রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতি কোন পথে



গত ২৩ জুন ব্রিটেনের গণভোটের সিদ্ধান্তের পর ইউরোপের তিন বড় অর্থনৈতিক শক্তি জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির শীর্ষ নেতারা গত ২২ আগস্ট ইতালির দ্বীপ ভেন্টোটেনে অবস্থিত একটি বিমানবাহী জাহাজে মিলিত হয়েছিলেন। জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেল, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফঁসোয়া ওলান্দ আর ইতালির প্রধানমন্ত্রী ম্যাটিও বেনজির মধ্যকার এই বৈঠকের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। কেননা আগামী মাসে বাটিসলোভা শহরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ইইউর এই শীর্ষ তিন নেতা নিজেদের মধ্যে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনাটা সেরে নিলেন। ব্রিটেনের ইইউ ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্তের পর সবার চোখ এখন জার্মানির দিকে। জার্মানি প্রথম থেকেই ইউরোপের ঐক্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। মূলত এঞ্জেলা মার্কেলের উদ্যোগেই এই মিনি শীর্ষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হলো। যদিও তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এই মিনি সামিটে নেয়া হয়নি। তবে তিন নেতা ইউরোপীয় ঐক্যকে ধরে রাখা, নিজেদের মধ্যে নিরাপত্তা বাড়ানো এবং তরুণদের আরো ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই তিন নেতা বিমানবাহী জাহাজ 'গারিবল্ডি'তে এক সংবাদ সম্মেলনেরও আয়োজন করেন। এই মিনি শীর্ষ সম্মেলনের পর জার্মানি নেতা এঞ্জেলা মার্কেল ইউরোপের ৪টি দেশ সফরে যাচ্ছেন। সেখানে তিনি ৮ জন ইউরোপীয় নেতার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হবেন। বোঝাই যাচ্ছে, ব্রিটেনের ইইউ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের পর জার্মানির ওপর বড় দায়িত্ব বর্তিয়েছে ইউরোপের ঐক্যকে ধরে রাখার। তবে এটা বলতেই হবে ইউরোপ একটি বড় ধরনের সংকটের মাঝে আছে। লাখ লাখ সিরীয়-ইরাকি নাগরিকের উপস্থিতি ইউরোপের রাজনৈতিক চরিত্রকে কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে। ফ্রান্সে আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকা- বেড়েছে। জার্মানিতে এই তৎপরতা এখনো বড় আকারে দেখা দেয়নি। তবে আইএস যে একটা সমস্যা সৃষ্টি করেছে, তা বোঝাই যায়। ইতালির বড় সমস্যা আফ্রিকা থেকে আসা 'অর্থনৈতিক শরণার্থীদের' নিয়ে। ইইউ আফ্রিকাতে ব্যাপক সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এই শরণার্থী আসা বন্ধ করা যাচ্ছে না। উপরন্তু ইতালির অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও ভালো নয়। সেখানে দারিদ্র্যতা বেড়েছে। ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে আসা অভিবাসীদের নিয়ে 'হাউজিং' সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ব্রিটেনের সিদ্ধান্ত ইইউকে একটি বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। যদিও নয়াব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে ২০১৭ সালের যে ডেটলাইন, সেই সময়সীমা আরো কিছুদিন বাড়াতে চান।
ইইউ মূলত একটি অর্থনৈতিক জোট হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক আসরে এর গুরুত্ব বেড়েছে। প্রায় ৪৩ লাখ ২৪ হাজার ৭৮২ বর্গকিলোমিটার আয়তন বেষ্টিত ইইউর জনসংখ্যা ৫০৮ মিলিয়ন। ২৮টি দেশ একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়নে আবদ্ধ হলেও নিজস্ব পার্লামেন্ট, নিজস্ব সরকার ও নিজস্ব সংবিধান তারা বজায় রেখেছে। ফলে দেখা যায় পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই ইইউর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর নিজস্ব দূতাবাস রয়েছে। ওই দেশগুলোতে আবার ইইউর মিশনও রয়েছে (যেমন বাংলাদেশ)। নিঃসন্দেহে ইইউ অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি।
ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ইইউর জিডিপির পরিমাণ ১৯ দশমিক ২০৫ ট্রিলিয়ন ডলার (সাধারণ হিসেবে ১৬ দশমিক ২২০ ট্রিলিয়ন ডলার), যা বিশ্বের তৃতীয় বড় অর্থনীতি। মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ৩৭ হাজার ৮৫২ ডলার (পিপিপি, সাধারণ হিসেবে ৩১ দশমিক ৯১৮ ডলার), যা বিশ্বের ১৮তম। এই অর্থনৈতিক শক্তির বলেই ইইউ বর্তমানে অন্যতম একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দেখা গেছে অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইইউ একটি 'অবস্থান' নিয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ইইউর সেই 'অবস্থান' যুক্তরাষ্ট্রের 'অবস্থান' এর বাইরে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রায়ণ ও মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে ইইউ সোচ্চার। এখন খুব সঙ্গত কারণেই ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায়, ইইউ দুর্বল হয়ে যাবে। এতে করে বিশ্ব আসরে তার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে।
প্রশ্ন হচ্ছে ব্রিটেন কখন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে। জনমতে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় হয়েছে বটে, কিন্তু এর আইনগত ভিত্তি কী? ইইউর গঠনের জন্য যে লিসবন চুক্তির প্রয়োজন ছিল, তার ৫০তম ধারায় বলা আছে যে কোন দেশ ইইউর কাঠামো থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে। সে ক্ষেত্রে ওই দেশের সাংবিধানিক আইন প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ ওই দেশের পার্লামেন্ট, জনগণ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। ব্রিটেনের জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন ব্রিটেনের পার্লামেন্ট তা অনুমোদন করবে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট এই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারবে না। তবে ব্রিটেন এখন থেকে দু'বছর সময় পাবে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। তবে এই গণভোটের রায়ের একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন ব্রিটিশ আইনজীবী ডেভিড এ্যালেন গ্রিন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস এ একটি প্রবন্ধ লিখে তিনি মন্তব্য করেছেন যে এই রায়টি বাধ্যতামূলক নয়, বরং এক ধরনের উপদেশমূলক। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন সরকার এই রায় 'উপেক্ষা' করতে পারে। এ ব্যাপারে পার্লামেন্ট সিদ্ধান্তে নেবে, এটা তার অভিমত। বাস্তবতা হচ্ছে এই রায় উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। পার্লামেন্টে এ এই রায় অনুমোদিত হবে, এটাই স্বাভাবিক।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ব্রিটেনের ইইউতে থাকার পক্ষে ক্যাম্পেইং করেছিলেন। কিন্তু ভোটাররা তার কথা শোনেননি। বেক্সিট বিরোধী ক্যাম্পেন এ বিরোধী লেবার পার্টির যে ভূমিকা রাখা উচিত ছিল, তা তারা করেনি। অথচ লেবার পার্টির এমপিদের প্রায় ৯০ ভাগই ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে। যে অভিযোগটি উঠেছিল ইইউ ছাড়লে ব্রিটিশ আরো গরিব হয়ে যাবে। এই অভিযোগটির কোনো সত্যতা খুঁজে পায়নি ভোটাররা। মূলত ইউরোপে ব্যাপক অভিবাসন এই গণভোটে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। অতি সাম্প্রতিককালে ব্যাপকহারে সিরীয়, ইরাকি ও আফগান নাগরিকদের ইউরোপে আগমন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত ব্রিটেনের ভোটারদের মধ্যে একটি মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। তাদের মাঝে এমন একটা শংকার জন্ম হয় যে ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসন গ্রহণের ফলে ব্রিটেন তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলবে। এদের মাঝে একটা ইসলাম ফোবিয়াও কাজ করেছিল। এটা উস্কে দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বেক্সিটকে সমর্থন করেছিলেন। এবং গণভোটে বেক্সিট এর পক্ষে রায় পড়লে, তিনি তাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। ক্যামেরন বেক্সিটের বিপক্ষে, অর্থাৎ ইইউর পক্ষে জনসংযোগ করলেও মন্ত্রিসভার দুই সদস্য মাইকেল গেভি ও বরিস জনসন এর বিরোধিতা করেছিলেন। অর্থাৎ তারা ছিলেন বেক্সিটের পক্ষে। ব্রিটেনের প্রবীণদের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেননি ক্যামেরন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরোধীরা যুক্তি তুলে ধরেছিলেন একটিই- ইইউ বা যুক্তরাজ্য। ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির নেতা বাইজেল ফরাজ সেস্নাগান তুলে ধরেছিলেন যুক্তরাজ্যের পক্ষেই। তাতে তিনি জয়ী হলেন। তিনি দলীয় নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছেন বটে, তবে এই জয় তাকে যদি ভবিষ্যৎ এ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর পদে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। নিঃসন্দেহে ফরাজ এখন যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে অন্যতম একটি নাম। তার দিকে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। মানুষ তার কথায় আস্থা রেখেছিল। গেল বছর ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে ক্যামেরনের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু ক্রমবর্ধমান অভিবাসন আগমন, ব্রিটেনের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি কারণে ক্যামেরন বাধ্য হয়েছিলেন গণভোট দিতে। সেই গণভোটেই শেষ পর্যন্ত তার পরাজয় ঘটেছিল। তিনি যা চেয়েছিলেন, তাতে কোনো সমর্থন ছিল না যুক্তরাজ্যবাসীর। তিনি পরাজয় মেনে নিয়েছেন। তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে পরে তা কার্যকরও করেছেন। টেরেসা মে এখন নয়া প্রধানমন্ত্রী।
টেরেসা মে'র ওপর চাপ এখন বাড়ছে। তিনি এই মুহূর্তে বুঝতে চেষ্টা করছেন কীভাবে তিনি ব্রিটেনকে আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবেন। তিনি ইইউর সঙ্গে এখনই আলোচনা শুরু করছেন না। তিনি সময় নিচ্ছেন। তার সমস্যা প্রধানত দুটি। প্রথমত, অর্থনীতি। ব্রিটেনের অর্থনীতিকে তিনি ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারবেন কি-না, দ্বিতীয়ত, উত্তর আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের রাজনীতি। অর্থনীতিকে শক্তিশালী একটি ভিত্তি দেয়ার কাজটি তার জন্য সহজ হবে না। উপরন্তু তার জন্য উত্তর আয়ারল্যান্ড ও সেই সঙ্গে স্কটল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি লক্ষ্য করার মতো। ব্রিটেনের এই গণভোট শুধুমাত্র স্কটিশ আর আইরিস কট্টরপন্থীদেরকেই উৎসাহিত করবে না। বরং দেখা গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত আরো বেশ কটি দেশের কট্টরপন্থীরা এতে করে আরো উৎসাহিত হয়েছেন। অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টির সাবেক সভাপতি হোয়ারও চান অস্ট্রিয়াকে ইইউ থেকে বের করে আনতে। বিশ্লেষকরা অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন যে যুক্তরাজ্যের পর অস্ট্রিয়া দ্বিতীয় রাষ্ট্র, যারা ইইউতে থাকা না থাকা নিয়ে গণভোট করতে পারে। এ কাতারে আরো আছেন বেলজিয়ামের ফ্লেমিন ন্যাশনালিস্ট পার্টির প্রধান টমভ্যান গ্রাইকেন। ডেনমার্কের ড্যানিশ পিপলস পার্টির ক্রিশ্চিয়ান থালেসেন, ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্টের মারিয়েন লি. পেন, জার্মানির অলটারনেটিভ ফর জার্মানির ফ্রক পেট্টি, হাঙ্গেরীর প্রধানমন্ত্রী ন্যাশনাল কনজারভেটিভ ফ্রিডেসজ পার্টির ভিক্টর অরবান, ইতালির ফাইভ স্টার স্যুভমেন্টের বেপ্পে প্রিল্লও, হল্যান্ডের ডাচ পার্টি ফর ফ্রিডমের নিয়ন্ট উইল্ডাস। এই উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি এখন বেক্সিটের ঘটনায় উৎসাহিত হবে। ফলে আগামী দিনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান ইউরোপীয় রাজনীতিতে কী রকম হবে, এর স্টাকচার কী হবে, এ প্রশ্ন থাকলই। বলতে দ্বিধা নেই ইউরোপে হাজার হাজার সিরীয় ও ইরাকি অভিবাসীর উপস্থিতি পুরো ইউরোপ জুড়ে যে অভিবাসন বিরোধী একটা জনমত গড়ে ওঠে, তার রেশ ধরেই ব্রিটেনের নাগরিকরা সিদ্ধান্ত নেবে ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার। স্পষ্টতই যে ধারণাকে কেন্দ্র করে ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার যাত্রা শুরু করেছিল, তা তখন মুখ থুবড়ে পড়ল। ইউরোপে আরো পরিবর্তন আসবে।
গত দু'সপ্তাহ আমি ইউরোপে অবস্থান করছি। খুব কাছ থেকে দেখছি পরিবর্তনটাকে। দেখেছি জার্মানি কীভাবে বদলে যাচ্ছে। একটি ভিন্ন শংকর জাতির জন্ম হয়েছে। আগামী বছর জার্মানিতে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন ফ্রান্সেও। সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি আবারো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ঘোষণা করেছেন। উভয় দেশেই সিরীয় অভিবাসী তথা আইএসের তৎপরতা যে নির্বাচনে একটি ইস্যু হয়ে দেখা দেবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। জার্মানিতে দুটো বড় দল সিডিইউ এবং এসপিডি এখন এখানে একটি 'গ্র্যান্ড কোয়ালিশন' গঠন করেছে। এই কোয়ালিশন আগামীতে থাকবে কি-না, সেটাও একটা প্রশ্ন।
আগামী মাসে ইইউর শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এই প্রথম ব্রিটেনকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হবে না। ইইউর নেতারা ইউরোপীয় ঐক্যকে ধরে রাখার কথা বলছেন বটে। কিন্তু যদি অর্থনীতিতে একটি গতি আনা না যায়, যদি দেশগুলোর ভেতরকার বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব না হয়, যদি সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধ না হয়, তাহলে এই ঐক্য টিকে থাকবে না। জার্মানি বড় দেশ। এঞ্জেলা মার্কেল ঐক্যের কথা বারবার বলছেন বটে। কিন্তু এটি সহজ নয়। আগামী দিনগুলোই বলবে এই ঐক্য কিভাবে এবং কোন পর্যায়ে টিকে থাকবে।
ফ্রাঙ্কফুট, জার্মানি
Daily Jai Jai Din30.08.2016

কেরির ঢাকা সফর ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা



বাংলাদেশ অনেকদিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শুল্কমুক্ত জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশ এ সুবিধা চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশকে এ সুবিধা দেয়া হয়নি। অথচ ১৫ দশমিক ৬২ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের বিশাল এক বাজার গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী এখন ভিয়েতনাম। টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তির ফলে ভিয়েতনামের পণ্য এখন বিনা শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলো এখন ভিয়েতনামি তৈরি পোশাকে ভরা। ফলে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। শুল্কমুক্ত থাকায় ভিয়েতনামি তৈরি পোশাক (শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, ব্লেজার) সস্তা। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে মার খাচ্ছে। উপরন্তু তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র নানা প্রতিবন্ধকতা আরোপ করায় (ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, মানসম্মত কারখানা ইত্যাদি) অনেক তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে অথবা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশের এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার জিএসপি সুবিধা নিশ্চিত করা। জন কেরির ঢাকা সফরে বিষয়টি আলোচনায় আসবে। বাণিজ্যমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, জিএসপি সুবিধা না দেয়ার বিষয়টি ‘রাজনৈতিক’। এটা আদৌ রাজনৈতিক বক্তব্য নাকি সত্যিকার অর্থেই যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার আশায় জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল (কিছু কিছু পণ্যে জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশ পেত)- বিষয়টি স্পষ্ট না হলেও এটা সত্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বারবার জিএসপি সুবিধা প্রাপ্তিকে গুরুত্ব দিয়ে আসছিল। তবে একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে- বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাংলাদেশের অনুকূলে। অর্থাৎ বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে বেশি রফতানি করে, আমদানি করে সে তুলনায় কম। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত সূত্রমতে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ রফতানি করেছে ৩০৫২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছে ৪৩৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এই ৬ মাসে ঘাটতির পরিমাণ ২৬১২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। গত কয়েক বছর ধরেই এ ঘাটতি বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ২০১৫ সালে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫০৪৮ মিলিয়ন ডলার, ২০১৪ সালে ৪১৬৪ মিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালে ৪৬৪৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার, ২০১২ সালে ৪৪০৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার, আর ২০১১ সালে ৩৭৩৩ মিলিয়ন ডলার। জিএসপি সুবিধা না পেলেও বাংলাদেশ যে রফতানি বাড়াতে পারছে, এটাই বড় প্রমাণ।

যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে নীতি প্রণীত হয়েছে, বাংলাদেশ তারই অন্তর্ভুক্ত। নানা কারণে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর প্রধান কারণ চীন। চীনকে ঘিরে ফেলার এক সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক নীতি প্রণয়ন করছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশ তথা ভারতের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে অনেক বেশি। একদিকে ভারত মহাসাগর, অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগর- এই দুটো অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র এক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি জাহাজ মোতায়েন করা হবে। উদ্দেশ্য ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর মুভমেন্টের দিকে লক্ষ্য রাখা। দক্ষিণ চীন সাগরকে বলা হচ্ছে সম্ভাব্য একটি স্থান, যাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সামরিক সংঘর্ষের সূত্রপাত হতে পারে। বছরে এই দক্ষিণ চীন সাগর এলাকা দিয়ে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য পরিবাহিত হয়। অর্থাৎ এই রুট ব্যবহার করে পণ্য পৃথবীর বিভিন্ন দেশে যায়, যার একটা বড় অংশ চীন রফতানি করে। ১১ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস রয়েছে এ অঞ্চলে। বছরে এ অঞ্চল থেকে ১০ মিলিয়ন টন মৎস্য আহরণ করা হয়। ফলে চীনের এ অঞ্চলের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এ অঞ্চল ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী জাহাজ এ অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছে। এ অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালত সম্প্রতি চীনের দাবি খারিজ করে দিলেও চীন তা মেনে নেয়নি। ফিলিপাইনের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে চীন। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে, তার ঢেউ এসে লাগবে ভারত মহাসাগরেও। সুতরাং চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থান নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার তৎপরতা বাড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই জন কেরির বাংলাদেশ ও ভারত সফর এ দৃষ্টিতেই আমাদের দেখতে হবে। মোদির জমানায় ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও বেড়েছে। ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ বেড়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির অংশ। ভারতকে তার প্রয়োজন এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোর জন্য। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, সেই নীতি ভারতকে আস্থায় নিয়েই তৈরি করা। অর্থাৎ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের আলোকেই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রচিত হবে। আলাদা করে বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো নীতি প্রণয়ন করবে না যুক্তরাষ্ট্র। এবং যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়। ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজন খুব বেশি।

