বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্বাচনের গুরুত্ব রয়েছে। আমরা চাই নয়া দিল্লিতে যে সরকারই আসুক না কেন, সেই সরকার দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানে আরও আন্তরিক হবে। এটা সত্য, ২০১০ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। তার শাসনামলেই ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, ভারত দীর্ঘদিন ওই চুক্তিটি অনুমোদন করেনি। কিন্তু বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধন করে ওই চুক্তিটি অনুমোদন করেছিল। এর জন্য ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। ৫ মে (২০১৫) ভারতের মন্ত্রিসভায়, ৬ মে রাজ্যসভায়, ৭ মে লোকসভায় বিলটি অনুমোদিত হয়েছিল। স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অগ্রগতি। ১১১টি ছিটমহলের ৪০ হাজার ৪৭০ জন নাগরিক এখন বাংলাদেশের নাগরিক। এতে ১৭১৬০ দশমিক ৬৩ একর জমি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৭১১০ দশমিক শূন্য ২ একর জমি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। কিন্তু কিছু কিছু সমস্যা যা ছিল, তা এখনো রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে আদৌ কোনো অগ্রগতি হয়নি। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে আসামের তথাকথিত নাগরিকত্ব তালিকা (এনআরসি), যে তালিকায় আসামে বসবাসকারী বেশ কিছু মুসলমানকে বাংলাদেশি হিসেবে ‘চিহ্নিত’ করে তাদের বাংলাদেশে জোর করে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছ। মোদি নিজে পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি করতে চান।
বাংলাদেশ-ভারত উষ্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া বড় ধরনের অন্তরায়। এ ক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের একটি সাম্প্রদায়িক মনোভাব লক্ষ করা যায়, যখন অমিত শাহ প্রকাশ্যেই বলেন, তারা পশ্চিমবঙ্গেও এই তালিকা করবেন। তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তারা থাকতে দেবেন। আসামে তারা এই তালিকা করলেও, পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির আপত্তির মুখে তারা এই তালিকা করতে পারেনি। মমতা প্রকাশ্যেই বলেছেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গে এই তালিকা করতে দেবেন না। অনেকেই জানে, সাম্প্রতিক সময়ে, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে (সাত বোন রাজ্য) বিধান সভার নির্বাচনে বিজেপি ভালো ফলাফল করেছে। ত্রিপুরাসহ বেশ কটি রাজ্যে বিজেপি সরকারও গঠন করেছে। এখন তাদের টার্গেট পশ্চিম বাংলা। মমতাকে হটিয়ে তারা সেখানে সরকার গঠন করতে চায়। সুতরাং তারা যে নাগরিকত্ব তালিকাকে ইস্যু করবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায় হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়া। যতদূর জানা যায়, মমতার আপত্তির কারণেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি করতে পারেনি। তিস্তা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি ইস্যু। মমতা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, পশ্চিম বাংলার উত্তরবঙ্গের মানুষদের পানি না দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে পানি দিতে পারবেন না! অথচ তার নিয়োগকৃত কল্যাণ রুদ্র কমিশনের অভিমত হচ্ছে, উত্তরবঙ্গকে পর্যাপ্ত পানি দিয়েও বাংলাদেশের প্রাপ্ত পানি দেওয়া সম্ভব। তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। আন্তর্জাতিক নদীর পানির ব্যবহার-সংক্রান্ত যেমন আইন রয়েছে (১৯৬৬ সালের হেলসিংকি নীতিমালা, ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালা, ১৯৯৭ সালর জাতিসংঘের জলপ্রবাহ কনভেনশন, কিংবা জীববৈচিত্র্য কনভেনশন), প্রতিটি আইনে বাংলাদেশের পানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। এখন মমতা ব্যানার্জি যদি উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেন, সেটা হবে আন্তর্জাতিক পানি-সংক্রান্ত আইনের বরখেলাপ। এ ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশের পানিপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে। ফারাক্কা চুক্তি নিয়েও চিন্তা করার সময় এসেছে। ১৯৯৬ সালে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ পানি বাংলাদেশের পাওয়ার কথা, বাংলাদেশ তাও পাচ্ছে না। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে, অর্থাৎ ১৯৭৭ থেকে ৫০ বছর পর। এই ৫০ বছরে জনসংখ্যা বাড়বে তিন গুণ। মোটামুটি হিসাবে পানির প্রয়োজনও বাড়বে তিন গুণ। কিন্তু ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে যে পানি পেয়েছি, ২০২৭ সাল পর্যন্ত পেতে থাকব আরও কম। সুতরাং বিষয়টির গভীরতা উপলব্ধি করে এখন থেকেই আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। গঙ্গার এই পানি সংকট মোকাবিলায় ভারতের পানি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন যে ১১টি রাজ্যে গঙ্গার অববাহিকা বিস্তৃতÑ সেখানে গঙ্গা বা উপনদীর ওপর জলাধার নির্মাণ ও সেচের প্রয়োজনে নদী থেকে পানি টেনে নেওয়া এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে নদীর কোনো অংশ সম্পূর্ণ শুকিয়ে না যায়। সেই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, ভূগর্ভের পানির স্তর থেকে নদীর দিকে বেইজ ফ্লো অক্ষুণœ রাখার জন্য নদীর পাড় থেকে ৫০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে সেচের পানি তোলা নিষিদ্ধ করা দরকার। সেই সঙ্গে গঙ্গা চুক্তির পুনর্মূল্যায়নের কথাও বলছেন তিনি।
বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি অন্তরায়। বাংলাদেশ ভারতে রপ্তনি করে কম, আমদানি করে বেশি। বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম বাজারে পরিণত হয়েছে। বাণিজ্য রেশিও ১:৭.৯। অর্থাৎ ৭ দশমিক ৯ ভাগ বেশি আমদানি করে বাংলাদেশ। বাণিজ্য ভারসাম্যের অন্যতম কারণ হচ্ছে ভারতের সরকারিনীতি। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলেও, কিছু অশুল্ক বাধার কারণে দুদেশের কাক্সিক্ষত বাণিজ্য বাড়ছে না। বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রে বন্দর, পণ্য পরীক্ষা ও বকেয়াসহ প্রতিবন্ধকতার ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট এবং চট্টগ্রাম-মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার নিয়েও কথা আছে। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আয় মিলিয়ে বন্দরভিত্তিক কার্যক্রমে বার্ষিক মোট ৩৭ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরিত হচ্ছে। এখন চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দর দিয়ে পণ্যপ্রবাহের শতকরা ১০ ভাগও যদি ভারতের ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যসামগ্রী পরিবহন করা হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে বছরে প্রায় তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকা (ফি বাবদ) ট্যারিফ, চার্জ, মাশুল বাবদ নিশ্চিত আয় হওয়ার কথা। এটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। নরেন্দ্র মোদির বৈদেশিক নীতির একটি অন্যতম দিক হচ্ছে তার ‘নেইবারহড ফাস্ট’ পলিসি। অর্থাৎ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিকে তিনি তার অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিও সে আলোকেই রচিত। তার শাসনামলে বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তি রচিত হয়েছে। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাংলাদেশের পানি সংকট ও জ¦ালানি সংকট সমাধানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ভারত থেকে বিদ্যুৎ পাচ্ছে। একই সঙ্গে নেপাল ও ভুটানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটানো সম্ভব। একই সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটেরও সমাধান সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ভারতকে আরও উদার হতে হবে। ভুটান কিংবা নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে হলে তা ভারতীয় এলাকার ওপর দিয়ে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারত না চাইলে আমরা তা পাব না। আশার কথা, মোদি সরকার এ ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে। মোদি সরকার একদিকে বিবিআইএন উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যেমনি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ‘সাত বোন রাজ্যের’ সম্পর্ককে আরও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি সার্ককে পাশে রেখে, অনেকটা নিষ্ক্রিয় করে বিমসটেক জোটকে (বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, নেপাল ও ভুটান) শক্তিশালী করতে চায় ভারত। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ বিআরআই (চীনের প্রস্তাবিত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ ইনিশিয়েটিভ) জোটে আছে। চীন থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিচ্ছে। এটাও ভারতের পছন্দ নয়। ভারত মনে করে এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বাড়বে। বাংলাদেশ প্রতিবেশী এই দুটি বড় দেশের সঙ্গে (চীন ও ভারত) এক ধরনের ভারসাম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে আসছে। আমাদের জাতীয় স্বার্থের কারণেই আমরা এ কাজটি করছি। সুতরাং ভারতে একটি নয়া সরকার এলে সংগত কারণেই এ প্রশ্নগুলো আলোচিত হবে।
যদিও ভারতে সরকার পরিবর্তন হলেও, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন আসে না। অতীতের সরকারগুলোর পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে মোদি সরকারের পররাষ্ট্রনীতির খুব একটা পার্থক্য লক্ষ করা যায় না। এ ক্ষেত্রে ‘এপ্রোচের’ হয়তো পার্থক্য রয়েছে। মোদির জমানায় বাংলাদেশ ভারতকে ‘অনেক বেশি’ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলেছেন সে কথা। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে আরও বেশি পাওয়ার কথা ছিল আমাদের, যা আমরা পাইনি। বড় দেশ হিসেবে আমরা সব সময়ই ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা চাই। সেই সঙ্গে এটাও চাই, ভারত দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হবে। সম্পর্কটা যেন একপক্ষীয় না হয়ে যায়। ভারতের নয়া সরকার নিশ্চয়ই বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারবে।
Daily Desh Rupantor
16.05.2019
0 comments:
Post a Comment