রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

বিরোধ মেটাতে চীনের ভূমিকা ও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ



সাম্প্রতিক সময়ে চীনের একটি ভূমিকা কোনো কোনো আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকের কাছে বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। চীনের এই ভূমিকাটি হচ্ছে বিরোধ মেটানো বা বিরোধ নিষ্পত্তি। অর্থাৎ দুটি দেশ কিংবা দুটি বিবদমান গোষ্ঠীর মাঝে বিবাদ ও দ্বন্দ্বের মীমাংসা করার জন্য একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই ঈড়হভষরপঃ জবংড়ষঁঃরড়হ-এর বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। একটি রাষ্ট্র ঈড়হভষরপঃ জবংড়ষঁঃরড়হ এবং সেই সঙ্গে আরও বেশ কিছু বিষয়ে (যেমন : বিশ^ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, গণতন্ত্র বিনির্মাণ, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, বৈষম্য হ্রাস ইত্যাদি) কতটুকু সক্ষমতা অর্জন করেছে, তা বিবেচনায় নিয়েই বিশ^ নেতৃত্বে তার মানদ- বিচার করা হয়। বিশ^ নেতৃত্বের শীর্ষে সেই দেশটি থাকবে, যদি দেশটি ঈড়হভষরপঃ জবংড়ষঁঃরড়হ-এর ক্ষেত্রেও একটা ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ বিশে^ নেতৃত্ব দেওয়ার একটি ভূমিকা রাখা।

একসময় বিশ^ দুধারায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, আমরা যাকে বলি স্নায়ুযুদ্ধÑ একদিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। আদর্শগতভাবে বিভক্ত ছিল শিবির দুটো। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিম ইউরোপে পুঁজিবাদ তথা পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছিল। অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র বিকশিত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ভিত্তি ও সামরিক সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রকে যেমনি বিশ^ শক্তিতে পরিণত করেছিল, ঠিক তেমনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক শক্তি দেশটিকেও বিশ^ আসরে অন্যতম শক্তি হিসেবে পরিণত করেছিল। তখন ‘শক্তির’ বিচারের ক্ষেত্রে যেমন ‘প্যারাডাইম’ ব্যবহৃত হতো, তাতে পরিবর্তন এসেছে। আয়তনে একটি ছোট্ট দেশও ‘শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে এবং বিরোধ নিষ্পত্তিতে একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু চীনের অবস্থানটা ভিন্ন। চীন অর্থনৈতিক শক্তি তো বটেই, একই সঙ্গে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম সামরিক শক্তিও বটে। চীনের ভূমিকা বাড়ছে। আফ্রিকাতে চীনের ভূমিকা ব্যাপক। এটা বিবেচনায় নিয়েই চীন এখন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় আবির্ভূত হচ্ছে। অবশ্য যেখানে চীনের স্বার্থ বেশি, সেখানেই চীন এই কাজটি করছে।

আফগান সংকটের যখন কোনো সমাধান হচ্ছিল না এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানদের ‘সংলাপ’ ও যখন সমাধানের কোনো পথ বাতলে দিচ্ছিল না, তখন চীন এগিয়ে আসে এ সমস্যার সমাধানে। পাকিস্তানি সংবাদপত্র ‘ডন’-এ প্রকাশিত এক সংবাদ (জুন ২০, ২০১৯) থেকে জানা যায়, চীন সম্প্রতি কাতারে নিযুক্ত তালেবানদের ‘রাষ্ট্রদূত’ আবদুল গনি বারাদারকে পেইচিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। চীন এটা স্পষ্ট করেছে, আফগান সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ওপর। অর্থাৎ বিবদমান গ্রুপগুলো নিজেরাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। এ ক্ষেত্রে চীন প্রয়োজনে এক ধরনের মধ্যস্থতা করতে পারে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বক্তব্যে এটা ফুটে উঠেছে। এটা বিবেচনায় নিয়েই চীন আবদুল গনি বারাদারকে পেইচিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। চীনের এই ভূমিকা নতুন। অতীতে চীনকে এ ধরনের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি।

Image :rushhour daily
বরং চীন ব্যস্ত থেকেছে নিজ দেশে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে, পরে অর্থনৈতিক সংস্কারে। চীন তার বিশাল জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে বিশে^র দ্বিতীয় বড় অর্থনৈতিক শক্তি। সাধারণ নিয়মে জাতীয় আয়ের পরিমাণ ১১,৩৯১ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ডলার (যুক্তরাষ্ট্রের ১৮,৫৬১ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন ডলার)। আবার ক্রয়ক্ষমতার (পিপিপি) ভিত্তিতে চীনের অবস্থান প্রথমÑ ২১,২৬৯ দশমিক ০২ মিলিয়ন ডলার (আইএমএফ)। একই সঙ্গে চীনের রিজার্ভের পরিমাণ ৩,৪০৫ মিলিয়ন ডলার। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার যদি বজায় থাকে, তাহলে চীন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় উৎপাদনের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমপর্যায়ে এসে যাবে। অস্ট্রেলিয়ার খড়ুি ওহংঃরঃঁঃব আটটি মানদ-কে সামনে রেখে বিশে^র ক্ষমতা বিন্যাসকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছে, তাতে চীনের অবস্থান দ্বিতীয়, প্রথম যুক্তরাষ্ট্র। চীনের এই ‘শক্তি’ (সামরিক ও অর্থনৈতিক) চীনকে এখন বড় ধরনের ‘প্রভাব’ ফেলতে সাহায্য করছে। খুব সংগত কারণেই আফগানিস্তানের সমস্যার সমাধানে চীন একটি ভূমিকা রাখতে চায়।
সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যাটি বহুল আলোচিত। চীন তার জাতীয় স্বার্থের কারণেই এত দিন পর্যন্ত মিয়ানমারকে সমর্থন করে আসছে। কিন্তু সারা বিশ^ এখন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চায়। চীনের উপলব্ধিতে এটা এখন এসেছে। একটি বিশ^শক্তি হিসেবে চীন বিশ^ জনমতের বাইরে যেতে পারে না। তাই প্রধানমন্ত্রী যখন জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে চীনে তার রাষ্ট্রীয় সফর শুরু করবেন, তখন একটা সুযোগ তৈরি হবে চীনকে তার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা গ্রহণ করার। বিশে^র কাছে এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে, মিয়ানমার নানাভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো থাকলেও, চীন শুধু ব্যবসায়িক ও তার নিজস্ব স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করেছে। বাংলাদেশের পাশে সেভাবে চীন দাঁড়ায়নি।

প্রধানমন্ত্রীর এই সফর বাংলাদেশের জন্য একটা সম্ভাবনা তৈরি করবে চীনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এটা বোঝাতে যে, চীন যদি মিয়ানমারের ওপর কিছুটা হলেও চাপ প্রয়োগ করে এ সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী না হয়, তাহলে তা চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রকারান্তরে চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর যে মহাপরিকল্পনা, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও 
নানা সংকট তৈরি করবে। চীন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম শক্তি। এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে চীনের একটি বড় ভূমিকা আছে। বাংলাদেশ চায় চীন তার এই ভূমিকাটা পালন করুক। মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘকাল তাদের আশ্রয় দিতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মিয়ানমার তার নাগরিকদের ফেরত নিতে বাধ্য। শুধু তা-ই নয়। অতি সম্প্রতি ওআইসির ১৪তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেখানে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান সমর্থন করা হয়েছে। ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আবুধাবি সম্মেলনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করারও একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অতীতে এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, বিশেষ করে কেনিয়ার গণহত্যা কিংবা হুতু-তুতসি গণহত্যাকারীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হয়েছে।

বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা গণহত্যাকারীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রীর এই চীন সফরে বাংলাদেশের জন্য একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে চীনের নেতাদের বোঝানো যে, রোহিঙ্গা সমস্যা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে মিয়ানমারের নেতাদের বিচারের দাবি আরও শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশের তখন করার কিছু থাকবে না। একমাত্র চীনই পারে মিয়ানমারকে বোঝাতে। দ্বিতীয়ত, চীনের একটি মহাপরিকল্পনা হচ্ছে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি। এই মহাপরিকল্পনার একটি অংশ হচ্ছে বিসিআইএম করিডর। অর্থাৎ বাংলাদেশ-চীনের ইউনান প্রদেশ-ভারতের পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমারকে নিয়ে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এ যে ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে, তার মধ্যে বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডরের গুরুত্ব অনেক। ভারতের জন্যও এই রুটের গুরুত্ব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যখন ২০১৪ সালে চীন গিয়েছিলেন, তখন খুনমিংয়ে তিনি এই বিসিআইএম করিডরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।

       Image: Abhinav Bhargava
                             
এই রুটের গুরুত্ব এ কারণে যে, আসিয়ান-এ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তখন খুনমিং-কক্সবাজার সড়কপথ যদি চালু হয়, তাহলে সড়কপথে আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করতে পারব। এই জোটের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা, এই ৪টি দেশের রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাসসম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টরও রয়েছে। রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) এবং রয়েছে সমুদ্রবন্দর (মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত)। এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা বিশ^ জিডিপির ১০ ভাগ। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা আর ৪৪০ মিলিয়ন মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশগুলোতে। পূর্বে রয়েছে কুনমিং আর পশ্চিমে কলকাতা। মাঝখানে মান্দালয় ও ঢাকা।
Image: The Hindu 
চীনের স্বার্থ রয়েছে এই জোটের ব্যাপারে। কারণ যদি খুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়কটি হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সোনাদিয়ায় যদি একটি সমুদ্রবন্দর হয়, তাহলে চীন সড়কপথ ব্যবহার করে ইউনান প্রদেশে উৎপাদিত পণ্য এই বন্দর দিয়ে বিদেশে রফতানি করতে পারবে। যদিও সোনাদিয়ায় যে গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হওয়ার কথা ছিল, তা ভারতের আপত্তির কারণে বাতিল হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও চীন যদি ভারতকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, প্রস্তাবিত এই সমুদ্রবন্দরটি  দিয়ে ভারতও তার পণ্য রপ্তানি-আমদানি করতে পারবে, তাহলে আগামীতে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে চীনকেই এগিয়ে আসতে হবে। ভারতকে আশ^স্ত করতে হবে যে, এই সমুদ্রবন্দর ভারতের জন্য কোনো নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করবে না। এমনকি বাংলাদেশ, চীন ও ভারতের ত্রিদেশীয় উদ্যোগে এই বন্দরের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়াও সম্ভব। যতদূর জানি, চীনের এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। চীন ভারতের কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এখন বাংলাদেশ এক ধরনের দূতিয়ালি করতে পারে।

বাংলাদেশের যেমন প্রয়োজন রয়েছে চীনকে, ঠিক তেমনি চীনেরও প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশকে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে অনেকগুলো সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে আমাদের জন্য।



দেশরূপান্তর 

১ জুলাই, ২০১৯ 

লেখক
তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফর রোহিঙ্গা ইস্যুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ





প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ জুলাই তার চীন সফর শুরু করছেন। এ সফরে তিনি বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেবেন। লিওয়ানিং প্রদেশের দালিয়ান শহরে এই শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হবে সম্মেলন শেষে তিনি বেইজিং যাবেন। ৩-৪ জুলাই দু’দেশের মধ্যে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। নানাবিধ কারণে তার এই চীন সফরের গুরুত্ব রয়েছে।

