রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

জোট রাজনীতির সহজ পাঠ



নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই নতুন নতুন জোটের জন্ম হচ্ছে। নতুন দলের জন্ম হচ্ছে, যাদের কারোরই নিবন্ধন নেই। সংবাদপত্রগুলোর কেন যেন বেশি আগ্রহ এসব জোটের ব্যাপারে। নাম সর্বস্ব এসব দল নিত্য ঢাকার প্রেসক্লাবে জমায়েত হয়ে সাংবাদিকদের জানান, তারা একটি নতুন দল অথবা জোট গঠন করেছেন। সংবাদপত্রগুলোতে তা ছাপাও হয়। তাতেই তাদের লাভ। সর্বশেষ এই কাজটি করলেন নুরুল আমিন বেপারী। প্রেসক্লাবের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন তারাই ‘আসল বিকল্প ধারা’। জানালেন তারা ডা. বি. চৌধুরী, মেজর (অব.) মান্নান এবং মাহী বি. চৌধুরীকে বহিষ্কার করেছেন। নুরুল আমিন বেপারী আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ান তিনি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি করতেই পারেন। কিন্তু শিক্ষকতায় থেকে একইসঙ্গে তিনি একটি দলের সভাপতি হবেন, তা কী করে সম্ভব?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘আইন- ১৯৭৩’ তো তা অনুমোদন করে না। ওটা তো নৈতিকতার প্রশ্নও বটে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও যখন অনৈতিক কাজ  করেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হয়ে আমার কষ্ট হয়। বেপারী জানালেন তারা সদ্য গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেবেন। চারটি দল নিয়ে ফ্রন্ট গঠিত হয়েছে। এখন অচিরেই আমরা দেখবো ২০-দলের প্রায় সবাই এই ফ্রন্টে যোগ দিয়েছে। এরই মাঝে আবার ন্যাপ ও এনডিপি ২০-দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে বি. চৌধুরীর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা জানিয়ে আরেকটি ফ্রন্ট গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এনডিপি, যাদের পূর্ণ কমিটি আছে কিনা সন্দেহ, দলটি আবার তিন ভাগ হয়ে গেছে।
২০ অক্টোবর সংবাদপত্র আমাদের খবর দিয়েছে যে জনৈক লামিনাল ফিহার নেতৃত্বে ৩৯ দলের সমন্বয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি জোট গঠন করেছে। কষ্ট করে ৩৯টি দলের নাম পড়লাম, জীবনে এই প্রথম আমি এ দলগুলোর নাম শুনলাম। জাতীয় পার্টির (এরশাদ) নেতৃত্বে রয়েছে সম্মিলিত জাতীয় জোট। এই জোটে দলের সংখ্যা ৫৮। সরকারপন্থী ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমানের নেতৃত্বে ১৫টি নাম সর্বস্ব দল ‘ইসলামী গণতান্ত্রিক জোট’ গঠন করেছে। চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের নেতৃত্বে রয়েছে ইসলামী আন্দোলন। বামরা আবার ‘বাম গণতান্ত্রিক জোটের’ ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই জোটে আছে সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ আটটি বামপন্থী দল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে ১৪ দলীয় জোট রয়েছে, সেই জোটের ব্যাপারে আগ্রহ অনেক দলের। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ইসলামি ঐক্যজোট, জাকের পার্টি ও ইসলামিক ফ্রন্ট ১৪ দলীয় জোটে যোগ দিতে চাইছে। এই জোট সম্প্রসারিত হতে পারে এমন আভাস দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দেশে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৩৯। অনিবন্ধিত দলের সংখ্যা একশ’ থেকে দেড়শ’র মতো। মজার ব্যাপার বড় দুই জোটে অনেক অনিবন্ধিত দলও রয়েছে। যেমন ১৪ দলে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা আটটি। ২০- দলীয় জোটে ( এখন ১৮ দল) অনিবন্ধিত দল রয়েছে একাধিক।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই জোটের যে রাজনীতি, তা অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। নাম তথা প্যাড সর্বস্ব এসব রাজনৈতিক দলের জন্ম অতীতে তেমনটি দেখা যায়নি। বড় বড় দলগুলো আবার এদেরকে ব্যবহার করে জোটের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। এতে করে জনসাধারণকে একধরনের ‘বোকা’ বানানো হয়। জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার জন্যই দলের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এতে করে রাজনীতিতে তেমন গুণগত পরিবর্তন আসে না। শুধু মন্ত্রিত্ব কিংবা সংসদ সদস্য হওয়ার আশায় এরা বড় দলে ভিড়তে চায়। চলতি সংসদে এমন একটি দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে, যার নেতার নাম সাধারণ মানুষ এই প্রথম শুনেছে। দুর্ভাগ্য এই জাতির এ ধরনের লোক সংসদে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে! দলের নিবন্ধনও পেয়েছে। আবার ‘এক ব্যক্তি, এক দল’এর বাম নেতা তার জীবদ্দশায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা করলেও শুধু প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। যদিও সংসদীয় নির্বাচনে তিনি কোনোদিন জামানত ফেরত পাননি।
বাংলাদেশে রাজনীতির ধারা মূলত দুটি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি ধারা, অপরটি আওয়ামী লীগ বিরোধী। বিএনপি ও জাতীয়  পার্টি এই ধারায় যুক্ত। যদিও জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে বিভ্রান্তি আছে। এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে বিলীন হয়ে যাবে। বামদের তৃতীয় ধারার প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ ছিল। কিন্তু ভুল রাজনীতি বামদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারেনি। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইসলামপন্থীরা বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলন (তারা এখনো কোনো জোটে নেই) তৃতীয় শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে! স্থানীয় সরকার নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। আগামীতে ইসলামি আন্দোলনের ব্যানারে যদি সকল ইসলামী দল একত্রিত হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
Daily Amader Notun Somoy
22.10.2018

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আমাদের কতটুকু আশাবাদী করে


বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সদ্য গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আমাদের কতটুকু আশাবাদী করে? ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে এই জোটটি গঠিত হয়েছিল কিছুদিন আগে। কিন্তু তারপর কিছুটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে নানা কাহিনী ও মন্তব্য প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। এর কোনোটি ইতিবাচক, কোনোটি নেতিবাচক। নেতিবাচক এই অর্থে যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের একাধিক মন্ত্রী বিরূপ মন্তব্য করেছেন। ‘সিকি-আধুলি’র সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে। তবে এটা সত্য, বিএনপি বাদে এই মুহূর্তে যেসব দল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছে, তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। অনেক দলেরই ৬৪ জেলায় কোনো সংগঠন নেই। উপরন্তু জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে বিকল্পধারা প্রথম থেকে উদ্যোগী হলেও, শেষ মুহূর্তে ‘জামায়াতের প্রশ্নে’ বিকল্পধারা নিজেদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। দলটি ইতোমধ্যে ভেঙে গেছে। তবে এটা সত্য, এতে করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের যে খুব ক্ষতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। আর ইতিবাচক এই অর্থে যে, এখানে যে দলগুলো সংযুক্ত হয়েছে, তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল হলেও ব্যক্তি হিসেবে এবং সরকারবিরোধী হিসেবে এদের ভূমিকাকে ছোট করার কোনো সুযোগ নেই। আ স ম আবদুর রব, কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্নার দলের ভিত্তি দুর্বল সন্দেহ নেই তাতে, কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে তাদের পরিচিতি রয়েছে। একই সঙ্গে ২০-দল থেকে এলডিপি ও কল্যাণ পার্টিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিচ্ছে। কর্নেল (অব.) অলি কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিমেরও ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। সরকারবিরোধী হিসেবে এরা রাজনীতিতে বড় অবদান রেখে আসছেন। ফলে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে এরা যখন একটি ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে তখন এই ফ্রন্ট যে ব্যাপক জনসমর্থন পাবে, তা বলাই যায়। তবে ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচি নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন।
ঐক্যফ্রন্ট ১১ দফা যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, সে ব্যাপারেও অস্পষ্টতা রয়েছে। ১নং লক্ষ্যে সরকার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার কথা বলা হয়েছে। তত্ত্বগতভাবে এটি ভালো প্রস্তাব। কিন্তু বর্তমান সংবিধান তো এই বিষয়টি অনুমোদন করে না। সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা উল্লেখ আছে। এটা সত্য, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা কী করে সম্ভব, কিংবা রাষ্ট্রপতি কী কী ভূমিকা পালন করলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সঙ্গে এক ধরনের ‘চেক্স অ্যান্ড ব্যালেন্স’ হয়, তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা প্রযোজন ছিল। কিন্তু ১১ দফায় তা নেই। ২নং লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদ সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। এটা কতটুকু যুক্তযুক্ত, এ প্রশ্ন করাই যায়। ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’ এখন ৭০ অনুচ্ছেদে যদি সংশোধনী আনা হয়, তা হলে সংসদে ‘হর্স ট্রেডিং’ হবে। অর্থাৎ সংসদ সদস্যরা নানা লোভ-লালসার স্বীকার হয়ে অন্য দলে যোগ দেবেন এবং সরকার গঠন করতে ওই দলকে সাহায্য করবেন। অথবা টাকার বিনিময়ে নতুন দল গঠন করে কোনো দলকে সরকার গঠনে সহযোগিতা করবেন। সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো সংবাদ হতে পারে না। সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব (১০নং লক্ষ্য) কিংবা প্রতিরক্ষা বাহিনীকে যুগোপযোগী করা (১১নং লক্ষ্য)- এসবই সংবিধানে আছে। এখানে নতুনত্ব কিছু নেই। ফলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা ও ১১ দফা এক রকম একটা দায়সারা গোছের কর্মসূচি হয়ে গেছে। বরং আমি খুশি হতাম যদি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আগামী ৫০ বছরের বাংলাদেশকে সামনে রেখে একটা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করত। বাংলাদেশ ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যে বাণিজ্যিক সুবিধা পায়, তা ২০২৭ সালে শেষ হয়ে যাবে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং চীনে বাংলাদেশের বাণিজ্য হ্রাস পাবে প্রায় ১১ ভাগ। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে যে সুবিধা পায়, ২০২৭ সালে তা বাতিল হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কী কর্মসূচি নেওয়া উচিত, তা ফ্রন্টের কর্মসূচিতে থাকা উচিত ছিল। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের এক-তৃতীয়াংশ বেকার। এদের জন্য কী কর্মসূচি নেওয়া উচিত, সে ব্যাপারেও বিস্তারিত থাকা উচিত ছিল, যা নেই। ফলে ৭ দফা ও ১১ দফা নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় যখন এগিয়ে আসছে, তখন নির্বাচন কমিশনে বড় ধরনের দ্বন্দ্বের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। ইসির বিরুদ্ধে বাকস্বাধীনতা হরণের অভিযোগ তুলেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। ‘বাকস্বাধীনতা হরণের’ অভিযোগ তুলে তিনি গত ১৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সভা বয়কট করেছেন। তিনি কমিশনের সভা ত্যাগের আগে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে কমিশনের সভা ত্যাগ করেন। তিনি পাঁচটি বিষয় উল্লেখ করে তা কমিশনের সভায় উপস্থাপনের দাবি করেছিলেন। কিন্তু তা উপস্থাপিত না হওয়ায় তিনি ‘প্রতিবাদ স্বরূপ’ কমিশনের সভা বয়কট করেন। তার ওই পাঁচ দফায় ছিল জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে, তা আগে থেকে নির্ধারণ করা; অংশীজনের সঙ্গে ইসির সংলাপে আসা সুপারিশগুলো নিয়ে তফসিলের আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা; সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা; নির্বাচনকালীন জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ইসির হাতে নেওয়া ইত্যাদি। বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার সুযোগ না পেয়ে তিনি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইসির নিরপেক্ষতাকে একটি প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে। এমনিতেই নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন নিয়ে যখন দাবি উঠেছে, তখন নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে বিরোধ নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তিকে একটি প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে। ইতোমধ্যে জানা গেছে, চলতি মাসেই মাহবুব তালুকদার ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্র গেছেন। তার এই ‘ছুটিতে যাওয়ার’ বিষয়টিও নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে এখন। নির্বাচনের আগে তিনি আর দেশে ফিরে আসবেন না, কিংবা তিনি বিদেশ থেকে পদত্যাগ করতে পারেন- এমন খবরও বাজারে চাউর হয়েছে। নির্বাচনের আগে এসব ‘ঘটনা’ যে রাজনীতিতে বার বার আলোচিত হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইতোমধ্যে দুটি দল ন্যাপ ও এনডিপি ২০-দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেছে। এই দল দুটি প্যাডসর্বস্ব। এদের আদৌ কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। এতে করে ২০-দলীয় জোটে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে না। ২০-দলীয় জোটের মূলশক্তি হচ্ছে বিএনপি। বিএনপি সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, তারা ২০-দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। বিএনপির এই সিদ্ধান্ত সঠিক ও যৌক্তিক। তবে বিএনপি বড় দল। দলটিকে বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারা যদি ফ্রন্টের তথা ২০-দলের রাজনীতি ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার চেষ্টা করে, তাহলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। বিএনপিকে এখন ‘লো-প্রোফাইল’ রাজনীতি গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল/জোট থাকা দরকার। জোট রাজনীতি বাংলাদেশের বাস্তবতা। সুতরাং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যদি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়, বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির জন্য তা হবে মঙ্গল। এর মধ্য দিয়ে দেশে একটি সুস্থ রাজনীতি চর্চাও শুরু হতে পারে। তবে সরকার যদি দমননিপীড়ন অব্যাহত রাখে, তাহলে নির্বাচন নিয়ে যে প্রত্যাশার জন্ম হয়েছে, তা ‘মিইয়ে’ যেতে পারে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একটি বড় প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে। ফ্রন্ট তাদের প্রথম কর্মসূচি হিসেবে স্থানীয় একটি হোটেলে বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। তাদের এই ‘মতবিনিময়’ও সমালোচিত হয়েছে। অভিযোগ করা হচ্ছে যে, যেখানে ঐক্যফ্রন্টের জনগণের কাছে যাওয়া উচিত, সেখানে তারা তা না করে বিদেশিদের কাছে ‘ধরনা’ দিয়েছেন! আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা একটা খারাপ দিক। এই ‘ঘটনা’ অতীতেও হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
বিদেশি দূতাবাস, বিশেষ করে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই ‘সকল দলের অংশগ্রহণমূলক’ একটি নির্বাচনের কথা বলে আসছে। ‘সকল দল’ বলতে তারা আসলে বোঝাতে চাচ্ছে বিএনপিকে। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ নেয়নি এবং এর আগে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, বেগম জিয়ার মুক্তি ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। বেগম জিয়া আইনি প্রক্রিয়ায় এখনো জেল থেকে মুক্তি পাননি। চিকিৎসার জন্য তিনি এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আছেন। দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দন্ডপ্রাপ্ত ও বিদেশে অবস্থান করছেন। এমনি এক পরিস্থিতিতে বিএনপি ড. কামাল হোসেন ও অন্যদের সঙ্গে নিয়ে ‘ঐক্য’ করেছে। এটা বিএনপির একটা কৌশল। এই ‘কৌশলটি’ অবলম্বন করেই বিএনপি এখন নির্বাচনে যাবে! এক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে সবার জন্য তা মঙ্গল। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি ‘বার্তা’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া বর্নিকাট ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করে এই ‘বার্তাটি’ পৌঁছে দেন (যায় যায় দিন, ১৯ অক্টোবর)। বার্নিকাট সেতুমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাশা করে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে (ওই)।’ এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ ও ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন। সরকারের লাভটা এখানেই যে, বিএনপি এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচনের পথে হাঁটছে। তাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সব ধরনের সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করা প্রযোজন। সিলেটে ২৩ অক্টোবর ফ্রন্ট জনসভা করার অনুমতি চেয়েও পায়নি। ২৪ অক্টোবর তাদের জনসভা করার কথা। ফ্রন্টকে জনসভা করতে দিলে বরং সরকারের ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল হবে। সরকার হার্ডলাইনে গেলে ভিন্ন মেসেজ পৌছে যাবে মানুষের মাঝে। যা কিনা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে পারে। এদিকে আগামী নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ২০ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত এক সভায় তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন হবে কি হবে না- আমরা জানি না। একটি দল পাঁচ দফা দিয়েছে। বর্তমান  সংবিধান অনুযায়ী তা মানা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় আগামী দিনগুলো নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের শঙ্কা রয়েছে (বাংলা ট্রিবিউন)। এরশাদ যখন নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন, তখন একটি সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সব মিলিয়ে এরশাদ নির্বাচন নিয়ে যে শঙ্কার কথা বলেছেন, তা নিয়ে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। বিএনপির অনেক সীমাবদ্ধতা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভূমিকাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এখন দেখার পালা ঐক্যফ্রন্ট সাধারণ মানুষের এই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারে।
Daily Bangladeher Khobor
23.10.2018

