে মার্কিন কংগ্রেসে ওই চুক্তির বিরোধিতা রয়েছে। ২০১৬ সালের নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওই ইরান ইস্যু কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি কিনটনের ‘সহজ বিজয়’ একটি বড় অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। রিপাবলিকানদের অবস্থান এতে শক্তিশালী হবে। অবশ্য হিলারি কিনটন স্পষ্ট করেই বলেছেন, তিনি কোনো অবস্থাতেই ইরানকে পারমাণবিক বোমা বানাতে দেবেন না। মার্কিনিদের জন্য একটি সুযোগ এসেছে উপসাগরীয় অঞ্চলে এক ধরনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে। ‘যুদ্ধবাজ’ মার্কিন প্রশাসন যদি ওই ‘সম্ভাবনা’ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেখানে যুদ্ধ আরও প্রলম্বিত হবে। ইরান চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইরানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক রামিন জাহানবেগলু (জধসরহ ঔধযধহনবমষড়ড়) একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির মেরুকরণে এ মুহূর্তে ইরান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ’। এটিই হচ্ছে মোদ্দা কথা। ইরানকে ছাড়া যে উপসাগর তথা মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা যাবে না, এটি প্রমাণিত হয়েছে। এখন দেখার পালা, মার্কিননীতিতে ওই পরিবর্তনটি কীভাবে প্রতিফলিত হয়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের আগে অর্থাৎ রেজা শাহ পাহলভির শাসন আমলে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে যে মার্কিননীতি, এর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ইরান। ইরানকে সঙ্গে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু ওই দৃশ্যপট বদলে যায় ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর। এখন নতুন আঙ্গিকে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ওই পুরনো বৃত্তে ফিরে যাচ্ছে কি না, সেটিই দেখার বিষয়। Daily Amader Somoy 22.07.15

প্রয়োজন দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন ছোট মন্ত্রীসভা

মন্ত্রীসভায় ৩ জন নতুন মন্ত্রীর অন্তর্ভূক্তির মধ্য দিয়ে মন্ত্রীসভার সম্প্রসারণ ঘটেছে বটে, কিন্তু এতে কোন চমক নেই। গত মঙ্গলবার মোট পাঁচ মন্ত্রী শপথ নিয়েছেন। এর মাঝে তিনজন পূর্ণমন্ত্রী, দুজন প্রতিমন্ত্রী এবং নবাগত। পূর্ণমন্ত্রীদের একজন নতুন, বাকি দু’জনের পদোন্নতি ঘটেছে। মিডিয়ায় একটি গুঞ্জন ছিল যে বিতর্কিত অন্তত দুজন পূর্ণমন্ত্রী বাদ পড়তে পারেন। কিন্তু মন্ত্রীসভা সম্প্রসারণে তারা বাদ পড়লেন না। বহাল তবিয়তেই তারা আছেন। তবে বিতর্কিত একজন মন্ত্রীর সাথে নয়া একজন প্রতিমন্ত্রীকে জুড়ে দেয়া হয়েছে। আর সৈয়দ আশরাফকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন মন্ত্রী করা হয়েছে।
মন্ত্রীসভায় রদবদল একটি স্বাভাবিক ঘটনা এবং সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী তার ‘সন্তুষ্টি সাপেক্ষে’ যে কাউকে মন্ত্রী করতে পারেন। যাদেরকে পদোন্নতি দেয়া হলো কিংবা নতুন যাদের নেয়া হলো, তাদের কোন যোগ্যতাবলে নেয়া হলো আমি বলতে পারবো না। তবে এদের নিয়েও সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন, তাকে পূর্ণমন্ত্রী করা হয়েছে। বিএনপির বিগত ‘ব্যর্থ আন্দোলন’ দমনে তিনি সফল ছিলেন। কিন্তু তিনমাসের জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচি, বাসে আগুন লাগিয়ে নিরীহ মানুষদের হত্যা করা তিনি বন্ধ করতে পারেন নি। তার প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে কোন কোন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক আসরে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। একসময় ‘গুম’ আতংক বাড়লেও এখন অবশ্য তা কমে এসেছে। মানুষের মনে স্বস্তি নেমে এসেছে। তার প্লাস পয়েন্ট ছিল একটাই- প্রতিমন্ত্রী হয়েও তিনি পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্বই পালন করছিলেন। এখন বাঁধাটা সরে গেল। এখন তিনি পূর্ণমন্ত্রী।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। অতীতে যারাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেছেন, তারাই বিতর্কিত হয়েছেন কোন না কোনভাবে। অনেক বাঘা বাঘা আওয়ামী লীগ নেতাও অতীতে মন্ত্রণালয় পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছিলেন। এখন দেখার পালা আসাদুজ্জামান খান কামাল কীভাবে আগামীতে পরিচিত হন।তবে তিনি মিডিয়াবান্ধব। আমার অনেক পরিচিত মিডিয়াকর্মীকে আমি দেখেছি সরাসরি তাকে ফোন করতে এবং তিনি তা রিসিভও করতেন। সজ্জন ব্যক্তি তিনি। বোধকরি এটা তার আরেকটি প্লাস পয়েন্ট। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি চ্যলেঞ্জিং জায়গা। এখানে শক্ত নেতৃত্ব দরকার। পুলিশ বাহিনীর দূর্নীতি নিয়ন্ত্রণ তথা ভাবমূর্তি উদ্ধারে তার ভূমিকার দিকে এখন তাকিয়ে থাকবে পুরো জাতি।
বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে যিনি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, তিনি পদোন্নতি পেয়ে পূর্ণমন্ত্রী হলেন। তিনি সংসদ সদস্য নন। একজন ছড়াকার। মিডিয়া জগতে একটা কথা চালু আছে, যা সত্য কি মিথ্যা আমি বলতে পারবো না। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটি ছড়া লিখে ‘পুরস্কার’ হিসেবে প্রথম মন্ত্রীসভায় ছোটমন্ত্রী হিসেবে জায়গা পেয়েছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর একজন সদস্য ও প্রয়াত ব্যক্তিত্ব শওকত ওসমানের সন্তান। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে তার কোন উল্লেখযোগ্য অবদান আমার চোখে পড়েনি। এমনকি তিনি তার মন্ত্রণালয়ে খুব বেশি ‘অগ্রগতি’ সাধন করেছেন এটাও বলা যাবেনা। তিনি এখনও ছড়া লেখেন এবং নি:শন্দেহে একজন সজ্জন ব্যক্তি। ইয়াফেস ওসমানের সাফল্য বোধহয় এখানেই যে তিনি নিজেকে দুর্নীতি ও সকল বিতর্কের উর্ধ্বে রাখতে পেরেছেন।
