যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা নিশ্চয়ই নিউইয়র্কের
‘অকুপাই মুভমেন্ট’ সম্পর্কে ধারণা রাখেন। গত ৩০ এপ্রিল এই আন্দোলন তার ২২৫
দিন পার করেছে। আগের মতো ওই ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর খবর শীর্ষস্থানীয়
মার্কিন সংবাদপত্রগুলোয় ছাপা হয় না সত্য, কিন্তু যারা অনলাইনে বিভিন্ন
ব্লগে তথ্য অনুসন্ধান করেন, তারা ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর খবর পাবেন। এ
আন্দোলন এখনও চলছে এবং বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। মূলত
মার্কিন সমাজে বৈষম্য, অসমতা, দারিদ্র্য আর ধনী শ্রেণীভিত্তিক যে সমাজ
ব্যবস্থা (প্লুটোনমি), তার প্রতিবাদেই নিউইয়র্কে এই ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর
জš§ হয়েছিল। এক সময় এই আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি বড় শহরে এবং
আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে ইউরোপ ও প্যাসিফিকভুক্ত
দেশগুলোয়ও ছড়িয়ে গিয়েছিল।
গত ২৮ এপ্রিল অনলাইনে যখন ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর সর্বশেষ সংবাদটি পাঠ করছি, তখন যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে দুটো রিপোর্ট।
নিউইয়র্কের ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের আন্দোলনের কোন মিল নেই সত্য, কিন্তু এক জায়গায় আমি অদ্ভুত এক মিল খুঁজে পাই আর তা হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ‘অকুপাই মুভমেন্টে’ নিজেদের শরিক করে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজš§ এক ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। আর জাহাঙ্গীরনগরের ‘শিক্ষক সমাজে’র ব্যানারে শিক্ষকদের একটা অংশ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ‘সব অন্যায়ে’র বিরুদ্ধে গত তিন মাস ধরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। মিলটা এখানেই। শিক্ষকরা হচ্ছেন সমাজের সচেতন শ্রেণী। তারাই তো প্রতিবাদ করবেন। প্রতিবাদের এই ধরন ন্যায়সঙ্গত। সমাজে অসমতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই যে প্রতিবাদ, যুগে যুগে বিভিন্ন আঙ্গিকে তার প্রকাশ ঘটেছে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ইউরোপজুড়ে তরুণ প্রজš§ প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ করেছিল। তারা সমাজ ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনতে পারেননি সত্য, কিন্তু সমাজ ব্যবস্থাকে একটা ধাক্কা দিয়েছিল। আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি পুঁজিবাদী সমাজে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ আমাদের দেখিয়ে দিল এই ‘বিদ্রোহে’র সঙ্গে সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ, তার কোন পার্থক্য নেই।
‘অকুপাই মুভমেন্ট’ একটি নতুন ধরনের ‘বিপ্লব’। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল, তার পেছনেও কাজ করেছিল সমাজের ভেতরকার অসমতা আর বৈষম্য। আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এবং যাদের সঙ্গে ২৮ এপ্রিল যোগ হয়েছেন সাংস্কৃতিক কর্মীরা, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরকার অসমতা আর বৈষম্যের প্রতিবাদ করেছেন। নোয়াম চমস্কি তার সর্বশেষ গ্রন্থ ঙপপঁঢ়ু-তে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন : দওঃ রং লঁংঃ ধ ধিু ড়ভ ষরারহম, যিরপয রং হড়ঃ নধংবফ ড়হ সধীরসরুরহম পড়হংঁসবৎ মড়ড়ফং, নঁঃ ড়হ সধীরসরুরহম াধষঁবং ঃযধঃ ধৎব রসঢ়ড়ৎঃধহঃ ভড়ৎ ষরভব’. অনেকেই জানেন, ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর সঙ্গে জড়িতরা একপর্যায়ে নিউইয়র্কের জুকোটি পার্ক দখল করে সেখানে বসবাস করে তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন। তাদের কাছে প্রাত্যহিক জীবনের আবেদন মুখ্য ছিল না। তাদের কাছে মুখ্য ছিল প্রতিবাদ করার বিষয়টি। তাই নোয়াম চমস্কি ঠিকই লিখেছিলেন : দওঃ রং লঁংঃ ধ ধিু ড়ভ ষরারহম’ জীবন ধারণের একটা অংশই। আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভিসির বাংলোর সামনে তাঁবু খাটিয়ে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর আন্দোলনের সেই ধারাবাহিকতাই রক্ষা করলেন। এটা তাদের কাজ নয়। ক্লাসে ছাত্র পড়ানোই তাদের কাজ। কিন্তু ক্যাম্পাসে যখন বৈষম্য তৈরি হয়, তখন তো তাদেরই প্রতিবাদ করতে হয়। সমাজে অগ্রসরমান শ্রেণী হিসেবে তাদের এই প্রতিবাদ ন্যায়সঙ্গত।
