রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

ভারতের বিধান সভার নির্বাচন ও আমাদের শঙ্কার কারণ


ভিারতের পাঁচটি রাজ্যের বিধান সভার নির্বাচন হয়ে গেল। এ নির্বাচনে পশ্চিম বাংলায় মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল আসনে বিজয়ী হয়ে আরও পাঁচ বছরের জন্য থেকে গেল। আসামে বড় পরিবর্তন হয়েছে। সেখানে দীর্ঘদিনের কংগ্রেস শাসনের অবসান হয়েছে। বিজেপি বিজয়ী হয়ে সবাইকে অবাক করেছে। বিজেপি এখন সেখানে রাজ্য সরকার গঠন করবে। কেরালায় বামফ্রন্ট আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। তামিলনাড়–তেও ফিরে এসেছে জয়ললিতার নেতৃত্বাধীন এআইএডিএমকে দল। জয়ললিতা আবারও মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। আর পদুচেরিতে কংগ্রেস বিজয়ী হয়েছে। এ নির্বাচন কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ’র সরকার পরিচালনায় কোনো পরিবর্তন ডেকে আনবে না। তবে অনেকগুলো ‘মেসেজ’ অন্তত দিল। প্রথমত, বেশ কিছু দিন ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলো যেভাবে শক্তিশালী হচ্ছে, সে ট্রেন্ডই বজায় থাকল। পশ্চিম বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের বিশাল বিজয় (২০১১ সালের বিধান সভার নির্বাচনের চেয়ে আরও ৩০টি আসন বেশি এবার) নয়াদিল্লির ওপর মমতার ‘চাপ’ আরও বাড়বে। মোদি আরও বেশি করে উপলব্ধি করবেন যে, তার মমতাকে আরও বেশি প্রয়োজন রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আসামে বিজেপির বিজয় নিঃসন্দেহে নরেন্দ্র মোদির হাতকে আরও শক্তিশালী করবে। তৃতীয়ত, জাতীয় কংগ্রেসের ভারতব্যাপী যে গ্রহণযোগ্যতা তা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ‘রাহুল গান্ধী ম্যাজিক’ কোনো কাজ করছে না। এ মুহূর্তে ভারতের ২৯টি রাজ্যের মাঝে মাত্র ৫টিতে কংগ্রেস সরকারে আছে। ২০১৭-১৮ সময়সীমায় বিধান সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে মণিপুর, হিমাচল, কর্নাটক, মেঘালয় ও মিজোরামে। এসব রাজ্যে কংগ্রেস কী ফল করে, তা দেখার বিষয়। তবে সোনিয়া গান্ধীর ওপর চাপ বাড়ছে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে সামনে নিয়ে আসতে। রাহুলের চেয়ে প্রিয়াঙ্কা ‘ভোট ক্যাচার’। অনেকে এরই মধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন, প্রিয়াঙ্কার মাঝে একজন ‘ভাবি ইন্দিরা গান্ধী’ রয়েছে। কগ্রেস তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে প্রিয়াঙ্কাকে নেতৃত্বের গাড়িতে নিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ নির্বাচনের ফলাফলের বেশ গুরুত্ব রয়েছে। দুইটি কারণে এর গুরুত্ব বেড়েছে। এক. পশ্চিম বাংলায় মমতার আগামী পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় থেকে যাওয়া একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করল যে, এবার হয়তো মমতা তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে তার সম্মতি দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে আগামীতে একটি তিস্তা চুক্তি হতে পারে। দুই. আসামে বিজেপির বিজয় ও সেখানে সরকার গঠন আমাদের জন্য একটা দুশ্চিন্তার কারণ। যদিও মমতা ব্যানার্জি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা আমাদের আশাবাদী করলেও আসামের হবু মুখ্যমন্ত্রী যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা আমাদের জন্য অনেক চিন্তার কারণ। মমতা যেখানে বলেছেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ নেবেন, সেখানে আসামের হবু মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল বলেন ভিন্ন কথা। সোনোয়াল বিজয়ী হওয়ার পরপরই তথাকথিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী ২ বছরের মধ্যেই এ সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন, যা বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে। সোনোয়াল একথাও জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সীমান্তকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করার জন্য দুই বছরের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। তিনি এরই মাঝে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার কাজটি সম্পন্ন করবেন। তিনি আসামের প্রতিটি নাগরিককে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) আওতায় আনবেন বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাও আমাদের জন্য আরেক চিন্তার কারণ। এর ফলে মুসলমানরা শুধু শুধু টার্গেট এবং হেনস্তার শিকার হবেন। বলা ভালো, আসামের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৬৩ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। মমতা ব্যানার্জি সর্বানন্দ সোনোয়ালের মতো কোনো উসকানিমূলক বক্তব্য রাখেননি, এটা সত্য। কিন্তু এটাও সত্য, মমতা ব্যানার্জিকে বিশ্বাস করা যায় না। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে নীতিগতভাবে রাজি হলেও শুধু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে চুক্তিটি হয়নি। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় তিনি তার সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন। আগেও এসেছিলেন একবার। বলেছিলেন, তার ওপর আস্থা রাখতে। তখন সংবাদপত্রে বলা হয়েছিল, পশ্চিম বাংলায় বিধানসভার নির্বাচনের (উত্তরবঙ্গ) কারণে তিনি কোনো চুক্তিতে যেতে রাজি হচ্ছেন না। কেননা, এতে করে বিজেপি এটাকে ইস্যু বানিয়ে ফেলতে পারে। তাই নির্বাচনের পর প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের অনেকের কাছেÑ মমতা কী এখন রাজি হবেন একটি চুক্তি করতে? রুদ্র কমিশনের সুপারিশমালা তার কাছে আছে। এ কমিশনটি তিনিই করেছিলেন। অধ্যাপক কল্যাণ রুদ্র তার সুপারিশে উল্লেখ করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের চাহিদা মিটিয়েও বাংলাদেশকে তিস্তার ৫০ ভাগ পানি দেয়া সম্ভব। তিনি এমন মতামতও দিয়েছিলেন, ‘ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তি’ ব্যবহার করে তিস্তার পানি মজুদ করা যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রণব কুমারও তার সঙ্গে একমত হয়েছিলেন বলে কলকাতার পত্রিকাগুলো আমাদের জানিয়েছিল। তবে যতদূর জানা যায়, মমতা ব্যানার্জি রুদ্র কমিশনের ব্যাপারে খুশি ছিলেন না। যে কারণে রুদ্র কমিশনের রিপোর্টটি তিনি প্রকাশ করেননি। এখন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি রুদ্র কমিশনের সুপারিশকে বিবেচনায় নেবেন কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। তবে এটাও সত্য, তার কাছে পশ্চিম বাংলার স্বার্থ আগে। কেন্দ্র তাকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে যেতে পারবে না। এক্ষেত্রে তিনি মোদির সঙ্গে একটি ‘সমঝোতায়’ যেতে পারেন। যেমনটি একটি সমঝোতায় তিনি স্থল সীমান্ত চুক্তি সমর্থন করেছিলেন। রাজ্যসভায় তৃণমূল সমর্থন না করলে বিলটি পাস হতো না। কেন্দ্র থেকে তার আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতা দরকার। নরেন্দ্র মোদি এ আর্থিক সহযোগিতার বিষয়টিকে তার স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। মমতা ঢাকায় আসার ব্যাপারেও সেই মানসিকতা কাজ করেছিল। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল কানেকটিভিটির প্রশ্নটি। তিনি ভারতের এক অঞ্চলকে অন্য অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চেয়েছেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গÑ এ তিনটি রাজ্য এ প্রক্রিয়ায় জড়িত। মোদি এজন্যই চেয়েছিলেন, এ তিন রাজ্যের তিন মুখ্যমন্ত্রী ঢাকায় যাবেন। তাই মমতা এসেছিলেন। তিস্তা এখানে প্রাধান্য ছিল না। অনেক পরিকল্পনা মমতা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না, যদি না কেন্দ্র আর্থিকভাবে তাকে সাহায্য করে। তখন সামনে নির্বাচন ছিল। মমতা তাই ঝুঁকিটি নিতে চাননি। নির্বাচনের আগে কেন্দ্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই’র একটি চাপও ছিল মমতার ওপর। সারদা কেলেঙ্কারি, তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ওপর সিবিআই’র নজরদারি ছিল বেশি। ফলে এ ‘চাপ’কে অনেকটা নিউট্রাল করতে তিনি মোদির সঙ্গে ঢাকায় আসতে রাজি হয়েছিলেন, কোনো চুক্তি করতে নয়। এখন মমতা ব্যানার্জি পুনরায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে যোগ দিতেও পারেন! অমিত শাহের গলায় সেই সুর। এক সময় তিনি এ জোটে ছিলেন। কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী ছিলেন। আবার বেরিয়েও এসেছিলেন। এখন পশ্চিমবঙ্গে তার বিজয় নিশ্চিত হয়েছে এবং সব কেলেঙ্কারি থেকে ‘মুক্ত’ হতে তিনি যদি আবারও এনডিএ জোটে ফিরে যান, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই! তার ওপর আস্থা রাখা কঠিন। যতদূর জানা যায়, তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকায় আসেননি তার একটাই কারণ। আর তা হচ্ছে, মমতাকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র এককভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করতে চাচ্ছিল, যা মমতার মনঃপূত হয়নি। ভারতের সংবিধানে রাজ্য সরকারের কিছুটা অধিকার স্বীকৃত। রাজ্য সরকারকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র এককভাবে কোনো চুক্তি করতে পারে না। ঢাকা সফরের আগে মোদি তাকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি ঢাকায় তিস্তার ব্যাপারে কোনো চুক্তি করবেন না এবং তিস্তার ব্যাপারে ঢাকার সঙ্গে কোনো কথা হবে না। যদি কথা বলতেই হয়, এ ব্যাপারে মমতাই কথা বলবেন। মমতা কথা বলেছিলেন। কূটনৈতিক ভাষায় বলেছিলেন তার ওপর আস্থা রাখতে। বাংলাদেশের মানুষ আস্থা রেখেছিল। এখন নির্বাচন শেষ হয়েছে এবং মমতা বিজয়ী হয়েছেন। তিনি আগামী ৫ বছরের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছেন। বিহারে নীতিশ কুমারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে (বিহারের রাজধানী পাটনায়) তিনি যোগ দিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন একটা মহাজোট গঠনের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তার কোনো সহাবস্থান হয়নি। জাতীয় কংগ্রেস ঐক্য করেছিল বামফ্রন্টের সঙ্গে। তার জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্য না করা কেন্দ্রে মোদি সরকারকে খুশি করে থাকবে। ফলে মমতা যদি না চান, তাহলে তিস্তার পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে মোদি সরকার তাকে চাপ দেবে না। আমাদের জন্য তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের অধিকার স্বীকৃত। ভারত (এক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলা) পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিতে পারে না। পশ্চিম বাংলা তাই করছে। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পানিশূন্য হচ্ছে। উল্লেখ্য, তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারীÑ এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত তিস্তার পানি প্রবাহের পরিমাণ বা কোন জায়গায় পানি ভাগাভাগি হবে, এরকম কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারত সেই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে উল্টো তিস্তার কমান্ড এরিয়া তাদের বেশি, এ দাবি তুলে বাংলাদেশ তিস্তার পানির সমানভাগ পেতে পারে নাÑ এ দাবি উপস্থাপন করেছিল। এরপর আর তিস্তার পানি বণ্টনের জট খোলেনি। এখানে বলা ভালো, বাংলাদেশ উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট ও বগুড়া জেলার ৩৫টি উপজেলায় তিস্তা সেচ প্রকল্প থেকে বর্ষা মৌসুমে সম্পূরক ও শুষ্ক মৌসুমে সেচ দেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৭৯ সালের আগস্টে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের প্রথম ফেজ কাজের উদ্বোধন করে। এরপর ভারত ১৯৮৫ সালে তিস্তার উৎসমুখে এবং তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের মাত্র ৬৫ কিলোমিটার উজানে গজলডোবা নামক স্থানে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ করে। এর ফলে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পটি সেচ প্রদানে অকার্যকর হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই তিস্তার পানিবণ্টনের দাবি করলেও শুধু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে এ চুক্তিটি হয়নি। এখন তিস্তার সঙ্গে যোগ হলো আসামে সীমান্ত ‘সিল’ করে দেয়ার ঘোষণা। দুইটি বিষয়ই আমাদের জন্য স্পর্শকাতর। এক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। এ সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের অনেক ‘দাবি’ মেনে নিয়েছে। এখন যদি তিস্তার পানি চুক্তি না হয়, যদি আসামে মুসলমানরা নিগৃহীত হন, তাহলে তা দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি ঘটাতে বাধ্য।
Daily Alokito Bangladesh
29.05.16

ইউরোপীয় ইউনিয়নের বক্তব্য ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা


