রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা

 
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে নানা মত ও পথ আছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যেখানে উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মূল স্পিরিটটি থাকছে উপেক্ষিত। এটা সত্য সাধারণ মানুষের সমৃদ্ধি ও সুখের জন্য উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। আবার এটাও সত্য উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে হলে প্রয়োজন রয়েছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা, যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেশ অভাব। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশ বিজয়ের ৪৫ বছর পার করেছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় আমাদের অর্জন তেমন আশাপদ নয়। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা আছে, ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি।’ একই সঙ্গে প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’। এই যে ‘গণতন্ত্র’, গত ৪৫ বছরে এই ‘গণতন্ত্রের’ অনেক উত্থান-পতন আমরা দেখেছি। একদলীয় শাসন, বহুদলীয় শাসন, সামরিক ছদ্মাবরণে গণতন্ত্রের নয়া রূপ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় অ-নির্বাচিত ব্যক্তিদের কর্তৃত্ব- গত ৪৫ বছরে গণতন্ত্রের যে ‘বহুরূপ’ আমরা দেখেছি, তার সাথে ধ্রুপদী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংসদে বিরোধী দল থাকা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি অংশ। এতে করে এক ধরনের ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স’ নিশ্চিত হয়। বিরোধী দল না থাকলে সরকার একদলীয় হয়ে পড়ে এবং সেখানে তখন ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ প্রধান্য পায়। তবে উন্নয়নশীল বিশ্বের কোথাও কোথাও এমন এক ধরনের গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটছে, যেখানে উন্নয়নটাই আসল। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতটা অনেকটা সে রকমই। এটা অনেকেই স্বীকার করছেন যে, ব্রিটেনের ‘ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপ’-এর গণতন্ত্র এ দেশে অচল। আমরা গণতন্ত্র চাই বটে, কিন্তু তাতে দরকার ব্যাপক ঐকমত্য। উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে অনেক ‘মত ও পথ’ নিয়ে একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেখানে অবশ্যই আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানুষের ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি থাকতে হবে। এগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির অস্তিত্ব অর্থহীন। ১৯৭২ সালের সংবিধান আমাদের সেই নিশ্চয়তাটুকু দিয়েছিল বটে, কিন্তু দীর্ঘ ৪৫ বছরের রাজনীতিতে তাতে পরিবর্তন এসেছে। আইনের শাসন আর মানবাধিকারের সঙ্গে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রশ্নটি সরাসরিভাবে জড়িত। আইনের শাসন না থকলে যেমন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয় না, ঠিক তেমনি রাষ্ট্র যদি তার নাগরিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে সে দেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও বলা যাবে না। তাই একটা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে কিংবা গণতন্ত্রকে স্থায়ী একটি রূপ দিতে হলে সে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়গুলো খুবই জরুরি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিনির্মাণ নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন থাকলেও, আমাদের সংবিধানে গণতন্ত্রকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংবিধানে আইনের শাসনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং মানবাধিকার রক্ষার অঙ্গীকারও করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ৮নং অনুচ্ছেদে যে চারটি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, গণতন্ত্র হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। আর ১১নং অনুচ্ছেদে এর পূর্ণ ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের তৃতীয়ভাগে মৌলিক অধিকারের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এতে [১৬(২)] স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোনো আইন প্রণয়ন করিবে না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’ এ অনুচ্ছেদ থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, রাষ্ট্র মানবাধিকার প্রত্যয়টির ব্যাপারে কত গুরুত্ব দিচ্ছে। একই প্রক্রিয়ায় সংবিধানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানে ২৭নং অনুচ্ছেদ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), ৩১নং অনুচ্ছেদ (আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার), ৩২নং অনুচ্ছে (জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ) ৩৬ ও ৩৭নং অনুচ্ছেদ (চলাফেরা ও সমাবেশের স্বাধীনতা), ৪১নং অনুচ্ছেদ (ধর্মীয় স্বাধীনতা), ৪৪নং অনুচ্ছেদ (মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ) অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে সংবিধান বৃহত্তর প্রেক্ষাপট আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছে। যদিও এ ধারার প্রয়োগ, কিংবা ব্যবহার নিয়ে প্রায়শই প্রশ্ন ওঠে। ক্ষমতাসীনরা বরাবরই ‘তাদের স্বার্থে’ সংবিধানের এসব ধারার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো কোনো বিষয়ে উচ্চ আদালতকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নটি এসে যায়। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ছাড়া, তা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো একেবারে খারাপ নয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের ওপরে ধরে রাখা, রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত, দরিদ্রতা কমিয়ে আনা (২৪ ভাগ), তৈরি পোশাকে ৭৭ লাখ উদ্যোক্তা ও ২৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান, শান্তিসূচকে ৯৮তম স্থান, ডিজিটাল স্বাধীনতায় ৬৩তম স্থান (৮৬টি দেশের মধ্যে) ইত্যাদি প্রতিটি সূচক আশার কথা বলে। কিন্তু বড় ব্যর্থতা প্রধান বিরোধী দলকে সরকার আস্থায় নিতে পারেনি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যেখানে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আমরা তা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি (২০১৪) একটি নির্বাচন হয়েছে বটে যেখানে ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ ছিল না। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়েছে। রাজনীতি এখন হয়ে পড়েছে অনেকটা একদলীয়। দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি সমাজের সর্বক্ষেত্রে এত প্রকট যে, গণতন্ত্র এখানে অনেকটা ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’-এর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এমনকি বিরোধী দলের টানা তিন মাসের ‘আন্দোলন’ বাংলাদেশে একটি ‘বোমাবাজির রাজনীতি’র জন্ম দিয়েছিল। এই ‘রাজনীতি’ সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার কথা বলে না। রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবে। কিন্তু সেই ‘বিরোধিতা’ থাকা উচিত কর্মসূচিভিত্তিক। অর্থাৎ কোন দল কোন প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষকে তাদের ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করবে, দলগুলো সেই পরিকল্পনা উপস্থাপন করবে এবং মানুষ তার একটিকে বেছে নেবে। এখানে কোনো কোনো দল সেই কর্মসূচি দিচ্ছে বটে, কিন্তু তাতে রয়ে যাচ্ছে বেশ অস্পষ্টতা। গত ৪৫ বছরের রাজনীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে রাজনীতি মূলত বিভক্ত হয়ে পড়েছে দুটি বড় দলের মাঝে। অর্থাৎ একদিকে রয়েছে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি। তৃতীয় কোনো শক্তি এখানে দাঁড়াতে পারেনি।

দ্বিতীয়ত, একটি ‘কোয়ালিশনের যুগেও’ প্রবেশ করেছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। অর্থাৎ দুটি বড় দলের নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছে দুটি জোট। দক্ষিণপন্থী ও ইসলামপন্থীরা রয়েছে একটি জোটে। অপরদিকে মডারেট, লিবারেল ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সমর্থকরা রয়েছেন দ্বিতীয় জোটে। মাঝখানে বামপন্থীরা কিছুটা সক্রিয় থাকলেও, নির্বাচনী রাজনীতিতে এদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। এরা দুটি বড় দল ও জোটের বাইরে থাকলেও, জোট রাজনীতিতে এদের কোনো ভূমিকা নেই।

তৃতীয়ত, রাজনীতিতে একটি স্পষ্ট ধারা লক্ষণীয়। একটি বড় জোট প্রতিনিধিত্ব করছে বাঙালি সংস্কৃতির, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রাধান্য পাচ্ছে। অন্যদিকে অপর জোট প্রতিনিধিত্ব করছে বাংলাদেশী সংস্কৃতির, যেখানে ইসলাম ধর্মকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। চতুর্থত, পরিপূর্ণভাবে ইসলামী দর্শননির্ভর কিছু রাজনৈতিক দলের জন্ম হলেও, এরা ব্যক্তিনির্ভর এবং সংসদীয় রাজনীতিতে এদের কোনো অবস্থান নেই। পঞ্চমত, বড় দলগুলোর মাঝে রাজনৈতিকভাবে যতটা না বিভক্তি, তার চেয়ে বেশি বিভক্তি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে। এ ‘বিভক্তি’ চলমান রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে। এখানে দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ষষ্ঠত, এক ধরনের ‘পপুলিজম’-এর রাজনীতির জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে একটি বিশেষ মত ও পথে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। এক ধরনের ‘মোহাবিষ্ট’ রাজনীতিতে তারা আকৃষ্ট হচ্ছে। রাজপথে তারা সক্রিয় হচ্ছে। বিরোধী পক্ষকে সহ্য না করার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে এবং প্রায় ক্ষেত্রে রাজনীতি একটি নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত হচ্ছে। এ ‘পপুলিজম’ সারা বিশ্বেই দেখা যায়, যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিপন্থী। সপ্তমত, আস্থার সম্পর্ক একদমই গড়ে ওঠেনি। মাঝে মধ্যে দু-একটি ঘটনা (এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ৫ম সংসদে ১৯৯২ সালে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন) উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও, অচিরেই তা ম্লান হয়ে যায়। এখানে ‘এক পক্ষ অপর পক্ষকে সহ্য না করার মানসিকতা’ নিয়ে রাজনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমাজ।

দীর্ঘ ৪৫ বছর একটা জাতির জন্য একেবারে কম সময় নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আমরা সাংবিধানিকভাবে গ্রহণ করে নিয়েছি বটে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দল, জাতীয় নেতারা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে ধারণ করেন না। ফলে গণতন্ত্রের মূল স্পিরিটটি রয়েছে উপেক্ষিত। দীর্ঘ ৪৫ বছরে আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। একটি শক্তিশালী তরুণ প্রজন্মের জন্ম হয়েছে, যাদের কাছে একটি ‘আদর্শিক সমাজ’ আমরা এখনও উপস্থাপন করতে পারিনি। আস্থা ও বিশ্বাসের রাজনীতির অভাবে আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। এ আস্থা ও বিশ্বাস যদি স্থাপন করতে না পারি, যদি পরস্পরকে ঘৃণা করার মানসিকতা পরিত্যাগ করতে না পারি, তাহলে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না এবং গণতন্ত্রকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি দিতে পারব না এ দেশে।
Daily Jugantor
01.02.2017

সার্চ কমিটি আস্থা পূরণ করতে পারবে কি


সার্চ কমিটি গঠিত হওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে ওই কমিটি সাধারণ মানুষের আস্থা পূরণ করতে পারবে কি? একটি ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য এই সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি গত শনিবার প্রথম বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো মঙ্গলবার ৫ জন করে নামের তালিকা জমা দেবে। তাদের ভেতর থেকে সার্চ কমিটি ৫টি নাম বেছে নেবে। আশার কথা, বিএনপিও একটি নামের তালিকা দেবে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি নয়া নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায় নিজেদের জড়িত করল। এতে সার্চ কমিটির গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু থাকবে, তা এক প্রশ্ন বটে। ইতোমধ্যে সার্চ কমিটি কেন্দ্র করে বড় দুটি দল পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘আক্রমণ’ শুরু করে দিয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল আমাদের জানালেন, সার্চ কমিটির ৫ সদস্যই বিতর্কিত। তিনি সার্চ কমিটির সদস্যদের নাম উল্লেখ করে পর্যন্ত বলেছেন, তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা আছে। একটি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে জানা গেল আরও একটি তথ্যÑ সার্চ কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ড. শিরীন আখতার কক্সবাজার জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের কার্যকর পরিষদের সদস্য। টিভি চ্যানেলটি আরও জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ড. শিরীন আখতারের পরিচয়ও দেওয়া আছে। ওই পরিচয়টি সরকার সমর্থক সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল ওই অনুষ্ঠানেই পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন ড. শিরীন আখতারকে। ড. শিরীন আখতার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেল থেকে কার্যনির্বাহী সদস্যপদে বিজয়ী হয়েছিলেন। তার বাবা ছিলেন কক্সবাজার আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আরেক শিক্ষকও আছেন ওই কমিটিতেÑ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সদ্য অবসরে গেছেন তিনি। তার সম্পর্কে মির্জা ফখরুল কোনো মন্তব্য করেননি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানেন, তিনি সজ্জন ও গুণী ব্যক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে তিনি ‘সরাসরি’ জড়িত না থাকলেও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মির্জা ফখরুল এক বিচারপতির পারিবারিক ইতিহাস নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এখন অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসা ওই সার্চ কমিটি নিয়ে। প্রথমত, বিএনপি সার্চ কমিটির ব্যাপারে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করলে এবং আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, বাংলাদেশ এখনো ওই ‘দোষারোপের রাজনীতি’র বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। বিএনপিকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আখ্যায়িত করেছেন, ‘বাংলাদেশ নালিশ পার্টি’ হিসেবে। তিনি কখনো ‘ফালতু’ কথা বলেন না। যুক্তিসঙ্গত কথা বলেন। তার ভাষা থাকে সংযত ও মার্জিত। সেই ওবায়দুল কাদের যখন বিএনপিকে বাংলাদেশ নালিশ পার্টি হিসেবে আখ্যায়িত করে বসলেন, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে কোথায়? দ্বিতীয়ত, সার্চ কমিটিতে থাকাটাই বড় কথা নয়। যেহেতু কথা উঠেছে, সেহেতু ড. শিরীন আখতার এবং ওই বিচারপতি ‘বিব্রত’ হয়ে কমিটি থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিতে পারতেন। কিন্তু তারা তা করেননি। আমরা তো অনেক সময় দেখি, উচ্চ আদালতে কোনো মামলা শুনানিতে কোনো কোনো বিচারপতি ‘বিব্রত’ হন। তাই এ ধরনের দৃষ্টান্ত তো আছে। ড. শিরীন আখতার কমিটিতে থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন। তৃতীয়ত, উচ্চ আদালতে সার্চ কমিটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট করা হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার, মানুষের মনে সন্দেহ আছে এর আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামো নিয়ে। আমরা এর আগে এবং আমি একটি টিভি চ্যানেলে বলেছিলাম, সার্চ কমিটির কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। তবে অতীতে ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি একবার সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন। ২০১৭ সালে আরও একবার হলো। ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ নামে একটা ব্যাখ্যা আছে। বিচারপতিরা মাঝে মধ্যে এর প্রয়োগ করে থাকেন। এখন বিচারপতিরা ওই রিটের মীমাংসা করবেন কীভাবে, তা জানি না। তবে এটি তো সত্য, সাংবিধানিক কোনো ভিত্তি না থাকলে রিট করা যায় না। চতুর্থত, পত্রপত্রিকায় বেশকিছু নাম এসেছেÑ যাদের বিবেচনা করা হচ্ছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে। তাদের মধ্যে দুইজন আবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আমলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। এখন তাদের মধ্যে একজন যদি ঘটনাক্রমে সিইসি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে যান, তাহলে রাজনৈতিক বলটি ঠেলে দেওয়া হবে বিরোধী দলের দিকে। তারা এটিকে পুঁজি করবেন। ফলে কোনো অবস্থাতেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সিইসি অথবা নির্বাচন কমিশনার (ইসি) হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া ঠিক হবে না। সার্চ কমিটির সদস্যরা নিশ্চয়ই এটি বিবেচনা করবেন। আমরা চাই কম বিতর্ক। পঞ্চমত, সার্চ কমিটি সুশীল সমাজের সঙ্গে কথা বলেছে রোববার। উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সুশীল সমাজের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে কতটুকু কার্যকর হবে? তারা মূল ফ্যাক্টর নন। বরং রাজনৈতিক দলগুলোই মূল ফ্যাক্টর। তাদের মতামতকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেনÑ যারা আদৌ নির্বাচনী ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখেন না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য হলেই তিনি সব জানবেন, তা তো নয়। তারা কী ভূমিকা রাখবেন, এ প্রশ্ন আমার থাকলই। তবে সাবেক সিইসি, দুই কমিশনার, অপর দুই ব্যক্তিÑ যারা নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেন, তাদের সার্চ কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। ষষ্ঠত, একটু ভিন্ন মেজাজের একটি নির্বাচন কমিশন এবার গঠিত হোক। এ ক্ষেত্রে আমার বিবেচনায় এবং সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমার প্রস্তাব নিম্নরূপÑ
সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন এক অফিসারকে (মেজর জেনারেল পদমর্যাদার অধিকারী) সিইসি পদে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হোক। সেনাবাহিনীর অফিসাররা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে কাজ করেন। রাষ্ট্রদূত হিসেবে আছেন বেশ কয়েকজন। যুক্তিটা হচ্ছে, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসাররা বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকেন। অনেক বড় রড় ‘কাজ’ তারা সাফল্যের সঙ্গে শেষ করেছেন। বিতর্ক তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে একটা সমস্যা হতে পারে। সিইসি ৫ বছরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। তাকে শপথ নিতে হবে। চাকরিকালীন কোনো সেনা কর্মকর্তা এটি নাও করতে পারেন। এ অবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত এক মেজর জেনারেলকেÑ যিনি রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করেননি, সার্চ কমিটি এ রকম এক সৎ, দক্ষ, নিরপেক্ষ ও ডেডিকেটেড সিনিয়র অফিসার খুঁজে বের করতে পারে। বাকি চার জনকে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি এক আমলা, সুশীল সমাজের এক প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র অধ্যাপক, এক সিনিয়র আইনজীবী অথবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া যেতে পারে।
যে কমিশনটি হতে যাচ্ছে, এর গুরুত্ব অনেক। ওই কমিশনকেই ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। আমরা চাই, একটি নির্বাচন হোকÑ যাতে সব দল অংশ নেবে। কোনো একটি দল যেন নির্বাচন বয়কট করতে না পারে। এ জন্য নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থাটা রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে (সংবিধানের ১১৮-৪ ধারা)। সমস্যা হচ্ছে স্বাধীনতার ব্যবহার নিয়ে। রকীব কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করতে পারেনি। তাই যারা আসবেন, তাদের নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে। এখন দেখার পালা, সার্চ কমিটি কাদের নাম প্রস্তাব করে।
সার্চ কমিটিকে একটি সুযোগ দেওয়া উচিত। দেখা যাক, সার্চ কমিটি কাদের নাম সুপারিশ করে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এটিইÑ সার্চ কমিটি কোনো বিতর্কিত ব্যক্তিকে সুপারিশ করবে না। যদিও ২০১২ সালে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে দিয়েই প্রথম সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং তারা রকীব উদ্দিনকে সিইসি পদে সুপারিশ করেছিলেন। তাদের অভিজ্ঞতা খুব সুখের হয়নি। সমসাময়িককালে রকীব কমিশন বিতর্কিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফলে সাধারণ মানুষ চাইবে না দ্বিতীয় আরেকটি ‘রকীব কমিশন’ গঠিত হোক। ফলে সার্চ কমিটির কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি।
আমরা চাই, এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হোক। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠুক। এই আস্থার সম্পর্ক গড়ে না উঠলে বারবার সংকটের জন্ম হবে। সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে প্রধান বিরোধী দল। তখন প্রধান বিরোধী দলের নানা সমালোচনায় মুখর থাকবে সরকারি দল। আমরা গণতন্ত্র চাই বটে কিন্তু ভুলে যাই। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থা স্থাপনের নামই গণতন্ত্র। ওই গণতন্ত্র এখন বাংলাদেশে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সার্চ কমিটি নিয়ে যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল, তা যেন ভেস্তে না যায়। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনও যেন না থাকে একটি প্রশ্নের মুখে। ইতোমধ্যে দাতাগোষ্ঠী আবার সক্রিয় হয়েছে। দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে চান। আগামী নির্বাচন নিয়েই তারা কথা বলতে চান। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনের বিষয়টি একান্তভাবেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। বাংলাদেশের সংবিধানে এ ব্যাপারে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে। তাই ‘বাইরের কোনো শক্তি’র এ ব্যাপারে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আস্থার সম্পর্কে ঘাটতি থাকায় সুযোগ নিচ্ছেন দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনে যদি কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি থাকেন ও বিএনপি তাদের প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে জটিলতা বাড়বে এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে। এ জন্য সার্চ কমিটির দিকে তাকিয়ে আছে জাতি। সার্চ কমিটিতে বেশ কয়েক ব্যক্তি আছেনÑ যাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। তারা নিশ্চয়ই এমন কোনো নাম সুপারিশ করবেন নাÑ যাতে বিতর্কটা আরও বেড়ে যায়। জাতি এক কঠিন সময় পার করছে। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) পুনরাবৃত্তি হোকÑ এটি কেউই আমরা চাই না।
Daily Amader Somoy
31.01.2017

