রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশ কি সত্যি সত্যিই সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিতে রয়েছে? ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া সম্প্রতি এই প্রশ্নটি তুলেছে। ২৮ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরে আসার কথা। এখন তারা ওইদিন আসছে না। সবকিছু ঠিক থাকলে ৮ অক্টোবর প্রথম টেস্ট শুরু হওয়ার কথা। এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র ও বাণিজ্যবিষয়ক অধিদপ্তর (ডিএফএটি)। তারা নিরাপত্তা ঝুঁকির প্রশ্নটি তুলেছে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের জন্য যে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ, তা জানাতেও তারা ভোলেনি। কোন কারণে ডিএফএটি এই সিদ্ধান্তটি নিল। আমরা জানি না। Global terrorism Inbox ২০১৪ ঘেঁটে আমরা দেখেছি, তাতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের বাস নেই। বরং পাকিস্তানের নাম আছে ৩ নাম্বারে (প্রথম ইরাক, দ্বিতীয় আফগানিস্তান)। তবে ডিএফএটি যখন এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেয় এবং যা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে, তাতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বৈকি! সন্ত্রাসবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কিন্তু ঝুঁকির সমস্যাটা ভিন্ন। গত প্রায় ১৫ বছর ধরেই বিশ্ব এই সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলা করেছে।
গত ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভাব-গম্ভীর পরিবেশে ১১ সেপ্টেম্বর দিনটি পালিত হয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটির জবাব এখনো পাওয়া যায়নি। এবং বোধকরি কোনোদিন পাওয়াও যাবে না, তা হচ্ছে আসলেই কি মুসলমানরা 'টুইন টাওয়ার' হামলা ও ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল? আসলেই কি আল-কায়েদা এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই হামলা চালিয়েছিল? সারা বিশ্ব অনেক আগেই জেনেছে ষড়যন্ত্রকারীরা সংখ্যায় ছিল ১৯ জন, যাদের প্রায় সবাই সৌদি, ইয়েমেন ও মিসরের নাগরিক। এরা দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে আসছিলেন এবং বিমান চালানোর প্রশিক্ষণও তারা নিয়েছিলেন। এর অর্থ পরিষ্কার দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে তারা অগ্রসর হয়েছিলেন। মোট ৪টি বিমান তারা হাইজ্যাক করেছিলেন। এর মধ্যে ২টি বিমান (আমেরিকান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট এএ ১১ ও ইউনাইটেড এয়ার ফ্লাইট ১৭৫) নিউইয়র্কে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার 'টুইন টাওয়ার'-এ বিধ্বস্ত হয়েছিল। অন্য একটি পেনসিলভানিয়া স্টেট ও অপরটি ভার্জেনিয়া স্টেটে বিধ্বস্ত হয়েছিল। বলা হয় হোয়াইট হাউসে একটি বিমান বিধ্বস্ত করতে চেয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা কিন্তু তা পেনসিলভানিয়ায় ভেঙে পড়ে। এই বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ২৯৯৬ ব্যক্তি, যাদের মধ্যে ২৭৫৩ জনের 'ডেথ সার্টিফিকেট' ইস্যু করা হয়েছিল। বাকিদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারের হামলায় যারা মারা গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরাও ছিলেন, যার সংখ্যা প্রায় ৪০ জন। গবেষকরা দেখিয়েছেন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ষড়যন্ত্রকারীরা ৫ লাখ ডলার ব্যয় করেছিল। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল ১২ বিলিয়ন ডলারের। ইনসিওরেন্স কোম্পানি পরিশোধ করেছিল ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের দাবিনামা। শুধু বিধ্বস্ত ভবন পরিষ্কার করতে ব্যয় হয়েছিল ৭৫০ মিলিয়ন ডলার। এসব পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে এ কারণে যে ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। যারাই এ কাজটা করে থাকুক না কেন, এর পেছনে ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্র। তাহলে যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছিল, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? এটা কী একটা 'ইহুদি ষড়যন্ত্র' যারা 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা এই ঘটনাকে একটি 'ষড়যন্ত্র' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ওই ঘটনায় কোনো মুসলমান জড়িত ছিল না, এ ধরনের তথ্য আমরা জানতে পারি মার্কিন গবেষকদের কাছ থেকেই। পাঠক,Elias Davidson-এর প্রসঙ্গ 'There is no evidence that muslims committed the crime of 9-11' পড়ে দেখতে পারেন। (oPEd News, 10 january, 2008)। শুধু তাই নয়_ অধ্যাপক Michel chossudovsky'র গ্রন্থ AmericaÕs war on Terrorism ও যুক্তরাষ্ট্রের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর পেছনের কাহিনীর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। অধ্যাপক চসুডোভস্কি, যিনি কানাডাতে থাকেন এবং সেখানে একটি গবেষণা সংস্থা পরিচালনা করেন তথ্য-উপাত্তসহ দেখিয়েছেন কারা 'টুইন টাওয়ার' হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বব্যাপী 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' প্রমোট করে কি কি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, তারও হিসাব দিয়েছে। তার মূল্যায়ন হচ্ছে 'টুইন টাওয়ার' ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের যত বেশি ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে লাভ হয়েছে অনেক বেশি। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর আফগানিস্তানের প্রয়াত তালেবান নেতা মোল্লাহ ওমর আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে 'আশ্রয়' দিয়েছেন, এই অভিযোগ তুলে আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটি দখল করে নেয়। এর পরের ইতিহাসও সবাই জানে। ২০০৩ সালে ইরাকে মরণাস্ত্র রয়েছে (Weapoms of Mass Destruction), এই অভিযোগ তুলে ইরাকে বোমা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটি দখল করে নিয়েছিল। এখানেই থেমে থাকেনি যুক্তরাষ্ট্র। লিবিয়াতেও বিমান হামলা চালিয়ে দেশটি ধ্বংস করে দিয়েছিল। অথচ ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানের অ্যাসোটাবাদ শহরে ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে এক মার্কিন সেনা অভিযানে লাদেন নিহত হয়েছেন বলা হলেও, সম্প্রতি প্রকাশিত এক গ্রন্থে দাবি করা হয়েছে অনেক আগেই লাদেন মারা যান। যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএসের অনুসন্ধানী প্রতিবেদক ড্যান রার্থাস তার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে 'টুইন টাওয়ার' হামলার একদিন আগে লাদেন ১০ সেপ্টেম্বর (২০০১) রাওয়ালপিন্ডির মিলিটারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। রার্থাস মনে করেন অসুস্থ লাদেনের পক্ষে সন্ত্রাসী হামলা চালানো ও পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে_ যুক্তরাষ্ট্র সরকার ৯-১১ নামে একটি কমিশন গঠন করেছিল। কমিশন ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পেছনে 'কোন শক্তি' কাজ করেছিল, সে ব্যাপারে কোনো অসুন্ধান করেনি। কমিশনকে এ ব্যাপারে কাজ করতে অনুমতিও দেয়া হয়নি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তবে এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর আল-কায়েদা সারা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়েছিল। দীর্ঘ ১৪ বছর পরও আল-কায়েদার সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধ হয়নি। এই সন্ত্রাসী কর্মকা-ের কারণে মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে যে খারাপ ধারণা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখন আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলামিক স্টেডের নাম। ২১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক আগ্রাসন, লিবিয়া ও সর্বশেষ ঘটনাবলিতে মারা গেছেন প্রায় ১১ মিলিয়ন মানুষ। এর মধ্যে রয়েছে ইরাকে ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ, আফগানিস্তানে ৫ মিলিয়ন, সিরিয়ায় ৫ লাখ। একই সঙ্গে ইতোমধ্যে ৩০ মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। শুধু সিরিয়ার ১১ মিলিয়ন মানুুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। আজ যখন হাজার হাজার সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থী ইউরোপে প্রবেশ করছে, তখন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর ফলে মুসলিম দেশগুলোতে ভয়াবহ অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য আসলে কী?
আমরা পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পকে চাঙ্গা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ও আফগান যুদ্ধে খরচ করেছে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। আর ১ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় এই যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করা হয়। বাহ্যত Corporate Globalization-এর যুগে যুক্তরাষ্ট্রের Corporate House-গুলোর স্বার্থে এসব যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে এবং তারা লাভবান হচ্ছে এসব Corporate House-গুলোরে জন্যই চাই যুদ্ধ। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। ইরাক যুদ্ধের পর ইরাক পুনর্গঠনের কাজ পেয়েছিল বেকটল গ্রুপ (Bectel Group) যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক প্রাথমিকভাবে দেয়া ১০০ বিলিয়ন ডলারের কনট্রাক্ট পেয়েছিল এই সেকটেল গ্রুপ, আর সঙ্গে জড়িত ছিল তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি। এমনকি যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মার্কিন প্রশাসন ৬টি মার্কিন বৃহৎ করপোরেশনের সঙ্গে ইরাক পুনর্গঠনের কাজের জন্য গোপনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। এরাই বুশ প্রশাসনকে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের পর ইরাক তেল বিক্রি করে যুক্তরাষ্ট্রকে এই অর্থ পরিশোধ করেছিল। আজ সিরিয়ার পরিস্থিতি অনেকটা এক রকমই। হঠাৎ করেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইসলামিক স্টেটের আর্বিভাব। সিরিয়ার সব তেল ক্ষেত্রগুলো এখন আইএস জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে। এরা কালো বাজারে তেল বিক্রি করছে। তেলের ব্যারেলপ্রতি মূল্য এখন ৪০ ডলারের নিচে। ফলে লাভবান হচ্ছে মার্কিন সংস্থাগুলো। তারা এখন সস্তায় তেল পাচ্ছে, যা তাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখছে।
একটি ছোট্ট শিশু আইলানের মৃতদেহ সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। এটা ছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফলশ্রুতি। এই যুদ্ধ ওই অঞ্চলে কোনো স্থিতিশীলতা আনতে পারেনি। কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধ করতে পারেনি। যুদ্ধও বন্ধ হয়নি। যতদিন ওই অঞ্চল অস্থিতিশীল থাকবে, যুদ্ধ বজায় থাকবে, ততই লাভ মার্কিন করপোরেট হাউসগুলোর। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। সুতরাং তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র করপোরেট হাউসগুলোর স্বার্থ যেমনি উদ্ধার করছে, তাদের ব্যবসা যেমনি বেড়েছে, ঠিক তেমনি ব্যবসায়ী অঞ্চলে উত্তেজনা জিইয়ে রেখে পরোক্ষভাবে ইহুদিবাদীর পক্ষেই কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্যই বোধকরি যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষক প্রফেসর চমস্কি মন্তব্য করেছেন, যে দেশগুলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রবক্তা তারাই মূলত রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাসের প্রধান মদদদাতা। তিনি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের নামই উল্লেখ করেছেন। তাই খুব সহসাই 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর ধারণা পরিত্যক্ত হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। পারস্যিয় অঞ্চল ছেড়ে সহসাই এই যুদ্ধ সম্প্রসারিত হবে আফ্রিকায়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে এই যুদ্ধের বিস্তার ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখানে মাঝেমধ্যে দু'একজন আকস্মিক জঙ্গির খবর পুলিশ বা র‌্যাবের মাধ্যমে সংবাদপত্রে প্রকাশ পায় বটে, কিন্তু তাদের সঙ্গে বৈশ্বিক জঙ্গিদের কতটুকু মেলানো যাবে, আমি তা নিশ্চিত নই।
বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেটপাগল। তারা ক্রিকেট পছন্দ করেন। আমি বিশ্বাস করি অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন যে বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি ঝুঁকি নেই। এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর অনুষ্ঠিত হবে। এখানে আরো একটা কথা বলা প্রয়োজন। অতীতে আমরা বার বার দেখেছি সরকারের কোনো কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের কথা বলা হচ্ছে। কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে নির্দিষ্ট দুই-একজন বক্তা বার বার এটা বলার চেষ্টা করেন যে বাংলাদেশ জঙ্গি ঝুঁকিতে রয়েছে। দুই-একজন সঞ্চালককেও আমি দেখেছি অতি উৎসাহ সহকারে জঙ্গি তৎপরতা ফলাও করে প্রকাশ করতে। এখন যদি ডিএফএটি ওইসব বক্তব্য, পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার ব্রিফিং আমলে নেয়, তাহলে কী তারা ভুল করবে? নিশ্চয়ই তারা অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশন থেকে পাঠানো এসব প্রতিবেদন আমলে নিয়েছেন। আমার মনে হয় জঙ্গিদের ব্যাপারে আমাদের আরো সতর্ক হয়ে মন্তব্য করা উচিত। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট করেছেন বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা একটা প্রপাগান্ডা মাত্র। র‌্যাবপ্রধানও একই কথা বলেছেন। বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা নেই এটাই হচ্ছে মুদ্দা কথা।
আমরা কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা ইরাকের পরিস্থিতিকে মেলাতে পারব না। ওইসব দেশের পরিস্থিতি আর বাংলাদেশের পরিস্থিতি এক নয়। ২০১৩ সালের পর থেকে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে শতকরা ৩৭ ভাগ হারে, আর আহতদের সংখ্যা বেড়েছে ২৮ ভাগ হারে (গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্স ২০১৪)। কিন্তু বাংলাদেশ যথেষ্ট স্থিতিশীল। মৃত্যু কিংবা আহতের খবর আদৌ নেই। সরকার ও রাষ্ট্র যথেষ্ট স্থিতিশীল এবং সরকার নাগরিকদের জানমাল নিশ্চিত করেছে। সুতরাং আজ ডিএফএটি যে বক্তব্য দিয়েছে, তা কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ আদৌ কোনো ঝুঁকিপূর্ণ দেশ নয়। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ আছে বটে, কিন্তু তা বাংলাদেশকে স্পর্শ করেনি এবং করার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।
কেননা বাংলাদেশের মানুষ সহনশীল ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। মানুষ ইসলামের নামে জঙ্গি তৎপরতা পছন্দ করে না। বরং জঙ্গিবাদকে তারা ঘৃণা করে। তাই আমরা বিশ্বাস করি অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল বাংলাদেশে আসবে এবং আমাদের তামিম-মুশফিকরা আবারো প্রমাণ করবে তারা বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম শক্তি। Daily Jai Jai Din 01.10.15