নুরুল ইসলাম বিএসসি স্কুল শিক্ষকতা দিয়ে তার জীবন শুরু করলেও তিনি এখন চট্রগ্রামের একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে বেশ কিছুদিন যাবৎ ছোট্র একটি কলাম লিখে আসছেন নিয়মিত। তিনি চট্রগ্রাম-৮ আসনে জাতীয় সংসদ (৫ জানুয়ারি) নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির সাথে সমঝোতার ফলশ্রুতিতে ওই আসনটি দেয়া হয় জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদককে। তখন প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন ভবিষ্যতে তাঁকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। এখন প্রধানমন্ত্রী তাকে পূর্ণমন্ত্রী বানিয়ে পুরস্কৃত করলেন। প্রধানমন্ত্রী তার কথা রেখেছেন। এভাবেই প্রধানমন্ত্রী কথা রাখেন। অতীতেও তিনি কথা রেখেছিলেন। এখন যিনি ধর্মমন্ত্রী তাঁকেও তিনি কথা দিয়েছিলেন। সে কথা তিনি রেখেছেন। দিলীপ বড়ুয়ার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। জীবনে কোন নির্বাচনে সাম্যবাদী দলের এই নেতা পাঁচশ ভোটের উপর পাননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। তার দলটি আবার ১৪ হলের শরিক দল। ফলে সংগত কারনেই তার আসনটিতে অন্য কাউকে মনোনয়ন দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রী তখন দিলীপ বড়ুয়াকে কথা দিয়েছিলেন। জীবনে যিনি নির্বাচিত হয়ে সংসদে যেতে পারেননি, তিনি শুধুমাত্র এবং একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদে পূর্ণমন্ত্রী হন। তবে দিলীপ বড়ুয়া কথা রাখেন নি। সারাজীবন বাম রাজনীতি করেও নানারকম দুর্নীতির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য কেউই প্রধানমন্ত্রীর দেয়া সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেননি। তবে নুরুল ইসলাম বিএসসি ৭৩ বছর বয়সে এসে মন্ত্রী হয়ে কতটুকু বিতর্কের উর্ধ্বে থাকতে পারবেন জানিনা। একজন ব্যবসায়ী যখন মন্ত্রী হয় তিনি কখনোই নিজেকে ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর উর্ধ্বে থাকতে পারেন না। একজন ব্যবসায়ীকে মন্ত্রী না করাই ভালো। দু’জন প্রতিমন্ত্রী নিয়ে মন্তব্য করার কিছু নেই। সাধারণত তরুন প্রজন্মের ছোট মন্ত্রীরা সমাজের জন্য মডেল হন। তাদেরকে দেখে অন্যরা অনুপ্রাণিত হন। এক্ষেত্রে কারো পারিবারিক জীবন নিয়ে যকি স্ক্যান্ডাল হয়, যদি তিনি মিডিয়ার আলোচনার খোরাক হন, তিনি তখন আর তরুণ সমাজের আদর্শ হতে পারেন না।
মন্ত্রীসভায় কোন রদবদল হয়নি। শুধু সংখ্যা বেড়েছে। গুণগত কোন পরিবর্তন হয়নি। আশাবাদী হওয়ার মতো কোন ঘটনাও ঘটেনি। এটা ছোটখাট একটা ‘কসমিক চেঞ্জ’। মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি ঈদের পর আরো একবার মন্ত্রীসভার সম্প্রসারণ ঘটবে। তখন হয়তো আমরা আরা বেশ কয়েকজন পূর্ণমন্ত্রী পাবো। এক্ষত্রে যে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার তা হচ্ছে যোগ্যতা এবং বিতর্কিত নন এমন ব্যক্তিদেরই যেন মন্ত্রীসভায় নেয়া হয়। একসময় যিনি ‘পাখির মতো’ সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন, বিদেশী মন্ত্রীদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেছেন এবং জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে যিনি ছিলেন উদাসীন, তিনি দলের বড় যতো বড় নেতাই হোন না কেন, মন্ত্রীসভার ভাবমূর্তির জন্য তিনি যোগ্য ব্যক্তি নন।
আরেকজনের কথা বলি। সিলেটের শিশু রাজন হত্যার জন্য তিনি দায়ী করেন খালেদা জিয়াকে। মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস এর উত্থানের জন্য তিনি দায়ী করেন বেগম জিয়াকে। তার দূর্নীতি নিয়ে যখন যমুনা টিভি প্রতিবেদন প্রকাশ করে তখন খটকা লাগে। এভাবে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে কী তিনি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন? আমার অবজারভেশনটা হচ্ছে এখানেই। বড় মন্ত্রীসভার প্রয়োজন নেই। দরকার ছোট মন্ত্রীসভা কিন্তু তারা হবেন দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন। যতদূর জানি অতীতে কোন একটি কমিটির সুপারিশ ছিল এমনটাই -২০ থেকে ২৫ জনের মধ্যে মন্ত্রীসভার সদস্য সীমাবদ্ধ রাখা। এটাই সঠিক। সাধারণত ‘জেলা কোটা’, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইত্যাদি কারনে কেবিনেট সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। প্রায় ক্ষেত্রেই যোগ্যতার বিষয়টি খুব একটা বিবেচনায় নেয়া হয় না। তবে বলতেই হবে বর্তমান কেবিনেটে বেশ ক’জন সদস্য রয়েছেন, যারা স্ব স্ব মন্ত্রণালয় পরিচালনায় যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।
সাধারণত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী নেয়া হয়। তবে সংবিধানের ৫৬(২) ধারা মতে, টেকনোক্রেট কোটায় মন্ত্রী নেয়া হয় (মোট সদস্যদের দশভাগের একভাগ)। এই ধারাটি পরিবর্তন প্রয়োজন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা যোগ্য এবং আন্তর্জাতিক আসরে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন, এমন কাউকে কাউকে মন্ত্রীসভায় নেয়া যায়। বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্যনির্ভর বিশ্বব্যবস্থায় যেখানে ‘নেগোশিয়েশনস’ এর বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে কোন কোন মন্ত্রনালয় (বাণিজ্য, শিল্প, পররাষ্ট্র, মানবসম্পদ) পরিচালনায় দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মন্ত্রী প্রয়োজন। সংসদ সদস্যরা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়, দলকে তারা সংগঠিত করে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির অনেক জটিল প্যাচ ও আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে তাদের ধারণা নাও থাকতে পারে। প্রয়োজনটা এ কারনেই।
মন্ত্রীসভার সম্ভাব্য সম্প্রসারণ নিয়ে আরো একটি কথা বলা দরকার। আর তা হচ্ছে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি! কোন কোন মিডিয়ায় এমন আভাষ দেয়া হচ্ছে যে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে (বর্তমানে জনপ্রশাসনমন্ত্রী) আরো বড় দায়িত্ব দেয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই নাকি উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে! যদিও এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দলের অভ্যন্তরে আরো বিতর্ক বাড়াবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা যাবে একসাথে একাধিক উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে কাউকে কাউকে ‘একোমোডেট’ করার জন্য। এটা কোন সমাধান হতে পারে না। যিনি বছরে মাত্র ২০ দিন অফিস করেন, তিনি যতো সৎ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিই হোন না কেন, উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে নিয়োগ দিয়ে তার ‘যোগ্যতা’ বাড়ানো যাবে না। তাই সম্প্রসারণ নয়, দরকার মন্ত্রীদের যোগ্যতা বিচার করা। কোন মন্ত্রী সঠিকভাবে মন্ত্রণালয় চালাতে পারছেন কীনা, নিজেকে দূর্নীতির উর্ধ্বে রাখতে পারছেন কীনা, ‘অতি ক্ষমতাধর’ আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন কীনা এটাই হোক ‘প্রায়োরিটি’, অগ্রাধিকার। ছোট মন্ত্রীসভাও অনেক দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারে। Prio.om 21 July 2015

পারমাণবিক চুক্তির ভবিষ্যৎ

