রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

প্রধানমন্ত্রীর একটি উক্তি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘দিদিমণি পানি (জল) দেন না।’ তিনি আরও বলেছেন, যখন প্রশ্ন তুললামÑ তিস্তার পানির কী হলো, মমতা ব্যানার্জি বললেন, বিদ্যুৎ নিন। বললাম, আচ্ছা তা-ই দিন। যা পাওয়া যায় আর কী! প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় সাংবাদিকদের আরও জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকা আত্রাই ও চূর্ণীর জল নিয়ে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন। তার মতে, এ সবই তিস্তার পানি না দেওয়ার অজুহাত! বাংলাদেশ-ভারত মিডিয়া সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতীয় সাংবাদিকরা। প্রধানমন্ত্রী তাদের আপ্যায়ন করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানেই প্রধানমন্ত্রী তিস্তার পানিবণ্টনের প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়েও নানা কথা বলেছেন (আনন্দবাজার, কলকাতা, ২২ ফেব্রুয়ারি)। প্রধানমন্ত্রী তিস্তায় পানি না পাওয়া নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, সে ব্যাপারে যখন মন্তব্য করেন, তখন এটাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী সত্য কথাই বলেছেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ জেনে গেছে, শুধু মমতা ব্যানার্জির কারণেই বাংলাদেশ তিস্তায় ন্যায্য পানি পাচ্ছে না, যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তায় পানিবণ্টনের পক্ষে। সাম্প্রতিককালে মমতা ব্যানার্জি দু-দুবার বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় একবার, আর দ্বিতীয়বার একুশের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে। প্রতিবারই তিনি আশার কথা শুনিয়েছেন। কিন্তু তিস্তার পানিবণ্টন আজও হয়নি। একেকবার তিনি একেক কথা বলেন। পশ্চিমবঙ্গে অনেকেই এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে, তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে মমতা মূলত একধরনের ‘রাজনীতি’ করছেন। তিস্তার পানিবণ্টনকে ইস্যু করে তিনি কেন্দ্রের মোদি সরকারের কাছ থেকে কিছুটা আর্থিক সুবিধা নিতে চান, যাতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট রিজার্ভিয়ার নির্মাণ করে বর্ষা মৌসুমে পানি ধরে রাখতে চান এবং শুষ্ক মৌসুমে সেই পানি ব্যবহার করতে চান। আরেকবার তিনি বললেন, আত্রাই থেকে বাংলাদেশ পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এসবই তার রাজনীতির খেলা। তার সমস্যা মোদির সরকারকে নিয়ে। পানিবণ্টন হলে মোদি সরকার সুবিধা নেবেÑ এটা কিছুতেই তিনি হতে দেবেন না। তাই আটকে আছে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি। অথচ পশ্চিমবঙ্গে রুদ্র কমিশনের রিপোর্ট তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেন, যেখানে বাংলাদেশকে তিস্তার শতকরা ৫০ ভাগ পানি দেওয়া সম্ভব বলে সুপারিশ করা হয়েছিল। তিস্তার পানিবণ্টনের পাশাপাশি আরও রয়েছে টিপাইমুখ বাঁধ কিংবা আন্তঃনদী সংযোগের বিষয়টিও, যা দু-দেশের সম্পর্কের মাঝে একটা ‘অন্তরায়’ সৃষ্টি করেছে। তবে তিস্তার পানিবণ্টন একটি বহুল আলোচিত বিষয়। দীর্ঘদিন বিষয়টি নিয়ে দু-দেশের মাঝে আলোচনা চলে এলেও শুধু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে পানিবণ্টনের বিষয়টি ঝুলে আছে। আজও কোনো সমাধান হয়নি। বরং পশ্চিমবঙ্গ তিস্তা থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ প্রত্যেকটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই ‘যুক্তি ও ন্যায়ের’ ভিত্তিটি উপেক্ষিত থাকে, যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নম্বর নীতিতে বলা হয়েছেÑ পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ কনভেনশন’ নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশসংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ, জলভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদÑ প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগসুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।
তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়া এবং তিস্তায় পানি না পাওয়া এখন আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এই দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তায় পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকার নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি বা সমর্থন আমাদের বিষয় নয়। আমাদের নেতৃত্ব বিষয়টিকে হালকাভাবে নেননি। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারোর সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খাড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরে কাউনিয়া পীরগাছা কুড়িগ্রামের রাজার হাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারীÑ এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দু-দেশের মন্ত্রিপর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত ও ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির শতকরা ৮০ ভাগ দু-দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয়েছিল মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই অতীতে মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। মমতা ব্যানার্জি এই পানি চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আন্তর্জাতিক নদীর পানি এককভাবে তিনি ব্যবহার করতে পারেন না। তিনি নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে (প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফর, ২০১৭ সালের এপ্রিল) নতুন একটি ‘ফরমুলা’ দিয়েছিলেন। তিনি তোসা ও জলঢাকাসহ চারটি নদীর নাম বলেছিলেন, যেখান থেকে পানি নিয়ে বাংলাদেশের চাহিদা পূরণ করা যায় বলে মনে করেন। বাংলাদেশে তোসা ও জলঢাকা নদী দুধকুমার ও ধরলা নামে পরিচিত। মমতার ওই বক্তব্য মূলত ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের নামান্তর। আগেই উল্লেখ করেছি, মমতা ঢাকায় এসে অভিযোগে করেছিলেনÑ বাংলাদেশ আত্রাই নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এ-ই হচ্ছে মমতা! তবে একটা সমস্যা আছেÑ প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমাদের জানিয়েছিলেন, মমতার সম্মতি নিয়েই তিস্তা চুক্তি হবে। দুর্ভাগ্য আমাদের, সেই ‘সম্মতি’ আজ অবধি পাওয়া যায়নি। আরও একটা ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারাজ। এই ব্যারাজ বাংলাদেশ ও ভারতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন আমাদের কাছে যে তথ্য ছিল, তা হচ্ছে রাজবাড়ীর পাংশায় একটি স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল, যেখানে একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় একটি রিজার্ভিয়ার নির্মাণ করা হবে, যাতে বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রাখা যায়। এই পানি শুল্ক মৌসুমে ব্যবহার করা যাবে। এক্ষেত্রে ভারতের সমর্থন ও আর্থিক সহযোগিতার প্রশ্ন ছিল। দুটি চীনা কোম্পানি এবং জাপান এ খাতে ২ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের তথা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল। ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২ দশমিক ৯০ ট্রিলিয়ন লিটার পানি ধরে রাখার কথা। ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও ছিল। এতে ভারতও উপকৃত হতো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, পাংশায় যে ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল, তা তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। তবে একটি উপযুক্ত স্থান দেখার জন্য তিনি মমতা ব্যানার্জির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি যৌথ উদ্যোগের কথাও বলেছেন। তবে একই সঙ্গে তিনি পানি ধরে রাখার জন্য নদী ড্রেজিংয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ২০১৭ সালে দুই প্রধানমন্ত্রী যে যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করেছিলেন, তার ৪১ নম্বর ধারায় গঙ্গা ব্যারাজের কথা বলা হয়েছিল। সেখানে দু-দেশের সমন্বয়ে একটি ‘যৌথ কারিগরি টিম’ গঠন করার কথাও বলা হয়েছিল। এই ‘যৌথ কারিগরি টিম’ এর ভারতীয় পক্ষ বাংলাদেশ সফর করবে এবং বাংলাদেশে তারা একটি সমীক্ষা চালাবে; কিন্তু সেই সমীক্ষা আজও চালানো হয়নি। এ কারণে পানি নিয়ে সংকট বাড়ছে। শুল্ক মৌসুম আসছে। তিস্তায় পানি থাকবে না। এটা বাংলাদেশে একটি বড় সংকট তৈরি করবে।
ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে ভারতের অবস্থান মাত্র ২ দশমিক ৮ ভাগ হলেও ২০৫০ সালে ভারত দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। সুতরাং ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ভারতকে আরও উদার হতে হবে। ভারত যদি আরও উদার না হয়, তাহলে উপাঞ্চলিক সহযোগিতার যে বড় সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে, তা বাধাগ্রস্ত হবে। ‘কবি’ নরেন্দ্র মোদি (তার দুটি কবিতার বই আছে) ঢাকায় এসে বলেছিলেন, পাখি কিংবা বায়ুর কোনো সীমান্ত নেই। তার ‘নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি’ আমাদের জন্য অনেক বড় কিছু। ২০১৭ সালে স্বাক্ষরিত যৌথ ঘোষণাপত্রে যে ৬২টি দফা আছে, তাতে অনেক ভালো ভালো কথা আছে। এখন দেখার পালা কতটুকু তা বাস্তবায়িত হয়। শুধু আশ্বাস বাংলাদেশিদের মন ভারতে পারবে না। ভারতীয় নেতাদের ‘মাইন্ড সেটআপে’ পরিবর্তন দরকার। যদি সেটি না হয়, তাহলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পানি কেউ আটকে রাখতে পারবে না। এই পানি অর্থাৎ তিস্তার পানিই কী হতে যাচ্ছে দু-দেশের মাঝে সম্পর্কের ভিত্তি? পানি নিয়ে মমতা রাজনীতি করছেন। এটা এখন অনেকের কাছেই স্পষ্ট। ভারতীয় গণমাধ্যমও মমতার এই অবস্থানকে সমর্থন করছে না। এখন মোদির বক্তব্যই আমাদের ভরসা। নয়াদিল্লিতে শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে মোদি আশ্বাস দিয়েছিলেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার আর নয়াদিল্লিতে মোদি সরকারের আমলেই তিস্তার পানি সমস্যার সমাধান হবে। মোদির কাছে আছে সংবিধানের ২৫৩ নম্বর ধারাটি, যে ধারাবলে বিদেশের সঙ্গে যে-কোনো চুক্তি তিনি করতে পারেন। এক্ষেত্রে কোনো রাজ্য সরকারের সমর্থন তার প্রয়োজন নেই। এখন এটাই আমাদের ভরসা। পশ্চিমবঙ্গ যদি তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তাদের আপত্তি অব্যাহত রাখে, তাহলে হয়তো মোদি এ ধারাটি ব্যবহার করেই বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করবেন। ২০১১ সালে চুক্তির একটি খসড়া তো দুই সরকারের কাছেই আছে। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের।
Daily Alokito Bangladesh
25.02.2018