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদমর্যাদা প্রসঙ্গে

দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন মূলত দুটি বিষয় সামনে রেখে। এক. তাদের জন্য স্বতন্ত্র একটি পে-স্কেল গঠন এবং দুই. তাদের পদমর্যাদা পুনর্নির্ধারণ। এ ব্যাপারে ১৯ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তাদের বৈঠক হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি যেমন আমার সহকর্মীদের দাবি-দাওয়ার বিরুদ্ধে যেতে পারি না, ঠিক তেমনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যাপারে যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে, আমি তা অস্বীকার করি কীভাবে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হোক, কিংবা আলাদা পে-স্কেল দেয়া হোক, এটা বোধকরি সবাই সমর্থন করবেন। তবে তাদের একটা দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করাও জরুরি। কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি টিভির টক-শো দেখছিলাম। আলোচক ছিলেন শিক্ষা সচিব এনআই খান এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মহব্বত খান। নজরুল সাহেব ‘স্পষ্টভাষী’ মানুষ, ‘ভালো কিছু’ করতে গিয়ে এর আগে তিনি বিতর্কিত হয়েছিলেন। কিন্তু ওই দিন টিভিতে তিনি যা বলেছিলেন, তা অস্বীকার করি কীভাবে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকদের সন্তানরা মেধাবী হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে বাবা অথবা মায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে হবে কেন? যুক্তরাষ্ট্রে এমনটি নেই। একজন ছাত্র যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেন, তিনি সাধারণত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন না। তারা তা পারেন না। কিন্তু আমরা তা করি। দিব্যি সিনিয়র শিক্ষক হয়ে আমার সন্তানকে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক বানিয়ে দিচ্ছি। আমরা সুযোগ দিচ্ছি না আমার সন্তানকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে তার মেধার বিকাশ ঘটাতে। প্রতিটি পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটি হচ্ছে। শিক্ষা সচিব এ কথাটাই বলেছিলেন ওই দিন। অধাপক মহব্বত খান গুণী শিক্ষক। আমার নিজেরও শিক্ষক। অত্যন্ত রাসভারী মানুষ। বলেছিলেন শিক্ষকদের পদোন্নতির তথাকথিত ‘রিস্ট্রাকচারিং’ নীতিমালা নিয়ে। তিনি নিজে এর ঘোর বিরোধী। অনেক কিছুই ইদানীংকালে বলা যায় না। পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক হওয়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে কি সম্ভব? আমরা পার্শ্ববর্তী দেশের কিংবা পাকিস্তানের দৃষ্টান্ত দিই পে-স্কেলের ব্যাপারে। কিন্তু সেসব দেশে কি পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক হওয়া যায়? শুধু বলে রাখি, পাকিস্তানের মতো দেশেও পাস করেই প্রভাষক হওয়া যায় না। যার নিজেরই পিএইচডি ডিগ্রি নেই, তিনি এ দেশে অবলীলায় পিএইচডির তত্ত্বাবধান করছেন! পিএইচডি ছাড়া শুধু অধ্যাপকই নয়, এমনকি মঞ্জুরি কমিশনের মতো জায়গায়ও নিয়োগ পাচ্ছি আমরা! বিজ্ঞানের কোনো ডিগ্রি না থাকলেও শুধু ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে! এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কেউ ভাবি না। প্রতিটি বিষয়ের জন্য যদি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কিছু হতে পারে না।অর্থমন্ত্রী শিক্ষকদের নিয়ে কিছু কড়া মন্তব্য করেছিলেন। পরে দুঃখও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? আমরা যারা শিক্ষক, আমাদেরও ভেবে দেখার বিষয় রয়েছে। ১৯৭৩ সালের পদোন্নতির নীতিমালার সঙ্গে ২০১৫ সালের পদোন্নতির নীতিমালাকে মেলানো কি ঠিক হবে? একটু চিন্তাভাবনা করা দরকার। তবে অভিযোগ যাই থাকুক না কেন, শিক্ষকদের সমাজে পদমর্যাদা দিতে হবে। শিক্ষকরা যদি মর্যাদা না পান, তাদের মাঝে ক্ষোভ থাকবেই।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন পে-স্কেলে খুশি হননি। তাদের যুক্তি, সিনিয়র শিক্ষকরা এখন ‘সিলেকশন গ্রেড’ বাতিল হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারা সচিব পদমর্যাদার গ্রেড-১-এর সুযোগ-সুবিধা, বেতনও পাবেন না। প্রশ্ন উঠতেই পারে, সচিবরা নিজেদের সুবিধার জন্য যদি সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে শিক্ষকদের জন্য সিনিয়র অধ্যাপকের পদ নয় কেন? বেতন স্কেলে অধ্যাপকের (সিনিয়র অধ্যাপক নন) গ্রেড এখন ৩-এ। অর্থাৎ তার বেতন শুরু হবে ৫৬,৫০০ টাকা দিয়ে। রাষ্ট্রের ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে’ তাদের অবস্থান অনেক নিচে, যুগ্ম সচিবেরও নিচে! এটা কি শোভন? একজন অধ্যাপককে কি যুগ্ম সচিবের সঙ্গে তুলনা করা যায়? তাহলে একজন উপাচার্যের পদমর্যাদা কী? তিনি যদি ‘সিলেকশন গ্রেড’ভুক্ত প্রফেসর না হয়ে থাকেন (৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন বাদে কেউই সিলেকশন গ্রেডভুক্ত প্রফেসর নন), তাহলে তার পদমর্যাদা কী হবে? ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কি সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে তার ‘ছাত্রতুল্য’ যুগ্ম সচিবদের কাতারে একসঙ্গে বসবেন? সচিব মহোদয়রাই এ কাজটি করলেন! তারা নিজেদেরকে শিক্ষকদের চেয়েও উপরে রাখলেন। অথচ অভিযোগ আছে অনেক সচিবের ডিগ্রি নাকি ‘ভুয়া’। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন, এমন সংখ্যাও কম নয়। এমনকি অনেকে ‘ভুয়া পিএইচডি’ ডিগ্রিও ব্যবহার করেন! ইদানীং দেখি অনেক সিনিয়র সচিব তাদের নামের আগে ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি ব্যবহার করেন। কীভাবে পেলেন এই ডিগ্রি? কোথায় করলেন? এখন তারাই যদি নিজেদের সিনিয়র অধ্যাপকের উপরে রাখেন, তা দুঃখজনক।সচিব আর আমলা কখনও এক হতে পারে না। তাদের কাজের ধরন আলাদা আলাদা। একজন সচিব যে শুধু এখন বেশি বেতন পাবেন, তাই নয়। তাদের সুযোগ-সুবিধা কয়েক লাখ টাকার সমান। যেমন একজন সচিব সার্বক্ষণিক তিনটি গাড়ি ব্যবহার করেন। তার স্ত্রী রাষ্ট্রের কর্মচারী নন। রাষ্ট্রীয় কাজে তিনি কোনো অবদানও রাখেন না। অথচ তিনি সার্বক্ষণিক একটি গাড়ি ব্যবহার করেন! বিভিন্ন প্রকল্প থেকে গাড়ি নিয়ে তা ব্যবহার করেন তার সন্তানরা! যে ‘বাংলো বাড়ি’তে তিনি থাকেন, তার বাসাভাড়া হিসাব করলে মাসপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। তাদের জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল খুব সম্ভবত ‘ফ্রি’। গাড়ির অকটেন, গ্যাস ফ্রি। হিসাব করুন, এ রাষ্ট্র একজন সচিবের জন্য কী খরচ করে, সে তুলনায় একজন শিক্ষক কী পান। এই বেতনই তার একমাত্র ভরসা। আমি কয়েক ডজন অধ্যাপককে চিনি, যাদের গাড়ি নেই, বাড়ি নেই, চলেন রিকশায় আর লক্কড়মার্কা বাসে। রাষ্ট্র তাদের জন্য ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি কেনার ব্যবস্থা করে দেয়নি। কিংবা সরকারি ব্যাংক থেকে কম সুদে বাড়ি, ফ্ল্যাট বা গাড়ি ক্রয় করার ব্যবস্থা করে দেয়নি। অথচ তারাই তথাকথিত ‘সমাজ গড়ার কারিগর’! তারাই সচিবদের ‘জন্ম’ দিয়েছেন, তৈরি করেছেন, শিক্ষিত করেছেন। আর এ সচিব কমিটিই তাদের অমর্যাদা করল। অর্থমন্ত্রী যে ভাষায় শিক্ষকদের সমালোচনা করেছেন, তা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। একজন অবিবেচক মানুষ তিনি। তিনি যে মনেপ্রাণে একজন ‘আমলা’, সেটাই তিনি প্রমাণ করলেন! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। তার মতো একজন সিনিয়র সিটিজেনের কাছ থেকে আমরা এটা আশা করিনি। তার অনাকাক্সিক্ষত বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে সরকারকে একটা মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। তিনি অবশ্য তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কিন্তু ‘ক্ষতি’ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।এটা সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে নন। এটা আমি মনেও করি না। যাদের শিক্ষক হওয়ার কথা ছিল না, তারা ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ শিক্ষক হয়েছেন- এটা অস্বীকার করা যাবে না। যিনি যে বিভাগের ‘ছাত্র’ নন, তাকে সেই বিভাগে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পদোন্নতির নীতি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক, তা বলা যাবে না। এ ব্যাপারে অনেক সরকারি আমলার মাঝে আমি এক ধরনের ‘ক্ষোভ’ দেখেছি। আমার ছাত্র, যারা আমলা হয়েছে, তাদেরও দেখেছি এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে।শিক্ষকরা তাদের যোগ্যতা বলেই পদোন্নতি পেতে চান। কিন্তু এ নীতিমালা যেন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এক হয়, এটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এমনও দেখা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতির নীতিমালার সঙ্গে বেশ পার্থক্য রয়েছে ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগরের নীতিমালার। সরাসরি প্রভাষক হিসেবে নিয়োগেরও আমি বিরোধী। যিনি ভালো ছাত্র, তিনি ন্যূনতম এক বছর গবেষণা করবেন, সিনিয়র শিক্ষকের সহযোগী হিসেবে কাজ করবেন, অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন, তারপরই তাকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হোক। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন শিক্ষক কোনো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘ফুলটাইম’ চাকরি করেন। নৈতিকভাবে তারা কি এটা পারেন? উপাচার্য মহোদয়রা এসব জানেন। কেননা তাদের অনুমতি নিয়েই এ ধরনের কাজ হয়। এ প্রবণতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। অর্থনীতি কিংবা ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক্লাস নেয়ার’ নাম করে ফুলটাইম চাকরিও করেন। নাট্যকলার শিক্ষকরা কাজ করছেন মিডিয়ায়, চ্যানেলে। এটা দুঃখজনক। এটা বন্ধ হোক।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হোক। তাদের বিনা সুদে গাড়ি, ফ্ল্যাট কেনার ব্যবস্থা করা হোক। মূল বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ১০ হাজার টাকা দেয়া হোক ‘বিশেষ ভাতা’ হিসেবে, যাতে তারা নিরুৎসাহিত হন অন্যত্র ক্লাস নিতে। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আইনের আওতায় আনা হোক। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একই পদোন্নতির নীতিমালা হোক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে পিএসসির মতো আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হোক। তরুণ শিক্ষকদের পিএইচডি করতে ‘ফান্ডে’র ব্যবস্থা করা হোক এবং পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক পদে পদোন্নতি নিষিদ্ধ হোক। অধ্যাপক পদে দুটি গ্রেড করা হোক- গ্রেড-১ ও গ্রেড-২। ‘সিলেকশন গ্রেড’ অথবা ১০ বছর অধ্যাপক পদে থাকা অধ্যাপকদের গ্রেড-১-এ পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হোক। তবে শর্ত থাকবে, তাকে একটি গবেষণামূলক বই লিখতে হবে। এছাড়া শিক্ষকদের গবেষণামূলক পাঠ্যবই লিখতে উৎসাহিত করা হোক। এটা আছে বটে; কিন্তু কেউই তা ব্যবহার করেন না।মোটকথা, শিক্ষকদের জন্য একটা দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা হোক। এ দায়বদ্ধতার জন্য চাই সুস্পষ্ট একটি নীতিমালা। একজন শিক্ষক কী করবেন, কতটুকু করতে পারবেন, এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতি থাকা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বায়ত্তশাসনের ভিন্ন ব্যাখ্যা করছেন কি-না, এটা ভেবে দেখা দরকার। রাষ্ট্র বেতন-ভাতা দেবে; কিন্তু এর যেন অপব্যবহার না হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পুরোটাই সরকারি টাকায় চলেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ‘আন্দোলনের’ সীমারেখা কতটুকু থাকা উচিত, তারা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারবেন- এর একটা সুস্পষ্ট নীতি থাকা উচিত। ১৯৭৩ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে ২০১৫ সালের পরিস্থিতি মেলানো ঠিক হবে না। বেতনবৈষম্যকে কেন্দ্র করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে এখনও ক্ষোভ বিরাজ করছে। সরকার বেতনবৈষম্য দূর করার জন্য আগের কমিটিকে পুনর্গঠন করেছে। শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এটা অত্যন্ত পাওয়ারফুল কমিটি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এ কমিটির প্রধান থাকায় শিক্ষকরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।আগামী অক্টোবরের মাঝামাঝি ছাড়া এ কমিটির বৈঠকের কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সংকট থেকেই গেল। আরও একটা কথা। শিক্ষকরা যদি বেতনবৈষম্য আর পদমর্যাদা নিয়ে পড়ে থাকেন, এটাও ঠিক হবে না। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি ৫ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই। অর্থাৎ শিক্ষকতার মান কমে গেছে। যোগ্য শিক্ষক তৈরি হচ্ছে না। যোগ্য শিক্ষক তৈরি করার দায়িত্বটি নিতে হবে মঞ্জুরি কমিশনকে। তরুণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ জরুরি। আমরা আমাদের মর্যাদা ফিরে পেতে চাই- এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি আমাদের দায়িত্ব বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে আমাদের অবস্থান বাড়ানো। Daily Jugantor 28.09.15

একটি ছবি কিন্তু প্রশ্ন অনেক


একটি শিশুর ছবি। কতই বা বয়স হবে ৫ থেকে ৬ মাস। কংক্রিটের রাস্তায় হামাগুড়ি দিচ্ছে, আর অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে পুলিশের দিকে। তুরস্ক-গ্রিস সীমান্তে সিরীয় শরণার্থীদের আটকে দিয়েছে তুরস্কের পুলিশ। বিবিসির ক্যামেরায় আটকে আছে ওই ছবি, যা বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় পাঁচ কলামে ছাপা হয়েছে গত ২০ সেপ্টেম্বর। ছবি কথা বলে। নাম না জানা ওই শিশুটির ভাগ্য ভালো, আয়লান তুর্কির মতো ওকে মৃত্যুবরণ করে সাগরের পাড়ে বালুতে পড়ে থাকতে হয়নি। কিন্তু ওর চাহনি, ওর অব্যক্ত কথা, সিরীয় শরণার্থীদের ব্যাপারে কোনো আশাবাদী করে না। এই শিশুটি বাবা-মায়ের সঙ্গেই ‘নিরুদ্দেশ পথে’ যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু আটকে দিয়েছে তুরস্কের পুলিশ। হয়তো বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ‘হাঁটতে না শেখা’ ওই শিশুটি একাই বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ক্যামেরার চোখ ওকে ফাঁকি দিতে পারেনি। ওই শিশুটির মতো শত শত শিশু তখন হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া আর সেøাভাকিয়ার পথে-প্রান্তরে, এমনকি জঙ্গলে। যাদের ভাগ্য ভালো, তারা জার্মানিতে ঢুকতে পেরেছে। যাদের ভাগ্য ভালো নয়, তারা এখনো পথে-প্রান্তরে, অনেকটা UNHCR-এর (জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা) মুখপাত্র মেলিসা ফেমিংয়ের ভাষায়, ‘পিং পং বল’-এর মতো ইউরোপের এক সীমান্ত থেকে অন্য সীমান্তে যাচ্ছে। ক্রোয়েশিয়া তাদের ফেরত পাঠাচ্ছে হাঙ্গেরিতে। হাঙ্গেরি তাদের ঠেলে দিচ্ছে সেøাভেনিয়ার দিকে। কিন্তু কেউই এখন আর জার্মানি যাওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের সীমান্তে বেড়া দিয়েছে, যাতে করে সিরীয় আর ইরাকি শরণার্থীরা ঢুকতে না পারে। জার্মানি তার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছেÑ তারা আর শরণার্থী নিতে পারছে না। এই শরণার্থী সমস্যা ইউরোপের অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। UNHCR-এর মতে, ইতোমধ্যে ৫ লাখ ৪০ হাজার শরণার্থী ইউরোপে ঢুকেছে। আর সব মিলিয়ে চলতি বছর রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৭ লাখ ৯৪ হাজারে। ১ লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি ‘কোটা’ সিস্টেম আরোপ করেছে। কিন্তু পূর্ব ইউরোপ তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ‘কোটা’ (শরণার্থী) নিতে চাচ্ছে না। তাদের নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে বর্ণবাদের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। শরণার্থীরা হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করলেও কেউই হাঙ্গেরিতে থাকতে চাচ্ছে না। সবার টার্গেট জার্মানি যাওয়ার।