ভিয়েনায় দীর্ঘ ১৭ দিন আলাপ-আলোচনার পর গত মঙ্গলবার ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় জাতির যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাকে 'ঐতিহাসিক' আখ্যায়িত করা হলেও চুক্তিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রথমত, মার্কিন কংগ্রেসে চুক্তিটি অনুমোদিত হতে হবে। না হলে চুক্তিটির কার্যকারিতা থাকবে না। কংগ্রেসের উভয় কক্ষ, সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ এখন ওবামাবিরোধী রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে। তাঁদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে এই চুক্তির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন। ওবামার ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থকরাও সবাই যে খুশি নয় তা-ও তাদের কারো কারো মন্তব্যে মনে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অন্যতম একটি ফ্যাক্টর হচ্ছে ইসরায়েল। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মন্তব্য করেছেন যে 'এটা একটা ঐতিহাসিক ভুল।' ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ চুক্তির কোনো কোনো ধারা নিয়ে সমালোচনা করেছেন। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ওই চুক্তির প্রশংসা এবং ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এই চুক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করলেও ঈশান কোণে একটি 'কালো মেঘ' থাকলই। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে- এই অভিযোগ তুলে ২০০৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বাতিল করার দাবিসংবলিত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এরপর অন্তত এ-সংক্রান্ত আরো ছয়টি প্রস্তাব পরে গ্রহণ করা হয়েছে এবং ইরান ওই কর্মসূচি বাতিল না করায় ২০১০ সালে জাতিসংঘ ইরানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার সম্পদ জব্দসহ দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে ২০০৬ সাল থেকেই ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানি) আলোচনা চলে আসছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে ২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত হাসান রুহানি বিজয়ী হলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। ফলে এই ছয় জাতি আলোচনা আরো গতি পায়। গেল বছরের নভেম্বরে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং এপ্রিলে (২০১৫) সুইজারল্যান্ডের লুজানে একটি খসড়া চুক্তিতে ইরান ও ছয় জাতি উপনীত হয়। গত ৩০ জুনের মধ্যে এই খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু তা হয়নি। এখন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অন্তত একটি জিনিস স্পষ্ট হলো আর তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই সম্পর্ক আরো উন্নত করার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে, প্রশাসনে, সেনাবাহিনীতে এখনো ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর দীর্ঘ ৪৪৪ দিন রেভল্যুশনারি স্টুডেন্টস কর্তৃক তেহরানের মার্কিন দূতাবাস দখল করে নেওয়ার ঘটনার স্মৃতি একটি 'ক্ষতচিহ্ন' হিসেবে রয়ে গেছে। ফলে সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনাটা অতি সহজ ছিল না। এরপর যোগ হয় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। ওই ঘটনার দীর্ঘ ৩৬ বছর পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এই দেশ দুটিকে আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এর ফলেই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো যুক্তরাষ্ট্রের 'বন্ধু' ইসরায়েলের আপত্তি সত্ত্বেও। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিস্টরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় জঙ্গিবাদী ইসলামিক স্টেটের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে হলে তাদের ইরানের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, গেল নভেম্বর মাসে (২০১৪) বারাক ওবামা স্বীকার করেছিলেন তিনি গোপনে ইরানি সমর্থন চেয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। প্রত্যুত্তরে খামেনিও তাঁকে গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। পরে ইয়েমেনে 'হুথি বিদ্রোহ' প্রমাণ করল এখানেও একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনে ইরানের সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে। কেননা হুথিরা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং অভিযোগ আছে, হুথি বিদ্রোহীরা ইরান থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পেয়ে থাকে; যদিও ইরান বারবার তা অস্বীকার করে আসছে। এখন 'ইরান চুক্তি' স্বাক্ষরিত হওয়ায় সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আরো স্বাভাবিক হবে ও যুক্তরাষ্ট্র এটাই চাইছে। একটি সৌদি-ইরান জোট পারস্য অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক, এটা চাইবে মার্কিন স্ট্যাটেজিস্টরা। একই কথা প্রযোজ্য সিরিয়ার ক্ষেত্রেও। তবে নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে উল্লেখ করার মতো। যুক্তরাষ্ট্র যদি 'ইরান চুক্তি'র পরও সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের বিরোধ জিইয়ে রাখে, তাহলে এ অঞ্চলে আইএসের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়বে।
১০৭ পৃষ্ঠাব্যাপী 'ইরান চুক্তি'তে ইরানের করণীয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে চুক্তির দুটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, চুক্তিতে ইরানের পরমাণু তৎপরতা কমিয়ে আনা হবে এবং পূর্ণ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ থাকবে ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। ইরান কোনো কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্য দেশে স্থানান্তর করবে এবং ভবিষ্যতে নতুন কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে না। দ্বিতীয়ত, ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে শিথিল করা হবে। তবে ইরানের ওপর থেকে অস্ত্র রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আপাতত তুলে নেওয়া হচ্ছে না। এখন ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে ইরান এ অঞ্চলে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। ইরানে বিনিয়োগ বাড়বে। বিশেষ করে ইরানের গ্যাস ও তেল সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়বে। তবে অনেক বিষয়ের ওপর এই চুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এক. ইসরায়েলের বিরোধিতা ও মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের আপত্তির মুখে এই চুক্তি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (নভেম্বর ২০১৬) বিষয়টি একটি ইস্যু হয়ে যেতে পারে। দুই. ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সমর্থনের ওপর নির্ভর করছে এই চুক্তির ভবিষ্যৎ। ইরানের সনাতন ধর্মীয় নেতারা এই চুক্তির বিরোধিতা করতে পারেন এবং আয়াতুল্লাহ খামেনিকে এই চুক্তিবিরোধী অবস্থান নিতে বাধ্য করতে পারেন। তিন. ইরানের উদারপন্থীদের জন্য এটা একটা টেস্ট কেস। প্রেসিডেন্ট রুহানির ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে এই চুক্তির ফলাফলের ওপর। ২০১৬ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচন ও ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুহানি পুনর্নির্বাচিত হবেন কি না, সেটা এই চুক্তির ওপর নির্ভর করছে। Daily Kalerkontho 16.07.15