 
গত ২২ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ঢাকায় একটি বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি হত্যাকা- ও তথাকথিত আইএস বা ইসলামিক স্টেটের এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার দাবির আলোকেই এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করলে কতগুলো বক্তব্য পাওয়া যায়, যা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার প্রায় একই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের শেষে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুও যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানে অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেখানে বলেছেন সাম্প্রতিক সময়ে যেসব হত্যাকা- সংগঠিত হয়েছে, তার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী জড়িত এবং বিএনপি এসব হত্যাকারীদের শেল্টার দিয়েছে। অন্যদিকে শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, দেশে অতি সম্প্রতি যে ৩৭টি হত্যাকা- সংগঠিত হয়েছে_ তার ২৫টির সঙ্গে জেএমবি জড়িত। আর বাকি ৮টির সঙ্গে আনসারউল্লাহ বাংলা টিম ও ৪টির সঙ্গে অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন জড়িত। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর ইইউর পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেয়া হয়, তাতে বলা হয় এসব হত্যাকা- দেশের মানুষের মানবাধিকার ও বাক-স্বাধীনতার জন্য হুমকি। ইইউ মনে করে বিশ্বে সহনশীল ও মুক্তচর্চার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম এতে করে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এসব হত্যাকা-ের কারণে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও ইইউর বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়। ইইউ অনেক দিন ধরেই বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা ও হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার দাবি করে আসছে। তারা গণতান্ত্রিক আচরণ নিশ্চিত ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে।
হঠাৎ করেই যেন বাংলাদেশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলো। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের তথাকথিত উত্থান নিয়ে দুজন মার্কিন মন্ত্রী ঘুরে গেছেন। এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিবও। বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সরকার উৎখাতের জন্য_ এমন খবরও পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে বলেছেন, মোসাদ বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। এই বিষয়গুলো খুবই স্পর্শকাতর। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোসাদের জড়িত থাকার বিষয়টি। অতীতে এরকমটি তেমন শোনা যায়নি। আদর্শগতভাবে মোসাদ আর বিএনপি দুই বিপরীত অবস্থানে থাকলেও, এখন সরকার উৎখাতে বিএনপি-মোসাদ সমঝোতা রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
বাংলাদেশে মোসাদ বিতর্ক এখন তুঙ্গে। বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী মোসাদ কানেকশনে বিতর্কিত হয়ে এখন পুলিশ রিমান্ডে। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ তিনি মোসাদ এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে ভারতের আগ্রায় 'গোপন বৈঠক' করেছেন। উদ্দেশ্য বাংলাদেশ সরকারকে উৎখাত করা। বিষয়টি রাজনীতিতে ভালো উত্তাপ ছড়িয়েছে। এই ঘটনাটি ঘটল এমন এক সময় যখন বাংলাদেশকে নিয়ে বহির্বিশ্বে 'ষড়যন্ত্র' হচ্ছে। বাংলাদেশে তথাকথিত আইএসের উত্থানকে কেন্দ্র করে একাধিক মার্কিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসেছেন এবং তাদের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। ঢাকা ঘুরে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিবও। তিনিও জানিয়ে গেলেন ভারত সরকারের উদ্বেগের কথা। আর সর্বশেষ খবরে কলকাতার একটি জনপ্রিয় পত্রিকা আমাদের জানাচ্ছে যে আইএস সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে! এই সংবাদের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, তা আমাদের দেশের গোয়েন্দারা ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা যে অবাস্তব একটি বিষয়, সেটা সবাই স্বীকার করবেন। কেননা বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এভাবে কোনো জঙ্গিগাষ্ঠী একটি রাষ্ট্রকে আক্রমণ করতে পারে না। এ ছাড়া যেখানে আইএসের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে, সেখানে এ ধরনের 'পরিকল্পনা' অর্থহীন। তবে বাংলাদেশে মোসাদ কানেকশনের বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। এটি আরো গুরুত্ব পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কারণে। প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে বাংলাদেশিদের এক সভায় এই বিষয়টির অবতারণা করেছেন।
একজন ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যের সঙ্গে বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিবের 'বৈঠক', নিঃসন্দেহে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেবে। ইসরাইলের সঙ্গে আমাদের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। আর এটা বিবেচনা করেই ইসরাইলের সঙ্গে কখনো কোনো পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়নি বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসরাইলিদের সহযোগিতা বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছিল। যদিও এটা সত্য, ইসরাইল দীর্ঘদিন চেষ্টা করে আসছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি আদায় করতে। বেশকিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভাগের একজন শিক্ষক একটি প্রসঙ্গে ইসরাইলকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। ওই সময় কম বিতর্ক হয়নি। এরপর থেকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ইসরাইলি নেতাদের সঙ্গে যে কোনো ধরনের সম্পর্ক পরিহার করে আসছে বাংলাদেশ। তাহলে আসলাম চৌধুরী কীভাবে মেন্দি এন সাফারির সঙ্গে বৈঠক করেন? জনাব চৌধুরী একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বটে; কিন্তু তিনি বিএনপিকে একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি দলের সিনিয়র নেতা। এটা কি শুধু 'একটি ভুল'? তিনি কি কোনো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার জালে আটকা পড়েছিলেন? ঘটনা যাই ঘটে থাকুক না কেন, বিএনপির এক সংকটকালিন সময়ে তিনি নিজ দলের অনেক ক্ষতি করেছেন। তিনি এখন পুলিশ রিমান্ডে আছেন। তাতে করে তার দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে না। তিনি 'সব দায়-দায়িত্ব মাথায় নিয়ে' পদত্যাগ করতে পারতেন। অথবা দলের চেয়ারপারসন 'শৃঙ্খলা ভঙ্গের' অপরাধে দলের যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে তাকে অপসারণ করতে পারতেন। এটা দলের জন্য মঙ্গল ছিল। কিন্তু তা হয়নি।
বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় যখন নানা চাপের মুখে আছে, তখন উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা। একজন আনসার কমান্ডারকে খুন করা হলো। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে এটা ডাকাতির ঘটনা। আসলেই কি এটা ডাকাতি ছিল? আমি নিশ্চিত নই। বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ, বসবাস, নানা রকম কর্মকা-, আমাদের জন্য নানা সংকট সৃষ্টি ক েছে। এদের কেউ কেউ বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তবে ভয়টা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিকাশ ঘটাচ্ছে। পাঠক নিশ্চয়ই রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) কথা স্মরণ করতে পারেন। ঝড়ঁঃয অংরধ ঞবৎৎড়ৎরংস ঢ়ড়ৎঃধষ এ বার্টিল লিনটনারের (ইবৎঃরষ খরহঃহবৎ) একটি প্রবন্ধ আছে। অনলাইনে পাঠক এটা পড়ে দেখতে পারেন। লিনটনার বলার চেষ্টা করেছেন যে আরএসওর অনেক জঙ্গি আফগানিস্তানের খোসত প্রদেশে ট্রেনিং নিয়েছেন। ট্রেনিং শেষ করে তাদের এই অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে। উদ্দেশ্য নাশকতামূলক ও জঙ্গি তৎপরতা বাড়ানো। একটি আন্তর্জাতিক চক্র এই রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে। এরা রোহিঙ্গাদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র চায়। অর্থাৎ রাখাইন স্টেট তারা 'স্বাধীন করতে চায়। গহিন অরণ্যে ট্রেনিং হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন সূত্র থেকে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। এরা পুরো ও অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফায়দা তুলতে চায়। তাই আনসার কমান্ডারের হত্যাকা-কে আমি শুধু ডাকাতি হিসেবে ভাবতে পারছি না। এটা রোগিঙ্গা জঙ্গিদের কাজ। এ ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা হচ্ছে আমরা রোহিঙ্গা সমস্যাকে আন্তর্জাতিক দরবারে নিয়ে যেতে পারিনি। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় যারা রেজিস্টার্ড নন এবং মিয়ানমার এদের স্বীকারও করে না। ফলে এদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কাজটিও সহজ নয়। প্রচ- মুসলমান বিদ্বেষী অং সান সু চি এদের ব্যাপারে নির্বিকার। আমার মনে হয় খুব দ্রুত উখিয়ার গহিন অরণ্যে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জঙ্গিদের উৎখাতের জন্য সেখানে সেনাবাহিনী পাঠানো উচিত। এবং সেনা মোতায়েন করাও জরুরি। নতুবা এই জঙ্গিরা কিছু বৈদেশিক শক্তির সহযোগিতায় এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এতে বিঘি্নত হতে পারে।
আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভক্তি আর বিভেদ বাড়ছে। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার, তা নেই। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছে। আর এতে সুযোগ নিচ্ছে বাইরের শক্তিগুলো। বাংলাদেশে 'মোসাদ কানেকশন'-এর বিষয়টি এমনই। কিংবা জঙ্গি উত্থানের যে কথা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে এই 'অনাস্থা'র সম্পর্কটি। দুটি বড় দলের মধ্যে যদি 'ঐক্য' থাকত, তাহলে বাইরের কোনো শক্তিই আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাতে পারত না। আজ আসলাম চৌধুরীর মতো একজন নেতার পক্ষে বিএনপির নেতারা যত ছাপাই গান না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে তিনি দল ও সেই সঙ্গে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মান-সম্মানও ক্ষুণ্ন করেছেন। আসলাম চৌধুরী দলের শীর্ষপদ পেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের অবদান কী, তা জানেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তিনি কি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কোনো বইপুস্তক পড়েননি? জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিলেন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জিয়া মনে করতেন বাংলাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্রিজস্বরূপ। জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশকে মুসলিম বিশ্বের নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশকে তিনি ইসলামিক বিশ্বে ব্যাপকভাবে পরিচিত করেছিলেন। তখন থেকেই মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশকে চিনতে শুরু করেছিল। জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করেছিল। সুতরাং তার গড়া বিএনপি কী করে ইসরাইলের সঙ্গে 'ষড়যন্ত্র' করে? আসলাম চৌধুরী আজ অভিযুক্ত। টিভি প্রতিবেদনে দেখলাম তিনি সাংবাদিকদের 'ভি' চিহ্ন দেখাচ্ছেন। এর অর্থ কী? তিনি বিজয়ী হয়েছেন, এটা তিনি বোঝাতে চান! কীভাবে তিনি বিজয়ী হয়েছেন আমি বুঝতে অক্ষম।
বাংলাদেশে বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভক্তি আর আস্থার অভাবের সুযোগ নিতে পারে ইসরাইল। ইসরাইল আসলাম চৌধুরীকে দীর্ঘদিন ধরেই 'ফ্রেম' করেছিল, এটাও আমার বিশ্বাস। আজ যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোসাদের 'ষড়যন্ত্র' নিয়ে কথা বলেন, আমি তাতে অবাক হইনি। এই 'ষড়যন্ত্র' নস্যাৎ করতে তাই প্রয়োজন দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব দলের মধ্যে আস্থার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। ইইউর বক্তব্যেও ফুটে উঠেছে এ কথাটি। ইইউ 'গণতান্ত্রিক আচরণ নিশ্চিত' করার যে আহ্বান জানিয়েছে, এর মধ্যদিয়ে সেই 'আশ্বাস আর বিশ্বাস' স্থাপনের কথাটাই বলতে চেয়েছে। তাই জঙ্গি উত্থান কিংবা মোসাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে দুটি বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
Daily Jai jai Din28.05.16

ভারতের পানি রাজনীতির অবসান হোক

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের প্রশ্নটি অন্যতম একটি ফ্যাক্টর। দু’দেশের মধ্য দিয়ে ৫৪টি নদী প্রবাহিত হলেও শুধু একটি নদীর অর্থাৎ গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি হলেও বাকি নদীগুলোর পানি বণ্টনের ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে অতীতে একটি চুক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই। এই যখন পরিস্থিতি তখন ভারত থেকে আসছে নানা উদ্বেগজনক সংবাদ। এই সংবাদগুলো আমাদের শুধু উদ্বিগ্নই করেনি, আমাদের নানা ‘প্রশ্নের’ মাঝেও ফেলে দিয়েছে। এ সংবাদগুলো আসছে এমন এক সময় যখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন এক উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারত যদি ইতিবাচক সাড়া না দেয়, তাহলে তা দু’দেশের সম্পর্ককে প্রশ্নের মাঝে ফেলে দেবে। এতে করে যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হবে, তা থেকে সুবিধা নেবে ‘তৃতীয় পক্ষ’।

অনেকগুলো উদ্বেগজনক খবর আমরা সম্প্রতি পেয়েছি- এক. গত ১৬ মে ভারতের পানি সম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় ৩০টি লিংক ক্যানালের মাধ্যমে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি সরিয়ে নেয়া হবে। দুই. গত ১০ মে (২০১৬) ফারাক্কা পয়েন্টে বাংলাদেশ মাত্র ১৬ হাজার কিউসেক পানি পেয়েছে। গত বছর এ সময় পানির প্রবাহ ছিল ৬৭ হাজার কিউসেক (সকালের খবর, ১৬ মে ২০১৬)। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এটা বাংলাদেশের সর্বনিু পানিপ্রাপ্তি। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী নভেম্বর (২০১৫) থেকেই পদ্মায় পানি নেই। যার ফলে সংকটে রয়েছে ২১ জেলার ১২০টি নদী। তিন. তিস্তার পানি বণ্টনের প্রশ্নে যখন একটি অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তখনই ভারত গ্রীধারি নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করছে। ভারত থেকে নেমে আসা এ নদী ধরলার সঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এখন বাঁধ দেয়ার ফলে শুষ্ক মৌসুমে ধরলায় ভয়াবহ নাব্য সংকট দেখা দেবে। ধরলা পরিণত হবে মরা গাঙে। আর বর্ষায় দেখা দেবে ব্যাপক ভাঙন। গ্রীধারি নদী ভারতে উৎপত্তি হয়ে লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের নামমাটারি এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। নদীটি আনুমানিক সাড়ে চার কিলোমিটার বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লালমনিরহাট জেলার কুঠিবাড়ি দিয়ে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করে। প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে এটি ধরলা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। অতীতে শতবর্ষের এই ধরলায় ছিল স্বাভাবিক পানি প্রবাহ। এবার এই নদীর পানি শুকিয়ে ধুঁ ধুঁ বালুচরে পরিণত হয়েছে (সমকাল, ২২ মে)।

এই তিনটি উদ্বেগজনক খবরের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও অনেক ইস্যু। ক. টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে। ভারত বারবার বলে আসছে, টিপাইমুখে এমন কিছু করা হবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। এ ধরনের কথা ভারত আন্তঃনদী সংযোগের ক্ষেত্রেও বলেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে ভারত এই প্রকল্পে হাত দিয়েছে। ফলে আশংকাটা হচ্ছে, ভারত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়েও এগিয়ে যাবে। খ. মমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফরের আগে তিনি কলকাতার একটি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছিলেন, বাংলাদেশ আত্রাই নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে! স্পষ্টতই মমতা তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ার জন্যই আত্রাই প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। এখন মমতা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। ফলে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে শংকা থাকলই।

আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প সংক্রান্ত খবর নতুন নয়। গেল বছর বাংলাদেশ একটি ‘নোট ভারবাল’ও পাঠিয়েছিল। ওই নোটে বাংলাদেশের ভয়াবহ ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিশেষ কমিটির পঞ্চম বৈঠকে মানস-সংকোস-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগের মাধ্যমে দক্ষিণে পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে (সকালের খবর, ২৩ জুলাই ’১৫)। শুধু সরকারের পক্ষ থেকে নয়, বরং তখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই ইস্যুতে (ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প) সরকারকে বিএনপি সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত। আন্তঃনদী সংযোগ ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে দেনদরবারে বিএনপি সরকারকে ‘ব্লাইন্ড সাপোর্ট’ দেবে বলেও বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। ধারণা করছি, বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনও এই ইস্যুতে সরকারের

পাশে থাকবে।

তবে বিষয়টি ভারত সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত কি-না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। যদিও ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতীর নাম উল্লেখ করে সংবাদটি প্রচারিত হয়েছে, তারপরও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাখ্যা এতে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ সরকারের উচিত অতি দ্রুত বিষয়টির ব্যাপারে ভারত সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া। সাধারণত ‘নোট ভারবাল’ একটি রুটিন ওয়ার্ক। এটা কোনো প্রতিবাদ নয়। ভারত যদি সত্যি সত্যি এ প্রকল্প কার্যকর করে, তাহলে তা হবে মোদির ঢাকা সফরের সময় যে ৬৫ দফা যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার বরখেলাপ। কারণ ৬৫ দফা সংবলিত যৌথ ঘোষণাপত্রের ২১নং দফায় বলা হয়েছে- ‘হিমালয় অঞ্চলের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে না নেয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।’ এখন ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতীর বক্তব্য কিংবা ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিশেষ কমিটির পঞ্চম বৈঠকের সিদ্ধান্তটি কি যৌথ ঘোষণার ২১নং দফার পরিপন্থী নয়? সুতরাং বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

এখানে বলা ভালো, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি মূলত আজকের নয়। এই প্রকল্প নিয়ে খোদ ভারতেই বিতর্ক রয়েছে। এই বিশাল নদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে ভারতের অভ্যন্তরে ৩০টি নদীকে ৯ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি খালের মাধ্যমে সংযোগ প্রদান করে ১৫০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করার জন্য। প্রকল্পটির মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গায়। সেখান থেকে তা নিয়ে যাওয়া হবে মহানন্দা ও কাবেরীতে। গোদাবরির পানি নিয়ে যাওয়া হবে কৃষ্ণায় এবং সেখান থেকে পেনার ও কাবেরীতে। নর্মদার পানি নিয়ে যাওয়া হবে সবরমতিতে। এই বিশাল আন্তঃঅববাহিকা পানি প্রত্যাহার প্রকল্প সম্পন্ন করার কথা ২০১৬ সালের মধ্যে। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকারকে এ প্রকল্প একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার পরামর্শ প্রদান করেছিল (আগে নির্ধারিত ৪৫ বছরের পরিবর্তে ১০ বছরের মধ্যে)। কিন্তু ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এই সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে যে, গঙ্গা-কাবেরী সংযোগ প্রকল্প কোনো নতুন ধারণা নয়। এ প্রকল্প কৌশলগতভাবে অগ্রহণযোগ্য ও অবাস্তব হওয়ায় আগেই বেশ কয়েকবার পরিত্যক্ত হয়েছিল। এ কাজের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, ভারত সরকারের এই প্রকল্প তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর জন্য কী ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে, তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। একই সঙ্গে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য আন্তর্জাতিক আইনের স্বীকৃত সব রীতিনীতির প্রতি নিদারুণ উদাসীনতা প্রদর্শন করা হয়েছে।

এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা রয়েছে। তাছাড়া এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থার ভয়াবহ প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের যেসব ক্ষতি হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এভাবে- ১. বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বর্তমানে পাওয়া প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের যে পানি থাকার কথা, তা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে। ২. বাংলাদেশের মিঠা পানির শতকরা ৮৫ ভাগের উৎস হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা। ব্রহ্মপুত্র থেকেই শতকরা ৬৫ ভাগ পানি পায় বাংলাদেশ। এ প্রকল্পের কারণে এই পানিপ্রাপ্তি বিঘ্নিত হতে পারে। ৩. ভারতের পানি প্রত্যাহারের ফলে ভূউপরিস্থ পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে আর্সেনিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। ৪. মিঠা পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় মৎস্য উৎপাদন কমে যাবে এবং জল পরিবহন ব্যাহত হবে। ৫. পানির অভাবে কৃষি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আন্তঃনদী সংযোগ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ যখন বাড়ছে, তখন তিস্তার পানি বণ্টনের প্রশ্নটিও আমাদের জন্য আরেক চিন্তার কারণ। এটিও ঝুলে আছে।

তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনায় নেবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন’কে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানি সম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই ‘যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিটি’ উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ কনভেনশন’ নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না।

আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমি বিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ- প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহের সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।

তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মাঝে রয়েছে। আমরা চাই এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান। এ ক্ষেত্রে প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, মোদি সরকার একটি চুক্তিতে যেতে চায়। ইতিমধ্যে স্থলসীমানা চুক্তিতে সম্মতি দিয়ে মমতা ব্যানার্জি ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। এখন তিস্তার ব্যাপারেও তিনি এমনটি করতে পারেন। এটা কঠিন নয়। তিনি যদি সত্যিই আন্তরিক হন, তাহলে তিনি কল্যাণ রুদ্র কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি নিজে এই কমিশন গঠন করেছিলেন। কলকাতার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রুদ্র কমিশন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দেয়া রিপোর্টে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গকে ক্ষতি না করেও বাংলাদেশকে শতকরা ৫০ ভাগ পানি দেয়া সম্ভব। তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন আরেকজন পানি বিশেষজ্ঞ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক প্রণব কুমার রায়। অধ্যাপক রায়ের অভিমত হচ্ছে, তিস্তায় পানি নেই এ কথাটা ঠিক নয়। পানি মজুদ রেখে (বর্ষা মৌসুমে) ও ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জির বিজয় যখন নিশ্চিত হয়েছে, তখন সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি ওঠে তা হচ্ছে, যে ‘আস্থা ও বিশ্বাস রাখার’ কথা তিনি ঢাকায় বলে গিয়েছিলেন, তা তিনি রাখবেন কি-না? চতুর মমতা তিস্তা চুক্তি না করে উত্তরবঙ্গে তার আসন বাড়িয়েছেন। আগেরবার তার আসন কম ছিল। তিস্তা চুক্তি নিয়ে উত্তরবঙ্গের মানুষের আপত্তি আছে। তিনি শুধু ভোটের রাজনীতি বিবেচনা করেই ঢাকায় এসেও তিস্তা চুক্তিতে সম্মতি দেননি। এখন ভোট শেষ। ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। এখন একটি ‘প্যাকেজ ডিলে’ তিনি যেতে পারেন, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের বড় ধরনের আর্থিক সহযোগিতার বিনিময়ে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি ‘গ্রিন সিগনাল’ দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে তিস্তায় পানি বণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি হলেও তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, সেটাই বড়

প্রশ্ন এখন।

এটা সত্য, ভারতে বড় ধরনের পানি সংকট চলছে। পানির অভাবে সেখানে কৃষকের আত্মহত্যার খবরও পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালু করতে পারে না। কিংবা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না করে বাংলাদেশকে পানিশূন্য করতে পারে না। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক আহ্বান অতি জরুরি। গেল বছর ‘নোট ভারবাল’ পাঠিয়েও বাংলাদেশ কোনো ‘উত্তর’ পায়নি। বাংলাদেশ শুধু ভারতের আশ্বাসের ওপর বসে থাকতে পারে না। Daily Jugantor 27.05.16

মমতার বিজয় ও তিস্তার পানি চুক্তির ভবিষ্যৎ

২৭ মে ২০১৬ তারিখ মমতা ব্যানার্জি পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নিতে যাচ্ছেন। গত ৪ এপ্রিল পশ্চিম বাংলার বিধান সভায় নির্বাচন শুরু হয়ে শেষ হয় ৫ মে। ১৯ মে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ফলাফলে দেখা যায় বিপুল ভোটে পশ্চিম বাংলার মানুষ মমতার তৃণমূল কংগ্রেসকে বিজয়ী করেছে। বিপুল ভোটে তার এই বিজয় (২৯৪ আসনের ২১১টিতে তার দল জয়ী), কেন্দ্রের সঙ্গে ‘হিসেব-নিকেশ’ ইত্যাদি বিষয়ে তার অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে। ইতোমধ্যে বিজেপি সভাপতি তাকে পুনরায় এনডিএ জোটে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বাংলাদেশের জন্য তার এই বিজয়ের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে তার সম্মতি একটি বড় ফ্যাক্টর। এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মমতার সম্মতি ছাড়া কোনো চুক্তিতে যেতে পারবে না। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি দু’ দুবার বাংলাদেশে এসেছেন। একবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আর দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। কিন্তু প্রতিবারই তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে তিনি আমাদের হতাশ করেছেন। এমনকি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে তিনি অযাচিতভাবে পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিস্তায় বেশি পানি দাবি করেছিলেন। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের মানুষ তার ওপর আস্থা রেখেছিল। ঢাকায় এসে তিনি বলেছিলেন, তিনি ‘কাঠবিড়াল হয়ে সেতুবন্ধনের’ মতো কাজ করে যেতে চান। অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারতের মাঝে এক ধরনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে চান। কিন্তু তিনি কি তা করেছেন? না, করেননি। ঢাকায় দ্বিতীয়বারের মতো আসার আগে তিনি বলেছিলেন নতুন এক কথা আত্রাই নদীতে বাংলাদেশ বাঁধ দিয়েছে। আর তাতে পশ্চিমবঙ্গ কম পানি পাচ্ছে! তিনি জানেন রাজনীতিকে কিভাবে জটিল করতে হয়। যেখানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চাচ্ছে তিস্তার ব্যাপারে একটি সমঝোতা, সেখানে ‘আত্রাই প্রসঙ্গ’ নতুন করে উত্থাপন করে কৌশলী মমতা চাচ্ছেন তিস্তার প্রসঙ্গটি ‘ডিপ ফ্রিজ’-এ পাঠাতে। এটাই তার কৌশল। তিনি তিস্তায় পানি দেবেন না, যাতে করে বাংলাদেশ-ভারতের মাঝে যে সম্পর্কের ‘নয়া অধ্যায়’-এর সূচনা হয়েছে তা একটি প্রশ্নের মধ্যে থাকুক! বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কারণে পশ্চিম বাংলায় বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়–ক, এটা মমতা কখনো চাননি। পশ্চিম বাংলার উত্তরাঞ্চলে (তিস্তার পানির ওপর যারা নির্ভরশীল) তার জনপ্রিয়তা তলানিতে ছিল। ‘ভোটের হিসাবে’ তিনি তাই চাননি তিস্তার পানি বণ্টন হোক। তিনি দেখাতে চেয়েছেন তিনিই প্রকৃত বাংলাদেশের বন্ধু। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘হাসিনা দিদি’ হিসেবে সম্বোধন করে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন তিনি আন্তরিক! প্রটোকল তার কাছে মুখ্য ছিল না, ছিল গৌণ। একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে যে এভাবে প্রকাশ্যে ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করা যায় না, মমতা ব্যানার্জির বিবেচনায় এটা আসেনি। সেবার তার জন্য গণভবনে দুপুরের খাবারেরও আয়োজন করা হয়েছিল। ১২ পদের খাবারের তালিকায় ইলিশ ছিল ৩ পদের। সবাই জানেন বাংলাদেশের ইলিশের প্রতি মমতার বিশেষ টান আছে। আগে মমতা যখন দিল্লিতে রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে যারাই মমতার বিজয় ও তিস্তার পানি চুক্তির ভবিষ্যৎনয়াদিল্লি গেছেন (বিশেষ করে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী), তারা অবধারিতভাবেই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘পদ্মার ইলিশ।’ তাই ইলিশ প্রসঙ্গ এসেছিল (আপাতত রফতানি বন্ধ)। মমতার সফরে কিন্তু সারা জাতি ও মিডিয়া তখন তাকিয়ে ছিল মমতা তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তার অনাপত্তির কথা জানিয়ে যাবেন। কেননা তিস্তায় পানি বণ্টনের সমস্যা একটাই আর তা হচ্ছে মমতা। মমতার আপত্তির মুখে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এমনকি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখনো মমতার আসার কথা ছিল। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যের কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী আসলেও শেষ মুহূর্তে মমতা তার আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। ফলে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি আর হয়নি। এরপর অনেক সময় পেরিয় গেছে। কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে মমতার দৃষ্টিভঙ্গির কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর তিনি দু’ দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন এ কথাটা। এর আগে ভারতীয় হাইকমিশন কর্তৃক আয়োজিত ‘বৈঠকি বাংলা’য়ও মমতা নিজেই বলেছিলেন তার ওপর ‘আস্থা’ রাখতে! স্থল সীমানা চুক্তি নিয়ে তার আপত্তি নেইÑএটা অবশ্য তিনি প্রমাণ করেছেন। ঢাকাতেও এ কথাটা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন মমতা। কিন্তু তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তার ‘কমিটমেন্ট’ কোথায়? সোজা সাপটা হিসাব হচ্ছে তিনি ঢাকায় এসে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে কোনো ‘কমিটমেন্ট’ করে যাননি। তিস্তার পানির ব্যাপারে তার স্বার্থ অনেক বেশি। এখন সেখানে বিধানসভার নির্বাচন শেষ। এটাকে তিনি বিজেপির হাতে তুলে দিতে চাননি। উত্তরবঙ্গে পানির চাহিদা বেশি। মমতা এটা জানেন ও বোঝেন। বলা ভালো, ১৯ ফেব্রুয়ারি (২০১৪) পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ঢাকা সফরের প্রাক্কালে তিস্তায় পানির সর্বনি¤œ প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছিল। এটা কাকতলীয় কি না জানি না। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ক’টি বিষয় অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল তার মাঝে তিস্তার পানি বন্টন অন্যতম। এ ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একটা আগ্রহ থাকলেও শুধুমাত্র মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। সেই মমতা ব্যানার্জিই এখন আবার ক্ষমতায় এলেন। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তার ঢাকা আসার কথা থাকলেও তিনি আসেননি। তিস্তায় পানি বণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেক বেশি। গত ৬ ফেব্রুয়ারি (২০১৫) সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ওই মাসের প্রথম ৫ দিনে তিস্তায় পানি প্রবাহ ছিল ৫০০ কিউসিকের নিচে। সেচ প্রকল্পের পানি দেযা দূরের কথা, শুধু নদী বাঁচানোর জন্যই দরকার এক হাজার কিউসেক। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা আজ মৃত্যুমুখে। গত নভেম্বর থেকেই তিস্তায় পানি প্রবাহ কমতে থাকে। বাংলাদেশের লালমনিরহাটের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীতে ইতিহাসের সবচেয়ে কম পানি প্রবাহ রেকর্ড হয়। ফেব্রুয়ারি (২০১৫) মাসের প্রথম চার দিনের হিসাবে দেখা গেছে, প্রথম দিন পাওয়া গেছে ৪২৬ কিউসেক, দ্বিতীয় দিন ৪৭৫ কিউসেক, তৃতীয় দিন ৪৪৫ কিউসেক, আর চতুর্থ দিন ৪১৬ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয় (সকালের খবর, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। যৌথ নদী কমিশন সূত্র জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ শুরুর আগে ১৯৭৩-৮৫ সময়কালে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি প্রবাহ ভালো ছিল বলে তুলনার জন্য এই সময়কালের হিসাবকে ঐতিহাসিক গড় প্রবাহ ধরা হয়। ওই ১২ বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম ১০ দিনে পানি প্রবাহ ছিল ৫৯৮৬ কিউসেক। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে আসে ৯৬৩ কিউসেকে। এরপর তা নেমে যায় ৫০০ কিউসেকের নিচে। অথচ নদী রক্ষার জন্যই দরকার ১ হাজার কিউসেক পানি। আর বিদ্যমান সেচ প্রকল্পের মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি ‘নোট ভারবাল’ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। মমতা ব্যানার্জির প্রথম ঢাকা সফরের আগে আমরা অনেক প্রত্যাশার কথা শুনেছি। তবে এটা সত্য, তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে এটা সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতি নির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হাল্কাভাবে দেখেন তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ খুব বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে করে বাড়বে। মনে রাখতে হবে তিস্তায় পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি বা সমর্থন এটা বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খাড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্দা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দু দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনের শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত ও ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু’ দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয়েছিল মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই অতীতে মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরো একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানি বণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে ক্রমেই। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা বরাবরই মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু।’ সুতরাং মমতা তিস্তা চুক্তি করে বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করবেন এটা আমার কখনই বিশ্বাস হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমাদের যা করণীয় তা হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে ভারতের ওপর ‘চাপ’ অব্যাহত রাখা। আমরা ভারতের অনেক ‘দাবি’ পূরণ করেছি। নরেন্দ্র মোদির আমলে সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে দু দেশের সীমানা এখন চিহ্নিত। দু দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের পর মমতা যদি তার ওপর রাখা আস্থার প্রতিদান না দেন, তাহলে তা যে দু দেশের সম্পর্কের মাঝে একটা অবিশ্বাসের জš§ দেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে রুদ্র কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিতে পারেন, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের এই পানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশকে শতকরা ৫০ ভাগ পানি দেয়া সম্ভব বলে সুপারিশ করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রণব কুমার রায়ও এই সুপারিশ সমর্থন করেছিলেন। এর ভিত্তিতেই মমতা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ঢাকায় আসার আগে আত্রাই প্রসঙ্গটি তুলে তিনি একটি ‘জট’ লাগিয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ আত্রাই-এর সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি এক করে দেখেছেন। এটি একটি ভিন্ন বিষয়। আত্রাই নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু তিস্তায় পানি প্রাপ্তি আমাদের অগ্রাধিকার। এর সঙ্গে অন্য কোনো ইস্যুর তুলনা করা যাবে না। বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টিকে সামনে রেখে ভারতের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। সমুদ্র সীমানাও নির্ধারিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক আসরে। ‘দ্বিপাক্ষিক’ আলোচনায় সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়নি। আমাদের জরুরি প্রয়োজনে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আসরে উত্থাপন করা যেতে পারে। কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষের বেঁচে থাকার বিষয়টি ঝুলে থাকতে পারে না। Daily Manobkontho 26.05.16

