বিশ্বে গণতন্ত্র বিকাশের অন্তরায় করোনাভাইরাস
04:33
No comments
চলতি বছর অনেক বিষয়ের সঙ্গে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ অন্যতম একটি আলোচিত বিষয় হয়ে থাকবে। এ করোনাভাইরাস বিশ্বের অনেক দেশে গণতন্ত্রের বিকাশকে যে বাধাগ্রস্ত করেছে, তা গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। গণতন্ত্রের ওপর নজরদারি সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া’ কর্তৃক প্রকাশিত এক গবেষণায় এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে।
তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বে প্রতি ১০টি দেশের মধ্যে ছয়টিরও বেশি করোনা মহামারীর কারণে এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছে, যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি হুমকিস্বরূপ। গেল বছরের (২০২০) মাঝামাঝি এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। তাদের তৈরি করা সূচকে বাংলাদেশেরও নাম রয়েছে। তবে আশার কথা, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরিস্থিতি আমাদের চেয়েও নাজুক। সংস্থাটি বলছে, ৬১ শতাংশ দেশ এমন কড়াকড়ি আরোপ করেছে, যা গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার জন্য হয় অবৈধ বা অন্যায্য কিংবা অপ্রয়োজনীয়। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ৪৩ শতাংশ দেশ এ ক্যাটাগরিতে পড়ে। ৯০ শতাংশ কর্তৃত্বপরায়ণ দেশের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।
বস্তুত, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এক ধরনের অশনিসংকেত। সনাতন গণতান্ত্রিক সমাজে যে প্র্যাকটিস, অর্থাৎ মুক্তচিন্তা, অবাধ ভোটাধিকার, আইনের শাসন-এ সবই কোনো কোনো দেশে ব্যাহত হচ্ছে। কোভিড-১৯কে কেন্দ্র করে ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করা, বিশেষ আইন চালু করা, সংবিধানে পরিবর্তন এনে (রাশিয়া) ক্ষমতায় থাকাকে দীর্ঘায়িত করা- এ ধরনের প্রবণতা অনেক দেশে লক্ষ করা যায়। International IDEA Supporting Democracy Worldwide-এর মতে, Governments around the world have assembled emergency powers to respond to the Covid-19 pandemic, at times underminig human rights and democratic processes। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও International IDEA’র সমন্বয়ে ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে The †lobal Monitor of Covid-19's Impact on Democracy and Human Rights নামে একটি উদ্যোগ, যারা ১৬২টি দেশে কোভিড-১৯ কীভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আঘাত করছে, তা মনিটর করছে। ১৪ আগস্ট (২০২০) তাদের ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, এশিয়ায় যেসব দেশে Authoritarian regime বা কর্তৃত্ববাদী শাসন রয়েছে, সেখানে মহামারির সময় কিছু কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যা গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগজনক।
সুইডেনের গোথেনবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের V-Dem Institute বিশ্বের গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে কাজ করে। তারা ডেমোক্রেসি রিপোর্ট ২০২০ প্রকাশ করেছে। V-Dem বা Varieties of Democracy তাদের রিপোর্টে বলছে : ১. ২০০১ সালের পর থেকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রবণতা বেড়েছে। ৯২টি দেশ (বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৪ ভাগ) এখন কর্তৃত্ববাদী শাসনের আওতায়; ২. হাঙ্গেরি এখন নির্বাচিত কর্তৃত্ববাদী শাসনের আওতায় (electoral authoritarian regime); ৩. বিশ্বের বড় অর্থনীতি ও এক সময়ের সামরিক বাহিনীর দেশ ব্রাজিল, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্ববাদী শাসনের আওতায়; ৪. ভারত বিশ্বে একটি বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিতি পেলেও দেশটি তার গণতান্ত্রিক স্ট্যাটাস হারিয়ে ফেলেছে। এর কারণ হচ্ছে- মিডিয়ার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন, সিভিল সোসাইটির ক্ষমতা হ্রাস, উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ইত্যাদি; ৫. ৩১টি দেশে মিডিয়ার ওপর হামলা ও মুক্তচিন্তার ওপর আঘাত স্পষ্ট হয়েছে, যা দুবছর আগে ছিল মাত্র ১৯টি দেশে; ৬. সুষ্ঠু নির্বাচনের ইনডেক্সে (Clean Elections Index) ১৬টি দেশের অবনতি হয়েছে; ৭. ৩৭টি দেশে মিডিয়া সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছে এবং সিভিল সোসাইটির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে; ৮. বিশ্বে ২০০৯ সালে গণতান্ত্রিক শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল শতকরা ৫৪ ভাগ মানুষ, ২০১৯ সালে এর পরিমাণ শতকরা ৪৯ ভাগ। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অবনতি হয়েছে; ৯. ২০০৯ সালে বিশ্বের শতকরা ৬ ভাগ মানুষ কর্তৃত্ববাদী শাসনের আওতায় ছিল, ২০১৯ সালে এর পরিমাণ শতকরা ৩৪ ভাগ; ১০. ২০০৯ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বে শতকরা ২৭ ভাগ দেশে আন্দোলন হয়েছে, ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ৪৪ ভাগ।