কেরির ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও গণতন্ত্র প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা নিয়ে কথা হতে পারে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা যুক্তরাষ্ট্র বারবার বলে এসেছে। কেরি এ বিষয়টাকে আবারও গুরুত্ব দেবেন। এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির যাতে উন্নতি হয়, সে ব্যাপারেও তিনি কথা বলবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আসলে এ ধরনের বক্তব্য নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এই বিষয়গুলো আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র কখনও এই বিষয়গুলো নিয়ে কোনো ‘শর্ত’ আরোপ করে না। কেরির সফরে এ ধরনের কোনো সম্ভাবনাও নেই। জন কেরির এ সফরে বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়বে। মার্কিন মিডিয়ায় নতুন করে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হবে। তবে এ সফরের মধ্য দিয়ে খুব বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Jugantor
28.08.2016

দক্ষিণ এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র

ক্ষিণ এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র


যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি দক্ষিণ এশিয়া সফরে আসছেন ২৯ আগস্ট। এ সফরে তিনি বাংলাদেশ ও ভারত সফর করবেন। ভারত সফরে তিনি দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্র-ভারত স্ট্র্যাটেজিক ও কমার্শিয়াল ডায়ালগে অংশ নেবেন। ওবামা প্রশাসনের শেষ সময়ে এসে জন কেরির এ সফর কিছুটা হলেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, ভারতে তার সফরের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এই মেসেজটি দিচ্ছে যে, তারা ভারতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশে কেরি তার ৩ বছরের দায়িত্ব পালনকালীন প্রথমবারের মতো আসছেন। তার পূর্বসূরি হিলারি ক্লিনটন ২০১২ সালে বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশে তার সফরও গুরুত্বের দাবি রাখে। তিনি এমন একসময় বাংলাদেশে আসছেন, যখন দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে কিছু কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান, আইএসের অবস্থান, মানবাধিকার ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই সোচ্চার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিপরীতে বাংলাদেশের বর্তমান। বিশেষ করে বাংলাদেশে আইএসের উত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, বাংলাদেশে আইএস ঘাঁটি গেড়েছে। বাংলাদেশ এটা স্বীকার করুকÑ এমনটাই চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ মনে করে, এদেশে আইএস নেই। তবে স্থানীয় জঙ্গি আছে। বিপরীতমুখী এ অবস্থান থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অবনতি ঘটেনি। জেএসপি সুবিধা বাতিল হলেও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি। বাংলাদেশ বারবারই তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়ে আসছে।
তবে এখানে একটা জিনিস মনে রাখা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে ভারতের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, সেই নীতির আলোকেই বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক গড়ে উঠছে। ভারত বড় দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ভারতে অনেক বেশি। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে পাশে চায়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ভারতকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। এশিয়ায় দ্বিতীয় অর্থনীতি ভারতের। বলা হচ্ছে, চলতি শতাব্দীতে ভারত ও চীন দুইটি বড় অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হবে, যারা বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। এদিকে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা প্রশাসনের চরাড়ঃ ঃড় অংরধ, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া পলিসির মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভারত। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ভারতের গুরুত্ব অনুধাবন করেই প্রেসিডেন্ট ওবামা দুই-দুইবার ভারত সফর করেছিলেন। সর্বশেষ ভারতের রিপাবলিকান ডে’র অনুষ্ঠানে ওবামা ছিলেন প্রধান অতিথি। মোদির জমানায় ভারতের অর্থনীতি আরও উন্মুক্ত হওয়ায় ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ বেড়েছে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে বেশি, আমদানি করে কম। একটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি সহজ হবে। ২০১৬ সালের প্রথম ৬ মাস যুক্তরাষ্ট্র ভারতে রফতানি করেছে ৯ হাজার ৯৯০ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছে ২২ হাজার ৬৭১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি ১২ হাজার ৬৮০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি ছিল ২৩ হাজার ৩৩৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার। এ থেকেই বোঝা যায়, দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেন গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভারতের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদারই নয়, বরং ভারতে পারমাণবিক প্রযুক্তিও সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে একাধিক চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। ভারত নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার্স গ্রুপের সদস্য হতে চায়। এ ব্যাপারেও সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। শুধু তাই নয়, ভারত জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সদস্য হতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রেরও সমর্থন রয়েছে তাতে। ওবামার ভারত সফরের সময় তিনি প্রকাশ্যেই ভারতের এ অবস্থান সমর্থন করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে নীতি প্রণীত হয়েছে, বাংলাদেশ তারই অন্তর্ভুক্ত। নানা কারণে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর প্রধান কারণ চীন। চীনকে ‘ঘিরে ফেলার’ এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক নীতি প্রণয়ন করছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশ তথা ভারতের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে অনেক বেশি। একদিকে ভারত মহাসাগর, অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরÑ এই দুইটি অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র এক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি জাহাজ মোতায়েন করা হবে। উদ্দেশ্য, ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর মুভমেন্টের দিকে লক্ষ রাখা। দক্ষিণ চীন সাগরকে বলা হচ্ছে সম্ভাব্য একটি স্থান, যাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সামরিক সংঘর্ষের জন্ম হতে পারে। বছরে এ দক্ষিণ চীন সাগর এলাকা দিয়ে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য পরিবাহিত হয়। অর্থাৎ এ রুট ব্যবহার করে পণ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যায়, যার একটা বড় অংশ চীন রফতানি করে। ১১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস রয়েছে এ অঞ্চলে। বছরে এ অঞ্চল থেকে ১০ মিলিয়ন টন মৎস্য আহরণ করা হয়। ফলে চীনের যে এ অঞ্চলের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এ অঞ্চল ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী জাহাজ এ অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছে। এ অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালত সম্প্রতি চীনের দাবি খারিজ করে দিলেও চীন তা মেনে নেয়নি। চীন ফিলিপাইনের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে, তার ঢেউ এসে লাগবে ভারত মহাসাগরেও। সুতরাং চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থান নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ভারতীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার তৎপরতা বাড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই জন কেরির বাংলাদেশ ও ভারত সফর এ দৃষ্টিতেই আমাদের দেখতে হবে। মোদির জমানায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও বেড়েছে। ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ বেড়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির অংশ। ভারতকে তার প্রয়োজন এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোর জন্য। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, সেই নীতি ভারতকে আস্থায় নিয়েই তৈরি করা। অর্থাৎ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের আলোকেই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রচিত হবে। আলাদা করে বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো নীতি প্রণয়ন করবে না যুক্তরাষ্ট্র এবং এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ ক্ষুণœ হয়। ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজন খুব বেশি।
এ প্রসঙ্গে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। চীনের বর্তমান শাসকচক্র ‘দি সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট অ্যান্ড মেরিটাইম সিল্ক রোড’ (বহুল প্রচারিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড) নামে যে নীতি প্রণয়ন করেছে, তাতে ৬০ দেশকে চীন তার বাণিজ্যিক কাঠামোয় নিয়ে আসতে চাইছে। এতে করে চীনের সঙ্গে সড়কপথে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো যেমনি সংযুক্ত হবে, ঠিক তেমনি দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও সামুদ্রিক পথে সংযুক্ত হবে। এই বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের খরচ হবে ৪ থেকে ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ ও শীর্ষস্থানীয় বড় অর্থনীতির সঙ্গে টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এবং ট্রান্স আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ নামে যে দুইটি চুক্তি করেছে, তার বিকল্প হিসেবেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ‘ব্রেন চাইল্ড’ হচ্ছে এ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি। সিরিয়াস পাঠকরা স্মরণ করতে পারেন, চীনের ‘ঝঃৎরহম ড়ভ চবধৎষং’ প্রজেক্টের কথা। এ প্রজেক্টের আওতায় চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক সমুদ্রবন্দরকে ‘মুক্তার মালা’র মতো একসঙ্গে সংযুক্ত করেছে। প্রতিটি বন্দরেই চীনের নৌবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, চীন ভারত মহাসাগরে অবস্থিত একাধিক দেশে তাদের নৌঘাঁটি নির্মাণের চেষ্টা করছে। জিবুতি, গাওদার (বেলুচিস্তান), হাসবানতোতা (শ্রীলঙ্কা), মিয়ানমার, ইয়েমেন, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, ওমান কিংবা কেনিয়াতে চীনা নৌঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। জিবুতি ও মাদাগাস্কারে নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। চীনের এ নৌঘাঁটি নির্মাণের বিষয়টিকে ভারত খুব সহজভাবে নেয়নি। ভারতও একইভাবে সিসিলি ও মৌরিতুসের দুইটি দ্বীপে তাদের নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। ২০১৫ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী মোদির এ দ্বীপ দুইটি সফরের সময় এ নৌঘাঁটি নির্মাণের কথা প্রথমবারের মতো জানা যায়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, হাসবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারত তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেছিল। ভারত বিষয়টিকে এত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত সেখানে রাজাপাকসের সরকারকে উৎখাত পর্যন্ত করেছিল ভারত। সিরিসেনাকে রাজাপাকসের বলয় থেকে বের করে এনে রাজাপাকসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে তাকে বিজয়ী করতে সাহায্য করেছিল ভারত। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে, ভারত মহাসাগরে চীনের তৎপরতাকে ভারত স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এখানে প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন দ্বন্দ্ব বাড়ছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হচ্ছে ভারতের পক্ষে। এ অঞ্চলজুড়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে উঠছে, যা চীনা স্বার্থকে আঘাত করছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে ভারতকে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। আগামী দিনে এ অঞ্চল ও সেই সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগর প্রত্যক্ষ করবে এক অস্ত্র প্রতিযোগিতা। যে কোনো ধরনের নৌ-সংঘর্ষকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সুতরাং আজ জন কেরি যখন ভারত সফরে আসছেন, এটাকে স্বাভাবিক একটি সফর ভাবলে ভুল হবে। চীনের কর্তৃপক্ষ চ্যালেঞ্জ করতেই ভারতকে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র। কেরির সফর এ আলোকেই রচিত। এক্ষেত্রে কেরি বাংলাদেশেও আসবেন। কিন্তু তাতে করে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে তেমন পরিবর্তন আসবে না। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের যে ভূমিকা, যুক্তরাষ্ট্র সেই ভূমিকার বাইরে যেতে পারবে না।

ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Alokito Bangladesh
28.08.2016

কোন পথে ইউরোপ

ইউরোপকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন এখন। গত ২৩ জুন ব্রিটেনের গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত, আর সেই সঙ্গে লাখ লাখ সিরীয় ও ইরাকি অভিবাসীর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ পুরো ইউরোপের দৃশ্যপটকে এখন পাল্টে দিয়েছে। গত দুই সপ্তাহ আমি ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়িয়েছি। অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। যে ইউরোপকে আমি প্রায় ২৫ বছর আগে ফেলে এসেছিলাম, সেই ইউরোপকে আমি এখন আর চিনি না। ইউরোপ বদলে গেছে। বদলে যাচ্ছে। নতুন এক ইউরোপের জন্ম হচ্ছে! জন্ম হচ্ছে নতুন এক সংস্কৃতির। একটি সংকর জাতির জন্ম হচ্ছে—আদি জার্মানিকে আমি আর খুঁজে পাইনি। ফ্রাংকফুর্টের বিখ্যাত বিপণি এলাকা সাইল এ ক্যাফে শপগুলোতে নিত্যদিন বসে কফি পান করেছি আমার পুরনো বন্ধু কামাল আর ফেরদৌসের সঙ্গে। আমার কাছে এ এক নতুন জার্মানি! এখানে এক মিশ্র জাতির জন্ম হয়েছে। ২৫ বছর আগে আমি যখন জার্মানি ছেড়ে চলে যাই, স্পষ্টতই মনে আছে আমি রাস্তায় কোনো হিজাবি মহিলাকে দেখিনি তখন। এখন সাইলের বিপণিবিতানগুলোর পাশে উন্মুক্ত কফি শপে বসে লক্ষ করেছি হিজাবি মহিলারা হেঁটে যাচ্ছেন কোনো ধরনের ভয়-ডর ছাড়াই! অধিকাংশ মহিলাই আরব দেশগুলো থেকে আসা—কেউ সিরীয়, কেউ ইরাকি, কেউ বা আবার অন্য কোনো আরব দেশের। নিউ ইয়র্কের কুইন্সি এলাকায় আমি বাংলাদেশি মহিলাদের আপাদমস্তক বোরকায় ঢেকে বাজার করতে দেখেছি। সেদিন অবাক হয়েছিলাম বৈকি! আমেরিকার মতো সমাজে থেকেও পুরো হিজাবি! না, কোনো বাংলাদেশি মহিলাকে আমি বোরকা পরে জার্মানির রাস্তায় ঘুরতে দেখিনি। বাংলাদেশি সন্তানদেরও আমি দেখিনি। তবে আরব দেশগুলো থেকে যাঁরা সাম্প্রতিককালে এসেছেন তাঁরা প্রায় সবাই পর্দাপ্রথা মেনে চলছেন। এটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিতর্ক চললেও জার্মানিতে আমি কোনো বিতর্কের খবর শুনিনি। একসময় জার্মানরা গর্ব করত তাদের রক্তে কোনো মিশ্রণ নেই বলে। অর্থাৎ তাদের রক্তে অন্য কোনো রক্ত মেশেনি। এখন তা পরিপূর্ণভাবে বদলে গেছে। এখন আদি খাঁটি জার্মান নাগরিক পাওয়া খুব দুষ্কর। সবাই জার্মান নাগরিক। কিন্তু আদি জার্মান নয়। রক্তে মিশ্রণ ঘটেছে। আগামী ২০ বছর পর যে জার্মানির জন্ম হবে, তা হবে এক মিশ্র জাতির জার্মানি। অনেকটা ফ্রান্সের মতো। ফ্রান্সে ব্যাপকভাবে আফ্রিকান নাগরিকদের অভিবাসন, আলজেরিয়া তথা মাগরেব দেশভুক্ত এলাকা থেকে আসা নাগরিকদের ফ্রান্সে অবস্থান, বৈবাহিক সম্পর্ক ইত্যাদির কারণে নতুন এক ফ্রান্সের জন্ম হয়েছে। যদিও এটা সত্য, আফ্রিকায় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল এবং সেখান থেকে আসা নাগরিকদের ফ্রান্সে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছিল ফ্রান্স। ফলে একসময়ের শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের দেশ ফ্রান্সকে এখন আর চেনা যায় না। শ্বেতাঙ্গ আর আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের সমন্বয়ে এক নয়া ফ্রান্সের জন্ম হয়েছে। সেই সঙ্গে মাগরেবভুক্ত অঞ্চল থেকে আসা বিপুলসংখ্যক (আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো) শ্বেতাঙ্গ মানুষেরও স্থান হয়েছিল ফ্রান্সে। এর পরই এক নতুন ফ্রান্স জন্ম নিয়েছে। তবে জার্মানির সঙ্গে পার্থক্য এখানেই যে জার্মানির কোনো উপনিবেশ ছিল না। ফলে আফ্রিকা থেকে এখানে অভিবাসন হয়েছে কম।
ইউরোপের সমস্যা এখন অনেক। প্রথমত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে যাওয়ার ফলে ইউরোপ যে বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে, তা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক এখনো অব্যাহত রয়েছে। ব্রিটেনের গত ২৩ জুনের গণভোটের সিদ্ধান্তে (বেক্সিট) অনেকেই অবাক হয়েছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন পদত্যাগ করেছেন এবং ব্রিটেন একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে, এ খবর অনেক পুরনো এখন। তবে ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্তকে ইউরোপের অনেক দেশই সমর্থন করেনি। গত ৪ আগস্ট আইপিএস-ডিএস মরি নামক একটি প্রতিষ্ঠান ইইউভুক্ত ৯ দেশের জনগণের ওপর একটি জনমত জরিপ করে। এই দেশগুলো ইউরোপের ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত। এতে দেখা যায়, ওই ৯টি দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ মনে করে ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত (বেক্সিট) ব্রিটেনের জন্য একটি খারাপ সিদ্ধান্ত। ৫৮ শতাংশ মানুষ মনে করে পুরো ইইউয়ের জন্যও এটি খারাপ। ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছে রাশিয়া। সুইডেনের ৬৮ শতাংশ মানুষ মনে করে ইইউয়ের জন্য সিদ্ধান্তটি ভালো ছিল না। সুইডেনের মানুষ মনে করে বেক্সিটের ফলে এ অঞ্চলের ব্যাপারে রাশিয়ার হুমকি আরো বাড়বে এবং রাশিয়া এ থেকে ফয়দা নেবে। অন্যদিকে ফ্রান্সের ৬৪ শতাংশ মানুষ মনে করে বেক্সিটের ফলে অর্থনৈতিকভাবে ইইউ আরো দুর্বল হবে। এখন ব্রিটেনের ব্যাপারে ইইউয়ের সিদ্ধান্ত কী হবে সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। জনমত জরিপেও তা প্রতিফলিত হয়েছে। জনমত জরিপে দেখা গেছে ২৮ শতাংশ মানুষ মনে করে ইইউ ব্রিটেনের ব্যাপারে কঠোর হবে। আবার ২৬ শতাংশ মানুষ মনে করে ইইউ ব্রিটেনের ব্যাপারে নরম হবে। বলা ভালো, যেসব দেশে এই জনমত জরিপ চালানো হয় সেগুলো হচ্ছে—স্পেন, জার্মানি, বেলজিয়াম, সুইডেন, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি ইত্যাদি (ইকোনমিস্ট, ৬ আগস্ট ২০১৬)। এর আগে এক নিবন্ধে আমি উল্লেখ করেছিলাম ব্রিটেনের এ ধরনের (বেরিয়ে যাওয়ার) সিদ্ধান্তে ইইউয়ের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। স্কটল্যান্ড ব্রিটেন থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইইউয়ের সঙ্গে থাকতে পারে। এ ব্যাপারে স্কটল্যান্ড দ্বিতীয়বারের মতো সেখানে গণভোটের আয়োজন করতে পারে। প্রথমবারের গণভোটে ব্রিটেনের সঙ্গে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছিল স্কটল্যান্ডের জনগণ। বেক্সিটের সিদ্ধান্তটি হয়েছে বটে; কিন্তু তা কার্যকর করতে ব্রিটেন দুই বছর সময় পাবে। ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্তের ফলে জার্মানির ওপর চাপ বাড়ছে। লন্ডনে শত শত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের অফিস ফ্রাংকফুর্টে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ফ্রাংকফুর্টের গুরুত্ব আরো বেড়েছে। তাই নিউ ইয়র্কের পর ফ্রাংকফুর্ট হতে যাচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর। জার্মানি এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। জার্মানিতে থাকার সময় লক্ষ করলাম সেখানে প্রচুর নির্মাণকাজ হচ্ছে। নতুন নতুন ‘হাইরাইজ’ ভবন তৈরি হচ্ছে। গালফ অঞ্চলের শাসকদের বিনিয়োগও বাড়ছে ফ্রাংকফুর্টে। নতুন এক ফ্রাংকফুর্ট তৈরি হচ্ছে।
ইউরোপে এই মুহূর্তে একটা বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থীদের নিয়ে। প্রায় ১০ লাখ সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে জার্মানি। শরণার্থীদের জন্য আগামী পাঁচ বছর ৯৪ বিলিয়ন ইউরো খরচ করবে জার্মানি। এই শরণার্থীদের নিয়ে ফ্রান্স এক মহাফ্যাসাদে আছে। সেখানে তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের তৎপরতা বেড়েছে। ফ্রান্সে একাধিক সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, যার সঙ্গে ফ্রান্সে মাগরেবভুক্ত দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীরা জড়িত ছিল। সিরীয় শরণার্থীদের মাঝে আইএসের এজেন্ট আছে—এ ধরনের কথা মিডিয়ায় বারবার এলেও তা এখনো প্রমাণিত নয়। ফ্রান্সে এখনো জরুরি অবস্থা চালু রয়েছে। জার্মানিতে অবশ্য আমি তেমন পুলিশি তৎপরতা দেখিনি। জার্মানি এটা নিয়ে তেমন আতঙ্কিত, সেটাও আমার মনে হয়নি। তবে সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীরা একটা সমস্যা তৈরি করতে পারে ভবিষ্যতে। তুরস্কের ‘গাস্ট আরবাইটার’দের নিয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে! গেল সপ্তাহে কোলন শহরে ৪০ হাজার তুরস্কের নাগরিকের এক বিশাল মিছিল হয়েছে। মিছিলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের পক্ষে স্লোগান উঠেছে। তুরস্কের সাম্প্রতিক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর তুরস্ক সরকার কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি দায়ী করার পর জার্মানি-তুরস্ক সম্পর্কও এখন খারাপের দিকে। জার্মানিতে তুরস্কের একটি গোপন নথি ফাঁস হওয়া, জার্মান সংসদীয় প্রতিনিধিদের তুরস্ক সফরের সময় ন্যাটোর ঘাঁটি দেখতে না দেওয়া ইত্যাদি ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্ক এখন অবনতির দিকে।
জার্মানিতে জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু রাখতে বিপুলসংখ্যক তুরস্কের নাগরিককে এখানে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তারা একটি নিজস্ব সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করেছে এখানে। তাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম এখন শিক্ষিত। জার্মান নাগরিক তারা। একজন পার্লামেন্ট সদস্যও আছেন, যাঁর মা-বাবা তুরস্ক থেকে এসেছিলেন। জার্মানিতে প্রায় তিন হাজার মসজিদ আছে, যার মাঝে দুই হাজার মসজিদ পরিচালনা করে তুরস্কের নাগরিকরা। এখন তাদের সঙ্গে যোগ হলো সিরিয়া ও ইরাকের শরণার্থীরা। তাদের এখন পর্যন্ত কোনো কাজের অনুমতিপত্র দেওয়া হয়নি। তবে তুরস্কের ‘গাস্ট আরবাইটার’দের মতো তারাও যে একসময় এখানে ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠবে, তা বলাই যায়। তারাও আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে স্থায়ীভাবে থাকার অধিকারসহ নাগরিকত্ব পাবে। এক নতুন সংস্কৃতি গড়ে উঠছে জার্মানিতে। জার্মানির উদারতার সুযোগ নিয়ে এখানে যদি ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ইউরোপ বদলে যাচ্ছে। ইয়ান ব্রেনার ও তার ইউরো-এশিয়া গ্রুপ (একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান) আগামী দিনে ইউরোপের জন্য সম্ভাব্য ১০টি ঝুঁকির কথা বলেছে। এসব ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তুরস্কের উত্থান, রাশিয়ায় পুতিনের নেতৃত্বে একটি উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান। উভয় ক্ষেত্রেই ইউরোপের জন্য তা এক ভয়ের কারণ। বিশ্বরাজনীতি আবার নতুন করে এক নয়া স্নায়ুযুদ্ধের উত্থান দেখছে, যা অভিহিত করা হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ-২ নামে। সর্বশেষ তুরস্ক-রাশিয়া-ইরান ঐক্য এই ধারণাকে আরো শক্তিশালী করেছে। আর এই ঐক্যের পেছনে সমর্থন রয়েছে চীনের। একদিকে ট্রান্স-আটলান্টিক ঐক্যে যেমন ফাটল ধরেছে, অন্যদিকে রাশিয়ার আগ্রাসী তৎপরতা আরো বেড়েছে। যা কিনা আগামী দিনে ইউরোপের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। ইউরোপে আইএস রিক্রুটদের তৎপরতা আরো একটা চিন্তার কারণ। ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও ইংল্যান্ডে এদের সমর্থকের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ইউরোপ নিয়ে একটা চিন্তা থেকেই গেল। ইউরোপজুড়ে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের উত্থানও দেখছেন কেউ কেউ। বিপুলসংখ্যক সিরীয় ও ইরাকি নাগরিক, যাদের বেশির ভাগই মুসলমান, ইউরোপের মাটিতে তাদের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে উগ্র, দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট স্থানীয় নির্বাচনে সফল হয়েছে। জার্মানিতে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি তার অবস্থান শক্তিশালী করেছে। পোল্যান্ডসহ পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে ধর্মীয় আবরণে এই দক্ষিণপন্থী রাজনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। স্পষ্টতই বদলে যাচ্ছে ইউরোপের রাজনীতি। এই রাজনীতি আগামী দিনে ইউরোপকে কোথায় নিয়ে যায় সেটাই হচ্ছে এখন আমাদের দেখার বিষয়। Daily Kaler kontho 25.08.2016

