রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

ব্রাসেলসের ঘটনা যে বার্তা দিয়ে গেল

২২ মার্চ ২০১৬ তারিখে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্যাসেলসে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের সন্ত্রাসী হামলার পর যে প্রশ্নটি এখন গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে, তা হচ্ছে এই সন্ত্রাসী হামলা কী বার্তা দিয়ে গেল আমাদের। ব্রাসেলসের জাভেনতেম বিমানবন্দরের বহির্গমন বিভাগে দুটি বিস্ফোরণ এবং এর ঘণ্টাখানেক পর মায়লবেক মেট্রো স্টেশন বোমা হামলায় ৩৬ জন নিহত হয়েছেন আর আহত হয়েছেন ২৭০ জন। ১৩ নভেম্বর (২০১৫) প্যারিসে একাধিক জঙ্গি হামলা হয়েছিল এবং তাতে মারা গিয়েছিলেন ১২৯ জন সাধারণ মানুষ। এই দুটি হামলার পেছনে একটি যোগসূত্র আছে এবং তা গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ সংস্থা এপি জানাচ্ছে যে, ইউরোপজুড়ে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা চালাতে ৪০০ প্রশিক্ষিত যোদ্ধা পাঠিয়েছে আইএস অর্থাৎ ইসলামিক স্টেট। এরা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হামলা চালাতে পারে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখন ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সর্বত্র। কিছুদিন আগে জার্কাতায় যে বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছিল তার দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেছিল আইএস। প্যারিসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরপরই পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে ইসলামিক জঙ্গিরা হোটেল রেডিসনে ১৭০ বিদেশিকে জিম্মি করেছিল। জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে ২৭ বিদেশি সেদিন মারা গিয়েছিলেন। সম্প্রতি পশ্চিম আফ্রিকায় ইসলামিক জঙ্গিদের তৎপরতা বেশ লক্ষণীয়।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মালির উত্তরে বা তুয়ারেগ অঞ্চলে ন্যূনতম চারটি ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীর খবর আমরা জানি, যারা সেখানে একটি ‘জিহাদি যুদ্ধ’ পরিচালনা করছে। একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও তারা কাজ করে যাচ্ছে। এই চারটি সংগঠন হচ্ছে আনসার দ্বীন, আল কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেব, মোজওআ ও আল মুয়াক্কিন বি ডিমা। সম্প্রতি ‘সাহেল জোন’-এর অন্তর্ভুক্ত মালি, মৌরিতানিয়া ও নাইজারে ইসলামিক জঙ্গিদের তৎপরতা বেড়েছে। মাগরেবভুক্ত এ অঞ্চলের বাইরে নাইজেরিয়াতে ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠী বোকো হারামের নৃশংস ঘটনাবলি সারা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছিল। বোকো হারামের জঙ্গিরা কিশোরী মেয়েদের স্কুল থেকে অপহরণ করত এবং তারা জঙ্গি কমান্ডারদের তথাকথিত যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করত। শত শত বিরোধী মেয়েদের অপহরণের পর আর তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। বোকো হারাম সম্প্রতি ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। একিউআইএম চাচ্ছে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। ২০০৭ সালে তারা এই ঘোষণা দেয়। আলজেরিয়া, লিবিয়া, মালি, মরক্কো ও তিউনেশিয়ায় তাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে নাইজেরিয়াতে বোকা হারাম ও আনসারুর মতো সংগঠন একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। নাইজার ও ক্যামেরুনেও তাদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হয়েছে। বলা হয় নাইজেরিয়ার ৩৬টি প্রদেশের মাঝে ১৪টিতে বোকো হারামের অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী আর মালিতে ২০১১ সালে জঙ্গি সংগঠন আনসার দ্বীন সেখানে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শারিয়া আইন বলবৎ করেছে। ফলে এ অঞ্চলগুলো একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে। উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশ এক সময় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। ফলে এসব দেশের অনেক মানুষ ফ্রান্স, বিশেষ করে রাজধানী প্যারিসে বসবাস করেন। এদের দ্বিতীয় তথা তৃতীয় জেনারেশন ফ্রান্সে বসবাস করে আসছেন। কিন্তু ফ্রান্সের নাগরিকত্ব পেলেও এরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। চাকরির ক্ষেত্রে সামাজিক দিক দিয়ে এরা বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছিলেন। আর এই সুযোগটি নিয়েছিল আইএস। এরা তরুণ সমাজের মাঝে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছিল। ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম এক্ষেত্রে আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করেনি। এর বড় প্রমাণ হাসনাআইত বুলাচেনের ঘটনা, যিনি ইউরোপে প্রথম নারী আত্মঘাতী হিসেবে পরিচিতি পান। বুলাচেন কিছুদিন আগ পর্যন্ত পশ্চিমা পোশাক ও পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট ছিলেন। তার বন্ধুরা ইংল্যান্ডের টেলিগ্রাফকে জানিয়েছিল হাসনা ব্যক্তিজীবনে জিন্স প্যান্ট, কোকাকোলা আর পশ্চিমা সংগীতে বুঁদ হয়ে থাকতেন। তার কাছে ইসলাম ধর্মের কোনো আবেদন ছিল না। হঠাৎ করেই তিনি ‘হিজাবি’ হয়ে যান এবং জিহাদি তৎপরতায় জড়িয়ে যান। আইএসের সমর্থক হাসনা বুলাচেন পুলিশের আক্রমণের মুখে গত ১৯ নভেম্বর প্যারিসে নিজেকে উড়িয়ে দেন। আইএস এভাবেই তরুণ প্রজšে§র ভেতরে তার ‘প্রভাব’ বিস্তার করেছিল।
সিরিয়ায় আইএস অর্থাৎ ইসলামিক স্টেটের নাম প্রথম শোনা যায় ২০১৩ সালে। তখন সংগঠনটির নাম ছিল ইসলামিক স্টেট আর ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট। এই এলাকার ঐতিহাসিক নাম লেভান্ট। জঙ্গিরা এই নামটি গ্রহণ করেছিল। পরে নামটি পরিবর্তন করে। তবে ১৯৯১ সালে জামায়াত আল তওহিদ ওয়াল জিহাদ নামে একটি সংগঠনের ব্যাপারে মূলত এটি সংগঠিত হয়েছিল। পরে এরা ‘আলকায়েদা ইন ইরাক’ নাম ধারণ করে। এই সংগঠনটি মূলত সুন্নি প্রভাবাধীন ও সুন্নি সম্প্রদায়নির্ভর। ২০০৬ সালে ইরাকে সুন্নি প্রভাবাধীন মুজাহিদিন শূরা কাউন্সিলে সংগঠনটি যোগ দেয়। ২০১৩ সালে সারা বিশ্ব প্রথমবারের মতো আবু বকর বুগদাদির নাম জানতে পারে। ২০১৪ সালের ২৯ জুন বুগদাদি একটি খেলাফতের ডাক দিলে সংগঠনটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। তখন সংগঠনটি নতুন নাম ধারণ করে আইএস বা ইসলামিক স্টেট। তবে আলকায়েদার সঙ্গে সংগঠনটির সম্পর্ক কী এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে, ২০১৪ সালের জুন মাস থেকে আইএসের সঙ্গে আলকায়েদার কোনো সম্পর্ক নেই। আল কায়েদার রাজনৈতিক দর্শন ও ইসলামিক স্টেটের রাজনীতির মাঝে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দুটি সংগঠনই মূলত জিহাদি, গালাফি ও ওয়াহাবি মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়। আল কায়েদা জিহাদি ও ওয়াহাবি মতবাদ অনুসরণ করলেও খেলাফতের কথা বলেনি কখনো। আইএস খেলাফতের কথা বলেছে। বুগদাদি নিজেকে খলিফা বা আমিরুল মুমেনিন হিসেবে ঘোষণা করেছেন যা আল কায়েদার নেতা লাদেন যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেননি। বুগদাদি নিজেকে সব মুসলিম বিশ্বের নেতা বা খলিফা হিসেবে ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে দাবি করেছেন সব মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে এই খেলাফতের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা। তিনি মুসলমান প্রধান সব দেশকে নিয়ে এক রাষ্ট্রের স্বপ্ন  দেখেন। অন্যদিকে আল কায়েদা স্ট্রাটেজি হচ্ছে ছোট ছোট আমিরাত প্রতিষ্ঠা করা। আল কায়েদা মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে অপারেট করে। কিন্তু আইএস তা করে না। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না আল কায়েদা ও আইএস উভয় সংগঠনই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার জš§ দেয়া। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় স্ট্রাটেজি রয়েছে। এখানে তার স্বার্থ অনেক। স্বার্থ রয়েছে ফ্রান্সেরও। বাহরাইন ও কাতারে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে আমিরাত ও সাইপ্রাসে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সস্তায় তেল পাওয়া যায়। এই তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। লিবিয়ার তেলের ওপর ৩টি পশ্চিমা দেশের নির্ভরশীলতা ইতোমধ্যে অনেক প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। ইতালির প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ২৯ ভাগ আসে লিবিয়া থেকে। ফ্রান্সের ও স্পেনের এই নির্ভরশীলতার হার যথাক্রমে ১৪ ভাগ ও ১০ ভাগ। তারা চাইবে সস্তায় তেল নিতে। সিরিয়ায় খুব বেশি তেল সম্পদ নেই। কিন্তু এই তেলই এখন ইসলামি স্টেটের জঙ্গিদের আয়ের অন্যতম উৎস। আইএস প্রতিদিন তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ৪০ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। কালোবাজারে তা বিক্রি করে। এর মূল্য বছর হিসাবে ৩২ কোটি ডলার আর প্রতিদিনের তেল বিক্রির অর্থ জমা হচ্ছে ইসলামিক স্টেটের ফান্ডে। এই ফান্ড ব্যবহƒত হয় জঙ্গিদের মাসিক বেতন (৪৩০ ডলার থেকে ১ হাজার ডলার) ও সেই সঙ্গে বিদেশে জঙ্গি তৎপরতার কাজে। যেমন বলা যেতে পারে প্যারিসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায় ৫০ হাজার ডলার ব্যয় হয়েছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা।
আইএস তার ‘দূরবর্তী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা পাক-ভারত উপমহাদেশে সম্প্রসারিত করার কথা বলছে। এটা আমাদের জন্য চিন্তার কারণ। বড় ধরনের সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিতে এখন ভারত ও বাংলাদেশ। পাকিস্তান ইতোমধ্যে তাদের প্রভাব বলয়ে চলে গেছে। পাকিস্তানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখন নিত্যদিনের ঘটনা। এ অঞ্চলের মানুষ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পছন্দ করে না। কিন্তু সন্ত্রাসীদের কাছে তারা অনেক সময় জিম্মি হয়ে যান। আইএসের এটাই স্ট্রাটেজি। জিম্মি করে মানুষ হত্যা করা। ভারত ও বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দুটি দেশ। এই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাই বেছে নেয় আইএসের জঙ্গিরা। জাকার্তার ঘটনা এর বড় প্রমাণ। বলা হচ্ছে, প্রায় ৭০০ ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক সিরিয়ায় আইএসের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিল। এরাই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। ভারত কিংবা বাংলাদেশের কারা কারা সিরিয়ায় গিয়েছিল তার পরিসংখ্যান জানাটা জরুরি। ভারতীয় গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে সক্রিয় থাকলেও আমরা বারবার পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলতে শুনেছি বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই। আমরাও তেমনটাই মনে করি। কিন্তু এ দেশে জঙ্গি আছে। তাদের কেউ কেউ যে আইএসের আদর্শে উদ্দীপ্ত হয়নি তা স্পষ্ট করে বলা যাবে না। কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন এ দেশে নিষিদ্ধ। এসব সংগঠনের শীর্ষ নেতারা আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতে পারেন। ভয়টা এখানেই। সর্বশেষ পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে খোরাসান অঞ্চলে ইসলামিক স্টেট তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি সম্প্রসারিত করেছে। তারা ঘোষণা করেছে ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের ‘খিলাফত’ সম্প্রসারিত করার। বিষয়টাকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি বিশ্বাস করি পুলিশের যে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটটি গঠিত হয়েছে, তারা বিষয়টি দেখছে। এই ইউনিটি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
ব্যাসেলসে সন্ত্রাসী হামলার পর আমি একাধিক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ পড়েছি। প্রতিটি গবেষণা প্রবন্ধে আইএসের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখার জন্য বলা হয়েছে। আইএসের মুখপত্র ‘দাবিগ’ ম্যাগাজিনে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করে মন্তব্য করা হয়েছে যে, আইএসের পরবর্তী টার্গেট হচ্ছে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, স্পেন আর ইতালি। এসব অঞ্চল থেকে ‘থার্ড জেনারেশনের’ যেসব মুসলমান সম্প্রদায়ের তরুণ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ‘জিহাদি’ যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য সিরিয়া গিয়েছিল, আইএস তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানোর জন্য। প্যারিস ও ব্রাসেলসে হামলা যে হলো এটা তার বড় প্রমাণ। আইএসের উদ্দেশ্য পরিষ্কার ইউরোপবাসীকে এক ধরনের ‘শাস্তি’ দেয়া। কেননা সিরিয়ার আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে বিমান হামলা শুরু করেছিল ইউরোপীয় শক্তিগুলো ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী মিত্র। ফলে আইএস এক ধরনের ‘প্রতিশোধ’ নিতে চেয়েছে। Institute for the Study of war-এ গত ২৫ মার্চ (২০১৬) হার্লিন গাম্ভীর (Harleen Gambhir) যে প্রবন্ধটি লেখেন (ISISÕS Campaign in Europe) তাতে এ ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে। আইএসের জঙ্গিরা (Crusoder Belgium) যে প্রতিশোধ নিয়েছে তাও বলা হয়েছে।ফলে ইউরোপে যে জঙ্গি তৎপরতা কমে যাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সমগ্র ইউরোপে যে মুসলমানবিদ্বেষী একটি জনমত গড়ে উঠবে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ইউরোপে মুসলিম প্রধান দেশগুলো থেকে বিশেষ করে পাক-ভারত-বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অভিযান প্রক্রিয়া আরো কঠিন হবে। সিরিয়া থেকে যেসব অভিবাসী ইউরোপে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন তারা মানবেতর জীবনযাপন করবেন। স্বদেশে কিংবা তুরস্কে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকির মুখে তারা এখন থাকবেন। স্থানীয়ভাবে দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো আরো শক্তিশালী হবে এবং স্থানীয় নির্বাচনে তারা ভালো করবে। চলতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না থাকা নিয়ে সেখানে গণভোট হবে। গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় পড়তে পারে। অর্থাৎ ৯/১১- এর পর যুক্তরাষ্ট্রে যে ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছিল আজ ১৫ বছর পর ইউরোপে ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ইউরোপ বদলে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ আর কখনো এ ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েনি। সবচেয়ে বড় কথা, ইউরোপে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রভাব ফেলতে পারে। দক্ষিণপন্থিরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে সমর্থন ছুড়ে দিতে পারে। সুতরাং ব্রাসেলস হামলার একটি প্রতিক্রিয়া থেকে যাবেই। - Daily Manobkontho 31.03.16

উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত


স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের ঢেউ বয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে কী ধরনের সমাজ, সংস্কৃতি বিকশিত হয়, এ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল অনেকের। দীর্ঘ ৭৩ বছর রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো একদলীয় সমাজতান্ত্রিক সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সাবেক চেক প্রেসিডেন্ট ভাসলাভ হাভেলের নেতৃত্বে যে ‘ভেলভেট রেভ্যুলুশনের’ জন্ম হয়েছিল, তা বদলে দিল পূর্ব ইউরোপকে, সেই সঙ্গে রাশিয়াকেও। অবসান ঘটেছিল স্নায়যুদ্ধের। আমেরিকার তাত্মিকদের কেউ কেউ তখন বলার চেষ্টা করেছিলেন, ‘সমাজতন্ত্র একটি ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে’ এবং লিবারেলিজমেরই জয় হলো (ফ্রান্সিস ফুকিয়ামা)। তখন থেকেই পূর্ব ইউরোপ তথা রাশিয়ার বিকাশমান গণতন্ত্র নিয়ে যেমন প্রশ্ন ছিল, ঠিক তেমনি প্রশ্ন ছিল উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্র নিয়েও। এখানে অধ্যাপক হানটিংটনের বিখ্যাত প্রবন্ধ (যা পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়) ঞযব পষধংয ড়ভ পরারষরুধঃরড়হ ঃযব হবীঃ ঢ়ধঃঃবৎহ ড়ভ পড়হভষরপঃ-এর কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেখানে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন কোন ‘সভ্যতা’ ভবিষ্যতে টিকে থাকবে এবং উন্নয়নশীল বিশ্ব কোন বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দেবে। অধ্যাপক হানটিংটন লিখেছিলেন, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নৈকট্যের কারণে বিভিন্ন জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোকে ৮টি ‘সভ্যতার’ ছত্রচ্ছায়ায় একত্রিত করবে এবং এদের মধ্যকার দ্বন্দ্বই বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তিনি অর্থনৈতিক শক্তিজোট ও আঞ্চলিক শক্তিকে একেবারে অস্বীকার করেননি। তিনি মন্তব্য করেছিলেন এভাবে, বপড়হড়সরপ ৎবমরড়হধষরংস সধু ংঁপপববফ ড়হষু যিবহ রঃ রং ৎড়ড়ঃবফ রং ধ পড়সসড়হ পরারষরুধঃরড়হ। অর্থাৎ অর্থনৈতিক জোটগুলো সাফল্য লাভ করবে যদি সাংস্কৃতিক (তথা ধর্মীয়) বন্ধনটা অটুট থাকে। এখানেই রয়েছে মোদ্দা কথাটি। অর্থনৈতিক সাফল্যটাই আসল, রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রধান নয়। যদি আরও খোলাসা করে বলা যায় তাহলে বলা যেতে পারে গণতন্ত্র হতে পারে, তবে ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়নই মঙ্গল।’ গণতন্ত্রকে কাটছাঁট করে যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ এই সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিটাই আসল। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর মাঝে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এর বড় প্রমাণ। মালয়েশিয়ার কথাও আমরা উল্লেখ করতে পারি। এসব দেশে সীমিত গণতন্ত্র আছে। এসব সমাজে বিকাশমান প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সঙ্গে পশ্চিমা সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না, এটা সত্য। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্য, সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্র নিয়ে সেখানকার মানুষ খুশি।
একটি ছোট্ট দেশ সিঙ্গাপুর। দ্বীপরাষ্ট্র। মাত্র ২৫০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে যে রাষ্ট্রটি আজ বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি তা এক সময় ‘জেলেদের পল্লি’ হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রয়াত লি কুয়ান ইউ এই রাষ্ট্রটিকে কোথায় নিয়ে গেছেন, তা আজ সবাই জানে। সিঙ্গাপুরকে একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে কাজ করেছিল লি কুয়ান ইউর দর্শন, যেখানে তিনি সফলভাবে প্রয়োগ করেছিলেন এই তত্ত্বটি হচ্ছে ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন।’ সেখানে গণতন্ত্র আছে। সংসদ আছে। বিরোধী দলও আছে। তবে পিপলস অ্যাকশন পার্টির রয়েছে একক কর্তৃত্ব। একটি শিক্ষিত, দক্ষ, ব্যবসাবন্ধব এলিট শ্রেণি রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সক্রিয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে (ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের মতে ঐুনৎরফ গণতন্ত্র) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। অনেকের মতে, কনফুসিয়াস মতবাদ সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিকে অন্যতম একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রাচীন চিনা প-িত কনফুসিয়াস ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক সমৃদ্ধি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিশ্বাস করতেন (চিনে এক সময় কনফুসিয়াস নিষিদ্ধ ছিল। আজ চিন কনফুসিয়াসের মতবাদ ধারণ করে)। সিঙ্গাপুর এই মতবাদটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যবহার করছে। সেই সঙ্গে যোগ্য নেতৃত্ব, রাজনীতিতে শিক্ষিত ও মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ, দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ, সুশাসন ও আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সেই সঙ্গে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সিঙ্গাপুরকে একটি বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে। তথাকথিত পশ্চিমা সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র এখানে বিকশিত হয়নি। সিঙ্গাপুরের নেতৃত্ব এর প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেননি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরেকটি দেশ মালয়েশিয়া। শতকরা ৬১.৩ ভাগ অধিবাসী মুসলমান, আর ১১ ভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর দেশ মালয়েশিয়া। এখানে বিকশিত হয়েছে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র। তবে নিঃসন্দেহে তার সঙ্গে ব্রিটেনের গণতন্ত্রের কোনো মিল নেই। লিকুয়ান ইউর মতো মালয়েশিয়াতেও মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়াকে উঠতি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন। এখানে রাষ্ট্রীয় দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে ‘ঐক্যই শক্তি’। অর্থাৎ বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত মালয়েশিয়ার জনগোষ্ঠীকে এক পতাকাতলে আনতে ও শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক শক্তির (বারিসোতা ন্যাসিওনাল বা ন্যাশনাল ফ্রন্ট, ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা উমনো যার মূল শক্তি) জন্ম দিয়েছিলেন মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ১৩টি রাজনৈতিক দলের এই ফ্রন্ট, যা মালয়েশিয়ার ঐক্যের প্রতীক, দীর্ঘদিন মালয়েশিয়াকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। মাহাথির ১৯৮১ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে ২০০৩ সালে অবসর নেন। এই ২২ বছরে তিনি মালয়েশিয়াকে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন। এখানেও কাজ করেছে সেই স্পিরিটÑ ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন।’ সেখানে রয়েছে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। মিডিয়া স্বাধীন নয়। রাজনৈতিক কর্মকা- নিয়ন্ত্রিত। সংসদ আছে। বিরোধী দলের অস্তিত্বও রয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলের বড় ভূমিকা লক্ষ করা যায় না। যদিও সংসদের নিম্নকক্ষে (উবধিহ জধশুধঃ) যেখানে ক্ষমতাসীন বারিসোতা ন্যাসিওনালের আসন সংখ্যা ১৩৩, সেখানে বিরোধী দলের ফ্রন্ট (চধশধঃধরহ চধশুধঃ, ৩ দল) পেয়েছে ৮৯টি আসন। বিরোধী দলের আসন বাড়লেও তা রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে রাশিয়ার কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়। সমাজতন্ত্র-পরবর্তী রাশিয়ায় যে ‘গণতন্ত্র’ বিকশিত হচ্ছে, তা ঐুনৎরফ গণতন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও এখানে দেখা গেছে একটি শ্রেণি ঘুরেফিরে ক্ষমতা পরিচালনা করছেন। অথবা বলা যেতে পারে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। পাঠক, স্মরণ করার চেষ্টা করুন ১৯৯৯ সালে ভøাদিমির পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন। কিন্তু মাত্র ৪ মাসের মাথায় ৩১ ডিসেম্বর (১৯৯৯) ইয়েলৎসিন প্রেসিডেন্ট থেকে পদত্যাগ করলে পুতিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। সেই থেকে তিনি আছেন। প্রেসিডেন্ট থেকে (দুই টার্ম) পরে প্রধানমন্ত্রী আবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দুই টার্ম পালন করার পর (২০০৮) ছেড়ে দেন। এখন আবারও প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এবং যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন (মেদভেদেভ) তিনি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৬ সালে পুতিন আবারও প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং সন্দেহাতীতভাবে ২০২০ সাল পর্যন্ত থাকবেন। এক সময় মনে করা হতো রাশিয়াতে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র বিকশিত হবে! কিন্তু দেখা গেল সেখানে গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের গোষ্ঠীতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, যারা ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। এখানে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র বিকশিত হয়নি। তবে রাশিয়া চেষ্টা করছে অর্থনৈতিকভাবে একটি শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হলেও অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে। এক ধরনের ‘অর্থনৈতিক মাফিয়াতন্ত্র’ এখন রাশিয়ার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। রাশিয়া অর্থনীতিতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থানে না থাকলেও বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি শক্তি। বিশ্ব সম্প্রদায় রাশিয়াকে সেই মর্যাদাও দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নটি এসে যায়। বাংলাদেশকে মাধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ছাড়া তা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো একেবারে খারাপ নয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগ ধরে রাখা, রিজার্ভ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত, দরিদ্রতা কমিয়ে আনা (২৪ ভাগ), তৈরি পোশাকে ৭৭ লাখ উদ্যোক্তা ও ২৫ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান, শান্তিসূচকে ৯৮তম স্থান, ডিজিটাল স্বাধীনতায় ৬৩তম স্থান (৮৬টি দেশের মধ্যে) ইত্যাদি প্রতিটি সূচক আশার কথা বলে। কিন্তু বড় ব্যর্থতা প্রধান বিরোধী দলকে সরকার আস্থায় নিতে পারেনি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যেখানে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আমরা তা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি (২০১৪) একটি নির্বাচন হয়েছে বটে সেখানে ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ ছিল না। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়েছে। রাজনীতি এখন হয়ে পড়েছে অনেকটা একদলীয়। দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি সমাজের সর্বক্ষেত্রে এত প্রকট যে, গণতন্ত্র এখানে অনেকটা ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’-এর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এমনকি বিরোধী দলের টানা তিন মাসের ‘আন্দোলন’ বাংলাদেশে একটি ‘বোমাবাজির রাজনীতি’র জন্ম দিয়েছিল, এই রাজনীতি সুস্থ গণতন্ত্র চর্চার জন্য কোনো ভালো খবর নয়। তবে এরই মাঝে একটি ভালো খবর হচ্ছে, বিএনপি তার ষষ্ঠ কাউন্সিল করতে পেরেছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। বিএনপি একটি কর্মসূচি (ভিশন ২০৩০) দেওয়ার কথাও বলেছে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি অতীতের ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা’ থেকে বেরিয়ে এসে সনাতন রাজনীতির সূচনা করেছে। এটা ভালো দিক। বাংলাদেশে আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চাই বটে। কিন্তু উন্নয়নকে বাদ দিয়ে নয়। বাংলাদেশে একটি তরুণ প্রজন্ম রয়েছে। এদের যদি দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে এই শক্তি অর্থনীতিতে একটি বড় অবদান রাখতে পারবে। তাই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে গণতান্ত্রিক চর্চাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একুশ শতকে এটাই হোক আমাদের অগ্রাধিকার।
Daily Amader Somoy
30.03.16

