গত সোমবার দেশে আবার ‘লকডাউন’ দেওয়া হলেও করোনা নিয়ন্ত্রণে তা তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়ছে। এ ‘লকডাউনে’র সময় অন্তত দুটি ছবি ও সংবাদ আমাদের জানিয়ে দিল ২০২০ সালের করোনাভাইরাস থেকে আমরা আদৌ কোনো শিক্ষা নেইনি। একটি ছবি সম্ভবত ঢাকার মুগদা হাসপাতালের সামনে থেকে তোলা।
এতে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তি শুয়ে আছেন ফ্লোরে, মুখে অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগানো, পাশে আত্মীয়স্বজন। হাসপাতালে কোনো ‘সিট’ খালি নেই। সম্ভবত অপেক্ষা করছেন ‘সিট’ পাওয়ার আশায়। আমি জানি না নাম না জানা ওই ভদ্রলোকের পরিণতি পরে কী হয়েছিল। তিনি তথাকথিত ভিআইপি নন, তাই সংবাদকর্মীরা তার ‘ফলোআপ’ স্টোরি করেননি। গেল বছর ব্রাজিলে আমরা এ ধরনের দৃশ্য দেখেছিলাম। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মানুষ পড়ে আছে রাস্তায়, মৃতদেহগুলো কবর দেওয়ার লোকও পাওয়া যায়নি তখন। আরেকটি ছবি ও সংবাদ সমকালে ছাপা হয়েছে ৬ এপ্রিল। চৌধুরী মহিদুল হকের একটি ছবি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক।
সংবাদের শিরোনাম- ‘আইসিইউ খালি নেই : রাস্তাতেই মৃত্যু হলো সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার’। মহিদুল মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একসঙ্গে পড়েছি। আমাদের বন্ধু। রাতে তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে অক্সিজেন সাপোর্টের জন্য তাকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটেন তার আত্মীয়স্বজনরা। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে বিনা চিকিৎসায় মারা গেল আমাদের মহিদুল। মহিদুল ছিল দেশের শীর্ষ ব্যাংকারদের একজন। প্রচলিত অর্থে ভিআইপি। একজন ভিআইপি হাসপাতালে কোনো ‘সিট’ পেলেন না, প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পেলেন না! এর চেয়ে আর দুঃখজনক কী থাকতে পারে?
এ সংবাদ দুটি অনেক সংবাদের দুটি মাত্র। করোনাভাইরাসের নতুন একটি ‘ধরন’ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আঘাত করেছে। দেশে মৃত্যুর সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। ৯ এপ্রিল মৃত্যুর সংখ্যা ৬৩, আর শনাক্ত ৭৪৬২ জন। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৯৫৮৪ জনের। সরকার ‘লকডাউন’ দিয়ে রাজধানীসহ সিটি করপোরেশনগুলোতে গণপরিবহণ বন্ধ ঘোষণা করলেও গেল বুধবার তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
সরকারের ‘লকডাউন’ ঘোষণা ছিল যৌক্তিক। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন ‘লকডাউন’ ও ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এটা কেউ মানতে চাইছে না। এত মৃত্যুর পরও মানুষের সচেতনতা বাড়েনি। মানুষ কোনো নির্দেশই মানতে চাইছে না। গাদাগাদি করে ফেরিতে যাওয়া যেন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
কোভিড-১৯-এর পেছনে রয়েছে SARS-COV-2 ভাইরাস। শরীরে যদি দীর্ঘস্থায়ী ‘ইমিউন’ সিস্টেম শক্তিশালী হয়, তাহলে তা ভাইরাসের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধকারী শক্তি হিসাবে গড়ে উঠবে। তাই শরীরের ‘ইমিউন’ সিস্টেম শক্তিশালী হলে মৃত্যুহার কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, সংক্রমণ কমাতে ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি কঠোরভাবে পালন করতে হবে। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক জোসেফ উ’র (Joseph Wu) মতে, The future will very much depend on how much social mixing resumes, and what kind of prevention we do (Nature, 5 August 2020)। মহামারির ধরন ও ‘মডেল’ নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের মাঝে জোসেফ উ অন্যতম। তিনি মডেলের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করেছেন কোভিড-১৯ কতদিন পর্যন্ত বজায় থাকবে। তবে করোনাভাইরাসের নতুন নতুন ধরন পৃথিবীতে আসবে এবং ২০২৫ সাল পর্যন্ত তা বিশ্বকে ঝুঁকির মুখে রাখবে। চীন, নিউজিল্যান্ড ও রুয়ান্ডা এ ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পেরেছে। এর কারণ হচ্ছে, ভাইরাসটি যাতে সংক্রমিত হতে না পারে সে জন্য লকডাউনের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ। সেই সঙ্গে ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি তারা কঠোরভাবে মেনে চলেছেন। ফলে মৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পেরেছেন তারা (Nature)। এটাই হচ্ছে আসল কথা। ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই চিত্র ছিল ভিন্ন। সেখানে ‘লকডাউন’ আর সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়নি। ৭ এপ্রিল (২০২১) ব্রাজিলে একদিনেই মারা গেছে চার হাজার মানুষ।
‘সামাজিক দূরত্ব’ আর ‘ঘরে থাকার’ কথা বারবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। ফ্লোরিডা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক Hakan Yilmazkuday তার এক গবেষণায় (Stay-at-Home Works to Fight against Covid-19: International Evidence from Google Mobility Data) দেখিয়েছেন (১৩০টি দেশের তথ্য নিয়ে), সাধারণ মানুষের কম Mobility বা সক্রিয়তা (গ্রোসারি শপ, পার্ক, কাজে কিংবা বাইরে না যাওয়া) দ্বারা করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেশও অনেকটা তেমনই-ঘরে থাকা, বাড়িতে বসে কাজ করা, বেশি মানুষের সংস্পর্শে না যাওয়া। নিউইয়র্কে বেশি মানুষের মৃত্যুর (বাঙালিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) কারণ ছিল একটাই-সেখানে প্রচুর মানুষ বাস করে এবং মানুষের মাঝে ‘মোবিলিটি’ বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা এর ব্যাখ্যা কী দেব? পোশাক শিল্প মালিকদের ‘অর্ডার বাতিল’ হওয়ার অজুহাতে গত বছর হাজার হাজার মানুষকে প্রথমবার ঢাকায় আনা এবং দ্বিতীয়বার পোশাক শিল্প চালু রাখা, গাদাগাদি করে ফেরিতে পার হওয়া এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে বিদেশফেরতদের নজরদারিতে না রাখা ইত্যাদি পরিস্থিতিকে খারাপের দিকে নিয়ে যায়। সম্ভবত বাংলাদেশ ‘হার্ড ইমিউনিটির’ দিকে গিয়েছিল! অর্থাৎ বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রাকৃতিকভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউনিটি) গড়ে তোলা যায় কিনা, তা নিয়ে কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে বাংলাদেশ। এতে প্রথমবার সফলও হয়েছে। তবে সব দেশ এ ‘হার্ড ইমিউনিটিতে’ গেছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। যেমন সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুর ‘হার্ড ইমিউনিটি’র প্রস্তাব বাতিল করেছিল। এ জন্য ‘সামাজিক দূরত্ব’ মেনে চলার বিষয়টি যথেষ্ট কার্যকর। তাই Medical News Today-তে ড. মারিয়া কোহুট (Maria Cohut) তার প্রবন্ধে (Why social distancing is key in containing the new coronavirus, March 24, 2020) সামাজিক দূরত্বের ব্যাপারে তার যুক্তি তুলে ধরেছেন। একই বিষয়ে Nature Communications-এ একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখেছেন Michael te Vrugt, Jens Bickmann এবং Raphael Wittkowski (Effects or social distancing and isolation on epidemic spreading model via dynamical density functional theory, 4 November 2020)। তাদের মন্তব্য- 'Controlling the spread of infections, such as the Plague or the Spanish flu, has been an important topic throughout history'। তারা মিথ্যা বলেননি, ইতিহাস তাই বলে-মহামারি বারবার ফিরে আসে। স্প্যানিশ ফ্লুর কথা আমরা জানি। স্প্যানিশ ফ্লু স্থায়ী হয়েছিল ১৯১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, ৩৬ মাস। ওই সময় ৫০ কোটি মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছিল, যা ছিল ওই সময়ে বিশ্বের জনগোষ্ঠীর প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। মৃত্যুর সংখ্যা ধরা হয় ১৭ মিলিয়ন থেকে ৫০ মিলিয়ন। বলা হয়, সমসাময়িককালের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারি ছিল সেটি। এর ১০০ বছর আগে অটোমান সাম্রাজ্যের সময় ১৮১২-১৮১৯ সময়সীমায় প্লেগে মারা গিয়েছিল ৩ লাখ মানুষ। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ১৯৫৭-১৯৫৮ সালে এশিয়ার ফ্লু’র কথাও আমরা জানি, যখন বিশ্বব্যাপী এ মহামারি ইনফ্লুয়েঞ্জায় (এইচ২এন২) মারা গিয়েছিল ১ থেকে ৪ মিলিয়ন মানুষ। ২০০৯-২০১০ সালে আরেক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জার (এইচ১এন১) খবরও আমরা জানি, যা মহামারি আকারে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তাতে মারা গিয়েছিল ৫ লাখের উপর মানুষ। এর অর্থ হচ্ছে, প্রকৃতিতে এ ধরনের ভাইরাস বারবার ফিরে আসে। কিন্তু এবারের করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ব্যতিক্রমধর্মী, ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে।
এ কারণে কয়েকটি বিষয় আমাদের বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। এক. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনাভাইরাস পুরোপুরি নির্মূল হবে না (আল জাজিরা); অর্থাৎ সাময়িকভাবে এ ভাইরাসটি ‘নিয়ন্ত্রণে’ এলেও তা থেকে যাবে এবং ফিরে আসবে। যেমন উহানে (চীন) আবার ফিরে এসেছিল। দুই. ব্লুমবার্গ গবেষকদের মতে, ‘করোনাভাইরাসের পরবর্তী সংকট তৈরি হবে ব্যাপক আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে (The Next Covid Crisis could be a wave of suicides, May 8, 2020)। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মানুষ আত্মহত্যা করবে, যাকে ব্লুমবার্গ বলছে ‘death of despair’। তিন. করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী ২৬ কোটি মানুষ ক্ষুধার কারণে মারা যেতে পারে (PBS News, April 22, 2020)। এ বক্তব্য বিশ্ব খাদ্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলের। সুতরাং করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্য দিয়ে যে সংকট শুরু হয়েছে, তা দ্রুত শেষ হয়ে যাবে মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিতে হবে। সেই প্রস্তুতি বাংলাদেশ কতটুকু নিতে পেরেছে, আমি নিশ্চিত নই। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউ যখন ইউরোপে আঘাত করেছে, তখন আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত তারা কতটুকু সচেতন ছিলেন, আমি হলফ করে তা বলতে পারব না। উচিত ছিল গত এক বছরে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা। আমরা তা করতে পারিনি। এ কারণে ঢাকার হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে। উচিত ছিল প্রতিটি হাসপাতালে আইসিইউ বেড বাড়ানো এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। তা হয়েছে বলে মনে হয় না। আমাদের বিশেষায়িত রোগের জন্য চিকিৎসক, দক্ষ নার্স ও টেকনিশিয়ান দরকার। হাসপাতালগুলোতে ‘ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ’ বাড়ানো দরকার। চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনা জরুরি ছিল, আমরা তা করিনি। চীন প্রশিক্ষণের ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করবে বলে জানিয়েছিল। এ ব্যাপারে খুব একটা অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না। বিষয়টিকে আমরা সিরিয়াসলি নেইনি।
ঢাকায় আরও হাসপাতাল দরকার। উত্তরায় বিশাল এলাকা পড়ে রয়েছে। এখানে বিএসএমএমইউ’র মতো একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায়। পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত জেল এলাকায়ও একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা যায়। আসলে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা দরকার। আরও একটা কথা-কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য কিছু বিশেষ হাসপাতাল নির্দিষ্ট না করে প্রতিটি হাসপাতালেই করোনা রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। একজন সাধারণ রোগী আইসিইউ বেডের অভাবে জরুরি বিভাগের বারান্দায় অথবা রাস্তায় পড়ে থাকবেন, একজন শীর্ষ ব্যাংক কর্মকর্তা চিকিৎসার জন্য, অক্সিজেনের জন্য এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে যাওয়ার পথে রাস্তায়ই মারা যাবেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা নিশ্চয়ই এটা প্রত্যাশা করি না।
করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে গেল। জানি না এ থেকে আমরা কতটুকু শিখব।
Jugantor
11.4.2021
Prof Dr Tareque Shamsur Rehman
In his Office at UGC Bangladesh
Prof Rahman With US Congressman Joseph Crowley
here you go!!!
Prof Dr Tareque Shamsur Rahman
During his stay in Germany
Prof Dr Tareque Shamsur Rahman
At Fatih University, Turkey during his recent visit.