গ্রিসের গণভোট ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

গ্রিসের গণভোটে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের শর্তসংবলিত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রস্তাব (বেইল আউট) প্রত্যাখ্যান হওয়ায় পুরো ইউরো জোনের ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ৫ জুলাই এই গণভোটটি অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটে ভোটারদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ঋণদাতাদের কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে কি না। ভোটাররা 'হ্যাঁ' অথবা 'না' টিক চিহ্ন দিয়ে তাঁদের মতামত প্রকাশ করেছেন। ভোটের ফলাফলে দেখা যায় ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ ভোটার 'না'সূচক জবাব দিয়ে বলেছেন, ঋণদাতারা কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের যেসব শর্ত দিয়েছিল, তা তাঁরা গ্রহণ করবেন না। প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস ও তাঁর সরকার এমনটিই চেয়েছিলেন। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা এবং গ্রিসের ডানপন্থী সংগঠনগুলো চেয়েছিল ভোটাররা হ্যাঁ-সূচক মতামত দিয়ে ঋণদাতাদের প্রস্তাব অনুমোদন করুক। কিন্তু ভোটাররা তা করেননি। গণভোটের এই ফলাফল এখন অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এলো। এক. এর মধ্য দিয়ে গ্রিস কি ১৯ সদস্যবিশিষ্ট 'ইউরো জোন' (যেখানে মুদ্রা হিসেবে ইউরো চালু রয়েছে) থেকে বেরিয়ে যাবে? এবং চূড়ান্ত বিচারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে? দুই. যেখানে গত ৩০ জুন (২০১৫) আইএমএফের ১০০ কোটি ৭০ লাখ ডলার পরিশোধের ব্যর্থতার কারণে গ্রিস দেউলিয়া হয়ে যায়, সেখানে ঋণদাতা সংস্থাগুলো কি গ্রিসের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে আরো ঋণ দেবে? তিন. গ্রিসের এই পরিস্থিতি কি পর্তুগাল, স্পেন ও ইতালিতেও প্রভাব ফেলবে? কেননা এসব দেশও ঋণসংকটজনিত সমস্যায় রয়েছে।
গ্রিসের গণভোটের এই ফলাফল যে সংকটকে আরো গভীরতর করবে, এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এক সপ্তাহ ধরে গ্রিসের সব ব্যাংক বন্ধ রয়েছে। এটিএম কার্ড থেকে মানুষ প্রতিদিন তুলতে পারছে মাত্র ৬০ ইউরো। কিন্তু এখন ব্রাসেলসের ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যদি অর্থ না আসে, তাহলে মানুষ আর টাকা তুলতে পারবে না। অন্যদিকে আইন ভঙ্গ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গ্রিসকে আবার নতুন করে আর্থিক সহায়তা দেবে, এটাও মনে হয় না। ফলে একটি জটিল সমীকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গ্রিস।
কতগুলো পরিসংখ্যান দিলেই বোঝা যাবে সংস্কার আনতে গিয়ে গ্রিসের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ ধস নেমেছে। ২০১০ সালের পর ২৯ লাখ লোকের পেনশনের পরিমাণ ৪৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। এটা করা হয়েছে আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী। গ্রিসের মোট ঋণের পরিমাণ তখন দাঁড়িয়েছে ৩২০ বিলিয়ন ডলারে, যা কিনা জিডিপির ১৮০ শতাংশ। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ কৃচ্ছ্র অবলম্বন করেও গ্রিস ঋণের পরিমাণ কমাতে পারেনি। আইএমএফের পরামর্শ অনুসরণ করে দেশটির জিডিপির পরিমাণ কমেছে, বাড়েনি। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সালে গ্রিসের জিডিপির পরিমাণ যেখানে ছিল ৩৫৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২৪২ বিলিয়ন ডলারে। এই পরিসংখ্যান বিশ্বব্যাংকের। গত ছয় বছরে অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংকট ও আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী চলার প্রায় কাছাকাছি সময় থেকে গ্রিসে ১০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছে। এ মুহূর্তে কর্মক্ষম গ্রিকবাসীর প্রতি চারজনের মধ্যে একজন বেকার। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় দুই লাখ গ্রিক নাগরিক দেশ ত্যাগ করেছেন, যাঁদের অনেকেই দেশে ইঞ্জিনিয়ার অথবা ডাক্তার এবং আইটি সেক্টরে কাজ করতেন। সেদিন বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখলাম মেলবোর্নে প্রায় চার লাখ গ্রিক নাগরিক বসবাস করেন। একজন গ্রিক ব্যাংকারের সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়েছিল, যিনি মেলবোর্নে (অস্ট্রেলিয়া) এখন একটি গ্রিক ক্যাফেতে সাধারণ কাজ করেন। মাত্র ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটিতে ১০ লাখ মানুষের কোনো স্বাস্থ্য ইনস্যুরেন্স নেই। যেখানে ইউরো জোনে বেকারের গড় হিসাব হচ্ছে জনসংখ্যার ১১ দশমিক ১ শতাংশ, সেখানে গ্রিসে এই সংখ্যা ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ। অথচ ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। গত পাঁচ বছর থেকেই গ্রিস আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী অর্থনীতিতে কৃচ্ছ্র সাধন করে আসছে। বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অথবা সেখানে কাটছাঁট করা হয়েছে। বর্তমানে বেতন কমানো হয়েছে ২০ শতাংশ হারে। সরকারি সেক্টরে বেতন বৃদ্ধি 'ফ্রিজ' করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস চেয়েছিলেন ন্যূনতম বেতন ৭৫০ ইউরোতে (৮৩৫ ডলার) উন্নীত করতে। কিন্তু আইএমএফের চাপে তিনি তা পারেননি। গ্রিকবাসীর মাঝে ২০ শতাংশ মানুষের বয়স ৬৫ বছরের ওপরে। এই বুড়ো মানুষগুলোর পেনশন কমানো হয়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ হারে। কিন্তু তাতে করে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি করা যায়নি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে বাংলাদেশে মানুষ দেখেছে গ্রিসে 'হোমলেস' অথবা গৃহহীন মানুষের সংখ্যা কিভাবে বাড়ছে। এই সংখ্যা এখন মোট জনগোষ্ঠীর ২৫ শতাংশ। চিন্তা করা যায় গ্রিসের মতো একটি উন্নত দেশে ২৫ শতাংশ মানুষের থাকার কোনো জায়গা নেই!
