রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কিছু কথা

গত ২২ আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে কোনো সেনা প্রত্যাহার করা হবে না। বরং সেখানে আরো সৈন্য পাঠানো হবে। তাঁর ওই ঘোষণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে দেওয়া তাঁর ঘোষণার ঠিক উল্টো। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তিনি বলেছিলেন, তিনি বিজয়ী হলে আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। ২০১০ সালে ওবামা প্রশাসনের আমলে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা হলেও এখনো সেখানে কিছু সৈন্য রয়ে গেছে, যারা আফগান সেনা তথা পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের কাজে নিয়োজিত। এখন ট্রাম্প সেখানে আরো কয়েক হাজার সৈন্য পাঠালে আফগান যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে এবং কোনো ধরনের সমঝোতা সেখানে বিলম্বিত হবে। তাঁর এই সিদ্ধান্ত থেকে মনে হচ্ছে মার্কিন যুদ্ধবাজ জেনারেলরা তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব খাটাচ্ছেন। উত্তর কোরিয়া নিয়ে একটা সংকট এখনো রয়ে গেছে। উত্তর কোরিয়া গুয়ামে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে পারে—এমন একটি আশঙ্কা থাকলেও আপাতত সেই হামলা হচ্ছে না। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক যে খুব ভালো, তা বলা যাবে না।
রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জন্য ভবিষ্যতে যে কয়টি বিষয় বেশি গুরুত্ব পাবে, তার অন্যতম হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগর। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেক। যুক্তরাষ্ট্রের নৌ স্ট্র্যাটেজিস্টরা দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বজায় রাখতে চাইছে। এবং এতে করে চীনের সঙ্গে যেকোনো ‘সংঘর্ষে’ জড়িয়ে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র! অনেক কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে এ অঞ্চলের ব্যাপারে। শুধু স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বই নয়, বরং দক্ষিণ চীন সাগরে রয়েছে বিপুল জ্বালানি সম্পদ, যে সম্পদের ব্যাপারে মার্কিন বহুজাতিক কম্পানিগুলোর আগ্রহ রয়েছে। এক্সন মোবিল-এর সাবেক প্রধান রেক্স টিলারসন এখন ট্রাম্প প্রশাসনে যুক্তরাষ্ট্রের নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বহুজাতিক তেল কম্পানির প্রধানকে যে কেন ট্রাম্প তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেন, এখন এটা বুঝতে কারো বাকি থাকে না। পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখন ‘ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি’ প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। দক্ষিণ চীন সাগরে তেল ও গ্যাসের যে বিপুল রিজার্ভ রয়েছে, তার হিসাব অনেকটা এ রকম : তেল ১১ বিলিয়ন ব্যারেল, গ্যাস ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। এখন ব্যবসায়ী ও সাবেক এক্সন মোবিল প্রধান তাঁর ‘আগ্রহ’ অস্বীকার করবেন কিভাবে? ওবামা প্রশাসন এটা অনুধাবন করেই ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিল। ওবামা ভিয়েতনামের সঙ্গে টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, যা ট্রাম্প বাতিল করেছেন এরই মধ্যে। এই তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সঙ্গে ভারতও জড়িত। ২০১৬ সালে ভারতের চারটি যুদ্ধজাহাজ এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, সেই স্ট্র্যাটেজির অংশীদার ভারতও।
অর্থাৎ এ অঞ্চলজুড়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য গড়ে উঠছে। ওবামা প্রশাসন ২০০৭ সালে ভিয়েতনামের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ পাওয়াকে সমর্থন করেছিল। ওবামা নিজে গত ২০১৬ সালের জুনে ভিয়েতনাম সফর করেছিলেন। চীনের বিরুদ্ধে একটি বলয় তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে ভিয়েতনামের। ভিয়েতনাম হচ্ছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কেন্দ্রবিন্দু। ফলে ওবামার ভিয়েতনাম সফর শুধু সাধারণ একটি সফর ছিল না। চীনের বিরুদ্ধে সামরিক ও অর্থনৈতিক বলয় সৃষ্টি করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করছে। আর এই মহাপরিকল্পনায় একাধিক দেশকে জড়িত করছে যুক্তরাষ্ট্র। এখানে বলা ভালো, চীনের বিরুদ্ধে একটি সামরিক বলয় তৈরি করার অংশ হিসেবেই গত বছর দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনসহ একাধিক দেশের সঙ্গে সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে পাঁচটি প্রাথমিক ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল ফিলিপাইন। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের নৌ ইস্টার্ন কমান্ডের চারটি গাইডেড মিসাইল সজ্জিত যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই জাহাজগুলো দক্ষিণ চীন সাগর ও উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছিল। এর অর্থ পরিষ্কার, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী যে নীতি, তাতে ভারতকেও পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে আমরা ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌ স্ট্র্যাটেজি নিয়ে কালের কণ্ঠে লিখেছি। ভারত এ অঞ্চলে অন্যতম নৌ শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর তার অংশ হিসেবেই ভারত এই প্রথমবারের মতো তাদের ইস্টার্ন কমান্ডের চারটি যুদ্ধজাহাজকে এ অঞ্চলে মোতায়েন করেছিল। যদিও দক্ষিণ চীন সাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। ভারত ভিয়েতনামের সঙ্গে চুক্তি করে এ অঞ্চলে তেল ও গ্যাসের অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
২০১৬ সালে ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা এবং ৩২০ কোটি ডলারের ছয়টি ইলেকট্রিক সাবমেরিন বিক্রির যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দিয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধব্যবস্থা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও বলা হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে দক্ষিণ কোরিয়াই এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। তবে চীনে আধা ঘণ্টারও কম সময়ে আঘাত হানতে সক্ষম এমন হাইপারসনিক গ্লিড ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থাও মোতায়েন করা হয় সেখানে। চীন বিষয়গুলো খুব সহজভাবে দেখছে না। এতে করে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আরো বাড়ছে। সর্বশেষ ট্রাম্পের ‘এক চীনা নীতি’ পরিত্যাগের হুমকি একটি নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে।
এখানে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। আগামী দিনে এই অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান-পতন বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। প্রায় ৩৫ লাখ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে চীন সাগরের বিস্তৃতি। এই অঞ্চলটি চীনের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণে, ফিলিপাইনের পশ্চিমে, মালয়েশিয়ার উত্তরে, ব্রুনাইয়ের উত্তর-পশ্চিম, ইন্দোনেশিয়ার উত্তরে এবং ভিয়েতনামের পূর্বে অবস্থিত। এ অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়েছে এ কারণে যে দক্ষিণ চীন সাগরে প্রায় ১১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রয়েছে। এবং গ্যাস রয়েছে ১৯০ দশমিক ২০ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার। চীনের আগ্রহ সে কারণেই দিনে দিনে বেড়েছে। চীনের প্রচুর ‘জ্বালানি ক্ষুধা’ রয়েছে। চীনের অর্থনীতিকে সঠিক পথে চালাতে প্রচুর জ্বালানি দরকার। এ ক্ষেত্রে এই অঞ্চলে যদি চীনের কর্তৃত্ব থাকে, তাহলে চীন তার জ্বালানি চাহিদা এখান থেকে মেটাতে পারবে। এই সমুদ্রপথটি পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ। এ কারণে এর গুরুত্ব আরো বেড়েছে। পৃথিবীর সমুদ্রপথে যত বাণিজ্য হয়, তার এক-তৃতীয়াংশ হয় এই পথে। চীন, জাপান, কোরিয়া দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ায় যাওয়ার বাণিজ্যিক রুট হিসেবে এ পথকে ব্যবহার করে। দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত স্প্রাটলি, প্যারাসেল ও টনকিন উপসাগরে অবস্থিত কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে আশপাশের দেশ, বিশেষ করে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার সঙ্গেই চীনের বিরোধ। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই অঞ্চলের, অর্থাৎ দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব বেড়েছে একাধিক কারণে। শুধু চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’ কিংবা চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে একটি ‘ঐক্য’ করার পাশাপাশি জাপানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকির মোকাবেলা করা, এই সাগর দিয়ে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করার ব্যাপারে মার্কিনি স্বার্থ রয়েছে। এর ওপরে রয়েছে এ এলাকার তেল ও গ্যাস সম্পদের ওপর মার্কিন বহুজাতিক কম্পানির লোলুপ দৃষ্টি। ফলে এই অঞ্চলটি যে আগামী দিনের প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করতে আজ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান, এমনকি ভারতও তৎপর। যুক্তরাষ্ট্র এ দেশগুলোকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে। এটি বিশ্বের বড় সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটের একটি। বিশ্ব বাণিজ্যের ৩২ শতাংশ এ পথ দিয়ে পরিবাহিত হয়। চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এটি সংযুক্ত নয়। মূল ভূখণ্ড থেকে এক হাজার নটিক্যাল মাইল দূরে এই দ্বীপপুঞ্জগুলো অবস্থিত। জাপান এই রুট দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করে এবং ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যিক রুট হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। জাপান এই দ্বীপগুলোর নাম দিয়েছে সেনকাকু, যা চীনের কাছে পরিচিত দিয়াওইউ নামে। ঐতিহাসিকভাবে চীনের শি ও হান রাজবংশের কর্তৃত্ব অনুযায়ী চীন এ অঞ্চলের মালিকানা দাবি করে এলেও এ অঞ্চলের আশপাশের দেশগুলো তা মানতে নারাজ। জাপানের নিজস্ব কোনো তেল ও গ্যাস নেই। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর দেশটি পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। জাপান দৈনিক ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই সামুদ্রিক পথটি ব্যবহার করে আমদানি করে থাকে।
এ অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব থাকায় চীন এ অঞ্চলে নতুন করে একটি কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়েছে। সেখানে যুদ্ধবিমান মোতায়েনের জন্য বড় বড় রানওয়ে তৈরি করছে। মিসাইল ব্যাটারি স্থাপন করেছে। এমনকি ভবিষ্যতে এখানে পারমাণবিক সাবমেরিন যাতে ‘ডক’ করতে পারে, সে ব্যবস্থাও করেছে চীন। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র এই আতঙ্ককে ব্যবহার করছে তার স্বার্থে। বলা ভালো, দক্ষিণ চীন সাগরের এই বিরোধটি জাতিসংঘের সামুদ্রিক বিবাদ নিষ্পত্তিসংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে উত্থাপিত হয়েছিল। ফিলিপাইন ছিল এর উদ্যোক্তা। তবে চীন এই শুনানিতে অংশ নেয়নি। কিন্তু আদালত চীনের বিরুদ্ধে রায় দিলেও চীন কূটনীতিতে বড় সাফল্য পেয়েছে। ফিলিপাইনের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট দুতার্তেকে চীনে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানিয়ে চীন ফিলিপাইনের সঙ্গে একটি  বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলছে। দুতার্তের আমলে ফিলিপাইনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। দুতার্তে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ওবামাকে আক্রমণ করেছিলেন। দুতার্তের স্ট্র্যাটেজি থেকে এটা বোঝা যায়, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে সব নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে চান। ফিলিপাইনে মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে এবং মার্কিন সেনারা চুক্তিবলে ফিলিপাইনের একাধিক সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করে। এখন ট্রাম্পের শাসনামলে এই সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাও দেখার বিষয়। ট্রাম্প প্রশাসনে একাধিক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল রয়েছেন। তাঁরা সবাই বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ‘প্রভাব’ দেখতে চান। এখন ট্রাম্প যতই বলুন না কেন তিনি আর ন্যাটোর খরচ বহন করবেন না, কিন্তু পেন্টাগন এটা কি চাইবে? খুব স্বাভাবিকভাবেই পেন্টাগন এটা চাইবে না। আর চাইবে না বিধায় একদিকে সিরিয়ায় যুদ্ধও থামছে না, অন্যদিকে আফগানিস্তানে নতুন করে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রাম্প। যদিও বলা হচ্ছে, অব্যাহত তালেবান আর আইএসের আক্রমণ ঠেকাতেই আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েনের এই সিদ্ধান্ত। তবে ট্রাম্প প্রশাসন এটাও চাইছে ভারত আফগানিস্তানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্কের যে অবনতি ঘটতে যাচ্ছে, সে রকমটির আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং এশিয়া-প্যাসিফিক তথা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে ‘কিছুটা’ পরিবর্তন আসছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে সম্মতি দিয়েছে বিশ্বের পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠী বা এনএসজিতে ভারতের অন্তর্ভুক্তির (৪৮ দেশ এর সদস্য)। চীনের আপত্তি আছে ভারতের ব্যাপারে। মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল এমটিসিতেও ভারত ঢুকতে চায়। নীতিগতভাবে তাতে সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এতে অত্যাধুনিক মিসাইল টেকনোলজি পাবে ভারত। ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনতে চায় এফ-১৬ ও এফ-১৮ জঙ্গি বিমান। এটা স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক এখন অনেক উষ্ণ। এশিয়া-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, তাতে স্পষ্টতই ভারত পালন করতে যাচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চীনের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত কিংবা মোদির ওয়াশিংটন সফর মূলত সবই এক সূত্রে গাঁথা। তাই আগামী দিনগুলোয় এশিয়া-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে তৈরি হবে যুদ্ধের একটি নয়া আবহ। স্নায়ুযুদ্ধের নয়া এক রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করব এ অঞ্চলে।
Daily Kalerkontho

29.08.2017



প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মন্তব্যগুলো ভাবিয়ে তুলেছে


বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন গত ২১ আগস্ট। তিনি কথাটি বলেছেন এমন এক সময়, যখন নির্বাচন কমিশন একাদশ জতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সুশীল সমাজ, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও ইলেকট্রুনিক মিডিয়ার সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এবং সাংবাদিকদের কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তার কথাবার্তায় নতুন করে একটা ‘শঙ্কা’ তৈরি হয়েছে আগামী নির্বাচনটি কেমন হবে, সে ব্যাপারে। ইইউ রাষ্ট্রদূত ও সিইসির বক্তব্যের মাঝে একটি যোগসূত্র আছে- আর সেই যোগসূত্রটি হচ্ছে ‘সকল দলের অংশগ্রহণমূলক’ একটি নির্বাচন। ইইউ রাষ্ট্রদূত আশাবাদী আগামীতে একটি ‘স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক’ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সে রকম একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এ নিয়ে গত সাড়ে তিন বছরে অনেক ‘ঘটনা’ ঘটেছে। নিরীহ অনেক মানুষ মারা গেছে। অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। এমনকি ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে যেসব মন্তব্য করেছেন, তাও রাজনীতিতে বড় ‘বিতর্ক’ সৃষ্টি করেছে। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণে বর্তমান সংসদ নিয়েও কথাবার্তা আছে।

ইইউ’র রাষ্ট্রদূত যে কথা বলেছেন, তা নতুন নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ কথাটা বলা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণেই যে বিএনপি নীতিগতভাবে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে তাদের একটা ‘শর্ত’ আছে। ‘শর্তটি’ হচ্ছে নির্বাচনকালীন একটি সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যেতে চাচ্ছেন না। রাষ্ট্রদূত তাই সাংবাদিকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে সবার মধ্যে একটা আগ্রহ দেখেছেন। তবে এ কথাটাও তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি, গত জাতীয় নির্বাচন (দশম জাতীয় সংসদ, ২০১৪) অনেককেই হতাশ করেছিল। এটি এখন অতীত এবং এ থেকে শিক্ষা হয়েছে। কিন্তু সিইসির কিছু বক্তব্য আমাদের হতাশার মাঝে ফেলে দেয়। ইইউ’র বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের মাত্র কয়েকদিন আগে ১৭ আগস্ট সিইসি বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন কোনো ধরনের মধ্যস্থতা করবে না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘কারও চাওয়া বা না চাওয়ার ওপর সেনা মোতায়েনের বিষয় নির্ভর করে না।’ তার আরও একটি বক্তব্য নিয়েও গুঞ্জন আছে। তিনি বলেছেন, ‘সরকার যে নির্বাচন পদ্ধতি সেট করে দেয়, সেই নিয়মেই আমাদের নির্বাচন করতে হয়।’ সিইসি তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিরোধীও বক্তব্য রাখেন। ফলে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে কিনা, এটা নিয়ে একটা শঙ্কা থাকলই। নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের প্রত্যাশা বেশি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কি সরকারের সহযোগিতা পাবে? সরকারি কর্মকর্তারা নির্বাচনপূর্ব তিন মাস সময়ে নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন থাকে। এটাই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা (সংবিধানের ধারা ১২৬)। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা দেখি ভিন্ন চিত্র। জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা ইসি নয়, বরং মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রিত হন। তারা সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যেতে পারেন না। অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কথা না হয় নাই বললাম। উপজেলা নির্বাচনে কী হয়েছিল? মিডিয়ার বদৌলতে আমরা দেখেছি ভোট কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা হচ্ছে, পুকুরে ব্যালট পেপার ভাসছে কিংবা তারও আগে প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। তাকে ‘হাইজ্যাক’ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইত্যাদি। ওই সময় তো ‘শান্তি-শৃঙ্খলা’ রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল। তারা কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিল? ডিসি সাহেবরা ছিলেন। কিন্তু তাদের ভূমিকা কী ছিল? সুতরাং সেনা মোতায়েনের প্রশ্নটা বিবেচনায় নেয়া জরুরি। ইসি এককভাবে এটা পারে না। সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা দরকার। এ সহযোগিতা ইসি সব সময় পেয়েছে, তা বলা যাবে না। তাই সুধী সমাজের এবং সাংবাদিকদের অনেক প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কাগজ-কলমেই থেকে যেতে পারে।

এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসিকে একটা ‘সমঝোতায়’ যেতে হবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইসির ৭ দফাকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বড় আলোচনায় যাওয়ার দরকার নেই। মূল আলোচনা হতে হবে বিএনপির সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। যদিও এটা সত্য, ‘সহায়ক সরকার’-এর যে কথা বিএনপি বলে আসছে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন নয়। তবে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ নিতে পারে নির্বাচন কমিশন। এটা কঠিন কিছু নয়। সিইসির আর জীবনে পাওয়ার কিছু নেই। পূর্ণ সচিব না হয়েও কিংবা সচিব হিসেবে সচিবালয়ে কাজ না করেও তিনি সিইসি হয়েছেন। থাকবেন ৫ বছর। এরপর তো তার আর পাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু জাতি তাকে মনে রাখবে যদি তিনি দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নেন। একমাত্র তার আন্তরিকতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি যদি আদৌ কোনো উদ্যোগ না নেন, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে সম্ভব? সব সময় সংবিধানের দোহাই দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সাংবিধানিকভাবে সরকারের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। সরকারি দলের জন্য এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। তারপরও ‘যে কোনো ফর্মুলায়’ বিএনপিকে নির্বাচনী রাজনীতিতে আনতে হবে। ইতিমধ্যে আদালতের অনুমতি না নিয়ে বেগম জিয়া দেশ ছেড়েছেন বলে দুদক আদালতের কাছে আর্জি জানিয়েছে। বেগম জিয়ার লন্ডন গমন নিয়ে মন্ত্রীরা নানা কথা বলছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এ ধরনের কথাবার্তা না বলাই মঙ্গল। আমরা চাই আস্থার সম্পর্ক। এ আস্থার সম্পর্কই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। ৭ দফা ‘রোডম্যাপ’ কিংবা রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে, তা নিশ্চিত করা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর আমরা পার করেছি।

আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধ শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফটপাওয়ার’ হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে ‘অর্জন’, এই ‘অর্জন’ মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এ ‘আস্থার সম্পর্ক’ শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি নেই। কিন্তু সময় এসেছে এ ব্যাপারে কথা বলার ও সিদ্ধান্ত নেয়ার। উচ্চ আদালতের একটি রায় নিয়ে (ষোড়শ সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গে) একের পর এক যেসব ‘ঘটনা’ ঘটে চলেছে, তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং গণতন্ত্রের জন্য হুমকিও বটে। প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবি, তার ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা কিংবা তিনি যখন অবসরে যাবেন (জানুয়ারি ২০১৮) তখন তার কী হবে, এ ধরনের কথাবার্তা বলে আমরা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি শুধু নষ্টই করছি না, বরং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণারও জন্ম দিচ্ছি। দুর্ভাগ্য এখানেই যে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায় ও প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ নিয়ে স্পষ্টতই জাতি বিভক্ত হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ যেখানে রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে তাদের ঘোরতর আপত্তির কথা জানাচ্ছে, সেখানে বিএনপি অনেকটাই উৎফুল্লিত। বিএনপি যেখানে বলছে পর্যবেক্ষণ নিয়ে মন্তব্যকারী মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ‘হাইকোর্ট অবমাননা মামলা’ দায়ের করতে, সেখানে প্রধান বিচারপতি নিজে বলেছেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক ট্রাপে জড়াবেন না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ দুটি বড় দলের ভেতরকার দ্বন্দ্ব ও এক পক্ষ অন্য পক্ষকে সহ্য না করার যে মানসিকতা- উচ্চ আদালতের সর্বশেষ রায়ের পর্যবেক্ষণেও তার প্রতিফলন ঘটল। বিদায়ী ইইউ রাষ্ট্রদূত যখন আবারও ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ প্রত্যাশা করেন এবং সিইসি যখন বলেন, দু’পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করা তার কাজ নয়, তখন সত্যিকার অর্থেই তা আমাদের হতাশার মধ্যে ফেলে দেয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কি আদৌ হবে? বিএনপি কি আদৌ নির্বাচনে অংশ নেবে? যদি না নেয়, তাহলে কি আমরা আবারও ২০১৪ সালের জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি? এসব প্রশ্ন আমাদের ভাবায়। আমাদের শঙ্কিত করে। আমাদের আশা ভঙ্গ হয়। এ ‘পথ’ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে রাজনীতিবিদদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা তারাই দেশ চালান ‘জনগণের প্রতিনিধি’ হয়ে। এ ক্ষেত্রে সিইসি তার ‘করার কিছু নেই’ বলে যখন মন্তব্য করেন, তখন আমাদের বলতেই হয় তিনি তার ‘পদের’ প্রতি সুষ্ঠু বিচার করছেন না। ‘সরকার যে নির্বাচন পদ্ধতি সেট করে দেয়, সেই নিয়মেই আমাদের নির্বাচন করতে হয়’- এ কথা বলে তিনি কার্যত সাংবিধানিকভাবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অস্বীকার করেছেন। এটা খারাপ নজির। প্রধান বিরোধী দল তার এ বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে! এখনও অনেক সময় বাকি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের সময় তিনি তাদের সংযত আচরণ করতে বলুন, বিএনপিসহ সব দলকে সভা-সমাবেশ করার ব্যবস্থা করুন, সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিন। সিইসি এ কাজগুলো যদি করেন, তাহলে ইইউর বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে। একটা ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ আমরা পেতে পারি। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এটাই। প্রধানমন্ত্রী এমনটি চান বলেও আমার ধারণা।
Daily Jugantor
27.08.2017

সিইসি কি শেষ কথাটা বলে ফেলেছেন




সিইসি বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা আবারও নিজেকে ‘বিতর্কিত’ করলেন। ১৭ আগস্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপের পর সংবাদ সম্মেলনে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা আবারও নতুন করে ‘বিতর্ক’ সৃষ্টি করেছে। তিনি এসব মন্তব্য করলেন এমন একসময়, যখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া অনেকটাই শুরু হয়ে গেছে এবং বিভিন্ন মহল থেকে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন কোনো ধরনের মধ্যস্থতা করবে না। এটা ইসির কাজ নয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘কারও চাওয়া বা না চাওয়ার ওপর সেনা মোতায়েনের বিষয় নির্ভর করে না।’ অপ্রসাঙ্গিকভবে তিনি এমন অনেক কথা বলেছেন, যা তার বলা উচিত ছিল না। তিনি কৌশলী হলে এ ধরনের কথা বলতেন না। তার ভাষায়, ‘আমরা তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর নির্ভরশীল নির্বাচন দেখেছি। বলুন তো, শেষের দিকের অবস্থা কেমন ছিল? শেষদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সে গ্রহণযোগ্যতা ছিল না।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দেশে টেকেনি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘সরকার যে নির্বাচন পদ্ধতি সেট করে দেয়, ওই নিয়মেই আমাদের নির্বাচন করতে হয়।’ সিইসি মনে করেন, ‘বর্তমানে আমরা শতভাগ অনুকূল ও আস্থাশীল অবস্থানে রয়েছি। কেউ আমাদের ডিস্টার্ব করেনি। কেউ কমিশনে দাবি-দাওয়া নিয়ে আসেনি।’ দেশের মানুষ যখন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, বিদেশিরা যখন সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন দেখতে চায়, সুশীল সমাজ যখন সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা বলে, তখন সিইসির আগ বাড়িয়ে এসব কথা বলা শুধু বিভ্রান্তিই বাড়াবে। তিনি ‘কম’ কথা বললে ভালো করবেন। তাকে সবার আস্থা অর্জন করতে হবে। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন তিনটি ‘সংলাপ’ করেছে। সুশীল সমাজ, সিনিয়র সাংবাদিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। সবাই মোটামুটি সেনাবাহিনী মোতায়েন আর ‘না’ ভোটের বিধান রাখার কথা বলেছেন। কিন্তু সিইসির কথায় আমার কাছে এটা মনে হয়নি যে, তিনি সেনাবাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে সিরিয়াস। এক্ষেত্রে তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন সরকারের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। আর যদি সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে প্রশ্ন উঠবে সরকারের অসহযোগিতা নিয়ে। কেননা নির্বাচন কমিশন এককভাবে নির্বাচন পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে না। নানাবিধ কাজে তার সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। ডিসি, এসপি, ওসিÑ এরা তত্ত্বগতভাবে নির্বাচনের আগে তিন মাস সময় নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন থাকে। এটাই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা (সংবিধানের ধারা ১২৬)। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা দেখি ভিন্ন চিত্র। জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা ইসি নয়, বরং মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রিত হন। তারা সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যেতে পারেন না। অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কথা না হয় না-ইবা বললাম। উপজেলা নির্বাচনে কী হয়েছিল? মিডিয়ার বদৌলতে আমরা দেখেছি ভোট কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা হচ্ছে, পুকুরে ব্যালট পেপার ভাসছে কিংবা আরও আগে প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি, কেউ কেউ তাকে ‘হাইজ্যাক’ করে নিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। ওই সময় তো শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল! তারা কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলেন? ডিসিরা ছিলেন; কিন্তু তাদের ভূমিকা কী ছিল? সুতরাং সেনা মোতায়েনের প্রশ্নটা বিবেচনায় নেয়া জরুরি। ইসি এককভাবে এটা পারে না। সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা দরকার। এ সহযোগিতা ইসি সব সময় পেয়েছে, তা বলা যাবে না। তাই সুধী সমাজের অনেক প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কাগজে-কলমেই থেকে যেতে পারে। এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসিকে একটা ‘সমঝোতা’য় যেতে হবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইসির সাত দফাকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বড় আলোচনায় যাওয়ার দরকার নেই। মূল আলোচনা হতে হবে বিএনপির সঙ্গে। এক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। যদিও এটা সত্য, ‘সহায়ক সরকার’র যে কথা বিএনপি বলে আসছে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন নয়। তবে দুইটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ নিতে পারে নির্বাচন কমিশন। এটা কঠিন কিছু নয়। সিইসির আর জীবনে পাওয়ার কিছু নেই। পূর্ণ সচিব না হয়েও কিংবা সচিব হিসেবে সচিবালয়ে কাজ না করেও তিনি সিইসি হয়েছেন। থাকবেন ৫ বছর। এরপর তো তার আর পাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু জাতি তাকে মনে রাখবে, যদি তিনি দুইটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নেন। একমাত্র তার আন্তরিকতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ তিনি যদি আদৌ কোনো উদ্যোগ না নেন, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে সম্ভব? সব সময় সংবিধানের দোহাই দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সাংবিধানিকভাবে সরকারের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। সরকারি দলের জন্য এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। তারপরও ‘যে কোনো ফর্মুলায়’ বিএনপিকে নির্বাচনী রাজনীতিতে আনতে হবে। এরই মধ্যে আদালতের অনুমতি না নিয়ে খালেদা জিয়া দেশ ছেড়েছেন বলে দুদক আদালতের কাছে আরজি জানিয়েছে। খালেদা জিয়ার লন্ডন গমন নিয়ে মন্ত্রীরা নানা কথা বলছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এ ধরনের কথাবার্তা না বলাই মঙ্গল। আমরা চাই, আস্থার সম্পর্ক। এ আস্থার সম্পর্কই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। সাত দফা ‘রোডম্যাপ’ কিংবা রংপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে, তা নিশ্চিত করা যাবে না।
সরকারি দল প্রকাশ্যে এবং গোপনে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। খালেদা জিয়াও লন্ডন যাওয়ার আগে ‘ধানের শীষে’ ভোট চেয়েছেন। এরশাদও সক্রিয়। সুতরাং বিএনপিসহ অন্য দলগুলোও যাতে সভা-সমাবেশ করতে পারে, এটা নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা কোনো দলই নির্বাচনী তফসিলের আগে কোনো সভা-সমাবেশ করতে পারবে না। ইসি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ করছে, তাতে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ থাকবে না। কেননা নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে। জামায়াত হিসেবে নির্বাচনে অংশ না নিলেও কীভাবে এবং বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী, এ ব্যাপারেও আগ্রহ থাকবে অনেকের। নতুন কয়েকটি ইসলামিক দল তথা জোটকে নতুন করে নিবন্ধন দেয়া হবে। হেফাজতের সমর্থকরা তাতে থাকবেন। এটাও রাজনীতিতে নতুন একটি দিক। তবে নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের আদৌ কোনো ভূমিকা থাকবে কিনা, এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা।
আমরা নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করেছি। যেখানে ভারতের মতো দেশে মাত্র তিনজন কমিশনার দিয়ে নির্বাচনের সব কর্মকা- পরিচালিত হয়, সেখানে আমরা পাঁচজন কমিশনার (একজন সিইসিসহ) নিয়ে নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করছি। কিন্তু এতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সরকারের নিরপেক্ষ থাকা যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনই নির্বাচন কমিশনেরও ‘ক্ষমতা প্রয়োগ’ করার বিষয়টি জরুরি। নির্বাচন কমিশন কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, আমরা তা কেউই চাই না। একটি অর্থবহ, গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন প্রয়োজন। তা হলেই আমরা গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব। আর না হলে এ দেশে গণতন্ত্রের ‘মৃত্যু’ ঘটবে। নির্বাচন কমিশন যদি বিষয়টি উপলব্ধি করে, তাহলে তা আমাদের সবার জন্য মঙ্গল।
এ দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য দুইটি বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধ শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফটপাওয়ার’ হিসেবে এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেন’-এ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে ‘অর্জন’, এই ‘অর্জন’ মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুইটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুইটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি নেই। কিন্তু সময় এসেছে এ ব্যাপারে কথা বলার এবং একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার। এ কারণেই ইসি সংলাপে বলা হয়েছেÑ এখনই সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হোক। মামলা-মোকদ্দমা থাকতেই পারে; এজন্য দেশে আইন আছে, আদালত আছে। আইন ও আদালতকে ‘ফেস’ করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা সবাই চাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। চাই একটি শক্তিশালী পার্লামেন্ট। আর এভাবেই গণতন্ত্রের ভিতকে আমরা আরও শক্তিশালী করতে পারব। না হলে আগামীতে বাংলাদেশের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারব না আমরা। যে কথাগুলো সুধী সমাজ বলেছে, তার মাঝে কোনো রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ নেই বা কোনো রাজনৈতিক দলের মনোভাবও তাতে প্রতিফলিত হয়নি। তবে সুশীল সমাজ নয়, বরং সিদ্ধান্ত নেবে রাজনৈতিক দলগুলো। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে আদৌ সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে কিনা, কিংবা ‘না’ ভোট কীভাবে পুনঃস্থাপিত হবে। আমরা চাই, এ ব্যাপারে একটা সমঝোতা হোক। কিন্তু আমরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি, যখন সিইসি বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলেন। তিনি যদি তার ‘মাইন্ড সেটআপ’ পরিবর্তন করতে না পারেন, তাহলে বড় দলগুলোর আস্থা তিনি পাবেন না। তাকে কথাবার্তায় সংযত হতে হবে এবং বড় দলগুলোকে আস্থায় নেয়ার লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে।
 Daily Alokito Bangladesh
27.08.2017