জার্মানির শরণার্থীদের বহনের ঐতিহাসিক ও বাস্তবভিত্তিক কারণ রয়েছে। আমি বেশ কিছুদিন জার্মানিতে ছিলাম। সেখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছি এবং কিছুদিন জার্মান সরকারের অনুবাদক হিসেবেও কাজ করেছি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি জার্মানি বরাবরই শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি প্রায় ১২ লাখ জাতিগতভাবে উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া জার্মান নাগরিককে গ্রহণ করেছিল। এরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে আসছিল। সেই থেকে মূলত শুরু। এরপর ষাটের দশকে যখন জার্মানি অন্যতম শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়, তখন তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে কর্মীর, যারা আবাসন খাতে এবং শিল্প-কারখানায় কাজ করবে। ষাটের দশকে তাই জার্মানি, তুরস্ক, ভিয়েতনাম ও সাবেক যুগোসøাভিয়া, পোল্যান্ড থেকে প্রচুর ‘গাস্ট আরবাইটার’ (অর্থাৎ অতিথি শ্রমিক) গ্রহণ করে। এদের তৃতীয় জেনারেশন (যারা ইতোমধ্যে জার্মান নাগরিকত্ব পেয়েছে) এখন স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। সিরিয়ার নাগরিক আমি কম পেয়েছি জার্মানিতে। তবে তিউনিশিয়া, ইরান ও ইরাকের নাগরিক আমি দেখেছি। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে জার্মানির একটা যোগাযোগ ছিল। ব্রিটেন, ফ্রান্স ছাড়া অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে আরব দেশগুলো থেকে আসা জনগোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটেছে, এটা বলা যাবে না। তাই শরণার্থীরা তাদের প্রথম পছন্দের তালিকায় জার্মানিকে রেখেছিল। বলা ভালো, জার্মানিতে অভিবাসন প্রক্রিয়া অনেক সহজ। ২০০৫ সালে জার্মানিতে নতুন একটি অভিবাসন আইন চালু হয়। তাতে বলা হয়, ‘জার্মানি হচ্ছে অভিবাসীদের দেশ।’ আগে এই আইনটি ছিল না। আমরা যখন আশির দশকে সেখানে পড়াশোনা করেছি, তখন অভিবাসন আইন বেশ কড়াকড়ি ছিল। এমনকি নাগরিকত্ব অর্জনের কাজটিও ছিল বেশ কঠিন। পরে ২০১২ সালে জার্মানি European Blue Card Lesislation আইনটি বাস্তবায়ন করে। এই আইনের মধ্য দিয়ে বিদেশ থেকে ‘বিশেষজ্ঞ’দের অথবা বিদেশি ছাত্ররা যারা জার্মানিতে পড়াশোনা করেছেন (যেমন আইটি সেক্টর, বিজ্ঞানী ইত্যাদি), তাদের কাজের অনুমতিপত্র ও থাকার অনুমতি দেওয়া হয়, যা আগে কখনো ছিল না। জার্মানিতে বর্তমানে আইটি সেক্টরে বেশ কিছু চিনা ও ভারতীয় ‘বিশেষজ্ঞ’ কাজ করছেন। তাদের নাগরিকত্বও দেওয়া হয়েছে।
ফলে সিরীয় শরণার্থীদের জার্মানির ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া ইউরোপের কোনো কোনো দেশে (গ্রিস, ইতালি, পর্তুগাল) অর্থনীতিতে শ্লথগতি ও সেখানে বেকার সমস্যা বাড়লেও জার্মানি ছিল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। জার্মানি ৩ দশমিক ৪১৩ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশ, যা বিশ্বের চতুর্থ বড় অর্থনীতি। মাথাপিছু আয় বছরে ৪১ হাজার ৯৫৩ ডলার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে যেখানে বেকার সংখ্যা প্রায় ২০ ভাগ, সেখানে জার্মানিতে এই সংখ্যা মাত্র ৫ ভাগ। ফলে অনেকের কাছেই এই দেশের ব্যাপারে একটা ‘আকর্ষণ’ রয়েছে। জার্মানি তার অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে হলে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দরকার। পরিসংখ্যান বলছে, শতকরা ৩৮ জন মানুষ জার্মানিতে এখন একা থাকেন। সেখানে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়ছে। আর কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পাচ্ছে। অনেক পরিবার সন্তান নিতে চাচ্ছেন না। তারা পেশার উন্নয়নের প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেন যে, সন্তান পালন করার ‘ঝুঁকি’ তারা নিতে চান না। অথচ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে ‘কর্মী’ দরকার। ফলে ‘গাস্ট আরবাইটার’ তাদের দরকার। উপরন্তু এমন বেশ কিছু পেশা রয়েছে (যেমন রেস্টুরেন্ট কর্মী, আবাসন খাতের কর্মী, কনস্ট্রাকশন কর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ইত্যাদি) যেখানে জার্মান নাগরিকরা কাজ করেন না বা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ফলে তাদের ‘কর্মী’ দরকার। তাছাড়া জার্মানিতে ‘সামাজিক নিরাপত্তা’র বিষয়টি অত্যন্ত শক্তিশালী। অর্থাৎ একজন কর্মী, তিনি যদি বিদেশিও হন এবং তার যদি কাজ করার অনুমতিপত্র থাকে, তিনি যদি বেকার থাকেন, তাহলে রাষ্ট্র তাকে বেকার ভাতা দেবে, বাসা ভাড়া দেবে, সন্তানদের জন্য আলাদা ভাতা দেওয়া হবে এবং মাস শেষে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে খাবার ভাতা দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে কাজ না করেও একজন তার পরিবারপ্রতি মাসে প্রায় ৩ হাজার ইউরো পাবেন। যে কোনো বিবেচনায় সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য এটা বড় পাওয়া। এই সুযোগটি তারা নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। উপরন্তু অনেকে চিন্তা করেন তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ। শরণার্থী মিছিলে আমি অনেক ছোট ছোট শিশু দেখেছি। অভিভাবকরা চিন্তা করেছেন তার সন্তানের ভবিষ্যৎ। উচ্চশিক্ষা নিতেও তাদের কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না, যা আমেরিকা কিংবা ব্রিটেনে চিন্তাও করা যায় না। একজন অভিবাসী ভিয়েতনামের পরিবারের সন্তান এখন জার্মান মন্ত্রী। আমার দেখা অনেক বাংলাদেশি পরিবারের সন্তানরা এখন কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও পিএইচডি ডিগ্রিধারী। সিরীয়রা এই বিষয়টি মাথায় নিয়েছিলেন। হাঙ্গেরি কিংবা অন্য দেশে এই সুযোগটি কম। সেখানে সামাজিক নিরপত্তাও নেই। জার্মানিকে টার্গেট করেই তারা সিরিয়া ছেড়েছিল। জার্মান সরকারের এসব শরণার্থীর ব্যাপারে মূল আগ্রহের কারণÑ এসব শরণার্থীর প্রায় সবার বয়স ৩৫-এর নিচে এবং এদের সঙ্গে সন্তান আছে। অর্থ পরিষ্কারÑ এরা দক্ষ কর্মী হয়ে যাবেন এবং জার্মান অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারবেন, যেমনটি রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা। ফলে শরণার্থীদের ব্যাপারে জার্মানিতে একটা ‘আগ্রহ’ তৈরি হয়েছিল এবং সেটা ছিল স্বাভাবিক। তবে এটাও সত্য, জার্মান সরকার যে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে শরণার্থীদের গ্রহণ করেছে, অন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে এই মানবিকতা এতটুকুও স্থান পায়নি। বরং হাঙ্গেরি কিংবা চেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল উসকানিমূলক। তারা ‘ধর্মীয় প্রশ্ন’ তুলেও তাদের উগ্র মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে জার্মানি ছিল ব্যতিক্রম। জার্মানির একটি ‘কালো ইতিহাস’ আছে। জনগণের ভোটেই হিটলার বিজয়ী হয়েছিলেন এবং তার উগ্রবাদী নীতি জার্মানিকে বিশ্বের দরবারে অনেক ‘ছোট’ করেছিল। হাজার হাজার ইহুদি জনগোষ্ঠীকে হত্যা ও ‘ডিপোর্ট’ করে হিটলার যে ‘রাজনীতি’র সূচনা করেছিলেন, জার্মানির মানুষ তাই আজও তাকে ঘৃণা করে। এত বছর পরও আমি কোনো সন্তানকে ‘হিটলার’ নামে ডাকতে দেখিনি। বরং জার্মান পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখেছি সাধারণ মানুষ শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। অনেককে দেখেছি তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শরণার্থী ফান্ডে তাদের বেতনের ১ ভাগ সরকারকে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। জার্মান সরকার তাদের ‘অতীত ইতিহাস’ থেকে বেরিয়ে এসে শরণার্থীদের গ্রহণ করে (প্রায় ৮ লাখ শরণার্থী এ বছর জার্মানিতে ঢুকবে) বিশ্বে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছেন এবং তাদের মর্যাদাও বেড়েছে। জার্মানি আবারও প্রমাণ করল দেশটি শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়, বরং বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এটা এই মুহূর্তে আর জার্মানির একার সমস্যা নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট করেই বলেছেন, সবাইকে এ সমস্যা ভাগ করে নিতে হবে। কিন্তু হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া, সেøাভেনিয়া, যারা ২৫ বছর আগেও এক একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল, আজ তারা শরণার্থীদের গ্রহণ করতে চাইছে না। সিদ্ধান্ত হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীকে ইউরোপের ২৫টি দেশে (ধনী ১১ ও মাঝারি ধনী ১৪) পুনর্বাসন করা হবে। কিন্তু বাকিদের কী হবে, কেউ জানে না। এত বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি মানবিক কারণে হলেও এই শরণার্থীরা আগামী দিনে সমস্যা তৈরি করতে পারেন। ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী শরণার্থীদের উপস্থিতি ইউরোপের খ্রিস্ট্রীয় সংস্কৃতির প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। একে কেন্দ্র করে উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী, বিশেষ করে জার্মানিতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ২০১৬ সালে ব্রিটেনে গণভোট হবে। গণভোটে বিপুলসংখ্যক মানুষ যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেয়, আমি অবাক হব না। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, শরণার্থীদের দেশত্যাগ বন্ধের ব্যাপারে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের ওপর সামরিক আক্রমণ কেন চালানো হচ্ছে না। এ নিয়ে নানা মত আছে। জাতীয় স্বার্থের কাছে মানবতা স্থান পায়নি যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করলে লাভবান হবে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে পুরো সিরিয়া। অন্যদিকে ইসলামিক স্টেটকে উৎখাত করলে লাভবান হবে সিরিয়ার আসাদ, আর পরোক্ষভাবে রাশিয়া ও ইরানের তাতে লাভ। আসাদের কোনো বিকল্পও নেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ‘মানবিক বিপর্যয়’-এর যুক্তি তুলে লিবিয়ায় জাতিসংঘের অনুমতি ছাড়াই বিমান হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। গাদ্দাফি উৎখাত হয়েছিলেন। আজ একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে সিরিয়ায়। কিন্তু সিরিয়ায় আসাদ কিংবা আইএস উৎখাতে ব্যাপক হামলা হচ্ছে না।
তুরস্ক-গ্রিস সীমান্তে ‘নাম না জানা’ ওই শিশুদের ছবি ও তার অভিব্যক্তি আমাকে মনে করিয়ে দিল, এখানে মানবতা নয় বরং রাজনীতিটাই প্রাধান্য। আর সে কারণে সিরিয়ার শরণার্থী সমস্যার অচিরেই সমাধান হবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই।
Daily Amader Somoy
28.09.15

বেগম জিয়ার লন্ডন সফর এবং বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি

বেগম জিয়া লন্ডন গেছেন ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে। কবে ফিরবেন, সে ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও, এটা ধারণা করা হয় কোরবানির ঈদের পরই তিনি দেশে আসবেন। প্রধানত দুটো কারণে তিনি লন্ডনে গেলেন। প্রথমত চিকিৎসা এবং দ্বিতীয়ত পরিবার। বিশেষ করে বড় সন্তান তারেক রহমান ও প্রয়াত ছোট সন্তান আরাফাত রহমানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে কোরবানির ঈদ উদ্যাপন করা। তিনি লন্ডনে গেলেন এমন একটি সময় যখন তার বিরুদ্ধে একটি মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। দল পুনর্গঠনের কথা বললেও সে প্রক্রিয়া বেগম জিয়া এখনো শুরু করেননি। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দল পুনর্গঠন নিয়ে তিনি তারেক রহমানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবেন। তারেক রহমান দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং দলের ভবিষ্যৎ নেতা। বেগম জিয়া ৭০ বছরে পা দিয়েছেন। শারীরিকভাবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। তার সুস্থতার ওপর দলের অনেক কিছু নির্ভর করছে। এ মুহূর্তে দলে তারেক রহমান ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই যিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তারেক রহমানের লন্ডন অবস্থানের কারণে বেগম জিয়াকে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়েছিল দলের পুনর্গঠন ও সিদ্ধান্ত নিতে। এখন বেগম জিয়া সে কাজটি সারবেন। তবে বেগম জিয়াকে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগামীতে। তার অবর্তমানে দলের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে, কিংবা দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে দলে 'কার্যকরী সভাপতি'র একটি পদ সৃষ্টি করা যায় কি না, এটাও ভাবতে হবে। কেননা এটা স্পষ্ট যে, তারেক রহমান দেশে আসতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে বেগম জিয়া যদি জেলে যান বা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে দল কে দেখবে? ইতোমধ্যে কর্নেল অলির (অব.) বিএনপিতে ফিরে আসা, কিংবা অধ্যাপক বি চৌধুরীর বিএনপিতে ফেরার আগ্রহ, রাজনৈতিক প-িতদের মাঝে নানা প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি এখনো বড় দল। জাতীয় পার্টির ব্যর্থতা বিএনপিকে সামনে নিয়ে এসেছে।
১ সেপ্টেম্বর বিএনপি ৩৭ বছরে পা রেখেছে। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এ ৩৭ বছর একেবারে কম সময় নয়। দলটি একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এ রাজনৈতিক দলটি বর্তমানে এক কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বোধ করি অতীতে কখনই দলটি এ ধরনের সংকটের মাঝে পড়েনি। যারা রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে দলটির একটি শক্ত অবস্থান আছে। তিনবার দলটি ক্ষমতায় ছিল (১৯৭৮-১৯৮২, ১৯৯১-৯৬, ২০০১-২০০৬)। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে দলটির একটি অবস্থান আছে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা থেকে বিএনপির উৎখাতের পর ওই সময় যখন বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে ছিল, ঠিক তখনই একজন গৃহবধূ থেকে (১৯৮৩) রাজনীতির পাদপ্রদীপে আসেন বেগম জিয়া। তখন তিনিই বিএনপির অবিসংবাদিত নেত্রী। তাকে কেন্দ্র করেই বিএনপির রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যে বেগম জিয়াকে দেখেছিল একজন অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে, সেই বেগম জিয়াকে এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে অংশ না নেয়া কিংবা পরবর্তীতে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যে সহিংস রাজনীতির জন্ম হয়েছে এ দেশে তা ব্যক্তিগতভাবে বেগম জিয়া তথা বিএনপির রাজনীতিকে উজ্জ্বল করেনি। বেগম জিয়াকে আমার এমন মনে হয়েছে 'নিঃসঙ্গ একজন নাবিক' হিসেবে, যিনি আদৌ জানেন না কোন দিকে এবং কোন পথে বিএনপি নামক জাহাজটিকে তিনি পরিচালনা করবেন। এক সন্তানহারা অন্য সন্তান অনেক দূরে, নেতা-কর্মীরা জেলে। নিঃসঙ্গ বেগম জিয়া এখন একাই বিএনপি। বর্তমানে বিএনপি নানা সমস্যায় আক্রান্ত এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি দল গোছানোর কথা বলছে। তবে বিএনপির কয়েকজন নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতাদের মাঝে এক ধরনের হতাশা আছে। বিএনপি ভাঙার গুজব এ কারণেই। বেগম জিয়াকে দিয়ে হবে না। কিংবা জিয়ার আদর্শে ফিরে যেতে হবে_ এ ধরনের বক্তব্য যখন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে বের হয়, তখন গুজবের নানা ডালপালা গজায়। মির্জা ফখরুল জামিন পেলেও, অনেকেই জেলে আছেন এখনো। অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা আছে। আর যারা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন ওই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। এর অর্থ পরিষ্কার, মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের 'ব্যস্ত' রাখতে চায় সরকার যাতে তারা 'আন্দোলনে' নিজেদের জড়িত করতে না পারেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অতীতে এমনটি কখনই দেখা যায়নি, এত বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা। ফলে এসব নেতা-কর্মী আর রাজপথে সক্রিয় হতে পারবেন না। বেগম জিয়াকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ২৭ ধারা অনুযায়ী (বিশেষ ট্রাইন্যুনাল গঠনসংক্রান্ত ধারা) বিচার, কিংবা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, একই সঙ্গে ডান্ডি ডায়িং মামলায় তারেক রহমানকে 'শাস্তি' দিয়ে তাকেও অযোগ্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এ ক্ষেত্রে বেগম জিয়াকে নির্বাচনে 'অযোগ্য ঘোষণা' (?) করা হলে আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি নির্বাচনের জন্য যোগ্য হবেন কি না, জানি না। তবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রশ্ন হবে তখন অবাস্তব। বেগম জিয়াই বিএনপির মূল শক্তি। বেগম জিয়া যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, বিএনপির 'বিকল্প নেতৃত্ব' নির্বাচনে অংশ নেবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে বিএনপি সংগঠিত হবে_ এটাও আমার মনে হয় না। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলা কার্যকর করতে চান, আমার ধারণা তা কোনো কার্যকর 'ফল' দেবে না। 'আসল বিএনপি' কিংবা নাজমুল হুদার 'ফালতু কথাবার্তা'য় মানুষ খুব আস্থাশীল এটা আমার মনে হয় না। জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েও সরকার খুব লাভবান হয়নি। জাতীয় পার্টি এখন অস্তিত্বহীনতার মুখে। ফলে সরকারের কাছে এখন বিকল্প পথ দুটি। বিএনপিকে যে কোনোভাবে আস্থায় নিতে ২০১৬ সালের শেষের দিকে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়া। অথবা সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। যে কোনো সময়ের চেয়ে সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। উপরোলি্লখিত দুটি সিদ্ধান্তের মাঝে একটি অর্থাৎ প্রথমটির ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ কম। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচনটিই সরকার করতে চায়। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে বাদ রেখে যদি ২০১৮ সালে নির্বাচন হয়, তাহলে সমস্যা যা ছিল, তা-ই থেকে যাবে। বিএনপির সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আর শক্তিশালী করা যাবে না।
এটা স্বীকার করতেই হবে বাংলাদেশে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিকল্পই বিএনপি, জাতীয় পার্টি নয়। দশম সংসদে জাতীয় পার্টি পারেনি। তাই যে কোনো বিবেচনায় বিএনপির সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা সরকারের জন্য জরুরি। কেননা বাংলাদেশ নিম্নমধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের উপরে, যেখানে ইউরোপের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি এসেছে। এখন নিম্নমধ্য আয়ের দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে হলে এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। আর এর পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু গত দেড় বছরের সংসদীয় রাজনীতির কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায় জাতীয় পার্টি সে দায়িত্বটি পালন করতে পারছে না। ফলে সংসদকে আরো গ্রহণযোগ্য, আরো অর্থবহ এবং সর্বোপরি একটি সঠিক জাতীয় নীতি প্রণয়নে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্ছনীয়। আর বিএনপিই সে দায়িত্বটি পালন করতে পারে। বলা বাহুল্য, বিএনপি সংসদে না থাকলেও বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ, দাতাগোষ্ঠী এটা স্বীকার করে এবং তারা সবাই বিএনপিকে মূলধারার রাজনীতিতেই দেখতে চায়। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অবস্থানও আমার ধারণা অনেকটা সে রকম। সরকারের ভূমিকা তাই এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। এ দুটি দল দুটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে, এ দুটি দলের একটিকে বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল জনগণের ভোটে। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদীয় জমানায় যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, তাতে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ওই সংসদ টিকে থাকেনি। ১৯৮৮ সালের সংসদও টেকেনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশ না নেয়ার কারণে। এ দুই দলের অংশগ্রহণ থাকার কারণেই পঞ্চম সংসদ (১৯৯১), সপ্তম সংসদ (১৯৯৬), অষ্টম সংসদ (২০০১) ও নবম সংসদ (২০০৮) গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির অংশগ্রহণ না থাকায় ৫ জানুয়ারির (২০১৪) দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি অনেক নমনীয় হয়েছে এবং তাদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া অনেক বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে বিএনপি সরকারের সঙ্গে একটি 'শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে' যেতে চায় এবং যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। বিএনপি নেত্রী ও বিএনপির মুখপাত্রের চারটি বক্তব্য দুটি বড় দলের মাঝে একটি 'বরফ গলা'র সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে বলে আমার ধারণা। এক. বেগম জিয়া বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক নয়, বরং একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে। এর অর্থ বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে এখন আর গুরুত্ব দিচ্ছে না। দুই. সৈয়দ আশরাফ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন তিনি দলনিরপেক্ষভাবেই এ মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবেন। বিএনপির মুখপাত্র এ বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিন. ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে বিএনপি সমর্থন করেছে এবং বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ইস্যুতে তারা সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। চার. বিএনপির পক্ষ থেকে 'স্বাভাবিক রাজনীতি' করার দাবি জানানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন একটা ধরপাকড়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপি মুখপাত্র নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করছেন। এখন দেখার পালা বিএনপিকে বড় সমাবেশ করতে সরকার দেয় কি না।
বেগম জিয়ার লন্ডন সফর গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে দলের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করবেন। তিনি ফিরে আসার পরই বোঝা যাবে বিএনপি কোন পথে যাবে? বিএনপিকে নিয়মতান্ত্রিক পথেই আন্দোলন করতে হবে। গত তিন মাসের আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে বিএনপি নিশ্চয়ই অনেক কিছু শিখেছে। সরকারের নিজের স্বার্থেই এখন শক্তিশালী বিএনপিকে রাখা দরকার। তাতে একটা 'চেক অ্যান্ড ব্যালান্স' হয়। জাতীয় পার্টির সুবিধাভোগী আচরণের কারণে তারা এ কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই বিএনপি কী কর্মসূচি নেবে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে বেগম জিয়ার ফিরে আসা পর্যন্ত Daily Jai Jai Din 22.09.15

