রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

ব্রেক্সিট কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতন ত্বরান্বিত করবে

  ব্রেক্সিট কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতন ত্বরান্বিত করবে অ- অ অ+ ব্রিটেনের মানুষ গত ২৩ জুনের গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে। এটা অনেকটা অপ্রত্যাশিত ছিল। ইউরোপ কেন, বলা যেতে পারে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নেতারা চেয়েছিলেন, ব্রিটেন ২৮ সদস্যবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকুক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা স্বয়ং ব্রিটেনে এসে ব্রিটেনবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা যেন ইইউতে থাকার পক্ষে রায় দেয়। জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেল, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাঁদও চেয়েছিলেন, ব্রিটেন ইইউতে থাকুক। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন ভোটাররা যেন ইইউতে থাকার পক্ষেই রায় দেয়। কিন্তু সেটি হলো না। ৫২ শতাংশ ভোটার রায় দিল বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে, আর ৪৮ শতাংশ দিল থাকার পক্ষে। এর অর্থ পরিষ্কার, ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ যেমন অতীতে কখনো চায়নি ব্রিটেন ইইউতে যোগ দিয়ে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলুক, এবারও ৪৩ বছর পর তারা চাইল না ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকুক। বলা ভালো, ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়ন যাত্রা শুরু করে। তবে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৮ সালে ইউরোপীয় কোল ও স্টিল কম্পানি গঠনের মধ্য দিয়ে। এই কম্পানিই পরে ১৯৬৭ সালে ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিশনের (ইইসি) জন্ম দেয়, যার পরিবর্তিত রূপ হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ছয়টি দেশ (ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, ইতালি, হল্যান্ড ও জার্মানি) নিয়ে ইইসির যাত্রা শুরু। ব্রিটেন ইইসিতে যোগ দেয় ১৯৭৩ সালে। ইইসি কিংবা ইইউ মূলত একটি অর্থনৈতিক জোট। কিন্তু ধীরে ধীরে এই অর্থনৈতিক জোটটি একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয় এবং বলা যেতে পারে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় ইইউ একটি শক্তি। ব্রিটেনের বরাবরই ইইউতে যোগদানের ব্যাপারে রিজার্ভেশন ছিল। যে কারণে ব্রিটেন ইউরো জোনে যোগ দেয়নি। অর্থাৎ তাদের মুদ্রা পাউন্ড তারা বহাল রেখেছিল। ইইউ ১৯৯৯ সালে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা একটি একক মুদ্রা চালু করবে। ২০০২ সালে সেই একক মুদ্রা ইউরো তারা চালু করে। কিন্তু ইইউভুক্ত সব দেশ এই মুদ্রা গ্রহণ করেনি। মাত্র ১৯টি দেশ এই মুদ্রা চালু করেছিল নিজস্ব মুদ্রার বিলুপ্তি ঘটিয়ে। ইইউ মূলত একটি অর্থনৈতিক জোট হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক আসরে এর গুরুত্ব বেড়েছে। প্রায় ৪৩ লাখ ২৪ হাজার ৭৮২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবেষ্টিত ইইউর জনসংখ্যা ৫০৮ মিলিয়ন। ২৮টি দেশ একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়নে আবদ্ধ হলেও নিজস্ব পার্লামেন্ট, নিজস্ব সরকার ও নিজস্ব সংবিধান তারা বজায় রেখেছে। ফলে দেখা যায়, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই ইইউর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর নিজস্ব দূতাবাস রয়েছে। এই দেশগুলোয় আবার ইইউর মিশনও রয়েছে (যেমন বাংলাদেশ)। নিঃসন্দেহে ইইউ অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ইইউর জিডিপির পরিমাণ ১৯.২০৫ ট্রিলিয়ন ডলার (সাধারণ হিসাবে ১৬.২২০ ট্রিলিয়ন ডলার), যা বিশ্বের তৃতীয় বড় অর্থনীতি। মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ৩৭ হাজার ৮৫২ ডলার (পিপিপি, সাধারণ হিসাবে ৩১,৯১৮ ডলার), যা বিশ্বের ১৮তম। এই অর্থনৈতিক শক্তির বলেই ইইউ বর্তমানে অন্যতম একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দেখা গেছে, অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইইউ একটি ‘অবস্থান’ নিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইইউর সেই ‘অবস্থান’ যুক্তরাষ্ট্রের ‘অবস্থান’-এর বাইরে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রায়ণ ও মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে ইইউ সোচ্চার। এখন খুব সংগত কারণেই ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ইইউ দুর্বল হয়ে যাবে। এতে করে বিশ্ব আসরে তার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রিটেন কি এখনই ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে? জনমতে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় হয়েছে বটে, কিন্তু এর আইনগত ভিত্তি কী? ইইউ গঠনের জন্য যে লিসবন চুক্তির প্রয়োজন হয়েছিল, তার ৫০তম ধারায় বলা আছে, যেকোনো দেশ ইইউর কাঠামো থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে। সে ক্ষেত্রে ওই দেশের সাংবিধানিক আইন প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ ওই দেশের পার্লামেন্ট, জনগণ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। ব্রিটেনের জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন ব্রিটেনের পার্লামেন্ট তা অনুমোদন করবে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট এই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারবে না। তবে ব্রিটেন এখন থেকে দুই বছর সময় পাবে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। এই গণভোটের রায়ের একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন ব্রিটিশ আইনজীবী ডেভিড অ্যালেন গ্রিন। ফিন্যানশিয়াল টাইমসে একটি প্রবন্ধ লিখে তিনি মন্তব্য করেছেন যে এই রায়টি বাধ্যতামূলক নয়, বরং এক ধরনের উপদেশমূলক। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, সরকার এই রায় ‘উপেক্ষা’ করতে পারে। এ ব্যাপারে পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নেবে, এটা তাঁর অভিমত। বাস্তবতা হচ্ছে এই রায় উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। পার্লামেন্টে ওই রায় অনুমোদিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। ডেভিড ক্যামেরন ব্রিটেনের ইইউতে থাকার পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছিলেন। কিন্তু ভোটাররা তাঁর কথা শোনেনি। ব্রেক্সিটবিরোধী ক্যাম্পেইনে বিরোধী লেবার পার্টির যে ভূমিকা রাখা উচিত ছিল, তা তারা করেনি। অথচ লেবার পার্টির এমপিদের প্রায় ৯০ শতাংশই ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে। যে অভিযোগটি উঠেছিল, ইইউ ছাড়লে ব্রিটেন আরো গরিব হয়ে যাবে। এই অভিযোগটির কোনো সত্যতা খুঁজে পায়নি ভোটাররা। মূলত ইউরোপে ব্যাপক অভিবাসন এই গণভোটে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। অতি সাম্প্রতিককালে ব্যাপকহারে সিরীয়, ইরাকি ও আফগান নাগরিকদের ইউরোপে আগমন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত ব্রিটেনের ভোটারদের মধ্যে একটি মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাদের মধ্যে এমন একটা সংশয়ের জন্ম হয় যে ব্যাপকসংখ্যক অভিবাসী গ্রহণের ফলে ব্রিটেন তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলবে। তাদের মধ্যে একটা ‘ইসলাম ফোবিয়া’ও কাজ করেছে। এটা উসেক দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ব্রেক্সিটকে সমর্থন করেছিলেন। এবং গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় পড়লে, তিনি তাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। ক্যামেরন ব্রেক্সিটের বিপক্ষে অর্থাৎ ইইউর পক্ষে জনসংযোগ করলেও মন্ত্রিসভার দুই সদস্য মাইকেল গেভি ও ররিস জনসন এর বিরোধিতা করেন। অর্থাৎ তাঁরা ছিলেন ব্রেক্সিটের পক্ষে। ব্রিটেনের প্রবীণদের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেননি ক্যামেরন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরোধীরা যুক্তি তুলে ধরেছিলেন একটিই—ইইউ না যুক্তরাজ্য? ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির নেতা নাইজেল ফরাজ স্লোগান তুলে ধরেছিলেন যুক্তরাজ্যের পক্ষেই। তাতে তিনি জয়ী হলেন। এই জয় তাঁকে যদি ভবিষ্যতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর পদে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। নিঃসন্দেহে ফরাজ এখন যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে অন্যতম একটি ফ্যাক্টর। মানুষ তাঁর কথায় আস্থা রেখেছে। গেল বছর ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে ক্যামেরনের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি বিজয়ী হয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান অভিবাসী আগমন, ব্রিটেনের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ইত্যাদি কারণে ক্যামেরন বাধ্য হয়েছিলেন গণভোট দিতে। সেই গণভোটেই শেষ পর্যন্ত তাঁর পরাজয় ঘটল। তিনি যা চেয়েছিলেন, তাতে কোনো সমর্থন ছিল না যুক্তরাজ্যবাসীর। তিনি পরাজয় মেনে নিয়েছেন। তাহলে এখন কী হবে? অনেক সম্ভাবনার এখন জন্ম হবে। এবং কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বে পরিবর্তন আসছে। ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করেছেন। এটাই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। ক্যামেরনের নীতি মানুষ গ্রহণ করেনি। এখন কনজারভেটিভ পার্টিতে শুধু যুক্তরাজ্যের জন্য নয়া নীতি গ্রহণ করতে হবে। নয়া নেতা নির্বাচিত হবেন অক্টোবরে। অর্থাৎ অক্টোবরে ব্রিটেন একজন নয়া প্রধানমন্ত্রী পাবে। দুই. লেবার পার্টির নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসতে পারে। কেননা বর্তমান লেবার নেতৃত্ব ব্রেক্সিটের বিপক্ষে ছিলেন। ফলে লেবার নেতৃত্বকেও এর দায় বইতে হবে। তিন. ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত খোদ স্কটল্যান্ডে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে স্কটল্যান্ডে গণভোট হয়েছিল স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে। গণভোটে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, স্বাধীন স্কটল্যান্ডের পক্ষে ও বিপক্ষে। মাত্র ৪৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিল স্বাধীনতার পক্ষে, বাকি ৫৫ শতাংশ ভোট দিয়েছিল ব্রিটেনের পক্ষে থাকার জন্য। ফলে সেবার স্কটল্যান্ড স্বাধীন হয়নি। এখন ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় স্কটল্যান্ড ইইউতে ব্রিটেনের জায়গাটি নিতে চায়। স্কটল্যান্ডের ফাস্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টুরগিওন বলেছেন, তিনি পুনরায় স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট চান। এই গণভোট এবার স্কটল্যান্ডের ভাগ্য খুলে দিতে পারে। স্কটল্যান্ড ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে যেতে পারে! এবং বেরিয়ে গিয়ে ইইউতে যোগ দিতে পারে। চার. ব্রিটেনের এই গণভোটের ফলে সমগ্র ইউরোপে একটি জাতীয়তাবাদী চেতনা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। দক্ষিণপন্থীদের হাত এতে করে শক্তিশালী হতে পারে। ফ্রান্স ও গ্রিস, এমনকি ইতালি হচ্ছে পরবর্তী রাষ্ট্র, যারা ব্রিটেনের পথ অনুসরণ করতে পারে। এরই মধ্যে ফ্রান্সের কট্টর দক্ষিণপন্থী নেতা মেরিন লি পেন ও তাঁর দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টি সেখানে গণভোটের ডাক দিয়েছে। তাঁর দলও ফ্রান্সকে ইইউ থেকে বের করে নিয়ে আসতে চায়। যদিও এটা সত্য, ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি নিজেরা এই গণভোটের আয়োজন করেছিল। কিন্তু ফ্রান্সের ক্ষমতাসীনরা এই গণভোটের পক্ষে নয়। পাঁচ. এই গণভোট জার্মানির দক্ষিণপন্থীদের আরো উৎসাহিত করতে পারে। এমনিতেই জার্মানিতে বিপুলসংখ্যক সিরীয় শরণার্থীর উপস্থিতি নিয়ে জার্মান সমাজে বিভক্তি আছে। তথাকথিত শরণার্থীবিরোধীদের মধ্যে ইসলাম ধর্মবিরোধীদের সংখ্যা বেশি। শরণার্থীদের মধ্যে আইএসের জঙ্গিরা লুকিয়ে আছে—এই অভিযোগ তুলে এরই মধ্যে শরণার্থী শিবিরে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এখন ব্রেক্সিটের ঘটনা জার্মানির দক্ষিণপন্থীদের আরো উৎসাহ জোগাবে। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে দক্ষিণপন্থীরা ভালো করেছে। এখন দক্ষিণপন্থীরা জার্মানিতে ইইউ ছাড়ার ডাক দিতে পারে। ছয়. ব্রেক্সিটের ঘটনা এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বকে বাধ্য করবে বড় সংস্কার আনতে। অনেক রাষ্ট্র এখন (পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক ও সুইডেন) নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অর্থনীতি সুরক্ষার জন্য আলাদা আইন করার উদ্যোগ নেবে। সাত. ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা অর্থনৈতিকভাবে ইইউকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেবে। ব্রিটেনের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। জেপি মরগ্যানের মতো বেশ কিছু বড় ব্যাংক এরই মধ্যে ব্রিটেনে তাদের কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা ঘোষণা করেছে। এতে করে সেখানে বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। অন্যত্র চলে যাবে ব্যবসা। ক্ষতি হবে স্থানীয় অর্থনীতির। অন্যদিকে ইইউর অবাধ চলাচল ও স্থায়ী বসবাসের সুযোগে পূর্ব ইউরোপ থেকে (পোল্যান্ড, চেক ইত্যাদি) যারা লন্ডনে অভিবাসী হয়েছিল, তারা থাকবে এখন বড় অনিশ্চয়তার মুখে। চাকরি চলে যাওয়ার আশঙ্কাও বাড়বে। আট. ব্রিটেনের ইইউ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে। প্রচুর বাংলাদেশি উদ্যোক্তা লন্ডনে আছেন। তাঁদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশে ব্রিটেনের বিনিয়োগ ও সহযোগিতা কমে যাবে। আরএমজি (তৈরি পোশাক) সেক্টরে রপ্তানি কমে যাবে। ব্রেক্সিটের ঘটনাবলিই যে শেষ ঘটনা, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। ধারণা করছি, ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের ঘটনা ঘটবে। এতে করে যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাঠামো ভেঙে যায়, তাও বিচিত্র কিছু নয়।
 Daily Kalerkonthoteo
29.06.16

