রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি
বা সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের রাজধানী
নেপিদোতে ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অব ডিসপ্লেসড পারসনস ফ্রম রাখাইন
স্টেট’ শীর্ষক এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল
হাসান মাহমুদ আলী এবং মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দফতরের মন্ত্রী খিও
তিন্ত সোয়ে। চুক্তির বিস্তারিত এখনও জানা না গেলেও নেপিদো থেকে সংশ্লিষ্ট
এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, চুক্তি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ
কিছুটা ছাড় দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল- জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা
ইউএনএইচসিআরসহ সব উন্নয়ন সহযোগীকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে
হবে। মিয়ানমার শেষ পর্যন্ত শুধু ইউএনএইচসিআরকে প্রয়োজনমতো কাজে লাগাবে বলে
সম্মত হয়েছে। চুক্তি সই হওয়ার ২ মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হবে। কবে
নাগাদ প্রত্যাবাসন শেষ হবে, বাংলাদেশ তার একটি সময়সীমা চেয়েছিল। কিন্তু
মিয়ানমার এ ধরনের কোনো সময়সীমা দিতে রাজি হয়নি।
বাংলাদেশ শুরু থেকেই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে আসছে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের অবস্থান নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো এখনও কিছু
ঘটেনি। এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ের (আসেম) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের শীর্ষ সম্মেলন শেষ
হয়েছে ২১ নভেম্বর। মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী এ
সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশসহ ৫৩টি দেশ ও সংস্থার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।
যেহেতু আসেম নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে, সেহেতু রোহিঙ্গাদের নিয়ে এ অঞ্চলে যে
নিরাপত্তা সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তা এ সম্মেলনে আলোচিত হবে, সেটাই ছিল
স্বাভাবিক। তাই এ সংকটের গভীরতা বুঝতে আসেম সম্মেলনে যোগ দেয়ার আগে ঢাকা
ঘুরে গিয়েছিলেন আসেমভুক্ত ৪টি দেশ ও সংস্থার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। জার্মানি,
জাপান, সুইডেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কক্সবাজারে
রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পও পরিদর্শন করেছিলেন। আমাদের প্রত্যাশা ছিল
রোহিঙ্গা সমস্যাটি আলোচিত হবে। সেটা হয়েছেও। এবং মিয়ানমারের স্টেট
কাউন্সেলর অং সান সু চি সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে কথাও বলেছেন। কিন্তু তাতে
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। এটা অস্বীকার করা
যাবে না, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমার খুব অস্বস্তিতে আছে। চাপে আছে। এশিয়া
ও ইউরোপের ১৫টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে কয়েকটি বিষয়ে
অনেকটা অভিন্ন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। তারা অনতিবিলম্বে সংঘাত বন্ধ,
রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী স্রোত থামানো এবং বাংলাদেশ
থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দ্রুত ফিরিয়ে নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন। একই সঙ্গে
তারা আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপীয়
ইউনিয়নের প্রতিনিধি ফেদেরিকা মঘেরিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রোহিঙ্গা
প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ একটি চুক্তিতে পৌঁছবে বলে তিনি
আশাবাদী। সেই চুক্তিটি অবশেষে স্বাক্ষরিত হল।
এদিকে চীন তিন দফার একটি প্রস্তাব দিয়েছে। তাতে অস্ত্র বিরতি (রাখাইনে), মিয়ানমার-বাংলাদেশ আলোচনা এবং রাখাইনের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। সু চি আসেমের উদ্বোধনী ভাষণে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি শুধু জানিয়েছেন, ১৯৯২ সালের চুক্তির ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া হবে! অথচ বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন, ১৯৯২ সালের চুক্তির ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এ কারণে যে, ওই চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজটি মিয়ানমারকে দেয়া হয়েছিল।