মালদ্বীপ ঘিরে গরম হচ্ছে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল


ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। মাত্র ২৯৮ বর্গকিলোমিটার অথবা ১১৫ বর্গমাইল আয়তনের এ রাষ্ট্রটির জনসংখ্যা ৪ লাখ ২৭ হাজার ৭৫৬ (২০১৭), যার একটা বড় অংশ আবার বিদেশি। সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, যা আরও ৩০ দিন বাড়ানো হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদ ভারতকে সামরিক হস্তক্ষেপের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ১ ফেব্রুয়ারি আদালত-সরকার দ্বন্দ্বে দেশটির রাজনীতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ভারত ও চীন এই ছোট্ট দেশটিতে একধরনের প্রভাববলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। চলমান রাজনৈতিক সংকটের মুখে চীন ২১ ফেব্রুয়ারি মালদ্বীপের সমুদ্রসীমায় ১১টি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, চীনা যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি দিল্লির উদ্দেশে শক্তি প্রদর্শনের নামান্তর মাত্র।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারত তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করছে। ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে ভারত মালদ্বীপে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল। ‘অপারেশন ক্যাকটাস’ নামের ওই সামরিক অভিযান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের সরকারকে রক্ষা করেছিল। এর আগে শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহীদের একটি অংশ, যারা ‘পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অব তালিম এলাম’ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা গাইয়ুম সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্যোগ নেয়। বিদ্রোহীরা গাইয়ুমকে গ্রেফতার করতে পারেনি। ফলে গাইয়ুম পালিয়ে গিয়ে ভারতের সামরিক সাহায্য চান। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী গাইয়ুমের ডাকে সাড়া দিয়ে সেখানে ১৬০০ সৈন্য পাঠান। বিদ্রোহের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর অনেক সময় পার হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপ একটি চীনপন্থী নীতি অনুসরণ করছে। চীনের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে মালদ্বীপ। মালদ্বীপ চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবিওআর) কর্মসূচিকে সমর্থন করেছে এবং তাতে যোগ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, মালদ্বীপ তার সংবিধান সংশোধন করে বিদেশিদের জমি কেনার সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে সুযোগটি নিয়েছে চীনারা। বলা হচ্ছে, এখানে বিনিয়োগের পাশাপাশি চীন একটি নৌঘাঁটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে, যা ভারতের অন্যতম চিন্তার কারণ।
১৯৮৮ সালে ভারত মালদ্বীপে সামরিক হস্তক্ষেপ করলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো নয়। মালদ্বীপ কিছুটা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি গত চার বছরে একবারও মালদ্বীপ সফর করেননি। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের প্রভাব ভারতের অন্যতম চিন্তার কারণ। এটা বিবেচনায় নিয়েই ভারত এসব অঞ্চলে তার সামরিক প্রভাব বাড়াচ্ছে। ফলে স্পষ্টতই একধরনের চীন-ভারত দ্বন্দ্বে এ অঞ্চলের দেশগুলো জড়িয়ে পড়ছে। মালদ্বীপের ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা কী হবে তা বলা না গেলেও দেশটির ব্যাপারে যে তার আগ্রহ রয়েছে তা বলা যায়। আগামীতে মালদ্বীপে ভারতের ‘ভূমিকা’ চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, তারা এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি ‘সহ্য’ করবেন না। ভুবনেশ্বর আইওআর সম্মেলনে (মার্চ ২০১৫) এই মেসেজটিই তারা দিয়েছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নতুন দিক। সিসিলি ও মরিশাসের সঙ্গে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ও দেশ দুটিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, শ্রীলংকায় ভারতীয় প্রভাব বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতে ‘জাফনা কার্ড’ ব্যবহার করা প্রমাণ করে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে দিল্লি তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, ভারত প্রাচীনকালের তার ‘কটন রুট’ ব্যবহার করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা বিকাশে ভারতীয় পণ্ডিতরা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌ-বাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। ওই সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারতীয় নৌ-বাণিজ্যের যে প্রাচীন রুট, তাতে দেখা যায় ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, মিসর, আফ্রিকার মাদাগাস্কার, অন্যদিকে শ্রীলংকা হয়ে সুমাত্রা, জাভা (মাল্লাকা প্রণালি), হংকং, জাপান পর্যন্ত ভারতীয় বাণিজ্য রুট সম্প্রসারিত ছিল। মোদি সরকার এই ‘কটন রুট’কেই নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চায়। প্রাচীনকালে ভারতীয় তুলা ও সুতা এই সমুদ্রপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। কাজেই দেখা যাচ্ছে, একদিকে চীনা নেতা শি জিনপিং তার ‘সিল্ক রুটের’ ধারণা নিয়ে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান, অন্যদিকে ভারত তার পুরনো ‘কটন রুটের’ ধারণা প্রমোট করছে। দ্বন্দ্বটা তৈরি হবে সেখানেই। বাণিজ্যনির্ভর এই দ্বন্দ্ব শেষ অব্দি পরিণত হবে সামরিক দ্বন্দ্বে। চীন তার নৌবহরে বিমানবাহী জাহাজ আরও বাড়াচ্ছে। ভারতও ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনী শক্তিশালী করছে। আন্দামানে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে।
বলা হয়, একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তি- চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এ ক্ষেত্রে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রেরও বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি। জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপানেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে, যা চীনের স্বার্থবিরোধী। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলেছেন, তা অন্য চোখে দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, এতে করে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃত্ব, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এই ‘সিল্ক রোড’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই রুটের মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য, সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি ‘মেরিটাইম সিল্ক রুটের’ কথাও আমরা জানি, যা কিনা চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চীন থেকে সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে চীনারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ব্র“নাই, মালয়েশিয়ায় এসেছিল। পরে তারা স্থায়ী হয়ে যায়। এমন কথাও বলা হয়, ব্র“নাইয়ে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে চীনাদের অবদান ছিল বেশি। ২০১২ সালে আমি তুরস্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে চীনাদের এই সিল্ক রুটের প্রতি আগ্রহের কথা জানতে পারি। এই সিল্ক রুটের যে অংশ তুরস্কে পড়েছে, আমি সেই পথ ধরেও বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিয়েছি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার প্রথম সফরে কাজাখস্তানে গিয়ে তার ঐতিহাসিক পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছিলেন। এর পরের মাসে ইন্দোনেশিয়ার পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে তিনি দ্বিতীয় ‘মেরিটাইম সিল্ক রুটের’ কথাও বলেন। এতে করে একটা ধারণার জন্ম হয় যে, চীন শুধু মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিশাল এক অর্থনৈতিক সংযোগ কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। ইরানে যে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, এটা নিশ্চয়ই অনেক পাঠক জানেন।
এখন যে প্রশ্নটি অনেক পর্যবেক্ষকই করেন তা হচ্ছে, ‘চীনের এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের’ নীতি ভারতের স্বার্থের সঙ্গে কতটুকু সাংঘর্ষিক? কেননা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার নিজস্ব মডেলে ‘ভারতীয় মনরো ডকট্রিনের’ কাঠামো গড়ে তুলছে। অর্থনৈতিক প্রভাববলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় দ্বন্দ্ব তাই অনিবার্য। আর আটলান্টিক ও প্যাসিফিকের ওপার থেকে যুক্তরাষ্ট্র এ দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ‘ফায়দা’ ওঠাতে চাইবে। আগামী দিনগুলো তাই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এখন চীন-ভারত দ্বন্দ্ব যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এ অঞ্চলের দেশগুলোও এতে করে ‘প্রভাবিত’ হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ঝুঁকির মুখে পড়বে ব্রিকস ব্যাংক। ভারত অন্যতম উঠতি শক্তি। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির পাশাপাশি শক্তিশালী আমলাতন্ত্র আছে ভারতের। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা পৃথিবীর শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি। এরা ভারতের স্বার্থকে সবসময় ‘বড়’ করে দেখতে চায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় এরই মধ্যে ভারতের একধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টদের চোখ এখন ভারত মহাসাগরের দিকে। ভারত মহাসাগরে শুধু যে বিশাল সম্পদই রয়েছে তা নয়, বিশ্বের কার্গো শিপমেন্টের অর্ধেক পরিবাহিত হয় এ মহাসাগর দিয়ে। একই সঙ্গে ৩ ভাগের ১ ভাগ কার্গো, ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৩ ভাগের ২ ভাগ এবং ৪ ভাগের ৩ ভাগ ট্রাফিক পৃথিবীর অন্যত্র যেতে ব্যবহার করা হয় ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ। পৃথিবীর আমদানি পণ্যের (তেলসহ) শতকরা ৯০ ভাগ পরিবাহিত হয় এই সামুদ্রিক রুট ব্যবহার করে। এ সমুদ্রপথের নিরাপত্তার প্রশ্নটি তাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি করে।
মালদ্বীপে ভারত ও চীনের স্বার্থ রয়েছে। মালেতে একটি বিশাল বন্দর নির্মাণের জন্য ভারতের একটি কোম্পানি কনট্রাক্ট পেয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন সেই চুক্তি বাতিল করে একটি চীনা কোম্পানিকে কাজ দেন। চীন সেখানে বিশাল বিনিয়োগ করছে। গেল ডিসেম্বরে (২০১৭) চীনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। চীন যে ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করেছে, সেখানে মালদ্বীপের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ‘মুক্তার মালা’ নীতির মাধ্যমে চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চায়। এতে করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ ক’টি সমুদ্রবন্দর ‘কানেকটেড’ থাকবে এবং চীন তা তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, পাকিস্তানের গাওদারে (বেলুচিস্তান) ও শ্রীলংকার হামবানতোতায় চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা চীনের হাতে। ভারত এ বিষয়টিকে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলেই মনে করে। হামবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতির জের ধরে শ্রীলংকায় সরকার পরিবর্তন পর্যন্ত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘চীনাঘেঁষা’ নেতা রাজাপাকসে পরাজিত হয়েছিলেন (২০১৬)। কিন্তু সম্প্রতি রাজাপাকসে আবার পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন। তিনি আগাম সংসদ নির্বাচন দাবি করেছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সিরিসেনাকে ভারতঘেঁষা বলে মনে করা হয়।
মালদ্বীপের পরিস্থিতি এখন কোনদিকে যাবে, বলা মুশকিল। দেশটির চলমান রাজনৈতিক সংকট আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে বলে আশঙ্কা করেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। মালদ্বীপের পরিস্থিতি নিয়ে ট্রাম্প-মোদি ফোনালাপ হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ আল হুসেন বলেছেন, ‘মালদ্বীপে জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং সব ধরনের সাংবিধানিক অবমাননার ফলে সামগ্রিক গণতান্ত্রিক কাঠামোই ভেঙে পড়েছে।’ সুতরাং বোঝাই যায়, মালদ্বীপের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেশ উদ্বিগ্ন। এখন দেখার পালা এ পরিস্থিতি মালদ্বীপকে কোথায় নিয়ে যায়। তবে একটা কথা বোধহয় বলাই যায়- মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলি, চীনের ১১টি যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ ইত্যাদি ঘটনাকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখছে না। এরই মধ্যে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব সংকুচিত করতে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার একটি উদ্যোগের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ‘ফিন্যান্সিয়াল রিভিউ’ এ ধরনের একটি সংবাদ দিয়েছে। এ উদ্যোগের নাম কী হবে, তা এখন অবধি প্রকাশ করা হয়নি। পাঠক স্মরণ করতে পারেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের একটি পরিকল্পনার কথা, যা চতুর্ভুজ উদ্যোগ বা Quadrilateral Initiative নামে পরিচিত। এই চতুর্ভুজ উদ্যোগের সঙ্গে নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত। প্রতিবছরই এ চার দেশ ভারত মহাসাগরভুক্ত মালাবার প্রণালিতে নিয়মিত নৌ-মহড়ায় অংশ নিয়ে আসছে। এটাই সম্ভবত চীনের ওবিওআরের ‘বিকল্প’ রূপ। জাপানের একটা স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে, তার ‘অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিসট্যান্সের’ (ওডিএ) আওতায় বৃহত্তর ‘স্বাধীন ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’ বাস্তবায়ন করা। পরিবহন ও যোগাযোগ তথা বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক বাড়িয়ে তোলার রূপরেখা রয়েছে এ কৌশলে। ২০১৭ সালে জাপান যে ওডিএ সংক্রান্ত শ্বেতপত্র তৈরি করেছে, তাতে এ রূপরেখা আছে। ভারত মহাসাগর এবং এশিয়া-প্যাসিফিকে মিত্র দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির এই জাপানি উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন রয়েছে বলেও জানা গেছে। ফলে স্পষ্টতই ভারত মহাসাগরে উত্তেজনা বাড়ছে। মালদ্বীপের পরিস্থিতি এবং দ্রুত চীনের ১১টি যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর সিদ্ধান্ত এ উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলবে।
Daily Jugantor
24.02.2018

রায়-পরবর্তী রাজনীতির চালচিত্র


জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার শাস্তি হয়েছে। তিনি এখন কারাগারে। রায়ের প্রতিবাদে বিএনপি তিন দিনের এক কর্মসূচি পালন করেছে। এ ক্ষেত্রে যা লক্ষণীয়, তা হচ্ছে বিএনপি কোনো হরতালের ডাক দেয়নি। এবং বিএনপির কর্মসূচিতে আদৌ কোনো সহিংসতা হয়নি। পুলিশ বড় ধরনের কোনো ‘অ্যাকশনে’ও যায়নি। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির জন্য খালেদা জিয়ার এই ‘জেলে যাওয়া’ একটি বড় ধরনের ঘটনা। এই ঘটনা রাজনীতিতে যে প্রভাব ফেলবে, তা অস্বীকার করা যাবে না। খালেদা জিয়ার সাজা ও চলমান রাজনীতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।
এক. খালেদা জিয়া আদৌ জামিনে মুক্তি পাবেন কি না? দুই. খালেদা জিয়া নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কি না? তিন. খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না? চার. নির্বাচনে না গেলে বিএনপি ভেঙে যাবে কি না? পাঁচ. এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের স্ট্র্যাটেজি কী হবে?
চলতি সপ্তাহে হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার জন্য জামিন চাওয়া হতে পারে। সাধারণত এসব মামলায় উচ্চ আদালত জামিন দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না একটি মামলায়, অর্থাৎ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া জামিন পেলেও তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়াকে অন্য কোনো মামলায় ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ দেখানো হয়নি। কুমিল্লার দুটি মামলায় হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। বাকি তিনটি মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ—এমন খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। সংবাদপত্রের যাঁরা সিরিয়াস পাঠক, তাঁরা লক্ষ করে থাকবেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে দুর্নীতি, ভুয়া জন্মদিন, মানুষ হত্যা, নাশকতা, মানহানিসহ নানা অভিযোগে ৩৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে চারটি মামলা দুর্নীতির। গ্যাটকো, নাইকো, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি মামলা দুর্নীতিসংক্রান্ত। এসব মামলার মধ্যে চারটি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, বাকি মামলাগুলো বর্তমান সরকারের আমলে করা হয়। খালেদা জিয়ার মামলার মধ্যে ১৯টি মামলা বিচারাধীন। আর তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে ১২টি মামলা। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া জামিন যদি পানও অন্যান্য মামলায় তাঁকে কারাগারেই থাকতে হচ্ছে। এরই মধ্যে ১৮ ফেব্রুয়ারি ও ৪ মার্চ পৃথক দুটি মামলায় খালেদা জিয়াকে আদালতে উপস্থিত করতে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে হাজিরা পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার—খালেদা জিয়াকে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে যেতে হচ্ছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য তাঁকে কারাগারেই থাকতে হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত! ডিসেম্বরে নির্বাচন।
ওই নির্বাচনে খালেদা জিয়া প্রার্থী হতে পারবেন কি না এটা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। সংবিধানের ৬৬(২) (খ)-তে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’ খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে এই ধারাটি একটি অন্তরায়। এই ধারা অনুযায়ী তিনি যোগ্য নন! কিন্তু নিম্ন আদালতের রায়কে পূর্ণাঙ্গ রায় বলে ধরে নেওয়া হয় না। এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল হবে এবং সেখানেও যদি খালেদা জিয়া ব্যর্থ হন, তিনি যাবেন আপিল বিভাগে। এমনকি নির্বাচন কমিশন যদি তাঁর প্রার্থীপদ অযোগ্য ঘোষণা করে, তার পরও তাঁকে উচ্চ আদালতে যেতে হবে। ফলে খালেদা জিয়ার প্রার্থীপদ এখন অনেকটাই আদালতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সময়টা কম। মাত্র আট মাস। নির্বাচনী শিডিউল ঘোষণা করা হবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। এই স্বল্প সময়ের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতের রায়ে তাঁর প্রার্থীপদ নিশ্চিত করতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই গেল। উপরন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মামলা একাধিক। যেকোনো মামলায় তাঁর ‘দণ্ডাদেশ’ হলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন! এটি বিবেচনায় নিয়েই বিএনপিকে এখন স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে হবে। তাহলে বিএনপি এখন কী করবে?
বিএনপি স্থায়ী কমিটি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না’! এমনকি খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পরও বিএনপি নেতারা বলে আসছেন, খালেদা জিয়াকে বাদ রেখে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না! আমি মনে করি না এটি কোনো ভালো সিদ্ধান্ত। মালয়েশিয়ার প্রধান বিরোধী দলনেতা আনোয়ার ইবরাহিম যখন জেলে ছিলেন, তাঁর দল ‘পিপলস জাস্টিস পার্টি’ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। তিনি জেলে থাকায় তাঁর প্রার্থীপদ অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিল এবং তাঁর স্ত্রী ওয়ান আজিজা ওয়ান ইসমাইল তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা রোবেন দ্বীপের নির্জন জেলে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ২৭ বছর। কিন্তু তাঁর দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস শ্বেতাঙ্গ নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে বর্ণবাদ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনা বন্ধ করেনি। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন (১৯৯৪-১৯৯৯)। তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তিনি মাত্র এক টার্ম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ভারতে চৌধুরী চরণ সিংয়ের সরকার ইন্দিরা গান্ধীকে গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু তিনি অবিসংবাদিত এক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের জেলে যাওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তাঁরা ফিরেও আসেন বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে। খালেদা জিয়ার জেলে গমন তাঁকে আরো শক্তিশালী নেতায় পরিণত করেছে। তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে বৈ কমেনি। আইনগতভাবে তিনি যদি চূড়ান্ত বিচারে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে নাও পারেন, বিএনপির উচিত নির্বাচনে অংশ নেওয়া। নির্বাচন বয়কট কোনো সমাধান হতে পারে না।
অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচন বয়কট করেও (২০১৪) বিএনপি সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়াই যে সংসদ গঠিত হয়েছিল (দশম জাতীয় সংসদ), সেই সংসদ এখনো টিকে আছে। ফলে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির মাধ্যমেই সরকারের পতন ঘটাতে হবে—এটা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে নিয়ে প্রশ্ন থাকবে অনেক। বাস্তবতাই হচ্ছে বিএনপি বড় দল। সংসদে ওই মুহূর্তে না থাকলেও বিএনপিই প্রধান বিরোধী দল। জাতীয় পার্টিকে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসিয়ে সংসদীয় রাজনীতি চালু রয়েছে বটে, কিন্তু মানুষ এটি গ্রহণ করে নেয়নি। গত চার বছর প্রকৃত অর্থেই বিএনপি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। তবে এটি স্বীকার করতেই হবে, জাতীয় পার্টির একটা সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টির কিছু নেতার উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনোভাব, সংসদে বিরোধী দলের নেতার ব্যর্থতা কিংবা পার্টি চেয়ারম্যানের ‘কমিটমেন্ট’-এর অভাব জাতীয় পার্টিকে প্রকৃত অর্থেই সরকারের ‘বি টিমে’ পরিণত করেছে। সাধারণ মানুষ এই দলটিকে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে দেখছে না। বিকল্প হিসেবে দেখছে বিএনপিকেই! তবে জাতীয় পার্টির জন্য একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে, যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়। তাই সব কিছুই নির্ভর করছে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের ওপর। আর জাতীয় পার্টিকেও তার ‘রাজনীতি’ স্পষ্ট করতে হবে। হয় সরকারে, নতুবা বিরোধী দলে। জাতীয় পার্টি যদি সরকারে থাকে, তাহলে সরকার শক্তিশালী হবে।
সরকারের শরিক অন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের চেয়ে জাতীয় পার্টির সারা দেশে অবস্থান ভালো। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র দল নিয়ে ‘মালয়েশিয়ান মডেলে’ একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হতেই পারে। আবার বিরোধী দলে থাকলে সত্যিকার অর্থেই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হবে। একটি ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ গঠন করতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের ভুলত্রুটিগুলো উল্লেখ করে সংসদে প্রকৃত অর্থেই প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হবে। এর মাধ্যমে জাতীয় পার্টির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব। আওয়ামী লীগ অনেক আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। দেশে আওয়ামী লীগের অবস্থান ভালো। প্রচুর উন্নয়নের কাজ করছে আওয়ামী লীগ। সরকারের এসব কর্মকাণ্ডকেই পুঁজি করবে আওয়ামী লীগ। তবে এটাও সত্য, একটি ‘অংশীদারিমূলক’ নির্বাচনের জন্য সরকারের বড় উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। নির্বাচনে না গেলে বিএনপি ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। এরই মধ্যে এর আলামত পাওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। বিএনপি ভেঙে গেলে এর দায় বর্তাবে সরকারের ওপর! মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত বিএনপির নেতাকর্মীরা। দুই-একজন সিনিয়র নেতা ছাড়া স্থায়ী পরিষদের সদস্যরা ‘আন্দোলনে’ নেই। কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকলেও নেতাদের নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। সুযোগসন্ধানীরা দল ভাঙতে পারে। কেউ কেউ এমপি হতে চাইবেন—এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ‘ধানের শীষ’-এর প্রতীক তাঁরা পাবেন বলে মনে হয় না। ফলে ‘খালেদা জিয়া মাইনাস’—সেই বিএনপির কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় খালেদা জিয়ার তথা বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে। বিএনপিকে এখন আইনি মোকাবেলা করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে হবে। বিএনপি যদি অন্যান্য দলের সঙ্গে ন্যূনতম একটি নির্বাচনী ঐক্য গড়ে তোলে, তাও দলটির জন্য মঙ্গল। নির্বাচনকে ‘আন্দোলনের অংশ’ হিসেবেই বিএনপিকে বিবেচনা করতে হবে। দেশে যাতে একটি ‘সুস্থ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন হয়, সেই লক্ষ্যে বিএনপিকে কাজ করতে হবে। সমস্যাটা বিএনপির জন্য ভালো নয়, এটা স্বীকার করি। এর মাধ্যমেই কর্মসূচি প্রণয়ন, প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে হবে। বিএনপির স্থানীয় নেতারাও খুব একটা স্বস্তিতে আছেন এটা মনে করি না। মামলা-মোকদ্দমায় তাঁরা ব্যতিব্যস্ত। তার পরও নির্বাচনের প্রস্তুতি তাঁদের নিতে হবে। আগামী পাঁচ বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সাল পর্যন্ত যদি তাদের সংসদের বাইরে থাকতে হয়, তাহলে সত্যিকার অর্থেই দলটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। কোনো কোনো পক্ষ বিএনপিকে আদালতকেন্দ্রিক ব্যস্ত রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে চায়। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিএনপিকে বাদ রাখলে ‘নানা জটিলতা’ তৈরি হবে। এটি সরকারের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। আমার বিশ্বাস, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও চান বিএনপি নির্বাচনে আসুক। আর বিএনপি নির্বাচনে এলেই একটি ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আর আমরা এমনটাই চাই।
Daily Kalerkontho
20.02.2018