কিন্তু যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে, তা হচ্ছে ভিসির অপসারণ দাবিতে শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন। মহান মে দিবসে এই অনশন শুরু হয়েছে। গতকাল নাটক ও নাট্যকলা বিভাগ এবং বাংলা বিভাগের দু’জন শিক্ষিকাও শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে ভিসির বাসভবনের সামনে অনশন ধর্মঘট শুরু করেছেন। আরও একটি বিষয় যা আমাকে কষ্ট দিয়েছে তা হচ্ছে একটি তথাকথিত সংহতি মঞ্চ তৈরি করা, যেখানে ভিসি সমর্থিত শিক্ষক ও ছাত্ররা ভিসির পক্ষাবলম্বন করেছেন। ফলে এক চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে জাহাঙ্গীরনগরে। শিক্ষকরা পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন এবং একটি অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করবেন, এটা কাম্য হতে পারে না। ২৮ এপ্রিল যে ঘটনা ঘটল, তার নিন্দা জানানোর ভাষাও আমার নেই। যাদের আমরা পড়াই, যারা আমাদের সন্তানতুল্য, তারা কিনা আমাদের গায়ে হাত তুলল! আমাদের আহত করল! এ কষ্ট আমরা কোথায় রাখি? উপাচার্য মহোদয় কি ভেবে দেখছেন, এ ধরনের ঘটনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে আদৌ কোন অবদান রাখবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলেই আমার ধারণা। উপাচার্য মহোদয়ের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছেন শিক্ষক ও ছাত্ররা। সেই ছবিও ছাপা হয়েছে ৩০ এপ্রিলের পত্রপত্রিকায়। একজন ভিসির জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে? সবাই ভিসি হতে পারেন না। অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর গোপালগঞ্জের মানুষ। ভিসি হয়েছেন। কিন্তু তার কুশপুত্তলিকা যখন দাহ করা হয়, তখন কি তাতে তার সম্মান বাড়ে? তার অনেক আগেই উচিত ছিল ‘শিক্ষক সমাজে’র সঙ্গে সরাসরি কথা বলা। আর ‘শিক্ষক সমাজে’র নেতৃত্বে তো রয়েছেন বামরা, প্রগতিশীল শিক্ষকরা, যারা অতীতে আওয়ামী ঘরানার শিক্ষকদের সঙ্গেই থেকেছেন। তাদের কেউই ভিসি হতে চান না। যুক্তরাষ্ট্রের অকুপাই মুভমেন্টের মতো ভিসিবিরোধী আন্দোলনে তরুণ বামমনা শিক্ষকদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। যে দু’জন শিক্ষক ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, তারা দু’জনই ঘোরতর বিএনপিবিরোধী। সুতরাং ভিসিবিরোধী আন্দোলনকে বিএনপি-জামায়াত চক্রের আন্দোলন বলে পার পাওয়া যাবে না। উপাচার্য মহোদয় যদি এরই মাঝে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতেন, তিনি ভালো করতেন। পরিস্থিতি এ পর্যায়ে আসত না। শিক্ষক নিয়োগ (প্রায় ১৯৬ জন) নিয়ে কথা উঠেছে। এদের কারও কারও যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকরা। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে তার সমর্থকদের ভরাডুবি এ কথাই প্রমাণ করে। ভিসি মহোদয় এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, দলীয় কোটায় শিক্ষক নিয়োগ কখনও শিক্ষার মানোন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না। কর্মচারী নিয়োগে তার নিজ জেলার লোকদের প্রাধান্য দেয়া, কোন কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগ, যৌননিপীড়নে অভিযুক্ত শিক্ষককে প্রশ্রয় দেয়া, ছাত্রলীগের মূলধারার নেতৃবৃন্দকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে না দেয়া ইত্যাদি যেসব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেছে, তা উপাচার্যের পদটিকে সম্মানিত করবে না। তিনি উপাচার্যের পদটিকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেননি। তার নিজের সম্মানের প্রতি তিনি সুবিচার করেননি। অনেক আগেই তার উচিত ছিল শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটি রিভিউ কমিটি গঠন করা। তা তিনি করেননি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী ও সরকারি দলের সমর্থক অনেকে তার কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেননি। একজন সাবেক উপাচার্যকে ডিন হিসেবে নিয়োগ দিয়েও তার সমর্থন তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি। তার সমর্থিত শিক্ষকদের একটা বড় অংশের সন্তানদের, তাদের জামাইদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ‘পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে’ পরিণত করেছেন। এই অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন কিভাবে?
