রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

বহির্বিশ্বে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা বাড়ছেই


গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ইতালির নাগরিক তাভেল্লা সিজারের হত্যার পর থেকে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা বাড়ছেই। যে প্রচারণাটা সবচেয়ে বেশি, তা হচ্ছে তাভেল্লা কিংবা জাপানের নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকা-ের সঙ্গে ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জড়িত থাকার অভিযোগটি। এটি ব্যাপক প্রচারণা পায় সাইট (ঝওঞঊ) নামক একটি জিহাদি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার কারণে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কর্মকা-ের ব্যাপারে ‘সাইট’ অন্তত তিনটি সংবাদ প্রকাশ করে এবং সর্বশেষ প্রতিবেদনটিতে তারা আবারও তাদের আগের ‘অবস্থান’-এ অটল থাকে। তাদের দাবি, বিদেশি হত্যাকা- ও শিয়াদের ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিল শুরু করার আগে যে ‘গ্রেনেড’ হামলা, এর সঙ্গে আইএস জড়িত। অবশ্য কোনো প্রতিবেদনেই তাদের নিজস্ব মূল্যায়ন নেই, বরং আইএস দাবিকারী একটি বক্তব্য তারা এ ওয়েবসাইটে তুলে দেয়। সর্বশেষ সংবাদে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য প্রকাশ করে তারা এই বক্তব্যকে আইএসের জড়িত থাকার বিষয়টি ‘আড়ালে রাখার বিভ্রান্তিকর প্রচেষ্টা’ হিসেবেও অভিহিত করে। এ থেকেই এটা স্পষ্ট, ‘সাইট’ বাংলাদেশে আইএস আছে- এটি প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে! এ ধরনের প্রতিবেদন তারা আরও প্রকাশ করবে- এটিও আশঙ্কা করছি। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার, বাংলাদেশে আইএস আছে- এটি প্রমাণ করা এবং কোনো পক্ষের এই প্রচারণা থেকে সুবিধা নেওয়া। আমরা প্রথম থেকেই ‘সাইট’-এর ভূমিকার ব্যাপারে সন্দিহান। প্রথমত, ‘সাইট’ ও এর কর্ণধার রিটা কাটজ অতীতে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে কাজ করেছে এবং বর্তমানে সাইটের সঙ্গে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার একটি সম্পর্ক থাকতে পারে! এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আইএস আছে- এটি প্রমাণ করে ইসরায়েল কোনো স্বার্থ আদায় করে নিতে চায়! যারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন- ইসরায়েল অনেক দিন ধরেই চাচ্ছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি। বাংলাদেশে কোনো কোনো ব্যক্তি অতীতে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে বিতর্কিত হয়েছিলেন। ইসরায়েলকে বাংলাদেশ এখনো স্বীকৃতি দেয়নি (ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে)। উপরন্তু ফিলিস্তিনিদের ‘হত্যা’ ও নির্যাতনের ব্যাপারে বাংলাদেশ বরাবরই সোচ্চার। দ্বিতীয়ত, আরও একটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। সাইট মূলত একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের নিজস্ব কোনো গবেষণা না থাকলেও তারা জিহাদি সংগঠনগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী এবং এ ব্যাপারে ‘বিভিন্ন সূত্র’ থেকে তথ্য সংগ্রহ ও তা ‘বিক্রি’ করে। মোসাদ ও পেন্টাগন তাদের অন্যতম ক্রেতা। মুসলমানপ্রধান বাংলাদেশ একটি ‘জঙ্গি হুমকির দেশ’ (?)- এটি দেখিয়ে বাংলাদেশের কাছ থেকে কোনো পক্ষ কোনো সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। প্রসঙ্গক্রমেই মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির দিকে আমরা দৃষ্টি দিতে পারি। সেখানে সিরিয়া-ইরাকে গৃহযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণ পুরো দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। চিন-রাশিয়া-ইরান ঐক্য এ ক্ষেত্রে মার্কিনি স্বার্থকে আঘাত করছে। চিন ‘ঘিরে ফেলা’র স্ট্র্যাটেজি চিনকে কয়েকটি ‘চিনারাষ্ট্রে’ পরিণত করা, মিয়ানমারে অং সান সু চিকে ক্ষমতায় বসিয়ে (?) সেখানে মার্কিনি স্বার্থ বাস্তবায়ন করা- এসবই পেন্টাগনের স্ট্র্যাটেজিতে রয়েছে। সিরিয়াস পাঠক মাত্রই জানেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ঝঙঋঅ ও অঈঝঅ চুক্তি করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি আইএসের বিরুদ্ধে যে বিশ্ব অ্যালায়েন্স গড়ে উঠছে (Global Coalition to Counter ISIL), ৬২ দেশ যার সদস্য- যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাংলাদেশ ওই অ্যালায়েন্সে যোগ দিক।  SOFA বা Status of Force Agreement কিংবা ACSA বা Acquisition of Cross servicing  Agreement চুক্তিতে বাংলাদেশ যদি স্বাক্ষর করে, তাহলে বাংলাদেশে সাময়িকভাবে মার্কিন সেনা মোতায়েন, জ্বালানি গ্রহণ, পোর্ট অব কল সুবিধা পাবে- যা মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চাইছেন। এখানে তত্ত্বগতভাবে যদি সন্ত্রাসী কর্মকা- (?) বেড়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশকে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করা সহজ হবে। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়- যেখানে প্রায় তিন হাজার পূজাম-পে দুর্গাপূজা নির্বিঘেœ সম্পন্ন হয়েছে বড় ধরনের কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ছাড়াই, সেখানে ঢাকার হোসেনি দালানে ‘গ্রেনেড’ হামলা চালানো হয়। তাহলে কোনো ‘পক্ষ’ কি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে? পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব প্রায়ই আন্তর্জাতিক সংবাদের জন্ম দেয়। পাকিস্তানে শিয়াদের মিছিলে হামলায় ২২ জন প্রাণ হারান- ঠিক একই সময় বাংলাদেশে তাজিয়া মিছিলের প্রাক্কালে গ্রেনেড হামলা হয়। বাংলাদেশে অতীতে কখনো শিয়াদের ওপর হামলা হয়নি। এমনকি শিয়া-সুন্নিদের দ্বন্দ্বের কোনো খবরও আমাদের জানা নেই। এখন বাংলাদেশকে কি সেদিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এখানে প্রসঙ্গক্রমেই আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন। তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তথাকথিত সন্ত্রাসী কর্মকা-ের নাম করে সেখানে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ বা সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার একটি উদ্যোগ নিয়ে আসছে। আফ্রিকায় নতুন একটি কমান্ড (AFRICOM) প্রতিষ্ঠা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের পরবর্তী টার্গেট মালি, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, অছওগ (আল কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেব) মালি, মৌরিতানিয়া ও নাইজারে তৎপর। নাইজেরিয়ায় তৎপর বোকো হারাম ও আনসারু নামের সংগঠন। সাহেলা জোনে তৎপর আনসার ডাইন বা মুজওয়া নামে উগ্র জঙ্গি সংগঠন। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ ও স্ট্র্যাটেজিক ভূমিকা মার্কিনিদের কাছে গুরুত্ব থাকবেÑ এটিই স্বাভাবিক। এ জন্যই সেখানে অঋজওঈঙগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন করে সীমিত মার্কিন সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে কিনা, সেটিই বড় প্রশ্ন এখন। পাঠকদের একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৮০০ সেনাছাউনি রয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে বছরে ১৫৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়। কোনো মার্কিনিকে এ জন্য বছরে দিতে হয় ১০ থেকে ৪০ হাজার ডলার। সচেতন পাঠক মাত্রই জানেন, মার্কিন অর্থনীতিই হচ্ছে যুদ্ধ অর্থনীতি। যদি বিশ্বে যুদ্ধ প্রলম্বিত হয়, তাহলে মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। এ কারণেই যুদ্ধটি (?) খুব প্রয়োজন ওবামা প্রশাসনের জন্য। মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধের শুরু হয়েছিল সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের মধ্য দিয়ে ২০০৩ সালে, ওই যুদ্ধের অবসান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই যুদ্ধ এখন সম্প্রসারিত হবে আফ্রিকায়। যেখানেই যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়েছে, সেখানেই বেড়েছে সন্ত্রাস। পাঠক, বাংলাদেশে সন্ত্রাস নেইÑ এ কথাটি আমরা বলছি না। অতীতে জঙ্গিদের তৎপরতা ও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকা- আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ত্রিশালে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ওই জঙ্গিরা জননিরাপত্তাকে কতটুকু হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে এবং তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর আদৌ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনাÑ এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। দুটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিতে চাই এ প্রসঙ্গে। লন্ডনের Institute for Economics and Peace প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- পর্যালোচনা করে এবং দেশগুলোকে একটি র‌্যাংকিং করে। চলতি বছর ২০১৪ সালের যে Global Terrorism Index (১৬২ দেশ নিয়ে) প্রকাশ করেছে, এতে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩ নম্বরে (স্কোর ৫ দশমিক ২৫)। সন্ত্রাসী কর্মকা-ের শীর্ষে রয়েছে ইরাক, এরপর আফগানিস্তান ও তৃতীয় অবস্থানে পাকিস্তান। সাধারণত কত ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- হয়েছে, কত মানুষ মারা গেছে, কত মানুষ আহত হয়েছে কিংবা জানমালের কত ক্ষতি হয়েছেÑ এটি বিবেচনায় নিয়েই সন্ত্রাসবাদের র‌্যাংকিং করা হয়। শীর্ষ ২২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম না থাকায় এটি প্রমাণ করে, বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ কোনো ঝুঁকির মুখে নেই। এমনকি বাংলাদেশকে একটি ‘ব্যর্থরাষ্ট্র’ (?) হিসেবে প্রচারণা চালানোরও কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এটি স্বীকার করে না। ওয়াশিংটনের Fund for Peace  প্রতি বছর যে  Failed state (অকার্যকর রাষ্ট্র)-এর তালিকা প্রকাশ করে, সেখানেও বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। Very High Alert কিংবা High Alert ভুক্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ নেই। যদিও বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও নেপালকে এক কাতারে রাখা হয়েছে (অষবৎঃ), তা যে আদৌ ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এটি স্পষ্ট স্বীকার করবেন। দক্ষিণ সুদানকে ‘অকার্যকর রাষ্ট্র’-এর শীর্ষে রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। মোট ১২টি ক্ষেত্র বিবেচনায় নিয়ে অকার্যকর তালিকা প্রকাশ করা এবং একটি স্কোর দেওয়া হয় (যেখানে দক্ষিণ সুদানের স্কোর ১১৪.৫, সেখানে বাংলাদেশের স্কোর ৯১.৪)। এই গবেষণায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উঠে এসেছে। তা হচ্ছে, সুশীল সমাজের মধ্যে বিভক্তি এখন অনেক গভীরে (১০-এর মধ্যে ৯ দশমিক ৬)। তবে বহির্শক্তির হস্তক্ষেপের আশঙ্কা এখানে কম (১০-এর মধ্যে ৫ দশমিক ৭)। ফলে সামগ্রিকভাবে অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো। এরপরও এখানে মাঝে মধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকা- বড় ধরনের সংবাদের জন্ম দেয়। বাংলাদেশ এখন একটি জটিল সময় পার করছে। ইতালির নাগরিক হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এক ‘বড়ভাই’-এর সংবাদও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকে দিয়েছেন। হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি পুলিশ উদ্ধার করতে পারলেও যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে একটি বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের ‘অনেক আগেই’ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এর পেছনে সত্যতা যতটুকুই থাকুক না কেন, পুলিশের ভূমিকাকে আমরা ছোট করে দেখতে চাই না। আস্থাটা রাখতে চাই। তবে কথিত ‘বড়ভাই’-এর একটি রাজনৈতিক পরিচয় থাকায় (যিনি টিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী দু’বছর ধরে দেশের বাইরে) নানা বিভ্রান্তি এতে তৈরি হতে পারে!
আমরা আশা করছি, একটি সুষ্ঠু তদন্ত আমরা পাব। তাজিয়া মিছিলের প্রাক্কালে হামলারও সুষ্ঠু তদন্ত আমরা চাই। এতে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। এখন তাভেল্লা হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করায় অন্তত এটি প্রমাণিত হলো, ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে আইএস জড়িত ছিল না। আমরা বারবার এ কথাটিই বলতে চেয়েছি, বাংলাদেশে আইএসের ‘অপারেটিভ’ নেই। তাদের সম্পর্ক থাকতে পারে। এখন প্রত্যাশা করছি, হোসেনি দালানে হামলার ঘটনায় যারা জড়িত ছিল, তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে এবং আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হবÑ এই হামলার সঙ্গেও আইএসের সংশ্লিষ্টতা নেই। আমাদের স্বার্থে এটি প্রয়োজন। এসব তদন্ত রিপোর্ট বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকা- আরও বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে মার্কিন আইনপ্রণেতাদের কাছে বাংলাদেশের সঠিক পরিস্থিতি ও অবস্থা তুলে ধরা দরকার। দূতাবাসের মিডিয়া উইং খুব শক্তিশালী নয়। তারা সঠিক দায়িত্বটি পালন করতে পারছেন বলে মনে হয় না।
Daily Amader Somoy
01.11.15

বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের তকমা পরিয়ে কার লাভ

গত ২৩ অক্টোবর শুক্রবার গভীর রাতে ঢাকার হোসনি দালানে শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে গ্রেনেড হামলা দেশে জঙ্গি তৎপরতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দুজন বিদেশী হত্যাকাণ্ড এবং প্রায় একই সময় দুজন পুলিশ অফিসার হত্যার ঘটনায় যখন জনমানসে তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অস্তিত্ব নিয়ে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, ঠিক তখনই ঘটল শিয়াদের ওপর গ্রেনেড হামলা। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতায় এটা একটা নতুন উপাদান- জঙ্গিদের হাতে গ্রেনেড চলে যাওয়া। এই গ্রেনেড আবার হাতে তৈরি! এমনটাই আমাদের জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা। কেননা গ্রেনেডে যেভাবে পিন খুলে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে এবং পুলিশ সেই পিনও খুঁজে পেয়েছে। খুব সাধারণভাবেই একটা প্রশ্ন উঠতে পারে- দুই বিদেশী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালের গ্রেনেড হামলা কি একই সূত্রে গাঁথা? ঘটনাগুলো যখন একের পর এক ঘটে চলেছে, তখন একটি যোগসূত্র খোঁজা স্বাভাবিক। এমনকি সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীও একই অভিমত দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা বেধেছে ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামানের সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্য নিয়ে। তিনি স্পষ্ট করেছেন, ইতালির নাগরিক হত্যার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। তিনি একটি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথাও বলেছেন। তার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তদন্ত কাজ সঠিকভাবে পরিচালিত হবে কি-না, সে প্রশ্ন থাকলই। ডিএমপি কমিশনারের এ বক্তব্য এলো এমন এক সময় যখন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে দুই বিদেশী নাগরিক খুনের ঘটনায় দুজন তথাকথিত বড় ভাইয়ের সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়েছে। এই দুজন বড় ভাই বিএনপির নেতা, যাদের সম্পর্কে খবর ও ছবি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ইতালিয়ান নাগরিক সিজারি তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের কারও কারও পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের আগেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল (যুগান্তর, ২৭ অক্টোবর)। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট- ডিএমপির পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে যে, ওই হত্যাকাণ্ডে আইএস জড়িত রয়েছে। এক্ষেত্রে আল কায়দাও জড়িত নয় বলে ধারণা করা যায়। তবে এসব আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সমর্থকরা বাংলাদেশে আছে। বলা ভালো, আল কায়দা স্থানীয়ভাবে কোনো কোনো সংগঠনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে সেই ব্যানারে কাজ করে (যেমন সিরিয়ায় নুসরা ফ্রন্ট)। বাংলাদেশের কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে আল কায়দার পরোক্ষ সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। তবে আইএসের নেই। আর এভাবে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করে, গ্রেনেড ফাটিয়ে আইএস তার অপারেশন পরিচালনা করে না। মুসলিমপ্রধান দেশে কোনো জঙ্গি সংগঠনকে তারা সাধারণত স্বীকৃতিও দেয় না। তাই আইএসের কোনো শাখা যে বাংলাদেশে নেই, তা প্রথম থেকেই আমাদের মনে হয়েছে।সাধারণত আইএস কোনো ব্যক্তিকে কখনও টার্গেট করে না। অথচ বাংলাদেশে একজন ইতালিয়ান ও একজন জাপানি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। পাঠকদের আরেকটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যে পর্যবেক্ষণ সংস্থার (SITE- Search for International Terrorist Entities) ওয়েবসাইটে এ তথ্যটি কোনো ধরনের বিশ্লেষণ ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই তুলে দেয়া হয়েছিল, সেটি মূলত মার্কিন ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করে। সুতরাং এটা প্রচার করার পেছনে (শিয়াদের ওপর গ্রেনেড হামলার খবরও তারা প্রকাশ করেছে) তাদের কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। যারা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস নিয়ে কাজ করে, গবেষণা করে, তাদের কোনো প্রতিবেদনে আমি বাংলাদেশে আইএসের তৎপরতা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন দেখিনি (যেমন The Long War Journal, South Asia Terrorism Portal, Institute for the Study of War)। কাজেই যিনি একজন ইহুদি এবং একসময় ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে কাজ করতেন, সেই রিটা কাটজের (SITE-এর কর্ণধার) উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। কোনো একটি পক্ষ চাচ্ছে এটা বহির্বিশ্বে প্রচার করতে যে, বাংলাদেশে আইএসের কার্যক্রম আছে। সারা বিশ্ব এটা এখন জেনেছে। শিয়াদের ওপর হামলার পর সারা বিশ্বের মিডিয়ায় এটা আইএসের কাজ বলে প্রচার পেয়েছে। এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এখন যারা এ থেকে সুবিধা নিতে চায়, তারা সুবিধা নেয়ার উদ্যোগ নেবে- এতে করে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে, এ প্রশ্ন থাকলই।এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব ঘটনা থেকে কারা সুবিধা নিতে চায়? যারা এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন, তারা জানেন এ অঞ্চল ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব এখন সংঘর্ষের রূপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে। পেন্টাগন Forward presence-এর যে নীতি গ্রহণ করেছে, তার আলোকে ভারত মহাসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি বাড়ানো হচ্ছে। সিরিয়া-ইরাকে গৃহযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান বহিনীর বোমাবর্ষণ পুরো দৃশ্যপটকে বদলে দিয়েছে। চীন-রাশিয়া-ইরান ঐক্য এ ক্ষেত্রে মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করছে। চীনকে ঘিরে ফেলার স্ট্র্যাটেজি, চীনকে কয়েকটি চীনা রাষ্ট্রে পরিণত করা, মিয়ানমারে অং সান সুচিকে ক্ষমতায় বসিয়ে (?) সেখানে মার্কিন স্বার্থ বাস্তবায়ন করা- এসবই পেন্টাগনের স্ট্র্যাটেজিতে রয়েছে। সিরিয়াস পাঠক মাত্রেই জানেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে SOFA ও ACSA নামে দুটি চুক্তি করতে চাচ্ছে। এমনকি আইএসের বিরুদ্ধে যে বিশ্ব অ্যালায়েন্স গড়ে উঠেছে (Global Coalition to Counter ISIL), ৬২টি দেশ যার সদস্য, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাংলাদেশ এই অ্যালায়েন্সে যোগ দিক। SOFA (Status of Forces Agreement) wKsev ACSA (Acquisition of Cross Servicing Agreement)-এ বাংলাদেশ যদি স্বাক্ষর করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সাময়িকভাবে সেনা মোতায়েন, জ্বালানি গ্রহণ, পোর্ট অব কল সুবিধা পাবে, যা মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চাইছেন। এখানে তত্ত্বগতভাবে যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড(?) বেড়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশকে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করানো সহজ হবে।আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়- যেখানে প্রায় তিন হাজার পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা নিবিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে কোনো বড় ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ছাড়াই, সেখানে ঢাকার হোসনি দালানে গ্রেনেড হামলা চালানো হল। তাহলে কোনো পক্ষ কি বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে? পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব প্রায়ই আন্তর্জাতিক সংবাদের জন্ম দেয়। পাকিস্তানে শিয়াদের মিছিলে হামলায় ২২ জন প্রাণ হারিয়েছেন ঠিক একই সময়ে, যখন বাংলাদেশে তাজিয়া মিছিলের প্রাক্কালে গ্রেনেড হামলা হয়। বাংলাদেশে অতীতে কখনও শিয়াদের ওপর হামলা হয়নি। এমনকি শিয়া-সুন্নিদের দ্বন্দ্বের কোনো খবরও আমাদের জানা নেই। এখন বাংলাদেশকে কি সেদিকেই টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এখানে প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তথাকথিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নাম করে সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ বা সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকায় নতুন একটি কমান্ড (AFRICOM) প্রতিষ্ঠা করেছে। মালি, নাইজেরিয়া ও সোমালিয়া যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী টার্গেট। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, অছওগ (আল কায়দা ইন ইসলামিক মাগরেব) মালি, মৌরিতানিয়া ও নাইজারে তৎপর। নাইজেরিয়ায় তৎপর বোকো হারাম আর আনসারুল। সাহেল জোনে তৎপর আনসার ডাইন বা মুজওয়া নামে উগ্র জঙ্গি সংগঠন। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ ও স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব মার্কিনিদের কাছে আকর্ষণীয় হবে এটাই স্বাভাবিক। সে জন্যই সেখানে AFRICOM প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন করে সীমিত আকারে মার্কিন সেনা মোতায়েনের কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন। পাঠকদের একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৮০০ সেনাছাউনি রয়েছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বছরে ১৫৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়। একজন মার্কিন নাগরিককে এজন্য বছরে দিতে হয় ১০ থেকে ৪০ হাজার ডলার। সচেতন পাঠক মাত্রই জানেন, মার্কিন অর্থনীতিই হচ্ছে যুদ্ধ অর্থনীতি। যদি বিশ্বে যুদ্ধ প্রলম্বিত হয়, তাহলে মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। আর এজন্যই যুদ্ধটা(?) খুব প্রয়োজন ওবামা প্রশাসনের জন্য। মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের মধ্য দিয়ে ২০০৩ সালে, সেই যুদ্ধের অবসান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই যুদ্ধ এখন সম্প্রসারিত হবে আফ্রিকায়। আর যেখানেই যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়েছে, সেখানেই বেড়েছে সন্ত্রাস। পাঠক, TomDispatch-এ প্রকাশিত এই নিবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন : Nick Turse, US Special Ops Mission in Africa Fail to Stem Rising Tide of Terror, 13 September 2015)।মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সিরিয়ায় যুদ্ধ নতুন একটি মাত্রা পাওয়ায় এবং সৌদি আরবে অভ্যন্তরীণ সংকট বেড়ে যাওয়ায় ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। এ অঞ্চল ঘিরে ভারত ও চীনের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। চীনের বর্তমান প্রশাসন নতুন করে সিল্ক রুট নবায়ন করার উদ্যোগ নিলে ভারত তার প্রাচীন কটন রুটকে নতুন করে সাজাতে চাচ্ছে। সিসিলি, মরিশাস ও শ্রীলংকায় ভারতের প্রভাব বাড়ছে। সিসিলির সঙ্গে ৪টি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চল নিয়ে ইন্ডিয়ান ওসেন বিমের নেতৃত্ব দিতে চায় ভারত। ভারতের এই অবস্থানকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করছে। বাংলাদেশসহ ভারতের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি রয়েছে। এই বলয়ে মিয়ানমারকেও আনতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ভারত মহাসাগরভুক্ত মালাক্কা প্রণালি দিয়ে বিশ্বের জ্বালানি তেলের অর্ধেক পরিবাহিত হয়। চীনের জ্বালানি তেলের শতকরা ৯০ ভাগ এ পথে সরবরাহ করা হয়। এই সরবরাহ যদি কোনো কারণে বিঘ্নিত হয়, তাহলে বিশ্ব একটি বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়বে, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব চাইবে না। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলের ওপর এরা এখনও নির্ভরশীল। এ কারণেই বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। বাংলাদেশে যদি সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়, তাহলে তা ভারতের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। সুতরাং ভারত এটা চাইবে না। সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড যদি বেড়ে যায়(?), তাহলে সরকারের বিদেশ নির্ভরতা আরও বাড়বে।তবে একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, বাংলাদেশে স্থানীয় জঙ্গিরা থাকলেও তারা এখনও কোনো হুমকি সৃষ্টি করতে পারেনি। অকার্যকর রাষ্ট্রের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। যুক্তরাষ্ট্রের Fund for Peace প্রতি বছর অকার্যকর রাষ্ট্রের তালিকা প্রকাশ করে। ২০১৫ সালের তালিকায় বাংলাদেশের (স্কোর ৯১.৮) অবস্থান মিয়ানমার, শ্রীলংকা, নেপাল ও মিসরের সঙ্গে (ক্যাটাগরি Alert)। ১৭৮টি দেশ নিয়ে অকার্যকর রাষ্ট্রের যে তালিকা, তার শীর্ষে রয়েছে দক্ষিণ সুদান (স্কোর ১১৪ দশমিক ৫, Very High Alert ক্যাটাগরি)। এর অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এটাকে এখনও বড় হুমকি বলে মনে করছেন না। তবে যে দু-একটি ঘটনা ঘটেছে, তা যেন আমরা হালকাভাবে না নেই। আইএসের হুমকির কথা বলে কোনো পক্ষ কোনো সুবিধা নিতে চাচ্ছে কিনা, এটা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ব্লেম গেম বা পরস্পরকে দোষারোপের মানসিকতা আমরা যত কমিয়ে আনতে পারব, ততই তা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। সন্ত্রাস দমনে জাতীয় ঐকমত্য থাকাও প্রয়োজন। জাতীয় ঐক্য সন্ত্রাসীদের যে কোনো অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।শিয়াদের ওপর হামলা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নতুন একটি মাত্রা দিয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতি মানুষের ধিক্কারও সেই সঙ্গে বেড়েছে। সাধারণ মানুষ এ ধরনের কর্মকাণ্ড পছন্দ করে না। হোসনি দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রাক্কালে গ্রেনেড হামলার পরও বড় তাজিয়া মিছিল হয়েছে। সুন্নিরাও এ মিছিলে অংশ নিয়েছে। এটাই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষ কোনোদিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সমর্থন করেনি। আগামীতেও করবে না। Daily Jugantor 30.10.15