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়ছে

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়ছে। গেল সপ্তাহে ভারত বেশ কয়েকটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। একই সঙ্গে অনেকটা নীরবে প্রতিরক্ষা বাহিনী আধুনিকীকরণও করে ফেলেছে ভারত। এসব কারণে পাকিস্তানের নয়া সরকার যে এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট একটি বিরূপ মন্তব্যও করেছেন। পাকিস্তানের নয়া প্রেসিডেন্ট আলফি মন্তব্য করেছেন এভাবে যে, ভারতের ‘আক্রমণাত্মক আচরণ’ দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে। তিনি আরও অভিযোগ করেন, কিছু দেশ ভারতকে অতিরিক্ত সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে। ভারত ফ্রান্সের সঙ্গে রাফাল চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। পৃথিবীর সেরা যুদ্ধবিমানগুলোর অন্যতম হচ্ছে এ রাফাল। ভারত রাশিয়া থেকে এস-৪০০ মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করছে। মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানগুলোর আধুনিকীকরণের কাজও সেরে ফেলেছে ভারত। ফলে পাকিস্তান যে এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। শুধু পাকিস্তান কেন, চীনও ভারতের সামরিক সজ্জাকে ভালো চোখে দেখছে না। সম্প্রতি মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চীনাপন্থি হিসেবে পরিচিত ইয়ামিন হেরে গেছেন। এর পেছনে ভারতের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। এটা চীনের জন্য একটা ‘সেটব্যাক’। মালদ্বীপে ভারত ও চীনের স্বার্থ রয়েছে। মালেতে একটি বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য ভারতের একটি কোম্পানি কন্ট্র্রাক্ট পেয়েছিল; কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন সে চুক্তিটি বাতিল করে একটি চীনা কোম্পানিকে দিয়েছিলেন। চীন সেখানে বিশাল বিনিয়োগ করছে। ডিসেম্বরে (২০১৭) চীনের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। চীন যে ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করেছে, সেখানে মালদ্বীপের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ‘মুক্তার মালা’ নীতির মাধ্যমে চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চায়। এতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়টি সমুদ্রবন্দর ‘কানেক্টেড’ থাকবে এবং চীন তা তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, পাকিস্তানের গাওদারে (বেলুচিস্তান) ও শ্রীলঙ্কার হামবানতোতায় চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা চীনের হাতে। ভারত এ বিষয়টিকে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলেই মনে করে। হামবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতির রেশ ধরে শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তন পর্যন্ত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘চীনঘেঁষা’ নেতা সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে পরাজিত (২০১৬) হয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি রাজাপাকসে আবারও পাদপ্রদীপের আলোতে এসেছেন। তিনি আগেই সংসদ নির্বাচন দাবি করেছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সিরিসেনাকে ভারতঘেঁষা বলে মনে করা হয়। সিরিসেনা শ্রীলঙ্কায় চীনা প্রভাব কমাতে চাচ্ছেন। ভারতের নীতিনির্ধারকরা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, তারা এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি ‘সহ্য’ করবেন না। ভুবনেশ্বর আইওআর সম্মেলনে (২০১৫) এ মেসেজটিই তারা দিয়েছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নয়া দিক। সিসিলি ও মরিশাসের সঙ্গে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ও এ দুটি দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় প্রভাব বাড়ানো এবং ভবিষ্যতে এ ‘জাফনা কার্ড’ ব্যবহার করা প্রমাণ করে ভারত ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, ভারত প্রাচীনকালে তার ‘কটন রুট’ ব্যবহার করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা বিকাশে ভারতীয় প-িতরা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌবাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। ওই সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারতীয় নৌবাণিজ্যের যে প্রাচীন রুট তাতে দেখা যায়Ñ ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, মিশর, আফ্রিকার মাদাগাস্কার, আবার অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা হয়ে সুমাত্রা, জাভা (মল্লিকা প্রণালি), হংকং, জাপান পর্যন্ত ভারতীয় বাণিজ্য রুট সম্প্রসারিত ছিল। মোদি সরকার এ ‘কটন রুট’কেই নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চায়। প্রাচীনকালে ভারতীয় তুলা তথা সুতি এ সমুদ্রপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। একদিকে চীনা নেতা শি জিন পিং তার ‘সিল্ক রুট’-এর ধারণা নিয়ে ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্ব যেমন প্রতিষ্ঠা করতে চান, এর প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত তার পুরোনো ‘কটন রুট’-এর ধারণা প্রমোট করছে। দ্বন্দ্বটা তৈরি হয়েছে সেখানেই। বাণিজ্যনির্ভর এ দ্বন্দ্ব শেষ অবধি পরিণত হবে সামরিক দ্বন্দ্বে। চীন তার নৌবহরে বিমানবাহী জাহাজ আরও বাড়াচ্ছে। ভারতও ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনী শক্তিশালী করছে। আন্দামানে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে।
বলা হয়, একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তিÑ চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি! জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপানেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে, যা চীনের স্বার্থের বিরোধী। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলেছেন, তা অন্য চোখে দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, এতে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃক প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এ ‘সিল্ক রোড’টি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ ‘সিল্ক রোড’-এর মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য, সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি মেরিটাইম সিল্ক রুটের কথাও আমরা জানি, যা চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চীন থেকে সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে চীনারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, মালয়েশিয়ায় এসেছিল। পরে তারা স্থায়ী হয়ে যায়, এমন কথাও বলা হয়Ñ ব্রুনাইয়ে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে চীনাদের অবদান ছিল বেশি। ২০১২ সালে আমি তুরস্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে চীনাদের এ সিল্ক রুটের আগ্রহের কথা জানতে পারি। এ সিল্ক রুটের যে অংশ তুরস্কে পড়েছে, আমি সে পথ ধরেও বেশ কিছুটা পাড়ি দিয়েছি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং তার প্রথম সফরে কাজাখস্তানে গিয়ে ঐতিহাসিক পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছিলেন। এর পরের মাসে ইন্দোনেশিয়ার পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে তিনি দ্বিতীয় ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’-এর কথাও বলেন। এতে একটা ধারণার জন্ম হয় যে, চীন শুধু মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিশাল এক অর্থনৈতিক সংযোগ কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। ইরানে যে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, এটা নিশ্চয়ই অনেক পাঠকই জানেন। এখন যে প্রশ্নটি অনেক পর্যবেক্ষকই করেন, তা হচ্ছে চীনের এ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর নীতি ভারতীয় স্বার্থের সঙ্গে কতটুকু সাংঘর্ষিক। কেননা, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার নিজস্ব মডেলে ‘ভারতীয় মনরো ডকট্রিন’-এর কাঠামো গড়ে তুলছে। অর্থনৈতিক প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় দ্বন্দ্ব তাই অনিবার্য। ‘ছায়াযুদ্ধ’-এর ধারণাটা তাই এখান থেকেই তৈরি হয়েছে। এ ‘ছায়াযুদ্ধ’ ও যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সিরিয়ায় পাঠকরা চতুর্ভুজ উদ্যোগ বা ছঁধফৎরষধঃবৎধষ ওহরঃরধঃরাব-এর কথা স্মরণ করতে পারেন। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এ উদ্যোগটি নিয়েছে। বলা হচ্ছে, এ উদ্যোগ চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর বিকল্প। এর অর্থ হচ্ছে, চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’-এর জন্ম হচ্ছে, আর এতে যোগ হচ্ছে চার শক্তি। দোকলামের ঘটনা (২০১৭) নিশ্চয়ই পাঠক স্মরণ করতে পারেন, যেখানে চীন ও ভারতের সেনাবাহিনী একটি ‘যুদ্ধ’-এর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। একই সঙ্গে অরুণাচল, অন্যদিকে কাশ্মীরÑ দুটি বিষয় নিয়েও দুই দেশের মাঝে দ্বন্দ্ব আছে। মাঝেমধ্যে চীন অরুণাচল নিয়ে তার দাবি উত্থাপন করলেও সেখানে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রয়েছে। বিতর্কিত কাশ্মীরের ওপর দিয়ে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের সড়ক পথটি চলে গেছে, যা বেলুচিন্তানের গাওদারে গিয়ে শেষ হয়েছে। এ সড়কপথের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। এ দুটি বিষয় বাদ রেখেই গেল বছর দোকলাম উপত্যকার কর্তৃত্ব নিয়ে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকুকÑ আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি। যদি দোকলাম নিয়ে উত্তেজনা অব্যাহত থাকে, তাতে সুবিধা পাবে তৃতীয় পক্ষ। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে ভারতের অনুদান তহবিল থেকে বার্ষিক বাজেটের বাইরে আরও ২০ হাজার কোটি রুপি দাবি করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। শুধু তা-ই নয়, আগামী ৫ বছর প্রতিরক্ষা বরাদ্দ বাড়িয়ে ২৬ লাখ ৮৪ হাজার কোটি রুপি করারও আবেদন করেছে মন্ত্রণালয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও ২ লাখ ৭৪ হাজার ১১৩ কোটি রুপি বরাদ্দ দিয়েছিল, যা জিডিপির ১ দশমিক ৬২ শতাংশ। ভারত নয়াদিল্লি ও মুম্বাইয়ে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে করেই বোঝা যায়, নয়াদিল্লির ভয়টা আসলে পাকিস্তানকে নিয়ে নয়, বরং চীনকে নিয়েই। ভারত এখন চুক্তির ফলে নিজেরাই এফ-১৬ বিমান তৈরি করবে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও তারা কিনছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এটা তো ঠিক, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ‘মিত্র’ হিসেবে চাইছে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে পাশের দেশগুলোর যে বিবাদ, তাতে চীনের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি ভারত। এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বই শেষ পর্যন্ত দোকলামে দুইপক্ষকে যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এখানে মেসেজটি স্পষ্ট। ভারত ও চীন কেউ কাউকে ‘ছাড়’ দিতে চায় না। উভয় দেশই দক্ষিণ এশিয়ার স্থানীয় সমস্যায় সুবিধা নিতে চায়। এখানে বলতেই হয়, চীনের অবস্থান কিছুটা শক্তিশালী। পাকিস্তানের পর মালদ্বীপে বড় স্বার্থ ছিল চীনের। এখন মালদ্বীপে চীনের স্বার্থ ক্ষুণœ হতে চলেছে। কিন্তু ভারতপন্থি একজন প্রেসিডেন্ট সেখানে দায়িত্ব নিলেও চীনের যে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, সে ব্যাপারে কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাকে হত্যা করতে চাচ্ছে! এটা একটা গুরুতর অভিযোগ। এর পেছনে সত্যতা যাই থাকুক না কেন, মালদ্বীপে সরকার পরিবর্তনের পর ভারতের ভূমিকা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো পাকিস্তানের উদ্বেগ। ভারতের সমরসজ্জা এখন দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দেয় কি নাÑ সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Alokito Bangladesh
22.10.2018