কোন পথে জার্মানি

গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে জার্মানিতে থেকে যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হল, কোন পথে জার্মানি? বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জার্মানির ভূমিকাকে সামনে নিয়ে এসেছে। জার্মানি শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেই বড় দেশ নয়। জার্মান বিশ্ব শক্তি। এখন জার্মানির ভূমিকা কী হবে? ইউরোপের ঐক্য ধরে রাখতে জার্মানির ভূমিকা কী হবে? জার্মানি বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। সাধারণ নিয়মে জিডিপিতে বিশ্বে জার্মানির অবস্থান চতুর্থ (৩ দশমিক ৩৭১ ট্রিলিয়ন ডলার); মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বে এ অবস্থান ২০তম (৪১ হাজার ২৫৭ ডলার)। আর পিপিপির হিসেবে, অর্থাৎ ব্যয় ক্ষমতার ভিত্তিতে এর পরিমাণ ৩ দশমিক ৮৪২ ট্রিলিয়ন ডলার (৫ম) এবং ৪৭ হাজার ৩৩ ডলার (মাথাপিছু আয়)। ফলে ব্রিটেন যখন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, তখন থেকেই সবার দৃষ্টি জার্মানির দিকে। ১৯৯৩ সালে ইইউ গঠনের উদ্যোক্তাদের অন্যতম হচ্ছে জার্মানি। ১৯৯৯ সালে যখন ইউরো জোন গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়, তখনও জার্মানি ছিল এর প্রধান উদ্যোক্তা। ফলে ইইউকে ধরে রাখা, একক মুদ্রা হিসেবে ইউরোকে আরও শক্তিশালী করাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে জার্মানির ভূমিকা এখন বড়। এ ভূমিকা জার্মানি এখন কতটুকু পালন করতে পারবে, এ প্রশ্ন এখন অনেকেই করছেন।

জার্মানির সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আমার শিক্ষাজীবনের একটা সময় কেটেছে জার্মানিতে। আজ এত বছর পর জার্মানিতে এসে পরিবর্তন দেখেছি অনেক, যা আমাকে অবাক করেছে। জার্মানি আরও বড় হয়েছে। শক্তিশালী হয়েছে। যে ফ্রাংকফুর্ট শহরকে আমি রেখে গিয়েছিলাম ২৫ বছর আগে, সেই ফ্রাংকফুর্ট শহর এখন অনেক বড়। আকাশছোঁয়া সব ভবন হচ্ছে। নতুন নতুন এলাকা গড়ে তোলা হচ্ছে। এ ফ্রাংকফুর্ট শহরকে আমি আর চিনতে পারি না। আমি যে বিভাগে পড়াশোনা করেছি, তার নামও কিছুটা বদলে গেছে। বর্তমান চেয়ারম্যান, তিনিও নতুন। আমাকে তিনি দেখেননি কখনও। তবে ছাত্রদের সুযোগ বেড়েছে অনেক। অনেক ফান্ড আছে। এখানে এখনও উচ্চশিক্ষা ‘ফ্রি’। আরও মজার কথা, ছাত্রদের প্রতি সেমিস্টারে (বছরে দুই সেমিস্টার) যে ‘ফি’ দিতে হয় মাত্র ২৮০ ইউরো (বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদা) এবং এর বদৌলতে ছাত্রদের শহরের মধ্যে ট্রামে বা বাসে চলাচল ফ্রি। অর্থাৎ ছাত্ররা বিনা পয়সায় পড়াশোনা ও যাতায়াতের সুযোগ পায়। আমাদের সময় এমন সুযোগ ছিল না। বড় শহরে ছাত্ররা ৭০০ ইউরোতে মাস চালাতে পারে, যা সপ্তাহে দু’দিন কাজ করে একজন ছাত্র অর্জন করতে পারে। শুধু স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলো ছাড়া অন্য কোনো দেশে এ সুযোগ নেই। আমাদের দেশের ছাত্ররা এ সুযোগটি কেন নেয় না, আমি বুঝতে পারি না। আগে পাস করার পর কাজের সুযোগ মিলত না, এখন মিলছে। ডিগ্রি নেয়ার পর সরকার সুযোগ দিচ্ছে কাজ করার ও অভিজ্ঞতা অর্জন করার। আমার সরাসরি ছাত্রী রহিমা আক্তার মাস্টার্স করে এখন ছোট শহর উজবুর্গে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করছে। মারুফ পিএইচডি করে এখন এখানে শিক্ষকতার অপেক্ষায় আছে।

জার্মান রাজনীতিকদের দূরদর্শিতার প্রশংসা করতে হয়। সারা বিশ্বে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন জাতিগত বিদ্বেষ বাড়ছে, তখন জার্মানিতে এ সমস্যা নেই বললেই চলে। প্রায় ১০ লাখ সিরীয়কে আশ্রয় দিয়েছে জার্মানি- চিন্তা করা যায়? মানবতা এখানে নিঃসন্দেহে বড় ভূমিকা পালন করেছে। পুরো ইউরোপজুড়ে সিরীয় শরণার্থীদের যখন ভিন্ন চোখে দেখা হচ্ছে, যখন পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী শুধু খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীদের আশ্রয় দেয়ার কথা বলেছিলেন, সেখানে জার্মানি তার ‘দুয়ার’ খুলে দিয়েছিল। যদিও কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, জার্মানিতে জন্মহার কমে যাওয়ায় ফ্যাক্টরি চালাতে দক্ষ মানবসম্পদ পাওয়া যাবে না, এটা বিবেচনায় নিয়েই সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এর পেছনে হয়তো সত্যতা কিছুটা আছে, কিন্তু মানবতাবোধ থেকে লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল জার্মানি, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না! শরণার্থীদের জন্য জার্মানি আগামী ৫ বছর ৯৪ বিলিয়ন ইউরো খরচ করবে। জার্মানির এ প্রতিশ্রুতি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমার ধারণা ছিল, ২০১৫ সালেই জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল তার ‘অবদানের’ জন্য নোবেল পুরস্কার পাবেন। তিনি তা পাননি। তবে ২০১৬ সালে এ পুরস্কারের জন্য তার নাম বিবেচনায় আছে, তা বলতেই হয়। বলা প্রয়োজন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানির যে রাজনীতি, তা নিয়ন্ত্রণ করছে দুটো বড় দল- এসপিডি ও সিডিইউ। কখনও এসপিডি থেকে চ্যান্সেলর বা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, কখনও বা সিডিইউ থেকে। তবে সিডিইউর বেভেরিয়ার অঙ্গ সংগঠন হচ্ছে সিএসইউ। ২০১৩ সালের ১৮তম সংসদ নির্বাচনের পর সিডিইউ আর এসপিডির সমন্বয়ে একটি গ্রান্ড কোয়ালিশনের জন্ম হয়েছে। জার্মান পার্লামেন্টের ৬৩১ সদস্যের মধ্যে ৫০৪ সদস্য বর্তমানে এ কোয়ালিশনের সদস্য। এর মাঝে ৩১১ সদস্য সিডিইউ/সিএসইউর সদস্য। অন্যদিকে এসপিডির সদস্য মাত্র ১৯৩। বিরোধী দলে আছে দি লেফ্ট (৬৪ সদস্য) এবং অ্যালায়েন্স ’৯০ ও গ্রিন (৬৩ সদস্য)। বোঝাই যায়, এ বামপন্থীদের ভূমিকা সীমিত। গ্রান্ড কোয়ালিশন থাকায় যৌথভাবে তারা শরণার্থীদের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। এটাই একটা প্লাস পয়েন্ট। এখানে শরণার্থীদের ব্যাপারে দক্ষিণপন্থীদের আপত্তি রয়েছে এবং কয়েকটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু তা সরকারের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। একটা ভয় ছিল, শরণার্থীদের ব্যাপক অভিবাসনের ফলে জার্মানিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঘটতে পারে। জার্মানিতে চরম দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব জার্মানির (এনডিপি) উত্থান ঘটলেও, তা জনমানসে কোনো বড় প্রভাব ফেলেনি। এনডিপি আদৌ কোনোদিন জার্মান পার্লামেন্টে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, নাজি পার্টি নেতা হিটলারকে এ দেশের জনগণই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিল। তবে অনেকেই মনে করেন, এ ধরনের সম্ভাবনা এখন আর নেই।

গত কয়েকদিন ফ্রাংকফুর্টের সাইলের বিপণিবিতান এলাকায় লক্ষ্য করেছি, কীভাবে জনসংখ্যার মধ্যে পরিবর্তন আসছে। ফ্রাংকফুট এখন ছোটখাটো নিউইয়র্কে পরিণত হয়েছে। বলতে গেলে ফ্রাংকফুর্টে এখন প্রতিটি দেশের নাগরিক খুঁজে পাওয়া যাবে। সাইলের শপিংমলে যারা যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে ৬০ ভাগ অভিবাসী, অর্থাৎ অন্য দেশ থেকে এখানে এসেছেন। এর ফলে এখানে একটা মিশ্র জনসংখ্যা তৈরি হচ্ছে। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে, জার্মান ভাষা শিখছে- বোঝার উপায় নেই, এরা আদি জার্মান কিনা! পূর্ব ইউরোপ থেকে প্রচুর অভিবাসন হয়েছে শেঙেন চুক্তির কারণে। পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে যারা শেঙেন চুক্তির কারণে আসতে পেরেছিলেন, তারা ছিলেন দক্ষ। চাকরি পেতে সমস্যা হয়নি। আমি ফ্রাংকফুটের পাশে এসর্বন নামে একটা ছোট্ট শহরে ছিলাম। এখানে আমার বন্ধু কামাল থাকে। ৮০’র দশকে আমি যখন এখানে নিয়মিত আসতাম, তখন এটি ছিল মূলত একটি গ্রাম, কোনো প্রতিষ্ঠান তেমন একটা ছিল না। এখন এসর্বন শহরকে চেনা যায় না। কর্পোরেট জগতের অনেকগুলো হেড অফিস এখানে। এখানেই গড়ে উঠছে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের কার্যালয়। অফিস সময় পার হলেই দেখা যায় শত শত তরুণ, যারা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং ৮০ ভাগই বিদেশী, রাস্তা পার হয়ে ট্রাম ধরছে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। আমি লক্ষ্য করেছি, এদের মধ্যে ভারতীয় ও চাইনিজের সংখ্যা বেশি। এরা আইটি বিশেষজ্ঞ, যে বিশেষজ্ঞ জার্মান স্কুলগুলো তৈরি করতে পারেনি। এসব জায়গায় আমরা দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে পারতাম। আমি বারবার বলেছি এবং এখনও বলছি, আইটি সেক্টরকে আরও গুরুত্ব দিতে। এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশে। কিন্তু দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারছি না, শুধু বেকারের সংখ্যা বাড়াচ্ছি। অথচ এই জার্মানিতেই দক্ষ জনশক্তির (আইটি, ডাক্তার, নার্স, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন ইত্যাদি) বাজার আমরা সৃষ্টি করতে পারতাম, যেমনটি করেছে ভারত ও চীন। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী জিপিএ-৫ নিয়ে গর্ব করেন। কিন্তু জিপিএ-৫ আমাদের দক্ষ জনশক্তি উপহার দিতে পারেনি। জার্মানিতে এসে আমার উপলব্ধি হয়েছে, এখনও সুযোগ আছে। আমরা এ সুযোগটি কাজে লাগাতে পারি।

