রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

এ কি কথা বললো বিকল্পধারা!

বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের একটি বক্তব্য, একটি অনলাইন (আরটিএনএন) সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে গত ১৯ নভেম্বর। ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বিকল্পধারার চেয়ারম্যান ডা. বি. চৌধুরীর বাসায় গিয়েছিলেন। বিকল্প ধারার নেতৃবৃদের সাথে ভারতীয় হাই কমিশনারের বৈঠকও হয়েছে। বৈঠক শেষে বিকল্প ধারার মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। নিবাচর্নের আগে তাদের সাহায্য প্রয়োজন। যদিও তিনি এটা স্পষ্ট করেননি যে, এই সাহায্যের ধরনটা কী হবে? এমনকি হাইকমিশনার শ্রিংলাও সাংবাদিকদের বলেননি, ভারত কীভাবে সাহায্য করবে বাংলাদেশকে। তবে তিনি বলেছেন, তারা বিকল্পধারাকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন। নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা নিয়ে তাদের কোনো মন্তব্য নেই, এ কথাটা বলতেও তিনি ভোলেননি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারতের সাহায্য প্রয়োজন। বিকল্প ধারার এই যে অবস্থান এটা বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। নির্বাচনের জন্য আমাদের ভারতের কেন ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে একটি নির্বাচনকালীন সরকার কাজ করতে শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচনের প্রস্তুতিও গ্রহন করেছে। এমতাবস্থায় বিকল্প ধারার মতো একটি রাজনৈতিক দল যদি বলে, নির্বাচনে ভারতের সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে, তখন এটা নিয়ে বিতর্ক হতে বাধ্য। বিকল্প ধারার মহাসচিব এ ধরনের একটি কথা বললেন, এমন একটি সময় যখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে নানা কথাবার্তা হচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বর্পূর্ণ। নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের তৎপর হতে আমার দেখছি। ভারতীয় হাই কমিশনারের পাশাপাশি ব্রিটিশ হাই কমিশনারও তৎপর হয়েছেন। ঢাকায় নিযুক্ত বৃটিশ হাই কমিশনার অ্যালিসন ব্লাকও সম্প্রতি দেখা করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সভাপতি ড. কামাল হেসেনের সাথে।
সাক্ষাৎকারের পর ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ব্রিটিশ হাই কমিশনারকে জানানো হয়েছে, ঐক্যফ্রন্ট নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। সেক্ষেত্রে সাত দফা দাবিও সরকারের কাছে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য মিস ব্লাকের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
স্পষ্টতই নির্বাচনের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে ভারত কিংবা বৃটিশ হাইকমিশনারের কোনো মন্তব্য থাকতে পারে না। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য এখানেই যে, আমরা বারবার আমাদের অভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে বিদেশিদের দারস্থ হয়েছি। এটা ভালো নয়।
একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকারের সব মন্ত্রীরাই এখন ক্ষমতায়। পুলিশ প্রটেকশন নিচ্ছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। সংসদও ভেঙে দেয়া হয়নি। ড. কামাল হোসেন একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবি করছেন বটে। কিন্তু এর পেছনে যুক্তি যাই থাকুক না কেন ঐক্যফ্রন্টের উচিত ছিলো, সাংবিধানিক কাঠামোয় এর একটি সমাধান বের করা। তারা তা করেননি। ঐক্যফ্রন্টের থিংক ট্যাঙ্ক অতো শক্তিশালী নয়। তারা কোনো ফর্মুলা দিতে পারেননি। এমনকি সংলাপেও তারা একটি ফর্মুলা দিতে পারতেন। জাতি কোনো বিকল্প কিছু পায়নি। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আছেন, মন্ত্রীরা সবাই আছেন। এটা ঐক্যফ্রন্টকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। একটি ছোট্ট মন্ত্রিসভা ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হলে মন্ত্রিসভার গ্রহণযোগ্যতা বাড়তো। কিন্তু তা হয়নি। সংলাপ হয়েছে বটে। কিন্ত ফলাফল শূন্য। এখন শূন্য ফালাফল নিয়েই ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনে যেতে হচ্ছে। তবে একটি ভালো খবর- ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাবে। এটাই সঠিক রাজনীতি। নির্বাচন বয়কট কোনো ‘রাজনীতি’ হতে পারে না। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচক বয়কট করেছিলো। কিন্তু তা দলেটির জন্য সুখের হয়নি।
এখন নির্ধারিত সময়ই নিবার্চন হচ্ছে। তবে এই নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেক। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যেখানে আস্থার সম্পর্ক থাকা জরুরি, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেই আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বারবার প্রশ্ন ওঠে। এর একটা স্থায়ী সমাধান দরকার। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করাও জরুরি। নয়া সরকার (২০১৯) বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিতে পারে। নির্বাচনের আগে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একটি জাতীয় দৈনিকে (প্রথম আলো ১৯ নভেম্বর) অভিযোগ তোলা হয়েছে নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা ব্যক্তিদের সম্পর্কে পুলিশ খোঁজ-খবর নিচ্ছে। অথচ ইসি জানিয়েছে, তারা পুলিশকে এই দায়িত্বটি দেয়নি। এতে করে ইসির সমতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। বিগত সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছিলো। ওই নির্বাচনে (খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর) ভোট কেন্দ্র দখল, সিলমারা রাজনীতির দৃশ্য মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিলো মিডিয়ার বদৌলতে।
তখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এইসব দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেেব না- ইসি এটা নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে ইসি জাতিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। তাই যেকোনো বিবেচনায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে স্পষ্টতই বেগম জিয়া ও তারেক রহমান অন্তত আগামী পাঁচ বছরের জন্য মাইনাস হয়ে গেলেন। এমনকি বিরোধী দলীয় রাজনীতিও চলে গেলো বিএনপির নেতৃত্বের বাইরে। ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি থাকলেও তাদের ভূমিকা এখন সীমিত হয়ে যাবে। নতুন এক রাজনীতির যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর যারাই সরকার গঠন করবে তারাই গুরুত্ব দেবে সংসদীয় রাজনীতিকে। এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের প্রতি নির্ভরশীলতাও কমে যাবে। সংসদ বয়কটের রাজনীতি থেকেও বেড়িয়ে আসবে বাংলাদেশ।

ঐক্যফ্রন্টের খসড়া ইশতেহার নিয়ে কিছু কথা

সংবাদপত্র জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের খসড়া ইশতে হারছাপা হয়ে। উক্ত ইশতেহারে বেশ কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা আলোর দাবি রাখে। জাতয়ি ঐক্যফ্রন্ট একাদশ জাতীয় নিবাচনকে সামনে রেখে এই ইশতেহার প্রকাশ করলো। সাধারণত প্রতিটি রাজনৈতিকদল বা জোট নির্বাচনের আগে কিছু কিছু প্রতিশ্রুতি দেয় যা ইশতেহারে উল্লেখ থাকে। একাদশ জাতীয় নিবার্চনের প্রাক্কালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং যা খসড়া ইশতেহারে উল্লেখ করেছে তা অনেকটা এরকম :
১.সরকারি চাকরিতে বয়স সীমা তুলে দেয়া ২.প্রতিবন্ধী কোটা চালু করা ৩. বেকার ভাতা ৪. পিত্রসসি জেএসসি বাতিল ও পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় গুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা ৫. মাদ্রাসা শিক্ষাথীর্দের কারিগরী শিক্ষা দিয়ে বিদেশে প্রেরণ ৬. দুর্নীতির বিচারে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন,৭. পর পর দু’মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না ৮. সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা। ৯. তিস্তা ও রোহিঙ্গা সমস্যার আলোচনার মাধ্যমে সমাধান ১০. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল ১১. ন্যায়পাল নিয়োগ ১২. নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোটার পরিবর্তে শতকরা ২০ ভাগ মনোনয়নের ব্যবস্থা ১৩. প্রবাসীদের ভোটাধিকার ১৪. শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ১৫. কৃষি ভর্তুকি বাড়িয়ে সার ও বীজ সহজলভ্য করা। এর বাইরে আরও কয়েকেটি প্রতিশ্রুতি রয়েছে। যা অত্যন্ত সাধারণ মানের।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হবার পর সাধারণ মানুষের পাশে এই জোটের ব্যাপারে আগ্রহ বেড়েছে। সাধারণ মানুষের মাঝে একটা প্রত্যাশা থাকবেই যে জোট ক্ষমতায় গেলে তাদের জন্য কী কী করবে। ক্ষমতায় গেলে তাদের পররাষ্ট্র নীতি কী হবে কিংবা অর্থনীতি কী হবে? সে ব্যাপারেও অনেকের আগ্রহ থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের খসড়া ইশতেহারে আগামীর বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। ইশতেহারে সব সাধারণ কথাবার্তা বলা হয়েছে। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে শুধু এক জায়গায় বলা হয়েছে তিস্তা ও রোহিঙ্গা প্রশ্নে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান। এর মাধ্যমে নতুনত্ব কী পেলাম আমরা? সরকার তো তিস্তার পানি বণ্টনে ভারতের সাথে ও রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের সাথে আলোচনা চালিয়ে আসছে। তাহলে সরকারের সাথে ঐক্যফ্রন্টের পার্থক্য থাকলো কোথায়? পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তিস্তা ও রোহিঙ্গা ইস্যু দুটোই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আমাদের ‘অ্যাপ্রোজ’ কী হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা থাকা উচিত ছিলো। সম্পর্ক, চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাদের জাতীয় স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু একটি বাক্যও লেখা নেই এ সংক্রান্ত বিষয়ে। অর্থনীতি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি হচ্ছে বলা হচ্ছে। এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে আমাদের কোন ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয়া প্রয়োজন। সে ব্যাপারে মহাপরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। আমাদের এক বিশাল তরুণ প্রজন্ম রয়েছে। এই তরুণ প্রজন্ম একটি শক্তি। এই তরুণ প্রজন্মকে আমরা শিক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে বিদেশে রফতানি করতে পারি। জাপানে ও ইউরোপে দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে। এ দেশগুলোতে এখন তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রাখতে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করবে। আমরা তাদের ‘অভাব’ পূরণ করতে পারি। কিন্তু সে জন্য যা প্রয়োজন তা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের দেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো বেকার সৃষ্টি করছে। এরা জাতীয় উন্নয়নের কোনো সমাধান রাখতে পারছে না। বিশেষ বিশেষ খাতকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। আইটি খাতে বিদেশে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। নার্সিং পেশায় চাহিদা বিদেশে ব্যাপক।