চীন-ভারত দ্বন্দ



গত প্রায় দুমাস ডোকলাম নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। সেখানে দুই দেশের সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। চীন ও ভুটানের মাঝখানে ৮৯ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই মালভূমিটি ভুটানের হলেও, চীন এর মালিকানা দাবি করছে। সেখানে চীন এখন একটি সড়ক নির্মাণ করছে। আর তাতেই আপত্তি ভারতের। ভারত এই সড়ক নির্মাণকে তার নিরাপত্তার প্রতি একধরনের হুমকি হিসেবে দেখছে। যদিও ডোকলাম নিয়ে চীন ও ভুটানের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সেখানে ভারতের জড়িত হবার কথা নয়। কিন্তু ভারত ও ভুটানের মধ্যকার ৭০ বছরের পুরনো মৈত্রী চুক্তি অনুযায়ী ভারত ‘আমন্ত্রিত’ হয়ে ডোকলামে সৈন্য পাঠিয়েছে। সংকট বাড়লে ভুটান ভারতকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়ার ‘অনুরোধ’ জানালেও, ভারত তাতে কর্ণপাত করেনি। বরং ডোকলাম মালভূমির ৩৫ কিলেমিটার দূরে অবস্থিত ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি গ্রাম থেকে সেখানে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিয়েছে। সেখানে এখন ভারতীয় বাহিনী ছাউনি ফেলেছে। কৌশলগতভাবে ডোকলাম ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেখান থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে রয়েছে শিলিগুড়ি করিডোর। ভারতের ভয়টা এখানেই। চীন যদি শিলিগুড়ি করিডোরে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, তাহলে ভারতের সাতবোন রাজ্যের সাথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাই ডোকলাম নিজের এলাকা না হওয়া সত্ত্বেও ভারত এখানে সেনা মোতায়েন করেছে। ফলে ডোকলামের কর্তৃত্ব নিয়ে যদি চীন-ভারত যুদ্ধ বাঁধে, তাতে ‘সুবিধা’ নেবে তৃতীয় পক্ষ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অনেকেই জানেন চীনকে ‘ঘিরে ফেলার’ একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তার সামরিক তৎপরতা সম্প্রসারিত করেছে ভারত মহাসাগরে। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ষ্ঠ ফ্লিন্টের যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করা হবে। পূর্ব চীন সাগরে বেশ কটি বিতর্কিত দ্বীপ রয়েছে, যে দ্বীপগুলোর মালিকানা নিয়ে চীনের সাথে জাপান ও ফিলিপাইনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এখন এ অঞ্চলে মার্কিন নৌ সেনা মোতায়েনের অর্থ হচ্ছে চীনের উপর পরোক্ষভাবে ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। একই সাথে ভারত মহাসাগরে চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। চীন এ অঞ্চল ঘিরে যে ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করেছে (বন্দর স্থাপনা, রিফুয়েলিং স্টেশন ইত্যাদি), এটাও ভাল চোখে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে চীনের স্বার্থ খর্ব করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগর (ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে রয়েছে বিশ্বের তেলের রিজার্ভের ৬০ ভাগ, আর গ্যাস রিজার্ভের তিন ভাগের এক ভাগ) আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে চীনের প্রয়োজন রয়েছে রাশিয়ার সমর্থনের। ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ অনুযায়ী এ অঞ্চলে মস্কো, তেহরান, বেইজিং ও কলম্বের মধ্যে যে ‘ঐক্য’ গড়ে উঠেছিল, সে ‘ঐক্য’-কে দৃঢ় করতেই শি জিন পিং গেল সেপ্টেম্বরে (২০১৬) ভারত সফর করেছিলেন। এর আগে তিনি মস্কো যান। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশে শি জিন পিং যে বক্তব্য রাখেন, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেখানে এক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের প্রভাব বিস্তারের বিরদ্ধে শি জিন পিং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। চীনা রাষ্ট্রপ্রধান গেল বছরের মাঝামাঝি ব্রাজিলে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকাও ব্রিকস এর অন্যতম শক্তি। ব্রিকস বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক জোট।
২০৫০ সাল নাগাদ ব্রিকস দেশগুলোর মোট জিডিপির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ১২৮.৪ ট্রিলিয়ন ডলার (যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান থাকবে ৩৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে)। একই সময় ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য সম্পর্ক ৩৪০ বিলিয়ন ডলার (২০১২) ডলার থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ৫০০ বিলিয়নে। সুতরাং চীন ও ভারত কেউই ঝুঁকি নেবে না উভয় দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হোক। চীন ও ভারত, উভয়েরই উভয়ের প্রয়োজন রয়েছে। বাণিজ্য নির্ভর বিশ্ব ব্যবস্থায় এক কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে উভয় দেশই সোচ্চার। প্রভাব বলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে সম্পর্কে উষ্ণতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে এটা সত্য। কিন্তু ইতিহাস বলে দেশ দুটি এক সময় বন্ধু ছিল। মধ্য পঞ্চাশের দশকে ‘হিন্দি- চিনি ভাই ভাই’ সেøাগান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। তিব্বতকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন যে ‘পঞ্চশীলা নীতি’ নীতি গ্রহণ করেছিল, যা ন্যাম বা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন প্রতিষ্ঠায় একটি ভিত্তি দিয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে এই পঞ্চশীলা নীতি। যেমন বলা যেতে পারে ইন্দোনেশিয়ার কথা। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে এই পঞ্চলীলার কথা বলা আছে। মধ্য পঞ্চাশের সেই ‘নেহেরু-চৌএন লাই ইমেজ আবার ফিরে এসেছিল ‘মোদি-শি জিন পিং বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে। এটি এখন কতটুকু কার্যকর হবে, মোদির সেপ্টেম্বরে বেইজিং সফর (২০১৭) দুদেশের সম্পর্ককে কত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে।
এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে মানসিকতার। ভারতের ব্যুরোক্রেসি ভারতকে একটি বিশ্ব শক্তি হিসেবে দেখতে চায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে এই প্রভাব কাটানো কঠিন। মনমোহন সিং পারেননি। এখন দেখার পালা মোদি কতটুকু পারেন? তবে এটা তো সত্য মোদির নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। তিনি রাজনীতিকে পাশে ঠেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি। তার চাই উন্নয়ন। চাই বিনিয়োগ। চাই ব্যবসা। সে কারণে পুরনো বৈরিতা ভুলে গিয়ে তিনি প্রথম চীন সফরে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। তার বৈদেশিক নীতির এটাই বড় বৈশিষ্ট্য। তার জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং সর্বশেষ চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরের উদ্দেশ্য ছিল একটাইÑ তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিকে সফল করা। এখন ভারতের সাথে চীনের সীমান্ত ‘দ্বন্দ্ব’ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে মোদি তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নিয়ে তিনি বেশি দূর যেতে পারবেন না। তিনি ভারতবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আগামী ২০২২ সালের মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সবার জন্য কাজের ব্যবস্থা করবেন। প্রতিবছর ১২০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ সেখানে ‘জব মার্কেটে’ প্রবেশ করছে। এদের জন্য কাজ দরকার। চীনের মতোই ভারতকে একটি ‘পণ্যের উৎপাদনশীল’ দেশে পরিণত করতে চান মোদি। চীনের সাথে দ্বন্দ্ব বাড়লে, সেনাবাহিনী চাইবে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ভার বাড়ানোর। ভারত তার নৌ ও বিমানবাহিনী আধুনিকীকরণ করছে। নৌবাহিনীতে মোট ২৮টি সাবমেরিন সংযোজনের (বর্তমানে আছে ১৫টি) উদ্যোগ নিয়েছে ভারত।
বিমানবাহিনীতে নতুন বিমান আসছে। ভারত এখন নিজেই তৈরি করবে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান। লকহিড়ের সাথে চুক্তিও হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আগামীতে আরও বাড়বে। সীমান্ত সমস্যা, বিশেষ করে ডোকলাম সমস্যার সমাধান যদি না হয়, তাহলে এই উত্তেজনা অন্য অঞ্চলেও সম্প্রসারিত হবে। খুব সংগত কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাতে আক্রান্ত হবে, যা এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য কোনো ভাল খবর নয়। আগামী মাসে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ব্রিকস এর র্শীষ সম্মেলন। নরেন্দ্র মোদির সেখানে যাবার কথা এবং মোদি শি জিন পিং এর মধ্যে বৈঠকের সম্ভাবনাও বেশি। কিন্তু দুপক্ষ যদি নমনীয় না হয় এবং সেখানে যদি ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় না থাকে, তাহলে আগামীতে ব্রিকস ভেঙে যাবার ঝুঁকিতে থাকবে। তাই এ মুহূর্তে ডোকলাম থেকে সকল পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহার জরুরি। দুঃখজনক হচ্ছে দুমাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কোনো পক্ষই নমনীয় হচ্ছে না। এরই মাঝে লাদাখে ভারত ও চীনা সেনাবাহিনীর মধ্যে হাতাহাতির খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ফুটেজ সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। তবে ভারত যুদ্ধের কোনো ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না। এর অনেকগুলো কারণ আছে।
প্রথমত, যুদ্ধ বেঁধে গেলে ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দের জন্য জোর দাবি করবে। মোদি সরকার সেটা দিতে বাধ্য হবে। ফলে মোদির বহুল আলোচিত ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ শুরু হলে চীন ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল রাজ্যগুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। চীনের গণমাধ্যম ইতোমধ্যে বলেছে প্রয়োজনে চীন সিকিম স্বাধীন করে দেবে। অরুণাচল নিয়ে চীন তার দাবি পরিত্যাগ করেনি। এক্ষেত্রে চীন অরুণাচলের অংশ বিশেষ দখল করে নিতে পারে। তৃতীয়ত, ডোকলাম থেকে ভারত যদি তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে না নেয়, তাহলে চীন কাশ্মীরে সেনা মোতায়েন করতে পারে। চীন এটা করতে পারে (?) পাকিস্তানের আমন্ত্রণ রক্ষা করে, যেমনি ভারত করেছে ভুটানের আমন্ত্রণ রক্ষা করে। চতুর্থত, যুদ্ধ বেঁধে গেলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোতে তার সামরিক প্রভাব বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারে। অন্যদিকে চীন চাইবে এই দেশগুলো যাতে চীনের প্রতিপক্ষ হয়ে না ওঠে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলো তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে চীনের উপর নির্ভরশীল। তারা চীনবিরোধী কোনো অবস্থান নাও নিতে পারে। পঞ্চমত, যেকোনো যুদ্ধে চীন ভারতীয় পণ্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করতে পারে। ভারতে চীনের রপ্তানি, আমদানির তুলনায় পাঁচগুণ বেশি।
উপরন্তু দক্ষিণ চীন সাগর ভারতের অন্যতম বাণিজ্য পথ। চীন এ পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। চীন দক্ষিণ চীন সাগরভুক্ত দেশগুলোর মাঝে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। কেননা দেশ দুটি এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যা ছিল চীনের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। এক্ষেত্রে ভারতের ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারে। সুতরাং চূড়ান্ত বিচারে ডোকলাম নিয়ে আদৌ চীন-ভারত যুদ্ধ হবে না। সেখানে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকবে। তবে এতে করে সমস্যার সমাধান হবে না। ভারতকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে চীনও তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে পারে। সমস্যার সমাধান সেখানেই নিহিত।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে সম্ভাব্য ‘হাতি বনাম ড্রাগন ’ যুদ্ধে কেউই লাভবান হবে না। বিশ্ব আসরে প্রতীকী অর্থে ভারতকে তুলে ধরা হয় ‘হাতি’ হিসেবে। অর্থাৎ সিম্বলিক অর্থে ভারতকে হাতির সঙ্গে তুলনা করা হয়। আর চীনকে তুলনা করা হয় ড্রাগন হিসেবে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও ভুটানের মধ্যবর্তী একটি ছোট্ট উপত্যকা ডোকলাম নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে এখনো এক রকম যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। এটা বিশ্লেষণ করতে গিয়েই বিশ্লেষকরা হাতি বনাম ড্রাগন এর যুদ্ধের কথা বলছেন। একধরনের ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ চলছে বটে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে কোনো পক্ষই যুদ্ধে যাবে না এবং ১৯৬২ সালের মতো একটি পরিস্থিতি তৈরি করবে না। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল। আর তাতে ভারতের পরাজয় ঘটেছিল। নরেন্দ্র মোদি সরকার এ ধরনের একটি ঝুঁকি গ্রহণ করবেন না। তবে ভারতের লোকসভায় যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, তাতে দেখা যায় যুদ্ধবাজ কিছু কিছু সাংসদ চীনকে ‘দেখে নেবার’ হুমকি দিচ্ছেন। অর্থাৎ ‘যুদ্ধের’ পক্ষে বলছেন কেউ কেউ! পাকিস্তান নয়, বরং চীনই পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু- এসব কথাও বলছেন কোনো কোনো সিনিয়র রাজনীতিবিদ।
Daily Amader Orthonity
23.08.2017