দুটি পর্যবেক্ষণ ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে দুটি পর্যবেক্ষণের খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। প্রথম পর্যবেক্ষণটি ছিল ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) একটি সার্ভে, যা ছাপা হয়েছিল ২ সেপ্টেম্বর। অন্য পর্যবেক্ষণটি ছিল ব্রিটেনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের, যা ১৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত 'গণতন্ত্র দিবস' উপলক্ষে প্রকাশ করা হয়েছিল। উভয় পর্যবেক্ষণেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশ, সমস্যা, সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয় বেরিয়ে এসেছে। আইআরআইয়ের সার্ভেটি ছিল যেকোনো বিবেচনায় বেশ ইন্টারেস্টিং। গেল বছরও তারা এ ধরনের একটি সার্ভে প্রকাশ করেছিল। মূলত আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা Global strategic partners-এর পক্ষ হয়ে আইআরআই বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় এই সার্ভে পরিচালনা করে। ওই সার্ভেতে যেসব ফলাফল পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়-এক. ৬৬ শতাংশ মানুষ মনে করে সরকার জনপ্রিয় ও প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা রয়েছে ৬৭ শতাংশ মানুষের কাছে। দুই. ৬২ শতাংশ মানুষ মনে করে দেশ ঠিকমতো চলছে। তিন. ৭২ শতাংশ মানুষ মনে করে অর্থনীতি ইতিবাচক। চার. দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে-এটা মনে করে ৬৪ শতাংশ মানুষ। পাঁচ. ৪৩ শতাংশ মানুষ মনে করে সংসদ নির্বাচন দরকার। ছয়. ৬৭ শতাংশ মানুষ মনে করে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করা ভালো। সার্ভেতে দেখা যায়, ৬০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে (অপছন্দ করে ২৯ শতাংশ)। অন্যদিকে ৪২ শতাংশ মানুষ বিএনপিকে পছন্দ করে (অপছন্দ করে ৪৬ শতাংশ)। ৫৯ শতাংশ মানুষ মনে করে গণতন্ত্র দেশটির জন্য ভালো। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ-এটা মনে করে মাত্র ৩৩ শতাংশ মানুষ। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে-এটা মনে করে ৬১ শতাংশ মানুষ, আর ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে, এটা মনে করে ৬৩ শতাংশ মানুষ। আমার বিবেচনায় এই সার্ভের এটিই উল্লেখযোগ্য দিক। অর্থাৎ গণতন্ত্র চাই বটে, সেই সঙ্গে চাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য। অন্যদিকে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিশ্বের ১৬৭টি দেশের গণতন্ত্রের ধরন ও বিকাশ নিয়ে রাষ্ট্রগুলোকে র‌্যাংকিং করেছে। তাতে দেখা যায়, যেখানে স্কোর ১০-এর মধ্যে নরওয়ে ৯ দশমিক ৯৩ স্কোর নিয়ে শীর্ষে রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫তম (স্কোর ৫ দশমিক ৭৮)। তবে ২০০৬ সালের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি হয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৬ দশমিক ১১। মোট পাঁচটি ক্ষেত্রকে সামনে রেখে এই র‌্যাংকিং করা হয়েছে। যেসব নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুমুখিতা (বাংলাদেশের স্কোর ৭ দশমিক ৪২), সরকারের পরিচালনা (বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ০৭), রাজনৈতিক অংশগ্রহণ (বাংলাদেশের স্কোর ৫), রাজনৈতিক সংস্কৃতি (বাংলাদেশের স্কোর ৪ দশমিক ৩৮) ও ব্যক্তিস্বাধীনতা (বাংলাদেশের স্কোর ৭ দশমিক ০৬)। ইকোনমিস্টের সার্ভেতে সরাসরি অর্থনৈতিক বিষয়টি স্থান না পেলেও আইআরআইয়ের সার্ভেতে বিষয়টি উঠে এসেছে। গণতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে যে অর্থনীতির বিষয়টি জড়িত, তা দেখা গেছে। গবেষকরা এখন এ বিষয়কে সামনে রেখে গণতন্ত্রের স্বার্থে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কতটুকু প্রয়োজন সে ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এটা বহুল আলোচিত একটি বিষয়-আগে উন্নয়ন, না আগে গণতন্ত্র। ওপরে উল্লিখিত দুটি সার্ভেতে বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসেছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের ঢেউ বয়ে যায়। বিশেষ করে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে কী ধরনের সমাজ, সংস্কৃতি বিকশিত হয়, এ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল অনেকের। দীর্ঘ ৭৩ বছর রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো একদলীয় সমাজতান্ত্রিক সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সাবেক চেক প্রেসিডেন্ট ভাসলাভ হাভেলের নেতৃত্বে যে 'ভেলভেট রেভল্যুশনের' জন্ম হয়েছিল, তা বদলে দিল পূর্ব ইউরোপকে, সেই সঙ্গে রাশিয়াকেও। অবসান ঘটেছিল স্নায়ুযুদ্ধের। আমেরিকার তাত্ত্বিকদের কেউ কেউ তখন বলার চেষ্টা করেছিলেন যে 'সমাজতন্ত্র একটি ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে' এবং লিবারেলিজমেরই জয় হলো (ফ্রান্সিস ফুকিয়ামা)। তখন থেকেই পূর্ব ইউরোপ তথা রাশিয়ার বিকাশমান গণতন্ত্র নিয়ে যেমন প্রশ্ন ছিল, ঠিক তেমনি প্রশ্ন ছিল উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্র নিয়েও। এখানে অধ্যাপক হানটিংটনের বিখ্যাত প্রবন্ধ (যা পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়) The clash of civilizations the next pattern or conflict-এর কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেখানে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন কোন 'সভ্যতা' ভবিষ্যতে টিকে থাকবে এবং উন্নয়নশীল বিশ্ব কোন বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেবে। অধ্যাপক হানটিংটন লিখেছিলেন, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নৈকট্য বিভিন্ন জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোকে আটটি 'সভ্যতার' ছত্রচ্ছায়ায় একত্র করবে এবং এদের মধ্যকার দ্বন্দ্বই বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তিনি অর্থনৈতিক শক্তিজোট ও আঞ্চলিক শক্তিকে একেবারে অস্বীকার করেননি। তিনি মন্তব্য করেছিলেন এভাবে, ‘Economic regionalism may succeed only when it in rooted is a common civilization.’ অর্থাৎ অর্থনৈতিক জোটগুলো সাফল্য লাভ করবে যদি সাংস্কৃতিক (তথা ধর্মীয়) বন্ধনটা অটুট থাকে। এখানেই রয়েছে মোদ্দাকথাটি। অর্থনৈতিক সাফল্যটিই আসল, রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রধান নয়। যদি আরো খোলাসা করে বলা যায়, তাহলে বলা যেতে পারে, গণতন্ত্র হতে পারে; তবে 'কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়নই মঙ্গল'। গণতন্ত্রকে কাটছাঁট করে যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ এই সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিটিই আসল। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এর বড় প্রমাণ। মালয়েশিয়ার কথাও আমরা উল্লেখ করতে পারি। এ দেশগুলোতে সীমিত গণতন্ত্র আছে। এসব সমাজে বিকাশমান প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সঙ্গে পশ্চিমা সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না, এটা সত্য। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্য, সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্র নিয়ে সেখানকার মানুষ খুশি।
একটি ছোট্ট দেশ সিঙ্গাপুর। দ্বীপরাষ্ট্র। মাত্র ২৫০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে যে রাষ্ট্রটি আজ বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি, তা একসময় 'জেলেদের পল্লী' হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রয়াত লি কুয়ান ইউ এই রাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে গেছেন, তা আজ সবাই জানে। সিঙ্গাপুরকে একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে কাজ করেছিল লি কুয়ান ইউয়ের দর্শন, যেখানে তিনি সফলভাবে প্রয়োগ করেছিলেন এই তত্ত্বটি, 'কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন'। সেখানে গণতন্ত্র আছে। সংসদ আছে। বিরোধী দলও আছে। তবে পিপলস অ্যাকশন পার্টির রয়েছে একক কর্তৃত্ব। একটি শিক্ষিত, দক্ষ, ব্যবসাবান্ধব এলিট শ্রেণি রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সক্রিয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে (ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মতে ‘Hybrid’ গণতন্ত্র) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। অনেকের মতে, কনফুসিয়াস মতবাদ সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিকে অন্যতম একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রাচীন চীনা পণ্ডিত কনফুসিয়াস ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক সমৃদ্ধি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিশ্বাস করতেন (চীনে একসময় কনফুসিয়াস নিষিদ্ধ ছিল। আজ চীন কনফুসিয়াসের মতবাদ ধারণ করে)। সিঙ্গাপুর এই মতবাদ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যবহার করছে। সেই সঙ্গে যোগ্য নেতৃত্ব, রাজনীতিতে শিক্ষিত ও মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ, দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ, সুশাসন ও আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সেই সঙ্গে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সিঙ্গাপুরকে একটি বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে। তথাকথিত পশ্চিমা সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র এখানে বিকশিত হয়নি। সিঙ্গাপুরের নেতৃত্ব এর প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেনি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরেকটি দেশ মালয়েশিয়া। ৬১.৩ শতাংশ অধিবাসী মুসলমান, আর ১১ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর দেশ মালয়েশিয়া। এখানে বিকশিত হয়েছে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র। তবে নিঃসন্দেহে তার সঙ্গে ব্রিটেনের গণতন্ত্রের সঙ্গে কোনো মিল নেই। লি কুয়ান ইউয়ের মতো মালয়েশিয়াকেও মাহাথির মোহাম্মদ উঠতি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন।
এখানে রাষ্ট্রীয় দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে 'ঐক্যই শক্তি'। অর্থাৎ বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত মালয়েশিয়ার জনগোষ্ঠীকে এক পতাকাতলে আনতে ও শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক শক্তির (বারিসোআ ন্যাসিওনাল বা ন্যাশনাল ফ্রন্ট, ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা উমনো যার মূলশক্তি) জন্ম দিয়েছিল মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ১৩টি রাজনৈতিক দলের এই ফ্রন্ট যা মালয়েশিয়ার ঐক্যের প্রতীক, দীর্ঘদিন মালয়েশিয়াকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে ২০০৩ সালে অবসর নেন। এই ২২ বছরে তিনি মালয়েশিয়াকে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন। এখানেও কাজ করেছে সেই স্পিরিট, 'কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন'। সেখানে রয়েছে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। মিডিয়া স্বাধীন নয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত। সংসদ আছে। বিরোধী দলের অস্তিত্বও রয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলের বড় ভূমিকা লক্ষ করা যায় না; যদিও সংসদের নিম্নকক্ষে (Dewan Rakyat) যেখানে ক্ষমতাসীন বারিসোআ ন্যাসিওনালের আসন সংখ্যা ১৩৩, সেখানে বিরোধী দলের ফ্রন্ট (Pakatain Rakyat, ৩ দল) পেয়েছে ৮৯টি আসন। বিরোধী দলের আসন বাড়লেও তা রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নটি এসে যায়। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ছাড়া তা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো একেবারে খারাপ নয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ ধরে রাখা, রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত, দারিদ্র্য কমিয়ে আনা (২৪ শতাংশ), তৈরি পোশাকে ৭৭ লাখ উদ্যোক্তা ও ২৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান, শান্তিসূচকে ৯৮তম স্থান, ডিজিটাল স্বাধীনতায় ৬৩তম স্থান (৮৬টি দেশের মধ্যে) ইত্যাদি সূচক আশার কথা বলে। কিন্তু বড় ব্যর্থতা প্রধান বিরোধী দলকে সরকার আস্থায় নিতে পারেনি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যেখানে 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আমরা তা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি (২০১৪) একটি নির্বাচন হয়েছে, যেখানে 'সব দলের অংশগ্রহণ' ছিল না। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়েছে। রাজনীতি এখন হয়ে পড়েছে অনেকটা একদলীয়। দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি সমাজের সর্বক্ষেত্রে এত প্রকট যে গণতন্ত্র এখানে অনেকটা 'নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র'-এর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এমনকি বিরোধী দলের টানা তিন মাসের আন্দোলন বাংলাদেশে একটি 'বোমাবাজির' রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। এই রাজনীতি সুস্থ গণতন্ত্র চর্চার জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
যাঁরা বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করেন, রাজনীতি নিয়ে সারা জীবন থাকতে চান তাঁদের কাছে এই সার্ভে বা তাদের পর্যবেক্ষণ অনেক চিন্তার খোরাক জোগাবে। আইআরআইয়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে (সারা দেশের মাত্র দুই হাজার ৫২৫ জনের মতামত এতে প্রতিফলিত হয়েছে) প্রশ্ন থাকলেও ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সার্ভেতে বাংলাদেশের অবস্থান অন্য ১৬৬ দেশের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এখানে দ্বিমতের সুযোগ কম। এখন সার্ভেতে যা-ই উঠে আসুক না কেন, তা থেকে সরকার কিংবা প্রধান বিরোধী দল কতটুকু শিক্ষা নেবে-এটিই বড় প্রশ্ন আমাদের। Daily Kaler Kontho 20.09.15