কোনো শক্তি বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে কি

প্রথমে হত্যা করা হলো ইতালিয়ান নাগরিককে। তারপর হত্যা করা হলো জাপানি এক নাগরিককে। এরপর বেছে নেওয়া হলো একজন পুলিশের এএসআইকে। এর রেশ ধরে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হলো ঢাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে। মারা গেল সাধারণ এক কিশোর। সব ঘটনা কি একই সূত্রে গাঁথা? মজার ব্যাপার, অন্তত দুটি ঘটনায় ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের স্বীকারোক্তি SITE নামক একটি জিহাদি পর্যবেক্ষণ সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশ কি সত্যি সত্যিই প্রমাণ করে বাংলাদেশে আইএস আছে? কোনো শক্তি কি এমনটি চাইছে? বাংলাদেশে সংকট বাড়ছে। হঠাৎ করেই যেন বাংলাদেশে আইএসের প্রসঙ্গটি সামনে চলে এলো! বাংলাদেশে কোনো শক্তি কি পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে? যাঁরা 'ষড়যন্ত্র' তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তাঁরা বিভিন্নভাবে এসব ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এসব ঘটনা আমাদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এতে করে নষ্ট হয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না।
কাকতালীয়ভাবে এটিও সত্য, বাংলাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিলে যখন গ্রেনেড হামলা চালানো হলো, ঠিক একই সময় পাকিস্তানে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে হামলা চালিয়ে সেখানে ২২ জনকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। কিন্তু এ অঞ্চলে গত সাড়ে ৩০০ বছরের ইতিহাসে কখনো শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালানো হয়নি। পাকিস্তানে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভাজন, দ্বন্দ্ব ও হামলার ইতিহাস অনেক পুরনো। কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটি নেই। বাংলাদেশে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায় একত্র হয়েই কারবালার সেই বিয়োগান্তক ইতিহাস স্মরণ করে। তাজিয়া মিছিলে সুন্নিদের অংশগ্রহণও স্বতঃস্ফূর্ত। যে কিশোরটি বোমা হামলায় মারা গেল, সেও একজন সুন্নি ধর্মাবলম্বী, সে শিয়া সম্প্রদায়ের নয়। এ ধরনের বোমা হামলা কী ইঙ্গিত করে? কোনো পক্ষ কি চাচ্ছে বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে? আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ২০০৮ সালের পর থেকে পাকিস্তানে শিয়া সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এখানে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর মাঝে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্তদের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশে এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। বাংলাদেশের মানুষ কে সুন্নি, কে শিয়া- এ বিভাজনটা কখনো করেনি। পাকিস্তানে ন্যূনতম চারটি জঙ্গি সুন্নি সংগঠনের খবর পাওয়া যায়, যারা সরাসরিভাবে শিয়াদের ওপর আক্রমণের জন্য দায়ী। এগুলো হচ্ছে লস্কর-ই-জানভি, সিপাহি সাহাবা, তেহরিকে তালিবান ও জুনদুল্লাহ। বাংলাদেশে এ রকমটি নেই। এমনকি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে শিয়া ধর্মাবলম্বীরা আদৌ মুসলমান ধর্মাবলম্বী কি না, এ নিয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকলেও (যেমন জর্দানের শতকরা ৪৩ জন মানুষ মনে করে শিয়ারা মুসলমান নন। তিউনিসিয়ায় এ সংখ্যা ৪১ জন আর মরক্কোতে ৫০ জন) বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো বিভ্রান্তি নেই। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, হঠাৎ করে শিয়াদের ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিলে এই হামলা ক তাই নিশ্চিত করেই বলা যায় এই হামলার সঙ্গে ইতালিয়ান, জাপানি ও এএসআই হত্যাকাণ্ডের একটা যোগসূত্র আছে- অর্থাৎ দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা! প্রশ্ন হচ্ছে দেশে যখন এক ধরনের 'স্থিতিশীলতা' বিরাজ করছে, তখন হঠাৎ করে কারা, কোন উদ্দেশ্যে এই অস্থিরতা সৃষ্টি করছে? এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে বহিঃশক্তির যোগসাজশের প্রশ্নটিও সামনে চলে এলো। একটি 'পক্ষ', তারা অভ্যন্তরীণ হতে পারে, তাদের সঙ্গে বহিঃশক্তির যোগসাজশ থাকতে পারে, তারা দেশে একটি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে 'ফায়দা' উঠাতে চায়। এই অভ্যন্তরীণ শক্তির সঙ্গে কি আইএসের (ইসলামিক স্টেট) কিংবা আল-কায়েদার কোনো যোগাযোগ রয়েছে? পাঠক লক্ষ করবেন SITE পর্যবেক্ষণ সংস্থার ওয়েবসাইটে শুধু আইএসের কথা বলা হয়েছে। আল-কায়েদার কোনো বক্তব্য কিন্তু উল্লেখ করা হয়নি! ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আল-কায়েদার বর্তমান নেতা জাওয়াহিরির একটি টেপ বার্তা প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল এই উপমহাদেশে (মিয়ানমারসহ) আল-কায়েদার একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। (আল-কায়েদা এভাবেই বিভিন্ন দেশে তাদের অপারেশন পরিচালনা করে- যেমন Al-Qaeda in Arabian Peninsula, Al-Qaeda in Islamic Magreb)। বাংলাদেশে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে আল-কায়েদার সম্পর্ক থাকতে পারে! কিন্তু আইএস এভাবে তাদের কোনো অপারেশন পরিচালনা করে না এবং মুসলিমপ্রধান দেশে কোনো জঙ্গি সংগঠনকে তারা সাধারণত স্বীকৃতি দেয় না। তাই আইএসের কোনো শাখা যে বাংলাদেশে নেই, তা নিয়ে প্রথম থেকেই আমাদের সন্দেহ ছিল। সাধারণত আইএস কোনো ব্যক্তিকে কখনোই টার্গেট করে না। অথচ বাংলাদেশে একজন ইতালিয়ান ও একজন জাপানি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল। পাঠকদের আরেকটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যে পর্যবেক্ষণ সংস্থার (SITE-Search for International Terrorist Entities) ওয়েবসাইটে তথ্যটি কোনো ধরনের বিশ্লেষণ ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই তুলে দেওয়া হয়েছিল, সেটি মূলত মার্কিন ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করে। সুতরাং এটি প্রচার করার পেছনে (শিয়াদের ওপর গ্রেনেড হামলার খবরও তারা প্রকাশ করেছে) স্পষ্টতই তাদের কোনো 'উদ্দেশ্য' থাকতে পারে। যারা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস নিয়ে কাজ করে, গবেষণা করে, তাদের কোনো প্রতিবেদনে আমি বাংলাদেশে আইএসের তৎপরতা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন দেখিনি (যেমন- The Long War Journal, South Asia Terrorism Portal, Institute for the Study of War)। ফলে একজন ইহুদি ও যিনি একসময় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে কাজ করতেন, সেই রিটা কাট্জের (SITE-এর কর্ণধার) উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। কোনো একটি 'পক্ষ' চাচ্ছে এটা বহির্বিশ্বে প্রচার করতে যে বাংলাদেশে আইএসের কার্যক্রম আছে! সারা বিশ্ব এটা এখন জেনেছে। শিয়াদের ওপর হামলার পর সারা বিশ্বের মিডিয়ায় এটা আইএসের কাজ বলে প্রচার করা হয়েছে। এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। এখন যারা এ থেকে 'সুবিধা' নিতে চায়, তারা সুবিধা নেওয়ার উদ্যোগ নেবে- এতে করে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে, এ প্রশ্ন থাকলই।
সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি হত্যাকাণ্ডসহ একের পর এক যেসব 'ঘটনা' ঘটে চলেছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও জনমানসে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। জঙ্গিবাদ, আইএস প্রশ্নে তাঁরা যত 'কম' কথা বলবেন, ততই আমাদের মঙ্গল। কোনো দেশে, এমনকি ভারতেও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এভাবে জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলেন না। আমাদের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ জঙ্গিবাদ নিয়ে এমনসব কথা বলেন, যা শুধু বিভ্রান্তিই বাড়ায়। এখন যেদিকে বেশি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন, তা হচ্ছে- ১. প্রতিটি ক্ষেত্রে সুষুম ও নিরপেক্ষ তদন্ত সম্পন্ন করা এবং দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা। না হলে এক ধরনের আস্থার সংকটের সৃষ্টি হবে; ২. বাংলাদেশে 'কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স' ফোর্সকে আরো শক্তিশালী করা। দক্ষ তরুণ অফিসারদের এখানে নিয়োগ দেওয়া। তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বৈদেশিক বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিয়ে দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ দেওয়া; ৩. গোয়েন্দা কার্যক্রমের শৈথিল্য দূর করা। ঢাকা শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। রাতে তল্লাশি বেড়েছে। এটা ভালো লক্ষণ। এটা যেন স্থায়ী হয়। মনিটরিং যেন বাড়ানো হয়। একটা ঘটনা ঘটাল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কিছুদিন থাকল। তারপর তৎপরতা থেমে গেল, এমনটি যেন না হয়; ৪. যদি আইএস (বা আল-কায়েদা) থেকে থাকে, তা স্পষ্ট করা হোক; ৫. জঙ্গি প্রশ্নে রাষ্ট্রের একজন মুখপাত্র কথা বলবেন। সবাই কথা বললে নানা রকম বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
আমরা জানি না এসব অপতৎপরতার শেষ কোথায়। একের পর এক 'ঘটনা'গুলো ঘটছে এবং তাতে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। মানুষ যে স্বস্তিতে আছে, তা বলা যাবে না। আমরা চাই না এ ধরনের 'আরেকটি ঘটনা'র জন্ম হোক! বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে থাকুক। আমি দুঃখজনকভাবে লক্ষ করেছি 'জঙ্গি প্রশ্নে' বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে নিয়ে যখন বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে তখন আমাদের দূতাবাসের (বিশেষ করে ওয়াশিংটনে ও জাতিসংঘে) কর্মকাণ্ড খুব একটা চোখে পড়ে না। বাংলাদেশে যে আইএস নেই, এটা প্রমাণে তাদের কর্মকাণ্ডকে আমি গুরুত্ব দিই। SITE-এর 'কর্মকাণ্ডে' আমাদের দেশের 'সহনশীল ইসলাম'-এর ভাবমূর্তি যতটুকু নষ্ট হয়েছে, তা উদ্ধারে দূতাবাসের কর্মকর্তারা নির্লিপ্ত বলেই মনে হয়। তাই দূতাবাসগুলো পরিচালনায় নয়া নীতি প্রণয়ন করাও জরুরি।
পর পর দুটি বিদেশি হত্যাকাণ্ডকে আমি যতটা না গুরুত্ব দিই (এমন ঘটনা অতিসম্প্রতি ফিলিপাইনেও ঘটেছে), তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই তাজিয়া মিছিলে হামলার ঘটনাকে। এ ঘটনা বহির্বিশ্বে একটি ভিন্ন মেসেজ দিচ্ছে। আশঙ্কা করছি, এর চেয়েও 'বড়' ঘটনা ঘটাতে পারে স্থানীয় জঙ্গিরা। তাই গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো, পুলিশি টহল অব্যাহত রাখা, নজরদারি বাড়ানো- এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। সাধারণ মানুষ যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তা হলে তা কারো জন্যই কোনো মঙ্গল নয়। তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে চারজনক গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আশা করি এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন হবে। Daily Kaler Kontho 29.10.15

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের চল্লিশ বছর

চলতি বছর বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর পার করছে। চীন বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী এবং দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যকার সাংস্কৃতিক বন্ধনের সম্পর্ক হাজার বছরের পুরনো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হলেও পাকিস্তানি জামানায়ও এ অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ চীন সফর করেছেন। মওলানা ভাসানী কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। তবে এটাও সত্য, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরই ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট চীন বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক ধাপে ধাপে উন্নত হয়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর উপলক্ষে চীন রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দিনটি পালন করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে চীন সফরে গিয়েছিলেন। এরপর গত মে মাসে (২০১৫) ঢাকা সফর করে যান চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী লিউ ইয়েন তোং। এর আগে গেল ডিসেম্বরে (২০১৪) ঢাকায় এসেছিলেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং আই। এসব সফর হয়েছে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর পালন উপলক্ষে। চীন বাংলাদেশকে যে গুরুত্ব দেয়, এসব সফর তাই প্রমাণ করে। এমনকি এ বছরের কোনো এক সময় চীনা প্রধানমন্ত্রী লি চেখিয়াংয়ের বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনাও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর একটা ব্যাপক প্রত্যাশার সৃষ্টি করলেও ওই সফর নিয়ে প্রশ্ন যে ছিল না, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার এই প্রবণতাকে ভালো চোখে দেখেনি ভারতের নীতিনির্ধারকরা। ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দি হিন্দু এক প্রতিবেদনে তখন জানিয়েছিল, চীনা নেতৃত্বাধীন শতাব্দীতে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারকরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। যদিও সরাসরি কোনো ভারতীয় নেতা এই সফরের সমালোচনা করেননি। ইতিমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার সার্ক সফরের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। ওই সফরে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্কের বন্ধনের কথাও উল্লেখ করে গেছেন। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে যেভাবে গুরুত্ব দেয়, ঠিক একইভাবে গুরুত্ব দেয় চীনের সঙ্গে সম্পর্ককেও। তবে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে গভীর সমুদ্রবন্দর (নির্মিতব্য) পরিচালনার ভার বাংলাদেশ কোনো বিদেশী কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে চায় না। চীনা সরকার এটি পেতে চেয়েছিল। উল্লেখ্য, চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির পাশাপাশি ইউএই, নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্ক সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু একটি বাছাই কমিটি প্রথমে চায়না হারবারকে যোগ্য বলে অভিমত দিয়েছিল। চায়না হারবারের প্রস্তাব অনুযায়ী তিন ধাপে ১০ বছরের মধ্যে এই নির্মাণ সম্পন্ন হবে। ব্যয় হবে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১.২৮ বিলিয়ন ডলার। ৩ বছরে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। বড় জাহাজগুলো তখন এখানে নোঙর করতে পারবে (এখন চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। সিঙ্গাপুর থেকে ছোট জাহাজে পণ্য আনতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয় প্রচুর)। প্রথম পর্যায়ে বন্দরে ২০ লাখ টিইউইউস (কনটেইনার টার্মিনাল) কনটেইনার ধারণ করতে পারবে। আর সাধারণ কার্গোর (খোলা পণ্য) ধারণ সক্ষমতা হবে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টন। এখানে এখন অনেকগুলো দেখার বিষয় রয়েছে। আমার বিবেচনায় বাছাই কমিটির চায়না হারবারকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল সঠিক। কেননা চীনারা এ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে। এ অঞ্চলে অন্তত তিনটি গভীর সমুদ্রবন্দরের খবর জানা যায়, যা চীনা অর্থে ও চীনা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্মিত হয়েছে এবং পরিচালিত হচ্ছে। শ্রীলংকায় দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। একটি হামবানতোতায়, অপরটি কলম্বোতে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত হামবানতোতায় ছিল গভীর জঙ্গল। ছোট একটি শহর, যেখানে কোনো ভালো হোটেল ছিল না। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জন্মস্থান এখানে। চীন এখানে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর ফলে পুরো হামবানতোতার দৃশ্যপট বদলে গেছে। হামবানতোতা আজ একটি আন্তর্জাতিক নগরীর মর্যাদা পেয়েছে। নামকরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে এখানে। আগামী ২০১৮ সালে এখানে কমনওয়েলথ গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কলম্বোতে যে বন্দরটি নির্মিত হয়েছে, তাতে বছরে ৮ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা একটাই, এখানে মেগাশিপ অর্থাৎ বড় জাহাজগুলো ভিড়তে পারে এবং পণ্য খালাস করতে পারে। বলা হচ্ছে, বন্দর পরিচালনা কার হাতে থাকবে- এটা নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। যদি সর্বশেষ কলম্বোর সিআইসিটি অর্থাৎ কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা দেখি, তাহলে দেখতে পাব শতকরা ৮৫ ভাগ মালিকানা চীনের হাতে। ১৫ ভাগের মালিকানা শ্রীলংকা সরকারের হাতে। যদি পাকিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা বলি, তাহলে শতকরা একশ ভাগ মালিকানাই চীনাদের হাতে। এক সময় সিঙ্গাপুরের হাতে দায়িত্ব ছিল এর পরিচালনার। এখন চীনাদের হাতে রয়েছে পরিচালনার ভার। যেখানে তাদের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেখানে পরিচালনার ভার থাকলে আপত্তি কোথায়? সোনাদিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যদি বিঘ্নিত না হয়, তাহলে চীনাদের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার দেয়া যেতে পারত। সবচেয়ে বড় কথা এ ধরনের বন্দর পরিচালনায় যে অভিজ্ঞ জনশক্তি প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। বরং চীনাদের সঙ্গে থেকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতাম। ডিজাইন তৈরিতেও অভিজ্ঞ চীনারা। সুতরাং তাদের ওপর আস্থা রাখা যেত। কিন্তু এখন তা আর হচ্ছে না।সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সংক্রান্ত চুক্তি না হওয়া ছিল নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তবে যত দ্রুত আমরা সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারব ততই আমাদের জন্য তা মঙ্গল। কেননা দেরি হলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএম-এর কর্মকাণ্ডকে স্বাগত জানিয়েছি। বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য) ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে যে অর্থনৈতিক করিডর গড়ে উঠছে, তার উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থেই এই সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অনেক বেশি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই বন্দর দিয়েই তাদের পণ্য আমদানি-রফতানি করতে পারবে। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব থাকলেও চুক্তিটি হল না কেন? একটি ধারণা দেয়া হয়েছে যে, চীনা ঋণের ধরন নিয়ে চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ সহজ শর্তে ঋণ চেয়েছিল। এতদিন একটা ধারণা ছিল যে, এ প্রকল্পে প্রথমে চীন নমনীয় ঋণের শর্ত দিয়েছিল। এই ঋণের সুদের হার কম, মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু পরে জানা গেল চীন এই ঋণকে বাণিজ্যিক ঋণে পরিণত করতে চায়, যেখানে সুদের হার ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এখানে একটি বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। প্রথমত, বাংলাদেশ অতীতেও বিভিন্ন চীনা প্রকল্পে যে ঋণ নিয়েছে, তার ধরন কী? তা কি বাণিজ্যিক ঋণ? দ্বিতীয়ত, এই প্রকল্প নিয়ে চীনের সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনা চলে আসছিল। ওই আলোচনায় কি বাণিজ্যিক বন্দরের ঋণের প্রশ্নটি এসেছিল? তৃতীয়ত, কোনো সমঝোতা ছাড়াই কেন বলা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে? চতুর্থত, বাংলাদেশের আলোচনাকারীরা কী চীনা অর্থে নির্মিত ও পরিচালিত গাওদার, হামবানতোতা ও কলম্বো গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও পরিচালনায় কি ধরনের চুক্তি হয়েছিল, তা পর্যালোচনা করেছিলেন? এমন কথাও বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ মূলত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনা অর্থায়নের বিষয়টি ভারত কীভাবে দেখছে, এটা বিবেচনায় নিতে চায়। যাই হোক, সোনাদিয়ায় আর গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হচ্ছে না। এখন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরে। এ ক্ষেত্রে সোনাদিয়ায় সমুদ্রবন্দরের পরিকল্পনাটি পরিত্যক্ত হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারেও একটা ধোঁয়াশা রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তা স্পষ্ট করা হয়নি। ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ এখনও চাচ্ছে সোনাদিয়াতে আরেকটি সমুদ্রবন্দর নির্মিত হোক। আমাদের অর্থনীতির জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরটির ব্যাপারে চীনাদের স্বার্থ আছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু আমাদেরও স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যিক স্বার্থে এই বন্দর, এমনকি কুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়কের গুরুত্ব অনেক।চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশের বেশ কটি বড় প্রজেক্টে চীন অর্থায়ন করেছে। বেশ কটি ব্রিজও চীন তৈরি করে দিয়েছে, যা চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী চীন সফরের সময় চীনের কাছ থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো ও বিশেষ ছাড়-এর দাবি বাংলাদেশ উত্থাপন করেছিল বলে জানা গেছে। বর্তমানে চীনের ঋণের ক্ষেত্রে পরিশোধের মেয়াদ ১০ থেকে ১৩ বছর, এ ছাড়া আরও ৩ বছর গ্রেস পিরিয়ড দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী এই ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২০ বছরের পাশাপাশি গ্রেস পিরিয়ড আরও ৫ বছর বৃদ্ধি করার অনুরোধ করেছিলেন। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করে দেখা যায়- বাণিজ্য চীনের অনুকূলে। বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য চীনে রফতানি করে, তার চেয়ে প্রায় ১৩ দশমিক ৮ গুণ পণ্য বেশি আমদানি করে। ১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলাদেশ রফতানি করেছিল ৪৮.৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছিল ৫৯২.৬৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০০১-২০০২ সময়সীমায় প্রায় ৬১ গুণ বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করতে হয়েছিল (১১.৬৭ মি.-এর বিপরীতে ৭০৮.৯৪ মি.)। ২০১২-১৩ সালে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৮.১২ মি. (রফতানি) ও ৬৩২৪ মি. (আমদানি)। অন্যদিকে চীনের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ তেমন বেশি নয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত চীন ঋণ দিয়েছিল ১৮১ মি. ডলার, যা ছিল সুদমুক্ত। একই সঙ্গে ৭৫ মি. কম সুদে, ৭৬৪ মি. সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট ও ৩২.৯৪ মি. অনুদান দিয়েছিল। ২০১৩ সালে চীন তার নিজ দেশে ৫০০০ আইটেমের বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ মূলত ফ্রজেন ফুড, পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া, তৈরি পোশাক চীনে রফতানি করে। চীনা বিনিয়োগের যে পরিসংখ্যান আমরা পাই, তাতে দেখা যায়, ২০০৯ সালে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৮৮ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৩ সালে এসে ১৮৬ জন উদ্যোক্তা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৩২০ মিলিয়ন ডলার। একইসঙ্গে প্রতিরক্ষা সেক্টরের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ব্যবহৃত সমরাস্ত্রের শতকরা ৭৫ ভাগের উৎস হচ্ছে চীন। ট্যাংক, সাঁজোয়াযান, আর বিমান বাহিনীর জন্য ফাইটার প্লেন চীন থেকে ক্রয় করা হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগেই বাংলাদেশ-চীন সামরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জীবদ্দশায় জিয়া একাধিকবার চীন সফর করেছেন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত চীনের ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের বাংলাদেশ সফর ছিল নিয়মিত। এখন এই প্রবণতা কিছুটা কম। ২০০২ সালে খালেদা জিয়ার সময়সীমায় বাংলাদেশ ও চীন একটি সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত ও চীনকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়। ভারত পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায়, খুব স্বাভাবিক কারণেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের গুরুত্ব অনেক বেশি। তবে নিকট প্রতিবেশী দেশ হিসেবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ককেও বাংলাদেশ গুরুত্ব দেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই দুটি দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর পার হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, মাত্র ৪০ বছর দিয়ে এ সম্পর্ককে বিচার করা যাবে না। হাজার বছরের সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ভিত্তি রয়েছে এই দুটি দেশের মাঝে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত গত ২৯ জুন (২০১৫) স্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে চায়। সে বছর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১০০ বছর পূর্তি হবে। বাংলাদেশের স্বপ্ন ২০৫০ সালে ধনী দেশে পরিণত হওয়া। এ স্বপ্ন পূরণে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। চীনা রাষ্ট্রদূত মা মিং ছিয়ায়ের বক্তব্যের মধ্যেই ফুটে উঠেছে আসল কথাটি। এটাই হচ্ছে মূল কথা। আমাদের উন্নয়নে, দারিদ্র্য দূর করতে ও আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করতে হলে চীনের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর পালন উপলক্ষে এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। Daily Jugantor 26.10.15

