রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

চীনের প্রস্তাব রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কতটুকু সহায়ক হবে


Image result for Rohingya



সদ্য শেষ হওয়া আসেম সম্মেলনে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন তিন দফার একটি প্রস্তাব দিয়েছে। গত ২১ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে ৫৩ সদস্যবিশিষ্ট আসেমের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন শেষ হয়েছে।
ওই সম্মেলন শুরু হওয়ার আগের দিন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এক সংবাদ সম্মেলনে এই তিন দফা পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। এর আগে তিনি নেপিডোতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর বা সরকারপ্রধান অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট তিন কিয়াউ ও ক্ষমতাবান সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল সিন অং থ্লইংয়ের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। এর আগে তিনি ঢাকা ঘুরে যান। ঢাকায় তিনি এমন আভাস দিয়েছিলেন যে চীন প্রয়োজনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘মধ্যস্থতা’ করবে। এখন তিনি মিয়ানমারের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাঁর তিন দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করলেন। এই তিন দফা পরিকল্পনায় রয়েছে : ১. অস্ত্রবিরতি ও শান্তি-স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, যাতে রাখাইন থেকে লোকজন না পালায় এবং শান্তিতে থাকে; ২. মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সাম্যের ভিত্তিতে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের উপায় খোঁজা; ৩. রাখাইন রাজ্যের উন্নয়নে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, চীন বিশ্বাস করে সংলাপের মধ্য দিয়েই প্রতিবেশী দুই দেশ রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করতে পারে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এটাও মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকটের মূলে রাখাইনের দারিদ্র্য দায়ী। প্রশ্ন হচ্ছে, চীনের এই তিন দফা পরিকল্পনা কি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আদৌ সহায়ক হবে? যেখানে নাগরিকত্ব মূল ইস্যু, সেখানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে চীনের কোনো স্পষ্ট বক্তব্য নেই। এ থেকে এটা স্পষ্ট হলো যে চীন সরাসরিভাবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেয়নি। মিয়ানমারে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। সেই বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হোক, এটা চীন চায় না। চীন রাখাইনের সমুদ্র উপকূলে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে। ২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে রাখাইনের গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস উত্তোলনে। এই তেল ও গ্যাস উত্তোলন গত এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে এবং চীন পাইপলাইনের মাধ্যমে তা নিয়ে যাচ্ছে ইউনান প্রদেশে। চীন চায় না, তার এই বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হোক। তবে রোহিঙ্গা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চারজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (জাপান, জার্মানি, সুইডেন ও ইইউ) ঢাকা সফর করে গেছেন। ঢাকা সফর করে গেছেন চারজন মার্কিন আইন প্রণেতা। মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে সম্প্রতি। এতে মিয়ানমারের রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটেছে বলে বলা হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের অবস্থান আশাব্যঞ্জক নয়। অং সান সু চিসহ মিয়ানমারের নেতারা মিথ্যাচারের আশ্রয় নিচ্ছেন বারবার। ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত আসিয়ানের ৩১তম সম্মেলনে সু চি বলেছিলেন, সমঝোতা চুক্তি হলে তিন সপ্তাহের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে মিয়ানমার! এটা সময়ক্ষেপণ করার একটা কৌশল। এর আগে অক্টোবরে সু চি বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা ফিরতে চায় না। তিনি একবার এমন কথাও বলেছেন যে মুসলমানরা কেন চলে যাচ্ছে, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। গেল সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় এসেছিলেন মিয়ানমারের বিশেষ দূত কিউ টিন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ফলে একাধিক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বাংলাদেশ সফর, এমনকি আসেম শীর্ষ সম্মেলনও আমাদের জন্য একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল। আমরা ওই সম্মেলন থেকে খুব বেশি কিছু পাইনি। তবে প্রত্যাশা ছিল। এই নভেম্বরেই আসছেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি বাংলাদেশে এসে মিয়ানমারেও যাবেন। আমরাও এই সুযোগ আমাদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারি। মোদ্দা কথা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের পাশে আছে। এখন দরকার কূটনৈতিক যোগাযোগ আরো শক্তিশালী করা। দুঃখজনক হলেও আমরা তা পারিনি। চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আসেম সম্মেলনে যোগদানের আগে ঢাকা সফর করে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের দেখাও হয়েছিল। নিশ্চয় বাংলাদেশ তার অবস্থান তুলে ধরেছে। আসেম সম্মেলনে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। মঙ্গলবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে এই শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। আসেম (ASEM-ASIA-EUROPE Meeting) একটি বড় সংগঠন। বর্তমানে ৫১টি দেশ ও দুটি আঞ্চলিক সংস্থা আসেমের সদস্য। ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ (ভারতসহ) এবং চীন আসেমের সদস্য। ফলে আসেম সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে বাংলাদেশ একটি সুযোগ পেয়েছিল রোহিঙ্গা সমস্যা তুলে ধরার। আসিয়ান সম্মেলনে রোহিঙ্গা প্রশ্নে কোনো আলোচনা হয়নি বটে, তবে আসিয়ানভুক্ত অনেক দেশ এ সংকট সম্পর্কে অবগত। আমাদের উচিত ছিল ওই সব দেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রশ্নে একটি যৌথ অবস্থানে যাওয়া। বিশেষ করে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া কিংবা থাইল্যান্ড বরাবরই রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের ভূমিকার সমালোচনা করে আসছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কুয়ালালামপুরে আয়োজিত একটি বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব পর্যন্ত দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের কোনো প্রতিনিধি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কেউ এসব দেশে গেছেন, এটা আমার জানা নেই। ২০১২ সালে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হলে, শত শত রোহিঙ্গা যখন সাগরে দিনের পর দিন ভাসছিল তখন থাইল্যান্ড একটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ব্যাংককে। এরপর মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বের করে দেওয়ার প্রবণতা কমেছিল। এর পর থেকে আমরা কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করিনি। এর রেশ ধরেই আবারও সৃষ্টি হয়েছে এই সংকট। তাহলে এর সমাধান হবে কিভাবে? বাকি রোহিঙ্গারা এভাবেই ক্যাম্পে থেকে মানবেতর জীবন যাপন করবে? সুতরাং রোহিঙ্গা প্রশ্নে সমাধানটা জরুরি। এ ক্ষেত্রে চীনের প্রস্তাব আদৌ কি কোনো জট খুলতে সাহায্য করবে? চীন বলছে অস্ত্রবিরতির কথা। রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা আসছে বটে; কিন্তু সহিংসতার খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না। জঙ্গিগোষ্ঠী রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির খবরও তেমন একটা নেই। কারা স্যালভেশন আর্মি তৈরি করেছে, এটা নিয়েও মানুষের মাঝে সন্দেহ আছে। চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সংলাপের কথা বলছে। শুধু সংলাপ সংবাদপত্রের জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু তা কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। সমাধানের জন্য চাই বিশ্বাস ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ছয় লাখ ৩১ হাজার রোহিঙ্গা আদৌ তাদের নাগরিক কি না, সে ব্যাপারে মিয়ানমারের কোনো স্পষ্ট বক্তব্য নেই। এরা বাঙালি, এ কথা তারা বারবার বলে আসছে। সেই অবস্থান থেকে মিয়ানমার এক চুলও সরে আসেনি। খুব কম রোহিঙ্গার কাছেই নাগরিকত্ব প্রমাণসংক্রান্ত কাগজপত্র আছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে সব কাগজ নষ্ট হয়ে গেছে। তাহলে তারা কিভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণ করবে? সুতরাং সংলাপে নাগরিকত্ব প্রশ্নে সমাধানের সম্ভাবনা ক্ষীণ। রাখাইন রাজ্যের উন্নয়নের কথা বলছে চীন। সেখানকার মানুষ দরিদ্র। এটাও সত্য কথা। এর সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো যোগসূত্র নেই। চীনের বক্তব্য আরো স্পষ্ট হলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু তা নেই। নাগরিকত্ব প্রমাণ করাই হচ্ছে মূল সমস্যা। উপরন্তু তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও আছে। তাদের বাড়িঘর তৈরি করা, তাদের নিরাপত্তা দেওয়া—এ বিষয় তো মিয়ানমারকে নিশ্চিত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিবারক কূটনীতি বলে একটা কথা আছে। বিশ্বরাজনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই পরিবর্তন সামনে রেখে এবং শান্তি নিশ্চিত করতে অনেক রাষ্ট্র নিবারক কূটনীতি বা ‘প্রিভেনটিভ ডিপ্লোম্যাসি’ প্রয়োগ করে। নিবারক কূটনীতির মূলকথা হচ্ছে দুটি দেশ যাতে কোনো বিপদ বা বিতর্কে জড়িয়ে না যায়, যাতে এ বিপদ সংঘর্ষ পর্যায়ে উপনীত না হয় এবং যাতে সব ধরনের বিপদকে নিষ্পত্তি করার জন্য পারস্পরিক বিশ্বাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করা যায়, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ এই নিবারক কূটনীতি প্রয়োগ করে আসছে। এর পরও কথা থেকে যায়। সদ্য আগত ছয় লাখ ৩১ হাজারসহ মোট ১০ লাখের ওপরে রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে হবে মিয়ানমারকে। এরা মিয়ানমারের নাগরিক। চীনের ‘প্রস্তাব’ এবং উদ্যোগ নিয়ে মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি। এরই মধ্যে আসেম সম্মেলন শেষে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি; যদিও বুধবার পর্যন্ত এ সমঝোতা স্মারকের বিস্তারিত জানা যায়নি। এটা ভুলে গেলে চলবে না, এর সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি জড়িত। রোহিঙ্গারা যদি এ দেশে ‘স্থায়ী’ হয়ে যায়, তাহলে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে তাদের বিবাদ ও সংঘর্ষ আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারে। একটি ‘ফিলিস্তিনি সংকটে’র মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। স্থানীয় বাঙালিরা এরই মধ্যে উখিয়ায় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে শুধু পরিবেশগত সমস্যাই নয়, বরং নিরাপত্তা সংকটও সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কিছু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের দৃষ্টি এখন রোহিঙ্গাদের দিকে। তারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে চায়। কোনো কোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রও পরোক্ষভাবে এসব সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে উৎসাহ দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এ এলাকাজুড়ে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করা। অস্থিরতা সৃষ্টি হলে এর সুযোগ নেবে ওই সব রাষ্ট্র। সিরিয়ায় আইএসের পতন হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও রাশিয়ার গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, রাকা (আইএসের অলিখিত রাজধানী) থেকে আইএস সদস্যদের পালাতে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে, আইএসের জঙ্গিরা গেল কোথায়? ফিলিপাইনে আইএসের একটি শক্ত ঘাঁটির পতন ঘটেছে। অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করছেন, আইএস জঙ্গিরা রাখাইনে প্রবেশ করতে পারে।
এসব কারণেই আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। একদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা, অন্যদিকে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’—দুইভাবে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। আন্তর্জাতিক মহল আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লাখ লাখ মানুষ, শুধু ধর্মের কারণে দেশান্তরিত হবে, এই একুশ শতকে এসে তা চিন্তা করা যায় না। আজকে রোহিঙ্গারা যদি ইসলাম ধর্মাবলম্বী না হতো, তাহলে সম্ভবত তাদের দেশ ত্যাগ করতে হতো না! শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে তাদের ওপর নেমে এসেছে অত্যাচার আর নির্যাতন। সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়নি, যা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ক্ষেত্রে হয়েছে। সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীরা সমুদ্রপথে দেশ ত্যাগ করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছে। শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। হিটলার যেভাবে ইহুদিদের হত্যা করেছিল, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অনেকটা সেভাবেই হত্যা করছে রোহিঙ্গাদের। এ বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করেনি। একজন শীর্ষস্থানীয় জাতিসংঘের কর্মকর্তা বলেছেন মিয়ানমারে ‘গণহত্যা’ হয়েছে। অতি সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেছে মার্কিন সিনেটর জেফ মার্কেলের নেতৃত্বে একটি কংগ্রেশনাল প্রতিনিধিদল। তারা স্বীকার করেছে ‘রাখাইনে যুদ্ধাপরাধের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ প্রশ্নেও চীনের কোনো বক্তব্য নেই। এর পরও আমি মনে করি, চীন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। মিয়ানমার অসন্তুষ্ট হবে, মনঃক্ষুণ্ন হবে, এটা চীন বিবেচনায় নিয়েই প্রস্তাব দিয়েছে। এখন এটাকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রশ্নে আলোচনা শুরু করেছে। এ আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান বের করা সম্ভব। বৈরিতা অব্যাহত রেখে সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না।
Daily Kalerkontho
28.11.2017

সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, কিন্তু রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে তো?