প্রথমত, এ সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুটি প্রাধান্য পাবে। প্রধানমন্ত্রী তার এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেছেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার গড়িমসি করছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেলেও শুধু চীনের (এবং রাশিয়ার) কারণে মিয়ানমার নানা ফন্দি-ফিকির করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করছে।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো থাকলেও চীন শুধু ব্যবসায়িক ও তার নিজস্ব স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করেছে। বাংলাদেশের পাশে সেভাবে চীন দাঁড়ায়নি। প্রধানমন্ত্রীর এ সফর বাংলাদেশের জন্য একটা সম্ভাবনা তৈরি করবে।
চীনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এটা বোঝাতে হবে যে, চীন যদি মিয়ানমারের ওপর কিছুটা হলেও চাপ প্রয়োগ করে এ সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী না হয়, তাহলে তা চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রকারান্তরে চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের’ (ওবিওআর) যে মহাপরিকল্পনা, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও নানা সংকট তৈরি করবে।
চীন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম শক্তি। এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে চীনের একটি বড় ভূমিকা আছে। বাংলাদেশ চায় চীন তার এ ভূমিকাটা পালন করুক। মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘকাল তাদের আশ্রয় দিতে পারে না।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মিয়ানমার তার নাগরিকদের ফেরত নিতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ওআইসির ১৪তম শীর্ষ সম্মেলনে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান সমর্থন পেয়েছে।
ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আবুধাবি সম্মেলনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করারও একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অতীতে এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের, বিশেষ করে বসনিয়ার এবং হুতু-তুতসি গণহত্যাকারীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হয়েছে।
বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা গণহত্যাকারীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারের কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে বাংলাদেশের জন্য চীনা নেতাদের এটা বোঝানোর একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যে, রোহিঙ্গা সমস্যা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে মিয়ানমারের নেতাদের বিচারের দাবি আরও শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশের তখন করার কিছু থাকবে না। একমাত্র চীনই পারে মিয়ানমারকে বোঝাতে।
দ্বিতীয়ত, চীনের একটি মহাপরিকল্পনা হচ্ছে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি। এ মহাপরিকল্পনার একটি অংশ হচ্ছে বিসিআইএম করিডোর। অর্থাৎ বাংলাদেশ, চীনের ইউনান প্রদেশ, ভারতের পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমারকে নিয়ে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডে’ যে ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে, তার একটি হচ্ছে বিসিআইএম করিডোর।
বাংলাদেশের যে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি, তাতে এই বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরের গুরুত্ব অনেক। ভারতের জন্যও ওই রুটের গুরুত্ব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যখন ২০১৪ সালে চীনে গিয়েছিলেন, তখন কুনমিংয়ে তিনি এই বিসিআইএম করিডোরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
এই রুটের গুরুত্ব এ কারণে যে, আসিয়ানে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এখন কুনমিং-কক্সবাজার সড়কপথ যদি চালু হয়, তাহলে সড়কপথে আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করতে পারব। এ জোটের সম্ভাবনা বিশাল।
কারণ তাদের রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাস সম্পদ (মিয়ানমার), শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর, বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) এবং সমুদ্রবন্দর (মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত)।
এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা বিশ্ব জিডিপির ১০ ভাগ। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা আর ৪৪০ মিলিয়ন মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশগুলোয়।
পূর্বে রয়েছে কুনমিং, আর পশ্চিমে কলকাতা। মাঝখানে মান্দালয় ও ঢাকা। চীনের স্বার্থ রয়েছে এই জোটের ব্যাপারে। কারণ যদি কুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়কটি হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সোনাদিয়ায় একটি সমুদ্রবন্দর হলে চীন সড়কপথ ব্যবহার করে ইউনান প্রদেশে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি করতে পারবে।
যদিও সোনাদিয়ায় যে গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হওয়ার কথা ছিল, তা ভারতের আপত্তির কারণে বাতিল হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও চীন যদি ভারতকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, প্রস্তাবিত এ সমুদ্রবন্দরটি দিয়ে ভারতও তার পণ্য রফতানি-আমদানি করতে পারবে, তাহলে আগামীতে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করা সম্ভবপর হবে।
এ ক্ষেত্রে চীনকেই এগিয়ে আসতে হবে। ভারতকে আশ্বস্ত করতে হবে, এ সমুদ্রবন্দর ভারতের জন্য কোনো নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করবে না। এমনকি বাংলাদেশ, চীন ও ভারতের ত্রিদেশীয় উদ্যোগেও এ বন্দরের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়া সম্ভব।
যতদূর জানি চীনের এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। চীন ভারতের কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এখন বাংলাদেশ এক ধরনের দূতিয়ালি করতে পারে।
তৃতীয়ত, চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি (ওবিওআর) আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা তৈরি করেছে। চীন এই মহাপরিকল্পনার আওতায় ৬৫টি দেশকে চীনের সঙ্গে সড়ক ও সমুদ্রপথে সংযুক্ত করছে।
এ মহাপরিকল্পনার আওতায় চীন ওবিওআরে যোগ দেয়া দেশগুলোর অবকাঠামো খাতে (রেল ও সড়ক পথের উন্নয়নে) ঋণ দিয়ে থাকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশ, দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও নেপাল চীন থেকে এ খাতে ঋণ নিয়েছে।
বাংলাদেশ ওবিওআরে যোগ দিয়েছে এবং কয়েকটি সুনির্দিষ্ট খাতে চীন থেকে ঋণ নিয়েছে। তবে এখানে একটা প্রশ্ন আছে। চীনা ঋণ ইতিমধ্যে নানা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বলা হচ্ছে, চীনা ঋণ এক ধরনের ‘ঋণ ফাঁদ’ তৈরি করেছে। আমরা শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও কেনিয়ার দৃষ্টান্ত দিতে পারব।
সুতরাং চীনা ঋণ নেয়ার ব্যাপারে আমাদের একটু সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। ভারত ওবিওআরে যোগ না দেয়ায় আমাদের জন্য কিছুটা হলেও ‘সংকট’ তৈরি হয়েছে। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশ ওবিওআরে যোগ দিয়ে তার জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে।
চতুর্থত, বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য চীনের অনুকূলে। অর্থাৎ চীন রফতানি করে বেশি, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে কম। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে বাংলাদেশ মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য চীনে রফতানি করে।
চীনের সঙ্গে এফটিএ (মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি) করার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। চীনের বাণিজ্য কর্মকর্তারা মনে করেন, এফটিএ করলে বাংলাদেশ তার বাণিজ্যিক ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারবে (রয়টার্সের প্রতিবেদন, ২৪ এপ্রিল ২০১৮)। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি কম।
এতদিন এ বাণিজ্য চলত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক এ দুই বাণিজ্য সুবিধার আওতায়। এগুলো হচ্ছে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্য চুক্তি (আপটা) ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। সম্প্রতি আপটা সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। সমঝোতার মাধ্যমে আপটা থেকে পাওয়া শুল্ক সুবিধা স্থগিত করা হয়।
এ লক্ষ্যে দুই দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘লেটার অব ইনডেন্টে’ সই করেছে। আর চীনের বাজারে বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ গন্তব্য এফটিএ হলেও দুই দেশের সরকারের মধ্যে এখনই এ চুক্তি হচ্ছে না। চুক্তিটি না হওয়া পর্যন্ত ডব্লিউটিও’র আওতায় থাকা চলমান শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল থাকছে।
তবে এফটিএতে শুধু পণ্যভিত্তিক আমদানি-রফতানির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এতে বাণিজ্যের পাশাপাশি বিনিয়োগ, সেবা, জনশক্তি, তথ্যপ্রযুক্তিসহ অর্থনৈতিক বৃহত্তর অংশীদারিত্বমূলক বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
একইভাবে এসব বিষয়ে চীন সরকারের সম্মতি আদায়ে শক্তিশালী দরকষাকষির অবস্থানে যদি যাওয়া যায়, তাহলে এফটিএ থেকে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক লাভ নেয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশ দরকষাকষিতে কতটুকু সক্ষম, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। ধারণা করছি, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
চীন শুধু বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশই নয়, বরং দেশটি যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিরোধ মীমাংসায় একটি ভূমিকা পালন করতে চায়, তা সম্প্রতি জানা গেছে। চীনের এই ভূমিকা আগে কখনও লক্ষ করা যায়নি।
চীন বরাবরই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নির্লিপ্ত থেকেছে। কখনও কোনো ভূমিকা পালন করেনি। চীন অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলিয়েছে, এ রকম কোনো দৃষ্টান্ত নেই। চীন দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করেছে তার অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে। তারা সেটা করেছে।
এখন তারা বিশ্ব আসরে তাদের ভূমিকা পালন করার স্বার্থেই একটি ‘ভূমিকা’ রাখতে চায়। আর এর প্রমাণস্বরূপ তারা সম্প্রতি আফগানিস্তানের তালেবান প্রতিনিধি ও সরকারি প্রতিনিধিদের চীনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল (ডন, ২৪ জুন)।
চীন মনে করে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব। এ জন্যই কাতারে নিযুক্ত ‘তালেবান রাষ্ট্রদূত’ আবদুল ঘানি বারাদারকে চীন বেইজিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
বলা ভালো, আফগানিস্তানের ব্যাপারে চীনের স্বার্থ রয়েছে। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্ত রয়েছে। সেখানে বসবাসরত উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে চীনের বড় ভয়। সেখানে ইসলামী জঙ্গিবাদ বিস্তারের আশঙ্কা রয়েছে।
চীন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’ গঠন করেছে। ফলে চীনের একটি ‘ভূমিকা’ এখন স্বীকৃত। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে চীন এ ধরনের একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের উচিত চীনের এ ভূমিকাকে ব্যবহার করা।




 প্রিন্ট সংস্করণ। ২৯ জুন ২০১৯, ০০:০০ ।
তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com