মোদির ওপর আস্থা রাখাটা জরুরি




ভারতের স্বাধীনতার ৭১তম বছর পালন উপলক্ষে গত ১৫ আগস্ট নয়াদিলি্লর ঐতিহাসিক মাঠে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে ভাষণটি দিয়েছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদ যখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, যখন সদ্য বিদায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট তার আশঙ্কার কথা বলেছেন। তখন মোদি তার ভাষণে স্পষ্ট করেছেন ভারতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। এটা একটা আশার জাগানিয়া মন্তব্য। নিঃসন্দেহে আমরা মোদির ওপর আস্থা রাখতে পারি। তবে অনেক কাজ বাকি। দরিদ্রতা দূরীকরণ, একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। মুসলমানদের আস্থায় নেয়া_ এ কাজগুলো করতে হবে। ভারত তার স্বাধীনতার ৭০ বছর পার করেছে। অনেক অর্জন ভারতের আছে। অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে। অর্থনীতির আকার বেড়েছে। কিন্তু দরিদ্রতা কমেনি। প্রশ্ন তাই সেখানেই ৭০ বছরের এই ভারতকে নিয়ে আমরা কতটুকু আশাবাদী হতে পারব? গণপিটুনিতে মৃত্যু, কুসংস্কার বিরোধিতাকারীদের মৃত্যু, ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে কৃষকদের আত্মহত্যা, কিংবা 'অর ওয়াপসি' (ঘরে ফেরা, হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে যারা অন্য ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাদের পুনরায় হিন্দু ধর্মে প্রত্যবর্তন)_ এসব ঘটনাবলি ভারতীয় মূল্যবোধের পতনের উদাহরণ। মোদি এর আগে নিজে বলেছেন, 'অবৈধ মুসলমান'দের (?) ভারত থেকে বের করে দেয়ার! টার্গেট করা হচ্ছে ভারতীয় মুসলমানদের। ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে শতকরা ২৪.৬৪ ভাগ হচ্ছে মুসলমান (১৮৯ মিলিয়ন, মোট জনগোষ্ঠী ১৩৪ কোটি)। ২০২৫ সালে মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১০ মিলিয়ন, যা বিশ্বের মুসলমান জনগোষ্ঠীর ১১ ভাগ। অথচ এই মুসলমানরাই আজ নির্যাতনের শিকার। মোদির এই হিন্দুত্ববাদের দর্শনে উৎসাহিত হয়ে উত্তর প্রদেশের এক সংসদ সদস্য সুরেন্দ্র সিং প্রকাশেই বলেছেন। 'ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হবে, মুসলমানদের হিন্দু বানানো হবে।' একুশ শতকে এসে মানুষ দেখছে ভারতীয় গণতন্ত্রের এক রূপ।
এই গণতন্ত্র উগ্র হিন্দুবাদকে উসকে দেয়া। কিন্তু কৃষকদের ঋণ পরিশোধ সহায়তা করতে পারে না। এই গণতন্ত্র ভারতে শতশত 'হাজার কোটিপতি' সৃষ্টি করেছে, কিন্তু ধর্ষণ বন্ধ করতে পারেনি। ইন্ডিয়া টুডে সাময়িকীর মতে, প্রতিদিন আন্তত ৩ জন দলিত নারী ধর্ষণের শিকার হন, অথচ এরা জনগোষ্ঠীর ৫ ভাগের মাত্র ১ ভাগ। জাতপাতের সমস্যা ভারতে অনেক বেশি। ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে আমরা গর্ব করি। কিন্তু এই গণতন্ত্র হায়দরাবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। দলিত শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সন্ত্রাসী ও ভারত বিদ্বেষী হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছিল। প্রতিবাদে রোহিত আত্মহত্যা করেছিল। ভারতে গণতন্ত্র ধনীদের আরও ধনী করেছে। কিন্তু জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী ৬০ কোটি মানুষের সেখানে কোন 'টয়লেট' নেই, সেই টয়লেট ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। ২ দশমিক ৩০৮ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ভারতের (পিপিপিতে ৭ দশমিক ৯৯৬ বিলিয়ন ডলার)। কিন্তু কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করে।
ভারতে কৃষক আত্মহত্যার 'কাহিনী' নতুন নয়। খরা, কিংবা প্রচুর বৃষ্টি ইত্যাদির কারণে প্রচুর কৃষক আত্মহত্যা করে থাকে। মোদি যখন ২০১৪ সালের মে মাসে ভারতের বিধানসভার নির্বাচনের বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন, তখন তিনি এক স্বপ্নের কথা শুনিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে ৪৭৭টি জনসভার বক্তৃতা করেছিলেন। ৩ লাখ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করেছিলেন। ৫১৮৭টি আনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। ৩৯ লাখ অনুসারী তার টুইটারে। আর ফেসবুকে নির্বাচনের আগে তার 'লাইক'-এর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি খুব কমই গ্রামে গেছেন। তবে ১৯ দেশ সফর করে বিশ্ব নেতাদের কাতারে তার নামকে স্থান দিতে পেরেছেন। কী পরিমাণ বদলে গেছেন মোদি, তার বড় প্রমাণ ১০ লাখ রুপির স্যুট পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে নয়াদিলি্লতে আমন্ত্রণ করা। এক সময় ট্রেনে ট্রেনে চা বিক্রি করে যিনি কৈশোরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, সেই মোদি কৃষক লাল সিং গত এক বছরে কোনো আশার বাণী নিয়ে আসেননি। গরিব ঘরের সন্তান হয়েও মোদি এখন অভিজাততন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। জাত-পাতে বিভক্ত ভারতীয় সমাজের জন্য তিনি কোনো 'মডেল' হতে পারেননি এখনও। জমি অধিগ্রহণ বিল নিয়েও একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে ভারতে। কংগ্রেস এটাকে পুঁজি করে ভারতব্যাপী একটা জনমত গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেও, তাতে তারা খুব লাভবান হয়েছে। তা বলা যাবে না; কিন্তু ভারতের জন্য যে সমস্যাটা প্রকট, অর্থাৎ সমাজে অসঙ্গতি তা মোদি দূর করতে পারেননি।
নিঃসন্দেহে গত তিন বছরে মোদি নিজেকে একজন উদ্যমী ও শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দলে আদভানীর (যিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়ে ছিলেন) মতো নেতাকে পাশে সরিয়ে রেখে তিনি তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি বড় তা হচ্ছে তিনি গরিব দেশের ধনী প্রধানমন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে স্বাগত জানাতে (জানুয়ারি ২০১৫) তিনি ১০ লাখ রুপির স্যুট পরিধান করে প্রমাণ করেছিলেন, তিনি আসলে ধনী শ্রেণিরই প্রতিনিধি! এক সময় যে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি কৈশোরে ট্রেনের কামরায় কামরায় চা বিক্রি করতেন, মা পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চলাতেন (২০১৫ সালের মে মাসের টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদকের কাছে তা তিনি স্বীকারও করেছেন), সেই মোদির সঙ্গে এখন করপোরেট জগতের বাসিন্দাদের সম্পর্ক বেশি। ট্রেনে চা বিক্রেতাদের মতো সাধারণ ভারতীয়দের কাছে এখন তিনি 'অনেক দূরের মানুষ'। তিনি যখন বিদেশ যান, তখন তার সঙ্গে যান ব্যবসায়ীরা, যান করপোরেট হাউসের প্রতিনিধিরা। কিন্তু গত তিন বছরে তার শরীরে দশ লাখ রুপির স্যুট উঠেছে সত্য, কিন্তু দরিদ্র ভারতের চেহার তিনি পরিবর্তন করতে পারেননি। কৃষকদের আত্মহত্যার প্রবণতা তিনি দূর করতে পারেননি। ইন্টরন্যাশনাল কম্পারিজন প্রোগ্রামের মতে জাপানকে হটিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে ভারত। ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল, আজ তৃতীয় অবস্থানে (সাধারণ নিয়মে এই অবস্থান সপ্তম)। আর গত বছর জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছে ২০২২ সালে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চীনের চেয়ে বেশি হবে। যেখানে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ ভাগ, সেখানে ভারতের হবে ৭ দশমিক ৭ ভাগ। নরেন্দ্র মোদি এই ভারতকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভারতের জনগোষ্ঠীর ৩৭ ভাগ মানুষ এখনো গরিব। ৫৩ ভাগ জনগোষ্ঠীর কোনো টয়লেট নেই। যারা প্রকাশ্যেই এই কাজটি নিত্য সমাধান করেন। পরিসংখ্যান বলে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ গরিব মানুষের বাস ভারতে, যাদের দৈনিক আয় বিশ্ব ব্যাংক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে। চিন্তা করা যায় প্রতিদিন ভারতে ৫ হাজার শিশু মারা যায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০)! গত বছর আগের এই পরিসংখ্যানে খুব পরিবর্তন এসেছে। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু দরিদ্রতা কেন বলি, প্রায় ৮০ কোটি লোকের দৈনিক আয় ২ দশমিক ৫০ ডলার। ৭০ ভাগ লোক গ্রামে বাসবাস করে। নারী-পুরুষের পার্থকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান (জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৮৬ কে হিসাবে ধরে) ১৪৬, ভারতের সেখানে ১৩৬। নারী নির্যাতন আর নারী ধর্ষণ এত ঘটনা ঘটার পরও বন্ধ হয়নি। নারী নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবি (যা বস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি) গুলাব গ্যাংয়ের (উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখ-ে গ্রামের সত্য কাহিনী) কথা নিশ্চই অনেকের মনে আছে। মোদি গত তিন বছরে এদের জন্য কি করেছেন? যদিও মাত্র তিন বছরে দরিদ্রতা কমানো সম্ভব নয়। কিংবা বিপুল তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরির সংস্থান করাও সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন বিনিয়োগ বাড়ালে কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু দরিদ্রতা কমানো তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তার গুজরাট মডেল নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। গুজরাটে তিনি সড়ক, মহা সড়ক করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পুরনে তিনি ব্যর্থ হয়ে ছিলেন। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অন্যান্য পণ্যের চাইতে গুজরাটে তার আমলে কম ছিল। মাত্র ১৩ দশমিক ৪ ভাগ (২০১২-১৩ সালে আসামে ছিল ২১.১ ভাগ, উত্তর খ-ে ২০.৮ ভাগ, মহারাষ্ট্র ১৯.৮ ভাগ)। শিশুমৃত্যুর হার গুজরাটে হাজারে ৩৮, অথচ কেরেলাতে ১২, তামিলনাড়ু ২১, মহারাষ্ট্র ২১। শিশুজন্ম দেবার সময় মাতৃমৃত্যুর হার গুজরাটে ৯.৫, কেরেলাতে ৩.৩, তামিলনাড়ু ৫, মহারাষ্ট্র ৫.২। যেখানে গুজরাটে খাবার পানি নিশ্চিত করা হয়েছে জনগোষ্ঠীর ৮৪ দশমিক ১ ভাগ মানুষকে, সেখানে পাঞ্জাবে এ সংখ্যা ৯৭.৬, উত্তর প্রদেশে ৮৭.৮, দিলি্লতে ৯৭.২। পাকাঘর হারিয়ানাতে ৯৪ দশমিক ৮ ভাগ মানুষের। দিলি্লর ৯৪.৭, উত্তরখ-ে ৯৩.৯। অথচ গুজরাটে মাত্র ৭৫.৭ ভাগ। ইন্ডিয়ান সেনসাস থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা । ফলে গুজরাট মডেল কীভাবে সারা ভারতের জন্য একটা মডেল হবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। আসলে সড়ক মহাসড়ক নির্মাণ করে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব একটি অর্থনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন গুজরাটে। কিন্তু তাতে করে সাধারণ মানুষের প্রতি তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এখন এই মানসিকতায় তিনি যদি ভারতকে পরিচালনা করতে চান, তিনি ভুল করবেন। দরিদ্রতা দূর হবে না। দরিদ্রতা থেকে উঠে আসা নরেন্দ্রমোদি এখন আর দরিদ্রতম মানুষকে স্মরণ করেন না। কাজপাগলা মানুষ তিনি। সন্দেহ নেই তাতে। মাত্র ৩ ঘণ্টা তিনি ঘুমান। এ কথাটা নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি টাইম প্রতিবেদকের কাছে। কম সরকার অনেক বেশি প্রশাসন এই হচ্ছে তার এপ্রোচ। তাতে করে ভারতকে কতটুকু বদলে দিতে পারবেন তিনি? টাইম মোদিকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল। শিরোনাম ছিল যিু সড়ফর সধঃঃবৎং মোদি কেন গুরুত্বপূর্ণ? তিনি গুরুত্বপূর্ণ বলেই গোধরায় ট্রেনে ৫৪ জন হিন্দু পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদে গুজরাটে হাজারের মতো মুসলমান হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প এবং ওবামা তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় চীনা প্রেসিডেন্ট ছুটে গিয়েছিলেন আহমেদাবাদে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ এবং মাত্র সাড়ে তিন বছরে শীর্ষ বিশ্ব নেতাদের তালিকায় নিজের নামটাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন (টাইম সাময়িকীর মতে, বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী নেতার একজন তিনি) তাই খুব সঙ্গত কারণেই মোদি বারবার আলোচনায় থাকলেও দরিদ্রতা দূরীকরণ ও সমাজে যে বৈষম্য তা দূরীকরণের ব্যাপারে কোনো বড় উদ্যোগ নিতে পারেননি। তাই অসন্তোষ বাড়ছে। মোদির জমানায় দলিত শ্রেণি যে কীভাবে প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হচ্ছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দলিত শ্রেণির স্কুল ত্যাগের হার শতকরা ৫০ ভাগ। প্রতিদিন ২ জন করে দলিত খুন হচ্ছেন। ২টি করে বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মোদি নিজে নিম্নশ্রেণির থেকে উঠে এলেও এ শ্রেণির মানুষের তিনি এখন আর প্রতিনিধিত্ব করেন না। তিনি এখন উচ্চ শ্রেণির প্রতিনিধি। ক্ষমতা গ্রহণ করার পর মোদি বলেছিলেন তিনি গত তিন বছর দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ উপহার দিতে পেরেছেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি প্রধান পাহারাদার, দেশের সম্পদের পাহারাদার; কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমে মোদির মেক ইন ইন্ডিয়া (ভারত নির্মাণ) অভিযানকে অতিরঞ্জিত প্রচার বলে মন্তব্য কারা হয়েছে। মোদি সরকারের কাছে বিপুল প্রত্যাশা থাকলেও কর্মসংস্থানের হাল যথেষ্ট খারাপ বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। প্রভাবশালী দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে ২০১৫ সালে মোদি সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতে মোদির এক বছর উচ্ছ্বাসের বাঁধ শেষ। সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল ভারতে এক বছর আগে পরিবর্তন পুনরুজ্জীবনের আশায় নরেন্দ্র মোদি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু এবার চূড়ান্ত বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে মোদি সরকার। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে মেকইন ইন্ডিয়ার অভিযান শুরু করলেও, ভারতের অর্থনীতি খুড়িয়েই চলছে। আর নিউইয়র্ক টাইসের মতে মোদির অধিকাংশ কর্মসূচি এখনো কথার কথাই রয়ে গেছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, দেশের অভ্যন্তরে আর্থিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার এখনো বেহাল। ব্যবসায়িক উদ্যোগেও তেমন দানা বাঁধছে না। একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও চাপে পড়েছেন মোদি। সমাজের দলিত শ্রেণি তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। এসব নরেন্দ্র মোদির সম্পর্কে কোনো ভালো ধারণা দেয় না। নিশ্চয়ই গত তিন বছরে মোদি অনেক কিছু শিখিয়েছেন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল তৈরি করেছেন। উন্নয়নকে প্রধান্য দিচ্ছেন। ভারতকে নিয়ে গেছেন বিশ্ব আসরে।
কিন্তু আগামী বছর সেখানে নির্বাচন। সাধারণ মানুষের জন্য তাকে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মুসলমানদের আস্থায় নিতে হবে। ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতই হওয়া উচিত তার আদর্শ। তাই তিনি যখন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলেন, তখন তার ওপর আস্থাটা রাখতে চাই।
Daily Jai Jai Din22.08.2017

চীন-ভারত দ্বন্দ্ব ও বিশ্ব রাজনীতিতে এর প্রভাব


ডোকলাম নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সেখানে একটি যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে লাদাখে দু’পক্ষের মাঝে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। গত দু’মাস ধরে ভারতীয় ও চীনা সেনারা সেখানে পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে আছে। সর্বশেষ ঘটনায় ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে আরও সৈন্য পাঠিয়েছে। শুধু তাই নয়, ডোকলামের কাছাকাছি একটি গ্রামের (নাথাং) বাসিন্দাদের তাদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ। এ গ্রামটি ডোকলাম (চীনারা বলে দং লাং) থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে। সিকিম ও অরুণাচলে মোতায়েন করা ভারতীয় সেনাবাহিনীকেও সেখানে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। অন্যদিকে একজন চীনা কমান্ডার কর্নেল লিলি বেইজিংয়ের হুয়াইবোউ সেনা ছাউনিতে আয়োজিত এক কর্মসূচিতে ভারতীয় সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ডোকলাম থেকে ভারতীয় সেনা সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, প্রয়োজন হলে চীন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আর চীন সরকারের মুখপাত্র হিসেবে বিবেচিত ‘গ্লোবাল টাইমস’ মন্তব্য করেছে ডোকলাম থেকে ভারতীয় সেনা হটাতে প্রয়োজনে সামরিক অভিযান চালাতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত চীন। যে কোনো মুহূর্তে চীন এ অপারেশন চালাতে পারে বলেও মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে ডোকলাম নিয়ে বড় ধরনের উত্তেজনা রয়েছে। এ উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত ১৯৬২ সালের মতো দ্বিতীয় চীন-ভারত যুদ্ধের জন্ম দেবে কিনা, তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে এশিয়ার দুই বড় শক্তি, চীন ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে যে ঐক্যের জন্ম হয়েছিল, ডোকলামের ঘটনায় তা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্পষ্টতই এই দেশ দুটির মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতার জন্ম হয়েছে, যা ব্রিকসের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কিছুটা হলেও এর প্রভাব পড়েছে। ডোকলাম ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য পশ্চিমা শক্তিগুলো ভারতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় শক্তিও ভারতের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে চীন চেষ্টা করছে ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে। বিশেষ করে ডোকলাম থেকে ভারত যাতে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়, সে ব্যাপারে ভুটানকে রাজি করাতে চেষ্টা করছে চীন। বলা ভালো, ডোকলাম নিয়ে সমস্যা মূলত ভুটান ও চীনের। ভারত সেখানে সৈন্য পাঠিয়েছে ভুটানের অনুরোধে। ভুটান-ভারত মৈত্রী চুক্তি বলে ভারত সেখানে সৈন্য পাঠিয়েছে। ডোকলামে চীন সড়ক নির্মাণ করছে। ভারতের ভয় এখানেই। কৌশলগতভাবে ভারতের জন্য এলাকাটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই এলাকার জম্পলরি (জামফেরি) পর্বত-শিরা থেকে শিলিগুড়ি করিডোর হাতের তালুর মতো দেখা যায়। চীন সেখানে তার স্থায়ী উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চাইছে। ইতিমধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেইজিং সফর করেছেন; কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। চীন ও ভারত কেউই ডোকলাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়নি। চীন ও ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। বিশ্ব অর্থনীতি দেশ দুটোর অবদান আছে। এখন দেশ দুটোর মধ্যে যদি উত্তেজনা অব্যাহত থাকে, তা একদিকে যেমনি চীনের জন্যও ভালো নয়, ঠিক তেমনি ভালো নয় ভারতের জন্যও। ব্রিকস মুখ থুবড়ে পড়বে। অথচ পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির কারণে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ব্রিকসের গুরুত্ব বাড়ছে। চীন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি। এ অঞ্চলের দেশগুলোর উন্নয়নে চীন একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি থেকে ভারতও উপকৃত হতে পারে। যদিও ভারত এতে যোগ দেয়নি। তারপরও কথা থেকে যায়- ভারত এই বিশাল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে না।

চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। ২০১০ সালে জিএনপির দিক থেকে জাপানকে ছাড়িয়ে যায় চীন। যেখানে ১৯৮০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান ছিল মাত্র ২ দশমিক ২ ভাগ (যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ ভাগ), সেখানে বলা হচ্ছে ২০৫০ সালে ppp (Purchasing, Price, Parity)-এর হিসাব অনুযায়ী চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে। উৎপাদনশীল পণ্যের, বিশেষ করে ইকেট্রুনিক্স পণ্যের দিক থেকে চীন এখন এক মহাশক্তি। বিশ্বের যত ফটোকপিয়ার, মাইক্রোওয়েভ ও জুতা উৎপাদিত হয়, তার ৩ ভাগের ২ ভাগ চীন একা উৎপাদন করে। সেইসঙ্গে বিশ্বে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ৬০ ভাগ, ডিভিডির ৫৫ ভাগ, ডিজিটাল ক্যামেরার ৫০ ভাগ, পারসোনাল কম্পিউটারের ৩০ ভাগ, শিশুদের খেলনার ৭৫ ভাগ চীন একা উৎপাদন করে। ফলে বিশ্বব্যাপী চীনা পণ্যের একটা বাজার তৈরি হয়েছে। চীনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে। ফরচুন ম্যাগাজিন বিশ্বের বড় ৫০০ কোম্পানির কথা উল্লেখ করেছে, সেখানে চীনের রয়েছে ৩৭টি কোম্পানি। বিশ্বে যত জ্বালানি ব্যবহৃত হয় তার মাঝে এককভাবে চীনে ব্যবহৃত হয় তার ১৬ ভাগ। আর বিশ্বে জ্বালানি তেলের ব্যবহারের দিক থেকে ৩ ভাগের ১ ভাগ ব্যবহার করে চীন। যে কারণে চীনকে বিশ্বের অন্যতম পরিবেশ দূষণকারী দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরিবেশ দূষণের কারণে চীনে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেড়েছে ২৯ ভাগ। চীনে রয়েছে বিশাল এক তরুণ প্রজন্ম, যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। প্রতিবছর ২১ মিলিয়ন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়। আর প্রতিবছর ৩ লাখ শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যায়। তারা ফিরেও আসে। ১৯৪৮ সালে (স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে) যেখানে চীনে শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ২০ ভাগ, এখন সেখানে ১০০ ভাগ শিক্ষিত। অর্থনৈতিক সংস্কারের কারণে চীনে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, তাতে প্রায় ২০ কোটি মানুষকে চীন অতি দরিদ্রতম অবস্থা (প্রতিদিন জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ১.২৫ ডলার আয় হিসাবে) থেকে বের করে এনে কিছুটা সচ্ছলতা দিয়েছে। যদিও বলা হয়, এখনও প্রায় ২০৭ মিলিয়ন লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশটিতে একদিকে যেমনি ধনী ও গরিবের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, ঠিক তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেও বৈষম্য তৈরি হয়েছে। মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এখন কর্মজীবী মানুষের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। মানুষের আয় সেখানে বেশি। হাজার হাজার টাউনশিপ এখন তৈরি হয়েছে, যা বদলে দিয়েছে চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবনযাত্রা। চীনকে নিয়ে খারাপ খবরও আছে। যেখানে ২০০৯ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ ভাগ, ২০১২ সালে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮ ভাগে। বর্তমানে ৬ দশমিক ৯ ভাগ। মুদ্রাস্ফীতি ৩ দশমিক ৫ ভাগ। আর শহুরে বেকার সংখ্যা ৪-৬ ভাগের নিচে। এই যে চীন, এই চীনের নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্বটি এখন বর্তিয়েছে শি জিনপিংয়ের ঘাড়ে। কোন পথে এখন চীন? শি জিনপিংয়ের এজেন্ডায় রাশিয়া ও ভারতকে প্রাধান্য দিলেও এটা সত্য, আন্তর্জাতিক ইস্যুকে গুরুত্ব দিচ্ছে চীন। বেশকিছু বিশ্লেষকের লেখা পড়ে যা মনে হয়েছে, তা হচ্ছে শি জিনপিং এখন প্রথমেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচিকে। এক বিশাল দেশ চীন। প্রায় ৫৫ জাতি ও উপজাতি নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশটি। ২২ প্রদেশ, ৫ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, ৪ বিশেষ অঞ্চল ও ১৪৭ বিশেষ এলাকা নিয়ে চীন রাষ্ট্র। রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সেই রাষ্ট্রটি ভেঙেও যেতে পারে। এ কারণেই চীনা নেতারা রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সতর্ক থাকছেন। যে ভুল করেছিলেন গর্বাচেভ, সেই ভুল করেননি চীনা নেতারা। সেনাবাহিনী এখনও পার্টির প্রতি অনুগত। তাই অর্থনৈতিক সংস্কারকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তবে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ফুজিয়ান, ঝে ঝিয়াং কিংবা সাংহাই প্রদেশগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক সমৃদ্ধশালী।

চীন ও ভারত নিকট প্রতিবেশী দুটি দেশ। প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে দেশ দুটির মাঝে এক ধরনের ‘দ্বন্দ্ব’ থাকলেও, পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির কারণে ভারতের যেমনি প্রয়োজন রয়েছে চীনের সাহায্য ও সহযোগিতার; ঠিক তেমনি চীনেরও প্রয়োজন রয়েছে ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা। ব্রিকস ব্যাংক বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কর্তৃত্ব ও প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন চীন ও ভারত যদি নিজেদের মাঝে বিরোধ অব্যাহত রাখে, তাহলে ব্রিকস ব্যাংক বিকশিত হবে না। ‘সিকিমকে স্বাধীন করার’ তথাকথিত চীনা বক্তব্য, তা-ও গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপের শামিল। চীন এটা করতে পারে না। সাধারণত চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলায় না। এ ক্ষেত্রে সিকিম প্রশ্নে চীনা গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক বক্তব্য ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপের শামিল, যা নিন্দনীয়। একুশ শতকে আমরা চীনকে দেখব অন্যতম এক শক্তি হিসেবে।

বিশেষ করে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান বিশ্বের সব অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছে। ব্রিকস এ চীন ও ভারত অন্তর্ভুক্ত হলেও এশিয়ার এই দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। ভারতে জনগোষ্ঠীর ৩৭ দশমিক ০২ভাগ দরিদ্রতার মধ্যে বসবাস করলেও আগামী ২৫ বছরের মধ্যে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। তখন সাধারণ মানুষের মাথাপিছু আয় ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে। ২০০৭ সালে যেখানে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ, তখন অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। সুতরাং ভারতকে ফেলে দেয়া যাবে না। তাই কোনো কোনো বিশ্লেষক, (জনাথন হোলসলাগ, ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন) একসময় একটি সম্ভাব্য ‘chindia’ ধারণার কথা বলেছিলেন, যেখানে চীন ও ভারত একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এ ধারণা অমূলক নয়। সাম্প্রতিক সময়ে চীন-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনা নেতারা ভারত সফর করেছেন। সীমান্ত সমস্যা নিয়েও (অরুণাচল) এক ধরনের স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে। ক্ষমতা গ্রহণ করে শি জিনপিং ভারতবিরোধী তেমন কোনো কথা বলেননি। তিনি ভারত সফরও করেছেন। সদ্যসমাপ্ত জি-২০ (হামর্বুগ) সম্মেলনে জিনপিং-মোদি সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। যদিও সাক্ষাৎকারটি উষ্ণ ছিল না। কিন্তু সাক্ষাৎকারটি না হলেই বরং নানা প্রশ্নের জন্ম দিত। এমনকি সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ারও সম্ভাবনা ছিল।

চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিত পরিস্থিতি এখন কোনো দিকে যায়, বলা মুশকিল। কিন্তু ১৯৬২ সালের মতো আরেকটি ‘যুদ্ধ’ হোক, এটা বোধকরি উভয় দেশের নেতারা কেউই চাইবেন না। আর্জিত দোভালের পাশাপাশি পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্করও বেইজিং সফরের পর আগামী সেপ্টেম্বরে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন। মোদি তখন চীনে যাবেন। আসলে উভয় দেশেই কট্টরপন্থী কিছু লোক আছে, যারা দু’দেশের মাঝে উত্তেজনা বজায় রেখে সুবিধা নিতে চায়। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এই মুহূর্তে ডোকলাম উপত্যকা থেকে উভয় দেশের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়া জরুরি। এর বাইরে অন্য বিষয়গুলো আলোচনা না করাই মঙ্গল।

একদিকে অরুণাচল, অন্যদিকে কাশ্মীর- দুটো বিষয়ই খুব স্পর্শকাতর। মাঝে মধ্যে চীন অরুণাচল নিয়ে তার দাবি উত্থাপন করলেও, সেখানে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রয়েছে। বিতর্কিত কাশ্মীরের ওপর দিয়ে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের সড়কপথটি চলে গেছে। যা বেলুচিস্তানের গাওদারে গিয়ে শেষ হয়েছে। এই সড়কপথের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। এই দুটো বিষয় বাদ রেখে এ মুহূর্তে সীমান্ত উত্তেজনা হ্রাস করা প্রয়োজন। সেখানে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকুক- আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি। যদি ডোকলাম নিয়ে উত্তেজনা অব্যাহত থাকে, তাতে সুবিধা নেবে তৃতীয় পক্ষ। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ইতিমধ্যে ভারতের অনুদান তহবিল থেকে বার্ষিক বাজেটের বাইরে আরও ২০ হাজার কোটি রুপি দাবি করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, আগামী ৫ বছর প্রতিরক্ষা বরাদ্দ বাড়িয়ে ২৬ লাখ ৮৪ হাজার কোটি রুপি করারও আবেদন করেছে মন্ত্রণালয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ফান্ড ২ লাখ ৭৪ হাজার ১১৩ কোটি রুপি বরাদ্দ দিয়েছিল, যা জিডিপির ১ দশমিক ৬২ শতাংশ। ভারত নয়াদিল্লি ও মুম্বাইয়ে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে করেই বোঝা যায় নয়াদিল্লির ভয়টা আসলে পাকিস্তানকে নিয়ে নয়, বরং চীনকে নিয়েই। ভারত এখন চুক্তি বলে নিজেরাই এফ-১৬ বিমান তৈরি করবে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও তারা কিনছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এটা তো ঠিক এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ‘মিত্র’ হিসেবে চাইছে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর যে বিবাদ তাতে চীনের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি ভারত। এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বই শেষ পর্যন্ত ডোকলামে দু’পক্ষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তারপরও কথা থেকে যায়- আদৌ যুদ্ধ হবে কিনা? শেষ পর্যন্ত হয়তো যুদ্ধ হবে না বরং এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকবে। তবে ডোকলাম নিয়ে যে আস্থার ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে, সেই ঘাটতি কীভাবে পূরণ হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
Daily Jugantor
21.08.2017