গেল বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু শুক্রবার পর্যন্ত এ সমঝোতা স্মারক সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু না জানায় একটা বড় প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া সব রোহিঙ্গা শেষ পর্যন্ত নিজ বাসভূমে ফেরত যাবে কিনা? আর যদি ফিরে যায়, তাহলে কবে নাগাদ তারা ফিরে যাবে? কবে থেকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে, সে ব্যাপারেও স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। বৃহস্পতিবার নেপিডোয় চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাংবাদিকরা কথা বলার চেষ্টা করেন। তিনি যে জবাব দিয়েছেন, তা আশাব্যঞ্জক নয়। চুক্তি সম্পর্কে বলা হলে তিনি জানান, ‘রোহিঙ্গারা ফেরত যাবে। সেখানকার (রাখাইনে) বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাড়িঘর তৈরি করতে হবে।’ তিনি নিশ্চিত করে বলেননি কত দিনের মধ্যে এ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ হবে, কিংবা কবে নাগাদ তা শুরু হবে। অবশ্য তিনি জানিয়েছেন, চুক্তির বিষয়গুলো ঢাকায় এসে তিনি জানাবেন। একটা আশঙ্কা তাই থেকেই গেল শেষ পর্যন্ত শুধু চুক্তির জন্য একটা চুক্তি করা হলো কিনা।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সঙ্গে অনেক প্রশ্ন জড়িত। এক. প্রত্যাবাসনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্নটি জড়িত। মিয়ানমার এদের আদৌ তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নেবে কিনা? সমঝোতা স্মারকে যদি ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ কথাটা লেখা না থাকে, তাহলে তাদের প্রত্যাবাসন অর্থহীন। বলা ভালো, মিয়ানমার এসব রোহিঙ্গাকে নিজেদের নাগরিক হিসেবেও স্বীকার করে না। এমনকি তারা রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করতেও নারাজ। তারা এদের মুসলমান নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকার করে। তবে মিয়ানমারে যে ১২৫টির মতো নৃগোষ্ঠী রয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গা তথা মুসলমান জনগোষ্ঠীর নাম নেই। দুই. রোহিঙ্গারা কী তাদের নিজ নিজ বাসভূমে থাকতে পারবে? সমঝোতা স্মারকে কি এ সম্পর্কে সুষ্ঠুভাবে কিছু বলা আছে? নাকি শুধু প্রত্যাবাসনের কথা বলা হয়েছে? এক্ষেত্রে আমরা মিয়ানমারের তৈরি করা ফাঁদে পা দিতে পারি। মিয়ানমারের সুস্পষ্ট একটা পরিকল্পনা আছে, রোহিঙ্গাদের অন্যত্র শত শত ক্যাম্প তৈরি করে সেখানে তাদের পুনর্বাসন করা। এতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার স্বার্থ রক্ষিত হবে। তারা একটি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় রোহিঙ্গাদের রাখবে। এতে মিয়ানমারের নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী মনোভাবের দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার সাতটি হোমল্যান্ড তৈরি করে কৃষাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে সেখানে যেতে বাধ্য করেছিল। মিয়ানমারের স্ট্র্যাটেজি অনেকটা সে রকম। এতে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি সেখানে আরও খারাপ হবে। তিন. সমঝোতা স্মারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা, বিশেষ করে ইউএনএইচসিআর’কে যদি জড়িত না করি, তাহলে নানা জটিলতা তৈরি হবে। অবশ্যই আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থাকে জড়িত করতে হবে, যা মিয়ানমার চায় না। এটা জরুরি এ কারণ যে, এতে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং রোহিঙ্গারা এক ধরনের স্বস্তিতে থাকবে। এরই মধ্যে মিয়ানমারের সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে যে, মিয়ানমার সরকার তিনটি এলাকায় (মংডু, বুথিয়াডং ও রাথেডং) একাধিক টাউনশিপ নির্মাণ করছে, যেখানে কিছু রোহিঙ্গার স্থান করে দেয়া হবে। এজন্য স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি একটি কমিটিও গঠন করেছেন, যার নাম Union Enterprise for Humanitation Assistance, Betterment and Development in Rakhine (UEHRD)। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব টাউনশিপ নির্মাণে রাখাইন রাজ্য সরকারকে সম্পৃক্ত তথা তাদের জড়িত করা হয়নি। এ নিয়ে রাখাইন রাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্যদের ক্ষোভ প্রকাশের খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। The Irrawaddy পত্রিকার গেল ২৩ নভেম্বর রাজ্য পার্লামেন্টের দুই সদস্য উ মং অন(U maung ohn) ও উ খা উইনের (U Kyaw Win) বক্তব্য ছাপা হয়েছে। তারা সরকারের কাছে এর ব্যাখ্যাও চেয়েছেন। এর অর্থ যাদের আগামীতে ‘ফেরত’ নেয়া হবে, তাদের সেসব টাউনশিপে রাখা হবে। তারা তাদের নিজ বাসভূমে ফেরত যেতে পারবে না। অথচ কফি আনান কমিশন তাদের (রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে) নাগরিকত্বসহ তাদের নিজ নিজ বাসভূমে পুনর্বাসনের প্রস্তাব করেছিলেন। মিয়ানমার সরকার এখন যদি টাউনশিপগুলোয় রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসিত করে, তাহলে সু চি তার আগের দেয়া প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করবেন। তিনি কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট গ্রহণ করার সময় বলেছিলেন, তার সরকার আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করবে। এতে আমরা যে নিরাপত্তার কথা বলছি, সে সম্ভাবনাও থাকল। চার. সমঝোতা চুক্তিতে সদ্য আগত প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গার কথা হয়েছে, নাকি ‘শব্দ চয়নে’ কিছু মুসলমানদের (রোহিঙ্গা শব্দ যেহেতু তারা ব্যবহার করে না) ফেরত নেয়ার কথা বলছে, তা-ও স্পষ্ট নয়। এখানে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই, মিয়ানমারের কাছে কূটনৈতিক সৌজন্যবোধ বলতে কিছু নেই। তারা মিথ্যা কথাও বলেন। অতীতে মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে দুই-দুইটি চুক্তি হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে ও ১৯৯২ সালে। যতদূর জানা যায়, ৪ লাখ ৭৬ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত গেছে। কিন্তু তারপরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বৈধ ও অবৈধভাবে কক্সবাজারে রয়ে গেছে। এদের একটা অংশ বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে। একটা অংশ বাংলাদেশী পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। অনেক দিন আগে থেকেই ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের দেখভাল করছে। তাদের হিসাবে বৈধ রোহিঙ্গাদের সংখ্যা মাত্র কয়েক হাজার। অবৈধ অর্থাৎ রেজিস্টারবিহীন রোহিঙ্গা নাগরিকের সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি। তারা অবৈধভাবে ক্যাম্প করে বসবাস করছে। এখন যোগ হলো আরও প্রায় ৭ লাখ। এদের মাঝে থেকে কতজনকে মিয়ানমার ফেরত নেবে, সে প্রশ্ন থাকলই। পাঁচ. মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের অফিস থেকে বলা হয়েছে, ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হবে। সমঝোতা চুক্তিতে এ ১৯৯২ সালের চুক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটা একটা বড় ধরনের ফাঁদ। আমরা সম্ভবত সে ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছি। ১৯৯২ সালের চুক্তিতে Certification ’ শব্দটা আছে। অর্থাৎ যেসব রোহিঙ্গার নাম দেয়া হয়েছে, মিয়ানমার তাদের নাম, ঠিকানা ইত্যাদি যাচাই করবে। অতীতে এ ধরনের নামের একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার এর কোনো জবাব দেয়নি। এবারও সে ফাঁদে আটকে যাবে বাংলাদেশ! Certification এর নামে সময়ক্ষেপণ করবে। লোকদেখানো কিছু রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত নিতে পারে। কিন্তু একটা বড় অংশকেই তথাকথিত Certification -এর নামে আর ফেরত নেবে না। এটাই মিয়ানমারের স্ট্র্যাটেজি। যেহেতু মিয়ানমারের ওপর একটি আন্তর্জাতিক ‘চাপ’ আছে, তাই তারা রোহিঙ্গাদের নিতে রাজি হয়েছে। এটাও বিশ্ববাসীকে দেখানো যে, তারা তাদের নাগরিকদের ফেরত নিচ্ছে। কিন্তু নেবে না। তারা সময়ক্ষেপণ করবে। ছয়. ৫০ থেকে ৬০ হাজার নারী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এরা সবাই অন্তঃসত্ত্বা। এদের সন্তান এখন জন্ম নেবে বাংলাদেশে। জন্মসূত্রে ওইসব সন্তান হবে বাংলাদেশী নাগরিক। মিয়ানমার ওইসব সন্তান ফেরত নেবে না। সন্তান না গেলে মায়েরাও যেতে চাইবে না। ফলে এক বিশাল জনগোষ্ঠীর এ দেশে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। শরণার্থীসংক্রান্ত যে আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে, তাতে কোনো শরণার্থীকে ‘জোর করে’ ফেরত পাঠানো যাবে না। আর ইউএনএইচসিআর দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, এদের জোর করে ফেরত না পাঠানোর। ফলে আগামীতে এক্ষেত্রে একটা জটিলতা তৈরি হতে পারে। সাত. বলা হচ্ছে, আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এটা প্রাথমিক স্টেজ। অর্থাৎ দুই পক্ষ বসবে। নীতিমালা ঠিক করবে। কীভাবে, কোন প্রসেসে ‘কাজটি’ শুরু হবে, তা নির্ধারণ করবে। অর্থাৎ দুই মাসের মধ্যেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই সে রকম একটি আভাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাড়িঘর করতে সময় লাগবে! তার কথা থেকেই বোঝা যায়, পুরোপুরি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে সময় লাগবে। ভয়টা হচ্ছে, দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা দীর্ঘ হতে পারে। বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে। এতে লাভ হবে মিয়ানমারের। আমাদের কোনো লাভ নেই। মিয়ানমারের একগুঁয়েমির কারণে আমরা তাদের কিছু দাবি মেনে নিয়েছি। কিন্তু তারপরও তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয় না। তাদের একগুঁয়েমি মনোভাব আজকের নয়। পাঠক নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারেন, অতীতে মিয়ানমার জাতিসংঘ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। আন্তর্জাতিক আইন, প্রচলিত বিধিবিধান তারা মানে না। সেনাবাহিনীর কথায় এখন চলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তাদের ফাঁদে পা দিয়ে অং সান সু চি বহির্বিশ্বে তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের নিয়ে তারা একের পর এক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্ট করছে। এটা আমরা বিবেচনায় নিতে পারি না; কিন্তু মুখ্য করতে পারি। কূটনৈতিক চ্যানেলে এখন আমাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। দক্ষ কূটনৈতিকদের প্রয়োজনে নিয়োগ দিতে হবে। কয়েকটি দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। এসব দেশের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। আইনপ্রণেতাদের সঙ্গেও সম্পর্ক বাড়াতে হবে। চীন ও রাশিয়ার বাংলাদেশে বড় বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে। এ বাণিজ্যিক স্বার্থের বিষয়টি আমরা আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনে যাননি। এমনকি রাশিয়ায়ও যাননি। এ ধরনের একটি সংকট হলে সাধারণত সরকারের বিশেষ দূত, নিদেনপক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর করেন। নিজ দেশের অবস্থা বিদেশে তুলে ধরেন। জনমত সৃষ্টি করেন। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে অনেকটাই নীরব। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটিতে ভোটাভুটিতে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এখানেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকা নেই। ওআইসি প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল। ১৩৫টি রাষ্ট্র প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ১০টি দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। সেসব দেশের মাঝে আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ রয়েছে। এখানেও আমাদের ব্যর্থতা আমরা সার্কভুক্ত দেশগুলোয়ও রোহিঙ্গা প্রশ্নে সমর্থন আদায় করতে পারিনি। একমাত্র পাকিস্তান ও মালদ্বীপকে আমরা আমাদের পাশে পেয়েছি।
অতিসম্প্রতি টিলারসনের একটি বক্তব্যে আশাবাদী হওয়ার মতো কারণ রয়েছে। টিলারসন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, মিয়ানমারে ‘জাতিগত নিধন’ এর মতো ঘটনা ঘটেছে। কিছুটা হলেও সত্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকার করে নিচ্ছে যে, মিয়ানমারের রাখাইনে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান চলছে। আমরা এ বক্তব্য আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। আমরা বারবার বলে আসছি, যারা রোহিঙ্গা হত্যা আর অত্যাচারের সঙ্গে জড়িত, তাদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হোক। যারা বিভিন্ন দেশে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত, তাদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হচ্ছে। সুতরাং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচারের দাবি করলে মিয়ানমার একটা ‘চাপ’ এর মুখে থাকবে। সুতরাং একদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুততর করা, অন্যদিকে গণহত্যার বিচার দাবি করতে পারে বাংলাদেশ। মনে রাখতে হবে, মিয়ানমারের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে সময়ক্ষেপণ করা। সুতরাং আমরা তাদের পাতা ফাঁদে যেন পা না দিই, এটা সবসময় বিবেচনায় নিতে হবে।

Daily Alokito Bangladesh
26.11.2017

রোহিঙ্গারা কি এবার ফিরে যেতে পারবে?

Image result for Rohingya exodus in Bangladesh
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অব ডিসপ্লেসড পারসনস ফ্রম রাখাইন স্টেট’ শীর্ষক এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দফতরের মন্ত্রী খিও তিন্ত সোয়ে। চুক্তির বিস্তারিত এখনও জানা না গেলেও নেপিদো থেকে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, চুক্তি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ কিছুটা ছাড় দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল- জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ সব উন্নয়ন সহযোগীকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মিয়ানমার শেষ পর্যন্ত শুধু ইউএনএইচসিআরকে প্রয়োজনমতো কাজে লাগাবে বলে সম্মত হয়েছে। চুক্তি সই হওয়ার ২ মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হবে। কবে নাগাদ প্রত্যাবাসন শেষ হবে, বাংলাদেশ তার একটি সময়সীমা চেয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার এ ধরনের কোনো সময়সীমা দিতে রাজি হয়নি।


বাংলাদেশ শুরু থেকেই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে আসছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের অবস্থান নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো এখনও কিছু ঘটেনি। এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ের (আসেম) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে ২১ নভেম্বর। মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশসহ ৫৩টি দেশ ও সংস্থার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। যেহেতু আসেম নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে, সেহেতু রোহিঙ্গাদের নিয়ে এ অঞ্চলে যে নিরাপত্তা সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তা এ সম্মেলনে আলোচিত হবে, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তাই এ সংকটের গভীরতা বুঝতে আসেম সম্মেলনে যোগ দেয়ার আগে ঢাকা ঘুরে গিয়েছিলেন আসেমভুক্ত ৪টি দেশ ও সংস্থার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। জার্মানি, জাপান, সুইডেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পও পরিদর্শন করেছিলেন। আমাদের প্রত্যাশা ছিল রোহিঙ্গা সমস্যাটি আলোচিত হবে। সেটা হয়েছেও। এবং মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে কথাও বলেছেন। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। এটা অস্বীকার করা যাবে না, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমার খুব অস্বস্তিতে আছে। চাপে আছে। এশিয়া ও ইউরোপের ১৫টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে কয়েকটি বিষয়ে অনেকটা অভিন্ন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। তারা অনতিবিলম্বে সংঘাত বন্ধ, রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী স্রোত থামানো এবং বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দ্রুত ফিরিয়ে নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তারা আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি ফেদেরিকা মঘেরিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ একটি চুক্তিতে পৌঁছবে বলে তিনি আশাবাদী। সেই চুক্তিটি অবশেষে স্বাক্ষরিত হল।

এদিকে চীন তিন দফার একটি প্রস্তাব দিয়েছে। তাতে অস্ত্র বিরতি (রাখাইনে), মিয়ানমার-বাংলাদেশ আলোচনা এবং রাখাইনের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। সু চি আসেমের উদ্বোধনী ভাষণে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি শুধু জানিয়েছেন, ১৯৯২ সালের চুক্তির ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া হবে! অথচ বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন, ১৯৯২ সালের চুক্তির ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এ কারণে যে, ওই চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজটি মিয়ানমারকে দেয়া হয়েছিল।