রোহিঙ্গারা বর্তমানে অবর্ণনীয় ও অমানবিক জীবনযাপন করছে উখিয়ায় তৈরি করা ক্যাম্পগুলোতে। তাদের নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা সমস্যা। সুতরাং রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানটা জরুরি। এক্ষেত্রে চীনের প্রস্তাব আদৌ কি কোনো জট খুলতে সাহায্য করবে? চীন বলছে অস্ত্রবিরতির কথা। রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা আসছে বটে; কিন্তু সহিংসতার খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না। জঙ্গিগোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) খবরও তেমন একটা নেই। কারা আরসা তৈরি করেছে, তা নিয়েও মানুষের মাঝে সন্দেহ আছে। চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সংলাপের কথা বলছে। শুধু সংলাপ সংবাদপত্রের জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে; কিন্তু তা কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। সমাধানের জন্য চাই বিশ্বাস ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৬ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা আদৌ মিয়ানমারের নাগরিক কিনা, সে ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের কোনো স্পষ্ট বক্তব্য নেই। তারা বারবার বলে আসছে, এরা ‘বাঙালি’। সেই অবস্থান থেকে মিয়ানমার এক চুলও সরে আসেনি। খুব কম রোহিঙ্গার কাছেই নাগরিকত্বের প্রমাণসংক্রান্ত কাগজপত্র আছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার কারণে সব কাগজপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। তাহলে তারা কীভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণ করবে? সুতরাং সংলাপে নাগরিকত্ব প্রশ্নে সমাধানের সম্ভাবনা ক্ষীণ। রাখাইন রাজ্যের উন্নয়নের কথা বলছে চীন। সেখানকার মানুষ দরিদ্র এটা সত্য। কিন্তু এর সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো যোগসূত্র নেই। চীনের বক্তব্য আরও স্পষ্ট হলে আমি খুশি হতাম। নাগরিকত্ব প্রমাণ করাই হচ্ছে মূল সমস্যা। উপরন্তু তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও আছে। তাদের বাড়িঘর তৈরি করা, নিরাপত্তা দেয়া- এ বিষয়টি তো মিয়ানমারকেই নিশ্চিত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিবারক কূটনীতি বলে একটা কথা আছে। বিশ্ব রাজনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই পরিবর্তনকে সামনে রেখে শান্তি নিশ্চিত করতে অনেক রাষ্ট্র নিবারক কূটনীতি বা ‘প্রিভেনটিভ ডিপ্লোমেসি’ প্রয়োগ করে থাকে। নিবারক কূটনীতির মূল কথা হচ্ছে, দুটো দেশ যাতে কোনো বিবাদ বা বিতর্কে জড়িয়ে না যায় কিংবা বিবাদ সংঘর্ষ পর্যায়ে উপনীত না হয় এবং যাতে করে সব ধরনের বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য পারস্পরিক বিশ্বাসের আবহ সৃষ্টি করা যায়, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ এ নিবারক কূটনীতি প্রয়োগ করে আসছে। তারপরও কথা থেকে যায়। সম্প্রতি আগত ৬ লাখ ৩০ হাজারসহ অন্তত ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে হবে মিয়ানমারকে। তারা মিয়ানমারের বাসিন্দা। তাই চীনের ‘প্রস্তাব’ ও উদ্যোগকে যথোপযুক্ত মনে হচ্ছে না।
এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি জড়িত। রোহিঙ্গারা যদি এদেশে স্থায়ী হয়ে যায়, তাহলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের নিত্য বিবাদ ও সংঘর্ষ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে ‘ফিলিস্তিন সংকটের’ মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। স্থানীয় বাঙালিরা ইতিমধ্যেই উখিয়ায় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে শুধু পরিবেশগত সমস্যাই নয়, নিরাপত্তা সংকটও সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কিছু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের দৃষ্টি এখন রোহিঙ্গাদের দিকে। তারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে চায়। কোনো কোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রও পরোক্ষভাবে এসব সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে উৎসাহ দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এ এলাকাজুড়ে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করা। অস্থিরতা সৃষ্টি হলে এর সুযোগ নেবে ওইসব রাষ্ট্র। সিরিয়ায় আইএসের পতন হয়েছে; কিন্তু রাশিয়াসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, রাকা (আইএসের অলিখিত রাজধানী) থেকে আইএস সদস্যদের পালাতে সাহায্য করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে, আইএসের জঙ্গিরা গেল কোথায়? ফিলিপাইনে আইএসের একটি শক্ত ঘাঁটির পতন ঘটেছে। তাই অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করছেন, আইএস জঙ্গিরা রাখাইনে প্রবেশ করতে পারে।