উত্তর কোরিয়াকে কতটুকু আস্থায় নেয়া যায়




শেষ পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন কালে আলোচিত গুয়ামে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ‘আপাতত’ স্থগিত ঘোষণা করেছেন। এ তথ্যটি আমাদের দিয়েছে উত্তর কোরিয়ার সরকারি সংবাদ সংস্থা কেসিএনএ, যা বিশ্বের সব গণমাধ্যম প্রচার করেছে। কেসিএনএ আরও জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়া এখন দেখতে চায়, যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ওই পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করেই পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ করবেন কিম জং উন। কিমের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিমের এ সিদ্ধান্তকে তিনি ‘বিচক্ষণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এক টুইটবার্তায় ট্রাম্প বলেছেন, ‘উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন বিচক্ষণ ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এর বিকল্প হতো ভয়াবহ ধ্বংসজজ্ঞ, যা গ্রহণযোগ্য নয়।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ টুইটবার্তা উত্তেজনা হ্রাসে কতটুকু সাহায্য করবে, বলা মুশকিল। কেননা এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সঙ্গে মিলে কোরীয় উপত্যকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গিয়ে সামরিক মহড়া চালিয়েছে। এ ধরনের সামরিক মহড়া যখনই হয়, তখনই উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়। আর উত্তর কোরিয়া তার আশপাশের এলাকায় যে কোনো সামরিক মহড়াকে এক ধরনের উসকানি হিসেবে বিবেচনা করে। এখন যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ‘স্থগিত’ করার ঘোষণার পর তাকে কতটুকু আস্থায় নেয়া যায়? এর মধ্য দিয়ে কি এ অঞ্চলে উত্তেজনা হ্রাস হলো? এখানে বলা ভালো, উত্তর কোরিয়া গেল জুলাইয়ে দুইটি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ দেশটির ওপর কঠোর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে যুদ্ধ হতে উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে ‘চূড়ান্ত সতর্কবার্তা’ দিতে আগস্টের মাঝামাঝি প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের গুয়াম দ্বীপের কাছে চারটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের হুমকি দেয়। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার ‘সমঝোতা’ যদি শেষ পর্যন্ত না হয়, তাহলে এ অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া বিচিত্র কিছু নয়। উত্তেজনা বাড়লে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র শুধু গুয়ামেই আঘাত করবে না (উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র মাত্র ১৪ মিনিটে গুয়ামে পৌঁছবে), বরং একই সঙ্গে সিউলেও আঘাত করতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় THAAD (Terminal High Altitude Area Defence) ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে, তারপরও কথা থেকে যায়। দক্ষিণ কোরিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুনজে ইন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় যেতে চান। এখানে বলা ভালো, কিম জং ইলের মৃত্যুর পর ২০১১ সালে তার ছেট সন্তান কিম জং উনকে উত্তর কোরিয়ায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এরই মধ্যে নানা কারণে উন বিতর্কিত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি তার আস্থা কম। প্রচলিত আইন-কানুন তিনি মানেন না। কিছুটা খ্যাপাটে স্বভাবের মানুষ তিনি। বালকসুলভ তার চেহারা। ধারণা করা হয়, মধ্য ত্রিশের ঘরে তার বয়স। কিন্তু প্রচ- হিংস্র প্রকৃতির তিনি। নিজের সৎভাইকে পর্যন্ত ‘খুন’ করতে দ্বিধাবোধ করেননি তিনি। এমনকি তাকে পরিপূর্ণ সম্মান না দেয়ায় সিনিয়র জেনারেল ও দেশরক্ষামন্ত্রীকে পর্যন্ত তিনি ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠিয়েছিলেন। সুতরাং পশ্চিমাবিশ্ব তার সঙ্গে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রশ্নে আলোচনা করে কোনো ফল পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না। এমনকি দুই কোরিয়ার মধ্যে পুনরেকত্রীকরণের আলোচনার সম্ভাবনাও ক্ষীণ পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে।
অনেকেই এটা বলার চেষ্টা করছেন, এটা এক ধরনের ‘প্রক্সি ওয়ার’। এ ‘প্রক্সি ওয়ার’-এ একদিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; অন্যদিকে রয়েছে চীন ও রাশিয়া। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, মার্কিন যুদ্ধজাহাজ যখন কোরীয় উপদ্বীপের আশপাশে অবস্থান করছে, ঠিক তখনই একটা সংবাদ এলো যে, উত্তর কোরীয় সীমান্তে সেনা সমাবেশ করেছে রাশিয়া। লন্ডনের ডেইলি মেইল জানিয়েছে, পুতিনের আশঙ্কা যদি ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ায় হামলা চালায়, তাহলে দেশটির নাগরিকদের একটা বিশাল অংশ শরণার্থী হয়ে রাশিয়ায় ঢুকে পড়তে পারে। এর আগে চীন তার উত্তর কোরীয় সীমান্তে ১ লাখ ৫০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছিল। এর অর্থ হচ্ছে, শরণার্থী ঠেকাতে চীন ও রাশিয়া তাদের নিজ নিজ সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করলেও পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা একটা ‘হুমকি’, অর্থাৎ যুদ্ধ যদি শুরু হয় তাহলে ধারণা করা হচ্ছে তারা উত্তর কোরিয়ার পক্ষে গিয়েই দাঁড়াবে। এর আগে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার সমালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যে নিন্দা প্রস্তাব এনেছিল, রাশিয়া তাতে ভেটো দিয়েছিল। বলা ভালো, এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ছিল। ওই নিষেধাজ্ঞা আমান্য করেই উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছিল। এখন নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর হলো।
কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা এখনও রয়ে গেছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের সিউল সফরের পরও দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা সংকট কাটেনি। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন এক ধরনের আশ্বাস চান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। তিনি জানিয়েছেন, প্রয়োজনে তিনি একজন দূতকে উত্তর কোরিয়ায় পাঠাতে চান। এ ব্যাপারে তিনি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের মতামত চেয়েছেন। কিন্তু এ মতামত দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পাবেন, তা মনে হয় না। কেননা ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের বিষয়টিকে উত্তর কোরিয়া খুব ভালো চোখে নেয়নি। ফলে দুই কোরিয়ার মাঝে আস্থাহীনতার সম্পর্ক রয়ে গেছে। এখন ট্রাম্প যে মানসিকতার মানুষ, তাতে তার ওপরও আস্থা রাখতে পারছেন না কেউ। কিম জং উনও অনেকটা একই মানসিকতার মানুষ। ফলে এদের দুইজনের কারণে কোরীয় উপদ্বীপে যে কোনো সময় ‘যুদ্ধ’ শুরু হয়ে যেতে পারে। ভয়টা হচ্ছে এখানে যে, খ্যাপাটে স্বভাবের উন কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই গুয়াম এবং একই সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। চীন উত্তর কোরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও চীনের কথা কিম জং উন কতটুকু শুনবেন, সেটাও একটা প্রশ্ন। অতীতে উত্তর কোরিয়া যুক্তি দেখিয়েছিল যে, তাদের পারমাণবিক প্রযুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণভাবে জ্বালানি চাহিদা মেটানো। সেক্ষেত্রে পশ্চিমাবিশ্ব উত্তর কোরিয়াকে অতিরিক্ত জ্বালানি সরবরাহ করেছিল; খাদ্যশস্য সরবরাহ করেছিল। এরপর উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পশ্চিমা বিশেজ্ঞদের জন্য খুলে দিয়েছিল। এবার তেমনই এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিমাবিশ্ব যদি ফের খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহের আশ্বাস দেয়, আমার ধারণা সেক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কর্মসূচি ‘আপাতত’ পরিত্যাগ করতে পারে। গুয়াম হামলার হুমকি একটা ‘অসিলা’মাত্র। কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। এমনিতেই উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রটির বহির্বিশ্বে তেমন কোনো সম্মান নেই (বাংলাদেশের রিজার্ভের টাকা হ্যাকিংয়ে উত্তর কোরিয়ার নাম এসেছে)। রাষ্ট্রটিকেSopranos State হিসেবে উল্লেখ করা হয় (দেখুন Sheena chestnut, International Security, 23 July, 2007, P-19)। যে রাষ্ট্র ও শাসকরা ক্রিমিনাল তৎপরতার সঙ্গে জড়িত, তাদের Sopranos state হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর অর্থ হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া একটি মর্যাদাহীন রাষ্ট্র। তাকে যদি আরও ‘চাপ’ এর মধ্যে রাখা হয়, তাহলে দেশটি আরও অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। এখন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় THAAD মোতায়েন করেছে (একটি ‘থাড ব্যাটারি স্থাপনে ব্যয় ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার)। সংগত কারণেই উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপ্তি বাড়াবে। ফলে আপাতত যদি উত্তেজনা হ্রাসও পায়, এ ধরনের আস্থাহীনতার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে উত্তর কোরিয়াকে চাপে না রেখে বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান বের করা মঙ্গল। একই সঙ্গে কোরীয় উপসাগরে টহল দেয়া সব মার্কিন যুদ্ধজাহাজ প্রত্যাহার করে নেয়াও জরুরি। এ অঞ্চলে মার্কিনি জাহাজগুলো যদি টহল অব্যাহত রাখে, তাহলে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকবে উত্তর কোরিয়া। এ মনস্তাত্ত্বিক চাপ দেশটিকে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি চালিয়ে নিতে আরও উৎসাহ জোগাবে। সুতরাং এ অঞ্চলে একটি ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকা জরুরি।
অতীতে এ অঞ্চলে যুদ্ধ হয়েছে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে যুদ্ধ বেধে গিয়েছিল। জাতিসংঘ এ যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি ওই সময় আহ্বান জানিয়েছিল। জাতিসংঘ বাহিনী মঞ্চুরিয়া সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং চীনা সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। এরপর ১৯৫৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তিবলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও উত্তর কোরিয়ায় কোনো চীনা সৈন্য মোতায়েন ছিল না। যদিও উত্তর কোরিয়া চীনের সঙ্গে ১৯৬১ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বক্ষর করেছিল। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, তাতে চীন যে কোনো সম্ভাব্য যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে অংশ নেবে, এটা মনে হয় না। আর যুদ্ধের ভয়াবহতা মোটামুটি সবাই অবগত। প্রথম কোরীয় যুদ্ধে (১৯৫০-১৯৫৩) দক্ষিণ কোরিয়ার ১ লাখ ৭৮ হাজার ৪০৫ জন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর উত্তর কোরিয়ার এ সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৬৭ হাজার ২৮৩ জন। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তাদের নাগরিকের মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার ৫৭৪। চীন ছিল উত্তর কোরিয়ার পক্ষে। তাদের পক্ষে মারা গিয়েছিল ১ লাখ ৫২ হাজার। ৬৭ বছর পর নতুন করে যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাতে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাতে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে পারে। চীন সব পক্ষকে সংযত আচরণ করার কথা বলেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কোনো ডেমোক্র্যাট-দলীয় সদস্যও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘ঠা-া মাথায়’ সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলছে। তবে এটা তো ঠিক, উত্তর কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশেই কিছু যুদ্ধবাজ জেনারেল রয়েছেন, যারা যুদ্ধ চান। এরই মধ্যে উত্তর কোরিয়ার দেশরক্ষামন্ত্রী জেনারেল পাক ইয়ং সিক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ‘উসকানিতে’ এ অঞ্চলে পারমাণবিক যুদ্ধ বেধে যেতে পারে বলে হুমকি দিয়েছেন। পেন্টাগনেও এ ধরনের জেনারেলের সংখ্যা একেবারে কম নয়।
গুয়ামে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে উত্তর কোরিয়া আপাতত ‘যুদ্ধ’ এর সম্ভাবনা কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে এটা সত্য। কিন্তু সীমিত যুদ্ধের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনাগুলো সীমিত আক্রমণ চালিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারে। এটা হবে বড় ধরনের বোকামি। আর এতে যুদ্ধের সম্ভাবনা আরও বাড়বে। এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখা। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বহুপক্ষীয় আলোচনা শুরু করাও জরুরি।
Daily Alokito Bangladesh
20.08.2017

চীন-ভারত যুদ্ধ কি আসন্ন


সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ভারতীয় সংবাদপত্র পাঠ করলে একটা ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, চীন ও ভারতের মধ্যে আবার বুঝি যুদ্ধ লেগে যাচ্ছে! গত প্রায় দুমাস ডোকলাম নিয়ে একটা যুদ্ধ-যুদ্ধভাব সেখানে বিরাজ করছে। ভুটানের পশ্চিমাংশে একটি ছোট্ট মালভূমির নাম ডোকলাম। এই মালভূমিটি খুব একটা বড় নয়। ১৮৯০ সালের কনভেনশন অনুযায়ী মাত্র ৮৯ বর্গকিলোমিটারের মালভূমিটি নিজের বলে মনে করে চীন। ডোকলামের চীনা নাম দংলাং। অন্যদিকে ভুটান মনে করে এই অঞ্চলটি তাদের। চীন ডোকলামে সড়ক নির্মাণ করলে ভারতীয় বাহিনী সেখানে নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলে এবং একপর্যায়ে ভারত-ভুটান মৈত্রী চুক্তি অনুযায়ী ভারত সেখানে সেনা মোতায়েন করে। গত প্রায় দুমাস ভারত ও চীনের সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। যুদ্ধ হবে কিনা বলা মুশকিল। তবে উত্তেজনা আছে। ভারত ডোকলাম নিয়ে আলোচনার কথা বললেও চীন বলছে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ওই অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত কোনো আলোচনা হবে না। এর আগে বহুল আলোচিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবেওআর)-এর একটি মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে বেইজিংয়ে, যেখানে ভারত যোগ দেয়নি। সাম্প্রতিককালে একাধিক ইস্যুতে ভারত ও চীনের মধ্যে এক ধরনের যুগ্ম প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। গত ১৬ মে বেইজিংয়ে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবেওআর) শীর্ষক যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, তাতে ভারত অংশ নেয়নি। অথচ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা মধ্য এশিয়ার প্রায় সব সরকারপ্রধান ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ওবেওআরের মাধ্যমে চীন তার দুই অঞ্চলের সঙ্গে প্রায় ৬১টি দেশকে সমুদ্র, সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত করছে। চীনের এই মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ভারত গেল জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে একটি সামুদ্রিক নৌমহড়া করেছে, যা চীন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছে। আর সর্বশেষ ঘটনায় ভুটানের পশ্চিমাংশে ডোকলাম মালভূমি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে চীন ও ভারত। এর আগেও ১৯৬৬ সালে চীন ডোকলাম দখল করার চেষ্টা করেছিল। তখনো ভারতের সাহায্য নিয়েছিল ভুটান। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে চীন ও ভুটান লিখিত চুক্তিবলে সম্মত হয় যে, তারা দুই দেশের সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে। চীনের এ অঞ্চলে মহাসড়ক নির্মাণকে ওই চুক্তির লঙ্ঘন বলে মনে করে। এই অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে ভারতের কাছে। এই মালভূমি আবার ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ শিলিগুড়ি করিডরের কাছে। এই করিডর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে পুরো ভারতকে যুক্ত করেছে। এখানে চীনা সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে ভারত হুমকি হিসেবে দেখছে। শুধু ডোকলাম নয়, বেশ কিছু বিষয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে কিছুদিন ধরে দ্বিমতও বিভাজন আছে। কিন্তু বাণিজ্যিক সম্পর্ক এতদিন এই বিভাজন আর বিদ্বেষকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অন্য সীমান্ত নিয়ে যে সমস্যা ছিল তা রয়েই গেছেÑ চীন অরুণাচল প্রদেশের একটা অংশকে তাদের নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে। এই দাবি চীন পরিত্যাগ করেনি। নরেন্দ্র মোদির বেইজিং উপস্থিতির সময় (মে ২০১৫) চীনা সরকারি টিভিতে ভারতের যে ম্যাপ দেখানো হয়েছিল তাতে কাশ্মীর ও অরুণাচলকে ভারতীয় অংশ হিসেবে দেখানো হয়নি। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে চীন সড়ক নির্মাণ শেষ করছে ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও। চীন এই সড়ক নির্মাণ বন্ধ করেনি। দক্ষিণ চীন সাগরে চীন একটি বিমান ঘাঁটি নির্মাণ করছে, যা কিনা জাপানের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ ধরনের কর্মকা- ভারতের নিরাপত্তা স্ট্র্যাটেজিস্টদের আতঙ্কিত করেছে। ভারত তার উদ্বেগ প্রকাশ করলেও চীন তাতে সম্মান দেখায়নি। নেপাল ও মিয়ানমারে চীনা প্রভাব বাড়ছেÑ এটাও ভারতীয়দের উৎকণ্ঠার অন্যতম একটি কারণ। ২০১৫ সালে ভূমিকম্পকবলিত নেপালে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের ‘ঠা-া লড়াই’ও আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। ভারত গেল বছরও ভারত মহাসাগরে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে একটি বড় ধরনের নৌ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছিল। এটা নিঃসন্দেহে চীনাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ভারত একটি পারমাণবিক শক্তি। ভারত এখন পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে (এনএসজি) অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। কিন্তু তাতে আপত্তি রয়েছে চীনের। ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষিপণ্য নিয়ে ভারত চীনা বাজারে ঢুকতে চায়। কিন্তু তাতে রয়েছে চীনাদের আপত্তি। আগামীতে চীনাদের একটা বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে ভারতের প্রাচীন ‘কটন রুট’র পুনরুত্থান। প্রাচীন যুগে ভারত ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে তার সুতিশিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছিল। প্রাচীন ভারতে বণিকরা ভারত মহাসাগরের কয়েকটি রুট ব্যবহার করে তাদের পণ্যসামগ্রী, বিশেষ করে ভারতীয় সুতি কাপড় নিয়ে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত যেত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল এ পথ ধরেই। অথচ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড মহাপরিকল্পনার সঙ্গে মোদির প্রস্তাবিত কটন রুটের ধারণা সাংঘর্ষিক। প্রাচীন কটন রুটকে নতুন করে সাজানোর মধ্য দিয়ে ভারত এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেÑ অর্থাৎ ভারত মহাসাগরে তার সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা। অনেকেই স্মরণ করতে পারবেন, মোদি ২০১৫ সালের মার্চ মাসে মরিশাস, সিসিলি ও শ্রীলংকা সফর করেছেন। মরিশাস সফরের সময় মরিশাসের সঙ্গে সেখানে একটি ভারতীয় নৌঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার সঙ্গে একটি মৈত্রী জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত এবং ওই জোটে মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকার আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল। এটা যদি কার্যকর হয়, তাহলে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূল থেকে শ্রীলংকা, দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের সিসিলি, মরিশাস কিংবা সুদূরের ওমান-মোজাম্বিকও একই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হবে। এর অর্থ পরিষ্কার বিশাল ভারত মহাসাগরে ভারত তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় এবং ‘ইন্ডিয়ান ওসেন রীম’ বা ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়। অথচ চীন ইতোমধ্যে তার ‘মুক্তার মালা’ নীতির মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। জিবুতিতে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ করেছে চীনÑ এ খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তবে চীনের জন্য একটি খারাপ খবর হচ্ছে, শ্রীলংকায় তার যে প্রভাব ছিল, তা এখন কমতির দিকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের ‘অতি চীননির্ভর’ নীতির কারণে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল। সিরিসেনার নেতৃত্বে একটি ‘ভারত বাজ’ সরকার সেখানে ক্ষমতাসীন হয়েছে। ফলে আগামী দিনে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন ও ভারতের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা যে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। ভারত ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় তার সীমান্তবর্তী যেসব দেশ রয়েছে, প্রতিটি দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক শুধু ভালোই নয়, বরং সর্বকালের সেরা সম্পর্ক রয়েছে এখন। এ অঞ্চলে ভারতের অর্থনৈতিক, সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। অতীতে ভারতের মনমোহন সিং সরকার যা করতে পারেনি, তা মোদি সরকার করে দেখিয়েছে। নেইবারহুড ফাস্টের অংশ হিসেবে ভারত এ অঞ্চলের দেশগুলোকে তার পতাকাতলে আনছে। এটা অনেকটা ‘মনরো ডকট্রিনের’ ভারতীয় সংস্করণÑ অর্থাৎ ভারত চাইবে না এ অঞ্চলে অন্য কোনো শক্তি কর্তৃত্ব করুক অথবা প্রভাব বিস্তার করুক। চীন এ অঞ্চলের নিকট-প্রতিবেশী। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে চীনা সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়। এ অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে সংকুচিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই ভারত কাজ করে যাচ্ছে। ভারতের আপত্তির কারণে ভুটানে এখন অবধি চীন তার দূতাবাস খুলতে পারেনি। তাই চীন-ভারত সম্পর্কটা অনেকের কাছেই আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়। এই সম্পর্ককে অনেক পর্যবেক্ষক ‘ভারতের হাতি বনাম চীনের ড্রাগন’ (ওহফরধহ ঊষবঢ়যধহঃ াং ঈযরহবংব উৎধমড়হ) হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ চীনের পরিচিতি যেখানে ড্রাগনকে দিয়ে, ঠিক তেমনি ভারতের পরিচিতি হাতিকে দিয়ে। ‘হাতি বনাম ড্রাগন’ দ্বন্দ্ব নিঃসন্দেহে একুশ শতকের মধ্যভাগে শুধু এ অঞ্চলেই নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের কথা, যে যুদ্ধে ভারতের একটা বিশাল এলাকা চীন দখল করে নিয়েছিল। এর আগে মধ্য পঞ্চাশের দশকে ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’ সেøাগান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। তিব্বতকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন যে ‘পঞ্চশালা নীতি’ গ্রহণ করেছিল, যা ন্যাম বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন প্রতিষ্ঠায় একটি ভিত্তি দিয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই পঞ্চশালা নীতি। যেমন বলা যেতে পারে ইন্দোনেশিয়ার কথা। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে এই পঞ্চশালার কথা বলা আছে। মধ্য পঞ্চাশের সেই ‘নেহরু-চৌ-এনলাই’ ইমেজ আবার ফিরে এসেছিল ‘মোদি-শি জিনপিং বহুত্বের মধ্য দিয়ে। এটি এখন কতটুকু কার্যকর হবে, মোদির সেপ্টেম্বরে বেইজিং সফর (২০১৭) দুদেশের সম্পর্ককে কত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে মানসিকতার। ভারতের ব্যুরোক্রেসি ভারতকে একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে দেখতে চায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে এই প্রভাব কাটানো কঠিন। মনমোহন সিং পারেননি। এখন দেখার পালা মোদি কতটুকু পারেন? তবে এটা তো সত্য মোদির নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। তিনি রাজনীতিকে পাশে ঠেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি। তার চাই উন্নয়ন। চাই বিনিয়োগ। চাই ব্যবসা। সে কারণে পুরনো বৈরিতা ভুলে গিয়ে তিনি প্রথম চীন সফরে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। তার বৈদেশিক নীতির এটাই বড় বৈশিষ্ট্য। তার জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং সর্বশেষ চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরের উদ্দেশ্য ছিল একটাইÑ তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়ান’ কর্মসূচিকে সফল করা। এখন ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত দ্বন্দ্ব যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে মোদি তার মেক ইন ইন্ডিয়া নিয়ে তিনি বেশিদূর যেতে পারবেন না। তিনি ভারতবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আগামী ২০২২ সালের মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী সবার জন্য কাজের ব্যবস্থা করবেন। প্রতিবছর ১২০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ সেখানে ‘জব মার্কেটে’ প্রবেশ করছে। এদের জন্য কাজ দরকার। চীনের মতোই ভারতকে একটি ‘পণ্যের উৎপাদনশীল’ দেশে পরিণত করতে চান মোদি। চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাড়লে, সেনাবাহিনী চাইবে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ভার বাড়ানোর। ভারত তার নৌ ও বিমানবাহিনী আধুনিকীকরণ করছে। নৌবাহিনীতে মোট ২৮টি সাবমেরিন সংযোজনের (বর্তমানে আছে ১৫টি) উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। বিমানবাহিনীতে নতুন বিমান আসছে। ভারত এখন নিজেই তৈরি করবে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। লকহিডের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আগামীতে আরও বাড়বে। সীমান্ত সমস্যা, বিশেষ করে ডোকলাম সমস্যার সমাধান যদি না হয়, তাহলে এই উত্তেজনা অন্য অঞ্চলেও সম্প্রসারিত হবে। খুব সঙ্গত কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাতে আক্রান্ত হবে, যা এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। আগামী মাসে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলন। নরেন্দ্র মোদির সেখানে যাওয়ার কথা এবং মোদি-শি জিনপিংয়ের মধ্যে বৈঠকের সম্ভাবনাও বেশি। কিন্তু দুপক্ষ যদি নমনীয় না হয় এবং সেখানে যদি ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় না থাকে, তাহলে আগামীতে ব্রিকস ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে। তাই এ মুহূর্তে ডোকলাম থেকে সব পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহার জরুরি।
Daily Amader Somoy
17.08.2017