রোহিঙ্গারা বর্তমানে অবর্ণনীয় ও অমানবিক জীবনযাপন করছে উখিয়ায় তৈরি করা ক্যাম্পগুলোতে। তাদের নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা সমস্যা। সুতরাং রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানটা জরুরি। এক্ষেত্রে চীনের প্রস্তাব আদৌ কি কোনো জট খুলতে সাহায্য করবে? চীন বলছে অস্ত্রবিরতির কথা। রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা আসছে বটে; কিন্তু সহিংসতার খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না। জঙ্গিগোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) খবরও তেমন একটা নেই। কারা আরসা তৈরি করেছে, তা নিয়েও মানুষের মাঝে সন্দেহ আছে। চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সংলাপের কথা বলছে। শুধু সংলাপ সংবাদপত্রের জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে; কিন্তু তা কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। সমাধানের জন্য চাই বিশ্বাস ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৬ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা আদৌ মিয়ানমারের নাগরিক কিনা, সে ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের কোনো স্পষ্ট বক্তব্য নেই। তারা বারবার বলে আসছে, এরা ‘বাঙালি’। সেই অবস্থান থেকে মিয়ানমার এক চুলও সরে আসেনি। খুব কম রোহিঙ্গার কাছেই নাগরিকত্বের প্রমাণসংক্রান্ত কাগজপত্র আছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার কারণে সব কাগজপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। তাহলে তারা কীভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণ করবে? সুতরাং সংলাপে নাগরিকত্ব প্রশ্নে সমাধানের সম্ভাবনা ক্ষীণ। রাখাইন রাজ্যের উন্নয়নের কথা বলছে চীন। সেখানকার মানুষ দরিদ্র এটা সত্য। কিন্তু এর সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো যোগসূত্র নেই। চীনের বক্তব্য আরও স্পষ্ট হলে আমি খুশি হতাম। নাগরিকত্ব প্রমাণ করাই হচ্ছে মূল সমস্যা। উপরন্তু তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও আছে। তাদের বাড়িঘর তৈরি করা, নিরাপত্তা দেয়া- এ বিষয়টি তো মিয়ানমারকেই নিশ্চিত করতে হবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিবারক কূটনীতি বলে একটা কথা আছে। বিশ্ব রাজনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই পরিবর্তনকে সামনে রেখে শান্তি নিশ্চিত করতে অনেক রাষ্ট্র নিবারক কূটনীতি বা ‘প্রিভেনটিভ ডিপ্লোমেসি’ প্রয়োগ করে থাকে। নিবারক কূটনীতির মূল কথা হচ্ছে, দুটো দেশ যাতে কোনো বিবাদ বা বিতর্কে জড়িয়ে না যায় কিংবা বিবাদ সংঘর্ষ পর্যায়ে উপনীত না হয় এবং যাতে করে সব ধরনের বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য পারস্পরিক বিশ্বাসের আবহ সৃষ্টি করা যায়, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ এ নিবারক কূটনীতি প্রয়োগ করে আসছে। তারপরও কথা থেকে যায়। সম্প্রতি আগত ৬ লাখ ৩০ হাজারসহ অন্তত ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে হবে মিয়ানমারকে। তারা মিয়ানমারের বাসিন্দা। তাই চীনের ‘প্রস্তাব’ ও উদ্যোগকে যথোপযুক্ত মনে হচ্ছে না।

এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি জড়িত। রোহিঙ্গারা যদি এদেশে স্থায়ী হয়ে যায়, তাহলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের নিত্য বিবাদ ও সংঘর্ষ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে ‘ফিলিস্তিন সংকটের’ মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। স্থানীয় বাঙালিরা ইতিমধ্যেই উখিয়ায় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে শুধু পরিবেশগত সমস্যাই নয়, নিরাপত্তা সংকটও সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কিছু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের দৃষ্টি এখন রোহিঙ্গাদের দিকে। তারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে চায়। কোনো কোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রও পরোক্ষভাবে এসব সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে উৎসাহ দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এ এলাকাজুড়ে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করা। অস্থিরতা সৃষ্টি হলে এর সুযোগ নেবে ওইসব রাষ্ট্র। সিরিয়ায় আইএসের পতন হয়েছে; কিন্তু রাশিয়াসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, রাকা (আইএসের অলিখিত রাজধানী) থেকে আইএস সদস্যদের পালাতে সাহায্য করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে, আইএসের জঙ্গিরা গেল কোথায়? ফিলিপাইনে আইএসের একটি শক্ত ঘাঁটির পতন ঘটেছে। তাই অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করছেন, আইএস জঙ্গিরা রাখাইনে প্রবেশ করতে পারে।

এসব কারণেই আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। একদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা, অন্যদিকে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’- দু’ভাবে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। আন্তর্জাতিক মহল আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লাখ লাখ মানুষ শুধু ধর্মের কারণে দেশান্তরিত হবেন, এই একুশ শতকে এসে তা চিন্তা করাও যায় না। রোহিঙ্গারা যদি মুসলমান না হতো, তাহলে সম্ভবত আজ তাদের দেশত্যাগ করতে হতো না! শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে তাদের ওপর নেমে এসেছে অত্যাচার আর নির্যাতন! সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়নি, যা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ক্ষেত্রে হয়েছে। সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীরা সমুদ্রপথে দেশত্যাগ করেছেন; কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছে। শিশুদের পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। হিটলার যেভাবে ইহুদিদের হত্যা করেছিল, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অনেকটা সেভাবেই হত্যা করেছে রোহিঙ্গাদের। এ বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করেনি, একজন শীর্ষস্থানীয় জাতিসংঘ কর্মকর্তা বলেছেন, মিয়ানমারে ‘গণহত্যা’ হয়েছে। অতি সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেছেন মার্কিন সিনেটর জেফ মার্কেলের নেতৃত্বে একটি কংগ্রেশনাল প্রতিনিধি দল। তারা স্বীকার করেছেন, রাখাইনে যুদ্ধাপরাধের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ প্রশ্নেও চীনের কোনো বক্তব্য নেই। তারপরও আমি মনে করি, চীন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। মিয়ানমার অসন্তুষ্ট হবে, মনোক্ষুণœ হবে- এসব বিবেচনায় নিয়েই চীন প্রস্তাব দিয়েছে। এটি আমরা বিবেচনায় নিতে পারি; কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যেন মনে না করি। কূটনৈতিক চ্যানেলে আমাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে এ কাজে দক্ষ কূটনীতিকদের নিয়োগ দিতে হবে। কয়েকটি দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। এসব দেশের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। আইনপ্রণেতাদের সঙ্গেও বাড়াতে হবে সম্পর্ক। বাংলাদেশে চীন ও রাশিয়ার বড় বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে। এ বিষয়টি আমরা আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন, কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনে যাননি, এমনকি রাশিয়াতেও যাননি। এ ধরনের একটি সংকট সৃষ্টি হলে সাধারণত সরকারের বিশেষ দূত, নিদেনপক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর করেন। নিজ দেশের অবস্থা বিদেশে তুলে ধরেন। জনমত সৃষ্টি করেন। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে অনেকটাই নীরব।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটিতে ভোটাভুটিতে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এক্ষেত্রেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকা নেই। ওআইসি প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল। ১৩৫টি রাষ্ট্র প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ১০টি দেশ ভোট দিয়েছে বিপক্ষে। ভোট প্রদানে বিরত ছিল ২৬টি দেশ। ওইসব দেশের মধ্যে আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ রয়েছে। এখানেও আমাদের ব্যর্থতা, আমরা সার্কভুক্ত দেশগুলোর কাছ থেকেও রোহিঙ্গা প্রশ্নে সমর্থন আদায় করতে পারিনি। একমাত্র পাকিস্তান ও মালদ্বীপকে আমরা আমাদের পাশে পেয়েছি।

মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে; কিন্তু এ চুক্তি অনুযায়ী কতসংখ্যক রোহিঙ্গা তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে, সব রোহিঙ্গা ফিরে যেতে পারবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। এজন্য মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে দেশটির ওপর ‘চাপ’ অব্যাহত রাখতে হবে।
Daily Jugantor
24.11.2017

রোহিঙ্গা সংকটে আমাদের কূটনীতি কতটা সফল


সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মহল যতটা সোচ্চার হয়েছে, আমাদের কূটনীতি কি ততটা সফল হয়েছে? এই সংকটের শুরু গত ২৫ আগস্ট থেকেÑ যখন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। এর পর প্রায় তিন মাস পার হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের কোনো ইতিবাচক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়নি। তবে এটা যে একটা বড় ধরনের সংকট, তা আন্তর্জাতিক মহল স্বীকার করে নিয়েছে। গত রবিবার ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) তিনটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা (জাপান, জার্মানি ও সুইডেন) ঢাকা সফর করে মিয়ানমার গেছেন। সেখানে তারা এশিয়া-ইউরোপ মিটিং বা আসেম সম্মেলনে যোগও দিয়েছিলেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও আসেম সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রাপ্তি কী? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাব আমরা কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছি? ১৬ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটির ভোটাভুটিতে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। ১৩৫টি রাষ্ট্র প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়ায় আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের একটি বড় বিজয় অর্জিত হয়েছে। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে রাশিয়া ও চীন। আর ভারত ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত ছিল। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে দেব? চীন ও রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। এ বিষয়টি আমরা বহুবার আলোচনা করেছি। আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা এখানেই যে, আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারিনি। বাংলাদেশে রাশিয়ার যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। রাশিয়া থেকে আমরা কয়েক হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র কিনছি। বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে দিচ্ছে রাশিয়া। নতুন করে বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। চীনও আমাদের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমরা চীন ও রাশিয়ার কাছে আমাদের ‘অবস্থান’ তুলে ধরতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। এটা ঠিক, মিয়ানমারে চীন ও রাশিয়ার স্বার্থ রয়েছে। জাতীয় স্বার্থের আলোকে দেশ দুটি তাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে। তবে রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের সরকারিনীতি কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে দেশান্তরিত হয়, তখন ওই সমাজকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। পশ্চিমাদের কাছে একটা প্রত্যাশা ছিল সু চিকে ঘিরে। তাদের ধারণা ছিল, মিয়ানমারে সত্যিকার অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু করবেন সু চি। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গোষ্ঠীস্বার্থেই তিনি কাজ করছেন। রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে রেখেই সু চি যে ব্যর্থ হয়েছেন, এটা আগামীতে সেনাবাহিনী ব্যবহার করবে। সেনাবাহিনীর পক্ষে এটা বলা সহজ হবে যে, মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে সু চি ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর সংসদ বসেছিল ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে অং সান সু চি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন হাতিন কিয়াউ (ঐঃরহ কুধ)ি। তার মেয়াদ শেষ হবে ২০২১ সালে। এর আগে ২০২০ সালের দিকে সেখানে নির্বাচন হবে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, এতে বহির্বিশ্বে সু চির ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। পুনরায় তার ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল অং চাইয়াং হতে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। সেনাবাহিনীর সমর্থনকারী একাধিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী এসব রাজনৈতিক দল ব্যবহার করবে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কী হবে? মিয়ানমার কি তাদের ফিরিয়ে নেবে? রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার কয়েকটি শর্তের কথা বলছে। প্রথমত রয়েছেÑ তারা যে মিয়ানমারের নাগরিক, তা প্রমাণ করতে হবে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না মিয়ানমার। মিয়ানমারের এসব নাগরিককে তারা বলছে ‘বাঙালি’। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবেন না। কেননা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জীবন বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন। ফলে তাদের কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণ করা সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র থাকার কথা নয়। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা সন্তানদেরও প্রমাণ করতে হবে তাদের মা-বাবা রাখাইনে অনেক আগে থেকেই বসবাস করে আসছিলেন। এটিও সম্ভব হবে না। তৃতীয়ত, রাখাইনের বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বাড়িঘরের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে তাদের বাড়িঘরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছেন। নতুন করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে ‘আস্থার সংকট’-এর যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা রয়ে গেছে। ফলে রোহিঙ্গারা কোনো নিশ্চয়তা না পেয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইবেন না। একটু সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এতে মিয়ানমারের রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটেছে বলে বলা হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের অবস্থান আশাব্যঞ্জক নয়। অং সান সু চিসহ মিয়ানমারের নেতারা মিথ্যাচারের আশ্রয় নিচ্ছেন বারবার। ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত আসিয়ানের ৩১তম সম্মেলনে সু চি বলেছিলেন, সমঝোতা চুক্তি হলে তিন সপ্তাহের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে মিয়ানমার। এটা সময়ক্ষেপণ করার একটা কৌশল। এর আগে গত অক্টোবরে সু চি বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা ফিরতে চান না। তিনি একবার এমন কথাও বলেছেন যে, মুসলমানরা কেন চলে যাচ্ছেন, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। গত সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এসেছিলেন মিয়ানমারের বিশেষ দূত কিউ টিন। কিন্তু ফল শূন্য। তাই একাধিক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বাংলাদেশ সফর, এমনকি আসেম শীর্ষ সম্মেলনও আমাদের জন্য একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। আমরা ওই সম্মেলন আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। এ নভেম্বরেই আসছেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি বাংলাদেশে এসে মিয়ানমারেও যাবেন। আমরাও এ সুযোগটি আমাদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারি। মোদ্দা কথা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের পাশে আছে। এখন দরকার কূটনৈতিক যোগাযোগ আরও শক্তিশালী করা। দুঃখজনক হলেও আমরা তা পারিনি। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসেম সম্মেলনে যোগদানের আগে ঢাকা সফর করে গেলেন গত শনিবার। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার দেখাও হয়েছে। নিশ্চয় বাংলাদেশ তার অবস্থান তুলে ধরেছে। আসেম সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য আরেকটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সোমবার থেকে মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিদোতে ওই শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়েছে। আসেম (অঝঊগ-অংরধ-ঊঁৎড়ঢ়ব গববঃরহম) একটি বড় সংগঠন। বর্তমানে ৫১টি দেশ ও দুটি আঞ্চলিক সংস্থা আসেমের সদস্য। ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ (ভারতসহ) এবং চীন আসেমের সদস্য। ফলে আসেম সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বাংলাদেশ একটি সুযোগ পাবে রোহিঙ্গা সমস্যাটা তুলে ধরার। আসিয়ান সম্মেলনে রোহিঙ্গা প্রশ্নে কোনো আলোচনা হয়নি বটে তবে আসিয়ানভুক্ত অনেক দেশ ওই সংকটটি সম্পর্কে অবগত। আমাদের উচিত ছিল ওইসব দেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রশ্নে একটা শক্ত অবস্থানে যাওয়া। বিশেষ করে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া কিংবা থাইল্যান্ড বরাবরই রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের ভূমিকার সমালোচনা করে আসছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কুয়ালালামপুরে আয়োজিত একটি বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব পর্যন্ত দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের কোনো প্রতিনিধি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীÑ কেউ এসব দেশে গেছেন, এটা আমার জানা নেই। ২০১২ সালে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হলে শত শত রোহিঙ্গা যখন সাগরে দিনের পর দিন ভাসছিলেন, তখন থাইল্যান্ড একটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ব্যাংককে। এর পর মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বের করে দেওয়ার প্রবণতা কমেছিল। আমরা তারপর থেকে রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করিনি। এর রেশ ধরেই আবারও সৃষ্টি হয়েছে ওই সংকট। তাহলে এর সমাধান হবে কীভাবে? বাকি রোহিঙ্গারা এভাবেই ক্যাম্পে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করবেন? যেহেতু রোহিঙ্গা সংকটের একটি মানবিক দিক আছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যথেষ্ট সচেতন, সেহেতু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি সংবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত শনিবার ঢাকা সফর করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াংই কথা বলেছেন। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সংলাপে সহযোগিতা করতে চীনের আগ্রহের কথা তিনি জানিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো খবর। চীন আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। বাংলাদেশে চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। চীনের যথেষ্ট প্রভাব আছে মিয়ানমার সরকারের ওপর, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর ওপর তাদের প্রভাব অনেক। এ ক্ষেত্রে চীন যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে একটা অর্থপূর্ণ সংলাপ হতে পারে। দ্বিতীয় সংবাদটিও উৎসাহব্যঞ্জক। মার্কিন সিনেটর জেফ মার্কেল গত শনিবার কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত মার্কিন কংগ্রেসে উপস্থাপন করবেন। তার সঙ্গে আরও এক সিনেটর ও তিন কংগ্রেসম্যান ছিলেন। নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় ঘটনা। আমরা ওই সফর আমাদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিবারক কূটনীতি বলে একটা কথা আছে। বিশ্ব রাজনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, ওই পরিবর্তন সামনে রেখে ও শান্তি নিশ্চিত করতে অনেক রাষ্ট্র নিবারক কূটনীতি বা ‘প্রিভেনটিভ ডিপ্লোমেসি’ প্রয়োগ করে। নিবারক কূটনীতির মূল কথা হচ্ছে, দুটি দেশ যাতে কোনো বিপদ বা বিতর্কে জড়িয়ে না যায়Ñ যাতে করে এ বিপদ সংঘর্ষের পর্যায়ে উপনীতি না হয় এবং যাতে সব বিপদ নিষ্পত্তি করার জন্য পারস্পরিক বিশ্বাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করা যায়, এ লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ এই নিবারক কূটনীতি প্রয়োগ করে আসছে। তারপরও কথা থেকে যায়। সদ্য আসা ৬ লাখ ২০ হাজারসহ মোট ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে হবে মিয়ানমারকে। তারা মিয়ানমারের নাগরিক। চীনের ‘সংলাপ’-এর উদ্যোগকে আমি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। চীনের ওপর আস্থা রাখাটা জরুরি। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এখন দেখার পালা চীন কী উদ্যোগ নেয়! আমাদের ভুললে চলবে না, চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে মিয়ানমারে। রাখাইনে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন (যা এক সময় করার কথা ছিল কক্সবাজারের সোনাদিয়ায়) এবং ২ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে তেল ও গ্যাস উত্তোলন খাতে। গত এপ্রিলে সেখানে উত্তোলন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে তা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ৭৭০ কিলোমিটার দূরে চীনের ইউনান প্রদেশে। এখন চীন যদি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মধ্যস্থতা করে, তাহলে তা আমাদের জন্য হবে বড় পাওয়া। এ জন্যই আমাদের যা দরকার, তা হচ্ছে দক্ষ কূটনীতি। সরকার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিশনও গঠন করতে পারেÑ যারা সরকারকে সহযোগিতা করবেন এবং প্রয়োজনে বিদেশে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরবেন।
Daily Amader Somoy
21.11.2017

