রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

ট্রাম্প কি নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করলেন

শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন ট্রাম্প। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের অর্থ বরাদ্দের জন্য কংগ্রেসকে এড়াতে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন তিনি। ট্রাম্পের দাবি, মেক্সিকো সীমান্তের বর্তমান অবস্থাই ‘জরুরি অবস্থা’ জারির পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এই যুক্তির সঙ্গে একমত নয় ট্রাম্পবিরোধীরা। ওদিকে ভেনিজুয়েলা প্রসঙ্গেও দেখা দিয়েছে নতুন প্রশ্ন। ভেনিজুয়েলায় সম্ভাব্য একটি সামরিক হামলা কিংবা আইএনএফ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কি নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করতে যাচ্ছেন? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা এখন এই বিষয়ের ওপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায় এবং সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে। এরপর দীর্ঘ ২৬ বছর বৃহৎ শক্তির মাঝে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়নি। কিন্তু প্রথমে ইউক্রেন, পরবর্তী সময়ে সিরিয়ার পরিস্থিতি এবং চলতি ২০১৯ সালের শুরুতে ভেনিজুয়েলা ও আইএনএফ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের ঘটনায় দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এখন অনেকটা পরস্পর মুখোমুখি। সিরিয়া ও ভেনিজুয়েলার পরিস্থিতিতে এই দুই পরাশক্তি পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বরাজনীতির পরিস্থিতিতে যখন প্রভাববলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ওই সময় একদিকে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব, অন্যদিকে ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব; যদিও সত্তর-পরবর্তী সময়ে সমাজতান্ত্রিক চীন বিশ্বরাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করেছিল। স্নায়ুযুদ্ধ দীর্ঘ ৪৫ বছর বিশ্বকে অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ইউক্রেনের পরিস্থিতি (২০১৪) বদলে দেয় দৃশ্যপট। প্রেসিডেন্ট ইয়ানোকোভিচকে উত্খাত, বন্দরনগরী ক্রিমিয়ার রাশিয়ায় সংযুক্তি, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে রাশিয়ার উসকানি ইত্যাদি কারণে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। এমনকি রাশিয়া তার সীমান্তে ব্যাপক সেনা সমাবেশ ঘটালে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের একটা ‘যুদ্ধের’ আশঙ্কা সৃষ্টি করেছিল। এমনই এক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটোর মিত্র দেশগুলো ইউক্রেনের পাশে এসে দাঁড়ায়। সেই থেকে সেখানে এক ধরনের ‘যুদ্ধ’ চলে আসছে, যাকে বলা হচ্ছে ‘ওয়ার ইন ডনবাস’ (War in Donbuss)। ক্রিমিয়ার সংকটের (গণভোটে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তি ও পরে তা কার্যকর) পরপরই ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের দোনেতসেক এবং লুহানসক অঞ্চলে (ডনবাস) ক্রিমিয়া মডেলে আন্দোলন গড়ে ওঠে। বিচ্ছিন্নতাকামীরা স্বঘোষিত ‘পিপলস রিপাবলিক অব দোনেতসেক’ ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব লুহানসকের’ ঘোষণা দেয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ক্রিমিয়ার মতো রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তি চায়। তাদের অনেকেই রাশিয়ার বংশগত। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ঠেকাতে ইউক্রেন সেখানে সেনাবাহিনী পাঠায়। অন্যদিকে রাশিয়া বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই চাচ্ছে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। আর রাশিয়ার ভয়টা এখানেই। যদি ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয়, তাহলে রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটো তার সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে পারবে। এতে রাশিয়াকে চাপের মুখে রাখা যাবে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ভয়টা এখানেই। ২০১৪ সালের পর থেকেই ইউক্রেনে এক ধরনের ‘প্রক্সিযুদ্ধ’ চলে আসছে—একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে রাশিয়া।
এর পরের দৃশ্য সিরিয়ায়। ২০১১ সালে ‘আরব বসন্ত’ পুরো আরব বিশ্বে একটা পরিবর্তন এনেছিল। সেখানে দীর্ঘদিনের একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর পতন ঘটেছিল (তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন ও লিবিয়া)। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম সিরিয়া। সেখানে আসাদবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম হলেও (২০১১-২০১২ পরবর্তী সময়ে) ক্ষমতা থেকে আসাদকে সরানো যায়নি। ২০১৪ সালে সেখানে প্রথমবারের মতো জঙ্গি ইসলামিক গোষ্ঠী ‘দি ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট’ (পরবর্তীকালে শুধু ইসলামিক স্টেট)-এর জন্ম হয়, যারা ইরাকের একটি অংশ ও সিরিয়ার একটি অংশ নিয়ে তথাকথিত একটি ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করে। এই খিলাফতে যোগ দিতে এবং একটি জঙ্গি রাষ্ট্র গঠন করতে হাজার হাজার মুসলমান যুবক সিরিয়ায় যায় এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আইএসের উত্থান সারা বিশ্বসম্প্রদায়কে আতঙ্কিত করে তোলে। আইএসের যোদ্ধারা দীর্ঘদিন আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিশাল এক সিরিয়ান এলাকা দখল করে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। এমনই এক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা (ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া) ২০১৪ সালে আইএস অবস্থানের ওপর বিমান হামলা শুরু করে সিরিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। এমনকি মার্কিন বিমান সিরিয়ার আসাদ সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায়ও বোমাবর্ষণ করে। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দি নিয়ন্ত্রিত ও আসাদবিরোধী সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সকেও সমর্থন করে অস্ত্র দিয়ে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার বিমানবাহিনীও ওই যুদ্ধে জড়িয়ে যায় (২০১৫ সাল থেকে)। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পৃথক বিমান হামলায় আইএস ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সেখান থেকে উত্খাত হয়। কিন্তু আসাদকে উত্খাত করা সম্ভব হয়নি শুধু রাশিয়া ও ইরানের কারণে। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার ‘অবস্থান’ ভিন্ন ভিন্ন। সিরিয়া সংকটের যখন কোনো সমাধান হচ্ছিল না তখন ভেনিজুয়েলা সংকটে জড়িয়ে পড়ল রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র।
অনেকেই এটা জানে যে ভেনিজুয়েলার তেলসম্পদের দিকে মার্কিন তেল সংস্থাগুলোর আগ্রহ দীর্ঘদিনের। ভেনিজুয়েলার তেলসম্পদ তারা তাদের নিজেদের কবজায় নিয়ে যেতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি বিভাগের মতে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেলের রিজার্ভ রয়েছে ভেনিজুয়েলায়। এর পরিমাণ তিন লাখ ৮৭৮ মিলিয়ন ব্যারেল (২০১৭ সালের পরিসংখ্যান)। পরের রিজার্ভ রয়েছে সৌদি আরবে, দুই লাখ ৬৬ হাজার ৪৫৫ মিলিয়ন ব্যারেল। ফলে এই তেল যে একটি ফ্যাক্টর, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। মাদুরো নিজেও স্বীকার করেছেন যে ভেনিজুয়েলার তেলসম্পদ জব্দ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। হুগো শাভেজের আমলে ভেনিজুয়েলা একটি ধনী দেশে পরিণত হয়েছিল। রাজধানী কারাকাসে তেলসম্পদের বদৌলতে অনেক হাইরাইজ ভবন তৈরি করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল বিনিয়োগকারীরা আসবে। কিন্তু সেসব ভবন এখন খালি। কোনো বিনিয়োগকারী নেই। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে। মুদ্রাস্ফীতি সেখানে চরমে। ২০১৬ সালের হিসাবে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৮০০ শতাংশ। আর আইএমএফের মতে, ২০১৯ সালে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১০০ শতাংশ (১০ মিলিয়ন)। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সেখানে পাওয়া যায় না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ২০১৮ সালে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আইএমএফ ভেনিজুয়েলার এই পরিস্থিতিকে ১৯২৩ সালে জার্মানি, আর ২০০০ সালের জিম্বাবুয়ের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেছে (রয়টার্স প্রতিবেদন, ৯ অক্টোবর ২০১৮)। ফলে সংগত কারণেই মানুষের মাঝে হতাশা আছে সেখানে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে ভেনিজুয়েলার মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী দেশে যাচ্ছে। কোনো কোনো যুবতী বা কিশোরী মেয়ে তার লম্বা চুল বিক্রি করছে জীবিকা নির্বাহের জন্য। অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্য ঘটনা। খাদ্যঘাটতি সেখানে রয়েছে। মাদুরোর অতি বাম নীতি বা পযধারংস ভেনিজুয়েলার সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এখানে যে ব্যর্থতা রয়েছে, তা সমাধান করতে পারেননি মাদুরো। তাই ডানপন্থী সংগঠনগুলো এর সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু মাদুরোকে উত্খাত কিংবা সেখানে একটি প্রো-ওয়েস্টার্ন সামরিক অভ্যুত্থান কি কোনো সমাধান এনে দেবে?
ট্রাম্প প্রশাসন ভেনিজুয়েলায় একটি ‘সামরিক আগ্রাসন’ চালানোর কথা বললেও তা শেষ পর্যন্ত কতটুকু তিনি কার্যকর করবেন, এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এমনিতেই অভ্যন্তরীণভাবে তিনি নানা সমস্যার সম্মুখীন। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণে তিনি কংগ্রেসের কাছে কয়েক বিলিয়ন ডলার চেয়েছিলেন। কংগ্রেস তা দেয়নি। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার ‘জড়িত’ থাকা (হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল হ্যাক করার ঘটনা) ও সে ব্যাপারে তাঁর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এ থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ভেনিজুয়েলায় ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর নির্দেশ দিতে পারেন ট্রাম্প। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই রেজিম চেঞ্জের নীতি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বেশ কয়েক বছর ধরে অনুসরণ করে আসছে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন আর লিবিয়ায় গাদ্দাফির উত্খাতের পেছনে এই ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর নীতি কাজ করেছিল। আবার সিরিয়ায় তা কাজ করেনি। সিরিয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার জড়িয়ে যাওয়া এবং আসাদ সরকারকে সমর্থন করায় এই ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর নীতি সেখানে কাজ করেনি। ভেনিজুয়েলার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছে। কেননা রাশিয়া, এমনকি চীনও মাদুরোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি সেখানে সামরিক আগ্রাসন চালায়, তা হীতে বিপরীত হতে পারে। এটা শুধু নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের আশঙ্কা বাড়াবে না, বরং পুরো লাতিন আমেরিকায় একটি মার্কিনবিরোধী শক্তিশালী জনমতের জন্ম দিতে পারে। এই যখন পরিস্থিতি তখন আমাদের জন্য আরেকটা খারাপ খবর হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া কর্তৃক আইএনএফ (Intermediate range nuclear forces treaty) চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া। চুক্তি ভঙ্গ করে রাশিয়া পরমাণু অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র বানাচ্ছে—এই অভিযোগ তুলে গত ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র আইএনএফ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। এর পরদিন রাশিয়াও বেরিয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে দুই পরাশক্তির মাঝে আবার নতুন করে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হলো। এরই মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ঘোষণা করেছেন যে শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ দ্রুতগামী হাইপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বানানোর কাজ শুরু করবে রাশিয়া। বলা ভালো, ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন (রিগ্যান ও গর্বাচেভের মধ্যে চুক্তি) এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ওই চুক্তিবলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পাল্লার (৫০০ থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ কিলোমিটার) সব পরমাণু অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের চার বছরের মধ্যে দুই হাজার ৭০০ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছিল রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এখন যদি বৃহৎ শক্তি অস্ত্র উৎপাদন শুরু করে, তাহলে বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়বে।
একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে প্রভাববলয় বিস্তারের নতুন এক প্রতিযোগিতা। স্নায়ুযুদ্ধ-২ নামে তা কোনো কোনো পর্যবেক্ষক তাঁদের লেখায় উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে পার্থক্য একটাই—আর তা হচ্ছে একসময় যা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ, এখন তা শুধু যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। চীন এখন একটি শক্তি। চীনের অবস্থান রাশিয়ার পক্ষে। ভেনিজুয়েলা, সিরিয়া কিংবা ইউক্রেন সংকটে চীন রাশিয়াকে সমর্থন করেছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ও যুক্তরাষ্ট্রকে চীন থেকে আলাদা করেছে। একসময় ছিল যখন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন স্নায়ুযুদ্ধকালে তৃতীয় বিশ্ব তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে তাদের পাশে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ফলে তৃতীয় বিশ্বেও বিভক্তি দেখা গিয়েছিল। একুশ শতকে এসে আঞ্চলিকভাবে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ শক্তিশালী। ভারতের মতো দেশ একটি উঠতি শক্তি। ভারত এরই মধ্যে ব্রিকস ও ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’-এর মতো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চীন-ভারত-রাশিয়া অক্ষ গড়ে তুলছে। ফলে অতীতের মতো যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রভাব বিস্তার করার সম্ভাবনা কম। বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পরস্পরবিরোধী অবস্থান বিশ্বে এখন উত্তেজনা বাড়াবে মাত্র।
Kalerkontho
17.02.2019

বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে দুটি কথা

ড. মোমেন প্রথম সফর হিসেবে ভারতকে বেছে নিয়েছেন, এটা যে কোনো বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। বিশেষ করে গত দশ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে
৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এর আগে ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪ সালেও তিনি সরকার গঠন করেছিলেন। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আমরা লক্ষ করি।
এক. নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন দায়িত্ব গ্রহণ করার পরপরই প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ভারতে যান। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে বাংলাদেশ যে গুরুত্ব দেয়, তা আবারও প্রমাণিত হলো।
দুই. বাংলাদেশ ১৪ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মাধ্যমে সৌদি আরব-ইয়েমেন সীমান্তে বাংলাদেশের ১ হাজার ৮০০ সেনাসদস্য মাইন অপসারণে নিয়োজিত থাকবে। এতে বিদেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা আরও বাড়ল। জাতিসংঘের বাইরে এ প্রথম কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ একটি সামরিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করল।
তিন. শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পরপরই যে দুটি দেশ প্রথম এ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, তার একটি হচ্ছে ভারত, অপরটি চীন। চীনের স্বীকৃতির মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হলো, দুটি প্রতিবেশী ক্ষমতাধর দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ যে ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে, চীন তা সমর্থন করছে। তবে সব ছাপিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ, এটা গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যাটির সমাধানে বাংলাদেশ যে আঞ্চলিক দেশগুলোকে সংশ্লিষ্ট করতে চায়Ñ এটা তার বড় প্রমাণ। যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের পর যে যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে রোহিঙ্গা শব্দটি এড়িয়ে রাখাইনের বাস্তুচ্যুত নাগরিক এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টিও ইশতেহারে উল্লেখ ছিল না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফরে তিনটি সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে। চুক্তিগুলো হচ্ছেÑ ১ হাজার ৮০০ মধ্যম সারির বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তাকে ভারতে প্রশিক্ষণ দেওয়া, দুর্নীতি দমন কমিশন ও ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের মধ্যে চুক্তি ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ভারতের আয়ুগের মধ্যে অপর একটি চুক্তি।
ড. মোমেন প্রথম সফর হিসেবে ভারতকে বেছে নিয়েছেন, এটা যে কোনো বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। বিশেষ করে গত দশ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ভারতকে যা দিয়েছে, তা ভারত অনেকদিন মনে রাখবে। কিন্তু তারপরও বেশকিছু বিষয় রয়েছে (তিস্তার পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা, ট্যারিফ হ্রাস ও বাণিজ্যে ভারসাম্য আনা ইত্যাদি), যার কোনো সমাধান হয়নি। ড. মোমেনের এ সফরে তার কোনো কিছুর জট খুলল না।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র হিসেবে আমরা বরাবর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিই। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারতের ভূমিকা অনেক বড় এবং ভারতের সাহায্য নিয়ে আমরা আমাদের উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে চাই। মনে রাখতে হবে, বর্তমান সরকার উন্নয়নকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রাক নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতে উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে বিশ্বের তৃতীয় দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রত্যাশা শীর্ষক জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উন্নয়নের ধারায় ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের তৃতীয় দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। চলতি বছর (২০১৯) বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আর ৭ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি নিয়ে ভারতের অবস্থান থাকবে দ্বিতীয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভারতের চেয়ে ভালো, যা স্বয়ং নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনও স্বীকার করেছেন। যেমনÑ বলা যেতে পারে, মেয়ে শিশুদের শিক্ষার হার। শিশুমৃত্যু (২০১৭) প্রতি হাজারে বাংলাদেশে যেখানে ২৭, সেখানে ভারতে ৩২। বাংলাদেশে গড়ে মানুষ বেঁচে থাকে ৭৮.৫ বছর, আর ভারতে ৬৮.৮ বছর। মহিলাদের সংসদে প্রতিনিধিদের হার বাংলাদেশে শতকরা ১৪ ভাগ, আর ভারতে শতকরা ১১ ভাগ। মাথাপিছু আয় বাংলাদেশে যেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে (২০১৩-২০১৬) শতকরা ৩৯ ভাগ হারে, সেখানে ভারতে এ বৃদ্ধি মাত্র ১৩ দশমিক ৮ ভাগ। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ সাফল্য বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে পারে। এ মন্তব্য বিশ্বব্যাংকের (সাউথ এশিয়ার মনিটর, ১০ জানুয়ারি ২০১৯)। ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার মতো দেশকে পেছনে ফেলে বিশ্বের ২৬তম অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারত হচ্ছে বড় অর্থনীতির দেশ। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এরই মধ্যে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে।
ভারত বর্তমানে বিশ্বের ষষ্ঠ অর্থনীতি (সাধারণ হিসাবে ২.৮৪৮ ট্রিলিয়ন ডলার), আর ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ভারতের অবস্থান তৃতীয় (১০ দশমিক ৩৮৫ ট্রিলিয়ন ডলার)। সুতরাং এমন একটি অর্থনীতির দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনেক বেশি। ভারতের আঞ্চলিক অভিযাত্রায় বাংলাদেশ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো দায়িত্ব নিয়ে তার পররাষ্ট্রনীতিতে যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি (নেইবারহুড ফার্স্ট) আনেন, তাতে তিনি বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মোদির ঢাকা সফরের সময় (২০১৫) বাংলাদেশ একটি উপআঞ্চলিক সহযোগিতা (বিবিআইএন) চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত (সাত বোন রাজ্য) ও নেপালকে নিয়েই গড়ে উঠছে বিবিআইএনের ধারণা। বিবিআইএনের আওতায় আঞ্চলিক বাণিজ্য জ্বালানি সংকটের সমাধান (বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ) এবং শুকনো মৌসুমে যে পানির ঘাটতি রয়েছে, তার সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশ ভারত থেকে (২০১৩) ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছে। আরও ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিয়ে চূড়ান্ত চুক্তিও হয়েছে। ভারতের সাত বোন রাজ্য ভুটান ও নেপালে প্রায় ৫৮ হাজার ৯৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের যে ‘বিদ্যুৎ ঘাটতি’, তা বাংলাদেশ এখান থেকে মেটাতে পারে। এজন্য বাংলাদেশ ‘পাওয়ার করিডোর’ চাচ্ছে। অর্থাৎ ভুটান বা নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে হলে ভারতের এলাকার ওপর দিয়ে তা আনতে হবে। এজন্যই দরকার ‘পাওয়ার করিডোর’, যাতে ভারতের সম্মতি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ভারতকে আসাম থেকে বিদ্যুৎ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বিহারে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। ভারতের একটি কোম্পানি (আদানি গ্রুপ) রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র (কয়লানির্ভর) নির্মাণ করছে। অন্যদিকে ভারতের রিলায়েন্স কোম্পানি ৩ মিলিয়ন ডলার এলএনজি খাতে বিনিয়োগ করেছে, যেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। ২০১৮ সালে ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন নির্মাণ শেষ হয়েছে, যার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশকে ৪ লাখ টন ডিজেল সরবরাহ করছে। ভারতের মোদি সরকার যে আঞ্চলিক ‘পাওয়ার ট্রেডিং সিস্টেম’ চালু করতে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ উপকৃত হবে।
প্রতিরক্ষা খাতেও দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক ভালো। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দি০ল্লি সফরের সময় একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন ভারত থেকে সমরাস্ত্রও ক্রয় করছে। ২০১১ সালে দুই দেশের সেনাবাহিনী একটি যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছিল। ওই মহড়া অব্যাহত রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনও সমস্যা রয়ে গেছে। বিশেষ করে ট্যারিফ ও প্যারা ট্যারিফের বাধা এখনও দূর করা যায়নি। যে কারণে ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় আমদানিকারকরা বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সাত বোন রাজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সেটা এখন ঝুঁকির মুখে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে পারবে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে কেবিনেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারত, বিশেষ করে ভারতের সাত বোন রাজ্যগুলো এখন চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে তাদের পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে। ভারতের সহযোগিতা নিয়ে পটুয়াখালীর অদূরে পায়রায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দরও নির্মাণ করা হচ্ছে। এটা তৈরি শেষ হলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর ‘চাপ’ কমবে। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশকে দুই বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগেরও প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল। স্পষ্টতই এই যে পরিসংখ্যান, এ পরিসংখ্যান বলে দুই দেশের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তবে সমস্যা যে নেই, তা নয়। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে জটিলতা আছে। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যতটুকু আন্তরিক, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ততটুকু আন্তরিক নন। সেখানে এটি মূলত একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। চলতি বছর সেখানে বিধানসভা ও লোকসভার নির্বাচন। মমতা ব্যানার্জি তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি একটি ইস্যু করতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার এটা উল্লেখ করেছেন যে, মমতা ব্যানার্জির কারণেই তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি আটকে আছে। আসামে এক ধরনের ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান শুরু হয়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
সৌদি আরবের সঙ্গে সামরিক চুক্তি নিয়ে সংসদে কথা হয়েছে। এক সময়ে যারা সরকারে ছিল, সেই ওয়ার্কার্স পার্টির এক অংশের সভাপতি রাশেদ খান মেনন সংসদকে না জানিয়ে এ ধরনের একটি চুক্তি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তবে দেখতে হবে এক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে। কেননা পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি জড়িত। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের প্রায় ২০ লাখ মানুষ সেখানে কর্মরত। তাদের পাঠানো অর্থ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস। দুটি পবিত্র মসজিদ (মসজিদে হারাম-মক্কা ও মসজিদে নববি-মদিনা) এর জিম্মাদার হচ্ছেন সৌদি বাদশাহ। বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য মসজিদ দুটি পবিত্রতম। মসজিদ দুটি রক্ষার ব্যাপারে বাংলাদেশ ‘কমিটেড’। তবে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ যদি প্রলম্বিত হয় এবং সৌদি আরব-যুক্তরাষ্ট্র যদি এ ‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে যায়, তাহলে ইয়েমেন সীমান্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হবেÑ সেটা একটা প্রশ্ন। হ
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্
Daily AlokitoBangladesh
17.02.2019