V-Dem Institute তাদের প্রতিবেদনে ১০টি দেশের নাম উল্লেখ করেছে, যারা লিবারেল ডেমোক্রেসি হিসেবে পরিচিত ছিল; কিন্তু ২০১৯ সালে এসে কর্তৃত্ববাদী শাসনে পরিণত হয়েছে। এই দেশগুলো হচ্ছে হাঙ্গেরি, তুরস্ক, পোল্যান্ড, সার্বিয়া, ব্রাজিল, ভারত, মালি, থাইল্যান্ড, নিকারাগুয়া ও জাম্বিয়া। লিবারেল ডেমোক্রেসি সূচকে ২০০৯ সালে এ দেশগুলো পরিচিত ছিল লিবারেল ডেমোক্রেসি অথবা ইলেক্টোরাল ডেমোক্রেসি হিসেবে। কিন্তু ২০১৯ সালে এসে তাতে পরিবর্তন আসে; তাদের পরিচিতি এখন ইলেক্টোরাল অটোক্রেসি অথবা গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র হিসেবে। ওইসব দেশে নিয়মমাফিক নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু সেই নির্বাচনে এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম দিয়ে (তুরস্ক, ভারত, ব্রাজিল) ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। নির্বাচন হয়েছে বটে; কিন্তু নির্বাচনে বহুদলীয় অংশগ্রহণ ছিল না, বরং একদলীয় কর্তৃত্ববাদী আচরণ আমরা লক্ষ করি। তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন অব্যাহত রেখেছেন এবং তিনি তার কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্য দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকদের পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন। বিশ্বের বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের নাম বারবার উচ্চারিত হয়। কিন্তু মোদির উত্থানের পরপরই ভারতের গণতান্ত্রিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ভারতের গণতন্ত্রের বিকাশকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ভারতে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের বদলে জন্ম হয়েছে ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ এক সরকারব্যবস্থা, যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য বেমানান। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ের বলসনারোর (জানুয়ারি ২০১৯ থেকে প্রেসিডেন্ট) রাজনৈতিক দল সোশ্যাল লিবারেল পার্টি সেখানে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালু করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হচ্ছেন তার আদর্শ। বলসনারো ট্রাম্পকেই অনুসরণ করেন। এক সময়ের লিবারেল মতাদর্শে বিশ্বাসী বলসনারো নির্বাচনকে ব্যবহার করছেন তার ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার হিসেবে।
দেখা গেছে, কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব তাদের সুযোগ করে দিয়েছে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার। এ মহামারির মধ্যেও কোথাও কোথাও নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণা সীমিত করে, বিরোধীদের তৎপরতায় বিধিনিষেধ আরোপ করে ক্ষমতাসীনরা পার পেয়ে গেছেন এবং নিজ দেশে এক ধরনের একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালু করেছেন। বলতে দ্বিধা নেই, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের উত্থান বিশ্বে গণতান্ত্রিক চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ‘ফ্রিডম হাউস’ তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, ১৯৯৫ সালের পর এই প্রথম সবচেয়ে কম দেশের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যাদেরকে সত্যিকার অর্থেই গণতান্ত্রিক দেশ বলা যাবে। গণতন্ত্রের যাত্রাপথ থেকে বেরিয়ে আসার এই যে প্রবণতা, যেখানে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করছেন, তাকে বলা হচ্ছে de-democratiæation (Cas Mudde এবং Cristobal Rovira Kaltwasser)। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে যাওয়া, গণতন্ত্র চর্চাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলোকে বিসর্জন দেওয়া। ফ্রিডম হাউসের রিপোর্টে ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, মন্টেনেগরোর গণতান্ত্রিক বিচ্যুতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই রিপোর্টে কয়েকটি দেশের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে সেখানে শাসনব্যবস্থায় যে পরিবর্তন এসেছে (কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা), তা উল্লেখ করা হয়েছে (আজারবাইজান, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরঘিজিস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান)। তবে সেই সঙ্গে এ অঞ্চলের বেশ ক’টি দেশ যে গণতন্ত্র সংহত করেছে, তাও উল্লেখ করা হয়েছে (স্লোভেনিয়া, স্লোভাকিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্টোনিয়া)। এখন স্লোভেনিয়া কিংবা লিথুয়ানিয়ার গণতন্ত্র সুসংহত করার মডেল ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য মডেল হিসেবে বিবেচিত হবে কিনা, সেটাই একটা প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। এক সময় সাহায্যের অন্যতম শর্ত হিসেবে গণতন্ত্র চালু করা কিংবা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে প্রমোট করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হতো। এখন জো বাইডেন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ওপর গুরুত্ব দেবেন কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।
গণতান্ত্রিক ‘ডিক্লাইন’ বা অধঃপতনের জন্য কোভিড-১৯কে দায়ী করা হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসকরা এই মহামারিটি তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। ২০২১ সালেও তারা এটা ব্যবহার করবেন। বিখ্যাত নিউজ ম্যাগাজিন টাইম-এর এক প্রতিবেদনেও (২ অক্টোবর, ২০২০) উল্লেখ আছে সে কথা। ইউরোপের একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান ‘দ্য সেন্টার ফর ইকোনমিক পলিসি রিসার্চ’ তাদের এক গবেষণাপত্রে মন্তব্য করেছে এভাবে- ‘Democracy has been in recession for over a decade and many fear that Covid-19 will accelerate this trend' (VOXEU/CEPR, Covid-19 and the future of democracy, 20 May, 2020)। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। গণতন্ত্রের অধঃপতন শুরু হয়েছিল, তা অব্যাহত থাকবে।
সুতরাং ২০২১ সালটি গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের উত্থান ‘পপুলিজম’ বা জনতুষ্টিবাদকে শক্তিশালী করেছিল। এতে গণতন্ত্রের ক্ষতি হয়েছিল। এখন বাইডেনের উত্থান গণতন্ত্রের বিকাশকে শক্তিশালী করবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।
Jugantor
3.1.2021
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment