রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য একটি কালো দিন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে বুধবার যা ঘটল, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৪ বছরের ইতিহাসে একটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে বুধবার যা ঘটল, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৪ বছরের ইতিহাসে একটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। নিয়মমাফিক ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রায়কে অনুমোদন দেওয়ার জন্য ক্যাপিটল হিলে কংগ্রেস সদস্যরা যখন সমবেত হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনা। ট্রাম্প সমর্থকরা ভবনটি দখল করে নিল। পিস্তল উঁচিয়ে লন্ডভন্ড করল ভবনের বেশকিছু রুম, যেখানে কংগ্রেস সদস্যদের অফিস। শুধু তা-ই নয়, প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির অফিস কক্ষ দখল করে তার চেয়ারে বসে সেলফিও তুলল কেউ কেউ। বিক্ষোভের ঘটনায় মারাও গেলেন চারজন। একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। জো বাইডেন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট পেয়েছিলেন ৩০৬ আর ট্রাম্প পেয়েছিলেন ২৩২। এরপর একের পর এক ‘নাটক’ করে চলছিলেন ট্রাম্প। দেশব্যাপী তার সমর্থকদের দিয়ে তিনি ৬২টিরও বেশি মামলা করেছিলেন নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু একটিতেও তিনি বিজয়ী হতে পারেননি। নিয়ম অনুযায়ী মার্কিন কংগ্রেস (উচ্চকক্ষ ও নিুকক্ষ) যৌথ বৈঠকে এই ফলাফল অনুমোদন করবে। আর এটা আটকাতেই ট্রাম্প তার সমর্থকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ক্যাপিটল হিলে জমায়েত হতে। তারপরই ঘটল এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এই ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় বয়ে গেলেও মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য এটা ছিল একটি কালো দিন। একজন ব্যক্তি, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতা ধরে রাখার নানা কৌশল গণতন্ত্রকে যে কত বড় ক্ষতি করতে পারে-এই ঘটনা তার বড় প্রমাণ। সংবিধান অনুযায়ী যৌথ সভায় ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স সভাপতিত্ব করেন। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের অনুরোধ উপেক্ষা করে পেন্স জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনুমোদন করেন। ২০ জানুয়ারি তিনি শপথ নেবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রচর্চার ইতিহাসে গেল বুধবারের ঘটনা একটি কালো ‘দাগ’ হয়ে থাকবে। এ ধরনের ঘটনা খোদ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সুশাসনের জন্য এক ধরনের অশনিসংকেত। এই ঘটনা দক্ষিণপন্থিদের উৎসাহ জোগাবে প্রচলিত আইন ও সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করতে। কেননা ট্রাম্পের জমানায় উগ্র দক্ষিণপন্থিরা শক্তিশালী হয়েছে। তার শাসনামলে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ণবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আশঙ্কা যে জায়গায় তা হচ্ছে, ট্রাম্পের বিদায়ের পরও মার্কিন সমাজে এই বর্ণবাদ থেকে যাবে আরও কিছুদিনের জন্য, যা সমাজব্যবস্থাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে রাখবে। ট্রাম্প যে ‘রাজনীতি’ মার্কিন সমাজে সৃষ্টি করে গেলেন, এই ক্ষত সারিয়ে উঠতে আরও সময় লাগবে। ভয়ের কারণ আরও একটি-ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করলেও হারিয়ে যাবেন না। তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবেন। ২০২৪ সালের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি যদি পুনরায় রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন চান, আমি অবাক হব না। তার প্লাস পয়েন্ট একটা-তিনি রিপাবলিকান শিবিরে তার সমর্থকদের নিয়ে একটা বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এরা তার পাশে থাকবে। ফলে তিনি যদি আগামী দিনগুলোয় রিপাবলিকান পার্টিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যান, কিংবা তার