মিয়ানমারের গণতন্ত্রের স্বরূপ

দীর্ঘ ৫৪ বছর পর মিয়ানমার একজন সিভিলিয়ান প্রেসিডেন্ট পেয়েছে। তাঁর নাম তিন কিয়াও। তিনি এনএলডি নেতা অং সান সু চির ঘনিষ্ঠ এবং ধারণা করা হচ্ছে তিনি  হতে যাচ্ছেন একজন ‘প্রক্সি প্রেসিডেন্ট’। মূল ক্ষমতা পরিচালনা করবেন সু চি স্বয়ং। মিয়ানমার একজন ভাইস প্রেসিডেন্টও পেয়েছে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মিন্ট সয়েও। তিনি সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি। মিয়ানমারে একটি পরিবর্তন এলেও সেনাবাহিনীর যে প্রভাব, তা থেকে যাবে। তাদের প্রভাব হ্রাস হবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সেনাবাহিনীর একটি নির্বাচন দেওয়া প্রয়োজন ছিল। সেটা তারা দিয়েছে। কিন্তু তারা ব্যারাকে ফিরে যাবে, এটা আমার মনে হয় না। একটি মিসরের মতো পরিস্থিতিরও জন্ম হতে পারে মিয়ানমারে! ‘আরব বসন্ত’ মিসরে পরিবর্তন ডেকে এনেছিল। সেনা নিয়ন্ত্রিত একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়েছিল কায়রোর ‘তাহরির স্কয়ার’-এর দীর্ঘ ১৭ দিনের গণ-অবস্থানের কারণে। তার পরের ঘটনা সবাই জানেন। হোসনি মুবারকের ক্ষমতা হস্তান্তর, একটি নির্বাচন, নির্বাচনে ড. মুরসির বিজয় (জুন ২০১২) এবং পরে (২০১৩) সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফিল্ড মার্শাল সিসির ক্ষমতা গ্রহণ। আরব বসন্ত মিসরে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এখন মিয়ানমার কি সেদিকেই হাঁটছে? সেনাবাহিনী নির্বাচন ও সংসদকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু সব ‘সুযোগ-সুবিধা’ তারা ছেড়ে দেবে, এটা মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে সু চিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে হবে। নতুবা তিনি ‘পর্দার অন্তরালে’ থেকেও ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারবেন না। এর অর্থ পরিষ্কার, সেনা সমর্থন নিশ্চিত হতে হবে। তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিন কিয়াওকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি নিজে প্রার্থী না হয়ে সংবিধান মেনে নিলেন। এর মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীর এক ধরনের ‘কর্তৃত্ব’ স্বীকার করে নিয়েছেন। সরকারে তাঁর ‘ভূমিকা’ নিয়েও এখন প্রশ্ন থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনি একটি ‘পদ’ পেতে পারেন। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বিচ্ছিন্নতাবাদী আটটি গ্রুপের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু চুক্তির বাইরে আরো বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ রয়েছে। এদেরও চুক্তির আওতায় আনা দরকার। অর্থনৈতিক সংস্কারটা খুবই জরুরি। বৈদেশিক বিনিয়োগ দীর্ঘদিন এ দেশে বন্ধ ছিল। এখন এটি উন্মুক্ত। বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে বিপুল জ্বালানিসম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ এলেই এই সম্পদ আহরণ সম্ভব। মার্কিন বিনিয়োগকারীরা মিয়ানমারে আসতে শুরু করেছেন। এখন ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতির’ কারণে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা আরো উৎসাহিত হবেন। রোহিঙ্গা সমস্যা বহির্বিশ্বে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট করেছে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এক অমানবিক জীবন যাপন করছে। সু চি এদের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি উগ্র বৌদ্ধ মানসিকতায় নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, ভোটপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। সেটা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর কাছ থেকে মানুষ আরো বেশি কিছু প্রত্যাশা করে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া, তাদের চলাচলে বাধানিষেধ প্রত্যাহার করে নেওয়া কিংবা তাদের নিজ বাসভূমে বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। নয়া সরকার এ কাজ করবে—এটিই মানুষ প্রত্যাশা করে।
১৯৬২ সালের পর মিয়ানমার এই প্রথমবারের মতো একজন সিভিলিয়ান প্রেসিডেন্ট পাচ্ছে। নয়া প্রেসিডেন্টের কাছে দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। দীর্ঘ ৫৪ বছর সামরিক বাহিনী সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। ফলে সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। সংবাদপত্র সেখানে স্বাধীন নয়। বিচার বিভাগও স্বাধীন নয়। এগুলোর সবই একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য প্রয়োজন। এখন একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা নিতে যাচ্ছে। ১ এপ্রিল নয়া প্রেসিডেন্ট তাঁর দায়িত্ব নেবেন। একটি সরকারও গঠিত হবে তখন। ফলে নতুন এক মিয়ানমারকে আমরা দেখতে পাব। সে ক্ষেত্রে আমাদের জন্য একটা সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে। একটি ‘নয়া মিয়ানমার’ আমাদের জন্য অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। মিয়ানমার আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি অতীতে। এমনকি দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্কও আশাব্যঞ্জক নয়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১-১২ সময়সীমায় বাংলাদেশ মিয়ানমারে রপ্তানি করেছিল ১৩ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ মিয়ানমার থেকে আমদানি করেছে ৬৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। কিন্তু পরের বছর আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ কমে যায়। ২০১২-১৩ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিল ৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানির পরিমাণ মাত্র ৮৭ হাজার ডলারের পণ্য। তুলনামূলক বিচারে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা নিকট প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে আমাদের বিশাল বাণিজ্য। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক একেবারেই গড়ে ওঠেনি। অথচ বাংলাদেশি পণ্য, বিশেষ করে সিমেন্ট, ওষুধ, বিস্কুট, আয়রন, টিন ও সফট ড্রিংকসের বেশ চাহিদা রয়েছে মিয়ানমারে। এখন নতুন একটি সিভিলিয়ান সরকার সেখানে গঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উদ্যোগ নিতে পারে এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো উন্নত করতে। বিসিআইএম জোটেরও বিশাল এক সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে দেখা যায় ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের দেশটির বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৯.৯৩ শতাংশ, আর ২০১১ সালে মাত্র ২.৬৩ শতাংশ। এখানে মিয়ানমারের অংশ কমেছে, এটা সত্য। এখন একটি সিভিলিয়ান সরকার এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো বাড়াতে পারে। বিশ্ববাণিজ্যে পরিবর্তন আসছে। আঞ্চলিক বাণিজ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে মিয়ানমার আমাদের জন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে।
সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেভাবে গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে, মিয়ানমার এ থেকে পার্থক্য নয়। ধ্রুপদী গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি, তা বলতে গেলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশেই নেই। এ ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারেও এক ধরনের গণতন্ত্র বিকশিত হতে যাচ্ছে, যার সঙ্গে বিশ্বের অন্যত্র গণতন্ত্র যেভাবে বিকশিত হয়েছে তার সঙ্গে মেলানো যাবে না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ আমরা লক্ষ করি। মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন জোটে গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সিঙ্গাপুরে একদলীয় (পিপলস অ্যাকশন পার্টি) শাসন বজায় রয়েছে; যদিও জনগণই তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। কম্পুচিয়ায় সমাজতন্ত্র-পরবর্তী রাষ্ট্র কাঠামোয় একদলীয় (পিপলস পার্টি) শাসন বর্তমান। থাইল্যান্ডে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সেখানে থাকসিন সিনাওয়াত্রার দলের প্রভাব অনেক বেশি। তাঁর নামেই তাঁর বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা বিজয়ী হয়েছিলেন এবং সরকারও গঠন করেছিলেন। সমাজতন্ত্র-পরবর্তী মধ্য এশিয়ার প্রতিটি দেশে গণতন্ত্রের নামে একদলীয় কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। এখন অং সান সু চির দল কি সেদিকেই যাচ্ছে? তাঁর রয়েছে বিশাল জনপ্রিয়তা। পারিবারিক রাজনীতি ধারণ করেই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। তিনি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রেসিডেন্ট হতে পারলেন না বটে; কিন্তু তাঁর একটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে বহির্বিশ্বেও তিনি সমান সমান জনপ্রিয়। একটি সরকার গঠিত হবে এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তিন কিয়াও পার্লামেন্টে ২২ সদস্যের কেবিনেটে ১৯ জন কেবিনেট মন্ত্রী নিয়োগ করবেন বলে জানিয়েছেন। তিনজন মন্ত্রী (প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা) নিয়োগ করবে সেনাবাহিনী। তিন কিয়াও নতুন মন্ত্রিসভা নিয়োগ দেবেন। এতে অং সান সু চি পররাষ্ট্র, জ্বালানি, শিক্ষা এবং প্রেসিডেন্ট অফিস সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। এ মুহূর্তে তিনি যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেবেন তা হচ্ছে : ১. সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা। সংবিধান পরিবর্তনটা জরুরি। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে একটি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হলে সেনাবাহিনীর সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। সংবিধানের বর্তমান কাঠামো ঠিক রেখেও সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা সম্ভব। ২. সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠানগতভাবেই এবং সিনিয়র জেনারেলদের স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজন নানাভাবে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত, যাঁরা মিয়ানমারের অর্থনীতির অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করেন। নয়া সরকার এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে সেনাবাহিনী এটা ভালো চোখে দেখবে না। দুটি প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করি, যার মাধ্যমে সেনাবাহিনী ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। ইউনিয়ন অব মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস ও মিয়ানমার ইকোনমিক কো-অপারেশন। সিনিয়র জেনারেলরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িত। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও সেনাবাহিনী স্থানীয় অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে (যেমন—চীনের ইউনান প্রদেশের পাশে মিয়ানমারের শান (shan) রাজ্যে মোতায়েনকৃত নর্থ ইস্টার্ন কমান্ড)। অভিযোগ আছে, স্থানীয় সেনা কমান্ডাররা মাদক ব্যবসা ও বিখ্যাত ‘টিক’ (কাঠ)-এর অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কৃষি উত্পাদন ও বিপণনের সঙ্গেও সেনাবাহিনী জড়িত। সেনা নেতৃত্ব এটা অনুমোদন করেছে। বলা হয়, স্থানীয় সেনাবাহিনীর খরচ তারা এভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে মেটায়। এর বাইরে সিনিয়র জেনারেলদের স্ত্রীরা মূল্যবান পাথর (রুবি, জেড, স্যাফায়ার, মার্বেল ইত্যাদি) ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ইউরোপ তথা যুক্তরাষ্ট্রে এই মূল্যবান পাথরের ভালো ব্যবসা। ২০১৪ সালে এ খাতে ব্যবসা করে মিয়ানমার আয় করেছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার। ভূগর্ভ থেকে এসব পাথর উত্তোলন করা হয় এবং মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় এসব পাথরের বিশাল রিজার্ভ রয়েছে। এই রিজার্ভ ঘিরে ওই অঞ্চলে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। এ ব্যবসায় সিনিয়র জেনারেলরা জড়িত। সুতরাং এ সেক্টরে যদি ‘স্টেটাস কো’ বজায় রাখা না হয়, তাহলে দ্রুত সিভিল প্রশাসন সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাবে। ৩. সিভিল প্রশাসনকে তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে হলে ১৪ রাজ্যে যে বিদ্রোহী গ্রুপ রয়েছে, তাদের আস্থায় নিতে হবে। শান্তিপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সঙ্গে একটি সহাবস্থান প্রেসিডেন্ট তিন কিয়াওকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। ৪. ভৌগোলিকভাবে মিয়ানমারের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চল ঘিরে একটি চীন ও ভারত দ্বন্দ্ব ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। মিয়ানমারে চীনা স্বার্থ দীর্ঘদিনের। ভারতও মিয়ানমারের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। ভারতের বিনিয়োগ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে তিন কিয়াওকে একটি ভারসাম্যমূলক নীতি অবলম্বন করতে হবে। ওবামার এশীয় নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে এই মিয়ানমার। ওবামা দুইবার মিয়ানমার সফর করেছেন। হিলারি ক্লিনটনও এসেছিলেন ২০১১ সালে। মার্কিনিদের আগ্রহের কারণে মিয়ানমারের স্বার্থ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকটাও বিবেচনায় নিতে হবে নয়া সরকারকে।
মিয়ানমার একটি সিভিলিয়ান সরকার পেতে যাচ্ছে; কিন্তু এ সরকার সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কী অবদান রাখতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। Daily Kaler kontho 29.03.16

ওবামার ঐতিহাসিক কিউবা সফর

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা তার দ্বিতীয় টার্মের শেষ পর্যায়ে এসে ‘পরিবর্তিত’ কিউবায় তিনদিনের সফর শেষ করলেন ২৩ মার্চ। ১৯২৮ সালে আমেরিকার ৩০তম প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ (১৯২৩-২৯) সে দেশে গিয়েছিলেন। কুলিজ ছিলেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট। আর একজন ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হাভনায় নামলেন ২০১৬ সালে। মাঝখানে চলে গেছে ৮৮ বছর। এ দীর্ঘ সময়ে দুই দেশের মাঝে আরেক পরিবর্তন এসেছে। কুলিজের কিউবা সফরের আগে কিউবায় আগ্রাসন চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ১৮৯৮-১৯০২ সালে, আবার ১৯১৭-২২ সালে। কিন্তু ১৯৫৯ সালের বিপ্লব বদলে দেয় দৃশ্যপট। মার্কিনি আগ্রাসন ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে ঠেলে দেয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে। সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্কে কোনো সুবাতাস বইছিল না। কিন্তু ওবামা উদ্যোগ নিলেন সম্পর্কোন্নয়নের। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ওবামা কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার কথা বলেছিলেন। এরপর শুরু হয় আলোচনা। ১৪ আগস্ট (২০১৫) দীর্ঘ ৫৪ বছর পর হাভানায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে মার্কিনি পতাকা উড়ানো হয়েছিল, যা ১৯৬১ সালে নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। এরপর এখন ওবামা গেলেন হাভানায়। এর মধ্যে দিয়ে কী পেল যুক্তরাষ্ট্র? কিউবারই বা স্বার্থ কী? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক অনেকদিন ধরেই আলোচনার একটি বিষয়। কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতি পরিত্যাগ করবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্র ‘আবারও’ হাভানায় সরকারের উৎখাতের উদ্যোগ নেবে- এসব প্রশ্ন বারবার মিডিয়ায় ও বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের লিখনীতে উঠে আসছিল। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব ইউরোপে ‘সোভিয়েত ধাঁচের’ সমাজতন্ত্রের পতনের রেশ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল, তখন বলতে গেলে সারা বিশ্বের দৃষ্টি এক রকম নিবদ্ধ ছিল কিউবার দিকে। কেননা কিউবা ছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অন্যতম সমর্থক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল কিউবার অর্থনীতির অন্যতম উৎস এবং সেই সঙ্গে নিরাপত্তার অন্যতম গ্যারান্টার ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে কিউবা টিকে থাকতে পারবে কিনা- এ প্রশ্নটিও বারবার উচ্চারিত হয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘আগ্রাসনের’ মুখ থেকে কিউবা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কিনা, এটা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। আরও একটি প্রশ্ন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে আলোচিত হচ্ছিল- তা হচ্ছে কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনছে? কেননা চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশেও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর পরিবর্তন এসেছে। এ দুটো দেশ এখন আর ধ্রুপদী মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। তাই খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ছিল কিউবা চীন বা ভিয়েতনামের পথ অনুসরণ করবে কিনা। কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ছিল কিউবার নিরাপত্তাহীনতা। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই কিউবায় একটি সমাজতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকার করে নেয়নি। বরং কিউবায় বিপ্লবের পর (১৯৫৯), কিউবা সরকার যখন ল্যাতিন আমেরিকাজুড়ে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে চাইল, চে গুয়েভারা যখন ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করার জন্য কিউবা সরকারের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে বলিভিয়ায় গেলেন (সেখানেই তাকে পরে হত্যা করা হয়), তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কাছে ভিন্ন একটি বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কখনই চায়নি ‘তার প্রভাবাধীন এলাকায়’ অন্য কোনো ‘শক্তি’ প্রভাব খাটাক। যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে এ এলাকায় তথা ল্যাতিন আমেরিকায় তার পূর্ণ কর্তৃত্ব। কিন্তু কিউবার বিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘হিসাব-নিকাশ’-এ বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র কিউবা বিপ্লবের মাত্র দু’বছরের মধ্যে ১৯৬১ সালে ভাড়াটে কিউবানদের দিয়ে কিউবা সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। সিআইএ’র অর্থে পরিচালিত এই অভিযান ‘বে অফ পিগস’-এর অভিযান হিসেবে খ্যাত। বলা বাহুল্য ওই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেমে থাকেনি। ঠিক এর পরের বছর ১৯৬২ সালের অক্টোবরে ‘কিউবা সংকট’ একটি পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছিল কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে, যা তার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছে, এটা বিবেচনায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র একটি নৌ-অবরোধ আরোপ করে, যাতে করে কিউবায় কোনো ধরনের সামরিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করা না যায়। এই নৌ-অবরোধ আরেকটা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে একটি যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্ক থেকে তাদের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নিতে হবে। দীর্ঘ ১৩ দিন এই নৌ-অবরোধ বহাল ছিল। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে মিসাইল প্রত্যাহার করে নিলে সোভিয়েত ইউনিয়নও কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরিয়ে নেয়। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে গেলেও সংকট থেকে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে এ অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে কিউবা ‘যুদ্ধ’ করে আসছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরও মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে তখন অবধি কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্পর্কোন্নয়নের ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বললেও, এটি খুব সহজ হবে না। কেননা ওবামাকে এ সংক্রান্ত একটি আইন পাস করাতে হবে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে কংগ্রেসে তার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। কংগ্রেসের উভয় কক্ষ এখন নিয়ন্ত্রণ করে রিপাবলিকানরা। রিপাবলিকানরা ওবামার উদ্যোগের ব্যাপারে খুশি নন। আমি একাধিক কংগ্রেস সদস্য তথা সিনেটরের বক্তব্য দেখেছি, যেখানে তারা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ওবামার এ উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন। সিনেটর জন মেককেইন ও সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামার বাণিজ্য নিয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ওই সিদ্ধান্ত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সংকুচিত করবে। অন্যদিক সিনেটর রয় ব্লান্ট মনে করেন এ ঘোষণা রাউল ক্যাস্ট্রোকে ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য করবে। ডেমোক্রেট দলীয় সিনেটর রবার্ট মেনডেজ মনে করেন প্রেসিডেন্ট ওবামার ওই সিদ্ধান্ত হচ্ছে কিউবার মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ও স্বৈরশাসনকে স্বীকার করে নেয়ার শামিল। সিনেটর মেনডেজ নিজে কিউবা-আমেরিকান। এতে করে ধারণা করা স্বাভাবিক যে কিউবার ওপর থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সংক্রান্ত কোনো আইনকে কংগ্রেস অনুমোদন দেবে না। ফলে ওবামার ঘোষণা ও উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ‘একটি ঘোষণা’ হিসেবে থেকে যেতে পারে! যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের দাবি কিউবায় আরও বেশি গণতন্ত্রায়ন। আরও বেশি অর্থনৈতিক উদারীকরণ। মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও উন্নতি। একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কার। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের শর্তে কিউবা সবকিছু ‘উন্মুক্ত’ করে দেবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নে সংস্কার কর্মসূচির ফলাফল তাদের অজানা নয়। চীন ও ভিয়েতনামে অর্থনৈতিক সংস্কার এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কার সেখানে আসেনি। চীনের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামকে ব্যবহার করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ভিয়েতনাম-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আজ যুক্তরাষ্ট্র যখন কিউবার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করতে চাইছে, তখন এ প্রশ্নটিও উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সৎ কিনা। লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে ‘কর্তৃত্ব’ বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বেশ কয়েকজন ভেনিজুয়েলার ভিআইপির ব্যাপারে। সম্পদ আটক থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ভেনিজুয়েলার মারাত্মক মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির। এটা সত্য হুগো শ্যাভেজের মৃত্যুর পর ভেনিজুয়েলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। কিন্তু এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে কলম্বিয়া কিংবা মেক্সিকোতে। যেখানে ২০১৪ সালে ৪৩ স্কুল শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। ভেনিজুয়েলার বিষয়টি যে পরিপূর্ণ রাজনৈতিক, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। তখন খুব সঙ্গতকারণেই ভেনিজুয়েলার ওপর মার্কিনি ‘চাপ’ যদি বাড়ে, তাহলে কিউবাকে দেয়া তাদের আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তা কিউবার অর্থনীতিকে আঘাত করবে। কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে খোদ যুক্তরাষ্ট্রও উপকৃত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাত মারাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করতে পারছে না। স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশ আসছে বাইরে থেকে। এ ক্ষেত্রে কিউবার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা জগৎ বিখ্যাত। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এই চাহিদা পূরণ করতে পারে। ২০০২ সালে ফিদেল ক্যাস্ট্রো এ ধরনের একটি প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা গ্রহণ করেনি। ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় মারাত্মক ইবোলা রোগ ছড়িয়ে পড়ায় কিউবার স্বাস্থ্যকর্মীরা সেখানে গিয়েছিলেন। তখন কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নত হলে যুক্তরাষ্ট্র স্বাস্থ্য খাতে উপকৃত হতে পারে। তবে মূল সমস্যাটিই হচ্ছে মানসিকতার। যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের মানসিকতায় কী পরিবর্তন আসে, সেটাই দেখার বিষয় এখন। ১৪ আগস্ট (২০১৫) হাভানায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে মার্কিন পতাকা উত্তোলনকালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব জন কেরি বলেছিলেন কিউবা এখন আর শত্রু নয়, বন্ধু। বাস্তব ক্ষেত্রে এ ‘বন্ধুত্ব’ কতটুকু প্রতিফলিত হয়, সেটাই দেখার বিষয় এখন। ওবামার কিছু কিছু বক্তব্যও এখানে উল্লেখ করা যায়। তিনি কি মনে করেন রাউল ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবায় পরিবর্তন এসেছে? এর অর্থ কী? কিউবা কি আসলেই সব ‘উন্মুক্ত’ করে দিয়েছে? আমার তা মনে হয় না। অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ‘কমান্ড’ এখনও বজায় রয়েছে। এখানে ভিয়েতনামের ‘দইমই’ স্টাইলে কিছু কিছু পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, এটা সত্য। বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে বিনিয়োগ উন্মুক্ত নয়। দুই দেশের মাঝে এখনও বেশকিছু বিষয়ে ন্যূনতম ঐকমত্যের অভাব রয়েছে। ওবামার হাভানা সফরের সময়ও তা লক্ষ করা গেছে। মানবাধিকার ইস্যু কিংবা গুয়ান্তানামো বে’তে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগার, কিউবাতে রাজনৈতিক বন্দি ইত্যাদি ইস্যুতে দুই রাষ্ট্রপ্রধান হাভানায় সংবাদ সম্মেলনে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এসব ইস্যুতে দুটো দেশের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা আলাদা। সংবাদ সম্মেলনে রাউল ক্যাস্ট্রো জানিয়েছেন তার দেশে কোনো রাজনৈতিক বন্দি নেই। গুয়ান্তানামো বে কিউবার কাছে হস্তান্তরিত করারও কোনো প্রতিশ্র“তি দেননি ওবামা। তবে প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের। কিউবার মানবাধিকার অবনতি হয়েছে এটাও স্বীকার করেননি ক্যাস্ট্রো। স্পষ্টতই এসব ইস্যুতে দুটো দেশের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। যুক্তরাষ্ট্র যাদের ‘রাজনৈতিক বন্দি’ হিসেবে গণ্য করছে, কিউবা তা করছে না। মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে দেখে, কিউবা সেভাবে দেখে না। ফলে মতপার্থক্য রয়েই গেছে। তবে বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এ মতপার্থক্য সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে একজন নয়া প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে যাবেন। এ ক্ষেত্রে হিলারি ক্লিনটন যদি ‘সেই ব্যক্তি’ হন তাহলে ওবামার অনুসৃত নীতি তিনি খুব একটা পরিবর্তন করবেন না। রিপাবলিকান কেউ প্রেসিডেন্ট হলে পরিবর্তন আসবে। সে ক্ষেত্রে কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বরফ গলবে না। ওবামার এ সফর একটি ঐতিহাসিক সফর হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সফর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করতে আরও অবদান রাখবে। Daily Jugantor 28/03.16