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কি সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে


দুজন বিদেশি নাগরিকের হত্যাকা-, এই হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সতর্কবার্তা ও তা নবায়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার সমালোচনা করে একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কি অবনতি ঘটেছে? যারা সমসাময়িক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন একাধিক ইস্যুতে এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র খুব সন্তুষ্ট ছিল না। এমনকি ‘সকল দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন’-এর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘অবস্থান’, সেই অবস্থানের এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি। জিএসপি সুবিধা না পাওয়ায় একাধিক মন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে আসছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছিলেন। এই যখন পরিস্থিতি তখন দুজন বিদেশি নাগরিকের হত্যাকা-কে যুক্তরাষ্ট্র খুব সহজভাবে নিতে পারেনি। দূতাবাসের দেওয়া সতর্কবার্তা নিয়ে একাধিক মন্ত্রী বিরূপ সমালোচনা করেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘মার্কিন নীতি আমাদের জন্য আরামদায়ক নয়। গত ৬-৭ বছর ধরে মার্কিন নীতি আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না।’ বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের অতি বাড়াবাড়ি। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সতর্কবার্তাকে ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের’ অংশ হিসেবে অভিহিত করেছেন। প্রসঙ্গক্রমেই গত ৫ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র পাশে না থাকলে বাংলাদেশ শেষ হয়ে যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশটি বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তাতে সার্বভৌম বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নির্দেশেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করেছিল। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যাতে না হয়, সে জন্য সব রকম চেষ্টা করেছিল বলেও দাবি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান। তার মন্তব্য ধরে নেওয়া যায়, এটাই সরকারের বক্তব্য। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা ‘ভূমিকা’র কারণে সরকারপ্রধান তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহুল আলোচিত টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল (২৫ নভেম্বর ২০১৩)। মজার ব্যাপার বাংলাদেশে বাম সংগঠনগুলো টিকফা চুক্তির বিরোধিতা করলেও জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি এই চুক্তির বিরোধিতা করেনি। এই দল দুটি সরকারের অন্যতম অংশীদার। পত্রপত্রিকায় তাদের কোনো মন্তব্য আমার চোখে পড়েনি। চুক্তিটি সম্পর্কে আমরা যা জানতে পেরেছি, তা হচ্ছে চুক্তিটিতে ১৬টি অনুচ্ছেদ আর ৭টি আর্টিকেল রয়েছে। প্রায় ৪২টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আমাদের জানিয়েছেন। অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তখন আমাদের জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৫০টি দেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে। তবে চুক্তির নামকরণের ব্যাপারে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। শুরুতে চুক্তির সঙ্গে ‘এগ্রিমেন্ট’ শব্দটি থাকলেও বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা ওঠায় ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ শব্দটি বদলে ফোরাম শব্দটি যুক্ত করা হয়। বিভিন্ন মহল থেকে চুক্তিটির সঙ্গে জেএসপির একটা যোগসূত্র আছে বলা হলেও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের আমাদের জানিয়েছিলেন, টিকফার সঙ্গে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কোনো যোগসূত্র নেই। বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধার দাবি অব্যাহত রাখবে, এরকমটিই আমাদের জানিয়েছেন বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তবে বিষয়টি যে খুব সহসাই সমাধান হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ বেশ ক’জন মার্কিন সিনেটর এক চিঠিতে জিএসপি সুবিধা স্থগিত রাখার অনুরোধ করেছিলেন। তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছেন এমনটি আমাদের জানা নেই। ইতোমধ্যে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের শীতলতা আসায় জিএসপি প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র নমনীয় হবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। ফলে বাংলাদেশি পণ্য, বিশেষ করে আরএমজি পণ্য জিএসপি সুবিধা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করবে। এখানে বলা ভালো, ২০১৩ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র কিছু পণ্যের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) বাংলাদেশকে দিত, তা স্থগিত করে। স্থগিত হওয়ার পেছনে মূল কারণটি ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমমান নিশ্চিত করার ব্যর্থতা। এমনকি আশুলিয়ায় শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে না পারা, তৈরি পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা না করার ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট ছিল। ফলে এক পর্যায়ে কংগ্রেস সদস্যদের চাপের মুখে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে যায়। এরপর বাংলাদেশ সরকারের একটা প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় যে, টিকফা চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেবে। প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে টিকফা চুক্তির কোনো যোগসূত্র নেই। দ্বিতীয় আরেকটি যে বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেলেও তাতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়বে না। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন যাবৎ তৈরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছে। কিন্তু তৈরি পোশাকে আমাদের কোনো জিএসপি সুবিধা নেই। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের। এর মাঝে মাত্র ০.৫ ভাগ পণ্য এই শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। এর পরিমাণ মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার কর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখনো তার পণ্য নিয়ে টিকে আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় যেসব বাংলাদেশি পণ্যে, তার মধ্যে রয়েছে তামাক, সিরামিক, ফার্নিচার, প্লাস্টিক, খেলনা ইত্যাদি। এর খুব কম পণ্যই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাকে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা শতকরা ১৫ ভাগ হারে শুল্ক পরিশোধ করে বাজার ধরে রেখেছে। অথচ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তি অনুযায়ী একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা দিচ্ছে না। এই সুবিধা উন্নত রাষ্ট্রগুলো পায়। তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দোহা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। তাই তৈরি পোশাকে আমরা যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা না পাই, তাহলে এই জিএসপি সুবিধা রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো বড় অবদান রাখতে পারবে না। আজ যদি জিএসপি সুবিধার আশ্বাসে আমরা টিকফা চুক্তি করে থাকি তাতে আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। টিকফা চুক্তির সঙ্গে তাই জিএসপি সুবিধাকে মেলানো যাবে না। জিএসপি সুবিধা একটি ভিন্ন বিষয়।
এখন যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে টিকফা চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হলাম। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় দেশে মার্কিনি বিনিয়োগ বাড়বে, এটা সত্য কথা। এতে করে আমাদের বাজার, সেবা খাত উন্মুক্ত হয়ে যাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য। ব্যাপক প্রাইভেটাইজেশন ঘটবে, তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যক্তিগত খাত। টিকফা চুক্তির আওতায় ৫ ও ১৯ ধারা মতে উভয় দেশ (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) বাণিজ্যে বেশ নমনীয় নীতি গ্রহণ করবে এবং ব্যাপক বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে। ৮নং ধারায় ব্যাপক ব্যক্তিগত খাত প্রসারের কথা বলা হয়েছে। এই ধারায় একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠন করার কথাও আছে। এদের কাজ হবে ব্যক্তিগত খাত কীভাবে আরও বিকশিত করা যায়, সে ব্যাপারে উভয় সরকারকে উপদেশ দেওয়া। ৯নং ধারায় বলা আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে কিন্তু উৎপাদন খাতে জড়াবে না। অর্থাৎ কোনো পণ্য উৎপাদন করবে না। এখানে সমস্যা হবে অনেকগুলো। এক. যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে (বিশেষভাবে সেবা খাতে) এবং ওই সব কোম্পানিকে ট্যাক্স সুবিধা দিতে হবে। আইনে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশকে সেই আইন সংশোধন করতে হবে। ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা মার খাবে। তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। দুই. চুক্তির ফলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ব্যবহার, টেলিকমিউনিকেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে গেলে, শিক্ষা খাত পণ্যে পরিণত হবে। বিনামূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। উচ্চশিক্ষা ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। এতে করে শিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যারা ধনী, তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে, আর যারা গরিব তারা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। একই কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্য খাতের ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়ে যাবে। এসব সেবামূলক খাত থেকে সাধারণ মানুষ যে ‘সেবা’ পেত তা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসবে। সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে তখন বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে।  বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ গ্রাহককে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস কিনতে হবে। সরকারি ভর্তুকির কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে কৃষি ও আইটি সেক্টর। কৃষিতে সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তা আর দিতে পারবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলো কৃষিতে ৫ ভাগের বেশি ভর্তুকি দিতে পারবে না। টিফকা চুক্তির ১৮নং ধারায় বলা হয়েছে, কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে। মজার ব্যাপার যুক্তরাষ্ট্র নিজে কৃষিতে ভর্তুকি দেয় ৯ ভাগ। এখন বাংলাদেশে কৃষি সেক্টরে ভর্তুকি কমানো হলে কৃষিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। কৃষক উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে কৃষি উৎপাদন, বিশেষ করে চাল উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে।
আমরা বিষয়গুলো আলোচনা করলাম এই যুক্তিতে যে, প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে। আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। এখানে আরও তিনটি চুক্তির কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি’ স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির আওতায় প্রতি বছর একবার ঢাকায় ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচান করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে একটি SOFA (Status of Forces Agreement) করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ এখন অবধি এ ধরনের কোনো চুক্তি করতে রাজি হয়নি। একই সঙ্গে ACSA (Acquisition of Cross Servicing Agreement) নামে অপর একটি চুক্তিও করতে চাচ্ছে। SOFA ও ACSA চুক্তিতে যদি বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে তাহলে মার্কিন সেনাদের বাংলাদেশে সাময়িক উপস্থিতি, জ্বালানি গ্রহণ, যাত্রাবিরতি, ‘পোর্ট অব কল সুবিধা’ নিশ্চিত হবে।
এমনকি এ ধরনের চুক্তির ফলে কোনো মার্কিন সেনার বিচার (যদি বাংলাদেশে কোনো অপরাধ করে) বাংলাদেশের আইনে করা যাবে না। সিরিয়ায় ‘ইসলামিক এস্টেট’-এর উত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ৬২টি দেশ নিয়ে একটি জোট Global Coatition to Counter ISIL গঠন করেছে। বাংলাদেশকে এই জোটে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাংলাদেশ এখন অবধি এই জোটে যোগ দেয়নি। (ভারতও যোগ দেয়নি)। আরও একটা কথাÑ যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে তারা যে Forward presence নীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সেই নীতির অন্তর্ভুক্ত। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছেই। এখন সর্বশেষ খবর অনুযায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ ৪ জন বিদেশি রাষ্ট্রদূত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে (২১ অক্টোবর) যখন বলেন, বিদেশিদের ওপর আরও হামলার আশঙ্কা রয়েছে, তখন বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের’ নাম করে এবং সন্ত্রাসের হুমকিকে নিউট্রাল করতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে কি না, এ প্রশ্নটি বারবারই আলোচিত হতে থাকবে। এ ক্ষেত্রে আমরা যেন পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা ভুলে না যাই। সন্ত্রাস দমনে আমরা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চাইব। তখন যুক্তরাষ্ট্রকেই বলতে হবে তারা যে ‘আশঙ্কার’ কথা বলছে তা কোত্থেকে আসছে? কারা হামলা করতে পারে কিংবা বিদেশি কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী এর সঙ্গে জড়িত কিনাÑ এ বিষয়গুলো তাদের খোলাসা করা দরকার। না হলে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। 
Daily Amader Somoy
26.10.15