জ্বালানি সম্পদ ও ভেনেজুয়েলার পরিস্থিতি

স্পষ্টই ভেনেজুয়েলার পরিস্থিতি সেখানে উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে। সেনাবাহিনী এখনও প্রেসিডেন্ট মাদুরোর প্রতি বিশ্বস্ত থাকায় সেখানে কোনো সামরিক অভ্যুত্থান হচ্ছে না। তবে অর্থনৈতিকভাবে চাপের মুখ আছে মাদুরো সরকার। যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে ভেনেজুয়েলা তার উত্তোলিত তেল বিশ্ববাজারে বিক্রি করতে পারছে না

জ্বালানি সম্পদ একটি দেশের জন্য যেমন আশীর্বাদস্বরূপ, ঠিক তেমনি একটি দেশের নিরাপত্তার জন্যও তা কখনও কখনও হুমকিস্বরূপও বটে। এ জ্বালানি সম্পদের কারণে অতীতে অনেক দেশে আন্তর্জাতিক তেল ও গ্যাস সংস্থাগুলোর প্ররোচনায় সেসব দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে এবং সেখানকার জাতীয়তাবাদী সরকার উৎখাত হয়েছে। ইরানের পরিস্থিতির কথা নিশ্চয়ই অনেকে স্মরণ করতে পারেন। ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয়তাবাদী নেতা মোসাদ্দেক ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কর্তৃক সে দেশে নিয়ন্ত্রিত তেল সম্পদ জাতীয়করণ করেন। ফলে তিনি ব্রিটিশ ও মার্কিন বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোর টার্গেটে পরিণত হন। এ কারণে ১৯৫৩ সালের আগস্টে তৎকালীন বাদশাহ রেজাশাহ পাহলভী যখন মোসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে সরানোর পরিকল্পনা করেন বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোর ষড়যন্ত্রে, ঠিক তখনই তেহরানে ব্যাপক বিক্ষোভ হয় এবং ওই গণঅসন্তোষে শাহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই পাল্টা অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেক ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর ইরানের পুরো তেলসম্পদ চলে যায় বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোর হাতে। আজ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলার পরিস্থিতি অনেকটা মোসাদ্দেকের সময়কার ইরানের মতোই। ভেনেজুয়েলার তেল সম্পদের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বামপন্থি মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। আর এর পেছনে রয়েছে বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোর ষড়যন্ত্র। তারা এ তেল সম্পদ নিজেদের হাতে নিতে চায়। বর্তমানে এটি ভেনেজুয়েলা সরকারের নিয়ন্ত্রণে, অনেকটা ১৯৫১-১৯৫৩ সালের ইরানের তেল সম্পদের মতো। বিশ্বে বর্তমানে যে তেলের রিজার্ভ রয়েছে তার মাঝে সবচেয়ে বেশি রিজার্ভ রয়েছে ভেনেজুয়েলায়, বিশ্ব রিজার্ভের শতকরা ১৭ দশমিক ৯ ভাগ। এ রিজার্ভ এখন বহুজাতিক তেল কোম্পানগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোর মধ্যে শেভরন, টোটাল, ইনি, স্টাটো অয়েল ভেনেজুয়েলায় তেল উত্তোলন (গভীর সমুদ্র) প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকলেও তারা সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণে তেল উত্তোলনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। মাদুরো সরকার পুরো জ্বালানি তেলের নিয়ন্ত্রণ তথা দেখভালের দায়িত্ব অর্পণ করেছিল সরকারি সংস্থা ভেনেজুয়েলার পেট্রোলিয়ামকে। ভেনেজুয়েলার বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এ জ্বালানি তেল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের যে চাহিদা তার একটা বড় অংশ আসে ভেনেজুয়েলা থেকে।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় ৫০০ মার্কিন কোম্পানি ভেনেজুয়েলায় তেল উৎপাদন, বিপণন, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি নানা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ খাত থেকে ভেনেজুয়েলা আয় করেছে ৩২৫ বিলিয়ন ডলার। মাদুরো সরকার ২০১৭ সালের পর থেকে জ্বালানি সম্পদের ওপর তার সরকারের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ফলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর মাঝে এক ধরনের অসন্তোষ দেখা যায়। সেই থেকে চেষ্টা চলছে কীভাবে ভেনেজুয়েলার তেল সম্পদকে কব্জা করা যায়। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে কীভাবে বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেভরন, হালিবার্টন শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে ভেনেজুয়েলায় একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে সেনাবাহিনীকে প্ররোচিত করছে Regime Change for Profit : Chevron, Halliburton cheer on US Venezuela Coup, February 4, 2019)। ভেনেজুয়েলায় মার্কিনি কোম্পানিগুলোর স্বার্থ কী, তা উল্লেখ রয়েছে এ প্রবন্ধে। মার্কিনি এ তেল কোম্পানিগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সেখানে ‘সরকার পরিবর্তন’-এ উৎসাহিত করছে। অতীতে মার্কিন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ ছিলেন তেল কোম্পানি শেভরনের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার। তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা কনডোলিৎসা রাইস ছিলেন শেভরনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ইরাক যুদ্ধের পর হালিবার্টন সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল। তাদের আয় বেড়েছিল ৩৯.৫ মিলিয়ন ডলার। ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ ছিল ৩৪ মিলিয়ন ডলার। ইরাক যুদ্ধের পর অতিরিক্ত তেল উত্তোলন করে হলিবার্টন ফায়দা উঠিয়েছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী ইরাক পুনর্গঠনের কাজও পেয়েছিল হালিবার্টন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পেরও বিনিয়োগ ছিল হালিবার্টনে। এ বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লাখ ডলার (২০১৬)। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তার শেয়ার তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। হালিবার্টনের সঙ্গে ‘অবৈধ সম্পর্ক’ রাখার কারণে ট্রাম্পের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়ান সিনকে (জুধহ তরহশব) পদত্যাগ পর্যন্ত করেছিলেন। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, ভেনেজুয়েলায় মার্কিনি তেল কোম্পানি, বিশেষ করে হালিবার্টনের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রহ রয়েছে। ভেনেজুয়েলায় এখন দুজন প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট মাদুরো এবং পার্লামেন্টের স্পিকার গুয়াইদো, যিনি নিজেকে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছেন। গুয়াইদোকে সমর্থন করছে এবং স্বীকৃতি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো। অন্যদিকে চীন, রাশিয়া, ইরান, লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ সমর্থন করছে মাদুরো সরকারকে।
১৯২২ সালে তেল পাওয়ার পর থেকে ভেনেজুয়েলার তেলসম্পদের দিকে মার্কিনি তেল সংস্থাগুলোর আগ্রহ বাড়ছে। ভেনেজুয়েলার তেল সম্পদ তারা তাদের নিজেদের কব্জায় নিয়ে যেতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি বিভাগের মতে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেলের রিজার্ভ রয়েছে ভেনেজুয়েলায়। এর পরিমাণ ৩ লাখ ৮৭৮ মিলিয়ন ব্যারেল (২০১৭ সালের পরিসংখ্যান)। পরের রিজার্ভ রয়েছে সৌদি আরবে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৫৫ মিলিয়ন ব্যারেল। ফলে এ তেল যে একটি ফ্যাক্টর, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। মাদুরো নিজেও স্বীকার করেছেন, ভেনেজুয়েলার তেলসম্পদ জব্দ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। হুগো শ্যাভেজের আমলে ভেনেজুয়েলা একটি ধনী দেশে পরিণত হয়েছিল। রাজধানী কারাকাসে তেল সম্পদের বদৌলতে অনেক হাইরাইজ ভবন তৈরি করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল, বিনিয়োগকারীরা আসবে। কিন্তু সেসব ভবন এখন খালি। কোনো বিনিয়োগকারী নেই। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে। মুদ্রাস্ফীতি সেখানে চরমে। ২০১৬ সালের হিসাবে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিল শতকরা ৮০০ ভাগ। আর আইএসএফের মতে, ২০১৯ সালে এর পরিমাণ দাঁড়াল শতকরা ১০০ ভাগ (১০ মিলিয়ন)। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সেখানে পাওয়া যায় না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ২০১৮ সালে বেড়েছে ১৩৭০০০০ ভাগ। আইএসএফ ভেনেজুয়েলার এ পরিস্থিতিকে ১৯২৩ সালে জার্মানি আর ২০০০ সালের জিম্বাবুয়ের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেছে (রয়টার্স প্রতিবেদন, ৯ অক্টোবর ২০১৮)। ফলে সংগত কারণেই মানুষের মাঝে হতাশা আছে সেখানে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ভেনেজুয়েলার মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী দেশে যাচ্ছে। কোনো কোনো তরুণী/কিশোরী তার লম্বা চুল বিক্রি করছে জীবিকা নির্বাহের জন্য। অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্য ঘটনা। খাদ্য ঘাটতি সেখানে রয়েছে। মাদুরোর অতি বাম নীতি ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এখানে যে ব্যর্থতা রয়েছে, তা সমাধান করতে পারেননি মাদুরো। তাই ডানপন্থি সংগঠনগুলো এর সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু মাদুরোকে উৎখাত কিংবা সেখানে একটি প্রো-ওয়েস্টার্ন সামরিক অভ্যুত্থান আদৌ কোনো সমাধান এনে দেবে না।
ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলায় একটি ‘সামরিক আগ্রাসন’ চালানোর কথা বললেও তা শেষ পর্যন্ত কতটুকু তিনি কার্যকর করবেনÑ এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এমনিতেই অভ্যন্তরীণভাবে তিনি নানা সমস্যার সম্মুখীন। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণে তিনি কংগ্রেসের কাছে কয়েক বিলিয়ন ডলার চেয়েছিলেন। কংগ্রেস তা দেয়নি। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার ‘জড়িত’ থাকা (হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল হ্যাক করার ঘটনা) ও সে ব্যাপারে তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এ থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ভেনেজুয়েলায় ‘রেজিস চেঞ্জ’-এর নির্দেশ দিতে পারেন ট্রাম্প। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ ‘রেজিস চেঞ্জ’-এর রীতি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বেশ কয়েক বছর ধরে অনুসরণ করে আসছে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন আর লিবিয়ায় গাদ্দাফির উৎখাতের পেছনে এ ‘রেজিস চেঞ্জ’-এর নীতি কাজ করেছিল। আবার সিরিয়ায় তা কাজ করেনি। সিরিয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার জড়িয়ে যাওয়া ও আসাদ সরকারকে সমর্থন করায় এ ‘রেজিস চেঞ্জ’-এর নীতি সেখানে কাজ করেনি। ভেনেজুয়েলার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছে। কেননা রাশিয়া, এমনকি চীনও মাদুরোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি সেখানে সামরিক আগ্রাসন চালায়, তা হিতে বিপরীত হতে পারে। এটা শুধু নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়াবে না, বরং পরো লাতিন আমেরিকায় একটি মার্কিনবিরোধী শক্তিশালী জনমতেরও জন্ম দিতে পারে।
স্পষ্টই ভেনেজুয়েলার পরিস্থিতি সেখানে উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে। সেনাবাহিনী এখনও প্রেসিডেন্ট মাদুরোর প্রতি বিশ্বস্ত থাকায় সেখানে কোনো সামরিক অভ্যুত্থান হচ্ছে না। তবে অর্থনৈতিকভাবে চাপের মুখ আছে মাদুরো সরকার। যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে ভেনেজুয়েলা তার উত্তোলিত তেল বিশ্ববাজারে বিক্রি করতে পারছে না। ব্রিটেনের ব্যাংকে রক্ষিত এক মিলিয়ন ডলারের স্বর্ণ ভেনেজুয়েলা প্রত্যাহার করে নিতে পারছে না। খাদ্য সংকট সেখানে চরমে। খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সেখানে কলম্বিয়া থেকে খাদ্যবাহী ট্রাক পাঠানো হয়েছিল; কিন্তু তা ভেনেজুয়েলায় ঢুকতে পারেনি। পরিস্থিতি সেখানে দিন দিনই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে মাদুরো আগাম পার্লামেন্ট নির্বাচনের ডাক দিলেও সাড়া মেলেনি বিরোধী পক্ষের। অন্যদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আহ্বান জানিয়েছে নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজন করার। সংকটের মাত্রা সেখানে বাড়ছে। কোনো পক্ষ থেকেই সমঝোতার কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। গুয়াইদো চাচ্ছেন একটি সামরিক অভ্যুত্থান, যাতে মাদুরো সরকার উৎখাত হয়। এ জন্য তিনি মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার কথাও বলেছেন। তবে কোনো সামরিক অভ্যুত্থানই সেখানকার সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে ভেনেজুয়েলায়। এরই মধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া দুটি বিপরীতমুখী প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে। আর চীন বলছে ভেনেজুয়েলার সমস্যার সমাধান ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলায় অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করায় দেশটির ক্ষতি হয়েছে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার। ফলে এত বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে দেশটি কীভাবে টিকে থাকবেÑ সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। 