জার্মানির রাষ্ট্রীয় চরিত্রও বদলে যাচ্ছে। বিভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয়ে নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। হিজাবি মহিলাদের সংখ্যাও বাড়ছে। ফ্রাংকফুট শহরের বিপণিবিতান সাইলের রাস্তায় হিজাবি মহিলা দেখা এখন অতি সাধারণ একটি ঘটনা। পুরো শরীর বোরকায় ঢাকা একাধিক মহিলাও আমি দেখেছি রাস্তায়। বদলে যাচ্ছে ফ্রাংকফুটের চরিত্র। তবে আমাকে যা অবাক করেছে, তা হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। নিউইয়র্ক শহরের মতো এই ফ্রাংকফুট শহরেও আমি দেখেছি মানুষকে, বিশেষ করে মহিলাদের ভিক্ষা করতে, যা আগে ছিল না। তবে অধিকাংশই বিদেশী। ডাস্টবিন থেকে কোকের বোতল সংগ্রহ করার দৃশ্য খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। প্রতি বোতল বিক্রি করে এরা পায় ২৫ সেন্ট। অনেকেই এ থেকে প্রতিদিন ন্যূনতম ১০ ইউরো আয় করেন। সরকার সবাইকে ভাতা দেয়। এটা তাদের উপরি আয়। আমার এক বন্ধু আমাকে শোনাল এক অদ্ভুত কথা- এখানে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ নয়। বেকার ভাতার জন্য যে আবেদন করা হয়, তাতে লেখা থাকে- আপনি ভিক্ষাবৃত্তি করে অতিরিক্ত কিছু ইউরো অর্জন করছেন কিনা। জানি না, এটা সত্য কিনা! তবে আমি নিজ চোখে দেখেছি- যারা ভিক্ষা করছে, পুলিশ তাদের কাগজ পরীক্ষা করছে এবং কিছু না বলে চলে যাচ্ছে। পরোক্ষভাবে আয় করতে উৎসাহিত করা আর কী! এক তরুণীকে আমি দেখেছিলাম, প্রধান রেলস্টেশনের পাশে কাইজার স্ট্রেসেতে রাস্তায় ছোট একটি টুলে বসে ভিক্ষা করতে। তরুণী সিরিয়া থেকে আসা। জানি না, শুধু উপার্জনের আশায়ই মেয়েটি ভিক্ষা করছিল কিনা! নিজের কাছেই খারাপ লাগছিল। জার্মানিতে আমি থাকতে থাকতেই দেখলাম, তুরস্কের সঙ্গে জার্মানির সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এখানে তুরস্কের নাগরিকদের নিয়ে সমস্যা দুটি। কুর্দিরা এখানে শক্তিশালী। তাদের সংগঠন আছে। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সমর্থকের সংখ্যাও অনেক।

আমার অবস্থানকালীন কোলন শহরে প্রায় ৪০ হাজার নাগরিকের এক বিশাল র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই র‌্যালিতে এরদোগানের বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কিন্তু জার্মান সরকার অনুমতি দেয়নি। অভিযোগ আছে, এরদোগান সরকার জার্মানিতে বসবাসকারী তুরস্কের নাগরিকদের- যাদের কেউ কেউ জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন, তাদের ব্যবহার করছেন তার সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য। জার্মানিতে প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার তুরস্কের নাগরিক বসবাস করেন, যারা ২০১৫ সালে ভোট দিয়েছেন এবং এদের প্রায় ৬০ ভাগ এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির পক্ষ ভোট দিয়েছিলেন। জার্মানিতে যে ৩ হাজার মসজিদ রয়েছে, তার মধ্যে ২ হাজার মসজিদ পরিচালনা করে তুরস্কের নাগরিকরা। জার্মানিতে ইসলাম প্রচারে তুরস্কের নাগরিকদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। এক সময় তুরস্কের নাগরিকরা গেস্ট ওয়ার্কার হিসেবে এদেশে এসেছিলেন এবং জার্মানির শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। এখন এদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। তুরস্কের নাগরিকদের দ্বিতীয় জেনারেশনের কেউ কেউ ইতিমধ্যে জার্মানির পার্লামেন্টের সদস্য পর্যন্ত হয়েছেন। যেমন মিস্টার ওজডেমিরের কথা বলা যেতে পারে, যিনি এখন পার্লামেন্টের সদস্য। দীর্ঘদিন জার্মান-তুরস্ক সম্পর্ক ভালো থাকলেও, এখন এ সম্পর্ক ঘিরে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ১৫ জুলাইয়ের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর দুই দেশের আস্থার সম্পর্কে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এরদোগান তার বৈদেশিক সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন সামরিক অভ্যুত্থানে জড়িত হওয়ার। তিনি রাশিয়া সফর করেছেন এবং প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এ বিষয়ে আমি আলোকপাত করেছিলাম। তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় জার্মানির সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে তা প্রভাব ফেলছে। বলা হচ্ছে, তুরস্ক এখন ন্যাটোর বিভক্তিকে আরও বৃদ্ধি করতে পারে। অর্থাৎ তুরস্কের ভূমিকার কারণে আগামীতে ন্যাটো ভেঙে যেতে পারে। ফলে পুরো ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে এরদোগানকে নিয়ে আলোচনা এখন বেশি; এরদোগানের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি এখন তুরস্ককে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন- এ প্রশ্ন অনেকের।

জার্মানিতে শরণার্থীদের নিয়ে দু-একটি প্রশ্ন আছে বটে; কিন্তু ফ্রান্সের মতো এখানকার শহরগুলোকে কোনো ধরনের নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে দেয়া হয়নি। তবে বলতেই হয়, বদলে যাচ্ছে জার্মানি ও জার্মানির রাজনীতি। শরণার্থীরা, বিশেষ করে সিরীয় শরণার্থীরা একটা সমস্যা- এটা অস্বীকার করা যাবে না। এ শরণার্থীদের মধ্যে আইএসের কোনো এজেন্ট নেই- তাও অস্বীকার করা যাবে না। তবে এখানকার মানুষ বিষয়টি নিয়ে অতটা ভাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জার্মানির পার্থক্য এখানেই যে, জার্মানি বিদেশীদের প্রতি যতটা সহানুভূতিশীল এবং তাদের যত সামাজিক নিরাপত্তা দেয়, যুক্তরাষ্ট্র তা দেয় না। যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। প্রায় তিন মাস যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ঘুরছি। জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করছি এখানকার রাজনীতি। তবে জার্মানির বর্তমান রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা আমাকে অবাকই করছে। এক সময় জার্মান নাগরিকত্ব পাওয়া অত সহজ ছিল না। জার্মানরা তাদের রক্তের সঙ্গে অন্য রক্ত মিশতে দিতে রাজি ছিল না। সেই জার্মানি এখন বদলে গেছে। আগামী ২০ বছর পর কোন জার্মানিকে দেখব, তা আমি কল্পনাও করতে পারছি না এখন।

ফ্রাংকফুর্ট, জার্মানি
Daily Jugantor
22.08.2016

ইতিহাসে এরদোগান কীভাবে চিহ্নিত হবেন

ইতিহাসে এরদোগান কীভাবে চিহ্নিত হবেনগত ১৫ জুলাই ২০১৬ তারিখ তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর কেটে গেছে প্রায় চার সপ্তাহ। এরই মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে তুরস্কে। প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ এক সামরিক কর্মকর্তাকে রিমান্ডে নেয়া, প্রায় একশ’র মতো জেনারেল তথা একই পদমর্যাদার অফিসারদের গ্রেফতার করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালানোর পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এরদোগান তুরস্ককে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত করছেন কেউ কেউ। যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা এবং রাশিয়া-চীনের প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতার কথাও বলছেন কেউ কেউ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। প্রধানমন্ত্রী এরদোগান যেভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করছিলেন, সে ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি আছে। তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগের একটি হচ্ছে, তিনি ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে চান। ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি একটানা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু সংবিধান তাকে আরো একবার দায়িত্ব পালনের সুযোগ না দেয়ায় তিনি ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। একপর্যায়ে তার ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে তিনি প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর ফলে তিনি তার এক সময়ের বিশ্বস্ত ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুলগলুর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যান এবং দাভুলগলুকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। তিনি রাজধানী আঙ্কারার একটি পাহাড়ে প্রেসিডেন্ট হাউস নির্মাণ করছেন, যার পরিচিতি ‘হোয়াইট প্যালেস’ হিসেবে। প্রায় এক হাজার কক্ষ বিশিষ্ট এই বাড়িটি ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসস্থান হোয়াইট হাউস থেকেও বড়। নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬১৫ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪৯২০ কোটি টাকা। এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে প্রাসাদতুল্য এ ধরনের একটি ভবন তৈরি করা আদৌ উচিত কিনা, সে প্রশ্ন কোনো কোনো মহলে উঠেছে। এরদোগানের মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য ও তাদের পরিবারবর্গ সরাসরি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। শীর্ষ স্থানীয় একেপি দলের নেতাদের এই দুর্নীতি তিনি রোধ করতে পারেননি। ইরানের বিরুদ্ধে যখন আন্তর্জাতিক অবরোধ বজায় ছিল, তখন তুরস্ক ইরান থেকে তেল ও গ্যাস আমদানি করে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেছে। একই কথা প্রযোজ্য সিরিয়ার আইএস (ইসলামিক স্টেট) বিদ্রোহীর ক্ষেত্রেও। সিরিয়ার এবং ইরাকের অনেক তেলক্ষেত্র দখল করে নিয়েছিল আইএস বিদ্রোহীরা। তারা ওই তেলক্ষেত্র থেকে তেল উত্তোলন করে অবৈধ পথে তুরস্ক দিয়ে ওই তেল বিদেশে রফতানি করত। এই তেল বিক্রি ছিল আইএসের অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস। সারা বিশ্ব যখন মোটামুটিভাবে জঙ্গি তৎপরতার ব্যাপারে উৎকণ্ঠিত, তখন তুরস্ক আইএসের অর্থ আয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এমন কথাও শোনা যায় জঙ্গিদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয় তুরস্কের কোনো কোনো গোপন আস্তানায়(?) খোদ এরদোগানের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ তিনি নিজেকে ইতোমধ্যেই তুরস্কের ‘সুলতান’ ভাবতে শুরু করেছেন। তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য ১৮০৮ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। একদিকে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়ার ককেশিয়ান অঞ্চল ও অন্যদিকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তুরস্কের শাসকরা, যারা সুলতান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর পরই এই রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর অটোমান সাম্রাজ্যের অবসানের ঘোষণা করা হয়। এরপর কামাল পাশার নেতৃত্বে আধুনিক তুরস্কের গোড়াপত্তন হয়। এখন এরদোগান যেভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করছেন, ইতিহাসে এরদোগান কীভাবে চিহ্নিত হবেনযেভাবে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, তাতে কেউ কেউ তাকে সাবেক অটোমান শাসকদের সঙ্গে তুলনা করছেন। গেল বছর তুরস্কের জনপ্রিয় পত্রিকা জামানের নিয়ন্ত্রণভার সরকারের হাতে তুলে দেয়া হয়। অর্থাৎ দৈনিক পত্রিকাটি সরকারিকরণ করা হয়। এর মাধ্যমে তিনি মিডিয়ার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা তার আছে। রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে ‘ক্যারিশম্যাটিক’ বা সম্মোহনী নেতৃত্ব বলে, সেই সম্মোহনী নেতৃত্ব তার রয়েছে। মুসলিম প্রধান দেশগুলোকে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার এক মহাপরিকল্পনা তার রয়েছে। চীনের মতোই পুরনো ‘সিল্ক রোড’কে তিনি পুনরুজ্জীবিত করতে চান। তুরস্কে আমি দেখেছি আফ্রিকার অনেক গরিব দেশের শিশুদের তার সরকার আশ্রয় দিয়েছে। ইসলামিক মতাদর্শের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস থাকলেও তিনি ওয়াহেবি বা জিহাদি মতাদর্শে বিশ্বাসী নন। এক সময়ের ফুটবল খেলোয়াড় এরদোগান তার রাজনৈতিক জীবন গড়ে তুলেছেন ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা নেকমাতিন এরবাকানের ছত্রছায়ায়। তিনি ছিলেন প্রাচীন নগরী ইস্তানবুলের জনপ্রিয় মেয়র। এই ইস্তানবুলই হচ্ছে তার ‘ক্ষমতার ঘাঁটি।’ যখন অভ্যুত্থানকারীরা আঙ্কারার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিল তখন তিনি ছিলেন অবসরকালীন ছুটিতে। তিনি কর্মীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন রাস্তায় অবস্থান নিতে। আর হাজার হাজার সমর্থক ইস্তানবুলের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে অভ্যুত্থানকারীদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছিল। এখানে বলা দরকার নেকমাতিন এরবাকানের নেতৃত্বে ইসলামি ওয়েলফেয়ার পার্টি ‘অতি ইসলামিক’ এবং তুরস্কের সংবিধানের মূল ধারার (অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষতার) পরিপন্থী হওয়ায় দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, যা কিনা সেনাবাহিনী চেয়েছিল। দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় ওই দলের সমর্থকরা প্রথমে ভাচু পার্টি গঠন করে এবং পরে গঠন করে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, যা একেপি নামেও পরিচিত। আবদুল্লাহ গুল ও এরদোগান একেপি পার্টি গঠনের উদ্যোক্তা। ২০০২ সালের নির্বাচনে একেপি পার্টি বিজয়ী হওয়ায় আবদুল্লাহ গুল প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এরদোগান তখন ছিলেন জেলে। একটি কবিতা আবৃত্তি করার অভিযোগে, যেখানে তিনি তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে কটাক্ষ করেছিলেন, তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। একেপি পার্টি সরকার গঠন করে তার সাজা মওকুফ করে দেয়। তিনি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদে আসেন, প্রধানমন্ত্রী হন আর আব্দুল্লাহ গুল হন প্রেসিডেন্ট। সেই থেকে তার যাত্রা শুরু। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। হয়েছেন প্রেসিডেন্ট এবং সংবিধানে পরির্তন এনে তুরস্ককে রাষ্ট্রপতিশাসিত একটি দেশে পরিণত করেছেন। দেশটিতে একজন প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ক্যাবিনেট থাকলেও মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে। তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নাম বার বার সংবাদপত্রে আসছে। তিনি হচ্ছেন ধর্মগুরু ফতেহউল্লাহ গুলেন। সনাতন অর্থে তিনি কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেননি কিংবা আমাদের দেশের মতো কোনো ‘খানকা’ প্রতিষ্ঠান করেননি। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তার আছে। এই অভ্যুত্থানের পেছনে এরদোগান গুলের অনুসারীদের দায়ী করেছেন। অভিযোগ আছে তুরস্কের সেনাবাহিনীর মধ্যে ফতেহউল্লাহ গুলেনের অনুসারীদের প্রভাব বাড়ছিল যা ছিল এরদোগানের চিন্তার কারণ। এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীতে এখন ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। ৬ লাখ ৪০ হাজার সদস্য নিয়ে গঠিত তুরস্কের প্রতিরক্ষা বাহিনী। এর মাঝে সেনাবাহিনীর সংখ্যা বেশি। ব্রিগেডিয়ার থেকে শুরু করে পূর্ণ জেনারেল পর্যন্ত সিনিয়র অফিসারের সংখ্যা ৩৫০ জনের ওপরে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী ১০৩ জন সিনিয়র অফিসারকে ইতোমধ্যে বহিষ্কার অথবা গ্রেফতার করা হয়েছে। এক সময় ধারণা করা হতো তুরস্কে ইসলামপন্থিদের যেভাবে উত্থান ঘটেছে, সেখানে কামাল আতাতুর্কের রাজনীতির অনুসারী সেনাবাহিনী তাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু সে ধারণা পাল্টে গেছে। গুলেনপন্থি ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের বহিষ্কার ও গ্রেফতারের ঘটনা প্রমাণ করে সেনাবাহিনী তথা নৌ ও বিমানবাহিনীতে গুলেনপন্থিদের প্রভাব বাড়ছিল। এতে গুলেনপন্থিদের প্রভাব প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়ে গেছে এটা যেমনি স্বীকৃতি পেল ঠিক তেমনি এদের উৎখাত করে সেনাবাহিনীতে তথা প্রশাসনে এখন ব্যাপক সংস্কার আনতে সক্ষম হবেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। এটা করতে গিয়ে তিনি তার জনপ্রিয়তাকে বিতর্কিত করতে পারেন। এখানে বলা ভালো, ফতেহউল্লাহ গুলেন একজন ইসলামিক চিন্তাবিদ। তথাকথিত ইসলামিক শিক্ষায় তিনি শিক্ষিত না হলেও কিংবা তুরস্কে কোনো শীর্ষ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান না হয়েও তিনি ইসলাম ও গণতন্ত্রের সমন্বয় করে ইসলামকে নতুন করে তুরস্কের মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি প্রচুর লিখেছেন এ বিষয়ে। ইংরেজিতে অনূদিত বইও আছে। আমার মনে আছে ঢাকাস্থ তুরস্কের সাংস্কৃতিক বিভাগের প্রধানের মাধ্যমে ২০১২ সালে আমি গুলেনের একটি বইও পেয়েছিলাম। বাংলাদেশে ইসলামিক বুদ্ধিজীবীদের মাঝে গুলেন খুব পরিচিত নাম নয়। তার ওপর লেখা-জোখা খুব কমই হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের এক অধ্যাপকের একটি প্রবন্ধও আমি পড়েছিলাম আজ থেকে ৪-৫ বছর আগে। গুলেন নিজে সুটেড-বুটেড, বর্তমানে স্বেচ্ছানির্বাসিত, থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়াতে। অনেকটা সুফী ভাবধারার অনুসারী তিনি। জিহাদি মতাদর্শকেও তিনি সমর্থন করেন না। তাকে বলা হয় ‘ইসলামের গাঙ্গী।’ তার মূল মন্ত্র হচ্ছে শিক্ষা। ‘জিহাদি শিক্ষা’র কথাও শোনা যায় কোনো কোনো প্রবন্ধে। এর অবিশ্যি বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। তুরস্কে একটি বিশাল সাম্রাজ্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন। যে সাম্রাজ্যের আওতায় রয়েছে ব্যাংক, বীমা, মিডিয়া ও শত শত স্কুল। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে এবং জার্মানিতে একশ’র অধিক স্কুল রয়েছে গুলেন অনুসারীদের। তিনি যে প্রতিষ্ঠান তুরস্কে গড়ে তুলেছিলেন তার নাম ঐরুসবঃ, ইংরেজি করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে ঝবৎারপব অথবা সেবা। এই সংগঠনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বলা হয় ঈবসধধঃ বা সম্প্রদায় অথবা কমিউনিটি। তার সংগঠন ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে তুরস্কে। বাংলাদেশে উত্তরার ৫নং সেক্টরে যে তার্কিস স্কুল রয়েছে, এটাও তারা পরিচালনা করে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতেও তাদের স্কুল রয়েছে। তুরস্কে তাদের অনুসারীদের সংখ্যা ৬০ লাখ বলে ধরা হয়। এরা প্রশাসনের এত গভীরে প্রবেশ করেছে যা এরদোগানের জন্য ছিল চিন্তার কারণ। একসময় এরদোগানকে গুলেন অনুসারী হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু ২০১৩ সালের পর থেকে এরদোগানের সঙ্গে গুলেনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরদোগান মনে করতেন গুলেন তার জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিচ্ছেন। গুলেন সমর্থকদের দ্বারা উৎখাত হওয়ারও ভয় ছিল তার। দুর্নীতির অভিযোগে এরদোগানের ছেলে তিন মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে এবং একটি বড় ব্যাংকের বিরুদ্ধে যখন তদন্ত শুরু হয় ২০১৩ সালে তখনই বোঝা গিয়েছিল গুলেনের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এরপর ঘটে ইস্তানবুলে গাজী পার্কের ঘটনা। ইস্তানবুলের মেয়র ছিলেন এরদোগান (১৯৯৪-৯৮) এবং এই ইস্তানবুলই হচ্ছে তার ‘ক্ষমতার উৎস।’ সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে এখানেই বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই ইস্তানবুলে তাকসিম গাজী পার্কের ঘটনা যখন ঘটে (২০১৩ জুন, নিউইয়র্কের অক্যুপাই মুভমেন্ট অব আদলে বিশাল এলাকা অক্যুপাই করা, পুলিশের উচ্ছেদ অভিযানে ১১ জনের মৃত্যু), তখন এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল খোদ এরদোগানের অনুসারীদের ভেতরেই একটি পক্ষ এই অক্যুপাই মুভমেন্টকে সমর্থন করেছিল। এরদোগান মনে করতেন এই আন্দোলনের পেছনে গুলেনের ইন্ধন রয়েছে। এ কারণেই গুলেনের প্রতি তার আক্রোশটা বেশি। জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণেও তিনি আবারো গুলেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। আপতত মনে করা হচ্ছে এরদোগান টিকে গেছেন। কিন্তু কতদিনের জন্য সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। তিনি শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। এই অভিযান তুরস্ককে কোথায় নিয়ে যাবে সেটাও একটা প্রশ্ন। তুরস্ক শুধু ন্যাটো বা পশ্চিমা বিশ্বের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর নয় বরং জঙ্গিবাদ দমনে, বিশেষ করে সিরিয়ায় আইএসের উত্থান ঠেকাতে তুরস্কের প্রয়োজন রয়েছে। তুরস্কের আদানা শহরে ইনসিরলিক বিমান ঘাঁটিতে মার্কিন যুদ্ধবিমান রয়েছে। আইএসের বিরুদ্ধে বোমাবর্ষণে এই ঘাঁটির বিমান ব্যবহার করা হয়। অভিযোগ আছে, এই বিমান ঘাঁটিতে পারমাণবিক সমরাস্ত্র মজুদ রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। সব মিলিয়ে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান অনেক প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। আর এসব প্রশ্নের জবাবের জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে মাত্র। ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে Daily Manob Kontho 08.08.2016

