রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

একজন বিপ্লবীর মৃত্যু


পরিণত বয়সে মারা গেলেন ফিদেল কাস্ত্রো। আপাদমস্তক তিনি ছিলেন বিপ্লবী। মার্কিন আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি এতটুকু ‘কমপ্রোমাইজ’ করেননি। এমনকি ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর শাসনামলে কিউবায় যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেয়, তখন বর্ষীয়ান এই ‘বিপ্লবী’ তাতে রাজি ছিলেন না, এমনটাও আমরা জেনেছি। ৯০ বছর বয়স হয়েছিল তার। রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, তাও চার বছর হলো। প্রকাশ্যে খুব একটা আসতেন না। মাঝে মধ্যে দু-একজন ‘পুরনো বিপ্লবী’ তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। এর মাঝে একজন ছিলেন লাতিন আমেরিকার আরেক বিপ্লবী ভেনিজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ। হুগো শ্যাভেজের সঙ্গে তার ছবি পত্রিকায় ছাপা হতো। হুগো শ্যাভেজও মারা গেছেন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে। বিশ্বব্যাপী বিপ্লবীরা খুব কমই এখন বেঁচে আছেন। এখন বিদায় নিলেন ফিদেল কাস্ত্রোও।
কিউবার বিপ্লব, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আর মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এককভাবে ‘সংগ্রাম’ করার নাম ফিদেল কাস্ত্রো। আমাদের মতো তরুণ প্রজন্ম সত্তর-পরবর্তী সময়ে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, আমাদের কাছে ‘আদর্শ’ ছিল দুজন চে গুয়েভারা ও ফিদেল কাস্ত্রো। দুজন বন্ধু ছিলেন। একসঙ্গে বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। বিপ্লবের পর কিউবার মন্ত্রীও হয়েছিলেন চে। কিন্তু ক্ষমতা ধরে রাখেননি। বিপ্লব সম্পন্ন করতে ছুটে গিয়েছিলেন বলিভিয়ায়। সেখানে চে-কে বলিভিয়ার সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছিল ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে। একজন ডাক্তার, লেখক এবং সর্বোপরি একজন বিপ্লবী চে কিউবা ছেড়ে যাওয়ার আগে কাস্ত্রোকে উদ্দেশ করে একটি আবেগময় চিঠি লিখেছিলেন। ভাষাটা ছিল এরকমÑ ‘বিপ্লব আমাকে ডাকছে। আমার অনেক কাজ বাকি। স্ত্রী ও সন্তানদের রেখে যাচ্ছি। জানি রাষ্ট্র এদের দেখভাল করবে!’ অনেকটা এরকমই ছিল ভাষা। একজন বিপ্লবী কতটুকু ‘ডেডিকেটেড’ হলে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতেও দ্বিধা করেন না। চে করেছিলেন। তাই চে আজও আদর্শ। চে’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ফিদেল। ফিদেল কিউবায় ‘সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য থেকে গিয়েছিলেন। সেই ফিদেল, জলপাই রঙের আউটফিট, মাথায় জলপাই রঙের টুপি, কোমরে মোটা বেল্টÑ একজন বিপ্লবীর ছবি মানেই যেন ফিদেল কাস্ত্রো। সেই ফিদেলকে দেখার শখ ছিল আমার। সুযোগ এসেছিল ১৯৯৫ সালের অক্টোবরে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন বসেছিল নিউইয়র্কে। আমি তখন নিউইয়র্কে। বিশেষ ‘পাস’ সংগ্রহ করে দর্শক সারিতে বসে ফিদেল কাস্ত্রোকে সেদিন দেখেছিলাম। কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম আমি। সেদিন ফিদেল জলপাই রঙের আউটফিট নিয়ে জাতিসংঘে আসেননি। এসেছিলেন স্যুটেড-বুটেড হয়ে। তবে আমার ভালো লেগেছিল একটি সংবাদেÑ কাস্ত্রো কোনো পাঁচ তারকা হোটেলে রাত্রি যাপন করেননি। তিনি রাতে ছিলেন কিউবার রাষ্ট্রদূতের বাসায়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সরকারপ্রধানরা থেকেছিলেন পাঁচ তারকা হোটেলে! কাস্ত্রোও থাকতে পারতেন। থাকেননি।
কিউবার বিপ্লবের অনেকগুলো দিক আছে। প্রথমত, তৎকালীন বাতিস্তা সরকারের দুর্নীতি, অযোগ্যতা, কর্তৃত্বপরায়ণতা ও স্বৈরাচারী মনোভাব, গুম-হত্যার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। এই ক্ষোভটি বিপ্লবীরা ব্যবহার করেছে এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা কিউবার স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করে। দ্বিতীয়ত, বিপ্লবীরা কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না প্রথমদিকে। ঞযব সড়াবসবহঃ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে তারা সংগঠিত হয়েছিলেন। পরে পর্যায়ক্রমে ১৯৬৫ সালে তারা কিউবার কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত হন। তৃতীয়ত, বিপ্লবের পূর্বমুহূর্তে কাস্ত্রো যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন (এপ্রিল ১৯৫৯)। উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রে তার সমর্থনে জনমত সংগ্রহ করা। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের স্পষ্ট করে বলেছিলেন, তিরিন কমিউনিস্ট নন। ফলে কিউবার বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করা। মূলত ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি কিউবায় বাতিস্তা সরকারের পতনের কিছুদিন আগে ১৯৫৩ সালে এই বিপ্লবের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তবে এটা সত্য কাস্ত্রো নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করতে চাননি। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি এই সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। কিউবার বিপ্লবের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, জেনারেল বাতিস্তার শাসনামলের শেষের দিকে বাতিস্তার শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে একজন আইনজীবী হিসেবে ফিদেল কাস্ত্রো আদালতে একটি আর্জি পেশ করেছিলেন। কিন্তু তার সেই আর্জি বাতিল হয়ে গিয়েছিল। এর পরই তিনি সশস্ত্র পন্থায় ক্ষমতা থেকে বাতিস্তাকে উৎখাতের উদ্যোগ নেন। প্রথমদিকে ১২০০ যুবককে নিয়ে তিনি একটি ব্রিগেড গঠন করেছিলেন। এই ব্রিগেড সদস্যদের নিয়ে ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই সান্টিয়াগো শহরের মনসাদা ব্যারাক ও বেয়ামো সেনাক্যাম্প আক্রমণ করেন। এতে তিনি ব্যর্থ হন। গ্রেপ্তার হন। তার ১৫ বছরের জেল হয়। আবার ১৯৫৫ সালে তিনি মুক্তিও পান। এর পর তিনি বিপ্লবকে সংগঠিত করতে চলে যান মেস্কিকোয়। এর পর শুরু হয় চূড়ান্ত বিপ্লবের প্রক্রিয়া। ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরে গ্রানমা জাহাজে করে ৮০ বিপ্লবীকে নিয়ে তিনি ফিরে আসেন কিউবায়। ‘সিয়েরা মায়েস্ত্রা’ পাহাড়ে আশ্রয় নেন বিপ্লবীদের নিয়ে। সেখান থেকেই বিপ্লব পরিচালনা করতে থাকেন। ১৯৫৭ সালের ১৩ মার্চ বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ ছাত্ররা প্রেসিডেন্ট ভবন আক্রমণ করে। কিন্তু সেই আক্রমণ ব্যর্থ হয়। এর পর একপর্যায়ে বিপ্লবীর হাতে পতন ঘটে বাতিস্তা সরকারের।
কাস্ত্রো বিপ্লবের পর ‘ইন্টিগ্রেটেড রেভ্যুলুশনারি অর্গানাইজেশন অব ২৬ মুভমেন্ট’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম দেন। ওই সময় পিপলস সোশ্যালিস্ট পার্টি তাকে সমর্থন করেছিল। ১৯৬২ সালের মার্চে তিনি গঠন করেন ‘ইউনাইটেড পার্টি অব দ্য কিউবান সোশ্যালিস্ট রেভ্যুলেশন’। এই পার্টিই ১৯৬৫ সালের ৩ অক্টোবর কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখানে বলা ভালো, বাতিস্তা দু-দুবার ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৪০-৪৪ সাল পর্যন্ত একবার। ওই সময় কমিউনিস্ট পার্টি তাকে সমর্থন করেছিল। জেনারেল বাতিস্তা ১৯৫২ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এর পর থেকেই তিনি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। ক্ষমতা দখল করে কাস্ত্রো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ চালান। ১৯৭৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। ২০০৮ সালে তিনি অবসরে যান। দেশটি এখন শাসন করছেন তার ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রো। অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, রাউল কাস্ত্রো ধীরে ধীরে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য তার দেশটি উন্মুক্ত করে দেবেন। তিনি দিয়েছেনও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা তিনি করছেন। গত ২১ জানুয়ারি দীর্ঘ ৫৪ বছরে বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিউবা আলোচনা শুরু করেছিল। হাভানায় পুনরায় মার্কিন দূতাবাস খোলা হয়েছে এবং ওবামা নিজে হাভানা সফর করেছেন। তবে সম্পর্কটি কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়, সেটাও দেখার বিষয়। কিউবা কি ফিদেল কাস্ত্রো-পরবর্তী কিউবায় সমাজতন্ত্রকে পরিত্যাগ করবে? কিউবা কি আবারও বাজার অর্থনীতিতে ফিরে যাবে? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে এসব প্রশ্ন উঠেছে এখন। বলা ভালো চিন ও ভিয়েতনামের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশও এই মুহূর্তে ধ্রুপদী মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। সেখানে পরিবর্তন এসেছে। তাই খুব সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন এখনÑ কিউবা চিন বা ভিয়েতনামের পথ অনুসরণ করবে কিনা? ইতোমধ্যে ওবামা কিউবা সফর করেছেন (২০১৬)। এর আগে আরেকজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট কিউবা গিয়েছিলেন ১৯২৮ সালে।
কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ছিল কিউবার নিরাপত্তাহীনতা। যুক্তরাষ্ট্র কখনই কিউবায় একটি সমাজতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকার করে নেয়নি। বরং কিউবায় বিপ্লবের পর (১৯৫৯), কিউবা সরকার যখন লাতিন আমেরিকাজুড়ে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে চাইল, চে গুয়েভারা যখন ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করার জন্য কিউবা সরকারের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে বলিভিয়ায় গেলেন (সেখানেই তাকে পরে হত্যা করা হয়), তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কাছে ভিন্ন একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কখনই চায়নি, ‘তার প্রভাবাধীন এলাকায়’ অন্য কোনো ‘শক্তি’ প্রভাব খাটাক। ‘মনরো ডকট্রিন’-এর আদলে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে এ এলাকায় তথা লাতিন আমেরিকায় তার পূর্ণ কর্তৃত্ব। কিন্তু কিউবার বিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রের এই হিসাব-নিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র কিউবা বিপ্লবের মাত্র দুবছরের মধ্যে ১৯৬১ সালে ভাড়াটে কিউবানদের দিয়ে কিউবা সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। সিআইর অর্থে পরিচালিত এই অভিযান ‘বে অব পিগস’-এর অভিযান হিসেবে খ্যাত। বলাই বাহুল্য ওই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেমে থাকেনি। ঠিক এর পরের বছর ১৯৬২ সালের অক্টোবরে ‘কিউবা সংকট’ একটি পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছিল, কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে, যা তার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছে, এটা বিবেচনায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র একটি নৌ-অবরোধ আরোপ করে, যাতে করে কিউবায় কোনো ধরনের সামরিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করা না যায়। এই নৌ-অবরোধ অনেকটা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে একটি যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দাবি করে, যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্ক থেকে তাদের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নিতে হবে। দীর্ঘ ১৩ দিন এই নৌ-অবরোধ বহাল ছিল। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে মিসাইল প্রত্যাহার করে নিলে সোভিয়েত ইউনিয়নও কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরিয়ে নেয়। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে গেলেও সংকট থেকে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে এই অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে কিউবা ‘যুদ্ধ’ করে আসছে।
তবে দুদেশের মধ্যে এখনো বেশ কিছু বিষয়ে ন্যূনতম ঐকমত্যের অভাব রয়েছে। ওবামার হাভানা সফরের সময়ও তা লক্ষ করা গেছে। মানবাধিকার ইস্যু কিংবা গুয়ান্তোনামো বে-তে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগার, কিউবায় রাজনৈতিক বন্দি ইত্যাদি ইস্যুতে দুই রাষ্ট্রপ্রধান হাভানায় সংবাদ সম্মেলনে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এসব ইস্যুতে দুটি দেশের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। সংবাদ সম্মেলনে রাউল কাস্ত্রো জানিয়েছিলেন, তার দেশে কোনো রাজনৈতিক বন্দি নেই। গুয়ান্তোনামো বে কিউবার কাছে হস্তান্তর করারও কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি ওবামা। তবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের। কিউবার মানবাধিকারের অবনতি হয়েছে, এটাও স্বীকার করেননি কাস্ত্রো। স্পষ্টতই এসব ইস্যুতে দুটি দেশের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। যুক্তরাষ্ট্র যাদের ‘রাজনৈতিক বন্দি’ হিসেবে গণ্য করছে কিউবা তা করছে না। মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে দেখে, কিউবা সেভাবে দেখে না। ফলে মতপার্থক্য রয়েই গেছে। তবে বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এই মতপার্থক্য সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে একজন নয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে যাবেন। তার মনোভাবের ওপর এখন অনেক কিছু নির্ভর করছে। কাস্ত্রোর মৃত্যুর পর ট্রাম্প যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে একটি ইঙ্গিত আছে। কিউবা যতদিন তার সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাবে, ততদিন রিপাবলিকান পার্টি নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস কিউবাকে এতটুকুও ছাড় দেবে না। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে এমনটাই উঠে এসেছে। এ ক্ষেত্রে ওবামার বক্তব্য ছিল অনেকটা ‘মডারেট’। তিনি কট্টর কোনো বক্তব্য দেননি।
একজন বিপ্লবীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। ফিদেল কাস্ত্রো কিউবার ধাঁচেই সমাজতন্ত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। সাফল্য তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু পুরোপুরি তিনি সফল ছিলেন, এটাও বলা যাবে না। মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ তিনি ৭ হাজার ডলারে উন্নীত করতে পেরেছিলেন, যা কিনা থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা জর্ডানের চেয়ে বেশি। সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাও তিনি নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু অর্থনীতি আরও উন্নত, আরও বিনিয়োগের পরিস্থিতি উন্নত করতে পারত কিউবা। এখন ফিদেল নেই। হয়তো কিউবায় আরও পরিবর্তন আসবে ভবিষ্যতে। আদিওস কমরেড ফিদেল! বিদায় কমরেড ফিদেল!
Daily Amader Somoy
28.11.2016

বাংলাদেশ অতিরিক্ত রোহিঙ্গা গ্রহণ করতে পারে না



গেল বছরের ৮ নভেম্বর সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে মিয়ানমারে একটি ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও সে সরকারের সময় যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়, তখন এ ‘গণতন্ত্রের’ ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। এতদিন মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- তারা সুপরিকল্পিতভাবে রাখাইন স্টেট থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করতে চায়। এখন ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারও একই ধরনের আচরণ করছে। যে কারণে মিয়ামনারের স্টেট কাউন্সিলর (যিনি কার্যত সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন) অং সান সু চির নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি আরও শক্তিশালী হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে যখন রোহিঙ্গা সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন সঙ্গত কারণেই বিভিন্ন স্থান থেকে একটি প্রশ্ন উঠেছে- অং সান সু চিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিল! নিঃসন্দেহে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অং সান সু চির যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন অন্তরীণ ছিলেন। অন্তরীণ থাকাবস্থায় তিনি তার ব্রিটিশ স্বামীকে হারিয়েছেন। দুই সন্তানের সঙ্গে তার যোগাযোগও তেমন নেই। তবুও গণতন্ত্রের স্বার্থে তিনি মিয়ানমারে রয়ে গিয়েছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত একটি ‘নির্বাচন’ দিতে তিনি সামরিক শাসকদের বাধ্য করেছিলেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, তিনি মূলত সেনাবাহিনী তথা উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের স্বার্থেই কাজ করছেন। উগ্রপন্থী ভিক্ষুরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা, যারা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান, তারা দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনামলে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন শহরে একধরনের ‘টাউনশিপ’ তৈরি করে সেখানে বসবাসে বাধ্য করা হয়েছিল। আজ রোহিঙ্গাদের অবস্থানও অনেকটা সেরকম। তাদেরও রাখাইন স্টেটে অনেকটা সরকার নিয়ন্ত্রিত এক ধরনের ‘টাউনশিপে’ থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের ন্যূনতম নাগরিক অধিকার নেই। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাওয়ারও অনুমতি নেই। উচ্চশিক্ষার অধিকার নেই। মিয়ানমারের সামরিক সরকার তাদের নাগরিকত্ব দেয়নি। বর্তমান ‘গণতান্ত্রিক সরকারও’ তাদের সেই নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এক্ষেত্রে সামরিক সরকার ও বর্তমান ‘গণতান্ত্রিক সরকারের’ মধ্যে কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) কিংবা সাবেক প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের নেতৃত্বাধীন ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (এসপিডিসি) মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবে অতীত অভিজ্ঞতার কারণে সু চির কাছে প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যারা গত দু’বছর সু চির ভূমিকা ও বক্তব্য অনুসরণ করেছেন, তারা দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু সেনা আস্থা কতটুকু তিনি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়।

মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও একটি ফ্যাক্টর। সেনাবাহিনী এ উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। প্রচণ্ড মুসলমানবিদ্বেষী এ উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা মাবাথা (অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন) সংগঠনের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। এদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য সু চি নির্বাচনে ১ হাজার ৭১১টি আসনের (সংসদের উভয় কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল) একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন স্টেট সফরে গিয়েছিলেন কিন্তু রোহিঙ্গাদের সমর্থনে সেখানে কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ্য করে থাকবেন, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যা ব্যাপকতা পাওয়া এবং শত শত রোহিঙ্গাকে নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারে সু চির কোনো বক্তব্য নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছেন। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু চিও এ প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য তার উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন আছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারে মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি যে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা। তাকে সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী বলা যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের আগে একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের ‘সহাবস্থানে’ গিয়েছিলেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছেন। এর ফলে তিনি নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সর্বজনগ্রহণযোগ্য একটি সমাজব্যবস্থা সেখানে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে, সে প্রশ্ন আছে। একটি জনগোষ্ঠী যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়, তখন সেই দেশটির সরকারকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। মিয়ানমারের জনগণ বিপুল ভোটে সু চিকে নির্বাচিত করেছেন। কিন্তু তিনি বাহ্যত একটি শ্রেণীর স্বার্থেই কাজ করছেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম অধিকার তিনি নিশ্চিত করেননি।

এখন যে অভিযোগটি মিয়ানমারের কোনো কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হয়- রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন, এর পেছনে আদৌ কোনো সত্যতা নেই। ইতিহাস বলে রোহিঙ্গারা অষ্টম শতাব্দী থেকেই আরাকান অঞ্চলে বসবাস করে আসছেন। ১৪৩০ সালের দিকে তৎকালীন আরাকান শাসক বৌদ্ধ রাজা নারামাইখলার (Narameikhla), যিনি মিন স মুন (Min Swa Mun) নামেও পরিচিত ছিলেন, শাসনামলে তিনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের এ অঞ্চলে নিয়ে এসেছিলেন এবং আরাকানে বসবাস করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে রোহিঙ্গারা সেখানে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন। সুতরাং আজ নতুন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন এবং তা গ্রহণযোগ্য নয়।

রোহিঙ্গা নিয়ে যে সমস্যা, তার শুরু মূলত ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে। ওই সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ‘Operation Dragon’-এর শিকার হয়ে আরাকানের মুসলমানরা (রোহিঙ্গা) দলে দলে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা ছিলেন আকিয়াব (সিটওয়ে), মিনবিয়া, মায়োহং, মাইবন, মংডু ও রাথেডং অঞ্চলের অধিবাসী। ওই সময় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে মিয়ানমার তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এবং ১৯৭৮ সালের ৩১ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে আগত ১ লাখ ৮৭ হাজার ২৫০ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। এদের সবার কাছেই মিয়ানমার সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত National Registration Card (NRC) ছিল। ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি সময়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আবারও আরাকানে ‘অপারেশন পিয়েথায়া’ নামে আরেকটি অভিযান পরিচালনা করলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজার এলাকায় অবৈধভাবে প্রবেশ করে এবং আশ্রয় নেয়। এরপর থেকেই দু’পক্ষের মাঝে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হলেও কার্যত তা খুব একটা ফল দেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমান বৃহত্তর কক্সবাজার অঞ্চলে অবৈধভাবে বসবাস করছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৪৫ জন। এরা টেকনাফের কতুপালং ও নোয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। কিন্তু অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশ সরকার অতি সম্প্রতি ‘বাংলাদেশে অবস্থানরত অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিক শুমারি ২০১৫’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এতে ব্যয় হবে ২২ কোটি টাকা। উদ্যোগটি ভালো। রোহিঙ্গাদের এ দুটো ক্যাম্প থেকে নিঝুম দ্বীপে সরিয়ে নেয়ার চিন্তাও করছে সরকার। এ উদ্যোগটিও ভালো।

বাংলাদেশ সরকারকে এখন রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক ‘ইয়াবা’ আসছে। বাংলাদেশ ইয়াবার চালানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ায় বিজিবি সদস্য রাজ্জাকের অপহরণের (জুন, ২০১৫) ঘটনাটি ঘটেছিল। রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে ইয়াবার প্রশ্নটিও তার অপহরণের সঙ্গে জড়িত। গত সাত বছরে ইয়াবার চোরাচালান বেড়েছে ১৭৭ গুণ। এ হিসাব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের। ঢাকায় ইয়াবা বিক্রির রয়েছে ৫ শতাধিক স্পট (আমাদের সময়, ২৪ জুন)। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৩৯টি ইয়াবা কারখানা রয়েছে, যেখান থেকে সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে প্রতি মাসে শত কোটি টাকার ইয়াবা চালান ঢুকছে বাংলাদেশে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবে বাংলাদেশে বছরে তিন হাজার কোটি টাকার মাদকের বাজার রয়েছে। এর অর্ধেক দখল করে রেখেছে ইয়াবা (সকালের খবর, ২৪ জুন)। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইয়াবা পাচারের সঙ্গে মিয়ানমারের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা জড়িত। দেশের আইনশৃংখলা বাহিনীর অনেক সদস্যও এ কাজে জড়িয়ে গেছেন বলে অভিযোগ আছে। অং সান সু চির দল এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও ইয়াবা পাচার রোধে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বলতে দ্বিধা নেই, একদিকে ইয়াবার আগ্রাসন, অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যু দু’দেশের সম্পর্ককে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছে। যদিও দেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের গুরুত্ব রয়েছে অনেক। বাংলাদেশ বরাবরই এ সম্পর্ককে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এখন রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে এ সম্পর্ককে নষ্ট করতে দেয়া যায় না।

মিয়ানমার বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দেশ। সেদেশে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সম্পর্ক আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, উভয় দেশই বিমসটেক ও বিসিআইএম জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোটটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেয়ায় এ জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এ জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারকরণে চট্টগ্রামে কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশী সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশকিছু সার-কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ সেদেশে সার রফতানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশ অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্টস সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এ অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদিপশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশীরা মিয়ানমারে গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এ সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপে আমাদের ফার্নিচার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমারের রুবি, জেড, বোস, মারবেল ইত্যাদি পাথর সমৃদ্ধ। এসব পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালু এডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার-বাংলাদেশ যে উপআঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে উঠছে, তা এ অঞ্চলের উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে পারে। সুতরাং রোহিঙ্গা ইস্যু কোনো অবস্থাতেই যাতে দু’দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে না পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করার কিছুই নেই। মিয়ানমারের সরকারকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশ বাড়তি রোহিঙ্গার চাপ নিতে পারে না। বাংলাদেশের উচিত হবে দ্রুত সরকারি পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা। একই সঙ্গে আসিয়ান ও জাতিসংঘের ‘হস্তক্ষেপও’ চাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ অতিরিক্ত রোহিঙ্গাদের জন্য তার ‘দুয়ার’ খুলে দিতে পারে না। ইউএনএইচসিআরের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান এখানেই নিহিত।
Daily Jugantor
27.11.2016
 

ট্রাম্প, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও বিশ্বরাজনীতি


যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় ও শীর্ষ পদগুলোয় যাঁদের তিনি নিয়োগ দিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করে এটা বলা যায়, একটি উগ্র জাতীয়তাবাদের রাজনীতি তিনি সূচনা করতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে। নির্বাচনের আগে ও পরে আমি বেশ কিছুদিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। মাঝখানে সীমিত সময়ের জন্য আমি ইউরোপেও ছিলাম। ইউরোপজুড়ে যে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান আমি লক্ষ করেছিলাম তার ঢেউ এসে লাগল এখন যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিটি বক্তব্য আমি অনুসরণ করেছি। তাঁর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট, ক্লিয়ার। তিনি মুসলমানবিরোধী ও বর্ণবাদবিরোধী একাধিক বক্তব্য দিয়ে গ্রামীণ শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে কাছে টানতে চেষ্টা করেছিলেন। ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট’—এই স্লোগান তুলে তিনি সাধারণ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করেছিলেন। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের তিনি সমর্থন পাননি। এর পরও এককভাবে তিনি এগিয়ে গেছেন। আর তাতে তিনি সফল হয়েছেন। ডালাস আর নিউ ইয়র্কে থেকে নির্বাচনের সময় আমি প্রত্যক্ষ করেছি, কিভাবে সাধারণ শ্বেতাঙ্গরা ট্রাম্পের বক্তব্যে ‘মোটিভেটেড’ হয়েছে। তারা মনে করেছে, বিদেশিরা, বিশেষ করে মেক্সিকানরা তাদের চাকরিবাকরি নিয়ে নিচ্ছে। ‘বিদেশিদের’ কারণে তাদের সন্তানরা ভবিষ্যতে কোনো চাকরি পাবে না—এ ধরনের একটি মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এ ধরনের মানসিকতা আমি সম্প্রতি জার্মানি ও ফ্রান্সেও দেখেছি। ইউরোপের এই দুটি দেশে প্রচণ্ড অভিবাসনবিরোধী একটা জনমত ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি ‘লিবারেল’ সমাজেও এর ঢেউ এসে লাগল। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামীণ সমাজের একটা বড় অংশ এবার ট্রাম্পের প্রতি এসব কারণেই তাদের সমর্থন ছুড়ে দিয়েছিল। ফলে নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন ট্রাম্প। এমনকি ধর্মীয়ভাবেও, পিউ রিসার্চের গবেষণায় দেখা গেছে, খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ের মানুষ ট্রাম্পের প্রতি নির্বাচনের আগে ঝুঁকে পড়েছিল। এর কারণ হচ্ছে, তাঁর মুসলমানবিরোধী ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘শক্ত’ নেতৃত্ব দরকার। তাই হিলারির বদলে তারা সমর্থন করেছিল ট্রাম্পকে।
ট্রাম্পের এই বিজয় প্রমাণ করে, ভবিষ্যতে তিনি একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রশাসনের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোর নেতৃত্বে যাঁদের তিনি নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁরা সবাই উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার অধিকারী। রেইনস প্রিবাসকে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ হিসেবে। ট্রাম্পের মুখ্য নীতিনির্ধারকের দায়িত্ব পেয়েছেন স্টিফেন ব্যানন। জেনারেল ফ্লাইন নিয়োগ পেয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তাপ্রধান হিসেবে। মাইক পমপেও পেয়েছেন সিআইএর পরিচালকের পদ। আর অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পেয়েছেন জেফ সেশনস। তাঁরা সবাই মুসলমান তথা অভিবাসনবিরোধী। কট্টর দক্ষিণপন্থী ও ট্রাম্পের নগ্ন সমর্থক। ফলে এটা স্পষ্ট, ভবিষ্যতে ট্রাম্প যেসব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন, তাতে ইসলামবিরোধী, অভিবাসনবিরোধী ইস্যুগুলোই প্রাধান্য পাবে। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই বলেছেন, তিনি ‘অবৈধ’ অভিবাসী, যার সংখ্যা তিনি উল্লেখ করেছেন ৩০ লাখ, তাদের তিনি ডিপোর্ট করবেন। এমনকি যারা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান; কিন্তু মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে, তারাও আছে দুশ্চিন্তায়। তাদের ‘স্ক্রিনিং’ করা হবে বলে তিনি ঘোষণা করেছেন। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে একটি ‘শ্বেতাঙ্গ সুপরেমেসি’ প্রতিষ্ঠা করতে চান। এতে ‘হেইট ক্রাইম’ আরো বাড়বে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে যে ‘লিবারেল’ রাজনীতি ধারণ ও প্রমোট করে আসছিল, তাতে এখন ছেদ পড়তে পারে। শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ দ্বন্দ্ব যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে আগে থেকেই ছিল। তা এখন আরো বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে ফেডারেল সরকারের সঙ্গে স্টেট সরকারগুলোর দ্বন্দ্ব বাড়তে পারে। যেমন—নিউ ইয়র্কের মেয়র (যিনি ডেমোক্র্যাট) বলেছেন, তিনি অভিবাসীদের ‘প্রটেকশন’ দেবেন। এ ক্ষেত্রে ফেডারেল সরকার যদি কোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যায়, তাতে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রের দ্বন্দ্ব অনিবার্য। অন্যদিকে ক্যালিফোর্নিয়ার মতো স্টেট ট্রাম্পের নির্বাচনে বিজয়ে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করেছে। সেখানে প্রকাশ্যে মিছিলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দাবি উঠেছে। এই দাবি অন্য স্টেটগুলোতেও ছড়িয়ে যেতে পারে! ইতিহাসে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের করুণ কাহিনী রয়েছে। একুশ শতকে এসে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর রাষ্ট্রে হয়তো বাস্তবতাবিবর্জিত। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার মতো স্টেটে প্রকাশ্যেই বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি উঠেছে। এটাকে নিছক হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এখন ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে, তারা কিভাবে বিষয়গুলোকে, বিশেষ করে এই অভিবাসন ইস্যুকে ‘ব্যবহার’ করে। এটা তো সত্য, ট্রাম্পের অনেক বক্তব্য ও নির্বাচনের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে। এই বিভক্তি আরো বাড়বে, যদি ট্রাম্প ত্বরিত কোনো সিদ্ধান্ত নেন।
ট্রাম্পের এই বিজয় প্রমাণ করল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে যে ‘লিবারেলিজম’-এর ধারণা বহমান ছিল, তা এখন ভাঙছে। কট্টরপন্থী উগ্র এক ধরনের জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এ কথা ভারতের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য (বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান), তেমনি প্রযোজ্য তুরস্কের ক্ষেত্রেও (একেকে পার্টির একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা)। ইউরোপে ব্যাপক সিরীয় শরণার্থীদের আগমনের কারণে সেখানে সমাজে রাজনীতিতে এক ধরনের মেরুকরণের জন্ম হয়েছে। এতে দেখা যায়, জার্মানি ও ফ্রান্সে কট্টর দক্ষিণপন্থী দলগুলোর উত্থান ঘটেছে। তারা মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। একটি কট্টর দক্ষিণপন্থী ইসলামবিরোধী ‘রাজনৈতিক স্রোত’ এখন সারা ইউরোপে বইছে। এর প্রভাব পড়ছে সেখানকার নির্বাচনে। ট্র্যাডিশনাল দলগুলো কট্টরপন্থীদের কাছে হেরে যাচ্ছে। আমি সম্প্রতি জার্মানি ও ফ্রান্স ঘুরে এসেছি। সিরীয় শরণার্থীদের ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি ও ফ্রান্সে আশ্রয়দানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে অভিবাসনবিরোধী একটি শক্তিশালী জনমত তৈরি হয়েছে। তারা স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ভালো করছে। আমি অন্তত সাতটি দেশের নাম করতে পারব, যেখানে দক্ষিণপন্থী নব্য নাজি পার্টি এই অভিবাসন ইস্যুকে কেন্দ্র করে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। যেমন বলা যেতে পারে, ফ্রিডম পার্টি (অস্ট্রিয়া), ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (পোল্যান্ড), ফিদেসজ (হাঙ্গেরি), সুইডেন ডেমোক্র্যাটস (সুইডেন), গোল্ডেন ডন (গ্রিস), ন্যাশনাল ফ্রন্ট (ফ্রান্স) ও অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (জার্মানি) পার্টির কথা। ফ্রিডম পার্টির নেতার (নরবার্ট হফার) প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। সংসদে তাঁদের আসনসংখ্যা এখন ৪০ (মোট আসন ১৮৩)। পোল্যান্ডের নির্বাচনে ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নেতা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে তাঁরা ভোট পেয়েছিলেন ৩৯ শতাংশ। হাঙ্গেরিতে ফিদেসজ পার্টি সরকারের অংশীদার। গ্রিসে বামরা ক্ষমতায় থাকলেও কট্টর দক্ষিণপন্থী পার্টি গোল্ডেন ডনের সংসদে আসন রয়েছে ১৮টি। ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট পুরনো রাজনৈতিক সংগঠন। অভিবাসন ইস্যুতে তারা স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ২৭ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করেছে। আর জার্মানির মতো ইউরোপের বড় গণতান্ত্রিক দেশে দক্ষিণপন্থী অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে ৪.৭ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করেছে (৫ শতাংশ ভোট পেলে তারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারত)। এই দলগুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা মিল আছে। এরা সবাই অভিবাসনবিরোধী, ইসলামবিরোধী ও ‘শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসি’তে বিশ্বাসী।
এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউরোপের দক্ষিণপন্থী ওই সব নেতার রাজনৈতিক দর্শনের একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ট্রাম্প নিজেও ইসলামবিরোধী, অভিবাসনবিরোধী এবং তাঁর যে স্লোগান—‘মেইক আমেরিকা গ্রেট’-এর পেছনে কাজ করেছে শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসির বিষয়টি। বিশ্বজুড়েই এক ধরনের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। আফ্রিকার অনেক দেশের কথা বাদই দিলাম। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ভারত ও তুরস্কের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিয়েও প্রশ্ন আছে। মোদি ‘হিন্দুত্ববাদের’ স্লোগান তুলে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। আর অতিসম্প্রতি তুরস্কে এরদোয়ান তথাকথিত ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে গুলেনপন্থীদের জড়িত থাকার অভিযোগ এনে পুরো রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। গণতন্ত্রের নামে সেখানে কায়েম হয়েছে একনায়কতন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বরাবরই সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করে আসছে। কিন্তু ট্রাম্পের বিজয় এখন অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। তাঁর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সেখানে ‘হেইট ক্রাইম’ বেড়েছে। মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ আরো বেড়েছে। এই সমাজকে মানুষ আগে কোনো দিন দেখেনি, তাই আগামী চার বছর ওই দেশে কী হবে এ নিয়ে চিন্তা অনেকের। পিউ রিসার্চ একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। তাতে বেরিয়ে এসেছে, ৫৬ শতাংশ মানুষ মনে করে ট্রাম্পের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তেমন শ্রদ্ধাবোধ নেই। গত ২৭ অক্টোম্বর (২০১৬), অর্থাৎ নির্বাচনের আগে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যদি পরিবর্তন আসে, বিশ্বরাজনীতিতেও তা প্রভাব ফেলে। ফলে ট্রাম্পের উত্থান ও তাঁর ঘোষিত নীতি যদি তিনি কার্যকর করার উদ্যোগ নেন, তা এক বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নিরাপত্তা ও বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি যেসব প্রস্তাব করেছেন বা দিয়েছেন, তা যদি তিনি কার্যকর করেন, তাহলে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসবে। কতগুলো বিষয় এখানে দেখার  রয়েছে—১. রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর সখ্য একটি রুশ-মার্কিন ঐক্য তথা ইয়াল্টা ২-এর জন্ম দেবে কি না (চার্চিল রুজভেল্ট-স্ট্যালিন শীর্ষ বৈঠক ১৯৪৫); ২. ওবামা প্রশাসনের আমলে ‘চীনকে ঘিরে ফেলার’ নীতিতে ট্রাম্প প্রশাসন ‘কমিটেড’ থাকবে কি না? ৩. রুশ-মার্কিন ‘ঐক্য’ সিরিয়ায় আসাদকে নতুন জীবন দেবে; কিন্তু আইএস উত্খাতে ট্রাম্পের স্ট্র্যাটেজি কী হবে? ৪. দক্ষিণ চীন সাগরের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা কী হবে? ৫. টিপিপি ও নাফটা চুক্তি যদি অকার্যকর হয়ে যায়, তাহলে এক ধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ অবধারিত। এই ‘যুদ্ধ’ এড়াতে ট্রাম্প কী ভূমিকা নেবেন? ৬. ইউরোপকে ট্রাম্প আশ্বস্ত করবেন কিভাবে? ৭. ন্যাটোর বিকল্প কোনো প্রস্তাবনা ট্রাম্প উপস্থাপন করবেন কি?
মোদ্দাকথা, এক বড় ধরনের পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে এখন যুক্তরাষ্ট্র। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং একই সঙ্গে বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আসবে। এখন পরিবর্তনটুকু দেখার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে মাত্র।
Daily Kaler kontho
27.11.2016


রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন পথে


হঠাৎ করেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যাটি আবার আলোচনায় এসেছে। মিয়ানমারের আরাকান স্টেটে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার আর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় শত শত রোহিঙ্গা আবার বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। কিছু কিছু লোক এরই মধ্যে ঢুকেও গেছে। নাফ নদীতে শত শত নৌকায় বেশকিছু মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে, এমন খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক রয়েছে। কিন্তু যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার জন্য সীমান্ত খুলে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ এটি করতে পারে না। কেননা এরই মধ্যে বেশ কয়েক লাখ অবৈধ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে বসবাস করছে, যাদের নিজ বাসভূমি ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকার তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। মিয়ানমার মূলত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে মনে করে না।
রোহিঙ্গা নিয়ে যে সমস্যা, তার শুরু মূলত ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে। ওই সময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ‘Operation Dragon’ এর শিকার হয়ে আরাকানের মুসলমানরা (রোহিঙ্গা) দলে দলে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা ছিলেন আকিয়াব (সিটওয়ে), পালেটবা, মিনবিয়া, মায়োহং, মাইবন, মংডু এবং রাথেডং অঞ্চলের অধিবাসী। ওই সময় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালের জুলাইয়ে মিয়ানমার তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং ১৯৭৮ সালের ৩১ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে আগত ১ লাখ ৮৭ হাজার ২৫০ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। এদের সবার কাছেই মিয়ানমার সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত National Registration Card (NRC) ছিল। এরপর ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আবারও আরাকানে ‘অপারেশন পিয়েথায়া’ নামে আরেকটি অভিযান পরিচালনা করলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজার এলাকায় অবৈধভাবে প্রবেশ করে এবং আশ্রয় নেয়। এরপর থেকেই দুইপক্ষের মাঝে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হলেও, কার্যত তা খুব একটা ফল দেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় অবৈধভাবে বসবাস করছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৪৫ জন। এরা টেকনাফের কুতুপালং ও নোয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। কিন্তু অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশ সরকার অতি সম্প্রতি ‘বাংলাদেশে অবস্থানরত অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিক শুমারি ২০১৫’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এতে ব্যয় হবে ২২ কোটি টাকা। এ উদ্যোগটি ভালো। রোহিঙ্গাদের এ দুইটি ক্যাম্প থেকে নিঝুম দ্বীপে সরিয়ে নেয়ার চিন্তাও করছে সরকার। এ উদ্যোগটিও ভালো। বাংলাদেশ সরকারকে এখন রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণে ‘ইয়াবা’ আসছে। বাংলাদেশ ‘ইয়াবা’র চালানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ায় বিজেবির সদস্য রাজ্জাকের অপহরণের (জনু ২০১৫) ঘটনাটি ঘটেছিল। রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে ইয়াবার প্রশ্নটিও তার অপহরণের সঙ্গে জড়িত। ৭ বছরে ইয়াবার চোরাচালান বেড়েছে ১৭৭ গুণ। এ হিসাব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের। ঢাকায় ‘ইয়াবা’ বিক্রির রয়েছে ৫ শতাধিক স্পষ্ট (আমাদের সময়, ২৪ জুন)। আরেকটি পরিসংখ্যান দেখা গেছে, মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৩৯টি ইয়াবা কারখানা রয়েছে, সেখান থেকে চোরাইপথে প্রতি মাসে সীমান্ত দিয়ে শতকোটি টাকার ইয়াবা চালান ঢুকছে বাংলাদেশে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবে, বাংলাদেশে বছরে ৩ হাজার কোটি টাকার মাদকের বাজার রয়েছে। এর অর্ধেক দখল করে রেখেছে ইয়াবা (সকালের খবর, ২৪ জুন)। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, ইয়াবা পাচারের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তারা জড়িত। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এ কাজে জড়িয়ে গেছেন। ফলে অং সান সু চি’র দল এখন রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করলেও মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর স্বার্থ যেখানে জড়িত, সে ব্যাপারে অগ্রগতি হবে এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। তবে বিগত নির্বাচন (২০১৫) প্রমাণ করেছিল, মানুষ সেখানে পরিবর্তন চায়। তাই পরিবর্তনটি এসেছে। ‘জনগণই সব ক্ষমতার উৎস’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এ স্বতঃসিদ্ধ ‘সত্য বাক্যটি’ মিয়ানমারের ক্ষেত্রে আবারও প্রমাণিত হয়েছিল। সেনাবাহিনী ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করলেও, জনগণের সম্মতি তাতে ছিল না। জনগণ চেয়েছিল, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। সেই নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল এবং অং সান সু চি সেখানে সরকার পরিচালনা করছেন বটে; কিন্তু নির্বাচিত সরকারের সময় আবারও রোহিঙ্গারা নির্যাতনের শিকার হবে তা কাম্য হতে পারে না। রোহিঙ্গারা আরাকানে তাদের বাসভবনে থাকবে। কিন্তু তারা থাকতে পারছে না। তাদের পরিকল্পিতভাবে দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। ১৯৭৮ ও ১৯৯১ সালেও এমনটি হয়েছিল। ২০১২ সালের পর আবার নতুন করে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা খেদাও অভিযান শুরু হয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বসতবাড়ি থেকে উৎখাত করা হচ্ছে। এটা সত্য, বাংলাদেশের ভেতরে বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। কিন্তু এরই মাঝে তারা নানা কর্মকান্ডে জড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ খবরে জানা যায়, মিয়ানমার সরকার নতুন করে আরাকানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়ালে আবারও রোহিঙ্গা খেদাও অভিযান শুরু হয়। এক্ষেত্রে সেখানকার বৌদ্ধভিক্ষুরা সংগঠিত হয়ে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়িতে আক্রমণ করছে এবং বসতবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। ফলে আবারও শুরু হয়েছে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগ। এদের একবার (২০১২ সালে) সাগরপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। একটি মানব পাচারকারী চক্র সেখানকার সরকারের পাশাপাশিও সক্রিয় ছিল। মে-জুনে (২০১২) সাগরভাসি মানুষকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বড় ধরনের সংবাদের জন্ম হয়েছিল। বলাই ভালো, বাংলাদেশের একটা চক্রও এদের সঙ্গে যোগ হয়েছিল। বাংলাদেশীদেরও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে এসব মানব পাচারকারী চক্র মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের উদ্যোগ নেয়। ওই সময় বিশ্বের মিডিয়ায় ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় ব্যাংককে আসিয়ানের উদ্যোগে একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে ওই সময় মিয়ানমার সরকার একটি চাপে ছিল। এখন আবার রোহিঙ্গা ইস্যুটি নতুন করে দুই দেশের সম্পর্ককে নানা প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের উচিত হবে না মিয়ানমারের ফাঁদে পা দেয়া। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট ডিপ্লোমেসি’ (Smart Diplomacy) প্রদর্শন করতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘর্ষে না গিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারে কাজ করে যেতে হবে। কেননা বাংলাদেশের কাছে মিয়ানমার নানাবিধ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই আসে এর ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্বের কথা। প্রায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখ- নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে মিয়ানমার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। মিয়ানমারের পশ্চিমে বাংলাদেশ, পশ্চিম ও উত্তরে ভারত, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে চীন, পূর্বে থাইল্যান্ড ও লাওস। মিয়ানমারের এ ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সঙ্গে যে সড়ক যোগাযোগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, যা কিনা চীনকেও সংযুক্ত করবে, এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকে বদলে দেবে। একসময় ‘কুনমিং উদ্যোগ’ এখন বিসিআইএম জোটে পরিণত হয়েছে। সমস্যা ছিল ভারতকে নিয়ে। এখন ভারতের সম্মতির পরই এই বিসিআইএম জোটের ধারণা শক্তিশালী হয়। এ জোটটি কার্যকরী হলে কুনমিং (ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়ক পথে বাংলাদেশে এবং ভারতেও আসা যাবে এবং পণ্য আনা-নেয়া যাবে। ফলে চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে। উপরন্তু ২০২০ সালের মধ্যে আসিয়ানে মুক্তবাজার সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএমের আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। নর্থ রুটে কুনমিং থেকে মিয়ানমারের Myitkyha হয়ে ভারতের Ledo পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। এ রুটে বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে না। এ রুটটি অনেক কঠিন। সাউথ রুটে ইউনান থেকে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর সোনাদিয়া পর্যন্ত সংযুক্ত ছিল। কুনমিং মান্দালয় (মিয়ানমার) ও Gway (মিয়ানমার) হয়ে এ রুটটি চট্টগ্রামে প্রবেশ করবে। পরে ঢাকা হয়ে কলকাতা যাবে। এখন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হওয়ায় (ভারতের আপত্তির কারণে) এ প্রস্তাবিত রুটটির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তৃতীয় প্রস্তাবিত রুটটি হচ্ছে মিডল রুট। এ রুটটি ভালো এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটাই প্রাচীন সিল্ক রুট। কুনমিং Bhamo-Lashio-Tamu (মিয়ানমার) ইম্ফল (ভারত)-সিলেট-ঢাকা ও কলকাতা হচ্ছে এ রুট, যা কিনা K2K নামেও পরিচিত। অর্থাৎ কুনমিং থেকে কলকাতা। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, এ রুটে (২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার) একটি মোটর র‌্যালি (২০১৩) চালু হয়েছিল। এ জোটের সম্ভাবনা ছিল বিশাল। কেননা এ চারটি দেশের (বিসিআইএম) রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাসসম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর, রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) এবং সমুদ্রবন্দর (বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে আগামীতে, যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি তো বটেই, বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেক অংশে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এ জোট। এ চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা বিশ্ব জিডিপির ১০ ভাগ। ভারত বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। জাপানকে টপকে এশিয়ায় দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশ ভারত। এ অঞ্চলের উন্নয়নে ভারত বড় অবদান রাখতে পারে। ফলে বিসিআইএম জোটে ভারতের সংযুক্তি এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিতে পারে। আমাদের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি অর্থাৎ পূর্বের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আসিয়ানে আগামীতে একটি মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এখানে রয়েছে একটি বিশাল বাজার। এ বাজার আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত আমেড-৮ এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে, অন্যদিকে তেমনি বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি সহনীয় ইসলাম (মডারেট ইসলাম) ধারণ করে, এ ধারণাও আরও শক্তিশালী হবে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা হবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর। উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুর বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে ‘এশিয়া মিডিলইস্ট ডায়ালগ-৮’ (আমেড-৮) এর প্রস্তাব করেছিল। আমেড-৮ এর অন্য দেশগুলো হচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিসর, জর্ডান, কুয়েত ও বাহরাইন। আমেড-৮ এর কথা প্রথম শোনা গিয়েছিল ২০০৪ সালে সিঙ্গাপুরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময়। এরপর আমেড-৮ নিয়ে তেমন কথাবার্তা শোনা যায় না।
আজ রোহিঙ্গা সমস্যাকে কেন্দ্র করে একটি বিশাল সম্ভাবনাকে আমরা জলাঞ্জলি দিতে পারি না। এটা সত্য, আরাকানে মানবিকতা আজ লুণ্ঠিত। বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার থেকে আজ রোহিঙ্গারা বঞ্চিত। শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তারা আজ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হবে এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই একদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আসরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচারের বর্ণনা তুলে ধরে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ অব্যাহত রাখতে হবে।
Daily Aklokito Bangladesh
27.11.2016