মমতার বিজয় কি আমাদের দিগন্তে কোনো রুপালি রেখা?

শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস আবারও বিজয়ী হল পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনে। ২০১১ সালের নির্বাচনের চেয়ে এবার আরও ৩০টি আসন বেশি পেয়েছে তৃণমূল। ২৭ মে মমতা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। নির্বাচনের আগে জাতীয় কংগ্রেস ও বাম জোট একত্রিত হয়েছিল। কিন্তু তারা নিজেদের মমতার বিকল্প হিসেবে দাঁড় করাতে পারেনি। মমতা ছিলেন একাই একশ’। তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, তা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ গ্রহণ করে নেয়নি। উপরন্তু জাতীয় কংগ্রেস ও বাম জোট ‘ঐক্য’ করলেও অনেক আসনেই বামরা কংগ্রেসের ভোট পায়নি বলে সংবাদপত্রের খবর। বিধানসভার ২৯৪ আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস যখন একাই ২১১টি আসন পায় (জাতীয় কংগ্রেস ৪৫, বাম ২৮, বিজেপি ও অন্যান্য ৭), তখন বুঝতে হবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মমতার অবস্থান অনেক শক্তিশালী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খোদ নিজে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেও মমতার ‘অবস্থান’ নড়াতে পারেননি। ফলে আগামী দিনগুলো মোদির জন্য যে খুব সুখের হবে, তা বলা যাবে না। তবে মোদির প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে আসামে বিজেপির বিজয়। সেখানে কংগ্রেস সরকারের পতন হয়েছে। এখন পশ্চিমবঙ্গে মমতার বিজয়ে আমরা কতটুকু আশাবাদী হব? তিস্তার পানি বণ্টনের প্রশ্নে মমতা ব্যানার্জির নাম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। এটা এখন স্পষ্ট যে, মমতা ব্যানার্জির কারণেই তিস্তা চুক্তিটি হয়নি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে নীতিগতভাবে রাজি হলেও শুধু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে চুক্তিটি হয়নি। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় মমতা তার সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন। পরেও এসেছিলেন একবার। বলেছিলেন তার ওপর আস্থা রাখতে। তখন সংবাদপত্রে বলা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচনের (উত্তরবঙ্গ) কারণে তিনি কোনো চুক্তিতে যেতে রাজি হচ্ছেন না। কারণ এতে করে বিজেপি এটাকে ইস্যু বানিয়ে ফেলতে পারে। তাই নির্বাচনের পর এখন বাংলাদেশের অনেকের প্রশ্ন- মমতা কি এখন রাজি হবেন একটি চুক্তি করতে? রুদ্র কমিশনের সুপারিশমালা তার কাছে আছে। এ কমিশনটি তিনিই করেছিলেন। অধ্যাপক কল্যাণ রুদ্র তার সুপারিশে উল্লেখ করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের চাহিদা মিটিয়েও বাংলাদেশকে তিস্তার ৫০ ভাগ পানি দেয়া সম্ভব। তিনি এমন মতামতও দিয়েছিলেন যে, ‘ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তি’ ব্যবহার করে তিস্তার পানি মজুদ করা যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রণব কুমারও তার সঙ্গে একমত হয়েছিলেন বলে কলকাতার পত্রিকাগুলো আমাদের জানিয়েছিল। তবে যতদূর জানা যায়, মমতা ব্যানার্জি রুদ্র কমিশনের ব্যাপারে খুশি ছিলেন না, যে কারণে এ কমিশনের রিপোর্টটি তিনি প্রকাশ করেননি। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি রুদ্র কমিশনের সুপারিশকে বিবেচনায় নেবেন কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। তবে এটাও সত্য, তার কাছে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ আগে। কেন্দ্র তাকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে যেতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে তিনি মোদির সঙ্গে একটি ‘সমঝোতায়’ যেতে পারেন। যেমন একটি সমঝোতায় তিনি স্থল সীমান্ত চুক্তি সমর্থন করেছিলেন। রাজ্যসভায় তৃণমূল সমর্থন না করলে বিলটি পাস হতো না। কেন্দ্র থেকে তার আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতা দরকার। নরেন্দ্র মোদি এ বিষয়টিকে তার স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। মমতার ঢাকায় আসার ব্যাপারেও সেই মানসিকতা কাজ করেছিল। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল কানেকটিভিটির প্রশ্নটি। তিনি ভারতের এক অঞ্চলকে অন্য অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চেয়েছেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গ- এ তিনটি রাজ্য এই প্রক্রিয়ায় জড়িত। মোদি এজন্যই চেয়েছিলেন এই তিন রাজ্যের তিন মুখ্যমন্ত্রী ঢাকায় যাবেন। তাই মমতা এসেছিলেন। তিস্তা এখানে প্রধান ছিল না। অনেক পরিকল্পনা মমতা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না, যদি না কেন্দ্র আর্থিকভাবে তাকে সাহায্য করে। তখন সামনে নির্বাচন ছিল। মমতা তাই ঝুঁকিটি নিতে চাননি। নির্বাচনের আগে কেন্দ্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইর একটি চাপও ছিল মমতার ওপর। সারদা কেলেংকারি, তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ওপর সিবিআইর নজরদারি ছিল বেশি। ফলে এই ‘চাপ’কে অনেকটা নিউট্রাল করতে তিনি মোদির সঙ্গে ঢাকায় আসতে রাজি হয়েছিলেন। কোনো চুক্তি করতে নয়। এখন মমতা ব্যানার্জি পুনরায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে যোগ দিতেও পারেন! অমিত শাহের গলায় সেই সুর। এক সময় তিনি এই জোটে ছিলেন। কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী ছিলেন। আবার বেরিয়েও এসেছিলেন। এখন পশ্চিমবঙ্গে বিজয়ের পর ওসব কেলেংকারি থেকে ‘মুক্ত’ হতে তিনি যদি আবারও এনডিএ জোটে ফিরে যান, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই! তার ওপর আস্থা রাখা কঠিন। যতদূর জানা যায়, তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকায় আসেননি একটাই কারণে। আর তা হচ্ছে, মমতাকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র এককভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করতে চাচ্ছিল, যা মমতার মনঃপূত হয়নি। ভারতের সংবিধানে রাজ্য সরকারের কিছুটা অধিকার স্বীকৃত। রাজ্য সরকারকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র এককভাবে কোনো চুক্তি করতে পারে না। ঢাকা সফরের আগে মোদি তাকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি ঢাকায় তিস্তার ব্যাপারে কোনো চুক্তি করবেন না এবং তিস্তার ব্যাপারে ঢাকার সঙ্গে কোনো কথা হবে না। যদি কথা বলতেই হয়, এ ব্যাপারে মমতাই কথা বলবেন। মমতা কথা বলেছিলেন। কূটনৈতিক ভাষায় বলেছিলেন তার ওপর আস্থা রাখতে। বাংলাদেশের মানুষ আস্থা রেখেছিল। এখন নির্বাচন শেষ হয়েছে এবং মমতা বিজয়ী হয়েছেন। তিনি আগামী ৫ বছরের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছেন। বিহারে নীতিশ কুমারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে (বিহারের রাজধানী পাটনায়) যোগ দিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন একটা মহাজোট গঠনের সম্ভাবনা তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তার কোনো সহাবস্থান হয়নি। জাতীয় কংগ্রেস ঐক্য করেছিল বামফ্রন্টের সঙ্গে। জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তার ঐক্য না করার বিষয়টি কেন্দ্রে মোদি সরকারকে খুশি করে থাকবে। ফলে মমতা যদি না চান, তাহলে তিস্তার পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে মোদি সরকার তাকে চাপ দেবে না। আমাদের জন্য তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের অধিকার স্বীকৃত। ভারত (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গ তা-ই করছে। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পানিশূন্য হচ্ছে। উল্লেখ্য, তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। সিকিম থেকে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ওই সিদ্ধান্তে তিস্তার পানি প্রবাহের পরিমাণ বা কোন জায়গায় পানি ভাগাভাগি হবে এ রকম কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু’দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারত সেই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে উল্টো ‘তিস্তার কমান্ড এরিয়া তাদের বেশি’ এ দাবি তুলে ‘বাংলাদেশ তিস্তার পানির সমান ভাগ পেতে পারে না’ এই দাবি উপস্থাপন করেছিল। এরপর আর তিস্তার পানি বণ্টনের জট খোলেনি। এখানে বলা ভালো, বাংলাদেশ উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট ও বগুড়া জেলার ৩৫টি উপজেলায় তিস্তা সেচ প্রকল্প থেকে বর্ষা মৌসুমে সম্পূরক ও শুষ্ক মৌসুমে সেচ দেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৭৯ সালের আগস্টে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের প্রথম ফেজ কাজের উদ্বোধন করে। এরপর ভারত ১৯৮৫ সালে তিস্তার উৎসমুখে এবং তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের মাত্র ৬৫ কিলোমিটার উজানে গজলডোবা নামক স্থানে ব্যারাজ নির্মাণ করে। এর ফলে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পটি সেচ প্রদানে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই সেচ প্রকল্পের উপকৃত এলাকা ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর। এদিকে কিশোরগঞ্জ উপজেলার (নীলফামারী জেলার অন্তর্গত) বাহাগিলি নামক স্থানে তিস্তা প্রকল্পের দ্বিতীয় প্রকল্পের কাজও হাতে নেয়া হয়েছে। এ কাজ সম্পন্ন হলে রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলার ৪ লাখ ৪৮ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে। কিন্তু পানির অভাবে তিস্তা এখন শুধু নামেই আছে। পানি নেই বললেই চলে। ভরাট হয়ে গেছে ৬৫ কিলোমিটার নদী। তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী হওয়ায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭ অনুযায়ী বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তি সেখানে স্বীকৃত। এক্ষেত্রে ভারতের কাছে চাওয়ার কিছু নেই। মমতা ব্যানার্জির আপত্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। তিস্তা চুক্তি হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। তিস্তা চুক্তি না হলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। দীর্ঘদিনের ছিটমহল সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়েছে। ভারতকে আমরা ট্রানজিট দিয়েছি। ভারত থেকে আমরা বিদ্যুৎ কিনছি। বিবিআইএন নামে নতুন একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্ম হয়েছে। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা যদি ‘কাজ’ করে, তাহলে বদলে যাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতি। বাংলাদেশ এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা থেকে উপকৃত হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘জটিলতা’ এখনও রয়ে গেছে। সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করার ঘোষণা, অবৈধ অভিবাসীদের কথা বলে বাংলাদেশকে কটাক্ষ করা, সীমান্তে হত্যা অব্যাহত রাখা ইত্যাদি বিষয় দু’দেশের সম্পর্ক আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পথে প্রধান অন্তরায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টিও। মমতা ঢাকায় এসে বলেছিলেন তার ওপর আস্থা রাখতে। বাংলাদেশের মানুষ তার ওপর আস্থা রেখেছে। কিন্তু অনির্দিষ্টকালের জন্য মানুষ আস্থা ধরে রাখতে পারে না। এর সমাধান বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জিকেই এগিয়ে আসতে হবে। ঢাকায় তিনি বলেছিলেন, তিনি ‘কাঠবিড়ালির’ মতো ভূমিকা পালন করতে চান দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে। এখন তিনি অনেক সংহত। ভোটে হেরে যাওয়ার ভয় তার নেই। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কিংবা বাম জোটও তার জন্য কোনো ফ্যাক্টর নয়। তাই আমরা চাই ‘কাঠবিড়ালি’ নয়, বরং তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে তিনি নিজে উদ্যোগ নেবেন। রুদ্র কমিশন যে ‘ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তি’ ব্যবহারের কথা বলেছেন, সে অনুযায়ী অর্থাৎ প্রাপ্ত পানি ধরে রাখা ও তার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এখন উদ্যোগটি নিতে পারেন মমতা স্বয়ং। না হলে বাংলাদেশকে তার পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ‘বিকল্প’ ভাবতে হবে। Daily Jugantor 21.05.16

