ভারতে অগি্ন-৫ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর এক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তান কর্তৃক হাতফ গজনবি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর ঘটনায় ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা উস্কে দিল। অগি্ন-৫ ও হাতফ গজনবি পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য। এবং দুই দেশের বড় শহরগুলোতে আঘাত হানার জন্য যথেষ্ট। ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঘটনাটি ঘটল এমন এক সময়ে, যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি বেসরকারি সফরে ভারত ঘুরে গেছেন এবং আগামী জুন মাসে সিয়াচেনে সৈন্যসংখ্যা হ্রাস করা নিয়ে দুই দেশ বৈঠকে বসছে। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার পাশাপাশি গ্যালাপ পোলের একটি প্রতিবেদনও সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
তাতে দেখা যায়, ভারতের প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন মানুষ আর্থিক দিক দিয়ে চরম কষ্টের মধ্যে বাস করে। এদের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। গ্যালাপের জরিপে দেখা যায়, দেশটির প্রায় ২৪ কোটি বা ৩১ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন এ অবস্থার শিকার। বিশ্বে চরম দারিদ্র্যের হার যেখানে ১৩ শতাংশ, সেখানে ভারতে তা দ্বিগুণেরও বেশি। অথচ এক বছর আগে ভারতে এই হার ছিল ২৪ ভাগ। অর্থাৎ দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যাঁরা দক্ষিণ এশিয়ার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের কাছে ভারতের এই দরিদ্রতার পরিসংখ্যান নতুন কোনো বিষয় নয়। কিছুদিন আগে ভারতের টয়লেট নিয়ে একটা মজাদার সংবাদ বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিল। প্রায় ১২১ কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ হচ্ছে ভারত। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জন্য আদৌ কোনো টয়লেট নেই। অবাক করার মতো হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের ৫৩ ভাগ লোক এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, ৪৭ ভাগ লোকের টিভি রয়েছে, ৯ ভাগ লোকের রয়েছে কম্পিউটার। অথচ ৫৩ ভাগ লোকের জন্য টয়লেটের কোনো ব্যবস্থা নেই। ৩৯ ভাগ লোকের স্থায়ী কোনো কিচেন নেই। ৫৭ ভাগ লোকের জন্য সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। ভারতের একজন বিশ্লেষক দেভিন্দার শর্মা ২০১০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ান এঙ্প্রেস পত্রিকায় লিখেছিলেন, প্রতিদিন ভারতে পাঁচ হাজার শিশু মারা যায় শুধু ক্ষুধা আর অপুষ্টির কারণে। তাঁর মতে, প্রতিবছর ১৮ লাখ ৩০ হাজার শিশু পাঁচ বছর পার হওয়ার আগেই মারা যায় নানা অসুখ-বিসুখে। ভারতে দরিদ্রতম রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড প্রভৃতি। শিশু মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে এসব রাজ্যে বেশি। কেরালায় প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার যেখানে ১৪, সেখানে মধ্যপ্রদেশে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৯২ ও উত্তর প্রদেশে ৯১। এই যখন একটি দেশের পরিস্থিতি, সেখানে দারিদ্র্য দূরীকরণের ব্যাপারে ভারতীয় নেতারা কোনো বড় ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ না করে শত শত কোটি টাকা খরচ করছেন অগি্ন-৫ ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবন ও গবেষণায়। পাকিস্তানের পরিসংখ্যানেও এ থেকে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? প্রশ্ন হচ্ছে, বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে দরিদ্রতার মধ্যে রেখে দুই দেশের এই ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি কোন দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে? পাঠকদের একটা ধারণা দিয়ে রাখি_একটা দূরপাল্লার (যেমন অগ্নি-৫) মিসাইলের মূল্য পাঁচ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ছয় লাখ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। একটি ক্রস মিসাইলের (সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য) মূল্য ১ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে এগারো