চীন-ভারত অ্যালায়েন্সের কথা

এক সময় মার্কিন গবেষকরা একটি সম্ভাব্য চীন-ভারত অ্যালায়েন্সের কথা বলেছিলেন। জনাথন হোলসলাগ ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন লিখিত একটি প্রবন্ধে চীন-ভারত এর ধারণা দিয়েছিলেন। চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের (২০১৪) পর ধারণা করা হয়েছিল যে দেশ দুটি আরো কাছাকাছি আসবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা, চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং সর্বশেষ চীনের আন্দামান-নিকোবর অঞ্চল দাবি দেখে মনে হয়েছে এই সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। নতুন আঙ্গিকে ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ ধারণা আবার ফিরে এসেছে। এই ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ মনকো ডকট্রিনের দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কারো কর্তৃত্ব ভারত স্বীকার করে নেবে না। এক সময় এই এলাকা অর্থাৎ ভারত মহাসাগরীয় এলাকা ঘিরে ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ (২০০৭ সালে রচিত। শ্রীলঙ্কা, চীন, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার ঐক্য)-এর যে ধারণা ছিল শ্রীলঙ্কায় সিরিসেনার বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণা এখন আর কাজ করছে না। ফলে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী ধারণাকে আরো শক্তিশালী করতে বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীনের ইউনান রাজ্য, ভারতের সাতকোন, মিয়ানমার) যে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, তাতে এখন শ্লথগতি আসতে পারে। সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত এখন আর বিসিআইএম ধারণাকে ‘প্রমোট’ করবে না। আর বাংলাদেশের একার পক্ষে চীন ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে ‘বিসিএম’ ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হবে না। ভারত এখন উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন জোটের কথা বলছে। ভারতের কর্তৃত্ব করার প্রবণতা এ অঞ্চলের দৃশ্যপটকে আগামী দিনে বদলে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও লক্ষণীয়। ভারত বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। এখানে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ছে। ফলে এখানে মার্কিন স্বার্থ থাকবেই। এ অঞ্চলে মার্কিনি স্বার্থের আবার একটি কারণ হচ্ছে চীন। চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’র একটি অপকৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘কৌশলগত সম্পর্কে’ নিজেদের জড়িত করেছে। এই দুই দেশের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। তবে ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই দেশের মাঝে অবিশ্বাসের জš§ হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নৌ স্ট্র্যাটেজি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরেই আবতিত হচ্ছে। অর্থাৎ এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের নৌ স্ট্র্যাটেজি শুধু প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরে রচিত হলেও এখন এর সম্প্রসারিত হয়েছে ভারত মহাসাগরে। একই স্ট্র্যাটেজির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে ভারত মহাসাগরকে যাকে ওবামা আখ্যায়িত করেছেন ‘Pivot to ara’ হিসেবে। বাংলাদেশ এই স্ট্র্যাটেজির আওতায়। এই স্ট্র্যাটেজির অন্তর্ভুক্ত চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য এখানে মোতায়েনরত যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ ফ্লিটের ৬টি যুদ্ধজাহাজকে ভারত মহাসাগরে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে গুরুত্ব আরো বেড়েছে। এতে চীনা নেতাদের উদ্বেগ ও শঙ্কা বাড়ছে। অতি সম্প্রতি ওয়াশিংটনে (১ এপ্রিল) যে চতুর্থ পারমাণবিক নিরাপত্তা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সেখানে ওবামার সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের আলাপচারিতায় চীনা নেতা তাদের উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এর কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে Terminal High Altifude Area Defense (THAAD) আলোচনা শুরু করেছে। যদিও বলা হচ্ছে, THAAD এক ধরনের মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (৪০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় আগত শত্রুপক্ষের মিসাইল ধ্বংস করা। ঞঐঅঅউ ব্যাটারি প্রতিস্থাপনের খরচ পড়বে ৮২৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার)। কিন্তু চীন মনে করছে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহƒত হবে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক দক্ষিণ চীন সাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠানোকে চীন মনে করছে তাদের ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি এক ধরনের হুমকিস্বরূপ। ওবামা-শি জিন পিং আলোচনায় এই প্রসঙ্গগুলো উত্থাপিত হয়েছে এবং শি জিন পিং এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, চীন এ ধরনের ‘কর্মকাণ্ড’ সহ্য করবে না। স্পষ্টতই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভূমিকা’ নানা প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। এতে এটা স্পষ্ট, এই ভূমিকা এই অঞ্চলে চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে। ফলে এ অঞ্চল অর্থাৎ ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চল আগামী দিনগুলোতে যে এক ধরনের প্রভাব বলয় বিস্তার করার প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতোমধ্যে মিয়ানমারে একটি নয়া সরকার গঠিত হয়েছে। অং সান সূচি আগামীতে মিয়ানমারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ভূমিকা’ পালন করতে যাচ্ছেন। মিয়ানমারকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বাড়ছে। মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ, বিশেষ করে গভীর সমুদ্র গ্যাস ও তেল প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে মিয়ামানরের আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে এক ধরনের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে। এই জ্বালানি সম্পদের ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে ভারতেরও। যেখানে ভারতের বিনিয়োগ বাড়ছে। স্পষ্টতই ভারত মহাসাগরকে ঘিরে একদিকে ভারত, অন্যদিকে চীন এবং মাঝখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজ নিজ স্ট্র্যাটেজি ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এই স্ট্র্যাটেজি এই দেশগুলোর স্বার্থে কত টুকু আঘাত করে কিংবা এই স্ট্র্যাটেজি আদৌ কোনো ‘সংঘর্ষের’ পর্যায়ে রূপ নেয় কিনা তা দেখার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো দক্ষিণ চীন সাগরের প্রশ্নটির। ফলে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের রাজনীতি আগামীতে আরো উত্তপ্ত হবে এবং ধীরে ধীরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হতে পারে।
 - Daily Manobkontho 27.06.16

এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধের ছায়া

 এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলজুড়ে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের ছায়া পড়তে শুরু করেছে। এক সময় বিশেষ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ইউরোপে স্নায়ুযুদ্ধের বিস্তার লাভ করেছিল। সেই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছিল ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। আজ ২১ বছর পর স্নায়ুযুদ্ধের নতুন এক রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। আমার সাম্প্রতিক ভিয়েতনাম সফর, জি-৭ সম্মেলনে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ভূমিকার সমালোচনা, সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত সাংগ্রিলা সংলাপে চীনের হুশিয়ারি এবং সর্বশেষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওয়াশিংটন সফরের সময় ভারতের এনএসজিতে (বিশ্বের পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠী) অন্তর্ভুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রমাণ করে নতুন করে এক স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া তথা প্যাসিফিক অঞ্চলে। এখানে স্পষ্টতই চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে ভারতকেও পেতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে নিঃসন্দেহে এবারকার ভিয়েতনাম সফর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে তার সীমান্তবর্তী অনেকগুলো দেশের (ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান) বিরোধ আছে। এমনকি চীনের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে তার যুদ্ধজাহাজ পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনের সঙ্গে একটি যৌথ নৌ-মহড়ায়ও অংশ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তার ভিয়েতনাম সফর এবং ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত এ কথাই প্রমাণ করে যে, ভিয়েতনামকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে ‘তৈরি’ করছে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি অর্থাৎ চীনের বিরুদ্ধে একটি বলয় তৈরি করা, তাতে ভিয়েতনাম এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম পার্টনার। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে বাদ দিয়ে ভিয়েতনামকে সঙ্গে নিয়ে টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি করেছে। ভিয়েতনাম এখন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড পার্টনার। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে শতকরা ১ হাজার ২০০ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৬ সালের মার্চ মাসে রফতানি করেছিল ১ হাজার ৭৩৬ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, অথচ আমদানি করেছিল ৯ হাজার ৯৩১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ৩০ হাজার ৯২১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার (রফতানি ৭ হাজার ৭১ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার, আমদানি ৩৭ হাজার ৯৯৩ মিলিয়ন ডলার)। ২০০৭ সালে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ওবামা নিজেই বলেছিলেন, ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কেন্দ্রবিন্দু। ফলে ওবামার ভিয়েতনাম সফর শুধু সাধারণ একটি সফর ছিল না। একদিকে চীনের বিরুদ্ধে সামরিক ও অর্থনৈতিক বলয় সৃষ্টি করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করছে। আর এ মহাপরিকল্পনার অংশ ছিল ওবামার এ সফর। এখানে বলা ভালো, চীনের বিরুদ্ধে একটি সামরিক বলয় তৈরি করার অংশ হিসেবেই দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনসহ একাধিক দেশের সঙ্গে সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে পাঁচটি সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে ফিলিপাইন এবং অতি সম্প্রতি ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের নৌ-ইস্টার্ন কমান্ডের চারটি গাইডেড মিসাইল সজ্জিত যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ জাহাজগুলো দক্ষিণ চীন সাগর ও উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কারÑ এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী যে নীতি, তাতে ভারতকেও পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে আমরা ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌ-স্ট্র্যাটেজি নিয়ে লিখেছি। ভারত এ অঞ্চলে অন্যতম নৌশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর তারই অংশ হিসেবেই ভারত এ প্রথমবারের মতো তাদের ইস্টার্ন কমান্ডের চারটি যুুদ্ধজাহাজকে এ অঞ্চলে মোতায়েন করল। যদিও দক্ষিণ চীন সাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। ভারত ভিয়েতনামের সঙ্গে চুক্তি করে এ অঞ্চলে তেল ও গ্যাসের অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এখন ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ৩২০ কোটি ডলারের ছয়টি ইলেকট্রিক সাবমেরিন বিক্রির যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্ত এ অঞ্চলে নতুন করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দেবে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে দক্ষিণ কোরিয়া এ সিদ্ধান্তটি নিল। তবে চীনে আধা ঘণ্টারও কম সময়ে আঘাত হানতে সক্ষম এমন হাইপারসনিক গ্লিড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাও মোতায়েন করা হয় সেখানে। চীন বিষয়গুলোকে খুব সহজভাবে দেখছে না। এতে করে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়বে। সর্বশেষ ওবামার সফর এতে একটি নতুন মাত্রা এনে দেবে। এখানে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। আগামী দিনে এ অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান-পতন বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। প্রায় ৩৫ লাখ বর্গকিলোমিটারজুড়ে রয়েছে চীন সাগরের বিস্তৃতি। এ অঞ্চলটি চীনের মূল ভূখ-ের দক্ষিণে, ফিলিপাইনের পশ্চিমে, মালয়েশিয়ার উত্তরে, ব্রুনাইয়ের উত্তর-পশ্চিমে, ইন্দোনেশিয়ার উত্তর এবং ভিয়েতনামের পূর্বে অবস্থিত। এ অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়েছে এ কারণে যে, দক্ষিণে চীন সাগরে প্রায় ২৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রয়েছে এবং গ্যাস রয়েছে ২৫ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার থেকে ৫৬ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার। চীনের প্রচুর ‘জ্বালানি সুধা’ রয়েছে। চীনের অর্থনীতিকে সঠিক পথে চলতে প্রচুর জ্বালানি দরকার। এক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যদি চীনের কর্তৃত্ব থাকে, তাহলে চীন তার জ্বালানি চাহিদা এখান থেকে মেটাতে পারবে। এ সমুদ্রপথটি পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ। এ কারণে এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। পৃথিবীর সমুদ্রপথে যত বাণিজ্য হয়, তার এক-তৃতীয়াংশ হয় এ পথে। চীন জাপান, কোরিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ায় যাওয়ার বাণিজ্যিক রুট হিসেবে এ পথকে ব্যবহার করে। দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত স্প্রাটলি, প্যারাসেল ও টনকিন উপসাগরে অবস্থিত কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে আশপাশের দেশ বিশেষ করে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনস, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার সঙ্গেই চীনের বিরোধ। সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ অঞ্চলের অর্থাৎ দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব বেড়েছে একাধিক কারণে। শুধু চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’ কিংবা চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে একটি ‘ঐক্য’ করার পাশাপাশি জাপানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকির মোকাবিলা করা, এ সাগর দিয়ে মার্কিন যুদ্ধ জাহাজের প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করার ব্যাপারে মার্কিনি স্বার্থ রয়েছে। এর উপরে রয়েছে এ এলাকার তেল ও গ্যাস সম্পদের ওপর মার্কিনি বহুজাতিক কোম্পানির লোলুপ দৃষ্টি। ফলে এ অঞ্চলটি যে আগামী দিনের প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করতে আজ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান, এমনকি ভারতও তৎপর। যুক্তরাষ্ট্র এ দেশগুলোকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে। এটি বিশ্বের বড় সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটের একটি। বিশ্ববাণিজ্যের ৩২ ভাগ এ পথ দিয়ে প্রবাহিত হয়। চীনের মূল ভূখ-ের সঙ্গে এটি সংযুক্ত নয়। মূল ভূখ- থেকে ১ হাজার নটিক্যাল দূরে এ দ্বীপগুলো অবস্থিত। জাপান এ রুটকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করে এবং ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যিক রুট হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। জাপান এ দ্বীপগুলোর নাম দিয়েছে সেনকাকু, যা চীনের কাছে পরিচিত দিয়াওইউ নামে। ঐতিহাসিকভাবে চীনের শিও হান রাজবংশের কর্তৃত্ব অনুযায়ী চীন এ অঞ্চলের মালিকানা দাবি করে এলেও আশপাশের দেশগুলো তা মানতে নারাজ। জাপানের নিজস্ব কোনো তেল ও গ্যাস নেই। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর দেশটি পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। জাপান দৈনিক ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এ সামুদ্রিক পথটি ব্যবহার করে আমদানি করে থাকে। এ অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব থাকায় চীনও এ অঞ্চলে নতুন করে একটি কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়েছে। সেখানে যুদ্ধবিমান মোতায়েনের জন্য বড় বড় রানওয়ে তৈরি করছে। মিসাইল ব্যাটারি স্থাপন করেছে। এমনকি আগামীতে এখানে পারমাণবিক সাবমেরিন যাতে ‘ডক’ করতে পারে, সে ব্যবস্থাও পাকাপাকি করেছে চীন। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র এ আতঙ্ককে ব্যবহার করছে তার স্বার্থে। এরই মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরের এ বিরোধটি জাতিসংঘের সামুদ্রিক বিবাদ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে উত্থাপিত হয়েছে। ফিলিপাইন এর উদ্যোক্তা। তবে চীন এ শুনানিতে অংশ নেয়নি। চীন আদালতের কর্তৃত্ব মানতে চাইছে না। ফলে বিবাদ নিষ্পত্তি নিয়ে একটি প্রশ্ন থেকেই গেছে। দক্ষিণ চীন সাগরের এ বিরোধ যখন অনিষ্পন্ন, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেন। এর ফলে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার অস্ত্র আমদানি শুরু করবে, যা কিনা এ অঞ্চলে এক ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দেবে। অতীতে চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমরা জানি, ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে সেই যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৩ সপ্তাহ। তখন চীনের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামকে সমর্থন করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। আজ যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামকে ব্যবহার করছে চীনের বিরুদ্ধে। প্রেক্ষাপট এক। চীন এ অঞ্চলের তথা বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম একটি ফ্যাক্টর। অর্থনৈতিক তথা সামরিক দিক দিয়ে চীন অন্যতম একটি শক্তি। তাই ঘুরেফিরে আসছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তী ‘কনটেইনমেন্ট থিওরি’, অর্থাৎ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলা ও সমাজতন্ত্রের পতন ঘটানোর এ দীর্ঘ ৪৬ বছর লেগেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে ফেলতে। আজ চীনকে নিয়ে শুরু হয়েছে ‘খেলা’। চীনের পতন ঘটিয়ে চীনকে ‘কয়েকটি চীনা রাষ্ট্রে’ পরিণত করার লক্ষ্যে নতুন করে ‘কনটেইনমেন্ট থিওরি’ ব্যবহৃত হচ্ছে! সে কারণেই একদিকে ভিয়েতনাম (সেই সঙ্গে ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান), অন্যদিকে ভারত আজ ‘মার্কিনি বন্ধু’, মার্কিনি স্ট্র্যাটেজির অংশ তারা। খুব সঙ্গত কারণেই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে ‘নয়া স্নায়ুযুদ্ধ’র এক নয়া রূপ! আর এই নয়া স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্সে ভারত পালন করতে যাচ্ছে একটি বড় ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্র সম্মতি দিয়েছে বিশ্বের পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠী বা এনএসজিতে ভারতের অন্তর্ভুক্তির। (৪৮ দেশ এর সদস্য। চীনের আপত্তি আছে ভারতের ব্যাপারে)। মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিম বা এমটিসিতে ভারত ঢুকতে চায়। নীতিগতভাবে তাতে সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এতে অত্যাধুনিক মিসাইল টেকনোলজি পাবে ভারত। ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনতে চায় এফ-১৬, এফ-১৮ জঙ্গি বিমান। এটা স্পষ্ট যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক এখন অনেক উষ্ণ। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি তাতে ভারত পালন করতে যাচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চীনের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামার ভিয়েতনাম সফর কিংবা মোদির ওয়াশিংটন সফর মূলত সবই একই সূত্রে গাঁথা। তাই আগামী দিনে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে অনেকের। এ অঞ্চলের রাজনীতি, বহিঃশক্তির ইন্ধন নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করতে পারে। হ Daily Alokito Bangladesh 26.06.16

যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব বাড়ছে

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের অরল্যান্ডো শহরের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ১৪ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে আবারও মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ১৪ বছর আগে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (যা ৯/১১ নামে পরিচিত) টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যে ব্যাপক মুসলমানবিদ্বেষী একটি মনোভাবের জন্ম হয়েছিল, আজ অরল্যান্ডোর ঘটনা সেই পুরনো স্মৃতিকে উসকে দিল। অরল্যান্ডোর একটি সমকামী রেস্তোরাঁয় আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৪৯ জন সাধারণ মানুষকে। আর যিনি একাই এই হত্যাকাণ্ড চালালেন, তিনি ওমর মতিন, একজন মুসলমান; কিন্তু আফগান-আমেরিকান নাগরিক। ৯/১১-এর ঘটনাবলির সঙ্গে যুক্ত ছিল কট্টরপন্থী সৌদি নাগরিকরা, যারা আল-কায়েদার মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিমান হাইজ্যাক করে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে দিয়েছিল। আজ অরল্যান্ডোতে যিনি হামলা চালালেন, তিনিও মুসলমান; কিন্তু তিনি তাঁর মুসলিম ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। ৯/১১-এর ঘটনার পেছনে ছিল একাধিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা। কিন্তু অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ডে ব্যক্তি ওমর মতিনের ভূমিকাই প্রধান। এখন পর্যন্ত যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, তিনি নিজেই এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন। এখানে মিলটা হচ্ছে ৯/১১-এর সময় জানা গিয়েছিল ওই ঘটনার সঙ্গে আল-কায়েদা জড়িত, আর মতিন নিজে হত্যাকাণ্ড চালানোর আগে তাঁর সঙ্গে আইএস বা ইসলামিক স্টেটের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করে গেছেন। অর্থাৎ আইএস এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। কিন্তু তার অতীত ইতিহাস বলে ধর্ম নয়, বরং সমকামীবিরোধিতাই তাঁকে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি উগ্র ইসলামী মতাদর্শে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, এমন কোনো তথ্য মার্কিন সংবাদপত্রগুলো আমাদের দিতে পারেনি। তিনি সিরিয়ায় গেছেন, সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, এমন তথ্যও নেই। এমনকি তিনি যে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে যে সংস্থায় কাজ করতেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটির হয়ে কাজ করে। ফলে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, একজন তথাকথিত সন্ত্রাসীকে নিশ্চয়ই তাদের হয়ে কাজ করার সুযোগ দেবে না। ফলে একটা প্রশ্ন এলোই—ওমর মতিন কি কারো ‘হয়ে’ কাজ করেছিলেন? তাঁকে কি কেউ বা কোনো পক্ষে ব্যবহার করেছিল? সামনে নির্বাচন। নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার জন্যই কি এই হত্যাকাণ্ড? কোনো কিছুকেই অস্বীকার করা যায় না। ৯/১১-এর ঘটনার প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায়নি। অনেক প্রশ্নের কোনো জবাব আজও পাওয়া যায়নি। তাই অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ আমেরিকাবাসী জানবে, এই আস্থাটি রাখতে পারছি না। ইতিমধ্যে ফ্লোরিডার প্রসিকিউশনের অফিস থেকে বলা হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত মোটিভ বের করতে এক বছরের ওপরে সময় লেগে যাবে। এরই মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা ‘থিওরি’ উঠবে এবং নির্বাচনে কট্টরপন্থীরা এটাকে ইস্যু করে নির্বাচনী হাওয়া তাদের পক্ষে নিতে চাইবে। রাজনীতির মাঠে তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প সোচ্চার। জনমত জরিপ তাঁর পক্ষে না থাকলেও, তিনি আবারও মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। মুসলমানদের তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দিতে চান। এবং মুসলমান অভিবাসীদের জন্য দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে চান! অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তাই বারবার সংবাদপত্রে আসছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে যেন এটাই আলোচনার মূল বিষয়। অরল্যান্ডোর ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন আইএসের নামটি আলোচনায় এসেছে, ঠিক তেমনি এসেছে ‘রেডিক্যাল ইসলাম’-এর বিষয়টিও। কিছুদিন আগে আইএসের জনৈক মুখপাত্র এই রমজান মাসে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালানোর কথা বলেছিলেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রের কট্টরপন্থীরা সেই মুখপাত্রের বক্তব্যটিই সামনে নিয়ে এসেছে। বলার চেষ্টা করেছে, আইএসই অরল্যান্ডোর এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। এই বক্তব্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে ওমর মতিনের হামলার আগে পাঠানো বার্তা, যেখানে তিনি আইএসের প্রতি তাঁর আনুগত্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন। আসলেই কি ওমর মতিন আইএসের সদস্য ছিলেন? যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো গবেষক একাধিক দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে দেখাতে চেয়েছেন, প্রকৃত অর্থেই ওমর মতিন কোনো সালাফি দর্শনে উদ্বুদ্ধ ছিলেন না। সালাফিস্টরা আদি ইসলাম ধর্মে আস্থাশীল, কট্টরপন্থী এবং ইসলাম প্রবর্তনের প্রথম যুগে যে ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ছিল তা কায়েম করতে চায়। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ইসলাম ধর্মে যেমন পরিবর্তন এসেছে, তা তারা মানতে নারাজ। প্রকৃত অর্থে একজন সালাফিস্ট (আইএস) যেভাবে জীবন যাপন করেন, ওমর মতিন সেভাবে জীবন যাপন করতেন না। যেমন একজন সালাফিস্ট কখনো মদপান করেন না। কিন্তু ওমর মতিন নিয়মিত অরল্যান্ডোর ওই সমকামী ক্লাবে (পালস) খেতেন এবং মদপান করতেন। সালাফিস্টরা কখনো সময় কাটানোর জন্য ‘মদের দোকানে’ আড্ডা দেন না। সালাফিস্টরা সমকামীদের ঘৃণা করেন। কারণ ইসলাম ধর্মে সমকামিতা নিষিদ্ধ। কিন্তু পাওয়া তথ্য মতে, ওমর মতিন সমকামীও ছিলেন। সমকামীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেটে এক ধরনের ‘অ্যাপ’ ব্যবহার করে। ওমর মতিন তা-ই করতেন। টিভিতে দুজনের বক্তব্য আমি দেখেছি, যাঁরা বলেছেন ওমর মতিন তাঁদের সঙ্গে ‘সমকামী সম্পর্ক’ স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। সালাফিস্টরা সাধারণত মুখমণ্ডলে দাড়ি রাখেন। এটা এক ধরনের বাধ্যবাধকতা। কিন্তু ওমর মতিন ছিলেন ‘ক্লিন শেভড’। সালাফিস্টরা সাধারণ শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর (লেবানন) সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেন না ধর্মীয় আনুগত্যের কারণে। কিন্তু ওমর মতিনের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, তিনি কোনো এক সময় হিজবুল্লাহ সংগঠনের ব্যাপারে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সালাফিস্টরা সাধারণত তাঁদের স্ত্রীদের ধর্মীয় বিধান মতে পর্দাপ্রথা তথা হিজাব পরতে ‘বাধ্য’ করেন। কিন্তু মতিনের প্রথম স্ত্রী সিতোরা ইউসুফি এবং দ্বিতীয় স্ত্রী নুর সালমান—কেউই হিজাবি ছিলেন না। তিনি তাঁদের পর্দা করতেও বাধ্য করেননি। ধর্ম সম্পর্কে ওমর মতিনের জ্ঞান ছিল সীমিত। শিয়া-সুন্নির পার্থক্য তিনি জানতেন না। নিয়মিত মসজিদে যেতেন কিংবা নামাজ আদায় করতেন, এমন তথ্যও পাওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্রে কট্টরপন্থী ইসলামিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে তিনি সম্পর্ক রক্ষা করতেন, এমন তথ্যও এফবিআইয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। তবে এফবিআই দু-দুবার তাঁর ব্যাপারে তদন্ত করেছে, এমন তথ্য আমরা পেয়েছি এবং দু-দুবারই এফবিআই তাঁকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে। তাহলে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কী মোটিভ কাজ করেছিল? তিনি হতাশাগ্রস্ত, বিকারগ্রস্ত ছিলেন। উগ্র মানসিকতার অধিকারী তিনি ছিলেন। প্রথম স্ত্রীকে তিনি পেটাতেন, এটা স্ত্রী নিজে স্বীকার করেছেন। এ কারণে মাত্র চার মাসের বৈবাহিক জীবন তাঁর ছিল সিতোরা ইউসুফির সঙ্গে। তাহলে শুধু রাগ, ক্ষোভ আর হত্যাশা থেকেই কি তিনি এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিলেন? ওটাও অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। শুধু সমকামীবিদ্বেষ থেকে (তাঁর বাবার ভাষ্য মতে) ওমর মতিন এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলেন? এটাও অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কেননা তিনি অনিয়মিত ‘পালস’ নামের এই সমকামী ক্লাবে যেতেন, নাকি কোনো তৃতীয় পক্ষ তাঁকে ব্যবহার করেছে? উদ্দেশ্য ক্লিয়ার—যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবকে আরো উসকে দেওয়া? সামনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিজয়ী করতেই কি এই হত্যাকাণ্ড? ৯/১১-এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে আফগানিস্তান, পরে ইরাক দখল করে নিয়েছিল। ২০০১ সালের পর তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে এই যুদ্ধ চলছে। ফলাফল? আফগানিস্তানে এখনো যুদ্ধ চলছে। গত সপ্তাহেই ন্যাটো সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানে ন্যাটোর সেনাবাহিনী আরো কিছুদিনের জন্য থাকবে। ইরাক থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে সত্য, কিন্তু ইরাক ধ্বংস হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে লিবিয়া ও সিরিয়াও। আফ্রিকায় বোকো হারাম, আল-শাবাবের মতো সংগঠনের জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ, তার শেষ হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানবিদ্বেষ কিছুটা কমেছে। তখন অরল্যান্ডোর এই হত্যাকাণ্ডে মুসলমানবিদ্বেষ আবার বাড়ল। অরল্যান্ডোর এই হত্যাকাণ্ডে আইএস নতুন একটি মাত্রা পেল। আইএসের কর্মকাণ্ড সিরিয়া-ইরাক ছাড়িয়ে ইউরোপের পর এখন যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রসারিত হলো। আইএস মার্কিন সমাজে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পেরেছে, এটা নিয়ে একদিকে বিতর্ক বাড়বে, অন্যদিকে নীতিনির্ধারকদের চিন্তার খোরাক জোগাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলমান সমাজে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে আইএস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা কী? আমি দুটি সার্ভে রিপোর্টের কথা উল্লেখ করতে চাই। দুটি সার্ভে রিপোর্টই পিউ (Pew) গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ওয়াশিংটন) থেকে পরিচালিত হয়েছে। পিউ ২০১৫ সালে বেশ কিছু মুসলমানপ্রধান দেশে আইএসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে একটি গবেষণা চালায়। যেমন লেবাননে শতভাগ মানুষ আইএসের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। জর্দানে এই সংখ্যা ৯৪ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৭৯ শতাংশ, ফিলিস্তিনে ৮৪ শতাংশ, তুরস্কে ৭৩ শতাংশ, নাইজেরিয়ায় ৬৬ শতাংশ, বুরকিনা ফাসোতে ৬৪ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৬৪ শতাংশ, সেনেগালে ৬০ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ মুসলমানপ্রধান দেশের মানুষ আইএসের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। আবার এসব দেশে আইএসের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ (তুরস্ক), ৪ শতাংশ (ইন্দোনেশিয়া), নাইজেরিয়ায় রয়েছে ১৪ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১১ শতাংশ, সেনেগালে ১১ শতাংশ, পাকিস্তানে ৯ শতাংশ। অর্থাৎ আইএস মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের একটা পরিসংখ্যান দিই। পিউ ২০১৬ সালে এই গবেষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ শতাংশ মানুষ আইএসকে অন্যতম হুমকি হিসেবে মনে করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে মনে করে ৭৬ শতাংশ মানুষ। সাইবার আক্রমণকে ৭২ শতাংশ মানুষ হুমকি মনে করে (ইইউয়ের ৫৪ শতাংশ) আর পরিবেশ বিপর্যয়কে হুমকি মনে করে ৫৩ শতাংশ (ইইউ ৬৬ শতাংশ)। পিউয়ের এই গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে আইএসের হুমকিকে তারা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। ফলে অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ড, আইএসের সংশ্লিষ্টতা যে মার্কিন সমাজে উদ্বেগ সৃষ্টি করবে, এটা বলাই বাহুল্য। এর প্রতিক্রিয়াও পাওয়া গেছে। মসজিদগুলোতে পুলিশি পাহারা বাড়ানো হয়েছে। মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় নজরদারি বেড়েছে। মুসলমানপ্রধান দেশগুলো থেকে অভিবাসনপ্রক্রিয়ায় এক ধরনের পরোক্ষ কড়াকড়ি আরোপ হতে যাচ্ছে। নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্প যদি বিজয়ী হন (?), তাহলে দৃশ্যপট বদলে যাবে। মুসলমানরা, বিশেষ করে অভিবাসী মুসলমানরা এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে। আর রিপাবলিকান আধ্যুষিত অঞ্চলে (যেমন টেক্সাস) তাদের সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হবে। সুতরাং অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমানদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। Daily kalerkonthoteo 23.06.2016

জঙ্গিরা কি এখন যুক্তরাষ্ট্রমুখী?