যোগসূত্রটি খুঁজে বের করতে হবে

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামিনিয়াম জয়শঙ্কর ঢাকা ঘুরে গেলেন ১৩ মে। তিনি ঢাকা এসেছিলেন নিশা দেশাই বিসওয়ালের ঢাকা সফরের পরপরই। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাও বলেছেন জয়শঙ্কর। এমনকি ক’জন মুখচেনা সুশীলসমাজের প্রতিনিধির সঙ্গে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে মতবিনিময়ও করেছেন। এরপর এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী মন্ত্রী উইলিয়াম ই. টড। এর বাইরে আরও বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে একের পর এক। যুদ্ধাপরাধী নিজামীর ফাঁসিকে কেন্দ্র করে তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়েছে। রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওসর্তুক ১২ মে রাতেই ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। একই ঘটনায় ইসলামাবাদ ও ঢাকায় দুই দূতকে পাল্টাপাল্টি তলব করা হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন সর্বনিু পর্যায়ে রয়েছে। ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রতিনিধির সঙ্গে বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিবের সাক্ষাৎ রাজনীতিতে ঢেউ তুলেছে। আর সর্বশেষ ঘটনায় টেকনাফে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে সশস্ত্র ব্যক্তিরা হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে আনসার কমান্ডারকে। সেই সঙ্গে নিয়ে গেছে ১১টি অস্ত্র ও ৫৭০ রাউন্ড গুলি। এ ঘটনাগুলোর একটির সঙ্গে অন্যটির হয়তো কোনো মিল নেই। কিন্তু সব কটিই যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তা বলা যাবে না। হঠাৎ করেই যেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা বহির্বিশ্বে আলোচিত হচ্ছে বেশি করে এবং বাংলাদেশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে ক্রমেই।

জয়শঙ্করের ঢাকা সফরের উদ্দেশ্যের মধ্যে যে সন্ত্রাসবাদের বিষয়টি ছিল, তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। তবে তিনি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত সফরের জন্য দাওয়াত দিতেও এসেছিলেন। চলতি বছরের অক্টোবরে গোয়ায় বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী সেই সম্মেলনে যাতে যোগ দেন, তার দাওয়াত দিয়ে গেলেন জয়শঙ্কর। এটা তার ‘ডিউটি ভিজিট’ ছিল না। বাংলাদেশে একের পর এক যেসব হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, তাতে যে ভারত উদ্বিগ্ন এটা বলতেই মূলত জয়শঙ্করের ঢাকা আগমন। ভারত যে বাংলাদেশে তথাকথিত ‘জঙ্গি তৎপরতায়’ উদ্বিগ্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ এখানে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে গেলে (?) তা ভারতের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। সুতরাং জয়শঙ্কর যে তার দেশের উৎকণ্ঠার খবর দিতে এসেছিলেন, তা খুবই স্বাভাবিক। এ সফরে তিনি বলে গেলেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঢাকার পাশে থাকবে নয়াদিল্লি। এই ‘অ্যাপ্রোচ’ ঠিক আছে। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে জঙ্গি দমন সম্ভব হবে কি? জয়শঙ্করের সফরের সময় আমরা লক্ষ করলাম জঙ্গি দমনে একটি ত্রিদেশীয় অ্যাপ্রোচের (ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ) ব্যাপারে ভারতের আপত্তি। নিশা দেশাই এমনটি চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের তাতে আপত্তি রয়েছে। ভারত দ্বিপাক্ষিকভাবে জঙ্গি সমস্যা মোকাবেলা করতে চায়। এটা ভারতের বৈদেশিক নীতির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। ভারত এভাবেই সমস্যার সমাধান করে- অর্থাৎ দ্বিপাক্ষিকতা। অথচ আমরা আমাদের বৈদেশিক নীতিতে বহুপাক্ষিকতাকে গুরুত্ব দিই। জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এখন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঠেকাতে আমরা শুধু ভারতের সহযোগিতা নিয়ে কি এই উত্থান রোধ করতে পারব? যদিও এটা সত্য, জঙ্গিবাদ ঠেকাতে মার্কিন ‘অ্যাপ্রোচ’ আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী। তাই প্রশ্ন থাকলই। যেখানে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের কোনো ‘ঐক্য’ হচ্ছে না, সেখানে জঙ্গি দমন প্রশ্নেও কোনো ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি।

জয়শঙ্করের ঢাকা সফরের সময় দু’দেশের মাঝে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এমনকি আমাদের তথাকথিত নাগরিক সমাজের সঙ্গে এ ‘সহযোগিতা’ নিয়ে তিনি আলাপ-আলোচনাও করেছেন। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমাদের যে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা রয়েছে, সেই সমস্যার সমাধানে ভারত কতটুকু কী করল, তা নিয়ে কিন্তু আলোচনা হয়নি। বিশেষ করে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়ে আলোচনা হল না। ফারাক্কা চুক্তির পর বাংলাদেশ স্মরণকালের সর্বনিু পানি পেয়েছে (২১-৩১ মার্চ বাংলাদেশ পানি পেয়েছে মাত্র ১৫ হাজার ৬০৬ কিউসেফ। এটা চুক্তির লংঘন)। এ বিষয়টিও আলোচনায় উঠে এল না! তথাকথিত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মুখেও উঠে এলো না এ কথাগুলো। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ব্যাপারে ভারত কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তাও কেউ বললেন না। আর নাগরিক সমাজ! এরা কারা? এরা কি সব শ্রেণীর বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করেন? সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে যারা পরিচিত, তাদের দিয়ে সব নাগরিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করানো কি ঠিক? জঙ্গি দমনে ভারতের সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন, সন্দেহ নেই তাতে। তবে এটি আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকেই দেখা উচিত। শুধু ভারতের ওপর নির্ভর করলে সমস্যার সমাধান হবে না। আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতা এবং সেই সঙ্গে এ প্রশ্নে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে জঙ্গিবাদ দমন করার উদ্যোগ নিতে হবে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে তুরস্ক যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা অনাকাক্সিক্ষত। তবে আমি এতে অবাক হইনি। কারণ তুরস্কের ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির রাজনৈতিক দর্শন এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দর্শন এক ও অভিন্ন। এরা মূলত ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনীতি অনুসরণ করে। ফলে আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও একটি বন্ধুপ্রতিম রাজনৈতিক দলের স্বার্থে তুরস্ক এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। তবে তুরস্ক কখনোই কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। কারণ বাংলাদেশে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। এ স্বার্থ নষ্ট হোক, এটি তুরস্ক চাইবে না। আমার ধারণা, আগামীতে তুরস্ক বাংলাদেশে একজন নয়া রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত ‘স্মার্ট ডিপ্লোমেসি’ অনুসরণ করা। বাংলাদেশের উচিত হবে না তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করা। তবে পাকিস্তানের ব্যাপারে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ব্যবসায়িক স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সীমিত আকারে দূতাবাসের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রদূতের পরিবর্তে কনস্যুলার বা মিনিস্টার পর্যায়ে দূতাবাসের প্রতিনিধিত্ব হতে পারে। করাচিতে একটি কনস্যুলেট থাকার প্রয়োজনীয়তা আছে কি-না, তাও বিবেচনায় নিতে পারে সরকার।

একজন ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যের সঙ্গে বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিবের ‘বৈঠক’ নিঃসন্দেহে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেবে। ইসরাইলের সঙ্গে আমাদের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। আর এটা বিবেচনা করেই ইসরাইলের সঙ্গে কখনও কোনো পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়নি বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসরাইলের সহযোগিতা বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছিল। যদিও এটা সত্য, ইসরাইল দীর্ঘদিন চেষ্টা করে আসছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি আদায় করতে। বেশকিছু দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভাগের একজন শিক্ষক একটি প্রসঙ্গে ইসরাইলকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। ওই সময় কম বিতর্ক হয়নি। এরপর থেকে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ইসরাইলি নেতাদের সঙ্গে যে কোনো ধরনের সম্পর্ক পরিহার করে আসছে বাংলাদেশ। তাহলে আসলাম চৌধুরী কীভাবে মেন্দি এন সাফারির সঙ্গে ‘বৈঠক’ করেন! চৌধুরী একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বটে। কিন্তু তিনি বিএনপিকে একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি দলের সিনিয়র নেতা। এটা কি শুধু একটি ‘ভুল’? তিনি কি কোনো বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার জালে আটকা পড়েছিলেন? ঘটনা যাই ঘটে থাকুক না কেন, বিএনপির এক সংকটের সময়ে তিনি নিজ দলের অনেক ক্ষতি করেছেন। তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। রোববার সন্ধ্যায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনায় তার দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে না। তিনি ‘সব দায় দায়িত্ব মাথায় নিয়ে’ দল থেকে পদত্যাগ করতে পারতেন। অথবা দলের চেয়ারপারসন ‘শৃংখলা ভঙ্গের’ অপরাধে দলের যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে তাকে অপসারণ করতে পারেন। এটা দলের জন্য মঙ্গল।

বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় যখন নানা চাপের মুখে আছে, তখন উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা। একজন আনসার কমান্ডারকে খুন করা হল। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে- এটা ডাকাতির ঘটনা! আসলেই কি এটা ডাকাতি ছিল? আমি নিশ্চিত নই। বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ, বসবাস, নানা রকম কর্মকাণ্ড আমাদের জন্য নানা সংকট সৃষ্টি করেছে। এদের কেউ কেউ বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তবে ভয়টা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিকাশ ঘটাচ্ছে। পাঠক, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) কথা স্মরণ করতে পারেন। South Asia Terrorism Portal-এ বার্টিল লিন্টনারের একটি প্রবন্ধ আছে। অনলাইনে পাঠক এটা পড়ে দেখতে পারেন। লিন্টনার বলার চেষ্টা করেছেন, আরএসও’র অনেক জঙ্গি আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশে ট্রেনিং নিয়েছেন। ট্রেনিং শেষ করে তাদের এ অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে। উদ্দেশ্য, নাকশকতামূলক ও জঙ্গি তৎপরতা বাড়ানো। একটি আন্তর্জাতিক চক্র এ রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে। এরা রোহিঙ্গাদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র চায়। অর্থাৎ রাখাইন স্টেটকে তারা ‘স্বাধীন’ করতে চায়। গহিন অরণ্যে ট্রেনিং হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন সূত্র থেকে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। এরা পুরো এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফায়দা তুলতে চায়। তাই আনসার কমান্ডারের হত্যাকাণ্ডকে আমি শুধু ডাকাতি হিসেবে ভাবতে পারছি না। এটা রোহিঙ্গা জঙ্গিদের কাজ। এ ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা হচ্ছে, আমরা রোহিঙ্গা সমস্যাকে আন্তর্জাতিক দরবারে নিয়ে যেতে পারিনি। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায়। তারা রেজিস্টার্ড নন এবং মিয়ানমার এদের স্বীকারও করে না। ফলে এদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কাজটিও সহজ নয়। মুসলমানবিদ্বেষী অং সান সুচি এদের ব্যাপারে নির্বিকার। আমার মনে হয়, উখিয়ার গহিন অরণ্যে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জঙ্গিদের উৎখাতের জন্য খুব দ্রুত সেখানে সেনাবাহিনী পাঠানো উচিত এবং সেনা মোতায়েন করাও জরুরি। নতুবা এই জঙ্গিরা কিছু বৈদেশিক শক্তির সহযোগিতায় এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এতে বিঘ্নিত হতে পারে।