ইতিহাস কিভাবে স্মরণ করবে মোহামেদ মুরসিকে

মোহামেদ মুরসির মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে ইতিহাস এখন কিভাবে স্মরণ করবে তাঁকে? মিসরের সমসাময়িককালের ইতিহাসে তিনি ছিলেন প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। আরব বসন্ত পরবর্তী সময়ে মিসরে ২০১২ সালে তিনি জনগণের ভোটে প্রথমবারের মতো সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে ২০১৩ সালের ৩ জুলাই তিনি সামরিক অভ্যুত্থানে উত্খাত হন। তাঁর বিচার চলছিল এবং বিচার চলাকালে তিনি আদালতেই কাঠগড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের অবসান হলো। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে কিভাবে স্মরণ করবে? একজন ইসলামপন্থী নেতা, যিনি মিসরকে ইসলামিক ধারায় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন? নাকি একজন ‘গণতন্ত্রী’, যিনি মিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক একজন সিনিয়র সাংবাদিক রবার্ট ফিসক (Robert Fisk) ইংল্যান্ডের দৈনিক ‘ইনডিপেনডেন্ট’-এ লিখেছেন, মুরসির সঙ্গে সঙ্গে মিসরের গণতন্ত্রেরও মৃত্যু হয়েছে বন্দিদের খাঁচায়। গণতন্ত্রের মৃত্যু। মিথ্যা বলেননি রবার্ট ফিসক। তিনি আরো লিখেছেন, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
ড. মুরসি অসুস্থ ছিলেন। দীর্ঘ পাঁচ বছরের অধিক সময়ে তিনি নির্জন প্রকোষ্ঠে দিন কাটিয়েছেন। একজন প্রেসিডেন্টের জন্য যে সম্মান পাওয়ার কথা, তা তিনি পাননি। উপরন্তু ‘খাঁচার মধ্যে’ রেখে তাঁর কথাকথিত বিচার চলছিল। দুঃখজনক হচ্ছে, হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে খাঁচার মেঝেতে তিনি ২০ মিনিট পড়ে থাকলেন। কোনো ডাক্তার এলেন না। তাঁকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে গেল না! কোনো ধরনের চিকিৎসাসেবা ছাড়াই তিনি চলে গেলেন পরপারে! এটা তো এক ধরনের হত্যাই। এ ধরনের মৃত্যুর নিন্দা জানিয়েছেন অনেকেই—জাতিসংঘ মুরসিকে হত্যার অভিযোগে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। শোক জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা। তুরস্ক বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। মুরসির মৃত্যুতে বিভিন্ন মুসলিম দেশ শোক ও প্রতিবাদ জানালেও ব্যতিক্রম আরববিশ্ব। কাতার বাদে আরববিশ্বের কোনো নেতার শোকবাণী পাওয়া যায়নি।
মিসরে হোসনি মুবারকের স্বৈরতান্ত্রিকতা যখন জনগণের ওপর চেপে বসেছিল, তখনই উদ্ভব ঘটেছিল মোহামেদ মুরসির। প্রকৃত ধর্মীয় নেতা বলতে যা বোঝায় কিংবা পশ্চিমের দৃষ্টিতে যেটাকে ইসলামী মৌলবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার একটি প্রয়াস লক্ষ করা যায়, মুরসি ঠিক তেমনটি ছিলেন না। মুরসি প্রথমবারের মতো নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে মিসরের পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০০ সালে। তিনি ইসলামিক ব্রাদারহুডে যোগদান করেন ২০০৫ সালে। তবে দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর আত্মপ্রকাশ করে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির প্রথম পছন্দ ছিল খায়রত আল শাতের। কিন্তু অতীতে তাঁর অপরাধমূলক কাজে যুক্ত থাকার প্রমাণ থাকায় তিনি মুরসি থেকে পিছিয়ে পড়েন। বলতে গেলে অনেকটা ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় পদটি পেয়ে যান মুরসি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রায় ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২০১২ সালের ৩০ জুন মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন মুরসি। কিন্তু তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০১২ সালের ২২ নভেম্বর একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন। তাতে তিনি প্রেসিডেন্টের হাতে সব ক্ষমতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। এমনকি বিচার বিভাগের কাছেও জবাবদিহি করতে প্রেসিডেন্ট বাধ্য থাকবেন না—এ ধরনের কথাও ছিল ওই ডিক্রিতে। আদালতের ক্ষমতা খর্ব করার পাশাপাশি ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে নানা দিক থেকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন মুরসি। এর পেছনে কারণ হিসেবে দেখা হয়েছিল যে তিনি মিসরের রাজনীতিতে প্রবেশে মুসলিম ব্রাদারহুডের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
গণতান্ত্রিকভাবে মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও কিছু কিছু ‘ভুল’ তিনি করেছিলেন। তিনি অতি দ্রুত ইসলামীকরণের দিকে গিয়েছিলেন। মিসরে নারীরা তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনে বড় ভূমিকা পালন করলেও বাকিদের ব্যাপারে মুরসি অতটা ‘উদার’ ছিলেন না। মিসরের নারীরা যথেষ্ট স্বাধীন এবং পশ্চিমের দৃষ্টিতে তারা আধুনিকমনস্ক। পূর্ণ পর্দাপ্রথা তারা অনুসরণ না করলেও, শালীনতা তারা বজায় রেখে চলে। মুরসি এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি মিসরে হিজাবকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। এতে নারীদের মধ্যে ভিন্ন একটা মেসেজ পৌঁছে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে তিনি ‘আন্ডারএস্টিমেট’ করেছিলেন। অর্থাৎ সেনাবাহিনী যে একটি ‘শক্তি’, তা তিনি বিবেচনায় নেননি। মিসরের ২১০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। তেল, দুধ, বেকারি, সুপেয় পানি, সিমেন্ট, গ্যাসোলিন, রিসোর্ট ও যানবাহন উৎপাদন শিল্পের সঙ্গে সেনাবাহিনী জড়িত। কোনো সরকারের পক্ষেই সেনাবাহিনীর এই ‘ক্ষমতাকে’ অস্বীকার করা সম্ভব না। মুরসি এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
মিসরে সেনাবাহিনী বরাবরই একটি ‘রাজনৈতিক ভূমিকা’ পালন করে গেছে। ১৯৫২ সালে প্রথমবারের মতো সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মুবারকের পতন পর্যন্ত সেনাবাহিনী রাজনৈতিক দল গঠন করে (লিবারেশন র‌্যালি, ন্যাশনাল ইউনিয়ন, আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি) ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এ কারণে দেখা যায় মিসরে কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়নি। ফলে সেনাবাহিনীই মূল শক্তি হিসেবে থেকে গেছে। হোসনি মুবারক ক্ষমতা থেকে উত্খাতের পর সীমিত সময়ের জন্য সেনাবাহিনী ‘ব্যাকসাইডে’ চলে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী কিছুটা সময় নিয়েছিল নিজেদের সংগঠিত করতে। শেষ পর্যন্ত জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল সিসির নেতৃত্বেই তারা সংগঠিত হয়ে আবার ক্ষমতায় এসেছে। ইতিহাস বলে মিসরের ফারাওরা (অর্থাৎ শাসক, বাদশাহ, রাজা) যেভাবে সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে করায়ত্ত করে রেখেছিলেন, আজকের যুগে মিসরের সেনাবাহিনী সেই ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছে। মাঝখানে পাঁচ হাজার বছর চলে গেলেও মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। মুরসির আরেকটি সমস্যা ছিল, তিনি ইসলামপন্থীদের এক কাতারে নিয়ে আসতে পারেননি। আল নুর নামে একটি ইসলামিক সংগঠন রয়েছে মিসরে, যারা যথেষ্ট শক্তিশালী। পশ্চিমা বিশ্বে তাদের সালাফিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ এরা আদি ইসলামী সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী। এদের সঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিকভাবে পার্থক্য রয়েছে। ব্রাদারহুড যেভাবে মিসরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আল নুর সেভাবে চায় না। আল নুর বেশ কনজারভেটিভ। সে তুলনায় ব্রাদারহুড অনেকটা লিবারেল। আরব বসন্ত পরবর্তী সময়ে মিসরে মাত্র দুই বছর আগে সংগঠনটির জন্ম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সামরিক বাহিনী যখন মিসরে ক্ষমতা দখল করল, তখন আল নুর পার্টি মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন না করে সমর্থন করেছিল জেনারেল সিসিকে। এতে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আল নুর রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চেয়েছিল।
আরব বসন্ত সময়কালে মিসরের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। মিসরে হোসনি মুবারকের দীর্ঘ শাসনামলে (১৯৮১-২০১১) অন্যায় ও অবিচারকে কেন্দ্র করে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে যে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছিল (২৫ জানুয়ারি-১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১), যা কিনা কোনো কোনো বিশ্লেষক Facebook Revolution হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন একটা সমর্থন ছিল। ফেসবুকের মাধ্যমে সেখানে ‘বিপ্লব’ সংঘটিত হয়েছিল বিধায় তাহরির স্কয়ারের ওই বিপ্লবকে Facebook Revolution হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। যাঁরা এই বিপ্লবকে সংগঠিত করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ ওয়াশিংটনে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। বিশেষ করে Kabaya Movement কিংবা April 6 Movement-কে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা থেকে সাহায্য ও সহযোগিতা দেওয়া হয়েছিল। ওয়াশিংটনভিত্তিক Carnegie Endowment, RAND কিংবা National Endowment for Democracy-এর মতো গবেষণা সংস্থাগুলো মিসরের এই ধরনের সংস্থাকে আর্থিক সহযোগিতাও করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস ২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
 (US Groups Helped Nurture and Uprising by Ron Nixon)। তাতে এই সাহায্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।
এটা সত্য, আরব বসন্তকে তারা উসকে দেয়নি। কিন্তু তরুণ প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাদের গণতন্ত্রের স্পিরিট শেখানো হয়েছিল। কিভাবে যোগাযোগ করতে হয়, সেই ‘নেটওয়ার্কিং’ শেখানো হয়েছিল। আর মিসরের তরুণ প্রজন্ম এটা ‘আরব বসন্ত’ সংগঠিত করতে ব্যবহার করেছিল। ওয়াশিংটন মিসরে একটা স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। এখানে ইসরায়েলি স্বার্থও একসঙ্গে কাজ করেছে। মিসরে একটি শক্তিশালী শক্তির উত্থান (লেবাননে হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনে হামাস) তাদের স্বার্থে আঘাত হানবে। তাই ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টিকে ভেঙে Al-Wasat পার্টি গঠন কিংবা Kabaya Movement-এর জন্ম দেওয়া ছিল সুদূরপ্রসারী ওয়াশিংটনের স্ট্র্যাটেজির ফল। Kabaya Movement-এর জন্ম ২০০৪ সালে। উদ্যোক্তা ছিলেন আবু লা আলা মাদি—একসময় ইসলামিক ব্রাদারহুডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় এর সমর্থকরা Ikhwan Muslim Brotherhood Movement-এর জন্ম দিয়েছিলেন। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাঈদ এল কাতাতিনি। হোসনি মুবারককে সরানো প্রয়োজন ছিল। কেননা তাঁর কোনো জনপ্রিয়তা ছিল না। ভয় ছিল, সেখানে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতা দখল করতে পারে। তাই Facebook Revolution-এর মধ্য দিয়ে মুবারকের বিদায়। একসময় যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা নেওয়া ড. মুরসিকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়ার মধ্য দিয়ে মিসরের বিপ্লবকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে না দেওয়া—এসবই ছিল ওয়াশিংটনের দীর্ঘ স্ট্র্যাটেজির ফল। একসময় মুরসির ‘প্রয়োজন’ ফুরিয়ে গেলে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধা বোধ করেনি ওয়াশিংটন। জেনারেল সিসিকে ক্ষমতায় বসিয়েই ওয়াশিংটন ও ইসরায়েলি লবি তাদের স্বার্থ আদায় করেছে।
পরিণত বয়সেই মুরসি মারা গেছেন। তবে ‘খাঁচার ভেতরে’ তাঁর মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। বাস্তবতা হচ্ছে, এই ‘মৃত্যু’ মিসরের চলমান রাজনীতিতে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না
Daily Kalekontho
25.06.2019

একটি সংবাদ ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন


বিশ্বের এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে অবস্থান করছে ৮০১তম স্থানে। ডেটা ও গবেষণার ওপর ভিত্তি করে প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে 'কিউএস'। এটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। এশিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১২৭তম। এই খবরটি খোদ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। খবরটি গণমাধ্যমে জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী 'কৃতিত্ব' নিতে চাইল, জানি না। তবে এটা বুঝি, ১২৭তম স্থান পাওয়া কোনো ভালো সংবাদ হতে পারে না। এর আগে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আরেকটি প্রতিষ্ঠান 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর একটি জরিপ প্রকাশ করে। ওই জরিপে ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অবস্থান ছিল না। আমাদের উচ্চশিক্ষার হাল কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা এ ধরনের জরিপের ফলাফল থেকেই বোঝা যায়।

অনেকেই হয়তো এই র‌্যাংকিংয়ের ধারণায় বিশ্বাস করেন না। কিন্তু প্রকারান্তরে এটা স্বীকার করেন, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন, বাংলাদেশে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কমেছে। কেন কমেছে কিংবা এ জন্য কী করা উচিত, এটা নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বলছেন। তাতে একটা কথা উঠে এসেছে আর তা হচ্ছে, গবেষণায় অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ কম। এর পেছনে সত্যতা যেমনি আছে, তেমনি আবার এটাও সত্য, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকরাও পাঠদানে কিংবা গবেষণার ব্যাপারে সিরিয়াস 'কমিটেড' নন। গবেষণা বা গবেষণাধর্মী পুস্তক প্রকাশের চেয়ে তারা এখন 'দ্বিতীয় আরেকটি চাকরি' কিংবা গবেষণার পরিবর্তে টিভিতে সময় কাটাতেই বেশি সময় দেন। রাষ্ট্র যখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা ও বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানকারীকে ৯০ লাখ ৩১ হাজার টাকা দামের মিতসুবিশি পাজেরো, স্পোর্টস কিউএক্স জিপ গাড়ি বরাদ্দ দেয় এবং একজন সিনিয়র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে যখন নিত্যদিন রিকশা কিংবা বাসে করে ক্যাম্পাসে আসতে হয়, তখন তিনি আর গবেষণায় উৎসাহী হন না- এটাই স্বাভাবিক। আবার গবেষণায় বরাদ্দও থাকে কম। ফলে ভালো মানের গবেষণাও হয় না আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিংয়েও নাম আসে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা এক জায়গাতে আর তা হচ্ছে, যারা উপাচার্য হয়ে আসেন, তারা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করার পরিবর্তে দলীয়করণের দিকেই মনোযোগী হন বেশি। দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া থেকে শুরু করে ক্ষমতাবান শিক্ষকরা নিজ স্বার্থে নতুন নতুন বিভাগ খুলছেন- এ সংবাদ তো পত্রপত্রিকাতেই ছাপা হয়েছে। এতে করে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে কীভাবে?