জঙ্গিরা কি এখন যুক্তরাষ্ট্রমুখী?ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো শহরে একটি সমকামী ক্লাবে হামলা চালিয়ে ৪৯ নাগরিককে হত্যা করার ঘটনা কি প্রমাণ করে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিরা সিরিয়া-ইরাক ছেড়ে তাদের কর্মকাণ্ড সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রসারিত করেছে? অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ডের পর এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা হত্যাকাণ্ডের জায়গায় ফুল দিয়ে নিহতদের প্রতি সম্মান জানিয়েছেন। কিন্তু যে প্রশ্নের জবাব এখনো পাওয়া যায়নি তা হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডটি আইএসের কাজ কিনা? সাধারণ হিসেবে এবং মার্কিন মিডিয়ায় বলা হচ্ছে, এটা আইএসের কাজ। এটা বলার পেছনে যুক্তিও আছে। প্রথমত, হামলাকারী ওমর মতিন আফগান-আমেরিকান নাগরিক। তিনি হত্যাকাণ্ড শুরু করার আগে জরুরি টেলিফোন বার্তায় (৯১১) নিজেকে আইএসের প্রতি তার আনুগত্যের কথা জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, রমজান মাস শুরু হওয়ার আগে আইএসের জনৈক মুখপাত্র জানিয়েছিলেন রমজানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালানো হবে। এখন সেই হামলাটি হলো। তবে এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা যায় তা হচ্ছে, এই হামলা ও হত্যাকাণ্ড এককভাবে ওমর মতিনের উদ্যোগেই পরিকল্পিত ও বাস্তবায়িত হয়েছে। ফলে এই হত্যাকাণ্ডটি আইএসের কাজ খুব সহজেই এটা ভাবা যায়। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। ওমর মতিনকে যারা চেনেন ও জানেন তারা টিভিতে বলেছেন মতিন উগ্র ধর্মীয় বিশ্বাসী ছিলেন না। তার ভেতরে কখনো জিহাদি মনোভাব কেউ কখনো দেখেনি। তিনি প্রচণ্ড সমকামীবিরোধী ছিলেন। তার বাবার বক্তব্যে এটি ফুটে উঠেছে। কিন্তু আবার এমন তথ্যও পাওয়া গেছে তিনি ওই সমকামী ক্লাবটিতে (পালস) অনিয়মিত যেতেন। তিনি মদ পান করতেন। তার সাবেক স্ত্রী কিংবা বর্তমান স্ত্রী পর্দা করতেন না। এতে আইএস জঙ্গিদের নেচারের সঙ্গে তাকে মেলানো যায় না। তিনি নিয়মিত মসজিদেও যেতেন না। দাঁড়িও রাখতেন না, যা আইএস জঙ্গিদের জন্য খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। তিনি বদরাগী ছিলেন। বৌ পেটাতেন। এক ধরনের হতাশা তার ভেতরে কাজ করছিল। এই হতাশা কিংবা মানসিক রোগ থেকেই কি তিনি এই হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন? হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়ার জন্য কি তিনি আইএসের নাম ব্যবহার করেছিলেন? এগুলো সবই স্পেসিক্যুলেশন। ধারণা মাত্র। নিশ্চয়ই এফবিআইয়ের তদন্তে বিষয়টি বেরিয়ে আসবে। এখানে তথ্য ধামাচাপা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একটি বড় ধরনের ঘটনা। অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ডের পেছনে মতিনের যে উদ্দেশ্যই কাজ করে থাকুক না কেন, ওখানে নতুন করে একটি মুসলমানবিদ্বেষী জনমত গড়ে উঠছে। ওবামা এই ঘটনাকে সন্ত্রাসীবাদী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করলেও তিনি তার বক্তৃতায় ‘রেডিকেল ইসলামের’ কথা কেন বলেননি, এটা নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। সরাসরি ডোনাল্ড ট্রাম্প ওবামার সমালোচনা করেছেন। ওবামা নিজে এবং ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন নিজেও এই ঘটনায় মুসলমান সাম্প্রদায়িক অভিযুক্ত করেননি। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটল এমন এক সময় যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র ৪ মাস। নভেম্বরে জঙ্গিরা কি এখন যুক্তরাষ্ট্রমুখী?সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এটা যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে, এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থিতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে। তারপরও দু’জন প্রার্থীর কিছু নির্বাচনী প্রচারণা বাকি রয়েছে। ট্রাম্প এসব প্রচারণায় তার আগের বক্তব্যের ব্যাপারে আরো সোচ্চার হচ্ছেন। অর্থাৎ আমেরিকাতে মুসলমানদের ঢুকতে না দেয়া এবং এই দেশে মুসলমান হিসেবে যারা অভিবাসী হয়েছিলেন তাদের বের করে দেয়া। ফলে যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ এ বিশ্বাস করেন তারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিন নির্বাচনের একটা যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। প্রায় প্রতিটি জনমতে যখন হিলারি ক্লিনটনের সম্ভাব্য বিজয়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন ৯/১১-এর মতো একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জনমত ট্রাম্পের পক্ষে নেয়ার এটি কোনো ষড়যন্ত্র কিনা! যদিও ৯/১১-এর পরিস্থিতির সঙ্গে অরল্যান্ডোর এই হত্যাকাণ্ডকে এক সঙ্গে মেলানো যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অতীতে কখনো এক সঙ্গে একই ঘটনায় একদিনে এত মানুষকে হত্যা করা হয়নি। অরল্যান্ডোর এই হত্যাকাণ্ডের প্রায় পাশাপাশি সময়ে প্যারিসে একটি ছোট্ট সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় একজন পুলিশ অফিসার ও তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে এবং আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেছে। আইএস সাধারণত ব্যক্তিকে টার্গেট করে না। কিন্তু এবার করল। আইএস ব্যাপক হত্যাকাণ্ড এক সঙ্গে সংঘটিত করে। অতীতে প্যারিস এবং ব্রাসেলসে তারা তাই করেছিল। আমি এই প্রথম দেখলাম আইএস ব্যক্তিকে টার্গেট করেছে এবং তাদের স্বীকারোক্তিও আছে। ফলে মুসলিমবিদ্বেষীরা প্যারিস আর অরল্যান্ডোর ঘটনাকে এক করে দেখতে চাইবে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাবকে উসকে দেয়া। এটা একটা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। কেননা হিলারি বিজয়ী হলে মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব চাপা পড়ে যাবে। একটি ‘মহল’ চাচ্ছে ট্রাম্পকে নির্বাচনে বিজয়ী করা। গেল সপ্তাহে অন্তত তিনটি জনমত জরিপে হিলারি ক্লিনটনকে এগিয়ে রাখা হয়েছে। ফক্স নিউজ জরিপে হিলারি এগিয়ে আছেন ৩ পয়েন্টের ব্যবধানে। রয়টার্সের জরিপে হিলারি এগিয়ে আছেন ৮ পয়েন্টের ব্যবধানে। আর কুইনিপিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপে বলা হয়েছে ৪ পয়েন্টে এগিয়ে থাকার কথা। ফলে ট্রাম্প শিবিরে একটি আতঙ্ক আছে। তারা যে একটি সুযোগ খোঁজার চেষ্টা করবেন না, তা বলা যাবে না। ওমর মতিন কি তাহলে কোন ‘শক্তি’ দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন? তার দ্বিতীয় স্ত্রী বিষয়টি জানতেন। যখন মতিন AR-15 রাইফেল কিনতে গিয়েছিলেন, তখন তার স্ত্রীও তার সঙ্গে ছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেন না কেন? মতিন যে নিরাপত্তা সংস্থায় (GYS) কাজ করতেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটির হয়ে কাজ করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে কাজ করা এক ব্যক্তি, থাকে এফবিআই (FBI) দু’ দুবার ‘ক্লিয়ার’ করেছে তার পক্ষে একা কী করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব? বাস্তবতা হচ্ছে ওই ঘটনায় পুলিশ তাকে হত্যা করে। ফলে পুরো ঘটনা কোনোদিনও জানা যাবে না। ৯/১১ নিয়ে যে এক ধরনের ধোঁয়াশা আছে, অরল্যান্ডোর ঘটনা নিয়েও এক ধরনের ধোঁয়াশা থেকে যাবে। মানুষ প্রকৃত সত্য জানতে পারবে না। তবে ষড়যন্ত্রকারীরা কতটুকু সফল হতে পারবে, সেটাই প্রশ্ন এখন। অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এখন যে প্রশ্নটি জড়িয়ে আছে, তা হচ্ছে অস্ত্র কেনার ব্যাপারে কোনো কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা উচিত কিনা? কেননা যে কেউ এ ধরনের অস্ত্র কিনতে পারে, যদি তার কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড না থাকে। দামও যে খুব বেশি, তাও নয়। এক তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ৫০ লাখ অজ-১৫ রাইফেল সাধারণ মানুষের কাছে আছে। এসব রাইফেল কি নিজেদের রক্ষার কাজেই সব সময় ব্যয় হয়? নিশ্চয়ই না। এসব অস্ত্র মানুষ হত্যায় ব্যবহƒত হয়, যেমনটি ব্যবহার করেছেন মতিন অরল্যান্ডোতে। অস্ত্রবাজদের হাতে বছরে মারা যায় প্রায় ১৩ হাজার নিরীহ মানুষ। অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ডের পর নতুন করে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি উঠে এসেছে। ওবামা নিজে এটি চান। হিলারি ক্লিনটন নিজেও বলেছেন, তিনিও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চান। কংগ্রেসেও বিষয়টি উঠেছে। কিন্তু অস্ত্র ব্যবসায়ীদের লবি এত শক্তিশালী যে, তারা কংগ্রেসম্যানদের নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হবে কিংবা অস্ত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে, এই বিশ্বাস রাখতে পারছি না। অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ড একটি দুঃখজনক ঘটনা। কোনো সভ্য দেশে এভাবে এত মানুষকে হত্যা করা হয় না। দুঃখজনক হলেও সত্য, সারাবিশ্বে আইএসের উত্থান যখন মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি ঘৃণার মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে, তখন একজন মুসলমান ওমর মতিন কর্তৃক এত মানুষ হত্যা ও নিজেকে আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে দাবি করা, আবার নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানবিরোধী একটা শক্ত মনোভাবের জš§ দেবে। ৯/১১-এর ঘটনাবলির পর মুসলমানরা যখন ধীরে ধীরে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পেরেছে, ঠিক তখনই ঘটল অরল্যান্ডোর ঘটনা। সামনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলীকে যে এই ‘সেন্টিমেন্ট’ প্রভাবিত করবে, এটাই স্বাভাবিক। তারপরও কথা থেকে যায় ‘মুসলমানবিরোধী’ এই মনোভাবকে পুঁজি করে ট্রাম্প যদি নির্বাচনে বিজয়ী হন (২) তাহলে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হবে একটি দুঃখজনক ঘটনা। এতে বহিঃবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ইমেজ সংকটের মুখোমুখি হবে। যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়বে। আর নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সুচনা হবে। সুতরাং অরল্যান্ডোর ঘটনাবলি দ্রুত মানুষ ভুলে যাবে, এটা মনে করার কারণ নেই। তবে সেই সঙ্গে এটাও লক্ষ্য রাখার বিষয় যে, অরল্যান্ডোর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডই কি শেষ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কি এ ধরনের হামলা আরো হতে পারে? আরো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থাকে একটি প্রশ্নের মধ্যে ঠেলে দেবে? কিংবা মুসলমানদের জীবন কি আরো অনিশ্চিত হয়ে উঠবে যুক্তরাষ্ট্রে? সম্প্রতি সিরিয়াতে আইএসের অবস্থান দুর্বল হয়েছে। সিরিয়া যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়ার সামরিক অংশগ্রহণের কারণে আইএসের অবস্থান দুর্বল হয়েছে। আইএস যেসব এলাকা দখল করে নিয়েছিল সেখান থেকে তারা নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। যুদ্ধের মাঠে আসাদ বাহিনীর অবস্থান এখন অনেক ভালো। ফলে আইএস বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অরল্যান্ডো কিংবা প্যারিস হামলা সংঘটিত করতে পারে এবং সে কারণেই তারা ব্যক্তিকে ব্যবহার করে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে পারে। আমার ধারণা, আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের হামলা আরো হতে পারে। ফলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি থাকবে এদিকে, কম দৃষ্টি থাকবে সিরিয়ার দিকে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে লাভ হবে কাদের? এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মুসলমানরা। তাদের ওপর নজরদারি বাড়বে। তাদের ভিন্ন চোখে দেখা হবে। চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার হবেন। যদিও এসব ঘটনার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই বক্তব্য এখানে মানুষ গ্রহণ করে নিয়েছে বলে মনে হয় না। ফলে এখানে মুসলিমবিদ্বেষ বাড়বে বলেই মনে হয়। এরই মাঝে যদি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যান তাহলে তা মুসলমান সমাজের জন্য হবে আরো খারাপ খবর।
 ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
 Daily Manobkontho
 20.06.2016

বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ নাকি নির্বাচনী ষড়যন্ত্র?

যুক্তরাষ্ট্রে অরল্যান্ডোর সমকামী ক্লাবে হত্যাকাণ্ডের রেশ এখনও ফুরিয়ে যায়নি। প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায়, টিভি চ্যানেলগুলোতে এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রায় প্রতিটি দেশ থেকে সমবেদনার বার্তা পাঠানো হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা নিজে ছুটে গেছেন অরল্যান্ডোতে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দু’জনই- হিলারি ক্লিনটন আর রোনাল্ড ট্রাম্প এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে মন্তব্য করেছেন। বলা হচ্ছে, সমসাময়িক যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একদিনে একটি ঘটনায় ৪৯ জন মানুষের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আগে আর কখনও ঘটেনি। ঘুরেফিরে আবারও এসেছে ৯/১১-এর ঘটনার প্রসঙ্গ। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসবাদীরা নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হাইজ্যাক করা প্লেন বিধ্বস্ত করিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। সন্ত্রাসবাদীদের প্রায় সবাই ছিলেন সৌদি নাগরিক ও মুসলমান। এরপর কেটে গেছে ১৪ বছর। বিশ্বজুড়ে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করলেও আজও সেই যুদ্ধের শেষ হয়নি। ঠিক এমনই একটি সময়ে ঘটল অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ডটি। সবচেয়ে বড় কথা, ওমর মতিন, যে একাই এ হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছে, সে পুলিশের হাতে নিহত হওয়ার আগে ৯১১-এ জরুরি বার্তা পাঠিয়ে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছিল। আর এ প্রসঙ্গটিই এখন মার্কিন মিডিয়ায় ঘুরেফিরে আসছে- আইএস এ হামলার সঙ্গে জড়িত! অরল্যান্ডো হামলাকে পুঁজি করে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও সরব হয়েছেন। তিনি আবারও বলেছেন, মুসলমানদের জন্য মার্কিন অভিবাসনের দরজা বন্ধ করে দিতে হবে। এর আগেও তিনি এ ধরনের দাবি তুলে বিতর্কিত হয়েছিলেন। এখন সামনে নির্বাচন। বাকি আছে মাত্র ৪ মাস। আবারও তিনি ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান-বিদ্বেষী বক্তব্য রাখলেন। অরল্যান্ডো হত্যাকাণ্ডের পর মুসলমানদের ওপর পরোক্ষ নজরদারি বাড়ছে। এখন রমজানের সময়। আমি এখন যে এলাকায় রয়েছি, ডালাসের পশ এলাকা হিসেবে পরিচিত হাইল্যান্ডের ভিলেজে মুসলমানরা (বিভিন্ন দেশের) সাধারণত মসজিদে গিয়ে রোজা ভাঙেন, দল বেঁধে ইফতার করেন এবং দীর্ঘসময় সেখানে কোরআন পাঠে অংশ নেন। সেদিন হঠাৎ করেই দেখলাম মসজিদে পুলিশ। কড়া পাহারা। এটা শুধু মুসল্লিদের পাহারার জন্য কিনা তার কোনো জবাব নেই। দু’-একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে যখন গেছি, তখন লক্ষ করেছি মানুষ আড়চোখে তাকায়। ৯/১১-পরবর্তী সময়ের মতো পরিস্থিতি ফিরে এলো কি-না বলতে পারব না। কিন্তু স্থানীয় মুসলমানরা এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকছেন। আগে আমি এমনটি দেখিনি। এটা সত্য, ওমর মতিন এককভাবেই এ হামলা চালিয়েছে। তবে তার সঙ্গে আইএস জঙ্গিদের সম্পর্ক ছিল কিনা কিংবা আইএস তাকে ব্যবহার করেছিল কিনা, সে প্রশ্ন হয়তো আগামী দিনে বের হবে। তবে অনেক ঘটনার খবর আমরা পাচ্ছি, যাতে করে এ হত্যাকাণ্ডটি বুঝতে সহজ হবে। এক. এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কারণ ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর এ ক্লাবটিতে মতিন নিয়মিত যেত। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মাত্র ৯ দিন আগে সে ১২০০ ডলারের বিনিময়ে একটি এআর-১৫ রাইফেল কেনে, যা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়। মার্কিন আইনে যে কেউ (তার বিরুদ্ধে যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ না থাকে) এ ধরনের রাইফেল কিনতে পারে। ওমর তা-ই কিনেছিল। দুই. ওমর মতিন নিজেও সমকামী ছিল। তার সাবেক স্ত্রী ব্রাজিল টিভিকে এ কথা বলেছেন। ওই ক্লাবে তার দু-একজন ‘বন্ধু’ ছিল, তারাও এটা স্বীকার করেছে। ফলে ধর্মীয় মতাদর্শের (ইসলাম সমকামিতা অনুমোদন করে না) কারণে সে সমকামী ক্লাবে হামলা চালিয়েছে- এই যুক্তি ধোপে টেকে না। তিন. এর আগে দু-দুবার এফবিআই তার সন্ত্রাসী কানেকশন নিয়ে তদন্ত করেছিল। কিন্তু তদন্তে কিছু অর্থাৎ জঙ্গি কানেকশন প্রমাণিত হয়নি। আর এফবিআইয়ের ছাড়পত্র ছিল বলেই সে এআর-১৫ রাইফেল কিনতে পেরেছিল। সাধারণত এফবিআইয়ের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া এ ধরনের অস্ত্র কেনা যায় না। চার. ওমর মতিন উগ্র মেজাজি, বদরাগি ছিল। কিন্তু প্রচণ্ড ধর্মীয় মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিল, এমনটা জানা যায়নি। তার সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল একটিই কারণে- তার বদমেজাজ। সে স্ত্রীকে নিয়মিত পেটাত। তার সাবেক স্ত্রী বা তার বাবা যেসব সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তাতে তারা তার জঙ্গি কানেকশন নিয়ে কোনো কথা বলেননি। ফলে একটা প্রশ্ন থাকলই যে, এ হামলায় আদৌ আইএসের কোনো ইন্ধন ছিল কিনা? বলা ভালো, ওমর মতিন পারিবারিকভাবে আফগান সংস্কৃতির ধারক হলেও সে যুক্তরাষ্ট্রেই জন্মগ্রহণ করে। তবে তার বাবা-মা আফগানিস্তান থেকে এসেছিলেন। তার সাবেক স্ত্রীও ছিলেন আফগান-আমেরিকান। চার. সে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করত। যে কোম্পানিতে সে চাকরি করত, তার মালিক ইহুদি। ফলে একটা ইসরাইলি কানেকশনের সম্ভাবনা থেকেই গেল। পাঁচ. ওমর মতিন কি মানসিক রোগী ছিল? অন্তত তার সাবেক স্ত্রী সিতোরা ইউসুফীর একটি বক্তব্য এ ধরনের একটি সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে। সিতোরা বলেছেন, মতিন মানসিকভাবে অস্থির প্রকৃতির মানুষ ছিল। সে অসুস্থ ও এক ধরনের ভয়ের মধ্যে থাকত সব সময়। তবে একজন মানসিক রোগী হিসেবে তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছিলেন কিনা, তা জানা যায়নি। তার সাবেক স্ত্রী এবং তার বাবাও এ প্রসঙ্গে কিছু বলেননি। অরল্যান্ডো হত্যাকাণ্ডের পেছনে মতিনের যে ‘উদ্দেশ্যই’ কাজ করে থাকুক না কেন, এখানে নতুন করে একটি মুসলমান-বিদ্বেষী জনমত গড়ে উঠছে। ওবামা এ ঘটনাকে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করলেও তিনি তার বক্তৃতায় ‘র‌্যাডিক্যাল ইসলামের’ কথা কেন বলেননি, এটা নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি ওবামার সমালোচনা করেছেন। ওবামা নিজে এবং ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনও এ ঘটনায় মুসলমান সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করেননি। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটল এমন এক সময় যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র ৪ মাস। নভেম্বরে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এটা যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থিতা ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে। তারপরও দু’জন প্রার্থীর কিছু নির্বাচনী প্রচারণা বাকি রয়েছে। ট্রাম্প এসব প্রচারণায় তার আগের বক্তব্যের ব্যাপারে আরও সোচ্চার হচ্ছেন। অর্থাৎ আমেরিকায় মুসলমানদের ঢুকতে না দেয়া এবং এই দেশে মুসলমান হিসেবে যারা অভিবাসী হয়েছিলেন, তাদের বের করে দেয়া। ফলে যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ বিশ্বাস করেন, তারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিন নির্বাচনের একটা যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন! প্রায় প্রতিটি জনমতে যখন হিলারি ক্লিনটনের সম্ভাব্য বিজয়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন ৯/১১-এর মতো একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জনমত ট্রাম্পের পক্ষে নেয়ার এটি কোনো ষড়যন্ত্র কিনা! যদিও ৯/১১-এর পরিস্থিতির সঙ্গে অরল্যান্ডো হত্যাকাণ্ডকে মেলানো যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অতীতে কখনও একসঙ্গে একই ঘটনায় একদিনে এত মানুষকে হত্যা করা হয়নি। অরল্যান্ডো হত্যাকাণ্ডের প্রায় কাছাকাছি সময়ে প্যারিসে একটি ছোট্ট সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় একজন পুলিশ অফিসার ও তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। এবং আইএস এ হত্যাকাণ্ডের দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেছে। আইএস সাধারণত ব্যক্তিকে টার্গেট করে না। কিন্তু এবার করল। আইএস ব্যাপক হত্যাকাণ্ড একসঙ্গে সংঘটিত করে। অতীতে প্যারিস ও ব্রাসেলসে তারা তা-ই করেছিল। আমি এই প্রথম দেখলাম আইএস ব্যক্তিকে টার্গেট করেছে। এবং তাদের স্বীকারোক্তিও আছে। ফলে মুসলিম-বিদ্বেষীরা প্যারিস আর অরল্যান্ডোর ঘটনাকে এক করে দেখতে চাইবে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান-বিদ্বেষী মনোভাবকে উসকে দেয়া। এটা একটা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। কারণ হিলারি বিজয়ী হলে মুসলিম-বিদ্বেষী মনোভাব চাপা পড়ে যাবে। একটি ‘মহল’ চাচ্ছে ট্রাম্পকে নির্বাচনে বিজয়ী করতে। গেল সপ্তাহে অন্তত তিনটি জনমত জরিপে হিলারি ক্লিনটনকে এগিয়ে রাখা হয়েছে। ফক্স নিউজ জরিপে হিলারি এগিয়ে আছেন ৩ পয়েন্টের ব্যবধানে। রয়টার্সের জরিপে হিলারি এগিয়ে আছেন ৮ পয়েন্টের ব্যবধানে। আর কুইনিপিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপে বলা হয়েছে ৪ পয়েন্টে এগিয়ে থাকার কথা। ফলে ট্রাম্প শিবিরে একটি আতংক আছে। তারা যে একটি সুযোগ খোঁজার চেষ্টা করবেন না, তা বলা যাবে না। ওমর মতিন কি তাহলে কোনো ‘শক্তি’ দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিল? তার দ্বিতীয় স্ত্রী বিষয়টি জানতেন। যখন মতিন এআর-১৫ রাইফেল কিনতে গিয়েছিল, তখন তার স্ত্রীও তার সঙ্গে ছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেন না কেন? মতিন যে নিরাপত্তা সংস্থায় (৪েঝ) কাজ করত, তারা যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটির হয়ে কাজ করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে কাজ করা এক ব্যক্তি, যাকে এফবিআই দু’দুবার ‘ক্লিয়ার’ করেছে, তার পক্ষে একা কী করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব? বাস্তবতা হচ্ছে, ওই ঘটনায় পুলিশ তাকে হত্যা করে। ফলে পুরো ঘটনা কোনোদিনও জানা যাবে না। ৯/১১ নিয়ে যে এক ধরনের ধোঁয়াশা আছে, অরল্যান্ডোর ঘটনা নিয়েও এক ধরনের ধোঁয়াশা থেকে যাবে। মানুষ প্রকৃত সত্য জানতে পারবে না। তবে ষড়যন্ত্রকারীরা কতটুকু সফল হতে পারবে, সেটাই প্রশ্ন এখন। অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরও যে প্রশ্নটি জড়িয়ে আছে তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র কেনার ব্যাপারে কোনো কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা উচিত কি-না? কারণ যে কেউ এ ধরনের অস্ত্র কিনতে পারে, যদি তার কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড না থাকে। দামও যে খুব বেশি, তাও নয়। এক তথ্য মতে যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ৫০ লাখ এআর-১৫ রাইফেল সাধারণ মানুষের কাছে আছে। এসব রাইফেল কি নিজেদের রক্ষার কাজেই সব সময় ব্যবহার হয়? নিশ্চয়ই না। এসব অস্ত্র মানুষ হত্যায় ব্যবহৃত হয়, যেমনটি ব্যবহার করেছে মতিন অরল্যান্ডোতে। অস্ত্রবাজদের হাতে বছরে মারা যান প্রায় ১৩ হাজার নিরীহ মানুষ। অরল্যান্ডোর হত্যাকাণ্ডের পর নতুন করে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি উঠে এসেছে। ওবামা নিজে এটি চান। হিলারি ক্লিনটন নিজেও বলেছেন, তিনিও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চান। কংগ্রেসেও বিষয়টি উঠেছে। কিন্তু অস্ত্র ব্যবসায়ীদের লবি এত শক্তিশালী যে তারা কংগ্রেসম্যানদের নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হবে কিংবা অস্ত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে, এ বিশ্বাস রাখতে পারছি না। অরল্যান্ডো হত্যাকাণ্ড একটি দুঃখজনক ঘটনা। কোনো সভ্য দেশে এভাবে এত মানুষকে হত্যা করা হয় না। দুঃখজনক হলেও সত্য, সারা বিশ্বে আইএসের উত্থান যখন মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটা ঘৃণার মনোভাব সৃষ্টি করেছে, তখন একজন মুসলমান ওমর মতিন কর্তৃক এত মানুষ হত্যা এবং নিজেকে আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে দাবি করা, আবার নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানবিরোধী একটা শক্ত মনোভাবের জন্ম দেবে। ৯/১১-এর ঘটনাবলীর পর মুসলমানরা যখন ধীরে ধীরে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পেরেছে, ঠিক তখনই ঘটল অরল্যান্ডোর ঘটনা। সামনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলীকে যে এ ‘সেন্টিমেন্ট’ প্রভাবিত করবে, এটাই স্বাভাবিক। তারপরও কথা থেকে যায়- ‘মুসলমানবিরোধী’ এ মনোভাবকে পুঁজি করে ট্রাম্প যদি নির্বাচনে বিজয়ী হন (?), তাহলে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হবে একটি দুঃখজনক ঘটনা। এতে করে বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ইমেজ সংকটের মুখোমুখি হবে। যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়বে। আর নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হবে। সুতরাং অরল্যান্ডোর ঘটনাবলী দ্রুত মানুষ ভুলে যাবে, এটা মনে করার কারণ নেই। ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র Daily Jugantor 19.06.16