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শেষ কোথায়


    নিউইয়র্কে ‘টুইন টাওয়ার’-এ সন্ত্রাসী হামলার ১৪ বছর পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে এই সন্ত্রাসী হামলার শেষ কোথায়? বিশ্বে কি সন্ত্রাসী কর্মকা- কমেছে? এর জবাব বোধকরি সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন, সন্ত্রাসী কর্মকা- বরং বেড়েছে, কমেনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক Reader Supported News আমাদের জানাচ্ছে যে, ২০০২ সালের পর থেকে সন্ত্রাসী কর্মকা- বেড়েছে শতকরা ৬৫০০ ভাগ হারে। আর সন্ত্রাসী আক্রমণের হার বেড়েছে শতকরা ৪৫০০ ভাগ হারে। মূলত যেখানে মার্কিন সেনার উপস্থিতি ছিল (ইরাক ও আফগানিস্তান, ২০০৭-২০১১) সেখানেই এসব সন্ত্রাসী কর্মকা- সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৪ সালে শতকরা ৭৪ ভাগ সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালিত হয়েছে ৫টি দেশেÑ ইরাক, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও সিরিয়ায়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছোট ও বড় আকারে মার্কিন সেনা উপস্থিতি যেমনি বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে মার্কিন সেনাছাউনির সংখ্যাও। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মার্কিন সেনাছাউনির অথবা ‘বেস’-এর সংখ্যা এখন ৮০০। সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে আফ্রিকাতে, গঠিত হয়েছে  US-African Command (AFRICOM)। আফ্রিকার ২৮ দেশে এখন মার্কিন সেনার উপস্থিতি রয়েছে। আর একে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছে বোকো হারাম, আল কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেব, মুরাবিতুন কিংবা আনসারুর মতো সংগঠন। আর তাতে করে সন্ত্রাসী কর্মকা- বেড়েছে, কমেনি। গত ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভাবগম্ভীর পরিবেশে দিনটি পালিত হয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটির জবাব এখনো পাওয়া যায়নি এবং বোধকরি কোনোদিন পাওয়াও যাবে না, তা হচ্ছেÑ আসলেই কি মুসলমানরা ‘টুইন টাওয়ার’ হামলা ও ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল? আসলেই কি আল কায়েদা এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই হামলা চালিয়েছিল? সারা বিশ্ব অনেক আগেই জেনেছে ষড়যন্ত্রকারীরা সংখ্যায় ছিল ১৯ জন, যাদের প্রায় সবাই সৌদি, ইয়েমেন ও মিসরের নাগরিক। তারা দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে আসছিলেন এবং বিমান চালানোর প্রশিক্ষণও তারা নিয়েছিলেন। এর অর্থ পরিষ্কার, দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে তারা অগ্রসর হয়েছিলেন। মোট ৪টি বিমান তারা হাইজ্যাক করেছিলেন। এর মধ্যে ২টি বিমান (আমেরিকান এয়ারলাইনস ফাইট এএ১১ ও ইউনাইটেড এয়ার ফাইট ১৭৫) নিউইয়র্কে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘টুইন টাওয়ার’-এ বিধ্বস্ত হয়েছিল। অপর একটি পেনসিলভানিয়া স্টেট ও অপরটি ভার্জেনিয়া স্টেটে বিধ্বস্ত হয়েছিল। বলা হয়, হোয়াইট হাউসে একটি বিমান বিধ্বস্ত করতে চেয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা, কিন্তু তা পেনসিলভানিয়ায় ভেঙে পড়ে। এই বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ২ হাজার ৯৯৬ ব্যক্তি, যাদের মধ্যে ২ হাজার ৭৫৩ জনের ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ ইস্যু করা হয়েছিল। বাকিদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারের হামলায় যারা মারা গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরাও ছিলেন। যার সংখ্যা প্রায় ৪০ জন। গবেষকরা দেখিয়েছেন, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ষড়যন্ত্রকারীরা ৫ লাখ ডলার ব্যয় করেছিল। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল ১২ মিলিয়ন ডলারের। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি পরিশোধ করেছিল ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের দাবিনামা। শুধু বিধ্বস্ত ভবন পরিষ্কার করতে ব্যয় হয়েছিল ৭৫০ মিলিয়ন ডলার। এসব পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে এ কারণে যে, ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। যারাই এ কাজটি করে থাকুক না কেন, এর পেছনে ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্র। তাহলে যারা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছিল, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? এটি কি একটি ‘ইহুদি ষড়যন্ত্র’ ছিল? যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা এ ঘটনাকে একটি ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ওই ঘটনায় কোনো মুসলমান জড়িত ছিল না, এ ধরনের তথ্য আমরা জানতে পারি মার্কিন গবেষকদের কাছ থেকেই। পাঠক, Elias Davidson-এর প্রবন্ধ ÔThese is no evidence that Muslims committed the crime of ৯/১১’ পড়ে দেখতে পারেন। (OP.Ed News, 10 January, 2008)। শুধু তাই নয়, অধ্যাপক Michel Choosiness -এর গ্রন্থ America's War on Terrorism ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর পেছনের কাহিনির বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক চসুডোভস্কি, যিনি কানাডাতে থাকেন এবং সেখানে একটি গবেষণা সংস্থা পরিচালনা করেন। তিনি তথ্য-উপাত্তসহ দেখিয়েছেন কারা ‘টুইন টাওয়ার’ হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ প্রমোট করে কী কী সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, তারও হিসাব দিয়েছেন। তার মূল্যায়ন হচ্ছে ‘টুইন টাওয়ার’ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের যত বেশি ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে লাভ হয়েছে অনেক বেশি। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর আফগানিস্তানের প্রয়াত তালেবান নেতা মোল্লা ওমর আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে ‘আশ্রয়’ দিয়েছেন, এ অভিযোগ তুলে আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটি দখল করে নেয়। এর পরের ইতিহাসও সবাই জানে। ২০০৩ সালে ইরাকে মারণাস্ত্র রয়েছে (Weapons of Mass Destruction) এই অভিযোগ তুলে ইরাকে বোমা হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটি দখল করে নিয়েছিল। এখানেই থেমে থাকেনি যুক্তরাষ্ট্র। লিবিয়াতেও বিমান হামলা চালিয়ে দেশটি ধ্বংস করে দিয়েছিল। অথচ ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে এক মার্কিন সেনা অভিযানে লাদেন নিহত হয়েছে বলা হলেও সম্প্রতি প্রকাশিত এক গ্রন্থে দাবি করা হয়েছেÑ অনেক আগেই লাদেন মারা যান। যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএসের অনুসন্ধানী প্রতিবেদক ড্যান রাথার্স (Dan Rathers) তার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ‘টুইন টাওয়ার’ হামলার একদিন আগে লাদেন ১০ সেপ্টেম্বর (২০০১) রাওয়ালপি-ির মিলিটারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। রাথার্স মনে করেন, অসুস্থ লাদেনের পক্ষে সন্ত্রাসী হামলা চালানো ও পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ৯-১১ নামে একটি কমিশন গঠন করেছিল। কমিশন ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পেছনে ‘কোন শক্তি’ কাজ করেছিল, সে ব্যাপারে কোনো অনুসন্ধান করেনি। কমিশনকে এ ব্যাপারে কাজ করতে অনুমতিও দেওয়া হয়নি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তবে এটি আমাদের স্বীকার করতেই হবে, ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর আল কায়েদা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়েছিল। দীর্ঘ ১৪ বছর পরও আল কায়েদার সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধ হয়নি। এ সন্ত্রাসী কর্মকা-ের কারণে মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে যে খারাপ ধারণা হবে, সেটিই স্বাভাবিক। এখন আল কায়েদার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলামিক স্টেটের নাম। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক আগ্রাসন, লিবিয়া ও সর্বশেষ সিরিয়ার ঘটনাবলিতে মারা গেছেন প্রায় ১১ মিলিয়ন মানুষ। এর মধ্যে রয়েছে ইরাকে ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ, আফগানিস্তানে ৫ মিলিয়ন, সিরিয়ায় ৫ লাখ। একই সঙ্গে ইতোমধ্যে ৩০ মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। শুধু সিরিয়ার ১১ মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। আজ যখন হাজার হাজার সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থী ইউরোপে প্রবেশ করছে, তখন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’-এর ফলে মুসলিম দেশগুলোতে ভয়াবহ অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই সংগতকারণেই প্রশ্ন উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য আসলে কী? আমরা পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পকে চাঙ্গা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ও আফগান যুদ্ধে খরচ করেছে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। আর এক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় এই যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করা হয়। বাহ্যত Corporate Globalization-এর যুগে যুক্তরাষ্ট্রের Corporate House -গুলোর স্বার্থেই এসব যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে এবং তারা লাভবান হচ্ছে। এসব Corporate House-এর জন্যই চাই যুদ্ধ। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারেÑ ইরাক যুদ্ধের পর ইরাক পুনর্গঠনের কাজ পেয়েছিল বেকটেল গ্রুপ (ইবপঃবষ এৎড়ঁঢ়)। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক প্রাথমিকভাবে দেওয়া ১০০ বিলিয়ন ডলারের কনট্রাক্ট পেয়েছিল এই বেকটেল গ্রুপ, আর সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি। এমনকি যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মার্কিন প্রশাসন ৬টি মার্কিন বৃহৎ করপোরেশনের সঙ্গে ইরাক পুনর্গঠনের কাজের জন্য গোপনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। এরাই বুশ প্রশাসনকে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের পর ইরাক তেল বিক্রি করে যুক্তরাষ্ট্রকে এই অর্থ পরিশোধ করেছিল। আজ সিরিয়ার পরিস্থিতি অনেকটা এ রকমই। হঠাৎ করেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইসলামিক স্টেটের আবির্ভাব। সিরিয়ার সব তেল ক্ষেত্রগুলো এখন আইএস জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে। এরা কালোবাজারে তেল বিক্রি করছে। তেলের ব্যারেলপ্রতি মূল্য এখন ৪০ ডলারের নিচে। ফলে লাভবান হচ্ছে মার্কিন সংস্থাগুলো, তারা এখন সস্তায় তেল পাচ্ছে যা তাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প মিডিয়ার যারা পাঠক, তারা দেখছেন বিভিন্ন গবেষক তথ্য-উপাত্ত সহকারে দেখিয়েছেন করপোরেট হাউসগুলোর স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ পরিচালনা করে। David Vine তার গ্রন্থে Base Nation: How US Military Bases Abroad Harm America and the World গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব সেনাছাউনি রয়েছে, তা পরিচালনা কিংবা মেইনটেইন করতে শুধু ২০১৪ সালেই খরচ হয়েছে ১৫৬ বিলিয়ন ডলার (আফগানিস্তান ও ইরাকসহ)। এর বাইরে রয়েছে যুদ্ধ খরচ ও বেতনভাতাদি। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছ থেকেই এ টাকা নেওয়া হয়। যার পরিমাণ বছরে ১০ থেকে ৪০ হাজার ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১-এর ঘটনার সঙ্গে (টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনা) যে ‘টাকার খেলা’ জড়িত, তার প্রমাণও আছে। একটি নয়, একাধিক গবেষণা প্রবন্ধে ও গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই টুইন টাওয়ার হামলায় কারা সুবিধা পেয়েছেন। টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর ‘গ্রাউন্ড জিরো’ (সেখানে টুইন পাওয়ার ছিল) কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য। ২০১৪ সালে আমি ‘গ্রাউন্ড জিরো’তে দেখে এসেছি সেখানে দাঁড়িয়ে গেছে সুউচ্চ নতুন একটি ভবন। আর এই ভবন কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে বিশাল এক বাণিজ্য। নিউজার্সি থেকে সরাসরি ট্রেন চালু হয়েছে লোয়ার ম্যানহাটন পর্যন্ত। পর্যটকরা আসছেন। টিকিট কেটে ঢুকছেন। স্যুভেনির কিনছেন। শুধুই বাণিজ্য। মোট ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার খরচ করে তৈরি হয়েছে নতুন শিল্প-বাণিজ্য সংস্থার ভবন। তৈরি করেছে সিলভারস্ট্রেইন প্রোপার্টিজ (Silverstein Properties) নামে একটি ডেভেলপার সংস্থা। এখানে তাদের বিনিয়োগ মাত্র ১৪ মিলিয়ন। চিন্তা করা যায়, ১০৪ তলা নতুন ভবনে সিলভারস্ট্রেইন মাত্র বিনিয়োগ করছে ১৪ মিলিয়ন, বাকিটা বিভিন্ন সংস্থার কাছে এরা ফোর বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করেছে। বলা ভালো, এখানে যে ভবনটি তৈরি হয়েছে (উচ্চতা ১৭৭৬ ফুট) তা শুরু হয় ২০০৬ সালে, আর শেষ হয় ২০১৩ সালে। উদ্বোধন হয় ২০১৪ সালে। নতুন ভবনটির জন্য ইন্স্যুরেন্স করা হয়েছে ৩ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন গবেষকের লেখাতে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, ১১ সেপ্টেম্বর (২০০১) ঘটনার পেছনে ছিল ‘টাকার খেলা’। ১১ সেপ্টেম্বরের ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের পেছনে ২৩ কারণের কথা উল্লেখ করেছেন রিচার্ড এনড্রিউ (Richard Andre তার একটি প্রবন্ধে (৯/১১ Trillions: Follow the Money, Courbet Report, 12 September,২০১৫)। মাইক ম্যালোয় (Mike Malloy) উল্লেখ করেছেন ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১৫ সৌদি নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস ও নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। অভিযুক্ত সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি জাতিসংঘ (OP.Ed News, 11 September, 2015)। একটি রাশিয়ান ওয়েবসাইট বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছে। তারা একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য আমাদের দিয়েছে। আর তা হচ্ছে, ‘টুইন টাওয়ার’ ধ্বংস করার জন্য ড-৫৪ নামে একটি পারমাণবিক অস্ত্র (স্বল্পমাত্রার) ব্যবহার করা হয়েছিল এবং এই ‘ষড়যন্ত্রের’ সঙ্গে জড়িত ছিল অ্যাংলো-আমেরিকান-ইসরায়েলি লবি (Michael Thomas, Resian 9/11 Date Dump Riveals State Actors, Zumfeed, 14 September, 2015)। ড-৫৪ ব্যবহার করা হয়েছিল, যাতে দ্রুত স্টিলের স্ট্রাকচারগুলো গলে যায়। এটি তো ঠিক, টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে যারা মারা গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজনও ইহুদি ছিলেন না। কেন? তাই খুব সংগতকারণেই এই সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে কারা জড়িত ছিল, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিলÑ এটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। দীর্ঘ ১৪ বছর পরও মানুষ আসল তথ্যটি জানল না। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের তালেবানদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা করতে গিয়ে দেশটি কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরাক আক্রমণের (২০০৩) আগে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ বলেছিলেনÑ তিনি ইরাকি জনগণের শান্তির নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। আজ ১২ বছর পর দেখা গেল, হাজার হাজার মানুষ দেশান্তরিত হচ্ছে। ইরাকে শান্তি আসেনি। সিরিয়া কার্যত এখন একটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি বোমা হামলা চালিয়ে তালেবান (আফগানিস্তান) ও সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করতে পারে, তাহলে সিরিয়া ও ইরাক থেকে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের কেন উৎখাত করতে পারছে নাÑ এ প্রশ্ন উঠবেই। এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা বজায় থাকলে লাভ যুক্তরাষ্ট্রেরই। যুক্তরাষ্ট্র এখন নজর দিচ্ছে আফ্রিকায়। পশ্চিম আফ্রিকায় সাদ, নাইজার, মালি, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুনে তথাকথিত সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়ছে। ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসনের। পারস্য অঞ্চলের তেলের নিয়ন্ত্রণ আর পশ্চিম আফ্রিকার খনিজসম্পদের (নাইজারের ইউরেনিয়াম) বড় প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। তাই যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ যে যুদ্ধ শুরু করেছে, তা প্রলম্বিত হবে এবং সম্প্রসারিত হবে। 

ভ্যাট গেল, বাকিগুলোর কী হবে?