মেডিকেল টেকনোলজিস্টও দরকার। এই খাতগুলো উপেক্ষিত। প্রতিটি জেলায় প্রতিটি কলেজকে টেকনোলজি কলেজে ধীরে ধীরে উন্নিত করতে হবে। বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ শিক্ষার পরিবর্তে প্রযুক্তিগত বিদ্যা, বায়োটেকনোলজি, কৃষি, আইটি এসব বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় ভেঙে প্রতিটি বিভাগে একটি করে টেকনিকাল বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। সাধারণ শিক্ষা আমাদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। দক্ষ জনশক্তিও তৈরি করতে পারছে না। সুতরাং ঐক্যফ্রন্ট একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা জাতিকে জানাতে পারতো। কিন্তু ইশতেহারে তা নেই।
তবে এটা ঠিক ইশতেহারে কিছু ভালো কথাও আছে। দুটার্মের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না-এটি ভালো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট দুটার্মের বেশি থাকতে পারেন না। এমনটি ইউরোপের অনেক দেশে দল হেরে গেলে দলের নেতা যিনি নেতৃত্ব থাকে কিংবা যার নেতৃত্বে দল নির্বাচনে যায়, দল হেরে গেলে তিনি নেতৃত্ব ছেড়ে দিবেন। দৃষ্টান্ত ব্রিটেনের পার্লামেন্টারি সিস্টেম। দুটার্মের বেশি কেউ ক্ষমতায় থাকলে, ক্ষমতা এককেন্দ্রিক হয়ে যায়। চাকরিতে (সরকারি) বয়সসীমা তুলে দেয়ার ঘোষণাও ভালো। প্রচলিত ব্যবস্থায় পিএসসির মাধ্যমে যারা নিয়োগ প্রাপ্ত হন, তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশ^ বদলে যাচ্ছে। বিষয় ভিত্তিক দক্ষ জনশক্তি না থাকায় আমরা অন্য দেশের সাথে নেগোসিয়েশনে আমাদের স্বার্থ আমরা আদায় করতে পারি না। তাই সচিবালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ক্যাডার খাতের বাইরে গিয়ে বেসরকারি থাত থেকে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেয়া যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা অনুসরণ করে। মোদি সরকারও ভারতে এট চালু করেছেন। নারীদের সংরক্ষিত কোটা না রাখার প্রস্তাবও ভালো (পশ্চিমবঙ্গ কিংবা নরডিক দেশগুলোর দৃষ্টিান্ত আমরা অনুসরণ করতে পারি। তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে বিরোধী দলের সাথে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। এ জন্য সংসদে প্রধান বিরোধী দল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার, একাধিক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানর পদ দেয়া যেতে পারে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও আস্থার রাজনীতি

রাজনীতি এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক। নির্বাচন নিয়ে যে শঙ্কা ছিল, তা কেটে গেছে। নির্বাচনী আকাশ এখন পরিষ্কার। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ড. কামাল নিজে নির্বাচনে লড়বেন, এমন একটি কথা নাকি মির্জা ফখরুলকে দিয়ে দিয়েছেন। ১০ জন সুধীর একটি তালিকাও দিয়েছেন ড. কামাল হোসেন, যাঁদের তিনি পার্লামেন্টে দেখতে চান। তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথমে ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল। এখন তা পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ অনেক আগেই মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করেছে। সেখানে ‘স্টার’দের বড্ড ভিড়। একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনারও এখন ‘নৌকায়’ উঠতে চান। একজন জনপ্রিয় ক্রিকেটার এখন খেলার মাঠ ছেড়ে এবং অবসর না নিয়েই ‘নৌকার’ মনোনয়নপত্র কিনলেন। বিএনপি কিছুটা পিছিয়ে, যদিও সেখানেও ‘স্টার’দের ভিড় আছে। ১৪ দলীয় শরিক দলগুলো এবার দলীয় প্রতীকে নয়, বরং নৌকায় ভরসা খুঁজছে। ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলো ‘ধানের শীষ’ নেবে। ভোটারদের কাছে ‘নৌকা’ আর ধানের শীষের আবেদন অনেক বেশি। নির্বাচনে মার্কা একটা ফ্যাক্টর। রাজনীতি এখন শুধুই নির্বাচনকেন্দ্রিক। কিন্তু দেশে একটি ভালো রাজনীতির জন্য যে আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার, তা কি নিশ্চিত হয়েছে?
ডালাসে এসেছি মাত্র কয়েক দিন। ঢাকা ছেড়েছিলাম যখন, তখন সবেমাত্র ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে প্রথম দফা সংলাপ শেষ হয়েছে। অনেকে এই ডালাসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে সংলাপের ভবিষ্যৎ কী? প্রবাসে পড়ে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিডটার্ম ইলেকশন’ তাদের যতটা না বেশি টেনেছে, তার চেয়ে বেশি টেনেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। কেমন হবে ওই নির্বাচন? আওয়ামী লীগ কি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে? খালেদা জিয়া কি মুক্তি পাবেন? এসব প্রশ্ন আমাকে এই ডালাসে বারবার শুনতে হয়েছে। দ্বিতীয় দফা সংলাপও হয়েছে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে। এরই মধ্যে ঐক্যফ্রন্ট আরো শক্তিশালী হয়েছে কাদের সিদ্দিকীর যোগদানের কারণে। কাদের সিদ্দিকীর দল ছোট। কিন্তু ব্যক্তি কাদের সিদ্দিকী অনেক ‘বড়’। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা তাঁকে ‘অবিসংবাদিত পুরুষে’ পরিণত করেছিল। প্রায় সময়ই তিনি স্পষ্ট করে কথা বলেন। এখন ঐক্যফ্রন্টে তাঁর যোগদান ঐক্যফ্রন্টকে যে আরো শক্তিশালী করবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সরকারের সংলাপ এবং সমঝোতা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বেশি। এর বাইরে এরশাদের নেতৃত্বে ফ্রন্ট বা জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপ হলেও তেমন কোনো গুরুত্ব নেই আমার কাছে। কেননা মহাজোটে থাকা জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করেই একসঙ্গে এখন নির্বাচনে যাবে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘আসন’ ভাগাভাগি হবে। কেননা যে সম্ভাবনা ছিল এরশাদের নেতৃত্বে একটি বিকল্প বিরোধী দল তৈরি হওয়া, সে সম্ভাবনা এখন আর নেই। মানুষ এখনই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ‘প্রধান বিরোধী দল’ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। এরশাদের সেই সুযোগটি এখন আর নেই। যদি মহাজোট আবার সরকার গঠন করে, তাহলে কিছু পদ-পদবি নিয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টিকে এখন খুশি থাকতে হবে।
দুই দফা সংলাপে সফলতার হার ১০০ শতাংশ, তা বলা যাবে না। তবে ‘দূরত্ব’ তো কমে এসেছে। প্রথম দফা সংলাপে সরকার ঐক্যফ্রন্টের উত্থাপিত সাত দফার বেশ কয়েকটি দফা পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছে। যেমন—সভা-সমাবেশে কোনো বাধা দেওয়া হবে না, বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও থাকতে পারবেন, মামলাগুলোর তালিকা দিলে তা তারা দেখবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) বাদ দিলেও সরকারের ক্ষতি নেই। তবে সংসদ বহাল থাকা, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে কিছু জটিলতা আছে। নির্বাচনের আগে পৃথিবীর কোনো দেশেই সংসদ বহাল থাকে না। বাংলাদেশে অতীতে যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে সংসদ বহাল ছিল না। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে নানা জটিলতা তৈরি হয়। এখন সরকার সংসদ ভেঙে নির্বাচন দিয়ে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখেও নির্বাচন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দলের (এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) প্রতিনিধিদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়, যাঁরা নির্বাচন পরিচালনা করবেন। সেই মন্ত্রিসভায় সরকারের শরিক হিসেবে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। সংবিধানে এর ব্যাখ্যা আছে। সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে, মন্ত্রিসভা গঠিত হবে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ‘টেকনোক্র্যাট’ কোটায় বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে ‘আস্থার সম্পর্ক’ স্থাপনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েন করাও সম্ভব। আইনগতভাবে খালেদা জিয়ার মুক্তি দেওয়াও সম্ভব।
ভালো নির্বাচনের পূর্বশর্তই হচ্ছে ‘আস্থার সম্পর্ক’। এই আস্থার সম্পর্ক ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি। নির্বাচনের আগে ন্যূনতম কিছু কোড অব কনডাক্ট (Code of Conduct) পালন করা সবার জন্যই মঙ্গল। নির্বাচন কমিশন (ইসি) একটি আচরণবিধি তৈরি করতে পারে, যেখানে জাতীয় নেতাদের, দলীয় প্রধানদের ব্যাপারে কোনো কটূক্তি করা যাবে না। নির্বাচনী প্রচারণায় শালীনতা বজায় রাখতে হবে। কোনো পর্যায়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করা যাবে না। ভোট কারচুপি কিংবা ‘সিল মারা সংস্কৃতি’ রোধে প্রতিটি কেন্দ্রে ইসি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দিয়ে একেকটি ‘সিটিজেনস কমিটি’ গঠন করতে পারে। চলমান সংলাপ আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় এক ধাপ অগ্রগতি। এই অগ্রগতিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কয়েকটি বিরোধী দলের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন নিয়ে আমাদের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রথমত, বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল কেন হলো? আমি মনে করি, বিএনপির এই সিদ্ধান্ত সঠিক ও যৌক্তিক। কেননা বিগত দিনগুলোতে দেখা গেছে, বিএনপি কোনো শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এটা বিএনপির ব্যর্থতা। যদিও সরকারের জুলুম, হামলা, মামলা, গুপ্তহত্যা ইত্যাদির কথা বলা হয়। এর পেছনে সত্যতা হয়তো আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি তেমন গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সরকারবিরোধী মঞ্চে যাওয়া ছাড়া বিএনপির কোনো বিকল্প ছিল না।