Prof Dr Tareque Shamsur Rehman
In front of an Ethnic Mud House in Mexico
দৃষ্টি এখন পশ্চিমবঙ্গের দিকে
23:16
1 comment
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন নিয়ে ভারতব্যাপী আলোচনা এখন তুঙ্গে। এ নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন হচ্ছে নন্দীগ্রাম। মমতা ব্যানার্জি এ আসনের প্রার্থী। তার প্রতিদ্বন্দ্বী শুভেন্দু অধিকারী, যিনি এক সময় মমতার কাছের মানুষ ছিলেন, কিন্তু এখন দলবদল করে চলে গেছেন বিজেপিতে। ফলে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি তো বটেই, দিল্লিও এখন সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে শুভেন্দুকে জিতিয়ে আনতে। এ কারণেই মোদি থেকে শুরু করে অমিত শাহ নাড্ডা (বিজেপি সভাপতি) পর্যন্ত ছুটে গেছেন নন্দীগ্রামে। বিজেপির জন্য এটি একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে তৃণমূলকে হারানো চাট্টিখানি কথা নয়। এটা তৃণমূলের সিট। ২০১৬ সালের বিধানসভার নির্বাচনে এ আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী।
তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সিপিআই প্রার্থী আবদুল কবির শেখ। ভোটের পার্থক্য ছিল ৮১ হাজারের উপরে। ওই সময় বিজেপিও প্রার্থী দিয়েছিল (বিজন কুমার দাস)। তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ১০ হাজার ভোট। ২০১১ সালের বিধানসভার নির্বাচনেও তৃণমূল প্রার্থী ফিরোজা বিবি বিজয়ী হয়েছিলেন। ২০০১ ও ২০০৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল সিপিআই। এর আগে এ আসন ছিল কংগ্রেসের। কিন্তু এবারের দৃশ্যপট ভিন্ন। আগেই বলা হয়েছে, তৃণমূলের সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি এবার প্রার্থী। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তারই এক সময়ের শিষ্য শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে। যদিও ধরে নেওয়া হচ্ছে, মমতাই শেষ পর্যন্ত এ আসনে বিজয়ী হবেন। গত ১ এপ্রিল এখানে নির্বাচন হয়ে গেল। এ আসনের নির্বাচন নিয়ে ‘জল’ কম ঘোলা হয়নি। জনসভায় যোগ দিতে গিয়ে পায়ে আঘাত পান মমতা। পায়ে প্লাস্টার নিয়ে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। তিনি অভিযোগ করেন, বিজেপির বহিরাগত গুণ্ডারা তাকে আঘাত করেছে। যদিও প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে সমর্থকদের চাপে গাড়ির দরজা লাগাতে গিয়ে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। এ নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। খোদ অমিত শাহ পর্যন্ত এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন।
বলা ভালো, গত ২৭ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন শুরু হয়েছে। প্রথম দফায় ৩০ আসনে এবং ১ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায়ও ভোট হয়েছে ৩০ আসনে। ছয় পর্যায়ে ভোট শেষ হবে ২৯ এপ্রিল। ফলাফল জানা যাবে ২ মে। ইতোমধ্যে নন্দীগ্রামের নির্বাচন নিয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে। মমতা ব্যানার্জিকে ‘বেগম’ হিসাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। সেখানে সংঘর্ষ হয়েছে। মানুষ মারা গেছে। মমতা নিজে অভিযোগ করেছেন, ভোটকেন্দ্র দখল করে ‘সিল’ মারা হয়েছে ব্যালটে। মোদি ঘোষণা করেছেন, মমতার দিন শেষ। আর শুভেন্দু বলেছেন, তিনি নন্দীগ্রামে বিজয়ী হয়েছেন এবং মমতা ব্যানার্জি ২ মে পদত্যাগ করবেন। নন্দীগ্রামের পরিস্থিতিই বলে দেয় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিরোধ, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
নন্দীগ্রাম হচ্ছে এমন একটি এলাকা, যা আজ থেকে ১০ বছর আগে বদলে দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি, সেই সঙ্গে ভারতের রাজনীতিও। ২০১১ সালে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে অবিসংবাদিত নেত্রীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ছোটখাটো একজন মানুষ, অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করা একজন মানুষ মমতা ব্যানার্জির ‘রাজনৈতিকভাবেই’ জন্ম হয়েছিল এ নন্দীগ্রামে। বলতে দ্বিধা নেই, পশ্চিমবঙ্গের বাম শাসনের বিরুদ্ধে একাকী লড়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ২০০৬ সালে হুগলির সিন্দুরে মোটর কারখানা গড়ার বিরুদ্ধে তিনি কৃষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে কৃষি জমি অধিগ্রহণ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ২০০৭ সালে এ নন্দীগ্রামে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যখন কৃষি জমিতে কেমিক্যাল কারখানা প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন তিনি এর প্রতিবাদ করে সেখানে কৃষকদের সংগঠিত করেছিলেন। নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি চালিয়ে ১৪ জন কৃষককে হত্যা করেছিল। তিনি দীর্ঘ ২৬ দিন সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের ঘটনার প্রতিবাদে অনশন পর্যন্ত করেছিলেন। ‘আজীবন প্রতিবাদী’ ও ‘পাশের বাড়ির মেয়েটি’র মতো মমতা ব্যানার্জি একটি ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। এ রাজ্যের মানুষ মমতা ও তৃণমূল কংগ্রেসের মাঝে সিপিআই (এম)-এর বিকল্প একটি ‘শক্তি’ খুঁজে পেয়েছিল।
তার রাজনীতিতে উত্থান কংগ্রেসের রাজনীতির মধ্য দিয়ে। তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতি। কিন্তু কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গেও তিনি থাকতে পারেননি। কংগ্রেসের সঙ্গে দীর্ঘ ২৬ বছরের সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস। যদিও এখন অবধি তৃণমূল কংগ্রেস সর্বভারতীয় একটি জাতীয় দল হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি। ৫৪৩ আসনের লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের আসন (কংগ্রেসের মাত্র ৫২) ২০, আর ২৪৫টি রাজ্যসভার আসনে তৃণমূলের আসন ১২। লোকসভায় ২০১৪ সালে দলটির আসন ছিল ৩৪। এর মধ্য দিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মমতা ব্যানার্জি তার প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছিলেন। ২০১১ সালে তিনি যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন, তখন কিন্তু তিনি বিধানসভার সদস্য ছিলেন না। ছিলেন কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী। সেখান থেকে পদত্যাগ করে তিনি ছয় মাসের মধ্যে বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজয়ী হন। তৃণমূল গঠিত হওয়ার পর দলটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেই নিজেদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রেখেছে। পরিসংখ্যান বলে, ২০০১ সালে বিধানসভায় তৃণমূলের আসন ছিল ৬০ (মোট আসন ২৯৪), ২০০৬ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩০-এ। কিন্তু দৃশ্যপট বদলে যায় ২০১১ সালে, যখন তৃণমূল ১৮৪ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ২০১৬ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ২১১ আসন।
কিন্তু ২০২১ সালে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। বিজেপি মরিয়া হয়ে উঠেছে তৃণমূলকে পরাজিত করতে। তাই বিজেপির শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন এবং এখনও নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, মিঠুন চক্রবর্তী এবং ফিল্মের অনেক নায়ক-নায়িকাকে ভিড় করিয়েছে বিজেপি। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় ছিল মিঠুন চক্রবর্তীর বিজেপিতে যোগদান। মোদির উপস্থিতিতে কলকাতার প্যারেড গ্রাউন্ডে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মিঠুন চক্রবর্তী বিজেপিতে যোগ দেন। এক সময় স্বঘোষিত নকশাল, পরবর্তী সময়ে বাম রাজনীতির সমর্থক এবং এক সময় তৃণমূলে যোগ দিয়ে রাজ্যসভার সদস্য- সেই মিঠুনই কিনা সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপিতে যোগদান করলেন নির্বাচনের আগে, এটা ছিল অবাক করার মতো ঘটনা। তখন থেকেই মিঠুনকে নিয়ে গুজবের ডালপালা গজাতে থাকে। এমন কথাও বলা হয়, মিঠুন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী! কিন্তু প্রার্থী তালিকায় তার নাম না থাকায় জল্পনা-কল্পনা থেমে যায়। মিঠুনের বিজেপিতে যোগদানের পর যতগুলো টিভি সাক্ষাৎকার দেখেছি, প্রতিটিতে বলেছেন তিনি রাজনীতি করেন না। মমতা ব্যানার্জি এখনও তার বোন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থে তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন এবং একটি পরিবর্তন তিনি চাচ্ছেন। তবে এটা ঠিক, মমতা সম্পর্কে তিনি কোনো খারাপ মন্তব্য করেননি। শুধু মিঠুন চক্রবর্তী কেন, তৃণমূলের অনেক নেতা, বর্তমান ও সাবেক বিধানসভার সদস্য বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন এবং নির্বাচন করছেন। এখানে রাজনীতির চেয়ে এক ধরনের সুবিধাবাদ কাজ করছে। বর্তমানে এ সুবিধাবাদের প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। সমাজে যারা বিশিষ্ট ব্যক্তি, ক্রীড়াঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তি, তাদের সবাইকে মোদি-অমিত শাহ জুটি চাচ্ছেন বিজেপির ব্যানারে নিয়ে আসতে। অতীতে ছবিপাড়ার ব্যক্তিরা এভাবে গণহারে রাজনীতিতে আসেননি। ‘দিদি’ অর্থাৎ মমতা ব্যানার্জি প্রথম তাদের অনেককে তৃণমূলের ব্যানারে নিয়ে আসেন। মোদি-অমিত শাহরা একই পথে গেছেন।
তবে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে নতুন একটি ‘শক্তি’র উত্থান ঘটেছে; আর তা হচ্ছে হুগলির ফুরফুরা শরীফের পীরের ছেলে আব্বাস সিদ্দিকীর নেতৃত্বে নতুন একটি ‘ফ্রন্ট’-‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টে’র (আইএসএফ) আত্মপ্রকাশ। আইএসএফ ইতোমধ্যে কংগ্রেস ও বামদের (সিপিআই-সিপিএম) সঙ্গে এক ধরনের নির্বাচনী আঁতাত করেছে। যদিও প্রার্থী মনোনয়নের প্রশ্নে তাদের মাঝে দ্বিমত রয়ে গেছে। আব্বাস সিদ্দিকী পীরের বংশধর, তার একটি ব্যাপক আবেদন আছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। প্যারেড গ্রাউন্ডের (কলকাতা) অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতা মানুষ শুনেছে। ৯ কোটি ১২ লাখ মানুষের বাস পশ্চিমবঙ্গে। এর মধ্যে ৬ কোটি ৪ লাখ (শতকরা ৭০ দশমিক ৫৪ ভাগ) মানুষ সনাতন ধর্মাবলম্বী। আর ২ কোটি ৪ লাখ, অর্থাৎ জনগোষ্ঠীর ২৭ ভাগ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। মুসলমানরা সবাই যে আইএসএফকে সমর্থন করবে, এর কোনো গ্যারান্টি নেই। অনেক মুসলমান তৃণমূলের সমর্থক।
তবে আব্বাস সিদ্দিকীর উত্থান নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মমতা ব্যানার্জি অভিযোগ করেছেন, এ ফ্রন্ট বিজেপির ‘দ্বিতীয় ফ্রন্ট’ হিসাবে কাজ করবে। আইএসএফ-কংগ্রেস-বাম ‘ঐক্য’ নিঃসন্দেহে একটি ‘শক্তি’। নির্বাচনে তাদের বড় প্রভাব না থাকলেও তারা ভোট কাটবে তৃণমূলের। মমতা ব্যানার্জির রাজনীতির একটি ব্যর্থতা এখানেই যে, তিনি সাম্প্রদায়িকবিরোধী এ তিন শক্তির সঙ্গে কোনো ‘ঐক্য’ করতে পারেননি। এর অর্থ হচ্ছে, এই তিন শক্তি যেখানেই নির্বাচন করবে, সেখানেই ভোট কাটবে তৃণমূলের। আর তাতে করে লাভবান হবে বিজেপি। ২৯৪ আসনের বিধানসভার নির্বাচনে সরকার গঠন করার জন্য দরকার ১৪৮ আসন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিধানসভার আসন বিন্যাস ছিল এরূপ : তৃণমূল কংগ্রেস ২১১ আসন, বিজেপি ৩৫, কংগ্রেস ২৩, সিপিআই(এম) ১৯, রেভ্যুলেশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি ২, ফরোয়ার্ড ব্লক ২, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চ্চা ২, নিরপেক্ষ ১। তৃণমূলের সঙ্গে আছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চ্চা। বিজেপি বিরোধী দলে নেই। কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট (মোট আসন ৪৬) বিরোধী দল বা ফ্রন্ট হিসাবে স্বীকৃত। এ আসন বিন্যাসে এখন পরিবর্তন আসবে। ধারণা করা হচ্ছে তৃণমূলের আসন কমবে, আর বিজেপির আসন বাড়বে। তবে বিজেপি সরকার গঠন করতে পারবে না। এটাই পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
তবে এটা বলতেই হবে, মোদির জন্য পশ্চিমবঙ্গের এ নির্বাচন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপি সরকার গঠন করতে না পারলেও মমতা ব্যানার্জি একটা ‘চাপে’ থাকবেন। বিধানসভায় বিজেপির আসন বাড়লে এবং দলটি প্রধান বিরোধী দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলে মমতা ব্যানার্জির পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়ত, ২০২৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে ভারতে লোকসভার নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গের এ নির্বাচনের ফলাফল লোকসভা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। তৃতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনের আগে মমতা ব্যানার্জি সর্বভারতীয় অবিজেপি নেতা-নেত্রীকে এক মঞ্চে থাকার জন্য একটি পত্র লিখেছিলেন। মমতার অভিযোগ, বিজেপি ভারতে একদলীয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। বিধানসভার নির্বাচনের পর এক মঞ্চ গড়ার প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হতে পারে। চতুর্থত, তৃণমূল বিজয়ী হলে তিস্তা চুক্তির সম্ভাবনা আরও পিছিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে চীনা অর্থায়নে তিস্তা পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প
বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প কিছু থাকবে না। তাই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।
Jugantor
4.4.2021
সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ : যেতে হবে অনেক দূর
20:11
1 comment
বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পালন করছে। স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তী পালন উপলক্ষে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ নেতা বাংলাদেশ সফর করে গেছেন এবং বাংলাদেশের প্রশংসা করে গেছেন। বাংলাদেশ যখন তার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে, তখন World Happiness report 2021 প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যায় বিশ্বের সুখী দেশের তালিকায় (মোট ১৪৯ দেশ) বাংলাদেশের অবস্থান ১০১।
অথচ ভারতের অবস্থান (১৩৯)। অর্থাৎ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষ বেশি সুখী! বলা ভালো, সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যান্ড। UN Sustainable Development Solution Networkএই তালিকা প্রণয়ন করেছে।
বাংলাদেশের মানুষ অনেক সমস্যায় রয়েছে। দুর্নীতি, ব্যাংকের টাকা লুট, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন পিয়নের কাছে যখন অবৈধ শতকোটি টাকা থাকে, তখন এসব নেতিবাচক সংবাদের পাশে বাংলাদেশের মানুষ ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের চেয়েও সুখীএমন একটা ভালো সংবাদ শুনতে ভালোই লাগে। ভালো সংবাদ আরও আছে২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে বিশে^র ২৫তম অর্থনীতির দেশ। ওই সময়সীমায় বিশ্ব অর্থনীতিতে পাকিস্তানের অবস্থান হবে ৩৬, শ্রীলঙ্কার ৬৭, নেপালের ৯৫, আফগানিস্তানের ১২৯, মালদ্বীপের ১৫০, আর ভুটানের অবস্থান হবে ১৬৪। অর্থাৎ ওই সময় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান হবে ভারতের পর দ্বিতীয়।
এটা আমাদের জন্য বড় অর্জন। সুবর্ণজয়ন্তীতে (২০২১) বিশ^ অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম, পাকিস্তান ৪৮, আর ভারতের ৬। বাংলাদেশকে এ অবস্থান ধরে রাখতে হবে, যেতে হবে অনেক দূর।
স্বাধীনতার পরপরই কিসিঞ্জার যে দেশটিকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে, সেই দেশটি চলতি ২০২১ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সব বাধা অতিক্রম করবে। উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি আসবে ২০২৬ সালে। এটা নিঃসন্দেহে একটা মর্যাদার বিষয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক দিয়ে অনেক দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এখন সামনের কাতারে। ১৯৭৪ সালে দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ যেখানে ছিল মাত্র ৪২.৫ মিলিয়ন ডলার (CEYTC Data.com), সেখানে ফেব্রুয়ারি (২০২১) মাসে এসে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। অথচ পাকিস্তানের রিজার্ভের পরিমাণ ২০.৫১২ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্ধেকেরও কম। যদিও ভারতের রিজার্ভের পরিমাণ অনেক বেশি, ৫৮১ বিলিয়ন ডলার। গেল ১০ বছরে রিজার্ভের পরিমাণ শতকরা ৪৪১ ভাগ হারে বেড়েছে। বাংলাদেশের যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে ১১ মাসের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যে জনসংখ্যা ছিল, গেল ৫০ বছরে তা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, যেখানে ১৯৭২-৭৩ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার, ২০১৯-২০ সালে তা বেড়েছে ২০৭৯ ডলারে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যেখানে ছিল শতকরা ২.৭৫ ভাগ (১৯৭২-৭৩), সেখানে ২০১৮-১৯ সময়সীমায় উন্নীত হয়েছিল শতকরা ৮.১৫ ভাগে। তবে করোনাকালে পৃথিবীর সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও শ্লথগতি আসে। এডিবির মতে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালে প্রাক্কলন করা হয়েছিল শতকরা ৫.২ ভাগ, আর ২০২১ সালে শতকরা ৬.৮ ভাগ। অথচ এডিবিই বলছে ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ভারতে মাইনাস শতকরা ৯ ভাগ, শ্রীলঙ্কায় মাইনাস শতকরা ৫.৫ ভাগ, আফগানিস্তানে মাইনাস শতকরা ৫ ভাগ, আর পাকিস্তানে মাইনাস শতকরা ০.৪ ভাগ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি শতকরা ৫.২ ভাগ বলে দেয় করোনাকালেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে ছিল।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে আরও কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে আমরা বোঝাতে পারব আমাদের অর্জন গেল ৫০ বছরে অনেক দেশের চেয়ে বেশি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতি ছিল শতকরা ৪.৭ ভাগ, ডলারপ্রতি বিনিময় মূল্য ছিল ৭.৩০ টাকা, রপ্তানি আয় ছিল ৩৩ কোটি টাকা, আমদানিব্যয় ছিল ২৮.৭৩ টাকা, রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ০.৮৩ কোটি ডলার, সেখানে প্রায় ৫০ বছরের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি শতকরা ৫.৫ ভাগে, ৮৬ টাকা ডলার প্রতি মূল্য, রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৬০০ কোটি ডলারে, আবার আমদানিব্যয়ও বেড়েছে ৫৪০০ কোটি ডলারে। রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেড়েছে ৪৫০০ কোটি ডলারে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দুই বা তিনটি পক্ষের ওপর নির্ভরশীল ছিল আমাদের রপ্তানি খাত। বিশেষ করে পাটজাত দ্রব্য, চা ও চামড়া চামড়াজাত পণ্যের বদলে এখন স্থান করে নিয়েছে তৈরি পোশাক ও জনশক্তি। ওষুধশিল্পও বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর তথ্য মতে (২০১৯-২০) বাংলাদেশ ১১৮টি দেশে বাংলাদেশ তৈরি ওষুধ রপ্তানি করেছে। স্বাধীনতার আগে আমাদের খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল কমবেশি এক কোটি টন। তখন লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সর্বশেষ তথ্য বলছে, আমাদের মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে চার কোটি টন। উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে চার গুণেরও বেশি। এর মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছি।
গত ৫০ বছরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবা খাতে যেসব উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তার একটি চিত্র আমরা পাব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স এইচডিআই-এ (ইউএনডিপি কর্তৃক প্রণীত)। কোনো কোনো ক্ষেত্রে (শিশুশিক্ষা, মাতৃমৃত্যু) আমাদের অগ্রগতি ভারতের চেয়েও ভালো এ কথা স্বীকার করেছেন স্বয়ং অমর্ত্য সেন। প্রাপ্ত তথ্য মতে এইচডিআই সূচকে ২০০০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫, সেখানে ২০১৭ সালে তা উন্নীত হয় শূন্য দশমিক ৬১-এ। ২০১৯ সালে অবস্থান ছিল ০.৬৩-এ। প্রথম অবস্থান নরওয়ের (০.৯৫৭)। ভারতের স্কোর (০.৬৪৫, ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৩১, আর বাংলাদেশের ১৩৩)। প্রাথমিক শিক্ষায় নিট ভর্তির সংখ্যা এখন শতকরা ৯৭.৯ ভাগ। মাতৃমৃত্যুর হার এখন মাত্র শতকরা ১৬.৫ ভাগ। ৭০ বছরের ওপরের বয়স্ক নাগরিকদের সাক্ষরতার হার এখন শত ভাগ। ২০০৬ সালে গড় আয়ুষ্কাল যেখানে ছিল ৬৪.৪, ২০১৯ সালে তা বেড়েছে শতকরা ৭২.৪ ভাগে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০.৫-এ কমে এলেও (বিবিএস রিপোর্ট), করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম-এর গবেষণা অনুযায়ী সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে এখন ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
টেকসই প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশ (জিএসসিআই-২০২০) ১৭ ধাপ এগিয়ে (১৮০ দেশের মধ্যে ১১৫তম, বাংলাদেশের স্কোর ৪৩.৩, ভারতের অবস্থান ১২৭তম, অর্থাৎ ভারত পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের চেয়ে) গেলেও বৈষম্য গত ৫০ বছরে আমরা দূর করতে পারিনি। বৈষম্য মাপা হয় ‘গিনি সহগ’ দিয়ে। ২০১৬ সালে আমাদের ‘গিনি সহগ’ ছিল শূন্য দশমিক ৪৮৩। শূন্য দশমিক ৫ হলেই অতি উচ্চবৈষম্যের দেশ হয়ে যায়। মাথাপিছু ঋণের বোঝা বাড়ছে এটা আমরা কমাতে পারিনি। ২০১৫ সালের শেষ দিকে মাথাপিছু ঋণ ছিল ১৩ হাজার ১৬০ টাকা, এখন তার পরিমাণ অর্থনীতি সমিতির মতে প্রায় ৭৯ হাজার টাকা। সাম্প্রতিককালে আমাদের অর্থনীতির জন্য দুটো খারাপ খবর এক. বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার, আর দুই. খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি। ২০২০ সালে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা (যুগান্তর, ৬ ডিসেম্বর ২০২০)।
বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি গত ৫০ বছরে একেবারে কম নয়। বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ তার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বহির্বিশে^ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও চীনের সম্পর্ক বেশি করে আলোচিত হয়েছে। এটা ঠিক গত ১২ বছরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর (২০১৬) ও প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর (২০১৪) এবং চীন কর্তৃক শতকরা ৯৭ ভাগ বাংলাদেশি পণ্যের চীনে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার (২০২০) চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও জোরদার করেছে। বাংলাদেশ অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে একটি ‘ভারসাম্যমূলক’ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিন যে সমুদ্রসীমানা বিরোধ ছিল, তা বাংলাদেশ (২০১২) অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সমাধান করেছে। ভারতের সঙ্গে সীমান্তে বিরোধেরও সমাধান হয়েছে। তবে তিস্তার পানিবণ্টনের সমাধান না হওয়া এবং ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আশ্রয়, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের সব অর্জনকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দেয়। এশীয়-প্যাসিফিক অঞ্চল ক্রমান্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে আগামী দিনে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়বে।
বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তী পালন করে এখন হীরকজয়ন্তী (৬০ বছর) পালনে একধাপ এগিয়ে গেল। সামনে রয়েছে প্লাটিনামজয়ন্তী (৭৫), তারপর শতবর্ষজয়ন্তী। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। তবে বলতেই হবে আমাদের সব অর্জন মøান হয়ে যাবে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হয়। এটাই এ মুহূর্তের অগ্রাধিকার। এখন থেকেই আমাদের দীর্ঘ পরিকল্পনা করা প্রয়োজন, কীভাবে আমরা হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে সমস্যাগুলো ও যুগের চাহিদা মোকাবিলা করব। বিশ^ এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর গুরুত্ব ও চাহিদা বাড়ছে। ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসার বেড়েছে। কভিড-১৯-এর কারণে সারা বিশ^ যখন স্থবির হয়ে গেল, তখন ইন্টারনেটের দুনিয়া একটা বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করল। ইন্টারনেট পুরো ব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা আমেরিকায় ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারব। শিল্পে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর চাহিদা বেড়েছে। এই প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি আমাদের গড়ে তুলতে হবে। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম ঢেলে সাজাতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে।
Generation Z, বা যারা তরুণ প্রজন্ম, তাদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সনাতন সিলেবাসের পরিবর্তে প্রযুক্তি তথা আইটিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এটা করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা পিছিয়ে পড়ব। আমাদের আছে এক তরুণ প্রজন্ম। এরা আমাদের শক্তি। এই শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। এজন্য দরকার যোগ্য নেতৃত্ব। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে অদক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করার চেয়ে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে দরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব। উপাচার্যদের নানা কাহিনী আমাদের আহত করে। দলীয় বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ না দিয়ে যোগ্য ও মেধাবী নেতৃত্ব যদি শিক্ষা ক্ষেত্রে আনা না যায়, তাহলে হীরকজয়ন্তীতে আমরা জাতিকে কোনো ভালো খবর শোনাতে পারব না।
সুবর্ণজয়ন্তীতে এটাই আমাদের শিক্ষা আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে একটা ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে বিশে্ব পরিচিত করতে প্রস্তুতিটা নিতে হবে এখন থেকেই।
Desh Tupsntor
29.3.2021
মোদির বাংলাদেশ সফর ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
20:07
No comments
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৬ মার্চ বাংলাদেশে এসেছেন। ২৭ মার্চ চলে গেছেন। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেন। মোদির এই সফর একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত। ১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ভারতের একজন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রমাণ করল বাংলাদেশকে তারা কত গুরুত্ব দেয়। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে মোদির যোগদান প্রমাণ করল ভারত বঙ্গবন্ধুকে কোন দৃষ্টিতে দেখে। মোদি এক টুইট বার্তায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সব ভারতীয় নাগরিকের নায়ক। তিনি একজন বীর।’ তিনি বাংলায় এই টুইট বার্তাটি দিয়েছিলেন। এই বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এটা স্পষ্ট করেছিলেন, ভারতীয়দের মনে বঙ্গবন্ধুর স্থান কোথায়। তৃতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড অনুষ্ঠানে তিনি যে বক্তব্য রাখেন, তার গুরুত্বও অনেক। নরেন্দ্র মোদি আমাদের জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। স্মৃতিচারণায় তিনি বলেন, জীবনের শুরুর দিকে আন্দোলনগুলোর, অন্যতম ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে শামিল হওয়া। তিনি আমাদের আরও জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ২০-২২ বছর। তিনি ও তার সঙ্গীরা সত্যাগ্রহ করেছিলেন। জেলেও গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এখানে অর্থাৎ বাংলাদেশে যতটা ইচ্ছা ছিল, ততটাই ছিল ওপারে অর্থাৎ ভারতে- তিনি এমনটাই মন্তব্য করেছেন। মোদি আরও বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ একসঙ্গে এগিয়ে যাবে। আমরা দেখিয়ে দিয়েছি পারস্পরিক বিশ্বাসে সমাধান হতে পারে। জমি হস্তান্তর চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। করোনাকালেও তালমিল রেখে কাজ করেছি। বাংলাদেশে কাজে লাগছে মেড ইন ইন্ডিয়া ভ্যাকসিন।’ এটাই বাস্তবতা। করোনাকালে ভারতীয় টিকা বাংলাদেশে এসেছে, যখন বিশ্বের অনেক দেশ এখনো টিকা পায়নি। মোদির সফরের আগে ভারত থেকে এসেছে একশর ওপরে অ্যাম্বুলেন্স। মোদি তার বক্তৃতায় অনেক বাংলাদেশির নামও উল্লেখ করেছেন।
প্যারেড গ্রাউন্ডে মোদির বক্তৃতা ২০১৫ সালের জুন মাসে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু কনভেনশন সেন্টারে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ওই বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের সালমা, সাকিব, নিশাত আর ওয়াসফিয়াদের প্রশংসা করেছিলেন। তার ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি এটা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তিনি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা চান। মোদির বৈদেশিক নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘নেইবারহুড ফাস্ট’ পলিসি। অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে তিনি গুরুত্ব দেন। এটা আবারও তিনি প্রমাণ করলেন। করোনার কারণে দীর্ঘ ১৫ মাস তিনি বিদেশ সফরে যাননি। করোনার মধ্যেই তিনি ঢাকায় এলেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তার সরকারের বেশকিছু সিদ্ধান্ত খোদ ভারতে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী এই ইস্যুতে ‘সুবিধা’ নিতে চাইছে। মুসলমানরা ভারতে নিগৃহীত হচ্ছেন এ ধরনের অভিযোগ থাকলেও এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যেমন আমরা ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস’ (এনআরসি) এবং ‘সিটিজেনস এমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ (সিএএ) প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে পারি। এসব ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ও জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী একটি দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাই বাংলাদেশ ভারতের ব্যাপারে কথা বলতে পারে না। নরেন্দ্র মোদি গতকাল গোপালগঞ্জের কাশিয়ানির ওড়াকান্দির মাতুয়া সম্প্রদায়ের ঠাকুরবাড়ির মন্দিরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এটা নিয়ে বাংলাদেশে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না হলেও পশ্চিমবঙ্গে এটা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেস সমর্থক জনৈক সাকেত গোখলে ভারতের নির্বাচন কমিশনে এক আর্জিতে মাতুয়া সম্প্রদায়ের মন্দিরে মোদির ভাষণ সম্প্রসারণ ও প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানিয়েছেন। তার যুক্তি মোদির ভাষণ পশ্চিম বাংলার বিধানসভার নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। ২৭ মার্চ সেখানে প্রথম পর্যায়ের নির্বাচন শুরু হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, মোদির এই ভাষণ ২৯ আসনে প্রভাব ফেলতে পারে। এসব আসনে মাতুয়া সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করেন। সাতক্ষীরার একটি মন্দিরেও তিনি যান। মোদি বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব জানেন ও বোঝেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে তা ভারত সমাধান করবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সমস্যাগুলোর সমাধান হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ ব্যাপারে একবার উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর (২০১৭) কিংবা নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর (২০১৫) এবং পরে ভার্চুয়াল বৈঠকেও (২০২০) আশ্বাস দেওয়া হয়েছে তিস্তার পানিবণ্টনের। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে তিস্তাচুক্তি হয়নি। সমস্যাটা ভারতের। এর সমাধান ভারতকেই করতে হবে। এভাবে বারবার যদি আশ্বাস দেওয়া হয় এবং সমস্যার যদি কোনো সমাধান না হয় তা হলে দুদেশের বন্ধুত্বের জন্য তা কোনো ভালো খবর নয়। বারবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। অথচ ভারত-নেপাল সীমান্ত কিংবা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে এ ধরনের হত্যাকা- হয় না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি এখন সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। এই ঘাটতির পরিমাণ এখন হাজার হাজার কোটি টাকা। ভারতীয় শুল্কনীতির কারণেই বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। সাফটা চুক্তিতে বেশ কয়েকটি পণ্যের ব্যাপারে শুল্ক হ্রাসের কথা বলা হলেও ভারত তা কার্যকর করেনি। ইতোপূর্বে ভারতের পক্ষ থেকে যে ৫১৩টি পণ্যের ছাড় দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে ৩৫০টি পণ্য বাংলাদেশের পক্ষে কোনোভাবেই রপ্তানি করা সম্ভব নয়। ভারত বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কহার না কমালেও বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের শুল্কহার কমিয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্কহার ধার্য ছিল শতকরা ৩০০ ভাগ। ১৯৯৪-৯৫ সালে তা কমিয়ে আনা হয় ৬০ ভাগে। এখন শুল্কহার দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৫ ভাগে। দুদেশের মধ্যকার বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধায় জাহাজযোগে ভারতীয় পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে। অথচ নেপালে ত্রিদেশীয় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ভারত এটা করছে দ্বিপাক্ষিকভাবে (ভারত-নেপাল)। শুষ্ক মৌসুমের জন্য বাংলাদেশ (রাজবাড়ীর পাংশা থেকে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত) একটা জলাধার নির্মাণ করতে চায় (গঙ্গা ব্যারাজ), সে ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। গত ১৬ মার্চ (২০২১) নয়াদিল্লিতে সচিব পর্যায়ে একটি সভা হয়েছে। সেখানে ৬টি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে বলে একটি সংবাদপত্র আমাদের জানিয়েছে (মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার)। শুধু বলা হয়েছে, তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘গুরুত্ব’ দেওয়া কিংবা অন্য ৬টি নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টি আলোচনার চেয়ে আমাদের প্রয়োজন তিস্তার পানিবণ্টন। আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য বসে থাকতে পারি না। ফলে চীনা অর্থায়নে তিস্তার পানির ব্যবস্থাপনার যে কথা বলা হয়েছে, তা দ্রুত একনেকে পাস করানো জরুরি। শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে যে গঙ্গার পানিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৭ সালে, অর্থাৎ এখন থেকে ৬ বছরের মধ্যে। অথচ এই সময়সীমায় মানুষ বেড়েছে, পানির চাহিদা বেড়েছে। তাই গঙ্গার পানিবণ্টনের বিষয়টি নিয়ে পুনরায় আলোচনা করা প্রয়োজন। হিমালয় অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এজন্য চীনকে সংযুক্ত করতে হবে। একটি বিদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চীন সিন্ধু, সুতলেন, ব্রহ্মপুত্র, মেকং, সালভিন, হুয়াং হো এবং ইয়াংটমের মতো এশিয়ার বড় নদীগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে। চীন তিব্বত মালভূমির বাইরে প্রবাহিত সব বড় নদীর ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। তিব্বতের নদীগুলোয় জলবিদ্যুৎ সমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে চীন। এ অঞ্চলে প্রায় ২৮টি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে চীন। ব্রহ্মপুত্রের পানিও সরিয়ে নিতে চাচ্ছে চীন। ফলে চীন যদি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, তা হলে শুধু ভারতই নয়, বাংলাদেশেও পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এশিয়াটিক সোসাইটির এক গবেষণায় মন্তব্য করা হয়েছে যে, পানি নিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলো এক ধরনের ‘পানিযুদ্ধ’ শুরু করে দিতে পারে আগামী দিনগুলোতে। তাই আঞ্চলিকভাবে একটি পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