সমর্থকদের বের করে এনে আরেকটি পার্টির জন্ম দেন, আমি তাতে অবাক হব না। দ্বিতীয়ত, একজন উগ্র মানসিকতাসম্পন্ন ও খ্যাপাটে লোক সমাজ ও রাষ্ট্রের যে কত ক্ষতি করতে পারেন, ট্রাম্প তার বড় প্রমাণ। রাষ্ট্রপরিচালনায় ব্যক্তিস্বার্থকে তিনি বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় আদর্শ, রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়নি কখনো। তিনি নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে অনেক ক্ষতি করলেন। তৃতীয়ত, তার যে আদর্শ, তাকে অনেকে জনতুষ্টিবাদ হিসেবে অভিহিত করেন এবং ক্ষমতা ধরে রাখার সব অপকৌশল, বিশ্বের কিছু কিছু দেশে তার একটি সমর্থকশ্রেণি তৈরি করেছিল। ব্রাজিল, ব্রিটেন, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডের নেতারা তাকে অনুসরণ করছেন। ওইসব দেশেও গণতন্ত্রের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন তাদের নেতারা। এখন ট্রাম্পের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে এদের বিদায় কতটুকু নিশ্চিত হবে, এটা একটা প্রশ্ন। চতুর্থত, সমর্থকদের দিয়ে কংগ্রেস ভবন দখল করা মার্কিন সমাজে এক ধরনের ‘গুন্ডাতন্ত্রের’ জন্ম দিয়েছে। এই ‘গুন্ডাতন্ত্র’ রাষ্ট্রব্যবস্থাকেও হুমকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। পঞ্চমত, পর্যবেক্ষকরা কেউ কেউ এই ঘটনাকে এক ধরনের ‘সিভিলিয়ান কুদেতা’ বা সিভিলিয়ান সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন (আটলান্টিক, ৬ জানুয়ারি)। এটা গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্য ‘ওয়েকআপ’ কল। ক্ষমতাসীন শক্তি নির্বাচনে হেরে গেলে তার সমর্থকদের নিয়ে কত বড় ‘ঘটনা’ ঘটাতে পারেন, বুধবারের ঘটনা তার একটি প্রমাণ। যষ্ঠ, ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডে অতীতে তাকে ইমপিচমেন্টের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সে যাত্রায় তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন বটে। কিন্তু জো বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার পর কিংবা ২০ তারিখের আগেও তিনি পুনরায় ইমপিচমেন্টের সম্মুখীন হতে পারেন (এনবিসি)। সপ্তম, ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত তার আপত্তি রেখেই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। তার ভাষ্যমতে, ‘নির্বাচনে কারচুপি’-এই বিষয়টি নিয়ে তিনি আগামী দিনে ‘রাজনীতির জল’ ঘোলা করতে পারেন। একজন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদায় নেবেন। কিন্তু গেল চার বছরে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি করে গেলেন, তা খুব সহজেই কাটিয়ে ওঠা কষ্টকর। তিনি একটি বিভক্ত সমাজের জন্ম দিয়ে গেলেন। জো বাইডেন এই বিভক্তি কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন, তা এক বড় প্রশ্ন। অতীতে ইমপিচমেন্টের সম্মুখীন হওয়া, ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ মুহূর্তে তার ফেসবুক, টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া, ব্যক্তি ট্রাম্পকে যতটা না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে প্রেসিডেন্ট পদটিকে। একজন প্রেসিডেন্ট যিনি বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবেন, তিনি বিতর্কের মধ্যে এবং অসম্মানজনকভাবে বিদায় নিতে যাচ্ছেন। অতীতে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এভাবে বিদায় নেননি। যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন (রিপাবলিকান, ১৮৬১-১৮৬৫) একবার বলেছিলেন, গড়ন rule begets mob rule (Daily Signal, 6 January)। উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসন উচ্ছৃঙ্খলতারই জন্ম দেয়। বুধবার ক্যাপিটল হিলে শত শত উচ্ছৃঙ্খল জনতার প্রবেশ ও আইনপ্রণেতাদের চ্যালেঞ্জ করা প্রায় ১৫৯ বছর আগে আব্রাহাম লিংকনের কথারই প্রতিধ্বনিত করল। এই উচ্ছৃঙ্খলতা গণতন্ত্র নয়। এটা গুন্ডাতন্ত্র। গণতন্ত্র চর্চার জন্য এই উচ্ছৃঙ্খলতা কখনই কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনতে পারে না। Jugantor 8.1.2021

0 comments:

Post a Comment