ড. কামাল হোসেন একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তাঁর দল শক্তিশালী নয়, সংগঠন দুর্বল; কিন্তু ব্যক্তি ইমেজ আছে। বিএনপি চেয়েছে এই ব্যক্তি ইমেজ ব্যবহার করে ‘বৈতরণী’ পার হতে। বিএনপির একটি ‘এক্সিট’-এর প্রয়োজন ছিল। খালেদা জিয়া জেলে। তারেক রহমান শাস্তিপ্রাপ্ত। নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ না করলে তিনি আপিল করতে পারবেন না। ফলে বিএনপি কৌশলগতভাবে এই দুই নেতাকে ‘মাইনাস’ করে ড. কামালের সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্য গড়ে তুলল। বিএনপির কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। শুধু তা-ই নয়, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না কিংবা আ স ম আবদুর রব—এঁরা কেউই অতীতে বিএনপির মিত্র ছিলেন না। বিএনপিকে এটা জেনেই তাঁদের সঙ্গে ঐক্য করতে হয়েছে। অনেকেই ‘মাহাথির মোহাম্মদ’-এর দৃষ্টান্ত দেন। তিনি অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন মালয়েশিয়ায়। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে দায়িত্বভার অর্পণ করতে যাচ্ছেন। প্রকাশ্যে তিনি এটা স্বীকারও করেছেন। এই ফর্মুলা বাংলাদেশে কাজ করবে না। ওবায়দুল কাদের আকার-ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়ার প্যারলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমার ধারণা, খালেদা জিয়া আইনগতভাবেই মুক্তি পাবেন। অথবা চিকিৎসার জন্য তাঁকে প্যারলে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কিংবা তারেক রহমান কেউই অংশ নেবেন না। ঐক্যফ্রন্টের নেতা হিসেবে কামাল হোসেনই থেকে যাবেন। আর চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া বিদেশে যাবেন।
দ্বিতীয়ত, বিএনপির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের অন্যান্য দলের সম্পর্ক কী হবে? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। কাদের সিদ্দিকী কিংবা আ স ম আবদুর রব অতীতে তারেক রহমান সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন একাধিকবার। এঁরা সর্বশেষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়েছেন বটে; কিন্তু তারেক রহমানের দণ্ডাদেশ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। এর অর্থ তাঁরা তারেক রহমানের বিষয়টিকে এড়িয়ে চলতে চাইছেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, তারেক রহমানই বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতা। তাঁকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের রাজনীতি কতদূর এগিয়ে যেতে পারবে, সেটা একটা প্রশ্ন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির নেতারা খুব সুবিধা করতে পারবেন না। মূল নেতা কামাল হোসেনের বাইরে কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্না প্রাধান্য পাবেন বেশি। এ ক্ষেত্রে মির্জা ফখরুল, ব্যারিস্টার মওদুদ, মির্জা আব্বাস কিংবা গয়েশ্বর রায়রা কম প্রাধান্য পাবেন। এতে  এক ধরনের অসন্তোষের জন্ম হতে পারে। নজরুল ইসলাম খান কিংবা ড. মঈন খানের মতো মডারেট নেতারাও গুরুত্ব পাচ্ছেন কম। এটা চোখে লাগার মতো।
তৃতীয়ত, একটা বড় প্রশ্ন ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোকে নিয়ে। ঐক্যফ্রন্ট বলছে, তারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করেছে, ২০ দলের সঙ্গে কোনো ঐক্য করেনি। ঐক্যফ্রন্টের জনসভায় ২০ দলের সিনিয়র নেতাদের, বিশেষ করে কর্নেল অলি কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিমকে দেখা যায় না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় শুধু জেনারেল ইবরাহিম উপস্থিত ছিলেন। অথচ এঁরা দুজন ২০ দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে তাঁদের অবমূল্যায়ন করেছে কিংবা তাঁদের অবদানকে ভুলে গেছে, এমন অভিযোগও আছে। ফলে তাঁদের ভূমিকা আগামী দিনে লক্ষ করার মতো। চতুর্থত, এটা অস্বীকার করা যাবে না যে ঐক্যফ্রন্ট একটি নির্বাচনী জোটে পরিণত হবে। এ ক্ষেত্রে আসন বণ্টনের ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে ফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর দ্বন্দ্ব অনিবার্য।
ফ্রন্টে থেকে বিএনপি কি ২০ দলীয় জোটের জন্য অধিক আসন দাবি করবে, নাকি ফ্রন্ট ফ্রন্টে অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর বাইরে অন্য কোনো দলের মধ্যে আসন বণ্টন করবে না? ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলো এখন পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করেনি। ফলে সংগত কারণেই ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ওই দলগুলো আসন দাবি করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে বিএনপির প্রতি ওই দলগুলোর এক ধরনের অসন্তোষ থেকে যাবে। জোটটি ভেঙেও যেতে পারে। নিঃসন্দেহ বিএনপি একটি বড় ডায়লামা ‘ফেস’ করছে—একদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, অন্যদিকে ২০ দলীয় জোট। বিএনপি অগ্রাধিকার দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে, গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে ২০ দলীয় জোট। উপরন্তু ঐক্যফ্রন্টে আসন বণ্টন নিয়েও বিএনপি ফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে। বিএনপি বড় দল। তারা বেশি আসন চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছোট দলগুলো যদি বেশি আসন চায়, যা এরই মধ্যে মান্নার কথার মধ্যে ফুটে উঠেছে। এতে ঐক্যফ্রন্টে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। বিএনপির অনেক নেতা তখন ফ্রন্টের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে পারেন। বিএনপি ভেঙে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। কোনো ‘পক্ষ’ কি সেটাই চাইছে? জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একটি আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে, সন্দেহ নেই তাতে। বিরোধী পক্ষের রাজনীতি এতে আরো শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক।
মূল প্রশ্ন একটাই—একটা আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের কয়েকটি দল যেভাবে এখনো ড. কামাল হোসেন, ঐক্যফ্রন্ট কিংবা বিএনপির বিরুদ্ধে যেভাবে নেতিবাচক মন্তব্য করছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস বা আস্থার সম্পর্ক থাকতে হবে। না হলে এ দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। বিগত বছরগুলোতে আমরা ভোটকেন্দ্র দখল, সিল মারা সংস্কৃতি, বিরোধী পক্ষকে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দান, মনোনয়নপত্র জমা দিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির (সিটি করপোরেশন নির্বাচন) যে ‘চিত্র’ আমরা দেখেছি, তা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা কেউ দেখতে চাই না। পেশিশক্তির নাম আর যা-ই হোক গণতন্ত্র নয়। এ কথাটা আমরা যেন ভুলে না যাই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পরিস্থিতি এড়িয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একটা সম্ভাবনাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। নির্বাচন ও জনগণের ভোটাধিকার এখানে মুখ্য। কিন্তু পেশিশক্তির কাছে জনগণের ভোটাধিকার যেন পরাস্ত না হয়—আমাদের প্রত্যাশা এটাই।

নির্বাচন আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় কতটুকু সহায়ক হবে

স্থানীয় পর্যায়ে যারা পার্টির হয়ে কাজ করেন, স্থানীয় জনগণের সুখে-দুঃখে যারা থাকেন, তাদেরই জনপ্রতিনিধি হওয়া উচিত। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা দেখলাম ভিন্ন চিত্র। ব্যবসায়ী, অভিনেত্রী, সেনা কর্মকর্তাÑ সবাই এখন এমপি হতে 
চান। এটা গণতন্ত্র নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে এটা বেমানান
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতির মাঠ এখন উত্তপ্ত। মনোনয়ন ফরম বিক্রি নিয়ে দুটি বড় দলের নেতাকর্মীদের যে শোডাউন আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, তাতে এটা আবারও স্পষ্ট হয়ে গেল, নির্বাচনে তথাকথিত দুটি বড় জোটের (১৪ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) অস্তিত্ব থাকলেও বাহ্যত দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরেই রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। তবে এ নির্বাচন দুটি বড় দলের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বেশি এ কারণে, ৪০ বছরের ইতিহাসে দলটি এতবড় বিপর্যয়ের মুখে আর কখনও পড়েনি। দলটি এই প্রথমবারের মতো জিয়া পরিবারকে ‘মাইনাস’ করেই নির্বাচনি রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। দলটির নেতৃত্ব কী শেষ পর্যন্ত জিয়া পরিবারের বাইরে চলে গেল, সেটা একটা ফান্ডামেন্টাল প্রশ্ন এখন। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচনে অংশ নিতে ও রাজনীতির ময়দানে থাকতে দলটিকে এখন ড. কামাল হোসেনের মতো লোকের ‘আশ্রয়’ নিতে হলো, যিনি কোনোদিনই বিএনপির রাজনীতিকে সমর্থন করেননি। এটা বিএনপির মতো সংগঠনের জন্য ভালো হয়েছে কী মন্দ হয়েছে, তা হয়তো আগামী দিনগুলোতে আমরা বিশ্লেষণ করব। তবে মনোনয়ন ফরম বিক্রির সময় বিএনপির অফিসের সম্মুখে যে জনমুদ্র আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে এটা আবারও প্রমাণিত হলো, সাধারণ মানুষের আস্থা এখনও বিএনপির প্রতি আছে। কিন্তু বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণ কি দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে আদৌ সাহায্য করবে? এটা একটা ওয়ান মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। কেননা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে বড় সমস্যা হচ্ছে দুটি বড় দলÑ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে আস্থাহীনতা এবং অবিশ্বাস। এ অবিশ্বাসের পেছনে যুক্তি যে নেই, তা বলা যাবে না। যুক্তি আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হলেও অবিশ্বাসের রাজনীতির কারণে এ দ্বিদলীয় ব্যবস্থা এখন ভেঙে পড়েছে। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের দ্বিদলীয় ব্যবস্থা সেখানকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। 