গেল বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাসিনা-মোদি যে ভার্চুয়াল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে মোদি স্বীকার করেছিলেন তার নেইবারহুড ফাস্ট পলিসির অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে বাংলাদেশ। এই করোনাকালেও বাংলাদেশ সফর তার সেই ‘কমিটমেন্ট’কে আবার প্রমাণ করল। তিনি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন যে, দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে তার সমাধান জরুরি। না হলে বাংলাদেশে অসন্তোষ বাড়বে। আমরা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখতে চাই। তার ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে এবং বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ দুদেশের সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে গেল। মোদি নিজে বলেছেন, ‘সম্পর্ক এমনভাবে তৈরি করতে হবে যা কোনোভাবেই ভাঙবে না। বাংলাদেশ-ভারতকে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে, এমন মন্তব্যও তার। মোদির এই সফরে ৪টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং বেশকিছু প্রকল্প তিনি উদ্বোধন করেছেন। সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ দমনে সহযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক বাধা দূরীকরণ ইত্যাদি। আর প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল, মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসমাধি, মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া হয়ে কলকাতা পর্যন্ত স্বাধীনতা সড়ক ইত্যাদি। তাই দুদেশের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ ধরনের চুক্তি ও সমঝোতার গুরুত্ব অনেক। আঞ্চলিক উন্নয়নের স্বার্থে এই দুদেশের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত জরুরি।
Amader Somoy
28.3.2021
হীরকজয়ন্তীর প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই
20:05
No comments
বাংলাদেশ এখন স্বাধীনতার ‘সুবর্ণজয়ন্তী’ পালন করছে; ২০৩১ সালে পালন করবে ‘হীরকজয়ন্তী’। সেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এখনই। ২০৩১ সালে বাংলাদেশের বয়স দাঁড়াবে ৬০ বছর। তখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়বে, মানুষের চাহিদা বাড়বে এবং এক ‘নতুন পৃথিবী’ দেখতে পাব আমরা। করোনাভাইরাস এক ‘নতুন পৃথিবীর’ জন্ম দিতে যাচ্ছে। ওই নতুন পৃথিবীতে মানুষের চাহিদার ধরন পাল্টে যাবে।
সনাতন শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে। সুতরাং এসব পরিবর্তন সামনে রেখে নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যখন ২০৩১ সালে ‘হীরকজয়ন্তী’ উদযাপন করবে, তার মাত্র চার বছরের মাথায় ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান হবে দ্বিতীয়। ভারত থাকবে শীর্ষে। যেখানে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ২৫তম, তখন পাকিস্তানের অবস্থান ৩৬, শ্রীলংকার ৬৭, নেপালের ৯৫, আফগানিস্তানের ১২৯, মালদ্বীপের ১৫০ আর ভুটানের অবস্থান ১৬৪তম। এর আগেই ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৪তম, আর ২০৩০ সালে ২৮তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে।
সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে-স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি মিলবে। এক্ষেত্রে একটি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে রপ্তানি আয় ৮ থেকে ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। একইসঙ্গে ঋণপ্রাপ্তিতে জটিলতা, ইউরোপ ও কানাডায় পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার ইত্যাদি ঝুঁকিও তৈরি হবে। ফলে ওইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য এখন থেকেই নিতে হবে মহাপরিকল্পনা। ইতোমধ্যে ভারত ‘কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট’র (সেপা) প্রস্তাব করেছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুবিধার ধরন কী হবে, তা নির্ণয় করাই হচ্ছে ‘সেপা’র লক্ষ্য। গোল্ডম্যান স্যাকস-পরবর্তী উঠতি যে ১১টি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশের কথা বলেছেন (এন-১১), বাংলাদেশ রয়েছে তার শীর্ষে। বাংলাদেশের অবস্থান উঠতি অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা মেক্সিকোর সঙ্গে। ফলে বাংলাদেশকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কীভাবে অর্থনৈতিক এ অগ্রগতি ধরে রাখা যায়। আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। অথচ পাকিস্তানের রিজার্ভের পরিমাণ ২০.৫১২ বিলিয়ন ডলার; অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্ধেকেরও কম। যদিও ভারতের রিজার্ভের পরিমাণ অনেক বেশি; ৫৮১ বিলিয়ন ডলার। গেল ১০ বছরে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪১ ভাগ হারে বেড়েছে। বাংলাদেশের যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে ১১ মাসের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যে জনসংখ্যা ছিল, গেল ৫০ বছরে তা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, যেখানে ১৯৭২-৭৩ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার, ২০১৯-২০ সালে তা বেড়েছে ২০৭৯ ডলারে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ২.৭৫ ভাগ (১৯৭২-৭৩), সেখানে ২০১৮-১৯ সময়সীমায় উন্নীত হয়েছিল ৮.১৫ ভাগে। তবে করোনাকালীন পৃথিবীর সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও শ্লথগতি আসে। এডিবির মতে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালে প্রাক্কলন করা হয়েছিলা ৫.২ ভাগ আর ২০২১ সালে ৬.৮ ভাগ। অথচ এডিবিই বলছে, ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ভারতে মাইনাস ৯ ভাগ, শ্রীলংকায় মাইনাস ৫.৫ ভাগ, আফগানিস্তানে মাইনাস ৫ ভাগ আর পাকিস্তানে মাইনাস ০.৪ ভাগ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫.২ ভাগ বলে দেয় করোকালেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে ছিল।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে আরও কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে আমরা বোঝাতে পারব-আমাদের অর্জন গেল ৫০ বছরে অনেক দেশের চেয়ে বেশি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৪.৭ ভাগ, ডলার প্রতি বিনিময় মূল্য ছিল ৭.৩০ টাকা, রপ্তানি আয় ছিল ৩৩ কোটি টাকা, আমদানি ব্যয় ছিল ২৮.৭৩ কোটি টাকা, রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ০.৮৩ কোটি ডলার। সেখানে প্রায় ৫০ বছরের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি ৫.৫ ভাগে, ৮৬ টাকা ডলার প্রতি মূল্য, রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৬০০ কোটি ডলারে, আবার আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে ৫৪০০ কোটি ডলারে। রেমিটেন্সের পরিমাণও বেড়েছে ৪৫০০ কোটি ডলারে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দুই বা তিনটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল আমাদের রপ্তানি খাত। বিশেষ করে পাটজাত দ্রব্য, চা ও চামড়া-চামড়াজাত পণ্যের বদলে এখন স্থান করে নিয়েছে তৈরি পোশাক ও জনশক্তি। ওষুধ শিল্পও বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর তথ্য মতে, (২০১৯-২০২০) বাংলাদেশ ১১৮টি দেশে তৈরি ওষুধ রপ্তানি করেছে। স্বাধীনতার আগে আমাদের খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল কম-বেশি এক কোটি টন। তখন লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সর্বশেষ তথ্য বলছে, আমাদের মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে চার কোটি টন। উৎপাদনের পরিমাণ গড়ে চারগুণেরও বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছি।
গত ৫০ বছরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবাখাতে যেসব উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তার একটি চিত্র আমরা পাব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স-এইচডিআই (ইউএনডিপি কর্তৃক প্রণীত) এ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে (শিশু শিক্ষা, মাতৃমৃত্যু) আমাদের অগ্রগতি ভারতের চেয়েও ভালো-এ কথা স্বীকার করেছেন স্বয়ং অমর্ত্য সেন। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এইচডিআই সূচকে ২০০০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫, সেখানে ২০১৭ সালে তা উন্নীত হয় শূন্য দশমিক ৬১-এ। ২০১৯ সালে অবস্থান ছিল ০.৬৩-এ (প্রথম অবস্থান নরওয়ের (০.৯৫৭)। ভারতের স্কোর (০.৬৪৫, ১৮৯টি দেশের মাঝে ১৩১, আর বাংলাদেশের ১৩৩)। প্রাথমিক শিক্ষায় নিট ভর্তির সংখ্যা এখন ৯৭.৯ ভাগ। মাতৃমৃত্যুর হার এখন মাত্র ১৬.৫ ভাগ। ৭০ বছরের ওপরে বয়স্ক নাগরিকদের সাক্ষরতার হার এখন শতভাগ। ২০০৬ সালে গড় আয়ুকাল যেখানে ছিল ৬৪.৪, ২০১৯ সালে তা বেড়েছে ৭২.৪ ভাগে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০.৫-এ কমে এলেও (বিবিএস রিপোর্ট) করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের গবেষণা অনুযায়ী, সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে এখন ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। টেকসই প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশ (জিএসসিআই-২০২০) ১৭ ধাপ এগিয়ে (১৮০ দেশের মাঝে ১১৫তম, বাংলাদেশের স্কোর ৪৩.৩, ভারতের অবস্থান ১২৭তম; অর্থাৎ ভারত পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের চেয়ে) গেলেও বৈষম্য গত ৫০ বছরে আমরা দূর করতে পারিনি। বৈষম্য মাপা হয় ‘গিনি সহগ’ দিয়ে। ২০১৬ সালের আমাদের ‘গিনি সহগ’ ছিল শূন্য দশমিক ৪৮৩। শূন্য দশমিক ৫ হলেই অতি উচ্চ বৈষম্যের দেশ হয়ে যায়।
মাথাপিছু ঋণের বোঝা বাড়ছে-এটি আমরা কমাতে পারিনি। ২০১৫ সালের শেষ দিকে মাথাপিছু ঋণ ছিল ১৩ হাজার ১৬০ টাকা, এখন তার পরিমাণ অর্থনীতি সমিতির মতে, প্রায় ৭৯ হাজার টাকা। সাম্প্রতিককালে আমাদের অর্থনীতির জন্য দুটো খারাপ খবর-এক. বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার আর দুই. খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি। ২০২০ সালে এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা (যুগান্তর, ৬ ডিসেম্বর ২০২০)। যে কোনো বিবেচনায় আমাদের জন্য এটি খারাপ সংবাদ। World Happiness Report 2021 সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যায়, বিশ্বের সুখী দেশের তালিকায় (মোট ১৪৯ দেশ) বাংলাদেশের অবস্থান ১০১। অথচ ভারতের অবস্থান (১৩৯)। অর্থাৎ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষ বেশি সুখী। বলা ভালো, সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যান্ড। UN Sustainable Development Solutions Network এ তালিকা প্রণয়ন করেছে।
বাংলাদেশে মানুষের অনেক সমস্যা রয়েছে। দুর্নীতি, ব্যাংকের টাকা লুট, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার কিংবা একজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পিয়নের কাছে যখন অবৈধ শত কোটি টাকা থাকে, তখন এসব নেতিবাচক সংবাদের পাশে বাংলাদেশের মানুষ ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের চেয়েও সুখী-এটাই একটা ভালো সংবাদ। এই ‘সংবাদ’ ধরে রাখতে হবে। এজন্যই প্রয়োজন মহাপরিকল্পনা। মহাপরিকল্পনা না নিলে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব না। তবে বলতেই হবে, আমাদের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে, যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হয়। এটাই এই মুহূর্তের অগ্রাধিকার। এখন থেকেই আমাদের দীর্ঘ পরিকল্পনা করা প্রয়োজন-কীভাবে আমরা হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে সমস্যাগুলো ও যুগের চাহিদা মোকাবিলা করব।
বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের গুরুত্ব ও চাহিদা বাড়ছে। ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসার বেড়েছে। কোভিড-১৯-এর কারণে সারা বিশ্ব যখন স্থবির হয়ে গেল, তখন ইন্টারনেটের দুনিয়া একটা বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করল। ইন্টারনেট পুরো ব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা আমেরিকায় ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারব। শিল্পে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের চাহিদা বেড়েছে। এ প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি আমাদের গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ঢেলে সাজাতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনা কাজে লাগতে হবে। Generation Z, যারা তরুণ প্রজন্ম, তাদের দক্ষ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। সনাতন সিলেবাসের পরিবর্তে প্রযুক্তি তথা আইটিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এটি করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা পিছিয়ে পড়ব।
আমাদের আছে এক তরুণ প্রজন্ম। এরা আমাদের শক্তি। এই শক্তি কাজে লাগাতে হবে। এজন্য দরকার যোগ্য নেতৃত্ব। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে অদক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করার চেয়ে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে দরকার শিক্ষাক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব। উপাচার্যদের নানা কাহিনি আমাদের আহত করে। দলীয় বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে যোগ্য ও মেধাবী নেতৃত্ব যদি শিক্ষাক্ষেত্রে আনা না যায়, তাহলে হীরকজয়ন্তীতে আমরা জাতিকে কোনো ভালো খবর শোনাতে পারব না। সুবর্ণজয়ন্তীতে এটাই আমাদের শিক্ষা। আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে একটা ঝড়ভঃ ঢ়ড়বিৎ হিসাবে বিশ্বে পরিচিত করতে প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। তাই ঐকমত্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। একটা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ যদি আমরা প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তাহলে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হব। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তাই এখনই।
Daily Jugantor
28.3.2021
কূটনীতিতে বাংলাদেশ ৫০ বছরের
বাংলাদেশ যখন তার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছে, তখন কূটনীতিতে দেশটির সাফল্যের পাল্লাটা কম ভারী নয়। গেল ৫০ বছরে আমাদের বেশ কিছু সাফল্য রয়েছে। তবে সেই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আগামী ২০৩১ সালে বাংলাদেশ পালন করবে হীরকজয়ন্তী। আর তাই চ্যালেঞ্জগুলোকে ‘এড্রেস’ করেই নিতে হবে মহাপরিকল্পনা। সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ শীর্ষ নেতাÑ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহ, নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারী, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং ও শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। বাংলাদেশের কূটনীতির জন্য এটা একটা বড় পাওয়া। দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ পাঁচ নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে ও ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিশ্ব নেতাদের বাংলাদেশে উপস্থিতি এর আগেও আমরা একবার দেখেছিলাম ১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার ২৫ বছর পূর্তি পালন করেছিল। তখনো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সুলেইমান ডেমিরেল।
advertisement
