09:50
বিএনপির
একজন মাঝ পর্যায়ের নেতা ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান নিয়ে রাজনীতি এখন উত্তপ্ত।
পরপর দু'দফায় হরতাল হয়ে গেল। দ্বিতীয় দফায় হরতাল শেষ হয়েছে গত ৩০ এপ্রিল।
আপাতত সপ্তাহ খানেক হরতালের বিরতি থাকবে বলেই আমার ধারণা। কেননা তিনজন
গুরুত্বপূর্ণ ভিআইপি বাংলাদেশে আসছেনন আগামী ৫ মে। একজন হিলারি কিনটন,
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব ও অপরজন প্রণব মুখার্জি, ভারতের অর্থমন্ত্রী
এবং জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই তিনটি সফর খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট হরতাল দেবে, এটা আমার মনে হয়
না। তবে হরতাল যে আগামীতে আসছে তা নিশ্চিত করেই বলতে পারি। কিন্তু হরতালের
পর হরতাল দিয়ে কি ইলিয়াস আলীকে আমরা খুঁজে পেয়েছি? কিংবা বলা যেতে পারে
ইলিয়াস আলী কি ফিরে এসেছেন? না, আসেননি। দশ-বারো দিনের ওপর হয়ে গেল তিনি
নিখোঁজ। তার নিখোঁজ রহস্য নিয়ে নানা 'কাহিনী' এখন বাজারে। দৈনিক যায়যায়দিন
আমাদের জানিয়েছে ১১টি কারণের কথা। এর কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা, আমরা বলতে
পারবো না। বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। গোল টেবিলে, টিভি টকশোতে সবারই একটি
বক্তব্য এটি অনাকাঙ্ক্ষিত। কেউ যদি তাকে লুকিয়েও রাখে, পুলিশ, গোয়েন্দা
সংস্থাগুলো তাকে খুঁজে পাবে না কেন? নাকি রুনি-সাগর হত্যাকা-, কিংবা সৌদি
কূটনীতিক খালাফ আলীর হত্যাকা-ের মতো ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধানের বিষয়টিও এক
সময় ধামাচাপা পড়ে যাবে? তবে তার অন্তর্ধান সবার মাঝে, বিশেষ করে
রাজনীতিবিদদের মাঝে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। রাশেদ খান মেনন, যিনি একজন সংসদ
সদস্য ও মহাজোটের শরিক, তিনি বলেছেন তিনি তার নিরাপত্তার ব্যাপারে
পুরোপুরি নিশ্চিত নন। জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন 'বাড়িতে
থাকলে খুন, বাইরে গেলে গুম'। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ বলেছেন
গত এক বছরে ৯৬ জন গুম হয়েছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে। আর ড. কামাল
হোসেন বলেছেন জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইলিয়াসকে উদ্ধার করতে হবে। এ ধরনের
বক্তব্য প্রমাণ করে জনমনে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এটা সরকারের একটা বড়
ব্যর্থতা। একজন ব্যক্তি, যিনি বিরোধী দলের রাজনীতির সাথে জড়িত, তিনি নিখোঁজ
হয়ে যাবেন, তা হতে পারে না। কে করলো, কারা তাকে 'গুম' করলো? এ নিয়ে
রাজনীতি এখন উত্তপ্ত। ২৯ এপ্রিল দিনে হরতালের সময় ঢাকা শহরে সহিংস ঘটনা
ঘটল। বাসে আগুন দেয়া হলো। সচিবালয়ে নিক্ষেপ্তি হলো ককটেল, হাতবোমা। হরতাল
হলো ৩০ এপ্রিল। কিন্তু হরতাল দিয়ে কি ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে?
অন্যদের কথায় নাইবা গেলাম। জলিল সাহেবের একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এই সদস্য বললেন, 'ইলিয়াসকে খুঁজে বের করা
রাষ্ট্রের দায়িত্ব'। মিথ্যা বলেননি জলিল সাহেব। ইলিয়াস আলী সাধারণ একজন
নাগরিক নন। সাবেক এমপি, সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির সাংগঠনিক
সম্পাদক। এমন কী ঘটেছিল, যাতে করে তিনি নিখোঁজ হয়ে যাবেন এবং আমরা কেউ তা
জানবো না? এ ক্ষেত্রে আমরা যারা লেখালেখি করি, আমরা কী লিখবো না? অনেকেই
জানেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলে একটা কথা আছে। রাজনীতি বিজ্ঞানে এই ষড়যন্ত্র
তত্ত্ব বহুল ব্যবহৃত। ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ রহস্যে কি আমরা এখন এই 'ষড়যন্ত্র
তত্ত্ব' ব্যবহার করবো? সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ ও
পুনরায় মন্ত্রিসভায় ফিরে আসার মধ্যে নাটকীয়তা এবং ৭০ লাখ টাকা উদ্ধারের
ঘটনার পেছনের কাহিনীর রহস উদ্ঘাটনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেও, এই ঘটনার সাথে
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব'-এ
যারা বিশ্বাস করেন, তারা এটা নিয়ে গবেষণা করতে পারেন। সংবিধান সাধারণ
নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। যেখানে সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে
মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, তৃতীয় ভাগের একাধিক
অনুচ্ছেদে, বিশেষ করে ২৭, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৬, ৩৯নং অনুচ্ছেদে সাধারণ একজন
নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সেখানে একজন সাধারণ নাগরিক ইলিয়াস আলীর
নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা সরকার উদ্ঘাটন করতে পারবে, এটা বিশ্বাস করতেই পারি।
ইতোমধ্যে র্যাবের এক অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন মিসেস ইলিয়াস গত ২১ এপ্রিল।
চাঁদপুরেও র্যাব অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তবুও আমরা
আশাবাদী। আশা আমরা করতেই পারি।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' এ আমি যাবো না। আমরা অনেকেই