কেমন হলো বিএনপির কাউন্সিল

কেমন হলো বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল? এটি বোধকরি এ মুহূর্তে আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়। এ কাউন্সিলের গুরুত্ব বেড়েছে একাধিক কারণে। প্রথমত, ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশে যে সহিংসতা রাজনীতির সূচনা হয়েছিল এবং বিএনপিকে যার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল, সেই পরিস্থিতি থেকে বিএনপি বেরিয়ে এসে নতুন দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ কাউন্সিলে বিএনপি নেত্রী নতুন কিছু বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, যা আমার বিবেচনায় আগামী দিনের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। তৃতীয়ত, বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে অন্য একটি বড় দল আওয়ামী লীগের কোনো ‘ভূমিকা’ না থাকলেও আমরা দেখেছিÑ শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন, যা কিনা প্রকারান্তরে বিএনপির কাউন্সিলের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি সবাই স্বীকার করেছেন, এ কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। দলটি ঘুরে দাঁড়াতে আদৌ পারবে কিনা, সেটি ভবিষ্যতের ব্যাপার। কিন্তু কাউন্সিল উপলক্ষে ঢাকায় হাজার হাজার তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীর উপস্থিতি প্রমাণ করে হতাশা থাকা সত্ত্বেও বিএনপির কর্মীরা উজ্জীবিত। তারা বিএনপিকে নতুন আঙ্গিকে দেখতে চান। তবে অনেক ‘অভিযোগের’ কথাও আমি শুনেছি টক শোগুলোতে। মজার কথা, বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরা এসব টক শোতে যত না ‘অভিযোগ’ উত্থাপন করেছেন, তার চেয়ে বেশি ‘অভিযোগ’ উত্থাপিত হয়েছে সরকারকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে। একটা অভিযোগ আমি শুনেছিÑ কেন কাউন্সিলে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের ‘ভার’মুক্ত করা হলো না। অর্থাৎ গত ৫-৬ বছর ধরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সবাই ধারণা করেছিলেন এই কাউন্সিলে তাকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হবে। সেটি আপাতত হয়নি। এটি বোধকরি বিএনপির অনেক নেতাকর্মীকেও আহত করে থাকবে। এটি হলে ভালো হতো। দ্বিতীয় আরেকটি অভিযোগ উঠেছে, আর তা হচ্ছেÑ কেন পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের দায়িত্ব এককভাবে বেগম জিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হলো? একটি ধ্রুপদী গণতান্ত্রিক সমাজে হয়তো এমনটি হয় না। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। বড় দল আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও এমনটি আমরা দেখেছি। এমনকি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানও একই ‘কাজ’ করেন। এককভাবে তিনি কো-চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে কম বিতর্ক সৃষ্টি করেননি। ফলে এগুলো একটি ‘স্বাভাবিক’ প্রক্রিয়া। বেগম জিয়া দল পুনর্গঠন করবেনÑ এটিই স্বাভাবিক। তবে কাউন্সিলের ভোটে নেতা-নেত্রী নির্বাচিত হলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে ব্যক্তিই মুখ্য। ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই রাজনীতি, দল বিকশিত হচ্ছে। সব দলের ক্ষেত্রেই এই কথাটি প্রযোজ্য।
বলতে দ্বিধা নেই বিএনপি বড় একটি রাজনৈতিক দল। দলটির নেতৃবৃন্দের অভিমত অনেক বেশি। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দলটির নেতাকর্মীরা যেভাবে জেল-জুলুম মোকাবিলা করছেন, অন্য কোনো দলের নেতৃবৃন্দ তা করেননি। গেল ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি ৩৭ বছরে পা রেখেছে। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এই ৩৭ বছর একবারে কম সময় নয়। দলটি একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া এই রাজনৈতিক দলটি বর্তমানে এক কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বোধকরি অতীতে কখনোই দলটি এ ধরনের সংকটের মাঝে পড়েনি। যারা রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে দলটির একটি শক্ত অবস্থান আছে। তিনবার দলটি ক্ষমতায় ছিল (১৯৭৮-১৯৮২, ১৯৯১-৯৬, ২০০১-২০০৬)। ফলে তৃণমূল পর্যায় দলটির একটি অবস্থান আছে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা থেকে বিএনপির উৎখাতের পর ওই সময় যখন বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে ছিল, ঠিক তখনই একজন গৃহবধূ থেকে (১৯৮৩) রাজনীতির পাদপ্রদীপে আসেন বেগম জিয়া। এখন তিনিই বিএনপির অবিসংবাদিত নেত্রী। তাকে কেন্দ্র করেই বিএনপির রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যে বেগম জিয়াকে দেখেছিল একজন অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে, সেই বেগম জিয়াকে এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বয়স বেড়েছে। অসুস্থ তিনি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে অংশ না নেওয়া কিংবা পরবর্তী সময় সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যে সহিংস রাজনীতির জন্ম হয়েছে এ দেশে, তা ব্যক্তিগতভাবে বেগম জিয়া তথা বিএনপির রাজনীতিকে উজ্জ্বল করেনি। বেগম জিয়াকে আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়েছে ‘নিঃসঙ্গ একজন নাবিক’ হিসেবে, যিনি আদৌ জানেন না কোন দিকে এবং কোন পথে বিএনপি নামক ‘জাহাজ’টিকে তিনি পরিচালনা করবেন। এক সন্তানহারা, অপর সন্তান অনেক দূরে, নেতাকর্মীরা জেলে। নিঃসঙ্গ বেগম জিয়া এখন একাই বিএনপি।
বিএনপি নানা সমস্যায় আক্রান্ত এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি দল গোছানোর কাজ শুরু করেছে। তবে অতীতে বিএনপির কয়েকজন নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা আছে। বিএনপি ভাঙার ‘গুজব’ ছিল এ কারণেই! ‘বেগম জিয়াকে দিয়ে হবে না’ কিংবা ‘জিয়ার আদর্শে ফিরে যেতে হবে’Ñ এ ধরনের বক্তব্য যখন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে বের হয়, তখন গুজবের নানা ডালপালা গজায়। মির্জা ফখরুল জামিন পেলেও কেউ কেউ জেলে আছেন এখনো। অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা আছে। আর যারা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন, ওই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। এর অর্থ পরিষ্কারÑ মামলা, মোকদ্দমা দিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ‘ব্যস্ত’ রাখতে চায় সরকার, যাতে করে তারা ‘আন্দোলনে’ নিজেদের জড়িত করতে না পারেন! বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অতীতে এমনটি কখনোই দেখা যায়নিÑ এত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা! ফলে এসব নেতাকর্মী আর রাজপথে সক্রিয় হতে পারেননি। বেগম জিয়াকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ২৭ ধারা অনুযায়ী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনসংক্রান্ত ধারা) বিচার, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় কিংবা গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, একই সঙ্গে ডা-ি ডায়িং মামলায় তারেক রহমানকে ‘শাস্তি’ দিয়ে তাকেও অযোগ্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলার দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এ ক্ষেত্রে বেগম জিয়াকে নির্বাচনে ‘অযোগ্য ঘোষণা’(?) করা হলে আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি নির্বাচনের জন্য যোগ্য হবেন কিনা জানি না। তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্ন হবে তখন অবান্তর। বেগম জিয়াই বিএনপির মূলশক্তি। বেগম জিয়া যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, বিএনপির ‘বিকল্প নেতৃত্ব’ নির্বাচনে অংশ নেবে, এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে কেউ যদি বিএনপিকে সংগঠিত করেÑ এটিও গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার মনে হয় না। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলা কার্যকর করতে চান, আমার ধারণা তা কোনো কার্যকর ‘ফল’ দেবে না। ‘আসল বিএনপি’ কিংবা নাজমুল হুদার ‘ফালতু কথাবার্তায়’ মানুষ খুব আস্থাশীল এটি আমার মনে হয় না। জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েও সরকার খুব লাভবান হয়নি। জাতীয় পার্টি আগামীতে অস্তিত্বের সম্মুখীন হতে পারে। বাহ্যত জাতীয় পার্টির মধ্যে দুটি ধারা বিদ্যমান। একটি ধারা- যারা সরকারের অংশ হিসেবেই থাকতে চায়। আর অন্য একটি ধারাÑ সত্যিকার অর্থেই ‘বিরোধী দলের’ ভূমিকা পালন করতে চায়। জাতীয় পার্টির এ ‘দ্বৈত ভূমিকা’ পার্টিকে এরশাদের অবর্তমানে, এমনকি ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে আরও একবার ভাঙনের মুখে ঠেলে দিতে পারে। বিএনপির অবর্তমানে জাতীয় পার্টির একটি সম্ভাবনা ছিল বিরোধী দল হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার। কিন্তু তা হয়নি। ফলে জাতীয় পার্টি নিয়ে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। ব্যক্তি এরশাদের নিজস্ব একটি ‘ইমেজ’ আছে, তাও আবার তার নিজস্ব এলাকায়। তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন। ফলে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে। বিএনপির কাউন্সিলে হাজার হাজার ডেলিগেটের উপস্থিতি প্রমাণ করল রাজনীতিতে ‘বিএনপির অবস্থান’টি জাতীয় পার্টি নিতে পারেনি। যদিও জাতীয় পার্টি এ মুহূর্তে সংসদে আছে।
এটি স্বীকার করতেই হবে বাংলাদেশে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিকল্পই বিএনপি, ঘুরেফিরে এটি প্রমাণিত। দশম সংসদে জাতীয় পার্টি পারেনি। তাই যে কোনো বিবেচনায় বিএনপির সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা সরকারের জন্য তথা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের ওপরে, যেখানে ইউরোপে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি এসেছে। এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে হলে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। আর এর পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। এটি সবাই বলেনÑ সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু গত প্রায় দুই বছরের সংসদীয় রাজনীতির কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয় পার্টি সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারছে না। জাতীয় পার্টিতে দ্বন্দ্ব আছে সরকারে থাকা না থাকা নিয়ে। ফলে সংসদকে আরও গ্রহণযোগ্য ও অর্থবহ এবং সর্বোপরি একটি সঠিক জাতীয় নীতি প্রণয়নে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্ছনীয়। আর বিএনপিই সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারে। বলা ভালো, বিএনপি সংসদে না থাকলেও বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ, দাতাগোষ্ঠী এটি স্বীকার করে এবং তারা সবাই বিএনপিকে মূল ধারার রাজনীতিতেই দেখতে চায়। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অবস্থান ও আমার ধারণা অনেকটা সে রকম। সরকারের ভূমিকা তাই এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। এটি স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। তাই দুটি দল দুটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে, এই দুটি দলের একটিকে বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল জনগণের ভোটে। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদীয় জামানায় যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, তাতে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ওই সংসদ টিকে থাকেনি। ১৯৮৮ সালের সংসদও টেকেনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশ না নেওয়ার কারণে। এ দুদলের অংশগ্রহণ থাকার কারণেই ৫ম সংসদ (১৯৯১), ৭ম সংসদ (১৯৯৬), ৮ম সংসদ (২০০১) ও ৯ম সংসদ (২০০৮) গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির অংশগ্রহণ না থাকায় ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাই ঘুরেফিরে বিএনপি আলোচনায় আছে এবং আমার বিবেচনায় আগামীতেও থাকবে।
বিএনপির কাউন্সিলে বিএনপি তার আগামী দিনের ‘রাজনীতি’ চূড়ান্ত করেছে। বেগম জিয়ার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই ‘রাজনীতি’ প্রকাশ পেয়েছে। কতগুলো বিষয় কেন্দ্র করে বিএনপির রাজনীতি এখন আবর্তিত হবে। প্রথমত, বিএনপি ‘ভিশন-২০৩০’-এর কথা বলেছে। অর্থাৎ বিএনপি কীভাবে ২০৩০ সালের বাংলাদেশকে দেখতে চায়, তার কিছু রূপকল্পের কথা বলেছে। যদিও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। একটি বড় দলের জন্য এ ধরনের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার। দ্বিতীয়ত, বিএনপি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একটি সংসদের কথা বলছে। বিএনপির জন্য এটি নতুন। তবে এ ক্ষেত্রে জটিলতা রয়েছে। এ ব্যাপারে আরও গবেষণা, আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন। একসময় জাসদের (রব) প্রবক্তা ছিল। সংবিধানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলা হয়নি। তৃতীয়ত, একটি অন্তর্বর্তীকালীন ও নিরপেক্ষ সরকারের কথা বিএনপি বলছে। যদিও এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিএনপি দেয়নি। বিএনপি তার কাউন্সিল শেষ করেছে। কর্মীরা এক নতুন দিকনির্দেশনা পেয়েছে। এখন দেখতে হবে এই ‘নতুন রাজনীতি’ নিয়ে বিএনপি সুস্থধারার রাজনীতিতে ফিরে আসে কিনা।
Daily AaderSomoy
27.03.16