ওবামার সতর্কবার্তা ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার শেষ ইউরোপ সফরে এসে উগ্র জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। বর্ণ, ধর্ম বা নৃতাত্ত্বিক সীমারেখা টানার কারণে যে বিভাজন, সে বিপদ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সজাগ বলেও তিনি জানান। উগ্র জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তিনি বক্তব্য দিলেন এমন এক সময় যখন এই উগ্র জাতীয়তাবাদ খোদ তার নিজ দেশ যুক্তরাষ্ট্রে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট’ এই বক্তব্য দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সাধারণ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের দৃষ্টি কেড়েছিলেন। তার এই বক্তব্যের পেছনে ছিল এই উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। আমি যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন আমাদের সময়ের পাঠকদের আমার মূল্যায়ন পাঠিয়েছি। দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার কারণে আমি দেখেছি কীভাবে এই উগ্র জাতীয়তাবাদ সেখানে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই উগ্র জাতীয়তাবাদ বিস্তারের পেছনে কাজ করছিল ইসলামবিদ্বেষ, অভিবাসন বিরোধিতা ও ধর্মীয়ভাবে একটা বিভক্তি টানা। ট্রাম্প এগুলো পুঁজি করেছিলেন। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। ইউরোপের অন্তত ৭ থেকে ৮টি রাষ্ট্রে এই উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা সেখানে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে সিরীয় অভিবাসীদের ব্যাপকভাবে ইউরোপে প্রবেশ কেন্দ্র করে ফ্রান্স, হাঙ্গেরি কিংবা জার্মানির মতো দেশে কট্টরপন্থি উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম হয়েছে। তারা স্থানীয় নির্বাচনে ভালো করছে এবং কোথাও কোথাও সনাতন ট্রাডিশনাল রাজনীতির পরাজয় হয়েছে। ইউরোপের এই উগ্র রাজনীতির সঙ্গে ট্রাম্পের উত্থানের আশ্চর্য এক মিল রয়েছে। ইউরোপে ন্যাশনাল ফ্রন্ট (ফ্রান্স), অলটারনেটিভ ফর জার্মানি (জার্মানি) কিংবা ল’ অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির (পোল্যান্ড) মতো উগ্র কট্টরপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ইসলামবিদ্বেষ, অভিবাসনবিরোধী ভূমিকাকে পুঁজি করে অন্যতম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ঠিক তেমনি ট্রাম্পের ইসলামবিদ্বেষ আর অভিবাসনবিরোধী ভূমিকা তাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী করেছে। তিনি আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ নেবেন। কিন্তু এর আগেই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে তার বিরুদ্ধে একটা জনমত শক্তিশালী হয়েছে। তিনি বলেছেন, ৩০ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের কর দেবেন। এটা সত্য অবৈধ মেক্সিকান অভিবাসীরা ‘ডিপোর্ট’ অথবা এক ধরনের ‘স্ক্রিনিং’-এর সম্মুখীন হতে পারেন। তারা নানা প্রশাসনিক জটিলতায় পড়তে পারেন। মুসলমানরা এ ক্ষেত্রে বড় ঝামেলায় পড়বেন। আমি অনেক বছর যাবৎ নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত করি। এখানে এক ধরনের বর্ণবাদ রয়েছে। এখন ট্রাম্পের শাসনামলে এই বর্ণবাদ আরও শক্তিশালী হবে। ট্রাম্পের বিজয়ে বর্ণবাদীরা এবং মুসলমান ধর্মবিরোধীরা আরও উৎসাহিত হবেন। ফলে বর্ণবাদী হামলা আরও বাড়বে। ইতোমধ্যেই সংখ্যালঘু অভিবাসীদের ওপর আক্রমণের খবর বেড়েছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম বিদ্বেষজনিত হামলা আগের তুলনায় ৬৭ শতাংশ বেড়েছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (নাইন-ইলেভেন) সন্ত্রাসী হামলার পর এটি সর্বাধিকসংখ্যক হেইট ক্রাইম। এই হেইট ক্রাইমের মধ্যে ধর্মীয় ও বর্ণবিদ্বেষমূলক হামলার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। ট্রাম্পের বিজয় এই হেইট ক্রাইমকে এখন উসকে দেবে। ট্রাম্প উগ্র জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়েছেন। ট্রাম্প নিজে অভিবাসী সন্তান হয়েও (তার পূর্বপুরুষ জার্মানি থেকে এসেছে ১৮৮৫ সালে) শুধু তার রাজনীতির স্বার্থেই অভিবাসীদের বিষয়টিকে ইস্যু করেছেন। তিনি যদি তার নীতিতে অটল থাকেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মেক্সিকো তথা লাতিন আমেরিকার স্পেনিশ ভাষাভাষী দেশগুলোর সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি বড় পরিবর্তন আনবেন। যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্য খাতে সেবা প্রদান একটি বড় সমস্যা। ওবামাকেয়ার সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করলেও সাম্প্রতিক সময়ে হেলথ ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম কোনো কোনো স্টেটে বেড়ে গিয়েছিল। নির্বাচনের আগে ট্রাম্প এটাকে পুঁজি করেছিলেন। এই ওবামাকেয়ার তথা হেলথ ইন্স্যুরেন্স ছিল সবার জন্য বাধ্যতামূলক। ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি এটা বাতিল করবেন। এখন বলছেন, তিনি এতে সংস্কার আনবেন। যদিও এটা এখন অবধি স্পষ্ট নয়, সংস্কারটা তিনি কীভাবে আনবেন এবং এতে করে সাধারণ মানুষ কতটুকু উপকৃত হবে, তাও স্পষ্ট নয়। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার ভূমিকা কী হবে এ বিষয়টি এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা নির্বাচনের আগে রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক, পুতিনকে ওবামার চেয়ে ভালো নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা এবং ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাশিয়া দেখতে চায়Ñ এ ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর একটা প্রশ্ন এখন অনেকের কাছে উঠেছেÑ আর তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে? রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনের ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এমনকি রাশিয়াকে জি-৮ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। এখন পরিস্থিতি কি বদলে যাবে? নির্বাচনের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি রাশিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারের পক্ষে। ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর টেলিফোনে ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের কথা হয়েছে। এই দুজনের ফোনালাপকে গভীর বন্ধুত্বের সুর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা ও বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের (স্নায়ুযুদ্ধ-২) জন্ম হয়েছিল এবং রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছিল। এখন কি যুক্তরাষ্ট্র একটি ইউটার্ন নেবে? এতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে? যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বিশেষ করে পেন্টাগনে যেসব কট্টরপন্থি রয়েছেন তারা কী রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার এই প্রবণতাকে মেনে নেবেন? সিনিয়র জেনারেলদের ভূমিকাই বা কী হবে এখন? রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র মৈত্রী কি ইতিহাসকে আবার স্মরণ করিয়ে দেবে? দ্বিতীয় ইয়াল্টার কি জন্ম হচ্ছে? পাঠক স্মরণ করতে পারেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ইউরোপের ভূমিকা কী হবে, এটা নিয়ে আলোচনার জন্য ইয়াল্টায় (১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি) চার্চিল (যুক্তরাজ্য), রুজভেল্ট (যুক্তরাষ্ট্র) ও স্ট্যালিন (সোভিয়েত ইউনিয়ন) এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সেই পরিস্থিতি কি তাহলে আবার ফিরে আসছে? এ ক্ষেত্রে যে কোনো রুশ-মার্কিন ঐক্য সিরিয়ার পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলবে? আসাদ ইতোমধ্যে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সম্ভাব্য এই ঐক্য আসাদকে আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দেবে মাত্র। কিন্তু তাতে করে যুদ্ধ সেখানে থামবে বলে মনে হয় না। যদিও ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আসাদবিরোধী নুসরা ফ্রন্টকে (পরিবর্তিত নাম জাবহাত ফাতেহ আল শাস) অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবেন না। কিন্তু তাতে করে কি আইএসকে ধ্বংস করা সম্ভব হবে? অনেকেই জানেন, আইএস পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সহযোগিতা পেয়ে থাকে। ট্রাম্পের সময় আইএস কি তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে? এ ক্ষেত্রে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এক ধরনের ‘গেরিলা যুদ্ধ’-এর জন্ম হবে। ট্রাম্প যদি সত্যি সত্যিই ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি সমর্থন করতে অস্বীকার করেন, তাহলে ইরান এই গেরিলা যুদ্ধের সম্ভাবনাকে উসকে দেবে। আল কায়েদা কিংবা আইএসের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সেই পুরনো ‘স্পাইডার ওয়েভ’ তত্ত্বেও ফিরে যাবে, এরা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গুপ্তহামলা চালাবে। ফলে একটি স্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্য দেখার সম্ভাবনা ক্ষীণ। চিনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন আছে। চিনের সঙ্গে এক ধরনের ট্রেড ওয়ার শুরু হয়ে যেতে পারে। চিনা পণ্যের ওপর শতকরা ৪৫ ভাগ হারে শুল্ক আরোপ করলেও (যা তিনি প্রস্তাব করেছেন), চিন বিষয়টি খুব সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। মেক্সিকোর সঙ্গে সীমান্তে উঁচু দেয়াল নির্মাণের বিষয়টিও অত সহজ হবে না। তবে একটা আশঙ্কার জায়গা হচ্ছে, নয়া প্রশাসনে জাতীয় নিরাপত্তাপ্রধান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মাইকেল কাইনের নিযুক্তি। কাইন অত্যন্ত কট্টরপন্থি, ইসলামবিরোধী এবং পুতিনের মতো নেতৃত্বকে পছন্দ করেন। তিনি সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। তাতে তিনি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হেরে যাওয়ার পেছনে ‘রাজনৈতিক সঠিক লাইন’-এর অভাব বলে মনে করেন এবং ইসলামবিদ্বেষকে তিনি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন। ফলে কাইনের মতো কট্টরপন্থিদের নিযুক্তি প্রমাণ করে ট্রাম্প তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসছেন না। ট্রাম্প যদি তার আগের অবস্থানে দৃঢ় থাকেন এবং মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করার আইন প্রণয়ন করেন, তাহলে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। দু-একটি মুসলমানপ্রধান দেশে সন্ত্রাসী কর্মকা- রয়েছে। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকেই দায়ী করা হয়। এ জন্য সব মুসলমানপ্রধান দেশকে দায়ী করা ঠিক হবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ট্রাম্পের প্রশাসনে একের পর এক যেভাবে কট্টরপন্থিদের ভিড় বাড়ছে তাতে করে তারা ট্রাম্পকে একটি কঠোর ইসলামবিরোধী ভূমিকা নিতে বাধ্য করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংখ্যালঘুদের (এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের) অধিকার নিশ্চিত করলেও সংবিধানের এই অধিকার এখন অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। কেননা নতুন করে আইন প্রণয়ন করতে এবং কংগ্রেসে তা পাস করিয়ে নিতে ট্রাম্পের কোনো সমস্যা হবে না। সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদে এখন রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টে তিনজন কনজারভেটিভ বিচারপতিকে তিনি নিয়োগ দিতে পারেন। সেই ক্ষমতা এখন তার আছে। ফলে তিনি যদি সংবিধান সংশোধন করার কোনো উদ্যোগ নেন, তিনি তা পারবেন। ন্যূনতম অভিবাসনবিরোধী তথা ইসলামবিরোধী কোনো আইন পাস করতে তার কোনো সমস্যা হবে না। এতদিন বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সংবিধানগুলোর একটি। সংবিধানের বিভিন্ন পর্যায়ে আইনের শাসন, চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স, মানবাধিকার রক্ষা, জনগণের সার্বভৌমত্ব, জনগণের ন্যূনতম অধিকারের স্বীকৃতি ইত্যাদি যে বিষয় সংযোজিত রয়েছে তা এখন ট্রাম্পের জমানায় ঝুঁকির মুখে থাকল। সমসাময়িককালে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এত বেশি ক্ষমতা নিয়ে আসেননি, যা কিনা ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর ট্রাম্পকে এনে দিয়েছে। তিনি এখন যা চাইবেন, তাই করতে পারবেন। তবে বাস্তবতা বলে একটা কথা আছে। তিনি নির্বাচনের আগে অনেক কথা বলেছেন বটে, কিন্তু কতটুকু কী করবেন, তা আগামী দিনগুলোই শুধু বলবে। নির্বাচনের পরপরই তার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ, ক্যালিফোর্নিয়ার মতো স্টেটের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি তার জন্য কোনো ভালো সংবাদ নয়। এ ক্ষেত্রে বাস্তবতা তার গৃহীত নীতিতে কতটুকু প্রতিফলিত হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। তবে একটা কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, অভিবাসন নীতিমালায় পরিবর্তন আসবে। নতুন নতুন বিধি প্রবর্তিত হবে। নাগরিকত্ব আইন কঠোর হবে। তাই বলাই যায়, বদলে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কি কোনো পরিবর্তন আসছে?



যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কি কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে? ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্লেষকরা এ বিষয়টির দিকে এখন দৃষ্টি দিয়েছেন বেশি করে। অনেক ইস্যু এখন সামনে এসেছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক, সিরিয়ার ব্যাপারে নয়ানীতি, চীন তথা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি কী হবে এ নিয়ে এখন আলোচনার শেষ নেই। ওবামা প্রশাসনের আমলে চীনকে ঘিরে ফেলার একটি মহাপরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে গিয়েছিল। ওবামা তার পররাষ্ট্রনীতিতে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে গুরুত্ব দিয়ে ‘Pivot to Asia’ পলিসি গ্রহণ করেছিলেন। এখন ট্রাম্প কি এ নীতি অব্যাহত রাখবেন এটা ব্যাপক আলোচিত একটি বিষয়। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ট্রাম্পকে ফোন করেছিলেন। তাদের মাঝে সংলাপ হয়েছে এবং এ ফোনালাপকে ‘গভীর বন্ধুত্বের সুর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও কথা হয়েছে ট্রাম্পের। অন্যদিকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি সন্ত্রাস দমনে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সহযোগিতা চান। যুক্তরাষ্ট্র এত দিন আসাদবিরোধী নুসরা ফ্রন্টকে সমর্থন দিয়ে আসছিল। এখন ট্রাম্প বলেছেন, তিনি নুসরা ফ্রন্টকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করবেন না। কিন্তু আইএস উৎখাতে তার অবস্থান কী, তা স্পষ্ট নয়। তবে নিঃসন্দেহে এটা বলা যায়, একটি রুশ-মার্কিন সমঝোতা আসাদের হাতকেই শক্তিশালী করবে মাত্র! তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দক্ষিণ চীন সাগর হবে ট্রাম্পের জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’। এ অঞ্চলে বিশাল জ্বালানি প্রাপ্তির সম্ভাবনা শুধু চীনকেই এই অঞ্চলের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলছে না, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এখানে বলা ভালো, এ অঞ্চল তথা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় অনিবার্যভাবে ভারত একটি শক্তি। এরই মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে ভারত চারটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। ফলে এটা বোঝাই যায়, আগামী দিনগুলোতে এ অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান-পতনে ভারত একটি ‘শক্তি’ হতে চায়। এক্ষেত্রে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ মূলত এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ চীনের কর্তৃত্ব কমানো। নীতিগত প্রশ্নে এ ব্যাপারে ওবামা প্রশাসন ও আগামী প্রশাসনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকার কথা নয়। ভারত এরই মধ্যে ভারত মহাসাগরে চীনের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, মার্চের শেষের দিকে ভারত বঙ্গোপসাগরে সাবমেরিন থেকে পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম ব্যালিস্টিক মিসাইল পরীক্ষা চালিয়েছিল। এতে চীনের কোনো প্রতিক্রিয়ার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হলেও, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একটি প্রতিক্রিয়া তখন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মার্ক টোনার বলেছিলেন, এই মিসাইল পরীক্ষা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষুণœ করবে। তিনি এ অঞ্চলের দেশগুলোকে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার ও উন্নয়ন কমিয়ে আনারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা লক্ষ করেছেন, ভারত মহাসাগরে তিনটি পরাশক্তির (যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত) তৎপরতা সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বেড়েছে। এতে এ অঞ্চলে ‘প্রভাব বলয় বিস্তারের’ রাজনীতিকে কেন্দ্র করে একদিকে চীন ও ভারত, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। এ ‘দ্বন্দ্ব’কে কেন্দ্র করে ভারত মহাসাগরের অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোও ‘আক্রান্ত’ হচ্ছে। চীন যখন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির আওতায় এ অঞ্চলের দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করছে, ঠিক তখনই ভারত এগিয়ে এসেছে তার প্রাচীন ‘কটন রুট’ নিয়ে। ভারত এরই মধ্যে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে তার তৎপরতা বাড়িয়েছে। ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও ব্রুনাইয়ের সঙ্গে চুক্তি করে সেখানে তার সামরিক তৎপরতা নিশ্চিত করেছে। এর আগে ভারত শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে যুদ্ধজাহাজ বিক্রমাদিত্যকে পাঠিয়েছিল। চীন-ভারত দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়া হিসেবে চীন অতি সম্প্রতি আন্দামান ও নিকোবর অঞ্চল তার বলে দাবি করেছে। পাঠকরা নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারেন, কলম্বোতে গেল বছর চীনা ডুবোজাহাজের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে শ্রীলঙ্কায় সরকার পর্যন্ত পরিবর্তন হয়েছিল। এ ডুবোজাহাজের উপস্থিতিকে ভারত দেখেছিল তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে। সাবেক শ্রীলঙ্কান রাষ্ট্রপতি রাজাপাকসে ছিলেন অতিমাত্রায় চীনানির্ভর। চীন শ্রীলঙ্কার হামবানতোতা ও কলম্বোতে দুইটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি খুব সহজভাবে দেখেনি ভারত। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেখানে এক ধরনের ‘হস্তক্ষেপ’ করে এবং সিরিসেনাকে রাজাপাকসের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে দাঁড় করায়।  নির্বাচনে সিরিসেনা বিজয়ী হয়েছিলেন এটা সত্য। ভারতে মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারতীয় মহাসাগর তথা মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলকে ঘিরে নয়া ভারতীয় স্ট্র্যাটেজি রচিত হয়েছে। গেল বছর (মার্চ) ভারতের উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরে ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ‘ইন্ডিয়ান ওশেন রিম’ এর একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশও তাতে অংশ নিয়েছিল। ওই সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সুস্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ভারত মহাসাগরে চীনের প্রবেশ ভারতের কাছে কাক্সিক্ষত নয়। ভুবনেশ্বর শীর্ষ সম্মেলনের আগে মোদি সরকার মরিশাসে একটি ভারতীয় ঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে একটি চুক্তি করেছে। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটি মৈত্রী জোট গড়ারও উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। এ জোটে মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে রাখারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল তথা ভারত মহাসাগর আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা। এ দুইটি অঞ্চলে সাম্প্রতিক বেশকিছু ‘সামরিক তৎপরতা’ লক্ষণীয়। দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে একটি সামরিক ঐক্যজোট গঠিত হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, চীনের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। অন্যদিকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন তার নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়িয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে অ্যারাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। কারণ এ পথ তার জ্বালানি সরবরাহের পথ। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। এদিকে ভারতও ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতের নৌবাহিনীর ‘নিউ ইস্টার্ন ফ্লিট’ এ যুক্ত হয়েছে বিমানবাহী জাহাজ। রয়েছে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন। আন্দামান ও নিকোবরে রয়েছে তাদের ঘাঁটি। ফলে এক ধরনের প্রতিযোগিতা এরই মধ্যে চীন ও ভারতের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে। এশিয়া-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্ব নিয়ে চীন এবং ভারতের অবস্থান এখন অনেকটা পরস্পরবিরোধী। যেখানে চীনা নেতৃত্ব একটি নয়া ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’ এর কথা বলছে, সেখানে মোদি সরকার বলছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোর’ এর কথা। স্বার্থ মূলত এক ও অভিন্ন এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই এশিয়ার এ দুইটি বড় দেশের মাঝে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। আর এটাকেই কাজে লাগাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা কী, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
একসময় মার্কিনি গবেষকরা একটি সম্ভাব্য চীন-ভারত অ্যালায়েন্সের কথা বলেছিলেন। জনাথন হোলসলাগ ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে লিখিত একটি প্রবন্ধে Chindia (অর্থাৎ চীন-ভারত) এর ধারণা দিয়েছিলেন। চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের (২০১৪ ও ২০১৬) পর ধারণা করা হয়েছিল, দেশ দুইটি আরও কাছাকাছি আসবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা, চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং সর্বশেষ চীনের আন্দামান-নিকোবর অঞ্চল দাবি দেখে মনে হয়েছে, এই সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। নতুন আঙ্গিকে ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ ধারণা আবার ফিরে এসেছে। এ ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ মনরো ডকট্রিনের দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কারও কর্তৃত্ব ভারত স্বীকার করে নেবে না। একসময় এ এলাকা, অর্থাৎ ভারত মহাসাগরীয় এলাকা ঘিরে ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ (২০০৭ সালে রচিত। শ্রীলঙ্কা, চীন, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার ঐক্য) এর যে ধারণা ছিল, শ্রীলঙ্কায় সিরিসেনার বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণা এখন আর কাজ করছে না। ফলে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী ধারণাকে আরও শক্তিশালী করতে বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীনের ইউনান রাজ্য, ভারতের সাতবোন, মিয়ানমার) যে আগ্রহ দেখিয়েছিল, তাতে এখন শ্লথগতি আসতে পারে। সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত এখন আর বিসিআইএম ধারণাকে ‘প্রমোট’ করবে না। আর বাংলাদেশের একার পক্ষে চীনকে সঙ্গে নিয়ে বিসিআইএম ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। শুধু তাই নয়, ভারত নয়া উপআঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিবিআইএনকে (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) বেশি গুরুত্ব দেয়ায় বিসিআইএম এখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের নৌ স্ট্র্যাটেজি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। অর্থাৎ একসময় যুক্তরাষ্ট্রের নৌ স্ট্র্যাটেজি শুধু প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরে রচিত হলেও এখন তা সম্প্রসারিত হয়েছে ভারত মহাসাগরে। একই স্ট্র্যাটেজির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে ভারত মহাসগারকে, যাকে ওবামা আখ্যায়িত করেছেন ‘Pivot to Asia’ হিসেবে। বাংলাদেশ এ স্ট্র্যাটেজির আওতায়। এ স্ট্র্যাটেজির অন্তর্ভুক্ত চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও। উল্লেখ করা প্রয়োজন, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য এখানে মোতায়েনরত যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ ফ্লিটের ছয়টি যুদ্ধজাহাজকে ভারত মহাসাগরে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। এতে চীনা নেতাদের উদ্বেগ ও শঙ্কা বাড়ছে।
অতি সম্প্রতি ওয়াশিংটনের (১ এপ্রিল) যে চতুর্থ পারমাণবিক নিরাপত্তা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, সেখানে ওবামার সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আলাপচারিতায় চীনা নেতা তাদের উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এর কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে Terminal High Altitude Area Defense (THAAD) আলোচনা শুরু করেছে। যদিও বলা হচ্ছে, THAAD এক ধরনের মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (৪০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় আগত শত্রুপক্ষের মিসাইল ধ্বংস করা। THAAD ব্যাটারি প্রতিস্থাপনে খরচ পড়বে ৮২৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার), কিন্তু চীন মনে করছে, এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক দক্ষিণ চীন সাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠানোকে চীন মনে করছে তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি এটি এক ধরনের হুমকি। ওবামা-শি জিনপিং আলোচনায় এ প্রসঙ্গগুলো উত্থাপিত হয়েছিল এবং শি জিনপিং এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, চীন এ ধরনের ‘কর্মকা-’ সহ্য করবে না। স্পষ্টতই এশীয়-প্যাসিফিক অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভূমিকা’ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এতে করে এটা স্পষ্ট, এ ভূমিকা এ অঞ্চলে চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে। ফলে এ অঞ্চল, অর্থাৎ ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চল আগামী দিনগুলোতে যে এক ধরনের প্রভাব বলয় বিস্তার করার প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন এখানে যে, ট্রাম্পের প্রশাসন এ বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখবে? ট্রাম্পের সময়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও বাড়বে। তবে চীনের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। ফলে আমরা ২০১৭ সালের দিকে একটি নয়া মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি পাব কিনা, সে ব্যাপারে আমাদের কৌতূহল থাকবেই। ২০ জানুয়ারি (২০১৭) তিনি দায়িত্ব নেবেন। সুতরাং ওই সময় পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
Daily Alokito Bangladesh
20.11.2016

এক নতুন যুগে প্রবেশ করছে যুক্তরাষ্ট্র


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, এ খবর এখন পুরনো। আগামী ২০ জানুয়ারি তিনি শপথ নেবেন। কিন্তু বিতর্ক যেন তার পিছু ছাড়ছে না। নির্বাচনের আগে তিনি বিতর্কিত ছিলেন নানা কারণে। নির্বাচনের ফলাফল নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। আর এখন ক্ষমতা নেয়ার আগেও তিনি বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলছেন একের পর এক। প্রশাসনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে যাদের তিনি নিয়োগ দিয়েছেন, তাদের নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। রেইনস প্রিবাসকে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন চিফ অব স্টাফ হিসেবে। আর ট্রাম্পের মুখ্য নীতিনির্ধারকের দায়িত্ব পালন করবেন স্টিফেন ব্যানন। প্র্রিবাস ট্রাম্পের অতীত অনেক অপকর্মকে সমর্থন করেছেন। এমনকি রিপাবলিকান পার্টির অনেক সিনিয়র নেতাকে তিনি ‘হুমকি’ দিয়েছিলেন ট্রাম্পকে সমর্থন দেয়ার জন্য। যে কারণে রিপাবলিকান পার্টির অনেকেই প্রিবাসকে সমর্থন করেন না। অন্যদিকে ব্যানন কট্টর দক্ষিণপন্থী হিসেবে পরিচিত। তিনি একজন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটটি সমকামীবিরোধী, নারীবিদ্বেষী ও উসকানিমূলক লেখায় পরিপূর্ণ। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, তিনি তার বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করতেই গুরুত্বপূর্ণ এ দুই পদে কট্টরপন্থীদের নিয়োগ দিলেন। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প যে ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন একটি প্রশাসন গড়ে তুলছেন, তাতে এক ধরনের ‘পারিবারিক কর্তৃত্ব’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মেয়ে ইভানকা ও তার স্বামী, যিনি ইহুদি বংশোদ্ভূত, জেয়ার্ড কুশনারের কর্তৃত্ব বাড়ছে। জেয়ার্ড বিভিন্ন নিয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন এবং ধারণা করা হয় ট্রাম্প প্রশাসনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকবেন।

এখন যে প্রশ্নটি অনেকেই করছেন তা হচ্ছে, কেমন হবে ট্রাম্পের রাজনীতি? পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি কী কী পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন? অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার টার্গেট দুটো সেক্টর। এক. অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ন, দুই. ওবামাকেয়ার বাতিল করা। বৈধ কিংবা অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনের আগে দীর্ঘ সময় আমি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। বিভিন্ন শহরে গেছি। খুব কাছ থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছি। নির্বাচনের দিনে আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে ভোট কেন্দ্রে গেছি। জানার চেষ্টা করেছি নির্বাচন নিয়ে তাদের ভাবনা কী। অনেক বাংলাদেশী-আমেরিকান নাগরিকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাদের মনোভাব জেনেছি। একটা শংকা যে তাদের মাঝে ছিল এবং এখনও আছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। অবৈধ বাংলাদেশীদের মাঝে আতংক থাকাটা স্বাভাবিক। তারা বৈধ হওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা এখন সদূরপরাহত। অন্যদিকে যারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছেন, তারাও আছেন বিপদে। কেননা ট্রাম্পের একজন উপদেষ্টার বক্তব্য এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গেছে, যেখানে তিনি বলেছেন, মার্কিন নাগরিকদের মাঝে যারা মুসলমান, তাদের পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে। এ বক্তব্য বাংলাদেশী-আমেরিকানদের মাঝে আতংক সৃষ্টি করেছে। আমি আমার পরিবারের অনেক সদস্যকে জানি, যারা বাংলাদেশে আসা পিছিয়ে দিয়েছেন। এরা সবাই দেখতে চান ট্রাম্প ক্ষমতা নেয়ার পর কী পদক্ষেপ নেন। তবে অভিবাসীদের ব্যাপারে প্রচলিত নীতিমালায় পরিবর্তন আসবে। ট্রাম্প এ ব্যাপারে কঠোর আইন প্রণয়ন করবেন বলেই আমার ধারণা। কংগ্রেসের উভয় কক্ষে এখন রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। উপরন্তু ট্রাম্প সুপ্রিমকোর্টে তিনজন কনজারভেটিভ বিচারককে নিয়োগ দেবেন। ফলে তার যে কোনো সিদ্ধান্ত এখন উচ্চ আদালত কর্তৃক অনুমোদিত হবে। ট্রাম্প এখন ৩০ লাখ অবৈধ অভিবাসীদের বের করে দেয়ার কথা বলছেন। এ ক্ষেত্রে একটি ‘নীতিমালা’ তিনি প্রণয়ন করবেন। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে, তারা এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে।

ট্রাম্পের প্রধান টার্গেট মেক্সিকানরা। প্রচুর মেক্সিকান নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাস করেন। আমি নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় দেখেছি অবৈধ অভিবাসীরা, যাদের অধিকাংশই মেক্সিকান নাগরিক, তারা রাস্তার পাশে কাজের জন্য নিত্যদিন বসে থাকেন। মূলত এরা নির্মাণকাজের শ্রমিক। সস্তা শ্রমের কারণে কনট্রাক্টররা এদের নিয়োগ দেন। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে এরা বছরের পর বছর যুক্তরাষ্ট্রে থাকছেন। প্রত্যক্ষভাবেই এরা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। অনেক কাজ আছে যা মেক্সিকানদের ছাড়া চলে না। যেমন- নিউইয়র্কের মতো বড় শহরে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কাজটি নিয়ন্ত্রণ করেন মেক্সিকানরা। বৈধ ও অবৈধ উভয় শ্রেণীর মেক্সিকানরাই এ কাজে নিয়োজিত। এ ক্ষেত্রে মেক্সিকানদের বের করে দেয়া হলে (?) পুরো নিউইয়র্ক শহরই অচল হয়ে যাবে। তাই আমার ধারণা, সিরিয়াস কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না ট্রাম্প প্রশাসন। কিছু অবৈধ অভিবাসী, যাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে, তারা ডিপোর্টের সম্মুখীন হতে পারেন। তবে সব বিদেশী, যাদের স্থায়ী বসবাসের অধিকার রয়েছে, তারা এক ধরনের ‘স্ক্রিনিংয়ের’ সম্মুখীন হতে পারেন। তারা নানা প্রশাসনিক জটিলতায় পড়তে পারেন। মুসলমানরা এ ক্ষেত্রে বড় ঝামেলায় পড়বেন।