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও চলমান রাজনীতির চালচিত্র

প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর অনেক প্রশ্ন এখন আলোচিত হচ্ছে। এবং নিশ্চিত করেই বলতে পারি, এ প্রশ্নগুলো এখন রাজনীতির ময়দানকে আরো উত্তপ্ত করবে। তবে সবচেয়ে কঠোর সমালোচনাটি এসেছে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে। ১৪ অক্টোবর শিবচরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘খুচরা আধুলি’ নিয়ে ঐক্য করেছেন ড. কামাল (কালের কণ্ঠ)। প্রধানমন্ত্রী হয়তো এ কথাটাই বলতে চেয়েছেন যে যাদের নিয়ে কামাল হোসেন ঐক্য করেছেন, তাদের গণভিত্তি তেমন নেই। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে প্রশ্ন তো আছে অনেক। এই ঐক্য কি শেষ পর্যন্ত একটি নির্বাচনী ঐক্যে পরিণত হবে? এ ক্ষেত্রে আসন ভাগাভাগি হবে কিভাবে? দ্বিতীয়ত, বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয় ঐক্যজোট রয়েছে। এই ২০ দলের ভূমিকা এখন কী হবে? তাহলে কি ২০ দল প্লাস জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একটি নির্বাচনী প্ল্যাটফর্ম হবে? তৃতীয়ত, ড. কামাল হোসেন কি শেষ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীকে মেনে নিলেন? চতুর্থত, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার মধ্য দিয়ে কি বিএনপি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে প্রকারান্তরে ‘মাইনাস’ করল? পঞ্চমত, নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি যে ‘এক্সিট রুট’ খুঁজছিল, তা কি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হলো?
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে ২০ দলীয় জোটে অস্বস্তি ছিল। বিশেষ করে এলডিপি ও কল্যাণ পার্টির এক ধরনের অস্বস্তি ছিল। আপাতত এই অস্বস্তি কিছুটা কাটিয়ে ওঠা গেলেও নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে ততই নানা ‘প্রশ্ন’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আসনবণ্টন নিয়েই অসন্তোষ বাড়বে। বিএনপি বড় দল। দলটির নেতা ও কর্মীরা দীর্ঘদিন মামলা-মোকদ্দমা মোকাবেলা করে এখনো ‘রাজনীতি’ করে আসছে। এটা ঠিক, নেতাকর্মীরা খুব একটা সক্রিয় ছিল না আন্দোলনে। মাঠপর্যায়ে তাদের নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে। শত শত মামলা হয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। তাদের একটা বড় অংশ জেলা-উপজেলায় টিকতে না পেরে ঢাকায় আশ্রয় নিয়ে আছে। সুতরাং নেতৃপর্যায়ের অনেকেই এবার দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত ছোট ছোট দল অযাচিতভাবে ‘প্রার্থী পদ’ চেয়ে বসতে পারে। এতে তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপির মতো বড় দল। বড় আপত্তি উঠবে এলডিপি ও কল্যাণ পার্টির পক্ষ থেকে। এই দলগুলো দীর্ঘদিন বিএনপির পাশে থেকে ‘সংগ্রাম’ করে আসছে। তারা স্বাভাবিকভাবেই বেশি আসন চাইবে। ফলে আসনবণ্টন নিয়ে সংকট তৈরি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। ঐক্যফ্রন্ট করে অন্তত আ স ম আবদুর রব কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্না তাঁদের নিজেদের ‘আসন’ দুটি নিশ্চিত করতে পারলেন। কেননা তাঁদের দুজনের নির্বাচনী আসনে (লক্ষ্মীপুর ও বগুড়া) শক্তিশালী বিএনপির প্রার্থী রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপির সমর্থন পেলে নিঃসন্দেহে তাঁদের ‘বিজয়’ লাভ সহজ হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে ড. কামাল হোসেন থাকলেও তিনি নির্বাচন করবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। কেননা তাঁর নিজের কোনো নির্বাচনী এলাকা নেই। ঢাকার মিরপুর অথবা মগবাজার তাঁর নির্বাচনী এলাকা হতে পারে। কিন্তু এই আসন দুটি তাঁর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাহলে বিএনপি যেখানে জনপ্রিয় (বগুড়া), সে ধরনের একটি নির্বাচনী এলাকায় তিনি প্রার্থী হবেন, নাকি বয়সের কারণে তিনি নির্বাচন করবেন না? তাহলে ঐক্যফ্রন্টের নেতা কে হবেন? বিএনপির তিন থেকে চার নেতা মূলত যৌথভাবে দলটি চালাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে, এমন কথাও শোনা যায়। সুতরাং এখানেও একটা সমস্যা আছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে জামায়াতের কী ভূমিকা হবে, তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। তবে জামায়াতের নেতৃত্ব ফ্রন্টের সভায় থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু তারা প্রার্থী হতে চাইবে। এ ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে স্থানীয় জামায়াত নেতারা প্রার্থী না হয়ে জামায়াত সমর্থকদের প্রার্থী দাবি করতে পারেন। এতে বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হতে পারবেন না। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই বিএনপিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এটা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই। আবারও নির্বাচন ‘বয়কট’ করার শক্তি ও সামর্থ্য বিএনপি রাখে না। ফলে বিএনপির জন্যও এ ধরনের একটি ঐক্যফ্রন্টের প্রয়োজন ছিল। এখন ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে। এতে  একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যে সনাতন সংসদের যে ‘চিত্র’, তা বদলে যেতে পারে। পঞ্চম জাতীয় সংসদের পর থেকেই এমন একটি সংসদীয় রাজনীতির চিত্র আমরা পাচ্ছি, যেখানে সংসদ বর্জন একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে অভাবনীয় এক ‘ঐক্য’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে দুই বড় দল সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছিল। বিএনপি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে আস্থাশীল থাকলেও, বৃহত্তর স্বার্থে সংসদীয় রাজনীতি সমর্থন করেছিল। কিন্তু এই সংসদীয় রাজনীতি ঠিকমতো কাজ করছিল না। সংসদ বয়কট, আস্থাহীনতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ইত্যাদি বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির যাত্রাপথকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। এর চূড়ান্ত পরিণতি ২০১৪ সালে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন। বেশ কয়েক বছর ধরে দোষারোপের যে রাজনীতি শুরু হয়েছে, তার ব্যাপ্তি বেড়েছে বৈ কমেনি। সুতরাং ২০১৮ সালে এসে একটা সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে সংসদকে ঠিকমতো কাজ করতে দেওয়ার। ড. কামাল হোসেনের মতো লোক যদি সংসদে আসেন, তাহলে বিরোধী দলের রাজনীতির চিত্র বদলে যেতে পারে। বন্ধ হতে পারে সংসদ বয়কটের সংস্কৃতি এবং সেই সঙ্গে দোষারোপের রাজনীতি। তবে আমি আরো খুশি হতাম যদি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের প্রস্তাবিত সাত দফা আরো স্পষ্ট করত।
সাত দফায় বেশ কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে; যেমন—১ নম্বর দফায় রয়েছে মূলত দুটি দফা। সরকারের পদত্যাগের কথা বলা হয়েছে। এটা সংবিধানসম্মত নয়। সব দলের আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সব দল এ ব্যাপারে যে একমত হবে তার যেমন গ্যারান্টি নেই, ঠিক তেমনি সংবিধানসম্মতভাবে এই সরকার কিভাবে করা সম্ভব তার একটি ব্যাখ্যা থাকা উচিত ছিল। ড. কামাল হোসেন নিজে একটা ফর্মুলা দিতে পারতেন। শুধু দাবি জানালে সরকার মেনে নেবে, তা মনে হয় না। ২ নম্বর দফায় রয়েছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন। নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র আড়াই মাস। এই স্বল্প সময়ে এটা কি আদৌ সম্ভব? উপরন্তু সরকারি দল বড় দল। তারা কি এ ধরনের কোনো প্রস্তাবে রাজি হবে? কিংবা সরকারকে কি বাধ্য করানো সম্ভব হবে? বিএনপি তো তা পারেনি। এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পারবে বলেও মনে হয় না। বরং নির্বাচন কমিশন কিভাবে নিরপেক্ষ থাকবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট একটা সুপারিশ থাকা উচিত ছিল। ৩ থেকে ৭ নম্বর দফা পর্যন্ত যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, তা খুবই সাধারণ। সরকার এসব দাবি মেনে তাদের আন্তরিকতা প্রকাশ করতে পারে। এতে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
ঐক্যফ্রন্টের ১১ দফা যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, সে ব্যাপারেও অস্পষ্টতা রয়েছে। ১ নম্বর লক্ষ্যে সরকার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার কথা বলা হয়েছে। তথ্যগতভাবে এটা ভালো প্রস্তাব। কিন্তু বর্তমান সংবিধান তো এ বিষয়টি অনুমোদন করে না। সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা উল্লেখ আছে। এটা সত্য, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য কী করে সম্ভব কিংবা রাষ্ট্রপতি কী কী ভূমিকা পালন করলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সঙ্গে এক ধরনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ হয়, তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ১১ দফায় তা নেই। ২ নম্বর লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। এটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, এ প্রশ্ন করাই যায়। ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’ এখন ৭০ অনুচ্ছেদে যদি সংশোধনী আনা হয়, তাহলে সংসদে ‘হর্স ট্রেডিং’ হবে। অর্থাৎ সংসদ সদস্যরা নানা লোভ-লালসার শিকার হয়ে অন্য দলে যোগ দেবেন এবং সরকার গঠন করতে ওই দলকে সাহায্য করবেন। অথবা টাকার বিনিময়ে নতুন দল গঠন করে কোনো দলকে সরকার গঠনে সহযোগিতা করবেন। সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো সংবাদ হতে পারে না। সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব (১০ নম্বর লক্ষ্য) কিংবা প্রতিরক্ষা বাহিনীকে যুগোপযোগী করা (১১ নম্বর লক্ষ্য) এ সবই সংবিধানে আছে। এখানে নতুনত্ব কিছু নেই। ফলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা ও ১১ দফা একরকম একটা দায়সারা গোছের কর্মসূচি হয়ে গেছে। বরং আমি খুশি হতাম যদি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আগামী ৫০ বছরের বাংলাদেশ সামনে রেখে একটা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করত। বাংলাদেশ ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যে বাণিজ্যিক সুবিধা পায়, তা ২০২৭ সালে শেষ হয়ে যাবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং চীনে বাংলাদেশের বাণিজ্য হ্রাস পাবে প্রায় ১১ শতাংশ। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ওষুধশিল্পে যে সুবিধা পায়, ২০২৭ সালে তা বাতিল হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কী কর্মসূচি নেওয়া উচিত, তা ফ্রন্টের কর্মসূচিতে থাকা উচিত ছিল। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের এক-তৃতীয়াংশ বেকার। তাদের জন্য কী কর্মসূচি নেওয়া উচিত সে ব্যাপারেও বিস্তারিত থাকা উচিত ছিল, যা নেই। ফলে সাত দফা ও ১১ দফা নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই।
তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। মিডিয়া এই ফ্রন্টকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এখন দেখার পালা ফ্রন্টের নেতারা জনগণের এই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করেন। ড. কামাল হোসেনের বয়স হয়েছে। শারীরিক অসুস্থতাও রয়েছে। এই অসুস্থতা নিয়ে তিনি ফ্রন্টের পক্ষ হয়ে কতটুকু গণসংযোগ করতে পারবেন—সে প্রশ্ন আছে। বিএনপি বড় দল। এখন তারা যদি ফ্রন্টের রাজনীতি ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার চেষ্টা করে, তাহলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। বিএনপিকে এখন ‘লো প্রফাইল’ রাজনীতি গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল বা জোট থাকা দরকার। জোট রাজনীতি বাংলাদেশের বাস্তবতা। সুতরাং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যদি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়, বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির জন্য তা হবে মঙ্গল। এর মধ্য দিয়ে দেশে একটি সুস্থ রাজনীতির চর্চাও শুরু হতে পারে।
Daily kalerkontho
21.10.2018

মাইকেল থেকে তিতলি : বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়

শেষ অব্দি বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় না ঘটিয়েই সামুদ্রিক ঝড় ‘তিতলি’ বাংলাদেশ অতিক্রম করে গেছে। ‘তিতলি’ আঘাত হেনেছে ভারতের উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ আর পশ্চিমবঙ্গে। প্রায় একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় সামুদ্রিক ঝড় ‘মাইকেল’ সেখানে আঘাত হেনে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটিয়েছে। মাইকেল কিংবা তিতলির মতো সামুদ্রিক ঝড় সিডর (২০০৭), আইলা (২০০৯), নারগিস (২০০৮), বিজলি (২০০৯) ইত্যাদির সঙ্গে আমরা মোটামুটিভাবে পরিচিত। প্রতিবছরই এই সামুদ্রিক ঝড় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটায়। বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। এর ফলে জন্ম হচ্ছে এসব সামুদ্রিক ঝড়ের। বিশ্বের উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল প্যারিসে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। পরের বছর জাতিসংঘ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে স্বাক্ষর করেছিল ১৭০টি দেশ। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র এই কপ-২১ চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ায় এই চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে এক এক গ্রুপভুক্ত দেশের এক এক এজেন্ডা। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি, তার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেক্স-১-এ অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগ এই দেশগুলোর। অথচ লোকসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ১৯ ভাগ। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশি, শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ-৭৭-এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ, জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ। কিন্তু কার্বন উিগরণ করে ৪২ ভাগ। আবার সাগর পারের দেশগুলো, যারা বিশ্বের জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ১ ভাগ, তাদের দাবি ছিল ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো, যারা ‘রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন’ হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ্ব জনগোষ্ঠীর ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ ভাগ তাদের। আর মাত্র ৪ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ ভাগ, জিডিপির ৩০ ভাগ তাদের। অথচ জনসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ৫ ভাগ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ ভাগ ও জনসংখ্যার ৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ ভাগ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ ভাগ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ ভাগ তাদের। প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটাকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। অর্থাৎ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উিগরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিন হাউজ গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে, এই হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিত- এটা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে, সে প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সঙ্গে ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়, সে কারণে এই দুটো দেশের কাছ থেকে ‘কমিটমেন্ট’ আশা করেছিল বিশ্ব। কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিল, ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চাইতে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল তারা ১৭ ভাগ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২.৮৫ টন, আর ভারতের ১.৮ টন। চীন ও ভারত দুটো দেশই বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে এই শতাব্দীতেই। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় তখন ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ, ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। তবে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ ভাগ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়- তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কেননা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। আর তাতে করে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৯০ সালের কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ৭ শতাংশ, জাপান ৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা ছিল। তা ছাড়া সার্বিকভাবে ৫.২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল সব দেশকে ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে রুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজ-কলমে থেকে গিয়েছিল। তবে প্যারিসে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু এই চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে ক’টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি ৭ জনে ১ জন আগামীতে উদ্বাস্তু হবে। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেন হেগেন ‘কপ’ সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি। অতীতে ‘কপ’ (COP)-এর দোহা সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা হবে যাতে এই দেশগুলো জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলা করতে পারে। উন্নত বিশ্ব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের, যেখান থেকে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ১৩০ মিলিয়ন ডলার। বলা হয়েছিল জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলায় পশ্চিমা বিশ্ব উন্নয়নশীল বিশ্বকে প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করবে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতিও রাখেনি পশ্চিমা বিশ্ব। ফলে প্যারিসে যে সমঝোতা হয়েছিল (২০১৫), তা নিউইয়র্কে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে কতটুকু কার্যকর হবে, সে প্রশ্ন থাকলই। মার্কিন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পরিবেশবিদ আল গোর নিজে একটি প্রবন্ধে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ ২ থেকে আড়াই কোটি বাংলাদেশিকে অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে। এর অর্থ প্রচুর মানুষ হারাবে তাদের বসতি, তাদের পেশা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া মানে কেবল বন্যা নয়, এর মানে নোনা পানির আগ্রাসন। সেই সঙ্গে ধানের আবাদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। ২ কোটি কৃষক, জেলে পেশা হারিয়ে শহরে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে এসে নতুন নতুন বস্তি গড়ে তুলবে। রিকশা চালানোর জীবন বেছে নেবে। সৃষ্টি হবে একটি শ্রেণির, যারা শহুরে মানুষের ভাষায় ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’। এই জলবায়ু উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনীতি হবে! বিদেশে অর্থ সাহয্য চাওয়া হবে। ইতোমধ্যে প্রাপ্ত সাহায্যের ব্যবহার নিয়ে নানা অনিয়মের খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই সরকার এমন অনিয়ম রোধ করতে পেরেছে। ২০১৬ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল বটে, কিন্তু চুক্তির কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায়, বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে এই চুক্তি কতটুকু কার্যকার হয়, তা নিয়ে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকেই গেল।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। একাধিক গবেষণায় তা প্রমাণিতও। তিন বছর আগে একটি শঙ্কার কথা আমাদের জানিয়েছিল এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবি। বাংলাদেশ এই জলবায়ু পরিবর্তনে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এডিবির রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এডিবি জানিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ করে কম হতে পারে। আর চলতি শতাব্দী শেষে এই ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৯ শতাংশ। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এডিবির ওই রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটো দেশ নেপাল ও মালদ্বীপের ক্ষতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। গত ১৯ আগস্ট (২০১৪) ঢাকায় এডিবির এই রিপোর্টটি উপস্থাপন করা হয়েছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শুধু এডিবির রিপোর্টেই নয়, বরং জাতিসংঘের রিপোর্টেও এই ক্ষতির দিকটি উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতিবছরই জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা কপ বা ‘কমিটি অব দ্য পার্টিস’ নামে পরিচিত, সেখানেও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা উঠে আসে। বাংলাদেশের যারাই পরিবেশমন্ত্রী থাকেন, তারা ঘটা করে ‘কপ’ সম্মেলনে যান। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইতোমধ্যে নাসা আরো একটি আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। নাসা আশঙ্কা করছে গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে, তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তাই কার্বন-ডাই-অক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। আল গোর তার ওই প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, বিশ্বের বৃহত্তম বন্দরগুলোয় ইতোমধ্যে ৪ কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর বিশ্বের ১০৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে (বাংলাদেশের সাবেক বনমন্ত্রী হাসান মাহমুদও ছিলেন ওই দলে) গিয়েছিলেন অ্যান্টার্কটিকায়, শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটি সিদ্ধান্ত, যেখানে তিনি বলেছেন, তিনি জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। তিনি এখন আর জলবায়ু চুক্তিতে নেই। জলবায়ু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র না থাকার ফলে জলবায়ু চুক্তিটি একটি প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিয়ন শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতিসংঘের দ্য ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আইপিসিসির বিশেষ অধিবেশন। একটি প্রতিবেদনও তারা প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, বৈশিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা না গেলে বিপর্যয় দেখা দেবে। সম্মেলনে ওয়ার্কিং গ্রুপের সহ-সভাপতি ডেব্রা রবার্টস বলেছিলেন, বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে এটাই সবচেয়ে ঝড় সতর্কবার্তা। এই মুহূর্ত থেকে সবাইকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। সর্বশেষ ‘মাইকেল’, ‘তিতলি’ কিংবা ইন্দোনেশিয়া-জাপানে যে জলোচ্ছ্বস হয়েছে, তা আমাদের জন্য ‘ওয়েকআপ’ কল। বিশ্ব যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত না নেয় এবং কপ-২১ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেয়, তাহলে এ ধরনের সামুদ্রিক ঝড় বার বার ঘটবে। সতর্ক হওয়ার এখনই সময়।
Daily Bangladesher Khobor
16.10.2018