শেষ পর্যন্ত সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর আরোপিত শতকরা সাড়ে ৭ ভাগ ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেও এরই মধ্যে অনেক প্রশ্ন উঠেছে, যার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। প্রথমত, কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিকভাবে সচ্ছল হলেও এরা যে ব্যবসা করছে, তাদের আর আর্থিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা গেল না। এখন কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণের পথ বন্ধ হয়ে গেল। ব্যক্তিগতভাবে আমি শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপের পক্ষপাতী নই। শিক্ষায় কেন ভ্যাট আরোপ করা হবে? শিক্ষা তো কোনো পণ্য নয়। কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের আয় থেকেই ভ্যাট দেবে। এটাই প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। যতই বলা হোক না কেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়, এর সঙ্গে সত্যের কোনো মিল নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই এখন লাভজনক। প্রধানমন্ত্রী গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এটা তদন্ত করে দেখতে পারেন। এনবিআরে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইল রয়েছে। অসাধু কর্মকর্তাদের কারণে ওইসব ফাইলে কোনো ত্র“টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের আয়ের সঠিক তথ্য দেন কিনা কিংবা ঠিকমতো কর পরিশোধ করেন কিনা এটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমি কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর জানি, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা হওয়ার পরিবর্তে জমা হয় ভিসি তথা মালিকদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে। এ নিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও কোনো একটি ক্ষেত্রে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এর কোনো রেকর্ড নেই। অভিযোগগুলো সংবাদপত্রের পাতাতেই থেকে যায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে এ বিষয়টি আমার সামনে চলে এলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যদি আয় না-ই হয়, তাহলে কোনো কোনো ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা মিটিংপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা নেন কী করে? মালিকপক্ষ নিশ্চয়ই নিজের পকেট থেকে এ টাকা দেবেন না। আসলে মালিকপক্ষ বিনিয়োগের একটা ক্ষেত্র হিসেবে এখানে বিনিয়োগ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন এবং নানা কৌশলে এখান থেকে তাদের বিনিয়োগকৃত পুঁজি উঠিয়ে নিচ্ছেন। সরকারকে অনুরোধ করব, এনবিআরের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইলগুলো পরীক্ষা করার। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এনবিআর এখানে অনেক ত্রুটি পাবে। শিক্ষা পণ্য নয়, এটা সত্য। ছাত্রদের ভুল ব্যাখ্যা শুনিয়ে তাদের মাঠে নামিয়েছে মালিকপক্ষ। কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষককে টিভি টকশোতে ভ্যাটের বিপক্ষে বলতে শুনলাম। এরা বললেন, এটাই স্বাভাবিক। কেননা এরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন না, চাকরি করেন। তারা মালিক পক্ষের জন্য তদবির করবেন, এটাই স্বাভাবিক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেমিস্টারপ্রতি যে ফি ধার্য করেন (যা আবার এক এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এক এক রকম), তার ভেতরেই ভ্যাট আছে। সুতরাং কর্তৃপক্ষকে এখন ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে, তা যেভাবেই হোক না কেন।দ্বিতীয়ত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনো লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়। যুক্তি হিসেবে এটা যদি সত্য বলে ধরে নিই, তাহলে উচিত হবে অলাভজনক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একত্রিত করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা। এ কাজটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন করতে পারে। তারা একটা স্টাডি করে দেখতে পারে কোন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ভিত্তি কী রকম। তবে ইউজিসির মাধ্যমে কোনো স্টাডি করানো ঠিক হবে না। কেননা সেখানে শর্ষের মধ্যে ভূত আছে। সৎ ও দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে সেখানে। তাদের কমিটমেন্ট নিয়েও প্রশ্ন আছে। ছাত্র অসন্তোষ এ বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এলো।তৃতীয়ত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের ধরন এ রকম যে, এটা এক একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাবা, মা, সন্তানরা সবাই ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। যিনি কোনোদিন শিক্ষকতা করেননি, যাদের কারও কারও বয়স ত্রিশের নিচে, শিক্ষায় যাদের কোনো উচ্চতর ডিগ্রি নেই, তারা কীভাবে ট্রাস্টি বোর্ডে থাকেন? আলু-পটোল আর সিমেন্টের ব্যবসায় তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে তারা বোর্ড মেম্বার হন, আপত্তি কোথায়? আমার আপত্তি সেখানেই যখন দেখি বাবা-মা, ভাই-বোন, বোধ করি নাতিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য! এরা তো শিক্ষা লিডার হতে পারেন না। বাপের টাকা আছে। নতুন একটা ভদ্রজনিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হলে সমাজে সম্মান বাড়ে। তাই আলু-পটোল ব্যবসায়ীরা এখন বিশ্ববিদ্যালয় চালান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার তারা ভিসি হন, নামের আগে ডক্টরেট, অধ্যাপক লাগান। দিব্যি অধ্যাপক পদবি ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির চেয়ারে বসেন। রাষ্ট্রপতি এদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেন কীভাবে? শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের ফাইল প্রসেস করে কীভাবে? এটা দেখার কেউ নেই। কদিন আগে শিক্ষা সচিব দুটো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আকস্মিক সফর করে মিডিয়া কভারেজ পেয়েছিলেন। তিনি তার অসন্তোষের খবর মিডিয়াকে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরোপ করেছিলেন? যদি না করে থাকেন, তাহলে কেন করলেন না? নাকি তিনি করতে পারলেন না? দুঃখ পাই যখন দেখি, তিনি স্পষ্ট কথা বলেন বটে, কিন্তু কাজ করেন ঠিক উল্টো। তার সম্পর্কে তাহলে আস্থাটা থাকে কোথায়? ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের ব্যাপারে যে আইন আছে, তা সংশোধন করা হোক। শুধু শিক্ষাবিদরাই এখানে থাকবেন। আলু-পটোল ব্যবসায়ীরা অন্য ব্যবসা করুন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার দরকার নেই।চতুর্থত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম মনিটর করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের। কিন্তু কমিশন দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না। আমি দুঃখজনকভাবে লক্ষ করেছি ছাত্রদের অসন্তোষ যখন চরমে, চারদিন ছাত্ররা যখন রাস্তা দখল করে একটা অরাজকতা সৃষ্টি করল এবং ঢাকা শহরকে যখন জিম্মি করে ফেলল, তখন মঞ্জুরি কমিশনের একজন সদস্যকেও দেখলাম না সেখানে ছুটে যেতে, ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে। মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানকে দেখলাম বিদেশে- সংকটের গভীরতা অনুধাবন করে তিনি দেশে এলেন না! একজন শিক্ষা লিডার, যার ওপর দায়িত্ব ৩৭টি পাবলিক ও ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখভাল করার, তিনি কী করে এ সংকটে বিদেশে থাকেন? মঞ্জুরি কমিশনে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তারা নমস্য ব্যক্তি। যোগ্য শিক্ষক। পণ্ডিত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করা, নজরদারি করার যে স্ট্র্যাটেজি ও মেধা থাকা দরকার, তা সবার আছে, এটা মনে হয় না। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখভাল করার দায়িত্ব বর্তমানে যার ওপর তাকে নিয়ে কিছু বলা শোভন নয়। কিন্তু একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেননি। একটি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু এ কাউন্সিলটি গঠিত হয়নি, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং করবে, যা দেখে ছাত্রছাত্রীরা তথা অভিভাবকরা তার সন্তানকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাবেন। আমরা একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে একটি ডাটাবেজ তৈরি করার, যাতে করে একজন অভিভাবক জানতে পারেন শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী। কেননা অভিযোগ আছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নাম ব্যবহার করে (ঢাবির সাবেক ভিসি অধ্যাপক ফায়েজের নাম ব্যবহার করতে আমি দেখেছি) কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। আমি এমন অনেক অধ্যাপককে চিনি, যাদের নাম একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবহার করছে শুধু ছাত্র টানার জন্য।ইউজিসি নিয়ে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন। সেখানে একজন সদস্যের দায়িত্ব ৮৩টি (আরও বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয় পাইপলাইনে আছে) বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করার। এটা কি সম্ভব? তিনি কীভাবে দেখবেন এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়? এখন সরকার দুটো কাজ করতে পারে। মঞ্জুরি কমিশন একটি আলাদা উইং প্রতিষ্ঠা করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি স্বতন্ত্র প্রশাসন পরিচালনা করতে পারে। এজন্য সেখানে একাধিক সদস্য নিয়োগ দিতে হবে। এটা করতে হলে মঞ্জুরি কমিশনের আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। অথবা বিকল্প হিসেবে মঞ্জুরি কমিশনের আদলে আরও একটি সংস্থা গঠন করা, যার কাজ হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরদারি করা। ছাত্র অসন্তোষের ঘটনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে, মঞ্জুরি কমিশন ব্যর্থ। মঞ্জুরি কমিশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকুক ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখভাল করার। ১৯৭৩ সালে মঞ্জুরি কমিশন গঠিত হয়েছিল। আজ ২০১৫ সালে এসে ভাবতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। দেশে যেখানে ১২০টি বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে মাত্র ৫ জন সদস্য কীভাবে এর দেখভাল করেন? মঞ্জুরি কমিশনের নামটিরও পরিবর্তন দরকার। সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় শুধু দলীয় লোকদেরই যদি এখানে নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে সুস্থ পরিচালনা নিশ্চিত হবে না। বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে পড়া ব্যক্তি (অনেকের বয়স ৭০-এর কাছাকাছি) কিংবা দলীয় কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকা ব্যক্তিদের এখানে নিয়োগ না দেয়াই মঙ্গল। পঞ্চমত, ছাত্র অসন্তোষের সময় অনেক ছাত্র মিডিয়াকে বলেছে, তারা কোয়ালিটি এডকুশেন চায়। এটাই হচ্ছে আসল কথা। দু-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষকমণ্ডলী আছেন। তারা ভালো শিক্ষা দেন। তাদের জ্ঞানও ভালো। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও একটা বড় প্রশ্ন রয়েছে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। তারা সার্টিফিকেট বিক্রি করেন। সেখানে আদৌ কোনো কোয়ালিটি এডুকেশন নেই। উত্তরায় একটি তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ছাত্রদের কাছে নোট বিক্রি করেন এবং ছাত্রদের বাধ্য করেন তা কিনতে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ভালো শিক্ষকমণ্ডলী নেই। সিনিয়র শিক্ষকেরও অভাব রয়েছে। এক বিভাগের শিক্ষক অন্য বিভাগে পড়ান, এমন খবরও আছে। আবার দেখা গেছে পার্টটাইম শিক্ষক দিয়ে চলছে বিভাগ দিনের পর দিন। আরও একটা ভয়ানক খবর উল্লেখ করতে চাই- প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আইন অনুষদ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের প্রায় সবারই অনার্স ল ডিগ্রি নেই। একজনকে চিনি, যিনি সোসিওলজিতে পাস করে যেনতেন প্রকারে রাতে ল ডিগ্রি নিয়ে (অবশ্যই অনার্স নয়) এখন ধানমণ্ডিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান। আরেকজনের কথা বলি- পাস করেছেন ইসলামিক ইতিহাসে। পিএইচডি আছে ইতিহাসে। এখন আইন বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক। এটাও সম্ভব এ দেশে! এ ক্ষেত্রে ইউজিসির যে নজরদারি থাকা দরকার ছিল, তা নেই। তাই সঙ্গত কারণেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। ভালো ও দক্ষ শিক্ষক না থাকলে ভালো গ্র্যাজুয়েট তৈরি হবে না, এটাই স্বাভাবিক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হাজার হাজার এমবিএ তথা বিবিএ ডিগ্রিধারী তৈরি করছে। কিন্তু কজন যোগ্য? কজন ভালো শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছে? কজন কাজের ক্ষেত্রে তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারছে? এই সমাজ কি হাজার হাজার এমবিএ ডিগ্রিধারীদের জন্য প্রস্তুত? ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক এমবিএ প্রোগ্রাম আছে। সেই প্রত্যন্ত পাবনা কিংবা পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়েও একাধিক এমবিএ প্রোগ্রাম আছে। কারা পড়ান সেখানে? বিশ্বাস করবেন- কলেজ শিক্ষকরা (কমার্সের শিক্ষক) পড়ান সেখানে! আমরা সার্টিফিকেটসর্বস্ব একটি জাতিতে পরিণত হয়েছি। আর যার মামার জোর আছে, তারা ওইসব ডিগ্রি দেখিয়ে ভালো চাকরিও বাগিয়ে নিচ্ছেন। ডিগ্রি পাস করে আমলা হওয়া অনেক সহকারী ও উপসচিব এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (কোনো ক্লাস না করেই) মাস্টার্স ডিগ্রি ক্রয় করছেন। এ প্রবণতা আমরা বন্ধ করতে পারিনি।এভাবে হাজার হাজার গ্রাজুয়েটের মাস্টার্স পড়ার কোনো দরকার নেই। পৃথিবীর কোনো দেশে এ নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। গ্রাজুয়েট শেষ করে সবাই কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণ করে। যারা শিক্ষকতায় যাবেন, শুধু তারাই মাস্টার্স করবেন। সরকারি চাকুরেদের জন্যও মাস্টার্সের প্রয়োজন নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা গ্রাজুয়েট তৈরি করার জন্য রেখে দিতে পারি। কিন্তু আমাদের শিক্ষা নীতিতে তা নেই। বছরে ক্লাস না করেও অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়া যায়-জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর বড় প্রমাণ। আর সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষকরা ক্লাস নেন না। তারা বাড়িতে প্রাইভেট পড়ান। একজন বাংলায় বা ইসলামের ইতিহাসে অনার্স পড়–য়া ছাত্র প্রাইভেট পড়ে- এটাই বাস্তবতা। কিন্তু দেখভাল করার কেউ নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা আসেন। যান। কিন্তু কোনো উদ্যোগ দেখি না ভালো করার।বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অসন্তোষ আমাদের চোখ খুলে দিল কিনা জানি না। কিন্তু দেখলাম এতবড় সংকটে শিক্ষামন্ত্রী নেই। মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নেই। তারা বিদেশে সেমিনারে অভিজ্ঞতা অর্জন করা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন! আর এ জাতি সংকটের মধ্য দিয়ে কাটাল কয়েকটি দিন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকেই সিদ্ধান্ত নিতে হল। তিনিই এগিয়ে এলেন। হতে পারে অর্থমন্ত্রী বয়সের কারণে সঠিকভাবে শব্দ চয়ন করতে পারেননি। যেখানে ব্যবসা হয়, সেখানে ভ্যাটের প্রশ্ন আসবেই- এটাকে ভ্যাট না বলে আয়ের ওপর ট্যাক্স আরোপের কথা বলা যেতে পারত। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কেউ এলেন না। সরকারকে একটি বেকায়দায় ফেলার কি কোনো উদ্যোগ ছিল? ঘটনা যাই ঘটে থাকুক না কেন, মালিকপক্ষের ভূমিকা প্রশ্নের মাঝে থাকল। সেই সঙ্গে থাকল মালিকপক্ষের সমিতির ভূমিকাও। Daily Jugantor 18 September 2015