গ্রিসের পরিস্থিতিকে অনেকে ২০০১ সালের আর্জেন্টিনার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেন। আর্জেন্টিনা ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। যদিও পরে ঋণদাতারা তাদের স্বার্থেই আবার আর্জেন্টিনাকে ঋণ দিয়েছিল। আজকে গ্রিসের পরিস্থিতিকে জিম্বাবুয়ে ও সোমালিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এ দেশ দুটি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। মূলত বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ কাঠামোগত সামঞ্জস্য বা Structural Adjustment-এর আওতায় এই ঋণ দিয়ে থাকে। এ ধরনের ঋণের সঙ্গে কড়া শর্ত জড়িত থাকে এবং এটা এক ধরনের সুপারিশমালা, যা ঋণগ্রহীতা দেশকে অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই সুপারিশমালা অনুসরণ করে ঋণগ্রহীতা দেশ তাদের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পেরেছে। কাঠামোগত সামঞ্জস্যে যেসব সুপারিশ থাকে, তার মধ্যে রয়েছে; ১. গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা, ২. সরকারি ব্যয় হ্রাস করা, ৩. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষি খাতে ভর্তুকি হ্রাস করা, ৪. প্রকৃত মজুরি হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, ৫. দাম নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, ৬. জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারীকরণ, ৭. উঁচু কর ও সুদের হার বাড়ানো, ৮. আমদানি অবাধ করা, ৯. মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এ সুপারিশমালা গ্রিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। গ্রিসের বামপন্থী সরকার আইএমএফ কর্তৃক দেওয়া এসব সুপারিশের অনেকগুলো গ্রহণ করেও সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তেমন উন্নতি করতে পারেনি। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো এবং সমাজতন্ত্র পরবর্তী পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো (১৯৯১ পরবর্তী) এই কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় ঋণ পেয়ে থাকে। কিন্তু তাতে করে কি ঋণগ্রহীতা দেশের অর্থনীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন এসেছে? কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১৯৭৭-৮৫ সালে পেরুতে বিশ্বব্যাংকের ফর্মুলা অনুযায়ী কাঠামোগত সামঞ্জস্যের শর্তাবলি গ্রহণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, এর ফলে মাথাপিছু আয় ২০ শতাংশ কমেছিল, মুদ্রাস্ফীতি ৩০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৬০ শতাংশে। সেই সঙ্গে বেড়েছিল বেকারত্ব। একই ফল দেখা যায় ফিলিপাইনে ১৯৮৪ সালে। সেখানে কাঠামোগত সামঞ্জস্যের ফলে মাথাপিছু প্রকৃত আয় ১৯৭৫ সালের পর্যায়ে চলে যায় এবং শ্রমিকদের আয় ৪৬ শতাংশ কমে যায়। অনেক গবেষক (সুসান জর্জ, জেমস বোভার্ড) দেখিয়েছেন, সাহায্যের একটা বড় অংশ বৈদেশিক উপদেষ্টা নিয়োগ ও তাদের নীতি অনুসরণের ফলে দাতা দেশেই ফিরে গেছে। উল্লেখ করতে চাই, বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের জুলাই মাস থেকেই এই তথাকথিত কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় বৈদেশিক ঋণ পেয়ে আসছে। আমি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাতে পারব, এই নীতি অবলম্বনের ফলে সমাজতন্ত্র-পরবর্তী পূর্ব ইউরোপে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের জিএনপির পরিমাণ কমে গিয়েছিল। তাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। তাদের প্রতিটি দেশের মুদ্রার মান কমে গিয়েছিল। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বেকার সমস্যা বেড়ে গিয়েছিল। পূর্ব ইউরোপের ওই সব দেশ পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিলেও কোনো একটি দেশও এখন পর্যন্ত ১৯ সদস্যবিশিষ্ট ইউরো জোনে (যেখানে একক মুদ্রা হিসেবে ইউরো চালু রয়েছে) যোগ দিতে পারেনি। এখানে আরো একটি কথা বলা প্রয়োজন, তা হচ্ছে বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ কর্তৃক ঋণ গ্রহণের সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের জাতীয়তাবাদী সরকারের পতনের একটা সম্পর্কও রয়েছে। যেমন- গুয়াতেমালায় আরবেনজ সরকার ১৯৫৪ সালে, ব্রাজিলে গাউলটি ১৯৬৪ সালে, ঘানায় নক্রুমা ১৯৬৬ সালে, চিলিতে আলেন্দে ১৯৭০-৭৩ সালে, আর্জেন্টিনায় ১৯৭২-৭৬ সালে পেরনিস্টরা, ব্রাজিলে গাউলটি সরকার বিশ্বব্যাংকের কোনো ঋণ পায়নি। অথচ তাঁরা যখন উৎখাত হন তখন সেখানে বিশ্বব্যাংকের সাহায্য বেড়ে যায়। গ্রিসের পরিস্থিতি আজ এ আলোকেই বিশ্লেষণ করতে হবে। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো খুব কম ক্ষেত্রেই এই 'ঋণের দুষ্টচক্র' থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। গ্রিসের পরিস্থিতি আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলের মতোই হবে। এই দুটি দেশই অতীতে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণেই দেশ দুটিকে আবারও ঋণ দিয়েছিল, যাতে দেশ দুটি ঋণের সুদ পরিশোধ করতে পারে। না দিলে আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিতে বাধ্য। এ জন্যই ঋণের পরিমাণ বাড়লেও পুঁজিবাদী সংস্থাগুলো তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য ভবিষ্যতেও ঋণ দিয়ে যাবে। চূড়ান্ত বিচারে 'ট্রয়কা' তাদের স্বার্থেই গ্রিসকে আরো ঋণ দেবে। আর প্রশ্নটা এখানেই। এতে করে গ্রিসের অর্থনীতিকে আবারও আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কি?
'ট্রয়কা' (অর্থাৎ আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন) তাদের মতো করে গ্রিসের অর্থনীতি পরিচালনা করতে চাচ্ছিল। কিন্তু তাদের প্রণীত নীতির কারণে গ্রিসের জনগণের কোনো মঙ্গল সাধিত হয়নি। বরং এক ধরনের 'আধিপত্যবাদের' জন্ম হয়েছে সেখানে। ফলে গ্রিকবাসী যে ঋণদাতাদের কৃচ্ছ্রসাধনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এটা বাস্তবতা যে এই ফলাফল এক মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ দেশগুলোতে। জার্মানি ও ফ্রান্সের নেতারা জরুরি বৈঠক করেছেন। প্রশ্ন একটাই- গ্রিককে শর্ত ছাড়া আরো ঋণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেবে কি না? ঋণ না পেলে গ্রিসের জন্য বিকল্প পথ দুটি। এক. তাদের নিজস্ব মুদ্রা 'দ্রাকমা'য় ফিরে যাওয়া, যা খুব সহজ নয়। দুই. চীনের নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে যোগ দেওয়া ও সেখান থেকে ঋণ গ্রহণ করা, যা কি না আইএমএফের বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতাকে একটি প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে এই গণভোট প্রমাণ করল গ্রিকবাসী একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবেই বেঁচে থাকতে চায়। আইএমএফ বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের 'মাতব্বরি' তারা সহ্য করবে না। এটা আইএমএফ তথা বিশ্বব্যাংকের জন্য একটি শিক্ষাও বটে। Daily Kalerkontho 12.07.15

গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট আমাদের কী শিক্ষা দেয়

উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত গ্রিসের ঋণ পরিশোধ করতে না পারা এবং গত ৫ জুলাই গণভোটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ঋণদাতা গোষ্ঠীর প্রস্তাবের প্রত্যাখ্যানের পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কোন পথে এখন গ্রিস এবং গ্রিসের এই সংকট আমাদের কী শিক্ষা দেয়? গ্রিসের শক্তিশালী নেতৃত্ব ‘ট্রয়কা’ শক্তির (আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন) বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এক ধরনের ‘চ্যালেঞ্জ’ ছুড়তে পেরেছিলেন। এতে করে আলোকসিস সিপরাসের নেতৃত্বাধীন সাইরিজা-আনয়েল (ঝুৎরুধ-অহবষ) কোয়ালিশন সরকারের পতন হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। বরং গণভোটে শতকরা ৬১ দশমিক ৩১ ভাগের সমর্থন তিনি পেয়েছিলেন। এই সমর্থন ‘ট্রয়কার’ সঙ্গে গ্রিস সরকারের আলোচনার পথকে আরও প্রশস্ত করবে। এটা সত্য, প্রধানমন্ত্রী সিপরাস এখন অনেক শক্তিশালী। জনগণের ম্যান্ডেট তিনি পেয়েছেন। গণভোটে গ্রিকবাসী স্পষ্টতই রায় দিয়েছে যে, তারা ‘ট্রয়কা’ কর্তৃক প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্যাকেজ (বেইল আউট) সমর্থন করে না। এখানে এখন দুটি সমস্যা তৈরি হয়েছে। এক. গ্রিক জনগণ কৃচ্ছ্রতা কর্মসূচি পরিত্যাগ করায় সিপরাস এখন এই ‘বেইল আউট’ প্যাকেজকে হ্যাঁ বলতে পারবেন না। ভোটে যদি হ্যাঁ ভোট বেশি পড়ত, তাহলে তিনি পারতেন। অন্যদিকে ইউরো জোন নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে জার্মানির অবস্থান। তারা আগের অবস্থান পরিবর্তন করবেন, করলে কতটুকু করবেনÑ সেটা একটা প্রশ্ন এখন। গ্রিস সরকারের সঙ্গে আলোচনায় উভয়পক্ষ কিছুটা নমনীয় হবে, এটাই প্রত্যাশিত। গ্রিসের যেমনি প্রয়োজন রয়েছে ইউরো জোনে থাকা ও ইউরোপীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা ঠিক তেমনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দও চাইবেন না তাদের ঐক্যে ফাটল ধরুক। যুক্তরাষ্ট্রও তা চাইছে না। ন্যাটোর অন্যতম সদস্য গ্রিসে রাশিয়া ও চিনের প্রভাব বাড়–কÑ এটা হোয়াইট হাউস চাইবে না। তবে গ্রিসের গণভোটে কৃচ্ছ্রসাধনের প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় আমি অবাক হইনি। কেননা ২০১০ সাল থেকেই গ্রিস অর্থনৈতিক সংকটে আছে। প্রথম ‘বেইল আউট’ প্যাকেজ গ্রহণ করেও গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। কতগুলো পরিসংখ্যান দিলেই বোঝা যাবে সংস্কার আনতে গিয়ে গ্রিসের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ ধস নেমেছে। ২০১০ সালের পর ২৯ লাখ লোকের পেনশনের পরিমাণ শতকরা ৪৫ ভাগ কমানো হয়েছে। এটা করা হয়েছে আইএসএফের পরামর্শ অনুযায়ী। গ্রিসের মোট ঋণের পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে ৩২০ বিলিয়ন ডলারে, যা কি না জিডিপির শতকরা ১৮০ ভাগ। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির মাত্র ৬০ ভাগ। অর্থাৎ কৃচ্ছ্রতা অবলম্বন করেও গ্রিস ঋণের পরিমাণ কমাতে পারেনি। আইএমএফের পরামর্শ অনুসরণ করে দেশটির জিডিপির পরিমাণ কমেছে, বাড়েনি। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সালে গ্রিসের জিডিপির পরিমাণ যেখানে ছিল ৩৫৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ২৪২ বিলিয়ন ডলারে। এই পরিসংখ্যান বিশ্বব্যাংকের। গত পাঁচ বছরে, অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংকট ও আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী চলার প্রায় কাছাকাছি সময় থেকে গ্রিসে ১০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছেন। এই মুহূর্তে কর্মক্ষম গ্রিকবাসীর প্রতি চারজনের মধ্যে একজন বেকার। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে প্রায় ২ লাখ গ্রিক নাগরিক দেশ ত্যাগ করেছেন, যাদের অনেকেই দেশে ইঞ্জিনিয়ার অথবা ডাক্তার এবং আইটি সেক্টরে কাজ করতেন। সেদিন বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখলাম মেলবোর্নে প্রায় ৪ লাখ গ্রিক নাগরিক বসবাস করেন। একজন গ্রিক ব্যাংকারের সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়েছিল, যিনি মেলবোর্নে (অস্ট্রেলিয়া) এখন একটি গ্রিস ক্যাফেতে সাধারণ কাজ করেন। মাত্র ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটিতে ১০ লাখ মানুষের কোনো স্বাস্থ্য ইন্স্যুরেন্স নেই। যেখানে ইউরো জোনে যে কারোর গড় হিসাব হচ্ছে জনসংখ্যার ১১ দশমিক ১ ভাগ, সেখানে গ্রিসে এই সংখ্যা ২৫ দশমিক ৬ ভাগ। অথচ ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ৭ দশমিক ৮ ভাগ। গত পাঁচ বছর থেকেই গ্রিস আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী অর্থনীতিতে কৃচ্ছ্রসাধন করে আসছে। বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকা- বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অথবা সেখানে কাটছাঁট করা হয়েছে। বর্তমানে বেতন কমানো হয়েছে শতকরা ২০ ভাগ হারে। সরকারি সেক্টরে বেতন বৃদ্ধি ‘ফ্রিজ’ করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সিপরাস চেয়েছিলেন ন্যূনতম বেতন ৭৫০ ইউরোতে (৮৩৫ ডলার) উন্নীত করতে। কিন্তু আইএমএফের চাপে তিনি তা পারেননি। গ্রিকবাসীর মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ মানুষের বয়স ৬৫ বছর বয়সের ওপরে। এই বুড়ো মানুষগুলোর পেনশন কমানো হয়েছে প্রায় ৪৮ ভাগ হারে। কিন্তু তাতে করে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি করা যায়নি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে গ্রিসে ‘হোমলেস’ অথবা গৃহহীন মানুষের সংখ্যা কীভাবে বাড়ছে। এই সংখ্যা এখন মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ২৫ ভাগ। চিন্তা করা যায়, গ্রিসের মতো একটি উন্নত দেশে শতকরা ২৫ ভাগ মানুষের থাকার কোনো জায়গা নেই! গ্রিসের পরিস্থিতিকে অনেকে ২০০১ সালের আর্জেন্টিনার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেন। আর্জেন্টিনা ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে ঋণদাতারা তাদের স্বার্থেই আবার আর্জেন্টিনাকে ঋণ দিয়েছিল। আজকে গ্রিসের পরিস্থিতিকে জিম্বাবুয়ে ও সোমালিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এই দেশ দুটি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। মূলত বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ কাঠামোগত সাহায্য বা ঝঃৎঁপঃঁৎধষ অফলঁংঃসবহঃ-এর আওতায় এই ঋণ দিয়ে থাকে। এই ধরনের ঋণের সঙ্গে কড়া শর্ত জড়িত থাকে এবং এটা এক ধরনের সুপারিশমালা, যা ঋণগ্রহীতা দেশকে অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই সুপারিশমালা অনুসরণ করে ঋণগ্রহীতা দেশ তাদের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পেরেছে। কাঠামোগত সামঞ্জস্যে যেসব সুপারিশ থাকে, তার মধ্যে রয়েছেÑ গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা, সরকারি ব্যয় হ্রাস করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষি খাতে ভর্তুকি হ্রাস করা, প্রকৃত মজুরি হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, দাম নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারিকরণ, উঁচু কর ও সুদের হার বাড়ানো, আমদানি অবাধ করা, মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এসব সুপারিশমালা গ্রিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। গ্রিসের বামপন্থী সরকার আইএমএফ কর্তৃক দেওয়া এসব সুপারিশমালার অনেকগুলো গ্রহণ করেও সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তেমন উন্নতি করতে পারেনি। বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো এবং সমাজতন্ত্র-পরবর্তী পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে (১৯৯১-পরবর্তী) এই কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ সোভিয়েত-নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় ও দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। তাই দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলার কতগুলো শর্ত