মালদ্বীপ নিয়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি


মালদ্বীপ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে একধরনের ‘প্রভাব বলয়’ বিস্তারের প্রতিযোগিতা এই মুহূর্তে আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়। গত ১ ফেব্রুয়ারি আদালত-সরকার দ্বন্দ্বে ভারত মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রটির রাজনীতিতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তার সমাধান এখনও হয়নি। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়, যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশিদ প্রকাশ্যে ভারতকে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানান। নাশিদের এই আহ্বানের  পরপরই চীনের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শ্যুয়াং বলেছেন, আন্তর্জাতিক মহলের উচিত, মালদ্বীপের সার্বভৌমত্ব মাথায় রেখে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা। তৃতীয় পক্ষের এমন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়, যাতে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। তার মতে, আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। কিন্তু নির্বাসিত সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদের কাছে চীনের এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হয়নি। কলম্বো থেকে তিনি টুইটারে জানিয়ে দেন, ভারতের উচিত অবিলম্বে সামরিক প্রতিনিধিদের পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। চীনের প্রস্তাবকে খারিজ করে তিনি জানান, আলোচনায় পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন, ১৯৮৮ সালে ভারত মালদ্বীপে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল। ওই সময় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদুল গাইয়ুমের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কান ভাড়াটে সৈনিকদের একটি অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে নস্যাৎ হয়ে যায়। কিন্তু ১৯৮৮ আর ২০১৮ সালের পরিস্থিতি এক নয়। বর্তমান সংকটটা শুরু হয় যখন উচ্চ আদালত ১ ফেব্রুয়ারি নাশিদের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল মালদিভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ১২ জন এমপিকে মুক্তির নির্দেশ দেন। সর্বোচ্চ আদালত তাদের বিচারকে ‘অসাংবিধানিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উল্লেখ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন তাদের মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি দেশে ১৫ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেন। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ দুই বিচারক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমকে গ্রেফতার করা হয়। এর পরপরই সুপ্রিমকোর্টের বাকি তিন বিচারক বিরোধীদলীয় এমপিদের মুক্তির রায় প্রত্যাহার করে নেন। পরিস্থিতি সেখানে তখনও থমথমে। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন তার তিন মন্ত্রীকে চীন, পাকিস্তান ও সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন।
১৯৮৮ সালে ভারত মালদ্বীপে সামরিক হস্তক্ষেপ করলেও সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেশটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো নয়। মালদ্বীপ কিছুটা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ কারণেই মোদি গত চার বছরে একবারও মালদ্বীপ সফর করেননি। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের প্রভাব ভারতের অন্যতম চিন্তার কারণ। এটা বিবেচনায় নিয়েই ভারত এসব অঞ্চলে তার সামরিক প্রভাব বাড়াচ্ছে। ফলে স্পষ্টতই একধরনের চীন-ভারত দ্বন্দ্বে এই অঞ্চলের দেশগুলো জড়িয়ে পড়ছে। মালদ্বীপের ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা কী হবে, তা বলা না গেলেও মালদ্বীপের ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ রয়েছে। আগামীতে মালদ্বীপে ভারতের ভূমিকা চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, তারা এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি ‘সহ্য’ করবেন না। ভুবনেশ্বর আইওআর সম্মেলনে (মার্চ ২০১৫) এই মেসেজটিই তারা দিয়েছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নয়া দিক। সিসিলি ও মরিশাসের সঙ্গে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ও এ দুটো দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় প্রভাব বাড়ানো এবং ভবিষ্যতে ‘জাফনা কার্ড’ ব্যবহার করা, প্রমাণ করে ভারত ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, ভারত প্রাচীনকালে তার ‘কটন রুট’ ব্যবহার করে এ অঞ্চলের দেশগুরোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা বিকাশে ভারতীয় প-িতরা একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌ-বাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। ওই সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারতীয় নৌ-বাণিজ্যের  যে প্রাচীন রুট, তাতে দেখা যায় ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, মিশর, আফ্রিকার মাদাগাস্কার, আবার অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা হয়ে সুমাত্রা, জাভা (মালাক্কা প্রণালি), হংকং, জাপান পর্যন্ত ভারতীয় বাণিজ্য রুট সম্প্রসারিত ছিল। মোদি সরকার এই ‘কটন রুট’কেই নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চায়। প্রচীনকালে ভারতীয় তুলা তথা সুতা এই সমুদ্রপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। একদিকে চীনা নেতা শি জিন পিং তার ‘সিল্ক রুট’ এর ধারণা নিয়ে ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্ব যেমনি প্রতিষ্ঠা করতে চান, এর প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত তার পুরোনো ‘কটন রুট’ এর ধারণা প্রমোট করছে। দ্বন্দ্বটা তৈরি হবে সেখানেই। বাণিজ্যনির্ভর এই দ্বন্দ্ব, শেষ অবধি পরিণত হবে সামরিক দ্বন্দ্বে। চীন তার নৌবহরে বিমানবাহী জাহাজ আরও বাড়াচ্ছে। ভারতও ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনী শক্তিশালী করছে। আন্দামানে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে।
বলা হয়, একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তি, চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি! জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপনেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে, যা চীনের স্বার্থের বিরোধী। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলেছেন, তা অন্য চোখে দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, এতে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃত্ব, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এই ‘সিল্ক রুট’টি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই ‘সিল্ক রুট’ এর মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য, সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রুট ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি মেরিটাইম সিল্ক রুটের কথাও আমরা জানি, যা কিনা চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চীন থেকে সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে চীনারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, মালয়েশিয়ায় এসেছিল। পরে তারা স্থায়ী হয়ে যায়। এমন কথাও বলা হয়, ব্রুনাইয়ে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে চীনাদের অবদান ছিল বেশি। ২০১২ সালে আমি তুরস্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে চীনাদের এই সিল্ক রুটের আগ্রহের কথা জানতে পারি। এই সিল্ক রুটের যে অংশ তুরস্কে পড়েছে, আমি সেই পথ ধরেও বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিয়েছি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং তার প্রথম সফরে কাজাখস্তানে গিয়ে তার ঐতিহাসিক পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছিলেন। এর পরের মাসে ইন্দোনেশিয়ার পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে তিনি দ্বিতীয় ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’ এর কথাও বলেন। এতে একটা ধারণার জন্ম হয় যে, চীন শুধু মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিশাল এক অর্থনৈতিক সংযোগ কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। ইরানে যে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, এটা নিশ্চয়ই অনেক পাঠকই জানেন। এখন যে প্রশ্নটি অনেক পর্যবেক্ষকই করেন, তা হচ্ছে চীনের এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট’ এর নীতি ভারতীয় স্বার্থের সঙ্গে কতটুকু সাংঘর্ষিক। কেননা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার নিজস্ব মডেলে ‘ভারতীয় মনরো ডকট্রিন’ এর কাঠামো গড়ে তুলছে। অর্থনৈতিক প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় দ্বন্দ্ব তাই অনিবার্য। আর আটলান্টিক ও প্যাসিফিকের ওপার থেকে যুক্তরাষ্ট্র এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ‘ফায়দা’ ওঠাতে চাইবে। আগামী দিনগুলো তাই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এখন চীন-ভারত দ্বন্দ্ব যদি অব্যাহত তাকে, তাহলে এ অঞ্চলের দেশুলোও এতে ‘প্রভাবিত’ হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ঝুঁকির মুখে থাকবে ব্রিকস ব্যাংক। ভারত অন্যতম উঠতি শক্তি। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির পাশাপাশি শক্তিশালী আমলাতন্ত্র আছে ভারতের এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা পৃথিবীর শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি। এরা ভারতের স্বার্থকে সব সময় ‘বড়’ করে দেখতে চায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ইতোমধ্যে ভারতের একধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টদের চোখ এখন ভারত মহাসাগরের দিকে। ভারত মহাসাগরে শুধু যে বিশাল সম্পদই রয়েছে, তা নয়। বরং বিশ্বের ‘কার্গো শিপমেন্ট’ এর অর্ধেক পরিবাহিত হয় ওই ভারতের মহাসাগর দিয়ে। একই সঙ্গে ৩ ভাগের ১ ভাগ কার্গো, ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৩ ভাগের ২ ভাগ এবং ৪ ভাগের ৩ ভাগ ট্রাফিক পৃথিবীর অনত্র যেতে ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ। পৃথিবীর আমদানিকৃত পণ্যের (তেলসহ) শতকরা ৯০ ভাগ পরিবাহিত হয় এই সামুদ্রিক রুট ব্যবহার করে। সুতরাং এই সমুদ্রপথের নিরাপত্তার প্রশ্নটি তাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি করে।
মালদ্বীপে ভারত ও চীনের স্বার্থ রয়েছে। মালেতে একটি বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য ভারতের একটি কোম্পানি কন্ট্রাক্ট পেয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন সেই কোম্পানি বাতিল করে একটি চীনা কোম্পানিকে দেন। চীন সেখানে বিশাল বিনিয়োগ করছে। গেল ডিসেম্বরে (২০১৭) চীনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। চীন যে ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করেছে, সেখানে মালদ্বীপের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ‘মুক্তার মালা’ নীতির মাধ্যমে চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চায়। এতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ ক’টি সমুদ্রবন্দর ‘কানেকটেড’ থাকবে এবং চীন তা তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, পাকিস্তানের গাওদারে (বেলুচিস্তান) ও শ্রীলঙ্কার হাম্বানতোতায় চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা চীনের হাতে। ভারত এই বিষয়টিকে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলেই মনে করে। হাম্বানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতির রেশ ধরে শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তন পর্যন্ত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘চীনাঘেঁষা’ নেতা সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে পরাজিত (২০১৬) হয়েছিলেন। কিন্তু রাজাপাকসে আবার পাদপ্রদীপের আলোতে এসেছেন। তিনি আগেই সংসদ নির্বাচন দাবি করেছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সিরিসেনাকে ভারতঘেঁষা বলে মনে করা হয়।
মালদ্বীপের পরিস্থিতি এখন কোনদিকে যাবে বলা মুশকিল। মালদ্বীপের চলমান রাজনৈতিক সংকট আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে বলে আশঙ্কা করেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। মালদ্বীপের পরিস্থিতি নিয়ে ট্রাম্প-মোদি ফোনালাপ হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ আল হুসেন বলেছেন, ‘মালদ্বীপে জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও সবধরনের সাংবিধানিক অবমাননার ফলে সামগ্রিক গণতান্ত্রিক কাঠামোই ভেঙে পড়েছে। সুতরাং বোঝাই যায়, মালদ্বীপের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেশ উদ্বিগ্ন। এখন দেখার পালা ওই পরিস্থিতি মালদ্বীপকে কোথায় নিয়ে যায়
Daily Alokito Bangladesh
18.02.2018