আইএস আছে, আইএস নেই

বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের অস্তিত্ব আছে কি নেই, এ বিতর্কের অবসান এখনো হয়নি। তবে সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের কারো কারো বক্তব্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন বাংলাদেশে আইএস জঙ্গিদের কোনো ঘাঁটি নেই, সেখানে কোনো কোনো মন্ত্রীর বক্তব্যে আইএস জঙ্গিদের অস্তিত্বের কথা বলা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে আইএস বা আল-কায়েদার ঘাঁটি রয়েছে, এটা আমার কাছে নিশ্চিত নয় এখন অবধি। আল-কায়েদার তাত্তি্বক হচ্ছেন আবু মুসাব আল সুরি। সুরি আল-কায়েদার স্ট্র্যাটেজির কথা বলতে গিয়ে ঝঢ়রফবৎ বিন-এর কথা বলেছেন অর্থাৎ মাকড়সারা যেমনি এখানে সেখানে জাল তৈরি করে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে এবং সেই জাল ভেঙে দিলে অন্যত্র গিয়ে ঠিক তেমনি জাল তৈরি করে, আল-কায়েদার স্ট্র্যাটেজিও ঠিক তেমনি। ছোট ছোট গ্রুপে অঞ্চল ভিত্তিতে তারা সংগঠিত হয় এবং তাদের ওপর আক্রমণ হলে তারা অন্যত্র গিয়ে সংগঠিত হয়, ঠিক মাকড়সারা যেমনটি করে। অষ-ছধবফধ রহ অৎধনরধহ চবহরহংঁষধ, অষ-ছধবফধ রহ ওংষধসরপ গধমৎধন, অষ-ছধবফধ রহ ওৎধয় এভাবেই সংগঠিত। এর বাইরে তারা ভিন্ন নামেও অপারেট করে। যেমন আল নুসরা ফ্রন্ট (সিরিয়া), আল-গামা আল ইসলামিয়া। এ দুটো সংগঠনের সঙ্গে আদর্শগতভাবে আল-কায়েদার মিল আছে। এখানে ইসলামিক স্টেট জঙ্গি সংগঠনটির কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। আল-কায়েদার সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের আদর্শগতভাবে অমিল রয়েছে। আল-কায়েদা যেখানে শরিয়াভিত্তিক ইসলামী শাসন চায়, সেখানে ইসলামিক স্টেট চায় একটি ইসলামী খিলাফত। অর্থাৎ একটি খিলাফত রাষ্ট্রের আওতায় সব মুসলিম রাষ্ট্র একত্রিত হবে। সেখানে একজন খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান থাকবেন। আল-কায়েদার সঙ্গে পার্থক্য এখানেই যে আল-কায়েদা খিলাফতের পরিবর্তে ইসলামী আমিরাতে বিশ্ববাসী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উপমহাদেশে আল-কায়েদা কি আদৌ স্থান করে নিতে পেরেছে? ভারতে এর কোনো স্থান নেই। পাকিস্তানে তালেবানদের প্রভাব বেশি, আল-কায়েদা তার শাখা স্থাপন করতে পেরেছে, এমন খবর আমাদের জানা নেই। তবে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকতে পারে। আর বাংলাদেশে তাদের আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই। বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে যারা পরিচিত তাদের সঙ্গে আল-কায়েদার যোগাযোগ আছে, এমন কোনো তথ্যভিত্তিক প্রমাণও আমাদের কাছে নেই। ফলে বাংলাদেশে বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে, এটাও ঠিক নয়। তাহলে অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তার ঝুঁকি তোলার অর্থা কী ছিল? এর আগে অনেক বিদেশি টিম বাংলাদেশ সফর করে গেছে। তখন তো এ প্রশ্ন তোলা হয়নি। এখন তাহলে তোলা হলো কেন? সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এমন কোনো 'ঘটনা' ঘটেনি, যাতে তা বিদেশিদের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে!
প্রধানমন্ত্রীই নিউইয়র্কে প্রথমে বলেছিলেন বাংলাদেশে জঙ্গিদের কোনো স্থান নেই। এটাই হচ্ছে আসল কথা। বাংলাদেশে ইসলামের নামে যারা উগ্রবাদ প্রচার করছে, তারা বিভ্রান্ত। আল-কায়েদা কিংবা ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের মেলানো যাবে না। তবে এটা সত্য, কোনো কোনো মন্ত্রী, সরকারের সম্পর্ক বুদ্ধিজীবী যখন মিডিয়ায় টিভির টকশোতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন, তখন তা দেশে নয় বরং বিদেশেও বিভ্রান্তি তৈরি করে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান। এখানে উগ্রপন্থী ইসলামী দল আছে। ফলে বাংলাদেশ যে কোনো কোনো দেশের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে রয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশ মডারেট মুসলমানের দেশ। এখানে উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই। উগ্রবাদকে মানুষ পছন্দ করে না। সাধারণ মানুষের মাঝে এদের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও নেই। তাই জঙ্গিবাদকে নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই মঙ্গল। মনে রাখতে হবে দলের সিনিয়র নেতারা, মন্ত্রীরা যদি জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলেন, তাতে সমর্থকরা প্রভাবান্বিত হন। তাই তাদের সংযত কথাবার্তা বলা উচিত। জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমরা কেন কোনো দেশই এ সমস্যার বাইরে নয়। এ সমস্যার সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি সরাসরি জড়িত। এ ক্ষেত্রে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মাঝে সমঝোতা প্রয়োজন। জঙ্গিবাদ নিয়ে কোনো 'গ্লেম গেম' নয়, বরং সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে তৃতীয় পক্ষ এ থেকে ফয়দা ওঠাবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উদ্ধারে তাই প্রয়োজন এ মুহূর্তে একটি সমঝোতার। তবে অতিসম্প্রতি ঢাকায় দেয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একটি মন্তব্য আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেছেন, আইএসের উগ্রবাদ দমনে যৌথ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বার্নিকাট আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও, তথাকথিত 'সন্ত্রাস দমনে' বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে গেল সেপ্টেম্বরে যায়যায়দিনে আমি একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম। এ তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই সামরিকভাবে নিজেদের জড়িত করেছে, সেখানে সন্ত্রাস দমন তো হয়ইনি, বরং সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকা- 'জিইয়ে' রেখে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। পাঠক, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া কিংবা সিরিয়ার বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিতে পারেন। আমার আতঙ্কটা সেখানেই_ আইএসের উগ্রবাদ দমনে বার্নিকাট 'যৌথ উদ্যোগের' কথা বলে কি কোনো ইঙ্গিত করলেন? একাধিক কারণে বাংলাদেশ ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একদিকে চীনের উত্থান, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া মৈত্রী যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। ভারত মহাসাগর ক্রমেই মার্কিন সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের কর্মকা- এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে ভারত মহাসাগরে। অনেকেই মনে করতে পারেন ২ মার্চ, ২০১২ মার্কিন সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত) তৎকালীন কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের 'বিশেষ বাহিনী' মোতায়েন রয়েছে। এ নিয়ে ওই সময় বাংলাদেশে কম বিতর্ক হয়নি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ বেশ কটি চুক্তিতে আবদ্ধ (যেমন_ অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি ২০১৩, টিকফা চুক্তি ইত্যাদি) যেখানে সন্ত্রাস দমনে 'যৌথ কর্মসূচি' নেয়ার কথা বলা হয়েছে। অনেকেই জানেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ঝঙঋঅ (ঝঃধঃঁং ড়ভ ঋড়ৎপবং অমৎববসবহঃ) চুক্তি ও 'আকসা' (অপয়ঁরংরঃরড়হ ধহফ ঈৎড়ংং ংবৎারপরহম অমৎববসবহঃ) নামে দুটি চুক্তি করতে চাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাময়িক উপস্থিতি, জ্বালানি গ্রহণ, 'পোর্ট অব কল' সুবিধা দেয়া হবে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সম্মতি না দিলেও 'চাপে' আছে। ফলে ঝওঞঊ-এর ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের অস্তিত্ব 'আবিষ্কার' এবং বার্নিকাটের 'যৌথ উদ্যোগে'র কথা বলার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। এটা সত্য, বিশ্বে মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য যেখানে বেশি সেখানেই ইসলামের নামে উগ্রবাদ জন্ম হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, সোমালিয়া, এমনকি থাইল্যান্ডের একটা অঞ্চলে (যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ) ইসলামের নামে উগ্রবাদ বিস্তার লাভ করছে। নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম কিংবা সোমালিয়ায় আল-শাবাব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর খবর আমরা জানি। সেখানে কি 'সন্ত্রাস দমনে' মার্কিন সেনাবাহিনী পাঠানো হচ্ছে? এখানে পাঠকদের কিছু তথ্য দিতে চাই। যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকায় তাদের প্রথম সেনা কমান্ড অঋজওঈঙগ (টং-অভৎরপধহ পড়সসধহফ) প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে আফ্রিকার ২৮টি দেশে ১ হাজার ৩০০ মার্কিন সৈন্য ঈড়ঁহঃবৎ ঞবৎৎড়ৎরংস কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত। ২০০৫ সাল থেকেই বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশে ঋওঘঞখঙঈক বা টং ঃৎধরহরহম ঊীবৎপরংব নামে মার্কিন সেনারা তৎপর। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ক্যামেরুনে ৩০০ সেনা পাঠাচ্ছে। যদি সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার দৃষ্টি আফ্রিকায় সম্প্রসারিত করছে। আফ্রিকার ইউরেনিয়াম ও তেলসম্পদের দিকে এখন তার দৃষ্টি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি সম্প্রসারিত হচ্ছে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলগুলোর দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের ৬টি যুদ্ধজাহাজ ২০২০ সালের মধ্যেই ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করা হবে। আর ভারত মহাসাগর ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বৃহৎ শক্তির কাছে। একদিকে চীন তার 'সিল্ক রুট'কে নতুন করে সাজাচ্ছে, যেখানে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল এর একটি অংশ। ভারতও এগিয়ে এসেছে তার প্রাচীন 'কটন রুট' নিয়ে। ভারত 'ইন্ডিয়ান ওশেন রিম'ভুক্ত দেশগুলোকে তার নেতৃত্বের আওতায় আনছে। এ নিয়ে চীনের উদ্বেগ আছে। ফলে এ অঞ্চলে সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়বে, আর তাকে কেন্দ্র করে বাড়বে মার্কিনি তৎপরতা। বাংলাদেশে দুজন বিদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। ঈশ্বরদীতে একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজককে হত্যার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এ তিনটি ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা কিনা আমরা জানি না। তবে ১৫ অক্টোবর দুটি জাতীয় দৈনিকে গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে_ যারাই দুজন বিদেশিকে হত্যা করেছে, তারা বিভ্রান্ত করতেই আইএসের নাম ব্যবহার করেছে। এ হত্যাকা-ে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাননি গোয়েন্দারা, এমন তথ্যও দিয়েছে একটি জাতীয় দৈনিক। তাহলে কি বাংলাদেশে আইএস নেই? এই যখন পরিস্থিতি, তখন যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জনৈক সাখাওয়াতুল কবীরসহ চারজনকে আইএস তথা জেএমবি সমন্বয়ক সাজিয়ে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ গঠনের দিনও নির্ধারণ করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত খবরও ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। যখন ওই দৈনিকের খবরে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অভিযুক্ত সাখাওয়াতুল কবীরের সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তখন নানা প্রশ্ন জন্ম দিতে বাধ্য। আজ এটা আমাদের জানা জরুরি যে, আমাদের দেশে আদৌ আইএসের কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা। কেননা এর সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা ও বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তির প্রশ্নটি জড়িত।
তাই যে কোনো বিবেচনায় দুজন বিদেশির হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ জরুরি। কারণ এর সঙ্গে অনেক প্রশ্ন জড়িত। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এখন ঝুঁকির মুখে। বিদেশি ক্রেতা তথা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। এ জন্য সন্ত্রাস দমনে এবং জঙ্গি উৎখাতে সব দলের মাঝে একটি ঐকমত্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। এটি ঠিক, দুটি হত্যাকা-কে বড় করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এতে বাংলাদেশ বড় ধরনের সংকটের মাঝে পড়েছে, তেমনটিও নয়। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও হত্যাকা-ের বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেয়া উচিত। Daily Jai Jai Din 23.10.15

নয়া স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা?