বাংলাদেশের সাফল্যের পালকে আরেকটি পালক যোগ হয়েছে যখন দেশটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে চলতি ২০২১ সালে। ২০২৬ সালে স্বীকৃতি মিলবে উন্নয়নশীল দেশের। এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনেক। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ায় বিশ্বে আমাদের মর্যাদা বেড়েছে সন্দেহ নেই তাতে, কিন্তু কিছুটা ‘ঝুঁকি’ রয়েছে। রপ্তানি আয় ৮ থেকে ১০ শতাংশ কমে যাওয়ায় ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা, ইউরোপ ও কানাডায় পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার ইত্যাদি ঝুঁকি
তৈরি হলো। ফলে এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিল করার জন্য এখন থেকেই নিতে হবে মহাপরিকল্পনা। গোল্ডম্যান স্যাক্স পরবর্তী যে উঠতি ১১টি শক্তিশালী অর্থনীতির কথা বলেছেন (এন-১১), বাংলাদেশ রয়েছে তার শীর্ষে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় প্রাপ্তি। গোল্ডম্যান স্যাকসের মূল্যায়নে বাংলাদেশ অবস্থান করছে উঠতি অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা মেক্সিকোর পাশাপাশি। আর তাই বিখ্যাত ম্যাগাজিন ডিপ্লোম্যাটের মন্তব্য ছিল এ রকম South Asia Has a New Leader : will the world Take Note ? ( Diplomat, October 23, 2020 ) . বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার নতুন অর্থনৈতিক শক্তিÑ বিশ্বকে এখন এ দিকেই নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের সাফল্যের কথা আছে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনেও। নিকোলাস ক্রিস্টফ তার প্রবন্ধ Look to Bangladesh (১০ মার্চ ২০২১)-এ লিখেছেন সে কথা। বাংলাদেশ যে ‘অর্জন’ করেছে তার পেছনের কারণ কী? ক্রিস্টফের মতে, What was Bangladesh's secreat ? It was education and girls - শিক্ষা, বিশেষ করে মেয়েশিশুদের শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বংলাদেশ। আর এভাবেই অনেক দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন ক্রিস্টফ। লিখে The World Bank calls Bangladesh an inspiring story of reducing poverty - with 25 million Bangladeshi,s lifted from poverty over 15 years. The share of children stunted by malnutritiin has fallen by about half in, Bangladeshsince 1991 and is niw lower than in India. এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে।
advertisement
কূটনীতিতে সাফল্যের কথা যদি বলতে হয়, তা হলে বলতে হবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির মাত্র চার বছরের মাথায় ১৯৭৮-১৯৮০ সময়সীমায় বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। ২০০০-২০১২ সালেও বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে সংসদের স্পিকার (১৯৯৬-২০০১) হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪১তম অধিবেশনে (১৯৯৬) সভাপতিত্ব করেছিলেন।
আরেকটি সাফল্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ। গড়পড়তা প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি সেনাসদস্য বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিলেন এবং এখনো আছেন। বিশেষ করে সোমালিয়া, রুয়ান্ডা, মোজাম্বিক, কুয়েত, বসনিয়া-হারজেগোভিনা, আইভরিকোস্ট, হাইতি, সিয়েরা লিওনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। একাধিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের প্রশংসা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। এমনকি সিয়েরা লিওনের কোনো কোনো অঞ্চলে বাংলা ভাষা ‘দ্বিতীয় ভাষা’ হিসেবে চালু হয়েছে। বাংলাদেশকে স্থানীয় মানুষ নামে চেনে। কৃষিক্ষেত্রে সেখানে বাংলাদেশিরা কাজ করছে। বাংলাদেশের জন্য একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সিয়েরা লিওনকে সামনে রেখে আফ্রিকায় বাংলাদেশি পণ্যের একটা বাজার গড়ে তোলার। মানবসম্পদের দিক দিয়ে বাংলাদেশিদের জন্য একটা বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে।
ইসলামি বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম দিক। এর ভিত্তি গড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামি ঐক্য সংস্থার (ওআইসি) সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। তার সফরসঙ্গীদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদের মতো তরুণ নেতৃত্বের পাশাপাশি আতাউর রহমান খানের মতো রাজনীতিবিদও ছিলেন (উইকি পিডিয়া)। মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায় যখন জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জেরুজালেম ও ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গঠিত ‘আল-কুদস’ কমিটিতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শুধু তাই নয়, ইরান-ইরাক দীর্ঘ যুদ্ধে (১৯৮০-১৯৮৮) মধ্যস্থতা করার জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, বাংলাদেশ ওই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে ইরাক কুয়েত আক্রমণ ও সীমিত সময়ের জন্য কুয়েত দখল করে নিলে সৌদি আরব অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হলে জাতিসংঘের নেতৃত্বে Operation Desert Shield গঠিত হয়। বাংলাদেশ এখন একটি কোয়ালিশন ফোর্সের পক্ষ হয়ে প্রথম গালফ যুদ্ধে অংশ নেয়। পরে কুয়েতে বাংলদেশ সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট স্থাপন করা হয়, যাদের কাজ ছিল কুয়েতকে ল্যান্ডমাইনমুক্ত করা। ইরাক-কুয়েত যুদ্ধে ইরাকই ওইসব মাইন স্থাপন করেছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কুয়েত থেকে ল্যান্ডমাইন অপারেশনের কাজে নিয়োজিত ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের সদস্যরা এখনো সেখানে আছে। বলা ভালো, প্রথম গালফ যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের ৫৯ জন সদস্য এবং পরে ল্যান্ডমাইন অপসারণে ৭২৮ জন সদস্যকে হারিয়েছে। মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায় যখন ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বরে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয় সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন Islamic Military Counter Terrorism Coalition ( IMCTC )- এ যোগ দিতে। বর্তমানে ৪১টি দেশ এর সদস্য। IMCTC এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামিক উগ্র জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের এপ্রিলে IMCTC এর একটি সামরিক মহড়া প্রত্যক্ষ করেন। IMCTC এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশকে কত গুরুত্ব দেয়। কূটনীতিতে বাংলাদেশের সাফল্য এখানেই যে, বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বে তার একটি অবস্থান তৈরি করে নিতে পেরেছে।
বাংলাদেশের কূটনীতির ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্যÑ আর তা হচ্ছে বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশ মনে করে আঞ্চলিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের উদ্যোক্তা। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এটা উপলব্ধি করে সত্তর দশকের শেষের দিকে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। বাংলাদেশের আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় দক্ষিণ এশিয়ার নেতাদের উপস্থিতিতে সার্ক গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ বিমসটেকেরও (১৯৯৭ সালে গঠিত) উদ্যোক্তা। বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোতে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর বসবাস ও দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এই সংস্থাটি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে যোগসূত্র। বলা যেতে পারে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলগুলোর (বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড) সঙ্গে সমুদ্র নেই ও পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশের (ভুটান ও নেপাল) মধ্যকার একটি যোগসূত্র। ২০০৪ সালে সংস্থাটি Bay of Bengal Initiative for Multi Sectoral Technical and Economic Cooperation হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
কূটনীতিতে বাংলাদেশের আরও তিনটি উদ্যোগের কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশ উদ্যোগ নিয়েছিল মুসলমানপ্রধান ৮টি দেশকে নিয়ে Developing 8 গঠন করার। এই ৮টি দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, মিসর, ইরান, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া ও পাকিস্তান। ১৯৯৭ সালে এটি গঠিত হয়। কৃষি, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে সংস্থাটি কাজ করছে। দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, প্রযুক্তি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে APTA - Asia Pacific Trade Agreement গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ ছিল অন্যতম উদ্যোক্তা। বাংলাদেশের পাশাপাশি চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা, ভারত, লাওস APTA -এর সদস্য। APTA ভুক্ত অঞ্চলের জনসংখ্যা ২৯২১ দশমিক ২ মিলিয়ন, আর মোট জিডিপি ১৪৬১৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। APTA -ভুক্ত দেশগুলো এখন একটি অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হচ্ছে ২০০৬ সালে বাংলাদেশের ASEAN Regional Forum ( ARF) -এ যোগদান। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি এবং অদূর ভবিষ্যতে আসিয়ানে যোগদানের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে ARF একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। বলা ভালো ভারত আসিয়ানের সঙ্গে ২০০৯ সালে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা ২০১০ থেকে কার্যকর হয়েছে। এই চুক্তির কারণে ভারত শুল্কমুক্তভাবে তার পণ্য নিয়ে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে যেতে পারবে। প্রসঙ্গক্রমেই ত্রিদেশীয় মহাসড়কের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। বাংলাদেশ এই ত্রিদেশীয় মহাসড়কে যুক্ত হতে চাইছে। সম্প্রতি মোদি-হাসিনা ভার্চুয়াল বৈঠকে বাংলাদেশ এই প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবিত ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়ক বাংলাদেশের জন্যও একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। ভারতের East West Evonomic Corridor -এর এটা একটা অংশ। মহাসড়কটি ভারতের মণিপুর রাজ্যের Moreh শহরকে মিয়ানমারের ওপর দিয়ে থাইল্যান্ডের Myawaddy Mae Sot শহরকে সংযুক্ত করবে। পরে এই মহাসড়ক আরও সম্প্রসারিত হবে লাওস ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত। বাংলাদেশের পণ্যও অদূর ভবিষ্যতে এই মহাসড়ক ধরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যেতে পারবে।
বাংলাদেশের জন্য পার্শ¦বর্তী দুটি বড় দেশের (ভারত ও চীন) সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেছে। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে চিহ্নিত হয়েছে। এগুলো দুটি দেশের সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে গেলেও, সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। তিস্তার পানিচুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। সর্বশেষ ফেনী নদীর ওপর মৈত্রী সেতু উদ্বোধন, ভারতকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে দেওয়া ইত্যাদি ঘটনায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নত হলেও অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর, চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনায় বাংলাদেশের যোগদান, বাংলাদেশে চীনের উন্নয়ন সহযোগিতা বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করলেও বাংলাদেশ অত্যন্ত কৌশলে একটি ভারসাম্যমূলক কূটনীতি অনুসরণ করছে। কোনো একটি দেশের প্রতি ‘ঝুঁকে পড়ার’ প্রবণতা বাংলাদেশ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। কূটনীতিতে সাফল্য এখানেই নিহিত।
তবে কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সমুদ্রসীমা (ভারত ও মিয়ানমার) নির্ধারণ হয়ে যাওয়ার পরও সমুদ্রের বিশাল সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো বড় পরিকল্পনা চোখে পড়ে না। একুশ শতক হবে ‘ব্লু-ইকোনমি’নির্ভর। ২০১৪ সালে তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঢাকা সফরের সময় জাপান ইওএ-ই পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিল। বঙ্গোপসাগরভুক্ত দেশগুলো উন্নয়নে (অর্থনীতি, অবকাঠামো, জ্বালানি, উন্নয়ন প্রক্রিয়া) জাপান অংশীদার হতে চায়, যাতে জাপানের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রক্ষিত হয়। বলা হচ্ছে, এই পরিকল্পনার আওতায় জাপান ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযুক্ত করতে চায়। BIG- B পরিকল্পনা Japan - Bangladesh Comprehensive Partnership এর অংশ। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ অঞ্চলে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত Quadrilateral Security Dialogue - QUAD , যেখানে সদস্য রয়েছে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এটি একটি সামরিক জোটও বটে। এই জোট চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহত হতে পারে বলে গবেষকদের ধারণা। বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ভৌগোলিক কারণে কৌশলগতভাবে ভারত, নেপাল, ভুটান ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর গেটওয়ে। এটা বিবেচনায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার যে স্ট্র্যাটেজি তাতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। গেল অক্টোবরে (২০২০) মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান তার ঢাকা সফরে বাংলাদেশকে এই প্রস্তাব দিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়নি।
সুতরাং কূটনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আগামীতে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দক্ষ জনশক্তি যদি তৈরি করা না যায়, তা হলে কূটনীতিতে সফলতা পাওয়া যাবে না।
Amader Somoy
26.3.2021
সংবাদগুলো আমাদের আশাবাদী করে না
08:51
No comments
বাংলাদেশ যখন তার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশটির সফলতা যখন বহির্বিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে, তখন সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত কিছু কিছু সংবাদ ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সম্প্রচারিত সংবাদ আমাদের আশাবাদী করে না। সংবাদগুলো রাজউক ১৮ নম্বর সেক্টরে (রুয়াপ) রাজউক কর্তৃক নির্মিত বহুতল ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ব্যবস্থাপনা ত্রুটি ও নানা অনিয়ম নিয়ে। উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরে একাধিক ভবনে (৭৯টি) ৬ হাজার ৬৩৬ ফ্ল্যাট রাজউক তৈরি করেছে। এটা প্রধানমন্ত্রীর একটি স্বপ্নের প্রকল্প।
যেখানে ঢাকা শহরে কোনো খালি জমি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না আগামীতে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হাইরাইজ ভবন নির্মাণ করে তা কিস্তিতে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্তকারী। আবাসন খাতে এটা ছিল একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সরকারের অনেকগুলো সাফল্যের মধ্যে এটা ছিল একটি।
কিন্তু ২০১২-১৩ সালে গ্রাহকরা কিস্তির টাকা দেওয়া শুরু করলে এবং অনেক আগেই কিস্তির টাকা পরিশোধ করলেও ২০২১ সালে এসেও রাজউক ফ্ল্যাট মালিকদের অনুকূলে ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি করে দেয়নি। দুবছর হলো প্রায় কয়েক হাজার পরিবার এখানে বসবাস করছে। অথচ পাঁচ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি করা হলেও যারা ফ্ল্যাট কিনেছেন, তারা বসবাস করতে পারছেন না। এখানে বসবাস করার জন্য যে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, তা রাজউক নিশ্চিত করেনি। ফলে এখানে অসন্তোষ বাড়ছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি (২০২১) ঢাকা পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিলম্বে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের ক্ষতিপূরণ চান মালিকরা।
রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক-এ মালিক কল্যাণ সমিতি, সেক্টর-১৮-এর উদ্যোগে সেখানে অনিয়মের বিরুদ্ধে একাধিকবার মানববন্ধন হয়েছে। শর্ত ছিল ২০১৬ সালে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু ২০২১ সালে এসেও তা সবাইকে বুঝিয়ে দিতে পারেনি রাজউক। ফলে ক্ষোভ আর অসন্তোষ বাড়ছে। এখানে ব্যবস্থাপনার ত্রুটি চরমে উঠেছে। গত ১ মার্চ (২০২১) যুগান্তরের তিন কলামব্যাপী একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ‘সেবা পাচ্ছেন না গ্রাহকরা’। প্রতিবেদনে নিম্নমানের লিফট সরবরাহ, ভবনের প্লাস্টার খসে পড়া, নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার, বাথরুম ফিটিংসে জং-ধরা ইত্যাদি নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে দোলনচাঁপা ভবনের ত্রুটিপূর্ণ লিফটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মাত্র দুবছরের মাথায় ভবনের চারটি লিফট অকার্যকর হয়ে পড়েছে! এ ব্যাপারে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সভাপতি একাধিকবার প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মোজাফফর আহমদকে লিখিতভাবে অবহিত করলেও ত্রুটিপূর্ণ লিফটগুলো সারিয়ে তোলা হয়নি। ফ্ল্যাট মালিকরা অভিযোগ করেছেন মাত্র দুবছরের মধ্যেই প্রতিটি লিফটে যদি ত্রুটি ধরা পড়ে, তাহলে আগামী ১০-১২ বছর পর আদৌ তা ব্যবহারের উপযোগী থাকবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট মালিকরা বুয়েটের অধ্যাপকদের দিয়ে প্রতিটি ভবনের লিফট পুনঃপরীক্ষার দাবি করেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অন্যান্য ভবনের লিফটেরও একই সমস্যা।