জার্মান-তুরস্ক সম্পর্ক ও এরদোগানের ভবিষ্যৎ

গেল প্রায় দুই সপ্তাহ আমি জার্মানিতে। এক শহর থেকে আরেক শহর ঘুরে বেড়াচ্ছি। উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাম্প্রতিক ইউরোপে যেসব পরিবর্তন এসেছে, বিশেষ করে লাখ লাখ সিরীয় শরণার্থীর উপস্থিতি, ব্রেক্সিট থেকে ইংল্যান্ডের বেরিয়ে যাওয়ার পর জার্মানির রাজনীতি কোন দিকে পরিচালিত হয়, তা কাছ থেকে দেখা। কিন্তু এখানে থাকতে থাকতেই আমি একটি বড় পরিবর্তন লক্ষ করেছি, এখানে বসবাসরত তুরস্কের নাগরিকদের নিয়ে এবং জার্মানি তুরস্কের একটি গোপন নথি ফাঁস করে দেয়ায় তুরস্কের সঙ্গে জার্মানির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। চলতি মাসের প্রথম দিক থেকে জার্মানিতে আমার অবস্থানকালীন কোলন শহরে প্রায় ৪০ হাজার নাগরিকের এক বিশাল র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়। ওই র‌্যালিতে এরদোগানের বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কিন্তু জার্মান সরকার ওই অনুমতি দেয়নি। অভিযোগ আছে, এরদোগান সরকার জার্মানিতে বসবাসকারী তুরস্কের নাগরিকদের যাদের কেউ কেউ জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন, তাদের ব্যবহার করছেন তার সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য। জার্মানিতে প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার তুরস্কের নাগরিক বসবাস করেন, যারা ২০১৫ সালে ভোট দিয়েছেন এবং প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ এরদোগান ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ পার্টির পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। জার্মানিতে যে ৩ হাজার মসজিদ রয়েছে, তার মাঝে ২ হাজার মসজিদ পরিচালনা করেন তুরস্কের নাগরিকরা। জার্মানিতে ইসলাম প্রচারে তুরস্কের নাগরিকদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। একসময় তুরস্কের নাগরিকরা ‘গেস্ট ওয়ার্কার’ হিসেবে এদেশে এসেছিলেন এবং জার্মানির শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদন বৃদ্ধিতে এক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। এখন এদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। তুরস্কের নাগরিকদের দ্বিতীয় জেনারেশনের কেউ কেউ এরই মধ্যে জার্মানির পার্লামেন্টের সদস্য পযন্ত হয়েছেন। যেমন মিস্টার ওজডেমিরের কথা বলা যেতে পারে, যিনি এখন জার্মান পার্লামেন্টের সদস্য। দীর্ঘদিন জার্মান-তুরস্ক সম্পর্ক ভালো থাকলেও এখন এ সম্পর্কে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে, ১৫ জুলাইয়ের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর দুই দেশের আস্থার সম্পর্কে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এরদোগান তার বৈদেশিক সম্পর্কে বড় পরিবর্তন এনেছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন সামরিক অভ্যুত্থানে জড়িত হওয়ার। রাশিয়া তিনি সফর করেছেন এবং এ বিষয়ে আমার একটি নিবন্ধ এর আগে আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ফলে তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় জার্মানির সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে তা প্রভাব ফেলছে। বলা হচ্ছে, তুরস্ক এখন ন্যাটোর বিভক্তিকে আরও বৃদ্ধি করতে পারে। অর্থাৎ তুরস্কের ভূমিকার কারণে আগামীতে ন্যাটো ভেঙে যেতে পারে। ফলে পুরো ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে এরদোগানকে নিয়ে আলোচনা এখন বেশি। এরদোগানের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি এখন তুরস্ককে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? প্রথমত, প্রেসিডেন্ট এরদোগান যেভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করছিলেন, সে ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি আছে। তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগের একটি হচ্ছে, তিনি ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে চান। ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি একটানা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু সংবিধান তাকে আরও একবার দায়িত্ব পালনের সুযোগ না দেয়ায় তিনি ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। এক পর্যায়ে তার ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে তিনি প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ফলে তিনি তার একসময়ের বিশ্বস্ত ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুলগলুর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যান এবং দাভুলগলুকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। দ্বিতীয়ত, তিনি রাজধানী আঙ্কারার একটি পাহাড়ে প্রেসিডেন্ট হাউস নির্মাণ করছেন, যার পরিচিতি ‘হোয়াইট প্যালেস’ হিসেবে। প্রায় ১ হাজার কক্ষবিশিষ্ট এ বাড়িটি ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসস্থান হোয়াইট হাউস থেকেও বড়। নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬১৫ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৪ হাজার ৯২০ কোটি। এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে প্রাসাদতুল্য এ ধরনের একটি ভবন তৈরি করা আদৌ উচিত কিনা, সে প্রশ্ন কোনো কোনো মহলে উঠেছে। তৃতীয়ত, এরদোগানের মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য ও তাদের পরিবারবর্গ সরাসরি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। শীর্ষস্থানীয় একেপি দলের নেতাদের এ দুর্নীতি তিনি রোধ করতে পারেননি। চতুর্থত, ইরানের বিরুদ্ধে যখন আন্তর্জাতিক অবরোধ বজায় ছিল, তখন তুরস্ক ইরান থেকে তেল ও গ্যাস আমদানি করে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেছে। একই কথা প্রযোজ্য, সিরিয়ার আইএস (ইসলামিক স্টেট) বিদ্রোহীর ক্ষেত্রেও। সিরিয়া এবং ইরাকের অনেক তেলক্ষেত্র দখল করে নিয়েছিল আইএস বিদ্রোহীরা। তারা ওই তেলক্ষেত্র থেকে তেল উত্তোলন করে অবৈধপথে তুরস্ক দিয়ে ওই তেল বিদেশে রফতানি করত। এ তেল বিক্রি ছিল আইএসের অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস। বিশ্ব যখন মোটামুটিভাবে আইএসের জঙ্গি তৎপরতার ব্যাপারে উৎকণ্ঠিত, তখন তুরস্ক আইএসের অর্থ আয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এমন কথাও শোনা যায়, জঙ্গিদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয় তুরস্কের কোনো কোনো গোপন আস্তানায়(?)। পঞ্চমত, খোদ এরদোগানের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, তিনি নিজেকে এরই মধ্যে তুরস্কের ‘সুলতান’ ভাবতে শুরু করেছেন। তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য ১৮০৮ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। একদিকে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়ার ককেশিয়ান অঞ্চল ও অন্যদিকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তুরস্কের শাসকরা, যারা সুলতান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পরপরই এ রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর অটোমান সাম্রাজ্যের অবসানের ঘোষণা করা হয়। এরপর কামাল পাশার নেতৃত্বে আধুনিক তুরস্কের গোড়াপত্তন হয়। এখন এরদোগান যেভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করছেন, যেভাবে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, তাতে করে কেউ কেউ তাকে সাবেক অটোমান শাসকদের সঙ্গে তুলনা করছেন। ষষ্ঠত, গেল বছর তুরস্কের জনপ্রিয় পত্রিকা জামান এর নিয়ন্ত্রণভার সরকারের হাতে তুলে দেয়া হয়। অর্থাৎ দৈনিক পত্রিকাটি সরকারীকরণ করা হয়। এর মাধ্যমে তিনি মিডিয়ার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা তার আছে। রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে  ‘ক্যারিসম্যাটিক’ বা সম্মোহনী নেতৃত্ব বলে, সেই সম্মোহনী নেতৃত্ব তার রয়েছে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসার মহাপরিকল্পনা তার রয়েছে। চীনের মতোই পুরনো ‘সিল্ক রোড’কে তিনি পুনরুজ্জীবিত করতে চান। তুরস্কে আমি দেখেছি, আফ্রিকার অনেক গরিব দেশের শিশুদের তার সরকার আশ্রয় দিয়েছে। ইসলামিক মতাদর্শের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস থাকলেও, তিনি ওয়াহেবি বা জিহাদি মতাদর্শে বিশ্বাসী নন। একসময়ের ফুটবল খেলোয়াড় এরদোগান তার রাজনৈতিক জীবন গড়ে তুলেছেন ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা নেকমাতিন এরবাকানের ছত্রছায়ায়। তিনি ছিলেন প্রাচীন নগরী ইস্তানবুলের জনপ্রিয় মেয়র। এ ইস্তানবুলই হচ্ছে তার ‘ক্ষমতার ঘাঁটি’। যখন অভ্যুত্থানকারীরা আঙ্কারার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিল, তখন তিনি ছিলেন অবসরকালীন ছুটিতে। তিনি কর্মীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, রাস্তায় অবস্থান নিতে। আর হাজার হাজার সমর্থক ইস্তানবুলের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে অভ্যুত্থানকারীদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছিল। এখানে বলা দরকার, নেকমাতিন এরবাকানের নেতৃত্বে ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টি ‘অতি ইসলামিক’ এবং তুরস্কের সংবিধানের মূল ধারার (অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষতার) পরিপন্থী হওয়ায় দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, যা কিনা সেনাবাহিনী চেয়েছিল। দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় ওই দলের সমর্থকরা প্রথমে ভার্চু পার্টি গঠন করে এবং পরে গঠন করে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, যা একেপি নামেও পরিচিত। আবদুল্লাহ গুল ও এরদোগান একেপি পার্টি গঠনের উদ্যোক্তা। ২০০২ সালের নির্বাচনে একেপি পার্টি বিজয়ী হওয়ায় আবদুল্লাহ গুল প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এরদোগান তখন ছিলেন জেলে। একটি কবিতা আবৃত্তি করার অভিযোগে যেখানে তিনি তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে কটাক্ষ করেছিলেন, তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছিল। একেপি পার্টি সরকার গঠন করে তার সাজা মওকুফ করে দেয়। তিনি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদে আসেন, প্রধানমন্ত্রী হন আর আবদুল্লাহ গুল হন প্রেসিডেন্ট। সেই থেকে তার যাত্রা শুরু। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। হয়েছেন প্রেসিডেন্ট এবং সংবিধানে পরিবর্তন এনে তুরস্ককে রাষ্ট্রপতি শাসিত একটি দেশে পরিণত করেছেন। দেশটিতে একজন প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ক্যাবিনেট থাকলেও মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে।
এখন ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর সন্দেহাতীতভাবে এরদোগানের হাত আরও শক্তিশালী হয়েছে। একটি শক্তিশালী প্রেসিডেন্সি কি তুরস্কের গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে? একটি জিনিস অবশ্য লক্ষণীয়, আর তা হচ্ছে, এরদোগান আর একেপি পার্টির ক্ষমতা পরিচালনা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকলেও সংসদে সব বিরোধী দল একত্রিত হয়ে সামরিক অভ্যত্থানের উদ্যোগকে সমালোচনা করেছে। এরদোগানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগানও সব বিরোধী দলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা  মেসেজ। জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে জাতি যদি বিভক্ত থাকে, তাহলে গণতন্ত্রও শক্তিশালী হয় না। তুরস্কের গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েনি, একটি ধাক্কা খেয়েছে। এক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যটা বড় প্রয়োজন। তবে সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরদোগানেরও দায়িত্ব রয়েছে অনেক। ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ এটা তুরস্কের জনগণ প্রমাণ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তি-স্বাধীনতা, আইনের শাসন, মিডিয়ার স্বাধীনতা, স্বাধীন বিচার বিভাগÑ এসব যদি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে সত্যিকার গণতন্ত্রের স্বাদ তুরস্কের জনগণ পাবে না। অভ্যুত্থান-পরবর্তী তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কাছে প্রত্যাশা তাই অনেক বেশি। কিন্তু যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তুরস্কের সঙ্গে জার্মানির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। বাটেন-উটেনবুর্গ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী উইনফ্রিড ক্রেটসম্যান অভিযোগ করেছেন, তার প্রদেশে গুলেন সমর্থিতদের দ্বারা পরিচালিত স্কুল বন্ধ করে দেয়ার জন্য তুরস্ক সরকার তাকে অনুরোধ করেছে। এটা তিনি করবেন না বলেও জানিয়েছেন। জুনে জার্মান পার্লামেন্ট একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাতে তুরস্ক কর্তৃক অতীতে আরমেনিয়ানদের হত্যা করার ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত তুরস্ক সরকার ভালো চোখে নেয়নি। এরদোগান জার্মান পার্লামেন্ট সদস্যদের তুরস্কে অবস্থানরত ন্যাটোর ঘাঁটি ভ্রমণের অনুমতিও দেননি। ফলে দুই দেশের সম্পর্কে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে।
এরদোগান তুরস্কে একটি বড় পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন। প্রায় ৮০ হাজার কর্মকর্তা, তথা কর্মচারীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি এখন অত্যন্ত শক্তিশালী এক ‘শাসক’। তবে স্পষ্টতই এটা করতে গিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি ‘বন্ধু’ হারিয়েছেন। এতে করে তার ‘স্বার্থ’ হয়তো হাসিল হতে পারে। কিন্তু তার ব্যক্তিগত ‘ইমেজ’ থাকবে নানা প্রশ্নের মুখে।
ফ্রাঙ্কফুট, জার্মানি
Daily Alokito Bangladesh
21.08.16

হিলারি কি যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন?