সামুদ্রিক ঝড় ‘মাইকেল’ এর স্যাটেলাইট চিত্র

সংগৃহীত ছবি

ঘূর্ণিঝড় ‘তিতলি’ ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন


 ঘূর্ণিঝড় ‘তিতলি’ শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো অঘটন না ঘটিয়ে ভারতের উড়িষ্যা ও অন্ধ্র প্রদেশ অতিক্রম করেছে গত শুক্রবার। ‘তিতলির’ তান্ডবে সেখানে ৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে সংবাদপত্র খবর দিয়েছে। ‘তিতলির’ কারণে আমাদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি এটা সত্যি। কিন্তু এটা একটা ‘ওয়েক আপ’ কল। আগামীতে আমাদেরকে এ ধরনের সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি হতে হবে বারবার। কারণ বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সাগর মহাসাগরে সামুদ্রিক ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রায় একই সময় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ঘূর্ণিঝড় মাইকেল এর বড় প্রমাণ। বলা হচ্ছে এ শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল মাইকেল। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের আইপিসিসি বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেও, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতার কারণে বিশ্বের উষ্ণতা কমানোর ব্যাপারে কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বলা ভালো, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে একটি জলবায়ু চুক্তিতে (কপ-২১) বিশ্বের প্রায় সকল দেশের ঐকমত্যে পৌঁছা এবং ২০১৬ সালে নিউইয়র্কে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করলেও ট্রাম্প প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর থেকেই জলবায়ু চুক্তিটি একরকম অকার্যকর হয়ে গেছে। উষ্ণতা কমানোর ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা, অর্থাৎ বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাস করার ব্যাপারে বিশ্বের দেশগুলো নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এবং এক এক গ্রুপের ছিল এক এক এজেন্ডা। দেশগুলো আলাপ আলোচনার মধ্যদিয়ে প্যারিসে ন্যূনতম একটি ঐকমত্যে পৌঁছে ছিল।
কিন্তু সেই ঐকমত্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ট্রাম্প জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। তিনি যে এ কাজটি করবেন, তা একরকম নিশ্চিতই ছিল। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার আগে ও পরে একাধিকবার তিনি এটা নিশ্চিত করে ছিলেন যে তিনি জলবায়ু চুক্তিটিকে মানেন না। নানা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছিল এবং জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত বৈজ্ঞানিক প্যানেলও এটা স্পষ্ট করেছিলো যে, অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহারের কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং বিশ্বের উষ্ণতা কমাতে হবে। আর এটা কমাতে হলে জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। কিন্তু ট্রাম্প বিজ্ঞানের এই গবেষণা অস্বীকার করেছিলেন। অতিরিক্ত জীবাষ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কারণেই যে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে, আর্কটিকের বরফ যে গলছে, ট্রাম্প এটা বিশ্বাস করেন না। আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর স্বর্থেই যে যুক্তরাষ্ট্র কপ-২১ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন, এটা অনেকে মনে করেন। গত মে মাসের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউরোপ সফরে গিয়েছিলেন। তার ওই সফরও যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। সিসিলিতে তিনি জি-৭ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন।
সেখানে জি-৭ ভুক্ত ৬টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে প্যারিস কপ-২১ চুক্তির ব্যাপারে তাদের সমর্থন ‘কমিটমেন্ট’ হারায় উল্লেখ করলেও, ট্রাম্প সেখানে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেননি। ফলে এখন বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করা কীভাবে সম্ভব হবে, সেটাও বড় প্রশ্ন। তবে বলা হচ্ছে ট্রাম্প একটি সিদ্ধান্ত নিলেও, তা র্কাযকর করতে অন্তত ৩ বছর সময় লাগবে। এখন যে উদ্দেশ্যটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তগুলোর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে? টেড স্ট্রান, যিনি প্যারিস কপ-২১ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি বলেছেন ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিবে। যুক্তরাষ্ট্র তার গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত বিশ্বের বড় কার্বন সরবরাহকারী দেশগুলো কীভাবে নেবে? এটা নিয়ে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও অতি সম্প্রতি দুটো সংবাদ আমাদের জন্য আশার সঞ্চার করেছে।
চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছেন তারা জীবাষ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমানোর ব্যপারে তাদের ‘কমিটমেন্ট’ তারা রক্ষা করবেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সাহায্য করার ব্যাপারে ১০০ মিলিয়ন ডলার ফান্ড সংগ্রহের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করবে। একই সাথে রাশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে প্যারিস সমঝোতাকে (কপ-২১) যাতে গুরুত্ব দেয় এবং মনে করে বড় কার্বন সংগ্রহকারী দেশগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া এই চুক্তি অর্থহীন। রাশিয়ার বক্তব্য মূলত মার্কিন বর্তমান অবস্থানকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। বলা ভালো এখন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সিরিয়া ও নিকারাগুয়াও জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর না করা দেশের তালিকায় থাকলেন। প্রসঙ্গক্রমেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বা সমঝোতা, যা কপ-২১ নামেও পরিচিত, সে বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। প্যারিস সমঝোতা স্মারকে ১৯৫টি দেশ স্বাক্ষর করেছিল, আর জাতিসংঘে স্বাক্ষর করেছিল ১৭০টি দেশ। চুক্তিতে বলা আছে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশে^র তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা হবে। এর জন্য বায়ুম-লে কার্বন নির্গমণ হ্রাস করতে হবে। প্রশ্ন ছিল তখন কে কতটুকু হ্রাস করবে। তা সুষ্ঠুভাবে উল্লেখ করা হয়নি। প্রশ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে কী একই কাতারে আমরা দেখবো? কিংবা রাশিয়াসহ ইউরোপের দেশগুলো কতটুকু কমাবে?
এ ব্যাপারে সমঝোতা চুক্তিতে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। সমঝোতায় আছে উন্নত কিংবা জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার সাহায্য দেবে। এটা শুনতে ভালোই শোনায়। কিন্তু এই অর্থ কে দেবে? কেন দেবে, কতটুকু দেবে, তার কোনো উল্লেখ নেই। দ্বিতীয়ত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো নানা ক্যাটাগরিতে বিভক্ত (ভলনারেবল ২০, রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন ইত্যাদি) এই দেশগুলোর মাঝে অর্থ বণ্টনের ভিত্তিটি কী হবে? তৃতীয়ত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এই অর্থ কীভাবে ম্যানেজ করবে? কেননা উন্নয়নশীল বিশে^ দুর্নীতির বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত। বাংলাদেশের জলবায়ু খাতে প্রাপ্ত টাকা বরাদ্দ নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। একসময় কথা হয়েছিল প্রাপ্ত টাকা বিলি-বণ্টনের বিষয়টি দেখভাল করবে বিশ্ব ব্যাংক। পরে বিশ্ব ব্যাংক এখান থেকে সরে যায়। বিষয়টা যে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা নয়। বরং উন্নয়নশীল বিশ্বে, বিশেষ করে সাগর পাড়ের অনেক দেশ নিজে এ রকম সমস্যায় আছে। সমঝোতা স্মারকে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থ দেখা হয়নি। আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও অত কঠোর নয়। অর্থাৎ সাগর পাড়ের দেশগুলো, যারা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে সাগর মহাসাগরে পানির পরিমাণ বেড়ে গেলে, তাদের বিশাল এলাকা সাগর গর্ভে হারিয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে, কোন ক্ষতিপূরণ এর জন্য দাবি করতে পারবে না। ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আসবে বড় দেশগুলোর মর্জি-মাফিকের উপর।
নিউইয়র্কে, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। এর প্রয়োজন ছিল। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা যে হারে বেড়ে যাচ্ছে,সাগর উত্তপ্ত হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট্ হচ্ছে। এ সবই বাস্তব।এ ব্যাপারে কারো কোন বক্তব্য নেই। পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে,গ্রীনল্যান্ড ও এন্টার্কটিকায় বরফ গলছে। এ জন্য একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া প্রয়োজন ছিলো। এটা সবাই উপলব্ধি করেন। কিন্তু কর্মপরিকল্পনাটা কী, কীভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো যাবে তার কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্যারিস সম্মেলনে নেওয়া হয়নি। এটা বলা যাচ্ছে বিশ্বে জীবাষ্ম জালানি ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে বায়ুমন্ডলে কার্বনের পরিমাণ বাড়ছে। অর্থাৎ শিল্পে, কল-কারখানায় যান-বাহনে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহার করার ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু এই জ্বালানির ব্যবহার আমরা কমাবো কিভাবে? জ্বালানি ব্যবহারের সাথে উন্নয়নের প্রশ্নটি সরাসরিভাবে জড়িত। জীবাষ্ম জ্বালানি কম ব্যবহার করলে কার্বন নিঃসরণ কম হবে, এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বের কাছে কি বিকল্প জ্বালানি আছে? উন্নয়নশীল বিশ্বে জীবাষ্ম জ্বালানির ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। উন্নত বিশ্বের কাছে ‘নয়া প্রযুক্তি’ থাকলেও তাদের অনীহা রয়েছে উন্নয়নশীল বিশ্বে এই প্রযুক্তি সরবরাহের। সোলার এনার্জির একটা বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও, উন্নয়নশীল বিশ্বে এই এনার্জির ব্যবহার বাড়ছে না। বাংলাদেমে যে পরিমাণে এর ব্যবহার বাড়ানো উচিত ছিল, তা কিন্তু হয়নি। কেননা এর জন্য যে খুচরা যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয় তা বিদেশ থেকে আনতে হয়। খরচ অনেক বেশি পড়ে, যা আমাদের সাধ্যেও মধ্যে পড়ে না। এই সেক্টরে যতদিন পর্যন্ত না বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যাবে, ততদিন এই সেক্টর বিকশিত হবে না।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সাগর-মহাসাগর উত্তপ্ত হচ্ছে। বাড়ছে ঘূণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসও। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা জাপানের মতো দেশও এই ঘূণিঝড় আর জলোচ্ছাস থেকে ‘মুক্ত’ হচ্ছে না। ভুলে গেলে চলবে না ‘মাইকেল’ ১৫৫ মাইল বেগে ফ্লোরিডায় আঘাত করেছিল। আমাদের জন্যও এটা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। কেননা ‘তিতলি’ এবার বড় ক্ষতি করতে পারেনি কিন্তু ‘সিডর’ কিংবা ‘আইলার’ কারণে যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল, তা থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারিনি।
Daily Amader Notun Somoy
15.10.2018

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে রাজনীতির লাভ-ক্ষতি

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে এ ফ্রদ্ধন্টের যাত্রা শুরু হয়। বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এ কারণে যে, বিএনপি ২০ দলের বাইরে কয়েকটি ব্যক্তিনির্ভর দলকে একজোটে নিয়ে এসেছে। এ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী ঐক্য হবে কি-না, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। এর মধ্যে আবার বিকল্পধারা বেরিয়ে গেছে। যদিও বিকল্পধারার ঐক্যফ্রন্টের বাইরে থাকায় কোনো ক্ষতি হবে না বলেই আমার মনে হয়। কারণ একদিকে তাদের সে অর্থে সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। আবার বিএনপির সঙ্গেও যে দীর্ঘমেয়াদে তাদের ঐক্য হবে- সেটাও বলা যায় না। এমনিতেই জাতীয় ঐক্য গড়ার শুরু থেকে প্রায় প্রতিটি বৈঠকেই অন্য দলগুলোর সঙ্গে বিকল্পধারার মতপার্থক্যের কথা সংবাদমাধ্যমের তরফে আমরা জেনেছি। বিকল্পধারার নানা শর্তও ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্যোগী নেতাদের পক্ষে পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এভাবেই চলতে থাকে টানাপড়েন। সর্বশেষ শুক্রবার যুক্তফ্রন্টের শরিক জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবের উত্তরার বাসভবনের বৈঠকেও বাকবিতণ্ডার খবর আমরা জানি। শেষ পর্যন্ত অন্য শরিকদের ঐকমত্যে বি. চৌধুরীকে বাদ দিতে বাধ্য হন ড. কামাল হোসেন।