ভেনিজুয়েলার পরিস্থিতি ও সংকটের মাত্রা

ভেনিজুয়েলার পরিস্থিতি বোধ করি এই মুহূর্তে বিশ্ব রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত বিষয়। দক্ষিণ আমেরিকার তেলসমৃদ্ধ এই দেশটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের আগ্রাসনের সম্মুখীন। সেখানে এখন দু'জন প্রেসিডেন্ট। নিকোলাস মাদুরো ক্ষমতায় আছেন ২০১৩ সালের পর থেকে। ভেনিজুয়েলার বহুল আলোচিত প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর (২০১৩) মাদুরো সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারিতে রাজনীতির দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে যায়। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ২০১৮ সালে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে মাদুরো 'বিজয়ী' হলেও তা ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দেয়। জানুয়ারিতে (২০১৯) মাদুরো প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলে কার্যত দেশটি রাজনৈতিকভাবে দু'ভাগে ভাগ হয়ে যায়। মাদুরোকে চ্যালেঞ্জ করে জাতীয় সংসদের স্পিকার জুয়ান গুইদো নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই থেকে দেশটিতে এক ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একদিকে রয়েছে মাদুরো ও তার দল 'ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টি অব ভেনিজুয়েলা' (পিএসইউভি), অন্যদিকে জুয়ান গুইদো ও তার নেতৃত্বাধীন 'ডেমোক্রেটিক ইউনিটি রাউন্ডটেনিল' (এসইউডি)সহ বেশ কয়েকটি বিরোধী দল। কিন্তু সংকটের মাত্রাটা বৃদ্ধি পেয়েছে যখন যুক্তরাষ্ট্র জুয়ান গুইদোকে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। একই সঙ্গে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড, পর্তুগাল ও স্পেনও যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করে। অন্যদিকে রাশিয়া, চীন, এমনকি তুরস্ক সমর্থন করছে মাদুরো সরকারকে। 

ভেনিজুয়েলার পরিস্থিতি এখন কোনদিকে যায়, বলা মুশকিল। মাদুরো সরকারকে উৎখাতে ভেনিজুয়েলায় সম্ভাব্য একটি মার্কিনি আগ্রাসন কিংবা সেনাবাহিনী কর্তৃক সামরিক অভ্যুত্থানের কথাও কোনো কোনো মহলে আলোচিত হচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী মাদুরো সরকারকে সমর্থন করে যাচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের উদ্যোগ নিতে পারে। একটি 'সামরিক অপশন'-এর সম্ভাবনা রয়েছে বলে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইঙ্গিত করেছেন। কোনো কোনো সংবাদপত্রে এমন আভাসও দেওয়া হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র হন্ডুরাসে অবস্থিত সটো কানো (Soto Cano) বিমান ঘাঁটি, গুয়ানতানামো বের নৌবাহিনী ঘাঁটি এবং পুর্টো রিকোতে অবস্থিত ফোর্ট বুকানান ((Fort Buchanan) বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করে ভেনিজুয়েলায় সামরিক আগ্রাসন চালাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ও মেরিন সেনারা এসব অঞ্চলে নিয়োজিত। 

প্রশ্ন হচ্ছে, ভেনিজুয়েলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হলো কেন? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, ভেনিজুয়েলায় প্রয়াত হুগো শাভেজের শাসনামল (১৯৯৯-২০১৩) থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনিজুয়েলার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। হুগো শাভেজ তার শাসনামলে কিউবা তথা রাশিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি যে রাজনীতি ধারণ করতেন, যা কোনো কোনো বিশ্নেষক Chavism হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থি। Chavism-এর ধারণা অনেকটা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ, বামপন্থি পপুলিজম, দেশাত্মবোধ, বলিভারিয়ানিজম, ফেমিনিজম এবং ক্যারিবিয়ান ও লাতিন আমেরিকার ইন্টিগ্রেশনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। হুগো শাভেজ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন। তেলসম্পদকে হুগো শাভেজ ব্যবহার করেছিলেন তার এই মতাদর্শ সারা ক্যারিবীয় ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিতে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল (১৯৯১), তখন শাভেজ তার সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ নতুন করে উপস্থাপন করেছিলেন। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলোতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কিউবা একটি বড় অবদান রেখে আসছিল। আর এর ব্যয়ভার বহন করত ভেনিজুয়েলা। সস্তায় অথবা বিনামূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহ করে ভেনিজুয়েলা ক্যারিবীয় অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি করেছিল। মাদুরো সেই নীতি এখনও চালিয়ে আসছেন। এখনও কিউবার ডাক্তার ও শিক্ষকরা ক্যারিবীয় অঞ্চলে কাজ করেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ভেনিজুয়েলার সেই তেলের রমরমা ব্যবসা এখন আর নেই। তারপরও ভেনিজুয়েলাকে নিয়ে ভয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে ভেনিজুয়েলায় একটি প্রো-ওয়েস্টার্ন তথা যুক্তরাষ্ট্রের একজন বন্ধু দরকার। তাই সুযোগ বুঝে জুয়ান গুইদোকে সামনে নিয়ে আসা ও তাকে দিয়ে একটি পাল্টা সরকার গঠন করে সেই সরকারকে সমর্থন করতে দ্বিধাবোধ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। 