এরই মধ্যে দুটি বড় দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রি শেষ। যাদের নাম পত্রপত্রিকায় এসেছে, তাতে তো আমার অবাক হওয়ার পালা। একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, একজন এক-এগারোর কুশীলব, একজন ক্রিকেটার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, পুলিশের সাবেক আইজিÑ সবাই এখন এমপি হতে চান! এতে অবিশ্যি নৌকার পাল্লাই ভারী। বিএনপি এখন সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। তাই বিএনপিতে তথাকথিত ভিআইপিদের ভিড় কম। তবে এটা বলতেই হবে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য একটি অগ্রগতি।
তবে কয়েকটি বিরোধী দলের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন আমাদের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল কেন হলো? আমি মনে করি, বিএনপির এ সিদ্ধান্তটি সঠিক ও যৌক্তিক। কেননা বিগত দিনগুলোতে দেখা গেছে, বিএনপি কোনো শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এটা বিএনপির ব্যর্থতা। যদিও সরকারের জুলুম, হামলা, মামলা, গুপ্তহত্যা ইত্যাদির কথা বলা হয়। এর পেছনে সত্যতা হয়তো আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি তেমন গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এক্ষেত্রে সরকারবিরোধী মঞ্চে যাওয়া ছাড়া বিএনপির কোনো বিকল্প ছিল না। ড. কামাল একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তার দল শক্তিশালী নয়, সংগঠন দুর্বল; কিন্তু ব্যক্তি ইমেজ আছে। বিএনপি চেয়েছে এ ব্যক্তি ইমেজ ব্যবহার করে ‘বৈতরণী’ পার হতে। বিএনপির একটি ‘এক্সিট’ এর প্রয়োজন ছিল। খালেদা জিয়া জেলে। তারেক রহমান শাস্তিপ্রাপ্ত। নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ না করলে তিনি আপিল করতে পারবেন না। ফলে বিএনপি কৌশলগতভাবে এ দুই নেতাকে ‘মাইনাস’ করে ড. কামালের সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্য গড়ে তুলল। বিএনপির কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। শুধু তা-ই নয়, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না কিংবা আ স ম আবদুর রবÑ এরা কেউই অতীতে বিএনপির মিত্র ছিলেন না। বিএনপিকে এটা জেনেই তাদের সঙ্গে ঐক্য করতে হয়েছে। অনেকেই ‘মাহাথির মোহাম্মদ’-এর দৃষ্টান্ত দেন। তিনি অন্তর্বর্তীকালীনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন মালয়েশিয়ায়। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আনোয়ার ইবরাহিমের কাছে দায়িত্বভার অর্পণ করতে যাচ্ছেন। প্রকাশ্যে তিনি এটা স্বীকারও করেছেন। এই ফর্মুলা বাংলাদেশে কাজ করবে না। ওবায়দুল কাদের আকার-ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমার ধারণা, খালেদা জিয়া আইনগতভাবেই মুক্তি পাবেন অথবা চিকিৎসার জন্য তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কিংবা তারেক রহমান কেউই অংশ নেবেন না। ঐক্যফ্রন্টের নেতা হিসেবে কামাল হোসেনই থেকে যাবেন। আর চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া বিদেশে যাবেন। বিএনপির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের অন্য দলগুলোর সম্পর্ক কী হবে? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। কাদের সিদ্দিকী কিংবা আ স ম আবদুর রব অতীতে তারেক রহমান সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন একাধিকবার। এরা সর্বশেষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়েছেন; কিন্তু তারেক রহমানের দ-াদেশ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। এর অর্থ এরা তারেক রহমানের বিষয়টিকে এড়িয়ে চলতে চাইছেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, তারেক রহমানই বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতা। তাকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের রাজনীতি কতদূর এগিয়ে যেতে পারবেÑ সেটা একটা প্রশ্ন। আপতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির নেতারা খুব সুবিধা করতে পারবেন না। মূল নেতা কামাল হোসেনের বাইরে কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্না প্রাধান্য পাবেন বেশি। এক্ষেত্রে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস কিংবা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়রা কম প্রাধান্য পাবেন। এতে এক ধরনের অসন্তোষের জন্ম হতে পারে। নজরুল ইসলাম খান কিংবা ড. মঈন খানের মতো মডারেট নেতারাও গুরুত্ব পাচ্ছেন কম। এটা চোখে লাগার মতো। একটা বড় প্রশ্ন ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোকে নিয়ে। ঐক্যফ্রন্ট বলছে তারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করেছে, ২০ দলের সঙ্গে কোনো ঐক্য করেনি। ঐক্যফ্রন্টের জনসভায় ২০ দলের সিনিয়র নেতাদের, বিশেষ করে কর্নেল অলি আহমদ কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিমকে দেখা যায় না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় শুধু জেনারেল ইবরাহিম উপস্থিত ছিলেন। অথচ এরা দুজন ২০ দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে এদের অবমূল্যায়ন করেছে কিংবা এদের অবদানকে ভুলে গেছে, এমন অভিযোগেও আছে। ফলে এদের ভূমিকা আগামীতে লক্ষ করার মতো। এটা অস্বীকার করা যাবে না, ঐক্যফ্রন্ট একটি নির্বাচনি জোটে পরিণত হবে। এক্ষেত্রে আসন বণ্টনের ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে ফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর দ্বন্দ্ব অনিবার্য। ফ্রন্টে থেকে বিএনপি কি ২০ দলীয় জোটের জন্য অধিক আসন দাবি করবে? নাকি ফ্রন্টে অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর বাইরে অন্য কোনো দলের মাঝে আসন বণ্টন করবে না? ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলো এখন অবধি ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করেনি। ফলে সংগত কারণেই ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ওই দলগুলো আসন দাবি করতে পারবে না। এক্ষেত্রে বিএনপির প্রতি ওই দলগুলোর এক ধরনের অসন্তোষ থেকে যাবে। জোটটি ভেঙে যেতে পারে। নিঃসন্দেহে বিএনপি একটি বড় ডিলেমা ‘ফেস’ করছেÑ একদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, অন্যদিকে ২০ দলীয় জোট। বিএনপি অগ্রাধিকার দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে, গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে ২০ দলীয় জোট। উপরন্তু ঐক্যফ্রন্টে আসন বণ্টন নিয়েও বিএনপি ফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে! বিএনপি বড় দল। তারা বেশি আসন চাইবেÑ সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছোট ছোট দলগুলো যদি বেশি আসন চায়, যা এরই মধ্যে মান্নার কথার মাঝে ফুটে উঠেছে, এতে ঐক্যফ্রন্টে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। বিএনপির অনেক নেতা তখন ফ্রন্টের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে পারেন! বিএনপি ভেঙে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। কোনো ‘পক্ষ’ কি সেটাই চাইছে? জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একটি আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে, সন্দেহ নেই তাতে। বিরোধী পক্ষের রাজনীতি এতে আরও শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। 
মূল প্রশ্ন একটিÑ একটি আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের কয়েকটি দল যেভাবে এখনও ড. কামাল হোসেন, ঐক্যফ্রন্ট কিংবা বিএনপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। দুটি বড় দলÑ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ বা আস্থার সম্পর্ক থাকতে হবে। না হলে এ দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। বিগত বছরগুলোতে আমরা ভোটকেন্দ্র দখল, সিল মারা সংস্কৃতি, বিরোধী পক্ষকে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দান, মনোনয়নপত্র জমা দিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির (সিটি করপোরেশন নির্বাচন) যে ‘চিত্র’ আমরা দেখেছি, তা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা কেউ দেখতে চাই না। পেশিশক্তির নাম আর যাই হোক গণতন্ত্র নয়Ñ এ কথাটা আমরা যেন ভুলে না যাই।
২০১১ সালের ৫ জানুয়ারির পরিস্থিতি এড়িয়ে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে একটি সম্ভাবনাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। নির্বাচন ও জনগণের ভোটাধিকার এখানে মুখ্য। কিন্তু পেশিশক্তির কাছে জনগণের ভোটাধিকার যেন পরাস্ত না হয়Ñ আমাদের প্রত্যাশা এটাই। আমাদের জন্য একটা সুযোগ এসেছে। এ সুযোগটি যদি আমরা কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সরকার উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু শুধু উন্নয়ন প্রক্রিয়া দিয়ে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যাবে না। গণতন্ত্রের স্থায়ী ভিত্তির জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন, আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। এর প্রায় সবগুলোতেই ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশে। রাজনীতিতে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাব বাড়ছে। যিনি কোনো দিন নিজ নির্বাচনি এলাকায় যাননি, নিজের ব্যবসা কিংবা প্রফেশন নিয়ে যিনি জীবনের দীর্ঘ সময় পার করেছেন, পরিণত বয়সে এসে তিনি এখন এমপি হতে চান। পার্লামেন্টে যেতে চান। এসব লোক দিয়ে জনগণের মঙ্গল আশা করা যায় না। এরা ‘শীতের পাখি’, নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে এদের আর নিজ এলাকায় কোনো দিন দেখাও যাবে না। স্থানীয় পর্যায়ে যারা পার্টির হয়ে কাজ করেন, স্থানীয় জনগণের সুখে-দুঃখে যারা থাকেন, তাদেরই জনপ্রতিনিধি হওয়া উচিত। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা দেখলাম ভিন্ন চিত্র। ব্যবসায়ী, অভিনেত্রী, সেনা কর্মকর্তাÑ সবাই এখন এমপি হতে চান। এটা গণতন্ত্র নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে এটা বেমানান। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে; কিন্তু এ নির্বাচন বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে কতটুকু শক্তিশালী করবেÑ সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। যতদিন পর্যন্ত না আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে, ততদিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। 

দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-ভারত দ্বন্দ্ব

শুধু মালদ্বীপ আর শ্রীলঙ্কার কথা কেন বলি, নেপালের ক্ষেত্রেও চীন-ভারত দ্বন্দ্ব লক্ষ করা যায়। নেপালের বামপন্থি সরকার এখন চীনামুখী। চীন থেকে ব্যাপক সাহায্য আসছে নেপালে। চীন-ভারত দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় পরিবর্তন এসেছে। আগামীতে এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতেও
তা প্রভাব ফেলতে পারে
১৮ নভেম্বর মালদ্বীপের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ শপথ গ্রহণ করেছেন। তিনি মালদ্বীপের সপ্তম প্রেসিডেন্ট। ২৩ সেপ্টেম্বর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন পরাজিত হন। এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছেÑ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি। নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি প্রমাণ করে ভারত মালদ্বীপের এ ক্ষমতার পরিবর্তনকে কত বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর মোদি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশ সফর করলেও মালদ্বীপ সফর করেননি। এর পেছনে কাজ করছিল সেই পুরোনো ভারত-চীন দ্বন্দ্ব। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন অতি বেশিমাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি বিমানবন্দর নির্মাণে ভারতীয় কন্ট্রাক্ট বাতিল করে চীনাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মালদ্বীপে চীনের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। স্ট্র্যাটেজিক্যালি মালদ্বীপের সমুদ্রসীমার গুরুত্ব বেশি থাকায় চীনের মালদ্বীপ সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ছিল। চীন মালদ্বীপে একটি নৌঘাঁটি করতে চেয়েছিলÑ এমন খবরও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ফলে সংগত কারণেই মালদ্বীপে চীনের নৌবাহিনীর সম্ভাব্য উপস্থিতিকে ভারত ভালো চোখে দেখেনি। ভারত এটাকে দেখেছিল তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে। তাই নির্বাচনে ইব্রাহিম সলিহর বিজয় এখন ভারতের জন্য একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে মালদ্বীপে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে। সলিহর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মোদির উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করল, ভারত এ সুযোগটি এখন তার স্বার্থে কাজে লাগাবে। শুধু তা-ই নয়, এরই মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে, মোহামেদ সলিহ তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ডিসেম্বর মাসে ভারত যাবেন। বলাই বাহুল্য, সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের আমলে ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্কে যথেষ্ট অবনতি ঘটেছিল। এক পর্যায়ে মালদ্বীপে যে একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার বহর রয়েছে, তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন ভারতকে অনুরোধ করেছিলেন। মোদির এ সফরের মধ্য দিয়ে এমন একটি আশঙ্কা এখন তৈরি হয়েছে যে, ভারত এখন মালদ্বীপে তার সামরিক উপস্থিতি আরও শক্তিশালী করবে। মালদ্বীপের নয়া নেতৃত্ব ভারতকে যে এখন কত বেশি গুরুত্ব দেয়, তার বড় প্রমাণ মোদিকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট আবদুল গাইয়ুম ও মোহাম্মদ নাশিদের উপস্থিতি। মোহাম্মদ সলিহ বিরোধী এমডিপি দলের সদস্য ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। নাশিদকে ভারতপন্থি হিসেবে অভিহিত করা হয়। মালদ্বীপে আপাতত ভারতপন্থিদের ‘বিজয়’ হলেও ভারত-চীন দ্বন্দ্বের কারণে মালদ্বীপের ভবিষ্যৎ একটা প্রশ্নের মাঝে থেকে গেল।
মালদ্বীপের মতো পরিস্থিতি অনেকটা শ্রীলঙ্কায়ও। সেখানেও ভারত-চীন দ্বন্দ্বের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। ভারত-চীন দ্বন্দ্বের কারণে সেখানে বর্তমানে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের জন্ম হয়েছে। ওই সংকটের শুরু হয় যখন ২৬ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করে সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। রাজাপাকসে ২০০৫-২০১৫ সাল অবধি দুই দফায় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি অতি বেশিমাত্রায় চীনের প্রতি ঝুঁকে গিয়েছিলেন। চীনের অর্থে তিনি হামবানতোতায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছিলেন এবং সেখানে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরও তৈরি করা হয়েছিল। তিনি শ্রীংহলী অধিবাসীদের কাছে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কেননা তিনি তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধে’ জয়ী হয়েছিলেন। তার অবদান ছিল তিনি দেশকে ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু অতি চীনা নির্ভরতার কারণে ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। শুধু তা-ই নয়, তার শাসনামলে তিনি হামবানতোতায় চীনা সাবমেরিনকে ডকিং করার সুযোগ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ হামবানতোতা গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনা সাবমেরিন সীমিত সময়ের জন্য ঘাঁটি গেঁড়েছিল। ভারত এটাকে দেখেছিল তার নিরাপত্তার প্রতি এক ধরনের হুমকি হিসেবে। ভারত কখনও চায়নি শ্রীলঙ্কা-ভারত সমুদ্রসীমানায় চীনা সাবমেরিন নোঙর করুক। ফলে রাজাপাকসেকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ভারতের জন্য। আর সে কারণেই ভারত রাজাপাকসের একসময়ের সহকর্মী সিরিসেনাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজাপাকসের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। অভিযোগ আছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (জঅড) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরিসেনাকে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু নির্বাচনে হেরে গেলেও রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাননি রাজাপাকসে। তিনি আলাদা দল গঠন করে পার্লামেন্ট এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে তার অবস্থান শক্তিশালী করেছিলেন। অন্যদিকে বিক্রমাসিংহের সঙ্গে জোট করে সিরিসেনা ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি এ ঐক্যে ভাঙনে ধরে। সিরিসেনা অভিযোগ করেছিলেন, বিক্রমাসিংহের নীতির সঙ্গে তার দ্বিমত থাকার কথা। বিক্রমাসিংহ ছিলেন ভারতপন্থি। তিনি শ্রীলঙ্কার উন্নয়নের জন্য চীনের পরিবর্তে ভারতকে বেছে নিয়েছিলেন। একসময় সিরিসেনা নিজেও ভারতপন্থি ছিলেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার উন্নয়নের জন্য, বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য তিনি চীনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার এ ‘চীনানীতি’ ও চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাকে ভারত ভালো চোখে দেখেনি। ‘র’ তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, এমন অভিযোগ সিরিসেনাকে উদ্ধৃতি করে ভারতীয় সংবাদপত্রে একটি সংবাদও ছাপা হয়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায়, সিরিসেনার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। এক পর্যায়ে তিনি রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিলে ভারতপন্থিরা এটাকে ভালো চোখে দেখেনি। সংকট সেখানে এখনও রয়ে গেছে। রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও সংসদের সমর্থন তিনি পাননি। এমনকি উচ্চ আদালত সংসদ বাতিল ও নয়া সংসদ নির্বাচনের ঘোষণাকেও অনুমোদন দেননি। পরিস্থিতি সেখানে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়Ñ এ মুহূর্তে তা বলা কঠিন।