কোটি টাকা)। আর বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের (যা ভারত ইতিমধ্যে অর্জন করেছে) মূল্য ছয় লাখ ডলার। এই টাকা এ খাতে ব্যয় না করে তা হাসপাতাল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজে ব্যবহার করা যেত। এমনকি ভারতে চরম দরিদ্রতম রাজ্য হিসেবে পরিচিত (দারিদ্র্যের কারণে যেখানে মাওবাদীদের তৎপরতা বেশি) মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ কিংবা ঝাড়খন্ডে 'ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প' চালু করতে পারত। ভারত তা করেনি। মুম্বাইয়ের চাকচিক্যময় ছবি দেখে ভারতের মানুষের জীবনযাত্রার মান বিচার করা যাবে না। ভারতে এক লাখ ৮৩ হাজার কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে গত ১০ বছরে আত্মহত্যা করেছে_এ রকম একটি সংবাদ সম্প্রতি পত্রিকায় বেরিয়েছে। পাকিস্তান থেকে এ ধরনের সংবাদ তেমন একটা শোনা যায় না। এ কারণেই নোবেলজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, এমডিজি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস) অর্জনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন ভারতের চেয়ে ভালো।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত প্রতিরক্ষা খাতে যথেষ্ট ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছে। সিপরির (SIPRI) বার্ষিক গবেষণাগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভারত ২০১৫ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে ৮০ মিলিয়ন ডলার খরচ করবে। জিডিপিতে প্রতিরক্ষা খাতে প্রবৃদ্ধির হার ২.৫ ভাগ থেকে ৩ ভাগ। ২০০০ সালের পর প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে শতকরা ৬৪ ভাগ। এই সময়সীমায় ভারতে যে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে, তার মধ্যে রাশিয়া একাই সরবরাহ করেছে ৮২ ভাগ। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ভারত ইতিমধ্যে তার নৌবহরে পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌশক্তিরূপে আবির্ভূত হতে চায় ভারত। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, চীনের নৌবাহিনীতে যেখানে জাহাজের সংখ্যা ১৩৫টি, সেখানে ভারতের জাহাজ রয়েছে ১০৩টি। অর্থাৎ প্রায় কাছাকাছি। ভারতের উদ্দেশ্য যে কী, তা সহজেই অনুমেয়। পাঠক, স্মরণ করার চেষ্টা করুন_প্রেসিডেন্ট ওবামার ভারত সফরের সময় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র কেনার জন্য চুক্তি করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী ১১ মিলিয়ন ডলার মূল্যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ১২৬টি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান সরবরাহ করবে। যেখানে জনগোষ্ঠীর অর্ধেক মানুষ নূ্যনতম টয়লেট সুবিধা পায় না, ৩১ ভাগ জনগোষ্ঠীর দৈনিক আয় ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে (যা কি না জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত অতিদরিদ্রের মানদণ্ড), সেখানে শত শত কোটি রুপি ভারত ব্যয় করছে অস্ত্র খাতে। ইতিমধ্যে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে অগি্ন-৫ উৎক্ষেপণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র চায়, ভারত এ অঞ্চলে অন্যতম পারমাণবিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হোক। সুদূরপ্রসারী এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত করেছে। তার টার্গেট মূলত চীন, চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা। আর এ লক্ষ্যেই দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে উঠেছে। ভারত এখন আর পাকিস্তানকে 'অন্যতম শত্রু' বলে মনে করে না। ভারতের অন্যতম 'শত্রু' এখন চীন। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এখানে এক ও অভিন্ন। হিলারি ক্লিনটনের ভারত সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল এটি_ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। আমরা ইতিমধ্যে কালের কণ্ঠে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ঘুরেও গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। মিসেস ক্লিনটনের ঝুড়িতে যে নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় যে মার্কিন স্ট্র্যাটেজি, অর্থাৎ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও সামরিক বলয়, সেই বলয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ভারতকে দিয়ে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অগি্ন-৫ উৎক্ষেপণ এই স্ট্র্যাটেজিরই একটি অংশ। ভারতকে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো কিংবা ভারতকে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত করার উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে বলতে পারব না, কিন্তু যে দেশ তার দারিদ্র্য দূরীকরণে কোনো বড় কর্মসূচি নিতে পারে না কিংবা কৃষকের আত্মহত্যা রোধ করার উদ্যোগ নিতে পারে না, সেই দেশ অগি্ন-৫ মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবন করে আমাদের জন্য কোনো 'মডেল' হতে পারে না। আগামী দিনে ভারতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে কন্যাসন্তানের ভ্রূণ হত্যার প্রবণতাও। একটি সভ্য সমাজে যা কখনো করা যায় না। অগি্ন-৫ উৎক্ষেপণ ছিল একটি প্রহসন মাত্র। আর পাকিস্তানের পরিস্থিতি যে ভারতের চেয়ে ভালো, তা বলা যাবে না। পাকিস্তান বাহ্যত আরেকটি 'তালেবানি রাষ্ট্রে' পরিণত হতে যাচ্ছে। একুশ শতকে এসেও পাকিস্তানের কোনো কোনো প্রদেশে মেয়েদের শিক্ষা সীমিত। তালেবান জঙ্গিরা মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে_এ রকম সংবাদ আমরা একাধিকবার পাঠ করেছি। পাকিস্তানের মতো দেশে, যেখানে তারা জঙ্গি তৎপরতা দমন করতে পারছে না, সেখানে শাহীন (১৮০০ মাইল দূরপাল্লা) কিংবা হাতফ গজনবির (১৮০ মাইল দূরে আঘাত হানার ক্ষমতাসম্পন্ন) মতো মিসাইল উদ্ভাবন করে পাকিস্তান পারমাণবিক প্রতিযোগিতাকে উস্কে দিল মাত্র। পাকিস্তান বা ভারতের এ থেকে লাভবান হওয়ার কিছু নেই। এতে করে দুই দেশের দরিদ্রতা আরো বাড়বে। আর লাভবান হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অস্ত্র ব্যবসায় তাদের প্রসার বাড়বে। ইতিমধ্যে খবর বেরিয়েছে, ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬৬ কোটি ডলার ব্যয়ে ১৪৫টি হালকা কামান আমদানি করছে। একসময় তথাকথিত 'নিরাপত্তা সুরক্ষার' নাম করে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ১০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সাহায্য করেছিল (বিবিসি, ডিসেম্বর ১৬, ২০১০)। এখানে বলা ভালো, ভারত ও পাকিস্তান এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারতের ব্যাপারে তার নীতির যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। উপমহাদেশের আগামী দিনগুলোতে এই প্রতিযোগিতা বাড়বে বলেই মনে হয়।
তাতে দেখা যায়, ভারতের প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন মানুষ আর্থিক দিক দিয়ে চরম কষ্টের মধ্যে বাস করে। এদের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। গ্যালাপের জরিপে দেখা যায়, দেশটির প্রায় ২৪ কোটি বা ৩১ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন এ অবস্থার শিকার। বিশ্বে চরম দারিদ্র্যের হার যেখানে ১৩ শতাংশ, সেখানে ভারতে তা দ্বিগুণেরও বেশি। অথচ এক বছর আগে ভারতে এই হার ছিল ২৪ ভাগ। অর্থাৎ দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যাঁরা দক্ষিণ এশিয়ার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের কাছে ভারতের এই দরিদ্রতার পরিসংখ্যান নতুন কোনো বিষয় নয়। কিছুদিন আগে ভারতের টয়লেট নিয়ে একটা মজাদার সংবাদ বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিল। প্রায় ১২১ কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ হচ্ছে ভারত। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জন্য আদৌ কোনো টয়লেট নেই। অবাক করার মতো হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের ৫৩ ভাগ লোক এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, ৪৭ ভাগ লোকের টিভি রয়েছে, ৯ ভাগ লোকের রয়েছে কম্পিউটার। অথচ ৫৩ ভাগ লোকের জন্য টয়লেটের কোনো ব্যবস্থা নেই। ৩৯ ভাগ লোকের স্থায়ী কোনো কিচেন নেই। ৫৭ ভাগ লোকের জন্য সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। ভারতের একজন বিশ্লেষক দেভিন্দার শর্মা ২০১০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ান এঙ্প্রেস পত্রিকায় লিখেছিলেন, প্রতিদিন ভারতে পাঁচ হাজার শিশু মারা