
এখন যে প্রশ্নটি বেশি করে আলোচিত হতে থাকবে তা হচ্ছে, বিএনপি কিংবা গণফোরামের সদস্যদের সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক? প্রথম কথা হচ্ছে, বিএনপি তথা গণফোরাম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা সংসদে যাবে না। এমনকি বিএনপি জাহিদুর রহমান ও গণফোরাম সুলতান মনসুরকে দল থেকে ‘বহিষ্কার’ এবং মোকাব্বির খানকে শোকজ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, তাঁদের কারোরই বরিহষ্কারাদেশ বা কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়নি। এমনকি ড. কামাল হোসেন মোকাব্বির খানকে পাশে বসিয়ে গণফোরামের বিশেষ কাউন্সিল পর্যন্ত করলেন। এর মধ্য দিয়ে দলীয় শৃঙ্খলা কি থাকল? একটি দলের জন্য শৃঙ্খলা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বিএনপি ও গণফোরামের ক্ষেত্রে সেই দলীয় শৃঙ্খলা থাকল না। উপরন্তু সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট করে বলা আছে—দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো ব্যক্তি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এখন সাতজন সংসদ সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলেন এবং দল তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ‘শাস্তিমূলক’ ব্যবস্থা নিতে পারল না! দল এখানে ‘মুখ্য’ হলো না, মুখ্য হয়ে গেল ‘ব্যক্তি’। যদিও বলা হয়েছে, বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের নির্দেশেই তাঁরা সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। তাহলে ‘প্রশ্নটি’ আসে—তারেক রহমান একাই কি দলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেউ? দলের স্থায়ী পরিষদের কি কোনো ভূমিকা নেই? এসব প্রশ্ন বারবার আলোচিত হতে থাকবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। সংসদীয় রাজনীতিতে সংসদ বয়কট কোনো ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। সংসদীয় রাজনীতির জন্য এটি কোনো ভালো খবরও নয়। অতীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগও সংসদ বয়কটের রাজনীতি করেছিল। ওই সংসদ বয়কটের রাজনীতি আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেনি। বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু নির্বাচন বয়কটের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। সাধারণ মানুষ এটি সমর্থনও করেনি। ওই সংসদের গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও শেষ দিন পর্যন্ত সংসদ টিকে ছিল। একটি দলের জন্য বিপর্যয় আসতে পারে। আমরা ভারতে কংগ্রেসের উদাহরণ দিতে পারি। যে কংগ্রেস ছিল ভারতের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত ‘শক্তি’, ১৬তম লোকসভা নির্বাচনে (২০১৪) দলটির কী হাল হয়েছিল, আমরা নিশ্চয়ই তা স্মরণ করতে পারি। ৫৪৩টি আসনের মধ্যে দলটি পেয়েছিল মাত্র ৪৪টি আসন। যে দলটি (কংগ্রেস) প্রথম লোকসভায় (১৯৫২) পেয়েছিল ৩৬৪টি আসন, দ্বিতীয় লোকসভায় ৩৭১ আসন, ১৯৭১ সালে ৩৫২ আসন, ১৯৮০ সালে ৩৫৩ আসন, ১৯৮৪ সালে ৪১৫ আসন—সেই দলটিও ৪৪ আসন পেয়েছিল। ফলে দলের বিপর্যয় হতেই পারে। এ ক্ষেত্রে সংসদ বর্জন সংসদীয় রাজনীতির জন্য কোনো ভালো খবর হতে পারে না। নিশ্চয়ই বিএনপি এটি থেকে শিখবে ও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। তবে সেই সঙ্গে এটিও সত্য, আমরা ভোট সংস্কৃতিকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছি (রাতের বেলা ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা, প্রকাশ্যে ভোটকেন্দ্র দখল ও সিল মারা, নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততা) এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। গণতন্ত্রের স্বার্থেই তা মঙ্গল।