রোহিঙ্গা সমস্যার আদৌ কি সমাধান হবে



আজ রোববার তিনটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এবং সেই সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উখিয়ায় অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির দেখতে যাচ্ছেন। সঙ্গে থাকবেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জার্মানি, জাপান ও সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে যাচ্ছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও। ফিরে এসে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন। তারপর তারা যাবেন মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে, যেখানে তারা আসেম বা এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ে যোগ দেবেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সমস্যা যে কত গুরুত্ব সহকারে স্থান পেয়েছে, তার বড় প্রমাণ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং মার্কিন সিনেটর জেক মার্কেলের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দলেরও একই সময় ঢাকা আগমন। এর অর্থ হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে একটি বড় ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা। এসব তৎপরতা অনুষ্ঠিত হয়েছে এমন একসময়, যখন গেল ১৬ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটিতে ভোটাভুটিতে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহনীর অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে ১৩৫টি রাষ্ট্র। বিপক্ষে পড়েছে ১০টি ভোট। কিছু দেশ ভোটদানে অনুপস্থিত ও বিরত ছিল। চীন ও রাশিয়া ভোটদানের সময় প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। ভারত ও জাপানসহ ২৬টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর সহিংসতা বন্ধ ও মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন পুনর্বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের ‘পূর্ণ নাগরিকত্ব’ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত ও রোহিঙ্গাদের ওপর যারা অত্যাচার-নিপীড়ন করছে, তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্যও দেশটির সরকারকে বলা হয়েছে। ওআইসি এ খসড়া প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল। এর কো-স্পন্সর ছিল ৯৭টি দেশ। যে কোনো বিবেচনায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটিতে এ ধরনের একটি প্রস্তাব পাস করানো আমাদের জন্য এক ধরনের ‘বিজয়’। চীন ও রাশিয়ার ‘অবস্থান’ আমাদের আগেই জানা ছিল। ভারত প্রথম দিকে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান করলেও এখন ভোটাভুটিতে ভারত বিরত থাকায় ভারতের অবস্থান কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হয়েছে বলে আমার ধারণা। এখন এতগুলো দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঢাকায় আসছেন। তারা নিজেরা রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখবেন। ফলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর এক ধরনের ‘চাপ’ আসতে পারে বলে আমার ধারণা। বলা হচ্ছে, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে দুই দেশের মাঝে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হবে, যারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করবে। কাজটি খুব সহজ নয়। এর সঙ্গে অনেক ‘প্রশ্ন’ জড়িত। তবে এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অন্যত্র নিয়ে গিয়ে তাদের একসঙ্গে রাখা।
রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন নিয়ে সাম্প্রতিককালে দুইটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল সংবাদপত্রে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেল ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির মিউনিখে একটি নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মরকেলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে জার্মানির সহযোগিতা চেয়েছিলেন। অপর সংবাদটিও রোহিঙ্গা পুনর্বাসনসংক্রান্ত। বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশ প্রধান শিনজি কুবো জানিয়েছিলেন, ১ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ভিন্ন কোনো দেশে পুনর্বাসনের জন্য তারা বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি চেয়েছেন। তবে সম্প্রতি যে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তদের মধ্য থেকে এ ১ হাজার রোহিঙ্গাকে বেছে নেয়া হবে বলে মনে হয় না। কুবো জানিয়েছেন, বাংলাদেশের দুইটি শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় ৩৪ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। সেখান থেকেই এ ১ হাজার রোহিঙ্গাকে বাছাই করা হবে। এ দুইটি সংবাদই রোহিঙ্গা শরণার্থী পুনর্বাসন প্রশ্নে একটি বড় সংবাদ। কিন্তু এতে করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারে অবৈধভাবে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের হাতিয়া উপজেলার একটি বিরান চর ঠেঙ্গারচরে (ভাসানচর) সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে স্পষ্ট করে বলা হয়নি, কবে নাগাদ সেখানে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হবে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনীকে একটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেখানে অবকাঠামো গড়ে তুলতে। ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের প্রশ্নে কিছু কিছু দ্বিমত থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন। কেননা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার কক্সবাজারে উপস্থিতি শুধু পরিবেশগত সমস্যাই বাড়িয়ে দিচ্ছে না, বরং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাকে ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিয়েছে। স্থানীয়রা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে এবং তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘর্ষ হচ্ছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে এ ধরনের সংবাদ প্রমাণ করে, রোহিঙ্গা সমস্যাটি ধীরে ধীরে একটি আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে এরই মধ্যে। সংগত কারণেই তাই প্রশ্নটি উঠছেÑ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন পথে? বাংলাদেশও এক্ষেত্রে কী করতে পারে? সম্প্রতি একাধিক টিভি চ্যানেলে রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনায় আমি অংশ নিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ ও হুমায়ুন কবির। দুইজনই সিনিয়র কূটনীতিক। সেখানেও এ প্রশ্নটি উঠেছিলÑ বাংলাদেশ এখন কী করবে? বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সমস্যাটি বিবেচনা করে সাময়িকভাবে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑ এতে কি সমস্যাটির সমাধান হবে? আমার বিবেচনায় এতে সমস্যার সমাধান হবে না; বরং সমস্যার গভীরতা আরও বাড়বে। বাংলাদেশ শুধু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে ‘বসে’ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের অনেক কিছু করার আছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যাটির আরও আন্তর্জাতিক করার উদ্যোগ নিতে পারে। এক্ষেত্রে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করতে পারে বাংলাদেশ এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় (বাংলাদেশ-মিয়ানমার) পাশাপাশি বাংলাদেশ চীন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারে এবং তাদের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারে ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করতে পারে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের ভেতরেই একটি ‘সেফ হ্যাভেন’ প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিক তদারকিতে সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার কথা বলতে পারে বাংলাদেশ। যেহেতু জাতিসংঘ রোহিঙ্গা নির্যাতনকে গণহত্যা বলছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এ গণহত্যার বিষয়টি তুলতে পারে। এটা সত্য, মিয়ানমারে আমাদের স্বার্থ রয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে এ সম্পর্কের গুরুত্ব অনেক। ন্যূনতম দুইটি আঞ্চলিক সংস্থায় (বিসিআইএন ও বিমসটেক) বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একসঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যাটাকে এ সম্পর্কের বাইরে রাখা যাবে না। এজন্য দরকার ‘স্মার্ট ডিপ্লোম্যাসি’। সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বলা ভালো, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে অং সান সু চির কাছ থেকে প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা পেলে এবং শত শত রোহিঙ্গার নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও ওই সময় সু চির কোনো বক্তব্য ছিল না। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে, শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু চি এ প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য তার উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন আছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করতে তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি যে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা। সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী তিনিÑ এ কথাটা বলা যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের আগে একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের ‘সহাবস্থান’ গিয়েছিলেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছিলেন। এতে তিনি ‘বিজয়ী’ হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি সমাজ ব্যবস্থা সেখানে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবেÑ সে প্রশ্ন আছে। একটি জনগোষ্ঠী যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়, তখন সেই সমাজকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। পশ্চিমাদের বিরাট একটা প্রত্যাশা ছিল সু চিকে ঘিরে। তাদের ধারণা ছিল, সু চি মিয়ানমারে সত্যিকার অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু করবেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, তিনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গোষ্ঠীস্বার্থেই কাজ করছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুকে সামনে রেখেই সু চি যে ব্যর্থ হয়েছেন, এটা আগামীতে সেনাবাহিনী ব্যবহার করবে। সেনাবাহিনীর পক্ষে এটা বলা সহজ হবে যে, সু চি মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর সংসদ বসেছিল ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে অং সান সু চি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি; প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন হাতিন কিয়াও(Htin Kyaw)। তার টার্ম শেষ হবে ২০২১ সালে। এর আগে ২০২০ সালের দিকে সেখানে নির্বাচন হবে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে বহির্বিশ্বে সু চির ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। ফের তার ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। এক্ষেত্রে বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল অং হ্লাইং হতে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। সেনাবাহিনীর সমর্থনকারী একাধিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী এসব রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করবে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কী হবে? মিয়ানমার কি তাদের ফিরিয়ে নেবে? মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কয়েকটি শর্তের কথা বলছে। প্রথমত রয়েছে তারা যে মিয়ানমারের নাগরিক, তা প্রমাণ করতে হবে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। মিয়ানমারের এসব নাগরিককে তারা বলছে ‘বাঙালি’। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব তারা প্রমাণ করতে পারবেন না। কেননা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জীনব বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন। ফলে তাদের কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণ করা সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র থাকার কথা হয়। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা সন্তানদেরও প্রমাণ করতে হবে তাদের বাবা-মায়েরা রাখাইনে অনেক আগে থেকেই বসবাস করে আসছিলেন। এটিও সম্ভব হবে না। তৃতীয়ত, রাখাইনের বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে বাড়ি ঘরের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে তাদের বাড়িঘরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। নতুন করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে ‘আস্থার সংকটে’র যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা রয়ে গেছে। ফলে রোহিঙ্গারা কোনো ধরনের নিশ্চয়তা না পেয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইবে না।
একটু সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এতে মিয়ানমারের রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটেছে বলে বলা হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের অবস্থান আশাব্যঞ্জক নয়। অং সান সু চিসহ মিয়ানমারের নেতারা মিথ্যাচারের আশ্রয় নিচ্ছেন বারবার। ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত আসিয়ানের ৩১তম সম্মেলনে সু চি বলেছিলেন, সমঝোতা চুক্তি হলে তিন সপ্তাহের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে মিয়ানমার। এটা সময়ক্ষেপণ করার একটা কৌশল। এর আগে অক্টোবরে সু চি বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা ফিরতে চায় না। তিনি একবার এমন কথাও বলেছেন, মুসলমানরা কেন চলে যাচ্ছেন, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। গেল সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এসেছিলেন মিয়ামনমারের বিশেষ দূত কিউ টিন। কিন্তু ফল শূন্য। ফলে একাধিক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বাংলাদেশ সফর, এমনকি আসেম শীর্ষ সম্মেলনও আমাদের জন্য একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। আমরা এ সম্মেলনকে আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। এ নভেম্বরেই আসছেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি বাংলাদেশে এসে মিয়ানমারেও যাবেন। আমরাও এ সুযোগটি আমাদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারি। মোদ্দাকথা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের পাশে আছে। এখন দরকার কূটনৈতিক যোগাযোগ আরও শক্তিশালী করা।
Daily Alokito Bangladesh
19.11.2017

ট্রাম্পের সফর কতটা বৈশ্বিক, কতটা সাম্রাজ্যবাদী?