কালের কণ্ঠের গত ২০ ফেব্রুয়ারির এক প্রতিবেদনেও এই প্রজেক্টের নানা অনিয়ম নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার এক প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছিল এই প্রজেক্টের নানা অনিয়মের কথা।
সরকার জনস্বার্থে অনেক ভালো ভালো কাজ করছে। একাধিক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এতে করে সরকার সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ওইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের শৈথিল্য, অদক্ষতা, অনেক মহাপরিকল্পনার শেষ অবধি সফল হবে না! রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প (উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টর) এমন একটি মহাপরিকল্পনা, যা এখন শুধু বিতর্কেরই জন্ম দিচ্ছে। এখানে রাজউক তার দক্ষতা প্রমাণ করতে পারেনি। পঞ্চবটির এই এলাকাটি সুরক্ষিত নয়। এই এলাকার পাশ দিয়ে চলে গেছে মিরপুর বেড়িবাঁধ, যা চলে গেছে আশুলিয়া পর্যন্ত। মিরপুরের এই বেড়িবাঁধটিতে একসময় রাতে প্রচুর ডাকাতি হতো। কিছুদিন আগে একজন অভিনেত্রী এই সড়কে ডাকাতির শিকার হয়েছিলেন। ২০১২ সালে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাজউক হাইরাইজ ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু রাজউক কখনো নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়নি। যদিও তুরাগ থানা এখন পঞ্চবটি মোড়ে রাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে পুলিশ টহলের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু রাজউক কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী না দিয়েই দ্রুত ভবনগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করেছে। এটাই ছিল তাদের বড় ভুল।
ইতিমধ্যে নানাবিধ অভিযোগ উঠেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও। শিডিউল অনুযায়ী যে লিফট সরবরাহ করার কথা ছিল, তা করা হয়নি। অত্যন্ত নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে ভবনগুলো তৈরি করা হয়েছে। হস্তান্তর হয়নি অনেক ভবন। কিন্তু সেখানে গেলে দেখতে পাবেন কোথাও কোথাও প্লাস্টার খসে পড়েছে। দরজাগুলো এক বছরের আগেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এখানে যে রাজউকের ‘ইন্সপেকশনের’ দরকার ছিল, রাজউক তা করেনি। দোলনচাঁপা ভবনে একাধিকবার লিফট ছিঁড়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা লিফট সংযোজন, তত্ত্বাবধানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা ‘অদৃশ্য কারণে’ বিষয়টির গুরুত্ব দিচ্ছেন না। উপরন্তু তারা দ্রুত চাপ দিচ্ছেন ভবনগুলো বুঝে নেওয়ার জন্য। তাদের উদ্দেশ্য কী বুঝতে অসুবিধা হয় না কারও। কোনো রকম দায়সারাগোছের লিফট, ভবন এবং জেনারেটরের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে চায় রাজউক। একটি কোম্পানি এই এলাকায় ৪৭টি লিফট সরবরাহ করেছে। প্রতিটি লিফটের মান অত্যন্ত নিম্নমানের। এ ধরনের হাইরাইজ ভবনে যে ধরনের লিফট থাকার দরকার, তা এখানে সরবরাহ করা হয়নি। উপরন্তু লিফট সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুপারভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পিডব্লিউডির কর্মকর্তাদের ‘সখ্য’ ইতিমধ্যেই প্রকল্প এলাকায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
৯,০৩০ কোটি টাকার প্রকল্প এটি। ৭৯টি হাইরাইজ ভবন এই এলাকায়, উত্তরা রাজউক প্রজেক্টে ‘এ’ ব্লকে তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে শুধু ‘এ’ ব্লকে ৭৯টি ভবনে ৬,৬৩৬টি ফ্ল্যাট তৈরি করে তা বিক্রি করা হয়েছে এবং সেখানে মানুষ বসবাস করছে। এরপর ‘বি’ ব্লকে তৈরি করা হবে ৮৬টি ভবনে ৭,২২৪টি ফ্ল্যাট। তারপর ‘সি’ ব্লকে ৭৫টি ভবনে তৈরি হবে আরও ৬,৩০০টি ফ্ল্যাট। এর অর্থ এই এলাকায় ২৪০টি হাইরাইজ ভবনে ২০,১৬০টি ফ্ল্যাট তৈরি করা হবে। ‘বি’ ও ‘সি’ ব্লক এখনো নির্মাণাধীন। অথচ শত শত ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। এমতাবস্থায় ‘বি’ ও ‘সি’ ব্লকে এ ধরনের একটি বহুতল আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। শুধু উন্নয়নের নামে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অর্থহীন। এতে দুর্নীতি বাড়ে ও সাধারণ মানুষ এতে উপকার পায় কম।
এই যখন পরিস্থিতি তখন দৈনিক সমকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছাপা হয়েছিল গত ৮ জানুয়ারি (২০২১)। ‘ফ্ল্যাটে কষ্টের জীবন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তথাকথিত সার্ভিস চার্জের নামে একটি গোষ্ঠী এখানে তৎপর হয়ে উঠছে। এখানে এক ধরনের অদৃশ্য চাঁদাবাজি চলছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তথাকথিত বিল্ডিং কমিটির নামে সার্ভিস চার্জ আদায় করছেন, যার কোনো হিসাব নেই। এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালককে অবহিত করা হলেও, ‘অদৃশ্য’ কারণে তিনি নিশ্চুপ রয়েছেন। উপরন্তু ভবন কমিটি গঠন করার জন্য তিনি এখন অনলাইন ভোটিংয়ের ব্যবস্থা করছেন! যেখানে প্রজেক্টে বসবাসকারীদের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি, সেখানে ফ্ল্যাট মালিকরা অভিযোগ করেছেন এ মুহূর্তে এটা তার অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা উচিত নয়। কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে প্রকল্প পরিচালককে তথাকথিত ‘অনলাইন ভোটিং’ না করার অনুরোধ জানানো হলেও তিনি তা এড়িয়ে যাচ্ছেন। ফ্ল্যাট মালিকরা মনে করেন সার্ভিস চার্জ আদায়ের সঙ্গে যেহেতু দুর্নীতির একটি প্রশ্ন জড়িত, সেহেতু বিষয়টি রাজউকের নিজের হাতে রাখা উচিত। অথবা তৃতীয় পক্ষকে জড়িত করে ‘আউটসোর্সিং’-এর মাধ্যমে সার্ভিস চার্জ আদায়ের উদ্যোগ নিতে পারে রাজউক। নির্বাচন দিলে তাতে নানা জটিলতা তথা রাজনীতি জড়িয়ে পড়তে পারে। দোলনচাঁপা ভবনসহ আরও কিছু ভবনে গ্যারেজ স্বল্পতা রয়েছে। বিকল্প গ্যারেজ নির্মাণে রাজউকের কোনো আগ্রহ নেই। প্রকল্প এলাকায় মশার উপদ্রব থাকলেও রাজউকের কোনো উদ্যোগ নেই মশক নিধনে। কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রকল্প এলাকার ভেতরেই চাষাবাদ হচ্ছে, ফলে জন্ম হচ্ছে মশক বাহিনীর। এই চাষাবাদ বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেই রাজউকের। ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছেন এটা বন্ধেও রাজউক কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
রুয়াপ প্রধানমন্ত্রীর একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প। জমি না দিয়ে ফ্ল্যাট তৈরি করে তা বিক্রি করা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। দীর্ঘ ৮ বছরেও ৭৯টি ভবনের ৬,৬৩৬ ফ্ল্যাট নির্মাণ শেষ ও তা ফ্ল্যাট মালিকদের যখন বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি, তখন ব্লক ‘বি’-তে ৮৬ ভবন (৭,২২৪ ফ্ল্যাট) ও ব্লক ‘সি’তে ৭৫ ভবনের (৬,৩০০ ফ্ল্যাট) নির্মাণকাজ কবে শেষ হবে, তা এক প্রশ্ন বটে। এখানে রাজউকের ব্যবস্থাপনার ত্রুটি রয়েছে। সরকারিভাবে একজন প্রকল্প পরিচালককে একাধিক প্রকল্পে না রাখার সিদ্ধান্ত হলেও শোনা যাচ্ছে রাজউক একই প্রকল্প পরিচালককে দিয়ে ব্লক ‘এ’, ব্লক ‘বি’ ও ব্লক ‘সি’-এর নির্মাণকাজ শেষ করতে চাইছে। এতে করে প্রকল্পের গতি পাবে না। ব্লক ‘এ’-এর জন্য বরাদ্দ ছিল ৯,০৩,০৭১ দশমিক ৮৭ লাখ টাকা। এই টাকার পরিমাণ এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আমরা তা জানি না। সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে তোলা এসব ভবন নানা অনিয়মে যদি জর্জরিত থাকে, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প ‘বিতর্কিত’ হয়ে পড়বে। সাধারণ ফ্ল্যাট মালিকরা তা চান না। এ জন্য রাজউকে শক্ত নেতৃত্ব দরকার। রাজউক একজন নতুন চেয়ারম্যান পেয়েছে। সুবর্ণজয়ন্তীতে উত্তরা প্রকল্পের সফলতা তার ওপর নির্ভর করছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ অত্যন্ত শক্ত মানুষ। তিনি রুয়াপের বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে দেখবেন, এটা প্রত্যাশা করি। ‘অনলাইন’ নির্বাচনের নামে একটি তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজউক একটা অহেতুক ‘বিতর্ক’ সৃষ্টি করছে। এর কোনো প্রয়োজন নেই। বরং এই প্রকল্পে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি আছেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে রাজউকের নিয়ন্ত্রণে রুয়াপ পরিচালিত হওয়া উচিত বলে বসবাসকারীরা মনে করেন।
Daily Desh Rupantor
18.3.2021
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন ও তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ
23:37
No comments
আগামী ২৭ মার্চ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে প্রথম পর্যায়ের ভোটগ্রহণ শুরু হচ্ছে। মোট ২৯৪ আসনের বিধানসভার এ নির্বাচনে প্রথম পর্যায়ে ৩০ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১ এপ্রিল ৩০ আসনে, ৬ এপ্রিল ৩১ আসনে, ১০ এপ্রিল ৪৪ আসনে, ১৭ এপ্রিল ৪৫ আসনে, ২২ এপ্রিল ৪৩ আসনে, ২৬ এপ্রিল ৩৬ এবং সর্বশেষ ২৯ এপ্রিল ৩৫ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলাফল জানা যাবে ২ মে। একই সময়সীমায় পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি কেরালা, তামিলনাড়ু, আসাম ও পণ্ডিচেরীতেও বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে সব ছাপিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি এবং তা ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।
বেশ কিছু কারণে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার এ নির্বাচন অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। প্রথমত, ২০১১ সালে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সর্বত্র আলোড়ন তুলেছিল। ২০১৬ সালে পরবর্তী নির্বাচনেও দলটির বিজয় সহজ হয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালে এসে দলটির সম্ভাব্য ‘বিজয়’ কতটুকু সহজ হবে, সেটি একটা প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ও নির্বাচনে বিজেপি অন্যতম একটি শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। বিজেপির উত্থান মমতাকে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তার প্রতিক্রিয়া নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতিতে কতটুকু প্রতিফলিত হয়, সেদিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। তৃতীয়ত, মমতার বিকল্প হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে বাম-কংগ্রেস-সেক্যুলার ফ্রন্ট ঐক্য কি আদৌ একটি ‘শক্তি’ হিসাবে আবির্ভূত হবে? নাকি বিকল্প শক্তি হিসাবে দাঁড়িয়ে যাবে বিজেপি? চতুর্থত, তৃতীয়বারের মতো মমতা ব্যানার্জি যদি বিজয়ী হন, তাহলে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ভবিষ্যৎ কী? এ ক্ষেত্রে মমতার আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হলে তা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কতটুকু প্রভাব ফেলবে?
পশ্চিমবঙ্গের এ নির্বাচন খোদ নরেন্দ্র মোদির ‘রাজনীতির’ জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’। মোদির জনপ্রিয়তা এখন আর আগের মতো নেই। ভারতে ‘কৃষক আন্দোলন’ ও অর্থনীতির দুরবস্থা মোদির জনপ্রিয়তায় কিছুটা হলেও ধস নামিয়েছে। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ফোর্বস লিখেছে, গেল ৪২ বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি এত খারাপ অবস্থার দিকে আর কখনো যায়নি। যদিও এটা ঠিক, পশ্চিমবঙ্গসহ যেসব রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তার ফলাফল কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের ওপর আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে না। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিজয়ী হতে না পারলেও মোদি সরকারকে তা বেকায়দায় ফেলবে না।
২০১৬ সালের বিধানসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র তিনটি আসন। এবার তাতে পরিবর্তন আসবে। ১০০টির উপর আসনে বিজেপি বিজয়ী হবে বলে জনমত জরিপ বলছে। তবে বিজেপি আসামে বিজয়ী হবে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি সেখানে প্রথমবারের মতো বিজয়ী হয়েছিল। এর বাইরে কেরালায় সিপিআই(এম), তামিলনাড়ুতে ক্ষমতাসীন অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাভিদা মুন্নেত্রা কাজাগাম এবং ইউনিয়ন টেরিটরি পণ্ডিচেরীতে কংগ্রেস ও আন্না দ্রাভিদা মুন্নেত্রা কাজাগামের কোয়ালিশন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে বলেই পর্যবেক্ষকরা অভিমত দিচ্ছেন। এসব অঞ্চলে বিজেপির তেমন প্রভাবও নেই।
অনেকদিন ধরেই নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গকে টার্গেট করছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রশ্নে মোদি সরকারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস) এবং সিএএ’র (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) আলোকে পশ্চিমবঙ্গের এ নির্বাচন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপির শীর্ষ নেতারা, বিশেষ করে অমিত শাহর মতো নেতা যখন কিছু ‘মুসলমান’কে বাংলাদেশি হিসাবে আখ্যায়িত করে (তিনি উইপোকা হিসাবে এদেরকে চিহ্নিত করেছিলেন) তাদের বের করে দেওয়ার হুমকি দেন, তখন মমতা ব্যানার্জি তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। মমতার বারবার বিজয়ের পেছনে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের ভোটের বড় ভূমিকা রয়েছে। এ কারণেই তিনি বিজেপির টার্গেট। তবে এবার মুসলমানদের ভোট তিনি কী পরিমাণ পাবেন, তা এক প্রশ্ন। কারণ রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন মালদহের ফুরফুরা শরিফের পীরের ছেলে ‘ভাইজান’ খ্যাত আব্বাস সিদ্দিকী। তার ভাই নওশাদ সিদ্দিকী ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের চেয়ারম্যান। তারা তৃণমূলের সঙ্গে ঐক্য করেননি। ঐক্য করেছেন বাম আর কংগ্রেসের সঙ্গে। এই ঐক্য তৃণমূলের মুসলমান ভোট কেড়ে নেবে। এটা মমতার একটি ব্যর্থতা যে তিনি আব্বাস সিদ্দিকীর মতো তরুণ মুসলিম নেতাকে কাছে টানতে পারেননি। তরুণ মুসলমান ভোটারদের মাঝে আব্বাস সিদ্দিকীর জনপ্রিয়তা আছে। তার সমর্থকদের ভোট তৃণমূল পাবে না। ফলে পরোক্ষভাবে সুবিধা পাবে বিজেপি।
এই নির্বাচন সামনে রেখে মমতা ব্যানার্জির একটি মন্তব্য বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি এখন সামনে নিয়ে এসেছে। মমতা ব্যানার্জির একটি মন্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে-‘তিস্তা উত্তরবঙ্গের হিস্সা। আগে নিজে খাব, তারপর তা দেব। আগে আমার ঘরে রাখতে হবে। তারপর দেওয়ার কথা উঠছে।’ গত ৭ মার্চ শিলিগুড়িতে মহামিছিল করে তিনি এ মন্তব্যটি করেন। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে তার অবস্থান তিনি আরও স্পষ্ট করলেন। ইতোমধ্যে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ব্যক্তিগতভাবে মোদিও চান তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি হোক। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি ঢাকায় এসেও বাংলাদেশের ন্যায্য দাবির প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেননি। বরং উল্টো তিস্তার পানি বণ্টনের সঙ্গে আত্রাই পানি বণ্টনের প্রশ্নটিও যুক্ত করেছিলেন। কাজেই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনের আগে যখন মমতা ব্যানার্জি তিস্তার পানি বণ্টনের প্রশ্নে এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন স্পষ্টতই তা বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য যথেষ্ট চিন্তার কারণ। তিস্তার পানির ওপর আমাদের অধিকার ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। উজানের কোনো দেশ (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) পানি প্রত্যাহার করে নিতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। সেখানে পানির চাহিদা আছে সত্য, কিন্তু তা কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশকে পানিবঞ্চিত করে নয়। আমাদের দাবি ভারত সরকারের কাছে। আর ভারত সরকারের উচিত বাংলাদেশের দাবির প্রতি সম্মান জানানো। এ ক্ষেত্রে কোনো ‘ইস্যু’ (এ ক্ষেত্রে তিস্তার পানি বণ্টন) যদি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো অন্তরায় সৃষ্টি করে, তা সমাধানের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের।