দেওয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউর সমস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া-হারজেগোভিনা কিংবা ক্রোয়েশিয়া এখনো ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সংকট সব সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সংকটে জর্জরিত ইউরোপে আবারও মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে। ২০১৩-১৪ সময়সীমায় ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের শূন্য প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ইইউর প্রবৃদ্ধিও ছিল শূন্যের কোটায়। তাই ইউরোপ নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। এখন ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ তা আরও বাড়বে। এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুস্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুস্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এই বিভক্তির কথা বলেছিলেন জার্মানির চ্যান্সেলর মেরকেল চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন, এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা। যদিও এই বিভক্তির বিরোধিতা করেছিলেন ইউরোপীয় কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান জোসেফ ম্যানুয়েল বারোসো। এখন সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কি না কিংবা ‘নতুন ইউরোপ’-এর স্বরূপ কী হবে তা এই মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসন্ন তা গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় ব্যর্থতা। তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন যখন ইইউতে থাকা না থাকা নিয়ে গণভোট করতে চান, তখন ইউরোপের ঐক্যে যে ফাটলের জন্ম হয়েছে তারই ইঙ্গিত দিলেন তিনি। ক্যামেরন স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘আমরা যদি এখনই এসব সমস্যা নিয়ে উদ্যোগ নিতে না পারি, তা হলে ইউরোপের পতন হবে এবং ব্রিটিশরাও পতনের দিকে যেতে থাকবে।’ অতীতে ইইউ সম্পর্কে এত ভয়ঙ্কর কথা কেউ বলেননি। এখন ক্যামেরন সাহস করেই বললেন। সামনের দিনগুলো অত্যন্ত কঠিন সময় ইইউর জন্য। অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংকট যদি ইইউ কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায় আগামী এক দশকের মধ্যে আমরা এক ভিন্ন ইউরোপের চেহারা দেখতে পাব।
 Daily Amader Somoy 12.07.15

কালাদান প্রজেক্ট ও বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যৎ

কালাদান প্রজেক্টটি নিয়ে বাংলাদেশে খুব বেশি আলোচনা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। যারা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন কিংবা লেখালেখি করেন, তাদের কোনো প্রবন্ধেও আমি কালাদান প্রজেক্ট নিয়ে খুব একটা আলোচনা দেখিনি। এই মুহূর্তে এর প্রাসঙ্গিকতা এ কারণেই যে, ভারত সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে তথাকথিত কানেকটিভিটির নামে একটি ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির আওতায় ভারতের এক অঞ্চল থেকে (কলকাতা) অন্য অঞ্চলে (ত্রিপুরা ও আসাম) যাত্রীসেবা চালু হয়েছে। এবং সেই সঙ্গে পণ্য পরিবহনও হবে আগামীতে। যদিও চুক্তিতে- যা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় স্বাক্ষরিত হয়- কোথাও ট্রানজিট শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। ব্যবহার করা হয়েছে কানেকটিভিটি শব্দটি। কালাদান প্রজেক্টের সঙ্গে এই ট্রানজিটের বিষয়টি জড়িত। অর্থাৎ কলকাতা থেকে মিজোরামে পণ্য পরিবহনের (মিয়ানমারের ওপর দিয়ে) লক্ষ্যেই এই কালাদান প্রজেক্টটি ভারত হাতে নিয়েছিল এবং ২০০৮ সালের ২ এপ্রিল এ ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছিল। এ প্রজেক্ট বাস্তবায়নে ভারত ৪৫০ কোটি রুপি বরাদ্দ করেছে (দ্য হিন্দু, ১ ফেব্র“য়ারি ২০১৫)। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারত এ কালাদান প্রজেক্ট নিয়ে কতদূর এগিয়ে যাবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় কলকাতা থেকে পণ্য এখন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ত্রিপুরায় পরিবহন করা হবে। এ ক্ষেত্রে ত্রিপুরা দিয়েও সেই পণ্য মিজোরামে পরিবহন সম্ভব। মিজোরামের সঙ্গে সীমান্ত (পূর্বে) রয়েছে মিয়ানমারের এবং উত্তরে বাংলাদেশের। মিজোরামের পশ্চিমে ত্রিপুরা আর সীমান্ত রয়েছে আসামের সঙ্গেও দক্ষিণে। ফলে কানেকটিভিটির দুটি পথ (কলকাতা-ঢাকা-ত্রিপুরা এবং কলকাতা-ঢাকা-আসাম) ব্যবহার করেই একই সঙ্গে ত্রিপুরা থেকে মিজোরামে কিংবা আসাম থেকে মিজোরামে পণ্য পরিবহন সম্ভব। এতে অর্থ ও সময় সাশ্রয় হবে। একসময় ভারত এ কালাদান (মিয়ানমারের কালাদান নদীর নামানুসারে প্রজেক্টটির নামকরণ করা হয়েছে) প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল এ উদ্দেশ্যে যে, এতে তিন পথে (সমুদ্র, নদী ও সড়ক) ভারতের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। প্রথম পর্যায়ে কলকাতা থেকে জাহাজে বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে পণ্য নেয়া হবে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের সিটওয়ে (আকিয়াব) সমুদ্র বন্দরে। এ রুটে ৫৩৯ কিলোমিটার সমুদ্রপথ অতিক্রম করতে হবে। অতঃপর ভারতীয় পণ্য সিটওয়ে থেকে কালাদান নদীপথ ব্যবহার করে নিয়ে যাওয়া হবে নদীবন্দর পালেটওয়ায় (মিয়ানমারের চিন স্টেট), যার দূরত্ব ১৫৮ কিলোমিটার। এরপর সেই পণ্য সড়কপথে ১২৯ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে নিয়ে যাওয়া হবে মিজোরাম সীমান্তে। বোঝাই যায়, কলকাতা থেকে পথটি দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ। মজার কথা, সিটওয়ে সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন ও সড়কপথ উন্নয়নে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হবে, তার পুরোটাই বহন করবে ভারত। বাংলাদেশের সঙ্গে পার্থক্য এখানেই। বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কটি চার লেনে উন্নীত করা হবে। সড়ক উন্নয়নে স্পাইয়ার্স ক্রেডিটের আওতায় ভারত আমাদের ঋণ দেবে। এবং সেই ঋণ আমাদের সুদসহ পরিশোধ করতে হব। বলা ভালো, কালাদান প্রজেক্টে প্রথম স্টেজে (সিটওয়ে সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন, নতুন টার্মিনাল তৈরি) ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ দশমিক ২৪ মিলিয়ন ডলার। সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হবে ৪৯ দশমিক ১৪ মিলিয়ন ডলার। আরাকান রিভার্স নেটওয়ার্কের তথ্য মতে ২০১৪-১৫ সালে এ প্রজেক্ট শেষ হওয়ার কথা। ভারত এ প্রজেক্টটি পরিত্যাগ করেছে এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। মোদির ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা এ প্রজেক্ট নিয়ে আদৌ এগিয়ে আসবেন কি-না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। দ্য হিন্দুর প্রতিবেদন অনুযায়ী এ প্রজেক্টের ব্যয় ইতিমধ্যে প্রায় ২৯ ভাগ বেড়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে- মিয়ানমার এই প্রজেক্টের কোনো ব্যয়ভার বহন না করলেও ভারতীয় পণ্য ও যানবাহনের নিরাপত্তা দেবে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। কারণ মিয়ানমারে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দীর্ঘদিনের। এবং কালাদান প্রজেক্টে যেমন রুট ব্যবহৃত হবে, সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলার আশংকা রয়েছে। তাই নিরাপত্তার বিষয়টি এর সঙ্গে জড়িত। তবে চুক্তি অনুযায়ী এসব রুটে (নদী ও