সিরিয়া সংকট শুরু হওয়ার পর এবং ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরের পর রাশিয়া প্রথমবারের মতো ভিন্ন একটি দেশে সামরিক হামলা চালিয়ে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিল কি-না, এ প্রশ্নটি এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়। সিরিয়ার ব্যাপারে জেনেভায় ২০১৩ সালে লেভারভ-কেরি সমঝোতা এবং জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকদের তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের পর ওই সময় মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ এড়ানো গিয়েছিল বটে; কিন্তু ইসলামিক স্টেটের উত্থান এবং সিরিয়ার এক অংশ ও ইরাকের এক অংশ নিয়ে তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্র গঠন পুরো পরিস্থিতিকে বদলে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত বিমান হামলার পরও যেখানে আইএস জঙ্গিদের উৎখাত করা যাচ্ছিল না, সেখানে রুশ বিমান আইএস জঙ্গিদের আস্তানা পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিতে না পারলেও তাদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। আর মজার ব্যাপারটা হচ্ছে এখানেই। যেখানে আইএস জঙ্গিদের উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ায় এক হওয়ার কথা, সেখানে এ রুশ হামলাকে সহজভাবে নিতে পারছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা মনে করছে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে রক্ষা করতেই এ রুশ হামলা। তবে এটা তো সত্য, মার্কিন তথা মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় যেখানে ইসলামিক স্টেটের ঘাঁটি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি, সেখানে ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে রুশ বিমান বাহিনীর হামলায় ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের অনেক ছোট ছোট ঘাঁটি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তাদের শক্তি অনেক দুর্বল হয়েছে। এদিকে রুশ বিমান হামলাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্বে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এই বিমান হামলা সিরিয়ায় আসাদবিরোধী মডারেট জোটকে দুর্বল করবে। প্রায় ৪০টির মতো ছোট ছোট জোট, যারা আসাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র যাদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিল, তারাও রুশ বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো কোনো গ্রুপ ধ্বংসও হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতদিন প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে এসব গ্রুপের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র এ প্রশিক্ষণ বাতিল ঘোষণা করেছে। ওবামা নিজে স্বীকার করেছেন, সিরিয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে।এ রুশ বিমান হামলা অনেকগুলো সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এক. এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া তার সীমান্তের বাইরে সমরশক্তিকে ব্যবহার করল এবং বিশ্বকে জানান দিল, বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্বকে রাশিয়া মেনে নেবে না। দুই. সিরিয়া সংকটে এবং আইএস জঙ্গিদের উৎখাতে রাশিয়ার অবস্থানকে সমর্থন করেছে চীন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে চীন-রাশিয়ার ঐক্য আরও শক্তিশালী হল। বলা ভালো, রাশিয়া ও চীন সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সদস্য। তিন. সৌদি আরব এ অঞ্চলের অন্যতম একটি শক্তি। সৌদি আরব আসাদ সরকারকে না চাইলেও সিরিয়া সংকট নিরসনে রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছে। সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথমদিকে রাশিয়া সফর করেন। প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে সোচিতে পুতিনের বৈঠকের খবরও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে সৌদি আরবের একটি শংকাও রয়েছে। ইরান-রাশিয়া-আসাদ ঐক্য সৌদি আরবের জন্য চিন্তার কারণ। ইরান-সৌদি বিরোধ নতুন কোনো ঘটনা নয়। চার. সিরিয়া সংকটে তুরস্ক একটি ফ্যাক্টর। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য এবং রুশ বিমানের তুরস্কের আকাশসীমা লংঘন তুরস্ক খুব ভালো চোখে দেখেনি। ঘরের পাশে রাশিয়ার উপস্থিতি (সিরিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ তুরস্ক) তুরস্ক খুব সহজভাবে নেবে বলেও মনে হয় না। একই সঙ্গে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় শান্তি সমাবেশে বোমা হামলার (যে ঘটনায় ৯৭ জন মারা যান) ঘটনায় আইএসকে অভিযুক্ত করেছে তুরস্ক। এ পরিস্থিতি তুরস্কের অবস্থানকে জটিল করে তুলেছে।এখানে নিঃসন্দেহে সিরিয়ার ব্যাপারে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে ২০০১ সালে আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর ঠিক দুবছর পর ২০০৩ সালে বুশ প্রশাসন প্রিয়েমটিভ অ্যাটাক তত্ত্ব ব্যবহার করে ইরাক দখল করে নিয়েছিল। এ তত্ত্বের মূল বিষয় হচ্ছে শত্র“র আঘাত করার আগেই শত্র“কে আঘাত করে শেষ করে দেয়া। বলা হয়েছিল, ইরাকের কাছে মারণাস্ত্র রয়েছে, যা মার্কিন স্বার্থের প্রতি হুমকিস্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক হামলা ও এর পরবর্তী পরিস্থিতি আমরা সবাই জানি। ইরাক এখন অকার্যকর একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রটি এখন কার্যত তিনটি অংশে ভাগ হয়ে গেছে। ইরাকের পর যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী টার্গেট ছিল লিবিয়া। লিবিয়া আক্রমণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল হিউম্যানিটারিয়ান ইন্টারভেনশন তত্ত্ব। তথাকথিত মানবিক বিপর্যয়ের কথা বলে গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হয়েছিল। এরপর পুরো লিবিয়া সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব নেই। গাদ্দাফির সময়কার পরিস্থিতির চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি অনেক খারাপ। সেখানে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে আর সেখানে হিউম্যানিটারিয়ান ইন্টারভেনশন তত্ত্ব ব্যবহার করতে দেখিনি। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট ছিলেন সিরিয়ার আসাদ। আসাদের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল, তিনি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করছেন। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়ায় একটি সামরিক হামলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একটি সমঝোতা এবং সিরিয়া তার কাছে সংরক্ষিত সব ধরনের রাসায়নিক অস্ত্র আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে ধ্বংস করার প্রতিশ্র“তি দিলে শেষ অব্দি সেখানে যুদ্ধ এড়ানো গেছে। কিন্তু ২০১৪ সালে হঠাৎ করে সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামক একটি জঙ্গি সংগঠনের উত্থান পুরো দৃশ্যপট বদলে দেয়। অনেক পর্যবেক্ষকই বলার চেষ্টা করেছেন, আইএসের উত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে। এমনকি ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থাও এর সঙ্গে জড়িত বলে অনেকে মনে করেন। ফলে সিরিয়ার ব্যাপারে মার্কিনি স্বার্থ স্পষ্ট নয়।সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যখন একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখছে, ঠিক তখনই এলো একটি উদ্বেগজনক সংবাদ। ডাচ অনুসন্ধানকারী দল জানিয়েছে, গেল বছর ইউক্রেনের আকাশে যে মালয়েশিয়ান বিমানটি ভেঙে পড়েছিল এবং তাতে ২৯৫ জন আরোহী প্রাণ হারিয়েছিল, তা রাশিয়ার মিসাইল হামলার শিকার হয়েছিল। এ প্রতিবেদন নিঃসন্দেহে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটাবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা অনেকদিন ধরেই লক্ষ করছেন, এ দুই বৃহৎ শক্তির মাঝে এক ধরনের আস্থাহীনতার সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক বর্তমান পরিস্থিতিতে স্নায়ুযুদ্ধকালীন ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। পাঠক স্মরণ করতে পারেন ক্রিমিয়ার গণভোট (২০১৪) এবং রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তি-পরবর্তী পরিস্থিতির কথা। ইউক্রেনে একটি রুশপন্থী সরকারকে উৎখাতের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের ষড়যন্ত্র এবং সরকার উৎখাতের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ক্রিমিয়ার রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তির পরই ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং সীমান্তে রাশিয়ার সেনা মোতায়েনের ঘটনা ঘটে। পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করেছিল রাশিয়া। এরপর একপর্যায়ে রাশিয়া ইউক্রেনে তাদের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। কার্যত ইউক্রেনের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল একটি প্রক্সি ওয়ারের- যার একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে রাশিয়া।সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যায়, স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর পূর্ব ইউরোপে যে ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটেছে, তাকে কেন্দ্র করেই এ অঞ্চলে উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরে চাচ্ছে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দুটি দেশ জর্জিয়া ও ইউক্রেন ন্যাটোর পূর্ণ সদস্য হোক। একসময় এ দেশ দুটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদি জর্জিয়া ও ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয়, তাহলে এ দেশ দুটিতে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা যাবে। ফলে চাপের মুখে রাখা যাবে রাশিয়াকে। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার জ্বালানি সম্পদ (গ্যাস), যার ওপর ইউরোপ অনেকটা নির্ভরশীল, তার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এখানে ২০০৮ সালে রাশিয়ার সঙ্গে জর্জিয়ার সীমিত যুদ্ধের (ওসেটিয়া প্রশ্নে) কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কৃষ্ণ সাগরের অপর পাশের দেশগুলো (বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড ও রুমানিয়া) এরই মধ্যে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। তুরস্ক ও গ্রিস আগে থেকেই ন্যাটোর সদস্য। জর্জিয়া ও ইউক্রেন এখনও ন্যাটোতে যোগ দেয়নি। তাই ইউক্রেনে একটি পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। তাই রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচের উৎখাতের প্রয়োজন ছিল। ২০১০ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হলেও গণঅভ্যুত্থানে তিনি উৎখাত হন। অভিযোগ আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই অভ্যুত্থানের পেছনে মদদ জুগিয়েছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্রসমর্থিত একটি সরকার ইউক্রেনে ক্ষমতায় রয়েছে।এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ক্রিমিয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা ইউরোপ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তিনটি পাইপলাইন- নর্ড স্ট্রিম, বেলারুশ আর ইউক্রেন লাইনে এ গ্যাস রাশিয়া সরবরাহ করে পূর্ব তথা পশ্চিম ইউরোপে। যদি সংকট আরও গভীরতর হয়, তাহলে রাশিয়া এ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। যদিও রাশিয়ার বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই গ্যাস (পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্যাস রিজার্ভ রাশিয়ায় অবস্থিত)। মজার কথা, বেলারুশ আর ইউক্রেন আবার রাশিয়ার গ্যাস নিয়ে নিজেরা রিজার্ভ গড়ে তুলছে। তারা এই গ্যাস পশ্চিম ইউরোপে বিক্রি করে। ২০০৯ সালে এই গ্যাস বিক্রির বিষয়টি নিয়ে বেলারুশের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল এবং একপর্যায়ে রাশিয়া বেলারুশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। ওই পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা গ্যাস ওয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই এ অঞ্চলে এক ধরনের প্রক্সি ওয়ার চলছে। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইলেও রাশিয়া তথাকথিত এই নিরাপত্তাকে দেখছে তার নিজের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে। অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এই পরিস্থিতিকে স্নায়ুযুদ্ধ-২ নামেও অভিহিত করেছেন।এখন ইউক্রেনের পরিস্থিতির যখন শান্তিপূর্ণ কোনো সমাধান হয়নি, তখনই রাশিয়া সিরিয়া সংকটে নিজেকে জড়িত করল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান হামলাকে সহজভাবে নেয়নি। গত দুসপ্তাহে রাশিয়ার বিমান হামলায় তাদের ব্যয় হয়েছে ৮৭ মিলিয়ন ডলার। লন্ডনের রয়েল ইউনাইটেড সার্ভিস ইন্সটিটিউটের মতে, প্রতিদিনের বিমান হামলার পেছনে খরচ হচ্ছে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। সুতরাং প্রশ্ন একটা থাকলই- কতদিন এই বিমান হামলা রাশিয়া অব্যাহত রাখতে পারবে? তবে এ বিমান হামলায় বেশ সফলতা পাওয়া গেছে। আইএসের শক্তি অনেক খর্ব হয়েছে, যা মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট পারেনি। রাশিয়া চীনকেও তার পাশে পেয়েছে। ভারতের অবস্থান স্পষ্ট না হলেও ভারত এক্ষেত্রে এক ধরনের নীরবতা পালন করবে। এ বিমান হামলার ঘটনায় নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের বিষয়টি আবার সামনে চলে এলো।ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিবাদকে উৎখাতের ব্যাপারে তত্ত্বগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অবস্থান এক হলেও রাশিয়ার জড়িত হওয়ার বিষয়টি মানতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব থেকে বোঝা যায়, তাদের মূল টার্গেট আসাদ সরকারকে উৎখাত করা, আইএসকে উৎখাত করা নয়। স্পষ্টতই সিরিয়ায় উত্তেজনা থেকেই গেল। সিরিয়ায় যুদ্ধ আপাতত বন্ধ হবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। তবে একটা কথা বলাই যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের যে চিড় ধরেছিল, তা আরও বড় হল। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বে উত্তেজনা বাড়বে বৈ কমবে না। Daily Jugantor 19.10.15

ভি২০ জোট এবং জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা প্রসঙ্গ


বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে কটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মাঝে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় পারস্পরিক সহযোগিতার অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ সম্প্রতি যোগ দিয়েছে নতুন একটি জোট ভি২০, অর্থাৎ ‘ভালনারেবল টুয়েন্টি’তে। এই জোটে ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল, আফগানিস্তানের পাশাপাশি বার্বাডোজ, কোস্টারিকা, ইথিওপিয়া, ঘানা, কেনিয়া, কিরিবাতি, টুভালু কিংবা ভাথুয়ানুর মতো দেশও রয়েছে। দেশগুলো গরিব। কোনো কোনো দেশ সাগরবেষ্টিত, কোনোটা আবার পাহাড়বেষ্টিত। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যে প্রযুক্তি ও অর্থের দরকার, এসব দেশের তা নেই। সম্প্রতি পেরুর রাজধানী লিমায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর যে বার্ষিক সভা শেষ হয়, সেখানে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের উপস্থিতিতে এই জোট গঠন করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের অনুন্নত এবং উন্নত সব দেশই আজ ঝুঁকির মুখে। এ ক্ষেত্রে মালদ্বীপ কিংবা বাংলাদেশের মতো দেশের ঝুঁকির পরিমাণ বেশি। তবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বের দেশগুলো নানা গ্রুপে বিভক্ত এবং তাদের স্ট্র্যাটেজিও ভিন্ন ভিন্ন। গ্রুপ-৭৭-এ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ১৩০টি দেশ। বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ এখানে বসবাস করে এবং বিশ্ব জিডিপির ১৯ ভাগ এরা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এই দেশগুলো বায়ুম-লে কার্বন নিঃসরণ করে বায়ুম-লে নিঃসরণকৃত মোট কার্বনের ৪২ ভাগ। চিন অন্যতম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ (২১ ভাগ), অথচ বিশ্ব জিডিপির ৬ ভাগ তাদের এবং বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগ চিনের। ধনী দেশগুলো এনেক্স-১ অন্তর্ভুক্ত দেশ, কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ৫১ ভাগ, অথচ বিশ্ব জনসংখ্যার ১৯ ভাগ তাদের, আর জিডিপির ৭৫ ভাগ তাদের নিয়ন্ত্রণে। যুক্তরাষ্ট্র এককভাগে শতকরা ২০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে, ৩০ ভাগ জিডিপি তাদের আর বিশ্ব লোকসংখ্যার মাত্র ৫ ভাগ তাদের। এর বাইরে আফ্রিকান ইউনিয়নভুক্ত ৩৯ দেশ, তেল ও গ্যাসসম্পদসমৃদ্ধ ওপেকভুক্ত দেশ এবং বনসম্পদসমৃদ্ধ ‘রেইনবো কোয়ালিশন’ভুক্ত দেশগুলোর অবস্থান আলাদা আলাদা। মোটামুটিভাবে সবাই এটা স্বীকার করে  যে, তারা বায়ুম-লে কার্বন নিঃসরণের হার কমাবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র, চিন ও ভারত কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে। ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ করেছিল (চিন করেছিল ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন টন), সেখানে ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিঃসরণের পরিমাণ ছিল ৬ মিলিয়ন টন (চিনের ৬ বিলিয়ন টনের ওপরে)। এখন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ২০২০ সালের মধ্যে তারা কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমাবে ১৭ থেকে ২০ ভাগ। চিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ ভাগ কমানোর। আর ভারতের প্রতিশ্রুতি ২০ ভাগ কমানোর। দেশগুলো এই প্রতিশ্রুতি কতটুকু রাখতে পারবে, এটাই বড় প্রশ্ন এখন।
বাংলাদেশের ঝুঁকির প্রসঙ্গটি বিশ্ব মিডিয়ায় অনেকবারই এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতরে বিষয়টি তেমন গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়নি। অনেকে স্মরণ করতে পারেন চলতি বছরের প্রথম দিকে অনেকটা অজান্তেই খুলনায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল তিনদিনব্যাপী জলবায়ু উদ্বাস্তু সংক্রান্ত একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের একটি সম্মেলনের যথেষ্ট গুরুত্ব থাকলেও মিডিয়ায় সম্মেলন সংক্রান্ত খবরাদি আমার চোখে পড়েনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংগঠন ‘ব্যানসেন ইনিশিয়েটিভ’-এর সহযোগিতায় ওই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। আর এতে অংশ নেয় দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরভুক্ত ১৪টি দেশের সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। খুলনায় এ ধরনের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য নিঃসন্দেহে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে। আর বাংলাদেশের যেসব এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মাঝে রয়েছে বৃহত্তর খুলনা এলাকা। ‘সিডর’ ও ‘আইলায়’ ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলো এ এলাকাতেই অবস্থিত। এই অঞ্চলের মানুষ আজও ঘূর্ণিঝড় ‘সিডির’ ও ‘আইলা’র বিপর্যয় থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি।
পাঠক এখানে গত ডিসেম্বরে পেরুর রাজধানী লিমায় অনুুষ্ঠিত হওয়া কপ-২০ (কমিটি অন দ্য পার্টিস) সম্মেলনের কথা স্মরণ করতে পারেন।
নিঃসন্দেহে লিমা ঘোষণা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। তবে প্রশ্ন থাকলই। উন্নত বিশ্ব শেষ পর্যন্ত প্যারিস চুক্তিতে (২০১৫)  স্বাক্ষর করে কিনা এর জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে কংগ্রেসের সাথে প্রেসিডেন্টের দ্বন্দ্বের আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত লিমা ঘোষণার ব্যাপারে কোনো আপত্তি তোলে কিনা, সেটাই দেখার বিষয় এখন। তবে আগামী এক মাস এ নিয়ে বেশ দেনদরবার হবে। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলো আন্তর্জাতিক আসরে দেনদরবার করবে। জাতিসংঘ উদ্যোগী হবে। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের করার কিছুই নেই। কেননা উন্নত বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যদি রাজি না হয়, তাহলে প্যারিস সম্মেলনে শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তিতে উপনীত হওয়া সম্ভব হবে না। এ জন্যই খুলনা সম্মেলনের গুরুত্ব রয়েছে। সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ আগামী নভেম্বর মাসের শেষে অনুষ্ঠিত ‘কপ’ সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে। খুলনা ঘোষণায় বলা হয়েছেÑ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের বাস্তুÍচ্যুতি একটি নির্মম সত্য। এই সমস্যা মোকাবিলায় স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে হবে। বাস্তুচ্যুতি ঠেকাতে এবং অগত্যা বাস্তুÍচ্যুতদের সহযোগিতার লক্ষ্যে দেশীয় পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী তথা ধনী ও উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন। এ ছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নীতিমালা তৈরি করা একান্ত জরুরি। এ ছাড়া বাস্তুচ্যুত অভিবাসীদের সুরক্ষার জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যারা উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন, তাদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে তেমন কোনো কর্মকা- পরিলক্ষিত হয়নি। বাংলাদেশ এ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করেছে বলেও আমার জানা নেই। অথচ দ্বীপাঞ্চল থেকে মানুষ প্রতিদিনই উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে এবং বড় বড় শহরে আশ্রয় নিয়ে এবং বস্তিজীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ তার পারিবারিক পেশা ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ এদের পুনর্বাসনের কোনো  সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। বাংলাদেশ বারবার আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেলেও, বাংলাদেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয় কিংবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যারা চালান, তারা কতটুকু সচেতন, সে ব্যাপারে  আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অতিসম্প্রতি একটি শঙ্কার কথা আমাদের জানিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবি। বাংলাদেশ এই জলবায়ু পরিবর্তনে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এডিবির রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এডিবি জানিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ করে কম হতে পারে। আর চলতি শতাব্দী শেষে এই ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৯ শতাংশ। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এডিবির উক্ত রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটো দেশ নেপাল ও মালদ্বীপের ক্ষতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯ আগস্ট (২০১৪) ঢাকায় এডিবির এই রিপোর্টটি উপস্থাপন করা হয়েছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শুধু এডিবির রিপোর্টেই নয়, বরং জাতিসংঘের রিপোর্টেও এই ক্ষতির দিকটি উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতিবছরই জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা কপ বা ‘কমিটি অব দ্য পার্টিস’ নামে পরিচিত, সেখানেও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা উঠে আসে। বাংলাদেশের যারাই পরিবেশমন্ত্রী থাকেন, তারা ঘটা করে ‘কপ’  সম্মেলনে যান। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইতোমধ্যে নাসা আরও একটি আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। নাসা আশঙ্কা করছে গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে, তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তাই কার্বন ডাইঅক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। আল গোর তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ  করেছিলেন বিশ্বের বৃহত্তম বন্দরগুলোয় ইতোমধ্যে ৪ কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর বিশ্বের ১০৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে (বাংলাদেশের সাবেক বনমন্ত্রী হাসান মাহমুদও ছিলেন ওই দলে) গিয়েছিলেন এন্টার্কটিকায়Ñ শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় এখনো নীরব। প্রতিবছরই ‘কপ’ সম্মেলনে ভালো ভালো কথা বলা হয়।  কোপেনহেগেন থেকে লিমা সম্মেলনÑ বলা হয়েছিল ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ব কার্বন নিঃসরণ কমাতে একটি চুক্তি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা শুরু হলেও বাংলাদেশ কী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত লিমা সম্মেলনে বলা হয়েছিল আগামী ৬ মাসের মধ্যে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রতিটি দেশ নিজস্ব কর্মপদ্ধতি ও কাঠামো উপস্থাপন করবে। প্রতিটি দেশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করার। অর্থাৎ তারা নিজেরাই কার্বন নিঃসরণ কমানোর পন্থা বের করবে। প্রশ্নটা এখানেই। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে একটি কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করেছে, কিন্তু এ নিয়ে স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা হয়নি। আমাদের আমলারা বিদেশে ‘ভ্রমণে’ যেতে পছন্দ করেন। সম্মেলনে যোগ দিয়ে যে ‘হাতখরচ’ পাওয়া যায়, তা নিয়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন তারা। দেশে ফিরে এসে ‘ভুলে’ যান সব কিছু!
খুলনা সম্মেলনে আমাদের পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহীদুল হক বলেছিলেন, শুধু ২০০৮-২০১৩ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৪ কোটি ৬ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে (কালের কণ্ঠ, ৬ এপ্রিল)। তখন তার এই বক্তব্যে আমি তাকে সাধুবাদ দিতে পারিনি। কেননা জলবায়ু কূটনীতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে সফল, তা তারা দাবি করতে পারে না। পত্রপত্রিকা থেকে দেখেছি, বাংলাদেশ লিমা সম্মেলনের আলোকে অতিসম্প্রতি একটি ‘কর্মপরিকল্পনা’  জমা দিয়েছে। এতে শতকরা ১৫ ভাগ কার্বন নিঃসরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু যদি বিনিয়োগ না আসে, যদি প্রযুক্তি সহায়তা না পাওয়া যায়, তাহলে ওই প্রতিশ্রুতি কাগজ-কলমেই থেকে যাবে। তাই ভি২০ জোটে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ তার স্বার্থ কতটুকু আদায় করতে পারবে, এ প্রশ্ন থাকলই। 
Daily Amader Somoy
17.10.15

