রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

হিলারির সফর : একটি মূল্যায়ন

এক ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন হিলারি ক্লিনটন। বাংলাদেশটা তার একেবারে অপরিচিত নয়। এর আগেও তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। তবে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নয়। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের বিকাশ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার সখ্য, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি নানা বিষয় হিলারি ক্লিনটনকে আগ্রহান্বিত করে তুলেছিল। এর প্রমাণও তিনি দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ না হলেও ড. ইউনূসের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। দীর্ঘ কথাও হয়েছে। তবে এবার হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিভিন্ন কারণে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব এ মুহূর্তে অনেক বেশি। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি বেড়ে যাওয়া, মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়া, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হওয়া ইত্যাদি নানা বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নিছক প্রটোকল রক্ষার্থে হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে এসেছেন, এটা আমি মনে করি না। বরং দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতিতে যে পরিবর্তন আসছে, সেই পরিবর্তনের আলোকেই এই সফরকে বিশ্লেষণ করতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী? বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের আলোকে এ সফর থেকে আমরা কতটুকু সুবিধা আদায় করে নিতে পেরেছি? যৌথ সংবাদ সম্মেলনে হিলারি ক্লিনটনের দেয়া বক্তব্য থেকে যে বিষয়গুলো বেরিয়ে এসেছে, তাতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি যে খুব বেশি, তা আমার কাছে মনে হয়নি। প্রথমত, একটি যৌথ অংশীদারিত্বের চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ে বছরে একবার সংলাপ হবে। এ ধরনের সংলাপ অতীতে হলেও এবার এর একটি আইনি কাঠামো দেয়া হল। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘সংলাপে’র মধ্য দিয়ে কি আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ আদায় করে নিতে পারব? নাকি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থটা এখানে বেশি? চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান আর জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধ রোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হতে পারে। যা আশংকা করা হচ্ছে তা হচ্ছে, ভবিষ্যতে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদ রোধে সহযোগিতা’র আলোকে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক, মার্কিন সেনা মোতায়েন হবে কিনা? যে ‘অংশীদারি সংলাপে’র কথা বলা হচ্ছে, তা এ দিকটা নির্দেশ করে কিনা? অনেকের মনে থাকার কথা, গত ২ মার্চ সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ প্যাসিফিক ফ্লিটের অন্তর্ভুক্ত) কমান্ডার রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ বাহিনী’ মোতায়েন রয়েছে। যদিও ঢাকার মার্কিন দূতাবাস পরে এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছিল।
আসলে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে নানা কারণে। ভারতীয় মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর শক্তিশালী উপস্থিতি, যা মার্কিন তথা ভারতীয় স্বার্থকে আঘাত করছে, এটা পেন্টাগনের উদ্বেগের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে মিয়ানমার এখন অনেকটা ‘উš§ুক্ত’ হয়ে যাচ্ছে। অং সান সু চি সংসদে গেছেন। সু চিকে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় বসানো এবং মিয়ানমারে তাদের উপস্থিতি বাড়িয়ে চীনকে ঘিরে ফেলার মার্কিন নীতিতে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। যদিও এটা ঠিক যে যুক্তরাষ্ট্র চায় না বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠুক। বাংলাদেশকে তারা একটি মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবেই মনে করে। জঙ্গিবাদকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভয়। প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের ব্যর্থতা স্বীকার করে ২০১৪ সালে সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে যাচ্ছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়া, ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ বিকশিত হোক, এটা যুক্তরাষ্ট্র কখনও চাইবে না। আমেরিকা-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব চুক্তি এ লক্ষ্যেই স্বাক্ষরিত হচ্ছে