সত্তর বছরে কতটুকু এগোতে পারল ভারত





ভারতে কৃষক আত্মহত্যার ‘কাহিনী’ নতুন নয়। খরা কিংবা প্রচুর বৃষ্টি ইত্যাদি কারণে প্রচুর কৃষক আত্মহত্যা করে থাকে। মোদি যখন ২০১৪ সালের মে মাসে ভারতের বিধানসভায় নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন, তখন তিনি এক স্বপ্নের কথা শুনিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে ৪৭৭টি জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। ৩ লাখ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করেছিলেন। ৫১৮৭টি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। ৩৯ লাখ অনুসারি তার টুইটারে। আর ফেসবুকে নির্বাচনের আগে তার ‘লাইক’ এর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হবার পর তিনি খুবই কমই গ্রামে গেছেন। তবে ১৯ দেশ সফর করে বিশ্বনেতাদের কাতারে তার নামকে স্থান দিতে পেরেছেন। কি পরিমাণ বদলে গেছেন মোদি, তার বড় প্রমাণ ১০ লাখ রুপির স্যুট পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওমাবাকে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ। একসময় ট্রেনে ট্রেনে চা বিক্রি করে যিনি কৈশোরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, সেই মোদি কৃষক লাল সিং-এর গত এক বছরে কোনো আশার বাণী নিয়ে আসেননি। গরিব ঘরের সন্তান হয়েও মোদি এখন অভিজাততন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন। জাত-পাত এ বিভক্ত ভারতীয় সমাজের জন্য তিনি কোনো ‘মডেল’ হতে পারেননি এখনো। জমি অধিগ্রহণ বিল নিয়েও একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে ভারতে। কংগ্রেস এটাকে পুঁজি করে ভারতব্যাপী একটা জনমত গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেও, তাতে তারা খুব লাভবান হয়েছে, তা বলা যাবে না। কিন্তু ভারতের জন্য যে সমস্যাটা প্রকট, অর্থাৎ সমাজে অসঙ্গতি তা মোদি দূর করতে পারেননি। নিঃসন্দেহে গত তিন বছরে মোদি নিজেকে একজন উদ্যমী ও শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দলে আদভানীর (যিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন) মত নেতাকে পাশে সরিয়ে রেখে তিনি তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি বড়, তা হচ্ছেÑ তিনি ‘গরিব দেশের ধনী প্রধানমন্ত্রী’। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে স্বাগত জানাতে (জানুয়ারি ২০১৫) তিনি ১০ লাখ রুপির স্যুট পরিধান করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন তিনি আসলে ধনী শ্রেণিরই প্রতিনিধি! একসময় যে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি কৈশোরে ট্রেনের কামরায় কামরায় চা বিক্রি করতেন, মা পরের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করে সংসার চালাতেন (মে মাসের ২০১৫ টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদকের কাছে তা তিনি স্বীকারও করেছেন), সেই মোদির সঙ্গে এখন কর্পোরেট জগতের বাসিন্দাদের সম্পর্ক বেশি। ট্রেনে চা বিক্রেতাদের মতো সাধারণ ভারতীয়দের কাছে এখন তিনি ‘অনেক দূরের মানুষ’। তিনি যখন বিদেশ যান, তখন তার সাথে যান ব্যবসায়ীরা, যান কর্পোরেট হাউসের প্রতিনিধিরা। কিন্তু গত তিন বছরে তার শরীরে দশ লাখ রুপির স্যুট উঠেছে সত্য, কিন্তু দরিদ্র ভারতের চেহারা তিনি পরিবর্তন করতে পারেননি। কৃষকদের আত্মহত্যার প্রবণতা তিনি দূর করতে পারেননি। ইন্টারন্যাশনাল কম্পারিজন প্রোগ্রাম এর মতে, জাপানকে হটিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে ভারত। ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল, আজ তৃতীয় অবস্থানে (সাধারণ নিয়মে এই অবস্থান সপ্তম)। আর গত বছর জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছেÑ ২০২২ সালে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চীনের চাইতে বেশি হবে। যেখানে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ ভাগ, সেখানে ভারতের হবে ৭ দশমিক ৭ ভাগ। নরেন্দ্র মোদি এই ভারতকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছেÑ ভারতের জনগোষ্ঠীর ৩৭ ভাগ মানুষ এখনো গরিব। ৫৩ ভাগ জনগোষ্ঠীর কোনো টয়লেট নেই, যারা প্রকাশ্যেই এই ‘কাজটি’ নিত্য সমাধান করেন। পরিসংখ্যান বলে বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ গরিব মানুষের বাস ভারতে, যাদের দৈনিক আয় বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে। চিন্তা করা যায় প্রতিদিন ভারতে ৫ হাজার শিশু মারা যায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০)! সাত বছর আগের এই পরিসংখ্যানে খুব পরিবর্তন এসেছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু দারিদ্র্যতা কেন বলি প্রায় ৮০ কোটি লোকের দৈনিক আয় ২ দশমিক ৫০ ডলার। ৭০ ভাগ লোক গ্রামে বসবাস করে। নারী-পুরুষের পার্থক্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান (জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৮৬-কে হিসেবে ধরে) ১৪৬, ভারতের সেখানে ১৩৬। নারী নির্যাতন আর নারী ধর্ষণ এত ঘটনা ঘটার পরও বন্ধ হয়নি। নারী নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবি (যা বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে তৈরি) গুলাব গ্যাং (উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ডে গ্রামের সত্য কাহিনী) এর কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। মোদি গত তিন বছরে এদের জন্য কি করেছেন? যদিও মাত্র তিন বছরে দারিদ্র্যতা কমানো সম্ভব নয়, কিংবা বিপুল তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরির সংস্থান করাও সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন, বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু দারিদ্র্যতা কমানো তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তার ‘গুজরাট মডেল’ নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। গুজরাটে তিনি সড়ক, মহাসড়ক করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অন্যান্য পণ্যের চাইতে গুজরাটে আসলে কম ছিল, মাত্র ১৩ দশমিক ৪ ভাগ (২০১২-১৩ সালে আসামে ছিল ২১.১ ভাগ, উত্তর খন্ডে ২০.৮ ভাগ, মহারাষ্ট্র ১৯.৮ ভাগ)। শিশু মৃত্যুর হার গুজরাটে হাজারে ৩৮, অথচ কেরালাতে ১২, তামিলনাড়– ২১, মহারাষ্ট্র ২১, শিশু জন্ম দেবার সময় মাতৃমৃত্যুর হার গুজরাটে ৯.৫, কেরালাতে ৩.৩, তামিলনাড়– ৫, মহারাষ্ট্র ৫.২। যেখানে গুজরাটে খাবার পানি নিশ্চিত করা হয়েছে জনগোষ্ঠীর ৮৪ দশমিক ১ ভাগ মানুষকে, সেখানে পাঞ্জাবে এ সংখ্যা ৯৭.৬, উত্তরপ্রদেশে ৮৭.৮, দিল্লিতে ৯৭.২।
পাকাঘর হারিয়ানাতে ৯৪ দশমিক ৮ ভাগ মানুষের। দিল্লির ৯৪.৭, উত্তর খন্ড ৯৩.৯। অথচ গুজরাটে মাত্র ৭৫.৭ ভাগ। ইন্ডিয়ান সেনসস থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা। ফলে ‘গুজরাট মডেল’ কিভাবে সারা ভারতের জন্য একটা মডেল হবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। আসলে সড়ক, মহাসড়ক নির্মাণ করে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব একটি অর্থনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন গুজরাটে। কিন্তু তাতে করে সাধারণ মানুষের প্রতি তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এখন এই মানসিকতায় তিনি যদি ভারতকে পরিচালনা করতে চান তিনি ভুল করবেন। দারিদ্র্যতা দূর হবে না। দারিদ্র্যতা থেকে উঠে আসা নরেন্দ্র মোদি এখন আর দারিদ্র্যতম মানুষগুলোকে স্মরণ করেন না। কাজ পাগলা মানুষ তিনি। সন্দেহ নেই তাতে। মাত্র ৩ ঘণ্টা তিনি ঘুমান একথা নিজেই স্বীকার করেছেন টাইম প্রতিবেদকের কাছে। ‘কম সরকার, অনেক বেশি প্রশাসন’ এই হচ্ছে তার অ্যাপ্রোচ। তাতে করে ভারতকে কতটুকু বদলে দিতে পারবেন তিনি? টাইম মোদিকে নিয়ে প্রচ্ছেদ করেছিল। শিরোনাম ছিল ডযু গড়ফর গধঃঃবৎং? মোদি কেন গুরুত্বপূর্ণ? তিনি গুরুত্বপূর্ণ বলেই গোধরায় ট্রেনে ৫৪ জন হিন্দু পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদে গুজরাটে হাজারের মতো মুসলমান হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প এবং ওবামা তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় চীনা প্রেসিডেন্ট ছুটে গিয়েছিলেন আহমেদাবাদে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ এবং মাত্র সাড়ে তিন বছরে শীর্ষ বিশ্ব নেতাদের তালিকায় নিজের নামটাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন (টাইম সাময়িকীর মতে বিশ্বের একশজন প্রভাবশালী নেতার একজন তিনি) তাই খুব সঙ্গত কারণেই মোদি বারবার আলোচনায় থাকলেও, দারিদ্র্যতা দূরীকরণ ও সমাজে যে বৈষম্য তা দূরীকরণের ব্যাপারে কোনো বড় উদ্যোগ নিতে পারেননি। তাই অসন্তোষ বাড়ছে। মোদির জমানায় দলিত শ্রেণি যে কিভাবে প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হচ্ছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইন্ডিয়ান টুডের প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ দলিত শ্রেণির স্কুল ত্যাগের হার শতকরা ৫০ ভাগ। প্রতিদিন দুজন করে দলিত খুন হচ্ছেন। দুটি করে বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মোদি নিজে নিম্ন-শ্রেণির থেকে উঠে আসলেও, এই শ্রেণির মানুষদের তিনি এখন আর প্রতিনিধিত্ব করেন না। তিনি এখন উচ্চ শ্রেণির প্রতিনিধি। ক্ষমতা গ্রহণ করার পর মোদি বলেছিলেন, তিনি গত তিন বছরে দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ উপহার দিতে পেরেছেন! তিনি বলেছিলেন তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি প্রধান পাহারাদার, দেশের সম্পদের পাহারাদার। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমে মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ (ভারত নির্মাণ) অভিযানকে অতিরঞ্জিত প্রচার বলে মন্তব্য করা হয়েছে। মোদি সরকারের কাছে বিপুল প্রত্যাশা থাকলেও কর্মসংস্থানের হাল যথেষ্ট খারাপ বলেও মন্তব্য করেছে তারা। প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ২০১৫ সালে মোদি সরকারের একবছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতে ‘মোদির একবছর উচ্ছ্বাসের পর্ব শেষ, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়েছিল, ‘ভারতে একবছর আগে পরিবর্তন ও আর্থিক পুনরুজ্জীবনের আশায় নরেন্দ্র মোদি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু এবার চূড়ান্ত বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে মোদি সরকার। কর্মসংস্থনের লক্ষ্যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ অভিযান শুরু করলেও, ভারতের অর্থনীতি খুড়িয়েই চলছে’। আর নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতে, মোদির অধিকাংশ কর্মসূচি এখনো কথার কথাই রয়ে গেছে। নিউইয়র্ক টাইমস এর মতে, দেশের অভ্যন্তরে আর্থিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার এখনো বেহাল। ব্যবসায়িক উদ্যোগেও তেমন দানা বাঁধছে না। একইসঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও চাপে পড়েছেন মোদি। সমাজের দলিত শ্রেণি তার উপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে এখন।
এসব মূল্যায়ন মোদি সম্পর্কে কোনো ভাল ধারণা দেয় না। নিশ্চয়ই গত তিন বছরে মোদি অনেককিছু শিখেছেন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল তৈরি করেছেন। হিন্দুত্ববাদ তার মূল আদর্শ। এটা থেকে তিনি বের হয়ে আসতে পারেননি। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত হিসেবে যে ভারতের বিশ্বে পরিচিত ছিল, সেই পরিচিতি থেকে ভারত এখন বেরিয়ে আসছে। ভারতের গত ৭০ বছরের রাজনীতিতে এটা একটা বড় পরিবর্তন। এই পরিবর্তন ভারতকে আগামীতে কোথায় নিয়ে যায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আজ ১৫ আগস্ট ভারতের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাক-ভারত উপমহাদেশ দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়Ñ একটি পাকিস্তান, অপরটি ভারত। ভারতের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ১৫ আগস্ট, আর পাকিস্তানের ১৪ আগস্ট। সত্তর বছর যে রাষ্ট্রটির বয়স, প্রতিষ্টাবার্ষিকী প্রাক্কালে সেই রাষ্ট্রটি সম্পর্কে একাধিক সংবাদ চলতি আগস্ট মাসেই ছাপা হয়েছে। গত সত্তর বছরে ভারতে ধনী শ্রেণি মানুষের সংখ্যা যেমনি বেড়েছে, ঠিক তেমনি বেড়েছে দারিদ্র্যতা। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে কৃষকদের আত্মহত্যা বেড়েছে, কমেনি। জাতিসংঘের একটি রিপোর্টে সম্প্রতি উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রায় ৬০ কোটি মানুষ সেখানে প্রকাশ্যে মলমূত্র ত্যাগ করে। এই সংখ্যা ভারতের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক। মোদি ‘স্বচ্ছ ভারত’ এর একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, যাতে তিনি ২০১৯ সালের মধ্যে এটি বন্ধ করতে চান। কিন্তু কতটুকু তিনি পারবেন বলা মুশকিল। মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে পুরো ভারতকে বদলে দিয়েছেন। ভারত এখন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। ভারতের জিডিপির পরিমাণ ২ দশমিক ৩০৮ ট্রিলিয়ন ডলার (পিপিপি অর্থাৎ ক্রয় ক্ষমতার হিসেবে ৭ দশমিক ৯৯৬ ট্রিলিয়ন ডলার)। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৩ ভাগ। বিশ্বের ৭ম বড় অর্থনীতি ভারতের (পিপিপিতে এর পরিমাণ তৃতীয়)। কিন্তু ঋণের দায়ে কৃষকের আত্মহত্যা বন্ধের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি নরেন্দ্র মোদি।
Amader Orthonity
15.08.2017