দক্ষিণ এশিয়ায় পানি সংকট ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক


দক্ষিণ এশিয়া একটি বড় ধরনের পানি সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক রিপোর্টে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরই মধ্যে ভারতের কোনো কোনো রাজ্যের খরার খবর আমরা সংবাদপত্র থেকে পাচ্ছি। খরায় মৃত্যুর খবরও আছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের দিকে বিশ্ব বড় ধরনের পানি সংকটের মুখে পড়বে। তখন মাত্র ৬০ ভাগ জনগোষ্ঠী পানি পাবে, বাকি ৪০ ভাগের ক্ষেত্রে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে না। জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশ্ব পানি উন্নয়ন সংস্থার এক রিপোর্টেও দক্ষিণ এশিয়ার ভয়াবহ পানি সংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, ভারতের ২২ থেকে ৩২টি শহর ভয়াবহ পানি সংকটের মুখে পড়বে। কাঠমান্ডু ও করাচির মতো শহরও পানি সংকটের মধ্যে পড়বে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুব ভালো, তা বলা যাবে না। ভারতের পানি রাজনীতির শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। তিস্তা যখন ‘মরা খালে’ পরিণত হয়েছে, তখন একটি উদ্যোগের কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের আপত্তি সত্ত্বেও ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত চালু করতে যাচ্ছে। স্বয়ং পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী আমাদের এ কথা জানিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশ প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। গেল জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় যে ৬৫ দফা সংবলিত যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেখানে ২১নং দফায় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল যে, ‘ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়।’ এখন উমা ভারতীর বিবিসিকে দেয়া বক্তব্য কী ওই প্রতিশ্রুতিকে ভঙ্গ করল না? যৌথ ঘোষণায় যখন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, তখন তা রক্ষা করার দায়িত্ব ওই রাষ্ট্রের। ভারতের এ ‘আচরণ’ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং তা দুই দেশের সম্পর্ককে একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে। বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা এর ব্যাখ্যা চাইবে। কিন্তু শুধু ‘ব্যাখ্যা চাওয়া’ই যথেষ্ট নয়। এখানে বলা ভালো, খোদ ভারতেই এ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক আছে। ভারতের পরিবেশবাদীরা প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছেন। এ নিয়ে তারা সেখানে আন্দোলন পর্যন্ত করেছেন। এখানে বলা ভালো, ভারতে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, অর্থাৎ হিমালয় অঞ্চল থেকে উৎপন্ন নদীগুলোর পানি ৩০টি খালের মাধ্যমে ভারতের খরাপীড়িত দক্ষিণাঞ্চলে সরিয়ে নেয়া এবং বিভিন্ন নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার এই যে মহাপরিকল্পনা, তার ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৮০ সালে এ পরিকল্পনার কথা প্রথম জানা যায় এবং ২০০২ সালে বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের একটি রায়ও তাদের পক্ষে যায়। তবে সাম্প্রতিক এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার পেছনে কাজ করছে ভারতের কয়েকটি অঞ্চল প্রচ- পানির অভাব ও খরা দেখা দেয়ার বিষয়টি। কৃষক পানি পাচ্ছেন না। পানির অভাবে কৃষকের আত্মহত্যার খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। সম্ভবত এটা বিবেচনায় নিয়েই ভারতের নীতিনির্ধারকরা দ্রুত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছেন। কিন্তু এটা যে মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি করবে ও পার্শ¦বর্তী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাবেÑ এটা তারা বিবেচনায় নেননি। ভারতের এ পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে এবং দুই দেশের সম্পর্কের ওপর তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বলা হয়, ভারতের খরা এলাকার জন্য পানি দরকার। কিন্তু এক নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে খালের মাধ্যমে অন্য এলাকায় (দক্ষিণে) নিয়ে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। ভারতের ভাকরা বাঁধ নিয়ে একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছিল, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা প্রদেশের জন্য ভাকরা থেকে পাওয়া পানি নয়, বরং ভূগর্ভস্থ পানি এবং উন্নত কৃষি ব্যবস্থা বেশি জরুরি। পাঞ্জাবের মোট ২০ শতাংশ এবং হরিয়ানার ৩১ শতাংশ চাষযোগ্য জমি বাঁধ নিয়ন্ত্রিত। এমনকি ৫০ বছর পর আজও সেখানকার বাস্তুহারা মানুষ কঠোর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুর জন্য। ওই গবেষণার ফলই বলে দিচ্ছে, নর্মদা বাঁধের উচ্চতা না বাড়িয়ে কীভাবে আরও বেশি পানি ও বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে মাথা ঘামানো দরকার। নর্মদা বাঁধসংলগ্ন অঞ্চলের বাস্তুহারা ৫০ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র, যখন কিনা ওইসব রাজ্যে বাড়তি কোনো জমি নেই তাদের পুনর্বাসনের জন্য? তিহরি বাঁধের শিকার হয়েছেন যারা, তারাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার। কেননা, না ইউপি, না কেন্দ্র সরকার কোনোরূপ সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল তাদের সাহায্যার্থে। এখন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প যে শুধু বাংলাদেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা নয়। বরং খোদ ভারতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ভারতের নীতিনির্ধারকরা এটা বিবেচনায় নিচ্ছেন না। এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি অবৈধ। আন্তর্জাতিক আইনবিশারদ অধ্যাপক ওপেনহেইম বলেছেন, কোনো রাষ্ট্রকে নিজ ভূখ-ের প্রাকৃতিক অবস্থা এমনভাবে পরিবর্তন করতে দেয়া যাবে না, যার ফলে তা প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের ভূখ-ের প্রাকৃতিক অবস্থার অসুবিধা সৃষ্টি করে। এ আলোকেই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি অবৈধ। যখন কোনো রাষ্ট্র একটি অভিন্ন সম্পত্তির উন্নতি, পরিবর্তন বা ধ্বংস সাধনের জন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে, তখন ওই রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কিছু নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়। আন্তর্জাতিক আইন আরও বেশি সুনির্দিষ্ট, যখন তা আন্তর্জাতিক নদী সম্পর্কিত হয়। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের সব ক’টি নদীই আন্তর্জাতিক নদী। তাই এসব নদীর একতরফা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেআইনি এবং অগ্রহণযোগ্য। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। তা অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি না করেই হতে হবে। কিন্তু ভারতের এ উদ্যোগে একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে, ভারত বাংলাদেশের ওপর এ প্রকল্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষা করছে।
হেলসিংকি নীতিমালার অনুচ্ছেদ ২৯ এ বলা হয়েছে, এক অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অপর অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্রকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক, নিষ্কাশন অববাহিকার পানির ব্যবহারের ব্যাপারে কৃত পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করবে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার (আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত) ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত একটি অস্বচ্ছ ও স্বেচ্ছাচারমূলক পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জলপ্রবাহ কনভেনশনটি গ্রহণ করা হয়। এ কনভেনশনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। কনভেনশনের ৬ অনুচ্ছেদে যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহার নির্দিষ্টকরণে কতগুলো শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহার নির্ধারণে এ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সব ক’টি শর্তকে একই সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বিবদমান দেশগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। জলপ্রবাহ কনভেনশনে উল্লিখিত নীতিমালাগুলোর আলোকে ভারতে প্রস্তাবিত নদী সংযোগ প্রকল্পকে বিচার করলে দেখা যাবে, ভারত সুস্পষ্টভাবে কনভেনশনে বিধিবদ্ধ প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করছে। এমনকি জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ অনুসারে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো পরস্পর পরামর্শ করবে এবং একই সঙ্গে জলাভূমির এবং সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর সংরক্ষণের স্বার্থে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা এবং বিধিবিধান প্রণয়ন করবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোকে ধ্বংস করার নামান্তর, যা কিনা রামসার কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করতে পারি। যেখানে ওই অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘উভয় পক্ষ সমতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং পারস্পরিক ক্ষতি না করার নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে’, সেখানে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করা হলে, তা হবে ওই চুক্তির বাধ্যবাধকতা ও অঙ্গীকারের চরম লঙ্ঘন।
এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে পানির বণ্টন বা পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। ভারতীয় সংবিধানের ২৪৬নং ধারা এবং সপ্তম শিডিউল অনুযায়ী কোনো রাজ্যের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহের অধিকার সেই রাজ্যের। এখানে কেন্দ্র কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। অতীতে কৃষ্ণা নদীর পানির ব্যবহার, প্রত্যাহার ও পানির সংরক্ষণ নিয়ে তিনটি রাষ্ট্র মহারাষ্ট্র, কর্নাটক আর অঙ্গরাজ্যের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল, যা ভারতে আন্তঃরাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের এক সংকটের সৃষ্টি করেছিল। এ বিবাদ মীমাংসার জন্য একটি ট্রাইব্যুনালও গঠিত হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত রাজ্যগুলোর প্রাপ্ত অধিকার স্বীকার করে ওই ট্রাইব্যুনাল একটি রায় দিয়েছিল। আজ বেশ ক’টি রাজ্যের আপত্তির মুখে কীভাবে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। আসলে একটি ব্যবসায়ী শ্রেণী মোদিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। তারা চান ব্যবসা। আর এ প্রকল্পটি হচ্ছে বিশাল একটা ব্যবসার জায়গা, যেখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৬০ হাজার কোটি রুপি, যা দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে ব্যবহৃত হবে। কোর্টের রায় অনুযায়ী তা এখন ১০ বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে। ফলে এ অর্থটাই হচ্ছে মূল কারণ। তবে আমরা বসে থাকতে পারি না। বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে একটি ‘নোট ভারবাল’ পাঠিয়েছে। এটা যথেষ্ট নয়। অতি দ্রুত দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এ বিষয়টি উত্থাপন করা প্রয়োজন এবং প্রকাশিত সংবাদটির ব্যাপারে ভারতের কাছ থেকে একটি ব্যাখ্যা চাওয়াও প্রয়োজন।
Daily Alokito Bangladesh
19.06.16

শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন



               
প্রস্তাবিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শিক্ষা খাত ও প্রযুক্তি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। শুধু শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। টাকার অঙ্কে বরাদ্দের পরিমাণ ৫২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। বরাদ্দের হার বিবেচনায়ও গেল ১০ বছরের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ একসঙ্গে থাকলেও আগামী অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ছে ১১ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ২৬ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ২২ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। মোট বরাদ্দ ৪৯ হাজার ৯ কোটি টাকা। অথচ চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩১ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে অর্থের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছিল। এখন শিক্ষা খাতে এ ব্যয় বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। অর্থাৎ এ বিপুল ব্যয় বরাদ্দ আমাদের উচ্চশিক্ষার মানকে কতটুকু উন্নত করতে পারবে? আমি যদি লন্ডনের বিখ্যাত ইকোনমিস্ট পত্রিকার ‘ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ এর তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করি, তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের মাঝে ৪৭ ভাগ বেকার। একমাত্র আফগানিস্তান বাদে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার বেশি। শ্রীলঙ্কায় যেখানে এই হার মাত্র ৭ ভাগ, নেপালে ২০ ভাগ, পাকিস্তানে ২৮ আর ভারতে ৩৩ ভাগ, সেখানে বাংলাদেশে এ হার ৪৭ ভাগ। এটা নিঃসন্দেহে একটা উদ্বেগজনক বিষয়। যেখানে প্রতি বছর ১৩ থেকে ১৬ লাখ জনশক্তি চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে, সেখানে বিভিন্ন কারণে (রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অন্যতম) এদেশে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে বেকারত্ব। এ বেকারত্বের মাঝে আবার আছে কিছু ‘ছায়া বেকারত্ব’। এদের দেখা যায় না বটে কিংবা কোনো পরিসংখ্যানেও এরা আসে না। কিন্তু ছোটখাটো, অর্ধবেলা কাজ করে এরা জীবিকা নির্বাহ করছে।
আমরা দেশে এরই মধ্যে ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১০টির মতো। সব মিলিয়ে ১৪৭টি বিশ্ববিদ্যালয় এদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ক’টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানসম্মত দক্ষ গ্রাজুয়েট আমরা তৈরি করেছি? এর জবাব অত্যন্ত হতাশাজনক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন অনেকটা সার্টিফিকেটসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ ছাত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় পড়াশোনা করে। কিন্তু এখানে কী আদৌ পড়াশোনা হয়? শত শত কলেজে অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। ঢাকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কিংবা ইউজিসির কর্তাব্যক্তিরা জানেন না, এ অনার্স কোর্স খুলে শত শত শিক্ষকের জন্য একটা ‘ব্যবসার’ সুযোগ করে দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়! আমি অনেক কলেজের খবর জানি, সেখানে আদৌ কোনো ক্লাস হয় না। শিক্ষকরা কলেজে শিক্ষাদানের পরিবর্তে বাসায় ব্যাচের পর ব্যাচ ‘প্রাইভেট’ পড়ান। অথচ ওই শিক্ষকের কালেজে থাকার কথা। অনার্স পর্যায়ে কোনো ছাত্র প্রাইভেট পড়ে অথবা শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন, এটা আমাদের জমানায় আমরা না শুনলেও এটা হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন সরকারি কলেজগুলোর একটি বাস্তব চিত্র। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আসেন, ভিসি যান; কিন্তু সংস্কার কেউ করেন না। এটা এখন মূলত একটি সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ভর্তি হয়ে চার বছর পর মেলে একখানা সার্টিফিকেট। ক্লাস না করে, সংসারধর্ম পালন করে; কোনো টেক্সট বই না পড়েও যে একখানা অনার্স সার্টিফিকেট পাওয়া যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর বড় উদাহরণ। এ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই দেশে উচ্চ শিক্ষায় বড় অংশের বেকারত্ব সৃষ্টি করছে। দুঃখ লাগে, শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি এদিকে পড়েনি। তিনি আদৌ ভেবেছেন কিনা, তাতেও রয়েছে আমার সন্দেহ।
একুশ শতকে একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরকে শক্তিশালী করতে হবে। সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি জোর দিতে হবে প্রযুক্তিগত তথা আইটিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। এ আইটিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা একদিকে যেমন বেকার সমস্যা সমাধানে বড় ভূমিকা রাখবে, ঠিক তেমনি বহির্বিশ্বে মানবসম্পদের একটা সুষ্ঠু ব্যবহারও হবে। আর তাই শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরকে ঢেলে সাজাতে হবে, সিলেবাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে এবং শিক্ষা কাঠামোতেও আনতে হবে পরিবর্তন। এজন্যই গ্রাম পর্যায়ে স্কুল বাড়িয়ে, সরকারি অনুদান বাড়িয়ে প্রতিটি স্কুলকে মানবসম্পদ গড়ার এক একটি ‘কারখানা’ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সিঙ্গাপুর এ কাজটি করেছিল বিধায়, ছোট এই দেশটি আজ উন্নয়নশীল বিশ্বে একটি আদর্শ। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, আমরা এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছি কম। শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছে সরকার। তাতে উপকৃত হয়েছে কারা? বেতন খাতেই তো চলে যায় পুরো টাকা। সরকারি কলেজগুলোতে অবকাঠামো খাতে কিছু উন্নয়ন হয়। কিন্তু এখানে মানসম্মত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন না কেউ। আর শিক্ষকরা এখন গুরুত্ব দেন প্রাইভেট পড়ানোর ওপর। মানসম্মত শিক্ষা তাদের কাছে মুখ্য নয়। এসব দেখারও যেন কেউ নেই। অর্থমন্ত্রী যখন নতুন বাজেট উপস্থাপন করলেন, তখন এ কথাটাই আবার মনে হলো। নিয়ম রক্ষার্থে তিনি শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হচ্ছে এ বিশাল ব্যয় দিয়ে আমরা উচ্চশিক্ষার কতটুকু মানোন্নয়ন করতে পারব? বাস্তবতা হচ্ছে, শিক্ষার মানোন্নয়ন, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় গবেষণা, আইটি সেক্টরের উন্নয়নÑ এ বরাদ্দ দিয়ে আদৌ সম্ভব নয়। কেননা এ অর্থের মাঝে ২২ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ব্যয় হবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পেছনে। আর ২৬ হাজার ৮৪৭ কোটি (নির্দিষ্ট) টাকা ব্যয় হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পেছনে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য যে বরাদ্দ, তাতে আমাদের উৎফুল্লিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা এ টাকার খুব সামান্যই ব্যয় হয় উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের মাঝে একটা অংশ বরাদ্দ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য। ২০০১-০২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৯৩.৫৭ কোটি টাকা, আর ২০১০-১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১১০২.২৪ কোটি টাকা। জাতীয় বাজেটের মাত্র ০.৭৫ ভাগ বরাদ্দ থাকে শিক্ষা খাতে (২০০১-০২)। এ পরিসংখ্যান বেড়েছে ০.৮৪ ভাগ ২০১০-১১ সালে। আবার যদি শুধু শিক্ষা খাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বরাদ্দের দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে, এ বরাদ্দ মাত্র ৭.৮৫ ভাগ (২০০১-০২) থেকে ৮.২২ ভাগ (২০১০-১১)। আগামী অর্থবছরে এ হার খুব বেড়েছে তা নয়। অর্থাৎ পরিসংখ্যানই বলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। সাম্প্রতিক শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে, বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। যদিও তুলনামূলক বিচারে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম। তারপরও কথা থেকে যায়। রাষ্ট্রের পক্ষে এর চেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব নয়। এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভেবে দেখতে হবে, কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় বাড়ানো যায় এবং সরকারের ওপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা কমানো যায়। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন আর তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে টাকা বরাদ্দ করা হয়, তার খুব কম অংশই ব্যয় হয় গবেষণার কাজে। বরাদ্দকৃত টাকার একটি সিংহভাগ চলে যায় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উপাচার্য মহোদয়রা উন্নয়ন খাতে কিংবা গবেষণায় যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, সে টাকা নতুন শিক্ষকদের বেতন দিতে ব্যয় করেছেন। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দলীয় কোটায়, স্থানীয় কোটায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। কিছু দিন আগে একটি জাতীয় দৈনিক ৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ওপর একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি নিজের মেয়ে, ভাই, আপন ভায়রা, শ্যালিকার মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়েকে শিক্ষক তথা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটা রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এ প্রবণতা প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। অভিযোগ আছে, জাহাঙ্গীরনগর এরই মধ্যে একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে! ফলে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নয়ন বাজেট থেকে টাকা এনে শিক্ষক তথা কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ২০১১-১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্জুরি কমিশন (বিমক) কর্তৃক বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২২২.৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬৫.১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে শুধু শিক্ষকদের বেতন দিতে। বিমক যে টাকা বরাদ্দ করে, তা দিয়ে বেতন, পেনশন, সাধারণ খরচ, শিক্ষা খরচ, যানবাহন মেরামত ও মূলধনের চাহিদা মেটানো হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেতন পরিশোধের পর যা থাকে, তা দিয়ে অন্য কিছু করা আর সম্ভব হয় না। ছাত্রদের আবাসিক সমস্যার সমাধান হয় না। তাদের ন্যূনতম চাহিদাও মেটাতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও খারাপ। তারা অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পেনশন দিতে পারে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। একুশ শতকে এসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুরোপুরিভাবে সরকারি অর্থে পরিচালিত হবে, এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বাংলাদেশ একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি কল্যাণকামী অর্থনীতিও নয়। অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপের কোনো কোনো রাষ্ট্রে (যেমন জার্মানি) কিংবা নরডিকভুক্ত রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্র সব নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ সেই পর্যায়ে যেতে পারেনি। ওইসব রাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা একদম ফ্রি। আমরা সেখানে পড়াশোনা করেছি কোনো রকম টিউশন ফি ছাড়াই (শুধু ছাত্র সংসদের জন্য কিছু অর্থ দিতে হয়)। স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরিভাবে ফ্রি না হলেও বেকার ভাতা সেখানে রয়েছে। জার্মানি বা সুইডেনের অর্থনীতির পক্ষে সম্ভব সাধারণ নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি সে পর্যায়ে নেই। তবে যে পর্যায়ে রাষ্ট্র শিক্ষা খাতকে প্রমোট করে, তা ঠিক আছে। রাষ্ট্র শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ দেবে। তবে এখানে উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে।
একুশ শতকে এসে একটা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ছাত্র বেতন না বাড়িয়েও আয় বাড়ানো যায়। এজন্য কতগুলো বিকল্প নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখতে পারেন। প্রয়োজন পিপিপি অথবা বেসরকারি খাতকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। যেমন ব্যবসা প্রশাসন, অর্থনীতি, প্রযুক্তিবিদ্যা, ফার্মেসিতে বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বেসরকারি পুঁজিতে ল্যাব হতে পারে, ছাত্রাবাস নির্মিত হতে পারে, ট্রেনিং প্রোগ্রাম হতে পারে। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী রয়েছেন। প্রয়োজন একটি নীতি প্রণয়ন ও যোগাযোগ। একই সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেকেন্ড ক্যাম্পাস কিংবা সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম (শুধু ব্যবসা প্রশাসন কোর্সই নয়) চালু করে তাদের আয় বাড়াতে পারে। প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় এ উদ্যোগ নিতে পারে। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা তেজগাঁওয়ে অবস্থিত টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করতে পারেন। আর সে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে দক্ষ জনশক্তি পেতে পারেন বড় বড় গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। গার্মেন্টের পর আমাদের একটা সম্ভাবনার খাত হচ্ছে ওষুধ শিল্প। প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়েই ফার্মেসি, বায়োটেকনোলজি বিভাগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলো বড় বিনিয়োগ করতে পারে। মোট কথা, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারি অর্থেই বিশ্ববিদ্যালয় চলবে। কিন্তু এখানে বিনিয়োগে বেসরকারি খাতকে আমরা উৎসাহিত করতে পারি। বেসরকারি উদ্যোক্তারা এরই মধ্যে বেশ ক’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করছে। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ভালো শিক্ষকও রয়েছেন। উদ্যোক্তারা যদি সেখানে বিনিয়োগ করতে পারেন, তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগে করবেন না কেন? আসলে এ জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে সুস্পষ্ট একটি নীতিমালা। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা যায় না। দলবাজ উপাচার্যরা এটা ব্যবহার করবেন তাদের স্বার্থে। দলবাজ শিক্ষকের সংখ্যা বাড়বে; কিন্তু দক্ষ জনশক্তি বাড়বে না।

Daily Alokito Bangladesh
12,06.16

শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি শিক্ষার মানোন্নয়ন নির্দেশ করে না


