মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর দেশ দুুটির মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের একটি সম্ভাবনার যখন জন্ম হয়েছে, ঠিক তখনই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ‘নালিশ’ করলেন ওআইসির সম্মেলনে তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাদে। তিনি ওই সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন যে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোরও দাবি করেন তিনি (সকালের খবর, ১৩ মে)। দীপু মনি যা বলেছেন তার মধ্যে কোনো মিথ্যা নেই। রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য একটা সমস্যা। এটা নিয়ে দীর্ঘদিন দু’দেশের মাঝে দেনদরবার চলছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আসরে বলার সময় এখনও আসেনি। সবচেয়ে বড় কথা, মিয়ানমার ধীরে ধীরে ‘উন্মুক্ত’ হয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তাদের অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের জন্যও একটা সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্য দু’দেশের মাঝে একটা আস্থার ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে। আমরা পররাষ্ট্রনীতিতে খুব সফলতা দেখছি না। তাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, তারা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ আদায়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় কোনো সফলতার পরিচয় দিতে পারেননি। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে দু’জন উপদেষ্টাকে তত্পর হতে দেখা গেছে, যদিও কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। শুধু তাই নয়, ভারতকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমরা আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারকে কখনই বিবেচনায় নিইনি এবং নিকট প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গাঢ় করার তেমন কোনো বড় উদ্যোগ নিইনি। আমাদের জাতীয় স্বার্থের কারণে মিয়ানমার ও চীনের প্রয়োজন রয়েছে অনেক বেশি। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন ও মিয়ানমার সফর করেছেন, কিন্তু দেশ দুটির সঙ্গে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। তবে একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। এই সম্ভাবনা এখন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ্য নেতৃত্ব দরকার, যারা সময়ের বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে নয়া দিকনির্দেশনা দেবেন।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাসী। কিন্তু ভারতের দ্বিপাক্ষিকতার কারণে আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির বহুপাক্ষিকতার চরিত্র হারিয়ে ফেলেছি। ফলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি না নেওয়ার কারণে। অথচ চীন, থাইল্যান্ড এবং ভারতও এই জ্বালানি সম্পদকে ব্যবহার করছে। প্রতিবেশী দেশ হওয়ার কারণে আমাদের সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক শিল্প-কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা থাকলেও আমরা এ ব্যাপারে গত তিন বছরে কোনো উদ্যোগ নিইনি। মিয়ানমার-চট্টগ্রাম সীমান্তে সার কারখানা স্থাপন করে মিয়ানমারের বিপুল সারের চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারতাম। কিন্তু তা হয়নি। আকিয়াব, মংডুর আশপাশে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এর ভিত্তিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারত। সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে তা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও আমরা উত্সাহিত করিনি। আমরা বেসরকারি উদ্যোগে আফ্রিকাতে জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদের উদ্যোগ নিয়েছি। অথচ পাশের দেশে রয়েছে প্রচুর অনাবাদি জমি। মিয়ানমার জমি ‘লিজ’ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও আমাদের নীতি প্রণেতারা বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি। এমনকি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও উত্সাহিত করেননি। অতিসম্প্রতি ভারত থেকে তুলা আমদানি নিয়ে একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ মিয়ানমারের মন্দালয়-ম্যাগাওয়ে অঞ্চলে প্রচুর তুলা উত্পন্ন হয়। আমরা কখনও ওই তুলার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাইনি। এমনকি ওই অঞ্চলে প্রচুর ভুট্টা চাষ হয়। মিয়ানমারে প্রচুর গবাদিপশু উত্পাদন হয়, যা কিনা আমাদের চাহিদা মেটাতে পারে। যৌথভাবে গবাদিপশুর ফার্ম তৈরি করাও সম্ভব। মিয়ানমারে প্রচুর বিদেশি পর্যটক আসেন। এরা যাতে বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আসেন কিংবা সুন্দরবনে এদের নিয়ে যাওয়া যায় কি না, আমাদের ট্যুর অপারেটররা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। কুনমিং-মুসে-ঘুমধুম সড়ক আমাদের জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে বটে, কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সড়ক যোগাযোগের জন্য ‘মৈত্রী সড়ক’-এর কাজ শুরু হয়েছিল বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়। ওই সড়কে বেশ ক’টি সেতু নির্মাণ করার কথা, যা কিনা বাংলাদেশ নিজের অর্থায়নে করবে। কিন্তু এই ‘মৈত্রী সড়ক’-এর কোনো খবর আমরা জানি না। অথচ ভারতকে ট্রানজিট দিতে আমরা অনেক রাস্তা সংস্কার করেছি। এমনকি তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতীয় ২৮ চাকার যান চলাচলের সুযোগ আমরা করে দিয়েছি। অথচ ‘মৈত্রী সড়ক’ দ্রুত সম্পন্ন করার তেমন কোনো উদ্যোগ আমাদের নেই। অর্থাত্ বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রয়োজনে আমরা মিয়ানমারকে গুরুত্ব দিইনি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ‘বিমসটেক’-এর সদস্য। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশি পণ্যের বাজারই আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর জন্য উন্মুক্ত করবে না, বরং আসিয়ানের সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আসিয়ানের ‘ডায়ালগ পার্টনার’-এর মর্যাদা পেতে সাহায্য করবে। বলা ভালো, ভারত ইতোমধ্যে ‘ডায়ালগ পার্টনার’-এর মর্যাদা পেয়েছে। মিয়ানমার আসিয়ানের সভাপতির দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে আগামী বছর। এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। বহির্বিশ্বে মিয়ানমারের যে ‘বদনাম’ ছিল তা ইতোমধ্যেই কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। গণতন্ত্রী নেত্রী সু চি’র সঙ্গে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন প্রশাসনের সম্পর্ক এখন ভালো। সু চি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। জেনারেল সেইন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্ক আগের মতো নেই। মিয়ানমারের বিপুল জ্বালানি সম্পদের সম্ভাবনা মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে মিয়ানমারের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে। বলতে বাধা নেই, মিয়ানমার আর আগের অবস্থানে নেই। এখানে ভারতের ভূমিকাও লক্ষ করার মতো। ভারত তার জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনেই মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এ ক্ষেত্রে সু চি’র গণতান্ত্রিক আন্দোলন কখনই প্রাধান্য পায়নি। ভারত বহির্বিশ্বে সু চি’র মুক্তির ব্যাপারেও তেমন কোনো আন্দোলন গড়ে তোলেনি। মিয়ানমার সরকারের ওপর কোনো ‘প্রেশার’ও সৃষ্টি করেনি। কেননা মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ ভারতীয় নেতাদের কাছে সু চি’র চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশ ভারতের এই ‘অ্যাপ্রোচ’ থেকে শিখতে পারে অনেক কিছু।
ঢাকায় নিযুক্ত নয়া চীনা রাষ্ট্রদূত লি জুন একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন গত ১৯ মার্চ। তিনি বলেছেন, চীন এ অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটি মেনে নেবে না। ক্রমবর্ধমান ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্তব্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এ অঞ্চলে মার্কিন কর্তৃত্ব ও প্রভাব বাড়ছে। মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের আওতাধীন এই অঞ্চল। তথাকথিত ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ দমনে এ অঞ্চলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মার্কিন সেনার উপস্থিতি রয়েছে, যা দৃশ্যমান নয়। তবে যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন এ অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতির উদ্দেশ্য একটাই-আর তা হচ্ছে ধীরে ধীরে ‘চীনকে ঘিরে ফেলা’। যুক্তরাষ্ট্রের এই স্ট্র্যাটেজি স্নায়ুযুদ্ধকালীন ‘কনটেইনমেন্ট পলিসি’র কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই চীন এ ধরনের কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কারণে স্বাভাবিকভাবেই দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বলয়ে বাংলাদেশ যদি প্রবেশ করে, তা হলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চীন তথা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি ‘ফ্রন্ট’ গড়ে তোলাই হচ্ছে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মূল উদ্দেশ্য। বিদেশের সংবাদপত্র তথা ব্লগে বাংলাদেশের সম্ভাব্য এই ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ও ওআইসির সম্মেলনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া একই সূত্রে গাঁথা। এতে করে বাংলাদেশ লাভবান হবে না। বাংলাদেশের এই ভূমিকা মিয়ানমার খুব ভালো চোখে দেখবে বলেও মনে হয় না। রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য অবশ্যই একটি সমস্যা। নানা সামাজিক সমস্যা তারা সৃষ্টি করছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) আশগাবাদে যৌথভাবে এই সম্মেলন আয়োজন করলেও অতীতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে ইউএনএইচসিআরের ভূমিকা ইতিবাচক ছিল না। তারা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
‘সফল কূটনীতি’ প্রয়োগে আমাদের সফলতা খুব বেশি নেই। আমাদের জন্য যেসব সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে, ‘সফল কূটনীতি’র ব্যর্থতার কারণে সেই সুযোগগুলো থেকে আমরা ফায়দা তুলতে পারছি না। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধান করা উচিত ছিল। তা না করে আন্তর্জাতিক আসরে রোহিঙ্গা প্রশ্নটি তুলে আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে পারব বলে মনে হয় না। বরং দু’দেশের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে বাধ্য। মিয়ানমার যখন ‘উন্মুক্ত’ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই রোহিঙ্গা প্রশ্নটি আন্তর্জাতিকীকরণের মধ্য দিয়ে আমরা একটা ভুল সিগন্যাল পৌঁছে দিলাম। এতে করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে না।
Daily SAKALER KHOBOR
15.5.12
0 comments:
Post a Comment