Image result for Trump cartoon

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সদ্য সমাপ্ত এশিয়া সফর একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট দীর্ঘ সময় (১২ দিন) এশিয়া সফর করলেন। দ্বিতীয়ত, তার চীন সফর ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা ট্রাম্পের শাসনামলে দু’দেশের সম্পর্ক কোনদিকে যায়, তা নিয়ে যথেষ্ট জল্পনা-কল্পনা ছিল। ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার আগে ও পরে চীন সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছিলেন তাতে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, তিনি চীনের ব্যাপারে বেশ কঠোর হবেন। তাই তার চীন সফরের দিকে সবার বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তৃতীয়ত, তিনি ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত অ্যাপেক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। ট্রাম্প চলতি বছরের প্রথমদিকে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তিটি বাতিল করে দেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলভুক্ত ১২টি দেশের সঙ্গে অ্যাপেক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। তাই দেখার বিষয় ছিল তার ওই সফরে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়।


ট্রাম্পের এ সফরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নতুন দিকে টার্ন নিয়েছে। বলা যেতে পারে, চীনের ব্যাপারে তিনি তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। তাকে চীনে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে, যা ওবামার শেষ সময়ে তার চীন সফরের সময় দেয়া হয়নি। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক সম্পর্ক চীনের অনুকূলে। এ নিয়ে অতীতে ট্রাম্প নানা বিরূপ মন্তব্য করেছেন। চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কথাও তিনি বলেছিলেন। কিন্তু চীনে এসে তিনি তার সুর বদল করলেন। বললেন, বাণিজ্য ঘাটতির জন্য চীনকে দায়ী করা যাবে না। তিনি উত্তর কোরিয়া প্রশ্নে চীনের সহযোগিতা চেয়েছেন এবং একসঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন। তার সফরে বাণিজ্য ছিল প্রধান। উল্লেখ্য, এ সফরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ২৫ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীনের ‘জ্বালানি ক্ষুধা’ মেটাতে আলাস্কা থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস চীনে রফতানি করা হচ্ছে। ৩৭০০ কোটি ডলারের বিনিময়ে ৩০০টি বোয়িং বিমানও কিনবে চীন। এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার কারণে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ‘কৌশলগত সম্পর্কের’ ওপর প্রভাব পড়তে পারে। এটা অনেকের কাছে স্পষ্ট, দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটা চিন্তার কারণ। তাই একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল যে, চীনের বিরুদ্ধে প্রক্সি বাহিনী হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এটা যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো কৌশল। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ব্যবহার করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। তখন ইউরোপে কর্তৃত্ব ও প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। আজ একুশ শতকে এসে স্নায়ুযুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র হয়েছে এশিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের বদলে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট। আর চীনের বিরুদ্ধে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভারতকে ব্যবহার করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তাই ভারতকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে যুক্তরাষ্ট্র।

চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ভারত তাতে যোগ দেয়নি, যদিও বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে ব্যবহার করতে চায়। অনেকের মনে থাকার কথা, কিছুদিন আগে ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে ৪টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছিল। ভারত ভিয়েতনাম নিয়ন্ত্রিত এলাকায় দক্ষিণ চীন সাগরে গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাব্যতা নিয়ে গভীর কূপ খননে নিয়োজিত রয়েছে। চীন এ কাজকে ভালো চোখে দেখছে না। ডোকলাম নিয়ে অতিসম্প্রতি ভারত ও চীনের দ্বন্দ্ব ও সম্ভাব্য একটি সংঘর্ষের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে নয়া স্ট্র্যাটেজি, তাতে যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত সেখানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা বাড়ছে। সেখানে ভারতের একটি বিমান ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভারত মহাসাগরে প্রভাববলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে চীনের একধরনের ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ চলছে। চীনের পাশাপাশি ভারতও ভারত মহাসাগরভুক্ত কোনো কোনো দেশে তাদের নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করছে। ফলে চীনকে ‘ঘিরে ফেলার’ যুক্তরাষ্ট্রের যে দীর্ঘ স্ট্র্যাটেজি তাতে ভারত অন্যতম অংশীদার হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই ট্রাম্প যখন এশিয়ায় দীর্ঘ সফরে এলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক নিয়েও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল অনেকের।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ট্রাম্প তার চীন সফরে চীনবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে। তিনি ‘নিষিদ্ধ নগরী’ (বেইজিং) পরিদর্শন করেছেন। সঙ্গে ছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ট্রাম্প তার নাতির গাওয়া একটি চীনা সঙ্গীত শি জিনপিংকে শুনিয়েছেন। এই সঙ্গীত শুনে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এই গায়কী ‘এ-প্লাস’ পাওয়ার যোগ্য। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে প্রশংসা করতে তিনি এতটুকু দ্বিধাবোধ করেননি। সম্প্রতি চীনে কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেস শেষ হয়েছে। কংগ্রেসে শি জিনপিং আবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে ‘মহান নেতা’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। এমনকি তাকে ‘রাজার’ সঙ্গে তুলনা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি (গার্ডিয়ান, ২৫ অক্টোবর ২০১৭)। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে হামবুর্গে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ট্রাম্পের সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল। এবার আবারও তাদের সাক্ষাৎ হল।

সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে চীনের কোনো কোনো সিদ্ধান্তে ট্রাম্প খুশি। চীন উত্তর কোরিয়ার আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে চীন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন ভালো করেই জানে, উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ করতে হলে চীনের সাহায্য প্রয়োজন। এজন্যই ট্রাম্প চীনে গিয়ে চীনবিরোধী কোনো শক্ত মন্তব্য করেননি। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে উত্তর কোরিয়াবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে হলে ট্রাম্পের প্রয়োজন চীনের সহযোগিতা। তবে দক্ষিণ চীন সাগর প্রশ্নে তিনি ‘স্ট্যাটাস কো’ পন্থা অবলম্বন করেন কিনা, সেটিই বড় প্রশ্ন এখন। দক্ষিণ চীন সাগরের আশপাশে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত টহল দেয়। এটা চীন কোনোমতে মেনে নেয়নি। চীন মনে করে এ অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজের চলাচল তার সার্বভৌমত্ব খর্বের শামিল। দক্ষিণ চীন সাগর চীনের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করে বেইজিং। ইতিমধ্যে চীন সেখানে তার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রচুর গ্যাস ও তেল রয়েছে এ অঞ্চলে, যা কিনা চীনের জ্বালানি ক্ষুধা মেটাতে সাহায্য করবে। এ অঞ্চলের ওপর তাইওয়ান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামেরও দাবি রয়েছে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক আদালত চীন-ফিলিপাইন দ্বন্দ্বে ফিলিপাইনের দাবির পক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু ফিলিপাইন চীনের আর্থিক সহযোগিতার (২৪ বিলিয়ন ডলার) পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর তার দাবি থেকে সরে এসেছে। চীনের সঙ্গে ফিলিপাইনের সম্পর্ক এখন ভালো। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে ইতিমধ্যে চীন সফর করেছেন। এ এলাকার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণ এলাকাটির স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তার ষষ্ঠ নৌবহরের রসদ সরবরাহের জন্য এ রুটের গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং দক্ষিণ চীন সাগরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সীমান্ত না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র এ এলাকার ব্যাপারে তার আগ্রহ হারায়নি। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে চীন সফরের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দক্ষিণ চীন সাগরের প্রশ্নটি উত্থাপন করেননি। বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেছেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সফরের সময় সঙ্গত কারণেই উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেছেন। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে তিনি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে ব্যবহার করবেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় ইতিমধ্যে ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছে। এটি দেশটিকে উত্তর কোরিয়ার যে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে রক্ষা করবে। যদিও ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন নিয়ে একধরনের ‘বিভ্রান্তি’ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে, ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের সব খরচ দক্ষিণ কোরিয়াকে বহন করতে হবে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া তাতে রাজি হয়নি। এ বিরোধের কোনো সমাধান হয়নি। তবে একটা ভালো খবর হচ্ছে, দক্ষিণ কোরিয়া সফরকালে ট্রাম্প প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী অসামরিক এলাকায় যেতে পারেননি। এতে করে উত্তর কোরিয়া যে কোনো ধরনের ‘প্রভোকেশন’ থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে, ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কেন্দ্রে ‘আগাম হামলা’ চালাতে পারেন! প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০৩ সালে ইরাকে ‘আগাম হামলা’ চালিয়েছিলেন। বুশের যুক্তি ছিল, সাদ্দাম হোসেনের কাছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র রয়েছে। সাদ্দাম হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা চালানোর(?) আগেই বুশ ইরাকের সব সমরাস্ত্র ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। অথচ পরে জানা গেল সাদ্দাম হোসেনের কাছে কোনো ধরনের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ছিল না। এখন ট্রাম্প একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে। আগাম হামলা বা প্রিয়েমটিভ অ্যাটাকের সূচনা যাতে ট্রাম্প করতে না পারেন, সেজন্য ডেমোক্রেটরা কংগ্রেসে একটি বিল উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন। এ বিল কংগ্রেসে পাস হলে ট্রাম্প আর উত্তর কোরিয়ায় আগাম হামলা চালাতে পারবেন না। তারপরও চূড়ান্ত বিচারে ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেন, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হয়ে টিপিপি চুক্তি বাতিল ঘোষণা করেছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের সীমান্তঘেঁষা ১২টি দেশ (যে দেশগুলোর কয়েকটিতে সফর করলেন ট্রাম্প) এই টিপিপির অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিশ্বের ৪০ ভাগ জিডিপির অধিকারী এ দেশগুলো। টিপিপির মাধ্যমে একটি শুল্কমুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র টিপিপি বাতিল করায় অন্য দেশগুলো কী করবে, তা স্পষ্ট নয়। চীন টিপিপিতে ছিল না। ফলে বাকি ১১টি দেশ (যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া) চীনের সঙ্গে এ ধরনের একটি চুক্তি করতে পারে। বলা ভালো, জাপান এ চুক্তিটি ইতিমধ্যে ‘রেটিফাই’ করেছে। ট্রাম্পের এ সফরে টিপিপির বিকল্প নিয়ে তেমন একটা আলোচনা না হলেও ট্রাম্প বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে টিপিপিভুক্ত দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্তভাবে তাদের পণ্যের যে সুবিধা পেত, তা এখন না থাকায় এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য কীভাবে বাড়বে, তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। উপরন্তু টিপিপিভুক্ত ১১টি দেশ যদি সত্যি সত্যিই চীনের সঙ্গে একটি শুল্কমুক্ত চুক্তি করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এটাকে ভালো চোখে দেখবে না, এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে ‘বাণিজ্য যুদ্ধের’ সম্ভাবনা বাড়বে বৈকি!

আগামী দিনের বিশ্ব রাজনীতিতে এশিয়া-প্যাসিফিক একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি বাড়াতে চায়। তিনটি বড় অর্থনীতির দেশ এ অঞ্চলে অবস্থিত- চীন, জাপান ও ভারত। বেইজিংয়ে তিনি যতই লালগালিচা সংবর্ধনা পান না কেন, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কই আগামী দিনের বিশ্ব রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করবে। এ ক্ষেত্রে চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন যে ভারতকে ব্যবহার করবে, তা অ্যাপেক সম্মেলনে দেয়া ট্রাম্পের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। ট্রাম্পের এ সফর প্রমাণ করল এ অঞ্চলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে এবং আগামী দিনগুলোতেও এর কোনো কমতি হবে না।
Daily Jugantor
16.11.2017