শিক্ষা খাতে সরকার বাজেট বৃদ্ধি করেছে। গত দশ বছরের মধ্যে এটা সর্বোচ্চ। কিন্তু এ বাজেট বৃদ্ধি কি আদৌ শিক্ষার মানোন্নয়নে কোনো অবদান রাখতে পারবে? বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে এ বাজেট বৃদ্ধির প্রভাব কী? এখানে আমাদের নীতিনির্ধারকদের একটা বড় সমস্যা- তারা মনে করেন প্রতি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে কিংবা হাজার হাজার জিপিএ-৫ ‘পাইয়ে’ দিয়ে তারা মনে করেন তারা উচ্চশিক্ষায় একটি ‘বিপ্লব’ আনতে যাচ্ছেন! কিন্তু এটা একটি ভুল ধারণা। এভাবে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন করা যায় না। অতি সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল তরুণ প্রজন্মের কয়েকজন ছাত্রের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং সবাই জিপিএ-৫-এর অধিকারী। সাক্ষাৎকারে তাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তারা যেসব জবাব দিয়েছে, তা এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। এ নিয়ে আলোচনা করা অর্থহীন। শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে জিপিএ-৫ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা আজ কোন্ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, ওইসব ছাত্রছাত্রীর জবাবের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ আমরা মানসর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারিনি। আমাদের ‘সমাজতান্ত্রিক’ শিক্ষামন্ত্রী জিপিএ-৫ নিয়ে গর্ব করেন। এখন ছাত্রছাত্রীদের ওই বক্তব্য তাকে কতটুকু গৌরবান্বিত করতে পারবে, আমি জানি না। কিন্তু আমি এটা বুঝি, তরুণ প্রজন্ম আমাদের ভরসার স্থল, তারা আমাদের আশা ভঙ্গ করেছে। এ প্রজন্মকে নিয়ে আমি আশাবাদী হতে পারছি না। বিভিন্ন ‘কোটায়’ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, তারা একটি দক্ষ জনশক্তি কি আদৌ গড়ে তুলতে পারবে? তাই ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে যখন শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৫২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়, তাতে করে শিক্ষার মানোন্নয়নে তা কতটুকু অবদান রাখবে, এ প্রশ্ন থাকলই। তরুণ প্রজন্ম আমাদের ‘শক্তি’। কিন্তু এই ‘শক্তি’কে দক্ষ জনশক্তিতে আমরা পরিণত করতে পারিনি। শিক্ষক হিসেবে এ ব্যর্থতা আমারও। কীভাবে একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায়, সিঙ্গাপুর আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত। চীনের দৃষ্টান্তও আমরা দিতে পারি। আমাদের বড় ব্যর্থতা এখানেই যে আমরা এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছি কম। শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছে সরকার। তাতে করে উপকৃত হয়েছে কারা? বেতন খাতেই তো চলে যায় পুরো টাকা। সরকারি কলেজগুলোতে আর কাঠামো খাতে কিছু উন্নয়ন হয়। কিন্তু এখানে মানসম্মত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন না কেউ। আর শিক্ষকরা এখন গুরুত্ব দেন ‘প্রাইভেট পড়ানোর’ ওপর। মানসম্মত শিক্ষা তাদের কাছে মুখ্য নয়। এসব দেখারও যেন কেউ নেই। আজ অর্থমন্ত্রী যখন নতুন বাজেট উপস্থাপন করলেন, তখন এ কথাটাই আবার মনে হল। নিয়ম রক্ষার্থে তিনি শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হচ্ছে এ বিশাল ব্যয় দিয়ে আমরা উচ্চশিক্ষার কতটুকু মানোন্নয়ন করতে পারব? বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষার মানোন্নয়ন, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় গবেষণা, আইটি সেক্টরের উন্নয়ন- এ বরাদ্দ দিয়ে আদৌ সম্ভব নয়। কেননা এ অর্থের ২২ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ব্যয় হবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পেছনে। আর ২৬ হাজার ৮৪৭ কোটি (নির্দিষ্ট) টাকা ব্যয় হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পেছনে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য যে বরাদ্দ, তাতে করে আমাদের উৎফুল্ল হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা এ টাকার খুব সামান্যই ব্যয় হয় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের একটা অংশের বরাদ্দ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য। ২০০১-০২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৯৩.৫৭ কোটি টাকা, আর ২০১০-১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১১০২.২৪ কোটি টাকা। জাতীয় বাজেটের মাত্র ০.৭৫ ভাগ বরাদ্দ থাকে শিক্ষা খাতে (২০০১-০২)। এ পরিসংখ্যান বেড়েছে ০.৮৪ ভাগ ২০১০-১১ সালে। আবার যদি শুধু শিক্ষা খাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বরাদ্দের দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে এ বরাদ্দ মাত্র ৭.৮৫ ভাগ (২০০১-০২) থেকে ৮.২২ ভাগ (২০১০-১১)। আগামী অর্থবছরে এ হার খুব বেড়েছে তা নয়। পরিসংখ্যানই বলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে, বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। যদিও তুলনামূলক বিচারে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম। তারপরও কথা থেকে যায়। রাষ্ট্রের পক্ষে এর চেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব নয়। এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভেবে দেখতে হবে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় বাড়ানো যায় এবং সরকারের ওপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা কমানো যায়। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন- আর তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে টাকা বরাদ্দ করা হয়, তার খুব কম অংশই ব্যয় হয় গবেষণার কাজে। বরাদ্দকৃত টাকার একটি সিংহ ভাগ চলে যায় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ভিসি মহোদয়রা উন্নয়ন খাতে কিংবা গবেষণায় যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, সে টাকা নতুন শিক্ষকদের বেতন দিতে ব্যয় করেছেন। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি দলীয় কোটায়, স্থানীয় কোটায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিক বেশ কয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ওপর একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি নিজের মেয়ে, ভাই, আপন ভায়রা, শ্যালিকার মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়েকে শিক্ষক তথা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটা রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এ প্রবণতা প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। অভিযোগ আছে জাহাঙ্গীরনগরও ইতিমধ্যে একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নয়ন বাজেট থেকে টাকা এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন দেয়া হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে লোক নিয়োগ করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ে বিজ্ঞাপিত পদের (প্রভাষক) বিপরীতে প্রায় দ্বিগুণ শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। অতীতে এমনটি কখনোই হয়নি। শুধু তাই নয়, শুধু ‘ব্যক্তিগত পছন্দের’ ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য একাধিক বিভাগ ভেঙে নতুন নতুন বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে, যার আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। অনেক শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলে তারা বলতে পারবেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বিভাগের সংখ্যা কত। ফলে সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হচ্ছে নতুন করে সৃষ্টি করা বিভাগগুলো কি আদৌ দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারবে? প্রসঙ্গক্রমেই আরও একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার ফলে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটের সঙ্গে পটুয়াখালী কিংবা গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটরা কি সমমান সম্পন্ন? আমি কাউকে ছোট করতে চাই না। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য শিক্ষক নেই। সেদিন একটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখলাম। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভিনিং বা সান্ধ্যকালীন এমবিএ কোর্সের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি। সান্ধ্যকালীন কোর্স, তাও আবার এমবিএ? কারা পড়াবেন? কে পড়বেন? এর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি তো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ওখানে তো বিজ্ঞান, আইটি সংক্রান্ত কোর্স চালু থাকবে। বিবিএর বিষয়টি কি আইন অনুমোদন করে? আরও দুটি দৃষ্টান্ত দিই : এক. গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চালু করা হয়েছে। আমি অবাক হয়ে যাই ওখানে কারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পড়াবেন? আমরা কি যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারব সেখানে? যারা শিক্ষক নিয়োগ কমিটিতে আছেন, তাদের আমি চিনি। কাউকে ছোট করা নয়, বরং বিবেচনায় নেয়া উচিত আমাদের আদৌ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ গণবিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা উচিত কিনা। মঞ্জুরি কমিশন নিশ্চয়ই অনুমতি দিয়েছে। এখানে মঞ্জুরি কমিশন বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারেনি। দুই. গণবিশ্ববিদ্যালয় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে! বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক! কে হাজার টাকা মাসে বেতন দিয়ে ওখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পড়বে? ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তার বিচক্ষণতাকে আমি সমর্থন করতে পারলাম না। সবাই সার্টিফিকেটসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করছে। কিন্ত ডা. জাফরুল্লা চৌধুরী কেন করবেন? এ ক্ষেত্রে অবশ্য মঞ্জুরি কমিশনকে ধন্যবাদ দিতে হয়। মঞ্জুরি কমিশন চায়নি গণবিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে শুধু সার্টিফিকেট বিক্রি করুক। ওখানে সরকার ও রাজনীতি বিভাগ আছে। প্রয়োজনে ওই বিভাগের কোর্সের আওতায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পড়ানো যায়। আমি বিনে পয়সায় ওখানে ছাত্রদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পড়াতে রাজি আছি- শুধু ছাত্রদের আপডেট রাখার জন্য। আমি অনুরোধ করব যারা মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য পদে আছেন, তারা যেন সর্বত্র গণহারে বিভিন্ন বিভাগ খোলার অনুমতি না দেন। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভাগ খুললে, তা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারবে না।

কয়েকদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহারে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওখানে আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও আছে। এর সত্যতা আছে। লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়। কীভাবে লাইব্রেরি ওয়ার্ক না করে, ফিল্ড সার্ভে না করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব? যারা করছেন, তারা কি এটা বোঝেন না? যে বিভাগে মাত্র একজন অধ্যাপক, ডক্টরেট ডিগ্রিধারী শিক্ষক নেই, সেই বিভাগে উচ্চতর শিক্ষা কমিটি গঠিত হয় কীভাবে? সংবাদপত্রে যে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়ার অভিযোগটি উঠেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত, এ ব্যাপারে তদন্ত করে দেখা। না হলে সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে মানুষ হাসাহাসি করবে। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালসও পিএইচডি ডিগ্রি দিচ্ছে! অথচ তাদের আদৌ সিনিয়র শিক্ষক নেই। ফুল টাইম সিনিয়র শিক্ষক ছাড়া পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া কতটুকু নীতিমালার মধ্যে পড়ে, আমি বুঝতে অক্ষম। মঞ্জুরি কমিশন অনুমোদন দিল কীভাবে? সেনাবাহিনীকে নিয়ে আমাদের অনেক গর্ব। ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারদের যোগ্যতা ও মেধা নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু তারা যদি একটি ভুল করেন, আমাদের তা কষ্ট দেয়। আমি জানি এ বিশ্ববিদ্যালয়টি আগামীতে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। কিন্তু এখানে দরকার যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক। অনেক শিক্ষক আছেন, যারা অবসর নিয়েছেন; কিন্তু কর্মক্ষম, তাদের বিশেষ বিবেচনায় নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের পিএইচডি কার্যক্রম অব্যাহত রাখুক, এ অনুরোধ রাখব।

এ প্রশ্নগুলো এলো এ কারণে, সরকার উচ্চশিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছে। এ ব্যয় বরাদ্দ যদি শুধু বেতন খাতেই চলে যায়, তাহলে তো উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাবে না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। শিক্ষামন্ত্রী একটু সিরিয়াস হোন। মঞ্জুরি কমিশন তার কর্মতৎপরতা বাড়াক। আমরা একটি দক্ষ শিক্ষিত জনবল গড়ে তুলি, এটাই আমার প্রত্যাশা।
Daily Jugantor
13.06,16

পানি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক


ভারত নিজেদের খরাকবলিত এলাকাগুলোতে পানির চাহিদা মেটাতে নদীর গতিপথ বদলে দেওয়া পরিকল্পনা কার্যকর করতে যাচ্ছে। এটা কার্যকর করতে গঙ্গা (পদ্মা) ও ব্রহ্মপুত্রের পানি সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে ভারত। ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী গত মাসে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ভারতের ইন্টার লিংকিং রিভার্স বা আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে পানি সরিয়ে নেওয়ার জন্য ৩০টি লিংক পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে যেকোনো সময় একটি লিংক পানি সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করবে। উমা ভারতী বিবিসিকে আরো জানিয়েছেন, আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প হচ্ছে তাঁদের অন্যতম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। উমা ভারতী জানিয়েছেন, ৩০টির মধ্যে বর্তমানে পাঁচটি লিংক নিয়ে তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন। যেকোনো সময় উত্তর ও মধ্য প্রদেশের মধ্যকার কেন-বেতওয়া লিংক উদ্বোধন করা হবে। উমা ভারতীর এই বক্তব্য আমাদের জন্য অনেক চিন্তার কারণ। কেননা আন্তনদী সংযোগ নিয়ে বাংলাদেশের অনেক উৎকণ্ঠা আছে। ভারত আন্তনদী সংযোগের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে নিলে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নদ-নদীতে কোনো পানি থাকবে না। বাংলাদেশ প্রথম থেকেই আন্তনদী সংযোগের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। গত বছরের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় যে ৬৫ দফাসংবলিত যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেখানে ২১ নম্বর দফায় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল যে ভারত আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। এখন উমা ভারতীর বিবিসিকে দেওয়া বক্তব্য কি ওই প্রতিশ্রুতিকে ভঙ্গ করল না? যৌথ ঘোষণায় যখন কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তখন তা রক্ষা করার দায়িত্ব ওই রাষ্ট্রের। ভারতের এই ‘আচরণ’ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং তা দুই দেশের সম্পর্ককে একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে। বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা এর ব্যাখ্যা চাইবে। কিন্তু শুধু ‘ব্যাখ্যা চাওয়া’ই যথেষ্ট নয়। এখানে বলা ভালো, খোদ ভারতেই এই আন্তনদী সংযোগ নিয়ে বিতর্ক আছে। ভারতের পরিবেশবাদীরা প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছেন। এ নিয়ে তাঁরা সেখানে আন্দোলন পর্যন্ত করেছেন। এখানে বলা ভালো, ভারতে আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প অর্থাৎ হিমালয় অঞ্চল থেকে উত্পন্ন নদীগুলোর পানি ৩০ খালের মাধ্যমে ভারতের খরাপীড়িত দক্ষিণাঞ্চলে সরিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার এই যে মহাপরিকল্পনা, তার ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৮০ সালে এই পরিকল্পনার কথা প্রথম জানা যায় এবং ২০০২ সালে বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে বিচারপতি এস এইচ কাপাডিয়ার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভিমত দেন যে  পরিকল্পনাটি ভালো। তাই এটি বাস্তবায়ন এবং একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে তা মনিটর করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁরা। হাইকোর্ট ৩৫ বছরের পরিবর্তে ১০ বছরের মধ্যে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেছে, ভারতের পরিবেশবাদীদের অনেকেই এই মতামতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। ভারতে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত পরিবেশবিদ বন্দনা সিভা বিজনেস টুডের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে (১৩ মার্চ ২০১৪) মন্তব্য করেছিলেন, আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক ব্যবস্থার নামান্তর মাত্র। তিনি আরো মন্তব্য করেছিলেন এভাবে, ‘It has no hydrological or ecological soundness and is just part or the corruption and construction package that has ruined India’s ecosystem and life support base. This is the same lobby that aggravated the Uttarkhand disaster with its hydrological projects.’ আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিবেশ, পানি ব্যবস্থাপনা কিংবা জীববৈচিত্র্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, বন্দনা সিভা তাঁদের অন্যতম। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আমাদের জানিয়েছেন, এই প্রকল্পে মোট যে খরচ ধরা হয়েছে অর্থাৎ ৫৬০ হাজার কোটি রুপি, তা ভারতের জিডিপির ২৫ শতাংশ। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দাতাগোষ্ঠী থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হবে এবং ভারতে যাদের আয় ৪০০ থেকে ৮০০ ডলারের মধ্যে, তাদের প্রত্যেকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ১১২ ডলার। বন্দনা জানিয়েছেন, তিনি নিজে কেন-বেতওয়ার (Ken-Betwar) এবং সারদা-যমুনা (Sharda-Jamuna) আন্তনদী সংযোগ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাতে তিনি দেখতে পেয়েছেন খরাপীড়িত এলাকায় পানি নিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর যে কথা বলা হয়, তা সত্য নয়। আমরা আরেকজন ভারতীয় পরিবেশবিদ রাজেন্দ্র সিংয়ের কথা উল্লেখ করতে পারি। রাজেন্দ্র সিং ২০০১ সালে বিখ্যাত ম্যাগসেসাই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। আর ২০১৫ সালে তিনি পেয়েছেন ‘পানির নোবেল পুরস্কার’ হিসেবে খ্যাত ‘স্টকহোম ওয়াটার প্রাইজ’। ভারতে তিনি Water Man of India হিসেবে খ্যাত। বোঝাই যায় তাঁর কর্মকাণ্ড পানি নিয়ে। আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে ভারতীয় দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে (১০ জুন ২০১৫) বলেছেন, ‘This will be disastrous for my country. It will displace a lot of people and cause undesirable effects, with floods in one side and drought on the other. River are not like roads. They have own gene pool and own life. Linkage of rivers will lead to privatisation of water resources.’ যে কথাটা বন্দনা সিভা বলেছেন, অনেকটা সেই সুরেই কথা বলেছেন ভারতের ‘ওয়াটার ম্যান’ রাজেন্দ্র সিং। এখানে যে একটা ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি কাজ করে অর্থাৎ ভারতের করপোরেট জগতের বাসিন্দারা যে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন চাচ্ছে, এটাই মোদ্দাকথা। এখানে খরাপীড়িত এলাকায় পানির প্রবাহ বাড়ানোর বিষয়টি মুখ্য নয়। পানির প্রবাহ না বাড়িয়েও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প যে অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য, তা স্বীকার করেছেন ভারতের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সদস্য ড. মিহির শাহ। তিনি গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এই প্রকল্পের ব্যাপারে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলেন (ইকোনমিক টাইমস, ৭ মার্চ ২০১৩)। ভারতের Working Group or Sustainable Ground Water Management-এর পরিচালক পিএস ভিজয়শংকর (P.S. Vijashankar) একটি সেমিনারে আসামের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেছিলেন, আসামে প্রচুর ভূ-গর্ভস্থ ও ভূ-উপরিভাগে পানি রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র-বরাক অববাহিকায় মাথাপিছু পানির ব্যবহার সর্বোচ্চ ১৪০৫৭ কিউবিক মিটার। মাত্র এক ভাগ ভূ-উপরিভাগের (Surface Water) পানি ব্যবহৃত হয়, অথচ ৬৬ ভাগ পানি ব্যবহার করা সম্ভব। সারা ভারতে ভূ-গর্ভস্থ পানির মাত্র তিন ভাগ ব্যবহৃত হয়, অথচ ৩৫ ভাগ পানি রয়ে যায় অব্যবহৃত। এই পানি ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এখানে বলা ভালো, প্রস্তাবিত এই আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পে যেসব রাজ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে আসাম, সিকিম ও কেরালা এর বিরোধিতা করেছে। শুধু তামিলনাড়ু এর পক্ষে।
বলা হয়, ভারতের খরা এলাকার জন্য পানি দরকার। কিন্তু এক নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে খালের মাধ্যমে অন্য এলাকায় (দক্ষিণে) নিয়ে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। ভারতের ভাকরা বাঁধ নিয়ে একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছিল পাঞ্জাব ও হরিয়ানা প্রদেশের জন্য ভাকরা থেকে পাওয়া পানি নয়, বরং ভূ-গর্ভস্থ পানি ও উন্নত কৃষিব্যবস্থা বেশি জরুরি। পাঞ্জাবের মোট ২০ শতাংশ এবং হরিয়ানার ৩১ শতাংশ চাষযোগ্য জমি বাঁধ নিয়ন্ত্রিত। এমনকি ৫০ বছর পর আজও সেখানকার বাস্তুহারা মানুষ কঠোর সংগ্রাম করে যাচ্ছে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুর জন্য। ওই গবেষণার ফলাফলই বলে দিচ্ছে নর্মদা বাঁধের উচ্চতা না বাড়িয়ে কিভাবে আরো বেশি পানি ও বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে। সে বিষয়ে মাথা ঘামানো দরকার। নর্মদা বাঁধসংলগ্ন অঞ্চলের বাস্তুহারা ৫০ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কিভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে গুজরাট, মধ্য প্রদেশ ও মহারাষ্ট্র, যখন কিনা ওই সব রাজ্যে বাড়তি কোনো জমি নেই তাদের পুনর্বাসনের জন্য? তিহরি বাঁধের শিকার হয়েছে যারা, তারাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার। কেননা না ইউপি, না কেন্দ্র সরকার—কোনোরূপ সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল তাদের সাহায্যার্থে। এখন আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প যে শুধু বাংলাদেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তা নয়। বরং খোদ ভারতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ভারতের নীতিনির্ধারকরা এটা বিবেচনায় নিচ্ছেন না।
এখানে আরো একটা কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পটি অবৈধ। আন্তর্জাতিক আইনবিশারদ অধ্যাপক ওপেনহেইম বলেছেন, কোনো রাষ্ট্রকে নিজ ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক অবস্থা এমনভাবে পরিবর্তন করতে দেওয়া যাবে না, যার ফলে তা প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক অবস্থার কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে। এ আলোকেই আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পটি অবৈধ। যখন কোনো রাষ্ট্র একটি অভিন্ন সম্পত্তির উন্নতি, পরিবর্তন বা ধ্বংস সাধনের জন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে তখন ওই রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কিছু নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়। আন্তর্জাতিক আইন আরো বেশি সুনির্দিষ্ট, যখন তা আন্তর্জাতিক নদী সম্পর্কিত হয়। আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের সব কটি নদীই আন্তর্জাতিক নদী। তাই এসব নদীর একতরফা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেআইনি ও অগ্রহণযোগ্য। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। তা অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি না করেই হতে হবে। কিন্তু ভারতের এই উদ্যোগে একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে ভারত বাংলাদেশের ওপর এ প্রকল্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষা করছে।
হেলসিংকি নীতিমালার অনুচ্ছেদ ২৯-এ বলা হয়েছে, এক অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অপর অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্রকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক নিষ্কাশন অববাহিকার পানি ব্যবহারের ব্যাপারে কৃত পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করবে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার (আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত) ২ নম্বর নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। কিন্তু আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত একটি অস্বচ্ছ ও স্বেচ্ছাচারমূলক পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জলপ্রবাহ কনভেনশনটি গ্রহণ করা হয়। এই কনভেনশনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কনভেনশনের ৬ অনুচ্ছেদে যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহার নির্দিষ্টকরণে কতগুলো শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহার নির্ধারণে এ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সব কটি শর্তকে একই সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বিবদমান দেশগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। জলপ্রবাহ কনভেনশনে উল্লিখিত নীতিমালার আলোকে ভারতে প্রস্তাবিত নদী সংযোগ প্রকল্পকে বিচার করলে দেখা যাবে ভারত সুস্পষ্টভাবে কনভেনশনে বিধিবদ্ধ প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করছে। এমনকি জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো পরস্পর পরামর্শ করবে এবং একই সঙ্গে জলাভূমির ও সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর সংরক্ষণের স্বার্থে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা এবং বিধিবিধান প্রণয়ন করবে। কিন্তু আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোকে ধ্বংস করার নামান্তর, যা কিনা রামসার কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করতে পারি। যেখানে ওই অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘উভয় পক্ষ সমতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং পারস্পরিক ক্ষতি না করার নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, সেখানে আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করা হলে, তা হবে উক্ত চুক্তির বাধ্যবাধকতা ও অঙ্গীকারের চরম লঙ্ঘন।’
এখন উমা ভারতীর বক্তব্যকে আমরা কিভাবে নেব? উমা ভারতী নিশ্চয়ই তাঁর ব্যক্তিগত মত দেননি। তিনি সরকারের সিদ্ধান্তের কথাই বিবিসিকে জানিয়েছেন। এখন ভারত সরকার যখন এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে যাচ্ছে তখন স্পষ্টতই তা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং মোদির ঢাকা সফরের সময় স্বাক্ষরিত যৌথ ঘোষণাপত্রের অঙ্গীকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে অতিদ্রুত বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করা।
Daily Kalerkontho
13.06.16