 হিলারি ক্লিনটন কি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন? চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ায় বিভিন্ন জনমতের যে রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে দেখা যায়, হিলারি অনেক এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে। চলতি মাসের ২ তারিখে সিএনএনের জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যায়, ৯ পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে আছেন হিলারি। হিলারির পক্ষে জনমত শতকরা ৫২ ভাগ। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে মাত্র ৪৩ ভাগ। সিএনএন এ জরিপটি চালায় রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট পার্টির জাতীয় কনভেনশনের পরপরই। জাতীয় কনভেনশনে রিপাবলিকান পার্টি ট্রাম্পকে আর ডেমোক্র্যাট পার্টি হিলারিকে ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়। ডেমোক্র্যাট পার্টির কনভেনশন একটি ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দেয়। ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৪০ বছরের ইতিহাসে কোনো নারী প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। এই প্রথম একজন নারী এ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটি ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সেটা হবে আরেক ইতিহাস। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের নারী আন্দোলন তথা নারীদের অধিকারের ক্ষেত্রে এটা হবে একটি মাইলফলক। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বড় অর্থনীতি ও বড় গণতন্ত্রের দেশ হলেও এখানে নারীদের ভোটের অধিকারের বয়স মাত্র ৯৬ বছর। দীর্ঘদিন এখানে নারীদের ভোটের অধিকার দেয়া হয়নি। এ নিয়ে নারী আন্দোলনের ইতিহাসও বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। নিঃসন্দেহে হিলারি ক্লিনটনের মনোনয়ন পাওয়া এখানকার নারী আন্দোলনকে আরও উজ্জীবিত করবে। এখানে বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের মতো কনজারভেটিভ সোসাইটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব সীমিত। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান বলে, কংগ্রেস ৫৩৫টি আসনে (সিনেট ১০০, প্রতিনিধি পরিষদ ৪৩৫) মাত্র ১০৭ জন নারী আইন প্রণেতা রয়েছেন (ডেমোক্র্যাট ৭৬ জন, রিপাবলিকান ২৮ জন)। সিনেটে নারী প্রতিনিধি রয়েছেন ২০ জন (১০০ জনের মাঝে, শতকরা ২০ ভাগ), আর প্রতিনিধি পরিষদে রয়েছেন মাত্র ৮৪ জন (শতকরা ১৯ দশমিক ৩ জন)। সুতরাং এ সীমিত প্রতিনিধিত্বের মধ্য দিয়ে নারীর পূর্ণ অধিকার রক্ষিত হয়েছে, এটি বলা যাবে না। স্পষ্টতই হিলারির এ মনোনয়ন যুক্তরাষ্ট্রের নারী সমাজের জন্য বড় ধরনের একটি অগ্রগতি। ১৮৪৮ সালে সেনেকা ফলস কনভেনশনে (ঝবহবপধ ঋধষষং ঈড়হাবহঃরড়হ) এই প্রথমবারের মতো নারীদের ভোটাধিকারের দাবি জানানো হয়েছিল। আর ওই কনভেনশনের ১৬৮ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র একজন নারী প্রার্থী পেল, যিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। জুলাই মাসের শেষে দুইটি দলের জাতীয় কনভেনশন শেষ হয়েছে। ক্লিভল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়েছে রিপাবলিকান পার্টির কনভেনশন, আর ফিলাডেলফিয়ায় ডেমোক্র্যাট পার্টির। দুইটি কনভেনশনেই ডোনাল্ড ট্রাম্প আর হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হয়। দুইটি কনভেনশন ঘিরেই বিপুল উৎসাহ লক্ষ করা গেছে। সিএনএন চার দিনব্যাপী এ কনভেনশন ‘লাইভ’ কাভার করে। এ কনভেনশনে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য দেখে আমার কাছে কতগুলো বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। তুলনামূলকভাবে ডেমোক্র্যাটদের জাতীয় কনভেনশন ছিল যথেষ্ট আকর্ষণীয়। ওবামা ও ক্লিনটনের মতো দুইজন প্রেসিডেন্টের উপস্থিতি ডিএনসিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এক্ষেত্রে রিপাবলিকান পার্টি কনভেনশনে কোনো সাবেক রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট উপস্থিত ছিলেন না, যাদের কেউ কেউ এখনও জীবিত আছেন (যেমন বুশ)। উভয় কনভেনশনেই আমি লক্ষ করেছি, বক্তারা (যাদের কেউ কেউ সিনেটর, গভর্নর, মন্ত্রী) ক্লিনটন, ট্রাম্পকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন বেশি। এমনকি মনিকা লিউনেস্কির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের যৌন সম্পর্কের বিষয়টিও পরোক্ষভাবে এসেছে। ট্রাম্প ‘অযোগ্য’, তার হাতে “পারমাণবিক অস্ত্রের চাবি তুলে দেয়া নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ, কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ তৈরি করে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তুলতে পারেন” এ ধরনের বক্তব্য বারবার উচ্চারিত হয়েছে। এটা ঠিক হিলারি ক্লিনটনের মনোনয়ন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘ইতিহাস’ সৃষ্টি করেছে এটা স্বীকার করতেই হবে। ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে তিনি যদি ‘বিজয়ী’ হন, তাহলে সেটা হবে আরেকটা ইতিহাস। হিলারি ক্লিনটন নির্বাচনী প্রচারণায় নারীদের অধিকারের কথাটি বারবার বলেছেন। তিনি শিশু ও মায়েদের ব্যাপারে আরও কিছু করতে চান। দুইটি কনভেনশনে দুই পরিবারের দুই ব্যক্তি ও ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা বক্তৃতা করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের পাশাপাশি মেয়ে চেলসি ক্লিনটনও বক্তৃতা করেছেন। আর অন্যদিকে ডোনাল্ডের স্ত্রী সাবেক মডেল মেলানিয়া ক্লাউস ট্রাম্পও বক্তৃতা করেছেন। এক্ষেত্রে মেলানিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, ২০০৮ সালে ওবামার স্ত্রী মিশেল ডিএনসি সম্মেলনে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, এটা তার কার্বন কপি। মার্কিন মিডিয়া আমাদের জানাচ্ছে যে, দুইজনের (মিসাইল ২০০৮, মেলানিয়া ২০১৬) বক্তৃতায় ভাষাগতভাবে অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। একই সালে চেলসি যতটুকু আবেগময়ী ভাষায় তার মাকে (হিলারি ক্লিনটন) তুলে ধরতে পেরেছেন, ইভানকা ট্রাম্প এতটা পারেননি। এরই মধ্যে চেলসিকে নিয়েও ‘গুঞ্জন’ শুরু হয়েছে। তিনি কি হতে যাচ্ছেন বিল ও হিলারির যোগ্য উত্তরসূরি? হিলারির নির্বাচনী এলাকা নিউইয়র্ক। এখানে তিনি সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আগামী দিনে এ এলাকা থেকে আরেকজন হিলারি ক্লিনটনকে কী দেখতে পাবে নিউইয়র্কবাসী? বিল ক্লিনটনের ভাষণও অনেকে প্রশংসা করেছেন। ৪৫ বছর আগে আরাকানসাস লাইব্রেরিতে হিলারির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা, তিন তিনবার হিলারিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া কনভেনশনে বিলের এ বক্তব্য তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে সবাই স্বাগত জানান। সমাপনী অনুষ্ঠানে হিলারি এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ৪৫ বছর আগে যে ‘যাত্রা’ শুরু হয়েছিল তা অব্যাহত থাকবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ডেমোক্র্যাটদের কনভেনশনে যেখানে দলীয় নেতৃত্বের মাঝে ঐক্য ও সংহতি প্রকাশিত হয়েছে (বিশেষ করে বার্নি শ্যান্ডার্স এর সমর্থকদের নিয়ে শঙ্কা ছিল), তা রিপাবলিকান শিবিরে দেখা যায়নি। মনোনয়নের জন্য শীর্ষ দাবিদার টেডক্রুজ শেষ সময় পর্যন্ত ট্রাম্পকে সমর্থন দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। উপরন্তু ট্রাম্পের ঔদ্ধত্য আচরণ, মেক্সিকান এবং মুসলমান বিদেষী মনোভাব লিবারেল রিপাবলিকানদের অনেকে সমর্থন করেননি। এমনকি ডেমোক্র্যাটদের কনভেনশনে একজন মুসলমান আমেরিকান খিজির খানের (যার সন্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হুমায়ুন খান ২০০৪ সালে ইরাকে আমেরিকান সৈন্যদের রক্ষা করতে গিয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলায় মারা যান) বক্তব্যের ট্রাম্প যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, তাও অনেকে সমর্থন করেননি। আসলে ট্রাম্প একজন ধনী ব্যবসায়ী, সন্দেহ নেই তাতে। পৃথিবীর অনেক দেশেই তার ব্যবসা আছে। অর্থ আয় আর নারী সঙ্গ ছাড়া (সুন্দরী প্রতিযোগিতা আয়োজনকারীদের একজন তিনি) অন্য কিছু তিনি বোঝেন না। তিনি কখনোই সেনাবাহিনীতে ছিলেন না। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থে তার কোনো অবদান নেই। এমনকি তার বিরুদ্ধে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। তিনি নৈতিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার হারিয়েছেন। তরুণদের কাছে তিনি জনপ্রিয় নন আদৌ। শিশুরা তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে। তবে কট্টরপন্থীদের কাছে তিনি একজন যোগ্য নেতা! কট্টরপন্থীরা চাচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন, যিনি আবার যুক্তরাষ্ট্রকে, বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পাবেন। একজন ‘নারী’ প্রেসিডেন্ট এ যোগ্যতা রাখেন না, এটাই তাদের অভিযোগ। কনভেনশনে হিলারি যখন সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন, বেতন বৃদ্ধি, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন, সেখানে ট্রাম্প গুরুত্ব দিয়েছেন অভিবাসন রোধ করা ও চাকরির সংখ্যা বাড়ানো ইত্যাদির ওপর। নির্বাচনী প্রচারণায় প্রায় প্রতিদিনই হিলারি ক্লিনটন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখছেন। এখন যে প্রশ্নটি অনেকেই করার চেষ্টা করছেন, তা হচ্ছে এই দুইজনের একজন যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করবেন, তখন কী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো বড় পরিবর্তন আসবে? ট্রাম্পের অভিযোগ, হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে ওবামা প্রশাসনের নীতিই তিনি অব্যাহত রাখবেন। ট্রাম্পের অভিযোগ, ডেমোক্র্যাটরা আইএসকে সৃষ্টি করেছিল এবং হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে আইএস আরও শক্তিশালী হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা আরও ঝুঁকির মুখে থাকবে। ট্রাম্পের আরও অভিযোগ, ওবামা টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তি করে অনেক মার্কিনিকে চাকরি হারানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হলে ওই চুক্তি তথা নাফটা চুক্তির (কানাডা, মেক্সিকো আর যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে মুক্ত বাজার) ব্যাপারে তিনি পুনর্মূল্যায়ন করবেন। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেছেন ট্রাম্প। তার অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের অর্থনৈতিক ‘প্রভাব’ বাড়ছে। এ ‘প্রভাব’ তিনি কমাতে চান। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাট শিবিরের বক্তব্য হচ্ছে, ট্রাম্প অতিমাত্রায় দক্ষিণপন্থী, যুদ্ধংদেহী, তিনি প্রয়োজনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু করে দিতে পারেন! তিনি অতিমাত্রায় রাশিয়াপন্থী। রাশিয়ায় তার বিশাল বিনিয়োগ আছে। পুতিনকে তিনি ওবামার চেয়েও যোগ্য নেতা মনে করেন। ফলে ট্রাম্পের অতি ‘রাশিয়াপ্রীতি’ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। ট্রাম্প মূলত মুনাফা অর্জন করতে বোঝেন। তার কাছে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, মধ্যবিত্তের সামাজিক কাঠামোর মানোন্নয়নের ব্যাপারে কোনো কমিটমেন্ট নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি মুসলমান ও মেক্সিকান বিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করার কথাও বলেছেন তিনি। তিনি সেনাবাহিনীর গৌরবকে আঘাত করেছেন; এমন অভিযোগও উঠেছে ডেমোক্র্যাট শিবিরের পক্ষ থেকে। মিডিয়ায় বারবার খিজির খানের বক্তব্য প্রচার হতে দেখেছি। যেখানে খিজির খান ডেমোক্র্যাটদের কনভেনশনে বক্তৃতা দেয়ার সময় বুক পকেট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান বের করে প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ট্রাম্প সংবিধান পড়েননি! তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য অযোগ্য। ওবামাও প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ট্রাম্প ‘অযোগ্য’। সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগকারীদের ব্যাপারে ও তার পরিবারদের ব্যাপারে ট্রাম্পের বিরূপ সমালোচনা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা কেউই মেনে নেননি। ফলে এ অংশের সমর্থন পাবেন হিলারি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ ভোট দেন বটে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নির্বাচকম-লীর ভোটে। অর্থাৎ প্রতিটি রাজ্যের সিনেট সদস্য ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের নিয়েই এ নির্বাচকম-লী গঠিত। এর সংখ্যা ৫৩৮। এরাই জনগণের নামে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করেন। এখানেও কিছুটা অসামঞ্জস্যতা আছে। যেমন দেখা গেছে, ক্যালিফোর্নিয়ার নির্বাচকম-লীর সংখ্যা ৫৫, এখানে জনগণের ভোটে ডেমোক্র্যাটরা যদি বিজয়ী হন, তাহলে ধরা হবে ডেমোক্র্যাটরা পুরো ৫৫টি ভোটই পেয়েছেন। এক্ষেত্রে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প যদি শতকরা ৪০ ভাগ ভোটও পান, তা আদৌ কোনো বিবেচনায় নেয়া হবে না। এজন্যই দেখা যায়ত, জনমত যাই থাকুক না কেন, ওই রাজ্য কাদের (ডেমোক্র্যাট না রিপাবলিকান) তার ওপরই নির্ভর করছে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার প্রশ্নটি। পর্যবেক্ষকরা লক্ষ করেছেন, বেশ ক’টি রাজ্য হয়েছে (যেমন নিউইয়র্ক বা ক্যালিফোর্নিয়া, যারা বরাবরই ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন করে। টেক্সাস সমর্থন করে রিপাবলিকানদের), এসব রাজ্য নির্বাচনে সবসময় একটা ভূমিকা পালন করে। তবে ১১টি রাজ্যের কথা বলা হচ্ছে (কলোরাডো, ফ্লোরিডা, আইওয়া, মিসিগান, নেভাদা, নিউহ্যাম্পশায়ার, নর্থ ক্যালোরিনা, ওহিও, পেনসেলভেনিয়া, ভার্জিনিয়া এবং উনসকনসিপ), যাদের বলা হচ্ছে ‘ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেটস’ (ইধঃঃষবমৎড়ঁহফ ঝঃধঃবং), যে রাজ্যগুলো গেল দুই-দুইটি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এসব রাজ্যের ভোটাররা দ্বিধাবিভক্ত। তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট সমর্থন নেই। কখনও তারা ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন করে। কখনও রিপাবলিকানদের। সুতরাং এ মুহূর্তে জনমতে হিলারি এগিয়ে থাকলেও এই ১১টি রাজ্যের ফল আগামী নির্বাচনে কোন প্রার্থীর বিজয়ের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করবে। ডালাস
Alokito Bangladesh
  রবিবার, আগস্ট ১৪, ২০১৬