আমি অনেক বছর ধরে নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত করি। এখানে এক ধরনের বর্ণবাদ রয়েছে। ট্রাম্পের শাসনামলে এ বর্ণবাদ আরও শক্তিশালী হবে। ট্রাম্পের বিজয়ে বর্ণবাদীরা ও মুসলমানবিরোধীরা আরও উৎসাহিত হবে। ফলে বর্ণবাদী হামলা আরও বাড়বে। ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘু অভিবাসীদের ওপর আক্রমণের খবর বেড়েছে বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম বিদ্বেষজনিত হামলা আগের তুলনায় ৬৭ শতাংশ বেড়েছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের (নাইন-ইলেভেন) সন্ত্রাসী হামলার পর এটি সর্বাধিকসংখ্যক হেইট ক্রাইম। এই হেইট ক্রাইমের মধ্যে ধর্মীয় ও বর্ণবিদ্বেষমূলক হামলার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। ট্রাম্পের বিজয় এ হেইট ক্রাইমকে এখন উসকে দেবে। ট্রাম্প উগ্র জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়েছেন। তিনি নিজে অভিবাসী পরিবারের সন্তান হয়েও (তার পূর্বপুরুষ জার্মানি থেকে এসেছিল ১৮৮৫ সালে) শুধু অপরাজনীতির স্বার্থে অভিবাসীদের বিষয়টিকে ইস্যু করেছেন। তিনি যদি তার নীতিতে অটল থাকেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মেক্সিকোর তথা লাতিন আমেরিকার স্প্যানিশ ভাষাভাষী দেশগুলোর সম্পর্কের অবনতি ঘটবে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাতে সেবা প্রদান একটি বড় সমস্যা। ওবামাকেয়ার সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করলেও সাম্প্রতিক সময়ে হেলথ ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম কোনো কোনো রাজ্যে বেড়ে গিয়েছিল। নির্বাচনের আগে ট্রাম্প এটিকে পুঁজি করেছিলেন। এ ওবামাকেয়ার তথা হেলথ ইন্স্যুরেন্স ছিল সবার জন্য বাধ্যতামূলক। ট্রাম্প বলেছিলেন তিনি এটা বাতিল করবেন। এখন বলছেন তিনি এতে সংস্কার আনবেন। যদিও এটা এখন অবধি স্পষ্ট নয় সংস্কারটা তিনি কীভাবে আনবেন। এতে করে সাধারণ মানুষ কতটুকু উপকৃত হবে, তাও স্পষ্ট নয়।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার ভূমিকা কী হবে, এ বিষয়টি এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা নির্বাচনের আগে রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক, পুতিনকে ওবামার চেয়ে ভালো নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা এবং ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাশিয়া দেখতে চায়- এ ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর একটা প্রশ্ন এখন অনেকের মনে দেখা দিয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে? রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনের ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। রাশিয়াকে জি-৮ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। এখন পরিস্থিতি কি বদলে যাবে? নির্বাচনের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি রাশিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারের পক্ষে। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর টেলিফোনে ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের কথা হয়েছে। এ দু’জনের ফোনালাপকে ‘গভীর বন্ধুত্বের সুর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা এবং বিভিন্ন অঞ্চলে তার সামরিক আগ্রাসন নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের (স্নায়ুযুদ্ধ-২) জন্ম দিয়েছিল। এবং রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্বের প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছিল। এখন কি যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে ‘ইউটার্ন’ নেবে? এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে? মার্কিন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে, বিশেষ করে পেন্টাগনে যেসব কট্টপন্থী রয়েছেন, তারা কি রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার এ প্রবণতাকে মেনে নেবেন? সিনিয়র জেনারেলদের ভূমিকাই বা কী হবে এখন? রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র ‘মৈত্রী’ কি ইতিহাসকে আবার স্মরণ করিয়ে দেবে? দ্বিতীয় ইয়াল্টার কি জন্ম হচ্ছে? পাঠক স্মরণ করতে পারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ইউরোপের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে আলোচনার জন্য ক্রিমিয়ার ইয়াল্টায় (১৯৪৫ সালের ফেব্র“য়ারি) চার্চিল (যুক্তরাষ্ট্র), রুজভেন্ট (যুক্তরাষ্ট্র) ও স্ট্যালিন (সোভিয়েত ইউনিয়ন) এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সেই পরিস্থিতি কি তাহলে আবার ফিরে আসছে? সেক্ষেত্রে রুশ-মার্কিন ঐক্য সিরিয়া পরিস্থিতির ওপর কী প্রভাব ফেলবে? আসাদ ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সম্ভাব্য এ ‘ঐক্য’ আসাদকে আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দেবে মাত্র। কিন্তু তাতে করে যুদ্ধ সেখানে থামবে বলে মনে হয় না। যদিও ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আসাদবিরোধী নুসরা ফ্রন্টকে (পরিবর্তিত নাম জাবহাত ফাতেহ আল শাম) অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবেন না; কিন্তু তাতে করে কি আইএসকে ধ্বংস করা সম্ভব হবে? অনেকেই জানেন, আইএস পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘সহযোগিতা’ পেয়ে থাকে। ট্রাম্পের সময় আইএস কি তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে? এক্ষেত্রে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এক ধরনের ‘গেরিলা যুদ্ধ’ দেখা দিতে পারে। ট্রাম্প যদি সত্যি সত্যি ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি সমর্থন করতে অস্বীকার করেন, তাহলে ইরান এই গেরিলা যুদ্ধ উসকে দেবে। আল কায়দা কিংবা আইএসের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সেই পুরনো ‘স্পাইডার ওয়েভ’ তত্ত্বে ফিরে যাবে। এরা ছোট ছোট গ্র“পে বিভক্ত হয়ে গুপ্তহামলা চালাবে। ফলে একটি স্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্য দেখার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

চীনের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন আছে। চীনের সঙ্গে এক ধরনের ‘ট্রেড ওয়ার’ শুরু হয়ে যেতে পারে। চীনা পণ্যের ওপর শতকরা ৪৫ ভাগ হারে শুল্ক আরোপ করলে (যা তিনি প্রস্তাব করেছেন) চীন বিষয়টি সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। মেক্সিকোর সঙ্গে সীমান্তে উঁচু দেয়াল নির্মাণের বিষয়টিও অত সহজ হবে না। তবে একটা আশংকার জায়গা হচ্ছে নতুন প্রশাসনে জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মাইকেল ফ্লাইনের নিয়োগ। ফ্লাইন অত্যন্ত কট্টরপন্থী, ইসলামবিরোধী এবং পুতিনের মতো নেতৃত্বকে পছন্দ করেন। তিনি সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। তাতে তিনি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হেরে যাওয়ার পেছনে ‘সঠিক রাজনৈতিক লাইনের’ অভাবকে দায়ী করেছেন। এবং ইসলামবিদ্বেষকে তিনি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন। ফলে ফ্লাইনের মতো কট্টরপন্থীদের নিয়োগ প্রমাণ করে ট্রাম্প তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসছেন না। ট্রাম্প যদি তার আগের অবস্থানে দৃঢ় থাকেন এবং মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করার আইন প্রণয়ন করেন, তাহলে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতে বাধ্য। কয়েকটি মুসলমানপ্রধান দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রয়েছে। এবং এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকেই দায়ী করা হয়। এজন্য সব মুসলমানপ্রধান দেশকে দায়ী করা ঠিক হবে না।

ট্রাম্প একটি উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। এ উগ্র জাতীয়তাবাদ শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, বরং সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে ‘লিবারেলিজমের’ যে ধারা বহমান ছিল, তা এখন ঝুঁকির মুখে পড়ল। প্রেসিডেন্ট ওবামা তার শেষ বিদেশ সফরে এ উগ্র জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। বর্ণ, ধর্ম বা নৃতাত্ত্বিক সীমারেখা টানার কারণে যে বিভাজন, সে বিপদ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সজাগ বলেও তিনি জানান। ওবামার এ বক্তব্য অনেককে খুশি করে থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা কী সেটাই দেখার বিষয়। ‘ট্রাম্প যুগ’ নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় কী পরিবর্তন আনে, সেটাই মুখ্য বিষয় এখন।
Daily Jugantor
19.11.2016

ট্রাম্পের বিজয়ের দশ কারণ


এক কথায় অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হবেন, এটা কেউই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। কিন্তু সেটাই ঘটল। সব জনমত জরিপকে মিথ্যা প্রমাণ করে নির্বাচকমণ্ডলীর ২৭৯টি ভোট পেয়ে বিজয়ী হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই সঙ্গে রচিত হল ইতিহাস। এটা কেউ কোনোদিন চিন্তাও করতে পারেনি রাজনীতির সঙ্গে দু’বছর আগেও যার কোনো সম্পর্ক ছিল না, যিনি কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক পদ (সিনেটর, প্রতিনিধি পরিষদ, গভর্নর) অলংকিত করেননি, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন। তবে তিনি এখন প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত, এটাই বাস্তব। একসময় মনে করা হতো, ট্রাম্প আদৌ তার প্রার্থিতা ঘোষণা করবেন না। তিনি করেছিলেন। একসময় মনে করা হতো, দলের প্রাইমারিগুলোতে তার প্রার্থীপদ কর্মীরা সমর্থন করবেন না। কিন্তু করেছিলেন। মনে করা হয়েছিল, দলের শীর্ষ নেতা যেমন মার্কো রুবিও, টেড ক্রুজ, পল রায়ান, জেব বুশ, বেন কারসন- এদের কেউ একজন রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু তাদের কেউ পাননি। পেয়েছিলেন ট্রাম্প। সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশ সিনিয়র এবং জুনিয়র বুশ- এই ফ্যামিলি প্রকাশ্যেই বলেছিল, তারা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন না। কিন্তু তাতে কিছু হয়নি। ট্রাম্প জিতেছেন। ১২ জন নারী প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, তারা ট্রাম্প কর্তৃক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের ওইসব অভিযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে নেননি ভোটাররা। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি হতে যাচ্ছেন, সেই মেলানিয়া ট্রাম্পের (ট্রাম্পের তৃতীয় স্ত্রী, মডেল) নগ্নছবি ছাপা হয়েছিল দু’মাস আগে নিউইয়র্কের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকায়। কিন্তু মানুষ তা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। মানুষ ট্রাম্পকেই ভোট দিয়েছে! তিনি ১৮ বছর কোনো ট্যাক্স দেন না। অথচ তিনি মিলিয়ন ডলারের মালিক। থাকেন নিউইয়র্কের ফিফথ এভিনিউর ট্রাম্প টাওয়ারে। অথচ ট্যাক্সের ভারে হতাশাগ্রস্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত ট্রাম্পকেই বেছে নিল পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে!
ট্রাম্প অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী। তিনি ২০০০ সালে চেষ্টা করেছিলেন রিফর্ম পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে। এখন তিনিই কিনা রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন! এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কোনো দিক থেকেই ট্রাম্পের সঙ্গে হিলারি ক্লিনটনের তুলনা করা যাবে না। হিলারির গ্রহণযোগ্যতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, দীর্ঘদিন প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা, সফল কূটনৈতিক ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন- কোনো দিক থেকেই কমতি ছিল না। তার পরও তিনি হেরে গেলেন। ইতিহাস অস্বীকার করল একজন নারীকে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট হতে। বেশিদিন আগে নয়, ১৯২০ সালে নারীরা যুক্তরাষ্ট্রে ভোটের অধিকার পেয়েছে। আর এর ৯৬ বছর পর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল একজন নারীর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার। এখন সেই সম্ভাবনাও পিছিয়ে গেল আরও কতদিনের জন্য কে জানে!
কেন এমনটি হল? কেন মানুষ এমন একজন বিতর্কিত মানুষকেই হোয়াইট হাউসে পাঠাল? আগামীতে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সাদা চোখে এ মুহূর্তে যে কারণগুলো পাওয়া যায়, তা হচ্ছে- ১. মানুষ একটি পরিবর্তন চেয়েছে। সাধারণ মানুষ মনে করেছে, একজন ডেমোক্রেটের চেয়ে একজন রিপাবলিকান প্রার্থী তাদের স্বার্থরক্ষা করবে বেশি, ২. যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এখনও একজন নারী প্রেসিডেন্টকে গ্রহণ করার ব্যাপারে অতটা উদার নন, ৩. বর্ণবাদ এখানে অনেক শক্তিশালী। সংবিধানে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা লেখা আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ এ সমাজে অত্যন্ত শক্তিশালী, ৪. হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল কেলেংকারিকে সাধারণ মানুষ তার নেতৃত্বের অদক্ষতা হিসেবেই দেখেছে। এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ৫. নারী ও তরুণ সমাজের সমর্থন হিলারি পেলেও বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ আর গ্রামীণ মানুষের সমর্থন ট্রাম্প পেয়েছেন। সেই সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ কর্মজীবী, যারা গ্রাজুয়েট নন তাদের সমর্থনও নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন ট্রাম্প; ৬. ট্রাম্পের ট্যাক্স রিফর্মকে সাধারণ মানুষ সমর্থন করেছে। তার চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করার প্রস্তাব সমর্থন পেয়েছিল। অন্যদিকে এসব ক্ষেত্রে হিলারির প্রস্তাব ভোটারদের মধ্যে আদৌ কোনো আবেদন তৈরি করতে পারেনি, ৭. ট্রাম্পের প্রচণ্ড অভিবাসীবিরোধী ভূমিকা ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে হিলারি ক্লিনটনের অভিবাসীদের ব্যাপারে একটি ‘সমন্বিত কর্মসূচির’ প্রতিশ্রুতি জনগণ সমর্থন করেনি। ট্রাম্পের মুসলমানবিরোধী ভূমিকাও সমর্থন পেয়েছে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর, ৮. ট্রাম্পের ‘ট্রেড পলিসি’কে মানুষ সমর্থন করেছে। বিশেষ করে তার চীনা ও মেক্সিকান পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের প্রস্তাব ভোটাররা সমর্থন করেছে। টিপিপি চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ চাকরি হারাবে, ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে- ট্রাম্পের এ বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেছে। হিলারির বক্তব্য এ ক্ষেত্রে ছিল অস্পষ্ট, ৯. স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের ‘ওবামা কেয়ার’ অব্যাহত রাখার প্রস্তাব ব্যাপক জনসমর্থন পায়নি। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট, ১০. ট্রাম্পের মেক্সিকানবিরোধী ভূমিকা স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের ওপর আদৌ কোনো প্রভাব ফেলেনি। ফ্লোরিডার কিউবান-আমেরিকানরা প্রকারান্তরে ট্রাম্পকেই সমর্থন করেছে। হিলারি এ সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেননি।
নব্বইয়ের দশক থেকে একটি ধারা লক্ষ করা যায়। দুই টার্মের (৮ বছর) পরই রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে। ক্লিনটন, বুশ ও ওবামা। ডেমোক্রেট, রিপাবলিকান, ডেমোক্রেট। সেই ধারাবাহিকতায় এখন আসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Jugantor
11.11.2016

