তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় এটি এখন আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে বাড়বে। তিস্তায় পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকার নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি বা সমর্থন—এটা আমাদের বিষয় নয়। আমাদের নেতৃত্ব বিষয়টিকে হালকাভাবে নেননি। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইন স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় এক হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রিপর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ, ৩৯ শতাংশ ভারত ও ২৫ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ শতাংশ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয়েছিল মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই অতীতে মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরো একটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টনে সিকিমকে জড়িত করারও প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই পানি চাইবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আন্তর্জাতিক নদীর পানি তিনি এককভাবে ব্যবহার করতে পারেন না। নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে তিনি এবার একটি ‘নতুন ফর্মুলা’ দিলেন। তিনি তোর্সা ও জলঢাকাসহ চারটি নদীর নাম বললেন, যেখান থেকে পানি নিয়ে বাংলাদেশের চাহিদা পূরণ করা যায়। বাংলাদেশে তোর্সা ও জলঢাকা দুধকুমার ও ধরলা নামে পরিচিত। মমতার এই বক্তব্য তো মূলত ভারতের আন্ত নদীসংযোগ প্রকল্পেরই নামান্তর। এর আগে ঢাকায় এসে মমতা অভিযোগ করেছিলেন, বাংলাদেশ আত্রাই নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এই হচ্ছে মমতা। এখন নয়াদিল্লিতে মোদি বললেন, মমতার সম্মতি নিয়েই তিস্তা চুক্তি হবে। মমতার বক্তব্যের পর মোদির আশ্বাস শুধু আশ্বাসের মধ্যে থেকে যায় কি না, সে আশঙ্কা থাকলই। সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে যৌথ ঘোষণাপত্রে কোনো উল্লেখ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রেস ব্রিফিংয়ে পাটজাত পণ্যের ওপর ১৩ শতাংশ হারে ভারত যে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক ও ৩০ শতাংশ হারে তৈরি পোশাকের ওপর কাউন্টার ভেইলিং শুল্ক আরোপ করেছে, তা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু ভারতের অঙ্গীকার তাতে পাওয়া যায়নি। ভারত যে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের ঋণের প্রস্তাব করেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ২০১০ সালে ভারত যে এক বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রস্তাব করেছিল, তার প্রায় ৫০ শতাংশ এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। ২০১৬ সালে আরো দুই বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রস্তাব দিয়েছিল ভারত। ওই অর্থের ব্যবহার এখনো শুরুই হয়নি। এখন এলো প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব। এতে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার কথা, কিংবা কবে নাগাদ তা ছাড় দেওয়া হবে, তাতে রয়ে গেছে অস্পষ্টতা। উপরন্তু এসব ঋণ প্রকল্পে প্রকারান্তরে লাভবান হবে ভারতই। প্রতিরক্ষা খাতে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব আছে। এর একটি ভালো দিক হচ্ছে বাংলাদেশ তার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই অর্থ দিয়ে সামরিক সরঞ্জাম কিনবে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে দুই দেশের সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তা এখন একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে গেল। অনেক আগে থেকেই সেনাসদস্যরা এসব ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ তথা শিক্ষালাভ করেন। পরমাণু শক্তি কেন্দ্র নির্মাণে ও প্রশিক্ষণে যে সহযোগিতা কিংবা সাইবার নিরাপত্তা চুক্তি, বিচারপতিদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নিঃসন্দেহে ভালো দিক। খুলনা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিস, কিংবা ঢাকা-খুলনা-কলকাতা বাস সার্ভিসও ভালো দিক। সাধারণ মানুষ এ থেকে উপকৃত হবে। তবে ভিসা সহজীকরণের ক্ষেত্রে যদি কোনো ঘোষণা আসত, তা বাংলাদেশিদের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনত। কিন্তু তা আসেনি। বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনার ব্যাপারেও কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে ভারতের সহযোগিতার ব্যাপারে আমাদের প্রত্যাশা ছিল, তাও পূরণ হয়নি।
সব মিলিয়ে ‘ভালো-মন্দ’ নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষ হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এটাকে ভালো চোখে দেখছে না। খালেদা জিয়া এসব চুক্তিকে আখ্যায়িত করেছেন ‘দেশবিরোধী’ চুক্তি হিসেবে। আর রিজভীর ভাষায়, ‘প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে দেশের নিরাপত্তা দুর্বল করল সরকার। ’ এটা ঠিক, চুক্তি ও সমঝোতায় বাংলাদেশের প্রত্যাশা ১০০ ভাগ পূরণ হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভারত বড় দেশ। ২.১ ট্রিলিয়ন ডলারের (বিশ্বে সপ্তম) অর্থনীতি ভারতের। ভারতের এই অর্থনীতি থেকে আমরা যতটুকু লাভবান হব, ততই আমাদের মঙ্গল। প্রধানমন্ত্রী চীনে গিয়েছিলেন। এবার ভারত গেলেন। চীনের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এতেই প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। আমাদের সাফল্য এখানেই যে আমরা এই দুই এশীয় তথা উঠতি বিশ্বশক্তির সঙ্গে এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ আদায় করতে সচেষ্ট হচ্ছি। এটাই সঠিক নীতি। ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। ভারতকে যেমন আমরা অস্বীকার করতে পারব না, ঠিক তেমনি উন্নয়নের জন্য আমাদের চীনেরও প্রয়োজন রয়েছে।
Daily Kalerkontho
11.04.2017
0 comments:
Post a Comment