নতুন উচ্চতায় দু’দেশের সম্পর্ক

সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরব সফর করেছেন। পাঁচদিনের জন্য তিনি সৌদি আরব যান গত ৩ জুন। গত ৫ জুন তিনি বাদশাহ সালমানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি নিয়ে মতবিনিময় করেন। বাংলদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উšে§াচন হলো। মুসলিম উম্মাহর শান্তি প্রতিষ্ঠায় এক সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে দুই দেশ। দু’ দেশের মধ্যে কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। এছাড়া সন্ত্রাসবাদ দমনে ৩৪টি মুসলিম দেশ নিয়ে সৌদি জোটের রূপরেখার বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটা তার প্রথম সৌদি আরবে রাষ্ট্রীয় সফর। এর আগে তিনি ২০১৩ সালের নভেম্বরে সৌদি আরবে ওমরাহ পালন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সৌদি আরব সফরের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত, সৌদি আরবের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যে যে সামরিক জোট গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ তার সদস্য অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সিরিয়ায় আইএসবিরোধী যে জোট গঠিত হয়েছে, বাংলাদেশ তাতে যোগ দেয়নি। সৌদি জোটে যোগ দেয়ায় সৌদি রাজ পরিবার বাংলাদেশকে যে গুরুত্ব দেয় সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, গত ৮ মার্চ বাংলাদেশ সফরে  এসেছিলেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবাইর। সমসাময়িককালে কোনো সৌদি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সেটা ছিল প্রথম বাংলাদেশ সফর। এতে প্রমাণিত হয়েছিল সৌদি আরব বাংলাদেশকে কত গুরুত্ব দেয়। তৃতীয়ত, সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীদের সংখ্যা ১২ লাখ ৮০ হাজার। এরা বাংলাদেশে যে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায় তা অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে। তবে সৌদি আরবে শ্রমবাজার বর্তমানে বন্ধ। তবে ৭ জুন ২০১৬ তারিখে গণমাধ্যমে প্রকাশ, বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব ৫ লাখ জনশক্তি নিতে নতুন করে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। - সৌদি অর্থনীতিতে বর্তমানে এক ধরনের মন্দা চলছে। তেলের দাম সম্প্রতি কমে যাওয়ায় তা সৌদি অর্থনীতিতে আঘাত করেছে। এর প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে নির্মাণ শিল্পে। সেখানে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বিন লাদেন কোম্পানি থেকে প্রায় ১৪ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে এ রকম একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে সম্প্রতি। ফলে সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে এই মুহূর্তে শ্রমিক নেবে কিনা, এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যেই সৌদির নতুন আগ্রহের কথা জানা গেল। তেলের দাম কমে যাওয়া ও সৌদি প্রতিরক্ষায় বিপুল অর্থ ব্যয় হওয়ায় সৌদি আরবের বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সৌদি আরবে প্রধানমন্ত্রীর এই রাষ্ট্রীয় সফরকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব? এটা নিছক একটি রুটিন সফর নয়। এটা রাষ্ট্রীয় সফর। এই সফরে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌদি বাদশাহর যেমনি আলোচনা হয়েছে তেমনি সৌদি শ্রমবাজার খুলে দেয়ার বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পেয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সৌদি জোটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের প্রসঙ্গটিও আলোচিত হয়েছে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন সম্প্রতি সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ এই জোটের সদস্য। জোটভুক্ত দেশের সেনাবাহিনী গত মার্চ মাসে একটি সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে সেখানে। একটি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ‘জধধফ-অষ-ঝযধসধধষ’ (ঘড়ৎঃয ঞযঁহফবৎ) নামে ওই মহড়ায় অংশ নিয়েছে জোটভুক্ত ২১ দেশের সেনাবাহিনী। আরো গুরুত্বপূর্ণ খবর হচ্ছেÑ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ গত ৯ মার্চ আলাদা আলাদাভাবে সৌদি আরব সফর করেছেন। দু’জনই সেখানে দুই দিন অবস্থান করেন। ধারণা করা হচ্ছে, পাকিস্তান এখন নীতিগতভাবে এই জোটে যোগ দিতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ তাই কোনো ‘সামরিক কার্যক্রমে’ অংশ নেয় কিনা সেটাই দেখার বিষয়। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ এই নীতি অনুসরণ করে আসছে। এখন বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দেয়ায় বাংলাদেশ এই নীতি থেকে সরে আসবে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। উপরন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫তম অনুচ্ছেদ ‘আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা, সংহতি ও উন্নয়নের’ কথা বলা হয়েছে। ২৫(ক) তে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করবে।’ অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ না করা আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথাও বলা হয়েছে এই অনুচ্ছেদে। তাই জোটে যোগ দিয়ে আগামীতে “অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বাংলাদেশ হস্তক্ষেপ করবে কিনা, ‘শক্তি প্রয়োগে’ অংশ নেবে কিনা, এ প্রশ্ন থাকলই। যদিও জোটের পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা কী হবে তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এই জোটের উদ্যোগে রিয়াদে একটি কেন্দ্র হবে এবং এই কেন্দ্র সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী তথ্য-উপাত্ত ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে।” তবে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এসপিএ আমাদের জানিয়েছিল, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামরিক অভিযান সমন্বয় ও তাতে সহায়তা করতে সৌদি নেতৃত্বাধীন এ জোট গঠন করা হয়েছে।’ বাংলাদেশ আগে যুক্তি দেখিয়েছিল যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির অংশ হিসেবে অন্য মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ এই কেন্দ্রে থাকবে। তবে এই জোটের ভবিষ্যৎ ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। জোটের অন্যতম শরিক পাকিস্তান প্রথমে কিছুটা অবাকই হয়েছিল এই জোট গঠনে এবং জোটে পাকিস্তানের নাম থাকায়। পাকিস্তানের বক্তব্য হচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে পরামর্শ না করেই এই জোটের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। আমি নিশ্চিত নই, এই জোট গঠনে বাংলাদেশের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা আদৌ হয়েছিল কিনা। সৌদি আরব এ ধরনের একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছে কিংবা বাংলাদেশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রারম্ভিক আলোচনা হয়েছেÑএটাও আমাদের অনেকের জানা নেই। ফলে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান যখন গত ১৫ ডিসেম্বর এই জোট প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন তখন বিষয়টি আমাদের অবাকই করেছিল। এমন হয়েছে কিনা সৌদি আরব একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে তা জোটবদ্ধ দেশগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে শুধু? এটা যদি সত্য হয় তাহলে তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। জোট নিয়ে পাকিস্তানের প্রশ্ন তোলা এই সম্ভাবনাটকেই সামনে নিয়ে এসেছিল। যদিও এখন মনে হচ্ছে পাকিস্তান তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। আরো একটা কথা বলা দরকার। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো যাদের নাগরিকদের প্রায় সবাই মুসলমান, ওই অঞ্চলের একটি দেশও জোটে যোগ দেয়নি। তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, কিরগিজস্তানÑ এই দেশগুলো এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ও সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে গেলে এই দেশগুলো স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ‘ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ’ যদি অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে থাকে জোটে যোগ দেয়ার ব্যাপারে, তাহলে মুসলমানপ্রধান এই দেশগুলো যোগ দিল না কেন? ইন্দোনেশিয়া বড় মুসলিম দেশ। এই দেশটিও নেই কেন? পাঠক, লক্ষ্য করুন কোন দেশগুলো যোগ দিয়েছে? বেনিন, সাদ, টোগো, জিবুতি, সুদান, সিয়েরালিওন, গ্যাবন, সোমালিয়া, মালদ্বীপÑএই দেশগুলোর সন্ত্রাস দমনে আদৌ কোনো অভিজ্ঞতা নেই বরং জাতিসংঘ এই দেশগুলোকে কখনো বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে আমন্ত্রণও জানায়নি। শুধু তাই নয়, সুদান, সিয়েরালিওন, সোমালিয়া, গিনি ইতিমধ্যে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এসব দেশে কোনো কেন্দ্রীয় সরকারও নেই। তাহলে এই দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হলো কেন? দেশগুলো গরিব। আর্থিক ভিত্তি দুর্বল। ধনী দেশগুলোর আর্থিক সহযোগিতার ওপর দেশগুলো নির্ভরশীল। এটাকে বিবেচনায় নিয়েই কি দেশগুলোকে সৌদি আরব তার জোটে রেখেছে? সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন এই জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী জোটে ৩৪ দেশ যোগ দিয়েছে। এই জোটকে বলা হচ্ছে, ‘ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেররিজম’ (আইএমএএফটি)। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেই এই জোটের জš§। এখানে কোনো একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কথা বলা হয়নি। সম্প্রতি সিরিয়া-ইরাকে জš§ নেয়া ইসলামিক স্টেট বা দায়েশের (আরবি নাম) বিরুদ্ধে আলাদা আলাদাভাবে বিমান হামলা পরিচালনা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট ও রাশিয়া। অনেক আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে একটি জোট ‘দি গ্লোবাল কোয়ালিশন টু কাউন্টার আইএসআইএল।’ এখানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে, আইএসআইএল তথা ইসলামিক স্টেটের কথা। ৬৫টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত এই জোটের মূল টার্গেট জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট। পরে এর পাশাপাশি গঠিত হয়েছিল আইএমএএফটি। একটির নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপরটির নেতৃত্বে সৌদি আরব। উভয় জোটের স্বার্থ কি এক? অর্থাৎ উভয় জোটই কি ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবহƒত হবে? বিষয়টি আমার কাছে অস্পষ্ট। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জোটে বাংলাদেশকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ ওই জোটে যোগ দেয়নি। কিন্তু সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশ যোগ দিয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিল না কেন? নাকি ওই জোটে যোগ দেয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আগে সৌদি জোটে যোগ দিলমার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ না দেয়ার পেছনে বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ নীতির কথা আমাকে বলতে চেয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এক টিভি টকশোতে তিনি আমাকে এ ব্যাখ্যাই দিয়েছিলেন। তবে জানিয়েছিলেন, ‘অসামরিক ও জাতিসংঘের উদ্যোগে যে কোনো উদ্যোগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে।’ অর্থাৎ আমি ধরে নিয়েছি যদি কোনো ধরনের ‘মানবিক বিপর্যয়ের’ ঘটনা ঘটে সিরিয়ায় তাহলে বাংলাদেশ মার্কিন জোটকে সহযোগিতা করবে এবং প্রয়োজনে জোটে যোগ দেবে। কিন্তু ইতোমধ্যে সৌদি জোট যার চরিত্র অনেকটা সামরিক, বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দিয়েছে। ফলে সৌদি জোটে যোগ দেয়া নিয়ে প্রশ্ন যে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। মজার ব্যাপার কিছু দেশ রয়েছে, যে দেশগুলো উভয় জোটেই আছে (জর্দান, আরব আমিরাত, বাহরাইন, তুরস্ক, কুয়েত প্রভৃতি)। সৌদি আরব মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটেও আছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হঠাৎ করে বাংলাদেশ সফর কিংবা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের সৌদি আরব গমন প্রমাণ করে সৌদি আরব তার সামরিক জোট নিয়ে সিরিয়াস। সেখানে একটি সামরিক মহড়ার আয়োজন করাও অনেক প্রশ্নের জš§ দিতে পারে। কিছুদিন ধরেই সৌদি আরব সিরিয়ায় একটি ‘সামরিক আগ্রাসন’ চালাতে পারে এমন কথা বলা হচ্ছে। এর প্রস্তুতি হিসেবে কি একটি সামরিক মহড়ার আয়োজন করেছিল সৌদি আরব? তবে মূল প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কি আদৌ আগামীতে কোনো সামরিক কার্যক্রমে তার দেশের সেনাবাহিনী পাঠাবে? বাংলাদেশ বারবার বলে আসছে তারা কোনো রকমের ‘সেনা কার্যক্রমে’ অংশ নেবে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’-এর কথা বাংলাদেশ বারবার বলে আসছে। এখন দেখতে হবে প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের পর এই প্রসঙ্গটি কোন পর্যায়ে আলোচিত হয়। আমাদের জাতীয় স্বার্থ হলো বড়। আমাদের শ্রমবাজার এখনো উš§ুক্ত হয়নি, এখন পর্যন্ত বিষয়টি ঘুরপাক খাচ্ছে আশাবাদ আর আগ্রহের মধ্যেই। সৌদি বিনিয়োগও আশাপ্রদ নয়। প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানানোর পেছনে সৌদি জোটে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সরাসরি অংশগ্রহণের বিষয়টি যে সৌদি আরবের প্রধান বিবেচিত বিষয় এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশকে তার জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্তটি নিতে হবে। শুধু সৌদি আরবের স্বার্থের কারণে বাংলাদেশ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আমাদের জাতীয় স্বার্থটাই হলো আসল। Daily Manobkontho 08.06.15