এসব কারণেই আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। একদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা, অন্যদিকে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’- দু’ভাবে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। আন্তর্জাতিক মহল আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লাখ লাখ মানুষ শুধু ধর্মের কারণে দেশান্তরিত হবেন, এই একুশ শতকে এসে তা চিন্তা করাও যায় না। রোহিঙ্গারা যদি মুসলমান না হতো, তাহলে সম্ভবত আজ তাদের দেশত্যাগ করতে হতো না! শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে তাদের ওপর নেমে এসেছে অত্যাচার আর নির্যাতন! সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়নি, যা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ক্ষেত্রে হয়েছে। সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীরা সমুদ্রপথে দেশত্যাগ করেছেন; কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছে। শিশুদের পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। হিটলার যেভাবে ইহুদিদের হত্যা করেছিল, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অনেকটা সেভাবেই হত্যা করেছে রোহিঙ্গাদের। এ বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করেনি, একজন শীর্ষস্থানীয় জাতিসংঘ কর্মকর্তা বলেছেন, মিয়ানমারে ‘গণহত্যা’ হয়েছে। অতি সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেছেন মার্কিন সিনেটর জেফ মার্কেলের নেতৃত্বে একটি কংগ্রেশনাল প্রতিনিধি দল। তারা স্বীকার করেছেন, রাখাইনে যুদ্ধাপরাধের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ প্রশ্নেও চীনের কোনো বক্তব্য নেই। তারপরও আমি মনে করি, চীন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। মিয়ানমার অসন্তুষ্ট হবে, মনোক্ষুণœ হবে- এসব বিবেচনায় নিয়েই চীন প্রস্তাব দিয়েছে। এটি আমরা বিবেচনায় নিতে পারি; কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যেন মনে না করি। কূটনৈতিক চ্যানেলে আমাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে এ কাজে দক্ষ কূটনীতিকদের নিয়োগ দিতে হবে। কয়েকটি দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। এসব দেশের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। আইনপ্রণেতাদের সঙ্গেও বাড়াতে হবে সম্পর্ক। বাংলাদেশে চীন ও রাশিয়ার বড় বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে। এ বিষয়টি আমরা আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন, কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনে যাননি, এমনকি রাশিয়াতেও যাননি। এ ধরনের একটি সংকট সৃষ্টি হলে সাধারণত সরকারের বিশেষ দূত, নিদেনপক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর করেন। নিজ দেশের অবস্থা বিদেশে তুলে ধরেন। জনমত সৃষ্টি করেন। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে অনেকটাই নীরব।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটিতে ভোটাভুটিতে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এক্ষেত্রেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকা নেই। ওআইসি প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল। ১৩৫টি রাষ্ট্র প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ১০টি দেশ ভোট দিয়েছে বিপক্ষে। ভোট প্রদানে বিরত ছিল ২৬টি দেশ। ওইসব দেশের মধ্যে আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ রয়েছে। এখানেও আমাদের ব্যর্থতা, আমরা সার্কভুক্ত দেশগুলোর কাছ থেকেও রোহিঙ্গা প্রশ্নে সমর্থন আদায় করতে পারিনি। একমাত্র পাকিস্তান ও মালদ্বীপকে আমরা আমাদের পাশে পেয়েছি।
মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে; কিন্তু এ চুক্তি অনুযায়ী কতসংখ্যক রোহিঙ্গা তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে, সব রোহিঙ্গা ফিরে যেতে পারবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। এজন্য মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে দেশটির ওপর ‘চাপ’ অব্যাহত রাখতে হবে।
এদিকে চীন তিন দফার একটি প্রস্তাব দিয়েছে। তাতে অস্ত্র বিরতি (রাখাইনে), মিয়ানমার-বাংলাদেশ আলোচনা এবং রাখাইনের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। সু চি আসেমের উদ্বোধনী ভাষণে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি শুধু জানিয়েছেন, ১৯৯২ সালের চুক্তির ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া হবে! অথচ বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন, ১৯৯২ সালের চুক্তির ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এ কারণে যে, ওই চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজটি মিয়ানমারকে দেয়া হয়েছিল।