শিক্ষায়, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে গুণগত মান নিশ্চিত করা যাবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে কতগুলো পদক্ষেপ নিতে পারে। তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানে সময় দিচ্ছেন বেশি। নিজ প্রতিষ্ঠানে তিনি যে বেতন পান, অন্য প্রতিষ্ঠানে 'সময় দিয়ে' তিনি তার চেয়ে বেশি আয় করেন। সুতরাং আইন করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্য প্রতিষ্ঠানে 'চাকরি' করা কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা (যে কোনোভাবে, পার্টটাইম বা কনসালট্যান্ট) নিষিদ্ধ করতে হবে। দুই প্রতিষ্ঠানে কেউ শিক্ষকতা-চাকরি করতে পারবেন না। আইনটা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। উপাচার্যের ইচ্ছায় বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে- এই প্রবণতা বন্ধ করে ইউজিসির অধীনে পিএসসির মডেলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আর শুধু লিখিত পরীক্ষা নয়, বরং মৌখিক ও 'ডেমো'র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং তিনি এক বছর শিক্ষানবিশ থাকবেন। এরপর আরেকটি মৌলিক গবেষণাকর্ম সম্পাদন করে স্থায়ী পদে যোগ দেবেন। সরাসরি কাউকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ। এর সত্যতা আছে। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এ জন্য নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে তৈরি করতে হবে, যা ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের স্থলাভিষিক্ত হবে। এরই সঙ্গে উপাচার্য নিয়োগে সিনিয়র শিক্ষকদের দিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করতে হবে। তরুণ শিক্ষকদের বিদেশে পিএইচডি করার জন্য পাঠাতে হবে। এর জন্য ফান্ড তৈরি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নামে এই ফান্ড হতে পারে, যেখানে শীর্ষ ব্যবসায়ীরা অনুদান দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। চাকরির বয়স পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হতে পারবে না। পদোন্নতির জন্য মৌলিক গ্রন্থ এবং পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে। এটা বর্তমানে নেই। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া সহযোগী অধ্যাপক পদেও পদোন্নতি পাওয়া যাবে না। ভিজিটিং স্কলার হিসেবে সিনিয়র প্রফেসরদের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। এতে করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপকৃত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গত দশ বছরে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। নিজের মেয়েকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পাইয়ে দেওয়া (যে বোর্ডে তিনি নিজে সভাপতিত্ব করেছেন), বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়া সন্তানের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া- এ ধরনের 'অভিযোগ' রয়েছে। ইউজিসি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা বিতরণ করবে- শুধু এই কাজটি করাই তাদের মুখ্য কাজ হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান দেখা, পর্যালোচনা করা, সুপারিশ করা ইত্যাদি তাদের 'কাজের' অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, এসব ক্ষেত্রে তাদের কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান নয়। ফলে ইউজিসিকে নিয়ে ভাবতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদগুলোতে (সচিব, অ্যাডিশনাল সচিব) সিনিয়র শিক্ষকদের পেষণে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

একুশ শতকে এসে কতগুলো বিশেষ মন্ত্রণালয় (শিক্ষা, অর্থ, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র) পরিচালনার ভার বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। ভারতে মোদি সরকার এই কাজটি শুরু করেছে। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশে এ ব্যবস্থা আছে। একটি কমিশন গঠন করে সরকার তাদের কাছে মতামত চাইতে পারে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের রয়েছে একটি শক্তিশালী তরুণ প্রজন্ম। দেশের জনগোষ্ঠীর ১৯.৩৬ ভাগ হচ্ছে ১৫ থেকে ২৪ বছরের যুবক-যুবতী। আর জনগোষ্ঠীর ৩৯.৭৩ ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৫৪ বছরের মধ্যে। এটা আমাদের জন্য একটি শক্তি। ইউরোপের প্রতিটি দেশে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি 'মাইনাস' অর্থাৎ জনসংখ্যা বাড়ছে না। জাপানেও বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। শিশুর জন্ম হ্রাস পাচ্ছে। তাই জাপান দক্ষ জনগোষ্ঠী 'আমদানি' করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে দেশগুলো থেকে তারা দক্ষ জনশক্তি আনবে, ওই তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশে একটি বিশাল তরুণ প্রজন্ম থাকলেও তারা দক্ষ নয়। আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে কতগুলো সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া দরকার। মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি করা জরুরি। প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যেখান থেকে শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট বের হবে। সাধারণ শিক্ষার প্রসার না ঘটিয়ে প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, কৃষি তথা কৃষিপ্রযুক্তির মতো বিষয় চালু করা উচিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে প্রতি বিভাগে একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ওই বিভাগের সব কলেজকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত করতে হবে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্য আলাদা একটি কমিশন গঠন করে এর মর্যাদা ইউজিসির মতো উন্নীত করা। একুশ শতকে এসে আমরা যদি একটি দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে না পারি, তাহলে এই জনগোষ্ঠী আমাদের জন্য 'বোঝা' হবে। এ ক্ষেত্রে চীনের দৃষ্টান্ত আমরা অনুসরণ করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিসর বাড়াতে হবে। না হলে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ব বারবার। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের দরকার যোগ্য নেতৃত্ব। কিন্তু সেটা নেই। দলীয়করণের কারণে যোগ্য শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইউজিসির মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা দ্রুত প্রয়োজন।
Daily Samakal
27.06.2019

শিক্ষামন্ত্রীর দুঃখবোধ, শিক্ষা বাজেট ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম


 

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ১৩ জুন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নানা জরিপে দেখা যাচ্ছে ইংরেজি দূরে থাক নিজভাষা বাংলাটাই আমাদের শিক্ষার্থীরা আয়ত্ত করতে পারছে না। তিনি আরও বলেন, মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের কথা বলছি, তা আইনের চেষ্টা করছি। তবে এর আগে শিক্ষার মানটা কী, তা কেমন, এসব আমাদের চিন্তা করে নিতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী যখন এ ধরনের কথাবার্তা বলেন, ঠিক একই দিন বিকালে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর পক্ষে উপস্থাপনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন প্রয়োজনে শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বিদেশ থেকে শিক্ষক আনা হবে। সংসদে তিনি প্রখাত জাপানি সম্রাট সুইসুহিটোর (যার পরিচিত ছিল সম্রাট মেইজি বা মেইজি টেননো) উদাহরণ দেন। সেইজি টেননো ১৮৬৭ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত জাপান শাসন করেন। তার শাসনামলে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে জাপানে ছাত্রের অভাব নেই। আছে উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। তাই তিনি প্রযুক্তিনির্ভর অশিক্ষিত কয়েক হাজার শিক্ষককে জাপানে নিয়ে আসেন। এভাবে জাপান জ্ঞানবিজ্ঞানে অগ্রসর হয়। প্রধানমন্ত্রী কিংবা শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে দুটি দিক আছে। এক. আমাদের শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের অভাব রয়েছে। দক্ষ শিক্ষকের অভাবে তাদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা যাচ্ছে না। দুই. বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেকটা জাপানের মেইজি সাম্রাজ্যের শাসনামলের মতো। প্রচুর জনশক্তি আছে। কিন্তু তারা দক্ষ ও সুশিক্ষিত নন। তাই বিদেশি শিক্ষক অথবা প্রশিক্ষক দরকার।
প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী বাস্তব সত্যটাই তুলে ধরেছেন। গত দশ বছর বর্তমান সরকারই ক্ষমতায়। এর আগে আমরা আরও একজন শিক্ষামন্ত্রীকে পেয়েছিলাম। কিন্তু গুণগত শিক্ষার মান আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। বরং জিপিএ-৫ নির্ভর একটা শিক্ষাব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি। এর মধ্য দিয়ে একটা তরুণ প্রজন্মকে আমরা ধ্বংস করেছি। এর ঢেউ গিয়ে লেগেছে উচ্চশিক্ষায়। উচ্চশিক্ষা এখন বেশি মাত্রায় বিসিএস-নির্ভর হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যিনি যে বিষয় নিয়েই পড়াশোনা করেন না কেন, তার টার্গেট হচ্ছে বিসিএস দেওয়া। তিনি যা শিখলেন, যা জানলেন, তা কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারছেন না। তিনি ‘দৌড়াচ্ছেন’ বিসিএসের জন্য। বাজারে বিসিএস গাইডে ভরা। তার পড়ার টেবিলে পাঠ্য বইয়ের পরিবর্তে স্থান পায় বিসিএস গাইড, যার অধিকাংশই আবার ভুলে ভরা। এই হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। উচ্চশিক্ষার হাল আরও খারাপ। রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে, যেখানে প্রধান্য পাচ্ছে রাজনৈতিক আনুগত্য। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থ। টিআইবির রিপোর্টে তো উল্লেখ করা হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতি আমাদের কোন প্রকার কথা হলো না।
শিক্ষায়, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে গুণগত মান নিশ্চিত করা যাবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে কতগুলো পদক্ষেপ নিতে পারে। তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানে সময় দিচ্ছেন বেশি। নিজ প্রতিষ্ঠানে তিনি যে বেতন পান, অন্য প্রতিষ্ঠানে সময় দিয়ে তিনি তার চেয়ে বেশি আয় করেন। সুতরাং আইন করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্য প্রতিষ্ঠানে ‘চাকরি’ করা কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা যেকোনোভাবে (পার্টটাইম বা কনসালট্যান্ট) নিষিদ্ধ করতে হবে। দুই প্রতিষ্ঠানে কেউ শিক্ষকতা/ চাকরি করতে পারবেন না। আইনটা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগে নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। উপাচার্যের ইচ্ছায় বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে। এই প্রবণতা বন্ধ করে ইউজিসির অধীনে পিএসসির মডেলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আর শুধু লিখিত পরীক্ষা না, বরং মৌখিক ও ডেমোর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এবং তিনি এক নম্বর শিক্ষানবিশ থাকবেন। এরপর একটি গবেষণা কর্ম সম্পাদন করে স্থায়ী পদে যোগ দেবেন। সরাসরি কাউকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে।
অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ। এর সত্যতা আছে।
এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এ জন্য নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে তৈরি করতে হবে, যা ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের স্থলাভিষিক্ত হবে। একই সঙ্গে উপাচার্য নিয়োগে সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করতে হবে। তরুণ শিক্ষকদের বিদেশে পিএইচডি করার জন্য পাঠাতে হবে। এর জন্য ফান্ড তৈরি করতে হবে। প্রধনামন্ত্রীর নামে এই ফান্ড হতে পারে। যেখানে শীর্ষ ব্যবসায়ীরা অনুদান দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। চাকরির বয়স পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হতে পারবে না। পদোন্নতির জন্য মৌলিক গ্রন্থ এবং পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে। এটা বর্তমানে নেই। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া সহযোগী অধ্যাপক পদেও পদোন্নতি পাওয়া যাবে না। ভিজিটিং স্বাক্ষর হিসেবে সিনিয়র প্রফেসরদের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। এতে করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপকৃত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও এক্সডিটেশন কাউন্সিল অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গত দশ বছরে যারা নিয়োগ পেয়েছে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। নিজের মেয়েকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পাইয়ে দেওয়া (যে বোর্ডে তিনি নিজে সভাপতিত্ব করেছেন), বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়া সন্তানের যোগ্যতা না থাকা সত্তে¡ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া, এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ইউজিসি শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা বিতরণ করবে শুধু এই কাজটি করাই তাদের মুখ্য কাজ হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান দেখা পর্যালোচনা করা, সুপারিশ করা ইত্যাদি তাদের ‘কাজের’ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, এসব ক্ষেত্রে তাদের কর্মকাÐ দৃশ্যমান নয়। ফলে ইউজিসিকে নিয়ে ভাবতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদগুলোতে (সচিব, এডিশনাল সচিব) সিনিয়র শিক্ষকদের পেষণে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। একুশ শতকে এসে কতগুলো বিশেষ মন্ত্রণালয় (শিক্ষা, অর্থ, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র) পরিচালনার ভার বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। ভারতে মোদি সরকার এই কাজটি শুরু করেছে। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশে এ ব্যবস্থা আছে। একটি কমিশন গঠন করে সরকার এদের কাছে মতামত চাইতে পারে।
সরকার শিক্ষায় বাজেট বাড়িয়েছে। কিন্তু এই বাজেটের একটা বড় অংশই চলে যাবে বেতন ভাতায়। সুতরাং আলাদা একটি খাত সৃষ্টি করে সেখানে অর্থ বরাদ্দ করে ওই অর্থ দিয়ে বিদেশি প্রশিক্ষক তথা শিক্ষক আনা যেতে পারে। মোদ্দা কথা, সনাতন শিক্ষার যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এসএসসি ও এইচএসসি লেভেলের পর তরুণ প্রজন্মকে বিশ্ববিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে তাদের ৩-৪ বছরের জন্য টেকনিক্যাল কলেজগুলোতে পাঠিয়ে বিভিন্ন শাখায় দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ওইসব কলেজে প্রয়োজনে বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর উদ্যোগে তারা তাদের প্রশিক্ষকও পাঠাতে পারেন। এবং গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নেওয়ার পর তাদের জন্য কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করতে পারেন তারা।
শুধু বাজেটে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ ও শিক্ষিত করে তোলা যাবে না। এজন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কতগুলো সিদ্ধান্ত দ্রæত নেওয়া সম্ভব। এক. দ্রæত মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনা। দুই. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি করা। তিন. প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যলয় নয়, বরং একটি করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখান থেকে শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট বের হবে। চার. সাধারণ শিক্ষার প্রসার না খাটিয়ে প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রসার খাটানো। নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, কৃষি তথা কৃষি প্রযুক্তির মতো বিষয় চালু করা। পাঁচ. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে প্রতি বিভাগে একটি করে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা এবং ওই বিভাগের সব কলেজকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত করা। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা। ছয়. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্য আলাদা একটি কমিশন করা, যার মর্যাদা হবে ইউজিসির মতো। একুশ শতকে এসে আমরা এখনও মানসম্মত শিক্ষার কথা বলছি। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার জন্য যা যা করা দরকার, তা আমরা করছি না। শিক্ষামন্ত্রীরা শুধু আশ্বাস দিয়ে যান। কিন্তু শুধু আশ্বাস দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না
Daily Somoyer Alo
25.06.2019