আজ আমার ‘সন্তান’রা যখন আমরণ অনশন শুরু করে, তখন একজন শিক্ষক হিসেবে আমি নীরব থাকতে পারি না। আমার বিবেক আমাকে বলে দেয় ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম যদি তিনি অনশনরত ছাত্রদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। উপাচার্য মহোদয় এ কাজটিও করেননি। তবুও সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে, এটা আমি মনে করি না। সমস্যার সমাধান তার হাতেই নিহিত। তিনি বিজ্ঞ মানুষ। তিনি জানেন, এমন পরিস্থিতিতে একজন উপাচার্যকে কী করতে হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবার তার কাছ থেকে তেমনটাই আশা করে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
গত ২৮ এপ্রিল অনলাইনে যখন ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর সর্বশেষ সংবাদটি পাঠ করছি, তখন যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে দুটো রিপোর্ট।
নিউইয়র্কের ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের আন্দোলনের কোন মিল নেই সত্য, কিন্তু এক জায়গায় আমি অদ্ভুত এক মিল খুঁজে পাই আর তা হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ‘অকুপাই মুভমেন্টে’ নিজেদের শরিক করে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজš§ এক ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। আর জাহাঙ্গীরনগরের ‘শিক্ষক সমাজে’র ব্যানারে শিক্ষকদের একটা অংশ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ‘সব অন্যায়ে’র বিরুদ্ধে গত তিন মাস ধরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। মিলটা এখানেই। শিক্ষকরা হচ্ছেন সমাজের সচেতন শ্রেণী। তারাই তো প্রতিবাদ করবেন। প্রতিবাদের এই ধরন ন্যায়সঙ্গত। সমাজে অসমতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই যে প্রতিবাদ, যুগে যুগে বিভিন্ন আঙ্গিকে তার প্রকাশ ঘটেছে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ইউরোপজুড়ে তরুণ প্রজš§ প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ করেছিল। তারা সমাজ ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনতে পারেননি সত্য, কিন্তু সমাজ ব্যবস্থাকে একটা ধাক্কা দিয়েছিল। আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি পুঁজিবাদী সমাজে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ আমাদের দেখিয়ে দিল এই ‘বিদ্রোহে’র সঙ্গে সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ, তার কোন পার্থক্য নেই।
‘অকুপাই মুভমেন্ট’ একটি নতুন ধরনের ‘বিপ্লব’। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল, তার পেছনেও কাজ করেছিল সমাজের ভেতরকার অসমতা আর বৈষম্য। আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এবং যাদের সঙ্গে ২৮ এপ্রিল যোগ হয়েছেন সাংস্কৃতিক কর্মীরা, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরকার অসমতা আর বৈষম্যের প্রতিবাদ করেছেন। নোয়াম চমস্কি তার সর্বশেষ গ্রন্থ ঙপপঁঢ়ু-তে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন : দওঃ রং লঁংঃ ধ ধিু ড়ভ ষরারহম, যিরপয রং হড়ঃ নধংবফ ড়হ সধীরসরুরহম পড়হংঁসবৎ মড়ড়ফং, নঁঃ ড়হ সধীরসরুরহম াধষঁবং ঃযধঃ ধৎব রসঢ়ড়ৎঃধহঃ ভড়ৎ ষরভব’. অনেকেই জানেন, ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর সঙ্গে জড়িতরা একপর্যায়ে নিউইয়র্কের জুকোটি পার্ক দখল করে সেখানে বসবাস করে তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন। তাদের কাছে প্রাত্যহিক জীবনের আবেদন মুখ্য ছিল না। তাদের কাছে মুখ্য ছিল প্রতিবাদ করার বিষয়টি। তাই নোয়াম চমস্কি ঠিকই লিখেছিলেন : দওঃ রং লঁংঃ ধ ধিু ড়ভ ষরারহম’ জীবন ধারণের একটা অংশই। আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভিসির বাংলোর সামনে তাঁবু খাটিয়ে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর আন্দোলনের সেই ধারাবাহিকতাই রক্ষা করলেন। এটা তাদের কাজ নয়। ক্লাসে ছাত্র পড়ানোই তাদের কাজ। কিন্তু ক্যাম্পাসে যখন বৈষম্য তৈরি হয়, তখন তো তাদেরই প্রতিবাদ করতে হয়। সমাজে অগ্রসরমান শ্রেণী হিসেবে তাদের এই প্রতিবাদ ন্যায়সঙ্গত।