সার্চ কমিটি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আস্থার ঘাটতি

গত ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। ৬ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিশন আগামী ১০ কর্ম দিবসের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কশিনারদের নাম প্রস্তাব করবেন। প্রস্তাবিত নামগুলোর মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি একজন সিইসি ও  চারজন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন। বর্তমানে যে কমিশন আছে, তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে ৯ ফেব্রুয়ারি। নয়া সিইসি ও কমিশনাররা দায়িত্ব নেবেন এরপর। কিন্তু সার্চ কমিটি নিয়েও প্রশ্ন তুলল বিএনপি। বিএনপির মহাসচিব জানিয়েছেন, সার্চ কমিটি গঠনে তার দল ‘হতাশ এবং ক্ষুব্ধ।’ এই বক্তব্য একটা ভিন্ন  মেসেজ এখন পৌছে দিতে পারে। এখন এই কমিটি যাদের নাম প্রস্তাব করবে, তারাও বিতর্কিত হয়ে যেতে পারে।  এক  কঠিন সময়ে নয়া কমিশন দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। কেননা তারাই ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে। ফলে নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিএনপিকে আস্থায় নিতে হবে। আস্থায় নিতে না পারলে আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নিবন্ধিত দলগুলোর আলোচনায় যে ধরনের প্রস্তাব পাওয়া গিয়েছিল তার ভিত্তি ধরেই এই সার্চ কমিটি গঠিত হলো। তবে সরকার এখন একটি আইন করতে যাচ্ছে যেখানে সিইসি তথা কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া উল্লেখ থাকবে। তবে এবার এটি হলো না। আগামী কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে এই আইনটি কার্যকর হবে। বিএনপি মহাসচিব তার দলের হতাশার কথা বললেও তিনি স্পষ্ট করে বলেননি কেন তার দল হতাশ। ৬ জন সদস্যের মধ্যে দু’জন আছেন শিক্ষাবিদ। তারা আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে যিনি পিএসসির চেয়ারম্যান তিনি এর আগে নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন তিনিই ‘সম্পন্ন’ করেছেন। ওই নির্বাচন একটি বড় বিতর্কের জš§ দিয়েছিল বাংলাদেশে। ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন, যা সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই নির্বাচন আয়োজন ও সম্পন্ন করার ব্যাপারে যিনি জড়িত ছিলেন তিনি যখন সার্চ কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন তখন বিতর্ক বাড়ে বৈকি! যিনি সার্চ কমিটির প্রধান নিযুক্ত হয়েছেন, তিনি এর আগেও সার্চ কমিটির প্রধান ছিলেন। তাকে নিয়ে অথবা অপর বিচারপতিকে নিয়েও প্রশ্ন তোলা যাবে না। মহাহিসাব নিরীক্ষক বিতর্কের বাইরে।
রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যখন আলোচনা করছিলেন, তখনই সার্চ কমিটির প্রস্তাব আসে। সেই সঙ্গে একটি আইন প্রণয়ন করারও দাবি ওঠে যা গত ৪৪ বছরে হয়নি। একজন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি উঠেছিল যা এবার রাখা হয়েছে। সুতরাং রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা বা উপস্থাপন করা যাবে না। রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র সাংবিধানিক ধারা অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ তিনি সংবিধানের ১১৮নং ধারা ও ৪৮নং ধারা অনুসরণ করেছেন। ৪৮ (৩)নং ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন পুনঃগঠনের ব্যাপারে তিনি যাই করুন না কেন, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ করেই তিনি তা করবেন। তিনি তা করেছেনও। অর্থাৎ সার্চ কমিটির নামের তালিকা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পরই তার সম্মতি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। আওয়ামী লীগ বারবার বলে আসছিল সার্চ কমিটি গঠিত হবে সংবিধানের আলোকেই। বিএনপি তো এটা জানতই যে সার্চ কমিটি গঠনেও প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির প্রয়োজন আছে। এখন কমিটি ১০ দিনের মাঝে তাদের নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবে। তবে এটা স্পষ্ট নয় সার্চ কমিটি সিইসি পদে একাধিক ব্যক্তি এবং ৪ জন কমিশনারের বিপরীতে ৮ জন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে কি না? রাষ্ট্রপতিকে সুযোগ দিতে হবে এবং সে কারণে একাধিক ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা উত্তম। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই দলগত দ্বন্দ্ব, একদল কর্তৃক অন্য দলকে সহ্য না করার মানসিকতা এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে কোনো একটি ক্ষেত্রেও কোনেন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি গঠন করলেন। তাও ‘বিতর্কিত’ হয়ে গেল এবং আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এবং দায়িত্ব নেবেন তাদেরকও বিতর্কিত করা হবে। এই ‘বিতর্কের’ ভয়ে অনেক শুভবুদ্ধির মানুষ নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হবেন না। সম্মানের ভয়ে কেউই আসতে চাইবেন না। ফলে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে বটে কিন্তু এই কমিশন একাদশ সংসদ নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে তা নিয়েও একটা শঙ্কা রয়ে গেল।
একটি ‘গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে’ নির্বাচন প্রয়োজন। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) একটি নির্বাচন হয়েছিল বটে কিন্তু ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এরপর থেকে দাতাগোষ্ঠী বারবার বলে আসছে ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচনের কথা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না।’ জানি না প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের সভায় কথাটা এভাবেই বলেছিলেন কিনা। বাস্তবতা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটা ভালো ছিল না। এর জন্য যে বক্তব্যই দেয়া হোক না কেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন এ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনটাও এমন দেখতে চাই না। একটি নির্বাচন হবে এবং তাতে সব দল অংশ নেবে, এটাই কাম্য। সেজন্যই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বটি অনেক বেশি। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। সমস্যা হচ্ছে স্বাধীনতার ব্যবহার নিয়ে। রকিব কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করতে পারেননি। সুতরাং যারা আসবেন তাদের নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে। এখন দেখার পালা সার্চ কমিটি কাদের নাম প্রস্তাব করে।
সংলাপের এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন বড় দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার। এটাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বড় সমস্যা। প্রতিটি ইস্যুতে মতপার্থক্য খুব বেশি। সার্চ কমিটি গঠনের প্রশ্নেও এই মতপার্থক্য দেখা গেল। তবুও আশা করব সার্চ কমিটি যাদের নাম রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য প্রেরণ করবে, তাদের নিয়ে বিতর্ক হবে না। কিংবা রাজনৈতিকভাবে যারা পরিচিত, তাদের নাম প্রস্তাব করবে না। সাবেক কোন আমলাকে সিইসি পদে প্রস্তাব না করাই মঙ্গল। সেক্ষেত্রে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নাম প্রস্তাব করা যেতে পারে। কমিশনার হিসেবে শিক্ষাবিদরা অথবা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও আসতে পারেন। সাবেক জেলা জজ কিংবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসাররাও যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না রকিব কমিশন এর বড় প্রমাণ। তাই সার্চ কমিটির দায়িত্ব অনেক বেশি। ১০ দিন সময়টা খুব বেশি নয়। ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে সার্চ কমিটি সবার কাছে নাম চাইতে পারে। অর্থাৎ দলগুলো নাম জমা দেবে। এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ১০ দিনের মধ্যে এটা কতটুকু করা সম্ভব হবে আমি নিশ্চিত নই। তবে সার্চ কমিটি গঠনের ব্যাপারে বিএনপি যে প্রস্তাব দিয়েছিল ওই প্রস্তাবগুলোকে সামনে রেখে সার্চ কমিটি একটি তালিকা তৈরি করতে পারে। এমনকি বিএনপি কোনো ব্যক্তির নাম না দিয়ে একটি কাঠামোর ধারণা দিতে পারে। প্রস্তাব করতে পারে, যা সার্চ কমিটি বিবেচনায় নিতে পারে। যেমন সিইসির ক্ষেত্রে একজন সাবেক বিচারপতি, একজন সাবেক আমলা অথবা সেনাবাহিনীর একজন সাবেক মেজর জেনারেলের অন্তর্ভুক্তির কাঠামো প্রস্তাব করতে পারে। সার্চ কমিটি সেখান থেকে কয়েকটি নাম বিবেচনায় নিতে পারে। এমনকি নামগুলো নিয়ে বিএনপির সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনায়ও হতে পারে। সেই সঙ্গে ৪ জন কমিশনারের একটি ‘কাঠামোও’ দিতে পারে, যেখান থেকে কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করা হবে। সেক্ষেত্রে একজন দলনিরপেক্ষ শিক্ষাবিদ, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে।
যে ৬ জনকে নিয়ে সার্চ কমিটি হয়েছে তার মাঝে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি তার বক্তব্যে নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি অনেকটা ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সার্চ কমিটিতে অন্তুর্ভুক্ত হওয়ার জন্য। তার বক্তব্য পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। এতে করে কি তার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না? অধ্যাক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম গুণী ব্যক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে তিনি একটি পক্ষের মানুষ। যদিও সিরিয়াসলি তিনি কখনো শিক্ষক রাজনীতি করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার সমর্থিত নীল দলের সমর্থক তিনি। তার ইন্টিগ্রিটি বা গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও প্রেসিডেন্টের এই মনোনয়ন তাকে বিতর্কিত করতে পারে। ড. সাদিকের অতীত ইতিহাস খুব উজ্জ্বল নয়। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচনের সময় তিনি ছিলেন নির্বাচন কমিশনের সচিব। ফলে তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে, তা একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। দুজন বিচারপতির বাইরে সরকারের মহাহিসাব নিরীক্ষক একজন সরকারি আমলা ড. সাদিকের মতো। যদিও তিনি শপথ নিয়েছেন এবং সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত। কিন্তু তারপরও সরকারের প্রভাবের বাইরে তিন কতটুকু যেতে পারবেন, সে প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারেন। তারপরও সার্চ কমিটিকে একটি সুযোগ দেয়া উচিত। দেখা যাক সার্চ কমিটি কাদের নাম সুপারিশ করে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এটাই যে, সার্চ কমিটি কোনো বিতর্কিত ব্যক্তিকে সুপারিশ করবে না। যদিও ২০১২ সালে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে দিয়েই প্রথম সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং তারা রকিব উদ্দিনকে সিইসি পদে সুপারিশ করেছিলেন। তাদের অভিমত খুব সুখের হয়নি। সমসাময়িককালে রকিব কমিশন বিতর্কিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফলে সাধারণ মানুষ চাইবে না দ্বিতীয় আরেকটি ‘রকিব কমিশন’ গঠিত হোক। সার্চ কমিটির কাছে তাই প্রত্যাশা অনেক বেশি।
আমরা চাই এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হোক। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠুক। এই আস্থার সম্পর্ক গড়ে না উঠলে বারবার সংকটের জš§ হবে। সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে প্রধান বিরোধী দল। আমরা গণতন্ত্র চাই বটে কিন্তু ভুলে যাই পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থা স্থাপনের নামই গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্র এখন বাংলাদেশে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সার্চ কমিটি নিয়ে যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল তা ভেস্তে গেল। ফলে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনও থাকল একটি প্রশ্নের মুখে। ইতোমধ্যে দাতাগোষ্ঠী আবার সক্রিয় হয়েছে। দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে চান। আগামী নির্বাচন নিয়েই তারা কথা বলতে চান। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনের বিষয়টি একান্তভাবেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের সংবিধানে এ ব্যাপারে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে। সুতরাং বাইরের কোনো ‘শক্তির’ এ ব্যাপারে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘আস্থার সম্পর্কে’ ঘাটতি থাকায় সুযোগ নিচ্ছে দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনে যদি কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি থাকেন এবং বিএনপি যদি তাদের প্রত্যাখ্যান করে তাহলে জটিলতা বাড়বে এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও একটা অশ্চিয়তার মধ্যে থাকবে। তাই সার্চ কমিটির দিকে তাকিয়ে আছে সারা জাতি। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই তারা সিইসি তথা কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করবে এটিই সবার প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে সিইসি হিসেবে কারো নাম প্রস্তাব না করে দশজনের নামের একটি তালিকা তারা জমা দিতে পারে। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে একজন সিইসি ও চারজন কমিশনার নিয়োগ দিতে পারেন। চলতি ২০১৭ সালটি শুরু হলো একটি অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। এখন দেখার পালা সামনের দিনগুলো কেমন যায়। Daily Manobkontho 30.01.2017