রাশিয়া-তুরস্ক সম্পর্ক ও কিছু প্রশ্ন

 ৯ আগস্ট তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে একটি গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হতে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কাছে এ সংবাদটির গুরুত্ব অনেক। কেননা, ১৫ জুলাইয়ের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ প্রথম তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশে যাচ্ছেন। এ সফরের সঙ্গে তুরস্কের নিরাপত্তার প্রশ্নটি যে সরাসরি জড়িত তা অস্বীকার করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র তথা সিআইএ’র জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছে তুরস্ক। তুরস্কের ন্যাটো থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একটা কথা বিভিন্ন মহলে শোনা যাচ্ছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও এমন একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে এরদোগানের রাশিয়া সফরের গুরুত্ব রয়েছে বৈকি। মনে রাখতে হবে, রাশিয়া অনেক আগেই তুরস্ককে সতর্ক করে দিয়েছিল যে, এ ধরনের একটি সামরিক অভ্যুত্থান হতে পারে। তৃতীয়ত, পুতিনের সঙ্গে এরদোগানের বৈঠক এ অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন ডেকে আনতে পারে। সিরিয়া সংকটও নতুন মোড় নিতে পারে। এ সফর রাশিয়া-ইরান-তুরস্ককে এক টেবিলে নিয়ে আসতে পারে। ইরানও রাশিয়ার মতো তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সমালোচনা করেছে। ইরানের অভিযোগ, এই ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে সৌদি আরব ও কাতারের ইন্ধন রয়েছে। এখন আইএস নির্মূলে তুরস্কের যেমন একটি ভূমিকা রয়েছে, ঠিক তেমনি সিরিয়ায় আসাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা, লাখ লাখ সিরীয় নাগরিকের দেশান্তরের ঘটনায়ও তুরস্কের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে তুরস্কের রাজনীতি, তুরস্কের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান গুরুত্বের দাবি রাখে। সুতরাং তুরস্কে যখন একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই এর একটি প্রতিক্রিয়া তুরস্কের রাজনীতির পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনীতিতেও থাকবে। বিশেষ করে, সিরিয়া সংকটের সমাধান, আইএসকে পরিপূর্ণভাবে নির্মূলের প্রশ্নে তুরস্কের ভূমিকা কী হবে, সেটা হবে একটা বড় প্রশ্ন এখন। এক্ষেত্রে দুইটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। তুরস্ক ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তুরস্কে মার্কিন সেনা রয়েছে এবং একাধিক বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজিক ইন্টারেস্ট রয়েছে, তাতে তুরস্ক অন্যতম একটি ফ্যাক্টর এবং তুরস্কের ব্যাপারে রাশিয়ারও স্বার্থ রয়েছে। তুরস্ক রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ নয়। ব্ল্যাক সি বা কৃষ্ণ সাগর এদেশ দুইটিকে আলাদা করেছে। এদেশ দুইটির মাঝে আছে আবার তিনটি দেশÑ জর্জিয়া, আরমেনিয়া ও আজারবাইজান। জর্জিয়াকে ন্যাটো সদস্যভুক্ত করার আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের। জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার ‘সীমিত যুদ্ধ’ এর খবর আমরা জানি। অন্যদিকে আরমেনিয়া ও আজারবাইজানের ‘অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে’ তুরস্ক ও রাশিয়া পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। তবে ক্রিমিয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় (২০১৪) কৃষ্ণ সাগরের গুরুত্ব বেড়েছে। এখানে রয়েছে রাশিয়ার বড় নৌ-ঘাঁটি। কৃষ্ণ সাগরের পাশ ঘেঁষে রয়েছে তুরস্কের বিখ্যাত বসফরাস প্রণালি ও মারমারা সাগর। ইস্তানবুলের বিখ্যাত বসফরাস প্রণালি হচ্ছে প্রাচ্য ও পশ্চিমের অদ্ভুত এক মিলন স্থান। এ মারমারা প্রণালি ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণ সাগরকে সংযুক্ত করেছে। রাশিয়ার নৌ-স্ট্র্যাটেজিস্টরা এ কারণেই তুরস্ককে গুরুত্ব দেন বেশি। সুতরাং তুরস্কে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যতটুকু ভূমিকাই পালন করে থাকুক না কেন, দুই পরাশক্তির (রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র) এতে একটা ‘যোগসূত্র’ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের ‘সনাতন সম্পর্ক’ থাকলেও সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছিল না ওয়াশিংটন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধও লক্ষণীয়। অন্যদিকে স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের কারণে রাশিয়া তুরস্কে এমন একটি সরকার চাইবে, যা তার স্বার্থ রক্ষা করবে। বিশ্ব আসরে রাশিয়াকে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে হলে তুরস্ককে তার আস্থায় নেয়া প্রয়োজন। এরই মধ্যে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের কারণে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে রাশিয়ার অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পারমাণবিক সমঝোতা’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। ইরান এ অঞ্চলের অন্যতম উঠতি শক্তি, যা কিনা বিশ্ব এখন গ্রহণযোগ্যতায় নিয়েছে। ফলে খুব সঙ্গত কারণেই এ অঞ্চলে যদি রাশিয়া-ইরান-তুরস্কের মধ্যে একটি ‘ঐক্য’ গড়ে ওঠে, তাহলে তা বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে, যা বলাই বাহুল্য। মনে রাখতে হবে, বেশকিছু ইস্যুতে চীন-রশিয়া ঐক্য গড়ে উঠেছে। দেশ দুইটি এসসিও বা ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’ এর সদস্য। ভারত এ জোটের অবজার্ভার। অন্যদিকে চীন-রাশিয়া-ভারত এবং আরও বেশ ক’টি দেশের সমন্বয়ে একটি বিকল্প বিশ্ব ব্যাংক (ব্রিকস ব্যাংক) গড়ে উঠেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। ফলে দুই পরাশক্তির মাঝে এক ধরনের প্রভাব বলয়ের রাজনীতি শুরু হয়েছে অনেক আগেই। এক্ষেত্রে তুরস্কের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের কারণে এ দুই পরাশক্তি তুরস্কের ব্যাপারে যে আগ্রহী হয়ে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করে আসছে। ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার হচ্ছে তুরস্ক। ন্যাটোর পারমাণবিক অস্ত্রের একটা মজুদ আছে তুরস্কে, যা কিনা রাশিয়ার বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হতে পারে আগামীতে। সুতরাং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাশিয়া যে তুরস্কের পাশে এসে দাঁড়াবে এটা স্বাভাবিক। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্কেরও একাধিক স্বার্থ কাজ করছে। প্রথমত, সিরিয়ার সংকটে কুর্দিদের একটি গ্রুপ কুর্দিস ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি) অত্যন্ত সক্রিয়। রাশিয়া পিওয়াইডিকে সমর্থন করে এবং মস্কোতে তাদের একটি লিয়াজোঁ অফিস খুলতেও অনুমতি দিয়েছে। তুরস্ক মনে করে, পিওয়াইডি হচ্ছে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) একটি অঙ্গ সংগঠন। পিকেকে তুরস্ক ও ইরাকি কুর্দিস্তানে তৎপর। দলটি ১৯৮৪ সালের পর থেকে তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। দলটি তুরস্কে নিষিদ্ধ। এখন তুরস্ক মনে করছে, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে পিকেকে তথা পিওয়াইডির ওপর থেকে রাশিয়ার সমর্থন কমে যাবে এবং পিকেকে তুরস্কের অভ্যন্তরে যে সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- পরিচালনা করে, তা হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার গ্যাস। প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার (১২০০ কোটি ডলার) ব্যয়ে একটি পাইপ লাইন নির্মিত হচ্ছে, যার মাধ্যমে রাশিয়ার গ্যাস ইউরোপে যাবে (টার্কিস স্ট্রিম প্রজেক্ট)। ইউরোপের অনেক দেশ রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল, যা কিনা ইউরোপের মাধ্যমে (সাউথ স্ট্রিম) সরবরাহ করা হতো। কিন্তু ইউক্রেন সংকট গভীর হলে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পুতিন তার তুরস্ক সফরের সময় এ বিকল্প ‘টার্কিস স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপ লাইন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ফলে রাশিয়ার গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে কৃষ্ণ সাগরের নিচ দিয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশে সরবরাহ করা হবে। এ গ্যাস পাইপ লাইন চালু হলে তা তুরস্কের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। তৃতীয়ত, তুরস্ক ও রাশিয়া একটি ‘যৌথ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ফলে তুরস্ক তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। রাশিয়াকে এখন কাছের বন্ধু হিসেবে মনে করছে। এ ‘নয়া সম্পর্ক’ সিরিয়ার সংকট থেকে শুরু করে এ অঞ্চলের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। সিরিয়ায় আসাদ বিরোধিতা থেকে তুরস্ক এখন সরে আসবে এবং আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহী বাহিনীগুলো এখন আর তুরস্ক সরকারের সহযোগিতা পাবে না। তুরস্কের এ ‘অবস্থান’ কিছুটা হলেও এ অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। তবে এ অবস্থান পরিবর্তন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখে, সেটাই এখন মূল আলোচনার বিষয়। নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দুইজন প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন নির্বাচনী প্রচারণার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছেন। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তাদের দুইজনের বক্তব্য পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। তবে এরা কেউ-ই তুরস্কের সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে কথা বলেননি। তবে ন্যাটো নিয়ে কথা বলেছেন ট্রাম্প। বলেছেন, ১৯৪৯ সালে ন্যাটো গঠিত হওয়ার পর প্রায় ৬৭ বছর পার করেছে। এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু আছে কিংবা যুক্তরাষ্ট্র এর আর্থিক সংশ্লিষ্টতা কতটুকু বহন করবে, তা ভেবে দেখতে হবে। যদিও হিলারি এ বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। রাশিয়া তথা পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সখ্য নিয়েও কথা উঠেছে। ফলে ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তা হলে ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবেই। সে ক্ষেত্রে তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়েও কথা উঠবে তখন। তবে এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র এরদোগানের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও প্রতিদিন তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত দিয়ে ১০০ ইসলামিক জিহাদি সিরিয়ায় প্রবেশ করত। এটা ছিল ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য। এসব জিহাদি আইএসের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিত। উপরন্তু তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো, এমন অভিযোগও উঠেছে। আইএসের জঙ্গিরা সিরিয়া ও ইরাকের দখলকৃত এলাকার তেল উত্তোলন করে তুরস্কের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে বিক্রি করত, যার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যায়। এ তেল ছিল আইএসের অর্থের অন্যতম উৎস। জিহাদিদের বেতন দেয়া হতো এ অর্থ থেকে। উপরন্তু ইরানের ওপর যখন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বজায় ছিল, ইরানের তেল তুরস্কের ব্যবসায়ীরা (যার সঙ্গে এরদোগানের ঘনিষ্ঠজনরা জড়িত ছিলেন) বিশ্ব বাজারে বিক্রি করে অবৈধ টাকা আয় করত। ফলে তত্ত্বগতভাবে মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এরদোগানের ওপর খুশি ছিলেন না। তাদের করারও কিছু ছিল না এরদোগানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা ছাড়া। সুতরাং সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিয়ে প্রকাশ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের যোগসূত্র আবিষ্কার করে এরদোগান যখন তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন, তখন এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনের চিন্তা থাকবেই। ওয়াশিংটনের এ চিন্তা উসকে দিতেই এরদোগান এখন যাচ্ছেন রাশিয়ায়। আর পুতিন এ দিনটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। এ সফরে হয়তো বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু মূল বিষয় হবে একটিÑ তুরস্ক-রাশিয়া ঐক্য। এই ঐক্য এ অঞ্চলের রাজনীতিতে যে পরিবর্তন ডেকে আনবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
 Daily Alokito Bangladesh
 07.08.2016

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নতুন মাত্রা



যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নতুন একটি মাত্রা যোগ হয়েছে- আর তা হচ্ছে ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করার শেষ মুহূর্তে ডিএনসির (ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশন) ই-মেইল ফাঁস। অভিযোগ উঠছে, ডিএনসির কয়েক হাজার ই-মেইল হ্যাক করেছে রাশিয়ার হ্যাকাররা। এটা এখানে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কারণ এর আগে রিপাবলিকান পার্টির ন্যাশনাল কনভেনশনে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যেই হিলারি ক্লিনটনের ব্যক্তিগত ই-মেইল হ্যাক করার জন্য রাশিয়ার হ্যাকারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। রিপাবলিকান পার্টির ওই কনভেনশনে (জিওপি) ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পার্টির পক্ষ থেকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। হিলারি ক্লিনটন যখন সেক্রেটারি অব স্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ছিলেন, তখন তিনি হাজার হাজার ই-মেইল, যা রাষ্ট্রীয় কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তা ব্যক্তিগত ই-মেইলের মাধ্যমে প্রেরণ করেছিলেন। এটা নিয়ে পরে এফবিআই তদন্তও করে। কিছু কিছু প্রকাশও করে। এখনও বেশ কিছু ই-মেইল রয়ে গেছে, যা প্রকাশ করা হয়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার জন্যই রাশিয়ার হ্যাকারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই আহ্বানের পেছনে তিনি আসলে কতটুকু সিরিয়াস ছিলেন এবং আদৌ তিনি পরে সরাসরি কোনো নির্দেশ দিয়েছিলেন কি-না, তা স্পষ্ট হয়নি। তবে বাস্তবতা বলে, ডিএনসির ওইসব ই-মেইল ‘হ্যাক্ড’ হয়েছে এবং এফবিআই এখন বিষয়টি তদন্ত করছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার সরকারি ও বেসরকারি খাতের নেতৃবৃন্দের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। তার বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে রাশিয়ায়। রাশিয়া তথা পূর্ব ইউরোপীয় সুন্দরীদের প্রতি তার মোহ ও ভালোবাসার প্রচুর প্রমাণ রয়েছে। তিনি সব সময়ই নারীসঙ্গ পছন্দ করেন। তার তিন স্ত্রীর মাঝে প্রথম স্ত্রী ছিলেন চেক মডেল ইভানা জেরলিসকোভা (বিয়ে ১৯৭৭), আর বর্তমান তৃতীয় স্ত্রী হচ্ছেন স্লোভেনিয়ার মডেল মেনালিয়া কাউস, যাকে তিনি বিয়ে করেন ২০০৫ সালে। ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়া তথা পূর্ব ইউরোপের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্ক থাকা বিচিত্র কিছু নয়। এর আগে ট্রাম্প ‘ওবামার চেয়ে পুতিন ভালো নেতা’ এ বক্তব্য দিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন। এক্ষেত্রে ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক, কিংবা তথাকথিত রাশিয়ার হ্যাকারদের মাধ্যমে ডিএনসির ই-মেইল হ্যাক করার বিষয়টি এখানকার অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যার, তার নির্বাচনী প্রচারণার কার্যক্রম একটি বিদেশী রাষ্ট্র কর্তৃক ফাঁস হয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে গণ্য করা হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেও বিপন্ন করে তুলতে পারে। যদিও ট্রাম্প ডিএনসির ই-মেইল ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু হিলারি নিজে অভিযোগ এনেছেন রাশিয়ার হ্যাকারদের বিরুদ্ধে।

জুলাই মাসের শেষে দুটি দলের জাতীয় কনভেনশন শেষ হয়েছে। ক্লিভল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়েছে রিপাবলিকান পার্টির কনভেনশন, আর ফিলাডেলফিয়ায় ডেমোক্রেটিক পার্টির। কনভেনশনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হয়। দুটি কনভেনশন ঘিরেই বিপুল উৎসাহ লক্ষ্য করা গেছে। সিএনএন চার দিনব্যাপী কনভেনশন লাইভ কভার করেছে। কনভেনশনে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য দেখে আমার কাছে কতগুলো বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। এক. তুলনামূলকভাবে ডেমোক্রেটদের জাতীয় কনভেনশন ছিল যথেষ্ট আকর্ষণীয়। ওবামা ও বিল ক্লিনটনের মতো দু’জন প্রেসিডেন্টের উপস্থিতি ডিএনসিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। কিন্তু রিপাবলিকান পার্টির কনভেনশনে কোনো সাবেক প্রেসিডেন্ট উপস্থিতি ছিলেন না, যাদের কেউ কেউ এখনও জীবিত আছেন (যেমন বুশ)।

দুই. উভয় কনভেনশনেই আমি লক্ষ্য করেছি বক্তারা (যাদের কেউ কেউ সিনেটর, গভর্নর, মন্ত্রী) ক্লিনটন ও ট্রাম্পকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন বেশি। এমনকি মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের ‘যৌন সম্পর্কের’ বিষয়টিও পরোক্ষভাবে এসেছে। ট্রাম্প ‘অযোগ্য’ তার হাতে ‘পারমাণবিক অস্ত্রের চাবি তুলে দেয়া নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ’, কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ তৈরি করে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে বিপজ্জনক করে তুলতে পারেন- এ ধরনের বক্তব্য বারবার উচ্চারিত হয়েছে।

তিন. হিলারি ক্লিনটনের মনোনয়ন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে- এটা স্বীকার করতেই হবে। ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর গত ২৪০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো একজন নারী প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পেলেন। ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে তিনি যদি বিজয়ী হন, তাহলে সেটা হবে আরেকটি ইতিহাস। চিন্তা করা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজে মহিলাদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে মাত্র ৯৬ বছর আগে! হিলারি ক্লিনটন নির্বাচনী প্রচারণায় এ কথাটিই বারবার বলেছেন। তিনি শিশু ও মায়েদের ব্যাপারে আরও কিছু করতে চান।

চার. দুটো কনভেনশনে দুই পরিবারের দুই ব্যক্তি এবং ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা বক্তৃতা করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের পাশাপাশি মেয়ে চেলসি ক্লিনটনও বক্তৃতা করেছেন। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্ত্রী সাবেক মডেল মেলানিয়া ক্লাউস ট্রাম্পও বক্তৃতা করেছেন। এক্ষেত্রে মেলানিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, ২০০৮ সালে ওবামার স্ত্রী মিশেল ডিএনসি সম্মেলনে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, এটা তার কার্বন কপি। মার্কিন মিডিয়া আমাদের জানাচ্ছে, দু’জনের (মিশেল ২০০৮, মেলানিয়া ২০১৬) বক্তৃতায় ভাষাগত অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। একই সঙ্গে চেলসি যতটুকু আবেগময়ী ভাষায় তার মাকে (হিলারি ক্লিনটন) তুলে ধরতে পেরেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়ে ইভানকা ততটা পারেননি। ইতিমধ্যে চেলসিকে নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। তিনি কি হতে যাচ্ছেন বিল ও হিলারির যোগ্য উত্তরসূরি? হিলারির নির্বাচনী এলাকা নিউইয়র্ক। এখানে তিনি সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আগামী দিনে এ এলাকা থেকে কি আরেক পরিচয়ে হিলারি ক্লিনটনকে দেখতে পাবে নিউইয়র্কবাসী? বিল ক্লিনটনের ভাষণও অনেকে প্রশংসা করেছেন। ৪৫ বছর আগে আরাকানসাস লাইব্রেরিতে হিলারির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হওয়া, তিন-তিনবার হিলারিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া- কনভেনশনে বিলের এ বক্তব্যকে তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে সবাই স্বাগত জানায়। সমাপনী অনুষ্ঠানে হিলারি এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ৪৫ বছর আগে যে ‘যাত্রা’ শুরু হয়েছিল, তা অব্যাহত থাকবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।

পাঁচ. ডেমোক্রেটদের কনভেনশনে যেখানে দলীয় নেতৃত্বের মাঝে ঐক্য ও সংহতি প্রকাশিত হয়েছে (বিশেষ করে বার্নি স্যান্ডার্সের সমর্থকদের নিয়ে শংকা ছিল), তা রিপাবলিকান শিবিরে দেখা যায়নি। মনোনয়নের শীর্ষ দাবিদার টেড ক্রুজ শেষ সময় পর্যন্ত ট্রাম্পকে সমর্থন দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। উপরন্তু ট্রাম্পের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, মেক্সিকান ও মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাবকে লিবারেল রিপাবলিকানদের অনেকে সমর্থন করেননি। এমনকি ডেমোক্রেটদের কনভেনশনে একজন মুসলমান আমেরিকান খিজির খানের (যার সন্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হুমায়ুন খান ২০০৪ সালে ইরাকে আমেরিকান সৈন্যদের রক্ষা করতে গিয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলায় মারা যান) বক্তব্যে ট্রাম্প যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, তাও অনেকে সমর্থন করেননি। আসলে ট্রাম্প একজন ধনী ব্যবসায়ী সন্দেহ নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই তার ব্যবসা আছে। অর্থ আর নারীসঙ্গ ছাড়া (সুন্দরী প্রতিযোগিতা আয়োজনকারীদের একজন তিনি) অন্য কিছু তিনি বোঝেন না। তিনি কখনোই সেনাবাহিনীতে ছিলেন না। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থে তার কোনো অবদান নেই। এমনকি তার বিরুদ্ধে ট্যাক্স ফাঁকির অভিযোগও উঠেছে। তিনি নৈতিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার হারিয়েছেন। তরুণদের কাছে তিনি জনপ্রিয় নন আদৌ। শিশুরা তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে। তবে কট্টরপন্থীদের কাছে তিনি একজন যোগ্য নেতা। কট্টরপন্থীরা চাচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন, যিনি আবার যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ করে দেবেন। একজন নারী প্রেসিডেন্ট এই যোগ্যতা রাখেন না, এটাই তাদের অভিমত।

ছয়. কনভেনশনে হিলারি যেখানে সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন, বেতন বৃদ্ধি, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন, সেখানে ট্রাম্প গুরুত্ব দিয়েছেন অভিবাসন রোধ করা, চাকরির সংখ্যা বাড়ানো ইত্যাদির ওপর।

৮ নভেম্বর নির্বাচন। দুই প্রার্থীই চূড়ান্ত মনোনয়নের পর প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্য, তার অভিবাসীদের পক্ষে কথা বলা, মধ্যবিত্তকে আকৃষ্ট করা, স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলা, টিম কেইনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন দেয়া- সব মিলিয়ে তার অবস্থান এখন শক্তিশালী বলেই মনে হয়। অন্যদিকে ট্রাম্পের কোনো বক্তব্যই সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তার রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘদিনের নয়। ওয়াশিংটন ডিসির রিপাবলিকান শিবিরেও তিনি খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। ৭০ বছর বয়সী ট্রাম্প বিপুল অর্থবিত্তের (ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার) মালিক হলেও তিনি ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ২০০০ সালে তিনি একবার রিফর্ম পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। তিনি অতীতে কখনও কোনো ‘রাজনৈতিক পদ’ গ্রহণ করেননি। টিভি উপস্থাপকও ছিলেন (রিয়েলটি শো, এবিসি)।