সিরীয় যুদ্ধের নয়া মোড়

ড. তারেক শামসুর রেহমান
সিরিয়ার যুদ্ধ একটি নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। গেল শনিবার সিরিয়া থেকে ছোড়া গোলার আঘাতে ইসরাইলের একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে। সিরিয়ার গত সাত বছরের গৃহযুদ্ধে ইসরাইল এর আগে কখনও জড়িত হয়নি। এই প্রথম এ যুদ্ধে ইসরাইল তার বিমান হারাল। ইসরাইলের সিরীয় সংকটে জড়িয়ে যাওয়া এবং বিমান হারানোর ঘটনা ঘটল এমন এক সময় যখন তুরস্ক সিরিয়ার অভ্যন্তরে কুর্দি অঞ্চলে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। এক সময় ধারণা করা হয়েছিল, সিরিয়া ও ইরাক থেকে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিদের উৎখাতের পর হয়তো সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। কিন্তু সেখানে যুদ্ধ পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে, তা বলা যাবে না। মার্কিন ও রুশ বিমানবহর সেখানে সীমিত কিছু টার্গেটের ওপর বোমাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে। সিরিয়ার যুদ্ধ এখন দেশটির সীমান্ত ছাড়িয়ে লেবানন পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। ইসরাইলের বিমান ধ্বংস হওয়ার পর ইসরাইল লেবাননের হিজবুল্লাহ জঙ্গিগোষ্ঠীর ওপর এবং একইসঙ্গে ইরানি অবস্থানের ওপর বিমান হামলার হুমকি দিয়েছে। হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী ইরান ও সিরিয়ার সমর্থনপুষ্ট। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী সিরিয়ার সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে। এর আগে সিরিয়া থেকে পাঠানো ইরানের একটি ড্রোন ইসরাইলের আকাশসীমায় প্রবেশ করলে সেটিকে ভূপাতিত করা হয়। এর পরপরই সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানি লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল। এ হামলা চালাতে গিয়েই ইসরাইল তার বিমানটি হারায়। উল্লেখ্য, একটি এফ-১৬ বিমানের দাম ১৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সিরিয়া যুদ্ধে এখন কয়েকটি ফ্রন্টের জন্ম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান- সবারই সিরিয়ায় স্বার্থ রয়েছে। এখন যোগ হল ইসরাইল। যুদ্ধবিমান হারানোর পর ইসরাইল এটাকে হালকাভাবে নেবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তুরস্ক সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত আফরিন দখল করে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। অথচ দুটি দেশই ন্যাটোর সদস্য। তুরস্কের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। রাশিয়া থেকে অস্ত্রও কিনছে তুরস্ক। এ অস্ত্র কেনার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে আফরিনে তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্রের ভালো না লাগারই কথা। তুরস্কে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড হয়েছে, তা কুর্দি সন্ত্রাসীদের কাজ বলে আংকারার অভিযোগ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কুর্দি অঞ্চল মানবিজকে নিয়ে। মানবিজ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের একটি শহর। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশের অবস্থান রয়েছে, যারা সেখানে ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে কর্মরত। তুরস্ক মানবিজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল জোসেফ ভোগেল সিএনএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তিনি সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে আদৌ কোনো চিন্তাভাবনা করছেন না। তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন, পেন্টাগন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে। এ ফোর্স আফরিন শহরকে মুক্ত করার জন্য তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ করছে। ফলে সিরিয়া সংকট নতুন একটি মোড় নিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে আফরিন অঞ্চল থেকে কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওয়াইপিজি উচ্ছেদ হলেও তারা পাল্টা লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে।
তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও বিঘ্নিত করবে। জেনেভায় জাতিসংঘের উদ্যোগে যে শান্তি আলোচনা চলে আসছিল, তা কোনো ফল বয়ে আনতে পারছিল না। অন্যদিকে রাশিয়ার সোচিতে ২৯ জানুয়ারি যে শান্তি আলোচনার আহ্বান করা হয়েছিল, সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ তাতে যোগ না দেয়ায় কার্যত সেই উদ্যোগও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে সঙ্গতকারণেই এ প্রশ্ন উঠেছে যে, সিরিয়ার রাজনীতি এখন কোন পথে? সিরিয়া থেকে আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠী একরকম উচ্ছেদ হয়েছে। বিশেষ করে বছর দুয়েক আগে মার্কিন ও রুশ বিমান হামলার পর আইএস সিরিয়ায় দুর্বল হয়ে যায়। তারা ২০১৪ সালের পর থেকে যেসব এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল এবং যেসব এলাকায় তারা তথাকথিত একটি ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করেছিল, ওই বিমান হামলায় তা ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে আইএস সিরিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু রাশিয়ার বিমান হামলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ ওঠে, রাশিয়ার বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে আসাদবিরোধী বেশকিছু বিদ্রোহী গ্র“প, যারা আইএসের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আফরিনে তুরস্ক সামরিক আগ্রাসন চালাল। তুরস্ক তার সামরিক আগ্রাসনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছে। তুরস্ক বলছে, তারা শহরটিকে সন্ত্রাসীদের করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবে না। এ সামরিক আগ্রাসনের ঘটনা ন্যাটোভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের একদিন আগে সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকায় কুর্দিদের নিয়ে শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নেতৃত্বেই যুক্তরাষ্ট্র এ পরিকল্পনা করে। পিকেকে তুরস্কে নিষিদ্ধ। ওয়াইপিজে হচ্ছে পিকেকের সামরিক শাখা। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে তুরস্কের অভ্যন্তরে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে পিকেকের হাত রয়েছে বলে তুরস্ক অভিযোগ করেছিল।
আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযানে সিরিয়ার জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি ওয়াইপিজি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এ হামলা ট্রাম্প প্রশাসনকে ন্যাটোভুক্ত তুরস্কের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে সিরিয়ার রাকা শহর থেকে আইএসকে উৎখাতে ওয়াইপিজির সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু তুরস্ক ওয়াইপিজি-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতাকে ভালোভাবে নেয়নি। তুরস্কের ভয় ছিল কুর্দি বিদ্রোহীরা ভবিষ্যতে মার্কিন সহযোগিতা নিয়ে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের অংশবিশেষ নিয়ে একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। সিরিয়ার কুর্দিরা বেশিরভাগই দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। ওয়াইপিজি ২০১২ সালে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বপাড়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকেই তুরস্ক একধরনের অস্বস্তিতে ছিল। বলা ভালো, ১৯৮৪ সাল থেকেই পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে আসছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অনেকের স্মরণে থাকার কথা, কুর্দি শহর কোবানিকে আইএসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনের বক্তব্য যদি আমরা সত্য বলে ধরে নিই, তাহলে এটা স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি রাখতে চায়। তারা সিরিয়ায় দুই হাজার সামরিক উপদেষ্টা পাঠাতে চায়। আর তাই তারা ব্যবহার করতে চায় ওয়াইপিজিকে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানে। তুরস্কের এটা পছন্দ নয়। ওয়াইপিজি যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা দেশটির (তুরস্ক) সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। এক সময় ওয়াইপিজির সঙ্গে রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক ছিল। অভিযোগ আছে, রাশিয়ার উপদেষ্টারা আফরিনে ওয়াইপিজির পক্ষে কাজ করত। কিন্তু ওয়াইপিজি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দ্বিতীয় ফ্রন্ট ওপেন করায় রাশিয়া কুর্দিদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে রাশিয়ার কোনো আপত্তি ছিল না। এখানে বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর একটি ভূমিকা লক্ষ করার মতো। সিরিয়ার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্পষ্টতই দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। এটা স্পষ্ট যে রাশিয়ার কারণেই আসাদ সরকার টিকে গেল। এখানে রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া একটি পক্ষ। আর যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া জোটের বিরুদ্ধে। তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থের কারণেই রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া শিবিরে অবস্থান করছে।
তাহলে সিরিয়া সংকটের সমাধান হবে কোন পথে? সেখানে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। ক্ষমতায় আসাদকে রাখা না রাখা নিয়ে একটি ‘বিতর্ক’ আছে। সিরিয়ায় আসাদবিরোধী অনেক ‘পক্ষ’ রয়েছে, যারা একদিকে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ করছে, অন্যদিকে ক্ষমতা দখলের জন্য নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত। দুটি বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াও সিরিয়া সংকটে নিজেদের জড়িত করেছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভায় একটি শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু ওই সম্মেলনে এখন অব্দি একটি শান্তি ফর্মুলা উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একইসঙ্গে রাশিয়ার উদ্যোগে সোচিতে আসাদবিরোধীদের নিয়ে একটি শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে রাশিয়া। কিন্তু সেখানেও কোনো সমাধান বের করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ সোচি বৈঠক বয়কট করেছে আসাদবিরোধী পক্ষ, যাদের কেউ কেউ জেনেভা সম্মেলনেও অংশ নিয়েছিল। জেনেভা সম্মেলনে যোগ দিতে বিরোধী দলগুলোর উদ্যোগে একটি ‘হাই নেগোসিয়েশন্স কমিটি’ (এইচএনসি) গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এ কমিটির মধ্যেও দ্বন্দ্ব আছে। এইচএনসি সৌদি আরব সমর্থিত। তবে কুর্দিদের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে এখানে দ্বন্দ্ব আছে। বস্তুত ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম হওয়া এইচএনসির কোনো ভূমিকা নেই।
তাহলে সমাধানটা হবে কীভাবে? সিরিয়ার পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই জটিল হয়ে পড়েছে। এখানে কার্যত দুটি বড় শক্তির অবস্থান পরস্পরবিরোধী। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টতই কুর্দিদের নিয়ে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী একটি ফ্রন্ট গড়ে তুলতে চায়। অর্থাৎ আসাদবিরোধী একটি পক্ষকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তার অবস্থান ধরে রাখতে চায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে তুরস্কের সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে না। কুর্দিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহাবস্থান ও সমর্থন তুরস্ক ভালো চোখে দেখছে না। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে সিরিয়ায় ইরানি প্রভাব কমানো। এ ক্ষেত্রে সুন্নি ধর্মাবলম্বী তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক মিত্র হতে পরত। কিন্তু তা হয়নি। বরং তুরস্ক ও ইরান একধরনের অ্যালায়েন্সে গেছে। রাশিয়া আইএসবিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে ছিল। কিন্তু রাশিয়া চায় না আসাদ অপসারিত হোক। আসাদকে রেখেই রাশিয়া একধরনের সমাধান চায়। এ ব্যাপারে তুরস্কের আপত্তি থাকলেও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুরস্ক আজ রাশিয়ার মিত্র। রাশিয়া নিজ উদ্যোগে সিরিয়ায় একটি রাজনৈতিক সমাধান বের করতে চায়। সেজন্যই সোচিতে সিরিয়ার সব দল ও মতের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সম্মেলনের আহ্বান করেছিল, যাকে তারা বলছিল ‘সিরিয়ান কংগ্রেস অব ন্যাশনাল ডায়ালগ’। কিন্তু আগেই বলেছি, সিরিয়ার বিরোধীপক্ষ এ সম্মেলনে অংশ নেয়নি। সিরিয়া সংকটের মূলে রয়েছে সব মত ও পথকে একটি কাঠামোর অধীনে আনতে না পারা। সেখানে সুন্নি, শিয়া মতাবলম্বীসহ বিভিন্ন সামরিক গ্র“পও রয়েছে। আসাদ সমর্থকরাও একটি পক্ষ। কিছু ইসলামিক গ্রুপও রয়েছে, যারা আইএসের বিরোধিতা করেছিল। সবাইকে নিয়ে একটি সমাধান বের করা সহজ কাজ নয়। যদিও সোচিতে সবাই সিরিয়ার অখণ্ডতা রক্ষায় একমত হয়েছেন। একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক ধারা ও নির্বাচনের প্রশ্নে সবাই একমত হয়েছেন। তারপরও কথা থেকে যায়- বড় বিরোধী দলের অবর্তমানে এ সমঝোতা আদৌ কাজ করবে কিনা?
এই যখন পরিস্থিতি তখনই ইসরাইলি বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা ঘটল। ইসরাইল এ ঘটনার জন্য ইরানকে দায়ী করেছে। ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হুমকির সুরে বলেছেন, তার দেশের বিরুদ্ধে এ ধরনের ‘হুমকি’ যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তা কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইল এ ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে সিরিয়া ও ইরানের কোনো কোনো প্রশিক্ষণ শিবিরে বিমান হামলা চালাতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে সিরিয়ায় একটি সর্বাÍক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া। লেবাননের ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্সের গবেষক সামি নাদেরের মতে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ইরানের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ল। এতদিন দেশ দুটি লেবানন ও সিরিয়ায় একধরনের ‘প্রক্সি যুদ্ধে’ নিয়োজিত ছিল। এখন তারা সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে।
এ আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ইরানের ব্যাপারে ট্রাম্পের একধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি পারমাণবিক সমঝোতা মানেন না। ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র তার ‘চাপ’ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যোগ দিল ইসরাইল। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ার সংকট নতুন একটি মাত্রা পেল। তাতে করে সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। সিরিয়ায় নতুন নতুন ‘ফ্রন্ট’ যুক্ত হচ্ছে। একদিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার স্বার্থ, অন্যদিকে তুরস্ক, ইরান ও ইসরাইলের নিজ নিজ স্বার্থ। সব মিলিয়ে দেশটি এখন বহুমাত্রিক স্বার্থের দ্বারা আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ। গত বছর আইএস সেখান থেকে উৎখাত হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ সেখানে থামেনি। আগামীতেও থামার সম্ভাবনা কম।
Daily Jugantor
17.02.2018

স্নায়ুযুদ্ধের ধারণায় ফিরছে যুক্তরাষ্ট্র!