সূক্ষèভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় এই যে পরিবর্তন, এর পেছনে কাজ করছে ভারত-চীন দ্বন্দ্ব। মোদি ক্ষমতায় আসার পর দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে নতুন একটি নীতি প্রণয়ন করেন। এ নীতির মূল কথা হচ্ছে, ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’Ñ অর্থাৎ প্রতিবেশীরাই অগ্রাধিকার পাবে বেশি। এ নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি ‘মনরো ডকট্রিন’র ভারতীয় সংস্করণ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। তার এ মতবাদের মূল কথা হচ্ছেÑ ভারত মহাসাগর তথা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত অন্য কারও ‘কর্তৃত্ব’ সহ্য করবে না। পাঠকদের ২০ থেকে ২২ মার্চে (২০১৫) ভুবনেশ্বরে ইন্ডিয়ান ওসেন রিম বা আইওআরের শীর্ষ সম্মেলনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ওই সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ভারত এ অঞ্চলে অন্য কারও কর্তৃত্ব মেনে নেবে না। অর্থাৎ ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলের ‘দেখ-ভাল’ করার দায়িত্ব ভারতের। জ্বালানি তেলের ওপর চীন ও ভারতের নির্ভরতা বাড়ছে। ফলে ভারত মহাসাগরের নৌরুট ক্রমান্বয়ে ভারত ও চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশ্বের কার্গো শিপমেন্টের অর্ধেক পরিবাহিত হয় এ ভারত মহাসাগর দিয়েই। একই সঙ্গে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৩ শতাংশের ২ শতাংশ এবং ৪ শতাংশের ৩ শতাংশ ট্রাফিক পৃথিবীর অন্যত্র যেতে ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ। পৃথিবীর আমদানীকৃত পণ্যের (তেলসহ) ৯০ শতাংশ পরিচালিত হয় এ সমুদ্র রুট ব্যবহার করে। ফলে সমুদ্রপথের নিরাপত্তা চীন ও ভারতের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। পাঠকমাত্রই জানেন, চীন যেখানে মেরিটাইম সিল্ক রুটের কথা বলে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলগুলোকে ‘কানেক্ট’ করতে চাইছে, সেখানে ভারত বলছে, ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোরের কথা। মূল প্রশ্ন একটাইÑ ভারত মহাসাগরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। চীন-ভারত দ্বন্দ্ব সেখান থেকেই শুরু। শ্রীলঙ্কার পর মালদ্বীপে চীনের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছিল। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে (ভারত যোগ দেয়নি)। এর আওতায় চীন এসব দেশে অবকাঠামো খাতে ঋণ দিচ্ছে। যেমনÑ মালদ্বীপের ‘চীন-মালদ্বীপ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ’-এর কথা উল্লেখ করা যায়। এ ‘ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ’ রাজধানী মালের সঙ্গে পাশের দ্বীপ হুলহুলেকে সংযুক্ত করেছে। দুই কিলোমিটার লম্বা এ ব্রিজ দিয়ে মাত্র ৫ মিনিটে রাজধানী মালেতে যাওয়া যায়। হুলহুলেতে প্রধান বিমানবন্দরটি অবস্থিত। মালদ্বীপ চীন থেকে প্রায় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। যদিও নয়া সরকার এ ঋণ নিয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। চীনের বদলে এখন তারা ভারতীয় সাহায্য চাইছে। শুধু মালদ্বীপ আর শ্রীলঙ্কার কথা কেন বলি, নেপালের ক্ষেত্রেও চীন-ভারত দ্বন্দ্ব লক্ষ করা যায়। নেপালের বামপন্থি সরকার এখন চীনামুখী। চীন থেকে ব্যাপক সাহায্য আসছে নেপালে।
চীন-ভারত দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় পরিবর্তন এসেছে। আগামীতে এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতেও তা প্রভাব ফেলতে পারে। 

বাংলাদেশ কি রাজনীতির নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে?

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই একটা প্রশ্ন জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে, আর তা হচ্ছে—বাংলাদেশ কি নতুন এক রাজনীতির যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে? নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতি নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিল। পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একত্র হয়ে সংবিধানে সংশোধনী এনে দেশে সংসদীয় রাজনীতির ধারা চালু করেছিল। কিন্তু সেই সংশোধনী সুখের হয়নি। সংসদীয় রাজনীতি আমরা চালু করেছিলাম বটে; কিন্তু দিনের পর দিন সংসদ বয়কটের রাজনীতি সংসদীয় রাজনীতির অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। একপর্যায়ে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করে আমরা সংসদীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে ব্যবস্থাও ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ‘ছদ্ম সেনা শাসন’, অর্থাৎ পরোক্ষ সেনা শাসন, যেখানে সেনাবাহিনী পর্দার অন্তরালে থেকে শাসনক্ষমতা পরিচালনা করেছে। সাধারণ মানুষ সেই ‘সেনা শাসন’কে গ্রহণ করে নেয়নি। ফলে আবারও রাজনীতিবিদদের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল দেশ পরিচালনা করার। ২০০৮ সালে ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ নির্বাচন হয়েছিল বটে; কিন্তু ওই নির্বাচন ও নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ (নবম) গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেনি, বরং দুটি বড় দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) মধ্যে ব্যবধান আরো বেড়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল ‘গণতন্ত্রের পিঠে ছুরিকাঘাত’-এর শামিল। একদিকে বিএনপির নির্বাচন বয়কট, অন্যদিকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা—এই ‘দ্বন্দ্বে’ বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছিল এমন একটি নির্বাচন, যেখানে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা ভোটে সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে সেটা ছিল একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। সেই সংসদ তার পাঁচ বছরের টার্মও পূরণ করতে যাচ্ছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী যে সহিংসতা, গাড়িতে অগ্নিসংযোগের যে ‘দৃশ্য’ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, তাতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়নি। বরং গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত প্রায় পাঁচ বছরে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর ‘হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টে বিএনপি মূল শক্তি হলেও নেতৃত্বে নেই বিএনপি। নেতৃত্ব চলে গেছে অন্যদের হাতে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের বিদেশ-নির্ভরতা এতটুকুও কমেনি। নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিদেশিরা।
স্পষ্টতই নির্বাচনের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে ভারত কিংবা ব্রিটিশ হাইকমিশনারের কোনো মন্তব্য থাকতে পারে না। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য এখানেই যে আমরা বারবার আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়েছি। এটা ভালো নয়। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকারের সব মন্ত্রীই এখন ক্ষমতায়। তাঁরা পুলিশ প্রটেকশন নিচ্ছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। সংসদও ভেঙে দেওয়া হয়নি। ড. কামাল হোসেন একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবি করছেন বটে। কিন্তু এর পেছনে যুক্তি যা-ই থাকুক না কেন, ঐক্যফ্রন্টের উচিত ছিল সাংবিধানিক কাঠামোয় এর একটি ‘সমাধান’ বের করা। তারা তা করেনি। ঐক্যফ্রন্টের থিংক ট্যাংক অত শক্তিশালী নয়। তাঁরা কোনো ফর্মুলা দিতে পারেননি। এমনকি সংলাপেও একটি ফর্মুলা আসতে পারত। জাতি কোনো বিকল্প কিছু পায়নি। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আছেন। মন্ত্রীরা সবাই আছেন। এটা ঐক্যফ্রন্টকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। একটি ছোট্ট মন্ত্রিসভা ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হলে মন্ত্রিসভার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত। কিন্তু তা হয়নি। সংলাপ হয়েছে বটে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এখন ‘শূন্য ফলাফল’ নিয়েই ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনে যেতে হচ্ছে। তবে একটা ভালো খবর—ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাবে। এটাই সঠিক রাজনীতি। নির্বাচন বয়কট কোনো ‘রাজনীতি’ হতে পারে না। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু তা দলটির জন্য সুখের হয়নি।
এখন নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হচ্ছে। তবে এই নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেক। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আস্থার সম্পর্ক থাকাটা জরুরি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেই আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বারবার প্রশ্ন ওঠে। এর একটা স্থায়ী সমাধান দরকার। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করাও জরুরি। নয়া সরকার (২০১৯) বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিতে পারে। নির্বাচনের আগে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একটি জাতীয় দৈনিক। অভিযোগ তোলা হয়েছে, নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা ব্যক্তিদের সম্পর্কে পুলিশ খোঁজখবর নিচ্ছে। অথচ ইসি জানিয়েছে, তারা পুলিশকে এই দায়িত্বটি দেয়নি। এতে করে ইসির ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। বিগত সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছিল। এই নির্বাচনে (খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর) ভোটকেন্দ্র দখল, সিল মারা রাজনীতির দৃশ্য মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল মিডিয়ার বদৌলতে। এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না—ইসি এটা নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে ইসি জাতিকে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তাই যেকোনো বিবেচনায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান অন্তত আগামী পাঁচ বছরের জন্য ‘মাইনাস’ হয়ে গেলেন। এমনকি বিরোধীদলীয় রাজনীতিও চলে গেল বিএনপির নেতৃত্বের বাইরে। ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি থাকলেও তাদের ভূমিকা এখন সীমিত হয়ে যাবে।