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নয়া বিশ্বব্যবস্থা

যুক্তরাষ্ট্রের নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে কেমন হবে নয়া বিশ্বব্যবস্থা? যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আনবেন তিনি? ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার পর এমন প্রশ্ন এখন সর্বমহলে আলোচিত হচ্ছে। একটা শঙ্কা আছে সর্বমহলে।
আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট থেকে শুরু করে খোদ তাঁর নিজ শহর আটলান্টিকের এপারে নিউ ইয়র্কে তাঁর শপথগ্রহণের দিন ও পরের দিন ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নারীদের নিয়ে ট্রাম্পের বিরূপ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রায় ১০ লাখ মানুষের প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিল উইমেন মার্চ, প্রায় ৮০টির মতো সংগঠনের একটি মোর্চা। এরই মধ্যে তিনি শুধু বিতর্কেরই জন্ম দেননি, বরং সাংবাদিকদের সঙ্গে হোয়াইট হাউসের একটি ব্যবধানও তিনি তৈরি করে ফেলেছেন। সাংবাদিকদের তিনি চিহ্নিত করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে অসৎ ব্যক্তি হিসেবে। সমসাময়িক মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে কম গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেছেন। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা মাত্র ৪০ শতাংশ। অথচ ওবামা যখন দায়িত্ব নেন (২০০৯) তখন তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল ৭৯ শতাংশ। বুশের (২০০১) ছিল ৬২ শতাংশ, ক্লিনটনের (১৯৯৩) ৬৮ শতাংশ (ওয়াশিংটন পোস্ট ও এবিসি পোল, জানুয়ারি ১২-১৫, ২০১৭)। এটা যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্টের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। শুধু তা-ই নয়, ক্যাবিনেটকে তিনি ধনীদের ক্লাবে পরিণত করেছেন। মন্ত্রিসভায় যাঁদের নাম তিনি প্রস্তাব করেছেন, তাঁদের মধ্যে ১৪ শতাংশ হচ্ছে বিলিয়নেয়ার। অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলার সম্পদ রয়েছে এ সংখ্যা একাধিক। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, ওবামা ও বুশের আমলে কোনো বিলিয়নেয়ার মন্ত্রী ছিলেন না। শপথ নেওয়ার পর তিনি যে ভাষণ দেন, তা নীতিনির্ধারণী ভাষণ না হলেও, তাতে তাঁর পররাষ্ট্রনীতির কিছুটা দিকনির্দেশনা আছে। যেমন—ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাঁর কট্টর অবস্থান কিংবা ‘স্বপ্নের যুক্তরাষ্ট্র গড়ার’ তাঁর প্রত্যয়ের কথা প্রমাণ করে তিনি সম্ভবত ওবামা প্রশাসনের আমলে গৃহীত নীতি থেকে সরে আসছেন। ফলে তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে কিছুটা নতুনত্ব থাকবে, এমনটাই আশা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা ৯টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন, যেখানে ট্রাম্প পরিবর্তন আনবেন। এই ৯টি জায়গা বা ক্ষেত্র হচ্ছে—১. ইসলামিক স্টেটের ক্ষেত্রে, ২. আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে, ৩. উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি, ৪. ইউক্রেনে সংকট ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক, ৫. চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ও সম্ভাব্য একটি বাণিজ্য যুদ্ধ, ৬. ইউরোপীয় ঐক্যের প্রশ্নে তাঁর অবস্থান, ৭. ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতার ভবিষ্যৎ, ৮. ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন প্রশ্নে তাঁর ভূমিকা এবং ৯. মেক্সিকোর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। তিনি ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট’—এই স্লোগান তুলে বিজয়ী হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ২৪ মিলিয়ন চাকরির ব্যবস্থা করবেন। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪-এ নিয়ে যাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ‘অটোমেশনের’ কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এখন ১৮ শতাংশ লোক কম লাগে। ‘আউটসোর্সিং’-এর মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বাইরে থেকে এনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। ফলে চাকরির ব্যবস্থা করার কথা বলা যত সহজ, বাস্তব ক্ষেত্রে অত সহজ নয়। তিনি শপথ নেওয়ার পর উদ্বোধনী ভাষণে এ বিষয়ে তেমন নতুন কিছু শোনাননি। তিনি বারাক ওবামা ও তাঁর স্ত্রীর প্রশংসা করেছেন। এটা তাঁর বদান্যতা। তাঁর উদ্বোধনী বক্তব্যে শঙ্কা আছে, আশার কথাও আছে। তিনি আবারও আশার কথা শুনিয়েছেন। স্বপ্নের যুক্তরাষ্ট্র গড়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন। বলেছেন, তাঁর কাজ হবে সবার ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান দেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা।
বিশ্বায়নের এই যুগে তিনি বিশ্বায়নের বিরোধিতা করেছেন। বিশ্বায়ন হচ্ছে বর্তমান যুগের বাস্তবতা। এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ‘সবার ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান’ দেবেন কিভাবে? বিশ্বায়নের এই যুগে তিনি যদি একলা চলতে চান, তাহলে তিনি পিছিয়ে যাবেন। তাঁর যেকোনো সংরক্ষণবাদী নীতি তাঁকে সামনে নয়, বরং পেছনের দিকে ঠেলে দেবে। চীন তার নিজস্ব আঙ্গিকে ‘চীনা মডেলের বিশ্বায়ন’ শুরু করেছে। চীন আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় তার বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির আওতায় মধ্য এশিয়ার তেল ও জ্বালানি সম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলোকে এক পতাকাতলে নিয়ে আসছে। চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশও ওই কর্মসূচিকে সমর্থন করেছে। ফলে ‘চীনা বিশ্বায়ন’ নতুন একটি মাত্রা নিয়ে এসেছে একুশ শতকে। এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি এই ‘চীনা বিশ্বায়নে’ নিজেকে সম্পৃক্ত না করে, তাহলে খোদ যুক্তরাষ্ট্রই পিছিয়ে পড়বে। সম্প্রতি ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং। সেখানে একটি অনুষ্ঠানে তিনি জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন মডেলের একটি সম্পর্ক শুরু করতে চায় পেইচিং; যদিও এই নয়া সম্পর্ক নিয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি। তবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যে আগামী দিনে অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে থাকবে সে ব্যাপারে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। এরই মধ্যে ইউরোপ, এমনকি জার্মানি সম্পর্কে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তা তাঁকে আরো বিতর্কিত করেছে। জার্মানিতে ১০ লাখ সিরীয় অভিবাসীকে সে দেশে আশ্রয় দেওয়ার ঘটনাকে ট্রাম্প আখ্যায়িত করেছিলেন ‘সর্বনাশা ভুল’ হিসেবে। জার্মানরা এটা পছন্দ করেনি। জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেল এর প্রতি উত্তরে বলেছিলেন তাঁদের ভাগ্য তাঁদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, তাঁদের বাইরের কোনো লোকের উপদেশের প্রয়োজন নেই। ট্রাম্প ন্যাটোকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘সেকেলে’ হিসেবে। এটা নিয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোয় এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প ব্রেক্সিটকে সমর্থন করেছিলেন। ব্রিটেন এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে।   ইউরোপীয় অন্যান্য রাষ্ট্র ব্রিটেনকে অনুসরণ করুক—এটাও ট্রাম্প চান। ফলে ইইউয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে ট্র্যাডিশনাল সম্পর্ক, তাতে এখন একটি অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে।
নির্বাচনে বিজয়ের পর তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর ‘ফোনালাপ’ একটি সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীনা নীতি’ পরিত্যাগ করতে পারে! চীন বিষয়টাকে খুব সহজভাবে নেয়নি। চীন তার ‘টুইটার কূটনীতি’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তবে একটা বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন রেস্কু টিলারসন, যিনি হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। টিলারসন বলেছেন, দক্ষিণ চীন সাগরে চীন যে কৃত্রিম দ্বীপ বানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সেখানে চীনাদের যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া। এর প্রতিবাদে চীন বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি তা করে, তাহলে তা এক ‘ভয়ংকর সংঘাতে’ রূপ নেবে। তবে রাশিয়া সম্পর্কে তিনি বরাবরই নরম মনোভাব দেখিয়ে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্র ওবামার শাসনামলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এমনকি রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এখন পরিস্থিতি কি বদলে যাবে? নির্বাচনের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি রাশিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারের পক্ষে। ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর টেলিফোনে ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের কথা হয়েছিল। এ দুজনের ফোনালাপকে তখন ‘গভীর বন্ধুত্বের সুর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা ও বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের (স্নায়ুযুদ্ধ-২) জন্ম হয়েছিল। আর রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছিল।
এখন কি যুক্তরাষ্ট্র তার এই অবস্থানে পরিবর্তন আনবে? এতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে? যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে, বিশেষ করে পেন্টাগনে যেসব কট্টরপন্থী রয়েছেন, তাঁরা কি ‘রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার’ এ প্রবণতাকে মেনে নেবেন? সিনিয়র জেনারেলদের ভূমিকাই বা কী হবে এখন? রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র ‘মৈত্রী’ কি ইতিহাসকে আবার স্মরণ করিয়ে দেবে? দ্বিতীয় ইয়াল্টার কি জন্ম হচ্ছে? পাঠক স্মরণ করতে পারেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ইউরোপের ভূমিকা কী হবে—এটা নিয়ে আলোচনার জন্য ইয়াল্টায় (১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি) চার্চিল (যুক্তরাজ্য), রুজভেল্ট (যুক্তরাষ্ট্র) ও স্তালিন (সোভিয়েত ইউনিয়ন) এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সেই পরিস্থিতি কি তাহলে আবার ফিরে আসছে? এ ক্ষেত্রে যেকোনো রুশ-মার্কিন ‘ঐক্য’ সিরিয়ার পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলবে? আসাদ এরই মধ্যে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সম্ভাব্য এই ‘ঐক্য’ আসাদকে আরো কিছুদিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দেবে মাত্র। কিন্তু তাতে যুদ্ধ সেখানে থামবে বলে মনে হয় না; যদিও ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আসাদবিরোধী নুসরা ফ্রন্টকে (পরিবর্তিত নাম জাবহাত ফাতেহ আল শাম) অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবেন না। কিন্তু তাতে  কি আইএসকে ধ্বংস করা সম্ভব হবে? অনেকেই জানেন, আইএস পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘সহযোগিতা’ পেয়ে থাকে। ট্রাম্পের সময় আইএস কি তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে? এ ক্ষেত্রে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এক ধরনের ‘স্নায়ুযুদ্ধ’-এর জন্ম হবে! ট্রাম্প যদি সত্যি সত্যি ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি সমর্থন করতে অস্বীকার করেন, তাহলে ইরান এই ‘স্নায়ুযুদ্ধের’ আশঙ্কাকে উসকে দেবে। আল-কায়েদা কিংবা আইএসের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো এতে  সুবিধা নেবে মাত্র। তিনি শপথ নেওয়ার পর প্রথম ভাষণে ‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদের’ বিরুদ্ধে পুরনো জোটকে শক্তিশালী করা, প্রয়োজনে নতুন জোট গঠন করার কথাও বলেছেন। এর অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার। আইএসবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সিরিয়া প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া ঐক্য হতে পারে। কাজাখস্তানে গত ২৩ জানুয়ারি সিরিয়াসংক্রান্ত একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। রাশিয়ার ভূমিকা এখানে মুখ্য।
আমরা ধারণা করছি, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প ১০০ দিনের একটি পরিকল্পনার কথা জানাবেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তাঁর নিজের অজ্ঞতা এবং তাঁর প্রশাসনে যথেষ্ট যোগ্য লোকের অভাব থাকায় আগামী দিনের যুক্তরাষ্ট্রের একটা ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত কপ-২১ চুক্তি (যা প্যারিসে ও জাতিসংঘে স্বাক্ষরিত হয়েছে) সমর্থন না করা, কিউবার সঙ্গে ‘সমঝোতা’কে অস্বীকার করা, চীনের সঙ্গে এক ধরনের ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’, ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ কমিয়ে আনা, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমাঝোতাকে অস্বীকার, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাতিল ইত্যাদি আগামী দিনে বিশ্বে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে না। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে। এখন আমাদের দেখতে হবে তাঁর এই ‘রাজনীতি’ একুশ শতকের তৃতীয় দশকে যুক্তরাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যায়। ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো সিদ্ধান্ত বিশ্বে বড় পরিবর্তন ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট। দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় ট্রাম্প তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে চলেছেন। ওবামাকেয়ার ও টিপিপি চুক্তি তিনি এরই মধ্যে বাতিল করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে, বাকি প্রতিশ্রুতিগুলোও তিনি এক এক করে বাস্তবায়ন করবেন। ফলে বিশ্বরাজনীতিতে তিনি যে একটি বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন, তা বলাই যায়।
Daily Kalerkontho
30.01.2017