বিএনপি যখন তার রাজনৈতিক দৈন্য থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিচ্ছে, ঠিক তখনই জামায়াতের সংস্কারবাদীদের একটি উদ্যোগ ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’—এই স্লোগান সামনে রেখে জামায়াতের তরুণ প্রজন্ম নতুন একটি দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি দীর্ঘদিন ধরেই প্রত্যাশিত ছিল। জামায়াতের অতীত ভূমিকা, বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা জামায়াতকে ‘জনতার কাঠগড়ায়’ দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার হয়েছে এবং বিচারে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ভার জামায়াত এড়াতে পারে না। সুতরাং জামায়াত সমর্থিত তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে বিভ্রান্তিতে ছিল। তারা এটি থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিল। তারা আদর্শিকভাবে জামায়াতের রাজনীতি সমর্থন করেছিল, এটি সত্য। কিন্তু জামায়াত নেতাদের একাত্তরের ভূমিকার দায়ভার নিতে চাইছিল না। তাদের এই মনোভাব প্রকাশ পায় যখন নতুন দল গঠনের উদ্যোক্তা মজিবুর রহমান মঞ্জু তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘একাত্তরের রাজনৈতিক অবস্থানের বোঝা একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্মের বহন করা উচিত নয়।’ এটিই হচ্ছে মোদ্দা কথা। একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা, নতুন প্রজন্ম এর দায়ভার নেবে না। মঞ্জুর আরো কিছু বক্তব্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জানিয়েছেন, নতুন দলটি কোনো ধর্মভিত্তিক দল হবে না। তাদের সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এটি কোনো আদর্শভিত্তিক দলও হবে না। তাঁর এই বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং নতুন দল সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়। তবে চান্সও আছেই। ‘এটি কি নতুন বোতলে পুরনো মদ।’ অর্থাৎ নতুন মোড়কে জামায়াত! জামায়াত কি নতুন দলে বিলীন হয়ে যাবে?
জামায়াত মূলত তার আদর্শকে ধারণ করে মিসরে ১৯২৮ সালে গঠিত ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনীতি থেকে। বলা হয়, মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ইখওয়ানুল মুসলেমিনের আদর্শকে ধারণ করে স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেছিল। পাক-ভারত-বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জন্ম এভাবেই। তারা ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনীতি ধারণ করে। কিন্তু মিসরে দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর তারা নানাভাবে ও নতুন সংগঠনের ব্যানারে নিজেরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছিল। সফল হয়নি। কিন্তু ‘আরব বসন্ত’ (২০১১) পুরো দৃশ্যপটকে বদলে দেয়। এই দলের সমর্থকরা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি গঠন করে সফলতা পায়। ড. মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হন। কিন্তু বেশি মাত্রায় ‘ইসলামীকরণ’ ও সেনাবাহিনীর স্বার্থ ক্ষুণ্ন করায় সেনাবাহিনী কর্তৃক অপসারিত হন। আমরা তুরস্কের দৃষ্টান্ত দিতে পারি। তুরস্কে ইসলামিক জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) ক্ষমতায়। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ২০০৩ সাল থেকেই ক্ষমতায়। ২০১৪ সালের পর থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। মূলত একে পার্টি ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনীতি ধারণ করে। প্রথমে এর সমর্থকরা নেকমাতিন এরবাকানের নেতৃত্বে ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির ব্যানারে সংগঠিত হয়েছিল। এরবাকানের ভাবশিষ্য হচ্ছেন এরদোয়ান। দলটি সরকারও গঠন করেছিল। কিন্তু ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় প্রথমে ভার্চু পার্টি ও পরে ইসলামিক জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (২০০১) নামে আত্মপ্রকাশ করে। আমরা তিউনিসিয়া ও জর্দানের, এমনকি মরক্কোর দৃষ্টান্তও দিতে পারি। মরক্কোয় ইসলামিক ব্রাদারহুডের ভাবধারায় গঠিত জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি এখন ক্ষমতায়। রাজতন্ত্রশাসিত এ দেশে ২০১৬ সালে সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। (দলটি ৩৯৫ আসনের মধ্যে ১২৫ আসন পেয়েছিল)। তিউনিসিয়ায় আননাহাদা ও জর্দানে ইসলামিক অ্যাকশন ফ্রন্ট একই রাজনীতি ধারণ করে এবং আরব বসন্ত-পরবর্তী সময়ে নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করেছে।
তুরস্কের দৃষ্টান্ত অনেকেই দেওয়ার চেষ্টা করে। ইসলাম ও গণতন্ত্রের সমন্বয়ে নতুন এক ‘রাজনীতি’ একে পার্টি তুরস্কে উপহার দিয়েছে। এ কারণেই দলটির জনসমর্থন আছে। ২০০২, ২০০৭, ২০১১, ২০১৫, ২০১৮ প্রতিটি সংসদীয় নির্বাচনে দলটি বিজয়ী হয়েছে। একে পার্টির উত্থানের কারণে তুরস্কের ট্র্যাডিশনাল পার্টিগুলোর ভূমিকা একরকম নেই বললেই চলে। রাজনীতিগতভাবে আননাহদা (১৯৮১) পার্টি তুরস্কের একে পার্টিকে অনুসরণ করে। আননাহদা পার্টির নেতা রশিদ ঘানুচি নিজে বলেছেন, এরদোয়ানকে তিনি অনুসরণ করেন। এমনকি মরক্কোর প্রধানমন্ত্রী সাদেদ্দিন ওথমানিও (২০১৭) এরদোয়ানের রাজনীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত। একই কথা জর্দানের ক্ষেত্রেও। এর অর্থ হচ্ছে, আরব বসন্ত-পরবর্তী সময়ে আরববিশ্বে যে পরিবর্তনের ঢেউ উঠেছে, তাতে ইসলামিক ব্রাদারহুডের সমর্থকরা নতুন নতুন দলের ব্যানারে আত্মপ্রকাশ করেছে। তারা আধুনিক এবং মৌলবাদী হিসেবে তাদের চিহ্নিত করাও যাবে না। তারা ইসলাম ও গণতন্ত্রকে একত্র করে আরববিশ্বে নতুন এক রাজনীতি নিয়ে এসেছে। তবে এটি সত্য, তাদের সবার মূল রুট হচ্ছে ইসলামিক ব্রাদারহুড, যাকে যুক্তরাষ্ট্র অতি সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এ নামে বর্তমানে কোনো দলেরই অস্তিত্ব নেই। এরদোয়ান যখন ২০০১ সালে একে পার্টি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তখন ধর্মনিরপেক্ষ ট্রুথ পার্টি, মাদারল্যান্ড পার্টি থেকেও সমর্থকরা নতুন দলে যোগ দিয়েছিল। এখন দেখার বিষয়, মজিবুর রহমান মঞ্জুরা যে ‘উদ্যোগ’ নিয়েছেন, তাতে তাঁরা ব্রাদারহুড কিংবা জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ থেকে কতটুকু সরে আসতে পারবেন। যদি সরে আসতে না পারেন, যদি একাত্তরের রাজনীতির জন্য ভুল স্বীকার না করেন, তাহলে নতুন দলও বিতর্কিত হবে।
শেষ পর্যন্ত বিএনপি সংসদে যাওয়ায় বর্তমান সংসদ গ্রহণযোগ্যতা পেল। সংসদীয় রাজনীতিও নতুন একটি মাত্রা পেল। মির্জা ফখরুলের সংসদে যোগ না দেওয়া, তাঁর আসন শূন্য ঘোষণা করা ও সেই আসন থেকে জিয়া পরিবারের কাউকে সংসদে নিয়ে আসা—এ আলোচনার মধ্য দিয়ে বিএনপি পারিবারিক রাজনীতিতে নতুন এক নেতৃত্ব পেতে পারে। তারেক রহমানের অবর্তমানে তিনিই হয়তো বিএনপির হাল ধরবেন। আর এর মধ্য দিয়ে ‘খালেদা জিয়া যুগের’ অবসান হতে যাচ্ছে বলেই আমার ধারণা।
Daily Kalerkontho
03.05.2019
0 comments:
Post a Comment