যুক্তরাষ্ট্র কি ফের স্নায়ুযুদ্ধের ধারণায় ফিরছে? গেল সপ্তাহে পেন্টাগনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে পরমাণু বোমার আকার ক্ষুদ্র করে আধুনিকায়নের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ‘স্টেট অব দি ইউনিয়ন’ ভাষণে বলেছিলেন, আগ্রাসন মোকাবিলায় পরমাণু অস্ত্র কাজ করবে। এখন পেন্টাগন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করতে নতুন এক কর্মসূচি হাতে নিতে যাচ্ছেÑ যাতে বড় আকারের নয়, বরং ছোট আকারের পরমাণু বোমা বানানো হবে। গেল সপ্তাহে পেন্টাগন ‘নিউক্লিয়ার পোসচার রিভিউ ২০১৮’ শীর্ষক পরমাণু পর্যালোচনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি টম ম্যানন বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রের বাইরে কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের পরমাণু অস্ত্র পাওয়ার চেষ্টার বিষয়টি আমাদের ভাবনায় সবচেয়ে আগে আছে। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘কোনো রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী সন্ত্রাসীদের অস্ত্র দেওয়ায় সমর্থন করলে বা অস্ত্র দিলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের জবাবদিহির মধ্যে আনবে। এর অর্থ পরিষ্কার, যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু শক্তিধর কয়েকটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। গত এক বছরে ট্রাম্প একাধিক ‘টুইট’ করেছেন উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে। তিনি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে ‘রকেটম্যান’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। এমনকি ইরানের সঙ্গেও তার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। তিনি ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় জাতি যে সমঝোতা হয়েছিল, তা মানতেও অস্বীকার করেছিলেন। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে তার আপত্তি রয়েছে। এমনকি রাশিয়া ও চীনের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারেও তিনি সন্দিহান। সুতরাং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু কর্মসূচি যে নতুন করে সাজাবেন, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। এমনকি তিনি পেন্টাগনকে একটি নির্দেশ দিয়েছেন ওয়াশিংটনে একটি সামরিক প্যারেড আয়োজন করার। এটা একটা শোডাউন; নিদেনপক্ষে উত্তর কোরিয়া, ইরান আর রাশিয়াকে পরোক্ষ একটা চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রকে স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতায় ফিরিয়ে নিয়ে এলো। অর্থাৎ স্নায়ুযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব’ বিরাজ করছিল, সেই মানসিকতায় আবার ফিরে এলো যুক্তরাষ্ট্র। এই মানসিকতা আবার নতুন করে বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দেবে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২৭ বছর আগে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছিল। একটা সময় ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ইউরোপে প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে দুই পরাশক্তির মাঝে একধরনের ‘যুদ্ধের’ সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। দীর্ঘ সময় ওই পরিস্থিতি বহাল ছিল, যা ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধকালীন দীর্ঘসময়ে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেখানে দুই পরাশক্তির কাছে যে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল, তা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে ভোর হওয়ার আগে বিশ্বে ‘ট্রিনিটি’ নামের বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। পরবর্তী ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে দ্বিতীয় আরেকটি পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এই দুই বোমাই জাপানের আত্মসমর্থন এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানকে ত্বরান্বিত করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পথ ধরে ১৯৪৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৬০ সালে সাহারা মরুভূমিতে ফ্রান্স, ১৯৪৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল মন্টেরোলো দ্বীপে ব্রিটেন এবং ১৯৬৪ সালে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ঝিনজিয়াং প্রদেশের পারমাণবিক পরীক্ষার এলাকায় চীনের পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে বিশ্ব আসরে নাম লিখিয়েছিল। পারমাণবিক যুদ্ধে ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ১৯৬৩ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আংশিক পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়মিত কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণ আলোচনা (সল্ট) শুরু করে। ১৯৭০ সালের মার্চে নতুন করে আর কোনো পারমাণবিক অস্ত্রের যাতে বিস্তার না ঘটে, সে লক্ষ্যে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে চুক্তি (এনপিটি) স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭৯ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সল্ট চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পারমাণবিক অস্ত্রের বিলোপসাধনে রাষ্ট্রপতি বুশ ও গরভাচেভ কৌশলগত অস্ত্র হ্রাস চুক্তি (স্ট্রাট) স্বাক্ষর করেন। ১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত হয় স্ট্রাট-২ চুক্তি। ওই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস করা হয়। ১৯৯৫ সালে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিকে (এনপিটি) ২৫ বছরের জন্য স্থায়ী রূপ দিতে জাতিসংঘে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এখানে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন। ভারত ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো এবং ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো, পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মতো, আর ২০০৬ সালে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। এর বাইরে ইসরাইলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হয়। যদিও ইসরাইলের এ ব্যাপারে কোনো স্বীকারোক্তি নেই। বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের সর্বশেষ যে তথ্য (২০১৭) আমরা পাই, তাতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৬ হাজার ৮০০টি, রাশিয়ার কাছ ৭ হাজার, যুক্তরাজ্যের কাছে ২১৫, ফ্রান্সের কাছে ৩০০, চীনের কাছে ২৭০, ভারতের কাছে ১২০-১৩০, পাকিস্তানের কাছে ১৩০-১৪০, উত্তর কোরিয়ার কাছে ১০-২০টি পারমাণবিক ওয়্যারহেড রয়েছে। একটি ওয়্যারহেড একাধিক পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করতে পারে। আরও একটি কথা, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ১২২টি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল। এখন ৫০টি দেশ চুক্তিটি অনুমোদন করলেই ৯০ দিন পর এটি কার্যকর হবে। তবে এই চুক্তি বয়কট করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। পরমাণুযুদ্ধ এড়াতে সাত দশকের প্রচেষ্টার পর প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করতে বৈশ্বিক ওই চুক্তিটি হয়েছিল। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্যদেশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ দেশের আলোচকরা ১০ পাতার চুক্তিটি চূড়ান্ত করেছিলেন। চুক্তির পক্ষে পড়েছিল ১২২টি ভোট। একটি ভোট পড়েছে বিপক্ষে। দেশটি হচ্ছে নেদারল্যান্ডস। সিঙ্গাপুর ভোটদানে বিরত ছিল। ভোটে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, ভারত, রাশিয়া, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইসরাইল বিশ্বের এই ৯টি পরমাণু অস্ত্র শক্তিধর দেশ কোনো আলোচনা ও ভোটাভুটিতে ছিল না। জাপানও আলোচনা বয়কট করে। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ছোট ছোট পারমাণবিক বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত বিশ্বে নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দিতে পারেÑ যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে চীন ও রাশিয়া তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। মস্কো মনে করে মার্কিন পরিকল্পনা সংঘাতপূর্ণ ও যুদ্ধের উসকানিমূলক। এ ধরনের পরিকল্পনা রাশিয়াবিরোধী বলেও মনে করে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর চীন মনে করে, ‘শান্তি ও উন্নয়নে অপরিহার্য বৈশ্বিক প্রবণতা বজায় রাখা দরকার। এর বিরুদ্ধে না গিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরমাণু অস্ত্রের মালিক যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তা অনুসরণ করে চলা। আমরা আশা করি যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধকালীন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসবে।’ চীনকে অযৌক্তিকভাবে পরমাণু হুমকি মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে চীনের নীতি সবসময় আত্মরক্ষামূলকÑ চীনের এটাই বক্তব্য। অন্যদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি স্পষ্টভাবেই পরমাণু অস্ত্র বিস্তারবিরোধী আন্তর্জাতিক আইনের (এনটিপি) লঙ্ঘন। পরমাণু বোমার ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে বেশি নির্ভরশীল, সে দিকটাই তুলে ধরেছে দেশটির নিউক্লিয়ার পোস্টার রিভিউ। এনপিটি লঙ্ঘনকারী এ পদক্ষেপ মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে।
এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এই ছোট ছোট পারমাণবিক বোমা বানানোর সিদ্ধান্ত কি শেষ পর্যন্ত একুশ শতকের তৃতীয় দশকে নতুন করে একধরনের পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দেবে? এই মুহূর্তে হয়তো এটা আঁচ করা যাবে না। কিন্তু নিশ্চিত করেই বলা যায়, চীন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া একটা পাল্টা কর্মসূচি গ্রহণ করবে। উত্তর কোরিয়া অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে সীমিত পাল্লার পারমাণবিক হামলার কথা বলে আসছে। এখন এ সম্ভাবনা আরও বাড়ল। গত ২৪ জানুয়ারি ‘দি ন্যাশন’ পত্রিকায় অষরপব ঝষধঃবৎ-এর একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেনÑ পৃথিবীর ৮০টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। আর সেনাবাহিনী মোতায়েন করা আছে ১ লাখ ৩৮ হাজার। অন্যদিকে ৯টি দেশে রাশিয়ার ২৬ থেকে ৪০টি ঘাঁটি রয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, রাশিয়া কম্বোডিয়ার তিনটি সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করার জন্য কম্বোডিয়া সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে। পাঠক, সিরিয়ার পরিস্থিতি স্মরণ করতে পারেন। সিরিয়ায় কুর্দি অঞ্চলে একসময় রাশিয়ার ঘাঁটি ছিল। পরবর্তীতে তুরস্কের সামরিক অভিযানের আগেই সেই ঘাঁটি প্রত্যাহার করে নেয় রাশিয়া। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি এখনও আছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমানঘাঁটি আছে। সিরিয়ার তারতাস ও লাতকিয়া সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে রাশিয়ার নৌবাহিনী। ফলে পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একধরনের ‘প্রতিযোগিতা’য় লিপ্ত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য পরিষ্কারÑ দেশ দুটি তাদের প্রভাব বাড়াতে চায়। এর বাইরে রয়েছে চীন ও ভারত। চীনকে টক্কর দিতে আফ্রিকায় সেনাঘাঁটি গাড়ছে ভারত (সিসিলি)। জিবুতিতে রয়েছে চীনা ঘাঁটি। আন্তর্জাতিক পরিসরে, বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া একধরনের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলছে। ঘুরে ফিরে সেই স্নায়ুযুদ্ধকালীন মানসিকতা ফিরে আসছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জমানায় এই মানসিকতা আরও স্পষ্ট হলো। ছোট পারমাণবিক বোমা বানানোর সিদ্ধান্ত এ রকমই একটি সিদ্ধান্ত, যার মধ্য দিয়ে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতার সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পেল। উল্লেখ্য, আকারে ছোট ও কম ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বোমার শক্তি থাকে ২০ কিলো টনের মতো। যদিও এই বোমার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ভয়াবহ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপানের নাগাসাকি শহরে একই ধরনের বিস্ফোরণে ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আর তাতেই ৭০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি হচ্ছে, ‘যতই সীমিত হোক না কেন, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার যে গ্রহণযোগ্য নয়, তা রাশিয়াকে অনুধাবন করাতে এই কৌশল কাজে দেবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘কৌশল’ আদৌ কোনো কাজে দেবে বলে মনে হয় না। বরং এই ‘কৌশল’ নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দেবে, যার আলামত আমরা ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করেছি।
Daily Alokito Bangladesh
11.02.2018

এক শিক্ষামন্ত্রীকে দুষে কী লাভ!

জাতীয় সংসদে সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির একজন সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষামন্ত্রীর ব্যর্থতা, অনিয়ম-দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু এ দাবি তোলেন। তার বক্তব্য শেষে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেছেন, নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি শুনেছেন। তিনি তার বিবেক-বিবেচনায় জাতির স্বার্থে যতটুকু করা প্রয়োজন, অবশ্যই তা করবেন।
সরকারের শরিক কিংবা বিরোধী দল, যেভাবেই আমরা জাতীয় পার্টিকে বিবেচনায় নিই না কেন, এই পার্টির একজন সংসদ সদস্য যখন প্রকাশ্যেই সংসদে দাঁড়িয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করার দাবি তোলেন, তখন বিষয়টিকে কি আমরা খুব হালকাভাবে নিতে পারি? এমন কোনো পাবলিক পরীক্ষা নেই যার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, এমনকি ক্লাস ওয়ানের প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে। এটা মহামারীর মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্ন ফাঁসকারীদের আদৌ চিহ্নিত করতে পারছে না। জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু যেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন, সেদিন এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি প্রথমপত্রের পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়, যা ৬ ফেব্রুয়ারির সংবাদপত্রগুলোতে ছাপা হয়েছে। এর আগে এসএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছিল। অনেকে স্মরণ করতে পারেন, শিক্ষামন্ত্রী তার একটি বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন। কয়েকদিন আগে তিনি শিক্ষা অধিদফতরের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আপনারা ঘুষ খান সহনীয় মাত্রায়। যদিও পরে এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন তিনি। অস্বীকার করেছিলেন যে এভাবে তিনি কথাটা বলেননি। কিন্তু টিভি ফুটেজে তার বক্তব্য স্পষ্ট ধরা পড়েছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তিনি হয়তো সত্যি সত্যিই এভাবে কথাটা বলতে চাননি। একজন মন্ত্রী এভাবে বলতে পারেন না- এটাই স্বাভাবিক। তার ওই বক্তব্যের সেদিন সমালোচনা হয়েছিল। মন্ত্রিপরিষদের কোনো কোনো সদস্য তার ওই বক্তব্যের সমালোচনা করেছিলেন। এটা সত্য, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে, এবং হচ্ছে। এই ক’বছরে আমাদের অনেক অর্জন আছে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অনেক বেশি। প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এখন প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় যদি বারবার ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যায় এবং তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে দক্ষ জনশক্তি আমরা গড়ে তুলব কীভাবে? আমরা একটা তরুণ প্রজন্ম গড়ে তুলছি, যারা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার জনশক্তি হওয়ার পরিবর্তে ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে অদক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠছে। এই অদক্ষ জনশক্তি আমাদের কী দেবে? শিক্ষামন্ত্রী সজ্জন ব্যক্তি। বাম রাজনীতির মানসিকতায় যিনি নিজেকে কৈশোরে তৈরি করেছিলেন, তার কাছে দুর্নীতি কখনও মুখ্য বিষয় হবে না, এটাই স্বাভাবিক। তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। কেন তিনি নকল বন্ধ করতে পারবেন না? প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করা কঠিন কিছু নয়। এটা সম্ভব। প্রযুক্তির এই যুগে এটা কঠিন কোনো কাজ নয়। কিন্তু তিনি বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন! বোধকরি তার ব্যক্তিজীবন দিয়ে জাতীয় নীতি বাস্তবায়নকে বিচার করা যাবে না। তিনি ব্যক্তিজীবনে অতি সাধারণ একজন মানুষ। আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতার মতো প্রতিপক্ষের নেতাদের সমালোচনা করতে অশ্লীল বাক্য কখনও ব্যবহার করেন না। খারাপ কথাও তিনি বলেন না। আমাদের ভালো লাগা এখানেই। কিন্তু শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে যে ‘শক্ত’ অবস্থানে যাওয়ার কথা, সেখানে তিনি প্রচণ্ডভাবে ব্যর্থ। ধারণা করছি, তার এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে কিছু অসাধু ব্যক্তি। তার নিজের ব্যক্তিগত ইমেজের স্বার্থেই তিনি সরে দাঁড়াবেন, এই প্রত্যাশা করতেই পারি।
২.
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে যখন আলোচনা করছি, তখন সঙ্গত কারণেই উচ্চশিক্ষা নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। শিক্ষামন্ত্রী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যান। সেখানে তিনি প্রতিবারই একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার কথা বলেন। কথাগুলো শুনতে ভালোই শোনায়। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, তারা উৎসাহিত হই তার কথায়। কিন্তু এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগটি কী? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কী হচ্ছে, সে ব্যাপারে তিনি কি জ্ঞাত আছেন? সেখানে যে অনিয়ম হচ্ছে, তা দূরীকরণে তার কোনো উদ্যোগ তো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রায় ৩৫-৩৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা বেড়েছে। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী এইচএসসি পাস করে। তাদের জন্য উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্তটি অযৌক্তিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেখানে কারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন? রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, টিআইবি আমাদের জানিয়েছে, টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে! টিআইবি বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সংবাদ সম্মেলনে ভয়াবহ এ তথ্যটি উপস্থাপন করেছিল। তারপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েও যখন এ ধরনের কথা শুনি, তখন আমাকে একধরনের হতাশায় পেয়ে যায়। যদি যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না হয়, তাহলে দক্ষ জনশক্তি আমরা গড়ে তুলব কীভাবে? যারা টাকার বিনিময়ে এবং রাজনৈতিক পরিচয়ে শিক্ষক হন, তারা পড়ানো ও গবেষণার পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছাত্ররা। এতে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের যে উদ্যোগ, তা ভেস্তে যেতে বাধ্য। আরও একটা কথা। নতুন নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে একধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ভালো শিক্ষকরা পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকায় সেখান থেকে ভালো ছাত্ররা বের হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যোগ্য শিক্ষকের অভাব থাকায় সেখানকার ছাত্ররা বঞ্চিত হচ্ছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন রাষ্ট্রপতির কাছে একটি সুপারিশ করেছে, যেখানে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেষণে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। দেখা যাবে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একেকটি বিভাগে সিনিয়র শিক্ষকের (প্রফেসর) সংখ্যা এত বেশি যে তাদের অনেকেরই পড়ানোর মতো কোর্স থাকে না। ফলে তাদের কিছুটা আর্থিক সুবিধা দিয়ে (যা মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশে আছে) প্রেষণে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পাঠানো যায়। সেই সঙ্গে আরও একটি সুপারিশ রাখছি : অনেক সিনিয়র শিক্ষক সাম্প্রতিক সময়ে অবসরে গেছেন। কিন্তু তারা শারীরিকভাবে সুস্থ। তাদের কাউকে কাউকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করতে দেখি। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ‘বিশেষ বিবেচনায়’ নিয়োগদান করা যেতে পারে। এজন্য হয়তো প্রচলিত আইন সংশোধন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ উদ্যোগটি নিতে পারে। তাহলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকের অভাব দূর হবে। একজন শিক্ষকের ৬৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পর কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনঃনিয়োগের সুযোগ নেই। অথচ অবসরপ্রাপ্ত এসব শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা উপকৃত হচ্ছে। তাহলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ সুযোগটি পাবে না কেন? আমি আমার অনেক সিনিয়র সহকর্মীকে জানি যারা নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন। জামালপুর ও নেত্রকোনায় দুটি নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে যাচ্ছে। আমার ভয় হচ্ছে- এখানে শিক্ষকতায় কারা যাবেন? শুধু প্রভাষক আর সহকারী অধ্যাপকদের দিয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন চলছে। উচ্চশিক্ষার জন্য এটা ভালো খবর নয়।
প্রধানমন্ত্রী উচ্চশিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে চান। উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু উদ্যোগটি নিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই। কাজটি মঞ্জুরি কমিশনের করা উচিত। কিন্তু মঞ্জুরি কমিশনের নেতৃত্ব এখানে ব্যর্থ। তারা কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন অনেক- ১৩৫ কিংবা আরও বেশি। মাত্র ৫ সদস্য নিয়ে মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষে এসব বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করা কঠিন একটি কাজ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আলাদা একটি কমিশন করা জরুরি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একেকটি ‘সনদ তৈরির’ কারখানায় পরিণত হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাই একধরনের নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ মুহূর্তে সমাজের বাস্তবতা। এর প্রয়োজনীয়তা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। কিন্তু যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে তাদের ‘সাহায্য’ করা। এটা মঞ্জুরি কমিশন পারছে না। মাত্র একজন সদস্য এ কাজে নিয়োজিত। তার একার পক্ষে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করা সম্ভব নয়। এ কারণেই একটি কমিশন গঠন করা জরুরি।
একসময় কথা উঠেছিল একটি ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ গঠন করা হবে, যাদের কাজ হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং করা। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিক পক্ষের চাপে সেই ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ আজও গঠন করা সম্ভব হয়নি। আমরা চাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রহণযোগ্যতা বাড়–ক। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যদি পারিবারিকভাবে পরিচালিত হয়, যদি সেগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি কাজ করে, তাহলে কোনোদিনই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যর্থতাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে। সেখানে যোগ্য ও মেধাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আমাদের রয়েছে একটি বিশাল তরুণ প্রজন্ম। এ তরুণ প্রজন্মকে আমরা দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে পারি, যা চীন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া করেছে। এজন্যই চীন, দক্ষিণ কোরিয়া আজ প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। ব্যক্তিবিশেষকে সামনে রেখে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে, যার কোনো চাহিদা নেই অভ্যন্তরীণ বাজারে কিংবা বিশ্ববাজারে। বিবিএ’র নামে ‘শিক্ষিত কেরানি’ তৈরি করছি আমরা, যারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারছেন না।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন ধীরে ধীরে ‘বেসরকারি’ চরিত্র পাচ্ছে। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রতিটি বিভাগে এখন সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করে অর্থ আয়ের একটি ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। কিছু শিক্ষক এ থেকে লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে তা কোনো অবদান রাখছে না। এখানেও ‘সনদ বিক্রির’ অভিযোগ উঠেছে। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে নৈরাজ্য। উপাচার্যরা নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন। দুদক তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে। এক্ষেত্রেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে জনগণের টাকায়।
৩.
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময়ের শিক্ষামন্ত্রী। এর আগে কোনো শিক্ষামন্ত্রী এত দীর্ঘদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ছিলেন না। বোধকরি তিনিই একমাত্র শিক্ষামন্ত্রী, যিনি সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হয়েছেন এবং সংসদে তাকে বরখাস্তের দাবি জানানো হয়েছে। আমাদের দুঃখ এখানেই, তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে এ কথাও সত্য, তিনি পদত্যাগ করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শৈথিল্য আছে। মন্ত্রণালয়ের অন্য অনেক কর্মকর্তাও এর জন্য দায়ী। দুদক এদের কর্মকাণ্ডও খতিয়ে দেখতে পারে। একুশ শতকে এসে যেখানে যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তি আমাদের দরকার, সেখানে আমরা ‘সনদ বিক্রির’ কারখানা প্রতিষ্ঠা করে অদক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলছি। শিক্ষামন্ত্রী ‘জ্ঞানভিত্তিক’ একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে, আমরা ধীরে ধীরে জ্ঞান ও মেধাহীন একটি জাতিতে পরিণত হতে চলেছি। তাই পুরো মন্ত্রণালয়েই আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভেঙে আলাদা একটি উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে ঢেলে সাজাতে হবে। সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, বরং মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে হবে। আইন করে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে সেখানে প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধতন শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রেষণে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করতে হবে। অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্ত অতি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
Daily Jugantor
10.02.2018