অনেকেই এটা জানেন, ভেনিজুয়েলার তেলসম্পদের দিকে মার্কিনি তেল সংস্থাগুলোর আগ্রহ দীর্ঘদিনের। ভেনিজুয়েলার তেলসম্পদ তারা নিজেদের কব্জায় নিতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি বিভাগের মতে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেলের রিজার্ভ রয়েছে ভেনিজুয়েলায়। এর পরিমাণ ৩,০০,৮৭৮ মিলিয়ন ব্যারেল (২০১৭ সালের পরিসংখ্যান)। পরের রিজার্ভ রয়েছে সৌদি আরবে ২,৬৬,৪৫৫ মিলিয়ন ব্যারেল। ফলে এই তেল যে একটি ফ্যাক্টর, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। মাদুরো নিজেও স্বীকার করেছেন, ভেনিজুয়েলার তেলসম্পদ জব্দ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। হুগো শাভেজের আমলে ভেনিজুয়েলা একটি ধনী দেশে পরিণত হয়েছিল। রাজধানী কারাকাসে তেলসম্পদের বদৌলতে অনেক হাইরাইজ ভবন তৈরি করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল, বিনিয়োগকারীরা আসবে। কিন্তু সেসব ভবন এখন খালি। কোনো বিনিয়োগকারী নেই। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে। মুদ্রাস্ম্ফীতি সেখানে চরমে। ২০১৬ সালের হিসাবে মুদ্রাস্ম্ফীতির পরিমাণ ছিল ৮০০ ভাগ। আর আইএমএফের মতে, ২০১৯ সালে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১০০ ভাগ (১০ মিলিয়ন)। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সেখানে পাওয়া যায় না। এসব জিনিসপত্রের দাম ২০১৮ সালে বেড়েছে ১৩,৭০,০০০ ভাগ। আইএমএফ ভেনিজুয়েলার এই পরিস্থিতিকে ১৯২৩ সালে জার্মানি আর ২০০০ সালের জিম্বাবুয়ের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেছে (রয়টার্স প্রতিবেদন, ৯ অক্টোবর ২০১৮)। ফলে সঙ্গত কারণেই মানুষের হতাশা আছে সেখানে।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ভেনিজুয়েলার মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী দেশে যাচ্ছে। কোনো কোনো যুবতী-কিশোরী মেয়ে তাদের লম্বা চুল বিক্রি করছে জীবিকা নির্বাহের জন্য। অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্য ঘটনা। খাদ্য ঘাটতি সেখানে রয়েছে। মাদুরোর অতি বাম নীতি বা Chavism ভেনিজুয়েলার সাধারণ মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এখানে যে ব্যর্থতা রয়েছে, তা সমাধান করতে পারেননি মাদুরো। তাই ডানপন্থি সংগঠনগুলো এর সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু মাদুরোকে উৎখাত কিংবা সেখানে একটি প্রো-ওয়েস্টার্ন সামরিক অভ্যুত্থান কি কোনো সমাধান এনে দেবে?

ট্রাম্প প্রশাসন ভেনিজুয়েলায় একটি 'সামরিক আগ্রাসন' চালানোর কথা বললেও তা শেষ পর্যন্ত কতটুকু তিনি কার্যকর করবেন- এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এমনিতেই অভ্যন্তরীণভাবে তিনি নানা সমস্যার সম্মুখীন। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণে তিনি কংগ্রেসের কাছে কয়েক বিলিয়ন ডলার চেয়েছিলেন। কংগ্রেস তা দেয়নি। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার 'জড়িত' থাকা (হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল হ্যাক করার ঘটনা) ও সে ব্যাপারে তার সংশ্নিষ্টতা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এ থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ভেনিজুয়েলায় 'রেজিম চেঞ্জ'-এর নির্দেশ দিতে পারেন ট্রাম্প। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই 'রেজিম চেঞ্জ'-এর নীতি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বেশ কয়েক বছর ধরে অনুসরণ করে আসছে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন আর লিবিয়ায় গাদ্দাফির উৎখাতের পেছনে এই 'রেজিম চেঞ্জ'-এর নীতি কাজ করেছিল। আবার সিরিয়াতে তা কাজ করেনি। 

সিরিয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার জড়িয়ে যাওয়া ও আসাদ সরকারকে সমর্থন করায় এই 'রেজিম চেঞ্জ'-এর নীতি সেখানে কাজ করেনি। ভেনিজুয়েলার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারে। কেননা রাশিয়া, এমনকি চীনও মাদুরোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি সেখানে সামরিক আগ্রাসন চালায়, তা হিতে বিপরীত হতে পারে। এটা শুধু নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনাই করবে না, বরং পুরো লাতিন আমেরিকায় একটি মার্কিনবিরোধী শক্তিশালী জনমতের জন্ম দিতে পারে। আবার এটাও সত্য, দক্ষিণ আমেরিকা তথা লাতিন আমেরিকায় মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের একটি কালো ইতিহাস রয়েছে। অনেক দেশেই যুক্তরাষ্ট্র সেসব দেশের সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেখানকার নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটিয়েছে। আর্জেন্টিনা (১৯৭৬ সালের কুদেতা, ইসাবেলা পেরেজের বিরুদ্ধে জেনারেল ভিদেলা কর্তৃক উৎখাত), ব্রাজিলে (সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতা গাউলাটকে সেনাবাহিনী কর্তৃক উৎখাত), চিলি (১৯৭৩ সালে সেনাবাহিনী প্রধান পিনোচে কর্তৃক জনপ্রিয় নেতা আলেন্দের উৎখাত), কোস্টারিকা, এল-সালভাদর, গুয়েতেমালা, নিকারাগুয়া, পানামা, প্যারাগুয়ে, পেরু, উরুগুয়ের দৃষ্টান্ত আমরা দিতে পারি। 

উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে সেখানকার নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। এখন এই 'তত্ত্ব' ভেনিজুয়েলায় প্রয়োগ করে কতটুকু সফলতা পাওয়া যাবে, সেটি একটি প্রশ্ন। কেননা, ভেনিজুয়েলার সেনাবাহিনী এখনও মাদুরোকে সমর্থন করে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে মাদুরো 'আরেকজন হুগো শাভেজ' হতে পারেননি। অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এক ধরনের একনায়কতান্ত্রিক শাসন তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণিও তার পাশে নেই এবং প্রচণ্ড রকম পশ্চিমা বিরোধিতার (সম্পদ জব্দ করা, তেল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা) মুখে তিনি আছেন। তার টিকে থাকা সত্যিকার অর্থেই কঠিন। মাদুরো আগাম পার্লামেন্ট নির্বাচন ও একটি সংলাপের কথা বলছেন বটে; কিন্তু জট খুলছে না। স্পষ্টতই ভেনিজুয়েলার রাজনীতি একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। 