জয়শঙ্করের ঢাকা সফরের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি কানেকশনের প্রশ্নটি সরাসরি সম্পর্কিত নয়। তবে তার সফরের সময় অনেক ঘটনাই ঘটল, যার একটির সঙ্গে অপরটির কোনো না কোনো যোগসূত্র আছে। সুতরাং বিষয়গুলোকে হালকাভাবে দেখা ঠিক হবে না। বাংলাদেশে আইএস নেই- একথা তথ্য-উপাত্ত সহকারে আমরা বারবার বলছি। একটি ‘শক্তি’ বাংলাদেশে আইএস আছে এমনটি প্রমাণ করতে চায়। আমরা যেন সেই ফাঁদে পা না দিই। খুব সতর্কতার সঙ্গে আমাদের এগোতে হবে। কোনো হত্যাকাণ্ডের ‘মোটিভ’ আমরা আজও উদঘাটন করতে পারলাম না। খুনিদের ধরতে পারলাম না। চিহ্নিত করা গেল না কারা তাদের হত্যা করেছে। ফলে বহির্বিশ্বের ‘চাপ’ থাকবেই। জঙ্গি দমনে ভারত কেন, কোনো বৈদেশিক শক্তিরই আমাদের প্রয়োজন নেই। সমস্যার সমাধান আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘অ্যান্টি’ টেরোরিজম ইউনিটকে’ আরও শক্তিশালী করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। Daily Jugantor 17.05.16

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন : প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিলারি আর ট্রাম্পের মাঝেই

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি আছে প্রায় ৬ মাস। ৮ নভেম্বর সেখানে নির্বাচন। এরই মধ্যে দুইটি দল, অর্থাৎ ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী প্রায় নিশ্চিত। হিলারি ক্লিনটন আর ডোনাল্ড ট্রাম্পই পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নিতে যাচ্ছেন। বিষয়টি অনেকটাই এখন নিশ্চিত। এক্ষেত্রে হিলারি যে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন, তা প্রথম থেকেই অনেকটা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু নিশ্চিত ছিল না ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন। তবে একের পর এক অঙ্গরাজ্যগুলোর পার্টি প্রাইমারিতে বিজয়ী হয়ে ট্রাম্প তার মনোনয়ন অনেকটাই নিশ্চিত করে ফেলেছেন। এ নিয়ে দলের মাঝে বড় ধরনের বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ ও তার ছোট ভাই জেব বুশ, যিনি সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন, তারা প্রকাশ্যেই বলেছেন, তারা ট্রাম্পকে সমর্থন করবেন না। এমনকি সাবেক স্পিকারও এ কাতারে শরিক হয়েছেন। যদিও ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন, এতে তার কিছু যায় আসে না। এরই মধ্যে দুইজন প্রার্থীই প্রাইমারিতে বিজয়ী হয়ে তাদের প্রার্থিতার সপক্ষে ডেলিগেটদের ভোট নিশ্চিত করেছেন। হিলারির পক্ষে ডেলিগেটদের সমর্থনের পাল্লা যথেষ্ট ভারি। ট্রাম্প একটু পিছিয়ে আছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নির্বাচকম-লীর ভোটে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা ৫০টি, আর নির্বাচকম-লীর সংখ্যা ৫৩৮। সাধারণত সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের সদস্য সংখ্যার ভিত্তিতে এ নির্বাচকম-লী গঠিত হয়। যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার নির্বাচকম-লীর ভোটের সংখ্যা ৫৪টি অথবা নিউইয়র্কের ৩৩টি। ছোট ছোট রাজ্য, যেমনÑ মেইন (চারটি), সাউথ ডাকোটা (চারটি) কিংবা ওয়াওসিভে (তিনটি) নির্বাচকম-লীর সংখ্যা কম। কোনো প্রার্থী কোনো রাজ্যে বিজয়ী হলে, সে রাজ্যে যে ক’টি নির্বাচকম-লীর ভোট রয়েছে, তার পুরোটা তিনি পেয়েছেন বলে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে যে প্রার্থী হেরে যান, তিনি নির্বাচকম-লীর কোনো ভোট পান না। অর্থাৎ জনসাধারণের ভোটে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচিত হন না, নির্বাচিত হন নির্বাচকম-লীর ভোটে। তবে জনসাধারণ ভোট দেন। এটাই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে তৃতীয় পার্টির তেমন কোনো অস্তিত্ব নেই। নামকাওয়াস্তে দুই-একটি প্রার্থী (গ্রিন, কনস্টিটিউশন পার্টি) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী দিলেও তারা প্রচারণার দৌড়ে এগোতে পারেন না। প্রচারণায় একজন প্রার্থীকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা ছোট ছোট দলের পক্ষে সম্ভব নয় সংগ্রহ করা। নির্বাচন দুইটি বড় দল, ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ দুই দলের প্রার্থীরা জনসাধারণ তথা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন। এটা বৈধ। প্রার্থীদের বিজ্ঞাপন ও প্রচুর ভ্রমণ করতে হয়। প্রয়োজন হয় প্রচুর অর্থের। আগে প্রেসিডেন্টের বাছাই পদ্ধতি ছিল জটিল। প্রতিনিধি পরিষদে স্থানীয় অঙ্গরাজ্যগুলোর প্রার্থীদের মধ্য থেকেই প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন সম্পন্ন করার ব্যবস্থা ছিল। এরপর পার্টি ‘ককাসে’ প্রার্থী নির্বাচনের ব্যবস্থা হয়। আর ‘ককাস’ বা বাছাই ব্যবস্থায় চূড়ান্ত পর্যায়ে মনোনীত হয়ে প্রার্থীরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৮৯-১৭৯৭)। তার কোনো দল ছিল না। তিনি ফেডারেলিস্টদের ব্যানারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্মরণ করিয়ে দিই, প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কোনো বেতন গ্রহণ করেননি। বলা হয়ে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন (১৮০১-১৮০৯) ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রতিষ্ঠাতা। আর সেই দলটি থেকেই গেল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন বারাক ওবামা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমদিকে দলটির নাম ছিল ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিকান। ১৮২৫ সাল পর্যন্ত এ দলটি থেকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। কুইন্সি এডামস (৬ষ্ঠ প্রেসিডেন্ট) ক্ষমতায় ছিলেন ১৮২৯ সাল পর্যন্ত। তারপর শুধু ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নাম ধারণ করে এন্ড্রু জনসন ও মার্টিন ভ্যান বুরেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন (১৮৪১)। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে উইগ পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত উইগ পার্টির প্রার্থীরা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এরপর দলটির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮৬১-১৮৬৫) ছিলেন রিপাবলিকান পার্টির প্রথম প্রেসিডেন্ট। এরপর থেকেই এ দুই পার্টি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। সাধারণত একজন প্রেসিডেন্ট ৪ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তিনি মাত্র দুই টার্ম ক্ষমতায় থাকতে পারেন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ১২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্র্র্রের এ ৩২তম প্রেসিডেন্টের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্ষমতাসীন থেকেও দ্বিতীয় টার্মের জন্য সেই প্রেসিডেন্ট বিজয়ী হতে পারেননি। সমসাময়িককালে জেরাল্ড ফোর্ড (৩৮তম প্রেসিডেন্ট, রিপাবলিকান, ১৯৭৪-১৯৭৭), জিমি কার্টার (৩৯তম, ডেমোক্র্যাট, ১৯৭৭-১৯৮১), কিংবা সিনিয়র জর্জ বুশ (৪১তম, রিপাবলিকান, ১৯৮৯-১৯৯৩) এর নাম উল্লেখ করা যায়। এখন দেখা যাক, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে হিলারি ক্লিনটন হোয়াইট হাউসে তার টার্ম শুরু করতে পারেন কিনা। নয়া প্রেসিডেন্টের টার্ম শুরু হবে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে।
প্রতিটি প্রাক-নির্বাচনেই দেখা গেছে, কতগুলো ইস্যু প্রাধান্য পায়। আর ওইসব ইস্যুর ব্যাপারে প্রার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব দেখে পার্টি ককাসে ডেলিগেটরা ভোট দেন ও কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেন। প্রার্থীদের একাধিক রাজ্যের ককাসে দলীয় অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। বিভিন্ন বক্তব্য এখানে প্রাধান্য পায় বেশি। যেমনÑ এবার প্রাধান্য পেয়েছে সিরিয়া, ইরান ইস্যু। চীনের প্রশ্নটিও এসেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট ওবামার সময়কার অর্থনৈতিক ইস্যুও রিপাবলিকান শিবিরে আলোচিত হচ্ছে। এমনকি রিপাবলিকান ‘ককাসে’ ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের পররাষ্ট্র সচিব থাকার সময় ব্যবহার করা ব্যক্তিগত ই-মেইল নিয়েও নানা কথা উঠেছে। রিপাবলিকানরা ওবামার অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তিনজনের মাঝে একজন গরিব। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সেখানে ৪৯ দশমিক ১ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, সেই সঙ্গে আরও ৫১ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে ধনী-গরিবের একটা বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ শতাংশ মানুষ রাষ্ট্রের সম্পদের ২৫ ভাগ নিয়ে যায়। এরা আবার সম্পদের ৪০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। এ এক ভাগ মানুষের বার্ষিক আয় ২ কোটি ৭৩ লাখ ৪২ হাজার ২১২ ডলারের উপরে। কিন্তু বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে দেখা যায়, একটি কাজের জন্য ন্যূনতম চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। আরও খারাপ খবর হচ্ছে, ৪৭ দশমিক ৮ ভাগ পরিবার সরকারি খাদ্য সাহায্য বা ফুড স্টাম্পের ওপর নির্ভরশীল। এসব পরিবার কর্মজীবী। কিন্তু এদের আয় যথেষ্ট নয়। প্রেসিডেন্ট ওবামা যেখানে প্রতিটি নাগরিকের চাকরি নিশ্চিত করতে পারেননি, যেখানে স্বাস্থ্যসেবায় কাটছাঁট করেছেন, স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায়ে যথেষ্ট শিক্ষক দিতে পারেননি, সেখানে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছেন ‘তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এর পেছনে। ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছিল সব মিলিয়ে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে (যুদ্ধ খরচ ৮০৬ মিলিয়ন, সৈনিকদের চিকিৎসা ও অন্যান্য খরচ ৪২২ থেকে ৭১৭ মিলিয়ন)। আর আফগান যুদ্ধের খরচ ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের অঙ্ককেও ছাড়িয়ে গেছে। শুধু সেনা প্রশিক্ষণের জন্য সেখানে ব্যয় হয়েছিল ৬ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে জনসংখ্যার ৯ দশমিক ১ ভাগ মানুষ বেকার, সেখানে যুদ্ধের পেছনে এত বিপুল ব্যয় নিয়ে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে। পররাষ্ট্রনীতিতে ডেমোক্র্যাটরা সফল, তাও বলা যাবে না। ২০০৯ সালের কায়রো ভাষণে ওবামা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ‘নতুন এক সম্পর্ক’ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, জঙ্গিবাদ উৎখাত করতে গিয়ে সেখানে জঙ্গিবাদেরই জন্ম হয়েছে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনে আত্মঘাতী বোমাবাজির জন্ম হয়েছে। সাদ্দাম উৎখাতের পর সেখানে ইসলামী কট্টরপন্থিরা শক্তিশালী হয়েছে। সিরিয়ায় আসাদকে উৎখাত করতে গিয়ে দেখা গেল অস্ত্র চলে গেছে জঙ্গিদের হাতে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ‘আরব বসন্ত’ তিউনিশিয়া, ইয়েমেন ও মিসরে পরিবর্তন ডেকে আনলেও সেখানে কী ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। মিসরে আবার স্বৈরতন্ত্র ফিরে এসেছে। সেনা কর্তৃত্বে আবার ফিরে গেছে দেশটি। লিবিয়া কার্যত এখন নিয়ন্ত্রণ করে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। সেখানে তথাকথিত একটি ‘সরকার’ থাকলেও সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই। উপরন্তু বেনগাজির কাছাকাছি শহর দারনা চলে গেছে ইসলামী স্টেট জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে। তারা এ শহরকে ইসলামিক স্টেটের সম্প্রসারিত অংশ বলে ঘোষণা করেছে। ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনের পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে এবং এসব অঞ্চলে সন্ত্রাসী কর্মকা- বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে ওবামা প্রশাসনের ব্যর্থতার দায়ভার বহন করতে হবে হিলারি ক্লিনটনকে, যদি তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হন। ডেমোক্র্যাটরা যে বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করতে পারেনি, এ অভিযোগ হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে উঠেছে। একসময় হিলারি নিজে ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্র সচিব (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ছিলেন। তিনি তার সময়ে লিবিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি। এটা তার একটা মাইনাস পয়েন্ট। উপরন্তু ক্লিনটন ফাউন্ডেশন নিয়েও নানা কথা আছে। হিলারি ক্লিনটন তার স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িত। এ প্রতিষ্ঠানটি বিদেশি অনেক রাষ্ট্র থেকে ফান্ড পেয়েছে এবং তাদের স্বার্থে কাজ করেছে এমন অভিযোগ এরই মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে। প্রাক-নির্বাচনী প্রচারণায় রিপাবলিকানরা ব্যবহার করছেন, এটাই স্বাভাবিক। যদিও বিখ্যাত সংবাদ মাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কিংবা সিএনএন একাধিক জনমত সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। সেখানে হিলারি ক্লিনটনকে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে আভাস দেয়া হয়েছে। সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তা হবে এক ইতিহাস।
মার্কিন নির্বাচন প্রচারণা এখন তুঙ্গে। যদিও প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি। তারপরও এক ধরনের প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে দুই শিবিরেই, অর্থাৎ রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট শিবিরে। এসব প্রচারণায় ব্যক্তিগত বিষয়াদিও আলোচিত হচ্ছে। জুলাইয়ে যখন চূড়ান্তভাবে প্রার্থী মনোনীত হবেন, তখন দুই দলের দুইজন প্রার্থী খুব কম সময় পাবেন। মাত্র ৪ মাস সময় পাবেন। এ কারণেই দুইটি বড় দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা বিভিন্ন রাজ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘ককাসে’ অংশ নিয়ে প্রচারণার কাজটি সেরে নিচ্ছেন। তবে বলতেই হবে, একজন ব্যক্তি কখনও কখনও ফ্যাক্টর হয়ে যান। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি নভেম্বরে নির্বাচকম-লীর ভোটে ‘বিজয়ী’ হন, তাহলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। আর হিলারি ‘বিজয়ী’ হলে, পরিবর্তন আসবে কম। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নানা বক্তব্য খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ‘মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেয়া হবে না’Ñ এ বক্তব্যে খোদ পোপ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, ট্রাম্প আদৌ খ্রিস্টীয় ধর্মে বিশ্বাসী কিনা সে ব্যাপারে তার সন্দেহ রয়েছে! ‘মেক্সিকান অবৈধ অভিবাসীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে টেক্সাসে তিনি উঁচু বেড়া নির্মাণ করবেন’Ñ এ বক্তব্যও কনজারভেটিভরা অনেকে গ্রহণ করেননি। এজন্য দেখা যায়, টেক্সাসে ট্রাম্প বিজয়ী হতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যেখানে ট্রাম্পের বিনিয়োগ রয়েছে (কানাডা, পানামা, তুরস্ক) প্রতিটি জায়গাতেই তিনি একজন বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। মজার কথা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা যখন শুরু হয়, তখন রিপাবলিকান শিবিরে ট্রাম্পকে সিরিয়াস প্রার্থী হিসেবে ভাবা হয়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি তার অবস্থান শক্তিশালী করেছেন। বহুল আলোচিত সুপার টুইসডেতে হিলারি ও ট্রাম্প আলাদা আলাদাভাবে বিজয়ী হলেও এখনও বাকি আছে আরও ক’টি রাজ্যের বাছাই পর্ব। এক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট শিবিরে হিলারি ক্লিনটনের প্রার্থী পদ প্রায় ‘নিশ্চিত’ হলেও ট্রাম্পের উত্থান রিপাবলিকান শিবিরের ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও ধরে নেয়া হয়, তিনিই রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পাবেন। তবে নানা বিষয়ে ট্রাম্প যে ‘বিতর্ক’ সৃষ্টি করেছেন, তাতে করে নির্বাচকম-লী চূড়ান্ত বিচারে, অর্থাৎ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে। আর এটাই হবে হিলারির জন্য প্লাস পয়েন্ট। এখনও কিছু প্রাইমারি বাকি আছে। প্রার্থীদের সবাইকে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের প্রাইমারিতেই অংশ নিতে হয় এবং তার পক্ষে সমর্থন আদায় করতে হয়। ফলে দলীয় প্রাইমারিগুলো নিয়ে হিলারি  এবং ট্রাম্প উভয়েই ব্যস্ত। তবে যেহেতু ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান শিবিরে অনেকেই তাদের প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, ফলে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় হিলারি আর ট্রাম্প থাকবেন বলেই মনে হয়।
Daily Alokoto Bangladesh
15.05.16