অভিবাসী সমস্যা :আন্দামান থেকে ভূমধ্যসাগর

আন্দামান সাগরে ভাসমান বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের করুণ কাহিনীর রেশ শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভূমধ্যসাগরে তথা হাঙ্গেরিতে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সিরীয় শরণার্থীদের কাহিনী এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনার অন্যতম বিষয়। মূল বিষয়, অর্থাৎ শরণার্থী সমস্যা এক থাকলেও, উভয় ঘটনায় কিছু মিল, কিছু অমিল আছে। ছোট শিশু আয়লান কুর্দির মৃতদেহ তুরস্কের উপকূলে পাওয়া গিয়েছিল বিধায় তা মিডিয়ায় ঝড় তুলেছিল এবং শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু আন্দামান সাগরে আয়লানের মতো কত রোহিঙ্গা শিশু না খেয়ে পিপাসায় মারা গেছে, তার হিসাব আমরা কোনো দিনই পাব না। সিরীয় কিংবা ইরাকি শরণার্থীদের এখন বলা হচ্ছে জবমরসব পযধহমব ৎবভঁমব অর্থাৎ সরকার পরিবর্তনের কারণে হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা যখন ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে তাদের দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল, তখন কোথাও আমি 'ধর্মীয় শরণার্থী' এ ধরনের কথা শুনিনি। তবে বাস্তবতা হলো এটা_ পাচারকারীরা আন্দামান সাগরে যেমনি শরণার্থীদের নিয়ে নৌকা ভাসিয়েছিল, ঠিক তেমনি ভূমধ্যসাগরেও তারা নৌকায় মানুষ তুলেছিল। এ মানব পাচারকারীরা আছে সর্বত্র। তাদের সবার চরিত্র এক।
তাই প্রশ্ন অনেক। এ মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি চক্র। এরা যেমন আছে বাংলাদেশ-মিয়ানমারে, ঠিক তেমনি আছে তুরস্কে, থাইল্যান্ডে আর মালয়েশিয়ায়। এখানে পাচারকারীরা মূলত প্রথমে টার্গেট করেছিল রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের, যারা মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের বাসিন্দা। মিয়ানমারে কয়েক বছর ধরেই এক ধরনের 'এথনিক ক্লিনসিং' অর্থাৎ অত্যন্ত সুকৌশলে মুসলমানদের আরাকান থেকে উৎখাত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধরাষ্ট্রে পরিণত করতে চান বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। আর এদের মদদ জোগাচ্ছে মিয়ানমারের শাসকচক্র। বৌদ্ধধর্ম শান্তির ধর্ম। এরা অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু আরাকানে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের কর্মকা- তা প্রমাণ করে না। যারা সংবাদপত্রের নিয়মিত পাঠক, তারা লক্ষ্য করেছেন বেশ কিছু দিন ধরেই আরাকানে জন্ম নেয়া ও সেখানে বসবাসরত মুসলমান নাগরিকদের (যারা রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত) ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এক বছর ধরে মিয়ানমারে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হচ্ছে না। মিয়ানমারের শাসকচক্র মনে করেন রোহিঙ্গারা মূলত চট্টগ্রামের অধিবাসী এবং তারা অবৈধভাবে আরাকানে বসবাস করছেন! অত্যন্ত কৌশলে এদের বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে ঠেলে দেয়ার প্রয়াস চালানো হয়েছে একাধিকবার। এরপর একটি 'চক্র' এদের কৌশলে মালয়েশিয়া পাচার করার উদ্যোগ নেয়। এর সঙ্গে যোগ হয় বাংলাদেশের মানব পাচারকারীরা। বাংলাদেশিরাও চাকরির আসায় যেতে চায় মালয়েশিয়ায়। কৌশলে পাচারকারীরা তাদের বড় সাম্পানে তুলে দিয়ে পরে থাইল্যান্ডের পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয় এবং মুক্তিপণ দাবি করা হয়। সমস্যাটা তৈরি হয়েছিল এভাবেই। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশিদেরও নেয়া হয় এবং পরে তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। রোহিঙ্গাদের বলা হয়েছিল মালয়েশিয়ায় আশ্রয় দেয়ার কথা। এখানে মিয়ানমার সরকারের প্রচ্ছন্ম ইঙ্গিতও ছিল। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা হচ্ছে সমুদ্রোপকূলবর্তী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যদের যোগসাজশে এ মানব পাচার চলে আসছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা নিয়েও খবর বের হয়েছিল। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা অস্বীকার করেছেন। এ মানব পাচারের ঘটনা যে এই প্রথম ঘটল, তা নয়। এর আগেও ঘটেছে। কিন্তু তা প্রকাশ পেয়েছে কম। এবারই সম্ভবত ব্যাপক মানব পাচারের ঘটনা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে স্থান পেয়েছিল। এখানে আরো একটা বিষয় দৃষ্টকটু_ এ মানব পাচারের ঘটনা বাংলাদেশের নৌবাহিনী কিংবা কোস্টগার্ডের চোখ এড়িয়ে গেল কিভাবে? কোস্টগার্ডের না হয় সমুদ্রে যাওয়ার বড় জাহাজ নেই। কিন্তু নৌবাহিনী? সমুদ্রসীমায় টহল দেয়া, বিদেশি মাছ ধরা ট্রলারগুলোর বাংলাদেশি সমুদ্রসীমায় প্রবেশে বাধাদান, সমুদ্রসীমান্ত রক্ষা এসবই তো নৌবাহিনীর কাজ। তাদের তো গভীর সমুদ্রে যাওয়ার জাহাজ রয়েছে। অতিসম্প্রতি নতুন নতুন জাহাজ নৌবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে। লেবাননে শান্তি মিশনে গিয়েছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনী। তাহলে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে সাগরপথে যে মানব পাচার হচ্ছে তা তাদের দৃষ্টিতে এলো না কেন? স্থানীয় কমান্ডার কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছিলেন? আরো দুর্ভাগ্য আমাদের যে, এ ঘটনায় বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। ভাবমূর্তি উদ্ধারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী ভূমিকা নেয়, সেটাই দেখার বিষয় এখন। আন্দামানের শরণার্থী আর ভূমধ্যসাগরের শরণার্থীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আলোচিত শিশু আয়লান কুর্দির বাবা আবদুল্লাহ গণমাধ্যকে জানিয়েছেন, তিনি পাচারকারীদের ৫ হাজার ইউরো দিয়েছেন ইউরোপে যাওয়ার পর। পাচারকারীরা সহজ একটি পথ বেছে নিয়েছিল তুরস্ক থেকে সমুদ্রপথে ছোট নৌকায় করে ইতালি যাওয়ার। অন্যদিকে, অনেকে ব্যবহার করেছেন বলকান রুট। এ 'রুট' ধরে তারা ঢুকে পড়েছিলেন হাঙ্গেরিতে। হাজার হাজার সিরীয়, ইরাকি আর আফগানের ভিড়ে গোটা বুদাপেস্টে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, কোনো সভ্য দেশের মানুষ আগে তা কখনই দেখেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কিংবা স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পরও পশ্চিম ইউরোপের মানুষের এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়নি। হাজার হাজার মানুষ, যাদের মাঝে আছে শিশু ও কিশোরী, তাদের সবার টার্গেট জার্মানি যাওয়া। এসব শরণার্থী এসে ইউরোপে মূলত দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপ শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। অন্যদিকে, পূর্ব ইউরোপ এদের বহন করতে নারাজ। অনেক দিন থেকেই পশ্চিম ইউরোপ আফগান শরণার্থীদের আশা দিয়ে আসছিল। জার্মানিতে এ সংখ্যা এখন কয়েক লাখ, যাদের অনেকেই জার্মানির নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। আর মানব পাচারকারীরা এটাকেই ব্যবহার করছে এবং তারা সুযোগটি গ্রহণ করে সিরিয়া, ইরাক থেকে মানব সন্তান পাচারের উদ্যোগ নিয়েছে। এটা সত্য, বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, লিবিয়া থেকে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের ইউরোপে অভিবাসন ঘটেছে অবৈধ পথে। তবে আফ্রিকা থেকে যারা আসছেন, তারা মূলত অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য, উন্নত জীবন, ইউরোপের জীবনযাত্রা, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদিতে আকৃষ্ট হয়ে ইউরোপে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেছেন অবৈধ উপায়ে। এমন খবরও শরণার্থীদের মুখ থেকে বের হয়েছে যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ২ থেকে ৩ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ করেছেন অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য। আবার এমনও দেখা গেছে, দালালচক্র এমন শরণার্থীদের জিম্মি করে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপে যাওয়ার ব্যাপারে অভিবাসীদের আগ্রহ বেশি কেন? এর একটা কারণ আমরা খুঁজে পেয়েছি যে, ইউরোপের অনেক নেতা এসব অভিবাসীর ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহী! এর কারণ হচ্ছে, সেখানে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার শূন্যতে নেমে এসেছে। অর্থাৎ পরিবারপ্রতি জনসংখ্যা বাড়ছে না। তরুণ প্রজন্ম তাদের স্ব স্ব পেশার প্রতি এত বেশি মনোযোগী যে, পৃথিবীতে সন্তান জন্ম দেয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ্য কম। ফলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পাওয়ায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কল কারখানা চালানোর জন্য লোকের প্রচ- অভাব অনুভূত হচ্ছে। জার্মানি একটি শিল্পোন্নত দেশ। তাদের ফ্যাক্টরিগুলো চালাতে লোক দরকার। ফলে তারা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে শরণার্থীদের অনুপ্রবেশে। একসময় জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলেই তা মঞ্জুর করা হতো। আশির দশকে হাজার হাজার আফগান নাগরিক জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তারা সেখানকার অর্থনীতিতে গড় অবদান রেখেছেন। আজকে ঘুরেফিরে সে পরিস্থিতি থেকে জার্মানি বেরিয়ে আসতে পেরেছে এটা মনে হয় না। তাদের 'শ্রমিক' দরকার কারখানাগুলো চালানোর জন্য। যদিও এটা সত্য, ১৯৯০ সালের পর পূর্ব ইউরোপ থেকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটেছে জার্মানিতে। এরা শ্বেতাঙ্গ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কোনো কোনো দেশের নাগরিক (যেমন চেক, পোল্যান্ড)। এরা আইনগতভাবেই জার্মানিতে থাকার ও চাকরি করার অধিকার রাখেন। কিন্তু তার পরও জার্মানিতে শ্রমিক সংকট রয়েছে। ফলে আজকে যারাই অবৈধভাবে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন, তাদের সবার টার্গেট থাকে জার্মানিতে যাওয়ার। এটা সত্য, ইউরোপে এ অভিবাসী সমস্যা কোনো একটি দেশের নয়। বরং সমস্যাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশের। তাই এর সমাধান ইউরোপীয় ইউনিয়নকেই খুঁজে বের করতে হবে। ইতোমধ্যে জার্মানির উদ্যোগে বলকান রাষ্ট্রগুলোর একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল অংশ নিয়েছিলেন।
উদ্দেশ্য ছিল একটাই_ কী করে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ করা যায়। কিন্তু ভিয়েনা সম্মেলনে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জার্মানি চাচ্ছে ঐক্যবদ্ধভাবে ইইউর এ সমস্যা মোকাবেলা করতে। কিন্তু স্পষ্টতই ইইউর নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভক্তি আছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, 'শেঙ্গেন জোন' (২৬ দেশ)-এর সুযোগ গ্রহণ করে এ অঞ্চলে একটি পাচারকারী চক্র অত্যন্ত সক্রিয়। ইইউভুক্ত প্রায় সব দেশ তাই 'শেঙ্গেন জোন'-এর অন্তর্ভুক্ত। এ 'জোন' ও অন্তর্ভুক্ত যে কোনা একটি দেশে প্রবেশ করলে অন্য দেশে ভিসা ছাড়াই যাওয়া যায়। ফলে পাচারকারীরা হাঙ্গেরিকে ব্যবহার করছে। প্রতিদিন হাঙ্গেরিতে পা রাখছে প্রায় তিন হাজার মানুষ। হাঙ্গেরি সার্বিয়ার সঙ্গে ১৭৫ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে, যাতে সার্বিয়া থেকে অবৈধ অভিবাসীরা হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করতে না পারে। একবার হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করলে ইইউভুক্ত যে কোনো দেশে যাওয়ার সুযোগ তাদের জন্য তৈরি হয় এবং তারা হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করা মাত্র ইইউর সব সুযোগ-সুবিধা পাবে। জার্মানিতে ইতোমধ্যে প্রায় ১২ হাজার লোক অস্ট্রিয়া দিয়ে প্রবেশ করেছে। জার্মান নাগরিকরা এদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ৬ বিলিয়ন ইউরো এদের জন্য বরাদ্দ করার কথাও বলেছেন জার্মান চ্যান্সেলর।
জাতিসংঘের মহাসচিব এ সেপ্টেম্বরেই অভিবাসীদের সমস্যা নিয়ে নিউইয়র্কে একটি শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান করেছেন। সিরিয়া ও ইরাক সংকটের গভীরতা অনেক বেশি, তাতে সন্দেহ নেই। আফগানিস্তানেও 'যুদ্ধ' শেষ হয়ে গেছে এটা বলা যাবে না। আর মিয়ানমারে সংকটের চরিত্রটা একটু ভিন্ন ধরনের। সেখানে জাতিগত নিপীড়ন চলছে। যুদ্ধ আছে আফ্রিকাসহ, একাধিক দেশে। সোমালিয়া থেকে শুরু করে নাইজেরিয়া, কঙ্গো এবং সিয়েরা লিওনেও। ফলে মানুষ একটু বেঁচে থাকার জন্য দেশান্তরিত হবেই। জার্মানি ব্যাপকসংখ্যক সিরীয় অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু জার্মানির একার পক্ষে সব শরণার্থী গ্রহণ করা সম্ভবও নয়।
ফলে জাতিসংঘ যদি পৃথিবীর সর্বত্র 'যুদ্ধ বন্ধ' ও জাতিগত নিপীড়ন বন্ধ করার উদ্যোগ না নেয়, তাহলে মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাবেই। তাই হয়তো আগামীতেও আবার আন্দামানের নৌকা ভাসবে। নৌকা ভাসবে ভূমধ্যসাগরেও। Daily Jai Jai Din 13.09.15

শিক্ষকদের অসন্তোষের কথা ।। নতুন পে স্কেল


নতুন পে স্কেল অনুমোদিত হয়েছে গত ৭ সেপ্টেম্বর। এই পে স্কেল নিয়ে বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তারা ৮ সেপ্টেম্বর একদিন সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মবিরতি পালন করেছেন। তারা আগামীতে বড় ধরনের কর্মসূচি নিতে পারেন, এমন কথাও গণমাধ্যমকে জনিয়েছেন শিক্ষক ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ। শিক্ষকদের অসন্তোষ নিয়ে কথা বলার আগে নতুন পে স্কেল নিয়ে সোজাসাপটা কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এতে করে সরকারি কর্মচারীদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মূল ২০টি গ্রেড থাকলেও আসলে গ্রেড ২২টি। মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও তিন বাহিনীর প্রধানকে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই পাঁচ ব্যক্তির বেতন ও গ্রেড-১ এর বেতনের চাইতে ৮ হাজার টাকা বেশি। এখানে এক ধরনের ‘শ্রেণিবৈষম্য’ তৈরি করা হয়েছে। সিনিয়র সচিব ও একই পদমর্যাদার সশস্ত্র বাহিনী কর্মকর্তাদের বেতন ৮২ হাজার টাকা নির্ধারণ করেও ‘আরও একটি বৈষম্য’ সৃষ্টি করা হয়েছে। তারাও গ্রেড ১-এর উপরে স্থান পেয়েছেন। স্পষ্টতই বিশেষ দুটি ‘গ্রেড’ সৃষ্টি করে ‘বিশেষ বিশেষ শ্রেণির’ কিছু লোককে ‘খুশি’ করার একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। নববর্ষ ভাতা চালু করে পেনশনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। এখন বাতিল হলো টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড। এটা ঠিক, চাকরিজীবনে অনেকেই সিলেকশন গ্রেড পান না। টাইম স্কেলও পান না। ফলে এটা না থাকায় অনেকেই স্বীকার করবেন তা ঠিক আছে। কিন্তু প্রশ্ন আছে অনেকটি। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, কিছু মানুষের কাছে (২১ লাখ সরকারি কর্মচারী) টাকার পরিমাণ বাড়বে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এতে উপকৃত হবে না। কেননা বাজারে টাকার জোগান বেড়ে গেলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। দ্বিতীয় প্রশ্ন, বেসরকারি সেক্টরে জনবল বেশি। এখন বেসরকারি খাতেও বেতন বাড়ানোর চাপের মুখে থাকবে। এ ক্ষেত্রে সব বেসরকারি খাতের পক্ষে এই বেতন বাড়ানো সম্ভব হবে না। ফলে বেসরকারি খাতে এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হবে। তৃতীয় প্রশ্ন, দুর্নীতি আমাদের সমাজজীবনে একটি সাধারণ চিত্র। এখন দুর্নীতির পরিমাণ যদি বেড়ে যায়, তা সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। চতুর্থ প্রশ্ন, বেতন বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে অসাধু বাড়িওয়ালা, পরিবহন ব্যবসায়ী, খুচরা ব্যবসায়ী, আমদানিকারকরা ‘সুযোগ’ গ্রহণ করবেন। বাড়িভাড়া বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। আমদানি করা জিনিসপত্রের দাম চলে যাবে ক্রয়সীমার বাইরে। এতে তো সাধারণ মানুষ আর পেনশনভোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন! বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ করার কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এ নিয়ে আদালতে মামলা হলেও তাতে কোনো ফয়সালা হয়নি। উপরন্তু ২১ লাখ সরকারি কর্মচারীর একটা অংশ সরকারি আবাসন সুবিধা পায়। একটা বড় অংশ, বেসরকারি সেক্টরে কর্মরতদের বড় অংশ বাসা ভাড়া করে থাকেন। তারা এখন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই পে স্কেলে খুশি হননি। তাদের যুক্তি, সিনিয়র শিক্ষকরা এখন ‘সিলেকশন গ্রেড’ বাতিল হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারা সচিব পদমর্যাদার গ্রেড ১-এর সুযোগ-সুবিধা, বেতনও পাবেন না। প্রশ্ন উঠতেই পারে, সচিবরা নিজেদের সুবিধার জন্য যদি সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে শিক্ষকদের জন্য সিনিয়র অধ্যাপকের পদ নয় কেন? দ্বিতীয়ত, বেতন স্কেলে (অধ্যাপকের সিনিয়র অধ্যাপক নন) গ্রেড এখন ৩-এ। অর্থাৎ তার বেতন শুরু হবে ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে। রাষ্ট্রের ‘ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সি’তে তাদের অবস্থান অনেক নিচে, যুগ্ম সচিবেরও নিচে। এটা কি শোভন? একজন অধ্যাপককে কি যুগ্ম সচিবের সঙ্গে তুলনা করা যায়? তাহলে একজন উপাচার্যের পদমর্যাদা কী? তিনি যদি ‘সিলেকশন গ্রেড’ভুক্ত প্রফেসর না হয়ে থাকেন (৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনও ‘সিলেকশন গ্রেড’ভুক্ত প্রফেসর নন), তাহলে তার পদমর্যাদা কী হবে? ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কি সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে তার ‘ছাত্রতুল্য’ যুগ্ম সচিবদের সঙ্গে বসবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কি তাই করবেন? সচিবরাই এ কাজটি করলেন। তারা নিজেদের শিক্ষকদের চেয়েও উপরে রাখলেন। অথচ অনেক সচিবের ‘ভুয়া ডিগ্রি’ আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন এ সংখ্যাও কম নয়। এমনকি অনেকে ‘ভুয়া পিএইচডি’ ডিগ্রি ব্যবহার করেন। অনেক সিনিয়র সচিবের নামের আগে ইদানীং দেখি তারা ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি ব্যবহার করেন। কীভাবে পেলেন এই ডিগ্রি? কোথায় করলেন? এখন তারাই যদি নিজেদের সিনিয়র অধ্যাপকদের উপরে রাখেন তা দুঃখজনক। সচিব আর আমলা কখনো এক হতে পারে না। তাদের কাজের ধরন আলাদা। একজন সচিব যে শুধু এখন বেশি বেতন পাবেন, তাই নয়। তাদের সুযোগ-সুবিধা কয়েক লাখ টাকার সমান। যেমন একজন সচিব সার্বক্ষণিক তিনটি গাড়ি ব্যবহার করেন। তার স্ত্রী রাষ্ট্রের কর্মচারী নন। রাষ্ট্রীয় কাজে তিনি কোনো অবদানও রাখেন না। অথচ তিনি সার্বক্ষণিক একটি গাড়ি ব্যবহার করেন! বিভিন্ন প্রকল্প থেকে গাড়ি নিয়ে তা ব্যবহার করেন তার সন্তানরা। যে ‘বাংলোবাড়ি’তে তিনি থাকেন, তার বাসাভাড়া হিসাব করলে মাসপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। তাদের জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল খুব সম্ভবত ‘ফ্রি’। গাড়ির অকটেন, গ্যাস ‘ফ্রি’। হিসাব করুন এই রাষ্ট্র একজন সচিবের জন্য কী খরচ করে? সেই তুলনায় একজন শিক্ষক কী পান? ওই বেতনই তার একমাত্র ভরসা। আমি কয়েক ডজন অধ্যাপককে চিনি, যাদের গাড়ি নেই, বাড়ি নেই, চলেন রিকশাতে আর লক্কর মার্কা বাসে। রাষ্ট্র তাদের জন্য ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি কেনার ব্যবস্থা করে দেয়নি। কিংবা সরকারি ব্যাংক থেকে কম সুদে বাড়ি, ফ্যাট বা গাড়ি ক্রয় করার ব্যবস্থা করে দেয়নি! অথচ তারাই তথাকথিত ‘সমাজ গড়ার কারিগর’। তারাই সচিবদের ‘জন্ম’ দিয়েছেন, তৈরি করেছেন, শিক্ষিত করেছেন।
আর এই সচিব কমিটিই তাদের অমর্যাদা করল। অর্থমন্ত্রী যে ‘ভাষায়’ শিক্ষকদের সমালোচনা করেছেন তা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। একজন অবিবেচক মানুষ তিনি। তিনি যে মনে-প্রাণে একজন আমলা, সেটাই তিনি প্রমাণ করলেন! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন! তার মতো একজন ‘সিনিয়র সিটিজেনের’ কাছ থেকে আমরা এটা আশা করিনি। তার অনাকাক্সিক্ষত বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে সরকারকে একটা মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। তিনি অবশ্য তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কিন্তু ‘ক্ষতি’ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এটা সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘সবকিছুর ঊর্ধ্বে’ নন। এটা আমি মনেও করি না। যাদের শিক্ষক হওয়ার কথা ছিল না, তারা ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ শিক্ষক হয়েছেনÑ এটা অস্বীকার করা যাবে না। যে যে বিভাগের ‘ছাত্র’ নন, তাকে সেই বিভাগে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতির নীতি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক তা বলা যাবে না। এ ব্যাপারে অনেক সরকারি আমলার মধ্যে আমি এক ধরনের ‘ক্ষোভ’ দেখেছি। আমার ছাত্র যারা আমলা হয়েছে, তাদেরও দেখেছি এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে!
এখন অর্থমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন বটে কিন্তু সবকিছু ‘শেষ’ হয়ে গেছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। একটি মন্ত্রিপরিষদ কমিটি করে দেওয়া হয়েছে, যারা শিক্ষকদের দাবি-দাওয়াগুলো খতিয়ে দেখবেন। এখানেও একটা ভুল হয়েছে। উচিত ছিল শিক্ষকদের নিয়ে ওই কমিটি গঠন করা। কমিটিতে সচিবরা থাকলে তারা বিরোধিতা করবেন। তবে মন্ত্রিপরিষদের বিবেচনার জন্য কিছু প্রস্তাব রাখতে চাই। ১. বর্তমান পে স্কেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষকদের (স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়) জন্য আলাদা বেতন কাঠামো তৈরি করা হোক। কমিটি সময় দিক ও সবার মতামত নিক এবং সব শ্রেণির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হোক এই কমিটিতে। ২. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান নিষিদ্ধ করা হোক। এখন অনুমতি নিয়ে, বিনা অনুমতিতে, প্রাপ্ত সম্মানীর ১০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা দেওয়ার শর্তে (যা কেউই দেন না) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাস নেন, এটা বন্ধ হোক। ৩. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক। তাদের কোনো সুদ ছাড়াই গাড়ি, ফ্যাট কেনার ব্যবস্থা করা হোক। মূল বেতনের পাশে অতিরিক্ত আরও ১০ হাজার টাকা দেওয়া হোক ‘বিশেষ ভাতা’ হিসেবে, যাতে তারা নিরুৎসাহিত হন অন্যত্র কাস নিতে। ৪. সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আইনের আওতায় আনা হোক। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একই পদোন্নতির নীতিমালা হোক। ৫. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে পিএসসির মতো আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হোক। ৬. তরুণ শিক্ষকদের পিএইচডি করতে ‘ফান্ড’-এর ব্যবস্থা করা হোক এবং পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক পদে পদোন্নতি নিষিদ্ধ হোক। ৭. অধ্যাপক পদে দুটি গ্রেড করা হোকÑ গ্রেড-১ ও গ্রেড-২। ‘সিলেকশন গ্রেড’ অথবা ১০ বছর অধ্যাপক পদে থাকা অধ্যাপকদের গ্রেড ১-এ পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হোক। তবে শর্ত থাকে, তাকে একটি গবেষণামূলক বই লিখতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষকদের গবেষণামূলক পাঠ্যবই প্রণয়নে উৎসাহিত করা হোক। ৮. পাস করার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক হিসেবে (প্রভাষক) নিয়োগ নিরুৎসাহিত করা হোক। এর পরিবর্তে তাকে ন্যূনতম এক বছর একজন সিনিয়র শিক্ষকের অধীনে ‘গবেষণা’ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ দেওয়া হোক।
মোট কথা, ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন (যা চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছে) পরিবর্তন করে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি আইন করা হোক। শিক্ষকদের ‘দায়িত্ব ও কর্তব্য’ সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক। ‘ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সি’তে শিক্ষকদের অবস্থান তুলে দেওয়া হোক। এটা থাকুক শুধু সরকারি কর্মচারীদের জন্য। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এর কোনো দরকার নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখনো আন্দোলনে আছেন। সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা হোক। সরকারপ্রধানও তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
Daily Amader Somoy
13 September 2015