কিন্তু যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে, তা হচ্ছে ভিসির অপসারণ দাবিতে শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন। মহান মে দিবসে এই অনশন শুরু হয়েছে। গতকাল নাটক ও নাট্যকলা বিভাগ এবং বাংলা বিভাগের দু’জন শিক্ষিকাও শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে ভিসির বাসভবনের সামনে অনশন ধর্মঘট শুরু করেছেন। আরও একটি বিষয় যা আমাকে কষ্ট দিয়েছে তা হচ্ছে একটি তথাকথিত সংহতি মঞ্চ তৈরি করা, যেখানে ভিসি সমর্থিত শিক্ষক ও ছাত্ররা ভিসির পক্ষাবলম্বন করেছেন। ফলে এক চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে জাহাঙ্গীরনগরে। শিক্ষকরা পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন এবং একটি অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করবেন, এটা কাম্য হতে পারে না। ২৮ এপ্রিল যে ঘটনা ঘটল, তার নিন্দা জানানোর ভাষাও আমার নেই। যাদের আমরা পড়াই, যারা আমাদের সন্তানতুল্য, তারা কিনা আমাদের গায়ে হাত তুলল! আমাদের আহত করল! এ কষ্ট আমরা কোথায় রাখি? উপাচার্য মহোদয় কি ভেবে দেখছেন, এ ধরনের ঘটনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে আদৌ কোন অবদান রাখবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলেই আমার ধারণা। উপাচার্য মহোদয়ের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছেন শিক্ষক ও ছাত্ররা। সেই ছবিও ছাপা হয়েছে ৩০ এপ্রিলের পত্রপত্রিকায়। একজন ভিসির জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে? সবাই ভিসি হতে পারেন না। অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর গোপালগঞ্জের মানুষ। ভিসি হয়েছেন। কিন্তু তার কুশপুত্তলিকা যখন দাহ করা হয়, তখন কি তাতে তার সম্মান বাড়ে? তার অনেক আগেই উচিত ছিল ‘শিক্ষক সমাজে’র সঙ্গে সরাসরি কথা বলা। আর ‘শিক্ষক সমাজে’র নেতৃত্বে তো রয়েছেন বামরা, প্রগতিশীল শিক্ষকরা, যারা অতীতে আওয়ামী ঘরানার শিক্ষকদের সঙ্গেই থেকেছেন। তাদের কেউই ভিসি হতে চান না। যুক্তরাষ্ট্রের অকুপাই মুভমেন্টের মতো ভিসিবিরোধী আন্দোলনে তরুণ বামমনা শিক্ষকদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। যে দু’জন শিক্ষক ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, তারা দু’জনই ঘোরতর বিএনপিবিরোধী। সুতরাং ভিসিবিরোধী আন্দোলনকে বিএনপি-জামায়াত চক্রের আন্দোলন বলে পার পাওয়া যাবে না। উপাচার্য মহোদয় যদি এরই মাঝে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতেন, তিনি ভালো করতেন। পরিস্থিতি এ পর্যায়ে আসত না। শিক্ষক নিয়োগ (প্রায় ১৯৬ জন) নিয়ে কথা উঠেছে। এদের কারও কারও যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকরা। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে তার সমর্থকদের ভরাডুবি এ কথাই প্রমাণ করে। ভিসি মহোদয় এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, দলীয় কোটায় শিক্ষক নিয়োগ কখনও শিক্ষার মানোন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না। কর্মচারী নিয়োগে তার নিজ জেলার লোকদের প্রাধান্য দেয়া, কোন কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগ, যৌননিপীড়নে অভিযুক্ত শিক্ষককে প্রশ্রয় দেয়া, ছাত্রলীগের মূলধারার নেতৃবৃন্দকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে না দেয়া ইত্যাদি যেসব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেছে, তা উপাচার্যের পদটিকে সম্মানিত করবে না। তিনি উপাচার্যের পদটিকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেননি। তার নিজের সম্মানের প্রতি তিনি সুবিচার করেননি। অনেক আগেই তার উচিত ছিল শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটি রিভিউ কমিটি গঠন করা। তা তিনি করেননি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী ও সরকারি দলের সমর্থক অনেকে তার কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেননি। একজন সাবেক উপাচার্যকে ডিন হিসেবে নিয়োগ দিয়েও তার সমর্থন তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি। তার সমর্থিত শিক্ষকদের একটা বড় অংশের সন্তানদের, তাদের জামাইদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ‘পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে’ পরিণত করেছেন। এই অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন কিভাবে?
আজ আমার ‘সন্তান’রা যখন আমরণ অনশন শুরু করে, তখন একজন শিক্ষক হিসেবে আমি নীরব থাকতে পারি না। আমার বিবেক আমাকে বলে দেয় ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম যদি তিনি অনশনরত ছাত্রদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। উপাচার্য মহোদয় এ কাজটিও করেননি। তবুও সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে, এটা আমি মনে করি না। সমস্যার সমাধান তার হাতেই নিহিত। তিনি বিজ্ঞ মানুষ। তিনি জানেন, এমন পরিস্থিতিতে একজন উপাচার্যকে কী করতে হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবার তার কাছ থেকে তেমনটাই আশা করে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
প্রফেসর,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য
(সূত্র: যুগান্তর০৩/০৫/১২)
(সূত্র: যুগান্তর০৩/০৫/১২)
0 comments:
Post a Comment