সার্চ কমিটি কি আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট

শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। সংবিধানের ১১৮(১) ধারা মতে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি যে অধিকার ভোগ করেন, সে অধিকার বলেই রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি গঠন করলেন। এই সার্চ কমিটি এখন সম্ভাব্য সিইসি ও কমিশনারদের নামের একটি তালিকা তৈরি করে রাষ্ট্রপতিকে দেবেন। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে একজনকে সিইসি ও চারজনকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেবেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে ৯ ফেব্রুয়ারি। সুতরাং এর আগেই সার্চ কমিটিকে নামের একটি তালিকা তৈরি করে রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য পাঠাতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন আছে অনেকগুলো। সার্চ কমিটি কতগুলো নামের তালিকা তৈরি করবে বটে; কিন্তু তাতে করে কী দুইটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাটি এখনও সুদূরপরাহত। কেননা, যেদিন সার্চ কমিটির নাম ঘোষিত হয়, সেদিনই বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়ে দিলেন, এরা আওয়ামী লীগের পছন্দের লোক। আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো আরেকটি নির্বাচন করতে চায় এমন অভিযোগও মীর্জা ফখরুলের। এর অর্থ পরিষ্কার। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করে এবং তার ওপর আস্থা রাখার কথা বললেও, বিএনপি সার্চ কমিটি গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অভিযোগটি উত্থাপন করল। তবে আশার কথা, বিএনপি এই সার্চ কমিটি প্রত্যাখ্যান করেনি। রাজনীতিতে দুইটি বড় দলের মাঝে যে বিভক্তি, সেই বিভক্তি সর্বশেষ সার্চ কমিটি গঠনের পরও কমল না। রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবে, সেটাই কাম্য ও সঠিক। কিন্তু সেই ‘বিরোধিতা’ থাকা উচিত কর্মসূচিভিত্তিক। অর্থাৎ কোন দল কোন প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষকে তাদের ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করবে, দলগুলো সেই পরিকল্পনা উপস্থাপন করবে এবং মানুষ তার একটিকে বেছে নেবে। এখানে কোনো কোনো দল সেই কর্মসূচি দিচ্ছে বটে; কিন্তু তাতে রয়ে যাচ্ছে বেশ অস্পষ্টতা। ৪৫ বছরের রাজনীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, রাজনীতি মূলত বিভক্ত হয়ে পড়েছে দুইটি বড় দলের মাঝে। অর্থাৎ একদিকে রয়েছে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি। তৃতীয় কোনো শক্তি এখানে দাঁড়াতে পারেনি। একটি ‘কোয়ালিশনের যুগেও’ প্রবেশ করেছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। অর্থাৎ দুইটি বড় দলের নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছে দুইটি জোট। দক্ষিণপন্থী ও ইসলামপন্থীরা রয়েছে একটি জোটে। অন্যদিকে মডারেট, লিবারেল ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সমর্থকরা রয়েছেন দ্বিতীয় জোটে। মাঝখানে বামপন্থীরা কিছুটা সক্রিয় থাকলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে এদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। এরা দুটি বড় দল ও জোটের বাইরে থাকলেও জোট রাজনীতিতে এদের কোনো ভূমিকা নেই। রাজনীতিতে একটি স্পষ্ট ধারা লক্ষণীয়। একটি বড় জোট প্রতিনিধিত্ব করছে বাঙালি সংস্কৃতির, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রাধান্য পাচ্ছে। অন্যদিকে অপর জোট প্রতিনিধিত্ব করছে বাংলাদেশী সংস্কৃতির, যেখানে ইসলাম ধর্মকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। পরিপূর্ণভাবে ইসলামী দর্শননির্ভর কিছু রাজনৈতিক দলের জন্ম হলেও এরা ব্যক্তিনির্ভর এবং সংসদীয় রাজনীতিতে এদের কোনো অবস্থান নেই। বড় দলগুলোর মাঝে রাজনৈতিকভাবে যতটা না বিভক্তি, তার চেয়ে বেশি বিভক্তি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে। এই ‘বিভক্তি’ চলমান রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে। এখানে দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এক ধরনের ‘পপুলিজম’ এর রাজনীতির জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে একটি বিশেষ মত ও পথে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। এক ধরনের ‘মোহবিষ্ট’ রাজনীতিতে তারা আকৃষ্ট হচ্ছে। রাজপথে তারা সক্রিয় হচ্ছে। বিরোধী পক্ষকে সহ্য না করার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে এবং প্রায় ক্ষেত্রে রাজনীতি একটি নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত হচ্ছে। এই ‘পপুলিজম’ সারা বিশ্বেই দেখা যায়, যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিপন্থী। ‘আস্থার সম্পর্ক’ একদমই গড়ে উঠেনি। মাঝেমধ্যে দুই-একটি ঘটনা (এরশাদবিরোধী আন্দোলন, পঞ্চম সংসদে ১৯৯২ সালে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন) উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও অচিরেই তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এখানে ‘এক পক্ষ অপর পক্ষকে সহ্য না করার মানসিকতা’ নিয়ে রাজনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমাজ।
দীর্ঘ ৪৫ বছর একটা জাতির জন্য একেবারে কম সময় নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আমরা সাংবিধানিকভাবে গ্রহণ করে নিয়েছি বটে; কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দল, জাতীয় নেতৃবৃন্দ গণতন্ত্রিক সংস্কৃতিকে ব্যক্তিগতভাবে ও দলীয়ভাবে ধারণ করেন না। ফলে গণতন্ত্রের মূল স্পিরিটটাই রয়েছে উপেক্ষিত। দীর্ঘ ৪৫ বছরে আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। একটি শক্তিশালী তরুণ প্রজন্মের জন্ম হয়েছে, যাদের কাছে একটি ‘আদর্শিক সমাজ’ আমরা এখনও উপস্থাপন করতে পারিনি। ‘আস্থা ও বিশ্বাসের রাজনীতি’র অভাব আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। এ আস্থা ও বিশ্বাস যদি স্থাপন করতে না পারি, যদি পরস্পরকে ‘ঘৃণা’ করার মানসিকতা পরিত্যাগ করতে না পারি, তাহলে আমরা আমাদের লক্ষে পৌঁছতে পারব না এবং গণতন্ত্রকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি দিতে পারব না এ দেশে। সর্বশেষ ঘটনায় এটা আবারও প্রমাণিত হলো যে, আমাদের মাঝে বিভক্তি কত বেশি। সার্চ কমিটি গঠন কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নয়। সংবিধানে এ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা নেই। তারপরও রাষ্ট্রপতি করেছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানও এরকম একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন ২০১২ সালে। ওই কমিটির মাধ্যমেই কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সমসাময়িককালে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ছিল রকিব কমিশন। তার নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল, যখন পৌর নির্বাচনের এক পর্যায়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন। অতি সম্প্রতি তিনি নিজেকে ‘সফল’ বলে দাবি করেছেন, যা তাকে আরও বিতর্কিত করেছে। ফলে সার্চ কমিটিও যে ‘ভালো কমিশন’ ও ‘গ্রহণযোগ্য কমিশন’ উপহার দিতে পারে না, সেটা প্রমাণিত হয়েছিল।
এবারের সার্চ কমিটি নিয়ে বিএনপি প্রশ্ন তুলেছে। ছয় সদস্যবিশিষ্ট যে কমিটি, তাতে দুইজন রয়েছেন বিচারপতি। দুইজন সাংবিধানিক পদের অধিকারী সরকারি কর্মকর্তা, দুইজন শিক্ষাবিদ। দুইজন শিক্ষাবিদ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। এরা দুইজন আওয়ামী লীগ ঘরানার শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী ঘরানার লোকদের সার্চ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত না করা হলে ভালো হতো। তবে দুইজন বিচারপতি ও একজন সাংবিধানিক পদের অধিকারী ব্যক্তিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। রাষ্ট্রপতি নিবন্ধিত প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছেন। ১৮ জানুয়ারি এই সংলাপ শেষ হয়েছে। সংলাপে তিনটি বিষয় উঠে আসে। এক. একটি সার্চ কমিটি গঠন, যারা নির্বাচন কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করবেন, দুই. একটি আইন প্রণয়ন করা, তিন. সার্চ কমিটিতে একজন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা। রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়েই এই সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। সুতরাং রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। তবে এটাও সত্য, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ধারাই অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ তিনি সংবিধানের ১১৮ নং ধারা ও ৪৮(৩) নং ধারা অনুসরণ করেছেন। ৪৮ অনু (৩) নং ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের ব্যাপারে তিনি যাই করুন না কেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই তিনি তা করবেন। তিনি তা করেছেনও। অর্থাৎ সার্চ কমিটির নামের তালিকা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পরই তার সম্মতি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। আওয়ামী লীগ বারবার বলে আসছিল, সার্চ কমিটি গঠিত হবে সংবিধানের আলোকেই। বিএনপি তো এটা জানতই যে, সার্চ কমিটি গঠনেও প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির প্রয়োজন আছে। এখন কমিটি ১০ দিনের মধ্যে তাদের নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবে। তবে এটা স্পষ্ট নয়, সার্চ কমিটি সিইসি পদে একাধিক ব্যক্তি এবং চারজন কমিশনারের বিপরীতে ৮ ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে কিনা? রাষ্ট্রপতিকে সুযোগ দিতে হবে এবং সে কারণে একাধিক ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা উত্তম। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই দলগত দ্বন্দ্ব, একদল কর্তৃক অন্য দলকে সহ্য না করার মানসিকতা এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে, কোনো একটি ক্ষেত্রেও কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।
রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি গঠন করলেন। তাও ‘বিতর্কিত’ হয়ে গেল! এবং আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এবং দায়িত্ব নেবেন, তাদেরও বিতর্কিত করা হবে। এ ‘বিতর্কের’ ভয়ে অনেক শুভবুদ্ধির মানুষ নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হবেন না। সম্মানের ভয়ে কেউই আসতে চাইবেন না। ফলে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে বটে; কিন্তু এ কমিশন একাদশ সংসদ নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে, তা নিয়েও একটা শঙ্কা রয়ে গেল। একটি গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন প্রয়োজন। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) একটি নির্বাচন হয়েছিল বটে; কিন্তু ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এরপর থেকে দাতাগোষ্ঠী বারবার বলে আসছে, ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচনের কথা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না।’ জানি না, প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের সভায় কথাটা এভাবেই বলেছিলেন কিনা। বাস্তবতা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটা ভালো ছিল না। এর জন্য যে বক্তব্যই দেয়া হোক না কেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনটাও এমন দেখতে চাই না। একটি নির্বাচন হবে এবং তাতে সব দল অংশ নেবে, এটাই কাম্য। সে জন্যই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বটি অনেক বেশি। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, স্বাধীনতার ব্যবহার নিয়ে। রকিব কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করতে পারেনি। সুতরাং যারা আসবেন, তাদের নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে। এখন দেখার পালা কমিশন কাদের নাম প্রস্তাব করে।
সংলাপের এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, বড় দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার। এটাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বড় সমস্যা। প্রতিটি ইস্যুতে মতপার্থক্য খুব বেশি। সার্চ কমিটি গঠনের প্রশ্নেও এই মতপার্থক্য দেখা গেল। তবুও আশা করব, সার্চ কমিটি যাদের নাম রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য প্রেরণ করবে, তাদের নিয়ে বিতর্ক হবে না। কিংবা রাজনৈতিকভাবে যারা পরিচিত, তাদের নাম প্রস্তাব করবেন না। সাবেক কোনো আমলাকে সিইসি পদে প্রস্তাব না করাই মঙ্গল। সে ক্ষেত্রে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নাম প্রস্তাব করা যেতে পারে। কমিশনার হিসেবে শিক্ষাবিদরা অথবা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও আসতে পারেন। সাবেক জেলা জজ কিংবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসাররাও যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না, রকিব কমিশন এর বড় প্রমাণ। তাই সার্চ কমিটির দায়িত্ব অনেক বেশি।
Daily Alokito Bangladesh
29.01.2017

ট্রাম্প আমলে কেমন হবে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক


ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন এক সপ্তাহের উপরে। এরই মধ্যে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন এবং তাতে করে ওবামা প্রশাসনের আমলে গৃহীত কয়েকটি সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে। এর একটি হচ্ছে ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত স্বাস্থ্যসেবা স্থগিতাদেশ সংক্রান্ত একটি নির্বাহী আদেশ। অপরটি হচ্ছে টিপিপি বা ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ নামে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি থেকে সরে আসা। নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প বারবার বলে আসছিলেন- তিনি নির্বাচিত হলে এগুলো বাতিল করবেন। এখন তিনি তার কথা রেখেছেন। যদিও ওবামা প্রশাসনের আমলে টিপিপি স্বাক্ষরিত (১২ দেশের মধ্যে) হলেও মার্কিন কংগ্রেসে অনুমোদিত না হওয়ায় তা তখন আইনে পরিণত হয়নি। এখন ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভাব্য সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই টিপিপির প্রসঙ্গ এসে যায়।

ট্রাম্প চুক্তিটি বাতিল করায় বাংলাদেশের এতে লাভই হল। আমি এর আগে যুগান্তরে আমার কলামে উল্লেখ করেছিলাম, টিপিপি যদি কার্যকর হয়, তাহলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কেননা চুক্তিটি কার্যকর হলে ভিয়েতনাম শুল্কমুক্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক নিয়ে প্রবেশ করত। এর ফলে ঝুঁকির মুখে থাকত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। এখন চুক্তিটি বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত লাভবান হবে। এখানে বলা ভালো, টিপিপি ছিল একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছিল। এতে মোট ১৮ হাজার পণ্যের শুল্ক হ্রাস করার কথা ছিল। চুক্তিটি কার্যকর হলে বিশ্ব বাণিজ্যের একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করত এই জোট। বিশ্বের মোট জিডিপির ৪০ ভাগ ছিল এই চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর হাতে (মোট জিডিপি ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার)। অভিযোগ উঠেছিল, এ চুক্তির ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লাভবান হবে। তারা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। চুক্তিবদ্ধ কোনো দেশের জাতীয় স্বার্থ যদি ক্ষুণ্ণ হয়, তাহলেও ওই চুক্তির বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা যাবে না। ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা এতে লাভবান হবে না। বেকার সমস্যা বাড়বে। চাকরি চলে যাবে অন্যত্র। তাই ট্রাম্প এটি বাতিল করলেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো কোনো দেশ ইতিমধ্যেই নিজেদের মধ্যে এ চুক্তি বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে। এ দেশগুলো এখন কী করবে? এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে যে চুক্তি, তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আমাদের একটা উৎকণ্ঠার জায়গা ছিল এই টিপিপি। এখন এটি বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশে স্বস্তি ফিরে আসবে।

তবে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক শুধু একটি চুক্তি বাতিলের ওপর নির্ভর করবে না। বেশ কিছু ইস্যুতে দু’দেশের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। ট্রাম্প জমানায় এ সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা দেখার বিষয়। বাংলাদেশের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। ১৯৭২ সালেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এরপর থেকে গত ৪৪ বছরে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। তবে সেই সঙ্গে এটাও সত্য, দুই দেশের মাঝে কোনো বড় ধরনের বিরোধ না থাকলেও কোনো কোনো ইস্যুতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক নয়। তৈরি পোশাকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জিএসপি সুবিধা পায় না। এ নিয়ে বাংলাদেশে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে এবং বাংলাদেশ মনে করে বিষয়টি সম্পূর্ণ ‘রাজনৈতিক’। বাংলাদেশে আইএসের তথাকথিত উত্থান নিয়ে দু’দেশের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বাংলাদেশে আইএস আছে, এটা বাংলাদেশের স্বীকার করা উচিত। অথচ বাংলাদেশ মনে করে, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই। তবে আইএসের সমর্থক কিছু জঙ্গি সংগঠন থাকতে পারে, যারা এ দেশে বিদেশীসহ বেশকিছু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। মার্কিন দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল অফিসার জুলহাস ও তার ‘বন্ধু’ তনয় হত্যাকাণ্ডের পর দেশে গত বছর এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। ঢাকায় নিশা দেশাই যে মন্তব্য করেছিলেন, যে কোনো বিবেচনায় তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তখন বলেছিলেন, জুলহাস-তনয় হত্যাকাণ্ডে আইএস যেভাবে দায় স্বীকার করছে, তা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। অর্থাৎ নিশা দেশাইয়ের ভাষায়, বাংলাদেশ স্বীকার করে নিক এ দেশে আইএস আছে! তবে জঙ্গি দমনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকবে এমন কথাও তিনি বলে গিয়েছিলেন।

এর আগে জিএসপি সুবিধা বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশ বিষয়টি সহজভাবে নেয়নি। রানা প্লাজা ও তাজরিন গার্মেন্টসে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা জিএসপি সুবিধা বাতিলের পেছনে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। এই কর্মপরিকল্পনা পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে, এটা বলা যাবে না। অসংখ্য নারী শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এর প্রভাব পড়ে জিএসপি সুবিধা বাতিলের ক্ষেত্রে। যদিও এটা সত্য, শুধু তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ বেশি। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে আমরা ১৫ দশমিক ৬২ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অবস্থান ধরে রেখেছি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে এখন ভিয়েতনাম। আর এই ভিয়েতনামের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র গেল বছর টিপিপি স্বাক্ষর করেছিল। এই চুক্তির আওতায় ভিয়েতনাম শুল্কমুক্তভাবে তার তৈরি পোশাক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে পারত। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঝুঁকির মুখে থাকত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা ভালো, চীনের পরই ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বড় রফতানিকারক। অর্থাৎ চীন বেশি রফতানি করে। তারপর ভিয়েতনাম। পরিসংখ্যান বলছে, তৈরি পোশাকে ভিয়েতনামের রফতানি বাড়ছে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হারে। টিপিপি’র ফলে এটা আরও বাড়ার সম্ভাবনা ছিল। ২০১৫ সালেই ভিয়েতনাম পোশাক রফতানি খাতে ২৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। দেশটি ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সামগ্রিক রফতানি ৫০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। টিপিপি বাতিলের ফলে এটি কতটুকু সহজ হবে বলা মুশকিল। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে সমস্যা রয়েছে। দেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ব্রিটেন এখন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। গেল বছর গণভোটে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন যুক্তরাজ্যকে সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে। ফলে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আলাদা একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। অন্যত্র আমাদের বাজার খুঁজতে হবে। টিপিপি না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের চাহিদা আরও বাড়বে। আমাদের যেতে হবে বৈচিত্র্যে, ফ্যাশনে। বাংলাদেশ তার রফতানি বাড়াতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি বাড়াতে হলে তাকে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে হবে। আর জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে হলে ওয়াশিংটনে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন যেহেতু বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে এবং প্রতিটি দেশের স্বার্থকে আলাদা করে দেখতে চায়, সেহেতু বাংলাদেশ তার যৌক্তিক দাবিটি ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে উপস্থাপন করতে পারে। এ জন্য ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসকে আরও তৎপর হতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল নতুন প্রশাসনের সঙ্গে ‘সম্পর্ক তৈরির’ ব্যাপারে ওয়াশিংটন ডিসি সফর করতে পারে। কংগ্রেস সদস্যদের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করা জরুরিও বটে।