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলজুড়ে স্নায়ুযুদ্ধের ছায়া

Image result for Trumps Asia visit
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন এশিয়ায়। তার ১২ দিনের এশিয়া সফর শেষ হয়েছে ১৪ নভেম্বর। এই সফরে তিনি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন সফর করেন। একই সঙ্গে দুটি আঞ্চলিক সংস্থা অ্যাপেক ও আশিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। অতীতে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এত দীর্ঘ সময়ে এশিয়া সফর করেননি। এর মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হলো যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলকে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলগুলোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ দীর্ঘদিনের। এখানে মোতায়েন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর একটি ফ্লিট। দীর্ঘদিন এ অঞ্চল এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেলেও ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে এর নতুন নামকরণ করা হয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক। অর্থাৎ ভারত মহাসাগর তথা ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার স্ট্র্যাটেজি রচনা করছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, ক্রমেই এই অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়ছে। একদিকে চীনের উত্থান ও ভারত মহাসাগরে চীনের কর্তৃত্ব করার প্রবণতা, অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচিÑ সব মিলিয়ে এই এলাকার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব। অর্থনৈতিকভাবে এই অঞ্চলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল। স্ট্র্যাটেজিক কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই অঞ্চলের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করতেই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে টানছে। ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার। এখানে অনেক আগে থেকেই প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। এই দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ভারত। একদিকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য, অন্যদিকে চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক, চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কর্মসূচি এ অঞ্চলে নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইউরোপে প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। এখন স্নায়ুযুদ্ধের কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ছে। এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব করার প্রবণতায় নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছে। দীর্ঘ সফরে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন এ অঞ্চলে যান, তখন বুঝতে কারো বাকি থাকে না, যুক্তরাষ্ট্র কোন দৃষ্টিতে এ অঞ্চলকে দেখছে। এখানে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। আগামী দিনে এই অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান-পতন বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। প্রায় ৩৫ লাখ বর্গকিলোমিটারজুড়ে রয়েছে চীন সাগরের বিস্তৃতি। এই অঞ্চলটি চীনের মূল ভূখ-ের দক্ষিণে, ফিলিপাইনের পশ্চিমে, মালয়েশিয়ার উত্তরে, ব্রুনাইর উত্তর-পশ্চিমে, ইন্দোনেশিয়ার উত্তরে এবং ভিয়েতনামের পূর্বে অবস্থিত। এ অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়েছে এ কারণে যে, দক্ষিণ চীন সাগরে প্রায় ১১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রয়েছে এবং গ্যাস রয়েছে ১৯০ দশমিক ২০ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার। চীনের আগ্রহ সে কারণেই দিন দিন বেড়েছে। চীনের প্রচুর ‘জ্বালানি সুধা’ রয়েছে। চীনের অর্থনীতিকে সঠিক পথে চলতে প্রচুর জ্বালানি দরকার। এ ক্ষেত্রে এই অঞ্চলে যদি চীনের কর্তৃত্ব থাকে, তা হলে চীন তার জ্বালানি চাহিদা এখান থেকে মেটাতে পারবে। এই সমুদ্রপথটি পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ। এ কারণে এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। পৃথিবীর সমুদ্রপথে যত বাণিজ্য হয়, তার এক-তৃতীয়াংশ হয় এই পথে। চীন, জাপান, কোরিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ায় যাওয়ার বাণিজ্যিক রুট হিসেবে এ পথকে ব্যবহার করে। দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত স্প্রাটলি, প্যারাসেল ও টনকিন উপসাগরে অবস্থিত কয়েকটি ছোট দ্বীপ নিয়ে আশপাশের দেশ, বিশেষ করে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার সঙ্গেই চীনের বিরোধ। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই অঞ্চলের অর্থাৎ দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব বেড়েছে একাধিক কারণে। শুধু চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’ কিংবা চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে একটি ‘ঐক্য’ করার পাশাপাশি জাপানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকির মোকাবিলা করা, এ সাগর দিয়ে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করার ব্যাপারে মার্কিনি স্বার্থ রয়েছে। এর ওপর রয়েছে এ এলাকার তেল ও গ্যাসসম্পদের ওপর মার্কিনি বহুজাতিক কোম্পানির লোলুপ দৃষ্টি। ফলে এই অঞ্চলটি যে আগামী দিনের প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করতে আজ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান এমনকি ভারতও তৎপর। যুক্তরাষ্ট্র এ দেশগুলোকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে। এটি বিশ্বের বড় সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটের একটি। বিশ্ব বাণিজ্যের ৩২ ভাগ এ পথ দিয়ে প্রবাহিত হয়। চীনের মূল ভূখ-ের সঙ্গে এটি সংযুক্ত নয়। মূল ভূখ- থেকে ১ হাজার নটিক্যাল মাইল দূরে এই দ্বীপগুলো অবস্থিত। জাপান এই রুটকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করে এবং ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যিক রুট হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। জাপান এই দ্বীপগুলোর নাম দিয়েছে সেনকাকু, যা চীনের কাছে পরিচিত দিয়াওইউ নামে। ঐতিহাসিকভাবে চীনের শি ও হান রাজবংশের কর্তৃত্ব অনুযায়ী চীন এ অঞ্চলের মালিকানা দাবি করে এলেও এ অঞ্চলের আশপাশের দেশগুলো তা মানতে নারাজ। জাপানের নিজস্ব কোনো তেল ও গ্যাস নেই। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর দেশটি পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। জাপান দৈনিক ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই সামুদ্রিক পথটি ব্যবহার করে আমদানি করে থাকে। এ অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব থাকায়, চীন এ অঞ্চলে নতুন করে একটি কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়েছে। সেখানে যুদ্ধবিমান মোতায়েনের জন্য বড় বড় রানওয়ে তৈরি করছে। মিসাইল ব্যাটারি স্থাপন করেছে। এমনকি আগামীতে এখানে পারমাণবিক সাবমেরিন যাতে ‘ডক’ করতে পারে। সে ব্যবস্থাও পাকাপাকি করেছে চীন। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র এই আতঙ্ককে ব্যবহার করছে তার স্বার্থে। বলা ভালো, দক্ষিণ চীন সাগরের এই বিরোধটি জাতিসংঘের সামুদ্রিক বিবাদ নিষ্পত্তিসংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে উত্থাপিত হয়েছিল। ফিলিপাইন ছিল এর উদ্যোক্তা। তবে চীন এই শুনানিতে অংশ নেয়নি। চীন আদালতের কর্তৃত্ব মানতে চাইছে না। ফলে বিবাদ নিষ্পত্তি নিয়ে একটি প্রশ্ন থেকেই গেছে। তবে রায় ফিলিপাইনের পক্ষে গিয়েছিল। দক্ষিণ চীন সাগরের এই বিরোধ যখন অনিষ্পন্ন তখন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। এর ফলে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার অস্ত্র আমদানি শুরু করবে, যা কিনা এ অঞ্চলে এক ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দেবে। অতীতে চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের খবর আমরা জানি। ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে সেই যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৩ সপ্তাহ। তখন চীনের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামকে সমর্থন করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। আজ যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামকে ব্যবহার করছে চীনের বিরুদ্ধে। প্রেক্ষাপট এক। চীন এ অঞ্চলের তথা বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম একটি ফ্যাক্টর। অর্থনৈতিক তথা সামরিক দিক দিয়ে চীন অন্যতম একটি শক্তি। তাই ঘুরেফিরে আসছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তী ‘কনটেনমেন্ট থিওরি’। অর্থাৎ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলা ও সমাজতন্ত্রের পতন ঘটানোর তত্ত্ব। দীর্ঘ ৪৬ বছর লেগেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটানোয়। আজ একই স্ট্র্যাটেজি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে এসেছে চীনের সমাজতন্ত্রের পতন ঘটানোর। এই স্ট্র্যাটেজিতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। চীনের বিরুদ্ধে প্রস্ক্রি বাহিনী হিসেবে ভারতকে ব্যবহার করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এটা যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো কৌশল। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ব্যবহার করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। তখন ইউরোপের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। আজ একুশ শতকে এসে স্নায়ুযুদ্ধের নতুন এক ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে এশিয়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বদলে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট। আর চীনের বিরুদ্ধে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভারতকে ব্যবহার করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই ভারতকে নিয়েই মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কর্মসূচির ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ভারত তাতে যোগ দেয়নি, যদিও বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে ব্যবহার করতে চায়। অনেকের মনে থাকার কথা, কিছুদিন আগে ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে ৪টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছিল। ভারত ভিয়েতনাম নিয়ন্ত্রিত এলাকায় দক্ষিণ চীন সাগরে গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাব্যতা নিয়ে গভীর কূপ খননে নিয়োজিত। চীন এই কাজকে ভালো চোখে দেখছে না। দোকলামের পর লাদাখে অতিসম্প্রতি ভারত ও চীনের দ্বন্দ্ব ও সম্ভাব্য একটি সংঘর্ষের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে নয়া স্ট্র্যাটেজি, তাতে যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত সেখানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা বাড়ছে। সেখানে ভারতের একটি বিমান ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভারতীয় মহাসাগরে প্রভাব বলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করেই ভারতের সঙ্গে চীনের এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। চীনের পাশাপাশি ভারতও ভারত মহাসাগরভুক্ত কোনো কোনো দেশে তাদের নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করছে। ফলে চীনকে ‘ঘিরে ফেলার’ যুক্তরাষ্ট্রের যে দীর্ঘ স্ট্র্যাটেজি তাতে ভারত অন্যতম অংশীদার হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই ট্রাম্প যখন এশিয়ায় দীর্ঘ সফরে এসেছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক নিয়েও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল অনেকের। ট্রাম্পের এই সফর তাই নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি চীনে লালগালিচা সংবর্ধনা পেলেও ভিয়েতনামে অ্যাপেক সম্মেলনে যোগ দিয়ে চীনবিরোধী নানা কথা বলেছেন। বলতে দ্বিধা নেই, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বর্তমান প্রেক্ষাপটে শুধু ব্যবসায়িক। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের ‘বাণিজ্যিক যুদ্ধের’ সম্ভাবনা বাড়ছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রশংসা করার অর্থ হচ্ছে, চীনা জনমানসে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। উত্তর কোরিয়া প্রশ্নে তার চীনা সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চীনবিরোধী অ্যালায়েন্স গড়ে তোলার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র তার স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করেনি। ভারত এই অঞ্চলের উঠতি শক্তি। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে ট্রাম্প কোনো মন্তব্য না করলেও এখানে চীনের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর এ অঞ্চলে টহল অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা রয়েই গেল। এই উত্তেজনা এ অঞ্চলে এক ধরনের যুদ্ধের ছায়া ফেলছে। ট্রাম্পের এশিয়া সফরে তিনি যে খুব ‘সফল’ হয়েছেন, তা বলা যাবে না। কেননা উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রশ্নে তিনি সফল হননি। তাই সঙ্গত কারণেই এ অঞ্চলের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ থাকবে অনেকের।
Daily Amader Somoy
15.11.2017

ট্রাম্পের সফর ও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আগামী রাজনীতি

Image result for Trumps Asia visit


মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ১২ দিনের এশিয়া সফর শেষ করেছেন। এই সফরে তিনি যেমন চীনে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি ২১ সদস্যবিশিষ্ট অ্যাপেক বা এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দেন।
এই সফরের মধ্য দিয়ে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল যে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, তা আবারও প্রমাণিত হলো। চীন, জাপান, সেই সঙ্গে ভারত এ অঞ্চলে অবস্থিত। যদিও সফর তালিকায় ভারত অন্তর্ভুক্ত ছিল না, কিন্তু ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সাম্প্রতিককালে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ অঞ্চলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি তাতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের ‘কৌশলগত অংশীদার’ হচ্ছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অর্থাৎ ভারতকে সরাসরি সম্পৃক্ত করছেন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনে গিয়ে চীনের প্রশংসা করেছেন। চীন ও ভারত যখন দোকলাম নিয়ে এক ধরনের সংঘর্ষের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, তখন ট্রাম্পের চীনের প্রশংসা করা এবং চীনের সঙ্গে ২৫ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর মনে হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র তার আগের, অর্থাৎ ‘প্রো-ভারত’ অবস্থান থেকে সরে গেছে! কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলে ভিন্ন কথা।
ভিয়েতনামে অ্যাপেক সম্মেলনে যোগ দিয়ে ট্রাম্প নরেন্দ্র মোদির কাজকর্মের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। পাশাপাশি চীনের সমালোচনা করেছেন। চীন সফর করেই তিনি ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত অর্থনৈতিক উন্নয়নে নজরকাড়া সাফল্য দেখিয়েছে। অন্যদিকে চীনের বাণিজ্যনীতির সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, ‘ওই নীতির ফলে কাজ হারাচ্ছে মার্কিনরা। এভাবে চললে আমেরিকা অন্ধ হয়ে থাকবে না। ’ (আনন্দবাজার, ১০ নভেম্বর)। এর ব্যাখ্যা কী? চীনে গিয়ে তিনি চীনের প্রশংসা করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, তাতে ভারতের ভূমিকাকে তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। চীনকে ‘ঘিরে ফেলার’ যে স্ট্র্যাটেজি, তাতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি সত্য, যুক্তরাষ্ট্রের চীনের প্রয়োজন রয়েছে। ‘ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট’ ট্রাম্পের চীনা নীতির পেছনে তাঁর ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি বড় ভূমিকা পালন করছে। চীনের কাছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করবে যুক্তরাষ্ট্র। আলাস্কা থেকে এই গ্যাস যাবে। এ ছাড়া তিন হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বিনিময়ে ৩০০টি বোয়িং বিমানও চীনের কাছে বিক্রি করা হবে। ফলে বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণে চীনের তথাকথিত বাণিজ্যনীতি ট্রাম্পের কাছে গুরুত্ব পায়নি। অন্যদিকে ৬০০ মার্কিন কম্পানি বর্তমানে ভারতে ব্যবসা করছে। গত দুই বছরে ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ ৫০০ শতাংশ হারে বেড়েছে। ২০১৬ সালে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১১৫ বিলিয়ন ডলার। এই পরিসংখ্যান ট্রাম্প অস্বীকার করেন কিভাবে? এর বাইরে রয়েছে ভারতের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান। চীন-ভারত দ্বন্দ্বকে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। দোকলাম নিয়ে যে দ্বন্দ্ব, তার সাময়িক সমাধান হয়েছে বটে; কিন্তু উত্তেজনা রয়ে গেছে। চীন আবার সেখানে সড়ক নির্মাণ করছে। ভারতের অরুণাচল নিয়েও কিছুটা উত্তেজনা রয়েছে। ওই উত্তেজনা যেকোনো সময়ে সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে! কাশ্মীর নিয়েও উত্তেজনা বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সম্ভাব্য ‘হাতি বনাম ড্রাগন’ যুদ্ধে কেউই লাভবান হবে না। বিশ্ব আসরে প্রতীকী অর্থে ভারতকে তুলে ধরা হয় ‘হাতি’ হিসেবে। অর্থাৎ সিম্বলিক অর্থে ভারতকে হাতির সঙ্গে তুলনা করা হয়। আর চীনকে তুলনা করা হয় ড্রাগন হিসেবে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও ভুটানের মধ্যবর্তী একটি ছোট্ট উপত্যকা দোকলাম নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল, এটি বিশ্লেষণ করতে গিয়েই বিশ্লেষকরা ‘হাতি বনাম ড্রাগন’-এর যুদ্ধের কথা বলেছিলেন। সেখানে এক ধরনের ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ চলছে বটে; কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে কোনো পক্ষই যুদ্ধে যাবে না এবং ১৯৬২ সালের মতো একটি পরিস্থিতিও তৈরি করবে না। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল। আর তাতে ভারতের পরাজয় ঘটেছিল। নরেন্দ্র মোদি সরকার এ ধরনের একটি ঝুঁকি গ্রহণ করবে না। তবে ভারতের লোকসভায় যেসব বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যায় যুদ্ধবাজ কিছু সংসদ সদস্য চীনকে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিচ্ছেন। অর্থাৎ ‘যুদ্ধের’ পক্ষে বলছেন কেউ কেউ। পাকিস্তান নয়, বরং চীনই ভারতের এক নম্বর শত্রু—এমন কথাও বলছেন কোনো কোনো সিনিয়র রাজনীতিবিদ।
কয়েক মাস ধরে দোকলাম নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। সেখানে দুই দেশের সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। চীন ও ভুটানের মাঝখানে ৮৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট এই মালভূমিটি ভুটানের হলেও চীন এর মালিকানা দাবি করছে। সেখানে চীন এখন একটি সড়ক নির্মাণ করছে। আর তাতেই আপত্তি ভারতের। ভারত এই সড়ক নির্মাণকে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছে। যদিও দোকলাম নিয়ে চীন ও ভুটানের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সেখানে ভারতের জড়িত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ভারত ও ভুটানের মধ্যকার ৭০ বছরের পুরনো মৈত্রী চুক্তি অনুযায়ী ভারত ‘আমন্ত্রিত’ হয়ে দোকলামে সেনা পাঠিয়েছিল। সংকট বাড়লে ভুটান ভারতকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়ার ‘অনুরোধ’ জানালেও ভারত তাতে কর্ণপাত করেনি। বরং দোকলাম মালভূমির ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভারত নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি গ্রাম থেকে সেখানে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিয়েছিল। সেখানে এখন ভারতীয় বাহিনী ছাউনি ফেলেছে। কৌশলগতভাবে দোকলাম ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেখান থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে শিলিগুড়ি করিডর। ভারতের ভয়টা এখানেই। চীন যদি শিলিগুড়ি করিডরে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, তাহলে ভারতের সাত বোন রাজ্যের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাই দোকলাম নিজের এলাকা না হওয়া সত্ত্বেও ভারত এখানে সেনা মোতায়েন করেছে। ফলে দোকলামের কর্তৃত্ব নিয়ে যদি চীন-ভারত যুদ্ধ বাধে, তাতে ‘সুবিধা’ নেবে তৃতীয় পক্ষ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। আপাতদৃষ্টিতে সেখানে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রয়েছে সত্য, কিন্তু চীন-ভারত দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা এটি বলার চেষ্টা করছেন যে ভারত মহাসাগরের ‘নিয়ন্ত্রণ’ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের ‘সীমিত সংঘর্ষের’ জন্ম হতে পারে! চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে ভারত মহাসাগরে। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নিয়ে ভারত আতঙ্কিত। চীনের ‘মুক্তার মালা’ নীতি ভারতের জন্য একটি চিন্তার কারণ। এমনকি এই ‘মুক্তার মালা’  নীতি, যেখানে চীন এ অঞ্চলের সমুদ্রবন্দরগুলো ‘কানেকটস’ করেছে, তা ভালো চোখে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্রও। স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগর (ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে রয়েছে বিশ্বের তেলের রিজার্ভের ৬০ শতাংশ, আর বিশ্বের গ্যাস রিজার্ভের তিন ভাগের এক ভাগ) আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতার। ভারতকে ‘কৌশলগত অংশীদার’ হিসেবে ঘোষণা করার পেছনে কাজ করছে এই স্ট্র্যাটেজি। আর এই স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসেবেই একটি ‘চার দেশীয় ঐক্য’ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এই চার দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। এর মধ্যে তিনটি দেশই প্যাসিফিক অঞ্চলভুক্ত। ভারত এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এর নতুন নামকরণ হয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক। চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অ্যালায়েন্স গড়ে তোলার লক্ষ্যেই এই প্রচেষ্টা।
চীনে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই চীনের প্রশংসা করুন না কেন, বাস্তব ক্ষেত্রে চীনই তাঁর প্রতিপক্ষ। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতি। এই অর্থনীতি এখন যুক্তরাষ্ট্রকে, বিশ্ব অর্থনীতি, তথা রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাই চীন-ভারত দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। অনেক দিন থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছিল যে চীনের  বিরুদ্ধে প্রক্সি বাহিনী হিসেবে ভারতকে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এটা যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো কৌশল। স্নায়ুযুদ্ধ চলার সময়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ব্যবহার করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। তখন ইউরোপের কর্তৃত্ব ও প্রভাববলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। আজ একুশ শতকে এসে স্নায়ুযুদ্ধের নতুন এক ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে এশিয়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বদলে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট। আর চীনের বিরুদ্ধে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভারতকে ব্যবহার করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই ভারতকে নিয়েই মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ভারত তাতে যোগ দেয়নি, যদিও বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে ব্যবহার করতে চায়। অনেকের মনে থাকার কথা, কিছুদিন আগে ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে চারটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছিল। ভারত ভিয়েতনাম নিয়ন্ত্রিত এলাকায় দক্ষিণ চীন সাগরে গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাব্যতা নিয়ে গভীর কূপ খননে নিয়োজিত। চীন এই কাজকে ভালো চোখে দেখছে না। দোকলামের পর লাদাখে অতি সম্প্রতি ভারত ও চীনের দ্বন্দ্ব ও সম্ভাব্য একটি সংঘর্ষের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে নয়া স্ট্র্যাটেজি, তাতে যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত সেখানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা বাড়ছে। সেখানে ভারতের একটি বিমানঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভারতীয় মহাসাগরে প্রভাববলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করেই ভারতের সঙ্গে চীনের এক ধরনের ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ চলছে। চীনের পাশাপাশি ভারত ও ভারত মহাসাগরভুক্ত কোনো কোনো দেশে তাদের নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করছে। ফলে চীনকে ‘গিলে ফেলার’ যুক্তরাষ্ট্রের যে দীর্ঘ স্ট্র্যাটেজি তাতে ভারত অন্যতম অংশীদার হবে—এটাই স্বাভাবিক। তাই ট্রাম্প যখন এশিয়ায় দীর্ঘ সফরে এসেছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক নিয়েও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল অনেকের।
ফলে ট্রাম্পের এশিয়া সফরের পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এই সফরে কী পেলেন ট্রাম্প? প্রথমত, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তা আবারও প্রমাণিত হলো। এ অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়ছে অন্য অঞ্চলগুলোর চেয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের গুরুত্বকে তার স্বার্থে নিতে চায়। দ্বিতীয়ত, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শুধু ব্যবসায়িক। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের ‘বাণিজ্যিকযুদ্ধ’-এর সম্ভাবনা বাড়ছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের প্রশংসা করার অর্থ হচ্ছে, চীনা জনমানসে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। উত্তর কোরিয়া প্রশ্নে তাঁর চীনা সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চীনবিরোধী অ্যালায়েন্স গড়ে তোলার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র তার স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করেনি। তৃতীয়ত, ভারত এ অঞ্চলের উঠতি শক্তি। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ আগামী দিনে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। চতুর্থত, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে ট্রাম্প কোনো মন্তব্য না করলেও এখানে চীনের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর এ অঞ্চলে টহল অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা। পঞ্চমত, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা রয়েই গেল।
Daily Kalerkontho
15.11.2017