আজকের দিন ঘিরে উৎকণ্ঠা

কী হতে যাচ্ছে আজ? বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট’ মামলার রায় এই দিন। এই রায় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। প্রতিদিনই পত্রিকায় তাঁদের বক্তব্য ছাপা হচ্ছে। টিভি টক শোতে প্রকাশ্যেই মন্তব্য করা হচ্ছে। টিভি টক শোর যাঁরা সঞ্চালক তাঁরা বোধ করি জেনেশুনেই দুটি বড় দলের দুজন নেতাকে আমন্ত্রণ জানান। নেতারা ঝগড়া করেন। আর জনগণ বিভ্রান্ত হয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি আলোচিত মামলা। এই মামলার রায়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। বিশেষ করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের বিষয়টি এই রায়ের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে। রায়ে কী হবে, কী হবে না—আমরা কেউ তা জানি না। কিন্তু বিএনপি, আওয়ামী লীগ কিংবা কোনো কোনো মন্ত্রী এরই মধ্যে মন্তব্য করেছেন। একজন ছোট মন্ত্রী তো বলেই ফেলেছেন, আগামী ১৫ দিন পর খালেদা জিয়াকে কারাগারে থাকতে হবে! সরকারের কোনো মন্ত্রী কি এ ধরনের কথা বলতে পারেন? রায় দেবেন তো আদালত। সেই রায়ে কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হতে পারে। কোনো পক্ষ খুশি হতে পারে। এ নিয়ে আগাম মন্তব্য করা যায় না। এটি আদালত অবমাননার শামিল! আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে আমরা আদালতে বিচারাধীন একটি মামলা নিয়ে প্রশ্ন করতেও দ্বিধা বোধ করি না। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অনেক ম্যাচিউরড বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা হবে কি হবে না—এটি আদালতের এখতিয়ার। সাক্ষ্য-প্রমাণ ও তথ্যের ভিত্তিতে আদালতই সিদ্ধান্ত নেবেন। এখানে সরকারের কোনো হাত নেই। আদালত কী রায় দেবেন, সেটি তো বিএনপি বলে দিচ্ছে! এর আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, খালেদা জিয়ার সাজা পূর্বপরিকল্পিত! এটি নিয়েও ওবায়দুল কাদের প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, এই রায় আগেভাগে জানলেন কিভাবে মির্জা ফখরুল!
স্পষ্টতই এই রায় ও খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সাজা নিয়ে দুটি বড় দলই ‘রাজনীতি’ করছে। বিএনপি জনসমর্থন টানতে চেয়েছে সম্ভাব্য সাজার বিষয়টিকে সামনে এনে। আর আওয়ামী লীগ আগেভাগেই সতর্ক অবস্থানে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের কিংবা মন্ত্রীদের সতর্ক হয়ে কথাবার্তা বলা উচিত ছিল। আদালতের ওপর আমাদের আস্থা রাখাটা উচিত ছিল। আদালত একটি রায় দিলেই তা যে চূড়ান্ত, তা তো বলা যাবে না। বিএনপির জন্য সে সুযোগ আছে। আমাদের এমন কোনো কিছু করা উচিত নয়, যা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। একজন ছোট মন্ত্রী যখন রায় ঘোষণার আগেই রায় নিয়ে মন্তব্য করেন তখন বিএনপির উচিত ছিল তা আদালতের নজরে আনা। বিএনপি নেতারা এটি করেছেন বলে মনে হয় না। গয়েশ্বর রায়ের মতো একজন সিনিয়র নেতা যখন বলেন, ‘সরকারের আদিষ্ট হয়ে যদি আদালত থেকে নেতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত প্রকাশ পায়, তাহলে তখন থেকে এই সরকারের পতনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে।’ ‘সরকারের আদিষ্ট হয়ে’ রায় দেওয়া যায় কি? এ ধরনের বক্তব্য একজন সিনিয়র নেতার মুখ থেকে আশা করা যায় না। তাঁরা যদি এ ধরনের কথাবার্তা বলেন, তাহলে জুনিয়র নেতারা কিভাবে বলবেন? কী তারা শিখবেন? ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট’ মামলা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। থাকাটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে আমাদের সবার বক্তব্য শোভন, গ্রহণযোগ্য এবং তা আদালতকে যেন প্রভাবিত না করে—এমনটিই হওয়া উচিত।
মামলাটি একটি স্পর্শকাতর মামলা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই মামলা হলেও ওই সরকারের আমলে দায়ের করা অনেক মামলা বর্তমান সরকার এগিয়ে নিয়ে যায়নি। তাই সুযোগ তৈরি হয়েছে বিএনপির জন্য কথা বলার। তবে বিএনপির দুটি সিদ্ধান্ত চলমান রাজনীতিতে আরো ঝড় তুলবে। বিএনপি বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলেছে গত মঙ্গলবার। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে সামনে রেখেই বিএনপি এই কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করল। দ্বিতীয়ত, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে খালেদা জিয়াকে ছাড়া ভোটে যাবে না বিএনপি। সংবাদ দুটি আমাদের চলমান রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চলতি বছর নির্বাচনী বছর। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগে কয়েকটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে সব দল, বিশেষ করে দুটি বড় দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। এই আস্থার সম্পর্ক না থাকলে দেশে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হবে, যা কোনো দলের জন্যই কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। যেহেতু আমরা ধীরে ধীরে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, সেহেতু আমাদের এমন কোনো বক্তব্য দেওয়া ঠিক নয়, যা উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে। বিএনপি ধরেই নিয়েছে খালেদা জিয়ার সাজা হবে! তাই তারা কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলেছে। আমরা বারবার বলে আসছি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বিদেশিদের জড়িত না করাই মঙ্গল। সমস্যা আমাদের। সমাধান আমাদেরই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের দ্বারস্থ হওয়ার অর্থ হচ্ছে, আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের ‘নাক গলানোর’ সুযোগ করে দেওয়া। গণতন্ত্রের জন্য এটা মঙ্গলজনক নয়। বিদেশিদের ‘প্রেসক্রিপশন’ মতো যদি আমরা চলি, তাহলে আমরা গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, বৈরিতা থাকবেই। এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব নিরসনে বিদেশিদের ডাকা কেন? তাদের শরণাপন্ন হওয়া মানে তাদের সুযোগ করে দেওয়া। এটি আমাদের দুর্বলতা। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দুর্বলতা। আমাদের সমস্যা আমাদেরই মেটাতে হবে। আর সমস্যা সমাধানের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সংলাপ। সিনিয়র মন্ত্রীরা যখন বলেন বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কোনো প্রয়োজন নেই তখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূলকথা। এখন আস্থার সম্পর্কে যদি ঘাটতির সৃষ্টি হয়, তাহলে একমাত্র সংলাপের মাধ্যমেই তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। বিএনপির নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত (?) আমার মনে হয় চূড়ান্ত নয়। বিএনপির একটি সিদ্ধান্ত পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে বটে; কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বিএনপিকে আরো বিতর্কিত করতে পারে। নির্বাচন বয়কট কোনো সমাধান নয়, বরং সরকার যাতে একটি গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন দেয়, সে ব্যাপারে দলটিকে কাজ করতে হবে। সিভিল সোসাইটির সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে হবে। সব দলের সঙ্গে এ প্রশ্নে ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। কিন্তু বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি। সরকার চার বছর পার করেছে। সুতরাং আগামী নির্বাচনও যদি বিএনপি বয়কট (?) করে, তার পরিণতি নিশ্চয় বিএনপি নেতারা অনুধাবন করবেন।
মূলকথা হচ্ছে, আমরা একটি ভালো জাতীয় নির্বাচন চাই। আর ভালো নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন সব দলের অংশগ্রহণ। ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য খুব ভালো খবর নয়। সরকারের জন্যও এটি কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। আরো একটি কথা। সিল মারা কিংবা ভোটকেন্দ্র দখলের যে সংস্কৃতি আমরা বারবার প্রত্যক্ষ করে আসছি কিংবা বিরোধী দলের প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার যে ‘রাজনীতি’ আমরা দেখেছি, এই প্রবণতা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্তরায়। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দায়িত্ব তাই অনেক বেশি। ইসিকে প্রমাণ করতে হবে তারা নির্বাচনের আগে ‘সবার জন্য সমান সুযোগ’ দেবে। নির্বাচনে মাস্তানতন্ত্র বন্ধ করবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে। কোনোখানেই কোনো সহিংসতা হয়নি। সব দল এই নির্বাচন দুটির ফলাফল মেনে নিয়েছে। ফলে কিছুটা হলেও একটা আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু ইসি সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কতটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করবে—প্রশ্ন সেখানেই। আমরা বারবার বলে আসছি সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে নির্বাচন কমিশন ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকে। সংবিধানের ১১৮(৪) ধারা নিয়ে একটি ব্যাখ্যা আছে। এই ধারায় বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন’ এবং সংবিধানের ১২৬ ধারায় বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হবে।’ এটিই হচ্ছে আসল কথা। নির্বাচনের তিন মাস আগে সব প্রশাসন চলে যায় নির্বাচন কমিশনের হাতে। অর্থাৎ জেলা প্রশাসক, এসপি, ওসিরা থাকেন নির্বাচন কমিশনের আওতায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা কি বলে? জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা থানার ওসিরা থাকেন জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায়। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন নয়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে, আর জেলা প্রশাসকরা নিয়ন্ত্রিত হন মন্ত্রণালয় থেকে। এ ক্ষেত্রে প্রায় ক্ষেত্রেই সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রতিফলিত হয়।
আরো একটি কথা। সংসদ বিলুপ্ত না করেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর অর্থ কী? সংসদ সদস্যরা নিজেদের অবস্থান ঠিক রেখেই প্রার্থী হবেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অর্থাৎ যিনি এখনো এমপি, তিনি প্রার্থী হবেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার একটি অভিযোগ থেকেই যাবে। স্থানীয় প্রশাসন একজন এমপিকে অস্বীকার করতে পারে না। এমপিকে তারা সমীহ করে। এমপি স্থানীয় রাজনীতির প্রধান ব্যক্তি। এমপির কথাকে গুরুত্ব দিয়ে স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন অন্য কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে! পৃথিবীর সব দেশে সাধারণত নিজেদের জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েই নির্বাচনটি হয়। ভারত এর বড় উদাহরণ। সংসদ বহাল রেখে কোনো নির্বাচনই হয় না। এটি অবশ্য ঠিক, ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকেন; কিন্তু তাঁর কোনো ‘নির্বাহী কর্তৃত্ব’ থাকে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংবিধানের এই ধারা নিয়ে বিতর্ক আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান পরস্পরবিরোধী।
চলতি বছরটি এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে থাকবে বারবার। দুটি বড় দলই তাদের নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। এ ক্ষেত্রে জট কিভাবে খুলবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে যা জরুরি, তা হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই আস্থার সম্পর্ক এখন তলানিতে অবস্থান করছে। আস্থার সম্পর্কটি জরুরি এ কারণে যে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অনেক অংশে দুই দল নির্ভর হয়ে পড়েছে। এক দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে, সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকে। আওয়ামী লীগ বড় দল। ইউনিয়ন পর্যায়ে এই দলের সাংগঠনিক ভিত্তি আছে। অন্যদিকে বিএনপি আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তৃতীয় শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির একটি সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্ত আর সুবিধাবাদিতার রাজনীতির কারণে জাতীয় পার্টি একটি অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। পাঠক লক্ষ করলে দেখবেন, এই দলের জন্মের পর থেকে যতবার ভাঙনের মুখে পড়েছে, অন্য কোনো দল এতবার ভাঙনের মুখে পড়েনি। অতীতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান কিংবা কাজী জাফর আহমদ যাঁরাই দল থেকে (জাতীয় পার্টি) বেরিয়ে গেছেন, তাঁরা রাজনীতির প্রশ্নের চেয়ে সুবিধাবাদিতার কারণেই দল থেকে বেরিয়ে গেছেন। এ ক্ষেত্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মূলধারা ধরে রেখেছেন বটে; কিন্তু তাঁর অবর্তমানে দল কয় টুকরায় বিভক্ত হয়, সেটিই দেখার বিষয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপিতে ভাঙন এসেছে। তবে তারা কেউই সুবিধা করতে পারেনি। আবদুর রাজ্জাকের মতো নেতা আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে বাকশাল নিয়ে গঠিত হতে চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। মূলধারায় ফিরে এসেছিলেন। বিএনপির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ওবায়দুর রহমান কিংবা মান্নান ভূঁইয়া চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। আর নাজমুল হুদা একবার বেরিয়ে গেছেন, আবার ফিরে এসেছেন, এখন আবার দলের বাইরে। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কিংবা কারিশমা কোনোটাই নেই। ফলে মুজিব কিংবা জিয়া পরিবারের বাইরে গিয়ে কেউই সফল হবেন না। আরো একটি কথা—আর তা হচ্ছে তৃতীয় শক্তি গড়ে ওঠার ব্যর্থতা। বারবার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু সফলতা আসেনি। আমরা যদি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (১৯৯১) ফলাফল থেকে নবম জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব জাতীয় সংসদ নির্বাচন দুটি বড় দল নির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে দল দুটির মধ্যে আস্থার সম্পর্ক থাকাটা জরুরি।
আজকের দিনটিকে ঘিরে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। দুটি দলের নেতারাই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। আদালতের একটি সম্ভাব্য রায় নিয়ে কারোরই আগাম মন্তব্য করা সমীচীন নয়। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা কমে যায়! আমরা চাই সব দল সহনশীলতা প্রদর্শন করবে। আদালতের ওপর আস্থা রাখবে এবং কোনো ধরনের সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেবে না। মনে রাখতে হবে, সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। কোনো দলেরই নির্বাচনপ্রক্রিয়া বানচাল হয়—এমন কোনো কর্মসূচি নেওয়া উচিত নয়
Daily Kalerkontho
08.02.2018

তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র কি যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে



সিরিয়ায় কুর্দি অবস্থানের ওপর তুরস্কের বিমান হামলা ও সামরিক অভিযানের পর তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে এবং দেশ দুটির মধ্যে একটি সীমিত যুদ্ধের সম্ভাবনাও দেখছেন কেউ কেউ। যুদ্ধ আদৌ হবে কি নাÑ এটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু সিরিয়া থেকে আইএস উৎখাতের পর সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, ঠিক তেমনই একই সময়ে তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি নতুন করে নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক ন্যাটো জোটের সদস্য। দীর্ঘদিন তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে আসছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ন্যাটোভুক্ত এ দুটো দেশের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের (জুলাই ২০১৬) পর থেকে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছে। তুরস্ক মনে করে, ওই ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের একটা ইন্ধন ছিল। এর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। ওই ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পরপরই এরদোগান রাশিয়ার দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েন। ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এরদোগান ছুটে গিয়েছিলেন রাশিয়ায়। সোচিতে ২০১৭ সালে দুই নেতা মিলিত হয়েছিলেন। একই বছর পুতিন তুরস্কও সফর করেছিলেন। সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে রাশিয়া-তুরস্ক সামরিক চুক্তি। ওই চুক্তির বদৌলতে রাশিয়া তুরস্কের কাছে এস-৪০০ মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও অত্যাধুনিক বিমান বিক্রি করতে সম্মত হয়েছে। ন্যাটোভুক্ত একটি দেশের রাশিয়ার সমরাস্ত্র ক্রয় এই প্রথম। খুব স্বাভাবিক কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের এটা ভালো চোখে দেখার কথা নয়। উপরন্তু রাশিয়ার সরকারি গ্যাস বিক্রি সংস্থা গেজপ্রম (Gazprom) এরই মধ্যে তুরস্কের মধ্য দিয়ে গ্যাস সরবরাহের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। গেজপ্রম কৃষ্ণসাগরের নিচ দিয়ে (Turkstream Project)এই গ্যাস তুরস্কে সরবরাহ করবে, যা ২০১৯ সালে ইউরোপে যাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাশিয়ার কৃষ্ণসাগরের নিকটবর্তী শহর ক্রাসনোডর হয়েBlack Sea বা কৃষ্ণসাগরের নিচ দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস তুরস্কের বন্দরনগর সামসুনে সরবরাহ করা হবে, পরে যা পাইপলাইনের মাধ্যমে যাবে আংকারা পর্যন্ত। পাশাপাশি অপর একটি লাইনে গ্যাস যাবে গ্রিসে। সেখান থেকে তা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর জ্বালানি চাহিদা মেটাবে। এই দুই পাইপলাইনে ১৫ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস সরবরাহ করা হবে। বোঝাই যায়, ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্নে (Turkstream Project)এর গুরুত্ব কত বেশি। রাশিয়া-তুরস্ক এই গ্যাস সমঝোতা, তাই যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিস্টদের মনঃপূত নয়। তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতির পেছনে এটাও অন্যতম একটা কারণ।তুরস্কের সিরিয়ায় কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চল (আফরিন) সেনা অভিযানের পেছনে তারা তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে বড় করে দেখছে। তুরস্কের অভ্যন্তরে সাম্প্রতিকালে যেসব সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- সংঘটিত হয়েছে, তা কুর্দি সন্ত্রাসীদের কাজ বলে তুরস্কের অভিযোগ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কুর্দি অঞ্চল মানবিজকে নিয়ে। মানবিজ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের একটি শহর। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশের অবস্থান রয়েছে, যারা সেখানে ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে কর্মরত রয়েছে। তুরস্ক মানবিজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল জোসেফ ভোগেল সিএনএনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে আদৌ কোনো চিন্তাভাবনা করছেন না। তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন, পেন্টাগন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সকে তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে। এই ফোর্স তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আফরিন শহর মুক্ত করার জন্য ‘যুদ্ধ’ করছে। ফলে সিরিয়া সংকট নতুন একটি মোড় নিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে আফরিন অঞ্চল থেকে কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওয়াইপিজি উচ্ছেদ হলেও তারা পাল্টা লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও বিঘিœত করবে। জেনেভায় জাতিসংঘের উদ্যোগে যে শান্তি আলোচনা চলে আসছিল, তা কোনো ফল বয়ে আনতে পারছিল না। অন্যদিকে রাশিয়ার সোচিতে যে বিকল্প শান্তি আলোচনা চলছিল, তাতেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ২৯ জানুয়ারি সোচিতে যে শান্তি আলোচনা আহ্বান করা হয়েছিল, সিরিয়ার বিরোধীপক্ষ তাতে যোগ না দেওয়ায় কার্যত সে উদ্যোগও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে একটা প্রশ্ন সংগত কারণেই উঠেছে যে, সিরিয়ার রাজনীতি এখন কোন পথে? সিরিয়া থেকে আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠী একরকম উচ্ছেদ হয়েছে। বিশেষ করে বছর দুয়েক আগে মার্কিন ও রাশিয়ার বিমান হামলার পর আইএস সিরিয়ায় দুর্বল হয়ে যায়। তারা ২০১৪ সালের পর থেকে যেসব এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল এবং যেসব এলাকায় তারা তথাকথিত একটি ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করেছিল, ওই বিমান হামলায় তা ধ্বংস হয়ে যায় এবং আইএস সিরিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু রাশিয়ার বিমান হামলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ ওঠেÑ রাশিয়ার বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে আসাদবিরোধী বেশকিছু বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা আইএসের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আফরিনে তুরস্ক সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। তুরস্ক তার সামরিক আগ্রাসনের জন্য যুক্তি দেখিয়েছে। তুরস্ক বলছে, তারা শহরটিকে সন্ত্রাসীদের করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবে না। এই সামরিক আগ্রাসনের ঘটনা ন্যাটোভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে একধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের এক দিন আগে সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকায় কুর্দিদের নিয়ে শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নেতৃত্বেই ওই পরিকল্পনা করে। পিকেকে তুরস্কে নিষিদ্ধ। ওয়াইপিজে হচ্ছে পিকেকের সামরিক শাখা। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় তুরস্কের অভ্যন্তরে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে পিকেকের হাত রয়েছে বলে তুরস্ক অভিযোগ করেছিল। আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযানে সিরিয়ার জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি ওয়াইপিজি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এ হামলা ট্রাম্প প্রশাসনকে ন্যাটোভুক্ত তুরস্কের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গেল অক্টোবরে (২০১৭) সিরিয়ার রাকা শহর থেকে আইএসকে উৎখাতে ওয়াইপিজির সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু তুরস্ক ওয়াইপিজি-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতাকে ভালো চোখে নেয়নি। তুরস্কের ভয় ছিল, কুর্দি বিদ্রোহীরা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের অংশবিশেষ নিয়ে একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে! সিরিয়ার কুর্দিরা বেশিরভাগই দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। পিকেকের সশস্ত্র শাখা ও ওয়াইপিজি বা পিপলস ডিফেন্স ইউনিট ২০১২ সালে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বপারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই তুরস্ক একধরনের অস্বস্তিতে ছিল। বলা ভালো, ১৯৮৪ সাল থেকেই পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে আসছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।অনেকের স্মরণ থাকার কথা, কুর্দি শহর কোবানিকে আইএসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনের বক্তব্য যদি আমরা সত্য বলে ধরে নিই, তাহলে এটা স্পষ্ট যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি রাখতে চায়। তারা সিরিয়ায় দুই হাজার সামরিক উপদেষ্টা পাঠাতে চায়। আর তাই তারা ব্যবহার করতে চায় ওয়াইপিজিকে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানে। তুরস্কের এটা পছন্দ নয়। ওয়াইপিজি যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা দেশটির (তুরস্ক) সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। একসময় ওয়াইপিজির সঙ্গে রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক ছিল। অভিযোগ আছে, রাশিয়ার উপদেষ্টারা আফরিনে ওয়াইপিজির পক্ষে কাজ করত। কিন্তু ওয়াইপিজি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দ্বিতীয় ফ্রন্ট ওপেন করায় রাশিয়া কুর্দিদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় এবং সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে রাশিয়ার কোনো আপত্তি ছিল না। এখানে বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর একটি ভূমিকা লক্ষ করার মতো। সিরিয়ার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্পষ্টই দুইটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। এটা স্পষ্ট যে, রাশিয়ার কারণেই আসাদ সরকার টিকে গেল। এখানে রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া একটি পক্ষ। আর যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া জোটের বিরুদ্ধে। তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থের কারণেই রাশিয়া-ইরান-সিরিয়ার শিবিরে অবস্থান করছে। তাহলে সিরিয়া সংকটের সমাধান হবে কোন পথে? সেখানে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। সেখানে আসাদকে রাখা বা না-রাখা নিয়ে একটি ‘ডিবেট’ আছে। সিরিয়ায় আসাদবিরোধী অনেকগুলো ‘পক্ষ’ রয়েছে, যারা একদিকে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধেও ‘যুদ্ধ’ করছে, আবার ক্ষমতা দখলের জন্য নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষেও লিপ্ত। দুটি বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াও সিরিয়া সংকটে নিজেদের জড়িত করেছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভায় একটি শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু ওই সম্মেলনে এখন অবধি একটি শান্তি ফরমুলা উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে রাশিয়ার উদ্যোগে সোচিতেও আসাদবিরোধীদের নিয়ে একটি শান্তি সম্মেলন আয়োজন করে আসছে রাশিয়া। কিন্তু সেখানেও কোনো সমাধান বের করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ সোচি বৈঠক বয়কট করেছে সিরিয়াবিরোধী পক্ষ, যাদের কেউ কেউ জেনেভা সম্মেলনেও অংশ নিয়েছিল। জেনেভা সম্মেলনে যোগ দিতে বিরোধী দলগুলোর উদ্যোগে একটি ‘হাই নেগোশিয়েশনস কমিটি’ (এইচএনসি) গঠিত হয়েছিল। কিন্তু কমিটির মধ্যেও দ্বন্দ্ব আছে। এইচএনসি সৌদি আরব সমর্থিত। তবে কুর্দিদের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে এখানে দ্বন্দ্ব আছে। বস্তুত ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম হওয়া এইচএনসির কোনো ভূমিকা নেই। তাহলে সমাধানটা হবে কীভাবে? সিরিয়ার পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই জটিল হয়ে পড়েছে। এখানে কার্যত দুটি বড় শক্তির অবস্থান পরস্পরবিরোধী। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টই কুর্দিদের নিয়ে সিরিয়ায় আসাদবিরোদী একটি ফ্রন্ট গড়ে তুলতে চায়। অর্থাৎ আসাদবিরোধী একটি পক্ষকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তার অবস্থান ধরে রাখতে চায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে তুরস্কের সমর্থন না পাওয়া। কুর্দিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহাবস্থান ও সমর্থন তুরস্ক ভালো চোখে দেখছে না। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে, সিরিয়ায় ইরানি প্রভাব কমানো। এক্ষেত্রে সুন্নি ধর্মাবলম্বী তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারাল মিত্র হতে পারত; কিন্তু তা হয়নি। বরং তুরস্ক ও ইরান একধরনের অ্যালায়েন্সে গেছে। রাশিয়া আইএসবিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে ছিল। কিন্তু রাশিয়া চায় না আসাদ অপসারিত হোক। আসাদকে রেখেই রাশিয়া একধরনের সমাধান চায়। এখানে তুরস্কের আপত্তি থাকলেও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুরস্ক আজ রাশিয়ার মিত্র। রাশিয়া নিজ উদ্যোগে সিরিয়ায় একটি রাজনৈতিক সমাধান বের করতে চায়। সেজন্যই সোচিতে সিরিয়ার সব দল ও মতের প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেছিল রাশিয়া, যাকে তারা বলছে ‘সিরিয়ান কংগ্রেস অব ন্যাশনাল ডায়ালগ’। কিন্তু সেখানেও বিরোধ আছে। নানা মত ও পক্ষের প্রায় ১ হাজার ৫০০ প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানান হলেও একটা বড় অংশ এতে অংশ নেয়নি। সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ ‘সিরিয়ান নেগোসিয়েশন কমিশন’ ওই সম্মেলনে অংশ নেয়নি। সিরিয়া সংকটের মূলে রয়েছে সব মত ও পথকে একটি কাঠামোয় আনা। সেখানে সুন্নি, শিয়া, দুর্জ, আলাউট মতাবলম্বীসহ বিভিন্ন সামরিক গ্রুপও রয়েছে। আসাদ সমর্থকরাও একটি পক্ষ। কিছু ইসলামিক গ্রুপও রয়েছে, যারা আইএসের বিরোধিতা করেছিল। সবাইকে নিয়ে একটি সমাধান বের করা সহজ কাজ নয়। যদিও সোচিতে সবাই সিরিয়ার অখ-তা রক্ষায় একমত হয়েছেন। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ধারা ও নির্বাচনের প্রশ্নে সবাই একমত হয়েছেন। তারপরও কথা থেকে যায়Ñ বড় বিরোধী দলের অবর্তমানে ওই সমঝোতা আদৌ কাজ করবে কি না? এ মুহূর্তে বড় প্রশ্ন হচ্ছেÑ তুরস্ক মানবিজ আক্রমণ করবে কি না? মানবিজে কুর্দিদের সঙ্গে আছে মার্কিন সেনা। যদিও এই সংখ্যা খুব বেশি নয়। তুরস্ক যদি মানবিজ আক্রমণ করে, তাহলে তা প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণের শামিল বলে বিবেচিত হবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এ ঝুঁকি নেবেন, নাকি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র মানবিজ থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেবেÑ এ মুহূর্তে তা স্পষ্ট নয়। এটা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।Daily Alokito Ba
04.02.2018