কিনা, এটাই বড় প্রশ্ন এখন। ভুলে গেলে চলবে না, দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব মার্কিনিদের কাছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। অতি সম্প্রতি এডমিরাল জেমস স্টাভরিডিস মার্কিন বাহিনীর ‘ভড়ৎধিৎফ ঢ়ৎবংবহপব’-এর কথা বলেছেন। এডমিরাল স্টাভরিডিস যুক্তরাষ্ট্রের ঊটঈঙগ (টহরঃবফ ঝঃধঃবং ঊঁৎড়ঢ়বধহ ঈড়সসধহফ)-এর প্রধান। স্টাভরিডিস দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য তথা আফ্রিকাতে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তার কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। এখন দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তিটিকে কিভাবে ব্যবহার করে। এখান থেকে আমাদের পাওয়ার কিছু নেই।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে সুযোগ চেয়েছিল তা পায়নি। বাংলাদেশকে তার তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে যে শুল্ক দিতে হয়, তাতে করে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারছি না। অথচ এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) দেশ হিসেবে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ আমাদের পাওয়ার কথা। তৃতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন’ (এমসিপি) থেকে বাংলাদেশ কোন সাহায্য পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের কোন বক্তব্য বা সহযোগিতার আশ্বাস আমরা পাইনি। চতুর্থত, মিসেস ক্লিনটন ‘গণতন্ত্রের জন্য সংলাপ’ ও ‘পার্লামেন্টারি ডিবেটে’র কথা বলেছেন। এগুলো হচ্ছে তত্ত্বের কথা। আমরা সবাই জানি, গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে সংলাপ ছাড়া কোন বিকল্প নেই। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখা যে জরুরিÑ এ কথাটা আমরা বারবার বলে আসছি। কিন্তু এই ‘সংলাপ’ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়নি। এমনকি সংসদীয় ডিবেটও তেমন কার্যকর নয়। এখন হিলারি ক্লিনটনের মুখ থেকে এ কথাটি বেরিয়ে এসেছে সত্য। কিন্তু আদৌ ‘সংলাপ’ অনুষ্ঠিত হবে, এ আস্থাটা রাখতে পারছি না। হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যের একটা খারাপ দিক হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নাক গলানো’। ভারত কিংবা অন্য কোন দেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এমনটা করে না। আমরা এমন একটা ‘ক্ষেত্র’ তৈরি করেছি, যেখানে বিদেশীরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করছে। পঞ্চমত, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অন্তর্ধান নিয়ে হিলারি ক্লিনটনের মন্তব্য, হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের যে অভিমত হিলারি দিয়েছেন, সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো করবে।
হিলারি ক্লিনটন তার বক্তব্য ও চুক্তিতে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, শক্তিশালী সুশীল সমাজ, এনজিওর ভূমিকা, খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনে সহযোগিতা, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা কিংবা হরতালের ক্ষতিকর দিক এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে কথা বলেছেন, তার মাঝে নতুনত্ব কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে এসব প্রতিফলিত হয়। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়নের কথা যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র বিনির্মাণের সমস্যাটা মানবিক। রাজনীতিকদের মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে এ দেশে সাচ্চা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়েও কথা আছে। ওয়ান-ইলেভেনে সুশীল সমাজের ভূমিকা তাদের বিতর্কিত করেছে।
আমরা হিলারি ক্লিনটনের সফরকে বেশি করে গুরুত্ব দিয়েছি। ক্লিনটনের সঙ্গে মমতা ব্যার্নাজির বৈঠকেও আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম যে, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে হিলারি কথা বলবেন। কিন্তু সেটা হয়নি। আমরা ভুলে গেছি, এটা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নয়। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কখনও হস্তক্ষেপ করে না। হিলারির এ সফরে আমাদের প্রাপ্তি খুব বেশি নয়। এতে করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা আরও ‘একটু উন্নত’ হল মাত্র। তবে মূল বিষয় যেটি তা হচ্ছে ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব চুক্তি’ বা সংলাপ তৃতীয় কোন দেশের (চীন) বিরুদ্ধে ব্যবহƒত হয় কিনা, তা দেখা। আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে আমরা এই চুক্তি থেকে কতটুকু উপকৃত হব।
দৈনিক যুগান্তর ,  ১০  মে ২০১২।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

0 comments:

Post a Comment