কেন চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে




ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত মা মিং ছিয়াং একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন ২১ মার্চ কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিকাবের অনুষ্ঠানে। তিনি বলেছেন, চীন অন্য যে কোনো দেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সোনাদিয়া কিংবা পায়রায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে আগ্রহী। বাংলাদেশে কোনো গভীর সমুদ্রবন্দর নেই। অথচ শ্রীলংকার মতো দেশেও গভীর সমুদ্রবন্দর আছে। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য যেভাবে বাড়ছে তাতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। গভীর সমুদ্রবন্দরে বড় বড় জাহাজগুলো ভিড়তে পারে এবং তাতে মালামাল খালাস খুব সহজ হয়। বাংলাদেশ অনেক আগেই কক্সবাজার উপকূলে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করেছিলেন। তখন বিষয়টি আলোচনার টেবিলে ছিল। যদিও প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ভারতীয় গণমাধ্যম খুব ভালো চোখে দেখেনি। ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক 'দি হিন্দু' এক প্রতিবেদনে তখন জানিয়েছিল শেখ হাসিনা চীনা প্রধানমন্ত্রী লি চেখিয়াংয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে 'চীনা নেতৃত্বাধীন' শতাব্দীতে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে ভারতের নীতি-নির্ধারকরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। যদিও সরাসরি কোনো ভারতীয় নেতারা ওই সফরের সমালোচনা করেননি। ইতোমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার সার্ক সফরের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। ওই সফরে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্কের বন্ধনের কথাও উল্লেখ করে গেছেন। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে যেভাবে গুরুত্ব দেয়, ঠিক একইভাবে গুরুত্ব দেয় চীনের সঙ্গে সম্পর্ককেও। তবে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে গভীর সমুদ্রবন্দর (নির্মিতব্য) পরিচালনার ভার বাংলাদেশ কোনো বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে চায় না। চীনা সরকার এটি পেতে চেয়েছিল।
উল্লেখ্য, চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির পাশাপাশি ইউএই, নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্ক সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু একটি বাছাই কমিটি প্রথমে চায়না হারবারকে যোগ্য বলে অভিমত দিয়েছিল। চায়না হারবারের প্রস্তাব অনুযায়ী তিন ধাপে ১০ বছরের মধ্যে এই নির্মাণ সম্পন্ন হবে। ব্যয় হবে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। তিন বছরে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। বড় জাহাজগুলো তখন এখানে নোঙর করতে পারবে (এখন চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। সিঙ্গাপুর থেকে ছোট জাহাজে পণ্য আনতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয় প্রচুর)। প্রথম পর্যায়ে বন্দরে ২০ লাখ টিইউইউস (কন্টেইনার টার্মিনাল) কন্টেইনার ধারণ করতে পারবে। আর সাধারণ কার্গোর (খোলা পণ্য) ধারণ ক্ষমতা হবে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টন। এখানে এখন অনেক কিছু দেখার বিষয় রয়েছে। আমার বিবেচনায় বাছাই কমিটির চায়না হারবারকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল সঠিক। কেননা চীনারা এ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে। এ অঞ্চলে অন্তত তিনটি গভীর সমুদ্রবন্দরের খবর জানা যায়, যা চীনা অর্থে ও চীনা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্মিত হয়েছে ও পরিচালিত হচ্ছে। শ্রীলংকায় দুটো গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। একটি হামবানতোতায়, অন্যটি কলম্বোতে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত হামবানতোতায় ছিল গভীর জঙ্গল। ছোট্ট একটা শহর, যেখানে কোনো ভালো হোটেল ছিল না। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জন্মস্থান এখানে। চীন এখানে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর ফলে পুরো হামবানতোতার দৃশ্যপট বদলে গেছে। হামবানতোতা আজ একটি আন্তর্জাতিক নগরীর মর্যাদা পেয়েছে। নামকরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে এখানে। আগামী ২০১৮ সালে এখানে কমওয়েলথ গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কলম্বোয় যে বন্দরটি নির্মিত হয়েছে তাতে বছরে ৮ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা একটাই এখানে 'মেগা শিপ' অর্থাৎ বড় জাহাজগুলো ভিড়তে পারে এবং পণ্য খালাস করতে পারে। বলা হচ্ছে বন্দর পরিচালনা কার হাতে থাকবে_ এটা নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। যদি সর্বশেষ কলম্বোর সিআইসিটি অর্থাৎ কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল কন্টেইনার টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা দেখি তাহলে দেখতে পাবো শতকরা ৮৫ ভাগ মালিকানা চীনের হাতে। ১৫ ভাগের মালিকানা শ্রীলংকা সরকারের হাতে। যদি পাকিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা বলি, তাহলে শতকরা একশভাগ মালিকানাই চীনাদের হাতে। একসময় সিঙ্গাপুরের হাতে দায়িত্ব ছিল এর পরিচালনার। এখন চীনাদের হাতে রয়েছে পরিচালনার ভার। যেখানে তাদের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেখানে পরিচালনার ভার থাকলে আপত্তি কোথায়? সোনাদিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যদি বিঘি্নত না হয় তাহলে চীনাদের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার দেয়া যেতে পারত। সবচেয়ে বড় কথা, এ ধরনের বন্দর পরিচালনায় যে অভিজ্ঞ জনশক্তি প্রয়োজন তা আমাদের নেই। বরং চীনাদের সঙ্গে থেকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতাম। ডিজাইন তৈরিতেও অভিজ্ঞ চীনারা। সুতরাং তাদের ওপর আস্থা রাখা যেত। কিন্তু এখন তা আর হচ্ছে না।
সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসংক্রান্ত চুক্তি না হওয়া ছিল নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তবে যত দ্রুত আমরা সোনাদিয়ায় একটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারব ততই আমাদের জন্য তা মঙ্গল। কেননা দেরি হলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা, বিসিআইএসের কর্মকা-কে স্বাগত জানিয়েছি। বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য) ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে যে অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে উঠছে তার উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থেই এই সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অনেক বেশি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই বন্দর দিয়েই তাদের পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব থাকলেও তাহলে চুক্তিটি হলো না কেন? একটা ধারণা দেয়া হয়েছে যে, চীনা ঋণের ধরন নিয়ে চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। বলা হচ্ছে বাংলাদেশ সহজ শর্তে ঋণ চেয়েছিল। এতদিন একটা ধারণা ছিল, এ প্রকল্পে প্রথমে চীন নমনীয় ঋণের শর্ত দিয়েছিল। এই ঋণের সুদের হার কম, মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু পরে জানা গেল চীন এই ঋণকে বাণিজ্যিক ঋণে পরিণত করতে চায়, যেখানে সুদের হার ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এখানে একটি বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। প্রথমত, বাংলাদেশ অতীতে বিভিন্ন চীনা প্রকল্পে যে ঋণ নিয়েছে, তার ধরন কী? তা কি বাণিজ্যিক ঋণ? দ্বিতীয়ত, এই প্রকল্প নিয়ে চীনের সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনা চলে আসছিল। ওই আলোচনায় কি বাণিজ্যিক ঋণের প্রশ্নটি এসেছিল? তৃতীয়ত, কোনো সমঝোতা ছাড়াই কেন বলা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে? চতুর্থত, বাংলাদেশের আলোচনাকারীরা কি চীনা অর্থে নির্মিত ও পরিচালিত গাওদার, হামবানতোতা ও কলম্বো গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও পরিচালনায় কী ধরনের চুক্তি হয়েছিল তা পর্যালোচনা করেছিলেন? এমন কথাও বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ মূলত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনা অর্থায়নের বিষয়টি ভারত কিভাবে দেখছে, এটা বিবেচনায় নিতে চায়।
যাই হোক সোনাদিয়ায় আর গভীর সমুদ্রবন্দরটি আপাতত নির্মিত হচ্ছে না। এখন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরে। এ ক্ষেত্রে সোনাদিয়ায় সমুদ্রবন্দরের পরিকল্পনাটি পরিত্যক্ত হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারেও একটা ধোঁয়াশা রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তা স্পষ্ট করা হয়নি। ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ এখনো চাচ্ছেন সোনাদিয়ায় আরেকটি সমুদ্রবন্দর নির্মিত হোক। আমাদের অর্থনীতির জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরটির ব্যাপারে চীনাদের স্বার্থ আছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু আমাদেরও স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যিক স্বার্থে এই বন্দর, এমনকি কুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়কের গুরুত্ব অনেক।
চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশের বেশ কটি বড় প্রজেক্টে চীন অর্থায়ন করেছে। বেশ কটি ব্রিজও চীন তৈরি করে দিয়েছে, যা চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় চীনের কাছ থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো ও বিশেষ ছাড়ের দাবি বাংলাদেশ উত্থাপন করেছিল বলে জানা গেছে। বর্তমানে চীনের ঋণের ক্ষেত্রে পরিশোধের মেয়াদ ১০ থেকে ১৩ বছর, এ ছাড়া আরো ৩ বছর গ্রেস পিরিয়ড দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী এ ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২০ বছরের পাশাপাশি গ্রেস পিরিয়ড আরো ৫ বছর বৃদ্ধি করার অনুরোধ করেছিলেন। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করে দেখা যায় বাণিজ্য চীনের অনুকূলে। বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য চীনে রপ্তানি করে তার চেয়ে প্রায় ১৩ দশমিক ৮ গুণ পণ্য বেশি আমদানি করে। ১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিল ৪৮.৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর আমদানি করেছিল ৫৯২.৬৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০০১-২০০২ সময়সীমার প্রায় ৬০ গুণ বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করতে হয়েছিল (১১.৬৭ মিলিয়নের বিপরীতে ৭০৮.৯৪ মিলিয়ন)। ২০১২-১৩ সালে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৮.১২ মিলিয়ন (রপ্তানি) ও ৬৩২৪ মিলিয়ন (আমদানি)। অন্যদিকে চীনের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ তেমন বেশি নয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত চীন ঋণ দিয়েছিল ১৮১ মিলিয়ন ডলার, যা ছিল সুদমুক্ত। একই সঙ্গে ৭৫ মিলিয়ন কম সুদে, ৭৬৪ মিলিয়ন সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট, ও ৩২.৯৪ মিলিয়ন অনুদান দিয়েছিল। ২০১৩ সালে চীন তার নিজ দেশে ৫০০০ আইটেমের বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ মূলত ফ্রজেন ফুড, পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া, তৈরি পোশাক চীনে রপ্তানি করে। চীনা বিনিয়োগের যে পরিসংখ্যান আমরা পাই, তাতে দেখা যায় ২০০৯ সালে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৮৮ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৩ সালে এসে ১৮৬ জন উদ্যোক্তা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৩২০ মিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা সেক্টরের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ব্যবহৃত সমরাস্ত্রের শতকরা ৭৫ ভাগের উৎস হচ্ছে চীন। চীন থেকে ট্যাংক, সাজোয়া যান, আর বিমান বাহিনীর জন্য ফাইটার প্লেন চীন থেকে ক্রয় করা হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগেই বাংলাদেশ-চীন সামরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জীবদ্দশায় জিয়া একাধিকবার চীন সফর করেছেন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত চীনের ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের বাংলাদেশ সফর ছিল নিয়মিত। এখন এই প্রবণতা কিছু কম। ২০০২ সালে বেগম জিয়ার সময়সীমায় বাংলাদেশ ও চীন একটি সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে চীনের সঙ্গে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসংক্রান্ত চুক্তি না হওয়ায়, আমাদের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য তা ছিল একটি দুঃখজনক সংবাদ। যদিও উভয়পক্ষই বলেছে তারা এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা আরো চালিয়ে যাবে। এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে। চীন ও ভারত এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারবে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রচুর। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাওদারে, শ্রীলংকার হামবানতোতা ও কলম্বোতে চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা যত দ্রুত সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করতে পারব, ততই আমাদের মঙ্গল।
বাংলাদেশ অতি সম্প্রতি মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে তার সমুদ্র সীমানাসংক্রান্ত বিবাদ মীমাংসা করেছে। এখন সীমানা নির্ধারিত হওয়ায় কত দ্রুত এই সীমানা আমরা ব্যবহার করে তেল, গ্যাস ও অন্যান্য মিনারেল আহরণ করতে পারব, আমাদের সাফল্য সেখানেই নিহিত। সুতরাং আজ ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে যে আগ্রহ দেখিয়েছেন, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। পায়রা বন্দর নির্মাণে ভারত আগ্রহ দেখিয়েছে। যদিও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ভারতের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এখন আমরা ভারত ও চীনের যৌথ সহযোগিতা নিয়ে সোনাদিয়া ও পায়রাতে দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিতে পারি। এতে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত এবং চীনেরও লাভ। চীন ও ভারত তাদের আমদানি-রপ্তানিতে এই সমুদ্রবন্দর দুটি ব্যবহার করতে পারবে। তাই চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।
Daily Jai Jai Din24.03.16