ইসলামিক স্টেটের পতন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা



Image result for IS picture
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। গেল মাসে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (্আইএস) তথাকথিত রাজধানী রাকার পতন ঘটেছে। আর গেল সপ্তাহে আইএসের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত দাইর আল জয়ুর (Deir al Zour)) শহরের পতন ঘটেছে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে। প্রায় একই সময় ইরাকি সেনাবাহিনী দখল করেছে আল কাইমে(al-Qaim) অবস্থিত আইএসের শেষ ঘাঁটিটি। অনেকের মনে থাকার কথা, গেল জুলাই মাসে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুলের পতনের মধ্য দিয়ে আইএসের পতন শুরু হয়েছিল। আর শেষ হলো দাইর আল জয়ুর ও আল কাইমে অবস্থিত আইএসের শক্ত দুইটি ঘাঁটি পতনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আইএসের পতনের মধ্য দিয়ে কি আইএসের মতবাদের পরিসমাপ্তি ঘটল? মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের পতন যখন সংবাদপত্রে বড় করে আলোচনায় আসছে, তখন গেল ৩১ অক্টোবর নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে সন্ত্রাসী কর্মকা- আইএসের আগামী ভূমিকাকে সামনে নিয়ে এসেছে। ম্যানহাটনের এ ঘটনায় জড়িত রয়েছেন সায়ফুল্লো সাইকভ নামে এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে আইএস সমর্থক বলে দাবি করছেন। এরই মধ্যে আইএসের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতাও প্রমাণিত হয়েছে। তিনি একজন উজবেকিস্তানের নাগরিক এবং যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিনকার্ড নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। ম্যানহাটনের ওই ঘটনায় সায়ফুল্লো ট্রাকের চাপায় পিষ্ট করে আটজনকে হত্যা করে। গেল বেশ কিছুদিন আইএস এ ধরনের স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করে আসছে। বিশেষ করে ফ্রান্সের নিস কিংবা লন্ডনে আইএসের সঙ্গে জঙ্গিরা এভাবে ট্রাক দিয়ে পিষে সাধারণ মানুষদের হত্যা করে। এভাবে আইএস সর্বত্র একটা ভয়ের আবহ তৈরি করে। ফলে যে প্রশ্নটি এখন উঠেছে, তা হচ্ছে আইএসের কর্মকা- কি শেষ হয়ে গেল? অনেক বিশেষজ্ঞের মতামত আমি পেয়েছি, যারা বলার চেষ্টা করেছেন যে, আইএস মধ্যপ্রাচ্য থেকে উৎখাত হয়েছে; কিন্তু তাদের মতাদর্শের মৃত্যু ঘটেনি। ২০১৪ সালের ১০ জুন প্রথমবারের মতো বিশ্ব জেনেছিল আইএস নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের কথা। সেদিন ইরাকের মসুল শহর দখল করে আইএস তাদের অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করেছিল। সেদিন তারা নিজেদের ঘোষণা করেছিল ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট (Islamic state and the Levant) নামে। Levant  হচ্ছে এ এলাকার ঐতিহাসিক নাম। পরবর্তী ক্ষেত্রে অবশ্য এরা আইএস বা ইসলামিক স্টেট হিসেবে পরিচিতি পায়। তারা একটি খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথাও ঘোষণা করে। এরা মুসলিমবিশ্বের সব মুসলমানের আনুগত্য দাবি করে। গেল দুই বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একের পর এক জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়, যারা আইএসের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে। বাংলাদেশেও আমরা নয়া জেএমবির উত্থান দেখেছি, যারা আইএসের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। তবে আশার কথা, এদের কর্মকা- এখন নেই বললেই চলে। আইএস তাদের নেতা আবু বকর বুগদাদির নাম প্রকাশ করেছিল। বুগদাদি নিজে প্রকাশ্যে আবির্ভূত হয়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু রাকার পতন এবং সিরিয়া ও ইরাক থেকে আইএসের উৎখাতের পর আবু বকর বুগদাদির খবর কেউ জানে না। সুতরাং সবার দৃষ্টি যে এখন আইএসের ভবিষ্যৎ কর্মকা-ের দিকে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এরই মাঝে ঘটল নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের সন্ত্রাসী কর্মকা-।
যারা বিশ্বব্যাপী জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ে কাজ করেন, তারা লক্ষ করেছেন যে সিরিয়া-ইরাকের আইএসের কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসছে। আইএস সিরিয়া-ইরাকও পরাজিত হয়েছে এরই মধ্যে। তবে এখানে যেসব জঙ্গি ‘যুদ্ধে’ অংশ নিয়েছিলেন, তারা এখন সেখান থেকে সটকে পড়েছেন। আগামীতে জঙ্গি কার্যক্রম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃত হবে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। এক্ষেত্রে দুইটি দেশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন অনেকে। একটি ফিলিপাইনে, অপরটি মিয়ানমার-বাংলাদেশে রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে। ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনে অক্টোবর (২০১৭) সংখ্যায় অধ্যাপক জাকারি আবুজার (Zachary Abuza) একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে ফিলিপাইনের জঙ্গিবাদের প্রসার নিয়ে। অধ্যাপক আবুজা যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত National war collage-এর একজন অধ্যাপক। তার প্রবন্ধের নাম গধুযবস  Mayhem in Marawi। ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের একটি শহর মারাবি(Marawi)। সেখানে গত মে (২০১৭) থেকে ফিলিপাইনের সেনাবাহিনী আইএস-সংশ্লিষ্ট আবু সায়াফ গ্রুপের সঙ্গে যে ‘যুদ্ধে’ লিপ্ত, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। ৪ মাসে সেখানে জঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন সেনাবাহিনীর ১৪৭ সদস্য এবং ৪৭ সিভিলিয়ান। জঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধে ওই শহরটি পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। এ যুদ্ধের সঙ্গে সিরিয়া-ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে সিরিয়া ও ইরাকি বাহিনী যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে, তার কথা মনে করিয়ে দেয়। সেনাবাহিনী এখন মারাবি শহরের নিয়ন্ত্রণভার নিতে পেরেছে। শহরটি এখন পরিপূর্ণভাবে পরিত্যক্ত। শহরের শতকরা একশ ভাগ বসতবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ এখন সম্প্রসারিত হয়েছে ফিলিপাইনে। সিএনএন ২৯ মে (২০১৭) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে Phillippines : The Next ISIS Stronghold? অর্থাৎ ফিলিপাইন কি হতে যাচ্ছে আইএসের পরবর্তী শক্তিশালী ঘাঁটি? ওই প্রতিবেদনে একটি মসজিদে আইএস কর্তৃক তাদের পতাকা উত্তোলন করার দৃশ্য আমরা দেখেছিলাম। এ অঞ্চলের তিনটি দেশেÑ ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ায় গেল ২ বছরে যেসব জঙ্গি কর্মকা- হয়েছে এবং যার সঙ্গে আইএস জড়িত, তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে সিএনএনের প্রতিবেদনে। পাঠকদের সেখান থেকে কিছু তুলে দিচ্ছিÑ জুন ২৮, ২০১৬। কুয়ালালামপুরের একটি নাইট ক্লাবে জঙ্গি হামলায় আটজনের মৃত্যু। জানুয়ারি ১৪, ২০১৬Ñ জার্কাতায় সন্ত্রাসী হামলায় চারজনের মৃত্যু। মে ২৪, ২০১৭Ñ জাকার্তায় সন্ত্রাসী হামলায় তিনজনের মৃত্যু। ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ফিলিপাইনের দাভাও শহর সন্ত্রাসী বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু ১৪ জন। আর মারাবির ঘটনা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। প্রতিটি ঘটনায় আইএস তার দায় স্বীকার করেছে। সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন তৎপর, যাদের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ রয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে, মরো লিবারেশন ফ্রন্ট (এমআইএলএফ)। এরা তৎপর সুলু দীপপুঞ্জ এলাকায়। সুলু দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় Bangoamoro Islamic Freedom Fighters (BIFF)--ও তৎপর। জাকার্তায় তৎপর জামেইয়া ইসলামিয়া। আবু সায়াফ গ্রুপ ও মাউটে গ্রুপ তৎপর দক্ষিণাঞ্চলে। আবার ব্রুনাইডে আবু সায়াফ গ্রুপ তাদের তৎপরতা সম্প্রসারিত করেছে। সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক Centre for Political Violence and Terrorism Research (ICPVTR)  তাদের এক গবেষণায় উল্লেখ করেছে, আইএস সম্প্রতি সিরিয়া ফেরত জঙ্গিদের নিয়ে এ অঞ্চলে নতুন একটি ব্রিগেড তৈরি করেছে, যার নাম Katibah Al Muhajirৎ. পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ ব্রিগেডের তৎপরতা রয়েছে। এ ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হাপিলন নামে এক জঙ্গি। হাপিলন এসেছেন সুলু অঞ্চল থেকে। ২০১৬ সালে আইএস তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আমির হিসেবে ঘোষণা করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মার্কিনি গোয়েন্দাদের মতে, হাপিলন ইংরেজি বা আরবি ভাষা কিছুই বোঝেন না এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্ক তার জ্ঞানও সীমিত। যুক্তরাষ্ট্র তাকে ধরার জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছে। কয়েক হাজার জঙ্গি বর্তমানে এ অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত। ফলে আগামী দিনগুলোয় এ অঞ্চলে যে অস্থিরতা বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হলো রোহিঙ্গাদের নাম।
সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণটি হচ্ছে, রাকা থেকে আইএস জঙ্গিরা উৎখাত হওয়ার পর এরা হারিয়ে যাবে না। এখন ফিলিপাইনের মারাবি শহর থেকে আইএসকে উৎখাত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে। তাহলে আইএস জঙ্গিরা কোথায় এখন আশ্রয় নেবেন? ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসিতে কর্মরত গবেষক আরন ওয়াই জেলিন মনে করেন, আইএস শেষ হয়ে যায়নি। তারা কিছুদিন চুপ করে থেকে ফের শক্তি সঞ্চয় করবে এবং তাদের অনুসারীদের উৎসাহ জোগাবে। তারা গেরিলা কায়দায় তাদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখবে(with loss of its Caliphate, ISIS May Return to Guerilla Roots, NP Times, Oct 18, 2017))। আর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা MIS-এর পরিচালক এন্ডু পারকার মনে করেন, That threat is multidimensional, wolving rapidly and operating at a scale and pace we’ve not seen before|। এসব মন্তব্যের পেছনে কিছুটা হলেও সত্যতা আছে। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের ঘটনা এর সর্বশেষ প্রমাণ। সায়ফুল্লো উজবেক নাগরিক। শত শত উজবেক নাগরিক আইএসে যোগ দিয়ে রাকায় যুদ্ধ করেছিলেন। অনেকে মারাও গেছেন। অনেকে আবার সেখানে থেকে অন্য দেশে চলে গেছেন। ভয়টা হচ্ছে, এসব উগ্রপন্থী উজবেক নাগরিক ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারেন এবং সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাতে পারেন। আইএসের কর্মকা- এ মুহূর্তে হয়তো সিরিয়া-ইরাকে দেখা যাবে না; কিন্তু অন্য কোনো জায়গায় দেখা দিতে পারে। মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পরবর্তী টার্গেট। আফ্রিকায়, বিশেষ করে সোমালিয়া কিংবা কেনিয়ার দিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। সিরিয়া-ইরাকের পর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এখন স্থান করে নেবে এসব অঞ্চল। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তৎপর হতে পারে, যা কিনা আমাদের নিরাপত্তাকে বিস্মিত করতে পারে। তাই রাকা থেকে আইএস উৎখাতের পর আমরা যেন উৎসাহিত না হই, আমাদের সতর্ক হতে হবে এবং যে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-কে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। আইএস জঙ্গিরা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এরা যে কোনো দেশে, বিশেষ করে মুসলমানপ্রধান দেশে জঙ্গি হামলা চালাতে পারে। তাই যা বলা যায়, তা হচ্ছে রাকা থেকে উৎখাত, কিংবা ম্যানহাটনে সন্ত্রাসী হামলাই শেষ হয়। গেল ৫ নভেম্বর টেক্সাসে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এটা এখন নিশ্চিত, এ হামলার সঙ্গে আইএস জড়িত ছিল না। তবু এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যে মুসলমানবিরোধী একটা ‘ক্যাম্পেইন’ শক্তিশালী হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তা অব্যাহত থাকবে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ ‘ক্যাম্পেইন’কে আরও শক্তিশালী করবেন। এবার এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মুসলমান।
Alokito bangladesh
12.11.2017

