শুধু নদী বাঁচানোই নয়। সেচ প্রকল্পের জন্যও আমাদের দরকার ন্যূনতম তিন হাজার কিউসেক পানি। সুতরাং তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে এটা সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে।
আমরা ভারতের অনেক ‘দাবি’ পূরণ করেছি। মোদির আমলে সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে দুই দেশের সীমানা এখন চিহ্নিত। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতির পরও মমতা যদি তাঁর ওপর রাখা আস্থার প্রতিদান না দেন, তাহলে তা যে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটা অবিশ্বাসের জন্ম দেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে রুদ্র কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিতে পারেন, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের এই পানি বিশেষত বাংলাদেশকে ৫০ শতাংশ পানি দেওয়া সম্ভব বলে সুপারিশ করেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রণব কুমার রায়ও এই সুপারিশ সমর্থন করেছিলেন। এর ভিত্তিতেই মমতা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে মমতাকে আস্থায় নেওয়া সত্যিকার অর্থেই কঠিন। ঢাকায় আসার আগে আত্রাই প্রসঙ্গটি তুলে তিনি একটি ‘জট’ লাগিয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ আত্রাইয়ের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি এক করে দেখেছেন। এটি একটি ভিন্ন বিষয়। আত্রাই নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু তিস্তার পানি প্রাপ্তি আমাদের অগ্রাধিকার। এর সঙ্গে অন্য কোনো ইস্যুকে তুলনা করা যাবে না। বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি সামনে রেখে ভারতের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। সমুদ্রসীমাও নির্ধারিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক আসরে। ‘দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়নি। আজকে প্রয়োজনে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আসরে তুলে ধরতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষের বেঁচে থাকার বিষয়টি ঝুলে থাকতে পারে না।
লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর বিষয়টি নির্ভর করে না। ভাটির দেশ হিসেবে তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকার আমাদের রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এককভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিতে পারেন না। তিনি তা যদি করেন, তাহলে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ক্ষেত্রে মমতাকে নয়, বরং ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর আমাদের চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, মমতা বারবার রং বদলাচ্ছেন। একবার বলেছিলেন তিনি ‘কাঠবিড়ালি’ হবেন। আর এবার বললেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেবেন। স্পষ্টতই এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি অন্যদিকে দৃষ্টি সরাতে চান।
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই ‘যুক্তি’ ও ‘ন্যায়ের ভিত্তি’ শব্দ দুটি উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটি হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ কনভেনশন’ নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬ নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরো আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশসংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫ নং অনুচ্ছেদ প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।
তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আমরা চাই এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বারবার ভারতীয় নেতাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তিস্তা চুক্তি আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা চাই। বর্তমান সরকারের সময় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। দীর্ঘ ৪০ বছর ছিটমহল সমস্যা দুই দেশের মধ্যে আস্থার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। এখন তা অতীত। ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতকে ‘ট্রানজিট’ দিয়েছে। ভারত থেকে আমরা বিদ্যুৎ পাচ্ছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় (২৭ মে ২০১৫) একটি চার দেশীয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা (বিবিআইএন) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখন শুধু তিস্তা চুক্তির কারণে এই সম্পর্ককে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না—এটা হতে পারে না। সুতরাং আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করবে। এ ব্যাপারে ভারতে একটি জনমত সৃষ্টি করাও জরুরি।
বাংলাদেশ ভবিষ্যতে বড় ধরনের পানি সংকটের সম্মুখীন হবে। তিস্তায় পানি নেই। পানি নেই পদ্মায়ও। গড়াই শুকিয়ে গেছে। এ অবস্থায় পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে ভারতের সহযোগিতা আমাদের দরকার। আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এই প্রশ্নটি জোরের সঙ্গে তিনি উত্থাপন করবেন।
Daily kalerkontho
13.03.2017
0 comments:
Post a Comment