মুরসির মৃত্যুর পর আরব বিশ্বের রাজনীতি


তিউনিসিয়ার সিদি বওজিদ শহরের বেকার কম্পিউটার গ্রাজুয়েট কেউয়াজিজির আত্মহননের মধ্যদিয়ে ‘আরব বসন্ত’র সূত্রপাত হলেও আরব বসন্ত তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। ২০১১ সালের আরব বসন্ত তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন এবং লিবিয়ায় স্বৈরশাসকদের পতন ঘটালেও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ সেখানে ঘটেনি। ২০১৯ সালের জুনে মিসরের নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট ড. মুরসির বিচার চলাকালীন এই মৃত্যু প্রমাণ করল আরব বিশ^ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বৈরশাসকদের সীমাহীন ক্ষমতার অপব্যবহার ‘আরব বসন্ত’র জন্ম দিয়েছিল। কায়রোর তাহরির স্কোয়ারের অবস্থান কর্মসূচি (২৫ জানুয়ারি-১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১) মিসরে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সূচনা করেছিল। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা (১৯৮১-২০১১) মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। এতে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ড. মুরসি তাতে বিজয়ী হয়েছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও নিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের কী নির্মম পরিণতিÑ যাকে তিনি সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, সেই জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল সিসিই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ড. মুরসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার এক বছরের মধ্যে ২০১৩ সালের ৩ জুলাই তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। মিসর ফিরে যায় সেই পুরনো বৃত্তে এক ধরনের ‘সিভিলিয়ান উর্দিতন্ত্র’। অর্থাৎ সিভিলিয়ান পোশাকে সামরিক একনায়কতন্ত্র। তার পূর্বসূরিদের মতো জেনারেল সিসিও যে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকবেন, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না।
দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের কারণেই ‘আরব বসন্ত’র জন্ম হয়েছিল। ইয়েমেনে আলী আব্দুল্লাহ সালেহ (১৯৭৮-২০১১), তিউনিসিয়ায় জাইন আল আবেদিন বেন আলি (১৯৮৭-২০১১), লিবিয়ায় মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি (১৯৬৯-২০১১), দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে সেখানে সবাই এক ধরনের গোষ্ঠীতন্ত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। বেকার সমস্যা সেখানে ছিল প্রবল। তরুণদের জন্য কোনো চাকরির ব্যবস্থা ছিল না। দুর্নীতিতে দেশগুলো ছিল শীর্ষে। গণতন্ত্র সূচকে দেশগুলোর অবস্থান ছিল অনেক নিচে। ফলে দীর্ঘদিনের অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটেছিল ২০১১ সালে। জন্ম হয়েছিল ‘আরব বসন্ত’। কিন্তু গত ৮ বছরের ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখা যাবে সেখানে নতুন ধরনের স্বৈরশাসনের জন্ম হয়েছে। মিসরের পাশাপাশি লিবিয়ায় গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে রাষ্ট্রটি এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম, সেখানে আরেক স্বৈরশাসক জেনারেল হাফতার এখন লিবিয়া দখলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। ইয়েমেনে কোনো কেন্দ্রীয় শাসন নেই। সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে। তিউনিসিয়ায় এক ধরনের গণতন্ত্র বিকশিত হলেও মুসলিম জঙ্গিবাদ সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মিসরে হোসনি মুবারকের স্বৈরতান্ত্রিকতা যখন জনগণের কাঁধে জোয়ালের মতো চেপে বসেছিল, তখনই উদ্ভব ঘটেছিল মোহাম্মদ মুরসির। প্রকৃত ধর্মীয় নেতা বলতে যা বোঝায় কিংবা পশ্চিমের দৃষ্টিতে যেটাকে ইসলামি মৌলবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার একটি প্রয়াস লক্ষ করা যায়, মুরসি ঠিক তেমনটি ছিলেন না। মুরসি প্রথমবারের মতো নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে মিসরের পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০০ সালে। তিনি ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এ যোগদান করেন ২০০৫ সালে। তবে দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর আত্মপ্রকাশ করে ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’। বিপ্লব পরবর্তী মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির প্রথম পছন্দ ছিলেন খায়রত আল শাতের। কিন্তু অতীতে অপরাধমূলক কাজে যুক্ত থাকার প্রমাণ থাকায় তিনি মুরসির থেকে পিছিয়ে পড়েন। বলতে গেলে অনেকটা ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় পদটি পেয়ে যান মুরসি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রায় ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২০১২ সালের ৩০ জুন মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন মুরসি। কিন্তু তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০১২ সালের ২২ নভেম্বর একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন। তাতে তিনি প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। এমনকি বিচার বিভাগের কাছেও জবাবদিহি করতে প্রেসিডেন্ট বাধ্য থাকবেন না, এ ধরনের কথাও ছিল ওই ডিক্রিতে। আদালতের ক্ষমতা খর্ব করার পাশাপাশি ক্ষমতায় আসার জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে নানাদিক থেকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন মুরসি। এর পেছনে কারণ হিসেবে দেখা হয়েছিল যে তিনি মিসরের রাজনীতিতে প্রবেশে মুসলিম ব্রাদারহুডের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
মুরসি গণতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও, কিছু কিছু ‘ভুল’ তিনি করেছিলেন। তিনি অতি দ্রুত ইসলামিকরণের দিকে গিয়েছিলেন। মিসরে নারীরা তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনে বড় ভূমিকা পালন করলেও নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে মুরসি এতটা ‘উদার’ ছিলেন না। মিসরে নারীরা যথেষ্ট স্বাধীন এবং পশ্চিমের দৃষ্টিতে তারা আধুনিকমনস্ক। পূর্ণ পর্দাপ্রথা তারা অনুসরণ না করলেও শালীনতা তারা বজায় রেখে চলেন। মুরসি এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি মিসরে হিজাবকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। এতে করে নারীদের মাঝে ভিন্ন একটা মেসেজ পৌঁছে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে তিনি ‘আন্ডার এস্টিমেট’ করেছিলেন। অর্থাৎ সেনাবাহিনী যে একটি ‘শক্তি’ তা তিনি বিবেচনায় নেননি। মিসরের ২১০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ১০ থেকে ১৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির সেনাবাহিনী তেল, দুধ, বেকারি, সুপেয় পানি, সিমেন্ট, গ্যাসোলিন, রিসোর্ট ও যানবাহন উৎপাদন শিল্পের সঙ্গে সেনাবাহিনী জড়িত। কোনো সরকারের পক্ষেই সেনাবাহিনীর এই ‘ক্ষমতাকে’ অস্বীকার করা সম্ভব না। মুরসি এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
মিসরে সেনাবাহিনী বরাবরই একটি ‘রাজনৈতিক ভূমিকা’ পালন করে গেছে। ১৯৫২ সালে প্রথমবারের মতো সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মুবারকের পতন পর্যন্ত সেনাবাহিনী রাজনৈতিক দল গঠন করে (লিবারেশন, র‌্যালি, ন্যাশনাল ইউনিয়ন, আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি) ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এ কারণে দেখা যায় মিসরে জনগণের অন্য কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়নি। ফলে সেনাবাহিনীই মূল শক্তি হিসেবে থেকে গেছে। হোসনি মুবারক ক্ষমতা থেকে উৎখাতের পর সীমিত সময়ের জন্য সেনাবাহিনী ‘ব্যাক সাইডে’ চলে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী কিছুটা সময় নিয়েছিল নিজেদের সংগঠিত করতে। শেষ অবধি জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল সিসির নেতৃত্বেই তারা সংগঠিত হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছে। ইতিহাস বলে মিসরের ফারাওরা (অর্থাৎ শাসক, বাদশাহ, রাজা) যেভাবে সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে করায়ত্ত করে রেখেছিলেন, আজকের যুগে মিসরের সেনাবাহিনী সেই ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছে। মাঝখানে পাঁচ হাজার বছর চলে গেলেও মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
মুরসির আরেকটা সমস্যা ছিল তিনি বেশিরভাগ ইসলামপন্থিদের এক কাতারে নিয়ে আসতে পারেননি। ‘আল নুর’ নামে একটি ইসলামপন্থি সংগঠন হয়েছে, মিসরে যারা যথেষ্ট শক্তিশালী। পশ্চিমা বিশ্বে তাদের সালাফিস্ট হিসেবে নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ এরা আদি ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। এদের সঙ্গে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর রাজনৈতিক পার্থক্য রয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুড যেভাবে মিসরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আল নুর সেভাবে চায় না। আল নুর বেশ কনজারভেটিভ হলেও সে তুলনায় ব্রাদারহুড অনেকটা লিবারেল। আরব বসন্ত পরবর্তী মিসরে মাত্র দু’ বছর আগে আল নুর সংগঠনটির জন্ম। মজার ব্যাপার হচ্ছে সামরিক বাহিনী যখন মিসরে ক্ষমতা দখল করল, তখন আল নুর পার্টি মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন না করে সমর্থন করেছিল জেনারেল সিসিকে। এতে করে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আল নুর রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চেয়েছিল।
ইয়েমেন ও লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। দেশ দুটি কার্যত একাধিক অংশে বিভক্ত হয়ে আছে। অস্ত্র সেখানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এই দেশ দুটিতে কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসন নেই। অস্ত্রবাজরা এক এক অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে স্বশাসিত প্রশাসন চালু করেছে। লিবিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন জেনারেল হাফতার, যিনি এক সময় গাদ্দাফির একজন ঘনিষ্ঠ জেনারেল ছিলেন। ইয়েমেনে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ হুথি বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছেন। সৌদি বিমানবাহিনী সেখানে নিয়মিত বোমা বর্ষণ করে চলেছে। সেখানে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে এক ধরনের ‘প্রক্সি ওয়ার’ চলছে। ইরান সমর্থন করছে হুতি বিদ্রোহীদের, যারা এখন রাজধানী নিয়ন্ত্রণ করছে। গণঅভ্যুত্থানে আলী আব্দুল্লাহ সালেহকে উৎখাতের পর আবদ রাব্ব মনসুর হাদি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে নিরাপত্তার অভাবে তিনি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। সেই থেকে তিনি সৌদি আরবে আছেন। আর সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তার সমর্থনে হুতিদের (ইরান সমর্থিত) ওপর বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছেন। এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের ‘প্রক্সি ওয়ার’ বা ‘ছায়াযুদ্ধে’র জন্ম হয়েছে।
‘আরব বসন্ত’ পুরো আরব বিশ্বে পরিবর্তন আনলেও ব্যতিক্রম হচ্ছে সিরিয়া। সিরিয়ায় ২০১৪ সালে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আইএস’-এর উত্থান; সমস্ত মুসলিম বিশ্ব নিয়ে একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা কিংবা মাত্র দু বছরের মাথায় (২০১৬-২০১৭) সময়সীমায় ‘আইএস’-এর পতনের পরও আসাদ সরকার সেখানে এখনো টিকে আছে। তিনি সেখানে ক্ষমতায় আছেন ২০০০ সাল থেকে। মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ ও অব্যাহত বোমা বর্ষণের পরও আসাদ সরকার টিকে আছে শুধুমাত্র রাশিয়ার হস্তক্ষেপের কারণে। রাশিয়া আসাদ সরকারকে সমর্থন করছে। আর যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করছে আসাদ বিরোধীদের। এখানে পরিবর্তনটা আসেনি। তবে ‘আরব বসন্ত’র ঢেউ অন্যত্রও আঘাত করেছিল। ওমান ও বাহরাইনের রাজপরিবার দেশের সংবিধান সংস্কার করে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। রাজা হবেন আনুষ্ঠানিক প্রধান। সম্মিলিত আরব আমিরাতেও এক ধরনের গণতন্ত্র চালু হয়েছে। ‘আরব বসন্ত’ সৌদি রাজপরিবারের ভিতকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে। কিছু সংস্কারের কথা তারা বলছেন। তবে এই মুহূর্তে ইরানের দিকে দৃষ্টি অনেকের। ইরান আরব বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত না হলেও আরব বিশে^র উত্থান-পতনে ইরানের একটি ভূমিকা রয়েছে।
‘আরব বসন্ত’ সময়কালে মিসরে মোবারকবিরোধী গণআন্দোলনের মূল স্পিরিট ছিল ‘Bread, Freedom, Social Justice’’- অর্থাৎ খাদ্য, স্বাধীনতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা। ‘আরব বসন্ত’র মধ্য দিয়ে সেখানে প্রায় সব দেশেই সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য দূর হয়নি। কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি। আর সাম্যও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধুমাত্র একটি ‘কসমেটিক’ পরিবর্তন হয়েছে অর্থাৎ ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। সাধারণ মানুষ এর মধ্য দিয়ে উপকৃত হয়নি
Daily Desh Rupantor
25.06.2019