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এশিয়া সফর প্রসঙ্গে

৩ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১২ দিনের এক সফরে এশিয়ায় এসেছেন। এ সফরে তিনি Asia Pacific Economic Co-operation (APEC) সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর এ প্রথম তিনি এশিয়া সফরে এলেন। এ সফরে তিনি চীনের পাশাপাশি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনও সফর করবেন। ৩ থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত এ সফর। সফরে তিনি ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত আপেক (অচঊঈ) সম্মেলনে যোগ দেবেন। একই সঙ্গে যোগ দেবেন ফিলিপাইনে অনুষ্ঠিত অঝঊঅঘ শীর্ষ সম্মেলনেও। যুক্তরাষ্ট্র আপেকের সদস্য হলেও আসিয়ানের সদস্য নয়। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় এশিয়ার গুরুত্ব বেড়েছে নানা কারণে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, নতুন করে যে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হতে যাচ্ছে, তার কেন্দ্রভূমি হচ্ছে এশিয়া। পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলের চেয়ে এ অঞ্চলে বর্তমানে উত্তেজনা বেশি। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার একের পর এক আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক হামলার হুমকি; অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগর ঘিরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব এ অঞ্চলকে চরম উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন উত্তেজনাপূর্ণ এ এলাকায় আসেন, তখন বিশ্বের দৃষ্টি এ অঞ্চলের দিকে থাকবেÑ এটাই স্বাভাবিক। তাই এ অঞ্চলে এসে ট্রাম্প কী ধরনের বক্তব্য রাখেন, সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, তাতে ভারতের ভূমিকা। ট্রাম্পের এ ১২ দিনের সফরে এশিয়ার দুইটি বড় অর্থনৈতিক শক্তির দেশ চীন ও জাপানের নাম থাকলেও এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি ভারতের নাম নেই। কিন্তু ট্রাম্পের এ সফরের প্রায় কাছাকাছি সময়ে ভারত নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ওয়াশিংটনের থিংক-ট্যাংক স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি একবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ভারতকে বেছে নেয়ার পরিকল্পনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি চীনের সঙ্গে ভারতের তুলনা করেছেন। কয়েক বছর আগে থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল, চীনের বিরুদ্ধে প্রক্সি বাহিনী হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশকে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এটা যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো কৌশল। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ব্যবহার করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। এখন ইউরোপের কর্তৃত্ব এ প্রভাববলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। আজ একুশ শতকে এসে স্নায়ুযুদ্ধের নতুন এক ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে এশিয়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বদলে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট। আর চীনের বিরুদ্ধে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভারতকে ব্যবহার করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। আর তাই ভারতকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে দেশটি। চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে চাইছে তারা। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কর্মসূচির ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ভারত তাতে যোগ দেয়নি, যদিও বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে ব্যবহার করতে চায়। অনেকের মনে থাকার কথা, কিছুদিন আগে ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে চারটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছিল। ভারত ভিয়েতনাম নিয়ন্ত্রিত এলাকায় দক্ষিণ চীন সাগরে গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাব্যতা নিয়ে গভীর কূপ খননে নিয়োজিত। চীন এ কাজকে ভালো চোখে দেখছে না। ডোকলাম নিয়ে অতিসম্প্রতি ভারত ও চীনের দ্বন্দ্ব এবং সম্ভাব্য একটি সংঘর্ষের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে নয়া স্ট্র্যাটেজি, তাতে যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত সেখানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা বাড়ছে। সেখানে ভারতের একটি বিমানঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভারতীয় মহাসাগরে প্রভাববলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে চীনের একধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। চীনের পাশাপাশি ভারতও মহাসাগরভুক্ত কোনো কোনো দেশে তাদের নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করছে। ফলে চীনকে ঘিরে ফেলার যুক্তরাষ্ট্রের যে দীর্ঘ স্ট্র্যাটেজি, তাতে ভারত অন্যতম অংশীদার হবেÑ এটাই স্বাভাবিক। তাই ট্রাম্প যখন এশিয়ায় দীর্ঘ সফরে এলেন, এখন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক নিয়েও আগ্রহ থাকল অনেকের।
ট্রাম্পের এ সফর তালিকায় চীনের নাম আছে। তিনি চীনে যাবেন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হবে। ট্রাম্পের অনেক বক্তব্য ছিল চীনবিরোধী। চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ট্যাক্স আরোপ করার কথা তিনি বলেছিলেন। এখন আর তিনি এ ধরনের কথা বলেন না; বরং তিনি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রশংসাও করেছেন। চীনের ১৯তম পার্টি কংগ্রেসে শি জিনপিং ফের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে এৎবধঃ খবধফবৎ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। এমনকি তাকে রাজার সঙ্গে তুলনা করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেনি। (গার্ডিয়ান, ২৫ অক্টোবর ২০১৭)। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে হামবুর্গে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল। এখন আবারও তিনি সাক্ষাৎ করবেন। 

সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে চীনের কোনো কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ট্রাম্প খুশি। চীন উত্তর কোরিয়ার আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণসমর্থন জানিয়ে চীন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সবধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভালো করে জানে, উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ করতে হলে চীনের সাহায্য প্রয়োজন। এজন্যই ট্রাম্প চীনে গিয়ে চীনবিরোধী কোনো শক্ত মন্তব্য করবেন না। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে উত্তর কোরিয়াবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে হলে ট্রাম্পের প্রয়োজন রয়েছে চীনের সহযোগিতার। তবে দক্ষিণ চীন সাগর প্রশ্নে তিনি স্ট্যাটাস কো পন্থা অবলম্বন করবেন কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। দক্ষিণ চীন সাগরের আশপাশে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত টহল দেয়। এটা চীন কোনো মতে মেনে নেয়নি। তারা মনে করে, এ অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজের চলাচল চীনের সার্বভৌমত্ব খর্বের শামিল। দক্ষিণ চীন সাগর চীনের অন্তর্ভুক্ত বলে দেশটি মনে করে। এরই মধ্যে চীন সেখানে তার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এ অঞ্চলে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রচুর গ্যাস ও তেল রয়েছে এ অঞ্চলে, যা চীনের জ্বালানি সুধা মেটাতে সাহায্য করবে। এ অঞ্চলের ব্যাপারে তাইওয়ান, ফিলিপাইন, ভিয়েতনামের দাবি রয়েছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক আদালত চীন-ফিলিপাইন দ্বন্দ্বে ফিলিপাইনের দাবির পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু ফিলিপাইন চীনের আর্থিক সহযোগিতার (২০ বিলিয়ন ডলার) পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর তার দাবি থেকে সরে এসেছে। চীনের সঙ্গে ফিলিপাইনের সম্পর্ক এখন ভালো। প্রেসিডেন্ট দুতার্তে এরই মধ্যে চীন সফর করেছেন। এ এলাকার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণ এখানকার স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব। যুক্তরাষ্ট্র তার ষষ্ঠ নৌবাহিনীর ফ্লিটের রসদ সরবরাহের জন্য এ রুটের গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং দক্ষিণ চীন সাগরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সীমান্ত না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র এ এলাকার ব্যাপারে তার আগ্রহ হারায়নি। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে চীন সফরের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দক্ষিণ চীন সাগরের প্রশ্নটি না-ও উত্থাপন করতে পারেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সফরের সময় নিঃসন্দেহে উত্তর কোরিয়ার পরমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করবেন। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে তিনি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে ব্যবহার করবেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় এরই মধ্যে থাড ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছে। এ ক্ষেপণাস্ত্র উত্তর কোরিয়ার যে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে দেশটিকে রক্ষা করবে। যদিও থাড ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন নিয়ে একধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে, থাড ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের সব খরচ দক্ষিণ কোরিয়াকে বহন করতে হবে; কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া তাতে রাজি হয়নি। এ বিরোধের কোনো সমাধান হয়নি। তবে একটা ভালো খবর হচ্ছে, দক্ষিণ কোরিয়া সফরে ট্রাম্প দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী অসামরিক এলাকায় যাবেন না। এতে উত্তর কোরিয়া যে কোনো ধরনের প্রভোকেশন থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে, ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কেন্দ্রে আগাম হামলা চালাতে পারেন। প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০৩ সালে ইরাকে আগাম হামলা চালিয়েছিলেন। বুশের যুক্তি ছিল, সাদ্দাম হোসেনের কাছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র রয়েছে। এ মারণাস্ত্র ধ্বংস এবং সাদ্দাম হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা চালানোর (?) আগেই বুশ সাদ্দাম হোসেনের সব সমরাস্ত্র ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। অথচ পরে জানা গেল, সাদ্দাম হোসেনের কাছে কোনো ধরনের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ছিল না। এখন ট্রাম্প একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে। আগাম আক্রমণ বা ঢ়ৎববসঢ়ঃরাব ধঃঃধপশ যাতে ট্রাম্প সূচনা করতে না পারেন, সেজন্য ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসে একটি বিল উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন। এ বিল কংগ্রেসে পাস হলে ট্রাম্প আর উত্তর কোরিয়ায় আগাম হামলা চালাতে পারবেন না। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়Ñ চূড়ান্ত বিচারে ট্রাম্প উত্তর কেরিয়ার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই দেখার বিষয়। 

ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হয়ে টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি বাতিল ঘোষণা করেছিলেন, যা বারাক ওবামার শাসনামলে সম্পাদিত হয়েছিল। প্রশান্ত মহাসাগরের সীমান্তঘেঁষা ১২টি দেশ (যে দেশগুলোয় সফরে যাচ্ছেন ট্রাম্প) এ টিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিশ্বের শতকরা ৪০ ভাগ জিডিপির অন্তর্ভুক্ত ছিল এ দেশগুলো। এর মাধ্যমে একটি শুল্কমুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র টিপিপি বাতিল করায় অন্য দেশগুলো কী করবে, তা স্পষ্ট নয়। চীন টিপিপিতে ছিল না। ফলে বাকি ১১টি দেশ (যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া) চীনের সঙ্গে এ ধরনের একটি চুক্তি করতে পারে। বলা ভালো, জাপান এ চুক্তিটি এরই মধ্যে রেটিফাই করেছে। ট্রাম্পের এ সফরে টিপিপির বিকল্প নিয়ে আলোচনা হতে পারে। নিঃসন্দেহে ট্রাম্পের এশিয়া সফর এ অঞ্চলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে আরও উন্নত করবে। তবে সত্যিকার অর্থেই যুক্তরাষ্ট্র তার এশীয় নীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনে, সেটাই হচ্ছে মুখ্য বিষয়। 


আলোকিত ০৫ নভেম্বর ২০১৭