মমতা ব্যানার্জি তিস্তার পানি বণ্টনের প্রশ্নে যখন একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেন, তখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে-বাংলাদেশের ভূমিকা এখন কী হবে? বাংলাদেশের উচিত হবে প্রস্তাবিত তিস্তা পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আশার কথা, এ প্রকল্পে চীনা অর্থায়নের আশ্বাস পাওয়া গেছে। চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানের শর্ত দিলে বাংলাদেশ তা গ্রহণ করে। প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতরের তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন চালিয়ে নদীর মাঝখানের গভীরতা ১০ মিটার বাড়িয়ে ফেলা হবে এবং নদীর প্রশস্ততাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা হবে। নদী শাসনের মাধ্যমে জমি উদ্ধার করা হবে এবং ব্যাপক চাষাবাদের উদ্যোগ নেওয়া হবে। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। একইসঙ্গে বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এ প্রকল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের জনজীবনে বড় পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা তৈরি করলেও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ভারত এ প্রকল্পের ব্যাপারে তাদের আপত্তি জানিয়েছে। এ কারণে প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত একনেক সভায় উপস্থাপন করা হয়নি। ভারতের যুক্তি হচ্ছে, প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণের কারণে তাদের দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হবে। ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পে বেশ কয়েকশ’ চীনা নাগরিক কর্মরত থাকবেন। ভারতের শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে বহুল আলোচিত ‘চিকেন লেকে’র কাছাকাছি চীনা নাগরিকদের উপস্থিতি তাদের ভাষায় ভারতের জন্য একটি নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে আমরা জানি না। প্রস্তাবিত তিস্তা পানি ব্যবস্থাপনার প্রশ্নটি আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারণ তিস্তার উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে মাঝেমধ্যে লালমনিরহাটের ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ ৫০০ কিউসেকে এসে দাঁড়ায়। অথচ নদী রক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় এক হাজার কিউসেক। আর সেচ প্রকল্পের জন্যও আমাদের দরকার ন্যূনতম তিন হাজার কিউসেক পানি। সুতরাং তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৭ ও ২০১১ সালে দু-দুবার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির মুখে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি আর স্বাক্ষরিত হয়নি। এখন মমতা ব্যানার্জি যদি আবারও ক্ষমতায় আসেন, তাহলে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ ক্ষেত্রে মোদি সরকারের ইচ্ছা থাকলেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারবে না। ফলে বাংলাদেশকে চীনের সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। তবে পশ্চিমবঙ্গে যদি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়, তাহলে তিস্তা চুক্তি হতে পারে। কিন্তু সে সম্ভাবনা ক্ষীণ।
সুতরাং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বারবার মমতা ব্যানার্জির ওপর আস্থা রেখেছি। আমরা তাকে সম্মানিত করেছি। কিন্তু বাংলাদেশের ন্যূনতম চাহিদার প্রতি মমতা ব্যানার্জি কোনো সম্মান দেখাননি। এমনকি তিনি নিজে অধ্যাপক কল্যাণ রুদ্রকে দিয়ে একটি কমিশন পর্যন্ত গঠন করেছিলেন। অধ্যাপক রুদ্র নিজে অভিমত দিয়েছিলেন, উত্তরবঙ্গের চাহিদা মিটিয়েও বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পানি দেওয়া সম্ভব। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি অধ্যাপক রুদ্রের মতামত গ্রহণ করেননি। আসলে ‘তিস্তার পানি বণ্টন’ মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু’। এ ইস্যুকে ব্যবহার করে তিনি বারবার বিজয়ী হয়েছেন। সম্ভবত এবারও বিজয়ী হবেন। সুতরাং তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি
Jugantor
14.3.2021
পাঁচ দশকের বাংলাদেশ : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা
23:34
No comments
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা দেবে চলতি মার্চ মাসে। একটি দেশের জন্য এ পাঁচ দশক একেবারে কম সময় নয়।
এ পাঁচ দশকে বাংলাদেশের রয়েছে অভাবনীয় সাফল্য। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কিসিঙ্গার যে দেশটিকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা তলাবিহীন ঝুড়ি হিসাবে, সেই দেশটি চলতি ২০২১ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে সব ধারা অতিক্রম করবে।
উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি আসবে ২০২৪ সালে। এটা নিঃসন্দেহে একটি মর্যাদার বিষয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক দিয়ে অনেক দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এখন সামনের কাতারে। ১৯৭৪ সালে দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ যেখানে ছিল মাত্র ৪২.৫ মিলিয়ন ডলার (CEIC Data.com), সেখানে ফেব্রুয়ারি (২০২১) মাসে এসে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে।
অথচ পাকিস্তানিদের রিজার্ভের পরিমাণ ২০.৫১২ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্ধেকেরও কম। যদিও ভারতের রিজার্ভের পরিমাণ অনেক বেশি, ৫৮১ বিলিয়ন ডলার। গেল ১০ বছরে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪১ ভাগ হারে বেড়েছে। বাংলাদেশের যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে ১১ মাসের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে জনসংখ্যা ছিল, গেল ৫০ বছরে তা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে যেখানে ১৯৭২-৭৩ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার, ২০১৯-২০ সালে তা বেড়েছে ২০৭৯ ডলারে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ২.৭৫ ভাগ (১৯৭২-৭৩), সেখানে ২০১৮-১৯ সময়সীমায় উন্নীত হয়েছিল ৮.১৫ ভাগে। তবে করোনাকালীন সময়ে পৃথিবীর সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও শ্লথ গতি আসে। এডিবির মতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালে প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৫.২ ভাগ, আর ২০২১ সালে ৬.৮ ভাগ। অথচ এডিবিই বলছে ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ভারতে মাইনাস ৯ ভাগ, শ্রীলঙ্কায় মাইনাস ৫.৫ ভাগ, আফগানিস্তানে মাইনাস ৫ ভাগ, আর পাকিস্তানে মাইনাস ০.৪ ভাগ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫.২ ভাগ বলে দেয় করোনাকালীন সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে ছিল।
অর্থনীতি ক্ষেত্রে আরও কিছু পরিসংখ্যা দিয়ে আমরা বোঝাতে পারব আমাদের অর্জন গেল ৫০ বছরে অনেক দেশের চেয়ে বেশি। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৪.৭ ভাগ, ডলার প্রতি বিনিময় মূল্য ছিল ৭.৩০ টাকা, রপ্তানি আয় ছিল ৩৩ কোটি টাকা, আমদানি ব্যয় ছিল ২৮.৭৩ টাকা, রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ০.৮৩ কোটি ডলার, সেখানে প্রায় ৫০ বছরের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি ৫.৫ ভাগে, ৮৬ টাকা ডলার প্রতি মূল্য, রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৬.০০ কোটি ডলারে, আবার আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে ৫৪০০ কোটি ডলারে। রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেড়েছে ৪৫০০ কোটি ডলার। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দুই বা তিনটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল আমাদের রপ্তানি খাত। বিশেষ করে পাটজাত দ্রব্য, চা ও চামড়া-চামড়াজাত পণ্যের বদলে এখন স্থান করে নিয়েছে তৈরি পোশাক ও জনশক্তি। ওষুধ শিল্পও বিকশিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর তথ্য মতে (২০১৯-২০২০) বাংলাদেশ ১১৮টি দেশে বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ রপ্তানি করেছে। স্বাধীনতার আগে আমাদের খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল কমবেশি এক কোটি টন। তখন লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সর্বশেষ তথ্য বলছে আমাদের মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে চার কোটি টন। উৎপাদনের পরিমাণ গড়ে চারগুণেরও বেশি। এর মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছি।
গত ৫০ বছরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবাখাতে যেসব উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তার একটি চিত্র আমরা পাব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স- এইচডিআই (ইউএনডিপি কর্তৃক প্রণীত) এ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে (শিশু শিক্ষা, মাতৃমৃত্যু) আমাদের অগ্রগতি ভারতের চেয়েও ভালো- একথা স্বয়ং স্বীকার করেছে অমত্য সেন। প্রাপ্ত তথ্য মতে এইচডিআই সূচকে ২০০০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫, সেখানে ২০১৭ সালে তা উন্নীত হয় শূন্য দশমিক ৬১ এ। ২০১৯ সালে অবস্থান ছিল ০.৬৩ এ (প্রথম অবস্থান নরওয়ের (০.৯৫৭)। ভারতের স্কোর (০.৬৪৫, ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৩১, আর বাংলাদেশের ১৩৩)। প্রাথমিক শিক্ষায় নিট ভর্তির সংখ্যা এখন ৯৭.৯ ভাগ। মাতৃমৃত্যুর হার এখন মাত্র ১৬.৫ ভাগ। ৭০ বছরের ওপরের বয়স্ক নাগরিকদের সাক্ষরতার হার এখন শতভাগ। ২০০৬ সালে গড় আয়ুকাল যেখানে ছিল ৬৪.৪, ২০১৯ সালে তা বেড়েছে ৭২.৪ ভাগে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০.৫ এ কমে এলেও (বিবিএস রিপোর্ট), করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের গবেষণা অনুযায়ী সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে এখন ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। টেকসই প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশ (জিএসসিআই-২০২০) ১৭ ধাপ এগিয়ে (১৮০ দেশের মধ্যে ১১৫তম, বাংলাদেশের স্কোর ৪৩.৩, ভারতের অবস্থান ১২৭তম অর্থাৎ ভারত পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের চেয়ে) গেলেও বৈষম্য গত ৫০ বছরে আমরা দূর করতে পারিনি। বৈষম্য মাপা হয় ‘গিনি সহগ’ দিয়ে।
২০১৬ সালের আমাদের ‘গিনি সহগ’ ছিল শূন্য দশমিক ৪৮৩। শূন্য দশমিক ৫ হলেই অতি উচ্চ বৈষম্যের দেশ হয়ে যায়। মাথাপিছু ঋণের বোঝা বাড়ছে- এটা আমরা কমাতে পারিনি। ২০১৫ সালের শেষ দিকে মাথাপিছু ঋণ ছিল ১৩ হাজার ১৬০ টাকা, তখন তার পরিমাণ অর্থনীতি সমিতির মতে প্রায় ৭৯ হাজার টাকা। সাম্প্রতিককালে আমাদের অর্থনীতির জন্য দুটি খারাপ খবর- এক. বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার, আর দুই. খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি। ২০২০ সালে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা (যুগান্তর, ৬ ডিসেম্বর, ২০২০)। যে কোনো বিবেচনায় আমাদের জন্য এটি খারাপ সংবাদ।
বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি গত ৫০ বছরে একেবারে কম নয়। বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ তার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বহিঃবিশ্বে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। গত ৫০ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও চীনের সম্পর্ক বেশি আলোচিত হয়েছে।
এটা ঠিক গত বারো বছরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর (২০১৬) ও প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর (২০১৪) এবং চীন কর্তৃক ৯৭ ভাগ বাংলাদেশি পণ্যের চীনে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার (২০২০) চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও জোরদার করেছে।
বাংলাদেশ অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিন যে সমুদ্রসীমানা বিরোধ ছিল, তা বাংলাদেশ (২০১২) অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সমাধান করেছে। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধেরও সমাধান হয়েছে।
তবে তিস্তার পানি বণ্টনের সমাধান না হওয়া এবং ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আশ্রয়, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের সব অর্জনকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দেয়। এশীয়-প্যাসিফিক অঞ্চল ক্রমান্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে আগামী দিনে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়বে।
বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তী পালন করে এখন হীরক জয়ন্তী (৬০ বছর) পালনে একধাপ এগিয়ে গেল। সামনে রয়েছে প্লাটিনাম জয়ন্তী (৭৫), তারপর শতবর্ষ জয়ন্তী। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। তবে বলতেই হবে আমাদের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হয়। এটাই এ মুহূর্তের অগ্রাধিকার।
Jugsntor
12.3.2021
পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ ও কিছু শঙ্কার জায়গা
20:34
No comments
আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশ পঞ্চাশ বছরে পা দেবে। এ পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। তবে শঙ্কার জায়গাও রয়েছে। বাংলাদেশ যখন পঞ্চাশ বছরে পা দিতে যাচ্ছে, তখনই ২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার বাধা অতিক্রম করেছে। তবে স্বীকৃতিটি পেতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। এটা আমাদের জন্য বড় পাওয়া। এই প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বড় শঙ্কার জায়গাও রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা এবং বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে উপস্থিতি সংকটকে আরও গভীরতর করবে। আমাদের জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, যে ১১টি দেশ আগামীতে অর্থনৈতিক শক্তির দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ তার অন্যতম। করোনার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬.৮ ভাগে থাকবে বলে এডিবি মনে করছে। আর মাথাপিছু আয় এখন ২০৬৪ ডলার (আইএমএফ)। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। খাদ্য ও এনার্জিতে এক রকম স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এশিয়ায় ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। ১৬০ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সংখ্যা প্রায় ১৫০ মিলিয়ন এবং ৯০ মিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে (প্রধানমন্ত্রীর স্বীকারোক্তি, সিএফআর, নিউইয়র্ক, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। আর এরাই অর্থনীতিতে পরিবর্তনটা ডেকে আনতে পেরেছেন। সামাজিক ক্ষেত্রে যেসব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে, যা অমর্ত্য সেন নিজেও স্বীকার করেছেন। বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো শীর্ষে। যা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানকে অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছে। তবে বলতেই হয়, সমস্যাও আছে। রোহিঙ্গা সংকটে এক ধরনের ঝুঁকির মুখে আছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সারাবিশ্ব প্রশংসা করেছে বাংলাদেশের। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় (বাংলাদেশ-মিয়ানমার) বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে সফল, তা বলা যাবে না। আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখন দেখার পালা আইসিজেতে চূড়ান্ত কী রায় আসে। আরেকটি শঙ্কার জায়গা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। বাংলাদেশ বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী না হলেও যে কটি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতি হবে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। সম্প্রতি গ্লোবাল ক্লাইমেট ইনডেস্ক ২০২০ প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। তালিকার শীর্ষে রয়েছে পুর্তোরিকো। বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে সাগর-মহাসাগরের পানি বেড়ে যাবে। এতে বাংলাদেশের মতো সাগরপারের দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা দীর্ঘদিন ধরেই বলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফলতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক আসরে অর্থায়নের ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে পেরেছে তা বলা যাবে না। এজন্যই পরিবেশ তথা জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে একটি দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমরা তা পারিনি। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে (‘কপ’ সম্মেলনসমূহ) আগ্রহ দেখা যায় বেশি। আন্তর্জাতিকভাবে বহুপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশ কখনই শক্ত অবস্থানে যেতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ঠিক একই অবস্থা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আলোচনায়ও। বাণিজ্যসংক্রান্ত আইনকানুন বেশ জটিল। এখানে দরকার দক্ষ আলোচক, দক্ষ জ্ঞানসম্পন্ন বাণিজ্য কর্মকর্তা, যা আমাদের নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও যথেষ্ট দুর্বল। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমরা আমাদের ‘অবস্থান’ ধরে রাখতে পারিনি। তাই কয়েকশ কোটি টাকা খরচ করে আমলাদের হার্ভার্ডে পাঠিয়ে তাদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা পারব না। এটা হবে এক ধরনের ‘প্রমোদভ্রমণ’!