কোন পথে এখন যুক্তরাষ্ট্র



যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হওয়ার পর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সারা যুক্তরাষ্ট্রে যে জনমত শক্তিশালী হচ্ছে, তাতে করে একটি প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসছে। আর তা হচ্ছে, কোন পথে এখন যুক্তরাষ্ট্র? যুক্তরাষ্ট্রের সময় বৃহস্পতিবার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে হোয়াইট হাউসে দেখা করতে গেছেন, তখন সেখানে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগের রাতে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের আরেক শহরে বিক্ষোভ দেখেছি। ট্রাম্প এই নিউইয়র্ক শহরের বাসিন্দা। তার নিজস্ব ট্রাম্প টাওয়ার (ফিফট এভিনিউ, ম্যানহাটন) এর সম্মুখে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে সিয়াটেল, নিউঅরলিন্স, শিকাগো, ওয়াশিংটন ডিসি, বস্টন, সানফ্রান্সিসকো কিংবা বার্কলের মতো বড় বড় শহরে। বিক্ষোভকারীরা সস্নোগান দিয়েছে 'নো রেসিস্ট ইউএসএ', 'নো ট্রাম্প', 'নো কেকেকে'। কোথাও কোথাও এমন সস্নোগানও ছিল_ 'হে হে গো গো ডোনাল্ড ট্রাম্প হ্যাজ গট টু গো' কিংবা 'ট্রাম্প মেইকস আমেরিকা হেইট।'
এ ধরনের বিক্ষোভ মিছিল নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। তিনি দায়িত্ব নিতে পারলেন না, এর আগেই তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ঘণীভূত হচ্ছে। স্পষ্টতই এ নির্বাচন মার্কিন সমাজকে বিভক্ত করেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাচকম-লীর হিসাব-নিকাশ নিয়েও প্রশ্ন আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচকম-লীর ভোট পেয়েছেন ২৭৯টি (মোট ভোট ৫৩৮), আর হিলারি পেয়েছিলেন ২১৮টি। অথচ 'পপুলার ভোট' হিলারি যেখানে পেয়েছেন ৫৯ দশমিক ৯ মিলিয়ন ভোট, সেখানে ট্রাম্প পেয়েছেন ৫৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ভোট। অর্থাৎ সাধারণ ভোটের দিক থেকে হিলারি বেশি ভোট পেয়েছেন। তবে এটা সত্য ও বাস্তবতা হচ্ছে, এই পদ্ধতি ২০০০ সালে বুশকে তেমনি জিতিয়েছিল, আজও ট্রাম্পকে জেতাল।
ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি বিতর্কিত নাম। এই নামের সঙ্গে কিন্তু সফলতা যেমনি জড়িয়ে আছে, তেমনি অনেক কুকর্মের সঙ্গেও তিনি জড়িত। মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করা, তাদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য, কিশোরী মেয়েদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক_ সব কিছুতেই ট্রাম্প ছিলেন সেরা। সুন্দরী নারীদের তিনি পছন্দ করেন। নারীদের নিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিলেন তিনি। একটি রিয়েলিটি শো তিনি টিভিতে করতেন। দুর্নীতি, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া ইত্যাদিতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। তবে তাকে প্রশংসা করতে হয় এক জায়গাতে। এমনকি তিনি লড়াই করে গেছেন। রিপাবলিকান শিবিরের কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতা তাকে সমর্থন করেননি। তারপরও তিনি হাল ছাড়েননি। এমনকি লড়াই চালিয়ে গেছেন এবং শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য অর্জন করেছেন। অর্থবিত্ত থাকলে মানুষ যে সবকিছু করতে পারে_ ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান এর বড় প্রমাণ। একজন ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া সফল ব্যবসায়ী থেকে সরাসরি প্রেসিডেন্ট। এ ধরনের দৃষ্টান্ত অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। ট্রাম্প বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্নে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেবেন। প্রথমত, মৈত্রী সম্পর্ককে নতুন করে সাজানো। দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আর্থিক তথা বাণিজ্যিক স্বার্থকে বিবেচনায় নেয়া। তৃতীয়ত, একক কর্তৃত্ব পরায়ণ সরকারগুলোর সঙ্গে 'বিশেষ সম্পর্ক' স্থাপন করা। এ তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে তিনি তার পররাষ্ট্রনীতি রচনা করবেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন এরই মধ্যে। তিনি বারবার বলার চেষ্টা করেছেন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বত্র যে ধরনের মৈত্রী বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তিতে আবদ্ধ, তা নতুন করে সাজাতে হবে। ন্যাটোর কথা বলেছেন তিনি। তিনি মনে করেন ন্যাটো এখন অকার্যকর।
ন্যাটো প্রতিষ্ঠা ও ন্যাটোর কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে ব্যয় হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তা এখন সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে বহন করতে হবে। পূর্ব এশিয়ায় ও জাপানের নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, তা এখন ওইসব রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে 'সামরিক সম্পর্কিততা', তা থেকে যুক্তরাষ্ট্র ফিরে আসবে। এশিয়ায় নিয়োজিত সপ্তম ফ্লিটের ব্যয়ভার নেবে ওইসব রাষ্ট্র। সম্ভাব্য রাশিয়ার আক্রমণ থেকে ইউরোপকে রক্ষা করার ও তার নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো জোটের ৫ নম্বর ধারায় যুক্তরাষ্ট্র এই নিরাপত্তা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ন্যাটোভুক্ত যে কোনো একটি দেশে হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা বলে গণ্য করা হয়। ট্রাম্প মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র এই দায়িত্বটি তখন আর নেবে না। পারমাণবিক নিরাপত্তারও কোন গ্যারান্টি দেবে না। পারমাণবিক নিরাপত্তারও কোনো গ্যারান্টি দেবে না। ন্যাটোর পূর্বমুখী সাম্প্রসারণেও তার আপত্তি রয়েছে। ট্রাম্প তাই 'মৈত্রী সম্পর্ক ও নিরাপত্তা গ্যারান্টি সংক্রান্ত' চুক্তিগুলোকে নতুন করে সাজাবেন। এটা যদি তিনি করেন, তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক নতুন করে গড়তে হবে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এটা সত্য, যুক্তরাষ্ট্র এসব 'মৈত্রী ও নিরাপত্তা চুক্তি' বাস্তবায়নে প্রতি বছর বিপুল অর্থ ব্যয় করে। ট্রাম্প চাচ্ছে, এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো আর্থিক দায়ভার বহন করবে না। তিনি এই পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবেন, সে প্রশ্ন ভিন্ন।
ট্রাম্প মূলত ব্যবসায়ী। তার কাছে বাণিজ্যিক লাভটাই বড়। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই লাভের দিকটাকে তিনি বিবেচনায় নেবেন। এ ক্ষেত্রে কতগুলো সম্ভাবনা আছে। ট্রাম্প বিজয়ী হলে তিনি নাফটা চুক্তি থেকে (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য) চুক্তি (স্বাক্ষরিত ও কার্যকর ১৯৯৪) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। টিপিপি চুক্তিকে (১২ দেশের মাঝে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, চিলি ও পেরু) তিনি সমর্থন দেবেন না। তিনি বিশ্ব বাণিজ্যিক সংস্থা থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। টিপিপি চুক্তি নিয়ে বিতর্ক বেশি। মোট ৮০০ মিলিয়ন মানুষ এর আওতাভুক্ত। এর মাধ্যমে ইইউর মতো একক বাজারে পরিণত হওয়ার কথা এই ১২টি দেশের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এখনও টিপিপি চুক্তিতে অনুমোদন দেয়নি। তবে ৪টি দেশ (ব্রুনাই, চিলি, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর) ২০০৬ সাল থেকে টিপিপি চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ট্রাম্প মনে করেন, নাফটা ও টিপিপি চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক লোক চাকরি হারিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তিনি ওই দুটি চুক্তি বাতিল করবেন। শুধু তাই নয়। চীনা পণ্যের ওপর শতকরা ৪৫ ভাগ শুল্ক কর ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ৩৫ ভাগ হারে শুল্ক কর আরোপ করবেন। শিল্পায়নের ধারণাকেও তিনি সমর্থন করেন না। এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে দরিদ্রতা বেড়েছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধ্বংস হয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন। তাই তিনি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তির পক্ষপাতি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ থাকবে বেশি। তিনি পুতিনকে সমর্থন করেন। রাশিয়ার সঙ্গে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। পুতিন এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা রাশিয়ায় প্রবর্তন করেছেন। এটা তার পছন্দ। ট্রাম্পের অতীত রেকর্ড থেকে দেখা যায়, চীনের তিয়েন আন মেন স্কয়ারে চীন যেভাবে ছাত্র আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল (১৯৮৯ সালে), তাকে তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে রাশিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবেন। ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সংযুক্তিকে তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন। তার মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব, মেক্সিকোর সঙ্গে দেয়াল নির্মাণ ইত্যাদি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনের আগে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি তার সমর্থনের ও এই ধর্মের প্রতি তার ভালোবাসার কথা বলেছিলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কার্যক্রম, দক্ষিণ চীন সাগর কিংবা বেক্সিট নিয়ে তার কোনো মন্তব্য আমার চোখে ধরা পড়েনি। আইএসএর সমালোচনা করলেও আইএস উৎখাতে তার কোনো কর্মসূচি নেই। তুলনামূলক বিচারে হিলারি ক্লিনটনের বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের নয়া পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে_ এ প্রশ্ন এখন অনেকের। ইরান ও আসাদ প্রশ্নে তার ভূমিকা কী, সে ব্যাপারেও লক্ষ্য থাকবে অনেকের। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তিনি যদি তা সমর্থন না করেন, তাহলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়বে। যেহেতু আসাদকে সমর্থন করছে রাশিয়া। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার স্বার্থে নতুন একটি ভূমিকা নিতে পারেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী নুসরা ফ্রন্টকে সমর্থন দিয়ে আসছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র সেই সমর্থন কতটুকু অব্যাহত রাখবে, সেটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। একটা জিনিস এখানে মনে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি আর সামরিক নীতি পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতি তাদের স্বার্থ রক্ষা করছে। ফলে ট্রাম্পের শাসনামলে এই সামরিক নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীন। এ ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরে তথা এশীয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উপস্থিতি কমবে না। চীনকে 'ঘিরে ফেলার' নীতি অব্যাহত থাকবে। আর ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও বাড়বে। এ থেকে আমরা কতটুকু উপকৃত হব_ সেটাই দেখার বিষয়।
নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর প্রথম ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি সবার প্রেসিডেন্ট হতে চান। বলেছেন একত্রিত হওয়ার এখনই সময়; কিন্তু তার কথায় মানুষ কতটুকু আস্থা রাখতে পারবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। তার অতীত ভালো নয়। তার বিতর্কিত মন্তব্যসমূহ তিনি প্রত্যাহার করে নেননি। বিভক্ত সমাজকে তিনি কতটুকু আস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবেন_ সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
Daily jai Jai Din15.11.2016
 
   

এককথায় অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হলেন, এটা কেউই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কিন্তু সেটাই ঘটল। সব জনমত জরিপকে মিথ্যা প্রমাণ করে নির্বাচকম-লীর ২৭৯টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে বিজয়ী হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে সঙ্গে রচিত হলো ইতিহাস। এটা কেউ কোনো দিন চিন্তাও করতে পারেনি, রিপাবলিকান রাজনীতির সঙ্গে ২ বছর আগেও যার কোনো সম্পর্ক ছিল না, যিনি কোনো দিন কোনো ‘রাজনৈতিক পদ’ (সিনেটর, প্রতিনিধি পরিষদ, গভর্নর) অলংকিত করেননি, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন! তিনি এখন প্রেসিডেন্ট হলেন। একসময় মনে করা হতো, তিনি আদৌ তার প্রার্থিতা ঘোষণা করবেন না। তিনি করেছিলেন। একসময় মনে করা হতো, দলের প্রাইমারিগুলোতে তার প্রার্থীপদ কর্মীরা সমর্থন করবেন না। কিন্তু করেছিল। যেখানে রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষ নেতা, যেমন মার্কো রুবিও, টেডক্রুস, পল রায়ান, জেব বুশ, বেন কারসনকে মনে করা হতো এদের কেউ একজন রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু কেউ পাননি। পেয়েছিলেন ট্রাম্প। সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশ সিনিয়র এবং জুনিয়র বুশÑ এ ফ্যামিলি প্রকাশ্যেই বলেছিল, তারা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন না। কিন্তু তাতে কিছু হয়নি। ট্রাম্প জিতেছেন। ১১ জন নারী প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, তারা ট্রাম্প কর্তৃক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের ওইসব অভিযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে নেননি ভোটাররা। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্টলেডি হতে যাচ্ছেন, সেই মেলানি ট্রাম্পের (ট্রাম্পের তৃতীয় স্ত্রী, মডেল) নগ্ন ছবি ছাপা হয়েছিল ২ মাস আগে নিউইয়র্কের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকায়। কিন্তু মানুষ তা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। মানুষ ট্রাম্পকেই ভোট দিয়েছে। তিনি ১৮ বছর কোনো ট্যাক্স দেন না। অথচ তিনি বিলিয়ন ডলারের মালিক। থাকেন নিউইর্য়কের ফিফ্থ অ্যাভিনিউর ট্রাম্প টাওয়ারে। অথচ ট্যাক্সের ভারে হতাশাগ্রস্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত ট্রাম্পকেই বেছে নিল পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে। একজন ট্রাম্প, অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী, যিনি ২০০০ সালে চেষ্টা করেছিলেন রিফর্ম পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে, এখন তিনিই কিনা রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন। এই ‘অসম্ভব’কে সম্ভব করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কোনো দিক থেকেই ট্রাম্পের সঙ্গে হিলারি ক্লিনটনকে তুলনা করা যাবে না। হিলারির গ্রহণযোগ্যতা, শিক্ষাগত অভিজ্ঞতা, দীর্ঘদিন প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা, সফল কূটনৈতিক, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনÑ কোনো দিক থেকেই কমতি ছিল না হিলারি ক্লিনটনের। তারপরও তিনি হেরে গেলেন। ইতিহাস অস্বীকার করল একজন নারীকে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট হতে। ১৯২০ সালে মাত্র নারীরা যুক্তরাষ্ট্রে ভোটের অধিকার পেয়েছিল। আর এর ৯৬ বছর পর একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল একজন নারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন। এখন সেই সম্ভাবনাও পিছিয়ে গেল আরও অনেক অনেক বছরের জন্য!
কেন এমনটি হলো? কেন মানুষ এমন একজন বিতর্কিত মানুষকেই হোয়াইট হাউসে পাঠাল? আগামীতে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সাদা চোখে এ মুহূর্তে যে কারণগুলো পাওয়া যায়, তা হচ্ছেÑ ১. মানুষ একটি পরিবর্তন চেয়েছে। সাধারণ মানুষ মনে করেছে, একজন ডেমোক্র্যাটের চেয়ে একজন রিপাবলিকান প্রার্থী তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে বেশি; ২. যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এখনও একজন নারী প্রেসিডেন্টকে গ্রহণ করার ব্যাপারে অতটা উদার নন; ৩. বর্ণবাদ এখানে অনেক শক্তিশালী। সংবিধানে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা লেখা আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ এ সমাজে অত্যন্ত শক্তিশালী, ৪. হিলারি ক্লিনটনের ইমেইল কেলেঙ্কারি সাধারণ মানুষ তার নেতৃত্বের অদক্ষতা হিসেবেই দেখেছে। এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ৫. নারী ও তরুণ সমাজের সমর্থন হিলারি পেলেও বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ আর রুরাল মানুষের সমর্থন ট্রাম্প পেয়েছেন। সেই সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ কর্মজীবী, যারা গ্রাজুয়েট নন, তাদের সমর্থনও নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন ট্রাম্প; ৬. ট্রাম্পের ট্যাক্স রিফর্মকে সাধারণ মানুষ সমর্থন করেছে। তার চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করার প্রস্তাব সমর্থন পেয়েছিল। অন্যদিকে এসব ক্ষেত্রে হিলারির প্রস্তাব আদৌ কোনো আবেদন রাখতে পারেনি; ৭. ট্রাম্পের প্রচ- অভিবাসীবিরোধী ভূমিকা ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল। এক্ষেত্রে হিলারি ক্লিনটনের অভিবাসীদের ব্যাপারে একটি ‘সমন্বিত কর্মসূচি’ জনগণ সমর্থন করেনি। ট্রাম্পের মুসলমানবিরোধী ভূমিকার ব্যাপারেও সমর্থন পাওয়া গেছে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর; ৮. ট্রাম্পের ‘ট্রেড পলিসি’কে মানুষ সমর্থন করেছে। বিশেষ করে তার চীনা ও মেক্সিকান পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব ভোটাররা সমর্থন করেছে। টিপিপি চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ চাকরি হারাবে, ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে, ট্রাম্পের এ বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেছে। হিলারির বক্তব্য এক্ষেত্রে ছিল অস্পষ্ট; ৯. স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের ‘ওবামা কেয়ার’ অব্যাহত রাখার প্রস্তাব ব্যাপক জনসমর্থন পায়নি। এক্ষেত্রে ট্রাম্পের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট; ১০. ট্রাম্পের মেক্সিকানবিরোধী ভূমিকা স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের ওপর আদৌ কোনো প্রভাব ফেলেনি। ফ্লোরিডার কিউবান-আমেরিকানরা প্রকারান্তরে ট্রাম্পকেই সমর্থন করেছিল। হিলারি এই সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেননি। ৯০’র দশক থেকেই একটি ধারা লক্ষ করা যায়। দুই টার্মের (৮ বছর) পরপরই রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে। ক্লিনটন, বুশ ও ওবামা। ডেমোক্র্যাট, রিপাবলিকান, ডেমোক্র্যাট। সেই ধারাবাহিকতায় এখন আসছেন ট্রাম্প। ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি শপথ নেবেন। ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি ক্ষমতায় থাকবেন ২০২০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তার জন্য খারাপ খবর আছে অনেক। তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে সর্বত্র। নারী, সমকামী মানুষ, অভিবাসীরা সবাই বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভের ভাষা যে শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ছিল তা নয়, বরং ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই বিজয় যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের কাছে হেয় করেছে, এমন বক্তব্যও ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’Ñ এ বক্তব্য রেখে জনমতকে তার পক্ষে নিয়ে গেছেন। এসব উসকানিমূলক বক্তব্যে একশ্রেণীর মানুষ অখুশি হয়েছে। সন্দেহ নেই, তার অনেক বক্তব্য সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে। তার মুসলমানবিদ্বেষ, অভিবাসীবিরোধী মনোভাব, হিলারি ক্লিনটনকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা ইত্যাদি নানা ঘটনায় সমাজকে বিভক্ত করেছে। অভিবাসীদের নিয়ে একটা সমস্যা আছে। প্রায় ২০ মিলিয়ন অভিবাসী (শতকরা ৪৭ ভাগ) এখন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। বাকি ৫৩ ভাগ, অর্থাৎ ২২ দশমিক ৪ মিলিয়ন অভিবাসী আইনসিদ্ধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকছেন (গ্রিনকার্ড, ছাত্র, ব্যবসায়ী)। প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ অবৈধ রয়েছেনÑ এটা সত্য। কিন্তু থাকতে পারছেন যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ফাঁকফোকর রয়েছে বিধায়। যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসীদের দেশ। ট্রাম্প ও হিলারি দুইজনই অভিবাসীর সন্তান। ট্রাম্পের দাদা এসেছিলেন (ফ্রেডেরিক ট্রাম্প, ১৮৮৫) জার্মানির রাইনল্যান্ড প্রদেশের কালস্ট্রাড নামক ছোট এক শহর থেকে। আর হিলারির পূর্বপুরুষ এসেছিলেন ওয়েলস ও ফ্রান্স থেকে। এরা পেনসেলভেনিয়ায় শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। দুই পরিবারই অর্থনৈতিক অভিবাসী। সুতরাং অভিবাসী নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য সাজে না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ (৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন) মুসলমান। এই এক ভাগ কখনোই নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্র এখন কোন দিকে যাবে? চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে? দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে? হিলারি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেন। এক্ষেত্রে দক্ষিণ চীন সাগর একটি সমস্যা। স্ট্র্যাটেজিক কারণে দক্ষিণ চীন সাগর যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটা তার সাপ্লাই লাইন। উপরন্তু এখানে রয়েছে প্রচুর জ্বালানি সম্পদ (তেল ও গ্যাস)। মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর বেশ আগ্রহ রয়েছে এ অঞ্চলের ব্যাপারে। চীনেরও আগ্রহ রয়েছে। অতি সম্প্রতি এ অঞ্চলের সমুদ্রসীমার অধিকারের ব্যাপারে ফিলিপাইনের দাবিকে সমর্থন করেছে আন্তর্জাতিক আদালত। চীনের দাবিকে সমর্থন করেনি। তবে চীনের একটা প্লাসপয়েন্ট হচ্ছে, চীন ফিলিপাইনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করেছে। ফিলিপাইনের নয়া প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি চীনে গিয়েছিলেন। তার যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ভূমিকা একটা বড় প্রশ্ন রাখলÑ এ অঞ্চলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আগামীতে কী হবে? যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ অঞ্চল ঘিরেই ওবামা তার ‘চরাড়ঃ ঃড় অংরধ’ পলিসি গ্রহণ করেছিলেন। এখন একজন নয়া প্রেসিডেন্ট কীভাবে এ বিষয়টি দেখবেন, সেটাই দেখার বিষয়। ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। ব্যবসায়িক স্বার্থের পাশাপাশি ভারতের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেক। আগামীতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারেÑ এমন কথাও বলছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচিও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। চীন ৬০টি দেশকে এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির আওতায় আনছে, যার মাঝে মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলোও আছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে একজন নয়া প্রেসিডেন্ট পেন্টাগনের স্বার্থের বাইরে যেতে পারবেন না। মেক্সিকোর সঙ্গে সীমান্তে উঁচু দেয়াল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এর খরচ তিনি বহন করবেন না। অবৈধ মেক্সিকানদের বিরুদ্ধে তিনি গুপ্তহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছিলেন। তিনি এদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে চান। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মেক্সিকানরা একটা বড় অবদান রাখছে। সুতরাং ট্রাম্প এটা অস্বীকার করতে পারবেন না। এমনকি এ সমাজে এমন অনেক কাজ আছে, যা মেক্সিকানদের ছাড়া চলে না। যেমন ধরা যাক, নিউইয়র্কের কথা। এখানে পরিচ্ছন্নতা কর্মী যারা আছেন, তারা প্রচুর অর্থ আয় করেন। এ পেশায় কোনো শ্বেতাঙ্গ আসেন না। গ্র্যাজুয়েট নন, এমন অনেক শ্বেতাঙ্গ আছেন, যারা অন্য কাজ করবেন। কিন্তু পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করবেন না। ফলে নিউইয়র্ক অচল হয়ে যাবে, যদি এই কাজে মেক্সিকানদের পাওয়া না যায়। অবৈধ মেক্সিকানরা আছে, সন্দেহ নেই তাতে। এরা নির্মাণ শ্রমিক হিসেবেই কাজ করছেন। এদের জন্য ট্রাম্প এক ধরনের ‘ওয়ার্ক পারমিট’ চালু করতে পারেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার প্রশাসন কঠোর হবে সন্দেহ নেই তাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ নির্বাচনের ব্যাপারে বাংলাদেশীদেরও যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের স্বার্থ রয়েছে। আমরা জেএসপি সুবিধা এখনও ফিরে পাইনি। ট্রাম্প বাংলাদেশকে জানেন না তেমন একটা। তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন; কিন্তু আমরা জেএসপি ফিরে পাব, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত সুবিধা আমাদের জন্য অন্যতম অগ্রাধিকার। দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের উত্থান রোধে মার্কিন সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। সে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কিংবা নবায়নকৃত জ্বালানি ক্ষেত্রে সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের দরকার। কেরির ঢাকা সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তিও হয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কে এখন দায়িত্ব নেবেন, সেটা আমাদের দেখতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো মানসিকতার অধিকারী কোনো ব্যক্তি যদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হবে না। একটা ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকবে। অর্থাৎ সম্পর্ক যা ছিল, তাই থাকবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তুলনামূলক বিচারে ভারতকে তিনি পছন্দ করবেন বেশি। নিউজার্সিতে হিন্দু কমিউনিটি, যারা বিজেপির সমর্থক, তারা ডোনাল্ডের নির্বাচনী তহবিলে ৯ লাখ ডলার চাঁদা দিয়েছিলেন, আমরা যেন এটা ভুলে না যাই। তবে আমার ধারণা, বৈদেশিক সম্পর্কের চেয়ে তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর বেশি গুরুত্ব দেবেন। বিভক্ত সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার ওপর গুরুত্ব দেবেন তিনি। তবে এতে করে অসন্তোষ কতটুকু দূর হবে, সেটা ভিন্ন কথা। আমরা নতুন বছরে ‘ট্রাম্পের যুগে’ প্রবেশ করতে যাচ্ছি। আর সেই ‘যুগ’টা কেমন হবে, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে মাত্র।হ
নিউইয়র্ক থেকে
Daily Alokito Bangladesh
12.11.2016