বাংলাদেশে আইএস বিতর্ক ও আমাদের শঙ্কা


বাংলাদেশে আইএস বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন ঢাকা ঘুরে গেলেন নিশা দেশাই বিসওয়াল। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ কিংবা ‘সন্ত্রাসীগোষ্ঠী যেখানে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করছে তা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই’—নিশা দেশাইয়ের এ ধরনের বক্তব্যের পরও আইএস নিয়ে বাংলাদেশের প্রশ্ন রয়েই গেল। তথাকথিত আইএস বা আল-কায়েদার হাতে মারা গিয়েছিলেন নিখিল জোয়ার্দার। দর্জি। ধর্মীয়ভাবে সনাতন ধর্মের অনুসারী। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করার অভিযোগে ২০১২ সালে তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছিল। তিনি জেলও খেটেছিলেন ২২৪ দিন। এটাই কি ‘অপরাধ’ যে তিনি মহানবী সম্পর্কে কটূক্তি করেছিলেন! যথারীতি SITE ইন্টেলিজেন্স আমাদের জানাচ্ছে, আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছে! এই আইএস নিয়ে মহাবিতর্ক এখন বাংলাদেশে। এর আগে একই কায়দায় খুন হন কলাবাগানের বাসিন্দা ও ইউএসএইডে কর্মরত জুলহাজ ও তাঁর ‘বন্ধু’ তনয়। তাঁদের ‘অপরাধ’ কী? জুলহাজ সমকামীদের পত্রিকা ‘রূপবান’ সম্পাদনা করতেন এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতেন। এটাই কি ‘অপরাধ’? এর একটি মারাত্মক প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি। শুধু মার্কিন রাষ্ট্রদূতই নন, স্বয়ং কেরি ফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। তবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের বক্তব্যটি ছিল স্পষ্ট। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে আইএস আছে এ কথা সরকারকে বিশ্বাস করতে হবে।’ এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা—যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বাংলাদেশে আইএস আছে এবং সরকার যেন তা স্বীকার করে নেয়। বাংলাদেশে আইএস নেই—এ কথা বারবার বলে আসছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পুলিশপ্রধানও বললেন, ‘পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশকে ইরাক-সিরিয়া বানাতে চায়।’ বাংলাদেশে আইএস বিতর্কটা সাম্প্রতিক সময়ের। আর আইএসের নিজস্ব ওয়েবসাইট ও ম্যাগাজিন ‘দাবিগ’-এ এ-সংক্রান্ত খবর খুব কমই ছাপা হয়েছে। অভিজিৎ, খিজির খান, দীপন, অনন্ত, কোনিও হোশি, রেজাউল করিম, নীলাদ্রি, তাবেল্লা আর সর্বশেষ জুলহাজ, তনয় ও নিখিল। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরপরই খুব দ্রুততার সঙ্গে সাইট ইন্টেলিজেন্সে খবরটি প্রকাশ করা হয়েছে। সাইট কোনো গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান নয়, যা গবেষকরা তাঁদের গবেষণার কাজে ব্যবহার করেন। এটা এমন এক প্রতিষ্ঠান, যারা ইসলামিক উগ্রপন্থীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এবং তা বিবিএস প্রতিষ্ঠানের কাছে ‘বিক্রি’ করে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এর বড় ‘ক্রেতা’। এর যিনি পরিচালক (রিটা কাট্জ), তিনি একসময় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদে কাজ করতেন। প্রতিষ্ঠানটি মোসাদের অর্থে পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন আছে। এ প্রশ্ন আছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও। কোনো একটি হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে আইএসের স্থানীয় জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতার খবর স্থানীয়ভাবে প্রচার করা হয়নি। আমার নিজের মনেও নানা প্রশ্ন আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই যখন বারবার বলে আসছেন যে এ দেশে ‘হোমগ্রোন’ জঙ্গি আছে, অর্থাৎ স্থানীয় জঙ্গি, তখন আরেকজন সিনিয়র মন্ত্রী ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কী করে বলেন, বাংলাদেশে আফগান ট্রেনিংপ্রাপ্ত আট হাজার আল-কায়েদা জঙ্গি রয়েছে! এতে দুই মন্ত্রী যখন দুই ধরনের ও পরস্পর বিপরীতমুখী বক্তব্য দেন তখন মানুষের মধ্যে এক ধরনের ‘কনফিউশন’ তৈরি হয়। মানুষ এখন কোনটা বিশ্বাস করবে? বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের তথা আইএসের তথাকথিত উত্থান নিয়ে একটা ‘বক্তব্য’ই থাকা উচিত। বাংলাদেশ সরকার বারবার আইএসের থাকার কথা অস্বীকার করে আসছে। সেটাই সঠিক। কেননা আইএস তাদের স্ট্র্যাটেজিতে কখনো ব্যক্তিকে টার্গেট করে না। প্যারিস, ব্রাসেলস কিংবা জাকার্তায় আইএসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠন যে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়েছিল, তাতে ‘সন্ত্রাস সৃষ্টি’ করাই ছিল মুখ্য, ব্যক্তিকে টার্গেট করে তারা হামলা চালায়নি। অনেক ক্ষেত্রেই তারা অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে একসঙ্গে অনেক স্থানে হামলা চালিয়েছে। বাংলাদেশে কোনো একটি ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। আইএসের মুখপত্র ‘দাবিগ’-এ অতি সম্প্রতি জনৈক শেখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে, যাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে আইএসের প্রধান হিসেবে। এটা যে একটা ভুয়া নাম, এটা সবাই স্বীকার করে। ফলে আজ যখন পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশে আইএস আছে, এই স্বীকারোক্তি আদায় করে নিতে চায় তখন প্রশ্ন উঠবেই। আইএস আছে, এই যুক্তি তুলে যুক্তরাষ্ট্র নতুন এক ‘যুদ্ধ’-এর সূচনা করেছে অনেক দেশেই। মধ্যপ্রাচ্যের পর তাদের দৃষ্টি এখন আফ্রিকার দিকে। দক্ষিণ এশিয়াও তাদের নজরে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প মিডিয়ার যাঁরা পাঠক, তাঁরা দেখেছেন বিভিন্ন গবেষক তথ্য-উপাত্ত সহকারে দেখিয়েছেন করপোরেট হাউসগুলোর স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্র ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা করে। David Vine তাঁর গ্রন্থ Base Nation : How Us Military Bases Abroad Harm America and the World-এ উল্লেখ করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব সেনা ছাউনি রয়েছে, তা পরিচালনা কিংবা মেইনটেন করতে শুধু ২০১৪ সালেই খরচ হয়েছে ১৫৬ বিলিয়ন ডলার (আফগানিস্তান ও ইরাকসহ)। এর বাইরে রয়েছে যুদ্ধ খরচ ও বেতন-ভাতাদি। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মজীবী নাগরিকদের কাছ থেকেই এ টাকা নেওয়া হয়, যার পরিমাণ জনপ্রতি বছরে ১০ থেকে ৪০ হাজার ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে ৯-১১-এর ঘটনার সঙ্গে (টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনা) যে টাকার খেলা জড়িত, তার প্রমাণও আছে। একটি নয়, একাধিক গবেষণা প্রবন্ধে ও গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে এই টুইন টাওয়ার হামলায় কারা সুবিধা পেয়েছে। টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর গ্রাউন্ড জিরোকে (যেখানে টুইন টাওয়ার ছিল) কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য। ২০১৪ সালে আমি গ্রাউন্ড জিরোতে দেখে এসেছি সেখানে দাঁড়িয়ে গেছে সুউচ্চ নতুন একটি ভবন। আর এই ভবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে বিশাল এক বাণিজ্য। করপোরেট হাউসগুলোর ব্যবসা সেখানে রমরমা। আফগান যুদ্ধ শুরু করার পর সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের খরচের পরিমাণ ছয় ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে (এক হাজার বিলিয়নে এক ট্রিলিয়ন)। আর এ থেকে ব্যবসা করেছে মার্কিন কন্ট্রাক্টররা। কিন্তু শান্তি ও স্থিতিশীলতা আফগানিস্তানে ফিরে আসেনি। পাঠক, ইরাকের কথা স্মরণ করতে পারেন। ইরাক আক্রমণের (২০০৩) আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। প্রতিটি ইরাকিকে খাদ্যের নিশ্চয়তা দেবেন। কার্যত ইরাক এখন ভেঙে যাওয়ার মুখে। জঙ্গিবাদ, আইএসের উত্থান ইরাককে কার্যত একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। কিন্তু ইরাকের অবকাঠামো নির্মাণে যে বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে, তা পেয়েছে শুধু মার্কিন কন্ট্রাক্টররা (বেকটেল গ্রুপের কথা পাঠক স্মরণ করতে পারেন, যার চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি)। ইরাক অতিরিক্ত তেল উত্তোলন করে ‘বিল’ মিটিয়েছে। লিবিয়ার কথা একইভাবে উল্লেখ করা যায়। ওবামা অনেকটা বুশকে অনুসরণ করে লিবিয়ায় বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই লিবিয়ায় আজ কার্যত কোনো সরকার নেই। জঙ্গিরা (আইএস) এখন লিবিয়ার একটি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে। তথাকথিত নাইন-ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে পৃথিবীর অনেক দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্ম হয়, যারা নিজ নিজ দেশের প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে। উত্তর নাইজেরিয়ায় ২০০২ সালে বোকো হারাম (আসল নাম ‘দ্য পিপলস অব দ্য সুন্নিস প্রিয়েচিং অ্যান্ড জিহাদ) নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়েছিল, যারা এখন মালি, নাইজার, চাদ, ক্যামেরুনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ‘অপারেট’ করছে। নাইজেরিয়ার শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকলেও এই সেনাবাহিনী বোকো হারাম দমনে ব্যস্ত। মিসরে জন্ম হয়েছে ‘আনসার বায়াত আল মাকডিস’। সিরিয়ায় রয়েছে বুশরা ফ্রন্ট। ইয়েমেনে রয়েছে আল-কায়েদার উপস্থিতি। এসব সংগঠনের অনেকেই আইএসের প্রতি এরই মধ্যে আনুগত্য প্রকাশ করেছে। ইন্দোনেশিয়ায় ‘কাতিবা বুসানতারা’ আইএসের আনুগত্য স্বীকার করেছে এবং জানুয়ারিতে জাকার্তায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো একটি কমান্ড প্রতিষ্ঠা করেছে (AFRICOM)। আফ্রিকায় রয়েছে (নাইজার) ইউরোপিয়ানের মতো প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ, যার অনেকটাই অনাবিষ্কৃত। মার্কিন কন্ট্রাক্টরদের আগ্রহ এখানে বিশাল। ২৮টি আফ্রিকান দেশে টঝ-অভত্রপধহ ঈড়সসধহফ (AFRICOM) রয়েছে। এর বাইরে FINTLOCK of US Training Exercise Africa নামে যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীকে জঙ্গি দমনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। শুধু তা-ই নয়, ২৮টি দেশে Trans Sahara Counter Terrorism Partnership কর্মসূচির আওতায় প্রায় এক হাজার ৩০০ মার্কিন সৈন্য এখন নিয়োজিত রয়েছে। পাঠক লক্ষ করবেন, লিবিয়াকে বলা হয় ‘গেটওয়ে টু আফ্রিকা’। অর্থাৎ এখান থেকে আফ্রিকায় যাওয়া যায়। ফলে এখানে যদি (লিবিয়া) একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার থাকে, তাহলে এখান থেকে আফ্রিকা ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা সম্ভব। এ কথাগুলো কাদের উদ্দেশে হচ্ছে? ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্র একক কর্তৃত্ব করতে চায় এবং প্রতিটি দেশ থেকে ‘সুবিধা’ আদায় করে নিতে চায়। যাঁরা অধ্যাপক Michel Chossudovsky-র বহুল আলোচিত গ্রন্থ America’s War on Terrorism পড়েছেন, তাঁরা দেখেছেন অধ্যাপক চসুডোভস্কি তথ্য-উপাত্তসহ দেখিয়েছেন, কারা টুইন টাওয়ার হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আসল উদ্দেশ্য কী। অধ্যাপক চসুডোভস্কি কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক। কানাডায় থাকেন এবং সেখানে একটি গবেষণা কেন্দ্র পরিচালনা করেন। তাঁর মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘টুইন টাওয়ার’ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের যত বেশি ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে লাভ হয়েছে অনেক বেশি। তাই আজ যখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত, জন কেরি কিংবা অ্যান্টনি ব্লিংকেন (ডেপুটি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বাংলাদেশে আইএস আছে বলে দাবি করেন এবং বাংলাদেশকে তা স্বীকার করতে বলেন, তখন স্পষ্টতই ওপরে উল্লিখিত তথ্যগুলো সামনে চলে আসে। বাংলাদেশে ‘হোমগ্রোন’ জঙ্গি আছে। সরকার জননিরাপত্তার প্রতি খুব বেশি সজাগ নয়। কিন্তু যে প্রশ্নটি আমাকে ভাবিত করে, তা হচ্ছে বার্নিকাটের সঙ্গে আলোচনা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, ‘সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ সেল গঠন করবে’—এর অর্থ কী? ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী যে অভিযান, তাতে কি বাংলাদেশ অংশ নিতে যাচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘দ্য গ্লোবাল কোয়ালিশন টু কাউন্টার আইএসআইএল’, তাতে কি বাংলাদেশ যোগ দেবে তখন? বাংলাদেশ সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগ দিয়েছিল (ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেররিজম)। কিন্তু বাংলাদেশ মার্কিন জোটে যোগ দেয়নি। ৫৯টি দেশ মার্কিন জোটে যোগ দিয়েছে। অনেক ইউরোপীয় দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ এই জোটে যোগ দিলেও বাংলাদেশ, পাকিস্তান কিংবা ভারতও এর সদস্য নয়। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন থেকেই চাচ্ছে বাংলাদেশ ‘সোফা’ (States of Forces Agreement) ও ‘আকসা’ (Acquisition of Cross Servicing Agreement) চুক্তিতে যোগ দিক। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত মার্কিনি ‘চাপ’ উপেক্ষা করে আসছে। বাংলাদেশ যদি এই চুক্তিতে রাজি হয়, তাহলে বিনা ভিসায় মার্কিন সেনা সদস্যরা বাংলাদেশে আসতে পারবে, অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে এবং তারা যদি কোনো ‘অন্যায়’ করে তাদের বাংলাদেশি আইন কিংবা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সোপর্দ করা যাবে না। তবে বাংলাদেশ এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারি সংলাপ চুক্তি ও TICFA চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এখন তথাকথিত আইএসের উপস্থিতিকে (?) স্বীকার করে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি চাচ্ছে বাংলাদেশকে তাদের সামরিক বলয়ে নিয়ে যেতে? এগুলো স্পষ্টতই স্পেসেকুলেশন। ধারণা মাত্র। এর সঙ্গে বাস্তবতা কতটুকু, তা হয়তো এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। আগামী দিনগুলোই প্রমাণ করবে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি কোন পর্যায়ে উপনীত হবে। যুক্তরাষ্ট্র কী চায়, তা তখন স্পষ্ট হবে। তাই বলে সাম্প্রতিককালে যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার সঙ্গে কারা জড়িত, এটা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের মোটিভ এখন পর্যন্ত উদ্ঘাটিত হয়নি। পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার এই ব্যর্থতা আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। বাংলাদেশে আইএস আছে কি নেই, আমার কাছে এই বিতর্ক মূল্যহীন। কেননা প্রতিটি হত্যাকাণ্ডই আমাদের জন্য খারাপ সংবাদ। এই সংবাদগুলো বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। আমাদের দূতাবাসগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত আমাদের দূতাবাস এসব হত্যাকাণ্ডের ‘সঠিক ব্যাখ্যা’ মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে তুলে ধরতে পারেনি। সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারলে জন কেরির মতো ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করার সৎসাহস পেতেন না। বাংলাদেশে স্থানীয় জঙ্গি আছে। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তারাই জড়িত। আমি এসব হত্যাকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলব না। বাংলাদেশকে এরা অস্থির করতে চায়। এখন আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে দ্রুত হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা, তাদের যদি রাজনৈতিক চরিত্র থাকে, তা-ও বলা এবং দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। পুলিশ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পুলিশি প্রহরা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা কোনো সমাধান নয়। সবাইকে পুলিশি নিরাপত্তা রাষ্ট্রের চরিত্রকে বদলে দিতে পারে। জঙ্গিবাদকে নির্মূল করতে হলে প্রয়োজন সব দল ও মতের ঐক্য এবং সেই সঙ্গে জনসচেতনতা। জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করার মধ্য দিয়েই আমরা পারি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে। Daily Kaler Kontho 15,05.16

জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন ও বাংলাদেশ

সাতটি অগ্রসর দেশের জোট জি-সেভেনের নেতারা বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াবলি নিয়ে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ঠিক করে নেওয়ার চেষ্টায় বছরে একবার শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন। চাপমুক্ত পরিবেশে অন্তরঙ্গ আলোচনা চালানোর উদ্দেশ্যে বার্ষিক এই সম্মেলন সাধারণত রাজধানী থেকে দূরের কোনো অবকাশকেন্দ্রে আয়োজন করা হয়। জোটের সদস্যরা পালাক্রমে শীর্ষ সম্মেলনের স্বাগতিক দেশের দায়িত্ব পালন করে থাকে। সেই হিসাবে ২০০৮ সালে জাপানের উত্তরের দ্বীপ হোক্কাইডোতে সর্বশেষ সম্মেলনের আয়োজন করার পর ২০১৫ সালে পরবর্তী বৈঠকের আয়োজন দেশটির করার কথা ছিল। 
২০০০ সালের গ্রীষ্মে দক্ষিণের দ্বীপ ওকিনাওয়ায় জাপান অগ্রসর দেশের জোটের শীর্ষ বৈঠক আয়োজন করার সময় রাশিয়াকে ধনী রাষ্ট্রসমূহের এই জোটের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছিল এবং তখন থেকে প্রায় দেড় দশক কাল ধরে জোটটি জি-৮ জোট নামে পরিচিতি পায় এবং জোটভুক্ত রাষ্ট্রের সংখ্যা দাঁড়ায় আটটি। এই আটের হিসাবের মারপ্যাঁচেই জাপানের আয়োজন করা পরবর্তী দুটি সম্মেলনের মধ্যে সময়ের ব্যবধান দাঁড়ায় ১৬ বছর। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নিয়ে সেই অঞ্চলকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে যুক্ত করে নিলে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে এবং সেই উষ্মার জের হিসেবে সেই একই বছর রাশিয়াকে জি-৮ থেকে খারিজ করে দেওয়া হলে জোট আবারও স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের জি-৭ জোট নামে আগের পরিচিতি ফিরে পায়। এবারের সম্মেলন হচ্ছে সংকুচিত আকারের তৃতীয় সম্মেলন। 
পশ্চিমের অগ্রসর দেশগুলোর আগের সেই অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক দাপট এখন অনেকটাই সংকুচিত। এর কারণ অবশ্য নতুন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের আবির্ভাব এবং বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়ার হারানো অবস্থান আংশিকভাবে হলেও ফিরে পাওয়া। এরপরও সাতটি রাষ্ট্রের শীর্ষ বৈঠক এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে বিশ্বরাজনীতিতে যার প্রভাব একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এ ছাড়া অর্থনৈতিক দিক থেকে জোটের তিনটি সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও জার্মানির অবস্থান হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ।
স্বাগতিক দেশ জাপানের আয়োজনে এবারের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে মধ্য জাপানের মিয়ে জেলার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বীপ ইসে-শিমায়। এর অল্প দূরেই আছে জাপানের পবিত্রতম শিন্তো মন্দির ইসে-জিঙ্গু। 
জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন হচ্ছে নানা বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করা। শীর্ষ বৈঠকের আগে ও পরে মন্ত্রী পর্যায়ের গোটা দশেক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। জাপানের বিভিন্ন শহরে সে রকম বৈঠক এপ্রিল মাসের গোড়া থেকে শুরু হয়েছে এবং শেষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে সেপ্টেম্বর মাসে। তবে সংবাদমাধ্যম ও বিশ্বের নজর মের ২৬ ও ২৭ তারিখে নির্ধারিত নেতাদের শীর্ষ বৈঠকের দিকেই মূলত নিবদ্ধ।
শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আইনি উপায় জি-৭ জোটের নেই। ফলে সেসব সিদ্ধান্তকে জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক পর্যায়ের বিভিন্ন সংগঠনের সামনে রাখা সুপারিশ হিসেবে গণ্য করা মনে হয় অনেক বেশি যুক্তিসংগত। এবারের শীর্ষ সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্থনীতির সামনে দেখা দেওয়া হুমকি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়ন পর্যন্ত বিস্তৃত নানা রকম বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
অগ্রসর দেশগুলোর মধ্যে চলা আলোচনা ও সম্মেলনের বিভিন্ন সুপারিশকে আরও অর্থবহ করে তোলার উদ্দেশ্যে কয়েক বছর ধরে সম্মেলন চলাকালে নির্বাচিত কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিদের সেখানে আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ লক্ষ করা গেছে। আগের কয়েকটি সম্মেলনে সাধারণত উন্নয়নশীল কয়েকটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। জোট এই উদ্যোগের নামকরণ করেছে আউট-রিচ বা যেটাকে আমরা অন্য প্রান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা বলে আখ্যায়িত করতে পারি। এবারের সম্মেলনে এই আউট-রিচ উদ্যোগ অবশ্য ভিন্ন অবয়ব লাভ করতে চলেছে এবং তা বাংলাদেশের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। 
জি-৭ সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ জাপান এবারের আউট-রিচ বৈঠককে ভিন্ন অবয়বের একটি শীর্ষ বৈঠকে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জোটবহির্ভূত সাতটি উন্নয়নশীল দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ নেয়। এর উদ্দেশ্য হলো, ধনী দেশের নেতারা বিশ্ব সমস্যা সমাধানে কী ভাবছেন এবং কী করতে চাইছেন, সেসব প্রশ্নে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা। জাপান যেহেতু অগ্রসর সাতটি দেশের জোটের একমাত্র এশীয় প্রতিনিধি এবং এবারের সম্মেলন যেহেতু এশিয়া মহাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেসব বিষয় বিবেচনায় রেখে এশিয়ার কয়েকটি দেশের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জি-৭ নেতাদের সঙ্গে নির্বাচিত সাতটি উন্নয়নশীল দেশের নেতাদের আলোচনার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে সম্মেলনের শেষ দিন, ২৭ মে।
জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের আউট-রিচ বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য জাপানের নির্ধারণ করে নেওয়া শর্তাবলির ভিত্তিতে এশিয়া মহাদেশের ছয়টি রাষ্ট্রের পাশাপাশি আফ্রিকা ইউনিয়নের সভাপতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনরত দেশের নেতাকেও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এশিয়ার ছয়টি বাছাই দেশের মধ্যে তিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে আসিয়ান জোটের সদস্যভুক্ত ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও লাওস। অন্যদিকে এশিয়ার দ্বীপদেশ হিসেবে জি-৭ শীর্ষ বৈঠকে আমন্ত্রণ পেয়েছে শ্রীলঙ্কা ও সমুদ্রপথের ওপর নির্ভরশীল পাপুয়া নিউগিনি। আর সর্বশেষ শর্ত, অবকাঠামো চাহিদা থাকা দেশ হিসেবে জি-৭ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭ মের বিশেষ বৈঠকে যোগ দিতে জাপান ভ্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, বিশ্বের সাতটি অগ্রসর দেশের নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনার সুযোগ পাবেন তিনি।
জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের এই আউট-রিচ বৈঠকে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বসার এই দুর্লভ সুযোগকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে হলে নেতাদের আস্থা লাভ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু অঘটন নিয়ে অগ্রসর দেশের নীতিনির্ধারকেরা বেশ উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে জঙ্গিবাদীদের হাতে একের পর এক মানুষ খুন হওয়া এবং অপরাধীদের খুঁজে বের করায় প্রশাসনের ব্যর্থতা। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করায় জাপানি ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভ্রমণে দেশটির নাগরিকদের জন্য জারি করা সতর্কতা এখনো তুলে নেওয়া হয়নি। উল্লেখ্য, গত বছর অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে একজন জাপানি নাগরিক নিহত হওয়ার পর এই সতর্কতা জারি করা হয়। 
বাংলাদেশে জাপান ও অন্যান্য অগ্রসর দেশের সরকার ও ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে হত্যাকারীদের কেবল শনাক্ত করা নয়, তাদের বিচারের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে পারলে জি-৭ নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকটি অনেক বেশি অর্থবহ হবে আশা করি।