বিকল্পধারার দুটি দাবিতে অনড় থাকায় বলা চলে তাদের এ ঐক্যফ্রন্টের বাইরে অবস্থান। প্রথমত, জটিলতা দেখা দেয় স্বাধীনতাবিরোধী শব্দ নিয়ে। দ্বিতীয়ত, বিকল্পধারা জাতীয় সংসদের 'ক্ষমতার ভারসাম্য'র জন্য ঐক্য গড়ে তোলার আগে 'আসন বণ্টনে'র নিশ্চয়তা চেয়েছিল। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দলটি বিএনপিকে দেড়শ' আসন দিয়ে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে দেড়শ' আসন দেওয়ার দাবি তোলে। এর মাধ্যমে তারা মূলত বিএনপির একক প্রভাব দেখতে চায় না। এটি অবশ্য বিকল্পধারার বি. চৌধুরীর বারিধারার বাসভবনে শনিবারের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যেও স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ক্ষমতার ভারসাম্যের রাজনীতির শর্ত মেনে নিতে হবে। জাতীয় ঐক্যের নামে বিএনপিকে এককভাবে ক্ষমতায় বসানোর 'চক্রান্তে'র সঙ্গে বিকল্পধারা নেই। সঙ্গত কারণেই বিকল্পধারার সঙ্গে দূরত্বের কারণ স্পষ্ট।

কথা হলো, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আদৌ রাজনৈতিক কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে কি-না- সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে এটা ঠিক, বিষয়টি মিডিয়ায় যেভাবে কাভারেজ পাচ্ছে, এ ব্যাপারে মানুষের মধ্য যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, তাতে নিশ্চিতই কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। বিশেষ করে, বিএনপি এখন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বাইরে একটি পথ খুঁজে পেল। ড. কামাল হোসেনকে তারা সামনে পেল। বলা চলে, এর মাধ্যমে বিএনপি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান-সংকট কাটাতে পারছে। যদিও এখানে এ দু'জন মাইনাস হয়ে গেলেন।

বিকল্পধারাকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সম্মিলিত এ যাত্রা প্রকারান্তরে এটা বোঝাচ্ছে যে, তারা জামায়াতে ইসলামীকেও মেনে নিল। যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে, তারা নিজেদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে না। তবে জামায়াত স্বতন্ত্রভাবে কিংবা অন্য দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে। স্থানীয় নানা নির্বাচনে তাদের সেভাবে নির্বাচন করতে আমরা দেখেছিও। এখন জাতীয় নির্বাচনেও হয়তো তারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবে। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করলেও তারা যে বিএনপি জোটকেই সমর্থন দেবে, তা বলা বাহুল্য। তাহলে বিকল্পধারার বিকল্প কী? ১৪ দল ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই। আমার মনে হয়, তারা ১৪ দলের সঙ্গেই এখন জোট বাঁধবে। এর বাস্তব কারণ রয়েছে। কারণ মাহী বি চৌধুরী ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে ব্যবসা করেন; আবার মেজর (অব.) মান্নান ১৪ দলের সঙ্গেই জোট করতে চাইবেন।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যদি নির্বাচনী জোট হয়; গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার অবস্থান শক্তিশালী হবে বলেই মনে করি। বিশেষ করে ভোটের রাজনীতিতে তারা ব্যাপক লাভবান হবে। এর মাধ্যমে জাতীয় সংসদে যাওয়া তাদের জন্য সহজ হবে।

নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দিয়ে সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্য সরকার গঠন, খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তিসহ সাত দফা দাবি এবং সংসদ ও সরকারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতসহ ১১ দফা লক্ষ্যের কথাও ঘোষণা করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ৭ দফার প্রথম দফায় যে নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে; সংবিধানের নিরিখে তা দেখতে হবে। দ্বিতীয় দফায় গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা প্রদানের দাবি জানানো হয়েছে। এসব ব্যাপারে সরকার কতটা আন্তরিক হবে, সেটি দেখার বিষয়। তবে সরকার নিশ্চয় কিছু দাবি মেনে নিতে পারে। যেমন বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা। এর সঙ্গে সব রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের দাবি মেনে নেওয়াও কঠিন নয়।

আমি তো মনে করি, বরং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনে সরকারেরই লাভ হলো। এর মাধ্যমে বিএনপির নির্বাচনে আসার পথ উন্মুক্ত হলো। যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা সবাই বলে আসছে, এর মাধ্যমে আমরা তার আশা দেখতে পাচ্ছি। এ জন্য সরকারকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসা দরকার। এ ফ্রন্টকে সাধুবাদ জানিয়ে তাদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্ত আস্থার সংকট চলছে। বড় দুই দলের মধ্যে আস্থাহীনতার কারণে রাজনীতিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই আস্থাহীনতা দূর না হলে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। আস্থাহীনতা দূর করতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকেন্দ্রিক জোটের মধ্যে আলোচনার বিকল্প নেই। ফলে আমরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের যাত্রা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। ১৪ দলীয় জোট ও এই ফ্রন্টের মধ্যে সমঝোতা অসম্ভব নয়। এখানে সরকারের দায়িত্বই বেশি। সরকারকে বেশি বেশি সমালোচনা না করে বরং কীভাবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, সে জন্য সচেষ্ট হতে হবে। নির্বাচন কাছে চলে আসছে। মানুষ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে। সে সুন্দর নির্বাচন উপহার দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। সে বিষয় মাথায় রেখেই সরকারের উচিত হবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সাধুবাদ জানানো
Daily Samakal
15.10.2018

ঘূর্ণিঝড় ‘তিতলি’ ও বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব




ঘূর্ণিঝড় ‘তিতলি’র প্রভাব বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে গেল সপ্তাহে। এর প্রভাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। শেষ অবধি ঘূর্ণিঝড় ‘তিতলি’ ভারতের দক্ষিণ উড়িষ্যা ও উত্তর অন্ধ্র প্রদেশে আঘাত করেছিল। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে প্রায়ই আমরা এ ধরনের ঘূর্ণিঝড় প্রত্যক্ষ করছি। আর এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমুদ্র ও মহাসাগরঘেঁষা দেশগুলো। ‘তিতলি’ যখন বাংলাদেশ ও ভারত অতিক্রম করল তার মাত্র কয়েক দিন আগে ইন্দোনেশিয়া ও জাপানে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত করেছিল। এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সাগর-মহাসাগর উত্তপ্ত হচ্ছে। বাড়ছে ‘তিতলি’র মতো ঘূর্ণিঝড়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি হ্রাস করার ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায় প্যারিসে কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষর করলেও (২০১৫) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অস্বীকৃতির ফলে এ চুক্তিটি কার্যত এখন অকার্যকর হয়ে গেছে! ওই চুক্তির ভবিষ্যৎ কী, তা-ও একটা বড় প্রশ্ন এখন। তবে এটা একটা প্লাসপয়েন্ট যে, বিশ্ব নেতাদের মাঝে একটা উপলব্ধিবোধ এসেছে, কার্বন নিঃসরণকারী জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে। কাজটি নিঃসন্দেহে সহজ নয়। এর সঙ্গে বেশকিছু প্রশ্ন জড়িতÑ উন্নত বিশ্ব কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য, জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় ‘টেকনোলজি ট্রান্সফার’, উন্নত বিশ্বের নিজের কার্বন নিঃসরণ হার কমানোÑ ইত্যাদি বিষয় জড়িত! এর আগে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে লিমা কপ-২০ সম্মেলনে প্রতিটি দেশকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি ও কাঠামো উপস্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ এটা করেছে। কিন্তু সব দেশ এটা করতে পেরেছে কিনা, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। চীন ও ভারতের মতো দেশের কার্বন নিঃসরণ নিয়েও কথা আছে। কেননা, দেশ দুটি সাম্প্রতিককালে বিশ্বের শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনে যে কয়টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মাঝে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গেল ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে আগামীতে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। অনেকের মনে থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর পরিবেশের ব্যাপারে বিশ্বজনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ২০১২ সালের জানুয়ারিতে অ্যান্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। আমাদের তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রীকেও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেখানে। সেটা ঠিক আছে। কেননা, বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মাঝে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পরপর দুইবার বন্যা ও পরবর্তী সময়ে ‘সিডর’-এর আঘাতের সম্মুখীন হয়। এরপর ২০০৯ সালের মে মাসে আঘাত করে ‘আইলা’। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ব্যাপক খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি দেখা দেয়। ওই সময় দেশে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ‘সিডর’-এর পর বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি বারবার বিশ্ব সভায় আলোচিত হচ্ছে! সিডরের ক্ষতি ছিল গোর্কির চেয়েও বেশি। মানুষ কম মারা গেলেও সিডরের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সিডরে ৩০ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল ৯টি জেলা। ২০০ উপজেলার ১ হাজার ৮৭১ ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫ পরিবারের ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৬ জন সিডরের আঘাতপ্রাপ্ত ছিল। মারা গিয়েছিলেন ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি। তবে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। সিডর ও আইলার পর ২০১৩ সালে ‘মহাসেন’ বাংলাদেশে আঘাত করেছিল। যদিও এতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব আমরা পাইনি। সিডর ও আইলার আঘাত আমরা এখনও পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আইলার আঘাতের পর খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছায় যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর করা সম্ভব হয়নি। জলাবদ্ধতা কোথাও কোথাও ১ থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত। আইলায় ৮০ শতাংশ ফলদ ও বনজ গাছ মরে গিয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে আজ নোনা পানির আগ্রাসন। সুপেয় পানির বড় অভাব ওইসব অঞ্চলে। এরপর ‘মহাসেন’ আমাদের আবারও ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়ে গিয়েছিল। এখন আঘাত করল ‘তিতলি’। আমাদের মন্ত্রী-সচিব কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিরা বিদেশ সফর ও সম্মেলনে অংশ নিতে ভালোবাসেন। কানকুন, ডারবান, কাতার কিংবা তারও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আমাদের পরিবেশমন্ত্রী গেছেন। আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য কোপেনহেগেনে প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিশ্বজনমত আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ রক্ষায় তাতে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা পাইনি।
বলা ভালো, বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনরোধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতারোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এজন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিদেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এ সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। গেলবার যে বন্যা হলো, আবার আমাদের সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল। বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় এখন এ দেশে স্বাভাবিক ব্যাপার; কিন্তু সিডর ও আইলার আঘাতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছিল, সে ক্ষতি সারাতে সরকারের বড়োসড়ো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও সেখানে ‘রাজনীতি’ ঢুকে গিয়েছিল। দলীয় বিবেচনায় টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে, যেসব এনজিও জলবায়ু নিয়ে কাজ করেনি, যাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেইÑ শুধু দলীয় বিবেচনায় তাদের নামে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। জলবায়ু তহবিলের অর্থ যাওয়া উচিত ওইসব অঞ্চলে, যেখানে ঘূর্ণিঝড়ের  আঘাত বেশি, আর মানুষ ‘যুদ্ধ’ করে সেখানে বেঁচে থাকে। অথচ দেখা গেছে, জলবায়ুর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দেওয়া হয়েছিল ময়মনসিংহ পৌরসভাকে, মানিকগঞ্জের একটি প্রকল্পে কিংবা নীলফামারী তিস্তা বহুমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থাকে। সিরাজগঞ্জের প্রগতি সংস্থাও পেয়েছিল থোক বরাদ্দ। অথচ এমন প্রতিষ্ঠানের একটিরও জলবায়ু সংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
আমাদের জন্য তাই প্যারিস চুক্তির (২০১৫) গুরুত্ব ছিল অনেক। বাংলাদেশ পরিবেশগত নানা সমস্যায় আক্রান্ত। বাংলাদেশের একার পক্ষে এর সমাধান করা সম্ভব নয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই বাংলাদেশ আজ আক্রান্ত। সুতরাং বৈশ্বিকভাবে যদি বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি কমানো না যায়, তাহলে বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করাও সম্ভব হবে না। তাই একটি চুক্তি অত্যন্ত জরুরি ছিল। সেসঙ্গে আরও প্রয়োজন জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় বৈদেশিক সাহায্যের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি এবং সেসঙ্গে প্রযুক্তি হস্তান্তরের একটা ‘কমিটমেন্ট’। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে আমাদের যেতে হবে। সোলার বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন, স্থানীয়ভাবে তাদের কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। সুতরাং আর্থিক সাহায্যের প্রশ্নটি অত্যন্ত জরুরি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিশ্ব নেতারা বারবার সাহায্যের কথা বললেও সে সাহায্য কখনোই পাওয়া যায়নি। প্যারিস সম্মেলন (২০১৫) চলাকালীন বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি উদ্বেগজনক সংবাদ প্রকাশ করেছিল জার্মান ওয়াচ নামে একটি সংস্থা। প্রতি বছর বৈশ্বিক জলবায়ু সূচক তারা প্রকাশ করে থাকে। শীর্ষ সম্মেলন চলাকালীনই তারা প্রকাশ করেছিল বৈশ্বিক জলবায়ু সূচক-২০১৬। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝড়, বন্যা, ভূমিধস ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকা এরা প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে ৬ নম্বরে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে হন্ডুরাস। তারপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে মিয়ানমার, হাইতি, ফিলিপাইন ও নিকারাগুয়া। তাই প্যারিস চুক্তিটি ছিল আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তি হলেও তাতে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় ওই চুক্তি মূল্যহীন হয়ে গেছে। এরই মধ্যে বিশ্ব নেতাদের সবাই, যারা প্যারিস কপ-২১ এ যোগ দিয়েছিলেন, তারা সবাই এখন প্যারিস চুক্তির ব্যাপারে হতাশা ব্যক্ত করছেন। আমাদের বনমন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছেন। নিউইয়র্কে (২০১৬) তিনি বলেছিলেন, এ ঐতিহাসিক চুক্তি বাস্তবায়ন হলে ধরিত্রী বাঁচবে, সূচনা হবে নতুন যুগের। মন্ত্রী আরও জানিয়েছিলেন, চুক্তিটি বাস্তবায়নে আরও পাঁচ বছর সময় রয়েছে। এ সময়ে চুক্তির অস্পষ্ট বিষয়গুলো আলোচনার সুযোগ রয়েছে। নিউইয়র্কে অনেক বিশ্বনেতাও বলেছেন, এ চুক্তি বিশ্বের দূষণ কমানোর ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখবে। ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে। খাদ্য নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও বিশ্ব শান্তি বজায় রাখতেও চুক্তিটি অনন্য ভূমিকা রাখবে বলেও তারা অভিমত পোষণ করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়েই বিশ্বের উষ্ণতা কমানো যাবে না। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি দেশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর কৌশল নিজেদের মতো করে ঠিক করবে। এটাই হচ্ছে আসল কথা। নিজেদেরই কৌশল ঠিক করতে হবে। বাংলাদেশ কি তা পারবে? আমাদের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর পছন্দ করেন। কিন্তু দূষণ কমানোর ব্যাপারে অত উৎসাহী নন। আমাদের পরিবেশমন্ত্রীও এ ব্যাপারে তেমন সক্রিয়, এটা আমার মনে হয়নি কখনও। দেশের ভেতরে প্রায়ই পরিবেশ দূষণের ঘটনা হরহামেশা পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। কিন্তু দূষণরোধ করার ব্যাপারে খুন কম উদ্যোগই লক্ষ করা গেছে। ফলে পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে আমরা যতই সোচ্চার হই না কেন, আমাদের নিজেদের পরিবেশ রক্ষায় আমরা কতটুকু সচেতনÑ এ প্রশ্ন উঠবেই। কেননা প্যারিস চুক্তিতে নিজেদের কর্মপদ্ধতির উদ্ভাবনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু আমরা কি ওই কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পেরেছি?
ঘূর্ণিঝড় ‘তিতলি’র মতো অতীতেও এ অঞ্চলে অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরে জন্ম হয়েছে অনেক ঘূর্ণিঝড় এবং বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় তা আঘাত হেনেছে। ঘূর্ণিঝড় সিডর (২০০৭), নারগিস (২০০৮), আইলা (২০০৯), বিজলি (২০০৯), পাইলিন (২০১৩), নিলোফার (২০১৪) এ ধরনের অনেক ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি আমাদের মনে আছে। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণেই এমন হচ্ছে। এর জন্য বাংলাদেশ কোনোভাবেই দায়ী নয়। কিন্তু বাংলাদেশকে এর ‘দায়’ বহন করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাই দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে না এলে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
Daily Alokito Bangladesh
14.10.2018