ইতিহাস এখন কীভাবে মূল্যায়ন করবে ট্রাম্পকে

 
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়কে (২০১৬) ইতিহাস এখন কীভাবে মূল্যায়ন করবে? ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছেনÑ এ কথা বাংলাদেশের মানুষ ইতোমধ্যে জেনে গেছে। এ নিয়ে বিতর্ক, আলোচন আরও বেশ কিছুদিন অব্যাহত থাকবে। বিভিন্ন সময়ে দেওয়া তার বক্তব্য ইতোমধ্যে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছেয়ে গেছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মানুষ এতে করে অবাক হয়েছে। অনেক বাংলাদেশিকে আমি হতাশ হতে দেখেছি। এক ধরনের অনিশ্চয়তা এখন অনেকের মাঝেই। কী হবে এখন? নির্বাচনের আগে তিনি যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে যা ছিল, তা যদি এখন তিনি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেন তাহলে আগামী দিনের যুক্তরাষ্ট্রকে আমরা কীভাবে দেখব? গত দু-তিন মাস আমি যুক্তরাষ্ট্রে থেকে লক্ষ করেছি, এই সমাজ এক ধরনের ‘বিভক্তি’র মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এখন ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয় কি এই বিভক্তিকে আরও বড় করবে? হাজারটা প্রশ্ন এখন বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে তার এই উত্থানকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে মার্কিন জনগণ, যারা নিজেদের সভ্য জাতি হিসেবে মনে করে, তারা এমন একজনকে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করল যাকে ‘নব্যনাজি’ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মুসোলিনী হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন ইউরোপের কোনো কোনো বিশ্লেষক। এখন যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে লিবারেলিজম : ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা, মানবাধিকার রক্ষা ইত্যাদি যে কথা যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর আমাদের শুনিয়েছে, তা থেকে কি যুক্তরাষ্ট্র বিচ্যুত হতে যাচ্ছে? প্রশ্নটা এই মুহূর্তে করাই যায়। কিন্তু এর জবাবের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক মাস। ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি শপথ নেবেন এবং তার পর তাকে মূল্যায়ন করার কথা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি বিতর্কিত নাম। এই নামের সঙ্গে কিছু কীর্তি যেমনি জড়িয়ে আছে, তেমনি অনেক কুকর্মের সঙ্গেও তিনি জড়িত। মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনষ্টি, তাদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য, কিশোরী মেয়েদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কÑ সবকিছুতেই ট্রাম্প ছিলেন সেরা। সুন্দরী নারীদের তিনি পছন্দ করেন। নারীদের দিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিলেন তিনি। একটি রিয়েলেটি শো তিনি টিভিতে করতেন। দুর্নীতি, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া ইত্যাদিতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম। তার পরও যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। তবে তাকে প্রশংসা করতে হয় এক জায়গায়। একাকী তিনি লড়াই করে গেছেন। রিপাবলিকান শিবিরের কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতা তাকে সমর্থন করেনি। তার পরও তিনি হাল ছাড়েননি। একাকী লড়াই চালিয়ে গেছেন এবং শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য অর্জন করেছেন। অর্থবিত্ত থাকলে মানুষ যে সবকিছু করতে পারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান এর বড় প্রমাণ। একজন ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া সফল ব্যবসায়ী থেকে সরাসরি প্রেসিডেন্টÑ এ ধরনের দৃষ্টান্ত অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। ট্রাম্প বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্নে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেবেন। প্রথমত, মৈত্রী সম্পর্ককে নতুন করে সাজানো। দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আর্থিক তথা বাণিজ্যিক স্বার্থকে বিবেচনায় নেয়া। তৃতীয়ত, একক কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারগুলোর সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ স্থাপন করা। এই তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে তিনি তার পররাষ্ট্রনীতি রচনা করবেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন এরই মাঝে। তিনি বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বত্র যে ধরনের মৈত্রী বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তিতে আবদ্ধ, তা নতুন করে সাজাতে হবে। ন্যাটোর কথা বলেছেন তিনি। তিনি মনে করেন ন্যাটো এখন অকার্যকর। ন্যাটো প্রতিষ্ঠা ও ন্যাটোর কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে ব্যয় হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তা এখন সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে বহন করতে হবে। পূর্ব এশিয়া ও জাপানের নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, তা এখন ওইসব রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘সামরিক সম্পর্ক’ তা থেকে যুক্তরাষ্ট্র ফিরে আসবে। এশিয়ায় নিয়োজিত ৭ম ফিটের ব্যয়ভার নেবে ওইসব রাষ্ট্র। সম্ভাব্য রাশিয়ার আক্রমণ থেকে ইউরোপকে রক্ষা করা ও তার নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো জোটের ৫নং ধারায় যুক্তরাষ্ট্র এই নিরাপত্তা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ন্যাটোভুক্ত যে কোনো একটি দেশে হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা বলে গণ্য করা হয়। ট্রাম্প মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র এই দায়িত্বটি এখন আর নেবে না। পারমাণবিক নিরাপত্তারও কোনো গ্যারান্টি দেবে না। ন্যাটোর পূর্বমুখী সাম্প্রসারণেও তার আপত্তি রয়েছে। ট্রাম্প তাই ‘মৈত্রী সম্পর্ক ও নিরাপত্তা গ্যারান্টিসংক্রান্ত’ চুক্তিগুলোকে নতুন করে সাজাবেন। এটা যদি তিনি করেন, তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক নতুন করে গড়তে হবে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এটা সত্য, যুক্তরাষ্ট্র এসব মৈত্রী ও নিরাপত্তা চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবছর বিপুল অর্থ ব্যয় করে। ট্রাম্প চাচ্ছেন এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো আর্থিক দায়ভার বহন করবে না। তিনি এই পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবেন, সে প্রশ্ন ভিন্ন।
ট্রাম্প মূলত ব্যবসায়ী। তার কাছে বাণিজ্যিক লাভটাই বড়। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই লাভের দিকটাকে তিনি বিবেচনায় নেবেন। এ ক্ষেত্রে কতগুলো সম্ভাবনা আছে। ট্রাম্প বিজয়ী হলে তিনি নাফটা চুক্তি থেকে (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত ও কার্যকর ১৯৯৪) যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন! টিপিপি চুক্তিকে (১২ দেশের মাঝে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। দেশগুলো হচ্ছেÑ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, চিলি ও পেরু) তিনি সমর্থন দেবেন না। তিনি বিশ্ব বাণিজ্যিক সংস্থা থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। টিপিপি চুক্তি নিয়ে বিতর্ক বেশি। মোট ৮০০ মিলিয়ন মানুষ এর আওতাভুক্ত। এর মাধ্যমে ইইউর মতো একক বাজারে পরিণত হওয়ার কথা এই ১২টি দেশের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এখনো টিপিপি চুক্তিতে অনুমোদন দেয়নি। তবে ৪টি দেশ (ব্রুনাই, চিলি, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর) ২০০৬ সাল থেকে টিপিপি চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ট্রাম্প মনে করেন, নাফটা ও টিপিপি চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক লোক চাকরি হারিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তিনি ওই দুটি চুক্তি বাতিল করবেন। শুধু তাই নয়, চিনা পণ্যের ওপর শতকরা ৪৫ ভাগ শুল্ক কর ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ৩৫ ভাগ হারে শুল্ক কর আরোপ করবেন। বিশ্বায়নের ধারণাকেও তিনি সমর্থন করেন না। এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে দরিদ্রতা বেড়েছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধ্বংস হয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন। তাই তিনি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তির পক্ষপাতী, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ থাকবে বেশি। তিনি পুতিনকে সমর্থন করেন। রাশিয়ার সঙ্গে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। পুতিন এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা রাশিয়ায় প্রবর্তন করেছেন। এটা তার পছন্দ। ট্রাম্পের অতীত রেকর্ড থেকে দেখা যায়, চিনের তিয়েন আনমেন স্কয়ারে চিন যেভাবে ছাত্র অসন্তোষকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল (১৯৮৯ সালে), তাকে তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে রাশিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবেন। ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সংযুক্তিকে তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন। তার মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব, মেক্সিকোর সঙ্গে দেয়াল নির্মাণ ইত্যাদি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনের আগে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি তার সমর্থন ও এই ধর্মের প্রতি তার ভালবাসার কথা বলেছিলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কার্যক্রম, দক্ষিণ চিন সাগর কিংবা ব্রেক্সিট নিয়ে তার কোনো মন্তব্য আমার চোখে ধরা পড়েনি। আইএসের সমালোচনা করলেও আইএস উৎখাতে তার কোনো কর্মসূচি নেই।
তুলনামূলক বিচারে হিলারি কিনটনের বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের নয়াপররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এ প্রশ্ন এখন অনেকের। ইরান ও আসাদ প্রশ্নে তার ভূমিকা কী, সে ব্যাপারেও লক্ষ থাকবে অনেকের। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তিনি যদি তা সমর্থন না করেন, তাহলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়বে। যেহেতু আসাদকে সমর্থন করছে রাশিয়া, এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার স্বার্থে নতুন একটি ভূমিকা নিতে পারেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী নুসরা ফ্রন্টকে সমর্থন দিয়ে আসছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র সেই সমর্থন কতটুকু অব্যাহত রাখবে, সেটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। একটা জিনিস এখানে মনে রাখা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি আর সামরিক নীতি পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতি তাদের স্বার্থরক্ষা করছে। ফলে ট্রাম্পের শাসনামলে ওই সামরিক নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরে তথা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উপস্থিতি কমবে না। চিনকে ঘিরে ফেলার নীতি অব্যাহত থাকবে। আর ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও বাড়বে। এ থেকে আমরা কতটুকু উপকৃত হব, সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Amader Somoy
11.11.2016