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক

মিয়ানমার দীর্ঘ প্রতিক্ষা আর লড়াইয়ের পর অবশেষে একজন ‘সিভিলিয়ান’প্রেসিডেন্ট পেয়েছে। তিন কিয়াও প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৫৪ বছরের সেনা-শাসনের অবসান হয়েছে। মিয়ানমারে একটি সিভিলিয়ান সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হবে? বাংলাদেশ-মিয়ানমারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উভয় দেশই বিমসটেক (BIMSTEC পরিবর্তিত নাম BBIMSTEC) এবং বিসিআইএম জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোটটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেয়ায় এই জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এই জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্পকারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশী সারের ভীষণ চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্ত-সংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশ কিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রপ্তানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশেপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজশিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদী রয়েছে।এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগাওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্টস সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এই অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সেগুনকাঠ দুনিয়া-বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এই সেগুনকাঠ, যার উপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপে আমাদের ফার্নিচার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমার মূল্যবান পাথর, যেমন রুবি, জেড, বোম আর মার্বেল সমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালু এডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার-বাংলাদেশ ও চীনের সমন্বয়ে যে আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে (বিসিআইএম), সেখানেও বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং মিয়ানমারে যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, তার সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কিন্তু মিয়ানমারকে নিয়ে প্রশ্ন অনেক। মিয়ানমারে একটি নির্বাচন হয়েছিল বটে। কিন্তু এই নির্বাচন সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি জন্মের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে না। দীর্ঘ ৫৪ বছর সেখানে সে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে তা হুট করে ভেঙে ফেলা যাবে না। সেনাবাহিনির রাজনীতিতে যে প্রভাব, তা হ্রাস করা যাবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সেনা বাহিনির একটি নির্বাচন দেয়া প্রয়োজন ছিল। সেটা তারা দিয়েছে। কিন্তু তারা ব্যারাকে ফিরে যাবে, এটা আমার মনে হয় না। মিসরের মতো এক পরিস্থিতিরও জন্ম হতে পারে মিয়ানমারে। ‘আরব বসন্ত’ মিসরে পরিবর্তন ডেকে এনেছিল। সেনা নিয়ন্ত্রিত একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়েছিল কায়রোর ‘তেহরির স্কোয়ার’র দীর্ঘ ১৭ দিনের গণ অবস্থানের কারণে। তার পরের ঘটনা সবাই জানেন। হোসনি মোবারকের ক্ষমতা হস্তান্তর, একটি নির্বাচন, নির্বাচনে ড. মুরসির বিদায় (জুন ২০১২) এবং পরবর্তীতে (২০১৩) সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফিল্ড মার্শাল সিসির ক্ষমতা গ্রহণ। ‘আরব বসন্ত’ মিসরের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।  এখন মিয়ানমার কী সেদিকেই হাঁটছে। সেনাবাহিনি নির্বাচন ও সংসদকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু সকল ‘সুযোগ সুবিধা’ তারা ছেড়ে দেবেন, এটা মনে হয় না। এক্ষেত্রে সূ চিকে সেনাবাহিনির সাথে একটা সহবস্থানে যেতে হবে। নতুবা তিনি ‘পর্দার অন্তরালে’থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারবেন না। এর অর্থ পরিষ্কার—সেনা সমর্থন তিনি পেলেন না। তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিন কিয়াওকেই সামনে নিয়ে আসলেন। তিনি নিজে আদৌ প্রার্থী না হয়ে সংবিধান মেনে নিলেন। এর মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনির আস্থা অর্জন করতে পারেন। সরকারে তার ‘ভূমিকা’নিয়েও প্রশ্ন থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনি একটি ‘পদ’পেতে পারেন। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বিচ্ছিন্নতাবাদী ৮টি গ্রুপের সাথে একটি চুক্তি সাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু চুক্তির বাইরে আরও বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ রয়েছে। এদেরকেও চুক্তির আওতায় আনা দরকার। অর্থনৈতিক সংস্কারটা খুবই জরুরী। বৈদেশিক বিনিয়োগ দীর্ঘদিন এদেশে বন্ধ ছিল। এখন এটি উন্মুক্ত। বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে বিপুল জ্বালানি সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আসলেই এই সম্পদ আহরণ সম্ভব। মার্কিন বিনিয়োগকারীরা মিয়ানমারে আসতে শুরু করেছেন। এখন ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’র কারণে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা আরো উৎসাহিত হবেন। রোহিঙ্গা সমস্যা বহির্বিশ্বে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট করেছে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এক অমানবিক জীবন যাপন করছে। সূচি এদের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেন নি। তিনি উগ্র বৌদ্ধ মানসিকতায় নিজেকে সম্পর্কিত করেছিলেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার—ভোটপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। সেটা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর কাছ থেকে মানুষ আরো বেশি কিছু প্রত্যাশা করে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া, তাদের চলাচল বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়া কিংবা তাদের নিজ বাসভূমে বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরী। নয়া সরকার এই কাজটি করবে—এটাই মানুষ প্রত্যাশা করে। ১৯৬২ সালের পর মিয়ানমার এই প্রথমবারের মত একজন সিভিলিয়ান প্রেসিডেন্ট পেল। যুক্তিযুক্ত কারণেই নয়া প্রেসিডেন্টের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি। দীর্ঘ ৫৪ বছরে সামরিক বাহিনি সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। ফলে সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। সংবাদপত্র সেখানে স্বাধীন নয়। বিচার বিভাগও স্বাধীন নয়। এগুলো সবই একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য প্রয়োজন। এখন একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা নিতে যাচ্ছে। ৩১ মার্চ নয়া প্রেসিডেন্ট তার দায়িত্ব নেবেন। একটি সরকারও গঠিত হবে তখন। ফলে নতুন এক মিয়ানমারকে আমরা দেখতে পাবো। সেক্ষেত্রে আমাদের জন্য একটা সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে। একটি ‘নয়া মিয়ানমার’ আমাদের জন্য অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। মিয়ানমার আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়া পরও এই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি অতীতে। পরিসংখ্যান বলছে ২০১১-১২ সমুদ্র সীমায় বাংলাদেশ মিয়ানমারে বাণিজ্য করেছিল ১৩ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ মিয়ানমার থেকে আমদানি করেছে ৬৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। কিন্তু পরের বছর আমদানি রফতানির পরিমাণ কমে যায়। ২০১২-২০১৩ সালে বাংলাদেশ রফতানি করেছিল ৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানির পরিমাণ মাত্র ৮৭ হাজার ডলারের পণ্য। তুলনামূলক বিচারে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা নিকট প্রতিবেশী চীনের সাথে আমাদের বিশাল বাণিজ্য। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সাথে আমাদের সম্পর্ক একেবারেই গড়ে ওঠেনি। অথচ বাংলাদেশী পণ্য, বিশেষ করে সিমেন্ট, ঔষধ, বিস্কুট, আয়রন, টিন ও সফট ড্রিংক-এর বেশ চাহিদা রয়েছে মিয়ানমারে। এখন নতুন একটি সিভিলিয়ান সরকার সেখানে গঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উদ্যোগ নিতে পারে এই বাণিজ্যিক সম্পর্কটা আরো বেশি উন্নত করতে। বিসিআইএম জোটেরও বিশাল এক সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৯১ সালে বিসিআইএম’র অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার। অথচ ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ২১ মিলিয়ন ডলারে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে বিসিআইএম এ দেশটির বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৯৩ ভাগ, আর ২০১১ সালে সেটি দাঁড়ায় মাত্র ২ দশমিক ৬৩ ভাগে। এখানে মিয়ানমারের অংশ কমেছে, এটা সত্য। এখন একটি সিভিলিয়ান সরকার এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো বাড়াতে পারে। বিশ্ব বাণিজ্যে পরিবর্তন আসছে। আঞ্চলিক বাণিজ্যকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ফলে মিয়ানমার আমাদের জন্য একটি সম্ভাবনার দার উন্মুক্ত করতে পারে। মিয়ানমারের একটি সিভিলিয়ান সরকার গঠিত হয়েছে। আন্তঃবাণিজ্য কিংবা বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্নে একটি সিভিলিয়ান সরকার সব সময়ই একটি ভিন্ন ‘এপ্রোচ’ নিয়ে থাকে। তাই আমরা আশা করবো, মিয়ানমারের ‘নয়া সরকার’এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করবে, যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে গুরুত্ব দেবে বেশি। Poriborton 22.03.16

বিএনপির কাউন্সিল ও আগামীর রাজনীতি

গত ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই কাউন্সিলকে ঘিরে দলের কর্মীদের মাঝে নতুন এক কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। হাজার হাজার কর্মীর উপস্থিতি প্রমাণ করে বিএনপি একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। কাউন্সিলে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন এবং আমার বিবেচনায় ওই ভাষণে বেগম জিয়া কার্যত বিএনপির আগামী দিনের রাজনীতির একটি রূপকল্প উপস্থাপন করলেন। তার বক্তব্যের দুটি বিষয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। এক. প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট। দুই. রূপকল্প ২০৩০। এই রূপকল্প হচ্ছে বিএনপির পরিকল্পনার ছক অর্থাৎ কীভাবে বিএনপি ২০৩০ সালে বাংলাদেশকে দেখতে চায়। এই কাউন্সিল বিএনপির নেতা ও কর্মীদের উজ্জীবিত করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ৫ জানুয়ারি (২০১৪) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়া এবং নির্বাচন বয়কট করার ডাক দিয়ে বড় ধরনের ‘সংকটের’ মাঝে পড়ে দলটি। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে ‘সহিংস রাজনীতির’ জš§ হয় এবং এর জন্য অভিযুক্ত করা হয় বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে। শত শত নেতাকর্মীর নামে মামলা করা হয়। শীর্ষ স্থানীয় নেতাকর্মীদের নামে শত শত মামলা হয়। এমনকি আজো শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ ‘বাস পোড়ানোর’ মামলা থেকে নিষ্কৃৃতি পাননি। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এ রকম ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এভাবে কোনো দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা অতীতে কখনো মামলা-মোকদ্দমা ও জেল-জুলুম মোকাবিলা করেননি। এতকিছুর পরও বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপির অবর্তমানে জাতীয় পার্টি ‘বিএনপির অবস্থান’টা নিতে পারেনি। বিএনপি এখনো প্রধান বিরোধী দল। ফলে সঙ্গত কারণেই বিএনপি যখন এ রকম একটি বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের কাউন্সিল সম্পন্ন করল তখন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি তাদের দিকেই থাকবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। তাই সংবাদপত্র যখন মন্তব্য করে ‘বিএনপি কি ঘুুরে দাঁড়াতে পারবে’ তখন তা যুক্তিসঙ্গত বৈকি! তবে এই কাউন্সিলের পর অনেক কিছু নির্ভর করছে। দলটিকে গোছানো দরকার। নেতৃত্বের সারিতে পরিবর্তনও আসছে। বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে চ্যালেঞ্জ করার দলে কেউ নেই বটে; কিন্তু শীর্ষ পদগুলোতে পরিবর্তন, যারা দল ত্যাগ করেছিলেন কিংবা বহিষ্কৃত হয়েছিলেন তাদের ফিরিয়ে আনা এই মুহূর্তে বিএনপির জন্য এগুলোই জরুরি। সেটা কাউন্সিলের পর সম্পন্ন হবে বলে আমার ধারণা।
গত পহেলা সেপ্টেম্বরে বিএনপি ৩৭ বছরে পা রেখেছে। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এই ৩৭ বছর একেবারে কম সময় নয়। দলটি একাধিকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জš§ নেয়া এই রাজনৈতিক দলটি বর্তমানে কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বোধ করি অতীতে কখনোই দলটি এ ধরনের সংকটের মাঝে পড়েনি। যারা রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে দলটির একটি শক্ত অবস্থান আছে। তিনবার দলটি ক্ষমতায় ছিল (১৯৭৮-১৯৮২, ১৯৯১-৯৬, ২০০১-২০০৬)। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে দলটির একটি অবস্থান আছে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা থেকে বিএনপির উৎখাতের পর ওই সময় যখন বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছিল ঠিক তখনই একজন গৃহবধূ থেকে (১৯৮৩) রাজনীতির পাদপ্রদীপে আসেন বেগম জিয়া। এখন তিনিই বিএনপির অবিসংবাদিত নেত্রী। তাকে কেন্দ্র করে বিএনপির রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ বেগম জিয়াকে দেখেছিল একজন অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে, সেই বেগম জিয়াকে এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল! বয়স বেড়েছে। অসুস্থ তিনি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে অংশ না নেয়া কিংবা পরবর্তীতে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যে সহিংস রাজনীতির জš§ হয়েছে এ দেশে তা ব্যক্তিগতভাবে বেগম জিয়া তথা বিএনপির রাজনীতির ক্ষতি করছে। বেগম জিয়াকে আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়েছে ‘নিঃসঙ্গ একজন নাবিক’ হিসেবে, যিনি আদৌ জানেন না কোন দিকে এবং কোন পথে বিএনপি নামক ‘জাহাজ’টিকে তিনি পরিচালনা করবেন। এক সন্তান হারা, অপর সন্তান অনেক দূরে, নেতাকর্মীরা জেলে। ‘নিঃসঙ্গ বেগম জিয়া এখন একাই বিএনপি। বর্তমানে বিএনপি নানা সমস্যায় আক্রান্ত এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি দল গোছানোর কথা বলছে। তবে অতীতে বিএনপির কয়েক নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে শীর্ষ স্থানীয় বিএনপি নেতাদের মাঝে এক ধরনের হতাশা আছে। বিএনপি ভাঙার ‘গুজব’ ছিল এ কারণেই। বেগম জিয়াকে দিয়ে হবে না কিংবা জিয়ার আদর্শে ফিরে যেতে হবেÑএ ধরনের বক্তব্য যখন বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে বের হয়, তখন গুজবের নানা ডালপালা গজায়। মির্জা ফখরুল জামিন পেলেও কেউ কেউ জেলে আছেন এখনো। অনেকের বিরুদ্ধেও মামলা আছে। আর যারা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন ওই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। এর অর্থ পরিষ্কার মামলা, মোকদ্দমা দিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ‘ব্যস্ত’ রাখতে চায় সরকার যাতে তারা ‘আন্দোলনে’ নিজেদের জড়িত করতে না পারেন! বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অতীতে এমনটি কখনোই দেখা যায়নি। এত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলাও হয়নি। ফলে এসব নেতাকর্মী আর রাজপথে সক্রিয় হতে পারবেন না। বেগম জিয়াকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ২৭ ধারা অনুযায়ী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনসংক্রান্ত ধারা) বিচার, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা কিংবা গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, একই সঙ্গে ডান্ডি ডায়িং মামলায় তারেক রহমানকে ‘শাস্তি’ দিয়ে তাকেও অযোগ্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলার দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এক্ষেত্রে বেগম জিয়ার নির্বাচনে ‘অযোগ্য ঘোষণা’(?) করা হলে আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি নির্বাচনের জন্য যোগ্য হবেন কিনা জানি না। তবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রশ্ন হবে তখন অবান্তর। বেগম জিয়াই বিএনপির মূল শক্তি। বেগম জিয়া যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, বিএনপির ‘বিকল্প নেতৃত্ব’ নির্বাচনে অংশ নেবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে কেউ যদি বিএনপিকে সংগঠিত করে এটাও গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার মনে হয় না। সরকারের নীতি নির্ধারকরা যদি ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলা কার্যকর করতে চান, আমার ধারণা তা কোনো ইতিবাচক ‘ফল’ দেবে না। ‘আসল বিএনপি’ কিংবা নাজমুল হুদার কথাবার্তায় মানুষ খুব আস্থাশীল এটা আমার মনে হয় না। জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েও সরকার খুব লাভবান হয়নি। জাতীয় পার্টি এখন নানা ‘জটিলতার’ মুখে। ফলে সরকারের কাছে এখন বিকল্প পথ দুটি। এক. বিএনপিকে যে কোনোভাবে আস্থায় নিয়ে ২০১৭ সালের প্রথম দিকে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়া। দুই. সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। যে কোনো সময়ের চাইতে সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। উল্লেখিত দুটি সিদ্ধান্তের মাঝে একটি অর্থাৎ প্রথমটির ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ কম। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচনটিই সরকার করতে চায়। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে যদি ২০১৮ সালের শেষে নির্বাচন হয় তাহলে সমস্যা যা ছিল তাই থেকে যাবে!
বিএনপির সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা যাবে না। সম্প্রতি ঢাকা সফর করে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দলও বলে গেছে ‘সব দলের অংশগ্রহণের স্বার্থে’ নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এখনই ‘সংলাপ’ শুরু হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সরকার তাতে সায় দেবে বলে মনে হয় না। বেগম জিয়াও কাউন্সিলে একটি ‘সংলাপ’-এর কথা বলেছেন। এটা স্বীকার করতেই হবে বাংলাদেশে একটি দ্বি দলীয় ব্যবস্থার জš§ হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিকল্পই বিএনপি ঘুরেফিরে এটা প্রমাণিত। দশম সংসদে জাতীয় পার্টি পারেনি। তাই যে কোনো বিবেচনায় বিএনপির সঙ্গে একটা আস্থা সম্পর্ক গড়ে তোলা সরকারের জন্য জরুরি। কেননা বাংলাদেশ নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের ওপরে। ইউরোপে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি এসেছে। এখন নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে হলে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। আর এর পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। এটা সবাই বলেন, সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু গত প্রায় দুই বছরের সংসদীয় রাজনীতির কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয় পার্টি সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারছে না। জাতীয় পার্টিতে দ্বন্দ্ব আছে সরকারে থাকা না থাকা নিয়ে। ফলে সংসদকে আরো গ্রহণযোগ্য, আরো অর্থবহ এবং সর্বোপরি একটি সঠিক জাতীয় নীতি প্রণয়নে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্ছনীয়। আর বিএনপিই সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারে। বলা বাহুল্য, বিএনপি সংসদে না থাকলেও বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ, দাতাগোষ্ঠী এটা স্বীকার করে এবং তারা সবাই বিএনপিকে মূল ধারার রাজনীতিতেই দেখতে চায়। ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের অবস্থানও আমার ধারণা অনেকটা সে রকম। সরকারের ভূমিকা তাই এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। এই দুটি দল দুটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে এই দুটি দলের একটিকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল জনগণের ভোটে। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদীয় জামানায় যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল তাতে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ওই সংসদ টিকে থাকেনি। ১৯৮৮ সালের সংসদও টেকেনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশ না নেয়ার কারণে। এ দু’দলের অংশগ্রহণ থাকার কারণেই ৫ম সংসদ (১৯৯১), ৭ম সংসদ (১৯৯৬), ৮ম সংসদ (২০০১) ও ৯ম সংসদ (২০০৮) গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির অংশগ্রহণ না থাকায় ৫ জানুয়ারির (২০১৪) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি অনেক নমনীয় হয়েছে এবং তাদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া অনেক বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে বিএনপি সরকারের সঙ্গে একটি ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে’ যেতে চায় এবং যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। গত ১৯ মার্চের বিএনপির কাউন্সিল সে রকম একটি মেসেজ দিয়েছে বলে ধারণা করি। বেগম জিয়া তার ভাষণে ‘নির্বাচন বয়কট’ এর কোনো কথা বলেননি। দল পুনর্গঠন হবে, এ রকম ইঙ্গিত আমরা আগেই পেয়েছি। কিন্তু এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত আমরা জানতে পারিনি নতুন সাংগঠনিক কাঠামোর রূপ কী হবে। কাউন্সিলের দল পুনর্গঠনের পুরো দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বেগম জিয়াকে। ধারণা করছি স্থায়ী কাঠামোতেও পরিবর্তন আসবে। বেগম জিয়া তার ভাষণে ‘শেখ হাসিনাকে বাদ রেখে নির্বাচন হবে’ বলে যে মন্তব্য করেছেন তাও গুরুত্বের দাবি রাখে। এটা কি শুধু ‘কথার কথা’ কিংবা ‘কর্মীদের উজ্জীবিত করার জন্য বলা?’ আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। কিন্তু ‘শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে’ নির্বাচন কীভাবে হবে তার কোনো ফর্মুলা তিনি উপস্থাপন করতে পারেননি। আশা করছি এ ব্যাপারে তিনি একটি ফর্মুলা দেবেন। ভারতের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি চায় না অন্য কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলাক।’ এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ স্টেটমেন্ট। এই বক্তব্য জাতিসংঘের নীতিমালাকে সমর্থন করে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা তিনি বলেছেন। এটাও ভালো। তিনি ‘কানেকটিভিটি’র কথা বলেছেন বটে কিন্তু সার্কের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলেননি। চীন ও মুসলিম বিশ্বের সম্পর্কের কথাও বলেননি অথচ জিয়াউর রহমানের বৈদেশিক নীতির অন্যতম দিক ছিল মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা ও চীনের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ককে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি সন্ত্রাসবিরোধী আন্তর্জাতিক অভিযানকে সমর্থন করেছেন বটে কিন্তু আইএস জঙ্গিদের গণহত্যা, সিরিয়ার শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপনের কথা উল্লেখ করেননি। তিনি সুনীতি, সুশাসন ও সুসরকারের কথা বলছেন। কিন্তু এর বিস্তারিত উল্লেখ করেননি। ধারণা করছি তার রূপকল্প ২০৩০-এ এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ পাবে।
বেগম জিয়ার ওই ভাষণ নিঃসন্দেহে কর্মীদের উজ্জীবিত করবে। কর্মীরা নতুন করে অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন এক দিকনির্দেশনা পাবেন। কিন্তু কিছু ‘ত্রুটি’ বাদ দিলে বিএনপির এই কাউন্সিল সফল হয়েছে, এটা বলা যায়। তবে খটকা লেগেছে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের একটা কথায়। সৈয়দ আশরাফ বলেছেন তিনি বিএনপির কাউন্সিলে দাওয়াত পাননি বলে যাননি। এর পেছনে কতটুকু সত্যতা আছে বলতে পারব না। যত দূর জানি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আরো একটা কথা। বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তাও শোভন নয়। এর মধ্য দিয়ে দুটি বড় দলের মাঝে কোনো আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠবে না। বিএনপির এই কাউন্সিল কর্মীদের আরো উৎসাহিত করবে সন্দেহ নেই তাতে। এখন দেখতে হবে বিএনপি আগামীতে ‘সুস্থ’ রাজনৈতিক চর্চা করে কিনা। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি বড় দল। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এ দেশে গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। Daily Manobkontho 22.03.16