যায় শুধু ক্ষুধা আর অপুষ্টির কারণে। তাঁর মতে, প্রতিবছর ১৮ লাখ ৩০ হাজার শিশু পাঁচ বছর পার হওয়ার আগেই মারা যায় নানা অসুখ-বিসুখে। ভারতে দরিদ্রতম রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড প্রভৃতি। শিশু মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে এসব রাজ্যে বেশি। কেরালায় প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার যেখানে ১৪, সেখানে মধ্যপ্রদেশে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৯২ ও উত্তর প্রদেশে ৯১। এই যখন একটি দেশের পরিস্থিতি, সেখানে দারিদ্র্য দূরীকরণের ব্যাপারে ভারতীয় নেতারা কোনো বড় ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ না করে শত শত কোটি টাকা খরচ করছেন অগি্ন-৫ ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবন ও গবেষণায়। পাকিস্তানের পরিসংখ্যানেও এ থেকে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? প্রশ্ন হচ্ছে, বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে দরিদ্রতার মধ্যে রেখে দুই দেশের এই ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি কোন দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে? পাঠকদের একটা ধারণা দিয়ে রাখি_একটা দূরপাল্লার (যেমন অগ্নি-৫) মিসাইলের মূল্য পাঁচ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ছয় লাখ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। একটি ক্রস মিসাইলের (সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য) মূল্য ১ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে এগারো কোটি টাকা)। আর বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের (যা ভারত ইতিমধ্যে অর্জন করেছে) মূল্য ছয় লাখ ডলার। এই টাকা এ খাতে ব্যয় না করে তা হাসপাতাল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজে ব্যবহার করা যেত। এমনকি ভারতে চরম দরিদ্রতম রাজ্য হিসেবে পরিচিত (দারিদ্র্যের কারণে যেখানে মাওবাদীদের তৎপরতা বেশি) মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ কিংবা ঝাড়খন্ডে 'ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প' চালু করতে পারত। ভারত তা করেনি। মুম্বাইয়ের চাকচিক্যময় ছবি দেখে ভারতের মানুষের জীবনযাত্রার মান বিচার করা যাবে না। ভারতে এক লাখ ৮৩ হাজার কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে গত ১০ বছরে আত্মহত্যা করেছে_এ রকম একটি সংবাদ সম্প্রতি পত্রিকায় বেরিয়েছে। পাকিস্তান থেকে এ ধরনের সংবাদ তেমন একটা শোনা যায় না। এ কারণেই নোবেলজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, এমডিজি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস) অর্জনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন ভারতের চেয়ে ভালো।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত প্রতিরক্ষা খাতে যথেষ্ট ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছে। সিপরির (SIPRI) বার্ষিক গবেষণাগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভারত ২০১৫ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে ৮০ মিলিয়ন ডলার খরচ করবে। জিডিপিতে প্রতিরক্ষা খাতে প্রবৃদ্ধির হার ২.৫ ভাগ থেকে ৩ ভাগ। ২০০০ সালের পর প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে শতকরা ৬৪ ভাগ। এই সময়সীমায় ভারতে যে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে, তার মধ্যে রাশিয়া একাই সরবরাহ করেছে ৮২ ভাগ। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ভারত ইতিমধ্যে তার নৌবহরে পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌশক্তিরূপে আবির্ভূত হতে চায় ভারত। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, চীনের নৌবাহিনীতে যেখানে জাহাজের সংখ্যা ১৩৫টি, সেখানে ভারতের জাহাজ রয়েছে ১০৩টি। অর্থাৎ প্রায় কাছাকাছি। ভারতের উদ্দেশ্য যে কী, তা সহজেই অনুমেয়। পাঠক, স্মরণ করার চেষ্টা করুন_প্রেসিডেন্ট ওবামার ভারত সফরের সময় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র কেনার জন্য চুক্তি করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী ১১ মিলিয়ন ডলার মূল্যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ১২৬টি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান সরবরাহ করবে। যেখানে জনগোষ্ঠীর অর্ধেক মানুষ নূ্যনতম টয়লেট সুবিধা পায় না, ৩১ ভাগ জনগোষ্ঠীর দৈনিক আয় ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে (যা কি না জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত অতিদরিদ্রের মানদণ্ড), সেখানে শত শত কোটি রুপি ভারত ব্যয় করছে অস্ত্র খাতে। ইতিমধ্যে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে অগি্ন-৫ উৎক্ষেপণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র চায়, ভারত এ অঞ্চলে অন্যতম পারমাণবিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হোক। সুদূরপ্রসারী এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত করেছে। তার টার্গেট মূলত চীন, চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা। আর এ লক্ষ্যেই দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে উঠেছে। ভারত এখন আর পাকিস্তানকে 'অন্যতম শত্রু' বলে মনে করে না। ভারতের অন্যতম 'শত্রু' এখন চীন। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এখানে এক ও অভিন্ন। হিলারি ক্লিনটনের ভারত সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল এটি_ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। আমরা ইতিমধ্যে কালের কণ্ঠে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ঘুরেও গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। মিসেস ক্লিনটনের ঝুড়িতে যে নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় যে মার্কিন স্ট্র্যাটেজি, অর্থাৎ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও সামরিক বলয়, সেই বলয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ভারতকে দিয়ে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অগি্ন-৫ উৎক্ষেপণ এই স্ট্র্যাটেজিরই একটি অংশ। ভারতকে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো কিংবা ভারতকে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত করার উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে বলতে পারব না, কিন্তু যে দেশ তার দারিদ্র্য দূরীকরণে কোনো বড় কর্মসূচি নিতে পারে না কিংবা কৃষকের আত্মহত্যা রোধ করার উদ্যোগ নিতে পারে না, সেই দেশ অগি্ন-৫ মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবন করে আমাদের জন্য কোনো 'মডেল' হতে পারে না। আগামী দিনে ভারতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে কন্যাসন্তানের ভ্রূণ হত্যার প্রবণতাও। একটি সভ্য সমাজে যা কখনো করা যায় না। অগি্ন-৫ উৎক্ষেপণ ছিল একটি প্রহসন মাত্র। আর পাকিস্তানের পরিস্থিতি যে ভারতের চেয়ে ভালো, তা বলা যাবে না। পাকিস্তান বাহ্যত আরেকটি 'তালেবানি রাষ্ট্রে' পরিণত হতে যাচ্ছে। একুশ শতকে এসেও পাকিস্তানের কোনো কোনো প্রদেশে মেয়েদের শিক্ষা সীমিত। তালেবান জঙ্গিরা মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে_এ রকম সংবাদ আমরা একাধিকবার পাঠ করেছি। পাকিস্তানের মতো দেশে, যেখানে তারা জঙ্গি তৎপরতা দমন করতে পারছে না, সেখানে শাহীন (১৮০০ মাইল দূরপাল্লা) কিংবা হাতফ গজনবির (১৮০ মাইল দূরে আঘাত হানার ক্ষমতাসম্পন্ন) মতো মিসাইল উদ্ভাবন করে পাকিস্তান পারমাণবিক প্রতিযোগিতাকে উস্কে দিল মাত্র। পাকিস্তান বা ভারতের এ থেকে লাভবান হওয়ার কিছু নেই। এতে করে দুই দেশের দরিদ্রতা আরো বাড়বে। আর লাভবান হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অস্ত্র ব্যবসায় তাদের প্রসার বাড়বে। ইতিমধ্যে খবর বেরিয়েছে, ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬৬ কোটি ডলার ব্যয়ে ১৪৫টি হালকা কামান আমদানি করছে। একসময় তথাকথিত 'নিরাপত্তা সুরক্ষার' নাম করে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ১০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সাহায্য করেছিল (বিবিসি, ডিসেম্বর ১৬, ২০১০)। এখানে বলা ভালো, ভারত ও পাকিস্তান এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারতের ব্যাপারে তার নীতির যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। উপমহাদেশের আগামী দিনগুলোতে এই প্রতিযোগিতা বাড়বে বলেই মনে হয়।
দৈনিক কালের কন্ঠ , 28 মে 2012।
0 comments:
Post a Comment