খোলা জানালা: শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি নিয়ে কিছু কথা

খোলা জানালা: শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি নিয়ে কিছু কথা
খোলা জানালা: শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি নিয়ে কিছু কথা। প্রতীকী ছবি
প্রতিবারের মতো এবারও বাজেটে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে সরকার। ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার যে বাজেট তাতে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটের ১৫ দশমিক ২ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেটে দেখা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের জন্য ২৯ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা।
অর্থাৎ বাজেটে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এ ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা যাবে কিনা। শুনতে হয়তো খারাপ শোনাবে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এতে করে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হবে না। আমাদের সমস্যা দু’জায়গাতেই- মাধ্যমিক স্তর ও উচ্চশিক্ষা। শিক্ষামন্ত্রী নিজেই একটি অনুষ্ঠানে গত ১৩ জুন বললেন, ‘ইংরেজি দূরে থাক, নিজ ভাষা বাংলাটাই আমাদের শিক্ষার্থীরা আয়ত্ত করতে পারছে না।’
তিনি আরও বললেন, ‘শিক্ষার মানটা কী, তা কেমন, এসব আমাদের চিন্তা করে নিতে হবে।’ অর্থাৎ এটা স্পষ্ট, আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী সন্তুষ্ট নন। সন্তুষ্ট না হওয়ারই কথা। গত কয়েক বছরে আমরা শিক্ষার মানের চেয়ে কীভাবে জিপিএ-৫ পাওয়া যায়, তার একটি ক্রেজ তৈরি করেছি। অর্থাৎ তরুণ প্রজন্ম কতটুকু জ্ঞান অর্জন করল এটা বড় কথা নয়, বড় কথা তাকে আমরা যাচাই করছি তার জিপিএ-৫ আছে কিনা তা বিবেচনা করে। অথচ জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারছে না।
অর্থাৎ গোড়ায় গলদ রয়েছে। তার ভিত্তিটা আমরা শক্তিশালী করতে পারিনি। আর কীভাবে গত বছরগুলোয় ছাত্রছাত্রীদের জিপিএ-৫ পাইয়ে দেয়া হয়েছে, তার সংবাদ তো পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। এতে কি প্রকারান্তরে শিক্ষামন্ত্রী স্বীকার করে নিলেন না আমাদের শিক্ষার্থীদের আমরা ‘যোগ্য প্রজন্ম’ হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি? আশার কথা জিপিএ-৫ এখন বাতিল হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, প্রয়োজনে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনা হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত।
এই শিক্ষক শুধু মাধ্যমিক পর্যায়েই নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও আনতে হবে। যদিও ইতিমধ্যে এর একটি নেতিবাচক মনোভাব লক্ষ করা গেছে। অনেকেই সামাজিক গণমাধ্যমে এর সমালোচনা করেছেন। অনেকের ধারণা এর ফলে ভারত থেকে শিক্ষক আসবে। বিশ্ব এখন ‘গ্লোবাল ভিলেজ’। যদি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ও সাবজেক্টে ভারত থেকে শিক্ষক আসে, ক্ষতি কী? মাধ্যমিক স্তরে ইংরেজি ও অঙ্ক ভীতি দিন দিন বাড়ছে। এ দুটি বিষয়ে যদি আমরা বিদেশ থেকে শিক্ষক আনি তাতে ক্ষতির কিছু দেখি না।
তবে তাদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। আমাদের একটা বড় সংকটের জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এখানে ভালো শিক্ষক নেই। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে শত শত বিশ্ববিদ্যালয়। তারা নিত্যদিন সার্টিফিকেট বিতরণ করছেন। হাজার হাজার তরুণ বিবিএ-এমবিএ, কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি নিয়ে ‘জব মার্কেটে’ আসছে। কিন্তু কী তাদের কোয়ালিটি? সাধারণ একজন শিক্ষার্থী যিনি সর্বোচ্চ টেকনিক্যাল স্কুল পাস করার যোগ্য এবং সেই মেধা তার আছে। কিন্তু শুধু ‘টাকার জোরে’ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একখানা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি জোগাড় করেছেন। কম পয়সায় চাকরিও পাচ্ছেন। তাতে কি আমরা গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলাম? দুঃখজনক হলেও সত্য, এটা নিয়ে কেউ ভাবেন না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অনেকেরই তেমন ‘দায়বদ্ধতা’ নেই। বিশেষ করে যারা ঢাকায় বসবাস করেন, তারা ব্যস্ত থাকেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিয়ে, আমরা টিভিতে অনুষ্ঠান করি। কেউ কেউ আবার সেখানে ‘ফুল টাইম’ চাকরিও করেন। মিডিয়ায় ‘কাজ’ করলে এই এক সুবিধা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু বলতে পারেন না, ভিসিরা ‘দুর্বল’ থাকেন। এ রকম একজনের ‘কাহিনী’ সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। যিনি ‘যোগ্যতা’ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি পেয়েছেন! পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এটা কি সম্ভব- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একসঙ্গে দুটি চাকরি করবেন! সম্ভব নয়। কেউ চিন্তাও করে না।
কিন্তু বাংলাদেশেই সম্ভব। আমার এক সহকর্মীকে দেখেছি গত ১০ বছর ধরে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ‘গবেষণা পরিচালক’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এখনও করছেন। ওই প্রতিষ্ঠানে তার নিজস্ব রুম, পদবি এমনকি ‘নেমপ্লেট’ও আছে! আরেকজনের খবর জানি- আমার বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। একটি টিভি চ্যানেলে ‘ফুল টাইম’ চাকরি করতেন বা এখনও করেন। এরা গবেষণা করবেন কখন? সময় কই তাদের? আমরা এ প্রবণতা বন্ধ করতে পারিনি। দেখভাল করবে ইউজিসি।
কিন্তু তারা কি তাদের কাজটি সঠিকভাবে করছেন? রাজনৈতিক বিবেচনায় সেখানে নিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু যোগ্য লোকরা সেখানে নিয়োগ পাচ্ছে না। সময় এসেছে ইউজিসির কাঠামোয় পরিবর্তন আনার। যারা নিয়োগ পাচ্ছেন, তারা হয়তো ভালো শিক্ষক। কিন্তু তারা শিক্ষাক্ষেত্রে যোগ্য ‘লিডার’ নন। একজন ইউজিসি মেম্বার কেন তার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছেলেকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবেন? নিজে কেন সেই বোর্ডে সভাপতিত্ব করবেন, যে বোর্ড তার মেয়েকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপের জন্য মনোনীত করবে? এ ধরনের অনিয়মের দু-একটিই সংবাদপত্রে ছাপা হয়। অনেকই ছাপা হয় না। কিন্তু যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, তারা অনেকেই জানেন অনিয়মগুলো কোথায় কোথায় হচ্ছে। আর উপাচার্যদের কাহিনী না হয় আরেক দিন বলা যাবে! একজন উপাচার্য তার সব আত্মীয়স্বজনকে অফিসার থেকে শুরু করে পিয়নের চাকরি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে যিনি উপাচার্য হয়ে এলেন, তিনি প্রতিদিন নাস্তার বিল তুললেন সাড়ে সাত হাজার টাকা করে! একজন শিক্ষক যখন দুর্নীতি করেন, দুদক যখন তাকে নোটিশ দেয়, তখন তার কাছ থেকে কী আশা করা যায়!
একজন পুলিশ কর্মকর্তার যদি দুর্নীতির অভিযোগে বিচার হতে পারে, তাহলে ওইসব উপাচার্যদেরও দুর্নীতির অভিযোগে বিচার হওয়া উচিত। আরেকজন উপাচার্য বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩২০ দিনই ঢাকায় থাকেন। রাত বারোটায় তিনি ক্লাস নিয়েছেন এমন অভিযোগও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যকে দুদক নোটিশ ইস্যু করেছে। উপাচার্য হওয়া মানেই নিজের ছেলে, মেয়ে, জামাই সবাইকে চাকরি দেয়া? এই যদি উপাচার্যদের ‘কাহিনী’ হয়, তাহলে শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে কীভাবে? এ জন্যই আমি বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার পক্ষপাতী। ন্যূনতম ‘কনট্রাক্ট বেসিসে’ হলেও শিক্ষক আনা প্রয়োজন। কেননা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাসে যেতে আগ্রহের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষকদের বেতন স্কেল বৃদ্ধি করা সত্ত্বেও, তাদের কেউ কেউ এখনও ক্লাস নিতে অনাগ্রহী। এ জন্যই উচ্চশিক্ষায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।
সরকার উচ্চশিক্ষায় বাজেট বাড়িয়েছে। কিন্তু এ বাজেটের একটা বড় অংশই চলে যাবে বেতন-ভাতায়। সুতরাং আলাদা একটি খাত সৃষ্টি করে সেখানে অর্থ বরাদ্দ করে ওই অর্থ দিয়ে বিদেশি প্রশিক্ষক তথা শিক্ষক আনা যেতে পারে। মোদ্দা কথা, সনাতন শিক্ষার যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এসএসসি ও এইচএসসি লেভেলের পর তরুণ প্রজন্মকে বিশ্ববিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে তাদের ৩-৪ বছরের জন্য টেকনিক্যাল কলেজগুলোয় পাঠিয়ে বিভিন্ন শাখায় দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ওইসব কলেজে প্রয়োজনে বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলো স্ব-উদ্যোগে তাদের প্রশিক্ষকও পাঠাতে পারেন।
এবং গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নেয়ার পর তাদের জন্য কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করতে পারেন তারা। শুধু বাজেটে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ ও শিক্ষিত করে তোলা যাবে না। এ জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কতগুলো সিদ্ধান্ত দ্রুত নেয়া সম্ভব। এক. দ্রুত বিদেশ থেকে মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক আনা। দুই. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি করা। তিন. প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নয় বরং একটি করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখান থেকে শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট বের হবে। চার. সাধারণ শিক্ষার প্রসার না ঘটিয়ে প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রসার ঘটানো। নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজি, কৃষি তথা কৃষি প্রযুক্তির মতো বিষয় চালু করা। পাঁচ. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে প্রতি বিভাগে একটি করে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা এবং ওই বিভাগের সব কলেজকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত করা। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা। ছয়. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্য আলাদা একটি কমিশন গঠন করা, যার মর্যাদা হবে ইউজিসির মতো। একুশ শতকে এসে আমরা এখনও মানসম্মত শিক্ষার কথা বলছি। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার জন্য যা যা করা দরকার, তা আমরা করছি না। শিক্ষামন্ত্রীরা শুধু আশ্বাস দিয়ে যান। কিন্তু শুধু আশ্বাস দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নতুন।
আমলারা এবং দলবাজ শিক্ষকরা তাকে যা বোঝাবেন, তিনি হয়তো তাই করবেন। তাতে করে শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে না। এটা সত্য, জাপানে সম্রাট মেইনি টেননো (১৮৬৭-১৯১২) এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, জাপানি তরুণ প্রজন্মকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হলে বিদেশি প্রশিক্ষক তথা শিক্ষক দরকার। তিনি সেটা করেছিলেন বিধায় জাপান প্রযুক্তি খাতে একটা ‘বিপ্লব’ এনেছিল। চীনের কথাই ধরুন। চীন আজ প্রযুক্তি শিক্ষায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিশাল জনসংখ্যার দেশ চীন। তরুণ প্রজন্মকে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত করে পুরো সমাজ কাঠামোকেই বদলে দিয়েছেন চীনের নেতারা। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই এটা সম্ভব হয়েছে।
আমাদের কথা ধরুন, একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি। জনগোষ্ঠীর মাঝে ১৫-২৪ বছরের জনগোষ্ঠীর হার ১৯.৩৬ ভাগ, আর ২৫-৫৪ বছরের জনগোষ্ঠীর হার ৩৯.৭৩ ভাগ, ৫৫-৬৪ বছরের জনগোষ্ঠীর হার ৬.৯৩ ভাগ, ৬৫ বছরের ওপরে জনগোষ্ঠী ৬.২৩ ভাগ (Bangladesh Demographics Profile)। তাহলে ২৫ থেকে ৫৪ বছরের যে জনগোষ্ঠী এবং ১৫-২৪ বছরের যে জনগোষ্ঠী- এই জনগোষ্ঠীই আমাদের টার্গেট। এদেরই প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। এই দুই প্রজন্ম আমাদের সম্পদ। কিন্তু সার্টিফিকেটসর্বস্ব যে শিক্ষা ব্যবস্থা, তা থেকে যদি বেরিয়ে আসতে না পারি, তাহলে আমরা জাপানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারব না। শিক্ষায় বাজেট বেড়েছে। এতে কোনো লাভ নেই। কিছু লোকের বেতন-ভাতা এতে পরিশোধ হবে। কিন্তু উল্লিখিত দুই প্রজন্ম এ থেকে উপকৃত হবে না, যতদিন না শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা হয়।
DailyJugantor
22.06.2019