রাজনীতিতে আস্থার সংকট


ইতোমধ্যে যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের সাথে বিএনপি জাতীয় ঐক্য করেছে। এই ঐক্য অনেকটাই এখন ‘কাগুজে ঐক্য’ হয়ে গেছে। কেননা বরাবরের মতো জাতীয় ঐক্য করেই ড. কামাল হোসেন বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। তিনি কবে দেশে ফিরবেন কেউ বলতে পারে না। উপরন্তু বিএনপির সাথে বিকল্প ধারার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরীর বক্তব্য পরিত্যাগ করেছে বিএনপি। বিএনপি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা জামায়াতকে ছাড়বে না। মাহী বি. চৌধুরী জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিএনপির অংশগ্রহণের প্রশ্নে কিছু শর্ত দিয়েছিলেন। তার একটি হচ্ছে বিএনপিকে জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। বিএনপি এটি করবে না। ফলে যে প্রত্যাশা নিয়ে ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্য করেছিলেন, তা এখন শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল!
বিএনপি গত ৩০ সেপ্টেম্বরের জনসভায় একটি ৭ দফা দাবি উত্থাপন করেছে। এই ৭ দফার মাঝে একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হচ্ছে সকল দলের সাথে পরামর্শ করে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন। কিন্তু সে সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হয়। কেননা প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের বলেছেন, সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সুযোগ নেই। তার এই বক্তব্যকে ধারণ করেও বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছে করলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে এই মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। সংবিধানের ৫৫(১) ধারায় মন্ত্রিসভা গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে। আর ৫৬(২) ধারায় প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংসদ সদস্যের বাইরে থেকে ‘টেকনোক্রেট কোটায়’ মন্ত্রী নিয়োগ করতে। সুতরাং নির্বাচনকালীন সময়ে মন্ত্রী পরিষদ গঠনের এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর। এক্ষেত্রে সংসদ সদস্য নন এবং বিএনপি সমর্থিত সদস্যদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। এখানে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাটাই হলো আসল। বিএনপি যে ৭ দফা দাবি উত্থাপন করেছে, তাতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহার না করার কথা বলা হয়েছে। যতদূর মনে আছে প্রধানমন্ত্রী নিজেও একবার ইভিএম মেশিন ব্যবহার না করার কথা বলেছিলেন। যেখানে এখনো ইভিএম মেশিন শতভাগ নির্ভরযোগ্য নয়, সেক্ষেত্রে ইভিএম মেশিন ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তবে অতি উৎসাহী সিইসির ইভিএম মেশিন নিয়ে বক্তব্য নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। ইতোমধ্যে ইসিতে নতুন করে দ্বন্দ্বের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। একটি বড় অভিযোগ করেছেন চার জন কমিশনার। তাদের অভিযোগ কমিশনারদের না জানিয়ে সিইসি একাই অনেক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এটা একটা গুরুতর অভিযোগ। কিছুদিন আগে নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হবে এমন বক্তব্য দিয়ে তিনি বিতর্কিত হয়েছিলেন। এ ধরনের বক্তব্য তার দেওয়া উচিত হয়নি। একটি বা দুটি সিটে ধানের শীষের প্রতীকী প্রার্থী দিয়ে বিএনপি ইচ্ছে করলে তার নিবন্ধন ধরে রাখতে পারে এটা একটা সাধারণ মানুষও বোঝে। অথচ সিইসি এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তার নিজের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করলেন!
নির্বাচনের খুব বেশিদিন বাকি নেই। সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের দাবি এখন শুধু দেশের ভেতর থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে না, বাইরে থেকেও উচ্চারিত হচ্ছে। সরকার সংবিধানের কথা বারবার বলছে। অথচ সংবিধানের ভেতরেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকার প্রধানের আন্তরিকতাই হলো আসল। ২০১৪ এর পরিস্থিতির সাথে ২০১৮ এর পরিস্থিতি মেলানো যাবে না। ঐক্য প্রক্রিয়া শেষ অব্দি নির্বাচনি জোটে পরিণত হবে কি না, তা নিয়ে খোদ বিএনপিতেই নানা প্রশ্ন আছে। তবে সরকারকে ‘খালি মাঠে গোল না দেয়ার’ স্ট্র্যাটেজি বিএনপিকে নিতে হবে। বিএনপি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করে যে সরকার এককভাবে নির্বাচন করতে পারে এবং সংসদে একটি বিরোধী দলও ‘সৃষ্টি’ করা সম্ভব। সুতরাং একদিকে আন্দোলন, অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কৌশল নিয়েই বিএনপির এগিয়ে যাওয়া উচিত।
মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত বিএনপির নেতৃবৃন্দ। ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপির সমাবেশের পরও বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপিকে এটা ‘মোকাবিলা’ করেই নির্বাচনি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যের ধারা অব্যাহত রেখে নির্বাচনের পথে যেতে হবে । এজন্য জনগণের সামনে একটি বিকল্প পরিকল্পনা উপস্থাপন করা প্রয়োজন। সেটা এখনো করেনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির প্রত্যাশাই-বা কি তাও প্রকাশিত নয়।
বিএনপির উচিত জাতির সামনে একটি বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করা, যা ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগ উপস্থাপন করেছে। তার আগে যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, এমনকি বাম জোটের নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও তাদের প্রস্তাব নিয়ে মত-বিনিময় করা উচিত। তাদের প্রস্তাবে সব দল যে ঐকমত্য পোষণ করবে, তেমনটি না-ও হতে পারে। তবে সবার সঙ্গে আলোচনা করলে ভালো একটি সমাধান হয়তো পাওয়া যাবে। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে একটি যৌথ প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকার সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সংবিধান সংশোধন করার কারণে সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। বাধ্য করা না গেলে সরকার সংবিধান সংশোধন করবে না। এক্ষেত্রে বিএনপির দাবি সরকার মানবে বলে মনে হয় না।
ইতোমধ্যে সরকার ১৪ দলীয় জোটকে আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। বাম দলীয় জোটের সাথে একধরনের ঐক্য করার কথা ভাবছে সরকার! এক্ষেত্রে যদি ন্যূনতম ঐক্যও হয়, এটাও ড. কামাল হোসেন তথা বিএনপির জন্য আরও একটি ‘মাইনাস পয়েন্ট’। তবে বাম ধারা আওয়ামী লীগের সাথে কোনো ঐক্যে যাচ্ছে না। তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ‘তৃতীয় ধারা’ সূচনা করতে চায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিগত ৪৭ বছরে ‘তৃতীয় ধারার’ কথা আমরা বারবার শুনেছি। কিন্তু মানুষ এই ধারাকে গ্রহণ করেনি। তবে এটা সত্য, এই তৃতীয় ধারার সাথে অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতা রয়েছেন। কিন্তু মানুষ তাদের ‘ভোট’ দেয় না। তথাকথিত ইসলামিক দলগুলোরও যে ‘সমর্থন’ রয়েছে, বাম দলগুলোর তা নেই। কেন নেই? কেন বাম দলগুলো ভালো ভালো এবং ‘সত্য’ কথা বলেও মানুষের কাছে যেতে পারছে না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। ঘুরেফিরে সাধারণ মানুষের আস্থা ওই ‘নৌকা’ আর ‘ধানের শীষ’-এ। তৃতীয় শক্তি হিসেবে ‘লাঙ্গলকেই’ মানুষ বেছে নিয়েছে শুধু এরশাদের ‘আঞ্চলিকতা প্রীতি’র কারণে।
রাজনীতি নয় বরং আঞ্চলিকতাই জাতীয় পার্টির মূল শক্তি। তবে লাঙ্গল কোনোদিনই ‘নৌকার’ বিকল্প হবে না, কিংবা ‘ধানের শীষ’-এর স্থান দখল করে নিতে পারবে না। বাস্তবতা যেহেতু ভোটের রাজনীতিতে ‘নৌকা’ আর ‘ধানের শীষ’ অন্যতম ফ্যাক্টর, সেক্ষেত্রে এই দুটি বড় দলের মাঝে ‘আস্থার সম্পর্ক’ থাকা দরকার। এই আস্থার সম্পর্কই এ দেশের রাজনীতিতে একটি স্থিতিশীলতা এনে দিতে পারে। এখন এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় তা নির্ভর করে এই দুই দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ওপর। একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ খুবই জরুরি।
Daily AmaderSomoy.com
06.10.2018