অনিয়মের তদন্ত হতে বাধা কোথায়?



গেল সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে পত্রিকায় একাধিক সংবাদ ছাপা হয়েছে, যার কোনো কোনোটি উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের ভূমিকাকে একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। সমসাময়িককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উপাচার্য এ ধরনের বিতর্কের মাঝে পড়েছিলেন বলে আমার জানা নেই। শুধু তাই নয়, তার ভূমিকা, বিশেষ করে অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের অভিযোগ, প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, অনৈতিক পন্থায় সিনেট অধিবেশন ডেকে তৃতীয়বারের মতো উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার চেষ্টার অভিযোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করেছে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত ৭টি কলেজের ছাত্রদের আন্দোলন এবং পুলিশের টিয়ারগ্যাস শেলে চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা সিদ্দিকুর রহমানের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দায়ভার উপাচার্য এড়াতে পারেন কিনা সে প্রশ্নও উঠেছে। আমার দুঃখ লাগে যখন দেখি এ ঘটনায় উপাচার্য অনুশোচনা কিংবা হাসপাতালে গিয়ে সিদ্দিকুরের প্রতি সমবেদনা জানাননি, অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে জানিয়েছেন সমবেদনা।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তো পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে জানিয়ে দিয়েছেন, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একাধিকবার চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন ছাত্রদের পরীক্ষা নেয়ার জন্য। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এখানেই রয়েছে সমস্যা। এখানেই সুশাসনের অভাব রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। আর উপাচার্য মহোদয়ের ‘অতি রাজনীতি’র কারণে তিনি এ সুশাসনটি নিশ্চিত করতে পারেননি। আমি ব্যক্তিগতভাবেও ওই অপশাসনের শিকার হয়েছি। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি বিভাগের আমি দ্বিতীয় পরীক্ষক ছিলাম। আমার অনেক ‘বিল’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিশোধ করেনি। এরপর গত দশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পরীক্ষার সঙ্গে আমি আর সম্পৃক্ত থাকিনি। সর্বশেষ ঘটনায় একটি পিএইচডি থিসিস (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ) কমিটির বহিঃস্থ সদস্য ও সভাপতি ছিলাম। সেটি বোধকরি ৬-৭ বছর আগের কথা। উপাচার্য মহোদয়কে আমি লিখিত ও মৌখিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি ‘বিল’ পরিশোধের বিষয়টি। কিন্তু তিনি এত ‘ব্যস্ত’ থাকেন যে একজন শিক্ষকের চিঠির জবাব দেয়ার সময় পান না। এখানেই এসে যায় দায়িত্বহীনতা ও সুশাসনের অভাবের প্রশ্নটি। আজকে যে ঘটনায় সিদ্দিকুর ‘অন্ধত্ব’বরণ করতে যাচ্ছেন, তার জন্য ব্যক্তিগতভাবে হয়তো উপাচার্যকে দায়ী করা যাবে না। কিন্তু যিনি প্রতিষ্ঠানের প্রধান, প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠু পরিচালনায় ব্যর্থতার দায়ভার তো তাকেই বহন করতে হবে। ভারতের মতো দেশে একজন উপাচার্য এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় পদত্যাগ করেছিলেন। আমাদের দেশে সেই সংস্কৃতি নেই।

সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা আমি হালকাভাবে নিতে চাই না। একটি বড় ধরনের ‘বিতর্কের’ জন্ম দিয়েছেন উপাচার্য সিনেট সভা আহ্বান করে। এ নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের হাতাহাতির খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। সিনেট সভা আহ্বান করা হয়েছিল তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি উপাচার্য প্যানেল গঠন করার জন্য। অভিযোগ উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মধ্য থেকে যে ২৫ জন প্রতিনিধি থাকেন, তাদের প্রতিনিধি নির্ধারণ বা নির্বাচন না করেই গত ২৯ জুলাই এ সিনেট সভা আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন ১২ জন শিক্ষকসহ ১৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন। এ রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ জুলাই হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সিনেট সভা স্থগিত করে দেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টের ওই আদেশ স্থগিত চেয়ে আবেদন করলে চেম্বার আদালত আদেশ স্থগিত করে বিষয়টি ৩০ জুলাই শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এরই মধ্যে ২৯ জুলাই সিনেট অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এবং তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি প্যানেল নির্বাচন করা হয়, যার মাঝে উপাচার্য স্বয়ং ছিলেন এক নম্বরে। কিন্তু আপিল বিভাগের কাছে এ প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য হয়নি। আপিল বিভাগ তিন সদস্যের প্যানেলের পরবর্তী কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। আপিল বিভাগের এ রায়ের ফলে উপাচার্য তার দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন বটে, কিন্তু তার উচ্চাকাক্সক্ষার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ক্ষতি হল, তা পূরণ হবে কীভাবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে আমার দুঃখ লাগে কেন তিনি এ কাজটি করতে গেলেন। তার মেয়াদ শেষ হবে ২৪ আগস্ট। সুতরাং বোঝাই যায় অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে তিনি সিনেটের বিশেষ অধিবেশন ডেকেছিলেন। তিনি তৃতীয় মেয়াদের জন্য উপাচার্য হতে চেয়েছিলেন। এর কি প্রয়োজন ছিল? একজন সজ্জন ব্যক্তি তিনি। তবে তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড তার সম্মানকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেনি। একজন উপাচার্যের জন্য দু’টার্মই সঠিক। আর কেন? নতুনদের সুযোগ দেয়া উচিত।

উপাচার্য মহোদয় নিজে নিজেকে বিতর্কিত করেছেন বলে মনে করেন অনেকে। গেল দুই বছর নিয়ম ভেঙে ৫০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর গত সাড়ে আট বছরে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৯০৭ জন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তে ছিল মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সব কটিতে প্রথম শ্রেণী থাকতে হবে। কিন্তু বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ, অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগ, দর্শন, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিদ্যা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংসহ একাধিক বিভাগে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের অনেকেই এ শর্ত পূরণ করেননি। একটি জাতীয় দৈনিকে তাদের নাম-ধাম দেয়া হয়েছে (কালের কণ্ঠ, ৪ আগস্ট)। বিজ্ঞপ্তিতে দেয়া পদের বিপরীতে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে একাধিক। এটা যেন একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে শুধু ‘অযোগ্যদের’ পুনর্বাসনের জন্য। কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রলীগ নেতা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং যার ছবি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, তাকেও পরিসংখ্যান বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর এসব নিয়োগের পেছনে রয়েছে রাজনীতি তথা দলীয়করণ। যিনি ছাত্রলীগ করেছেন, তাকে ও তার স্ত্রীকে নিয়োগ দেয়া কতটা নীতিসম্মত সেটা এক প্রশ্ন। আর এ অভিযোগটি উত্থাপিত হয়েছে বিরোধী সাদা গ্রুপ থেকে নয়, বরং আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দল থেকে। তাদের বক্তব্যও ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। আর এ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যটি ছিল যথেষ্ট যুগোপযোগী। তিনি মন্তব্য করেছেন, শিক্ষক নিয়োগে ঐতিহ্য হারিয়েছে ঢাবি (যুগান্তর, ৪ আগস্ট)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে নিয়োগ পাওয়া জনৈক তোফায়েল আহমদের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন হাইকোর্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। তখন প্রধান বিচারপতি এ মন্তব্যটি করেন। দেশের প্রধান বিচারপতি যখন এ ধরনের একটি মন্তব্য করেন, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান কোথায় থাকে? এর দায়ভার কি উপাচার্য মহোদয়ের ওপর বর্তায় না? যদিও এক টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি কোনো অনিয়মের কথা স্বীকার করেননি। বলেছেন, প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ কমিটিতে সভাপতিত্ব করেন উপ-উপাচার্য।

অতীতে কোনো উপাচার্যের আমলে এমনটি হয়নি। ব্যক্তি আরেফিন সিদ্দিক আমার খুব পছন্দের। ভালো মানুষ তিনি। কোনো ধরনের অহংকার তার মধ্যে আমি দেখিনি। অন্য উপাচার্যদের মতো ‘সবকিছু’ ফেলে তিনি ‘টকশো’ নিয়ে পড়ে থাকেন না। খুব কমই টকশোতে যান। একাধিক টকশোতে আমি তার সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করেছি। তিনি সরাসরিই আওয়ামী লীগ করেন। দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগে দলীয় চিন্তা-চেতনা তিনি বিবেচনায় নেবেন, এটা আমি চিন্তাও করিনি। কোর্ট যখন কোনো রুলিং দেন তখন তার সেই ‘ভালো মানুষের’ ইমেজটি আর থাকে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ছাত্র হিসেবে আমি লজ্জিত ও দুঃখিত। এখন তিনি কী করবেন, আমি জানি না। তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে ২৪ আগস্ট। এর অর্থ পরিষ্কার। এ সময়ের মধ্যে সিনেট অধিবেশনও হচ্ছে না। আর তিনিও তৃতীয় টার্মের জন্য প্যানেলে থাকতে পারছেন না। এক ধরনের অপবাদ নিয়ে তিনি তার পদ ছাড়ছেন। নিশ্চই তিনি উপলব্ধি করবেন তার ভুলগুলো কোথায় ছিল। তাকে যারা পরামর্শ দিয়েছিলেন, তারা সঠিক পরামর্শ দেননি। সুশাসনের চরম অবনতি ঘটেছিল। অভিযোগ আছে, তিনি ‘শিক্ষক রাজনীতি’ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতেন যে, সুশাসন নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ নেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, বেআইনিভাবে সিনেট অধিবেশন ডাকা এবং তা উচ্চ আদালত কর্তৃক স্থগিত হয়ে যাওয়া কিংবা শিক্ষক নিয়োগ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য- এসব ঘটনা অন্তত একটি মেসেজ আমাদের দিচ্ছে। আর তা হচ্ছে, দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ আর যাই হোক, উচ্চশিক্ষার মান সমৃদ্ধ করতে পারে না, বরং প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজ যে দুরবস্থা, তার পেছনে কাজ করছে এ শিক্ষক রাজনীতি তথা অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগদান। জানি না পরবর্তী উপাচার্য কে হবেন। এখানে তো ভালো ও যোগ্য শিক্ষকের কোনো সম্মান নেই। এখানে গুরুত্ব পায় শিক্ষক রাজনীতি। যিনি শিক্ষক রাজনীতিতে যোগ্য, তিনিই উপাচার্য হন, ইউজিসির সদস্য হন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানের কোনো পিএইচডি নেই বলে প্রশ্ন তোলে, তখন সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বৈকি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কি এ ধরনের প্রশ্ন তুলতে পারে? ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কোনো নেতিবাচক সংবাদ যেমন আমাকে কষ্ট দেয়, ঠিক তেমনি ইউজিসি নিয়ে কোনো মন্তব্যও আমাকে কষ্ট দেয়। এ রকম ঘটনা আর ঘটবে না, এমনটাই আমরা প্রত্যাশা করি। রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ হলে শিক্ষক নিয়োগে এমনটিই ঘটবে। একজন ভালো ও যোগ্য শিক্ষকই আরেকজন যোগ্য শিক্ষক তৈরি করতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই শুধু নয়, প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক নিয়োগে এ অনিয়মের খবর আমরা পাই। এ ক্ষেত্রে যা করা দরকার তা হচ্ছে, শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি ছেড়ে দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হাতে। অথবা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো একটি কমিশন গঠন করতে হবে, যাদের কাজ হবে দেশের ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া। আর তিন স্তরে (মূল রেজাল্ট, লিখিত পরীক্ষা ও প্রেজেনটেশন) এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। নিয়োগপ্রাপ্তকে এক বছর ‘রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট’ হিসেবে সিনিয়র শিক্ষকের অধীনে একটি গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করতে হবে। তারপরই তিনি প্রভাষক হিসেবে স্থায়ী নিয়োগ পাবেন। ইউরোপে এ সিস্টেম চালু রয়েছে। একসময় যেভাবে শিক্ষক নিয়োগ হতো, আজ সেভাবে শিক্ষক নিয়োগ হওয়া উচিত নয়। সময় অনেক বদলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। দুঃখ লাগে এ জন্যই, যাদের এসব ভাবার কথা, তারা এসব নিয়ে ভাবেন না। ইউজিসির চেয়ারম্যানের কোনো ভূমিকা আমি দেখি না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন সংকটে, তখন তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

সবকিছু নিয়মের মধ্যে আসুক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জনপ্রিয় হয়েও অনেকগুলো অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়েই তিনি এখন চলে যাচ্ছেন। এরপর যিনি উপাচার্য হয়ে আসবেন, তিনি নিশ্চয়ই এ থেকে শিক্ষা নেবেন। আমরা শুধু এটুকু প্রত্যাশাই করতে পারি।

পুনশ্চ : উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। তিনি অভিযোগ এনেছেন কয়েকজন সহকর্মীর বিরুদ্ধে। রবীন্দ্রনাথ মানুষের ওপর আস্থা হারাতে নিষেধ করেছিলেন। তাই তার প্রতি আস্থা রেখেই বলতে চাই- একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হোক, যারা অনিয়মগুলো তদন্ত করবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির কি সেই ‘সাহস’ আছে?
Daily Jugantor
13.08.2017