জিএসপি সুবিধা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সালে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে ধনী দেশগুলো ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার শর্ত কার্যকর করতে রাজি হয়েছিল। এতে করে এমন একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, অনুন্নত বিশ্ব পশ্চিমা উন্নত দেশে তাদের রফতানি পণ্যের আওতা বাড়াতে পারবে। তবে একটা প্রশ্ন ছিল পণ্যের মান ও উৎস নির্ধারণ নিয়ে। এ দুটো বিষয় নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল আমদানিকারক দেশগুলোর হাতে। হংকং সম্মেলনের দীর্ঘ ৮ বছর পর ২০১৩ সালের ৩-৭ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সর্বশেষ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক)। বালি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বটে; কিন্তু ‘বালি ঘোষণায়’ কোন পক্ষ কী পেল, কিংবা বাণিজ্যবৈষম্যের শিকার অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন হবে কিনা, সে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। বাস্তবে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নগুলোই আবারও উত্থাপিত হয়েছে। আমাদের জিএসপি সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাকে কোনো জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে না। তারপরও অন্যান্য পণ্যে যতটুকু সুবিধা পেত বাংলাদেশ, তাও গত জুন (২০১৩) থেকে স্থগিত রাখা হয়েছে। জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। এক. শ্রমমান, দুই. শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ তদন্ত ও বিচার, তিন. ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। ঢাকায় টিকফার প্রধান বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্র আকার-ইঙ্গিতে এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল।

শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ‘রুলস অব অরিজিনের’ কঠিন শর্তে আটকে আছে। ধনী দেশগুলো এটা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের মোট রফতানির ৬১.৩ ভাগ জিএসপি সুবিধার আওতায়। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে মোট রফতানির প্রায় ৬০ ভাগ সুবিধা ব্যবহার করতে পারছে বাংলাদেশ। বলা ভালো, বাংলাদেশের মোট রফতানির ৭৮ ভাগ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এ তৈরি পোশাকের ৬০ ভাগ যায় ইউরোপে, আর ২৫ ভাগ যুক্তরাষ্ট্রে। তৈরি পোশাক আমাদের আয়ের অন্যতম উৎস হলেও এ খাতের সঙ্গে জড়িত নানা ‘প্রশ্নের’ ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা ও বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করতে পারেনি। দরকষাকষিতে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। আমলানির্ভর আমাদের মন্ত্রণালয়ের আমলারা ‘বিদেশ সফর’, ‘সম্মেলনে অংশগ্রহণ’ ইত্যাদিকেই প্রাধান্য দেন বেশি। এখানে দক্ষ জনশক্তির বড় অভাব। বিজিএমইএ দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারেনি। তাদের গবেষণা সেলও শক্তিশালী নয়। শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধার সঙ্গে ‘রুলস অব অরিজিন’, ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ ও ‘কাউন্টারভেইলিং ব্যবস্থা’, প্রেফারেন্স ইরোসন, শ্রমমান ইত্যাদি নানা টেকনিক্যাল প্রশ্ন জড়িত। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায়ও আমরা এসব প্রশ্নে শক্ত অবস্থানে যেতে পারিনি।

বাংলাদেশ যখন জিএসপি সুবিধায় আটকে আছে, তখন ‘আকসা’ ও ‘সোফা’ চুক্তির ব্যাপারেও কোনো সমাধান হয়নি। ওবামা প্রশাসনের আমলে সোফা (Status of Forces Agreement) এবং আকসা (Acquisition and Cross Servicing Agreement) এ দুটো চুক্তি করতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। দুটোর ক্ষেত্রেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বেশি। এই চুক্তি দুটোর বলে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসদস্যরা ভিসা ছাড়া বাংলাদেশে আসা, অবস্থান, প্রোটোকল সুবিধা ইত্যাদি পাবে। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তারা যদি কোনো ক্রিমিনাল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়, তাদের বাংলাদেশে বিচার করা যাবে না। বাংলাদেশ এসব কারণেই ওই দুটো চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়নি। এখন এটা স্পষ্ট নয়, বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন এ ধরনের চুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাবে কিনা। তবে আগামী দিনগুলোতে মার্কিন স্ট্র্যাটেজিতে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব বাড়বে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ফলস্বরূপ এ অঞ্চলে ভারতকেন্দ্র্রিক যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তা আরও শক্তিশালী হবে। ভারতকে সঙ্গে নিয়ে চীনবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স গড়ার যে উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছিল, তা ট্রাম্প পরিত্যাগ করবেন বলে মনে হয় না। এ কারণেই ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব থাকবেই। ইতিমধ্যে ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে একটা বার্তা তিনি দিলেন। ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থও রয়েছে। এটা ট্রাম্প অস্বীকার করতে পারবেন না। ট্রাম্প তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, এখন আমরা আমাদের স্বার্থ কতটুকু আদায় করতে পারব, সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Jugantor
29.01.2017

ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক কোন পথে যাবে

গেল শুক্রবার ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে প্রশ্নটি এখন বড় করে দেখা হচ্ছে, তা হলো ট্রাম্পের শাসনামলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে কি বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে? সাম্প্রতিক এ দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে কোনো বড় ধরনের ‘বিরোধ’ না থাকলেও কোনো কোনো ইস্যুতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক নয়। তৈরি পোশাকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে কোনো জিএসপি সুবিধা পায় না। এটা নিয়ে বাংলাদেশে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে এবং বাংলাদেশ মনে করে, বিষয়টি সম্পূর্ণ ‘রাজনৈতিক’। বাংলাদেশে তথাকথিত আইএসের উত্থান নিয়ে দুই দেশের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, বাংলাদেশে আইএস আছে, এটা বাংলাদেশের স্বীকার করা উচিত। অথচ বাংলাদেশ মনে করে, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই। তবে আইএসের রাজনীতি সমর্থক কিছু জঙ্গি সংগঠন থাকতে পারে, যারা বিদেশিসহ বেশ কিছু হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত। মার্কিন দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল অফিসার জুলহাস ও তার ‘বন্ধু’ তনয় হত্যাকা-ের পর গেল বছর বাংলাদেশে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। ঢাকায় নিশা দেশাই   যে মন্তব্য করেছিলেন তা যে কোনো বিবেচনায় ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তখন বলেছিলেন, জুলহাস-তনয় হত্যাকা-ে আইএস যেভাবে দায় স্বীকার করছে, তা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। অর্থাৎ নিশা দেশাই’র ভাষায়, বাংলাদেশ স্বীকার করে নিক এ দেশে আইএস আছে। তবে জঙ্গি দমনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকবে, এমন কথাও তিনি বলে গিয়েছিলেন। এর আগে জিএসপি সুবিধা বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশ বিষয়টি সহজভাবে নেয়নি।
রানা প্লাজা ও তাজরীন গার্মেন্টে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা জিএসপি সুবিধা বাতিলের পেছনে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। ওই কর্মপরিকল্পনা পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে, এটা বলা যাবে না। অসংখ্য নারী শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এর প্রভাব পড়ে জিএসপি সুবিধা বাতিলের ক্ষেত্রে। যদিও এটা সত্য, শুধু তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ বেশি। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে আমরা ১৫ দশমিক ৬২ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অবস্থান ধরে রেখেছি। এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে ভিয়েতনাম। আর এ ভিয়েতনামের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র গেল বছর টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি করেছিল। এ চুক্তির আওতায় ভিয়েতনাম শুল্কমুক্তভাবে তার তৈরি পোশাক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে পারত। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঝুঁকির মুখে থাকত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা ভালো, চীনের পরই ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বড় রফতানিকারক দেশ। অর্থাৎ চীন বেশি রফতানি করে। তারপর ভিয়েতনাম। পরিসংখ্যান বলছে, তৈরি পোশাকে ভিয়েতনামের রফতানি বাড়ছে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হারে। এখন টিপিপির ফলে এটা আরও বাড়ত। ২০১৫ সালেই ভিয়েতনাম পোশাক রফতানি খাতে ২৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ভিয়েতনাম ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সামগ্রিক রফতানি ৫০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়।
ওবামা প্রশাসনের আমলে টিপিপি চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস তা অনুমোদন করেনি। ফলে তা আইনে পরিণত হয়নি। তবে আমাদের জন্য একটা সুখের খবর হলো, ট্রাম্প বলছেন, তিনি এ টিপিপি চুক্তি অনুমোদন করবেন না। তিনি মনে করেন, এ চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বেকার সমস্যা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক শিল্প নষ্ট হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের যে বিশাল বাজার, তা পূরণ হয় ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ও চীনে তৈরি আরএমজি থেকে। অর্থাৎ এসব দেশ এ চাহিদা মেটায়। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের আরএমজি সেক্টরের চাহিদা যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ছে। বাংলাদেশ তার রফতানি বাড়াতে চায়। উল্লেখ্য, তৈরি পোশাকে ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া ৮ হাজার ১৭৮ কোটি ডলারের মধ্যে চীনের একার ২ হাজার ৯৭১ কোটি ডলার। তার পরের অবস্থানই ভিয়েতনামের ৯২৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া রয়েছে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে। চতুর্থ ও পঞ্চম যথাক্রমে মেক্সিকো ও ভারত। দেশ দুইটির রফতানি যথাক্রমে ৩৭৩ ও ৩৪০ কোটি ডলার। বিজিএমইএ’র দেয়া তথ্যমতে, ২০১৪ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি (যুক্তরাষ্ট্রে) কমেছে ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আমাদের শঙ্কার কারণটা এখানেই। এমনিতেই যখন জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হলো না, তখন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের সঙ্গে টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এক্ষেত্রে টিপিপির ফলে আমাদের তৈরি পোশাক খাত ঝুঁকির মুখে ছিল। এ ধরনের সংকট ভবিষ্যতে কীভাবে কাটিয়ে উঠতে পারব, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।
জিএসপি সুবিধা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সালে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে ধনী দেশগুলো ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার শর্ত কার্যকর করতে রাজি হয়েছিল। এতে করে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, অনুন্নত বিশ্ব পশ্চিমা উন্নত দেশে তাদের পণ্যের আওতা বাড়াতে পারবে। তবে একটা প্রশ্ন ছিল পণ্যের মান ও উৎস নির্ধারণ নিয়ে। এ দুইটি বিষয় নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল আমদানিকারক দেশগুলোর হাতে। হংকং সম্মেলনের ৮ বছর পর ২০১৩ সালের ৩ থেকে ৭ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সর্বশেষ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক)। বালি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বটে; কিন্তু বালি ঘোষণায় কোন পক্ষ কী পেল, কিংবা বাণিজ্যবৈষম্যের শিকার অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন হবে কিনা, সে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের প্রশ্নে এ প্রশ্নগুলোই আবারও উত্থাপিত হয়েছে। আমাদের জিএসপি সুবিধা পাওয়ার কথা; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাকে কোনো জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে না। তারপরও অন্যান্য পণ্যে যতটুকু সুবিধা পেত বাংলাদেশ, তাও গেল জুন (২০১৩) থেকে স্থগিত রাখা হয়েছে। জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র মূলত প্রথমে তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। এক. শ্রমমান, দুই. শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকা-ের পূর্ণ তদন্ত ও বিচার এবং তিন. ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। ঢাকার টিকফার প্রথম বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্র আকার-ইঙ্গিতে এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল।
শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ‘রুলস অব অরিজিন’ এর কঠিন শর্তে আটকে আছে। ধনী দেশগুলো এটা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বাংলাদেশের মোট রফতানির ৬১.৩ ভাগ জিএসপি সুবিধার আওতায়। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে মোট রফতানির প্রায় ৬০ ভাগ সুবিধা ব্যবহার করতে পারছে বাংলাদেশ। বলা ভালো, বাংলাদেশের মোট রফতানির ৭৮ ভাগ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এ তৈরি পোশাকের ৬০ ভাগ যায় ইউরোপে, আর ২৫ ভাগ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। তৈরি পোশাক আমাদের আয়ের অন্যতম উৎস হলেও এ খাতের সঙ্গে জড়িত নানা ‘প্রশ্ন’ এর ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা ও বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করতে পারেনি। দরকষাকষিতে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। আমলানির্ভর আমাদের মন্ত্রণালয়ের আমলারা ‘বিদেশ সফর’, ‘সম্মেলনে অংশগ্রহণ’ ইত্যাদিকেই প্রাধান্য দেন বেশি। এখানে দক্ষ জনশক্তির বড় অভাব। বিজিএমইএও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারেনি। তাদের গবেষণা ‘সেল’ও শক্তিশালী নয়। শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধার সঙ্গে ‘রুলস অব অরিজিন’, ‘এন্টি ডাম্পিং’ ও ‘কাউন্টারভেইলিং ব্যবস্থা’, ‘প্রেফারেন্স ইরোসন’, শ্রমমান ইত্যাদি নানা টেকনিক্যাল প্রশ্ন জড়িত। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায়ও আমরা এসব প্রশ্নে শক্ত অবস্থানে যেতে পারিনি।
আমাদের সমস্যা এখানেই। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত ইস্যুগুলোর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আসরে আমরা আমাদের অবস্থান জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি। প্রতিপক্ষ এ থেকে সুবিধা নিয়েছে। তৈরি পোশাকের ব্যাপারে আমাদের আরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। এখানে এক ধরনের শৈথিল্য কাজ করেছিল প্রথম থেকেই। যুক্তরাষ্ট্র যে ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিল, তার সবগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে, এটা বলা যাবে না। তবে এটা সত্য, এ ১৬ দফার বেশ ক’টি আমরা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে কথাটা বলা হয়েছে তা হচ্ছে, তারা ১৬ দফার পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। আংশিক বাস্তবায়ন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সেই সঙ্গে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জঙ্গিবাদের প্রশ্নটি। যুক্তরাষ্ট্র এখন চাচ্ছে, বাংলাদেশ স্বীকার করুক এ দেশে আইএস ও আল কায়দা আছে। কিছুদিন আগে তথ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছিলেন, বাংলাদেশে ৮ হাজার আল কায়দা জঙ্গি আছে। কোন যুক্তিতে, কোন তথ্যমতে তথ্যমন্ত্রী ভারতীয় পত্রিকা ‘দি হিন্দু’কে তথ্যটি দিয়েছিলেন, আমি জানি না। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর এ ধরনের সংগঠনের বাংলাদেশে উপস্থিতির কথা অস্বীকার করে আসছেন।
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা যদি জঙ্গি প্রশ্নে পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলেন, তা শুধু বিভ্রান্তিই বাড়ায় না, বরং এতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তি এ থেকে সুবিধা নেবে, এটাই স্বাভাবিক। জিএসপি নিয়ে সমস্যা আছে। তার সমাধান হয়নি। পূর্বে জঙ্গিবাদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘চাপ’ আরও বাড়ে। এ ‘চাপ’ কি বাংলাদেশ উপেক্ষা করতে পারবে? সচেতন পাঠক জানেন, যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের সঙ্গে ‘আকসা’ এবং ‘সোফা’ নামে দুইটি চুক্তি করতে চাচ্ছে। এর বাইরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী যে জোটটি গঠিত হয়েছে, তাতে অংশগ্রহণের প্রশ্নটি। তবে আমাদের কাছে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয় যে, ট্রাম্প প্রশাসন ‘আকসা’ ‘সোফা’ বা সন্ত্রাসবিরোধী জোট নিয়ে এগিয়ে যাবে কিনা। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে ওবামা প্রশাসনের যে ‘অবস্থা’ ছিল, ট্রাম্প তাতে পরিবর্তন আনতে পারেন। তবে একটা কথা বলা যায়, তিনি জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করবেন না। এর অর্থ হচ্ছে, শুল্ক পরিশোধ করেই তৈরি পোশাকের বাজারটি ধরে রাখতে হবে। ধারণা করছি, শিগগিরই ট্রাম্প একটি নীতিনির্ধারণী ভাষণ দেবেন। একটি ব্যাপক পরিবর্তন আশা করছেন অনেকে। এখন দেখার পালা, এ ‘পরিবর্তন’, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ওপর কতটুকু প্রভাব ফেলে।
Daily Alokito Bangladesh
22.01.2017