অথঃ মিজান-মোয়াজ্জেম সমাচার

ডিআইজি মিজান ও ওসি মোয়াজ্জেম
ডিআইজি মিজান ও ওসি মোয়াজ্জেম। ফাইল ছবি
একজন মিজান, অপরজন মোয়াজ্জেম। এই মিজান-মোয়াজ্জেম কাহিনী এখন শুধু সংবাদপত্রই নয়, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বড় ধরনের ঝড় তুলেছে।
প্রথমজন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নারী নির্যাতন আর নারী কেলেংকারির ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন। তিনি ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন দুদক কর্মকর্তাকে, যারা তার ‘অবৈধ সম্পদের’ তদন্ত করছিল। তিনি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন, তার মাঝে দুদক কর্মকর্তাকে ২৫ লাখ টাকা দিয়েছেন, যাতে রিপোর্টটি ওই কর্মকর্তা তার পক্ষে লেখেন!
একটি টিভি চ্যানেলে একটি অডিও রিপোর্টও প্রকাশ করে, যাতে অভিযুক্ত মিজান দুদক কর্মকর্তা বাছিরকে যে ঘুষ দিতে চেয়েছেন তার কথোপকথন প্রকাশ পেয়েছে। ইতিমধ্যে ওই দুদক কর্মকর্তা ‘তথ্য ফাঁস’ করার অভিযোগে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছেন। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন, ফাঁস হওয়া অডিওতে যে কণ্ঠ রয়েছে তা তার নয়।
মিজান-বাছির ‘কাহিনী’ ছিল গেল সপ্তাহে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এ নিয়ে ‘টকশো’ পর্যন্ত হয়েছে। আমরা জানি না মিজান-বাছির কাহিনী শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে- এ ঘুষ দেয়া ও ঘুষ নেয়ার ঘটনা পুলিশ ও দুদকের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। যদিও দুদকের অনেক ভালো কাজ আমাদের আশাবাদী করেছিল।
মিজানের পাশাপাশি আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা মোয়াজ্জেমের ‘কাহিনী’ও গত সপ্তাহে ব্যাপক আলোচিত ছিল। তিনি ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে গত ৬ এপ্রিল পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ১০ এপ্রিল তিনি মারা যান। ওই সময় সোনাগাজী থানায় নুসরাতের পরিবার মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে ওই সময় থানায় দায়িত্বরত ওসি মোয়াজ্জেম তাকে আপত্তিকর প্রশ্ন করেন এবং তা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ওসির বিরুদ্ধে মামলা হলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ১৬ জুন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
দুই.
মিজান-মোয়াজ্জেমের কাহিনী পুলিশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট করেছে। মিজান কেন ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন কিংবা কেন তিনি অডিওটি ফাঁস করেছেন, তা তিনি নিজে স্বীকারও করেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী তিনি নিজেকে বাঁচাতেই ওই কাজটি করেছেন! এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে আমরা জানি না। কিন্তু পুলিশের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হল, তা কি তিনি একবারও চিন্তা করেছেন? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অবৈধ সম্পদ আহরণের। পুলিশের চাকরিকালীন তিনি কি এই সম্পদ অর্জন করতে পারেন? যে ৪০ লাখ টাকা তিনি ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন তার উৎস কী? নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় সারা জাতি কেঁদেছিল। খোদ প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত এ ঘটনা স্পর্শ করেছিল।
পুলিশের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ। আমার একটা দুর্বল জায়গা হচ্ছে এই পুলিশ বাহিনী। আমার অনেক ছাত্র এখন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা। জাতিসংঘের পুলিশ বাহিনীতে যখন আমার ছাত্রী কমান্ডে থাকে, তখন একটা প্রচণ্ড ভালোলাগা আমাকে স্পর্শ করে। আবার যখন ছোটখাটো দু-একটি ঘটনায় পুলিশের উদাসীনতা ধরা পড়ে, তখন খারাপ লাগে। যখন পরিচিত কোনো পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতির খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়, তখন কষ্ট লাগে বৈকি! পুলিশের ওপর থেকে কি আস্থাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? তাহলে কার কাছে যাব আমরা? কোথায় যাব? কয়েক মাস আগে একটি জাতীয় দৈনিকের নির্বাহী সম্পাদকের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেছিল একজন পুলিশ সার্জেন্ট। তার পরিচয়, জাতীয় পর্যায়ে অবস্থান ও স্বীকৃতির পরও কি একজন সার্জেন্ট এ ধরনের আচরণ করতে পারেন? শেষ অবধি বিষয়টি কোথায় গড়িয়েছিল আমি বলতে পারব না। কেননা আমি ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকাগুলোতে সংবাদটি ছাপা হয়েছিল। আমার নিজের তিনটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। রাতে নাগরিক টিভির টকশো করে ফিরছি। আমি যেখানে বর্তমানে বসবাস করি (উত্তরা ১৮ সেক্টর), সেখানে রাতের বেলা নিরাপত্তার অভাব দেখিয়ে গাড়ি প্রকল্প এলাকায় ঢুকতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। যথারীতি আমাকে ঢুকতে দেয়া হল না। একজন এসআই আমার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করলেন। উত্তরার ডিসিকে বললাম। তিনি বললেন লিখিত দিতে। দিলাম। ডিসি সাহেব আবার বড় অফিসার! আমার বই পড়ে বিসিএস দেয়া ডিসি সাহেবও তার ‘ক্ষমতা’ দেখালেন! আমরা আমজনতা। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কী মূল্য আছে তার কাছে দেখলাম। ওই ঘটনায় কী হয়েছিল শেষ পর্যন্ত জানি না। কিন্তু ডিসি সাহেব প্রয়োজন বোধ করলেন না একজন ‘সিলেকশন গ্রেডে’র প্রফেসরকে ওই ঘটনার ‘ফলোআপ’ জানানোর। একজন প্রফেসরের মূল্য তার কাছে কী? একজন এসআই তার কাছে বড়। আমাদের দুঃখ এখানেই, আমরাই এসব অফিসারকে তৈরি করি।
দ্বিতীয় ঘটনা ওই উত্তরাতেই। আমি প্রতারণার শিকার হলাম। অভিযোগ করলাম। দায়িত্ব দেয়া হল এক পুলিশ কর্মকর্তাকে। তিনি উত্তরা পশ্চিমের জোনাল কর্মকর্তা। তিনি আমাকে জানালেন তার কিছুই করার নেই! অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। মানুষ তো পুলিশের কাছেই ‘সাহায্যের’ জন্য যায়। আমার মতো একজন ব্যক্তিও যদি পুলিশের সাহায্য না পায়, তাহলে সাধারণ মানুষ কী পুলিশের কাছ থেকে সহযোগিতা আশা করতে পারে?
তৃতীয় ঘটনায়ও পুলিশের মুখোমুখি আমি। এবার আমি অভিযুক্ত! আমার গাড়ি ‘আইন অমান্য’ করেছে! ট্রাফিক ভায়োলেশন! চিঠি পাঠিয়েছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। পুলিশের গোপন ক্যামেরা টিম আছে। সেই ক্যামেরায় ধরা পড়েছে আমার গাড়ি ট্রাফিক আইন লংঘন করেছে! সুতরাং ফাইন। গেলাম ট্রাফিক (পশ্চিম) জোন অফিসে। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। ডিসি সাহেব এলেন না। ফাইন দিলাম। দেখলাম পুলিশের নাকের ডগাতেই একটি অসাধু চক্র ব্যাংকের হয়ে এই ‘ফাইন’ সংগ্রহ করছে! পুলিশ কি তাহলে এর অনুমতি দিয়েছে? আমি আইন মেনে চলা নাগরিক। ফাইন দিলাম। যার কাছে জানতে গিয়েছিলাম তিনি উর্দি পরা অফিসার। প্রয়োজনবোধ করলেন না আমার ড্রাইভার কোথায় ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেছেন তা দেখানোর! তার কাছে ভিডিও আছে। বললেন ট্রাফিক আইন ভঙ্গ হয়েছে! তার বক্তব্যই ঠিক। তাকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না- তার ভাষায় আইন ভঙ্গ হয়েছে। তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া অর্থহীন। আমার ইচ্ছে ছিল ট্রাফিকের ডিসি সাহেবকে জিজ্ঞেস করার সন্ধ্যার পর যখন টেকনিক্যাল মোড় থেকে শ্যামলী পর্যন্ত প্রতিদিন দূরপাল্লার গাড়িগুলো রাস্তার দু’পাশে ‘অবৈধ পার্কিং’ করে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি করে রাখে, তখন কোথায় থাকে পুলিশের ওই ক্যামেরা? কোথায় থাকে তখন ট্রাফিক আইন? কথাটা বলতে পারলাম না। কেননা পুলিশের সঙ্গে ‘বিতর্কে’ জড়ানো মানেই বিপদ ডেকে আনা! ওই নির্বাহী সম্পাদক সার্জেন্টের সঙ্গে অযথা ‘বিতর্কে’ জড়িয়ে বিপদ সৃষ্টি করেছিলেন। আমি নিরীহ মানুষ। আমি ডজন ডজন পুলিশ কর্মকর্তা সৃষ্টি করেছি বটে। কিন্তু আস্থার জায়গাটা যেন কেন ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তিন.
যখন মিজান-মোয়াজ্জেম প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছি তখন চোখ আটকে গেল একটি সংবাদে। সংবাদটি ছাপা হয়েছে মানবজমিনে, গত ৭ মার্চ। সংবাদটিতে আছে আইজিপির একটি বক্তব্য। তিনি লক্ষ্মীপুর গিয়েছিলেন চন্দ্রগঞ্জ থানা ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘থানায় কেউ বেড়াতে আসে না, বিপদে পড়ে আসে। হয়রানির শিকার হলে কঠোর ব্যবস্থা।’ এ ধরনের কথাবার্তা আইজি সাহেবরা বলেন। যখন পুলিশের শীর্ষ সম্মেলন হয়, এ ধরনের কথাবার্তা আমরা শুনি। সংবাদপত্রে তা ছাপাও হয়। আইজি সাহেব সত্যি কথাই বলেছেন- মানুষ বিপদে পড়েই পুলিশের কাছে যায়। আমিও গিয়েছিলাম আইজি সাহেব। কিন্তু সাহায্য পাইনি! পুলিশ কর্মকর্তা তো আমাকে জানিয়ে দিলেন তার এই মুহূর্তে করার কিছুই নেই। তাহলে আমি এখন কী করব আইজি সাহেব? আপনি তো আমাদের ছাত্র ছিলেন। একজন এসআই যখন আঙুল উঁচিয়ে আমাকে আমার বাসস্থান এলাকায় ঢুকতে বাধা দেয়, ঘটনাটার বিচার চাইতে কি এখন আপনার কাছে আমাকে যেতে হবে? আপনি কি এবার বিচারের নির্দেশ দেবেন?
চার.
পুলিশের ওপর আস্থাটা রাখতে চাই। পুলিশে সংস্কার প্রয়োজন। একজন মিজান কিংবা একজন মোয়াজ্জেমকে দিয়ে আমরা অবশ্যই সমগ্র পুলিশ বাহিনীকে বিচার করব না। পুলিশের সদস্যদের অনেক ভালো কাজ আছে। পুলিশের অনেক সদস্য দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেছেন এটা যেমন সত্য, তেমনই এটাও সত্য কোনো কোনো পুলিশ সদস্য নিজের জীবনকে বাজি রেখে মানুষকে বাঁচিয়েছেন। দুর্ঘটনায় যাত্রীদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের পা হারিয়েছেন। একটা শিশুকে উদ্ধার করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন।
একজন বেকার বাবা সন্তানের জন্য দুধ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লেও একজন পুলিশ অফিসার তাকে চাকরি জোগাড় করে দিয়েছেন। সব প্রফেশনেই খারাপ লোক থাকে। ভালো লোক থাকে। শিক্ষকতায় সবাই যে ভালো তা তো নয়। আমাদের মাঝেও তো অনেক খারাপ লোক আছে। প্রধানমন্ত্রী গত ১২ জুন সংসদে বলেছেন, পুলিশের কেউ অনিয়ম করলে ছাড় পাবে না (যুগান্তর)। তিনি আরও বলেছেন, ‘ঘুষ যে দেবে আর যে নেবে, উভয়ই অপরাধী।’ এটাই হচ্ছে আসল কথা। একজন মিজান ঘুষ দিতে চেয়েছেন। এটা তার নিজের স্বীকারোক্তি। এটা অপরাধ। আইনে এ ধরনের অপরাধের বিচার হয়। আর যিনি ঘুষ নিয়েছেন, রমনা পার্কে বাজারের ব্যাগে নেয়া ওই টাকার যদি সত্যতা থাকে, সেটাও অপরাধ। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। আমরা দেখতে চাই তদন্ত কমিটি কী সুপারিশ করে।
ওসি মোয়াজ্জেম অন্যায় করেছেন। এক কিশোরীর সঙ্গে তিনি যে আচরণ করেছেন, আইনের লোক হয়ে তিনি সেই আচরণ করতে পারেন না। এজন্যই বলি পুলিশে আরও সংস্কার প্রয়োজন। তাদের আরও প্রশিক্ষণ দরকার। তাদের মানসিকতায়ও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। অন্যায়কে অন্যায় হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে।
অন্যায়কে যদি আমরা ‘চেপে’ রাখি তাহলে আরেকটা অন্যায়ের জন্ম হবে। পুলিশ সদস্যদের মনে রাখতে হবে তারা জনগণের সেবক, তারা শাসক নন। একজন কৃষকও তাদের অর্থের জোগান দেয়।
সাধারণ মানুষের প্রতি সম্মান জানালেই নিজে আরও বেশি সম্মানিত হবেন। একজন বোয়ালখালীর ওসি যখন ঢাকার বসুন্ধরায় ৮ তলা ভবনের মালিক হন (একুশে পত্রিকা), কিংবা যখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, পয়সা দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে কেনা যায় (বাংলা ট্রিবিউন, ১৫ মে), তখন তো আমাকে আশাবাদী করে না। আশাবাদী করে একজন জাহিদুল ইসলামের (এএসপি, খিলগাঁও) ভূমিকায়, যিনি দুধ চুরি করা একজন ‘বাবা’কে দোষী সাব্যস্ত করেননি। আমি আশাবাদী হতে চাই। আমার গর্বের জায়গাটা যেন নষ্ট হয়ে না যায়।
Daily Jugantor
17.06.2019

শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাবে কতটুকু আশাবাদী হতে পারি


অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন গত ১৩ জুন। এটি অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম বাজেট আর আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। প্রস্তাবিত বাজেট চলতি বাজেটের আকার থেকে ১৩ শতাংশ বড়। খাতওয়ারি ব্যয়ের হিসাবে বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে। আগামী অর্থবছরে বাজেটের ১৫.২ শতাংশই এ খাতে ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে শুধু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা এই দুই মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দের পরিমাণ বাজেটের ১০.২৬ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে দেখা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের জন্য ২৯ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এটি নতুন বাজেটের ৫.৬৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ ২৫ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫.৮৫ শতাংশ।

অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়ন ও গুণগত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। দক্ষ শিক্ষকের কথাও বলেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে  তিনি জাপানের একসময়কার সম্রাট মেইজির মতো প্রয়োজনে বিদেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসার কথাও উল্লেখ করেন। অর্থমন্ত্রীর বাজেট ভাবনার দুটি দিক আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এক. তিনি গুণগত শিক্ষার মান বাড়াতে চান। দুই. প্রয়োজনে তিনি বিদেশ থেকে শিক্ষক আনতে চান। শিক্ষার ব্যয় বরাদ্দ বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। সব কিছুতে ব্যয় বেড়েছে। তার সঙ্গে সংগতি রেখে চলতে গেলে শিক্ষায় ব্যয় বরাদ্দ বাড়বে, আমি এতে অবাক হই না। কিন্তু গুণগত শিক্ষার মান নিশ্চিত করব কিভাবে? বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গুণগত মান নিশ্চিত হবে কিভাবে? প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার শিক্ষার, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। কিন্তু শিক্ষার মানের যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। এখানে আমাদের ব্যর্থতা আছে, এটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো। আমরা যোগ্য শিক্ষক তৈরি করতে পারছি না। গুণগত মান নিশ্চিত করার দায়িত্ব যার ওপর, সেই যোগ্য নেতৃত্ব আমরা তৈরি করতে পারিনি। কেন পারিনি, এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় গলদ কোথায়, এটা নিয়ে আমি আলোচনা করব না। কেননা এ ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা কম। আমি মনে করি উচ্চশিক্ষাই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, মাধ্যমিক পর্যায়ে একটা ছাত্রকে আমরা যদি দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে তাকে আমরা উচ্চপর্যায়েও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে পারব না। আর এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু এদিকে কেউ হাত দিচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যাঁরা চালান, তাঁদের অভিজ্ঞতা কম। আমলানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার আমরা জন্ম দিচ্ছি। আমলারা যা করেন, তা অনেকটাই রুটিন ওয়ার্ক। এখানে পরিবর্তন বা সংস্কার আনার কোনো উদ্যোগ নেই। মন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁকে আমলারা সহযোগিতা করবেন না। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা  অনেকটাই বিসিএস বেইসড হয়ে পড়েছে। কী তিনি পড়লেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা সেই শিক্ষা দিয়ে তিনি জাতিকে কতটুকু সমৃদ্ধ করতে পারবেন, এটা তাঁর কাছে কখনোই মুখ্য নয়। তাঁর কাছে মুখ্য বিসিএস পাস করা, একটা সরকারি চাকরি, চাকরির প্রবেশপথেই গাড়ি-বাড়ির সুযোগ ইত্যাদি। সুতরাং অর্থমন্ত্রী গুণগত শিক্ষার মানের কথা যখন বলেন তখন বিসিএসনির্ভর এই শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হবে কিভাবে? আমরা অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই সঙ্গে এক শর ওপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আমরা সার্টিফিকেটসর্বস্ব জাতিতে পরিণত হয়েছি! একখানা সার্টিফিকেট আমাদের দরকার। তারপর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে আমলা! একজন চিকিৎসক কিংবা একজন প্রকৌশলীকে যখন আমি পুলিশের কর্মকর্তা হিসেবে পাই তখন শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আস্থাটা নষ্ট হয়ে যায়। একজন চিকিৎসক কিংবা একজন ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করতে রাষ্ট্র মাথাপিছু একজনের পেছনে কত খরচ করেছে? তিনি চিকিৎসক হয়ে জনগণকে সেবা করবেন। তিনি কেন পুলিশ কর্মকর্তা হবেন? একজন মহিলা জেলা জজের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম। তিনি জজিয়তি ছেড়ে বিসিএস দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হয়েছেন। কেন? আমার এক ভালো ছাত্র। তাকে খণ্ডকালীন শিক্ষকতার সুযোগ দিয়েছিলাম আমার বিভাগে। ইচ্ছা ছিল ও শিক্ষকতায় আসবে। না, সে চলে গেল পুলিশে, বিসিএস দিয়ে। ১০ বছরের চাকরিজীবনে তার একাধিক ফ্ল্যাট, গাড়ি-বাড়ি-জমি হয়েছে। অথচ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনো ঢাকা শহরে বাসে ঘুরে বেড়ান, ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য তাঁর হয়নি। আমার সিনিয়র সহকর্মী ছিলেন অধ্যাপক আউয়াল। শেষ জীবন তাঁর কাটছে বৃদ্ধাশ্রমে। তাঁর কথা তো টিভি চ্যানেলে প্রচারিতও হয়েছে। অর্থমন্ত্রী শিক্ষার গুণগত মানের কথা বলেন। কিন্তু যে শিক্ষাব্যবস্থা বিসিএস পরীক্ষানির্ভর হয়ে যায়, সেখানে দক্ষ জনশক্তি আমরা গড়ব কিভাবে? উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যদি নজরদারি বাড়ানো না হয়, তাহলে অচিরেই উচ্চশিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়বে।
শিক্ষায়, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে গুণগত মান নিশ্চিত করা যাবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে কতগুলো পদক্ষেপ নিতে পারে। ১. তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের নামে শিক্ষকরা এখন নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানে সময় দিচ্ছেন বেশি। নিজ প্রতিষ্ঠানে তিনি যে বেতন পান, অন্য প্রতিষ্ঠানে ‘সময় দিয়ে’ তিনি তার চেয়ে বেশি আয় করেন। সুতরাং আইন করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্য প্রতিষ্ঠানে ‘চাকরি’ করা কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা (যেকোনোভাবে, পার্টটাইম বা কনসালট্যান্ট) নিষিদ্ধ করতে হবে। দুই প্রতিষ্ঠানে কেউ শিক্ষকতা বা চাকরি করতে পারবেন না। আইনটি সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। ২. শিক্ষক নিয়োগে নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। উপাচার্যের ইচ্ছায় বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে—এই প্রবণতা বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অধীনে পিএসসির মডেলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আর শুধু লিখিত পরীক্ষাই নয়, বরং মৌখিক ও ‘ডেমো’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এবং তিনি এক বছর শিক্ষানবিশ থাকবেন। এরপর একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করে স্থায়ী পদে যোগ দেবেন। সরাসরি কাউকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ। এর সত্যতা আছে। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ৩. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এ জন্য নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে তৈরি করতে হবে, যা ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের স্থলাভিষিক্ত হবে। ৪. উপাচার্য নিয়োগে সিনিয়র শিক্ষকদের দিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করতে হবে। ৫. তরুণ শিক্ষকদের বিদেশে পিএইচডি করার জন্য পাঠাতে হবে। এর জন্য ফান্ড তৈরি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নামে এই ফান্ড হতে পারে, সেখানে শীর্ষ ব্যবসায়ীরা অনুদান দেবেন। ৬. পদোন্নতির নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। চাকরির বয়স পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হতে পারবে না। পদোন্নতির জন্য মৌলিক গ্রন্থ এবং পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে। এটা বর্তমানে নেই। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া সহযোগী অধ্যাপক পদেও পদোন্নতি দেওয়া যাবে না। ৭. সিনিয়র অধ্যাপকদের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। এতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপকৃত হবে। ৮. বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গত ১০ বছরে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের কারো কারো বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ রয়েছে। নিজের মেয়েকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পাইয়ে দেওয়া (যে বোর্ডে তিনি নিজে সভাপতিত্ব করেছেন), বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়া সন্তানকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া—এ ধরনের ‘অভিযোগ’ রয়েছে। ইউজিসি শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ করা টাকা বিতরণ করবে—শুধু এ কাজ করাই তাদের মুখ্য কাজ হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান দেখা, পর্যালোচনা করা, সুপারিশ করা ইত্যাদি তাদের কাজের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও এসব ক্ষেত্রে তাদের কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান নয়। ফলে ইউজিসিকে নিয়ে ভাবতে হবে। ৯. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদগুলোতে (সচিব, অ্যাডিশনাল সচিব) সিনিয়র শিক্ষকদের প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। একুশ শতকে এসে কতগুলো বিশেষ মন্ত্রণালয় (শিক্ষা, অর্থ, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র) পরিচালনার ভার বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। ভারতে মোদি সরকার এ কাজ শুরু করেছে। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশে এ ব্যবস্থা আছে। একটি কমিশন গঠন করে সরকার এদের কাছে মতামত চাইতে পারে। ১০. উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘বিদেশি শিক্ষক’ নিয়োগের সিদ্ধান্তটি অবিলম্বে কার্যকর করা উচিত। এতে আমাদের লাভ হবে দুটি—এক. গুণগত মান নিশ্চিত করা, দুই. আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হওয়া। ১১. তরুণ শিক্ষকদের (প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক) জন্য প্রশিক্ষণ জরুরি। এ জন্য একটি প্রশিক্ষণ একাডেমি তৈরি করা যেতে পারে। ১২. উচ্চশিক্ষার স্বার্থে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে প্রতিটি বিভাগে পুরনো কলেজগুলোকে এক কাঠামোর আওতায় এনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। বর্তমান কাঠামোয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি ‘সার্টিফিকেট বিতরণ’ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ক্লাস না করেও ডিগ্রি নেওয়া যায়—এর বড় উদাহরণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিবছরের মতো এবারও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। এ নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু শিক্ষার মান যদি নিশ্চিত না হয়, যদি একুশ শতক উপযোগী একটি তরুণ প্রজন্ম আমরা তৈরি করতে না পারি, তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও আমরা আমাদের লক্ষ্যে কোনো দিনই পৌঁছতে পারব না। শিক্ষা খাতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ শিক্ষার গুণগত মানের কোনো নিশ্চয়তা দেয় না
Daily Kalerkontho
17.06.2019

কেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে হবে

Image result for Sheikh Hasina