‘মিনিস্টার আই হ্যাভ এ কোয়েশ্চেন’


একটি ছোট ঘটনা। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ঘটনাটি আলোড়ন তুলেছিল। একটি কিশোরী মেয়ে শতাব্দী প্রশ্ন করেছিল যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকেÑ ‘মিনিস্টার আই হ্যাভ এ কোয়েশ্চেন’Ñ মন্ত্রী বাহাদুর আমার একটি প্রশ্ন আছে। মন্ত্রী সেদিন ব্যস্ত ছিলেন সড়কে চলাচলকারী অবৈধ বাসচালক আর সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করতে। মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন টিভি ক্যামেরা, মিডিয়ার ক্যামেরা, বিআরটির লোকজন। আর সেই সঙ্গে পুলিশ। কিশোরী শতাব্দী দাঁড়িয়ে দেখছিল মন্ত্রীর কর্মকা-। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে একজন মন্ত্রীকে রাস্তায় নামতে হয় অবৈধ বাসচালকদের আটক করার জন্য। পৃথিবীর কোথাও এমনকি ভারতের মতো দেশেও এভাবে একজন ‘বড় মন্ত্রী’ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক কনট্রোল করেন কিনা, ড্রাইভারদের কাগজপত্র পরীক্ষা করেন কিনা, বিষয়টি আমার জানা নেই। কিন্তু আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী অবশ্য প্রায়ই এ কাজটি করেন। এটা তার করা উচিত, কী উচিত নয়Ñ এ নিয়ে বিতর্ক উঠতেই পারে। অনিয়মটাই এখানে নিয়ম। শত শত ড্রাইভারের কোনো লাইসেন্স নেই। গাড়ির মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে এক যুগ আগে। তারপরও চলছে। খোদ ঢাকা শহরকে বাদ দিলাম। ঢাকার পাশে আমিনবাজার ব্রিজ অতিক্রম করে পাশের বাজারে আসেন। দেখবেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ডজন ডজন গাড়ি। এই গাড়িগুলো ঢাকায় ঢুকতে পারে না বটে, কিন্তু আমিনবাজারের ওপাশে মহাসড়কে নিত্য চলাচল করে। এটা কীভাবে সম্ভব?
ড্রাইভারদের দৌরাত্ম্য কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, কিশোরী শতাব্দী তার বড় প্রমাণ। শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী। শেওড়াপাড়া থেকে তাকে বাসে চড়ে স্কুলে যেতে হয়। মেয়ে বলে বাস ড্রাইভাররা ওকে নেয় না। নেয় না সরকারি বিআরটিসির বাসও। তাই অনেকটা সাহস করে মন্ত্রীকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল শতাব্দী। স্পষ্ট করে ইংরেজিতেই বলল, ‘মিনিস্টার আই হ্যাভ এ কোয়েশ্চেন’। তারপর জানাল তার অভিযোগ। মন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গেই সমাধান দিলেন। নির্দেশ দিলেন মেয়েদের বাসে নেওয়ার। সেই সঙ্গে গুলিস্তান-আব্দুল্লাহপুর ১২৩নং রুটে বিআরটিসি বাসে কেন শতাব্দীর মতো মেয়েদের নেওয়া হলো না, সেটাও জানতে চাইলেন। সামাজিক মাধ্যমে শতাব্দীর ছবিসহ মন্ত্রীর ছবি ও বক্তব্য ছাপা হয়েছে। এরপর তো কেটে গেছে আরও কয়েকটি দিন। বিআরটিসির বাস এখন শেওড়াপাড়ায় থামে। মেয়েদের তুলে নেয়। আমি ঠিক জানি না এটা ক’দিন চলবে? কিন্তু এটা জানি মন্ত্রীকে ওই ধরনের নির্দেশ আরও দিতে হবে। নতুন রুট খুলতে হবে। পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বা হবে, এটা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।
তবে শতাব্দীর মতো আমিও সাহস করে একখান কথা বলতে চাই। মন্ত্রীকে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তাই ভরসা এই সংবাদপত্র।
কোয়েশ্চেন নম্বর ‘ওয়ান’Ñ মাননীয় মন্ত্রী আপনি নির্দেশ দিয়েছিলেন মহাসড়কে কোনো ‘থ্রি হুইলার’ চলবে না। আমরা আপনার এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছিলাম। কেননা মহাসড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই ‘থ্রি হুইলার’, রিকশা ও স্কুটার। আপনার ওই আদেশকে আমি যদি ‘নির্দেশ’ হিসেবে ধরে নিই, তাহলে এখনো আমিনবাজার-সাভার-মানিকগঞ্জ মহাসড়কে নিত্য রিকশা, ভ্যান ও স্কুটার চলছে কীভাবে? লাইসেন্সবিহীন গাড়িও বা চলছে কীভাবে? উল্টোপথে ট্রাক চলছে অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই। এটা দেখবে কে? আপনি তো নির্দেশ দিয়েই খালাস। কিন্তু মনিটরিং করবে কে? আপনার বিআরটিএ কোথায় মাননীয় মন্ত্রী? কোয়েশ্চেন নম্বর ‘টু’ : মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধকল্পে হাইওয়ে পুলিশ গঠন করেছিল সরকার। তাদের জন্য যানবাহন ও জনবলও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী আবারও আমিনবাজার-মানিকগঞ্জ মহাসড়কের কথা বলি। আমি নিত্যদিন এ পথে চলাচল করি। বলতে পারেন আমার ‘জানটাকে’ হাতে নিয়েই আমার ব্যক্তিগত গাড়িতে সপ্তাহে একাধিকবার আমার পেশাগত কাজে এ পথে চলাচল করতে হয়। মাননীয় মন্ত্রী আমাকে ক্ষমা করবেন এই রুটে আমি কোনো হাইওয়ে পুলিশের পেট্রোল দেখিনি। হাইওয়ে পুলিশের নজরদারি কিংবা পেট্রোল থাকলে বাসচালকরা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে পারে না। সেই সঙ্গে এই রুটে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট বসানো উচিত। এই কাজটি কী আপনি করবেন? আমি দেখতে চাই আপনি একদিন টিভি ক্যামেরা নিয়ে সাভার রুটে মোবাইল কোর্ট বসিয়েছেন। আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি সাধারণ মানুষ আপনাকে সমর্থন করবে। কোয়েশ্চেন নম্বর ‘থ্রি’: আপনি প্রায়ই ঢাকা শহরে সড়কে নেমে যান। বাসে উঠে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন। এটা ভালো। এতে করে কি যানজট কমাতে পারছেন? দুটো দৃষ্টান্ত দিই। গাবতলীতে অবৈধ বাসস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করেছিলেন ঢাকা উত্তরের মেয়র। আপনি নিজেও এ ধরনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। শতকরা আশি ভাগ উচ্ছেদ হয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু এখনো দেখি মূল সড়কে দু-একটা বাস দাঁড়িয়ে থাকে। আর একটু দূরে আমিনবাজার ব্রিজে কোনো বাসস্ট্যান্ড না থাকলেও সেখানে বাসচালকরা অবৈধ একটা স্ট্যান্ড বানিয়ে নিয়েছে। সেখানে একাধিক বাস দাঁড়িয়ে থেকে নিত্যদিন যাত্রী উঠায়। ফলে যানজট তৈরি হয়। আমি দুঃখজনকভাবে লক্ষ করেছি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিক সার্জেন্ট, ট্রাফিক পুলিশ খোশগল্প করে! এখন যাদের ওপর দায়িত্ব ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা তারা যদি নিয়ন্ত্রণ না করে তাহলে আমরা কোথায় যাই মাননীয় মন্ত্রী। শতাব্দীর মতো সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে এ প্রশ্ন রাখলাম। এখানে আপনি ভালো ফল পাবেন যদি দুটো কাজ করেন। এক. প্রতি সপ্তাহে এখানে ট্রাফিক সার্জেন্ট ও ট্রাফিক পুলিশদের বদলি। এটা করলে অবৈধ বাসচালকদের কাছ থেকে সার্জেন্টরা আর ‘বখরা’ নিতে পারবে না। তাদের সখ্যও তৈরি হবে না। দুই. এখানে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট বসান। মোবাইল কোর্ট থাকলে বাসচালকরা ভয় পাবে। অবৈধভাবে যাত্রী উঠানোর জন্য রাস্তার ওপর বাস দাঁড় করিয়ে রাখবে না। তবে আপনাদের এখন সিরিয়াসলি ভাবতে হবে গাবতলীতে আদৌ আপনারা আন্তঃজেলা বাসস্ট্যান্ড রাখবেন কিনা? ঢাকা বড় হয়েছে। মানুষ বেড়েছে। মানুষদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়া আপনাদের দায়িত্ব। কোয়েশ্চেন নম্বর ‘ফোর’ : ঢাকার যানজট কমানোর অনেক উদ্যোগের কথা আমরা শুনি। কোটি টাকা খরচ করে ট্রাফিক ব্যবস্থা ডিজিটাল করা হয়েছিল। তা এখন কোনো কাজ করে না। একদম পানিতে গেল এতগুলো টাকা! টক শোতে ‘মহাবিশেষজ্ঞরা’ মহাকথা বলেন। সবাই সেখানে বিশেষজ্ঞ! যানজট কমাতে হলে ট্রাফিক পুলিশকে কঠোর হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে মোবাইল কোর্টের সংখ্যা। কেন যানজট হয়? এখানে ট্রাফিক পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি একটা বড় সমস্যা। আবারও দৃষ্টান্ত দিই। শ্যামলীর রিংরোডে রাত ৮টা বাজার আগেই আন্তঃজেলা বড় বাসগুলো রাস্তা দখল করে নেয়। আগে দেখতাম ছোট ছোট গাড়িতে করে যাত্রীদের মূল বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হতো। এখন আটটার আগেই বাসগুলো রাস্তা দখল করে যানজট সৃষ্টি করে। এটা দেখার কেউ নেই। আমি নিজে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পশ্চিম জোনের (ট্রাফিক) ডিসি মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। খুব সজ্জন ব্যক্তি তিনি। আমার সম্মুখেই নির্দেশ দিলেন। তারপরও যা ছিল তাই রয়ে গেছে। রিংরোডে সন্ধ্যার পর অসহনীয় যানজট সৃষ্টি হয়। এখানে প্রিন্সবাজার তাদের একটি নতুন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর চালু করেছে। রাস্তার ওপরই ক্রেতাদের গাড়ি পার্ক করা থাকে ডজন ডজন। মূল রাস্তা এতে সংকুচিত হয়। অথচ প্রিন্সবাজারের নিজস্ব ‘পার্কিং প্লেস’ থাকার কথা। উচ্চ আদালতের এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু প্রিন্সবাজার তা মানছে না। এসব দেখার দায়িত্ব কার? পত্রিকায় দেখলাম রাজউক উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছে। ভালো কথা। রাজউক কী দেখবে ‘পার্কিং প্লেস’ ছাড়া কী করে প্রিন্সবাজারকে তাদের স্টোর চালু করতে অনুমতি দেওয়া হলো? একই কথা প্রযোজ্য প্রিন্সবাজারের পাশে নতুন চালু একটি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজকে নিয়েও (সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল হসপিটাল)। এই হাসপাতালের কারণে সেখানে যানজট এখন নিত্যসঙ্গী। মাননীয় মন্ত্রী আপনাকে সন্ধ্যায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এই এলাকায়। নাগরিক হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। ট্রাফিক ডিসিকে অনুরোধ করেছি। দিনের বেলায়ও এখানে রাস্তা ব্লক করা থাকে! এটা কী কোনো নির্দেশ কারও? দিনের বেলা কি গাড়ি তল্লাশি হয়েছে কখনও? হয় না। কিন্তু মন্ত্রী বাহাদুর আসুন রিংরোডের সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল হসপিটাল ও কলেজের সম্মুখে। ব্লকগুলো সরানোর কেউ নেই। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার জবাবÑ ওপরের নির্দেশ! আমি ধরে নিচ্ছি ট্রাফিক পশ্চিমের ডিসি মহোদয়ের নির্দেশেই দিনের বেলায়ও রাস্তাটিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে! ওপরের নির্দেশ তো, তাই আমরা মানছি মাননীয় মন্ত্রী! কোয়েশ্চেন নম্বর ‘ফাইভ’ : চন্দ্রিমা উদ্যানের পাশে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। এই বাসভবনকে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাত আটটার পরপরই যদি মূল রাস্তার পাশে আন্তঃজেলা চলাচলের জন্য বাসগুলো এনে রাখা হয় এবং যাত্রী উঠানো হয় এবং তাতে করে এ এলাকায় যে যানজট সৃষ্টি হয়, তা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু এতে করে কী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের নিরাপত্তা বিঘিœত হয় না? এটা কে দেখবে? দেখার দায়িত্ব ট্রাফিকের। বিশ্বাস করবেন মাননীয় মন্ত্রী যেখানে মূল রাস্তায় বাসগুলো দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, সেখান থেকে ট্রাফিক ডিসি মহোদয়ের কার্যালয়ের দূরত্ব মাত্র ৫০০ গজ। তার কী নজরে পড়েনি কখনো? তিনি কী এটা উপলব্ধি করতে পারেননি যে, এভাবে বাসগুলো দাঁড়িয়ে থাকলে, প্রচুর যাত্রী একসঙ্গে থাকলে, তা এক ধরনের নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি করতে পারে। কোয়েশ্চেন নম্বর ‘সিক্স’ : মাননীয় মন্ত্রী সড়কে রিকশা চলে কীভাবে? মিরপুর রোডে এখন রিকশার স্রোত! আগে তো বড় রাস্তায় রিকশা চলত না। এখন চলে কীভাবে? কারা অনুমতি দিয়েছে? মাননীয় মন্ত্রী আপনি কী জানেন ও বোঝেন যে ঢাকা এখন রিকশার নগরীতে পরিণত হয়েছে। অলিগলিতে রিকশার গ্যারেজ তৈরি করে অবৈধ রিকশা তৈরি করা হচ্ছে। এটা তো একটা ভালো ব্যবসা। এসব গ্যারেজ কারা নিয়ন্ত্রণ করে? মাননীয় মন্ত্রী আপনি একটু খোঁজ করলেই জানতে পারবেন কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত। সড়কে যদি রিকশা চলে, তাহলে তো অন্য যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। সৃষ্টি হবে যানজট। এখন রিকশা নিয়ন্ত্রণ করবে কে? গলিতে রিকশা চলুক, কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু সড়কে কেন? ট্রাফিক বিভাগ থেকে প্রায়ই একটা কথা বলা হয়Ñ তা হচ্ছে তাদের জনবল কম। এটা হয়তো সত্য। যদি জনবল কম থাকে, তাহলে ‘আউটসোর্সিং’ করে জনবল বাড়ানো যায়। আনসার সদস্যদের তো নিয়োগ করা হয়। এদের সংখ্যা আরও বাড়ালে ক্ষতি কী?
মাননীয় মন্ত্রী আসুন আমরা সবাই মিলে এই ঢাকা শহরকে বসবাসের উপযুক্ত করে গড়ে তুলি। আপনি রাস্তায় নেমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। এটা শোভন নয়। এতে সাময়িক ফল পাওয়া যায় বটে, কিন্তু একজন মন্ত্রী কেন রাস্তায় নামবেন! সমস্যা হচ্ছে যার যা দায়িত্ব, তারা সেই দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করছেন না। রাজনৈতিকভাবে পরিবহন শ্রমিকদের ‘প্রটেকট’ করা হয়। তাদের উৎসাহিত করা হয়। ফলে ড্রাইভারদের আর হেল্পারদের কোনো ভয়-ডর থাকে না। বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে, মানুষ হত্যা করে এরা পার পেয়ে যায়। তাই দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ে বৈ কমে না। ছোট শতাব্দীর সমস্যা আপনি সমাধান করেছেন। কিন্তু আমরা যারা আমজনতা, রাষ্ট্রকে কর দিই যাতে করে রাষ্ট্রাযন্ত্র চলে, আমাদের সমস্যার সমাধান করবে কে?