ট্রাম্প কী বার্তা দেবেন বিশ্বকে



যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে গত ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পেশায় একজন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে কী বার্তা দিলেন বিশ্বকে? সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দীর্ঘ ৮ বছরের শাসনামলে বিশেষ স্থিতিশীলতা ছিল হয়তো এটা বলা যাবে না। কিন্তু তার নেতৃত্বের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের যেমনি আস্থা ছিল, তেমনি অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে তার ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছিল। এখন কি বিশ্ব সেই নীতিতে একটি ‘ইউটার্ন’ দেখতে পারে? দায়িত্ব নেওয়ার আগে ট্রাম্পের অনেক বক্তব্যে সারা বিশ্বের মানুষ আশাহত হয়েছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ওইসব বক্তব্য ভালো চোখে দেখেনি। গেল বছর জার্মানি কয়েক লাখ সিরীয় তথা ইরাকি অভিবাসীকে সে দেশে আশ্রয় দেওয়ার ঘটনাকে ট্রাম্প আখ্যায়িত করেছিলেন ‘সর্বনাশা ভুল’ হিসেবে। জার্মানরা এটা পছন্দ করেনি। জার্মান চ্যান্সেলর মেরকেল এর প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, তাদের ভাগ্য তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওঁলাদ এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, তাদের বাইরের কোনো লোকের উপদেশের প্রয়োজন নেই। ট্রাম্প ন্যাটোকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘সেকেলে’ হিসেবে। এটা নিয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোয় এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প ব্রেক্সিটকে সমর্থন করেছিলেন। ব্রিটেন এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্র ব্রিটেনকে অনুসরণ করুক, এটাও ট্রাম্প চান। ফলে ইইউর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে ট্রেডিশনাল সম্পর্ক, তাতে এখন একটি অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ের পর তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার ‘ফোনালাপ’-এ একটি সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এক চীনানীতি পরিত্যাগ করতে পারে। চীন বিষয়টাকে খুব সহজভাবে নেয়নি। চীন তার টুইটার কূটনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তবে একটা বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন রেস্ক টিলারসন, যিনি হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। টিলারসন বলেছেন, দক্ষিণ চীন সাগরে চীন যে কৃত্রিম দ্বীপ বানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সেখানে চীনাদের যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া। এর প্রতিবাদে চীন বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি তা করে তাহলে তা এক ভয়ঙ্কর সংঘাতে রূপ নেবে। তবে রাশিয়া সম্পর্কে তিনি বরাবরই নরম মনোভাব দেখিয়ে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্র ওবামার শাসনামলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এমনকি রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এখন পরিস্থিতি কি বদলে যাবে? নির্বাচনের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি রাশিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারের পক্ষে। ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর টেলিফোনে ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের কথা হয়েছিল। এই দু’জনের ফোনালাপকে তখন গভীর বন্ধুত্বের সুর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা ও বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধর (স্নায়ুযুদ্ধ-২) জন্ম হয়েছিল এবং রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছিল। এখন কি যুক্তরাষ্ট্র তার এই অবস্থানে পরিবর্তন আনবে? এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে? যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে, বিশেষ করে পেন্টাগনে যেসব কট্টরপন্থি রয়েছেন, তারা কি ‘রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার’ এই প্রবণতাকে মেনে নেবেন? সিনিয়র জেনারেলদের ভূমিকাই বা কী হবে এখন? রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র ‘মৈত্রী’ কি ইতিহাসকে আবার স্মরণ করিয়ে দেবে? দ্বিতীয় ইয়াল্টার কী জন্ম হচ্ছে? পাঠক স্মরণ করতে পারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ইউরোপের ভূমিকা কী হবে এটা নিয়ে আলোচনার জন্য ইয়াল্টায় (১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি) চার্চিল (যুক্তরাজ্য), রুজভেল্ট (যুক্তরাষ্ট্র) ও স্টালিন (সোভিয়েত ইউনিয়ন) এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সেই পরিস্থিতি কি তাহলে আবার ফিরে আসছে? এ ক্ষেত্রে যে কোনো রুশ-মার্কিন ‘ঐক্য’ সিরিয়ার পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলবে? আসাদ ইতোমধ্যে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সম্ভাব্য এই ঐক্য আসাদকে আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দেবে মাত্র। কিন্তু তাতে করে যুদ্ধ সেখানে থামবে বলে মনে হয় না। যদিও ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আসাদবিরোধী নুসরা ফ্রন্টকে (পরিবর্তিত নাম জাবহাত ফাতেহ আলশাস) অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবেন না। কিন্তু তাতে করে কি আইএসকে ধ্বংস করা সম্ভব হবে? অনেকেই জানেন, আইএস পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘সহযোগিতা’ পেয়ে থাকে। ট্রাম্পের সময় আইএস কি তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে? এ ক্ষেত্রে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এক ধরনের ‘স্নায়ুযুদ্ধ’-এর জন্ম হবে! ট্রাম্প যদি সত্যি সত্যিই ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি সমর্থন করতে অস্বীকার করেন, তাহলে ইরান এই স্নায়ুযুদ্ধের সম্ভাবনাকে উসকে দেবে। আল কায়েদা কিংবা আইএসের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সেই পুরনো ধারণায় ফিরে যাবে। বাড়বে সন্ত্রাস। এরা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গুপ্তহামলা চালাবে। ফলে একটি স্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্য দেখার সম্ভাবনা ক্ষীণ। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন আছে। চীনের সঙ্গে এক ধরনের ‘ট্রেড ওয়ার’ শুরু হয়ে যেতে পারে। চীনা পণ্যের ওপর শতকরা ৪৫ ভাগ হারে শুল্ক আরোপ করলে (যা তিনি প্রস্তাব করেছেন), চীন বিষয়টি খুব সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। মেক্সিকোর সঙ্গে সীমান্তে উঁচু দেয়াল নির্মাণের বিষয়টিও অত সহজ হবে না। তবে একটা আশঙ্কার জায়গা হচ্ছে, নয়া প্রশাসনে জাতীয় নিরাপত্তাপ্রধান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মাইকেল ফ্লাইনের নিযুক্তি। ফ্লাইন অত্যন্ত কট্টরপন্থি, ইসলামবিরোধী এবং পুতিনের মতো নেতৃত্বকে পছন্দ করেন। তিনি সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। তাতে তিনি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হেরে যাওয়ার পেছনে ‘রাজনৈতিক সঠিক লাইন’-এর অভাব বলে মনে করেন এবং ইসলামবিদ্বেষকে তিনি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন। ফলে ফ্লাইনের মতো কট্টরপন্থিদের নিযুক্তি প্রমাণ করে, ট্রাম্প তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসছেন না। ট্রাম্প যদি তার আগের অবস্থানে দৃঢ় থাকেন এবং মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করার আইন প্রণয়ন করেন, তাহলে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। দু-একটি মুসলমানপ্রধান দেশে সন্ত্রাসী কর্মকা- রয়েছে এবং এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকেই দায়ী করা হয়। এ জন্য সব মুসলমানপ্রধান দেশকে দায়ী করা ঠিক হবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ট্রাম্পের প্রশাসনে একের পর এক যেভাবে কট্টরপন্থিদের ভিড় বাড়ছে, তাতে করে তারা ট্রাম্পকে একটি কঠোর ইসলামবিরোধী ভূমিকা নিতে বাধ্য করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংখ্যালঘুদের (এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের) অধিকার নিশ্চিত করলেও সংবিধানের এই ‘অধিকার’ এখন অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। কেননা নতুন করে আইন প্রণয়ন করতে এবং কংগ্রেসে তা পাস করিয়ে নিতে ট্রাম্পের কোনো সমস্যা হবে না। সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদে এখন রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টে তিনজন কনজারভেটিভ বিচারপতিকে তিনি নিয়োগ দিতে পারেন। সেই ক্ষমতা এখন তার আছে। ফলে তিনি যদি সংবিধান সংশোধন করার কোনো উদ্যোগ নেন, তা পারবেন। ন্যূনতম অভিবাসনবিরোধী তথা ইসলামবিরোধী কোনো আইন পাস করতে তার সমস্যা হবে না।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা তাই ৯টি ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করছেন, যেখানে ট্রাম্প পরিবর্তন আনবেন। এই ৯টি জায়গা বা ক্ষেত্র হচ্ছে : ১. ইসলামিক স্টেটের ক্ষেত্রে, ২. আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে, ৩. উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি, ৪. ইউক্রেনে সংকট ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক, ৫. চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ও সম্ভাব্য একটি বাণিজ্যযুদ্ধ, ৬. ইউরোপীয় ঐক্যের প্রশ্নে তার অবস্থান, ৭. ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতার ভবিষ্যৎ, ৮. ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনির প্রশ্নে তার ভূমিকা এবং ৯. মেক্সিকোর সঙ্গে তার সম্পর্ক। তিনি ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট’ এই সেøাগান তুলে বিজয়ী হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ২৪ মিলিয়ন চাকরির ব্যবস্থা করবেন। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪-এ নিয়ে যাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ‘অটোমেশনের’ কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানে এখন শতকরা ১৮ ভাগ লোক কম লাগে। ‘আউটসোর্সিং’-এর মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বাইরে থেকে এনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। ফলে চাকরির ব্যবস্থা করার কথা বলা যত সহজ, বাস্তব ক্ষেত্রে অত সহজ নয়। তিনি শপথ নেওয়ার পর উদ্বোধনী ভাষণেও তেমন নতুন কিছু শোনাননি। তিনি বারাক ওবামা ও তার স্ত্রীর প্রশংসা করেছেন। এটা তার বদৌন্যতা। তার উদ্বোধনী বক্তব্যে শঙ্কা আছে, আশার কথাও আছে। তিনি আবারও আশার কথা শুনিয়েছেন। স্বপ্নের যুক্তরাষ্ট্র গড়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন। বলেছেন, তার কাজ হবে সবার ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান দেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। সমসাময়িককালে সবচেয়ে কম জনপ্রিয়তা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন। ওয়াশিংটন পোস্টের জরিপে দেখা গেছে, শতকরা মাত্র ৪০ জন মানুষ তাকে সমর্থন করছে এখন, শতকরা ৫৪ জনই তাকে সমর্থন করছে না। অথচ ওবামা যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন (২০০৯) তখন শতকরা ৭৯ ভাগ মানুষ তাকে সমর্থন করেছিল। আর ক্লিনটন (১৯৯৩) ও সিনিয়র বুশের (১৯৮৯) এই জনপ্রিয়তা ছিল যথাক্রমে ৬৮ ভাগ ও ৬৫ ভাগ। তিনি যখন ক্যাপিটল হিলে শপথ নিচ্ছিলেন তখন ওয়াশিংটন ডিসি ও নিউইয়র্কের মতো শহরে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছিল। পুলিশ কর্তৃক বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার দৃশ্য টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে মানুষ বাংলাদেশে দেখেছে। তাই তার যাত্রাটা ভালো হলো না। তিনি বলেছেন, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখবেন। কিন্তু কীভাবে? তিনি যে মন্ত্রিপরিষদের নাম প্রস্তাব করেছেন, সেখানে একজনও লাতিন আমেরিকা থেকে আসা অভিবাসী বংশধরের সন্তান নেই। যেখানে ওবামা প্রশাসনের আমলে লাতিনো মানুষের প্রতিনিধিত্ব ছিল, ট্রাম্পের প্রশাসনে তা নেই। তার ক্যাবিনেটে শতকরা প্রায় ১৫ জন আছেন যারা বিলিওনিয়ার। অথচ ওবামা কিংবা বুশ প্রশাসনের আমলে ক্যাবিনেটে বিলিওনিয়ার ছিল না। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের হার তার আমলে শতকরা ৯ জন। ওবামা প্রশাসনে ছিল শতকরা ৪ জন। যেখানে ওবামা প্রশাসনের আমলে ক্যাবিনেটে অতীতে সরকারি কাজে দক্ষতার অধিকারীÑ এ সংখ্যা ছিল শতকরা ৮৭ ভাগ। ট্রাম্পের প্রশাসনে অর্থাৎ ক্যাবিনেটে এ সংখ্যা মাত্র ৫৫ ভাগ। তাই বোঝাই যায়, অনভিজ্ঞ, কিন্তু সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া কট্টর দক্ষিণপন্থিদের নিয়ে ট্রাম্প তার যাত্রা শুরু করলেন। ফলে তার প্রশাসন নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেলই। তিনি একশ দিনের একটি পরিকল্পনার কথা জানাবেন বটে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তার নিজের অজ্ঞতা এবং তার প্রশাসনে যথেষ্ট যোগ্য লোকের অভাব থাকায় আগামী দিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কপ-২১ চুক্তি (যা প্যারিসে ও জাতিসংঘে স্বাক্ষরিত হয়েছে) সমর্থন না করা, কিউবার সঙ্গে ‘সমঝোতা’কে অস্বীকার করা, চীনের সঙ্গে এক ধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’, ন্যাটোয় যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ কমিয়ে আনা, রাশিয়ার সঙ্গে তার আঁতাত, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বাতিল ইত্যাদি আগামীতে বিশ্বে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে না। তার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে। এখন আমাদের দেখতে হবে, তার এই ‘রাজনীতি’ একুশ শতকের তৃতীয় দশকে যুক্তরাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো সিদ্ধান্ত বিশ্বে বড় পরিবর্তন ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট।
Daily Amader Somoy
22.01.2017

ট্রাম্পের আমল এ অঞ্চলে কী প্রভাব ফেলবে



মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প আজ অভিষিক্ত হচ্ছেন। অনেক বিতর্ক আর এক ধরনের শংকার মধ্যে দায়িত্ব নিলেন তিনি। এখন প্রশ্ন, বিশ্ব রাজনীতিতে তিনি কি কোনো পরিবর্তন আনবেন? বিশেষ করে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন নীতিতে কি আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে? যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির আওতায় বাংলাদেশ। সুতরাং এ অঞ্চলে যে কোনো পরিবর্তন বাংলাদেশকেও স্পর্শ করবে। বৈদেশিক নীতিতে ট্রাম্পের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কেননা অতীতে তিনি কোনোদিন আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন না। তিনি কোনো রাজ্যের গভর্নরও ছিলেন না। বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে আনকোরা একজন মানুষ এমন এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি বড় রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন, যখন বিশ্বে নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছে, যাকে অভিহিত করা হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ-২ হিসেবে। তার যে কোনো সিদ্ধান্ত বিশ্বে একদিকে যেমন উত্তেজনা বাড়াতে পারে, অন্যদিকে তেমনি বিশ্বব্যবস্থায় একটি ‘আস্থার সম্পর্ক’ গড়ে তুলতে পারে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য আগামীতে যে ক’টি বিষয় বেশি গুরুত্ব পাবে, তার অন্যতম হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগর। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেক। যুক্তরাষ্ট্রের নৌ স্ট্র্যাটেজিস্টরা দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বজায় রাখতে চাইবে। এবং এতে করে চীনের সঙ্গে যে কোনো ‘সংঘর্ষে’ জড়িয়ে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

বেশ কিছু কারণে এ অঞ্চলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে। শুধু স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বই নয়, বরং দক্ষিণ চীন সাগরে রয়েছে বিপুল জ্বালানি সম্পদ, যে সম্পদের ব্যাপারে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগ্রহ রয়েছে। এক্সন মোবিলের সাবেক প্রধান রেক্স টিলারসন হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। একটি বহুজাতিক তেল কোম্পানির প্রধানকে কেন ট্রাম্প তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিলেন, তা বুঝতে কারও বাকি থাকার কথা নয়। পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখন ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি প্রাধান্য পাবে। দক্ষিণ চীন সাগরে তেল ও গ্যাসের যে বিপুল রিজার্ভ রয়েছে, তার হিসাব অনেকটা এরকম : তেল ১১ বিলিয়ন ব্যারেল, গ্যাস ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। এখন ব্যবসায়ী ও সাবেক এক্সন মোবিল প্রধান এ ব্যাপারে তার ‘আগ্রহ’ অস্বীকার করবেন কীভাবে? ওবামা প্রশাসন এটা অনুধাবন করেই ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি ভিয়েতনামের সঙ্গে টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, যা ট্রাম্প বাতিল করবেন বলে জানিয়েছেন। এই তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সঙ্গে ভারতও জড়িত। গেল বছর ভারতের চারটি যুদ্ধজাহাজ এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, তার অংশীদার ভারতও। অর্থাৎ এ অঞ্চলজুড়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য গড়ে উঠছে।