কোন পথে মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে গেল সপ্তাহে তুমুল গণবিক্ষোভের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, কোন পথে এখন মালয়েশিয়া? সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক হিসেবে পরিচিত মাহাথির মোহাম্মদ নাজিব রাজাকের পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সাড়া দেননি প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, পদত্যাগ নয়, এই মুহূর্তে প্রয়োজন ঐক্য। নাজিবের আর একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে ক্ষমতাসীন ফ্রন্ট তার প্রতি সমর্থন ছুড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ তার নিজ দল ও ফ্রন্ট তার পেছনে আছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী সংকটকে আপাতত কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে কেন এই অসন্তোষ? কেনই বা তার পদত্যাগের আহ্বান। নাজিবের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ উঠেছে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ওয়ান এমডিবি নামক রাষ্ট্রীয় তহবিলের ৭০ কোটি ডলার জমা হওয়া নিয়ে। এই অর্থ কী কাজে ব্যয় হবে, কিংবা কারা দিয়েছে, কেন দিয়েছে, এর জবাব প্রধানমন্ত্রী দিতে পারেননি। প্রশ্ন উঠেছে, মালয়েশিয়াতে ঘুষ, দুর্নীতি যেখানে কঠোর হাতে দমন করা হয়, সেখানে কী করে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তহবিলে এত টাকা জমা হল? প্রশ্নটি তুলেছেন খোদ মাহাথির মোহাম্মদ। নানাভাবে এই টাকার কথা বলা হচ্ছে। ইহুদি হুমকি মোকাবিলায় এই অর্থের দরকার ছিল, কিংবা মালয়েশিয়ার সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে ওই অর্থ একটি উপহার- এ সব কথা নাজিব সমর্থকদের মুখ থেকে শোনা গেলেও সাধারণ মানুষের মাঝে এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এ সংবাদটি পরিবেশন করলেও, উৎস সম্পর্কে কোনো কথা বলেনি। যে কারণেই বিদেশী উৎস থেকে এ টাকা পাওয়া যাক না কেন, নিশ্চয়ই তা সরকারি ফান্ডে অথবা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু যখনই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ইমেজকে তা ক্ষতিগ্রস্ত করে। এরকমটি অতীতে কখনও দেখা যায়নি। অতীতে কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আমরা শুনিনি। এর মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়ার নেতৃত্বে পরিবর্তন যদি নাও আসে, বলার অপেক্ষা রাখে না এতে করে বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রটির ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হল। তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি বেশ স্থিতিশীল। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে থাইল্যান্ডে কালার রেভ্যুলুশন সরকার পতন ও সামরিক অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করলেও বাকি দেশগুলোতে স্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা যায়। মালয়েশিয়ার রাজনীতিও অস্থিতিশীল ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হওয়ায় দেশটি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। সেখানেও এক ধরনের কালার রেভ্যুলুশন-এর জন্ম হয়েছে, যারা হলুদ শার্ট পরিধান করে রাজধানী কুয়ালালামপুরের কেন্দ্রস্থল দখল করে নিয়েছিল। এই আন্দোলন আরও গুরুত্ব পেয়েছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের অংশগ্রহণের কারণে। যদিও এই কালার রেভ্যুলুশন থাইল্যান্ডের মতো কিংবা অতীতে ফিলিপাইনে কোরাজান আকিনোর ইয়োলো শার্ট মুভমেন্টের মতো স্থায়ী হয়নি। এখানে স্পষ্টতই একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফিলিপাইনে কোরাজান আকিনো ১৯৮৬ সালে নিজে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান মার্কোসের বিরুদ্ধে ইয়োলো শার্ট ম্যুভমেন্টের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। থাইল্যান্ডেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা ও তার বোন ইনলাক সিনাওয়াত্রার সমর্থকরা লাল শার্টপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আর তার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল, তার নেতৃত্ব দিয়েছিল (২০০৬) হলুদ শার্টপন্থীরা পিপলস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসির ব্যানার। এই লাল ও হলুদ শার্ট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। এ মালয়েশিয়ার আন্দোলনের সঙ্গে এর পার্থক্য এখানেই যে, মালয়েশিয়ার হলুদ শার্ট আন্দোলন স্থায়ী হয়নি। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আন্দোলনের খবর আমরা তেমন একটা পাইনি। পৃথিবীর অন্যত্র যেভাবে কালার রেভ্যুলুশন সংগঠিত হয়েছে, মালয়েশিয়াতে তেমনটি হয়নি। কায়রোর তাহরির স্কোয়ার-এ আন্দোলনকারীরা দুসপ্তাহ অবস্থান করে আরব বসন্তের জন্ম দিয়েছিল মিসরে। হোসনি মোবারকের পতন ঘটেছিল। থাইল্যান্ডেও আমরা এমনটি লক্ষ্য করেছিলাম। কিন্তু মালয়েশিয়ায় তেমনটি হয়নি। এর পেছনে আরেক কারণ থাকতে পারে। তবে সাধারণ মানুষের মাঝে যে হতাশা আছে, তা দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল। প্রথমত, ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে রক্তপাতহীন প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা অর্জন করার পর থেকেই একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা বারিসোয়া নেসিওনাল (Barisna Nasional) ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এখানে কোনো শক্ত বিরোধী দলের জন্ম হয়নি। ক্ষমতাসীন ফ্রন্টে ১৩টি রানৈতিক দল রয়েছে। মূল শক্তি হচ্ছে উমনো বা United Malaya National Organization। এই ফ্রন্টে Malaysian Chinese Association ও Malaysian Indian Congress-এর মতো দলও আছে। এই দুটি সংগঠন চীনা ও ভারতীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৬ ভাগ মালয়, আর ৩৫ ভাগ চীনা ও ১১ ভাগ ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ২০১৩ সালে সর্বশেষ জাতীয় সংসদ (Dewan Rakyat)-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে দেখা যায়, মোট আসন ২২২টির মধ্যে ন্যাশনাল ফ্রন্ট পেয়েছে ১৩৩ আসন (উমনো একা ৮৮ আসন), শতকরা হিসাবে ৫৯ দশমিক ৯১ ভাগ। অন্যদিকে এই প্রথমবারের মতো একটি শক্তিশালী বিরোধী জোট রয়েছে সংসদে (Pakatan Rokyat)। এই বিরোধী ফ্রন্টের মূল শক্তি হচ্ছে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টি, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। বিরোধী ফ্রন্টের আসন সংখ্যা হচ্ছে ৮৯, শতকরা হিসাবে ৪০ দশমিক ০৯ ভাগ। তিনটি দল নিয়ে এই বিরোধী ফ্রন্ট, যেখানে মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টির (আসন ২১) মতো ইসলামিক দলও রয়েছে। শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে না ওঠায় ক্ষমতাসীন বারিসোয়া ন্যাশনাল বারবার ক্ষমতায় আসছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নাজিব রাজাক, যিনি ক্ষমতায় আছেন ২০০৯ সাল থেকে), তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল একটি মানবাধিকার সংগঠন বেরসিহ। পরে অবশ্য পাঁচটি বিরোধী দল এই আন্দোলনে শরিক হয় (ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টি, পার্টি ইসলাম মালয়েশিয়া, পার্টি কোয়ালিশন রাকায়েত, পার্টি সোসাইলিস মালয়েশিয়া, সারাওয়াক ন্যাশনাল পার্টি)। দ্বিতীয়ত, নাজিব রাজাক নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যের ওয়ান মালয়েশিয়া গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। কিন্তু সংখ্যালঘুরা অভিযোগ করছেন যে, তারা বৈষম্যের শিকার। তৃতীয়ত, নাজিব প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন, তিনি সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে সরাসরি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন। তিনি নিজে ফেসবুক ও টুইটারের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কিছু কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হতেই তিনি সোসাল মিডিয়ায় কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করেন। এখন শোনা যাচ্ছে, তিনি নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছেন, যাতে সোসাল মিডিয়ার ব্যাপারে কিছু বিধি-নিষেধ থাকবে। চতুর্থত, তিনি প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন, দেশকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করবেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, তিনি খাদ্য ও জ্বালানিতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে করে বিত্তবানরা খুশি হবে, সাধারণ মানুষ খুশি হয়নি। তাই একটা অসন্তোষ ছিল। পঞ্চমত তিনি দুর্নীতি কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও, তার নিজের আর্থিক কেলেংকারির কারণে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। ষষ্ঠত, বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য তার স্ত্রী রোজমাহ মনসুর বারবার বিতর্কিত হয়েছেন (শুধু চুলের স্টাইল করার জন্য প্রতিবার খরচ করেন ৪০০ ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৩২ হাজার টাকা)। এটা পরোক্ষভাবে নাজিবের ইমেজ বৃদ্ধিতে কোনো ভূমিকা রাখেনি।প্রশ্ন হচ্ছে, নাজিববিরোধী এই আন্দোলন সরকারের ভিতকে কি আদৌ কাঁপিয়ে দিতে পেরেছে? মনে হয় না। নিঃসন্দেহে নাজিবের ব্যক্তি-ইমেজ এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সরকারের অবস্থান বেশ শক্তিশালী। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যত্র যে আন্দোলন হয়েছিল, তা ছিল সরকারবিরোধী একটি আন্দোলন। এখানে অর্থাৎ মালয়েশিয়াতে আন্দোলনের চরিত্র কিন্তু সরকারবিরোধী নয়, তা ব্যক্তি নাজিবের বিরুদ্ধে। এক সময় মনে করা হতো মালয়েশিয়া এমন একটি সমাজ বিনির্মাণ করেছে, যেখানে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হয় না, বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর আইন। এমনকি সুশাসনের জন্যও মালয়েশিয়া বারবার আলোচিত। যদিও এটা সত্য, এখানে যে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, তা অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। বিরোধীদলীয় কর্মকাণ্ডও সীমিত। এখানে রাজনীতির চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে উন্নয়নকে। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন, মালয়েশিয়া উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি মডেল। এটা সম্ভব হয়েছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের কারণে, যিনি ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আর ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর অবসরে গিয়েছেন। উমনো থেকেও বিদায় নেন ২০০৮ সালে। তবে ২০০৯ সালে আবার উমনোতে ফিরেও এসেছিলেন। তার ভূমিকা নিয়েও এখন প্রশ্ন আছে। অতীতে তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমকে দল থেকে, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করেছিলেন। আনোয়ারের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ ছিল। অনেকের ধারণা তিনি দলে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাখতেন না (আনোয়ার ইব্রাহিম তার নিকট আত্মীয় এবং তাকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গণ্য করা হতো)। এখন নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে তার অবস্থানও সেখানে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। দলকে মাহাথির মোহাম্মদ সঙ্গে পাননি। শুধু তাই নয়, সরকার উৎখাতের অভিযোগে পুলিশ এখন মাহাথিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।আগামী ১০ অক্টোবর সরকার সমর্থকরা রাজনীতিতে প্রায় ১০ লাখ লোকের একটি সমাবেশের আয়োজন করছে। এর মধ্যে দিয়ে নাজিব প্রমাণ করতে চান দল ও সাধারণ মানুষের সমর্থন তার প্রতি আছে। পুরো সরকারের সমর্থন নাজিব নিশ্চিত করেছেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ফলে আন্দোলনকারীরা খুব বেশি একটা সুবিধা করতে পারছেন না। নাজিব তার পদত্যাগের দাবিও প্রত্যাখ্যান করেছেন। সরকার ও সরকারপ্রধান নাজিব রাজাক টিকে গেলেন বটে, কিন্তু মালয়েশিয়ার বুকে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা সারবে কীভাবে? মালয়েশিয়ার শীর্ষ রাজনীতিবিদরা যে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে নন, সেটা কি প্রমাণিত হল না এখন? নিঃসন্দেহে এতে করে মালয়েশিয়ার ভাবমূর্তি নষ্ট হল। বিরোধী জোটের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। গত নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। এখন আনোয়ার ইব্রাহিম যদি এই দুর্নীতির ইস্যুকে প্রাধান্য দেন, আমার ধারণা এতে করে তার ও জোটের জনপ্রিয়তা বাড়বেই। Daily Jugantor 10.09.15