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে যখন বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে প্রশংসা করা হয় তখন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আমাদের দরকার একটি দক্ষ আমলা শ্রেণি। বর্তমান কাঠামোয় দক্ষ আমলা শ্রেণি আমরা পাচ্ছি না, যারা বাংলাদেশকে ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার যে ‘স্বপ্ন’, তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নেবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টান্ত আমরা অনুসরণ করতে পারি, যেখানে বেসরকারি খাত থেকে দক্ষ জনশক্তি নিয়ে প্রশাসন পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ২০২০ সালের শেষের দিকে এসেও আমরা অর্থনীতিকে সচল হতে দেখেছি। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। মনে রাখতে হবে ২০২৬ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের ‘তকমা’ ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। বিশ্বের শীর্ষ ২৪টি অর্থনীতির দেশের একটিতে পরিণত হবে তখন।
আইসিটি খাতকে বাংলাদেশ গুরুত্ব দিয়েছে। ১২০টি কোম্পানি বর্তমানে ৩৫টি দেশে তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত প্রযুক্তি রপ্তানি করছে। এর পরিমাণ বছরে এক বিলিয়ন ডলার, যা কিনা বাংলাদেশ ২০২২ সালে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। বাংলাদেশ আইসিটিতে বিশ্বে বড় ভূমিকা রাখতে চায়। ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল অর্থনীতিতে পরিণত হতে চায় দেশটি। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের মতে, বাংলাদেশে অনলাইনে যে জনশক্তি নিয়োজিত তা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এখানে একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এই সেক্টরটিও গার্মেন্টসের মতো যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশ এই সেক্টরকে গুরুত্ব দিয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ শতকরা একশ ভাগ ‘ইন্টারনেট কানেকটিভিটি’ অর্জন করতে চায়। কিন্তু কিছু কিছু নীতিগত ত্রুটি থাকার কারণে লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ ব্যর্থ হতে পারে! বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় একটি তরুণ প্রজন্ম থাকা সত্ত্বেও তাদের আমরা দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারিনি। এই তরুণ প্রজন্মকে আমরা জেনারেশন ‘জেড’ বলছি (এবহবৎধঃরড়হ-ু)। যাদের জন্ম ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে, তাদেরই ‘জেনারেশন জেড’ নামে অভিহিত করা হয়। এই জেনারেশন জেড চীনকে বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশে এই জেনারেশন জেড গ্রুপের একটি বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও আমাদের ভ্রান্ত নীতির কারণে এদের আমরা যুগোপযোগী শ্রমশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। দেশে বর্তমানে এমএ তথা মাস্টার্স পাস করা তরুণ প্রজন্মের মাঝে শতকরা ৩৪ জনই বেকার। প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে আসছে, যারা অদক্ষ। অথচ আইটি সেক্টরে যোগ্য করে গড়ে তুলে আমরা বিদেশি বাজারের জন্য এদের তৈরি করতে পারতাম। আমরা তা পারিনি। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। অথচ বহির্বিশ্বে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আইটি সেক্টরের যে চাহিদা, সেদিকে আমাদের কারোরই নজর নেই। তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরে নতুন নতুন যে প্রযুক্তি ঃযব রহঃবৎহবঃ ড়ভ ঃযরহমং, নষড়পশপযধরহ ধৎঃরভরপরধষ রহঃবষষবমবহপব নরম ফধঃধ ধহফ ধহধষুঃরপং এসব প্রযুক্তির সঙ্গে আমরা জেনারেশন জেড প্রজন্মের সঙ্গে ব্যাপক পরিচয় করিয়ে দিতে পারিনি। অথচ এসব প্রযুক্তির সঙ্গে যারা জড়িত এবং দক্ষ তাদের চাকরির বাজারের একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। যারা আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেতৃত্ব দেবেন, তাদের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত শিক্ষা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু আগামী ৫০ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে কোন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন সে ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে কম। তবে আশার কথা, বহির্বিশ্বে কোনো কোনো গবেষকের লেখায় বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় জনশক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উচিত এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো।
বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে উন্নত দেশগুলোতে জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমিয়ে ‘সবুজ এনার্জির’ দিকে ঝুঁকছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। এখানে সবুজ এনার্জি নিয়ে তেমন গবেষণাও হয় না। উপরন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ করার ব্যাপারে উন্নত বিশ্বের কাছে নয়া প্রযুক্তি থাকলেও তাদের অনীহা রয়েছে উন্নয়নশীল বিশ্বে এ প্রযুক্তি সরবরাহের। সোলার এনার্জির একটা বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও উন্নয়নশীল বিশ্বে এ এনার্জির ব্যবহার বাড়ছে না। বাংলাদেশে যে পরিমাণ সোলার এনার্জি ব্যবহার করা উচিত ছিল সে পরিমাণ ব্যবহার হচ্ছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সোলার এনার্জি ব্যবহারে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। ভারতের মতো দেশে যেখানে সোলার এনার্জির ব্যবহার বাড়ছে, সেখানে আমরা বাংলাদেশে তা বাড়াতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি বোঝেন বলেও মনে হয় না। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা ‘কপ’ সম্মেলন হলেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন সম্মেলনে যোগ দিতে। কিন্তু তারা সম্মেলনে গিয়ে কী শিখলেন, তার প্রয়োগ বাংলাদেশে কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে আদৌ ভাবেন না। একটি দৃষ্টান্ত দিই। গবেষণাধর্মী জার্নাল সায়েন্সে (ঝপরবহপব) গত ৫ জুলাই (২০১৯) একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। বেশ কয়েকজন গবেষক লিখেছেন ঞযব মষড়নধষ ঃৎবব ৎবংঃড়ৎধঃরড়হ ঢ়ড়ঃবহঃরধষ. গবেষণার মূল বক্তব্য হচ্ছে যদি কয়েকশ বিলিয়ন গাছ লাগানো যায়, তা হলে জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীর উষ্ণতা যে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা রোধ করা সম্ভব। গবেষকরা বলছেন, যদি ৫০০ বিলিয়ন গাছ লাগানো যায় তা হলে বায়ুম-লে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড রয়েছে তার শতকরা ২৫ ভাগ শোষণ করে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণের হার কমিয়ে আনতে পারবে। গাছ যে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এটা আমরা সবাই জানি। ভারতের উত্তরপ্রদেশে ব্যাপক বৃক্ষরোপণ, নিউজিল্যান্ডে কয়েক কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা কিংবা ফিলিপাইনে এ গাছ লাগানো ছাড়া কোনো শিক্ষার্থীকে স্নাতক ডিগ্রি দেওয়া হবে না- এ ধরনের সংবাদ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, যা আমাদের উজ্জীবিত করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সংবাদের গুরুত্ব রয়েছে। দুঃখজনক সংবাদ হলো, উত্তরপ্রদেশের একটি কট্টরপন্থি সরকার ব্যাপকভাবে গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলেও আমরা বাংলাদেশে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের সবাইকে তিনটি করে গাছ লাগানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সেই উপদেশ বাস্তবায়নের ব্যাপারেও তেমন কোনো উদ্যোগ আমাদের চোখে ধরা পড়ে না।
দাতব্য সংস্থা অক্সফামের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতি দুই সেকেন্ডে একজন মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এটি একটি উদ্বেগের বিষয়। এরা জলবায়ু উদবাস্তু। বাংলাদেশেও এই জলবায়ু উদবাস্তুর সংখ্যা বাড়ছে। এটা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশকে আগামীতে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আর বৈষম্য বাড়ছে বাংলাদেশে। করোনার কারণে এই বৈষম্য আরও বেড়েছে। মাথাপিছু ঋণের বোঝা বেড়েছে- এটা আমরা কমাতে পারিনি। এটাও একটা চ্যালেঞ্জ। ২০১৫ সালে মাথাপিছু ঋণের বোঝা ছিল ১৩ হাজার ১৬০ টাকা। এটা এখন প্রায় ৭৯ হাজার টাকা। আমাদের শঙ্কার জায়গা এখানেই।
সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের আশাবাদী হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। বাংলাদেশ আর ‘বটমলেস বাস্কেট’ নয়। বিশ্বকে বাংলাদেশ অনেক কিছু দিতে পারে। তাই হীরকজয়ন্তী ( 60 বছর) পালনে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হব এখনই। খাতগুলো চিহ্নিত করতে হবে। আর নিতে হবে মহাপরিকল্পনা।
Daily Amader Somoy
9.3.2021
সুবর্ণজয়ন্তীতে মোদির ঢাকা সফর
20:06
No comments
বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ২৬ মার্চ ঢাকায় আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ সফর চূড়ান্ত করতে গত ৪ মার্চ ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ঢাকায় তিনি এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে বক্তব্যও রাখেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আলোচিত হলেও, দুদেশের মধ্যে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে, যার সমাধান হয়নি এবং এর রেশ ধরে বাংলাদেশে একটি মিশ্রপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।
বিশেষ করে তিস্তার পানি বণ্টন ও এনআরসির মতো ইস্যু দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে অন্যতম অন্তরায়।
ভারতে এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস) এবং সিএএ’র (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) কারণে ভারত জুড়ে যে বড় ধরনের গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার প্রভাব বাংলাদেশে এসেও লেগেছিল। আসামে এনআরসির কারণে প্রায় ১৯ লাখ মানুষ (বিবিসি) ভারতের নাগরিক অধিকার হারিয়েছেন। ২০১৯ সালের ৩১ আগস্ট আসামের নাগরিকপঞ্জির যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, তাতে বাংলাভাষী পাঁচ লাখ হিন্দু ও সাত লাখ মুসলমান ভারতের নাগরিকত্ব হারান। এই নাগরিকপঞ্জি পশ্চিম বাংলায় বড় বিতর্ক তোলে এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে এনআরসির বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা যায়। চলতি ২০২১ সালে এই এনআরসি পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে অন্যতম একটি ইস্যু হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এ কারণে যে, বলা হচ্ছে নাগরিকত্ব হারানো প্রায় ১৯ লাখ মানুষ সবাই বাংলাদেশি এবং এরা বাংলাদেশ থেকে গিয়ে আসামে অবৈধভাবে বসবাস করে আসছিলেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ২০১৯ সালে ‘পুশইন’র ঘটনাও ঘটেছে। কিছু কিছু বাংলাভাষী মানুষ যশোরের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এমন খবরও বিদেশি মিডিয়ায় পরিবেশিত হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা ‘দুর্বল’ অবস্থানে গেছে বলে মনে হয়। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশকে কোনো চিন্তা না করতে আশ্বাস দিলেও বাংলাদেশ বেশ বড় ধরনের অস্বস্তিতেই ছিল এবং এখনো আছে। একপর্যায়ে বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রী (২০১৯) তাদের ভারত সফর স্থগিত করেন। তখন এর সঙ্গে এনআরসির একটা যোগসূত্র আছে বলেও কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে। এনআরসির বিষয়টি একটু পুরনো। ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই নাগরিকপঞ্জি নিয়ে একটি রায় দেয়। ওই রায় অনুসরণ করেই আসামে নাগরিক তালিকা তৈরি করা হয়। তবে এটা বিতর্ক বাড়ায় যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর লোকসভায় ঘোষণা করেন ভারতের সব রাজ্যে এনআরসি করা হবে। এরপরই পশ্চিম বাংলায় এনআরসিবিরোধী বড় আন্দোলন গড়ে ওঠে। এনআরসি নিয়ে বিতর্কের রেশ ফুরিয়ে আসার আগেই ভারতের সংসদে সিএএ পাস হয়। এটি বর্তমানে একটি আইন। এই আইন বলে উপমহাদেশের তিনটি দেশের (বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান) মুসলমান বাদে অন্য সব ধর্মের নাগরিকদের ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জনের পথ সহজ করা হয়। মুসলমানদের নাগরিকত্ব অর্জনে বঞ্চিত রাখা হয়। এই আইনও ভারতে বড় বিতর্ক তৈরি করে। এনআরসি ও সিএএ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই এবং বাংলাদেশ কোনো মন্তব্যও করতে পারে না। তবে অত্যন্ত ক্ষমতাবান অমিত শাহ যখন বাংলাদেশিদের ‘ছারপোকা’র সঙ্গে তুলনা করেন এবং প্রকাশ্যে জনসভায় বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য রাখেন, তখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা প্রভাব ফেলে বৈকি! এই ইস্যু দুটি দুদেশের সম্পর্কের জন্য একটি ‘টেস্ট কেইস’। বাংলাদেশের ক্ষমতাবান জনৈক মন্ত্রীর একটি উক্তিও (‘যারা বাংলাদেশি তাদের ফেরত নেওয়া হবে’) মিশ্রপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। তবে আশার কথা বাংলাদেশে তথাকথিত ভারতীয় বাঙালি নাগরিকদের, যারা মুসলমান তাদের ‘পুশইন’ করা হয়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আগামী ২৭ মার্চ থেকে পশ্চিম বাংলার বিধান সভার নির্বাচন শুরু হচ্ছে। আর আসামে শুরু হচ্ছে ২ মে থেকে। পশ্চিম বাংলা আর আসামে মুসলমান ভোটাররা একটি ফ্যাক্টর। যে কারণ এনআরসি ও সিএএ’র বিষয়টি সেখানে যে আলোচনায় থাকবে তা বলাই বাহুল্য। তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি স্পর্শকাতর। এর সমাধান হচ্ছে না। এর আগে নরেন্দ্র মোদি একবার ঢাকা ঘুরে গেছেন (২০১৫)। নরেন্দ্র মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে পাশর্^বর্তী দেশগুলোকে গুরুত্ব দেন। তার ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ পলিসির কারণে ভারতের সঙ্গে তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সম্পর্ক আরও উন্নত হয়েছে। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপ, নেপাল কিংবা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বিষয়টি উল্লেখ করতে পারি। মিয়ানমারের সঙ্গেও ভারত সম্পর্ক উন্নত করেছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশকে যে কত বেশি গুরুত্ব দেন, তার বড় প্রমাণ বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে মোদির ঢাকা সফর। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একটি ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন গত ১৭ ডিসেম্বর। করোনাকালে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এই বৈঠকের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত অতিক্রম করছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ৫০তম বছরেও পা রেখেছে বাংলাদেশ। ভার্চুয়াল বৈঠকের পর যে যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তাতে ভারত তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি ও সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার আশ্বাস আবারও দিয়েছে।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারত, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের মধ্যে যে আঞ্চলিক সড়ক হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ যুক্ত হতে চায়। এ ধরনের একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই ভার্চুয়াল বৈঠকের আগে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সিইও ফোরাম, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সহযোগিতা, জ¦ালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হাইড্রো-কার্বন বিষয়ে সহযোগিতা, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হাতি সংরক্ষণ বিষয়ে সহযোগিতা, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল জাদুঘর ও ভারতীয় জাতীয় জাদুঘরের মধ্যে সহযোগিতা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ও বরিশাল স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট-সংক্রান্ত সহযোগিতা চুক্তি। পরে দুদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল সামিটে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বন্ধ হয়ে যাওয়া নীলফামারীর চিলাহাটি সীমান্ত থেকে পশ্চিমবঙ্গের হলদিবাড়ি পর্যন্ত রেল যোগাযোগ উদ্বোধন করা হয়। দুদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ভারতের ডাক বিভাগের একটি স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত ও বঙ্গবন্ধু-বাপুজি ডিজিটাল এক্সিবিশনের উদ্বোধন করেন। ভার্চুয়াল বৈঠকে দুই প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় একসঙ্গে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ভারত থেকে ‘বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ’ ২০ লাখ ডোজ করোনা টিকা পেয়েছে। এটাকে তারা বলছে ‘ভ্যাকসিন মৈত্রী’।
কভিড-১৯ একটি বৈশি^ক সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবিলায় একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা দরকার। এ ক্ষেত্রে ভারতের অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারি। বলা ভালো, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ৩ কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন কিনছে বাংলাদেশ। ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য যে ১ হাজার ২৭১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছিল, তার মধ্যে ৭৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয় ও বায়োফার্ম অ্যাস্ট্রাজেনেকা কভিড-১৯-এর যে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে, তা এখন ভারতের পুনায় সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত হচ্ছে। সেরাম কর্তৃক উৎপাদিত ভ্যাকসিন (১ কোটি ডোজ প্রতি মাসে) দক্ষিণ এশিয়া তথা উন্নয়নশীল বিশে্বর জন্য একটি আশীর্বাদ। ভারত জনবহুল দেশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যাও ১৭ কোটির মতো। সুতরাং এই দুদেশে করোনা ভ্যাকসিনের (দুই ডোজ দিতে হবে) চাহিদা বিশাল। সুতরাং সেরাম আমাদের চাহিদার একটা অংশ মেটাতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের কোনো ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে এই ভ্যাকসিনটি আগামীতে উৎপাদন করা যায় কি না, তাও বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে।
বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক ৫০ বছরে পা দিয়েছে। ২৬ মার্চ (২০২১) বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে। এই সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি আমাদের জন্য একটি বড় পাওয়া। নিঃসন্দেহে তার উপস্থিতি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা দুদেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যার সমাধান হোক। বিশেষ করে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো ইত্যাদির ব্যাপারে ভারত একটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এ প্রত্যাশা বাংলাদেশের জনগণের। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর (২০১৭) কিংবা নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর (২০১৫) এবং পরে ভার্চুয়াল বৈঠকেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে তিস্তার পানি বণ্টনের। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে তিস্তা চুক্তি হয়নি। সমস্যাটা ভারতের। এর সমাধান ভারতকেই করতে হবে। এভাবে বারবার যদি আশ্বাস দেওয়া হয় এবং সমস্যার যদি কোনো সমাধান না হয়, তাহলে তা দুদেশের বন্ধুত্বের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। বারবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। অথচ ভারত-নেপাল সীমান্ত কিংবা ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত এ ধরনের হত্যাকা- হয় না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি এখন সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। তাই ঘাটতির পরিমাণ এখন হাজার হাজার কোটি টাকা। ভারতীয় শুল্কনীতির কারণেই বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। সাফটা চুক্তিতে বেশ কয়েকটি পণ্যের ব্যাপারে শুল্ক হ্রাসের কথা বলা হলেও, ভারত তা কার্যকর করেনি। ইতিপূর্বে ভারতের পক্ষ থেকে যে ৫১৩টি পণ্যের ছাড় দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে ৩৫০টি পণ্য বাংলাদেশের পক্ষে কোনোভাবেই রপ্তানি করা সম্ভব নয়। ভারত বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কহার না কমালেও বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের শুল্কহার কমিয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্কহার ধার্য ছিল শতকরা ৩০০ ভাগ। ১৯৯৪-৯৫ সালে তা কমিয়ে আনা হয় ৬০ ভাগে। এখন শুল্কহার দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৫ ভাগে।
দুদেশের মধ্যকার বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধায় জাহাজযোগে ভারতীয় পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে। অথচ নেপালে ত্রিদেশীয় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ভারত এটা করছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে (ভারত-নেপাল)। শুষ্ক মৌসুমের জন্য বাংলাদেশ (রাজবাড়ীর পাংশা থেকে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত) একটি জলাধার নির্মাণ করতে চায় (গঙ্গা ব্যারেজ), সে ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু তা যেন হয় পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। বারবার আশ্বাস দেওয়া হলে এবং বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে, প্রশ্ন উঠবেই।
Desh Rupsntor
9.3.2021
Subscribe to:
Posts (Atom)