ওবামা প্রশাসন ২০০৭ সালে ভিয়েতনামকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ পেতে সমর্থন দিয়েছিল। ওবামা নিজে গেল বছরের জুনে ভিয়েতনাম সফর করেছিলেন। চীনের বিরুদ্ধে একটি বলয় তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে ভিয়েতনামের। ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মার্কিন নীতির কেন্দ্রবিন্দু। ফলে ওবামার ভিয়েতনাম সফর শুধু সাধারণ একটি সফর ছিল না। চীনের বিরুদ্ধে সামরিক ও অর্থনৈতিক বলয় সৃষ্টি করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করছে। আর এই মহাপরিকল্পনায় একাধিক দেশকে জড়িত করছে যুক্তরাষ্ট্র। এখানে বলা ভালো, চীনের বিরুদ্ধে একটি সামরিক বলয় তৈরি করার অংশ হিসেবেই গেল বছর দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনসহ একাধিক দেশের সঙ্গে সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে পাঁচটি সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল ফিলিপাইন। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের নৌ ইস্টার্ন কমান্ডের চারটি গাইডেড মিসাইল সজ্জিত যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ওই জাহাজগুলো দক্ষিণ চীন সাগর এবং উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছিল। এর অর্থ পরিষ্কার, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী যে নীতি, তাতে ভারতকেও পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ভারত এ অঞ্চলে অন্যতম নৌশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এর অংশ হিসেবেই দেশটি প্রথমবারের মতো তার ইস্টার্ন কমান্ডের চার যুদ্ধজাহাজকে এ অঞ্চলে মোতায়েন করেছিল। যদিও দক্ষিণ চীন সাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। ভারত ভিয়েতনামের সঙ্গে চুক্তি করে এ অঞ্চলে তেল ও গ্যাসের অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

২০১৬ সালে ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা এবং ৩২০ কোটি ডলারের ছয়টি ইলেকট্রিক সাবমেরিন বিক্রির যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দেবে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও বলা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে দক্ষিণ কোরিয়াই এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছে, তবে চীনে আধা ঘণ্টারও কম সময়ে আঘাত হানতে সক্ষম এমন হাইপারসনিক গ্লিড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাও মোতায়েন করা হয় সেখানে। চীন বিষয়গুলোকে খুব সহজভাবে দেখছে না। এতে করে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়বে। সর্বশেষ ট্রাম্পের এক চীন নীতি পরিত্যাগের হুমকি এ উত্তেজনায় নতুন মাত্রা এনে দেবে।

এখানে দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। আগামী দিনে এ অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান-পতন বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। প্রায় ৩৫ লাখ বর্গকিলোমিটারজুড়ে রয়েছে চীন সাগরের বিস্তৃতি। এ অঞ্চলটি চীনের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণে, ফিলিপাইনের পশ্চিমে, মালয়েশিয়ার উত্তরে, ব্র“নাইয়ের উত্তর-পশ্চিমে, ইন্দোনেশিয়ার উত্তরে এবং ভিয়েতনামের পূর্বে অবস্থিত। এ অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়েছে এ কারণে যে, দক্ষিণ চীন সাগরে প্রায় ১১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রয়েছে। এবং গ্যাস রয়েছে ১৯০ দশমিক ২০ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার। এই হিসাব আমরা পেয়েছি যুক্তরাষ্ট্র থেকে। চীনের প্রচুর ‘জ্বালানি ক্ষুধা’ রয়েছে। চীনের অর্থনীতিকে সঠিক পথে চালাতে প্রচুর জ্বালানি দরকার। সেক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যদি চীনের কর্তৃত্ব থাকে, তাহলে দেশটি তার জ্বালানি চাহিদা এখান থেকে মেটাতে পারবে। এ সমুদ্রপথটি পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ। এ কারণে এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। পৃথিবীর সব সমুদ্রপথে যত বাণিজ্য হয়, তার এক-তৃতীয়াংশ হয় এই পথে। চীন, জাপান, কোরিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত স্প্রার্টলি, প্যারাসেল ও টনকিন উপসাগরে অবস্থিত কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে আশপাশের দেশ, বিশেষ করে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার সঙ্গেই চীনের বিরোধ। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ অঞ্চলের অর্থাৎ দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব বেড়েছে একাধিক কারণে। চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’ কিংবা চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে একটি ‘ঐক্য’ করার পাশাপাশি জাপানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকি মোকাবেলা করা এবং এ সাগর দিয়ে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করার ব্যাপারে মার্কিন স্বার্থ রয়েছে। এর উপরে রয়েছে এ এলাকার তেল ও গ্যাস সম্পদের ওপর মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির লোলুপ দৃষ্টি। ফলে এ অঞ্চলটি যে আগামী দিনের প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান, এমনকি ভারতও তৎপর। যুক্তরাষ্ট্র এ দেশগুলোকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে। এটি বিশ্বের বড় সমুদ্র-বাণিজ্য রুটগুলোর একটি। বিশ্ব বাণিজ্যের ৩২ ভাগ এ পথ দিয়ে প্রবাহিত হয়। চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এটি সংযুক্ত নয়। মূল ভূখণ্ড থেকে ১ হাজার নটিক্যাল দূরে এই দ্বীপপুঞ্জগুলো অবস্থিত। জাপান এই রুটকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করে এবং ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যিক রুট হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। জাপান এই দ্বীপগুলোর নাম দিয়েছে সেনকাকু, যা চীনের কাছে পরিচিত দিয়াওইউ নামে। ঐতিহাসিকভাবে চীনের শি ও হান রাজবংশের কর্তৃত্ব অনুযায়ী চীন এ অঞ্চলের মালিকানা দাবি করে এলেও এ অঞ্চলের আশপাশের দেশগুলো তা মানতে নারাজ। জাপানের নিজস্ব কোনো তেল ও গ্যাস নেই। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর দেশটি পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। জাপান দৈনিক ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই সমুদ্রপথ ব্যবহার করে আমদানি করে থাকে।

স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব থাকায় চীন এ অঞ্চলে নতুন করে একটি কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়েছে। সেখানে যুদ্ধবিমান মোতায়েনের জন্য বড় বড় রানওয়ে তৈরি করছে। মিসাইল ব্যাটারি স্থাপন করেছে। এমনকি আগামীতে এখানে যাতে পারমাণবিক সাবমেরিন ‘ডক’ করতে পারে, সে ব্যবস্থাও পাকাপাকি করেছে চীন। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একটি আতংক ছড়িয়ে গেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র এই আতংককে ব্যবহার করছে তার স্বার্থে। বলা ভালো, দক্ষিণ চীন সাগরের এই বিরোধ জাতিসংঘের সামুদ্রিক বিবাদ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে উত্থাপিত হয়েছিল। ফিলিপাইন ছিল এর উদ্যোক্তা। তবে চীন এই শুনানিতে অংশ নেয়নি। কিন্তু আদালত চীনের বিরুদ্ধে রায় দিলেও চীন কূটনীতিতে বড় সাফল্য পেয়েছে। নবনির্বাচিত ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তেকে চীন রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফিলিপাইনের সঙ্গে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলছে। দুতার্তের আমলে ফিলিপাইনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। দুতার্তে ওবামাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছিলেন। দুতার্তের স্ট্র্যাটেজি থেকে বোঝা যায়, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে সব নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে চান। ফিলিপাইনে মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে এবং মার্কিন সেনারা চুক্তিবলে একাধিক ফিলিপাইনের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করে। এখন ট্রাম্পের শাসনামলে এই সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাও দেখার বিষয়।

ট্রাম্প প্রশাসনে একাধিক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল রয়েছেন। তারা সবাই যুদ্ধবাজ এবং বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ‘প্রভাব’ দেখতে চান। এখন ট্রাম্প যতই বলুন না কেন, তিনি আর ন্যাটোর খরচ বহন করবেন না, পেন্টাগন কি তা মানবে? পেন্টাগনের সামরিক স্ট্র্যাটেজিস্টরা চাইবেন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্বার্থ, তা বজায় থাকুক। এর ফলে দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন নজরদারি থাকবে। ফলে চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে পারে ট্রাম্প প্রশাসন। এতদিন যুক্তরাষ্ট্র যে ‘এক চীন নীতি’ অনুসরণ করে আসছিল, তাতেও এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ের পর তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার ফোনে আলাপ হয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘এক চীন নীতি’ পরিত্যাগ করতে পারেন এমন আশংকাও তৈরি হয়েছে। চীনে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। চীন বলছে, এটি একটি মীমাংসিত বিষয়। এটা নিয়ে দরকষাকষি কিংবা আলাপ-আলোচনার কিছু নেই। ট্রাম্প তাইওয়ান প্রশ্নে নতুন করে আলোচনার কথা বলেছিলেন। চীন হুমকি দিয়ে সম্প্রতি বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীন নীতি’ থেকে সরে দাঁড়ালে চীন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুদের অস্ত্র সরবরাহ করবে। স্পষ্টতই এটা একটা হুমকি। ফলে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকল। যুক্তরাষ্ট্র এখানে জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকেও জড়িত করছে। আর এই নয়া স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্সে ভারত পালন করতে যাচ্ছে একটি বড় ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠী বা এনএসজিতে ভারতের অন্তর্ভুক্তির (৪৮টি দেশ এর সদস্য। চীনের আপত্তি আছে ভারতের ব্যাপারে) প্রতি সম্মতি দিয়েছে। মিসাইল টেকনোলজি কনট্রোল রেজিম বা এমটিসিএ’তেও ভারত ঢুকতে চায়। নীতিগতভাবে তাতে সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এতে করে অত্যাধুনিক মিসাইল টেকনোলজি পাবে ভারত। ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনতে চায় এফ-১৬, ও এফ-১৮ জঙ্গি বিমান।

এটা স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক এখন অনেক উষ্ণ। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি তাতে স্পষ্টতই ভারত পালন করতে যাচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চীনের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর অ্যালায়েন্স গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ওবামা। তার Pivot to Asia-এর মূল দর্শনই হল চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে ঐক্য। এখন ট্রাম্প প্রশাসন এই নীতি নিয়ে এগিয়ে যাবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপে প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। এখন দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল হয়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বন্দ্ব একটি বড় উত্তেজনার কারণ হতে পারে। এ ব্যাপারে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর লক্ষ্য থাকবে অনেকের।
Daily Jugantor
20.01.2017

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও চলমান রাজনীতির চালচিত্

প্
রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছেন গত ১২ জানুয়ারি। দ্বিতীয় মেয়াদে তার সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে তিনি জাতির উদ্দেশে এই ভাষণটি দিলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘বিতর্কিত’ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি সরকার গঠন করেছিলেন। এ নিয়ে টানা আট বছর তিনি ক্ষমতায় আছেন। এবারে জাতির উদ্দেশে তিনি ভাষণ দিলেন এমন একটা সময় যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছেন। বিএনপি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার একটি আভাস দিয়েছিল। ফলে রাজনীতি আগের মতো এত উত্তপ্ত ও অসহিষ্ণু নয় এখন। ধীরে ধীরে একটি ‘আস্থার সম্পর্ক’ তৈরি হচ্ছে। ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তিনি গত তিন বছরে তার সাফল্যের কথা বলবেন, এটা স্বাভাবিক। তবে ‘সমঝোতার রাজনীতির’ ব্যাপারে কি বক্তব্য রাখেন সে ব্যাপারে আগ্রহ ছিল অনেকের। কেননা এর মধ্য দিয়ে তিনি একটি ‘মেসেজ’ দিলেন যা চলমান রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হতে পারে। এর আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভবিষ্যতে কোনো বিতর্কিত নির্বাচন চান না বলে সংলাপে রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদিন সাংবাদিকদের এই তথ্যটি দিয়েছেন। এ থেকে ধরে নেয়া স্বাভাবিক যে প্রধানমন্ত্রী চান ‘সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক।’ তাতে নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। জনগণের অংশগ্রহণ বাড়বে এবং যে কোনো ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবে নির্বাচন কমিশন। ঠিক তেমনি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর এই ‘স্পিরিটটি’ প্রতিফলিত হয়েছে। ভাষণে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন সব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে গঠিত নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নেবে এবং দেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে সহায়তা করবে। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণে নীতি নির্ধারণী কোনো বক্তব্য নেই। তিনি গত তিন বছরে কি কি করেছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন তার একটা পরিসংখ্যান দেন। এটা খুবই স্বাভাবিক। আগেও তিনি এ ধরনের বক্তব্য রেখেছেন। তবে এক্ষেত্রে একটি ‘আস্থার সম্পর্ক’ কি করে প্রতিষ্ঠা করা যায় তার কোনো দিক নির্দেশনা আমরা পাইনি। তার ভাষণ সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগ যে ৪টি প্রস্তাব দিয়েছে, তার একটি ই-ভোটিং এর ব্যাপারেও কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তাদের মতামত দিয়েছে। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের ওই প্রস্তাবটি দেখছেন ইতিবাচক হিসেবে। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন এটা ‘খুবই গৌণ বিষয়।’তিনি ওই প্রস্তাবকে আখ্যায়িত করেছেন ‘মৌলিক বিষয় আড়াল করার একটা প্রয়াস’ হিসেবে। আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন বাংলাদেশে ইভিএম গ্রহণযোগ্য নয়। বলা ভালো আওয়ামী লীগের দেয়া প্রস্তাবের মাঝে আরো রয়েছে ১. সিইসি ও কমিশনার নিয়োগে একটি আইন প্রণয়ন করা এবং ২. রাষ্ট্রপতি ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে যে প্রক্রিয়া উপযুক্ত মনে করবেন তাই তিনি করবেন। অন্যদিকে বিএনপির প্রস্তাবের মাঝে রয়েছে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি গঠন, ৫ সদস্য বিশিষ্ট বাছাই কমিটি, একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বাছাই কমিটি, বাছাই কমিটিতে একজন জ্যেষ্ঠ নারী কিংবা শিক্ষাবিদসহ আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের অন্তর্ভুক্ত করা ইত্যাদি। জাতীয় পার্টিও একটি সার্চ কমিটির প্রস্তাব করেছে। একই সঙ্গে ইসি নিয়োগে একটি আইন ও ইসি সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দাবিও তাদের। সুতরাং দেখা যাচ্ছে তিনটি বড় দলের মাঝে তাদের স্ব স্ব প্রস্তাবের ব্যাপারে খুব যে একটা মিল আছে, তা বলা যাবে না। একটি আইন প্রণয়ন করার ব্যাপারে কিছুটা মিল আছে। নীতিগতভাবে বিএনপিও এটা সমর্থন করে। তবে এক্ষেত্রে প্রশ্ন আছে অনেক। ৯ ফেব্রুয়ারিতে এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং এত অল্প সময়ের ব্যবধানে আইন করে সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পদগুলো ‘সীমিত সময়ের’ জন্য খালি রাখা যায় কি না? তাহলে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সংসদে আইনটি পাস করানো সম্ভব। সাংবিধানিক পদগুলো খালি রাখা যায় কি যায় না, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের একটি ‘রেফারেন্স’ চাওয়া যেতে পারে। তবে আইনটি প্রণয়ন করার সময় সব রাজনৈতিক দলের মতামত নেয়া হবে কি? সিভিল সোসাইটির মতামত নেয়াও প্রয়োজন। সিইসি তথা কমিশনারদের একটা ‘নিরপেক্ষতার’ কথা বলেছেন সবাই। কিন্তু এই নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা কি কিংবা এই ‘নিরপেক্ষতা’ নিশ্চিত হবে কিভাবে? কাজী রকিবউদ্দিনের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ‘জনতার মঞ্চে’ তিনি গিয়েছিলেন, এমন তথ্যও আমাদের জানা নেই। তাহলে তিনি বিতর্কিত হলেন কেন? আসলে একজন ‘আমলাকে’ বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আমলাদের যে মানসিকতা, তা তারা ছাড়তে পারেন না। দীর্ঘ চাকরি জীবনে সরকারের প্রতি যে ‘দায়বদ্ধতা’ থাকে, কিংবা চাকরি জীবনে তিনি যা ধারণ করেন তা নতুন করে যখন পরবর্তী জীবনে নতুন করে চাকরিতে প্রবেশ করেন ওই মানসিকতা থেকে তিনি বের হয়ে আসতে পারেন না। উপরন্তু সরকারও যে নির্বাচন কমিশনকে প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করে না, তা নয়। সংবিধানের ১১৮(৪) এর অধীনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই ধারাটি সিইসি কিংবা কমিশনাররা প্রয়োগ করেন না। একজন দৃঢ়চেতা সিইসিকে আমরা কখনো পাইনি। ভারতের নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টান্ত আমরা প্রায়সই দেই। সেখানে মাত্র তিনজন কমিশনার নিয়ে ভারতের মতো দেশের পুরো নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। আমরা এখানে আইন করে ৫ জনের কমিশন করলাম। তাতে ফলটা কি হয়েছে? বর্তমান কমিশন নিয়ে আমাদের সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রস্তাবিত ৪ দফার মধ্যে ৩ নং দফায় যে আইন প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে, এটাই হচ্ছে মুখ্য। এটা জরুরি। কিন্তু আইন প্রণয়ন করার সময় সরকার যাতে বিতর্কিত না হয়ে যায় সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। সরকারের পক্ষে যায় অথবা সরকার ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এমন কোনো ধারা বা বিধান যদি আইনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে মূল উদ্দেশ্যটি ব্যাহত হবে-অর্থাৎ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আমরা পাব না। দ্বন্দ্ব, বিভেদ, বিতৃষ্ণা থেকে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অনুষ্ঠিত বেশ ক’টি নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেলেও ওই সময় আমরা ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র অভিযোগ শুনেছি। নির্বাচনে হেরে গেলে ওই নির্বাচনের রায়কে মেনে নেয়ার মানসিকতা আমাদের তৈরি হয়নি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটাই বড় সমস্যা। আসলে মূল কথা একটিই- আস্থার সম্পর্ক গড়ে না উঠলে সার্চ কমিটি গঠন করেও কোনো লাভ হবে না। সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা মতে রাষ্ট্রপতি ‘সম্ভাব্য সার্চ কমিটি গঠন’ কিংবা ‘কমিশনারসহ সিইসিকে নিয়োগ’ দানের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে বাধ্য। এখানেই রয়েছে তার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা। সুতরাং এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীই হচ্ছেন মুখ্য ব্যক্তি। যদিও প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তা তারা মেনে নেবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে অনেক বিকল্প আছে। তিনি সার্চ কমিটির ব্যাপারে নাম চাইতে পারেন দলগুলোর কাছে। এককভাবে তিনি সার্চ কমিটি গঠন করতে পারেন। অথবা সরাসরি সিইসিসহ ৫ জনকে নিয়োগ দিতে পারেন। এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তাই একটা সংলাপ হচ্ছে। ভালো হোক, মন্দ হোক এই সংলাপ একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে পারে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। প্রধানমন্ত্রীর দুটি বক্তব্যকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তিনি কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না।’ তাকে সাধুবাদ জানাই। আওয়ামী লীগ আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। আওয়ামী কেন এমন একটি নির্বাচনের আয়োজন করবে, যে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দ্বিতীয়, তিনি এমন একটি নির্বাচন চান, যে নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের কথা। আমরা সবাই জানি কোন পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল। যে নির্বাচনে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হন, সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। আমরা ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনকে ভুলে যেতে চাই। তাকাতে চাই সামনের দিকে। একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০১৮ সালের শেষে অথবা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। সংবিধানে পরবর্তী নির্বাচনের কথা এভাবেই বলা হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কয়েকটি বড় দল অংশগ্রহণ করেনি। কেন করেনি, কি জন্য করেনি, এটা নিয়ে আমরা বিতর্ক যত কম করব, ততই আমাদের জন্য ভালো। ওই নির্বাচন থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দল যাতে অংশ নেয়, সে চেষ্টাই আমাদের করা উচিত। এ কারণেই নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখাটা জরুরি। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সরকারের জন্যও মঙ্গল। সরকারের ভুল ত্রুটিগুলো তুলে ধরে সরকারকে সঠিক নীতি গ্রহণ করতে সাহায্য করতে পারে বিরোধী দল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, দশম জাতীয় সংসদে সেই ‘বিরোধী দল’ আমরা পাইনি। গত তিন বছর জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে সংসদে বিতর্ক হয়নি। ফলে সংসদ হয়ে পড়েছে একদলীয়। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে উন্নয়নের অনেক কথা বলেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক বেশি, সন্দেহ নেই তাতে। এখন এই অর্জনকে ধরে রাখতে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের দরকার শক্তিশালী একটি বিরোধী দল। এখন প্রত্যাশা এটাই বিএনপি ‘মূল ধারার রাজনীতিতে’ নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করবে এবং আমরা আগামীতে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল পাব সংসদে। এই প্রত্যাশা আমাদের কতটুকু পূরণ হবে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। Daily Manobkontho 16.01.2017