নির্বাচনী রাজনীতি স্বস্তিদায়ক মনে হচ্ছে না

গত ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটে জনসভা করে নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করেছেন। আর খালেদা জিয়া ওই দিন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় হাজিরা দেন। ওই দিন আরও দুটো ঘটনা ঘটেছে। কূটনীতিকদের কাছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবহিত করেছে বিএনপি। বিশেষ করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে, সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেয়া হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। একই দিন ঢাকায় কদম ফোয়ারার মোড়ে বিএনপির মিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলা, ভাংচুর ও প্রিজন ভ্যানের তালা ভেঙে আটক দুই কর্মীকে ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। অর্থাৎ ৩০ জানুয়ারি একটি বড় দলের প্রধান নির্বাচনের প্রচারণা চালিয়েছেন, আর অপর একটি বড় দলের প্রধান মামলায় হাজিরা দিয়েছেন। রাজনীতির এ দৃশ্য কিছুটা হলেও বেমানান।
এরই মাঝে শঙ্কা তৈরি হয়েছে- কী হবে ৮ ফেব্রুয়ারি? ওইদিন খালেদা জিয়ার মামলার রায় দেয়া হবে। এ রায় নিয়েও এখন টানটান উত্তেজনা। কী হতে পারে রায়ে? খালেদা জিয়ার সাজা? খালাস? সাজা হলে দলের কী হবে? এসবই এখন বড় প্রশ্ন। রায় দেবেন আদালত। তথ্য-উপাত্ত, আইন ইত্যাদি বিবেচনা করে বিচারক রায় দেবেন। এই রায়ই চূড়ান্ত রায় নয়। বিচারিক আদালতের রায়ে কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে তিনি বা তারা উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। এরপর আপিল বিভাগে যাওয়ারও সুযোগ আছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত মামলাটি নিঃসন্দেহে একটি স্পর্শকাতর মামলা। এ মামলার মেরিট আছে কী নেই তা বিবেচনায় না নিয়েই কোনো কোনো মন্ত্রী যখন আগেভাগেই বলে দেন, ‘খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হবে’, তখন গুজবের ডালপালা গজায় বৈকি! এ ধরনের বক্তব্য না দেয়াই মঙ্গল, কারণ তা আদালত অবমাননার শামিল।
যা হোক, এ মামলার রায় চলমান রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে। ইতিমধ্যে বিএনপির স্থায়ী পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। এ সিদ্ধান্তের পেছনে বিএনপির নেতারা যে বক্তব্যই দিন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে একাধিক ঝুঁকিতে পড়তে পারে দলটি। তাছাড়া সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যে নির্বাচন করতে পারবেন না, এ ধরনের কোনো সুস্পষ্ট বিধি নেই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জেলে থেকেও নির্বাচন করেছিলেন এবং বিজয়ী হয়েছিলেন। এ ব্যাপারে বিএনপি একটি আইনি ব্যাখ্যা নিতে পারে। সাধারণত নিন্ম আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন থাকে। তাই কেউ সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে এর প্রতিকার চাইতে পারে। সেটাই মঙ্গল। সেটাই শ্রেয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত মামলাটি নিয়ে খুব বেশি মাত্রায় ‘রাজনীতি’ হচ্ছে। এটা নিয়ে বিএনপি যেমন রাজনীতি করছে, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগও রাজনীতি করছে। মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া না দেখালেও পারতেন। একইভাবে একজন শীর্ষ বিএনপি নেতা বলেছেন, ‘সরকারের আদিষ্ট হয়ে যদি আদালত থেকে নেতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত প্রকাশ পায়...।’ তিনি কি এ ধরনের কথা বলতে পারেন? এটাও তো আদালত অবমাননার শামিল। আদালত তো ‘সরকারের আদিষ্ট’ হয়ে কোনো রায় দেন না। এ ধরনের বক্তব্য বিভ্রান্তি বাড়ায়। পুলিশের গাড়িতে হামলা, কর্মী ছিনিয়ে নেয়া, রাইফেল ভেঙে ফেলা(?) ইত্যাদি আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এটা নির্বাচনী বছর। রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকবেই। কিন্তু তা হতে হবে শান্তিপূর্ণভাবে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যদি অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়, তাহলে তা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
একটি ভালো নির্বাচনের পূর্বশর্তই হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, যা ছিল সংবিধানসম্মত। কিন্তু নির্বাচনের পর দেশজুড়ে যে সহিংস ঘটনাবলি জাতি প্রত্যক্ষ করেছিল, বিএনপির রাজনীতিকে তা একটা বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। বিএনপি এক ধরনের ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছিল। সেই থেকে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ৫ জানুয়ারিকে ভিন্ন ভিন্নভাবে পালন করে আসছে। দিনটিকে আওয়ামী লীগ পালন করে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ হিসেবে, অন্যদিকে বিএনপি এ দিনটি পালন করে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতেও আমরা এটা প্রত্যক্ষ করলাম। ফলে এক ধরনের অনিশ্চয়তা থাকলই।
প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর চলমান রাজনীতি এখন কোন দিকে মোড় নেবে? এটা সত্য, সাধারণ মানুষ সহিংসতা পছন্দ করে না। সহিংস আন্দোলন করে যে সরকারের পতন ঘটানো যায় না, সরকারের চার বছর ক্ষমতায় টিকে থাকা এর বড় প্রমাণ। সরকারপ্রধান তার চার বছরের কর্মকাণ্ডের একটা ফিরিস্তি দিয়েছেন তার ১২ জানুয়ারির ভাষণে। তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলেছেন। বুঝতে বাকি থাকে না, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ উন্নয়নের এ কর্মকাণ্ডকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রাক্কালে প্রাধান্য দেবে। কিন্তু বছরের শুরুতে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দুটি বড় দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থান সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে একটি হতাশার জায়গা তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী যেমন ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ ব্যাখ্যা দেননি, তেমনি বিএনপিও ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের’ কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। ধারণা করা যায়, ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ সময় একটি ছোট্ট মন্ত্রিসভা থাকবে। ওই মন্ত্রিসভায় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর প্রতিনিধি থাকবে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সদস্যদের নিয়ে একটি ছোট্ট মন্ত্রিসভা থাকবে। কিন্তু এ মন্ত্রিসভায় বিএনপির থাকার কোনো সুযোগ নেই। কেননা বিএনপি এ মুহূর্তে সংসদে নেই। যে দলটি সংসদে নেই, তার প্রতিনিধিত্ব মন্ত্রিসভায় কীভাবে নিশ্চিত হবে? সাংবিধানিকভাবে এ সুযোগটি নিশ্চিত করতে হলে বিএনপিকে সংসদে আসতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব? এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ৮ ফেব্রুয়ারির রায়ের আগেই পরিস্থিতি যেভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে তাতে করে জনমনে আশঙ্কা বাড়ছে। একটি সংলাপের কথা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হলেও সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এ সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। তাই খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সাজা, বিএনপির নির্বাচন বয়কটের হুমকি আবারও দেশটিকে একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আগামী দিনগুলোয় এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে থাকবে বারবার। দুটি বড় দলই তাদের স্ব স্ব অবস্থানে অনঢ়। এ ক্ষেত্রে জট কীভাবে খুলবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে যা জরুরি তা হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই আস্থার সম্পর্কটি এখন তলানিতে অবস্থান করছে। আস্থার সম্পর্কটি জরুরি এ কারণে যে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অনেক অংশে দু’দলনির্ভর হয়ে পড়েছে। একদলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকে। আওয়ামী লীগ বড় দল। ইউনিয়ন পর্যায়ে এ দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি আছে। অপরদিকে বিএনপি আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তৃতীয় শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির একটি সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু পাঠক লক্ষ করলে দেখবেন, এই দলটি জন্মের পর থেকে যতবার ভাঙনের মুখে পড়েছে, অন্য কোনো দল ততবার ভাঙনের মুখে পড়েনি। অতীতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান কিংবা কাজী জাফর আহমেদ, যারাই দল থেকে (জাতীয় পার্টি) বেরিয়ে গেছেন, তারা রাজনীতির প্রশ্নের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ তথা সুবিধাবাদিতার কারণেই দল থেকে বেরিয়ে গেছেন। এ ক্ষেত্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মূলধারাটি ধরে রেখেছেন বটে, কিন্তু তার অবর্তমানে দলের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটাই দেখার বিষয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ভাঙন এসেছে। তবে মূলধারা থেকে বেরিয়ে গিয়ে কেউই সুবিধা করতে পারেননি। আবদুর রাজ্জাকের মতো নেতা আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে বাকশাল নিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। মূলধারায় ফিরে এসেছিলেন। বিএনপির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ওবায়দুর রহমান ও মান্নান ভূঁইয়া চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। আর নাজমুল হুদা একবার বেরিয়ে গেছেন, আবার ফিরে গেছেন, এখন আবার দলের বাইরে। তার গ্রহণযোগ্যতা কিংবা ক্যারিশমা কোনোটাই নেই। কাজেই মুজিব কিংবা জিয়া পরিবারের বাইরে গিয়ে কেউই সফল হবেন না। আরও একটা কথা- তৃতীয় শক্তি গড়ে ওঠার ব্যর্থতা। বারবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সফলতা আসেনি। আমরা যদি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (১৯৯১) ফলাফল থেকে নবম জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব জাতীয় সংসদ নির্বাচন দুটি বড় দলনির্ভর হয়ে পড়েছে। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ১৪০ আসন, (৪৬.৬৬ ভাগ), আওয়ামী লীগ ৮৮ আসন (২৯.৩৩ ভাগ), জাতীয় পার্টি ৩৫ আসন (১১.৬৬), আর জামায়াত ১৮ আসন (৬ ভাগ)। ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন (৩৭.০৪), বিএনপি ১১৬ (৩৩.৬১), জাতীয় পার্টি ৩২ (১৬.৪), জামায়াত ৩ (৮.৬১)। ৮ম জাতীয় সংসদে (২০০১) বিএনপি ১৯৩ (৪৪.৯৭), আওয়ামী লীগ ৬২ (৪০.১৩), জাতীয় পার্টি ১৪ (৭.২৫), জামায়াত ১৭ (৪.২৮)। ৯ম জাতীয় সংসদে (২০০৮) আওয়ামী লীগ ২৩০ (৪৯), বিএনপি ৩০ (৩৩.২), জাতীয় পার্টি ২৭ (৭), জামায়াত ২ (৪.৬)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভোটাররা সাধারণভাবে দুটো বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ওপর আস্থাশীল। ফলে সংসদীয় রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এ দুটি দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। এই আস্থার সম্পর্ক না থাকলে সংসদীয় রাজনীতি বিকশিত হবে না। গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তাই আগামী দিনগুলো আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, এর আগে আরও কয়েকটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এ দুটি বড় দল অংশ নেবে। ফলে এখানে যদি আস্থার সম্পর্ক গড়ে না ওঠে, তাহলে দেশে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করবে। কিন্তু খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি এখন যেদিকে টার্ন নিচ্ছে, তা দুটো বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। আমাদের শঙ্কাটা এখানেই। উপরন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় পুলিশের ওপর হামলার যেসব ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমরাও এ ধরনের দৃশ্য দেখেছিলাম। বাসে আগুন দেয়া আর বার্ন ইউনিটে অনেক মানুষের আর্তনাদের দৃশ্য এক আস্থাহীনতার সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। সেই রাজনীতি থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারিনি। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা গণতন্ত্রের ‘দ্বিতীয় যাত্রা পথে’ হাঁটতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু গত ২৬ বছরে সংসদীয় রাজনীতি নিয়ে আমরা খুব বেশি দূর যেতে পারিনি। আশাব্যঞ্জক তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিগত ২৬ বছরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী হতে পারত। কিন্তু হয়নি। তাই ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যখন গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ ৮ ধাপ পিছিয়ে পড়ছে বলে জানায়, আমি তাতে অবাক হই না।
সহিংসতা গণতন্ত্র বিকাশের অনুকূল কিছু হতে পারে না। ঠিক তেমনি আস্থার সম্পর্ক না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিতও হয় না। আমরা গণতন্ত্রের ওপর আস্থা রেখেছি। গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছি। কিন্তু পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেইনি। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম। কেননা আমরা মনে করেছিলাম, একটি নিরপেক্ষ সরকার আমাদের একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে পারবে। সেটা দিয়েও ছিল। সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তা গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছিল। কিন্তু আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। পরপর তিনটি সংসদ নির্বাচনের পর আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারত। কিন্তু পারেনি। তাই আবারও প্রশ্ন উঠল দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন। আবার সংবিধান সংশোধন হল। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হল। কিন্তু ওই নির্বাচন (দশম জাতীয় সংসদ) আমাদের জন্য কোনো সুখের বার্তা বয়ে আনেনি। আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই রয়ে গেছি। আস্থাহীনতার সম্পর্ক এত ব্যাপক ও গভীর যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও আবার প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিএনপি যদি সত্যি সত্যিই নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ নির্বাচনের যে দাবি তা নিশ্চিত হবে কীভাবে?
নির্বাচন হতে এখনও বাকি ন’মাস। প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, ‘সহায়ক সরকারের’ দাবি অসাংবিধানিক। এটাই সত্য। আর এ সত্যটা মেনেই বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে। এ ছাড়া বিএনপির কাছে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা আছে বলে আমার মনে হয় না। বিএনপিকে নিয়মতান্ত্রিক পথেই যেতে হবে। পুলিশের গাড়িতে হামলা চালানোর যে অভিযোগ উঠেছে তা এখন বিএনপিকেই কাটিয়ে উঠতে হবে। যদিও মির্জা ফখরুল বলেছেন, যারা মিছিল থেকে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়েছে তারা বহিরাগত। তারা যে সত্যি সত্যিই বহিরাগত তা বিএনপিকেই এখন প্রমাণ করতে হবে। বিএনপির মিছিল থেকে যখন পুলিশের ওপর হামলা হয়, তখন বিএনপি এর দায় এড়াতে পারে না।
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষিত হওয়ার পরপরই রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল, তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। বিএনপিকে ‘পজিটিভ’ রাজনীতিতে আসতে হবে। ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার মামলার রায় যাই হোক না কেন, বিএনপিকে আইনি মোকাবেলা করেই আগামী নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির অনেক বক্তব্য থাকতে পারে। সেসব বক্তব্য নিয়েই বিএনপিকে জনগণের কাছে যেতে হবে। এটা সত্য বিএনপিকে কোর্ট-কাচারি মোকাবেলা করতে হবে। আর কোর্ট-কাচারি মোকাবেলা করেই বিএনপিকে জনগণের কাছে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আমরা চাই একটি স্থিতিশীল রাজনীতি। চাই সন্ত্রাসমুক্ত রাজনীতি। সন্ত্রাসমুক্ত ও স্থিতিশীল রাজনীতিই পারে বাংলাদেশের জনগণকে একটি প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র উপহার দিতে।
Daily Jugantor
03.02.2018