ব্রেক্সিট নিয়ে জটিলতা কাটল না

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ব্রেক্সিট চুক্তির পরিবর্তনের পক্ষে তাদের সম্মতি না দেওয়ায় তেরেসা মে খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন বলে মনে হয় না। ফলে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তার আপাতত কোনো 
সমাধান হচ্ছে না
ব্রেক্সিট নিয়ে জটিলতা কাটল না। গত ১৫ ডিসেম্বর ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে ব্রেক্সিট চুক্তি নাকচ হওয়ার পর ২৯ জানুয়ারি ফের বর্তমান চুক্তির বিকল্প কী হতে পারে, তা নিয়ে ভোটাভুটি হয়েছে। ভোটাভুটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা চুক্তিটি পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিলেও, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তা মানতে রাজি হয়নি। ফলে ব্রেক্সিট চুক্তি এখন একটি নতুন মোড় নিল। খুব সঙ্গত কারণেই তাই এখন একটি প্রশ্ন সামনে চলে এসেছেÑ ব্রেক্সিটের ভবিষ্যৎ এখন কী? ব্রিটেনের গণভোট ২০১৬ সালের ২৩ জুন ব্রেক্সিট, অর্থাৎ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় পড়েছিল। ওই রায়ে ব্রিটেনের সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের চার দশকের সম্পর্কের অবসান ঘটেছিল। ওই সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কনজারভেটিভ দলের ডেভিড ক্যামেরন। তিনি পদত্যাগ করলে একই দলের তেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দুই বছর ধরে তেরেসা মে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছেন। আইন অনুযায়ী আগামী ২৯ মার্চের মধ্যে ব্রিটেনকে ইইউ ত্যাগের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। আর এ লক্ষ্যেই ১৫ জানুয়ারি তেরেসা মে পার্লামেন্টে ভোটাভুটির জন্য তার খসড়া চুক্তি উপস্থাপন করেন। এ ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে। কিন্তু তেরেসা মে জানতেন তিনি এ খসড়া চুক্তি পার্লামেন্টে পাস করাতে পারবেন না। এ জন্য তিনি ভোটাভুটি কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। তার খসড়া চুক্তিটি অনুমোদিত হয়নি। তবে একটা প্লাস পয়েন্ট তার জন্যÑ দল এখনও তার ওপর আস্থা রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখন ব্রেক্সিটের কী হবে? হাউস অব কমন্সে প্রথম দফা ভোটাভুটিতে দেখা গেছেÑ ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট পড়েছে ২০২, আর বিপক্ষে ৪৩২। মোট আসন ৬৫০। ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে কনজারভেটিভ পার্টির মাঝে বিভক্তি আছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনের নেতৃত্বে কনজারভেটিভদের ১১৮ এমপি চুক্তির বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন, আর দলের ১৯৬ জন এমপি পক্ষে ভোট দিয়েছেন। অন্যদিকে ২৪৮ জন লেবার এমপিও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। প্রস্তাবের বিপক্ষে অন্যান্য দলের ৫৬ জন এমপিও ভোট দিয়েছেন। ফলে এটা স্পষ্ট যে, ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে ব্রিটেনের সামনে বড় ধরনের বিভক্তি রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তেরেসা মে’র ওপর আস্থা রেখেছে তার দল। আস্থা ভোটে তিনি পেয়েছেন ৩২৫ ভোট, আর বিপক্ষে ভোট পড়েছে ৩০৬। এর অর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি থেকে গেলেন। আস্থা ভোটে তেরেসা মে হেরে গেলে ব্রিটেনে আবারও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। এখন তেরেসা মে টিকে গেলেন বটে; কিন্তু তাকে সব দলের সহযোগিতা নিয়ে একটি চুক্তি করতে হবে। অথবা এমনও হতে পারে, কোনো চুক্তি ছাড়াই ২৯ মার্চ ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগ কার্যকরী হবে। তবে এতে করে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না! যদিও ইউরোপীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ডোনাল্ড টাস্ক বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে একমাত্র বাস্তব সমাধান হচ্ছে যুক্তরাজ্যের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থেকে যাওয়া। কিন্তু এটি কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি বাতিল হওয়ায় হতাশ অনেক ইউরোপীয় দেশ। এরই মধ্যে অনেক দেশই বলছে তারা এ চুক্তি নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি নয়। জার্মানির মতো দেশ এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, তেরেসা মে’র সঙ্গে যে খসড়া চুক্তিটি সাক্ষরিত হয়েছিল, সেটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান। কারণ এর আওতায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যবসাকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সময় দেওয়া হবে। তারপরও কথা থেকে যায়। এখন কী করবেন তেরেসা মে? ব্রিটেনই বা যাবে কোন পথে?
হাউস অব কমন্সে ব্রেক্সিট চুক্তিটি বাতিল হওয়ায় এখন অনেকগুলো সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে। এক. যেহেতু ইইউভুক্ত দেশগুলো আর চাচ্ছে না ব্রেক্সিট নিয়ে ফের ব্রিটেনের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা, সেহেতু কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই অনেকটা অগোছালোভাবে ২৯ মার্চ ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে। এতে করে ব্রিটেন বড় ধরনের আর্থিক সমস্যার মধ্যে পড়তে পারে। অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে পড়বে ব্রিটেন। ইইউভুক্ত ২৭টি দেশের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে কাস্টমস চুক্তি করতে হবে ব্রিটেনকে। আমদানি-রপ্তানি শুল্কহার নির্ধারণ করতে হবে। ব্রিটিশ পাউন্ডের সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউকের মান নতুন করে নির্ধারণ করতে হতে পারে। দুই. ব্রিটেনের যেসব নাগরিক এখন ইইউভুক্ত দেশে কাজ করেন, কিংবা ইইউর যেসব নাগরিক ব্রিটেনে কাজ করেন, তাদের স্ট্যাটাস কী হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। ইইউর নাগরিকরা ২৭টি দেশের যে কোনো একটি দেশে কোনো ধরনের ‘ওয়ার্ক পারমিট’ ছাড়াই কাজ করতে পারতেন। ২৯ মার্চের পর নতুন করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিন. ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাজ্যের বড় ট্রেডিং পার্টনার হচ্ছে জার্মানি। যুক্তরাজ্য জার্মানি থেকে আমদানি করে বছরে প্রায় ৮০ বিলিয়ন পাউন্ডের পণ্য (এ পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের চেয়ে বেশি)। হল্যান্ড থেকে আমদানি করে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন পাউন্ড। ফ্রান্স থেকে আমদানি করে প্রায় ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড, স্পেন থেকে ৩০ বিলিয়ন পাউন্ডের পণ্য। অথচ রপ্তানি করে কম। জার্মানিতে রপ্তানির পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন পাউন্ড, ফ্রান্সে ৩৫ বিলিয়ন পাউন্ড। এখন ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে আমদানি-রপ্তানিতে এর প্রভাব পড়বে। ব্রিটেনে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে। বলা ভালো, ২০১৭ সালে ব্রিটেন ইইউভুক্ত দেশগুলোতে মোট রপ্তানি করে ২৭৪ বিলিয়ন পাউন্ড (মোট রপ্তানির ৪৪ শতাংশ), আর আমদানি করে মোট ৩৪১ বিলিয়ন পাউন্ড (মোট আমদানির ৫৩ শতাংশ)। সুতরাং বোঝাই যায়, কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়া ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে ব্রিটেনের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া কী হবে। চার. এরই মধ্যে কোনো কোনো মহল থেকে দাবি উঠেছে যে, নতুন করে ব্রেক্সিট প্রশ্নে আরেকটি গণভোটের আয়োজন করা হোক। কিন্তু বাস্তবতা বলে, ২৯ মার্চের আগে আর নতুন করে আরেকটি গণভোটের আয়োজন করা সম্ভব হবে না। কেননা গণভোটের জন্য নতুন একটি আইন তৈরি করতে হবে এবং বিধি-বিধান তৈরি করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সময় দিতে হবে। সুতরাং ২৯ মার্চের আগে এটি আয়োজন করা কোনো মতেই সম্ভব নয়। পাঁচ. তেরেসা মে পার্লামেন্টে জিতে গেলেও, তিনি ব্রেক্সিট প্রশ্নে জনগণের সমর্থন পাওয়ার আশায় সাধারণ নির্বাচনের ডাক দিতে পারেন। এতে করে তিনি যদি বিজয়ী (?) হনও, তাতে করে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। এমনকি নির্বাচনে তার দল অর্থাৎ কনজারভেটিভ পার্টির হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে লেবার পার্টি যদি বিজয়ী হয়, তারা ইইউতে পুনঃযোগদানের প্রশ্নে সিদ্ধান্তও নিতে পারে! এতে করে সংকট আরও বাড়বে। বড় জটিলতা তৈরি হবে। সুতরাং তেরেসা মে আগাম নির্বাচনের দিকে যাবেন বলে মনে হয় না। ছয়. ব্রেক্সিট ভোটের পর একটা বড় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে স্কটল্যান্ডকে নিয়ে। স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অংশ। ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদাভাবে স্বাধীন হতে পারে এবং এরপর ইইউর সঙ্গে থাকতে আবেদন করতে পারে। ব্রেক্সিট গণভোটের সময় স্কটল্যান্ডে যে ভোট হয়েছিল, তাতে ৬২ শতাংশ ভোট পড়েছিল ইইউতে থাকার পক্ষে, আর ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছিল যুক্তরাজ্যের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা নিকোলা স্টুরজিওন ফের স্কটল্যান্ডে একটি গণভোটের ডাক দিতে পারেন। এখন মিস স্টুরজিওন কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই দেখার বিষয়। 
১৫ জানুয়ারি হাউস অব কমনন্সে ব্রেক্সিট চুক্তি নাকচ হওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। পরিষ্কার করে বোঝা যাচ্ছে না পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাবে। ২৯ মার্চের পর ব্রিটেন যদি সত্যি সত্যিই বেরিয়ে যায়, তাহলে তা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। দক্ষিণপন্থি জাতীয়তাবাদীরা বিভিন্ন দেশে তাদের অবস্থান এখন আরও শক্তিশালী করবেন। ফ্রান্স, গ্রিস, এমনকি ইতালি হচ্ছে পরবর্তী রাষ্ট্র, যারা ব্রিটেনের পথ অনুসরণ করতে পারে। ফ্রান্সের কট্টর দক্ষিণপন্থি নেতা মেরিন লি পেন ও তার দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট সেখানে আবারও গণভোটের ডাক দিতে পারে। তার দল ফ্রান্সকে ইইউ থেকে বের করে নিয়ে আসতে চায়। জার্মানিতে দক্ষিণপন্থিরা আরও শক্তিশালী হবে। তারা এ প্রথমবারের মতো জার্মান পার্লামেন্টে গেছে (অলটারনেটিভ ফর জার্মানি-এএফডি পার্টি)। তারা জার্মানির ইইউ ত্যাগ করার ডাক দিতে পারে। ইতালিতেও এ কট্টরপন্থিরা (নর্থান লীগ, ফাইভ স্টার মুভমেন্ট) ২০১৮ সালে নির্বাচনের পর শক্তিশালী হয়েছে। নর্থান লীগ ও এর নেতা ম্যাটিও সালভিনি প্রচ-ভাবে ইইউবিরোধী। ইইউর অন্য দেশগুলোতেও এ দক্ষিণপন্থি উত্থান লক্ষ্য করার মতো। 
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে তেরেসা মে যাচ্ছেন। তিনি এরই মধ্যে পার্লামেন্টের সব দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। কিন্তু তা কী ফল বয়ে আনবে, তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপিয়ান ইইউনিয়ন (ইইউ) তার যাত্রা শুরু করেছিল। আজ ২৫ বছর পর সে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়ল। ইইউ নামে এটি যাত্রা শুরু করলেও এর যাত্রা শুরু হয়েছিল আরও আগে ১৯৫৮ সালে। পর্যায়ক্রমে ১৯৬৭ সালে ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিশন গঠন, ২০০২ সালে একক মুদ্রা চালু করার মধ্য দিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্ব আসরে আবির্ভূত হয়েছিল। প্রায় ১৯.২০৫ ট্রিলিয়ন ডলারের (পিপিপি) যে অর্থনীতি, এ অর্থনীতিতে ইইউকে বিশ্ব আসরে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং রাজনীতি ক্ষেত্রেও অন্যতম শক্তিতে পরিণত করেছে। এখন ব্রিটেন চূড়ান্তভাবে বেরিয়ে গেলে ইইউর শক্তিকে দুর্বল করবে। আগামী দুই মাস ব্রিটেনের জন্য অত্যন্ত কঠিন একটি সময়। আস্থা ভোটে তেরেসা মে টিকে গেলেন বটে; কিন্তু এটাই সব কথা নয়। সত্যিকার অর্থেই ব্রিটেনের জন্য আগামীতে এক কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। এদিকে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যরা জানিয়ে দিয়েছেন, বিতর্কিত ‘বেকস্টপ’ ধারা বাদ দিলেই তারা চুক্তিটি সমর্থন করবেন। ব্রিটেনের ‘বেকস্টপ’ (ইধপশংঃড়ঢ়) ধারণা মূলত কাস্টমস ধারা সম্পর্কিত। যাতে ব্রিটেনের স্বার্থ রক্ষিত হবে। দ্বিতীয় দফা ভোটাভুটির পর তেরেসা মে জানিয়েছেন, শিগগিরই তিনি আলোচনার জন্য ব্রাসেলসে যাবেন। কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ব্রেক্সিট চুক্তির পরিবর্তনের পক্ষে তাদের সম্মতি না দেওয়ায় তেরেসা মে খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন বলে মনে হয় না। ফলে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তার আপাতত কোনো সমাধান হচ্ছে না। 