যেসব প্রশ্নের জবাব এখনও মেলেনি

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের পদত্যাগ করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। খোদ অর্থমন্ত্রীর অসন্তুষ্টি এবং সরকারদলীয় শীর্ষ নেতাদের পদত্যাগের আহ্বানের পর তার পক্ষে আর ওই পদে থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ড. আতিউরের পদত্যাগ এবং অতি দ্রুততার সঙ্গে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণের পরও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে, যার কোনো জবাব এ মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। এর জবাব পাওয়া না গেলে তা বারবার আলোচিত হতে থাকবে এবং বিরোধী পক্ষ এটাকে পুঁজি করে রাজনীতি করবে। মূল প্রশ্ন একটিই- যে রিজার্ভ নিয়ে আমরা এত গর্ব করি, তার নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত? লুট হয়ে যাওয়া টাকা আদৌ ফেরত পাব কি-না? বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি সেকশন কতটুকু নিরাপদ? ৮০৮ কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাওয়ার পর সংবাদপত্রে যেসব প্রতিবেদন ও মন্তব্য ছাপা হয়েছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। আমরা যেন ভুলে না যাই, মার্কিন রিজার্ভ ব্যাংকে শুধু আমরাই আমাদের রিজার্ভের টাকা আমানত রাখছি না। বিশ্বের প্রতিটি দেশই তাদের রিজার্ভের একটা অংশ সেখানে রাখে। পৃথিবীতে রাষ্ট্রের সংখ্যা অনেক। দু’শর ওপরে রাষ্ট্র তাদের রিজার্ভের একটা অংশ ডলারে মার্কিন রিজার্ভ ব্যাংকে জমা রেখেছে। এখানে ‘ডলার রাজনীতি’ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ইরাকের সাবেক শাসক সাদ্দাম হোসেন জীবদ্দশার শেষের দিনগুলোতে তার দেশের রিজার্ভের একটা অংশ ইউরোতে পরিবর্তন করার চিন্তা করেছিলেন। এবং যতদূর জানি, ডলারের পরিবর্তে ইউরোতে একটি রিজার্ভ তিনি গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বাংলাদেশ তার রিজার্ভের সবটুকু মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখেনি। অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও একটা অংশ রেখেছিল। এখন সেখান থেকেই হ্যাকাররা কিছু ডলার সরিয়ে নিল। এ ক্ষেত্রে আমরা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংককে অভিযুক্ত করতে পারব বটে; কিন্তু দায়ী করতে পারব কতটুকু, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।

আমাদের দায়ভারটা কি বেশি নয়? বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে গভর্নর ‘নৈতিক দায়িত্ব’ নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। দু’জন ডেপুটি গভর্নরকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে আইডিগুলো থেকে ‘অ্যাডভাইজ’ পাঠানো হয়েছে, সেই আইডিগুলো কারা পরিচালনা করতেন? কিংবা অ্যাডভাইজ পাঠানোর পর যে কম্পিউটার থেকে পরে অনুমোদন দেয়া হয়, তা কাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল? যিনি ‘ডাটাবেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’ হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন, তিনি কি তার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন? সার্ভার কাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল? সেখানে ‘ফায়ার ওয়াল’ কেন ইনস্টল করা হয়নি? এটা কি শুধুই উদাসীনতা?

হ্যাকারদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী আজ এক ধরনের আতংক বিরাজ করছে। বাংলাদেশে এর আগেও আমরা দেখেছি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হ্যাক্ড হয়েছে। এ থেকে কি আমরা কিছুই শিখিনি? যদি বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের আইটি সেক্টরকে সুরক্ষা করতে বা রাখতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আইটি সেক্টরকে সুরক্ষায় রাখতে পারল না কেন? এটা শুধু এক ধরনের উদাসীনতা বলে আমার মনে হয় না। নিশ্চয়ই তদন্ত কমিটি বিষয়গুলো দেখবে এবং জাতিকে তা জানাবে। আমি চাই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ হিসেবে চিহ্নিত না করে তা প্রকাশ করা হবে। সেই সঙ্গে আমরা নিশ্চিত হতে চাই আমাদের রিজার্ভ আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না, পদত্যাগকারী গভর্নরের খুব কাছের কিছু লোক তাকে সামনে রেখেই সেখানে একটা বলয় তৈরি করেছিলেন। এরা নানা সুযোগ-সুবিধা নিতেন। বিদেশ ভ্রমণে ব্যস্ত থাকতেন বেশি। তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখতে পারে কতজন কর্মকর্তা গত কয়েক বছরে কতবার বিদেশ ভ্রমণে গেছেন। এ বিদেশ ভ্রমণে তারা কী ‘অভিজ্ঞতা’ অর্জন করেছেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনায় সেই অভিজ্ঞতা কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছেন? এদের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংক কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে, এটাও আমাদের জানা দরকার।

ড. আতিউরের জন্য আমার দুঃখ হয়। তিনি ভালো ছাত্র ছিলেন। কিন্তু ভালো ‘নেতা’ ছিলেন না। তার দুর্বল নেতৃত্বের কারণে অনেক ফাঁকফোকর তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাংলাদেশের জনগণের ৮০৮ কোটি টাকা যখন ‘হাওয়া’ হয়ে গেল, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘ঘুম’ যখন হারাম হয়ে গিয়েছিল, ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে তিনি নয়াদিল্লি যান কীভাবে? এটা সত্য, তিনি অনুমতি নিয়েই গিয়েছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় তাকে অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়কে ‘টাকা চুরির’ বিষয়টি অবহিত করেননি।

তিনি সজ্জন ব্যক্তি সন্দেহ নেই তাতে। ঘনিষ্ঠ অনেককেই তিনি সাহায্য করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে অনেক ভালো কাজ করেছেন, এটা সত্য। কিন্তু তিনি যখন বলেন, বীরের বেশে মাথা উঁচু করে বিদায় নিয়েছি, আমি চাই না আমার কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হোক- এটা ঠিক মানতে পারছি না। কেননা তিনি ‘বীরের বেশে’ যেতে পারেননি। কলংক মাথায় নিয়ে গেছেন। অতীতে কোনো গভর্নরকেই এভাবে যেতে হয়নি। কেউ এভাবে অভিযুক্তও হননি। আর দেশের ভাবমূর্তি? ৮০৮ কোটি টাকার চুরি ঠেকাতে ব্যর্থতার পরও তিনি যদি মনে করে থাকেন, তার কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি, তাহলে আর বলার কী আছে!

আমি দুঃখিত, যখন দেখি সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেল হলমার্ক, তখন তিনি নিশ্চুপ। বেসিক ব্যাংক থেকে যখন ৬ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেল, তখনও তাকে সোচ্চার হতে আমরা দেখিনি। অথচ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে আমরা প্রতিবাদী হতে দেখেছি। কিন্তু দেশের গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থা যখন তার হাতে, তখন স্বভাবতই মানুষ চেয়েছিল তিনি এ ব্যাপারে সোচ্চার হবেন। হননি। সাধারণ কৃষকদের জন্য ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করার উদ্যোগের কথা শুনেছি। তাতে কৃষক কি লাভবান হয়েছে? বর্গাচাষীদের ঋণের ব্যবস্থা কিংবা কারেন্সি মিউজিয়াম করা আর্থিক ব্যবস্থায় কি কোনো অবদান রেখেছে? সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে কমিয়ে আনা, কিংবা ব্যাংকিং সেক্টরকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি। বারবার সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তখন তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত।

অর্থমন্ত্রী একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে পদত্যাগী গভর্নরের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তার অবদান ছিল শূন্য। অর্থমন্ত্রী ওই সাক্ষাৎকারে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সেটা হল, গত অর্থবছরে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। তিনি এর কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যানকে। বলেছেন, এনবিআর চেয়ারম্যান কাজ করেন না। তিনি কেবল বক্তৃতা দেন। একজন অর্থমন্ত্রী যখন এনবিআর চেয়ারম্যান সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন, তখন সেই কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরির ঘটনা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। এক. আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। এ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের আরও মতামত নেয়া প্রয়োজন। তাদের দিয়ে আমাদের দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে যা ক্ষতি হয়ে গেছে, তা পুষিয়ে ওঠা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। আর যাতে ক্ষতি না হয় তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। দুই. প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশ যেহেতু আইসিটি খাতে যথেষ্ট উন্নতি করেছে, সেহেতু আন্তর্জাতিক হ্যাকারদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। এখানেই রয়েছে আসল কথাটি। আমরা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি। কিন্তু আমাদের আইসিটি সেক্টর সুরক্ষিত নয়। আমার ভয়টা এখানেই- হ্যাকাররা আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ‘গোপন ফাইল’ হাতিয়ে নিতে পারে। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা সেক্টর কতটুকু সুরক্ষিত আমি নিশ্চিত নই। পুরো সিস্টেমগুলো এখন খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সাহায্য-সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। তিন. আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের ব্যাপারে একটা অভিমত আমরা শুনেছি গত কয়েকদিনে। বলা হচ্ছে, এদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কারণ এরাও ‘তথ্য’ হাতিয়ে নিতে পারে। একটা অভিযোগ উঠেছে- বাংলাদেশ ব্যাংকে সার্ভার স্থাপন করা হয়েছিল ফিলিপিনো বিশেষজ্ঞদের দিয়ে। আর ফিলিপিনো হ্যাকাররাই এ বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করল। এদের মাঝে কোনো যোগসূত্র আছে কি-না তা তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখতে পারে। ইতিমধ্যে রাকেশ আস্তানা নামে এক ভারতীয় আমেরিকান বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আস্তানা আবার নিজের প্রতিষ্ঠান ফায়ার আইকে নিয়োগ দিয়েছেন। এখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন থাকবে আস্তানার সততা নিয়ে। তার কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি থাকা প্রয়োজন। চার. রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিলে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে- বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনা এর বড় প্রমাণ। সাবেক আমলা ফজলে কবীরকে নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কেউ অর্থনীতিবিদ হলেই যে ভালো গভর্নর হতে পারেন না, কলংক নিয়ে ড. আতিউরের বিদায় এর বড় প্রমাণ। সাবেক দুই আমলা ড. ফরাস উদ্দিন ও ড. সালেহউদ্দীন সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক চালিয়েছেন। কোনো সমস্যা হয়নি। এখন এক কঠিন সময়ে ফজলে কবীর দায়িত্ব নিলেন। তিনি যে দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন, এ জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। পাঁচ. অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে সিরিয়াস রিফর্ম প্রয়োজন। এ উপলব্ধিটুকু আরও আগে হলেই ভালো হতো। তবে দু’জন ডেপুটি গভর্নরকে অব্যাহতি এবং ব্যাংকিং সচিবকে ওএসডির বিষয়টি বিভ্রান্তি বাড়াতে পারে। দু’জন ডেপুটি গভর্নর যদি ‘দোষী’(?) হয়ে থাকেন, তাহলে বাকি দু’জনকে বাইরে রাখা হল কেন? অব্যাহতি পাওয়া দু’জন যদি ব্যর্থ হয়ে থাকেন, তাহলে বাকি দু’জনও ব্যর্থ। এ ক্ষেত্রে চারজনের মাঝে একটা বিভেদ রেখা টানা কোনো ভালো খবর নয়। অর্থমন্ত্রী যখন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে সংস্কার জরুরি, তখন পুরো সেটআপই পরিবর্তন প্রয়োজন। অন্যায় করলে শুধু গভর্নর এবং অব্যাহতি পাওয়া দু’জন ডেপুটি গভর্নরই করেননি। বাকি দু’জন ডেপুটি গভর্নরও একই অপরাধে অপরাধী। তাদের স্বপদে বহাল রাখা বিভ্রান্তি ছড়াবে মাত্র। আরও একটি কথা। অব্যাহতি পাওয়া একজন ডেপুটি গভর্নরকে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। মাত্র ৪ ঘণ্টার ব্যবধানে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কেন? যদি তাকে অব্যাহতি দিতে হয়, তাহলে তাকে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল কেন?

আরও একটি কথা। প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুততার সঙ্গে গভর্নরের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ব্যবহার করে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পার পেয়ে যান। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি এটা একটা ভালো দিক।

রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ৮০৮ কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এ টাকা আদৌ বাংলাদেশে ফিরে আসবে এমন আস্থা রাখতে পারছি না। কেননা এ টাকা আর ব্যাংকিং চ্যানেলে নেই। হ্যাকাররা পরিকল্পিতভাবেই এ টাকা ক্যাসিনোর মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। তদন্ত কমিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কতটুকু চিহ্নিত করতে পারবে জানি না। তবে সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে পুরো ঘটনাটা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারে। ফিলিপাইনের সিনেট যদি বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে পারে, তাহলে আমাদের জাতীয় সংসদ এ ব্যাপারে নিশ্চুপ কেন? এ ঘটনা একটি কালো অধ্যায়। অভিযুক্ত ব্যক্তি যেই হোক, তাদের বিচার হবে- এ প্রত্যাশা আমাদের সবার। Daily Jugantor 20.03. 2016