জাতিসংঘ কি আরো ৭০ বছর টিকে থাকতে পারবে

জাতিসংঘ যখন তার ৭০ বছর পূর্তি পালন করছে তখন অনেক পর্যবেক্ষক এ প্রশ্নটিই তুলেছেন যে জাতিসংঘ কি আরো ৭০ বছর টিকে থাকতে পারবে? বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থতা, ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে পার্থক্য দূর করা, মধ্যপ্রাচ্যে উগ্রপন্থী রাজনীতির বিকাশ, বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি জাতিসংঘে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পশ্চিমা শক্তি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা রোধ করার ব্যর্থতা একুশ শতকে জাতিসংঘের ভূমিকাকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন ফোরামে এটি বারবার বলা হচ্ছে যে জাতিসংঘ উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। জলবায়ু পরিবর্তনে সাগরপারের দেশগুলো বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকলেও জাতিসংঘ বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে যখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসে তখন এ প্রশ্নটিই ঘুরেফিরে আলোচিত হতে থাকে যে জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? বলতে দ্বিধা নেই উন্নত বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ ক্ষমতাধর পাঁচটি দেশ তাদের নিজেদের স্বার্থেই জাতিসংঘকে টিকিয়ে রাখছে। তবে এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ১৯৪৫ আর ২০১৫ এক নয়। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো শহরে যে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়েছিল, এত দিনে তার কর্মপরিধি বেড়েছে। ১৯৪৫ সালে মাত্র ৫০টি দেশ নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজকে তার সদস্য সংখ্যা ১৯৬টি। জাতিসংঘ যে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না, এ অভিযোগ অনেক পুরনো। তবে জাতিসংঘের সাফল্য যে একেবারে নেই, তা বলা যাবে না। ১৯৯০ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ ও কুয়েতকে শত্রুমুক্ত করা, এল সালভাদর, কম্বোডিয়া কিংবা নামিবিয়ায় পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া ও শান্তি ফর্মুলায় রাজি করানোর মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠছে, তাতে জাতিসংঘের একটা ভূমিকা রয়েছে। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার গৃহযুদ্ধ থামাতে সেখানে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো, কম্বোডিয়ায় গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে সেখানে জাতিসংঘ বাহিনী মোতায়েন এবং পরবর্তী সময়ে সেখানে একটি সুষুম নির্বাচন সম্পন্ন করা, এমনকি নেপালেও নির্বাচন আয়োজনে সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ তার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে আফ্রিকায় যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করার মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি উদ্যোগও লক্ষণীয়। তবে ব্যর্থতার পাল্লাটা যেন ভারী। অতি সম্প্রতি হাজার হাজার সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থী যখন ইউরোপে প্রবেশ করে এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, জাতিসংঘ এদের দেশত্যাগ ঠেকাতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে আফগানিস্তানে হামলা চালানো এবং যে যুদ্ধের শুরু করেছিল, জাতিসংঘ দীর্ঘ ১৪ বছর পরও সেই যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই ইরাক দখল করে নিয়েছিল ও সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করেছিল, যা ছিল জাতিসংঘ চার্টারের বরখেলাপ। ২০১১ সালে তথাকথিত 'মানবাধিকার রক্ষায় হস্তক্ষেপ'- এই অভিযোগ তুলে লিবিয়ায় বিমান হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। ওই হামলায় গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং রাষ্ট্রটি এখন কার্যত একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অস্ত্রবাজরা এখন সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসন নেই। অথচ একই অভিযোগ উঠেছে সিরিয়ার একটি অংশ ও ইরাকের একটি অংশ নিয়ে গড়ে ওঠা তথাকথিত একটি অলিখিত জিহাদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যার নেতৃত্বে রয়েছে সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা। অভিযোগ আছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি লবির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে এই জঙ্গিগোষ্ঠী 'ইসলামিক স্টেট'-এর উত্থান ঘটেছে। এরা হাজার হাজার সিরীয় নাগরিককে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করছে। অথচ এখানে তথাকথিত 'মানবাধিকার রক্ষায় হস্তক্ষেপ'-এর তত্ত্ব প্রয়োগ করছে না যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি জাতিসংঘের কোনো উদ্যোগও আমরা লক্ষ করছি না। জাতিসংঘের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদ বৃদ্ধিতে শক্তিশালী কোনো উদ্যোগ নেই। স্থায়ী পরিষদে রয়েছে পাঁচটি দেশ (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও রাশিয়া)  ও ১৫টি অস্থায়ী দেশ। অস্থায়ী দেশগুলো দুই বছর পর পর অঞ্চল ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়। কিন্তু স্থায়ী পরিষদের একটি রাষ্ট্র 'ভেটো' প্রয়োগ করে যেকোনো সিদ্ধান্তের মৃত্যু ঘটাতে পারে। কিন্তু অস্থায়ী সদস্য দেশগুলো তেমনটি পারে না। তাই অনেক দিন থেকেই উন্নয়নশীল বিশ্ব স্থায়ী পরিষদে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু আজও তা নিশ্চিত হয়নি। তবে অনেকেই স্মরণ করতে পারেন জাতিসংঘের উদ্যোগে অনেক আগেই Commission on Global Governance নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জাতিসংঘে কিভাবে সংস্কার আনা যায় সে ব্যাপারে একটি সুপারিশ করা। সিদ্ধার্থ রামপাল ও ইন্যাভার কার্লসন ছিলেন ওই কমিশনের যৌথ চেয়ারম্যান। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসে কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। ওই কমিশনের সুপারিশে নিরাপত্তা পরিষদে এক ধরনের 'স্ট্যান্ডিং' সদস্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল, যার সদস্য সংখ্যা হবে পাঁচ। এর মধ্যে দুটি দেশ আসবে উন্নত দেশ থেকে, আর বাকি তিনটি দেশ আসবে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা থেকে। কিন্তু তাদের কোনো 'ভেটো' ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু দীর্ঘ ২০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলো ভেটো ক্ষমতাসহ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য পদ চায়। যেমন ভারতের কথা বলা যেতে পারে। ভারত এখন এশিয়ায় চীনের পর দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ। দুই ট্রিলিয়ন ডলারের (দুই লাখ কোটি ডলার) অর্থনীতি ভারতের। ভারতের পাশাপাশি জাপানও এখন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হতে চায়। এ লক্ষ্যে জাপানের সংবিধান সংশোধন করে এই প্রথমবারের মতো বিদেশে জাপানি সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর এবং পাঁচটি পশ্চিমা শক্তির সমর্থন এতে পাওয়া যাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হলেও ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে মূল আলোচনা শুরু হয়ে চলে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন ৩০ সেপ্টেম্বর। এবার প্রধানত দুটি কারণে এই অধিবেশনের গুরুত্ব বেশি ছিল। এক. এই অধিবেশনে এসডিজি বা Sustainable Development Goals কর্মসূচি অনুমোদিত হয়েছে। এর আগে এমডিজি বা Millenium Development Goals নামে যে কর্মসূচি জাতিসংঘ গ্রহণ করেছিল, তা এই ২০১৫ সালেই শেষ হয়ে যায়। এ জন্যই প্রয়োজন ছিল এসডিজি কর্মসূচি গ্রহণ করার। দুই. আগামী নভেম্বরে প্যারিসে বসছে CoP-21 সম্মেলন। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে প্যারিসে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার কথা। চলতি অধিবেশনে এ ব্যাপারে একটি সুপারিশ থাকবে। বাংলাদেশের জন্য এ দুটি বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দুটি পুরস্কার গ্রহণ করেছেন চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন কর্তৃক প্রবর্তিত আইসিটি পুরস্কার। বাংলাদেশের জন্য দুটি পুরস্কারের গুরুত্ব অনেক। বাংলাদেশের জন্য এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চ্যালেঞ্জও বটে। এখানে বলা ভালো, এমডিজি বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (২০১৫ সালে শেষ হয়ে যাবে) অর্জনের পর জাতিসংঘ প্রণয়ন করেছে এসডিজি, যা চলতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অনুমোদিত হয়েছে। এমডিজি অর্জনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে (মোট আটটি ক্ষেত্রে) বাংলাদেশের সফলতার যে চিত্র অতি সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা যায় দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা হয়েছে ২৪.৫ শতাংশে। প্রাথমিক শিক্ষার হার এখন ৮১ শতাংশ। শিশুমৃত্যুর হার (প্রতি হাজারে) যেখানে ছিল ১৪৬ (১৯৯০ সালে), সেখানে এখন তা ৪৬-এ। অর্থাৎ এমডিজির আটটি ক্ষেত্রের অনেকটিতে বাংলাদেশ সফল হয়েছে। এখন এসডিজি অর্জনের পালা। উল্লেখ্য, এসডিজির নির্ধারিত ১৭টি এজেন্ডার মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্যের হার বিলোপ, ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী, সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ, গুণগত শিক্ষা, নারী-পুরুষের সমতা, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যবিধান, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ইত্যাদি। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা এমডিজির ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলো তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ০.৭ শতাংশ সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পাওয়া গিয়েছিল মাত্র ০.৪ শতাংশ। তা-ও আবার ধনী দেশগুলো দিয়েছিল তাদের জিডিপির মাত্র ০.২ শতাংশ। ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল যে এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে সাহায্য দরকার হবে, তা পাওয়া যাবে কি না? না পেলে বাংলাদেশ কেন, কোনো অনুন্নত দেশই এসডিজির লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা হবে তাই গুরুত্বপূর্ণ। এসডিজির পাশাপাশি প্যারিসে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু আলোচনা শীর্ষক CoP-21 (Committee of parties-21) নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে চলতি অধিবেশনে। CoP-21 আলোচনাটি প্যারিসে অনুষ্ঠিত হবে ৩০ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে একটি ঐকমত্যে পৌঁছলেও ধনী দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। জাতিসংঘের মতে, কার্বন হ্রাসের মাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনতে হবে। এ ব্যাপারে প্যারিসে একটি চুক্তি হতে হবে। না হলে অনুন্নত দেশগুলো, বিশেষ করে সাগরপারের দেশগুলোর জন্য খারাপ সংবাদ অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের জন্য প্যারিস সম্মেলন তাই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকে দায়ী করা হয়। আর এ জন্য দায়ী শিল্পোন্নত পশ্চিমা বিশ্ব। বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশ এর জন্য দায়ী নয়। উন্নত বিশ্বের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশ্ব জিডিপির ৭৫ শতাংশ, আর তারা কার্বন নিঃসরণ করে ৫১ শতাংশ। বাংলাদেশ এসব উন্নত বিশ্বের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের মানুষ অন্যত্র বিশেষ করে ঢাকা শহরে বস্তিতে বসবাস করতে শুরু করেছে। গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে প্রতি সাতজনে একজন মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেনের কপ সম্মেলনে এসব উদ্বাস্তু মানুষকে Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু এ দাবি গ্রহণযোগ্য হয়নি। জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য, টেকনোলজি ট্রান্সফার ইত্যাদি প্রশ্নে কোনো কমিটমেন্ট পাওয়া যায়নি। ফলে প্যারিস সম্মেলন নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা থেকেই গেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু সমস্যার কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে, তা বিশ্ব সভায় তুলে ধরেছেন। জাতিসংঘ ৭০ বছরে পা দিয়েছে। সময়টা একেবারে কম নয়। প্রতিবছর একটি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করে আমরা অনেক ভালো ভালো কথা শুনি বটে; কিন্তু তা উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো মঙ্গল ডেকে আনতে পারেনি। বরং সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে গেছে, প্রাচীন ঐতিহ্য নষ্ট করা হয়েছে কিংবা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; কিন্তু জাতিসংঘ তা বন্ধ করতে পারেনি। শিশু আয়লান কুর্দির মতো শত শত শিশুর জীবন রক্ষা করতেও পারেনি জাতিসংঘ। তাই আগামী ৭০ বছর অর্থাৎ ২০৮৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ টিকে থাকতে পারবে- এটা নিশ্চিত হতে পারছি না। Daily Kaler Kontho 13.10.15