ব্রেক্সিটের পরিণতি কী হতে যাচ্ছে


গত ১৫ জানুয়ারি ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে ব্রেক্সিট চুক্তি নাকচ হওয়া এবং এর পরপরই আস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মের টিকে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে, তা হচ্ছে ব্রেক্সিটের ভবিষ্যৎ কী? ব্রিটেনের গণভোটে ২০১৬ সালের ২৩ জুন ব্রেক্সিট, অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসার পক্ষে রায় পড়েছিল। ওই রায়ে ব্রিটেনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চার দশকের সম্পর্কের অবসান ঘটেছিল। ওই সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কনজারভেটিভ দলের ডেভিড ক্যামেরন। তিনি পদত্যাগ করলে একই দলের টেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দুই বছর ধরে টেরেসা মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছেন।
আইন অনুযায়ী আগামী ২৯ মার্চের মধ্যে ব্রিটেনকে ইইউ ত্যাগের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। আর এ লক্ষ্যেই ১৫ জানুয়ারি টেরেসা মে পার্লামেন্টে ভোটাভুটির জন্য তাঁর খসড়া চুক্তি উপস্থাপন করেন। এই ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে। কিন্তু টেরেসা মে জানতেন তিনি এই খসড়া চুক্তি পার্লামেন্টে পাস করাতে পারবেন না। এ জন্য তিনি ভোটাভুটি কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। তাঁর খসড়া চুক্তিটি অনুমোদিত হয়নি। তবে একটা প্লাস পয়েন্ট তাঁর জন্য—তাঁর দল এখনো তাঁর ওপর আস্থা রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রয়ে যাচ্ছেন। এখন ব্রেক্সিটের কী হবে? হাউস অব কমনসে ভোটাভুটিতে দেখা গেছে ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট পড়েছে ২০২, আর বিপক্ষে ৪৩২। মোট আসন ৬৫০। ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যে বিভক্তি আছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনের নেতৃত্বে কনজারভেটিভদের ১১৮ জন এমপি চুক্তির বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন, আর দলের ১৯৬ জন এমপি পক্ষে ভোট দিয়েছেন। অন্যদিকে ২৪৮ জন লেবার এমপিও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। প্রস্তাবের বিপক্ষে অন্যান্য দলের ৫৬ জন এমপিও ভোট দিয়েছেন। ফলে এটা স্পষ্ট যে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে ব্রিটেনের সমাজে বড় ধরনের বিভক্তি রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও টেরেসা মের ওপর আস্থা রেখেছে তাঁর দল। আস্থা ভোটে তিনি পেয়েছেন ৩২৫ ভোট, আর বিপক্ষে ভোট পড়েছে ৩০৬। আস্থা ভোটে টেরেসা মে হেরে গেলে ব্রিটেনে আবারও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। এখন টেরেসা মে টিকে গেলেন বটে; কিন্তু তাঁকে সব দলের সহযোগিতা নিয়ে একটি চুক্তি করতে হবে। অথবা এমনও হতে পারে কোনো চুক্তি ছাড়াই ২৯ মার্চ ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগ কার্যকরী হবে। তবে এতে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না! যদিও ইউরোপীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ডোনাল্ড ট্রাস্ক বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে একমাত্র বাস্তব সমাধান হচ্ছে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়া। কিন্তু এটি কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি বাতিল হওয়ায় হতাশ অনেক ইউরোপীয় দেশ। এর মধ্যে অনেক দেশই বলছে, তারা এই চুক্তি নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি নয়। জার্মানির মতো দেশ এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে টেরেসা মের সঙ্গে যে খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান। কারণ এর আওতায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যবসাকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সময় দেওয়া হবে। তার পরও কথা থেকে যায়। এখন কী করবেন টেরেসা মে? ব্রিটেনই বা যাবে কোন পথে?
হাউস অব কমনসে ব্রেক্সিট চুক্তিটি বাতিল হওয়ায় এখন অনেক সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে। এক. যেহেতু ইইউভুক্ত দেশগুলো আর চাচ্ছে না ব্রেক্সিট নিয়ে আবার ব্রিটেনের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা, সেহেতু কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই অনেকটা অগোছালভাবে ২৯ মার্চ ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে। এতে ব্রিটেন অনেক সমস্যার মধ্যে পড়বে। ইইউভুক্ত ২৭টি দেশের সঙ্গে আলাদাভাবে কাস্টমস চুক্তি করতে হবে ব্রিটেনকে। আমদানি-রপ্তানি শুল্ক হার নির্ধারণ করতে হবে। ব্রিটিশ পাউন্ডের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরোর মান নতুন করে নির্ধারণ করতে হতে পারে। দুই. ব্রিটেনের যেসব নাগরিক এখন ইইউভুক্ত দেশে কাজ করে, কিংবা ইইউর যেসব নাগরিক ব্রিটেনে কাজ করে, তাদের স্ট্যাটাস কী হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। ইইউর নাগরিকরা ২৭টি দেশের যেকোনো একটি দেশে কোনো ধরনের ‘ওয়ার্ক পারমিট’ ছাড়াই কাজ করতে পারত, ২৯ মার্চের পর নতুন করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিন. ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাজ্যের বড় ট্রেডিং পার্টনার হচ্ছে জার্মানি। যুক্তরাজ্য জার্মানি থেকে আমদানি করে বছরে প্রায় ৮০ বিলিয়ন পাউন্ডের পণ্য (এই পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের চেয়ে বেশি। হল্যান্ড থেকে আমদানি করে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন পাউন্ড, ফ্রান্স থেকে আমদানি করে প্রায় ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড, স্পেন থেকে ৩০ বিলিয়ন পাউন্ডের পণ্য। অথচ রপ্তানি করে কম। জার্মানিতে রপ্তানির পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন পাউন্ড, ফ্রান্সে ৩৫ বিলিয়ন পাউন্ড। এখন ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে আমদানি-রপ্তানিতে এর প্রভাব পড়বে। ব্রিটেনে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে। বলা ভালো, ২০১৭ সালে ব্রিটেন ইইউভুক্ত দেশগুলোতে মোট রপ্তানি করে ২৭৪ বিলিয়ন পাউন্ড (মোট রপ্তানির ৪৪ শতাংশ), আর আমদানি করে মোট ৩৪১ বিলিয়ন পাউন্ড (মোট আমদানির ৫৩ শতাংশ)। সুতরাং বোঝাই যায়, কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়া ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে ব্রিটেনের আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া কী হবে।

চার. এরই মধ্যে কোনো কোনো মহল থেকে দাবি উঠেছে যে নতুন করে ব্রেক্সিট প্রশ্নে আরেকটি গণভোটের আয়োজন করা হোক। কিন্তু বাস্তবতা হলো ২৯ মার্চের আগে আর নতুন করে আরেকটি গণভোটের আয়োজন করা সম্ভব হবে না। কেননা গণভোটের জন্য নতুন একটি আইন তৈরি করতে হবে এবং বিধি-বিধান তৈরি করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সময় দিতে হবে। সুতরাং ২৯ মার্চের আগে এটি আয়োজন করা কোনো মতেই সম্ভব নয়। পাঁচ. টেরেসা মে পার্লামেন্টে জিতে গেলেও তিনি ব্রেক্সিট প্রশ্নে জনগণের সমর্থন পাওয়ার আশায় সাধারণ নির্বাচনের ডাক দিতে পারেন। এতে তিনি যদি বিজয়ী (?) হনও, তাতে করে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে তেমন কোনো পরিবর্তন আনবে না, এমনকি নির্বাচনে তাঁর দল অর্থাৎ কনজারভেটিভ পার্টির হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে লেবার পার্টি যদি বিজয়ী হয়, তারা ইইউতে পুনঃযোগদানের প্রশ্নে সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এতে সংকট আরো বাড়বে। বড় জটিলতা তৈরি হবে। সুতরাং টেরেসা মে আগাম নির্বাচনের দিকে যাবেন বলে মনে হয় না। ছয়. ব্রেক্সিট ভোটের পর একটা বড় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে স্কটল্যান্ডকে নিয়ে। স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অংশ। ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদাভাবে স্বাধীন হতে পারে এবং এরপর ইইউর সঙ্গে থাকতে আবেদন করতে পারে। ব্রেক্সিট গণভোটের সময় স্কটল্যান্ডে যে ভোট হয়েছিল, তাতে ৬২ শতাংশ ভোট পড়েছিল ইইউতে থাকার পক্ষে, আর ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছিল যুক্তরাজ্যের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা নিকোলা স্টুরজিওন আবার স্কটল্যান্ডে একটি গণভোটের ডাক দিতে পারেন। এখন মিস স্টুরজিওন কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই দেখার বিষয়।
গত ১৫ জানুয়ারি হাউস অব কমনসে ব্রেক্সিট চুক্তি নাকচ হওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। পরিষ্কার করে বোঝা যাচ্ছে না পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাবে। ২৯ মার্চের পর ব্রিটেন যদি সত্যি সত্যিই বেরিয়ে যায়, তাহলে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতন ত্বরান্বিত করতে পারে। দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীরা বিভিন্ন দেশে তাদের অবস্থান এখন আরো শক্তিশালী করবে। ফ্রান্স, গ্রিস, এমনকি ইতালি হচ্ছে পরবর্তী রাষ্ট্র, যারা ব্রিটেনের পথ অনুসরণ করতে পারে। ফ্রান্সের কট্টর দক্ষিণপন্থী নেতা মেরিন লি পেন ও তাঁর দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট সেখানে আবারও গণভোটের ডাক দিতে পারে। তাঁর দল ফ্রান্সকে ইইউ থেকে বের করে নিয়ে আসতে চায়। জার্মানিতে দক্ষিণপন্থীরা আরো শক্তিশালী হবে। তারা এই প্রথমবারের মতো জার্মান পার্লামেন্টে গেছে (অলটারনেটিভ ফর জার্মানি—এএফডি পার্টি)। এরা জার্মানির ইইউ ত্যাগ করার ডাক দিতে পারে। ইতালিতেও এই কট্টরপন্থীরা (নর্থান লীগ, ফাইভ স্টার মুভমেন্ট) ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর শক্তিশালী হয়েছে। নর্থান লীগ ও এর নেতা ম্যাটিও সালভিনি প্রচণ্ডভাবে ইইউবিরোধী। ইইউর অন্যান্য দেশেও এই দক্ষিণপন্থী উত্থান লক্ষ করার মতো।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে টেরেসা মে যাচ্ছেন। তিনি এরই মধ্যে পার্লামেন্টের সব দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। কিন্তু তা কী ফল বয়ে আনবে, তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তার যাত্রা শুরু করেছিল। আজ ২৫ বছর পর সেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়ল। ইইউ নামে এটি যাত্রা শুরু করলেও এর যাত্রা শুরু হয়েছিল আরো আগে ১৯৫৮ সালে। পর্যায়ক্রমে ১৯৬৭ সালে ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিশন গঠন, ২০০২ সালে একক মুদ্রা চালু করার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্ব আসরে আবির্ভূত হয়েছিল। প্রায় ১৯.২০৫ ট্রিলিয়ন ডলারের (পিপিপি) যে অর্থনীতি, এই অর্থনীতি ইইউকে বিশ্ব আসরে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং রাজনীতি ক্ষেত্রেও অন্যতম শক্তিতে পরিণত করেছে। এখন ব্রিটেন চূড়ান্তভাবে বেরিয়ে গেলে ইইউর শক্তিকে দুর্বল করবে। আগামী দুই মাস ব্রিটেনের জন্য অত্যন্ত কঠিন একটি সময়। আস্থা ভোটে টেরেসা মে টিকে গেলেন বটে। কিন্তু এটিই সব কথা নয়। সত্যিকার অর্থেই ব্রিটেনের জন্য ভবিষ্যতে এক কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
কালের কন্ঠ ২২ জানুয়ারি, ২০১৮