ইসি পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতির অভিভাবকত্ব ফুটে উঠুক


নির্বাচন কমিশন গঠন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি সংলাপ করেছেন ১১ জানুয়ারি। গত ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ সংলাপ শুরু করেছিলেন। বিএনপিকে দিয়ে এ সংলাপ শুরু হয়েছিল। সংলাপ শেষ হবে আগামী সপ্তাহে। ইতিমধ্যে বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে তাদের মতামত দিয়েছে। এখন আওয়ামী লীগও তাদের মতামত দিল। রাষ্ট্রপতির এ সংলাপে আমি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতামতকে গুরুত্ব দিতে চাই। কারণ আওয়ামী লীগ এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। দলটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল। একাধিকবার তারা ক্ষমতায় ছিল ও আছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর ‘ভূমিকা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কী মতামত দিয়েছে, তা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। অন্যদিকে বিএনপিও বড় দল। তৃণমূল পর্যায়ে দলটির কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। দলটি বর্তমানে সংসদে নেই বটে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে, তাদের যে জনসমর্থন তাতে খুব একটা বড় পরিবর্তন আসেনি। শতকরা ৩৩ থেকে ৩৯ ভাগ মানুষের সমর্থন রয়েছে দলটির প্রতি। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে (১৯৯১) যতগুলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে, তার প্রতিটিতে বিএনপির সমর্থন এমনই ছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিএনপি যে একটি ‘ফ্যাক্টর’ তা অস্বীকার করা যাবে না। তাই বিএনপির মতামতকেও আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। একই সঙ্গে জাতীয় পার্টি বর্তমানে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। যদিও এটা নিয়ে একটা বিভ্রান্তি আছে- জাতীয় পার্টি সরকারি দলের ‘কোয়ালিশনভুক্ত’ নাকি বিরোধী দল? জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিত্ব রয়েছে মন্ত্রিসভায়, আবার সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকাও পালন করছে দলটি। কিন্তু তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, জাতীয় পার্টির বেশ কিছু নির্দিষ্ট সংসদীয় আসন রয়েছে। পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ওইসব আসনে বিজয়ী হয়েছিল। সুতরাং জাতীয় পার্টির মতামতও আমরা বিবেচনায় নিতে পারি।

তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, আওয়ামী লীগের মতামত আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বেশি। নির্বাচন কমিশন গঠনে সম্ভব হলে এখনই আইন প্রণয়ন অথবা অধ্যাদেশ জারির প্রস্তাব করেছে আওয়ামী লীগ। তবে সময় স্বল্পতায় যদি এবার আইন করা বা অধ্যাদেশ জারি সম্ভব না হয়, তাহলে পরের বার সে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তারা রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে তারা ই-ভোটিংয়েরও প্রস্তাব দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবে রয়েছে : ১. সংবিধানের ১১৮ নম্বর অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি, ২. এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যে প্রক্রিয়া উপযুক্ত বিবেচনা করবেন, তা-ই করবেন, ৩. একটি আইন প্রণয়ন করা, ৪. ই-ভোটিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।

বিএনপি যেসব প্রস্তাব দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি গঠন, ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি বাছাই কমিটি গঠন এবং বাছাই কমিটির আহ্বায়ক হবেন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি যিনি সরকারের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না, বাছাই কমিটির সদস্যরা হবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সাবেক সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, একজন জ্যেষ্ঠ নারী। প্রতি পদের বিপরীতে ২ জনের নাম প্রস্তাব করা হবে এবং রাষ্ট্রপতি ৫ জনকে (সিইসিসহ) মনোনয়ন দেবেন। অন্যদিকে জাতীয় পর্টি ৫ সদস্যের একটি সার্চ কমিটির নাম প্রস্তাব করেছে। তারা একটি আইন গঠন করার কথা বলেছে। ইসি সচিবালয় গঠনের প্রস্তাবও আছে তাদের।

সুতরাং তিনটি বড় দলের মধ্যে তাদের স্ব স্ব প্রস্তাবের ব্যাপারে খুব যে একটা মিল আছে, তা বলা যাবে না। একটি আইন প্রণয়ন করার ব্যাপারে কিছুটা মিল আছে। নীতিগতভাবে বিএনপিও এটা সমর্থন করে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন আছে অনেক। এক. ৯ ফেব্রুয়ারিতে এ কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং এত অল্প সময়ের ব্যবধানে আইন করে সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনারের পদগুলো ‘সীমিত সময়ের’ জন্য খালি রাখা যায় কিনা? তাহলে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সংসদে আইনটি পাস করানো সম্ভব। সাংবিধানিক পদগুলো খালি রাখা যায় কিনা এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের একটি ‘রেফারেন্স’ চাওয়া যেতে পারে। দুই. আইনটি প্রণয়ন করার সময় সব রাজনৈতিক দলের মতামত নেয়া হবে কিনা? সিভিল সোসাইটির মতামত নেয়াও প্রয়োজন। তিন. সিইসি তথা কমিশনারদের ‘নিরপেক্ষতার’ কথা বলেছেন সবাই। কিন্তু এ নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা কী কিংবা এ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে কীভাবে? কাজী রকিবউদ্দীনের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ‘জনতার মঞ্চে’ তিনি গিয়েছিলেন, এমন তথ্যও আমাদের জানা নেই। তাহলে তিনি বিতর্কিত হলেন কেন? আসলে একজন ‘আমলাকে’ বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তটি ভুল। আমলাদের যে মানসিকতা, তা তারা ছাড়তে পারেন না। দীর্ঘ চাকরি জীবনে সরকারের প্রতি তাদের যে ‘দায়বদ্ধতা’ থাকে কিংবা চাকরি জীবনে তারা যা ধারণ করেন, পরবর্তী জীবনে নতুন করে চাকরিতে প্রবেশ করলে ওই মানসিকতা থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারেন না। উপরন্তু সরকারও যে নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করে না, তা নয়।

সংবিধানের ১১৮(৪)-এর অধীনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ ধারাটি সিইসি কিংবা কমিশনাররা প্রয়োগ করেন না। একজন দৃঢ়চেতা সিইসিকে আমরা কখনও পাইনি। ভারতের নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টান্ত আমরা প্রায়ই দিই। মাত্র তিনজন কমিশনার নিয়ে ভারতের মতো দেশের পুরো নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। আমরা এখানে আইন করে ৫ জনের কমিশন করলাম। তাতে ফলটা কী হয়েছে? বর্তমান কমিশন নিয়ে আমাদের সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত ৪ দফার মধ্যে ৩নং দফায় যে আইন প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে, সেটাই হচ্ছে মুখ্য বিষয়। এটা জরুরি। কিন্তু আইন প্রণয়ন করার সময় সরকার যাতে বিতর্কিত না হয়ে যায়, সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি। সরকারের পক্ষে যায় অথবা সরকার ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশনারের কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এমন কোনো ধারা বা বিধান যদি আইনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে মূল উদ্দেশ্যটি ব্যাহত হবে- অর্থাৎ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আমরা পাব না। দ্বন্দ্ব, বিভেদ, বিতৃষ্ণা থেকে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অনুষ্ঠিত বেশ ক’টি নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেলেও ওই সময় আমরা ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ শুনেছি। নির্বাচনে হেরে গেলে রায় মেনে নেয়ার মানসিকতা আমাদের তৈরি হয়নি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটাই বড় সমস্যা।

আসলে মূল কথা একটিই- আস্থার সম্পর্ক গড়ে না উঠলে সার্চ কমিটি গঠন করেও কোনো লাভ হবে না। সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা মতে রাষ্ট্রপতি ‘সম্ভাব্য সার্চ কমিটি গঠন’ কিংবা কমিশনারসহ সিইসিকে নিয়োগদানের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে বাধ্য। এখানেই রয়েছে তার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা। সুতরাং এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীই হচ্ছেন মুখ্য ব্যক্তি। যদিও প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তা তারা মেনে নেবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে অনেক বিকল্প আছে। তিনি সার্চ কমিটির ব্যাপারে নাম চাইতে পারেন দলগুলোর কাছে। এককভাবে তিনি সার্চ কমিটি গঠন করতে পারেন। অথবা সরাসরি সিইসিসহ ৫ জনকে নিয়োগ দিতে পারেন। এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তাই একটা সংলাপ হচ্ছে। ভালো হোক, মন্দ হোক, এ সংলাপ একটা আস্থার সম্পর্ক আদৌ তৈরি করতে পারবে কিনা, সেটি একটা বড় প্রশ্ন এখন।

স্বাধীনতার ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। এ ৪৫ বছরে আমাদের অনেক অগ্রগতি হলেও বড় সমস্যা ঐকমত্যের অভাব। দুই বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্কের অভাব এত বেশি যে, বিপুল সম্ভাবনায় এ দেশ রয়েছে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা পরস্পর পরস্পরের ওপর দোষারোপ করছি। দোষারোপ করতে গিয়ে আমরা অতীতকে বারবার টেনে আনছি। প্রয়োজন যেখানে বেশি, সেই প্রয়োজনকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। অতীতমুখিতা, ব্যক্তি আক্রমণ আমাদের সব অর্জন ম্লান করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে আর আমাদের খুব বেশিদিন বাকি নেই। এখনও যখন কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা দেখছি না, তাহলে কি এই পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস আর একে অন্যকে বিতর্কিত করার প্রবণতা চলতেই থাকবে? যেভাবে রাজনীতি বিকশিত হচ্ছে, তাতে যাদেরই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেয়া হোক না কেন, তারা অচিরেই বিতর্কিত হবেন। সমালোচিত হবেন। তাই শুভবুদ্ধির কোনো মানুষ সমালোচনার ভয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করতেও রাজি হবেন না। এটা আমাদের জন্য যদি কোনো ‘শিক্ষা’ হয়, তা আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভবিষ্যতে কোনো বিতর্কিত নির্বাচন চান না বলে রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদিন সাংবাদিকদের এ তথ্যটি জানিয়েছেন। এ থেকে ধরে নেয়া স্বাভাবিক, প্রধানমন্ত্রী চান সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। তাতে করে নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। জনগণের অংশগ্রহণ বাড়বে। এবং যে কোনো ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবে নির্বাচন কমিশন। একটি ভালো নির্বাচনের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান। সরকার যদি চায়, তাহলে ভালো নির্বাচন সম্ভব। নারায়ণগঞ্জ এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। একটি কঠিন সময় পার করছি আমরা। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। টিভি টকশোতে অনেকে অনেক কথাই বলেছেন। এটি নিয়ে যত কম বিতর্ক হবে, ততই মঙ্গল। তাকাতে হবে সামনের দিকে।

প্রধানমন্ত্রী ‘ভবিষতে আর কোনো বিতর্কিত নির্বাচন চান না’, তার এ উপলব্ধিকে আমি স্বাগত জানাই। গত ৩৫ বছর ধরে তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তার আর কীই বা চাওয়ার আছে? বরং ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ যদি তিনি নিশ্চিত করতে পারেন, তা শুধু আমাদের স্বস্তিই এনে দেবে না, বরং ইতিহাসে তার নাম উজ্জ্বল হয়ে লেখা থাকবে। তিনি উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। দারিদ্র্য কমেছে। এখন যদি তিনি দুর্নীতি রোধ আর সর্বক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোগী হন, তাহলে মানুষ এমনিতেই আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে।

সময় খুব অল্প। ৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হবে না। তবে প্রক্রিয়াটা এগিয়ে থাকুক। আর রাষ্ট্রপতি সবার মতামতের প্রতি সম্মান দেখিয়েই একটি সার্চ কমিটি গঠন করুন, যারা ন্যূনতম ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবেন, যেখান থেকে ৫ জনকে (সিইসিসহ) নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
Daily Jugantor
15.01.2017