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা

এটা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত যে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের যেকোনো এক দিন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতাও লক্ষণীয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করলেই সিনিয়র সাংবাদিকরা নির্বাচন নিয়ে তাঁর মনোভাব জানতে চান। জাতিসংঘের ৭৩তম অধিবেশনে যোগ দিয়ে বরাবরের মতো গত ৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী যখন একটি সংবাদ সম্মেলন করলেন তখনো নির্বাচনসংক্রান্ত প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছিল। এবং প্রধানমন্ত্রী এর জবাবও দিয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বলেছেন। এক. তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন চায়। কোন দল নির্বাচনে আসবে, কে আসবে না—এটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। এতে আমাদের কিছু করার নেই। দুই. নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ২০১৪ সালে চেষ্টা করেছিলাম সব দলকে নিয়ে একটা সরকার গঠন করব। আমরা ক্যাবিনেটে আলোচনা করব। দু-একটি দলের সঙ্গে এরই মধ্যে আলোচনা হয়েছে। বাকিদের সঙ্গে আলোচনা করব, এরপর সিদ্ধান্ত নেব। (কালের কণ্ঠ, ৪ অক্টোবর)। বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচনকালীন সরকার—এই দুটি বিষয়ই এখন আলোচনার অন্যতম বিষয়। বিএনপি নির্বাচনে যাবে বলেই দলটির নেতারা বারবার বলে আসছেন। তবে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা মাঝেমধ্যে শর্ত জুড়ে দেন। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যখন দলীয় সিদ্ধান্তের কথা বলেন তখন বোধ করি তিনি এটাই বোঝাতে চাচ্ছেন যে বিএনপি যদি নির্বাচনে না-ও আসে, এ ব্যাপারে তাঁর করণীয় কিছু নেই। মিথ্যা বলেননি প্রধানমন্ত্রী। এটা তো ঠিক, কোনো দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি বাধ্য করতে পারেন না। এটা ওই দলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট, তিনি নিউ ইয়র্কে একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে এমন দলগুলোকে নিয়েই তিনি নির্বাচনকালীন একটি সরকার গঠন করবেন; যদিও সংবিধানে ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে তিনি বিএনপিকে এ ধরনের একটি সরকারে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি ওই সরকারে যোগ দেয়নি। এখন সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে তিনি যদি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করেন, সে ক্ষেত্রে ওই সরকারে বিএনপির থাকার কোনো সুযোগ নেই। কেননা দশম সংসদে বিএনপির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি বড় দল। তাদের একটা জনসমর্থন আছে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারে দলটির প্রতিনিধিত্বের সুযোগ কম। তবে সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, তাতে তিনি বিএনপিকে এই মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। সংবিধানের ৫৫(১) ধারায় মন্ত্রিসভা গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে। আর ৫৬(২) ধারায় প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংসদ সদস্যের বাইরে থেকে ‘টেকনোক্র্যাট কোটায়’ মন্ত্রী নিয়োগ করতে। সুতরাং নির্বাচনকালীন মন্ত্রিপরিষদ গঠনের এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য নন এবং বিএনপি সমর্থিত সদস্যদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। এখানে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাটাই হলো আসল। বিএনপি যে সাত দফা দাবি উত্থাপন করেছে, তাতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার না করার কথা বলা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নিজে ব্যক্তিগতভাবে ইভিএম ব্যবহার করার পক্ষে কথা বলেছেন। তবে যেখানে এখনো ইভিএম ১০০ শতাংশ নির্ভরযোগ্য নয়, সে ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। এর আগে অতি উৎসাহী প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) ইভিএম নিয়ে বক্তব্য নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। এরই মধ্যে ইসিতে নতুন করে দ্বন্দ্বের যে খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল, তার সমাধান হয়েছে। একটি বড় অভিযোগ করেছিলেন চারজন কমিশনার। তাঁদের অভিযোগ সিইসি কমিশনারদের না জানিয়ে একাই অনেক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এটা একটা গুরুতর অভিযোগ। কিছুদিন আগে নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হবে—এমন বক্তব্য দিয়ে সিইসি বিতর্কিত হয়েছিলেন। এ ধরনের বক্তব্য তাঁর দেওয়া উচিত হয়নি। একটি বা দুটি ‘সিটে’ ধানের শীষের প্রতীকী প্রার্থী দিয়ে বিএনপি ইচ্ছা করলে তার নিবন্ধন ধরে রাখতে পারে—এটা একটা সাধারণ মানুষও বোঝে। অথচ সিইসি এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তাঁর নিজের নিরপেক্ষতা তিনি ক্ষুণ্ন করেছেন।
নির্বাচনের খুব বেশিদিন বাকি নেই। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের দাবি আজ শুধু দেশের ভেতর থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে না, বরং বাইরে থেকেও উচ্চারিত হচ্ছে। সরকার সংবিধানের কথা বারবার বলছে। অথচ সংবিধানের ভেতরেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারপ্রধানের আন্তরিকতাই হলো আসল। ২০১৪ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে ২০১৮ সালের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। ঐক্যপ্রক্রিয়া আলোচিত হলেও শেষ পর্যন্ত তা নির্বাচনী জোটে পরিণত হবে কি না, তা নিয়ে খোদ বিএনপিতেই নানা প্রশ্ন আছে। তবে সরকারকে খালি মাঠে গোল না দেওয়ার স্ট্র্যাটেজি বিএনপিকে নিতে হবে। বিএনপি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করে যে সরকার এককভাবে নির্বাচন করতে পারে এবং সংসদে একটি বিরোধী দলও গঠিত হতে পারে। সুতরাং একদিকে আন্দোলন, অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া—বিএনপির এই স্ট্র্যাটেজি নিয়েই এগিয়ে যাওয়া উচিত। মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত বিএনপির নেতারা। ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপির সমাবেশের পরও বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপিকে এটা মোকাবেলা করেই নির্বাচনী প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যের ধারা অব্যাহত রেখে নির্বাচনের পথে যেতে হবে বিএনপিকে। এ জন্য জনগণের সম্মুখে একটি বিকল্প পরিকল্পনা উপস্থাপন করা প্রয়োজন। সেটা বিএনপি এখনো করেনি। বিএনপির একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যাশা কী, এটা বিএনপি নিশ্চিত করেনি। জাতির সম্মুখে একটি বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করা প্রয়োজন। এই প্রস্তাব এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ উপস্থাপন করেছে। বিএনপির প্রস্তাবে নির্বাচকালীন সরকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। এর আগে যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, এমনকি বাম জোটের নেতাদের সঙ্গে তাদের প্রস্তাব নিয়ে মতবিনিময় করা উচিত। তাদের প্রস্তাবে সব দল যে ঐকমত্য পোষণ করবে, তেমনটি নয়। সুতরাং সবার সঙ্গে আলোচনা করলে একটি সমাধান হয়তো পাওয়া যাবে এবং সে ক্ষেত্রে সবাই মিলে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে একটি যৌথ প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সংবিধান সংশোধন করার কারণে সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। সরকার সংবিধান কেন সংশোধন করবে? যদি সরকারকে বাধ্য করা না যায়, তাহলে সরকার সংবিধান সংশোধন করবে না। এ ক্ষেত্রে বিএনপির দাবি সরকার মানবে—এটা আমার মনে হয় না। সরকার ১৪ দলীয় জোটকে আরো সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেবে না, প্রধানমন্ত্রী এমনটাই বলেছেন। বামদলীয় জোটের সঙ্গে এক ধরনের ঐক্য করার কথা ভাবছিল সরকার। এ ক্ষেত্রে যদি ন্যূনতম ‘ঐক্যও’ হয়, এটাও ড. কামাল হোসেন তথা বিএনপির জন্য আরো একটি ‘মাইনাস পয়েন্ট’। তবে বাম ধারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো ঐক্যে যাচ্ছে না। তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ‘তৃতীয় ধারা’ সূচনা করতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত ৪৭ বছরে এই ‘তৃতীয় ধারার’ কথা আমরা বারবার শুনেছি। কিন্তু মানুষ এটা গ্রহণ করে নেয়নি। এটা সত্য, এই তৃতীয় ধারার সঙ্গে অনেক ত্যাগী, ও যোগ্য নেতা রয়েছেন। কিন্তু মানুষ তাদের ভোট দেয় না। তথাকথিত ইসলামিক দলগুলোর যে ‘সমর্থন’ রয়েছে, বাম দলগুলোরও তা নেই। কেন নেই? কেন বাম দলগুলো ভালো ভালো এবং ‘সত্য’ কথা বলেও মানুষের কাছে যেতে পারছে না, এটা ভেবে দেখা প্রয়োজন। ঘুরেফিরে সাধারণ মানুষের আস্থা ওই ‘নৌকা’ আর ‘ধানের শীষে’। তৃতীয় শক্তি হিসেবে ‘লাঙলকেই’ মানুষ বেছে নিয়েছে শুধু এরশাদের ‘আঞ্চলিকতা প্রীতি’র কারণে। রাজনীতি নয়, বরং আঞ্চলিকতাই জাতীয় পার্টির মূল শক্তি। তবে লাঙল কোনো দিনই ‘নৌকার’ বিকল্প হবে না কিংবা ‘ধানের শীষে’র স্থান দখল করে নিতে পারবে না। বাস্তবতা যেহেতু ভোটের রাজনীতিতে ‘নৌকা’ আর ‘ধানের শীষ’ অন্যতম ফ্যাক্টর, সে ক্ষেত্রে এই দুটি বড় দলের মধ্যে ‘আস্থার সম্পর্ক’ থাকা দরকার। এই ‘আস্থার সম্পর্কই’ এ দেশের রাজনীতিতে একটি স্থিতিশীলতা এনে দিতে পারে। এখন এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নির্ভর করে দুই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ওপর। একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য এই আস্থার সম্পর্কটা খুবই জরুরি। এই আস্থার সম্পর্কটা গড়ে উঠছে না। দোষারোপের রাজনীতির বৃত্ত থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না। এই দুটি বড় দল, এক দল অন্য দলকে দোষী সাব্যস্ত করছে। এর প্রভাব পড়ছে রাজনীতিতে। গায়েবি মামলার সংখ্যা বাড়ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের কড়া বার্তার পরও ‘গায়েবি’ মামলা করা থেমে নেই। মামলায় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের আসামি করার ক্ষেত্রে ভালোভাবে যাচাই করার নির্দেশনা থাকলেও তা প্রতিপালন করা হচ্ছে না বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে। এমনও দেখা গেছে, জনৈক বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা দেশেই ছিলেন না; কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ‘উসকানি দেওয়ার’ অভিযোগে মামলা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা পুলিশের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে।
রাজনৈতিক এই ডামাডোলের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক সম্ভাবনাময়। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকিং করপোরেশন এইচএসবিসি সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বিশ্বে ২০১০ সাল নাগাদ যেসব দেশের অর্থনীতির আকার দ্রুত বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, সেই তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে সবার ওপরে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে ‘বিগেস্ট রাইজার্স’ বা সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে অভিহিত করেছে এইচএসবিসি গ্লোবাল রিসার্চ। এইচএসবিসি বলছে, বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল ও উদীয়মান ৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি সবচেয়ে বেশি হারে বাড়বে। জিডিপির আকার বিবেচনায় বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৪২তম। ২০৩০ সালে ১৬ ধারা এগিয়ে বাংলাদেশ উঠে আসবে ২৬তম অবস্থানে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরবর্তী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭.৩ শতাংশ হারে। অর্থনীতির এই চিত্র আশার কথা বলে। কিন্তু অর্থনীতির এই চিত্র মুখ থুবড়ে পড়বে যদি দেশে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে। এ ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনীতিতে আস্থার সম্পর্ক বজায় থাকা। সামনে নির্বাচন। নির্বাচনে প্রতিটি দলই তাদের কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাবে। কিন্তু যদি আস্থার সম্পর্ক না থাকে, যদি রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয় কিংবা সহিংসতার পথ বেছে নেয়, তাহলে আমাদের জন্য তা কোনো শুভ সংবাদ বয়ে আনবে না। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। আর সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে, আমাদের প্রত্যাশা এটাই।
Daily Kalerkontho
11.10.2018

রাজনীতিতে সুবাতাস কি বইবে?


আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখন পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান নিয়েছে, ঠিক তখনই একটি ভালো খবর আমরা পেলাম গত ৬ অক্টোবর। চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ভর্তি করানো হয়েছে। গত ৪ অক্টোবর হাইকোর্টের এক নির্দেশে বেগম জিয়াকে এই হাসপাতালে ভর্তি ও তার পছন্দমতো চিকিৎসকদের দিয়ে চিকিৎসা করানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এর আগে অবশ্য তিনি এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করে আসছিলেন। তার পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, বিএসএমএমইউ নিয়ন্ত্রণ করে সরকারপন্থি চিকিৎসক দল। এখানে তিনি ভালো চিকিৎসা পাবেন না। বেগম জিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার। আদালত শেষ অব্দি বিএসএমএমইউকে চিকিৎসার নির্দেশ দিলেন বটে, তবে বেগম জিয়ার পছন্দের চিকিৎসকদের দিয়ে চিকিৎসার অনুমতিও দিলেন। সরকার পক্ষও এ ব্যাপারে আপত্তি করল না। এর মধ্যে দিয়ে কি রাজনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করল? বিএনপির পক্ষ থেকে যে সাত দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল তাতে এক নম্বর ছিল বেগম জিয়ার মুক্তি। বেগম জিয়ার এখন ‘মুক্তি’ হলো না বটে, কিন্তু তিনি এখন ভালো চিকিৎসা পাবেন। এর প্রয়োজন ছিল। তিন তিনবারের একজন প্রধানমন্ত্রী। তিনি যদি ‘চিকিৎসা’ না পান, তা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। বেগম জিয়ার চিকিৎসা আর রাজনীতি দুটো ভিন্ন বিষয়। সামনে নির্বাচন। বিএনপি ইতোমধ্যে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে ‘যোগ’ দিয়েছে। যদিও ঐক্য প্রক্রিয়ার অন্যতম শরিক বিকল্পধারার সঙ্গে বিএনপির একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ঐক্য প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে একটি লিয়াজোঁ কমিটিও গঠন করেছে। এই লিয়াজোঁ কমিটি ঐক্য প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট দলগুলোর মধ্যে ‘কো-অর্ডিনেশন’ করবে। বিকল্পধারার পক্ষ থেকে যেসব দাবিদাওয়া উপস্থাপন করা হয়েছিল, সেসব বিএনপি যে মানবে না, তা ইতোমধ্যে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। এতে করে একটা সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে যে, বিকল্পধারাকে বাদ দিয়েই ঐক্য প্রক্রিয়া একটি নির্বাচনী জোট গঠন করতে পারে বিএনপির সঙ্গে। অথবা বিএনপি ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে আন্দোলন করলেও, ২০-দলীয় জোটের ব্যানারেই নির্বাচন করবে; ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যানারে নয়।
স্পিরিটটি হচ্ছে সরকারবিরোধী সব শক্তিকে একটি প্ল্যাটফর্মে আনা। এ ক্ষেত্রে বিএনপি বড় দল হলেও, ড. কামালের নেতৃত্ব তারা মেনে নিয়েছে। যদিও ২০-দলীয় জোটে এই ঐক্য নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে। এলডিপি, কল্যাণ পার্টি কিংবা ন্যাপের মতো সংগঠন জাতীয় ঐক্যজোটের ব্যাপারে খুব যে উৎসাহী, তা বলা যাবে না। এই দলগুলো দীর্ঘদিন বিএনপির সঙ্গে আছে। এখন বিএনপি যদি ‘নতুন মিত্র’ পেয়ে এদের ‘পরিত্যাগ’ করে, তাহলে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকবে। বিএনপির উচিত হবে ২০-দলীয় জোটকে সঙ্গে রেখেই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়া। জাতীয় ঐক্যজোট গঠিত হওয়ায় সরকারের কোনো ক্ষতি নেই। কেননা শেষ পর্যন্ত ঐক্যজোটের ব্যানারে বিএনপি থাকায় একটি শক্তিশালী বিরোধী জোটের জন্ম হলো। আর বিএনপিরও একটা প্লাসপয়েন্ট- আওয়ামী লীগ বিরোধী বেশ কয়েকটি দলকে তারা সঙ্গে পেল। কিন্তু দুটো প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। এক. নির্বাচনকালীন সরকার, দুই. সংসদ ভেঙে দেওয়া। ড. কামালও এ দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারের মনোভাব এখনো অনমনীয়। সরকার বার বার সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে। প্রশ্ন এখানেই- সরকারের দাবি মেনেই কি জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাচ্ছে? এবং বিএনপি বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে ‘মাইনাস’ করেই কী নির্বাচনে যাচ্ছে! এসব প্রশ্ন বার বার আলোচিত হতে থাকবে। মানুষ একটি ভালো নির্বাচন চায়। চায় তার ভোট সে নিজে তার মানোনীত প্রার্থীকে দেবে। ভোট কেন্দ্র দখল, সিলমারা সংস্কৃতি, প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দান- এই যে ‘সংস্কৃতি’ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তা থেকে বের হয়ে আসা দরকার। এটা আওয়ামী লীগের জন্য যেমনি ভালো, তেমনি ভালো বিএনপিসহ অন্যান্য দলের জন্যও। একটা সুযোগ এসেছে। সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপিকে নির্বাচনী ধারায় নিয়ে আসতে পারলে লাভ সরকারেরও। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করেছে। সেখানেও বিএনপি তাদের সাত দফা দাবি উত্থাপন করেছে। এক্ষেত্রে প্রধান দাবিটি হচ্ছে, সব দলের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের বলেছেন, সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সুযোগ নেই। এর অর্থ হচ্ছে, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়েই তিনি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করবেন। তার এই বক্তব্যকে ধারণ করেও বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছে করলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে এই মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। সংবিধানের ৫৫(১) ধারায় মন্ত্রিসভা গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে। আর ৫৬(২) ধারায় প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংসদ সদস্যদের বাইরে থেকে ‘টেকনোক্রেট কোটায়’ মন্ত্রী নিয়োগ করতে। সুতরাং নির্বাচনকালীন সময়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য নন এবং বিএনপি সমর্থিত সদস্যদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। এখানে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছেটাই হলো আসল। বিএনপি যে সাত দফা দাবি উত্থাপন করেছে, তাতে নির্বাচন কমিশন পুনঃগঠন ও নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহার না করার কথা বলা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নিজে ব্যক্তিগতভাবে ইভিএম মেশিন ব্যবহার করার পক্ষে কথা বলেছেন। তবে যেখানে এখনো ইভিএম মেশিন শতকরা একশ’ ভাগ নির্ভরযোগ্য নয়, সে ক্ষেত্রে ইভিএম মেশিন ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। এর আগে অতি উৎসাহী সিইসির ইভিএম মেশিন নিয়ে বক্তব্য নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। ইতোমধ্যে ইসিতে নতুন করে দ্বন্দ্বের যে খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল তার সমাধান হয়েছে। একটি বড় অভিযোগ করেছিলেন চারজন কমিশনার। তাদের অভািযোগ, সিইসি কমিশনারদের না জানিয়ে একাই অনেক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এটা একটা গুরুতর অভিযোগ। এখন এর অবসান হয়েছে। কিছুদিন আগে নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হবে- এমন বক্তব্য দিয়ে সিইসি বিতর্কিত হয়েছিলেন। এ ধরনের বক্তব্য তার দেওয়া উচিত হয়নি। একটি বা দুটি ‘সিটে’ ধানের শীষের প্রতীকী প্রার্থী দিয়ে বিএনপি ইচ্ছে করলে তার নিবন্ধন ধরে রাখতে পারে। এটা একটা সাধারণ মানুষও বোঝে। অথচ সিইসি এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তার নিজের নিরপেক্ষতা তিনি ক্ষুণ্ন করেছেন।
নির্বাচনের খুব বেশি দিন বাকি নেই। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের দাবি আজ শুধু দেশের ভেতর থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে, তেমনটি নয়। বরং দেশের বাইরে থেকেও উচ্চারিত হচ্ছে। কমনওয়েলথের মহাসচিব পেট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড ইতোমধ্যে বিএনপির মহাসচিবকে একটি চিঠি লিখেছেন। তাতে তিনি আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বিএনপির মহাসচিব এই চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি এই চিঠির জবাব দেবেন। দাতা দেশগুলোর পক্ষ থেকে বার বার সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। বিএনপি যে বড় ডায়লামা ‘ফেস’ করছে, এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। বেগম জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার চিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরও কিছু প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে। তারপরও ধারণা করছি, নির্বাচন পর্যন্ত বেগম জিয়া বিএসএমএমইউতেই থাকবেন। তাকে আর নজিমুদ্দিন রোডে যেতে হবে না। ৭ অক্টোবর বিএনপি-যুক্তফ্রন্ট জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার বৈঠক হয়েছে। বিকল্পধারার মহাসচিব ছিলেন ওই বৈঠকে। এটা নিঃসন্দেহে একটি মেসেজ। বোঝাই যাচ্ছে যুক্তফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ বিকল্পধারাকে নিয়েই বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করতে যাচ্ছে। আবার বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের একটি বক্তব্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। গত শনিবার রাতে নোয়াখালী প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে তিনি মন্তব্য করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে যেতেও আপত্তি নেই তাদের। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবারের নির্বাচন থেকে কোনোভাবেই দূরে থাকবে না তার দল (সূত্র : ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি সংবাদ)। এখন দেখা যাচ্ছে, বিকল্পধারার মহাসচিব ও যুগ্ম মহাসচিব যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, তা বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করার পরিপন্থী। তবে বিকল্পধারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিতে চাইলেও, চূড়ান্ত বিচারে তারা তা পারবে কি না তাতে সন্দেহ রয়েছে। কেননা প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ১৪ দলের জোটের সম্প্রসারণের পক্ষে নন। শেষ অব্দি বিকল্পধারা ‘একূল-ওকূল’- দুকূলও হারাতে পারে। বিকল্প ধারা ঐক্য প্রক্রিয়ায় আছে বটে, কিন্তু নির্বাচনী জোটে থাকবে কি না, তা বলা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের আস্থার সঙ্কট রয়েছে। এ দেশের রাজনীতি দুটি বড় দলই নিয়ন্ত্রণ করে। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, এই দুটি বড় দলের মধ্যেই আস্থার সঙ্কট রয়েছে। কেউ কাউকে আস্থায় নিতে পারছেন না। দুটি বড় দলের নেতৃবৃন্দ নিত্যদিন পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখছেন। টিভি টক-শোতে গিয়ে ঝগড়ায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। মানুষ এতে করে বিভ্রান্ত হচ্ছে। এই রাজনীতি বাংলাদেশের কোনো মঙ্গল ডেকে আনতে পারছে না। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করছে। ২০২৪ সালে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে। আন্তর্জাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি সম্প্রতি তাদের প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশ ২০৩০ সাল পর্যন্ত তার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭-এর উপরে রাখবে। যেকোনো বিবেচনায় এটা একটা আশাব্যঞ্জক খবর। কিন্তু এর পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যদি বিঘ্নিত হয়, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়বে। আমাদের সব অর্জন ব্যর্থ হবে। ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল বিশ্বে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সৃষ্টি হবে বড় প্রতিবন্ধকতা। তাই আস্থার সম্পর্ক থাকাটা জরুরি। নির্বাচনের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই শঙ্কা বাড়ছে জনমানসে। কী হবে এবার? ২০১৮ সালে কি ২০১৪ সালের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে? সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে নির্বাচনটি হয়েছিল (২০১৪) সত্য, কিন্তু জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠেনি। ১৫৩ জন সংসদ সদস্যের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা আর যাই হোক গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যায় না। তাই ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সব দল অংশগ্রহণ করুক, আমরা একটা স্থিতিশীল পরিবেশ পাই- সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বোধহয় এটাই।
Daily Bangladesher Khobor
09.10.2018

দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি



সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার বেশ ক’টি দেশে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রত্যেকটি দেশে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়েছে অথবা বলা যেতে পারে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেখানে নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। পাকিস্তান থেকে শুরু করে মালদ্বীপ, আর এর আগে নেপাল ও ভুটান সর্বত্রই পরিবর্তন এসেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সেখানে নয়া সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চীন ও ভারতের বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। অর্থাৎ কোথাও ‘চীনাবান্ধব’ সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, কোথাওবা আবার ‘ভারতবান্ধব’ সরকার দেশ পরিচালনায় দায়িত্ব পেয়েছে।
সর্বশেষ ‘বড়’ পরিবর্তনটা সাধিত হয়েছে মালদ্বীপে। বলা হয়, হাজারো দ্বীপের দেশ হচ্ছে মালদ্বীপ। সম্প্রতি মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গেছেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন। নির্বাচনে শতকরা ৫৮ ভাগ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। দেশটিতে সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যায়, সেখানে চীন ও ভারতের মধ্যে একধরনের ‘প্রভাব বলয় বিস্তারের’ প্রতিযোগিতা ছিল। নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে চীনাপন্থি বলে গণ্য করা হতো। অন্যদিকে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহকে ভারতপন্থি বলে বিবেচনা করা হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই সেখানে সংকট শুরু হয়। মুখোমুখি অবস্থান নেন দেশটির আদালত। ওই সময় দেশটির সর্বোচ্চ আদালত এক আদেশে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদসহ বিরোধীদলীয় নয়জন রাজনৈতিক বন্দিকে অবিলম্বে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে বহিষ্কৃত ১২ জন আইন প্রণেতাকে স্বপদে ফিরিয়ে আনারও আদেশ দেওয়া হয়েছিল। এটি হলে দেশটির ৮৫ সদস্যের আইনসভায়ও ওই সময়ই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যেত মালদ্বীপের বিরোধী দলগুলো। কিন্তু আবদুল্লাহ ইয়ামিন এতে রাজি ছিলেন না। পরিস্থিতির অবনতি হলে সেখানে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। এ সংকটের সময় চীন ইয়ামিনের পাশে এসে দাঁড়ায়। সম্ভাব্য ভারতীয় হস্তক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় হেলিকপ্টার প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি পর্যন্ত জানিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন অতিমাত্রায় চীনের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। চীনের বিনিয়োগও বাড়ছিল মালদ্বীপে। মালদ্বীপের কাছে চীন পাবে ১৩০ কোটি ডলার।
কোনো কোনো মহল থেকে অভিযোগ করা হয়, মালদ্বীপের চীনের প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতাকে ভারত ভালো চোখে দেখেনি। একসময় শ্রীলঙ্কাকে নিয়েও ভারতের শঙ্কা ছিল। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে অতিমাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এটাকে ভারত দেখেছিল তার নিরাপত্তার প্রতি একধরনের ‘হুমকি’ হিসেবে। ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে ভারত-চীন দ্বন্দ্ব বাড়ছে। ভারত চায় না, চীন এ অঞ্চলে তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়াক। এখন মালদ্বীপে মোহাম্মদ সলিহর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাবে ভারত। এটা স্পষ্ট, নয়া প্রেসিডেন্ট চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা কমাবেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করবেন। ভারত-মালদ্বীপ সম্পকর্কে আগের অবস্থায় নিয়ে আসবেন। অনেকটা শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার মতো স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করবেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সলিহ। শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপে চীন এখন কিছুটা ব্যাকফুটে। ভারতের অবস্থান এখানে শক্তিশালী।
মালদ্বীপের পাশাপাশি ভুটানেও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৫ সেপ্টেম্বর। ভুটানের অবস্থান, এর স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব ভারত ও চীন উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে ভারতপন্থি দল হিসেবে পরিচিত পিডিপির বড় ধরনের পরাজয় হয়েছে। ভোটের ফলাফলে দলটি নেমে গেছে তৃতীয় অবস্থানে। এটা ছিল প্রথম রাউন্ডের নির্বাচন। ফাইনাল রাউন্ড অনুষ্ঠিত হবে ১৮ অক্টোবর। ১৫ সেপ্টেম্বরের ফলাফলে সর্বোচ্চ প্রাপ্ত ভোটে যারা প্রথম ও দ্বিতীয়, সেই দলের দুই প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। ২০১৩ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে পিডিপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। এবার তাদের অবস্থান তৃতীয়। ২০১৩ সালে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ডিপিটি। এবারও তাদের অবস্থান দ্বিতীয়। কিন্তু যারা তৃতীয় হয়েছিল ডিএনটি, তারা সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রথম অবস্থানে আছে। দলটির বয়স মাত্র অল্প কিছুদিনের। মজার ব্যাপার হলো, ডিএনটি দলের যিনি প্রধান, তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, তিনিই হবেন প্রধানমন্ত্রী। ভুটানে ভারতের প্রভাব বেশি। প্রশাসন বেশি মাত্রায় ভারত নির্ভর। ভুটানের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি ভারত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যে কারণে চীনের কোনো দূতাবাস খোলার অনুমতি দেয়নি ভুটান সরকার। ভুটানে যেতে হলে ভারতের ওপর দিতে যেতে হয়। ভুটান একদিকে ভারত, অন্যদিকে চীন দিয়ে ঘেরা, এমনকি ভুটানে প্রচুর জলবিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও তা যদি বাংলাদেশ ব্যবহার করতে চায়, তাহলে এতে ভারতের সম্মতির প্রয়োজন হবে। মোদির ঢাকা সফরের সময় একট উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার (বিবিআইএন) কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এখন ভারতপন্থি দল হিসেবে পরিচিত পিডিপির হেরে যাওয়া ভুটানের রাজনীতিতে তা এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। এখন নয়া সরকার গঠিত হওয়ার পরই বোঝা যাবে, নয়া সরকার ভারত ও চীনের ব্যাপারে কী ভূমিকা নেয়।
নেপালের খবর আমরা সবাই জানি। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকার পর সেখানে এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। ২০১৫ সালে সংবিধান প্রণয়ন করার পর সেখানে ১৫ ফেব্রুয়ারি (২০১৮) নির্বাচনের দুই মাস পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন কেপি শর্মা অলি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ২৭৫ আসনের মধ্যে নেপালি কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৬৩ আসন। অন্যদিকে বাম জোট পেয়েছিল ১৭৪ আসন। এর মাঝে অলির নেতৃত্বাধীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির (ইউনাইটেড-মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট) আসন ১২১ আর পুষ্প কুমার দাহালের (প্রচ-) নেতৃত্বাধীন মাওবাদীদের আসন ৫৩। এর বাইরে রাষ্ট্রীয় জনতা পার্টির ১৭, আর সমতাবাদী পার্টির আসন ১৬। অলির বিজয় একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেপালের ক্ষেত্রে। এতদিন ভারতের একটা প্রভাব ছিল নেপালে। অলি সেই ভারতীয় প্রভাব থেকে বের হয়ে এসে চীনের দিকে ঝুঁকছেন। নেপাল চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে। নেপাল ও চীন রেলসংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছেন নয়া প্রধানমন্ত্রী। চীনের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ায়ও অংশ নিচ্ছে নেপাল। নেপালের এ ভূমিকা ভারতের পছন্দ নয়। সংগত কারণেই ভারত এতে অসন্তুষ্ট। ফলে ভারত-চীন দ্বন্দ্ব নেপালের রাজনীতিতেও এখন পড়ল। চলতি বছর বাংলাদেশে নির্বাচন। আর ২০১৯ সালের জুনে ভারতের লোকসভার নির্বাচন। পাঠকমাত্রই জানেন, পাকিস্তানে চলতি বছর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ইমরান খানের নেতৃত্বে একটি নয়া সরকার সেখানে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। ইমরান খান অনেক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন পাকিস্তানে। তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সেখানে খারাপ। চীনের ওপর নির্ভরশীলতা পাকিস্তানের আরও বেড়েছে। আর আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০১৯ সালের এপ্রিলে।
সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কিছু কিছু পরিবর্তন আসছে। নতুন নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের জন্ম হয়েছে। চীন-ভারত দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটেছে। বঙ্গোপসাগরে ভারতের সামরিক তৎপরতা বেড়েছে। ভারত মহাসাগরজুড়ে বেশ কয়েকটি দেশের সাম্প্রতিক যুদ্ধজাহাজ ও ডুবোজাহাজের সংখ্যা এবং সামরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধির ফলে এ অঞ্চলজুড়ে এখন চলছে একধরনের চাপা উত্তেজনা। গাওদারে ও হামবানতোতায় চীনা ডুবোজাহাজের উপস্থিতি ভারতকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এ অঞ্চলে ভারত তার প্রভাব বাড়াচ্ছে। পাকিস্তানে নয়া সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা এরই মধ্যে মিইয়ে গেছে। পাকিস্তানে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। আগামীতে যে হবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে সার্ক একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশগুলো এখন সার্কের পরিবর্তে বিমসটেককে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের সমন্বয়ে যারা বঙ্গোপসাগর অববাহিকায় অবস্থিত, নতুন এক শক্তিশালী আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্ম হচ্ছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। নতুন নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটছে।
এসব নতুন শক্তি নতুন রাজনীতি নিয়ে আসছে। পুরানো ট্র্যাডিশনাল শক্তিগুলোর প্রভাব ও প্রতিপত্তি কমছে। পাকিস্তান থেকে শুরু করে মালদ্বীপ, এমনকি ভুটানেও নতুন শক্তির উত্থান ঘটছে। এখন দেখার পালা, এ নতুন শক্তি একুশ শতকে দক্ষিণ এশিয়াকে কোথায় নিয়ে যায়।
Daily Alokito Bangladesh
07.10.2018