সড়ক) মিয়ানমারের পণ্য এবং জনসাধারণ পরিবহন করা যাবে না। কালাদান প্রজেক্টের সম্ভাবনা যতই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকুক না কেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক সম্পর্ক, বিশেষ করে বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারতের সাতবোন রাজ্য ও নেপাল) জোট আত্মপ্রকাশ করায় বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি একটি প্রশ্নের মুখে থাকল। এখন পূর্বমুখী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বাড়ানোর লক্ষ্যে বিসিআইএম (বাংলাদেশ চীনের ইউনান, ভারতের সাতবোন ও মিয়ানমার) জোট অকার্যকর হয়ে পড়বে। একসময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এ পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তেমন কোনো কথাবার্তা শোনা যায় না। এমনকি সরকারপ্রধান কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেও এটা প্রমাণিত হয়নি, বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে। বলতে গেলে চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলেই (২০০১-২০০৬) বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যাগ নিয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্বমুখিতার কথা বলে বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলাদেশের গত ৪৪ বছরের পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্ব দিগন্তের দেশগুলো ছিল উপেক্ষিত। বিশেষ করে মিয়ানমার কিংবা থাইল্যান্ডের মতো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার কোনো বড় উদ্যোগ অতীতে লক্ষ্য করা যায়নি। পূর্বমুখী নীতি বলতে সাধারণত দক্ষিণ-পূর্ব ও প্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, জোরদার ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগকে বোঝায়। এটি ছিল অনেকটা উপেক্ষিত। যেমন বলা যেতে পারে সিঙ্গাপুরের কথা। ১৯৭৩ সালে সিঙ্গাপুর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশটি সফর করেছিলেন। এরপর ২০০৪ সালে সিঙ্গাপুরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোহ চোক টং বাংলাদেশে এসেছিলেন। এরপর থেকে দেশ দুটির মাঝে উচ্চপর্যায়ে তেমন একটা সফর বিনিময় হয়নি। তবে খালেদা জিয়া ২০০৫ সালে সিঙ্গাপুর সফর করেছিলেন। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের একটা গুরুত্ব আছে। সিঙ্গাপুর কর্তৃক প্রস্তাবিত আমেড-৮-এ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী এশিয়া মিডিল ইস্ট ডায়ালগ-৮ (আমেড-৮)-এর প্রস্তাব করেছিলেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, মিসর, জর্ডান, কুয়েত ও বাহরাইনের সমন্বয়ে প্রস্তাবিত এ ফোরামের লক্ষ্য হবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় এবং পারস্পরিক উন্নয়নের জন্য একে অপরকে সাহায্য করা। পরবর্তীকালে চীনের উদ্যোগে ও ভারতের সমর্থনে নতুন একটি অর্থনৈতিক জোট বিসিআইএম গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় শোনা গেল বিবিআইএনের কথা। এগুলো সবই আঞ্চলিক সহযোগিতা। তবে এর মাঝে বিসিআইএমের গুরুত্ব অনেক বেশি। ২০০৩ সালে চীনের প্রস্তাবিত কুনমিং উদ্যোগই পরবর্তীকালে বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। মজার ব্যাপার হল, ভারত এ ব্যাপারে আগ্রহী হওয়ার পরই এই বিসিআইএম জোটের ধারণা শক্তিশালী হয়। এ জোটটি কার্যকর হলে কুনমিং (চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়কপথে বাংলাদেশে এবং ভারতেও আসা যাবে এবং পণ্য আনা-নেয়া করা যাবে। ফলে চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে। উপরন্তু ২০২০ সালের মধ্যে আসিয়ানে যে মুক্তবাজার সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএমের আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুট ইউনান প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। কিন্তু ক্রমেই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, ভারত ও চীন ধীরে ধীরে এক ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। চীন এখন প্রকাশ্যেই তার ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কর্মসূচি নিয়ে পৃথিবীর ৫০টি দেশকে একটি পতাকাতলে আনতে চায়। ভারত মহাসাগরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এই স্ট্র্যাটেজির অন্যতম অংশ। ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ভারতের স্বার্থের প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ কারণে ভারত তার পাঁচ হাজার বছরের পুরনো কটন রুটকে আবার নতুন আঙ্গিকে পুনর্গঠন করছে। হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌবাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। এ সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারত আবারও ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ফলে ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব অনিবার্য। তাই বিসিআইএম জোট নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবেই। এ জোটের ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ এখন অনেক কমে যাবে। তার অগ্রাধিকার তালিকায় উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন গুরুত্ব পাবে বেশি। একসময় বাংলাদেশের অসহযোগিতার কারণে ভারত কালাদান প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। বাংলাদেশের সঙ্গে কানেকটিভিটি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর যে সমস্যা, তা ভারত সমাধান করেছে। তাই কালাদান প্রকল্প গুরুত্ব পাবে কম। এখন দেখার বিষয় ভারত এ প্রকল্প পরিত্যাগ করে কি-না। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের বিপুল জ্বালানি চাহিদা ও পানি সমস্যার সমাধানে এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা (বিবিআইএন) একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে ভারতের মনোভাবের ওপর অনেককিছু নির্ভর করছে। ভারত যদি দ্বিপাক্ষিক দৃষ্টিকোণের আলোকে এই জোটকে বিবেচনায় নেয়, তাহলে এ জোট নিয়ে প্রশ্ন থাকবে এবং তা কোনো ফল বয়ে আনবে না। আমাদের জন্য পূর্বদিকের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আসিয়ানে আগামীতে একটি মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এখানে রয়েছে একটি বিশাল বাজার। এ বাজার আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত আমেড-৮-এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে, অন্যদিকে বাংলাদেশ যে একটি সহনীয় ইসলাম (মডারেট ইসলাম) ধারণ করে, বিশ্বে এ ধারণা আরও শক্তিশালী হবে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা হবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর। উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুর বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে আমেড-৮-এর প্রস্তাব করেছিল। আমেড-৮-এর অন্য দেশগুলো হচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিসর, জর্ডান, কুয়েত ও বাহরাইন। আমেড-৮-এর কথা প্রথম শোনা গিয়েছিল ২০০৪ সালে সিঙ্গাপুরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময়। আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্ব অনেক বেশি। বিবিআইএনের প্রতি গুরুত্ব বেশি দিলে এ পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি যদি উপেক্ষিত থাকে, তাহলে আমাদের জন্য তা হবে দুঃখজনক। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতিই আমাদের কাম্য। Daily Jugantor 10.07.15