বলি- বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনার দেশ। গত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে একটি
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে আমি গিয়েছিলাম তুরস্কে। ওই সম্মেলনে যোগ
দিয়েছিলেন ২৬টি দেশের প্রতিনিধিরা, যারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
একাধিক শিক্ষক আমাকে বলেছেন বাংলাদেশের সম্ভবনা আছে। প্রয়োজন সঠিক নীতি ও
যোগ্য নেতৃত্বের। এখানেই এসে যায় প্রশ্নটি- আমরা কি সবাই মিলে সঠিক নীতিটি
গ্রহণ করতে পেরেছি? ২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর। ৪১ বছরে
পা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? যৌথভাবেই পরিকল্পনা নেয়া দরকার।
এরই নাম গণতন্ত্র। অর্থনীতি একটি সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু
নির্মাণ নিয়ে একটি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
বিশ্ব মন্দায় আমরা আক্রান্ত নই- এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তৈরি পোশাকের
রপ্তানি কমেছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহও কম। যেখানে ইউরোপজুড়ে কৃচ্ছ্র সাধন
চলছে (গ্রিস এর বড় উদাহরণ), সেখানে আমাদের রাজস্ব ব্যয় বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, যারা
বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিনির্মাণে পালন করছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এরাই ভোট
দিয়ে 'প্রিয় দলকে' ক্ষমতায় পাঠায়। বিদ্যুৎ সঙ্কট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো
জটিল করেছে। এই যখন দেশের পরিস্থিতি তখন সরকার ও বিরোধী দল পরস্পর বিরোধী
একটি অবস্থান গ্রহণ করেছে। প্রায় প্রতিটি ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের
অবস্থান পরস্পর বিরোধী। ইলিয়াস আলীর 'নিখোঁজ' হওয়ার ব্যাপারেও এই পরস্পর
বিরোধী অবস্থান আমরা লক্ষ্য করি। যেখানে সরকার বলছে 'এটা সাজানো নাটক',
সেখানে বিরোধী দল বিএনপি বলছে 'এটা সরকারের কাজ'। আর মাঝখানে আমরা, আমজনতা,
আমরা আছি এক অনিশ্চয়তায়। দেশের বিবেচনায় এটা কোনো ভালো খবর নয়। বিএনপির
নেতৃবৃন্দ যখন তাদের নেতাদের সতর্কতার সাথে চলাফেলার নির্দেশ দেন, তখন
আতঙ্কের বিষয়টিকে আরো উসকে দেয়।
সংবাদপত্র থেকে জানলাম ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের এমপি রিচার্ড ফুলার বৃটিশ
পার্লামেন্টে ইলিয়াস আলীর 'গুম' হওয়ার ঘটনাটি উত্থাপন করেছেন। এটা নিশ্চয়ই
আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এতে করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোথায়
গিয়ে দাঁড়াল? রাষ্ট্র যদি একজন সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে
ব্যর্থ হয়, আন্তর্জাতিক আসরে সেই রাষ্ট্রের মর্যাদা নষ্ট হয় বৈকি! এমনিতেই
দুর্নীতিতে আমাদের সকল অর্জন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। গত ৪০ বছরে আমাদের অর্জন
একেবারে কম নয়। কিন্তু সেই অর্জনগুলো একে একে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উচ্চ
পর্যায়ের দুর্নীতি আমরা নির্মূল করতে পারছি না। আর এখন যদি এই 'গুম' এর
প্রবণতা আমরা রোধ করতে না পারি, তাহলে আগামী দিনগুলোতে আমাদের জন্য কোনো
ভালো খবর অপেক্ষা করছে না।
রাজনীতি উত্তপ্ত হচ্ছে। হরতাল ঠেকাতে সরকারি দল মাঠে নেমেছে। এতে করে
সংঘর্ষের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের
বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। এমনি এ পরিস্থিতিতে উত্তরণ কীভাবে সম্ভব, আমি
জানি না। আমাদের সিনিয়র সিটিজেনরাও কোনো দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন না। হরতাল
আমরা চাই না বটে, কিন্তু হরতালের বিকল্প কী? এক সময় আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী
দলে ছিল, তখনও আওয়ামী লীগ দিনের পর দিন হরতাল দিয়েছে। আজ হরতালের সপক্ষে
বিএনপির নেতারা যেসব কথা বলছেন, ওই সময় আওয়ামী লীগের নেতারাও এ ধরনের কথাই
বলতেন। পরিস্থিতির আদৌ কোনো উন্নতি হয়নি। ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে মাত্র।
আমরা সংসদকে গুরুত্ব দিতে পারিনি। সংসদের বদলে রাজপথেই এখন সিদ্ধান্ত
নেয়া হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দরকার। একটি স্থিতিশীল রাজনীতি আমরা
চাই, যেখানে সরকার ও বিরোধী দলের যৌথ অংশগ্রহণে নিশ্চিত হবে। চলি্লশ বছর
আমরা পার করে এসেছি। জানি না, আমাদের আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে। রাজনীতির
এই অস্থিরতা আমাদের সকল অর্জনকে নষ্ট করে দিচ্ছে। আমরা জানি না আমাদের
রাজনীবিদদের মাঝে শুভ বুদ্ধির উদয় কবে হবে। তবুও আমরা প্রত্যাশা করি আস্থার
একটা পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং আমরা এই হরতালের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব। ড. তারেক শামসুর রেহমান: অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষকসূত্র ঃ দৈনিক যায় যায় দিন, ৪ মে ২০১২.
0 comments:
Post a Comment