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর প্রসঙ্গে


নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন ভারত সফরে যাচ্ছেন চলতি মাসের ৭ ফেব্রুয়ারি। কাছাকাছি সময়ে ভারতে থাকার কথা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এবং শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির। যদিও দীপু মনি নয়াদিল্লি যাবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। তিনি যাবেন ত্রিপুরায় সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বইমেলা উদ্বোধন করতে। তবে যেকোনো বিবেচনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এটি কোনো রাষ্ট্রীয় সফর নয় এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় এই সফর সৌজন্যমূলক সফর এবং এই সফরে তিনি ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হবেন। তিনি এই সফরে দিল্লিতে দুই দেশের যৌথ কমিশনের (জেসিসি) বৈঠকে যোগ দেবেন।
ড. মোমেন এমন একটা সময়ে দিল্লি যাচ্ছেন, যখন আগামী এপ্রিল ও মে মাসে ভারতে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সাধারণত নির্বাচনের আগে কোনো সরকারই কোনো ধরনের নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। এ ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ে যে ‘জটিলতা’ রয়েছে ড. মোমেনের সফরে তার সমাধান হবে, এটা মনে হয় না। এমনকি বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট যদি আবার দিল্লিতে সরকার গঠনও করে, ওই সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সুষমা স্বরাজের থাকার সম্ভাবনা কম। স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি নতুন সরকারে নাও থাকতে পারেন, এমনটাই তিনি জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে যিনি নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, তাও স্পষ্ট নয় এই মুহূর্তে। উপরন্তু ড. মোমেনের দিল্লি সফরের প্রাক্কালে ঠাকুরগাঁও সীমান্তে জানুয়ারির শেষ ১০ দিনে তিনজন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন, যা স্থানীয় মানুষের মধ্যে উষ্মার জন্ম দিয়েছে। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার ঘটনা নতুন নয়। এ ব্যাপারে ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি।
ড. মোমেন প্রথম সফর হিসেবে ভারতকে বেছে নিয়েছেন, এটা যেকোনো বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। বিশেষ করে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ভারতকে যা দিয়েছে, তা ভারত অনেক দিন মনে রাখবে। কিন্তু তার পরও বেশ কিছু বিষয় রয়েছে (তিস্তার পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা, ট্যারিফ হ্রাস ও বাণিজ্যে ভারসাম্য আনা ইত্যাদি), যার কোনো সমাধান হয়নি। ড. মোমেনের এই সফরে তার কিছু জট খুলবে, তাও মনে হয় না।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র হিসেবে আমরা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিই। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারতের ভূমিকা অনেক বড় এবং ভারতের সাহায্য নিয়ে আমরা আমাদের উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে চাই। মনে রাখতে হবে বর্তমান সরকার উন্নয়নকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রাক-নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে বিশ্বের তৃতীয় দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উন্নয়নের ধারায় ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের তৃতীয় দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। চলতি বছর বাংলাদেশের জিডিপি দাঁড়াবে ৭.৪ শতাংশ। আর ৭.৬ শতাংশ জিডিপি নিয়ে ভারতের অবস্থান থাকবে দ্বিতীয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভারতের চেয়ে ভালো, যা স্বয়ং নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনও স্বীকার করেছেন। যেমন বলা যেতে পারে মেয়েশিশুদের শিক্ষার হার। শিশুমৃত্যু (২০১৭) প্রতি হাজারে বাংলাদেশে যেখানে ২৭, সেখানে ভারতে ৩২। বাংলাদেশে মানুষ গড়ে বেঁচে থাকে ৭৮.৫ বছর, আর ভারতে ৬৮.৮ বছর। মহিলাদের সংসদে প্রতিনিধিত্বের হার বাংলাদেশে ১৪ শতাংশ, আর ভারতে ১১ শতাংশ। মাথাপিছু আয় বাংলাদেশে সেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে (২০১৩-২০১৬) ৩৯ শতাংশ হারে, সেখানে ভারতে এই বৃদ্ধি মাত্র ১৩.৮ শতাংশ হারে (দ্য প্রিন্ট, ৩০ জানুয়ারি)। অর্থনীতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই সাফল্য বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারে। এই মন্তব্য বিশ্বব্যাংকের (সাউথ এশিয়ান মনিটর, ১০ জানুয়ারি ২০১৯)। ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার মতো দেশকে পেছনে ফেলে বিশ্বের ২৬তম অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ (‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০৫০’, এইচএসবিসি গ্লোবাল রিপোর্ট)। অন্যদিকে ভারত হচ্ছে বড় অর্থনীতির দেশ। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এরই মধ্যে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। 

ভারত বর্তমানে বিশ্বের ষষ্ঠ অর্থনীতির দেশ (সাধারণ হিসাবে ২.৮৪৮ ট্রিলিয়ন ডলার), আর ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ভারতের অবস্থান তৃতীয় (১০.৩৮৫ ট্রিলিয়ন ডলার)। সুতরাং এমন একটি অর্থনীতির দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনেক বেশি। ভারতের আঞ্চলিক অভিযাত্রায় বাংলাদেশ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো দায়িত্ব নিয়ে তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন (নেইবারহুড ফার্স্ট) আনেন, তাতে তিনি বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মোদির ঢাকা সফরের সময় (২০১৫) বাংলাদেশ একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা (বিবিআইএন) চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত (সাত বোন রাজ্য) ও নেপালকে নিয়েই গড়ে উঠছে বিবিআইএনের ধারণা। বিবিআইএনের আওতায় আঞ্চলিক বাণিজ্য জ্বালানি সংকটের সমাধান (বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ) এবং শুকনা মৌসুমে যে পানির ঘাটতি রয়েছে, তার সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশ ভারত থেকে (২০১৩) ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছে।  আরো ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিয়ে চূড়ান্ত চুক্তিও হয়েছে। ভারতের সাত বোন রাজ্য এবং ভুটান ও নেপালে প্রায় ৫৮ হাজার ৯৭১ মেগাওয়াট বিদুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের যে ‘বিদ্যুৎ ঘাটতি’, তা বাংলাদেশ এখান থেকে মেটাতে পারে। এ জন্য বাংলাদেশ ‘পাওয়ার করিডর’ চাচ্ছে। অর্থাৎ ভুটান বা নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে হলে ভারতের এলাকার ওপর দিয়ে তা আনতে হবে। এ জন্যই দরকার ‘পাওয়ার করিডর’, যাতে ভারতের সম্মতি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ভারতকে আসাম থেকে বিদ্যুৎ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বিহারে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। ভারতের একটি কম্পানি (আদানি গ্রুপ) রামপালে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎন্দ্র (কয়লানির্ভর) নির্মাণ করছে। অন্যদিকে ভারতের রিলায়েন্স কম্পানি তিন বিলিয়ন ডলার এলএনজি খাতে বিনিয়োগ করেছে, যেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। ২০১৮ সালে ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন নির্মাণ শেষ হয়েছে, যার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশকে চার লাখ টন ডিজেল সরবরাহ করছে। ভারতের মোদি সরকার যে আঞ্চলিক ‘পাওয়ার ট্রেডিং সিস্টেম’ চালু করতে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ উপকৃত হবে।
প্রতিরক্ষা খাতেও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভালো। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন ভারত থেকে সমরাস্ত্রও ক্রয় করছে। ২০১১ সালে দুই দেশের সেনাবাহিনী একটি যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছিল। ওই মহড়া অব্যাহত রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ৯.৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো সমস্যা রয়ে গেছে। বিশেষ করে ট্যারিফ ও প্যারা ট্যারিফের বাধা এখনো দূর করা যায়নি। যে কারণে ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় আমদানিকারকরা বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। সাত বোন রাজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সেটাও এখন ঝুঁকির মুখে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে পারবে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারত, বিশেষ করে ভারতের সাত বোন রাজ্যগুলো এখন চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে তাদের পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে। ভারতের সহযোগিতা নিয়ে পটুয়াখালীর অদূরে পায়রায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দরও নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি তৈরি শেষ হলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর ‘চাপ’ কমবে।
২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশকে দুই বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগেরও প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল। স্পষ্টতই এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান বলে দুই দেশের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তবে সমস্যা যে নেই, তা নয়। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে জটিলতা আছে। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যতটুকু আন্তরিক, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ততটুকু আন্তরিক নন। সেখানে এটি মূলত একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। চলতি বছর সেখানে বিধানসভা ও লোকসভার নির্বাচন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি একটি ইস্যু করতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার এটা উল্লেখ করেছেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণেই তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি আটকে আছে। আসামে এক ধরনের ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান শুরু হয়েছে। তথাকথিত নাগরিকত্ব আইনে সেখানে বসবাসকারী কিছু বাঙালি মুসলমানকে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ভারত ত্যাগ করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি অস্বস্তিকর। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুও। ভারতে আশ্রয় নেওয়া বেশ কিছু রোহিঙ্গা পরিবারকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাদের এখন আশ্রয় মিলেছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে। ভারত রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলোতে কিছু বাড়ি তৈরি করে দিলেও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া তাদের এক ধরনের ‘দ্বৈত নীতি’ বলেও অনেকে মনে করে। বাংলাদেশ সব সময়ই বলে আসছে রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে (মিয়ানমার) ফেরত যেতে চীনের পাশাপাশি ভারতও একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চীন ও ভারতের সঙ্গে ‘ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক’ বজায় রেখে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা। আমাদের উন্নয়নের স্বার্থে চীনের সহযোগিতা যেমনি প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ভারতের সহযোগিতাও। ভারত চীনের প্রস্তাবিত ও বহুল আলোচিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচিতে যোগ না দিলেও বাংলাদেশ তাতে যোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ এ থেকে সুবিধা নিচ্ছে এবং বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, এই কর্মসূচিতে ভারতের যোগ না দেওয়ার তিনি কোনো কারণ খুঁজে পান না। বলা ভালো ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর আওতায় চীন দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশকে নিজ ভূখণ্ডের সঙ্গে ‘কানেক্ট’ করছে। এতে করে ওই দেশগুলো এক ধরনের ঋণের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে—এমন অভিযোগও আছে। সুতরাং পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ভারত সফরে যাবেন, তখন অনেকেরই আগ্রহ থাকবে এই সফরের ব্যাপারে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই সফর থেকে বড় কিছু আশা করা যাবে না। এটি একটি রুটিন সফর।
কালের কন্ঠ, ৩রা ফেব্রুয়ারি ২০১৯