জঙ্গি উত্থান, বৈশ্বিক সম্পর্ক ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

হঠাৎ করেই যেন অনেকগুলো ঘটনা একের পর এক ঘটে গেছে দেশে। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরের আগেই প্রশ্ন তোলা হল নিরাপত্তার। বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের নিরাপত্তা দল যখন ঢাকায় এলো, ঠিক তখনই ঢাকায় খুন হলেন এক ইতালিয়ান নাগরিক। এর ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় রংপুরে খুন হলেন একজন জাপানি নাগরিক। সারা দেশের মানুষ যখন এ দুটি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে এক ধরনের উদ্বেগের মাঝে ছিল ঠিক তখনই পুলিশ চট্টগ্রাম থেকে গ্রেনেডসহ গ্রেফতার করল জঙ্গিগোষ্ঠী জেএমবির পাঁচ সদস্যকে। একজন আবার গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মারাও গেলেন। প্রায় একই সময় ঈশ্বরদীতে খ্রিস্টান ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ধর্মপ্রচারক লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। তিনি বেঁচে যান। কিন্তু বাঁচতে পারেননি ঢাকায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ খিজির খান, আর ঈশ্বরদীতে কর্তব্যরত একজন পুলিশ সদস্য সুজাউল ইসলাম। এগুলো কি সব একই সূত্রে গাঁথা? বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার একটি চেষ্টা? চলতি সপ্তাহে প্রতি রাতেই বিভিন্ন টিভি টকশোতে আলোচনার বিষয় ছিল এ হত্যাকাণ্ড তথা জঙ্গি উত্থান। দুজন বিদেশীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে চট্টগ্রামে জেএমবির আস্তানা থেকে গ্রেনেড উদ্ধার ও শীর্ষ জেএমবি কমান্ডারের মৃত্যুর কোনো যোগসূত্র আছে কি-না বলতে পারব না; তবে দুজন বিদেশী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যে জঙ্গি কানেকশন আছে, এটাই এখন প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি করে। তবে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিদেশী জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) যোগসূত্র রয়েছে বলে অভিযোগ উঠলেও তা প্রমাণিত নয়। ঝওঞঊ নামে একটি জিহাদ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা, যাদের সঙ্গে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তারা ইতালিয়ান নাগরিককে হত্যার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ সংবাদটি প্রচার করলেও আইএস নিজে ভিডিও টেপের (যা সাধারণত তারা করে) মাধ্যমে সিজারি তাভেল্লার হত্যাকাণ্ডের কথা প্রচার করেনি। এমনকি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা তথা একাধিক কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স গ্র“পের পক্ষ থেকে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আইএসের সম্পর্ক থাকার প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচিত তাদের গোয়েন্দা কার্যক্রমের কারণে। তারাও বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছে, এমন তথ্যও আমাদের জানা নেই। তবে ৬ অক্টোবর একটি ভারতীয় সংবাদপত্র ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে আমাদের জানাচ্ছে যে, বিদেশী নাগরিকদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জামায়াতের একটি অংশ জড়িত রয়েছে।আসলে বিদেশী দুই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কারা জড়িত, তা এখন অব্দি প্রমাণিত না হলেও কতগুলো প্রশ্ন কিন্তু সামনে চলে এসেছে। এক. যেখানে নিরাপত্তা শংকার কথা আগেই বলেছিল যুক্তরাষ্ট্র, সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন সতর্কতা অবলম্বন করল না? দুই. মার্কিন রাষ্ট্রদূত যে বলেছেন, আইএসের উত্থান ঠেকাতে যৌথ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ, তা কোনো ইঙ্গিত বহন করে কি-না? তিন. সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশীদের আশ্বাস ও নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলা হলেও বিদেশীরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তারা নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছেন। এমনকি তৈরি পোশাক ক্রেতাদের সংস্থা বায়ার্স ফোরামের সভাও স্থগিত করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কি তৈরি পোশাক রফতানিতে ভাটা পড়বে? জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হবে? এ ঘটনা কীভাবে বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা এ মুহূর্তে স্পষ্ট করে বলা না গেলেও এটা ঠিক, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান এখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সংযোজিত নতুন একটি অধ্যায়!আমি দীর্ঘদিন ধরে মিডিয়ায় বলার চেষ্টা করছি, দেশে তথাকথিত চরমপন্থী জঙ্গি উত্থানের সম্ভাবনা ক্ষীণ। পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে যে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের তথাকথিত জঙ্গিদের মেলানো যাবে না। বাংলাদেশে কিছু উগ্রপন্থী সংগঠনকে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সরকারিভাবেও এদের জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেমন-আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিজবুত তাহরির, হরকাতুল জিহাদ, জামাআতুল মুজাহিদীন, জাগ্রত মুসলিম জনতা, শাহাদাত আল হিকমা। টিভিতে আমার সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে অনেককে বলতে শুনেছি, আল কায়দা অথবা ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের মিল আছে এবং তাদের সহযোগী মিত্র হিসেবে বাংলাদেশের জঙ্গিরা কাজ করছে। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়া সিনিয়র অফিসারদের কেউ কেউ যখন প্রকাশ্যে মিডিয়ায় এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন সাধারণ মানুষ ওই সব মন্তব্য বিবেচনায় না নিয়ে পারে না। সাধারণ মানুষ এসব কথা বিশ্বাস করে। বিদেশী দূতাবাস, গবেষণা সংস্থা এসব বক্তব্য গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র ও বাণিজ্যবিষয়ক অধিদফতর যদি ওই সব বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে থাকে, তাহলে আমরা তাদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারব না। তাই বলে আমি বলছি না বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি নেই। দেশে যারা ওই সব চরমপন্থী রাজনীতি ধারণ করে, তাদের সংখ্যা কম। তারা বিভ্রান্ত। সাধারণ মানুষের মধ্যে এদের কোনো প্রভাব নেই। এটা সত্য, আমাদের সমাজেই শায়েখ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের মতো সন্ত্রাসীর জন্ম হয়েছিল। একসময় (২০০৫) সারা দেশে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে তারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল। ২১ আগস্ট বোমা ফাটিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হত্যা করতে চেয়েছিল। এরা সন্ত্রাসী। কিন্তু এরা যে আদর্শ লালন করে, এ দেশে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। আল কায়দার বর্তমান নেতা জাওয়াহিরি ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত-বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে আল কায়দার শাখা গঠন করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আল কায়দা যেভাবে তাদের অপারেশন পরিচালনা করে (যেমন- ইয়েমেন ও ইরাকে), বাংলাদেশে সেভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা হতে এখনও আমরা দেখিনি। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে পরিচিত আল কায়দার বাংলাদেশে কোনো শাখা আছে- এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। যারা সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন আল কায়দার তাত্ত্বিক হচ্ছেন আবু মুসাব আল সুরি। সুরি আল কায়দার স্ট্র্যাটেজির কথা বলতে গিয়ে Spider Web-এর কথা বলেছেন। অর্থাৎ মাকড়সারা যেমন এখানে-সেখানে জাল তৈরি করে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে এবং সেই জাল ভেঙে দিলে অন্যত্র গিয়ে একইরকম জাল তৈরি করে, আল কায়দার স্ট্র্যাটেজিও ঠিক তেমনি। ছোট ছোট গ্রুপে অঞ্চল ভিত্তিতে তারা সংগঠিত হয় এবং তাদের ওপর আক্রমণ হলে তারা অন্যত্র গিয়ে সংগঠিত হয়, ঠিক মাকড়সারা যেমনটি করে। Al-Qaeda in Arabian Peninsula, Al-Qaeda in Islamic Magreb, Al-Qaeda in Iraq এভাবেই সংগঠিত। এর বাইরে তারা ভিন্ন নামেও অপারেট করে। যেমন আল নুসরা ফ্রন্ট (সিরিয়া), আল গামা আল ইসলামিয়া। এ দুটো সংগঠনের সঙ্গে আদর্শগতভাবে আল কায়দার মিল আছে।এখানে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গি সংগঠনটির কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। আল কায়দার সঙ্গে আইএসের আদর্শগতভাবে অমিল রয়েছে। আল কায়দা যেখানে শরিয়াভিত্তিক ইসলামী শাসন চায়, সেখানে আইএস চায় একটি ইসলামী খিলাফত। অর্থাৎ একটি খিলাফত রাষ্ট্রের আওতায় সব মুসলিম রাষ্ট্র একত্রিত হবে। সেখানে একজন খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান থাকবেন। আল কায়দার সঙ্গে পার্থক্য এখানেই যে, আল কায়দা খিলাফতের পরিবর্তে ইসলামিক আমিরাতে বিশ্বাসী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ উপমহাদেশে আল কায়দা কি আদৌ স্থান করে নিতে পেরেছে? ভারতে এর কোনো স্থান নেই। পাকিস্তানে তালেবানদের প্রভাব বেশি, আল কায়দা তার শাখা স্থাপন করতে পেরেছে, এমন খবর আমাদের জানা নেই। তবে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকতে পারে। আর বাংলাদেশে তাদের আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই। বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে যারা পরিচিত তাদের সঙ্গে আল কায়দার যোগাযোগ আছে, এমন কোনো তথ্যভিত্তিক প্রমাণও আমাদের কাছে নেই। ফলে বাংলাদেশে বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে, এটা ঠিক নয়। তাহলে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ দেখানোর অর্থ কী ছিল? এর আগে অনেক বিদেশী ক্রিকেট টিম বাংলাদেশ সফর করে গেছে। তখন তো এ প্রশ্ন তোলা হয়নি? এখন তাহলে তোলা হল কেন? সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, যাতে করে তা বিদেশীদের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে বলেছিলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। এটাই হচ্ছে আসল কথা। বাংলাদেশে ইসলামের নামে যারা উগ্রবাদ প্রচার করছে, তারা বিভ্রান্ত। আল কায়দা বা আইএস জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের মেলানো যাবে না। তবে এটা সত্য, কোনো কোনো মন্ত্রী, সরকারের সমর্থক বুদ্ধিজীবী যখন মিডিয়ায়, টিভির টকশোতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন, তখন তা দেশে নয় বরং বিদেশেও বিভ্রান্তি তৈরি করে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ৯০ ভাগ মুসলমান। এখানে উগ্রপন্থী ইসলামী দল আছে। ফলে বাংলাদেশ যে কোনো কোনো দেশের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশ একটি মডারেট ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দেশ। এখানে উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই। উগ্রবাদকে মানুষ পছন্দ করে না। সাধারণ মানুষের মাঝে এদের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও নেই। তাই জঙ্গিবাদকে নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই মঙ্গল। মনে রাখতে হবে, দলের সিনিয়র নেতারা, মন্ত্রীরা যদি জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলেন, তাহলে তাতে সমর্থকরা প্রভাবিত হন। তাই তাদের সংযত কথাবার্তা বলা উচিত।জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমরা কেন, কোনো দেশই এ সমস্যার বাইরে নয়। এ সমস্যার সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি সরাসরি জড়িত। এ ক্ষেত্রে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মাঝে সমঝোতা প্রয়োজন। জঙ্গিবাদ নিয়ে কোনো ব্লেমগেম নয়, বরং সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে তৃতীয় পক্ষ এ থেকে ফায়দা উঠাবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উদ্ধারে তাই প্রয়োজন এ মুহূর্তে একটি সমঝোতা। তবে অতি সম্প্রতি ঢাকায় দেয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একটি মন্তব্য আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেছেন, আইএসের উগ্রবাদ দমনে যৌথ উদ্যোগ গুরুতপূর্ণ। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বার্নিকাট আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও তথাকথিত সন্ত্রাস দমনে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ ইতিমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে গেল সেপ্টেম্বরে (২০১৫) যুগান্তরে আমি একটি উপ-সম্পাদকীয় লিখেছিলাম। এই তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে সামরিকভাবে নিজেদের জড়িত করেছে, সেখানে সন্ত্রাস দমন তো হয়ইনি, বরং সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জিইয়ে রেখে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। পাঠক আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া কিংবা সিরিয়ার বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিতে পারেন। আমার আতংকটা সেখানেই- আইএসের উগ্রবাদ দমনে বার্নিকাট যৌথ উদ্যোগের কথা বলে কি কোনো ইঙ্গিত করলেন?একাধিক কারণে বাংলাদেশ ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। একদিকে চীনের উত্থান, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া মৈত্রী যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। ভারত মহাসাগর ক্রমশই মার্কিন সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের কর্মকাণ্ড এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে ভারত মহাসাগরে। অনেকেই মনে করতে পারেন, ২ মার্চ (২০১২) সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত) তৎকালীন কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবাট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। এ নিয়ে ওই সময় বাংলাদেশে কম বিতর্ক হয়নি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ বেশ কটি চুক্তিতে আবদ্ধ (যেমন, অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি ২০১৩, টিকফা চুক্তি ইত্যাদি), যেখানে সন্ত্রাস দমনে যৌথ কর্মসূচি নেয়ার কথা বলা হয়েছে। অনেকেই জানেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে SOFA (Status of Forces Agreement) ও আকসা (Acquisition and Cross Servicing Agreement) নামে দুটি চুক্তি করতে চাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাময়িক উপস্থিতি, জ্বালানি গ্রহণ, পোর্ট অব কল সুবিধা দেয়া হবে। বাংলাদেশ এখন অব্দি এ ব্যাপারে সম্মতি না দিলেও চাপে আছে। আইএসকে মোকাবেলায় বৈশ্বিক কোয়ালিশনে বাংলাদেশ যাতে যোগ দেয়, সেজন্যও চাপ থাকতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে SITE-এর ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব আবিষ্কার এবং বার্নিকাটের যৌথ উদ্যোগের কথা বলার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি-না, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।এটা সত্য, বিশ্বে মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য যেখানে বেশি, সেখানেই ইসলামের নামে উগ্রবাদের জন্ম হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, সোমালিয়া, এমনকি থাইল্যান্ডের একটা অঞ্চলে (যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ) ইসলামের নামে উগ্রবাদ বিস্তার লাভ করেছে। এদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগসাজশও রয়েছে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। এখানে আল কায়দা কিংবা আইএস সরাসরি সংগঠিত হতে না পারলেও স্থানীয় জঙ্গিরা যে তাদের কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেউ কেউ চেষ্টা করছে যোগাযোগ রাখার। তবে যোগাযোগ হয়েছে, এটা বলার সময় বোধহয় এখনও আসেনি। বিদেশীদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিল। অভ্যন্তরীণ কিংবা বাইরের শক্তি এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। তাই বিষয়গুলো হালকাভাবে না নেয়াই মঙ্গলজনক।
Daily Amader Somoy