‘নতুন এক রাজনীতির যুগে’ প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর যারাই সরকার গঠন করবে, তারাই গুরুত্ব দেবে সংসদীয় রাজনীতিকে। এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের প্রতি নির্ভরশীলতাও কমে যাবে। সংসদ বয়কটের রাজনীতি থেকেও বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ। কিন্তু অনেক প্রশ্ন আছে নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতি নিয়ে। সংসদীয় রাজনীতির মূল কথা হচ্ছে বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়া। ব্রিটিশ সংসদীয় রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দলকে বলা হয় সরকারেরই অংশ। অর্থাৎ সরকারকে সঠিক নীতিটি গ্রহণ করতে বিরোধী দল সাহায্য করে। পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশে প্রধান বিরোধী দল বিদেশে কখনোসখনো প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে এমনটি হওয়া উচিত। যারাই সরকার গঠন করবে, বিরোধী দলকে তাদের আস্থায় নিতে হবে। সংসদীয় কমিটিতে কোথাও কোথাও বিরোধী দলকে চেয়ারম্যানের দায়িত্বটি দিতে হবে। বিরোধী দল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সংসদীয় রাজনীতিতে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে। দশম জাতীয় সংসদ বেশি মাত্রায় এককেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় সেখানে সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি। একাদশ জাতীয় সংসদে বিষয়টি লক্ষ রাখতে হবে। দেশে সংসদীয় সচিবের পদ না থাকায় সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা অতি ক্ষমতাধর হয়ে পড়েছেন। মন্ত্রীরা জনপ্রতিনিধি হয়েও বেশি মাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য যদি ‘পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি’ বা সংসদীয় সচিবের পদ সৃষ্টি করা যায়, তাহলে গণতন্ত্র শুধু শক্তিশালীই হবে না, বরং অতি ক্ষমতাধর আমলাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কমে যাবে। সচিবালয়ের আমলারা শুধু প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত থাকবেন। সংসদীয় সচিবরা আইন প্রণয়নে মন্ত্রীকে তথা সংসদকে সহযোগিতা করবেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে আইন ও বিধি সংশোধন করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়োগ বা মনোনয়ন সংসদ কর্তৃক পরীক্ষিত বা স্ক্রুটিনির ব্যবস্থা থাকতে হবে। এর মধ্য দিয়ে ওই শীর্ষ ব্যক্তির দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে সংসদই শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়োগ চূড়ান্ত করে। বর্তমান সংবিধানে বেশ কিছু অসংগতি রয়েছে। যেমন—সংসদ রেখেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে অস্পষ্টতা, কাগজ-কলমে ইসির ভূমিকা ইত্যাদি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে একধরনের অন্তরায়। প্রতি সংসদীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে এই বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে পারে, যেখানে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। কমিশন সংবিধান সংশোধনের জন্য কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করবে। বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাউন্সিল ও একটি নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করাও জরুরি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এই সংসদে অনেক অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানের দেখা মিলবে, যাঁরা বিরোধী দলে থাকবেন। সংসদকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা হবে মুখ্য। তাঁরা ‘নতুন এক রাজনীতি’ উপহার দেবেন—এমন একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতার যে রাজনীতি আমাদের চলমান রাজনীতিকে বিষাক্ত করে তুলেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ কারণেই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এমপি হওয়ার সহজ পাঠ ও সংসদ নির্বাচন

এটা মোটামুটিভাবে এখন নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন কারা কারা পাচ্ছেন। নৌকার মনোনয়ন নিশ্চিত করে প্রার্থীদের চিঠিও দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থীদের তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে কিছু ‘জটিলতা’ এখনো রয়ে গেছে। কিন্তু নৌকার প্রার্থী তালিকায় খুব বড় পরিবর্তন আসেনি। আওয়ামী লীগ অনেকটা পুরনোদের ওপরই বেশি আস্থা রেখেছে। একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন ক্রিকেটার কিংবা বিতর্কিত এমপিদের কারো কারো স্ত্রী কিংবা বাবাকে মনোনয়ন দিয়ে আওয়ামী লীগ কি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে? কিংবা রাজনীতিতে যে পরিবারতন্ত্র, সেই বৃত্ত থেকেও আওয়ামী লীগ বের হয়ে আসতে পারেনি। রাজনীতিতে স্থানীয়ভাবে সেই পারিবারিক রাজনীতির ধারাই বহাল রাখল আওয়ামী লীগ। একটা প্রত্যাশা ছিল, আওয়ামী লীগ স্থানীয় পর্যায়ে তরুণ ও আধুনিক মনস্ক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। এবার সেই সুযোগ ছিল। কিন্তু প্রার্থী তালিকা দেখে মনে হলো আওয়ামী লীগ সেই পুরনোদের ওপরই আস্থা রাখল। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টে নতুন করে যোগদানের হিড়িক, বিশেষ করে কয়েকজন পুরনো আওয়ামী লীগ নেতার, সাবেক মন্ত্রীর গণফোরামে যোগদান, সেনা কর্মকর্তাদের (অবসরপ্রাপ্ত) গণফোরামে যোগদানের বিষয়টি যতটুকু না রাজনৈতিক, তার চাইতে বেশি মাত্রায় সুবিধাবাদের রাজনীতি দ্বারা প্রভাবান্বিত। এদের সবারই টার্গেট সংসদে যাওয়া, এমপি হওয়া! কিন্তু এতে করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে কতটুকু? যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশের রজনীতিকে ‘বিষাক্ত’ করে তুলেছে, তা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারব কি? রাজনীতিতে যে ‘আস্থা’র সম্পর্কটা থাকা জরুরি, তা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে কি-না, সে প্রশ্ন থাকলই। তবে রাজনীতিতে সূক্ষ্মভাবে হলেও একটি পরিবর্তনের ‘ধারা’ সূচিত হতে যাচ্ছে। ঐক্যফ্রন্টের জন্ম ও বিএনপি নেতাদের সেই নেতৃত্ব মেনে নেওয়া রাজনীতিতে নতুন একটি সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে। এই যে রাজনীতি, এই রাজনীতি চলমান বিদ্বেষমূলক রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে পারবে কি-না, সে প্রশ্ন এখন অনেকের। মানুষ চায় এই বিদ্বেষমূলক রাজনীতির অবসান। মানুষ চায় নতুন এক রাজনীতি। মানুষ চায় একটি শক্তিশালী সংসদ। সেই সংসদ আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, সেটাই প্রশ্ন এখন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই একটা প্রশ্ন জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে— আর তা হচ্ছে বাংলাদেশ কি নতুন এক রাজনীতির যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে? নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতি নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিল। পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একত্রিত হয়ে সংবিধানে সংশোধনী এনে দেশে সংসদীয় রাজনীতির ধারা চালু করেছিল। কিন্তু সেই সংশোধনী সুখের হয়নি। সংসদীয় রাজনীতি আমরা চালু করেছিলাম বটে, কিন্তু দিনের পর দিন সংসদ বয়কটের রাজনীতি সংসদীয় রাজনীতির অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। এক পর্যায়ে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করে আমরা সংসদীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই ব্যবস্থাও ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ‘ছদ্ম সেনাশাসন’— অর্থাৎ পরোক্ষ সেনাশাসন, যেখানে সেনাবাহিনী পর্দার অন্তরালে থেকে শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। সাধারণ মানুষ সেই ‘সেনাশাসন’কে গ্রহণ করে নেয়নি। ফলে আবারো রজনীতিবিদদের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল দেশ পরিচালনা করার। ২০০৮ সালে ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ নির্বাচন হয়েছিল বটে। কিন্তু ওই নির্বাচন ও নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ (নবম) গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেনি, বরং দুটি বড় দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) মধ্যে ব্যবধান আরো বেড়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল ‘গণতন্ত্রের পিঠে ছুরিকাঘাত’-এর শামিল। একদিকে বিএনপির নির্বাচন বয়কট, অন্যদিকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা— এই ‘দ্বন্দ্বে’ বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছিল এমন একটি নির্বাচন, যেখানে ১৫৩ প্রার্থী বিনাভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে সেটা ছিল একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। সেই সংসদ তার পাঁচ বছরের টার্মও পূরণ করতে যাচ্ছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনপরবর্তী যে সহিংসতা, গাড়িতে অগ্নিসংযোগের যে ‘দৃশ্য’ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, তাতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়নি। বরং গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত প্রায় পাঁচ বছরে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর ‘হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টে বিএনপি মূলশক্তি হলেও, নেতৃত্বে নেই বিএনপি। নেতৃত্ব চলে গেছে অন্যদের হাতে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের বিদেশনির্ভরতা এতটুকুও কমেনি। নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিদেশিরা।
স্পষ্টতই নির্বাচনের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে ভারত কিংবা ব্রিটিশ হাইকমিশনারের কোনো মন্তব্য থাকতে পারে না। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য এখানেই যে, আমরা বার বার আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়েছি। এটা ভালো নয়। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকারের সব মন্ত্রীই এখন ক্ষমতায়। তারা পুলিশ প্রটেকশন নিচ্ছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। সংসদও ভেঙে দেওয়া হয়নি। ড. কামাল হোসেন একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবি করছেন বটে, কিন্তু এর পেছনে যুক্তি যাই থাকুক বা কেন, ঐক্যফ্রন্টের উচিত ছিল সাংবিধানিক কাঠামোয় এর একটি ‘সমাধান’ বের করা। তারা তা করেনি। ঐক্যফ্রন্টের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অত শক্তিশালী নয়। তারা কোনো ফর্মুলা দিতে পারেনি। এমনকি সংলাপেও তারা একটি ফর্মুলা দিতে পারত। জাতি কোনো বিকল্প কিছু পায়নি। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আছেন। মন্ত্রীরা সবাই আছেন। এটা ঐক্যফ্রন্টকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। একটি ছোট্ট মন্ত্রিসভা ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হলে মন্ত্রিসভার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত। কিন্তু তা হয়নি। সংলাপ হয়েছে বটে, কিন্তু ফলাফল শূন্য। এখন ‘শূন্য ফলাফল’ নিয়েই ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনে যেতে হচ্ছে। তবে একটা ভালো খবর— ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাবে। এটাই সঠিক রাজনীতি। নির্বাচন বয়কট কোনো ‘রাজনীতি’ হতে পারে না। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু তা দলটির জন্য সুখের হয়নি।
