সর্বশেষ ওবামা যে ভাষণ দিয়েছেন, তাতে তিনি আরব বিশ্বের গণতন্ত্রের জন্য এক ধরনের মায়াকান্ন দেখালেও, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এ অবসানের কথা তিনি বলেননি। এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিতৃষ্ণা মনোভাব অব্যাহত রয়েছে। ওবামার ২০০৮ সালে দেয়া কায়রো ভাষণ (যেখানে তিনি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলেছিলেন) ও সর্বশেষ ভাষণেও এমন কোনো বক্তব্য দেননি, যা মুসলমানদের আস্থা অর্জন করতে পারে। তাই আল-কায়েদার তৎপরতা কমাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আল-কায়েদা ইরাকি সংস্করণ। একই সঙ্গে অষ-য়ধবফধ রহ ওংষধসরপ সধমযৎধন আমেরিকার ঝধষধভরংঃ মৎড়ঁঢ় ভড়ৎ ঢ়ৎবধপযরহু পড়সনধঃ এবং অষ-য়ধবফধ রহ ঃযব অৎধনরধহ ভৎহরহংঁষধ-এর মতো সংগঠনগুলোর তৎপরতা বাড়বে। মৃত ওসামা তাদের জন্য তখন একই আদর্শ। জিহাদি তৎপরতা উত্তর আফ্রিকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে তখন। ঙঢ়বৎঃরড়হ এবৎড়হরসড় নিঃসন্দেহে একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করেছে। আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। এটা যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করল। তখন যে কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যুক্তরাষ্ট্র (অথবা অন্য কোনো রাষ্ট্র) হামলা চালাতে পারে। এ ধরনের প্রবণতা কিংবা শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোনো অবদান রাখবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ওসামার মৃত্যুর পর এখন আফগানিস্তান থেকে খুব দ্রুত সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। কিন্তু এটি হবে না। কারণ আফগানিস্তানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। এ অঞ্চল থেকে মধ্য এশিয়ার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে গ্যাস ও তেলের বড় রিজার্ভ। এ তেল ও গ্যাসের ব্যাপারে আরো রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ওয়েল কোম্পানিগুলো (আইওসি)। ইতোমধ্যে বেশ কটি আইওসি (বিলি, মবেল, ইউনিকল, সেল, টোটাল) এ অঞ্চলে গ্যাস ও তেল উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। মধ্য এশিয়ার এই জ্বালানি সম্পদের কারণে আগামী দিনে এ অঞ্চলে আঞ্চলিক যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সখ্য, তা ভেঙে যেতে পারে মধ্য এশিয়ার এই জ্বালানি সম্পদের কারণে। ভারত ও চীনেরও আগ্রহ রয়েছে এই জ্বালানি সম্পদের ব্যাপারে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে চীন ইতোমধ্যে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন গড়ে তুলেছে। যেখানে রাশিয়াও এর সদস্য। মধ্য এশিয়ার এই তেল ও গ্যাস চীন বা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে যাবে এটা যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না। তাই আফগানিস্তানে তার উপস্থিতি দীর্ঘায়িত হবে। প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় যাবে।
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন প্রশ্নের মুখে। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ৩ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় শুধু সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকা- রোধ করতে। তখন মার্কিন কংগ্রেস এই অর্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন লাদেনের ঘটনায় দুই রাষ্ট্রের মাঝে আস্থার ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য সামনের দিনগুলো খারাপ। পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যদি নিজেদের মাঝে আস্থার সম্পর্ক বাড়াতে না পারেন, তাহলে তা পাকিস্তানের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণভার চলে যেতে পারে, এই যুক্তি তুলে ওঅঊঅ পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণভার নিজেদের হাতে রাখার একটি উদ্যোগ নিতে পারে। স্পষ্টতই লাদেনের ঘটনায় প্রমাণিত হলো পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের লালন করে ও প্রশ্রয় দেয়। এই ঘটনায় পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়ল। ভারত এখন পাকিস্তানকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নিতে পারে। ভারত যদি এটা করে, তাহলে তা উপমহাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরো বাড়াবে মাত্র। প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০০৯ সালের জুন মাসে কায়রোতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে করে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন সূচনার কথা তিনি বলেছিলেন। এখন, লাদেনকে হত্যার পরে এই আস্থায় চিড় ধরতে বাধ্য। কোনো মুসলিম দেশই এখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কথা বিবেচনা করে প্রকাশ্যে মার্কিন প্রশাসনের বিরোধিতা অথবা সমর্থন করেন না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ডড়ড়ফৎড় িডরষংড়হ ঈবহঃবৎ-এর গবেষকরাও বলেছেন লাদেনের হত্যাকা-ের ঘটনার পর আরব বিশ্বে ইসলামপন্থীদের উত্থান রোধ করা সম্ভব হবে না। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনির মধ্যে একটা সমঝোতা হবে, এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখন ইসরাইলের আগ্রাসী তৎপরতা আরো বাড়তে পারে। মিসরে ইসলামপন্থী হিসেবে খ্যাত 'ইসলামিক ব্রাদারহুড' পার্টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলেছে। বোঝাই যায় লাদেনের হত্যাকা- যে 'সহানুভূতির ঢেউ' সৃষ্টি করেছে, তা থেকে ফায়দা ওঠাতে চাচ্ছে আরব বিশ্বের ইসলামিক দলগুলো। ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা একটি নতুন মাত্রা পাবে। এ অঞ্চলে ন্যাটোর এশীয়করণ হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের তথা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের কয়েকটি দেশ এবং ভারতের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে ন্যাটোর এশীয় সংস্কার, যা কিনা তথাকথিত 'নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হতে পারে ন্যাটো বাহিনী। মনে রাখতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ ১৯৪৮ সালে এভাবেই ন্যাটো গঠিত হয়েছিল। এ ধরনের যে কোনো সিদ্ধান্ত এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে। চীনও বিষয়টি সহজভাবে দেখছে না। ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকা-ের পর খুব দ্রুত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাবুল সফর প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র চায় পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত একটা বড় ভূমিকা পালন করুক। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্স এ অঞ্চলে নতুন করে এক ধরনের যুদ্ধের নাম দিতে পারে।
ইতোমধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করেছেন। চীন পাকিস্তানকে শুধু ৫০টি আধুনিক যুদ্ধ বিমান দিয়েই সাহায্য করছে না; বরং বিশ্ববাসীকে চীন জানিয়ে দিয়েছে সঙ্কটের এই মুখে চীন পাকিস্তানের পাশে থাকবে। এর অর্থ চীন-পাকিস্তান এবং রাশিয়াকে নিয়ে একটি পক্ষ গড়ে উঠতে পারে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে।
এরই মাঝে আল-কায়েদার নবনির্বাচিত নেতা সাইফ আল আদেল হুশিয়ারি দিয়েছে ব্রিটেনে হামলার। পাকিস্তানে তালেবান অনুসারি লাদেনের মৃত্যুর বদলা নিতে ন্যাটোর মালবাহী ট্যাংকারে হামলা চালিয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, তা হচ্ছে লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদ কমলো না, বরং বাড়ল এবং জঙ্গিরা এখন লাদেন হত্যার প্রতিশোধ নিতে আরো সংঘবদ্ধ।
ড. তারেক শামসুর রেহমান: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের বাঙলাদেশ
প্রথম প্রকাশঃ দৈনিক যায় যায় দিন
শুক্রবার ২৭ মে ২০১১ ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮ ২২ জমাদিউস সানি ১৪৩২ বছর ০৫ সংখ্যা ৩৪৪
0 comments:
Post a Comment