রোহিঙ্গারা বর্তমানে অবর্ণনীয় ও অমানবিক জীবনযাপন করছে উখিয়ায় তৈরি করা ক্যাম্পগুলোতে। তাদের নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা সমস্যা। সুতরাং রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানটা জরুরি। এক্ষেত্রে চীনের প্রস্তাব আদৌ কি কোনো জট খুলতে সাহায্য করবে? চীন বলছে অস্ত্রবিরতির কথা। রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা আসছে বটে; কিন্তু সহিংসতার খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না। জঙ্গিগোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) খবরও তেমন একটা নেই। কারা আরসা তৈরি করেছে, তা নিয়েও মানুষের মাঝে সন্দেহ আছে। চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সংলাপের কথা বলছে। শুধু সংলাপ সংবাদপত্রের জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে; কিন্তু তা কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। সমাধানের জন্য চাই বিশ্বাস ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৬ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা আদৌ মিয়ানমারের নাগরিক কিনা, সে ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের কোনো স্পষ্ট বক্তব্য নেই। তারা বারবার বলে আসছে, এরা ‘বাঙালি’। সেই অবস্থান থেকে মিয়ানমার এক চুলও সরে আসেনি। খুব কম রোহিঙ্গার কাছেই নাগরিকত্বের প্রমাণসংক্রান্ত কাগজপত্র আছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার কারণে সব কাগজপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। তাহলে তারা কীভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণ করবে? সুতরাং সংলাপে নাগরিকত্ব প্রশ্নে সমাধানের সম্ভাবনা ক্ষীণ। রাখাইন রাজ্যের উন্নয়নের কথা বলছে চীন। সেখানকার মানুষ দরিদ্র এটা সত্য। কিন্তু এর সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো যোগসূত্র নেই। চীনের বক্তব্য আরও স্পষ্ট হলে আমি খুশি হতাম। নাগরিকত্ব প্রমাণ করাই হচ্ছে মূল সমস্যা। উপরন্তু তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও আছে। তাদের বাড়িঘর তৈরি করা, নিরাপত্তা দেয়া- এ বিষয়টি তো মিয়ানমারকেই নিশ্চিত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিবারক কূটনীতি বলে একটা কথা আছে। বিশ্ব রাজনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই পরিবর্তনকে সামনে রেখে শান্তি নিশ্চিত করতে অনেক রাষ্ট্র নিবারক কূটনীতি বা ‘প্রিভেনটিভ ডিপ্লোমেসি’ প্রয়োগ করে থাকে। নিবারক কূটনীতির মূল কথা হচ্ছে, দুটো দেশ যাতে কোনো বিবাদ বা বিতর্কে জড়িয়ে না যায় কিংবা বিবাদ সংঘর্ষ পর্যায়ে উপনীত না হয় এবং যাতে করে সব ধরনের বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য পারস্পরিক বিশ্বাসের আবহ সৃষ্টি করা যায়, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ এ নিবারক কূটনীতি প্রয়োগ করে আসছে। তারপরও কথা থেকে যায়। সম্প্রতি আগত ৬ লাখ ৩০ হাজারসহ অন্তত ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে হবে মিয়ানমারকে। তারা মিয়ানমারের বাসিন্দা। তাই চীনের ‘প্রস্তাব’ ও উদ্যোগকে যথোপযুক্ত মনে হচ্ছে না।
এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি জড়িত। রোহিঙ্গারা যদি এদেশে স্থায়ী হয়ে যায়, তাহলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের নিত্য বিবাদ ও সংঘর্ষ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে ‘ফিলিস্তিন সংকটের’ মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। স্থানীয় বাঙালিরা ইতিমধ্যেই উখিয়ায় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে শুধু পরিবেশগত সমস্যাই নয়, নিরাপত্তা সংকটও সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কিছু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের দৃষ্টি এখন রোহিঙ্গাদের দিকে। তারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে চায়। কোনো কোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রও পরোক্ষভাবে এসব সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে উৎসাহ দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এ এলাকাজুড়ে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করা। অস্থিরতা সৃষ্টি হলে এর সুযোগ নেবে ওইসব রাষ্ট্র। সিরিয়ায় আইএসের পতন হয়েছে; কিন্তু রাশিয়াসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, রাকা (আইএসের অলিখিত রাজধানী) থেকে আইএস সদস্যদের পালাতে সাহায্য করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে, আইএসের জঙ্গিরা গেল কোথায়? ফিলিপাইনে আইএসের একটি শক্ত ঘাঁটির পতন ঘটেছে। তাই অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করছেন, আইএস জঙ্গিরা রাখাইনে প্রবেশ করতে পারে।