এখন নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হচ্ছে। তবে এই নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেক। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যেখানে আস্থার সম্পর্ক থাকা জরুরি বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও সেই আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বার বার প্রশ্ন ওঠে। এর একটা স্থায়ী সমাধান দরকার। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করাও জরুরি। নয়া সরকার (২০১৯) বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিতে পারে। নির্বাচনের আগে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একটি জাতীয় দৈনিক (প্রথম আলো ১৯ নভেম্বর)। অভিযোগ তোলা হয়েছে নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা ব্যক্তিদের সম্পর্কে পুলিশ খোঁজখবর নিচ্ছে। অথচ ইসি জানিয়েছে তারা পুলিশকে এই দায়িত্ব দেয়নি। এতে করে ইসির ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। বিগত সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযেগ্য করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছিল। ওই নির্বাচনে (খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর) ভোটকেন্দ্র দখল, সিল মারা রাজনীতির দৃশ্য মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল মিডিয়ার বদৌলতে। এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এইসব দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না- ইসি এটা নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে ইসি জাতিকে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তাই যেকোনো বিবেচনায় একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই বেগম জিয়া ও তারেক রহমান অন্তত আগামী পাঁচ বছরের জন্য ‘মাইনাস’ হয়ে গেলেন। এমনকি বিরোধীদলীয় রাজনীতিও চলে গেল বিএনপির নেতৃত্বের বাইরে। ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি থাকলেও তাদের ভূমিকা এখন সীমিত হয়ে যাবে।
‘নতুন এক রাজনীতির যুগে’ প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর যারাই সরকার গঠন করবে, তারাই গুরুত্ব দেবে সংসদীয় রাজনীতিকে। এক্ষেত্রে বিদেশিদের প্রতি নির্ভরশীলতাও কমে যাবে। সংসদ বয়কটের রাজনীতি থেকেও বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ। কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্ন আছে নির্বাচনপরবর্তী রাজনীতি নিয়ে। সংসদীয় রাজনীতির মূলকথা হচ্ছে, বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়া। তা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হবে কি না, বলা কঠিন। নির্বাচনের আগে যে হারে ঐক্যফ্রন্ট তথা গণফোরামে সাবেক আওয়ামী লীগ সমর্থকদের যোগদানের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, তাতে করে ব্যক্তির সুবিধাবাদী রাজনীতিই বেশি করে প্রকট হয়ে উঠেছে। এতে করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কাউকে কাউকে দেখা গেছে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়ে নমিনেশন ‘আদায়’ করে নিয়েছেন। এতে করে বিএনপির রাজনীতিরই বা কতটুকু উন্নতি হবে, সে প্রশ্ন থাকলই।
এমপি হওয়ার এটা একটা সহজ সুযোগ। সারা জীবন স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে, স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকলেও, এবার দেখা গেল দল-বদলের হিড়িক। নির্বাচন যেন অনেকটা এমপি হওয়ার প্রতিযোগিতা! এই প্রতিযোগিতায় ব্যবসায়ী তথা অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংখ্যাই বেশি। এদের দ্বারা রাজনীতিতে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই। একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে বটে, কিন্তু এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বাংলাদেশের খবর ৩০ নভেম্বর ২০১৮

দল বদলের রাজনীতি

অনেকগুলো নাম, এ কে খন্দকার, আবু সাইয়িদ, ড. রেজা ও সর্বশেষ গোলাম মাওলা রনি। এই নামগুলো এখন ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। কারণ এরা সবাই একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও এমপি হয়েছিলেন। এখন কেউ গণফোরামে যোগ দিয়েছেন। কেউ আবার বিএনপিতে। এদের সংখ্যা এখন মোটামুটি ভালোই। দল বদল করেছেন। নতুন দল তাদের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নও দিয়েছে। এই দল বদলের রাজনীতি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ কারণেই যে সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন। এরা কেউই মূল দল থেকে নমিনেশন না পেয়ে আশ্রয় নিয়েছেন গণফোরামে এবং বিএনপিতে।
এ ক্ষেত্রে গণফোরামের পাল্লাই ভারী। গণফোরাম এতোদিন অনেকটাই ঘুমিয়েছিলো। সাংগঠনিক তৎপরতা একদমই ছিলো না। ৬৪টি জেলায় এদের সাংগঠনিক কমিটিও নেই। কিন্তু ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে সাথে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করলেন।
মানুষের আগ্রহ বাড়লে, কামাল হোসেন তৎপর হলেন। তার বিদেশ যাওয়া কমে গেলে আর তাই রাজনীতির অতিথি পাখিরা ভীড় জমাতে শুরু করলেন গণফোরামে। ভাবখানা এই গণফোরামই হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি! একসময় বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলো। এখন যেন সেই জায়গাটা দখল করে নিলো গণফোরাম। তাই রাজনীতির অতিথি পাখিরা তৎপর হয়েছেন। গোলাম মাওলা রনি তো স্পষ্ট করেই বলেছেন, তিনি পটুয়াখালীর একটি আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে এবং না পেয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। ওই মনোনয়নও পেয়েছেন বিএনপি থেকে। তার অনেক অতীত বক্তব্য এখন ফেসবুকে ভাইরাল। যেখানে তিনি বিএনপির তথা মির্জা ফখরুল সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। মির্জা সাহেব এটা জেনে-শুনেই রনিকে দলে আশ্রয় দিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব রাজনীতির অতিথি পাখিদের দল বদলের কারণে দল বা রাজনীতি কতোটুকু উন্নত হবে? গণফোরাম বা বিএনপি কি খুব লাভবান হবে?
নির্বাচন হবে। নির্বাচনী রাজনীতি এখন তুঙ্গে। তবে এই নির্বাচন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বদলে দিতে পারবে না। রাজনীতির অতিথি পাখিরা রাজনৈতিক আদর্শের জন্য নয় বরং নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্যই দল ত্যাগ করে নতুন দলে যোগ দিয়েছেন।
যদি আদর্শের ব্যাপারে তারা কমিটেড থাকতেন, তাহলে তো অনেক আগেই তাদের গণফোরামের অথবা বিএনপিতে যোগ দেবার কথা। কিন্তু তারা তা করেননি।
আবু সাইয়িদ কিংবা গোলাম মাওলা রনিরা নতুন দলে গণফোরাম ও বিএনপিতে যোগ দেওয়ার দুই দিন আগেও টক-শোতে আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলেছেন। রনির একাধিক বক্তব্য আছে টক-শোতে। যেখানে তিনি বিএনপি ও বিএনপির নেতৃবৃন্দের সমালোচনা করেছেন। এখন রনি বলছেন, আমৃত্যু বিএনপির সাথে থাকার কথা। কিন্তু নির্বাচনের পর তিনি কী বিএনপির সক্রিয় থাকবেন? ঐক্যফ্রন্ট ও মহাজোট কেন্দ্রিক রাজনীতি এখন জমে উঠেছে। ঐক্যফ্রন্ট থেকে কারা কারা মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করবেন তা এখন অব্দি নিশ্চিত হয়নি।
মহাজোট নিয়েও কথা আছে। মোহাজোট শেষ অব্দি টিকে থাকবে কিনা, সেটাও আলোচিত হতে থাকবে বারবার। এর বাইরে তৃতীয় একটি শক্তির উত্থানের কথা বারবার বলা হলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সে সম্ভাবনাও ঘটলো না। আবারও প্রমাণ করলো জাতীয় রাজনীতি মূলত দুভাগে বিভক্ত হয়ে আছে।
একদিকে আওয়ামী লীগ ও অন্যদিকে আওয়ামী লীগবিরোধী একটি শক্তি। এতোদিন বিএনপি আওয়ামী লীগবিরোধী শিবিরের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলো। এখন বিএনপির পরিবর্তে সেখানে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জন্ম হয়েছে একটি জোটের। যেখানে বিএনপির একক কর্তৃত্ব আর নেই। তবে রাজনীতিতে যে আস্থাহীনতা বিদ্বেষ অপর পক্ষকে সহ্য না করার যে মানসিকতা তা রয়ে গেছে। তাতে পরিবর্তন আসেনি। একটি সংলাপ হয়েছিলো বটে। তবে তার কোনো ফল বয়ে আনেনি। তবে প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে একটাই ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির ঘটনার পুনরাবৃত্ত্বি হচ্ছে না। অর্থাৎ নির্বাচন বয়কট হচ্ছে না।
বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে। সব কিছু ঠিক থাকলে আমরা একটি শক্তিশালী বিরোধী দল পাবো একাদশ জাতীয় সংসদে। এখন নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হচ্ছে।
ব্যবসায়ী ও সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের সরকারি দলে যোগদানের হিড়িক বেড়েছে। সবাই চায় এমপি হতে! এতে করে স্থানীয় নেতৃত্ব উপেক্ষিত থাকছে। অথচ স্থানীয় পর্যায়ে এরাই দলকে টিকিয়ে রাখেন।
এখন রাজনীতির অতিথি পাখিরা যাদের সাথে স্থানীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এরাই দলের মনোনয়ন ভাগিয়ে নিচ্ছেন। এতে করে রাজনীতি উন্নত হবে না। স্থানীয় রাজনীতি বিকশিত হবে না। অর্থের জোরে, শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের সাথে সম্পর্কের জোরে দলীয় মনোনয়ন পেলে এবং নির্বাচিত হলেও স্থানীয় রাজনীতিতে ও সাধারণ মানুষের জন্য এদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। এরা ঢাকা কেন্দ্রিক হয়ে যাবে।
নিজেদের ব্যবসার পরিধি বাড়াবে। শুল্কমুক্ত গাড়ি ও প্লট ভাগিয়ে নেবে। রাজনীতি ধীরে ধীরে ব্যবসায়ী, অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর সুবিধাবাদীদের কব্জায় চলে যাচ্ছে। এই রাজনীতি গণমানুষের রাজনীতি না। এই রাজনীতি দ্বারা তৃণমূল মানুষের উন্নয়নের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই নির্বাচনের আগে যেভাবে শুধু মনোনয়ন না পাওয়া নিয়ে দল বদলের হিড়িক বাড়ছে তা আমাদের আশাবাদী করছে না।