অন্যদিকে হিলারি ক্লিনটনের রাজনৈতিক জীবন বেশ বর্ণাঢ্য। তরুণ আইনজীবী হয়ে তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। কর্পোরেট আইনজীবী না হয়ে তিনি শিশু অধিকার, মাতৃ অধিকার নিয়ে তার কর্মময় জীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ফার্স্ট লেডি, নিউইয়র্কের সিনেটর এবং সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তুলনামূলক বিচারে রাজনীতি, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে তার স্পষ্ট ধারণা রয়েছে। এবং তিনি অভিজ্ঞ। অন্যদিকে পররাষ্ট্র তথা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো ধারণাই নেই। ন্যাটো প্রশ্নে, আইএস প্রশ্নে, ব্রেক্সিট প্রশ্নে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার অজ্ঞতাই প্রমাণ করেছে। নাফটা ও টিপিপি চুক্তির ব্যাপারেও তার অবস্থান হিলারির বিপরীতে। তিনি মনে করেন, নাফটা ও টিপিপি চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব বেড়েছে। অথচ হিলারি মনে করেন, এই দুটো চুক্তির কারণে মার্কিন স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে বেশি। ট্রাম্প মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে উঁচু দেয়াল নির্মাণ করে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে চান। অন্যদিকে হিলারি মনে করেন, মেক্সিকানরা মার্কিন অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন আছে ট্রাম্পের। ডেমোক্রেটরা গত আট বছরে (ওবামা প্রশাসন) যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের হাতে তুলে দিয়েছে- এই অভিযোগ ট্রাম্পের। অন্যদিকে হিলারি মনে করেন, চীনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্কই নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার অন্যতম শর্ত। ওবামার শাসনামলে আইএসের জন্ম হয়েছে এবং এজন্য ডেমোক্রেটরাই দায়ী- ট্রাম্পের এ ধরনের অভিযোগ স্বীকার করেন হিলারি ক্লিনটন। হিলারি বলেছেন, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় ১২২টি দেশ সফর করেছেন এবং প্রায় ১০ লাখ মাইল ভ্রমণ করেছেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে। অথচ ট্রাম্প তার ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যই নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। তবে ট্রাম্পের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তিনি সোজাসাপ্টা কথা বলেন। আক্রমণ করে কথা বলেন, যা হিলারি করেন না কখনও। তিনি তার বক্তৃতায় ট্রাম্পকে আক্রমণ করেন সত্য; কিন্তু তা অনেক মার্জিত ভাষায়। তাই একটি প্রাক গবেষণায় (সিন কোলারোসি কর্তৃক পরিচালিত) যখন হিলারি সর্বোচ্চ নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে বিজয়ী হবেন বলে মন্তব্য করা হয়- আমি তাতে অবাক হই না। ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ৫৩৮টি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে হিলারি পাবেন ৩৪৭ ভোট, আর ট্রাম্প পাবেন ১৯১ ভোট। নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয় কংগ্রেস সদস্যদের নিয়ে। অর্থাৎ হাউস অব কংগ্রেসের ৪৩৫ আর সিনেটের ১০০ সিট নিয়ে ৫৩৮টি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট। ৫০টি রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটও আলাদা আলাদা। যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট ৫৫, আর নিউইয়র্কের ২৯। জনগণ ভোট দেয় বটে, কিন্তু তারা প্রেসিডেন্টকে নির্বাচন করে না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে রাজ্যে যে প্রার্থী বিজয়ী হবেন, তিনি নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতিটি ভোট পেয়েছেন বলে ধরে নেয়া হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণা এখন তুঙ্গে। ট্রাম্প তার ব্যক্তিগত বিমানে এক শহর থেকে আরেক শহরে যাচ্ছেন। ট্রাম্প ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ৫১ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছেন, যা হিলারি পারেননি। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বিভিন্ন সংস্থা ও মিডিয়ার জনমত জরিপের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে কোথাও ট্রাম্পকে, কোথাও হিলারিকে সম্ভাব্য বিজয়ী বলা হচ্ছে। তবে বলা যায়, দুটো বিষয় সাধারণ মানুষ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। এক. রাশিয়ার হ্যাকারদের দ্বারা হিলারি ক্লিনটন তথা ডিএনসির ই-মেইল হ্যাক্ড হওয়া এবং দুই. একজন মুসলমান সৈনিকের আত্মত্যাগের ঘটনাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেখা। টিভি চ্যানেলগুলোতে এ আলোচনা এখন অব্যাহত রয়েছে। তাই নির্বাচনের ৯০ দিন আগে এটা স্পষ্ট করে বলা যাবে না কে হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।

ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Jugantar
05.08.16

আঞ্চলিক রাজনীতিতে পরিবর্তন আসন্ন

আঞ্চলিক রাজনীতিতে পরিবর্তন আসন্ন
তুরস্কে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা। গত প্রায় দুই সপ্তাহ যাবৎ শীর্ষস্থানীয় প্রতিটি সাময়িকীতে এ নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং ধারণা করছি ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। বেশ কিছু কারণের জন্য এ অঞ্চলের রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আইএসের উত্থান এ অঞ্চলের রাজনীতিকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ফিলিস্তিন সমস্যা, ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনি এলাকায় আগ্রাসন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে আসছিল। এখন ফিলিস্তিনের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দখল করে আছে আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। দ্বিতীয়ত, ‘আরব বসন্ত’ আরব বিশ্বে ব্যাপক পরিবর্তন ডেকে আনলেও একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল সিরিয়া। সিরিয়ায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।তৃতীয়ত, সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে নতুন করে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে যে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল, যাকে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক স্নায়ুযুদ্ধ-২ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে সেই স্নায়ুযুদ্ধ আরো গভীর হয়েছে। চতুর্থত, এ অঞ্চলের রাজনীতি, অস্থিরতা, জঙ্গিবাদের উত্থান, এক ধরনের ‘অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ’ ইত্যাদি কারণে এ অঞ্চল থেকে লাখ লাখ লোক দেশান্তরিত হয়েছে এবং ইউরোপের ‘ঐক্যে’ বড় ধরনের ফাটল ধরিয়েছে। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই রাজনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থাকে একটি বড় ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে তুরস্কের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ একটা যোগসূত্র রয়েছে। আইএস নির্মূল প্রশ্নে তুরস্কের যেমন একটি ভূমিকা রয়েছে, ঠিক তেমনি সিরিয়ায় আসাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা, লাখ লাখ সিরীয় নাগরিকের দেশান্তরের ঘটনায়ও তুরস্কের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে তুরস্কের রাজনীতি, তুরস্কের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান গুরুত্বের দাবি রাখে। সুতরাং তুরস্কে যখন একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই এর একটি প্রতিক্রিয়া তুরস্কের রাজনীতির পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনীতিতেও থাকবে। বিশেষ করে সিরিয়া সংকটের সমাধান, আইএসকে পরিপূর্ণভাবে নির্মূলের প্রশ্নে তুরস্কের ভূমিকা কী হবে, সেটা হবে একটা বড় প্রশ্ন এখন। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। এক. তুরস্ক ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তুরস্কে মার্কিন সেনা রয়েছে এবং একাধিক বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজিক ইন্টারেস্ট রয়েছে, তাতে তুরস্ক অন্যতম একটি ফ্যাক্টর। দুই. তুরস্কের ব্যাপারে রাশিয়ারও স্বার্থ রয়েছে। তুরস্ক রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ নয়। ব্ল্যাক সি বা কৃষ্ণ সাগর এ দেশ দুটিকে আলাদা করেছে। এই দেশ দুটির মাঝে আছে আবার তিনটি দেশ—জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। জর্জিয়াকে ন্যাটো সদস্যভুক্ত করার আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের। জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার ‘সীমিত যুদ্ধ’-এর খবর আমরা জানি। অন্যদিকে আমেরিকা ও আজারবাইজানের ‘অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে’ তুরস্ক ও রাশিয়া পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। তবে ক্রিমিয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় (২০১৪) কৃষ্ণ সাগরের গুরুত্ব বেড়েছে। এখানে রয়েছে রাশিয়ার বড় নৌঘাঁটি। কৃষ্ণ সাগরের পাশ ঘেঁষে রয়েছে তুরস্কের বিখ্যাত বসফোরাস প্রণালি ও মারমারা সাগর। ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত বসফোরাস প্রণালি হচ্ছে প্রাচ্য ও পশ্চিমের অদ্ভুত এক মিলনস্থান। এই মারমারা প্রণালি ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণ সাগরকে সংযুক্ত করেছে। রাশিয়ার নৌ স্ট্র্যাটেজিস্টরা এ কারণেই তুরস্ককে গুরুত্ব দেন বেশি। সুতরাং তুরস্কে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যতটুকু ভূমিকাই পালন করে থাকুক না কেন দুই পরাশক্তির (রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র) এতে একটা ‘যোগসূত্র’ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের ‘সনাতন সম্পর্ক’ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়গুলোতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছিল না ওয়াশিংটন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধও লক্ষণীয়। অন্যদিকে স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের কারণে রাশিয়া তুরস্কে এমন একটি সরকার চাইবে, যা তার স্বার্থ রক্ষা করবে। বিশ্ব আসরে রাশিয়াকে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে হলে তুরস্ককে তার আস্থায় নেওয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের কারণে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে রাশিয়ার অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পারমাণবিক সমঝোতা’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ইরান এ অঞ্চলের অন্যতম উঠতি শক্তি, যা কি না বিশ্ব এখন গ্রহণযোগ্যতায় নিয়েছে। ফলে খুব সংগত কারণেই এ অঞ্চলে যদি রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক একটি ‘ঐক্য’ গড়ে ওঠে, তাহলে তা বিশ্ব রাজনীতিতেও যে প্রভাব ফেলবে, তা বলাই বাহুল্য। মনে রাখতে হবে বেশ কিছু ইস্যুতে চীন-রাশিয়া ঐক্য গড়ে উঠেছে। দেশ দুটি এসসিও বা ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’-এর সদস্য। ভারত এ জোটের অবজারভার। অন্যদিকে চীন-রাশিয়া-ভারত এবং আরো বেশ কয়েকটি দেশের সমন্বয়ে একটি ‘বিকল্প বিশ্বব্যাংক’ (ব্রিকস ব্যাংক) গড়ে উঠেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। ফলে দুই পরাশক্তির মধ্যে এক ধরনের প্রভাব বলয়ের রাজনীতি শুরু হয়েছে অনেক আগেই। এ ক্ষেত্রে তুরস্কের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের কারণে এই দুই পরাশক্তি তুরস্কের ব্যাপারে যে আগ্রহী হয়ে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখন যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে যেখানে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সদস্য ও দীর্ঘদিন এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে আসছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কি তুরস্কের সম্পর্কের আদৌ অবনতি ঘটেছিল? সম্পর্ক যে আগের পর্যায়ে নেই, এটা বলাই বাহুল্য। তুরস্কের বিচার বিভাগীয় মন্ত্রী ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর অভিযোগ করেছেন যে এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত। অভিযোগ উঠেছে ইসলামিক স্কলার তথা ধর্মগুরু ফেতুল্লাহ গুলেনকে নিয়ে। গুলেন ইসলামকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি কট্টরপন্থী নন। আদি ইসলামের ধারায়ও বিশ্বাসী নন। তিনি ইসলামকে আধুনিকতার ধারায় উপস্থাপন করেছেন। তাঁকে বলা হয় ‘ইসলামের গান্ধী’। এরদোয়ান এক সময় তাঁর অনুসারী ছিলেন। দেশের সেনাবাহিনী, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে গুলেনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। গুলেনপন্থী সমর্থকদের দ্বারা এরদোয়ানের ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করা, সেই সঙ্গে আরো তিন মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনলে ২০১৩ সালের পর থেকেই এরদোয়ানের সঙ্গে গুলেনপন্থীদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরপর ঘটে ইস্তাম্বুলে গাজি পার্কে অবস্থান ধর্মঘটের ঘটনা (২০১৩)। এ ক্ষেত্রেও অভিযোগ আনা হয়েছিল গুলেনপন্থীদের বিরুদ্ধে। একটা ধারণা চালু হয়ে গিয়েছিল যে গুলেনপন্থীরা এরদোয়ানকে উত্খাত করে ক্ষমতা দখল করতে পারে। এরদোয়ান স্বয়ং অভিযোগ এনেছেন যে ফেতুল্লাহ গুলেন এই ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত। গুলেন এখন অনেকটা নির্বাসিত জীবনযাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায়। অভিযোগ আছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ গুলেনকে ব্যবহার করে এই অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। সিআইএর সহযোগিতায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ‘গ্রিনকার্ড’ পেয়েছেন, এমন অভিযোগ তুরস্কের সরকারি দলের নেতাদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছে। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু, তা বিতর্কিত। কিন্তু সিআইএর স্টেশন কমান্ডার (তুরস্ক) তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের জন্য চিঠি দিয়েছিলেন, এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তুরস্ক সরকারের অভিযোগের জবাবে অবশ্য গুলেন বলেছেন, তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত নন। এটা এরদোয়ানের সাজানো নাটক! ক্ষমতা স্থায়ী করতেই তিনি এ কাজটি করেছেন। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমি পেয়েছি জন চুকম্যান কর্তৃক ফরেন পলিসি জার্নালে (২২ জুলাই, ২০১৬) প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে। চুকম্যান তাঁর প্রবন্ধে ইঙ্গিত করেছেন যে ইনসিরলিক বিমানঘাঁটি (যেখানে কয়েক হাজার মার্কিন বিমান সেনা, ৬০টির মতো বিমান ও পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে) বিদ্রোহীরা ব্যবহার করেছিল। বিদ্রোহীদের পক্ষে যে বিমানগুলো উড়ছিল, তারা এই বিমানঘাঁটি থেকে জ্বালানি নিয়েছিল। সুতরাং ঊর্ধ্বতন মার্কিন বিমানবাহিনীর অফিসারদের এটা জানার কথা। তাঁদের সম্মতিতেই বিমানগুলো জ্বালানি নিয়েছিল। এই স্টেশনের তুর্কি কমান্ডার জেনারেল বেকির এরকান ভ্যান গ্রেপ্তার হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন। ফলে অনেকেই এই যুক্তি খাড়া করাতে চাইবেন যে তুরস্কে সরকার উত্খাতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন থাকতে পারে! তবে এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র এরদোয়ানের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছিল না। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও প্রতিদিন তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত দিয়ে শতাধিক ইসলামিক জঙ্গি সিরিয়ায় প্রবেশ করত। এটা ছিল ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য। এসব জঙ্গি আইএসের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিত। উপরন্তু তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, এমন অভিযোগও উঠেছে। দ্বিতীয়ত, আইএসের জঙ্গিরা সিরিয়া ও ইরাকের দখলকৃত এলাকার তেল উত্তোলন করে তুরস্কের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে বিক্রি করত, যার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যায়। এই তেল ছিল আইএসের অর্থের অন্যতম উৎস। জিহাদিদের বেতন দেওয়া হতো এই অর্থ থেকে। উপরন্তু ইরানের ওপর যখন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বজায় ছিল, ইরানের তেল তুরস্কের ব্যবসায়ীরা (যার সঙ্গে এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠজনরা জড়িত ছিলেন) বিশ্ববাজারে বিক্রি করে অনেক টাকা আয় করতেন। ফলে তত্ত্বগতভাবে মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এরদোয়ানের ওপর খুশি ছিলেন না। তাঁদের করারও কিছু ছিল না এরদোয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা ছাড়া। অন্যদিকে ২০১৫ সালের নভেম্বরে একটি রাশিয়ান বিমান ধ্বংস করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও তা এখন অতীত। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আজ রাশিয়ার যেমনি প্রয়োজন তুরস্কের, ঠিক তুরস্কেরও প্রয়োজন রাশিয়াকে। তুরস্ক হচ্ছে রাশিয়ার তৃতীয় বাণিজ্যিক অংশীদার। বিনিয়োগের দিক থেকে রাশিয়ার অবস্থান চতুর্থ। দুটি খাত—গ্যাস বিক্রি ও ট্যুরিজম খাতে রাশিয়ার আগ্রহ বেশি। এর বাইরে তুরস্কের আক্কুউইউ শহরে রাশিয়া একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। রাশিয়ার বিমান ধ্বংস করে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়া তুরস্কের বিরুদ্ধে যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তাতে তুরস্কের বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধি ০.৭ ভাগ কমে গিয়েছিল। এসব এখন অতীত। যে বিমানের পাইলট রাশিয়ার প্লেনকে ধ্বংস করেছিলেন (অবৈধভাবে তুরস্কের সীমানায় প্রবেশ করায়), অতি সম্প্রতি তুরস্ক সরকার তাঁকে গ্রেপ্তারও করেছে, ক্ষমাও চেয়েছে। এটা রাশিয়াকে আস্থায় আনার একটা বড় উদ্যোগ। শোনা যায়, সম্ভাব্য একটি সামরিক অভ্যুত্থানের খবর রাশিয়া আগেই তুরস্ক সরকারকে জানিয়েছিল। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্কের একাধিক স্বার্থ কাজ করছে। প্রথমত, সিরিয়ার সংকটে কুর্দিদের একটি গ্রুপ কুর্দিজ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি) অত্যন্ত সক্রিয়। রাশিয়া পিওয়াইডিকে সমর্থন করে ও মস্কোতে তাদের একটি লিয়াজোঁ অফিস খুলতেও অনুমতি দিয়েছে। তুরস্ক মনে করে, পিওয়াইডি হচ্ছে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) একটি অঙ্গ সংগঠন। পিকেকে তুরস্ক ও ইরাকের কুর্দিস্তানে তত্পর। দলটি ১৯৮৪ সালের পর থেকে তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। দলটি তুরস্কে নিষিদ্ধ। এখন তুরস্ক মনে করছে, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে পিকেকে তথা পিওয়াইডির ওপর থেকে রাশিয়ার সমর্থন কমে যাবে এবং পিকেকে তুরস্কের অভ্যন্তরে যে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তা হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার গ্যাস। প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার (এক হাজার ২০০ কোটি ডলার) ব্যয়ে একটি পাইপলাইন নির্মিত হচ্ছে, যার মাধ্যমে রাশিয়ার গ্যাস ইউরোপে যাবে (টার্কিশ স্ট্রিম প্রজেক্ট)। ইউরোপের অনেক দেশ রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল, যা কি না ইউক্রেনের মাধ্যমে (সাউথ স্ট্রিম) সরবরাহ করা হতো। কিন্তু ইউক্রেন সংকট গভীর হলে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পুতিন তাঁর তুরস্ক সফরের সময় এই বিকল্প ‘টার্কিশ স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর ফলে রাশিয়ার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে কৃষ্ণ সাগরের নিচ দিয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশে সরবরাহ করা হবে। এই গ্যাস পাইপলাইন চালু হলে তা তুরস্কের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। তৃতীয়ত, তুরস্ক ও রাশিয়া একটি ‘যৌথ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ফলে তুরস্ক তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। রাশিয়াকে এখন ‘কাছের বন্ধু’ হিসেবে মনে করছে। এই ‘নয়া সম্পর্ক’ সিরিয়ার সংকট থেকে শুরু করে এ অঞ্চলের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। সিরিয়ায় আসাদবিরোধিতা থেকে তুরস্ক এখন সরে আসবে এবং আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহী বাহিনীগুলো এখন আর তুরস্ক সরকারের সহযোগিতা পাবে না। তুরস্কের এই ‘অবস্থান’ কিছুটা হলেও এ অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। তবে এই অবস্থান পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে দেখে, সেটাই এখন মূল আলোচনার বিষয়। Daily Kaler Kontho 03.08.2016