এসব কারণেই আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। একদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা, অন্যদিকে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’- দু’ভাবে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। আন্তর্জাতিক মহল আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লাখ লাখ মানুষ শুধু ধর্মের কারণে দেশান্তরিত হবেন, এই একুশ শতকে এসে তা চিন্তা করাও যায় না। রোহিঙ্গারা যদি মুসলমান না হতো, তাহলে সম্ভবত আজ তাদের দেশত্যাগ করতে হতো না! শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে তাদের ওপর নেমে এসেছে অত্যাচার আর নির্যাতন! সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়নি, যা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ক্ষেত্রে হয়েছে। সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীরা সমুদ্রপথে দেশত্যাগ করেছেন; কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছে। শিশুদের পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। হিটলার যেভাবে ইহুদিদের হত্যা করেছিল, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অনেকটা সেভাবেই হত্যা করেছে রোহিঙ্গাদের। এ বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করেনি, একজন শীর্ষস্থানীয় জাতিসংঘ কর্মকর্তা বলেছেন, মিয়ানমারে ‘গণহত্যা’ হয়েছে। অতি সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেছেন মার্কিন সিনেটর জেফ মার্কেলের নেতৃত্বে একটি কংগ্রেশনাল প্রতিনিধি দল। তারা স্বীকার করেছেন, রাখাইনে যুদ্ধাপরাধের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ প্রশ্নেও চীনের কোনো বক্তব্য নেই। তারপরও আমি মনে করি, চীন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। মিয়ানমার অসন্তুষ্ট হবে, মনোক্ষুণœ হবে- এসব বিবেচনায় নিয়েই চীন প্রস্তাব দিয়েছে। এটি আমরা বিবেচনায় নিতে পারি; কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যেন মনে না করি। কূটনৈতিক চ্যানেলে আমাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে এ কাজে দক্ষ কূটনীতিকদের নিয়োগ দিতে হবে। কয়েকটি দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। এসব দেশের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। আইনপ্রণেতাদের সঙ্গেও বাড়াতে হবে সম্পর্ক। বাংলাদেশে চীন ও রাশিয়ার বড় বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে। এ বিষয়টি আমরা আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন, কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনে যাননি, এমনকি রাশিয়াতেও যাননি। এ ধরনের একটি সংকট সৃষ্টি হলে সাধারণত সরকারের বিশেষ দূত, নিদেনপক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর করেন। নিজ দেশের অবস্থা বিদেশে তুলে ধরেন। জনমত সৃষ্টি করেন। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে অনেকটাই নীরব।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটিতে ভোটাভুটিতে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এক্ষেত্রেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকা নেই। ওআইসি প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল। ১৩৫টি রাষ্ট্র প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ১০টি দেশ ভোট দিয়েছে বিপক্ষে। ভোট প্রদানে বিরত ছিল ২৬টি দেশ। ওইসব দেশের মধ্যে আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ রয়েছে। এখানেও আমাদের ব্যর্থতা, আমরা সার্কভুক্ত দেশগুলোর কাছ থেকেও রোহিঙ্গা প্রশ্নে সমর্থন আদায় করতে পারিনি। একমাত্র পাকিস্তান ও মালদ্বীপকে আমরা আমাদের পাশে পেয়েছি।
মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে; কিন্তু এ চুক্তি অনুযায়ী কতসংখ্যক রোহিঙ্গা তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে, সব রোহিঙ্গা ফিরে যেতে পারবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। এজন্য মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে দেশটির ওপর ‘চাপ’ অব্যাহত রাখতে হবে।
Daily Jugantor
24.11.2017
0 comments:
Post a Comment